১১-১২. মো এবং তার ভাই

১১.

মো এবং তার ভাই-এর মুখে কীরকম আতংক ফুটে উঠেছে চিতা তা পর্যবেক্ষণ করছিল। দুজনেই জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে। তাদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে চিতা রীতিমত মজা পাচ্ছিল। সত্যিকারের বড় কাজ যখন হাতে আসে আর প্রতিপক্ষের প্রবল ক্ষমতা হাড়ে হাড়ে বোঝা যায়–তখনই বোঝা যায় কে পুরুষ আর কে নাবালক। এদের দুজনের কাউকেই খাঁটি পুরুষমানুষ বলা চলে না।

কর্কশ গলায় মা বলল, ওখানে ঐ মড়াটা কার?

কী মনে হয় তোমার? ঐ হলদে চামড়ার চাকরটা। তাকে খুন করতে হয়েছিল। আর তুমি এখন স্রেফ চোরাবালিতে পা ডুবিয়েছ। পুলিশ খুন করে কেউ রেহাই পায় না।

মো বদ্ধ গলায় বলল, আমি ইচ্ছে করে এ কাজ করিনি। গুলিটা হঠাৎ ছুটে গেল। আমি খুন করতে চাইনি।

নরম গলায় চিতা বলল, আদালতে সেই কথাই বোলো।

রিফ তাকে ধমক দিয়ে বলল, তুই চুপ কর তো। একটা পুলিশ যখন দেখেছি তখন আরো পুলিশ লুকিয়ে আছে। সুতরাং পুরো ব্যাপার নির্ঘাত ফাঁস হয়ে গেছে।

খিলখিল করে চিতা হেসে উঠল। সত্যি নাকি। ভাগ্যিস তুই বললি।

মো কাঁপা পায়ে দালান পেরিয়ে ক্যারীর ঘরে ঢুকল।

ততক্ষণে ক্যারী জানলা বন্ধ করে চটপট স্ন্যাক্স আর শার্ট পরে নিয়েছে। মো দেখল সে ভয়ে সাদা, চোখ দুটো অস্বাভাবিক অবস্থায় থোকার পাশে দাঁড়িয়ে।

 মো ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। তখনো তার হাতে পিস্তল রয়েছে। ক্যারী ভয়ে শিউরে উঠল।

মো পিস্তল রেখে বলল, ভয় পেয়ো না আমরা বিপদে পড়েছি। তুমি শুনছ তো?

 হ্যাঁ–আমি শুনেছি।

মো ব্যাপারটা কাউকে বোঝাবার জন্য ব্যাকুল, হুড়মুড় করে বলল, বাইরে একজন পুলিশ অফিসার লুকিয়ে ছিল। আমি তাকে গুলি করে মেরে ফেলেছি। একজন লোককে হঠাৎ নড়তে দেখে পিস্তল থেকে গুলি ছুটে গেল। আমি ইচ্ছে করে করিনি। জীবনে কখনো আমি মানুষ খুন করিনি। বিশ্বাসযোগ্য না হলেও আমি সত্যি কথাই বলছি। যাক এখন আমাদের সামনে খুব বিপদ। তোমার ও বাচ্চারও সামনে বিপদ। আমার হাতে তোমাদের বিপদ হবে না–মনে রেখো। আমি তোমাদের ভালোর চেষ্টাই করব।কিন্তু অন্য দুজন ঝামেলা বাধাতে চাইবে। তুমি এখনো আমার সঙ্গে আছো তো?

এই ভীত মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল ক্যারী, হ্যাঁ, আমি আপনার সঙ্গেই আছি।

আমি আর বেশিক্ষণ বাঁচবনা-বুঝতে পারছি।কিন্তু আগে তোমার ব্যবস্থা করে যাবার চেষ্টা করবো। তুমি এখানে থাকো, আর আমি যা বলব ঠিক তাই করবে।

মো এসে দেখল রিফ এখনো জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আর চিতা একটা চেয়ারের হাতলে বসে সিগারেট খাচ্ছে।

চড়া গলায় রিফ বলল, এবার আমরা কী করব শুনি?

মো বলল, আমরা গাড়িতে চড়ে চম্পট দেবার চেষ্টা করব।কাজটা মারাত্মক হলেও এখন মৃত্যু ছাড়া কিছুই চাইবার নেই। গুলির মুখে দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারলেই সে সুখীহয়। কারণ সে আবার জেলে ফেরার কথা ভাবতেও পারছে না। তার একমাত্র কামনা-মৃত্যুটা যেন তাড়াতাড়ি হয় আর ডারমটের বাচ্চার যেন কোনো বিপদ না হয়। আমরা খিড়কির দরজা দিয়ে পালাব।

চিতা বিস্ময়ভরা গলায় বলল, কী করতে চাইছ তুমি বলো দেখি, আত্মহত্যা?

এছাড়া পালাবার পথ নেই। আমরা ওদের চোখ ধাঁধিয়ে পালাব। চলো, পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলবার আগে পালাতে হবে।

রিফ দরজার দিকে পা বাড়াল। কিন্তু চিতা তার রাস্তা আড়াল করে দাঁড়াল। রিফ। বোকার মত কাজ করিসনে। বাড়ি থেকে বেরোলেই ওরা আমাদেরকে গুলি মেরে ঝাঁঝরা করে দেবে।

মো বলল, ওর কথায় কান দিও না। চলো-পালানো যাক।

চিতার চোখে সেই অতি পরিচিত আগুনের ঝলক, রিফ তার দিকে তাকিয়ে আছে।

চিতা বলল, মোটকুর কথা শুনিসনে। পালাবার সময় ডারমটের বৌকে সঙ্গে নিতেই হবে। সে গাড়িতে থাকলে কেউ গুলি চালাতে সাহস করবে না।

সহসা নিশ্চিন্ত হাসি হেসে রিফ বলল, মাইরী, মাথা আছে বটে তো।

সে ক্যারীকে আনবার জন্যে পাবাড়াতেই মো পিস্তল তুলে বলল, দাঁড়াও। ও মতলব ছেড়ে দাও। প্রাণের ঝুঁকি নিতে হয় আমরা তিনজনেই নেব-মিসেস ডারমটকে সঙ্গে নেওয়া চলবে না।

বালিয়াড়ির পেছনে ভিক্টর, হার্পার ও ব্রডি কথা বলছিল।

হার্পার উত্তেজিত গলায় বলল, দেখুন, মিঃ ডারমট, পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠেছে। আমাদের উপস্থিতির কথা ওরা জেনে গেছে। ইতিমধ্যেই আমাদের একজনকে ওরা খুন করেছে। আরো লোকজন না আসা পর্যন্ত কিছুই করা উচিত নয়।

ভিক্টর ভয়ে আশঙ্কায় বলল, আমার বৌ ছেলে ঐ বাড়িতে রয়েছে। আপনি কি বলতে চান। তাদেরকে খুনীদের হাতে ফেলে চুপচাপ আপনার দলবল আসার অপেক্ষায় থাকব? এক্ষুনি আমি ওখানে যাবো। আমার কাছে মুক্তিপণের টাকা আছে। ওরা টাকা পেলেই চলে যাবে। তারপর তারা পালালো না পালালো তাতে কি? আমার বৌ-ছেলের নিরাপত্তার কথাই আগে ভাবব।

হার্পার বলল, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি, কিন্তু ওরা পুলিশের খবর পেয়ে গেছে তাই টাকা পেলে ওরা পালাবে ঠিকই। কিন্তু পালাবার সময় আপনার স্ত্রী-পুত্রকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে। যাতে আমরা গুলি না চালাই। এমন কি শেষে খুন করেও রেখে যেতে পারে। অতএব এখন আপনার টাকা নিয়ে ওখানে যাওয়া চলবে না।

ইতিমধ্যে ব্রডি জীপে ফিরে গিয়েছিল। হঠাৎ সে ছুটতে ছুটতে হাজির হল।

ডেনিসন রেডিও টেলিফোনে কথা বলছেন। উনি তোমায় ডাকছেন।

রেডিও টেলিফোনের দিকে হার্পার দৌড়ল। পিছু পিছু ব্ৰডিও গেল। ভিক্টর একা একটু ইতস্ততঃ করে নিজের ক্যাডিলাক গাড়িতে চেপে তীরবেগে র‍্যাঞ্চ হাউসের দিকে বেরিয়ে গেল।

চটপট হার্পার ডেনিসনকে সব জানাল।

আর এখন মিঃ ডারমট গাড়ি করে বাড়িটার দিকে রওনা হয়ে গেছেন। আমি বারণ করেছিলাম, কিন্তু উনি শুনলেন না।

অসন্তুষ্ট হয়ে ডেনিসন বললেন, সবকিছু গোলমাল করে বসে আছে। মিস ভ্যান ওয়াইলিকে সরিয়ে দাও। সে নিজে জীপ চালাতে পারবে?

ব্রডি বলছে সেটা সম্ভব নয়। মেয়েটা একেবারে মৃগীরোগীর মত কান্নাকাটি করছে।

তাহলে ব্রডিকে বলো মেয়েটাকে তার বাবার কাছে পৌঁছে দিতে। আমার বিশ্বাস, ডাকাতগুলো নিরাপত্তার জন্য মিসেস ডারমটকে সঙ্গে নেবে। ওরা সত্যিই যদি মিসেস ডারমটকে নিয়ে পালায়, আমাকে খবর দেবে। কারণ, আমি ওদের পালাবার রাস্তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করব।– বাড়ির ধারেকাছে যেও না। যা যা হচ্ছে, সব আমায় জানাবে।

রিফ ও চিতা পিস্তলধারী মো র দিকে তাকিয়ে ছিল।

রিফ দাঁত খিঁচিয়ে বলল, তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? ও মেয়েটাকে সঙ্গে নিলেই তো কেল্লাফতে। আমাদের আর কোন অসুবিধে হবে না পালাতে।

মো ক্লান্তভাবে বলল, সে আর কতক্ষণের জন্য? ওকে সঙ্গে নিলে আমাদের ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না। ও এখানেই থাকবে।

চিতা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, ওকে না নিয়ে আমরা যাব না।

মো কঠিনমুখে বলল যা বলছি, তাই করো। তোমরা একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছ। আমি আর কিছুর পরোয়া করি না। হয় আমার কথা শোনো নয়তো দুজনকেই আমি শেষ করে দেব।

ঠিক তখুনি ভিক্টরের গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো জানালার পর্দায় এসে পড়ল। মো জানালার দিকে ছুটে গেল। চিতা সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ছিটকে ফেলে দিল। তার হাতের অস্ত্র চিতা ছিনিয়ে নিয়ে পিছু হটল। মোর দিকে পিস্তল তুলে হিংস্রভাবে বলল, এখন থেকে যা করবার আমরাই করব।

ততক্ষণে রিফ জানালা দিয়ে উঁকি মারছে। চিতা ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। রিফ ভিক্টরের গাড়ি চিনতে পারল। সে ভিক্টরকে নামতে দেখল।

ডারমট এসেছে।

চিতা বলল, সাবধান, গা ঢাকা দিয়ে থাক।

পিস্তলটা আমায় দে।

পিস্তলটা চিতা রিফকে দিল। রিফ আবার উঁকি দিল। ভিক্টর বাড়ির দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ভিক্টর হাঁক দিল, আমি একলা আছি। টাকা নিয়ে এসেছি।

রিফ বলল, একলা এসে থাকলে তোমারই মঙ্গল দোস্ত। আমার পিস্তল তোমার দিকে আছে। টাকা নিয়ে সোজা চলে এসো।

রিফ চিতাকে বলল, দরজা খোল।

মোর দৃষ্টি ঘরের আনাচে কানাচে একটা অস্ত্রের খোঁজে ঘুরছিল। তার কাছেই টেবিলের ওপর ব্রোঞ্জের তৈরী ছোট একটা নগ্ন নারীমূর্তি ছিল। পায়ে পায়ে সে এসে টেবিলের পাশটিতে দাঁড়াল।

রিফ ঘুরে তাকাল কোনো চালাকি করবার চেষ্টা কোরো না, মোটকু।

মো বলল, কিছুই করবার নেই। সব শেষ হয়ে এসেছে। আমরা আর পালাতে পারব না।

চুপ করো। তুমি না পারলেও আমরা ঠিকই পালাব।

ভিক্টর ঘরে ঢুকল, পেছনে চিতা।

হিংস্রভাবে রিফ বলল, পুলিশ তাহলে এসে গেছে, কি বল ইয়ার। এ তোমার বদমায়েশী?

ভিক্টর বলল, ওখানে দুজন পুলিশ ছিল। একজন মারা গেছে। অন্যজন ভ্যান ওয়াইলিকে পৌঁছতে গেছে।

জীপ স্টার্ট দেবার আওয়াজ ভেসে এল। জীপের হেডলাইট আলোকিত করে দ্রুত গতিতে পীট শহরের দিকে চলে গেল।

রিফ মুখ ভ্যাংচাল, বটে? ভেবেছ তোমার ভাওতায় আমি বিশ্বাস করব? চটপট বলো দেখি, ওখানে ঠিক কজন আছে?

এখন কেউ নেই। তবে শীগগিরই ওরা ফিরে আসছে। আর একঘণ্টার মধ্যে পুরো জায়গাটা পুলিশে ছেয়ে যাবে। তোমাদের টাকা নিয়ে সোজা দৌড় দাও।

রিফ বলল, আলো জ্বালা। তা ক্র্যামার কোথায়? তিনি এলেন না কেন?

ভিক্টর বলল, তিনি আসবেন কেন? তোমাদের ভাগের টাকা পাঠিয়েই তিনি সরে পড়েছে।

রিফ স্যুটকেসের দিকে তাকিয়ে বলল, কত আছে এতে?

ষোলো লাখ ডলার।

মিথ্যে কথা।

নিজের চোখেই দেখ তাহলে বলে তালা খুলে ডালা তুলে সরে দাঁড়াল।

ক্রেন ভাইবোন দুজন রাশিকৃত টাকা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। রিফ এতদূর সম্মোহিত হয়ে পড়েছিল যে পিস্তল নামিয়ে স্যুটকেসের দিকে এগিয়ে গেল। মোর কাছাকাছি আসতেই মো বিদ্যুৎবেগে ব্রোঞ্জের মূর্তিটা তুলে সজোরে রিফের কব্জিতে আঘাত করল। এত দ্রুত যে কেউ বোঝবার সময়ই পেল না।

পিস্তল খসে পড়ল রিফের হাত থেকে। মো পিস্তল তুলে তাদের দুজনের দিকে তুলে ধরল।

চিতা চেয়ারের হাতলের ওপর বসে রইল–নির্বিকার ভাবে, কিন্তু দুই চোখ জ্বলছে।

মো বলল, সত্যি কথা বলুন, মিঃ ডারমট। বাইরে কি পুলিশ আছে? আমি এদুজনকে ধরিয়ে দিতে চাই–নিজেও ধরা দেব আমি। বাইরে যদি পুলিশ থাকে, তাদের ডেকে আনুন।

ভিক্টর বলল, একজন অফিসার আছে।

ঠিক আছে, তাকেই ডাকুন তাহলে।

রিফ কব্জিতে হাত বুলোতে বুলোতে গালাগাল দিল।ভিক্টরদরজার দিকে গেল। আর মোরিফের দিকে পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চিতার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়েছিল। তাই সে দেখতে পেল না কখন চিতার হাত ধীরে ধীরে চেয়ারের কুশনের নীচে ঢুকে গেল। আগের দিন রাত্রে সে ভাইয়ের পকেট থেকে ভিক্টরের রিভলবারটা হাত সাফাই করে কুশনের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল।

ভিক্টর দালানে বেরিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় শোবার ঘর থেকে ক্যারী বেরিয়ে এল।

সে সানন্দে চেঁচিয়ে উঠল, ভিক। তাই যেন মনে হল তোমার গলার আওয়াজ পেলাম।

তাকে জড়িয়ে ধরল ভিক্টর, সব ঠিক আছে তো ডার্লিং। এক মিনিট দাঁড়াও–আমি পুলিশ অফিসারটিকে ডেকে আনি। আমি

সহসা বসবার ঘর থেকে গুলি চালানোর কানফাটা শব্দ ভেসে এল।

চিতা কুশনের নীচে রিভলবারের সেফটি ক্যাচ সরিয়ে সেটা বার করেছে। তারপর মোর পিঠের ওপর লক্ষ্য স্থির করে ট্রিগার টেনেছে।

মো বুলেটের ধাক্কায় কেঁপে উঠল, কিন্তু কোনরকম যন্ত্রণা অনুভব করল না। মনে হল কেউ যেন তাকে একটা কাপড় জড়ানো হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেছে। উল্টে পড়ে গেল সে, পিস্তল ছিটকে পড়ল রিফের পায়ের কাছে। চিতার মুখটা এক কঠিন সাদা মুখোশের মত দেখাচ্ছে। মো ওঠবার চেষ্টা করতেই, মোর মাথার ওপর লক্ষ স্থির করে আরেকবার ট্রিগার টিপল।

মো মায়ের কথা ভাবছিল। তিনি মরবার আগে ভয় পেয়েছিলেন কিনা। মায়ের মৃত্যুর পর তার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। সে যদি ক্র্যামারের প্যাঁচে না পড়ত, তাহলেও ব্যাপারটা একই রকম দাঁড়াত। সারাটা জীবন সে মা ছাড়া কাউকে আপন বলে ভাবতে পারেনি। সুতরাং মায়ের জীবন শেষ হবার সাথে সাথে তাঁর জীবনের তাৎপর্যও শেষ হয়ে গেছে।একটুও ব্যথা করছে না, তবু বুঝতে পারছে যে মৃত্যু আসছে। আর যাইহোক, সেই জঘন্য জেলখানায় তাকে আর ফিরে যেতে হবে না। দ্বিতীয় বুলেটটি এসে তাকে শেষ করবার ঠিক আগের মুহূর্তে সে ডারমটের বাচ্চার কথা ভাবছিল।

মোর পিস্তলটা রিফ তুলে নিল।

শালা আমার কব্জিটা একেবারে ভেঙ্গে দিয়েছে।

আঃ, চুপ কর।বলে চিতা দরজার কাছে গিয়ে ভিক্টর ও ক্যারীর দিক রিভলবার তুলে ধরল।

চিতা বলল, ভেতরে এসো। সাবধানে।

ক্যারী মোর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে চাপা আর্তনাদ করে ভিক্টরের কাঁধে মুখ লুকালো।

 চিতা বলল, টাকাটা তুলে নিয়ে গাড়িতে রাখ।

 রিফ খেঁকিয়ে উঠল, পারব না। আমার কব্জি ভেঙ্গে গেছে।

যা বলছি তাই কর! তোর কব্জির নিকুচি করেছে।

রিফ গালাগাল দিতে দিতে পিস্তলটা হিপ পকেটে ঢুকিয়ে, সুটকেসের ডালা বন্ধ করে বাঁহাতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

ভিক্টর ও ক্যারীর দিকে চিতা তাকাল, ওকে আমিই খুন করেছি। সুতরাং আমি কোন কিছুর পরোয়া করি না। আমরা যাচ্ছি, কিন্তু তোমার বৌকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।

ভিক্টর দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ওকে তোমরা নিয়ে যেতে পারো না। কখনো না।

রাস্তা ছাড়ো, আর একবারও যেন বলতে না হয়।

ক্যারী ভিক্টরের হাত ছাড়িয়ে সরে এল।

 সে রুদ্ধশ্বসে বলল, আমি ওদের সঙ্গে যাচ্ছি। ভিক্ দোহাই

, আমি যাব। একজন গেলেই তো হল? আমার স্ত্রীকে বাচ্চার দেখাশোনা করতে হবে।

রিফ ঘরে ঢুকল, ভিক্টরের পেছন দিকে সে ছিল। চিতা মাথা নাড়ল। ক্যারী শেষ মুহূর্তে রিফকে দেখতে পেল, কিন্তু চেঁচিয়ে সাবধান করবার আগেই রিফ ভিক্টরের মাথার পেছনে পিস্তলের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করল। ভিক্টর অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল। ক্যারী সেদিকে এগোতেই রিফ তাকে ধরে ফেলল।

দ্রুতকণ্ঠে চিতা বলল, চল, চল। চটপট সরে পড়া যাক।

ক্যারীকে একরকম টানতে টানতেই দুজনে তাকে ক্যাডিলাক গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেল। চিতা ড্রাইভারের জায়গায় বসল আর রিফ ক্যারীকে পেছনের সীটে ঠেলে দিয়ে নিজে তার পাশে বসল। চিতা গাড়ি চালিয়ে দিল।

রিফ কাঁপা গলায় বলল, ওরা গুলি চালাবে নাকি?

আমায় জিজ্ঞেস করছিস কেন? এক্ষুনি নিজেই জানতে পারবি।

ক্যারীকে ঢালের মত সামনে ধরে রিফ মাথানীচু করে বসে রইল। চিতার দিকে তাকাল–চিতা দুই হাত স্টিয়ারিং হুইলের ওপর রেখে গাড়ি চালাচ্ছে লোহার গেটের দিকে।

নষ্টনীড়ের আশপাশের এলাকার একটা ম্যাপে ডেনিসন চোখ বুলোচ্ছিলেন। এমন সময় হার্পারের ফোন এল।

হার্পার খবর দিল, এইমাত্র ওরা পালাল। আমি কেবল, দুটো মেয়ের চেহারা দেখতে পেলাম গাড়ির ভেতর। অন্য ডাকাতগুলো হয়তো গাড়ির মেঝেতে মাথা গুঁজে রয়েছে। একটি মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল, আর অন্যজন পেছনের সীটে। ডারমটের ক্যাডিলাক গাড়িটা নিয়ে গেছে। গেট থেকে বাঁদিকে মোড় নিল, অর্থাৎ বোস্টন ক্রীকের দিকে যাচ্ছে।

ঠিক আছে, টম। বাড়িতে গিয়ে ঢোকো। দেখ ডারমটের কি হল। সাবধানে যেও, শীগগির সব জানাও। আমি অপেক্ষা করছি।

রেডিও টেলিফোনটা কাঁধে ঝুলিয়ে হার্পার পিস্তল হাতে র‍্যাঞ্চ হাউসের দিকে দৌড়ল।

বাড়ির সামনে আসতেই দেখল ভিক্টর টলমল করে সদর দরজায় এসে দাঁড়াল।

দরজার গায়ে হেলান দিয়ে ভিক্টর বলল, ওরা আমার স্ত্রীকে নিয়ে গেছে। আপনারা কিছু করতে পারছেন না? এরা যে ক্যারীকে নিয়ে চলে গেল।

হার্পার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করতেই ভিক্টর তার হাতে খামচে ধরল।

কোন দিকে গেছে ওরা?

বোস্টন ক্রীকের দিকে। এখানে গোলাগুলি চলছিল কেন বলুন তো?

নিজের চোখেই দেখে নিন, ওখানে একজন মরে পড়ে আছে।

বসবার ঘরে ঢুকে হার্পার দেখল মো মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দেহটাকে চিৎ করে দেখল সত্যিই মরেছে কিনা। তারপর রেডিও টেলিফোন চালু করল।

ডেনিসন ততক্ষণে চারিদিকে জাল ছড়িয়ে দিয়েছেন-বোস্টন ক্রীকের পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে প্রতিটি টহলদারীপুলিশকে ভিক্টরের ক্যাডিলাক গাড়ির খোঁজ করতে বলা হয়েছে, প্রতিটি পেট্রোল পাম্পকে বলে দেওয়া হয়েছে। এলাকার সবকটি এয়ারপোর্টকেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।

ডেনিসন গম্ভীর হয়ে গেলেন সব শুনে।

ডেনিসন বললেন, ওরা তো আর অনন্তকাল গাড়ি চালাবেনা। একসময় না একসময় থামাতেই হবে। অবশ্য যতক্ষণ মিসেস ডারমট ওদের হাতে রয়েছেন ততক্ষণ আমরা ওদের আটকাতে পারব না। তুমি অফিসে ফিরে এস, টম। মিঃ ডারমটকে নিয়ে এসো। তাকে বলল আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করছি তার স্ত্রীকে রক্ষা করবার।

হার্পারের কানে একটা মোটর গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ এল।

একটু ধরুন, কর্তা, বলেই সে জানলার দিকে গিয়ে দেখল ভিক্টর মোর লিংকন গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বার করে রাস্তায় নামিয়ে আনল, তারপর উধাও হয়ে গেল।

হার্পার মাইকের কাছ এসে বলল, ডারমট পালিয়েছে। ভদ্রলোকের মাথায় ঢুকেছে যে হয়তো তিনি ক্যাডিলাক গাড়িটা ধরতে পারবেন। এবার একটা বাচ্চার একটানা কান্নার শব্দ। হে ভগবান, এখন আবার ডারমটের বাচ্চাটা কান্না জুড়েছে। কী করব আমি?

শীগগির তোমারও বিয়ে হবে। তোমারও বাচ্চাকাচ্চা হবে। এখন থেকে অভ্যাস থাকা ভাল। তুমি বরং বাচ্চাটাকে হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে এস।

.

ঘন্টায় পঁচাশি মাইল বেগে ক্যাডিলাক গাড়িটা বোষ্ট্রনীকের দিকে ছুটল। চিতার মন উল্লাস ও বেপরোয়া উত্তেজনায় ভরে উঠেছে। ইতিমধ্যেই সে পালাবার একটা মতলব ভেবেছে। তাদের কাছেনগদ ষোলো লাখ ডলার আর এক জোড়া আগ্নেয়াস্ত্র আছে। এখন তাদের অসাধ্য কিছু নেই।

রিফ বলল, কোন চুলোয় যাচ্ছিস তুই? এত জোরে চালালে গাড়ি উল্টে যাবে।

একটা বাঁক ঘুরতে গিয়ে গাড়িটা বিপজ্জনক ভাবে কাত হয়ে গেল। অনেক ধস্তাধস্তির পর গাড়ি সোজা হলে চিতা আবার তুমুল গতিতে ড্রাইভ শুরু করল।

সভয়ে রিফ চীৎকার করল, শুনতে পাচ্ছিস না? গাড়ি উল্টে যাবে।

আঃ চুপ কর।

কোথায় যাচ্ছিস তুই?

ধারে কাছে নিশ্চয় একটা এয়ারপোর্ট আছে। আমাদের মেক্সিকো পালানো একমাত্র উপায়। একবার যদি একটা প্লেন ভাড়া করে বর্ডার পেরিয়ে মেক্সিকোতে ঢুকে পড়তে পারি, তাহলে আমাদের কেউ ছুঁতে পারবে না।

মাইরি, বুদ্ধি আছে বটে তোর। সত্যি, একবার মেক্সিকো পলাতে পারলেই এখানকার পুলিশ আর কিছু করতে পারবে না।

চিতা বলল, গাড়ির ভেতর কোথাও একটা রোড ম্যাপ আছে কিনা দ্যাখ। সবকিছু আমাকেই করতে হবে নাকি?

চটছিস কেন? বলে রিফ সামনে এসে চটপট গাড়ির সবকটা খোপর খুঁজল। কিন্তু কোনো রোড-ম্যাপ দেখতে পেল না। ক্যারীর দিকে ঘুরে বলল, কাছাকাছি কোনো এয়ার পোর্ট আছে?

এ এলাকার কোথায় এয়ারপোর্ট আছে তা সে জানত, কিন্তু এদেরকে সাহায্য করবার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।

আমি জানি না।

দাঁত খিঁচিয়ে, ঘুষি পাকিয়ে রিফ বলল, শিগগীর বলল এয়াপোর্ট কোথায়? ওসব ধাপ্পা আমি শুনতে চাই না। দাঁত ভেঙে দেব।

আমি জানি না।

চিতার দিকে তাকাল রিফ, এখন তাহলে কী করবি?

চিতা বলল, খুঁজে বার করতে হবে। পেট্রোল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তুই মেয়েটার পাশে গিয়ে বোস। পরের পেট্রোল পাম্পটায় থামতে হবে। তোর পিস্তল তৈরী রাখিস।

পৌঁছনোর শীর্ষে গিয়ে রিফ বলল, শোনো সখি!টু শব্দটি যেন না বেরোয়। শয়তানী করবার চেষ্টা করলে স্রেফ খতম।

তারা বোস্টন ক্রীকের কাছাকাছি এসে একটা পেট্রোল পাম্প দেখতে পেল।

আস্তে করে চিতা বলল, গোলমাল বাধতে পারে, সাবধানে থাকিস রিফ। নিজের রিভলবারটা সে উরুর নীচে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর গাড়ি ঢোকাল পেট্রোল পাম্পে।

একজন লম্বা-চওড়া, স্মিত চেহারার অ্যাটেন্ড্যান্ট গাড়িটা দেখতে পেয়ে বেরিয়ে এল।

 চিতা বলল, ট্যাঙ্ক ভর্তি করে দাও। ঝড়পোছ করবার দরকার নেই। আমাদের তাড়া আছে।

লোকটি হেসে হেসে পাইপের মুখটা গাড়ির ট্যাঙ্কের ভেতর দিয়ে বলল, তাড়া নেই কার? তেল, জল, চাকার হাওয়া সব ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ।

ক্যারীর ওপর থেকে চোখনা সরিয়ে রিফ একটা স্যুটকেসের ডালা খুলে একটি একশ ডলারের নোট বার করল।

অ্যাটেন্ড্যান্ট লোকটি বকবক করে চলল, তবু ভালো যে আপনারা টেলিফোন করতে চাইলেন না, ওটা সারাদিন ধরে খারাপ। আমায় পাগল করে তুলেছে। এই রাস্তা দিয়ে যে-ই যায় তারই টেলিফোন করবার দরকার হয়।

চিতা বলল, তাড়াতাড়ি হাত চালাও। আমাদের ফোনের দরকার নেই। আচ্ছা, কাছাকাছি এরোপ্লেন-ট্যাক্সির কোনো স্টেশন আছে?

লোকটি বলল, আছে বৈকি! এই রাস্তা ধরে মাইল দুয়েক গিয়ে বাঁদিকে ঘুরতে হবে। বাঁকের মাথায় একটা সাইনবোর্ডও আছে। ছোট স্টেশন,দুজন কমবয়সী ছেলে এই ব্যবসাটা করে। অবশ্য পয়সাকড়ি তেমন আসে না, কারণ কাছেই একটা বড় এয়ারপোর্ট আছে। তবে তাড়াতাড়ি প্লেন ভাড়া করতে চাইলে এখানেই সুবিধে হবে।

ট্যাঙ্ক থেকে হোসপাইপটা বার করে রিফের হাত থেকে একশ ডলার নিয়ে লোকটা বলল, ছোট নোট নেই?

না।

বেশ কিছু সময় লাগল নোটটা ভাঙিয়ে আনতে। রিফ বা চিতা ধারণাও করতে পারল না যে এই পেট্রোল পাম্পের টেলিফোন খারাপ থাকায় তাদের কতবড় সুবিধে হল। বোস্ট ক্রীক থেকে পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে একমাত্র পেট্রোল পাম্প যাকে পুলিশের লোকেরা ফোনে ধরতে পারেনি এবং ক্যাডিলাক গাড়িটি সম্পর্কে সতর্ক করতে পারেনি।

চিতা রাজপথ দিয়ে তীরবেগে গাড়ি ছোটালো। চিতার এই পালানোর মতলবটা রিফের যুৎসই মনে হচ্ছিল। কিন্তু একটু চিন্তা করতেই তার মনে হল, ব্যাপার অত সহজ নয়।

সে বলল, এই, মেক্সিকো যেতে পাসপোর্ট লাগবে না? প্লেনওয়ালারা যদি নিয়ে যেতে রাজি না হয়?

চিতা বলল, একশোবার রাজি হবে। আমাদের কাছে ষোলো লাখ ডলার ও দুটো পিস্তল আছে। রাজি হতেই হবে।

কিন্তু এ মেয়েটাকে নিয়ে কী করব? একে কোন কাজে লাগবে?

তোর কি মনে হয়? যতক্ষণ না আমরা নিরাপদ হচ্ছি ও আমাদের সঙ্গে থাকবে।

কী মনে হয় তোর? আমরা পালাতে পারব?

জানি না। তবে পালাবার চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।

সামনে একটা সস্তা সাইনবোর্ড দেখা গেল, তাতে লেখা,বসউইক বিমান-ট্যাক্সী কেন্দ্র, দু মাইল।

চিতা এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা বেয়ে এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে চলল।

.

১২.

যখন ভিক্টর নষ্টনীড়ে ফিরছিল তখন তার ক্যাডিলাক গাড়িতে অল্পই পেট্রোল ছিল। বোস্টন ক্রীকে পৌঁছনোর আগে ক্রেন ভাইবোনদের পেট্রোল নিতে থামতেই হবে। ওদের দশ মিনিট পরে ভিক্টর রওনা হয়েছে। ওরা যদি পেট্রোল নিতে গাড়ি থামায় তবে ভিক্টর জোরে গাড়ি চালালে ওদের ধরতে পারবে। ক্যারীর কাছাকাছি পৌঁছনো ছাড়া সে অন্য কিছু ভাবতেই পারছে না।

ভিক্টর লিংকন গাড়িটাকে এত জোরে চালাচ্ছিল যে পরপর তিনবার সে এগিয়ে আসা ড্রাইভারদের ঘাবড়ে দিয়ে বিদ্যুতের মত বেরিয়ে গেল। স্পীডোমিটার কাটা একশ দুই মাইলের ওপর স্থির হয়ে আছে। এ গাড়ি এত জোরে যেতে পারে না।

এখন তার আপশোস হচ্ছে ডেনিসনের অস্ত্র না নেওয়ার জন্য। যদি সে ক্যাডিলাককে ধরে ফেলতে পারে, তখন সে কী করবে? ওদের দুজনের কাছেই অস্ত্র আছে। সে কোন উপায়ে। ক্যারীকে মুক্ত করবে?

পাশের একটা গাড়ি পেরিয়ে ভিক্টর চলে গেল। তীব্র হর্নের আওয়াজ তার কানে এল। পিছিয়ে পড়া গাড়িটার ড্রাইভার চমকে শেষে হর্ন বাজিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

ভিক্টর সামনে একটা ক্যালটেক্স পেট্রোল পাম্প দেখতে পেল। রাস্তায় এই প্রথম পেট্রোল পাম্প। নিশ্চয় এখানেই ওরা পেট্রোলের জন্য থেমেছিল। তারপর সজোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামাল।

একটি উর্দিপরা লম্বা লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। ভিক্টর গাড়ি থেকে নামল।

 লোকটি বলল, আরে সর্বনাশ! আমায় ঘাবড়ে দিয়েছিলেন, আগুন নেভাতে ছুটছেন নাকি?

ভিক্টর প্রশ্ন করল, মিনিট দশেক আগে একটানীল-সাদা ক্যাডিলাক এখানে কি পেট্রোল নিতে এসেছিল? গাড়ির ভেতর দুজন মেয়ে আর একজন ছেলে ছিল?

খুশী গলায় লোকটি বলল, বাঃ, নিশ্চয়! এই মিনিট পাঁচেক তারা গেল। তারা আপনার বন্ধু বুঝি?

বন্ধুই বটে! দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভিক্টর বলল, কোথায় যাচ্ছে কিছু বলল?

একটি মেয়ে আমায় জিজ্ঞেস করছিল যে কাছাকাছি কোনো এরোপ্লেন-ট্যাক্সীর স্টেশন আছে কিনা। আমি বসউইক এয়ারপোর্টে যেতে বলেছি।

তোমার টেলিফোন আছে?

আজ সারাদিন ধরে ফোনটা খারাপ হয়ে আছে। দুঃখিত, কিন্তু কোনো উপায় নেই–ও, এই নিয়ে কতবার যে এই একই কথা বলতে হল।

ভিক্টর গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, একটা বন্দুক পিস্তল কিছু ধার দিতে পারো?

 বিস্ফারিত চোখে লোকটি বলল, বন্দুক? তার মানে?

বাদ দাও।

বন্দুক চাইলেন কেন শুনি একবার?

কিছু নয়,বলে গাড়ি হাঁকিয়ে সে বসউইক এয়ারপোর্টের দিকে চলল। বোস্টন ক্রীক যাবার সময় সে অনেকবার তাদের সাইনবোর্ড দেখেছে।

ভিক্টর ভাবল ওরা তাহলে আকাশপথে পালাবার চেষ্টা করছে। পেট্রোল পাম্পের লোকটির কথানুযায়ী ওরা বড়জোর পাঁচ থেকে দশমিনিট এগিয়ে রয়েছে। একটা প্লেন ভাড়া করে আকাশে উঠতে অন্ততঃ একঘণ্টা লাগবে। সুতরাং তার আগেই সে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে পারবে।

.

র‍্যালফ বসউইক টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে উঠে দাঁড়াল। বসউইকের বয়েস বেশী নয়বলিষ্ঠ চেহারা, মাথায় বালি রঙের চুল।

তার পার্টনার জেফ ল্যান্সিং প্লেনের একটা বাতিল করা চেয়ারের ওপর গা এলিয়ে শুয়েছিল। সে বলল, কে ফোন করেছিল।

একটা সিগারেট ধরিয়ে বসউইক বলল, তুই হয়তো বিশ্বাস করবি না। পুলিশ স্টেশন থেকে ফোন করেছিল। বলল যে একদল অপহরণকারী এখানে হানা দিতে পারে। একটি মেয়ে ও একটি ছেলে অন্য একটি মেয়েকে চুরি করে নাকি এইদিকেই আসছে। পুলিশগুলোর মাথা খারাপ। পুরো গত হপ্তাটায় কাউকে এদিকে মাড়াতে দেখলাম না।

লম্বায় ল্যান্সিং তেমন বেশী নয়, তবে চওড়ায় প্রচুর। গায়ের রং শ্যামলা। বসউইকের চেয়ে বয়সে একটু বড়। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পার্টনারের দিকে তাকিয়ে সে বলল,লোকগুলো কেমন দেখতে? সে বিষয়ে কিছু বলল নাকি?

 নিশ্চয়। ছেলেটা লম্বা, বলিষ্ঠ, আর শ্যামলা চেহারা। কালো চামড়ার পোশাক পরে আছে। মেয়েটার চুল সোনালী, সে ঐ ছেলেটিরই যমজ বোন। অন্য মহিলাটি সুন্দরী, চুলের রং লালচে। ওরা বলল, ডাকাতদের প্রত্যেকেই সশস্ত্র এবং অতি বিপজ্জনক।

ল্যান্সিং বলল, ডাকাতগুলো যদি প্লেন বাগাবার মতলবে থাকে তাহলে এরকম একটা নির্জন এয়ারপোর্টেই প্রথমে হানা দেবে। বিপজ্জনক লোক।

বটে? বলে সে ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা ৪৫ অটোম্যাটিক রিভলবার বার করল।

হেসে বসউইক বলল, ছেলেমানুষি করিসনা, জেফ। ওটা চালাতে গেলে তোর হাতেই ফেটে যাবে। গত কয়েক বছরে একবারও ওটাকে পরিষ্কার করা বা তেল দেওয়া হয়নি। আর তাছাড়া ওর কার্তুজ পর্যন্ত নেই।

বিব্রত হয়ে ল্যান্সিং রিভলবারটা ড্রয়ারে রেখে দিয়েবলল, ডাকাতগুলো যদি সত্যিই এখানে আসে তাহলে আমরা মাইরি একেবারে বোকা বনে যাব।

 বসউইক বলল, আসবেনা। আমাদের এখানে কেউ আসতে চায় না।–জেফ, কথাটা বলতে আমার ভালো লাগছেনা কিন্তু খাতাপত্র দেখে মনে হচ্ছে যে শিগগীর নতুন একটা কিছু না ঘটলে আমাদের পাততাড়ি গুটানো ছাড়া উপায় নেই। এ ব্যবসাটা মোটেই চলছে না।

তোকে নিয়ে আসল ঝামেলা যে, তুই রাতারাতি বড়লোক হতে চাস। আরে বাবা, সবকিছুতেই একটু সময় লাগে। আরো মাস দুয়েক দ্যাখ, তার মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

বসউইক ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বার করতে করতে বলল, যদি এইভাবেআর কিছুদিন চলে, আমরা স্রেফ দেউলিয়া হয়ে যাব। সত্যি বলছি, জেফ। আয়, এই হিসেবগুলো দেখে যা একবার।

তাঁরা দুজনে মিলে দেনা-পাওনার হিসেব শুরু করল। পুরো এক ঘণ্টা ধরে যোগবিয়োগ করবার পর পেনসিল ফেলে ল্যান্সিং উঠে দাঁড়াল।

অবস্থা যে এত খারাপ তা আমি এর আগে কখনো ভাবিনি, এখন আমরা কী করব?

বসউইক বলল, অন্যেরা যা করে, তাই করতে হবে আর কি। আমাদের চেয়েও বুদ্ধ কাউকে পাকড়ে ব্যবসাটা বিক্রি করে দিতে হবে। আমরা হঠাৎ সে থেমে গেল। অফিসঘরের দরজা নিঃশব্দে খুলে গেছে, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে ফুলকাটা সুতির পোশাক, মাথার চুল অযত্নভরে সোনালি রঙে রাঙাননা। আর দুই চোখে সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি।

চিতা বলল, একটা প্লেন চাই–আমাকে ও আমার বন্ধুদের এক্ষুনি স্যান ফ্রান্সিসকো নিয়ে যাবার জন্য। পাওয়া যাবে কী?

প্রশস্ত হাসি হেসে ল্যান্সিং বলল, আরে নিশ্চয়! প্লেন তৈরী আছে। স্যানফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টের অনুমতি পেয়ে গেলে আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে উড়ে যেতে পারবো। তাহলে হবে তো?

সন্দেহভরে চিতা প্রশ্ন করল, স্যানফ্রান্সিসকোর অনুমতি নিতে হবে কেন?

ল্যান্সিং বলল, ওখানে প্লেন নামাতে গেলে অনুমতি নিতে হয়, বেশিক্ষণ লাগবে না।

মেয়েটির চেহারাটা তেমন সুবিধের ঠেকছে না। সহসা বসউইকের মনে পড়ল পুলিশের সতর্কবাণী। সে সহজভাবে বলল, ওকে এবং ওর সঙ্গীদের ওয়েটিং রুমে নিয়ে বসাও, জেফ। কফি টফি যা লাগে এনে দাও। আমি অনুমতির ব্যবস্থা করছি।

চিতার দিকে ফিরে ল্যান্সিং বলল, নিশ্চয়। এদিক দিয়ে আসুন। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি সে নেমে গেল। চিতা কাপড়ের ভাজে রাখা রিভলবারটা তুলে ধরেছে।

ফোন-টোন কিছু করতে হবে না। এক্ষুনি আমাদের আকাশে উড়তে হবে। ডেস্ক থেকে সরে এসো।

বসউইক ল্যান্সিং-এর পাশে এসে দাঁড়াল। ল্যান্সিং অবাক হয়ে বলল, এসব কী হচ্ছে?

চুপ করো বলে চিতা অফিসের আরো ভেতরে ঢুকল পেছনে ক্যারী ও রিফ। আর রিফের গায়ে কালো চামড়ার পোশাক দেখে ল্যান্সিং বুঝল, এরাই সেই ডাকাত দল।

টেলিফোনের তার রিফ একটানে ছিঁড়ে ফেলল, তোমরা দুই মক্কেল যদি বেঁচে থাকতে চাও তাহলে যা বলছি তাই করো। আমাদের বেশী সময় নেই। আমরা সীমান্ত পেরিয়ে মেক্সিকো পালাতে চাই–আমাদের নিয়ে যেতে হবে। অতএব চটপট হাত-পা চালাও।

বসউইক বলল,মেক্সিকো? অসম্ভব।ভি জুয়ানা এয়ারপোর্টে প্লেন নামানোর অনুমতি নিতেই হবে। তাছাড়া পাসপোর্ট কন্ট্রোল দপ্তরের লোকেরাও তোমাদের চেপে ধরবে। ওরকম করে মেক্সিকো যাওয়া যায় না।

চিতা বলল, হ্যাঁ, যায়। তোমরা আমাদের যে কোনো জায়গায় একটা মাঠের ওপর নামিয়ে দেবে। এয়ারপার্টেই নামতে হবে এমন কোন কথা আছে? সোজা কথা, আমরা মেক্সিকো যাব। আর তোমাদের নিয়ে যেতে হবে।

বসউইক বলল, তা হয় না। একটা হালকা প্লেনকে মাঠে নামানো সম্ভব নয়। আর মাঠই বা তেমন পাচ্ছ কোথায়? মেক্সিকো গিয়েছ কোনদিন? এ হয় না।

অস্বস্তিভরে রিফ বোনের দিকে তাকাল। খামোখা সময় নষ্ট হচ্ছে। রাস্তা বরাবর পালাবার চেষ্টাই করা যাক। আমার আগেই মনে হয়েছিল এ মতলবটা তেমন–

চুপ কর! আমরা মেক্সিকোই যাবো। গুলি খেতে না চাও তো আমাদের ভালোয় ভালোয় পৌঁছে দাও। চলল।

হতাশ ভঙ্গীতে বসউইক বলল, তোমরা যদি তাই চাও, তাই হোক তাহলে। রিভলবারের সঙ্গে তর্কাতর্কি চলে না। তবে আমি আগেই বলে দিচ্ছি, ক্র্যাশ-ল্যান্ড করতে হতে পারে। আমার প্লেনের পাল্লা তেমন বেশীনয়।সুবিধেমত একটা সমতল জায়গার করবার আগেই তেল ফুরিয়ে যেতে পারে।

চিতা বলল, সে যখন হবে তখন দেখা যাবে, অত কথা বলতে হবে না। চটপট করো।

বসউইক ল্যান্সিং-এর দিকে বা চোখের পাতা একটু নাচিয়ে বলল, তুই বরং প্লেনটা তৈরী কর, জেফ।

ল্যান্সিং বলল, ঠিক আছে। কিন্তু তার মনে হল বসউইক বোধহয় বিপজ্জনক কিছু একটা মতলব করছে।

চিতাকে রিফ বলল, তুই ওর সঙ্গে যা। আমি এ দুজনকে পাহারা দিচ্ছি। চিতা বলল ল্যান্সিংকে, চলো, দোস্ত। চালাকী করবার চেষ্টা করো না।

.

এড ব্ল্যাক ডেনিসনের অন্যতম কর্মচারী টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখল।

এলাকার সবকটা পেট্রোল পাম্পকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে কর্তা, কেবল বোস্টন ক্রীকের বাইরের পাম্পটাকে খবর দেওয়া যায়নি ওদের ফোন খারাপ বলে।

ম্যাপ থেকে ডেনিসন মুখ তুললেন।

তিনি অধীরভাবে বললেন, একজন টহলদারী অফিসারকে তাড়াতাড়ি পাঠাও। ওখানেই ডাকাতগুলোর থামবার সম্ভাবনা বেশী।

মাইক্রোফোন তুলে নিল ব্ল্যাক। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বোস্টন ক্রীক-গামী পুলিশের একটি গাড়িকে ধরা গেল। টহলদারী পুলিশ অফিসার বেনিং জানাল যে, সে এক্ষুনি ক্যালটেক্স পেট্রোল পাম্পটিতে খবর পাঠাচ্ছে।

রাত একটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে ক্যালটেক্স পেট্রোল পাম্পের অ্যাটেন্ডটির ছুটি হয়ে গেছে এবং তার জায়গায় এসেছে তার সহকারী। তার ডিউটি রাত একটা থেকে পরদিন সকাল নটা পর্যন্ত।

বেনিং-এর প্রশ্নের উত্তরে সহকারীটি বলল, আমি তো সে বিষয়ে বলতে পারব না। আমি এইমাত্র কাজে এসেছি। ফ্রেড হয়তো কিছু খবর দিতে পারত কিন্তু তার ডিউটি শেষ হয়ে গেছে।

তার বাড়ির ফোন নম্বর জানো?

জানি বৈকি। কিন্তু আমাদের টেলিফোন কাজ করছেনা। তাছাড়া ফ্রেড বোধহয় এখনো বাড়ি। ফেরেনি। সে প্রতিদিন বোস্টন ক্রীকের কোনো এক রেস্তোরাঁয় থেমে রাতের খাবার খেয়ে নেয়।

বেনিং ফ্রেডের বাড়ির ফোন নম্বর ও ঠিকানা নিয়ে গাড়িতে ফিরে ওয়্যারলেস মারফৎ ডেনিসনকে সব জানাল।

ডেনিসন আদেশ দিলেন, খুঁজে বার করো তাকে। চটপট।

কফি হাউসের সংখ্যা কম নয় বোস্টন ক্রীকে। রাত প্রায় পৌনে দুটোয় বেনিং ক্যালটেক্সের অ্যাটেন্ড্যান্টটিকে খুঁজে বার করল। ফ্রেডের কাছে সমস্ত খবর সংগ্রহ করে ডেনিসনকে জানাতে দুটো বাজল।

টম হার্পার ততক্ষণে হেড কোয়ার্টার্সে এসে গেছে। অতিশয় তেতো মুখে ডারমটের ছেলেকে কোলে করে ভেতরে ঢুকল। বাচ্চাটা সারা রাস্তা চেঁচিয়েছে। দুজন মহিলা পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কান্না থামাতে পারল না।

ডেনিসন বললেন, ওরা বসউইক এরোপ্লেন-ট্যাক্সীর স্টেশনের দিকে চলেছে। খুব সম্ভবতঃ মেক্সিকো পালাবার চেষ্টা করবে। ওরা আমাদের চেয়ে এক ঘণ্টা এগিয়ে আছে। অবশ্য ডারমট ওদের পেছন পেছন গেছে। তুমি একবার ঐ এয়ারপোর্টটাকে সতর্ক করে দাও।

হার্পার ফোন করার চেষ্টা করল কিন্তু ফোন খারাপ।

ডেনিসন বললেন, আমি বেনিংকে বলেছি ঐ এয়ারপোর্টে যেতে। যতক্ষণ মিসেস ডারমট ওদের হাতে রয়েছেন ততক্ষণ আমরাও ওদের ওপর চড়াও হতে পারছি না। চলে এসো, টম। আর বসে থাকা যায় না। আমরা হেলিকপ্টারে ঘটনাস্থলে গিয়ে পড়ি।

.

এয়ারপোর্ট পর্যন্ত চলে যাওয়া কাঁচা রাস্তার মাঝামাঝি এসে ভিক্টর গাড়ির আলো নিভিয়ে দিল। আস্তে গাড়ি চালিয়ে এয়ারপোর্টের গেটের সামনে থামল। নেমে গাড়ির পেছনদিকের ডালা খুলে গাড়ি মেরামত করার যন্ত্রপাতিগুলো থেকে একটা ছোট্ট লোহার বড় নিল–এটাই অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগতে পারে। তারপর দ্রুত সতর্ক গতিতে ছোট অফিস ঘরটার দিকে এগোলো।

ক্যাডিলাক গাড়ির কাছাকাছি আসতেই ভিক্টর দেখল একটি ছেলে ও একটি মেয়ে বেরিয়ে আসছে। চিতাকে সে চিনতে পারল। ক্যাডিলাকের পেছনে লুকিয়ে সে শুনতে পেল চিতা ছেলেটিকে বলছে, পা চালাও দোস্ত। হাতে পায়ে খিল ধরেছে নাকি?

তারা বেশ কিছুদূর যাওয়া পর্যন্ত ভিক্টর অপেক্ষা করল, তারপর নিঃশব্দে অফিসঘরের জানলায় উঁকি মারল।

দেওয়ালে হেলান দিয়ে একজন বলিষ্ঠ চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে ডেস্কের ওপর রিফ বসে। আর তাদের থেকে একটু দূরে ফ্যাকাশে মুখে ক্যারী দাঁড়িয়ে।

প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল ঘরে ঢুকে রিফকে আক্রমণ করে। কিন্তু সে জানত, যতক্ষণ রিফের হাতে পিস্তল আছে, ততক্ষণ তাকে পরাস্ত করা যাবে না। তার মাথায় এক মতলব, এল। দ্রুতপদে ক্যাডিলাক গাড়িটার কাছে গিয়ে পেছনের সীটে তাকাল। দেখল টাকা ভর্তি স্যুটকেসটা সেখানেই রয়েছে। ভিক্টর সে দুটোকে গাড়ি থেকে বার করল, একবার উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে হ্যাঁঙ্গারের দিকে তাকাল।

হ্যাঙ্গারের দরজা খুলে ল্যান্সিং ভেতরে ঢুকছে, পেছনে চিতাও। দুহাতে দুটো সুটকেস নিয়ে ভিক্টর অফিসঘরের পেছন দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

চিতা হ্যাঙ্গারের ভেতর দাঁড়িয়ে ল্যান্সিং-এর প্লেন চালু করা দেখছিল।

দেখ দোস্ত, ভেবো না যে বিনি পয়সায় তোমাদের দিয়ে এসব করিয়ে নিচ্ছি। আমাদের মেক্সিকো পৌঁছে দিতে পারলে পুরো এক হাজার ডলার পাবে। তোমাদের ব্যবসা পত্রের যা অবস্থা দেখছি তাতে এ টাকা তোমাদের অনেক কাজে লাগবে।

ল্যান্সিং বলল, তাই নাকি? আর যদি ক্র্যাশ-ল্যান্ডিং করতে নিয়ে প্লেনটি ভেঙ্গে যায়?

আঃ চেপে যাও। প্লেনটা ইনসিওর করা আছে নিশ্চয়? এখন হাত চালাও।

হঠাৎ বসউইকের নজর পড়ল রিফের ক্ষতবিক্ষত ফুলে ওঠা কব্জির ওপর। তার মনে হল যদি কোনক্রমে রিফের কাছাকাছি যেতে পারে, তাহলে পিস্তলটা ছিনিয়ে নেওয়া মোটেই শক্ত হবে না। কব্জির যা অবস্থা তাতে ডানহাতটা অচল বললেই হয়।

বসউইক বলল, আমার পার্টনার একা প্লেন চালু করতে পারে না। প্লেনটা ঠেলে বার করতে দুজন লাগে। তোমাদের যদি সত্যিই তাড়া থাকে তাহলে এখন হ্যাঁঙ্গারে গিয়ে আমার হাত লাগানো উচিত।

আগে একথা বলনি কেন?

তোমরা আমাকে রীতিমত ঘাবড়ে দিয়েছিলে।

 রিফের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সে সহজভাবে জানলার কাছে গিয়ে বাইরেটা দেখল। রিফ সতর্ক ভঙ্গীতে তার ওপর পিস্তলের নল উচিয়ে রইল।

হুম, আমাকেও হাত লাগাতে হবে দেখছি। চলো যাওয়া যাক।

 রিফ ক্যারীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এসো।

বসউইককে বলল, তুমি আমার সামনে যাও।

বসউইক এখন রিফের তিন ফুটের মধ্যে। ক্যারী এখনো নড়েনি দেখে রিফ ঘুরে তাকে দরজা দিয়ে বেরোতে ইঙ্গিত করল। ফলে বসউইকের উল্টোদিকে ঘুরতে হল তাকে।সঙ্গে সঙ্গে বসউইক ঝাঁপিয়ে পড়ে পিস্তলটা আঁকড়ে ধরল। পিস্তলের নল এক ঝটকায় নীচের দিকে নেমে যেতেই সশব্দে গুলি ছুটলবুলেটটা ক্যারীর কয়েক ফুট দূরে মেঝের ওপর এক গর্তের সৃষ্টি করল।

বসউইক বুঝতে পারেনি যে রিফের গায়ে কী অসামান্য শক্তি। হাতাহাতি লড়াইয়ে রিফের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কথাও তার জানা ছিল না।

রিফ তার ডানহাত ব্যবহার করতে না পেরে তার লোহা বাঁধানো স্কী বুট দিয়ে সজোরে বসউইকের পায়ে আঘাত করল। তীব্র যন্ত্রণায় তার হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে এল। পরক্ষণেই রিফ কাঁধের এক ধাক্কায় দেওয়ালের ওপর ছিটকে ফেলে দিল তাকে। তারপর কুৎসিত মুখভঙ্গী করে পিস্তল তুলে বসউইককে গুলি করল।

ক্যারী দুহাতে মুখ ঢেকে কুঁকড়ে সরে গেল। বসউইকের হালকা বাদামী রঙের শার্ট রক্তে ভিজে গেল। তারপর তার চোখ উল্টে গেল, দেয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল মেঝের ওপর।

গুলি চলবার কয়েক সেকেন্ড আগে ল্যান্সিং এরোপ্লেনের ইঞ্জিন চালু করেছিল। ইঞ্জিনের তীব্র গর্জনে গুলির শব্দ চাপা পড়ে গেল। ভিক্টরও গুলির আওয়াজ শোনে নি। সে অফিসঘর থেকে শখানেক গজ দূরে এয়ারপোর্টের সীমানা বরাবর একটা ফাটলের মধ্যে স্যুটকেসটা ফেলে দিয়ে ফিরে আসছিল।

রিফ গালাগাল দিতে গিতে ক্যারীকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এল। হ্যাঁঙ্গারের দিকে পা চালাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে গেল।

বিড় বিড় করে সে বলল, কী হল আমার। টাকাটা নিতেই ভুলে যাচ্ছিলাম আরেকটু হলে। এক পা নড়বে না এখান থেকে। বলে ক্যাডিলাকের কাছে গিয়ে পেছনের সীটে হাত বাড়াল স্যুটকেস দুটোর জন্য। না পেয়ে সচকিত হয়ে এক টানে পেছনের দরজা খুলে ফেলল। গাড়ির ভেতরের আলো জ্বালল।

সবিস্ময়ে রিফ ফাঁকা সীটটার দিকে তাকিয়ে রইল–তার সর্বাঙ্গে এক আশ্চর্য রাগ ও ভয়ের অনুভূতি। সামনের সীটটা একবার দেখল, বিড়বিড় করতে করতে ছুটে পেছনের ডালা খুলল।

টাকা উধাও হয়ে গেছে।

স্তম্ভিত হয়ে রিফ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। ষোল লাখ ডলার। অদৃশ্য হয়ে গেল? কে নিল?

কারীর বুক দুরদুর করছে রিফের ভাবসাব দেখে।তার ডানদিকে কুড়িগজ দূরে অফিসঘর থেকে একফালি আলো এসে পড়েছে, তাছাড়া শুধু জমাট অন্ধকার। একবার যদি ঐ অন্ধকারে গা ঢাকা দিতে পারে, তাহলে বোধহয় কেউ তাকে ধরতে পারবেনা। এই তার পালাবার সুযোগ। এখন যদি পালাতে না পারে তাহলে মেক্সিকো পৌঁছনোর পর তার যে কী অবস্থা হবে তা ভাবা যায় না।

ক্যারী সেই অন্ধকারের দিকে ছুটল। এত জোরে জীবনে সে কখনও দৌড়য়নি।

তখনও রিফ দাঁড়িয়ে ভাবছে, কে নিল টাকাটা? টাকার কথা ছাড়া তখন তার মাথায় আর কিছু নেই। ক্যারীর কথা সে সম্পূর্ণ ভুলেই গেছে।

রিফের সহসা মনে হল চিতা! চিতা তার সঙ্গে প্রতারণা করছে। চিতাই তবে পকেট থেকে রিভলবার চুরি করেছে। চিতই ভিয়েতনামী চাকরটার মৃতদেহ বার করেছিল। চিতাই জেলডার সঙ্গে তার বিয়ের মতলব বানচাল করে দিয়েছে। আর এখন সেই চিতাই তাকে ফেলে সব টাকা নিয়ে মেক্সিকো পালাচ্ছে।

সে দুশো গজ দূরে হ্যাঁঙ্গারের দিকে তাকাল। অনেকগুলো বড় বড় আলো জ্বলে উঠল। রানওয়ের একাংশ উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল। ছোট্ট প্লেনটা হ্যাঁঙ্গারের ভেতর থেকে বেরিয়ে রানওয়ের ওপর দাঁড়াল। রিফ দেখল চিতাও বেরিয়ে এসে প্লেনের দিকে এগোচ্ছে। উজ্জ্বল আলোতে চিতাকে খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। টহলদারীঅফিসার বেনিংও তাকে দেখতে পেল। বেনিং সবে এয়ারপোর্টে পৌঁচেছে। এবড়ো-খেবড়ো ঘাসজমির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে হ্যাঁঙ্গারের দিকে তাকিয়েছিল। রিফ ও ক্যারীকে সে অফিসঘর থেকে বেরোতে দেখেছে। আপাততঃ এরোপ্লেন ও চিতাকে দেখে ভাবছিল এখন তার কী করা উচিত। দূর আকাশ থেকে যেন এক যন্ত্রযানের ক্ষীণ গর্জন ভেসে আসছে। বেনিং ভাবল, মনে হচ্ছে এ ডেনিসনের হেলিকপ্টারের আওয়াজ।

রিফের মাথায় প্রচণ্ড আক্রোশে আগুন জ্বলছিল। পিস্তলশুদ্ধ হাত ক্যাডিলাকের ছাদের ওপর রেখে চিতার পিঠের ওপর লক্ষ্য স্থির করল। চিতা দাঁড়িয়েছিল আর ল্যান্সিং প্লেনটাকে ঠিকমত রানওয়ের ওপর দাঁড় করাচ্ছিল।

রিফের মনে হল, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চিতা প্লেনে উঠবে আর টাকাশুদ্ধ উধাও হয়ে যাবে। একবার দ্বিধা করল হয়তো দূরত্বটা বেশী হয়ে যাচ্ছে। ইতস্ততঃ করা সত্ত্বেও ট্রিগারের ওপর আঙ্গুলের চাপ বেড়ে গেল। সহসা তীব্র এক আলোর ঝলকানি দিয়ে ভীষণ শব্দে পিস্তল গর্জে উঠল।

ভিক্টর ছোট লোহার রডটা সজোরে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে অফিস ঘরের আলোকিত জানলার দিকে ছুটে আসছিল। কিন্তু পঞ্চাশ গজ মত যাবার পর হঠাৎ সে থেমে গেল।

ক্যারীর হাত ধরে অফিস থেকে রিফকে বেরিয়ে আসতে দেখল। ভিক্টর অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে বসে তাদের ওপর নজর রাখল। দেখল রিফ থমকে দাঁড়িয়ে ক্যারীকে কী যেন বলে গাড়ির দিকে গেল।

বুক ঢিপ ঢিপ করছে ভিক্টরের গুণ্ডাটা এক্ষুনি জানবে যে টাকাভর্তি সুটকেস দুটো উধাও। এখন তার কী করা উচিত? দেখতে পেল ক্যারী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। রিফ গাড়ির দরজা খুলছে। ক্যারী যেন সহসা প্রাণ পেয়ে তীরবেগে তার দিকেই ছুটে আসছে। রিফ কী দেখে ফেলবে? গুলি চালাবে? কিন্তু না, রিফ খেয়ালই করল না যে ক্যারী, পালাচ্ছে।

ক্যারী তার কুড়ি গজের মধ্যে এলে, ভিক্টর উঠে দাঁড়াল।

ক্যারী! আমি ভিক্টর।

কোনোরকমে ভয়ার্ত চীৎকারটাকে চেপে তার দিকে তাকাল। অন্ধকারের মধ্যে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ভিক্টর আবার বলল, আমি, ডার্লিং!

ক্যারী তার বাহু বন্ধনের মধ্যে ছুটে এল। ভিক্টরকে আঁকড়ে ধরল। ভিক্টর রিফের দিকে তাকাল, রিফ এখনও টের পায়নি। সে হ্যাঁঙ্গারের দিকে চোখ ফেরাল। চিতাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পরক্ষণেই পিস্তলের গর্জনে তারা চমকে উঠল। ভিক্টরের চোখের ওপর চিতা একবার কেঁপে উঠে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল রানওয়ের ওপর।

ভিক্টর বলল, চল, পালানো যাক। ক্যারীকে টানতে টানতে সে এয়ারপোর্টের প্রবেশদ্বারের দিকে ছুটল।

কিছুদূর যেতে না যেতেই অন্ধকারের ভেতর থেকে আদেশ শোনা গেল, থামো! পালাবার চেষ্টা করো না।

ভিক্টর এক টানে ক্যারীকে থামিয়ে দিল। পুলিশ অফিসার বেনিং পিস্তল হাতে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল।

মাটির বুকে চিতা আছড়ে পড়তেই রিফ এক তীব্র, অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করল। মনে হল যেন একটা ধারালো ছোরা তাকে–এফেঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। দীর্ঘ ভয়াবহ কয়েকটা মুহূর্ত সে তার ভূলুষ্ঠিত বোনের দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। চিতার স্কার্ট অনেকখানি উঠে গেছে, তীব্র আলোয় তার সোনালী চুল নেচে বেড়াচ্ছে।

সহসা রিফের নিঃসঙ্গ মনে হল, সে আতঙ্কগ্রস্তের মত হ্যাঁঙ্গারের দিকে ছুটে চলল।

ল্যান্সিং পাইলটের আসনে বসে তাকে দেখতে পেল। একবার ইচ্ছে হল সোজা প্লেনশুদ্ধ চম্পট দিতে, কিন্তু বসউইকের কথা মনে পড়ে গেল। তাই সে চুপচাপ বসে রইল–প্লেনের ইঞ্জিন গর্জে উঠল, প্রপেলারের পাখা তীব্র গতিতে ঘুরে চলল।

বোনের কাছে এসে রিফ হাঁপাচ্ছে আর ঘামছে। চিতার পিঠের ঠিক মাঝখানে জামার ওপর লাল রক্তের ছোপ। রিফ হাঁটু গেড়ে বসে পিস্তল নামিয়ে খুব সাবধানে বোনকে চিৎ করল।

চিতা গুঙিয়ে উঠল। চোখ মেলে বলল, পালা, পুলিশ এসে গেছে। এই প্লেনে চেপে পালা–আমার জন্য ভাবিস না। পালিয়ে যা শীগগির।

রিফ কাঁপা গলায় বলল, টাকাটা কোথায়? কোথায় রেখেছিস? আমার সঙ্গে তুই এরকম কেন করলি?

চিতা মাথা নেড়ে অতিকষ্টে কী যেন বলতে গেল কিন্তু চোখ বন্ধ হয়ে গেল।

রিফের গলা ভেঙ্গে গেল, চিতা। টাকাটা কোথায়? কী করেছিস তুই টাকাটা নিয়ে?

অনেক চেষ্টায় চিতা বলল, টাকা তো গাড়িতেই আছে কী বলছিস কী তুই? ওটা নিয়ে প্লেনে উঠে পড়, রিফ! আমায় গুলি করেছে ওরা।

রিফ সোজা হয়ে বসল। পাইলটের আসন থেকে তার দিকে তাকিয়ে ল্যান্সিং শিউরে উঠল। তার মনে হল, ছেলেটা বুঝি এক্ষুনি উন্মাদ হয়ে যাবে।

রিফ চিৎকার করে উঠল তুই টাকাটা নিসনি? টাকাটা যে উধাও হয়ে গেছে। আমি ভাবলাম তুই নিয়েছিস। শুনতে পাচ্ছিস? টাকা উধাও হয়ে গেছে।

চিতা তীব্র যন্ত্রণায় কেঁপে উঠল, আমি নেব? আমি নিতে যাব কেন? ও তো আমাদেরই টাকা–তোর আর আমার। আমি নেব কেন?

দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে রিফ নিজের মাথায় ঘুষি মারতে লাগল। কানের ওপর বাঁধা নোংরা ব্যান্ডেজটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। অসহ্য দুঃখ ও যন্ত্রণা তাকে উন্মাদ করেছে।

চিতা–আমি ভাবলাম তুই ও টাকা চুরি করেছিস। আমিই তোক গুলি করেছি, বোনটি। আমায় মাফ করে দে। আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বোনটি। আমি তোকে এখান থেকে নিয়ে যাব, তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তুই কিছু ভাবিসনে।

ঠোঁট বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ল, চিতারিফের একটাহাতনিজের হাতেরমধ্যে ধরে, তুই যা রিফ! এখন আর আমার জন্য কিছু করবার নেই। আমি সব বুঝতে পেরেছি-তুই এখন পালা।

আমি তোকে ফেলে কোথাও যাবো না। বলে পাগলের মত পিস্তলটা হাতে তুলে নিল। একসঙ্গেই যাব আমরা। মেক্সিকো পৌঁছলেই তোকে সারিয়ে তোলবার ব্যবস্থা করব। সব ঠিক হয়ে যাবে, বোনটি! টাকা পয়সা সব চুলোয় যাক। আমরা আগের মত থাকব–তুই আর আমি।

চিতাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল রিফ। চিতার মুখ থেকে এক চাপা কান্না বেরিয়ে এল, সমস্ত শরীর বেঁকে গেলো। তারপর মুখ দিয়ে আরো রক্ত বেরোলে–চোখ বুজে এল।

চিতার প্রাণহীন মুখের দিকে তাকিয়ে রিফ দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ওপর গরম রক্তের স্পর্শ পেল। তারপর আবার চিতাকে মাটিতে আস্তে করে শুইয়ে দিল।

চিতা মরে গেছে। চিতার মুখটা সে যেন আর চিনতে পারছে না। এই কি সেই চিতা! যাকে সে ভালবাসত, যার সঙ্গে সে ঝগড়া করেছে, চুরি করেছে, বড় হয়েছে। জীবনের সবকিছু ভাগ করে নিয়েছেনা, এ কখনো চিতা নয়।

তার গলা দিয়ে এক বন্য পাশবিক-আর্তনাদ বেরিয়ে এল। রিফ শোকে দুঃখে উন্মত্ত হয়ে দুহাতে মাটির ওপর ঘুষি মারতে মারতে একটানা কেঁদে চলল।

.

হেলিকপ্টারের পাইলট আঙুল দেখিয়ে বলল, প্লেনের ইঞ্জিনের অত আওয়াজে ওরা কিছু শুনতে পাবে না। আমি আপনাদেরকে নামিয়ে দিতে পারি–কেউ টের পাবে না।

ডেনিসন বললেন, নামাও তাহলে।

এয়ারপোর্ট থেকে পাঁচশো গজের মধ্যে হেলিকপ্টারটি আস্তে করে নামল। পিস্তল হাতে ডেনিসন ও হার্পার বেরিয়ে এলেন। প্লেনটা হ্যাঁঙ্গারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিফ তার বোনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। হঠাৎ একটা মৃদু শিসের আওয়াজ। টহলদারী অফিসার বেনিং অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল।

আমি বেনিং স্যার। আমার সাথে মিঃ ও মিসেস ডারমট আছেন। একটু আগে গুলির আওয়াজ পেলাম। আমি এগিয়ে গিয়ে দেখব?

ডেনিসন ভিক্টর ও ক্যারীকে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন।

তিনি বললেন, সব ঠিক আছে। এই অফিসারটি আপনাদের হেডকোয়ার্টার্সে পৌঁছে দেবে। এখন আর ভয়ের কিছু নেই। সেখানে আপনাদের বাচ্চা আছে। আপনারা রওনা হন। আমরা এখানকার বাকী কাজটুকু সেরে ফেলছি। বেনিং তুমি মিঃ এবং মিসেস ডারমটকে সোজা হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যাও।

ভিক্টর বলল, ঐখানে একটা ফাটলের মধ্যে ষোলো লাখ ডলার রাখা আছে।

হেসে ডেনিসন বললেন, টাকার কথা এখন বাদ দিন। আপনারা চটপট হেডকোয়ার্টার্সে যান। মনে হয়, আপনারা ওখানে পৌঁছলে আমার লোকেরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে।

বেনিং ভিক্টর ও ক্যারীকে নিয়ে তার গাড়ির দিকে রওনা হল। ডেনিসন রওনা হলেন প্লেনের দিকে, সঙ্গে হাপার।

চিতার দেহের চারিপাশে রিফ এখন চক্কর খাচ্ছে। সে যেন নিজেই জানে না সে কী করছে, সহসা একবার আহত জন্তুর মত আর্তনাদ করে উঠল। ল্যান্সিং-এর সবকটা লোম খাড়া হয়ে গেল।

এখন ডেনিসন ও হার্পার আর বেশীদূরে নেই। একজোড়া পিস্তল উঁচিয়ে উঠল রিফের ওপর। চড়া গলায় ডেনিসন বললেন, পিস্তল ফেলে মাথার ওপর দুহাত তোলো।

 চট করে রিফ ঘুরে দাঁড়াল।মূঢ়ের মত গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে ভয়ে দিশেহারা হয়ে সহসা সে উল্টোদিকে দৌড় লাগাল, অন্ধের মত ছুটে এসে পড়ল এরোপ্লেনের প্রপেলারের ওপর। বিশাল প্রপেলারটা তখননক্ষত্ৰবেগে ঘুরে চলেছে–কেউ কিছু বোঝবার আগেই সাক্ষাৎ মৃত্যুর মত নেমে এল রিফের ওপর। কসাইয়ের ছুরির মত নির্মমভাবে দ্বিখণ্ডিত করে দিল রিফের মাথা।