০৫-৬. কুমারী জেলডা ভ্যান ওয়াইলি

০৫.

কুমারী জেলডা ভ্যান ওয়াইলি যদি একশ কোটি ডলারের উত্তরাধিকারিনী না হতো তাহলে যে তার ভাগ্যে কি ছিল তা বলা মুশকিল। এক দ্বিতীয় শ্রেণীর দোকানের সেলস গার্ল কিংবা বড়জোর সাদামাটা এক টাইপিস্টহওয়া। কারণ তার পড়াশুনোর যা অবস্থা তাতে এর বেশী কিছু হওয়া তার স্বপ্নেও আসত না।

সৌভাগ্যবশতঃ সে একজন টেক্সান কোটিপতির একমাত্র প্রিয় সন্তান হয়ে জন্মেছে। সেহেতু প্রকৃতির তরফ থেকে পাওয়া বঞ্চনার অনেকটাই সে ঢেকে রাখতে পেরেছিল।

এমন কিছু সুন্দর নয় তার চেহারা। যেটুকু সৌন্দর্য আছে, তাও কেমন যেন নিষ্প্রাণ ও বর্ণহীন। বড় বড় বাদামী চোখদুটো প্রায় সারাক্ষণই বিষয় দেখায়। নাক ও ঠোঁটজোড়া বেশ সুন্দর, কিন্তু চিবুকের গড়ন বেমানান হওয়ায় মুখের সামগ্রিক সৌন্দর্যের অনেকটা নষ্ট হয়েছে। বুকের গড়নও মোটেই উঁচু নয়। এজন্য তার যথেষ্ট দুঃখ কারণ অত্যুন্নত বক্ষ চিত্রাভিনেত্রীদের সে খুব ভক্ত।

অতিরিক্ত আদরে সে আঠারো বছর বয়সে আজ এক বিষণ্ণ মেজাজের অবদমিত কাম, খিটখিটে ও অলস প্রকৃতির কুমারী মেয়ে। যে সব যুবক তার চারপাশে থাকে, তাদের আসলনজর তার বাবার ঐশ্বর্যের ওপর, সুতরাং পুরুষ জাতটার ওপরেই তার অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা জন্মে গিয়েছিল।

টাকা দিয়ে যা কেনা যায়, তার সবকিছু থাকা সত্ত্বেও জেলডার দৈনন্দিন জীবন ছিল নিতান্ত একঘেয়ে। হপ্তায় সে কম করে চারটে সিনেমা দেখত, আর হপ্তায় অন্ততঃ দুবার তাদের বাড়িতে পাটি বসত। এসব পার্টি চটুলতা আর জাঁকজমক ছাড়া কিছুই না, তবে নিমন্ত্রিত যুবক যুবতীরা রাশি রাশি উপাদেয় খাদ্য ও পানীয় ধ্বংস করে উল্লসিত হত কারণ বিনা পয়সায় ভোজের সম্ভার ছাড়া যায় না। অথচ এরাই আড়ালে মুখ ভ্যাংচায় আর প্রতিদান দেবার কোন চেষ্টাও করে না।

জেলডার কয়েকজন অন্তরঙ্গ জানত যে সে মনে মনে তার সব অসুবিধে আর অস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বাবাকে দায়ী করে। সে বিশ্বাস করত বাবার অত টাকাপয়সা না থাকলে এতদিনে তার ভালো বিয়ে হয়ে যেত। তার ধারণা বিয়ে হলেই সব ঝামেলা মিটে যাবে। কিন্তু তার বাবার ভালবাসা যেন তার বুকে ভারী পাথরের মত, তার সব ব্যাপারে বাবার আকুল–আগ্রহ দেখে জেলডার সর্বাঙ্গ জ্বলত। আজ যে পুরুষমানুষের ওপর জেলডার অনাগ্রহ তার পেছনেও রয়েছে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা আর ফুর্তি করবার জন্য বাবার সারাক্ষণের উপদেশ।

সকাল সাতটায় জেলডার ঘুম ভেঙেছে। তারপর একজন মহিলা মালিশ বিশেষজ্ঞ এক ঘণ্টা ধরে তার ওপর যন্ত্রণাদায়ক মালিশ চালিয়ে গেছেন। একে আপাততঃ এই বাড়িতে আমন্ত্রণ করে এনে রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য জেলডার নিতম্বের ঘের ছোট করে আনা। তারপর বাবার সঙ্গে বিরক্তিকর প্রাতঃরাশ সেরে নটার কয়েক মিনিট আগে বাড়ি থেকে বেরোল। তার জাগুয়ার গাড়িতে গিয়ে উঠল।

একটু বৈচিত্র্য আনবার জন্য সে ঠিক করেছিল আজ তার চুল তাজা অ্যাপ্ৰিকটের রঙে রাঙিয়ে নেবে। কয়েকটি মেয়েদের পত্রিকায় সে পড়েছে, চুল রাঙানোর ব্যাপারে এটি যে কেবল আধুনিকতম রঙ তাই নয়, এ এটি খুব মিষ্টি ও সম্ভ্রান্তও বটে। জেলডার চিরদিনের বাসনা নিজেকে মিষ্টি ও সম্ভ্রান্ত করে রাখা।

সে লম্বা-রাস্তা বেয়ে জাগুয়ার চালালো। রেসিং ড্রাইভারের মত দক্ষতার সঙ্গে যে কোনো গাড়ি চালানোর ক্ষমতা তার আছে।

চিতা বিদ্যুৎবাহী গেটের কাছে তার জন্য অপেক্ষা করছে পাশেনীল রঙের ফোর্ড লিংকনগাড়ি।

মো জেগেটি প্রায় বিশ গজ দূরে এক ঘন ঝোঁপের আড়ালে ছিল। সে জানত একবার মেয়েটাকে দখলেআনতে পারলে আর তাদের ফেরবার উপায় থাকবেনা।রিফ ক্রেনেরমত সেও জানত–তার জীবন বিপন্ন। যদিও ক্র্যামার কখনও ভুল করেননি। তবুতার মনবলছিল যে ক্র্যামার একদাচরম সাহস ও সাফল্য অর্জন করেছেন। সেই মানুষের আজ আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

সে বেরোবার আগে হাসপাতাল থেকে এক টেলিফোন আসে। একজন নার্স জানাল তার মা খুব অসুস্থ। তিনি মো-কে দেখতে চাইছেন।

মোর এখন আর উপায় নেই, সে কাজটির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সে নার্সটিকে বলল, যত শীঘ্র সম্ভব সে হাসপাতালে আসবে।

তার বিষয় চিন্তায় ছেদ পড়ল গাড়ির আওয়াজে। তীরবেগে গাড়িটা গেটের দিকে আসছে। মো মাথা নীচু করে বসে রইল। চিতা গাড়ির বনেট খুলে ফেলেছে। তার পরনে নতুন নীল সাদা পোশাক। মাথার সোনালীচুলনীল রিবন দিয়ে পরিপাটি করে বাঁধা। তাকে আর পাঁচটা আমেরিকান মেয়ের মতই দেখাচ্ছিল।

মো আর রিফের মনে যতই ভয় থাকুক, চিতা কিন্তু পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজে নেমেছে। প্রাপ্য দশ হাজার ডলার তারা কিভাবে খরচ করবে, এখন থেকেই প্ল্যান করছে। রিফের অস্বাচ্ছন্দ্য সত্ত্বেও একবারও মনে হয়নি যে ব্যাপারটা ফেঁসে যেতে পারে।

জেলডা গাড়ি থেকে নেমে গেট খুলতে খুলতে ঈর্ষান্বিত চোখে চিতার দিকে তাকায়। চিতার দুই সুকঠিনস্তনবৃন্ত যেনতার সস্তা পোশাকফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। জেলডাবুঝল, যেসবযাচ্ছেতাইরকম অস্বস্তিকর নকল কাঁচুলি তাকে পরে থাকতে হয়, সে সব পরবার মেয়েটার দরকার হয় না।

প্রশস্ত, বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হেসে চিতা বলল, আমার একটু উপকার করবেন? গাড়ির ইগনিশন্টা খারাপ হয়ে গেছে। কাছাকাছি কোনো গ্যারেজ আছে কি?

জেলডার মেয়েটাকে ভাল লাগল। মেয়েটা এমন এক জগৎ থেকে আসছে, যার সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ তার আজ পর্যন্ত হয়নি। তার বেশ কৌতূহল হলো।

বড় রাস্তার ওপর একটা গ্যারেজ আছে। চল তোমায় পৌঁছে দিই।…উঠে এসো।

 চিতা গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, বাঃ! কী দারুণ গাড়িটা! আপনার নিজের?

হা-তোমার পছন্দ হয়েছে?

একশ মাইলের চেয়েও, জোরে যায় নিশ্চয়ই?

একথাটা বলা খুব ভুল হল, কারণ জেলডা চাল মারতে ওস্তাদ। পায়ের চাপ বাড়িয়ে জেলড়া গীয়ার বদলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি সামনের দিকে ছিটকে গেল। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে স্পীডোমিটারের কাটা উঠে গেল ঘণ্টায় একশ পঁয়ত্রিশ মাইলে।

লিংকন গাড়িটার ভেতর মো সবেঢুকতে যাচ্ছে এমন সময় জাগুয়ার গাড়িটা উধাও হয়ে গেল। মো গালাগালি দিতে দিতে লিংকনটা স্টার্ট দিয়ে রাজপথের ওপর নিয়ে এল।

এত জোরে চললে মো তাদের ধরতে পারবে না চিতা বুঝল। দুহাতে মুখ ঢেকে চীৎকার করল, বড় জোরে যাচ্ছেন। দোহাই আপনার, এত জোরে নয়।

জেলডা তৃপ্তির হাসি হাসল, এই ভেবে যে সে জোরে গাড়ি চালিয়ে কাউকে ভয় পাইয়ে দিতে পেরেছে। আস্তে আস্তে গতি কমিয়ে ঘণ্টায় সত্তর মাইলে নিয়ে এল।

সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিলে নাকি? এরকম জোরে তো আমি প্রায়ই যাই–জোরে গাড়ি চালাতে আমার খুব ভালো লাগে।

চিতা ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখল, মোর কোনো চিহ্ন নেই, আমিও ভেবেছিলাম মজা লাগবে কিন্তু তা বলে এত জোরে। আশ্চর্য গাড়ি এটা! আপনি কি স্যান বার্নাডিনো যাচ্ছেন? ওখানে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবার কথাবড্ড দেরী হয়ে গেছে।

ওখানেই যাচ্ছি কিন্তু গ্যারেজে একটু থেমে তোমার গাড়ি সারিয়ে দিতে বলে গেলে হত।

ওরা বরং গাড়িটাকে স্যান বার্নাডিনোতে তোমার কাছে পৌঁছে দেবে।

থাকতে দিন। আমি ট্যাক্সিতে ফিরে আসব।এখন যত সম্ভবতাড়াতাড়ি আমার শহরে পৌঁছানো দরকার। ভীষণ দেরী হয়ে গেছে।

গাড়ি গ্যারেজ ছাড়িয়ে যাবার পর আয়নায় এক ঝলক দেখে জেলডা সক্ষোভে বলল, মাটি করেছে। আবার সেই ব্যাপার।

কী হয়েছে?

 বিরক্তির সঙ্গে জেলডা বলল, এক ব্যাটা পুলিশ, কিছু মনে কোরো না। আমি একটু গাড়ি থামাচ্ছি বলেই বাঁ পাশে গাড়ি থামিয়ে দিল।

পরক্ষণেই এক লালমুখো দৈত্যাকার পুলিশ মোটর সাইকেলে এসে তাদের পাশে দাঁড়াল।

পুলিশটি মোটর সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে এসে, সুপ্রভাত, মিস ভ্যান ওয়াইলি। এইমাত্র আপনি ঘণ্টায় একশ তিরিশ মাইল বেগে যাচ্ছিলেন। কিছু মনে করবেন না। অত্যধিক জোরে গাড়ি চালানোর জন্য আপনার নামটা টুকে নিতে বাধ্য হচ্ছি।

জাহান্নামে যাও তুমি, ছেলে বৌ শুদ্ধ। যত প্রাণে চায় আমার নাম লিখে নাও। ভগবান করুন তোমার হতচ্ছাড়া মোটর সাইকেলটা থেকে পড়ে তোমার ঘাড় ভেঙে যায়।

পুলিশটি হাসল, নিশ্চয়ই, মিস ভ্যান ওয়াইলি। কিন্তু ভগবানের দোহাই। রাজপথে একটু আস্তে গাড়ি চালাবেন। ছোট্ট একটা প্যাডে কীসব লিখে সে একটা জরিমানার টিকিট জেলডাকে এগিয়ে দিয়ে বললে, আপনার বাবা ভাল আছেন?

তাতে তোমার কী এসে যায়। এমনিতেই তিনি তোমার ওপর চটা। আর আজকের ব্যাপারের পরে আরো বেশি চটে যাবেন।

 সে জেলকে ভালভাবে চেনে। যে মেয়ে পৃথিবীর এক বৃহত্তম সম্পত্তির অধিকারিনী, তাকে জরিমানা করতে তারও ভাল লাগে না। জোরে গাড়ি চালানোর জন্যে হপ্তায় অন্ততঃ একবার জরিমানা তার হয়। এবার তার পুলিশী চোখ চিতার ওপর পড়তেই কঠিন হয়ে উঠল। চিতাও ভয় পেয়ে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল।

সাড়ম্বরে স্যালুট করল পুলিশটি দুপা পিছিয়ে। বলল, থামালাম বলে রাগ করবেন না। মিস্ ভান ওয়াইলি। বুঝতেই তো পারছেন, না থামিয়ে উপায় ছিল না।

হয়েছে মারফি! এবারে যাও, ডুবে মরে গিয়ে বলে, জেলডা হেসে ফেলল।

গাড়ি আবার বড় রাস্তায় আসতেই লিংকন গাড়িতে করে মো তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

জেলডা বলল, তোমার গাড়ি বলে মনে হল।

চিতা মাথা নেড়ে বলল, আমার গাড়ি? কি করে হতে পারে?

কাধ ঝাঁকিয়ে জেল বলল, মনে হল যেন তোমার গাড়িটার মত দেখতে। ঐ পুলিশটা আচ্ছা ঝামেলা করতে পারে। এখন ও স্যান বার্নাডিনো পর্যন্ত আমার পিছু পিছু আসবে। লোকটাকে আমি চিনি। মহাপাজি। আমায় জরিমানা করে খুব আনন্দ পায়।

পাহাড়ের গা বেয়ে শহরের দিকে উঠছে ওরা। চিতা পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল দূরে পুলিশটা তাদের পিছু পিছু আসছে। ব্যাপারটা বিপজ্জনক হতে পারে। চিতা হাতব্যাগ খুলে ক্র্যামারের দেওয়া অ্যাসিডের চ্যাপ্টা বোতলটা বার করল।

জেলডা বলল, কী বার করলে ওটা?

চিতা হিংস্র গলায় বলল এটা মারাত্মক অ্যাসিড

.

বেশ কিছুক্ষণ ভিক্টর ডারমট রক্তে ভেজা জুতোটার দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে জুতোজোড়া পা থেকে খুলে ফেলল।

ক্যারী কাঁপা গলায় বলল, ওটা রক্ত, তাই না?

হতে পারে জানি না। ওঠো ক্যারী, যাওয়া যাক।

ক্যারী বলল, আমি তৈরী–ভি-ওটা রক্তের দাগ, তাই না?

অন্য এক জোড়া জুতো পরতে পরতে ভিক্টর ভাবছিল কোন জায়গায় গিয়ে তার জুতোয় রক্ত লাগল। মনে হয় ডি-লং-এর। কেবিনে কোথাও রক্ত জমে আছে। ডি-লং কি আহত হয়েছে?

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। ও নিয়ে আর আলোচনা করে লাভ নেই। চলো, আমরা… হঠাৎ কানে এলো রেফ্রিজারেটরের দরজা বন্ধ করার শব্দ।

ফিসফিসিয়ে ক্যারী বলল, শুনতে পেলে? রান্নাঘরে কেউ ঢুকেছে।

রেফ্রিজারেটরের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ মনে হল যেন, ভীত হয়ে বলল সে।

ঠিকই শুনেছ, ভিক, বাড়িতে কেউ একজন এসেছে।

 ঠিক আছে। অত ভয় পেয়ো না। তুমি এখানে থাকো। আমি দেখে আসছি।

 না–কখখনো তুমি যাবে না। আমার কাছে থাকো।

ডার্লিং-দোহাই ওরকম কোরো না–তুমি একটু খোকার কাছে থাকো। তারপর সে দ্রুত নিঃশব্দ পায়ে দালান পেরিয়ে রান্নাঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

দরজার সামনে গিয়েই তার হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেল। ক্ষতচিহ্নে ভরা বীভৎস মুখ নিয়ে রিফ জেনবসেআছেরান্নাঘরের টেবিলের ওপর। পরনেকুচকুচে কালো চামড়ার নোংরা পোক, হাতে একটা মুরগীর ঠ্যাং নিয়ে আরাম করে চিবোচ্ছে। ঐ দৃশ্য দেখে কোন মানুষ ভয় না পেয়ে যায় না।

তার বুক সজোরে ধক ধক করছে। ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বেয়ে পড়ছে। ভিক্টর নির্বাক।

একমুখ হেসে রিফ বলল, ভয়ে হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল নাকি ইয়ার? মুরগীর ঠ্যাংটা একদিকে ছুঁড়ে ফেলতেই ভিক্টরের সমস্ত ভয় রাগে পরিণত হল।

কী করছ কী এখানে বসে? কে তুমি?

নিষ্প্রাণ ও কঠিন দৃষ্টিতে রিফ তাকিয়ে পকেট থেকে সাইকেলের চেনটা বার করল।

শোনো ইয়ার, আমার সঙ্গে তোমায় মানিয়ে চলতেই হবে। আমি বেশ কয়েকদিন এখানেই থাকব। আমার কথা ঠিকঠাক শুনে চললে তুমি, তোমার বৌআর তোমার বাচ্চার কোনো বিপদ হবে না। এখন আমার কফি চাই। তোমার বৌকে বল আমায় কফি করে দিতে কথা কানে গেল?

ভিক্টর বলল, বেরিয়ে যাও এখান থেকে। ওঠো এক্ষুনি বেরিয়ে যাও।

ক্যারী এসে রিফকে দেখেই আঁতকে উঠল। রিফ তার দিকে তাকিয়ে হাসল।

রিফ বাঁকা হাসি হেসে বলল, বাঃ বেশ দেখতে তো। এই যে খুকী, আমায় একটু কফি বানিয়ে দাও। নইলে তোমার প্রাণেশ্বরের মুখ ভেঙে দেব।

ভিক এগোবার চেষ্টা করলে ক্যারী ভয় পেয়ে তার হাত আঁকড়ে ধরল, কিছু করতে যেও না, ভিক! আমি ওকে কফি তৈরী করে দিচ্ছি। ভিক-দোহাই তোমার।

এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মত কথা। তোমরা কথা শুনে চললেই আর কোনো ঝামেলা হয় না। রিফ লোহার চেন জড়ানো ডান হাতের মুঠো দিয়ে সশব্দে টেবিলের ওপর কিল মেরে চীৎকার করে বলল, কফি আনো। শুনতে পাচ্ছো? আর একবারও যেন আমায় বলতে না হয়।

ভিক্টর ক্যারীকে জোর করে রান্নাঘর থেকে ঠেলে বার করে দিয়ে, যাও, খোকার কাছে যাও। আমি এ গুণ্ডাটাকে শায়েস্তা করছি।

রিফ টেবিল থেকে নেমে একমুখ বিদ্রুপের হাসি নিয়ে এগিয়ে আসছে।

ভিক্টর কলেজে পড়বার সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার ভাল নাম ছিল। কিন্তু রিফকে জ্ঞান হওয়া ইস্তক অলিতে গলিতে নিষ্ঠুরভাবে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। তার ক্ষমতার সঙ্গে ভিক্টরের তুলনাই চলে না। লোহার চেনসুদ্ধ ডান হাতের মুঠো সজোরে ভিক্টরের মুখের একপাশে আঘাত হানল। ভিক্টর ঠিকরে পড়ে গেল।

ক্যারী তীক্ষ্ণ চীৎকার করে তার পাশেহাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। জ্ঞানহীন দেহটা সোজা করতেই আবার সে চীৎকার করল–ভিক্টরের মুখের একপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

রিফ চেনটা খুলে পকেটে রেখে তার মোটা আঙুলগুলোর সাহায্যে ক্যারীকে চুল ধরে টেনে তুলল। তারপর তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চীৎকার করল, কফি!কানে গেল কথাটা!কফি আনো, নইলে এ শালাকে আমি বুটের বাড়ি মারব।

ক্যারী আতংকিত চোখে একবার রিফের পায়ের লোহাবাঁধানোস্কীবুটের দিকে তাকিয়ে টলতে টলতে রান্নাঘরের কোণের দিকে গিয়ে পারকোলেটার চালিয়ে দিল।

.

জে ডেনিসনের টেবিলের ওপর রাখা অনেকগুলো টেলিফোনের একটা বেজে উঠল। হাত বাড়িয়ে রিসিভার নিয়ে মোটা গলায় তিনি বললেন,ফেডারেল ফিল্ড অফিস।ইন্সপেক্টর ডেনিসন কথা বলছি।

ডেনিসন তার হবু জামাইয়ের গলা পেলেন। কর্তা–আমি টম। আমি দুঃখিত-ক্র্যামারকে হারিয়ে ফেলেছি–এই একটু আগে। ও বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে আমি পিছু নিয়েছি। আমার সঙ্গে হ্যারী ছিল। দুজনকেই বোকা বানিয়ে স্রেফ হাওয়ার সঙ্গে লোকটা মিশে গেল।

ডেনিসন কোনমতে রাগ সামলিয়ে বললেন, বেশ ঠিক আছে, টম। এখানে ফিরে এসো চটপট।

দশ মিনিট পরে স্পেশাল এজেন্ট হ্যারী গার্সন ফোন করে বললে, মাফ করবেন কর্তা, আমরা জেগেটিকে হারিয়ে ফেলেছি।

ডেনিসন হিংস্রভাবে বললেন, জানি জানি, স্রেফ লোকটা হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেল। তাই? বলেই দড়াম করে রিসিভার রেখে দিলেন। পাইপে তামাক ভরছেন এমন সময় টম হার্পার ঘরে ঢুকল।

ডেনিসন বললেন, জেগেটিও ভেগেছে। সুতরাং ও দুব্যাটাতে নিশ্চয় কোনো মতলব এঁটেছে কিন্তু কী মতলব?

হার্পার চেয়ারে বসে, ক্র্যামার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল যে পেছনে কেউ লেগেছে কিন্তু এমন ভোজবাজী দেখাবে, তা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। একটা লবিতে ঢুকল, তারপর

অধৈর্যভাবে ডেনিসন বললেন, বাদ দাও। চল একটু বেরোনো যাক। মাথায় টুপি চড়িয়ে তিনি এগোলেন। কুড়ি মিনিটের মধ্যে তার গাড়ি ক্র্যামারের বাড়ির সামনে এল।

লোহার গেটের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ক্র্যামার নিশ্চয় বাড়ি নেই। কিন্তু তার বৌয়ের তো বাড়ি থাকার কথা। মেয়েটা এক সময় এক নাইট ক্লাবে গান গাইত। শুনেছি আজকাল নাকি বেশ সম্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। পুলিশের আবির্ভাবে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে না যায়।

টম নেমে গেট খুলে আবার গাড়িতে বসল।

বিরাট বাড়িটার দিকে যেতে যেতে ঈর্ষার সঙ্গে সে বলল, লোকটা বেশ স্টাইলের মাথায় থাকে, কি বলেন?

ডেনিসন তেতো গলায় বললেন, দশ লাখ ডলার কামালে তুমিও চাইবে স্টাইলে থাকতে। ক্র্যামারের আছে পুরো চল্লিশ লাখ ডলার।

একজন মোটা, স্মিত চেহারার নিগ্রো মেয়ে দরজা খুলে দিল।

ডেনিসন বললেন, মিঃ ক্র্যামার আছে?

মিঃ ক্র্যামার বাড়ি নেই।

মিসেস ক্র্যামারকে ডেকে দিলেও চলবে। তাকে বল যে কেন্দ্রীয় পুলিশবাহিনীর (ফেডারেল বুরো) ইনসপেক্টর ডেনিসন এসেছেন। একরকম জোর করেই ডেনিসন ভেতরে ঢুকে পড়লেন। অগত্যা নিগ্রো মেয়েটি সরে দাঁড়াল। অফিসার দুজন সুন্দর আসবাবপত্রে সাজানো প্রশস্ত লবিতে ঢুকল।

হেলেন ক্র্যামার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিল দুজনকে দেখে থমকে গেল। অস্বস্তিভরে একটা হাত গলার কাছে উঠে গেল।

ডেনিসন ভারী গলায় বললেন, শুভসন্ধ্যা, মিসেস ক্র্যামার। আমরা হচ্ছি কেন্দ্রীয় পুলিশবাহিনীর অফিসার। মিঃ ক্র্যামার বাড়ি নেই বুঝি?

এক অসহায় আতংকে হেলেন শক্ত হয়ে উঠল। জিম অবসর নেবার পর থেকেই এরকম এক পরিস্থিতির জন্য সে ভয় পেয়েছে। নিজেকে কোনরকমে সামলে নীচে নেমে এল। নিগ্রো পরিচারিকাটিকে রান্নাঘরে যাবার জন্য ইঙ্গিত করে।

হ্যাঁ, মিঃ ক্র্যামার বাইরে গেছেন। কী ব্যাপার বলুন তো?

তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমি হচ্ছি ইন্সপেক্টর ডেনিসন,পাশের খোলা দরজা দিয়ে লাউঞ্জের দিকে তাকিয়ে, ঐখানে গিয়ে কথাবার্তাগুলো হলে ভাল হয়। বলেই তিনি লাউঞ্জটার ভেতরে গিয়ে ঢুকলেন, তার পেছনে হাপার।

দ্বিধাগ্রস্তভাবে হেলেন সে ঘরে ঢুকে বলল, আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি নাকী হয়েছে?

আমি মিঃ ক্র্যামারের সঙ্গে দেখা করতে চাই–পুলিশী ব্যাপার। কোথায় গেছেন তিনি?

কেমন যেন কুঁকড়ে দুই হাত সহসা মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এল হেলেনের।

উনি নিউ ইয়র্ক গেছেন। আমি–আমি ঠিক জানি না কোথায় গিয়ে উঠেছেন। নিজের ব্যবসার ব্যাপারে গিয়েছেন।

ডেনিসন মনে মনে বললেন পনেরো বছর আগে মেয়েটির চেহারা কত ভাল ছিল এখন অনেক বিবর্ণ হয়ে গেছে। আর খানিকটা ঘাবড়ে গেছে।

তিনি পুলিশী মেজাজে বললেন, একথা কি সত্যি, মিসেস ক্র্যামার, যে মো জেগেটি নামক একজন জেল ফেরৎ আসামী এবং কুখ্যাত অপরাধী হপ্তাদুয়েক আগে আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?

হেলেন একটা চেয়ারে বসে বলল, হ্যাঁ এসেছিল। সে আমার স্বামীর পুরনো বন্ধু। প্যারাডাইস শহরেনতুন একটা রেস্তোরাঁ খোলবার জন্য জায়গা খুঁজছিল। মো এ শহরে আসছে শুনে স্বভাবতঃই আমার স্বামী মধ্যাহ্নভোজের নেমন্তন্ন করেছিলেন।

ডেনিসন বিদ্রুপের স্বরে বললেন, জেগেটি খুলবে রেস্তোরাঁ? তাই বলেছেনাকি আপনাকে?

হ্যাঁ, সেইরকমই তো বলল।

আর আমি যদি জানাই যে গত কয়েক মাস মো একটি পঞ্চম শ্রেণীর হোটেলে এক তৃতীয় শ্রেণীর বেয়ারার কাজ করছে এবং নিজস্ব বলতে দশটা পয়সাও নেই, তাহলে কী আপনি খুব আশ্চর্য হবেন?

হেলেন শিউরে উঠে বলল, দেখুন, আমি ওর সম্বন্ধে কিছুই জানিনা। ও আমার স্বামীকে যা বলেছে, আপনাকে সেইটুকুই জানালাম।

দেখুন মিসেস ক্র্যামার, আপনার বা আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নেই। আপনার স্বামী এককালে খুব বড় দস্যু ছিলেন। আমরা তাকে ছোঁবার আগেই তিনি বুদ্ধি করে সেই জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু তিনি আবার হয়ত পুরোনো পেশায় ফেরার চেষ্টা করছেন। অবশ্য আমার মঙ্গলের জন্য আমি চাই যে তিনি আবার সে চেষ্টা করুন। যাইহোক, তাকে জানিয়ে দেবেন, আমার নজর ওর ওপর আছে। কোনো অপকীর্তি করবার চেষ্টা করলেই বিপদে পড়বেন। বন্ধু হিসেবে একবার তাকে সাবধান করলাম আর দ্বিতীয়বার আমি আসব না। বুঝতে পেরেছেন? হার্পার, চলো এবার ওঠা যাক।

.

যখন ডেনিসন হেলেনের সঙ্গে কথা বলছেন, জিম ক্র্যামার সেই সময় লেক অ্যারোহেড হোটেলে এসে পৌঁছলেন। চমৎকার বিলাসবহুল হোটেল। বছরের ওই সময়ে ধনী খদ্দেরদের ভীড়ে ঠাসা থাকে।

ক্র্যামার হোটেল রেজিস্টারে সই করবার সময় নাম লিখলেন–আর্নেস্ট বেন্ডিকস। গত হপ্তায় বুদ্ধি করে তিনি টেলিফোন মারফৎ একটি কামরা রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে একটি সুন্দর ঘর পেলেন। ঘরটির ব্যালকনি থেকে হ্রদ দেখা যায়।

পুলিশ দুটোকে ধোঁকা দিয়ে ক্র্যামার বেশ সন্তুষ্ট বোধ করছিলেন। তিনি আশা করছেন মো ও ফাঁকি দিয়ে সরে পড়তে পেরেছে। ব্যাগ থেকে জিনিষপত্র বার করে রেখে তিনি ব্যালকনিতে গেলেন। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সেখানে বসে হ্রদের শোভা উপভোগ করে তারপর বসবার ঘরে গিয়ে টুইন ক্রীক ট্যাভার্নে একটা টেলিফোন কল বুক করলেন। ফোন পাবার পর তিনি মিঃ ম্যারিয়নের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন-মো এই ছদ্মনামে উক্ত হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়েছে।

সংক্ষেপে কথা হল দুজনের। কোনো সন্দিগ্ধ ব্যক্তি আড়ি পাতলেও তাদের কথা বুঝতে পারত না। কিন্তু ক্র্যামার ঠিকই বুঝে নিলেন যে সব ঠিকঠাক চলছে এবং ক্রেন ভাইবোন এসে পৌঁছেছে।

কাল ঠিকমত মাল ডেলিভারি দেওয়া হয়ে গেলে আমায় জানিও,বলে ফোন ছেড়ে দিলেন। হেলেনের কথা একবার মনে হয়েছিল কিন্তু ভাবলেন তিনি তো তাকে বলে এসেছেন যে সলি লুকাসের মৃত্যু সংক্রান্ত ব্যাপারে নিউইয়র্ক যাচ্ছেন সে যেন চিন্তা না করে। তিনি জানেন হেলেন বোকা নয়। সে হয়ত তার কথার একবর্ণ বিশ্বাস করেনি। এখন তাকে ফোন করা বিপজ্জনক হবে।

ক্র্যামার ঘরেতেই ডিনার সারলেন। তারপর বাকি সন্ধ্যেটা ব্যালকনিতে বসে কাটালেন–মুখে জ্বলন্ত সিগার হাতে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে সব দেখতে লাগলেন।

তিনি পরের দিন সকালেও রইলেন। এগারোটার একটু পরে মোর টেলিফোন এল। কাঁপা গলায় এমনভাবে বলছিল যেন তার দম আটকে আসছে।

মো বলল, মাল পাওয়া গেছে কিন্তু একটু গোলমাল বেঁধেছে।

তুমি এখন কোথায় আছো?

লো পাইন-এ। এক টেলিফোন বুথ থেকে কথা বলছি।

ক্র্যামার জানতেন যে হোটেলের লবিতে কয়েকটা টেলিফোন বুথ রয়েছে, যেগুলোর লাইন হোটেলের সুইচবোর্ডের ভেতর দিয়ে যায় না।

তুমি ওখানেই থাকো। তোমার নম্বরটা দাও। এক্ষুনি আবার তোমায় ফোন করছি।

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এটুকু বলাও বিপজ্জনক হল। হয়ত হোটেলের সুইচবোর্ডের কোনো এক অপারেটর লাইনে আড়ি পেতে আছে। কিন্তু কী গোলমাল বেঁধেছে তা জানা দরকার।

মো তাকে ফোন নম্বর জানিয়ে লাইন কেটে দিল।

লিফটে চড়ে ক্র্যামার নীচের জনাকীর্ণ লবিতে নেমে এলেন। কপালজোরে একটি টেলিফোন বুথ খালি ছিল। বুথে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মোর নম্বরটা ডায়াল করতেই সাড়া দিল সে।

কী হয়েছে? কীসের গোলমাল?

মো তাকে মোটর সাইকেলওয়ালা পুলিশটির ব্যাপার জানাল।

যদি কোনো কিছু ফাস হয়ে যায় তাহলে পুলিশটি চিতার পরিষ্কার বর্ণনা দিতে পারবে। আমাদের বরাত মন্দ, কিন্তু মেয়েটা পাগলের মত গাড়ি চালাচ্ছিল। পুলিশে ধরা বিচিত্র নয়।

কিন্তু ফাস হবে না। ঐখানেই এই কাজটার মজা। তুমি নিশ্চিন্ত হতে পারে পুলিশরা কিছুই জানতে পারবে না। ভ্যান ওয়াইলি মেয়েটা কী বলছে?

চিতা ওকে সামলে আছে–সেদিকে কোনো ঝামেলা নেই। অ্যাসিড দেখে ভয়ে ওর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমি ভাবলাম পুলিশের ব্যাপারটা তোমায় জানানো উচিত।

ঠিক আছে মো। তুমি এবার বেরিয়ে পড়ো। একঘণ্টার মধ্যে নষ্টনীড়ে পৌঁছে যাবে। আমি তোমায় সাড়ে বারোটায় ওখানে ফোন করব। তুমি পৌঁছেই টেলিফোনের তারটা জুড়ে দেবে। ওখানে পৌঁছেছে জানলেই আমি ভ্যান ওয়াইলির সঙ্গে কথা বলব।

 নিজের কামরায় ফিরে ক্র্যামার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। কোনো কাজেই দেখছি নিশ্চিত হবার জো নেই, পুলিশের ঘটনাটি তাকে উদ্বিগ্ন করেছে। পুলিশটির যদি ফেঁপর দালালি করার অভ্যাস থাকে তাহলে হয়ত হেড কোয়ার্টার্সে রিপোর্ট করে দেবে যে ভ্যান ওয়াইলির মেয়ে একজন নিম্নশ্রেণীর মেয়ের সঙ্গে এক গাড়িতে যাচ্ছে।

নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না ক্র্যামার, বারবার চোখ যাচ্ছে হাতঘড়ির দিকে। শেষে সাড়ে বারোটার কয়েক মিনিট আগেই টেলিফোন অপারেটরকে বললেন, নষ্টনীড়ের নম্বরটা দিতে।

অপারেটর জানাল, দুঃখিত। লাইনটা খারাপ আছে। আমাদের ইঞ্জিনীয়ার ইতিমধ্যে লাইন সারাবার জন্য ওখানে গেছেন। আপনি ঘন্টাখানেক পরে আবার চেষ্টা করুন।

অপারেটর মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন ছেড়ে দিলো। এবার বোঝা যাচ্ছে ঘটনার গতি তার অনুকূলে নয়। হয়ত জেলডার কেশ পরিচর্যাকারী ভ্যান ওয়াইলিকে ফোন করে জানাবে যে তার মেয়ে এখনো এসে পৌঁছোয়নি। তিনি খোঁজ নেবেন কান্ট্রি ক্লাবে কারণ, তিনি জানেন চুল বাঁধা শেষ হলে জেল ওখানে লাঞ্চ সারে। সেখানেও যদি শোনেন যে সে আসেনি, তাহলে তিনি হয়তো পুলিশে খবর দেবেন। সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকবে না।

মো কি পরিস্থিতিটা সামলাতে পারবে? লাইন কাটা দেখলে ইঞ্জিনিয়ার কি ভাববে? সে কি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করবে?তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, মোর ওপরেই সবকিছু নির্ভর করছে। মো এবং চিতা জেলডাকে নিয়ে নষ্টনীড়ে পৌঁছে গেছে। ভ্যান ওয়াইলি পুলিশে খবর দেওয়ার আগেই তাকে ফোন করা দরকার।

নোটবুক থেকে ভ্যান ওয়াইলির ফোন নম্বর বের করে ডায়াল করে হঠাৎকানেকশানটা কেটে দিলেন। এঅঞ্চলে ভ্যান ওয়াইলির প্রতিপত্তি বিরাট। ফোনটা কোথা থেকে এসেছেতিনি অনায়াসে বার করতে পারবেন। তারপর তদন্ত চালালেই দফারফা।

বুথ থেকে বেরিয়ে দ্রুতপদে ক্র্যামার একটা ট্যাক্সী ধরে ড্রাইভারকে বললেন, মেন স্ট্রীটে নিয়ে যেতে। কয়েক মিনিটের মধ্যে জেনারেল পোস্ট অফিসে পৌঁছে সেখান থেকে তিনি ভ্যান ওয়াইলির নম্বর ডায়াল করলেন।

অপরপ্রান্তে একজন বলল, মিঃ ভ্যান ওয়াইলির বাড়ি থেকে কথা বলছি।

আমি ভ্যান ওয়াইলির সঙ্গে কথা বলতে চাই। জরুরী দরকার–মিস ভ্যান ওয়াইলির সম্পর্কে কিছু বলবার আছে।

আপনার নামটা কি?

উনি আমায় চিনবেন না। আমি তার মেয়ের জনৈক বন্ধু। আমার নাম ম্যানিকিন।

একটু ধরুন দয়া করে।

সবে ফিরে জন ভ্যান ওয়াইলি পড়বার ঘরে বসে সকালের ডাকে আসা একরাশ চিঠিপত্রে চোখ বোলাচ্ছেন। সামনের ডেস্কের ওপর বড় এক গ্লাস মার্টিনি রাখা আছে।

তার পরিচারক ফেলোস দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকে বলল যে, মিঃ ম্যানিকিন নামে একজন ফোন করছেন।

স্যার, উনি বলছেন যে মিস জেলডার সঙ্গে নাকি ওর পরিচয় আছে।

জন ভ্যান ওয়াইলি এক খর্বাকৃতি ভারী চেহারার মানুষ। চওড়া ধাঁচের মুখ, ছোট ছোট চোখে কঠিন দৃষ্টি। চওড়া কর্তৃত্বব্যঞ্জক চোয়াল। তিনি যেমন মানুষ তার চেহারাও তেমনি এক প্রাক্তন ওয়াগন ড্রাইভারের সন্তান। যিনি একটি টাকাকে অনায়াসে দশ টাকায় পরিণত করতে পারেন এবং উপার্জনের পন্থা সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র বাদ-বিচার নেই।

তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। আজ পর্যন্ত জেলার কোনো বন্ধু তাকে সরাসরি টেলিফোন করেনি। টেলিফোনের কাছে গিয়ে বাঁহাতে ফোনের লাইনের সঙ্গে একটা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে ডান হাতে রিসিভার তুললেন।

বলুন।

মিঃ ভ্যান ওয়াইলি?

হ্যাঁ।

আপনার মেয়ের বিষয়ে কথা আছে। আপনার ব্যস্ত হবার কিছু নেই–আপনার মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। সে নিরাপদে আছে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে অক্ষতদেহে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অবশ্য আপনি যদি পুলিশে খবর না দেন বা আমাদের নির্দেশের কোনোরকম খেলাপ না করেন, তাহলে আর আপনার জীবনে ইহজীবন দেখবেন না। আমাদের বিরাট দল–আপনার বাড়ির ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখা হচ্ছে, আপনার টেলিফোনও ট্যাপকরা হয়েছে। আপনি কোন কিছু করবার চেষ্টা করবেন না। কাল আবার আপনাকে ফোন করব আমি। ক্র্যামার ফোন রেখে চটপট ট্যাক্সী স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সী নিয়ে হোটেলে ফিরলেন।

খানিকক্ষণ জন ভ্যান ওয়াইলি নিশ্চল হয়ে গেল। মুখ বিবর্ণ দেখাল। কিন্তু অধরোষ্ঠ সহসা এক কুৎসিত ও নিষ্ঠুর রূপ নিল। রিসিভার নামিয়ে শক্ত গলায় বললেন, অ্যানড্রুজকে পাঠিয়ে দাও।

দুমিনিটের মধ্যেই মেরিল অ্যানড্রুজ, ভ্যান ওয়াইলির সেক্রেটারী দীর্ঘ তামাটে, পোড় খাওয়া চেহারার একজন টেক্সান, পরনে স্পোর্টস শার্ট ও নীল রঙের জীনস্, ঘরে ঢুকল। ভ্যান ওয়াইলি তখন ফোনে টেলিফোন অফিসের সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলছেন।

ভদ্রমহিলা জানালেন, ফোনটা জেনারেল পোস্ট অফিস থেকে এসেছিল। ওখানকার এক পাবলিক বুথ থেকে।

ধন্যবাদ জানিয়ে ভ্যান ফোন ছেড়ে অ্যানড্রুজের দিকে ফিরে, এইমাত্র একটা লোক আমায় ফোন করে জানাল যে জেলডাকে অপহরণ করা হয়েছে। ওর চুল বাঁধবার দোকানে এবং কানট্রি ক্লাবে খোঁজ নাও। জেনে নাও জেলডা ওখানে গিয়েছিল কি?

ভ্যান ওয়াইলি জানালার দিকে গিয়ে দুহাত পেছনে মুষ্টিবদ্ধ করে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। অ্যানড্রুজ চটপট ফোন দুটো সেরে জানাল যে, মিস জেলডা চুল বাঁধতে যাননি। আর কানট্রি ক্লাবেও যাননি। পুলিশে খবর দিই?

ভ্যান ওয়াইলি বিকৃত গলায় বললেন, না, কাউকে কিছু বলল না। এখন বাইরে যাও। আমার অনেক কিছু চিন্তা করার আছে।

.

০৬.

নষ্টনীড়ের বারান্দায় রিফ দাঁড়িয়েছিল। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে এগিয়ে আসা গাড়িটার দিকে তাকিয়ে হিপ পকেটে রাখা ডারমটের অটোমেটিক রিভলবারটা ধরল।

বারোটা বাজে, রিফ সামনের ঘরটায় ডারমট এবং তার ছেলে-বৌকে পুরে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। ঘরের জানালা খোলা ছিল। তাছাড়া আর বেরোবার রাস্তা নেই। রিফ যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে সবকটা জানালাই দেখা যায় সুতরাং তার দুশ্চিন্তা নেই। একটি মোক্ষম ঘুষিতেই সে ডারমট এবং তার বৌ-এর সব সাহস উড়িয়ে দিয়েছে।

ভিয়েতনামী লোকটাকে খুন করে রিফ ভীষণ অস্বস্তি অনুভব করছে। তার মতে এটা হচ্ছে ছিঁচকে চোর থেকে এক ধাক্কায় ডাকাত হবার ফল। পুঁচকে লোকটাকে অত জোরে মারবার জন্যে নিজেকে গালাগাল দিচ্ছিল। ডারমটের সাইজের একজন তার হাতের মোক্ষম মার সামলাতে পারে, কিন্তু ঐরকম ক্ষুদে লোক কী করে সহ্য করবে। রিফ ঠিক করল মো-কে চাকরটার ব্যাপারে কিছু বলবে না। মো যতই চালাক হোক না কেন, ভেতরটা তার খুবই নরম। সে হয়তো ঐ সংবাদে। ক্ষেপেই যাবে।

কয়েক গজ দূরে গাড়ি থামল। মো গাড়ি চালাচ্ছিল, পেছনের সীটে চিতা আর চুরি করা মেয়েটা।

কৌতূহলের সঙ্গে রিফ মেয়েটির দিকে তাকাল। কিন্তু সে এর চেয়ে রূপবতী কাউকে আশা করেছিল। মেয়েটি গাড়ি থেকে নামলে তার প্রশস্ত নিতম্বের দিকে তাকিয়ে ভাল তাহলে চেহারাটা তেমন কিছু খারাপ নয়।

মো গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, সব ঠিক আছে তো?

কোনো গোলমাল নেই–তোমার খবর ভাল তো?

হ্যাঁ, কিন্তু আমি বরং গাড়িটাকে লুকিয়ে ফেলি। গ্যারেজটা কোথায়?

 রিফ আঙুল দেখিয়ে বলল, ভেতরে অনেক জায়গা আছে।

গ্যারেজের দিকে মো চলে গেল। রিফ চিতার দিকে তাকাল। চিতা জেলডার পাশে দাঁড়িয়েছিল, রিফ তাকাতেই চিতা জানাল সব ঠিক আছে। জেলডা এতক্ষণ কৌতূহলী দৃষ্টিতে রিফের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে নিশ্চিন্ত যে মো তাকে যা বলেছে তাতে উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। যতক্ষণ না তার বাবার কাছ থেকে টাকা পাওয়া যায় ততক্ষণ শুধু তাকে আটকে থাকতে হবে। জেলডা এই কালো চামড়ার পোশাক পরা নোংরা চেহারার লোকটিকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল। সিনেমার পর্দায় সে অনেকবার এইরকম ডাকাতদের দেখেছে। যাদের দেখলেই শরীরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে।

মেয়েটার সারা মুখে কেমন লাল রং ছড়িয়ে চোখ কেমন ঘন হয়ে এল। রিফ বুঝল যে মেয়েটা তাকে দেখে বেশ বিচলিত হয়েছে। রিফ বলল, আমার নাম রিফ। তোমার নামটা কি সখি?

জেলডা ভ্যান ওয়াইলি। তুমিও আছে নাকি এর মধ্যে?

নিশ্চয়ই সখি, আমরা সবাই আছি এর মধ্যে। এসো, তোমার নতুন বাসাটা একটু দেখে শুনে নাও। কয়েক পা এগিয়ে জেলার বাহু চেপে ধরল।কাছাকাছি আসতেই জেল দেখল তার ময়লা কাঁধ। নোংরা নখের ডগা আর তার কদমছাট চুলের ওপর ধুলো রাশি।

 ঘেন্নায় সে নাক কুঁচকে, ছিটকে সরে এল। জেলডা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আমার গায়ে হাত দিও না। তোমার–তোমার গায়ে বিচ্ছিরি গন্ধ।

রিফের মুখের ধূসর চামড়ার নীচে পেশীগুলো ফুলে উঠল। তার চোখ ধারালো হল, অধরোষ্ঠ সুকঠিন হল।

চিতা বুঝতে পারল গতিক সুবিধের নয়, শান্ত থাক রিফ। শুনতে পাচ্ছিস? ঢের হয়েছে।

রিফের চোখে ভয়াবহ হিংস্রতার আগুন দেখে জেলডা কয়েক পা পিছিয়ে গেল।

 চিতা চেঁচিয়ে উঠল, রিফ, থেমে যা! মো আসছে।

ঠিক আছে সখি, আমার মনে থাকবে। অনেক সময় হাতে আছে–আমার মনে থাকবে।

মো এসে বলল, এখানে কি করছ তোমরা? ওকে ভেতরে নিয়ে যাও।

জেলডাকে নিয়ে চিতা বাড়ির ভেতরে ঢুকল। রিফের দৃষ্টি জেলডার পেছনের দিকটায়।

মো জিজ্ঞেস করল, ডারমটদের কী করলে?

ওদেরকে সামনের ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছি। লোকটা একটু সাহস দেখাবার চেষ্টা করেছিল তাই এক ঘা লাগাতে হয়েছে। এখন আর ঝামেলা করবে না।

কুকুরটা?

কোনো অসুবিধে হয়নি। পুতে দিয়েছি।

চাকরটা?

চাকরদের কেবিনটা দেখিয়ে রিফ বলল, ওখানে আটকে রেখেছি। আমায় দেখেই ভয়ে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। পালাবার চেষ্টা করবে না।

তুমি এবার টেলিফোনের তারটা জোড়া দাও। কর্তা এক্ষুণি ফোন করবে।

রিফ হুকুম জিনিসটা সহ্য করতে পারে না। বলল, হবে না। কেটে দিয়েছিলাম। কিন্তু জোড়া লাগাবার মত তার নেই।

মো অধৈর্যভাবে বলল, গ্যারেজের মধ্যে দ্যাখো না একবার। ওখানে নিশ্চয়ই কয়েক টুকরো তার পাবে। লাইন ঠিক করতেই হবে। চটপট করো। বলেই সে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।

রিফ ভেবে দেখল এত তাড়াতাড়ি মোর সঙ্গে ঝগড়া বাধানো ঠিক হবে না। অলস পদক্ষেপে গ্যারেজের দিকে গেল।

পড়বার ঘরে খাটের ওপর ভিক্টর ডারমট শুয়েছিল। গাড়ির আওয়াজ তার কানে গেল। মাথা ভীষণ ব্যথা করছে। আর মুখের ডানপাশটা একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। তিনঘন্টা হল তার জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু এখনও হাত পা অসাড় হয়ে আছে। ক্যারী পাশে বসে একটি হাত নিজের মুঠোর মধ্যে ধরে উদ্বিগ্ন চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। ভিক্টর গাড়ির আওয়াজ পেয়ে ওঠবার চেষ্টা করল।

ক্যারী উঠে বলল, শুয়ে থাকো তুমি, আমি দেখছি।জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই সে দেখল রিফের সামনে চিতা ও জেলড়াদাঁড়ানো। তারপর দেখল মো গাড়ি চালিয়ে গ্যারেজের দিকে গেল। আরো তিনজন এলো। উঃ ভিক! এসব কী হচ্ছে? এরা কারা?

ভিক্টর আস্তে আস্তে উঠে বসল। মাথাটা বনবন করে ঘুরে গেল তারপর দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এল। সে ক্যারীর পাশ দিয়ে জানালার বাইরে তাকাল।

তখন রিফ জেলডার সঙ্গে কথা বলছে। ভিক্টর চিতার ও জেলডার দিকে তাকাল।

ভিক্টর বিড়বিড় করে বলল, অসম্ভব ঐ মেয়েটা কিন্তু তা কি করে হতে পারে। ঠিক যেন ভ্যান ওয়াইলির মেয়ের মত দেখতে। তুমি তো জানো ক্যারী–ও এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে বিত্তশালী মেয়েদের একজন। ওর নামটা বোধহয় জেলডা–তাই না?

দমবন্ধ গলায় ক্যারী বলল, ঠিক বলেছ। বারবার মনে হচ্ছিল মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছি। ওকে নিশ্চয় চুরি করে এখানে আনা হয়েছে।

বরফজলের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা স্পঞ্জটা নিয়ে মুখের পাশে চেপে ধরতে ধরতে বলল, ওরা বোধহয় মেয়েটাকে এখানে লুকিয়ে রাখার মতলবকরছে।চমৎকার মতলব। এরকম এক জায়গায় তল্লাসী চালাবার কথা কে ভাববে?

ক্যারী বলে উঠল, আরেকটা গাড়ি আসছে। ভিক্টর তাকিয়ার ওপর গা এলিয়ে দিল। তার মাথায় দপদপ করছে। এমন সময় খোকা ফুঁপিয়ে–কেঁদে উঠল। ক্যারী সেদিকে ছুটল।

দ্রুতপদে রিফ লাউঞ্জে গেল। জেলডা ও চিতা বসেছিল। মো ককটেল টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একপাত্র পানীয় তৈরী করছিল।

রিফ বলল, একটা গাড়ি আসছে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে পড়বে।

মো জানালার কাছে গেল। ডানহাতের আঙুলগুলো নার্ভাস ভঙ্গিতে একবার কোটের নীচে খাপের মধ্যে লুকানো পিস্তলটা স্পর্শ করল। সে চিতার দিকে ফিরে বলল, তুমি পরিচারিকার ভূমিকানাও। কেউ যদি আসে,দরজা খুলে বলবে ডারমটরা বেরিয়েছে। আমরা তোমার পেছনেই থাকব। জেলডাকে বলল, একটা আওয়াজ করেছ কি মজা দেখিয়ে দেব।

রিফ হেসে বলল, না না, আওয়াজ করবে কেন? কী বলো সখি?

জেলডা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

 রিফ বঙ্কিম হেসে বলল, ভারী লক্ষ্মী মেয়ে, দাঁড়াও সখী, আমিতোমাকে শায়েস্তা করছি। আমি–।

মো গর্জে উঠল, চুপ করো। ডারমটদের পাহারা দাও। তারা যেন চুপচাপ থাকে। আমি এখানেই আছি।

রিফ লবি পেরিয়ে পড়বার ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল।

চিতা বলল, টেলিফোন মেরামত করবার ট্রাক একটা।

মো চাপা গলায়, নিশ্চয়ই টেলিফোনের তার চেক করতে এসেছে। যদি দেখে যে তার কাটা

চিতা চড়া গলায় বলল, আঃ ঠাণ্ডা হও বাপু। ওদেরকে আমি সামলে নেব।

বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থামল, ছাদের ওপর একটা বড় মই। ভেতরে দুজন কমবয়েসী ইঞ্জিনিয়ারা বসে আছে। চিতা এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলল।

লেক অ্যারোহেড হোটেলের লবি পেরিয়ে ক্র্যামার গেটের কাছে আসতেই দারোয়ান তাকে সেলাম করে বলল, আপনার গাড়ি তৈরী। স্যার, আপনার তো দুদিনের জন্য দরকার। তাই না?

দারোয়ানের হাতে একটা পাঁচ ডলারের নোট গুঁজে দিতে দিতে ক্র্যামার বললেন, হুম। তার পরেও যদি দরকার থাকে, তোমায় জানাব।

গাড়ি পার্ক করবার জায়গায় দারোয়ানটি ক্র্যামারকে নিয়ে গিয়ে একটা বুইক কনভার্টিবল গাড়ির দরজা খুলে ধরল।

যে কোন সময় গাড়ির দরকার হলে আমায় বলবেন স্যর।

ক্র্যামার স্টিয়ারিং হুইলের সামনে বসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে শহরের দিকে গাড়ি ছোটালেন।

দুপুর তিনটের কয়েক মিনিট পরে ক্র্যামার নষ্টনীড়ের গেটের সামনে এসে পৌঁছলেন। গাড়ি থামিয়ে গেট খুলে গাড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে আবার গেট বন্ধ করলেন।

বুকের বাঁদিকের ব্যথাটা আবার ফিরে এসেছে। আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে ক্র্যামার অনুভবকরলেন তার অত্মবিশ্বাস ক্রমেই কমে আসছে।বয়েস বাড়ছে। যদি কোনো গণ্ডগোল বাঁধে? এতদিন ধরে দস্যুবৃত্তি করে শেষে যদি জেলে ঢুকতে হয়। এখন আর উপায় নেই। মোর ওপর তার বিশ্বাস আছে। প্ল্যানটাও নিখুঁত হয়েছে। কোনো গোলমাল হবে না।

ক্র্যামার দেখলেন রিফ বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে, দুপা রেলিঙে ভোলা। ক্র্যামার গাড়ি। থেকে বেরোতেই সে উঠে দাঁড়াল।

গম্ভীর গলায় ক্র্যামার বলেন, গাড়িটা সরিয়ে ফেল। মো কোথায়?

সদর দরজার দিকে বুড়ো আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করে বারান্দার রেলিং ডিঙিয়ে নেমে গাড়িতে বসে গ্যারেজের দিকে চালিয়ে দিল।

ক্র্যামার সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন, এমন সময় মো দরজা খুলে বেরিয়ে এল।

দুজনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর ক্র্যামার কড়া গলায় কী খবর?

মো বলল, সব ঠিক আছে। মেয়েটা ভেতরে। ডারমটদের নিয়ে কোনো গোলমাল হয়নি। একজন টেলিফোন ইঞ্জিনীয়ার লাইন দেখতে এসেছিল, চিতা তাকে ম্যানেজ করে নিয়েছে। কোন ঝামেলা নেই।

একটা প্রশস্ত, নিশ্চিন্ত হাসি হেসে বলল, আমার প্ল্যানিং-এ কখনও ফাঁক থাকে না, কী বল? ডারমট কোথায়? ওর সঙ্গে আমার কথা আছে।

পড়বার ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে মো বলল, ঐখানে আছে। ওর বৌয়ের সঙ্গে।

ক্র্যামার এগোতেই মোবলল, এক মিনিট–জিম। লোকটা একটু ঘায়েল হয়েছে। রিফ তাকে এক ঘা দিয়েছে।

ক্র্যামারের মুখ লাল হয়ে গেল। মার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে বললেন, মেরেছে? কী বলছ তুমি?

তা লোকটা একটু বীরত্ব দেখাতে গিয়েছিল। রিফ অগত্যা তাকে ঠাণ্ডা করতে বাধ্য হয়েছে।

টুপি খুলে ঘর্মাক্ত মুখ মুছে ক্র্যামার বললেন, কেমন আছে সে?

এখন ভালই আছে, তবে রিফের ঘুষির জোর বড় বেশী।

ক্র্যামার অসন্তোষ প্রকাশ করে তারপর পড়বার বড় ঘরটায় ঢুকলেন।

ভিক্টর আর ক্যারী পাশাপাশি বসেছিল। বয়স্ক বিশালাকৃতি মানুষটিকে দেখে ভিক্টর উঠে দাঁড়াল।

ক্র্যামার তার ব্যবসায়ীসুলভ ছদ্ম আন্তরিক গলায় বললেন, আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি। শুনলাম আমার এক সহকারী নাকি একটু বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। আমি দুঃখিত।

ভিক্টর বলল, কে আপনি? এই সব গুণ্ডাগুলো এ বাড়িতে কী করছে আমায় বলবেন?

আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ক্র্যামার বসে, ক্যারীর দিকে একটু মাথা হেলিয়ে বললেন, আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন মিসেস ডারমট। এ সবকিছুর জন্য আমি দুঃখিত এছাড়া আমার উপায় ছিল না। মিঃ ডারমট, আপনার বরাত খারাপ যে এ বাড়িটা ভাড়া নিয়েছেন। আপাততঃ আশা করছি যে আপনি আমাদের সহযোগিতা করবেন। আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আমি পুরো ব্যাপারটা বলছি। তারপর আপনি বিবেচনা করে দেখুন আমাদের সঙ্গে হাত মেলাবেন কিনা।

দৃষ্টি বিনিময় করল ক্যারী ও ভিক্টর। তারপর রাগ সামলিয়ে ভিক্টর বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, বসুন, সব ব্যাপারটা আমার সত্যিই জানা দরকার।

পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মেয়েদের একজনকে আমি চুরি করে আনতে পেরেছি। আমার আন্দাজমত মেয়েটির বাবার কাছ থেকে চল্লিশ লক্ষ ডলার মুক্তিপণ চাওয়া যাবে। মুক্তিপণ নিয়ে দরদস্তুর করার সময়, মেয়েটিকে লুকিয়ে রাখবার জন্য আমাদের একটা গোপন আজ্ঞা দরকার। এ কাজের জন্য এর চেয়ে ভাল জায়গা পাওয়া খুব শক্ত। মিঃ ডারমট ব্যাপারটা আমি সংক্ষেপে সারছি। আপনাকে আমি নির্বাচিত করেছি টাকাটা মিটিয়ে দিতে রাজি করবার জন্য। টাকাটা সংগ্রহ করে আমার হাতে এনে দেওয়ার ভারও আপনার ওপর থাকবে।

শক্ত হয়ে গেল সর্বাঙ্গ ভিক্টরের। কী যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ক্র্যামারের শয়তানি চোখের দৃষ্টি কারীর ওপর স্থির দেখে সে থেমে গেল।

ক্র্যামার বললেন, আপনাদের বোধহয় একটি বাচ্চা আছে–ছেলে তাই না? বাচ্চাদের আমি ভালবাসি। একটি বাচ্চা বিপদে পড়ুক এ আমি কখনও চাই না। আমার কথা বুঝতে পারছেন তো?

শান্ত গলায় ভিক্টর বলল, পেরেছি বোধহয়–যদি আপনার কথামত না চলি, তাহলে আমার ছেলে তার প্রতিফল পাবেকি বলেন?

প্রশস্ত হাসি হেসে ক্র্যামার বললেন, আপনার মত মানুষের সঙ্গে কারবার করা সত্যিই বড় আনন্দের, মিঃ ডারমট। আপনি হচ্ছেন চটপটে, বুদ্ধিমান ও যুক্তিবাদী। ঐ যে রিফ ছোকরা বড় গোঁয়ার, আর ওকে পুরোপুরি সামলানো আমার কর্মনয়। আপনার ওপর দেখছিহাতও চালিয়েছে। হাত চালানোর ব্যাপারে ওর কোনো বাছবিচার নেই–তা সে ছেলেই হোক, মেয়েই হোক আর বাচ্চাই হোক।

রিফের চেহারা ভিক্টরের চোখে ভেসে উঠল। বস্তির নর্দমা থেকে উঠে আসা এক ঘৃনিত কীট-ওর অসাধ্য কিছু নেই। এখন তার কর্তব্য ক্যারী ও খোকাকে বিপদ থেকে রক্ষা করা।

ভিক্টর বলল, আমি চেষ্টার ত্রুটি করব না, অবশ্য আদৌ যদি ভ্যান ওয়াইলিকে টাকা দিতে রাজী করানো সম্ভব হয়।

ভীষণ হিংস্র গলায় ক্র্যামার বললেন, ভ্যান ওয়াইলির কথা আপনি জানলেন কোত্থেকে?

মেয়েটাকে আমি চিনতে পেরেছি। এ অঞ্চলে ওকে কে না চেনে। আমাকে কি করতে হবে বলুন।

ক্যারী বলল, না ভিক! ও কাজ তুমি কখনো-।

তার দিকে তাকিয়ে ভিক্টর মাথা নাড়ল। তার চোখের দৃঢ় দৃষ্টি দেখে ক্যারী চুপ করে গেল।

ক্র্যামার বললেন, আপনার কোনো বিপদ হবে না। আপনি কেবল ভ্যান ওয়াইলিকে বুঝিয়ে বলবেন যে, তিনি যদি টাকা না দেন তাহলে ইহজীবনে আর মেয়েকে দেখতে পাবেন না। তার কাছ থেকে আপনি চার লক্ষ ডলারের দশটি চেক নেবেন। ভ্যান ওয়াইলির যা আর্থিক প্রতিপত্তি, তাতে চেকগুলো ভাঙাতে অসুবিধে হবে না। মিঃ ডারমট, আপনার পরবর্তী কাজ হবে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে গিয়ে চেকগুলো ভাঙানো। আমি বেশ কয়েকটা ব্যাংকের নাম লিখে দেব। তারপর আপনি এসে টাকাটা আমার হাতে তুলে দেবেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে মিস ভ্যান ওয়াইলিকে ছেড়ে দেব। আপনিও নিশ্চিন্তে নাটকটি শেষ করতে পারবেন। কাজটা তেমন কিছু শক্ত নয়, কী বলেন?

সেইরকমই তো মনে হচ্ছে।

ক্র্যামার এক কঠোর কুৎসিত মুখে বললেন, যদি আপনি ভ্যান ওয়াইলিকে বুঝিয়ে রাজী করাতে না পারেন, টাকা না দিলে তার মেয়েকে খুন করা হবে। পুলিশে খবর দেবেন না তাহলে কিন্তু আপনার স্ত্রী ও ছেলে ভীষণ বিপদে পড়বে। ঐ টাকাটা আমার কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমার এখন যা অবস্থা, তাতে দয়ামায়া দেখালে চলবে না। আপনাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, যদি কোন গণ্ডগোল বাধে তা আপনার দোষেই হোক আর ভ্যান ওয়াইলির অবাধ্যতার জন্যেই হোক–তাহলে প্রথমেই বিপদে পড়বে আপনার স্ত্রী ও ছেলে। ভেবে দেখুন, রিফের মত এক শয়তান একটা বাচ্চার ওপর কীনা করতে পারে। আত্মরক্ষার ক্ষমতা যার নেই, তার ওপর গায়ের জোর ফলাতে ও বেশী আনন্দ পায়। আমার বক্তব্য আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমার ষড়যন্ত্র যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আপনাদের তিনজনকে রিফের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি সরে পড়ব। অতএব, খুব সাবধান। আপনারা দুজনে কথা বলে দেখুন। কাল সকালে আপনাকে ভ্যান ওয়াইলির কাছে যেতে হবে। সব টাকা যোগাড় করতে তিনদিন লাগবে। তারপর এখানে ফিরে আসবেন। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে হলে আমরা তখনই বিদায় নেব। আর যদি কোনো গোলমাল বাধে… একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে তিনি দরজার দিকে চললেন।

ভিক্টর বলল, দাঁড়ান একটু। আমার চাকরের কী অবস্থা, বলবেন একটু?

কী আবার হবে। ভালই আছে।

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তার শোবার ঘরে রক্ত-উধাও হয়ে গেছে লোকটা।

ক্র্যামারের মুখ শক্ত হয়ে গেল। দরজা খুলে, রিফ! তার গভীর ও ভারী গলায় সারা বাড়ি গমগম করে উঠল।

রিফ কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চলে এল।

আমাকে ডাকলেন।

 ক্র্যামার কড়া গলায়, ভিয়েতনামী চাকরটা কোথায়? কী হয়েছে তার?

চাকরদের কেবিনের দিকে ইঙ্গিত করে রিফ বলল, ওর ভেতরে আছে।

ভিক্টর বলল, মিথ্যে কথা। ও ঘরে নেই।

রিফ বিশ্রীভাবে হেসে, কী ইয়ার। আরেক ঘা বসাব নাকি?

ক্র্যামার বললেন, থামো। ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে গেলেন। ভিক্টরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রিফও বেরিয়ে গেল। লবিতে এসে ক্র্যামার বললেন, কী করেছ চাকরটাকে?

একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। তাই এক ঘা লাগাতে একটু রক্ত পড়েছিল। এখন ভাল হয়ে গেছে।

ক্র্যামারের মাথায় এখন অনেক চিন্তা। একটা চাকরকে নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় এখন নেই।

মো শোবার ঘর থেকে বেরোচ্ছিল। ক্র্যামার ইঙ্গিতে ডেকে, আজ রাতটা আমি এখানেই থাকব। জায়গা হবে তো?

নিশ্চয়ই। অনেক জায়গা আছে।

ভ্যান ওয়াইলির মেয়েটা কোথায়?

চিতা ওকে পাহারা দিচ্ছে।

পালাবার সম্ভাবনা নেই তো?

কোনো সম্ভাবনা নেই।রাজপথ পর্যন্ত পৌঁছতে পাকা পনের মাইল হাঁটতে হবে। এই জায়গাটা বাছা চমৎকার হয়েছে।

তারা শোবার ঘরে ঢুকল। আর রিফ বারান্দায় বেরিয়ে ক্ষুদৃষ্টিতে একশ গজ দূরে জায়গাটার দিকে তাকিয়ে রইল, যেখানে সে ডি-লংকে কবর দিয়েছে।

অপহরণের পর ভাইবোনের মধ্যে প্রথম কথাবার্তা হল মধ্যরাত্রে।

বারান্দার শেষপ্রান্তে ইজিচেয়ারে রিফ বসেছিল। যে ঘরদুটোতে ডারমটরা এবং জেলড়া ঘুমুচ্ছে, তাদের প্রত্যেকটি জানালার ওপর ওখান থেকে নজর রাখা যায়।

চিতা এসে চেয়ারের পায়ার কাছে মেঝের ওপর বসে পড়ল। রিফ ওকে সিগারেট দিল।

অমন উসখুস করছিস কেন? ঐ মেয়েটার কথা ভাবছিস?

বিদ্রুপের ভঙ্গিতে রিফ বলল, তোর কি মনে হয় আমি ঐ মেয়েটাকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি!

আমার তো সেইরকমই মনে হচ্ছে।

চেপে যা। আজ পর্যন্ত আমার মাথা কোন মেয়ে ঘোরাতে পারেনি।

নিঃশব্দে দুজনে সিগারেট খাচ্ছে। চিতা বুঝল যে একটা কিছু গোলমাল হয়েছে। ব্যাপারটা শোনবার জন্য সে অপেক্ষা করছিল। তার ভাই চিরকাল নিজের সব ঝামেলার কথা তাকে খুলে বলে। কিন্তু দশমিনিট পরেও যখন কিছু বলল না তখন চিতা বলল, আচ্ছা আমি তাহলে শুতে চললাম। তোর পরে তো জেগেটির পাহারা দেবার পালা, তাই না?

হুম। চিতা ওঠবার সময় সে বলে ফেলল, ঐ হলদে চামড়ার লোকটা

 চিতা বুঝল, এবার রিফ পেটের কথা বলবে। তাই সে চেপে বসল।

ওকে এবার কিছু খাবার পৌঁছে দিতে হবে। ওর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। লোকটার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে।

রিফ বলল, তাই নাকি? আমার তো সেরকম মনে হচ্ছে না। লোকটা মরে গেছে।

 পাথরের মত স্থির হয়ে চিতা ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল।

মরে গেছে। কী হয়েছিল?

লোকটা চেঁচাতে যাচ্ছিল। আমি ঘাবড়ে গিয়ে খুব জোরে মেরে দিয়েছি, হাতে আবার চেন জড়ানো অবস্থায়। শালার মাথাটা একেবারে পচা ডিমের মত ফেটে গেল।

ঘর্মাক্ত হাতদুটো স্কার্টে মুছতে মুছতে চিতাবুঝল যে এবার তারা সত্যিকারের বিপদে পড়েছে। চিতা একটু সহজ হয়ে বলল, মড়াটাকে নিয়ে কি করেছিস?

সামনে বালুর প্রান্তরে পুঁতে দিয়েছি।

যদি ওরা কোনদিন জানতে পারে যে লোকটা খুন হয়েছে তাহলে আর ক্র্যামার পুলিশের ঝামেলা এড়াতে পারবে না।

রিফ খিঁচিয়ে বলল, আমার ও কথাটা আগেই খেয়াল হয়েছে। বললাম তো, আমার তো কোনো দোষ নেই। ঘুষিটা একটু জোরে লেগে গিয়েছিল, এই যা।

চিতা ভাবল-মেয়ে চুরি। তারপর শেষে নরহত্যা।

তুই প্রতিদিন ঐ চাকরদের কেবিনে খাবার নিয়ে যাবি। জেগেটিকে বরং বুঝিয়ে দিস যে লোকটা তোকে দেখে ফেলেছে। কিন্তু তাকে বা আমাকে দেখেনি। দলের আর কারো মুখ যদি ও না চিনে রাখে তাতেই আমাদের মঙ্গল। কথাটা জেগেটি নিশ্চয়ই মেনে নেবে। এতে আমরা আরো দিন দুয়েক সময় হাতে পাব।

রিফ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা সামলানো যাবে বলে মনে হয় না, লোকটা যে সত্যিই আমার হাতে খুন হয়েছে।

চিতা বলল, ভেবে দেখতে হবে। দোষটা জেগেটির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পুলিশ ওকে চেনে কিন্তু আমাদের চেনে না।

রিফ খেঁকিয়ে উঠল, হয়েছে, চেপে যা। চাকরটা কখন টেসেছে তা ওরা বার করে নেবে। লোকটা মরবার পনেরো ঘণ্টা পরে মো এখানে পৌঁছেছে। পুলিশ অত বোকা নয়।

ভেবে দেখি–রিফ-মেয়েটার সঙ্গে তুই ঝামেলা বাধাস না।

রিফ হিংস্র ভাবে বলল, মেয়েটাকে আমি শায়েস্তা করব। কোনো শালী আমার সঙ্গে ওভাবে কথা বলে রেহাই পায় না। তুই এর মধ্যে নাক গলাতে আসিসনা। ওকে আমি ভালভাবেই শায়েস্তা করব।

উঠে দাঁড়িয়ে চিতা বলল, ওর গায়ে হাত দিলে বিপদে পড়বি। আমাদের অবস্থাটা একবার ভেবে দ্যাখ। ইতিমধ্যেই আমরা যথেষ্ট বিপদে পড়েছি। এর ওপর তুই যদি মেয়েটাকে নিয়ে ঝামেলা করিস রেহাই পাবার উপায় থাকবে না। মেয়েটার কথা ভুলে যা। কী আছে মেয়েটার মধ্যে? চেহারাও তো আহামরি কিছু নয়।–তুই চাকরটার কথা কী বলবি ঠিক করে নে। আমি এখান থেকে পুরো দশ হাজার ডলার নিয়ে বেরোতে চাই, এবং সে টাকা খরচও করতে চাই। বলে চিতা ভেতরে চলে গেল।

শোবার ঘরে ভিক্টর ও ক্যারী পাশাপাশি শুয়ে ছিল। ক্যারী চাইছিল স্বামীর যথাসম্ভব কাছাকাছি থাকতে, তাদের বিছানার পাশে ঘুমন্ত খোকা শুদ্ধ ছোট খাটটা রয়েছে।

দুজনের একজনও ঘুমোতে পারছে না। ক্যারী বলল, তুমি এ কাজ করো না ভিক। তুমি কখনও ঐ লোকটার দালাল হিসেবে কাজ করতে পারো না। তুমি কি বুঝতে পারছ না কথাটা?

অস্বস্তির সঙ্গে ভিক্টর বলল, ভ্যান ওয়াইলিদের নিয়ে আমার একটুও মাথাব্যথা নেই। আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যেই আমায় এ কাজ করতে হবে। লোকটা আমাকে মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে না। ক্যারী–আমার কিন্তু মনে হচ্ছে ডি-লং মারা পড়েছে।

না, না। কী বলছ তুমি?

মারা না পড়লেও সাংঘাতিক আঘাত পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। ওর কেবিনে রক্ত জমেছিল। গুণ্ডাটার হাতে সত্যি জোর আছে। নিজের ক্ষতে হাত বুলিয়ে, যদি এতটা জোরে ডি-লংকে মেরে থাকে

চুপ করো ভিক।

এ লোকগুলো পাকা অপরাধী। মোটা লোকটাকে আমি চিনি না, তার ঐ ছোকরা গুণ্ডাটার চেয়ে কিছু কম শয়তান নয়। ওর কথামত না চললে তোমার বা খোকার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করবে না। সুতরাং ওর কাজ আমায় করে দিতেই হবে।

ক্যারী বলল, কিন্তু ভিক্ ঐ লোকগুলোর কাছে আমাকে একলা ফেলে তুমি চলে যাবে?

এরা ঝামেলা বাধাবার চেষ্টা করবে না। এরা শুধু টাকা চায়। তোমাদের কোন ক্ষতি করবে না–এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত।

আমি মোটেই অত নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। তুমি কি সত্যিই কাল আমাকে ফেলে চলে যাবে?

ক্যারী, তোমার মাথায় যদি অন্য কোনো মতলব না এসে থাকে, তাহলে এ কাজ করা ছাড়া আমার গতি নেই।

মতলব? তার মানে?

তার মানে, এ ছাড়া অন্য কিছু করার মতলব।

আমি তো বারবার বলছি, তুমি আমার আর খোকার কাছে থাকো।

অর্থাৎ ঐ লোকটা যা করবে বলে শাসাচ্ছে, তাই করতে দেব?

কোনো মীমাংসায় পৌঁছানো গেল না। এ নিয়ে অনেকবার একই ব্যাপার হল। ভিক্টর বুঝতে পারলেও, যে ক্যারী এই ডাকাতদের মধ্যে একা থাকতে ভয় পাচ্ছে, এছাড়া তো উপায় নেই।

আমায় যেতেই হবে, ডার্লিং।

ভিক্টরের আরো কাছে সরে এসে ক্যারী চোখ বুজল।

মো জেগেটি চতুর্থ গেস্টরুমে আরামদায়ক শয্যায় শুয়েছিল। সে অনেকদিন এত আরামে শোয় নি। কিন্তু তার মার কথা মনে পড়ে অস্বস্তি লাগছে। দু-হপ্তা তার সঙ্গে দেখা হয়নি। স্যান ফ্রানসিসকো ছাড়ার পর আর কোনো খবরও পায়নি। মায়ের অবস্থা খারাপ জেনেও আড়াই লাখ ডলার হাতে আসবে ভেবে আর বিগ জিম তাকে কথা দিয়েছেন। তিনি কখনো কথার খেলাপ করেন না। মনে মনে মো ভাবল, অতগুলো টাকা হাতে পেলে সে মাকে ঠিক সারিয়ে তুলতে পারবে।

টাকাটা কিন্তু এখনো হাতে আসেনি। সেই মোটর সাইকেলওয়ালা পুলিশটা তাকে দুশ্চিন্তায় · ফেলেছে। আবার রিফ ক্রেনকে নিয়েও দুশ্চিন্তা-ছেলেটা অতি বদ। যেভাবে ভ্যান ওয়াইলির মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছিল, মোর মোটেই ভাল লাগেনি। বুঝতে পারছিল যে, এ দুজনকে নিয়ে মুশকিল বাধবে। রিফের কাছে আবার ডারমটের রিভলবারটা রয়েছে। রিফের মত এক কাঠ গোঁয়ারের হাতে রিভলবার থাকাটা মোটেই নিরাপদ নয়।

জেলডা মোর পাশের ঘরে শুয়ে আছে। তার চোখেও ঘুম নেই। সে ভাবছিল, তার বাবা এখন কি করছেন। ঘোড়ার ডিম করছেন মনে মনে বলল। টাকাটা যে ভদ্রলোক চটপট মিটিয়ে দেবেন সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে ভেবে তার আপশোস হচ্ছিল, কারণ সে ব্যাপারটা রীতিমত উপভোগ করছে, ঐ মেয়েটা যখন জাগুয়ার গাড়ির ভেতর অ্যাসিড স্প্রে করল সঙ্গে সঙ্গে পুরো জায়গাটার চামড়া কুঁকড়ে খসে পড়ল। সে সত্যিই খুব ভয় পেয়েছিল। তারপর যখন ভয় কেটে গেল তখন থেকেই তার সমস্ত ঘটনাটা খুব মজার বলে মনে হচ্ছে। সে আরামেই আছে। এ ঘরটা বেশ চমৎকার। আবার ঐ সাংঘাতিক চেহারার ছেলেটির সঙ্গে দেখা হল। ছেলেটির কথা মনে পড়তেই জেলডার শরীর উষ্ণ হয়ে উঠল। স্রেফ একটা জানোয়ার–কিন্তু দারুণ জানোয়ার!