০১-২. শারদ প্রভাতের পদধ্বনি

এ ব্রাইট সামার মর্নিং

০১.

এক অপরূপ সুন্দর শারদ প্রভাতের পদধ্বনি তখন আকাশে বাতাসে শোনা যাচ্ছে। হঠাৎভিক্টর ডারমটের ঘুম ভেঙে গেল। কোন এক অজানা আতংকে সারা গা ঘামে ভিজে উঠেছে। ঘড়িতে পাঁচটা বেজে সাঁইত্রিশ মিনিট।

বয়স সাঁইত্রিশ। উন্নত, বলিষ্ঠ, শ্যামলা চেহারা ভিক্টর ডারমটের। অতি-উৎসাহী স্বাক্ষর শিকারীরা প্রায়ই তাকে চিত্রতারকা গ্রেগরী পেক বলে ভুল করে। ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেও সে এ জন্য বেশ বিরক্তি অনুভব করে। কারণ স্ব-পরিচয়েই সে যথেষ্ট খ্যাতি ও বিত্তের অধিকারী। গত দশ বছরে তার চারটি নাটক নিউইয়র্কের বৃহত্তম রঙ্গমঞ্চগুলিতে মঞ্চস্থ হয়ে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। এখনও মধ্য ইউরোপের বড় বড় শহর থেকে এই কটি নাটকের অভিনয় বাবদ তাঁর মোটা টাকা উপার্জন হয়। ভিক্টর বিবাহিত জীবনেও সুখী। স্ত্রীর বয়স এখন আটাশ। দুজনের পারস্পরিক ভালবাসার বন্ধন অটুট। তাদের দশ মাস বয়েসের একমাত্র সন্তান।

হঠাৎ দুমাস আগে ভিক্টর ডারমটের মাথায় এক দুর্ধর্ষ নাটকের আইডিয়া আসে–এক অসাধারণ প্লট, যা তক্ষুনি একটানা লিখে ফেলা দরকার।

ভেরা সিওর হলো ডারমটের সেক্রেটারী। পক্ককেশ এবং দক্ষ এক মহিলা। সে তাকে বুলল একটা নির্জন জায়গা খুঁজতে যেখানে সম্পূর্ণ নির্জনেমাস তিনেক ধরে লেখাটা শেষ করতে পারবে। মাত্র দুদিনের মধ্যে ভদ্রমহিলা চমৎকার একটি বাড়ি খুঁজে বার করলেন। নেভাজ মরুভূমির সীমান্তে একটি ছোট্ট সর্বাধুনিক ধাঁচের র‍্যাঞ্চ হাউস। সেখান থেকে নিকটতম মনুষ্য আবাস হল বোপ্টন ক্রীক, কুড়ি মাইল দুরে এবং পীট শহর পঞ্চাশ মাইল দূরে।

বেশ বড় শহর, পীট শহর, কিন্তু বোস্টন ক্রীকে একটা গাড়ী মেরামতের দোকান, গোটা কয়েক কফি হাউস ও একটি মুদির দোকান ছাড়া আর কিছুই নেই।

নষ্টনীড় বাড়িটার নাম। এটির মালিক এক প্রবীণ দম্পতি, ইউরোপের নানান জায়গায় বেড়িয়ে তাদের অধিকাংশ সময় কেটে যায়।

একটি দীর্ঘ প্রাইভেট রাস্তা এসে মেঠো রাস্তায় মিলেছে বাড়িটি থেকে। সেই রাস্তা ধরে ঝোঁপঝাড় ও বালির ভেতর দিয়ে আরো পনেরো মাইল গেলে পীট শহরে যাওয়ার পাকা রাস্তা পাওয়া যাবে। সম্পূর্ণ নির্জনতা ও সর্বাধুনিক আরাম পেতে হলে নষ্টনীড়ের থেকে ভালো জায়গা পাওয়া মুস্কিল।

একদিন ভিক্টর ডারমট তার স্ত্রী ক্যারিকে নিয়ে গাড়ি চেপে বাড়িটাকে দেখতে এসেছিল। ঠিক এইরকম একটা বাড়িই সে চেয়েছিল। সুতরাং তিনমাসের জন্য ভাড়া নেওয়ার চুক্তিতে সে সই করে দিল।

নষ্টনীড়ে রয়েছে একটি বড় হলঘর, একটি খাবার ঘর, একটি পড়বার ও অস্ত্রশস্ত্র রাখবার ঘর, তিনটি শোবার ঘর, তিনটি বাথরুম, একটি সর্বাধুনিক সরঞ্জাম সমেত রান্নাঘর এবং একটি সুইমিং পুল। এছাড়া একটি বড় গ্যারেজ ও টেনিস কোর্টও আছে। বাড়ি থেকে শদুয়েক গজ দূরে চাকরবাকরদের জন্য একটি পাঁচ কামরাওয়ালা কাঠের কেবিন।– একটু বেশী ভাড়া, কিন্তু ভিক্টর এখন প্রচুর রোজগার করছে এবং জায়গাটা তার মনে ধরেছিল।

সে ভাড়া নেওয়ার আগে ক্যারীর সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিল,–ব্যাপারটা তোমার পক্ষে খুব ক্লান্তিকর হতে পারে। লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হবে না। তুমি বরং বাড়িতেই থাকো, আর আমি একলা গিয়ে কাজটা সেরে আসি।

কিন্তু ক্যারীর মতে তার হাতেও কিছু কম কাজ থাকবে না। বাচ্চার দেখাশুনা করতে হবে, ভিক্টর যা লিখবে সেগুলো টাইপ করতে হবে। রান্না করতে হবে। তাছাড়া তার অসমাপ্ত ছবিগুলোওঃ আঁকা শেষ করতে পারবে।

ডি-লং নামে এক ভিয়েতনামী চাকর নেবে বলে দুজনে ঠিক করল। ছেলেটি বছরখানেক তাদের কাছে কাজ করছে। সে যে কেবল গৃহস্থালী কাজকর্ম ভালো পারে তা নয়, মোটর সারানোরব্যাপারেও দক্ষ। ডারমট ভাবল, গাড়ি মেরামতের দোকান থেকে এতদূরে থাকতে হবে, সুতরাং ডিলং সঙ্গে থাকলে ভালই হবে।

দুমাসের কঠোর ও একাগ্র পরিশ্রমের পর নাটকের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ভিক্টর এখন সংলাপের ওপর শেষ পালিশ চড়াচ্ছে এবং দ্বিতীয় অংক নিয়ে ঈষৎ ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। কারণ এ অংকটি তার সম্পূর্ণমনোমত হয়নি। আর হপ্তা দুয়েকের মধ্যে যেনাটক মঞ্চস্থ হবার জন্য তৈরী হয়ে যাবে সে বিষয়ে সে নিশ্চিত। তার এই নাটকটিও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করবে নিশ্চিত।

নষ্টনীড়কে এই দুমাসে ভিক্টর ও ক্যারী ভালবেসে ফেলেছে। লস অ্যাঞ্জেলেস-এর হট্টগোলের মধ্যে ফিরে যেতে হবে ভাবতেই খারাপ লাগছে। মধুচন্দ্রিমার পর এই প্রথম তারা দুজনে মনের সুখে একান্তে বাস করবার সুযোগ পেল। এখন তারা অনুভব করছে যে, সামাজিক জীবনের গুরুভার ও অন্তহীন পার্টি আর টেলিফোনের আওয়াজ তাদের পরস্পরকে জানবার আশ্চর্য অভিজ্ঞতা থেকে কতটা বঞ্চিত করছিল। এমনকি তাদের সন্তান যে কেমন আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে তা লক্ষ্য করবার সময়ও তারা এর আগে কখনও পায়নি।

ডারমট দম্পতির নষ্টনীড় যতই ভালো লাগুক না কেন, তাদের ভিয়েতনামী চাকরের এই … নির্বাসন একেবারেই সহ্য হচ্ছিল না। যত দিন যাচ্ছে, ক্রমশঃই সে আরো বিষণ্ণ হয়ে উঠছে। সেই জন্যে কাজকর্মের চাড়ও কমে আসছে।

মাঝে মাঝে ভিক্টর ধৈর্যচ্যুত হয়, কারণ ডি-লং-কে একজন সাধারণ চাকরের থেকে তিনগুণ মাইনে বেশী দেওয়া হয়। ক্যারীর আবার দয়ামায়া একটু বেশী। সে স্বামীর সঙ্গে তর্ক করে যে, মাইনে যতই হোক না কেন, নিঃসঙ্গতা সম্পর্কে অভিযোগ করার অধিকার তার আছে।

.

এক শারদ প্রভাতে আমাদের কাহিনী শুরু হচ্ছে। তখন ভিক্টর ডারমটের ঘুম হঠাৎ ভেঙে যেতে দেখে তার সর্বাঙ্গ ভিজে চপচ করছে।

সে চুপ করে শুয়ে রইল। ঘড়ির টিক টিক শব্দ আর রান্নাঘরের রেফ্রিজারেটারের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া বাড়িটাতে কোনো শব্দ নেই।

কোনো দুঃস্বপ্ন ও তো দেখেনি অথচ গভীর ঘুমটা ভেঙে যে এতটা ভয় পেয়েছে।

মাথা তুলে দেখল ক্যারী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ছোট্ট খাটের ওপর তাদের ছেলেও আরামে ঘুমোচ্ছে।

তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান দুই সম্পত্তি নিরাপদে আছে দেখে তার অদ্ভুত ভয়টা কমে এল। হৃদপিণ্ডের গতিও স্বাভাবিক হল।

মনে মনে বলল, নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম, কিন্তু আশ্চর্য ভিক্টর স্বস্তি পেল না, বিছানা থেকে নেমে পড়ল। সে নিঃশব্দে যাতে ক্যারীর ঘুম না ভাঙে, ড্রেসিং গাউনটা পরে, চটিতে পা গলিয়ে আস্তে দরজা খুলে বড় চৌকো দালানটাতে বেরিয়ে এল।

বড় বসবার ঘরটায় ঢুকে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, সবকিছু যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটিই আছে। বিরাট জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। উঠোনের মাঝখানে ফোয়ারা থেকে সজীব জলেব রাশি উচ্ছ্বসিত হচ্ছে, টেরাসের ওপর পড়ে আছে ক্যারীর ফেলে যাওয়া একটি পত্রিকা।

পড়বার ঘরে এবার ঢুকল সে। জানালা দিয়ে তাকাল শদুয়েক গজ দূরে চাকরদের ঘরটার দিকে, যেখানে ডি-লং ঘুমোয় সেখানে কোনো প্রাণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য ডি-লং কস্মিনকালেও সাড়ে সাতটার আগে ওঠে না।

ভিক্টর বিরক্তবোধ করে অথচ কারণ খুঁজে পায় না। রান্নাঘরের দিকে গেল। সে জানত এখন বিছানায় গেলেও ঘুম আসবে না। বরং একটু কফি খেয়ে কাজ শুরু করা যাক।

সে রান্নাঘরে ঢুকে ঘরের অন্য দিকের একটা দরজা খুলে দিল। এ দরজার বাইরে আরেকটা ছোট উঠোন। এই উঠোনের ছোট গেটটি সর্বদা খোলা থাকে। যাতে তাদের অ্যালসেশিয়ান কুকুর ব্রুনো বাড়ি পাহারা দিতে পারে আর ঘুম পেলে উঠোনে রাখা খাঁচায় এসে ঘুমোতে পারে।

কুকুরের উদ্দেশ্যে ভিক্টর একবার শিস্ দিয়ে কফির পারকোলেটার চালিয়ে দিল। ব্রুনোর খাবার বাটিতে ঢেলে মেঝেতে নামিয়ে রেখে বাথরুমে গেল।

দশ মিনিট পরে দাড়ি কামিয়ে শাওয়ারে স্নান সেরে সাদা শার্ট, নীলরঙের সুতীর প্যান্ট ও সাদা জুতো পরে সে রান্নাঘরে রেগুলেটার বন্ধ করতে যাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে দেখে ব্রুনোর খাবার তেমনি পড়ে রয়েছে। কুকুরটার পাত্তা নেই। আবার কেন যেন মনটা ভয়ে আঁতকে উঠল। এ বাড়িতে এসে অবধি কখনো এরকম ঘটেনি। প্রতিদিন শিস শোনামাত্র ব্রুনো রান্নাঘরে এসে ঢুকেছে।

ভিক্টর খাঁচায় ওকে দেখতে পেল না। আবার শিস দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গেটের কাছে গিয়ে বাইরের ঝোঁপঝাড়ে কোথাও কুকুরটাকে দেখতে পেল না।

 সে ভাবল এখনোও তো সকাল হয়নি। কুকুরটা বোধহয় ইঁদুর টিদুর কিছু তাড়া করে দূরে গিয়ে পড়েছে। কিন্তু আজকে সব কিছুই কেমন বিশ্রীরকম অস্বাভাবিক।

সে রান্নাঘরে এসে কফি ঢেলে নিয়ে তার মধ্যে ক্রীম মেশাল। তারপর পড়বার ঘরে ডেস্কের সামনে বসে কয়েক চুমুক-কফি খেয়ে একটা সিগারেট ধরাল।

সমাপ্ত প্রায় পাণ্ডুলিপিটা হাতে তুলে নিয়ে শেষ কপাতায় চোখ বোলাল। কিন্তু তার সমস্ত মন জুড়ে রয়েছেব্রুনোর অন্তর্ধান রহস্য। পাণ্ডুলিপিসরিয়ে রেখে কফি শেষ করে আবার রান্নাঘরে গেল।

একইভাবে ব্রুনোর খাবার পড়ে রয়েছে।

ভিক্টর আবার গেটের কাছে গিয়ে শি দিল। নিজেকে হঠাৎ বড় একা মনে হল। ক্যারীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করল কিন্তু তাকে না জাগানোই ভাল। সে পড়বার ঘরে গিয়ে ইজি চেয়ারে শুয়ে মাথাটাকে একটু ঠাণ্ডা করতে চেষ্টা করল।

সেখান থেকেই বড় জানলাটা দিয়ে দেখতে পেল টকটকে লাল বর্ণের গোলাটা আকাশে উঠল। প্রতিদিন তাকে এই দৃশ্য মুগ্ধ করে। কিন্তু আজ তাদের চারিদিকে বিশাল জনশূন্য মরুভূমির নিঃসঙ্গতার কথা অনুভব করল।

হঠাৎ তার কানে তার ছেলের ফেঁপানো কান্নার শব্দ এল। দ্রুত সে শোবার ঘরে ঢুকল।

তখন খাবারের জন্য খোকা প্রাতঃকালীন চিৎকার শুরু করেছে। বিছানায় বসে ক্যারী আড়মোড়া ভাঙছিল, ভিক্টরকে দেখে হাসল।

আজ তুমি সকাল সকাল উঠে পড়েছ। কটা বাজে?

 ভিক্টর ছেলের কাছে যেতে যেতে বলল, সাড়ে ছটা। বাবার কোলে উঠেই ছেলের কান্না থেমে গেল।

ক্যারী বলল, তোমার ঘুম হল না?

না, কিছুতেই আর ঘুম এল না।

ছেলে কোলে নিয়ে ভিক্টর খাটে বসল আর তার স্ত্রী বাথরুমে ঢুকল। পনেরো মিনিট পরে ক্যারী খোকাকে খাওয়াচ্ছিল আর ভিক্টর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে তাই দেখছিল। দৃশ্যটা তার খুব ভাল লাগে।

ক্যারী বলল, কাল রাতে সেই মোটর সাইকেলটার আওয়াজ পেয়েছিলে?

ক্যারীর কথায় সে আবার সজাগ হয়ে বলল, মোটর সাইকেল? কই আমি তো শুনিনি।

কাল রাতে কেউ একজন মোটর সাইকেলে এখানে এসেছিল। তখন দুটো হবে। কিন্তু চলে যাওয়ার শব্দ আর পেলাম না।

পুলিশ-টুলিশ কেউ হবে হয়ত। টহলদারী পুলিশদের একজন মাঝে মাঝে এখানে আসে–মনে পড়েছে তোমার?

কিন্তু লোকটা যে আর ফিরল না।

তুমি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলে তাই আর চলে যাওয়ার আওয়াজটা শুনতে পাওনি। চলে না গেলে সে এখানেই থাকত। কিন্তু আমি কাউকে দেখতে পাইনি।

ক্যারী বলে, কি করে জানলে যে সে এখানে নেই?

দেখ ডার্লিং লোকটা এখানে থাকবে কি জন্যে? তাছাড়া ব্রুনো তো চিৎকার–ও, হ্যাঁ মনে। পড়ল ব্রুনোকে সকাল থেকে দেখছি না। শিস্ দিলাম কিন্তু সে এল না। ক্যারী দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে দেখে খাবার তেমনি রয়েছে।

ক্যারী এসে বলল, কোথায় গিয়ে থাকতে পারে?

কিছু তাড়া করেছে বোধ হয়। আমি একটু খুঁজে দেখি।

ওদিকে খোকার কান্না শুনে ক্যারী শোবার ঘরে ফিরে গেল। ভিক্টর বড় গেটের দিকে শিস দিতে দিতে হেঁটে চলল।

বড় গেটের কাছে এসে সরু মেঠো রাস্তাটার চারপাশে তাকাল। কোথাও কোনো চাঞ্চল্য নেই।

বালু ঢাকা রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখল তার নিজের গাড়ির চাকার দাগের ফাঁকে এক জোড়া মোটর সাইকেলের চাকার দাগ। সেই চাকার দাগ তার গেটে এসে থেমে গেছে। সে বাঁদিকে তাকাল, সেখানে চাকার দাগ নেই। মনে হয় কেউ একজন মোটর সাইকেলে চেপে পীট শহরের বড় রাস্তা থেকে মেঠো পথ ধরে তার বাড়ির গেট পর্যন্ত এসেছে। তারপর আরোহী শুদ্ধ মোটর সাইকেলটি স্রেফ হাওয়ায় মিশে গেছে। চাকার দাগ দেখে বোঝা যায় যে, গাড়িটা গেট থেকে তার বাড়ির দিকেও যায়নি। অথবা বোষ্টন ক্রীকের রাস্তাও ধরেনি। গেটের কাছে। এসে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে।

সেই আশ্চর্য চাকার দাগের দিকে তাকিয়ে নিঃসঙ্গতার বিচিত্র অস্বস্তিকর অনুভূতি আবার তাকে ঘিরে ধরল। সে বাড়ীর দিকে জোরে পা চালাল।

ক্যারী দরজায় দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবেতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছে। ভিক্টর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

ভিক্! বন্দুকগুলো নেই।

ক্যারী ভয় পেয়েছে। আশংকায় তার নীল দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে।

বন্দুকগুলো! নেই।

তোমার ঘরে গিয়েছিলাম–তাকে একটাও বন্দুক নেই।

সে অস্ত্রশস্ত্রের ঘরের দিকে চলল। বন্দুকের তাকগুলো তাঁর ডেস্কের আড়ালে একটি ছোট ঘরের মধ্যে ছিল। প্রতিটি তাক খালি পড়ে রয়েছে। এখানে চারটি বন্দুক ছিল, আর ৪৫ ও ১২ ক্যালিবারের দুটি রাইফেল। তাদের একটাও নেই।

মৃদু, ভয়ার্ত স্বরে ক্যারী বলল, কাল রাতেও তো বন্দুকগুলো ছিল।

ছিল বৈকি। ভিক্টর তার ডেস্কের নীচের ড্রয়ারটি খুলল। এই ড্রয়ারে একটি ৩৮ পুলিশ .. স্পেশাল অটোমেটিক রিভলবার থাকে। লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশের বড়কর্তা তাকে এটি উপহার। দিয়েছিলেন। ড্রয়ারটা একেবারে ফাঁকা।

ক্যারী এগিয়ে এসে বলল, তোমার রিভলভারও নেই?

মনে হচ্ছে গত রাত্রে কেউ একজন এখানে ঢুকে বন্দুকগুলো নিয়ে সরে পড়েছে। আমি বরং পুলিশকে একটা খবর দিই।

আমি যে মোটর সাইকেলের আওয়াজটা পেয়েছিলাম।

হতে পারে। দেখা যাক, পুলিশ কি করতে পারে।

টেলিফোনের রিসিভার তুলতেই ক্যারীবলল, সেই লোকটা হয়তো এখনও এখানেই আছে। আমি তো তোমায় বললাম–ওর চলে যাওয়ার আওয়াজ আমি শুনিনি।

রিসিভার কানে লাগিয়ে ডায়াল করতেই সে বুঝল ফোন কেটে দেওয়া হয়েছে।

ভিক্টর শান্ত গলায় বলল, মনে হচ্ছে টেলিফোনটাও কেটে গেছে।

দমবন্ধ গলায় ক্যারী বলল, গতরাত্রেও তো ঠিক ছিল। সেই যে আমাদের একটা ফোন এল।

জানি, জানি, কিন্তু আপাততঃ আর এটা কাজ করছে না।

পরস্পরের দিকে তাকাল তারা। চোখ বড় বড় করে ক্যারী বলল, ব্রুনোর কী হয়েছে? তোমার কী মনে হয়?

তুমি আবার বাড়াবাড়ি কোরো না। কেউ একজন কাল রাতে এ বাড়িতে ঢুকে সেই বন্দুকগুলো হাতিয়েছে আর টেলিফোনের তার কেটেছে। ব্রুনো হয়তো তার হাতে ঘায়েল হয়েছে।

তুমি বলতে চাও ব্রুনো মারা গেছে?

জানি না ডার্লিং। হয়তো কিছু ওষুধ টযুধ খাইয়ে দিয়েছে জানি না।

ক্যারী ভিক্টরকে জড়িয়ে ধরল। ভিক্টর তাকে ধরে থাকল। ক্যারীর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। ভি এসব কি হচ্ছে? আমরা এখন কী করব?

ভিক্টর বুঝতে পারল যে সে নিজেও কেশ ভয় পেয়েছে, সচেতন হয়েছে চারিদিকের বিশাল নির্জনতার বিষয়ে। ডি-লং-এর কথা তার মনে পড়ল।

শোনো, তুমি খোকার কাছে থাকো। আমি বরং ডি-লংকে ডেকে তুলি। তাকে তোমার কাছে রেখে আমি চারিদিকটা ঘুরে দেখবো। আর তুমি অত ভয় পেয়ো না।

ভিক্টর তাকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকল। থোকা তখন হাত পা ছুঁড়ে খেলছে।

তুমি এখানে থাকো, আমি দুমিনিটের মধ্যে ফিরে আসছি।

ক্যারী তার হাত চেপে ধরে, না, ভিক, তুমি আমায় একলা রেখে কখনো যাবে না।

কিন্তু, ডার্লিং

দোহাই তোমার। আমায় ছেড়ে যেও না।

 আচ্ছা, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি না। তুমি ঘাবড়ানো বন্ধ কর।

সে জানালার সামনে গিয়ে হাঁক দিল, ডি-লং! ডি-লং।

প্রত্যুত্তরে শুধু প্রতিধ্বনি ভেসে এলো। নিস্তব্ধতা যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠল।

ক্যারী তখন অগোছাল ও ব্যস্ত ভঙ্গিতে একজোড়া স্ন্যাকস্ ও হালকা সোয়েটার পরে নিচ্ছে।

ভিক্টর বলে, ব্যাটা একেবারে মড়ার মত ঘুমোয়। চল ক্যারী লোকটাকে ডেকে তুলতে হবে। খোকাকে তুলে নাও।

দুজনে কেবিনের দিকে হেঁটে চলল। ক্যারীর কোলে ছেলে।

ভিক্টর কেবিনের দরজায় টোকা দিয়ে অপেক্ষা করল।

ভিক্টর অসহিষ্ণু গলায় বলে, আমি ভেতরে ঢুকছি, তুমি এখানে দাঁড়াও।

হাতল ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল। ভিক্টর ঢুকে–ডিং!

কোনো সাড়া নেই।রান্নঘরেরকল থেকেজলপড়ারটটআওয়াজ।আর কোনো শব্দ নেই।

ভিক্টর বসবার ঘর পেরিয়ে শোবার ঘরে ঢুকল। অন্ধকার ঘর, বাতাসে একটা কটুগন্ধ ভেসে আসছে। হাতড়ে হাতড়ে আলো জ্বালাল।

ঘরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। বালিশের গায়ে ডি-লং-এর মাথার খাঁজ। সে যে এখানে শুয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। গায়ের চাদর একদিকে সরানো। সেখানে ডিলংকে না পেয়ে একবার রান্নাঘরটা দেখে, ক্যারীর কাছে ফিরে এসে, ভিক্টর বলল

লোকটা নেই।

 তার মানে সে-ই বন্দুকগুলো–আর ব্রুনোকে নিয়ে পালিয়েছে? তোমার কি মনে হয়?

ভিক্টর দ্বিধাগ্রস্ত মনে বলে, হতে পারে। এ জায়গাটা ওর ভাল লাগছিল না। সে ব্রুনোকে খুব ভালবাসতো। হয়তো তার এক বন্ধুকে দিয়ে একটা মোটর সাইকেল আনিয়েছিল।

কিন্তু বন্দুকগুলো?

একটু ভেবে ভিক্টর বলল, হুম, এই ভিয়েতনামীগুলোকে বোঝা বড় মুস্কিল। হয়তো সে কোনো এক গুপ্ত সমিতির সভ্য যাদের বন্দুকের প্রয়োজন রয়েছে। মনে হচ্ছে, নিশ্চিন্তে পালাবার জন্যে টেলিফোনের তারও কেটে দিয়েছে।

ক্যারী বলে, কিন্তু অতগুলো বন্দুক আর ব্রুনোকে নিয়ে কি করে একটা মোটর সাইকেলে চাপতে পারে?

হয়ত একটা গাড়ীও নিয়ে গেছে। আমি একবার দেখে আসি। আমরা গাড়ীতে করে পীট শহরে গিয়ে এখানে পুলিস পাঠাব। এসব ব্যাপার তারাই ভাল সামলাতে পারবে।

ক্যারী সম্মতি জানিয়ে, বলল আমি তাহলে খোকার জিনিষপত্র গুছিয়ে নিই। তুমি গাড়ী নিয়ে এসো।

বাড়ির দিকে ক্যারী চলে গেল। ভিক্টর গ্যারেজের দিকে যেতে যেতে কি মনে হল ডি-লংরে শাবার ঘরে গিয়ে বিছানার বাঁদিকের ছোট আলমারীটা খুলল। সামনেই রয়েছেতকতকে পরিস্কার তিনটি স্যুট ও কয়েকটি উর্দি। অন্য তাকে ডি-লং-এর ইলেকট্রিক সেভার পড়ে আছে। গত বড়দিনে ভিক্টর তাকে এটা উপহার দিয়েছিল। সেভারের পাশে একটা কোডাক ক্যামেরা। নতুন লাইকা ক্যামেরা কেনার পর সে এটা ডি-লং-কে দিয়েছিল। ডি-লং-এর সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ এ-দুটি।

অসাধারণ কোনো বিপদ না ঘটলে ডি-লং কখনো এ দুটো জিনিষ ফেলে যেত না। কিন্তু কি হতে পারে?

তারপর ভিক্টর গ্যারেজে গিয়ে বিরাট দরজাদুটো খুলল।নীল-সাদা ক্যাডিলাকও মার্কারী এস্টেট ওয়াগন পাশাপাশি রয়েছে দেখে সে যেন একটু নিশ্চিন্ত হলো। ক্যাডিলাকে চড়ে বসল। চাবি লাগানোই ছিল। চাবি ঘুরিয়ে পায়ের চাপ দিতেই ঘড় ঘড় করে শব্দ হল। কিন্তু ইঞ্জিন স্টার্ট নিল না। পর পর তিনবার চেষ্টার পর সে গাড়ী থেকে বেরিয়ে মার্কারী এস্টেট ওয়াগনটাতে গিয়ে বসল। এটাকে চালাবার চেষ্টা করতে সেই একই ব্যাপার হল। ঘড় ঘড় শব্দ হল কিন্তু গাড়ী চলল না।

ভিক্টর ওয়াগন থেকে বেরিয়ে ক্যাডিলাকের বনেট খুলল। গাড়ী সম্বন্ধে তার জ্ঞান অল্প হলেও সে দেখেই বুঝল যে পার্কিং প্লাগদুটো লাগানো নেই। দুটোতে একই ব্যাপার।

কেউ একজন পার্কিং প্লাগ কটা খুলে নিয়ে দুটো গাড়ীকেই সম্পূর্ণ অচল করেছে।

এক জোড়া অচল গাড়ীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভাবল, একলা থাকলে সে পুরো অবস্থাটা একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করত কিন্তু ক্যারী আর বাচ্চার কথা ভেবে সে ভীত হয়ে উঠল। ব্রুনো নেই। ডি-লং নেই। অস্ত্র নেই, টেলিফোন নেই, এখন দেখা যাচ্ছে গাড়ীও নেই।

ক্যারী আর খোকা একলা রয়েছে মনে হতেই সে বাড়ির দিকে দৌড় লাগাল।

শোবার ঘরে ক্যারী একটা স্যুটকেশে বাচ্চার জিনিষপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল। ভিক্টর ঘরে ঢুকতেই ক্যারী বুতে পারল কিছু একটা ঘটেছে। সে তীক্ষ্ণ–গলায় বলে, কি হয়েছে?

ব্যাপার খুব গোলমেলে, গাড়ী দুটোকে অচল করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখান থেকে পালাবার উপায় নেই। কিছুই বুঝতে পারছি না।

ক্যারী বসে পড়ল, কী হয়েছে গাড়ীর?

প্লাগগুলো কেউ খুলে নিয়েছে। ডি-লং তার ক্যামেরা আর সেভার ফেলে গেছে। সে কখনন ও দুটো ফেলে চলে যাবে না, যদিনা।

ভিক্টর ক্যারীর পাশে বসে বলে, তোমায় ভয় পাওয়াতে চাই না, কিন্তু ব্যাপারটা বড় ঘোরালো হচ্ছে। কেউ একজন এখানে এসেছে–একজন তোক যে।

ক্যারী তার দিকে ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে, তুমি বলছ ডি-লং বন্দুকগুলো চুরি করেনি?

 না। চলে গেলে সে কখনো তার ক্যামেরা আর সেভার ফেলে যেত না।

 তাহলে সে কোথায় গেল? আর ব্রুনোরই বা কী হল?

জানি না।

ক্যারী উঠে দাঁড়িয়ে, চল আমরা এখান থেকে চলে যাই ভিক। এক্ষুনি! আমি আর এখানে থাকতে পারছি না।

এখান থেকে যাবার উপায় নেই। বড় রাস্তা এখান থেকে পনোর মাইল দূরে। রোঙ্গুরের। তাপ বাড়ছে। খোকাকে কোলে নিয়ে এতটা পথ হাঁটতে পারবে না।

আমি হাঁটতে রাজি আছি। এখানে থাকার চেয়ে অনেক ভালো। তুমি খোকাকে নাও। আমি জিনিষপত্র নিচ্ছি। আর এক মুহূর্তও এখানে নয়।

অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হবে কিন্তু। ঠিক আছে, চল হাঁটাই যাক। কিছু পানীয় নিতে হবে। আমি একটা ফ্লাক্স ভরে নিচ্ছি। সূর্য একটু বাদে ভীষণ তেতে উঠবে।

তাতে আমার কিছু হবে না–তাড়াতাড়ি করো ভিক।

ভিক্টর রান্নাঘরে গিয়ে একটা ফ্লাস্কে হিমশীতল কোকাকোলা ভরল। দুপ্যাকেট সিগারেট পকেটে নিল। চেকবই আর হঠাৎ দরকারের জন্য রাখা একশো ডলারের তিনটে নোট পকেটে পুরল।

তোমার টুপিটা পরে নিও। আমি একটা ছাতা নিয়ে খোকাকে আড়াল করে রাখব। তোমার গয়নাগাটি নিয়ে নাও ক্যারী। আমরা–

সে থমকে গেল ক্যারীর অস্ফুট চীৎকারে। রক্তহীন মুখে ক্যারী তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

তাকে অনুসরণ করে ভিক্টর নিজের পায়ের দিকে তাকাল। তার জুতোর ধার বরাবর একটা গাঢ় লাল রঙের দাগ–লাল দাগটা যে কিসের, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

ভিক্টর বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখবার সময় কোনো এক জায়গায় একরাশ রক্তের মধ্যে নিশ্চয়ই পা ফেলেছে।

.

০২.

 মাস তিনেক আগের সেই দিনটিতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে নষ্টনীড়-এর বিচিত্র ঘটনা প্রবাহের কারণ বুঝতে হলে। যেদিন লস্ অ্যাঞ্জেলস শহরে সলি লুকাস নামক একজন অ্যাটনী মুখের মধ্যে একটি অটোমেটিক পিস্তলেরনল পুরে তার বিরলকেশ মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল।

চিরকাল সলি লুকাস কুখ্যাত সব অপরাধীদের হয়ে ওকালতি করে এসেছে। কিন্তু তবু সুচতুর উকিল ও শেয়ার মার্কেটের যাদুকর হিসেবে তার প্রতিপত্তি কম ছিল না। আত্মহত্যার সময় তার বয়েস ছিল পঁয়ষট্টি বছর। গত তিরিশ বছর ধরে সে জিম ক্র্যামারের অধীনে কাজ করেছে–আন ক্যাপোনের পর আমেরিকার সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধীদের অন্যতম। লুকাসের কাজ ছিল বহির্জগতে ক্র্যামারের প্রতিনিধিত্ব করা এবং তার উপার্জিত টাকা ঠিক মত খাটানো।

 প্রায় ষাট বছর বয়েস ক্র্যামারের অপরাধ জীবন শুরু হয় কুখ্যাত–দ রোজার টুহির দেহরক্ষী হিসেবে। তারপর ধীরে ধীরে একদিন তিনি নিজে দস্যসর্দারের পদ দখল করলেন এবং আমেরিকার সবচেয়ে ভয়াবহ গুপ্তসংস্থা মার্ডার ইনকরপোরেটেড-এর সদস্য নির্বাচিত হলেন। শেষে দেশের কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় শিল্পকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষমতা এসে পড়ল তার লৌহমুষ্ঠির মধ্যে।

তিনি সমগ্র অপরাধী জীবনে ষাট লক্ষ ডলার অর্থ জমাতে পেরেছিলেন।

আমেরিকান পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তর ফেডারেল ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশন (এফ.বি.আই.) ভালভাবেই জানত যেক্র্যামার খুব বড় জাতের অপরাধী,দস্যু সম্রাট এবং দেশের বৃহত্তম কয়েকটি ব্যাংক ডাকাতির পেছনেও তার হাত আছে।তবু তারা কিছুতেই তার কোনো অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। ফ্র্যামারের আশ্চর্য চাতুরী ও লুকাসের অসাধারণ আইনের প্যাঁচের সামনে তারা দাঁড়াতে পারেনি।

ক্র্যামার পঞ্চান্ন বছর পূর্ণ হবার পর অবসর নিতে হবে ভাবলেন। দস্যুদলের নায়কের পক্ষে অবসর গ্রহণ করা সহজ কাজ নয়। সাধারণতঃ দলপতির দুর্বলতার লক্ষণ দেখা দিলেই দলের আরেকজন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায় আর সেখানেই দলপতির শেষ। কিন্তু ক্র্যামার বুদ্ধি করে ষাট লক্ষ ডলার আগেই নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলেছিলেন। তার থেকে কুড়ি লক্ষ ডলার ভবিষ্যত জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তার খাতিরে খরচ করতে হল। এই কুড়ি লক্ষ ডলার তার দলত্যাগের পথ এত সুন্দরভাবে পরিষ্কার করল যে, তিনি সত্যিই শেষ পর্যন্ত আরামে ও নিরাপদে লোকচক্ষুর আড়ালে সরে যেতে পারলেন। খুব কম দস্যসম্রাটই একাজে সফল হয়েছেন।

লুকাসের হাতে বাকী চল্লিশ লক্ষ ডলার ঠিকমত খাটাবার জন্য দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন। লস্ অ্যাঞ্জেলস থেকে অল্পদূরে প্যারাডাইস শহরে একটি বিলাসবহুল বাড়ি কিনে ক্র্যামার অবসর জীবন শুরু করলেন।

হেলেন ডোর্সকে তিনি দস্যুবৃত্তি করবার সময়েই বিয়ে করেছিলেন। সে তখন একটি নাইট ক্লাবে গান গাইতো।–সোনালী চুল। বড় বড় চোখ। বয়সের চেয়ে একটু বেশী বড় দেখাত। ক্র্যামারকে ভালবেসে সে তার সব কিছু মেনে নিয়েছিল।

কিন্তু দস্যুবৃত্তি থেকে বেরিয়ে ক্র্যামার নিজেকে একজন অতি অমায়িক ভদ্রলোক হিসেবে প্রমাণিত করলেন। চমৎকার গল খেলতে পারতেন। ব্রিজ খেলার হাতও ভাল, মদও খেতেন। প্যারাডাইস শহরের উচ্চবিত্ত সমাজ তাকে সহজে মেনে নিল। তারা অবশ্য জানত তিনি একজন পয়সাওয়ালা-অবসরপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী। হেলেনও এ সমাজে সহজেই মিশে গেল। একটু মোটা হয়েছে এবং রংটা ফ্যাকাশে হয়েছে কিন্তু সেই উচ্ছল–সুরেলা গলার কোন পরিবর্তন হয়নি। এখনও সে পিয়ানোর সামনে বসে মুখে মুখে মজার মজার গান তৈরী করে গাইতে পারে। ক্লাবের আসর যখন এক একদিন ঝিমিয়ে আসে সে সময়ে হেলেনের গান কৌতুকের সৃষ্টি করত।

হেলেন যখন লস্ অ্যাঞ্জেলসে বাজার করতে যেত, বৃষ্টির জন্য গল খেলা বন্ধ। সেই সময় ক্র্যামার বাড়িতে একলা পড়ে যেতেন। তখন তার মন পুরনো দিনের তীব্র উত্তেজনায় ভরা দিনগুলোর জন্য আনচান করত। তখন ছেড়ে আসা বিশাল ক্ষমতার জন্য তার আপসোস হত। কিন্তু তিনি সেই চিন্তাকে আমল দিতেন না। অপরাধ জীবন থেকে কোনো কলংকের ছাপনা নিয়ে তিনি বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। এফ. বি. আই. (ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন) তাকে ছুঁতে পারেনি। সলি লুকাস তার টাকা খাঁটিয়ে নিয়মিত মোটা টাকা এনে দিচ্ছে। ক্র্যামার দস্যুজীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বলে নিজেকে খুব ভাগ্যবান ভাবেন।

ক্র্যামার মনে মনে অনেক সময় দুর্দান্ত সব ডাকাতি অপহরণ বা ব্যাংক লুঠের কথা ভাবতেন। এতে যে শুধু সময় কাটত তা নয় এগুলো তার কাছে দাবার ধাঁধার মতোই আকর্ষণীয় ছিল। তিনি কল্পনার চোখে দেখতেন মাত্র পাঁচজন তোক কী করে লস্ এ্যাঞ্জেলসের চেস্ ন্যাশনাল ব্যাংকের ভেতর ঢুকে দশ লক্ষ ডলার নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। হয়তো এক বর্ষণ ক্লান্ত দ্বিপ্রহরে হেলেন একটি গানের সুর ভাজছে আর ক্র্যামার বসে বসে ভাবছেন কী করে টেক্ৰাস প্রদেশের এক কোটীপতির কন্যাকে অপহরণ করে কয়েক লক্ষ ডলার মুক্তিপণ রাখা যায়। এই সমস্ত ভাবনাগুলি তার ভাল লাগত। একবারও তিনি হেলেনকে এই সব ষড়যন্ত্রের কথা কিছু বলেন নি।

যেদিন সকালবেলা সলি লুকাস আত্মহত্যা করল, সেই সকালেই ক্র্যামার চমৎকার একদান গলফ খেলা শেষ করে তার পার্টনারের সঙ্গে ক্লাবের বারে ঢুকছিলেন। তাঁরা দুগেলাস জিন্ এর অর্ডার দিলেন।

ক্র্যামার পরিতৃপ্তির সঙ্গে পানীয়ের গেলাসটি শেষ করে নামিয়ে রাখলেন। এমন সময় বার ম্যান তাকে বলল, আপনার একটা ফোন আছে, মিঃ ক্র্যামার, লস্ অ্যাঞ্জেলস্ থেকে।

ক্র্যামার টেলিফোন বুথে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। সলি লুকাসের বড় কেরানী এবং বন্ধু জ্যাকবস তাকে কর্কশ গলায় খবরটা জানাল।

আত্মহত্যা করেছে?

তিনি গত তিরিশ বছর ধরে সলি লুকাসকে চেনেন। তাকে তিনি এক সুচতুর আইনজীবি বলে জানতেন। জানতেন যে টাকা রোজগারের তার এক সহজাত ক্ষমতা ছিল। কিন্তু এও ঠিক যে মেয়েদের ব্যাপারে লুকাস কোনদিন মাথা ঠিক রাখতে পারত না। আর ফাটকা বাজীতে সে ছিল চরম উহ্ঙ্খল ও বেপরোয়া। শেষ কপর্দকটি শেষ না হয়ে গেলে লুকাস কখনো আত্মহত্যা করত না। ক্র্যামারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঠাণ্ডা ঘাম ফুটে উঠল। তার চল্লিশ লক্ষ ডলারের পরিণাম সম্পর্কে আতংকিত হয়ে উঠলেন তিনি।

এক নাগাড়ে দুহপ্তা ঘোরাঘুরি করে তিনি সলি লুকাসের আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বার করলেন। বোঝা গেল সলির চারজন বড় মক্কেল ছিল-ক্র্যামার তাদের একজন। এরা প্রত্যেকেই তার কাছে বিরাট অংকের টাকা জমা রেখেছিলেন। সমস্ত টাকা লুকাস নিজের কাজে লাগিয়েছিল। হয়ত তাঁর ভাগ্য খারাপ ছিল কিংবা হয়ত ঠিকমত ফাটকাবাজি করবার বয়স তার চলে গিয়েছিল। যে কারণেই হোক, তার প্রচুর ক্ষতি হচ্ছিল। সুতরাং আরো বেশী করে টাকা ঢেলে অবস্থা সামলাবার চেষ্টা করল। জমি, বাড়ি ও শেয়ারের ফাটকাবাজী ক্ৰমশঃ তাকে এক অন্তহীন খাদের গভীরে টেনে নিয়ে গেল। শেষ আশাটুকু যখন ধ্বসে গেল, তখন তার মক্কেলদের জমা দেয়া পুরো নব্বই লক্ষ ডলার অদৃশ্য হয়েছে। ক্র্যামারের চল্লিশ লক্ষ ডলারও তার মধ্যে ছিল। লুকাস ক্র্যামারকে চিনত, সে কখনো তাকে ক্ষমা করবে না। তাই নিজেকেই শেষ করে দিল সে।

তিরিশ বছরের বিশ্বস্ত সহচর ও বন্ধু লুকাস যে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে চরম দারিদ্রের মধ্যে ঠেলে দিয়ে গেছে এটা উপলব্ধি করতে তার কিছু সময় লাগল। ব্যাংকের পাঁচ হাজার ডলার বাদে তার সমস্ত শেয়ার, সমস্ত বণ্ড, এমন কি সেফ ডিপোজিটে রাখা টাকাটাও লুকাসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

লুকাসের বিশাল বিলাসবহুল অফিসের ভেতর এবং জ্যাকবসের সামনে তিনি বসেছিলেন? জ্যাকবসলম্বা, রোগা চেহারার,শান্তভঙ্গিতে জ্যাকবসবলছিল,এই হল ব্যাপার। মিঃ ক্র্যামার।আমি দুঃখিত।কর্তা যেকীকরছিলেন, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। ক্ষতি আপনার একলার হয়নি, প্রায় নব্বই লক্ষ ডলার হারিয়ে ভদ্রলোকের মাথাটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়।

ক্র্যামার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন, জীবনে প্রথম নিজেকে বৃদ্ধ বলে মনে হল।

তিনি বললেন, আমার নাম যেন না বেরোয়, এবং কেউ যেন জানতে না পারে যে আমার একটি পয়সাও গেছে বুঝতে পেরেছ? খবরের কাগজের লোকেরা যদি আমায় এসে ধরে, আমি তোমায় ধরব!

ক্র্যামার এসে গাড়ীতে বসে চুপচাপকিছুক্ষণ ভাবলেন, চোখের ওপর ভাসছে কেবল অন্ধকার। দারিদ্রে ভরা ভবিষ্যত। হেলেনকে এক্ষুনি খবরটা জানাবেন না। কিন্তু এবার তিনি কি করবেন? সংসার চলবে কি করে? অর্ডার দেওয়া নতুন ক্যাডিলাক গাড়ীটার কথা মনে পড়ল। হেলেনকে জন্মদিনে একটা ফারের স্টোল উপহার দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। দূরপ্রাচ্য সফরের জন্য এক বিলাসবহুল জাহাজের একটি কামরা রিজার্ভ করা আছে। তার টাকা দেওয়া হয়নি। এই সব খরচ মেটাতে গেলে ব্যাংকের সামান্য পাঁচ হাজার ডলার এক হপ্তার মধ্যে উড়ে যাবে।

ক্র্যামার সিগার ধরিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ধীর গতিতে প্যারাডাইসে চললেন। যেতে যেতে ভাবলেন–কিছু একটা করতে হবে।

ঠিক আছে, সজোরে মুখের সিগারটাকে চিবোতে চিবোতে তিনি মনে মনে বললেন, নতুন করে টাকা রোজগারের বয়েস তো এখনও যায়নি। কিন্তু কী করে? ষাট বছর বয়সে চল্লিশ লক্ষ ডলার উপার্জন করা তো মুখের কথা নয়–যদি

তিনি বাড়িতে পৌঁছে দেখেন হেলেন বেরোবার জন্য তৈরী হচ্ছে। ক্র্যামার ঢুকতেই সে বলল, জানতে পারলে কিছু? সে কেন আত্মহত্যা করল?

দেনার দায়ে, ওপর চালাকি করতে গিয়েছিল-সবাই যে ভুলটা করে। তুমি বেরিয়ে পড়ো। আমার কিছু ভাববার আছে।

টাকা রোজগারের ব্যাপারে হেলেন সলি লুকাসকে যাদুকর বলে জানত, তুমি বলতে চাও সলি শেষে ফতুর হয়ে গিয়েছিল?

ঠিক তাই, স্রেফ ফতুর।

হেলেন বলল, তা আমাদের কাছে এল না কেন? আমরা তাকে সাহায্য করতে পারতাম। বেচারা সলি! কেন এল না আমাদের কাছে?

ক্র্যামার মুখ কালো করে বললেন, বেরোবে তুমি? আমার কাজকর্ম আছে।

ভাবছি শহরের দিকে যাব–সেই ফারের স্টোলটাকে পছন্দ করে আসব।

দামী স্টোল কেনবার সময় এটা নয়। কিন্তু তিনি হেলেনকে কথা দিয়েছেন। পরে অবস্থা বুঝে অর্ডারটা না হয় বাতিল করা যাবে। হেলেনের হাতে একটা মৃদু চাপড় দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, বেরিয়ে পড়ো। তাড়াতাড়ি ফিরবে। তারপর পড়বার ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরে অজস্র বই। একটা ডেস্ক ও কয়েকটা বড় চেয়ার। জানালার ওপারে গোলাপের বাগান।

ক্র্যামার দরজা বন্ধ করে একটা সিগার ধরিয়ে ডেস্কের সামনে বসলেন। টু-সীটার জাগুয়ার চড়ে হেলেনের বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ পেলেন। হেলেনের ফিরতে ঘণ্টা দুয়েক দেরী।এর মধ্যেই কিছু একটা করতে হবে। বাড়িতে দুজন নিগ্রো চাকর আছে কিন্তু তারা বিরক্ত করতে আসবে না। ক্র্যামার স্থির হয়ে বসে, ঘড়ির কাঁটা দুরে চলল। তার অসামান্য অপরাধ প্রতিভা তন্ন তন্ন করে একটা পথ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিভাবে তিনি তার হারানো সম্পদ ফিরে পাবেন।

প্রায় একঘণ্টা ভাবার পরে উঠে জানালার কাছে গিয়ে বাইরের ছাঁটা লন ও গোলাপের ঝাড়ের দিকে তাকালেন। ফিরে এসে ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা সভা ফাইল বার করলেন। ফাইল খুলে কয়েকটা খবরের কাগজের কাটিং-এর ওপর চোখ বোলালেন। তার মুখ গভীর চিন্তায় থমথমে হয়ে উঠল। শেষে ফাইল বন্ধ করে দুয়ারে রেখে দিলেন।

তিনি নিঃশব্দে গিয়ে দরজা ফাঁক করে কান পাতলেন। রান্নাঘর থেকে দুই চাকরের মৃদু কণ্ঠস্বর। দরজা বন্ধ করে এসে ওপরের ডানদিকের ড্রয়ার হাতড়িয়ে একটা ছোেট, কোঁচকানো ঠিকানার বই বার করলেন। বইটার পাতা ওলটাতে লাগলেন।

শেষ পর্যন্ত যে টেলিফোন নাম্বারটা খুঁজছিলেন সেটা পেয়ে গেলেন। ফোনে তুলে অপারেটরকে বললেন স্যানফ্রান্সিসকোতে একটা ফোন করতে চান। ঠিকানা বই থেকে নম্বরটা পড়ে শোনালেন। অপারেটর মেয়েটি বলল ক্ষিণের মধ্যেই জানাব।

অনেকক্ষণ বাদে সেই নম্বরটা অপারেটর ধরে দিলেন; নম্বর পাওয়া গেছে। তবে বদলে গিয়েছিল নম্বরটা। ক্র্যামার ধরলেন।

হ্যালো? কে কথা বলছেন?

আমি মো জেগেটির সঙ্গে কথা বলতে চাই।

লোকটি বলল, কথা বলছি। আপনি কে? ক্র্যামার বললেন, তোমার গলা চিনতে পারিনি। মো, অনেকদিন হল-সাত বছর তাই না?

কে আপনি?

কে বলে মনে হয় তোমার? অনেকদিন দেখা হয়নি মো। কেমন আছ?

 জিম? হে ঈশ্বর! জিম তুমি?

মো জেগেটি বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে, বিগ জিম ক্র্যামার তার সঙ্গে কথা বলছে। স্বয়ং আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফোন করলেও সে এতটা অবাক হোত না।

মো দীর্ঘ পনেরো বছর ক্র্যামারের ডানহাত হিসেবে কাজ করেছে। ক্র্যামার পরিচালিত অন্ততঃ বিশটি বড় ব্যাংক লুঠের নায়ক ছিল সে। সেই পনের বছর পুলিশ এবং অপরাধী মহলা মো-কে দস্যুবৃত্তির সবচেয়ে দক্ষ শিল্পী বলে জানত। জটিলতম লোহার সিন্দুক সে চোখের পলকে খুলতে পারত। পাকা হাতে পকেট মারতে পারত। টাকা জাল করত। চোর ধরার সবচেয়ে নিখুঁত ফাঁদ তছনছ করে দিতে পারত, ডাকাতির পর ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে উধাও হোত। কিন্তু এত দক্ষতা সত্ত্বেও পরিচালনার ক্ষমতা একেবারে ছিল না। একটা ডাকাতির প্ল্যান পুরো ছক কেটে সাজিয়ে দিলে সে অনায়াসে কাজ সেরে আসতে পারত। কিন্তু তার নিজের ওপর প্ল্যান করবার দায়িত্ব এলেই সে একেবারে জলে পড়ত।

ক্র্যামার অবসর নেবার পর সে এই তথ্যটা আবিষ্কার করলা। মো নিজে মতলব এঁটে একটা ছোটখাট ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে স্যান কোয়েন্টিন-এর জেলে দীর্ঘ ছটি বছর কাটাতে হল। পুলিশ ভাল করেই জানত যে অনেকগুলি অসাধারণ ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে সে জড়িত ছিল। কারারক্ষীরাও সে খবর পেয়েছিল। ফলে তারা মোর ওপর জঘন্য অত্যাচার চালাল।

মো জেল থেকে বেরিয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছে। তখন তার বয়েস আটচল্লিশ। জেলের অমানুষিক প্রহারে একটা কিডনি একেবারে জখম হয়ে গেছে। ছবছর আগে যে দক্ষতম দস্যু বলে পরিচিত ছিল, আজ তার ছায়ামাত্র নেই।

সে দস্যু জীবনে প্রচুর রোজগার করেছিল। কিন্তু দুহাতে খরচ করে আর বেপরোয়া জুয়া খেলে কাটিয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে তার হাতে একটি পয়সাও নেই। কিন্তু আশ্রয় পাবার মত একটা জায়গা ছিল–তার মা।

বিশালকায়া একদা সুন্দরী ডল জেগেটির বয়স এখন বাহাত্তর। স্যানফ্রান্সিসকোর দুটি উঁচুদরের গনিকালয়ের মালিক তিনি। ছেলে তাকে যতটা ভালবাসত তার কাছে ছেলেও ততটা প্রিয় ছিল। জেল থেকে বেরিয়ে মো যখন তার কাছে এল, ছেলের শোচনীয় অবস্থা দেখে তিনি শিউরে উঠলেন। বুঝতে পারলেন যে তার সমস্ত কর্মক্ষমতা ও স্নায়ু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করাতে হলে সেবা শুশ্রূষা করা দরকার।

তিনি বসবাসের জন্য একটা তিন-ঘরওয়ালা ফ্ল্যাট ঠিক করে দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বললেন। সে আরামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জানালার পাশে একটি চেয়ারে বসে থাকত আর বন্দরে জাহাজদের যাওয়া আসা দেখত। আবার ডাকাতি করবার চিন্তা পর্যন্ত তার মাথায় এলে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যেত।

আঠারো মাস তার এভাবে কেটে গেল। প্রায়ই ক্র্যামারের কথা মনে পড়ে। ক্র্যামার তার উপাস্য দেবতা ছিলেন। তিনি যে সময় মত দস্যুবৃত্তি ছেড়ে চল্লিশ লাখ ডলার নিয়ে সরে পড়েছেন এজন্য সে তাকে প্রশংসার চোখে দেখত। তার প্রাক্তন দলপতি যে কিছু করে তার সহায়তা করতে পারেন, এ চিন্তাই তার মাথায় আসেনি।

ডলের ভাগ্যে তারপর বিপর্যয় নেমে এল। আঞ্চলিক পুলিশের অপরাধ বিভাগীয় প্রধান ক্যাপ্টেন ও-হার্ডি অবসর নিলেন।ক্যাপটেনক্যাপশ এলেন তার জায়গায়।রোগা,কড়া মেজাজের মানুষ এবং এক গোঁড়া ধর্মসম্প্রদায়ের সভ্য। গণিকা বৃত্তিকে তিনি ঘৃণা করেন আর কখনো তিনি ঘুষ নিতেননা। কাজে লাগবার তিন সপ্তার মধ্যে তিনি ডলের দুটি গণিকালয়ই বন্ধ করে দিলেন এবং সেখানকার অধিকাংশ গণিকাকে গ্রেপ্তার করলেন। রাতারাতি ডলের সমস্ত উপার্জন বন্ধ হয়ে গেল, তার ওপর এসে জুটল অজস্র দেনার দায়। এই বিরাট আঘাত তাকে পঙ্গু করে দিল। এখন তিনি হাসপাতালে। কী সব বিচিত্র চিকিৎসা চলছে তার উপর। মোর কাছে সবই এক রহস্যময় প্রহেলিকা।

ডলের মাসোহারা বন্ধ হয়ে যেতে মো বিপদে পড়ল। সে ফ্ল্যাট ছেড়ে বন্দরের কাছে এক নোংরা বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে চাকরী খুঁজল। অধিকাংশ জামাকাপড় ও জিনিষপত্র বেচে ফেলল। তারপর খাবার জোটা মুশকিল হয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত একইটালীয়ান রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ পেল। একটা মাত্র সে কাজের কাজ করেছিল–স্যানফ্রান্সিসকোর টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে তার ফোন নম্বর পরিবর্তনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল। এই জন্যেই সেদিন ক্র্যামার তাকে ধরতে পেরেছিল।

অতিকষ্টে উত্তেজনা চেপে সে বলল, বিগ জিম! আবার যে তোমার গলা শুনতে পাব এ আমি ভাবতেও পারিনি।

ক্র্যামারের পরিচিত সেই উদাত্ত হাসি, কেমন আছ, মো? কাজকর্ম কেমন চলছে-ভালো

মো তাকাল তেল চটচটে টেবিলে ঠাসা রেস্তোরাঁটার দিকে পড়ে, থাকা রাশিকৃত এঁটো । বাসনগুলোর দিকে, যেগুলো তাকে ধুতে হবে।

সে মিথ্যে কথা বলল, ভালই আছি। জিমকে সে জানে, একবার যে ব্যর্থ হয়েছে তাকে তিনি কখনও বিশ্বাস করেন না। সে রেস্তোরাঁর মালিক ফ্রান্সিওলির দিকে তাকাল, লোকটা একমনে টাকা গুণছে। তারপর নীচু গলায় বলল, এখন আমি নিজে ব্যবসা আরম্ভ করেছি…ভালই চলছে।

ক্র্যামার বললেন, খুব ভাল, শোনো মো, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। একটা কাজ হাতে এসেছে–তোমার আগ্রহ থাকতে পারে। প্রচুর টাকার ব্যাপার। তোমার ভাগে আড়াই লাখ ডলারের মত পড়তে পারে। আসবে নাকি তুমি?

মো বলে, ঠিক শুনতে পাচ্ছি না। লাইনে কিছু গোলমাল আছে বোধহয়। কি বললে যেন তুমি?

আমি বললাম যে বড় একটা কাজ হাতে এসেছে। তোমার ভাগে আড়াই লাখ পড়তে পারে।

মো চোখ বুজতেই জেলখানার সেই ভয়ংকর মারের স্মৃতি মনে পড়ল, তার সর্বাঙ্গ ভয়ে কেঁপে উঠল।

হ্যালো? শুনতে পাচ্ছে না মো?

নিশ্চয়–শুনে তো ভালই লাগলো। কিন্তু কাজটা ঠিক কি, জিম?

সে সব কথা তো আর টেলিফোনে বলা যায় না।

ক্র্যামারের গলা ধারালো শোনাল। তোমার এখানে আসতে হবে। তখন কথা হবে। আমি প্যারাডাইস শহরে আছি। কবে তুমি আসতে পারবে?

করুণ দৃষ্টিতে নিজের পোশাকের দিকে তাকাল, অন্য স্যুটটারও একই অবস্থা। প্যারাডাইস শহরে যাবার ভাড়া কুড়ি ডলার তার কাছে নেই। রেস্তোরাঁর কাজে কোন ছুটি নেই। কিন্তু তবুও রোমাঞ্চ, বিগ, জিম–আড়াই লক্ষ ডলার। বিগ জিম কখনও তাকে ভুল রাস্তা দেখান নি।

মো গলা নীচু করে বলল, শনিবার নাগাদ যেতে পারি। এখন কাজের চাপ বড় বেশী।

আজ কি বার। মঙ্গলবার? কাজটা জরুরী মো, আরো আগে আসা চাই। তুমি বৃহস্পতিবার এসো। পারবে বৃহস্পতিবার আসতে?

তা তুমি যখন বলছ। ঠিক আছে জিম। বৃহস্পতিবারেই পৌঁছব।

সে বুঝতে পারল ফ্রান্সিওলি তাঁর কথা শুনে বিষাক্ত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

ক্র্যামার বললেন, প্লেনে করে চলে এসো। আমি এয়ার পোর্টে থাকব। পৌনে বারটায় একটা প্লেন আছে। তোমায় গাড়ীতে করে আমি বাড়ি নিয়ে আসব। এখানেই লাঞ্চ সারা যাবে। ঠিক আছে?

তাহলে চাকরীটা ছাড়তে হবে। কিন্তু আবার বিগ জিমের সঙ্গে সে কাজ করতে পারবে।

আসবো আমি।

চমৎকার–আবার দেখা হবে মো বলে ক্র্যামার ফোন ছেড়ে দিলেন।

ফ্রান্সিওলি তার সামনে এসে বলল, ব্যাপারটা কি? কোথাও যাবার মতলব করছ নাকি?

নোংরা অ্যাপ্রনে হাত মুছতে মুছতে মো বলে, কিছু না এক মাতাল ব্যাটা ফোন করছিল। অনেকদিন আগে একবার আলাপ হয়েছিল। লোকটার মাথায় ছিট আছে।

ফ্রান্সিওলি সন্দিগ্ধ চোখে তাঁর দিকে তাকাল। সে গেলাস ধুতে চলে গেল।

 মোর কাছে বাকী দিনটুকু খুব দীর্ঘ বলে মনে হল। আড়াই লক্ষ ডলার কথাটায় যাদু আছে।

মো চারটে নাগাদ নিজের ঘরে ফিরে এল। দুঘণ্টার মধ্যে আর রেস্তোরাঁয় যেতে হবে না। চটচটে জামাকাপড়গুলো খুলে স্নান করে নিল। মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ির ওপর ইলেকট্রিক রেজার বুলিয়ে নিল। তারপর একটা পরিষ্কার শার্ট ও সুট পরে এক দৌড়ে চারর্সিড়ি পেরিয়ে রাজপথে নেমে এল। বাসস্টপে এসে থামল। পথে ঘোট একগোছা ভায়োলেট ফুল নিয়েছিল। রোজ সে এই ফুল কেনে ডলের জন্য। এটা মায়ের সবচেয়ে প্রিয় ফুল।

সে হাসপাতালে এসে সেই দীর্ঘ বিষণ্ণ ঘরটিতে উপস্থিত হল। ঘরভর্তি অজস্র বৃদ্ধা–কেউ অসুস্থ, কেউ বা মৃত্যুপথযাত্রী। মায়ের বিছানায় পৌঁছনো অবধি প্রতিটি বৃদ্ধার দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ রইল।

মো যতবার এখানে আসে মাকে দেখে চমকে উঠে, কেমন যেন কুঁকড়ে ঘোট হয়ে যাচ্ছেন। বিবর্ণ সাদা মুখ, ঠোঁটের দুপাশে যন্ত্রণার গভীর রেখা। আর এই প্রথম তার চোখে যেন ফুটে উঠছে পরাজয়ের পূর্বাভাস।

মার পাশে বসে হাতটা তুলে নিল নিজের হাতে। ডল বললেন, তিনি বেশ ভালো আছেন। ভাববার কিছু নেই। হপ্তাদুয়েকের মধ্যে তিনি হাঁটা চলা করতে পারবেন তখন দেখা যাবে ক্যাপ্টেন ক্যাপশকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায়।

সে আস্তে আস্তে মাকে বলল, ক্র্যামারের টেলিফোনের কথা। ব্যাপারটা কি আমি জানি না। তবে বিগ জিমকে তো তুমি জানোতার কথা শুনে কোনদিন আমি ঠকিনি।

খবরটা শোনামাত্র তার বাম অঙ্গের তীব্র যন্ত্রণাটা যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। বিগ জিমকে তিনি চিরকাল সম্ভ্রমের চোখে দেখেছেন। অনেকবার তিনি ডলের বাড়িতে এসেছেন। বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে এক তুমুল সন্ধ্যা কাটিয়ে যাবার আগে ডলের সঙ্গে বসে আধ বোতল স্কচ হুইস্কি শেষ করে বিদায় নিতেন। পুরুষ বটে একজন। ধূর্ত, বুদ্ধিমান ও চটপটে। আজ তার দরকার ডলের ছেলেকে।

তুমি ওর সঙ্গে দেখা করো মো। বিগ জিম কখনও ভুল করে না। আড়াই লাখ ডলার। একবার ভেবে দ্যাখো।

হ্যাঁ, বিগ জিম নিজে যখন বলেছে, তখন কথাটা ভাওতা নয়। কিন্তু মা, এই চেহারা নিয়ে তো আর যেতে পারি না। জিম বলল প্লেনে করে চলে আসতে। আমার কাছে একদম টাকা নেই। আমি তাকে বললাম যে ভালই রোজগার করছি। আমার নিজের একটা রেস্তোরাঁ আছে। তুমি তো জানো জিমের মতিগতি। আমাদের দুরবস্থার কথা তাকে বলা সম্ভব ছিল না।

মো ঠিকই করেছে বুঝে বললেন, আমার কাছে টাকা আছে মো। তুমি যখন যাচ্ছ, তখন বেশ স্টাইলের সঙ্গেই যাওয়া দরকার। বিছানার পাশে ছোট আলমারী থেকে একটা কালো কুমীরের চামড়ার ব্যাগ বের করে তার থেকে একটা খাম বের করে মো কে দিলেন। টাকাটা নাও, মো। ভালো একটা সেট কিনো। পায়জামা শার্ট আর টুকিটাকি অনেক জিনিষপত্র লাগবে। ভাল চেহারার একটা সুটকেসও নিও। বিগ জিম এসব খুঁটিনাটি খুব লক্ষ্য করে।

দশখানা একশো ডলারের নোট দেখে, বিস্ফারিত চোখে সে বলল, একী কাণ্ড, মা! এত টাকা কোত্থেকে এলো?

হেসে ডল বললেন, টাকাটা আমার কাছেই ছিল। এটা আমার জরুরী দরকারের জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম, মো। এ টাকা এখন তোমার। সাবধানে খরচ কোরো। আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই।

কিন্তু এ টাকা তোমার লাগবে মা! এ আমি নিতে পারব না। সেরে উঠতে হলে তোমার এখন শেষ পয়সাটা পর্যন্ত দরকার।

হাতটা চেপে ধরে ডল বললেন, কয়েকদিনের মধ্যেই তুই আড়াই লাখ ডলার পাবি, বোকা। জিমের সঙ্গে একবার দেখা করলে আমাদের আর কোনদিন অভাব থাকবে না। নিয়ে নে টাকাটা।

টাকার খামটা নিয়ে মো গেল রেস্তোরাঁয়। ফ্রান্সিওলিকে বলল যে সে আর চাকরী করবে না। ফ্রান্সিওলি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল যে, ওয়েটার আজকাল পয়সায় এক ডজন করে পাওয়া যায়। মো যাবার সময় সে করমর্দন করল না বলে মোর মনটা একটু খারাপ হল।

বুধবারটা কেটে গেল জিনিষপত্র কিনতে। তারপর ঘরে ফিরে নতুন সুটকেশে সবকিছু গুছিয়ে রাখল। ইতিমধ্যেই চুল কাটা ও নখের পরিচর্যা সেরে নিয়েছিল। নতুন সুট পরে সে আয়নায় নিজেকে প্রায় চিনতেই পারছিল না।

সে সুটকেশ হাতে নিয়ে হাসপাতালে গেল। কিন্তু ওয়ার্ডের নার্সটি জানাল যে আজ তার মায়ের সঙ্গে দেখা করা বারণ। তিনি একটু কষ্ট পাচ্ছেন, তাকে বিরক্ত না করাই ভাল।

অসহায় ভাবে সুঠাম, স্বর্ণকেশী নার্সটির দিকে তাকিয়ে এক তীব্র নিঃসঙ্গতা আর ভয় হৃদপিণ্ডকে আঁকড়ে ধরল।

বোধ হয় খারাপ কিছু হয়নি, না? ভীতু গলায় প্রশ্ন করল সে।

অত্যন্ত সহজ ভঙ্গীমায় বসে, বেল্টটা ঠিক করতে করতে মেয়েটি চলে গেল। যেন কিছুই নয় ব্যাপারটা।

 মো ইতস্তুতঃকরে বাইরের দিকে পা বাড়াল। রাস্তায় এসে খেয়াল হল ভায়োলেটের গোছাটা। আবার ফিরে গেল ফুলওয়ালীর কাছে। ফুলগুলো দিল। বলল, মা ভালো নেই। কাল আবার নেব না হয়। তোমাকে দিয়েছি জানলে মা খুশী হবেন।

মোরে গিয়ে দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। একটু পরে অন্ধকার নেমে এল। কী করে প্রার্থনা করবে ভুলে গেল। শুধু, প্রিয় যীশু আমার মাকে দেখো, যত্ন নিও-সঙ্গে থেকো। মাকে আমার বড় দরকার।

বলতে পারল না সে এর চেয়ে বেশী কিছু। মো নীচে নেমে টেলিফোন ধরে হাসপাতালে ফোন করল।

এক মহিলা তাকে জানালেন যে, ডল একটু অস্বস্তিতে আছেন। মো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে, কিন্তু জানতে পারল তাকে পাওয়া যাবে না।

সারা রাত্রিটা মো এক মদের আয় কাটাল। দুবোতল শেষ করে যখন বাড়ি ফিরল, তখন সে মাতাল।