৩. প্রথম শ্রেণীর ডেকের রেলিং

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

৩.১

ফেরি বোটের প্রথম শ্রেণীর ডেকের রেলিং-এ ঝুঁকে আমি তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের লোয়ার ডক-এ ওঠার জন্যে মারামারি, ঠেলাঠেলি দেখছিলাম।

বেশ আকর্ষণীয় দৃশ্য। প্রত্যেক যাত্রীই, এর সকলেই চীনা, এমন তাড়াহুড়ো করছে, যেন বোটটা এখুনি ছেড়ে দেবে, যদিও ওটার ফেরি ছাড়তে এখনও পনের মিনিট বাকী। কুলীরা জেটির তক্তার ওপরে এমন ঠেলাঠেলি করছে যেন এই ভীড় বোটের কামরায় উঠতে না পারলে তাদের জীবনই বৃথা। চীনা মেয়েরা, পিঠে বাচ্চা বাঁধা সঙ্গে অল্প বয়সের কিছু শিশু জেটির তক্তার ওপর দাঁড়িয়ে বোটে ওঠার চেষ্টা করছে। একটা অর্ধ-উলঙ্গ চীনা জোয়ান, ভারী মাল বয়ে তার কাঁধটাই ঝুলে গেছে একপাশে, ঐ ঝোলা কাঁধেই মাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুটো চীনা পুলিশ বেল্টে হাত লাগিয়ে সহনশীলতার সঙ্গে এই দৃশ্য দেখছে। আমি চোখ ফিরিয়ে প্রথম শ্রেণীর সহযাত্রীদের দিকে তাকালাম, দু-একজন করে ঢুকছে, কিন্তু স্টেলার কোন চিহ্ন নেই। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে ও খুব তাড়াতাড়ি আসবে না বা খুব দেরী করবে না। শেষ সময়ে আসবে।

একটা চীনা লোক, খুব ভাল স্বাস্থ্য, পরণে কালো সুট, একটা ভারী ব্রিফকেস নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে ওঠার জন্যে জেটির তক্তার ওপর দাঁড়াল। লোকটাকে দেখেই আমার এনরাইটদের বাড়িতে আয়নায় দেখা লোকটার কথা মনে পড়ল।

লোকটার বয়স চল্লিশের মধ্যে, শরীর বেশ মজবুত, জিমন্যাস্টদের মত স্বচ্ছন্দে হাঁটাচলা করতে পারে।

আমি মনে মনে ভাবলাম ও হয়তো আয়নায় দেখা লোকটা নাও হতে পারে। সব চীনাদেরই তো একরকম দেখতে। লোকটা আমাকে পেরিয়ে, সীটে বসে একটা খবরের কাগজ খুলে নিজেকে আড়াল করল।

বোট ছাড়ার ঠিক এক মিনিট আগে স্টেলাকে দেখতে পেলাম। পরনে আপেল-সবুজ সুতীর পোষাক, হাতে একটা বেতের ঝুড়ি। আমাকে দেখে হাত নাড়ল। ওই ছিল বোটের শেষ যাত্রী।

আমি গিয়ে ওর হাত থেকে ঝুড়িটা নিলাম। ও ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বোট ছেড়ে দিল।

–হ্যালো স্টেলা। আমি বললাম।

–হ্যালো। আমি ঠিক সময়েই এসে গেছি।

আমরা ডেকের বেঞ্চ-এ বসে কথাবার্তা বললাম। ব্যক্তিগত কোন কথা উঠল না এমনকি জেফারসনের নামও উচ্চারিত হল না। স্টেলা জিজ্ঞেস করল সারাদিনটা আমি কিভাবে কাটিয়েছি। আমি বললাম, কস্থা দেখে কাটিয়ে দিয়েছি।

–আমরা, এসে গেছি। ঠোঁটটা সিলভার মাইন জেটিতে এসে লাগলে স্টেলা বলে উঠল, এই জিনিষগুলো এখানে আমার প্রিয় সেই বৃদ্ধাকে দিয়ে আসতে হবে। একটু কথাবার্তা বলে দেড়ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবো। আপনি জলপ্রপাতটা দেখে আসুননা। এটা এখানকার একটা দেখার মত জায়গা।

-হ্যাঁ, আমি দেখতে যাবো। আমরা কখন এখানে এসে মিলিত হবো?

–ফেরার বোট পাওয়া যাবে ঠিক ছটায়। ঐ সময়ই মিলিত হব।

স্টেলা আমাকে জলপ্রপাত যাবার পথনির্দেশ দিল।

–এই পথ দিয়ে সোজা গেলে বাটারফ্লাই পাহাড়, তারপর একটা ব্রীজ দেখতে পাবেন, সেটা পেরোলেই আরেকটা ব্রীজ। এই দ্বিতীয় ব্রীজটার পরেই জলপ্রপাতটা দেখতে পাবেন। এটা সত্যিই দেখার মত জায়গা।

-ঠিক আছে। আমি ঠিক দেখে নেব। আমি হেসে জবাব দিলাম।

আমি ওর চলে যাওয়া লক্ষ্য করলাম। ঘাট পেরিয়ে দুরে এক সারি জীর্ণ বাড়ির দিকে নয়ন মনোহর ভঙ্গীতে হেঁটে চলে গেল। তারপরআমিচারদিকেতাকিয়ে সেইচীনা লোকটাকে খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলাম না। আমাদের সঙ্গেই তো নামল। এর মধ্যে ও কোথায় গেল?

এখন থেকে ছটা পর্যন্ত আমার কিছু করার নেই। পরিষ্কার আবহাওয়া, রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, কোন তাড়া নেই, তাই স্টেলার দেওয়া পথনির্দেশ ধরে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে একটা গ্রাম পেরিয়ে হঠাৎ দেখতে পেলাম আমার ডানদিকে বাটারফ্লাই পাহাড়। তারপর দুটো ব্রীজ পেরোলাম।

 জলপ্রপাতটার কাছে চলে এলাম। সত্যিই প্রশংসা করার মতো প্রপাত। ফিরে যাওয়া মনস্থ করলাম। আর ঠিক সেই সময়ে কানের পাশ দিয়ে ভীমরুলের মত আওয়াজ করে কিছু একটা বেরিয়ে গেল এবং তারপরেই একটা রাইফেল ছোঁড়ার আওয়াজ।

আমি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে পড়লাম। এই কায়দাটা আমি সেনাবাহিনীতে থাকার সময় শিখেছিলাম। পরক্ষণেই আবার গড়িয়ে রাস্তার ধারে আসতেই আবার গুলির আওয়াজ। কিছুটা ধুলো উড়ে এলো।

আবার গড়িয়ে পাশের ঘন ঘাসের ওপর গিয়ে পড়তেই রাইফেলের গুলি এসে পড়তে লাগল। মাথার খুব কাছ দিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রায় খতম করে দিয়েছিল।

নিজের বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পাচ্ছি। ভয়ে ঘেমে চান হয়ে গেছি। দেরী না করে গড়িয়ে একটা পাথরের আড়ালে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম।

অনেকক্ষণ কিছু ঘটল না। আমিও একটু ধাতস্থ হলাম। যে আমাকে গুলি করছে মনে হয় সে টেলিস্কোপিক লেন্স ব্যবহার করেছিল। কেননা গুলির আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে সিকি মাইল দূর থেকে ছোঁড়া হচ্ছে।

আমার পয়েন্ট থ্রী এইট রিভালভারটা না আনার জন্যে নিজেকে গালাগাল দিলাম। আমি খুব সাবধানে মাথা তুলে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, পালাবার কোন রাস্তা আছে কিনা। সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখের পাশ দিয়ে একটা গুলি বেরিয়ে গেল। আমি মাথা নামিয়ে নিলাম। তাহলে ওরা দুজন আছে। শেষ ওলিটা আমার পেছন থেকে এসেছে।

আমার পোষাক দেখে ওরা বুঝেছে যে আমার সঙ্গে অস্ত্র নেই। ওরা দুজনেই সশস্ত্র।

খুব আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে বড় ঘাসগুলোর ভেতর দিয়ে সাপের মত পাহাড়ের তলদেশের দিকে মিনিট পাঁচেক ধরে এগোতে লাগলাম। এবার খুব সন্তর্পণে মাথা তুলতেই মাথার পাশ দিয়ে একটা বুলেট চলে গেল। আবার সটান হলাম। আস্তে আস্তে আগের জায়গাটা ত্যাগ করলাম। ভগবানকে ধন্যবাদ! প্রায় সেই মুহূর্তে আমার আগের জায়গাটায় একটা বুলেট ছুটে এল এবং একটা রাইফেলের ফায়ারের আওয়াজ পেলাম।

আমি আবার ডানদিকে একটু একটু করে সরতে লাগলাম। এরপর বড় ঘাস আর নেই। এরপর উপত্যকা অঞ্চল।

আমি মাথা না তুলে মাটিতে কান চেপে ভারতীয় কায়দায় শুনতে চেষ্টা করলাম। প্রথম কয়েক মিনিট পেরোবার পর আমার ডাইনে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূর থেকে আমার দিকে কেউ হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে শুনতে পেলাম। খুব শীগগির ও এসে পড়বে।

আমি ভাবলাম মৃত্যুর কাছে এবার আমায় আত্মসমর্পণ করতেই হবে। নিজেকে কেমন অক্ষম মনে হল। পরক্ষণেই মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে প্রথমে ডানদিকে তারপর বাঁ-দিকে লাফ দিলাম। উদ্দেশ্য ছিল লোকটাকে বোকা বানানো। সফল হলাম। রাইফেলটা গর্জে আমার কয়েক গজ দূর দিয়ে গুলিটা চলে গেল। আমার সামনের ঘাসে একটা নড়াচড়া দেখলাম। প্রায় ছ-গজ দূরে।

হামাগুড়ি দিচ্ছি। দেখি চীন, নীল জামা, ট্রাউজার, মাথায় কালো টুপি পরা একটা লোক, আমাকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। লোকটা বেঁটেখাটো কিন্তু মজবুত। হাতে ধরা ছুরি। আমি ওকে কোনরকম সুযোগ না দিয়ে লাফিয়ে ডান হাত দিয়ে ছুরিটা, বাঁ-হাত দিয়ে লোকটার গলাটা জাপটে ধরলাম।

আমি কাঁধ দিয়ে ওর বুকে একটা ঝাঁপটা ঝাড়লাম। ও সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। ও আঙুল দিয়ে আমার চোখ খামচে দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু আমি আমার মাথা দিয়ে ওর মুখে মারলাম এক ধাক্কা। ও গো করে উঠল। ওর ওজন আমার অর্ধেক, শক্তিও তাই। ওর হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে ওর গলায় চাপ দিতে লাগলাম। ওর সারা শরীরটা যতক্ষণ না পর্যন্ত মোচড় দিয়ে চোখ উল্টে ঠাণ্ডা হল, ততক্ষণ পর্যন্ত ছাড়লাম না। ও নেতিয়ে পড়লে আমি কয়েক গজ দূরে গড়িয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখলাম চীনাটার শরীর অল্প-অল্প নড়ছে। আমি হামাগুড়ি দিয়ে ওর কাছে গিয়ে ওর শরীরটা দিয়ে আমার শরীরটা আড়াল করে শুয়ে রইলাম।

আগের মারামারিতে ওর মাথা থেকে টুপিটা খুলে গিয়েছিল। ওর মাথায় টুপি না থাকায় ওকে আমি বলে ভুল করতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে আমার অনুমান সত্যে পরিণত হল। রাইফেলে গুলি ছোঁড়ার শব্দ পেলাম। চীনাটার দেহটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নেতিয়ে পড়ল। ওর নিথর, নিস্পন্দ দেহটা শুইয়ে দিয়ে আবার আমি হামাগুড়ি দিয়ে পনের গজ দূরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। হয়তো অপেক্ষা করতে করতে লোকটার ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। অবশেষে ও এল।

নিজের ওপর যথেষ্ট আস্থা নিয়ে ও এগোচ্ছে। দু-হাতে ধরা রাইফেল। আমার দিকেই মুখ ফেরানো। মশু, সুগঠিত চেহারা। পরনে কালো সিটি স্যুট। এই সেই এনরাইটদের আয়নায় দেখা লোকটা।

ওকে আসতে দেখে আমার সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। আমি বুঝলাম স্টেলার এই নির্জন দ্বীপে আসার প্রস্তাবটা, বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানো এ-সবই একটা পরিকল্পিত ফাঁদ। এই ফাঁদের থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই।

ঘাসের মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলাম হামাগুড়ি দিয়ে। হাতে ছুরি আছে বটে কিন্তু রাইফেলের সঙ্গে ছুরি! হাতের কাছে একটা পাথর পেয়ে নিয়ে রাখলাম।

লোকটা এবার আমার খুব কাছে, আমি ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমি ডান হাতে পাথর আর বাঁ-হাতে ছুরি নিয়ে অপেক্ষা করছি।

আমার ধারণা মত ও ওর মরা দোসরকে আগে দেখতে পেল। ঝুঁকে ওকে দেখতে লাগল। একটা অস্ফুট আওয়াজ করল মুখে। তারপর চোয়াল শক্ত করে, রাইফেলটা বাগিয়ে আমাকে লক্ষ্য করল। সঙ্গে সঙ্গে আমি পাথরটা ছুঁড়লাম। ও গুলি ছুঁড়ল। কিন্তু পাথরের ধাক্কায় নিশানা সঠিক হল না। গুলিটা আমার কাঁধের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। পাথরটার একটা কোণা লেগে ওর হাত থেকে বন্দুকটা খসে পড়ল। ও নীচু হয়ে ওটা কুড়িয়ে নেবার আগেই আমি ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

ও দু-পায়ে ভর দিয়ে ধাক্কাটা সামলালো। আমি উল্টে পড়লাম। ও দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করল। ইস্পাতের মত আঙুল। আমি সর্বশক্তি দিয়ে ওর তলপেটে মারলাম এক লাথি। ওর হাতটা নরম হতেই এক লাফ মেরে পাহাড়ের দিকে গিয়ে পড়লাম। খেয়াল পড়ল ছুরিটা আমার হাতে নেই। কাজেই আবার গড়িয়ে পাহাড়ের দিকে যেতে লাগলাম। সঙ্গে সঙ্গে ওর ছুটে আসার আওয়াজ পেলাম। যেম বুঝে শুয়োর গাঁ গাঁ করে ছুটে আসছে। আমি গড়ানো বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম। ওঁর হাতে রাইফেল নেই দেখে আমি পাহাড়ের দিকে ছুট লাগালাম।

লোকটা আমার পেছনে উধশ্বাসে ছুটে আসছে। ও যখন আমার খুব কাছে তখন আমি থেমে গিয়ে ওর মুখ লক্ষ্য করে এক লাথি মারলাম। ও নিজেকে সামলাবার কোন সুযোগই পেল না। গড়িয়ে পড়ল।ও গড়িয়ে পড়ার মুখে আমি একটা বড় পাথর তুলে ওর মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়লাম। ওর মাথার পেছনটা ফেটে গ করে রক্তের ফোয়ারা ছুটল। হয়তো ওর মাথার খুলি গুড়ো হয়ে গেছে। ও গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। ঠিক যেন একটা কাদার তাল। যাকগে, আমি আর চিন্তা করছি না। আমাকে আর জ্বালাতন করতে আসবেনা।

বুক ভরে দম নিয়ে সিলভার লাইন জেটির দিকে হাঁটা দিলাম। কাঁধটা জ্বালা করছে। পাহাড় থেকে নেমে রাস্তায় এলাম।

.

৩.২

 ঠিক আটটায় ওয়াঞ্চাই এলাকার বার-এ গিয়ে ঢুকলাম। এর আগে আমি স্নান করেছি। ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়েছি। আমার সৌভাগ্য তেমন ক্ষতিকর কিছু হয়নি।

বার একেবারে ভর্তি। খালাসীরা মদের গ্লাস নিয়ে হৈ-চৈ করছে, চীনা ছেলেমেয়েরা কেউ গল্প করছে, কেউ নাচছে।

বক্সে কান ফাটানো আওয়াজে গান বাজছে। আমি ভেতরে ঢুকে চারিদিকে তাকালাম। চীনা মাদাম ভীড় থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে একটা কেবিনে নিয়ে গিয়ে মুখোমুখি বসে খের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি খাবেন বলুন?

–একটা স্কচ…আপনি?

আমি আপনার জন্যে স্কচ বলছি। মাদাম নাচিয়েদের পেছন দিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। মিনিট পাঁচেক পর একটা ওয়েটার আমাকে স্কচ আর সোডা দিয়ে গেল। আরও মিনিট দশেক পরে চিন্তিত মুখে মাদাম ফিরে এসে চেয়ারে বসল।

–মু-হাই-তন আপনার সঙ্গে দেখা করবে, তবে এখানে নয়, আপনাকে ওর ঘরে যেতে হবে।

আবার ফাঁদ? একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। আসল কথা বিকেলের ঐ ঘটনার পর আমি একটু দুর্বল হয়ে গেছি। অবশ্য এখন আমি স্যুট পরে, পয়েন্ট-থ্রী-এইট যন্ত্রটা সঙ্গেই এনেছি। বুকে অনেকটা জোর আছে।

বুকের ঐ জোরের সঙ্গেই বললাম, কোথায় আছে ও?

-খুব দূরে নয়। আমি একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, মাদাম বলল।

–ঠিক আছে। কিন্তু আমি কি করে বুঝবো ওই আসল মেয়ে?

–ওর সঙ্গে কাগজপত্র আছে, আপনাকে দেখাবে। আপনি যাকে চাইছেন, ও ঠিক সেই মেয়ে।

–তাহলে আমি এক্ষুনি যাবো। আমি বললাম।

নিশ্চয়ই। ও আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে।

আমি তাড়াতাড়ি পানীয় শেষ করে উঠলাম।

–আমি ওর সঙ্গে যদি কথা বলে সন্তুষ্ট হই যে ও সেই মেয়ে যাকে আমি খুঁজছি, তাহলে আপনাকে পঞ্চাশ হংকং ডলার দেব।

মহিলা শক্ত মুখে হাসল।

-ঠিক আছে। চলুন, ট্যাক্সি করে দিই।

আমি অপেক্ষা করলাম। মহিলা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে এল আর আমাকে বলল, ট্যাক্সিওলা জানে আপনাকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে। ওর ঘরটা সবচেয়ে উঁচু তলায়। আপনার কোন অসুবিধা হবে না।

আমি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বার-এ অপেক্ষা করতে বললাম।

ট্যাক্সিচালক আমাকে দেখে হাসল। আমি গা না করে ভেতরে গিয়ে বসলাম। মিনিট ছয়েকের মধ্যে একটা গয়নার দোকানের সামনে এসে থামল। চালক তার পাশের একটা দরজা দেখিয়ে দিল। ট্যাক্সি চলে গেল।

তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠেদরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। দশ-পা এগোলো একটা লিফট। আমি লিফট চালিয়ে একেবারে উঁচু তলায় গেলাম। পিস্তলটা একবার দেখে নিলাম। কয়েক পা এগিয়ে একটা দরজা দেখতে পেয়ে বেল টিপলাম।

একটু দেরীতে একটা চীনে মেয়ে দরজা খুলে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

মেয়েটা লম্বা, স্লিম এবং সুন্দরী। একটা ক্ৰীম রঙের এমব্রয়ডারী করা সিল্ক জামা পরা, পায়ে হরিণের চামড়ার চটি। মাথায় ফুল গোঁজা।

–আমি রায়ান। মনে হয় তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করছ?

মেয়েটা সুন্দর ঝকঝকে দাঁতে হেসে বলল, হ্যাঁ, আসুন। ভেতরে আসুন।

ঘর বড়, সুন্দর ফুলে সাজানো। আধুনিক ওক কাঠের আসবাব। জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে।

–তুমি মু-হাই-তন? মেয়েটা দরজা বন্ধ করে আমার দিকে এগিয়ে এলে প্রশ্ন করলাম।

মেয়েটা চেয়ারে বসে বলল, হ্যাঁ আমার নাম। হাতদুটো ভাঁজ করে কোলে রাখা।

–আমি কী করে জানবো তুমি সত্যিই মু-হাই-তন কিনা?

আমার প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে টেবিলের দিকে হাত দেখিয়ে বলল, আমার সব কাগজপত্র ওখানে আছে।

আমি ওর পরিচয়পত্র দেখালাম। পাঁচ বছর আগে হংকং-এ এসেছে। জীবিকা-নর্তকী। বয়স–তেইশ। আমি ওর ঠিক উল্টো দিকে বসলাম।

–তুমি হেরম্যান জেফারসনকে চিনতে?

–হ্যাঁ চিনতাম। হপ্তা-দুয়েক আগে ও মারা গেছে।

–ওর বউকে চিনতে? আমি প্রশ্ন করলাম।

–অবশ্যই। আমি ওদের বিয়েতে সাক্ষী ছিলাম।

–তুমি জান হেরম্যান জীবিকা অর্জন করত কিভাবে?

–আমার মনে হয় আমি আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। দয়া করে বলবেন আপনি কে এবং কী জন্যে আমার কাছে এসেছেন?

–আমি হেরম্যানের বাবার হয়ে অনুসন্ধান করতে এসেছি। উনি জানতে চান ওঁর ছেলে এখানে কী ভাবে জীবনযাপন করত।

ভুরু তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ও জিজ্ঞেস করল, কেন?

-তা জানি না। উনি আমাকে টাকা দিয়েছেন, এইসব খবর সংগ্রহের জন্যে। তুমি কিছু খবর দিলে তোমাকেও টাকা দেব। মেয়েটা মাথা ঝাঁকাল।

–আপনি আমায় কত টাকা দেবেন?

–সেটা নির্ভর করছে তুমি আমাকে কী রকম খবর দাও তার ওপর।

–আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন ও কি করত? একটু তেতো হেসে বলল, ও কিছুই করত না। জো-অ্যান-এর কাছ থেকে টাকা নিয়ে খেত।

–লেইলা বলে কোন মেয়েকে চেনো?

–হ্যাঁ। ও তো জো-অ্যানের সঙ্গেই থাকত।

–লেইলা আমাকে বলেছিল হেরম্যান রিপালস্ উপসাগরের কাছে একটা অট্টালিকা ভাড়া করে থাকত। সত্যিই কি ও অট্টালিকা ভাড়া করেছিল?

মেয়েটা হো হো করে হেসে বলল, জেফারসন সেলেশিয়াল হোটেলের ভাড়াই দিতে পারত না। একটা অকর্মার ধাড়ি…ভিখিরী।

–আমি শুনেছিলাম ও মাদকদ্রব্য চোরাচালান করত?

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার মুখটা শক্ত হয়ে গেল। তারপর একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে থেকে একটু সহজ হয়ে বলল, এসব চোরাচালানের ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা।

–আমি বলছিনা যে তুমি এসব কর। তুমি শুনেছ, ক্যান্টন থেকে হেরোইন হংকং-এ চালান। হয়?

না। মেয়েটা বলল।

 –ফ্র্যাংক বেলিং কিন্তু এই চোরাচালান করত।

–আমি এ ব্যাপারে কিছু জানিনা। ও আমাকে খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করতে করতে বলল।

–তুমি বেলিংকে চিনতে, তাই না?

–আমি একবার মাত্র ওকে দেখেছিলাম, জেফারসনের বিয়েতে।

–ও কি জেফারসনের বন্ধু ছিল?

–বোধহয়, ঠিক জানি না। আমি কিছু জানি না এ ব্যাপারে।

–আমি এও শুনেছি বিয়ের পর জেফারসন ওর বৌকে ছেড়ে রিপালস্ উপসাগরের ঐ বাড়িতে চলে যায়।

মেয়েটা ছটফট করতে লাগল।

বললাম তো মরার আগের দিন অবধি হেরম্যান সেলেশিয়ালেই থাকত জো-অ্যানের সঙ্গে। ও কোনদিন রিপা যায়নি।

আমি ওকে সিগারেট দিতে গেলাম। ও নিলো না। ভাবলাম এ প্রসঙ্গে আর প্রশ্ন করে লাভ নেই। সবাই একই কথা বলছে, শুধু লেইলা ছাড়া। তবে আমি এটাই ধরে নিতে পারি লেইলা মিথ্যে বলেছে।

-ঠিক আছে। আমরা জো-অ্যানকে নিয়ে আলোচনা করি। তুমি ওকে ভালভাবে চিনতে?

-হ্যাঁ। ও আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। ও আমেরিকা চলে যেতে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আশা করছি খুব শিগগির চিঠি পাবও বলে গেছে আমার জন্যে ও কিছু করতে পারলে জানাবে। আমিও তাহলে আমেরিকা চলে যাবো।

আমি ভাবলাম এবার খোলাখুলি ভাবে আলোচনা দরকার।

-তুমি তাহলে শোননি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

–শুনব..কী?

 –ও মারা গেছে।

 ও ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হতবিহ্বল হয়ে বুকে হাত ঠেকাল। অভিনয় নয় সত্যিই ও ভয়ানক শক পেয়েছে।

মারা গেছে? কী করে? কি হয়েছিল?

–প্যাসাছোনা সিটিতে পৌঁছবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ও খুন হয়। ওর চোখে মুখে যন্ত্রণার ছাপ।

-আপনি মিথ্যে বলছেন।

–আমি সত্যিই বলছি। পুলিশ ওর খুনীকে ধরার চেষ্টা করছে।

 ও কান্নামিশ্রিত গলায় বলল, বলে যান। দয়া করে আমাকে সব বলুন।

ব্যাপারটা একটু সহজভাবে নাও। আমি বললাম, আমার খুব খারাপ লাগছে কেননা দুঃখজনক খবরটা আমিই তোমাকে দিয়েছি। আমি নিজেও খুনের ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত করছি, আর তুমি আমাকে যথাসম্ভব সাহায্য কর। এখন শোন…।

কথার মাঝখানেও হঠাৎলাফিয়ে উঠে পাশের ঘরে চলে গিয়ে দড়াকরেদরজাবন্ধ করে দিল। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে লিফটে করে পরের তলায় নেমে চুপচাপ অপেক্ষা করলাম। কয়েক মিনিট পরে ওর ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেলাম। খানিকক্ষণ পর আবার মজা বন্ধ করার শব্দ পেলাম। আমি সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে ওপর তলায় এসে ওর দরজায় কান পাতলাম। কিছুক্ষণ পর টেলিফোন ডায়ালেরশব্দ এবংতারপর খুবনীচু গলায় চটপটুকাউকেকিছুবলার আওয়াজ পেলাম। আমি তাড়াতাড়ি নীচে নেমে কোলাহলমুখর রাস্তার উল্টোদিকে এলাম। সেখানে একটা ক্যামেরার দোকানের শো-কেস-এখুবকমদামীএকটাক্যামেরা দেখার ছলকরেকাছেমু-হাই-তন-এরবাড়ির দরজার প্রতিচ্ছবির দিকে লক্ষ্য রাখছিলাম। প্রায় মিনিট দশেকঅপেক্ষাকরেওসব আশা ছেড়ে দিয়ে। যখন চলে যাব ভাবছি, ঠিক তখনই দেখলাম ও পোষাক পরিবর্তন করে, কালো কস্টিউম আর ট্রাউজার পরে, রাস্তায় এসে খুব সন্তর্পণে এদিক-ওদিক চেয়ে সমুদ্র এলাকার দিকে হাঁটা লাগাল। আমিও ওকে অনুসরণ করে চললাম।ও একটা ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে এসে ড্রাইভারকেকিছুবলল, তারপর ট্যাক্সিতে উঠে বসল। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় এসে পড়ল।

আমারও ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। স্ট্যান্ডের দ্বিতীয় ট্যাক্সির ড্রাইভারকে মোটামুটি ভাবে ইংরেজীতে বোঝাতে পারলাম যে সামনের ট্যাক্সিটাকে অনুসরণ করতে হবে তাহলে ওকে আমি কুড়ি হংকং ডলার দেব। ট্যাক্সিতে চড়ার সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার জোরে ছেড়ে দিল, মুহাই-তন এর থেকে আমার ট্যাক্সিটা গজ পঞ্চাশেক দূরে।

ওর ট্যাক্সিটা স্টার ফেরি স্টেশনেএসে থামল, ও ট্যাক্সি থেকে নেমে এগোতে থাকল, আমিও ওর পেছন পেছন ঘাটে এলাম। ও ফেরিঘাটের থার্ড ক্লাসে, আমি ফার্স্ট ক্লাসে উঠলাম। বোট আমাদের কউলুন সিটি জেটিতে নামিয়ে দিল। সামনেই কাই-তাক এয়ারপোর্ট।

ফেরিঘাট থেকে ও একটা রিক্সা নিল। আমি ভাবলাম এই ভীড় রাস্তায় হেঁটে গেলেই বোধহয় ওকে চোখেচোখে রাখতে পারব। কিন্তু এটা আমার খুব ভুল হল। ওর রিক্সা চালক খুব জোরে রিক্সা চালাচ্ছিল, ওকে লক্ষ্য রাখতে ঐ ভীড় রাস্তার মধ্য দিয়ে আমাকে ছুটতে হচ্ছিল। চীনারা হয়তো ভাবছিল আমি একটু ক্ষ্যাপাটে, যাইহোক, ওকে ধরলাম অতি কষ্টে।

একটা সরু রাস্তার সামনে রিক্সা থেকে নেমে ও একটা সরু নোংরা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমি জানতাম এই রাস্তা দিয়ে পাঁচিলঘেরা কউলুনের পুরোনো শহরে যেতে হয়।

বস্তুতঃ হংকং-এর এই এলাকাটা রেড চীনাদের একটা বড় ঘাঁটি। ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে খুনী, অপরাধী, নেশাখোরদের আস্তানা ছিল। অবস্থা এখন আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাওয়ায় দিনরাত পুলিশ এখানে টহল দেয়। ইউরোপীয়রা এখানে ঢুকতে পারেনা বা আসতেও চায়না।

আমি ওর পেছন পেছন চললাম। ঐ সরু নোংরা গলিতে হঠাৎ লুকিয়ে পড়া সম্ভব ছিল না। ও পেছন ফিরলেই আমাকে দেখতে পেত কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তাকায়নি। আমি ওর থেকে গজ কুড়ি পেছনে ছিলাম। নেশাগ্রস্ত চীনাগুলো আমার দিকে একবার করে তাকিয়ে এমনভাবে চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল যেন আমি অস্পৃশ্য।

হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা একটা দরজার সামনে এসে থামল। তারপর দরজাটায় ধাক্কা মেরে ঢুকে গেল ভেতরে। আমি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম। বেশ কিছু চীনা আমাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছে। যদিও ওদের মুখগুলো নেশাগ্রস্থ, ফ্যাকাসে। আমার মনে হচ্ছিল এরা শুধুশূন্যদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েই আছে। ঠিক দেখার দৃষ্টি দিয়ে দেখছে না। তবু একটা ভয়ের স্রোত আমার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল।

আমিও ঠেলা মেরে দরজাটা খুললাম। ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। একটা মেয়ের অস্পষ্ট গলা আমার কানে এল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠলাম।

আমার ঠিক সামনের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা লোকের গলা শুনতে পেলাম, দেখ শালী, হলদে চামড়ার বাচ্চা, যদি মিথ্যে বলিস আমি তোকে মেরে ফেলব। উচ্চারণটা আমেরিকান।

–লোকটা আমাকে তাই বলেছে, মু-হাই-তনের কাঁপা গলার স্বর শুনলাম।ও বলছে, লোকটা আমাকে বলেছে, প্যাসাডোনা সিটিতে পৌঁছবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ও খুন হয়।

আমার ঠিক পেছনে খুব ঠাণ্ডা, ভারী চীনা গলার আওয়াজ পেলাম, একদম নড়বেন না, মিঃ রায়ান। স্বরটা শুনে আমি লোকটাকে চিনতে পারলাম না।

আমি না নড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

দয়া করে কোন বেয়াড়াপনা না করে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকুন। আপনার পেছনে আমার হাতে একটা পিস্তল আছে। আমি এক-পা এগিয়ে দরজায় একটা ঠেলা মারলাম, দরজা খুলে গেল।

একটা নোংরা খালি ঘর। একদিকে কাঠের বেঞ্চ। আর এক কোণে একটা প্যাকিং বক্স-এ ওপর একটা পোড়া কেটলী আর কতগুলো নোংরা চায়ের কাপ। দেওয়ালে একটা হকে একট। তোয়ালে, ঠিক তার তলায় একটা বেসিন।

ঘরের মেঝেতে চোখ পড়তে দেখি মু-হাই-তন আর একজন রোগা, খবুটে চেহারা, পরনে ময়লা চীনাদের পোশাক, মাথায় কালো টুপী পরা একজন ইউরোপীয় লোক বসে। আমাকে দেখে মু-হাই-তন চীৎকার করে উঠল। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখ চেপে ধরে এক ঠেলা মেরে আমার পায়ের কাছে ফেলে দিলো।

চুপ খচ্চরী। মেরে ফেলব। তারপর আমার পেছনের লোকটাকে বলল, তুমি একে এখানে এনেছো কেন? যাও বেরিয়ে যাও।

–আপনি আরো ভেতরে ঢুকে যান মিঃ রায়ান।আমার পেছনের লোকটা বলল। আমি আমার পিঠে পিস্তলের স্পর্শ পেলাম।

মেয়েটা হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এক দৌড়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল। আমার দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে কয়েকবার তাকিয়ে গেল।

আমি কথামতো আরো ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলাম। লোকটা আমার দিকে একদৃষ্টে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমি এক ফাঁকে পেছন ফিরে আমার পেছনের লোকটাকে দেখে নিলাম। ওয়ং-হপ-হহ, আমার সেই ইংরেজী বলিয়ে গাইড যেন অনুতপ্ত হয়েছে, সেইভাবে মৃদু হাসল। ওর ডানহাতে ধরা পয়েন্ট-ফোর-ফাইভ কোল্ট রিভলভার আমার পিঠে ঠেকান।

আমার সামনের লোকটা অত্যন্ত নোংরা দেখে মনে হল অধভুক্ত এবং অসুস্থ। দাড়ি কামায় নি, গা দিয়ে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। ঐ লোকটা ওয়ংকে বলল, দেখ ওর কাছে কোন অস্ত্র আছে কিনা।

ওয়ং আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা খুঁজে আমার রিভালভারটা বের করে নিল, তারপর দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।

আমার মনে হল আমার সামনের লোকটা ফ্রাংক বেলিং। এছাড়া অন্য কেউ নয়।

—আপনি বেলিং? আমি প্রশ্ন করলাম, আমি আপনাকে খুঁজছি।

-খুব ভাল কথা, তা আমাকে তো পেয়ে গেছেন। তবে আপনার এতে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয়না।

আমি ওয়ং-এর দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি তোমার কথা ভাবছি, সেই এয়ারপোর্ট থেকেই তুমি আমাকে ধাওয়া করেছে। আমার এ ব্যাপারটা লক্ষ্য না করে খুব বোকামী হয়েছে। কী করে খবর পেলে আমি এখানে আসছি?

ওয়ং খিলখিলিয়ে হেসে জবাব দিল, খবর কি আর পাওয়া যায়, খবর রাখতে হয়। আপনার এখানে আসা একদমই উচিৎ হয়নি।

কী আর করা যাবে, এসে যখন পড়েছি, আমি বললাম, আর আমার কাজটাই কৌতূহলী হওয়া।,

–আপনি কী চান? বেলিং প্রশ্ন করল।

জো-অ্যানকে কেন খুন করা হয়েছে আমি সেটা জানতে এসেছি। এখানে সে সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে দেশে ফিরে যাব।

-তাই নাকি, ও মারা গেছে? বেলিং বলল।

হ্যাঁ,..সে মারা গেছে,

মাথা থেকে টুপীটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, রোগা শিকের মত আঙুলগুলো দিয়ে চুলে একবার হাত চালিয়ে বলল, ও কী করে মারা গেল?…আমাকে পুরো ঘটনাটা বলুন।

আমি সেই ভুতুড়ে টেলিফোন থেকে শুরু করে সংক্ষেপে পুরো ঘটনাটা ওকে বললাম। আমি ওকে এও বললাম যে মিঃ জেফারসন অ্যানের খুনীকে খুঁজে বের করার জন্যে আমাকে নিয়োগ করেছেন। আমি আরো বললাম, উনি বলেছেন ওঁর ছেলে বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই জো-অ্যানের খুনীকে খুঁজে বের করত। সুতরাং সেই কাজটুকু অন্ততঃ তার করা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন।

বেলিং বলল, পুলিশ কেন খুনীকে খুঁজে বের করছেনা?

–ওরা খুঁজে পাচ্ছেনা। অবশ্য আমিও এখনও কোন কিনারা করতে পারিনি। তাই আপনাকে খুঁজছিলাম।

কী করে ভাবছেন যে আমি আপনাকে সাহায্য করব? বলতে বলতে বেলিং ওর রোগা ভাঙ্গা গালের ঘাম মুছল। গলা শুনে মনে হল বেশ ভয় পেয়েছে।

আপনি আমাকে হেরম্যান জেফারসন সম্বন্ধে কিছু জানাতে পারেন? সেও কি আপনার এই মাদকের চোরাচালানের দলে ছিল?

আমি জেফারসন সম্বন্ধে কিছু জানিনা। জেফারসন মারা গেছে ও মৃতই থাকুক। আপনি এখন এখান থেকে বেরিয়ে যান।

আমার অসতর্কতায় আমাকে ভুগতে হল।

আমি দেখলাম বেলিং, ওয়ং-কে ইশারায় কিছু বলল আর আমি বেরোবার জন্যে ঘুরতেই ওয়ং পিস্তলের ব্যারেল দিয়ে আমার তলপেটে সজোরে আঘাত করল, তারপর আমি যন্ত্রণায় কাতরে উঠতে পিস্তল-এর বাঁট দিয়ে আমার মাথার ঠিক মাঝখানে একটা আঘাত করল।

.

৩.৩

 আমি যেনকাউকে খুব আস্তে আস্তে বলতে শুনলাম, ফ্রাংক বেলিংইংরেজ, তাইনা?সঙ্গে সঙ্গে আর একটা গলা মনে হল যেন চীফ-ইন্সপেক্টর ম্যাকার্থীর গলা, উত্তর করল, হা…ও ইংরেজ।

কিন্তু ঘোরের মধ্যেও আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ঐ বোগা, নোংরা, আমেরিকান ঢং এ ইংরেজী বলিয়ে লোকটা একজন ইংরেজ হতে পারে।

মাথায় তীব্র যন্ত্রণা চাগাড় দিয়ে সব চিন্তা আমার ভণ্ডুল হয়ে গেল।

চোখ খুলে দেখলাম গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছি। নাকে পরিচিত গন্ধ পেয়ে বুঝলাম, আমি–সেখানেই আছি। মাথায় হাত দিতেই তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলাম। আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। দেওয়াল ধরে হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুঁজে পেয়ে বাইরের বারান্দায় বের হলাম। ওখানে মৃদু আলো রয়েছে। আর নীচে গলিতে শুনতে পেলাম কিছু চাপাকণ্ঠস্বর। হাতের ঘড়িটা দেখলাম। মাঝরাত পেরিয়ে পাঁচ মিনিট হয়েছে। তার মানে আমি আধঘণ্টার মতো অজ্ঞান ছিলাম।

এই এতক্ষণ সময়ের মধ্যে বেলিং আর ওয়ং-এর পালিয়ে যেতে কোন অসুবিধাই হয়নি, এতে কোন সন্দেহ নেই।

সিঁড়ির দিকে এগোতেই কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠছে শব্দ পেলাম। কোটের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে শুধু খাপটা হাতে ঠেকল। এক ঝলক তীব্র আলো চোখে এসে পড়ল। আপনি এখানে কি করছেন। পরিচিত স্কটিশ গলা।

–এই একটু ঘুরছি। বেশ রসিয়ে জবাব দিলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি এখানে কি মনে করে?

সার্জেন্ট হ্যামিশ আর একজন চীনা পুলিস অফিসার ওপরে উঠে এল।

–আপনার একটু দেরী হয়ে গেল। আমি এতক্ষণ একাই আপনার বন্ধু বেলিং-এর সঙ্গে কথা বলছিলাম।

–ফ্রাংক বেলিং? রীতিমত উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল, কোথায় সে?

–পালিয়েছে। আমার মাথার পেছন দিকটা দেখিয়ে বললাম, ওর একটা চীনা দোসর আমার সঙ্গে একটু ইয়ার্কি করেছে। হ্যামিশ ওর ফ্লাশলাইট দিয়ে ক্ষতস্থানটা দেখে আঁতকে উঠল।

উঃ! নিজের চোখে দেখলেন? হংকং-এর সবচেয়ে নোংরা এলাকা। আমার পাশ দিয়ে সে ঘরের ভেতর ঢুকে সব জায়গায় আলো ফেলে বেরিয়ে এল।

চীফ ইন্সপেক্টর আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন। চলুন, যাওয়া যাক।

-উনি আমার সঙ্গে ছাড়াও চীনা মেয়ে মু-হাই-তন-এর সঙ্গেও কথা বলতে চাইবেন। এই নিন ওর ঠিকানা-আর তাড়াতাড়ি যান, নইলে উড়ে যাবে। আমি হ্যামিশকে ঠিকানা দিলাম।

–ওর সঙ্গে ঐ মেয়েটার কী সম্বন্ধ আছে?

–ওকে অনুসরণ করেই আমি বেলিং-এর খোঁজ পেয়েছি। তাড়াতাড়ি করুন,নইলে পালাবে।

সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিসটাকে ক্যান্টনীজ ভাষায় কী যেন বলল। সে বলল, আসুন আমরা এগোই। আমি ওর কথামতো নীচে নেমে সেই অন্ধকার, নোংরা গলি দিয়ে পুলিসটাকে অনুসরণ করে এগোতে লাগলাম।

আধঘণ্টা পরে আমরা চীফ ইন্সপেক্টর ম্যাকার্থীর অফিসঘরে পৌঁছলাম। রেডিও টেলিফোনে ওকে ওরা বিছানা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে বলে বেশ অখুশী মনে হচ্ছে। মাথার যন্ত্রণাটা কষ্ট দিচ্ছে। আমাদের সামনে দুকাপ চা রাখা আছে। চা-টা খেয়ে অনেকটা চাঙ্গা মনে হল নিজেকে।

সার্জেন্ট হ্যামিশ দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত খুঁটছে আর আমাকে লক্ষ্য করছে।

ম্যাকার্থী ওর পাইপ অন্যমনস্কভাবে টানতে টানতে আমার কাছে পুরো ঘটনাটা শুনল। আমি অবশ্য সিলভার বের ঘটনাটা বাদ দিয়ে, (কেননা আমি জানি তাহলে ব্যাটা ক্ষেপে যাবে) ওকে কিভাবে মাদাম-এর মাধ্যমে মুন-হাই-নকে পাকড়াও করলাম এবং জো-অ্যান এর মৃত্যু সংবাদ শুনে ওর প্রতিক্রিয়া সব খুলে বললাম।

আমি বললাম, আমার ধারণা ছিল ও জো-অ্যান-এর মৃত্যুসংবাদ শুনে হয়ত পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে, তাই রাস্তার ধারে অপেক্ষা করে ওর পিছু নিয়ে নিয়ে ঐনরকে গিয়ে ঢুকলাম। আমি ম্যাকার্থীকে ঐনরকে কিভাবে ওয়ং-আবির্ভূত হল এবং বেলিং-এর সঙ্গে ওর কথাবার্তা এবং তারপর ওয়ং আমাকে কিভাবে আঘাত করল সব বললাম। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে আমার কথাগুলো শুনে ম্যাকার্থী বলল, এসবের আগে আমাকে জানানো উচিত ছিল আপনার।আমি ওরকথা এড়িয়ে গেলাম।

ম্যাকার্থী কিছু চিন্তা করতে লাগল। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। খুব তাড়াতাড়ি ফোন তুলে নিয়ে কথা শুনল। তারপর বলল, ঠিক আছে, নজর রাখো। মেয়েটাকে আমার চাই।

আমি মনে মনে হাসলাম এজন্য যে, ঐ মেয়েটা নিজের ঘরে বসে থাকবে বা ফিরে আসবে ম্যাকার্থীর কাছে। তবে একটা কথা ভেবে শিউরে উঠলাম, ওর আবার লেইলার মত অবস্থা হবে না তো?

মেয়েটা এখনও ওর ঘরে ফিরে আসেনি, তবে আমরা ওর ঘরের ওপর নজর রাখছি এবং অন্যত্রও খুঁজছি। আমার দিকে চেয়ে ম্যাকার্থী বলল।

–আপনার কাছে ফ্রাংক বেলিং-এর কোন ফটো আছে? আমার মনে হচ্ছে ঐ লোকটা একজন আমেরিকান, ও বেলিং নয়। আমি বললাম।

ম্যাকার্থী আগের তুলনায় একটু বেশিই আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি বলার সঙ্গে সঙ্গে ড্রয়ার খুলে পেটমোটা একটা ফাইলের ভেতর থেকে একটা খাম বের করে হাফ-প্লেট সাইজের একটা ফটো আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। ফটোটা দেখে আমি একেবারে খ মেরে গেলাম। এ একেবারে সেই ফটো যা আমাকে জেনেৎ ওয়েস্ট দিয়েছিল। যে ফটোটা দেখিয়ে জেনেৎ বলেছিল এই হচ্ছে হেরম্যান জেফারসন।

–আপনি কি নিশ্চিত যে এ ফ্রাংক বেলিং?

 ম্যাকার্থী আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, নয় তো কি? এটাই তো ওর পুলিস ফটোগ্রাফ। আমরা ওকে ধরার যখন ঠিক করেছিলাম, তখন কাগজেও এর অনেক কপি বেরিয়েছিল। হ্যাঁ, এই হচ্ছে ফ্রাংক বেলিং।

কিন্তু আমি যার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তার সঙ্গে এর তো কোন মিল নেই। ও নিজেকে বলেছিল ফ্রাংক বেলিং।

ম্যাকার্থী খানিকটা চা খেয়ে পাইপ ভরতে ভরতে আমার দিকে খানিকটা অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তাহলে যার সঙ্গে আপনি কথা বললেন ও কে ছিল?

আমি বললাম, আপনি কোনদিন হেরম্যানকে দেখেছেন? ম্যাকার্থী বলল, হ্যাঁ…কেন?

–ওর ফটোগ্রাফ আপনার কাছে আছে?

না…ওতো আমেরিকান নাগরিক। ওর ফটো আমরা কেন রাখতে যাবো?

–আপনি দয়া করে বলুন…ওকে দেখতে কেমন ছিল?

–রোগা, পাতলা, বেশ চোখা চেহারা, বালি রং-এর চুল, ম্যাকার্থী খুব চটপট জবাব দিল।

–যে রকম বিবরণ দিচ্ছেন, তাতে যে লোকটা নিজেকে বেলিং বলে পরিচয় দিয়েছে, তার সঙ্গে একেবারে মিলে যাচ্ছে।

ম্যাকার্থী কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর গভীর ভাবে বলল, জেফারসন মারা গেছে। পথ দুর্ঘটনায় ওর মৃত্যু হয় এবং ওর মৃতদেহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমি বলছি, জেফারসন বেঁচে আছে। অন্ততঃ দু-ঘন্টা আগেও ও বেঁচে ছিল, আপনার বর্ণনার সঙ্গে ওর চেহারা বহু মিলে যাচ্ছে। আমি বেশ জোরের সঙ্গে বললাম।

কিন্তু…মোটর গাড়িতে যে দেহটা পাওয়া গিয়েছিল সেটা তো জেফারসনের সঙ্গে মিলে…অবশ্য দেহটা যেভাবে পুড়ে গিয়েছিল তাতে বোঝা মুশকিল ছিল। কিন্তু ওর স্ত্রী ওর আংটি আর সিগারেট কেস দেখে ওকে সনাক্ত করে। আমি কিন্তু এখনও বিশ্বাস না করার কোন কারণ দেখছি না যে ওই জেফারসন ছিল।

–ঠিক আছে, আমি যে লোকটার সঙ্গে কথা বলেছি, ধরলাম ও যদি জেফারসন না হয়, তবে ও কে ছিল? আমি প্রশ্ন করলাম।

–আমাকে জিজ্ঞেস করছেন? আমি তো বলেছি জেফারসন যে বেঁচে আছে, এমন ধারণা। করার কোন কারণ এখনও পর্যন্ত দেখছিনা।

আপনি বললেন রোগা, লম্বা, বালি রং-এর চুল…আমি বললাম। তারপর একটু চিন্তা করে বললাম, ডান হাতের একটা আঙুল একটু বাঁকা ছিল, হয়ত কখনও ভেঙে গিয়েছিল, ঠিকমত সে করা হয়নি, তাই…।

–ঠিক, ঠিক, এই জেফারসন–হ্যামিশ বলল। আমি অফিসে আসার পর ওকে এই প্রথম কথা বলতে শুনলাম।ও বলল,ঐবাঁকা আঙুলের কথা আমার মনে পড়েছে, ও নিশ্চয়ই জেফারসন।

ম্যাকার্থী ওর পাইপে গভীর একটা টান দিল।

–তাহলে কার ডেডবডি কবর দেওয়া হল? খুব অস্বস্তিভরে বলল, কার বডি আমেরিকা পাঠানো হল?

–আমার ধারণা ফ্রাংক বেলিং-এর বডি পাঠানো হয়েছে। আমি বললাম, কোন বিশেষ কারণে জেফারসন নিজেকে ফ্রাংক বেলিং বলে আমাকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিল।

–কিন্তু, কেন সে তা করবে?

-সেটা আমি বলতে পারছি না। মাথায় হাত বোলাতে গিয়ে যন্ত্রণাটা চাড়া দিয়ে উঠল। উঃ বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। ঠিক আছে। চীফ ইন্সপেক্টর, আমি উঠছি, আমার এখনই বিছানায় যাওয়া দরকার। আমার মাথায় মনে হচ্ছে বেড়ালে আঁচড়াচ্ছে।

–আচ্ছা। আপনি আগে ওয়ং-এর একটু বিবরণ দিন।

-ঐ একই রকম; আর সবচীনারা যেমন দেখতে হয়। আঁটসাট, ঠোঁটে ভারী চেহারা, সোনা বাঁধানো দাঁত।

–হুঁ, ঠিক আছে। আমরা যেমন.ওদের সবাইকে এরকম দেখি, ওরাও তেমনি আমাদের সবাইকে এরকম দেখে।

তারপর হ্যামিশকে বলল, যত লোক লাগে নিয়ে ওর ডেরায় গিয়ে ওকে তন্নতন্ন করে খোঁজ, পাওয়া যাবে বলে তো মনে হয় না, তবু প্রাণপণ চেষ্টা চালাও। আমাকে বলল, মিঃ রায়ান, আপনি আমাদের ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়ে বিছানায় যান।

আমি ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে হ্যামিশের সঙ্গে বেরিয়ে এলাম।

ঐ আড্ডায় জেফারসনকে খোঁজা আর একটা অশরীরীকে খোঁজা একই ব্যাপার। ওখানে কিছু বোঝা যায় না, হয়ত দেখব জেফারসন আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আমি জানতেই পারব না। হ্যামিশ, তেতো গলায় বলল।

–আরে ভাই লড়ে যান না। কিছু তো পেয়েও যেতে পারেন।

বুঝলাম, হ্যামিশ আমাকে মনে মনে বেশ কিছু গালি দিল। যাই হোক, ওকে বিদায় জানিয়ে আমি এসে উঠলাম আমার প্যাকার্ড গাড়িটায়। চলে এলাম রিপালস্ বে-তে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থা আমার।

লিফট চালিয়ে পাঁচতলায় এলাম। ঘরের দিকে এগোতে এগোতে নাইট বয়টাকে দেখতে পেলাম। মৃদু হেসে আমাকে ঘরের চাবি দিল। আমি ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বসার ঘরে এসে জ্যাকেটটা খুলে ফেললাম। এয়ার কন্ডিশনটা চালিয়ে একটু আরাম বোধ করলাম। এই হোটেলে বসার ঘর আর শোবার ঘরের মাঝখানে একটা পর্দার ব্যবধান আছে। হোটেলের সব ঘরেই এই ব্যবস্থা। পর্দা সরিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দেখি আলো জ্বলছে।

একটা মেয়ে আমার বিছানায় শুয়ে আছে। মেয়েটা স্টেলা এনরাইট। সোনালী আর কালো রং-এর ককটেল ড্রেস পরা, বিছানার পাশে ওর দামী জুতো পড়ে রয়েছে।

প্রথমে ওকে দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম কারণ আমার মনে হয়েছিল ও মারা গেছে। তারপর ভাল করে লক্ষ্য করতে দেখি, না, ওর বুক ওঠানামা করছে। ওর দিকে তাকিয়ে দুটো জিনিষ ভেবে অবাক হলাম, এক, ও এখানে কি করছে? দুই,আমার ঘরে ঢুকল কী করে? পরক্ষণেই মনে পড়ল হাসি মাখানো মুখের নাইট-বয়টাকে, স্টেলা নিশ্চয়ই ওকে পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করেছে।

অল্পক্ষণ পরেই ও চোখ মেলে তাকালো আর পা দুটো ঝুলিয়ে উঠে বসল।

–আমি অত্যন্ত দুঃখিত মিঃ রায়ান,–স্টেলা হেসে বলল। ঘুমিয়ে পড়ব বলে ভাবিনি আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি দুঃখিত।

আপনি কি অনেকক্ষণ ধরে আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন? কিছুবলতে হয়, তাই বললাম। দেখলাম ও উঠে জুতো পড়ল, হাত দিয়ে চুল ঠিক করে বসার ঘরে এলো।

–আমি এখানে সেই দশটা থেকে বসে। আপনার জন্যে আমার চিন্তা হচ্ছিল। আশা করি আপনার এখানে এসেছি বলে কিছু মনে করবেন না। স্টেলা হেসে বলল।

আমি কিছু বলার আগেই ও আবার তাড়াতাড়ি বলল, আপনার কী হয়েছিল? আমি তো প্রায় ফেরিটা মিস্ করে ফেলেছিলাম আরকি। আপনি আমার জন্যে অপেক্ষা করলেন না কেন?

–আমার একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, আমি বললাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার সেই চীনা দুটোর, একটার হাঁতে রাইফেল আর একটার সঙ্গে ছুরির কথা মনে পড়ল।

-এখন আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। সিলভার মাইন উপসাগরে যাওয়ার প্রোগ্রামটা কি আপনি ঠিক করেছিলেন?

ও আমার সামনে একটা চেয়ারে এসে বসল। চোখ, মুখে ভাবখানা যেন কিছুই বুঝছে না।

–আমিই প্রোগ্রামটা করেছিলাম…। আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন, বুঝতে পারছি না।

না বোঝার মত কোন শক্ত ব্যাপার এটা নয়। আপনিই আমাকে বলে জলপ্রপাতটা দেখতে পাঠালেন। এটা কি আপনিই ঠিক করেছিলেন? নাকি অন্য কারোর পরামর্শে আমাকে এটা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন? আমি কঠিনভাবে বললাম।

স্টেলা চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি না, আপনি কেন এই প্রশ্ন করছেন। প্রোগ্রামটা আমার দাদা করেছিল। আমার দাদাই বলেছিল আপনাকে ওখানে আমন্ত্রণ জানাতে। ও আরও বলেছিল আপনি একা থাকেন, সুতরাং আপনাকে সঙ্গ দিলে আপনার ভালই লাগবে।

-উনি কি সত্যিই আপনার দাদা?

একথা শুনে স্টেলার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। আমার দিকে একবার তাকিয়েই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

ও কিছু বলল না দেখে প্রশ্নটা আবার করলাম।

–আপনি…এমন একটা প্রশ্ন করছেন যে…আমার দিকে না তাকিয়েই ও বলল, আপনি এরকম প্রশ্ন করছেন কেন?

তার কারণ আপনাদের দুজনের মধ্যে কোন মিল নেই। আমি বললাম, আমি ভেবে পাচ্ছি না যে আপনার মতো একটা মেয়ে দাদার সঙ্গে থাকতে চাইবে কেন?

আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে কি যেন ভেবে বলল, না ও আমার দাদা নয়। আমার সঙ্গে ওর পরিচয় গত কয়েক মাসের। এখন মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে আমার পরিচয় না হলেই বোধহয় ভাল হত।

আমি আমার প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে ওকে একটা দিলাম আর নিজে একটা ধরালাম। চেয়ারে হেলান দিয়ে বেশ আরাম করেবসেও একটা বড় টান দিল। আমি আমার শোবার। ইচ্ছে ত্যাগ করলাম।

–আপনার সঙ্গে ওর আলাপ হয় কোথায়? আমি প্রশ্ন করলাম।

সিঙ্গাপুরে। আমি ওখানে একটা নাইট ক্লাবেক্যাবারেনাচতাম, নিউইয়র্ক থেকে কাজ করতে করতে ওখানে যাই। হঠাৎ একদিন ঐনাইট ক্লাবে পুলিস হানা দিল আর আমি টাকা-পয়সা কিছুই পেলাম না। একেবারে অকূলে ভাসলাম। ও চোখ বুজে বলে যেতে লাগল। এমন বিপদের দিনে আমি হ্যারিকে পেলাম। ও কয়েকবার ঐ ক্লাবে আমার নাচ দেখেছে। ও আমাকে ওর সঙ্গে থাকার প্রস্তাব দিল। ওর টাকাপয়সা এবং অন্যান্য আকর্ষণে ওর প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তখন থেকে আমরা একসঙ্গে থাকতে লাগলাম। ম্যাকরিটি রিজার্ভয়ের পাশে ওরবাংলোটা ছিল ছিমছাম সুন্দর। আমরা ওখানে বেশ ভালই ছিলাম। তা হলেও আমি দেশে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। ও একবার চোখ খুলে সিগারেটটা দেখে নিল। কিন্তু হ্যারি আমাকে যাওয়ার ভাড়া দিল না। এমন সময় হঠাৎ ও এখানে মানে হংকং-এ চলে এল। আমার জন্যে একটা জাল পাসপোর্ট যোগাড় করল। আমরা সেই থেকে ভাই-বোন এই পরিচয়ে বসবাস করতে লাগলাম। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আমি এখনও বাড়ি ফিরে যেতে চাই। আপনি আমাকে টাকাটা ধার দেবেন? কথা দিচ্ছি কয়েকমাসের মধ্যে শোধ করে দেব।

–হ্যারি ফল পাসপোর্ট কিভাবে জোগাড় করল?

ও মাথা নাড়ল। বলল, সে সব আমি জানি না। আপনি আমাকে টাকাটা ধার দেবেন কিনা বলুন।

–আমি এভাবে টাকা ধার দিইনা।

–ঠিক আছে, আমার ওপর আপনার ভরসার অভাব থাকলে আমরা একসঙ্গে ফিরব, বলে ও হাসল। কেন যেন মনে হল ও ভয় পেয়েছে। ওর চোখ-মুখে সেইরকম একটা ভাব। তারপর আবারও বলল, আর আমি… এই টাকার উপযুক্ত দাম দেবার চেষ্টা করব। আমি কি বলতে চাইছি, আশা করি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।

–এখন আমি একটু ড্রিঙ্ক করব। আমি বললাম। আপনার জন্যে কিছু বলব? আমি প্রশ্ন করলাম।

ও চেয়ারে তাড়াতাড়ি খাড়া হয়ে বসে চোখ বড় বড় করে বলল, না, না, এ ঘরে কাউকে আসতে দেবেন না। আমি চাই না কেউ জানুক আমি এ ঘরে আছি।

নাইট বয়টা জানে, ওই তো আপনাকে এ-ঘরে ঢুকতে দিয়েছে, তাই না?

না। আমি আপনার ঘরের নম্বর জেনে বোর্ড থেকে চাবি নিয়ে এসেছি। দুটো চাবি ছিল, ও জানে না আমি এখানে আছি।

আমি আমার মাথার যন্ত্রণা ভুলে গেলাম।

আমি বললাম, আপনি কেমন একটা ভয় পাচ্ছেন, যেন?

চেয়ারে ও আরাম করে বসে আমার দিকে চেয়ে বলল, কই, নাতো, আমি ভয় পাচ্ছিনা। আমি এখান থেকে দূরে চলে যেতে চাইছি। আমার বাড়ির জন্যে ভীষণ মন খারাপ করছে।

হঠাৎ এখনই আপনি বাড়ির জন্যে এত উতলা হচ্ছেন কেন?

–আপনি এত প্রশ্ন করবেন না আপনি আমায় টাকাটা দেবেন? আপনি যদি টাকাটা দেবেন বলে কথা দেন, তাহলে এখনই আপনার সঙ্গে সোব। স্টেলা বলল।

টাকাটা আমি আপনাকে দেব, যদি আপনি হ্যারি এনরাইটের সম্বন্ধে আমাকে সব জানান।

একটু ইতস্ততঃ করে ও বলল, আমি ওর সম্বন্ধে বেশি কিছুই জানি না। সত্যি বলছি, ও খুব ফুর্তিবাজ…হৈ চৈ করে থাকার লোক।

আমার পক্ষে ধৈর্য ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, ঠিক আছে আপনি যদি এনরাইটের সম্বন্ধে এটুকুই জানেন, তাহলে আপনাকে টাকা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আমি টেলিফোনের দিকে যেতে যেতে বললাম, আমি এখন ড্রিংক অর্ডার দিচ্ছি। সেটা খেয়ে আমি বিছানায় যাবো এবং একা। সুতরাং ওয়েটার আসার আগে আপনি ঘর ছেড়ে চলে যেতে পারেন।

না, দাঁড়ান। স্টেলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল।

 আমি টেলিফোনে একবোতল স্কচ আর বরফ আমার ঘরে দিয়ে যেতে বললাম।

আমি রিসিভার রাখতেইও বলে উঠল, আমি হ্যারি সম্বন্ধে যা জানি বললে, আপনি সত্যিই আমাকে টাকাটা দেবেন?

–হ্যাঁ, সেইরকমই বলেছিলাম। আমি বললাম।

–আমার মনে হয় ও একজন মাদক দ্রব্যের স্মাগলার। ও খুব অস্বক্তির সঙ্গে হাত কচলাতে কচলাতে বলল।

-আপনার এরকম মনে হল কেন?

–লোকজন ওর সঙ্গে রাত্রে দেখা করতে আসে। সিঙ্গাপুরে থাকার সময়ও দেখেছি। ও প্রায়ই ডকে গিয়ে খালাসীদের সঙ্গে দেখা করত। পুলিসের সন্দেহ হওয়ায় আমাদের বাংলোতে রেইড করেছিল, যদিও তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পায়নি। যাই হোক, এখানেও লোকজন আসে রাত্রে এবং তারা সকলেই চীনা।

–আপনারা আসার আগে জেফারসন ঐ বাংলোতে থাকতো?

-হ্যাঁ। আমাকে হ্যারি একথা কাউকে বলতে বারণ করে দিয়েছিল। জেফারসন মারা গেলে হ্যারিকে ওর জায়গায় সিঙ্গাপুর থেকে আনা হয়। মাদক দ্রব্য আনা এবং পাচারের জন্য আমাদের বাংলোটা উপযুক্ত জায়গা।

দরজায় মৃদু একটা টোকা পড়লা

–ওয়েটার এসে গেছে, আমি বললাম। আপনি বাথরুমে গিয়ে অপেক্ষা করুন।

 স্টেলা বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করার পর আমি গিয়ে দরজা খুললাম।

দরজার বাইরেই হাসি হাসি মুখে হ্যারি এনরাইট দাঁড়িয়ে। ওর হাতে একটা পয়েন্ট থ্রী এইট অটোমেটিক রিভলভার আমার দিকে তাক করা।

নড়ার চেষ্টা করনা, টিকটিকি। ও বলল, হাত দুটো তুলে দাঁড়াও। ঘরে ঢোক।

আমি হাত তুলে ঘরে ঢুকে পড়লাম।

–কোন হৈ-চৈ করার চেষ্টা কর না। ওয়েটারকে বলেছি তুমি মত বদল করেছ। কাজেই ও আর এখন আসবে না। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে হ্যারি বলল।

–ঠিক আছে, বসতে পারিতো? আমি বললাম উত্তেজনাটা আমার পক্ষে একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে।

আমি বসে হ্যারিকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। ওর মুখে স্থির হাসি, চোখের দৃষ্টি ঠাণ্ডা এবং ভয় জাগানো। আমি সতর্ক হলাম। রিভালভারটা শক্ত হাতে ধরা আর তাক করা আমার দু-চোখের মাঝখানটায়।

এনরাইট বলল, তুমি বেশ স্মার্ট এবং একটু বেশিই স্মার্ট। গত তিন সপ্তাহ ধরে আমি যা খুঁজছি সেটা তুমি আমার আগেই পেয়ে গেন্ত্রে?

–কি সেটা? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

–তুমি জেফারসনকে খুঁজে বের করেছা ঐ কুত্তার বাচ্চাটাকে আমি কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারছিলাম না। শেষে তোমার ওপর নজর রাখতে রাখতে ওর খোঁজ পেলাম। উঃ! আমি, ওর জন্যে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।

 যাই হোক আমি তো তোমাদের পেছনে লাগিনি। তুমি দয়া করে পিলটা সরাবে? আজ সারাটা দিন আমার খুৰ খাটুনী গেছে, এরপর ওটার ধকল…। হ্যারি তবুও পিস্তল না সরিয়ে ঘরের ভেতরে একটা চেয়ারে এসে বল যে চেয়ারটায় কয়েক মিনিট আগে স্টেলা বসেছিল।

-পিতলের জন্যে কিছু চিন্তা কোরনা। উল্টো-পাল্টা কিছুনা করলে পিস্তলও তোমার সঙ্গে অভদ্রতা করবে না। এখন বল, পুলিসকে তুমি কী বলেছে? হ্যারি প্রশ্ন করল।

–পুলিসকে আমি কিছু বলেছি এটা তুমি ভাবছে কেন? আমি বললাম।

–যে মুহূর্তে তুমি পেডালে নিয়ে আমার ভিলার সামনে ঘুরতে ঘুরতে আগ্রহ দেখিয়েছিলে, সেই মুহূর্তে থেকে আমাদের লোকেরা তোমার ওপর থেকে চোখ সরায়নি। হ্যারি বলল।

–আমাদের লোকেরা মানে তোমাদের ঐ মাদকদ্রব্য চালানকারী লোকেরা?

— হ্যাঁ। এটা খুব বড় ব্যাপার…তোমার পক্ষে তো খুবই বড়। আমি ভেবেছিলাম লোক দুটো তোমাকে ঘাবড়ে দিয়েছে। অবশ্য দিলে ভাল হত না। তুমি যে জেফারসনুকে খুঁজে বেড়াচ্ছো সেটা আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি।

না, জেফারসনকে আমি খুঁজছিলাম না…আমি ভেবেছিলাম ও সত্যি সত্যিই মারা গেছে। আমি বললাম।

আমরাও তাই ভেবেছিলাম। হারামীটা আমাদের ধোঁকা দিয়েছে। আমরা বেলিংকে খুঁজছিলাম। তারপর তোমার পিছু নিয়ে আমরা জেফারসনকে পেয়ে গেলাম।

আমি ভাবছিলাম স্টেলা বাথরুমে এখন কি করছে। ওর দিকে চেয়ে বললাম, তাহলে তোমরা ওকে পেয়ে গেছ?

ক্রুর হেসে হ্যারি জবাব দিল, হ্যাঁ, আমরা ওয়ং-কেও পেয়েছি।

ওয়ং কে? আমি প্রশ্ন করলাম।

–ওয়ং আমাদের দলের একজন দলছুট চামচা ও ব্যাটা জেফারসনের চামচাগিরি করছিল। ঠিক এই মুহূর্তে ওদের আচ্ছা করে দলাই-মলাই করা হচ্ছে। তারপর ওদের শরীরের অবশিষ্ট সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে।

-ওরা তোমার কী করেছে?

দলছুটদের আমরা এইভাবেই শাস্তি দিই। এনরাইট বলল, এবং তুমি সেটা ভেবেই বল, পুলিসকে তুমি কি বলেছে?

ওরা যা জানে, তার থেকে নতুন কিছুই না। আমি বললাম।

আমার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে ও উঠে দাঁড়াল।

-ঠিক আছে চল আমরা কিছুটা হেঁটে গাড়িতে উঠব। তুমি যদি পালাবার চেষ্টা কর, জেনে রাখবে সেটাই তোমার শেষ চেষ্টা। আমার চারজন লোক বাইরে অপেক্ষা করছে। ওদের প্রত্যেকের কাছে ছোরা আছে। ওরা চল্লিশ গজ দূর থেকেও তোক খুন করতে পারে। আর তোমার মৃত্যুর খবর কেউ পাওয়ার আগেই ওরা কয়েক শো মাইল দূরে চলে যেতে পারে। এটা মনে রেখে চুপচাপ এগোও।

–চুপচাপ হেঁটে গাড়ির দিকে চললাম।

তারপর কোথায় যাব? প্রশ্ন করতে এনরাইট মিচকে হেসে বলল, এখনই এত চিন্তা করার কি আছে, চল দেখতেই পাবে। এস।

দরজার সামনে গিয়ে দরজা খুলে একপাশে দাঁড়িয়ে হ্যারি বলল, নাইট বয় তোমাকে কোন সাহায্য করবেনা। ও আমার হয়ে কাজ করছে। কাজেই বোকার মত কিছু কোর না। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামব। ওখানেও চারিদিকে আমার লোকেরা রয়েছে। বেঁচে থাকতে চাইলে ভালমানুষের মত এগিয়ে চল।

প্যাসেজে বেরিয়ে এলাম। এনরাইট ওর পিস্তল পকেটে ভরে নিয়েছে, কিন্তু হাতে ধরা। আমরা কয়েক পা এগিয়ে সিঁড়ির মুখে এলাম।

এনরাইট বলল, সিঁড়ি দিয়ে নাম, আমি তোমার পেছনে আছি।

চারধাপ সিঁড়ি ভেঙে নীচে লবিতে এসে দেখলাম লবি একবারে ফাঁকা।লাউঞ্জিং চেয়ারে দুজন বসে, তার মধ্যে একজন সার্জেন্ট হ্যামিশ অন্যজনকে আমি আগে দেখিনি। ওদের দেখেই আমি ইচ্ছে করে কার্পেটে পা জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম। সেই মুহূর্তে পেছনে একটা রিভলভার গর্জে উঠল। পর মুহূর্তেই বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটার শব্দের সঙ্গে শুনতে পেলাম, আমার ওপর দিয়ে এক ঝাক গুলি পেছন দিকে চলে গেল। আমি মরার মতো শুয়ে রইলাম।

কিছুক্ষণ পরে জুতোর আওয়াজে চমক ভাঙল।

–উঠে পড়ুন। হ্যামিশ বলল। একটু গড়িয়ে গিয়ে চিৎ হলাম. মাথাটায় কেমন ঘোর লেগে আছে। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম।

দেখলাম, আমার ঠিক পেছনেই এনরাইট চিৎহয়ে পড়ে আছে।বুলেটে মুখটা ক্ষত-বিক্ষত। রক্ত বেরিয়ে গড়িয়ে গেছে। জ্যাকেট দিয়ে তখনও অল্প ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলাম ও মারা গেছে।

-ওকে মেরে ফেলতে হল? হ্যামিশকে বললাম।

না মারলে ও আপনাকে মারত, নিরাসক্তভাবে জবাব দিল। হয়তো আমাকেও মেরে ফেলত।

–এদের দলের আরও কয়েকজন এখানে আছে, আর পাঁচতলার নাইট বয়ও এদের দলের লোক। আমি বললাম।

অন্য পুলিসটা লিফটের দিকে এগোতেই হ্যামিশ বলল, আর সবাইকে ধরার ব্যবস্থা আমি আগেই করেছি। আমাদের টেলিফোন করল মেয়েটা কে?

আমি ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

–একটা মেয়ে ফোন করেছিল? আমি প্রশ্ন করলাম।

–হ্যাঁ, তা না হলে আমরা কী করে জানব এখানে কি হতে চলেছে। একটু উত্তেজিত হয়ে হ্যামিশ আবার জানতে চাইলো, একটা মেয়ে ফোন করেছিল, মেয়েটা কে?

-ঠিক বলতে পারব না। কেউ একজন হবে হয়ত।

–প্রায় আধ ডজন চীনা পুলিস লবিতে নেমে এল। হ্যামিশ ওদের সঙ্গে কথা বলে আমার দিকে তাকাল।

চলুন, হ্যামিশ আমাকে বলল, আপনাকে সব ঘটনা চীফ ইন্সপেক্টরকে বলতে হবে।

 চীনা পুলিসগুলো এনরাইটের মৃতদেহ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।আমরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিসের জীপে গিয়ে উঠলাম।

.

৩.৪

 পুলিস হেডকোয়ার্টারে এসে একটা ঘরে আমি ঘণ্টা তিনেক আটকে রইলাম। ঘরটায় একটা কোচ ছিল, আমি সেটায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোর চারটে নাগাদ ঠেলা খেয়ে ঘুম ভাঙল, দেখি হ্যামিশ, ওকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

–আসুন। ও বলল।

 ওঠার সময় মাথার যন্ত্রণাটা টের পেলাম। ঝাঁকিয়ে উঠলাম, বললাম, কী হবে এখন?

চীফ আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে প্রস্তুত। তাছাড়া আপনি একাই বা ঘুমোবেন কেন? হ্যামিশ বলল।

ম্যাকার্থী ঘরে বসে বসে পাইপ টানছে। হাতের কাছে এক কাপ চা। একটা পুলিস অফিসার আমাকেও এককাপ চা দিয়ে গেল। আমি একটা চেয়ারে বসলাম। ম্যাকার্থী দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাই তুলতে লাগল।

জল পুলিস একজনকে ধরেছে, সে এনরাইটের স্পীডবোট নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ম্যাকার্থী বলল। অনেক ঝামেলার পর, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছে।

–লোকটা কি আমেরিকান?

না, না-চীনা ক্যান্টনের লোক। আপনি যেহেতু জেফারসনের কেসটা দেখছেন, আপনাকে এটা জানিয়ে রাখা ভাল।

ধন্যবাদ, জেফারসনকে কি পাওয়া গেছে?

আধঘণ্টা আগে ওর মৃতদেহ উপসাগরে পাওয়া গেছে। ম্যাকার্থী আমাকে জানালো।

ম্যাকার্থী আবার ক্লিষ্ট হেসে বলল, আমার মনে হয় ও প্রথমবারে মারা গেলেই ভাল হতো। কারণ মেরে ফেলার আগে ওর ওপর প্রচণ্ড দৈহিক অত্যাচার হয়েছে। ব্যাপারটা আমার কাছে এখন অনেকটা পরিষ্কার। কী রকম বলছি, জেফারসন এখানে আসার পর থেকে জো-অ্যানের অসামাজিক উপায়ে রোজগারের পয়সায় দিন কাটাত। মেয়েটাকে ও বিয়ে করেছিল হয়ত ওর মুখ বন্ধ করার জন্যে। যাই হোক, ফ্রাংক বেলিং এর সঙ্গে সাক্ষাতের কয়েক সপ্তাহ পরে ও জো অ্যানকে বিয়ে করে।

বেলিং মাদক চালানের এক নম্বর পাণ্ডা। ও রিপালস্ বের ভিলাটা লিম-ফানের কাছ থেকে ভাড়া নেয়, কিন্তু কী কাজের জন্যে ভিলাটা ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা লিন-ফান হয়ত জানত না। তবে এ ব্যাপারে আমি খোঁজ নিচ্ছি। ভিলাটার একটা ঘাটে, একটা স্পীডবোট রয়েছে, জায়গাটা নির্জন,সুতরাং ঐ ভিলাটা মাল চালান নেওয়ার পক্ষে খুবই আদর্শ স্থান। কিন্তু জায়গাটা কিছুদিনের মধ্যে বেলিং-এর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল। আমরা ওকে অ্যারেস্ট করার সমস্ত ব্যবস্থা নিতে লাগলাম। এটা জানতে পেরে ও ঠিক করল ও ক্যান্টনে পালিয়ে যাবে। আর ব্যাপারটা একটু ঠাণ্ডা হলে ফিরে আসবে।

কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ভিলাতে মাল এনে সেটা নেবার জন্যে জেফারসনকে ও বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠিক করল। তা ওখানে গিয়ে জেফারসন বেশ আরামেই রইল যার জন্যে জো অ্যানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন হল মা। বেলিং ক্যান্টনে গিয়ে দু-হাজার আউন্স হেরোইন পাঠাবার ব্যবস্থা করল। একদিন রাত্রে বেলিং এসে জেফারসনকে বোঝাল মালটা কিভাবে দিতে হবে।

জেফারসন ভাবছিল এই মালটা যদি ও হাত সাফাই করতে পারে তাহলে তার ভাগ্য ফিরে যাবে। কিন্তু পালাবে কি করে! ওদের সংগঠন যে বেশ শক্তিশালী সেটা ও জানত। যাই হোক, বলা যায় ভাগ্য ওর সহায় ছিল। হেরোইন এল, সেটা ভিলাতে মজুত করা হল। তারপর বেলিং আর জেফারসন গাড়ি নিয়ে লেকিপাস-এর দিকে চলল।ওখান থেকে ক্যান্টনে কেটে পড়া সোজা। কিন্তু পথ দুর্ঘটনায় বেলিং মারা গেল। জেফারসন চালাকি করে নিজের আংটি আর সিগারেট কেস ওর পকেটে ঢুকিয়ে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। দুর্ঘটনাটা ভোরবেলা একটা নির্জন এলাকায় ঘটেছিল বলে জেফারসনের কোন অসুবিধা হয়নি। একটা সাইকেল চুরি করে ভিলায় ফিরে এসে হেরোইনটা সরিয়ে সম্ভবতঃ সেলেশিয়াল এম্পায়ার হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল। খানিকটা অনুমান করে বলছি যে, ওখানে ও জো-অ্যানকে বুঝিয়ে অথবা ভয় দেখিয়ে বেলিং-এর মৃতদেহ সনাক্ত করতে বলে। তারপর ও কউলুনের দেওয়াল ঘেরা শহরে আশ্রয় নেয়।

–ও এটা করল কেন? আমি প্রশ্ন করলাম।

–আসলে কাজটা ঝোঁকের মাথায় খুব তড়িঘড়ি করে করেছে। একটা সুযোগ নিতে গিয়ে বুঝল, ও ফেঁসে গেছে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ওরা দলের লোকেরা হেরোইনের খোঁজে ভিলায় গিয়ে দেখে সেটা হাওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই ওর বেলিংকে সন্দেহ করে ও ওর খোঁজে নেমে পড়ে। জেফারসনের সৌভাগ্য যতক্ষণ পর্যন্ত দলের লোকেরা বেলিং-এর পিছনে ছুটবে, ততক্ষণ ওর রাস্তা পরিষ্কার। কিন্তু ওকে হংকং থেকে পালাতে হবে। দেখা গেল, সেটা ওর পক্ষে অসম্ভব। ধরে নেওয়া হয়েছে ও মারা গেছে, কাজেই একটা জাল পাসপোর্ট-এর ব্যবস্থাও করতে পারেনি। কাজেই ও নিজের ফাঁদে আটকা পড়েছিল!

–হেরোইনটা কী হল?

 ম্যাকার্থী চোখ কোঁচকালো।

–আমার মনে হয়না ওটা আমরা পাব বলে। জেফারসনের বডি দেখে আমরা নিশ্চিন্ত যে ওকে মেরে ফেলার আগে ওর ওপর প্রচুর অত্যাচার করা হয়েছে এবং ওরা জেনে নিয়েছে হেরোইনটা কোথায় লুকোনো আছে। ম্যাকার্থী বলল।

কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার সন্দেহ হচ্ছে জো-আন কেন বেলিং-এর দেহ জেফারসনের বাবার কাছে নিয়ে যাওয়ার ঝামেলাটা নিল। আমি বললাম।

–ওর হংকং থেকে চলে আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পয়সা কড়ি ছিলনা।বডিটা আনার মওকায় ও শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা পেয়েছিল। ম্যাকার্থী বলল।

–হু…এটা হতে পারে। আচ্ছা ওয়ং কে?

–সেও ওদের দলের লোক। তবে জেফারসন্দ্রে সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে ভুল করেছে।

এয়ারপোর্টে ওয়ং আমাকে পাকড়াও করে। আচ্ছা আমি যে আসছি, ও জানল কী করে? ও খবরটা পেল কার কাছ থেকে? ওকে যখন আমি, দো-ভাষী নিয়োগ করলাম ও আমাকে তাড়াতাড়ি কউলুন থেকে কাটিয়ে দিল। অবশ্য ও চাইছিল আমি যাতে জেফারসনের থেকে দূরে থাকি। লেইলার সঙ্গে দেখা না হলে আমি এনরাইটের কোন খোঁজই পেতাম না।

–মিঃ জেফারসন কি ওর ছেলের বডি ফেরৎ চাইবেন? ম্যাকার্থী জিজ্ঞেস করল।

আমি বললাম, তাইতো মনে হয়। আমি আমেরিকান কনস্যুলেট-এ মিঃ উইলকক্স-এর সঙ্গে দেখা করে সব কাগজ পত্রের ব্যবস্থা করে রাখব। ওয়ং-এর বডি পাওয়া গেছে?

–এখনও জলে খোঁজ হচ্ছে। যে চীনাটাকে আমরা ধরেছি সে বলেছে দুটো দেহই এক জায়গায় ফেলা হয়েছে।

আমি সপ্রশংস দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম।

ম্যাকার্থী পাইপ দিয়ে নিজের নাকটা ঘষতে ঘষতে বলল, হ্যাঁ, একটা কথা, আপনি বোধহয় জানেন না সিলভার মাইন উপসাগরীয় অঞ্চলে একটা চীনার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। মাথার ঠিক মাঝখানে কেউ লী এনফিল্ড রাইফেল দিয়ে গুলি করেছে, আপনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন?

-তাই নাকি? আর্মির চাকরি ছাড়ার পর থেকে আমি লী এনফিল্ড-এ হাত দিইনি।

–আমি বলছি না গুলিটা আপনি ওকে করেছেন। আপনি তো কাল বিকেলে ওখানে গিয়েছিলেন?

-হা গিয়েছিলাম ওখানকার জলপ্রপাতটা দেখতে।

 –ঠিক ওখানেই বডিটা পাওয়া গেছে।

–হ্যাঁ, তাতে কি হয়েছে?

 –আপনি কোন গুলির আওয়াজ পাননি?

না।

ম্যাকার্থী একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, অবশ্য আমি জানতাম যে আপনি জানতে পারলে নিশ্চয়ই আমাকে জানাতেন।

–ঠিক বলেছেন।

 বেশ খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর আবার ওর পাইপ ভরতে ভরতে ম্যাকার্থী বলল, এনরাইটের একটা বোন ছিল।.বেশ সুন্দরী, আপনি জানেন ও কোথায়?

আমি বললাম, হয়তো ওদের ভিলাতে ঘুমুচ্ছে, যেটা এই মুহূর্তে আমার ভীষণ দরকার।

-ওখানে নেই…আমরা খোঁজ নিয়েছি। আপনি ওকে শেষ কোথায় দেখেন?

–ফেরি বোটে-সিলভার মাইনে যাবার সময়। যে মেয়েটি আগে ওদের বাড়ি কাজ করত তার জন্যে খাবার নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা এক বোটেই ছিলাম।

-তারপরে ওকে দেখেন নি?

না

–আমাদের ধারণা, ঐ মেয়েটিই আমাদের ফোন করেছিল এবং সেটা আপনার ঘর থেকে।

হতে পারে। ওর স্বভাব খুব ভাল। আমি বললাম।

ম্যাকার্থী হঠাৎ হেসে উঠে বলল, ঠিকই ধরেছেন মিঃ রায়ান। আমরা ওর সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওর নাম স্টেলা মে টাইসন। সিঙ্গাপুরে এক নাইট ক্লাবের নর্তকী ছিল। ঘটনাচক্রে এনরাইটের সঙ্গে যোগ দেয়। তারপর একটা জাল পাসপোর্ট বানিয়ে এখানে আসে।

তাই নাকি?

–ও যখন ফোনটা করে তখন আমরা এটা নির্দিষ্ট করি ওটা হোটেল থেকে এসেছে এবং হোটেল থেকে জানতে পারি ওটা আপনার ঘরের বাথরুম থেকে করা হয়েছে। দশটার সময় ওকে আপনার ঘরে যেতে দেখা গেছে এবং এখনও হয়ত ও আপনার ঘরেই আছে।

–থাকতে পারে। ও আমার প্রাণু বাঁচিয়েছে। একটু বিব্রত ভাবে আমি বললাম, কি করে আশা করেন ওকে আপনাদের হাতে তুলে দেব?

–কিন্তু পুলিস অফিসারের কাছে মিথ্যে বলাটাও ঠিক নয়। যাইহোক আপনার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে এবং মাদকপাচারকারীদলটি ধরতে সাহায্য করার জন্যে ওকে আমরা ক্ষমা করার কথা চিন্তা করতে পারি। কিন্তু আপনি ওকে বলে দেবেন যেন আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই স্থান ছেড়ে চলে যায়। তারপরেও ও এখানে থাকলে আমরা অন্য ব্যবস্থা নেব।

ধন্যবাদ, ওকে আমি বলে দেব। মিঃ ম্যাকার্থী আমিও এবার চলে যাচ্ছি। এখানে যে কাজে। এসেছিলাম, তা বোধহয় শেষ হয়েছে। এখন আমার কাজ জো-অ্যানকে কে খুন করল খুঁজে বের করা। তবে, সে লোক প্যাসাডোনায় আছে। এখানে যে সব সূত্র পেলাম, তার ভিত্তিতে ওটার সমাধান করা যাবে। তাহলে এখন আমি চলি।

ঠিক আছে। ম্যাকার্থী বলল।

–এখন হোটেলে গিয়ে স্নান করে লম্বা ঘুম দিতে হবে।

–তবে মেয়েটা যদি এখনও আপনার ঘরে থাকে, তাহলে আপনাকে বেশিক্ষণ ঘুমতে দেবে কিনা সন্দেহ আছে। ম্যাকার্থী ফিচেল হাসি হেসে বলল।

–আপনার আন্দাজের তুলনা হয়না। আমার হোটেলে যাবার জন্যে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারেন?

ম্যাকাধী হ্যামিশের দিকে তাকাল।

–একটা গাড়ি করে ওকে তাড়াতাড়ি হোটেলে পৌঁছানোর ব্যবস্থা কর। ওর একটু বেশিই তাড়া আছে। ও একটা ফাইল টেনে নিল।

হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন মাথার ওপর সূর্যদেব উঁকি মারছেন। করিডোরে অন্য একটা চীনা ছেলে আমাকে চাবি দিল। আমি ঘর খুলে দেখলাম ঘরে আলো জ্বলছে আর স্টেলা একটা আরাম কেদারায় বসে ঝিমোচ্ছে। আমাকে দেখেই ভয়ে তাকাল।

–আরাম করুন, এখন আপনার জয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি বললাম।

–আমি বাইরে গুলির আওয়াজ পেয়ে ভাবলাম ওরা বোধহয় আপনাকে মেরে ফেলেছে।

আমি আর একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লাম আর বললাম,

–আপনার জন্যে খুব জোর বেঁচে গেছি।…ধন্যবাদ।

–প্রথমে খুব ভয় পাচ্ছিলাম, যদি টেলিফোন করার শব্দটা ও পায়।

যাক! আমার ভাগ্য এবং আপনিও শুনুন। আপনাকে এখান থেকে আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চলে যেতে হবে। ভাড়ার টাকাটা আমি দেব। পুলিস কোন ঝামেলা করবেনা। আপনি আপনার নিজের পাসপোর্ট ব্যবহার করবেন। ওটা আছে তো?

একটা বড় নিশ্বাস ফেলে স্টেলা বলল, হ্যাঁ আছে। আর হ্যারি?

–ও মারা গেছে। ভালই হয়েছে তা না হলে সারাজীবন জেলে পচতে হতো।

স্টেলা ডুকরে উঠল।

মারা গেছে? উঃ!

–হ্যাঁ, মারা গেছে। আমাকে এখন একটু ঘুমতে হবে। আমি বাথরুমে যাচ্ছি। আপনি আমার বিছানাটায় শুতে পারেন, আমি শোফাটায় শোব।

বাথরুমে স্নান করলাম বেশ ভাল করে। তারপর পাজামা পরে বাইরে এলাম। বেশ ভাল লাগছে। স্টেলা তখনও আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ওর সব জামাকাপড় বিছানার পাশে পড়ে রয়েছে। একটা পাতলা চাদরে ঢাকা ওর শরীর। ও হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরল, বিছানায় শুয়ে আলো নিবিয়ে দিলাম।