১. টেলিফোনটা বেজে উঠল

এ কফিন ফ্রম হংকং

প্রথম পরিচ্ছেদ

১.১

বিকেল বেলা, ঠিক ছটা বেজে দশ মিনিট। ঠিক এই সময়ে টেলিফোনটা বেজে উঠল। সারাটা দিন কোন দর্শনার্থী না আসায় খুব বাজে কেটেছে। একটা পয়সার মুখ দেখিনি। এমন কি জরুরী চিঠির খামের মুখগুলো আটকাবারও ইচ্ছা হচ্ছিল না। এমনিএকটা সময়ে হঠাৎ রিসিভারটা বেজে উঠলো।

রিসিভার তুলে বললাম- নেলসন রায়ান। গলার স্বরটা যথাসম্ভব আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করলাম।

কয়েক সেকেন্ড নীরবতায় কাটলো। টেলিফোন লাইনে খুব আস্তে আস্তে একটা শব্দ আমার কানে আসছিল, শব্দটা ক্ৰমশঃ মিলিয়ে গেল। মনে হল শব্দটা একটা এরোপ্লেন স্টার্ট নেওয়ার। কিছু অস্পষ্ট গলার স্বর শুনতে পেলাম, তারপরই সেগুলো বন্ধ হয়ে গেল। বুঝলাম বুথের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

মিঃ রায়ান? গম্ভীর পুরুষকণ্ঠ।

–ঠিকই ধরেছেন।

–আপনি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর?

এবারও আপনার অনুমান ঠিক।

আবার কিছুক্ষণের নীরবতা। শুনতে পেলাম ভদ্রলোক গাঢ় নিঃশ্বাস খুব আস্তে আস্তে ফেলছেন। মনে হল আমার কথা খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, আমি এয়ারপোর্ট থেকে বলছি। হাতে সময় খুব কম। আমি আপনাকে কিছু কাজ দিতে চাই, করে দিতে হবে।

লেখার জন্য প্যাডটা টেনে নিলাম।

–আপনার নাম আর ঠিকানা বলুন, আমি বললাম।

জন হার্ডউইক, ৩৩ নং কনট্‌ বুলেভার্ড।

তাড়াতাড়ি নাম ঠিকানা প্যাডে লিখে প্রশ্ন করলাম–ঠিক কি ধরনের কাজ আমাকে করতে হবে মিঃ হার্ডউইক?

–আমার স্ত্রীর ওপর আপনাকে নজর রাখতে হবে। আবার একটা এরোপ্লেন স্টার্ট নেবার শব্দ পেলাম। আবার নীরবতা।মিঃ হার্ডউইক কিছু বললেন, কিন্তু জেট ইঞ্জিনের আওয়াজে তার কথা শুনতে পেলাম না।

আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না মিঃ হার্ডউইক। যতক্ষণ না এরোপ্লেনের শব্দ মিলিয়ে গেল, উনি চুপ করে রইলেন। তারপর খুব তাড়াতাড়ি বললেন, আমাকে ব্যবসা সূত্রে মাসে দুবার নিউইয়র্ক যেতে হয়। আমার মনে হয় আমি যখন বাড়ি থাকি না, বাইরে যাই তখন আমার স্ত্রীর চালচলন ঠিক…। যাই হোক, আমি চাই আপনি তার ওপর নজর রাখুন। আমি পরশু অর্থাৎ শুক্রবার ফিরে এসে আপনার কাছে জানতে চাই, আমি যখন থাকিনা সে কি কি করে। তা আপনার দক্ষিণা কত বলুন?

আমি ঠিক এই ধরনের কাজের আশা করছিলাম না। যাই হোক, শুধু শুধু বসে থাকার চেয়ে এটা খারাপ কি?

–আপনি কি করেন, মিঃ হার্ডউইক? প্রশ্ন করলাম। খানিকটা অধৈর্যের সুরে বললেন, আমি হেরন-এ আছি।

হেরন করপোরেশন প্রশান্ত মহাসাগরের এই উপকূল অঞ্চলে একটা নামজাদা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। প্যাসাডেনা শহরের সমৃদ্ধির এক চতুর্থাংশ এরই দান।

–প্রত্যেক দিন পঞ্চাশ ডলার হিসেবে আর যা খরচপত্র হবে–আমার রেট যা তার দশগুণ বাড়িয়ে বললাম।

–ঠিক আছে। আপনি কাজ শুরু করুন। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাকে তিনশ ডলার পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনার কাজ, আমার স্ত্রী কোথায় কোথায় যায়, তার গতিবিধির ওপর নজর রাখা। সে যদি বাড়ি থেকে কোথাও না যায়, তাহলে কে কে তার সঙ্গে বাড়িতে দেখা করতে আসে, আমি তাও জানতে চাই।

তিনশ ডলারের জন্যে এর চেয়ে অনেক কষ্ট করা যায়। বললাম করব। কিন্তু দয়া করে একবার আসতে পারেন না, মিঃ হার্ডউইক। আমি আমার মক্কেলের সঙ্গে সামনাসামনি একবার আলাপ করতে পারলে খুশী হতাম।

আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার হাতে সময়ের খুবই অভাব। আমি এখনই নিউইয়র্ক চলে যাচ্ছি। তবে শুক্রবার ফিরে এসে আমি অবশ্যই দেখা করব আপনার সঙ্গে। আর আমার এই অনুপস্থিতির সময়টুকুতে আপনি আমার স্ত্রীর ওপর কড়া নজর রাখবেন। এ ব্যাপারে আমি আপনার ওপর ভরসা করতে পারি তো? ·

–অবশ্যই, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। খানিকক্ষণ থামলাম। এবার টেলিফোনে একটা এরোপ্লেন নামার আওয়াজ পেলাম।

মিঃ হার্ডউইক, আমি আপনার স্ত্রীর কোন বর্ণনা এখনো পাইনি।

-বললাম তো, ৩৩নং কনট বুলেভার্ড আমার ঠিকানা। আর আমার সময় নেই। আমি যাচ্ছি। ছাড়ছি, শুক্রবার দেখা হবে। লাইন কেটে গেল।

রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। ডেস্কের ওপর রাখা সিগারেট ধরিয়ে বেশ খানিকটা ধোঁয়া টেনে ওপর দিকে ছেড়ে দিলাম।

বছর পাঁচেক হল আমি এই অনুসন্ধানকারী পেশায় কাজ করছি। এর মধ্যে বেশ কিছু ক্ষ্যাপাটে মক্কেল আমাকে সামলাতে হয়েছে। হার্ডউইকও হয়ত এদের মত আর একজন। আবার নাও হতে পারে। মনেহয় লোকটা খুবচাপের মধ্যে আছে।হয়ত বেশকয়েক মাস ধরেই বউয়ের সন্দেহজনক চালচলনে উদ্বিগ্ন।হয়ত বুঝে উঠতে পারছিলনাকি করবে। শেষ-মেষ এবারেবাইরে যাবার আগে ঠিক করে ফেলেছে ব্যাপারটা জানতে হবে। একটা সদা উদ্বিগ্ন, অসুখী লোক এছাড়া আর কিবা করতে পারে। সে যাই হোক এই বেনামী মক্কেল আর কাজটার কথা ভেবে আমার কিন্তু খুব একটা ভাল লাগছিল না। যার টাকায় কাজ করব, তাকে দেখলাম না, যার ওপর নজর রাখতে হবে তার বিষয়ে কিছু জানলাম না, ব্যাপারটা আমার ঠিক পছন্দ নয়। আমি চাই যার হয়ে কাজ করব, তার সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা থাকবে। ব্যাপারটা তড়িঘড়ি ঠিক করলেও মনে হচ্ছে, এর পেছনে গভীর কোন মতলব কাজ করছে।

এই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে ভাবছি, এমন সময় সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ পেলাম। কেউ পা দিয়ে দরজাটায় ধাক্কা মারলো আর দরজাটা খুলে গেল।

একজন পত্রবাহক টেবিলে একটা মোটা খাম রেখে, আমার সই করার জন্যে হাতের খাতাটা এগিয়ে দিল।

লোকটা বেঁটেখাটো। মুখে হাজার দাগ। আমি যখন সই করছিলাম তখন সে আমার অফিস ঘরটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। আধা অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে,এককোণেইপত্তর রাখার টেবিল,রঙওঠা এই ডেস্ক, একটা নড়বড়ে চেয়ার আর দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার।

লোকটা যাবার পর খামটা খুলে দেখি দশ ডলারের তিরিশটা নোট আর একটা ছোট চিরকূট–প্রেরক : জন হার্ডউইক, ৩৩ নং কন বুলেভার্ড, প্যাসাডেনা।

 প্রথমটায় আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম কারণ আমি বুঝলাম না যে লোকটা এত তাড়াতাড়ি টাকা পাঠালো কি করে? তারপর ভাবলাম যে হার্ডউইকের নিশ্চয়ই এক্সপ্রেস মেসেঞ্জার কোম্পানীর সঙ্গে এরকম টাকাপয়সা পাঠাবার বন্দোবস্তু আছে। আমাকে টেলিফোন করার পর ওদেরও টাকা পাঠাবার জন্য ফোন করে দিয়েছে। আর ওদের অফিস তো আমার অফিস যে ব্লকে তার উল্টোদিকে।

টেলিফোন গাইডটা নিলাম হার্ডউইকের নাম খোঁজবার জন্যে, কিন্তু পেলাম না। চেয়ার ছেড়ে উঠে বইয়ের টেবিলে স্ট্রীট ডাইরেক্টরীটা দেখতে লাগলাম উল্টে-উল্টে। দেখা গেল, ৩৩ নং কনট বুলেভার্ডে জন হার্ডউইকের নাম নেই, সেখানে থাকেন জ্যাক মায়ার।

ব্যাপারটা কি? প্রথমেই যে চিন্তাটা আমার মাথায় এলোে সেটা এইরকম, কনটু বুলেভার্ড শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে অন্ততঃ তিন মাইল ভেতরে পালমা পর্বতের ওপর একটা জায়গা। শহরের, ওপরের বড় রাস্তাটা দিয়ে একটা মাঝারি রাস্তা বেরিয়ে বুলেভার্ডের দিকে গিয়েছে। এখানে লোকেরা সাধারণতঃ ছুটি কাটাতে আসে। জন, হার্ডউইকের মত হেরন কর্পোরেশনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী সম্ভবতঃ এখানে সাময়িকভাবে এই বাড়িটা ভাড়া নিয়ে আছেন, পরে নিজে বাড়ি করে উঠে যাবেন।

বুলেভার্ডে আমি কিছুদিন আগে একবারই গেছি। যুদ্ধের ঠিক পরে এই এলাকাটার একটু উন্নতি হয়েছে, তবে দেখার মত বিশেষ কিছু নেই। সব বাড়িগুলো অর্ধেক ইটের, অর্ধেক কাঠের তৈরী ছোট ছোট বাংলো টাইপের। তবে এখানকার সমুদ্র, দূরের শহরের দৃশ্য আর নির্জনতা সত্যিই উপভোগ করার মত।

আমাকে যে কাজটা করতে হবে সে সম্বন্ধে ভাবতে আমার খারাপ লাগছে। যে মহিলার ওপর নজর রাখবো তাকে কোনদিন চোখে দেখিনি বা তার সম্বন্ধে কিছুই জানিনা। যদি তিনশ ডলার না পাঠাতো তাহলে হার্ডউইকদের না দেখে কাজটা শুরু করতাম না। কিন্তু টাকাটা নেবার জন্যে আমাকে কাজটা শুরু করতেই হবে।

উঠে পড়ে অফিসের দরজায় তালা লাগালাম। করিডোর দিয়ে হেঁটে লিফটের কাছে এসে দাঁড়ালাম।

আমার পাশের ঘরটায় একজন কেমিস্টের অফিস, এখনও শুনছি জোরে জোরে সেক্রেটারিকে ডিক্টেশন্ দিচ্ছেন। ভদ্রলোক ব্যবসার জন্যে খুব লড়ে যাচ্ছেন।

লিফটে করে নেমে এসে সামনের রাস্তা পেরিয়ে কুইক স্ন্যাকস বার-এ ঢুকলাম। সাধারণতঃ আমি এখানেই খাই। কাউন্টারের ছেলেটা স্প্যারো আমাকে দেখে হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। অর্ডার দিলাম। বললাম, চটপট কিছু হ্যাম আর চিকেন সান্ডউইচ পাঠাও।

স্প্যারো রোগা, লম্বা, চুলগুলো সাদা। লোকটা খারাপ নয়। আমি মাঝে মাঝে আমার জীবনে ঘটেনি এমন সব দুঃসাহসিক ঘটনা ওকে বলি, আর ও খুব অবাক হয়ে শুনতে থাকে। আমার কাজ সম্বন্ধে ও খুব আগ্রহী।

আজ রাতে কি আপনার কোন কাজ আছে, মিঃ রায়ান? স্যান্ডউইচ তৈরী করতে করতে ও জিগ্যেস করল।

নিশ্চয়ই কাজ আছে। আজ রাতে আমার এক মক্কেলের বউ-এর ওপর নজর রেখে কাটাতে হবে। মেয়েটা যাতে কোন বদমাইশের পাল্লায় না পড়ে।

-তাই নাকি? তা তাকে দেখতে কেমন? স্প্যারোর চোখ দুটো আগ্রহে চক্ করে উঠল।

তুমি এলিজাবেথ টেলরকে দেখেছো?

–হ্যাঁ, হা,

মেরিলীন মুনরোকে?

নিশ্চয়ই! উত্তেজনায় ওর কণ্ঠনালী লাফাতে লাগলো।

আমি একটু হেসে বললাম, ওকে এদেরই মতো দেখতে।

স্প্যারো একটু হকচকিয়ে চোখ পিটপি করলো। পরে আমি মজা করছি বুঝতে পেরে বলল, খুব যে আমাকে ঠকাচ্ছেন, অ্যাঁ।

তাড়াতাড়ি কর স্প্যারো, আমাকে এখন রোজগারের ধান্দায় বেরোতে হবে।

কাগজ মুড়ে স্যান্ডউইচগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে সে বলল, দেখুন মিঃ রায়ান। পয়সাকড়ি না পাওয়া গেলে ফালতু কোন কাজ করতে যাবেন না।

সাতটা বেজেকুড়ি। গাড়িচালিয়ে কনটু বুলেভার্ডে এলাম।খুব একটাতাড়াহুড়োকরতে হয়নি। যখন পৌঁছোলাম দূরে পাহাড়ের কোলে সূর্য আস্তে আস্তে ডুবে যাছে। এখন সেপ্টেম্বরের শেষ।

কনট্‌ বুলেভার্ডের বাংলোগুলো রাস্তার ধারেই। সব বাড়ির সামনেই দেখলাম কিছু ঝোঁপ ঝাড় আর ফুল গাছের ঝাড়। আমি খুব আস্তে গাড়ি চালিয়ে ৩৩ নং বাড়িটা পেরিয়ে এলাম। বাড়ির সামনে ডাবল দরজা। প্রায় কুড়ি গজ দূরে রাস্তার ধারে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে সেখানে গাড়িটা থামালাম। সেখান থেকে সমুদ্রটা খুব সুন্দর দেখা যায়। ইঞ্জিন বন্ধ করে আমি ড্রাইভারের সীট ছেড়ে পেছনের সীটে এসে বসলাম, যাতে ঐখান থেকে ডাবল দরজাটা আমি পরিষ্কার দেখতে পাই।

এখন ঠায় বসে থেকে অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই, আর এতে আমার আপত্তিও নেই। আমার মত এই বৃত্তির লোকেদের ধৈর্যই হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি।

 পরবর্তী এক ঘণ্টায় বিশেষ কিছু ঘটল না। তিন চারটে গাড়ি আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। ড্রাইভারেরা আমার দিকে এক নজর গকিয়ে চলে যাচ্ছে। সারাদিন খেটে-খুটে পরিশ্রান্ত হয়ে তারা বাড়ি ফিরছে। আমাকে দেখে সবাই হয়তো ভাবছে কোন বান্ধবীর জন্যে অপেক্ষা করছি। এটা আমাকে দেখে নিশ্চয়ই মনে হচ্ছিল না যে মক্কেলের বউয়ের ওপর নজর রাখতে এখানে ঘাপটি মেরে বসে আছি।

একটা মেয়ে টাইট স্ন্যাকস আর সোয়েটার পরা আমার গাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ওর সামনে লাফিয়ে লাফিয়ে একটা লোমওকুকুর এগোচ্ছিল। মেয়েটা আমার দিকে তাকাতে আমি অবহেলা ভরে ক্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালাম আর মেয়েটাও মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

রাত নটার মধ্যে বেশ অন্ধকার নেমে এলো। আমি সঙ্গে আনা স্যান্ডউইচগুলো খেয়ে নিলাম। আর সঙ্গে একটা হুইস্কির বোতল ছিল। বের করে এক ঢোক গিলে নিলাম।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। এবার ক্লান্তি আসছে। এর মধ্যে ৩৩ নং বাড়িতে কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখলাম না। তবে এখন অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসায় নজর রাখতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। তাই গাড়ি থেকে নেমে আভে আস্তে গেটের কাছে এসে ডাবল দরজার একটা খুলে ভেতরে উঁকি মারলাম। দেখলাম কে সুন্দর একটা বাগান, দু-দিকে সুন্দর সুন্দর ফুলগাছের মধ্য দিয়ে রাস্তাটা সোজা বাংলো অবধি চলে গেছে। বাংলোর সামনে একটা সুদৃশ্য লন। বাংলোর সামনে বারান্দাটা নজরে এল।

বাংলোর ভেতরে কোন আলো জ্বলছিল না। মনে হল বাড়িতে কেউ নেই। নিশ্চিত হবার জন্যে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে এগিয়ে গিয়ে বাংলোর পেছন দিকটাও ঘুরে এলাম। না, কোন ঘরেই আলো জ্বলছে না।

কেমন হতাশ বোধ করে আবার গাড়িতে ফিরে এলাম। মনে হয় যে মুহূর্তে কর্তা এয়ারপোর্টে গিয়েছে, গিন্নীও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। যাই হোক, রাত্রিতে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে এই আশায় গাড়িতে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কি আছে?কথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশ ডলার পাঠিয়ে দিয়েছে ভদ্রলোক। কিছু তো আমাকে করতেই হবে।

অপেক্ষা করতে করতে রাত তিনটে নাগাদ আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভোরের সূর্যের আলো কাঁচের ভেতরে দিয়ে চোখে এসেপড়তেই ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ভাবলাম ইস্! অন্ততঃ তিনটে ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। এ সময়টায় আমার আরো সজাগ থাকা উচিৎ ছিল।

 রাস্তায় নেমে এসে দেখলাম, একটা দুধের ভ্যান থেকে বোতলে ভরা দুধ নিয়ে বাড়ি বাড়ি দিচ্ছে। দেখলাম লোকটা ৩৩ নং বাড়ি ছাড়িয়ে আমার উল্টোদিকে ৩৫ নং বাড়িতে ঢুকল।

লোকটা বেরিয়ে এলে আমি ওর পাশে পাশে চলতে লাগলাম। লোকটার বেশ বয়স হয়েছে। ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার সারা শরীরটা দেখল। হাতে তারের জাল দিয়ে তৈরী দুধের বোতল রাখার ঝুড়িটা ঝুলিয়ে একটু হেঁটে আমার দিকে ফিরে দাঁড়ালো।

তুমি ৩৩ নং বাংলোতে দুধ দিতে ভুলে গেছ। আমি বললাম।

–ওরা এখানে কেউ নেই। কী ব্যাপার? ওদের ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখছি। কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ও জবাব দিল।

লোকটার কথাবার্তার কায়দা শুনেই বুঝলাম, একে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে কথা বার করা যাবে না। তাই পকেট থেকে আমার কার্ডটা বার করে ওর হাতে দিলাম। কার্ডটা উল্টে-পাল্টে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটু হেসে কার্ডটা ফেরত দিল।

–৩৩ নং বাড়ির লোকজন সম্বন্ধে তুমি কিছু জান?

জানি বৈকি। কিন্তু ওরা মাসখানেকের জন্যে বাইরে গেছে।

–ওরা কারা?

মিঃ এবং মিসেস মায়ার।

–কিন্তু আমি জানি এই বাংলোতে এখন মিঃ এবং মিসেস হার্ডউইক থাকে।

লোকটা ঝুড়িটা মাটিতে রেখে হাত দিয়ে টুপিটা পেছনে হেলিয়ে বলল, এখন এই বাড়িতে কেউ থাকেনা স্যার। আমি একাই এখানকার সব বাড়িতে দুধদিই। এই মাসে আমি ৩৩নং বাড়িতে দুধ দিচ্ছি না কারণ বাড়িতে কেউ নেই।

–তাই নাকি? আচ্ছা মিঃ এবং মিসেস মায়ার অন্য কাউকে বাড়িটা ভাড়া দিয়ে যাননি তো?

-আমি আট বছর ধরে এই মায়ার পরিবারকে দুধ দিচ্ছি। আজ পর্যন্ত ওরা কাউকে এই বাড়ি ভাড়া দেয়নি। আর প্রত্যেক বছরের এই মাসটায় ওরা বাইরে থাকে বলে জানি। লোকটা দুধের বুড়ি তুলে নিয়ে ভ্যানের দিকে পা বাড়ায়।

তুমি এই এলাকায় জন হার্ডউইক বলে কাউকে চেনো না?

না স্যার, আমি এই এলাকার প্রত্যেককে চিনি। জন হার্ডউইক বলে কাউকে চিনি না। এই কথা বলে লোকটা দ্রুত পায়ে ভ্যানের দিকে গেল আর গাড়িটাকে ৩৭ নং বাড়ির সামনে এনে দাঁড় করাল।

বাড়ির নম্বরটা আমি ঠিক শুনেছি তো? হ্যাঁ! ভুল তো হবার নয়। কারণ হার্ডউইকের পাঠানো চিরকূটেও তো এই একই নম্বর লেখা ছিল।

৩৩ নং বাড়ির একটা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ভোরের আলো সারা বাংলোতে আবছা ছড়িয়ে পড়েছে। রাতের অন্ধকারে স্পষ্টসবকিছু দেখতে পাইনি।দরজা জানলা সাটার সমেত বন্ধ। প্রাণের স্পন্দন এখানে পেলাম না।

হঠাৎ বিদ্যুতের মত একটা চিন্তা আমার মাথায় খেলে গেল! আহা এই রহস্যময় হার্ডউইক কোন্ বিশেষ উদ্দেশ্যে আমাকে তিনশো ডলার দিয়ে অফিস থেকে বের করে আমাকে বুনো হাঁসের পেছনে ছোটাল!আমাকে ভয় পাবার মতো, এতখানি গুরুত্ব দেবার মতোরহস্য-সন্ধানী আমিনই।

যাই হোক এখন আমার দাড়ি কামানো, স্নান করা বা ঝিমুনিভাব কাটানোর জন্যে এক কাপ কফি খেতে অফিস যাওয়া ভীষণ ভীষণ জরুরী।

ছুটে গিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। পাহাড়ী রাস্তা ফাঁকা থাকায় সাতটার মধ্যে অফিসে পৌঁছে গেলাম। লবির সামনে দারোয়ানটা আমার দিকে একটা নীরস চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে সরে গিয়ে ব্যাট দিতে লাগল। এই লোকটা কাউকেই পছন্দ করেনা। নিজেকেও নয়।

পাঁচতলায় পৌঁছে দ্রুত পায়ে আমার পরিচিত ঘরের সামনে এসে পৌঁছলাম। দেওয়ালের ফলকে লেখাঃ

নেলসন রায়ান–অনুসন্ধানকারী। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলতে যাব, হাতলে হাত দিয়ে বুঝলাম দরজা খোলা। একটু ঠেলা দিলাম, দরজা খুলে গেল। আমার মূল অফিস ঘরের বাইরের ঘর এটা। দর্শনার্থীদের বসার জন্য কয়েকটা মোটামুটি সুন্দর চেয়ার, ছোট একটা টেবিলে কয়েকটা ম্যাগাজিন, মেঝেতে এক চিলতে কাপেট দেখলেই মনে হবে কাউকে প্রবেশের জন্যে সব সময় আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।

দেখলাম, ভেতরের ঘরের দরজা হাট করে খোলা, অথচ এটাও আমি কাল চাবি দিয়ে দিয়েছিলাম।

হঠাৎ দেখি, আমার মক্কেলের চেয়ারে খুব মিষ্টি একটা চীনা মেয়ে বসে আছে। হাত দুটো ভাঁজ করে কোলের ওপর রাখা। পরনে সবুজ ও সাদা ফ্রক। সুন্দর পা দুটা অনাবৃত চোখ দুটো শান্ত, নিশ্চল। বাঁ-ভনের ঠিক নীচে সরু একটা রক্তের ধারা নেমে গেছে। দেখে মনে হল খুব কাছ থেকে, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ওকে গুলি করা হয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটা সামান্যতম আতঙ্কিত হবারও সুযোগ পায়নি।

জলে ভেসে যাবার মতো আলতো পায়ে ঘরে এসে ঢুকলাম। মুখটা স্পর্শ করে দেখি ঠাণ্ডা; বেশ কয়েকঘন্টা আগে মারা গেছে।

একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে পুলিশকে একটা টেলিফোন করতে এগিয়ে গেলাম ফোনের দিকে। রিসিভার তুলে ডায়াল ঘোরালাম।

.

১.২

 পুলিসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি আমার এই এশীয় আগুন্তুককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। এক নজরে দেখে মনে হল মেয়েটার বয়স তেইশ-চব্বিশ এবং বেশ পয়সাওলা ঘরের মেয়ে। জামাকাপড় গুলো বেশ দামী, জুতোটা একেবারে নতুন। শরীরে একটা চেকনাই আছে। হাতের নখগুলো সযত্নে লালিত, চুলগুলো ভারী সুন্দর আর পরিপাটি। মেয়েটার সঙ্গে কোন ভ্যানিটি ব্যাগ বা এ ধরনের কিছু না থাকায় ওর পরিচয় পাবার কোন উপায় ছিল না। আমার মনে হয় হত্যাকারী ওটা নিয়ে গেছে। এরকম একটা মেয়ে হ্যান্ডব্যাগ ছাড়া বাইরে বেরিয়েছে, এটা ভাবা যায়?

না। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে মনে হল, কস্মিনকালেও একে কোথাও দেখিনি। পাশের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে না করতেই সিঁড়িতে একসঙ্গে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। মনে হল, একদলা চিনির ওপর এক ঝাক পিঁপড়ে ছুটে আসছে।

সবশেষে ঘরে ঢুকল ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের লেফটেন্যান্ট ড্যান রেটনিক। গত চার বছরে লোকটার সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। সারা শরীরে ধূর্ততা মাখা, ছোটখাট রোগা চেহারা। লোকটার আজ এই পদে উন্নতির পেছনের কারণ, ও এই শহরের মেয়রের শালা। এক পুলিশ অফিসারের পদে লোকটা একেবারেই বেখাপ্পা। তবে ওর ভাগ্য ভাল, এই শহরে ও আসার পর থেকে বড় রকমের কোন অপরাধ ঘটেনি। সম্ভবতঃ ওর আমলে এটাই প্রথম খুনের কেস।

একটা কথা এর সম্বন্ধে আমার বলা উচিত। ওর মাথায় বাচ্চাদের ক্রস ওয়ার্ড-পাজল সমাধান করার মত বুদ্ধি না থাকলেও ঠাটেবাটে একেবারে পাক্কা পুলিশ অফিসার। এখন এমনভাবে ঘরে এসে ঢুকল যেন সব কিছু পায়ে মাড়িয়ে একটা সামান্য কেস দেখতে আসছে। সঙ্গে সার্জেন্ট পুলস্কি।

সার্জেন্ট পুলস্কি মোটাসোটা লালচে চেহারার। ছোট ছোট চোখ। হাতের মোটা পাতা দুটোকে ও সব সময় মোচড়ায়–যেন যাকেই সামনে পাবে তার চোয়ালটা হাত দিয়ে মুচড়ে ভেঙে দেবে। বুদ্ধিসুদ্ধিও ভোতা। তবে পেশীশক্তি দিয়ে সেই ঘাটতিটা পুষিয়ে নেয়।

দুজনের কেউ আমার দিকে তাকাল না। মৃত দেহটার দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ ধরে সেটা দেখলো তারপর পুলস্কি হাঁটু মুড়ে বসে মৃতদেহটার পাশে কিছু পরীক্ষা করল। আমি রেটনিককে নিয়ে বাইরের ঘরে এলাম।

 ওকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। আমার ডেস্কের ওপর বসে পা দুটো দোলাতে দোলাতে বলল, আচ্ছা বলতো মেয়েটা কি তোমার কোন মক্কেল।

-না, মেয়েটাকে আমি চিনি না তোমরা এখন যেমন দেখছ, আমিও সকালে ঘরে ঢুকে ঐরকমই দেখেছি।

হু, নিভে যাওয়া চুরুটটা দাঁত দিয়ে চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি রোজই এত সকালে অফিস খোল?

তখন আমি কোন কিছু গোপন না করে, গতরাত্রের সমস্ত ঘটনা বললাম। পুলস্কিও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে আমার সমস্ত কথা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনল।

সুতরাং বুঝতেই পারছেন, আমি বাংলো ফাঁকা দেখেই এখানে ফিরে এসেছি। আমার মনে হয়েছিল কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু ঠিক এরকমটা হবে আশা করিনি।

–ওর হাত ব্যাগটা কোথায়? রেটনিক প্রশ্ন করল।

জানি না। আপনারা আসার আগে আমিও ব্যাগটা চারিদিকে খুঁজেছিলাম, আমারও মনে হয় ওর সঙ্গে কোন ব্যাগ ছিল। তবে আমার অনুমান হত্যাকারীরা ব্যাগটা নিয়ে গেছে।

রেটনিক আমার দিকে তাকাল। তারপর নিভে যাওয়া চুরুটটা দুবার কপালে ঠুকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, ওর সঙ্গে কী এমন ছিল, যার জন্যে ওকে খুন করতে হল?

এই হল রেটনিক। কত সহজে, তাড়াতড়ি এই সরল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। আমি পুলিশকে ফোন করার সময়েই ভেবেছিলাম যে প্রথম সন্দেহটা আমার ওপরই পড়বে।

–যদি ওর সঙ্গে কোহিনূর হীরেও থাকত তবু আমি এমন বুছুনই যে ওকে এখানে খুন করব। খুব ধীরে ধীরে বললাম, ও যেখানে থাকে, আমি সেই জায়গা খুঁজে বের করে সেখানেই ওকে…।

 আচ্ছা। ঠিক আছে, তবে আমাকে বোঝাও ও এখানে কি করতে এসেছিল আর দরজায় তালা লাগানো সত্ত্বেও ও ঘরে ঢুকল কী করে?

-ঠিক বলতে পারবো না, তবে খানিকটা আন্দাজ করতে পারি।

–বেশ, বলল তোমার আন্দাজটা?

–আমার মনে হয় মেয়েটার আমার সঙ্গে কোন দরকার ছিল। জন হার্ডউইক নামের সেই লোকটা, অবশ্য জানি না ওটা ওর আসল নাম কিনা আমার সঙ্গে মেয়েটার দেখা যোক এটা চায়নি। এটা আমি জানিনা ও কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। এটা আমার ধারণা মাত্র।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম; হার্ডউইক আমাকে একটা ফলস ফোন করে একটা খালি বাংলো পাহারা দিতে পাঠিয়ে নিশ্চিত ছিল যে আমি ঐ সময় অফিসে থাকবোনা। ঠিক ঐ সময়েই মেয়েটা আমার চেম্বারে আসবে। ইতিমধ্যে ও আমার চেম্বারে ডেস্কের ওপরবসেরইল।আর আমার তালাগুলোর কোন বিশেষত্ব নেই। সাধারণ বাজারে ও-গুলো কিনতে পাওয়া যায় কাজেই ওর তালা খুলতে কোন অসুবিধাই হয়নি। মেয়েটার চোখে মুখে আতষ্কের কোন চিহ্ন নেই দেখে আমার মনে হয় ও নোকটাকে চিনত না। ভেবেছে আমিই বসে আছি। আর তারপর মেয়েটা এসে বসে ওর সব কথা বলেছে। আর তখন লোকটা কাছ থেকে খুব দক্ষতার সঙ্গে ওকে গুলি করেছে। এত তাড়াতাড়ি সেটা ঘটেছে যে ওর মুখে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

রেটনিক পুলস্কিকে বলল, খুব সাবধানে থেকে পুলস্কি। এর যা মাথা তাতে তোমাদের আর খুব বেশিদিন করে খেতে হবেনা। পুলস্কি দাঁত থেকে কিছু খুঁটে বের করে আমার গালিচার ওপর থু থু করে ফেলছিল। ও কোন মন্তব্য করল না। চুপ করে থাকা ওর কাজ আর এ ব্যাপারে ও একজন পেশাদারী শ্রোতা।

রেটনিক কিছুক্ষণ চিন্তকাল। তারপর বলল, তোমার এই ধারণাগুলো যে আজগুবি তা তোমায় বুঝিয়ে দিচ্ছি। ঐ লোকটা তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করেছিল। ঠিক ত? এয়ারপোর্ট এখান থেকে প্রায় মাইল ছয়েক দূরে। তুমি যদি সত্যিই বলে থাকে, তবে তোমার কথা অনুযায়ী তুমি ছটার পর অফিস থেকে বেরিয়েছে। এবার তুমি তো জানো বিকেলে ঐ রাস্তায় ট্রাফিকের যা অবস্থা তাতে ও কিছুতেই তোমার অফিসে সাড়ে সাতটার আগে পৌঁছতে পারে না। আর মেয়েটিও জানত বিকেলে তোমার ওখানে পৌঁছনো অনেক সময়ের ব্যাপার, সুতরাং ও তোমাকে একটা টেলিফোন না করে আসবেই না।

–ও যে টেলিফোন না করে এসেছে এটা কে জানে? হয়ত হার্ডউইক সেই সময় আমার অফিসে চলে এসেছে, আর আমি সেজে ওকে বলেছে, আমার এখানে সোজা চলে এসো।

ব্যাপারটা যে এরকমও হতে পারে এটা চিন্তা করে চুরুট কামড়াতে কামড়াতে গুম হয়ে রইল রেটনিক।

এমন সময় একজন মেডিক্যাল অফিসার, দুজন শববাহী হাতে স্ট্রেচার নিয়ে দরজায় উঁকি দিল।

রোগা, ফ্যাকাশে মুখের মেডিক্যাল অফিসার মৃতদেহ পরীক্ষা করার জন্যে তার লোকজন নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

রেটনিক তার হীরের টাই-পিন ঠিক করতে করতে বলল, ঠিক আছে মেয়েটা একে হলদে চামড়া, তায় সুন্দরী সুতরাং কারোরই চোখ এড়াতে পারেনি, ওর-খোঁজখবর ঠিক পেয়ে যাব। আর ঐ লোকটার কি নাম হার্ডউইক, ও তোমার সঙ্গে কবে দেখা করবে বলেছিল?

আগামীকাল, শুক্রবার।

-তোমার কি মনে হয় ও দেখা করবে?

সম্ভাবনা কম।

–হু, মাথা নাড়ল রেটনিক, তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘোঁৎ করে উঠল, তোমার চেহারা তো দেখছি ঝোড়ো কাকের মতো? যাও কফি-টফি খেয়ে এসো। আর শোন! কারোর সঙ্গে এ ব্যাপারে বেশি কথা বলবে না। আমি আধঘণ্টা পরে আবার তোমার সঙ্গে বসব।

–হ্যাঁ, একটু কফি খাবো, আর বাড়ি গিয়ে একটু স্নান করবো।

–না, তোমার আর কোথাও যাওয়া চলবে না, শুধু কফি খেয়ে চলে আসবে।

আমি লিফটে নীচে নেমে তাড়াতাড়ি কুইক-ম্যাক্স বার-এর দিকে এগোলাম। এখন সকাল আটটা বাজে কুড়ি। অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিসের গাড়ি ঘিরে জিজ্ঞাসু মানুষের ভিড়।

আমি বুঝলাম পুলিশ প্রহরায় আমাকে কফি খেতে হবে।

আমাকে দেখেই বার-এর স্প্যারো উদ্বিগ্নভাবে এগিয়ে এলো আপনার ওখানে কি হয়েছে মিঃ রায়ান। চাপা হিসহিসে গলায় ও জিজ্ঞেস করল।

-খুব তাড়াতাড়ি এক কাপ কালো কফি কড়া করে বানাও আর হ্যাঁমের ওপর দুটো ডিম ফেলে ভেজে দাও। বারের বাইরে দরজার কাছে দুটো সাদা পোষাকের পুলিশ দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করতে লাগলো।

স্প্যারো আর কথা না বাড়িয়ে নিজের মনে প্রশ্নগুলোকে চাপা দিয়ে কফি তৈরী করতে লাগল।

ডিম ভাঙতে ভাঙতে আমার দিকে তাকিয়ে দোনামোনা করতে করতে জিজ্ঞাসা করলো, ওখানে কি কেউ মারা গেছে মিঃ রায়ান?

বাইরে অপেক্ষমান পুলিশটাকে নজরে রেখে জিজ্ঞেস করি, তুমি রাত্রে কটার সময় দোকান বন্ধ কর স্প্যারো?

–ঠিক দশটায়। এবার কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে ও জিজ্ঞেস করল রাস্তার ওখানে কি হচ্ছে বললেন না তো?

–একটা চীনা মেয়ে খুন হয়েছে। কফিতে চুমুক দিলাম। সত্যি কফিটা স্প্যারো দারুণ বানিয়েছে। খুব গরম আর কড়া। আবার বললাম, আর সেটা আমার অফিসের মধ্যেই। আধঘণ্টা আগে দেখে এসেছি।

উত্তেজনায় ওর কণ্ঠনালী লাফাতে লাগল।

–সত্যি বলছেন, খুন?

 –ভগবানের দিব্যি। আর এক কাপ কফি দাও। আগের কাপটা এগিয়ে দিলাম।

 –একটা চীনা মেয়ে? এরকম একটা খুনের ঘটনা শুনে ও রীতিমত উত্তেজিত।

–হ্যাঁ, এর বেশি কিছু প্রশ্ন কর না। এছাড়া তুমি যা জান আমিও তাই জানি। আচ্ছা, কাল আমি যাবার পর কোন চীনা মেয়েকে আমার অফিস ব্লকে ঢুকতে দেখেছো?

কাপে কফি ঢালতে ঢালতে মাথা নেড়ে ও বলল, কাল সন্ধ্যার পর দোকানে একদমই ভিড় ছিল না। আমি দোকান বন্ধ করার আগে কেউ ঢুকলে অবশ্যই দেখতে পেতাম।

এবার আমি অল্প অল্প ঘামতে লাগলাম। রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত আমার একটা অ্যালিবাই আছে। যখন ঐ মেয়েটা কুকুর নিয়ে আমার গাড়ির পাশ দিয়ে গেছে, মনে হয় তখনই মেয়েটা আমার অফিসে ঢুকেছে। তারপর থেকে আমি একা সেইমিঃ মায়ারের খালি বাড়ি পাহারা দিয়েছি।

–আচ্ছা আমি তোমার দোকানে খেয়ে যাওয়ার পর থেকে তোমার দোকান বন্ধ করা পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে অপরিচিত কাউকে আমার অফিস বাড়িতে ঢুকতে দেখেছো?

-না সেরকম কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। দারোয়ান অন্য দিনের মতো নটায়। তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আমাকে হ্যাম দিতে দিতে ও জিজ্ঞেস করল, কে মেরেছে ওকে?

 জানি না। হঠাৎ আমার ক্ষিদের ইচ্ছেটা একদম চলে গেল। ঘটনার ছবি এখন পর্যন্ত যা, তাতে রেটনিকের মাথাকে সে ভাবে সব ব্যাপার পরিষ্কার করে না দিলে ও আমার পেছনে লেগে থাকবে। আমি বললাম, আমার মনে হয় এই পথ দিয়ে মেয়েটা কাল ঠিকই গেছে, তুমি খেয়াল করনি।

–তা অবশ্য হতেও পারে। আমি তো জানলার দিকে সবসময় তাকিয়ে বসে থাকিনা।

 দুটো লোক চুকে ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিয়ে স্প্যারোকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে ওখানে?

স্প্যারো জবাব দিলো, জানি না।

 দুজনের মধ্যে একজন মোটা, গায়ে ব্রান্ডো জ্যাকেট, সে বলল, কাকে যেন একেবারে ঝেড়ে দিয়েছে। সে জন্যই তো ঐ অ্যাম্বুলেন্স, দেখলে না?

–ক্ষিদের ইচ্ছেটা চলে যাওয়ায় খাবারের প্লেটটা সরিয়ে উঠে পড়লাম।

দরজা দিয়ে বেরোতেই পাহারারত পুলিশটা আমার পিছু নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায়, যাওয়া হচ্ছে?

–তাচ্ছিল্য ভরে জবাব দিলাম, অফিসে, কেন? তোমার কি তাতে অসুবিধে আছে?

যতক্ষণ না লেফটেন্যান্ট আপনাকে ডাকছেন, ততক্ষণ আপনি ঐ গাড়িটায় গিয়ে বসুন। বুঝলাম তর্ক করে লাভ নেই। সামনের একটা পুলিসের গাড়ির পিছনের সীটে গিয়ে বসলাম। কৌতূহলী এক দঙ্গল লোক আমাকে দেখতে এসে ভিড় জমাতে লাগল। আমি ওদের উপস্থিতি অবজ্ঞা করতে একটা সিগারেট ধরালাম।

সিগারেট খেতে খেতে আমি ঘটনার পূর্বাপর চিন্তা করতে লাগলাম। বুঝলাম বেশ প্ল্যান করেই আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে স্ট্রেচারে মেয়েটাকে নামিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঢুকিয়ে দেওয়া হল।

মনে হল, একটা ছোট মেয়ে ঘুমিয়ে আছে আর ভিড়ের লোকজন যথারীতি ইস্, আঃ–এই সব দুঃখসূচক শব্দগুলো করতে লাগলো।

মেডিক্যাল অফিসার ভদ্রলোক নেমে এলেন এবং নিজের গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন।

খানিক পরে ওপরের এক দঙ্গল পুলিশ নেমে এল।ওদের মধ্যে একজন আমার পাহারাদারকে ইশারায় কি যেন বলল। সব পুলিশই বার গাড়িতে উঠে ওদের গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

এবার নেমে আসুন, আপনাকে ডাকছে। পাহারারত পুলিশটা বলল।

আমি নেমে রাস্তা পার হচ্ছি তখন মিঃ ওয়েডে সেই ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট ভদ্রলোক, তিনি তার গাড়ি থেকে নেমে আমার সঙ্গে লিফটে উঠলেন।

ভদ্রলোকের বয়স আমার চেয়ে চার বছর কম হবে। অ্যাথলিটদের মতো বড় সড় চেহারা, ক্ষিপ্র, স্মার্ট। স্ক্রু কাট চুল, রোদে পোড়া চামড়া। লিফটে উঠতে উঠতে খুব কম সময়ের মধ্যে

অঙ্গ কথা হয়।

আমি একেও রং-চড়িয়ে বেশ দুঃসাহসিক দু-একটা কাহিনী শুনিয়েছি এবং সেগুলোও বেশ উপভোগ করেছে। আমার এই বৃত্তি সম্বন্ধে ইনিও বেশ আগ্রহী।

–ওপরে কি হচ্ছে? লিফট মাটি ছেড়ে পাঁচ তলায় ওঠার সময় ও জিজ্ঞেস করল।

-সকালে অফিসে গিয়ে দেখি আমার ঘরে একটা চীনা মেয়ের মৃতদেহ! পুলিশ তাই এই ব্যাপারে খুব উত্তেজিত।

–মৃতদেহ? ভদ্রলোকের ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন।

 –হ্যাঁ, মনে হয় কেউ গুলি করেছে।

খবরটায় ভদ্রলোক চমকে গেলেন–গুলি করেছে? তার মানে খুনের কেস?

–তাইতো মনে হয়। ফ্যাকাশে হাসি হেসে বললাম।

হু, কে মারল বলুন তো?

–সেটাই তো কথা। কাল রাত্তিরে আপনি কটার সময় দোকান বন্ধ করেছেন? আমি যখন বেরোই তখনও কি আপনি অফিসে ছিলেন?

–এই ন-টা নাগাদ দারোয়ান এসে বন্ধ করে দিল আর আমিও তখন চলে গেলাম।

ঐ সময়ের মধ্যে কোন গুলির আওয়াজ পাননি?

 না, ভগবানের দিব্যি!

–আচ্ছা, যখন আপনি বেরোলেন অফিস থেকে, তখন কি আমার ঘরে কোন আলো জ্বলছিল?

না তো, আপনি তো কাল ছটায় চলে গেলেন?

হু

তাহলে মনে হচ্ছে মেয়েটাকে রাত নটার পর খুন করা হয়েছে, সুতরাং আমার অ্যালিবাই তো এখন ভিজে মুরগীর চেয়েও দুর্বল।

লিফট এসে থামল। সেই সময় সার্জেন্ট পুলস্কি আর দারোয়ানটা আমার অফিস থেকে বেরিয়ে এল। দারোয়ানটা আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন চোখের সামনে একটা দু মাথাওলা রাক্ষস দেখছে। ওরা আমাকে পাশ কাটিয়ে লিফটে উঠে নেমে গেল।

আমার মনে হয় এখন আপনাকে বেশ ব্যস্ত থাকতে হবে। ঠিক আছে, যদি কোন প্রয়োজন হয় ডাকনে।

ধন্যবাদ, নিশ্চয়ই ডাকবো।

 আমার অফিসের দরজার কাছে পুলিশ দাঁড়িয়ে। তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলাম।

লেঃ রেটনিক ডেস্কের পিছনে আমার চেয়ারে বসে। আমার দিকে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে মক্কেলদের জন্যে নির্দিষ্ট চেয়ারে ইশারা করে বসতে বললেন।

ঐ চেয়ারটাতেই মেয়েটা বসেছিল। খুব হাল্কা রক্তের দাগ দেখে আমি চেয়ারে না বসে হাতলটায় বসলাম।

–তোমার বন্দুকের পারমিট আছে? রেটনিক প্রশ্ন করল।

–আছে।

কী বন্দুক?

–একটা পয়েন্ট থ্রী-এইট পুলিশ স্পেশাল।

দাও। হাত বাড়াল।

–ডান দিকের ড্রয়ারের ওপরের ধাপে আছে।

আমার দিকে তাকিয়ে থেকে খানিকক্ষণ পর বলল,না নেই। আমি তোমার সারা ড্রয়ার খুঁজে দেখেছি।

আমার ঘাড় দিয়ে ঠাণ্ডা ঘাম শিরশির করে নামছে। কোনমতে নিজেকে ঠিক করে বললাম, ওখানেই তো থাকার কথা।

রেটনিক তার শুয়োরের চামড়ায় বাঁধানো সিগারেট কেস থেকে একটা চুরুট বের করে জ্বালিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু টান মেরে বলল, মেয়েটাকে পয়েন্ট থ্রী এইট দিয়েই মারা হয়েছে আর মেডিকেল অফিসারের অভিমত অনুযায়ী সেটা ঘটেছে আজ ভোর তিনটে নাগাদ। রায়ান, সত্যি বলে ফেল। কেন শুধু শুধু জল ঘোলা করছ?বল মেয়েটার ব্যাগে কী ছিল? মেজাজ এবং গলা ঠাণ্ডা রেখে বললাম, মিঃ রেটনিক আমাকে দেখে এতটা বুদ্ধ মনে হয় জানি না। তবে মেয়েটার ব্যাগে কুবেরের ধন থাকলেও আমি তাকে আমার মক্কেলের চেয়ারে বসিয়ে খুন করে, আপনাদের খবর দোব অতটা গবেট আমি নই।

জানিনা। হয়ত তুমি জুৎসই একটাঅ্যালিবাই তৈরী করে তারপরেই এই কাজে নেমেছে।

আর যদি আমিই ওকে খুন করতাম তবে আমার অ্যালিবাইটা রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত রাখতাম না। ভোর তিনটে পর্যন্তই করে রাখতাম। আপনাকে তো কালরাত্তিরে আমি কী করেছি সব বিস্তারিত জানিয়েছি।

রেটনিক নিজের বুদ্ধিতে শান দেওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার চারপাশে গোমড়া মুখে পায়চারী করতে লাগল।

–ভোর তিনটের সময় ঐ মেয়েটা তোমার এখানে কি করছিল?

–তাহলে আমাকে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বলতে হয়।

–দেখ রায়ান, খানিক উত্তেজিত অথচ অন্তরঙ্গ গলায় রেটনিক বলল, আমাদের শহরে গত পাঁচ বছরে কোন খুনের কেস পাইনি। এখন সাংবাদিকরা এই ঘটনায় ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের দেবার মত বিশ্বাসযোগ্য গল্প তো আমার চাই।ঠিক আছে তুমি অনুমান করে কি বলবে বলছিলে বল, আমি শুনব। আমার কাছে এখন পর্যন্ত যা সাক্ষ্য প্রমাণ আছে তাতে তোমাকে আমি গ্রেপ্তার করতে পারি। কিন্তু তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি, তুমি প্রমাণ কর আমার ধারণা ভুল। বল, কি বলবে।

ধরা যাক, মেয়েটা সানফ্রান্সিসকো থেকে এসেছে এবং এটাও ধরে নেওয়া যাক যে ওর খুব জরুরী কিছু আমাকে বলার ছিল। হয়তো বলবেন, সানফান্সিসকোতে কোন প্রাইভেট ডিটেকটিভের সঙ্গে কথা বলতে পারত। পারতো, কিন্তু ধরে নিন আমার এখানেই আসছিল এবং ঠিক ছিল কাল রাত সাতটা নাগাদ প্লেনে করে ও চলে আসবে। তখন আমি থাকব কিনা এই ভেবে হয়তো ও ওখান থেকেই একটা ফোন করল। আর আমাকে তাড়িয়ে হার্ডউইক আমার চেয়ার থেকে ফোন ধরল। ফোনে মেয়েটা জানাল যে ও প্লেনে রাত তিনটের সময় আসছে। হার্ডউইক জানাল যে ও যেন সোজাসুজি অফিসে চলে আসে। ও অপেক্ষা করবে।

মেয়েটা এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি ধরে সোজা এসে হার্ডউইককে আমি মনে করে সব কথা খুলে বলল। ও সেগুলো শুনল এবং গুলি করল।

–তোমার বন্দুক দিয়ে?

–হ্যাঁ, আমার বন্দুক দিয়ে।

–এই বাড়ীর প্রবেশ দ্বার নটায় বন্ধ হয়, তাছাড়া দরজার তালাও ভাঙা হয়নি। হার্ডউইক। বা মেয়েটা ঢুকল কিভাবে?

–আমি অফিস ছাড়ার পরে এবং দারোয়ান দরজা বন্ধ করার আগেই হার্ডউইক ঢুকে পড়ে। মেয়েটা আসার সময় নীচে নেমে দরজার ইয়েল লকখুলে ওকে ঢুকিয়ে নিয়েছে। এই লক ভেতর থেকে খুলতে কোন অসুবিধাই হয়নি।

–সিনেমার জন্য গল্প লিখো, কাজ হবে, তেতো হাসি হেসে রেটনিক বলল। তুমি কি জুরীদের সামনে এই গল্প বলবে?

–অবশ্যই। আমার ধারণাটা যাচাই করতে হলে এয়ারপোর্টের ট্যাক্সিওয়ালাদের কাছে খোঁজ নিলেই ব্যাপারটা জানা যাবে।

–ঠিক আছে, ধরে নিলাম তুমি যা যা বললে সব ঠিক। শুধু ঐ বানানো হার্ডউইকের জায়গায় তুমি…। ধূর্ত হাসি হেসে রেটনিক বলল।

–মিঃ হার্ডউইক যে বানানো কোন লোক নয়, এটা আপনি এক্সপ্রেস মেসেঞ্জার সার্ভিস এ খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। রাত্রে ওদের মাধ্যমে আমি তিনশ ডলার পাই। আর সে রাতে সাড়ে সাতটা থেকেনটা পর্যন্ত ৩৩নংকন বুলেভার্ডের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম সেটাও খোঁজ নিন। রাত দুটো নাগাদ একটা গাড়ি যায়, জানি না ড্রাইভার আমাকে লক্ষ্য করেছে কিনা। তবে সকাল ছটায় দুধওলা লোকটার সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে।

–আমি শুধু জানতে চাই রাত একটা থেকে আজ ভোর চারটে অবধি তুমি কোথায় ছিলে?

 –৩৩ নং বুলেভার্ড রোডের বাড়ির সামনে।

রেটনিক কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, দেখি তোমার পকেটগুলো।

আমি কোন কথা না বলে পকেট উন্টে যা ছিল বের করে দিলাম। রেটনিক যখন আগ্রহভরে সেগুলো দেখছে, বললাম, মেয়েটার থেকে কিছু নিয়ে থাকলে সেটা পকেটে নিয়ে বেড়াতাম না।

উঠে দাঁড়াল রেটনিক। বলল, শহর ছেড়ে কোথাও যাবে না। আমি আরও কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড় করে তোমায় দেখব। গটগট করে চলে গেল ও।

টেবিল থেকে জিনিষগুলো তুলে পকেটে রেখে একটা সিগারেট ধরালাম। আমার বিরুদ্ধে একটা জোরালো কে সাজাতে রেটনিককে আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নতুন সূত্র বার করতে হবে। আমার মনে হচ্ছে প্রকৃত খুনী এই কেসটায় আমাকে ভাল করে জড়াতে চাইছে। আমার বন্দুক হাওয়া হয়ে যাবার একটাই কারণ, ওটা খুনী এমন জায়গায় রেখে দিয়েছে যেটা রেটনিকের হাতে পড়বে আর আমার ওপর আরও বেশী সন্দিহান হয়ে উঠবে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। নাঃ অনেক কাজ আছে। এভাবে সময় নষ্ট করা ঠিক হবেনা।

অফিসের দরজা বন্ধ করে লিফটের দিকে এগোতে দেখলাম, রেটানিক মিঃ ওয়েডের সামনে বসে আছে। অর্থাৎ আমার বিরুদ্ধে আরো সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। চুলোয় যাক্।

নীচে নেমে দুটো পুলিশকে পেরিয়ে রাস্তায় নেমে গাড়ীতে উঠে বসলাম।

আমার মধ্যে উত্তেজনা এবং ভয় দুটোই কাজ করছে। হঠাৎ এক ঢোক হুইস্কির জন্যে তেষ্টা অনুভব করলাম। সাধারণতঃ সন্ধ্যে ছটার আগে আমি ড্রিংক করি না। কিন্তু আজকের দিনটা ব্যতিক্রম। সামান্য ঝুঁকে সীটের সামনের খুপরী থেকে বোতলটার জন্যে হাত বাড়ালাম। কিছু একটাতে হাত ঠেকতেই মনে হল আমার সারা শরীরের রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে, সারা শরীর ভয়ে অবশ হয়ে এতই মনে হল আমার পরী থেকে বোতলকা

খুপরীর মধ্যে আমার পয়েন্ট থ্রী-এইটটা আর একটা টিকটিকি চামড়া রং-এর হাতব্যাগ।

বিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। মাথার চিন্তাগুলো সব এলেমেলো হয়ে গেল। কোন সন্দেহ নেই, হাত ব্যাগটা ঐ চীনা মেয়েটারই।

.

১.৩

 পুলিশ হেড কোয়ার্টারের পেছনের দিকটা আট ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এখানে পুলিসের টহলদারী গাড়ি, রায়ট স্কোয়াড ট্রাক এবং খুব জরুরীকাজের জন্য দ্রুতগামী গাড়িগুলিমজুদ থাকে।

দেওয়ালের একদিকে লাল অক্ষরে বড় বড় করে কতগুলো কথা লেখা আছে যার অর্থ হচ্ছে এখানে শুধুমাত্র পুলিসের গাড়ি দাঁড় করানো যাবে।

খোলা গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে আমি আস্তে আস্তে টহলদারী গাড়ির পাশে গাড়িটা দাঁড় করালাম।নামতে যাচ্ছি এমন সময় একটা লালমুখো আইরিশ বাজখাই গলায় চীৎকার করে বলল,– এখানে কি লেখা আছে পড়তে জানো না? কি ব্যাপার, আঁ?

–কোন ব্যাপারই নয় আর পড়তেও জানি।

ও আমাকে কিভাবে আক্রমণ করবে ঠিক করতে মুখটা হাঁ করে রইল। ও কিছু বলার আগেই মৃদু হেসে গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললাম, ডিটেকটিভ, লেঃ রেটনিক মানে আমাদের মেয়রের শালা আমাকে এখানে গাড়ি পার্ক করতে বলেছে। ইচ্ছে হলে জিজ্ঞেস করুতে পারো, তবে যদি গালাগালি খাও তো আমাকে দোষ দিও না।

পুলিশটা ভড়কে গিয়ে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল।

মিনিট কুড়ি গাড়িতে বসে থাকার পরে একটা গাড়ি এসে থামল। রেটনিক গাড়ি থেকে নেমে হেড কোয়ার্টারের ধূসর বাড়িটার দিকে হাঁটা লাগাল।

লেফটেন্যান্ট…।

আমি খুব আস্তে ডাকলেও শুনতে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন এইমাত্র কেউ ওর ঘাড়ে লোহার ডাণ্ডা মেরেছে। দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এল।

-কি ব্যাপার, এখানে কেন?

–এই আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।

–হু। কয়েক সেকেন্ড ভাল করে দেখে বলল, তা আমি তো এসে গেছি, কি বলার আছে বল।

আমি গাড়ি থেকে নামলাম।

–আপনি আমাকে খুব ভাল করে সার্চ করলেন, কিন্তু আমার গাড়িটা সার্চ করতে ভুলে গেছেন।

রেটনিক শক্ত হয়ে নাকের পাটা দুটো ফুলিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল।

–কেন তোমার গাড়ি সার্চ করতে যাব কেন?

–আপনি তো জানতে চাইছিলেন যে ঐ হলুদচামড়ার মেয়েটার হাতব্যাগে কি আছে যার জন্যে আমি ওকে আমার অফিসে খুন করেছি। তাই তো? তা আমি ভেবেছিলাম আমাকে সার্চ করার সঙ্গে সঙ্গে আমার গাড়িটাও সার্চ করবেন, একজন সত্যিকারের বুদ্ধিমান পুলিশ অফিসার যা করে আর কি! যাক গে। তা এখন আমি আমার গাড়িটা এনেছি আপনাকে একজন বুদ্ধিমান পুলিশ অফিসার হবার সুযোগ দেবার জন্যে।

রাগে রেটনিকের মুখ লাল হয়ে গেল।

–শোন, শুয়োরের বাচ্চা। তোমার মত ছুঁচো গোয়েন্দাদের কাছ থেকে বড় বড় বাত শুনতে চাই না। আমি পুলস্কিকে পাঠাচ্ছি। তোমাকে কী করতে হয় দেখাবে। তোমার হাড়-মাস এক করা উচিত।

তার আগে গাড়িটা একবার পরীক্ষা করলে মনে হয় ভাল হবে। এই ভেতরের কুঠুরিটা দেখুন, তাতে মনে হয় আপনার অনেক সময় বাঁচবে। গাড়ি থেকে নেমে দরজাটা খুলে দাঁড়ালাম।

ঝুঁকে পড়ে ও ভেতরের কুঠুরিটা পরীক্ষা করতে লাগল, আমি ওর প্রতিক্রিয়া উপভোগ করতে লাগলাম।

ওর চোখে মুখে যে রাগ ভাবটা ছিল সেটা চলে গেল। বন্দুক, হাতব্যাগ কোন কিছু স্পর্শ না করে, কিছুক্ষণ ধরে জিনিষ গুলো দেখলো। তারপর আমার দিকে তাকাল।

বন্দুকটা তোমার?

–হ্যাঁ।

–হাত ব্যাগটা মেয়েটার?

–সেটা বলে দিতে হবে কি?

আমাকে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। বুঝলাম বেশ ঘাবড়ে গেছে।

–ঠিক আছে। ওসব কথা ছাড়ো। চলল, তুমি যে ওকে খুন করেছে, সেটা স্বীকার করে বিবৃতি দেবে।

–আমি ত তোমাকে ব্যাপারগুলো যেভাবে ঘটেছিল, ঠিক সেভাবে বলেছি, এখন তুমি এগুলো কিভাবে নেবে তোমার ব্যাপার!

গেটের পাহারারত পুলিশটাকে রেটনিক ইশারা করে ডাকল, তারপর তাকে পুলস্কিকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলল।

ইতিমধ্যে রেটনিক মেয়েটার হাতব্যাগ আর বন্দুকটা স্পর্শ না করে বেশ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল।

–আমি তোমাকে দুবার বাঁচার সুযোগ দেব না, রেটনিক বলল।

গাড়িতে যেগুলো পেয়েছি, সেগুলো তোমাকে দেখাতে না আনলে নিশ্চয়ই দুবার সুযোগ নেওয়ার প্রশ্ন আসতো না। কিন্তু যেহেতু আমি এসেছি দুবার, বাঁচার সুযোগ আমাকে নিতেই হবে।

–তুমি কি সব সময় গাড়ি চাবি দিয়ে রাখ? একদৃষ্টে চেয়ে রেটনিকের প্রশ্ন। বুঝলাম ওর ব্রেন কাজ করছে।

–হ্যাঁ, তবে একটা ডুপ্লিকেট চাবি আমি বন্দুকটা যে ড্রয়ারে থাকে সেখানে রাখি, আমি যদিও খুঁজে দেখিনি, তবুও বাজি ধরে বলতে পারি ঐ চাবিটা ওখানে এখন নেই। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে গাল চুলকোতে চুলকোতে রেটনিক বলল, তোমার আন্দাজই ঠিক। আমি দেখেছি ড্রয়ারে কোন চাবি নেই।

পুলস্কি এসে দাঁড়ালো। রেটনিক বলল, এই গাড়িটা ভাল করে সার্চ কর। তবে বন্দুক আর হাতব্যাগটা সাবধানে রাখবে। তুমি বরং লেসনিকে ডেকে বন্দুকটা ওকে নজরে রাখতে বলল।

এরপর আমাকে ইশারা করতে আমরা সিঁড়ি পেরিয়ে প্যাসেজ দিয়ে এগোতে লাগলাম।

 প্যাসেজের শেষে করিডোর। এখান থেকে কয়েক পা এগিয়ে মুরগীর খাঁচার মত একটা ঘর। তাতে একটা ডেস্ক, দুটো চেয়ার, একটা ফাইলিং ক্যাবিনেট আর একটা ছোট জানালা। দেখলে মনে হবে কোন অনাথ আশ্রমের কমনরুম।

ডেস্কের পেছনের চেয়ারে নিজে বসে আমাকে সামনের চেয়ারটায় বসতে বলল।

–এইটা আপনার অফিস? ভেবেছিলাম মেয়রের শালার অফিসে আরও কিছু থাকবে।

আমার অফিস নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। এখন ভাবো ঐ বন্দুকটা যদি তোমার হয় আর ব্যাগটা মেয়েটার হয়, তাহলে তোমার কি হবে! ধরে নিতে পারো তুমি মরেছ। এতে কোন ভুল নেই।

চেয়ারে আরাম করে বসতে বসতে বললাম, তাই নাকি!দেখুন প্রায় দশ মিনিট কিংবা তার বেশি সময় ধরে আমাকে প্রলোভনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। যদি আমি ঐ বন্দুক আর হ্যান্ডব্য সমুদ্রে ফেলে দিতাম কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলতাম, তাহলে লেফটেন্যান্ট, আপনার মত বুদ্ধিমান পুলিশ বাহিনীর সাধ্য হতো না ওগুলো খুঁজে বের করা। তাই আমার উদ্দেশ্যটা বুঝুন, আমি চাই এই খুনের একটা কিনারা হোক।

কী বলতে চাইছো তুমি?

আমি এগুলো লোপাট করিনি এইজন্য যে সমস্ত ব্যাপারটা সাজানো হয়েছে প্ল্যানমাফিক। গাড়ির জিনিষগুলো এইজন্য দেখালাম যে না দেখালে কেসটার কিনারা করতে আপনার অসুবিধা হবে।

–তা এই বন্দুক আর হ্যান্ড ব্যাগটা দেখে কি হলো?

–আপনি শুধু আমার দিকেই চোখটা নিবদ্ধ রাখবেন না। এগুলো থেকে আপনি কোন সূত্র পেতে পারেন। আসল খুনী তো এটাই চায় আমাকে খুনী বানিয়ে নিজে পেছন থেকে দেখবে, আপনি আমার পেছনে ধাওয়া করছেন।

রেটনিক কিছুক্ষণ ঝিম মেরে তারপর সিগারকেস থেকে চুরুট বের করে একটা আমাকে দিল। যদিও চুরুট খেতে আমার ভাল লাগেনা, তবুও আস্তে আস্তে টানতে লাগলাম।

ঠিক আছে রায়ান, আমি তোমাকে বিশ্বাস করলাম, ভেবেছিলাম মেয়েটাকে তুমিই মেরেছে, তাহলে আমার কাজকর্ম অনেক হালকা হয়ে যেত। এখন আর সেটা ধরা যাচ্ছে না। যাই হোক, আমি এখন আর তোমাকে খোঁচাব না।

আবার বলতে লাগল রেটনিক, তবে হ্যাঁ, শালা,বাস্টার্ড বড়সাহেবকে তো জানো, ও শালাকে বোঝানো একটা ঝামেলার ব্যাপার! হাতের কাছে জেলে ভরার মত একটা লোক থাকতে মনে হয় না ধৈর্য ধরে কিছু শুনবে বলে।

ব্যাপারটা ঠিকই, আমি চুপ করে রইলাম।

রেটনিক জানলার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছে।

-তোমাকে নিয়ে যে কি করব, তাই ভাবছি। এই বলে ফোনের দিকে হাত বাড়াল।–এজন্যে কিছু সময়ের প্রয়োজন।

টেলিফোনের অপর প্রান্তে কারোর গলা পেয়ে রেটনিক বলল, শিগগীর চলে এস, দরকার আছে।

কিছুক্ষণ পর বেশ ঝকঝকে, বুদ্ধিদীপ্ত এক যুবক ঘরে ঢুকলো।

রেটনিক আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। আমাকে দেখিয়ে বলল, এ হচ্ছে নেলসন রায়ান একটা টিকটিকি। একে আমার পরে দরকার পড়বে, তুমি একে সঙ্গ দাও। এরপর ওকে দেখিয়ে বলল, এ হচ্ছে প্যাটারসন, নতুন জয়েন করেছে। একে নষ্ট করে দিও না।

আমরা করিডোর দিয়ে কিছুটা হেঁটে একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকলাম। সারা ঘরে জীবাণুনাশক ওষুধের গন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি জানলার ধারে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। প্যাটারসন ডেস্কের কোণায় ঠেকা দিয়ে দাঁড়ালো।

–আরাম করে বসা যাক। আমি বললাম। এখানে হয়ত কয়েকঘণ্টা বসে থাকতে হবে আমাদের। জানেন তো আপনার বস্ আমাকে একটা চীনা মেয়ের খুনীবলে চালাতে চেষ্টা করছে, যদিও সেটা প্রমাণ করার সুযোগ নেই। চোখ কুচকে তাকালো প্যাটারসন।

ওকে একটু খোলামেলা করার জন্যে রেটনিকের আধপোড়া চুরুটটা দিয়ে বললাম, এটা মিউজিয়ামে রাখার মত জিনিষ। রেটনিকের স্টকের মাল। তোমার সংগ্রহশালার জন্যে এটা নেবে?

প্যাটারসনের মুখটা আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে আসছে, বলল, দেখুন আমরা বসদের নিয়ে এরকম…

ব্যস্ ব্যস্। ঠিক আছে। আমি তোমার বসূদের প্রতি অসম্মানজনক কিছু বলেছি, এটা স্রেফ মজা করার জন্যে।

কয়েক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করে ও হেসে আরাম করে বসল।

লাঞ্চের সময় একটা পুলিশ আমাদের থালায় করে মাংস আর জীন দিয়ে গেল। অল্প বয়সের প্যাটারসনের খাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল ওর বেশ ভাল লেগেছে আর খিদেও পেয়েছে। আমি থালাটা নাড়াচাড়া করে ফেরৎ পাঠালাম।

এরপর প্যাটারসন এক প্যাকেট তাস বের করল। আমরা দেশলাই দিয়ে রামি খেলোম।

ওর পুরো দেশলাই বাক্স জিতে নেওয়ার পর ওকে দেখিয়ে দিলাম ওকে আমি কিভাবে ঠকাচ্ছিলাম। ওকে বেশ মনমরা দেখাল। তারপর ওকে এই খেলার চুরি বিদ্যেটা শিখিয়ে দিলাম। ও উৎসাহী ছাত্রের মত ব্যাপারটা শিখে নিল।

রাত আটটা নাগাদ সেই পুলিশটাই আবার সেই একই খাবার নিয়ে এল। এতখানি সময়ের মধ্যে এমন একটা অবসাদ এসে গেছে যে সমস্ত খাবারটা আমরা বিরক্তি কাটাবার জন্য খেয়ে নিলাম।

খাওয়ার পর আমরা আবার রামি খেলতে বসলাম। এবার প্যাটারসন আমাকে ঠকিয়ে পুরো বাক্সটাই জিতে নিল। একেই বলে গুরু মারা বিদ্যে।

মাঝরাত নাগাদ টেলিফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার তুলে প্যাটারসন ও-ধারের কথা শুনল।

তারপর বলল, হ্যাঁ স্যার।

টেলিফোন রেখে বলল, লেঃ রেটনিক আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। চলুন যাই।

আমরা এতক্ষণ বেশ কথাবার্তা বলছিলাম। কিন্তু আমরা বিচ্ছেদের আগে কথা বলা বন্ধ করেছি।

দুজনে করিডোর দিয়ে হেঁটে রেটনিকের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।

রেটনিক বেশ ক্লান্ত এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। একটা চেয়ারদেখিয়ে আমাকে বসতে বলল। প্যাটারসন চলে গেল।

বেশ কিছু সময় আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

–তুমি খুব ভাগ্যবান লোক,বুঝলে রায়ান। আমি মনে করিনা খুনটা তুমি করেছে কিন্তু আমি নিশ্চিত বড়সাহেবের কাছে তোমাকে নিয়ে গেলে তোমার বাপও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।

গত পনের ঘন্টা আমি এই বাড়িতে কাটিয়েছি। সত্যি বলতে কি এতক্ষণ আমি বেশ একটা অস্বস্তিকর ভয়ের মধ্যে ছিলাম।

রেটনিকের কথা শুনে আমি বেশ বড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

–তাহলে আপনি বলছেন আমি ভাগ্যবান।

–হ্যাঁ। চেয়ারে বেশ হেলিয়ে বসে একটা চুরুটের জন্যে প্যাকেট হাতড়াতে গিয়ে খেয়াল হল তার দাঁতের ফাঁকে একটা নিভে যাওয়া চুরুট আটকানো। সেটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে বাস্কেটে ফেলে দিল। তারপর বলল, দেখ গত চোদ্দ ঘণ্টা আমার টিম এই ঘটনার পেছনে খাটছে। আমরা একজন সাক্ষী পেয়েছি যে তোমাকে ভোর আড়াইটে নাগাদ তোমায় গাড়িতে বুলেভার্ডে দেখেছে। সাক্ষী একজন অ্যান্টনী। বড়সাহেবের সঙ্গে ওর অনেকক্ষণ ধরে খচাখচি চলছে। সুতরাং এই সাক্ষীই বড় ঝাহেবের উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাদ সাধবে। তাহলে ধরে নিচ্ছি তুমি খুন করনি।

-একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, কিছু মনে করবেন না। আচ্ছা খুনটা কে করতে পারে এ ব্যাপারে কি আপনার কোন আইডিয়া আছে?

না। এত তাড়াতাড়ি কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে সে যেই হোক এখনও পর্যন্ত কোন সূত্র পাওয়া যায়নি। খুব প্ল্যানমাফিক কাজটা হাসিল করেছে।

চীনা মেয়েটার সম্বন্ধে কিছু জানতে পারলেন।

–ও, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মেয়েটার ব্যাগে সাধারণ টুকিটাকি জিনিষ ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ও হংকং থেকে এসেছে। নাম জো-অ্যান-জেফারসন। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য হচ্ছে মেয়েটা লক্ষপতি তেলের ব্যবসায়ী উইলবার জেফারসনের পুত্রবধূ। স্বামীর নাম হেরম্যান জেফারসন। বছর খানেক আগে ওদের হংকং-এ বিয়ে হয়। তারপর হঠাৎ মোটর দুর্ঘটনায় হেরম্যানের মৃত্যু হয়। তার মৃতদেহ কবর দেওয়ার জন্যে মেয়েটা এখানে নিয়ে আসছিল।

-কেন? আমি রেটনিকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।

বৃদ্ধ জেফারসন চেয়েছিলেন ওঁদের পারিবারিক কবরখানাতেই ওদের ছেলেকে সমাহিত করা হোক।

উনি মৃতদেহটা এখানে আনার জন্যে টাকাও পাঠিয়েছিলেন।

–তারপর মৃতদেহটার কি হল?

-সেটা ওঁর আদেশে একজন এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে গেছে। দেখ গিয়ে, এখন ওটা জেফারসনের বারান্দায় রেখে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

–আপনি নিজে গিয়ে দেখে এসেছেন? রেটনিক খুব ক্ষেপে গেল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, আমার কাজের ব্যাপারে তোমার থেকে জ্ঞান শুনতে চাইনা। আমি নিজে গিয়ে কফিনটা দেখে এসেছি, সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও। সব ঠিক আছে। মেয়েটা হংকং থেকে রাত দেড়টার সময় এয়ারপোর্টে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা তোমার অফিসে যায়। একটা ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি না যে, মেয়েটা এখানে এসে সোজা তোমার সঙ্গে দেখা করতে গেল কেন? এবং খুনীই বা জানতে পারল কী করে যে ও তোমার কাছেই যাচ্ছে? তোমার সঙ্গে ওর কি কথাই বা ছিল?

–আমারও তো ঐ একই প্রশ্ন। আর তাছাড়াও যদি হংকং থেকে এসে থাকে আমার কথা জানলই বা কী করে? আমি বললাম।

–তুমি বলেছিলে না তোমার ধারণা মেয়েটা সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ তুমি যখন অফিসে ছিলে না ফোন করেছিল। সেটা খাটছে না। কারণ মেয়েটা সেই সময়ে প্লেনে। আর যদি সে চিঠি লিখে। কোন যোগাযোগ করত, তবে আমরা কিছু জানতে পারতাম।

আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম, আচ্ছা রা যাক মেয়েটা এয়ারপোর্টে এসে হার্ডউইকের সাক্ষাৎ পেল। কারণ সে আমাকে ছটায় ফোন করেছিল। আবার এটাও ধারণা করতে পারি যে হার্ডউইক মেয়েটা আসা পর্যন্ত এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করল এবং সে নিজেকে আমি বলে পরিচয় দিল। তারপর মেয়েটার কফিন খালাসের সময়টুকুতে আগে আমার অফিসে গিয়ে পৌঁছল। আর বাইরের দরজার তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে মেয়েটার জন্যে অপেক্ষা করছিল।

আইডিয়াটা রেটনিকের মনঃপুত হল না। অবশ্য আমার নিজেরও হয়নি।

-কিন্তু তোমার সঙ্গে ওর দেখা করার প্রয়োজনটা কি ছিল? বেশ অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করল।

–এর উত্তর জানা থাকলে আমরা উভয়ে উভয়কে একই প্রশ্ন করে চলতাম। যাকগে মেয়েটার মালপত্রের খোঁজ নিয়েছেন?

–হুঁ। এয়ারপোর্ট ছাড়ার আগে ও নিজের মালপত্র পরীক্ষা করে দেখেছিল। তেমন কিছু না,, একটা সাধারণ সুটকেশে কিছু জামাকাপড়, একটা ছোট বুদ্ধমূর্তি আর কয়েকটা ডার্স স্টিক।

–আপনি মিঃ জেফারসনের সঙ্গে দেখা করেছেন?

 মুখটা বিকৃত করে বলল, করেছি। উঁচু মহলের সঙ্গে আমার ওঠাবসা আছে বলে ব্যাটা আমাকে দেখলে জ্বলে যায়। বুঝলে প্রতিপত্তিশালী পরিবারে বিয়ে করার এই জ্বালা। আমার বড় শালার সঙ্গে জেফারসনের সম্পর্ক দা আর কুমড়োর। হতভাগা বলে কি আর যদি আমি তাড়াতাড়ি ওর পুত্রবধূর খুনীকে ধরতে না পারি, তবে ও আমাকে বিপদে ফেলবে। আর ইচ্ছে করলে আমাকে বিপদে ফেলতেও পারে।

এ ব্যাপারে ও আমাদের সাহায্য করবে?

একদম না।

–আচ্ছা সেই এক্সপ্রেস মেসেঞ্জার-এর খোঁজ নিয়েছে? সে হয়ত খুনীকে দেখে থাকতে পারে।

রেটনিক এবার বেশ খচে গিয়ে বলল, দেখ টিকটিকি তুমি নিজেকে যত বড় গোয়েন্দা বলে ভাব, তার অর্ধেকও তুমি নও। আমি সবরকম খোঁজ করেছি ঐ অফিসের বুড়ো কেরানীগুলো খেয়াল করেনি টাকাটা কে দিয়ে গেছে আর একটা ব্যাপার, টাকার খামটা চারটের সময় পাঠানো হয়েছিল এবং নির্দেশ ছিল যে তোমাকে যেন ছটা পনেরর সময় দেওয়া হয়।

হেরন কর্পোরেশনে খোঁজ নিয়েছেন, হার্ডউইক নামের কেউ কাজ করে কিনা।

–ঐ নামের কেউ ওখানে কাজ করে না। অনেক হয়েছে আজ। হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এবার বিছানায় চললাম, কাল কথা হবে।

আমিও উঠে দাঁড়ালাম।

রেটনিকের চোখ ঢুলুঢুলু। তবুও ওঁকে আর একটা প্রশ্ন করলাম।

-খুনটা কি আমার বন্দুক দিয়েই করা হয়েছে?

–হ্যাঁ, তবে হাতের ছাপ বন্দুকে কিংবা গাড়িতেও পাওয়া যায়নি। ব্যাটা একটা বাস্তু ঘুঘু। তবে একটা ভুল নিশ্চয়ই ও করেছে। সব খুনীরাই করে।

সব খুনীরা নয়, কেউ কেউ। আমি বললাম।

রেটনিক বলল, যাক গে সে সব কথা, আমি তোমাকে অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচিয়েছি, এবার আমার দরকারে আমি তোমার সাহায্য চাই।নতুন কোন আইডিয়া মাথায় এলে বোল। আমার আরো নতুন নতুন আইডিয়া দরকার।

নিশ্চয়ই। ধন্যবাদ। আমার যথাসাধ্য সাহায্য আমি আপনাকে করব।

 নীচে নেমে এসে, গাড়িতে চড়ে, ঘরে এসে ঘুমে ঢলে পড়লাম।

.

১.৪

 পরদিন সকাল নটায় অফিস পৌঁছে দেখি ঢোকার মুখে কয়েক জোড়া খবরের কাগজের লোক অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখে প্রথমেই প্রশ্ন করল, কাল সারাদিন আমি কোথায় ছিলাম, তারপর খুনের ব্যাপারে নানা প্রশ্ন করতে আমি ওদের নিরাশ করলাম।

আমি সকলকে আমার অফিস ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালাম এবং জানালাম কাল সারাদিন পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ছিলাম। খুনের ব্যাপারে তাদের চেয়ে আমি বেশি কিছু জানিনা। চীনা মেয়ে কি জন্যে এসেছিল, কি করে আমার ঘরে ঢুকল আমার কোন ধারণাই নেই। তারপর আধঘণ্টা ধরে নানা প্রশ্ন করে উত্তর না পেয়ে তারা চলে গেল।

ডাকবাক্সটা খুলে বেশিরভাগ চিঠিই পড়ে আবর্জনা বাস্কেটে ফেলে দিলাম। একটা চিঠি এসেছে পামা মাউন্টেন থেকে এক ভদ্রমহিলা লিখেছেন তার কুকুরকে কে বিষ খাইয়েছে তাকে ধরে দেওয়ার জন্যে।

ঠিক এমনই সময় দরজায় কে টোকা দিল।

আমি তাকে ভিতরে আসতে বললাম। মিঃ ওয়েডে ভেতরে এল।

আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল, আপনাকে বিরক্ত করলাম বোধহয়। যদিও এটা আমার কোন ব্যাপার নয় তবুও কৌতূহলবশতঃ জিজ্ঞেস করছি, পুলিশ জানতে পেরেছে খুনী কে?

না। আমি বললাম।

একটা কথা বলার ছিল। একটু ইতস্ততঃ করে বলল, অবশ্য এতে আপনার কোন সাহায্য হবে কিনা জানি না। সেদিন সাতটা নাগাদ, আপনার টেলিফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বেজেছিল।

-আমার ফোন সব সময়ই বাজে। তবে আপনাকে ধন্যবাদ। বলা যায় না এটাও একটা দরকারী খবর হতে পারে। আমি মিঃ রেটনিককে জানাবো।

ওয়েডে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, আমি ভাবলাম এসব খুনের কেসে এইসব খুঁটিনাটি ব্যাপার অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তবে একটা ব্যাপার সবাই জানতে চাইছে যে মেয়েটা আপনার ঘরে ঢুকল কি করে। এটা আপনাকে একটু অসুবিধেয় ফেলবে বলে মনে হয়।

না, একটুও না। খুনী আগে থেকেই আমার অফিসে ঢুকেছিল এবং মেয়েটাকে ঢুকিয়েছে।

–তবে তো ভালই। আচ্ছা মেয়েটার সম্বন্ধে কিছু জানা গেল?

–ওর নাম জো-অ্যান-জেফারসন। হংকং থেকে এসেছিল।

-জেফারসন? আমি একজন হেরম্যান জেফারসনকে জানি যে হংকং-এ গিয়েছিল। ও আমার স্কুলের পুরোন বন্ধু।

আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ডেস্কের ওপর পাটা ছড়িয়ে দিয়ে বললাম, তা আপনি এখন বসুন। আর বলুন হেরম্যান সম্বন্ধে কি জানেন। মেয়েটা ওরই স্ত্রী।

ওয়েডে চমকে উঠল। বসে পড়ে বলল, হেরম্যান চীনা মেয়েকে বিয়ে করেছিল?

–তাইতো মনে হচ্ছে।

আমি চুপ করে ওকে লক্ষ্য করতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, অবশ্য চীনা মেয়ে তো কি? আজকাল তো শুনেছি চীনা মেয়েরা খুবই আকর্ষণীয়া হয়। কিন্তু হেরম্যানের বাবা এটাকে কিভাবে নেবে। আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে ও কী করতে এসেছিল?

–ও ওর স্বামীর মৃতদেহ এখানে কবর দেওয়ার জন্যে নিয়ে আসছিল।

এবার ও চমকে শক্ত হয়ে গেল।

তার মানে হেরম্যান মারা গেছে?

গত সপ্তাহে…এক মোটর দুর্ঘটনায়।

বোবা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল। মনে হল যা শুনল তার কিছুই বুঝতে পারছে না। খালি উচ্চারণ করল, হেরম্যান…মারা গেছে উঃ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। ওর বাবা এ খবর পেলে কি দুঃখ পাবেন। ।

-হ্যাঁ সে তো নিশ্চয়ই। আপনি কি ওদের ভালভাবে জানেন?

–ভালভাবে? না সেভাবে নয়। আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। ও চিরকালই একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। একটা না একটা কিছু নিয়ে ঝামেলা পাকাত। মেয়েদের পেছনে গাড়ি ছোটাত। সে সময় ওকে আমার খারাপ লাগত না। এরপর আমি কলেজে ভর্তি হলাম। ওর কোন পরিবর্তন হল না। সেই মদ্যপান, মেয়ে নিয়ে ফুর্তি, অকাজকুকাজ বেড়েই চলতে লাগল। তারপর ওর– সঙ্গে আমি মেলামেশা ছেড়ে দিলাম। পরে ওর বাবা ওকে পূর্ব দিকের কোন দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সে বছর পাঁচেক আগের কথা। তারপর পায়ের ওপর পা-টা তুলে বলল, শেষে ও একটা চীনা মেয়েকে বিয়ে করেছিল? এটা কিন্তু ওর পক্ষে খুবই আশ্চর্য ঘটনা।

–কিন্তু এটাই ঘটেছে।

–ও একটা মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছে? অবশ্য ও যেভাবে গাড়ি চালাত, তাতে তো যে কোন সময়েই ভেঙে চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারত। এতদিন যে গাড়ি চালাতে পেরেছে, সেটাই মহা আশ্চর্যের। ঘটনাটা শুনে এত খারাপ লাগছে। কিন্তু মেয়েটা খুন হল কেন?

-সেটাই তো পুলিশ খুঁজে বের করতে চাইছে।

 –আমি খালি ভাবছি মেয়েটা আপনার কাছে এলে কেন? এটা একটা রহস্য নয় কি?

 ভদ্রলোকের এই অযাচিত কৌতূহলে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, হ্যাঁ।

ও-ঘরে ফোনের আওয়াজ পেলাম। ও উঠে দাঁড়ালো।

-দেখুন তো আমি আপনার কত সময় নষ্ট করলাম। দুঃখিত। যাই হোক হেরম্যান সম্বন্ধে বিশেষ কিছু মনে করতে পারলে আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে এসে জানিয়ে যাবে। এখন চলি।

আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার চলে যাওয়াটা লক্ষ্য করলাম। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।

চেয়ারের গদীতে গা ডুবিয়ে মিঃ ওয়েডে এতক্ষণ যা বলে গেল সেগুলো চিন্তা করছিলাম, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠতে রিসিভারটা তুললাম।

মিঃ জে, উইলবার জেফারসনের সেক্রেটারী বলছি। একটা মেয়েলী, সুন্দর, পরিষ্কার কণ্ঠস্বর, শুনতে বেশ ভাল লাগে। আপনি কি মিঃ রায়ান?

–হ্যাঁ। আমি জবাব দিলাম।

–মিঃ জেফারসন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনি কি আজ বিকেল তিনটে নাগাদ একবার আসতে পারবেন?

আমি উৎসাহিত হয়ে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট রেজিস্টার টেনে নিয়ে দেখলাম বেশির ভাগ পাতাই সাদা। তার মানে আজ তিনটের সময় কোন কাজ নেই। এমন কি, এ সপ্তাহটাই আমার কাজহীন কাটবে অর্থাৎ কাজ নেই।

 বললাম, ঠিক আছে যাবো।

বীচ ড্রাইভে সমুদ্রের দিকে মুখ করা শেষ বাড়িটা। কোন অসুবিধা হবে না তো? বাড়ির নাম বীচ-ভিউ।

–আচ্ছা। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবো।

ধন্যবাদ। ওদিকে টেলিফোন রেখে দিল।

মেয়েটার গলার আওয়াজ আমার কানে বাজছে। গলা শুনে মনে হল যুবতী। অবশ্য গলা শুনে চেহারা আন্দাজ করলে অনেক সময় ঠকতে হয়। রিসিভার রেখে দিলাম।

পাশের ঘরে মিঃ ওয়েডে মনে হচ্ছে খুব ব্যস্ত। সারাদিন টেলিফোন বেজেই চলেছে, তার সঙ্গে টাইপ রাইটারের খটখট শব্দ। সন্দেহ নেই, ভদ্রলোক আমার মতো নিষ্কর্মাভাবে কাটাচ্ছে না। পকেটও ভারি হচ্ছে। আমার পকেটে অবশ্য রহস্যময় মিঃ হার্ডউইকের দেওয়া তিনশ ডলার রয়েছে।

বেলা একটার সময় কুইক-ম্যাক্সবার-এ খেতে গেলাম। দেখলাম দোকানে খুব ভিড়। স্প্যানোর মুখ দেখে মনে হল খুনের ঘটনাটা এখনও পর্যন্ত কতখানি এগোল জানার জন্যে খুবই কৌতূহলী। কিন্তু কথা বলার সুযোগ ও পেল না। আমি খেয়ে বেরিয়ে এলাম।

তারপর গাড়ি নিয়ে গেলাম বীচ ড্রাইভ-এ। প্যাসাডেন সিটির মতো বর্ধিষ্ণু এলাকা। ধনী, অবসরপ্রাপ্ত লোকেরা শহরের ভীড় এড়িয়ে একটু নিরিবিলিতে এখানে বাস করে।

-তিনটে বাজার কয়েক মিনিট আগেই আমি বীচ-ভিউ এর ফটকে পৌঁছালাম। প্রায় চল্লিশ গজ ভেতরে গাড়ি চালিয়ে বাড়ির সামনে গাড়ি থামালাম।

বাড়িটা পুরোনো ঢং-এর এবং বড়সড়। সাদা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরের সামনে এসে বেল বাজালাম।

বেল টেপার কয়েক মিনিট পর ফ্যাকাসে মুখের এক বাটলার এসে প্রশ্নসূচক ভঙ্গিমায় ভ্র তুলে আমার দিকে তাকাল।

নেলসন রায়ান, আমার এখানে আসার কথা ছিল। আমি বললাম।

 বাটলারের ইঙ্গিতে আমি ওর পেছন পেছন চললাম। অন্ধকার হলঘরে কিছু পুরোনো আসবাবপত্র। ওটা পেরিয়ে একটা ছোট ঘর; কয়েকটা চেয়ার আর টেবিল। টেবিলে ম্যাগাজিন। লোকটা আমাকে বসতে বললেও আমি পায়চারী করতে করতে সমুদ্রের শোভা দেখছি। এমন সময়ে একটা মেয়ে ঘরে ঢুকল।

বয়স আটাশ থেকে ত্রিশ-এর মধ্যে। লম্বা, কালো, সুন্দরী। চোখ দুটো কালচে নীল, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। গাঢ় নীল পোষাকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছিল।

–আপনাকে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্যে দুঃখিত মিঃ রায়ান। ঈষৎ মিষ্টি হেসে বলল, মিঃ জেফারসন এখন আপনার সঙ্গে দেখা করতে প্রস্তুত।

–আপনি কি তার সেক্রেটারি?

হ্যাঁ, আমার নাম জেনেৎ ওয়েস্ট। আসুন আমার সঙ্গে।

মেয়েটিকে অনুসরণ করে একটা বড় ঘরে ঢুকলাম। পুরোনো সেকেলে ঘর। সুন্দর বসার ব্যবস্থা। দুটো বড় জানলা খোলা। দূরে গোলাপ বাগান দেখা যাচ্ছে।

মিঃ উইলবার জেফারসন একটা চাকা লাগানো বেড চেয়ারে বসে আছেন। ভদ্রলোক লম্বা, রোগা, খাদা নাক, গায়ের রং হলদে হয়ে যাওয়া পুরোনো হাতির দাঁতের মত, মাথায় সাদা নরম চুল, হাতদুটো নোগা এবং শিরা ওঠা। পরণে সাদা লিনেন সুট, পায়ে হরিণের চামড়ার জুতো। আমি ঘরে ঢুকতে আমার দিকে তাকালেন।

–ইনি মিঃ রায়ান, বলে আমার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে জেনেৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

এই চেয়ারটায় বসুন, বলে জেফারসন তার খুব কাছে একটা চেয়ার দেখালেন। আবার বললেন, আমার শ্রবণশক্তি ইদানিং একটু কমে গেছে, সুতরাং একটু জোরে কথা বলবেন। আমি বছর ছয়েক হলো ধূমপান ছেড়ে দিয়েছি, আপনি যদি চান তো খেতে পারেন।

–আমি আপনার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়েছি, কিছুক্ষণ নীরবতার পর উনি বললেন। আমি শুনেছি আপনি সৎ, নির্ভরযোগ্য ও বুদ্ধিমান। উনি খুব নিবিষ্ট মনে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে বললেন।

আমার সম্বন্ধে এই খোঁজ খবর তাকে কে দিয়েছে জানতে ইচ্ছে হলেও কিনীত মুখে চুপ করে বসে থাকলাম।

–আমি আপনাকে এখানে ডেকে এনেছি কারণ যে লোকটা আপনাকে ফোন করেছিল এবং আপনার অফিসে চীনা মেয়েটাকে কিভাবে মৃত অবস্থায় দেখলেন, এই পুরো ঘটনাটা মুখ থেকে শুনতে চাই।

লক্ষ্য করলাম উনি আমার পুত্রবধূ বললেন না এবং চীনা মেয়েটা বলার সময় ওঁর মুখের দু-পাশে ঘৃণায় কুঁচকে গেল। অবশ্য অনুমান করা যায় তার মতো প্রাচীনপন্থী ধনী ব্যক্তি তার একমাত্র পুত্র অন্য জাতের বা এশীয় দেশের মেয়েকে বিয়ে করলে তার আপত্তি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

আমি পুরো ঘটনাটা তাকে বেশ জোর গলায় শোনালাম। আমার কথা শেষ হলে উনি বললেন, ধন্যবাদ মিঃ রায়ান। আপনার সঙ্গে মেয়েটি কেন দেখা করতে এসেছিল, সে ব্যাপারে আপনি কোন আন্দাজ করতে পারেন কী?

-না, আমার কোন ধারণা নেই।

–ওকে কে মেরেছে, সে ব্যাপারে কিছু আন্দাজ করতে পারেন?

না। খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললাম, তবে যে লোকটা নিজেকে হার্ডউইক বলেছে, সে হতে পারে কোন ভাবে এই খুনের সঙ্গে জড়িত।

–আমার রেটনিকের ওপর একদম বিশ্বাস নেই। ও একটা গাধা,বুদ্ধ। ঐ পদে চাকরি করার ওর কোন যোগ্যতাই নেই। তবে যে আমার পুত্রবধূকে খুন করেছে আমি তাকে ধরতে চাই। তারপর নিজের হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন, দুর্ভাগ্যবশতঃ ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল ছিল না। আজ সে মৃত, এখন বুঝতে পারছিআমি যদি আরও একটু ধৈর্যশীল হতাম, তবে হয়ত ঘটনাটা এরকম হতো না। আমি এটাও জানি যে আমার ধৈর্যের অভাব দুজনের মধ্যে একটা ফাঁক সৃষ্টি করেছিল। ওকে যদি আরও একটু বুঝতে চেষ্টা করতাম তবে ও এতটা অশান্ত হতো না। যাকে । ও বিয়ে করেছিল আমি জানি ও বেঁচে থাকলে খুনীর শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত ও শান্ত হতো না। আমার ছেলে এখন মৃত,সুতরাং ওর স্ত্রীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা আমার দায়িত্ব। এতে আমি সফল হলে বুঝবো মৃত পুত্রের জন্য এটুকু অন্ততঃ করলাম।

এরপর জেফারসন বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ জানলার দিকে চেয়ে রইলেন। দুঃখী মুখ, কিন্তু বোঝা যায় এই কাজে উনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখুন মিঃ রায়ান, আমি বৃদ্ধ। একটুতেই হাঁপিয়ে যাই। এই দুর্বল শরীরে খুনীকে খুঁজে বের করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি। খুনটা যখন আপনার অফিসেই হয়েছে আশা করি এ কেসটা নিতে আপনি আগ্রহীসুতরাং খুনীর অভিসন্ধি আপনাকেও এই কেসেজড়ানো। আপনি কি কাজটা নেবেন? আমি আপনাকে আপনার পরিশ্রমের পুরো মূল্য দেব।

আমি বললাম, এ ব্যাপারে পুরো তদন্ত এখন পুলিসের হাতে। শুধু তারাই খুনীকে খুঁজে বের করতে পারে। তাছাড়া খুনের কেস একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের কাজের আওতার বাইরে। রেটনিক এটা চাইবে না যে বাইরের কেউ এ কেসটায় হাত দিক বা কোন সাক্ষীকে প্রশ্ন করুক। আপনি আমাকে টাকা দিলেও আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারবো না মিঃ জেফারসন।

আমার কথা শুনে ভদ্রলোক আশ্চর্য হলেন বলে মনে হল না, বরং তার চোখেমুখে একটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাব ফুটে উঠল।

–আমি জানি। তবে রেটনিকের ওপর আমার কোন ভরসা নেই। ওকে বলেছিলাম হংকং-এ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে একটা কেবল করতে যাতে মেয়েটা সম্বন্ধে আরও বিশদ কিছু জানা যায়। আমার ছেলের চিঠি থেকে আমি শুধু এটুকু জানি যে ও একজন রেড চায়নার উদ্বাস্তু। বছর খানেক আগে ও আমাকে চিঠি লিখেছিল যে ও একটা চীনা উদ্বাস্তুকে বিয়ে করছে। আমি বোকার মত এই বিয়েতে অমত করেছিলাম আর তারপর কোন চিঠিপত্তর পাইনি। একটা গাঢ় নিঃশ্বাস ফেললেন।

–আপনার কি মনে হয় বৃটিশ পুলিশ মেয়েটির সম্বন্ধে আরও বিশদ কিছু জানাতে পারবে? আমি প্রশ্ন করলাম।

উনি মাথা নাড়লেন এবং বললেন, সে সম্ভাবনা আছে, তবে জোর দিয়ে বলতে পারি না। প্রত্যেক বছর কয়েক হাজার রিফিউজি-হংকং-এ আসে। এদের পরিচয়পত্র বা কাগজপত্রও থাকেনা। হংকং-এ অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় থাকায় ওখানকার অবস্থার অনেককিছু জানি আমি। যতদূর জানি রেডচায়না থেকে নৌকোতে এই উদ্বাস্তুদের মাকাউ পর্তুগীজ এলাকায় চালান দেওয়া হয়। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের জন্যে এরা মাকাউতে জায়গার অভাবে হংকং-এ চলে আসে নৌকো করে। সেখানে ব্রিটিশ পুলিশ তাদের নৌকোকে তাড়া করলে ঐ উদ্বাস্তু নৌকোগুলো ওখানকার সাধারণ মাছধরা নৌকো গুলোর সঙ্গে মিশে যায়। দুটো নৌকোই প্রায় একই রকম দেখতে। পুলিশের পক্ষে তাদের খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া ঐ পুলিশরা ওদের ওপর বেশ সহানুভূতিশীল কারণ ওরাও একসময় ঐরকম ভয়ঙ্কর রাত্রি কাটিয়েছে শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে। নৌকোগুলো যখন হংকং এর সমুদ্র সীমানার মধ্যে ঢুকে যায় তখনই রিফিউজি খোঁজা বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ মনে করে এরা সব হারিয়েছে, এদের আবার ফেরৎ পাঠানো অমানুষিক ব্যাপার। তখন বৃটিশ পুলিশ এদের কাগজপত্র দিয়ে নতুন পরিচয় তৈরী করে। কাজেই এদের আসল নামধাম জানার কোন উপায় থাকে না। হংকং-এ ঢোকামাত্র নতুন জীবন শুরু হয় এদের। আমার পুত্রবধূও এদেরই একজন। এখন যতক্ষণ না এর প্রকৃত পরিচয় জানা যাচ্ছে, ততক্ষন খুনী কে, উদ্দেশ্য কি ছিল কিছুই জানা যাবেনা। তাই আমি বলি তুমি হংকং চলে যাও এবং দেখ এর সম্বন্ধে কোন খোঁজখবর আনতে পার কিনা। রেটনিক বা বৃটিশ পুলিশ এ ব্যাপারে খুব একটা গা করবে না। খরচপাতি সব আমার। তোমার কি মত?

আইডিয়াটা মন্দ নয়, তবে কতটা সফল হতে পারবে সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

–আমি যাবো, তবে মনে হয় খুব একটা সুবিধে করতে পারবো না। যতক্ষণ না ওখানকার হালচাল বুঝছি কিছুই বলা যাচ্ছে না। যাই হোক দেখা যাক।

–তুমি আমার সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বল। সে তোমাকে কতকগুলো চিঠি দেখাবে, আমার ছেলের লেখা। তোমার কাজে লাগতে পারে। যাই হোক যথাসাধ্য চেষ্টা কর। ডানদিকের বারান্দা ধরে চলে যাও, তিন নম্বর ঘরে আমার সেক্রেটারিকে পেয়ে যাবে।

আপাততঃ উনি বিদায় করতে চাইছেন আমাকে, এটা বুঝে উঠে দাঁড়ালাম।

–আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি এক্ষুণি যেতে পারছি না। কেননা রেটনিকের জিজ্ঞাসাবাদ এখনও শেষ হয়নি। কাজেই ওর কাছ থেকে গ্রীন সিগন্যাল না পেলে আমি কোথাও যেতে পারছি না।

উনি মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক আছে। আমি দেখব রেটনিক যাতে তোমাকে কোন বাধা দিতে না পারে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি চলে যাও।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ভদ্রলোকের চোখদুটো দেখে মনে হলো বিগত দিনের ঘটনাগুলি স্মরণ করে বেদনায় পাথর হয়ে গেছে।

অফিস ঘরের মত সাজানো একটা বড় ঘরে জেনে ওয়েস্টকে খুঁজে পেলাম। সামনের ডেস্কের ওপর ছড়ানো একগোছ চেকবই, একগোছা বিল। আমি ঢুকতেই মদিরতাময় চোখ দিয়ে ইশারায় আমাকে বসতে বললো।

–আপনি কি হংকং যাচ্ছেন, মিঃ রায়ান, চেক বইটা ঠেলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল। বুঝলাম। ও আমাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছে।

–হ্যাঁ, যাব তো ভাবছি, তবে এক্ষুণি নয়। ভাগ্য ভাল হলে এসপ্তাহের শেষের দিকে যেতে পারব বলে আশা রাখি।

–আপনাকে তাহলে স্মল পক্স টীকা নিতে হবে, কলেরার টীকা নেওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ, তবে ওটা বাধ্যতামূলক নয়।

আমার এসব নেওয়া আছে, এজন্য চিন্তা করবেন না। সিগারেটের বাক্স এগিয়ে দিলাম, ও মাথা নাড়ল, আমি একটা ধরালাম তারপর বাক্সটা পকেটে ভরে রাখলাম। বললাম, মিঃ জেফারসন, ওনার ছেলের লেখা কিছু চিঠিপত্র আপনার কাছে আছে বলছিলেন, ওগুলো আমাকে দিন, এছাড়া সামান্য কোন খবরের সূত্র পেলে আমাকে জানাবেন তাহলে মিছিমিছি সময় নষ্ট হবে না।

–আমি সবকিছু আপনার জন্যে রেডি করে রেখেছি, বলে ড্রয়ার খুলে গোটা ছয়েক চিঠির গোছা আমাকে দিল।

–হেরম্যান বছরে একটার বেশি চিঠি লিখত না। ঠিকানাটা ছাড়া আর কোন খবর চিঠি থেকে পাবেন বলে মনে হয় না।

চিঠিগুলো এক ঝলক দেখে নিলাম, খুব সংক্ষিপ্ত এবং প্রত্যেকটাতেই টাকা পাঠানোর জন্যে জরুরী অনুরোধ। প্রথম চিঠিটার তারিখ পাঁচ বছর আগেকার এবং প্রত্যেকটা চিঠি একবছর অন্তর লেখা হয়েছে। শেষ চিঠিটাই আমাকে আগ্রহী করল।

সেলেশিয়াল এম্পায়ার হোটেল,
ওয়ানচাই।

 প্রিয় বাবা,

এখানে আমার সঙ্গে একটা চীনা মেয়ের আলাপ হয়েছে নাম জো-অ্যান। খুব শীঘ্রই একে বিয়ে করছি। মেয়েটা রেড চায়নার উদ্বাস্তু, সংগ্রামী, সুন্দরী, স্মার্ট। আমার মনে হয় খবরটা তোমাকে সুখী করবে না। তুমিই আমাকে শিখিয়েছে নিজের জীবন নিজেরই চালান উচিৎ। সুতরাং আমি ওকে বিয়ে করে সুখী হতে চাই। একটা ঘর খুজছি কিন্তু ভীষণ দামী। তাই ঠিক করেছি বিয়ের পর কিছুকাল হোটেলে থাকব। পরে আমার একটা বাড়ি কেনার ইচ্ছে আছে।

আশা করছি তুমি আমাদের আশীর্বাদ করবে। যদি মনে কর বাড়ি কেনার জন্যে একটা চেক পাঠাবে তাহলে অবশ্যই ভাল হয়।

তোমার
হেরম্যান।

 চিঠিটা নামিয়ে রাখলাম।

–এটাই হেরম্যানের লেখা শেষ চিঠি। জেনেৎ কথাগুলো খুব আস্তে আস্তে বলল। মিঃ জেফারসন খুব রেগে গিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তারের মাধ্যমে এই বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন। তারপর আর কোন চিঠি বা কোন খবর পাঠায়নি। এই দিন দশেক আগে এই চিঠিটা এসেছে বলে জেনেৎ একটা চিঠি আমাকে এগিয়ে দিল।হাতের লেখা খুব বাজে।কষ্ট করে পড়তে হল।

সেলেশিয়াল এম্পায়ার হোটেল,
ওয়ানচাই।

মিঃ জেফারসন,

গতকাল এক মোটর দুর্ঘটনায় হেরম্যান মারা গেছে। ও প্রায়ই বলত ওকে যেন আপনাদের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়। আমার কাছে একদম টাকাপয়সা নেই, আপনি যদি কিছু টাকা পাঠান তবে.ওকে আপনার ওখানে নিয়ে গিয়ে ওর ইচ্ছামতো জায়গায় সমাধি দিতে পারি। এখানে ওকে কবর দেবার মতো পয়সাও আমার কাছে নেই।
—জো-অ্যান-জেফারসন।

চিঠিটা পড়ে সহজেই অনুমান করতে পারলাম কী ভীষণ অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছিল।

–তারপর কী হল?

জেনেৎ তার সোনার ফাউন্টেন পেন দিয়ে ডেস্কের ওপর কাল্পনিক আঁকিবুকি কাটতে লাগল।

–মিঃ জেফারসন এই চিঠি পেয়ে ভেবেছিলেন চিঠিতে যা লেখা আছে তা সত্যি নয়। তার। ছেলে মারা যায়নি, মেয়েটা পয়সার জন্যে এই মিথ্যেকথা লিখেছে। আমি হংকং-এ আমেরিকান কনসুলেটে ফোন করে জানতে পারি সত্যিই হেরম্যান মারা গেছে। জেফারসন তখন আমাকে বললেন মেয়েটিকে একটা চিঠি লিখে দিতে যে সে মৃতদেহটা পাঠিয়ে দেয়। মেয়েটির আসার কোন দরকার নেই। ওখানেই সে প্রত্যেক মাসে নিয়মিত ভাবে টাকা পাবে। সে ব্যবস্থা উনি করবেন। কিন্তু জানেন তো ও নিজেও চলে এসেছিল, যদিও এখানে এসে পৌঁছয়নি।

–আর হেরম্যানের ডেডবডি? ওটা কোথায়?

আছে, পরশু সৎকারের সব কাজ করা হবে।

–রুজি রোজগারের জন্য হেরম্যান হংকং-এ কী করত?

-সেটা আমরা ঠিক জানিনা। প্রথম ওখানে যখন যায় তখন ওর বাবা একটা রপ্তানী বাণিজ্য ফার্মে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের চাকরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছ-মাস পরে হেরম্যান সে চাকরী ছেড়ে কি করত তা তার বাবাকে জানায়নি। শুধু প্রত্যেক বছর টাকার জন্য অনুরোধের চিঠি আসত।

–ও যা টাকা চাইত, জেফারসন কি তাই পাঠাত?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ। ও যখনই যা টাকা চেয়েছে, তখনই সেই টাকা পাঠানো হয়েছে।

এই চিঠিগুলো দেখে মনে হচ্ছে হেরম্যান বছরে একবারই টাকা চাইত। এক সঙ্গে কি ও অনেক টাকা চাইত?

না, পাঁচশো ডলারের বেশী কখনও চায়নি।

–পাঁচশো ডলারে তো সারা বছর চলে না। ওর নিশ্চয়ই অন্য কোন রোজগার ছিল।

–হ্যাঁ, তাইতো মনে হয়।

–ঠিক আছে, দেখা যাক।বলে আমি যে প্রশ্নটা করব বলে ভাবছিলাম, সেটা করে ফেললাম।

আপনি কি হেরম্যানকে ব্যক্তিগত ভাবে জানতেন?

সঙ্গে সঙ্গে জেনেৎ-এর চোখেমুখে চাপা রাগ কয়েক মুহূর্ত ভেসে উঠল আর তারপর স্বাভাবিক হয়ে গেল।

–কেন? হ্যাঁ..হ্যাঁ অবশ্যই। আমি মিঃ জেফারসনের সঙ্গে আট বছর ধরে আছি, হংকং-এ যাবার আগে হেরম্যান এখানেই থাকত। হ্যাঁ, ওকে আমি জানতাম।

–কেমন লোক ছিল? ওর বাবা বলছিলেন ওর স্বভাবটা বন্য ছিল। কিন্তু এখন উনি ভাবছেন যে ওকে একটু বোঝার চেষ্টা করলে হয়তো এতটা বন্যতা ওর মধ্যে আসত না। আপনার কী মনে হয়?

জেনেৎ-এর চোখ-মুখ জ্বলে উঠল। বোঝা গেল ওর ভেতরে কঠোরতাও আছে।

মিঃ জেফারসন ছেলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে খুবই মর্মাহত হয়েছেন। বেশ ধরা গলায় বলল সে। সুতরাং এই মুহূর্তে আরও আবেগপ্রবণ। হেরম্যান লম্পট ছিল। ও ওর বাবার এমনকি আমার টাকাও চুরি করেছিল। মিঃ জেফারসন খুবই সুন্দর মানুষ, কোন নীচ কাজ করেননি। ওর ছেলে এমন কী করে হয়, আমি ভেবে পাইনা।

-ঠিক আছে, ধন্যবাদ। আমি উঠে দাঁড়ালাম।

–আমি মিঃ জেফারসনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তবে অনেকটা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে।

জেনেৎ সই করা চেকগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে একটা টেনে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল। বলল, মিঃ জেফারসন আপনাকে আগাম কিছু টাকা দিতে বলেছেন। আপনি যাবার দিন জানালেই আমি প্লেনের টিকিট কেটে রাখব। আপনার যদি আরও টাকার দরকার লাগে আমাকে জানাবেন।

আমি চেকটার দিকে তাকালাম। এক হাজার ডলারের চেক।

আমার রেট অত বেশী নয়। তিনশ ডলারই যথেষ্ট। আমি বললাম।

 মিঃ জেফারসন আপনাকে এই টাকাই দিতে বলেছেন। জেনেৎ বলল।

–ভাল কথা। টাকা কেউ দিতে চাইলে আমি অবশ্য অস্বীকার করিনা। দিন। চেকটা নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করলাম–আপনি কি মিঃ জেফারসনের সবকিছু দেখাশোনা করেন?

–আমি ওর সেক্রেটারি। ধারালো সংক্ষিপ্ত জবাব।

–হুঁ, আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি কবে যেতে পারব জানতে পারলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

দরজার দিকে এগোতে যাচ্ছি, এমন সময় জেনে জিজ্ঞাসা করল, ওকে কি দেখতে খুব সুন্দর ছিল?

প্রথমটায় আমি ধরতে পারিনি, কি বলতে চাইল। শান্তভাবে চেয়ারে বসে থাকলেও ওর সারা মুখে কৌতূহলের অভিব্যক্তি।

কাকে? হেরম্যানের স্ত্রীকে? হুঁ, সুন্দরীই তো মনে হল। অনেক চীনা মেয়ের মতো এও সুন্দরী ছিল এমনকি মারা যাবার পরও।

–হুঁ। চোখটা নামিয়ে উত্তর দিল।

কলম টেনে নিয়ে সে আবার. চেক সই করতে লাগল।

 যাই হোক আমি এগোলাম।

হলের কাছে এসে দেখি বাটলারটা অপেক্ষা করছে। আমাকে মাথা নীচু করে অভিবাদন জানালো এবং চুপচাপ পথ দেখিয়ে আমাকে বাইরে নিয়ে গেল।

আস্তে আস্তে গাড়ির দিকে এগোলাম। জেনেৎ-এর শেষ প্রশ্নটায় এটা মোটামুটি নিশ্চিত হলাম। যে জেনেৎ এবং হেরম্যান উভয়ে প্রণয়াসক্ত ছিল। হেরম্যানের বিয়ে এবং মৃত্যু দুটোতেই জেনে সমান আঘাত পেয়েছে।

গাড়ি চালিয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে চলে এলাম। আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর রেটনিকের ঘরে ঢুকে দেখি চেয়ারে বসে অভ্যেসমত পোড়া চুরুট চিবোচ্ছে।

–তোমার সঙ্গে বকবক করে নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে আছে? দরজাটা বন্ধ করে ওর ডেস্কের সামনে যেতে বল, কি দরকার?

আমি বললাম, মিঃ জেফারসন আমাকে ঐ ব্যাপারে বলতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু ভাবলাম এটা আপনাকে জানানো উচিত।

ওর মুখ শক্ত হয়ে গেল।

–তুমি যদি তদন্তের কাজে কোনরকম ঝামেলা কর তো আমি তোমার লাইসেন্স বাতিল করাব। এই সাবধান করে দিচ্ছি। খানিক থেমে আবার বলল, কত টাকা দিচ্ছে তোমাকে?

যথেষ্ট টাকা দিচ্ছে। আর আপনার কাজে ঝামেলা করার মত সুযোগ পাওয়ার আগেই আমি হংকং চলে যাচ্ছি।

-কোথায়? হংকং? এঃ, দরকার হলে তো আমিই যেতে পারতাম। সেখানে গিয়ে কি পাবে, বল তো?

মিঃ জেফারসন চাইছেন যে মেয়েটার আসল পরিচয় বা তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালভাবে জেনে এগোলে কেসটার সুরাহা করা যাবে। ওঁর ধারণা ঠিকও হতে পারে।

অস্থিরভাবে বলপেনটা নাড়াচাড়া করে রেটনিক বলল, ওখানে গিয়ে লাভ কিছু হবে না। শুধু টাকা আর সময়ের অপব্যবহার। অবশ্য টাকা পেলে তোমার কিছু যায় আসে না।

আমি একটু ফিচেল হাসি হেসে বললাম, ঠিকই, ওঁর বাজে খেয়াল মেটাবার জন্য যথেষ্ট টাকা আছে। আর আমারও নষ্ট করার মত অফুরন্ত সময় আছে। বলা যায় না, হয়তো এর থেকেই আমার ভাগ্য খুলে যেতে পারে।

–আমাকে মেয়েটার সম্বন্ধে জানতে হংকং-এ যেতে হয়নি। আর আমি যতটা জানি তুমি হংকং গিয়েও জানতে পারবেনা। আমি শুধু একটা কেবল করে সব খবর পেয়ে গেছি।

–কি কি খবর পেলেন?

 –মেয়েটার নাম জো-অ্যান-চিয়াং।বছর তিনের আগে ও ম্যাকাউ থেকে এসে হংকং-এনামার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। ছ-সপ্তাহ জেলে থাকার পর ওকে কাগজপত্র দেওয়া হয়। তারপর থেকে ও প্যারোডা ক্লাবে রাত্রে নাচত। সুতরাং মনে হয় ও ছিল একটা বেশ্যা।

জানলার দিকে তাকিয়ে কান চুলকোতে চুলকোতে আবার শুরু করল, গত একুশে সেপ্টেম্বর ও হেরম্যানকে বিয়ে করে আমেরিকাননসুল থেকে। তারপর ওরাসেলেশিয়াল হোটেলনামে একটা চীনা হোটেলে থাকত। জেফারসন কোন রোজগার করত না। মেয়েটা যা আনত আর বুড়োর কাছ থেকে ছোকরা যা হাতাতে পারত তাতেই চলতো ওদের। এবছর ছই সেপ্টেম্বর ছেলেটার মোটর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। মেয়েটা তখন ওর ডেডবডি এখানে আনার জন্য আমেরিকান। কনস্যুলেটে আবেদন জানায়। এই তো ঘটনা। এর জন্য হংকং যাওয়ার কি দরকার?

-আমাকে ওখানে যাওয়ার জন্যে টাকা দেওয়া হয়েছে আর এখানে থেকে আপনার কাজের কোন ঝামেলা করতে চাইনা।

শয়তানের মতো হেসে বলল, আমার কাজে ঝামেলা…? তোমার ঝামেলা করার মত ক্ষমতা কতটুকু? কি হে টিকটিকি? জানো আমি ইচ্ছে করলেই তোমাকে আমার পথ থেকে সরিয়ে দিতে পারি।

আমি চুপ করে ওর কথাগুলো শুনে গেলাম আর ভাবলাম এ ধরণের লোকগুলো নিজেদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। ব্যাটা সেরকমই ভাবুক।

কিছুক্ষণ পর বললাম, যাক, কেস কতদুর এগোলো? আরও নতুন কিছু জানতে পারলেন?

নাঃ। একটা জিনিষ আমার মাথায় ঢুকছে না, ও ভোর তিনটের সময় তোমার অফিসে এসেছিল কেন?

–ঠিক। হয়তো হংকং গেলে এর উত্তর পাবো। একটু থেমে সিগারেট ধরিয়ে আবার বললাম, বৃদ্ধ জেফারসনের প্রচুর সম্পত্তি। এর উত্তরাধিকারী ছিল হেরম্যান। এখন হেরম্যানের মৃত্যুতে ওর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী জো-অ্যানই। এখন আমাকে দেখতে হবে যে, এমন কেউ কি আছে যে, অ্যানকে সরিয়ে দিতে পারলে সেই হবে ঐ সম্পত্তির মালিক। কে-সে? এটা জো-খুন এর একটা মোটিভ হতে পারে।

রেটনিক মাথা নাড়ল। হু, তোমার এই আইডিয়াটা চিন্তা করার মত।

–আপনি কি বুড়োর সেক্রেটারি জেনেৎ-এর সঙ্গে কথা বলেছেন? যদি জেফারসনের মৃত্যুর পর ও কিছু টাকা-পয়সা পায়, আমি তাতে আশ্চর্য হবনা। আমার মনে হয় একসময় হেরম্যানের সঙ্গে ওর প্রেম ছিল। নিটের সময় মেয়েটা যখন খুন হয় জেনেং সেই সময় কোথায় ছিল, সেটা একবার খোঁজ করতে পারেন।

–সেটা কিভাবে করব? বুড়োর তো সব ব্যাপারেই জেনেৎ। এখন আমি যদি ওর ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি মারি তবে ও আমাকে বিপদে ফেলতে পারে। আমি সেটা করবনা। তারপর আশাভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে, তুমি কি করে জানতে পারলে জেনে বুড়োর ছেলের সঙ্গে প্রেম করত?

কথা বলে। একসময় ওর মুখ ফস্কে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার মনেহয় ও খুনের ব্যাপারে আরও বেশী কিছু জানে, এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে যেন কিছুই জানো। খোঁজ নেবেন আরও ওর কোন বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা।

–ওসব খবরে আমার দরকার নেই। আমার খালি একটা খবর দরকার মেয়েটা তোমার অফিসে কেন এসেছিল। ব্যাস! এটা জানতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলব।

–আমি উঠে দাঁড়ালাম।

আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। আমার সম্বন্ধে অনুসন্ধান কখন করছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে ছেড়ে দিলে ভাল হয়।

আগামীকাল দশটায়। কাল অবশ্যই তুমি এখানে আসবে। বলপেন, দিয়ে ব্লটিং পেপার ফুটো করতে করতে বলল, তবে খেয়াল থাকে যেন কিছু জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে।

মনে মনে ওকে মুখ ভেংচে বেরিয়ে এলাম।

অফিসে ফিরে এলাম। ঘরের দরজা খুলতে যাব এমন সময় হঠাৎ একটা আইডিয়া মাথায় আসতে হেঁটে মিঃ জে. ওয়েডের ঘরে টোকা মেরে ঢুকে গেলাম।

বেশ বড় অফিস। সুন্দর আসবাবপত্র। টেবিলে রয়েছে একটা টেপরেকর্ডার, একটা টেলিফোন আর একটা পোর্টেবল টাইপ রাইটার।

ডেস্কের সামনে ওয়েডে বসে পাইপ টানছে। হাতে কলম, সামনে কাগজ।

 ওয়েডের ডানদিকের দরজা দিয়ে টাইপরাইটারের টক টক্ শব্দ আসছে।

ঘরটা আলো বাতাস যুক্ত। দেখলেই বোঝা যায় ভাল পার করেছে। আমার মত একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের চেয়ে ওর পয়সা খরচ করার ক্ষমতা অনেক বেশী।

-আরে, আসুন আসুন। আমাকে দেখে বেজায় খুশী। গদিমোড়া একটা চেয়ারে বসতে বলল।

আমি এগিয়ে এসে চেয়ারে বসলাম।

–আপনি আসবেন ভাবতেই পারিনি। ও ওর সোনার ওমেগা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, কি খাবেন বলুন? ছটা বাজে, একটু স্ক হয়ে যা।

আমাকে আপ্যায়নের জন্য ভদ্রলোক বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি সম্মতি জানালাম। খুব তাড়াতাড়ি ড্রয়ার থেকে একটা বোতল আর দুটো গ্লাস বের করে গ্লাসে ঢালল। বরফ নেই বলে দুঃখ প্রকাশ করল। বললাম আমি এই জিনিস নীট খাই এবং এখনও বেঁচে আছি, বলে দুজনে হেসে পানীয়টা খেলাম। ভাল স্কচ।

–সেদিন আপনি হেরম্যানের সম্বন্ধে বলেছিলেন। আপনার যদি তার বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা থাকে তাহলে বলতে পারেন। আমি সেই খোঁজেই এসেছি। যে কোন বিষয় জানালে আমার কাজে আসবে।

নিশ্চয়, নিশ্চয়ই বলে আগ্রহী দৃষ্টি হেনে বলল, কোন্ ব্যাপারে জানতে চান বলুন!

আমি মুখে একটা হাসি ফোঁটালাম যার মানে আমি কোন্ ব্যাপারে জানতে চাইছি আপনি বেশ ভাল করেই জানেন। এই ধরণের লোকদের এই ভাবেই কাৎ করতে হয়।

মুখে বললাম, সেটা আমি কি করে বলি? যেকোন খবরই সমান প্রয়োজনীয়। যেমন ধরুন ওর চরিত্র। মেয়েদের ব্যাপারে ও কেমন ছিল?

–মেয়েছেলে নিয়ে তো একেবারে নোংরা ছিল।

ওয়েডের চোখে একটা ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ দেখলাম।

-যৌবনে মেয়েছেলে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি সবাই করে। কিন্তু ও ছিল একেবারে নোংরার হদ্দ। ওর বাবার যদি এশহরে প্রতিপত্তি না থাকত, তবে তো এতদিনে ওরনামে অনেক স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে যেত।

–বিশেষ কোন মেয়ের সঙ্গে ওর কিছু? আমি প্রশ্ন করলাম।

একটু ইতস্ততঃ করে, আমি কারোর নাম ঠিক বলতে চাইনা, তবে ওর বাবার সেক্রেটারি জেনেৎ ওয়েস্ট-এর সঙ্গে ছিল। মেয়েটা..আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বলল, মাপ করবেন ভাই, আমার বলা উচিৎ হবেনা। এসব ঘটেছিল বছর নয়েক আগে। হেরম্যান আমাকে বলেছিল।

দুঃখিত মুখে বললাম, আপনার দেওয়া সামান্য সংবাদ থেকে খুনের কিনারা করতে পারি। দেখুন বলবেন কি বলবেন না সেটা আপনার বিবেচনা।

কাজ হল আমার কথায়। ওর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বলল, ঠিক আছে, নিশ্চয়ই এটা আমার বলা উচিত। মাথায় হাত বুলিয়ে এমন একটা ভাব দেখাল, যেন কোন সত্যবাদী এবং নির্মল চরিত্রের এক ভদ্রলোক কিছু বলছেন।

-নবছর আগে জেনেৎ আর হেরম্যানের মাখামাখি সম্পর্ক ছিল। একটা বাচ্চাও হয়। হেরম্যান জেনেৎকে কাটানোর চেষ্টা করলে জেনেৎ ওর বাবাকে সব কথা বলে দেয়। বাবা রেগে যান এবং জেনেৎ-কে বিয়ে করতে বলেন। এই প্রস্তাব হেরম্যান সরাসরি উড়িয়ে দেয়। বাচ্চাটা অবশ্য পরে মারা যায়। মনে হয় মেয়েটার ওপর ভদ্রলোকের খুব মায়া হয় এবং ওকে প্রাইভেট সেক্রেটারি করে নেন। ভদ্রলোক হয়তো ভেবেছিলেন বাড়িতে জায়গা দিলে ছেলের মনের পরিবর্তন হবে। কিন্তু যখন বুঝলেন সে সম্ভাবনা নেই তখন তিনি ছেলেকে পূর্বদেশে পাঠিয়ে দিলেন। তখন থেকে জেনেৎ ঐ বুড়োর কাছেই আছে।

মেয়েটা বেশ আকর্ষণীয়া না? আশ্চর্য লাগছে মৌয়টা এখনও বিয়ে করেনি কেন?

এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বৃদ্ধ ভদ্রলোক হয়তো তা চাননি। কারণ তিনি মেয়েটার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তাছাড়া ওঁর মৃত্যুর পর বিপুল সম্পত্তির ভার মেয়েটার ওপরই মনে হয় বর্তাবে।

তাই নাকি! অনেক কষ্টে আগ্রহ দমন করলাম এবং বললাম–নিশ্চয়ই ওঁর আরো কোন নিকট আত্মীয় আছে।

 না, আমি ওদের পরিবারকে অনেকদিন ধরে জানি। হেরম্যান একসময় আমাকে বলেছিল, ওদের পরিবারে আর কোন দাবীদার না থাকায় ওর বাবার সম্পত্তির অধিকারী ও একাই। আমি বাজী রেখে বলতে পারি, বুডোর মৃত্যুর পর জেনেৎ ওর সম্পত্তির কোন ভারী একটা অংশ বাগাবে।

–হু, মেয়েটার ভাগ্য ভাল। কারণ হেরম্যানের স্ত্রী বেঁচে নেই ভাগ বসাবার জন্যে।

–না, ও বেঁচে থাকলেও চীনা বলে ভদ্রলোক ওকে কিছু দিয়ে যেতেন না।

তা না দিলেও তোও হেরম্যানের স্ত্রী হিসেবে দাবী করতে পারত, জজসাহেব একটু দয়ালু হলে কিছু অংশ ও অবশ্যই পেত।

ওয়েডের ডানদিকের দরজা খুলে একটা মেয়ে ঢুকল। এক গোছ চিঠি রেখে চলে গেল। আমি বললাম, যা অনেক ধন্যবাদ। এবার আমি চলি। আবার দেখা করব।

নতুন কিছু জানা গেল? পুলিশ কি নতুন কিছু সূত্র পেয়েছে?

না আগামীকাল জুরীদের সামনে অনুসন্ধানের কাগজপত্র দেওয়া হবে। মনে হয় জুরীরা রায় দেবেন যে, কোন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি মেয়েটাকে খুন করেছে। খুব প্ল্যানমাফিক খুনটা করা হয়েছে।

–যদি কিছু করতে পারি…আমাকে জানাবেন।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনাকে সব জানাবো।

আমার অফিসে এসে রেটনিককে ফোন করলাম। জেনেৎ সম্বন্ধে আমার জ্ঞাত খবর সব জানালাম।

ব্যাপারটা পুরোপুরি আপনি দেখছেন। আমি বললাম–আপনার জায়গায় আমি থাকলে কিন্তু জো-অ্যানের খুনের সময়ে জেনে কোথায় ছিল খোঁজ নিতাম।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে রেটনিক বলল, আমি আমার জায়গায় আছি।

ও আবার বলল, কাল অনুসন্ধান ঘরে ঠিক সময়মত এসো দয়া করে, পরিষ্কার জামা কাপড় পরে আসতে ভুলো না কিন্তু।

রেটনিক বলে চলল,করোনার জজ খুব সামান্য ব্যাপার নিয়ে ভীষণ হৈ-চৈ করে। শালা একটা কুকুরীর বাচ্চা।

টেলিফোন রেখে দিল।

আমিও রিসিভার নামিয়ে রাখলাম।

.

১.৫

 যেমন ভেবেছিলাম, করোনার কোর্টে বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধান কোনোরকম হট্টগোল ছাড়াই শেষ হল। মোটা কুতকুতে একটা লোক নিজেকে জেফারসনের অ্যান্টনী বলে রেটনিককে পরিচয় দিল। জেনেৎকে গাঢ় রং-এর পোলাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমাকে ও যা যা বলেছিল, মোটামুটি সেগুলোই করোনার জজকে ও বলল। রেটনিক ওর কথা বলল। আমি আমারটা বললাম। জজ পুলিশকে আরও অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে বলল। আমার মনে হয় একটা চীনা উদ্বাস্তু মারা গেছে বলে কেউ তেমন গা করছেনা। জজ কোর্ট থেকে চলে গেলে আমি রেটনিকের কাছে গেলাম।

তাহলে এখন তো আর আমার শহর ছেড়ে যেতে কোন বাধা নেই?

না, না, তোমাকে এখন আটকে রাখার দরকার নেই।

ঘরের এক কোণে জেনেৎ জেফারসনের অ্যাটর্নীর সঙ্গে কথা বলছিল। সেদিকে ধূর্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, খবর নিয়েছিলে সেদিন রাত্রে ঐ মেয়েছেলেটা বিছানায় বা অন্য কোথায় ছিল?

–সেটাতো আপনার এক্তিয়ার। আমি বললাম–যান না, ওকে জিজ্ঞেস করুন। সঙ্গে ওর অ্যান্টনী আছে। এটাই তো ভাল সময়।

রেটনিক মুচকি হাসল।

আমার অত গরজ নেই। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, যাও বুড়োর পয়সায় কদিন ফুর্তি করে এসো। ওখানে ওরকম বাজারের অনেক মেয়েছেলে পাওয়া যায়, তারা বেশ আনন্দও দিতে পারে।

রেটনিক চলে যাবার পর আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। জেনেৎ যখন দরজার দিকে এগোচ্ছে ওকে পাকড়াও করলাম।

–আগামীকাল যেতে পারি। কোন প্লেনে রিজার্ভেশন পাওয়া যাবে?

চোখের দৃষ্টি সহজ হল। হ্যাঁ মি রায়ান আমি আজ সন্ধ্যায় আপনার টিকিটের ব্যবস্থা করে রাখব। আপনার আর কিছু দরকার হবে?

–হ্যাঁ, মানে হেরম্যানের ফটোগ্রাফ দরকার। দিতে পারবেন?

ফটোগ্রাফ? ও অবাক হলো।

–ওটার প্রয়োজন হতে পারে। আমি মর্গ থেকে ওর স্ত্রীর একটা ফটো নিয়ে নেব।

–আচ্ছা। দেব আপনাকে একটা।

–আজ সন্ধেবেলা আমরা যদি রাত আটটা নাগাদ এ্যাক্টর বার-এ দেখা করি কেমন হয়?

 –ঠিক আছে আটটার সময়।

ধন্যবাদ। এতে আমার অনেক উপকার হবে।

মিষ্টি হেসে চলে গেল জেনেৎ।

দেখলাম দু-সীটের জাগুয়ারটা নিজেই ড্রাইভ করে চালিয়ে চলে গেল।

ওর দিকে অত নজর দিও না, আমি নিজেকে নিজে বললাম।

অফিসে ফিরে এলাম।

আপাততঃ আমার হাতে এমন কিছু কাজ নেই যে কয়েক সপ্তাহ বাইরে কাটালে এমন কিছু অসুবিধা হবে।

ভাবছিলাম বাইরে গিয়ে স্যান্ডউইচ খেয়ে আসি। এমন সময় টোকা মেরে ওয়েডে এসে ঢুকল।

–আমি আপনাকে আটকাবো না। আমি শুধু জানতে এলাম হেরম্যানের সৎকারের কাজ কখন হবে, আমার সে সময়ে থাকা উচিত।

আগামীকাল। কিন্তু সময়টা তো জানিনা।

–ও। ঠিক আছে, আমি মিস ওয়েস্টকে ফোন করে জেনে নেব। না গেলে ওরা হয়তো কিছু মনে করবে।

আমি আজ সন্ধ্যেতে মিসওয়েস্টের সঙ্গে দেখা করছি, আপনি বললে আমি জিজ্ঞেস করতে পারি।

–তাহলে তো ভালই হয়। ওর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমার পক্ষে জিজ্ঞেস করাটা কেমন অস্বস্তিকর।

–ঠিকই তো। আমি বললাম।

করোনার কোর্টে বিচারের কি হল?

 মুলতুবি করে রেখেছে। একটু থেমে সিগারেট ধরিয়ে বললাম, আমি কাল হংকং যাচ্ছি।

আপনি? তাই নাকি? যান ভালই লাগবে। এই খুনের কেসের ব্যাপারে যাচ্ছেন?

নিশ্চয়ই। আপনার বন্ধুর বাবা আমাকে পয়সা কড়ি দিয়ে নিয়োগ করেছেন। কাজেই আমি যাচ্ছি।

বাঃ। ওখানে আমারও অনেকদিনের যাবার ইচ্ছে। আপনার ভাগ্য দেখে আমার হিংসে হচ্ছে।

–আমার নিজের ওপরই হিংসে হচ্ছে।

–যান আপনার মুখে সব কিছু শুনব। গেলে ও ব্যাপারে কিছু জানতে পারবেন বলে মনে হয়?

–জানি না। দেখি চেষ্টা করে।

 –হু, তাহলে আপনি মিঃ জেফারসনের সঙ্গে দেখা করেছেন? কেমন লাগলো ভদ্রলোককে?

–মন্দ নয়? খুব ঠাণ্ডা মাথার লোক। অবশ্য উনি বেশীদিন বাঁচবেন বলেও মনে হয়না।

হু। সত্যিই, বয়স তো অনেক হল। ছেলের মৃত্যুর শকও তো পেয়েছেন। এগোতে এগোতে বললেন, ঠিক আছে, চলি। আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার জন্যে কিছু করতে হলে বলবেন।

-না, ধন্যবাদ। আমি অফিস বন্ধ করে যাব।

–ঠিক আছে। ফিরে এলে একদিন সময় দেবেন। ড্রিংকস নিয়ে বসে আপনার গল্প শুনব। আপনি সকারের কথাটা জানতে ভুলবেন না।

না, না। আমি কাল আপনাকে জানিয়ে দেব।

বিকেলে গাড়ি চালিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে চলে এলাম। রেটনিককে বলা ছিল ও মর্গ থেকে জো-অ্যান-এর একটা ফটো তুলিয়ে রেখেছিল। ফটোটায় অ্যানকে জীবন্ত মনে হচ্ছে। গাড়িতে বসে ফটোটা খুঁটিয়ে দেখছিলাম।মর্গের পরিচারকের কাছেঅ্যান-এর সৎকারের ব্যাপারটা জানতে চেয়েছিলাম। বলেছিল, আগামী পরশু জেফারসনের খরচে উডসাইড় সিমেট্রি-তে কবর দেওয়া হবে। তার মানে ওদের পারিবারিক কবর এলাকায় ওকে কবর দেওয়া হচ্ছে না।

ছটার সময় অফিসে তালা দিয়ে বাড়ি চলে এলাম। একটা ব্যাগে কয়েক সপ্তাহের দরকারী জিনিষ গুছিয়ে সোজা এ্যাক্টর বার-এ গিয়ে হাজির হলাম। ঘড়িতে তখন ঠিক আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকী।

আমার ঘড়িতে যখন কাঁটায় কাটায় আটটা তখন জেনেৎ এল। খুব সুন্দর সেজেছে।

আমি কোণের দিকে একটা টেবিলের সামনে বসেছিলাম। ও আমার দিকে এগিয়ে আসার সময় দেখলাম বারের সমস্ত পুরুষ অকিয়ে দেখছে। প্রথমে দু চারটে কথা বলার পর আমি ওর জন্যে ভোদা-মাচিনী আর আমার জন্যে স্কচ অর্ডার দিলাম।

ও আমাকে প্লেনের টিকিট আর একটা চামড়ার সুন্দর মানিব্যাগ দিল।

–কিছু হংকং ডলার এর মধ্যে আছে। উপকারে আসবে ওখানে গেলে। ওখানে আপনার থাকার জন্যে একটা টেলিফোন করে দেব।

দি পেনি সুলার আর মিরমো হচ্ছে ওখানকার সবচেয়ে ভাল হোটেল, জেনেৎ বলল।

ধন্যবাদ। কিন্তু আমি চেষ্টা করব হোটেল সেলেশিয়াল এম্পায়ার-এ থাকতে।

খানিক সচকিত হয়ে বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

ফটোর কথা আপনাকে বলেছিলাম, মনে আছে?

 ওয়েটার এসে পানীয় দিয়ে গেল। জেনেৎ ওর হাতব্যাগ থেকে আমাকে একটা খাম দিল। হাফ পোস্টকার্ড সাইজের ফটো। মুখে অল্প হাসি, চোখে অসীম ধূর্ততা। দেখতে মোটেও সুন্দর নয়, মোটা ভুরু, চোয়াড়ে চেহারা, ছোট মুখ, ভাঙা চোয়াল।

আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ হেরম্যানকে এরকম দেখতে হবে ভাবতে পারিনি। এরকম চেহারার লোকেরা ভীষণ জ্বর হয় এবং নোংরা কাজকর্ম করতে পারে। জেনেৎ-এর ওর সম্বন্ধে বলা কথাগুলো মনে পড়ল।

আমি চোখ তুলে দেখলাম ও আমাকে লক্ষ্য করছে।

হু, আপনার কথাগুলো আমার মনে পড়ছে। একে জেফারসনের ছেলে বলে মনে হয়না।

জেনেৎ চুপ করে রইল। আমি হেরম্যানের ফটো ব্যাগে ঢুকিয়ে জো-অ্যান-এর মর্গ থেকে তোলা ফটোটা বের করলাম।

জেনেৎকে ফটো দেখিয়ে বললাম, আপনি জানতে চেয়েছিলেন মেয়েটাকে দেখতে কেমন, এই দেখুন ওর ফটো এনেছি।

অনেকক্ষণ ধরে ও ফটোটা নেবার জন্যে হাত বাড়াল না। আলোতে ওর মুখটা দেখলাম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, তারপর ফটোটা নিয়ে দেখতে লাগল, দেখলাম ওর চোখ-মুখ অভিব্যক্তিহীন। তারপর ফটোটা আমাকে ফেরৎ দিল।

হু, ওর গলার স্বর ভারী হয়ে গেছে। দুজনে দুটো গ্লাস নিয়ে পান করলাম।

আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, আপনি বলেছিলেন না আগামীকাল হেরম্যানের সত্ত্বার?

-হ্যাঁ।

-হেরম্যানের এক বন্ধুর নাম জে. ওয়েডে, আমার অফিসের পাশেই ওর অফিস। হেরম্যানের সঙ্গে একই স্কুলে পড়াশুনা করেছে। ও সৎকারের সময়টা জানতে চেয়েছে।

দেখলাম জেনেৎ বেশ শক্ত হয়ে গেল।

–মিঃ জেফারসন এবং আমি ছাড়া, হেরম্যানের কোন বন্ধুকে ওখানে আমার চাইছি না।

–ঠিক আছে, আমি বলে দেব। ও কিছু ফুল পাঠাতে চাইছিল।

–ওখানে ফুল পাঠানোর কোন প্রয়োজন নেই। এবার আমি চলি। মিঃ জেফারসন আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন। আমি আপনার জন্যে আর কিছু করতে পারি?

ওর এই কথা শুনে আমি বেশ একটু হতাশ হলাম। মনে এই আশা নিয়ে এসেছিলাম যে, ওর সঙ্গে আলাপ করে ওকে একটু ভালভাবে জানব। কিন্তু সে সুযোগ আর কোথায় দিল। এই তো হাল।

না ধন্যবাদ। প্লেন কখন ছাড়বে?

 এগারোটায়, আপনি সাড়ে দশটার মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাবেন।

ধন্যবাদ।

জেনেৎ এগিয়ে যেতে আমি ওয়েটারের হাতে দু-ডলার গুঁজে দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম।

বার-এর ঠিক উল্টোদিকে জাওয়ারটা দাঁড় করানো। আমিতো অন্ততঃ একশ গজ দূরে গাড়ী পার্ক করতে বাধ্য হয়েছি। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, জেফারসনের এই শহরে বেশ প্রতিপত্তি আছে।

গাড়ীর সামনে এসে ও একটু হাসল। তারপর বলল, আশা করি আপনি আপনার কাজে সফল হবেন। যাবার আগে যুদি কিছু প্রয়োজন হয় তো একটা টেলিফোন করবেন।

–আচ্ছা, আপনি কাজে বাইরে কি আর কিছু জানেন না। একটু হেসে বললাম, প্রাইভেট সেক্রেটারিও তো কাজের সময়ের বাইরে একটু সহজ হতে পারেন।

–ওকে ক্ষণিকের জন্যে অবাক হয়ে যেতে দেখলাম। আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।

কোন কথা না বলে পরিচ্ছন্নভাবে গাড়ীতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিল।

-গুডনাইট, মিঃ রায়ান। গাড়ী স্টার্ট করে সেকেন্ডের মধ্যে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।

আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আটটা বেজে পঁয়ত্রিশ, ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে ডিনার খাব। কিন্তু কিছু করার নেই।

ধূস শালা! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। আমার যে পাঁচ-ছটা মেয়ের সংগে আলাপ আছে, তাদের কাউকে ডেকে ডিনার খেয়ে নেব। নাঃ ওয়েস্টের জায়গায় কাউকে মনে ধরল না। ঠিক করলাম, স্যান্ডউইচ খেয়ে, টেলিভিশন দেখে সময় কাটাবো।

একটু হেঁটে মাল বারে ঢুকলাম বাজনা বাজছে। ঢোকার মুখে দুটো মেয়ে আমার দিকে ঢলঢলে চোখে ফিরে তাকালো। জিন্স প্যান্ট, সোয়েটার পরে বসে আছে। আমি ওদের পাশ কাটিয়ে ঢুকে একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম।

বীফ আর হ্যাম-স্যান্ডউইচ খেয়ে ভাল লাগলো না। হেরম্যান আর অ্যানের ফটো দুটো বের করে দেখতে লাগলাম। মনে হল দুজনের মধ্যে সবদিক থেকে অমিল। আমি ভাবলাম, জেনে এরকম একটা লোককে কি করে ভালবাসল?

আকাশ-পাতাল চিন্তা করে ফটো নিয়ে উঠে পড়লাম। স্যান্ডউইচের দাম মিটিয়ে রাস্তায় নামতে কানে এলো মেয়েদুটো আমাকে দেখে হাসছে আর ক্যাবলা বলে আওয়াজ দিল। দিক!

গাড়ী চালিয়ে আমার ডেরায় ফিরে এলাম। একটা অ্যাপার্টমেন্টের ওপরের তলায় একটা বড়সড় লিভিংরুম, একটা ছোট বেডরুম আর কিচেন নিয়ে আমার ডেরা। প্যাসাডেনা সিটিতে আসার পর থেকে এখানেই আছি। এখানে ভাড়া সস্তা এবং সবদিক থেকে সুবিধাজনক। বাড়ীতে কোন লিফটু নেই। তাতে আমার ক্ষতি কিছু নেই। পাঁচতলায় উঠতে নামতে আমাকে যে সিঁড়ি ভাঙতে হয়, তাতে আমার শরীরটা বেশ ফিট থাকে।

তালা খুলে লিভিং রুমে ঢুকলাম। দরজা বন্ধ করার আগে লোকটাকে আমি দেখতে পাইনি ঘরটা অন্ধকার বলে। লোকটার গায়ে কালো পোষাক।

আমার ঘরের উল্টোদিকে নিওন আলোয় গুড়ো সাবানের বিজ্ঞাপনের প্রতিফলনে ওকে দেখতে পেলাম।

জানলার ধারে আমার প্রিয় হাতলওলা চেয়ারে ও বসেছিল। একটা পায়ের ওপর আর একটা পা ভোলা। কোলের ওপর খবরের কাগজ। যেন আরাম করে কোলের ওপর হাতদুটো রেখে বসে আছে।

আমি হঠাৎ ওকে দেখে চমকে গেছি। হাতের কাছের সুইচটা তাড়াতাড়ি জ্বেলে দিলাম। আঠারো-উনিশ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে। চেহারা, কাঁধদুটো বেশ শক্তসমর্থ। কালো চামড়ার জ্যাকেট পরা, মাথায় কালো উলের টুপী। গলায় রুমাল বাঁধা।

ঠিক এই ধরণের ছেলেগুলোকে রাত্রে বার-এর সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। বাস্তবিকই রাস্তার জঘন্য প্রকৃতির ছেলে।

ছেলেটার চোখ দুটো ভাবলেশহীন। দেখলেই বোঝা যায় মদ্যপ, ধূমপায়ী, খুন করতে কোন দ্বিধা করেনা। ডানদিকের কানটা নেই। কানের ডগা থেকে থুতনী পর্যন্ত কাটা দাগ। এরকম ভয়ঙ্কর কুৎসিত দর্শন লোক আমি আগে কখনও দেখিনি।

চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমার গা ঘিনঘিন্ করে উঠল।

-এই শালা, বেশ্যার বাচ্চা। আমি তো ভেবেছিলাম তুই ফিরবি না, মোটা ঘড়ঘড়ে গলায় ও বলল। আমার পিস্তলটা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে কোথাও পড়ে আছে। এখন বুঝতে পারছি ওটা থাকলে উপকারে আসত।

–এখানে তুমি কি করছ?

আরাম করছিরে কুত্তার বাচ্চা। বোস্, তোর সঙ্গে কথা আছে। একটা চেয়ার দেখাল আমাকে।

লক্ষ্য করলাম ওর হাতে কালো সুতীর দস্তানা। আমার শরীরে ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল। আমি ভাবতে লাগলাম এ বোধহয় ভাড়াটে খুনী। আমাকে খুন করতে এসেছে। কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ওর নিজের ওপর খুব আস্থা আছে।

গলায় যথাসম্ভব জোর এনে ভারী গলায় বললাম, আমি তোমাকে বেরিয়ে যাবার জন্যে দু সেকেন্ড সময় দিলাম। না গেলে এ ঘর থেকে তোমায় ছুঁড়ে ফেলে দেব।

ও নাকটা দস্তানা দিয়ে ঘষতে ঘষতে ফিকে হাসি হাসতে লাগল। হাত থেকে ওর কাগজটা পড়ে গেল মেঝেতে আর দেখলাম ওর কোলের ওপর পয়েন্ট ফোর-ফাইভ পিস্তল। একটা বারো ইঞ্চি মত লম্বা ধাতুর নল-এর ব্যারেলের সঙ্গে আটকালো।

চুপ শুয়োরের বাচ্চা। খ্যাক করে উঠল। আমি জানি তোর একটা রডও নেই। পিস্তলটা হাতে নাচাতে নাচাতে নলটা চেপে দিল, ব্যস্। এখন গুলি চালালেও কোন শব্দ হবেনা। এতে তিনটে গুলি আছে। অবশ্য তোর জন্যে একটাই যথেষ্ট।

আমি ওর দিকে তাকালাম। বদমাশটা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে সামনে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। দুজনের মধ্যে দূরত্ব ফুটের।ওখানে বসেই। ওর ঘামের আর তামাকের নোংরা গন্ধ আমার নাকে ভেসে এল।

কী চাই তোমার? আমি বললাম।

এখনও তোর বেঁচে থাকার ইচ্ছে আছে? কীরে কুত্তার বাচ্চা? কিন্তু আমি তোকে বাঁচতে দেবনা। মরতে তোকে হবেই।

সাপের মত ঠাণ্ডা চাউনী, ফোলা ফ্যাকাসে চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মেরুদণ্ড শিরশির করে উঠল।

কেন আমি মরবো? একটা কিছু বলার জন্যে বললাম, কেন আমি তো বেশ ভালই আছি।

না, ভাল থাকতে পারবিনা। পিস্তলটা আস্তে আস্তে আমার দিকে ঘুরিয়ে বলল, কটা মেয়ের সঙ্গে তোর ভাব আছে বল?

–বেশ কয়েকজন–কেন?

–এমনি, ধর তোকে যদি এখন এই পিস্তলটা দিয়ে ঝেড়ে দিই, কটা মেয়ে কষ্ট পাবে?

দু-একজন পেতে পারে। দেখ এসব উল্টোপাল্টা কথার অর্থ কি? তোমার সঙ্গে আমার কি কোন ঝগড়া আছে? তাহলে তুমি আমার পেছনে কেন লেগেছ?

সে সব কিছু নয় রে হারামী। ওর রক্তহীন কোঁচকানো ঠোঁট কামড়ে শয়তানী হাসি হেসে। বলল, তোকে দেখতে তো বেশ ভাল, আস্তানাটাও ভাল, যখন আসি তখন তোকে লক্ষ্য করছিলাম–গাড়িখানাও তত বেশ জব্বর।

আমি গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

–তোমার পিস্তল বরং সরিয়ে রাখো। এ কথায় কোন কাজ হবে না জেনেও বললাম, এসো আমরা স্কচ পান করি।

আমি মদ খাই না।

–ভাল। মাঝে মাঝে আমারও মনে হয় যে বলি মদ খাই না। তা আজ তোমার সম্মানে একটু হয়ে যাক।

মাথা নাড়ল ছোকরা। শালা এটা কি ড্রিঙ্কিং পার্টি?

এই সমস্ত আজেবাজে কথাবার্তা চালিয়ে আমি ঠিক করে নিয়েছি কি করব। ছোকরা আমার সমান লম্বা। প্রথমেই যদি লাফ মেরে ওকে একটা আঘাত করি, তাহলে মনে হয় ওর সঙ্গে যুঝতে পারব। কিন্তু ওর কাছে পিস্তল আছে।

–তাহলে এটা কিসের পাটি? প্রশ্ন করে আমি আমার ডান পা-টা একটু এগিয়ে দিলাম। এমন পোজিশন নিলাম যাতে সুযোগ পেলেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি।

–গুলি ছোঁড়ার পার্টি রে হারামীর বাচ্চা। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উঠল।

কাকে গুলি মারা হবে?

–তোকে রে বুদ্ধ।

আমি ঘামতে লাগলাম। জীবনে অনেক ভয়ঙ্কর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি কিন্তু জীবন মৃত্যুর মাঝখানে এমনটি আগে কখনও হয়নি।ঠিক করলাম, ভীরুতাকে প্রশ্রয় দিলেভীরুতা আরো চেপে বসবে। বললাম, কিন্তু কেন গুলি করবে বলবে তো!

জানি না। আর আমার জানার দরকারও নেই। আমার কিছু পয়সা পাওয়া নিয়ে কথা।

আমার সারা শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। জিভ শুকিয়ে কাঠ।

–আমাকে মারার জন্যে তোমাকে টাকা দেওয়া হয়েছে? তাই না?

–হ্যাঁ, তাই। টাকা ছাড়া তোকে আমি মারতে যাবো কেন?

কম্পিত গলায় আমি বললাম, ঘটনাটা আমাকে সব খুলে বল। আমাদের হাতে অনেক সময় আছে। কে তোমাকে পাঠিয়েছে। আমাকে খুন করে তোমার কি হবে?

–আমি জানি না, যাঃ। কোন কাজকর্ম ছিল না, ধান্দায় ঘুরছিলাম। একটা কুত্তা শালা এসে বলল, তোর এখানে আসতে হবে, তোকে হাপিস করতে পারলেই পাঁচশ ডলার দেবে। একশ ডলার দিয়েছে আর চারশো কাজ হাসিলের পর। তাই তোর এখানে এসেছি।

-লোকটা কে?

বলব না রে শালা। সে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। ও শালা রাস্তার কোন পাবলিক। মাথায় একটা গুলি ঝাড়ব, চিন্তা মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে।

–লোকটাকে দেখতে কেমন? মরীয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

হঠাৎ ও হিংস্রভাবে আমার দিকে তাকাল। পিতলটা আমার কপালে টিপ করে হিংস্র স্বরে বলল, সেটা জেনে তোর কাজ কি? তোর সময় শেষ, সেটাই চিন্তা কর। আমি বুকে বল এনে, মন শক্ত করে বললাম, পাঁচশো ডলার কি যথেষ্ট? আমি তোমাকে হাজার ডলার দোব। বন্দুকটা নামিয়ে নাও।

চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কাউকে কথা দিলে কথার খেলাপ করিনা।

ঠিক সেই সময়ে টেলিফোনটা বেজে উঠল। এদিকে আমিও গত কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যে আমার কর্মপন্থা ঠিক করে নিয়েছি। টেলিফোনের আওয়াজে খানিকটা চমক ভেঙে ও চোখ কুঁচকে ফোনের দিকে তাকাল।

আমি আমার মাথা ওর মুখের দিকে আর হাতটা ওর পিস্তলের দিকে লক্ষ্য করে শক্ত হয়ে দাঁড়ালাম।

হঠাৎ ঠিক রকেটের মত ছিটকে ওকে আঘাত করলাম। আমার শক্ত মাথা ওর নাকে আর মুখে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। একই সঙ্গে বিশাল ওজনের একটা ঘুষি চালালাম ওর পিস্তল ধরা হাতে। ও সশব্দে চেয়ার নিয়ে পড়ে গেল। আমি একটু সরে গেলাম।

ঐ আচমকা আঘাতে ও রীতিমত ঘাবড়ে গেছে, না হলে ও আমাকে ওর মজবুত দু-হাত দিয়ে গুড়ো করে দিতে পারতো। ঐ ঘুষিতেও ওর হাত থেকে পিস্তল খসে পড়ল না।ও ওঠার আগেই আমি খাড়া বসাবার কায়দায় ওর দুটো কাঁধে পরপর দুটো ঘুষি চালালাম। ওর হাতদুটো আলগা হয়ে পিস্তলটা মেঝেতে পড়ে গেল। আমিনীচু হয়ে তুলতে যেতেই ও বিদ্যুৎবেগে আমার চোখের ওপর ঘুষি চালাল। ঠিক যেন হাতুড়ির বাড়ি খেয়ে আমি ছিটকে পড়লাম।

আমি সম্বিৎ হারিয়ে ফেললাম। কয়েক সেকেন্ড বাদে স্বাভাবিক হতে দেশি ও উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, ওর নাক মুখ দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরছে। ও আমার মাথা লক্ষ্য করে লাথি চালাল।

আমি দুহাত দিয়ে লাথি আটকাবার চেষ্টা করলাম এবং একটু গড়িয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দুজনে দুজনের মুখোমুখি, মাঝখানে মেঝের ওপর পড়ে আছে পিস্তল।

ও ক্রুদ্ধ কুকুরের মত চীৎকার করে উঠল। কিন্তুনীচু হয়ে ভুল করেও পিস্তলটা তোলার চেষ্টা করলনা। ও জানত তাহলে আমি ওকে লাথি মেরে গুঁড়ো করে দেব। কাজেই ও ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত তেড়ে আসতেই আমি ওর মুখে সজোরে একটা ঘুষি চালালাম। ও ছিটকে আমার একটা ঝোলানো ছবির ওপর গিয়ে পড়ল।

আমি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লাফিয়ে মাথা দিয়ে ওর মুখে, নাকে আঘাত করলাম এবং পর পর ছ খানা খুঁখি ওর পেটে মারলাম। ও ঘূষিগুলো খেয়ে একটু নরম হয়ে গেল আর ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকাল। তারপর আবার কতকগুলো ঘুষি চালাতেই দেখিওর হাতে চচ্চকে একখানা ছুরি। চোখে খুনীর দৃষ্টি।

কী বীভৎস দেখতে হয়েছে লোকটাকে। নাক, মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে জমে আছে। আমি কয়েক পা পিছিয়ে এলাম, ওর খ্যাপা কুকুরের মত তাড়া খেয়ে।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকতেই এক ঝটকায় গায়ের কোট খুলে বাঁ হাতটা পুরো জড়িয়ে নিয়ে, ছুরি তোলার সঙ্গে সঙ্গে সেটা এগিয়ে দিলাম। ছুরিটা আমার কোটে জড়িয়ে গেল। আমি ঠিক সেই মুহূর্তে একটা নিখুঁত, সময়মত ও কার্যকরী একখানা ঘুষি মারলাম ওর চোয়ালে। ওর মুখে একটা কঁক করে আওয়াজ বেরোল। একটু ঝুঁকে পড়তেই ঘাড়ে একটা। ছুরিটা খসে পড়ল। আমি বিদ্যুৎবেগে লাথি মেরে ছুরিটা মেঝের অন্যপ্রান্তে সরিয়ে দিলাম। ও মেঝেতে পড়ার সময়ে ওর চোয়ালে আর একখানা বিশাল ঘুষি মারতেই একটা বিশাল শব্দ করে কার্পেটের ওপর থুতনী রেখে ও আছড়ে পড়ল।

দেওয়াল ধরে ঝুঁকে কুকুরের মত হাপাচ্ছিলাম। শরীরে কোন জোর নেই। এরকম ঘুষি কাউকে কোনদিন মারিনি বা খাইনি। হঠাৎ দড়াম করে একটা আওয়াজ হল। দেখি দরজা খুলে দুটো পুলিশ ঢুকলো হাতে বন্দুক।

কী ব্যাপার! সমস্ত রকটাকে কাঁপিয়ে কী ধরণের মারপিট হচ্ছে আঁ? একটা পুলিস ঝাঁঝিয়ে উঠল।

পুলিস দুটো ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শয়তানটা মেঝের ওপর গড়িয়ে গিয়ে ওর পিস্তলটা তুলে নিল। তখনও ওর চারশো ডলার আয় করার ইচ্ছে ছিল। আমাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল কিন্তু গালের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। দেওয়ালের প্লাস্টারের চাপড়া ভেঙ্গে পড়ল।

একটা পুলিশ ওকে গুলি করল। আমি চীৎকার করে বাধা দিতে গেলাম কিন্তু ততক্ষণে ছোকরা শেষ। হাতটা তুলেছে আমাকে দ্বিতীয় গুলি মারবে বলে।