২.৫ সুলতানা ও যিরাব

সুলতানা ও যিরাব

এরপরে পেরিয়ে গেছে বেশ কযুগ। ভূমধ্যসাগর গড়িয়ে গেছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কিউসেক পানি। সময় চলেছে তার আপন গতিতে। সে কত শিশুকে জোয়ান আর জোয়ানকে করেছে বুড়ো। আবদুর রহমানের হেরেমেও সময়ের পরিবর্তন এসেছে। যুবতী সুলতানা আজ ৫০ বছরের মাঝবয়সী। নিটোল গালে পড়েছে তার ভাঁজ বেশ কটা। আবদুর রহমানের বয়স ৬০ এর কোটা অতিক্রম করে গেছে, যিরাব ৭০-এর ঘরে। সুলতানার পুত্র আবদুল্লাহ যৌবনের সিঁড়িতে। বয়স ১৯ কিংবা ২০।

আবদুর রহমানের চিন্তাজগতে আমূল বিপ্লব সাধিত হয়েছে। যিরাবও সেই আগের যিরাব নেই। আমীর আবদুর রহমান থাকলেও বেশ কিছুকাল হুকুমত ছিল যিরাবের। তিনি সুখ ও সংগীতের যাদুতে মাতিয়ে রেখেছিলেন আবদুর রহমানকে। তার দেমাগে রাজত্বের ভূত চেপে বসেছিল। কিছু সিংহশাবক স্পেন অরণ্যে হুংকার মেরেছিল সেদিন, যে হুংকার আবদুর রহমানের আলস্য নিদ ভেঙ্গেছিল, নয়ত দ্বিতীয় আবদুর রহমানের যুগেই স্পেনের পতন ঘটে যেত। প্রতিষ্ঠিত হত খ্রীস্টানদের রাজত্ব।

যিরাব অভাবিতরূপেই অগাধ মেধার অধিকারী। তিনি বেশ কিছুকাল গবেষণার দ্বারা ভেবে দেখেছিলেন যে, আবদুর রউফ, উবায়দুল্লাহ, মূসা ইবনে মূসা, আবদুল করিম, করতুন ও আবদুর রহমানের ভাই মোহাম্মদের উপস্থিতিতে তার সকল প্ল্যান মাথা কুটে মরতে বাধ্য। প্রাসাদে তার যে মর্যাদা বিলক্ষণ তাও হারিয়ে যেতে বসেছে। হৃদয়বীণার তার দিয়ে কাউকে মোহাচ্ছন্ন করা আর ক্ষমতার বাগডোর হাসিল করা এক কথা নয়। কাজেই ক্ষমতালিন্দু মনোভাটি ও ষড়যন্ত্র শব্দটি জীবন ডায়েৰী থাকে এক সময় মুছেই ফেললেন তিনি। তবে সুলতানা প্রেম থেকে বিরত থাকতে পারলেন না। এ এক ধরনের পাগলামি; বয়স, মেধা ও চিন্তা যেখানে খেই হারিয়ে ফেলে।

তিনি সুলতানকে প্রায়ই বলতেন, আমার রাগ-রাগিণীতে সেই প্রতিক্রিয়া আর নেই যা আছে তোমার সৌন্দর্য-সুষমায়। আমার মিউজিক এখনো তোমার মুক্তাসম দণ্ডমালার হাসিবোল ফুটিয়ে তুলতে পারেনি।

সুলতানা তার পার্শ্বে থাকলে উন্মাতাল হয়ে যেতেন। সুলতানা অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে বলা শুরু করে, যিাব? এবার আপনি কারো গলে মালা পড়ান।

যিরাব বলে, জীবন একটা। সেখানে অধিকারও একজনের। দ্বিতীয় কারো প্রবেশের সুযোগ নেই। একথা ২০/২৫ বছর আগেকার। তুমি আছো তো সব আছে। তুমি নেই কিছু নেই।

কিন্তু আমি যে আমীরে স্পেনের। সুলতানা বলত, আপনি আমাকে প্রাসাদ থেকে তুলে নিতে পারবেন না। হাত ধরাধরি করে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলে যাব কৈ? সিংহশাবক নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছার পূর্বেই আমরা ধরা খেয়ে যাব। করুণ পরিণতিও আপনার অজানা নয়। কাজেই আমাকে অন্তরঙ্গভাবে পাবার আশা ত্যাগ করুন। তবে আমাকে আপনি মনে করতে পাররেন অধিকার কেবল কথার, দেহের নয়। আমি কী আপনাকে আমার জায়গীরে নিয়ে যাইনি? আমার ও আপনার গভীর সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় কাউকে রেখেছি কি কখনো?

সুলতানার এ কথাগুলো সত্য। যিরাব ও তার মাঝে তৃতীয় কেউ থাকত না, কিন্তু সুলতানার এই লুকোচুরির মাঝে একটা স্বার্থ লুকিয়ে ছিল। প্রেমাভিনয়ের মাধ্যমে সে যিরাবকে ব্যবহার করত। সুলতানার ভেতরে ভেতরে সম্পর্ক খ্রীস্ট মৌলবাদীদের সাথে, ধুরন্ধর নীতিজ্ঞানহীন ধর্মান্ধ এলোগেইছের সাথে। সুলতানা এলোগেইকে বলে রেখেছিল, যিরাকে প্রেম মরীচিৎকার মোহে আটকে অবাধে কার্যোদ্ধার করতে চাচ্ছি, কিন্তু ক্রমশসে আমার থেকে সটকে পড়ছে।

প্রেমের আদিম নেশায় সে কেবল ধরা দিয়েছে হেরেমে, আবদুর রহমানের পৌরুষবহুল পেশীতে সে-ই একমাত্র নারী, আবদুর রহমানের মত সিংহশাবক যার ছলনার পড়ে ছাগ শিশুতে পর্যবসিত। কেমন একটা যাদু, একটা অনুরাগে সে আটক ফেলে এক মর্দে মুজাহিদকে। মাঝপথে যিরা তার সান্ত্বনার ধন ও আরাধনার বন্ধুতে রূপান্তরিত হয়। এতে অর আত্মিক প্রশান্তি হয়। এভাবে একই সময়ে সে আমীর স্পেন ও যিরাবের মধ্যে মরীচিকা সৃষ্টি করে। দ্বি-চারিণী আর কাকে বলে।

কিন্তু কালের প্রবাহে সবকিছুতে এসেছে পরিবর্তন। পরিস্থিতি গেছে পাটে। গোটা প্রকৃতিতে পালাবদলের হিড়িক। স্পেনের নদ-নদী এরপর পানি প্রবাহিত করেনি। স্পেনের অলি গলি ও শহর বন্দরে যে রক্ত শুকায়নি, তথাপিও সুলতানার প্রকৃতিতে কোন পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন যা এসেছে তাহলো, সে এক বাচ্চার মা হয়েছে আর আমীরে স্পেন তার বাচ্চার স্বীকৃতি দিয়েছে। ইতিপূর্বে সে রাণী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল এজন্য ছিল পাগলপারা। সে ঈসায়ীদের সাথে যোগসাজশ করেছে। আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে তখত তাজ উল্টানোর ষড়যন্ত্র করেছে, কিন্তু সাফল্যের সোনার হরিণের নাগাল পায়নি।

প্রথম ও সর্বশেষ সন্তানের মা হয়ে তাই সে তাকে স্পেনের ভাৰী গভর্ণর বানানোর জন্য জন্য আদাজল খেয়ে নামে। তার যৌবন এখন পুরানো দিনের কাহিনী। পুত্র তখন জোয়ান। আমীরে স্পেন বার্ধক্যের বারিধি তীরে উপনীত। বিষধর কালনাগিনীর চরিত্রে সুলতানা, ভরা নাগিন সে। যে কোন নারী-পুরুষকে দংশনে নীল করতে সে বদ্ধপরিকর। যাকে নিয়েই পুত্রের ভবিষ্যৎ-এ সে অন্ধকার দেখেছে তাকেই সে ছোল মেরেছে।

যুগের পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে মানব-সভ্যতায়। কত দোস্ত দুশমনে আর দুন-দোস্তুতে রূপ নিয়েছে, কিন্তু সুলতানা সুলতানাই থেকে গেছে, কালনাগিনী রয়ে গেছে। এক সময়কার যৌবনের রাণী এখন বার্ধক্যের কালসাপ। বয়সের ভারে বুড়ি হয়েও সে নিজকে বিশ্বসুন্দরী ভাবতে থাকে।

***

পঞ্চাশের ঘরে সুলতানার বয়স। মিথ্যা নয়। বাস্তবিকই এ বয়সে তাকে ষোড়ষীই মনে হয়। আমীরে স্পেনের নয়নমণি সে। শাহজাদীর মত ব্রাজকীয় তার জীবন। কোন দুঃখ নেই, ভাবনা নেই। ডালিমের লালদানার মত গণ্ড, মাথায় দীঘল কালো একরাশ চুল, চোখের জ্বর চমক সেই আগের মতই। স্বাস্থ্য সুস্থ্য-লাবণ্যবহুল।

একবার তার চাকরাণী চুল পরিপাটি করছিল। চিরুনি রেখে চাকরাণী তার একটা চুল উপড়াল। সুলতানা আহু করে উঠল। চাকুরাণীকে বলল, কি হলো? সে বলল, পেকে যাওয়া সাদা চুল উপড়ে ফেললাম।

মিথ্যা সুলতানা বলল, এখনই চুল পেকে সাদাঁ?

বৃদ্ধা চাকরাণী হেসে লুটোপুটি খায়। চাঁদের মত সাদা চুল তার সামনে মেলে ধরা হয়।

শুধু একটা নয় মা! চাকরাণী বলল, আরে। আপনার চুল এমন যে, এর থেকে পাকা-কাঁচা চেনা মুশকিল। বেশ কিছু চুলে পাক ধরেছে।

বেশ কিছু! এমনভাবে সুলতানা বললো যেন তার প্রিয়জন মারা গেছে।

হা! বেশ কিছু। কিন্তু আপনি ঘাবড়ে গেলেন যে চুল সেতো পাকবেই। মৃত্যু সেতো একদিন আসবেই। আমিও যুবতী ছিলাম। আমার রূপ লাবণ্যও তো একসময় আমীর-ওমরাহদের চোখ ঝলসে দিত। আমার রূপ লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে বর্তমান আমীরের বাবা আল-হাকাম আমার বাবাকে শাহী আস্তাবলের একটি হীরক খচিত তলোয়ার উপহার দিয়েছিলেন। পরে তাকে দরবারে বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন করেছিলেন। পুরস্কার ও অন্ন-অনুদানে দুহাত ভরে দিয়েছিলেন। আমিও এক সময় ভাবতাম, রূপ-যৌবন বুঝি অম্লান, কিন্তু প্রথম পাকা চুল আমার সেই ভুল চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। সেই চুল আমি উপড়ে ফেলেছিলাম। পরে একদিন ভাবলাম, যে চুলরাজি দ্বারা এক সময় আমীরে স্পেনকে পায়ের জিঞ্জির বানিয়েছিলাম তাতে পাক ধরবেই। আমার ভুবন মোহিনী রূপ-জৌলুসে ভাটা পড়বেই।

সুলতানা মা। আমার কোন আশ্রয় ছিল না তখন। হেরেমের চৌহদ্দি থেকে আমাকে ডাস্টবিনে ফেলে দেবার কথা। আমি দেখেছি পরবর্তীতে শাসক দল তী তরুণী আমদানী করেছে। যাদের ইশারায় এরা নেচেছে। আমার বয়স এখন ৭৫-এর কোঠায়। হেরেমের দাসী-বাদীও রাজ মহিষীদের জীবন্ত দলিল আমি, সূর্য সাক্ষীও বলতে পার। সুলতানা! তোমারে জীবনেও সে পালা এসে গেছে। আবদুর রহমান বুড়িয়ে গেছে। এক্ষণে কোন যুবতী তাকে উন্মাতাল করতে পারবে না, ইতিপূর্বে করা হত যা।

সুলতানা ফেলে আসা সোনালী অতীতে ফিরে গেল। খামোশ দাঁড়িয়ে টহল দিতে লাগল।

সুলতানা। বৃদ্ধা চাকরাণী বলতে লাগল, তুমি এত ভড়কে গেলে যে? তোমার খোশ কিসমত যে, যৌবনের সোনালী দিনগুলোতে যে মর্যাদা ছিল তোমার আমীরে স্পেন এ বয়সেও সে পজিশন থেকে তোমায় নামায় নি, অবমূল্যায়ন করেনি। আমি তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী, শুভানুধ্যায়ী। তোমার প্রতিটি রহস্যে আমাকে শরীক করেছে। এজন্য বড় নির্মম বাস্তব কথাটি আজ শোনালাম। তুমি এতে তকলিফ পেয়ে থাকলে আমায় ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখো।

জানি। তোমার সত্য নিয়তে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমীরে স্পেন আমার পদমর্যাদায় কোন প্রকার কমতি আনেননি। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেল অথচ আমায় একটিবারের জন্যও কাছে ডাকেননি তিনি। স্বেচ্ছায় কখনও কাছে গেলে কর্মব্যস্ততার বাহানায় দূরে ঠেলে দিয়েছেন। নিঃসঙ্গ জীবনের করুণ প্রান্তরে অবস্থান আমার। যিরাব না থাকলে হয়ত মারাই যেতাম।

তোমার পুত্র জোয়ান হয়েছে সুলতানা। খোদা তোমার পুত্রকে দীর্ঘজীবী করুন। এখন থেকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনায় নিজকে উৎসর্গ করো। তাকে ভাবী আমীর বানানোর কোশেশ করো। আমীরে স্পেন বার্ধক্যে উপনীত। প্রতিটি যুদ্ধে সে অংশ নিচ্ছে। যে কোন সময় মারা যেতে পারেন। তোমার পুত্রের জন্য কিছু একটা করো।

তাতো আমি করবই, কিন্তু ওকে ভাবী আমীর বানানো নিয়ে একটি শব্দও মুখে আনেননি আবদুর রহমান। এরও একটা কারণ আছে। আমার পুত্রই পরিস্থিতি ঘোলা করে তুলেছে। ওকে শাহযাদা বানানোর খেয়াল করেছিলাম, কিন্তু ও আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। বানাতে চেয়েছিলাম শাহ্ সওয়ার, পাঠিয়েছিলাম তেগ-তলোয়ার চালাতে সমরবিদদের কাছে, কিন্তু পালিয়ে এসে আমার সব আশার গুড়েবালি দিয়েছে। হয়ে উঠেছে বিলাসী ও অমিতব্যয়ী।

বিলাসী ও অমিতব্যয়ী হয়েছে তাতে কি! আবদুর রহমানের ৪৫ পুত্রের কে না। বিলাসী ও অমিতব্যয়ী? চাকরাণী বলল।

 সুলতানা আয়েনার সামনে গিয়ে বসল। চাকরাণীকে আর কোন কথা বলার সুযোগ দিল না। খোলা চুল পেছন থেকে সামনে এনে দেখল। একগাছি সাদা চুল তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। চেহারা আয়নার একেবারে কাছে নিয়ে গিয়ে দেখল তাতে মসৃণতা নেই, আছে ভাঁজ পড়ার ভূমিকা।

তুমি যাও। চাকরাণীকে বলল সে, যিরাব অবসর থাকলে বলো সুলতানা ডেকে পাঠিয়েছে।

***

চাকরাণী চলে যাবার পর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চেহারা আয়নায় পরখ করল। চোখ দেখল। দেখল চোখের কোণে কালচে সরুরেখা। পরখ করল হাত। উল্টিয়ে পাল্টিয়ে বারবার দেখল। অস্থিৰ্ব্ববে এগিয়ে গেল বেলকনির দিকে। পরে এলো করিডোরে। দরজা ফাঁক করে কারো আগমনের প্রতীক্ষা-মহড়া।

খানিকবাদে কামরায় কারো পদধ্বনি শোনা গেল। মনে মনে যার প্রতীক্ষা সে এলো বুঝি। পেছনে ফিরে তাকাল সুলতানা।

হ্যাঁ, যিরাব এসেছে। প্রেমের ছলনায় যাকে আজীবন উপেক্ষায়ই করে এসেছে সে। ওই চেহারায় কত আকুতি ছিল। ওই মনে কত শত আকাঙ্ক্ষা বাসা বেঁধেছিল। তবে প্রতিবারই সে সুলতানাকে ডেকে পাঠিয়েছে। আজ বোধ হয় এর ব্যতিক্রম। আজ প্রথম সুলতানা তাকে ডাকল। এতে ভো যিরাবের আনন্দে আত্মহারা হবার কথা, কিন্তু একি! যিরাবের সেই অবয়বে কত পরিবর্তন। ভাবনার সাথে আনন্দে ডুবে যায় সে। আচমকা তার ভাবনা জাল স্নি হয় এই ভেবে যে, বেচারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে অথচ বসতে বলার সৌজন্যটুকু তার লোপ হয়েছে। যিরাবকে বসবার আমন্ত্রণ জানায়। যিরাব বসেন। তার চোখে মুখে সেই স্মৃতি নেই। সুলঅনা বলে,

আমার প্রেম আপনার হৃদয় থেকে মুছতে বসেছে বুঝি?

উঁহু। পূর্বের থেকে সেটা আরো বেড়েছে; কিন্তু সেই সোনালী অতীতে আমরা ফিরে যেতে পারব না, যৌবনের কলকাকলীতে এক সময় মুখরিত ছিল যা। কাজেই অতীত ইতিহাসের স্মৃতিচারণ এক্ষণে নিবুর্পিতাকে খানিক বাড়িয়েই তুলবে। তোমার, পেয়েশানিরও কারণ বোধ হয় সেটা। সময় যত ফুরিয়ে যাচ্ছে-তুমি আলেয়ার আলোর মত এর পেছনে ছুটছ, অতীতকে স্মৃতির এলবামে সযত্ন লালিত্যে রেখে দাও সুলতানা। চলমান সময়কে প্রশান্তির সাথে ব্যয় করার চেষ্টা করো।

হ্যাঁ যিরাব! আমরা বারবার পেছন অতীতে ফিরতে চাচ্ছি। অতীত থেকে আমি মুখ ফেরাতে পারছি না। যদিও সে অতীতের সৌন্দর্য সুষমা আমার নেই তথাপিও বিগত সৌন্দর্যের কল্পনায় আমি আমার সৌন্দর্য চর্চা করতে চাই এবং করবও। নিঃসঙ্গতা আমাকে পুড়ে ছাই করছে। আমার মধ্যে কেমন যেন একটা ভয় আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠছে। সুখময় কিছু আলাপ করো যিল্প। তোমার ভাণ্ডারে শব্দের কমতি নেই। শব্দে শব্দে আমাকে নিয়ে চলো তোমার ধূসর অতীতের ডিকশনারীতে। ভোমার বাহুতে কি, এখন জোর নেই যিরাব? আমার যৌবনে ভাটা পড়েছে এ শুষ্ক কথার নিরস জ্ঞান আমাকে দিও না যিরাব!

দেহ থেকে তুমি দৃষ্টি হটাতে পার না সুলতানা। আপনার রুহকে সজীব করো। দেহ বুড় হলে রূহ জোয়ান হয়ে যায়। আমি আমার শারীরিক শক্তি রূহের মধ্যে স্থানান্তর করেছি।

সুলতানা ভয়াতুর শিশুর মত যিরূবকে জাপটে ধরতে চাচ্ছিল, কিন্তু যিরাব উঠে দাঁড়ালেন।

তুমি মিথ্যা মরীচিৎকার পেছনে ছুটছে। কালকের উপাখ্যানের স্মৃতিমন্থন করে তুমি আজকের বাস্তবতা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছ। দেমাগকে ড্রাইভিং সিটে বসাও, তারপর তোমার সাথে অতীতের আলাপ করব। বললেন যিরাব। শরাবের একঢোঁক সুলতানাকে সরস করে তুলল। তার ওষ্ঠ ও ভাষা দুটোতেই পরিবর্তন আসল। সে তার বাহু যিরাবের বুকে এলিয়ে দিয়ে বললো, যিরাব! আমি তোমার দাসী। তুমি সেই-সথা যার সাথে আমার আন্তরিক সম্পর্ক। তুমি আমাকে এতটুকু সন্দেহের চোখে দেখেনি যে, মুসলমানের সবচেয়ে নিকৃষ্ট দুশমন এলোগেইছের সাথে আমার নেপথ্য সম্পর্ক এবং তার সাথে হাত মিলিয়ে আমি স্পেনের তখতে তাউস উল্টানোর কাজে কোশেশ করে যাচ্ছি। তোমার প্রতি আমার একটি অভিযোগ যে, তুমি কোনদিন এ ব্যাপারে আমাকে সহায়তা করোনি।

আমি এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গ দিলেও এলোগেইছের সে মিশন সফল হত না। দীর্ঘ ২৫ বছর পর আমি কথাটা এজন্য পরিষ্কার করেছি যে, বার্ধক্যে যেন ব্যাপারটি আমাকে লজ্জিত ও অনুতপ্ত না করে। সত্যিই আজ নিজকে বেশ ফুরফুরে লাগছে।

সুলতানার হাত থেকে যিরা এক পেগ মুখে নিলেন পরে বাকীটা রেখে দিলেন। ৭০-এর সিঁড়িতে তার বয়স। চুলের সবটাই বলতে গেলে সাদা। চোখে-মুখে দীপ্তি। এ বয়সেও তিনি সুলতানাকে একান্ত করে চান।

সুলতানা বললো, একটি পুরানো কথা আমার মনে পড়ে গেল। ফ্লোরার কথা তোমার মনে আছে? ওকে আমি মাত্র একবার দেখেছি। নজরকাড়া সুন্দরী সে। একবার আমীরে স্পেনকে বলেছিলাম, রোকে কিডন্যাপ করুন কিংবা কিনে আনুন। হেরেমে ওকে স্থান দিন। একথা তোমাকে বলিনি কোন দিনও। এ এক রহস্য। আজ বলছি শোন।

ফ্লোরা হেরেমে এলে তোমার মর্যাদায় ভাটা পড়ত। বয়সে সে তোমার চেয়ে ছোট। দেখতেও মনোরমা। আমীরে স্পেন তার প্রেমে দেওয়ানা হয়ে যেতেন। তুমি তাকে একথা বলতে গিয়েছিলে কেন? তাকে খুশী করতে কি?

না। তাকে দেওয়ানা বানাতে। ফ্লোরা হেরেমে এলে আমীরে স্পেন পুরোপুরি আমাদের জালে আটকা পড়বেন। আমি একরাতে জায়গিরে এলোগেইছের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। বলেছিলাম, আমীরে স্পেন সিংহশাবক হতে চলেছেন। তার সর্বকনিষ্ঠ। স্ত্রী মোদাচ্ছেরা তার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। ফ্লোরা এসে গেলে আমরা পুরোপুরি তাকে কুপোকাত করতে পারব। কিন্তু এলোগেইছ এ প্রস্তাবে রাজী হলো না। সে বলল, ফ্লোরা পবিত্রা নারী। হেরেমে গিয়ে সে কেবল নাপাকই হবে। পরে জংগলে কিংবা নির্জনে যীশুর নাম জপতে জপতে নিজকে বিলিয়ে দেবে এবং আমীরে স্পেনের কাছে সব কথা বলে দেবে। এতে আমাদের সকল রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে।

তোমার অজানা থাকার কথা নয় সে আমাকে দেশের কোন এক অংশের রাণী বানানোর প্রস্তাবনা রেখেছে। আমার ইশারায় নেচে থাকে; কিন্তু আমার কথায় সে এতটুকু নিজস্ব চিন্তাধারা থেকে টলেনি সেদিন। সত্যি বলতে কি, আমি বেশ রাগও করেছিলাম। এলোগেইছ ওই সময়টায় মদ গিলে আমার সাথে কথা বলেছিল। আমি তখন বেশ চটে চটে কথা বলেছিলাম। তার মিশন সফল করতে অনেক কিছুই করতে পারতাম। এজন্য সে আমাকে নারাজ করা ভালো মনে করেনি।

সুলতানা দম নিল। আমার বলতে লাগল, তুমি বিরক্ত হচ্ছে না তো যিরি! আমার ভালবাসার জালে তোমাকে আটকাবার জন্য এ কথা বলছি না। ফ্লোরা আমার মিশনে শামিল হলো। কোন এক রাতে আমরা একটি কক্ষে একত্রিত হই। জনৈক পাদ্রী আমাদেরকে ওখানে গোপন করে রেখেছিলেন। ফ্লোরা যখন জানতে পারল, বিশেষ এক উদ্দেশ্যে আমি আমার নারীত্ব থেকে বঞ্চিত রয়েছি তখন সে আমার সাথে প্রাণ খুলে আলাপ করল। ভাবতেও পারিনি কচি বয়সের মেয়ে এতটা বিজ্ঞতার সাথে কথা বলতে পারে। তার কথায় আমার মাঝে নব উদ্দীপনা ও অদম্য স্পৃহা দেখা দিল।

এলোগেইছ আমাকে বলল, ফ্লোরার প্রেম সে মন থেকে মুছতে পারছে না। থামল সুলতানা- যিরাব বললেন, মোর হয়ত জানা নেই এলোগেইছ ও তার কি পরিণতি ঘটেছে।

জানি। সকলেই জানে।,

হয়ত ওদের মৃত্যু সংবাদ তোমার জানা। কিন্তু ওদের সম্মিলিত মিশনের খবর তোমার জানা নেই এবং এক নারীর ভরসা করে এলোগেইছ কি ভুলটাই না করেছিল? যিরাব অতীতের একটি ধূসর পর্দা উন্মোচন করলেন, আপনার জীবদ্দশায়ই স্পেনে যীশুরাজত্ব কায়েমের জন্য মুসলমানদের রাজ্যহারা করার ইবলিসি প্ল্যান করেছিল ফ্লোরা। স্রেফ একারণেই সে তার নারীত্ব ও যৌবনকে জলাঞ্জলি দিয়েছিল। সেজেছিল পাদ্রী। খ্রীস্টানরা তাকে দ্বিতীয় মরিয়ম মনে করছিল। খ্রীস্টানরা ভেল্কি আগুনের ধোঁয়ায় কবরস্থানে যীশুর এক নিবেদিত প্রাণ সেবিকা হিসেবে তাকে তুলে ধরে জনতার খ্রীস্টত্বকে জাগরুক করতে সচেষ্ট হয়েছিল। এরাই মাদ্রিদ ও টলেডোয় বিদ্রোহ করিয়ে হাজারো খ্রীস্টানকে যমালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থাদি করেছিল। কিন্তু এতে ওদের ফল শূন্যের কোঠায়ই থেকে গিয়েছিল। মোহাম্মদ ইবনে আঃ জব্বারকেও তাদের দলে ভিড়িয়ে ছিল। তুমি আবদুর রহমানকে ময়দান নামতে যারপরনাই বাধা দিয়েছিলে কিন্তু………

কিন্তু মোদাচ্ছেরা তার ওপর যাদু চালিয়েছিল। সুলতানা বলল।

স্রেফ মোদাচ্ছেরা নয়- স্পেনের সালাররাও তাকে জাগরুক করে তুলেছিল যাদের ঈমান ছিল শক্ত মজবুত। শহীদী চেতনা ছিল পুঁজি। স্পেন বিজেতারা ছিল তাদের আবেগের উৎস। এদেশে ইসলামী ঝান্ডা পোথিতকারীরা ছিল তাদের স্পৃহার সূতিকাগার। ওরা তাকে কি করে মর্দে মুমিন বানিয়েছিল তা তোমার অজানা নয়।

তুমিও কি ফ্লোরাকে আমার চেয়ে সুন্দরী মনে কর? নেশার বুঁদ হয়ে সুলতানা বলল।

আমি কাকে কি মনে করতাম সে প্রশ্ন এখন থাক। তুমি আমার কাছে অতীত কাহিনী জানতে চেয়েছো জানাচ্ছি; কাজেই আমাকে আমার কথা বলতে দাও। তোমারই কারণে আমি ঈসায়ীদের পক্ষে নির্লজ্জ দালালী করেছি। আবার জায়গীরে দরবেশরূপী এলোগেইছের সাক্ষাৎ করেছ তুমি। তোমার প্রেমে অন্ধ ছিলাম আমি। এলোগেইছ আমাকে বলেছিল, আমি আরব থেকে এসেছি–আজই মুসলমানদের তাহযীব-তামাদ্ন বদলে দাও। তুমি বলেছিল, স্পেনে মুসলিম শাসনের বারোটা বাজাও, খ্রীষ্টানরা আমাদের একটা প্রদেশ দেবে। সে প্রদেশের রাজা হব আমি, তুমি হবে রাণী।

তোমার প্রেম আমার রাগ রাগিণী সব কিছুকেই ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তোমাকে রাণী করার খাব আমাকে পাগল করে তুলেছিল। তোমার স্বামী আমাকে উন্মাদ বানিয়েছিল। আমি সকলের কাছে প্রবাদপ্রতীম ছিলাম। আমিই ইসলামী তাহযীব-তামাদুনের আমুল পরিবর্তন এনেছি। পুরুষের চুল বড়, দাড়ী খাটো এবং আমীর-ওমরাদের মেয়েদের পোশাক টেডি করেছি। 

এলোগেইছ বলত, স্রেফ সৈন্য ও তলোয়ার দ্বারা বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়। সুলতানা বলল, জাতির অন্তরঙ্গ জীবন, অবসর সময় ও বিনোদনে বিস্মৃতি আনো তাহলে ওই জাতি তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। হায়! যে জাতি এক সময় তলোয়ারের ছায়ায় ঘুমাত সে জাতি আবার মিউজিকের ধূম ধাড়াক্কায় মেতে উঠল।

আমি সামান্য সময়ের ব্যবধানে বুঝতে পারলাম তোমার হৃদয়ে আমার ঠাই নেই। তুমি আমার সাথে খেল-তামাশা ও অভিনয় করে যাচ্ছে। কিন্তু আমার হৃদয়ে গাথা তোমার প্রেমকে সহজে মেটাতে পারলাম না। কাজেই আমার জাতির শিরা-উপশিরায় খ্রিষ্টত্বের বিষ ঢুকিয়ে দিলাম।

স্বীকার করছি তোমাকে আমি প্রেমের নামে ধোকা দিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার প্রেমে তোমার উম্মাতাল ভাব দেখে নিজেও ধোকায় জড়িয়ে গেছি এবং জীবনে এই প্রথম সেই ধোকাময় প্রেমের বাস্তবতা অনুধাবন করে অমৃতস্বাদ নিচ্ছি। আমি এলোগেইছকে বলেছিলাম, আমি তাকে ধোকা দিতে পারব না। প্রেমকে খেল তামাশার বস্তু মনে করে যিরাবের আবেগকে দলিত-মথিতও করতে পারব না।

আমার আবেগ আজো তথৈবচ, তোমার যৌবনে যা ছিল। তুমি চাইলে আজো যে কোন কোরবানী করতে প্রস্তুত। প্রেমের টান থাকা সত্ত্বেও তুমি যেমন অনেক কথা আমার কাছে গোপন রেখেছে সেভাবে আমিও অনেক কথা তোমার থেকে গোপন রেখেছি। সেগুলো আজ শুনে নাও…….. আমি যখন শুনলাম ফ্লোরা এক মুসলমান বাবার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও খ্রীস্টবাদের জন্য নিজেকে ওয়াকফ করেছে তখন তাকে খোর বড্ড শখ পয়দা হয় মনে।

স্পেনে দুধরনের গোয়েন্দা ছিল। কিছু রাজনীতির আর কিছু ফৌজি। ওদের মাধ্যমে আমি ফ্লোরার সন্ধান পাই। একবার শুনতে পাই, কর্ডোভা থেকে মাইল খানেক দূরে কোন এক গ্রামে এলোগেইছ ও ফ্লোরা অবস্থান করছে, তখন আমি রওয়ানা হয়ে যাই। ওই গ্রামে গিয়ে আমার লোক দ্বারা গোপনে এলোগেইছের কাছে খবর পাঠাই যে, ফ্লোরাসহ আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী আমি।

গ্রামবাসী আমাকে দেখল, কিন্তু কেউ ধারণাও করতে পারল না যে, আমি রাজ প্রাসাদের নামীদামী সঙ্গীতজ্ঞ।

***

সুলতানা কায়মনোবাক্যে যিরাবের কথা শুনে যাচ্ছিল। শরাবের পেগ-এ ঠোঁট ছোঁয়ানোর ফুরসৎ কৈ তার। যিরা বলে চলেছেন, আমাকে এক বিরান ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। টিতে মাকড়সার জাল বাসা বাঁধা। দেয়ালের চুন-সুড়কিগুলো খসে পোড়া ইটগুলো আমার দিকে তাকিয়ে যেন হাসছিল। মনে করেছিলাম আমাকে বুঝি হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু এলোগেইছের আচমকা আগমন আমার ভুল ভাঙ্গাল, হেরেমের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ এই দূর-সুদূরে আগমনের কষ্ট করতে গেল কেন তা জানতে পারি কি?

আমার প্রতি তার সন্দেহ ছিল। বললাম, তোমার হতবুদ্ধি খামাখা নয়। তোমাকে আমি কোনদিনও ধোকা দিয়েছি কি? ধোকা দিলে তুমি এখানে আসতে না দিলে কেউ এসে তোমাকে ও ফ্লোরাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেত। আমি তোমার মিশনের সহযাত্রী।

সে প্রশ্ন করল, কোন সে খায়েশ তোমাকে এখানে টেনে এনেছে? আমি বললাম, আমি ফ্লোরাকে দেখতে এসেছি। লোকেরা বলে, ফ্লোরা যিরাবের সঙ্গীতের চেয়ে আকর্ষণীয়। এলোগেইছ আমার সাথে আরো কিছু কথা বলার পর বুঝল আমি তার সাথে প্রতারণা করতে আসিনি। সে আমাকে আরেকটি ঘরে নিয়ে গেল। খানিকবাদে এক নওজোয়ান যুবতী এলে সৌন্দর্যে আমার চোখ ছানাবড়া। সুলতানা তুমিও যৌবনে সুন্দরী ছিলে খুব। এতে ফ্লোরা তোমার চেয়ে একধাপ এগিয়ে। খ্রীস্টানের বাচ্চীর চেহারা কেবল আকর্ষণীয়ই নয় যাদু ছিল তাতে। তার ঠোঁটের মদুকম্পন জমিনে কম্পন তুলত। ডাগর ডাগর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারত না কেউই।

এলোগেইছ ফ্লোরাকে বলল, ফ্লোরা! ইনি রাজ প্রাসাদকে হাতের ইশারায় নাচান এবং আমাদের মিশন সফল করার প্রধান রূপকার। ফ্লোরা অগ্রসর হয়ে আমার ডান হাত তার উভয় হাতের মাঝে পুরে নিল। প্রথমে চুমো পরে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করল। তাঁর পঙ্কবিম্ববৎ ওষ্ঠাধরের মুচকি হাসি আমার আপাদমস্তকে কাঁপন ধরাল। মনে হলো এ কোন দেহ নয় আত্মার প্রতিবিম্ব। সুলতানা। ফ্লোরা ফুল নয়– কলি। আমি ওকে বললাম, ফ্লোরা! তুমি এত নজর কাড়া সুন্দরী, তুমি কি না করতে পার। তুমি তোমার যৌবনকে এভাবে তিলে তিলে নিঃশেষ করছ কেন?

ফ্লোরা বলল, শুনেছিলাম তুমি বিশ্ববিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ। কিন্তু তোমার এতটুকু জানা নেই যে, কিছু একটা করতে হলে দৈহিক শক্তির দরকার নেই। মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তাধারা পরিপক্ক হলে আত্মিক বলে বলীয়ান হলে সেটাই যথেষ্ট। এলোগেইছ বলেছিল, মাদ্রিদ ও টলেডোর বিদ্রোহ ফ্লোরার চিন্তাধারার ফসল। এই ফ্লোরা বন্দীত্ব থেকে পালিয়েছিল। খ্রীস্টানরা বাজারে ও কাজীর দরবারে প্রকাশ্য যে ইসলাম বিরোধী প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল এর হাতে খড়ি ফ্লোরার মাধ্যমে।

ফ্লোরার এই ধর্মান্ধ খীস্টত্ব– প্রেম দেখে আমার চৈতন্যোদয় হলো। ভাবলাম, আমি একজন পুরুষ। মানুষ আমাকে মহাজ্ঞানী মনে করে আর আমি ঠিক ওদের নাচের পুতুল। এ সময় আমার ভেতরের লুকানো ধর্ম-মানুষটি আড়মোড়া দিয়ে জেগে ওঠে। লজ্জায়-অনুতাপে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। আমার চিন্তাজগতে বিপ্লবের বান ডাকল। ফ্লোরা ও এলোগেইছকে বললাম, তোমাদের সাথে আছি, কিন্তু মনে মনে কসম করলাম, ওদের সঙ্গ দেব না কোনদিনও।

ফিরে এলাম। বারবার মনে করেছি তোমাকে ওদের পথ থেকে ফেরাব বলে, কিন্তু এলোগেইছের সাথে জুড়ে দেয়া তোমার ভবিষ্যৎ চিন্তায় এতটুকু ফারাক না দেখে বারবার আমার সিদ্ধান্ত বদলেছি। তুমি স্বপ্ন দেখে যাচ্ছিলে………….ফ্লোরা করে যাচ্ছিল তার কাজ। তার কর্মকারে ফিরিস্তি আমার কাছে প্রতিনিয়ত পৌঁছতে থাকল। তোমার অজানা নয়, কত বিদ্রোহ হয়েছে সবগুলোই কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছে।

পরে মরিয়ম নাম্নী নামী আরেক যুবতী পাদ্রীর ফ্লোরার সাথে সাক্ষাৎ হয়। মরিয়মের এক ভাই ইসলামের নিন্দাবাদ করতে গিয়ে ধরা খায়। তাকে জল্লাদের কাছে সোপর্দ করা হয়। মরিয়ম গীর্জা থেকে বেরিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য গালাগালি শুরু করে দেয়। এখানে তাদের দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়। সংবাদদাতা ও গোয়েন্দারা তাদের খুঁজে ফেরে।

***

সুলতান মুখে হাত দিয়ে শুনে যাচ্ছে, যিরাব বলে চলেছেন অবিরাম গতিতে, এরপর এক লোক আমার কাছে এলো। সে আমার কাছে এলোগেইছের পয়গাম দিয়ে বললো, কোন এক পল্লীতে আমার সাক্ষাৎপ্রার্থী সে। আমি গেলাম। সে আমাকে বলল, এবারের বিদ্রোহত ব্যর্থতায় পর্যবসিত। ফ্রান্স থেকেও সাহায্য আসতে পারছে না। কেননা আমীরে স্পেন সীমান্ত চৌকি খুবই চৌকস রেখেছেন। ঘোড়ায় কাউকে ওই এলাকায় দেখলে তার রক্ষা নেই। তার সীমান্ত রক্ষা বাহিনীকে ফাঁকি দিতে পারে এমন সাধ্য কার।

বললাম, আপনি চাচ্ছেন কি, কেন ডেকেছেন আমায়? বলল, আমি কর্ডোভায় বিদ্রোহ করতে চাই, যে বিদ্রোহের সূচনা আবদুর রহমানের রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু হবে। আমীরকে কয়েদ করা হবে। তার গোটা. সালারদের হত্যা করা হবে। ব্যক্তিগতভাবে সৈনিকদের মাঝে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করে দেখেছি। কিন্তু ধর্ম ও দেশের আসন্ন বিদ্রোহে কেউই আমার কথায় কান দেয়নি। সে আমাকে তখন অন্তরঙ্গ মনে করছিল। বন্ধুত্বের ধোকায় তখনও রাখলাম তাকে। বললাম, তা কি করতে হবে আমাকে? বলল, সালারদের মাঝে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে দিন। ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করুন। এমন একদল সেনা নির্বাচিত করুন যারা গৃহযুদ্ধে পা চালিয়ে লড়বে। তাদের আমরা এই পরিমাণ অর্থ দেব যে, চৌদ্দ খান্দানও যা বসে খেয়ে শেষ করতে পারবে না। সুলতানা ও আপনার কৃত ওয়াদা পালনে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকব। দেশের একটা প্রদেশের মালিক বানিয়ে দেব আপনাদের।

বললাম, আপনারা স্পেন থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে ফেলতে চান। যদি সফলকাম হন তাহলে আপনাদের খ্রীস্টাজ্যে খণ্ডিত ইসলামী প্রদেশ আপনারা সহ্য করবেন কি? সে বলল, জমিনে ইসলামী শাসন থাকলে তাতে আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না। সে আরো বললো, আপনি ও সুলতানা যে প্রদেশের মালিক তা নামকাওয়াস্তের ইসলাম। আমার যদুর বিশ্বাস আপনারা ইসলাম ছেড়ে খ্রীস্টবাদে প্রবেশ করবেন। কিন্তু এ পরের কথা। আমি যেমন চাইব তেমনটা হবে। সর্বাগ্রে আপনারা আপনাদের কাজ করুন। বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের ব্যবস্থাদি করুন। আপনারা যে পরিমাণ অর্থ চান দেব।

আমি শরীব পান করিনি। আমার আত্ম সচেতনতা লোপ পায় কি-না, এ ভয়ে। দুযুবতী আমার পাশে ছিল। শেষ পর্যন্ত ওখান থেকে এই বলে আত্মরক্ষা করলাম, বেশ তাই হবে। এলোগেইছ বললো, যিরাব! আমার যদুর বিশ্বাস আপনি আমাদের ধোকা দেবেন না। ধোঁকা দিলে আপনার পরিণতি খুব একটা সুখকর হবে না। আমার গোস্বা এসে গেল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার জন্য সুখকর না হলে তাতে কি? সে বললো, আপনি দুনিয়াতে থাকবেন না। আমি বললাম, আমার একটি শর্ত আছে। যদি পূরণ হয় তাহলে প্রাসাদে বিদ্রোহের পরিবেশ সৃষ্টি করব। চার সালারকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করব। এলোগেইছ শর্ত জানতে চাইলে তারা তিনজন একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওরি করল।

আমি ফ্লোরা ও মরিয়মের চেহারায় না গোস্বার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম, না খুশীর। তাদের ঠোঁটে দেখলাম কেবল তৃপ্তির কঢোক হাসি। এলোগেইছ বললো, আমি সামান্য অপেক্ষা করব। বলে সে দুযুবতাঁকে ওপাশের কামরায় নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে সে এলো, কিন্তু যুবতীদ্বয় সাথে নেই। বললো, ওই দুযুবতীর মুসলমানদের প্রতি এতটা ঘৃণা যে, তারা আপনাদের দেহের ঘ্রাণ পর্যন্ত বরদাশত করতে পারে না।

আমি শিও বাচ্চা নই সুলতানা! এলোগেইছের কথা দ্বারা বুঝলাম, ফ্লোরাকে তারা দ্বিতীয় মরিয়ম বানিয়ে রেখেছে। তারা কোনো পুরুষের গা ছুঁলে পর্যন্ত গোসল করে নেয় এবং গীর্জায় গিয়ে মাফ চেয়ে নেয়।

তুমি কি মনে মনে চাইতে এ দুযুবতী তোমার পাশে আসুক– অথচ তুমি আমার প্রেম দেওয়ানা?

না! যিরাব বললেন, আমার মাঝে জাতীয় চেতনাবোধ সেই পূর্ব থেকেই সজাগ হয়েছিল। এভাবে এলোগেইছ আমাকে হত্যার হুমকি দিলে আমার আত্ম সম দিয়ে তার সাথে প্রতারণার সুযোগে থাকলাম। এলোগেইছ আমাকে বললো, ফ্লোরা ও মরিয়মের অন্তরে মুসলমানদের ঘৃণা ভরা। ওদের প্রতি আমার যতটুকু যা শ্রদ্ধা ছিল এসব কথা শোনার পর সেটুকুও দূরীভূত হয়ে গেল। এলোগেইছ আমাকে পরবর্তী রাতে আসতে বললে আমি সায় দিলাম। সে রাতে আমার সাথে বোধ হয় অন্য কোন খেল খেলতে চাচ্ছিল। সন্দেহ ছিল আমার। খুব সম্ভব মেয়েগুলো রাজী হতেও পারত। এ জাতির কথা আমার জানা ছিল। ইহুদী-খ্রীস্টানরা ধর্মের নামে ইজ্জত-আব্রু বিকিয়ে দিতে জানে, কিন্তু আমার মন তখন চিন্তা করেছে অন্য কিছু।

 এলোগেইছকে বললাম, আগামীকাল আমি আসব এবং একসাথে বিদ্রোহের ছক আঁকব। আমার আগমন নিশ্চিত করেই তবে তার ওখান থেকে বেরোলাম। তাকে এই ধারণায় তৃপ্ত করলাম যে, আমি তোমার ফাঁদে আটকে গেছি।

সকালে আমি চীফ পুলিশ ইন্সপেক্টরের কাছে গেলাম। তাকে বললাম, এলোগেইছ, ফ্লোরা ও মরিয়ম অমুক স্থানে আত্মগোপন করে আছে। তাদেরকে আজ রাতেই গ্রেফতার করা সম্ভব। আমি ওখানে গিয়েছিলাম; সে কথা বলিনি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমি এ সংবাদ অবগত হয়েছি বললাম তাকে একথাও।

মনসুর ইবনে মোহাম্মদ জঁদরেল পুলিশ অফিসার ছিলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি ভিখারীর ছদ্মবেশে এক গোয়েন্দাকে প্রেরণ করেন। এদের গতিবিধির প্রতি ন্যর রাখতে বলেন। আরো বলেন, এলোগেইছ ও তার সাথী দু মেয়ে কোথাও বেরোলে তাদের অগোচরে খেয়াল রাখবে। কোথায় যায়, কি করে সবার প্রতি নযর দেবে। রাতে এসে জানাবে।

পরদিন জানতে পারলাম ফ্লোরা ও মরিয়মকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এলোগেইছ পালাতে সক্ষম হয়েছে। হামলাকারী পুলিশদের সাথে এমনও দুলোক ছিলেন যারা ফ্লোরা ও মরিয়মকে চিনতেন। নির্দিষ্ট বাড়ীতে তারা আগমন চলিলে বাড়ীওয়ালারাও পুলিশের ওপর চড়াও হয়। গ্রামের লোকজন হৈ হুল্লোড়ে বেরিয়ে আসে। জনগণের প্রতিরোধের সম্মুখীন হলে পুলিশ ইন্সপেক্টর ঘোষণা করেন, একজনও সামনে এলে গোটা জনপদ জ্বলে ছাই করে ফেলব। ফ্লোরা ও মরিয়ম চিৎকার দিয়ে লোকালয়বাসীকে উত্তেজিত করে তোলে। ফ্লোরা চিৎকার দিয়ে বলে,

তোমাদের আত্মশ্রমের কি হলো কুশ পূজারীরা! এই মরিয়মকে দেখো! ইনি সন্ন্যাসিনী। তোমাদের ইজ্জতকে মুসলমানরা নিয়ে যাচ্ছে। খোদার বেটার কাছে কি জবাব দেবে?

মনসূর ইবনে মোহাম্মদ জানতেন, বিদ্রোহী জাতির লোকেরা অবশ্যই পুলিশদের সাথে লড়াই করবে। এজন্য তিনি সতর্কতামূলক অজস্র সেপাই সঙ্গে নিয়েছিলেন। জদের মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা ছিল। সেখানে ফ্লোরা ও মরিয়মকে রাখা হলো। জনপদের বাইরেও একদল পুলিশ ছিল, প্রয়োজনে তাদেরকে ব্যবহারের স্বার্থে।

ঐ দুকুলাঙ্গার যুবতাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসার প্রাক্কালে পুলিশ অফিসার কড়া ভাষায় ঘোষণা করলেন, কোন প্রকার প্রতিরোধ করলে গোটা জনপদে কিয়ামত কায়েম হয়ে যাবে। এতদসত্ত্বেও কয়েকবার তীর বৃষ্টির সম্মুখীন হতে হল তাদের। পুলিশের হস্তক্ষেপে সে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। ফ্লোরা ও মরিয়মকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

সুলতানা বললো, আমার যদুর বিশ্বাস-পথিমধ্যে ওই দুই যুবতী ছাড়া পাবার জন্য পুলিশ ইন্সপেক্টরকে নিশ্চয়ই কোন সুন্দর লোভনীয় প্রস্তাব রেখেছিল। স্বর্ণ-রৌপ্য ছাড়া অন্য কিছুও।

না সুলতানা! আজীবন তুমি এই আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছ যে, নারীর মধ্যে যে শক্তি আছে পুরুষের মধ্যে তা নেই। ওরা তোমার মত নীতিজ্ঞানহীনা নয়, ধর্মোদ্দীপনাও মৌল বিশ্বাসে টইটুম্বুর ওদের মন মস্তিষ্ক। মরিয়ম পথিমধ্যে কাউকে কোনো প্রস্তাব দেয়নি, উল্টো ইসলামের বিরুদ্ধে যা তা বলেছে। বলেছে স্পেনীয় মুসলমানদের শান্তিতে বসবাস করতে দেব না।

তুমি অবাক হবে সুলতানা! তোমার কোন মৌলনীতি নেই। স্বার্থ-ই তোমার মূলনীতি। এদেশে এমন কিছু মা আছেন যারা তারিক বিন যিয়াদের মত সন্তান জন্ম দিয়েছেন যারা স্পেন জয় করেছেন। আবার এমন কিছু মা আছেন যারা এমনো সন্তান জন্ম দিয়েছেন যারা কেবল গদী আর ক্ষমতার চিন্তায় বিভোর। শেষের খান্দানের বাচ্চারা কেবল ক্ষমতা দখলের সবক পেয়ে আসছে। তুমি সেই খান্দানের একজন। তুমি ভাবতেও পার না, মুক্তির বিনিময়ে নিজেদের ইজ্জত-আব্রকে সওদা করার প্রস্তাব একবারের জন্যও রাখেনি তারা।

পথিমধ্যে ওরা ইসলামকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়েছে। পরদিন তাদেরকে কাজীর দরবারে উঠানো হয়েছে। চীফ জাস্টিস ফ্লোরাকে বলছেন, তোমার শান্তি কেবল এই সুবাদে মাফ করছি যে, তুমি এক মুসলমান বাবার সন্তান। আমার যদুর ধারণা এই বন্দী দশা থেকে তুমি উপদেশ গ্রহণ করবে এবং সার্বিক পথে এসে যাবে।

ফ্লোরা তার মুখ বন্ধ করেনি। কাজী সাহেব এদেরকে দীর্ঘ কারাভোগের শাস্তি দেন। একবার সাদা শশ্রুমন্ডিত এক পত্রী কারাগারে তাদের সাথে দেখা করতে আসে। তাকে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু জেলদারোগা পরে ওই পাত্রীকে কয়েদখানা থেকে বের করে দেন। কেননা সে ফ্লোরাদের বলেছিল, ইস্পাত কঠিন থেকো। অচিরেই হেরেম থেকে তোমাদের ডাক আসবে।

বহুদিন পরে জানতে পারি এলোগেইছই পাদ্রীবেশে কয়েদখানায় এসেছিল। ফ্লোরা ও কয়েদখানায় মধ্যেই ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য গালিগালাজ শুরু করে দিলে আবারো তাদেরকে কাজীর দরবারে উঠানো হয়। বিজ্ঞ কাজী দেখলেন, এদের চিন্তা-চেতনা পূর্বের চেয়ে ক্রমশঃ অবনতি হচ্ছে। এবার তিনি স্বাভাবিক আইন প্রয়োগ করলেন। উভয়কে শূলে চড়িয়ে ফাঁসির হুকুম জারী করলেন।

উভয়কে মরণ ঘুমে ঘুম পাড়ানো হলো। এলোগেইছ প্রচণ্ড শক পেল, এক সাথে তার প্রতিশোধ বহি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। তার আন্দোলন চরম আকার ধারণ করল। খ্রীস্টানর খোলাখুলি ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিলাম শুরু করল। অবশ্য তারা নতুন করে আর বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারল না। স্পেনের আমীর ফরমান জারী করলেন, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গালি দেয়ার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যু। সুতরাং কমাসের ব্যবধানে ৮ হাজার খ্রীস্টানকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেয়া হলো। এলোগেইছ ফ্লোরার শোকে আধাপাগল। তাকেও এক সময় গ্রেফতার করে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হলো।

***

যিরাব। সুলতানা উদাস ও হতাশার সুরে বললো, তোমাকে বলেছিলাম সোনালী অতীতের সে সব কাহিনী শোনাতে যা আমার যৌবনকে চাঙ্গা করে তুলবে কিন্তু তুমি আমাকে প্রচণ্ডভাবে হতশে করেছ। সে সোরাহী উঁচিয়ে পেগ-এ মদ ঢালতে লাগল।

যিরাব সোরাহী ধরে টেবিলে রাখলেন। বললেন, সুলতানা জীবনের সাঁঝবেলাজে দাঁড়িয়ে আমারও মন চায় আমার সাথে কেউ ফেলে আসা দিনগুলোর বর্ণিল কাহিনী শোনাক, কিন্তু তোমার-আমার চাহিদার মাঝে বেশ ফারাক। তুমি বার্ধক্যে এসে জোয়ান হতে চাইছ। এজন্য মনোরম সুতি মন্থন করতে চাও। এটা এক ধরনের হীনমন্যতা, বাস্তবতা থেকে পলায়ন। আমি তা চাই না। বার্ধক্যকে সাদরে গ্রহণ করো সুলতানা।

তুমি ব্যর্থ জীবন কাটাচ্ছ। কাজেই তোমার স্বার্থপরতা ত্যাগ কর।

তুমি না বলেছিলে আমার সাথে তোমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক?

সেতো এখনো বলি। এখনো উপলব্ধি হয়, তুমি যদি আগুনে ঝাঁপ দিতে বল তাহলে দেব। কিন্তু শেষ রাতের এ নিরিবিলিতে সে কথা শুনে নাও, যা হয়ত আর কোনদিন শুনতে পাবে না।

মনে হচ্ছে তুমি পরিপক্ক মুসলমান হয়ে গেছে। সুলতানা হেসে বললো, আমীরে স্পেন বোধ হয় হালুয়াক্কটি তোমাকে একটু বাড়িয়ে দিয়েছেন।

আমীর আবদুর রহমানেরও বড় এনাম হচ্ছে তিনি আমায় মর্দে মুমিন বানিয়েছেন।

আমার বিশ্বাস ছিল তুমি কখনো মর্দে মুমিন হতে চেষ্টা করবে না। তোমাকে আমার গলার কারণ বলতে পার এটাও। আমি তোমাকে শরাব ও নারীত্বে ডুবিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।

যিরাব স্রেফ সংগীতজ্ঞ ছিলো না তিনি সংগীতে নতুনত্ব আধুনিকতাও এনেছিলেন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞতার প্রবাদপুরু, জ্ঞানবিদ্যার পিরামিড।

তিনি বললেন, হ্যাঁ সুলতানা! আমি আমীরে স্পেনকে বিলাসিতা ও নারীমোহে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। আমার যৌবনের পাতাগুলো তোমার সামনেই ধূসর অতীতে চলে গেছে। আমার এক একটি গোনাহ তুমি সামনে পেশ করতে পার। ঘাবড়াব না এতটুকু। প্রত্যেকটি গোনাহর স্বীকৃতি দেব। বলব আমি তওবা করেছি, অনুতপ্ত হয়েছি। আজ আমি সে সব কথার স্মৃতিচারণ করব যা তুমি শুনতে চাও না…………হ্যাঁ সুলতানা। একটি গোনাহ যা আমি এখনো করে যাচ্ছি, এর থেকে আমি তওবা করব না। সেটা কি নিশ্চয়ই শুনতে চাইবে। সে তোমার ভালবাসা। এর থেকে আমার মুক্তি নেই।

প্রেম-ভালবাসাকে তুমি গোনাহ মনে কর? প্রশ্ন সুলতানার।

এটা নির্ভর করে কার প্রেম আর কিসের প্রেম, কি উদ্দেশ্যে প্রেম-এর ওপর। তোমার অজানা নয় আমাদেরটা কেমন। আমীর আবদুর রহমানও তোমাকে হেরেমের হীরা বানিয়েছেন, আমিও তোমাকে হীরা বানিয়েছি।

অন্য কোন কথা থাকলে বলো যিরাব!

নাগো সুলতানা। দুঃখিত মনে যিরাব বললেন, ফেলে আসা দিনগুলোর পাতা ওলটালে আমার দুঃখ বেড়ে যায় তখন যবান সংযত করে রাখতে পারি না। আমাকে বলতে দাও, তারপর না হয় তোমারটা বলো।

আমার কাছে এক্ষণে কথা স্রেফ একটাই বাকী। আমার পুত্র আবদুল্লাহ আবদুর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হবে। রাজপ্রাসাদের প্রভাবশালী জনাচারেক আমলাকে ইতোমধ্যে আমার মতানুসারী করে ফেলেছি, এক্ষণে আমীরের মৃত্যুর প্রহর গুনছি। এখন তার মরা দরকার। বেটা মরেও না। তুমি কি আমার পুত্রের পক্ষে নও?

সময় আসতে দাও। আমীরে স্পেনের পঁয়তাল্লিশ পুত্র। এই পুত্রদের কিন্তু তার বিবাহিত স্ত্রীর গর্ভের আর কিছু দাসীদের। এর এক বেটা তোমার। আমীর আবদুর রহমান তাদের কারো একজনকে নির্ধারণ করবেন। তিনি জীবদ্দশায় এমনটা না করলে রাজপ্রাসাদে হট্টগোল বেঁধে যাবে। মোয়াল্লেদীনরা ব্যাপারটাকে লুফে নেবে। ফলে দেশের অপূরনীয় ক্ষতি হবে। আর হ্যাঁ,একথাও মনে রেখো সুলতানা। মোদারে যে প্রভাব মহলে আছে, তোমার তা নেই। তিনি চাইলে তোমাকে মহল থেকে বের করে দিতে পারেন।

সুলতানা ভাবনার অথৈ সাগরে ডুবে গেল।

তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে আমীরে স্পেনকে মর্দে মুমিন কে বানিয়েছে? তুমি তাছিল্য স্বরূপ বলেছিলে, সে আমি নইতো! হ্যাঁ, সুলতানা! আমি নই। মোদাচ্ছেরা-ই তাকে মর্দে মুমিন সিংহশাবক বানিয়েছেন। তিনি ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী। আবদুর রহমানের শরীরের রক্তেও রয়েছে আত্মসমবোধের স্রোত। সুলতানা। আমীরে স্পেনকে সিংহশাবক করে স্পেনের শেকড় মজবুতই করা হয়েছে। তার শাসনামলের শুরুতে খ্রস্টানদের ষড়যন্ত্রে শেনের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কেননা এই লোক তোমার মত ডানাকাটা পরীদের অচিনপুরিতে ডুবে গিয়েছিল। মনে নেই, তোমার সৌন্দর্য সুষমা আর সংগীতের সুর মূর্ঘনা তাকে কোন পর্যায়ে নামিয়েছিল?

প্রশাসক অযোগ্য, সতর্ক কিংবা বিলাসী যাই হোক না কেন, হোক না সে চাটুকারদের কথায় ওঠ-বসকারী, তার দৃষ্টিতে ঐসব লোকই আজ ভালো মনে হবে যারা তাদেরকে অযোগ্য-অথর্ব সাব্যস্ত না করে।

আমি এ কাজ করেছি। এ কাজ করেছ তুমিও। এ সুযোগেই খ্রীস্টানরা মুসলিম সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ করার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে। মোয়াল্লেদিনরা আন্দোলন করেছে। খুনের দরিয়া বয়েছে। দুহাত ভরেছে কবি-সাহিত্যিকদের। মোটকথা স্পেন পরিণত হয়েছে দুশমনদের অভয়ারণ্যে। কিন্তু এ বিশাল ব্যক্তিটি শেষ পর্যন্ত শরাবের পেগ দেয়ালে ছুঁড়ে দিয়েছেন। সঙ্গীতের তারগুলো ছিঁড়ে ফেলেছেন, তোমার সৌন্দর্য সুষমা উপেক্ষা করেছেন। এ সবই হয়েছে জাতির দুর্দিনের কিছু কাণ্ডারীর ঘাম ঝরা মেহনতের বদৌলতে।

কাজেই আমার এক্ষণের আশা, তুমি বাকী জীবনটা নিঃসঙ্গ কাটাবে। সিংহশাবক আবদুর রহমানকে আর কটা দিন একাকী কাজ করতে দাও। আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবী করুন। মরার আগে তিনি জালিম শাহীর টুটি টিপে ধরুন। তিনি এমন লোকদের মেরে তক্তা বানান, খোদা ছাড়া যাদের কেউ মারতে পারবে না। কেউ না।

তুমি জানো সুলতানা! এ সেই আবদুর রহমান যার দরবারে দুশমন হামেশা দোস্তির পয়গাম নিয়ে এসেছে। বাইজেন্টাইনের মিখাইল এসেছিল। এসেছিল থিওফেলিস। এমন কি স্পেন সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট দুশমনকে ফ্রান্স সম্রাট লুই তার পুত্রদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থেকে পরিত্রাণ পেতে আব্দুর রহমানের শরণাপন্ন হয়েছিল। দূত পাঠিয়ে সে বলেছিল, স্পেনের বিদ্রোহে আমি আর কোনো প্রকার মদদ করব না, এর বিনিময়ে আপনি আমার দেশে হামলা করবেন না। এজন্য আপনি অর্থকড়ি দাবী করলে আপনার চাহিদামাফিক দেব। আবদুর রহমান এ প্রস্তাবের জবাবে কেবল এতটুকু বলেছিলেন যে, আমি কোনো বিনিময় চাই না। বিনিময় কেবল এতটুকু যে, তুমি আমার স্পেনের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। তাকালে সে চোখ আমি উপড়ে ফেলব। স্পেনের। কোনো বিদ্রোহী তোমার দেশে আশ্রয় নিলে ঘোড়ার পিঠে বেঁধে পাঠাবে।

সুলতানা! এ সেই আবদুর রহমান! সমুদ্রেও যার শাসন চলত। তুমি তোমার দুনিয়ার সামান্য এক নারী মাত্র। তোমার আজীবনের কোশেশ ছিল তিনি যেন খোদ ময়দানে নেমে তলোয়ার না চালান।

আমি যাকে আপন করে চাই সে ময়দানে না মরুক– এজন্য তাকে আমার ময়দানে যেতে না দেওয়া। সুলতানা বলল।

এ বয়সে মিথ্যা বলা পরিহার করলে আত্মিক প্রশান্তি পাবে তুমি। কেন স্পেনের দুশমনরা কি তোমায় এ কথা বলেনি যে,আবদুর রহমানকে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরাও। কেননা তার সে যোগ্যতা রণাঙ্গনে। ওটা আর কারো নেই। এ ছাড়া আমীর কোন ফৌজের সাথে থাকলে তাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তুমি তাকে রুখতে পারনি। মোদাচ্ছেরা কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে তার তলোয়ারে ঠুক দিয়েছিলেন। তার হাতে তলোয়ার দিয়ে বলেছিলেন, যাও এ আমার মাথার মুকুট! আল্লাহ তোমার সহায় হোন।

শেষ পর্যন্ত আবদুর রহমানের পৌরুষটা জেগে উঠেছিল। নরম্যান- পানিদস্যুরা ভূ-মধ্য সাগরে ডাকাতি করত ও মুসাফিরদের বড় বড় জাহাজ লুঠন করত। এই ডাকাতরা ছিল জার্মানীর বাঁশিন্দা। সমুদ্রে শিকার না পেলে তারা উপকুলে উঠে আসত এবং লোকালয়ে লুটতরাজ করত। তারা স্কভতিউয়ায় ঘাঁটি গেড়েছিল। সমুদ্রের ওই দিকটা দিয়ে কোনো জাহাজই যেতে পারত না। আবদুর রহমান এদের শক্ত হাতে দমন করে শুধু স্পেন নয় গোটা ইউরোপের উপকার করেন।

ক বছর আগের ঘটনা। কাজে কাজে হাঁপিয়ে আবদুর রহমান তার খাস কামরায় শ্রান্ত-ক্লান্ত বসেছিলেন। তিনি আমাকে সেতারা নিয়ে ডেকে পাঠালেন। আমি গেলে তিনি মুচকি হেসে বললেন, যিরাব। ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েছি। বুড়িয়ে গেছিতো! শোনাও না কিছু। তার ফরমায়েশ পুরা করতে তখন গুনগুন করছিলাম। এমন সময় দারোয়ান এলো। বললো, সালার উবায়দুল্লাহ এসেছেন পর্যটক কিসিমের কিছু লোকজন নিয়ে। তাদের সাথে কিছু নারীও আছে।

আমি বলেছিলাম আমীর এ সময় কারো সাথে কথা বলবেন না। কিন্তু তিনি নড়ে চড়ে বসলেন। আমাকে বললেন, সেতারা বন্ধ। এরা মজলুম হলে ঘটনা স্বাভাবিক নয়। তিনলোক ভেতরে এলো। তাদের সাথে মাঝবয়সী এক মহিলাও ছিলেন। ছিল দুযুবতী। তাদের কাপড়-চোপড় ছেঁড়া ফাটা। নারীদের চোখে অবিরল ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। এরা মুসলিম ছিল না। সকলেই ফরাশের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। সকলেই হাতজোড় করা।

আমীর আবদুর রহমান স্বাভাবিক অবস্থায় বসতে বললেন। প্রহরী ডেকে এদের খানাপিনার ব্যবস্থা করতে বললেন। তাদের সামনে ফল-পাকড়ার তূপ জমা করা হলো। পরে বলা হলো, তোমরা কি উদ্দেশ্যে এখানে। আধবুড়ো মহিলা গেছো ভাষায় বললো, আপনি কি আমাদেরকে ঐ সব হিংস্ৰদানবদের ওপর ছেড়ে রাখবেন? আমরা কি মানুষ নই? এক লোক কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বললো, সাবধান হয়ে কথা বলো, ইনি বাদশাহ। আমীর আবদুর রহমান গর্জে ওঠলেন। বললেন, আরো সাবধান হয়ে কথা বলে। এখানে কোনো বাদশাহ নেই। আমরা তোমাদের সাহায্য করতে চাই। বলো সেই হিস্ৰদানব গুলোর পরিচয় কি? মহিলা বললেন, ওরা জার্মানীর পানি। এদের নরম্যান বলা হয়। ওরা বসতি উজাড় করে দিচ্ছে। ফসলই আমাদের রুটি রুজির মাধ্যম। তারা যাবতীয় ফসল ও শস্য লুট করে নিয়ে যায়। সুন্দরী তরুণীদের ধরে নিয়ে যায় এবং সমুদ্র উপকূলে তাদের বিক্রী করে ফেলে। আমরা যাব কোথায়? ওদের জাহাজ উপকূলে নোঙর ফেললে আমাদের লোকজন বসতবাড়ী ছেড়ে পালায়। এরা আমার মেয়ে। ওদের নিয়ে আমি শংকিত। এতদিন বন-বাদাড়ে ছিলাম। হাড় কাঁপানো শীতেই আমার এক বাচ্চা মারা গেছে ইতোমধ্যে। আমার পাগল হবার উপক্রম। আমার স্বামীই আমাকে কর্ডোভায় নিয়ে এসেছেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্য সয়ে আমরা এই দূর সুদুরে উপস্থিত হয়েছি। আপনার তরবারীর ডগা নরম্যান পানিদস্যুদের মোকাবেলায় ভোতা হয়ে থাকলে এই বাচ্চাদের আশ্রয় দিন। আমরা শুনেছি মুসলমানরা নারী জাতির ইজ্জত-আব্রুরক্ষায় প্রাণ বিসর্জন দিয়ে থাকে।

সুলতানা! সেই রং আমার এখনো স্মরণ আছে, আবদুর রহমানের চেহারায় সেদিন দেখেছিলাম যা। তিনি প্রহরীকে বললেন, ওদেরকে শাহী মেহমানখানায় নিয়ে যাও। গোসল করানোর পর ভাল কাপড় পরাও। সেনাপতি উবায়দুল্লাহকে সর্বশেষে ডেকে পাঠাও। দেখলাম বুড়ো আবদুর রহমানের চোখ দুটো বালবের মত জ্বলে উঠল। তিনি আমাকে বললেন, খোদা তায়ালা আমাকে এই দায়িত্ব সঁপেছেন। অতি অবশ্যই আমার দায়িত্ব আমি পালন করব। তার বার্ধক্যের ক্লান্তি কোথায় যে লুকালো।

***

সেনাপতি এলে আবদুর রহমান তাকে বললেন, আপনার প্রেরিত পুরুষ-নারীরা আমার এখানে এসেছিল। আমাদের ভাণ্ডারে নৌ-সরঞ্জামাদি অতটা নেই যতটা আছে নরম্যানদের, কিন্তু ওদেরকে আমি নাস্তানাবুদ করতে চাই। সেনাপতি বললেন, আমাদের নৌ বহরে বিশাল নৌকাও ছোট বজরা আছে এ দিয়ে আমরা লড়াই করতে পারব না। আমি হুকুম দিলে বিশাল জঙ্গী জাহাজ বানাতে পারি। ততদিনে আমাদের ফেীজ উপকূল প্রহরা দেবে। নরম্যান পানি দস্যু থেকে দেশ বাঁচাবে।

তড়া করে সৈন্য প্রেরণ করা ভাল। নরম্যানদের দুঃসাহসিকতা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, তারা বেত ও চামড়ার ছিপি নৌকায় করে স্পেন উপকূলে হামলা করার সাহস পেল। গোয়েদলকুইভারে ওদের সাথে সর্বপ্রথম লড়াই হয়। নৌ জাহাজ ওদেরই খুব শক্তিশালী ছিল বিধায় সেখান থেকে উড়ে আসা তীর বৃষ্টিতে আমাদের বাহিনী পিছটান দিতে বাধ্য হলো।

ততদিনে মুসলিম নৌ-জাহাজ তৈরী হয়ে গেছে এবং কিছু জাহাজ বিদেশ থেকেও কেনা গেল। আমীর আঃ রহমান এদের চিরতরে খতম করার আশংকা ব্যক্ত করেন। তার নিজস্ব তত্ত্ববধানে বিশাল নৌবহর গড়ে তোলা হলো। বড় জাহাজের সংখ্যা পনের এর পাশাপাশি ছোট জাহাজ পালতোলা নৌকার সংখ্যাও কম নয়। নৌ-সৈন্য মহড়াও চালাল মাসখানেক। সমুদ্র উপকূলে বিশাল টাওয়ার বানানো হলো। সেখানে তীরন্দায় বসানো হলো। সমুদ্রবক্ষে সন্দেহজনক জাহাজ দেখলে এরা খবর পাঠাত।

নরম্যান দস্যুরা পূর্ণশক্ষিতে সমুদ্রে নামল। আমীর আবদুর আঃ রহমান খবর পেয়ে নিজেই নেতৃত্ব হাতে নিলেন। নেমে পড়লেন নৌ-যুদ্ধে। দস্যুরা কোনদিন এমন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। এবার ওদের যুদ্ধ সুশিক্ষিত সুদক্ষ জঁদরেল আঃ রহমান বাহিনীর সাথে। ওদের নৌবহরে আগুন লেগে গেল আবদুর রহমানের নিক্ষিপ্ত অগ্নিবাণে। বড় ক্ষতি স্বীকার করে ওরা প্রাণ নিয়ে পালাল। এরপর কেবল নরম্যান নামটাই বাকী থাকল। এরপর উপকূলে হামলার সাহস করেনি ওরা কোনদিন।

***

যিরাবের কথা শুনতে শুনতে সুলতানা বিরক্ত। বার্ধক্যের রওয়াসওয়া রূপটুকুনকে পুঁজি করে সে নিজকে যুবতী সাজিয়ে যিরাবকে হাত করতে গিয়ে বিলক্ষণ বিপাকেই পড়ে গেল। যিরাব তাকে কল্পনার জগত থেকে বাস্তবতার জগতে নিয়ে এলো। যিরাব তাকে বললেন, এখন তোমার শান্তি নেই কোন কাজেও। তার একান্ত আগ্রহ আবদুল্লাহকে আমীর বানানো। তার ধারণা ছিল, যিরাব একাজে সহায়তা দেবে কিন্তু যিরা তার আশার গুড়ে কেবল বালিই ছিটিয়েছে।

নপুংসক বুড়ো! যিরাব চলে যাবার পর সে ঘৃণায় রাগ ঝাড়ে, শরীরের শক্তি লোপ পাওয়ায় কোনো নারীর অযোগ্য হবার পরই এখন নিজকে আল্লাহর ওলি সাজিয়েছে। এক্ষণে আমীরে স্পেনের হিতাকাঙ্ক্ষী ও মুরীদ হয়েছে। ওর চেয়ে আমার প্রভাব কম কিসে। প্রাসাদের সকলেই আমার মুঠোয়। যাকে দিয়ে যখন খুশী তখন বিদ্রোহ করাতে পারি। রাখো! এক একজনকে ধরব। প্রথমে তোমার পালা আবদুর রহমান, এরপর মোদাচ্ছেরা। অবশেষে যিরাব, তোমাকেও ছাড়ছি না।

তার শিরা-উপশিরায় খুশীর নহর এবং শয়তানী ও পাশবিকতা ফুটে উঠল। মাথার সাদা চুল, যিরাবের কথা ও উদাসীনতা তাকে কালনাগিনী বানাল। এক্ষণে পালা দংশনের। পালা ছোবলের। বিষে বিষে নীল আরক্তের।

ইতিহাস যেখানে আবদুর রহমান, যিরাব, সুলতানা, মোদাহেরীর নামোল্লেখ করেছে সেখানে এক গোলামেরও নামোচ্চারণ দেখা যায়। গোলামের নাম নসর। তার কিছু গুণে মুগ্ধ হয়ে আবদুর রহমান গোলামীত্ব ছেড়ে দরবারের উঁচু পদ দেন তাকে। সুলতানা আমীরে স্পেনের সামনে এর অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেন। যৌবনে সুলতানার হাতে যেহেতু গোটা মহল ছিল সেহেতু সে, এই নসরকে হাতের পুতুল করে রাখত। সে তাকে ধন-সম্পদও দিত।

নসর যিরাবের বয়সী হলেও সে তখন সুলতানার আজ্ঞাবহ ছিল।

পরদিন সূর্যের আলেয়াতে সুলতানার ঘুম ভাংল। তৎক্ষণাৎ সে চাকরাণীর মাধ্যমে নসরকে ডেকে পাঠাল।

নসর এলে তাকে পালংকে বসাল। বলল তার সাথে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। বুড়ের আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত মনের কথাটি বলল। নিয়ে গেল তার কানের কাছে মুখ। নগরের চোখ-মুখ ফুলে বড় হয়ে গেল ঐ কথা শুনে।

এই গোনাহ আমার হাত দিয়ে করাবেন? নসর একথা শুনে বলল।

হ্যাঁ নসর। এ গোনাহ আমার হাতদ্বারা করাব। সে সব গোনাহর কথা মনে করে দেখো, যেগুলো করে আমার করুশায় বেঁচে গেছো তুমি। সেসব গোনাহর একটাও আগে ফাস করে দিলে বধ্যভূমি হবে তোমার ঠিকানা। জল্লাদ আমার ইশারায় চলে সে কথাও তোমার অজানা নয়। তুমি এ কাজ করলে আমার পুত্র স্পেনের আমীর হবে আর তোমার পুত্র হবে স্পেনের সেনাপতি।

জিঞ্জিরে আটকা পড়ে গেল নসর। সে জানত সুলতানা এক কালনাগিনীর নাম। হেন কাজ নেই যা সে করতে পারে না। এর পাশাপাশি তার ছেলের ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল। সে মুচকি হেসে বলল, আমি করব না তো কে করবে এ কাজ।

দীর্ঘক্ষণ আলাপ সেড়ে নসর সুলতানার ঘর থেকে বেরিয়ে, শাহী হেকিমের কাছে গেল। হেকিম হুররাণীও বেশ বুড়া। সুলতানার শিখিয়ে দেওয়া কথা সেহেকিমের কাছে বলল। সুলতানা তাকে বলেছিল, হেকিমের আপত্তি থাকবে প্রচুর। তারপরও এ কুপ্রস্তাব শুনে হেকিমের আপাদমস্তক কেঁপে উঠল।

নসর বলল, আপনার সামনে দুটি রাস্তা খোলা। প্রথমত আজীবন কয়েদখানায় কাটাবেন। এমন শাস্তির সম্মুখীন হবেন, জোয়ানরাও যা সহ্য করতে পারে না। আমার যবান আপনার বিরুদ্ধে যা বলবে তা নির্মম সত্য হয়ে দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত দুনিয়ায় জান্নাতের দেখা পাওয়া। এখন বলুন কোনটা পছন্দনীয় আপনার।

দুর্বল হুররাণী গেড়াকলে আটকে গেলেন। অশুভ পরিণতির কথা ভেবে তিনি এমন বিষ তৈরী করে দিলেন যার এক ঢোক সেবন করলেই কেচ্ছা খতম। ইতিহাস এই বিষের নাম দিয়েছে লিবিয়ান আল-মানুক। নসর তাকে বললনা, এ বিষ কার ইশারায় বানানো হলো।

***

আমীর আবদুর রহমানের স্ত্রী মোদাচ্ছেরা বয়স সুলতানার চেয়ে কিছু কম। তাকে মদ, নারী ও সঙ্গীত জগৎ থেকে মুক্তি দিতে এই স্ত্রীর হাত দিল সর্বাধিক। সন্ধ্যার দিকে জনৈক চাকরাণীর মাধ্যমে সংবাদ প্রেরণপূর্বক হুররাণী জানান, অসুস্থতার বাহানায় আমাকে ডেকে নেয়ার ব্যবস্থা করো। সন্ধ্যার পূর্বেই মোদাচ্ছেরা জনৈকা চাকরাণীর মাধ্যমে শাহী হেকিমের কাছে খবর পাঠালেন যে, আমার খুব পেটব্যথা করছে। জলদি আসুন। শাহী হেকিম এসে পড়লেন।

মালেকায়ে আলিয়াহ! আজ সে কথা মনে পড়ছে, সুলতানা আপনাকে প্রয়োগের জন্য এক সময় আমার কাছ থেকে বিষ সংগ্রহ করেছিল। আমি আপনাকে সেদিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, কোনো চাকরাণী শরবত দিলে আপনি তা গ্রহণ করবেন না, কেননা ওটা শরবত নয় বিষ।

হ্যা! হেকিম সাহেব! মনে আছে। শুধু তাই নয়, এজন্য আপনি মহল ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি বাদ সেধেছিলাম। হতে পারে একদিন আমীরে স্পেনকেই আপনার হাতে বিষ প্রয়োগ করা হতে পারে-তখন আপনি এমন হুশিয়ার করবেন; বলেছিলাম সে কথাও। জানিনা সেদিন অমন কথা আমি কেন বলেছিলাম। ও হ্যাঁ! আপনি আমাকে আজ ওকথা কেন স্মরণ করালেন- বলুন তো। আর এ অভিনব পদ্ধতিতে আপনার সাক্ষাতের হেতু কি?

আপনি যেহেতু সহজ, সরল, নিষ্পাপ নারী, হয়ত সে কারণেই খোদাতায়ালা আপনার মুখ দিয়ে ও কথা বের করিয়েছিল। আমীরে স্পেনের সর্বাপেক্ষা প্রিয় গোলাম যাকে তিনি দরবারে বিরাট পদমর্যাদা দান করেছেন সে আমার থেকে বিষ নিয়ে গেছে আমীরে স্পেনের মুখে তুলে দিতে। বলে হুররাণী মোদাচ্ছেরার কাছে পুরো ঘটনা তুলে ধরলেন। আমার বাধ্যবাধকতা বুঝেছেন তো?

বুঝব না মানে! বলেন কি! নসর একথা বলেছে কি, সে কার কথায় এ বিষ নিচ্ছে? কেন এ মহান অন্যায় করতে যাচ্ছে?

না! তা বলেনি। আমার জিজ্ঞাসার পরও বলেনি। আপনি আমীরে স্পেনকে বলবেন, তিনি যেন নসরের হাত থেকে কিছু গ্রহণ না করেন। এবার আমায় এজাযত দিন। আমার জিম্মা আমি পালন করলাম।

***

বয়স, নানা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ সর্বোপরি সামুদ্রিক যুদ্ধ সফরে আমীর আবদুর রহমান খুবই ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তিনি কোন না কোন ওষুধ সেবন করে যাচ্ছিলেন। একদিন তার বিশেষ খাদেম নসর এসে বলল, আমি আপনার ক্লান্তি দূর করতে শক্তিবর্ধক টনিক নিয়ে এসেছি। সেবন করতে করতেই দেখবেন হারানো যৌবন ফিরে এসেছে।

আবদুর রহমান মুচকি হেসে বললেন, তুমিও তো বেশ বুড়িয়ে গেছ নসর। বার্ধক্য জোয়ান করে এমন লোভনীয় ওষুধ আমার আগে তো তোমারই সেবন করা অতি জরুরী। আমি বহু দাওয়া সেবন করেছি। এ ওষুধটা তুমিই সেবন কর।

নসর অস্বীকৃতি জ্ঞাপনপূর্বক বললো, এ ওষুধ তো স্রেফ আপনার জন্য এনেহি। আমি না হয় পরে বানিয়ে খেলাম।

নসর। আবদুর রহমান শাহী দাপট নিয়ে বললেন, আমি তোমাকে এই ওষুধ খেতে নির্দেশ দিচ্ছি। আবদুর রহমান নয় স্পেন-আমীর তোমাকে সেবন করতে বলছেন। জলদি মুখে পুরে দাও।

নসরের চেহারায় বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। হুকুম তামিল করতে গিয়ে ওষুধ নিজের মুখে পুরে দিল। আমীরে স্পেন তাকে সটকে পড়তে বললেন। নসর বেরিয়ে গেল। দৌড়ে শাহী হেকিমের কাছে এসো, বললো, যে বিষ আমীরকে খাওয়াতে গিয়েছিলাম তা আমাকেই খাইয়ে দেয়া হয়েছে। খোদার দিকে চেয়ে আমাকে বিকল্প কিছু একটা দিন।

জলদি গিয়ে বকরীর দুধ পান করো শাহী হেকিম বললেন।

নসর পাগলের মত দৌড়ে বেরোল। বিষে তাকে ধরেছে সেই কখন। বকরীর দুধ তার আর খাওয়া হলো না। পথিমধ্যেই চিৎপটাং। সেই সাথে দেহ থেকে প্রাণপাখি উধাও।

আবদুর রহমান বিষ প্রয়োগ থেকে বেঁচে তো গেলেন এবং বিষ দাতাই বিষের শিকার হল। তথাপিও এতে তিনি নেহাৎ চোট পান। যাকে তিনি বিশাল পদমর্যাদা দান করেছেন, গোলাম থেকে দরবারের অফিসার বানিয়েছেন সেই কি না তাকে বিষ প্রয়োগ করতে পারে? এ আত্মজিজ্ঞাসা তাকে পীড়া দিতে দিতে সাত দিনের মধ্যেই নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য করল।

কিছুদিনের মধ্যেই নসরের মৃত্যু রহস্য উদঘাটিত হলো। জানা গেল, সুলতানার প্ররোচনায়ই নসর অনিচ্ছাকৃত মহাপাপ করতে গিয়ে জঘন্য মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে। আমীর আবদুর রহমানের মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র মোহাম্মদ ক্ষমতারোহণ করেন এবং সুলতানা ও তার পুত্র আবদুল্লাহ ইতিহাসের নিঃসীম আঁধারে হারিয়ে যায়। (সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *