২.১ দ্বিতীয় খণ্ড – কালনাগিনী

দ্বিতীয় খণ্ড – কালনাগিনী

মাদ্রিদের পথে

ক্রুসেড যুদ্ধ সেদিনই শুরু হয়েছিল, যেদিন থেকে গীর্জা অনুভব করল যে, কুশদণ্ডের ওপর চাঁদ-তারার ছায়াপাত শুরু হয়েছে। এ ঘটনা সালাহউদ্দীন আইয়ূবীর যুগের বহু পূর্বের। উত্তাল তরঙ্গময় নোম সাগর পাড়ি দিয়ে ইসলাম গীর্জার জগতে প্রবেশ শুরু করলে কুশপূজারীরা খড়গহস্ত হয়ে ইসলামকে নাস্তানাবুদ করতে ময়দানে নামল। ওই যুগে যে কোন লড়াইকে দুরাজার লড়াই বলা হোত। পরে দুধর্মের লড়াইতে রূপ নিত। রূপ নিত দুটি পারস্পরিক আকীদার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের।

মুসলিম জাতি সর্বদা আল্লাহ ও তলোয়ারের ওপর ভরসা করে আসছে। সর্বদাই সমরবিদ্যা ও জেনারেলশিপ অবলম্বন করেছে, ময়দানে কারিশমা দেখিয়েছে। অল্পসংখ্যক সৈন্য জঙ্গী চাল, গেরিলা টেকনিক এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার দরুন বিশাল বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছে। পরে বিজিত এলাকায় তলোয়ার খাপে, ঢুকিয়ে একনিষ্ঠতা ও প্রেম-প্রীতিবলে মানব হৃদয় জয় করেছে।

খ্রীস্টান ধর্মগুরু ও রাজাগণ মুসলমানদের ক্রমাগত বিজয় দেখে যুদ্ধের পাশাপাশি অন্যান্য কৌশল অবলম্বন করেন। এগুলো সবই গুপ্ত কৌশল ও নারীঘটিত। ঐ যুগে যদিও মনোবিজ্ঞানের অস্তিত্ব ছিল না তথাপিও মানুষের বুদ্ধি, মেধা ও জ্ঞান-গরিমা কম ছিল না। মানব জীবনের দুর্বল ও স্পর্শকাতর দিকগুলো তারা চিহ্নিত করতে পারতো। এমনই কিছু দিক হচ্ছে গদীলোভ, নারী সুষমা ও অর্থ টোপ। গীর্জা নারী সুষমাবলে মুসলিম সরকার, মন্ত্রী ও সেনানায়কদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করে। সর্বোপরি তারা মুসলিম সমাজে আত্মঘাতী গাদ্দারও সৃষ্টি করে।

মুসলিম জাতির প্রাণঘাতী চরম দুশমন ইহুদী চক্রও এসময় খ্রীস্টশক্তির এসব গুপ্ত কৌশলে হিস্যা নেয়। ইহুদীদের ইতিহাস শয়তানি আর সন্ত্রাসের ইতিহাস। খ্রীস্টান শক্তিকে এরা হেন কোন সন্ত্রাস নেই মুসলমানদের মোকাবেলায় যা করতে শেখায়নি। তাদের ভুবন মোহিনী যুবতীদের দিয়েও সাহায্য করে। ইহুদী নারীদের সম্মোহনী কৌশলে সফলতা দেখে শেষ পর্যন্ত খ্রীস্টানরাও তাদের নারীদের নিয়োগ করে এ কাজে। শুধু কি তাই! ইসলামকে নাস্তানাবুদ করতে তারা কোরআন-হাদীসের গবেষণা শুরু করে। এমন কি মসজিদে পর্যন্ত ইমামতি শুরু করে। ইসলাম খেদাও অভিযানে ক্রুসেডাররা আত্মদানও করে। ইসলামের ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে খ্রীষ্টধর্মের স্থিতিশীলতায় তারা যা করেছে তা সত্যিই প্রশংসাই। পক্ষান্তরে অদূরদশী মুসলিম শাসকবর্গ নিজেরা ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে কলহে লিপ্ত হয়। বেশ কিছু সেনানায়ক ক্ষমতার মোহে গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত লাগিয়ে দেয়। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ দুর্বল প্রতিপক্ষকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে। তারা রণাঙ্গন ছেড়ে সিংহাসনমুখী হয়। পরিণতিতে যা হবার তাই হয়। শাসনকার্যে। সিংহশাবক অদক্ষ এসব নীল ভ্রমরদের কারণে রাজনীতি দেউলিয়াত্ব রূপ ধারণ করে। যাদের একটু-আধটু প্রজ্ঞা ছিল তাও নিঃশেষ করে দেয় চাটুকাররা। এরা রাজাদেরকে বিশ্বাধিপতি করে তুলছিল। এতদসত্ত্বেও ওই যুগে এমন কিছু সিংহশাবক ছিল যাদের আত্মোৎসর্গের দরুন স্পেনে দীর্ঘ ৮০০ বছর ধরে হেলালী নিশান পতপত করে উড়ছিল। টিমটিম করে হলেও এদের বদৌলতে এখানে হকের আলো জ্বলছিল। এরা আজ অতীত ইতিহাসের নিঝুমপুরীতে এভাবে বিলীন যে, খুব তত্ত্ব-তালাশ না করলে কাউকে উদ্ধার করা যায় না। চটি বই, ক্ষুদ্র পুঁথি ছাড়া তাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সত্যিই এটা ইতিহাস বিমুখ জাতির এক বেদনাদায়ক দিক।

স্পেন ইতিহাসে ৮২২ খ্রীস্টাব্দ ছিল সালার ওবায়দুল্লাহ, আঃ করিম, আঃ রউফ ও করনের যুগ। এরা সেই সিংহশাবক যারা দ্বিতীয় আব্দুর রহমান ইবনুল হাকামকে যিরাব ও সুলতানার মোহজাল থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আব্দুর রহমান যখন ফ্রান্স অভিমুখে টর্নেডো গতিতে ধেয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাকে সেই মদ্যপ ও নারী লোলুপ মনে হয়নি, কর্ডোভা প্রাসাদে যিনি সুলতানার বাহুবন্ধনে দিনাতিপাত করতেন। তার চোখে তখন খালিদী রশ্মি, মুখে তারিকী হুংকার ও দেহে ইবনে নুসায়েরের শৌর্য বীর্য। আপাদমস্তক জুড়ে তার জেহাদী উদ্দীপনা ছিল। দেমাগে শুধু রণাঙ্গনের রক্তলাল দৃশ্য।

তিনি মাদ্রিদে আব্দুল জব্বারের অ্যুত্থান কাহিনী শুনে এতটুকু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। মনে হয় ব্যাপারটা তিনি আগেভাগেই জানতেন। তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেননি কোনদিনও। এটাই যোগ্য শাসকের বৈশিষ্ট্য। ফওরান ফ্রান্স যাত্রা স্থগিত ঘোষণাকরত আঃ রউফকে জানান, ফ্রান্স অভিযান থেকে ফিরে এসো মাদ্রিদে কোচ করো। আব্দুর রহমানও তার বাহিনীসহ মাদ্রিদ অভিমুখী হন।

মাদ্রিদ অভ্যুত্থান একদিনেই হয়নি, ঘটা করে হয়নি, ঈসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহী পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। ওরা আঃ জব্বারের মত নেককার ও সৎ শাসককে বদকার ও অসৎ বানিয়ে তাকে এই টোপ দিয়েছিল যে, তোমাকে মাদ্রিদের স্বাধীন সম্রাট বানানো হবে। খ্রীস্টানরা হবে তোমার জনগণ ও মদদগার। শুধু কি তাই, তাকে লোকালয় ছেড়ে নির্জন পাহাড়ের গুহায় নারী ও মদে ডুবিয়ে রাখা হয় গলা অবধি।

লাগাতার যুদ্ধের দরুন ট্যাক্স বেড়ে যাচ্ছিল। মাদ্রিদ রাজ্যে বিশেষ ট্যাক্সের মাত্রা বেড়েছিল অধিক। যদ্দরুন এই অঞ্চলের মানুষ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল।

এদিকে কেন্দ্রীয় গভর্নরের বিরুদ্ধাচরণ কার দরুন আব্দুল জব্বারকে গদীচ্যুত করা হয়েছিল। খ্রীস্টানদের বিগবস এলোগেইছ ও এলিয়ার মাদ্রিদে পৌঁছে গেল। এদের মাদ্রিদ গমনকে গোপন রাখা হল। তারা গীর্জার পাদ্রিদের সেখানে একটি গুপ্ত মিটিং-এ জরুরী পরামর্শ দিল।

কাজেই এপর থেকে পাদ্রীরা তাদের ধর্মোপদেশের মধ্যে একথাও সংযোজন করল যে, ঈসায়ীদের মুসলিম জাতিতে পর্যবসিত করার জন্য ট্যাক্সের ভারবাহী বোঝা চাপানো হচ্ছে। ঈসায়ীরা এই বোঝা কবুল করে এর তলে পিষ্ট হতে হতে একসময় ভিক্ষুকের জাতিতে পর্যবসিত হবে এবং একদিন ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হবে। আর কেউ বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলে সে হবে মুসলমানদের দাস, সুতরাং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় একটাই-কর্ডোভাকে ট্রাক্স দেয়া বন্ধ করো। গীর্জার অফিসার ও কর্মচারীদের জানিয়ে দেয়া হলো, যে কোন শ্রেণীর লোকদের জন্য দরজা উন্মুক্ত করো। সবাইকে বলো, কর্ডোভাকে ট্যাক্স না দিতে। ইতোমধ্যে আঃ জব্বার ষড়যন্ত্র করে কেন্দ্রের ট্যাক্স উসূল কারীদের হত্যা করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রিদের ট্যাক্স অর্ধেক মওকুফ করে দিল। বলল, এখন থেকে আমার লোকজনই ট্যাক্স আদায় করবে।

নিহত ট্যাক্স উসূলকারীদের দাফন করে দেয়া হলো। তারা ফিরে না যাওয়ায় তালাশ শুরু হল, কিন্তু কোন হদিস করা গেল না। কানাঘুষার মাধ্যমে ছড়ানো হলো, তাদেরকে দেশের অন্য কোথাও দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত জানা গেল আঃ জব্বার ট্যাক্স উসূল শূরু করে দিয়েছে, কিন্তু তারওতো কোন খোঁজখবর নেই, তার দ্বারা জনগণ উপকৃত হচ্ছিল। কাজেই তার সন্ধান দিতে কেউই তেমন একটা আগ্রহ দেখালো না।

এলোগেইছ শহর-বন্দরে ঘুরে ঘুরে মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প হড়াতে ব্যাপৃত হল। বলে বেড়ালো, আব্দুল জব্বারই আমাদের শাসক। মাদ্রিদ স্বাধীন রাজ্য। সুতরাং এখন প্রতিটি খ্রীস্টানকে সেটাই মনে করতে হবে। মাদ্রিদের বর্তমান গভর্নর এক্ষণে আমাদের হাতে বন্দী। কিছুদিনের মধ্যে কর্ডোভা বাহিনী আসবে। লড়াইতে নামতে হবে সকলকে, ওদের মোকাবেলা করতে হবে। স্পেনকে মুসলিম মুক্ত করার অভিযানের এইতো সময়।

জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে আবুল জারের পতাকাতলে শামিল হতে লাগল। এক রাতে ডঙ্কা পিটিয়ে ঘোষণা করা হলো, সকালে রণসংগীত বাজতেই সকলে সশস্ত্র ঘর থেকে বের হবে এবং গভর্নর হাউজে চড়াও হয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে।

মাদ্রিদের আমীর আবদুল জব্বার সম্পর্কে জানা গেল, মানুষের থেকে ট্যাক্স উসূল করে তিনি অন্তর্ধান হয়ে গেছেন, কিন্তু তিনি জানতেও পারলেন না যে, মাদ্রিদের খ্রীস্টানরা সৈনিক হয়ে গেছে। মাদ্রিদ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। যে কোন সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। রাজ্যটা ছিল না খ্রীস্টান অধ্যুষিত। নও মুসলিমরা পর্দার আড়ালে খ্রীস্টানদেবই আজ্ঞাবহ ছিল। আরব অধিবাসীরা ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তারা শহরের পরিস্থিতি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না।

ইতিহাসের পাতা নীরব ভাষার বলে চলেছে, আরব থেকে আগত মুসলিমরা স্পেন বিজয় করে নিজদেরকে বাদশাহ ভাৰা শুরু করে দিল, তারা খ্রীস্টান আবাসন থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসবাস করত এবং এদেরকে ঘৃণা করত দুর্ব্যবহার করত। এজন্য নও মুসলিমদের হৃদয়ে ইসলাম স্থান করে নিতে পারেনি। ইসলামের সৈনিক হওয়ার স্থলে তারা ঈসায়ী হয়ে ওঠে। মুসলমানদের ওই অদূরদর্শীতার ফল হলো এই যে, খ্রস্টানরা যখন কোনো ষড়যন্ত্র করেছে, দেখার মত কেউ ছিল না তখন। কাজেই ভূগর্ভস্থ ওই ষড়যন্ত্র তাদের অজ্ঞাতসারে করা গেছে সহজেই। গভর্নরদের গোয়েন্দা বিভাগ এতই সংকুচিত ও চিলাচল ছিল যে, শহরের কোনো খবরাখবর তারা রাখতে পারত না। ওখানে ছিল স্রেফ গভর্নরের সামান্য বডিগার্ড, সামন্য কিছু ফৌজ।

***

মধ্যরাত।

 মাদ্রিদ ঘুমিয়ে গেছে।

ঘুমিয়ে গেছে আরব্য মুসলিম নিজ বাসভবনে।

কিন্তু বিদ্রোহীরা বিদ্রি। মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার সাধুবেশে শহরে পৌঁছে গেলেন। ওই সময় পর্যন্ত তার অধীনে ৪০ হাজার ফৌজ ছিল। যাঁর সিংহভাগই শহরের বাইরে। বাদবাজ সামান্য মাদ্রিদে।

গভীর রাতের সূচিভেদ্য অন্ধকারের বুকে গভর্নর হাউজের সামনে হাজারো মশালের আলোতে নারা ধ্বনি শোনা গেল। আমীরে গভর্নরের বডিগার্ডরা ঘুম ভেঙ্গে পরিস্থিতি আঁচ করারই সুযোগ পেল না, প্রতিরোধ তো পরের কথা। গভর্ণর চোখ মেলে দেখলেন তার সম্মুখে আট দশ জন সশস্ত্র সেপাই। সকলের হাতে নাজা আসি। তারা তাকে উঠিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। বাইরে বিদ্রোহী জনতার গগন বিদারী চিৎকার। ঘোড়ার হ্রেসাধ্বনি। মুসলমানদের ঘরে আগুন। চলছে লুটতরাজ সেখানে সমানে। আমীরে মাদ্রিদ চিৎকার দিয়ে বলেন, দেহরক্ষীরা কৈ? এগুলো হচ্ছে কি?

তোমার আগেই তাদের জেলে পুরা হয়েছে জনৈক বিদ্রোহী বলল, তোমার বাহিনীকে নিরস্ত্র করে আশে পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এর নাম অভ্যুত্থান। তোমার নেতৃত্ব শেষ। এখন তুমি গর্ভনর নও-আমাদের বন্দী।

তাকে এক আলীশান মহলে নেয়া হলো। যেখানে ঝাড়বতি জ্বলছে। ওখানে এক লোককে দেখে তিনি চমকে উঠলেন। বললেন,

তুমি! মুহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বার? আমার থেকে জবাবদিহিতার সময় শেষ। তোমার গোস্বা এমুহূর্তে থোক। বাকী জীবন তোমাকে জেলের ঘানি টানতে হবে।

গাদ্দার! শেষ পরিণামের প্রতি এতটা উদাসীন হয়ো না। গাদ্দার বাদশাহকে হত্যা করতে পারে, বাদশাহ হতে পারে না। কদিন নেতৃত্বের নেশা পুরে নিজের চোখেই এর পরিণতি দেখবে। যাদের কাঁধে করে এ পর্যন্ত পৌঁছেছে তারাই তোমাকে রেখে বিপদ দেখে সটকে পড়বে।

মুহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বারের চোখে-মুখে এ সময় ক্ষমতার নেশা। তিনি ঘৃণাসুলভ মুখে বললেন, তাকে নিয়ে যাও। বন্দী করে তার পরিবার-পরিজনকে।

ফৌজকে নিরস্ত্র করা হয়েছিল। তাদের আশেপাশে বিদ্রোহীদের প্রহরা। চারদিকেই মশালের আলো। শহরে কিয়ামতের বিজষিকা। মুসলমানদের ধন-সম্পদ খ্রীস্টান মাড়োয়ারীদের ঘরে জমায়েত হচ্ছে। বাড়ীতে বাড়ীতে আগুনের লেলিহান শিখা। এ সময় জনৈক মুসলিম কমান্ডার সুযোগ বুঝে একটি বৃক্ষে চড়ে আত্মরক্ষা করেন। তিনি মাদ্রিদ থেকে পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ওই বৃক্ষের নীচে পাহারাদারেরা টহল দিচ্ছে। তিনি এক সময় সুযোগ পেয়ে গেলেন। এক পাহারাদার একাকী ঘোড়ার পিঠে টহল দিচ্ছিল। কমান্ডার সহসাই বৃক্ষ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে ঘোড় সওয়ারকে হত্যা করে তার পিঠে চেপে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

শহরের প্রবেশ দরোজা উন্মুক্ত ছিল। মোহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বারের যে বাহিনী শহরের বাইরে অবস্থান করছিল তারা ভেতরে ঢুকছিল। আবার ভেতরের লোকজনও বাইরে আনাগোনা করছিল। লুটতরাজের দরুন গোটা শহরে হুলুস্থল কারবার। কে কার খবর রাখে। অতি দ্রুত সে শহর থেকে বেরিয়ে পড়ে এবং কর্ডোভাভিমুখী হয়। সামনে তার দূরপাল্লার পথ অথচ পৌঁছাতে হবে দ্রুত। জলদি মাদ্রিদের খবর পৌঁছানো দরকার যে, এখানে অভ্যুত্থান হয়েছে। রাতভর সফর করল সে। অবসাদ মোচনের এতটুকু সময় হয়নি তার। আঁধারের বুক চিরে সূর্য উঠে এলো। সন্নিকটে এক জোড়া ঘোড়া তার সামনে ভেসে উঠল। মনে হচ্ছে ওরা ফৌজ। দ্রুত সে তাদের কাছে গেল। জানাল মাদ্রিদ অ্যুত্থানের কাহিনী। তারা বলল,

কর্ডোভায় গিয়ে কি করবে। স্পেনের আমীরকে ফ্রান্স অভিমুখী দেখবে। তিনি সসৈন্যে ফ্রান্স আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। কোথাও যেতে হলে ওদিকেই যাও।

সওয়ারদ্বয় কমান্ডারের দিকে ও তার ক্লান্ত ঘোড়ার দিকে তাকাল। তারা সাগ্রহে ঘোভা বিনিময় করল। এক্ষণে সে একটি তাজা ফৌজি ঘোড়ার পিঠে। পদাঘাত করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটোয়। দিগন্ত প্রসারী ধূলিঝড় উড়িয়ে ঘোড়া চলে টগবগিয়ে। এভাবে এই কমান্ডারের মাধ্যমেই আমীরে স্পেন মাদ্রিদ-অভ্যুত্থানের খবর পান।

***

ফ্রান্স অভিযান স্থগিত রেখে সালার আবদুর রউফকে প্রত্যাবর্তন করতে হলো। তার গতি ছিল দ্রত। তিনি মাদ্রিদ থেকে খুব একটা দূরে ছিলেন না। এদিকে আবদুর রহমানও ছুটছেন মাদ্রিদমুখো। তিনি সহসাই রণসঙ্গীত বাদকদের মাঝে এনে বাদ্য বাজালেন। সঙ্গীত বাদকরা বলল, আলীজাহ! আমরা রক্ত উত্তেজক বাদ্য বাজাব। আমাদের বাজনায় ঘোড়ার পর্যন্ত জোশ-জযবা বাড়বে। বাদকদল উত্তেজনাকর বাজনা শুরু করল। পুরো ফৌজে তখন প্রতিশোধের আগুন।

আবদুর রহমান যা চাচ্ছিলেন তাই-ই হলো। আবদুর রহমান যেন শরীর থেকে দূষিত রক্ত বের করে ভাল রক্ত ভরে দেন। তার দিগ্বিজয়ী চাঁদ-তারা পতাকা এভাবে উড়ছিল যাতে সৈনিকদের উদ্দীপনা বেড়েই চলছিল। ভাবখানা যেন এমন যে, তাদের সকলকে দুর্গম পাহাড় অতিক্রম করতে হবে।

আবদুর রহমান বদিকে তাকালেন। তার প্রধান সেনাপতি উবায়দুল্লাহ চলে যাচ্ছিলেন। তিনি তার কাছে এগিয়ে গেলেন। বললেন, উবায়দুল্লাহ! রণসংগীত থেকে যেদিন মুসলিম জাতি বিমুখ সেদিন থেকেই তাদের পতন শুরু।

উবায়দুল্লাহ বললেন, সংগীতে এমন সম্মোহনী শক্তি আছে যা মৃতদের জাগিয়ে তোল। পক্ষান্তরে এই সংগীতের বদৌলতে জাগ্রত মানুষও সময় বিশেষ মরণ ঘুমে বিভোর হয়ে পড়ে। এটা শিরার জমাট খুনকে যেভাবে গরম করে তোলে, তেমনি গরম খুনকেও হিমশীতল করে ফেলে। কাজেই এক্ষণে মানুষের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন ধরনের সংগীতামোদী।

নারীর মধ্যেও এ ধরনের স্ববিরোধী সমোহনী শক্তি বিদ্যমান। নারী যেমন খাপ ছিঁড়ে তলোয়ার বের করে প্রিয়জনের হাতে তুলে দেয়, তেমনি নাঙ্গা তলোয়ারও অনেক সময় খাপে ঢুকাতে বাধ্য করে। আমি নারীর

এ দুটি রূপই দেখেছি। মোদাচ্ছেরাই আমার হাতে তলোয়ার তুলে দিয়েছিল। আর আপনার তলোয়ার খাপে ঢুকিয়েছিল কে?

আবদুর রহমান চকিতে উবায়দুল্লাহ দিকে তাকালেন। তাঁর চিন্তাজগতে কেমন যেন চমক লেগে গেছে। তিনি আনমনা হয়ে গেলেন। এই প্রশ্ন তার কাছে প্রত্যাশিত নয়। তিনি যেন সহসাই নিজকে সংযত করে নেন। উবায়দুল্লাহ তাঁর পরিবর্তন দেখে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। আমীরের চোখে এ সময় ভেসে ওঠে কর্ডোভার রাজপ্রাসাদ যেখানে যিরাব ও সুলতানার রূপের ঝিলিক। উবায়দুল্লাহ মাদ্রিদ অবরোধের প্ল্যান নিয়ে কথা শুরু করলেন। তিনি দেখলেন, আবদুর রহমানের ভেতরের স্পন্দন ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি। মাদ্রিদ নিয়ে তিনি উচ্চাশা পোষণ করলেন।

মাদ্রিদ তখনও বেশ দূরে। ফৌজ চলছে লাগাতার। যাত্রা বিরতি দরকার।

***

মাদ্রিদের খানায় ইবনে আবদুল জব্বারের কালো গ্রাস। তিনি রীতিমত মাদ্রিদের স্বাধীন গভর্নর হয়ে গেছেন। নও মুসলিমরা ইসলাম ছেড়ে খ্রীস্টান ধর্মে ফিরে গেছে। এলোগেইছদের মিশনের এটা প্রথম সাফল্য। নও মুসলিম দ্বি-চারী মনোভাবই এই সাফল্যের মূল কারণ। এলোগেইছ ও ইলিয়ার মাদ্রিদেই ছিল। তাদের ফৌজি পরিসংখ্যান ৪০ হাজারের ওপরে। মাদ্রিদ দখল করতেই এই সংখ্যার সাথে আরো ১৫ হাজার যোগ হয়। অবশ্য এরা সুদক্ষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত নয় আদৌ। সকলেই শহুরে। একক লড়াই জানত। সৈনিকদের মত দলবদ্ধ লড়াই জানবে কোত্থেকে। খুব সহজেই তাদের অভ্যুত্থান নাটক মঞ্চায়িত হয়েছিল। বিজয়োৎসবে তাই তারা বিভোর। মুসলিম ঘর-বসতি তখন জ্বলন্ত ছাই-ভয়ে রুপান্তরিত। প্রিয়জন কোথায় কি হালে আছে তাও অনেকের জানা ছিল না।

মাদ্রিদের কেন্দ্রস্থলে বিশাল এক ময়দানে ঘোড়দৌড় ও ফৌজি মহড়া হত। বিদ্রোহী লিডারদের আমন্ত্রণে জনগণ ওই রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হলো। খানিক পর মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার, এলোগেইছ ও ইলিয়ার ঘোড়ায় চেপে সেখানে এলো।

এলোগেইছ সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে জ্বালাময়ী ভাষণ রাখিল :

মাদ্রিদ বিজয়ী বীর জনতা হে। অভূতপূর্ব বিজয়ে তোমাদের মোবারকবাদ জানানোর ভাষা নেই আমার। মাদ্রিদের গভর্নর, সুলতান কিংবা আমীর যাই বল না কেন, সে এক্ষণে তোমাদের সামনে। সমবেত জনতা ইবনে আবদুর জব্বার জিন্দাবাদ, ঈসা মসীহ জিন্দাবাদ নারা লাগাল। স্পেন আমাদের আমরা স্পেনের। হাজার জনতার গগন বিদারী চিৎকারে আকাশ বাতাস মুখরিত। খ্রীস্টান মহিলারাও ওখানে এসেছে। তারা একে অপরের বুকে মিশে যাচ্ছে। এতে নগ্নতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

জনতার তুমুল করতালির মধ্যে এলোগেইছ বলে চলেছে, বন্ধুরা আমার। আমীর ইবনে আবদুর জব্বার প্রমাণ করেছেন ধর্মের কোন গুরুত্ব নেই মানব জীবনে। তোমাদের মুক্তির স্বার্থে তিনি হুকুমত ও ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। তোমাদের হাতে মাদ্রিদের পতন ঘটেছে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন কর্ডোভাও তোমাদের হাতে চলে যাবে। তবে এর জন্য তোমাদের চরম কোরবানী দিতে হবে।

আচমকা জনৈকা ঘোড়সওয়ার কাতার চিরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। তার চোখে-মুখে ভীতির ছাপ। বক্তারা তার কথা শোনার পর এলোগেইছ আবারো জনতার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াল।

মাদ্রিদের বীর বাহাদুরগণ! তোমাদের আত্মত্যাগের মুহূর্ত আসন্ন। এইমাত্র জানতে পারলাম, স্পেনের গভর্নর মাদ্রিদ অভিমুখ ধেয়ে আসছেন। শহরের প্রবেশদ্বার ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও। যার যা আছে তাই নিয়ে শহর রক্ষা প্রাচীরে উঠে যাও। তীর-পাথর মেরে দুশমনের গতিরোধ কর। অনবরত নারা আর দুয়োধ্বনির মাধ্যমে দুশমনকে অভিনন্দন জানাও। খেয়াল রেখো, কর্ডোভা বাহিনী যেন প্রাচীরের কাছেও ঘেঁষতে না পারে। ভয় পেয়ো না। আমাদের পর্যাপ্ত খাদ্য-রসদ রয়েছে। আমরা ভাতে মরব, পানিতে মরব তবুও দুশমনকে শহরে প্রবেশ করতে দেব না।

মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, মাদ্রিদের ব্যাঘ্র সন্তান! বিজয় তোমাদের পদচুম্বন করবেই, তবে এবারে তোমাদের টক্কর হবে সুদক্ষ সুশিক্ষিত কর্ডোভা বাহিনীর সাথে। আবদুর রহমান বাহিনী কেল্লা পতনের কৌশল জানে। তোমরা নিছক নারা ও দুয়োধ্বনি দ্বারা তাদের পরাভূত করতে পারবে না। তবে ওদের পরাজিত করা অসম্ভব নয়। তোমরা হতাশ হবে না। দুশমন যেদিক থেকে চড়াও হতে চাইবে সিংহশাবক সেদিক থেকেই তীরবৃষ্টি বর্ষণ করবে। মনে রেখো, সুযোগ তোমাদের এই প্রথম এবং শেষ। জিতলে বেঁচে গেলে আর হারলে নির্ঘাত করুণ পরিণতির শিকার হবে তোমরা। কর্ডোভা বাহিনী ভেতরে ঢুকলে যে বিভীষিকা সৃষ্টি হবে তা তোমাদের কল্পনারও বাইরে। ওরা আমাদের ফৌজ। ওদেরকে জানি আমি। শাস্তি দেয়া শুরু করলে ওদের অন্তর পাথর হয়ে যায়। পাইকারী হত্যার সম্মুখীন হবে তোমরা। তোমাদের যুবতী মেয়েদের কর্ডোভা বাহিনীর বিমায় নিয়ে যাওয়া হবে। যে আযাদী তোমরা হাসিল করেছ তার মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করো, সংরক্ষণ করতে ব্যাপৃত হও।

জনতার উৎসাহ এই জ্বালাময়ী বক্তৃতার পর বহুগুণে বৃদ্ধি পেল। চারদিকে কেবল স্লোগান। এলোগেইছ, ইলিয়ার ও মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার যোগ্য লোক বেছে বেছে নড়াইয়ের স্কীম বানাতে লেগে গেল। আবদুর রউফ ও মূসা ইবনে মূসার বাহিনী টর্নোডো গতিতে ধেয়ে আসছিলেন। তিন দিনের দূরত্ব তারা দুদিনে অতিক্রম করলেন। কিছু বাহিনী আলাদা করে আবদুর রহমান পথিমধ্যে সাময়িক যাত্রাবিরতি করলেন। তিনি উবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে কিছু সেনা মাদ্রিদ রওয়ানা করে বললেন,

উবায়দুল্লাহ! আপনার অজানা নয় বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন ফ্রান্স সম্রাট লুই। আমি এই খণ্ডদল নিয়ে ফ্রান্স ও মাদ্রিদের মাঝপথে থাকব। ফ্রান্স বাহিনী মাদ্রিদ অবরোধ ভাংতে এগিয়ে আসতে পারে। আমার বাহিনীকে টহলরত রাখব, টহল দেব খোদ আমি নিজেও।

ফ্রান্স বাহিনী এসে গেলে সামান্য বাহিনী নিয়ে আপনি ওদের প্রতিহত করতে পারবেন না। তবে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে আমাদের থেকে কমান্ডো চেয়ে পাঠাবেন।

মুসলমান হামেশা সামান্যই থাকে ও থাকবে। আমি ফ্রান্সীয়দের পথ আগলে রাখব লড়াই করব না। সৈন্যদের দলে দলে বিভক্ত করে গেরিলা হামলা শানাব। ওদেরকে হাঁকিয়ে হাঁকিয়ে ঘাম বের করে ছাড়ব। আল্লাহর উপর অগাধ আস্থা রেখে আপনি যান সেনাপতি। আল্লাহ আমাদের সহায়।

এ ছিল স্পেন অধিপতি আবদুর রহমানের প্রকৃত রূপ। তিনি যেমন সিংহাসনের যোগ্য লোক ছিলেন, তেমনি ছিলেন রণ নিপুণ জাদরেল সেনানায়ক। উচ্চজ্ঞানের মহান বিবেক দ্বারা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ফ্রান্স বাহিনী অতি অবশ্যই সীমান্তে ঘোরাফেরা করে থাকবে এবং গেরিলা আক্রমণ চালাবে। কিন্তু সংগীত আর নুপুর-নিক্কণের ঝনঝনানিতে সিংহশাবক কিছুকাল ঘুমিয়েছিলেন।

***

মাদ্রিদের যে সামান্য কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল তারা সকলেই কারাবন্দী। এদের এক কমান্ডার পলায়ন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইনি কর্ডোভার ফৌজকে বিদ্রোহের খবর দিয়েছিলেন। যেদিন মাদ্রিদে কর্ডোভা বাহিনীর আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়ে সেদিন সকলের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী কমান্ডার মুসলিম বন্দী সেপাইদের বলেন, কাল নাগাদ কর্ডোভার ফৌজ এসে পড়বে আমরা কিছুতেই তাদের অবরোধ সফল হতে দেব না। ওরা শহরে কোনক্রমে প্রবেশ করতে পারলে পাইকারী হত্যাযুদ্ধ চালাবে। আমাদের সঙ্গ দেয়ার স্বার্থে তোমাদের নিজেদের জান বাঁচাতে পার। কর্ডোভা বাহিনী অবরোধ উঠিয়ে নিলে তোমাদের মুক্ত করে দেয়া হবে, তখন যেখানে ইচ্ছা যেতে পার।

এটা একটি চাল। বিদ্রোহীদের প্রকৃতপক্ষে টেনিংপ্রাপ্ত দক্ষ সৈনিকদের দরকার। এরা জেলখানা থেকে জনাচারেক মুসলিম সেপাইকে রাজী করতে পারল। ওই চারজনের একজনের নাম আবু রায়হান। ইনি গেরিলা কমান্ডার। অন্যরা সাধারণ সেপাই। সকল মুসলিম ফৌজ অবাক হলো আবু রায়হানকে দুশমনের দলে ভিড়তে দেখে। এরা চলে গেল। কারার সেলে আবদ্ধ ফৌজ এদের গাদ্দার ও বুদিল বলে ধিক্কার দিল। বিদ্রোহী কমান্ডার এগিয়ে চলছে, আর এর পেছনে। এরা গলির মোড়ে এলে বুদ্ধিমত্তা বলে আবু রায়হান একটু পেছনে চলতে লাগলেন। সঙ্গীরা পর্যন্ত ব্যাপারটা আঁচ করতে পারল না। আবু রায়হান পেছনে তাকাল এবং আরেক গলির মোড়ে অদৃশ্য হয়ে গে। কমান্ডার কর চলার পর খেয়াল করলেন, চারজনের একজন উধাও। আবু রায়হান তখন অনেক দূরে চলে গেছেন। সূর্য ডুবছে। গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে, কর্ডোভা বাহিনী আসছে। সকলের মাঝে হতাশা।

শহরের কোল জুড়ে রয়েছে অগভীর নদী। রয়েছে বিশাল প্রাচীর ও তার নীচে খাদ। জনশ্রুতি রয়েছে যে, ওইসব খাদে ভূত-প্রেতের আনাগোনা। মানুষের আনাগোনা তাই এদিকটায় কম।

আবু রায়হান সাথীদের কাছে গেলেন না। তিনি শহর ছেড়ে বেরুতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু কর্ডোভা বাহিনীর আগমনি শুনে সকল প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি শহরেও কোথাও আত্মগোপন করতে পারছিলেন না। তিনি বিরান এলাকাভিমুখী হলেন। সূর্যাস্তের পর তিনি ওই এলাকায় গেলেন। ওই খাদ-এর পাশে এসে দাঁড়ালেন। তার হৃদয়ে তোলপাড়। না জানি ভূত-প্রেত গলা টিপে দেয় কি-না! রাত বাড়ার সাথে সাথে তার ভীতিভাবও বেড়ে চলছিল।

আবু রায়হানের সামনে মৃত্যু বিভীষিকা। এখন বাঁচার একমাত্র পন্থা খ্রীস্টান কমান্ডারের কাছে আত্মসমর্পণ করা এবং বিদ্রোহী বাহিনীর হয়ে লড়াই করা। কিন্তু এ যে তার পক্ষে অসম্ভব। হাড় কাঁপানো শীতে তার অবস্থা করুণ। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর তিনি একটি গবরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

***

যবানে তার খোদার নাম। বার বার উচ্চারণ করছিলেন কোরআনের আয়াত। নির্জন গুহায় কেননা সাড়াশব্দ নেই। ভয়াল কোনো ভূত-পেতিরও দেখা নেই। গুহার দেয়ালে ধূলি ধূসর তৈলচিত্র, কোথাও অশ্বথবৃক্ষের শেকড় দাঁত বের হাসছে। আলোহীন মোট পরিবেশ। শিরশির হিম বাতাসের হিন্দোলে তিনি গুহার আরো ভেতরে প্রবেশ করেন। আচমকা মানবশিশুর আর্ত চিৎকারে তার আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। আবু রায়হান ব্যাপারটা আঁচ করার চেষ্টা করেন। তার সামনে এখন শহর থেকে বের হওয়াই মূল সমস্যা নয়- সমস্যা জান বাঁচানোরও।

নির্জন গহ্বরের অভ্যন্তরের এই চিৎকার ও ফিসফিসানি তাকে দুঃসাহসী করে তোলে। তিনি উচ্চস্বরে সূরা ইয়াসীন তেলাওয়াত করতে থাকেন। ভেতরে একটি করিডোর দেখতে পান। ওখানে থেকে সামান্য বামে ফোপানো কাঁদার সুর ভেসে আসে। মনে হচ্ছে, ভূত-প্রেত তাকে গ্রাস করতে আসছে। এই বুঝি ছোঁ মারল। ঠিক এ সময় পেছন থেকে কারো লঘু পদধ্বনি কানে আসে। ভূত ছাড়া এই ভৌতিক কর্মকাণ্ড আর কার? আবু রায়হান বড় সাহস করে সামনে এগোল, পেছনে সরার উপায় নেই। কেননা পেছনে কারো আগমন ঘটছে। বাচ্চার চিৎকার আচমকা থেমে গেল। নারীর সানাদায়ক ছেলে ভুলানো কথা কানে এলো। আবু রায়হান এ সময় মৃত্যু হাতের মুঠোয় পুরেন। রিক্তহস্ত তিনি। বিদ্রোহীরা তার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। মনে মনে বলেন, গোটা ব্যাপারটাই ভূতুড়ে। ওদেরকে বলব, আমি চোর-ডাকু নই। আল্লাহর সেপাই। আল্লাহর নামে লড়ি। আমি কাফেরদের বন্দীশালা থেকে ভেগে এসেছি। ওদের সামনে আসমর্পণ করিনি।

ভূত-পেত্নীকেও তিনি খোদার সৃষ্টি মনে করতেন। খোদা তায়ালা তাকে এই মুসিবত থেকে বাঁচাবেন বলে তার বিশ্বাস। বাচ্চার কান্না থামার পর আরবী ভাষায় পুরুষ কন্ঠে বলতে শুনলেন,

ওকে দুধ দাও কিংবা গলা টিপে দাও। পরক্ষণে নারীকণ্ঠে শোনা গেল, এ আওয়াজ বাইরে যাবে না।

আবু রায়হান একে জীবিত মানুষের আওয়াজ বলে মনে করছেন না। তারপরও লঘুপায়ে তিনি আগে বাড়েন। কুপির টিমটিমে আলো তাকে আরো ধোকায় ফেলে দেয়। যে কোনো পরিস্থিতি হজম করতে তিনি সিদ্ধহস্ত। আচমকা কারো কড়া নির্দেশে তার মোহভ হয়। কে যেন বলে, দাঁড়াও। একচুলও নড়বে না। খোলা তলোয়ারের ডগা তার পিঠে ছুঁয়ে আছে। নির্দেশটা আরবী ভাষায়।

কে তুমি? আবু রায়হান আরবীতেই প্রশ্ন ছোঁড়েন, প্রাণে মারার আগে আমার কথা শোনো। আমি মাদ্রিদ বাহিনীর কমান্ডার। নিরস্ত্র করে আমাদের বন্দী করা হয়। আমি কোনোক্রমে পালিয়ে এসেছি, এখান থেকে শহরের বাইরে বেরোতে আমার আসা।

ইতোমধ্যে একটা কুপি আনা হয়। যিনি কুপি এনেছেন তার অপর হাতে নাঙ্গা তলোয়ার। ওই লোক জিজ্ঞেস করেন, লোকটা কে?

আবু রায়হান আমার নাম। ফৌজি কমান্ডার।

তার পেছনের লোকটা সামনে এলো। আবু রায়হান বললেন, তোমরা জিন্দালোক,

অশরীরী আত্মা। যাই কিছু হও না কেন, আমাকে বলল। অশরীরী আত্মা হলে নিশ্চয়ই আরবী হবে। তবে আরবী হলে প্রেতাত্মা হতে পার না-নেককারই হবে। আমাকে সাহায্য কর। আকে শহরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ করে দাও। আমি আমার ফৌজ নিয়ে আসব এবং কাফেরদের মাদ্রিদ থেকে বের করে দেব।

আগে বাড়ো।

***

কামরাটি অতি প্রশস্ত।

দুটি কুপি জ্বলছে টিমটিম।

ওখানে ১০/১২ জন যুবতী ও ৩/৪ জন বয়স্কা মহিলা। জনৈকা মহিলা বাচ্চাকে দুধ পান করাচ্ছিলেন। পুরুষ মাত্র দুজন, যারা আবু রায়হানকে ভেতরে নিয়ে এসেছে এদের একজন বৃদ্ধ। তিনি আবু রায়হানকে বললেন, ওদের দেখো! আমাদের মেয়ে। সেই আরবী মেয়ে যারা মাদ্রিদে বসবাস করত। ওদের কারো বাপ, আর কারো ভাই শহীদ হয়েছে। আমাদের বেশ কিছু নারী কাফেরদের হাতে চলে গেছে। এদের কোনক্রমে কাফেরদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছি, ওরা এখানে ভালই আছে।

কার অপরাধে আমাদের এই পরিণতি। বৃদ্ধ বললেন, এই কাফেররা বিদ্রোহের অগ্নিকুণ্ডলী তৈরী করছিল। মোহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বার আকাম-কুকাম করে খ্রীস্টানদের সাথে হাত মিলিয়েছে সেই কবে। অথচ কর্ডোভার আমীর এখানে সৈন্য বুদ্ধি করেননি। এমন কি ননীর পুতুল মাদ্রিদের আমীর এতটুকু ঠাহরও করতে পারেননি যে, মাদ্রিদ এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি।

এসব পেঁচাল পেড়ে এখন লাভ? আবু রায়হান বললেন, বাইরের অবস্থা সম্পর্কে খুব সম্ভব তোমাদের কোনো ধারণা নেই।

না। এক লোক বলল, সত্যিই আমরা বাইরের কিছুই জানি না। বলতে পার অভ্যুত্থানের পর কতদিন অতিবাহিত হয়েছে? আমরা পোকা-মাকড়ের মত দিন গুজরান করছি। এই মেয়েগুলো নিয়ে সমস্যায় আছি। ইজ্জতের সাথে আমরা বেরুতে চাই।

আমি একাকী বেরুতে চেষ্টা করছি। তবে এ সমস্যা আমারও। আমি এ ব্যাপারে আপনাদের সঙ্গ দেব। বাইরের অবস্থা এ মুহূর্তে ভাল নয়। মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার মাদ্রিদের স্বাধীন বাদশাহ। খ্রীস্টানরা তার আনুগত্য কবুল করেছে। ওদের দুলিডার এলোগেইছ ও ইলিয়ার এর পুরোধা। কর্ডোভার ফৌজ ঝডোগতিতে এগিয়ে আসছে। শহরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা লড়াই করার জন্য তৈরী। এতে অবরোধ কতটা ফলপ্রসূ হবে তা এক্ষণে বলা মুশকিল। ওদের জনৈক কমান্ডার এসে আমাদের বলেছিল যারা আসন্ন অবরোধে আমাদের সঙ্গ দেবে তাদের মুক্ত করে দেয়া হবে। পক্ষান্তরে, যারা সঙ্গ দেবে না তাদের হত্যা করা হবে। মাত্র তিনজন সৈন্য ওদের এ কথায় প্রতারিত হয়েছে বাকীরা অস্বীকার করেছে। আমি ওদের চতুর্থজন। এই আশায় ওদের সঙ্গ দিয়েছিলাম যাতে পলায়নের সুযোগ পাই। মোক্ষম স্থান এটাই। তোমাদের মনে করেছিলাম প্রেতাত্মা।

প্রেতাত্মায় পর্যবসিত হতে যাচ্ছি আমরা। বাদশাহদের আলসেমি আমাদের এরূপ করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

মুহতারাম বুযুর্গ! এটা স্বীয় কৃতকর্মের সাজা। এখানকার প্রতিটি মুসলমান নিজকে খ্রীস্টানদের বাদশাহ বলে মনে করত এবং তাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করত। নিছক মসজিদে নামায পড়াকেই আপনি ইসলাম মনে করতেন, কিন্তু মানুষের প্রতি ভালবাসা আল্লাহকে ভালবাসার-ই নামান্তর শিক্ষাটি বেমালুম ভুলে গেছেন। আপনার অজানা নয়, শাসিতের প্রতি অবজ্ঞা একদিন শোষককেই ভোগ করতে হয়। শোষিতের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতেই থাকে। ওই আগুনে একদিন শোষককে পুড়ে মরতেই হয়। নিজেদের হাতে তৈরী অগ্নিকুণ্ডে এক্ষণে নিজেরাই জ্বলে মরছেন। অবশ্য আমাদের সমস্যা এখন ভিন্ন ধাচের। আমাদের ফৌজ আসছে, তাদের শহরে প্রবেশের মওকা পাইয়ে দিতে হবে। গোটা শহরবাসী লড়তে উম্মাদপ্রায়। ভেতর থেকে কোনক্রমে দরজা খুলে দিতে হবে। আমাদের বন্দী সেপাইদের হত্যা করার হুমকিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। থামলেন রায়হান। বৃদ্ধ বললেন,

আমাদের যার পর নাই কোরবানী দিতে হবে। ভেতর থেকে দরোজা খোলার মত কোন প্ল্যান তোমার আছে কি? তুমি সৈনিক, কমান্ডার। বহু অভিজ্ঞতা তোমার ঝুলিতে।

স্রেফ সৈনিক নই-গেরিলা কমান্ডারও। এই যুবতীদের সর্বাগ্রে হেফাযতে রাখা জরুরী।

ওরা যদি না থাকত……………।

আমরা মেয়েরা তো আর শল্য নই বলল জনৈকা যুবতী। আপনি আমাদেরকে পুরুষদের মত সড়াতে চাইলে আমরা প্রস্তুত।

আমরা এখানে আত্মগোপন এজন্য করেছি যে, খ্রীস্টান বিদ্রোহীরা অসংখ্য। খোদার কসম, যদি একক যুদ্ধ হত তাহলে আমরা এই নির্বাসনের পথে এগুতাম না। আপনি প্ল্যান তৈরী করুন, ইনশাআল্লাহ আমাদের সেপাই পাবেন। আমাদের সতীত্ব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। বলল আরেক যুবতী।

খবর যদি সত্যি হয় তাহলে আজ রাতেই অবরোধ হওয়ার কথা। আচ্ছা, তোমাদের কাছে হাতিয়ার আছে কেমন?

চারটি বর্শা। নয়টি তলোয়ার। সামান্য খঞ্জর। তিনটি ধনুক ও বেশ কিছু তীর।

বহুত আচ্ছা। খ্রীস্টানরা তাদের মেয়েদের স্বপ্নের রাজকন্যা, শয্যার প্রজাপতি, ভূগর্ভস্থ মায়াবিনী ছলনাময়ী হিসেবে পেশ করেছে, আর আমাদের মেয়েদেরকে আমরা বীরাঙ্গনা করে পেশ করব আসন্ন যুদ্ধে। এটাই ইসলামের শিক্ষা ও আভিজাত্য। ইসলাম নারীকে তার দেহের উঁচু নীচু তরঙ্গ দেখিয়ে পুরুষকে আকর্ষণ করতে শেখায় না বরং তলোয়ারের চমকে দুশমনকেই তার পদতলে নাচাতে শেখায়। প্রস্তুত হও জাতির বীরাঙ্গনা! এর পাশাপাশি ক্ষুধা-কষ্টের প্রস্তুতি নাও। একনাগাড়ে অনেকগুলো কথা বলে আবু রায়হান হাঁপিয়ে উঠলেন।

***

ওই রাতে মাদ্রিদ অবরোধ করা হলো। মাদ্রিদবাসী রাতে ঘুমুতে পারেনি। সূর্যাস্তের পূর্বেই কর্ডোভাবাহিনী সতর্কভাবে এগিয়ে আসছিল। শহরবাসী খাদ্য সামগ্রী সঞ্চয় করছিল যাতে দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে না হয়। দড়াম করে লেগে গেল প্রবেশদ্বারগুলো। সামর্থ্যবান পুরুষেরা হাতিয়ার নিয়ে প্রাচীরে চড়ল। সিঁড়ি স্থাপন, সুরঙ্গ খোদাই কিংবা দেয়ালের কাছে আসতেই যেন প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারে এজন্য তারা জ্বালানী কাঠ নিয়ে গেল। পানি কামানেরও ব্যবস্থা থাকল। প্রতিটি বুর্জে ঝানু তীরন্দাযকে নিয়োগ দেয়া হলো। মোটকথা অবরোধকারীদের দেয়ালের কাছে আসার সম্ভব সব ব্যবস্থাদি করা হলো।

সালার আবদুর রউফ ও উবায়দুল্লাহ মাদ্রিদ থেকে সামান্য দূরে অবস্থান নিলেও নেতৃত্ব ওবায়দুল্লাহর হাতেই ছিল। ফৌজকে যুদ্ধসাজ দিয়ে সামান্য কিছুকে রাখালের ছদ্মবেশে অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে শহর রক্ষা প্রাচীরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানকার পরিস্থিতি অবলোকন করতেই এদের পাঠানো। উবায়দুল্লাহ এর পূর্বেই জানতে পারেন। শহরের বাইরে বিদ্রোহীদের টিকিটিই নেই।

উবায়দুল্লাহ সৈনিকদের উদ্দেশে বলেন, বন্ধুরা আমার। বিদ্রোহীদের সামান্যও সমর কৌশল জানা থাকলে তারা শহর ছেড়ে এখানেই আমাদের বাধা দিত। ওরা আমাদের আগমণ শোনেনি, তাও অবিশ্বাস্য। ওদেরকে অদূরদর্শীই মনে হচ্ছে। শহরের ভেতরে থেকে আত্মরক্ষামূলক হামলাকে ওরা যুতসই মনে করছে।

সালার উবায়দুল্লাহ বাহিনীকে ছড়িয়ে দিলেন। একসময় বাহিনী শহর রক্ষা প্রাচীরের নিকটে পৌঁছে গেল। তারা দেখল প্রাচীরের ওপরে মশাল জ্বলছে। উবায়দুল্লাহ আবদুর রউফকে বললেন, পেছনে লক্ষ্য রাখবেন। দুশমন পশ্চাৎদিকে ওঁৎ পেতে থাকতে পারে।

***

গভীর রাতে প্রাচীরের ওপর থেকে ভেসে এলো, দুশমন এসে গেছে। শহর অবরুদ্ধ। হুঁশিয়ার। সাবধান। প্রাচীরের ওপর থেকে তারা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ শুরু করে। উবায়দুল্লাহ উঁচুস্থানে দাঁড়িয়ে বলেন, আমরা বিদ্রোহীদের ক্ষমার সুযোগ দিতে চাই। শহরের দরজা খুলে দাও। ক্ষমা করা হবে তোমাদের। গ্রেফতার পর্যন্ত করা হবে না কাউকে।

প্রাচীরের ওপর থেকে ভেসে এলো, হিস্মত করো মুসলমানরা! পারলে আগে বেড়ে দরজা নিজ হাতেই খুলে নাও।

জনৈক কমান্ডার প্রাচীরের কাছে গিয়ে বললেন, আমীরে স্পেন স্বয়ং এই অবরোধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ……………কথা শেষ হতে না হতেই এক পশলা তীর তাকে ঝাঁঝরা করে ফেলে।

সালার উবায়দুল্লাহ বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের স্থলে পাল্টা আক্রমণ করতে দেখে দেয়াল ও ফটকে চড়াও হবার নির্দেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীর থেকে অগ্নিগোলা ও তীরবৃষ্টি ছুটে আসে। আগুয়ান ফৌজ সামান্যতমও প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারে না। এই পরিস্থিতি উবায়দুল্লাহ আগেভাগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ মিনজানিক (পাথর ছোঁড়া কামান) প্রস্তুত করেন এবং কামান থেকে পাথর ছুঁড়তে নির্দেশ দেন।

প্রাচীরের হৈ চৈ বাংকারের সৈনিকদের কানে পর্যন্ত যায়। এদিকে আবু রায়হান শহরের প্রবেশদ্বারগুলো সম্পর্কে সবিশেষ অবগত ছিলেন। তিনি এক হাতে তলোয়ার ও আরেক হাতে তীর নিয়ে বেরুলেন। তিনি দেখতে চান, শহর ফটকে বিদ্রোহীদের অবস্থান কিরূপ। এক্ষণে গ্রেফতারীর ভয় নেই তার। তিনি সবদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকেন। উম্মাদপ্রায় মানুষ ছুটাছুটি করছে। কে কার খবর রাখে। আবু রায়হান মুখ ও মাথা ঢেকে শহুরে মানুষের ভীড়ে ঢুকে পড়েন।

তিনি দুএকটি দরজা ঘুরে আসেন। দেখলেন সহস্রাধিক লোকের প্রহরা প্রতিটি দরজায়! ওরা মুসলমানদের অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছে। ওখানে প্রহরীদের এতই ভীড় যে, সুঁই রাখারও স্থান নেই। ওরা বাইরে তীর নিক্ষেপ করেই চলেছে। প্রাচীরের বাইরে কামান থেকে নিক্ষিপ্ত প্রকাও পাথর দরজায় না লেগে দেয়ালে লাগলে দুদ্রোহী মারা যায়। আবু রায়হান কামানোর টার্গেট ব্যর্থ হওয়ায় নিরাশ হয়ে পড়েন।

***

গর্তে লুকানো মুসলিম আত্মগোপনকারীদের রাতেই জানানো হলো, বাইরে কি হচ্ছে তার কিছু আশা করা যাচ্ছে না। তবে মুসলিম বাহিনী অতি অবশ্যই দরজা ভাঙ্গার প্ল্যান নিয়ে থাকবে। কেননা দরজা ভাঙ্গা ছাড়া অবরোধ সফল হবে না– এতে প্রাণহানি যতই ঘটুক না কেন তাদের।

পরদিন সকালে মুখে নেকাব লাগিয়ে আবু রায়হান বেরিয়ে পড়েন। প্রাচীরে চড়েন এক সময়। দেখেন কর্ডোভা বাহিনীর অবস্থান। দিগন্তে লকলকিয়ে ওঠা ফসলী ক্ষেত। উবায়দুল্লাহ ওই ফসলগুলো কেটে ফেলতে বলেন। হাজারো ফৌজ তলোয়ার দ্বারা ফসল কাটা শুরু করেন। পরে ঘোড়ার খাদ্য হিসেবে আটি বেঁধে ওগুলো নিয়ে আসা হয়। ফলদার বৃক্ষগুলো কুঠারাঘাতে ধরাশায়ী করা হতে থাকে। আবু রায়হান প্রাচীরে দাঁড়িয়ে কতবার দেখেছেন, সুরঙ্গ করার জন্য কর্ডোভার জানবার্য সেপাইরা আগে বাড়লেও তীয়বৃষ্টির সম্মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটেছে। তাকে কেউই চিনতে পারেনি। দেয়াল থেকে নেমে এলেন তিনি। তার মনে এক নতুন পদ্ধতি এসে যায়। দরকার এক্ষণে তার কাগজ-কলম। তিনি একটি দরোজায় করাঘাত করেন। জনৈকা মহিলা দরজা খুলে দেয়। তিনি বলেন, তিন চারটা কাগজ, কলম ও কালি দরকার। কমান্ডারদের কালি লাগবে। তখনকার মানুষের রক্ত দিতেও প্রস্তুত। ওই মহিলা ফওরান কাগজ, কালি ও কলম এগিয়ে দেন।

আবু রায়হান এদিক সেদিক নজর বুলিয়ে গর্তের একপাশে চলে যান। কাগজে কিছু লেখে গুহার লোকদের হাতে সোপর্দ করেন। প্রতিটি কাগজের ভাষ্য একই।

দক্ষিণ দিক থেকে ফৌজ হাটিয়ে নিন। বেশী বেশী প্রহরা প্রধান ফটকে রাখুন। বিদ্রোহীরা দক্ষিণ দরজা থেকে ফৌজ খালি করতে যাচ্ছে। রাত আমরা দক্ষিণ দরজা ভাংতে চেষ্টা করব।

এই কাগজের নীচে তিনি আপনার নাম ও পদবির উল্লেখ করেন। চিরকুট তিনটি মুড়ে পৃথক তিনটি তীরের মাথায় গেঁথে দেন। এই তীর তিনটাসহ একটা ধনুক নিয়ে বের হন। কেউ দেখতে না পাক এভাবে চুপিসারে গুহার মুখ থেকে বের হন এবং প্রাচীরে চড়েন। এদিকটায় প্রহরী নেই দেখেই তিনি এখানটায় চড়েন।

তিনি আরেকটু দক্ষিণ দিকে যান। তার ধনুকটি বড় মজবুত। ধনুকটা যতটুকু বাঁকানো যায় ততটুকু বাঁকিয়ে তীর নিক্ষেপ করেন। প্রথমটা মেরে দেখেন যথাস্থানে পতিত হলো কিনা? আঁ! তিনি জানেন প্রতি তীরই সৈন্যদের মাঝে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে পড়েছে এবং কর্ডোভা বাহিনী তা তুলে নিয়েছে।

ওই তিনটা তীরের একটা সালার আবদুর রউফের শিবিরের সন্নিকটে পতিত হয়। জনৈক সেপাই ওটি উঠিয়ে সালারের কাছে পৌঁছে দেন। আবদুর রউফ চিরকুটটি প্রধান সালারের কাছে নিয়ে যান। তিনি বলেন– এটা ধোকাও তো হতে পারে।

হ্যাঁ, এর একটি কারণ থাকলেও থাকতে পারে, চিরকুটের কথামত আমরা দক্ষিণ দিকটা খালি করে দিলে দুশমন ওদিক থেকে বেরিয়ে আমাদের ওপর হামলা শানাতে পারে। এমনটা হলে এ থেকে আমরাও ফায়দা লুটতে পারি। বিদ্রোহীরা বাইরে এলে ওদের একটাকেও ভেতরে যেতে দেব না। বরং আমরাই সে সময় ভেতরে যাব। বললেন আবদুর রউফ।

দ্বিতীয়ত দরজা উন্মুক্ত দেখে ভেতরে ঢুকলে হয়ত দেখব দুশমন ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে আছে। বললেন সালারে আলা।

আমাদের দরজা খোলা দরকার। আমার খণ্ডবাহিনী তাহলে টর্নেডো গতিতে ভেতরে ঢুকবে। যে কোন অবস্থায় আমাদের ঝুঁকি নিতেই হবে। ঝুঁকি নেয়ার সিদ্ধান্ত তো সেই প্রথম থেকেই নেয়া হয়েছে।

সূর্যাস্তের সময় দক্ষিণ দিকের বাহিনী তাঁবু টাল। ভাবখানা যেন অবরোধ উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে। ওদিকে পশ্চিম দরোজায় প্রচণ্ড হামলা চলছে। প্রাচীর রক্ষীদের যারা এদিকে সেদিকে ছিল তাদের সকলের দৃষ্টি প্রধান দরজায় পড়ল এবং সকলে ওই দরজা রক্ষা করতে এগিয়ে এলো। এদিকে দক্ষিণ দিকের মুসলিম বাহিনী পিছু হটছে দেখে বিদ্রোহীরা ওই দিকের বাহিনীকে অন্যত্র সরিয়ে দিল।

সূর্যাস্তের পর আবু রায়হান গুহার ভেতরে এলেন। বললেন, আমার পয়গাম পৌঁছে গেছে। দক্ষিণ প্রান্ত থেকে আমাদের বাহিনী সরে গেছে। কাজেই আমাদের সালাররা আজ ওই দরজা খোলার অপেক্ষায় থাকবেন। দরজাটা খোলার ব্যবস্থা করা দরকার। আমি যে প্ল্যান করেছি তাতে তিনজনে কাজ হবে না। কমপক্ষে দশজন চাই।

সে চাওয়া আমরা পূরণ করব। প্ল্যানটা আগে বলবেন কি। জনৈকা যুবতী বলল।

হা! ওদের নিয়ে যাও। বৃদ্ধ বললেন।

তবে এদের পুরুষের বেশে যেতে হবে। কারো সন্দেহ হলে সেরেছে। বললেন আবু রায়হান।

পরিস্থিতি সে পর্যন্ত গেলে আমরা জানবামি রাখতে কুণ্ঠিত হব না। জনৈকা যুবতীর কণ্ঠে দৃঢ়তা। এরপর আবু রায়হান তার প্ল্যান বলে গেলেন।

***

মাদ্রিদ থেকে দূরে অবস্থানরত আবদুর রহমান তার বাহিনী ছদ্মবেশে দূর দূরন্তে ছড়িয়ে দেন। এদের মাধ্যমে পালাক্রমে যাবতীয় তথ্যাদি তার কাছে পৌঁছুতে থাকে। গেরিলা বাহিনী ঘোড়ায় চেপে বিভিন্ন পয়েন্টে ওঁত পেতে পরিস্থিতির প্রতি গভীর নযর রাখে। ছাউনির কেন্দ্রবিন্দুতে হেড কোয়ার্টার থাকলেও দিন-রাতের অধিকাংশ সময় তিনি ঘোড়ার পিঠেই থাকেন। কমান্ডারদের কাছ থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করেন। সালার মূসা ও করন তার সঙ্গী।

আবদুর রহমান আপাদমস্তকে সিপাহীসুলভ অভিব্যক্তি। মনে হত রণাঙ্গনেই তার জন্ম আবার মৃত্যু সেই রণাঙ্গনেই, এমন কি দাফনও। এক সময়কার সংগীতের সুর, মূৰ্ছনা ও নারী সৌন্দর্যে বিভোর আবদুর রহমান এখানটায় ঠিক এভাবেই বিচরণ করতেন যেন চিতাবাঘ তার শিকার খুঁজে ফিরছে। তার আত্মিক ও জাগতিক শক্তির দুটোই এক্ষণে জাগরুক। মানসিক ইদ্রিয়ানুভূতি এমন যে, ওটা যদি অতিন্দ্রীয়ভাবে আত্মার সাথে দেহের সংমিশ্রণ ঘটে তাহলে তা বজ্রবিদ্যুৎ ঘটতে সময় লাগবে না। একরাতে তিনি অধীনস্থ কমান্ডারকে বলেন, আমরা এখান থেকে তাঁবু গুটাব ভাবলে দুশমনকে হতাশই হতে হবে। ইসলামী সাম্রাজ্য সংকুচিত হওয়ার স্থলে ক্রমশই এর সীমা বিস্তার লাভ করবে। স্পেন আমাদের পূর্ববর্তীদের রক্ত আমানত। স্পেন ইসলাম ও ইজ্জতের প্রতিভূ। আমারা একে রক্তের মাধ্যমে পবিত্র ও হেফাজতে রাখব।

কমান্ডাররা এখন আমীরের কঠে এ আওয়াজ শোনেন যিরাব ও সুলতানার কোপানল মুক্ত। বিলক্ষণ তারা শংকা করছিলেন, আবদুর রহমান না আবার যিরাব ও সুলতানাকে এখানে ডেকে পাঠান। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে আবদুর রহমান বলেন, ফ্রান্স সম্রাট লুইয়ের লেজে আঘাত করতে হবে। ফেত্নার উৎপত্তি যেখান থেকে সেখানেই তাকে প্রতিহত করতে হবে। মাদ্রিদের অবরোধ সফল হলে ওখানকার কাউকেই ক্ষমা করা হবে না। ইতিহাস আমাকে রক্ত খাদক হিসেবে চিহ্নিত করলে করুক। ব্যক্তিস্বার্থে একফোঁটা খুন ঝরালে ইহকালে-পরকালে খোদা আমাকে সাজা দিন, কিন্তু জেহাদের প্রতি আমি অকুণ্ঠচিত্ত। কাফেররা অস্ত্র সমর্পণ করুক, ক্ষমা ভিক্ষা চাক কিংবা পরাজিত হয়ে তোমাদের কদমে পড়ুক তথাপিও ওদের বিশ্বাস নেই।

কিন্তু আমীরে মুহতারাম! কোরআন বলছে দুশমন সন্ধির হাত বাড়ালে তাতে সাড়া দাও। করন বললেন।

কিন্তু কোরআন এও বলেছে, ওদের ওপর কোনো প্রকার ভরসা করো না। ওদের সাথে সখ্য, করো না। মুসিবতে পড়লেই নিরূপায় হয়ে ওরা সন্ধির প্রস্তাব করে। অবস্থার পরিবর্তন হলেই ওরা তোমাদের না জানিয়েই সন্ধিভঙ্গ করবে। দেখছ না আমাদের মাঝে কি করে ফেত্না গজিয়ে উঠছে একের পর এক। মাদ্রিদে অভ্যুত্থান ঠিক তখনই হলো যখন আমরা ফ্রান্সভিমুখী হই। বিদ্রোহীরা ফ্রান্স হামলা থেকে আমাদের বিমুখ করতেই এই অত্যুথান করেছে।

বিদ্রোহীদের পুরোধাকে আপনি চেনেন কি? প্রশ্ন মূসার।

মাদ্রিদের বিদ্রোহাগ্নি তো মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারই জ্বেলেছে, কিন্তু তার খুঁটির জোড় খ্রীস্টান জাতি। বললেন আবদুর রহমান

ওদের একজনের নাম এলোগেইছ। অপর একজন ইলিয়ার মূসা বললেন।

ওদের দুজনকেই গ্রেপ্তার করতে হবে। মাদ্রিদ থেকে কোনো খবর আসছে না। উবায়দুল্লাহ হয়ত খুব শীঘ্ৰ মাদ্রিদ ঢুকবেন। বললেন আমীরে স্পেন।

***

সালার ওবায়দুল্লাহ দ্রুত শহরে প্রবেশ করতে চাচ্ছিলেন। দেয়ালে সুরঙ্গ সৃষ্টিকারী জানবাব মুজাহিদরা ক্রমশ শহীদ কিংবা যখমী হয়ে যাচ্ছিলেন। প্রাচীরের ওপর থেকে তীর, পাথরও অগ্নিবান পরিস্থিতিকে নাযুক থেকে নাযুকরো করে ফেলছিল। খণ্ড বাহিনীর প্রধানের উদ্দীপনা দেখে তিনি মনে করছিলেন, তারা ত্বরা করেই শহরে ঢুকতে পারবেন। তিনি বলেছিলেন, দেয়াল টপকাতে না পারলে বিদ্রোহীরা শহরবাসীদের দুঃসাহস আরো বাড়িয়ে তুলবে। কর্ডোভার মিনজানিক মাদ্রিদবাসীদের সাহসে এতটুকু ভাটা ফেলতে পারছে না। কেননা কামান দাগানোর সুযোগ দিচ্ছে না।

ভেতরে এক লোক কর্ডোভা বাহিনীর রাস্তা সাফ করার ব্যবস্থা করছিলেন। যুবতীরাই তার সাথী। যুবতীদের সাথে দুলোক। এদের হাতে তলোয়ার, খঞ্জর ও তীর-ধনুক, ওদের দরকার পুরুষ বেশে সাজা, কিন্তু পুরুষের পোশাক অপ্রতুল।

গভীর রাতে আবু রায়হান এদের নিয়ে বেরোলেন। নিলেন প্রচণ্ড ঝুঁকি। এক্ষণে তাদের দরকার কিছু হৈ-হুঁল্লোড়। ঘটনাক্রমে হৈ-হুঁল্লোড় লেগে যায়। বেশ কিছু পাথর বসতবাড়ীর ছাদে পড়ে। বসতির লোকজন ঘরদোর ছেড়ে বেরোয়। গোটা শহরে হুলুস্থুল পড়ে যায়।

***

আবু রায়হান দক্ষিণ ফটকে এগিয়ে যান। এর পূর্বে শেষবারের সঙ্গীদের নির্দেশনা দেন। বলেন, এবার একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যাও, যেন তোমাদের কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। সফরে দ্রুত এদের মত চল। কেননা আস্তে চললে মানুষ সন্দেহ করতে পারে।

ফটকের কাছাকাছি চলে এলেন তিনি। ওখানে দপদপ করে গোটাচারেক মশাল জ্বলছে। শহরের হৈ চৈ-এ প্রবৃদ্ধি আসে। ফটকের ওপরে-নীচে কম করে হলেও এক জনের বিচরণ। প্রহরীরা এভ-ক্লান্ত। আবু রায়হান তার সঙ্গীদের আড়ালে রেখে দরজার কাছে যান। তিনি ওদের ভাষা জানতেন। খুবই ঘাবড়ে তিনি বলেন, এত লোক এখানে কি করছ। ওই পাশের ফটকে কোনো প্রহরী নেই। মুসলিম বাহিনী ওই ফটক ভাংতে চেষ্টা করছে। ওরা বলেছে, এখানে মাত্র চারজন লোক যথেষ্ট। বাদ বাকীরা ওদিকে যাও। জলদি যাও, কাপুরুষের জাতি। শহর হাতছাড়া হয়ে গেল।

কারা দরজায় থাকবে আর কারা যাবে অতিশীঘ্র তিনি তা নির্ধারণ করেন। মাত্র চারজন লোককে রেখে বাদবাকীদের হাঁকিয়ে দেন। আবু রায়হানও ওখান থেকে সরে যান। তার বাহিনী ওই চার প্রহরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুবতীরা বর্শা ও তলোয়ার দ্বারা এদের যমালয়ে পাঠায়। সকলে ফটক খুলে ফেলেন। আবু রায়হান সঙ্গীদেরকে দ্রুত মুসলিম শিবিরে গিয়ে খবর দিতে বলেন, কয়েকজনকে এখানে থাকতে বলেন।

উপরের বুর্জ থেকে তিন/চার জন লোক নীচে চলে আসে। মশাল জ্বলছে। তারা দরজা সামান্য খেলা দেখতে পেল। ওখান থেকে আবু রায়হান বেরুচ্ছিলেন। আরো দেখল, তাদের বেশ কজন প্রহরীর লাশ। এদের একজন আবু রায়হানকে লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করল। বর্শাটি গিয়ে তার পার্শ্বদেশে গেথে গেল। যুবতীরা এই চারজনকে শেষ করে দিলেন।

আবু রায়হান জমিনে লুটিয়ে পড়লেন। অবশিষ্ট সাথীরা এগিয়ে এল। তিনি বললেন, সামনে বেড়ে ডান দিয়ে মোড় নিও। ওদের বলো, দক্ষিণের দরজা খোলা। বাকীরা তোমরা দরজার ওপাশে ওঁৎ পেতে থেকো। কেউ যেন দরজা বন্ধ করতে না পারে।

***

মানব ও ঘোড়ার স্রোত দক্ষিণ গেটে ছুটে আসছিল। প্রাচীর থেকে শাঁ শাঁ করে তীর ছুটে আসছে। বেশ কজন ওই তীরাঘাতে ঘায়েল হয়। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর উদ্দীপনায় ভাটা ফেলতে পারে না। এরা সুদক্ষ, সুশিক্ষিত বাহিনী। কেল্লা ও ফটক দখল করার কৌশল ওদের জানা ছিল। প্রতিটি সৈনিক জানে এ মুহূর্তের করণীয় কি! একদল দরজা ভেদ করে ভেতরে গিয়েই প্রাচীরে উঠে যায়। মশাল নিভিয়ে প্রাচীরে রক্ষীদের পাইকারী হত্যা শুরু করা হয়।

এদেরই একদল ফটকের দুকপাট পুরোপুরি খুলে দেয়। এবার বিদ্রোহীর জীবন-মৃত্যুর দোলায় দোল খেতে থাকে। জনৈক ইতিহাসবিদ লেখেন,

বিদ্রোহীরা জানত, তারা মারাত্মক অপরাধী। এরা মুসলিম খেলাফতের বিদ্রোহী। তারা মুসলিম নেতৃত্বে আঘাত হেনেছে। তাদের ঘরদোরে আগুন জ্বেলেছে। মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছে। সুতরাং তারা ওই কৃতকর্মের শাস্তির জন্য প্রস্তুত ছিল। কাজেই তারা ও সময় জীবনবাজি রেখে এভাবে লড়তে থাকে যাতে মুসলিম শিবিরে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।

লড়াই এবার অলি গলিতেও ছড়িয়ে পড়ল।

এ সময় মুসলিম সেনাপতি চিৎকার দিয়ে বলেন, পুরুষদের গলা কেটে ফেল। ওদের একটাও যেন প্রাণে রক্ষা না পায়। কাফেরদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।

সকাল বেলা দেখা গেল মাদ্রিদের রাজপথে রক্তবন্যা। পা পিছলানো অবস্থা। প্রধান সেনাপতি দক্ষিণ ফটক খোলার খবর শুনতেই জনৈক দ্রুতগামী দূতের মাধ্যমে এ খবর আমীরে স্পেনের কাছে পৌঁছান।

উবায়দুল্লাহ শহরে প্রবেশ করেই সরকারী ইমারত দখল করার ঘোষণা করেন এবং একদল চৌকস গুপ্তবাহিনীকে কোষাগার দখল করতে বলেন। নিজে একদল নিয়ে কয়েদখানায় যান। ওখানে সামান্য প্রতিরোধ হয়। জেল দারোগাকে মুসলিম ফৌজও গভর্নরকে ছাড়িয়ে বাইরে নিয়ে আসতে বলেন।

সেনাপতি এবার আবদুর রউফকে বলেন, এলোগেইছ, ইলিয়ার ও মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারকে পাকড়াও করার হুকুম জারী করেন। কিন্তু তা কি করে সম্ভব। তার বাহিনীর কেউই এ তিনজনকে চেনে না। কোনদিন দেখেনি। ইবনে আবদুল জব্বারকে কেবল সালারগণ চিনতেন। এদের পাকড়াও করার জন্য শহরের প্রতিটি কোণে খোঁজাৰুবাহিনী যায়। কিন্তু পরবর্তীতে জানা গেল, বাহিনী প্রবেশের আগে ভাগেই এরা শহর ছেড়ে আত্মগোপন করেছে।

***

আবদুর রহমানের কাছে দূত খবর দিতেই তিনি মূসা ও করনকে বললেন, তাদের বাহিনী যেন পূর্বের মতই টহল দিতে থাকে এবং ফ্রান্স বাহিনী চোখে পড়তেই যেন তাদের ওপর চড়াও হয়। ওদের একটা। যেন ফিরে যেতে না পারে। এরপর তিনি সসৈন্যে মাদ্রিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তার চলার গতি খুবই তীব্র। পরদিন দুপুরের পূর্বেই মাদ্রিদের কেন্দ্রস্থলে চলে আসেন। শহরে কখনও লড়াই চলছে।

আমীরকে দেখামাত্রই ঘোষণা হলো, আমীরে স্পেনের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম।

আবদুর রহমানকে দেখামাত্রই ফৌজের মাঝে নব জীবনের জোয়ার এলো। তিনি প্রথম যে ফরমান জারী করেন, তা হচ্ছে ওই দুশমন পুরুষের একটাও যেন জীবিত না থাকে।

সূর্যাস্তের পূবেই বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ করল। তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো। মশালের আধিক্যে অন্ধকার বোঝার উপায় নেই। আমীরের ফরমান মোতাবেক ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে পুরুষদের বের করে আনা হলো। মোহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার, এলোগেইছ ও ইলিয়ারের টিকিটিও নেই। পাদ্রীদেরও গ্রেপ্তার করা হলো। শহরবাসীদেরকে জিজ্ঞেস করলে কেউ না কেউ এই পাদ্রীদের নামোল্লেখ করলই। এভাবে নেতৃস্থানীয়দের বিরাট একটা দল বেরিয়ে এলে তাদের আলাদা করা হল।

ওই কার্যক্রমে দুদিন লেগে গেল। নেতৃত্বদানকারী কাউকে সন্দেহ করা হলে তাকে আলাদা করা হলো। শহরবাসীদের কড়া ভাষায় বলা হোল, বাঁচতে চাইলে বলো, আর কে কে তোমাদের নেতৃত্ব দিয়েছে। এবারও বিশাল একটা দল বেরিয়ে এলো। মুসলিম নারীদের অপহরণকারী ও ঘরে আগুনদাতাদেরও পৃথক করা হোল, আমীর এবার তার চূড়ান্ত ফয়সালা করলেন। এদের সকলকে হত্যা করা হোক। তিনি বললেন, এলোগেইছ, ইলিয়ার ও আবদুল জব্বারের সন্ধান দাতাদের মাফ করে দেয়া হবে। কিন্তু কেউই তাদের সন্ধান দিতে পারল না। এরা মুসলিম ফৌজ শহরে প্রবেশ করার পূর্বেই পালিয়েছে। ইবনে আবদুর জব্বার লিজবন আর বাকীরা অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়।

এই সময় আবদুর রহমান জানতে জানতে পারেন, শহরের প্রথম দরোজা খোলা মুজাহিদ আবু রায়হান শাহাদত বরণ করেছেন। আরো জানতে পারেন কিছু লৌহমানবীও এ কাজে সহযোগিতা করেছে। আবদুর রহমান ওই যুবতী ও বাপ-মাকে অঢেল সম্পদ দিয়ে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

মাদ্রিদ লাশের শহরে পরিণত। আবদুর রহমান গোটা শহরে বিচরণ করেন। লাশ অপসারণ নিজের চোখেই অবলোকন করেন। সর্বশেষ মাদ্রিদের বন্দী গভর্নরকে উদ্ধার করে তাকেই আবার এখানকার গভর্নর নিযুক্ত করেন।

***

কর্ডোভায় খবর পৌঁছে যায়, আমীর সাহেব আসছেন। চাটুকাররা তাদের থলের ভাষার অলংকার ঘষেমেজে চোখা করে রেখেছিল। মহলে চলছিল চুনকাম। যিরাব ও সুলতানার ঘুম চলে গেছে। সংবাদদাতারা বলেছিল যে, ফ্রান্স অভিযান স্থগিত হয়ে গেছে। কিন্তু মাদ্রিদে বিদ্রোহীদের রক্তবন্যা বইয়ে দেয়া হয়েছে। আরো জানানো হয়, ময়দানে আবদুর রহমানকে চেনার উপায় নেই। খুব সম্ভব তিনি ভুলে গেছেন যে, তাকে স্পেন সম্রাট খেতাব দেয়া হচ্ছে।

ফুলে ফুলে সুশোভিত নয়নাভিরাম একটি স্থানে সুলতানা ও মোদাচ্ছেরা পায়চারী করছিলেন। সুলতানা মোদাচ্ছারকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি মোদাচ্ছেরার সাথে এভাবে সখ্য দেখান যা ইতিপূর্বে ছিল না। মোদাচ্ছেরা বলেন,

রাণী হে। যা বলার বলে ফেলুন। যদিও জানি আমার প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি নেই আপনার মাঝে।

তাহলে শোন মোদাচ্ছেরা! আমীরে স্পেনের ওপর তোমার প্রভাব ফেলা চলবে না। মনে রেখে, হেরেমের সামান্য এক বিৰি মাত্র তুমি। সুলতানা বলল,

আপনি কোন ধরনের প্রভাবের কথা বলছেন?

স্পেন সম্রাট একজন রসিক ও মিশুক প্রকৃতির লোক। সেই মিশুক লোককে তুমি ময়দানে নামাতে বাধ্য করেছ। লড়াই তার জন্য নয়, এজন্য ভাড়াটে সেনা ও সিপাহসালার রয়েছে। তারাই দেশকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাবে।

তিনি না খোদ নিজে যাচ্ছিলেন, না সিপাইসালারদের যাবার ফরমান দিচ্ছিলেন। তিনি যদি সৈন্য প্রেরণ না করতেন তাহলে ফ্রান্সবাহিনী স্পেনের ওপর হামলা করে বসত এবং মাদ্রিদের বিদ্রোহ দমন সম্ভবপর হত না।

তিনি মারা গেলে তুমি কি বিধবা হতে না? তোমার বাচ্চারা কি এতিম হতো না?

মুসলিম নারীরা খোদার রাহে স্বামী সোহাগকে কোরবান দিয়ে থাকে। তারা সে মুহূর্তে বাচ্চাদের এতিম হওয়ার ভয় করে না। মোদাচ্ছেরার কণ্ঠে দৃঢ়তা, ইসলাম আমাদের থেকে এই কোরবানীই চায়। শহীদের বিধবাকে আপনি ঘৃণার চোখে দেখে থাকেন বুঝি? স্পেন আমীরের সাথে আপনার সম্পর্ক কিসের শুনি? তিনি শহীদ হলে আপনি সেক্ষেত্রে পরবর্তী আমীরের দাসীই তো হবেন-নয় কি?

আমি স্পেন সম্রাটের দাসী নই। আমি তার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছি। আমি স্পেনের ভাবী সম্রাটের গর্ভধারিণী।

স্পেনভূমি এতটা নাপাক হয়ে যায় নি যে, তার ভাবী সম্রাট এমন এক বাচ্চা হবে যার মায়ের সাথে তার বাবার বিয়েই হয়নি এখনো। জারজ সন্তান স্পেনের ভাবী আমীর হতে পারে না। আর মনে রাখবেন রূপের রাণী! আপনার মত আবদুর রহমানের হাতে আমি শরাবের পেগ তুলে দেব না– তুলে দেব তলোয়ার।

 মোদাচ্ছেরা! সুলতানা গর্জে ওঠল, হৃদয় থেকে আত্মতৃপ্তি মুছে ফেল। আবেগের প্রশ্রয় নিও না। তোমার কাছে মিনতি নয়, সিদ্ধান্ত দিয়ে বলছি, আমীরের ওপর প্রভাব বিস্তার করার পরিণতি ভাল হবে না।

আপনার হুকুম আমি মানতে প্রস্তুত নই। বিবাহিত কোনো নারী স্বামীর দাসীর হুকুমে চলে না। আমি বনী উমাইয়ার মেয়ে, দাসী নই। মোদাচ্ছেরা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সুলতানা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল, অচিরেই টের পাবে, হুকুম দাসীরটা চলে না স্ত্রীরটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *