১.৫ গভীর রাত

গভীর রাত

গাঢ় নিদ্রায় বিভোর আবদুর জব্বার। কামরার কোণে টিমটিম করে জ্বলছে কুপি। আচমকা তার দৃষ্টি খুলে গেল। কে যেন তাকে সুড়সুড়ি দিয়ে জাগাচ্ছে। কে তাকে এভাবে জাগাতে পারে? ধড়ফড়িয়ে উঠলেন তিনি। সহসাই তলোয়ার উঁচিয়ে ধরেন। আবছা আলোয় খাটের কোণে জনৈক তরুণীকে দণ্ডায়মান দেখেন তিনি।

তুমি! তুমি এখানে?

আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে। আমি এর অযোগ্য হলে বলুন কি করে আপনার এই অনুদান শোধ কর। বলে যুবতী খাটের কোণে বসে গেল।

আমি এমন আহামরি কি করলাম তোমার জন্য। আবদুর জব্বার বললেন, প্রতিদান দেয়ার স্থলে তুমি আমাকে উদ্বিগ্নই করে তুলছ, তুমি দিতে এসেছ আমার মুখে চুনকালি।

যুবতী তার ১ হাত নিজের মুখে পুরে নিল এবং চোখ ঘেঁয়াল, পরে নামিয়ে দিল ঠোঁট।

আবদুর জব্বারের চেহারায় যৌবনের ইতিহাস। তার যৌবনের সেই সোনালী দিন এখন কেবল ধূসর অতীত। যুবতীর আবীর ছোঁয়া তাকে পেছন অতীতে নিয়ে চলে। নিযুতি রাত আর ভুবন মোহিনীর এই সম্মোহনী শক্তি আবদুর জব্বারকে তার পরিণতির কথা ভুলিয়ে দেয়।

রাত আরো গম্ভীর হতে থাকে। নেককার গভর্নর আর কুলটা যুবতীর জীবনে আরেক দুনিয়ার দরজা উন্মুক্ত হচ্ছিল। জীবনে যা তার কাছে অভাবনীয় ছিল তা বাস্তবে ধরা দিল। বড় মনোমুগ্ধকার হয়ে দেখা দিল। যেখানে তার তিনদিন থাকার কথা, সেখানে তিনি দশদিন থাকলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে ফিরতে হল। অবশ্য যুবতীদের সাথে নিতে ভড়কালেন। ওদেরকে ওখানেই থাকার ব্যবস্থা করলেন। ডাকাতগংকে বললেন, এদের শান্তি-নিরাপত্তায় খেয়াল রাখতে। আরো বললেন, তিনি আসতে থাকবেন। এরপর তিনি চলে গেলেন।

যুবতীদের যাবতীয় ব্যবস্থা করল ওরাই যারা ওদেরকে কাফেলা থেকে বন্দী করে নিয়ে এসেছিল। মুহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বারের প্রস্থানের পর ডাকাতরা যুবতীদের কাছে এলো।

মনে হচ্ছে তোমাদের মিশন সফল হয়েছে। ডাকাত সর্দার বলল।

তোমরা বলতে লোকটা পাথুরে হৃদয়বিশিষ্ট। কিন্তু আমরা তাকে মোমের মত গলিয়ে দিয়েছি। যুবতী বলল।

গোনাহর একটি দরজা খুললে অন্যান্য দরজাও খুলে যেতে লাগল আবদুল জব্বারের জীবনে একে একে। জীবনের পিছল পথে গোনাহ অতি অবশ্যই ওঁত পেতে থাকে কিন্তু একে সামাল দেয় সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি। অবশ্য ওঁত পাতা এই দুশমন মানব প্রতিরোধের পাহাড়কে দুমড়ে মুচড়ে থেতলে দেয়। যে আবদুল জব্বার বৈধ পন্থায় রাজস্ব আদায়কে ঈমানী দায়িত্ব বলে অংগীকারবদ্ধ ছিলেন, সেই আবদুল জব্বারই নীতিজ্ঞানহীন খ্রীষ্টানদের মায়াজালে আটকে পড়লেন। তার সে এমন এক মায়াজাল, এমন এক সম্মোহনী শক্তি যা যে কোন গোনাহর জন্ম দিয়ে চলে একের পর এক। তিনি অধিকাংশ সময়ই দেশ শাসন ছেড়ে সফরে বের হতেন। আসতেন সেই গ্রামে যেখানে ঐ দুযুবতীর অবস্থান।এরা সেই যুবতী যারা পয়লা মোলাকাতে কেঁদেছিল এক্ষণে হাসিখুশিতে কালাতিপাত করতে লাগল। ওরা কুলটা হতে শাহযাদীতে রূপান্তরিত হল। পুরানো দিনের পোড়াবাড়ী প্রাসাদোপম অট্টালিকায় রূপ নিল। সেই মহলে শরাব আমদানী হল। অল্পদিনে নতকীরও অন্তর্ভুক্তি হল। এই জলসা সাজাতে চাই কাড়ি কাঁড়ি অর্থ। আবদুল জব্বার ট্যাক্সের আমানতে খেয়ানত করতে শুরু করলেন। ডাকাতের সূচী লম্বা হতে লাগল। আবদুল জব্বার রীতিমত হেরেম বানালেন। বনে গেলেন মুকুটহীন সম্রাট।

***

অল্পদিনের ব্যবধানেই তিনি আঁচ করতে পারলেন তার আশেপাশে যারা চাটু কারের ভূমিকার ছিল তাদের সকলেই খ্রীস্টান। তমধ্যে মুসলমানও ছিল। কিন্তু সকলেই নও মুসলিম। যারা বাহ্যত নব দীক্ষিত মুসলিম হলেও তলে তলে কুশ পূজারী। ওরা নেপথ্যে পেয়ে যেতে লাগল মুসলিম শেকড় কাটার ষড়যন্ত্র বার্তা। আবদুর জব্বারের উপদেষ্টারা যেতেন-এরা তারই নির্বাচিত। তারা তাকে রঙ্গ-রসের আসরে গলা অবধি ডুবিয়ে রাখল। এরা শুধু তার ডান হাত নয় তার রহস্যের সংরক্ষকও।

একবার তার এই করুণ দশা দেখতে পেল ন্যায়নিষ্ঠ এক মুসলিম সেনা। তিনি তাদেরকে এনাম দেয়ার টোপে তথ্য প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। এর ভেতরে-বাইরের দশা দেখে রীতিমত কেঁপে উঠলেন তিনি। দেখলেন দিগম্বর নর্তকীরা কোমর দুলিয়ে নাচছে, শরাবের বন্যা বইছে। পরদিন আবদুল জব্বার অধিবেশন ডাকেন। ট্যাক্স অনাদায়ী লোকদের হাজির করা হয়। তারা টাক্স আদায়ের অপারগতার কথা শোনায়, আব্দুল জব্বার জনগণের পক্ষেই সব সময় ফায়সালা করতেন। কাজেই এই অধিবেশনের ফায়সালা ওদের পক্ষেই গেল।

আবদুল জব্বার মাদ্রিদ চলে গেলেন। তার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান সালারকে জিজ্ঞেস করলেন, আবদুল জব্বার বাইরে কোথায় যান? খাজাঞ্চিখানা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। ট্যাক্স ফাঁকিদাতাদের গ্রেফতার না করে তাদের ফোর্সে শামিল করেছেন।

আবদুল জব্বার আর মাদ্রিদ ফিরলেন না। মাস্তান গুণ্ডাদের নিয়ে তিনি ওখানেই এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুললেন। ডাকাত দলের প্রধানকে ডেকে গোটা এলাকায় এ মর্মে ঘোষণা করতে বললেন যে, আজ থেকে আবদুল জব্বার এখানেই থাকবেন-মাদ্রিদ যাবেন না। ট্যাক্সের অফিস এখানেই খোলা হচ্ছে। কাজেই ট্যাক্স এখন থেকে এখানে আদায় করতে হবে। এলোগেইছ এবার পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। তার মিশন সাকসেসফুল। তখন আবদুর জব্বার তার টোপ গিলে ফেলেছে। কাজেই তাঁর সাথে কথা বলা যায়। বলা দরকার। এলোগেইছ এসে বলল,

আপনাকে মনে রাখতে হবে, জীবন চলার পথে একাকী মুসাফির নন আপনি। এক্ষণে আপনার কোন প্রভাব কিংবা মূল্যায়ন নেই। যে কোন সময় আপনাকে হত্যা করা হতে পারে। কিন্তু আপনাকে আমি মাদ্রিদের স্বাধীন রাজা বানাব। মাদ্রিদ হবে খণ্ডিত স্পেনের স্বাধীন রাজ্য। খ্রীস্টান ও নবদীক্ষিত মুসলমানরাই আপনাকে সাহায্য করবে। ওরাই আপনার বাহিনী। আপনার মর্যাদা পুনরুদ্ধারের অপচেষ্টা চালিয়ে আমাদের ধোকা দেয়ার চেষ্টা করলে পরিণাম এতই ভয়াবহ হবে যে, এর কল্পনাও করতে পারবেন না আপনি।

এই পরামর্শ আবদুল জব্বারের আনুকূল্যেই। তিনি এলোগেইছের সাথে প্রাণ দাঁড় করালেন। ঈসায়ীরা তাকে সম্রাট ঠাওরাল। তারও আশা ছিল, বিদ্রোহের ঝাণ্ডা কোনো মুসলমানের হাতে থাক। সে মুসলমান তিনি পেয়ে গেলেন।

***

ট্যাক্স আদায় করতে নয়া আমলা এলাকায় গেলে আবদুল জব্বারের প্রাক-সরকারী আমলারা তাকে অভিশাপ দিল এবং তাকে হৃদয় থেকে মুছে ফেলল। মাদ্রিদ থেকে নির্বাচিত হবার কয়েক মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। আবদুল জব্বার যে এলাকায় ছিলেন সেখানে বিদ্রোহীদের স্বাধীন রাজ্য কায়েমের খবর আসতে থাকে। কিন্তু মাদ্রিদের কেউই জানতেন না যে, কে এই সদ্য স্বাধীন রাজ্যের কর্ণধার।

নয়া আমলারা ট্যাক্স আদায় করতে মাদ্রিদের উপকণ্ঠে পৌঁছুলে পাহাড়ের অজ্ঞাত স্থান থেকে পশলাদার-তীর বৃষ্টিতে তাদের সকলেই মারা পড়ল। যারা প্রাণ ভয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল তারাও বেশী দূর এগুতে পারল না। এদেরকে গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দেয়া হল।

আবদুল জব্বার ট্যাক্সের মাত্রা কমিয়ে দিলেন। এতে তিনি জনগণের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেলেন। তিনি প্রাসাদ স্থানান্তর করলেন। কেউ জানল না তিনি কোথায় গায়েব হয়ে গেলেন। তিনি পাহাড়ী এলাকায় আত্মগোপন করলেন। খ্রীস্টান সন্ত্রাসীরা তারা তাকে অন্তরীণ করে রাখল।

এবার কর্ডোভার প্রাচীন গীর্জার ঘটনার অনেকদিন পর সেখানকার ফৌজি শক্তি আন্দায করতে সেখানে ছুটে গেল এলোগেইছ।

ওইদিন সালার ওবাইদুল্লাহ সসৈন্যে কর্ডোভায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন। এটা ছিল তার আখেরী যাত্রাবিরতি। যাত্রাছাউনির অদূরে ছিল আবাসিক এলাকা। সালার অত্র এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তার ওপর একটি প্রাণঘাতী হামলাও হয়েছিল। ছাউনির চারদিকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন গোয়েন্দা টিম। সাধারণ মানুষেরা ছদ্মরণে এই এলাকায় বিচরণ করত। এদের দুজন আবাসিক এলাকা ঘুরে এসে সালারকে জানাল, এখানে একটি মসজিদ আছে। এই মসজিদে অপরিচিত কে যেন কি দরস দেবে।

ওবাইদুল্লাহ বাদ এশা ছদ্মবেশে ওই মসজিদে গেলেন। বাদ নামায নামাযীরা বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার স্থলে বসে ছিল। খবর নিয়ে জানা গেল, আজ ইমাম সাহেব বাদ নামায তকরীর রাখবেন।

আজ আপনাদেরকে জেহাদ বিষয়ে আলোকপাত করব। ইমাম সাহেব ওয়াজ শুরু করলেন।, মুসলিম জাতির জিন্দা থাকার মাকছাদ হচ্ছে, তারা কিছু একটা করবে। মসজিদে ইবাদত কিংবা রনাঙ্গনে লড়াইয়ের একটাই উদ্দেশ্যে ছওয়াব। পরকালে তাই প্রতিদান পাবে সকলে। তারপরেও কেন বাচ্চাদের এ এতীম ও নারীদের বিধবা বানানো? নামাযটাইতো এক ধরনের জেহাদ। রনাঙ্গন থেকে মসজিদ উত্তম। তিনি একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন। দুতিনটি জাল হাদীস পড়লেন। বললেন, রাসূলে পাক (স)-এর জীবনের এমন অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে যখন তিনি জেহাদ বিমুখ হয়েছেন এবং লাগাতার রাত জেগে নফল ইবাদতে লিপ্ত থেকেছেন। স্পেনে যে বাদশাহ একে ইসলামী রাজ্য বলছেন তিনি আপনাদেরকে ইসলামের নামে গোনাহে লিপ্ত করছেন। ইমাম বলে চলছেন, তিনি নিজে মদ্যপ ও উলঙ্গ নর্তকীর নৃত্য উপভোগকারী। মুসলমান কারো গোলাম নয়। আপনাদের থেকে যে ট্যাক্স উসুল করা হয় তার সবই তার রঙ্গরসের জলসায় খরচ হয়।

এভাবেই তিনি হুকুমতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছিলেন। দলিলের বেলায়। কুরআন-হাদীসের রেফারেন্স টানছিলেন।

তার হৃদয়গ্রাহী তকরীর শুনে মুসল্লীরা বাড়ীমুখী হচ্ছিল। উবাইদুল্লাহ তার স্থানে উপবিষ্ট। সঙ্গে তার দুকমাণ্ডার। ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা বসে কেন?

আপনার তকরীরে এতটাই প্রভাবিত যে, কিছু প্রশ্ন মনে জাগছে, বললেন উবাইদুল্লাহ।

অবশ্যই! আপনারা কেথেকে? আর প্রশ্নই বা কি? ইমামের সপ্রশ্ন দৃষ্টি। আমরা ভিনদেশী, যাচ্ছি কর্ডোভা। জানতে ইচ্ছে, স্পেনের বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধে আমাদের করণীয় কি এক্ষণে। আপনি বলেছেন, বাদশাহ গোনাহগার, আমাদের ঘামঝরা শ্ৰমার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করে রঙ্গরসের আসর জমাচ্ছে। আমার মনে হয় এ ধরনের শাসকের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে তার কোষাগার লুণ্ঠন করা উচিত। উবাইদুল্লাহ বললেন।

আরেকদিন আসবেন। আমি আপনাদের প্রশ্নের জবাব দেব সেদিন। ইমাম বললেন।

ইমাম সাহেব বেরিয়ে গেলেন। উবাইদুল্লাহ ও তার দুকমান্ডার তার পিছু নেয়। আবাসিক এলাকায় চোরাগলিতে সে ঢুকলে উবাইদুল্লাহ তাকে দ্রুত অনুসরণ করেন। শেষ পর্যন্ত ইমাম সাহেব থমকে দাঁড়ান। উবাইদুল্লাহকে বলেন, ওরা দুজন আমার পিছু নিচ্ছে কেন? উবাইদুল্লাহ বলেন, ওরা আপনার পদাংক অনুসরণ করতে চায়। ইমাম চলছেন। উবাইদুল্লাহ তার পিছু নেন আবারো। ইমাম বসতির বাইরে বেরোলে উবাইদুল্লাহ তার পথ আগলে বলেন, ইমাম সাহেব! আপনার বাসা কোথায়?

আমি এই আবাসিক এলাকায়ই থাকি। এই একটু বাইরে যাচ্ছি জরুরী কাজে। বললেন ইমাম।

চলুন না! এক সাথেই যাওয়া যাক।

ইমাম এবার খানিক রাগ হয়ে গেলেন। সালারের ইশারায় কমান্ডার তলোয়ার বের করল। উভয়েই তলোয়ারের ডগা তার দুপাশে ছোঁয়াল। আমাদেরকে তোমার বাসায় নিয়ে চলো। এদিক সেদিক করেছ কি আমার সাথে ফৌজ আছে। এলাকার বাড়ী বাড়ী চিরুনী অভিযান চালাব। সে অবস্থায় ঘোড়ার পেছনে রশিদ্ধ করে আবাসিক এলাকার ঘোরাবোতোমাকে। বললেন সালার।

***

ইমাম সাহেব একটি পৃথক বাড়ীতে থাকতেন। পরে জানা গেল ওই ঘরে আর কারো প্রবেশানুমতি ছিল না। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তার এখানে কিছু ভূত-প্রেতের আনাগোনা, তারা ইমামর কাছে দরস নিতে আসে। ইমাম ও উবাইদুল্লাহ ওখানে এসে দাঁড়ালেন। সর্বাগ্রে তাদের চোখে ভেসে উঠল দুযুবতী। ঘর তল্লাশি শুরু হোল। তম্মধ্যে একটি কামরা অবিকল গির্জার মত। ওখানে ক্রুশদণ্ড, মেরীর মূর্তি ও ঈসার প্রতিকৃতিও পাওয়া গেল। গির্জায় এবাদত করতে যা লাগে তার সব উপকরণই এখানে। উবাইদুল্লাহর প্রশ্নের জবাবে ইমাম বললেন, তিনি প্রায় মাস ছয়েক ধরে এখানে ইমামতি করে আসছেন।

সালার ওইসব ইবাদত-উকরণাদি তুলে নিলেন। সঙ্গে দুযুবতী ও তথাকথিত ইমাম। পথিমধ্যে ইমাম সাহেব বললেন, আপনি দু যুবতাঁকে নিয়ে নিন এবং যত অর্থ চান এর বিনিময়ে আমাকে ছেড়ে দিন। চাইলে এর চেয়ে ভুবন মোহিনী নারী কোন অর্থ ব্যতীতই আপনাকে দেয়া হবে।

আঁধার রাতে এ দুযুবতী কমান্ডারদের হৃদয়ে উত্তাপ বাড়িয়ে তুলতে গা ঘেঁষে চলছিল। তারা নারী সুষমার সবটুকু উজাড় করে দেয়ার জন্য মেহনত করে যাচ্ছিল। কিন্তু লোহার ছাঁচে গড়া এই সালারের এতে এতটুকু পরিবর্তন নেই। উবাইদুল্লাহ ছাউনিতে এসে, এদেরকে নিয়ে চললেন অফিসে। বললেন যুবতীদের লক্ষ্য করে,

শুনে নাও! তোমরা এক ফৌজি খিমায় এক্ষণে। তোমাদের অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দিতে হবে। উত্তর এদিক সেদিক করেছ কি ক্ষুধার্ত সেপাইদের হাওয়ালা করে দেব। ওরা সবে হিংস্র বর্বর। মনে করে দেখ সেই বীভৎস চিত্রের কথা-কোন নারী যাকে সহ্য করতে পারে না। পারবে না তোমরাও।

আপনি আমার প্রস্তাব কবুল করছেন না তাহলে? ইমাম সাহেব উবাইদুল্লাহকে প্রশ্ন করেন। এ মুহূর্তে তার কণ্ঠে চ্যালেঞ্জের সুর। মনে হচ্ছে কতকটা ধমকি দিয়েই তিনি বলছেন।

না করছি কমিনা! এক্ষণে তোমার প্রাণ হরণের প্রস্তাব গ্রহণ করছি। সত্য কথা বললে বাঁচলেও বাঁচতে পার। সালারের কণ্ঠে দৃঢ়তা।

সত্য কথা শুনতে চান। তবে শুনুন। আপনাদের সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। আমাদের নারীদের ব্যবহার করছি-এ মর্মে আসমহীনতার ধিক্কার দিলেন শুনে নিন, আমরা একে আত্মসন্ত্রামহীনতা মনে করি না। ওই দুনারীকে আলাদা জিজ্ঞেস করে দেখুন। তারা সানন্দে আমাদের এই আন্দোলনে শরীক হয়েছে। ওদের কাউকেই আমরা জবরদস্তিমূলক শরীক করিনি। ধর্মের খাতিরে আমরা সবকিছুই কোরবান করতে পারি। আমরা এদেশ থেকে ইসলামকে উৎখাত করবই। আমরা না পারলেও আমাদের পরবর্তী বংশধর এ কাজ করবে। যে তুফান আমরা উছলে দিয়েছি তোমাদের গোটা সাম্রাজ্য মিলেও তাকে প্রতিহত করতে পারবে না। দৈহিক কোন আঘাত করার অভিপ্রায় নেই আমাদের। আঘাত করেছি তোমাদের মৌল বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করেছে, করছে এবং করবে।

তোমরা কোনো সম্প্রদায় বিশেষকে চিহ্নিত করছ কি? সালার প্রশ্ন করেন। না। তিনি জবাব দেন, আমাদের সম্প্রদায়ের কোন ক্ষতি করতে পারবে না তোমরা। নিজেদের চড়কায় তেল দাও। তোমাদের বেশ কিছু ইমাম মসজিদে মসজিদে জুয়া তাফসীর দিচ্ছে। তারা জানতেও পারছে না যে, তারা যাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে তারা সকলেই খ্রীস্টান। এখন থেকে এই তাফসীরই তোমরা মসজিদে মসজিদে গুনতে থাকবে। এর মূলে কাজ করছে ইহুদী ওলামা ও ইমাম। ছদ্মবেশে আর কিছু আমার মত খ্রীষ্টানরা। আবার তোমাকে বলে রাখছি…………তুমি তো সামান্য এক সালার। তোমার জীবনের সিংহভাগ কেটেছে রণাঙ্গনে। তুমি কোরআন পড়েছ হয়তবা কিন্তু এর মর্মোদ্ধার করতে পারনি। আমি এর মর্মোদ্ধার করেছি। কোরআন এক পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মুসলিম জাতি সত্যিই যদি এর মর্যোদ্ধারে সক্ষম হত তাহলে তাদের সাম্রাজ্য সীমা অস্ত-উদয়ের মধ্যবর্তী তামাম জনপদে বর্ধিত হত। কিন্তু ইহুদী-খ্রীস্টানদের সাফল্য বলতে পারতারা একে যাদু ও তাবিজ-কবজের সমন্বিত কিতাব বলে চালিয়ে দিতে পেরেছে। সর্বোপরি মতানৈক্য পয়দা করে এর এক এক আয়াতের হাজারো দুর্বোধ্য ব্যাখ্যায় রূপান্তরিত করেছে। থামলেন ইমাম সাহেব।

সালার উবাইদুল্লাহ শুনে চলেছেন নিশূপ নির্বিকার। এক্ষণে তার আর কিছু জিজ্ঞাসার জরুরত নেই। এরা ইসলামের বিকৃতি সাধন করে চলেছে। এরা বড় চৌকস। দুযুবতাঁকে কমান্ডারদের কাছে হাওয়ালা করে দিলেন। তারা ইমামের জবানবন্দীর বাইরে আরো কিছু তথথ্যাদ্ধারের চেষ্টা করলেন, কিন্তু তেমন কিছু উদ্ধার করা গেল না। উবাইদুল্লাহ শেষ প্রহরে কর্ডোভার উদ্দেশ্যে ছাউনি তুলে নিলেন। ইমাম ও যুবতাঁকে বন্দী করে নিয়ে চললেন।

***

রাতের বেলা উবাইদুল্লাহ কর্ডোভায় প্রবেশ করেন। কয়েদীদের জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। সকালে ক্যাম্পে হাজির করার কথা বলা হলো। কর্ডোভায় উজির আব্দুল করিম, সালার আবদুর রউফ, মূসা ইবনে মূসা ও করন তাদের সংবর্ধনা জানান। আগে ভাগেই ফৌজি আগমনের সংবাদ দেয়া হয়েছিল। আমীরে নেই তাদের এ খবর দিয়েছিলেন।

উবাইদুল্লাহ ছিলেন খুবই ক্লান্ত। তিনি সালার ও উজিরকে নিরিবিলি স্থানে নিয়ে গেলেন। তিনি এদের জানালেন, কি করে তার প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করা হয় এবং টহলদার বাহিনীর তাকে উদ্ধারের কাহিনীও শোনান। বলেন, প্রত্যাবর্তনের পথে বন্দী করা ইমাম ও দুযুবতীর কথাও। এরপর সংক্ষেপে ওই কাহিনী শুনিয়ে যান।

উপসংহারে তিনি বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে খ্রীস্টানরা সম্মুখ সমরে আমাদের মোকাবেলা করতে অপারগ। ওরা নেপথ্যে আমাদের মোকাবেলার জন্য তৈরী হচ্ছে। প্রত্যাবর্তনের পথে বহু ছাউনি দেখেছি। সংবাদদাতা, গোয়েন্দা ও টহলদার বাহিনীর মাধ্যমে আশপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছি। এদের তথ্যের মাধ্যমে বুঝেছি, তলে তলে বিশাল এক ফেৎনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সীমান্তের লড়াই থেকে যে সব কয়েদী আমি ধরে এনেছি তন্মধ্যে বেশ কিছু পদস্থ অফিসারও রয়েছে। ওরা বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে। ওরা বলেছে, স্পেনে যে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছে ফ্রান্স সম্রাট লুই এর পৃষ্ঠপোষক। শুধু কি তাই! তার বাহিনীও আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানো শুরু করে দিয়েছে।

আমি লোকমুখে এলোগেইছ নামী এক লোকের কথা শুনেছি। মনে হচ্ছে, লোকটা কট্টর খ্রীস্টান আলেম এবং অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন। এই লোকের নেতৃত্বেই বিদ্রোহ হচ্ছে। ওর টিকটিকি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যাচ্ছে। আমাদের চৌকস হতে হবে। কোটা বৃদ্ধি করতে হবে সেনা তালিকায়। প্রতিটি মহকুমায় সেনাক্যাম্প গড়ে তুলতে হবে। শেষকথা স্পেন পরিস্থিতি এ মুহূর্তে বিস্ফোরনোমুখ।

ভাই উবাইদুল্লাহ! উজির বললেন, তোমার দেখার আনেক কিছুই বাকী রয়ে গেছে। তুমি লড়াইয়ে যাবার পর এখানে এক ভৌতিক কাণ্ড ঘটে গেছে। ঈসা (স)-এর নামে এক পাহাড়ে আবির্ভাব নাটক দেখানো হয়েছে। বলে উজির তাকে গির্জায় কাহিনী ঘটা করে শুনিয়ে যান। আমাদের উদারচিত্ত রহমদিল আমীর অপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছেন। দেখারও প্রয়োজন মনে করেননি শহীদানের লাশ। আমরা তার নিরুজ্ৰব ভূমিকায় যারপরনাই হয়রান হয়েছি।

আর তোমরা মুখ বুজে সহ্য করে গেলে? সালারের কষ্টে বিষয়।

ভাই। আমি ও রউফ যথাসাধ্য করেছি। তাকে লজ্জিত করেছি। অবশেষে রাগ করে বেরিয়ে এসেছি। উজির বললেন।

যিরাব ও সুলতানা তার দিল-দিমাগে প্রভাবে ফেলেছে পুরোদস্তুর। তিনি এখন আর কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। বললেন আবদুর রউফ।

দরবারে তোষামোদ ও চাটুকারদের ঠাসা ভিড়। ওরাই এখন দেশ চালাচ্ছে। সাথে সাথে ভারী হচ্ছে ওদের ঝুলি। মূসা ইবনে মূসা বলে বললেন।

এর এলাজ একটাই। সালার করতুন বললেন, ওদের কাউকেই বাঁচিয়ে রাখা যাবে না, নয়তো স্পেন থেকে আমাদের গাভি-বোঁচকা গুটাতে হবে।

না। উবাইদুল্লাহ বললেন, খুন-খারাবি ও অভ্যুত্থানের পরিণতি সাধারণত ভালো হয় না। এতে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা থাকে। গৃহযুদ্ধ লেগে গেলে দুশমন জ্বলন্ত আগুনে ঘি ছিটাবে। এতে জাতি কমযোর হয়ে পড়বে। সীমান্তের ওপারের দুশমন নির্বিঘ্নে অভ্যন্তরে হামলা চালাবে। কেউই ওদের রুখতে পারবে না। আমরা আমীরকে হত্যা করলে একটি বদ রেওয়াজ চালু হবে। পরবর্তী বংশধর মনে করবে হত্যা কর, গদী দখল কর।

তাই বলে কি নিপ বসে থাকব? বললেন জনৈক সালার।

এখন একটাই উপায়, আমীরে স্পেনের ভেতরটায় টোকা মারা। তিনি মামুলী লোক নন। তার অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা আপনাদের অজানা নয়। আল হাকামের যুগে তিনিই ছিলেন রাষ্ট্রের সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। তিনি লড়াই করেছেন। আমার যদুর বিশ্বাস স্পেনে তার মত দ্বিতীয়জন কেউ নেই। বললেন উবাইদুল্লাহ।

কিন্তু আমরা কতদিন অপেক্ষা করব? উজির প্রশ্ন করেন। উজির প্রশ্ন করেন, আমরা আবদুর রহমানের রঙে রঙিন হতে পারি না। ঈমান ও স্বাধীন সত্তাবলে বলীয়ান আমরা। ইসলাম বলেছে, আমীর কিংবা খলীফা পথচ্যুত হলে তাকে খতম করে দাও। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে হবে আমাদের-আবদুর রহমানকে নয়।

কাল সকালে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি। ভুয়া ইমাম ও যুবতীদেরও সাথে নেব। তিনি আমার জযবা ঠাণ্ডা করতে চাইলে আপনাদের সাথে পরামর্শ করব এবং অন্য প্ল্যান নেব। ফ্রান্সের পক্ষ থেকে আমি হুমকি পাচ্ছি। আমি ফ্রান্স অভিমুখে সৈন্য প্রেরণে তাকে বাধ্য করতে চেষ্টা করব। আপনারা সকলেই সেনা কমান্ডার কমান্ডারদের নীতি হচ্ছে, দুশমনের থেকে হুমকি এলে সঙ্গে সঙ্গে হামলা চালানো। ওরা প্রস্তুতি নিয়ে ময়দানে নামার পূর্বে গ্রেপ্তার করা। সামনের পথ খুবই দুর্গম আমাদের। স্পেনকে বাঁচাতে চাই আমরা। ইসলামের এই প্রতিরোধ দুর্গ হেফাজত করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।

***

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ স্পেনের আমীর আবদুর রহমানের সাক্ষাৎক্তমে তার বিগত কর্মকাণ্ড শোনাচ্ছিলেন। সালারদেরকে বলা কথারই পুনরাবৃত্তি করেন তার সামনে। আরো বলেন : স্পেন আমীর গীর্জায় গাঁজায় হুকুমত বিরোধী প্রপাগাণ্ডা চলছে-একথা কেউ কি বলেনি আপনাকে? মুসল্লীদেরকে মসজিদে মসজিদে বিকৃত তাফসীর শোনানোর মাধ্যমে তথ্য সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে। আমি জনৈক খ্রীস্টান ও দু যুবতী নারীকে ধরে এনেছি। এই লোক কয়েকমাস ধরে মসজিদে ইমামতি করছে। আমার দুমান্ডার তার বিকৃত তাফসীর শুনেছে। আমি ছদ্মবেশে এথানে যাই। বলে তিনি পুরো কাহিনী বলেন।

ওদের আমি সাজা দেব উবাইদুল্লাহ। আপনার এতটা উত্তেজনা ও উদ্বিগ্নতা আমি আশা করিনি। মাত্র একটা লোক আমাদের কি করবে? দুনারী আর এমন কি সমস্যা? সিপাহসালার অবাক হয়ে যান। স্পেনের আমীর এতটুকুও জানেন না যে, তাদের দেশের কোথায় কি ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তিনি বলছেন দুএকজন দেশের কি করবে? উবাইদুল্লাহ গির্জার ভেল্কিবাজির কথাও তুলে ধরেন। আবদুর রহমান বলেন, উজির আঃ করিম ও সালার বড্ড বাড়াবাড়ি করেছে। তারা খামোখাই গির্জায় আগুন লাগিয়েছে।

আমীর সাহেব! আমার যদ্র বিশ্বাস দেশের প্রকৃত খবরাখবর আপনার থেকে সযতে গোপন করা হয়েছে।

আমি একজন মানুষ বৈ তো নই। আবদুর রহমান সাদামাটা গলায় জবাব দেন। এই জবাবের মধ্যে শাহী দাপটের লেশমাত্র নেই। আমি তো আর গোটাদেশে সফর করে খবর নিতে পারি না। আমার কানে যে খবর দেয়া হয় একেই সত্য ও বিশ্বস্ত বলে মনে করি।

আবদুর রহমানের টেবিলে একটুকরা কাগজ পড়ে ছিল, এতে দীর্ঘ কবিতা লেখা। কথার ফাঁকে উবাইদুল্লাহ তা পড়ে ফেলেন। কোনো কবি এটা স্পেন-আমীরের নামে লেখেন। কাগজটি হাতে তুলে নেন উবাইদুল্লাহ বলেন, আলীজাহ! স্পেন যদি আপনার জায়গীর হত আর আমি যদি আপনার কেনা গোলাম হতাম তাহলে সর্বাগ্রে আপনার সম্মুখে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করতাম। এমন দিস্তার পর দিস্তা কবিতা লেখতাম আপনার স্তুতি বন্দনায়। আপনার কানে যা দেয়া হয় অবলীলায় তাকে সত্য বলে মেনে নেন কেন? আলীজাহ! বলুন! কেন এমনটা হচ্ছে?

উবাইদুল্লাহ! তোমাদের হয়েছেটা কি শুনি! আবদুল করিম ও আবদুর রউফও কেমন যেন আমার প্রতি অসন্তুষ্ট। আমি বুঝতে পারি ওরা কি বলতে চায়। ওদের জবা সম্পর্কে আমি সবিশেষ অবগত, কিন্তু তোমরা কেন দরবারের শ্রদ্ধা-সম্মান ও আদব ভুলতে বসেছ সকলেই।

আর এ সেই বিষ যা স্পেনের শিরা-উপশিরায় প্রবিষ্ট হচ্ছে। চাটুকারদের প্রতি আপনি ঝুঁকে পড়েছেন। কলমবাজ, ফটকবাজ কবি-সাহিত্যিকের কলম আপনার দিল দেমাগে বাসা বেঁধেছে। আপনার কান কেবল চাটুকারদের স্তুতিগান শুনতে অভ্যস্ত। আরেক বিষ হচ্ছে, যাকে আপনি দরবারী আদব বলছেন, ইসলামে দরবার কেবল খোদার হয় যেখানে আমরা সিজদা করি। আলীজাহ! আপনি আপনাকে খোদা বানাবেন না।

কি বলছ উবাইদুল্লাহ। আবদুর রহমান গর্জে উঠলেন, তুমি আমাকে ফেরাউন ঠাওরাচ্ছ?

***

উবাইদুল্লাহ কিছু বলতে যাবেন এমন সময় যিরাব সেখানে প্রবেশ করল। সালার তাকে দেখে কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান। সে দুহাত প্রসারিত করে উবাইদুল্লাহকে বগলদাবা করতে আসে।

আমার ভাই! বিজেতা সিপাই সালার উবাইদুল্লাহ। কোলাকুলিতে উদ্যত যিরাব অগ্রসর হয়ে বলল। সেনাপতি বসে বসেই কেবল মোসাফাহা করলেন। যিরাব খুশীতে গদগদচিত্তে বলল, আলীজাহ! আমরা সেনাপতি মহোদয়ের জন্য বিজয়োসব করব। আমার পুরোদল এমন নাচ নাচবে, আসমানের অযুত সেতারা যা দেখে বিমোহিত হয়ে যাবে। এমন গীত শোনাবে যা আপনারা শোনেন নি কোনদিনও।

হা হা যিরাব! আবদুর রহমান ভাঙ্গাকণ্ঠে বললেন, ও আমার বাঘ! স্পেনের বাঘ এখন শ্রান্ত-ক্লান্ত।

কেমন উৎসব পালন করবে যিরাব? সালার বললেন, সেই শহীদানের উৎসব পালন করবে, দরবারীরা যাদের সম্পর্কে এতটুকু জানার আগ্রহ ব্যক্ত করেনি যে, তারা কি জন্য জান কোরবান করেছে?

ইতোমধ্যে সুলতানা কামরায় প্রবেশ করল। সেও যিরাবের ন্যায় আনন্দ জাহির করল। করল উৎসবের অভিব্যক্তি। বসে গেল আবদুর রহমানের পাশে। উবাইদুল্লাহ লক্ষ্য করছেন, তার কথায় আবদুর রহমানের চেহারায় যে উদাসীনতার ছাপ পড়েছিল সুলতানার স্পর্শে তা মুহূর্তে দূরীভূত হল। উবাইদুল্লাহর দেহে আগুনের উত্তাপ কিন্তু তিনি দাঁত কামড়ে নিজকে সংযত করেন।

আলীজাহ! তিনি ঠাণ্ডা গলায় বলেন, রণাঙ্গনে মৃত্যুবরণকারীদের উৎসব পালনের পূর্বে আপনার সাথে নিরিবিলিতে কটি কথা বলতে চাই।

উবাইদুল্লাহ প্রত্যুৎপন্নমতি লোক। তিনি যিরাব ও সুলতানার চাল ভালভাবেই পরিজ্ঞাত। তাকে আগেভাগেই উজির ও নায়েব সালার বলে দিয়েছিল, এরা আবদুর রহমানকে একা থাকতে দেয় না। কোনো সালার কিংবা সরকারী কর্মকর্তা যখন মহলে আসেন তখনই তারা তার পাশে জেঁকের মত লেগে থাকে এবং আমীরের কানভারী করে থাকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই চাটুকাররা আমীরের কাঁধে এমনভাবে চেপে বসেছিল যার থেকে তার মুক্তি ছিল না। না ছিল ওদের ধর্মীয় কিংবা জাতীয় স্বার্থ। আবদুর রহমানসহ তার পূর্বেকার আমীরগণ দরবারে চাটুকার নিয়োগ করে আসছেন বরাবরই। ওরা বাইরের সঠিক রিপোর্ট পেশ করত না কখনই। চাটুকারিতাই ওদের ধর্ম। এরা সকলেই মুসলমান থাকা সত্ত্বেও নেপথ্যে ছিল খ্রীস্টশক্তির ক্রীড়নক।

উবাইদুল্লাহ নিরিবিলিতে কথা বলার আগ্রহ ব্যক্ত করতেই আবদুর রহমানের মুখটা মেঘলা দিনের মত কালো হয়ে ওঠে। এতে তাদের কথাবার্তায় কিছুটা তেতো স্বাদও এসে যায়।

বলুন আমি না হয় চলে যাই। সেনাপতি বলেন, তবে বলে রাখছি, আমি আপনার দরবার থেকে চলে যাব ঠিকই, তবে স্পেন থেকে নয়। এই অনুভূতি নিয়ে যাব না যে, স্পেন আপনার বাপ-দাদার সম্পত্তি। যতক্ষণ আমার ও আমার অধীন বাহিনীর দেহে প্রাণ আছে ততক্ষণ কাউকে এই চিন্তা করতে দেব না যে, স্পেন কারো কেনা জায়গীর।

আমি তোমার কথা শুনে চলছি। যিরাব ও সুলতানার সম্মুখে কথা বলতে তোমার আপত্তি থাকার কথা নয়।

আমি ওদের মুখের ওপরই বলছি যে, মহলের এক সামান্য গায়ক আর এক সুন্দরী নারী যদি রাষ্ট্রীয় গোপন আলোচনায় শরীক থাকে তাহলে এ দেশে না স্থায়ী হবেন আপনি, আর না স্পেন। আপনি আমীর না হলে আপনার মুখ দর্শনও করতাম না। যদি এ লোকটা গায়ক আর ঐ মেয়েটার মুখশ্রী নিটোল সুন্দর না হত তাহলে হয়ত আপনি এদের মুখও দেখতেন না। ওদের জাদু কেবল ওটাই। একজনের কাছে সংগীত অপর জনের কাছে সৌন্দর্য। এই সম্পদই আপনার অবস্থার ভিত্তি। বললেন সেনাপতি।

যিরাব ও সুলতানা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। চোখের ইশারায় সুলতানাকে বের হতে বলে সে এমনভাবে বেরিয়ে গেল যেন তার গোটা দেহে আগুন লেগে গেছে। চকিতে উভয়ের দিকে তাকালেন আবদুর রহমান, তিনি জবেহকৃত মুরগীর ন্যায় ছটফট করছেন। রাগে তিনি অগ্নিশর্মা।

উবাইদুল্লাহ! তোমার দাবী কি শুনি! স্পেনের আমীর, যাকে ইতিহাস আগামীতে স্পেন সম্রাট বলেই আখ্যায়িত করবে তার সামনে কথা বলছ- সেকথা ভুলে গেলে কি করে? আমার অন্তরঙ্গ জীবন বলতেও তো একটা জিনিষ আছে। সেখানে হস্তক্ষেপ করছ কেন?

এজন্য যে, খোদাতায়ালা আপনাকে বিশাল পৃথিবীর এক ভূখণ্ডের অধিপতি করেছেন। আমার কোনো ব্যক্তিস্বার্থ এখানে কাজ করছে না। যে মসনদে আপনি উপবিষ্ট সে মসনদে বসে কোনো আমীর রঙ্গরসের সাগরে ডুবে যেতে পারে না। পারে না সে প্রজাদের ঘামঝরা পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ কোনো গায়ক কিংবা ভ্ৰষ্টা নারীর দুপায়ে লুটাতে। পারে না উৎসব পালন করতে। অন্তরঙ্গ জীবন নিয়ে যে আমীর এটা উদ্বিগ্ন রাজমহল ছেড়ে তার বেরিয়ে পড়াই শ্রেয়।

উবাইদুল্লাহ! যা বলতে এসেছে বলো!

যে মানসিকতা আপনি পয়দা করেছেন তাতে মূল আলোচনা আসছে না। আমি বলতে এসেছি যুদ্ধের কথা। আপনি কি ফ্রান্সে আক্রমণের কথা শুনবেন? শুনবেন সেই সব বিদ্রোহের কথা যা আপনার চারপাশে আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠছে? কান দেবেন কি সেই রক্তাক্ত উপাখ্যানের দিকে স্পেনের জমিন যা বলে চলেছে?

এ কথায় প্রভাবিত হলেন আবদুর রহমান। আর যাই হোক তিনি তো স্পেনের কর্ণধার। তিনি সহসাই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন শাহী দাপটে,

ফৌজ কোথায় যাবে, কি করবে সে ফায়সালা দেব আমিই। কোনো সেনাপতিকে আমি যাচ্ছেতাই করতে দিতে পারি না। দেব না। তোমার অধীনদের জানিয়ে দাও, আমি তাদেরকে যে কোনো সময় ডেকে পরিস্থিতি আঁচ করে ব্যবস্থা নেব।

পরিস্থিতি যা তাতে আপনার এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি সেনা প্রধান। অধীনস্থ সালারদের বলব, পরিস্থিতি কি এবং ত্বরা করেই আমাদের রওয়ানা হতে হবে।

আমার হুকুম ছাড়া একজন সৈন্যও স্থান থেকে নড়তে পারে না। বললেন আবদুর রহমান।

আলীজাহ! স্বস্তির সুরে ক্ষীণকণ্ঠে উবাইদুল্লাহ বললেন, আপনি মুসলিম ইতিহাসের চাকা উল্টাতে চলেছেন। মোহাম্মদ ইবনে কাসিম হিন্দুস্তানের মত কাফেরদের দেশে আল্লাহ ও তার রাসূলের পয়গাম পৌঁছিয়েছেন। ইসলাম দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছিল। কিন্তু ওই সময় সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক জ্বলে উঠলেন। জাতি খলিফার থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ওই সেনানায়কের গুণকীর্তনে লেগে যায়। তিনি বিন কাসিমকে ডেকে কয়েদ করেন ও গুপ্তহত্যা করেন।

আমার হৃদয়ে এমন কোনো হিংসা নেই। বললেন আবদুর রহমান

আর স্পেনের ইতিহাসও আপনার স্মৃতিভ্রম না ঘটলে ভুলে যাবার কথা নয়। আবদুর রহমানের কথা কেটে উবাইদুল্লাহ বললেন, স্পেন উপকূলে নেমে রণতরী জ্বালানো তারিক বিন যিয়াদ এদেশ জয় করে নিলে প্রধান সেনানায়ক মূসার হৃদয়ে এই হিংসা জ্বলে উঠেছিল। তিনি তারিকের সাথে ছিলেন। তারিক অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছিল। মূসা কেবল তার গতিরোধই করলেন না বরং জবাব চাইলেন, কেন সে স্পেন ছেড়ে আরো দূরপাল্লার পথে অভিযান চালাচ্ছেন। তিনি তারিকের নেতৃত্ব কেড়ে নেন, কিন্তু তারিক তাকে বলেন, হুকুম মূসারটাই চলবে, শেষ পর্যন্ত উভয়ের সমঝোতা হয় এবং ফ্রান্স সীমান্তে গিয়ে উপনীত হন।

আমার মনে আছে উবাইদুল্লাহ! এটা আমাদের বাপ-দাদার উপাখ্যান। সবই মনে আছে।

আপনার কিছুই মনে নেই। আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি। আপনার বাপ-দাদার কি কি পদস্খলন ঘটেছিল। তারিক ও মূসা ফ্রান্স সীমান্তে পৌঁছালে দামেস্ক থেকে ওলিদ ইবনে আব্দুল মালিকের ফরমান এলো, থেমে যাও এবং দামেস্ক চলে এসো। অত অগ্রযাত্রার দরকার নেই। তিনি এদেরকে খেলাফতের হুমকি মনে করেছিলেন। মূসা বলেছিলেন তিনি প্রত্যাবর্তন করবেন না, কিন্তু তারিক বলেছিলেন, খলীফার হুকুম বরখেলাফের মত গোনাই করবেন না। তিনি চলে এলেন। মূসাও বাধ্য হলেন চলে আসতে।

পরবর্তী কাহিনী আমি জানি উবাইদুল্লাহ! খলীফা মূসার সাথে খুবই দুর্ব্যবহার করেছিল এবং তারেককে গুপ্তহত্যার শিকার হতে হয়েছিল।

আবদুর রহমনের অবস্থা এক্ষেত্রে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়। তিনি যেন সেনাপতির সামনে তলোয়ার সোপর্দ করে অসহায় হয়ে পড়েছেন। সালারে আলা তাকে বাপ-দাদার অতীত কাহিনী শোনাচ্ছেন। তার কথায় তেতো ঝাঁঝ থাকলেও তা ছিল উত্তেজনাবর্ধক। উত্তেজনায় মৃদু রাগ থাকলেও এতে ছিল না অভিযোগের সুর, ছিল না প্রতিবাদ। উবাইদুল্লাহ তাকে ভৎর্সনা করছিলেন না। তার আগুনঝরা বক্তব্য থেকে শব্দ আসছিল, আমীরে স্পেন কিছু করবেন না করার যা তা আমিই করব।

আবদুর রহমান তাকে খামোশ করানোর বহু কোশেশ করেছিলেন, কিন্তু এতে ভেতরে ভেতরে তার জ্বলে ছাই হবার উপক্রম। তাঁর রাজমহল ও ব্যক্তিত্ব সামান্য এক সালারের উত্তেজক বক্তব্যের মাঝে লীন হয়ে যাচ্ছে। উবাইদুল্লাহ তাকে বনি উমাইয়ার কাহিনী শোনাচ্ছিলেন। আবদুর রহমান বনি উমাইয়ার নয়ন মনি। এটা কোনো কেচ্ছা নয় বরং এটাই ওইযুগের খেলাফত ও স্পেনের বাস্তব ইতিহাসের প্রতিফলন। ইতিহাস আমাদের কাছে এভাবেই পৌঁছেছে। এই ইতিহাসের তেমন একটা গুরুত্ব না দেয়ার কারণে আমাদের পতন ও অবক্ষয় ত্বরান্বিত হয়েছে।

আলীজাহ! উবাইদুল্লাহ বললেন, আপনি বলেছেন, মূসার সাথে খলীফা খুবই দুব্যবহার করেছেন-এটুকু বলা যথেষ্ট নয়। বরং মূসা ও তারিক তখনও দামেস্কে থেকে দূরে ছিলেন। এ সময় খলিফার ভাই সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক উপকণ্ঠে এসে তাদের বললেন, খলীফা মুমূর্ষ। কিছু দিনের মধ্যেই মারা যাবেন এজন্য আপনারা এ মূহুর্তে দামেস্কে প্রবশে করবেন না। পরপর্তীতে দেখা গেছে গদীলোভী আরো লোক ছিল। সুলায়মান এদের মধ্যে প্রধান। তিনি মূসা ও তারিককে সাথে নিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন……………..।

মূসা তাকে বলেছিলেন, খেলাফতের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। নেই তারিকেরও। প্রত্যাবর্তনের ফরমান পেয়ে আমরা এসেছি। সুলায়মান তাকে ক্ষমতা দখলে সাহায্য করার যথেষ্ট কাকুতি-মিনতি করেছেন। মূসা তাকে এই বলে চুপ করিয়েছিলেন যে, সেনানায়কদের যেমনি ক্ষমতালোভী হওয়া অনুচিত তেমনি আমিও ফৌজের মধ্যে রাজনীতি ঢুকতে দেব না। সুলায়মান এতে যার পরনাই রাগ করে চলে গেল।

মূসা ও তারিক ওয়ালিদের রাজমহলে এলেন এবং নানান তোহফা ও নগদ অর্থ পেশ করলেন। ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক তখন একটু সুস্থ। তিনি বেশ খুশি হলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়েন। চল্লিশ দিন পর ওয়ালিদ ইবনে আবুল মালিক মারা যান এবং সুলায়মান তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি মূসার থেকে এমন করুণ প্রতিশোধ নেন, ইতিহাসে বনি উমাইয়াকে তা মাথা হেঁট করে দেয়। দুর্নীতি দমনের নামে তিনি মূসার বিরুদ্ধে এমন ভিত্তিহীন, আজগুবি অপবাদ আনেন যার ক্ষতিপূরণ আদায় তার পক্ষে অসম্ভব।

ইতিহাস লিখেছে, সুলায়মান মূসার প্রতি দুলাখ দীনার ক্ষতিপূরণ মামলা করেন। একজন সেনাপতির পক্ষে এই পাহাড়সম ক্ষতিপূরণ আদায়ের সামর্থ্য কৈ? সুলায়মান পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক তার প্রতি বর্বর প্রতিশোধ নেন। থৈ ফোঁটা তপ্ত বালুকাপ্রান্তরে খুঁটি গেড়ে তাতে মূসাকে পিঠমোড়া বাঁধেন। আলীজাহ! জানেন তখন মূসার বয়স কত? ৮০ বছর বয়সে মূসা তারিককে নিয়ে স্পেন জয় করেছিলেন। এর প্রতিদানে ৮০ বছর বয়স্ক সালারকে খৈ ফোঁটা মরুতে বেঁধে রেখে পরে বন্দী করে রাখে। আলীজাহ! আপনার অজানা নয় মূসার এক নওজোয়ান পুত্র ছিল। নাম আঃ আজিজ। তিনিও সেনানায়ক ছিলেন। পিতার এই বর্বর আচরণের প্রতিশোধ শংকায় সুলায়মান তাকেও ফযরের নামাযের সময় হত্যা কনে। আঃ আজিজ সূরা ফাতেহা পড়ে সূরা ওয়াকেয়াহ শুরু করলে সুলায়মানের নিযুক্ত আততায়ী তাকে কূপ হত্যা করে।

এখানেই কি শেষ? বর্বর সুলায়মানের বর্বর হত্যাকাণ্ড। তিনি আঃ আজিজের ছিন্ন মস্তক জেলখানায় মূসার সামনে পেশ করেন। মূসা এর প্রতিক্রিয়ার স্রেফ এতটুকু বলেছিলেন, পাষণ্ড এমন এক সেনা নায়ককে হত্যা করল, যে দিনে যোদ্ধা ছিল আর রাতে তাহাজ্জুদ গোর। ৮০ বছরের গুপ্ত এ শোকও বরদাশত করে নিলেন।

হিজরী ৯৭ সালের হজ্জের কথা মনে করুন আলীজাহ! সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক মূসা ইবনে নুসায়েরকে তার সাথে করে নিয়ে যান পায়ে শেকল দিয়ে এবং তাকে মক্কায় গ্রাম্য ভিক্ষুকদের মত ভিক্ষা করতে বাধ্য করেন। সুলায়মান তাকে বলেন, ভিক্ষা করুন, জরিমানা আদায় করুন সবশেষে মুক্ত হোন। ওই বছর হাজীগণ খুবই উ ফুল্লচিত্ত ছিলেন। তারা একে অপরকে মোবারকবাদ দিচ্ছিলেন এজন্য যে, সম্প্রতি স্পেন সীমান্ত বর্ধিত হয়েছে। কিন্তু কারো জানা ছিল না যে, স্পেন বিজেতা ভিখারীর মিছিলে জিঞ্জিরাবদ্ধ। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমত উপচে উঠল। মদীনা মুনাওয়ারায় এসে মূসা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অপরদিকে তারিক বিন যিয়াদ গুপ্ত হত্যার শিকার হন। খলীফা সুলায়মান তাকেও নতুন কোনো যুদ্ধে যেতে দেননি।

আবদুর রহমান উঠে দাঁড়ান। পেরেশানি হালতে বিক্ষিপ্ত পায়চারী শুরু করেন। খোদার কানুন নিজ হাতে তুলে নেবেন না। আপনি ইচ্ছে করলে আমার সাথে সুলায়মানের মত ব্যবহার করতে পারেন। আমিও মুসা ইবেন নূসায়ের, মুহাম্মদ বিন কাসিম ও তারিক যিন যিয়াদের মত বিড়ম্বনার শিকার হতে পারি। তবে আপনাকে দরাজ কণ্ঠে বলছি, আমি ও আমার বাহিনী সত্য কণ্ঠ উচ্চারণে এতটুকু কুণ্ঠিত হব না। আগাম সতর্ক করে বলছি, আপনার পরিণতি খুবই ভয়াল বলে মনে হচ্ছে। বলে উবাইদুল্লাহ বেরিয়ে গেলেন। আব্দুর রহমান বড় চোখ করে উবাইদুল্লাহর চলে যাবার তাকিয়ে রইলেন।

আবদুর রহমান সাধারণ ব্যক্তি নন। তিনি বিজ্ঞ শাসক ও চৌকস। দেশ শাসনে যতটা দক্ষ তেমনি যুদ্ধ নিপুণ। উবাইদুল্লাহ জীবন বীণার সূক্ষ্ম তারগুলো ছিঁড়ে গেলো যেগুলো গুনগুনিয়ে যাচ্ছিল যিরাব ও সুলতানা। তিনি বসে গেলেন। ললাটে চিন্তায় রেখা।

***

কারো স্পর্শে তিনি চমকে উঠলেন। অঁকানো মাথা উত্তোলন করলেন। দেখলেন মোদাচ্ছেরা তার পেছনে দণ্ডায়মান। মেদাচ্ছেরা তার বাঁদী থেকে স্ত্রী হওয়া নারী। সুলতানার সাথে তার রূপের তুলনা চলে না। বড়ই ভুলিভালি মেয়ে। চেহারায় নিষ্পপের মত ছাপ। আব্দুর রহমান তাকে বিয়েই করেছিলেন। সুলতানার সম্মোহনী রূপ ও চঞ্চলতা তাকে মুগ্ধ করেছিল।

মোদাচ্ছেরা মৃদু হেসে বললেন, আপনি হেরে গেলেন কি? আপনি না সেই আবদুর রহমান, আল হাকামের যুগে যিনি কয়েকবার ফ্রান্স সীমান্তে ক্রুসেডারদের রক্তবন্যা বইয়েছিলেন? আপনি না সেই আবদুর রহমান যিনি শার্লিম্যান খ্রীস্টানকে শোচনীয়ভাবে পরাভূত করেছিলেন? শার্লিম্যান অবরোধ করলে সেই অবরোধ ভেঙ্গেছিলেন যিনি সেই আবদুর রহমান কি আপনি নন?

আবদুর রহমান আড়চোখে মোদাচ্ছেরার দিকে তাকাল। মোদাচ্ছেরাকে এই মুহূর্তে সুলতানার চেয়ে ভাল্লাগছে তার কাছে। মোদাচ্ছেরা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন। আবদুর রহমান খামোশ হয়ে বসে। মোদাচ্ছেরা কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন, হাতে তার কোষবদ্ধ তলোয়ার। কোষ থেকে তলোয়ার বের করলেন। এগিয়ে দিলেন তলোয়ার স্বামীর দিকে। বললেন,

শুকে দেখুন! চোখ মেলে তাকান। এতে পাবেন সে সব কাফেরদের রক্তঘ্রাণ যারা অবশ্যই আল্লাহর দুশমন ছিল। এই তলোয়ারের চমকে দেখতে পাবেন সেই কেল্লাগুলো, এর ধারের কাছে যা পরাভূত হয়েছিল। ভোতা হয়নি এ তলোয়ার, মরচে ধরেনি। আপনার মাথা নীচু কেন রাজন?

তুমি শোননি এই লোক কি বলে গেল আমাকে? আবদুর রহমান বললেন।

ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে হুংকার মারার জন্য যতটুকু ঝাঁকুনি দেয়া দরকার ততটুকু দিয়ে গেলেন তিনি। তার প্রতিটি শব্দ শুনেছি আমি। প্রেমের দোহাই পাড়ব না, কেননা বহু নারীই ওই জিনিষটায় ভাগ বসিয়েছে। অবশ্য ওই দু অবোধ শিশুর দোহাই পাড়ব যারা আমার কলজে ছেঁড়া ধন। ওদেরকে সেই সবক দিন যা ওর দাদা-পরদাদারা আপনাকে দিয়েছেন। বনি উমাইয়াদেরকে আজকাল সেনাপতি ও ইসলামী বিজেতা হন্তা নামে খেতাব দেয়া হচ্ছে। আপনি ওই কালো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করবেন না।

মোদাচ্ছেরা তলোয়ারখানা তার ক্রোড় রাখলেন। দুহাতে মাথা রেখে স্বামীর চোখে চোখ রাখলেন তিনি।

কিন্তু তার উদ্দেশ্য কি? আজকাল হলো কি, যে-ই আমার কাছে আসে টেরা কথা জানিয়ে চলে যায়; বললেন আবদুর রহমান।

গোথ একটি প্রকাণ্ড শক্তিরূপ ধারণ করতে যাচ্ছে। ফ্রান্স সম্রাট লুই তাকে মদদ করছেন। আপনার মাদ্রিদে বিদ্রোহের পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।

কে বলছে তোমাকে এ কথা?

তাদের থেকে, যাদের কথা আপনি শুনতে চান না।

তাহলে আমার কাছে এসব কথা এতদিন লুকিয়ে রেখেছে কে?

এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না। দিলে আপনি আমাকে আস্ত রাখবেন না। আপনি বলবেন, মোদাচ্ছেরা! তুমি সামান্য এক বাদী বৈ তো নও! সামান্য এক নারী। রাজপ্রাসাদের আভিজাত্য থেকে নিশ্চয়ই নিজকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে দেবে না। আপনার হৃদয়ে এখন থেকে এই তলোয়ারের প্রেম হওয়া চাই। শুধু এই তলোয়ারের।

আবদুর রহমান হাতে তরবারী ধারণ করলেন। ভালভাবে ওটি পর্যবেক্ষণ করলেন, মোদাচ্ছিরা একপাশে খামোশ হয়ে দণ্ডায়মান। তার চেহারার রঙে দ্রুত পরিবর্তন আসছে। তিনি আচমকা উঠে দাঁড়ান এবং দারোয়ানকে ডেকে পাঠান বলেন, প্রধান সেনাপতিকে তার অধীনস্থ সালারদের নিয়ে আমার সাথে জলদি দেখা করতে বল। মোদাচ্ছেরাকে বললেন, তুমি এখন যাও।

সালারগণ এসে সম্মেলন কক্ষে জমায়েত হলেন। আবদুর রহমান ফুঁসছেন সিংহ শাবকের ন্যায়। কালকের আবদুর রহমান আর আজকের আবদুর রহমানের মধ্যে বিরাট ফারাক। তিনি সিংহাসনের সামনে এভাবে পায়চারী করছিলেন যেন কোন বিশ্ববিজেতা পায়চারী করছেন। সিংহ যেমন শিকারের দিকে তাকায়, সালারদের প্রতি সেভাবে তাকালেন বনি উমাইয়ার এই সিংহশাবক। সালারদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। হুংকার মারেন তিনি,

সেনাপতি উবাইদুল্লাহ! ফ্রান্স সীমান্তের অবস্থা আমাকে বলুন! আর বলুন ফ্রান্সে হামলা করলে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হওয়া লাগবে।

সিদ্ধান্ত নিলে কোনই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না। অবস্থাদি পর্যালোচনা করলে ফল এই দাঁড়ায় যে, আমাদের সামান্য মহড়া করতে হবে। বলে সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ফ্রান্সের অবস্থাদি তুলে ধরেন। আবদুর রহমান ও অন্যান্য সালাররা অনেক কিছু অবগত হতে পারলেন। এরপরে আবদুর রহমান এমন ফরমান জারী করলেন যাতে সকলেই চমকে ওঠেন। আবদুর রহমান বললেন, আমরা ফ্রান্সে হামলা করব। ফেত্নার উৎস গিরির মুখ আমি মূলোৎপাটন করবোই।

সালারদের বিস্ময় মুচকি হাসিতে রূপ নেয়। কেননা তারাও তো সিংহের বাচ্চা এক একটা। এই ফরমান শোনার অপেক্ষায় ছিলেন তারা অধীর আগ্রহে। আব্দুর রহমান তাদের যুদ্ধের বিভিন্ন দিকের পরামর্শ দিয়ে কথা শুরু করেন। বলেন?

যে বাহিনী ফ্রান্সে হামলা করবে, তাদেরই একদল মূসা ইবনে মূসার নেতৃত্বে গোখমুর্চের দিকে কোচ করবে। আরেক দল সালার আবদুর রউফের নেতৃত্বে ফ্রান্স সীমান্তের দিকে রওয়ানা হবে। আবদুর রউফ বিক্ষিপ্ত হামলা করবে যাতে ওরা বুঝতে পারে আমাদের হামলা সীমান্তেই সীমাবদ্ধ। আমি নিজেই আপনাদের সাথে যাব আমার সাথে উবাইদুল্লাহ, আব্দুল করিম আর করনের কাহিনী থাকবে। আমি ঝড়োগতিতে ফ্রান্সে হামলা করব, পরে গোটা স্পেন বাহিনী আমার সঙ্গ দেবে। এই অভিযান থেকে ফারেগ হয়ে আমি অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের বিষদাঁত ভাঙব। সর্বাগ্রে বিদ্রোহীদের উৎসগিরি চুরমার করা দরকার, এটাকে আমি ইসলামের চূড়ান্ত লড়াই মনে করি।

সালারগণ এই প্ল্যানকে খুব পছন্দ করলেন। কেউ কেউ সামান্য পরামর্শ দিলেন। সকলের ঐকমত্যে অবস্থাটা এমন দাঁড়াল যাতে বোঝা গেল, ফ্রান্স অচিরেই ইসলামী সাম্রাজ্যভুক্ত হতে যাচ্ছে।

***

আবদুর রহমানের প্ল্যান মোতাবেক সেনাবাহিনী রওয়ানা হলো। গন্তব্য পৌঁছুতে কম করে হলেও বিশ দিন দরকার। সালার মূসা ইবনে মূসা ও আবদুর রউফ আগে ভাগেই মূল বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে যান। দিনদুয়েক পর আবদুর রহমানও তাঁর বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করেন।

এই বাহিনী যখন কর্ডোভা ছাড়ছিল তখন দ্রুতগামী একটি ঘোড়া দূরপাল্লার উদ্দেশ্যে লাগাম কষল। এই ঘোড়ার গন্তব্য মাদ্রিদ। সুলতানা ও হেরেমের রমণীগণ উঁচু মহলে দাঁড়িয়ে এদের চলে যাবার দৃশ্য দেখছিল। শহরের হাজারো নারী-পুরুষ খোদমস্ত সৈনিকদের দিচ্ছিল প্রাণঢালা আল-বিদা।

এদিকে সুলতানা যিরাবকে তখন বলছে, লোকটা সময়মত কি পৌঁছুতে পারবে?

তাতো বটেই। যিরাব বলল।

আবদুর রহমানকে এই যুদ্ধে মোদাচ্ছোই উদ্বুদ্ধ করেছে। আবদুর রহমান এখনো তার প্রভাবে প্রভাবিত। আমি ওকে বাঁচতে দেব না।

বুঝে শুনেই পদক্ষেপ নাও সুলতানা আবদুর রহমান আমাদের প্রতি সন্দিহান হন৷ এমন কোন কাজ করতে যেও না। তুমি এখনো আবিষ্কার করতে পারনি আবদুর রহমান চিজখানি কি! চিন্তা করো না। অর্ধেক পথ থেকে তাঁকে ফিরে আসতে হবে।

ঘোড় সওয়ার মদ্রিদের উদ্দেশ্যে ছুটছে। যিরাব তাকে রওয়ানা করিয়েছে। মাদ্রিদে আঃ জব্বার তখন একটি একক শক্তিতে রূপ নিয়েছে। হাজারো ঈসায়ী তার দলে ভিড়েছে। নও মুসলিমের সংখ্যাও কম না।

রাতের বেলা ঘোড়সওয়ার পৌঁছে গেল। সে বিদ্রোহীদের জানাল আবদুর রহমান ফ্রান্সে হামলা করতে রওয়ানা হয়ে গেছে। আবদুর রহমানের অগ্রাভিযান খুবই গোপনীয় ছিল। কিন্তু যেখানে চাটুকার থাকে সেখানে তারা আস্তিনের সাপের ভূমিকা পালন করে।

পনেরো দিনের ব্যবধান সালার মূসা ইবনে মূসা ও আবদুর রউফ পরিকল্পিত ময়দানে গিয়ে ছাউনি ফেলেন। ওদিকে আবদুর রহমান তখনও ফ্রান্স থেকে দূরে। এ সময় মাদ্রিদের জনৈক কমান্ডার তার কাছে এসে খবর দেন, আঃ জব্বার মাদ্রিদে হামলা। করে বসেছে এবং সে এখানকার গভর্নরকে গ্রেপ্তার করেছে। খ্রীস্টানরা লুটপাট শুরু করে দিয়েছে। এখানে ওখানে আঃ জব্বারের শাসন চলছে।

আবদুর রহমান ফ্রান্স অভিযান মুলতবি করতে বাধ্য হলেন। দ্রুত এক ঘোড়ায় জনৈক দূত মারফত আঃ রউফের কাছে পাঠিয়ে বললেন, মাদ্রিদে পৌঁছুতে এবং এ শহর অবরোধ করার নির্দেশ দেন। তিনি নিজ বাহিনীসহ ফ্রান্সের দিন ধাবমান বাহিনীর গতি মাদ্রিদ্রের দিকে ঘোরান। সিংহশাবকদের দংশন শুরু করে স্পেনের কালনাগিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *