১.৪ হুংকার

হুংকার

দিগন্ত প্রসারী অলোর বন্যা নিয়ে সূর্য উঠছে।

হাজেব আবদুর করীম ও সালার আঃ রউফ আবদুর রহমানের মহলে এসে পৌঁছলেন। তাঁদের সাথে মুসলিম-খ্রিষ্টান জানবাষদের লাশ। এমন কি হযরত ঈসার ছবি, কাষ্ঠলক ও প্লেটও, যা আলোতে চমকাত। সাথে ওই দুজীবিত খিস্টানও। তাদের আগমন বার্তা স্পেনরাজ আবদুর রহমান জানতে পারেন। তিনি এই মাত্র ঘুম থেকে জেগেছেন। পাশে সুলতানা। আবদুর রহমান তাকে পাশে থাকতে বললেন।

তারা উভয়ে হলঘরে বসলেন। আবদুর রহমান হেরেম থেকে বেরোলে, সুলতানা তার খাস খাদেমের মাধ্যমে যিরাবকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তাকে যে অবস্থায় পাও বলো, উজিরে আলা ও সালার এসেছেন। আবদুর রহমান হল ঘরে ঢুকলে তার সাথে সুলতানা থাকলেন। তিনি তখনও নাইট গাউন পরিহিতা। কাঁধ ও বাহুতে রেশমী কোমল চুল চকচক করছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তার যৌবনের কাঁচা অঙ্গ। কোন প্রকার প্রসাধনী নেই এ মুহূর্তে তার দেহে। দর্শককে যেন বলছে, দেখো! আমাকে প্রকৃতি নিজ হাতে গড়িয়েছেন।

স্পেনের উজিরে আলা ও সালার তার দিকে এক ন্যর দিয়ে পরস্পরে মুখ চাওয়া চাওয়ি করেন। সুলতানাকে দেখে তারা কেমন যেন চমকে ওঠেন। চোখে চোখ রেখে তারা বললেন, আমাদের খুবই সজাগ হয়ে কথা বলতে হবে। কারণ কথার যাদুতে যে আবদুর রহমান মারা পড়েছে তাকে নতুন কথার যাদুতে জাগিয়ে তুলতে হবে। তার ভেতরকার পৌরুষকে জাগাতে হবে, যাতে মর্দে মুমিন হুংকার মারতে পারেন। নারীদেহের এই অশ্রুতপূর্ব হাস্য-লাস্যে কোন পুরুষের পক্ষে জীবিত থাকা সম্ভব নয়। আবদুর রহমান মৃত লাশে পরিণত। তাকে জাগিয়ে ভোলা এই মুহূর্তের প্রধান কাজ। উজিরে আলা কথা শুরু করলেন,

আমরা আপনাকে তিরস্কার করব না। কিন্তু স্পেনে খ্রিস্টানরা এমন কিছু শুরু করেছে যাতে আমাদের ঘুম হারাম হবার উপক্রম। ওদের ভেল্কিবাজি ইসলামের উপর প্রভাব ফেলছে। ওরা স্রেফ খ্রিস্টানদের নয় মুসলমানদেরও বিদ্রোহী করে তুলছে।

ভীতিকর কোন ঘটনা ঘটেছি কি? আবদুর রহমান হাই তুলে বললেন, নাকি কোন সংবাদদাতার সংবাদ আমাকে শোনাতে এসেছেন?

আমীরে স্পেন! গতরাতে একটি ঘটনা ঘটে গেছে ইতিপূর্বেও যা ঘটে আসছিল। গত রাতে আমরা ওই ঘটনার যবনিকাপাত ঘটিয়েছি। বাইরে কিছু লাশ পড়ে আছে। তন্মধ্যে কিছু আমাদের করে বাদ বাকী খ্রিস্টানদের। ওদের জীবিত দুজনকে আমরা ধরে এনেছি। সিংহশাবক

লাশ! আবদুর রহমান চমকে ওঠেন, ব্যাপারটি কি এতই গুরুতর যে, রক্তারক্তি করতে হলো?

এ প্রশ্নের জবাবে সালার ও উজির পুরো কাহিনী শুনিয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে যিরাব এসে হাজির। তিনি বড় এক নিমেষে রাতের ঘটনা বলে যাচ্ছিলেন। আবদুর রহমানের ঘুমের ঘোর কাটেনি তখনও। সালার আবদুর রউফ বললেন,

আমরা আপনার হুকুমের অপেক্ষায় মাননীয় আমীর। এ দুকয়েদীর খেকে শোনা যেতে পারে, কে এর নাটের গুরু! অচিরেই ওদের কারারুদ্ধ কিংবা জল্লাদের কাছে হাওয়ালা করা দরকার। তাদের বন্দী করা দরকার যারা এ কাজের হোতা। ওদের মেজাজ-মর্জি পরীক্ষা করা প্রয়োজন, যা এই ফেত্নর জন্মদাতা।

গোস্তাকি মাফ করবেন স্পেনরাজ! আবদুর রহমানের স্থলে যিরাব বললেন, শ্রদ্ধাভাজন উজির ও মান্যবর সালার যে কাজ করেছেন তা পরধর্মসহিষ্ণুতার বিরোধী। স্বাধীন ধর্মকর্মের প্রতি নগ্ন হস্তক্ষেপের শামিল। ভেল্কিবাজি ধর্মের নামে কেউ করলে করুক- আমাদের ধর্মে এর কোন ঠাঁই নেই। ওদেরকে এ ধরনের ভিত্তিহীন কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া উচিত, যাতে জনতা বুঝতে পারে ইসলাম ও খ্রিস্টবাদের ফারাক। অচিরেই তারা জানতে পারবে ইসলাম কোন ভেল্কিবাজির ধর্ম নয়।

যিরাব! উজির গর্জে ওঠেন, আমরা আমীরে স্পেনের সাথে কথা বলছি তোমার সাথে নয়। হুকুম তার থেকে চাই-তোমার থেকে নয়। নয় মহলের সামান্য এক গায়ক থেকে। আমীরে মুহতারাম। এই ভেল্কিবাজি ইসলামের বিরুদ্ধে হচ্ছিল।

আমীরে স্পেন আবদুর রহমানের ভেতরটা সজাগ হয়ে উঠল। তিনি কোন আনাড়ি শাসক নন। জ্ঞানী ও কর্মঠ মর্দে মুজাহিদ। তার জ্ঞান গরিমার কথা ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে। নারী ও সংগীতইও তাকে খেয়েছে। এর ওপর ঘুমের প্রকোপ। আবদুল করীমের গর্জন তার পৌরুষে আঘাত হেনেছে। তিনি যিরাবের দিকে ফিরে তাকান। সুলতানা নিছক এ উদ্দেশ্যেই যিরাবকে ডেকে পাঠিয়েছিল। আবদুর রহমান বললেন,

যিরাব! তুমি চুপ থাক, ওরা ঠিকই বলেছে। হুকুম দেব আমিই।

যিরাবও খুব চৌকস। কুদরত তাকে অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন করেছিলেন। তার সুরে ছিল মাদকতা। কথায় যাদু। ঠোঁটে খেলে গেল মুচকি হাসি। তিনি বললেন, স্পেনরাজ! আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। সেই সাথে ক্ষমা চাচ্ছি মাননীয় উজির ও মান্যবর সালারের কাছে। আমি আপনাদের চেতনা বিরোধী কথা বলিনি। বলতে চেয়েছি স্পেনরাজ আপনাদের কৃতকর্মের জন্য সাধুবাদ দিন। তবে রাজাকে তার প্রজাদের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। আপনারা আজ বাদে কাল ক্ষমতায় এসে এমন চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত দেবেন বলে আমার বিশ্বাস। যদি স্পেনরাজকেও সেনাপতি বানানো হত তাহলে আপনাদের চেয়ে কঠোর হস্তে এই ফেত্নার মূলোৎপাটন করতেন তিনিও।

যিরাব চাতুর্যপূর্ণ যুক্তির বেড়াজালে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তার বক্তব্য ঝেড়ে যাচ্ছিলেন। উপস্থিত শ্রোতাকুলে পিনপতন নিস্তব্ধ। আবদুর রহমান মন্ত্রমুগ্ধের মত গোগ্রাসে গিলছেন এই চাটুকারের বচন। তার ওপর আবার অর্ধনগ্ন সুলতানার রেশমী কোমল কুন্তলরাজি তার দেহে মাদকতার সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে। তার দেহে লাগছে নারী সৌন্দর্যের পিরামিডের উত্তাপ। ওর দিকে তাকালে স্পেনরাজের শ্বাস আর ওর শ্বাস একাকার হয়ে যেত। আরদুর রহমান বললেন, তোমরা যা করেছ-বেশ করেছে। ব্যাপারটা এখানেই চুকিয়ে ফেল।

এ সময় সুলতানা বললো, ওই দুকয়েদীকে যেন মুক্তি দেয়া হয়, যাতে অমুসলিম সংখ্যালঘুরা যেন একথা বলতে না পারে যে, ইসলাম একটি প্রজাপীড়ক ধর্ম।

হ্যা! ওদের ছেড়ে দিতে হবে, আবদুর রহমান বললেন।

 হাজেব আবদুল করীম গোস্বায় উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়ালেন আবদুর রউফও।

আমীরে স্পেন? উজিরে আলা দরবারী রীতি উপেক্ষা করে বলতে লাগলেন, আপনি আরাম করুন। আমরা স্পেনে থাকি। আমরাই ইসলামকে জিন্দা রাখি। ইসলামের দেখুভাল ওইসব শহীদানই করে যাবে যারা বুকের তাজা খুন নজরানা দিয়ে আপনার দরজায় পড়ে আছে। যাদের আপনি এক নযর দেখারও প্রয়োজনবোধ করেননি।

আপনাকে দেখতে হবে না আমীরে মোহতরাম! খোদাতাআলাই ওদের দেখবেন। সালার আবদুর রউফ বললেন।

আপনারা শান্ত হয়ে বসুন! গোবেচারাস্বরে বললেন, আবদুর রহমান, আমি শুনে চলেছি। আমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে।

স্পেন আপনার জায়গীর হলে আপনার অনুমতি ব্যতিরেকে আমরা শ্বাস ছাড়তাম না। এদেশ খোদাপ্রদত্ত। এদেশে ইসলাম কাউকে ভয় পেয়ে টিকবে না। কারো পরোয়া করবে না সে। ইসলাম ও ইসলামী সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে আমরা একপায়ে খাড়া। জীবনের শেষ ফোঁটা রক্ত দিয়ে হলেও এ মহতী কাজে আমরা পিছপা হব না।

আফসোস! আমার কারণে……………যিরাব বলতে লাগলো।

হাজেব তার কথার মাঝে বললেন, তোমার কথার কোন মূল্যায়ন নেই আমাদের কাছে মিঃ যিরাব। রাষ্ট্রীয় কাজে-কর্মে তোমার মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। তোমাকে আর এই নারীকে রুমবন্দী থাকা চাই। খেলাফতের কোন পরামর্শে তোমারা নাক গলাবার কে?

আমরা যা বুঝেছি করেছি। আবদুর রউফ বললেন, আমরা চলে যাচ্ছি। আমরা যদি কোন অন্যায় করে থাকি তাহলে আমাদের শাস্তি দাও।

উভয়েই আবদুর রহমান থেকে অনুমতি না নিয়েই চলে যেতে উদ্যত হলেন। আবদুর রহমান বললেন, দাঁড়াও! আমি শহীদানকে শ্রদ্ধা করি।

তারা থেমে গেলেন। তিনি তাঁদের দিকে এগিয়ে গেলেন। চলনে তার সিংহের ক্ষিপ্রতা। সুলতানা ও যিরাবও ভড়কে যায় ওই চলনে। তাঁর যাবতীয় ক্লান্তি ও প্রভাব যেন উবে গেছে। তিনি বললেন, আমি এইমাত্র বিছানা থেকে গাত্ৰোস্থান করেছি। আলোচ্য ঘটনা আমি এতটা ভেবে দেখিনি।

জাগো আমীরে স্পেন জাগো, দুশমন জাগছে। তুমি ঘুমিয়ে থেকোনা, তাহলে গোটা স্পেনই মরণ ঘুমে ঢলে পড়বে।

তারা আমীরে স্পেনের বিবেকের রুদ্ধদ্বারে টাকা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

***

শার্সির কপাট ফাঁক করে আবদূল রহমান বাইরে তাকালেন। হাজেব আবদুর করীম ও সালার আবদুর রউফ শহীদানের লাশ ওঠাচ্ছেন।

ঈসায়ীদের লাশ ও জীবিত দুকয়েদী কি এখানে থাকবে? দারোয়ান জিজ্ঞেস করল।

 আমীরে স্পেন যে হুকুম দেন তাই করো। আমরা স্রেফ শহীদানের লাশ নিয়ে যাচ্ছি।

আবদুর রহমান শহীদানের লাশ নিয়ে যেতে দেখলেন। প্রতিটি লাশ কাষ্ঠখণ্ডে শায়িত। চারজন করে সেপাই এদের বাহক। শহীদদের এ শব মিছিল মৌনতায় ভরপুর। উজির ও সালার সর্বপেছনে। এঁদের সম্মানে কোষমুক্ত তলোয়ার উঁচানো তাঁদের হাতে। ঘোড়া থাকতেও পদাতিক তারা। সামনে ডানে-বামে তলোয়ার উঁচিয়ে রাখা সেপাই। তাদের চাল-চলন ও গমন শোকের। ওরা তীব্রগতিতে চলছে। কেঁপে উঠছে যমীন। লাশবাহকদের চলায় গাম্ভীর্য বিদ্যমান। মামুলি চলছে তারা, যেন কাঁধে কিছু নেই।

আবদুর রহমান শার্সির ফাঁক দিয়ে এ দৃশ্য দেখে চলেছেন। তাঁর দৃষ্টির সীমায় শহীদী কাফেলার মৌন মিছিল। তার জোশ-জ্যবায় জোয়ার এল। টগবগ করে উঠল শিরার খুন। শাসির ফাঁক বন্ধু করে পেছনে ফিরলেন তিনি। তার দেহে নেই এক্ষণে সংগীত কিংবা সুলতানার আকর্ষণ। যিরা তাঁর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন আনয়ন করেন। তিনি তাকে লক্ষ্য করে বলেন,

ওরা যা করেছে ঠিক করা বোধ হয় ঠিক হয়নি। আমিও আমার ভুল স্বীকার করছি। আপনি তাদের গোস্তাকি আশা করি সহজে নেবেন না।

কেন সহজে নেব না? আবদুর রহমান প্রশ্ন করেন, বিশ্বস্ততার সাথে তারা স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছে। ওদের দরবারী রেওয়াজের বিরুদ্ধাচরণ হজম করেই ওদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখব। আর যিরাব! সুলতানা! তোমরা আগামীতে আমার উজির ও সালারের সামনে ওভাবে কথা বলবে না। এটা নিছক রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। এতে কোন কথা কিংবা সিদ্ধান্তের যিম্মা ওদের-তোমাদের নয়। রাজনীতি যারা বোঝে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে কথা বলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কেবল তারাই।

যিরাবের আপাদমস্তক ঝটকা মেরে ওঠল। সুলতানা তা দেখে মাথা নীচু করলো। আমীরে স্পেন তাকিয়ে বললেন, সুলতানা! আমার গোসলের ব্যবস্থা করে। এরপর ওই দুই খ্রিষ্টানকে আমার সামনে হাজির করো। চীফ জাস্টিসই ওদের বিচার করবেন। কিন্তু এর আগে জানতে চাই, ওদের উদ্দেশ্য কি!

সুলতানা কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো। আবদুর রহমান গেলেন বেডরুমে। যিরাবও বেরিয়ে গেল। যাবার সময় সে সেপাইদের বলল, দুকয়েদীকে আমার কাছে সোপর্দ কর। সে ওদের নিয়ে আরেকদিকে চলে গেল এবং তাদের সাথে জরুরী আলাপে মশগুল হল।

***

গোসল সেরে আবদুর রহমান শাহী হলরুমে প্রবেশ করেন। তার সামনে খ্রিস্টান দুকয়েদী। যিরাবও আছে ওদের সাথে।

তোমরা সত্য উচ্চারণ না করলে এমন ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হবে-যার কল্পনাও করতে পার না। আবদুর রহমান বললেন, কে এই ভেল্কিবাজির উদগাতা? আমি এই পরিকল্পনার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। তবে সে শাস্তির কবল থেকে রক্ষা পাবে না। সত্য উচ্চারণ করলে তোমরা জানে বেঁচে যেতে পার।

কি অপরাধ আমাদের? দুজনের একজন ফরিয়াদী সুরে বলল, আমরা আপনার প্রজা। উজির ও সালারের মোকাবেলায় আমাদের কথাকে আপনি বিশ্বাস করবেন না-যদিও আমরা সত্যবাক। বাস্তবতা আরেক রকম। আপনার লোকেরা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ানো গির্জায় আগুন লাগিয়েছেন, যা হযরত ঈসা (স)-এর যুগে নির্মিত। একে আপনি বাংকার বললেও সেটা আমাদের কাছে এমন পবিত্র যেমন আপনাদের কাবা শরীফ। রাতে আমরা ওখানে এবাদত করতে যাই। আমরা যখন ইবাদতে লিপ্ত তখন আপনার সেপাই আমাদের ওপর অকস্মাৎ হামলা চালায়। আমাদের সকল লোককে হত্যা করা হয় কেবল আমরা বন্দী হই। যেহেতু এক্ষণে আপনার কয়েদী আমরা, এজন্যই আমাদের অপরাধী বলতে পারেন।

ইসলামের শিক্ষা কি এই যে, সংখ্যালঘুর ইবাদতগাহে হামলা চালানো হবে? অপর কয়েদী প্রশ্ন করল, এই ঈসা মসীহর ছবি ওখানে পড়ে আছে। আপনার সেপাইরা এটা উঠিয়ে এনে এখানে আছড়ে ফেলেছে। আমাদেরকে এভাবে প্রভাবিত করে মুসলমান বানাবেন-এই খেয়াল করে থাকলে তা বাস্তবায়িত হবে না কোন দিনও।

ইয়াহইয়া। আবদুর রহমান দরবারী জনৈক চাটুকার আলেমকে লক্ষ্য করে বললেন, আমার সালার ও উজিরের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারী করব? ওরা মিথ্যা বলছে বলে মনে করব?

ইয়াহইয়া এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন এমতাবস্থায় এক কয়েদী বলে উঠল, উজির ও সালার তো কোন ফেরেশতার নাম নয়। ধর্মীয় উন্মাদনায় তারা আমাদের ওপর জুলুম করেছে। কিন্তু তারা ধারণা করেনি যে, এতে খ্রিস্টান সমাজ তাদের বিরুদ্ধে গেছে। আমরা আপনার বিশ্বস্ত প্রজা। ফ্রান্স সম্রাট লুই আর আল-ফাও খ্রিস্টান-এতদসত্ত্বেও আমরা তাদের বিরোধী, কেননা তারা আপনার দুশমন। দুশমন স্পেনের।

ওদের দুজনকে বাইরে নিয়ে যাও। আবদূল রহমান বললেন, আমাকে ভাববার একটু সময় দাও।

কয়েদীদের বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। যিরাবের ঠোঁটে খেলে গেল আঠাল হাসি। ইয়াহইয়া গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। আবদুর রহমানের গালে হাত। তার ও ইয়াহইয়ার জানা নেই যে, স্পেনরাজ গোসলখানায় গেলে যিরাব বেরিয়ে গিয়েছিল। সাথে নিয়ে ছিল দুকয়েদীকে। যিরাব যেহেতু দরবারী লোক, সেহেতু সেপাই বা কয়েদীদ্বয়কে তার হাতে তুলে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি।

আমি উজির ও সালারের বিরুদ্ধে যাব? না না, তা হয় না। আবদুর রহমান ইয়াহইয়াকে প্রশ্ন করে নিজেই স্বগতোক্তি করেন।

হ্যাঁ। তাই। উজিরের বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক হবে না। বললেন ইয়াহইয়া। যিরাব তার সুরে সুর মিলিয়ে বলল, হ্যাঁ! উজির ও সালারের বিরুদ্ধে যাবার ঝুঁকি নিতে যাবেন না। আবদুল করীম যেমন উজির তেমনি তিনি সালারও। তিনি মারাত্মক একটি ভুল করেছেন, তাই বলে পরিস্থিতি এখনও হাতের বাইরে যায়নি। আমি খ্রিস্টানদের উত্তেজনা প্রশমনে যারপরনাই চেষ্টা করব। আপনি এদের মুক্তি দিন।

আপনি চাইলে তাই করুন। ইয়াহ্ইয়া বললেন, তবে এটা ভুলবেন না যে, বিদ্রোহ ফুঁসে উঠছে। আমি যদুর নিরপেক্ষ সূত্রে জেনেছি এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে, রহস্যপূর্ণ রশ্মির মাধ্যমে পুরানো ওই গির্জায় স্পেনের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের উঙ্কে দেয়া হয়েছে। তবে কে এর হোতা তা জানা যায় নি। আমার পরামর্শ হচ্ছে, ওদের দুজনকে রেহাই দিয়ে খ্রিস্টানদের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখা। গির্জায় আগুন জ্বেলে আপনি বিদ্রোহ নির্বাপিত করতে পারেন না। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন।

কিছুক্ষণ এভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা হোল। ইয়াহইয়া খ্রিস্টানদের পক্ষাবলম্বন না করলেও তাদের মাঝে তার স্বার্থ নিহিত ছিল, তাই কথা কিছুটা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে তাদের পক্ষেই নিলেন। যিরাব ওপরে ওপরে আবদুর রহমানের লোক হলেও প্রকৃতপক্ষে সে খ্রিস্টানদের-ই মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিলেন। এরা দুজন প্রভাব বিস্তার করে দুকয়েদীকে আবদুর রহমানের মুখ দিয়ে মুক্ত করার ঘোষণা বের করাল।

কর্ডোভার গির্জায় এই সময় অনবরত ঘন্টাধ্বনি বেজে উঠল। কখনও জোরে, আবার কখনও আস্তে। এটা গির্জার ঘন্টাধ্বনির সময় নয়। মনে হচ্ছে তাদের ওপর কোন মুসিবত এসেছে।

আবদুর রহমান পেরেশান হয়ে বললেন, ওদের কি হলো? কোন মুসিবত ধরল ওদের?

যিরাব বললেন, প্রাচীন গির্জায় আগুন কি কম মুসিবত? এটা শোকধ্বনি। ওদের শোক-বিলাপ কি করে রুখবো রাজন! আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওদের সান্তনা দেব। ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে ওখানেই শেষ করব।

***

প্রাচীন এই গির্জা ছিল পাহাড়ের ওপর। এর ওপর প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা কর্ডোভার মানুষেরা দেখেছিল। কর্ডোভার গির্জায় গির্জায় তথাকথিত ঈসা মসিহের সেই কল্পিত বাণী চর্চা হতে লাগল যে, তোমরা স্বধর্মে ফিরে এসো।

কর্ডোভার পোপ বিশপরা জনগণকে বলতে লাগল, তোমাদের সেই গির্জায় আজ মুসলমানরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে যেখানে তোমাদের ইশ্বর-পুত্রের আগমন ঘটেছিল। এই গির্জাই তার নিকট প্রিয়পাত্র ছিল। তিনি বলতেন, তোমরা দুশমনদের হাতে পুরাভূত হবে। কোন কোন গির্জায় এ আওয়াজও শ্রুত হলো যে, ঈসা মসিহ নিজেই ওই গির্জায় আগুন লাগিয়ে চলে গেছেন যেখানে তিনি আঁধার রাতে আসতেন।

গির্জার ঘন্টা বেজেই যাচ্ছিল যেন এটা আর বন্ধ হবে না, আবদুর রহমানের প্রাসাদে এর ঢন ঢন্ আওয়াজ গুঞ্জরিত হয়। তিনি সিংহাসনে এলে ওই আওয়াজ আরো জোরালো হয়। তিনি গর্জে উঠে বলেন, ওদেরকে বন্ধ করতে বল। আমিতো সিদ্ধান্ত ওদের পক্ষে দিয়েছি।

স্পেনরাজের হুকুম তামিল করতে দুজন গির্জার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। বাইরে শোনা যায় এদের বিলীয়মান ঘোড়ার খুরধ্বনি। খানিকবাদে ঘন্টাধ্বনি কমে যায়।

গীর্জার ঘন্টা বন্ধ হয়ে গেছে আমীর সাহেব। আবদুর রহমানকে জানাল কেউ।

হা হা! আমার কান আছে। বললেন তিনি।

 কিন্তু আপনি ওই তুফানকে কি করে প্রতিহত করবেন, গির্জাকে কেন্দ্র করে যা ফুঁসে উঠছে? উজির আবদুল করিম বললেন, যিনি পদমর্যাদানুযায়ী তার পাশে। বসেছিলেন, মানুষের মধ্যে ধিকি ধিকি করে জ্বলা আগুন নেভানো কি প্রক্রিয়া আছে আপনার কাছে? আমীরে স্পেন। আমি এইমাত্র শহীদদের দাফন করে এসেছি।

শহীদ! শহীদ!! আবদুর রহমান আনমনে উচ্চারণ করেন। আবদুল করীম অন্য কোন প্রশ্ন থাকলে বল, এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে একটু ভাবতে দাও। বলে তিনি দরবারের সকলকে অবাক করে দিয়ে অন্দরে চলে যান।

সন্ধ্যার দিকে আবদুর রহমানকে রোজকারমত সারাদিনের খবরাখবর শোনানো হচ্ছিল। তার তথ্য উপদেষ্টা ছিলো দুজন। সরাসরি তারা আবদুর রহমানের সাথে দেখা, করতে পারত না। জনৈক দরবারী আমলা এদের থেকে তথ্য নিত এবং কেবল সে সব খবরই আবদুর রহমানের কানে দিত যা শুনতে তিনি পছন্দ করতেন। যিরাব দরবারে ঠাই পাবার পর থেকে দেশের সুখকর খবর- গুলোই (স) তার গোচরে আনতেন আর খারাপ খবরগুলো সযতে এড়িয়ে যেতেন।

জনগণ কেন্দ্রীয় মুসলিম খলিফাঁকে চেনে না, চেনে কেবল স্পেনরাজকে। তথ্য উপদেষ্টা আবদুর রহমানকে বলল,

কোথাও কি বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে না? প্রশ্ন করেন তিনি।

বিদ্রোহ? কি ধরনের বিদ্রোহ? মুসলিম খ্রীস্টান সকলেই হুজুরের নামে সেজদা করে। পাগল মাত্রই বিদ্রোহের কথা ভাবতে পারে। বলল তথ্য উপদেষ্টা।

প্রতি সন্ধ্যায়, তাকে এমন খবর দেয়া হত যাতে খোদার পরেই তাকে আসন দানের প্রয়াস থাকত। তিনি প্রজাদেরকে চাটুকার আমলাদের মত মনে করতেন এবং ওদের কান দ্বারা বাইরের খবর শোনতেন। এরাই স্পেন গভর্নরকে স্পেন সম্রাটে, পরিণত করেছিল।

গোটা স্পেনে যখন বিদ্রোহের ধূম্রগিরি উদগীরণ, হচ্ছিল, যখন ভেল্কিবাজির আগুন খ্রীষ্ট সমাজে মুসলিম বিদ্বেষী চেতনা ছড়াচ্ছিল; ঠিক তখন চাটুকাররা প্রজারা রাজাকে সেজদা করে-এমন খবর পরিবেশন করত। স্পেনের সেই আমীরের সামনে যিনি আলেম, বিজ্ঞ, রাজনীতিজ্ঞ, তর্কবাগিশ, ধীমান এবং যার তলোয়ারের সামনে ফ্রান্স সম্রাট লুই এবং আল-ফাপ্পর মত যুদ্ধংদেহী যার সামনে মাথা নোয়াত। কিন্তু তিনি আঁচ করতে পারলেন না চাটুকাররা কিছু বলছে আর পর্দার আড়ালে অন্য কিছু করছে। তাদের দ্বারা যা কিছু বলা হচ্ছে কিং করানো হচ্ছে-তাই আগামী দিনের ইতিহাস, ইতিহাস ইসলামের।

ইতিহাস যেমন শিক্ষাপ্রদ তেমনি আলোবর্তিকাও। অনাগত ভবিষ্যৎ যেমন এর আলোকে পথভ্রষ্ট হতে পারে ঠিক তেমনি এর দ্বারা মঞ্জিলে-মকসুদেও পৌঁছতে পারে। পথ হারিয়ে ফেলা কিংবা পথপ্রাপ্তির মানদণ্ড হচ্ছে, পূর্বসূরিদের মিথ্যা বলা কিংবা সত্য বলা। যে জাতির ইতিহাসে চাটুকার ও গাদ্দারদের প্রবল দখল তাদের ইতিহাসের পৃষ্ঠা অবশ্যই মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ। মানুষ মানুষকে আত্মপূজারী বানাতে পারে। বানাতে পারে রাজাও, কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা বড় কঠিন ও ভয়াল।

হিন্দুস্তানে মোঘল ও স্পেনে বনি উমাইয়ারা যে ইতিহাস রচনা করেছে তা চাটুকারদেরই হাতে লেখা, যার ওপর আমরা গর্ব করে থাকি। প্রাচ্যের তাজমহল, শাহী মসজিদ আর পাশ্চাত্যের আলহামরা, কর্ডোভা মসজিদ দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই, কিন্তু আমাদের কজনা এই চিন্তা করেন যে, এই স্থাপত্য শিল্পীদের অবক্ষয় এল কেন? কেন ইসলামী সাম্রাজ্য শত খণ্ডে খণ্ডিত হল?

এই কার্যক্রম চাটুকার ও গাদ্দারদের যারা প্রশাসনের বিবেচনার ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল। এরা তারাই যারা এই প্রশাসনের মৃত্যুর পর তাদের কবরের ওপর প্রমোদ ভবন নির্মাণ করেছিল। স্পেন ইতিহাসের এক একটি পৃষ্ঠা ও এক একটা শব্দের ওপর চিন্তা করলে আমাদের স্বতঃই উপলব্ধি হবে যে, শতাব্দীকাল ধরে আমরা সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছি। চাটুকার উপদেষ্টারা আমাদের প্রশাসনকে দেশী-বিদেশী পুরস্কার ও সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে তাদের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডকে ধামাচাপা দিচ্ছে। রাজা-প্রজার সম্পর্ক আজ সাপে-নেউলে পর্যায়ের। আজকের শাসকবর্গ মনে করছে, তারা যাই কিছু করুক না কেন প্রজারা তাদের সম্মুখে করজোড় প্রণাম রত আছে, থাকবে।

***

যে সন্ধ্যায় আবদুর রহমানকে ওই খবর শোনানো হয় সেই খবরের কোথাও খ্রীস্ট প্রজ্বলন ও তাদের বিরূপ জাগরণের নামোল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। এমন কি খোদ আবদুর রহমান প্রশ্ন করেন যে, এ ব্যাপারে কি কোন খবর নেই?

এমন কিছু হয়নি যা বলার মত। কেউ তাকে উত্তর দেয়।

সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওই দিন প্রত্যূষে বলা উজির ও সেনাপতির কথা মনে পড়ে যায়। তারা বলেছিলেন, আপনি আরাম করুন আমরা জিন্দা আছি। ইসলামকে আমরা জিন্দা রাখবই। ইসলামেরাও সম্ভ্রম রক্ষা তাদের দ্বারাই হবে যাদের লাশ আপনার দরজায় পড়ে আছে।

যদি বলার মত গুরুত্বপূর্ণ কথা না-ই হবে তাহলে গির্জায় ঘন্টা বাজলো কেন? প্রশ্ন আবদুর রহমানের, তোমরা ওই শহীদানের নামোল্লেখ করোনি আজ যাদের দাফন করা হয়েছে, জনগণ তাদের জানাযায় শরীক হয়েছে। তাদের মাঝে নানান কথার কানাঘুষা, নানান অভিমত, আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে নিশ্চয়ই।

স্পেনরাজের এ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় কৈ? এ বিষয় নিয়ে তারাই ভেবে দেখবে যারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট। আপনি নিশ্চিত থাকুন। যিরাব বললেন।

যে রাতে তথ্য সন্ত্রাস দ্বারা আবদুর রহমানকে অবোধ শিশুর মত ঘুম পাড়ানো হচ্ছিল সে রাতে কর্ডোভা থেকে ৫০/৬০ মাইল দূরে জনৈক দুঘোড়া চালক এলোগেইছকে বোঝাচ্ছিল যে, পুরাতন গির্জায় যে ঈসা-নাটক শুরু হয়েছিল, দুর্ভাগ্যজনক হলেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে তা। অবশ্য এর দ্বারা উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে পুরোপুরি। রাতের বেলায় ঘটা করে এ কাহিনী তাকে সবিস্তার শোনানো হয়। বলা হয়, গীর্জায় লাগানো ভেল্কিবাজির কথা। এরা সেই লোক যাদেরকে গীর্জা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং পরে আবদুর রহমান যাদেরকে রেহাই করে দিয়েছিলেন।

তোমাদের মুক্তি দেয়ার অর্থ এই যে, আবদুর রহমানের কাছে ব্যাপারটায় তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। আমলারা এ ব্যাপারে কি প্রতিক্রিয়া জাহির করেছে? প্রশ্ন করে এলোগেইছ, আপনি যথার্থই অনুমান করেছেন। স্পেনরাজের সম্মুখ হাজির করার পূর্বে যিরাব আমাদেরকে বাইরে এনে বলে দিয়েছিল, কি বলতে হবে আবদুর রহমানের সামনে। যিরাব ও সুলতানা স্পেনরাজের দিমাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। আমরা মজলুমের অভিনয়ে বলেছিলাম, আপনার আমলারা সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে আমাদের গীর্জায় আগুন দিয়েছিল। বলল জনৈক ঈসায়ী।

স্পেনরাজের হরমের দুজন খ্রীস্টান নারী বলেছে, আবদুর রহমানের দিমাগ পরিষ্কার করা হয়েছে। তিনি তাই এ ঘটনাকে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছেন না, অপর ঈসায়ী বলল।

গীর্জায় এক্ষণে খ্রীস্টানরা আবারো জমায়েত হচ্ছে। তাদের প্রতিশোধস্পৃহা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। প্রথম খ্রীস্টান বলল।

আমি মুসলমানদের মধ্যে এর বেশ প্রতিক্রিয়া দেখেছি। সিংহভাগ মুসলমানের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, হযরত ঈসা (আ)-এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, আর এই আগুন তাদের বদ দোয়ার কারণে লেগেছে। দ্বিতীয়জন বলল।

এই আগুন আমরা নিভতে দেব না। বলল- এলোগেইছ এদের পুরোকথা শোনার পর, তোমরা কর্ডোভায় ফিরে যাও, আমি মাদ্রিদ যাচ্ছি।

এলোগেইছ যে পাদ্রীর আশ্রয়ে ছিল সে জিজ্ঞেস করল, মাদ্রিদ গিয়ে তুমি কি করবে- কর্ডোভায় কেন যাবে না? বিদ্রোহাগ্নি জ্বলছে-একে এগিয়ে নেয়া দরকার নয় কি?

আমার দৃষ্টি এ মুহূর্তে গোটা স্পেনকে নিয়ে দেখতে চায়। এলোগেই বলল, এ মুহূর্তে মাদ্রিদে একপশলা স্ফুলিঙ্গ জ্বালানো দরকার। এতদুদ্দেশে আমার জনৈক সহপাঠী ওখানে আগেই চলে গেছে। ওখানে এমন এক মুসলিম শাসক রয়েছে যাকে আমরা বিদ্রোহী ভরে তুলতে পারি। আমার প্ল্যান হচ্ছে, বিদ্রোহের দায়ভার নিজেদের কাঁধে না নিয়ে কোন মুসলমানে ওপর দায়ভার চাপানো।

তুমি এমন কোনো মুসলমানকে দলে পাওয়ার আশাবাদী, যে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধুম্র গিরি উদগীরণ করবে? পাদ্রী জিজ্ঞেস করল, দেখো, কোনো মুসলমান তোমার সহপাঠীর সাথে হাত মিলিয়ে না আবার তোমায় শ্রীঘরে পাঠায়। তোমার অনুপস্থিতিতে ওই বিদ্রোহাগ্নি তো সহসাই নিভে যাবে।

এলোগেইছকে খোদাতাআলা এমন কিছু গুণ দান করেছিলেন যা অন্যের বেলায় করেননি। সে কোরআন গবেষণার এতই গভীর পৌঁছেছিল যে, মুসলিম মনীষীরা যে গভীরে পৌঁছুতে পারেননি। কোরআন গবেষণার দরুন সে স্বধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নামকাওয়াস্তের খ্রীষ্টানে পর্যবসিত হলেও প্যাম্পোলনার প্রাচীন গির্জায় গভীর রাতে জনৈক পাদ্রীর লিখিত একখানা পুস্তক আবিষ্কার করল। ওই বইতে ইসলাম ও এর নবীর বিরুদ্ধে কুত্সায় ভরা। মনগড়া কথকতায় ঠাসা। ইসলামের প্রতি কোরআন গবেষণার দ্বারা যে প্রভাব তার মনে দাগ কেটেছিল ওই পাণ্ডুলিপি পড়ে তার খ্রীস্টত্ব পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তার ইসলাম মিত্ৰতা সে সময় বৈরিতায় পর্যবসিত হলো। মুহূর্তেই মুসলমানদের ঘোরর দুশমনে পরিণত হল।

সর্বাগ্রে তাই সে জনৈক ঈসায়ী আলেম সেন্ট জুলিয়াসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল। পরে সে কেবল খ্রীস্টীয় আলেমই নয় বরং মানুষের দুর্বল পয়েন্টগুলো জেনে যথোপযুক্ত আঘাত করার বুৎপত্তি অর্জন করল। যিরাবের মত চৌকস লোককেও সে নাচের পুতুলে পরিণত করেছিল। কর্ডোভার ঈসা মসীহের তথাকথিত আত্মপ্রকাশ তারই তীক্ষ্ণমেধার ফসল। পরিস্থিতি যেমনই হোক একে অনুকূলে নিয়ে আসার যোগ্যতাটুকু ছিল তার পুরোপুরিই।

বিছানো কুটিল ফাঁদের রিপোর্টগুলো এবার সে নিতে শুরু করল একে একে। পাদ্রী তাকে বলেছিল, কোনো মুসলমানের ওপর আস্থা না আনতে। কেননা এ জাতি খুবই ধূর্ত। শেয়াল যাদের কাছে হার মানে।

নারী ও ধন-দৌলত এমন এক সম্মোহনী শক্তি যা স্বীয় ইবাদতগাহে পর্যন্ত আগুন লাগাতে পারে। এলোগেইছ বলল, আমি যতটা ইঞ্জিলের আলেম ততটা কোরআনেরও। ও দুধর্মগ্রন্থে খোদাতায়ালা ধনের মোহ থেকে দূরে থাকতে এবং কোনো নারীকে ভাল লাগলে তাকে বিয়ে করে নিতে বলেছেন। অবৈধভাবে কোনো নারীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সাজা মৃত্যু। ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে কোরআন পাথরাঘাতে শেষ করতে বলেছে। ইঞ্জিলের বিধানও এমন………কিন্তু কেন? কেন এত কঠোর? কেননা একজন সুন্দরী নারী দেশ-জাতির এতটা ক্ষতিসাধন করতে পারে-যা। পারে না একটি দেশের সব সৈন্য মিলেও।

নারী এক ধরনের মদ। এক ধরনের নেশা। এক প্রকারের যাদু আছে যা বড় বড় যুদ্ধংদেহীকে পর্যন্ত কুপোকাত করেছে। দিগ্বিজয়ী বীরবিক্রমকে সে নাচের পুতুল বানিয়েছে। এর চেয়ে মারাত্মক নেশা হচ্ছে মনি মান্নিক্যের ও রাজ সিংহাসনের। কোনো মানুষকে গদীর লোভ দেখালে দেখবে সে তার ঔরসের মেয়েকে নিলাম করে দেবে। মিথ্যা কথা বলবে। নিজ খোদা ও ধর্মকে পর্যন্ত মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে দ্বিধাবোধ করবে না। একদিকে সে যেমন খানার মুখ খুলবে তেমনি খুলবে কয়েদখানার মুখও। কাউকে অন্ন-অস্ত্রে দুহাত ভরে দেবে আবার কাউকে শ্রীঘরে পাঠিয়ে রাজার্সন পোক্ত করবে।

এরপরও আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমাকে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে, পাদ্রী বলল, অনেক ক্ষেত্রে পরিপক্ক কানুন ও দর্শন বিফল হয়ে থাকে।

আবদুর রহমানের মত চৌকস ও পাক্কা মুমিন যদি নারীর বাহুতে আটকে যেতে পারে তাহলে আমার মনে হয় দুনিয়াতে এমন কোনো মুসলমান নেই-নারীর মোহ থেকে যে বাঁচতে সক্ষম। যবান থেকে এক্ষণে আমার পরিকল্পনা ফাঁস করব না-এটা এক ধরনের গোনাহ। আমার মিশন খ্রীষ্টবাদ ও স্পেনকে মুসলিম মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। ধর্ম ও জাতির জন্য তাই মিথ্যা বলতেও রাজি আমি। এতে সওয়াবেরও আশা করি। আমি হুকুমত চাই না, চাই না আত্ম প্রসিদ্ধি। আমি নিজেকেই নিজে হাতে হত্যা করেছি। মুসলিম ঘরনা ও শাসকবর্গকে জিন্দা রাখার কোশেশ করছি। বাহ্যত তাদের মধ্যে একতা দেখাব, কিন্তু পরস্পরকে পরস্পরের দুশমন বানাব। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে এর বিকল্প নেই।

মাদ্রিদে আবদুল জব্বার নামী শাসককে এতদিন নেককার মুমিন বলে জেনেছি। বর্তমান শুনেছি সে নাকি গদিলাভের স্বপ্ন দেখছে। আমি তাকে হাতের মুঠোয় আনতে চাই। আমাদের কিছুলোক তার পিছু নিয়েছে। তাকে আমার চাই। শুধুই আমার। শেষের দিকের কথাগুলো বলতে গিয়ে এলোগেইছের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল।

***

মুহাম্মদ ইবনে আবদুর জব্বার স্পেন। আমীর দ্বিতীয় আবদুর রহমান ইবনে হাকামের যুগে স্পেনের বিখ্যাত রাজনীতিজ্ঞে পরিণত হয়েছিলেন। তবে সুখ্যাতি নয় তার নামে ছড়িয়েছিল কুখ্যাতি। আবদুর রহমানের বাবা আল-হাকামের যুগে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এই পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, জনগণের ওপর থেকে ট্যাক্স উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। এদিকে আবদুর রহমানের যুগে কোষাগার প্রতিনিয়ত তলাহীন ঝুড়িতে পরিণত হতে চলেছিল। কথিত আছে, সীমান্তে যেহেতু প্রায়শই বিদ্রোহ হত সেহেতু সেনা প্রেরণ করতে হত। বারবার ব্যাটালিয়ন প্রেরণের কারণে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বেড়ে যেত। এর চেয়ে বেশী ব্যয় হত মহল সামলাতে। যিরাব ও সুলতানা স্পেনরাজের জন্য খাই খাই হাতিতে পরিণত হয়েছিল। সর্বোপরি চাটুকারদেরও আবদুর রহমান সেলামি দেয়া শুরু করেন। যিরাব ও সুলতানা যাকে যখন যেমন চাইত বখশিস দিত।

এসব ট্যাক্সের অতিরিক্ত বোঝাটা চাপানো হত মাদ্রিদের জনগণের ওপর। মাদ্রিদ ওইযুগে এ যুগের প্রদেশের মত ছিল। ট্যাক্স, কর ও বখরা উসুলের জন্য কর্মী নিযুক্ত ছিল। মাদ্রিদের গভর্নর ছিলেন আবদুর জব্বার, তার প্রায়শই গ্রাম-গঞ্জে সফর করতে হত। তিনি ছিলেন দ্বীনদার গভর্নর এবং কঠোর প্রশাসক। এজন্য লোকেরা তাকে সমীহ করে চলত। তার প্রভাবে প্রভাবিত থাকত।

সরকারী বডিগার্ড ছাড়াও তার আশেপাশে ঠাই দিয়েছিলেন গ্রাম্য লড়াকু মাস্তান ও গুণ্ডাদের। এরা ট্যাক্স আদায় করে আবদুল জব্বারের খুব মদদ করতেন। এরা বখশিসের যোগ্য ছিল, কিন্তু উসুলকৃত ট্যাক্স থেকে সামান্যও দিতেন না তিনি। এই চক্র একটি পন্থা বের করে। সেই পন্থার নাম ডাকাতি। তারা অযথা হয়রানি করে কাফেলার গতিরোধ করে চাঁদাবাজি করত।

এদের ছাড়া আবদুল জব্বার ছিলেন অসহায়। তিনি এই রাহাজানির পথ রুদ্ধ করেন। তিনি বলেন, তোমরা পাইকারী হারে রাহাজানি করো না-একটু আধটু করলে তাতে আপত্তি নেই। মাস্তান গং এই প্রস্তাব লুফে নিল। ওরা দুএকদিন পরপর কাফেলার গতিরোধ করে। একবার তারা একটি কাফেলার গতিরোধ করে একটি তলোয়ার আবদুল জব্বারকে হাদিয়া দিল। পর্যায়ক্রমে এভাবে তারা দুএকটা উপহার গভর্নরকে দিয়ে চলত।

***

লুটের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকল, আবদুর জব্বার ডাকাতদের হাদিয়া কবুল করে যেতে থাকলেন। কিন্তু উসুলকৃত ট্যাক্সের কানাকড়িও তাদের দিতেন না। একবার তিনি শহর থেকে দূরে কোন এলাকায় ট্যাক্স আদায় করতে গেলেন। তাকে দুচারদিন ওখানে থাকার দরকার ছিল। রাতের বেলা ডাকাতদল তার কাছে এলো। সাথে তাদের সুন্দরী দুযুবতী। ডাকাতরা বলল, এ সামান্য তোহফা। এরা কাফেলা থেকে এদের অপহরণ করেছিল।

মুহাম্মদ ইবনে জব্বার এই তোহফা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেন।

আপনি এদের একজনকে না হয় গ্রহণ করুন। ডাকাতদের একজনে বলল, দুজন রাখলে আপত্তি নেই।

ডাকাতির যে মাল আমি এতদিন গ্রহণ করে এসেছি তাও এক ধরনের গোনাহ। কিন্তু এই যুবতীদের গ্রহণ করে কবিরা গোনাহ করতে পারব না। নিয়ে যাও ওদের। আবদুর জব্বারের কণ্ঠে তিরস্কার।

এক যুবতী তার পথে আছড়ে পড়ল, অপরজন ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।

আমাদেরকে আপনার কাছে রাখুন। আছড়ে পড়া যুবতী বলল, আমাদেরকে ওই হিংস পশুদের হাতে সোপর্দ করবেন না।

যুবতীরা দেখল লোকটা খুবই সৎ। খুব সম্ভব তিনি তাদেরকে বাড়ী ফেরৎ পাঠাবেন, প্রথমজন বলল, আপনি আমাদের ফেরৎ না পাঠিয়ে আপনার স্ত্রীত্বে বরণ করুন।

উভয়ে এমনভাবে কাকুতি মিনতি করল যাতে আবদুল জব্বারের মন গলে গেল। তিনি বললেন, আমি এই তোহফা কবুল করলাম। আমি ওদের বাবা-মার কাছে পৌঁছালে তোমাদের কোন আপত্তি থাকবে না তো!

শর্ত হচ্ছে, আমাদের গ্রেফতার করবেন না। ডাকাত সর্দার বলল।

তোমাদের কেউ গ্রেফতার করবে না। তোমরা যাও। এদেরকে আমার কাছে থাকতে দাও। গভর্নর বললেন।

ডাকাতরা চলে গেল। আবদুর জব্বার যুবতীদের বললেন, তোমরা এখন নিরাপদ। রাতে তোমাদের আলাদা কামরায় থাকতে দেয়া হবে। আমার কাজ শেষ হলে তোমাদের বাড়ী পৌঁছে দেব।

তিনি ওদের ওপাশের কামরায় পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, চাইলে দরজায় ছিটকিনি ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে পার। এরা উভয়ে এমন খুবসুরত ছিল যে, নেহাৎ নেককার হওয়া সত্ত্বেও কেমন যেন তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। জীবনে এমন নারী এই প্রথম দেখছেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *