১.২ প্রতিরোধ

প্রতিরোধ

স্পেনভূমি বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের আখড়ায় রূপ নিতে লাগল। এক শাসকের পর আরেক শাসক স্থলাভিষিক্ত হত। খেলাফতের গদীতে একের পর এক খলিফা আসীন হতে থাকল। বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র কমা তো দূরে থাক আরো বাড়তে লাগল। স্পেন শাসক যিনি কেন্দ্রীয় খেলাফতের গভর্নর ছিলেন নিজকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করলেন। আপনার দায়িত্ব সম্পর্কে বিলকুল উদাসীনতার পরিচয় দিলেন। তারা ইসলামের মহান শিক্ষা ভুলে গেলেন। ভুলে গেলেন ঔসব শহীদানের রক্তস্নাত কাহিনী যাদের বুকের তাজা খুনে স্পেনের সীমানা বাড়ছিল। এসব দুর্নীতিবাজ শাসকের মাথায় ক্ষমতায় নেশা চেপে বসে। রাজত্ব ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার ওপর আলোচনার স্থলে এদের প্রাসাদ চাটুকারিতা ও তোষামোদী চর্চা হতে থাকে।

বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের ভিত্তিমূলে ছিল খ্রিস্টান জাতি আর এদের পৃষ্ঠপোষকতা করছিল স্পেনের প্রতিবেশী রাজন্যবর্গ। আমরা ওদের সমালোচনায় কলম ধরতে চাই না। ধরব কি করে-ওরা তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছিল, ইসলাম ও মুসলমানদের ইউরোপ থেকে নিশ্চিহ্ন করেই আমরা দম নেব। ওরা একে ধর্মীয় যুদ্ধ সাব্যস্ত করেছিল।

স্পেনের মুসলিম শাসকদের প্রথম ও একমাত্র লক্ষ্য থাকা উচিত ছিল, ইসলাম ও মুসলমানদের জানমাল রক্ষার্থে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। কিন্তু তারা এর স্থলে নিজেদের গদীরক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল সেদিন পুরোদস্তুর। পরিণতিতে এক শাসক মারা গেলে তার স্থলাভিষিক হিসেবে বেশ কজন দাবীদার দাঁড়িয়ে যেত। গদীতে বসতে পারত। একজন, কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে তার জ্ঞাতী ভাই ভাইয়ের দুশমনে পর্যবসিত হত এবং তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হত। দুশমন ওই সুযোগে সীমান্তে মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ আর সীমান্তে যখন শত্রুর আনাগোনা তখন প্রাসাদে অবস্থানরত চাটুকাররা রিপোর্ট দিত, দেশ পুরা শান্ত। কোথাও কোন কোন্দল নেই। এসব জ্ঞান-পাপীরা স্বজাতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে দিত।

মুসলিম ইতিহাসে চাটুকারিতা তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি, কিন্তু স্পেনে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে প্রতিযুগেই। স্পেন প্রাসাদের চাটুকাররা ছিল খুবই অভিজ্ঞ ও চৌকস। এরা উপদেষ্টা ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিযুক্ত ছিল। ওর যাদুকরি ভাষণে গভর্নরকে কুপোকাত করত। ওদের অন্তরে কোন ন্যায়নিষ্ঠা ছিল না, ছিল না চিন্তায় গভীরতা। জাতির দরদে, ধর্মের দরদে ওদের চিন্তার ললাটে ভাঁজ পড়ত না। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোতে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকাও ছিল না। স্পেনে এমন কর্মকাণ্ড হয়ে আসছিল এবং ওইভাবে হয়ে যাচ্ছিল। ইতিহাস থেকে বিমুখ জাতি আমরা। আমাদের পদস্খলন ও নির্বুদ্ধিতাকে চাটুকারদের জ্ঞানের আলোকে চালিয়ে দেয়ার জাতি আমরা। আগামী বংশধরেরা শাসকবর্গের ওপর বিরাগভাজন হয়-এমন ইতিহাস লিখতে আমরা হীনমন্যতার পরিচয় দিয়ে নেহাৎ জুলুম করেছি। স্পেনের ইতিহাস লিখতে হচ্ছে ল্যাটিন কিংবা অমুসলিম ইউরোপিয়ানদের একপেশে ইতিহাসের ওপর ভর করে। এসব ইতিহাসবেত্তা যেখানে গ্রানাডা ট্রাজেডির কথা লিখতে গিয়ে খ্রিস্টানদের বিরোচিত কাহিনী উল্লেখ করেছে সেখানে অন্ধকার ইউরোপের রন্ধ্রেরন্ধ্রে ইসলামের আলো বিকিরণকারী মুসলিম সিংহপুরুষদের কথাও না এনে পারেনি।

স্পেন থেকে ইসলাম সেদিনই বিদায় নিতে শুরু করেছিল যেদিন কেন্দ্রীয় খলীফার নিযুক্ত গভর্নর নিজকে বাদশাহ খেতাব দেয়া শুরু করল এবং চাটুকার কর্তৃক দেশ চালাতে লাগল। কিন্তু তদানীন্তন মুসলিম ফৌজে এমনও কিছু মর্দে মুজাহিদ ছিলেন যারা শাসনবর্গের বিলাসিতা ও হেরেমে নারী সমাবেশ দেখে বিরাগভাজন হয়ে নিজেরা দেশ ও জাতির জন্য জান কোরবান দিয়েছিলেন। তুলে ধরেছিলেন খোদার দ্বীনকে সবার ওপরে।

দ্বিতীয় আবদুর রহমানের যুগে বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের কুটিল জাল বিস্তার লাভ করছিল। ক্রমশঃ বেড়ে চলছিল এর সিলসিলা। ষড়যন্ত্রের এই বীজ প্রথমদিকের শাসকবর্গের যুগেও ছিল। যেহেতু তারা এর মূলোৎপাটন করেননি, সেহেতু পরবর্তীতে এর শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়।

আবদুর রহমান সবচেয়ে বিষধর যে সাপটিকে তার দরবারে দুধকলা দিয়ে পুষছিলেন যিরাব তম্মধ্যে অন্যতম। অনেক ঐতিহাসিক যিরাবকে বড় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ কয়েছেন। তারা তাকে পাক্কা মুসলমান ও চৌকস বলে মত ব্যক্ত করেছেন। করেছেন। তাকে দেশ প্রেমিক হিসেবে চিহ্নিত।

সে জ্ঞানী ও চৌকস ছিল বটে তবে তার সবখানিই ব্যয়িত হয়েছে চাটুকারিতায়। ইতিহাসবেত্তারা লিখেছেন, লোকটা সজ্ঞানে ও পাণ্ডিত্যে কর্ডোভার দরবার মাত করে দিত। একদিকে যেমন সংগীতজ্ঞ অন্যদিকে তেমন কূটনীতিবিদও। আবদুর রহমান তার খোদাপ্রদত্ত মেধা ও কর্মকুশলতায় এতই হতবাক হন যে, তাকে শেষ পর্যন্ত প্রাইভেট সেক্রেটারী হিসেবে নিয়োগ দেন। এছাড়া বাগিতা ও তর্কে তার জুড়ি ছিল না।

জন্মগত কারিশমা ও অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর তার সংগীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এছাড়া সে বিজ্ঞ ফ্যাশন ডিজাইনার ছিল। সাদা কাপড়ের ওপর নকশা ও ফুল বুননে ওই যুগে সে অদ্বিতীয় হিসেবে আখ্যা পায়। নারীদের এমনও পোশাক সে বানাতে পারত যা তাদেরকে নগ্ন বানানোর নামান্তর। চিত্ত বিনোদনের নামে নিত্য-নতুন প্রোগ্রাম তৈরিতে ওস্তাদ ছিল এই যিরা। যে স্পেনে একদা আরবী তাহযীব-তামাদুন জারী ছিল এই লোক সেখানে সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনল। আরবী কালচার বদলে গেল। যিরাবের রকমারি শৌখিন ফ্যাশন ও আধুনিকতার নিপুণ ছোঁয়াই এর মূলে কাজ করেছিল সেদিন।

আরব থেকে আগত মুসলমানরা বাবরী চুল ও লম্বা দাড়ি রাখতেন। যিরাবের সাংস্কৃতিক বিপ্লব সেই আরবদের বাবরী পাংক-এ এবং পোষাকে ইউরোপিয়ান স্টাইল আনল। তাদের দাড়ি ছোট হতে লাগল। এক সময় শেভ শুরু হলো। দূর আকাশের ওই হাজার সিতারা তার নীরব ভাষায় বলে চলেছে, ক্রুসেডাররা মুসলমানদের স্পেনছাড়া করেনি বরং যিরাবের মত সাংস্কৃতিক কর্মীরাই এ জাতিকে ডুবিয়েছে। স্পেন ট্র্যাজেডি প্রমাণ করেছে, যে জাতিকে তলোয়ার দ্বারা নিশ্চিহ্ন করা যায় না, সাংস্কৃতিক বিপথগামিতাই তাদের নাস্তানাবুদ করতে যথেষ্ট। যিরাবই নারী সুষমাকে পরপুরুষের সামনে সুন্দর আদলে ফুটিয়ে তুলেছিল। খোশবু আতর আবিষ্কার করেছিল।

ধুরন্ধর যিরাবের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মুসলিম মননের পরতে পরতে প্রভাব সৃষ্টি করল। সে প্রবাদ পুরুষ বনে গেল। কুদরত তাকে এমন বিস্ময়কর মেধা দান করেছিলেন যদ্দরুন সে নিত্য নতুন ফ্যাশন উদ্ভব ঘটাতে লাগল। তার প্রকৃতিই এমনটা হয়ে গিয়েছিল।

যিরাবের প্রভাব রান্নাঘর থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। স্পেনরাজ পর্যন্ত তার প্রতি অনুরাগী ছিল। যে সব তদবিরকারগণ বাদশাহর দরবারে প্রবেশানুমতি পেত না তারা যিরাবের শরণাপন্ন হতেই মুশকিলে আসান হত। এর ফলে বাদশাহ-বেগম, উজির-নাজির, শাহযাদা-শাহযাদীদের চোখে সে অল্প দিনেই প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। বিশেষ করে আবদুর রহমানের নিঃসঙ্গ মুহূর্ত তাকে ছাড়া চলেই না।

সুলতানার আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে। আবদুর রহমানের দিবানিশির স্বপ্ন ওই কালনাগিনী। তিনি যখন যিরাবের সাথে প্রেম নিবেদন করেন তখন প্রমাণ মেলে যে, সুলতানা যিরাবের– আবদুর রহমানের নয়। এই প্রেমাভিনয়ের পেছনে ইসলামের ঘোরতম দুশমন এলেগেইছের হাত ছিল-যিরাব যা বুঝতে পারেনি। অন্যের ওপর কথার যাদু বিস্তারকারী যিরাব বুঝতে পারল না-সুলতানা তার ওপর যাদু করেছে। এদিকে আবদুর রহমান ঠাহর করতে পারেননি যে, তার সবচে অনুরাগী দাসী তুরুবের রাণী তার নয়-ফিরাবের।

আবদুর রহমানের দরবারে যখন সংগীত আর রূপবতীর এই রূপ-যৌবনের লুকোচুরি চলছিল তখন তার সেনাপতি প্যাম্পোলনায় খ্রিস্টানদের প্রতিরোধ করে যাচ্ছিলেন। তিনি ফ্রান্সের দু কাউন্টকে শোচনীয়ভাবে পরাভূত করলেন যারা অত্র এলাকায় লুটতরাজ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলছিল। এবার তিনি তার বাহিনী নিয়ে কর্ডোভার পথ ধরলেন। তার এই প্রত্যাবর্তন একটানা হয়নি। পথিমধ্যে তিনি স্পর্শকাতর এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন। সিংহভাগ এলাকাই পাহাড়ী ও ঘন-ঝোপে ঠাসা। তার কাছে এ মর্মে সংবাদ এসেছিল যে, খ্রিস্টানরা যুৎসই স্থানে গুপ্তঘাঁটি স্থাপন করেছে গেরিলা আক্রমণের জন্য। তার যেখানেই সন্দেহ হয়েছে সেখানেই তল্লাশি চালিয়ে তিনি ঘাঁটিসমূহ ধ্বংস করে দিয়েছেন। এজন্য তার প্রত্যাবর্তন ছিল খুবই ধীরগতির, ঢিমেতালের।

কর্ডোভায় তাঁর প্রত্যাবর্তনের প্রতি আবদুর রহমানের তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। এদিকে হাজেব আবদুল করীম এবং অন্য আরেক সালার আবদূর রউফের উবাইদুল্লাহর ব্যাপারে বড় শংকা ছিল। তাঁরা দূত প্রেরণ করে তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন।

সেদিন সালার আবদুর রউফ হাজেবকে বললেন, আমার শংকা হয় আবদুর রহমান এই সাম্রাজ্যকে রসাতলে দেয় কিনা। এর কি কোন প্রতিকার নেই?

আমরা আবদুর রহমানকে হত্যা করতে পারি। যিরাব ও সুলতানাকেও পরলোকের পথ দেখাতে পারি-কিন্তু এতে লাভ? আবদুর রহমান খান্দানেরই কেউ তার স্থলাভিষিক্ত হবে। পরে একটা রেওয়াজ হয়ে যাবে যে, হত্যা কর, ক্ষমতা দখল কর। এতে খেলাফত দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। আমরা সাধ্যমত আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাই-এই ভালো। বললেন-হাজেব।

স্পেন গভর্নরকে আমি একটা কথা বলতে চাই। দেশ শাসন কর-কিন্তু ইসলামের নাম মুখে এনো না। ধর্মের নামে সে আমাদের সাথে প্রতারণা করছে। নয়নাভিরাম মসজিদ নির্মাণ করছে। কথায় কথায় কোরআনের রেফারেন্স টানছে। এটা কি অপরাধ নয়?

আমার যা ধারণা, স্পেন অবক্ষয় নয় পতনের চোরাবালিতে আছড়ে পড়তে যাচ্ছে। শাসকবর্গ সংগীত, নারী ও চাটুকারদের পাল্লায় পড়লে দেশের ভিত্তিমূলে ঘুণ ধরা শুরু করে। শত্রুপক্ষ তাদের তলোয়ারে শান দিচ্ছে আর আমাদের ননীর পুতুল শাসকশ্রেণী ওদের দিকে মিত্রতার হাত বাড়াচ্ছে। কেননা ওদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করলেই ক্ষমতা পাকাঁপোক্ত করা সম্ভব। আবদুর রউফ! তুমি তোমার দায়িত্ব সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়ে যাও-অনাগত ভবিষ্যৎ তোমাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। হতে পারে তোমার কর্মকাণ্ড তাদের জেহাদী জীবনে প্রাণসঞ্চার করবে। পক্ষান্তরে তুমি যিরাবের প্রদর্শিত অপসংস্কৃতির কোলে আশ্রয় নিলে জাতির ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করবে। কালের গতিপথ যেভাবে বদলাচ্ছে তাতে আমার ভয় হয়, বিশ্ব একদিন না আবার ইসলামকে নগণ্য একটি মতবাদ ও কৌলীন্য প্রিয় জাতির ভ্রান্তি বিলাস মনে করে বসে। সেই প্রদীপে আমাদের তেল সঞ্চার করতে হবে, শহীদী খুনের দ্বারা যাকে প্রজ্বলিত করেছিলাম আমরা। কুফরী শক্তি ফুঁসে উঠছে, এরপরও হতে পারে আমাদের ভাগ্য প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলবে। আগামীতে হয়ত এমনও বংশধর আসবে যারা ওই নিভু প্রদীপকে রাসূলে আরাবীর যুগের মত প্রদীপ্ত প্রত্যুজ্জ্বল করবে।

সালার আবদুর রউফের চেহারায় ঝিকিমিকি ও চোখে উদ্যমী আলোর রেখা ফুটে উঠল। এটি তার অধ্যাত্ম নূর যা মুখমণ্ডলে দীপ্ত হয়েছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা আত্মসম্ভ্রম বোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্ববান–ক্ষমতা বা গদীর লোভে লোভী নন।

***

এমন ঝিকিমিকি কিছুটা যিরাবের চেহারায়ও যে ছিল না তা কিন্তু নয়। যিরাব যদিও মদ্যপ ছিল, কিন্তু তার মাদকতা সুলতানার জীবনে আসার পর আরো বেড়ে যায়। সুলতানার জায়গীরে সে ইতিপূর্বেও গিয়েছে। মহলে দম আটকে আসছে- মুক্ত বায়ু সেবনের এ অজুহাতে যিরাবসহ সুলতানা কতবার তার জায়গীরে গিয়েছেন এর ইয়ত্তা নেই। আবদুর রহমানের অস্বীকৃতির কোন সৎসাহস ছিল না। প্রথমদিকে তিনি চুপেচাপে যিরাবকে সাথে নিতেন, কিন্তু পরবর্তীতে একাকিত্বের জ্বালা ঘুচানোর অজুহাতে খোলামেলা সাথে নিয়ে যেতেন।

চাঁদনী রাত। কমলকুঞ্জে পুষ্পসৌরভ, দুর্বাঘাস মখমলের সবুজ গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। এর ওপর কপোত-কপোতী উপবিষ্ট। নিথর-নিস্তব্ধ রজনী। কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই। পিয়ানো যিরাবের সবচে আকর্ষণীয় বাদ্যযন্ত্র। এতে সুর তুলে সে শ্রোতাকে অচিনপুরীতে নিয়ে যেত। এতে সে সুর দিয়ে যে কাউকে অন্য জগতে নিয়ে যাবার যোগ্যতা লাভ করেছিল। সুলতানার তন্ত্রীতে খেলে যায় শিহরণ। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সে যেন এর থেকে মুক্তি চাইছে। যিরাব বলে।

তুমি আমার পাশে না থাকলে আমার ব্যক্তিত্ব লোপ পায়। আমি তোমার সত্ত্বায়লীন হয়ে যাই। যিরাব সুলতানার হস্তস্পর্শ করে কাছে টানে। কাছে আসার স্থলে সুলতানা দূরে সরে। যিরাব মৃদু হাসে। বলে, তুমি জান না, কি পরিমাণ তৃষ্ণার্ত আমি। ওভাবে দূরে থেকো না।

খোদা তোমাকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন যিরাব। কিন্তু প্রেমরহস্য এখনও তোমার কাছে অজানা। তুমি কি সত্যিই তৃষ্ণার বিস্বাদ পাচ্ছ? সুলতানা বললেন।

বিরহের স্বাদ তুমি নিয়েছ কি কখনও? নাকি এতদসম্পর্কে তোমার কোন এক্সপেরিয়েন্স নেই?

বিরহের তড়পানিতে যে স্বাদ– বিরহে তা নেই। পুরুষের প্রকৃতিতে টোকা মারায় ওস্তাদ সুলতানা বললো, তোমার হয়তো জানা নেই স্পেনরাজ অন্ধ নন কিন্তু আমার প্রেমে তিনি তা-ই। তার প্রেমের বয়স আমার বয়সের চেয়েও বেশী। যেদিন তিনি আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে যান সেদিন আমি হেরেমের নিকৃষ্ট এক কীটে পরিণত হই। আমি চাই না, তুমি আমার দেহের স্বাদ নিয়ে অমন বিরক্ত হও। আমি এক রহস্য। এই রহস্য ফাঁস হয়ে গেলে তোমার হৃদিক তড়পানিতে ভাটা আসবে। তুমি আমাকে খেল-তামাশার বস্তুতে রূপান্তরিত করলে তোমাকে নিছক রূপের হাটের সওদাগর মনে কবর। আমাকে আমার পূজা করে যেতে দাও।

যিরাবের হাতের বাঁধন ঢিল হয়ে এল। যিরাবের জীবনে সুলতানার এই আলাপ প্রথম নয়। যে তৃষ্ণা তিনি যিরাবের মনে পয়দা করেছেন ঠিক তদ্রূপ পয়দা করে আবদুর রহমানের বেলায়ও। মহলের তিন বাদির মধ্যে স্পেনরাজকে মত্ত রেখে সুলতানা তার যাদুকরী চাল চালিয়েই যাচ্ছেন। আবদুর রহমানের পাশে থেকেও দূরত্ব বজায় রেখেই চলতো এই রহস্যময়ী নারী।

***

সন্নিকটে অশ্বখুড়ধ্বনি শোনা গেলে যিরা বলল, এলোগেইছ এল বলে।

মনে হয় তা-ই। তুমি এখানে বস। আমি তার সাথে দেখা করে আসি। তিনি চলে গেলেন। তাদের ধারণা যথার্থ। আগন্তুক এলোগেইছ-ই। সুলতানা তার ঘোড়ার লাগাম জনৈক নওকরের হাতে তুলে দিলেন। এলোগেইছকে নিয়ে গেলেন, খানিক দূরে। বললেন, যিরা আছে আমার সাথে। আমি একটি মুসিবতে পড়ে গেছি এলোগেইছ! সে কথা তুমিও জানো যে, সে আমার প্রেমে দিওয়ানা। পরিণতিতে আমিও কেমন যেন তার প্রতি ঝুঁকে পড়ছি ক্রমশ। দেখো এলোগেইছ! তোমার কথামত আমি যতই ওর জন্য মরীচিৎকার অভিনয় করছি ততই হন্যে হয়ে সে আমার পিছু নিচ্ছে। কিন্তু এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারছি না যে, ওর প্রতি আমারও দুর্বলতা আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ও নয় বরং আমিই ওর প্রতি প্রেমের পরাগরেণু ছড়াচ্ছি। এক্ষণে আমার জানার ইচ্ছা, কি যাদু আছে ওর মধ্যে যদ্দরুন আবদুর রহমানের মত ধীমান, জ্ঞানী ও চৌকস লোককেও মুরিদ সাব্যস্ত করতে পেরেছে? উপরন্তু দেখছি সে একটি জাতির তাহযীব-তামদুনও সমূলে বদলে ফেলেছে।

এলোগেইছ যেন তেন খ্রিস্টানের নাম নয়। সে যেমন খ্রিস্ট আলেম তেমনি মুসলিমও। সে যদিও সঙ্গীতজ্ঞ নয় তথাপিও জ্ঞান-গরিমা ও বাগ্মীতায় যিরাব থেকে কম নয়। সে খ্রিস্ট সমাজে মুসলিম বিরোধী এমন জীবাণু ছড়ায় যদ্দরুন তারা মুসলিম বিরোধী হয়ে যায়।

প্রেম কোন পাপকর্ম নয় সুলতানা! কিন্তু আত্মসচেতন লোকেরা আপনার অভিষ্ট লক্ষ্য ও ব্যক্তিত্বকে প্রেমের ওপর কোরবান করে না। আমরা তোমাকে সম্রাজ্ঞী বানাচ্ছি, সেই দৃষ্টি নিয়েই তোমাকে দেখে থাকি, কিন্তু অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছুতে তোমাকে নাটক করে যেতে হবে। সেই নাটকের একটা অংকে যিরাবের সাথে নায়িকার ভূমিকায় থাকতে হবে। ওর প্রতি মনের মাধুরী মেশানো টান দেখাতে হলে ওকে আত্মসচেতন হতে দেয়া যাবে না। সর্বদা তোমার রূপ-মাধুর্যে ডুবিয়ে রাখবে। শুনেছি সে আমাদের অনেক কাজ করেছে। সম্প্রতি এমনও লোকদের দেখেছি যারা আরব হয়েও পোশাক আশাকে আমাদের মত।

তুমি বহুত কমই দেখেছ, আমরা ওর চেয়েও সর্বক্ষেত্রে সফলকাম হয়েছি। বললেন সুলতানা

চলো সে আমাদের অপেক্ষায়! ওকে কোন প্রকার সন্দেহে ফেলা উচিত হবে না তোমাকে আবারও বলছি, আত্মসচেতন থেকো সর্বদা। যিরাবের দৃষ্টিতে সুন্দর থাকবে। রূপ-মাধুর্যে ডুবিয়ে রেখে কার্যোদ্ধারই এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা এক সময় যিরাবের কাছে এলো।

তোমার কর্মকাণ্ড শোনা এবং শুনানোর মত দীর্ঘ সময় আমার হাতে নেই। আমার চাহিদা মোতাবেক তুমি কাজ করে যাচ্ছ বলে শুনেছি। আমার প্ল্যান বুঝতে পারায় তোমাকে ধন্যবাদ। এ স্বার্থ কেবল আমার নয়-তোমারও। ক্ষমতা-লোভী নই আমি যে, তোমাকে বলব স্বধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টান হয়ে যাও। আমার দৃষ্টিতে ধর্মের কোন মূল্যায়ন নেই। মানবতার মুক্তিকামী আমি। তোমরা দুজন মানুষ। সুলতানা ভুবন মোহিনী আর তুমি উঁচুস্তরের সংগীতজ্ঞ না হলে তোমাদের এই পদমর্যাদা জুটতো কি, দরবারে যা হাসিল করেছো তোমরা। আবদুর রহমান স্পেন শাসন করার যোগ্য বলে তুমি মনে কর কি? শাসন করার যোগ্য সে তো তুমি-ই? যার যার মোগ্যতানুযায়ী প্রাপ্তি বুঝে নাও।

আবদুর রহমান সম্পর্কে আপনি ভুল ধারণা করছেন। যিরাব বলেন, তার যোগ্যতার কথা প্রতিবেশী খ্রিস্ট রাজন্যবর্গ অকপটে স্বীকার করেন। আপনার হয়ত জানা নেই যে, তার বাবা আল-হাকাম যখন আমাকে স্পেনে নিয়ে আসেন তখন প্রশাসনের লাগাম তার মুঠায় ছিল। বেশীর বেশী এতটুকু বলতে পারেন যে, আমি ও সুলতানা তার বুদ্ধিমত্তা ও মোগ্যতা উপেক্ষা করে কাজ করে যাচ্ছি। নারী ও সংগীতের প্রতি লোকটার টান না থাকলে স্পেনে কোন খ্রিস্টান বিদ্রোহের কথা কল্পনাও করত না। আজো কেউ তাকে আমাদের পথ হতে বিচ্যুত করলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যাবে। তবে আমি ও সুলতানা সহজে তা হতে দেব না। গোটা প্রাসাদে আমি মুসলিম চেতনা বিরোধী ইউরোপিয়ান কালচার চালু করে দিয়েছি। যেভাবে ধর্মের প্রতি আপনার কোন আকর্ষণ নেই সেভাবে নেই আমারও।

যিরাবের সত্যিই ধর্মের প্রতি কোন অনুরাগ ছিল না। কিন্তু এলোগেইছের ছিল শতকরা ১০০ ভাগই। যিরাবের মত জ্ঞানী মানুষ ঠাহর করতে পারল না যে, এলোগেইছ তাকে ধোকা দিচ্ছে। আবদুর রহমান নারী ও সংগীতের প্রতি দুর্বল মন্তব্য করে যিরাব নিজেই যে এক নরীর প্রতি দুর্বল তা বুঝতে পারল না। অনুধাবন করতে পারল না, সুলতানা তার বিবেকের ওপর সওয়ার হয়ে বিধর্মীদের স্বার্থোদ্ধার করে যাচ্ছে।

ওই রাতে তারা অনেক কথা বলল। পূর্ব প্রানেরই চর্বিত চর্বণ করা হলো এলোগেইছ সতর্ক লোক। সে ওদের কাছে গুপ্তকথার একবর্ণও উচ্চারণ করল না। ধুরন্ধর আর কাকে বলে।

***

সালার উবাইদুল্লাহ প্যাম্পেলনায় ফ্রান্সীয় ফৌজকে চরম মার দিয়ে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। তার বাহিনী ছিল ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন। পথিমধ্যে তিনি একটি ময়দানে খিমা গেড়েছিলেন। স্থানটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সন্ধ্যার পূর্বক্ষণ। এ সময় দু ঘোড়সওয়ার আবির্ভূত হলো। সাধারণ মুসাফিরের মত দেখতে তারা। তারা জানাল, আমরা খ্রিস্টান ছিলাম, ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং সালারে আলার সাথে দেখা করতে চাই। রহস্যময় একটি কথা তাঁর কাছে বিবৃত করতে চাই। তল্লাশি করে এদের কাছে কোন অস্ত্র পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সালারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।

হতে পারে এটা আমাদের ভ্রান্তি বিলাস। আগন্তুকদ্বয়ের একজন বলল, কিন্তু আমরা যা অবলোকন করেছি তা আপনার গোচরে আনা জরুরী মনে করেছি। আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি ইসলামকে মুক্তি ও শান্তির ধর্ম মনে করেই।

দীর্ঘ এই ভূমিকার পর তারা জানাল, আমরা ময়দানে বিচার করছিলাম আচমকা চার/পাঁচজন মহিলাকে একটি বাংকারে প্রবেশ করতে দেখলাম। পোশাক-আষাকে তাদেরকে অত্র এলাকার বলে মনে হলো না। এই বিজন অঞ্চলে তারা একাকী সফর করতে পারে না। আমরা দুজন এদের অনুসরণ করলাম। বাংকারটি পুরানো একটি গীর্জার মধ্যেই ছিল। আমরা দুজনই ওই নারীদের দেখেছি। দেখতে ওরা গ্রাম্য। জিজ্ঞাসা করেছি, তোমরা কে, কোত্থেকে এসেছ? কোথায় যাচ্ছ?

তারা বলল, আমরা মুসলমান, মুসলিম ফৌজের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলছি। আমরা ফৌজের সালারের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। কিন্তু নারী হিসেবে আমরা সাক্ষাৎ করার সাহস পাচ্ছি না। আমাদের কাছে এমন তথ্য আছে, যা সেনাপতিকে ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না। দেখা না পেলে আমরা এমনিতেই চলে যাবো। ওরা এখানে এসে সব কথা শুনতে পারেন।

উবায়দুল্লার ঠোঁটে রহস্যপূর্ণ হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন– তোমরা কি আমাকে বেকুফ ঠাওরাচ্ছ?

পুরুষ হলে আমরা ধরে আনতাম, কিন্তু নারীর গায়ে হাত দিয়ে আমরা কোন সমস্যার জড়িয়ে যাই-এজন্য ধরে আনেনি। তদুপরি আমাদের সাথে আসতে বলেছিলাম, কিন্তু আমাদের সাথে আসতে রাজী হয়নি ওরা। ওদের দুজন কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। জানিনা, কি সে কথা যা তারা আপনার কাছেই বলতে চায়। আপনি কি নারীদের ভয়ে কুঁচকে গেলেন? না গেলে সে আপনার মর্জি। আমরা পর্যটক। এখান থেকেই আমাদের পথ আলাদা হয়ে যাবে।

ওদের কথায় সালার উবাইদুল্লাহ প্রভাবিত হয়ে রওয়ানা করলেন। সঙ্গে স্রেফ দুজন দেহরক্ষী। ওই এলাকায় তিনি তল্লাশি চালিয়ে যে থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি করছিলেন তাতে কেউ তার সাথে প্রতারণা করবে বলে তার মনে হয়নি।

গীর্জাভ্যন্তরের সেই বাংকার সেনাছাউনি থেকে মাইল তিনেক দূরে। আগন্তুকদ্বয় অগ্রে অশ্বপৃষ্ঠে চলছিল। সালার দেহরক্ষীসহ এদের পেছনে। বাংকারের কাছে আসতেই নারীকন্ঠে কান্না শোনা গেল। ঘোড় সওয়াররা থমকে দাঁড়াল।

সামনে যাবেন না। তম্মধ্যে একজন বলল, এদের মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। জিন-ভূত মনে হচ্ছে। ওরা কাঁদবে কেন? অত্যাচারিত হওয়ার মত কোন কথা তো ওরা আমাদের গোচরে আনেনি!

ভেতরে চিৎকার শোনা গেল বাঁচাও! জালেমদের কবল থেকে উদ্ধার কর! আগন্তুকদ্বয় তলোয়ার হাতে অশ্বপৃষ্ঠ হতে নেমে এল এবং বাংকারের দিকে এগিয়ে গেল। দেহরক্ষী দুজনও ওদের অনুসরণ করল। আগন্তুকরা ফিরে এসে বলল, চিৎকার থেমে গেছে। তারা সালার ও দেহরক্ষীদের বাইরে থামিয়ে এ কথা জানাল কিছু না! এমনিতেই ওরা কান্নাকাটি করছিল।

দেহরক্ষীরা বাইরেই থাক। আপনি ভেতরে যান। জরুরী কোন কথা হবে হয়তবা। এরা নিরিবিলিতে আপনার সাথে কথা বলতে চায়। আগন্তুকদের একজন বল।

উবাইদুল্লাহ ভেতরে গেলেন। উবুজুবু হয়ে পড়া ভগ্ন ছাদের নীচ দিয়ে তিনি এগিয়ে চলছেন, ভেতরে কেমন একটা উৎকট গন্ধ। উবাইদুল্লাহ কামরার ভেতরে প্রবেশ করলেন।

এখানে কোন নারী নেই। উবাইদুল্লাহ কোষ থেকে তরবারী বের করলেন। কামরাটিতে ৪টি দরজা। তম্মধ্যে একটি খোলা, ওই পথে তিনি তাকালেন। লঘু পদধ্বনি শুনতে পেয়ে তিনি পেছনে তাকালেন। দেখলেন উঁচুকায় বর্শাধারী দুলোক এগিয়ে আসছে। চেহারা-সুরতে এরা খ্রিস্টান। চোখে-মুখে হিংস্রতা। সালারের দিকে তাকিয়াই ওরা তাকে ঘিরে নিল। উবাইদুল্লাহর নিজ ভুলের উপলব্ধি হলো। আগন্তুকদের কথায় প্রভাবিত হওয়া ঠিক হয়নি।

কি চাও তোমরা? আচমকা প্রশ্ন করেন তিনি।

যা চাই তা পেয়ে গেছি। দুজনের একজনে বলল।

সালারে আলা! তোমার দুদেহরক্ষীকে আমরা শেষ করে দিয়েছি। দেউরীর দরজা থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এল। তিনি ভড়কে পেছনে তাকালেন। এ কণ্ঠ সেই আগন্তুকদের যারা তার সাথে প্রতারণা করেছে। ওদের হাতে তলোয়ার। টাটকা রক্ত ঝরে পড়ছে তা থেকে।

তুমি এক্ষণে আমাদের হাতে বন্দী। ভয় নেই। আমরা তোমাকে হত্যা করব না। ফ্রান্স সম্রাটই এ বেলার বিচার করবেন। একজন বলল।

খ্রিস্টানদের হত্যার হিসাব দিতে হবে তোমাকে, আরেকজনে বলল।

আরেকজন অগ্রসর হয়ে বলল, তোমার তলোয়ার আমাদের কাছে সোপর্দ কর।

উবাইদুল্লাহ ঈমানদীপ্ত কণ্ঠে বললেন, জান দেব তবু তলোয়ার সোপর্দ করব না। তোরা ৮ জন, আমি একা, তোদের বর্ণা আমার দেহ ঝাঁঝরা করে রূহ বের করে নিলেই কেবল পারব তলোয়ার কজা করতে।

সাবধানে কথা বলো উবাইদুল্লাহ! আমরা তোমাকে হত্যা করতে চাই না, আমরা তোমাকে জীবন্ত বন্দী করতে চাই। কিন্তু শক্তি পরীক্ষা করলে অহেতুক জীবনটা ঘোয়াবে।

আমি এজন্যে পূজারী প্রস্তুত। জীবিত নয় মৃত উবাইদুল্লাহ-ই ফ্রান্স সম্রাটের প্রাসাদে যাবে।

আমরা ক্রুশ পূজারী। তোমার রাসূল (স)-কে ডাক, পারলে আমাদের হাত থেকে তোমাকে উদ্ধার করুক। আমরা তলোয়ার চাই-দিয়ে দাও।

তলোয়ার আমার রাসূল (স)-কেই দেব। রাসূলের অনুসারীরা দুশমনের হাতে তলোয়ার দেয় না।

এসময় বাইরে অসংখ্যা অশ্বখুরধ্বনি শোনা গেল, যা আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল। জনৈক খ্রিষ্টান বলল, দেখতো? বাইরে কারা এলো?

ওদের একজন বেরিয়ে গেল। পরে ফিরে এসে বললো, একে হত্যা করে বেরোও।

সালার উবাইদুল্লাহ অনুমান করলেন তার সোকজন এসে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে এরা খোঁজারু বাহিনী। এলাকায় বিচরণ করে পরিস্থিতির প্রতি নয়র বুলাত। সংখ্যায় জনাবিশেক। বাংকারের সামনে এসে তারা ঘোড়র গতিরোধ করল। তাদের-ই পরিচিত দেহরক্ষী বাহিনীর দুসদস্যের লাশ দেখে সন্দেহ হল। তারা আরো দেখল, এরা সেনাপতিরই দেহরক্ষী। তাছাড়া খালি ঘোড়াটি যে সেনাপতির এতে তাদের কোন সন্দেহ ছিল।

খ্রিষ্টানদের কমান্ডার ভেতরে এলো। সকলে তাকাল তার দিকে। উবাইদুল্লাহ তলোয়ার বের করলেন। এবং অতি কাছের এক খ্রিস্টানের গরদান কেটে ফেললেন। সেই সাথে ভীত কমান্ডার সকলকে ভেতরে ডাকলেন। কমান্ডারের নির্দেশ পালন করা হলো। কজন বাইরে দাঁড়িয়ে আগত মুসলিম সেপাইদের প্রতিহত করছে আর কজন বর্শাসহ উবাইদুল্লাহর ওপর আক্রমণ চালাল। যারা বাইরে বেরোল মুসলমানরা তাদের পথ আগলে রাখল। ওরা পলায়নের কোন কোশেশ করেনি- মোকাবেলার জন্যই ওদের বেরোনো। উবাইদুল্লাহ বর্শাধারীদের প্রতিহত করে যাচ্ছিলেন। বর্শাধারীদের বর্শাগুলো খুবই লম্বা বিধায় এগুলো ভেদ করে আক্রমণ করা যাচ্ছিল না। ওদিকে তার অনুসন্ধানী বাহিনীর সদস্যরা ক্রুসেডারদের আগমত ধোলাই দিচ্ছিল।

তলোয়ারের আঘাতে সেনাপতি একটি বর্শা ভেঙ্গে ফেললেন। ইতোমধ্যে তার দুসেপাই ভেতরে এসে পড়ল। এক খ্রিস্টানকে পয়লা আঘাতেই যমালয়ে পাঠাল তারা। উবাইদুল্লাহর হুকুমে তারা জিন্দা একজনকে পাকড়াও করল। তিনি বাইরে এসে দেখলেন ক্রুসেডারদের সকলে মারা পড়েছে, আর তার বাহিনীর মাত্র তিনজন শহীদ। ঈসায়ীরা বড় জোশ-জযবার সাথে এই খণ্ড লড়াই করেছিল।

জীবিত যে লোককে পাকড়াও করা হলো তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, এরা কারা, কি উদ্দেশ্যে এই ফাঁদ পেতেছিল? বন্দী সেপাইটি বলল,

জীবনের মায়ায় আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দেব ভাবলে বলব, আপনারা ভুল করছেন। স্যালাস আমার নাম। উবাইদুল্লাহকে গ্রেফতার করতেই এই ফাঁদ পাতা। আমাদের উপর নির্দেশ ছিল, তার পক্ষ থেকে কোন প্রকার আক্রমণ এলে হত্যা করে ফেলার। এতটুকু বলতে পারি, তাঁকে গ্রেফতার করে ফ্রান্স সম্রাট সুইয়ের কাছে নিয়ে যাবার কথা। এর চেয়ে বেশী কিছু বলতে পারব না।

বলতে হবে, তোমাদের এই চক্ৰজাল কতদূর বিস্তার লাভ করেছে? সেনাপতি বললেন, আর এখানকার মুসলমানদের কারা কারা তোমাদের দলের হয়ে কাজ করছে-বলতে হবে তাও।

বলবো না। আমরা মা মেরীর নামে কসম খেয়ে এসেছি, জীবন গেলেও রহস্য ফাঁস করব না। আমরা আত্মোৎসর্গী বাহিনী-বলতে পারেন আত্মঘাতী। ধর্মের জন্য আমরা মরতে রাজি। স্যালাস বলল।

অনুসন্ধানী বাহিনীর উপ-সেনাপতি তলোয়ার কোষমুক্ত করে চোখ রাঙিয়ে বললেন, আমাদের প্রশ্নের উত্তর তোমাকে দিতেই হবে।

সালারে আলা উবাইদুল্লাহ এদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। বললেন,

ধর্মের জন্য জানযি রাখায় এ লোককে মোৰারকবাদ। আমি ওর ওপর সামান্যও কঠোরতা প্রদর্শনের বিরোধী, ………. স্যালাস। তোমার গোপন তথ্যকে গোপন রাখার পূর্ণ অধিকার দিলাম। এমন কি তোমাকে মুক্তও করে দিলাম। এতগুলো মানুষের দ্বারা নিরত্র এক লোককে হত্যায় কোন প্রকার বীরত্ব দেখছি না আমি। যাও, ফ্রান্স সম্রাটকে গিয়ে বললো, আমাকে গ্রেফতার করতে হলে যেন সে নিজেই আসে। তুমি ধর্মের নামে সুইসাইড বাহিনী গড়েছ আর এদিকে সালার থেকে সামান্য এক সেপাই পর্যন্ত ধর্মের প্রতি অনুরাগী হয়ে সুইসাইড স্কোয়াডে নাম লিখিয়েছ। যাও স্যালাস! ওই ভীরু নপুংসককে বলবে, নিঃসঙ্গ কোন কাফেরের উপর মুসলিম সেনাপতিরা হাত উঠায় না। আর শোন তোমার এক সাথী এইতো কিছুক্ষণ পূর্বে শ্লেষমিশ্রিত কষ্টে আমাকে বলেছিল, তোমার রাসূল (আ)-কে ডাকো। পারলে তোমাকে উদ্ধার করুক। দেখলে! আমার রাসূল আমাকে কি করে উদ্ধার করলেন? বলে তিনি সেস্থানে এসে দাঁড়ালেন যেখানে তার দুদেহরক্ষী দাঁড়িয়ে ছিল। এ সময় বন্দী খ্রিস্টান বলল, আপনি আমার সাথে প্রতারণা না করলে দুএকটা কথা বলতে চাই।

না, কোন প্রকার প্রতারণা করার ইচ্ছে নেই দোস্ত আমার! আমি অভয় দিচ্ছি যা বলার অকপটেই বলে ফেল। যদি তুমি আমাকে অকথ্য ভাষায় গালও দাও তাহলেও তুমি আযাদ। সেনাপতি বললেন।

আমি নির্ভীকচিত্তেই বলছি সালারে আলা! তবে আপনাকে গাল দেব না। সুইসাইড বাহিনী জিহ্বা নয় সর্বদা তলোয়ারের ভাষায়-ই কথা বলে থাকে। আমি আপনার উদারতার সামান্য বদলা দিতে চাই। আপনি জানতে চেয়েছেন, কোন কোন মুসলমান আমাদের দলে ভিড়েছে? এ প্রশ্নের জনাব দিতে আমি অপারগ। কেননা এর উত্তর আমার কাছে নেই। তবে এতটুকু বলতে চাচ্ছি, আপনাদের শাসন ক্ষমতায় ঘুণ ধরে গেছে। বোধ হয় খুব বেশিদিন আপনারা এদেশ শাসন করতে পারবেন না। স্পেনের মূল শত্রু এক্ষণে আপনাদের শাসকবর্গই। এটা গোপনীয় কোন তথ্য নয়। খোদ নিজেরাই যেটা নিত্য-নৈমিত্তিক দেখে চলেছেন। আপনারা এই ঘুণ দূর করতে পারবেন কি? পারবেন না। হাজারো খ্রিস্টান ইসলাম গ্রহণ করেছে। আরব থেকে এসেছে হাজারো মুসলমান, যাদেরকে আপনারা পাকা মুসলমান ঠাওরান। ওরা নামকাওয়াস্তের মুসলিম। যে কাজ জিহ্বা দিয়ে চলে তলোয়ার দিয়ে চলে না সেটা। যে জাতি আপনার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনে তাদের তলোয়ার হামেশাই ভোতা প্রমাণিত হয়।

কাবার রবের কসম! তুমি পেশাদার ভাড়াটে খুনী নও। তোমার কথায় বিজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছে। প্রশংসা করছি তোমার চিন্তার গভীরতাকে। উবাইদুল্লাহ বললেন।

আপনার ধর্মোদ্দীপনা দেখে আমি বিমূঢ় হয়ে গেছি। এই উদ্দীপনার সামনে আমরা শতাব্দীকাল ধরে দুর্বল প্রমাণিত হয়ে আসছি। স্যালাস বলল। ( আমি দীপ্ত কণ্ঠে বলতে চাই, ষড়যন্ত্র করে তোমর কামিয়াব হতে পারবে না কোনদিনও।

আমাদের ওস্তাদ বলেছেন, কোন জাতিকে একদিন কিংবা একরাতে খতম করা যায় না। আপনার অভূতপূর্ব ব্যবহার-ই আমাকে এসব বাক্য ব্যয়ে উদ্বুদ্ধ করছে। শত্রু পক্ষকে পতনের পথ দেখাও-এতেই তোমাদের কামিয়াবি। ভবিষ্যৎ বংশধরকে বলে যাবে এ পথকে তোমরা আঁকড়ে ধরবে। শিশুদের বলবে তারা যেন পূর্বসূরিদেরদের পদাংক অনুসরণ করে জান কোরবান করে। ওদের কানে দেশ-জাতির জন্য জীবনো সর্গী অজানা বীরদের কাহিনী শোনাও- এরাই আমাদের রেখে যাওয়া কাজ করে যাবে। আর এর ফলশ্রুতিতে দেখবে, দুশমন একদিন এমনিতেই নিঃশেষ হয়ে যাবে, যেভাবে সকালের আগমনে কুয়াশা বিদূরিত হয়। আমরা আপনাদের অবক্ষয় ও পতনের চোরাবালিতে আছড়ে ফেলার নীল নকশা এঁকে যাচ্ছি। স্যালাস বলল।

আমাদের ফৌজ সম্পর্কে তোমার ধারণা কি? আমাদের ফৌজদেরও কি তোমরা অবক্ষয়ের পথ ধরাতে চাও? ওদেরকে তোমরা পরাভূত করতে পারবে কি?

যে জাতির বাদশাহ ক্ষমতাসন পাকাঁপোক্ত করার জন্য হেন কাজ নেই করে না, যে তার দুশমনের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে, যে সরকার গান-বাজনা আর নারীদের অতিরিক্ত মূল্যায়ন করে, সে জাতির ফৌজ যতই দুর্ধর্ষ ও প্রভাবশালী হোক না কেন তারা নিৰ্মা প্রমাণিত হতে বাধ্য। আপনাদের ফৌজদের অবস্থাও এমনটা হবে। সরকার তার আইন-শৃখলা রক্ষা বাহিনীর চিন্তার সাথে ঐকমত্য পোষণ না করে তাদের শিকড় কাটলে সে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। দাঁড়ালেও গোলাম হিসেবে, স্বাধীন হিসেবে নয়।

সালারে আলা! লোকটা ভাড়াটে খুনী নয় মনে হচ্ছে জাদরেল নেতা। একে জীবিত রাখা রীতিমত ভৌতিক বৈতো নয়। ওকে হত্যা করছেন না কেন? অনুসন্ধানী বাহিনীর প্রধান বললেন না।

সালারে আলার চোখে স্যালাসের কথাগুলো ভেসে বেড়ায়। ঠোঁটে প্রশান্ত হাসি। তিনি বলেন, ওর হত্যা আমার জন্য অবধারিত নয়। বুদ্ধিমান দুশমনকে আমি মূল্যায়ন করি।

আর আমি আপনাকে করি মূল্যায়ন। স্যালাস সেনাপতিকে একথা বলে অনুসন্ধানী বাহিনীর প্রধানকে বলল, হত্যা করতে হয় তো তোমাদের বাদশাহকেই করো। তাকেই বাদশাহ বানাও যে স্বার্থোদ্ধারে অন্ধ নয়।

খানিক পরে স্যালাস ঘোড়ায় চেপে অদৃশ্য হয়ে যায়।

***

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, খ্রিস্টানরা স্পেন সাম্রাজ্যকে পতনের চোরাবালিতে আছড়ে ফেলেছিল। তাদের মধ্যে ধর্মোদ্দীপনা সৃষ্টি করা হয়েছিল। ওদের এলোগেইছ ও আইলিয়রেরা এবং পাত্রীসমাজ এমনভাবে অগ্রসর হচ্ছিল যাতে কাউকে মুসলিম গোয়েন্দা কিংবা টহলদার বাহিনীর সামনে পড়তে না হয়। ওদের প্রথম টার্গেট ছিল মুসলিম তাহযীব-তামাদুনের ওপর, যাতে ভোগ, বিলাসিতা ও ইবাদতবিমুখতা নিহিত। একদিকে উবায়দুল্লাহর মত জানবায সিংহশাবকেরা যখন ইসলামের নামে ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন অন্যদিকে তখন প্রাসাদে নারীকণ্ঠের কলকাকলী আর সংগীতের টুং টাং শব্দমজুরীতে ভূমিকম্পের রেশ তৈরী হচ্ছিল।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, আবদুর রহমানও সালার ছিলেন। ছিলেন সমকালীন বিশ্বের নামজাদা যুদ্ধংদেহীও কিন্তু নারী ও সংগীতের কোপানলে পড়ে আপনার পরিচয় গিলে ফেলেছিলেন তিনি। কবি ও কাব্য-চর্চায় ছিল তাঁর অকৃত্রিম শখ। তারপরও তার সত্তা যেন অন্যের কজায় ছিল।

কাব্য চর্চা আর কবিগানের আসরই স্পেনকে ডুবিয়েছে। দরবারী চাটুকাররা বাদশাহর মেজাজ-মর্জির বিরুদ্ধে কথা বলত না। উপরন্তু তারা বাদশাহকে কথার আফিমে মত্ত রাখত। ইতিহাস লিখেছে, বনী উমাইয়ারা চাটুকারদের দরবারী আমলা বানাত। দেশ ও জাতির হিতাকাক্ষী ন্যায়-নিষ্ঠ লোকদের তারা চিনত, কিন্তু তাদের থেকে সযতে দূরে থাকত। মন্ত্রী ততক্ষণ মন্ত্রীত্বে থাকত যতক্ষণ সে বাদশাহর দৃষ্টিতে প্রিয়পাত্র থাকতে পারত। এসব রাজা-বাদশাহরা যেহেতু ক্ষমতাকে পারিবারিকীকরণ করতে চাইত সেহেতু শহর-বন্দরের প্রভাবশালী লোকদের দরবারে ঠাই দিত। এজন্য তারা দুহাতে খাজাখির ধন খরচ করত। মন্ত্রী, আমলা ছাড়াও দেশের কবি, বুদ্ধিজীবীরাও চাটুকারদের খাতায় নাম লিখিয়ে সরকারী ভাতা ভোগ করত।

স্পেনের ঐতিহাসিকবৃন্দ এসব চাটুকার কবি ও বুদ্ধিজীবীদের দোষ দিতে গিয়ে বলেছেন, এরাই তদানীন্তন শাসকদেরকে ডুবিয়েছে, আত্মতুষ্টিতে ভুগিয়েছে। পরিণতিতে পতন শুধু স্পেনিয় মুসলিমদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি পতনের এই ধারাবাহিকতা ইসলাম পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। উন্নয়নের সিঁড়িতে পা কেবল সে জাতিই রাখতে পারে যারা পূর্বসূরিদের বিভ্রান্ত পথ ও মত এড়িয়ে চলে।

স্পেন বিজয় নাটকে আজো ফ্লোরা কাহিনীর নাট্যরূপ দেয়া হয় এবং তাকে কোন না কোন মুসলমানের প্রতি অনুরাগী বানানো হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এই ফ্লোরারাই সুলতানার মত সুন্দরী ছিল যারা উপর দিয়ে মুসলিম অনুরাগী থাকলেও তলে তলে ছিল কুশ পূজারী। এ সেই ফ্লোরা যাকে চীফ জাস্টিসের কাঠগড়ার ওঠানো হয়েছিল এবং একেই আজ প্ৰেমজগতের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারিনী সাব্যস্ত করা হচ্ছে।

দ্বিতীয় আবদুর রহমানের যুগে খ্রিজাতি চারদিক দিয়েই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াচ্ছিল অথচ তিনি শরাবের মটকায় জাতির ভাগ্যতরীকে ডুবিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশ্য এ সময় কিছু জাত্যাভিমাণী মুসলিম সন্তান ন্যায় নিষ্ঠার সাথে ইসলাম নামের বৃক্ষটির গোড়া বুকের তাজা খুনে সিঞ্চিত করছিলেন। অনেকে ইসলাম প্রচারের মাধ্যমেও এ কাজ করে যাচ্ছিলেন। এদের দাওয়াতে কিছু মানুষ আন্তরিকভাবেই মুসলমান হয় আর কিছু হয় নামকাওয়াস্তের।

***

আচমকা একদিন কর্ডোভায় এ খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, এখান থেকে পাঁচ-ছয় মাইল দূরে একটি উপত্যকায় হযরত ঈসা মসীহ (আ)-এর বিশেষ এক শিষ্যের আবির্ভাব ঘটেছে। ওখানকার সমতল প্রান্তরে একটি বৃক্ষের ওপর একটা তারকা চমকাচ্ছে, সেইসাথে ওই শিষ্যের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

ওখানে একটি প্রাচীন গীর্জা ছিল। ওটি উঁচু প্রান্তরে নির্মিত। বিগত কোন যুগের বসতি যা আজ পোডড়াবাড়ীতে রূপান্তরিত। খ্রিস্টান সমাজে প্রচলিত ছিল, এখানে দুষ্টু আত্মার সদম্ভ বিচরণ রয়েছে। বড় ভয়ানক কাহিনী এ গীর্জা অবলম্বনে যার শ্রুতি রয়েছে। অনেক বলত, এটা দুষ্টু আত্মা নয় বরং ঈসা (আ)-এর যুগের নেক শিষ্যদের পুণ্যাত্মা। সম্প্রতি ওখানে এ নিয়ে বেশ রটনা, আলোচনা ও পর্যালোচনা। সর্বশেষ এই খবর বেরোল, এখানে তার এক শিষ্যের আবির্ভাব।

মানুষেরা ভয়ে ওদিক তেমন একটা যেত না। কিন্তু পাদ্রী সমাজে এই আলোচনা শুরু হলে দু একজন মানুষ যাতায়াত শুরু করে নিতান্তই কৌতূহলবশে। ওখানে যখন মানুষের আনাগোনা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় তখন গীর্জাসংলগ্ন বৃক্ষে তারকা চমকাতে শুরু করে। ওখানে গির্জা আর বৃক্ষের মাঝে একলোককে ঘোষণা করার জন্য দাঁড় করিয়ে দেয়া হত। ভয় নেই, তারকা চমকালে ঈসা মসীহকে স্মরণ কর বলে সে এলান করত।

ওই সময়কার রাতগুলো খুবই জমকালো হত। মধ্যরাতের পর চাঁদ উঠত। কোন এক রাতে লোকজনকে দুপ্রান্তের মাঝে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। তাদের সামনে একটি সমতল ভূমি, পেছনে উঁচু পাহাড় যা ঘন ঝোঁপ-ঝাড় আর বৃক্ষে ঠাসা। এরই মাঝে গীর্জাটি স্থাপিত। যাতায়াতের জন্য একটিমাত্র রাস্তা। যাতায়াত না থাকার কারণে সেটিও ঝোঁপঝাড়ে পূর্ণ। পাহাড়ের বুক চিরে কখনও বেরিয়ে আসত ঝর্ণা। এখন ওখানে প্রকাণ্ড এক জলাশয়। যেখানে জন্ম নিয়েছিল ছোট আকৃতির কুমীর। মানুষের আনাগোনা বন্ধের কারণ এও হতে পারে। আশেপাশে ছোটখাট টিলা।

মানুষেরা আসত টিলার পাদদেশে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। মানুষের কানাঘুষা আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। নেমে এল কবরের নিস্তব্ধতা। সামনের পাহাড়ের ঢালের একটি বৃক্ষে তারকা চমকে উঠল। এখনও একটি প্রবাদ খ্রিস্টান সমাজের প্রচলিত আছে যে, বৃক্ষে তারকাকৃতিতে ঈসা (আ) আবির্ভূত হন। আসমানের তারকার মতই ওটি ঝিকমিক করে।

গির্জা থেকে সমবেত কণ্ঠের গান-বাজনা শ্রুত হলো। রীতিমত গীতবাদ্য। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে এই গীত যাদুকরী আকর্ষণ সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। সকলে সামনে পিছে নজর বুলিয়ে বুকে হাত রেখে ঈসা (আ)-এর উপস্থিতি অনুধাবন করে যেতে লাগল। সকলেই ওই গীত মুখে উচ্চারণ করল। তারকাটি দুলছে ও এর কিরণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

ক্রুশ পূজারীবৃন্দ। জলদগম্ভীর একটি কণ্ঠে সকলে চমকে উঠল, ঈসা মসিহর ভক্তবৃন্দ। আমি বাণী নিয়ে এসেছি। পতন তোমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। একে রুখখা। রুখবার শক্তি আছে তোমাদের। ঈসা কুষ্ঠরোগকে উপশম করতেন কিন্তু ওরা কুষ্ঠ ছড়াচ্ছে। তোমাদের যারা খ্রিস্টধর্ম ছেড়েছে তারা পুনরায় স্বধর্মে ফিরে যাও নয়তো সকলকে কুষ্ঠ রোগে ধরবে।

তারকাটি অদৃশ্য হয়ে গেল। জমকালো আঁধারে ঢেকে গেল পরিবেশ। সমবেত মানবের মাঝে নেমে এল কবরের নিস্তব্ধতা। পরে ওই পাহাড় থেকে বিশেষ আওয়াজে সকলের চমক ভাঙ্গলো। একটি কণ্ঠে ঘোষণা হলো, এবার তোমরা স্বগৃহে ফিরে যাও। নিজস্ব আমলের প্রতি সতর্ক থেকে। কাল আবারো এসো। আবির্ভাব আবারও হতে পারে।

মানুষেরা ভয়ে ভয়ে বাড়ীর পথ ধরল।

***

এ ঘটনা উপস্থিত শ্রোতামগুলীর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকল না। ওই যুগ ছিল নিরক্ষরতার যুগ। লেখাপড়া জানত না মানুষ। জনশ্রুতিকে ওহী জ্ঞান করত। এ ধরনের কথা তারা অন্তরের অন্তঃস্থল দিয়ে শুনত ও পরে তা মানুষের কাছে বলত। তখন এতে বেশ কিছু কথা মিশ্রণ করে দিত। হযরত ঈসা (আ)-এর সাহাবীর আবির্ভাব-তাও আবার তারকাকৃতিতে-এমন এক মোজেযায় রূপ নিল যে, যাকে দেখার শখ জাগল সকলের মনে। মুসলমানরাও যেতে প্রস্তুতি নিল।

মসজিদে মসজিদে এ খবর ছড়িয়ে পড়ল। মুসল্লীরা ইমাম ও মৌলবী সাহেবানদের জিজ্ঞেস করতে লাগল, এ ঘটনা কতটুকু সত্য। বিজ্ঞ ইমামবৃন্দ একে কৃত্রিম বলে এর ওপর বিশ্বাস আনতে নিষেধ করলেন। এটা প্রকাশ্য কুফর। আমাদের ধর্মের ওপর চুনকালি মাখতে খ্রিস্টানরা নিরর্থক এক নাটক মঞ্চায়ন করছে। এটি বানোয়াট, উদ্ভট ও বিভ্রান্তিকর।

এটা কোন ভেল্কিবাজিও হতে পারে। জনৈক বিজ্ঞ আলেম এই ফতোয়া দিলেন। তিনি আরো বললেন, কোন মুসলমান একে দেখতে গেলে শেরকের গোনাহ হবে।

***

ঈসা (আ)-এর শিষ্য তারকা আকৃতিতে আবির্ভূত হয়েছেন-এ কথার সত্যাসত্যের জন্য দরকার ছিল ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার। এটা কোন ভেল্কিবজি কি-না। কি এর নেপথ্যে রয়েছে? এতে কোন সন্দেহ এই যে, খ্রিস্টানরা নাশকতামূলক, বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাচ্ছিল কিন্তু এ সময় আলেম সাহেবরা শিরক ফতোয়া দিয়ে ব্যাপারটি তদন্তের পথ বন্ধ করে দিলেন।

সেনাপতি উবাইদুল্লাহ তখনও কর্ডোভা পৌঁছাননি। উজির হাজেব ও আবদুর রউফ পরস্পরে আলাপ করছিলেন, ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখা উচিত। খ্রিস্টানেরা মুসলিম মনকে বিভ্রান্ত করাতে ধূম্রজাল সৃষ্টি করেনি তো! তারা অনেক আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিলেন, আবদুর রহমানকে জানানোর পূর্বে আমরা তদন্ত করে দেখতে চাই।

ওদিক খ্রিস্টানরা গোটা শহরে ব্যাপারটা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে দিল।

আবদুল করীমের দুরহস্যভেদী রহীম গাযালী ও হামেদ আরাবী পরের রাতে খ্রিস্টানদের সাথে ওখানে গেলেন। এখানে মুসলমানরা খুবই কমই হাজির হয়েছে। কেননা ওখানে না যাওয়ার প্রতি মসজিদে মসজিদে ফতোয়া ঝেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ওই রাতটিও ছিল জমকালো। দুপাহাড়ের মাঝখানে অন্ধকার আর। উৎসুক জনতার ঠাসাভীড়। আচমকা সেখানে গীতবাদ্যের আওয়াজ গুঞ্জরিত হল। জনতার মাঝে পীন পতন নিস্তব্ধতা। খানিকবাদে পাহাড়ের চূড়ায় একটি তারকা চমকে উঠল। সিংহশাবক বেশ কিছু কষ্ঠ সেই সাথে গীত গেয়ে ওঠল। এই গীত প্রতিটি গির্জার খ্রিস্টানরা গেয়ে ওঠে। জনতার মাঝে এই গীত গুঞ্জরিত হল।

তারকা এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল। বিস্ময় বিস্ফোরিত লোচনে সকলে এ দৃশ্য দেখল। তারকার দীপ্তি গির্জা চূড়ায়ই দেখা গেল, সাধারণতঃ যেখানে কুশদণ্ড স্থাপিত থাকত। দুই-আড়াই গজ দীর্ঘ ছিল এই চমক। এর মধ্যে কুশের ছায়াচিত্র দৃশ্যায়িত হত। জনতার ভীড়ে কান্নাকাটি শোনাগেল। সকলেই হাঁটু গেড়ে বসে গেল এবং পবিত্ৰগীত তাদের মুখে। রহীম গাযালী ও হামেদ আরাবী বসলেন না। তারা মুখ-চাওয়া চাওয়ি করে বললেন, এটা কোন ভেল্কিবাজি হতে পারে না। পরে তারা কেমন একটা মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে গেলেন। মনে হলো কোন অদৃশ্য শক্তি তাদের বসিয়ে দিয়েছে। তারা খ্রিস্টানদের রহস্যপূর্ণ গীত জানতেন না। তাই মনে মনে কালেমা-ই তাইয়্যেবা উচ্চারণ করতে থাকেন।

গীত উচ্চারণ আস্তে আস্তে থেমে এলো। তারকার দীপ্তিও ম্লান হলো, যাতে ঈসা (আ)-এর অবয়ব দৃশায়িত ছিল।

এই হতাশ রূহ তোমাদের সতর্ক করছে। দূর থেকে একটি আওয়াজ ভেসে এলো, স্বধর্ম ত্যাগ করো না। তোমরা বুঝতে পারছ না গোনাহর শাস্তি কি! যে যমীনে গির্জা বিরান হয়ে যায় সে যমীন মানুষের বসবাসের যোগ্য থাকে না। গির্জায় যাতায়াত কর। সেখানে তোমাদের করণীয় কি তা বুঝিয়ে দেয়া হবে। বলা হবে সম্ভাব্য মুসিবতের কথা। একতা ও সততা বজায় রেখ। তোমাদের একতায় চিড় ধরছে। তোমাদের যারা মুসলমান হয়েছে তারাও গির্জায় যাবে। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তওবা করবে। তোমাদের দেশে ঈসা মসীহের নূর বিচ্ছুরিত কর।

***

রহীম গাযালী ও হামেদ আরাবী উজির আবদুর করীমের বাসভবনে যান। তাদের দেখা কাহিনী বর্ণনা করেন। বলেন, এটা কোন ভেল্কিবাজি হতে পারে না।

আবদুল করীম বিজ্ঞ উজির ছিলেন। তিনি আচমকা প্রশ্ন করলেন, তোমরা কি কেবল ওই চমক দেখছিলে, না কি আশে পাশেও ঘুরেছিলে?

তারা জানালেন, যখন তারকার চমক শেষ হয়ে যায় তখন গির্জার বিপরীত দিকের নীচে কোথাও আগুন জ্বলছিল। পরে এই আগুনও নিভে যায়।

এটা ভেল্কিবাজি। অলৌকিকতা নয়। নয় যাদুও। খ্রিস্টানদের মনে ভীতি সঞ্চার করতে আমাদের বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র। এটি নও মুসলিমদের পুনরায় খ্রিষ্টান বানানোর প্ল্যান। তোমাদের দুজনকেই এটি খতম করতে হবে। যে আওয়াজ তোমরা শুনেছ, গির্জায় যাও তাহলে বুঝতে পারবে-কি মুসিবত আসছে। আমার যদুর বিশ্বাস, এ আওয়াজ এই দুনিয়ার মানুষেরই মেকী আওয়াজ। কাল নাগাদ আমার কানে আসবে, ওইসব লোককে পুনরায় কি বলতে বলা হয়েছে।

পরের রাতে হাজেব আবদুল করীমের কাছে চার/পাঁচজন লোককে বলতে শোনা গেল, আজ গির্জায় এত ভীড় ছিল যে, উঁচ রাখারও জায়গা অবশিষ্ট নেই। পাদ্রীরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার তুলেছে। স্পেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে এমনও কথা বলেছে, যা শুনলে গা শিউরে ওঠে। তারা বলেছে, এই প্রশাসনের বিরুদ্ধাচরণ ধর্মের-ই কাজ। বিদ্রোহ জরুরী। তারা ঈসা (আ)-এর আবির্ভাব জোরালো ভাষায় সমর্থন করে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করেছে। জনতা যখন গির্জা থেকে বেরোয় তখন সকলের মনে ভীতিভাব।

আবদুল করীম পরদিন সালার আবদুর রউফকে বললেন, আবদুর রহমানকে না জানিয়ে এই ভেল্কিবাজির রহস্যোদ্ধার করতে হবে। তিনি ওই মুহূর্তেই রহীম ও হামেদকে ডেকে পাঠালেন। ডেকে পাঠালেন আরো চার লোককে। বললেন, আমরা তোমাদেরকে অগ্নি পরীক্ষায় পাঠাচ্ছি। আমরা জেনেছি, হযরত ঈসা (আ)-এর আবির্ভাব সম্পূর্ণ বানোয়াট। যখন তথাকথিত ওই তারকা চমকায় ও মানুষের মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি হয় তখনই লোকসম্মুখে একে চুরমার করে দিতে হবে। তোমরা সতর্ক থাকবে। যে রাতে তোমরা শুনবে ঈসা (আ) আবির্ভূত হচ্ছে, সে রাতে তোমরা উঠানে উপস্থিত থাকবে। তবে জনতার কাতারে নয় থাকবে বিরান গির্জার নিকটে, ওখানেই তোমরা উদ্ধার করতে পারবে কোত্থেকে আসছে তথাকথিত এই তারকা চমক।

কোথাও না কোথাও দেখবে আগুন জ্বলছে। এমন স্থান থেকে আগুন জ্বলছে, যা মানুষের নজরে পড়ছে না। খুব সম্ভব দুএকজন লোক এ কাজে জড়িত। ওদের ওপর আক্রমণ করে আগুন আয়ত্তে আনবে। এর পূর্বে তোমরা দুজন গির্জার পাশে ওঁত পেতে থাকবে। লক্ষ্য করবে, কে কথা বলে। তাকে পাকড়াও করবে। তোমাদের সাথে খঞ্জর ও বর্শা থাকা চাই। ওদের সাথে লড়াই করতে হতে পারে। এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে কাউকে জীবিত রাখবে না। পরে তোমাদেরই একজনকে ভেল্কিবাজি ও প্রতারণা বলে একে ঘোষণা করতে হবে। বলতে হবে, ওখানে কোন ঈসার আবির্ভাব ঘটেনি। আর আমরা বিরান গির্জা জনতাকে নিয়ে দেখাব। দেখাব সে জিনিষও যা বৃক্ষে চমকাত।

উজির ও সালার তাদেরকে এই অভিযানের বিস্তারিত সব কিছু বুঝালেন। সবশেষে বললেন, এই কাজের প্রতিদান আল্লাহ-ই দেবেন। আমি আবারও বলছি, এ অভিযান সহজ নয়। কুশ পূজারীরা পাক্কা বন্দোবস্ত করেই রেখেছে। তোমাদের জীবন হুমকির মুখে মনে করতে পার। আমি তোমাদের হুকুম দিচ্ছি না। তোমরা যেতে না চাইলে কোন প্রকার প্রতিশোধ নেব না। এমন কি রাগও করব না। ধর্ম ও জাতির অতন্দ্র প্রহরী তোমরা। এদেশ কোন খান্দান বিশেষের নয়– তোমাদের। তোমাদের ঘরে ডাকাত পড়লে তোমাদের বাপ-দাদারা, ওদের ছেড়ে দিলেও তোমরা কি নিশ্চুপ থাকবে?

স্পেন তোমাদের ঘর। ঘর আমাদের সকলের। শেষের দিকের কথাগুলো বলতে গিয়ে হাজেবের চোখে পানি এসে গেল।

আমরা যে কোন কোরবানী দিতে প্রস্তুত। আমরা প্রস্তুত-এদের একজন বললেন।

আমরা কারো থেকে কোন প্রতিদান চাইব না।

 খোদা তায়ালার কাছেও কোন প্রতিদান চাইবো না।

 ছ’ছজন জানবায প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন।

***

দুরাত পরেই খবর এলো, আজ কিছু নযরে আসবে। ওখানে যে-ই যেতে চায় সে যেন গোসল করে যায়। মসজিদ মসজিদে এলান করা হয়, কোন মুসলমান যেন না যায়। ছজন জানবার্য পরিকল্পনামত রওয়ানা দিলেন।

রহীম, হামেদ ও চার সেপাই সূর্যাস্তের পর পরই তারা ওখানে উপনীত হলেন। দিনের বেলা ছদ্মবেশে প্রথমোক্ত দুজন এলাকাটা সফর করে এসেছেন। পাহাড়ে উঠেও তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। আঁধার রাতে এই ছমুজাহিদ পাহাড়ের কোন এক প্রান্ত দিয়ে ওপরে চড়লেন। ওপরে ওঠার পথ কয়েকটা। চূড়ায় সামান্য সমতল ভূমি। এখান থেকে আরো উপরে ঢালু আছে। পাহাড়ী ঘাসে ওই ঢালগুলো ঠাসা। স্থানটা খুবই ভীতিজনক। ওখান থেকে একটি ঝর্ণা নীচে নেমে গেছে অবিরাম ধারায়।

রহীম গাযালী দুসেপাই সাথে নিলেন এবং বাদবাকী দুজনকে হামেদের সাথে দিলেন। সকলের হাতেই বর্শা ও খঞ্জর। সকলে গেলেন পৃথক হয়ে। রহীম তার দুসাথী নিয়ে গির্জার পাশে ওঁৎ পেতে থাকলেন। আর হামেদ তার দুসাথীসহ ওই বৃক্ষের কাছে গেলেন যেখানে ভৌতিক তারকা চমকাত।

আঁধার জমকালো রূপধারণ করলে রহীম গীর্জার নিকটে সে ধরনের আওয়াজ শুনতে পেলেন। পরমুহূর্তেই গির্জার আলো জ্বলে উঠল, যা শার্সির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। গির্জার কপাট খুলে কজন বলল, গোটা সরঞ্জামাদি শেষবারের মত পরখ করে নাও। আরেকজনে বলল, আমরা সবকিছু দেখে নিয়েছি। তোমরা গাছে চড়। উৎসূক জনতার আগমন শুরু হয়েছে। পরে আরেকজন বলল, মানুষের চিন্তা করোনা। ওরা উপরে আসছে না।

হামেদ আরাবী বৃক্ষের নিকটে ছিলেন। তিনি পায়ের আওয়াজ টের পেলেন। অন্ধকারে দুটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। ওদের একজন গাছে চাপল। নীচে দাঁড়ানো লোকটা বলল, ওই স্থানটা মনে আছে তো?

মনে আছে। গাছের ওপর থেকে আওয়াজ এলো।

দুতিনজন লোক হামেদের কাছ থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে গেল। পর মুহূর্তে চূড়া-প্রান্ত থেকে লঘু আওয়াজ শ্রুত হলো। উৎসুক জনতা সমবেত হল। ওদের সুরও স্ব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।

মুহূর্তেই প্রান্তরে স্থাপিত দেয়াল আলোকিত হয়ে উঠল। হামেদ খুব ধ্যান-খেয়ালের সাথে তাকিয়ে দেখলেন, বড় সাইজের একটি ঝাড় ফানুস এর আলো কেবল সামনে ঠিকরে পড়ছে। ডানে-বামে, উপরে কিংবা নীচে পড়ছে না। হামেদ দেখলেন, গাছে চড়া লোকটা নেমে আসছে। নীচে যে লোকটা ছিল সে চলে গেছে। তিনি লঘু পায়ে অগ্রসর হলেন এবং তার বুকে বর্শা ছুঁয়ে বললেন, আবার গাছে চড়, উপরে যা রেখে এসেছে তা নিয়ে এসো।

লোকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল, কে তুমি?

যা বলছি তা কর। হামেদ বললেন।

 বর্শা সরাও। উপরে যাচ্ছি।

লোকটা গাছে চড়তে লাগল। বিদঘুঁটে অন্ধকার। হামেদ দেখতে পাচ্ছেন না, লোকটা কি করছে। তিনি তলোয়ার বের করলেন। লোকটা গাছে সামান্য উঠে ঠুস করে নেমে খঞ্জর বের করে হামেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনি নিজকে বাঁচাতে পারলেন না। খণ্ডরের ডগা তার বাহুতে ঢুকে গেল। হামেদ মুহূর্তে বাঁ হাতের বর্শা লোকটার পেটে ঢুকিয়ে দিলেন। লোকটা আর্তনাদের সুরে কারো নাম ধরে ডাকল। হামেদও তার লোকজনকে ডাকলেন। ওদিকে যে আলো জ্বলছিল তা হামেদ ও তার লোকজনের দিকে বিচ্ছুরিত শুরু করল। গির্জার ভেতর থেকে কলোক দৌড়ে বেরোল। সকলেরই হাতে খোলা তলোয়ার। হামেদ তার লোকজনকে আত্মগোপন করতে বললেন। নিজেও আত্মগোপন করলেন। গির্জা থেকে আগুয়ান লোকেরা সংখ্যা বেশ। তাদের সাথীকে বৃক্ষের নীচে পতিত দেখতে পেয়ে আশেপাশে তল্লাশি শুরু করল। আততায়ী মুহূর্তে গেল কৈ?

একলোকে হামেদের কাছে পৌঁছে গেল। বসা অবস্থায় তার পার্শ্বদেশে তিনি বর্শা ঢুকিয়ে দিলেন। তার মুখ থেকে নির্গত বিশেষ আওয়াজে অন্যান্য সাথীরা দৌড়ে এল। ওদেরই কেউ চিৎকার দিয়ে বলল, আলো এদিক ফেরাও।

হামেদ যখমী ছিলেন। তাঁর সঙ্গী মাত্র দুজন। তারা সকলে ওদের নযরে পড়ে গেলেন। হামেদ রহীমকে ডাকলেন এবং এদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। ওরা এদের তিনজনকেই ঘিরে ফেল। ওদিকে রহীম তার লোকজন নিয়ে স্পটে এসে পৌঁছলেন।

পাহাড়ের পাদদেশে যখন সমবেত জনতা তারকা দীপ্তির অপেক্ষা করছে, এদিকে তখন দীপ্তিকারীরা জীবন-মৃত্যুর দোলনায় দোল খাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *