১.১ প্রথম খণ্ড – ষড়যন্ত্র

সিংহশাবক / মূল : এনায়েতুল্লাহ আলতামাস / অনুবাদ : ফজলুদ্দীন শিবলী

ভূমিকা

বড়ই রোমাঞ্চকর সেই যুগ যে যুগে আজকের স্পেনে সবুজ চাঁদতারা নিশান উড়ত। সুন্দর, স্বপ্নীল ও বর্ণিল অনুভূতি নিয়ে কর্ডোভার মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আলহামরার পোড়া ইট, বালুকণা আজ তারিকী তলোয়ারের স্মৃতি-রোমন্থন করে। গোয়াদেলকুইভার, জিব্রাল্টার প্রণালী, যাল্লাকা প্রান্তর, আলমেরিয়ার যমীন বুকে ধারণ করে আছে বীর মুসলিম জাতির অশ্বখুরের ছোঁয়া।

স্পেনের ইতিহাসের ধূসর পাতা খুললে সর্বাগ্রে মনে পড়ে সেই মহান বিজেতাদের অমিততেজা হিম্মতি উপাখ্যান, উপকূলে নেমে যারা জ্বেলে দিয়েছিলেন স্বদেশে ফেরার রণতরীগুলো। অপরিচিত দেশ, অচেনা মানুষ এমন কি আসমান-যমীনও যাদের কাছে বৈরী সেই মর্দে মুমিনদের এই দুঃসাহসিকতা দেখে ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিকদের কলম পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে যায়।

মুসলিম জাতির বিজয় কেবল স্পেন ভূ-ভাগেই থেমে থাকেনি-সীমানা পেরিয়ে তা প্যারিস পর্যন্তও বিস্তৃত হয়। কুলাঙ্গার উমাইয়া খলীফা সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক তারিক বিন যিয়াদ ও মূসা ইবনে নুসায়েরের অগ্রাভিযানের মাঝপথে বাদ না সাধলে হয়ত আজকের ইউরোপের মানচিত্র অন্যভাবে আঁকতে হত।

মোটকথা স্পেন সেদিন একটি শক্তিধর মুসলিম রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। খোদাপাগল বিজেতাদের মৃত্যুর পর অবশ্য স্পেনের গদিতে এমন সব নীল ভ্রমরদের আবির্ভাব ঘটে যারা পূর্বসূরিদের রক্তমাখা উপাখ্যানগুলো গিলে খেতে থাকে। কেন্দ্রীয় খলীফার শাসনাধীন হয়েও এরা নিজেদের বাদশাহ ভাবতে শুরু করে। পতনের শুরুটা মূলত এখান থেকেই। পরবর্তী ইতিহাস আরো করুণ আরো বেদনাবিধুর।

খ্রিস্টানরা মুসলমানদের প্রজা ছিল। তাদের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল। ইসলাম গ্রহণের জন্য তাদের ওপর জবরদস্তি করা হয়নি কোনদিনও। এদের যারা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে-তারা নিজ উদ্যোগেই ইসলামের মহানুভবতায় আকর্ষিত হয়েছিল। কিন্তু ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিহিংসাপরায়ণ, মৌলবাদী, গোড়া খ্রীস্টানরা উগ্রবাদী মনোভাব নিয়ে স্পেন ও মুসলমানদেরকে স্পেন ছাড়া করতে আদা নুন খেয়ে ময়দানে নামে। এই শয়তানী লক্ষ্যে হেন কাজ নেই যা। তারা করেনি। এ জন্য তারা তাদের সুন্দরী মেয়েদেরকে আমীর-ওমরাদের প্রাসাদে পাঠিয়েছে। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের শয্যাসঙ্গিনী হয়ে এরা ধোকা, ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহে অদৃষ্টপূর্ব ভূমিকা রেখেছে। এই কূলটা নারীরাই সেদিনের স্পেনে মুসলিম প্রশাসনের জন্য কালনাগিনী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দাগাবাজ বিদ্রোহী খ্রীষ্টানরা ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্যান্য শাসকবর্গ থেকে মদদ পেতো।

বিধর্মীরা মুসলিম স্পেনকে যতটা না ক্ষতি করেছে তার চেয়ে অধিক ক্ষতি করেছে বিলাসী নারীলোভী ও মদ্যপ রাজা-বাদশাহরা। বক্ষ্যমান বইয়ে আমি স্রেফ এমন এক আমীরের কাহিনী তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। আমার লেখার উপজীব্য হচ্ছে রাজধানী কর্ডোভর হেরেমে ঠাই পাওয়া চাটুকারদের ষড়যন্ত্র ও হেরেমের বাইরের এলোগেইছ ও জোরা কাহিনী। ৮ম খ্রীষ্টাব্দের স্পেনের আমীর ছিলেন দ্বিতীয় আঃ রহমান। ওই সময় কিছু সিংহশাবক গাঁটে গামছা বেঁধে নেমেছিলেন আন্তর্জার্তিক ও অভ্যন্তরীণ শত্রু থেকে স্পেনকে বাঁচাতে। এরা স্রেফ স্পেন নয় বাঁচিয়েছিলেন আঃ রহমানকেও।

আমাদের কাহিনীকাররা ফ্লোরাকে কোন না কোন মুসলিম শাসকের হেরেমের হীরা সাব্যস্ত করেছেন। তাকে নিয়ে রোমাঞ্চকর উপাখ্যান তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাস্তব এর উল্টো। ফ্লোরা কোনদিনও মুসলিম হেরেমে কারো শয্যাসঙ্গিনী হয়নি।

সবশেষ কথা হলো এটি উপন্যাস, ইতিহাসনির্ভর। ঘটনা সত্য। কাল্পনিকতা স্রেফ সাহিত্যের উপস্থাপনে, মৌলিকতায় নয়। হায়! এ যুগের শাসকবর্গ ও আগামী দিনের শাসকবর্গ যদি এ থেকে সবক নিতেন।

.

প্রথম খণ্ড ষড়যন্ত্র

৮২৫ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকের কথা। আজকের স্পেনে সেদিন মুসলিম শাসন ছিল। ওই সময় পর্তুগালও মুসলিম শাসনাধীনে ছিল। ওই সময়কার ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন সুই। একদিন তিনি রাজ দরবারে উপবিষ্ট। তার পাশেই গোথ মুর্চের রাজা ব্রেন হার্ট ও কর্ডোভার এলোগেইছ নামী প্রভাবশালী খ্রীস্টান। সারিবদ্ধ চেয়ারে উপবিষ্ট যথাক্রমে মন্ত্রী ও দু জেনারেল।

এলোগেইছ। সম্রাট লুই শাহী কণ্ঠে বলেন, স্পেনে সরকারীভাবে কোন পদমর্যাদা নেই জেনে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছিলাম যে, তোমাকে সাক্ষাতের অনুমতি দেব কিনা। কিন্তু এক্ষণে বুঝলাম, তোমার মত লোকের সাক্ষ্য আমার কাছে খুবই জরুরী ও তাৎপর্যবহুল। আমার স্রেফ এটুকু নিশ্চিত হওয়া দরকার যে, তুমি মুসলিম গোয়েন্দা নও! আর তুমি আবেগপ্রবণ হয়ে আলাপ করতেও আসেনি। এক্ষণে প্রয়োজন কাজ ও শ্রমের; ত্যাগ-তিতিক্ষার মুহূর্তে আবেগ কোন কাজে আসেনা।

এলোগেইছ বলল, আমি মুসলিম নই-এ হয়ত মুখের ভাষা দিয়ে বোঝাতে পারব না। আপনার গোয়েন্দা যদি এতটা চৌকস ও সুনিপুণ হয় যতটা মুসলিম গোয়েন্দারা; তাহলে প্রস্তাবের উত্তর ত্যাগ-তিতিক্ষাক্ষণেই পেয়ে যাবেন।

তবুও আমি সতর্ক পদক্ষেপের পক্ষপাতী। আমি যেমন তোমাকে ভয় পাই না, তেমনি পাই না মুসলমানদেরও। বললেন টলুই।

আপনার বাপ-দাদাও সতর্ক পদক্ষেপের পক্ষপাতী ছিলেন যার ফলশ্রুতিতে স্পেনে মুসলিম শাসনের গৌরবময় এক শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে গেছে। আপনি দেখছি পূর্বসূরীদের পদাংক অনুসরণ করে ফিরছেন। স্পেনে আমরা যেমন গোলামের জাতিতে পর্যসত ঠিক তেমনি আমাদের ধর্ষও। আপনার হৃদয়ে যদি ঈসা মসীহ এবং কুমারী মরিয়মের ভারাসা ও ইজত থাকত তাহলে আপনি এভাবে যত গুটিয়ে বসে থাকতে পারতেন না। তারপরও কি আপনি বলবেন, আমি আবেগ তাড়ি হয়ে এই সূদূরে ছুটে এসেছি? আমি মহৎ এক উদ্দেশ্যে এসেছি। সে উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত নয়। আপনার মত বিশাল বাহিনী আমার অধীন থাকলে মুসলমানদের স্পেনছাড়া করতে না পারলেও তাদের সুস্থে বসে থাকতে দিতাম না। ওদের লোকালয়ে গুপ্তহত্যা ও গেরিলা হামলা চালাতাম। শেষের দিকের কথাগুলো বলতে গিয়ে এলোগেইছএর চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল।

আমরা তোমার চেতনার কদর করি এলোগেই। কিন্তু তোমার হয়ত জানা নেই যে, আরব মরুচারীদের পরাভূত করা দুঃসাধ্য। সম্রাট লুই বললেন।

তার মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি? এলোগেইছে, কণ্ঠে বিস্ময়।

আমি বলতে চাচ্ছি, মুসলমানরা ধর্মীয় উদ্দীপনা নিয়ে লড়াই করে। আল্লাহর সন্তুষ্টিকয়ে ওরা দুশমনের বিরুদ্ধে লড়ে। ওরা মনে করে, খোদা নাকি ওদের সাথে কানে। এলোগেইছ। তুমি ওদের স্পেন বিজয়ের গোড়ার কথা যদি জেনে না থাক, তাহলে আমার থেকে শুনতে পার। ওরা সংখ্যায় ছিল হাজার সাতেক। স্পেন উপকূলে অবতরণ করেই ওরা ওদের রণতরীগুলোয় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল যাতে কারো মনে পলায়ন করার মানসিকতা জেঁকে না বসে। তুমি হয়ত বাহিনী গড়তে পারবে কিন্তু এই চেতনা পাবে কোথায়? এই চেতনা-ই ওদের স্পেন বিজয়ে সহায়তা করেছিল সেদিন। ওদের ঘোড়া যেখানেই যেত সেখানেই বিজয়ী পতাকা উড্ডীন হত। কোন অভিযানেই ওরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেনি। খুব সম্ভব ফ্রান্স ওদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। ফ্রান্স বিজয় করে ও স্পেনের সীমানা বাড়াতে চাইবে। থামলেন সম্রাট লুই।

আপনি ওদের এই অগ্রযাত্রা রোখার কোন উদ্যোগ নেবেন না? আমি তো ওদের পায়ের তলার যমীনও ছিনিয়ে নিতে পরিকল্পনা সেধেছি। শেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার মত বাহিনীও তৈরী করছি। এলোগেইছ বললেন।

আমাদের মেহমানের কি জানা নেই যে, এ পর্যন্ত কি পরিমাণ খ্রীস্টান মুসলমান হয়েছে? বলে সম্রাট লুই মন্ত্রী কেনেথের দিকে তাকালেন, ওরা পাকা মুসলমান বনে গেছে। ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ওরা কান দেবে না। তনুমন দিয়েই ওরা ইসলাম গ্রহণ করেছে।

এলোগেইছের ঠোঁটে পরিধি বাড়ান মুচকি হাসিফুটে উঠল। তিনি রাজ দরবারে উপবিষ্ট জনের প্রতি তাকিয়ে নিলেন। বললেন, জানি সে কথা। কিন্তু আপনি হয়ত জানেন না, ওদের আমি হাত করে নিয়েছি ইতোমধ্যে। বেশক ওরা মুসলমান। মসজিদে নামায পড়ে, রোজাও রাখে। কিন্তু ওদের মন মীনার থেকে কুশ-চেতনা মোছেনি। ওরা পূর্বেকার মত খ্রীস্টান-ই রয়ে গেছে। কারণ, আরব্য মুসলমানরা প্রথম শ্ৰেণীর নাগরিক আর নও মুসলিম খ্রীস্টানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। ওদের ব্যবহার-ই এই শ্রেণী বৈষম্যে বাধ্য করেছে। এটাই আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। ও নও মুসলিমদের ধোঁকা দিয়ে চলেছে। ওরা নামায পড়লেও তলে তলে মুসলিম শেকড় কেটে চলেছে। ওদের একজন জাদরেল নেতা দরকার। দরকার কোন খ্রীষ্ট শামরে মদদ। মদদ দ্বারা উদ্দেশ্য, ফৌজি মদদ।

সম্রাট লুই এলোগেইছের কথায় নিশ্চিত হলেন যে, লোকটা মুসলমানদের গোয়েন্দা নয়। এই উদ্দেশ্য মনে মনে পুষে আসছেন তিনি। এই একটা চিন্তা-ই তাকে ততদিন কুরে কুরে খেয়েছে। কেননা, মুসলিম জাতির অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ না করা গেলে একদিন গোটা ইউরোপে ইসলাম ছড়িয়ে পড়বে।

এলোগেইছ! সম্রাট লুই বললেন, তুমি নিজকে একাকী ভেবো না। আমি বলেছি, ওদের সাথে সম্মুখ সমরে পেরে ওঠা যাবে না। এর মতলব এই নয় আমি হাতমুখ গুটিয়ে বসে থাকব। গোথ মুর্চের রাজা নে হার্টকে বিশেষ এক উদ্দেশ্যে ডেকে পাঠিয়েছি। মুসলিম শাসনের প্রোথিত শেকড় আমাকে ভূ-গর্ভে গিয়েই কাটতে হবে। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান এখন শেনের শাসক। গুপ্তচর মারফত জেনেছি তার প্রকৃতি, জেনেছি তার চারিত্রিক দুর্বলতার দিকগুলো। বাস্তবিকই তিনি যুদ্ধংদেহী। লড়াই করা ও কানোত অদ্বিতীয় তিনি। তার হৃদয়ে ধর্মোদ্দীপনা টইটম্বুর। স্পেনের সীমা বৃদ্ধিকল্পে তিনি নানান পরিকল্পনার জাল বুনছেন। জ্ঞান-গরিমায়ও কমতি নেই। তাঁর বাবা আল-হাকাম স্পেনের বেশ ক্ষতি করেছেন। বিলাস ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ হিসেবে তিনি যথেষ্ট দুর্নাম কুড়িয়েছেন। তোষামোদ ও চাটুকারদের জন্য উজাড় করে দিয়েছিলেন রাজকোষ। কিন্তু আবদুর রহমান ভিন্ন ধাতুর। তার বাবা মুসলিম স্পেনের যে ক্ষতি সাধন করেছিলেন আবদুর রহমান তা পুষিয়ে দিতে চাইছেন।

এতদসত্ত্বেও তার চরিত্রের একটা দিক খুবই দুর্বল। সংগীত ও নারীর প্রতি তার রয়েছে অগাধ আকর্ষণ। রণাঙ্গন থেমে বিমুখ করতে ওই দুটো অস্ত্র আমাদের প্রয়োগ করতে হবে। এলোগেইছ যাও! চেতনা ও আবেগ দুটোই পুঁজি করে বেরিয়ে পড়। জানি, তুমি বেছে বেছে এক একটা মুসলমানকে হত্যা করতে চাইছ। ফলে একদিন সম্মুখ সমরে লড়াই। যার পরিণতিতে আমরা চরম মার খাব। কিছু একটা যদি করতেই চাও তাহলে ওদের দুর্বল দিকগুলো আরো দুর্বলতর করে তোল। বললেন সম্রাট লুই।

কিন্তু তা কি করে? প্রশ্ন এলোগেইছের।

সম্রাট লুই মন্ত্রী কেনেথের দিকে নজর বুলান। উতয়ে কেবল মুচকি হাসেন। মন্ত্রী বললেন, আমাদের প্রিয় দোস্ত। তুমি একজন আবদুর রহমানকে হত্যা করলে আরেক অবদুর রহমান ক্ষমতায় বসে হাজার খ্রীস্টানকে হত্যা করবে। সকলের প্রগাঢ় ধারণা জম্মাবে, খ্রীস্টানরাই আবদুর রহমানকে হত্যা করেছে। হয়ত শাসকের মৃত্যুর পর এমনও লোক ক্ষমতায় বসতে পারে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে যে পাকা মুসলিম আর চারিত্রিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। আবদুর রহমানের নারীর প্রতি এতই মোহ যে, বাঁদী থেকে এক মহিলাকে রাজরাণী করেছেন বলে শুনেছি। তার হেরেমে এমনও তুবন মোহিনী রয়েছে যাদেরকে তুমি হীরের টুকরো বলতে পার। এরা সবাই তারই রঙে রঙীন। তার হেরেম এমন এক নারীকে টোপ দেয়া যেতে পারে, যে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। এমন এক নারীও ইতোমধ্যে আমি নির্বাচন করে ফেলছি।

সে মুসলমান, না খ্রীস্টান?

নামকাওয়াস্তে মুসলমান। মন্ত্রী কেনেথ বললেন, এ ধরনের মহিলাদের কোন ধর্মকর্ম থাকে না। তুমি হয়ত জানে, স্পেনে তুরুব নামে একটি জায়গীর রয়েছে। জায়গীরদার মারা গেছে। তার একটি মেয়ে আছে। সুলতানা তার নাম। জুবের রাণী হিসেবে তার পরিচয়। গুপ্তচর মারফত যতদূর জানতে পেরেছি, সে তুরুব-সীমান্ত সম্প্রসারণ করতে নিজস্ব রূপ-যৌবনকে সওদা বানিয়ে চলেছে। কথিত আছে, সে খুবই

চৌকস ও বুদ্ধিমতী। ভুবনমোহিনী শাহাদীরা পর্যন্ত তার অঙ্গুলী হেলনে নেচে থাকে। তার সৌম্যকান্তি অনিন্দ্য সুন্দর দেহবল্পরীত স্বর্গের অপ্সরা না বলে উপায় নেই। দ্বিতীয় আবদুর রহমানের নষর এখনও তার প্রতি পুড়েনি। তুমি যদি পরিকল্পনা মোতাবেক তোমার মিশন এগিয়ে নিতে চাও তাহলে তাকে বাগে এনে তুরুবের মত আরেকটি জায়গীর প্রাপ্তির টোপে তাকে দলভুক্ত করে কাজে লাগাতে পার। তার স্পর্শকাতর্ব দিকে এভাবে টোকা মারতে পারো যে, সামান্য ভূ-সম্পত্তির কন্যা হয়েও তুমি আজ রাণী হিসেবে পরিচিত। সে রাণী হতে চায়। আমরা তাকে রাণী বানাব…… কি পারবে তুমি এ কাজ করতে?

পারব না মানে! আলবৎ পারবো, সরাসরি তার সাথে কথা বলব। বললেন এলোগেইছ।

আমি এও শুনেছি, আবদুর রহমান সংগীতানুরাগী। বললেন সম্রাট লুই, তাঁর দরবারে যিরাব নামে জনৈক সংগীতজ্ঞ আছে। যদি সুলতানা তার সাথে একযোগে কাজ করতে পারে তাহলে কার্যসিদ্ধি ত্বরিৎ অর্জন করতে পার।

কার্যোদ্ধার যদি এতেই নিহিত মনে করেন তবে আমি তাই করব। ভবে তলোয়ারের আশ্রয় না নিয়ে লুকোচুরি খেলায় মশগুল হওয়াকে আমি কাপুরুষতা মনে করি।

আমাদের উদ্দেশ্য কি মিঃ এলোগেইছ? মন্ত্রী কেনেথ প্রশ্ন করেন, ইউরোপকে মুসলিম শূন্য করা-এই তো! আর খ্রস্টের শিক্ষা গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া। মুসলিম শক্তির ভিত্তিমূলে আঘাত করতে হবে। ওদের ধর্মোদ্দীপনার ভিত্তি নড়বড়ে করে দিতে হবে। আমাদের নারীরা এ কাজে মোক্ষম হাতিয়ার। তারা যে কোন ত্যাগ স্বীকারে অকুণ্ঠ। দুশমনকে কুপোকাত করতে যে কোন কাজ-ই জায়েজ। খোদা না করুন, এদের প্রতিহত করতে না পারলে সেদিন বেশী দূরে নয় যেদিন গোটা ইউরোপে মুসলিম পতাকা পতপত করে উড়বে।

ইসলামকে আমরা মুসলিম রাজা-বাদশাদের মাধ্যমেই কমযোর করে দেব। আমাদের যুবতী নারী ও সংগীতজ্ঞরা আবদুর রহমানের ওপর প্রভাব বিত্তার করতে পারলে ব্রেনহার্ট গোটা স্পেন সীমান্তে গুহামলা ও গেরিলা আক্রমণ শুরু করে দেবে। তুমি স্পেনে বিদ্রোহের শ্রগিরি উদগীরণ করো। এই মহতি অভিযানে দুমি নিঃসঙ্গ নও বন্ধু। তোমার সাথে ছায়ার মত আছি আমরাও। বললেন সম্রাট লুই। দরুবার ওদিনের মত মুলতবি ঘোষণা করা হল।

***

যে সময় ফ্রান্সের রাজপ্রাসাদে স্পেন পতনের নীল-নকশা প্রণয়ন করা হলি এর থেকে ১১৪বছর পূর্বে মাত্র হাজার সাতেক ফৌজ নিয়ে তারিক বিন যিয়াদ স্পেন উপকূলে নোর স্করেছিলেন। জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ তার রণতরীগুলো, যাতে কারো মনে প্রত্যাবর্তনের খেয়াল না চাপে। সমর ইতিহাসে সম্ভবত: এমন নজীর আর নেই। রণতরীতে আগুন লাগিয়ে ইবনে যিয়াদ যে বক্তব্য রেখেছিলেন, আরবী ইতিহাসের বইগুলোতে হুবহু সে শব্দগুলো লিপিবদ্ধ আছে।

তিনি বলেছিলেন,

শহীদী কাফেলার সাথীরা আমার! রণাঙ্গন থেকে পালানোর মূলযান জ্বালিয়ে দেয়া হল। তোমাদের অগ্রে দুশমন আর পশ্চাতে সুবিশাল ভূ-মধ্যসাগর। সততা, ধৈর্য ও সমই এক্ষণের সম্বল তোমাদের। স্পেন উপকূলে তোমরা ঠিক কৃপণের দস্তরখানে বসা এতিমের মত। সামান্যতম ভীরুতা নাস্তানাবুদ করে দেবে তোমাদের অস্তিত্ব। এমন এক বাহিনীর সম্মুখীন হতে যাচ্ছ তোমরা, যাদের ভাণ্ডারের অস্ত্র ও ফৌজ অফুরন্ত পক্ষান্তরে সামান্য কয়েকটি তলোয়ার-ই তোমাদের ভরসা। রসদ হাসিল করার জন্য রয়েছে ওদের হাজারো মাধ্যম। খোদা না করুন তোমরা অমিততেজা হিম্মত ও কালজয়ী বীরত্ব প্রদর্শন না করলে মুসলিম ঐতিহ্য ধূলি ধূসরিত হবার পাশাপাশি দুশমনের দুঃসাহসিকতায় প্রবৃদ্ধি আসবে। এক্ষণে ইজ্জত ও ইসলামের মান রক্ষার একমাত্র পন্থা হলো, যে দুশমনকে তোমরা মোকাবেলায় পাচ্ছে তাদের ওপর টর্নেডোর বিভীষিকা বিস্তার করে ওদের শক্তিবাহু দুর্বল করে দিও।

এমন কোন বিষয় থেকে তোমাদের অভয় দিচ্ছি না, খোদ আমি নিজেই যে ব্যাপারে ভীতসন্ত্রস্ত। এমন সরেযমীনে তোমাদেরকে শত্রুর মুখোমুখি করছি না, আমি যেখানে লড়ব না। আমীরুল মুমীনুন ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক তোমাদের মত তারুণ্যের অহংকারীদের এজন্য নির্বাচন করেছেন, যাতে তোমরা স্পেন সম্রাটের জামাতা হতে পার। এখানকার শাহ-সওয়ারদের কচুকাটা করতে পারলে দেখবে খোদা ও তাঁর রাসূলের বিধান কায়েম হয়ে গেছে। যে বধ্যভূমিতে তোমাদের ডাকছি, সে ভূমির দিকে সর্বপ্রথম যাত্রী খোদ আমি-ই। দুশমন ধেয়ে এলে যাকে সর্বাগ্রে তাদের মোকাবেলায় এগিয়ে যেতে দেখবে, সে আমিই। দুশমনের রক্তে যার তলোয়ার সর্বপ্রথম স্নান করবে সে তলোয়ার আমারই। আমি শহীদ হলে তোমরা আমার অন্য কাউকে সেনাপতি নিযুক্ত করো তবুও খোদার রাহা হতে পিছপা হবো না। স্পেন বিজয় না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে না।

তারিক বিন যিয়াদ যে স্থানটিতে ভাষণ দিয়েছিলেন ইতিহাস একে জাবালুততারেক জিব্রাল্টার নামে নামকরণ করেছে।

ওই সাত হাজার মর্দে মুজাহিদ-ই আজকের স্পেনকে জয় করেছিলেন। ইতিপূর্বে রোমানরা একে জয় করেছিল তারা এর নাম দিয়েছেন হেম্পেনিয়া। পরবর্তীতে এই উপদ্বীপকে জার্মানীরা জয় করে এর আন্দালাস নাম রাখে। ৭১১ হিজরীতে তারিক বিন যিয়াদের নারা বুলন্দ হবার পাশাপাশি আযান ধ্বনি উচ্চকিত হলে এদেশকে আন্দালুসিয়া বলা হতে থাকে। বদলে যায় এর পাহাড়, নদী-নালা, খাল-বিল ও শহরের নামও। এখানকার পুরানো তাহযীব-তামাদুন বদলে এক নয়া কালচারের উন্মেষ ঘটায়। এই নয়া সংস্কৃতি মানুষকে ইসলাম ধর্মে টানতে উৎসাহ যোগায়। আলহামরা ও কর্ডোভার মসজিদ আজও কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, যদিও বন্ধ হয়ে গেছে আযান দেয়ার কষ্ঠ চিরদিনের তরে।

এই সাত হাজার মুজাহিদ ওখানকার ক্ষমতা দখল করতে যাননি, গিয়েছিলেন আল্লাহর যমীনে আল্লাহর রাজ কায়েম করতে। এঁদের কতজন শহীদ হয়েছিলেন, কতজন আজীবন পঙ্গুত্বের জ্বালা সয়েছিলেন-ইতিহাস এ ব্যাপারে খামোশ হলেও কল্পনা খামোশ থাকেনি। জ্ঞানীমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন কি পরিমাণ রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছিল। স্পেনের মাটি তাদের হাড়মাংস খেয়ে ফেলছে। এরাই তারা যারা বুকের তাজা খুন নযরানা দিয়ে দ্বীনের মশাল জ্বেলে দিয়েছিল।

***

তারিক বিন যিয়াদ একদিন এ জগতের সফর শেষ করেন। এরপর এক শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে যায়। এ সময় স্পেন-তখতে এমনও শাসক আসেন যারা মন-মীনার হতে তারিক ও তার জানবার্য সঙ্গীদের চেতনা মুছে ফেলেন। যে সব আত্মোৎসর্গী মুজাহিদ কলজের ঘামে এ দেশের বৃক্ষলতাকে রক্তস্নাত করেছিল, এরা তাকে অপকর্মের কালিতে কলংকিত করে। খোদার রাজত্বের স্থলে মানবের রাজত্ব শুরু হয়। যে দরবারে একদিন আদল-ইনসাফ হতো, সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পীদের কোমর দোলানো নাচে সে দরবার রিনিঝিনি করে উঠল। চাটুকারদের ভীড়ে রাজ দরবার টইটম্বুর হয়ে গেল। আমীর-ওমরারা চাটুকারদের ভাষায় কথা বলতে লাগল।

৮২২ খ্রীস্টাব্দে এমন এক বাদশাহর মৃত্যু হল আল-হাকাম যার নাম। ইতিহাস কালের সাক্ষী, তিনি রাজতন্ত্র ও হেন জুলম নেই যা বাকী রেখেছিলেন। একদিকে তিনি যেমন জনমতের তোয়াক্কা করেননি তেমনি ধার ধারেননি তাদের জান-মাল এস্তেমালের। গদীরক্ষার স্বার্থে স্রেফ দুএকজন নয়, হাজারও জনতার খুন বহাতে ন্যূনতম কার্পণ্য করেননি তিনি। মনে চাইলে মানুষের জমি-জিরাত বাজেয়াপ্ত করতেন। তার জুলুম নিপীড়নের তালিকা থেকে দ্বীনী আলিম ও মুফতীয়ানে কেরামও বাদ যাননি। রাজতন্ত্র কায়েমের ইবলিসী নেশায় তিনি হেন যড়যন্ত্র ও কূট-কৌশল নেই যা করেননি। মোটকথা আল হাকামের যুগ ছিল জুলুম ও বর্বরতার যুগ। রাজার সংবিধান ছিল তার জিহ্বা-ই।

আল-হাকামের যুগে অর্জিত বিজয়ে আম-জনতার রক্ত বইলেও তার খান্দানের কারো ফোঁটা রক্তও ঝরেনি। তিনি জানতেন না, এদেশের প্রাথমিক দিকের বিজেতারা কি পরিমাণ ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিল। যেহেতু তিনি জানতেন না, সেহেতু এর মর্যাদা দেননি কোনদিনও। রাজার মৃত্যু হলে পুত্র ক্ষমতার মসনদে বসে যেত। মসনদে বসতে গিয়ে কেউ এ উপলব্ধি করেন যে, এদেশ জয় করতে এসে মুজাহিদবৃন্দ তাদের রণতরীগুলোয় আগুন ধরিয়েছিলেন। তারা তাদের চেতনা হাতে কলমে বাস্তবায়িত করেই দেখিয়েছিলেন।

কোন দেশের মান-মর্যাদা বাস্তবিকপক্ষে তারা-ই দিতে জানে, যারা ওই দেশ জয় করতে বুকের খুন ন্যরানা দিয়ে থাকে। বিজিত দেশে যারা রক্তপাহীন ঝঞ্ঝাটমুক্ত শাসনের অধিকারী হয়, তারা নিজকে রাজা আর অধীনস্থদের প্রজা ঠাওরায়। দরবারে চাটুকারদের ঠাই দেয়। আর এদের দৃষ্টি কেবল নাকের ডগা অবধিই থাকে। ইতিহাস তো তাই বলে আসছে, বলছে, এমন কি ভবিষ্যতে বলবে। এরাই দেশ ও জাতির অবক্ষয়ের মাধ্যম। ওদের হাতে দেশ, জাতি ও স্বাধীনতা কিছুই নিরাপদ নয়। স্পেনের গ্রানাডা ট্রাজেডি এ ধরনের বিকারগ্রস্ত আমীর-ওমরাদের দ্বারাই হয়েছিল সেদিন।

***

আল-হাকামের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় আবদুর রহমান ৩১ বছর বয়সে ক্ষমতাসীন হন। ইতিহাস কালের সাক্ষী হয়ে নীরব ভাষায় বলে চলেছে, তাঁর দরবারে কাব্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য ও বুদ্ধিচর্চার চাটুকারদের এতটা ভীড় ছিল যতটা দেখা যায়নি অন্য কোন শাসকের কালে। আবদুর রহমানের প্রাসাদ যেখানেই স্থানান্তরিত হত সেখানেই রঙ্গ-রসের আসর জমত। তিনি একদিকে যেমন তলোয়ারবাজ রণ নিপুণ ছিলেন তেমনি ছিলেন নারীর প্রতি চরম আসক্ত। মহলে তিন নারী তার জন্য প্রাণোৎসর্গী ছিল। এরা তিনজনই বাদী। এরা প্রত্যেকেই ভুবন মোহিনী কেউ কারো চেয়ে কম নয়। তম্মধ্যে একজনের নাম মোদাচ্ছেরা। আবদুর রহমান তার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে বিবাহ-ই করে ফেলেন। দ্বিতীয় জনের নাম জারিয়াহ আর শেষোক্ত জন শেফা। গান-বাজনার মুহূর্তে এরা আবদুর রহমানের পাশ ঘেঁষে বসে থাকত।

এরপর তার দৃষ্টি এক সময় সুলতানার ওপর পড়ে। সুলতানার অনিন্দ্য সুন্দর মুখ ও নিটোল দেহবল্লরীতে যাদুর কারিশমা। আবদুর রহমান স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি ভেবে পান না যে, তার দেশে এমনও রূপের রাণী বর্তমান। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন না যে, সুলতানা নিজে আসেনি তাকে আনা হয়েছে।

স্পেনের অন্যান্য রাতের মত একটি রাত। আবদুর রহমানের প্রাসাদে সংগীতের সুর-মূৰ্ছনা। সংগীত সম্রাট যিরাবের সুনিপুণ বাদ্যযন্ত্রে সম্মোহনী টান। জারিয়া তার পার্শ্বে উপবিষ্ট। বাঁশির সুরে দ্বিতীয় আবদুর রহমান এতটা নিমগ্ন যে, তিনি ঠাহর করতে পারছেন না। তিনি স্পেনের বাদশাহ। তিনি ঠিক তখনই বিলাসিতায় নাক অবধি ডুবছেন যখন তার প্রাসাদ ঘিরে ক্রুসেডের ষড়যন্ত্রজাল। তিনি ভুলে গেছেন যে, তাকে ইসলামের সুমহান দাওয়াত নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। অন্ধকার ইউরোপে হকের মশাল জ্বালাতে হবে, যাতে নিপীড়িত মানবতার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সিংহশাবক

ইসলামী খেলাফতের এই আমীর তার বাবার মত নিজকে একজন স্বাধীন রাজা মনে করতেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিভোর না থেকে সংগীত চর্চায় মেতে ওঠেন।

একদিন তুরুবের প্রাসাদে জনৈক দরবেশ প্রবেশ করলেন। এই দরবেশকে ইতিপূর্বেও সুলতানা তার মহলের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন। একবার সুলতানা তার গতিরোধ করে পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়াছিলেন। সুলতানা শুভ্র ঘোড়া গাড়ীতে সওয়ারকালীন ওই দরবেশকে পথ চলতে দেখে সখীকে বলেছিলেন, মনে হচ্ছে বেটা কোন সেঁক খাওয়া প্রেমিক। কতবার এপথে তাকে চলতে দেখেছি।

মনে হচ্ছে লোকটা ভিক্ষুক। সখি বলেছিল।

না। সুলতানা বললেন। ভিক্ষুক নয়? তার চেহারায় এক ধরনের আভিজাত্য রয়েছে যা তাকে অভিজাত বলেই মনে হতে বাধ্য করে। চোখে-মুখে বুদ্ধির রেশ। পুরুষের চেহারা শনাক্ত করতে আমি কখনই ভুল করি না।

সখী মুচকি হেসে বলেন, দরবেশ হোক আর সপ্ত মহাদেশের বাদশাহ হোক, তোমার রূপ-লাবণ্যের সম্মোহন সকলের তরে সমান।

সুলতানা ঘাড় কাত করে তার দিকে তাকালেন। দরবেশ পূর্বস্থানেই দণ্ডায়মান। তার দৃষ্টি সুলতানার ঘোড়ার গাড়ীকে লেহন করছে। এ যেন টিকটিকির চুপিসারে আসামী অনুসরণ। সুলতানার গাড়ী এগিয়ে চলছে। সূর্য ডুবু ডুবু ভাব। দরবেশ পূর্বস্থানে দাঁড়ান। প্রত্যাবর্তনের পথে তাকে দেখে সুলতানা চমকে ওঠেন। তিনি গাড়ী থামান। ইশারায় তাকে কাছে ডাকেন। দরবেশের চোখের রঙ নীল, দেহ বাদামী, দাড়ি আধাপাকা।

তোমাকে আমি কয়েকবার দেখেছি, সুলতানা বললেন, আমাকে যেভাবে পর্যবেক্ষণ কর সেভাবে কি প্রত্যেক নারীকেই পর্যবেক্ষণ কর?

দুনিয়ার কিছু নারী সুলতানার চেয়ে সুন্দরী হলেও ভোমার সৌন্দর্য কিছুটা ভিন্ন। অন্যের সৌন্দর্য চোখ ঝলসে দেয় আর তোমারটা হৃদয়ে উষ্ণ পরশ বুলায়। আর যাদের রূপ-লাবণ্য হৃদয়ে টোকা মারে তারা পার্থিব নারীদের চেয়ে ভালো হবেই। দরবেশ বললেন।

নিছক আমাকে দেখার জন্যই কি আমার মহলের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে? প্রশ্ন সুলতানার।

হা! এর সাথে কিছু বলার জন্যও।

কি বলার জন্যে?

যাদের দৃষ্টি তোমাকে লেহন করছে ওই দর্শকদের সামনে দরবেশ তোমাকে কিছু বলতে পারে? দেখ রাণী! পথে পথে লোক তোমাকে কি ভালবাসা ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। আমি তোমাকে এমন পথ দেখাতে চাই যে পথে দৰ্শককুল কেবল তোমার রূপসুধা পান করবে না বরং শ্রদ্ধায় মস্তকাবনতও করবে। সুলতানার জন্য স্পেনের সিংহাসন অপেক্ষমান।

তুমি যদি গণক হয়ে থাক এবং আগামী দিনের কথা আগাম বলে দিতে সক্ষম হও তাহলে আজকের রাতটা আমার মহলে থেকে যাও। দারোয়ান তোমায় রুখবে না।

রাতের বেলায় দারোয়ান রুখা তো দূরে থাক বরং সসম্মানে সুলতানার কামরায়, পৌঁছে ছিল। এই কামরায় সাধারণত সুলতানা ছাড়া আর কারো প্রবেশের অনুমতি নেই। সুলতানা অর্ধনগ্ন মিহি রেশমী পোশক আচ্ছাদিত। পিঠে আছড়ে পড়া একরাশ কেশ ওই রেশমের চেয়েও মোলায়েম। ঝাড়-ফানুসের আলোয় তার রূপটা গোটা কক্ষকে আরো উজ্জ্বল করে তুলছে। সুলতানা উত্থিত যৌবনা। তার কণ্ঠে সংগীতের সুরলহরী। চাল-চলন যাদুকরী। কথন-বচন গভীর। হাসিতে শরাবের মাদকতা।

ইতিহাস লেখে, খোদা তাকে যেমন রূপ-যৌবন দিয়েছিলেন তেমনি দিয়েছিলেন মেধা ও বিচক্ষণতা। ছুটন্ত চঞ্চল হরিণীর ক্ষিপ্রতা। চোখে প্রেম ও আকর্ষণের অধীর চাহনি। পক্ষান্তরে তিনি ছিলেন প্রতারক ও শ। তিনি আপনার মূল্যায়ন জানতেন এবং পুরুষকে হাত করার কৌশল রপ্ত করেছিলেন। রূপের দরিয়ায় ঝড় তুলে বীর পুরুষকে কুপোকাত করতে তার জুড়ি নেই।

দরবেশ এই অপ্সরাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ শেষে চেহারায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।

তুমি কি করে বললে, স্পেনের সিংহাসন আমার জন্য অপেক্ষমান? সুলতানা প্রশ্ন করেন।

এটি রূহের জগতের কথা রাণী! আমি যদুর জানি, আপনি রাণী হওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী। কিন্তু কোন পন্থা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাছাড়া অদ্যাবধি এমন কাউকে পাননি, যে আপনাকে দিতে পারে সে পথের সন্ধান। দরবেশ বললেন।

তুমি সে পথ দেখতে পারলে আমার অর্ধেকটা জায়গীর তোমায় এনাম দেব।

এনাম চাই না রাণী। খাজানা আমার চারপাশে অঢেল। কিন্তু সেটা আমার জন্য বেকার। আমি এ জগতের মানুষ নই। নই জ্যোতিষী, বরং আমি গণক। স্পেনরাজ দ্বিতীয় আবদুর রহমান তোমার পথ চেয়ে বললেন দরবেশ।

কিন্তু তিনি আমাকে দেখলেন কবে? শুনেছি জনাতিনেক পরমা সুন্দরী হেরেমে আটকা। আরও শুনেছি তিনি একজন পাক্কা মুসলমান ও দরবেশ প্রকৃতির যুদ্ধংদেহী। খুব সহব এজন্যই বুঝি তার কাছে আমার নামোচ্চারিত হয়নি আজো; সুলতানা বললেন। সুলতানার কণ্ঠে আকুতি ও খায়েশের সুর।

ইতিহাস বলছে, রাণী হওয়ার পাগলামি তার চেপে বসেছিল। রাণী হওয়ার ব্যাপারে তিনি প্রচণ্ড আশাবাদীও ছিলেন। এজন্য অন্য কোন পুরুষের প্রেম নিবেদনে সাড়া দেননি কোনদিনও। এছাড়া প্রতারণায়ও তার বিশেষ খ্যাতি ছিল। তিনি দরবেশকে বললেন,

আমি রাণী হতে চাই-একথা বলা ছাড়াই রাণী হওয়ার ব্যাপারে তুমি আমাকে। কোনরূপ মদদ করতে পার না? পার না আমাকে ময়ূর সিংহাসনে পৌঁছে দিতে? শুনেছি দরবেশরা অনেক কিছুই করতে পারে।

এর পূর্বে বলল, তুমি কোন মুসলিম শাসকের রাণী হতে চাও কি………

সুলতানা হেসে বললেন, আমার চাহিদা ধর্মীয় দৃষ্টিতে নয়। ধার্মিক হলে এতদিনে আমি অন্য কারো স্ত্রীত্বে থেকে বাচ্চা-কাচ্চার মা হতাম।

তাহলে আমি যা বলব সে অনুযায়ী কাজ করতে পারবে কি? একটি প্রদেশ তোমার অপেক্ষায়- যেটা মুসলমানদের হতে পারে না। তোমাকে দ্বিতীয় আবদুর রহমানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে এবং তার হেরেমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হতে হবে।

অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে তাকে বাধ্য করবো আমাকে রাণী করতে-এইতো? না। সে তোমাকে রাণী নয় বিবি বানাবে। পরে একদিন তোমার ওপর বিরাগী হয়ে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। পরবর্তীতে তোমার মত কাউকে নির্বাচিত করে নেবে। তার চেয়ে শোন, এই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে পার। করলে তুমি ওই প্রদেশের রাণী হতে পারবে। তোমার হাতে থাকবে বিশাল ফৌজ ও স্বাধীন রাজত্ব।

সুলতানা অসাধারণ বুদ্ধিমতী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্না নারী ছিলেন। তিনি দরবেশের কথা খুবই ধীরস্থির মস্তিষ্কে শুনে যাচ্ছিলেন। বারকয়েক দেখে নিয়েছিলেন তার চেহারাও। আচমকা তিনি উঠে দাঁড়ালেন। অগ্রসর হয়ে দরবেশের দাড়ি ধরে আঁকা দিলেন। দাড়ি তার হাতে উঠে এল। অপর হাত দরবেশের মাথায় রেখে হ্যাঁচকা টান মারলে মাথার চুলও তার হাতে লেগে থাকল। মুখের থেকে নকল দাড়ি ও মাথা থেকে নকল চুল অপসারিত করে সুলতানা দেখলেন, কোথায় কার দরবেশ! এতো এক জোয়ান আদমি।

কে তুমি? গোৰা, বিস্ময়ে হতবাক কণ্ঠে বলেন সুলতানা, কি জন্যে এসেছে এখানে? তোমার কি জানা নেই যে, আমি তোমার লাশ কুত্তা দিয়ে খাওয়াতে পারি?

তাগড়া জোয়ানটি ভয়ে না কেঁপে মুচকি হাসতে লাগল।

এলোগেইছ আমার নাম রাণী! ছদ্মবেশে তোমার কাছে আসা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তুমি আমার লাশ কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে- এ মানসিকতা নিয়েও আমি আসিনি। আমার ছদ্মবেশ উন্মোচিত হবার পরও ঐকথা বলবো- ছদ্মবেশী থাকতে যা বলেছিলাম। কথার মাঝে ধর্ম এজন্য টেনেছি যাতে তোমার ইসলাম প্রিয়তা প্রবল হলে ওভাবেই ফিরে যেতে পারি।

তুমি কি আমায় খ্রীস্টান বানাতে এসেছ? প্রশ্ন সুলতানার।

না সুলতানা, তুমি মুসলমান থাকছ এবং রাণী হবার পরও থাকবে। বলে এলোগেইছ পকেট হাতড়ে একগোছা মোতির মালা বের করলেন। কুপির টিমটিমে আলোতে তা চকচক করে ওঠল। তিনি আরো বললেন, এটা কেবল রাণীদেরই সোনার অংগে শোভা পায়।

মোতির মালা তিনি সুলতানার দিকে বাড়িয়ে বললেন, এটা তোহফা। জানো, কে প্রেরণ করেছে? ফ্রান্স সম্রাট লুই। নাও, তোমার এটা।

সুলতানার চোখে বিস্ময়। তিনি আনন্দে উহ্। সত্যিই এ ধরনের মালা তার জীবনে প্রথম। তারপরও তা ফ্রান্স সম্রাট প্রেরিত। বিস্ময়ের ঘোর কেটে তিনি জিজ্ঞেস করেন, কি চান ফ্রান্স সম্রাট? প্রশ্নের ঢং কতকটা এমন যেন তিনি নিজকে ভুবন মোহিনী ভাবছেন এবং সম্রাট তার নারী সুষমার স্বাদ নিতে পাগলপারা।

তিনি তোমাকে সম্রাজ্ঞী বানাতে চাচ্ছেন না, চাচ্ছেন একটি প্রদেশ দিতে। প্রতারণা বা প্রবঞ্চনা দেয়া হবে না তোমাকে বরং তোমাকেই প্রতারণায় প্রতিভূ হতে হবে।

তার মানে দ্বিতীয় আবদুর রহমানের প্রাসাদে প্রবেশ করিয়ে আমার দ্বারা তাকে ধোকা দেয়া হবে এই তো। তোমার দুঃসাহসিকতার তারিফ করি আমার গ্রেফতানীর শংকা তোমার মাঝে নেই দেখে। আমি তোমায় হত্যাও তো করতে পারি।

তুমি জিন্দা থাকলে তো? আমার যবান এক কিন্তু শক্তিৰাহু ও হাত অনেক। আমি একাকী নই। এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য আমাকে ছায়ার ন্যায় ঘিরে আছে। যতটা আমি যমীনের ওপরে ঠিক ততটা অভ্যন্তরেও আমাকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা ত্যাগ কর সুলতানা। আমি তোমার ভবিষ্যৎ চমকে দেব। তোমার ভুবন মোহিনী সৌন্দর্য থেকে ফায়দা তোল। তোমার ওই রূপ-যৌবন ক্ষণিকের তরে। তোমার থেকে কিছু নিতে নয় দিতে এসেছি আমরা। আবদুর রহমান তোমাকে নয়নমণি বানাবে। তাঁকে দিওয়ানা বানিয়েই তোমার স্বার্থোদ্ধার করতে হবে।

এমনিতেই আমি একাকী। প্রাসাদে যাবো ভাবলে তুমি ভুল করছ। একাকী যাঞ্চা করে গেলে আমার মূল্যায়ন হবে না।

তার চোখে তোমার রূপের ঝলক ফোঁটানোর দায়িত্ব না হয় আমিই নিলাম। তুমি স্রেফ বলো, আমাদের প্রস্তাবে সম্মত কি-না। বাকী কাজ আমরাই করব।

কি করতে হবে আমাকে?

আবদুর রহমানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে, রূপের হাটের সওদাগর বানাতে হবে। তিনি তার তিন বাদীর জন্য পাগল। ওদেরকে সতীন জ্ঞান না করে ওদের সাথে মিলে আবদুর রহমানের সত্তাকে নারীত্বের মাঝে লীন করে দেবে। যেনতেন মানুষ নয় সে। নারীমোহ হোক একবার চোখ ফেরালে গোটা খ্রিস্ট বিশ্বে তার প্রভাব পড়বে। তাঁকে পাগলপারা করে তোল, বিষ প্রয়োগ কিংবা হত্যা নয়। বিনিময়ে যা পাবে তা তোমার স্বপ্নাতীত ও কল্পনাতীত।

আমি প্রস্তুত। সুলতানা বললেন।

তাহলে এখন শোন- তোমার করণীয় কি? বলে এলোগেইছ বলতে আরম্ভ করলেন।

***

যে রাতে আবদুর রহমান সঙ্গীতজ্ঞ যিরাবের যাদুকরী সুর-মূর্ঘনায় ডুবেছিলেন এবং তার প্রিয় তিন বাদী তার চারপাশে ছিল যাদের একজনকে তিনি স্ত্রীত্বে নিয়েছিলেন, ঐ রাতেই তার সাধের স্পেনে এক নয়া ষড়যন্ত্রের কুটিল জাল বিস্তার করা হচ্ছিল। এ সেই আবদুর রহমান যিনি রণসিংহ হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। যিনি ছিলেন খ্রিস্টবিশ্বের ব্রাস, যার দূরদর্শিতার সামনে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফ্রান্স সম্রাট দুই পর্যন্ত মাথা নোয়াতে বাধ্য ছিলেন। সেই আবদুর রহমানই রঙ্গরসের আসর সাজিয়ে আপনার বীরত্ব আর নারীমাংসমোহে গলা অবধি ডুবে ছিলেন। যে হাত এক সময় জাতির বীর গাযীদের সফলতায় তালি বাজাত সেই হাতই এখন নৃত্যশিল্পীর কোমর দোলানোয় স্পন্দিত হতে থাকল।

যিরাব ইরানী বংশোদ্ভূত। প্রকৃত নাম আলী ইবনে নাফে। উপনাম আবুল হাসান। তিনি ওই যুগের সাড়া জাগানো সংগীতবিশরিদ ছিলেন। সুগায়ক ইসহাক আল মোহলী মুকরীর শাগরেদ ছিলেন। যিরাবের কণ্ঠের গানে যে মাদকতা তা তার ওস্তাদদের মাঝেও ছিল কি-না মুশকিল। তিনি কেবল সঙ্গীত সম্রাট-ই নয়, ছিলেন হ্যান্ডসাম ও সুঠামদেহী। তিনি গেয়ে যেতেন শ্রোতারা মন্ত্রযুদ্ধের ন্যায় শুনত। গানের সুরে মানব হৃদয়কে কি করে কাছে টানতে হয় সে গুণটি ছিল তার মাঝে। জনগণের মাঝে এমনও একটা শ্রুতি ছিল যে, লোকটার কজায় হয়ত কোন গায়েবী শক্তি কিংবা জিন-ভূত আছে। কেননা এ বয়সের এক যুবকের মাঝে এ পরিমাণ যোগ্যতা থাকার কথা নয়।

তিনি আফ্রিকা চলে গিয়েছিলেন। আবদুর রহমানের পিতা আল হাকাম তার খ্যাতি শুনে ইহুদী গায়ক মারফত স্পেনে ডেকে পাঠান। যিরাব ঠিক তখনই কর্ডোভায় পৌঁছেন। যখন আল-হাকাম পরকালের পথ ধরেছেন এবং তার স্থানে তদীয় পুত্র আবদুর রহমান সিংহাসনে বসেছেন। যিরাবের হতাশ হতে হয়নি, কেননা আবদুর রহমানও তার পিতার মত সঙ্গীত পাগল ছিলেন। তিনি যিরাবকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানালেন। তিনি সামান্য দিনের ব্যবধানে প্রাসাদে প্রভাব বিস্তার করলেন। শুধু কি তাই! সঙ্গীতজ্ঞের পাশাপাশি নিজকে একজন আলেম, দার্শনিক ও তর্কবাগীশের কাতারে শামিল করলেন।

***

এর দিনদুয়েক পরে আবদুর রহমান শিকারে বের হলেন। যেদিকটায় হরিণের আনাগোনা বেশী সাধারণত সেদিকটায় তিনি বেশি যেতেন। সঙ্গে রাজকীয় গার্ড বাহিনী। আবদুর রহমান ঘোড়ার পিঠে। তীর হাতে সর্বাগ্রে তিনি। সন্নিকটে একটা সফেদ ঘোড়ার গাড়ী দেখা গেল। ওই গড়ীর কোচোয়ানের গতি আবদুর রহমানের দিকেই। আচমকা সে থেমে গেল। বোঝা গেল তার ঘোড় ভীত হয়েই ছুটছে। যমীন বন্ধুর। ঠাসা বৃক্ষরাজি। ঘোড়ার গাড়িটা বারবার পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। আবদুর রহমানের দৃষ্টিতে ব্যাপারটা পড়ে। সহসাই তিনি গার্ড বাহিনীকে এই গাড়ির সাহায্যে ছুটে যেতে বলেন। ঘোড়ার গাড়ীটা তখন এলোপাথাড়ি ছুটছে তো ছুটছে। গাড়ী চালক লাগামশেষে টান মারে। ভেতরে শোনা যায় নারীকণ্ঠের আর্তনাদ। গাড়ী চালক এই আর্তনাদে প্রভাবিত হয়ে প্রচেষ্টার পর প্রচেষ্টা চালিয়ে থামিয়ে ফেলে। তাকে সাহায্যে করে দেহরক্ষী বাহিনী।

গাড়ী থেকে পরমা সুন্দরী এক নারী বেরিয়ে এলো। সে দেহরক্ষী বাহিনীকে কৃতজ্ঞতা জানাল। তার ফুলে ফেঁপে ওঠা চোখ-মুখ নেপথ্যে বলে চলছে, সে বেশ ভড়কে গিয়েছিল। চালকের অবস্থা তার চেয়ে সঙ্গীন। দেহরক্ষীরা জানাল, এটা স্পেনরাজের রাজকীয় শিকার ক্ষেত্র, এখানে আসার কারণ কি তোমাদের? তারা আরো বলল, তোমাদেরকে বর্তমান স্পেনরাজ দ্বিতীয় আবদুর রহমানের সামনে যেতে হবে। তারা আরো বলল, তোমাদেরকে বর্তমান স্পেনরাজ দ্বিতীয় আবদুর রহমানের সামনে যেতে হবে। তার হুকুমেই আমরা তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি। উদ্ধার করে তোমাদের তার সামনে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ আছে।

দেহরক্ষীরা অগ্রে চলছে। গাড়ীতে অবস্থানরত নারী হাওদার মধ্যে থেকে চালকের দিকে তাকাল। সে কতকটা উপরে বসা।

এলোগেইছ! নারীকণ্ঠ ফিসফিসিয়ে ওঠল, সত্যিই কি আমাদের ঘোড়া ভয়ে অমন টগবগিয়ে ছুটছিল? আমার রক্ত তো শুকিয়ে যাবার মত অবস্থা।

এলোগেইছ হেসে বললেন, আমার কারসাজির প্রশংসা কর সুলতানা! ঘোড়া ভয়ে অমন করেনি। আমিই ইচ্ছাপূর্বক ওদের অমন করতে বাধ্য করেছি। যাতে রাজার দেহরক্ষীরা সাহায্যে ছুটে এসে আমাদের বন্দী করে নেয়। এক্ষণে ওরা তোমাকে তাঁর সমুখে নিয়ে চলেছে। সত্যি বলতে কি, সরকারী শিকার ক্ষেত্রে আনাগোনা অন্যায়। আমার সুনিপণ চাল তুমি দেখেছ। এবারের পালা তোমার।

***

এটা নিছক এলোগেইছের চাল। আবদুর রহমানের প্রাসাদে তারই এক লোক সংবাদ দিয়েছিল যে, অমুক দিন তিনি শিকারে বেরোচ্ছেন। সুলতানাকে পেশ করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে এই শিকারকে লুফে নিলেন তিনি। ইচ্ছে করেই ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে সুন্দরী সুলতানাকে পেশ করার চাল চাললেন। ঘোড়া প্রকৃতপক্ষে তার করায়ত্তেই ছিল।

সুলতানাকে যখন আবদুর রহমানের সামনে পেশ করা হল তখন গোস্বার স্থলে তার চেহারায় ফুটে ওঠল আনন্দদ্যুতি। ঠোঁটে পরিধি বাড়ানো মুচকি হাসি। সুলতানাদের পরিকল্পনা সফল। আবদুর রহমান এলোগেইছের-দিকে তাকালেন যিনি ছদ্মবেশে চালকের আসনে ছিলেন। তিনি এই বলে আসন থেকে নামলেন, অপরাধ আমার স্পেন সম্রাট! ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসেছিলাম। তাছাড়া শাহী শিকার ক্ষেত্রের জ্ঞানও ছিল না আমার।

আবদুর রহমান যেন তার ওজর গুনেও শুনছেন না। তার দৃষ্টি সুলতানার চেহারায় নিবদ্ধ।

শাহী শিকার ক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই আমার। তুমি কে? সুলতানাকে প্রশ্ন করেন আবদুর রহমান।

তুরুবের রাণী। সুলতানা আমার নাম।

কোন প্রদেশের রাণী? তুরু? আবদুর রহমান জিজ্ঞাসুনেত্রে সরকারী অফিসারদের দিকে তাকান।

তুরুব একটি জায়গীর; কোন প্রদেশ নয়। জনৈক অফিসার বললেন।

সুলতানা তাঁকে জানালেন যে, তার বাবা মারা গেছেন, তিনি এখনও কুমারী। ওই জায়গীরের মালিক।

সত্যি সত্যিই তুমি রাণী হতে পার। তুমি যুবতী। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ফায়সালা করার এখতিয়ার আছে তোমার। আমার যদুর বিশ্বাস, কি বলতে চাই আমি-তা তোমার অবোধগম্য নয়।

বুঝেছি স্পেনরাজ! এতটুকু ইশারা বুঝাবার মত জ্ঞান আছে আমার।

খানিকবাদে ঋীমায় দস্তরখানে খানা খাচ্ছিলেন সুলতানা। খাদ্য তালিকায় ছিল সদ্য শিকারকৃত হরিণ শাবকের রনি। আবদুর রহমানের খুশীর অন্ত নেই। যুৎসই শিকার মিলে গেছে তার। সুলতানার নিটোল মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি যেন অতৃপ্ত হৃদয়ের জ্বালা নিবারণ করে যাচ্ছিলেন অহর্নিশ।

***

জ্বালা নিবারণের এই পরম্পরা, আবদুর রহমান ইবনুল হাকামের ওপর ছায়া বিস্তার করে রইল। সুলতানা তার বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন না বটে, কিন্তু হেরেম ও আবদুর রহমানের অন্দর মহল তার অধীনেই চলত। তিনি আবদুর রহমানকে ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে দেননি যে, প্রথম তার সাথে যে মোলাকাত হয় সে সময় তার ঘোড়ার গাড়ী চালক মিঃ এলোগেইছ তার কর্মচারী ছিল না। ওই ঘটনা ছিল সাজানো নাটক। সুলতানার চরিত্র সম্পর্কে এলোগেইছ বলছে,

ভুবন মোহিনী তার রূপ, সৌন্দর্য অনন্য। কুদরত বুঝি নিজ হাতে তাকে বানিয়েছিলেন। যেমন সুন্দরী এই নারী তেমনি চালাক ও প্রতারকও। আপাদ মস্তকে তার বুদ্ধি টইটম্বুর। যেমন পোষাকী তেমনি দেমাগী। ভাবখানা যেন এমন, রাজা বাদশাহরা তার কর্মচারী। তিনি আবদুর রহমানকে পাগল বানিয়ে ফেলেন। আমীরের এই দুর্বলতা ভালভাবেই উপলব্ধি করেন। একবার আবদুর রহমান তাকে খুশী করতে গিয়ে এত সোনা-দানা দান করেন যাতে খাজাঞ্চিখানা তলাহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়।

একবার সুলতানা স্পেন আমীরের ওপর রাগ করে দরোজায় খিল এঁটে দেয়। তার বিরহে আবদুর রহমানের জীবন তেতো হয়ে ওঠে। পরিবেশ খাঁ খাঁ করে ওঠে। তিনি কবাদীর মাধ্যমে তাকে রাজী করিয়ে হেরেমে যেতে উদ্বুদ্ধ করান। কিন্তু সুলতানা অনড়। মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা তাঁকে বোঝান। সামান্য একা নারী এতই দাম্ভিক যে, সে হেরেমে থেকেও রাজার সম্মান বজায় রাখতে ভুলে গেছে। তারা বলেন, দরোজার বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়া হোক যাতে সে ভেতরেই দম আটকে মরে।

আবদুর রহমান এই পরামর্শ তো শুনলেনই না উপরন্তু উপদেষ্টাদের ওপর প্রচণ্ড রাগ করলেন। বললেন, যাও। তার কামরার সম্মুখে স্বর্ণমুদ্রার নূপ জমা করো। তার হুকুম তামিল হল। আবদুর রহমান দরজার কাছে গিয়ে সুলতানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দরজা খুলে দেব। এসব দৌলত তোমার। দরজা খুলে গেল। সুলতানা এই খেল-তামাশায় পাক্কা খেলুড়ে। তিনি বের হয়ে আবদুর রহমানের পায়ে পড়লেন, হাতে নামিয়ে দিলেন দুঠোঁট। ভাবখানা যেন এই তিনি বাদশাহর জন্য দেওয়ানা। দেওয়ানা তো বাদশাহ স্বয়ং, যিনি দেখে দেখলেন না যে, এই নারী কিসের পাগল। তিনি বাদশাহর হাতে চুমো দিলেন ঠিকই, এর পাশাপাশি বাদশাহকে কামরায় নিয়ে যাওয়ার পূর্বেই সোনা-দানা ও মনি-মাণিক্যের থলেগুলোকে ঝুলিতে পুরলেন।

মহলে কানাঘুষা শুরু হল। হেরেমের নারীরা দাতে আংগুল কাটল।

সকলের মনে সুলতানার প্রভাব সঞ্চারিত হল। এরা সকলে আবদুর রহমানের সৌন্দর্য, সমর নিপুণতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কথা জানত। তারা এক্ষণে অনুধাবন করল, এহেন সিংহপুরুষকে যে কাবু করতে পারে, তার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন অলৌকিক গুণ কিংবা যাদু রয়েছে।

সবচেয়ে বেশী হতাশ হয়ে পড়ল ওই তিন নারী আবদুর রহমান যাদেরকে চক্ষুর আড়াল হতে দিতেন না। সুলতানা তাদের প্রিয় মানুষটিকে কুক্ষিগত করে নিয়েছে। নারীসুলভ ঈর্ষায় এরা জ্বলতে থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক। সুলতানা একবার এদেরকে তার কামরায় ডেকে পাঠালেন। তিনজনই যেন অশেষ ঘৃণা নিয়ে হাজির হল। তারা তার ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা দেখল যা এক প্রকার বিজয়িনীর-ই টিপ্পনি বলা বলে।

তোমরা আমার নিকটে এসো। সুলতানা বললেন, আমি যদুর জানি এখানকার সকলের যবান আমার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সবকিছুই আমার কানে এসেছে। কিছু কথা তোমরাও বলেছ।

তিনজনই বে-চাইন হয়ে পড়ে। এটা ভীতিভাবের বহিঃপ্রকাশ। কারণ, সুলতানা তাদেরকে হেরেম থেকে বহিষ্কার করে দিতে পারে। স্পেনরাজ তার হাতের পুতুল। এমন কি এদের হত্যার হুকুমও জারী করাতে সক্ষম। তিনি আবারও বললেন,

তোমাদের চেহারায় চিন্তার ভাজ দেখছি যে তোমরা কি আমায় সতীন ঠাওরাচ্ছ? মন থেকে এমন চিন্তা মুছে ফেল। আমি আর যা কিছুই হই না কেন-তোমাদের মত এক নারীতে! নারীই বোঝে নারীর হৃদয়। আমি নিজে যেমন তোমাদেরকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না তেমনি করবে না তোমরাও। স্পেন রাজ্যের প্রতি ভালবাসা সবার তরে সমান। আজ তিনি মারা পড়লে কাল কোন বন্ধুবখশ তার স্থানে আমীর হলে আমরা চারজনই তার দাসী হব। তোমরা আমার পজিশন লক্ষ্য করেছ। আমি কি করতে পারিকি পারি না। তবে আমি হেরেমের কোন নারীর বিরুদ্ধে না যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি।

মুদাচ্ছেরা? সুলতানা বললেন, স্পেনরাজ তোমায় বিবাহ করেছেন, তুমি তার স্ত্রী। তিনি তোমার প্রতিও দুর্বল। তুমি কি মনে কর কেবল তোমার প্রতিই তার সব ভালবাসা উৎসর্গিত?

তিনি কারো নন, বললেন মুদাচ্ছেরা, আমি তার একমাত্র স্ত্রী নই। অন্যের তুলনায় তিনি আমাকে অধিক পেয়ার করেন। এজন্যেই আমাকে বিয়ে করেছেন। এক্ষণে তুমি তার কাছে সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় হলে……….

কিন্তু আমি তার সাথে বিবাহ বসব না। বিবাহ-বহির্ভূত পন্থায় তাঁর সান্নিধ্যে থাকবো। তোমাদেরকে বলছি, কোন অবস্থায় আমার প্রতি শক্ৰমনোভাবাপন্ন হবে না। পূর্বেই বলেছি আমি যেহেতু নারী, তাই কোন নারীকে আমার পদতলে নেব না।

তার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমি এর দ্বারা তোমরা এ ধারণা করে না যে, তাঁকে তোমাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। কাজেই তোমরা মনমুকুর থেকে উদাসীনতা ও হীনতা মুছে ফেল।

ওই তিন রাণী সুলতানার কক্ষ থেকে এই চেতনা নিয়ে বের হল যে, সে না কোন রাণী, না কেবল স্পেন রাজ্যের একক অধিকারিণী বরং সে এদের সহমর্মী ও সহনশীল। কাজেই সকল ঘৃণা ও ক্ষোভ তার মন মীনার থেকে ধুয়ে ফেলল।

***

এটা বে-ইনসাফী, এটাও জুলুম যে, কাল পর্যন্ত যে আপনার দৃষ্টিতে সেরা ছিল-আজ আমার প্রেম আঁচলে বন্দী হয়ে তাকে ভুলে চলেছেন। সুলতানা বললেন আবদুর রহমানকে, আপনি স্রেফ পুরুষ নন-একজন বাদশাহও। সুতরাং আপনার হৃদয়টাও বাদশাহসুলত হওয়া চাই। কোন নারী অপর এক নারীর হৃদয়কে কাঁচপাত্রের টুকরো হতে দিতে নারাজ। আমি দু-তিন দিন পর জায়গীর যেতে চাই। কাজেই আপনি মোদাচ্ছেরা, জারিয়াহ ও শেফাকে সে দৃষ্টিতে দেখবেন যে দৃষ্টিতে আমাকে দেখে থাকেন। নতুবা ওদের হাহাকার আমাকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে।

না, সুলতানা। আবদুর রহমান সমোহনী সুরে বললেন, দুতিন দিন তো দূরে থাক তোমাকে দুতিন মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেব না।

আপনি বাদশাহ বলে আপনাকে কামনা করি না। অঢেল মনি-মাণিক্যের লোভেও আপনি আমার প্রিয়পাত্র নন। একজন মানুষ হিসেবেই আপনাকে ভালবাসি। আমার সেই ভালবাসা ঠিক তখনই আহত হয় যখন আমি কোন নারীকে আমারই কারণে হাহাকার করতে দেখি। মাত্র তিন দিন রাজন!

তিনি আবেগতাড়িত আলাপ করে আবদুর রহমানকে এভাবে কাবু করলেন যেভাবে ধুরন্ধর সাপুড়ে তার বাঁশি দ্বারা বিষধর সাপকে নত করে। সুলতানা এভাবে প্রেম নিবেদন করলেন যেন আবদুর রহমানকে ছাড়া তার দুতিন মুহূর্তও চলে না।

সন্ধ্যার দিকে তিনি জায়গীরের উদ্দেশ্যে হেরেম ছাড়লেন। আবদুর রহমান তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেহরক্ষী দিলেন-রাতের বেলা যারা তাকে দুশমন থেকে রক্ষা করবে। দিলেন শাহী বাবুর্চিও এবং অসংখ্য চাকর-বাকরও। এলোগেইছ ছদ্মবেশী হয়ে হাজির হল। দেহরক্ষীদের কেউ তাকে সন্দেহও করার সুযোগ পেল না।

সুলতানা বললেন, আমি সর্বদিক দিয়ে কামিয়াব। জানতাম না এই লোকটা নারীদের প্রতি এতটা দুর্বল। নারীদের ঘ্রাণ পেলেই সে দুজাহানই ভুলে যায়।

দিমাগে নারীসুষমা প্রভাব ফেললে রক্তখেকো যুদ্ধাংদেহী অস্ত্রধারণ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। পক্ষান্তরে নারী যদি কোন কাপুরুষের পিঠ চাপড়ে বলে, আমি তোমার সম্ভম তো সে বীর পুরুষ হয়ে যায়। আমরা স্পেনের মুসলিম শাসকদের এভাবেই অকর্মা বানিয়ে ছাড়ব। বলল এলোগেইছ।

এলোগেইছ ছোট একটা বাক্স এনেছিল। সেটি খুলে সুলতানার সামনে রেখে বলল, নগণ্য এই উপঢৌকনটুকু ফ্রান্স সম্রাট তোমায় দিয়েছেন। প্রকৃত উপঢৌকন এখন তোমার অপেক্ষায়।

আমাকে আর কি করতে হবে? সুলতানা প্রশ্ন করেন।

যা করে চলেছ-তাই। আমি তোমাকে বলে যাব তুমি সে অনুযায়ী কর্ম-সাধন করে যেতে থাকবে।

ওই তিন নারীকে আমি হাতের মুঠোয় এনেছি। মহলে কারো সাথে আমার দুশমনি নেই। মহলে যিরাব নামের সংগীতজ্ঞ যার প্রতি স্পেনরাজ উৎসর্গিত-তার কথায় দরবার চলে। সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, এমন কি করেও ছাড়ে। কুদরতের এক অলৌকিক সৃষ্টি এই লোক। তার মাঝে এমন কিছু শক্তি আছে যার বদৌলতে পাথরে ফসল ফলাতে পারে। শেনরাজ তার সামনে মক্তবের ছাত্রের মত। আমাকে সে কতকটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করেছে। আমি তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছি। আশা করি তাকেও কুপোকাত করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।

ওকে তোমার সহকর্মী করে নাও। আর হ্যাঁ, মনে রেখ সুলতানা! স্পেনরাজকে হত্যা করা যাবে না। জীবিত আবদুর রহমানই আমাদের উপকারে বেশী আসবে মৃত আবদুর রহমান থেকে। তাকে ইন্দ্রিয়পরায়ণতা ও বিলাসিতায় গলা অবধি ডুবিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার, বাদবাকী কাজ আমাদের।

এলোগেইছ! আমার সম্পর্কে একটা কথা তোমাকে বলতে চাই। আমি কারো হাতের খেলনা কোনদিনও হইনি। খেলনা বানিয়েছি সকলকে। তুমি এখনও তোমার প্ল্যান-প্রোগ্রাম আমাকে জানাও নি। কি তোমার ষড়যন্ত্র যার ক্রীড়নক হিসেবে আমাকে ব্যবহার করছ? আমার ওপর কি তোমাদের ভরসা নেই? যদি বলি তোমরা নিজেদের স্বার্থোদ্ধারেই আমাকে ব্যবহার করছ-এটা বললে ভুল হবে কি? এই মনি-মাণিক্য দ্বারা আমাকে ক্রয় করতে যেও না এলোগেইছ।

আমি যদ্দুর শুনেছি ধীমান নারী ইশারা বুঝতে সক্ষম। আমি তোমাকে নির্বাচন করে ভুল করিনি। অদ্যাবধি কি বুঝলে না, কি আমাদের প্ল্যান ও ষড়যন্ত্র? মনে করে দেখ তো, প্রথম সাক্ষাতে যখন তুমি আমার ছদ্মবেশ আবিষ্কার করেছিলে, তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম-কি তোমার ধর্ম আর ধর্মের প্রতি কেমন তোমার টান? তুমি উত্তর দিয়েছিলে, ধর্মের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই কেবল তোমায় ধর্ম। রাণী হওয়া এর অন্যতম। বলেছিলাম, তোমাকে আমরা রাণী বানাবো, বেশ কিছুদিন তুমি আবদুর রহমানের রাণী হিসেবে থেকেছ। স্পেনে মুসলিম পতনের শুরু হতেই একটা প্রদেশ পেয়ে যাবে। ফ্রান্স সম্রাট নিজ হাতে তোমার আঁচলে বেঁধে দেবেন এর চাবি।

আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, এদেশে আমাদের বিদ্রোহাগ্নি জ্বালাতে হবে। আমরা এক গুপ্ত আন্দোলনের দাবানল সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। তোমার হয়ত অজানা নয় যে, যে দেশে বাদশাহর বিরুদ্ধে অত্যুত্থান হয় সে দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে রক্তপাতের সৃষ্টি হয়। যদি বাদশাহ যিরাবের মত সংগীতজ্ঞ আর তোমার মত ভুবনমোহিনীর রূপে মোহাচ্ছন্ন থাকে, আর তার অধীনে সুদক্ষ সেনাবাহিনীও থাকে তাহলে তারা কমযোর হয়ে পড়বে অতি অবশ্যই। তুমি তোমার রূপের যাদুতে স্পেনরাজকে কাবু কর। তাকে তোমার নারী সুষমায় রাজ্য ও প্রতি-আক্রমণের কথা ভুলিয়ে দাও।

বুঝেছ সুলতানা। কি বলছি আমি। আমরা আবদুর রহমানকে জীবিত রাখতে চাই। তবে তার পৌরুষবহুল বীরোচিত ভেতরটা ভোলা বানিয়েই। এ কাজ খুব একটা সহজ নয়। এজন্য তোমার এনাম এত বিশাহু-বিশাল এক প্রদেশ, যার কর্ণধার হবে তুমি। থামল এলোগেইছ।

***

এলোগেইছ যে গুপ্ত আন্দোলনের প্ল্যান বয়ান করছিল তা কেবল ঔপন্যাসিক গল্প নয়- এই প্ল্যান বাস্তব। এলোগেইছ-ই যার পথিকৃত। স্পেনের মুসলিম শাসকদের গ্রানাডাচ্যুত করার প্রথম অধিকর্তা এই লোকই। কুদরত তাকে দিয়েছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞা ও মেধা। ধর্মজ্ঞানে সুপন্ডিত আর কূটনৈতিক ময়দানে সুদক্ষ সেপাই। সে আরবী ভাষা রপ্ত করেছিল এবং কুরআনের মানে মতলব বুঝতে শিখেছিল। স্পেনের প্যালোনায় খ্রীস্টানদের ইবাদাতগাহ ছিল। ওখানে একটি বই উদ্ধার করা হয়, যাতে বিশ্বনবী সম্পর্কে কুৎসা লেখা ছিল।

এ বইতে অনেক বইয়ের রেফারেন্স ছিল। এলোগেইছ এর কপি নকল করে গীর্জায় বিলি করে ও পাদ্রীদেরও নকল করে বিলি করতে বলে। সুতরাং ইসলামের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা পুরোদস্তুর চলতে থাকে। মুসলমান প্রশাসক যারা আমীর বা গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত ছিল তাদেরকে বাদশাহ আখ্যা দেয়া শুরু হল। তারা জানলনা ইসলাম ও ইসলামী সাম্রাজ্য নিয়ে চলছে কি ষড়যন্ত্র।

এলোগেইছ শহরে শহরে ঘুরে অবশেষে ফ্রান্সে গিয়ে উপনীত হল। ইসলামী সাম্রাজ্যের শেকড় কাটা ও মুসলিম শাসন ধ্বংসের মিশন বানাল সে। তার এ আওয়াজ গীর্জা ও খ্রীস্টান বাড়ী বাড়ীতে পৌঁছে গেল যে, ধর্ম-কর্ম ছেড়ে দিলে আগামী বংশধরও মুসলমানদের গোলাম হয়ে যাবে। ধর্মের ঝান্ডাবাহীরাই বর্তমান সময়ে ধর্মের রক্ষাকর্তা। মুসলমানদের নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। তাদের শাসক মহলে নূপুর, নিক্কণ ও নারী বিলাসিতা জেঁকে বসেছে। হৃদয়ে প্রগাঢ় হয়েছে ক্ষমতালোভ। ওরা জাতিকে এক্ষণে ধোকা ও প্রতারণা দিয়ে চলেছে। ওদের সেই অজেয় সমর চেতনা লোপ পেয়ে গেছে যার বদৌলতে এক সময় অর্ধ দুনিয়া শাসন করেছে। ওদের বাদশাহরা জাতিকে এমন স্থানে নিয়ে গেছে যেখানে কোন তারিক বিন যিয়াদ পয়দা হবে না। এ জাতি এমন সন্তান পয়দা করতে অপারগ। ওদের বধূ-মাতারা বন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন থেকে কর্তৃত্ব হবে ঈসা মসিহর। শাসন হবে ক্রুসেডের।

এলোগেইছের এই আন্দোলনকে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা বলে। কপটচারিতা বলেও অনেক ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন। আরবীতে একে মোয়াল্লেদীন বলে। মোয়াল্লেদীন ঐসব খ্রীস্টানদের বলে, যারা মুসলিম শাসনের যবনিকাপাতের স্বার্থে ইসলাম গ্রহণ করে। এদের অধিকাংশই কর্ডোভা, টলেডো ও মালাকাবাসী।

এরা এলোগেইছের মত নেতা পেয়ে খ্রিস্টধর্মে প্রত্যাবর্তন না করে মুসলমান থেকেই ইসলামের শেকড় কাটতে থাকে। ইতিহাস লিখেছে, ওরা মসজিদে নামায আদায় করত। দেখতে পাকা মুসল্লী, কিন্তু তলে তলে পাক্কা খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের আস্তিনের সাপ। ইসলাম বিরোধী চেতনা ছাড়াও আরবদের ব্যবহার ওদের হতাশ করে দিয়েছিল। আরবজাতি এই নও মুসলিমদের ঘৃণার চোখে দেখত। অথচ কুরআন ও ইসলামী ভাবধারা মোতাবেক ওদের প্রকৃত আরবদের মতই পজিশন লাভ করার দরকার ছিল, কিন্তু বাস্তবে ছিল এর উল্টো।

এলোগেইছ আরেক সতীর্থের সন্ধান পেয়েছিলেন। আইলিয়র তার নাম। এরা দুজনই জনৈক ঈসায়ী ধর্মপ্রচারক শীর-এর শাগরেদ। ওদের এই বস একটি ইসলাম বিরোধী বই লিখেছিলেন।

দ্বিতীয় আবদুর রহমানের যুগে মুসলিম চেতনাকে বিনাশ করার জন্য যখন এহেন ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠছিল তখন তিনি মিউজিকের ধুম-ধাড়াক্কা ও নারীদেহ নিয়ে মেতে ছিলেন।

***

তুরুবের রাণী সুলতানা আব্দুর রহমানকে বলেছিলেন যে, দুতিন দিনের মধ্যে ফিরে আসবেন। যে উদ্দেশ্যে তিনি গিয়েছিলেন তা প্রথম দিনেই সমাধা হয়ে যায়। মাত্র এক রাতই জায়গীরে অবস্থান করেছিলেন। এটি তার জীবনের এক স্মরণীয় রাত। এলোগেইছের যাদুকরী প্ল্যান আর তার যৌবনদীপ্ত চেহারা সুলতানাকে আকর্ষণ করে। সুলতানার মনে দাগ কাটে। তাছাড়া তিনি এলোগেইছের সাথে এজন্য ভাব রাখতে চান। যাতে নয়া প্রদেশ পেয়ে যান।

এলোগেইছ রাতে আলাদা কামরায় থাকল। মাঝরাতে কারো হস্তস্পর্শ ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ গেল খুলে। দ্রুত সে কোমরে গোঁজা ছোরায় হাত বুলাল। সুলতানা কথা বলে না ওঠলে তার ছোরা সমূলে বিদ্ধ হত বুকে। এলোগেইছ বলে উঠল, সুলতানা! কি সংবাদ নিয়ে এলে?

সংবাদ নয় তোমার পৌরুষে টোকা মারতে এসেছি। সুলতানা আধো ঘুম অবস্থায় নিজের শরীর এলোগেইছের দেহে লীন করে দিয়ে বলল, যে কথা তুমি বলতে চাওনি তা আমি বুঝতে পেরেছি। নিজকে এভাবে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে কেন এলোগেইছ?

এলোগেইছ হো হো করে হেসে ওঠল। এ হাসি মুচকি নয়-গম্ভীর। সে বলতে লাগল, আমাকে ওই শ্রেণীর পুরুষের কাতারে শামিল করো না যারা নারী সুষমায় মাতোয়ারা। তুমি যে পৌরুষে সুড়সুড়ি দিতে এসেছ তাতে আমার দেহ সজাগ হলেও হৃদয় মরে যাবে, আমার দেহ নিয়ে যেমনি কোন অনুরাগ নেই তেমনি নেই তোমার দেহের প্রতিও কোন রকম টান।

সুলতানা ঠিক এভাবে কামরা থেকে বেরোল যেন এলোগেইছই তাকে জোরপূর্বক বের করেছিল। যাবার সময় তিনি বললেন, এলোগেইছ! আমাকে তোমার অযোগ্য মনে করছ বুঝি?

যোগ্য মনে না করলে তোমাকে আমার গুপ্তরহস্য খুলে বলতাম কি? তোমাকে মহলে প্রেরণ করতাম না। তোমার অবস্থান আমার হৃদয়ে। আমি তোমার পূজারী-ভোগকারী নই। আর যাকে পূজা করা হয় তার দ্বারা জৈবিক চাহিদা নিবারণ মহাপাপ। ভোমাকে কলুষিত করা আমার অভিপ্রায় নয়। বারবার তোমাকে এই বাস্তব সত্যটি বোঝাতে চাইছি। তোমার প্রতি কোন প্রকার দুর্বলতা থাকলে আব্দুর রহমানের মহলে নয় আমার মহলেই রাখতাম তোমাকে। যে ব্যক্তি স্বার্থমোহে নারীর ওপর সওয়ার হয় তার সব কাজই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। হয়ে যায় সে হায়েনা। এই একটি পয়েন্টেই আমি স্পেন রাজ আবদুর রহমানকে কুপোকাত করতে চাই। তার মত যদি আমিও নারীমাংসলোভী হয়ে উঠি তাহলে আমার সুবিশাল মিশন মাঝপথেই মুখ থুবড়ে পড়বে। এই মিশন সামনে রেখেই আমি জীবন-যৌবন জলাঞ্জলি দিয়েছি।

তুমি মহান। এলোগেইছের হাতে দুঠোঁট নামিয়ে সুলতানা বললো, তুমি যে ত্যাগ-ই চাইবে আমি তা-ই দেব। তোমার শ্রেষ্ঠত্বের প্রাপ্য সেটাই। এতটুকু বলে সে বেরিয়ে গেল।

***

পরদিন। আবদুর রহমানের মহলে পৌঁছলো সুলতানা। স্পেনরাজ কল্পনাও করেননি যে সুলতানা দ্বিতীয় দিনেই ফিরে আসবে। সুলতানা আবদুর রহমানের বাহুতে নিজকে এলিয়ে দিয়ে বললেন, যেখানে এক মুহূর্ত আমাকে ছাড়া আপনার চলে না সেখানে আমার চলে কি করে রাজন? সুলতানার নারী সুষমার ঘ্রাণ আবদুর রহমানকে করে তোলে পাগলপারা। সুলতানা ওই রাতে সঙ্গীতজ্ঞ যিরাবকে আপনারে কামরায় ডেকে পাঠাল এবং তিন বাদীকে আবদুর রহমানের হাওয়ালা করল। সঙ্গীতজ্ঞকে বললেন,

তোমার কণ্ঠে যাদু আছে যিরাব! তোমার আওয়াজ শুনলে আমার শীরাতন্ত্রীতে শিহরণ জাগে। এটা কোন গোস্তাকি নয় তো৷ যিরাব জিজ্ঞাসা করেন।

না! তুমি আমায় মাতাল করে তুলেছ। তোমার নেশাদার ওই দুটি চোখ সঙ্গীতের তানে পাগল বানিয়ে ছাড়ে আমায়।

যিরাব জানতেন, সুলতানা আবদুর রহমানের-ই প্রাইভেট পাত্রী,এজন্য তিনি মাথা নীচু করে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ খামোশ থাকার পর সুলতানার কামরা থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার পর তার প্রগাঢ় ধারণা জন্মে যে, সুলতানা আবদুর রহমানের একার নয়, সে তারও। তার প্রেম তলে তলে লালন করে আসছে। এই মোলাকাতের পর তার ওই ধারণা আরো মজবুত হয়। একরাতে সুলতানা আবদুর রহমানকে বলেন, আমার জায়গীরে যেতে হবে। যিরাব থাকবে সাথে। সুলতান এমনভাবে ছুটি চাইল যেন জায়গীরের মুক্ত বাতাস সেবন না করলে তার দম আটকে যাবে। আবদুর রহমান তৎক্ষণাৎ অনুমতি দিয়ে দেন।

রাতে এলোগেইছ এলো। তার সাথে সুলতানার আগে থেকেই যোগাযোগ। যিরাব সুলতানার প্রেমে এতই মজেছিল যে, স্পেন সুন্দরী পর্যন্ত চিন্তায় পড়ে গেল। তিনি যিরাবের অন্তরে আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্যই প্রেমাভিনয় করেছিলো। একবার সে বললো, কেমন যেন একটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে আটকে আছি। তোমার সংগীতের কাছে বিক্রী হয়ে গেছি। আমার সৌন্দর্যও খরিদকৃত। না তুমি পলায়ন করতে পারবে, না পারব আমি। যেখানেই যাবে সেখানেই ধরা খেয়ে যাবে। এ ছাড়া সুলতানা তাকে বলে রেখেছিল, এলোগেইছ আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। মুক্তির ব্যবস্থা হলে আমরা একটি জায়গীর পেয়ে যাব। সে অবস্থায় তুমি হবে আমার উপদেষ্টা।

ওই রাতে যিরাবের সাথে এলোগেইছের সাক্ষাত। সুলতানার সাথে যিরাবের পরিচয় ঠিক এমনভাবে উপস্থাপিত হল যেন মা ও ছেলে কোন প্রানে একমত হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, যিরাব নিছক একজন গায়ক-সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন না বরং অসাধারণ মেধাবী ও রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু সুলতানা জগদ্দিল পাথরের মত তার মেধা-বিবেকের ওপর চেপে বসল। এতে কোন ফাঁক-ফোকর থাকলে এলোগেইছ সেটুকু পূরণ করেছিল। মোটকথা যিরাব ও সুলতানার নাচের পুতুলে পর্যবসিত হল।

শেষ পর্যন্ত এলোগেইছ তাকে বললেন, মুসলিম তাহযীব-তামাদুন বদলে দাও। যে জাতি তার তাহযীব-তামাদ্ন ভুলে যায় সে জাতি কোনদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। অথবা এও মনে করতে পার, তারা ক্ষমতা চালানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে। জানি, এতে প্রচুর সময় লাগবে। বছর কিংবা যুগও একাজে পেরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু কোন জাতিকে নিঃশেষ ও দেউলিয়া বানাতে এর বিকল্প নেই। স্পেনরাজকে আমরা প্রকাশ্য ময়দানে যুদ্ধে ডাকলে আরব থেকে অসংখ্য ফৌজ আসবে সেক্ষেত্রে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে।

সুলতানা ও এলোগেইছ কথায় কথায় যিরাবকে একটি প্রদেশের রাজা ও সুলতানাকে রাণী বানিয়ে দিল। সুলতানা যিরাবকে তিনদিন পর্যন্ত জায়গীর রাখল। স্থানটি বড়ই মনোরম। গাছ-গাছালিতে ঠাসা। ফুলে ফলে সুশোভিত। প্রানোচ্ছল। সুলতানা ও যিরাব হাত ধরাধরি করে তিনদিন ওই কানকুঞ্জে বিচরণ করল। সুলতানা নারী সুষমা আর যিব তার সঙ্গীতের সুর মূৰ্ছনা বিনিময়ের দ্বারা পরস্পরকে আকৃষ্ট করে যেতে লাগল। প্রাসাদে ফিরে আসার পর যিরাবের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতায় বেশ পরিবর্তন দেখা গেল। তার কণ্ঠে পূর্বেকার সুর তো ছিল, কিন্তু এর অনেকখানি দখল করেছিল সুলতানার প্রেম।

সুলতানা নারীসুলভ প্রতারণার মাধ্যমে যিরাবকে আবদুর রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুললো।

***

সময় বসে থাকে না নিশুপ। সময় এগিয়ে চলে আপন গতিপথে। এক রাতে আবদুর রহমানের উজীরে আলা হাজেব আবদুল করীম দুলোক সহকারে সিপাহসালার ওবাইদুল্লাহর বাসভবনে এলেন।

উবায়েদ। তিনি সিপাহসালারকে বললেন, এ দুজনকে চেনো?

হা! কেন নয়। ওবায়দুল্লাহ জবাব দেন, আমাদের গুপ্তচর বৃত্তিতে ওরা ওস্তাদ।

 শুনুন। এরা কি খবর দিচ্ছে।

সালারে মুহতারাম। তন্মধ্যে একজনে বললো, কর্ডোভা সীমান্তে, টলেডো ও মালাকায় খ্রিস্টানরা সশস্ত্র হচ্ছে। অভ্যুত্থানের জন্য তৈরী হচ্ছে। ওরা অতি সংগোপনে নও মুসলিমদের ওদের দলে ভেড়াচ্ছে। গলায় গলায় ভাব ওদের। কি অদ্ভুত ব্যাপার! আমাদের সাথে একসাথে যারা নামায পড়ে তারাই আমাদের বিরুদ্ধে দল ভারী করে চলেছে। খুব শীঘ্র ওরা আমাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে। দলভারী মুসলিম সৈন্য ওদের মোকাবেলায় টিকবে না বলে ওদের বিশ্বাস। মরনের অঙ্গীকার নিয়েছে ওরা।

গুপ্তচররা আরো জানাল, ফ্রান্স সম্রাট লুই ওদের তলে তলে মদদ যোগাচ্ছেন। ওদিকে গোথমার্চের সম্রাট ব্রেনহার্ট স্পেন ভূমি যতটুকু সম্ভব দখল করবে। এই গুপ্তচরদ্বয় নও মুসলিমের ছদ্মবেশে এদের সাথে কথা বলেছে। তারা বলেছেন, এলোগেইছ নামীয় জনৈক খ্রীস্টান বক্তৃতা ও গোপন পরিকল্পনার মাধ্যমে খ্রীস্টানদের রক্ত গরম করে বেড়াচ্ছে। বিদ্রোহীদের সে-ই শিরোমণি। বিদ্রোহাগ্নি আরো কিছুস্থানে দানা বেঁধে উঠছিল। উজিরে আলা হাজে আবদুল করিমও ইতিপূর্বে এই বিদ্রোহ প্রস্তুতির খবর আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি বারদুয়েক আব্দুর রহমানকে এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারীও দিয়েছিলেন, কিন্তু আবদুর রহমান এতে কান দেননি।

উবায়েদ ভাই। হাজেব সিপাহসালারকে বললেন, আমাদের প্রতি এভাবে বেপরোয়াভাব দেখানো হলে কি ভূমিকা থাকবে আমাদের? আমরা তো তার মত উদাসীন থাকতে পারি না।

না। সালার উবায়দুল্লাহ বললেন, স্পেন আবদুর রহমানের নয়। এ সেই স্পেন যা এক সিংহের জাতি জয় করেছিল। ওরা এদেশ জয় করে পুনরায় ফিরে যায়নি। আফসোসের বিষয়, সাধের সেই স্পেন আজ গোষ্ঠীবিশেষের উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে রূপান্তরিত। দেশ ও জাতির সাথে ওদের কোন সম্পর্ক নেই। ওদের সম্পর্ক গদির সাথে, বিলাসিতার সাথে। আজ স্পেনের বড় দুশমন ওই ক্ষমতাসীনরা যারা চাটুকারদের ইশারায় ক্ষমতা চালাচ্ছে। এই ভূ-খণ্ডকে কুফরের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। বহিঃশত্রুর যড়যন্ত্র ও বিদ্রোহীদের মদদ দেয়ার পর আমার কানেও এসেছে। সেটার সত্যায়ন করলে তুমি। তোমরা যদি আমার পরামর্শমত কাজ কর তাহলে আমীর আবদুর রহমানের কাছে চলো।

আমার পরামর্শও কতকটা এমন। কিন্তু এক্ষণে সে স্পেনসুন্দরী সুলতানা আর গায়ক যিরাবের কজায়। এই কজা জ্বিনে ধরা রোগীর মত। এ এমন এক প্রাচীর যা টপকাতে পারব না আমরা।

হাজের বললেন, চেষ্টা করে দেখতে অসুবিধা কোথায়? বললে এখনই যেতে চাই। ওবাইদুল্লাহ বললেন।

হাজেব ও উবায়দুল্লাহ উভয় গুপ্তচরসহ প্রাসাদ অভিমুখে চললেন।

উজিরে আলা ও সিপাহসালার জরুরী কথা নিয়ে আমীরের সাথে দেখা করতে চান- এ মর্মে আবদুর রহমানের কাছে খবর এলে সুলতানা বেরিয়ে এলেন। পরনে তার নগ্নপোষা। তার আকর্ষণীয় চাঁদমাখা বদনে বিরক্তির ছাপ সুস্পষ্ট। তিনি এদের বললেন,

আপনারা কি দিনের বেলায় দেখা করতে পারেন না? এইমাত্র তিনি যিরাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এ সময় স্পেনরাজ কারো সাথে দেখা করবেন না।

কিন্তু আমরা যে তার সাথে দেখা করেই ফিরে যেতে চাই। হুকুম আমরা তার থেকে চাই-তোমার থেকে নয় সুন্দরী। তাঁকে গিয়ে বললো, আমরা দেখা না করে ফিরব না। উবায়দুল্লাহ বললেন।

আর আমি আপনাদেরকে তার সাথে দেখা করতে দেব না। সুলতানার কণ্ঠে ক্ষোভ ও দৃঢ়তা।

হাজে আবদুল করীম উবায়দুল্লাহকে বললেন, এরপরও কি তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে চাও?

আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব না। আবার খালি হাতেও ফিরব না– ভেতরে যাব। হেবেমের এক নারী রাণীর দাপট নিয়ে চলছে। তার বিরক্তি ও দাপটে আমার কিছুই যায় আসে না। উবায়েদ বললেন।

স্পেনরাজ অন্দর মহলে যিরাবের সুর মূর্ঘনায় ডুবেছিলেন। সেই সুর জগত থেকে ভেসে এলো, সুলতানা! তুমি কৈ! ওদেরকে কাল আসতে বল। উবায়দুল্লাহ আবদুর রহমানের কামরায় পৌঁছে যান। হাজেব করেন তাঁর অনুসরণ। পেছনে পেছনে সুলতানা। আবদুর রহমান অর্থ নিমিলিত চোখে সকলের প্রতি দৃষ্টি বুলান।

এদের কি শাহী রেওয়াজ মনে নেই? চাপা ক্ষোভ নিয়ে বাঘিনীর মত গর্জে ওঠে সুলতানা।

কোন জরুরী কথা হবে হয়তবা সুলতানা। সামান্যতেই ক্ষেপে যেও না। এসো আমার পাশে এখানটায় বসো। এরপর তিনি আগন্তুকদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, এমন কি কিয়ামত ঘটে গেছে যে, তোমরা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলে না? আর যেখানে আমি বললাম, এখন দেখা হবে না, সেখানে তোমরা কোন্ সাহসে অন্দরে প্রবেশ করলে? তোমরা কি তোমাদের পদমর্যাদার কথা ভুলে গেছ? প্রশ্ন, বিস্ময় ও ক্ষোভযুক্ত কণ্ঠে বলেন আবদুর রহমান।

 হ্যাঁ! আমীরে স্পেন! আমরা পদমর্যাদার কথা ভুলে গেছি। এই ভূ-খণ্ডের বিজেতা কোন পদমর্যাদার খাতিরে এখানে আসেনি। ওই শহীদান কি বদলা পেয়েছিল যারা এদেশে আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টিতে এখানে এসেছিল? অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেই পূতঃ পবিত্র যমীনের রাজপ্রাসাদে জনৈকা নগ্ন নর্তকী প্রধানমন্ত্রী ও কমান্ডার-ইন-চীফকে একথা বলার সাহস পায় যে, তোমরা এখান থেকে চলে যাও! উবায়দুল্লাহ শেষের দিকের কথাগুলো বলতে গিয়ে গলার স্বর পরিবর্তন করেন।

উবায়দুল্লাহ! কাঁচা ঘুমভাঙ্গা বাঘের মত গর্জে ওঠেন আবদুর রহমান, কি হলো তোমাদের? আজ এ কি বলছ তুমি?

তখনও তার চোখ অর্ধ নিমিলিত। এবার তা পুরো খুলে যায়। যিরাবের সঙ্গীত যায় থেমে। সুলতানা দূরে দাঁতে দাঁত পেষেণ। আবদুর রহমানের চোখ রক্ত জবার মত লাল। এ লাল রাগ-গোস্বার নয়। এই রক্তিমাভা সর্বপ্রথম দেখছে যিরাব ও সুলতানা। এঁরা অবাক, এ আবার কোন আবদুর রহমান। এ কি কোন ঘুমন্ত ব্যাঘ্রের ন্দ্রিাভঙ্গ, না কি কোন লৌহ মানবের গাত্রোত্থান? তিনি বললেন, তোমরা কি বসবে না? আগন্তুকম্বয়কে বলে তিনি যিরাব ও সুলতানাকে বললেন, তোমরা ওপাশের কামরায় যাও। মনে হয় জরুরী কোন কথা আছে। নইলে এরা এভাবে বিনা অনুমতিতে আসার মত ব্যক্তি নয়। তার কণ্ঠে এক ধরনের ওজর ও মিনতি।

যিরাব ও সুলতানা চলে গেলে উবায়দুল্লাহ ও হাজেব বসে পড়েন। আবদুর রহমান যেভাবে যিরাব ও সুলতানার কাছে মিনতি করলেন তাতে এরা ব্ৰিতিবোধ করে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। তারা ফিস ফিস করে বলেন, আজ এর একটা বিহিত বিধান করেই ছাড়বেন। আবদুর রহমান বললেন, বলল! কি বলতে এসেছ?

খলীফা আপনাকে স্পেনের আমীর নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু দরবারী চাটুকাররা আপনাকে স্পেন সম্রাট বলতে শুরু করেছে, আর আপনিও পুরোদস্তুর সম্রাট সেজে বসে আছেন। উবায়দুল্লাহ বললেন।

কি বলতে চাও উবায়েদ! আবদুর রহমানের কন্ঠে শাহী দাপট, তুমি নিজকে সর্বদা রণাঙ্গনের অধীন সেনার মত মনে কর। তোমার কল্পনাও কেবল ক্যান্টনমেন্টসুলভ। যা বলতে এসেছ তা সহজে বল!

না! আমি সহজে বলতে পারছি না। যেদিন আমার লড়াই খতম হয়ে যাবে সেদিন আপনার সিংহাসনের তলার মাটিটুকুও সরে যাবে এবং স্পেনভূমি হতে ইসলামী পতাকা ও আযানের সুরলহরী স্তব্ধ হয়ে যাবে চিরদিনের তরে। সেনাপতি কখনও দরবারী হয় না। হয় না ক্ষমতালোভী। তার অবস্থান রণাঙ্গনে। অবস্থান কুফর ও বাতিলের বিরুদ্ধে। আপনিও একজন সেনাপতি। রণসিংহ। কিন্তু আফসোস! সেই সিংহশাবককে আজ খোঁচা মেরে জাগাতে হল। সংগীত ও নারী সুষমা লাভের উম্মাদনায় আপনি তলোয়ার। সিংহাসনের নীচে ছুঁড়ে মেরেছেন। আপনার প্রজ্ঞা আছে, মেধা আছে কিন্তু এক উদ্ধত নারী আপনার ওপর আছর করেছে যে আপনাকে জান্নাতী পরিবেশ দান করেছে, যদিও সেটা নিরেট জাহান্নাম।

সমস্যা হচ্ছে, যে জাহান্নামের দিকে উবাইদুল্লাহ ইশারা করছেন ওতে কেবল বাদশাহ একাকী নয় নিপতিত হবে গোটা জাতিই। বাদশাহর ভুলে গোটা জাতি এর ইন্ধন হবে। বাদশাহর অপরাধে প্রায়শ্চিত্ত করে গোটা কওম। দুশমন সম্পর্কে উদাসীন বাদশাহর প্রজাদের ললাটে বিজাতির গোলামী ছাড়া আর কিইবা লেখা থাকতে পারে। হাজেব বললেন।

দেমাগ থেকে ক্ষমতার নেশা ঝেড়ে ফেলুন আমীরে মুহতারাম! আজ বিজাতি অভ্যুত্থানের নীলনকশা তৈরী করছে, কাল মুসলিম ফৌজই আপনার টুটি টিপে ধরতে আসবে। সেনাপতি বললেন।

বিদ্রোহ! অভ্যুত্থান! কেমন বিদ্রোহ। কোন ফৌজ অভ্যুত্থান করবে? আমার জানা নেই। খোদার দিকে চেয়ে খুলে বল। আবদুর রহমান চমকে ওঠেন।

আপনি এজন্য জানেন না যে, দরবারী চাটুকাররা আপনার চোখ-কান বন্ধ করে দিয়েছে। আপনার নিকটতম তোষামোদকারী বেসরকারী উপদেষ্টারা যেটা বলে দেবেন কেবল সেটাই আপনি শুনবেন। এক নর্তকী আর সুরেলা গায়ক আপনার ভেতরকার সিংহপুরুষকে হত্যা করে ফেলেছে। এদেশ স্বাধীনচেতা মর্দে মুজাহিদদের। আপনি তাদের আমীর নন-আমীর জনতার, হাজেব বললেন।

না হাজেব! সুলতানা আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না। যিরাব আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না।

কে ধোঁকা দিল-আর কে দিল না, কে নেমকহারাম আর কে নেমক হালাল–তাও বলতে আসিনি আমরা। এর প্রতি আমাদের কোন আকর্ষণই নেই। আমাদের ক্ষোভ সেসব বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে যারা স্পেন হতে ইসলামের নাম-নিশানা মিটিয়ে দিতে চায়। খুব চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন আমীরে মুহতারাম।

উবাইদুল্লাহ ও হাজেব গুপ্তচরদের ডেকে পাঠালেন। আমীরের সম্মুখে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে নির্দেশ দিলেন। তারা বিস্তারিতভাবে রিপোর্ট পেশ করলেন। হাজেব ও উবায়দুল্লাহও এতে কিছু প্রবৃদ্ধি ঘটালেন।

***

আবদুর রহমানের ভেতরের সিংহপুরুষটা সজাগ হয়ে ওঠল।

ওদিকে ওপাশের কামরায় যিরাব ও সুলতানা আক্ষেপে উরু চাপড়াচ্ছিল। সুলতানা কক্ষের শার্সিতে আড়ি পেতে এতক্ষণের আলাপ শুনেছেন। তিনি বললেন,

দুরাচাররা বাদশাহর ভেতরটা জাগিয়ে তুলেছে। তিনি একবারের জন্যও ময়দানে নামলে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবেন। আমরা সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হব। এলোগেইছ বলেছে, বিদ্রোহীরা প্রস্তুত। ওদিকে ফ্রান্স সম্রাট লুই আর বার্সিলোনা ও গোথের বাহিনীও প্রস্তুত। কিন্তু এ তথ্য এরা পেল কি করে? এলোগেইছকে জানিয়ে দেয়া দরকার যে, মুসলিম টিকটিকিরা তোমার প্রস্তুতি জেনে ফেলেছে। জেনে ফেলেছেন আবদুর রহমানও। এদুলোককে পাক্কা টিকটিকি মনে হচ্ছে। যিরাব বললেন।

হা! এরা টিকটিকিই বটে। ওদের খতম করা জরুরী।

যিরাব খুবই চৌকস লোক। তিনি বললেন হত্যা করলে কোন লাভ হবে না। তাদের স্থানে আরো দুজন এসে যাবে। তার চেয়ে টোপ ফেলে ওদেরকে আমাদের দলভুক্ত করতে পারি। ওরা সরকারী গোয়েন্দার ছদ্মাবরণে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে কাজ করবে এলোগেইছের হয়ে। এরা সেনাপতি ও প্রধানমন্ত্রীকেও ধোঁকা দিতে সক্ষম।

এনামস্বরূপ এদেরকে হেরেমের সুন্দরী নারীকে দিতে পারি। এই এনামের বিনিময় ওরা আমাদের গোলাম হবে। বলে সুলতানা আবারো আড়ি পাতলেন। উবাইদুল্লাহ বলে যাচ্ছে আর সুলতান শুনে যাচ্ছে। তার চেহারার রং-এ এসেছে পরিবর্তন।

প্যাম্পোলনায় ফ্রান্সীয় কাউন্ট আবলুস ও আইসেন এয়ার্স-এর ফৌজ হামলা করেছে। আপনাকে বলা হয়েছে এ ফৌজ পিছপা হতে গিয়ে সংকীর্ণ উপত্যকায় মুসিবতের সম্মুখীন হয়েছে। ওরা ওই সংকীর্ণ গিরিপথে চরম মার খেয়েছে। বেশুমার ফৌজ বন্দী হয়েছে। এক্ষণে বার্সিলোনা আক্রান্ত হবার সম্ভবনা।

তোমরা কি মনে করছ? প্রথমে জেনে নাও, এই সম্ভাবনার ভিত্তি কতটুকু? ভুলও হতে পারে। বললেন আবদুর রহমান

আমিও হাজেব আপনার কমান্ডে কাজ করতে পারলে গৌরববোধ করব। দূত রওয়ানা করে দিয়ে আমরা সেনাপতি ও উজীর হিসেবে এখানে বসে থাকব আর অধীনরা আমাদের সালাম করবে-এই হয় কি? আমীরে মোহতারাম আমরা আমাদের দায়িত্বে এতটুকু শিথিলতা আনিনি। দুশমনের মোকাবেলায় আপনি এমন ঔদাসীন্য মনোভাব দেখালে এ মুহূর্তে ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে রক্ষায় যা করার দরকার, আপনার নির্দেশ উপেক্ষা করে হলেও তা আমরা করে যাব। আপনার গদীরক্ষার জন্য আমাদের ব্যবহার করতে যাবেন না। দুশমন সে দুশমনই। ওদের মিত্রতাও শক্রতা। আমরা সীমান্তে ফৌজ পাঠাতে চাই। এদের নেতৃত্ব থাকবে আমার হাতে। আমরা এক্ষণে যা চাইব তা দিতে হবে আপনাকে। সেনাপতি বললেন।

তোমাদেরকে সকালে বলব। খানিক ভাবতে দাও। আবদুর রহমান বললেন। সকালে আমরা মার্চ করব। অর্ধেকটা ফৌজ কর্ডোভায় থাকবে। এদের নেতৃত্বভার থাকবে হাজেবের হাতে। আপনার অজানা নয়, হাজেও একজন দক্ষ সেনানায়ক। আমার অনুপস্থিতিতে বিদ্রোহ হলে হাজেবই এদের দমন করবেন। উবাইদুল্লাহ বললেন।

আমি আমীরে মুহতারামকে জানিয়ে দিতে চাই আমার কর্মকাণ্ড আভিজাত্যপূর্ণ হবে না। আমি সেই বিষবৃক্ষের শিকড় উপড়ে ফেলব যারা উপর দিয়ে মুসলমান সেজে তলে, তলে খ্রীস্টানদের মদদ দিয়ে চলেছে। ওদের রক্তে গোসল করে লাশ পুড়ে ছাই বানাব। হাজেব বললেন,

সুলতানা তখন শার্সিতে আড়িপাতা। তার কানে আবদুর রহমানের আওয়াজ এলো, তোমরা প্ল্যান-প্রোগ্রাম তৈরী কর। যেখানে যখন যত সৈন্য প্রয়োজন পাঠাও।

উবাইদুল্লাহ ও হাজেব বেরিয়ে গেলেন।

ওরা চলে গেল। যিরা সুলতানাকে বলল, খেয়াল রেখো সুলতানা! বাদশাহ যেন টের না পান– আমরা তার এই ফয়সালায় ক্ষুব্ধ। কথা আমাকে বলতে দিও।…. কাল এলোগেইছকে বিস্তারিত রিপোর্ট জানাবে। সে-ই ভাল বুঝবে-এ অবস্থায় করণীয় কি।

আজকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত দ্বারা এতটুকু অনুধাবন করা গেল, আমাদের প্রভাব আবদুর রহমানের ওপর পুরোপুরি পড়েনি। তার ভেতরের সিংহপুরুষ এখনও নিস্তেজ হয়ে যায়নি। সুলতানা বললেন।

আবদুর রহমান তাদের ডেকে পাঠালেন। ওরা ফওরান এসে পড়ল। সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন, সালার ও উজীর কেন এসেছিলেন? আবদুর রহমান তাদেরকে সব কথা খুলে বললেন।

জিন্দাবাদ স্পেনরাজ! যিরাব বলল, সৈন্য মার্চ করতে বলে আপনি বিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। কাফেরদের কেটে শত টুকরা করা দরকার। ইতিহাসে আপনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

সুলতানা আবদুর রহমানের গাঁ ঘেষে গলায় হাত রেখে সোহাগ করে বললেন, স্পেনরাজ মর্দে-মুমিন ও মর্দে মুজাহিদ। আপনার পৌরুষ ও দুঃসাহসিকতা-ই আমাকে হেরেমে এনেছে। আমি আপনার মত বীর মুসলিমের মেয়ে। আরবী বংশোদ্ভূত ঘোড়ায় চেপে ময়দানে নামতে ইচ্ছে করে।

তুম যাবে কেন? সুলতানাকে কোলে চেপে আবদুর রহমান বলেন, তোমার জন্য আমি আমার গোটা ফৌজ ফরমান করতে পারি।

স্পেনরাজ আরেক বার বাস্তব দুনিয়া থেকে ছিটকে পড়লেন।

***

যারা ধর্ম ও দেশের প্রতি মুহাব্বত রাখেন তারা যেমন মিত্রদের চেনেন তেমনি চেনে শত্রুদের। নিশ্চিন্তে তারা কখনও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। ইউরোপিয়ানদের বেলায় আমরা এমনটা দেখতে পাই। তাদের সীমার ওপর হেলালী নিশান প্রোথিত হয়েছিল। তারা শংকা করছিল, ইসলামের অগ্রযাত্রা এখনই রোধ করা না গেলে এটা গোটা ইউরোপ দখল করে তবেই ক্ষান্ত হবে। সুত্রং তারা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিল। সূচনাতেই তাই তারা ইউরোপের প্রবেশদ্বার স্পেনে হামলা শানাল ও সীমান্তবর্তী বসতি ছিন্ন ভিন্ন করে চলল। সীমান্তবর্তী মুসলিম ফৌজ এদের যথাসাধ্য প্রতিরোধ করে যেতে লাগল। এতে মুসলিম ফৌজে ক্রমশঃই ঘাটতি দেখা দিল ও নয়া ফৌজ ভর্তি করা শুরু হল।

ইউরোপিয়ানদের যখন এই অবস্থা তখন মুসলিম শাসকবর্গ নিশ্চিত প্রাসাদে দাবার খুঁটি চালছিল। পরিণতিতে স্পেনের সীমানা সম্প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্রে আরো সংকুচিত হতে লাগল। কুদরত প্রতি শতাব্দীতে স্বাধীনচেতা মর্দে মুজাহিদ সৃষ্টি করলেন যদরুন তারা আট শতাব্দী পর্যন্ত স্পেনকে মুসলিম শাসনে রাখতে পেরেছিলেন। স্বাধীনচেতা মনোভাবের লোক যেহেতু বাদশাহ আমীর কিংবা খলীফাগণ ছিলেন না সেহেতু এক সময় এই মনোভাবেও চিড় ধরল, কাজেই এক সময় হাল ধরার মত কাণ্ডারীও ফুরিয়ে গেল।

স্বাধীনচেতা এমন এক মর্দে মুজাহিদ ছিলেন উবাইদুল্লাহ বিন আবদুল্লাহ। তিনি ভ্যালেন্সিয়ার অধিবাসী। আরেকজন হাজেব আবদুল করীম যিনি তার অধীনদের নিয়ে বিলাসী শাসকদের বিরুদ্ধে আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু।

রাতের বেলায় সালার উবাইদুল্লাহ তার ফৌজ ও সহকারী কমান্ডারদের জাগ্রত করেছিলেন। বলেছিলেন, আমাদের দেশে বিদ্রোহের ধূম্রগিরি উদগীরণ হতে যাচ্ছে। এ থেকে আমাদের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে দুশমন সীমান্তে হামলা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে।

আমাদেরকে একটি প্রাবনে ভাসিয়ে নিতে দুশমন ফুঁসে উঠছে। আমাদের বাহিনীকে কমান্ডারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যশীল থাকতে হবে। লড়তে হবে দুর্গম গিরি, কান্তার মরু ও দুস্তর পারাবারে। জীবন দিতে অকুষ্ঠ চিত্ত থাকতে হবে। আল্লাহর সৈনিক অন্যান্য সৈনিক থেকে পৃথক। মহান এক উদ্দেশ্যে আমাদের লড়াই। কোন ব্যক্তি বিশেষ বা খান্দান বিশেষের ক্ষমতার আসন পাকাঁপোক্ত করার জন্য আমরা লড়াই করি না। আল্লাহর আইন মানব-জীবনে প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যেই আমাদের লড়াই। কুফর খতম না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের লড়াই চালিয়ে যাওয়া ফরয-আমাদের লড়াই কোরআনের এ আয়াতকে সামনে রেখেই।

আমাদের সেপাইদের তারিক বিন যিয়াদের ঐতিহ্য মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, অল্প কজন সৈন্য নিয়ে তারা এদেশে এসেছিলেন। সেই জানবাষ শহীদান আমাদের পবিত্র আমানত। স্পেন উপকূলে নেমেই তারা রণতরীগুলো জ্বেলে দিয়েছিলেন। সেই চেতনা পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।

যে কথা আমি বলতে চাচ্ছি, তা তোমাদের সিপাইদের বলো চাই না বলল, তোমরা ধ্যান-খেয়ালের সাথে শুনে নাও-খলীফার পক্ষ থেকে যিনি আমীর নিযুক্ত হয়েছেন সম্প্রতি তাকে বাদশাহ খেতাবে ডাকা শুরু হয়েছে। এটা অনৈসলামিক পন্থা। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় কোন বাদশাহ হয় না, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজ আমাদের ওপর এমন বাদশাহ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যে নামকাওয়াস্তে মুসলমান আর তার কর্মকাণ্ড সবই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বিরোধী। তার হেরেম আবাদ হচ্ছে গায়ক ও খেমটা নর্তকীদের দ্বারা।

আমাদের বর্তমান আমীরের অবস্থা এমন-ই। তোমাদের পুঞ্জীভূত অভিযোগ পুঁজি করেই বলছি, আমীর সাহেব কোনদিন তোমাদের সাথে দেখা করেননি। নিজ চোখে কোনদিন দেখেননি তোমাদের হাল-হকিকত। তোমাদের অনেকেরই জানা আমাদের বাদশাহ রাগ-রাগিনীতে আসক্ত। সুতরাং এক্ষণে ময়দানে লড়ে লাভ কি।

এমন খেয়ালের কেউ থেকে থাকলে বাহিনী থেকে বেরিয়ে যাও। এ যমীন খোদা তাআলার- তোমরা এর রক্ষক। যার যার কবরে সে যাবে। বাদশাহ তোমাদের কবরে আর তোমরা তাঁর কবরে যাবে না। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, যে দেশে কোরআনের শাসন কায়েম হয় সে দেশ কোন ব্যক্তি বা বংশের জায়গীর হতে পারে না। আমরা সবে এ দেশের মালিক, সুতরাং এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সকলের। বাদশাহর দরবারে নয় আমাদের জবাবদিহি করতে হবে প্রভু পরওয়ারদেগারের দরবারে। এই মহান উদ্দেশ্যে সামনে নিয়েই মুসলমানরা লড়ে থাকে। জয়-পরাজয়ের তোয়াক্কা নেই তাদের।

এভাবে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে উবাইদুল্লাহ উপ-সেনাপতিদের রক্ত গরম করে দিলেন। সকাল বেলা সমস্ত উপ-সেনাধ্যক্ষ মার্চ করলেন।

***

সৈন্যবাহিনীর অগ্রযাত্রা ছিল খুবই তেজোদীপ্ত। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে এরা শহরের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। আবদুর রহমান ন্দ্রিা থেকে গাত্রোখান করে পি এ-র মাধ্যমে সেনাপতিকে খবর দিয়ে বললেন, আমি বাহিনীকে বিদায় জানাতে চাই।

ফৌজ এ মুহূর্তে শহরের চৌহদ্দী থেকে অনেক দূরে চলে গেছে আমীরে মোহতারাম! হাজে আপনার অপেক্ষায় আছেন। পি এ বললেন।

তাকে ভেতরে ডেকে পাঠাও। হাজেব এলে তিনি বললেন, উবাইদুল্লাহ খানিক অপেক্ষা করতে পারত না?

না, আমীরে মোহতারাম? দুশমন এ খেয়াল করে না যে, তাদের প্রতিপক্ষ বাদশাহর বিদায়ী সালাম নিয়ে এসেছে কি-না। বিদায়ী সালামের সময় নেই আমীরে স্পেন। অবধারিত দায়িত্বের হাতছানি এমনই হয়। হাজেব বললেন।

আবদুর রহমানের মনে চাপা ক্ষোভ থাকলেও তা প্রকাশ করার সাহস পান না। হাজেব তাকে শুনিয়ে যান খ্রীস্টানদের কচুকাটা করার প্ল্যান একের পর এক।

সীমান্তের প্যাম্পোলোনা চৌকি।

দুফ্রান্সীয় কাউন্ট এখানে কিছুদিন পূর্বে হামলা করেছে। বেশ কিছু মুসলমানদের তারা বন্দী করে নিয়ে গেছে। তাদের সাথে এরা পাশবিক ব্যবহার করেছে।

কদিনের ব্যবধানে সালার উবাইদুল্লাহ এখানে এসে উপনীত হন। তিনি এখানকার অধিবাসীদের মাধ্যমে এখানকার অবস্থাদি পর্যবেক্ষণ করেন। জানতে পারেন, খ্রীস্টানরা সীমান্তে দুর্গ স্থাপন করেছে। এই কেল্লাপ্রাচীর টপকানো চাট্টিখানি কথাতো নয়। উবাইদুল্লাহ স্পেন পাড়ি দেয়ার অনুমতি আবদুর রহমান থেকে নেননি। নেয়ার প্রয়োজনও মনে করেননি। প্রয়োজনে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করবেন-এক্ষণের সিদ্ধান্তে তার কতকটা এমন-ই।

গভীর রাত।

সীমান্তবর্তী কিছু গাইডের মাধ্যমে তিনি স্পেনসীমানার বাইরে পা রাখেন। গাইডরা তাকে বড় কেল্লাটি দেখান। তাদের চলার শক্তি দ্রুত। আঁধার রাতে তারা কেল্লা ঘেরাও করেন। এর পরপরই কামান থেকে পাথর ছোঁড়া শুরু করেন সাথে সাথে নিক্ষেপ করেন অগ্নিগোলা। কামানের পাথর আর অগ্নিবান ওইযুগে শক্রমনে বিভীষিকা সৃষ্টি করত।

খ্রীস্টানরা কেল্লাপ্রাচীর থেকে তীর নিক্ষেপ শুরু করে কিন্তু ওদিকে উবাইদুল্লাহ ও তার বাহিনীর মধ্যে চরম উত্তেজনা। তাঁদের কমান্ডার তেঁতে আগুন। অনেক ফৌজ তীর মারতে কেল্লা প্রাচীরে পৌঁছে যায়। তারা কুঠার দ্বারা কেল্লাঘার ভাঙ্গতে শুরু করে এক সময় দরজা ভেঙ্গে ফেলে। তুমুল রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু হয়। বানের পানির মত মুসলিম ফৌজ কেল্লাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এদের অনবরত বর্শাঘাতে বিপক্ষ বাহিনী জাহান্নামে পৌঁছতে থাকে। লাশের পাহাড় হয়ে যায়। এর পরের লড়াই উবাইদুল্লাহ বাহিনীর খ্রস্টানদের লাশে পাহাড় রচনার লড়াই।

মুসলিম কয়েদীরা এই কেল্লায়ই ছিল। তাদের পায়ে ডাবেড়ী। রাতে ওই বেড়ীর সাথে শেকল পেঁচানো হত। চতুষ্পদ জন্তুর মত তাদেরকে খোয়াড়ে রাখা হত। এদের সকলকে মুক্তি দেয়া হলো।

এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ কেল্লা অবরোধ করা হলো।

উবাইদুল্লাহ যখন ওখান থেকে ফিরে আসেন তখন ওখানে খ্রিস্টান লাশের পাহাড় আর কেল্লায় ধূম্রকুণ্ডলী ঘুরপাক খাচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *