কে এই নারী

কে এই নারী

বনহুরও সঙ্গে সঙ্গে ফিরে তাকালো দেখলো সেই নারীমূর্তি, যে নারী তাকে মনসুর ডাকুর অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা করেছে। দ্রুত উঠে দাঁড়ালো বনহুর, রহমানও সর্দারের সঙ্গে মৃত্তিকা আসন ত্যাগ করে দাঁড়িয়ে পড়লো। বনহুরের হাতে তখনও তীরফলকটি রয়েছে। তীরফলকের সঙ্গে গাঁথা রয়েছে একখণ্ড কাগজ।

বনহুর আর রহমান ফিরে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গেই নারীমূর্তি অশ্বসহ যেন নিমিশে হাওয়ায় মিশে গেলো। শুধু শোনা গেলো অশ্ব পদশব্দ।

রহমান বললো– সর্দার, এই সেই নারীমূর্তি……

হাঁ, আমি চিনতে পেরেছি।

 চলুন সর্দার, ওকে পাকড়াও করি।

না, ওকে যেতে দাও রহমান।

বনহুর এবার হাতের তীরফলকটার দিকে ফিরে তাকালো, খুলে নিলো তীর থেকে ভাঁজ করা কাগজখণ্ডটা। মেলে ধরলো চোখের সামনে। তাতে লেখা আছে–

বনহুর, আমাকে জানতে চেষ্টা করো না,
কে আমি। আড়াল থেকে আমি
তোমার কাজে সহায়তা করবো।
আগামী অমাবস্যা রাতে হিন্দলের
 কালীমন্দিরে নরবলি হবে। এক
মহান ব্যক্তির হত্যা। মনে রেখো,
তুমি ছাড়া কেউ তাকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে না।
— আশা

 বনহুর কাগজখানা রহমানের হাতে দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো পড়ে দেখ রহমান।

রহমান কাগজের লেখাগুলো পড়ে গম্ভীর হয়ে পড়লো, একটু ভেবে বললো– সর্দার, আমার মনে হচ্ছে, আপনাকে বিপদে ফেলার এটা এক নতুন চক্রান্ত।

রহমানের কথায় বনহুরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো, বললো বনহুর যে তোমাকে এতখানি সাহায্য করলো, আজ হঠাৎ তার প্রতি তোমার অবিশ্বাসের ছায়াপাত হলো কেন?

সব যেন কেমন রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে সর্দার। কারণ, যে নারী মনসুর ডাকুর পাতালপুরীর অন্ধ গহ্বর হতে আপনাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হলো…….

আমিও তো সে কথাই বলছি রহমান, যে আমাকে এই দুর্গম স্থান হতে বাঁচিয়ে নিলো সে কি করে আবার আমার অমঙ্গল কামনা করতে পারবে।

 আমি ঠিক সে কথা বলছি না, বলছি যে এমন কাজ করতে পারলো, আর সে পারবে না হিন্দলের কালীমন্দির হতে এক মহান ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে?

সবই কি সবার পক্ষে সম্ভব হয় রহমান? চল এবার ফেরা যাক।

রহমান আর বনহুর ফিরে এলো আস্তানায়।

*

হিন্দলের কালীমন্দির।

গভীর রাত।

জমকালো বিরাট কালীমূর্তির চোখ দুটো যেন রক্তের নেশায় জ্বলছে। একরাশ কৃষ্ণ কালো চুল ছড়িয়ে আছে পিঠে। গলায় নরমুণ্ডের মালা। লক্লকে জিহ্বায় গড়িয়ে পড়ছে তাজা লাল রক্ত। দক্ষিণ হস্তের খাঁড়াখানা মন্দিরের আলোতে ঝকমক করছে।

সম্মুখে হাত-পা বাঁধা এক বৃদ্ধ দণ্ডায়মান। চোখে তার কালো পট্টি বাঁধা।

কতকগুলো ভীষণ চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। এক এক জনের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। প্রত্যেকের হাতেই আছে সূতীক্ষ্ণ ধার বর্শা।

এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী মন্ত্র পাঠ করছে, তার সামনে বিরাট একটা অগ্নিকুণ্ড দাউ দাউ করে জ্বলছে। জটাজুটধারী কি যেন মন্ত্র পাঠ করছে আর সম্মুখস্থ অগ্নিকুণ্ডে ঘি ঢেলে দিচ্ছে।

এবার ভয়ঙ্কর লোকগুলো একসঙ্গে কিছু উচ্চারণ করলো।

সঙ্গে সঙ্গে দু’জন বলিষ্ঠ লোক বৃদ্ধকে ধরে অগ্নিকুণ্ডের সম্মুখে টেনে আনলো। কাঠগড়ায় তাঁকে উবু করে ধরলো তারা।

বৃদ্ধ আর্তনাদ করে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করলেন।

জটাজুটধারী মন্ত্র পাঠের সঙ্গে সঙ্গে খাড়া উঁচু করে ধরলো। আর এক মুহূর্ত, তা হলেই বৃদ্ধের দেহ থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

ঠিক সেই দণ্ডে জমকালো পোশাক পরিহিত এক মূর্তি এসে দাঁড়ালো মন্দিরের দরজায়, তার হাতের রিভলভার গর্জে উঠার সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক আর্তনাদ করে জটাজুটধারী গড়িয়ে পড়লো একপাশে। জমকালো মূর্তির হাতের রিভলভারের গুলী কাপালিক সন্ন্যাসীর বক্ষ ভেদ করে বেরিয়ে গেছে।

একসঙ্গে মন্দির মধ্যস্থ ভীষণকায় লোকগুলো ফিরে তাকালো মন্দিরের দরজায় দণ্ডায়মান জমকালো মূর্তিটার দিকে।

জমকালো মূর্তি কঠিন কণ্ঠে বললো– খবরদার, নড়বে না!

মন্দির মধ্যস্থ শয়তানগুলো বেকায়দায় পড়ে নিশ্চুপ রইলো, কারণ মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের মৃত্যুদূত। কেউ এগুতে সাহসী হলো না।

জমকালো মূর্তির রিভলভার গর্জে উঠলো আবার, সঙ্গে সঙ্গে যারা বৃদ্ধকে উবু করে ধরেছিলো তাদের একজন মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। তারপর দ্বিতীয় জন, তৃতীয় জন, চতুর্থ জন, পঞ্চম জন- জমকালো মূর্তির রিভলভার যেন থামতে চায় না।

সবগুলো কাপালিকের রক্তাক্ত দেহ হিল কালীমন্দিরের মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো। রক্তের স্রোত বয়ে চললো।

জমকালো মূর্তি এবার বৃদ্ধের পাশে এসে দাঁড়ালো, উন্মোচন করে দিলো তার চোখের বাঁধন।

চোখের পট্টি সরে যেতেই অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলেন বৃদ্ধ–দস্যু বনহুর তুমি! তুমি আমাকে সদ্য মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচালে!

বনহুরের মুখের নিচ অংশ পাগড়ির আঁচলে ঢাকা ছিলো–সেও চিনতে পারলো, এ বৃদ্ধ অন্য কেই নয়, মন্থনা দ্বীপের দানবীর মহারাজা মহেন্দ্র দেব।

মহেন্দ্র দেব মন্দিরের মেঝের রক্তাক্ত দেহগুলোর দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ফিরে তাকালেন বনহুরের দীপ্ত চোখ দুটির দিকে। কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছে তার মন, মহেন্দ্র দেব বনহুরের পা জড়িয়ে ধরতে গেলেন।

বনহুর বাধা দিয়ে তুলে নিলো বুকে– আপনি আমার পিতৃতুল্য। আপনাকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করতে পেরেছি বলে আমি নিজকে ধন্য মনে করছি। শুধু আমিই নই, আপনার জীবনরক্ষা ব্যাপারে আর একজন আছে, যার জন্য আমি আপনাকে আজ বাঁচাতে পেরেছি।

ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন মহেন্দ্র দেব– কে, কে সে? কার এত দয়া?

জানি না! আমিও জানি না কে সে? বনহুর ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয়ে যায়। তারপর বলে– চলুন মহারাজ, আপনাকে মন্থনা দ্বীপে পৌঁছে দিয়ে আসি।

চলো, চলো……

বনহুর মহারাজ মহেন্দ্র দেবসহ অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে মন্দিরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক নারীমূর্তি। নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে রইলো সে বনহুরের চলে যাওয়া পথের দিকে। চোখেমুখে তার খুশির উচ্ছ্বাস।

*

ভূগর্ভে অন্ধগহ্বরে মনসুর ডাকুর দরবার বসেছে। গহ্বরের দেয়ালে কয়েকটা মশাল গোঁজা। মশালগুলো দপ দপ করে জ্বলছে।

মনসুর ডাকু তার সুউচ্চ আসনে উপবিষ্ট।

পাশে মনসুর ডাকুর একমাত্র কন্যা ইরানি উপবিষ্ট। সম্মুখে দণ্ডায়মান মনসুর ডাকুর অনুচরগণ, প্রত্যেকের হাতেই মারাত্নক অস্ত্র। এক একজনকে এক একটি শয়তান বলে মনে হচ্ছে। সবাই নীরবে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তাদের সর্দারের মুখের দিকে।

মনসুর ডাকুর দু’চোখে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। ইরানির চোখ দুটোও যেন মশালের আলোতে জ্বলছে, ঠিক যেন নাগকন্যার চোখের মত।

 মনসুর ডাকু গর্জন করে উঠলো– কে সেই নারী যে আমার পাতালপুরীর ভূগর্ভ গহ্বরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে, আর সহায়তা করেছে দস্যু বনহুরের অনুচরদের এখানে প্রবেশে?

সর্দারের কথায় মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলো মনসুর ডাকুর অনুচরগণ। কারণ তারাও জানে না, সেদিন যে নারী-মূর্তিটাকে তারা দেখেছে– কে সে? সমস্ত দেহে ছিলো কালো পোশাক, মাথায় ছিলো কালো টুপি, চোখে ছিলো কালো গগলস চিনবার কোন উপায়ই ছিলো না তাকে।

 মনসুর ডাকু ক্রুদ্ধভাবে আসনের হাতলে মুষ্টাঘাত করে বজ্রকঠিন স্বরে বললো– এক সপ্তাহ। সময় দিলাম, এই সময়ের মধ্যে তোমরা সেই নারীকে খুঁজে বের করবে। আমি নিজ হাতে সাজা দেবো। যে সাজা আমি দস্যু বনহুরের জন্য ব্যবস্থা করেছিলাম।

ইরানি পিতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তীব্র কণ্ঠে বললো– তোমাদের মধ্যে যে সেই নারীকে। গ্রেপ্তার করে আনতে পারবে, তাকে আমি আমার গলার হীরক হার উপহার দেবো।

মনসুর ডাকুর অনুচরদের চোখেমুখে একটা খুশিভরা ভাব দেখা দিলো। তারা জানে, ইরানির কণ্ঠের হীরক হার কত মূল্যবান। এ হার যদি কোনো অন্ধকার স্থানে রাখা হয় তাহলে সেই অন্ধকার স্থান আলোকিত হয়ে উঠে। অপূর্ব এ হার!

এরপর মনসুর ডাকুর অনুচরগণ সেই অজ্ঞাত নারীটির সন্ধানে উঠে পড়ে লেগে গেলো। এক একজন ছুটলো এক একদিকে। সবার মনেই বিপুল উন্মাদনা–যেমন করে থোক, তাদের সেই নারীমূর্তিকে খুঁজে বের করতেই হবে– একদিকে সর্দার মনসুর ডাকুর শাস্তির ভয়, আর একদিকে ইরানির কণ্ঠের হীরক হার।

 মনসুর ডাকু নিজেও নিশ্চুপ রইলো না, সে নানা ছদ্মবেশ ধারণ করে অনুসন্ধান করে চললো কে সেই নারী। তার কন্যা ইরানিও পিতার সহযোগিতা করতে লাগলো।

*

মনসুর ডাকু তার গোপন বিশ্রামকক্ষে বসে তার প্রধান অনুচর গোমেশের সঙ্গে আলোচনা করছিলো। গোমেশ এক ভয়ঙ্কর ডাকু। যেমন তার চেহারা তেমনি তার ব্যবহার। তার প্রাণে মায়া-মমতা বলে কিছু নেই। অদ্ভুত এক জীবের মতই হলো শয়তান গোমেশ।

রঘুলালের মৃত্যুর পর মনসুর ডাকু গোমেশকে হীরানগর থেকে ডেকে এনেছে।

কান্দাই থেকে প্রায় সাত শত মাইল দূরে হীরানগর। মনসুর ডাকু তার প্রধান সহচর গোমেশকে এই হীরানগরে রেখেছিলো, এখানে যে সব রাহাজানি আর নরহত্যা সংঘটিত হতো, সব এই গোমেশের দ্বারাই হতো। গোমেশ বিশ-পঁচিশ জন সহচর নিয়ে হীরা নগরের গোপন একস্থানে অবস্থান করতো।

 মনসুর ডাকু মাঝে মাঝে হীরানগরে যেতো এবং গোমেশের সঙ্গে যোগ দিয়ে দস্যুবৃত্তি করতো। রঘুলালের মৃত্যুতে মনসুর ডাকু বেশ ঘাবড়ে পড়েছিল। শুধু রঘুলালের মৃত্যুতেই নয়, কে এক অদৃশ্য নারী হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে দস্যু বনহুরকে উদ্ধার করলো এবং বনহুরের অনুচরদের পথ দেখিয়ে পাতালপুরীর অন্ধ গহ্বরে নিয়ে এসেছিলো– এ সব তাকে ভাবিয়ে তুলেছিলো। সেই কারণেই প্রয়োজন বোধ করেছিলো সে গোমেশের।

দুর্দান্ত গোমেশ আর মনসুর ডাকু মিলে যখন গোপন পরামর্শ ছলছিলো তখন আচম্বিতে তাদের সম্মুখে একটি তীরফলক এসে গেঁথে গেলো।

বিস্ময়ে চমকে উঠলো মনসুর ডাকু আর গোমেশ। পাতাল গহ্বরের কোনো এক গোপন স্থানে এই জায়গা–মনসুর ডাকুর অনুচরগণ পর্যন্ত এ গুহার সন্ধান জানে না। এখানে কে এমনভাবে তীর নিক্ষেপ করলো?

আশ্চর্য বটে!

মনসুর আর গোমেশ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলো। তীরফলকখানা মনসুর ডাকু তুলে নিলো হাতে। দেখলো, তীরফলকে একখণ্ড কাগজ ভাঁজ করা আছে। মনসুর তীরফলক থেকে ভাঁজ করা কাগজখণ্ডটা খুলে নিয়ে মেলে ধরলো চোখের সম্মুখে। মশালের আলোতে পড়লো, তাতে লিখা আছে…

মনসুর, আমার সন্ধানে যতই
 প্রচেষ্টা চালাও, সব ব্যর্থ হবে।
 মিছামিছি এত ব্যস্ত হচ্ছো তোমরা।
— আশা

মনসুর ডাকু দাঁতে দাঁত পিষে বললো– কে এই আশা, যে আমার এই গোপন গুহার সন্ধান জানে? কে সেই দুঃসাহসিকা নারী..

মনসুর ডাকু এবং গোমেশ ক্রুদ্ধভাবে উঠে দাঁড়ালো। করতালি দিলো মনসুর ডাকু, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হলো একজন অনুচর। এখানে আর কারো প্রবেশ নিষেধ, শুধু এই পরশুরাম ছাড়া আর কেউ কোনোক্রমে এখানে আসতে পারে না।

পরশুরাম কুর্ণিশ জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ তাকে আহ্বান জানানোর জন্য সে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছে। কারণ, এই গোপন গুহায় মনসুর ডাকু যখন কারো সঙ্গে গোপন আলোচনা করতো তখন কেউ সেখানে প্রবেশে সক্ষম হতো না। আজ তার ব্যতিক্রম ঘটেছে।

পরশুরাম কুর্ণিশ জানিয়ে দাঁড়াতেই মনসুর ডাকু হুঙ্কার ছাড়লো– পরশুরাম, এই দেখো পুনরায় সেই নারীর আগমন ঘটেছে। তার নিক্ষিপ্ত তীর প্রবেশ করেছে আমার গোপন গুহায়।

 পরশুরামের চোখেমুখে ভীতিভাব ফুটে উঠে, বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় সে। অস্ফুট কণ্ঠে। বলে– সর্দার, আমি তো গুহার মুখে সজাগ পাহারারত ছিলাম।

তবে কোন্ পথে সে নারী আমার এই গোপন গুহায় প্রবেশে সক্ষম হলো, সে কৈফিয়ৎ তোমাকে দিতে হবে পরশু।

সর্দার, আমি– আমি কিছু জানি না।

কথা শেষ হয় না পরশুরামের, মনসুর ডাকুর হস্তস্থিত ছোরাখানা আমুখ বিদ্ধ হয় তার তলপেটে।

তীব্র একটা আর্তনাদ করে ঘুরপাক খেয়ে পড়ে যায় মুখ থুবড়ে পরশুরাম, একটু ছটফট করে থেমে যায় ওর দেহটা।

*

চির-চঞ্চল নূরী ধীরস্থিরা হয়ে পড়েছে। এখন সে মা হতে চলেছে। তার মধ্যে জেগেছে। একটা নতুন অনুভূতি। সে প্রায়ই বনহুরের সঙ্গে থাকতো, কিন্তু এখন পারে না। তাকে আস্তানায় থাকতে হয় সর্বক্ষণ বন্দী হয়ে।

বনহুর যতক্ষণ আস্তানায় থাকে ততক্ষণ নূরী ওকে ঘিরে থাকে। কত কথা, কত আশার স্বপ্ন নিয়ে ছবি আঁকে ওরা দু’জন।

বনহুরের অবশ্য বেশি ভাববার সময় নেই। তাকে সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়। বিশেষ করে ভাবিয়ে তুলেছে তাকে এই অজ্ঞাত নারী।

সেদিন বনহুর নূরকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলো আস্তানায়। হঠাৎ একখানা তীর এসে বিদ্ধ হলো তার অশ্ব বল্লায়।

বনহুর অশ্ব থামিয়ে ফেললো, দু’চোখে তার বিস্ময় ফুটে উঠে। চলন্ত অশ্বের বল্লা লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করা কম কথা নয়! বনহুর অশ্ব থামিয়ে তাকালো যেদিক থেকে তীর ছুটে এসেছিলো সেই দিকে।

অবাক হলো বনহুর, কারণ সে কিছুই দেখতে পেলো না। বনহুর অশ্ব বল্লা থেকে তীরফলকটা হাতে তুলে নিতেই দেখলো, তীরে গাঁথা একটা কাগজখণ্ড।

বনহুর দ্রুতহস্তে কাগজখণ্ডটা খুলে নিয়ে মেলে ধরলো চোখের সম্মুখে। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা মাত্র কয়েক লাইন

বনহুর, তোমার নামই শুনেছিলাম।
তোমাকে যে দেখবো কোনোদিন ভাবতে পারিনি।
এখন আমি তোমাকে খুঁজে পেয়েছি
 আর কোনোদিন তুমি আমার দৃষ্টির আড়ালে
হারিয়ে যাবে না। আমি তোমাকে ভালবাসি।
— আশা।

 বনহুর একবার নয়, কয়েকবার পড়লো সেই ক্ষুদ্র চিঠিটা। কে এই নারী যে আমার নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলো কিন্তু সে আমাকে দেখেনি কোনোদিন। বনহুর অল্পক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে পড়লো, একটুখানি হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে।

 বনহুর এবার তার অশ্বের গতি বাড়িয়ে দিলো। উল্কাবেগে ছুটে চললো সে আস্তানা অভিমুখে।

আস্তানায় এসে পৌঁছতেই দু’জন অনুচর ছুটে এলো, বনহুর অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়াতেই অনুচরদ্বয় চেপে ধরলো অশ্বের লাগাম।

বনহুর আস্তানায় প্রবেশ করলো।

নাসরিন ছুটে এলো বনহুরের পাশে– সর্দার, শুভ সংবাদ।

বলো?

নূরীর পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে।

 বনহুরের মুখমণ্ডল দীপ্ত হয়ে উঠলো, বললো– নাসরিন, বলো কি চাও আমার কাছে?

নাসরিন বললো– যা আপনার খুশি আমাকে দিন সর্দার।

এই নাও…বনহুর নিজের বাজু থেকে বহু মূল্যবান হীরক বলয় খুলে দিলো নাসরিনের হাতে।

আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠলো নাসরিন, সে ছুটে গেলো নূরীর কক্ষে। খুশিতে গদগদ হয়ে বললো–এই দেখ নূরী, তোমার সন্তান হয়েছে শুনে সর্দার আমাকে তাঁর বাজুবন্দ উপহার দিয়েছেন।

 নূরী তার নবজাত শিশুকে বুকে আঁকড়ে ধরে ছোট্ট মুখে চুমো দিয়ে বলে– সর্দার তোকে হীরক বলয় দিয়েছে আর আমাকে দিয়েছে এই অমূল্য রত্ন।

 নূরী আর নাসরিন যখন নবজাত শিশুকে নিয়ে আনন্দে আত্নহারা, তখন বনহুর হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রবেশ করে সেখানে।

বনহুরকে দেখে লজ্জায় কুঁকড়ে যায় নূরী।

নাসরিনও একটু লজ্জা পায়, তবু সে নিজকে সামলে নিয়ে নূরীর কোল থেকে কচি শিশুটাকে নিজের কোলে নিয়ে এগিয়ে আসে বনহুরের সম্মুখে, বলে– এই দেখুন সর্দার।

 বনহুর নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে নবজাত ফুটফুটে শিশুর মুখের দিকে, তারপর ফিরে তাকায় নূরীর মুখে।

বনহুরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে নূরীর গণ্ড, দৃষ্টি নত করে নেয়। সে। বনহুরের দৃষ্টির মধ্যে সে খুঁজে পায় আন্তরিক অভিনন্দন।

*

দু’টি সন্তানের পিতা হলেও বনহুর কিন্তু ঠিক পূর্বের মতই উচ্ছখল, চঞ্চল, খেয়ালী রইলো। দস্যুতা তার পেশা নয়–নেশা। ধনবান, ঐশ্বর্যবান, যারা পরের ধনে ধনি তাদের ধন-সম্পদ লুটে নিয়ে সাগরের জলে নিক্ষেপ করতে তার বড় আনন্দ। অতি মূল্যবান মনিমুক্তা বা হীরকখণ্ডে তার কোনো মায়া-মমতা নেই। লোভ নেই তার ধন-সম্পদ বা ঐশ্বর্যে। ধনবানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে। নিয়ে দীন-দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া তার নেশায় পরিণত হয়েছে। কয়েক দিন যদি সে এ কাজ করতে না পারে তাহলে রীতিমত হাঁপিয়ে উঠে। বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে এ কাজ তার করা। চাই-ই।

সেদিন ধনকুবের জালাল শাহের জাহাজ ফারহা বন্দর থেকে নীল নদ অতিক্রম করে মিসরের দিকে রওয়ানা দিলো। সংবাদটা ফারহা ঘাটি থেকে বনহুরের অনুচরগণ জানিয়ে দিলো সর্দারকে। তারা এ কথাও জানালো, জালাল শাহ ফারহা নগরির গরীবের মুখের অন্ন কেড়ে নিয়ে প্রচুর ঐশ্বর্য আর ধন-সম্পদ করেছে। কোটি কোটি টাকার কারবার তার চলছে। হাজার হাজার দীনহীন অসহায় শ্রমিকের রক্তে সঞ্চিত তার ঐশ্বর্য। এ হেন ব্যক্তির মাল বোঝাই জাহাজ মিসরে নিরাপদে পৌঁছবে অথচ তাদের করবার কি কিছুই নেই।

 ফারহার ঘাটি থেকে সংবাদ কান্দাই আস্তানায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের দলে সাড়া পড়ে গেলো। বনহুর আদেশ দিলো রহমানকে রহমান, আমার সব অনুচরকে, প্রস্তুত হতে বলো। নীল নদের উদ্দেশ্যে আমাদের এ যাত্রা।

কথাটা নূরীর কানে পৌঁছামাত্র সে বিচলিত হয়ে পড়লো। বনহুর যখন প্রস্তুত হচ্ছিলো তখন নূরী তার শিশুপুত্রটিকে কোলে করে প্রবেশ করলো বনহুরের বিশ্রামকক্ষে, আশঙ্কাপূর্ণ কণ্ঠে বললো– হুর, তুমি নীল নদ অভিমুখে যাত্রা করছো, একথা সত্য?

বনহুর বললো– হাঁ নূরী, তুমি যা শুনেছে সম্পূর্ণ সত্য।

তোমাকে নীল নদের উদ্দেশ্যে আমি যেতে দেবো না হুর।

একথা তোমার মুখে শোভা পায় না নূরী।

না না, তোমার যদি কোনো অমঙ্গল হয়……

ওসব চিন্তা তুমি করো না। নূরী, এখন তুমি শুধু দস্যুপত্নী নও, তুমি দস্যুমাতা। কথাটা বলে। বনহুর নূরীর কোলে নবজাত শিশুটিকে চুম্বন করলো।

নূরী অভিমানভরা কণ্ঠে বললো– না, আমার সন্তানকে আমি দস্যু হতে দেবো না।

হেসে বললো বনহুর– তুমি না চাইলেও জাবেদ দস্যু হবেই নূরী! কারণ ওর শরীরে আছে। দস্যুর রক্ত। মাতা যার দস্যু দুহিতা, পিতা যার দস্যু, সে কখনও..

চুপ কর হুর, আমি আমার ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবো, ওকে লণ্ডন পাঠিয়ে উচ্চশিক্ষায়। শিক্ষিত করবো।

তবু তবুও পারবে না নূরী জাবেদকে দস্যুতা হতে পরিহার করতে। নূরী যাও, শিশুকে দুধ পান করাতে যাও। বনহুর কথাটা বলে রিভলভার তুলে নিলো হাতে।

 নূরী বুঝতে পারলো, তার বাধা মানবে না বনহুর, সে অভিমানে মুখ ভার করে রইলো।

 বনহুর নূরীর কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলো তার জাহাজে। নীল নদ অভিমুখে রওয়ানা দিলো তারা।

বনহুরের একজন অনুচর জালাল শাহের জাহাজে ফারহা বন্দর থেকে আত্মগোপন করে। রওয়ানা দিয়েছিলো। জাহাজে খালাসীর বেশেই ছিলো সে, সুযোগ বুঝে ওয়্যারলেসে পথের নির্দেশ দিচ্ছিলো বনহুরকে।

 বনহুরের জাহাজখানা ছিলো অত্যন্ত দ্রুতগামী জাহাজ, নাম ছিলো এর বুলেট। বনহুর যখন জলপথে কোথাও দস্যুতার জন্য গমন করতো তখন এই বুলেটেই যেতো। এ জাহাজখানা সব সময়ের জন্য মারাত্নক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকতো।

এই জাহাজে শুধু অস্ত্রশস্ত্রই বোঝাই থাকতো না, এ জাহাজে ছিলো ওয়্যারলেস মেশিন, দিকদর্শন যন্ত্র, টেলিভিশন, রেডিও এবং অটোম্যাটিক কামান মেশিন। দূরে কোনো শত্রু-জাহাজ বা কোনো জলজন্তুর আবির্ভাব ঘটলে সুইচ টিপে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কামান থেকে গোলাগুলী নিক্ষিপ্ত হতে থাকবে।

বনহুর এই জাহাজেই নীল নদ অভিমুখে যাত্রা করলো।

প্রথম যেদিন জাহাজ ছাড়লো সেইদিন বনহুর তার ক্যাবিনে পেলো একখানা তীরফলক। ক্যাবিনে প্রবেশ করেই তার নজরে পড়লো ক্যাবিনে দেয়ালে গাথা, তীরটি। বিস্মিত হলেও তীরফলকটা তার অতি পরিচিত যে তীর নিক্ষেপকারিণী তাকে মনসুর ডাকুর অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার করেছে, এ তীর যে তারই নিক্ষিপ্ত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বনহুর অবাক হলো কে সেই অদৃশ্য নারী যে তার এই গোপন যাত্রার সন্ধান জানতে পেরেছে এবং তারই ক্যাবিনে তীর নিক্ষেপ করে তাকে সজাগ করে দিয়েছে। বনহুর দেখলো, তীরফলকে। একখণ্ড কাগজ পূর্বের মত করে আটকানো আছে।

তীরফলক থেকে কাগজখণ্ডটা খুলে নিলো বনহুর। পড়ে দেখলো সে কাগজের লেখাগুলো—

বনহুর, নীল নদ অতি ভয়ঙ্কর সাগর তা
তুমিও জানো। যাচ্ছো যাও, কিন্তু কোনো
 সময় অসতর্ক বা অসাবধান হবে না,
বিপদ তোমার জন্য প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করবে।
– আশা।

চিঠিখানা পড়ে বনহুর হাসলো আপন মনে, ঠিক সেই দণ্ডে রহমান এসে দাঁড়ালো তার পাশে। সর্দারের হাতে চিঠি এবং তীরফলক দেখে রহমান কম অবাক হয়নি! হঠাৎ কিছু বলতেও সাহসী হলো না সে, জিজ্ঞাসা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সে বনহুরের মুখের পানে।

বনহুর বুঝতে পারে, রহমান তার হাতে তীরফলক আর চিঠিখানা দেখে অবাক হয়ে গেছে। বললো বনহুর রহমান, সেই অদৃশ্য নারী আমাদের যাত্রার খবর পেয়ে গেছে।

বলেন কি সর্দার?

হু, এই দেশ তীর এবং এই চিঠি। নীল নদ যাত্রাকালে আমাকে সাবধান করা হয়েছে।

রহমান চিঠিটা পড়ে মুখ কালো করে ফেললো। তার মনে আশংকা হলো, এ যাত্রা অতি রহস্যময় বলে মনে হতে লাগলো তার কাছে।

রহমানকে গম্ভীর হতে দেখে বললো বনহুর– তোমার কি কোনো সন্দেহ হচ্ছে রহমান?

তা হচ্ছে বৈকি! সর্দার, মেয়েটি অত্যন্ত সুচতুরা বলে মনে হচ্ছে। তা ছাড়া সে আপনার পিছনে জোঁকের মত লেগে আছে……

রহমানের কথার মাঝখানে বলে উঠে বনহুর– যে কোনো মুহূর্তে আমাকে সে বিপদেও ফেলতে পারে, বুঝলে রহমান?

বুঝেছি সর্দার। এ এক ভীষণ রহস্য ছাড়া কিছু নয়। সর্দার, সেই অদৃশ্য নারীমূর্তি আমাদের জাহাজেও আত্নগোপন করে থাকতে পারে।

তা সত্য হতে পারে। কারণ, যে আমার ক্যাবিনে তীর নিক্ষেপ করতে পারে, সে সব পারে। হাঁ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি, সেই নারী অত্যন্ত সুচতুরা আর বুদ্ধিমতী।

বনহুরের নির্দেশে সমগ্র জাহাজখানা তন্ন তন্ন করে সন্ধান করা হলো, কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না অজ্ঞাত কোনো নারী বা পুরুষকে।

বনহুর নীল নদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।

 কিন্তু বনহুরের মনের কোণে একটা গোপন কথা বারবার উঁকি দিয়ে চললো, কে সেই তীর নিক্ষেপকারিণী, যে তাকে এমনভাবে অনুসরণ করে চলেছে।

সেই নারীর কথা বনহুর যত ভাবছে ততই বিস্ময় জাগছে তার মনে। নিশ্চয়ই সে তার মঙ্গলকামী।

বনহুর জালাল শাহের জাহাজ আক্রমণ করলো। লুটে নিলো তার যথাসর্বস্ব। জালাল শাহ এবং তার সঙ্গী-সাথীদেরকে বন্দী করে ফেললো সে।

বিজয় উল্লাসে হর্ষধ্বনি করে উঠলো বনহুরের অনুচরগণ। লুণ্ঠিত সমস্ত মাল জমা করা হলো। জাহাজের ডেকে।

 জালাল শাহ এবং তার সঙ্গীদেরও বেঁধে ডেকে এনে জড়ো করা হলো।

বনহুর এসে দাঁড়ালো জালাল শাহের সম্মুখে, শরীরে তার জমকালো ড্রেস– মাথায় পাগড়ি, পাগড়ির আঁচলে মুখমণ্ডলের নিচের অংশ ঢাকা।

বনহুর তার অনুচরদের আদেশ করলো– তোমরা জালাল শাহ এবং সকল বন্দীর হাত-পার বন্ধন উন্মোচন করে দাও।

সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের আদেশ পালন করলো রহমান ও বনহুরের অনুচরগণ। জালাল শাহ এবং তার সঙ্গীদের হাত-পার বন্ধন মুক্ত করে দেওয়া হলো।

বনহুরের ইংগিতে কয়েকজন অনুচর রাইফেল উদ্যত করে রইলো, ওদের হাত-পার বন্ধন উন্মোচন করে দেবার পর ওরা যেন কোনো রকম গণ্ডগোল পাকাতে না পারে। বনহুরের হাতেও গুলীভরা রিভলভার উদ্যত রয়েছে।

সকলের হাত-পার বাঁধন মুক্ত হলে বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো– এবার তোমাদের ধন সম্পদগুলোর সৎ ব্যবস্থা কর।

জালাল শাহ খুশি হয়ে উঠলো যেন, সে আনন্দিতভাবে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে, ভাবলো এবার বুঝি দস্যুটার মনে দয়া হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার কানে ভেসে এলো বনহুরের কঠিন কণ্ঠস্বর– তোমরা প্রত্যেকেই মাল কাঁধে উঠিয়ে নাও।

 বনহুরের আদেশ পাওয়ামাত্র জালাল শাহ এবং তার সঙ্গী-সাথীরা যদিও বা তাদের খুব কষ্ট হচ্ছিলো তবুও তারা মূল্যবান সামগ্রীগুলো কাঁধে তুলে নিলো, আশায়-আনন্দে চোখগুলো যেন। জ্বলছে তাদের। এবার তারা ক্যাবিনের দিকে পা বাড়াতেই বনহুর বললো–ওদিকে নয়, ডেকের রেলিংয়ের দিকে পা বাড়াতেই বনহুর বললো–ওদিকে নয়, ডেকের রেলিংয়ের দিকে যাও এক এক করে সব জিনিস সাগরের পানিতে নিক্ষেপ কর।

 মুহূর্তে জালাল শাহ ও তার সাথীদের মুখমণ্ডল বিবর্ণ নিষ্প্রভ হয়ে গেলো সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে দেখে বনহুর কঠিন কণ্ঠে বললো–বিলম্ব হলে তোমাদের জীবন নেবোনাও, ফেল এসব সাগরের পানিতে।

জালাল শাহ বলে উঠলো-এসব যে অতি মূল্যবান জিনিসপত্র …

মূল্যবান বলেই তো সাগরে নিক্ষেপ করতে বলছি, কারণ এসব সামগ্রী তুমি গরিবের রক্ত শুষে নিয়েই সঞ্চয় করেছিলে, তাই এর মূল্য সাগরই দিবে।

 জালাল শাহ বনহুরের চোখের দিকে তাকালো, তারপর তাকালো তার হাতের রিভলভারের–দিকে পারলো না অবাধ্য হতে, মালগুলো সাগরের পানিতে নিক্ষেপ করতে বাধ্য হলো।

 সে এক অদ্ভুত দৃশ্য কত মূল্যবান সম্পদ সাগরবক্ষে নিক্ষেপ করে চললো জালাল শাহ নিজে এবং তার সাথী-সঙ্গীরা।

 জালাল শাহের মুখে কে যেন এক পোচ কালি মাখিয়ে দিয়েছিলো, সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে চুপসে উঠেছে। এত মাল তারা বয়ে নিয়ে সাগরে ফেলতে হাঁপিয়ে উঠেছিলো রীতিমত, তাছাড়া তাদের মনের অবস্থাও হয়েছিলো অবর্ণনিয়।

 এক সময় সমস্ত মাল সাগরে নিক্ষেপ করা সমাপ্ত হলো। জালাল শাহ এবং তার দলবল কম বিস্মিত হয়নি, কারণ তারা জীবনে বহু দস্যুতার সংবাদ অবগত হয়েছে কিন্তু এমন দস্যুতার খবর তারা কোনোদিন শোনেনি বা শোনেনি যে, লুণ্ঠিত মাল কোনো দস্যু বা ডাকাত সাগরের পানিতে ফেলে দেয়।

জাহাজ যখন সম্পূর্ণ মালশূন্য হলো তখন বনহুর জালাল শাহ এবং তার দলবলকে একটি বড় ক্যাবিনে আটক রেখে বললো–এবার তোমাদের আমি ক্ষমা করলাম, এরপর আবার যদি পরের ধন কেড়ে নিয়ে ব্যবসা কর বা গরিবের মুখের অন্ন কেড়ে নাও তাহলে আর ক্ষমা নয়, তখন ঐ মালগুলোর মত তোমাদেরকেও সাগরের পানিতে নিক্ষেপ করে তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো।

জালাল শাহের জাহাজ আপনা আপনি ভেসে চললো। বনহুর দলবল নিয়ে নিজ জাহাজে ফিরে এসেছে তখন।

 জালাল শাহর জাহাজ দিকহীনভাবে ভেসে চলেছে। কারণ, জাহাজের চালক ও অন্যান্য খালাসীকেও বনহুর আটক করে রেখেছিলো, উদ্দেশ্য জালাল-শাহকে উচিত সাজা দেওয়া।

*

মনসুর ডাকু আর গোমেশে পরামর্শ চলছিলো। আজ মনসুর.ডাকুকে অত্যন্ত উফুল্ল মনে হচ্ছে। কথার মাঝে মাঝে অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ছিলো মনসুর ডাকু।

এমন সময় ইরানি এসে দাঁড়ালো–বাপু, তোমরা কোনো কাজের নও; আজ পর্যন্ত তোমরা দস্যু বনহুরকে খুঁজে বের করতে পারলে না? শত ধিক্ তোমাদের।

হো হো করে হেসে উঠলো মনসুর ডাকু, তারপর বললো–মা ইরানি তোর বাপুকে এত অকেজো ভেবেছিস? তোর বাপু সব পারে, শুধু পারে না মরা মানুষ বাঁচাতে। গোমেশ আছে, আমার আর কোনো ভাবনা নেই বুঝলি?

বুঝেছি, কিন্তু তোমরা কতদূর কি করলে বল তো? ইরানি কথাটা বলে পাশের আসনে বসে পড়লো। দস্যুকন্যা তাই সর্বক্ষণ তার কোমরের বেল্টে সূতীক্ষ্ণ ধার একখানা ছোরা থাকতো। ইরানি আসনে বসবার পূর্বে কোমরের বেল্ট থেকে ছোরাখানা খুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো।

ইরানির এটা অভ্যাস, বিশেষ করে গোমেশের সম্মুখে এলেই সে ছোরাখানা নিয়ে নাড়াচাড়া করতো। অবশ্য এর পিছনে কারণ আছে–ইরানি দস্যুকন্যা হলেও সে ছিলো অপূর্ব অদ্ভুত সুন্দরী। কাজেই মনসুর ডাকুর আড্ডার অনেকেরই লোভাতুর দৃষ্টি ছিলো তার উপর। সর্দার-কন্যা বলে কারো সাহস হতো না তাকে প্রেম নিবেদন করবার। শুধু গোমেশ ছিলো দুর্দান্ত দুঃসাহসী, সে কাউকে পরোয়া করতো না, সুযোগ পেলেই ইরানির কাছে প্রেম নিবেদন করতে ছাড়তো না। তাই ইরানি গোমেশের সম্মুখে এলে তার হাতে যে কোনো অস্ত্র থাকতো।

গোমেশের ইচ্ছা, যেমন করে হোক ইরানিকে সে একদিন আপনার করে নেবেই, বিয়ে সে তাকে করবেই। গোমেশ হিন্দু হলেও তার ধর্মের কোনো ঠিক ছিলো না। হিন্দু-মুসলমান বলে কোন ভেদাভেদ ছিলো না–বিশেষ করে ইরানির বেলায়।

এহেন গোমেশকে ইরানি অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতো। পিতার সহকারি বলে সে তেমন কিছু না বললেও ওকে ইরানি দেখতে পারতো না কিছুতেই।

ইরানি হস্তস্থিত ছোরাখানা সম্মুখের টেবিলে গেঁথে সোজা হয়ে বসলো। দৃষ্টি তার পিতার মুখে নিবদ্ধ রয়েছে।

মনসুর গোমেশের দিকে তাকিয়ে বললো–বল না গোমেশ, কতদূর খোঁজ সংগ্রহ করে?

গোমেশের গোঁফ জোড়া যেন খাড়া হয়ে উঠলো। মুখে তার হাসি ফুটে উঠলো বললো– ইরানির কণ্ঠের হীরক হার আমি নেবোই। সেই নারীকে আমি ধরে আনবোই এবং দস্যু বনহুরকেও মৃত কিংবা জীবিত আমি পাকড়াও করে আনবো। সে এখন নীল নদ অতিক্রম করে কান্দাইয়ের দিকে আসছে। হাঃ হাঃ হাঃ সেই নারী ও দস্যু বনহুরকে বন্দী করে আনতে না পারলে আমি গোমেশ নাম পাল্টাবো।

ইরানি ভ্রূ কুঞ্চিত করে তাকালো গোমেশের মুখে, ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি হেসে বললো–গোমেশ নামটা পাল্টানোই তোমার শ্রেয়, বুঝলে? আর হাঁ শোন দস্যু বনহুরকে যদি জীবিত আনতে পারো তবেই তুমি আমার কণ্ঠের হীরক হার পাবে নচেৎ নয়, কারণ দস্যু বনহুরকে আমি নিজ হাতে মৃত্যুদণ্ড দেবো। আমার বাপুর অপমানের প্রতিশোধ আমি নিজ হাতে গ্রহণ করবো। ইরানির চোখ দুটো জ্বলে উঠলো গোপন গুহার মশালের আলোতে।

মনসুর ডাকু বললো–হ্যাঁ মা ঠিক বলেছিস বনহুর আমাকে শুধু অপমানই করেনি, রীতিমত নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। আমাকে দু’মাস সে তার ভূগর্ভস্থ আস্তানার বন্দীখানায় বন্দী করে রেখেছিলো।

ইরানি কঠিন কণ্ঠে বলে উঠে–বাপু, আমি জানতাম, তোমার মত ডাকু এ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় জন নেই। মনেপ্রাণে আমি তাই তোমাকে শ্রদ্ধা করতাম কিন্তু—

কিন্তু কি–বল, বল্ ইরানি, থামলি কেন বল?

বাপু, তোমাকেও নাকানি-চুবানি খাওয়াতে পারে, এমন লোকও আছে। তাই তাই আমি চাই সেই অসীম শক্তিশালী দস্যুকে বন্দী করে তোমার অপমানের প্রতিশোধ নিতে।

আমিও তাই চাই ইরানি। তোমার বাপু আমার মালিক, কাজেই মালিকের অপমান আমার অপমান! আমি শপথ করছি দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসবো।

ইরানি তাচ্ছিল্যভরে বললো–আমার বিশ্বাস হয় না তুমি দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করে আনতে পারবে।

গোমেশ নিজের বুকে মুষ্টাঘাত করে বলে উঠে–দস্যু বনহুরকে যদি কেউ বন্দী করে আনতে পারে সে এই গোমেশ। মনসুর ডাকুর শিষ্য আমি

সে কথা তোমার মুখে বহুবার শুনেছি গোমেশ। এবার বলো, দস্যু বনহুর এবং নীল নদ– কি যেন বলছিলে?

 মনসুর ডাকু বললো এবার–আমি বলছি শোন ইরানি। আমরা সন্ধান নিয়ে জানতে পেরেছি। দস্যু বনহুর এখন নীল নদ অতিক্রম করে কান্দাই অভিমুখে ফিরে আসছে।

 ইরানি বলে উঠলো–আশ্চর্য দস্যু বনহুর এখন নীল নদ অতিক্রম করে কান্দাই অভিমুখে ফিরে আসছে, এ কথা তোমরা কি করে জানতে পারলে? আমার মনে হচ্ছে, কেউ তোমাদের ধোকা দিয়েছে।

অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে বললো মনসুর ডাকু–এ সংবাদ মিথ্যে নয় ইরানি।

ইরানি বললো–তার প্রমাণ?

গোমেশ বুকে চাপড় মেরে বললো–আমি। আমি তার প্রমাণ। ইরানি, আমি কান্দাই থেকে এ সংবাদ সংগ্রহ করেছি। শুধু সংগ্রহ নয়, আমি নিজে ছিলাম যখন তাদের জাহাজ কান্দাই থেকে রওয়ানা দেয়—

হঠাৎ ইরানি খিল খিল করে হেসে উঠলো, তারপর দাঁত পিষে বললো–নিজে ছিলে মানে উপস্থিত ছিলে, তবু দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করতে পারোনি? তোমাকে শত ধিক গোমেশ বাহাদুর।

ইরানি তুমি জানো না দস্যু বনহুর কতখানি—

চুপ করো গোমেশ! শুধু দস্যু বনহুর অসাধারণ আর তোমরা কি মানুষই নও? তোমাদের দেহে কি একটুও শক্তি নেই?

মনসুর ডাকু কন্যার ক্রুদ্ধ ভাব লক্ষ্য করে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো–ইরানি। আমরাও কম নই, তুই তো জানিস দস্যু বনহুর যত শক্তিশালীই হোক, তাকে আমরা বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিলাম–

বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিলে কিন্তু তার কোনো ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছে? পারবে না পারবে না বাপু তার কোনো ক্ষতি করতে। তোমাদের মত—থাক্, আর বলব না। কিন্তু মনে রেখো বাপু যতদিন তোমার অপমানের প্রতিশোধ আমি না নিয়েছি ততদিন আমি দস্যু বনহুরকে ক্ষমা করব না। ক্রুদ্ধ নাগিনির মত ফোঁস ফোঁস করে উঠলো ইরানি।

মনসুর ডাকু বললো–এবার দস্যু বনহুরের নিস্তার নেই মা গোমেশ সহ আমরা কালকেই যাত্রা করবো। আমাদের জাহাজ প্রস্তুত।

বাপু, আমিও যাবো তোমাদের সঙ্গে। দস্যু বনহুরকে আমি সায়েস্তা করে ছাড়বো। দেখবো। কেমন পুরুষ সে!

বেশ, আমি রাজি আছি। বললো মনসুর ডাকু।

*

 নীল নদ অতিক্রম করে ছুটে চলছে দস্যু বনহুরের জাহাজখানা। বনহুর নিজে পথের নির্দেশ দিচ্ছিলো। মাঝে মাঝে ওয়্যারলেস ক্যাবিনে প্রবেশ করে বিভিন্ন আস্তানার সঙ্গে যোগাযোগ করছিলো সে।

হঠাৎ ওয়্যারলেসে ভেসে আসে একটি নারীকণ্ঠ—বনহুর জানি না তোমার জাহাজ এখন নীল নদের কোন্ অংশ অতিক্রম করে কান্দাই অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে—সম্মুখে অগ্রসর হতে বিরত হও—তোমার পথে উপস্থিত বিপদ প্রতীক্ষা করছে—তোমার মঙ্গল আমার কামনা–

বনহুর বিস্মিত হতবাক! সে তাড়াতাড়ি তাকালো ওয়্যারলেসের উপরিভাগের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাল্বের দিকে। ওয়্যারলেসের উপরে বহু সংখ্যক নীল, লাল হলুদ সবুজ বিভিন্ন রংয়ের বাল্ব বসানো রয়েছে এই বাল্বগুলোর নিচে দস্যু বনহুরের বিভিন্ন ঘাটির নম্বর দেওয়া আছে। বনহুর দেখলো, তার জন্ধুর ঘাটির গাঢ় নীল বাল্বটি জ্বলছে আর নিভছে। অবাক হলো বনহুর, নারীকণ্ঠ তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাছাড়া জন্ধুর ঘাটিতে তার বহু অনুচর রয়েছে, অপরিচিত জনের প্রবেশ সেখানে অসম্ভব। কে এই নারী যে তার মঙ্গল কামনা করছে? বনহুরের চিন্তা স্রোত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখনও ওয়্যারলেসে ভেসে আসছে সেই নারীকণ্ঠ—যদি মঙ্গল চাও তবে নীলনদের দক্ষিণ মোহনা অতিক্রম করে কান্দাই ফিরে যাও–

বনহুর বলে উঠেকে, কে তুমি আমার জম্বুর ঘাটি থেকে বলছো?

পুনরায় সেই কণ্ঠ—আমি আশা। তোমারই জন্ধুর ঘাঁটি থেকে বলছি। তোমার অনুচরদের কিছুক্ষণের জন্য বন্দী করে রেখেছি। এক্ষুণি তাদের মুক্ত করে দেবো। হাঁ, মনে রেখো, তোমার জন্য নীল নদ মোটেই নিরাপদ নয়। তুমি আমার নির্দেশমত কাজ করবে—

বনহুর হেসে উঠলো হাঃ হাঃ হাঃ দস্যু বনহুর কোনো সময় বিপদকে ভয় করে না, বিপদকে জয় করাই হলো তার স্বভাব।

জানি তুমি আমার কথা মানবে না–তবু বলছি আমার নির্দেশ মেনে চললে তোমার মঙ্গল হবে—

উপরের গাঢ় নীল বাল্ব নিভে গেলো। বনহুর বুঝতে পারলো, আশা ওয়্যারলেস ছেড়ে দিয়েছে। বনহুর সুইচ অন্ করে জম্বুর ঘাটির সঙ্গে ওয়্যারলেস যোগ করে নিলো, কিন্তু ওদিক থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছে না বনহুর। কয়েক মিনিট ধরে বনহুর চেষ্টা চালাতে লাগলো, হঠাৎ ভেসে এলো জল্লুর ঘাটি থেকে তার প্রধান অনুচরের বিহ্বল কণ্ঠ—সর্দার—কে এক নারীমূর্তি অতর্কিতভাবে—আমাদের সবাইকে বন্দী করে ফেলে—ওয়্যারলেস ব্যবহার–

বনহুর ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠলো–একটি নারী তোমাদের অতর্কিতভাবে বন্দী করে ফেললো, আর তোমরা আমারই অনুচর হয়ে নীরবে বন্দী হলে–তোমাদের জন্য আমি উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবো—প্রস্তুত থেকো।

হানিফ জানে তাদের সর্দারের শাস্তি কতখানি ভয়ঙ্কর তাই ভয়কম্পিত স্বরে বলে উঠলো সে—সর্দার আপনি সব শুনলে আশ্চর্য হবেন–আমাদের কোনো অপরাধ নেই সর্দার—আমাদের কৌশলে বন্দী করা হয়েছে–

—থাক্ আর শুনতে চাই না এখন বলল সে নারী কোথায়?

–আমাদের মুক্ত করেই সে অদৃশ্য হবার মতই উধাও হয়েছে। সে আমাদের বা আমাদের ঘাটির কোনো ক্ষতি করেনি। সর্দার আমরা নির্দোষ—

বনহুর ওয়্যারলেস মেশিন অফ করে বেরিয়ে আসে বাইরে। সর্দারকে বাইরে বেরিয়ে আসতে, দেখেই দু’জন অনুচর এগিয়ে এলে, কুর্ণিশ জানালো তারা সর্দারকে।

বনহুর বললো–রহমানকে এক্ষুণি পাঠিয়ে দাও আমার ক্যাবিনে।

অনুচর দু’জন চলে গেলো।

বনহুর ফিরে গেলো তার নিজের ক্যাবিনে।

যতক্ষণ রহমান না এলো ততক্ষণ বনহুর পায়চারী করে চললো মাঝে মাঝে সিগারেট থেকে ধূম্ররাশি নির্গত করে চলেছে সে।

 রহমান ক্যাবিনে প্রবেশ করেই বিস্মিত হলো কারণ সে সরদারকে বেশ বিচলিত দেখলো। কুর্ণিশ জানিয়ে বললো–সর্দার, আমাকে ডেকেছেন?

বনহুর অর্ধদগ্ধ সিগারেটটি এ্যাসট্রের মধ্যে খুঁজে রেখে ফিরে পঁড়ালো রহমানকে লক্ষ্য করে বললো–রহমান সেই নারীমূর্তি আমাদের জন্ধুর আস্তানা হতে ওয়্যারলেসে আমাকে সাবধানবাণী শুনালো।

সর্দার, সেই আশা?

 হাঁ, আশা।

আশ্চর্য আমাদের জন্ধুর আস্তানায় আশা—

তার চেয়েও আশ্চর্য সে আমাকে নীল নদের দক্ষিণ মোহনা হয়ে কান্দাই ফিরে যাবার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। নচেৎ আমাদের সম্মুখে ভয়ঙ্কর বিপদ হানা দেবে।

সর্দার, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না?

বসো, আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি।

বনহুর আর রহমান ক্যাবিনের আসনে বসে পড়লো। রহমানকে সব খুলে বললো বনহুর।

 রহমান সব শুনে আশ্চর্য হলো, বললো সে–সর্দার আশা যা বলেছে সত্যি হতে পারে, তার নির্দেশ মেনে চলা কি ভাল নয়?

বনহুর হেসে উঠলো, তারপর হাসি থামিয়ে বললো–রহমান, আমি দেখতে চাই, কি বিপদ আমার পথ আগলে আছে।

সর্দার।

বলো?

নীল নদ অত্যন্ত ভয়ানক।

জানি আর জানি বলেই তো আমি নীল নদ বেয়ে ফিরে চলেছি। রহমান, আমার অনুচরদের সর্বক্ষণের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলো।

আচ্ছা সর্দার। রহমান বেরিয়ে যায়। বনহুরের আদেশ জানিয়ে দিলো রহমান তার অনুচরদের সবাইকে।

*

হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে এলো।

নীল নদের পানি যেন ক্রমান্বয়ে কেঁপে উঠছে দ্রুতগতিতে। সাইক্লোনের পূর্ব লক্ষণ বুঝতে পারলো বনহুর। আশা যে বিপদের পূর্বাভাষ তাকে জানিয়েছিলো, সেই বিপদের সম্মুখীন হবার পূর্বেই তাকে আর এক বিপদের সম্মুখীন হতে হলো। এ বিপদ মানুষের হাতে গড়া নয়–প্রকৃতির দেওয়া।

বনহুর সঙ্গে সঙ্গে লাউড স্পীকারে ঘোষণা করলো, সবাই যেন সাবধানতা অবলম্বন করে, কারণ অল্পক্ষণের মধ্যেই সাইক্লোন শুরু হবে।

বনহুরের ঘোষণা শেষ হতে না হতে ভীষণভাবে ঝড় শুরু হলো। আকাশ আর নীল নদ যেন এক হয়ে গেলো। সে কি ভয়ঙ্কর মেঘের গর্জন আর জলোচ্ছাস। বনহুরের জাহাজখানা মোচার খোলের মত দুলতে লাগলো দুদিকে।

বনহুর ইঞ্জিনরুমে প্রবেশ করে জাহাজখানাকে ঠিকভাবে চালনা করতে চেষ্টা করলো। কারণ এই ভয়ঙ্কর ঝড়ের মধ্যে তার মত দক্ষ চালক আর বুঝি কেউ নেই। জাহাজের অন্যান্য চালকও নিশ্চুপ ছিলো না বনহুরকে যথাসাধ্য সাহায্য করে চললো।

 ঝড়ের বেগ ক্রমে ভীষণ আকার ধারণ করলো। বনহুর এই প্রথম নয় জীবনে সে বহুবার। সামূদ্রিক সাইক্লোনের কবলে পড়েছে তাই সে এত বিপদেও স্থিরভাবে জাহাজ চালনা করে চললো কিন্তু সে ক্রমেই যেন হতাশ হয়ে পড়ছে আর বুঝি তাদের জাহাজ রক্ষা পেলো না। প্রচণ্ড প্রচণ্ড ঢেউগুলো ভীষণ দানবের মত আছড়ে পড়ছে তাদের জাহাজখানার উপর। এই বুঝি জাহাজখানা নীল নদের অতলে তলিয়ে যাবে।

বনহুর তবু বিচলিত বা উদ্ভ্রান্ত হয়নি, সে অত্যন্ত কৌশলে জাহাজখানাকে সাগরবক্ষে ভাসিয়ে রাখবার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ঝড়ের বেগ বেড়ে যাওয়ায় জাহাজ দিকহারা হয়ে একদিকে ছুটে চলেছে। বনহুরও জানে না তারা এখন কোন পথে কোথায় কতদূর চলে এসেছে। সাইক্লোন যখন ভীষণ আকার ধারণ করেছে। প্রত্যেকে জীবন রক্ষার জন্য যখন আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুরের জাহাজের পাশ কেটে চলে গেলো আর একখানা জাহাজ।

 বনহুর বুঝতে পারলো জাহাজখানা তাদের জাহাজের মতই দিক হারাভাবে একদিকে ছুটে চলেছে। ভাগ্যি বলতে হবে, নাহলে ঐ জাহাজখানার সঙ্গে তাদের জাহাজের সংঘর্ষ হলে আর রক্ষা ছিলো না, জাহাজ দু’খানা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নিমজ্জিত হতো নীল নদের বুকে।

কিন্তু বেশিক্ষণ এসব ভাববার সময় নেই বনহুরের। সে নিজের জাহাজখানাকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে চলেছে।

জাহাজের হেড মেশিনে রইলো বনহুর, যেমন করে হোক সাইক্লোন থেকে রক্ষা করবে তার জাহাজ আর অনুচরগণকে।

ঝড়ের বেগ যেন থামতে চাইছে না–সেকি প্রচণ্ড জলোচ্ছাস! এই বুঝি তলিয়ে যাবে জাহাজখানা।

বহুক্ষণ ঝড় চললো।

সাইক্লোন থেকে সহসা কোনো জাহাজ রক্ষা পাওয়া মুস্কিল। কোনো রকমে বনহুরের জাহাজখানা টিকে রইলো যেন।

একসময় ঝড়ের বেগ কমে এলো।

নীল নদ শান্ত হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।

রাত শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলো।

বনহুর এবার নিশ্বাস ফেলে বাঁচলো। মুক্ত আকাশের তলে ডেকে এসে দাঁড়ালো বনহুর, রহমানও এসে দাঁড়ালো তার পাশে। বনহুর চোখে দূরবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়ে দেখতে লাগলো চারিদিক। প্রচণ্ড ঝড়ের পর শান্ত নীল নদকে বড় সুন্দর লাগছে আজ। ঢেউগুলো যেন বিরাট অজগরের মত ছুটে চলেছে একদিকে।

বনহুর হঠাৎ বলে উঠলো–রহমান, দেখো দেখো, দূরে–বহুদূরে বিরাট একটা কিছু ভাসছে বলে মনে হচ্ছে না?

রহমান দূরবীক্ষণ যন্ত্র চোখে লাগিয়ে ভালভাবে লক্ষ্য করে বললো–হাঁ সর্দার আপনার অনুমান সত্য। কিছু একটা দেখা যাচ্ছে বটে।

বনহুর আদেশ দিলো তার জাহাজখানাকে সেইদিকে চালনা করার জন্য।

 অল্পক্ষণের মধ্যেই বনহুরের জাহাজ সেই বিরাটকার বস্তুটার নিকটবর্তী হলো।

বনহুর এবং তার অনুচরগণ ভালভাবে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলো একটি জাহাজ সম্পূর্ণ উল্টে আছে। আশ্চর্য হলো বনহুর জাহাজখানা তলিয়ে না গিয়ে ভেসে আছে কি করে! বনহুর অনুচরদের আদেশ করলো জাহাজখানার চারপাশে বোট নিয়ে দেখতে। হয়তো জাহাজের আরোহিগণ কেউ কেউ রক্ষা পেলেও পেতে পারে। আরও বুঝতে পারলো, এ জাহাজখানা কাল রাতের ঝড়ে উল্টে গেছে।

বনহুরের নির্দেশমতে কয়েকজন বোট নিয়ে সাগরবক্ষে নেমে পড়লো। ডুবন্ত জাহাজখানার চারপাশ সন্ধান করে দেখবার জন্য অগ্রসর হতেই দেখলো, কয়েকজন লোক সংজ্ঞাহারার মত জাহাজের চারপাশে ভাসছে।

বনহুরের অনুচরগণ বহু কষ্টে তাদের তুলে নিলো বোটে। লোকগুলো প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলো। জাহাজে ওদের তুলে নেওয়া হলো।

বনহুরের সম্মুখে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে ভীষণভাবে চমকে উঠলো–এরা যে স্বাভাবিক ব্যক্তি নয়, তা সত্য। এক এক জনের চেহারা ভয়ঙ্কর যদিও তাদের শরীরে তেমন কোনো জামাকাপড় ছিলো না তবু বনহুর এবং তার দলবল বুঝতে পারে, এরা কোনো দস্যু বা ডাকাতের। দল। ….

বনহুর সংজ্ঞাহারা লোকগুলোকে ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। হঠাৎ একজনের উপর নজর পড়তেই অদ্ভুতভাবে শব্দ করে বললো বনহুর রহমান দেখো দেখো—

 রহমান সরে আসতেই সে অস্ফুট শব্দ করে উঠলো–মনসুর ডাকু–

বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ালো, এতক্ষণ সে সবাইকে ঝুঁকে ঝুঁকে পরীক্ষা করে দেখছিলো। হেসে বললো বনহুর রহমান, খোদার অপূর্ব লীলা! নিশ্চয়ই মনসুর আমাদের সন্ধানেই আসছিলো, ভাগ্যক্রমে তার সে প্রচেষ্টা সার্থক হলো।

অবাক হয়ে বললো রহমান–সর্দার।

 আমার কথা তুমি ঠিক বুঝতে পারোনি রহমান?

না সর্দার।

 মনসুর আমার অন্বেষণেই নীল নদে পাড়ি জমিয়েছিলো। কিন্তু সাইক্লোন তার বাহন জাহাজুটিকে গ্রাস করে তাকে সে পথ থেকে বিরত করতে চেয়েছিলো। একটু থেমে বললো আবার বনহুর–ভাগ্য ক্রমে আমার জাহাজেই তাদের আসতে হলো, কাজেই তার সাধ অপূর্ণ রইলো কই?

রহমান বললো–সর্দার, মনসুর ডাকু নিশ্চয়ই মন্দ উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলো—

মন্দ তো বটেই। সে জানতে পেরেছিলো আমি নীল নদে পাড়ি জমিয়েছি এবং সেই কারণেই সে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলো।

বনহুরের অনুচরদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো–সর্দার হুকুম করুন মনসুর ডাকু আর তার সাথীদের খতম করে দেই। এগিয়ে এলো লোকটা সূতীক্ষ্ণ ধার বর্শা হাতে।

বনহুর বললো-মংলু, আমার নীতি নয় অসহায়ের প্রতি দুর্ব্যবহার করা। কাজেই এরা আমার যতই শক্র হোক না কেন এদের আমি হত্যা করতে পারি না।

বনহুরের কথায় তার অনুচরগণ কেউ তেমন খুশি হতে পারলো না। রহমানের জোড়া। কুঁচকে গেলো সে না বলে পারলো না, বললো–সর্দার মনসুর ডাকু আপনার প্রধান শত্রু তাছাড়া সে আপনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই যাত্রা করেছিলো, অথচ আপনি তাকে–

 হাঁ রহমান, এ অবস্থায় ওদের রক্তে আমাদের অস্ত্র রঞ্জিত করতে চাই না। ওদের খেতে দাও, বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দাও। ওরা সুস্থ হলে নীল নদের তীরে নামিয়ে দেওয়া হবে।

সর্দারের কথার পর কেউ মনসুর ডাকু এবং তার সাথীদের শরীরে অস্ত্র প্রয়োগ করতে সাহসী হলো না।

মনসুর ডাকু এবং তার সঙ্গীদের জ্ঞান ফিরে এলো একসময়। বনহুর পূর্বেই বলে দিয়েছিলো ওরা যেন বুঝতে না পারে যে তারা দস্যু বনহুরের জাহাজে আশ্রয় পেয়েছে।

বনহুরের আদেশমত মনসুর ডাকু তার সঙ্গীদের রীতিমত খাবার দেওয়া হলো, তাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। কিন্তু সবাই সাবধানতার সঙ্গে সতর্ক রইলো ওরা যেন টের না পায় যে এটা তাদের শত্রুর জাহাজ।

বনহুর তাদের জাহাজখানাকে নীল নদের তীরের দিকে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলো।

মনসুর ডাকুর সংজ্ঞা ফিরে আসার পর সে জাহাজের মালিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যার দয়ায় তারা রক্ষা পেয়েছে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চায় সে। যদিও মনসুর ডাকুর সবগুলো অনুচর রক্ষা পায়নি তবু বেশ কিছুসংখ্যকের জীবন রক্ষা পেয়েছিলো। মনসুর ডাকু সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে তার কন্যা ইরানিকে হারিয়ে। ইরানিও তাদের জাহাজে ছিলো। কিন্তু মনের ব্যথা মনে চেপে রাখলো মনসুর, আফসোস করে আর কি হবে–নিজেদের জীবন রক্ষা পেয়েছে এটাই ভাগ্য।

মনসুর ডাকু মালিকের সঙ্গে দেখা করার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠায় বনহুরের এক অনুচর গিয়ে জানালো সর্দার মনসুর ডাকু জাহাজের মালিকের সঙ্গে দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

বনহুর বিশ্রাম করছিলো সোজা হয়ে বসলো–তোমরা কি বলেছ?

বলেছি, আমাদের মালিক সহসা কারো সঙ্গে দেখা করেন না।

তোমরা ভুল করেছো যাও বলো গে, তোমাদের মালিক তার সঙ্গে দেখা করবেন। আর শোনো যদি জিজ্ঞাসা করে এ জাহাজের মালিকের নাম কি তবে বলবে সওদাগর জাহাঙ্গীর আলী।

আচ্ছা সর্দার।

 অনুচরটি বেরিয়ে যায়।

বনহুর ক্যাবিনে আয়নাখানার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। নিপুণ ছদ্মবেশ ধারণ করে যখন রহমানের পাশে এলো তখন তাকে দেখলে কেউ চিনতে পারবে না–মুখে সুন্দর দাড়ি ছোট করে ছাটা গোঁফ মাথায় কঁচা পাকা চুল।

রহমান সর্দারকে এ ড্রেসে দেখে বিস্মিত হলো বললো–সর্দার আপনি এভাবে—

রহমানকে কথা শেষ করতে দেয় না বনহুর বলে–চলো রহমান মনসুর ডাকু আমার সাক্ষাৎ কামনা করছে। হাঁ মনে রাখবে, যতদিন মনসুর ও তার সাথীরা আমার জাহাজে আছে ততদিন আমি সওদাগর জাহাঙ্গীর আলী। রহমান যাও তুমিও ছদ্মবেশ ধারণ করে এসো।

 অল্পক্ষণেই রহমান বেশ পরিবর্তন করে ফিরে এলো।

 বনহুর আর রহমান মনসুর ডাকুর ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই বনহুরের অনুচরগণ যারা যেখানে উপস্থিত ছিলো তারা সম্মানে কুর্ণিশ জানালো।

একজন বললো–হুজুর, এরা আপনার সাক্ষাৎ চায়।

বনহুর হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে এলো।

মনসুর ডাকু বনহুরকে লক্ষ্য করে বলে উঠলোসওদাগর সাহেব, আপনার দয়ায় আমরা জীবনে রক্ষা পেয়েছি। আমরা সেজন্য কৃতজ্ঞ।

বনহুর পূর্বের ন্যায় মুখোব হাস্যোজ্জল রেখে বললো–ছিঃ ছিঃ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমাকে লজ্জা দেবেন না, কারণ আমি এমন কিছু করিনি যাতে আপনারা আমাকে এভাবে—

মনসুর বলে উঠে–আমাদের জীবন আপনি রক্ষা করেছেন। …

মোটেই না, কারণ জীবন রক্ষার মালিক খোদা। তিনি আপনাদের রক্ষা করেছেন, আপনারা তার কাছে শোকরানা আদায় করুন।

 মনসুর ডাকু বললো–খোদা তো সব করনেওয়ালা কিন্তু আপনি যদি দয়া না করতেন তাহলে আমরা এ যাত্রা কিছুতেই বাঁচতাম না।

বনহুর বললো–যাক সে কথা এবার বলুন আমরা আপনাদের কি উপকার করতে পারি?

 আপনারা যা করেছেন এবং করছেন এটাই সবচেয়ে বড় উপকার।

 আমি জানতে চাই, আপনারা কোথায় এবং কি উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন?

মনসুর ডাকুর মুখ গম্ভীর হলো, একটু ভেবে নিয়ে বললো–আমরা ঝিনুকের ব্যবসায়ী। সাগর থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে দেশ বিদেশে বিক্রি করি।

ও হো, তাহলে আপনার জাহাজে বহু টাকার ঝিনুক ছিলো নিশ্চয়ই? বনহুরের কথায় সহানুভূতির সুর।

মনসুর ডাকু মুখোভাব করুণ করে বললো–সওদাগর সাহেব, আপনার অনুমান মিথ্যা নয়। আমার বহু টাকার ধন নীল নদে গ্রাস করেছে। আমার অমূল্য রত্ন হারিয়ে গেছে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো মনসুর ডাকুর গলা। একটু থেমে বললো সে–সওদাগর আমার যা হারিয়ে গেছে তা আর কোনোদিন ফিরে পাবো না।

বনহুর মনে মনে আশ্চর্য হলো বললো-আপনি মিছামিছি অনিসোস করছেন, কারণ ব্যবসা করতে গেলে প্রায় লোককেই এ রকম বিপদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হয়।

মনসুর ডাকু এবার প্রায় কেঁদেই ফেললো সে বনহুরকে নিজের পাশে বসিয়ে বললো– আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছেন, আপনার কাছে মিথ্যা কথা বলে খোদার দরবারে গোনাহগার হতে পারবো না আমি। আমার কন্যাও জাহাজে ছিলো, আমি তাকেও হারিয়েছি সওদাগর সাহেব আমি তাকেও হারিয়েছি—

 মনসুর ডাকুর কথায় বনহুর কিছু অবাক হলো; সে বুঝতে পারলো মনসুর ডাকু তার কন্যাসহ দস্যু বনহুরের সন্ধানে নীল নদে পাড়ি জমিয়েছিলো। সখ তাহলে মন্দ নয়। প্রকাশ্যে বললো বনহুর–আপনার কন্যা সঙ্গে ছিলো বলেন কি?

হাঁ, আমার দুর্ভাগ্য—

 নিশ্চয়ই আপনার কন্যা নীল নদে ডুবে প্রাণ ত্যাগ করেছে।

হাঁ, আমার ইরানিকে নীল নদ গ্রাস করেছে সওদাগর সাহেব আমার ইরানিকে নীল নদ গ্রাস। করেছে—হাতের পিঠে চোখের পানি মুছে মনসুর ডাকু।

বনহুর মনসুর ডাকুর ব্যথায় সহানুভূতি জানালো, বললো–বলুন, আমি আপনাদের কোন্ বন্দরে পৌঁছে দিতে পারি?

 মনসুর ডাকু বনহুরের হাত মুঠায় চেপে ধরে বললো–সত্যি আপনি কত মহৎ। আমাদের জীবন রক্ষা করে আপনি আমাদের চির ঋণী করে ফেললেন তারপর আবার কষ্ট করে—

না না, এটা আমার কর্তব্য আপনি বলুন কোথায় যাবেন?

মনসুর মাথা চুলকে বললো–আমাদের গন্তব্যস্থল বহুদূরে কাজেই আপনি সম্মুখে যে বন্দর পাবেন আমাদের সেইখানে নামিয়ে দিলেই চলবে কিন্তু–

বলুন–কিন্তু কি? বললো বনহুর।

 মনসুর ডাকু বললো-একটা কথা বলব কারণ আপনি আমাদের প্রাণরক্ষক।

বলুন?

আমরা জানতে পেরেছি দস্যু বনহুর তার জাহাজ নিয়ে নীল নদ অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছে

অবাক হবার ভাণ করে বললো বনহুর–দস্যু বনহুর!

 হা সওদাগর সাহেব আপনি কি দস্যু বনহুরের নাম শোনেননি?

দস্যু বনহুরের নাম শুনবো না–সে তো বিশ্ববিখ্যাত দস্যু! বনহুর নিজের মুখমণ্ডলে ভীতি ভাব টেনে তাকালো রহমানের মুখের দিকে যেন সে দস্যু বনহুর নাম শুনে ভীষণ আঁতকে উঠেছে।

রহমান বললো–হুজুর, দস্যু বনহুর যদি নীল নদে বিচরণ করে এবং আমাদের জাহাজ যদি তাদের চোখে পড়ে যায় তাহলে আর আমাদের রক্ষা থাকবেনা।

বনহুর তার নকল দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে চিন্তিত সুরে বললো–সত্যি অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় পড়লাম দস্যু বনহুরের কবলে পড়লে–

ঠিক বলেছেন, আপনাদের রক্ষা থাকবে না। সমস্ত ধন-সম্পদ লুটে নেবে এবং আপনাদের সে হত্যা করবে। বড় সাংঘাতিক দস্যু বনহুর। শুধু নরহত্যাই সে করে না, যে কোনো লোককে হরণ করে নিয়ে যায়, তারপর তাকে চরম শাস্তি দেয়—

সে সাংঘাতিক দস্য এ কথা জানি কিন্তু নরহত্যা তার নেশা সে কথা জানি না!

একবার তার সাক্ষাৎ পেলে বুঝতে পারবেন–মনসুর ডাকু দস্যু বনহুরের নানারকম নিন্দায় মেতে উঠে। কথায় কথায় আরও বলে মনসুর ডাকু–আমার প্রতিজ্ঞা আছে, আমি দস্যু বনহুরকে শায়েস্তা করবো।

বনহুর বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলে–আপনি একজন সৎ-মহৎ বণিক আপনি কি করে দস্যু বনহুরকে শায়েস্তা করবেন বুঝতে পাচ্ছি না?

আপনি বুঝবেন না সওদাগর সাহেব, সে হিম্মৎ আমার আছে। আমার জাহাজডুবি নাহলে আমি তাকে দেখে নিতাম।

সর্বনাশ, দস্যু বনহুরের থাকবে কত অস্ত্রশস্ত্র, থাকবে কত অনুচর, তাছাড়া দস্যু বনহুর—

আপনি আমাকে জানেন না বলেই এ কথা বলছেন সওদাগর সাহেব! কথাটা বলতে গিয়ে মনসুর ডাকুর চোখ জ্বলে উঠে যেন, কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো অত্যন্ত সতর্কভাবে।

সেইদিন গভীর রাতে মনসুর ডাকু এবং তার অনুচরদের যে ক্যাবিনে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিলো, সে ক্যাবিনের পিছনে এসে দাঁড়ালো বনহুর আর রহমান।

বনহুর বললো–শোনো রহমান ওরা কি বলছে।

রহমান কান পেতে দাঁড়ালো।

ক্যাবিনের মধ্য হতে ভেসে আসছে মনসুরের চাপা কণ্ঠস্বর হাবিল, যেমন করে হোক সওদাগর এবং তার লোকজনদের কাবু করে এ জাহাজ আমাকে হস্তগত করতে হবে। মনে রেখো মনসুর ডাকু সব হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েনি।

 অন্য একটি গলার আওয়াজ–মালিক, কিভাবে আপনি এদের কাবু করবেন? আমরা যে নিরস্ত্র!

 চাপা স্বরে হাসলো মনসুর ডাকু, তারপর দাঁত পিষে বললো মনসুর ডাকু অস্ত্রের প্রত্যাশা করে না। কৌশলে আমি সওদাগর এবং তার লোকজনকে বন্দী করবো, তারপর এক এক করে সাগরের জলে নিক্ষেপ করবো বুঝলে?

বুঝেছি মালিক।

 হাঁ, তারপর জাহাজ আমার হবে, এ জাহাজের সমস্ত মাল আমার হবে।

বনহুর চাপা স্বরে বললো–সব শুনলে রহমান?

 হাঁ সর্দার সব শুনেছি।

 বলো এখন আমার কর্তব্য কি?

সর্দার—

 বলো রহমান?

আমি জানতাম বিষধর সাপকে আশ্রয় দিলে সে ছোবল মারবেই এবং সেজন্যই তাকে খতম করাই শ্রেয় ছিলো।

চলো রহমান, বিষধর সাপ ছোবল মারবার পূর্বেই তাকে সরিয়ে ফেলা ভাল।

বনহুর আর রহমান ফিরে এলো নিজের ক্যাবিনে।

 নিজ ক্যাবিনে এসে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো বনহুর।

রহমান দাঁড়িয়ে রইলো নিশ্চুপ হয়ে।

বনহুর হাসি থামিয়ে বললো–ঠিক বলেছিলে রহমান, বিষধর সাপকে আশ্রয় দিলে সুযোগ, বুঝে সে ছোবল মারে। হাঁ এক কাজ করো, যে ক্যাবিনে মনসুর ও তার সঙ্গীরা আছে সেই ক্যাবিনে ক্লোরোফর্ম গ্যাস প্রয়োগ করে দাও, তারপর বোট নামিয়ে ওদের সবাইকে ভাসিয়ে দাও নীল নদে।

বনহুরের কথামত কাজ করলো রহমান।

*

 মনসুর ডাকুর সংজ্ঞা ফিরে আসার পূর্বেই তার এক সঙ্গীর জ্ঞান ফিরে এলো। চোখ রগড়ে উঠে বসতেই আঁতকে উঠলো সে। মাথার উপর সূর্যের প্রখর তাপ আগুন ছড়াচ্ছে। চারিদিকে সীমাহীন পানি–যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সাগর তীরের কোনো চিহ্ন নেই কোনো দিকে।

মনসুর ডাকুর অনুচরটি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সে দিশেহারার মত সর্দার এবং তার সঙ্গীদের ডাকাডাকি শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মনসুর ডাকু ও তার সাথীদের জ্ঞান ফিরে এলো, সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত হতভম্ব হয়ে পড়লো। তারা যে জাহাজে ছিলো, কখন সাগরবক্ষে বোটে এলো ভেবে পেলো না। এ যেন আলাউদ্দিনের যাদুর প্রদীপের খেলা। কোথায় গেলো সেই সওদাগর আর কোথায় সেই জাহাজ।

হঠাৎ মনসুরের দৃষ্টি পড়লো তার হাতে একটা সুতা বাঁধা এবং তাতে একটা কাগজ ভাঁজ করে আটকানো আছে। মনসুর দ্রুতহস্তে সুতা ছিঁড়ে কাগজখানা খুলে নিয়ে সূর্যের আলোতে মেলে ধরলো। কাগজে লেখা আছে–

মনসুর এবারও তোমাকে ক্ষমা করলাম।
যদি তুমি আমাকে হত্যা উদ্দেশ্যে
নীল নদে গমন করেছিলে।
–দস্যু বনহুর।

মনসুর উচ্চকণ্ঠে প্রতিধ্বনি করে উঠলো–দস্যু বনহুর।

মনসুরের অন্যান্য অনুচর বিস্ময়ভরা কণ্ঠে একসঙ্গে বলে উঠলো –সর্দার, কোথায়– কোথায় বনহুর?

জাহাজে! ঐ যে সওদাগর জাহাঙ্গীরের বেশে যাকে জাহাজে দেখেছিলে সে দস্যু বনহুর—

 একজন বলে উঠলো–আমরা তাহলে দস্যু বনহুরের জাহাজে ছিলাম?

হাঁ সেই শয়তান আমাদের এভাবে অজ্ঞান করে বোটে নামিয়ে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। পূর্বে। একটু যদি বুঝতাম তাহলে আমি আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করতাম।

অন্য একজন অনুচর বলে উঠে–সর্দার, যে জীবন রক্ষা করেছে তাকে আপনি হত্যা করতেন?

হাঃ হাঃ হাঃ ডাকুর আবার ন্যায়নীতি। মনসুর ক্রুদ্ধভাবে হেসে কথাটা বললো, তারপরই প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো অনুচর টিকে নীলনদের বুকে।

সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ তরঙ্গায়িত জলরাশির অতলে তলিয়ে গেলো অনুচরটি। মনসুর ডাকু অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়লো। হাসি থামিয়ে বললো–জীবনরক্ষক দস্যু বনহুর নই আমি। ইচ্ছা করলে আমি মারতে পারি বাঁচিয়ে রাখতে পারি। হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ—–

মনসুর ডাকুর হাসির বিকট শব্দে নীল নদের জলরাশি যেন দুলে উঠলো।

কিন্তু একদিন দু’দিন করে যখন তিন-চারটে দিন কেটে গেলো, তখন মনসুর ডাকুর মুখ চুন হয়ে গেলো, ভেবেছিলো দু’একদিনের মধ্যে তারা কোনো জাহাজের সন্ধান পাবে এবং সেই জাহাজে আশ্রয় নেবে জাহাজডুবি অসহায় বণিক হিসেবে।

সব আশা বিফল হলো, তিন-চারটে দিনে ক্ষুধাপিপাসায় মরিয়া হয়ে উঠলো তারা। মনসুর ডাকুর মুখে কালি পড়লো। তেজ আর দম্ভভরা কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে গেলো। প্রাণ যায় যায় অবস্থা।

 পঞ্চম দিনে মনসুর ডাকু এবং তার অনুচর কয়েকজন যখন প্রায় মৃত্যু মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তখন হঠাৎ তাদের নজরে পড়লো দূরে বহুদূরে একটা জাহাজ এগিয়ে আসছে। মনসুর ডাকু এবং তার অনুচর কয়েকজনের মনে বাঁচার আশা দেখা দিলো। মনসুর ডাকু অনুচরদের বললো তোমরা সবাই গায়ের জামা খুলে নাড়তে থাকো, যেমন করে হোক ঐ জাহাজের দৃষ্টিতে পড়তে হবে।

মনসুর ডাকু নিজে এবং অনুচরগণ গা থেকে জামা খুলে নাড়তে লাগলো।

দুদিন কেটে গেলো, তবু জাহাজটা এগুচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। স্রোতের টানে বোটখানাই এগিয়ে চলেছে সেই জাহাজটার দিকে।

মনসুর ডাকু ও তার অনুচরগণ একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়েছে। ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা। ক্ষুধায় নাড়িভুড়ি হজম হবার জোগাড় হয়েছে। তাদের বোটখানা একেবারে জাহাজটির অনতিদূরে এসে পড়েছে কিন্তু জাহাজটাও ঢেউয়ের টানে ভেসে চলেছে সামনের দিকে তবে অতি ধীরে ধীরে।

মনসুর ডাকু ও তার অনুচরদের ভাগ্য বলতে হবে, তাদের বোটখানা একসময় জাহাজের একেবারে সন্নিকটে এসে পড়লো।

কিন্তু এখন উপায়? জাহাজখানার পাশ কেটে মনসুর ডাকুর বোটটা চলে যাবে আর কি! মনসুর ডাকু চিৎকার করে জাহাজের আরোহিগণকে ডাকতে লাগলো–কিন্তু আশ্চর্য জাহাজে কোনো লোক আছে বলে মনে হলো না।

হঠাৎ পানির ঘূর্ণিপাকে তাদের বোটটা এসে জাহাজের গায়ে লাগলো। মনসুর ডাকু ও তার অনুচরগণ ক্ষুধার জ্বালায় একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়েছিলো তবু প্রাণপণ চেষ্টায় জাহাজের বন্দু এটে ধরলো তারা।

অতিকষ্টে জাহাজে উঠে আসতে সক্ষম হলো মনসুর ডাকু আর সঙ্গী কয়েকজন; কিন্তু একজন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলো সে আর জাহাজে উঠতে সক্ষম হলো না। মনসুর তাকে। বোটে ত্যাগ করেই চলে এলো।

জাহাজে এসে অবাক হলো মনসুর ডাকু ও তার সঙ্গীরা কারণ, জাহাজে কোনো আরোহী নজরে পড়লো না। সমস্ত জাহাজ অনুসন্ধান করে কোন জিনিসপত্রও দেখলো না। ক্লান্ত, অবসন্ন। হতাশ হয়ে পড়লো মনসুর ডাকুর দল। হঠাৎ একটা ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই দেখলো, সেখানে, রুটি, মাংস দুধ রয়েছে কিন্তু সব পঁচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।

ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা মনসুর দলবল নিয়ে গোগ্রাসে ঐ সব পঁচা দুধ মাংস আর শুকনো রুটি খেতে শুরু করলো। ভাগ্যিস পানির পাত্রে প্রচুর খাবার পানি জমা ছিলো, প্রাণভরে পানি। খেলো ওরা।

এসব ভক্ষণ করার পর কিছুটা শান্তি পেলো, বাঁচার আশা এলো মনসুর ডাকুর মনে। সে জীবনের আশা একরকম প্রায় ত্যাগই করেছিলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পর আবার মনসুর ডাকু সঙ্গীদের নিয়ে অনুসন্ধানে উঠে পড়লো।

মনসুর ডাকু বললো–এটা কি জনশূন্য জাহাজ?

একজন অনুচর বললো–সর্দার, লোক ছিলো বলে মনে হচ্ছে; দেখলেন না কত খাবার। রয়েছে।

কিন্তু লোকজন গেলো কোথায়? বললো মনসুর ডাকু।

আর একজন বললো–সর্দার, আরও একটা আশ্চর্য ব্যাপার।

 কি?

জাহাজে কোনো মালমাত্তা দেখছি না, ব্যাপার কি?

সেই কথা আমিও ভাবছি?

এমন সময় মনসুর ডাকুর অনুচরদের একজন উঠিপড়ি করে ছুটে এলো, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো–সর্দার–সর্দার—

মনসুর ডাকু অবাক হয়ে বললো কি হয়েছে? কি হয়েছে বলো?

সর্দার বহু মানুষ

বহু মানুষ? কোথায় কোথায় বহু মানুষ?

আসুন সর্দার আমার সঙ্গে ঐ যে ওদিকের নিচের একটা ক্যাবিনে বহু মানুষ রয়েছে—

কই–কোথায়? চলো, চলো দেখি—

মনসুর ডাকু ও তার সঙ্গীরা সবাই সেই অনুচরটির সঙ্গে জাহাজের পিছন অংশের দিকে এগিয়ে চললো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো ওরা। একটা বড় ক্যাবিনে সম্মুখে এসে অনুচরটি থামলো চাপা স্বরে বললো–সর্দার এই ক্যাবিনে—এই ক্যাবিনে দেখুন—-

মনসুর ডাকু সঙ্গীদের আদেশ দিলো–ক্যাবিনের দরজা ভেঙে ফেলো।

সর্দারের আদেশে অনুচর কয়জন ক্যাবিনটার দরজা ভেঙে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে অবাক হলো, দেখলো ক্যাবিনে বেশ কিছু লোক বন্দী হয়ে আছে।

মনসুর ডাকু তাদের জিজ্ঞাসা করলোকে আপনারা? আর আপনাদের এ অবস্থা কেন?

এগিয়ে এলো জালাল শাহ, হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো–কে, কে আপনারা? কেমন, করে এ জাহাজে এলেন?

মনসুর ডাকু মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এবং তার জাহাজডুবি হয়েছে বলে দুঃখ জানালো।

জালাল শাহ জানালো তার দুঃখ-দস্যু বনহুর তাকে এভাবে নাজেহাল করেছে–সব কথা। খুলে বললো জালাল শাহ মনসুর ডাকুর কাছে।

মনসুর ডাকু সাধু বনে সব শুনে গেলো। বনহুর জালাল শাহের ধন সম্পদ লুটে নিয়ে সব সাগরবক্ষে নিক্ষেপ করেছে শুনে মনে মনে ভীষণ অবাক হলো, আপন মনে বলে উঠলো–আশ্চর্য, বটে।

*

বনহুরের নির্দেশমত মনসুর ডাকু এবং তার সঙ্গীদের অজ্ঞান অবস্থায় বোটে নামিয়ে ভাসিয়ে দেওয়ার পর তাদের জাহাজ সোজা নীল নদ অতিক্রম করে দক্ষিণ মোহনার দিকে এগিয়ে চললো।

কয়েক ঘন্টা চলার পর রাত ভোর হয়ে এলো। আকাশ পরিষ্কার, নীল নদের কালো পানি কেটে দ্রুতবেগে বনহুরের জাহাজ এগুচ্ছে। পথে বিলম্ব করার ইচ্ছা আর বনহুরের নেই। বিশেষ করে নূরী এবং তার নবজাত শিশুর জন্য মনটা বড় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলো। সব কথা সব সময় তো কারো কাছে বলা যায় না, তাই বনহুর মনোভাব গোপন রেখে রহমানসহ ডেকে এসে দাঁড়ালো, বনহুর চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখতে লাগলো।

 জাহাজ নীল নদের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে।

 হঠাৎ বনহুরের নজরে পড়ে– একখণ্ড তক্তার উপর একটি মানুষ মৃতের ন্যায় পড়ে আছে, তক্তাটা আপন মনে ভেসে চলেছে।

বনহুর বললো– রহমান দেখো, দেখো ঐ যে একটা তক্তা ভেসে যাচ্ছে না?

 হা সর্দার, তক্তার উপর একটা মৃতদেহও রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

বনহুর ভালভাবে লক্ষ্য করে বললো- লোকটি মৃত না-ও হতে পারে রহমান, জাহাজের গতি কমিয়ে দিতে নির্দেশ দাও। জাহাজ থেকে মোটর-বোট নামিয়ে তক্তাটি ধরে ফেলো। দেখা যাক দেহটি জীবিত না মৃত।

রহমান নিজেও চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখছিলো, বলে উঠলো– সর্দার, লোকটা মৃত। নয়, জীবিত বলে মনে হচ্ছে; তাছাড়া লোকটা পুরুষ নয়– নারী।

বনহুরও দেখছিলো, বললো–হাঁ, তোমার অনুমান সত্য। লোকটা নারী এবং সে জীবিত আছে। একটু নড়ছে বলে মনে হচ্ছে।

জাহাজের গতি মন্থর হয়ে এলো।

রহমান জাহাজ থেকে মোটর-বোট নামিয়ে নিজে এবং আরও দুজনকে সঙ্গে করে তক্তাখানার দিকে এগুলো।

রহমান তক্তাখানার নিকটে এগুতেই বিস্ময়ে স্তব্ধ হলো– সে দেখলো, একটি যুবতী মৃতের ন্যায় পড়ে আছে তক্তাখানার উপরে। যদিও যুবতী জীবিত তবু তাকে মৃতের ন্যায় মনে হচ্ছে।

বিলম্ব না করে রহমান তার সঙ্গীদ্বয়ের সহায়তায় যুবতীটিকে তুলে নিলো মোটর-বোটে। যুবতী সম্পূর্ণ সংজ্ঞা হারায়নি বটে কিন্তু অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। রহমান যখন তাকে মোটর বোটে তুলে নিলো তখন যুবতী ক্ষীণ কণ্ঠে ধন্যবাদ জানালো।

জাহাজে তুলে আনার পর বনহুরের সম্মুখে নিয়ে আসা হলো যুবতীটিকে।

যুবতীর চুল এলোমেলো, জামা-কাপড় ছিন্নভিন্ন। মুখমণ্ডল শুষ্ক ক্ষীণকায়, তবু তাকে একনজরে সুন্দরী বলা যায়। বনহুর প্রথম নজরেই বুঝতে পারলো, যুবতী সাধারণ মেয়ে নয়।

যুবতীর ভালভাবে চিকিৎসা এবং যত্নের নির্দেশ দিলো বনহুর। সে বুঝতে পারলো, কোনো জাহাজডুবি হয়ে এর এই অবস্থা হয়েছে। যতক্ষণ সে সম্পূর্ণ সুস্থ না হয় ততক্ষণ তাকে কিছু প্রশ্ন করা উচিত হবে না।

বনহুরের মনে আর একটি প্রশ্ন উঁকি দিয়ে গেলো, যদিও সে ঐ কথাটা কাউকে বললো না, রহমানকেও না। সে হলো মনসুর ডাকুর সেই কথাটা। মনসুর বলেছিলো, আমার কন্যা ইরানি আমাদের জাহাজেই ছিলো, তাকে নীল নদ গ্রাস করেছে।

মনের কথা মনে চেপে বনহুর নিশ্চুপ রইলো।

বনহুরের অনুমান মিথ্যা নয়, আজ রহমান যে যুবতীটিকে নীল নদ থেকে তুলে আনলো, সেই যুবতীই ডাকু মনসুরের কন্যা ইরানি।

ইরানিকে যখন দস্যু বনহুরের সম্মুখে আনা হলো তখন যদিও ইরানির সংজ্ঞা ছিলো তবু ভালভাবে সে কথা বলতে পারছিলো না, অত্যন্ত দুর্বল, ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়েছিলো, তাই সে কোনো কথা বললো না, বলতে পারলো না।

বনহুরের নির্দেশ অনুযায়ী নিভৃত একটা ক্যাবিনে ইরানির থাকবার ব্যবস্থা হলো। চিকিৎসা এবং নানারকম ওষুধ পথ্যাদিও চললো। বনহুর জানে, যদি তার অনুচরগণ বুঝতে পারে এই যুবতী ডাকু মনসুরের কন্যা, তাহলে তারা ওকে চিকিৎসা বা যত্নের বদলে ওর অমঙ্গলের চেষ্টা চালাতে পারে। এ সব ভেবে বনহুর নিশ্চুপ রইলো।

কয়েক দিন পর বনহুর এলো ইরানীর ক্যাবিনে।

 ইরানি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে।

বনহুর আর রহমান একসঙ্গেই এসেছিলো, রহমান বললো–ইনি আমাদের মালিক।

ইরানি তাকালো বনহুরের মুখের দিকে, হঠাৎ যেন চমকে উঠলো সে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিলো সংযতভাবে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললো– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। শুনেছি আপনার দয়ায় আমি প্রাণ ফিরে পেয়েছি।

বনহুর একটু হেসে বললো– আমার শুধু নির্দেশ, আপনি প্রাণ ফিরে পেয়েছেন এদের জন্য। রহমানকে দেখালো বনহুর আংগুল দিয়ে।

ইরানি কোনো কথা বললো না, সে আর একবার বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো।

বনহুর বললো– আপনি নিশ্চয়ই এখন সুস্থ, এবার জানতে পারি কি, কি করে আপনি নীল নদের বুকে এসেছিলেন?

ইরানি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। বনহুরের কথার জবাব সে চট করে দিলো না। বেশ বিলম্ব করে কিছু বলতে গেলো ইরানি।

বনহুর আসন গ্রহণ করেছিলো, সে ইরানির কথা বলার পূর্বেই বলে উঠলো– আপনি জানেন না, আমি গণনাশাস্ত্রে অভিজ্ঞ, কাজেই আমার কাছে কোনো কথা লুকোতে চেষ্টা করবেন না।

ইরানি বললো তাহলে তো আপনি আমার কথা সব জানেন বলতে হয়।

 হাঁ, সে কথা অবশ্য মিথ্যা নয়।

তবে আপনি বলুন না কেন, আমি কে এবং কিভাবে এখানে এসেছি?

এখন নয় পরে বলবো, কারণ আমাকে গণনা করে দেখতে হবে। বনহুর আর রহমান বেরিয়ে যায় ইরানির ক্যাবিন থেকে।

বনহুর ডেকে এসে দাঁড়ালো!

রহমান তাকে অনুসরণ করে তার পিছনে এগিয়ে এলো, বললো–সর্দার, মেয়েটি কি আপনার পরিচিত?

পরিচিত না হলেও ওর পরিচয় আমার জানা আছে। রহমান, এই সেই ইরানি মনসুর ডাকুর কন্যা……

সর্দার, আপনি কি করে বুঝলেন?

 আমার অনুমান মাত্র। তবে সঠিক নাও হতে পারে।

সর্দার, বিষধর সাপের বাচ্চা বিষধরই হয়…

আবার গোবরেও পদ্মফুল ফোটে।

সে কথাও মিথ্যে নয়, কিন্তু…

বল, থামলে কেন?

 মেয়েটি যদি সত্যি মনসুর ডাকুর মেয়ে ইরানি হয় তাহলে তাকে আমাদের জাহাজে…..

 রাখা বা আশ্রয় দেওয়া ঠিক নয় বলতে চাচ্ছো?

 না, আমি বলছি তার উপর কড়া পাহারা রাখা উচিত।

হাঁ, সে কথা অবশ্য সত্য। কিন্তু এখনো আমি সঠিক নই সে মনসুর ডাকুর কন্যা কিনা, সে অন্য কোনো সওদাগর বা কোনো মহৎ ব্যক্তির কন্যাও হতে পারে। শোনো রহমান, একটা কথা মনে রেখো, যুবতীটি যদি সত্যি মনসুর ডাকুর কন্যা ইরানি হয় তাহলে আমার অনুচরগণ তার উপর দুর্ব্যবহার করতে পারে, কাজেই শুধু তুমি জানবে সে কে, আর কেউ নয়, বুঝলে?

বুঝেছি সর্দার।

 চল, গিয়ে জানা যাক সত্যি আমাদের অনুমান সত্য কিনা।

 চলুন সর্দার।

 বনহুর আর রহমান ফিরে এলো ইরানির ক্যাবিনে।

ইরানি সসম্মানে উঠে দাঁড়ালো।

বনহুর আসন গ্রহণ করে বললো– আপনার পরিচয় আমি অবগত হয়েছি মিস ইরানি।

বিস্ময়ভরা চোখে তাকালো ইরানি বনহুরের মুখের দিকে। কি করে সে তার নাম জানলো– অবাক হওয়ার কথা বটে!

বনহুর ইরানির মুখোভাব লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো, সে তার মুখে নিজের নাম শুনে শুধু বিস্মিতই হয়নি, ভীষণভাবে চমকে গেছে। বনহুর বললো– আপনার হাতখানা আমার সামনে মেলে ধরুন, আমি সব বলছি।

ইরানির দু’চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়লো, সে মনে মনে বেশ ঘাবড়ে গেছে, তবু হাতখানা মেলে ধরলো সে বনহুরের সামনে।

বনহুর হাতের দিকে এক নজর তাকিয়ে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লো। বললো– হুঁ, আপনি দেখছি অসাধারণ মেয়ে। আপনার পিতাও কম নন, পিতার উপযুক্ত কন্যা।

ইরানি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে, দৃষ্টি যেন তার সরতে চাইছে না।

কথার ফাঁকে বনহুরের দৃষ্টিও ইরানির চোখে এসে স্থির হয়। ইরানি দৃষ্টি নত করে নেয় সঙ্গে সঙ্গে। বনহুরকে দেখে ইরানির মনে যে একটা ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে তা স্পষ্ট বুঝা না গেলেও বনহুর বুঝতে পারে।

বলে বনহুর– আরও কি আপনি জানতে চান?

ইরানি বলে উঠে– না, না। আপনি এখন যেতে পারেন।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো যাচ্ছি। হাঁ, আর একটি কথা, আপনি আপনার পিতা ও তার সঙ্গীদের কথা জিজ্ঞাসা করলেন না তো?

অবাক হয়ে তাকালো ইরানি, চোখ দুটো তার ছলছল করে উঠলো বনহুর বললো– আপনি যা সন্দেহ করছেন তা হয়নি। আপনার পিতা এবং তার কয়েকজন সঙ্গী এখনও জীবিত আছেন।

ইরানি নিশ্চুপ পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেছে। বনহুর বেরিয়ে গেলো, ইরানি স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলো তার চলে যাওয়া পথের দিকে। মনে মনে ভাবছে কত কি!

সেইদিন রাতে বনহুর বিশ্রাম করছিলো তার ক্যাবিনে। জাহাজ পথে আর কোথাও নোঙ্গর করকে না, সোজা কান্দাই বন্দরে গিয়ে নোঙ্গর করবে।

সর্দারের নির্দেশ অনুযায়ী জাহাজ চলেছে।

বনহুর ল্যাম্পের সম্মুখে বসে একখানা বই পড়ছিলো। পদশব্দে মুখ তুললো– অবাক হলো, তার সামনে দাঁড়িয়ে ইরানি। বনহুর একটু হাসবার চেষ্টা করে বললো– বসুন!

ইরানি কোনো দ্বিধা না করে বসে পড়লো বনহুরের পাশের সোফায়।

বনহুরই কথা বললো প্রথমে জানি আপনি কেন এসেছেন আপনার বাপুর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলো কি করে, একথা জানতে নয় কি?

হাঁ, বলুন আমার বাপু কোথায়?

জেনে রাখুন, আপনার বাপু জীবিত আছেন এবং তিনি নীল নদের বুকেই আছেন। বনহুর সংক্ষেপে কথাটা বললো।

ইরানি আরও ঝুঁকে পড়লো বনহুরের দিকে সত্যি বলছেন, আমার বাপু জীবিত আছেন তো?

আছেন এবং একদিন তাকে পাবেন মিস ইরানি। অবশ্য যদি কোনো জাহাজ তাঁদের তুলে। নেয়।

আমি জানতে চাই সব কথা, দয়া করে বলুন?

বনহুর কিভাবে মনসুর ডাকু এবং তার সঙ্গীদের দেখতে পেয়েছিলো আর তাদের জাহাজে উঠিয়ে নিয়েছিলো, সব খুলে বললো ইরানির কাছে।

বনহুরের কথায় ইরানির মুখমণ্ডল রাঙা হয়ে উঠলো, কৃতজ্ঞতা জানালো সে বনহুরের কাছে।

বনহুর বললো- মিস ইরানি, একটা কথা বলবেন, অবশ্য সত্যি কথা বলতে হবে?

বলুন, বলবো?

আপনার পিতা মনসুর নিশ্চয়ই কোনো কারণে নীল নদের উদ্দেশ্যে গমন করেছিলেন?

 হাঁ, উদ্দেশ্যবিহীন কেউ কিছু করে না।

 তাহলে আপনার পিতা কি উদ্দেশ্য নিয়ে……

আপনি হয়তো শুনে থাকবেন, দস্যু বনহুর নামে এক ভয়ঙ্কর দস্যু আছে?

বনহুর মুখোভাব স্বাভাবিক রেখে বললো–দস্যু বনহুরের নাম শুনেছি কিন্তু সে ভয়ঙ্কর দস্যু কিনা, এ কথা জানি না। বলুন তারপর?

আমার বাপু এই দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করার জন্য নীল নদে যাত্রা করেছিলেন।

তোমার পিতা দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করার উদ্দেশ্যে নীল নদে যাত্রা করেছিলেন বটে কিন্তু তুমি, তুমি কোন উদ্দেশ্য নিয়ে……. ভ্রূ বাঁকা করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বনহুর ইরানির মুখে।

ইরানি অধর দংশন করে বললো– পিতার শত্ৰু কন্যারও শত্রু, এ কথা হয়তো আপনার অজানা নেই?

ও, তুমিও দেখছি দস্যু বনহুরকে… …

হাঁ, আমি তাকে জীবিত পেলে নিজ হাতে সাজা দেবো। আর যদি মৃত অবস্থায় তাকে পাও?

কথার ফাঁকে কখন যে বনহুর ইরানিকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বসেছে তার নিজেরই খেয়াল নেই। বনহুরের কথায় বললো ইরানি –মৃত পেলেও তাকে আমি অগ্নিদগ্ধ করে মাটিতে পুঁতে ফেলবো।

চমৎকার!

এ্যা, কি বললেন?

না না, কিছু না। ভাবছি দস্যু বনহুর যদি এই মুহূর্তে তোমার সম্মুখে হাজির হতো?

আমি তাকে হত্যা করতাম– শুধু হত্যাই নয়, যে চরম শাস্তি আমি তাকে দিতাম তা সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না।

দস্যু বনহুর তোমার পিতার ভয়ানক ক্ষতি সাধন করেছে বুঝলাম, কিন্তু তোমার তো সে কোনো ক্ষতি করেনি ইরানি?

আমার ক্ষতি সে করেনি, কিন্তু আমার পিতার ক্ষতি সে করেছে। একবার নয়, সে বারবার আমার পিতাকে বন্দী করে তাকে অপমান করেছে।

হেসে উঠলো বনহুর হাঃ হাঃ হা!

 ইরানি বনহুরের মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, বড় অদ্ভুত, অপূর্ব দেখাচ্ছে তাকে।

বনহুর হাসি থামিয়ে বললো– কি দেখছো ইরানি আমার মুখের দিকে চেয়ে?

 ইরানি স্পষ্ট গলায় বললো– আপনাকে।

আমাকে?

হাঁ, আশ্চর্য হচ্ছেন? আপনি একবার যদি দস্যু বনহুরকে দেখতেন তাহলে অমনভাবে হাসতে পারতেন না।

তাই নাকি?

হাঁ।

তুমি তাকে দেখেছো ইরানি?

না, দেখিনি।

না দেখেই তার উপর তোমার এত রাগ?

শুধু রাগ নয়, তাকে আমি

কাছে পেলে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে, তাই না?

 ইরানি মাথা দুলালো।

বনহুর বললো– ভয় হচ্ছে, হঠাৎ যদি দস্যু বনহুরের জাহাজ আমাদের জাহাজের সম্মুখীন হয়ে যায়, তাহলে কি হবে?

ভাল হবে।

অবাক হবার ভাণ করে বলে বনহুর ভাল হবে? মানে?

আপনারা তাকে বন্দী করতে না পারলেও আমি তাকে বন্দী করতে সক্ষম হবো।

সাবাস! যাক্, নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম।

কেন?

কারণ, তোমার মত একটি সাহসী মেয়ে আমাদের জাহাজে রয়েছে, এটা কম কথা নয়।

জানেন তো, দস্যুকন্যা ভয়ঙ্করই হয়। আমার বাপুর পরিচয় যখন আপনি জানেন তখন গোপন করে তো আর কোনো লাভ হবে না। চলুন, এবার আমাকে ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে আসবেন, চলুন?

বসো, আরও একটু বসো ইরানি। কথাতো কেবল শুরু হলো। তোমার মত একটি সাহসী মেয়েকে আমি সঙ্গী হিসেবে পেয়ে এই নীল নদে অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আরও খুশি হয়েছি তোমাকে রক্ষা করতে পেরে। কারণ, তোমার দ্বারা দেশের বিরাট একটা মঙ্গল সাধন হবার সম্ভাবনা রয়েছে। যে দস্যু বনহুরের জন্য দেশময় এত আতঙ্ক, সেই দস্যুকে তুমি পাকড়াও করতে চাও, এত সৎ এবং মহৎ সাহস কার আছে, বলো?

ইরানি বললো– আপনি কি পারেন না আমাকে সাহায্য করতে?

নিশ্চয়ই পারি! দস্যু বনহুর শুধু তোমার পিতার শত্রু নয়, আমারও শত্রু……

 তাই নাকি?

হা।

কারণ?

কারণ, লোকে যাকে শত্রু মনে করে বা যে ব্যক্তি দেশের শত্রু, তাকে আমিও শত্রু মনে করি। ইরানি, তুমি এ ব্যাপারে আমার সাহায্য পাবে নিঃসন্দেহে।

যাক, নিশ্চিন্ত হলাম। ইরানি আশ্বস্ত হলো যেন। একটু থেমে বললো আবার দেখুন, আপনি আমার জীবনরক্ষক, আপনার নির্দেশ অনুযায়ী আপনার অনুচরগণ আমাকে সদ্যমৃত্যুর মুখ হতে উদ্ধার করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি আপনার পরিচয় পাইনি। দয়া করে যদি……

ও, এটা আমারই ভুল, কারণ আমি যখন তোমার পরিচয় জানি তখন আমার পরিচয়টাও তোমাকে জানানো উচিত ছিলো। আমার পরিচয় অতি সামান্য কান্দাই-এর আমি একজন রাজকর্মচারী, নাম জাহাঙ্গীর আলী।..

 ও, এই নাম আমি শুনেছি। আপনার অনেক মহৎ কাজের কথাও আমার কানে এসেছে। যাক, আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে খুশি হলাম। সবচেয়ে বড় আনন্দ, আপনি আমার জীবনরক্ষক….ইরানি আনন্দে গদগদ হয়ে উঠলো।

চলো ইরানি, এবার তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। উঠে দাঁড়ালো বনহুর।

ইরানিও উঠে পড়লো, ওভারকোটটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বললো– সত্যি আপনি। কত মহৎ!

বনহুর চোখ তুললো– কি রকম?

না থাক, পরে বলবো। কথাটা বলে ইরানি পা বাড়ালো ক্যাবিনে দরজার দিকে।

 বনহুরও এগিয়ে চললো।

ইরানির দেহে ওভারকোট এ পোশাক বনহুরেরই দেওয়া, কারণ তার পোশাক-পরিচ্ছদ ছিঁড়ে যাওয়ায় তার সবকিছু বনহুরকে দিতে হয়েছিলো। অবশ্য ইরানির দেহে ছিলো বনহুরেরই পোশাক– মেয়েদের পোশাক তো জাহাজে ছিলো না।

ইরানিকে ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে বনহুর ফিরে চললো নিজ ক্যাবিনের দিকে।

 রহমান বেরিয়ে এলো অন্ধকার থেকে।

 বনহুর বললো তুমি!

হাঁ সর্দার।

মেয়েটা অত্যন্ত সুচতুর।

 মনসুর ডাকুর মেয়ে বড় সাংঘাতিক।

শুধু সাংঘাতিক নয়, বিষধর সাপের মত ভয়ঙ্কর। বড় রাগ তার দস্যু বনহুরের উপর, যদি সে একবার তাকে পায় তাহলে আর রক্ষা থাকবে না। বন্দী করে হত্যা করবে দস্যু বনহুরকে…… হাঃ হাঃ হাঃ, হেসে উঠলো বনহুর।

 রহমান নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে সর্দারের মুখের দিকে।

*

ডেকের ধারে দাঁড়িয়েছিলো দস্যু বনহুর আর ইরানি। আর দু’টি দিন মাত্র, তাহলেই তাদের জাহাজ কান্দাই বন্দরে পৌঁছে যাবে।

বনহুর সিগারেট পান করছিলো, দৃষ্টি তার সম্মুখে সীমাবদ্ধ। বললো বনহুর– ইরানি, তুমি কি ভাবছো?

ইরানি বললো– ভাবছি আপনি কত মহৎ!

কারণ, তোমার জীবন রক্ষা ব্যাপারে……

 না।

তবে?

আমি একজন নিকৃষ্ট ডাকুকন্যা জেনেও আপনি আমার প্রতি কোনো অসৎ ব্যবহার করেননি।

এ ধারণা তোমার ভুল ইরানি, কারণ পিতার দোষে কোনোদিন সন্তান দোষী হতে পারে না, আবার সন্তানের অপরাধে কোনো পিতা অপরাধী নন। কাজেই তোমার পিতা ডাকু হলেও আমার চোখে তুমি নিরপরাধ।

ইরানি নিশ্চুপ শুনতে লাগলো, দৃষ্টি তার বনহুরের মুখের দিকে।

 কিছুক্ষণ উভয়েই নীরব।

একসময় বলে উঠলো ইরানি সত্যি, আপনার সান্নিধ্য আমাকে অভিভূত করেছে। এই মুহূর্তগুলোর কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না।

আমারও স্মরণ থাকবে তোমার কথা। ইরানি?

বলুন?

তোমার সাধ পূর্ণ হলো না।

 মানে?

তোমার যাত্রা ছিলো দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার কিংবা হত্যা উদ্দেশ্যে, কিন্তু দস্যু বনহুরকে পেলে কই? কাজেই তোমার সাধ পূর্ণ হলো না।

ইরানি বলে উঠলো– আমার সাধ পূর্ণ না হলেও বাসনা পূর্ণ হয়েছে….

এ্যা, কি বললে?

না না, কিছু না, কিছু না……

ইরানি দ্রুত চলে গেলো সেখান থেকে।

 বনহুর মৃদু হাসলো।

সেইদিন গভীর রাতে রহমান এসে জানালো বনহুরকে– সর্দার, ইরানি তার ক্যাবিনে নেই।

বনহুর বিছানা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো, অবাক কণ্ঠে বললো ইরানি তার ক্যাবিনে নেই?

না।

 তবে জাহাজের কোথাও আছে।

সমস্ত জাহাজ তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা হয়েছে সর্দার।

আশ্চর্য!

হা সর্দার, আশ্চর্য বটে।

 চলো তো দেখা যাক।

বনহুরের আদেশে সমস্ত জাহাজে পুনরায় খোঁজা হলো কিন্তু ইরানিকে পাওয়া গেলো না। কোথাও।

জাহাজের মোটর-বোট, নৌকা-বোট গণনা করে দেখা হলো–সব ঠিক আছে অথচ ইরানি নেই।

রহমান বললো– আশ্চর্য মেয়ে, হাওয়ায় উবে গেছে যেন।

 বনহুর শুধুমাত্র একটা শব্দ উচ্চারণ করলো–হুঁ!

 বনহুর বুঝতে পারে, ইরানি তার জাহাজ ত্যাগ করে কোথাও যায়নি–যেতে পারে না।

জাহাজের যে খালাসীগুলো সব সময় ইঞ্জিনের কাজে ব্যস্ত থাকতো, বনহুর তাদের প্রত্যেকের মধ্যে গোপনে অনুসন্ধান চালালো।

সেদিন ইঞ্জিনের পাশে দাঁড়িয়ে একজন ছোকরা গোছের অনুচর কাজ করছিলো, আশেপাশে অন্য কেউ নেই।

বনহুর এসে দাঁড়ালো তার পাশে।

ছোকরা মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো।

 বনহুর পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো।

চমকে উঠলো ছোকরা।

বনহুর চাপা কণ্ঠে বললো– ইরানি, এভাবে আত্নগোপন করার উদ্দেশ্য কি?

লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠলো ছোকরা-বেশি ইরানির মুখ, চোখ দুটো বনহুরের মুখে তুলে ধরে আবার সে দৃষ্টি নত করে নিলো।

বনহুর বললো– উদ্দেশ্য আমার জাহাজের ইঞ্জিন নষ্ট করে দেওয়া, এই তো?

আমাকে ক্ষমা করুন, আমি…

 বলো?

আমি আপনার মঙ্গল চাই।

তাহলে তুমি আত্নগোপন করে আমার জাহাজের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করতে না।

আপনি বিশ্বাস করুন, আপনার জাহাজের কোনো ক্ষতি করা আমার উদ্দেশ্য নয়।

তবে এভাবে হঠাৎ আত্নগোপন করার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে, বলো?

উদ্দেশ্য……না না, বলবো না।

 বলতে হবে, নাহলে আমি তোমাকে হত্যা করবো।

 জানি, আপনি আমাকে হত্যা করতে পারবেন না।

 তুমি আমাকে জানোনা ইরানি……

জানি বলেই তো আমার এত সাহস। বেশ, আমি বলছি কেন– কেন আমি আত্নগোপন করতে চেয়েছিলাম। আপনার জাহাজ দুদিনের মধ্যেই কান্দাই পৌঁছবে। আমি চেয়েছিলাম, আপনার আসল পরিচয় এবং আপনার…..

থামলে কেন, বলো?

আপনার আবাসস্থলের সন্ধান জানা।

 হুঁ, তুমি দেখছি অত্যন্ত চালাক মেয়ে।

এ কথা আপনি কেন, সবাই বলে আমার বাবাও বলেন।

কিন্তু মনে রেখো ইরানি, তোমাকে আমি কিছুতেই আমার পরিচয় জানাবো না, জানতে দেবো না আমার আবাসস্থল কোথায়। ইরানি, তুমি আমার বন্দী।

খিল খিল করে হেসে উঠলো ইরানি আমাকে বাঁচালেন, কারণ, আমি আর ফিরে যেতে চাই না আমার পিতার পাশে।

আমার জাহাজে খালাসী হয়েই থাকবে তুমি?

 যদি আপনার কোনো অমত না থাকে।

তোমাকে বিশ্বাস কি?

 দস্যুকন্যা বলে আমাকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছেন না?

বনহুর কোনো জবাব দেবার পূর্বে বাইরে পদশব্দ শোনা গেলো, ইরানি দ্রুত সরে গেলো সেখান থেকে।

*

কান্দাই পৌঁছবার পর মুহূর্ত পর্যন্ত ইরানি সবার অগোচরে বনহুরের জাহাজেই খালাসীর বেশে আত্নগোপন করে রইলো। বনহুর অবশ্য রহমানকে বলেছিলো ইরানি সম্বন্ধে সব কথা এবং তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্যও বলে দিয়েছিলো সে।

বনহুরের জাহাজ কান্দাই ফিরে এলো।

ইরানি কান্দাই বন্দরে পৌঁছবার পর বনহুরের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। অবশ্য বনহুরের সঙ্গে আবার দেখা হবে, বলে গেলো সে।

বনহুর তার জাহাজ কান্দাই বন্দর থেকে কান্দাই জঙ্গলে তার গোপন ঘাটিতে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে নেমে পড়লো। প্রথমে মা, নূর আর মনিরার সঙ্গে দেখা করবে, তারপর ফিরে যাবে সে আস্তানায়।

বনহুর কান্দাই পৌঁছবার পূর্বেই মনসুর ডাকু জালাল শাহের জাহাজ যোগে পৌঁছে গেছে তার পাতালপুরীর গোপন আডড়ায়। জালাল শাহের কাছে মনসুর নিজকে বণিক বলেই পরিচয় দিয়েছিলো, যেমন দিয়েছিলো বনহুরকে জাহাঙ্গীর আলী মনে করে।

বনহুরকে হত্যা কিংবা বন্দী উদ্দেশ্যেই মনসুর ডাকু দলবল নিয়ে নীল নদে জাহাজ ভাসিয়েছিলো। বহু অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদ নিয়েছিলো সে তার জাহাজে। সব হারিয়ে রিক্তহস্তে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে মনসুর– জীবনটাও হারাতে হতো নিঃসন্দেহে–ভাগ্যিস, বনহুর তাদের প্রতি সদয় হয়েছিলো, তাই জীবনে বেঁচে আছে।

 মনসুর ডাকুর আক্রোশ বেড়ে গেছে চরমভাবে। বনহুরের মন্দ করতে গিয়ে তারই চরম মন্দ হয়েছে। বনহুরকে ধ্বংস করতে না পারলে তার শান্তি নেই– স্বস্তি নেই।

মনসুর ভাবে, তার মত ডাকু থাকতে আবার একজন শক্তিশালী ডাকু থাকবে কেন, যার। কাছে সে বারবার নাকানি-চুবানি খাচ্ছে।

কঠিন কণ্ঠে গর্জে উঠলো মনসুর– রামলাল!

 বলুন সর্দার?

 শয়তান বনহুরকে সায়েস্তা করতে গিয়ে আমি নিজেই সায়েস্তা হয়েছি।

 হাঁ সর্দার!

আমাদের বহু অস্ত্র, গোলাগুলী বিনষ্ট হয়েছে।

 হাঁ সর্দার, বহু অস্ত্র, গোলাগুলী বিনষ্ট হয়েছে।

শুধু তাই নয়, আমার বহু অনুচর জীবন হারিয়েছে।

ঠিক বলেছেন সর্দার, আমাদের বহু অনুচর জীবন হারিয়েছে।

এসব তুচ্ছ আমার কাছে….

 একেবারে তুচ্ছ সর্দার আপনার কাছে…

 ধমকে উঠে মনসুর ডাকু–চুপ কর!

 চুপ করলাম।

সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে, আমার একমাত্র কন্যা ইরানিকে আমি হারিয়েছি। দস্যু বনহুরকে জব্দ করতে গিয়ে…..

এমন সময় পিছনে নারীকণ্ঠে কে যেন বলে উঠে– নিজেই জব্দ হয়েছ, তাই না?

 কে– কে ইরানি..তুই বেঁচে আছিস্?

 হাঁ বাপু, আমি বেঁচে আছি।

আমাকে বাঁচালি মা, তোর জন্য আমি একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়েছিলাম। তুই কি করে বাচলি ভেবে পাচ্ছি না।

এক মহান ব্যক্তি আমাকে উদ্ধার করেছিলেন বাপু।

 কে সে মহান ব্যক্তি? তাকে তুই জানিস্ না?

 না।

মনসুর ডাকু এবার বলে উঠলো– ইরানি, তোকে পেলাম এ আমার ভাগ্য। কিন্তু আবার আমি শপথ করছি দস্যু বনহুরকে নিঃশেষ না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না।

বাপু, আমিও শপথ করছি, তোমায় সহায়তা করবো। দস্যু বনহুরের জন্য আজ তোমার এ অবস্থা, আমারও কাজেই তাকে দেখে নিতে চাই।

*

বনহুরকে নিয়ে যখন মনুসুর ডাকু এবং তার কন্যা নানারকম শলা-পরামর্শে মেতে উঠে তখন বনহুর মনিরার কোলে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে গল্প করে চলেছে।

অনেকদিন পর স্বামীকে কাছে পেয়ে মনিরা যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। সেদিন নূরকে পৌঁছে দেবার পর বেশি বিলম্ব করবার সময় পায়নি বনহুর, তাই মনিরার মনে একটা দারুণ অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলো।

বনহুর এলে তো প্রথমে সে কথাই বলেনি সহজে।

বনহুর যখন মায়ের পাশে বসে কথাবার্তা বলছিলো তখন মনিরা ফুলছিলো অভিমানে। মনিরার এ অভিমান অহেতুক ছিলো না, কারণ আজও সে স্বামীকে একেবারে ঘনিষ্ঠ করে পেলো না, যদিও পেতো তা ক্ষণিকের জন্য মাত্র। কোন্ নারী না চায় তার স্বামীকে একান্ত নিজের করে? মনিরাও তাই বনহুরকে ধরে রাখতে চায় সর্বক্ষণের জন্য।

মনিরার কত আশা ছিলো, স্বামী-পুত্র নিয়ে সুখের সংসার করবে, সব সময় স্বামীকে পাবে। কিন্তু সব বাসনা তার ধূলিসাৎ হয়েছে।

 শুধু মনিরাই নয়, বনহুরকে যে কামনা করেছে, ভালবেসেছে সে-ই দুঃখ ছাড়া কিছু পায়নি, বনহুর যেন সবার স্বপ্ন।

 নূরীও সুখী নয়। সেও বনহুরকে নিবিড় করে অলবেসেছিলো, জীবন দিয়ে কামনা করেছিলো, তার জন্য বহু ব্যথা তাকে সহ্য করতেও হয়েছে। যদিও বনহুরকে লাভ করেছে সে, কিন্তু মনের কোণে যেন একটা কাঁটা সব সময় তার খচ্‌ খচ্‌ করে ফুটতো। নূরী জানে, বনহুর তার একার নয়। এটাই হলো তার মনের গভীর ক্ষত। •

. তবু নূরী নিজেকে সর্বক্ষণ খুশি রাখার চেষ্টা করতো, কোনোক্রমে তার মনের গোপন ব্যথা যেন প্রকাশ না পায়, এজন্য নিজেকে সে সব সময় সংযত রাখতো।

বনহুর যখন মনিরার কথা বলে তখন নূরী নিজের বুকে কঠিন একটা আঘাত অনুভব করে, বুকটা যেন তার ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় কাঁচের টুকরার মত। নূরী নীরবে সহ্য করে, মুখে হাসি টেনে নিজেকে ভুলিয়ে রাখে, যেন সে কিছু গায়ে মাখছে না।

 নূরী দস্যু দুহিতা, কাজেই সাধারণ মেয়েদের চেয়ে সে আলাদা। বনহুরকে সে যতটুকু পেয়েছে তাই তার কাছে অনেক বেশি, অনেক সাধনার। বেশি সে চায় না, চাইলেও সে পাবে না ওকে ধরে রাখতে, তাই নূরী বনহুরকে যতটুকু পেয়েছে তাই তার কাছে অনেক বেশি, অনেক সাধনার। বেশি সে চায় না, চাইলেও সে পাবে না ওকে ধরে রাখতে, তাই নূরী বনহুরকে যতটুকু পায় তাতেই সে খুশি।

মনিরা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা, সে স্বামীকে যতটুকু পায় তার চেয়ে অনেক বেশি কামনা করে। ছেড়ে দিতে মন চায় না তার কোনো সময়।

বনহুর সব বুঝে, মনিরার মনোভাব সে জানে, তাই সে কোনো দিন নূরী সম্বন্ধে কোনো কথা খোলাখুলি বলে না তার কাছে।

আজ কিন্তু বনহুরের মনে প্রচণ্ড একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়, এমন করে আর কতদিন সে নূরীর কথা গোপন রাখবে? শুধু নূরী নয়, নূরীর গর্ভে তারই একটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে। বনহুর হেসে বলে- মনিরা, একটা গল্প বলবো তোমাকে, সুন্দর একটা গল্প শুনবে?

বলো শুনবো?

মনিরা, এ গল্পটা তোমাকে অনেক দিন থেকে বলবো ভাবছি কিন্তু বলা হয়নি। জানি না, গল্পটা শোনার পর পাল্টে যাবে নাতো?

চমকে উঠে মনিরা, বনহুরের কথায় কেমন যেন একটা আনন্দ জাগে তার মনে। ভীতকণ্ঠে বলে মনিরা তোমার কথাগুলো যেন কেমন হেঁয়ালি ভরা মনে হচ্ছে।

একটু হাসে বনহুর।

কক্ষের নীলাভ আলোকরশ্মিতে বনহুরকে ভারী সুন্দর লাগছিলো। স্বামীর এলোমেলো চুলগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো মনিরা, দৃষ্টি তার স্বামীর মুখে নিবদ্ধ।

মনিরার চিবুকে মৃদু চাপ দিয়ে বলে বনহুর– গল্প না শুনেই যেভাবে চমকে উঠলে তুমি!

থাক শুনে আর কাজ নেই।

 না, তোমাকে বলতে হবে। মনিরার কণ্ঠে আব্দারের সুর।

বনহুর মনিরাকে নিবিড়ভাবে টেনে নিলো, বললো–শোনো তবে বলছি। হাঁ, বলবার আগে একটা কথা বলবো, গল্পটা কিন্তু আমার এক বন্ধুর জীবন কাহিনি। আমার এক নাবিক বন্ধু ছিলো, তার নাম ছিলো আসলাম। অত্যন্ত বদনসীব ছিলো সে, খুব ছোট বেলায় মা বাবাকে হারিয়ে বড় দুঃখে দিন যাচ্ছিলো। পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, বড় কষ্ট– এমন দিনে এক জাহাজে চাকরি পেলো সে।

তারপর?

জাহাজের ক্যাপটেন ছেলেটাকে খুব ভালবাসতো, কারণ ছেলেটা ছিলো বড় কাজের। কাজ করতে ভালবাসতো বলে ওকে আদর করতে সবাই। ছেলেটা কিন্তু দেখতে খুব কুৎসিত ছিলো। তবু সে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সবার। দিন যায়…ছেলেটা বড় হতে লাগলো। জাহাজের মালিকের একটি মেয়ে ছিলো, সে সব সময় আসলামের পাশে পাশে থাকতো।

তারপর?

আসলাম মেয়েটিকে ভাল না বাসলেও মেয়েটি ওকে দিন দিন গভীরভাবে ভালবেসে ফেললো, মানে অন্তর দিয়ে…।

বুঝেছি, তুমি বলো?

এদিকে আসলাম যখন ছোট ছিলো তখন তার ভাব ছিলো একটি মেয়ের সঙ্গে, বড় হয়ে যদিও সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো তাকে, তবু মাঝে মাঝে তার কথা স্মরণ হতো ওর। থামলো বনহুর।

মনিরার মুখ ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে আসছে, সে কোনো কথা না বলে নীরবে শুনে যাচ্ছে।

বনহুর বাঁকা দৃষ্টি মেলে আলগোছে দেখে নিচ্ছিলো মনিরার মুখোভাব। সহসা বজ্রপাত হবে না তো? ভয়ও হচ্ছিলো বনহুরের মনে। গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে বলে বনহুর আসলামের সঙ্গে হঠাৎ একদিন তার ছোট বেলার সাথীর দেখা হলো। দু’জন চিনলো দু’জনাকে– সে এক অদ্ভুত মিলন! কি আনন্দ সেদিন আসলামের

তা বুঝতে পারছি, তারপর কি হলো বলো?

এই সোজা কথাটা বুঝতে পারছো না, বিয়ে করলো আসলাম ওকে।

 জাহাজের মালিকের মেয়ের কি হলো?

আসলাম ভীষণ এক সমস্যায় পড়লো, সে মালিক-কন্যাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।

হু, তারপর?

আসলামকে মালিক-কন্যা সারাক্ষণ অক্টোপাশের মত আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, কারণ, তাকে সে এত ভালবাসে যা কম মেয়েই পারে। মেয়েটির ভালবাসাকে উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়লো আসলামের।

মনিরা বলে উঠলো—-কেন, আসলাম বললেই পারতো, সে তার ছোট বেলার সাথীকে বিয়ে করেছে।

সে কথা ও বলেছিলো কিন্তু গুলের কোনো কথাই শুনতে রাজি ছিলো না।

জাহাজের মালিক-কন্যার নাম গুলেনূর বুঝি?

হাঁ, গুলেনূর।

আর আসলামের ছোট বেলার সাথীর নাম কি ছিলো?

ঠিক আমার মনে নেই, কারণ এ গল্পটা আমি প্রায় আট-দশ বছর আগে আসলামের মুখে শুনেছিলাম কিনা!,

তোমার মনে না থাকলেও আমার মনে আছে, বলবো?

 মনিরা, তুমি কি করে শুনলে আমার বন্ধুর কাহিনি?

তোমার বন্ধু আমার কাছেও বলেছিলো।

তাই নাকি?

হাঁ, তোমার বন্ধু আমার কাছে এসেছিলো প্রেম নিবেদন নিয়ে, কিন্তু আমি তাকে উপেক্ষা করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কারণ, সে বড় কুৎসিত ছিলো কিনা!

বনহুর তখন মনিরার কোল থেকে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে উঠে বসে বলে তোমার সঙ্গে আসলামের পরিচয় ছিলো, তাতো জানি না।

দেখো, নেকামি ছেড়ে সোজা কথায় বলল তুমি কি বলতে চাও আমাকে?

মনিরা, তুমি আমাকে গল্পটা শেষ করতে দিলে না?

 বলো গুলেনূর কে?

বনহুর যা বলতে চেয়েছিলো তা আর বলা হলো না। মনিরা নাগরাণীর মত ফোঁস ফোঁস করছে দেখে নিশ্চুপ হলো সে।

বনহুর বিপদ গণলো, নূরীর কথাটাই বলবে বলে সে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলো। বনহুর চুপ হলেও মনিরা তাকে ছাড়লো না, চেপে ধরলো বনহুরের জামার আস্তিন– বলো গুলেনূর কে?

বললাম তো, আমার বন্ধু আসলামের…

 মিথ্যা কথা বলে আমাকে ধোকা দিতে পারবে না। বলো, বলো? আমি জানতে চাই কে সে?

আঃ ছাড়ো বলছি।

বলো, না বললে তোমাকে আজ মজাটা দেখাব!

বনহুর ভাবতে লাগলো, এই মুহূর্তে সত্য বললে আর রক্ষা থাকবে না তার। কাজেই কোমল। কণ্ঠে বললো– তুমি বিশ্বাস করো মনিরা, গল্প গল্পই। আসলাম বলে আমার কোনো বন্ধুও ছিলো না, তার কোনো বান্ধবীও ছিলো না। সময় কাটানোর জন্য একটা…

 মিথ্যা কাহিনি….

হাঁ, একটা মিথ্যা কাহিনি শুনিয়ে তোমাকে অবাক করে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তা শুনলে কই?

এক সময় রাত ভোর হয়ে আসে। বনহুর মনিরার কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে চৌধুরীবাড়ির বাইরে।

*

আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দস্যু বনহুরের প্রধান অনুচর রহমান গাড়িসহ উধাও হওয়ার পর পুলিশ মহল ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলো। দস্যু বনহুর মৃত্যুবরণ করেছে অথচ তার অনুচরগণও। এক একজন কম নয়– পুলিশের এত সাবধানতা ব্যর্থ করে রহমানকে নিয়ে ভাগলো। পুলিশ মহল বহু অনুসন্ধান করেও সেই ভ্যানটিকে আর খুঁজে পায়নি, রহমানকে পাওয়া তো দূরের কথা।

এই ঘটনার পর থেকে পুলিশ মহল সদা-সর্বদা দস্যু বনহুরের ঘাটি এবং তার অনুচরগণের সন্ধান করে ফিরছে। অনেক পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার, তবু কোনোও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি, সেই পুলিশ ভ্যানটিরও পাত্তা পায়নি আজ পর্যন্ত। গাড়িখানাই বা গেলো কোথায়?

পুলিশ মহল যখন বনহুরের অনুচরদের সন্ধানে ব্যস্ত তখন ভীষণভাবে এখানে-সেখানে লুটতরাজ, ডাকাতি হচ্ছে।

 এমন দিনে কান্দাই পুলিশ মহলে আবার একটা ভীষণ আশঙ্কা দোলা দিলো ফারহা নগরের হাফিজুল রিজভীর বাড়িতে ডাকাতি এবং আশ্চর্যভাবে লুষ্ঠিত সামগ্রী ফেরত।

 হাফিজুল রিজভীর বাড়ি ডাকাতি ব্যাপারটা গোপন রইলো না, কিন্তু কে বা কারা তার বাড়িতে হানা দিয়েছিলো এবং লুষ্ঠিত মাল কারাই বা ফেরত দিলো– এসব সকলের কাছেই অগোচর রইলো। রিজভী সাহেব এ নিয়ে বেশি ঘাটেননি, কারণ তিনি জানেন, পুলিশ মহলে দস্যু বনহুর মরে গেছে। তাই বেশি ঘাটতে গেলে আসল ব্যাপারটা উদঘাটিত হয়ে পড়তে পারে।

আজ পর্যন্ত তাই রিজভীর বাড়ির ডাকাতি রহস্যময়ই রয়ে গেছে। পুলিশ মহলে মাঝে মাঝে এ নিয়ে আলোচনা হয় এবং নানারকম মতামত প্রকাশ পায়।

 কান্দাই পুলিশ অফিসে কয়েকজন পুলিশ অফিসার বসে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিলো।

মিঃ হাসান, মিঃ ইয়াসিন এবং মিঃ হারুনও ছিলেন সেখানে। প্রখ্যাত পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ চৌধুরী এসেছেন কান্দাই-এর পুলিশ সুপার হয়ে। আজ তারই সঙ্গে আলাপ হচ্ছিলো কান্দাই-এর ঘটনাগুলো নিয়ে। দস্যু বনহুর এবং তার অনুচরদের কার্যকলাপ নিয়েই আজকের আলোচনা।

যদিও মিঃ আরিফ চৌধুরী দস্যু বনহুর সম্বন্ধে বিশেষভাবে অবগত ছিলেন তবু কান্দাই এসে নতুন করে দস্যু বনহুর সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করছিলেন। তিনি যত শুনছিলেন ততই বিস্ময়ে যেন হতবাক হয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর বড় সখ ছিলো, একবার দস্যু বনহুরের সঙ্গে বোঝাপড়া করেন, কিন্তু আফসোস, দস্যু বনহুর আর জীবিত নেই!

 মিঃ হাসানকে লক্ষ্য করে বললেন মিঃ আরিফ চৌধুরী–দস্যু বনহুরের মৃত্যু হলেও তার অনুচরগণ দেখছি কম নয়।

হাঁ স্যার, প্রকাশ্য দিবালোকে অগণিত পুলিশ বেষ্টনি ভেদ করে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দস্যু বনহুরের প্রধান অনুচর রহমানকে আর একজন অনুচর কৌশলে উদ্ধার করে নিয়ে গেলো কম কথা নয়! আজ পর্যন্ত আমরা বহু চেষ্টা করেও তার কোনো খোঁজ-খবর পেলাম না।

এমন সময় একজন পুলিশ একটা চিঠি এনে মিঃ হাসানের হাতে দিলো– স্যার চিঠি।

 মিঃ হাসান চিঠিখানা খুলে নিয়ে পড়তে পড়তেই দু’চোখ তার গোলাকার হয়ে উঠলো।

মিঃ আরিফ এবং অন্যান্য অফিসার তাকিয়েছিলেন মিঃ হাসানের মুখের দিকে, তারা অবাক হলেন– বুঝতে পারলেন, চিঠিখানা নিশ্চয়ই কোনো বিস্ময়কর সংবাদ বহন করে এনেছে।

মিঃ হাসান চিঠিখানা পুলিশ সুপারের দিকে বাড়িয়ে ধরে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেন– স্যার, পড়ে দেখুন।

কার চিঠি?

অজ্ঞাত কোনো ব্যক্তির।

পড়ুন।

মিঃ হাসান পড়তে শুরু করলেন—

আপনারা জানেন, দস্যু বনহুর জীবিত নেই। কিন্তু জানাতে বাধ্য হচ্ছি, সে। জীবিত আছে এবং সে পুলিশের চোখে ধোকা দিয়ে স্বচ্ছন্দে কার্যোদ্ধার করে চলেছে। তার প্রমাণ ফারহা। নগরীর জালাল শাহের জাহাজে নীল নদে দস্যুতা। পুলিশ মহলকে সতর্ক উদ্দেশ্যেই আমার এ চিঠি। —জনগণের বন্ধু

একসঙ্গে উচ্চারণ করলেন যেন সবাই আশ্চর্য, দস্যু বনহুর জীবিত আছে!

পুলিশ সুপার আরিফ চৌধুরীর মুখোভাবে বিস্ময় ফুটে উঠলেও একটা দৃঢ়তা জেগে উঠলো, বললেন তিনি– দস্যু বনহুরের অসাধ্য কিছু নেই। সে জীবিত থাকাটাও অসম্ভব নয়।

মিঃ ইয়াসিন বলে উঠলেন– কি ভয়ঙ্কর কথা, দস্যু বনহুর জীবিত। আমার কিন্তু মোটেই বিশ্বাস হয় না, কারণ আমাদের দৃষ্টি সম্মুখে মাত্র কয়েক গজ দূরে তার গাড়িখানা হাজার হাজার ফুট নিচে পাহাড়ের তলদেশে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আগুন ধরে যায়। সব মিথ্যা বলে মনে হচ্ছে।

 মিঃ হাসানের চোখেমুখেও অবিশ্বাসের ছায়া, তিনিও যোগ দিলেন ইয়াসিন সাহেবের সঙ্গে, কারণ, সেদিন দস্যু বনহুরকে যে পুলিশ ভ্যানটি অনুসরণ করেছিলো সেই ভ্যানে তিনিও ছিলেন। তাঁর চোখের সম্মুখেই দস্যু বনহুরের গাড়িখানা কিভাবে ধ্বংস হয়েছিলো, তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। কাজেই এখানে অবিশ্বাসের কিছু নেই। তিনি প্রকাশ্যে বললেন– দস্যু বনহুর জীবিত আছে, এটা আমারও বিশ্বাস হয় না। এই চিঠি তারই কোনো অনুচরের লেখা। পুলিশ মহলকে একটা ধোকার মধ্যে ফেলে নাকানি-চুবানি খাওয়ানোই তাদের মুখ উদ্দেশ্য হতে পারে।

 পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ চৌধুরী বললেন– আপনি যা বলছেন সত্য হতে পারে, কিন্তু চিঠিখানা একেবারে অবহেলা করা যায় না। আপনি ফারহা পুলিশ অফিসে যোগাযোগ করে জেনে নিন সেখানে জালাল শাহের ব্যাপারটা, তাহলেই সব জানা যাবে।

পুলিশ অফিসার মিঃ কাওসার বলে উঠলেন– স্যার, ফারহার সংবাদ যেটা আমরা জানতে চাচ্ছি, এর কিছুটা সংবাদ আমি জানতে পেরেছি। জালাল শাহের জাহাজে কোনো ডাকাত বা দস্যু হানা দিয়েছিলো বটে কিন্তু কোনো জিনিস তারা হরণ করেনি।

তার মানে? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ আরিফ?

দস্যু নাকি সব নীলনদের পানিতে নিক্ষেপ করেছিলো।

 আশ্চর্য। মিঃ হাসান বলে উঠলেন– এই রকম আমিও শুনেছি।

মিঃ আরিফ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন– দস্যু বনহুরের কার্যাবলিই এই রকম। আমি পুলিশ রিপোর্টে জেনেছি, দস্যু বনহুরের দস্যুতা নেশা–দস্যুতা করে কখনও সে নিয়ে গেছে, কখনও সে বিলিয়ে দিয়েছে দীন-দরিদ্রের মধ্যে, আবার কখনও সে ফেলে দিয়েছে সাগরের পানিতে। যা হোক, এ চিঠি অবহেলা করা যায় না, আপনারা ফারহার সঙ্গে যোগাযোগ করে আসল খবর জেনে নিন।

 এই বৈঠকের পরই পুলিশ মহল সজাগ হয়ে পড়লো। পুলিশ সহ নিজে ফারহা পুলিশ অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন, জালাল শাহের জাহাজে দস্যু বনহুর স্বয়ং হানা দিয়েছিলো। সে জীবিত আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কথাটা সমগ্র কান্দাই শহরে ছড়িয়ে পড়লো– দস্যু বনহুর জীবিত আছে।

পুলিশ মহলে আবার সাড়া পড়লে দস্যু বনহুরকে পাকড়াও অভিযান।

*

মনসুর ডাকু বলে উঠলো– গোমেশ, আমার চিঠিখানা ঠিক ওষুধের মত কাজ করেছে। দস্যু বনহুর যে জীবিত, এ কথা তারা জানতে পেরে ভীষণভাবে তারা দস্যু বনহুর সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

গোমেশ গম্ভীর কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো– সর্দার, আর একটা শুভ সংবাদ আছে

কি-সংবাদ গোমেশ? বললো ইরানি।

আজকাল ইরানি প্রায় সময়ই পিতার পাশে পাশে থাকে। দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারে সেও অত্যন্ত উৎসাহী। দস্যু বনহুরের কার্যকলাপের বর্ণনা শুনে তার মনে একটা ভীষণ আক্রোশ জন্মেছে। যাতে বনহুর তার পিতার হাতে-বন্দী হয়, এটাই তার একান্ত কামনা, সে নিজে দস্যু বনহুরকে নাজেহাল-পেরেশান করে ছাড়বে।

ইরানির প্রশ্নে বললো গোমেশ কান্দাই পুলিশ মহল বহু চেষ্টা করেও দুর্দান্ত দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করতে না পেরে আমেরিকা থেকে প্রখ্যাত গোয়েন্দা মিঃ লাউ লংকে আনছে।

অবাক হয়ে বললো ইরানি– লাউ লং, এ আবার কেমন নাম!

যেমন দস্যু বনহুর তেমনি লাউ লং সাংঘাতিক গোয়েন্দা– তেমনি তার অদ্ভুত নাম।

মনসুর-ডাকুর মুখ খুশিতে বিকৃত হয়ে উঠছে, দাঁতে দাঁত পিষে বললো– এবার বেটা কেমন করে আত্নগোপন করে দেখা যাবে! প্রখ্যাত গোয়েন্দা লাউ লং-এর হাতে তাকে বন্দী হতেই হবে।

ইরানি পিতার কথায় খুব খুশি হতে পারলো না, সে নিরুৎসাহ কণ্ঠে বললো– অমন কত প্রখ্যাত গোয়েন্দা এলো, কেউ পেরেছে দস্যু বনহুরকে সায়েস্তা করতে? মিঃ জাফরী বলে এক নামকরা পুলিশ অফিসার এসেছিলেন, তিনিও শেষ পর্যন্ত দস্যু বনহুরের কাছে পরাজয় বরণ করেছিলেন।

গোমেশ বলে উঠে– লাউলং মিং জাফরীর চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিমান গোয়েন্দা। তাঁকে বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা বলা যায়।

মনসুর ডাকু বললো– এবার পুলিশের সঙ্গে মনসুর ডাকু যোগ দিয়েছে, কোনো মতেই নিস্তার নেই দস্যু বনহুরের। হোঃ হোঃ হোঃ, ইরানি তোমার বাপুর উপর বিশ্বাস রেখো, কাঁচা কাজ আর সে করবে না।

ইরানি অবাক কণ্ঠে বললো–বাপু, তুমি পুলিশের সঙ্গে যোগ দিয়েছে? তোমাকে যদি তারা পাকড়াও করে ফেলে?

আমাকে পাকড়াও করবে এমন জন আছে?

 বাপু, তুমি মিছামিছি বড়াই করছে, দস্যু বনহুর তোমাকে পাকড়াও করে…..

ঐ শয়তান দস্যুর কথা বাদ দাও ইরানি। ও আমাকে বাগে পেয়ে বন্দী করেছিলো কি বলো, সত্যি কিনা গোমেশ?

হাঁ হাঁ সর্দার, কেন, আমাকেও কি পাকড়াও করতে পারতো, কৌশলে আমাদের কাবু করে বন্দী করেছিলো সে।

 তার প্রতিশোধ নেবার জন্যই আমি আজ উন্মাদ হয়ে উঠেছি ইরানি। কান্দাইবাসী ব্যবসায়ী সেজে পুলিশ মহলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছি। আজ আমি যা বলবো ওরা সেইভাবে কাজ করবে। বুদ্ধি বলে কান্দাই পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ চৌধুরীকে কলের পুতুল বানিয়েছি। এখন সমস্ত পুলিশ ফোর্স আমার হাতের মূঠায়।

ইরানি আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠলো, বললো– বাপু, তুমি দেখছি আমার মহা মূল্যবান হারছড়া…।

গোমেশ বলে উঠে সর্দার, আমার যুক্তি-বুদ্ধিতেই আপনি এসব কাজে অগ্রসর হয়েছেন, কাজেই…

হেসে উঠলো মনসুর ডাকু– তুমিই তো আমার ডান হাত! ইরানির হারছড়া আমি পেলেও তুমি পাবে ইরানিকে।

ইরানি ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠলো– বাপু।

 মা, তুমি ঘাবড়াচ্ছো কেন! সব ঠিক হয়ে যাবে।

 গোমেশ বলে উঠলো– সর্দার, শেষে ফাঁকি দেবেন আমাকে ভাবছেন?

মোটেই না, দস্যু বনহুরকে এবং সেই নারী যে বনহুরকে সেদিন রক্ষা করেছিলো তাকে যদি গ্রেফতার করতে পারো, তাহলে হয় ইরানি, নয় তার মহামূল্য হারছড়া পাবেই…

সর্দার, মনে রাখবেন, কথা ঠিক না থাকলে কিন্তু!

 ঠিক থাকবে, ঠিক থাকবে– কি বলো মা ইরানি?

 ইরানি কোনো জবাব দিলো না।

এই ঘটনার কিছুদিন পরের কথা।

মনসুর ডাকুর গোপন আড্ডায় গোপন বৈঠক বসেছে। মনসুর ডাকুর বিশিষ্ট বিশিষ্ট অনুচর এবং তার কন্যা ইরানি আর গোমেশ রয়েছে। আমেরিকা থেকে মিঃ লাউলং এসে পৌঁছেছেন, তারই জন্য আজ মনসুর ডাকুর আড্ডায় এই গোপন পরামর্শ।

*

মিঃ লাউলং-এর আগমনে কান্দাই পুলিশ মহলে একটা বিপুল সাড়া পড়ে গেলো। এবার যে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করা অত্যন্ত সহজ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কান্দাই-এর বিভিন্ন শহর থেকে ধনকুবের যারা দস্যু বনহুরের কছে নাকানি-চুবানি খেয়েছেন বা তার ভয়ে প্রকম্পিত রয়েছেন তারা সবাই এসেছেন প্রখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা মিঃ লাউলংকে অভিনন্দন জানাতে।

কান্দাই পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ মিঃ লাউলং-এর আগমনে একটা উৎসবের আয়োজন করেছেন– এ উৎসব হবে কান্দাই শহরের সবচেয়ে বড় উৎসব। বিভিন্ন দেশ থেকে নামকরা পুলিশ কর্তাগণ যোগ দিবেন এ উৎসবে। আর যোগ দিবেন বিভিন্ন দেশের ধ্বনি মানি ব্যক্তিগণ।

 শুধু তাই নয়, এ উৎসবে আসবে মনসুর ডাকু ভদ্র নাগরিক ধনকুবের হাসিম রিজভীর বেশে। তার বিশিষ্ট অনুচর গোমেশও বাদ যাবে না। ইরানিকেও আসার জন্য বলেছে মনসুর ডাকু– সে হাসিম রিজভীর কন্যা হামিদা রিজভীর বেশে আসবে। তার কণ্ঠে থাকবে মূল্যবান হীরক হার।

প্রথমে ইরানি রাজি হয়নি– যখন সে জানতে পেরেছে, মনসুর ডাকুর অভিসন্ধি দস্যু বনহুরকে এই উৎসবে গ্রেফতার করা এবং হীরক হারই হবে এ উৎসবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু। ইরানি এমন একটা সুযোগ ত্যাগ করতে মোটেই রাজি নয়। যে দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করার জন্য সে তার কণ্ঠের হার পুরস্কার ঘোষণা করেছিলো, তাকে পাকড়াও উদ্দেশ্যই হবে এ উৎসবে তার আগমন ইরানি খুশি মনে রাজি হয়ে গেছে।

সমস্ত শহরে উৎসব ব্যাপার নিয়ে নানা-রকম আলাপ-আলোচনা চলছে। আমেরিকা থেকে প্রখ্যাত গোয়েন্দা এসেছেন দস্যু বনহুর গ্রেফতারে– এটা কম কথা নয়। তাকে দেখবার জন্য সবাই উন্মুখ।

পুলিশ কর্মকর্তাগণ মিঃ জাফরীকেও এনেছেন দস্যু বনহুর গ্রেফতারের সহায়তার জন্য। কারণ মিঃ জাফরীই দস্যু বনহুরকে চেনেন ভাল।

পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে জায়গাটা। প্রায় লক্ষ টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এসব আয়োজন করতে।

যে মুহূর্তে কান্দাই-এর বহু লোক ক্ষুধায় হাহাকার করে মরছে, সেই ক্ষণে এই বিরাট আয়োজন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষের মুখের অন্ন কেড়ে নিয়ে যারা বড় হয়েছে তাদের উদরই পূর্ণ হবে এ উৎসবে।

মিঃ লাউলং-এর আগমন উৎসব উপলক্ষে দেশ-বিদেশ থেকে গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ আসতে শুরু করেছেন। পুলিশ মহলে ব্যস্ততার অন্ত নেই।

*

বনহুরের জামার বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বললো নূরী– কোথায় যাচ্ছো আজ বললে না তো?

আমন্ত্রণ রক্ষা করতে।

আমন্ত্রণ।

হ।

কোথায়?

কান্দাই পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণে লাউলং এর আগমন উৎসবে।

 দু’চোখ বিস্ময়ে কপালে তুলে বললো নূরী পুলিশ সুপার লাউলং-এর আগমন উৎসবে…

কেন, সেখানে কি আমার দাওয়াত থাকতে পারে না– অত অবাক হচ্ছো কেন নূরী?

শুনেছি লাউলং সাহেবকে পুলিশ বিভাগ সুদূর আমেরিকা থেকে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করার জন্য এনেছে…

তুমি যা শুনেছে সত্য, নূরী।

 পুলিশ ইন্সপেক্টার জাফরীও নাকি এসেছেন?

হা।

 তোমাকে গ্রেফতারের জন্য নাকি ভীষণভাবে আয়োজন চলছে?

 এত কথা কে তোমাকে জানালো? নিশ্চয়ই রহমান বলেছে।

না।

তবে কায়েস?

না, সেও বলেনি। আমি কান্দাই শহরের তোমার ঘাটিতে যোগাযোগ করে সব জানতে পেরেছি। হুর, তুমি কেন অবুঝ হচ্ছো? যেখানে তোমাকে নিয়ে এত……

 আমাকে নিয়েই তাদের এ আয়োজন– আমি না গেলে চলবে কি করে? নূরীর চিবুকে মৃদু নাড়া দিলো বনহুর।

অভিমানভরা গলায় বললো নূরী– এতসব জেনেও তুমি যাবে সেখানে?

আজ নতুন করে এ প্রশ্ন করছো কেন নূরী? মিঃ লাউলং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আমার একান্ত প্রয়োজন।

আমার কিন্তু মোটেই ভাল লাগছে না।

 যাক্, বলো জাভেদ কোথায়?

 দাইমার কোলে ঘুমাচ্ছে।

ওকে আজ একটিবারও দেখিনি, নিয়ে এসো।

নূরী গম্ভীর গলায় বললো– সে সময় তোমার কোথায়? সব সময় তুমি ব্যস্ত।

হাঁ, আমার জীবনটাই শুধু ব্যস্ততায় পূর্ণ নূরী।

তুমি নিজে যদি সর্বক্ষণ কাজ নিয়ে থাকো তাহলে কাজ কি করে তোমাকে এড়িয়ে চলবে, বলো?

যাও নূরী, জাবেদকে নিয়ে এসো।

 নূরী বেরিয়ে যায়, একটু পরে ফিরে আসে– কোলে তার ফুটফুটে ঘুমন্ত শিশু জাভেদ।

 বনহুরের সম্মুখে এসে দাঁড়ায় নূরী– এই নাও।

 উঁহু, তোমার কোলেই ওকে মানাচ্ছে ভাল। ঝুঁকে চুমো দিলো বনহুর জাবেদের কচি ঠোঁটে।

একটু নড়ে উঠলো জাভেদ।

বনহুর হেসে বললো– যখন এই হাত আমার হাতের মত শক্ত হবে তখন মানাবে আমার সঙ্গে, বুঝলে? কচি হাতখানা ধীরে আস্তে ঝাঁকুনি দিলো বনহুর।

নূরী বললো– যাও, সব কিছুতেই তোমার ঠাট্টা।

এমন সময় বাইরে কায়েসের গলা শোনা যায়– সর্দার, তাজ তৈরি।

বনহুর রিভলভারটা জামার গোপন পকেটে রেখে নূরীর মুখ খানা উঁচু করে ধরলো, ঝুঁকে এলো বনহুরের মুখখানা নূরীর ওষ্ঠদ্বয়ের উপর।

নূরী বললো লজ্জা নেই, দেখছো না জাভেদ চোখ মেলেছে।

বনহুর হেসে দ্রুত বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

 তাজ প্রস্তুত ছিলো, বনহুর এসে দাঁড়াতেই দু’জন অনুচর সরে দাঁড়ালো দু’পাশে।

বনহুর তাজের পিঠে চেপে বসতেই তাজ সম্মুখের পা দুটি উঁচু করে শব্দ করলো– চিহি চিহি…..

তাজ এবার ছুটতে শুরু করলো।

কান্দাই জঙ্গল অতিক্রম করে এগিয়ে চললো বনহুর সোজা জঙ্গলের শেষ প্রান্তে, পথের দিকে।

পথের উপর রহমান বনহুরের গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো।

বনহুর পৌঁছতেই রহমান ড্রাইভ আসন থেকে নেমে দাঁড়ালো, কুর্ণিশ জানালো সে সম্মানে।

বনহুর তাজ থেকে নেমে গাড়িতে উঠে বসলো। রহমানকে লক্ষ্য করে বললো– ফিরতে বিলম্ব হতে পারে। নূরী যেন বিচলিত না হয়।

আচ্ছা সর্দার।

বনহুর গাড়িতে স্টার্ট দিবে, ঠিক সেই মুহূর্তে একটি তীর এসে বিদ্ধ হলো বনহুরের পাশের আসনে।

বনহুর আর রহমান একসঙ্গে চমকে উঠলো।

রহমান তীরফলকটা তুলে নিতেই নজরে পড়লো, তীর ফলকে গাঁথা আছে একটি কাগজের টুকরা। রহমান ভাঁজ খুলে পড়লো–

বনহুর, সাবধান, লাউলং-এর আগমন উৎসবে যেও না। তোমাকে হত্যা উদ্দেশ্য নিয়ে এ উৎসবের আয়োজন হয়েছে।
– আশা

রহমান পড়া শেষ হতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো বনহুর।

অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো রহমান সর্দারের মুখের দিকে। তারপর বললো- সরদার, এত বাধার পর সেখানে যাওয়া কি ঠিক হবে?

তুমিও দেখছি মেয়েদের মত ভীতু।

 আমাকে তবে সঙ্গে নিন।

তা হয় না রহমান, আমি একা যেতে চাই লাউলং-এর আগমন উৎসবে। একটু ভেবে বললো বনহুর– কিন্তু কে কে এই আশা, যে আমাকে এভাবে সাবধান করে দিচ্ছে বার বার? সত্যি আশ্চর্য…

সরদার, মেয়েটি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, সুচতুরা।

সে তো নিশ্চয়ই কিন্তু কে সে?

সেটাই ভাবার বিষয়। গাড়িতে ষ্টার্ট দিলো বনহুর, অস্ফুট কণ্ঠে বললো– খোদা হাফেজ..

রহমানের আড়ষ্ট কণ্ঠ হতে বের হলো– খোদা হাফেজ।

ফিরে দাঁড়াতেই রহমানের সম্মুখে এগিয়ে এলো তাজ। রহমান তাজের লাগাম চেপে ধরলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে কালো আলখেল্লা পরা একটি মূর্তি এসে দাঁড়ালো রহমানের সম্মুখে, দক্ষিণ হস্তে তার উদ্যত রিভলভার।

রহমান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখলো আলখেল্লা পরা মূর্তির পা থেকে মাথা অবধি। রহমানের মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো, সে বুঝতে পারলো, যে এই দণ্ডে তার সামনে দাঁড়িয়ে সে নারী, পুরুষ নয়। তবে কে এই নারী? রহমান বললো– তুমিই আশা?

নারীকণ্ঠ– হাঁ!

তুমি কি চাও আমার কাছে?

তোমার কাছে কিছু চাই না, তবে তোমাকে বলছি, তোমাদের সর্দার মোটেই নিরাপদ নয়। যত শীঘ্র পারো তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করো।

আমাদের সর্দার কাপুরুষ নয়, মৃত্যুর ভয়ে সে কখনও পিছন ফিরে আসবে না।

আলখেল্লা পরিহিতা নারীমূর্তি অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো, তারপর গম্ভীর হয়ে বললো– যদি সর্দারের মঙ্গল চাও তাহলে আমার সঙ্গে এসো।

কে তুমি কেন তোমার সঙ্গে আমি যাবো? আর তোমাকে বিশ্বাসই বা কি?

তোমাকে হত্যা করলে এই মুহূর্তে আমি করতে পারি, এটা তুমি ঠিক বুঝতে পারছে; কারণ কোনো অস্ত্র তোমার হাতে নেই রয়েছে কোমরের বেল্টে। কোমর থেকে অস্ত্র খুলে নেবার সুযোগ তোমার হবে না। কাজেই আমি তোমাকে হত্যা করবো না, এটা তুমি নিঃসন্দেহে জেনে নিতে পারো।

রহমান কোনো প্রতিবাদ না করে বললো– চলো তবে! কিন্তু কোথায় যেতে হবে, বলো?

 মিঃ লাউলং-এর আগমন উৎসবে।

সেখানে সর্দার থাকবেন……

তাকে রক্ষার জন্যই তো তোমার এ যাত্রা, আর বিলম্ব করো না, অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসো। কথা শেষ করে একটা শিস্ দিলো আলখেল্লা পরিহিতা নারী।

সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের ভিতর হতে বেরিয়ে এলো একটি অশ্ব। আলখেল্লা পরিহিতা নারী উঠে বসলো অশ্বপৃষ্ঠে। অশ্ব ছুটতে শুরু করলো।

রহমানও তাকে অনুসরণ করলো।

বহুক্ষণ চলার পর কান্দাই শহরের এক প্রান্তে একটি বহুকালের পুরানো বাড়ির সম্মুখে এসে অশ্ব থেকে নেমে পড়লো নারীমূর্তি।

রহমানও নামলো তার অশ্বপৃষ্ঠ হতে।

 সম্মুখে অগ্রসর হলো আলখেল্লা পরিহিতা।

 রহমান তাকে অনুসরণ করলো।

একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন গলি ধরে হাঁটতে লাগলো, কিছু দূর এগুতেই একটা লৌহদরজার সম্মুখে এসে থামলো আলখেল্লা পরিহিতা।

সঙ্গে সঙ্গে লৌহদরজা খুলে গেলো।

ভিতরে প্রবেশ করলো আলখেল্লাধারিণী।

রহমান তাকে অনুসরণ করলো বাধ্য ছাত্রের মত।

যেখানে এসে দাঁড়লো আলখেল্লাধারিণী এবং রহমান, সেখানে বহুরকম ড্রেস টাঙ্গানো রয়েছে। একটা পুলিশ অফিসারের ড্রেস হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে ধরলো আলখেল্লাধারিণী রহমানের দিকে নাও, পরে নাও এই পোশাকটা। ঐ পাশের ঘরে যাও।

রহমান পোশাক হাতে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলো।

একটু পরে ফিরে এলো রহমান, তাকে দেখলে কেউ এখন চিনতে পারবে না একেবারে খাঁটি পুলিশ বনে গেছে সে।

আলখেল্লাধারিণী বললো– চমৎকার। আর কোনো ভয় নেই। কেউ তোমাকে চিনবে না– এই নাও, তোমার পিস্তল, সাবধানে রাখবে। যাও, আর তোমাকে কেউ বাধা দেবে না, সর্দারের পাশে পাশে থাকবে এবং তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। একটা কথা মনে রেখো।

বলো?

এক দণ্ডের জন্যও তোমার সর্দারের পাশ থেকে সরে যেও না। তোমার সর্দারের পাশেই থাকবে যে ব্যক্তি সেই হত্যা করবে তোমার সর্দারকে মনে রেখো। আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমি পাশের ব্যক্তিকে ঠেলে দেবে সম্মুখে, এতে তার হাতের পিস্তলের গুলি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হবে। সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলে উঠবে, তার পূর্বেই তুমি সরে পড়বে সেখান থেকে।

আচ্ছা।

যাও তবে, বাইরে যে গাড়ি অপেক্ষা করছে সেই গাড়ি তোমাকে পৌঁছে দেবে উৎসব মঞ্চে।

রহমান বেরিয়ে আসতেই দেখলো একটি পুলিশ ভ্যান অপেক্ষা করছে। ড্রাইভার আসনে বসে আছে একজন পুলিশ। রহমান হকচকিয়ে গেলো, দুঃসাহসী মনটা তার কেঁপে উঠলো ক্ষণিকের জন্য। তবে কি তাকে বন্দী করার জন্যই এতো ছলনা। কিন্তু এই মুহূর্তে দ্বিধা করে কোনো ফল হবে না, রহমান জামার নিচে পিস্তলটায় হাত বুলিয়ে একবার দেখে নিলো, তারপর গাড়িতে এসে বসলো সে।

প্রতি দণ্ডে রহমানের মনে আশঙ্কা জাগছিলো, এই বুঝি তাকে গ্রেপ্তার করে ফেলে। রহমান প্রস্তুত ছিলো ভিতরে ভিতরে। কিন্তু রহমানের সন্দেহ সত্য হলো না।

 একসময় রহমানসহ পুলিশ ভ্যানখানা রাজপথ বেয়ে পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছলো। সশস্ত্র পুলিশ রাইফেল হাতে ফটকে পাহারা দিচ্ছিলো, রহমানের গাড়ি এগিয়ে আসতেই ফটক খুলে দিলো।

এখনও রহমানের মন থেকে সন্দেহের ছায়া মুছে যায়নি। সে ভাবছে, তাকে বন্দী করার জন্যই এই কৌশল। সে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে সরে পড়েছিলো, এবার তাই এতো সতর্কতার সঙ্গে তাকে পুলিশ অফিসে আনা হলো।

কিন্তু রহমানের চিন্তা মিথ্যায় পরিণত হলো। কারণ, তাকে বন্দী না করে অভ্যর্থনা জানালো পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ চৌধুরী।

রহমান অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে উৎসব প্রাঙ্গণে এগিয়ে চললো। দৃষ্টি তার চারিদিকে সতর্কভাবে বিচরণ করে ফিরছে। সর্দারের সন্ধান করছে সে তীক্ষ্ম নজরে। কারণ সে জানে, তাদের সর্দার এখানে সম্পূর্ণ ছদ্মবেশে থাকবেন। রহমানের কাছে তার সর্দারের কোনো ছদ্মবেশই তাকে গোপন রাখতে পারবে না। সর্দারের চোখ দুটি তাকে পরিচিত করবে।

রহমান অনেক চেষ্টা করেও তার সর্দারকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়লো, মনটা তার দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। তবে কি সর্দার এখনও এসে পৌঁছান নি। হঠাৎ রহমানের মুখমণ্ডল দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ওপাশে মহামান্য প্রখ্যাত গোয়েন্দা মিঃ লাউলং-এর পাশে বসে এক পুলিশ অফিসার হাস্যোজ্জ্বল মুখে ইংরেজিতে, আলাপ-আলোচনা করছিলো।

পুলিশ অফিসারের ড্রেসে বনহুরকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। রহমান ক্ষণিকের জন্য হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সর্দারের দিকে। সেই দণ্ডে মিঃ হাসান রহমানের কাঁধে হাত রাখলেন।

চমকে ফিরে তাকালো রহমান, মিঃ হাসান তার কাঁধে হাত রেখে হাসছেন।

রহমানের পিলে চমকে গেলো, এইবার তাকে হয়তো চিনে ফেলেছে, তাই বুঝি হাসছেন পুলিশ ইন্সপেক্টার হাসান সাহেব। মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো রহমানের ক্ষণিকের জন্য।

মিঃ হাসান হেসে বললেন– ওনাকে চিনতে পারছেন না মিঃ রুস্তম, উনি ফারহার পুলিশ সুপার মিঃ কাউসারী।

এতক্ষণে রহমান যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, বললো– আমি ওনাকে চিনতে না পেরে তাকিয়েছিলাম।

আসুন মিঃ রুস্তম, আপনার সঙ্গে মিঃ কাউসারীর এবং মিঃ লাউলং-এর পরিচয় করিয়ে দেই।

 রহমান এমন একটা সুযোগের প্রতীক্ষাই করছিলো, বললো– চলুন।

 মিঃ হাসান রহমানসহ উৎসব মঞ্চের দিকে এগিয়ে চললেন।

মঞ্চের পাশে এসে বললেন মিঃ হাসান– মিঃ রুস্তম আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হতে ইচ্ছুক। ইনি আমাদের কান্দাই পুলিশ সার্জন। প্রথমে মিঃ লাউলং, পরে মিঃ কাওসারী-বেশি দস্যু বনহুরের সঙ্গে পরিচিত হলো রহমান।

 প্রখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা মিঃ লাউলং-এর সঙ্গে করমর্দন করে সর্দারের সঙ্গে করমর্দন করতে গিয়ে রহমান যেন একটু ঘাবড়ে গেলো।

সে মুহূর্তে বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রহমানের মুখে। একটা মৃদু হাসির আভাস ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের ফাঁকে।

রহমান বুঝতে পারলো সর্দার তাকে চিনতে পেরেছেন। সে দাঁড়িয়ে ছিলো, মিঃ লাউলং বললেন- বসুন।

রহমান ঠিক সর্দারের পাশের আসনে বসে পড়লো। যদিও সর্দারের পাশের আসনে বসতে তার দ্বিধা বোধ হচ্ছিলো, তবু বসলো সে ইচ্ছা করে।

উৎসব এখনও শুরু হয়নি, গণ্যমান্য ব্যক্তি সবাই আছেন। মিঃ জাফরী এখনও আসেননি, তিনি কোনো কাজে আটকা পড়ে গেছেন হয়তো।

উৎসব প্রাঙ্গণের ফটকে মিঃ আরিফ চৌধুরী এবং আরও দু’জন সম্মানি পুলিশ অফিসার অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন। মিঃ জাফরীরও থাকার কথা ছিলো ফটকে, কারণ তিনি ছাড়া দস্যু বনহুরকে সহজে কেউ চিনতে পারবেন না এবং এইজন্যই মিঃ জাফরীকে নিতান্ত প্রয়োজন।

কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি এলেন না ব্যাপার কি। সবাই মিঃ জাফরীর আগমন প্রতীক্ষায় উদ্বিগ্ন রয়েছেন। বারবার তার অফিসে ফোন করেও কোন যোগাযোগ পাওয়া যায়নি। বাসা থেকে জানিয়েছে, তিনি সন্ধার পর পরই বেরিয়ে এসেছেন।

উৎসব ব্যাপার নিয়ে সবাই অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেও মিঃ জাফরী এতক্ষণও না আসায় সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

এদিকে উৎসব শুরু হয়ে গেলো।

এমন সময় এলেন হাসিম রিজভী তাঁর কন্যা মিস হামিদা রিজভী সহ। এ উৎসবে মহামান্য অতিথি হাসিম রিজভী ও তাঁর কন্যা হামিদ রিজভী। তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ চৌধুরী এবং মিঃ হাসান।

উজ্জ্বল আলোতে মিস হামিদার কণ্ঠের হীরক হার ছড়া ঝকমক করে উঠলো। নিলাভো একটা দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে হার ছড়া থেকে।

হাসিম রিজভীর পিছনে তার দেহরক্ষীর বেশে যে ব্যক্তি এগিয়ে আসছে সে হলো গোমেশ। মনসুর ডাকু হাসিম রিজভীর ছদ্ম বেশে কন্যা ইরানি সহ এসেছে এ উৎসবে।

হাসিম রিজভীর বেশি মনসুর ডাকু এবং তার প্রধান অনুচর গোমেশ উৎসব মঞ্চে প্রবেশ করেই চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলো, তারা জানে– এ উৎসবে দস্যু বনহুর না এসেই পারে না।

বনহুর আজ এতো নিখুঁতভাবে পুলিশ অফিসারের বেশে সজ্জিত হয়েছিলো যে, তাকে তার অতি পরিচিত জনও চিনতে পারবে না। মনসুর ডাকুও পারলো না, গোমেশও না।

উৎসব শুরু হলো।

নানা রকম গান-বাজনা, কমিক, ইংরাজি গান চললো, সবার অনুরোধে মিস হামিদা রিজভীও গান গাইতে রাজি হলো। কিন্তু তার সঙ্গে বীণা বাজাবে কে। তেমন বীণা বাদক কেউ সেখানে উপস্থিত ছিলো না।

মিঃ কাওসারী বীণা বাজাবেন রাজি হলেন।

করতালিতে মুখর হয়ে উঠলো উৎসব প্রাঙ্গণ।

মিস হামিদা একটা ইংরাজি গান পরিবেশন করবেন। বীণা বাজাবেন মিঃ কাওসারী।

উৎসব প্রাঙ্গণে সবাই উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রইলেন মিস হামিদা রিজভী আর মিঃ কাওসারীর দিকে।

মিস হামিদা রিজভী মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন।

 পাশে এসে দাঁড়ালো মিঃ কাওসারী।

একজন লোক বীণা এনে তুলে দিলো তাঁর হাতে।

মিস হামিদার দৃষ্টি মিঃ কাওসারীর সুন্দর দীপ্ত মুখে যেন আটকা পড়ে যায়।

মিঃ কাওসারীও তাকালো মিঃ হামিদার মুখের দিকে।

উৎসবের উজ্জ্বল আলোতে মিস হামিদার কণ্ঠের হারছড়া জ্বলছে। অপূর্ব লাগছে ওদের দু’জনকে।

গান গাইতে শুরু করলো মিস হামিদা রিজভী।

মিঃ কাওসারীর হাতে বীণা অদ্ভুত সুমিস্ট সুর ছড়িয়ে দিতে লাগলো।

মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনছে সবাই।

মিঃ কাওসারী যখন বীণা বাজাচ্ছিলেন তখন গোমেশ এসে মিঃ হাসিম রিজভীর কানে কিছু বললো।

মুহূর্তে হাসিম রিজভীর চোখ দুটো জ্বলে উঠলো, তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো সে মিঃ কাওসারীর দিকে।

 ঠিক সেই দণ্ডে মিঃ রুস্তম-বেশি রহমানও চিনে নিলো মিঃ হাসিম রিজভী ও গোমেশকে। মনসুর ডাকু ও তার অনুচর গোমেশ যে তার সর্দারকে নিয়ে গোপন কোনো অভিসন্ধি আঁটছে বুঝে নিলো সে অতি সহজে। সকলের অজ্ঞাতে রহমান এসে বসলো মনসুর এবং গোমেশের পিছনের একটি খালি আসনে।

সকলের দৃষ্টি তখন মঞ্চে মিঃ কাওসারী ও মিস হামিদা রিজভীর দিকে থাকায় মিঃ রুস্তম কে লক্ষ্য করলো না।

মিঃ কাওসারীর বীণার সুর আর মিস হামিদা রিজভীর গান সবাইকে একেবারে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এমন বীণার সুর তারা কোনো দিন শুনেছে কিনা সন্দেহ।

মিঃ হাসিম রিজভী ও তার দেহরক্ষীর পিছনে বসে মিঃ রুস্তম সব দেখছিলো আর শুনছিলো। ওদের সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা আর ইংগিতপূর্ণ চালচলন তাকে বিচলিত করে তুললো। সে দেখলো মিঃ হাসিম রিজভীর দেহরক্ষী অতি সন্তর্পনে আসন ত্যাগ করে উঠে গেলো।

 মিঃ রুস্তম-বেশি রহমানও একটু পরে সকলের অজ্ঞাতে গোমেশ কে ফলো করে এগিয়ে। গেলো।

পুলিশ মহল তখন মিঃ জাফরীর আগমন প্রতিক্ষা করে হাঁপিয়ে উঠেছে। পুলিশ সুপার আরিফ এবং আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার সতর্কতার সঙ্গে অতিথিদের পরীক্ষা করে দেখছেন দস্যু বনহুর ছদ্মবেশ ধারণপূর্বক তাদের এ উৎসবে আগমন করেছে কিনা।

কেউ কেউ ছুটেছেন মিঃ জাফরীর সন্ধানে।

একটা থামের আড়ালে এসে দাঁড়ালো গোমেশ। চোখেমুখে তার ফুটে উঠেছে একটা কুৎসিত হিংসামূলক ভাব। পকেটে ডান হাত রেখে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলো সে মঞ্চের দিকে।

রহমান ঠিক তার পিছনে আর একটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করে গোমেশকে লক্ষ্য। করছে। তারও ডান হাতখানা প্যান্টের পকেটে প্রবেশ করানো আছে।

প্রখ্যাত গোয়েন্দা মিঃ লাউলং পর্যন্ত মিঃ কাওসার সাহেবের বীণার সুরে আত্মহারা হয়ে। পড়েছেন। ভুলে গেছেন তিনি দস্যু বনহুর সন্ধানে এ উৎসবের আয়োজন, তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছেন।

এমন সময় হঠাৎ আলো নিভে গেলো সঙ্গে সঙ্গে গুলির শব্দ শোনা গেলো। একটা তীব্র আর্তনাদ ভেসে উঠলো নানা রকম গুজন ধ্বনি ভেদ করে।

 মিঃ আরিফের উচ্চ কণ্ঠ শোনা গেলে–আপনারা বিচলিত হবেন না। যে যেখানে আছেন বসে থাকুন।

সব কণ্ঠ ছাপিয়ে মিঃ লাউলং এর গলা শোনা গেলো তিনি চিৎকার করে বললেন–নিশ্চয়ই। দস্যু বনহুর আমাদের উৎসবে এসেছে, তারই কাজ এটা। আপনারা সবাই নিজ নিজ শরীর সাবধানে রক্ষা করুন।

মিঃ হাসানের কণ্ঠ–মেইন সুইচ অফ করে দেওয়া হয়েছে। তাই এই অন্ধকার। আমরা এক্ষুণি আলোর ব্যবস্থা করছি।

মিঃ হাসিম রিজভীর গলা শোনা গেলো-ইরানি, ইরানি—

 অল্প কিছুক্ষণ পরই আলো জ্বলে উঠলো।

সবাই দেখলো, মঞ্চের পাশে দণ্ডায়মান একটি পুলিশ রক্তাক্ত দেহে মঞ্চের উপর পড়ে আছে।

মিঃ কাওসারী এবং মিস হামিদা রিজভীও নেই। বীণাটাও পড়ে আছে মঞ্চের পাশে।

পুলিশ অফিসারগণ সবাই হতভম্ব। এ কি কাণ্ড ঘটে গেলে কোথায় তারা দস্যু বনহুরকে এই উৎসবে গ্রেপ্তার করবে কিন্তু ঘটলো বিপরীত।

মিঃ হাসিম রিজভীর দু’চোখ যেন আগুনের গোলার মত জ্বলছে। বিপুল দেহ নিয়ে কঠিন কণ্ঠে বললো–আপনারা পুলিশের লোক কোনো কাজের নয় শেষ পর্যন্ত আমার মেয়েটাকেও হারালাম।

মিঃ আরিফ ব্যস্তকণ্ঠে বললেন–নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়ছেন মিস হামিদা।

না, তাকে দস্যু বনহুর নিয়ে ভেগেছে।

 দস্যু বনহুর! সবাই অবাক কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করলো।

মিঃ হাসিম রিজভী বলে উঠলো–মিঃ কাওসারী, ফারহার পুলিশ সুপার নয়, সেই দস্যু বনহুর। দেখছেন না সে পুলিশ পাহারাদার কে হত্যা করে আমার কন্যাকে নিয়ে ভেগেছে।

মিঃ লাউলং মিঃ হাসিম রিজভী বেশি মনসুর ডাকুর জামার কলার চেপে ধরলেন–তিনি দস্যু বনহুর, এ কথা আপনাকে কে বললো?

আমি তাকে চিনি!

 কি বললেন, আপনি দস্যু বনহুরকে চেনেন অথচ চিনেও বলেননি কেন?

বলিনি, বললে হয়তো আপনারা আমাকে সন্দেহ করতেন–

ঠিক সেই মুহূর্তে মিঃ রুস্তম বেশি রহমান পিস্তলসহ গোমেশ কে টানতে টানতে নিয়ে এলো, বললো সে–স্যার, এই লোকটা পাহারারত পুলিশ টিকে হত্যা করেছে। এই দেখুন, এর হাতের পিস্তল পরীক্ষা করে দেখুন।

সঙ্গে সঙ্গে গোমেশের চারপাশে সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স ঘিরে ফেললো, পিস্তলখানা ওর হাত থেকে কেড়ে নিলেন মিঃ আরিফ।

 মিঃ রুস্তম–বেশি রহমান এবার মনসুর ডাকুর বুকের কাছে তার নিজ পিস্তল চেপে ধরে বললো–স্যার, একেও গ্রেপ্তার করুন। এটাই হলো দস্যু বনহুরের প্রধান অনুচর—এই দেখুন, এর মুখের দাড়ি সব নকল। একটানে ওর দাড়িগোছা খুলে নিলো।

মনসুর ডাকু বন্দী হিংস্র জন্তুর মত রুস্তম বেশি রহমানের গলা টিপে ধরতেই মিঃ লাউলং নিজে মনসুর ডাকুর বুকে রিভলভার চেপে ধরলেন–হ্যাণ্ডস্ আপ।

মনসুর ডাকু বাধ্য হলো হাত উঠাতে।

গোমেশের হাতে ততক্ষণে হাতকড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এবার খোলস খুলে পড়লো, মিঃ হাসিম রিজভীর জায়গায় মনসুর ডাকু গ্রেপ্তার হলো। কিন্তু পুলিশ মহল জানলো দস্যু বনহুরের দু’জন অনুচরকে তারা গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন।

একজন পুলিশ নিহত হওয়ায় যদিও পুলিশ মহলে একটা গভীর শোকের ছায়া নেমে এলো তবু তারা স্বস্তি পেলো দস্যু বনহুরের অনুচর দু’জনকে বন্দী করতে পেরে।

মনসুর ডাকু এবং গোমেশ নানারকম কৌশলে এই উৎসবের আয়োজন করতে পুলিশ মহলকে বাধ্য করেছিলো। উদ্দেশ্য দস্যু বনহুরকে বন্দী নয় হত্যা করা কিন্তু বিপরীত ফল ফললো। যারা ফাঁদ পেতেছিলো তারাই ফাঁদে আটকে পড়লো।

মনসুর ডাকু এবং গোমেশের জামার ভিতর থেকে যে সব মারাত্মক অস্ত্র শস্ত্র বের হলো তারপর তাদের উপর কোনো রকম বিশ্বাস চলে না। লৌহ শিকলে আবদ্ধ করা হলো, হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ি। দস্যু বনহুরের অনুচর, কাজেই পুলিশ মহলের সাবধানতার অন্ত রইলো না।

 এখানে যখন পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণে উৎসবমঞ্চে মহাহুলস্থুল তখন মিঃ কাওসারী বেশি দস্যু বনহুর তার গাড়িখানা স্পীডে চালিয়ে চলেছে।

গাড়ির পিছন আসনে মিঃ হামিদা রিজভী-বেশি ইরানি বসে রয়েছে চিত্রার্পিতের ন্যায় স্থির হয়ে। তার হাত দুখানা পিছ মোড়া করে মজবুতভাবে বাঁধা। মুখেও রুমাল গুঁজে দিয়েছে বনহুর যেন চিৎকার করতে না পারে।

শহরের নির্জন পথ ধরে বনহুর গাড়ি চালাচ্ছিলো। এসব পথে বড় একটা বেশি যানবাহন। চলাচল করে না। ক্কচিৎ দু’একজন পথচারী পায়ে হেঁটে এদিক-সেদিক যাওয়া-আসা করে।

বনহুর সাবধানে গাড়ি চালিয়ে চলেছে।

পিছনে ইরানি পুতুলের মত বসে আছে। সে ভেবে পাচ্ছে না এই পুলিশ অফিসার তাকে নিয়ে কোথায় চলেছে। কিই বা তার উদ্দেশ্য তাই বা কে জানে!

ইরানি ভাবছে, সে তো সুন্দর গান গাইছিলো। মিঃ কাওসার রিজভীর বীণার সুর তার কণ্ঠকে আরও যেন অপূর্ব করে তুলেছিলো। হঠাৎ এমন হলো কেন? তবে সে জানতো, তার বাপু দস্যু বনহুরকে হত্যার কারণেই সেখানে গমন করেছিলো। আলোটা যে হঠাৎ অফ হয়ে গেলো তার পিছনেও ছিলো তার বাবার ইংগিত। গুলীর শব্দ শুনবার জন্য প্রস্তুত ছিলো সে।

কিন্তু সে ভাবতে পারেনি মিঃ কাওসারী তাকে এমনভাবে হঠাৎ হরণ করবে। অন্ধকার হবার সঙ্গে সঙ্গে ইরানি অনুভব করলো কাউসারী তাকে ধরে ফেলেছে এবং মুহূর্ত বিলম্ব না করে মুখে রুমাল গুঁজে দিয়ে হাতের উপর তুলে নিয়েছে তার দেহটা।

জাপটা জাপটি করতে গিয়ে পারেনি মিঃ কাওসারীর বলিষ্ঠ হাতের মুঠকে সে এতটুকু শিথিল করতে। নীরব থাকা ছাড়া উপায় ছিলো না ইরানির।

 আশ্চর্য না হয়ে পারে না ইরানি কি ভয়ঙ্কর পুলিশ বাহিনির বেষ্টনি ভেদ করে তাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে মিঃ কাউসারী। গাড়িতে তাকে বসিয়ে দ্রুত চেপে বসেছিলো সে ড্রাইভিং আসনে। ইরানি যত ভাবে, ততই যেন হতবাক হয়-কে এই মিঃ কাউসারী?

 মিঃ কাওসারীর গাড়িখানা তখন একটি নির্জন বাংলোর সম্মুখে এসে থেমে পড়েছে।

[পরবর্তী বই নির্জন বাংলোর অভ্যন্তরে]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *