কাপালিক ও দস্যু বনহুর

কাপালিক ও দস্যু বনহুর

আরও কয়েকদিন কেটে গেলো, এবার হোটেলেই নরহত্যা শুরু হয়েছে। প্রতিদিন একটি নয়, তিন-চারটি মস্তকহীন লাশ হোটেলের অভ্যন্তরে পাওয়া যায়।

পুলিশফোর্স সতর্ক পাহারা থেকেও এই নরহত্যার কোনোই হদিস খুঁজে পেলো না।

বনহুর পূর্বের চেয়ে আরও গম্ভীর হয়ে পড়েছে।

রহমান ভেবে পায় না তার সর্দার হঠাৎ এমন শান্ত আর গম্ভীর হলেন কেন।

হোটেলের জনসংখ্যা কমে গেছে একেবারে।

রহমান ভীত আতঙ্কগ্রস্ত, না জানি কোন্ মুহূর্তে তাদের দেহ থেকেও মস্তক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কে জানে! একদিন রহমান বনহুরকে বললো- সর্দার, এ হোটেল ত্যাগ করাই এখন আমাদের পক্ষে সমীচীন। বাইরে কোথাও থেকে কাপালিকের সন্ধান করলে হয় না কি?

বনহুর সিগারেট পান করছিলো, বললো– প্রাণ বাঁচানোর জন্য অন্যত্র গমন করা আমাদের শোভা পায় না রহমান। তুমি ভেবে দেখো, এভোগুলো লোক প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে আর আমরা এদের ছেড়ে দূরে সরে যাবো! কাপালিক আর বেশিদিন নরহত্যা করবার সুযোগ পাবে না।

সর্দারের কথায় রহমান সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিন্ত হতে পারলো না, কারণ সে এই কদিনে বিশেষভাবে বুঝতে পেরেছে কাপালিক শুধু ভয়ঙ্করই নয়, সে নররাক্ষসের চেয়েও সাংঘাতিক।

 সেইদিন গভীর রাতে রহমান হঠাৎ জেগে উঠলো, পাশে নজর পড়তেই চমকে উঠলো বিস্ময়ে– সর্দার নেই, বিছানা শূন্য!

 রহমান এই কদিনে রাতে একটি বারের জন্যও ঘুমাতো না, সে সব সময় জেগে থাকতো সতর্কভাবে। তার সদা-সর্বদা আতঙ্ক সর্দারকে নিয়ে। কখন সর্দার একা ক্যাবিন ত্যাগ করে বেরিয়ে যাবে আর তাকে হত্যা করে বসবে কাপালিক পাষণ্ড।

 রহমান তাই এক মুহূর্তের জন্য রাতে নিদ্রা যেতো না কিংবা বিশ্রাম আশায় শয্যা গ্রহণ করতো না।

সর্দারকে লক্ষ্য রাখাই ছিলো রহমানের মূল উদ্দেশ্য, যদিও সে নিজে সর্দারকে কাপালিক হত্যার জন্যই মরিলা দ্বীপে নিয়ে এসেছে; তবুও সে কেমন যেন সদা আগলে রাখতে চাইতো সর্দারকে।

 রহমানের মনোভাব বুঝতে পেরে একদিন হেসে বলেছিলো বনহুর– তুমি সব সময় আমাকে নিয়ে এতো ভাবো কেন রহমান?

রহমান বনহুরের কথায় জবাব দিয়েছিলো– সর্দার, কাপালিক হত্যা করতে এসে যদি আপনার কোনো কিছু ঘটে যায় তাহলে আমি কোন্ মুখ নিয়ে ফিরে যাবো কান্দাই, কোন মুখ নিয়ে আমি বৌ-রাণীর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াবো।

বনহুর রহমানের কথায় হো হো করে হেসে উঠেছিলো, তারপর হাসি থামিয়ে বলেছিলো আজকাল তোমরা দেখছি বড্ড দুর্বলমনা হয়ে পড়েছে। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলো রহমান, দস্যু বনহুর মরণকে কোনো সময় ভয় করে না। তুমি তারই প্রধান অনুচর, কাজেই তুমি নিজেও মরণের জন্য কোনো মুহূর্তে নার্ভাস হবে না।

রহমান কোনো জবাব দিতে পারেনি, মাথা নিচু করেছিলো সর্দারের কথায়।

আজ সর্দারের বিছানা শূন্য দেখেই আতঙ্কিত হলো রহমান। সে শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো। অতি সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো সে বাইরে। তাকালো চারিদিকে, কোথাও কিছু নজরে পড়লো না। সর্দার হয়তো এলিনের কামরায় গেছে মনে করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে চললো। রহমান। সমস্ত হোটেল নীরব নিস্তব্ধ, কোথাও জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই– লণ্ঠনগুলো টিমটিম করে জ্বলছে।

 রহমানের দক্ষিণ হস্তে রিভলভার। অন্ধকারে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে পড়লো। এলিনের দরজায় এসে দাঁড়ালো সে, মৃদু চাপ দিতেই দরজা খুলে গেলো। অবাক হলো রহমান কামরা শূন্য, এলিন কামরায় নেই! তার সর্দার কোথায় গেছে কে জানে!

 আজ প্রথম রহমান এলিনের ক্যাবিনে প্রবেশ করলো। সুন্দর পরিচ্ছন্নভাবে ক্যাবিনখানা সাজানো। একপাশে একটি খাট, খাটের পাশেই টেবিল। টেবিলে খান কয়েক বই সুন্দর করে সাজানো। একটা ফুলদানীতে ফুল রয়েছে। একটা কাঁচের গেলাস আর একটা বোতলও রয়েছে। ফুলদানীর পাশে রহমান স্পষ্ট বুঝতে পারলো, এলিন বা কেউ একটু পূর্বে এই ক্যাবিনে মদ পান করেছে। গেলাসে এখনও মদের কিছুটা পড়ে রয়েছে দেখতে পেলো সে।

হঠাৎ রহমান ঝুঁকে গেলাসটা যেমন হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখবে ঠিক সেই মুহূর্তে কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করে চমকে উঠলো। মুখ ফিরাতেই অস্ফুট শব্দ করে উঠলো– সর্দার…..

তার পিছনে দণ্ডায়মান দস্যু বনহুর। দক্ষিণ হস্তে তার রিভলভার, বাম হস্তখানা রেখেছে রহমানের কাঁধে। রহমান অস্ফুট শব্দ করে উঠতেই বনহুর বাম হস্তের আংগুলখানা ঠোঁটের উপর রেখে চাপা স্বরে বললো –চুপ! এসো আমার সঙ্গে।

রহমান সর্দারকে অনুসরণ করলো।

বনহুরের দেহে জমকালো ড্রেস, মাথায় পাগড়ি, পাগড়ির খানিকটা অংশ দিয়ে মুখের নিচের ভাগ ঢাকা রয়েছে। বনহুর নিঃশব্দে অগ্রসর হলো। ওপাশের দেয়ালের কাছে এসে দাঁড়ালো এবার।

রহমান আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছে সর্দারকে।

দেয়ালের পাশে একটি মডেল দাঁড় করানো রয়েছে। একটি অর্ধ-উলঙ্গ নারীমূর্তি সেটা। বনহুর মডেলের দক্ষিণ হস্তে মৃদু চাপ দিতেই দেয়ালের সামান্য ফাঁকের সৃষ্টি হলো।

বনহুর সেই কিঞ্চিৎ ফাঁকে দৃষ্টি রেখে ঝুঁকে দাঁড়ালো।

রহমান তখন সর্দারের মুখোভাব লক্ষ্য করছিলো। সে দেখলো, বনহুরের চোখমুখে দারুণ এক বিস্ময় ফুটে উঠেছে। অদ্ভুত হয়ে উঠেছে তার চোখ দুটো।

বনহুর এবার রহমানকে ইংগিত করলো সেই ফাঁকে দৃষ্টি রাখতে।

রহমান দেয়ালের ফাঁকে দৃষ্টি রাখতেই আড়ষ্ট হয়ে গেলো যেন ভয়ে-বিষ্ময়ে চিৎকার করতে যাচ্ছিলো, নিজের মুখে হাত-চাপা দিয়ে মৃদু স্বরে বললো- সর্দার, কি ভয়ঙ্কর…

বনহুর বললো- কাপালিক!

রহমান বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখছে, একটা বিরাট চেয়ারে বসে আছে রাক্ষসের মত এক বিরাটদেহী মানুষ। তার মুখে চোখে এক ভয়ঙ্কর ভাব ফুটে উঠেছে, সমস্ত মুখে লম্বা দাড়ি গোঁফ গুলো ঝুলে পড়েছে চোখের উপর। দাঁতগুলো ঠোঁটের উপর বেরিয়ে আছে। সমস্ত দেহেও একরকম লম্বা খাড়া খাড়া চুল। হাত এবং পাগুলো যেন এক-একটা থামের মত মোটা।

কাপালিক দুলছে বসে বসে। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়ালো তারপর ক্ষিপ্রগতিতে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

রহমান ভয়ে-বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে, অস্ফুট কণ্ঠে বললো– সর্দার, কাপালিক বেরিয়ে গেলো…..

হাঁ রহমান, কাপালিক রক্তের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে, তাই সে রক্ত পান করতে গেলো।

সর্দার।

 আজ সে হোটেলেই কাউকে হত্যা করে রক্ত পান করবে।

সর্দার আপনি………..

সব আমি জানি রহমান! চুপ করে দাঁড়াও, তারপর আরও জানতে পারবে।

রহমান দেয়ালের ফাঁকে দৃষ্টি রাখতেই বলে উঠলো- একি, এলিনকে দেখছি যে? ওর হাতে একটা সিরিঞ্জ দেখছি না?

হ, সিরিঞ্জই বটে। চুপ করে দাঁড়াও রহমান, আজ সব তুমি নিজ চোখে দেখতে পাবে।

রহমান আর বনহুর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, দৃষ্টি তাদের দেয়ালের ফাঁকে পাশের কামরায় সীমাবদ্ধ।

এলিন সিরিঞ্জখানা নিয়ে কিছু যেন করছে বলে মনে হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ দমকা ঝড়ের মত কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে কাপালিক।

বনহুর বলে উঠলো–সর্বনাশ……….

বনহুরের কথা শেষ হয় না, কাপালিককে দেখবামাত্র এলিন আর্তনাদ করে উঠলো– আ!–সে কি প্রাণফাটা তীব্র চিৎকার!

রহমানের মুখ মুহর্তে ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো।

বনহুর আর রহমান দেখলো–কাপালিক কক্ষে প্রবেশ করেই এলিনকে ধরে ফেললো, সঙ্গে সঙ্গে কোমরে বাঁধা খৰ্গখানা খুলে নিয়ে বসিয়ে দিতে গেলো এলিনের কণ্ঠদেশে কিন্তু সেই দণ্ডে বনহুর এলিনের কামরায় মডেলটার দক্ষিণ হস্তে খুব জোরে চাপ দিলো। মুহূর্তে দেয়ালের ফাঁকটা প্রশস্ত হয়ে গেলো। বনহুর রিভলভার হস্তে তীরবেগে প্রবেশ করলো সেই কামরায়।

 এত দ্রুত বনহুর কাজ করলো যে, কাপালিকের খর্গ এলিনের কণ্ঠদেশ ছেদন করবার পূর্বেই সে কাপালিক আর এলিনের সম্মুখে এসে পরপর কয়েকটা গুলী ছুঁড়লো কাপালিকের বুক লক্ষ্য করে।

কাপালিক মুহূর্তে ফিরে দাঁড়ালো এবং সঙ্গে সঙ্গে খৰ্গ নিয়ে আক্রমণ করলো বনহুরকে।

 রহমান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে, সর্দারের রিভলভারের গুলী কাপালিকের বক্ষে বিদ্ধ না হয়ে ঠিকরে পড়লো তার চারপাশে কি আশ্চর্য, কাপালিক একটুও টলবে না!

কাপালিক খর্গ নিয়ে বনহুরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই বনহুর সরে দাঁড়ালো বিদ্যুৎগতিতে।

কাপালিক হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো ভূতলে।

বনহুর এবারও এরপর দুটো গুলী ছুঁড়লো কিন্তু একটুও কাবু হলো না কাপালিক। সে ভীষণ আকার ধারণ করে খর্গ তুলে ধরলো বনহুরের দিকে।

 রহমান শিউরে উঠলো, হাতের পিঠে চোখ দুটো ঢেকে ফেললো সে। পরক্ষণেই রিভলভারের আওয়াজ পেয়ে রহমান চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো– দেখলো সর্দার আর কাপালিকের ভীষণ ধস্তাধস্তি চলেছে। রহমান আরও লক্ষ্য করলো– কাপালিক হস্তে খর্গখানা নেই, হাতখানা খুলছে একপাশে, রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে কাপালিকের দেহটা।

এলিন এক পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে তার গোটা মুখমণ্ডল।

বনহুরকে ভূতলে ফেলে কাপালিক চেপে ধরলো তার গলা। এবার বনহুর মরিয়া হয়ে উঠলো, চোখ দুটো ঠিকরে বের হয়ে আসছে যেন।

কাপালিক তার হাত দু’খানা দিয়ে ভীষণভাবে চাপ দিচ্ছে বনহুরের গলায়। বনহুর তার দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে কাপালিকের হাত থেকে নিজের গলাটাকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে চলেছে।

 রহমান বুঝতে পারলো, কাপালিকের হাত হতে সর্দার বুঝি এ যাত্রা রক্ষা পাবে না। রহমান তীব্র চিৎকার করে ছুটে এলো কক্ষমধ্যে।

 ঠিক সেই মুহূর্তে এলিন তার হস্তস্থিত সিরিঞ্জে পাশের ক্যাবিন থেকে কিছু তরল পদার্থ পূর্ণ করে ছুটে এসে কাপালিকটার পিঠের বাম পাশে পুশ করে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়কর একটা ঘটনা ঘটে গেলো। কাপালিক তীব্র চিৎকার করে ঢলে পড়লো মেঝেতে।

তৎক্ষণাৎ বনহুর উঠে দাঁড়ালো।

 রহমান অস্ফুট শব্দ করে উঠলো– সর্দার!

 বনহুর তাকালো রহমানের মুখে, তারপর এলিনের একখানা হাত চেপে ধরলো।

এলিন রীতিমত হাঁপাচ্ছে, ঘেমে উঠেছে ওর মুখমণ্ডল। ঢোক গিলে বললো– মিঃ সোহেল, ওকে আমি শেষ করে দিয়েছি। আর উঠতে পারবে না।

বনহুর আর রহমান তাকিয়ে দেখলো, কাপালিকটা দু’চোখ বড় বড় করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। হাত-পা গুলো বলির পাঠার মত আছাড় খাচ্ছে ওর। রিভলভারের শব্দ সমস্ত হোটেলে ছড়িয়ে পড়লেও কেউ বাইরে বের হবার সাহসী হলো না। সবাই ভীত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যার যার ক্যাবিনে বসে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। কারো এতোটুকু সাহস নেই যে, বাইরে এসে। দেখে কোথা থেকে এই গুলীর শব্দে আসছে। এ হোটেলের অভ্যন্তরেই যে কোথাও একটা প্রলয় কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে তা বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছে সবাই।

নিজ নিজ ক্যাবিনে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে চলেছে সকলে। এ ক’দিনে বহুলোক হোটেল ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলো। যারা অত্যন্ত অনুপায় তারাই রয়ে গিয়েছিলো হোটেলে।

 মরিল দ্বীপ জুড়ে এই একটি মাত্র হোটেল। এই দ্বীপে যারা আগমন করে তারা প্রায় সকলেই আশ্রয় নেয় এই হোটেলে। কাপালিকের অত্যাচারে মরিলা দ্বীপবাসী যখন অস্থির তখন মরিলা দ্বীপের বাসিন্দা অনেকেই তাদের বাড়ি ঘর ত্যাগ করে এই হোটেলটিকে নিরাপদ স্থান মনে করে আশ্রয় নিয়েছিলো, কিন্তু এখানে এসেও তারা প্রাণ বাঁচাতে পারেনি, কাপালিক হস্তে অনেকেই জীবন দিয়েছে।

মরিলা দ্বীপবাসিগণ যখন অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করেছিলোসন্ধ্যার পর একটি প্রাণীও যখন পথঘাটে চলাফেরা বন্ধ করে গৃহমধ্যে অতি সতর্কভাবে আত্মগোপন করেছিলো তখন দ্বীপে নরহত্যা কমে এসেছিলো অনেক পরিমাণে। কিন্তু হোটেলে বেড়ে গিয়েছিলো ভীষণভাবে।

ভয়ে হোটেল ত্যাগ করে পালাতে শুরু করেছিলো সবাই। এমনি এক রাতে এই ঘটনা ঘটলো মরিলা দ্বীপ হোটেলের নিচের গোপন এক কক্ষে।

ভয়ঙ্কর কাপালিকের-দেহটা কিছুক্ষণের মধ্যেই অসাড় নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো।

বনহুর বললো এবার কাপালিক চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লো, আর সে জাগবে না। যাও রহমান, হোটেলের সবাইকে সংবাদ জানিয়ে দাও এবং সবাইকে ডেকে আনন।

রহমান যেন একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলো। সে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, কাপালিকের দেহটার দিকে তাকিয়ে আছে সে বোবাদৃষ্টি মেলে। সর্দারের কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় সে, বলে–সর্দার, কাপালিকটা সত্যি মরলো?

হাঁ, সত্যি কাপালিক মৃত্যুবরণ করেছে। সে আর নরক্ত পান করবার জন্য নরহত্যায় প্রবৃত্ত হবে না।

 রহমান বেরিয়ে যায়।

 অল্পক্ষণের মধ্যেই হোটেলের নিমতলায় সবাই এসে ভীড় করে দাঁড়ায়। সকলের মুখেই একটা উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটে উঠেছে–ভয়-ভীতি আর আনন্দ নিয়ে সকলে ঠেলাঠেলি শুরু করে দেয়। সবাই বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে কাপালিক মৃত্যুবরণ করেছে, এ যেন এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার!

সবাই এসে ঘিরে দাঁড়ালো কক্ষটার মধ্যে।

বনহুর সবাইকে লক্ষ্য করে বললো–আপনারা এখন নিশ্চিন্ত। কাপালিক আর আপনাদের হত্যা করতে আসবে না।

সকলে একসঙ্গে আনন্দধ্বনি করে উঠলো।

বনহুর বললো–আজ আপনারা বিপদমুক্ত হলেন, এজন্য মিস এলিনকে ধন্যবাদ দিন। তিনিই ঐ কাপালিক-দেহে বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করে তাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছেন।

এলিনের হাতে তখনও সিরিঞ্জটা ধরাই ছিলো, সে বলে উঠলোকাপালিক হত্যা ব্যাপারে আমার চেয়ে মিঃ সোহেল বেশি ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। এই বিষাক্ত ইনজেকশন তিনিই আমাকে দিয়েছিলেন এবং কিভাবে এটা কাপালিক দেহে পুশ করতে হবে তাও তিনিই আমাকে নিপুণভাবে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তাই আজ আমি এই নরখাদক কাপালিক হাত থেকে উদ্ধার পেলাম। শুধু আমিই নই সমস্ত মরিলা দ্বীপবাসী এবং দ্বীপের আশেপাশের জনগণও এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার লাভে সক্ষম হলো।

রহমান স্তব্ধ নিশ্বাসে শুনছিলো এলিনের কথাগুলো। হোটেলের অন্য সকলেও বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখছিলো আর এলিনের কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলো মনোযোগ সহকারে। এবার হোটেলের ম্যানেজার বলে উঠলো– সবাইকে দেখছি কিন্তু মালিক কোথায়?

রহমানও বললো– তাইতো, হাউবার্ডকে দেখছি না তো?

সকলেই মিঃ হাউবার্ডের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।

বনহুর বললো– আপনাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই, এক্ষুণি আপনারা আপনাদের হোটেলের মালিক হাউবার্ডকে দেখতে পাবেন।

সবাই অবাক হয়ে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। বনহুর বললো– আপনারা হয়তো অবাক হয়েছেন কাপালিক এখানে এলো কেমন করে? তাছাড়া এ-কক্ষটা আপনাদের কারো পরিচিত কক্ষ নয়। হোটেলের নিচে এটা অত্যন্ত গোপন কক্ষ। এই কক্ষটা হাউবার্ডের ল্যাবরেটরী কক্ষ। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করে দেখতে পাচ্ছেন, কক্ষের চারদিকে অনেক বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম সাজানো রয়েছে। এগুলো অত্যন্ত মারাত্মক ওষুধ তৈরির সরঞ্জাম এবং মেসিনপত্র। হাউবার্ড দিনে এ ক্যাবিনে কোনো সময় প্রবেশ করতেন না, তিনি গভীর রাতে এই ক্যাবিনে প্রবেশ করে ল্যাবরেটরীর কাজে আত্মনিয়োগ করতেন। এমন একটা ওষুধ তিনি তৈরি করেছিলেন যা মানুষের দেহে পুশ করে দেবার কয়েক মিনিট পর মানুষটি অদ্ভুত শক্তি লাভ করতো এবং সঙ্গে সঙ্গে তার আকার দেহের দেড়গুণ বেড়ে যেতো। আর একটি নেশায় উন্মুক্ত হয়ে উঠতো সে–তা হলো রক্তের নেশা।

থামলো বনহুর।

 কক্ষমধ্যেই সবাই স্তব্ধ নিশ্বাসে বনহুরের কথা শুনে যাচ্ছিলো। বললো বনহুর আবার–সেই মারাত্মক ওষুধ তৈরি নিয়ে মেতে উঠেছিলেন হাউবার্ড। তাকে বাধ্য হয়ে সহযোগিতা করতে হতো তার কন্যা মিস এলিনকে। আপনারা অনেকেই জানেন না, মিস এলিন হাউবার্ডের আপন কন্যা নয়। তাকে কোনো দূরদেশ থেকে চুরি করে আনা হয়েছিলো। এই তরুণীটিকে তিনি সত্যি স্নেহ। করতেন, এবং তাকে দিয়েই তার ঐ মারাত্মক ওষুধ নিজ শরীরে পুশ করিয়ে নিতেন—

 বনহুরের কথার মধ্যেই সবাই অস্ফুট গুঞ্জনধ্বনি করে উঠলো, মিঃ হাউবার্ডই তাহলে—

বনহুর স্থিরকণ্ঠে বললোহা, মিঃ হাউবার্ডই নররক্ত পান কারী ভয়ঙ্কর এই কাপালিক। কথাটা বলেই বনহুর ভুলুষ্ঠিত কাপালিকের মুখ থেকে টান দিয়ে একটা বিকট আকার মুখোস খুলে নিলো। তারপর দেহ থেকেও খুলে ফেললো একটা লোমশওয়ালা বর্ম। বনহুর বাম হস্তে মুখোস আর দক্ষিণা হস্তে বর্মটা উঁচু করে ধরে বললো–এই বর্ম পরে মিঃ হাউবার্ড কাপালিকের আকার ধারণ করে নরহত্যা এবং নররক্ত পান করে বুকের জ্বালা নিবারণ করতো।

কক্ষমধ্যে সবাই তখন নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে আছে হাউবার্ডের প্রাণহীন বিরাট মোটা দেহটার দিকে। সকলের চোখেমুখে বিস্ময়। তারা নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

হোটেলের ম্যানেজার অত্যন্ত ভদ্র এবং মহৎ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কাপালিকের ভয়ে ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। না জানি কখন আবার হোটেলে কার দেহ থেকে মুন্ড বিচ্ছিন্ন হবে, এটাই ছিলো তার সবচেয়ে বড় চিন্তা।

কাপালিক নিহত হলো এবং সে আর কাউকে হত্যা করতে সক্ষম হবে না। এখন থেকে তার হোটেলই শুধু নয়, সমস্ত মরিলা দ্বীপবাসী নিশ্চিন্ত হলো  অনাবিল শান্তিতে ভরে উঠলো ম্যানেজার মিঃ কিউস্মিথের মন। তিনি বনহুরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন–মিঃ সোহেল, আপনার বুদ্ধি কৌশলগুণেই আমরা এতবড় একটা ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে উদ্ধার পেলাম। আপনাকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু আর একটি কথা আমি বলছি, কাপালিক মিঃ হাউবার্ড যে লোকগুলোর মস্তকছিন্ন করে রক্ত পান করতো সেই মস্তকগুলো কোথায়?

বনহুর এবার এগিয়ে গেলো কক্ষটার পূর্বদিকের দেয়ালের পাশে, তারপর বললো– আপনারা এবার দেখতে পাবেন কাপালিক ছিন্ন মস্তকগুলো কোথায় জমা করে রেখেছিলো–সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের এক স্থানে একটি সুইচে হাত রেখে চাপ দিলো, অমনি দেয়ালটা সরে গেলো এক পাশে।

কক্ষমধ্যে সকলেই ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলো–সর্বনাশ, একি দেখছি–দু’হাতে কেউ কেউ চোখ ঢেকে ফেললো।

সবাই যেন জমে গেছে পাথরের মূর্তির মত। দেয়ালের ওপাশে স্তূপাকার নরমুন্ড জমা হয়ে আছে। কত লোককে এই হাউবার্ড হত্যা করেছে তার কোনো হিসাব নেই।

বনহুরের মনে পড়লো রাণী দুর্গেশ্বরীর কথা। সেও তার গোপন একটি কক্ষে বহু নরকঙ্কাল জমা করে রেখেছিলো। হয়তো এর পিছনে কোনো উদ্দেশ্য ছিলো যা তারা কেউ জানে না।

 খবর পেয়ে পুলিশ সুপার এবং পুলিশ অফিসারগণ সবাই এসে হাজির হলেন মরিলা হোটেলে। কাপালিক নিহত হয়েছে জেনে তারা আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন।

সব জানতে পারলেন তারা মিঃ সোহেলের কাছে। মিঃ হাউবার্ডই যে কাপালিক জেনে বিস্ময়ের সীমা রইলো না কারো। পুলিশ সুপার এবং অফিসারগণ সবাই হাউবার্ডের লাশ পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন।

*

মরিলা হোটেলকক্ষে বিশ্রাম করছে দস্যু বনহুর।

অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ তাকে সচ্ছ-স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। শয্যায় শয়ন করে নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট পান করে চলেছে সে। মরিলা দ্বীপের কাজ তার শেষ হয়েছে, এবার তারা কান্দাই ফিরে যাবে।

রহমানও বসে ছিলো তার পাশে একটা আসনে। আজ তাকেও প্রসন্ন লাগছে। কাপালিক হত্যা ব্যাপার নিয়েই রহমান সর্দারকে এই মরিলা দ্বীপে এনেছিলো এবং যতক্ষণ কাপালিকটাকে হত্যা করতে না পেরেছিলো ততক্ষণ তার মনে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলো না। আজ রহমানের বুক থেকে একটা পাষাণভার যেন নেমে গেছে।

বনহুর তার হস্তস্থিত সিগারেটটা এ্যাসট্রের মধ্যে খুঁজে রেখে বালিশ টেনে উবু হয়ে শুয়ে পড়লো, তারপর বললো–রহমান, কাপালিক হত্যা-ব্যাপারে আমাকে অনেক বেখাপ্পা কাজ করতে হয়েছে যা তোমাকে বেশ কৌতূহলী করে তুলেছিলো, আর করেছিলো সন্দিহান।

থামলো বনহুর।

রহমান এতোক্ষণ নিশ্চুপ বসে আবোল তাবোল ভাবছিলো। সর্দার এ সময়ে তাকে নিজের বিশ্রাম ক্যাবিনে কেন ডেকেছেন তাও ভালভাবে বুঝতে পারছিলো না। বনহুরের কথায় সোজা হয়ে বসলো রহমান, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো সে সর্দারের মুখের দিকে।

বনহুর বললো–মিস এলিনের সহযোগিতা না পেলে আজ কাপালিক হত্যা কিছুতেই সম্ভব। হতো না এবং এই নরহত্যা রহস্য উদ্মাটন হতো না। মিস এলিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে ওকে। আয়ত্তে এনে তবেই আমি সব গোপন রহস্য জানতে পারি। জানতে পারি মরিলা হোটেলের মালিক মিঃ হাউবার্ডই কাপালিক।

রহমান বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে ছিলো বনহুরের দিকে, সে যেন সর্দারের কথাগুলো গিলছিলো একটির পর একটি করে।

 বনহুর বলেই চলেছে–মিস এলিনের সঙ্গে আমাকে শুধু মিশতেই হয়নি, তার সঙ্গে আমাকে রীতিমত প্রেমের অভিনয় করতে হয়েছে। রহমান, আমি নিজের কাছে নিজেই অপরাধী, কারণ আমি এলিনের সঙ্গে মিথ্যা অভিনয় করলেও সরল প্রাণা এলিনা আমাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছে—

 বনহুর নিজের অজ্ঞাতেই যেন আনমনা হয়ে যায়, কিছু যেন ভাবে সে মনোযোগ সহকারে। তারপর বলে আবার– এলিন এখন নিঃসহায়, আত্মীয়হীন–ওকে কি করা যায় বলো?

রহমান জবাব দিলো–ওকে ওর দেশে পাঠিয়ে দিলে হয় না?

বনহুর বিছানায় উঠে বসলো, বালিশটা কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে ভাল হয়ে বসে বললো– রহমান, তুমি জানো না সে কতখানি অসহায়! তাকে দূর কোনো দেশ থেকে চুরি করে আনা হয়েছিলো। এত ছোট বেলায় তাকে চুরি করে আনা হয়েছিলো যখন তার কোনোরকম জ্ঞান। হয়নি। সে জানতো না তার নাম কি, জানতো না কি তার পরিচয়–

বনহুরের কথা শেষ হয় না, কক্ষে প্রবেশ করেন হোটেলের ম্যানেজার কিউস্মিথ, তার সঙ্গে পুলিশ ইন্সপেক্টারও আরও দু’জন পুলিশ অফিসার হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন।

বনহুর আর রহমান উঠে তাদের অভ্যর্থনা জানালো।

 বনহুর বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো তাদের মুখের দিকে।

ম্যানেজার কিউস্মিথ ব্যস্ততার সঙ্গে বলে উঠলেন–মিঃ সোহেল, একটা আশ্চর্য সংবাদ!

বলুন? বললো বনহুর।

ম্যানেজার কিউস্মিথ বলার পূর্বেই বলে উঠলেন পুলিশ ইন্সপেক্টার–মিঃ হাউবার্ডের মৃতদেহ মর্গ থেকে উধাও হয়েছে মিঃ সোহেল।

অকস্মাৎ কক্ষমধ্যে বাজ পড়লো যেন।

মুহূর্তে বনহুরের মুখমন্ডল কঠিন এবং চিন্তাযুক্ত হয়ে উঠলো, জোড়া কুঁচকে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। অস্ফুট গম্ভীর কণ্ঠে বললো–মিঃ হাউবার্ডের লাশ মর্গ থেকে উধাও হয়েছে–বলেন কি?

হাঁ মিঃ সোহেল, ভোরে সুইপার মর্গে গিয়ে দেখতে পায় ট্রেচার শূন্য পড়ে আছে, হাউবার্ডের লাশ নেই। কথা কয়টা বলে থামলেন পুলিশ ইন্সপেক্টার।

বনহুর সবাইকে বসার জন্য অনুরোধ জানালো।

আসন গ্রহণ করলেন সবাই।

বনহুর একবার রহমানের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো। দেখলো রহমানের মুখমন্ডল কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। বনহুর তাকে লক্ষ্য করে বললো–মিস্ এলিনকে ডেকে আনো রহমান।

রহমান নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো।

একটু পরে ফিরে এলো এলিনকে সঙ্গে নিয়ে।

বনহুর এলিনকে বললো–বসো।

এলিন কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে অবাক চোখে তাকাচ্ছিলো কক্ষ সকলের মুখের দিকে। মিঃ সোহেলের কক্ষে অসময়ে এদের দেখে রীতিমত ঘাবড়ে গেছে এলিন।

বনহুর বললো–এলিন, তোমার বাবার লাশ মর্গ থেকে উধাও হয়েছে!

বিদ্যুঙ্গতিতে উঠে দাঁড়ালো এলিন, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো–মর্গ থেকে লাশ উধাও হয়েছে?

হাঁ এলিন।

 এলিনের চোখ দুটো যেন গোলাকার হয়ে উঠেছে। ভয়ে দেহটা ওর বেতসপত্রের মত থরথর করে কাঁপছে। পড়ে যাচ্ছিলো এলিন, বনহুর ওকে ধরে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। তারপর নিজের শয্যায় শুইয়ে দিলো।

অল্পক্ষণেই কক্ষমধ্যে ভীড় জমে গেলো। সকলের চোখে মুখেই একটা ভীতিভাব। ম্যানেজার বললেন–আপনারা দয়া করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। এখানে ভীড় করবেন না। কয়েকজন এলিনের সংজ্ঞা ফিরে আনার চেষ্টা করতে লাগলো। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগলো, বাবার মৃত্যুতে যে যুবতী জ্ঞান হারালো না, সেই যুবতী কি করে আর কেনই বা অজ্ঞান হলো বাবার মৃতদেহের উধাও সংবাদ পেয়ে।

ডাক্তার এলেন। এলিনকে পরীক্ষা করে বললেন–অত্যন্ত বিচলিত এবং ঘাবড়ে যাওয়ার জন্য এমন হয়েছে। বিশ্রাম ও নিরিবিলির প্রয়োজন।

পরদিন।

এলিন শয্যায় শায়িত।

বনহুর পাশে বসে আছে। এলিন ওর হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে আছে, চোখেমুখে ওর ভীত আর আতঙ্কভাব। বনহুরকে সে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় নিজের পাশে। মনোভাব বনহুর সরে গেলেই যেন ওর বিপদ ঘটবে।

বনহুর সান্ত্বনার স্বরে বললো–এলিন, ভয় নেই, হাউবার্ডকে যে বিষাক্ত ঔষধ প্রয়োগ করা হয়েছিলো তা অতি মারাত্মক। কাজেই সে কিছুতেই জীবিত হতে পারে না—

না না, আমার মন বলছে ঐ কাপালিক নররক্ত পিপাসু মরেনি। সে বেঁচে আছে—-সে বেঁচে আছে। আমাকে সে হত্যা না করে ছাড়বে না মিঃ সোহেল। এলিনের সমস্ত মুখে তখন একটা দারুণ উদ্বিগ্নতার ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছিলো।

বনহুর এলিনকে যতই সান্ত্বনা দিক, আসলে তার মনেও ভীষণ একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিলো। কারণ পুলিশ মর্গ থেকে লাশ উধাও হওয়া কম কথা নয়। বনহুর এলিনের জন্য বেশি। চিন্তিত, কারণ হাউবার্ড যদি সত্যিই জীবন ফিরে পেয়ে উধাও হয়ে থাকে তাহলে এলিনকে সে। কিছুতেই ক্ষমা করবে না। এলিনের প্রতি তাই বনহুর নজর রাখলো নিপুণভাবে।

*

একসময় রহমান বললো–সর্দার, কান্দাই ফিরে যাওয়া একান্ত দরকার। কারণ কান্দাই অধিবাসিগণের মধ্যে আবার ভীষণ একটা অরাজকতা দেখা দিয়েছে। শুধু নাগরিকের মধ্যেই নয়, কান্দাই মহারাজ হিরোন্ময় সেন প্রজাদের প্রতি ভীষণ অত্যাচার-অনাচার শুরু করে দিয়েছে।

আমি জানি, রহমান, আর সেই কারণেই আমি তোমাদের বৌরাণীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে নাগরিক জীবন-যাপন করবো বলে মনস্থ করেছিলাম। নগরমধ্যে বাস করে আমি নগরের ভিতরের। রহস্য উঘাটন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু…

বনহুরের কথা শেষ হয় না, দমকা হাওয়ার মত তাদের ক্যাবিনে প্রবেশ করে এলিন, চোখেমুখে দারুণ ভীতির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ছুটে এসে জাপটে ধরে বনহুরকে–আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান মিঃ সোহেল—

বনহুর আর রহমান আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো, হঠাৎ এলিন তার কামরা থেকে এভাবে ঝড়ের বেগে ছুটে আসবে তাদের ক্যাবিনে, ভাবতেও পারেননি তারা।

রাত এখন বেশি নয়, সাড়ে বারোটা বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে।

বনহুরকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে এলিন, বনহুর যেন হকচকিয়ে গেলো। বিশেষ করে রহমান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, সেকারণেই বনহুর বিব্রত বোধ করলো বেশি।

 এলিন থরথর করে কাঁপছে আর বলছে–আমাকে বাঁচান মিঃ সোহেল! আমাকে বাঁচান! বাঁচান—-

বনহুর বললো কি হয়েছে বলো? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এলিন?

ভয়ঙ্কর দু’খানা হাত—ভয়ঙ্কর দু’খানা হাত মিঃ সোহেল। আমাকে গলা টিপে হত্যা—- করতে—এ—সে–ছি–লো–ভয়ঙ্কর–দুটি—হাত–

বনহুর এলিনকে সাহস দিয়ে বললো–কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছো এলিন!

না, আমি দুঃস্বপ্ন দেখিনি মিঃ সোহেল। আমি তখনও নিদ্রা যাইনি, ঠিক সেই সময় অন্ধকারে দু’টি হাত আমার গলার দিকে এগিয়ে আসছিলো। আমি স্পষ্ট দেখিছি দু’টি হাত–সেকি ভয়ঙ্কর জমকালো দুটি হাত মিঃ সোহেল! না না, আমি স্বপ্ন দেখেনি—বনহুরের জামার আস্তিন এঁটে ধরে কথাগুলো বলে চলেছে এলিন।

রহমান কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত তাকিয়ে আছে এলিন আর সর্দারের দিকে। সেও কম বিস্মিত হয়নি, এলিন যে কোনো মিথ্যা কথা বলছে না বা স্বপ্ন নয় তা ওর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

অনেক বুঝানো সত্ত্বেও এলিন তার ঘরে ফিরে আর গেলো না। সে বনহুরের ক্যাবিনেই থাকবে জেদ ধরে বসলো।

রাত বেড়ে আসছে।

 রহমান বারবার হাই তুলছিলো, কারণ তার খুব ঘুম পাচ্ছিলো, বললো, রহমান–সর্দার, আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে।

বেশ, তুমি যাও শোওগে।

 রহমান বেরিয়ে যায়।

বনহুর তাকায় এলিনের দিকে, ভয়-বিহ্বল চোখে এলিন তাকিয়ে আছে। বনহুর হাতঘড়ির দিকে দেখে নেয় রাত একটা বেজে গেছে প্রায়। বললো এবার সে–এলিন, এবার তাহলে শুয়ে পড়ো।

দরজা বন্ধ করে ফিরে এলো বনহুর এলিনের পাশে। এলিন অসহায় করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। বনহুর বিছানার দিকে আংগুল দেখিয়ে আবার বললো–যাও বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো।

এলিন বললো–আর আপনি?

বনহুর সোফায় ধপ করে বসে পড়ে দেহটা এলিয়ে দিয়ে বললো–আমার এখানেই চলবে।

এলিন অগত্যা শয্যায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

 বনহুর সোফায় হাতলে মাথায় ঠেশ দিয়ে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো।

এলিন অত্যন্ত ক্লান্তি বোধ করছিলো, অল্পক্ষণেই গভীর নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়লো সে।

দেয়াল ঘড়িটা টিটি করে বেজে চলেছে।

ক্যাবিনের দরজা-জানালা সব বন্ধ, রহমান বেরিয়ে যাবার পূর্বে চারিদিকের জানালাগুলো ভালভাবে বন্ধ করে যেতে ভুলেনি। কারণ এলিনের কথাগুলো তাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও সন্ত্রস্ত করে তুলেছিলো। শুধু এলিনের জন্য নয়, সর্দারের জন্য সে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো তাই ক্যাবিনের জানালাগুলো খুব ভালভাবে বন্ধ করে তবেই রহমান নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো।

বনহুর কিন্তু ঘুমাতে পারেনি কিছুতেই। চোখ বুজে কিছুক্ষণ পড়ে রইলো নিস্তব্ধ হয়ে।

এলিনের নিশ্বাসের শব্দ আর ঘড়ির কাঁটার টিটি শব্দ মিলে নির্জন ক্যাবিনটাকে কেমন যেন ভাবগম্ভীর করে তুলেছিলো। এপাশ-ওপাশ করছে বনহুর।

অনেক চেষ্টা করেও বনহুর ঘুমাতে পারছে না, এলিনের উক্তিগুলোই সে ভেবে চলেছে। মিঃ হাউবার্ডের মৃতদেহ উধাও ব্যাপারের সঙ্গে তবে কি এলিনের সেই ভয়ঙ্কর হাত দু’খানার কোনো যোগাযোগ আছে? এলিন কি সত্যিই এমনি কোনো হাত দেখেছিলো? যে হাত দু’খানা তাকে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিলো? বনহুর যেন কিছুতেই এলিনের কথা বিশ্বাস করতে পারছিলো না, কারণ এলিন যা বলেছিলো সে কথাগুলো বড় অদ্ভুত আর আজগুবি ধরনের ছিলো।

রাত অনেক বেজে গেছে।

বনহুর ঘুমাতে পারেনি এখনও। ডিমলাইটের স্বল্পালোকে নিজের বিছানার দিকে তাকালো। শুভ্র শয্যায় এক খোকা রজনী গন্ধার মত পড়ে আছে এলিন।

বনহুর সহসা দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারলো না। ধীরে ধীরে ওর মন থেকে সব চিন্তা সরে গেলো, তার মনে জেগে উঠলো পৌরুষ মনোভাব।

বনহুর একসময় নিজের অজ্ঞাতে এসে দাঁড়ালো এলিনের শয্যার পাশে। নির্নিমেশ নয়নে তাকিয়ে রইলো এলিনের নিদ্রামগ্ন মুখমন্ডলের দিকে।

কক্ষের স্বল্প আলোতে এলিনকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে।

বনহুর নিজকে সংযত রাখতে পারছে না যেন কিছুতেই, সে পায়চারী করতে লাগলো এবার। মাঝে মাঝে ওর দৃষ্টি চলে যাচ্ছিলো এলিনের এলায়িত সুকোমল দেহখানির দিকে।

একসময় পায়চারী বন্ধ করে এলিনের শয্যার পাশে এসে বসে বনহুর। দক্ষিণ হস্তখানা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ওর এলিনের গন্ডের দিকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে কোনো একটা শব্দে চমকে উঠে বনহুর। উঠে দাঁড়ায় এলিনের শয্যা থেকে, ফিরে আসে নিজের আসনে।

আবার এলিয়ে দেয় দেহখানা সোফায়।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বনহুর হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়–ফিরে তাকায় সে এলিনের শয্যার দিকে। বিদ্যুঙ্গতিতে সোজা হয়ে বসে বনহুর–এলিন শয্যায় নেই, শয্যা শূন্য!

ছুটে যায় বনহুর এলিনের শূন্য বিছানার পাশে, ব্যাকুল দৃষ্টি নিয়ে কক্ষমধ্যে চারিদিকে তাকায়। কক্ষমধ্যে কোথাও এলিন নেই, সমস্ত কক্ষ নির্জন নিস্তব্ধ। বনহুরের চোখদুটো অকস্মাৎ চলে যায় ওদিকে জানালার দিকে। বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় বনহুর–জানালা ভাঙা, জানালার মোটা শিকগুলো একেবারে বাঁকিয়ে ফেলা হয়েছে–

বনহুর ক্ষিপ্তের ন্যায় ছুটে যায় জানালার কাছে। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে ভাঙা জানালার দিকে, ঐ পথে কেউ এলিনকে নিয়ে উধাও হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যথায় বনহুরের মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজে ন্দ্রিা যাওয়ার জন্য অনুতাপে ভরে উঠলো তার মন। সোফায় বসে চুলগুলো টানতে লাগলো বনহুর নিজের মাথার।

 দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো বনহুররাত এখন চারটা বেজেছে। হোটেল নীরব নিস্পন্দ, একটি শব্দও কোথাও শোনা যাচ্ছে না। রহমান বা ম্যানেজারকে জানাবে কিনা। ভাবতে লাগলো। জানিয়ে কোনো ফল হবে না, বনহুর রিভলভার হস্তে বেরিয়ে পড়লো ক্যাবিন থেকে।

 অন্ধকার রাত। নিস্তব্ধ হোটেলের বারান্দা বেয়ে বনহুর এগিয়ে চললো সামনের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে কিন্তু কোথাও কোনো কিছু নজরে পড়লো না।

বনহুর গভীর রাতে হোটেলের চারিপাশে তন্ন তন্ন করে সন্ধান করলো কোথাও কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা। হঠাৎ বনহুরের নজরে পড়লো, হোটেলের সম্মুখে রাস্তার উপরে সাদা কিছু পড়ে আছে। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়লো বনহুর সাদা জিনিসটা হাতে তুলে নিয়ে বুঝতে পারলো সেটা এলিনের স্কার্ফ।

 বনহুর স্কার্ফটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তার উপর। এলিনকে এ পথ ধরেই। নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রায় ঘন্টা দুই কেটে গেছে বনহুরের হোটেলের চারপাশ খোঁজ করতে গিয়ে। বনহুর এবার স্কার্ফখানা হাতে নিয়ে যখন ফিরে এলো তখন ভোরের আলোয় ভরে উঠেছে চারিদিক।

বনহুর হোটেলে নিজ ক্যাবিনে এসে দাঁড়াতেই রহমান ব্যস্ত হয়ে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, বনহুরকে দেখে তার চোখ দুটো খুশিতে দীপ্ত হয়ে উঠলো, বললো–সর্দার, কোথায় গিয়েছিলেন। আপনি?

বনহুর রহমানের কথায় কোনো জবাব না দিয়ে হাতের রিভলভারটা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। সমস্ত মুখমন্ডলে তার ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে।

রহমান সর্দারের মুখোভাব লক্ষ্য করে চিন্তিত হলো, না জানি কি একটা কিছু ঘটেছে, যার জন্য সর্দার অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছেন।

রহমান নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সর্দারের মুখের দিকে। আর কোনো প্রশ্ন করার মত সাহস হচ্ছে না তার।

বনহুর সোফায় ঠেশ দিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললো–রহমান, এলিনকে রক্ষা করতে পারিনি।

রহমান এতক্ষণ এলিন সম্বন্ধে খেয়ালই করেনি–সে ভেবেছিলো, এলিন হয়তো তার ঘরে চলে গেছে। সর্দারের জন্যই রহমান ভাবিত হয়ে পড়েছিলো। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো রহমান এলিন কোথায় সর্দার?

বনহুর ক্যাবিনের জানালার দিকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।

রহমান সেই দিকে নজর দিয়েই ভূত দেখার মতই চমকে উঠলো, ঢোক গিলে বললো– জানালা ভাঙা, কি অদ্ভুত কান্ড–এত মোটা মোটা শিকগুলো বাঁকানো হয়েছে।

হাঁ, ঐ পথে এলিনকে হাউবার্ড নিয়ে উধাও হয়েছে রহমান।

রহমান বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠলো–হাউবার্ড।

হাঁ রহমান, হাউবার্ড জীবিত আছে।

কি সর্বনাশ, এলিনকে তাহলে হাউবার্ডই চুরি করে নিয়ে গেছে?

সে ছাড়া এমন আক্রোশ এলিনের উপর কারো ছিলো না। একটু থেমে পুনরায় বললো বনহুর-বেচারী বাঁচতে চেয়েছিলো কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না।

রহমান সর্দারের ব্যথাকরুণ কণ্ঠস্বরে নিজেও যারপরনাই ব্যথিত হলো।

বনহুর সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো নিজকে সংযত করে নেওয়ার জন্য।

*

গভীর জঙ্গলমধ্যে একটা সুড়ঙ্গপথ।

 এলিনের দেহটা কাঁধে নিয়ে ভীষণ চেহারার একটা লোক এগিয়ে চলেছে সুড়ঙ্গপথ ধরে।

ভীষণ চেহারার লোকটা অন্য কেউ নয়–স্বয়ং হাউবার্ড। আজ তার দেহে কোনো বর্ম নেই, শুধু দেহটা ফুলে মোটা হয়ে উঠেছে তার স্বাভাবিক দেহের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। জমাট কালো তার দেহটা কঠিন লোহার মত রুক্ত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ কেউ দেখলে তাকে হাউবার্ড বলে চিনতে পারবে না।

হাউবার্ডের শরীর এমন বিষাক্ত ওষুধ দ্বারা পাকানো হয়েছিলো যার জন্য বনহুরের দেওয়া বিষাক্ত ঔষধের ইনজেকশন কার্যকরী হয়নি। তাকে মৃত বলে সনাক্ত করা হলেও আসলে তার মৃত্যু ঘটেনি। ডাক্তারী পরীক্ষার পর তাকে পুলিশমর্গে রাখা হয়েছিলো। তাকে সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত করে একটা ট্রেচারে শুইয়ে রেখেছিলো, কারণ তখনও হাউবার্ডকে দেখার জন্য মরিলার মহারাজ আসেননি। মহারাজ আসবেন পরদিন, কিন্তু রাতেই হাউবার্ডের মৃতদেহ উধাও হয়েছিলো অদ্ভুতভাবে।

 এলিনের দেহটা নিয়ে হাউবার্ড সুড়ঙ্গপথে ফিরে এলো মরিলা জঙ্গলের তলায় গোপন এক। গুহায়।

এলিনকে শুইয়ে দিলো হাউবার্ড পাথরের মেঝেতে।

 তারপর হাতে তালি দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ভয়ঙ্কর চেহারার লোক কোথা থেকে এসে দাঁড়ালো হাউবার্ডের সম্মুখে। তাদের হাতে এক-একটা সূতীক্ষ ধার বর্শা।

হাউবার্ড বললো-এলিনকে নিয়ে এসেছি। বিশ্বাসঘাতিনীকে হত্যা করে রক্ত পান করবো।

একসঙ্গে লোকগুলো বর্শা উদ্যত করে এলিনকে হত্যা করতে গেলো।

 হাউবার্ড বিশাল হাতখানা উঁচু করে বললো–না, ওভাবে নয়। খৰ্গ দিয়ে ওর মাথাটা কেটে আমি রক্ত চুষে খাবো। বিশ্বাসঘাতিনীই আমাকে সেদিন বিষাক্ত ইনজেকশন দ্বারা হত্যা করেছিলো।

 একজন বললো–আমাকে আদেশ করুন কাপালিক বাবা, আমিই ওকে হত্যা করে মাথাটা আপনার হাতে তুলে দেই।

আজ নয়।

আজ নয় কেন কাপালিক বাবা?

আজ আমি রক্ত খাবো না মার্লেশ সিং। রক্তের নেশা আমাকে পাগল করলেও আমি নিজকে শক্ত করে নিয়েছি। কারণ আমি লোকসমাজে জানাতে চাই কাপালিকের সত্যি মৃত্যু ঘটেছে।

আসন গ্রহণ করলো হাউবার্ড, বললো আবার সে–মার্লেশ সিং তুমি এই শয়তানী এলিনকে লৌহশিকলে আবদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখো। ওকে শাস্তি দিয়ে তিল তিল করে মারবো।

তৎক্ষণাৎ এলিনের সংজ্ঞাহীন দেহটা লৌহশিকলে আবদ্ধ করে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। তারপর চললো নানারকম অত্যাচার। হাউবার্ডের আদেশে চাবুক মারা হতে লাগলো এলিনের শরীরে।

হাউবার্ড তখন গুহার মধ্যে একটা বিরাটকায় আসনে বসে কিছু তরল পদার্থ পান করছিলো।

হাউবার্ডের চারপাশ ঘিরে বসলো তার দলবল, তারাও নেশাপানে মত্ত হয়ে উঠলো।

সম্মুখে একটা লৌহথামের সঙ্গে ঝুলছে এলিনের দেহটা। চাবুকের আঘাতে দেহের বসন ছিঁড়ে গেছে খন্ড খন্ড হয়ে।

একজন বললো–মালিক ওকে এভাবে মেরে কোনো ফল হবে না। এখন ও অজ্ঞান আছে, কিছুই অনুভব করতে পারছে না।

আর একজন বললো–ঠিক বলেছিস্ চার্লিং সিং, ওর জ্ঞান নেই, ওকে মেরে কিছু হবে না। জ্ঞান ফিরে এলে যত খুশি মারতে হবে, চামড়া ছাড়িয়ে নিতে হবে ওর দেহ থেকে।

এবার হাউবার্ড বলে উঠলো–বিশ্বাসঘাতিনী ঐ নেংটি ইঁদুরটার সঙ্গে মিশে আমাকে বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করে হত্যা করেছিলো। ওকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করব না, হত্যাও করবো না সহজে।

তাহলে কি করবেন মালিক? বললো মার্লেশ সিং।

হাউবার্ড বড় একটা বাটিভর্তি মদ মুখে ঢেলে দিয়ে বললো– হত্যা করলে তো মরেই গেলো। ওকে জীবিত রেখে ওর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো। দাও, আমার দেহে ১নং শিশি দিয়ে দাও।

হাউবার্ড লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো আসনের উপরে।

একটা লোক মুখে মাক্স, হাতে গ্লাবস পরা সিরিঞ্জ হাতে এগিয়ে এলো, হাউবার্ডের দেহে ঔষধটা পুশ করে দিলো সে। তবে হাতে পায়ে নয়, বাম কাদের বাম পাশের কোনো এক নির্দিষ্ট স্থানে।

অল্পক্ষণেই হাউবার্ডের দু’চোখ মুদে এলো, নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লো শয়তান কাপালিক হাউবার্ড।

যখন ওর নিদ্রাভংগ হলো তখন তার দেহ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এখন তাকে মরিলা হোটেলের মালিক হাউবার্ড বলে চিনতে ভুল হবে না কারো।

হাউবার্ড জেগেই হুঙ্কার ছাড়লো–কোলাইম্যান, সিংহিলাউ, মার্লেশ সিং—

সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে ছুটে এলো সবাই, ঘিরে দাঁড়ালো হাউবার্ডের চারপাশে।

 হাউবার্ড চিৎকার করে বললো জ্বালা, বুকের জ্বালা, বড় জ্বালা। রক্ত,—রক্ত দাও মার্লেশ সিং–

রক্ত কোথায় পাবো মালিক, আপনি না বলেছেন মরিলা দ্বীপে কোনো নরহত্যা করা চলবে না।

 সে কয়েক সপ্তাহের জন্য মাত্র। এলিনের জন্যই আমি বাধ্য হয়ে নরহত্যা বন্ধ করেছি। ওকে যেদিন হত্যা করবো সেদিন হতে আবার আমি হবো কাপালিক হাউবার্ড–এখন বুকটা আমার বড় জ্বালা করছে। যা থাকে তাই নিয়ে এসো। তাই নিয়ে এসো মার্লেশ সিং।

 শরাব আনবো মালিক?

 হাঁ, নিয়ে এসো। শরাব নিয়ে এসো কোলাইম্যান। সিংহিলাউ, মার্লেশ সিং, তোমরা এলিনকে ঝুলিয়ে রেখেছো তো?

হাঁ, মালিক।

তাকে চাবুক মারা হচ্ছে তো?

 হাঁ মালিক, তাকে চাবুকের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে।

যাও, আরো লাগাও। চামড়া ছাড়িয়ে ফেলোগে।

মালিক, এলিনের জ্ঞান ফিরে এসেছে, তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বটে কিন্তু সে চিৎকার করে কাঁদাকাটা করে চলেছে।

কোনো কিছুই তোমরা শুনবে না। আমাকে সে হত্যা করে ছিলো, আমাকে সে বিষাক্ত ঔষধ। দিয়ে হত্যা করেছিলো। বিশ্বাসঘাতিনী শয়তানীকে আমি নিজ কন্যার মত করেই মানুষ করেছিলাম। তারই প্রতিদানে সে আমাকে ………….. চলো, আমি নিজে গিয়ে ওকে দেখবো।

হাউবার্ড উঠে দাঁড়ালো।

কোলাইম্যান আর মার্লেশ সিং তাকে ধরে নিয়ে চললো। হাউবার্ডের দেহটা টলছে এখনও মাতালের মত।

 যে স্থানে এলিনকে লৌহশিকলে আবদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো সেস্থানে এসে দাঁড়ালো হাউবার্ড। তীব্র কটাক্ষে তাকালো সে এলিনের রক্তাক্ত ছিন্নবসন দেহখানার দিকে। চুলগুলো এলিনের এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার কাঁধের চারপাশে। জামা ছিঁড়ে কাঁধ বেরিয়ে পড়েছে। পিঠের যে অংশ দেখা যাচ্ছিলো সে অংশ রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে।

হাউবার্ড এলিনের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি হেসে উঠলো। সে কি বিকট আর বীভৎস হাসি, তার হাসির শব্দে কেঁপে উঠলো সুড়ঙ্গমধ্যস্থ গুহাপথ।

এলিন জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দু’খানা চেটে নিয়ে ভয় বিহ্বল করুণ দৃষ্টি মেলে তাকালো হাউবার্ডের পৈশাচিক মুখ মন্ডলের দিকে।

হাউবার্ড দাঁতে দাঁত পিষে বললো–লাগাও চাবুক। আরও লাগাও। চামড়া তুলে নাও কোলাইম্যান, ওর চামড়া ছাড়িয়ে নাও। শয়তানী বিশ্বাসঘাতিনী, আমার সঙ্গে চাতুরী! আমাকে হত্যা করেছিলি কোন্ সাহসে? বুঝেছি সব, ঐ মিঃ সোহেলের চক্রান্তে আমাকে তুই হত্যা করেছিলি। সব জানি, সব জানি আমি—

 এলিন বহুকষ্টে উচ্চারণ করলো–একটু জল দাও–একটু জল দাও–

জল খাবে? হাউবার্ড কোলাইম্যানকে ইশারা করলো পানির পেয়ালাটা ওর মুখের সম্মুখে বাড়িয়ে ধরতে।

কোলাই মালিকের ইঙ্গিতে পানির পেয়ালা এলিনের মুখের কাছে এগিয়ে ধরলো।

এলিনের দু’হাত দু’পাশে লৌহশিকল দিয়ে বাঁধা ছিলো। কোলাইম্যানের হাতে পানির পেয়ালা দেখে মাথাটা এগিয়ে দিলো সেইদিকে।

সঙ্গে সঙ্গে হাউবার্ড পিশাচের মত বললো–পেয়ালা সরিয়ে নাও কোলাইম্যান, ওকে জল দিও না।

 আদেশ পালন করলো কোলাইম্যান।

এলিনের মুখের কাছ থেকে পানির পাত্র সরিয়ে নিলো সে।

 হাউবার্ড হেসে উঠলো আবার হাঃ হাঃ করে।

এলিন মৃত্যুমলিন অসহায় চোখে তাকালো হাউবার্ডের কঠিন মুখখানার দিকে।

হাউবার্ডকে নর শয়তান বলেই মনে হচ্ছিলো তখন।

অসহায় এলিনের উপর চলেছে হাউবার্ডের নির্মম অকথ্য নির্যাতন। আজ দু’দিন তাকে এমনিভাবে লৌহশিকলে আবদ্ধ করে বেঁধে রাখা হয়েছে। কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি তাকে। চোখ বসে গেছে, চেহারা বিবর্ণ হয়েছে–আর কতক্ষণ এমনি অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করবে সে।

এখানে যখন হাউবার্ডের গোপন সুড়ঙ্গমধ্যে এলিনের উপর অত্যাচার চলেছে তখন মরিলা দ্বীপে আবার ভীষণ একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে এলিনের অন্তর্ধান নিয়ে।

পুলিশমহল এলিনের সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। দ্বীপের সর্বত্র পুলিশ নানাভাবে খোঁজ খবর চালাচ্ছে কিন্তু এলিনের আজও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

*

এলিনের দেহটা নেতিয়ে পড়েছে, এবার তার মৃত্যু নিশ্চিত। আজ পুরো তিন দিন তাকে এভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। এক ফোঁটা পানি তার মুখে পড়েনি। চলেছে তার উপরে নির্মম অত্যাচার। মাঝে মাঝে তার সম্মুখে পানির পাত্র ধরা হচ্ছে, আবার সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে সে পাত্র স্পর্শ করার পূর্বেই।

হাতে পায়ে শিকল কেটে বসে গেছে একেবারে।

জামা ছিঁড়ে খসে পড়েছে দেহ থেকে, প্যান্টেরও স্থানে স্থানে ছিঁড়ে গেছে। সে কি নির্মম করুণ দৃশ্য।

অন্ধকার সুড়ঙ্গমধ্যে গুপ্তগুহা।

এলিনকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে একটা লৌহথামের সঙ্গে। গুহার মধ্যে দু’পাশে দুটো মশাল জ্বলছে। মশালের আলোতে এলিনকে জীবন্ত প্রেতাত্মার মত মনে হচ্ছে।

হাউবার্ড আর তার অনুচরগণ প্রবেশ করলো সে গুহামধ্যে। আজ এলিনকে হত্যা করবে হাউবার্ড এবং সেই কারণেই এখন তারা আগমন করেছে। এক-একজনকে ভয়ঙ্কর নর পিশাচের মত লাগছে। হাউবার্ডের হাতে সূতীক্ষ্ণ ধার খর্গ।

এলিনের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো হাউবার্ড, কোলাইম্যান, সিংহিলাউ, মার্লেশ লিং। প্রত্যেকেই যেন এক একটা যমদূত।

এলিন ওদের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো–হ্যাঁউবার্ড আমাকে হত্যা করো, আমাকে হত্যা করো হাউবার্ড, আমি এ কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।

এলিনের কথায় হাউবার্ড ও তার দলবল হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বললো হাউবার্ড–এলিন, আজ তুমি মুক্তি পাবে–

এলিনের মৃত্যুমলিন নিষ্প্রভ চোখ দুটো চকচক করে উঠলো, বললো–আমাকে মুক্তি দেবে তোমরা? আমাকে মুক্তি দেবে?

হাঁ, আমি মুক্তি দেবো—-কিন্তু জীবন দান নয়, জীবন নাশ করে।

শিউরে উঠলো এলিন। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দু’খানা বারবার চাটতে লাগলো অসহায়ভাবে।

হাউবার্ডের হাতের খর্গখানা মশালের আলোতে চৰ্চ করে উঠলো। কঠিন কণ্ঠে দাঁত পিষে বললো–মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও এলিন! বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি গ্রহণ করো!

হাউবার্ড খর্গ উদ্যত করে এলিনের মস্তক দ্বিখন্ডিত করতে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে পিছনে বজ্রকঠিন কণ্ঠে কে যেন গর্জে উঠলো– ক্ষান্ত হও হাউবার্ড!

শূণ্যে খর্গখানা থেমে গেলো হাউবার্ডের হস্তে, ফিরে তাকালো সে। হাউবার্ডের সঙ্গে কোলাইম্যান, সিংহিলাউ, মার্লেশ সিং বিদ্যুৎ গতিতে ফিরে তাকালো। বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে ওরা দেখলো, তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে একটি জমকালো মূর্তি। তার দু’হাতে দুটি রিভলভার। মুখের অর্ধেক অংশ পাগড়ির আঁচলে ঢাকা। চোখ দুটিতেও কালো চশমা রয়েছে।

হাউবার্ড জমকালো মূর্তি লক্ষ্য করে ভড়কে গেলো না, সে ঘাবড়ে গেলো তার হাতের আগ্নেয় অস্ত্র দুটি লক্ষ্য করে। এক্ষণে হাউবার্ডের দেহে কোনো বর্ম পরা ছিলো না,বিশেষ করে সেই কারণেই সে বেশি ভীত হলো। এই মুহূর্তে তার দেহে যদি বর্ম পরা থাকতো তাহলে কোনো অস্ত্রকেই হাউবার্ড কেয়ার করতো না।

এবার হাউবার্ড কঠিন কণ্ঠে বললো–কে তুমি? আর কেমন করেই বা আমার এই গোপন সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করলে?

হাউবার্ডের কথার ফাঁকে কোলাইম্যান, সিংহিলাউ, আর মার্লেশ সিং সরে পড়তে যাচ্ছিলো। হয়তো অস্ত্র নিয়ে জমকালো মূর্তিকে আক্রমণ করবে, এই অভিসন্ধি নিয়েই মতলব আঁটছিলো ওরা।

জমকালো মূর্তি হুঙ্কার ছাড়লো–এক পা নড়েছো কি মরেছ।

 বাধ্য হয়েই থেমে পড়লো ওরা তিন জন।

হাউবার্ডের শয়তানিভরা কঠিন মুখে ভীতির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। খৰ্গসহ হাতখানা ধীরে ধীরে। নেমে এলো নিচের দিকে বললো আবার—জবাব দাও কে তুমি?

আমি তোমাদের যমদূত।

 যমদূত? অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো হাউবার্ড।

 তার অনুচরগণের মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হলো।

হাউবার্ড খর্গ উত্তোলন করে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলো জমকালো মূর্তির উপর–যমদূত তোমাকে আমি হত্যা করবো।

সঙ্গে সঙ্গে জমকালো মূর্তি হাউবার্ডের উদ্যত হস্ত লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়লো।

মুহূর্তমধ্যে হাউবার্ডের দক্ষিণ হস্ত থেকে খর্গ খসে পড়লো, ঝুলে পড়লো ওর হাতখানা। রক্তের ধারা ছুটলো তীরবেগে।

মালিকের হাত থেকে খর্গ ভুলুষ্ঠিত হতেই মার্লেশ সিং দ্রুত হস্তে খৰ্গখানা তুলে নিতে গেলো।

জমকালো মূর্তি সে সুযোগ দিলো না ওকে, তার হস্তের রিভলভার গর্জে উঠলো।

তৎক্ষণাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো মার্লেশ সিং, একটা তীব্র আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়লো নিস্তব্ধ সুড়ঙ্গ গুহায়।

এলিন মৃত্যুকাতর যন্ত্রণায় যদিও ছটফট করছিলো, সেও আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। জমকালো মূর্তির কার্যকলাপ তাকেও বিস্ময়াহত করে তুলেছিলো। কে এই যমদূত যে অকস্মাৎ যাদুমন্ত্রের মত আবির্ভূত হলো এই গোপন সুড়ঙ্গ মধ্যে। কাতর দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিলো তার জীবনরক্ষকের দিকে।

মার্লেশ সিং-এর দেহটা বার দুই মোচড় খেয়ে অসাড় হয়ে পড়লো। চিরদিনের জন্য বিদায় হলো সে।

মার্লেশ সিং-এর ভয়াবহ মৃত্যু হাউবার্ড এবং তার সঙ্গী দু’জনকে আতঙ্কিত করে তুললো। মার্লেশ সিং-এর পাঁজর ভেদ করে চলে গেছে জমকালো মূর্তির রিভলভারের গুলী। রক্তে লালে লাল হয়ে উঠলো পাথুরে মেঝেটা।

হাউবার্ড তার হাতের যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে ফেলেছে। হাত দিয়ে রক্তের ধারা বইছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে হউবার্ড, বোধ হয় পালাবার পথ খুঁজছে সে।

সঙ্গীর অবস্থা দেখে কোলাইম্যান আর সিংহিলাউ দারুণভাবে ছটফট করতে লাগলো। আর কেউ সাহসী হচ্ছে না এক পা নড়তে। ওরা ভীত দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে বারবার জমকালো মূর্তিটার দিকে।

জমকালো মূর্তি এবার সিংহিলাউ-এর বুক লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়লো।

মুহূর্তে তীব্র আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো সিংহিলাউ। একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ করে স্তব্ধ হয়ে গেলো ওর কণ্ঠ চিরদিনের জন্য।

 জমকালো মূর্তি আর বিলম্ব করলো না, এবার সে হাউবার্ডের বুক লক্ষ্য করে দক্ষিণহস্তের রিভলভার তাক করলো। হাউবার্ড ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো–তুমি কি চাও বলো, আমি তাই দেবো। তবু আমাকে হত্যা করো না।

জমকালো মূর্তি দাঁতে দাঁত পিষে বললো এলিনকে মুক্ত করে দাও।

যুউবার্ড বামহস্তে চাবি নিয়ে এলিনের লৌহশিকলের তালা খুলতে গেলো কিন্তু একহস্তে তালা খোলা সম্ভব হলো না।

জমকালো মূর্তি গর্জে উঠলো–চাবির গোছা ওকে দাও। আংগুল দিয়ে কোলাইম্যানকে দেখিয়ে দিলো সে।

 হাউবার্ড চাবির গোছা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলো।

কোলাইম্যান ভয়াতুর চোখে জমকালো মূর্তির দিকে এক নজর তাকিয়ে মালিকের বাম হাত থেকে চাবির গোছা নিলো তারপর খুলে দিলো বাধ্য দাসের মত ধীরে ধীরে।

কোলাইম্যান চাবির গোছা নিয়ে এলিনের লৌহশিকলের তালা খুলে দিতেই এলিন খপ করে পড়ে গেলো মেঝেতে কারণ তার দাঁড়াবার শক্তিটুকুও ছিলো না।

জমকালো মূর্তির রিভলভার গর্জে উঠলো তৃতীয়বারের মত। কোলাইম্যান মোচড় খেয়ে পড়ে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ আর্তনাদ করে উঠলো।

এবার জমকালো মূর্তি বললে–হাউবার্ড পুলিশ মর্গ থেকে তুমি পালিয়েছিলে! মৃত্যু থেকে জীবন লাভ করেছিলে তোমার বিষাক্ত ওষুধ হজম করার অসীম শক্তিবলে। কিন্তু এবার তোমাকে রেহাই দেবো না। এবার তুমি মর্গ থেকে সরে পড়ার ক্ষমতাচ্যুত হবে।

হাউবার্ড ক্ষণিকের জন্য তাকিয়ে দেখে নিলো কোলাইম্যানকে কোলাইম্যান তখন মেঝেতে পড়ে বলি পাঁঠার মত ছটফট করছিলো।

জমকালো মূর্তি ওকে এগুতে দিলো না, গুলী ছুঁড়লো সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, অকস্মাৎ হাউবার্ড কোথায় অন্তর্ধান হলো চোখের নিমিশে!

এলিনকে ছেড়ে সরে এলো জমকালো মূর্তি যে স্থানে হাউবার্ড একটু পূর্বে দাঁড়িয়েছিলো সেই স্থানে। অনেক সন্ধান করেও জমকালো মূর্তির হাউবার্ডের কোনোই খোঁজ পেলো না। কি আশ্চর্য কোনোরকম কিছুই নজরে পড়লো না কোন পথ সে অন্তর্ধান হয়েছে।

জমকালো মূর্তি এবার এলিনের পাশে গিয়ে দ্রুত ওকে তুলে নিলো কাঁধে, তারপর বেরিয়ে এলো যে পথে সে প্রবেশ করেছিলো সেই পথে।

এলিন যদিও ভয় পাচ্ছিলো তবু সে নীরব ছিলো, নিজকে ছেড়ে দিয়েছিলো সে ভাগ্যের উপরে। কে এই জমকালো মূর্তি, আর কেনই বা তাকে এভাবে নিয়ে যাচ্ছে তাও জানার বাসনা অন্তর্ধান হয়েছে তার মন থেকে। নিশ্চুপ অসাড়ের মত চুপ করে রইলো এলিন। সে বুঝতে পারলো, জমকালো মূর্তি যেই হোক তাকে সে হত্যা করবে না।

এলিন একসময় অনুভব করলো তাকে নিয়ে কোনো একটা গাড়িতে ভোলা হলো। এলিন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে অশ্বপদ শব্দ খট খট খট–তাকে ঘোড়াগাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এলিন আরও বুঝতে পারছে, তার মাথাটা কারো কোলের উপর রয়েছে। কেউ যেন সযত্নে মাথাটা ধরে আছে যেন সে কষ্ট না পায়।

অন্ধকারে দ্রুত এগিয়ে চলেছে ঘোড়া গাড়িখানা।

 এলিন ক্ষীণ জড়িত কণ্ঠে বললো–জল দাও—

জল দেবো, আরও কিছু সময় ধৈর্য ধরো এলিন। বললো জমকালো মৃর্তি। কাছে বসলো বনহুর –খাও এলিন, জল খাও।

এলিনের বসবার শক্তি ছিলো না, বনহুর তাহাকে ধরে বসিয়ে পানি পান করালো।

এলিন এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি পান করে নিলো।

 বনহুর ওকে শুইয়ে দিলো আবার যত্নসহকারে।

এলিন নির্বাক নজরে কিছুক্ষণ বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, কৃতজ্ঞতায় মন তার ভরে উঠেছে কানায় কানায়।

বনহুর বললো– কি দেখছো এলিন?

আপনাকে! আপনি আমাকে না বাঁচালে আজ আমার জীবন প্রদীপ কখন নিভে যেতো—

এলিন, ওসব ভেবে মন অস্থির করোনা, কারণ তুমি এখন অত্যন্ত অসুস্থ। তোমাকে বিশ্রাম করতে হবে অনেক। তারপর রহমানকে লক্ষ্য করে বললো–তুমি একজন ডাক্তার ডেকে আনে। এলিনের চিকিৎসার প্রয়োজন। যাও—

রহমান চলে গেলো।

বনহুর তার জমকালো ড্রেস পাল্টে ফিরে এলো।

 এলিন বললো–আসুন আমার পাশে।

এগিয়ে এলো বনহুর।

বললো এলিন–বসুন আমার পাশে।

বনহুর বসলো এলিনের বিছানায়।

এলিন বনহুরের হাতখানা তার জীর্ণ হাতের মুঠায় চেপে ধরলো, বললো–সত্যি আপনি কতবড় মহৎ ব্যক্তি। আপনি আমার জীবনরক্ষক। আপনি আমার সব কিছু মিঃ সোহেল।

এলিন, তুমি সুস্থ হয়ে উঠো।

এখন আমি কোথায় মিঃ সোহেল?

হাউবার্ডের হোটেলে নয়, মরিলা দ্বীপের কোনো এক গোপন স্থানে। এলিন, এখানেও আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নই! কারণ হাউবার্ডের মৃত্যু না ঘটা পর্যন্ত কোথাও স্বস্তি নেই। আশঙ্কাহীন নই, বিশেষ করে তোমাকে নিয়ে–

মিঃ সোহেল, আমার জন্য আপনাদের চিন্তার অন্ত নেই।

না এলিন, সে কথা বলছি না, তোমাকে হাউবার্ডের কবল থেকে রক্ষা করাই আমাদের ধর্ম। তোমাকে বাঁচাতে চাই এলিন।

মিঃ সোহেল–এলিন বনহুরের বুকে মাথা রাখার চেষ্টা করে কথাটা উচ্চারণ করে।

বনহুর এলিনকে শুইয়ে দিয়ে একটা চাদর টেনে দেয় ওর গায়ে।

একটু পরে রহমান একজন ডাক্তার নিয়ে ফিরে আসে।

ডাক্তার এলিনের অবস্থা দেখে আশঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি ভালভাবে ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করে বিদায় হলেন।

রহমান বললো–সর্দার, মরিলা দ্বীপে অপেক্ষা করা আমাদের উচিত হবে না আর। বিশেষ করে এলিনের জন্য। কারণ হাউবার্ড এখনও জীবিত।

হাঁ রহমান, তোমার কথা সত্য। যদিও হাউবার্ডের একটি হাত নষ্ট হয়ে গেছে তবু সে অসুরের মতই ভয়ঙ্কর। এলিনকে নিয়ে মরিলা দ্বীপে অপেক্ষা করা যায় না কিন্তু হাউবার্ডকে জীবিত রেখে যাওয়াও সম্ভব নয়, বুঝলে? রহমান, এক কাজ করো।

বলুন সর্দার?

তুমি এলিনকে নিয়ে কান্দাই ফিরে যাও, আমি হাউবার্ডকে তার পাপের উপযুক্ত সাজা দিয়ে

সর্দার, মাফ করবেন, আপনাকে একা রেখে আমি কান্দাই ফিরে যাবো না।

রহমান, তা হয় না। যেমন করে তোক এলিনকে বাঁচাতেই হবে।

সর্দারের কথার পর কোনো কথা বলতে পারে না রহমান নিশ্চুপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

 রহমান এলিনকে যতই সমীহ করুক কিন্তু সর্বান্তঃকরণে তাকে গ্রহণ করতে পারছিলো না। এলিনের সান্নিধ্য দস্যু বনহুরকে কোনোরকম মোহমুগ্ধ করে, এটা সে সহ্য করতে পারে না। অবশ্য এলিনের সঙ্গে রহমানের হিংসা নয়, এটা তার মনের অহেতুক একটা দ্বন্দ্ব।

কয়েক দিনের মধ্যেই এলিন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো।

 ডাক্তারের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আর বনহুরের সেবা-যত্নে এলিন ফিরে পেলো তার স্বাভাবিক জীবন।

 এলিনের জন্য রহমানও যে করেনি তা নয়, সেও সর্দারের আদেশে এলিনের অনেক কাজ করেছে। এলিন যে একেবারে চলৎশক্তি রহিত হয়ে পড়েছিলো–মুখে দুধের গেলাসটা তুলে না। ধরলে খাবার কোনো উপায় ছিলো না ওর।

বনহুরই অবশ্য এলিনকে খাবারটুকু খাইয়ে দিতো।

 রহমান একদিন বলেছিলো–সর্দার, একটা নার্স রাখলে হয় না?

বনহুর বলেছিলো-হয়, কিন্তু আমি চাই না আমরা এখানে আছি সেটা বাইরে প্রকাশ পায়। ডাক্তারের মুখ আমি বন্ধ করে দিয়েছি, সে কিছুতেই আমাদের সন্ধান কারো কাছে প্রকাশ করবে না।

এরপর রহমান আর এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেনি।

এখন এলিন সম্পূর্ণ সুস্থ।

সেদিন রহমান বাইরে গেছে।

বনহুর তার কক্ষে বসে একটা বই পড়ছিলো, কিন্তু বইয়ের পাতায় তার মন ছিলো না– ভাবছিলো এলিনের কথা। হাউবার্ড হত্যার পর তাকে কান্দাই ফিরে যেতে হবে। অনেক কাজ তার কান্দাই জমা হয়ে রয়েছে। এলিনকে নিয়ে যত সমস্যা। ওকেও নিয়ে যেতে হবে সঙ্গে–বড় অসহায় অনাথ মেয়ে এলিন। নূরী আর নাসরিন একে কেমনভাবে গ্রহণ করবে কে জানে–

বনহুরের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়–কেউ যেন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফিরে তাকাতেই বিস্মিত হয়ে বলে–এলিন তুমি!

একা একা ভাল লাগছিলো না, তাই এলাম–

তুমি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নও এলিন। এখানে আসাটা তোমার সমীচীন হয়নি।

 মিঃ সোহেল, আপনিও চলুন আমার কক্ষে।

উঠে দাঁড়ায় বনহুর বলে–চলো।

এলিন বনহুরের হাত ধরে এগিয়ে যায়।

 নিজের কক্ষে প্রবেশ করে দু’হাতে মাথাটা টিপে ধরে এলিন–মিঃ সোহেল, আমি বড় অসুস্থ বোধ করছি। আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিন—

 বনহুর ওকে ধরে ফেললো দ্রুতহস্তে।

ঠিক সেই মুহূর্তে রহমান প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে। বনহুর আর এলিন দেখবার পূর্বেই সে আলগোছে বেরিয়ে গেলো পিছন থেকে। রহমান কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো বটে কিন্তু তার মুখমন্ডল রাগে ক্ষোভে রাঙা হয়ে উঠলো। রহমানের মনে সন্দেহের ছায়া রেখাপাত করলো।

রহমান নিজ কক্ষে গিয়ে ক্ষিপ্তের ন্যায় পায়চারী শুরু করলো। ভেবে চললো যা সে দেখলো তা কি সত্য! সর্দার কি সত্যিই এলিনকে নিয়ে প্রেমখেলা শুরু করেছেন? না, তা হতে পারে না। সর্দার কোনোদিন এমন জঘন্য কাজে লিপ্ত হতে পারেন না। কিন্তু কি করে নিজের চোখকে সে অবিশ্বাস করবে। সে নিজে দেখেছে এলিন সর্দারের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। তবে সর্দার কেন তাকে বলেছিলেন এলিনের সঙ্গে তিনি প্রেমের অভিনয় করেছিলেন হাউবার্ডের গোপন রহস্য জেনে নেওয়ার জন্য। এখন তাহলে কি উদ্দেশ্যে এ অভিনয়।

 হঠাৎ রহমান উত্তেজিত হয়ে উঠলো, সে আর একটি দিন এখানে অপেক্ষা করবে না। আজই সর্দারের অনুমতি নিয়ে চলে যাবে সে কান্দাই। তার পূর্বেই ওয়্যারলেসে জানিয়ে দেবে সব কথা নূরীর কাছে।

 রহমান তার কক্ষের গোপন একটা স্থানে বসে ওয়্যারলেসের যন্ত্র খুলে বসলো। নূরীর সঙ্গে কথা হলো রহমানের—নূরী, যে কাজে আমরা এসেছি তা এখনও শেষ হয়নি।– কাপালিক হত্যা করা হয়নি। তাকে কাবু করা হয়েছে মাত্র।

নূরীর ব্যাকুল কণ্ঠ—হুর কোথায়—সে একটি দিনও আমার সঙ্গে কথা বললো না কেন– সে কি সব সময় ব্যস্ত–

রহমান জবাব দিলো—-সর্দার ব্যস্তই বটে—কিন্তু একটা ঘটনা ঘটে চলেছে—

নূরীর প্রশ্ন—ঘটনা—কিসের ঘটনা—বলো বলো—রহমান–বনহুরের তো কোনো অমঙ্গল হয়নি–

রহমান বললো—-না, আল্লার রহমতে তার কোনো অমঙ্গল হয়নি নূরী—

নূরীর কণ্ঠ—কোথায় এখন আমার হুর–

রহমান চাপাস্বরে বললো–সর্দার এখন পাশের কক্ষে—নূরী, একটা অবিশ্বাস্য কথা— হয়তো তুমিও বিশ্বাস করবে না–সর্দার একটা যুবতীর প্রেমে পড়েছে—তাকে নিয়েই পাশের কামরায় সর্দার–

খপ করে রহমানের হাতের মুঠা থেকে বনহুর কেড়ে নেয় ওয়্যারলেস সাউন্ড বক্সটা। কখন। যে বনহুর তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলো দেখতে পায়নি রহমান।

রহমান ফিরে তাকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠে।

বনহুর ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে–রহমান, একি পাগলামি করছিলে? ভ্রূকুঞ্চিত করে বলে আবার কার কাছে জানলে তোমার সর্দার একটি যুবতীর প্রেমে পড়েছে?

রহমান নীরব, কোনো উত্তর সে দিতে পারলো না বা মাথা উঁচু করে তাকাতে পারলো না দস্যু বনহুরের দিকে।

বনহুরও এবার হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো, তারপর হাসি থামিয়ে বললো–আমি সব তো খুলেই বলেছি রহমান। কেন তুমি তোমার সর্দারকে অবিশ্বাস করো?

এবার রহমান মুখ তুললো দৃষ্টি বিনিময় হলো সর্দারের দৃষ্টির সঙ্গে। আশ্চর্য হলো রহমান ঐ চোখে নেই কোনো কুৎসিত লালসার চিহ্ন নেই কোনো পাপময় বাসনার ছায়া। গভীর নীল সুন্দর দুটি চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির আভাস।

রহমান মাথা নত করে নিলো।

বনহুর বললো–রহমান, জানি এলিনের সঙ্গে আমার মেশাটা সত্যি অশোভনীয় কিন্তু আমি পারছি না ওকে দূরে সরিয়ে দিতে। কারণ যতক্ষণ না শিকার হাতের মুঠায় পেয়েছি ততক্ষণ টোপ আমাকে ধরে রাখতেই হবে। এলিনকে ছাড়া শয়তান হাউবার্ডকে আয়ত্তে আনা যাবে না। যত গোপন স্থানেই আমি ওকে লুকিয়ে রাখি না কেন, হাউবার্ড তার খোঁজ পাবেই এবং আসবেই সে যে কোনো মুহূর্তে।

রহমান কিছু বলতে চাইলো কিন্তু বলতে পারলো না। লজ্জায় এতোটুকু হয়ে গেছে যেন সে।

বনহুর বললো আবার–এবং এই কারণেই আমি সর্বক্ষণ এলিনকে আগলে থাকি। একটু হাসলো বনহুর, সরলা নারী ও মনে করে আমি ওকে গভীরভাবে ভালবাসি। তাই এলিন নিজেও আমাকে সব সময় পাশে পেতে চায়। রহমান।

বলুন সর্দার?

কার কাছে এ খবর জানাচ্ছিলে তুমি?

 রহমান ঢোক গিলে বললো–দূরীর কাছে।

 ভালই করেছে। ভাগ্যিস মনিরার কাছে জানাওনি রহমান। আমার বেশি ভয় মনিরাকে।

সর্দার।

হাঁ রহমান, নূরীকে বুঝালে বুঝবে কিন্তু মনিরা বড় অবুঝ। এসো রহমান, তোমার সঙ্গে পরামর্শ আছে।

রহমান সর্দারের আচরণে অভিভূত হয়ে যায়। সে ভেবেছিলো সর্দার তাকে না জানি কি কঠিন শাস্তি দেবে! এত বড় একটা অপ্রীতিকর কথা বলা কম নয়!

রহমানের মাথা সর্দারের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে। তাই তো সে সর্দারকে এতো ভালবাসে, নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসে সে দস্যু বনহুরকে। দস্যু বনহুর স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অনেক উপরে।

*

হাউবার্ডের মৃতদেহ পুলিশ মর্গ থেকে উধাও হবার পর মরিলা দ্বীপে একটা ভীষণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিলো। একে তো কাপালিকের অত্যাচারে মরিলা দ্বীপবাসী অতিষ্ঠ, তারপর এই অদ্ভুত কান্ড। হাউবার্ডের লাশ গেলো কোথায়, পুলিশ অনেক সন্ধান করেও এর কোনো হদিস সংগ্রহ করতে পারেনি। বনহুর হাউবার্ড সম্বন্ধে জানিয়েছিলো–হাউবার্ড কাপালিক নয়, রক্তখাদক এবং তার জীবনটা অত্যন্ত রহস্যময়। পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ লোরী হাউবার্ডের জীবন ডায়রী করার জন্য। বনহুরকে জিজ্ঞাসা করলে সে শুধু বলেছিলো–আজ নয়, পরে আপনাকে আমি সব জানাবো।

আজ হঠাৎ পুলিশ সুপার মিঃ লং এবং পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ লোরী এসে হাজির হলেন বনহুরের হোটেলের ঠিকানায়।

দিনে একবার করে বনহুর আর রহমান যেতে মরিলা হোটেলে কারণ তারা সবাইকে বলতো। হোটেলেই থাকে ওরা। অন্যদিনের মত বনহুর আর রহমান যখন হোটেলে গেছে তখন পুলিশ। সুপার এবং পুলিশ ইন্সপেক্টার ধরে বসলেন। আজ তাঁদের কাছে জানাতে হবে হাউবার্ডের জীবন। কাহিনী। তারা পুলিশ ডায়রী করে রাখবেন এই অদ্ভুত লোকটার জীবনী।

বনহুর রাজি হয়ে গেলো।

 বসলো ওরা সবাই গোলাকার হয়ে ম্যানেজারের ক্যাবিনে।

বনহুর সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বললো–আমি যার জীবন কাহিনী আপনাদের জানাবো সে এখন জীবিত আছে।

অস্ফুট কণ্ঠে বললেন পুলিশ ইন্সপেক্টারহাউবার্ড জীবিত আছে, এ কথা আপনি বিশ্বাস করেন মিঃ সোহেল?

হাঁ, সে জীবিত–এ কথা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করি। বললো বনহুর।

পুলিশ সুপার বললেন–পাশের জানালার মোটা শিক বাঁকানো দেখে আপনি এ ধারণা করেছেন মিঃ সোহেল। এমনও তো হতে পারে ধরুন কেউ বা কারা জানালার মোটা শিক বাঁকিয়ে সে পথে হাউবার্ডের লাশ উধাও করেছে?

বললো বনহুর মিঃ লংআপনিই শুধু নন, অনেকেই বলেন এ কথা। কিন্তু এমন অনেক প্রমাণ আছে যা শুনলে আপনারা বিশ্বাস না করে পারবেন না।

হাউবার্ডের জীবন কাহিনী বলতে গিয়ে এলিনের হরণ কাহিনী এবং তার উদ্ধার পর্যন্ত সব কথা খুলে বললো বনহুর পুলিশ অফিসারদ্বয়ের কাছে। হাউবার্ড জীবিত আছে জেনে পুলিশ সুপার এবং পুলিশ ইন্সপেক্টার মুখ কালো করে ফেললেন। কিন্তু মিঃ সোহেলকে তাঁরা ধন্যবাদ জানালেন বাবার করে।

 হাউবার্ডের দলকে নিহত করে এলিনকে উদ্ধার করা হয়েছে শুনে অনেক খুশি হলেন তারা। কিন্তু এখনও মরিলা দ্বীপের দুর্যোগ কাটেনি যতক্ষণ না হাউবার্ড সত্যিকারের নিহত হয়েছে।

হোটেলে কথাবার্তা শেষ করে বনহুর আর রহমান তাদের গোপন আস্তানায় ফিরছিলো। একটা ঘোড়ার গাড়িতেই তারা চলেছে।

হঠাৎ পথের মধ্যে একটা ট্যাক্সি তাদের গাড়ির পথ রোধ করে।

বাধ্য হয় কোচোয়ান তার গাড়ি রুখতে।

ঘোড়া গাড়ি থেমে পড়তেই ট্যাক্সি থেকে কয়েকজন লোক নেমে পড়লো। প্রত্যেকের দেহেই আঁটসাট ডোরা কাটা ড্রেস। মাথায় ঝাকরা চুল, চোখে কালো চশমা। এরা কোনো গুন্ডা দল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বনহুর চাপাস্বরে বললো–রহমান, গতিক ভাল নয়।

রহমান বললো–সর্দার, পিস্তল বের করবো?

না। চুপ করে বসো, দেখি ওরা কি করে।

ততক্ষণে লোকগুলো ঘোড়ার গাড়িটাকে ঘেরাও করে ফেলেছে। একজন কনিষ্ঠ লোক গাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে বনহুরের জামার কলার চেপে ধরলো।

রহমান বিস্ময়ভরা চোখে তাকায়। সর্দার চুপ করে আছেন ব্যাপার কি? সর্দারের ইংগিতের অপেক্ষায় করতে লাগলো রহমান।

লোকটা বনহুরের জামার কলার ধরে গাড়ি থেকে টেনে নিচে নামিয়ে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে রহমান নিচে নেমে পড়লো তরাস করে।

 লোকটা তখন বনহুকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো–বের করো টাকা-পয়সা কি আছে! বের করো বলছি??

 বনহুর হাত তুলে দাঁড়ালো–যা পাও নিয়ে যাও তোমরা।

রহমান সর্দারের আচরণে অবাক হয়ে গেছে একেবারে। সে ভেবে পাচ্ছে না সর্দার কিছু না। বলে নিরীহ জনের মত ওদের আদেশ পালন করে চলছে কেন? ইচ্ছা করলেই তো সে ওদের কাবু করে নিজের পথ পরিস্কার করে নিতে পারে। সর্দারের এক ঘুষির অপেক্ষা মাত্র—

রহমানের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়, আর একজন লোক রহমানকে এসে ধরে বের করা টাকা পয়সা?

রহমানের দেহে জ্বালা ধরে গেলো, ইচ্ছা হলো এই মুহূর্তে এদের উপযুক্ত সাজা দেয় কিন্তু সর্দারের জন্য সে কিছু না বলে চুপ করে রইলো।

 লোকগুলো বনহুরের দেহে হাতড়ে চলেছে। কারো কারো হাতে ছোরা লাঠিও রয়েছে। অন্ধকারে ছোরাগুলো চক্ করছে যেন।

রহমানকেও হাতড়াচ্ছে দু’জন লোক।

বনহুরের পকেট হাতড়ে যেমন লোকটা রিভলভারে হাত দিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বনহুর প্রচন্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলো ওর নাকে।

হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো লোকটা মুখ থুবড়ে।

 সর্দারকে ঘুষি লাগাতে দেখে রহমান উত্তেজিত হয়ে উঠলো, সেও ঘুষি চালালো ভীষণভাবে।

লোকগুলো এবার সবাই মিলে আক্রমণ করলো বনহুর আর রহমানকে।

বনহুর এবার তার দস্যুরূপ ধারণ করলো, যুদ্ধ শুরু হলো ভয়ঙ্করভাবে। রহমান এবং বনহুর দু’জনা আর ওরা সংখ্যায় প্রায় আট দশ জন হবে।

 বনহুর এক-এক জনকে বজ্রমুষ্ঠাঘাত দ্বারা কাবু করে ফেললো। ছোরা নিয়ে যারা আক্রমণ করলো বনহুর আর রহমান তাদের হাতে মোচড় দিয়ে ছোরাগুলো কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো দূরে।

লাঠি নিয়ে যারা আক্রমণ করলো, তারা নিজেরাই নিজেদের মাথায় আঘাত করে আহত হলো। বনহুর আর রহমানের সঙ্গে পেরে উঠলো না কেউ। অল্পক্ষণেই ওরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচালো।

বনহুর আর রহমান ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসলো।

 কোচোয়ান এতক্ষণ কোচবাক্সে বসে থরথর করে কাঁপছিলো– সে অবাক হয়ে গেছে, তার গাড়ির আরোহীদ্বয়ের অসীম সাহস আর শক্তি দেখে। মাত্র দু’জনার কাছে এতগুলো লোক পরাজিত হয়ে পালালো– কম কথা নয়!

বনহুর আর রহমান ফিরে আসতেই এলিন ছুটে এলো।

ওদের চেহারা দেখে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো– একি অবস্থা? কোথাও কি যুদ্ধ করে এলেন নাকি মিঃ সোহেল, মিঃ রুহেল আপনারা?

বনহুর তার জামার দিকে তাকিয়ে দেখলো, কয়েক স্থানে ছিঁড়ে গেছে। কোথাও বা রক্তের দাগ লেগে আছে। কোথাও ধূলোবালি লেগে রয়েছে। বনহুর বললো-হা, যুদ্ধই করেছি আমরা।

সত্যি বলছেন?

 হাঁ এলিন, ডাকাতের দল আমাদের দু’জনাকে আক্রমণ করেছিলো।

ডাকাতের দল– বলেন কি! ভাগ্যিস কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এলিন বনহুরের দেহে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। সমস্ত অন্তর দিয়ে সে যেন বনহুরের ব্যথা অনুভব করছে।

রহমান নিজ কক্ষে চলে গেলো।

এলিন বললো– জামা খুলে ফেলুন মিঃ সোহেল, অনেক জায়গায় আঁচড় লেগে কেটে গেছে, আমি ঔষধ লাগিয়ে দি।

বনহুর বললো– থাক, তেমনভাবে কোথাও কাটেনি এলিন।

না না, আপনার জামার অনেক জায়গায় রক্তের দাগ লেগে আছে, নিশ্চয়ই কেটে গেছে।

অগত্যা বনহুর নিজ দেহের জামা খুলে ফেলতে বাধ্য হলো এলিনের জেদে পড়েই, না হলে সে খুলতো না সহজে। আজও এলিন বনহুরের নগ্নদেহ স্বচক্ষে দেখেনি।

এলিন বনহুরের সুন্দর সুঠাম বলিষ্ঠ শরীরের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলো। সহসা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারলো না এলিন।

 বনহুর এলিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো, তারপর বললো– কই, ওষুধ লাগিয়ে দাও?

এলিন ওষুধের শিশি আর তুলো হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে এলো বনহুরের পাশে। নিজের হাতে বনহুরের দেহের সামান্য ক্ষতগুলোতে যত্নসহকারে ওষুধ লাগিয়ে দিতে লাগলো।

ওষুধ লাগিয়ে দেবার সময় এলিন আলগোছে চুম্বন করলো বনহুরের পিঠে। বললো এলিন– মিঃ সোহেল, সত্যি আপনি অপূর্ব…..

বনহুর হাসলো, কোনো জবাব দিলো না এলিনের কথায়।

এলিন বললো আবার আপনার পৌরুষদীপ্ত চেহারা, আপনার শান্ত-গম্ভীর কণ্ঠস্বর আমাকে অভিভূত করে ফেলেছে, মিঃ সোহেল..

বনহুর অস্ফুট কণ্ঠে বললো– এলিন!

আপনাকে পেয়েছি আমি, এ আমার পরম সৌভাগ্য। মিঃ সোহেল, একটা কথা বলব?

বলো?

আপনি আমাকে ভালবাসেন কিনা জানতে চাই। এলিন দু’হাতে বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরে।

বনহুর বলে– আমি তোমাকে অত্যন্ত ভালবাসি এলিন। তোমাকে ভালবাসি বলেই তো আজও আমি মরিলা দ্বীপে পড়ে আছি।

বনহুর এলিনকে খুশি করবার জন্যই কথাগুলো বললো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া এলিনের মত সরল-স্বাভাবিক একটা মেয়েকে ব্যথা দিতে মন তার চাইলো না।

*

পাশাপাশি দু’টো বিছানায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন দস্যু বনহুর আর এলিন। আজকাল বনহুর এলিনকে নিজ কক্ষেই রাখে, কারণ যে কোনো মুহূর্তে এলিনের বিপদ ঘটতে পারে। হাউবার্ড যে হানা দেবেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং সে জন্যই বনহুর এলিন ব্যাপারে সদা-সর্বদাই সজাগ। থাকতো।

আজও বনহুর জেগেছিলো, হঠাৎ কখন যে একটু নিদ্রা এসেছে সে জানে না।

রহমান কিন্তু ঘুমাতে পারেনি, সে নিজের বিছানায় শয়ন করে লক্ষ্য করছিলো সবকিছু। সর্দার নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লো, এটাও রহমান তীক্ষ্ণভাবে খেয়াল করেছে। বিশেষ করে এ মুহূর্তে তাকে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে।

বনহুর আর এলিনের বিছানা পাশাপাশি ছিলো।

রহমান শয়ন করতে কিছুদূরে অন্য একটি শয্যায়।

প্রথমে কয়েক দিন এ কক্ষে একটি শয্যা ছাড়া কোনো শয্যা ছিলো না। তখন এলিনকে এই শয্যায় শয়ন করতে দিয়ে বনহুর নিজে সোফায় শয়ন করতো।

রহমান শয়ন করতে পাশের কামরায়।

কয়েক দিন হলো বনহুর নিজে এ ব্যবস্থা করেছে।

এলিনকে সদা দৃষ্টিপথে রাখাই শুধু বনহুরের মূল উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য এলিনকে রক্ষা করা এবং কাপালিক শয়তান হাউবার্ড কে হত্যা করা।

হাউবার্ড নিহত হলেই বনহুর মরিলা দ্বীপ ত্যাগ করবে। এখানকার কাজ তার শেষ হবে।

বনহুর শুয়ে শুয়ে কান্দাই আস্তানার কথা ভাবছিলো তারপর কখন যে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছে, সে নিজেই জানে না।

রহমান বালিশের তলা থেকে রিভলভার বের করে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, ভয় হয় সে আবার ঘুমিয়ে না পড়ে। রিভলভার হাতে নিয়ে বনহুর আর এলিনের শিয়রে পায়চারী করতে থাকে সে। বারবার হাই তুলতে থাকে রহমান।

ন্দ্রিায় দু’চোখ জড়িয়ে আসছে যেন ওর।

আপন মনে পায়চারী করছে রহমান– দক্ষিণ হস্তে রিভলভার, বাম হস্ত মুষ্টিবদ্ধ।

হঠাৎ একটা শব্দে রহমান চমকে উঠলো। বিদ্যুৎগতিতে ফিরে তাকালো ওপাশের বন্ধ জানালার দিকে। বিস্ময়ে আড়ষ্ট হলো সে, জানালার ফাঁকে দু’খানা হাত জানালার মোটা মোটা লোহার শিকগুলোকে বাঁকিয়ে ফেলছে!

রহমান মুহূর্তে বনহুরের শয্যার পাশে এসে মৃদু ধাক্কা দিলো তার দেহে, চাপাস্বরে বললো– সর্দার…সর্দার…

বনহুর উঠে বসলো দ্রুতগতিতে, তারপর বললো– রহমান, কি ব্যাপার?

আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো রহমান ওদিকের জানালাটা।

বনহুর ওদিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হলো না, সে রহমানসহ দ্রুত আড়ালে সরে দাঁড়ালো। বনহুর রিভলভারখানা চেপে ধরলো দক্ষিণ হস্তে।

অল্পক্ষণেই জানালার শিকগুলো বাঁকা হয়ে গেলো। একটা মাথা প্রবেশ করলো সন্তর্পণে।

বনহুর আর রহমান দেয়ালের সঙ্গে ঠেশ দিয়ে রইলো, তাদের হাতের রিভলভার দুটি উদ্যত রয়েছে।

রহমান চাপাস্বরে বললো– সর্দার, হাউবার্ড স্বয়ং….

হাঁ, আমি দেখতে পাচ্ছি। ওকে ভিতরে প্রবেশ করতে দাও।

হাউবার্ড তখন বাম হস্তে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরাসহ জানালাপথে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে।

এগিয়ে আসছে হাউবার্ড এলিনের বিছানার দিকে।

রহমান কিছু বলতে যাচ্ছিলো।

বনহুর ওর মুখে হাতচাপা দিয়ে তাকে কথা বলতে বারণ করলো।

হাউবার্ডকে ঠিক অসুরের মতই মনে হচ্ছে। গেঞ্জি গায়ে, পুরানো একটা রং-উঠা ফুলপ্যান্ট। মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল, মুখেও খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ দুটো যেন আগুনের ভাটার মত জ্বলছে। ডান হাতখানায় ব্যান্ডেজ জড়ানো।

বনহুর বুঝতে পারলো, সেদিন তারই গুলীতে হাউবার্ডের এই অবস্থা হয়েছে। লোকটার দুঃসাহস কম নয়, একটি মাত্র হাত নিয়ে এসেছে এলিনকে হরণ করতে।

বনহুর দেখলো, এটাই একমাত্র সুযোগ, সে এক লাফে এসে পড়লো হাউবার্ডের সম্মুখে খবরদার, এগুবে না হাউবার্ড।

চমকে উঠলো হাউবার্ড কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য, মুহূর্তে দেহে এক ঝাঁকি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। হুঙ্কার ছাড়লো– এলিন কোথায়?

ততক্ষণে রহমান এলিনের পাশে গিয়ে রিভলভার উদ্যত করে দাঁড়িয়েছে।

হাউবার্ডের বজ্রকণ্ঠে জেগে উঠেছে এলিন। সে ভয়বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে বনহুর আর হাউবার্ডের দিকে! হাউবার্ড এলিনকে দেখে ভীষণ হয়ে উঠলো। বনহুরকে আক্রমণ করলো সে। ক্রুদ্ধ ব্যাঘের মত।

বনহুর সেই দন্ডে সরে দাঁড়ালো।

হাউবার্ড হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে। দক্ষিণ হাতে বুঝি আঘাত লেগেছিলো তাই। মুখটা বিকৃত হয়ে উঠলো যন্ত্রণায়। বনহুর সেই সুযোগে হাউবার্ডের বাম হাত লক্ষ্য করে গুলী। ছুঁড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ছোরাখানা ছিটকে পড়লো দেয়ালের পাশে।

হাউবার্ড গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু বাম হাতখানা ঝুলে পড়েছে– রক্ত ঝরছে ঝরঝর করে। হাউবার্ডের মুখ কালো হয়ে উঠেছে।

বনহুর দাঁতে দাঁত পিষে বললো– হাউবার্ড, তুমি শুধু নর হত্যাকারীই নও, তুমি শয়তান! তাই তোমাকে হত্যা করে আমি মুক্তি দেবো না। তোমাকে ধুকে ধুকে মারবো।

হাউবার্ড বিকৃত কণ্ঠে বললো– মিঃ সোহেল, তুমি– তুমিই আমাকে এইভাবে নাকানি চুবানি খাওয়ালে! আমি……..

কিন্তু সে সুযোগ তুমি পাবে না হাউবার্ড-হাঃ হাঃ হাঃ…. হেসে উঠলো বনহুর অদ্ভুতভাবে।

রহমান আর এলিন তখন বনহুরের অনতিদূরে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ্য করছিলো। হাউবার্ড গরিলার মত ভীষণ আকারের দেহটা দুলিয়ে বনহুরের দিকে অগ্রসর হলো, দাঁত দিয়ে কামড়ে দেবে সে বনহুরকে।

 ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুরের রিভলভার গর্জে উঠলো, গুলীর শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই হাউবার্ডের বিরাট দেহটা গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো, যেন ঠিক আহত সিংহের গর্জন। বারকয়েক গড়াগড়ি দিয়ে নীরব হয়ে গেলো দেহটা। বনহুর এবার এলো। হাউবার্ডের পাশে, পা দিয়ে উল্টে চিৎ করে দিলো ওর দেহটা, তারপর হঠাৎ হেসে উঠলো বনহুর আপন মনে– হাঃ হাঃ হাঃ……।

এলিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো, এমন করে মিঃ সোহেলকে সে হাসতে দেখেনি কোনোদিন।

রহমান নীরবে তাকিয়ে রইলো, সে খুব খুশি হয়েছে। হাউবার্ড নিহত হওয়ায় এবার তারা নিশ্চিন্ত।

বনহুর হাসি বন্ধ করে বললো– এলিন, আজ থেকে মরিলা দ্বীপ পাপমুক্ত হলো। হাউবার্ড আর জীবিত হবে না। রহমান, যাও পুলিশ অফিসে গিয়ে সংবাদ দাও, শয়তান হাউবার্ড এবার সত্যি সত্যি নিহত হয়েছে।

রহমান বেরিয়ে গেলো সর্দারের আদেশ পেয়ে।

এলিন বনহুরের বুকে মাথা রেখে বললো– মিঃ সোহেল, আপনি আমাকে বাঁচালেন। আমাকে রক্ষা করলেন…….

বনহুর এলিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো– এবার তুমি নিজকে রাহুমুক্ত মনে করতে পারো এলিন।

অল্পক্ষণের মধ্যে পুলিশ সুপার, পুলিশ ইন্সপেক্টার, আরও অন্যান্য বনহুরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন– অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি মিঃ সোহেল। আপনার চেষ্টায় আজ মরিলা দ্বীপবাসী নবজীবন লাভ করলো। আপনি শয়তান কাপালিক হাউবার্ডকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছেন, এজন্য আপনাকে আমরা পুরস্কৃত করবো।

বনহুর হেসে বললো– মিঃ লং, পুরস্কারের লোভ আমার নেই। আপনি সেই অর্থ মরিলা। দ্বীপবাসীর অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করে দেবেন!

বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন পুলিশ অফিসারগণ মিঃ সোহেলবেশী দস্যু বনহুরের মুখের দিকে। অদ্ভুত মানুষ এই মিঃ সোহেল, ভাবেন তারা মনে মনে।

 এরপর বিদায়ের পালা।

মরিলা দ্বীপের কাজ শেষ হয়েছে, বনহুর আর রহমান এবার মরিলা দ্বীপ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুতি নিলো, সমস্যা হলো এলিনকে নিয়ে। •

এলিন নিঃসহায় অনাথা মেয়ে। মরিলা দ্বীপে তার কেউ নেই, সে এলিনকে আশ্রয় দেবে। তাছাড়া এলিন তার ছোটবেলার কিছু বলতে পারে না, কোথায় তার দেশ, কে তার বাবা-মা, কিছুই সে জানে না।

বনহুর ওকে নিয়ে চিন্তিত হলো। কান্দাই আন্তানায় নিয়ে গেলে নূরী ওকে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। বিশ্বাসও করবে না কোনো রকমে।

অনেক ভেবেও কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হলো না। এলিনের সম্মুখে রহমানকেও কিছু বলতে পারছে না বনহুর।

 বনহুরকে চিন্তামগ্ন দেখে রহমান বুঝতে পারলো, সর্দাররের মনে কিসের যেন একটা অশান্তি জটলা পাকাচ্ছে। একসময় সে বললো– সর্দার, আপনি কোনো ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছেন বলে মনে হচ্ছে?

হাঁ রহমান, অত্যন্ত ভাবনায় আছি। একটু থেমে বললো– এলিন কোথায়?

 এলিন বাগানে।

 বসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে।

 রহমান পাশের চেয়ারে বসে পড়লো।

বনহুর সিগারেট-কেসটা বের করে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বললো– কাল ভোরে আমরা মরিলা দ্বীপ ত্যাগ করবো কিন্তু সমস্যা হলো এলিনকে নিয়ে। রহমান, এলিনকে নূরী কিছুতেই গ্রহণ করবে না। সে যে বিভ্রাট সৃষ্টি করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

রহমান মাথা চুলকে বললো– সে কথা মিথ্যা নয় সর্দার, এলিনকে নিয়ে সমস্যাই হবে।

 বনহুর বললো- একটা উপায় করতে হবে তো?

সর্দার, এলিনকে আমাদের শহরের আস্তানায় রাখলে হয় না?

হাঁ, ঠিক বলেছো রহমান, আপাততঃ তাকে কান্দাই আমার শহরের আস্তানায় রাখতে হবে। বনহুর যেন কতকটা আশ্বস্ত হলো এবার।

এমন সময় এলিন এসে পড়লো সেখানে, হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো– মিঃ সোহেল, আপনি এখানে? আমি আপনাকে খুঁজে ফিরছি……চলুন না বাগানে যাই?

বনহুরের হাত ধরে ছোট্ট বালিকার মত আব্দারভরা কণ্ঠে বললো এলিন শেষ কথাটা।

বনহুর একটু হেসে তাকালো রহমানের দিকে, তারপর বেরিয়ে গেলো এলিনের সঙ্গে।

রহমান মাথা নিচু করে হাসলো– সে বুঝতে পারলো, এলিনের আব্দার রক্ষা করতে সর্দার নাজেহাল হয়ে পড়েছে। সর্দার অভিনয় করেছিলো, এলিন ভালবেসে ফেলেছে তাকে গভীরভাবে। ওকে সহসা এড়ানো বড় মুস্কিল হবে এখন।

*

কান্দাই পৌঁছে বনহুর রহমান আর এলিনসহ সর্বপ্রথম বনহুরের শহরের আস্তানায় গেলো। সেখানে এলিনকে রেখে বললো বনহুর– এখানে তুমি থাকবে এলিন, এরা সবাই তোমাকে সমীহ করে চলবে। তোমার আদেশ পালন করবে।

এলিন বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে বললো– আপনি? আপনি থাকবেন না এখানে?

আপাততঃ আমাকে যেতে হবে এলিন। আমার অনেক কাজ আছে। মাঝে মাঝে এসে তোমার সংবাদ নেবো।

এলিন আরও এঁটে ধরে বনহুরের জামাটা– না, আমি আপনাকে যেতে দেবো না মিঃ সোহেল।

এলিন, তুমি ছেলেমানুষি করো না। কথা দিলাম, তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।

আপনি আসবেন তো?

হাঁ, আসবো। মিঃ রুহেলও এসে সংবাদ নেবে তোমার।

শেষ পর্যন্ত এলিন রাজি হলো, বনহুরের জামার আস্তিন ছেড়ে দিয়ে বললো– আচ্ছা যান, তবে না এলে আমি কিন্তু কেঁদে একাকার করবো।

হাসলো বনহুর, তারপর বেরিয়ে গেলো রহমানসহ।

পাশাপাশি গাড়িতে বসেছিলো বনহুর আর রহমান। বনহুর স্বয়ং ড্রাইভ করছে। রহমান নীরবে তাকিয়ে ছিলো বাইরের দিকে।

নির্জন প্রশস্ত পথ।

সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা। জমাট অন্ধকারে পৃথিবী এখনও আচ্ছন্ন হয়নি। আকাশে পাখির ঝাঁক ফিরে চলেছে নিজ নিজ আবাসে।

 পথের দু’ধারে শস্যশ্যামল ধান ক্ষেতের উপরে বেলা শেষের ম্লান আলোকরশ্মি এখনও মিশে যায়নি। বনহুরের গাড়ি স্বাভাবিক গতিবেগে এগিয়ে চলছে।

হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার কানে আসে বনহুর আর রহমানের। করুণ প্রাণফাটা সে চিৎকার বাঁচাও, বাঁচাও, কে আছো বাঁচাও..

বনহুর মুহূর্তে গাড়ি থামিয়ে ফেললো।

রহমান বললো– সর্দার, কেউ বাঘের কবলে পড়েছে। দেখছেন না ওদিকে গভীর জঙ্গল!

বনহুর বললো– এসো দেখা যাক কি ব্যাপার।

বনহুর রিভলভার বের করে নিলো হাতের মুঠায়।

 রহমানও প্রস্তুত হলো, গুলী ভরে নিলো রিভলভার।

বনহুর দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ছুটলো জঙ্গল লক্ষ্য করে, রহমান তাকে অনুসরণ করলো।

জঙ্গলমধ্যে প্রবেশ করতেই বনহুর দেখলো, কয়েকজন লোক একটা লোককে ভূতলে ফেলে তার দেহের নানা স্থানে অস্ত্রাঘাত করে চলেছে।

বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে গুলী ছুঁড়লো কিন্তু গুলী কারো দেহে বিদ্ধ হবার পূর্বেই সবাই জঙ্গলমধ্যে গা ঢাকা দিলো। এতো দ্রুত লোকগুলো অদৃশ্য হলো তাতে বনহুর আর রহমান স্তম্ভিত না হয়ে পারলো না। অতি দক্ষ শয়তান দল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 বনহুর আর রহমান তাড়াতাড়ি এসে দেখলো লোকটার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। রক্তাক্ত দেহটা পড়ে আছে চিৎ হয়ে। হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো, মৃতদেহটার পাশে পড়ে আছে একখানা কাগজের টুকরা।

বনহুর কাগজখানা খুলে মেলে ধরলো, মাত্র দুটি লাইন লেখা রয়েছে কাগজখানায়–

মতিচুর মালা পাঠালাম।
মালাটা নিয়ে একেবারে খতম করে দেবে,
তাহলেই সব কথা বন্ধ হয়ে যাবে, বুঝলে?
 চিঠিখানা পড়ে ছিঁড়ে ফেলো।
তোমাদের বন্ধু
মো…ন।

 বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ালো অস্ফুট কণ্ঠে বললো– কান্দাই ফিরে না আসতেই একটা শয়তানের পাল্লায় পড়লাম। চলো রহমান, এখানে এক মুহূর্ত বিলম্ব করা ঠিক নয়।

চলুন সর্দার। কিন্তু লাশটা…..

 ওটার কোনো প্রয়োজন নেই।

 বনহুর আর রহমান ফিরে এলো গাড়ির পাশে।

তখন সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে।

 বনহুর চালকের আসনে বসলো।

উল্কা বেগে গাড়ি ছুটলো।

বনহুর বললো– রহমান, এক্ষণে আমি আস্তানায় ফিরে যাবো না।

তাহলে কোথায় যাবেন সর্দার?

আপাততঃ কান্দাই শহরের বিভিন্ন রাস্তায়। কারণ আমাদের গাড়িখানাকে কেউ ফলো করতে পারে।

হাঁ সর্দার, ঠিক বলেছেন।

বনহুর গাড়ি ব্যাক করে আবার অন্য পথ ধরে।

রহমান বললো- সর্দার, এই হত্যাকান্ডটা……

হাঁ, রহমান, অত্যন্ত রহস্যজনক। বহুদিন আমি কান্দাই ত্যাগ করে বাইরে ছিলাম, তাই আবার এমনি কত শয়তান মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার হিসাব নেই। আমাকে আবার পাপকাজে নিযুক্ত হতে হবে রহমান।

সর্দার।

পাপ মানে অন্য কিছু কুৎসিত কাজ নয় রহমান। কতগুলো লোক প্রাণ হারাবে অহেতুক……

সর্দার, এটা অহেতুক নয়। আমি জানি, আমার সর্দার কোনোদিন অহেতুক কারো প্রাণনাশ করেন না! সর্দার, আমি একটা কথা বলতে চাই!

বলো?

 মতিচুর মালা, সেকি সর্দার?

 এ মালা অত্যন্ত মূল্যবান। লক্ষ টাকার চেয়েও বেশি এর দাম, বুঝলে?

সর্দার, চিঠিখানা পড়ে আপনি কি বুঝলেন?

কোনো শয়তান তার দলের কাছে এই মতিচুর মালা লোক দ্বারা প্রেরণ করে এবং তারই। হাতে বন্ধ করা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, মালা গ্রহণ করার পর তাকে যেন হত্যা করা হয়। তা, লোকটা সত্যিই নির্বোধ, নাহলে অমন করে প্রাণ হারাতো না। টাকার লোভেই যে সে এ কাজ করতে সম্মত হয়েছিলো তাতে সন্দেহ নেই।

সর্দার, নিচের নামটা?

নামটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে রহমান। অতি সংক্ষেপে শয়তান তার নাম সই। করেছে…তারপর ফাঁক রেখে…নাম লিখেছে। আগের এবং শেষ অক্ষর ব্যবহার করেছে।

গাড়িখানা তখন ফিরে এসেছে আবার কান্দাই শহরের বুকে।

বনহুর বললো আবার রহমান, আর কতক্ষণ এভাবে পথে পথে গাড়ি নিয়ে ঘুরে। বেড়াবো?

সর্দার, আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাদের ফলো করেনি।

তোমার মনের কথা সত্য নয় রহমান। আমাদের গাড়ি-খানাকে কোনো নিপুণ সন্ধানী গাড়ি ফলো করছে। তুমি অপেক্ষা করো, আমি অল্পক্ষণেই তোমাকে এর প্রমাণ দেখিয়ে দেবো।

 বনহুরের কথায় রহমান অত্যন্ত আশ্চর্য হলো। কারণ, সে লক্ষ্য করেছে, এতোক্ষণ তাদের গাড়িখানার পিছনে এক নাগাড়ে কোনো গাড়িই অগ্রসর হয়নি যাতে কোনো সন্দেহ জন্মাতে পারে।

বনহুর গাড়ির স্পীড কমিয়ে দিলো।

গাড়িখানা এখন জনবহুল রাজপথ বেয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো, দু’পাশে অসংখ্য বৈদ্যুতিক আলোক সুসজ্জিত দোকান, রেষ্টুরেন্ট, সিনেমা হল এবং হোটেল।

বনহুরের গাড়ির পাশ কেটে চলে যাচ্ছে নানারকম যানবাহন।

বনহুর গাড়ির স্পীড কমিয়ে দিতেই একখানা ধূসর রংএর গাড়ি তাদের গাড়িখানার পাশ কেটে চলে গেলো।

 বনহুর বললো– দেখলে, যে গাড়িখানা এই মুহূর্তে চলে গেলো সেখানাই আমাদের গাড়িকে ফলো করছিলো এতক্ষণ।

রহমান বললো– তাহলে এতক্ষণ আমরা ঐ গাড়িখানা দেখতে পাইনি কেন সর্দার?

 হাঁ, বলতে ভুল হয়েছে আমার। আসলে আমাদের গাড়িখানাকে ঐ ধূসর রং-এর গাড়িখানা ফলো করেনি, করেছিলো গাড়ির ভিতরের লোক। বার বার তারা গাড়ি বদল করে আমাদের অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে। চলো রহমান, এখন আমরা সম্মুখে বার-এ গিয়ে হাজির হই। কতদিন নাচগান দেখিনি শুনিনি।

রহমান কিছু না বলে নীরবে রইলো।

বনহুর তার গাড়িখানাকে বার-এর সম্মুখে রেখে নেমে পড়লো।

রহমান লক্ষ্য করলো, একটু পূর্বে যে গাড়িখানা তাদের পাশ কেটে চলে গিয়েছিলো বার এর অদূরে, সেই-গাড়িখানা দাঁড়িয়ে আছে।

বনহুর আর রহমান প্রবেশ করলো ভিতরে।

 বনহুর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই শুনতে পেলো নানারকম হাসি আর গল্পের আওয়াজ। আরও দেখলো, অগণিত নারী-পুরুষ প্রত্যেকটি টেবিলে জটলা করে বসে আছে। সম্মুখে নানারকম খাদ্যসম্ভার, মদের বোতল আর কাঁচের গেলাস রয়েছে।

বনহুর একটা খালি টেবিল দেখে বসে পড়লো। রহমানকেও বসার জন্য ইংগিত করলো।

বনহুর আর রহমান আসন গ্রহণ করতেই বয় এসে কিছু ফলমূল আর মাংস রেখে বললো– শরাব চাই স্যার?

বনহুর প্লেট থেকে ছুরি আর একটা আপেল হাতে উঠিয়ে নিয়ে বললো– নিয়ে এসো।

বয় চলে গেলো।

রহমান জানে, তার সর্দার কোনোদিন শরাব স্পর্শ করেন না। হয়তো এটাও তার অভিনয়। রহমান একখানা ছুরি আর একটা ফল হাতে তুলে নিলো।

বয় শরাব এনে রাখলো টেবিলে, আর কাঁচের দুটো গেলাস।

চলে গেলো বয়।

রহমানকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর রহমান, ওদিকে টেবিলে তিনজন লোক আমাদের দেখছে।

রহমান সর্দারের কথায় সোজাসুজি না তাকিয়ে একটা আপেল মেঝেতে ফেলে দিলো, তারপর ফিরে তুলে নেবার সময় তাকিয়ে দেখলো, সত্যিই তিনজন লোক তাদের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন বলাবলি করছে। এবার একজন উঠে চলে গেলো বার-এর ভিতরে।

বনহুর বললো– রহমান, ওরা কোনো মতলব নিচ্ছে। উদ্দেশ্য মোটেই ভাল নয়।

রহমান বললো এখানে বিলম্ব না করে……

তুমি জানো না রহমান, আমি কোন্ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছি। এই হোটেল-বারই হলো সেই মো…ন’র আসল আড্ডাখানা। নাও, খেতে শুরু করো.. ..কথার ফাঁকে বনহুর ফল কেটে মুখে ফেলতে থাকে।

রহমানও খেতে আরম্ভ করলো।

এমন সময় মুখে পাতলা আবরণ জড়ানো একটা সুন্দরী তরুণী নর্তকী সিঁড়ি বেয়ে নাচতে নাচতে নেমে আসে বার এর মেঝেতে।

একসঙ্গে সকলের দৃষ্টি চলে যায় সিঁড়ির নিচের দিকে।

 নর্তকী তখন নাচের তালে তালে সুরের ঝঙ্কার সৃষ্টি করে নেমে আসছে।

বনহুর আর রহমান অবাক চোখে তাকালো।

 নর্তকী নেমে এলো নিচে।

ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকটা টেবিলের পাশে যাচ্ছে নর্তকী আর গানের ঝঙ্কার তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে সকলের। কারো টেবিল থেকে মদের বোতল তুলে নিয়ে ঢেলে দিচ্ছে নিজের মুখে, আবার কখনও বা ঢেলে দিচ্ছে টেবিলের পাশে বসা পুরুষগুলোর মুখ-গহ্বরে।

বনহুর বললো– রহমান, এরা অত্যন্ত চালাক লোক। দেখলেনা লোকটা উঠে গিয়ে কেমন ট্রেনিং দেওয়া একজন নর্তকীকে এনে হাজির করলো।

তাইতো দেখছি সর্দার। বড় বদমাইশ এরা। ঐ দেখুন সর্দার, যে লোকটা ভিতরে উঠে গিয়েছিলো, আবার সে ফিরে এসে নিজের আসন গ্রহণ করলো।

হাঁ, ওরা বারবার আমাদের দু’জনাকে লক্ষ্য করছে। কুমতলব আছে এটা নিঃসন্দেহ।

ঠিক সেই মুহূর্তে নর্তকীটা নাচের তালে তালে এসে বনহুরের টেবিল থেকে শরাবের বোতলটা তুলে নিলো হাতে, তারপর বোতল থেকে খানিকটা শরাব গেলাসে ঢেলে এগিয়ে ধরলো বনহুরের মুখের কাছে।

বনহুর বিলম্ব না করে খপ করে ধরে ফেললো নর্তকীটির গেলাসসহ হাতখানা। ঝাঁকি লেগে খানিকটা শরাব পড়ে গেলো টেবিলের উপরে। সঙ্গে সঙ্গে নর্তকীর কণ্ঠে গানের সুরও থেমে গেলো দমকা হাওয়ার নিভে যাওয়া প্রদীপের মদ দপ করে।

বনহুর নর্তকীর হাতখানা ধরে ফেলতেই ওপাশে টেবিলে বসা লোক তিনজন ধা করে ছুটে এলো। কেউ বা ছোরা বের করলো বিদ্যুৎগতিতে।

 বনহুর ধীর গতিতে উঠে দাঁড়ালো। তখনও তার হাতের মুঠায় নর্তকীর গেলাসসহ হাতখানা রয়েছে।

নর্তকী একবার তাকাচ্ছে বনহুরের দিকে, একবার অন্যান্য লোকগুলোর মুখে যারা ক্রুদ্ধ শার্দুলের মত ছুটে এসে টেবিলের চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।

রহমানও উঠে দাঁড়িয়েছে, বারবার তার হাতখানা প্যান্টের পকেটে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো।

 সর্দার পকেটে হাত প্রবেশ করার চেষ্টা করছে না দেখে সেও নিশ্চুপ রয়েছে।

হঠাৎ একজন ছোরা উদ্যত করে ঝাঁপিয়ে পড়ে বনহুরের উপর, সঙ্গে সঙ্গে বনহুর ওর ছোরাসহ হাতখানা ধরে ফেলে এবং প্রচন্ড এক লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ওকে দূরে।

মুহূর্ত বিলম্ব না করে আর একজন আক্রমণ করে বনহুরকে, তাকেও বনহুর প্রচন্ড এক ঘুষি দিয়ে ধরাশায়ী করে।

ততক্ষণে রহমানের সঙ্গেও তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

বার-এর মধ্যে চললো সেকি ভীষণ ধস্তাধস্তি! বনহুরের প্রচন্ড ঘুষি খেয়ে এক একজন মরিয়া হয়ে উঠলো। কে কোন্ দিকে পালাবে যেন দিশে রইলো না।

বনহুর একজনকে ধরাশায়ী করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো, সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর কণ্ঠস্বর– বন্ধু, অত ক্ষেপেছো কেন? ওরা তো সব নেংটি ইঁদুর!

ফিরে তাকালো বনহুর, দেখলো একটা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে তার কাঁধে হাত রেখে।

রহমান একজনের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত ছিলো, সে তার বিপরীত জনকে ভূতলে ফেলে ছোরা। বসিয়ে দিতে গেলো তার বুকে।

বনহুর বললো ছেড়ে দাও রহমান।

রহমান তৎক্ষণাৎ সর্দারের আদেশ পালন করলো, উঠে দাঁড়ালো রহমান ভূতলশায়ী . লোকটার বুকের উপর থেকে।

বনহুর নিজের কাঁধ থেকে লোকটার হাতখানা সরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো– ওরা নেংটি ইঁদুর। তুমি কে বন্ধু?

একটু হেসে বললো লোকটা– আমি কে, তাই না?

 হাঁ, তুমি কে জানতে চাই?

আমি এই বার-এর মালিক।

 তা তোমার পোষা নেংটি ইঁদুরগুলো অত বেয়ারা কেন?

আমার পোষা নয়, ওরা বাইরের লোক।

বনহুর জামাটা গুটিয়ে নিয়েছিলো লড়াই-এর পূর্বে। এবার সে হাতলের আস্তিন মেলে দিতে দিতে বলে– তাই বলো, তোমাকে দেখে বেশ অভদ্র বলেই মনে হচ্ছে, আর ওরা একেবারে যা তা…….।

ঠিকই বলেছো ভাই। লোকটা গদগদ কণ্ঠে বললো।

ভাই নয়, বন্ধু বলো। তীব্র কণ্ঠে কথাটা বললো বনহুর। এবার রহমানকে লক্ষ্য করে বললো। সে- চলো এবার যাওয়া যাক।

লোকটা শান্তকণ্ঠে বললো– যাবে কেন বন্ধু, বসো তোমরা; খাওয়াতে হয়নি? চলো বন্ধু চলো।

লোকটা বনহুরের হাত ধরে টেবিলের পাশে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।

 বনহুর আসন গ্রহণ করতেই রহমান নিজেই বসে পড়লো একটা চেয়ার দখল করে নিয়ে।

 লোকটা বসে পড়লো।

 সমস্ত বার-গৃহ তখন পূর্বের ন্যায় শান্ত আকার ধারণ করেছে।

নর্তকীটা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে।

 লোকটা বললো বন্ধু, কি খাবে তোমরা?

বনহুর বললো- খাওয়া আমাদের শেষ হয়েছে।

কলিং বেলে হাত রাখলো লোকটা।

তৎক্ষণাৎ বয় ছুটে এলো, দাঁড়ালো টেবিলের পাশে।

লোকটা বললো– মাংস আর খাঁটি জিনিস নিয়ে এসো।

বয় চলে গেলো।

লোকটা হেসে বললো– খাঁটি জিনিস কাকে বলে হয়তো জানো না। এই যে সম্মুখে বোতল দেখছো সব বাজে। এবার আসবে খাঁটি মাল……

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো– ওসব আমি খাই না।

লোকটা হো হো করে হেসে উঠলো, সে বনহুরকে সাধারণ কোনো এক শক্তিশালী লোক মনে করেছে এবং সেই কারণেই সে হাসলো অমন করে। তারপর হাসি থামিয়ে বললো– বন্ধু একদিন খেলে তুমি জীবনভর মনে রাখবে। আমাদের এখানে সবরকম মাল আছে।

রহমান চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলো সর্দার আর লোকটার কথাবার্তা।

বয় দু’বোতল খাঁটি মাল এনে সামনের টেবিলে রাখলো আর রাখলো মাংসের পাত্র।

বনহুর রহমানকে ইংগিত করলো খেতে।

নিজেও বনহুর মাংস আর কাঁটা-চামচ টেনে নিয়ে মাংস তুলে খেতে আরম্ভ করলো।

রহমান সর্দারের আদেশ পালন করলো, সেও কাঁটা-চামচ তুলে নিলো হাতে।

 রহমান খাচ্ছে আর বারবার তাকাচ্ছে সর্দারের মুখের দিকে।

 বনহুর আপন মনে খেলো, তারপর বোতল থেকে শরাব ঢেলে গেলাসটা তুলে নিলো হাতে।

রহমান শিউরে উঠলো, কারণ তার সর্দার শরাব পানে অভ্যস্ত নয়। আজ কি সে শরাব পান। করবে?

রহমান অবাক হলো, বনহুর ঢকঢক করে শরাব পান করলো।

এক গেলাস নয়, পর পর দু’তিন গেলাস পান করে উঠে দাঁড়ালো জড়িতকণ্ঠে বললো চলো রহমান। আচ্ছা বন্ধু, আবার দেখা হবে। হাত বাড়িয়ে লোকটার সাথে করমর্দন করলো বনহুর, তারপর বেরিয়ে গেলো।

গাড়ির দিকে এগুলো বনহুর ও রহমান।

বনহুর টলতে টলতে গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো।

 রহমান ড্রাইভ আসনে উঠে বসলো তাড়াতাড়ি করে।

কারণ সর্দারের এই মুহূর্তে গাড়ি চালানো কিছুতেই সম্ভব নয়।

 রহমানকে ড্রাইভ আসনে উঠে বসতে দেখে বনহুর গাড়ির সম্মুখ দিয়ে ওপাশে গিয়ে বসলো।

রহমান গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

 উল্কা বেগে ছুটলো গাড়িখানা।

*

বনহুর আর রহমান বেরিয়ে যেতেই লোকটা টেবিলে প্রচন্ড মুষ্টাঘাত করলো, চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তার।

লোকটা টেবিলে মুষ্টাঘাত করতেই বারগৃহের অভ্যন্তর হতে বেরিয়ে এলো সেই জোয়ান বলিষ্ঠ চেহারার লোকগুলো। একটু পূর্বে যারা বনহুরের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলো।

লোকটা তাদের লক্ষ্য করে পুনরায় টেবিলে মুষ্ঠাঘাত করে বললো– এমন উল্লুক তোমরা, দুটো লোকের সঙ্গে পারলে না? নেংটি ইঁদুরের দল সব!

 লোকগুলো যেন ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপতে লাগলো। কেউ কেউ চোখ তুলে তাকালো ভয় বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে। একজন বললো– ওস্তাদ, আপনি জানেন না, লোকদুটো যেন সিংহশাবক। আমাদের বুকের পাজর গুঁড়ো করে দিয়েছে।

আর একজন বললো- ওস্তাদ, ঐ প্রথম লোকটার দেহের শক্তি যেন অসুরে শক্তির চেয়ে বেশি। এই দেখুন ওস্তাদ; আমার চোয়াল থেতলে দিয়েছে।

হুঙ্কার ছাড়লো লোকটা– তোমরা কাপুরুষ! শোনো, ঐ লোকটাকে আমাদের চাই। যেমন করে হোক, আমাদের দলে ওকে আনতে হবে।

একজন বললো- ওস্তাদ, তা কি করে সম্ভব?

সবই সম্ভব মানসিং, সবই সম্ভব। আমাদের দলে এমনি একটা লোকের নিতান্ত দরকার। ওকে বশীভূত করতে পারলে ওমন কত মতিচুর মালা আসবে আমাদের হাতের মুঠায়, বুঝলে?

এবার সবাই চুপ রইলো।

 নর্তকীটা এগিয়ে এলো– ওস্তাদ, আমার পুরস্কার।

হাঁ পাবে। ওকে যদি আয়ত্তে আনতে পারো তাহলে লাখ রুপিয়া বখশীস পাবে। নাচো– নাচো এবার।

নর্তকী নাচতে শুরু করলো।

 টেবিলের পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে শরাবের বোতলটা তুলে নিয়ে মুখে চেপে ধরে। ওস্তাদ।

 এমন সময় একখানি গাড়ি এসে থামলো বার-এর সম্মুখে। কয়েকজন লোক নেমে এলো গাড়ি থেকে। প্রত্যেকের চেহারায় শয়তানের ছাপ বিদ্যমান।

বার-গৃহের মধ্যে প্রবেশ করে সবাই টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো।

ওস্তাদ তখন গেলাসের পর গেলাস পান করে চলেছে। লোকগুলো টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াতেই বললো ওস্তাদ মাল কোথায়?

লোকগুলো তখন যে যার পকেট থেকে নানারকম মানিব্যাগ, পুটলি, হার, দুল, টাকা টেবিলে বের করে রাখতে লাগলো।

ওস্তাদ সবগুলো জড়ো করে টেনে নিলো কাছে, বললো– এইসব সামান্য জিনিস…..যেমন সব নেংটি ইঁদুর তেমনি তোমাদের কাজ। শোন, মতিচুর মালা এনেছো?

পিছন থেকে সম্মুখে এসে দাঁড়ালো একজন, বললো সে– ওস্তাদ, মতিচুর মালা বোমসিং এর কাছে আছে।

সে কোথায়?

ওস্তাদ, সে এক্ষুণি আসবে।

অল্পক্ষণ পরই একজন লোক ঘরে প্রবেশ করলো, তার চেহারা একেবারে খাঁটি ভদ্রলোকের মত। পরনে স্যুট, মাথায় ক্যাপ। লোকটা কক্ষমধ্যে প্রবশে করেই বললো- হ্যালো মোদন, কি করছো বন্ধু? একটা চেয়ার দখল করে নিয়ে বসে পড়লো সে।

ওস্তাদ মোদন বললো– বোমসিং, মতিচুর মালা এনেছো?

বোমসিং বোতল থেকে খানিকটা শরাব ঢেলে ঢক করে পান করলো, তারপর বললো– এনেছি। কিন্তু আমাকে কত দেবে?

তোমাকে যা দেবো সে পরে হবে। এখন মালাটা কোথায় বের করো।

বোমসিং ঢেকুর তুলে বললো– মালা আছে! তবে আমার সঙ্গে নেই।

সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মোদন– তাহলে তুমি মতিচুর মালা সঙ্গে আছে বললে কেন?

মানে আমার উদরে আছে।

উদরে মানে?

আমার গোপন আস্তানায় আছে

 তাহলে তুমিও মালা আনোনি?

না। কত দেবে বলো? যদি হিসাবে ঠিক হয় তাহলে পেয়ে যাবে।

তিন ভাগের একভাব পাবে।

না, আমাকে হাফ দিতে হবে। বলো দেবে কিনা?

 মোদন মুহূর্ত বিলম্ব না করে বোমসিং-এর টাইসহ জামাটা এঁটে ধরলো– মতিচুর মালাটা কেন আনোনি?

বন্ধু, চটছো কেন? আহা ছেড়ে দাও, কাল ঠিক আনবো।

 অন্যান্য দলবল বলে উঠলো– ওস্তাদ, আজ বোমসিংকে ছেড়ে দিন, কাল আনবে বলছে।

 আচ্ছা দিলাম, কিন্তু কাল ক্ষমা করবো না।

আর যদি না আনি?

খুন করবো তোমাকে।

বোমসিং হেসে উঠলো দেখা যাবে কেমন খুন করো।

 কি বললে? মোদন ক্ষেপে উঠলো ভীষণভাবে, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো লড়াই।

বোমসিং শক্তিশালী মাড়োয়ারী লোক, সে মোদনকে কাবু করে পালিয়ে গেলো।

তার দলবল তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে।

মোদন গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো, বললো– উল্লুক তোমরা, বোমসিংকে ধরতে পারলে না?

সর্দার, ওর হাতে পিস্তল ছিলো।

দাঁতে দাঁত পিষে বললো মোদন– মরার এত ভয় তোমাদের? নেংটি ইঁদুর কোথাকার! তোমাদের দিয়ে কিছু হবে না। যেমন করে হোক, ঐ ওকে আমার চাই। একজন হয়ে তোমাদের পঞ্চাশ জনকে যে কাবু করে দিতে পারে।

মোদন যাকে নিয়ে কথাগুলো বলছে সে তখন গাড়ির মধ্যে ঢলে পড়ছে বারবার।

রহমান স্পীডে গাড়ি চালিয়ে চলেছে, ভেবে পাচ্ছে না সর্দার এমন কাজ করলো কেন আজ।

সোজা আস্তানায় এলো রহমান সর্দারকে নিয়ে। কারণ সে কিছুই ভেবে পাচ্ছিলে: না, সর্দারকে এমন অবস্থায় সে কোথায় নিয়ে যাবে।

রহমানের কাঁধে ভর দিয়ে বনহুর প্রবেশ করলো আস্তানায়, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো নূরী। বনহুরকে এই অবস্থায় দেখে প্রথমে হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলো, তারপর ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো– একি দেখছি রহমান? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?

রহমান কোনো জবাব দিতে পারলো না, নীরবে মাথা নিচু করে নিলো।

নূরী এসেছিলো উচ্ছ্বাসিত আনন্দ নিয়ে, কতদিন পর তার হুর ফিরে এসেছে আস্তানায়, খুশিতে ডগমগ সে! কিন্তু এসে যখন দেখলো বনহুর স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসেনি, যা সে কোনোদিন ভাবতে পারে না সেই অবস্থায় আজ সে প্রথম দেখলো তার বনহুরকে। বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলো নূরী, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেনি সে। তারপর ছুটে পালিয়ে গেলো নূরী নিজের কক্ষে।

রাগে-দুঃখে-অভিমানে নূরীর কান্না আসছিলো ভীষণভাবে। নিজের বিছানায় শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলো নূরী।

রহমান বনহুরকে তার কক্ষে পৌঁছে দিলো।

বনহুর টলতে টলতে গিয়ে দাঁড়ালো নিজের শয্যার পাশে। ধপ করে বসে পড়লো শয্যায়। তাকালো চারিদিকে, হয়তো নূরীর সন্ধান করলো সে। তারপর বললো– রহমান…….নূরী কোথায়…..গেলো?……ওকে পাঠিয়ে…..দাও…..

রহমান ব্যথায় মুষড়ে পড়ছিলো, কারণ সে কোনদিন সর্দারকে এ অবস্থায় দেখেনি। দু’চোখ ফেটে পানি আসছিলো তার, বললো– আচ্ছা, আমি নূরীকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

রহমান এগিয়ে চললো নূরীর কক্ষের দিকে, যদি ও সে জানে, নূরী এই মুহূর্তে কিছুতেই তাদের সর্দারকে ক্ষমা করবে না, কারণ নূরী শরাব কোনোদিন পছন্দ করে না।

রহমান অপরাধীর মত এসে দাঁড়ালো নূরীর কক্ষে।

 নূরী তখন বিছানায় পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

 রহমান ডাকলো– নূরী!

নূরীর কান্না থেমে গেলো মুহূর্তে, সোজা হয়ে বসে বললো– এখানে কেন এসেছো তুমি?

নূরী শোনো।

না, আমি তোমার কোনো কথাই শুনবো না রহমান। বেরিয়ে যাও, যাও বলছি।

নূরী, সব শোনো, তারপর রাগ করো।

না না, কিছুই আমি শুনতে চাই না। আমি ভাবতে পারিনি, আমার হুর কোনোদিন মদ স্পর্শ করতে পারে।

আমিও তোমার মতই অবাক হয়েছি নূরী! সব শোনো তারপর রাগ করো।

নূরী অধর দংশন করে বললো– রহমান, আমাকে ভুলতে পারবে না। আমি তোমার চেয়ে অনেক চালাক, বুঝলে?

সর্দার তোমাকে খুঁজছেন নূরী। চলো, চলো নূরী?

না না, যাবো না। যাও। আমি মাতালকে দেখতে চাই না। নূরী রহমানকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।

অগত্যা রহমান, ফিরে এলো সর্দারের কামরায়।

বনহুর পদশব্দে চোখ তুলে তাকালো– নূরী এসেছো…..

 রহমান নির্বাক নয়নে তাকিয়ে আছে, কোনো জবাব সে দিলো না।

বনহুর বললো– এলো না……বেশ……আমি যাচ্ছি…..তুমি যাও রহমান… বনহুর উঠে নূরীর কক্ষের দিকে এগুলো।

রহমান চলে গেলো ওদিকে।

এগিয়ে এলো নাসরিন, স্বামীর কণ্ঠ বেষ্টন করে বললো– অমন মুখ ভার কেন তোমার!

চলো নাসরিন, সব বলছি।

 কি হয়েছে? কোনো মন্দ খবর না তো?

না।

সর্দার ভাল আছে তো?

 আছে।

না, তোমার আচরণ আমার কাছে খুব সচ্ছ মনে হচ্ছে না, কিছু একটা ঘটেছে।

 রহমান নাসরিনসহ চলে গেলো তাদের বিশ্রামকক্ষের দিকে।

বনহুর এসে দাঁড়ালো নূরীর বন্ধ দরজায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে জড়িত কণ্ঠে ডাকলো—নূরী……নূরী দরজা খোলো––নূরী……নূরী দরজা খোলো……

নূরী নিজকে কঠিন করে রাখলো, কোনো কথা সে বললো না।

বনহুর আবার ডাকলো–দরজা…….খোলো নূরী….আমাকে মাফ করো…..রী…..মাফ। করো……

নূরী এবার দরজা না খুলে পারলো না।

দরজা খুলে সরে দাঁড়ালো কয়েক হাত দূরে, অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো মেলে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর টলতে টলতে প্রবেশ করলো, জড়িত কণ্ঠে বললো– নূরী আমাকে মাফ……করে দাও……আমি…..বনহুর নূরীকে ধরতে গেলো।

সঙ্গে সঙ্গে নূরী সরে দাঁড়িয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো– আমাকে তুমি স্পর্শ করোনা, স্পর্শ করোনা বলছি…..

থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো বনহুর, জড়িত আঁখি দুটি টেনে তুলে তাকালো, অস্ফুট কণ্ঠে। বললো– নূরী!

না না, আমি তোমাকে দেখতে চাই না। বেরিয়ে যাও তুমি আমার কামরা থেকে।

নূরী….আমার বড় মাথা ঘুরছে…..আমি দাঁড়াতে পারছি না…..আমাকে তুমি…..ক্ষমা…..করো…..

যাও তুমি যাও বলছি।

নূরী বনহুরকে একরকম জোর করেই ঘর থেকে ঠেলে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।

বনহুর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালো, তারপর ফিরে গেলো সে নিজ কামরায়। বিছানায় ধ করে উবু হয়ে পড়ে গেলো, হাতখানা ঝুলে রইলো এক পাশে।

সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললো বনহুর।

নূরী বনহুরকে যতই উপেক্ষা করে তাড়িয়ে দিক, সে কিছুতেই ঘুমাতে পারলো না। বসে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলো, তার মনের পর্দায় বারবার ভেসে উঠতে লাগলো বনহুরের মুখখানা। নিদ্রা ঢুলুঢুলু দুটি চোখ, এলোমেলো চুল, সুন্দর শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয়। কানের কাছে প্রতিধ্বনি হচ্ছে বনহুরের জড়িত মায়াভরা কণ্ঠস্বর…- নূরী….আমাকে মাফ করে দাও…..আমার বড় মাথা ঘুরছে….আমি দাঁড়াতে পারছি না…..আমাকে তুমি…..ক্ষমা করো….আমাকে তুমি ক্ষমা করো……

নূরী পারলো না নিজকে স্থির রাখতে, সে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে।

বনহুরের কক্ষে প্রবেশ করে দাঁড়িয়ে পড়লো, দেখলো বিছানায় উবু হয়ে পড়ে আছে সে। হাতখানা ঝুলছে একপাশে। পায়ে বুট, গায়ে জামা পরা রয়েছে। মাথার নিচে কোনো বালিশ নেই।

নূরী সরে এলো, ধীর পদক্ষেপে বনহুরের বিছানার পাশে। অতি যত্নে ওর ঝুলে-পড়া হাতখানা তুলে রাখলো পাশে, আংগুল দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে ললাটে আস্তে করে একটা চুম্বন দিলো, দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো বনহুরের গন্ডের উপর। তারপর পায়ের কাছে এসে বসলো নূরী। পা থেকে জুতা খুলে রেখে পা দুখানার উপর মাথা রাখলো। নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে চললো নূরী।

ভোরে বনহুরের ঘুম ভাঙতেই পা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না, কিছু যেন ভারী অনুভব করলো সে নিজ পা দু’খানার উপর।

বনহুর তাড়াতাড়ি উঠে বসে অবাক হয়ে গেলো। নূরী তার পা দু’খানার উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। বনহুরের ধীরে ধীরে মনে পড়লো সব কথা। একটুকরা হাসির রেখা ফুটে উঠলো বনহুরের ঠোঁটে। আস্তে আস্তে নূরীর মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো বনহুর নূরী….

নূরীর নিদ্রা ছুটে গেলো মুহূর্তে। সোজা হয়ে বসলো সে। বনহুরের দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই নূরী গম্ভীর মুখে মাথাটা নিচু করে নিলো।

বনহুর হেসে ওর চিবুকটা তুলে ধরলো–নূরী, আমাকে মাফ করেছো তো?

নূরী উঠে দাঁড়ালো।

 বনহুর ওকে টেনে নিলো কাছে, মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললো-নূরী, আমার ভুল হয়েছে।

অভিমানভরা কণ্ঠে বললো নূরী হুর, আমি ভাবতে পারিনি তুমি শরাব পান করা শিখেছো। তুমি…..মাতাল…..।

নূরী, আমাকে ভুল বুঝো না, সত্যি বিশ্বাস করো, আমি মাতাল নই।

তুমি কাল শরাব পান করোনি?

 হাঁ, করেছিলাম……

 এ অভ্যাস তোমার হলো কবে থেকে বলো?

 জীবনে এই বুঝি প্রথম, তবে হঠাৎ কোনো সময় ভুল করে…..

ভুল– অমন ভুল তোমার এখন প্রায়ই হবে। একবার যে মদ গলধঃকরণ করে সে নাকি কোনোদিন এই নেশা ত্যাগ করতে পারে না।

নূরী, জীবনরক্ষার জন্য কাল শরাব পান করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি কালচক্রের প্যাঁচে আটকা পড়েছিলাম। তুমি বিশ্বাস করো নূরী, তাই…..

কিন্তু আবার যদি কোনোদিন ঐ জিনিস স্পর্শ করো।

তুমি যা খুশি শাস্তি আমাকে দিও।

 বলো, আর ওসব খাবে না কোনোদিন?

বললাম, খাবো না।

বনহুরের বুকে মাথা রাখে নূরী।

*

ওস্তাদ, সেদিন থেকে ঐ লোকটাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোথাও তার টিকিটা দেখিনি। আমাদের এতগুলো লোকের চোখে ধুলো দিয়ে ওরা দু’জন যে কোথায় গুম হলো! মানসিং কথাগুলো বলে থামলো।

মোদন চোখ দুটো গোলাকার করে বললো– আমাকে জিজ্ঞাসা করছে ওরা কোথায় গুম হলো?

না ওস্তাদ, আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি না, বলছি আশ্চর্য বটে। কান্দাই শহর তন্নতন্ন করে সন্ধান করেছি তবু ওদের সন্ধান পাইনি। মানসিং থামলো এবার। ৬০৪ O

মোদন হুঙ্কার ছাড়লো–আমাদের ব্যবসা আরও জোরদার করতে হবে। কাজেই শক্তিশালী লোকের প্রয়োজন, ওকে যে নেশা আমি সেদিন খাইয়ে দিয়েছি, কোনোদিন সে ও নেশা ছাড়তে পারবে না। নিশ্চয়ই সে আসবে।

হরিলাল নামক অনুচরটি বলে উঠে– ওস্তাদ, আমারও তাই মনে হচ্ছে, বেটা না এসেই পারবে না। শুধু আপনার ওষুধের নেশা নয় ওস্তাদ, ডালিয়ার রূপসুধা সে পান করেছে……

কই আর ডালিয়ার রূপসুধা পান করলো? সে তো শুধু হাত পাকড়েছিলো। বেটা রঘুনাথ সব মাটি করে দিয়েছিলো সেদিন। হাঁ, আর একবার এলে হয়!

আসবে আসবে– হাঁ, তোমরা শোনো, যে তাকে আমার নিকটে পৌঁছে দিতে পারবে তাকে আমি বিশটা মোহর দেবো।

মোহর দেবেন ওস্তাদ! বিশটা?

হাঁ, বিশটা স্বর্ণমোহর…..হাঃ হাঃ হাঃ…..

নর্তকী পাশেই ছিলো, সে বললো– অতোগুলো মোহর আপনি নষ্ট করবেন ওস্তাদ?

নষ্ট নয় ডালিয়া, নষ্ট নয়। হীরা নিতে কাঁচ নষ্ট, বুঝলে? ওকে যদি বশীভূত করতে পারি তাহলে আমার বরাৎ ফিরে যাবে। সমস্ত কান্দাই শহর আমি হাতের মুঠায় নিয়ে নেবো। হাঃ হাঃ হাঃ…. হাঃ হাঃ হাঃ…

 ওস্তাদ, মতিচুর মালাতো এখনও আপনার আয়ত্তে এলো না? ভূল করে আপনি সেদিন ওটা বোমসিং-এর কাছে পাঠিয়ে হাতছাড়া করেছিলেন?

 না মানসিং, আমি ভুল করিনি। সেদিন মতিচুর মালা আমার এখানে থাকলে পুলিশ নিশ্চয়ই ওটা পেতো এবং আমাকে আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াতে হতো। জানোত মতিচুর মালা লাভের জন্য আমাকে কতগুলো খুন করতে হয়েছে?

জানি ওস্তাদ। আমরাই যে আপনার সাহায্যকারী।

মানসিং, তুমি আজই বোমসিং-এর কাছে যাও, যেমন করে পারো ওকে হত্যা করে মতিচুর মালা নিয়ে এসো। বন্ধুত্বের উপযুক্ত সাজা দেবো আমি ওকে…….

কথা শেষ হয় না মোদন ওস্তাদের, বোমসিং বিরাট দেহ নিয়ে বার-গৃহে প্রবেশ করে, বলে সে বন্ধুত্বের উপযুক্ত সাজা দিতে হবে না মোদন, মালা আমি নিয়ে এসেছি…..

কক্ষমধ্যে সবাই তাকালে বোমসিং-এর দিকে।

মোদন বললো– এসেছে তাহলে?

বললো বোমসিং না এসে কি পারি? আমার যে কথা সেই কাজ। তবে মালা যদি চাও, এক শর্তে দেবো বা দিতে পারি।

বলো?

এ মালা পেতে তোমাকেও যেমন পরিশ্রম করতে হয়েছে, তেমনি হয়েছে আমাকে। এ মালার মূল্য দুই লাখ টাকা! তুমি আমাকে এক লাখ দাও, আমি তোমাকে মালাটা বিনা দ্বিধায় দিয়ে দেবো।

এই কথা! তা এতদিন বলোনি কেন? হা হা রাজি। তুমি বলেছিলে তিন ভাগ নেবে, তাই তো আমি ক্ষেপেছিলাম বন্ধু। বেশ, মালা বের করো?

আগে তুমি টাকা আনো?

 আচ্ছা, তাই আনছি। এত অবিশ্বাস বন্ধু আমাকে?

না না, অবিশ্বাস নয়, এটা নীতি……

থাম, আর বেশি বকতে হবে না। চলো, গোপনকক্ষে চলো, টাকা সেখানেই পাবে।

দেখো মো….ন, শেষে মনটা কালো করোনা।

মানে?

মানে কোনোরকম চালাকি করতে যেও না।

না না, কোনোরকম চালাকি করবো না বন্ধু। এক লাখ টাকা তোমাকে গুণে দিয়ে মালাটা গ্রহণ করবো।

মোদন আর বোমসিং বার-গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। অন্যান্য অনুচর তাদের দু’জনাকে অনুসরণ করলো।

বার-গৃহের একটি গোপনকক্ষে গোলাকার টেবিলের পাশে সবাই গোল হয়ে চারদিক ঘিরে বসলো।

 বোমসিং-এর অলক্ষ্যে মোদন পকেটে স্পিংওয়ালা ছোরাখানা গোপনে লুকিয়ে রেখেছিলো। বোমসিং যখন টাকা গুণে নিতে যাবে তখন পেছন থেকে তার পিঠে ছোরা বসিয়ে দেওয়া হবে।

মানসিং রঘুলাল এবং মোদনের দলবল সবাই গোল টেবিলটা ঘিরে দাঁড়ালো।

মোদন আসন গ্রহণ করে বললো– বসো বন্ধু!

বোমসিং বসলো।

মোদন নিজে টেবিলের ড্রয়ার খুলে গাদা গাদা টাকার ফাইল বের করে টেবিলে রাখলো। বললো সে বোম, মালা বের করো এবং টাকা গুণে দাও।

 অত টাকা দেখে বোম সিং- এর চোখ দুটো জ্বলে উঠলো যেন, তাড়াতাড়ি পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে খুলে ফেললো। ঝকমক করে উঠলো মালাটা বার-গৃহের উজ্জ্বল আলোকছটায়। অপূর্ব অদ্ভুত মূল্যবান মতিচুর মালা।

সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকালো মালাটার দিকে।

 মোদন বললো– দাও বন্ধু, আমার হাতে দাও। টাকাগুলো এবার গুণে নাও……হাত পাতলা মোদন।

বোমসিং মালাখানা মোদনের হাতে দিয়ে টাকার ফাইলগুলো টেনে নিতে গেলে কাছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে মোদন বাম হাতে মালা ধরে ডান হাতে ছোরাখানা মেলে বোম সিং-এর পিঠে বিদ্ধ করতে গেলো।

সঙ্গে সঙ্গে জমকালো পোশাক পরা কে যেন এসে দাঁড়ালো তাদের পিছনে যমদূতের মত। গম্ভীর চাপা স্বরে বললো– খবরদার, ছোরা নামিয়ে নাও।

সবাই এক সঙ্গে ফিরে তাকালো।

বোম সিং চমকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলো, দেখলো মোদনের হাতে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা উদ্যত তারই পিঠের কাছে। তার দৃষ্টিও গিয়ে পড়লো জমকালো মৃর্তিটার দিকে এবার।

গোলাকার টেবিলের পাশে সকলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে জমকালো মূর্তির দিকে।

মোদনের বাম হাতে মতিচুর মালা আর ডান হাতে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা, চোখেমুখে ভয়-ভীতি আর বিস্ময়। সে দেখলো, জমকালো মূর্তির দক্ষিণ হস্তে জমকালো একটা রিভলভার। ফ্যাকাশে হলো মোদনের মুখ, ঢোক গিলে বললো- কে তুমি?

জমকালো মূর্তি হস্তস্থিত রিভলভার সম্মুখে উদ্যত রেখে বললো– দস্যু বনহুর!

মুহর্তে কক্ষমধ্যের সবাই আড়ষ্ট হয়ে গেলো, ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো সকলের মুখমন্ডল।

 মোদন ভয় বিহ্বল কণ্ঠে বললো– দস্যু বনহুর! তুমি …….তুমি জীবিত আছো?

হাঁ, আমি তোমাদের জান নেবার জন্য আজও জীবিত আছি একটুও নড়তে চেষ্টা করোনা, সবাই যার-যার অস্ত্র ফেলে দাও। মোদন, তুমি ছোরা ফেলে দাও……

দস্যু বনহুরের রুদ্রমূর্তি দর্শন করে সকলের হৃৎপিন্ড ভয়ে স্তব্ধ গিয়েছিলো যেন। সবাই অস্ত্র নিক্ষেপ করলো এক এক করে। মোদন হস্তহিত ছোরাখানা ফেলে দিলো মেঝেতে। তাকালো সে দস্যু বনহুরের মুখোশপরা মুখ খানার দিকে। সে ভাবতেও পারেনি, তখন আচম্বিতে দস্যু বনহুরের। আবির্ভাব ঘটবে।

কেউ নড়বার সাহস পেলো না, কারণ জমকালো দস্যুহস্তে জমকালো মরণ-অস্ত্র উদ্যত রয়েছে। যে নড়বে সেই মরবে তাতে কোনো ভুল নেই।

মোদনকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর মালাছড়া আমার দিকে ছুঁড়ে দাও মোদন। কথা। বলার সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারের মাথাটা দোলালো সে একটু।

মোদনের কণ্ঠ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মতিচুর মালার জন্য সে বহু লোকের জীবননাশ করেছে, এমন কি আজও সে হত্যা করতে যাচ্ছিলো তার পার্টনার বোমসিংকে।

মোদনকে ভাবতে দেখে হুঙ্কার ছাড়লো বনহুর বিলম্ব করছো কেন? মরতে চাও নাকি?

মোদন অসহায়ভাবে তাকালো বোমসিং- এর মুখের দিকে। একটু পূর্বে যাকে খুন করতে যাচ্ছিলো সেই বোমসিংকে পরম বন্ধু বলে মনে হলো এক্ষণে। কিন্তু কোনো উপায় নেই, মালা তাকে দিতেই হবে, কারণ তারা জানে দস্যু বনহুর কতখানি ভয়ঙ্কর!

মোদন মতিচুর মালাছড়া ছুঁড়ে ফেলে দিলো বনহুরের দিকে।

 বনহুর বাম হস্তে লুফে নিলো মালাছড়া।

এবার বনহুর বোমসিংকে লক্ষ্য করে বললো– টাকার বান্ডিলগুলো ছুঁড়ে দাও। এক-একটা করে দাও…….

বোমসিং দস্যু বনহুরের আদেশ পালন করলো। সে একটা একটা করে দশটা বান্ডিল ছুঁড়ে দিলো বনহুরের দিকে।

বনহুর এক-একটা নিয়ে পকেটে রাখলো।

 দশটা বান্ডিলে ছিলো এক লাখ টাকা।

বনহুর মালা এবং টাকার বান্ডিলগুলো নিয়ে হঠাৎ যেমন ধুমকেতুর মত কক্ষমধ্যে আবির্ভাব হয়েছিলো তেমনি অকস্মাৎ উধাও হলো।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই।

বনহুর বেরিয়ে যেতেই হুঁশ হলো সকলের।

মোদন প্রাণফাটা চিৎকার করে উঠলো গ্রেফতার করো…দস্যু বনহুর…দস্যু বনহুর…

মোদনের অনুচরগণ ছুটলো এদিকে সেদিকে।

ততক্ষণে বার-গৃহে একটা মহা হুলস্থুল পড়ে গেছে, মোদন ছুটে গিয়ে ফোন করলো– হ্যালো, হ্যালো ইন্সপেক্টার, আপনি এক্ষুণি চলে আসুন পুলিশ-ফোর্স নিয়ে, দস্যু বনহুর আমার বারে হানা দিয়ে আমাকে সর্বস্বান্ত করে সব নিয়ে গেছে আমাকে সর্বস্বান্ত করে সব নিয়ে গেছে। ইন্সপেক্টার… আপনি চলে আসুন…..

ওদিকে পুলিশ অফিসে সাড়া পড়ে যায়।

ইন্সপেক্টার ইয়াসিন আহমদ বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেন- দস্যু বনহুর? বলেন কি!

হাঁ, দস্যু বনহুর এইমাত্র আমার বার-এ এসেছিলো। আপনি দয়া করে শীঘ্র চলে আসুন……হ্যালো, হ্যালো ইন্সপেক্টার, চলে আসুন…

ইন্সপেক্টার ইয়াসিন আহমদ তাঁর সহকারী এবং পুলিশ অফিসারগণকে বললেন–মোদন মোহন বার’-এ দস্যু বনহুর হানা দিয়ে সব লুটে নিয়ে গেছে। আপনারা পুলিশ ফোর্সসহ প্রস্তুত হয়ে নিন। এক্ষুণি যেতে হবে।

কান্দাই পুলিশ ডায়রীতে দস্যু বনহুর সম্বন্ধে অনেক কিছু উল্লেখ আছে, কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো কান্দাই শহর নীরব ছিলো। দস্যু বনহুরের উপদ্রব ছিলো না বললেই চলে, হঠাৎ পুলিশ অফিসের লোকজন এবং অফিসারগণ উদ্বিগ্ন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

অল্পক্ষণেই পুলিশ বাহিনী নিয়ে ইন্সপেক্টার ইয়াসিন আহমদ হাজির হলেন ‘মোদন মোহন বার’-এ।

কিন্তু তখন দস্যু বনহুর কোথায়।

পুলিশ ইন্সপেক্টার ইকোয়ারী করে কোনো কু আবিষ্কারে সক্ষম হলেন না। তিনি সব দেখেশুনে ডায়রী করে ফিরে এলেন পুলিশ অফিসে।

পরদিন।

কান্দাই পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হলো–

কান্দাই শহরে পুনরায় দস্যু বনহুরের আবির্ভাব। মোদন মোহন বার থেকে লক্ষ টাকা এবং মূল্যবান কোনো এক সামগ্রী নিয়ে দস্যু বনহুর উধাও হয়েছে। কান্দাই পুলিশ দস্যকে গ্রেফতার করতে গিয়ে বিফল হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি

 পত্রিকাখানা হাতে নিয়ে মোদন পায়চারী করছে তার .বার-গৃহের অভ্যন্তরে একটি কক্ষের মেঝেতে। তার চারপাশে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে মোদনের সহচর দল।

মোদন পত্রিকায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলছে– দস্যু বনহুর আমার এতবড় সর্বনাশ করলো! আমি তাকে উপযুক্ত সাজা না দিয়ে ছাড়বো না। মানসিং, দস্যু বনহুরকে কাবু করতে পারে সে ঐ লোক, যে তোমাদের মত শক্তিশালী বিশজনকে পটকান দিয়ে স্বচ্ছন্দে চলে গেলো।

হাঁ ওস্তাদ, লোকটা অসীম শক্তির অধিকারী। কোনক্রমে ওকে পেলে আমাদের কাজ অনেক হালকা হবে। মানসিং কথাটা বলে থামলো।

মোদন বললো– তোমাদের যে কেউ তাকে আমার নিকট এনে দিতে পারবে তাকে আমি বিশখানা মোহর দেবো বলেছি, আবার আমি কথা দিলাম।

উপস্থিত সকলের মুখেই একটা লোভাতুর ভাব ফুটে উঠলো। সবাই চায় তাকে খুঁজে আনতে। সেদিনের ঘোষণার পর থেকে এরা ওকে রীতিমত সন্ধান করে চলেছে– পথেঘাটে, যানবাহনের মধ্যে, হোটেল-ক্লাবে, ষ্টেশনে, এরোড্রোমে সব জায়গাতেই, কিন্তু আজ পর্যন্ত ওকে তারা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি।

আজ আবার মোদন মোহনের কথায় সবাই সজাগ হয়ে উঠলো নব উদ্যমে। বিশটা স্বর্ণমোহর কম কথা নয়।

বার-এর অভ্যন্তরে যখন মোদন আর তার দলবল এসব আলোচনায় মত্ত তখন বার-গৃহে প্রবেশ করে বনহুর। আজ তার দেহে পূর্ব দিনের সেই ড্রেস।

বনহুরকে দেখামাত্র কয়েকজন ছুটে এলো, যারা সেদিন তাকে ছোরা নিয়ে আক্রমণ করেছিলো।

 মোদন নিজে পত্রিকাখানা হাতে ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে দাঁড়ালো বনহুরের সম্মুখে– আরে বন্ধু, তুমি এসে গেছো?

বনহুর কারো বলবার অপেক্ষা না করে বসে পড়লো একটা চেয়ারে। মোদনও বসে পড়লো তার পাশের চেয়ারে মুখখানা বনহুরের দিকে ফিরিয়ে।

অন্যান্য দলবল সবাই উদগ্রীবভাবে দাঁড়িয়ে রইলো টেবিলের চারপাশে।

মোদনের চোখেমুখে আনন্দ উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছে, বিশখানা স্বর্ণ মোহরের বিনিময়ে যাকে সে কামনা করেছিলো এই মুহূর্তে তাকে বিনা দ্বিধায় পেয়ে গেলো। মোদনের কাছে এ যে অমূল্য সম্পদ।

 মোদন ওকে দেখামাত্র খুশির উচ্ছ্বাসে ভরপুর হয়ে উঠেছে, তৎক্ষণাৎ নানারকম ফলমূল, মাংস আর মূল্যবান শরাবের অর্ডার দিলো।

বনহুর স্থিরকণ্ঠে বললো– সেদিন তোমার এখানে যা খেয়েছিলাম তার বিল না দিয়েই আমি চলে গিয়েছিলাম, তাই বিল দিতে এসেছি।

 মোদন হেসে উঠলো হো হো করে, বনহুরের পিঠে মৃদু আঘাত করে– আরে বন্ধু, ওসব। কিছু লাগবে না। তুমি যত খুশি খেতে পারো।

 বনহুর ভ্রু কুঁচকে বললো– তা হয় না। বিনা পয়সায় খেয়ে আমি তোমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারি না। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বনহুর।

 মোদন বনহুরের হাত থেকে মানিব্যাগটা নিয়ে পুনঃ বনহুরের পকেটে রেখে দিয়ে বলে– যত খুশি খাও।

ততক্ষণে বয় টেবিলে নানারকম ফলমূল আর বিলেতী মদের বোতল সাজিয়ে রাখলো।

মোদন ফলমূলের ট্রেখানা এগিয়ে দিলো বনহুরের দিকে খাও বন্ধু।

অন্যান্য অনুচরও যে যা পারছে এগিয়ে দিচ্ছে বনহুরের সম্মুখে। কেউ বা আপেল কেটে বাড়িয়ে ধরছে ওর মুখের কাছে। কেউ বা কাঁটা দিয়ে মাংস তুলে গুঁজে দিচ্ছে ওর মুখ-গহ্বরে।

বনহুর মনে মনে হাসছে, আর খাবারগুলো পরম আনন্দে খাচ্ছে। সবাই যেন বনহুরকে খুশি করবার জন্য মেতে উঠেছে। একজনের ইংগিতে যে এসব হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বনহুর লক্ষ্য করছে, এদের সত্যি কারের পরিচালক কে মোদন না বোমসিং।

আজ আসরে বোমসিং নেই।

মোদনের ইংগিতে নর্তকী কস্তরী বাঈ এসে হাজির হলো বনহুরের সম্মুখে।

সরে দাঁড়ালো সবাই একপাশে।

বনহুর অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো নতুন নর্তকীটার দিকে। নর্তকীর সমস্ত দেহ কালো আবরণে ঢাকা। মুখের অর্ধেকটাও ঢাকা রয়েছে।

মোদনের ইংগিতে নর্তকীটা এসে দাঁড়ালো।

 মোদন আদেশ করলো শরাব ঢালো।

নর্তকীটা শরাব ঢাললো কাঁচপাত্রে।

 বললো মোদন নাচো নাচো এবার।

 নর্তকী নাচেতে শুরু করলো।

বনহুর খেতে খেতে তাকাচ্ছিলো নর্তকীর দিকে।

মোদন এবং তার দলবল হাতে তালি দিয়ে নর্তকীকে উৎসাহ দান করে চললো।

বনহুর ফলমূল বেশি ভালবাসে তাই সে ফলমূল খেতে লাগলো আপন মনে।

 মোদন একসময় বললো তোমার সঙ্গীকে আজ দেখছিনা কেন বন্ধু?

বনহুর ফল চিবুতে চিবুতে নর্তকীর দিকে দৃষ্টি রেখে অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলো তার কাজে সে সরে পড়েছে।

মোদন বনহুরের ভাব লক্ষ্য করছিলো, সে বুঝতে পারছিলো, নর্তকীর নাচ তাকে অভিভূত করেছে। একটা আশার আলো দেখা দিলো শয়তান মোদনের মনে। সেদিনের চেয়ে আজ ওকে বেশি আনন্দমুখর দেখাচ্ছে। মোদন একসময় শরাবের গেলাসটা এগিয়ে ধরলো বনহুরের সামনে।

বনহুর গেলাসটা হাতে নিয়ে টেবিলে রাখলো।

মোদন বললো– তোমার নাম কি বন্ধু? তোমার নামটা আজও জানতে পারিনি।

আফসোস, নামটা আমারই মনে নেই। আচ্ছা, কাল আমার বন্ধুর কাছে জেনে আসবো। আবার অন্যমনস্ক হবার ভান করে বনহুর।

মোদন ভিতরে ভিতরে খুশি হয়, এমন আপনভোলা মানুষ সে তো কোনোদিন দেখেনি। এমনি লোকেরই দরকার যে অদ্ভুত শক্তি রাখে, দেখতেও অপূর্ব সুন্দর, কাজেও হবে ক্ষমতাবান কিন্তু মনে রাখেবে না কিছু। ওকে দিয়ে যা খুশি করানো যাবে।

বললো মোদন তোমাকে ভোলাসিং বলে ডাকবো, বুঝলে?

 বেশ বেশ, ভোলা নামটাই আমার বেশি পছন্দ।

আচ্ছা ভোলাসিং?

 বলো বন্ধু?

তুমি আমাদের দলে এসে যাও না কেন?

 সে কি রকম?

 মানে আমাদের বার-এ কাজ করবে। মোটা টাকা মাহিনা পাবে।

ঊ মোটা মাহিনা দেবে?

 হাঁ।

কত দেবে আমাকে?

 যত চাও। দু’শ, চার শ, হাজার, যত চাবে ততই পাবে।

এ্যা, কি বললে বন্ধু? দু শো– চার শো– হাজার– বলো কি সত্যিই এত টাকা মাইনে দেবে আমাকে?

হাঁ, আজ থেকে তুমি আমাদের দলের লোক হলে, বুঝলে? মাইনে পাবে মাসে এক হাজার।

এক হা– জা– র?

হ্যা।

বেশ, কি কাজ করতে হবে, বলো বন্ধু?

এবার মোদন তার সম্মুখে পত্রিকাখানা মেলে ধরলো; বললো পড়ে দেখো কান্দাই শহরে দস্যু বনহুরের পুনঃ আবির্ভাব।

অস্ফুট ভীতস্বরে বলে উঠলো বনহুর কান্দাই শহরে দস্যু বনহুর…..

হাঁ, ভয় পাবার কিছু নেই বন্ধু।

সর্বনাশ, দস্যু বনহুর কান্দাই শহর আগমন করেছে আর তোমরা বলছো ভয় নেই?

 তোমার শক্তির কাছে দস্যু বনহুর কোন্ ছার। একমাত্র দস্যু বনহুরকে তুমিই পারবে কাবু। করতে। পত্রিকায় খবরটা পড়ে দেখো, সে আমার সর্বনাশ করেছে।

পড়েছি তোমার এক লাখ টাকা আর কোনো একটা মূল্যবান জিনিস নিয়ে ভেগেছে…..

মূল্যবান জিনিসটা কি জানো না বন্ধু, সেটা বহু টাকা মূল্যের মতিচুর মালা…..

এ্যা, বলো কি মতিচুর মালা?

হাঁ

 সে কেমন দেখতে?

দস্যু বনহুরকে যদি কাবু করতে পারো তাহলে ঐ মতিচুর মালা তোমাকে দেখাবো, আর পেলে তুমি দশ হাজার টাকা। জীবনে তোমাকে আর পেটের জন্য ভাবতে হবে না বন্ধু?

সত্যি!

সত্যি বলছি। নাও শরাব পান করো।

শরাব আমি পান করিনা বন্ধু।

এখানে কাজ করতে হলে শরাব তোমাকে খেতে হবে। মোদন শরাব ভর্তি গেলাসটা এগিয়ে ধরলো বনহুরের দিকে।

বনহুর গেলাসটা অগত্যা হাতে নিলো, শরাবের উগ্রগন্ধ তার নাকে প্রবেশ করছে। মনে পড়ছে নূরীর মুখখানা, সেই অশ্রুভরা দুটি আঁখি, সেই রাগতঃ কণ্ঠস্বর শরাব পান সে করবে না আর।

 বনহুর শরাবের গেলাস হাতে তাকায় টেবিলের চারপাশে ঘিরে দাঁড়ানো লোকগুলোর মুখে, যেন এক-একটা জীবন্ত শয়তান। ওরা সবাই শ্যেন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার হাতের রাব পাত্রটার দিকে।

বনহুর ভেবেছিলো মোদনের দৃষ্টি এগিয়ে একসময় হাতের পাত্র থেকে শরাব ফেলে দেবে টেবিলের কোণে এক বাসনের মধ্যে। কিন্তু এতগুলো চোখের দৃষ্টি তার হাতের পাত্রে সীমাবদ্ধ রয়েছে অগত্যা শরাব পান করতে হলো আজও বনহুরকে কতকটা বাধ্য হয়ে।

শরাব পান করে বনহুর উঠে দাঁড়ালো।

মদন বললো– চলো তোমাকে আমাদের আসল আস্তানাটা দেখিয়ে দেই।

 বনহুর বললো- চলো।

মোদন এবং তার সঙ্গিগণ বনহুরকে সঙ্গে নিয়ে বার এর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। গুপ্ত, একটা কক্ষমধ্যে এসে দাঁড়ালো ওরা বনহুরকে নিয়ে।

মোদন সবার আগে দাঁড়িয়ে, পাশে বনহুর।

 পিছনে মোদনের অন্যান্য অনুচর।

মোদন দেয়ালে একটা বোতামে চাপ দিতেই দেয়াল ফাঁক হয়ে একটা পথ বেরিয়ে এলো।

মোদন বনহুরকে নিয়ে সেই পথে অগ্রসর হলো। অবাক হয়ে দেখলো বনহুর একটা বিরাট কক্ষে এসে তারা দাঁড়িয়েছে। কক্ষটা আধো অন্ধকার, কক্ষমধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চমকে উঠলো। কতকগুলো কঙ্কালের মত জীন মানুষকে সেই কক্ষে শিকলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সহসা দেখলে বোঝা মুস্কিল ওরা জীবিত না মৃত।

মোদন বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো– এই যে দেখছো এরা সবাই কান্দাইবাসী নয়। কেউ কান্দাই শহরের, কেউ কান্দাই এর বাইরের, কেউ আরও দূরের। এদের সবাইকে বন্দী করে রাখা। হয়েছে কারণ এদের জন্য আমরা মোটা টাকা দাবি করে চিঠি লিখেছি এদের আত্নীয়-স্বজনের কাছে যারা ঐ টাকার দাবি পূরণ করবে তারাই মুক্তি পাবে আর যারা ঐ টাকা দিতে অক্ষম হবে, তাদের মুক্তি নেই। এখানে তিল তিল করে শুকিয়ে মরবে এরা……

বনহুর অবাক হয়ে দেখছিলো আর শুনছিলো মোদনের কথাগুলো। ভিতরে ভিতরে রাগে ক্রুদ্ধ সিংহের মত ফুলছিলো বনহুর, দক্ষিণ হস্তখানা মুষ্ঠিবদ্ধ হচ্ছিলো। কিন্তু শরাব পানের নেশায়– ঢুলুঢুলু করছে ওর দেহটি তখন।

মোদম সেই বন্দীশালা অতিক্রম করে বনহুরসহ একটি কক্ষ্যমধ্যে এসে দাঁড়ালো। কক্ষটা জমাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন।

মোদন একটা সুইচ টিপতেই অদ্ভুত শব্দ হলো ঘড় ঘড় ঘড়– তারপর একটা আওয়াজ হলো– ঠিক পাতালপুরী থেকে কেউ যেন কথা বলছে, কিংবা কোনো ফাঁকা হলঘর থেকে আওয়াজ করছে।…কি খবর মোদন…..তোমার সঙ্গে কে ওটা…..কি চায় সে……বলো?

বনহুর অবাক হয়ে চারিদিকে তাকালো, কোথাও কাউকে দেখতে পাচ্ছে না সে, কিন্তু এত স্পষ্ট কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। কেউ যেন সেই কক্ষে তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

বনহুরকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে বললো মোদন চুপ করে শোনো, কথা বলোনা যেন ভোলা।

বনহুর মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো, সে কথা বলবে না।

মোদন বললো– মালিক, খবর ভাল। আমি একজন লোককে সঙ্গে এনেছি, সে অত্যন্ত শক্তিশালী লোক। একাই বিশ জনকে কাবু করতে পারে। ওকে আমরা কাজে বহাল করে নেবো কিনা, তাই আপনার কাছে জানতে এসেছি।

আবার সেই শব্দ, যেন কেউ সামনে দাঁড়িয়ে বললো……

……কাজে বহাল করে নেবার পূর্বে ওকে পরীক্ষা করে নেবে। কারণ বাইরের লোককে বিশ্বাস নেই।

মোদন বললো– আচ্ছা মালিক।

পুনরায় সেই গুরুগম্ভীর আওয়াজ….যাও কিন্তু….হুশিয়ার মোদন….

মোদন বললো আবার হুঁশিয়ার মালিক।

এবার বনহুরকে নিয়ে বেরিয়ে এলো মোদন।

লৌহশিকলে আবদ্ধ অসহায় লোকগুলোর কথা, দস্যু বনহুরকে অত্যন্ত চিন্তাগ্রস্ত করে তুললো। আরও একটা বিষয় তাকে ভাবিয়ে তুললো সে হলো, মোদন এই শয়তান দলের শিরমণি নেতা নয়, আরও একজন আছে যার ইংগিতে এরা পুতুলের মত কাজ করে চলেছে। কিন্তু কে সে আর কোথা হতেই বা সে এদের পরিচালনা করে চলেছে।

বনহুরকে ভাবতে দেখে বলে মোদন– এসো, তোমাকে আমরা কাজে বহাল করে নেবো, তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই।

বনহুর খুশি হবার ভান করে বললো– আচ্ছা বন্ধু।

গভীর রাতে ফিরে এলো বনহুর আস্তানায়, তখন তার নেশায় ঢুলুঢুলু অবস্থা। চুপি চুপি। নিজের বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করলো, যেন নূরী টের না পায় তেমনিভাবে শয্যা গ্রহণ করলো বনহুর।

 আড়ালে লুকিয়ে নূরী সব দেখলো, রাগে-ক্ষোভে অধর দংশন করলো। মনে মনে সে একটা পরামর্শ আঁটলো- গোপনে ফলো করবে বনহুরকে কোথায় যায় আর কে তাকে শরাব পানে মত্ত করে, দেখবে সে আপন চোখে।

কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে নূরী।

বনহুর একসময় নূরীর সন্ধানে বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে।

টলতে টলতে এগিয়ে চললো সে নূরীর কক্ষের দিকে। দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো, দরজায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকলো–নূরী নূরী দরজা খোলো, দরজা খোলো–নূরী…..

কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়া এলো না।

 অনেক কেঁদেছে নূরী, তাই সে ক্লান্তি আর অবসাদে গভীর অচেতন হয়ে পড়েছে। বনহুরের কণ্ঠ তার নিদ্রাভংগ করতে পারে না।

সোজা বেরিয়ে আসে বনহুর আস্তানা থেকে।

তাজের পিঠে চেপে বসে বনহুর; তাজ প্রভুকে পিঠে পেয়ে উল্কাবেগে ছুটতে শুরু করে।

*

মনিরা তাদের নতুন বাড়ি তালাবন্ধ করে চলে এসেছে চৌধুরীবাড়িতে। মরিয়ম বেগম নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছে মনিরা আর নূরীকে।

মনিরা বসে বসে নূরের জামা সেলাই করছিলো।

বয় এসে পাশের ত্রি-পয়ার উপরে দৈনিক পত্রিকাখানা রেখে গেলো।

মনিরার দৃষ্টি পড়লো পত্রিকার উপরে বড় বড় অক্ষরগুলোতে। সেলাই রেখে পত্রিকাখানা তুলে নিলো হাতে, বিস্ময় ভরা নয়নে পড়তে লাগলো–

কান্দাই শহরের বুকে পুনরায় দস্যু বনহুরের আবির্ভাব। শহরে ভীষণ চাঞ্চল্যকর অবস্থা। ইত্যাদি।

মনিরা একবার নয়, বারবার পড়তে লাগলো। দস্যু বনহুর তাহলে মরিলা দ্বীপ থেকে ফিরে এসেছে। আনন্দে দু’চোখে তার পানি এলো। খোদার কাছে শুকরিয়া করলো সে দু’হাত তুলে। কিন্তু পরক্ষণেই মুখ তার শুকিয়ে গেলো পুলিশ তাকে পাকড়াও করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, যে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করে দিতে পারবে তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা সরকার পুরস্কার দেবেন ঘোষণা করেছেন। না জানি তার স্বামীর জন্য কত গুপ্তচর ছড়িয়ে পড়েছে কান্দাই শহরের আনাচে কানাচে। কত লোক এই টাকার লোভে সন্ধান করে ফিরছে তাকে, কে জানে!

মনিরার মনে একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে, পত্রিকা হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মনিরা।

এমন সময় নূর এসে পড়ে সেখানে।

মনিরা পত্রিকাখানা তাড়াতাড়ি বালিশের তলায় লুকিয়ে রেখে জামাটা তুলে নিলো হাতে।

নুর মায়ের পাশে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো, বললো– আম্মি, জামা সেলাই হয়েছে। তোমার?

মনিরা আঁচলে চোখ দুটো মুছে নিয়ে বললো হয়েছে বাবা এসো পরিয়ে দেই।

মনিরা পুত্রদেহে জামাটা পরিয়ে দিতে দিতে বললো– নূর, তোমার আব্বুর জন্য মন কেমন করছে, না?

হাঁ, সব সময় আব্বুর কথা মনে পড়ছে। আচ্ছা আম্মি, আব্বু সেদিন চলে গেলো, আর এলো না কেন? বলো কবে আসবে?

 জানি না।

আব্বুর কথা বললেই তুমি কেমন যেন আনমনা হয়ে যাও। বলোনা আম্মি, আব্বু কোথায় যায় এমন করে?

বললাম তো জানি না? যাও, স্কুলে যাবার সময় হয়ে গেছে।

মরিয়ম বেগমের কণ্ঠ শোনা যায়- নূর, সরকার দাদু এসেছেন, তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। শীগগীর এসো।

নূর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বেরিয়ে গেলো, যেতে যেতে উচ্চকণ্ঠে বললো– আসছি দাদী আম্মা……

মনিরা আবার স্বামীর চিন্তায় ডুবে যায়।

 সমস্ত দিনটা মনিরার ছটফট করে কাটে। কান্দাই ফিরে এসে আজও এলো না সে তার কাছে। কেন এলো না? দস্যুতাই কি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্রত? মা, সন্তান, স্ত্রী এরা কি কিছু নয়! এতই হৃদয়হীন সে…….

রাত বেড়ে আসছে, মন তার হাঁপিয়ে উঠছে আজও কেন এলো না সে। নূর দাদীমার ঘরে শোয়, এ ঘরে মনিরা একা থাকে।

বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে মনিরা, মনে পড়ে পত্রিকাখানার কথা। বালিশের নিচে হাত দিতেই মনে হয়, সে তো সকালে ওঘরে বসে সেলাই করছিলো, পত্রিকাখানা নূরের বালিশের তলায় রেখেছিলো তখন।

আবার শুয়ে পড়ে মনিরা।

ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে চলে।

হঠাৎ শব্দ হয় কক্ষমধ্যে।

মনিরা অস্ফুট শব্দ করে উঠে– কে?

সুইচ টিপে আলো জ্বালে বনহুর।

মনিরা বলে উঠেলো– তুমি। তুমি এসেছো? নেমে দাঁড়ালো মনিরা শয্যা ত্যাগ করে।

বনহুর এগিয়ে এলো, জড়িত কণ্ঠে ডাকলো– মনিরা।

মনিরা চমকে উঠলো, স্বামীর কণ্ঠস্বর তার কাছে কেমন যেন লাগলো, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো মনিরা বনহুরের চোখের দিকে।

লাল টকটকে ওর চোখ দুটো, কেমন যেন অভিভূতের মত তাকাচ্ছে মনিরার দিকে।

মনিরা পাথরের মূর্তির মত জমে গেলো যেন, বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো স্বামীর দিকে।

বনহুর টলতে টলতে এগিয়ে এলো, আবেগভরা জড়িত কণ্ঠে ডাকলো– কাছে এসো প্রিয়া……

মনিরা দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বললো– তুমি মদ খেয়েছে।

মদ–কই না তো।

মিথ্যা কথা বলছো! খবরদার, এক পাও আমার দিকে এগুবে না। ছিঃ ছিঃ তুমি মদ পান। করা শিখেছো। এতো অধঃপতনে গেছো তুমি…..

হেসে উঠলো বনহুর দস্যুর আবার অধঃপতন। হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ……

মনিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে স্বামীর মুখের দিকে।

হাসি থামিয়ে এগিয়ে আসে বনহুর মনিরার দিকে, ওকে ধরতে যায় সে বলিষ্ঠ হাত দু’খানা বাড়িয়ে।

মনিরা ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠে আমাকে তুমি স্পর্শ করোনা– যাও, তুমি চলে যাও এখান থেকে! তোমাকে আমি চাই না…..

বনহুরের কানের কাছে নূরীর সেদিনের কথাগুলোর প্রতিধ্বনি হয়। বনহুর নিজকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাক দৃষ্টি নিয়ে তাকায় বনহুর মনিরার মুখে।

মনিরা বলে– আমি ভাবতে পারিনি তুমি এতো হীন জঘন্য হতে পারো।

বনহুর ব্যথাভরা কণ্ঠে ডাকলো– মনিরা..

মনিরা তীব্রকণ্ঠে বলেই চলেছে– দস্যুতা করে তোমার সখ মিটলো না আজও? কবে থেকে তুমি নেশা ধরেছো?

তুমিও আমাকে তিরস্কার করছো?

 তুমি চলে যাও, আমি মনে করবো তুমি মরে গেছে।

 মনিরা!

হাঁ, আমি সব সহ্য করে নেবো। যেমন বিনা দ্বিধায় একদিন দস্যুকে স্বামী বলে গ্রহণ করে নিয়েছিলাম, তেমনি তাকে বিনা দ্বিধায় ত্যাগ করবো……

বনহুর এবার মনিরাকে ধরে ফেলে, বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বলে– আর বলো না মনিরা, আর বলো না, আমি তোমাকে স্পর্শ করে শপথ করছি..

 না না, তুমি আমাকে ছেড়ে দাও! চাই না তোমাকে! মনিরা স্বামীর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে সরে দাঁড়ায়।

বনহুর এবার মনিরার পায়ের কাছে বসে দু’হাতে চেপে ধরে ওর পা দু’খানা– মনিরা তুমি বিশ্বাস করো, আর আমি কোনোদিন মদ স্পর্শ করবো না। আমাকে ক্ষমা করো মনিরা!

মনিরা পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে, কঠিন পাষাণী দেবীর মত স্থির হয়ে। ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মনিরার গন্ড বেয়ে।

মনিরা পারে না আর নিজকে ধরে রাখতে, স্বামীর হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়।

বনহুরের আঁখি দুটিও শুষ্ক ছিলো না, সে মনিরাকে গভীরভাবে টেনে নেয় কাছে।

মনিরা স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।

বনহুর বলে আজ থেকে এমন ভুল আর আমি করবো না মনিরা….

মনিরা ভুলে যায় সব কিছু, বনহুরের বুকে মাথা রেখে বলে– সত্যি বলছো?

হাঁ মনিরা, জীবনে যা করিনি কোনোদিন, তাই করেছিলাম–শপথ করলাম আর কোনোদিন আমি এ ভুল করবো না।

মনিরা বনহুরকে সেদিন কিছুতেই ছেড়ে দেয় না। ধরে রাখে সে সন্তান আর মায়ের দোহাই দিয়ে।

ভোরে তার আব্বুকে দেখে আনন্দে অধীর হলো নূর।

চৌধুরীবাড়িতে আনন্দের বান বয়ে চললো।

 মরিয়ম বেগম পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ-অশ্রু বর্ষণ করলেন।

 ফুলমিয়ার তো খুশি ধরছে না সে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলো।

বনহুর তখন মনিরার কক্ষে বসে মনিরার সঙ্গে গল্প করছিলো।

এমন সময় নূর গতদিনের পত্রিকাখানা নিয়ে ছুটে আসে– আম্মি, আম্মি, দেখো কি দুঃসংবাদ……।

একসঙ্গে মনিরা এবং বনহুর চোখ তুলে তাকালো।

বললো বনহুর– কি দুঃসংবাদ আব্বু?

নূর পত্রিকাখানা এনে মেলে ধরলো পিতামাতার সম্মুখে এই দেখো, কান্দাই শহরে পুনরায়। দস্যু বনহুরের আবির্ভাব। আম্মি, ঐ শয়তান দস্যুটা আবার এসেছে…

মনিরা তাকালো স্বামীর মুখের দিকে।

বনহুর হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে।

মনিরা পত্রিকাসহ নূরকে টেনে নিলো কাছে– বাবা দস্যু হলেই কি সে শয়তান হয়? ছিঃ ও কথা বলতে নেই।

না আম্মি, দস্যু বনহুরকে চেনো না, তাই ওমন কথা বলছে আমাদের স্কুলে সবাই বলে– দস্যু বনহুরের মত অতবড় বিখ্যাত দস্যু নাকি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই।

মনিরা বিব্রত দৃষ্টি নিয়ে তাকালো স্বামীর দিকে। ভেবেছিলো নিশ্চয় তার স্বামী ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে। কিন্তু দেখলো বনহুরের মুখে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠেছে, অপলক চোখে তাকিয়ে আছে বনহুর সন্তানের মুখের দিকে।

এবার বনহুর নূরের পিঠ চাপড়ে বললো– তাই নাকি, দস্যু বনহুর খুব বড় দস্যু?

 হাঁ আব্বু।

তুমি দেখেছো তাকে?

সর্বনাশ, দস্যু বনহুরের ভীষণ চেহারা, তাকে দেখলে……

মনিরা এবার হেসে বললো– দস্যু হলেও সে তো মানুষ বাবা। তাকে দেখলে ভয় পাবার কি আছে?

আম্মি, তুমি বড় বোকা, দস্যু বনহুরকে দেখলে তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবে।

বনহুর হেসে বললো– তোমার আম্মি দস্যু বনহুরকে দেখে অজ্ঞান হবে, আর তুমি যদি তাকে দেখো?

আমি একটুও ভয় পাবো না, অজ্ঞানও হবো না। আমি বড় হয়ে তাকে পাকড়াও করব……

চমকে উঠে মনিরা, ফ্যাকাশে হয় তার মুখ।

বনহুর নূরকে টেনে নেয় বুকের মধ্যে, শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলে– সাবাস!

[পরবর্তী বই কান্দাই রহস্য]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *