ঢাকায় দস্যু বনহুর

ঢাকায় দস্যু বনহুর

বলে চলেছে শোহেলী–দেখলাম এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, টলছেন তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ঘোলাটে চোখ তার নেশায় ঢুলুঢুলু। পাশের টেবিলে কয়েকটা খালি মদের বোতল।

আমি হতভম্ব হয়ে পড়েছি–একি দেখছি! পালাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াতে প্রৌঢ় ভদ্রলোকটা ধরে ফেললেন আমাকে বললেন– পালাচ্ছো কেন? কি চাও বলো?

লোকটার কথার মধ্যে সহানুভূতির সুর ছিলো; আমি সোজা হয়ে ফিরে দাঁড়ালাম, বললাম– আপনি আমাকে বাঁচান বড় সাহেব, আমাকে বাঁচান। কশাই সোনামিয়ার কবল থেকে বাঁচান..

প্রৌঢ় ভদ্রলোকটার চোখ দুটোতে ক্রুদ্ধভাব ফুটে উঠলো–কি বললে? কশাই সোনামিয়া?

বললাম–হাঁ, সে আমার সতীত্ব নষ্ট করতে চায়।

বলো কি! আমি ওকে খুন করবো। একটা অসহায় বালিকার প্রতি তার এই নিমর্ম আচরণ! মিথ্যা নয়, সেই রাতেই সোনামিয়া হানা দিলো বড় সাহেবের কুঠিরে। বড় সাহেবের হাত থেকে আমাকে কেড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করলো। অবশ্য এতো সাহস পেতো না যদি আমার বাবার প্রশ্রয় সে না পেতো। কারণ বাবা তার কাছে আমার বিনিময়ে অনেকগুলো টাকা নিয়ে ফেলেছিলেন। সেই অধিকারেই রাত দুপুরে সোনামিয়া গিয়েছিলেন বাংলোয়।

বড় সাহেব সোনামিয়াকে উপযুক্ত শাস্তিই দিলেন, কুকুরের মতন তাকে গুলী করে হত্যা করলেন তিনি। কিন্তু খুন– খুনের অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড হবে। সেই রাতেই বড় সাহেব বাংলো ছেড়ে পালালেন। আমাকে তিনি সঙ্গে নিলেন দয়া করে, কারণ আমিও তখন চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। বাবা-মা তাদের উপর আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি জানতাম, তাদের কাছে ফিরে গেলে আমাকে দেহ বিক্রি করে খেতে হবে। না না, তা আমি পারবো না। পতিতার মেয়ে বলে সমাজ আমাদের আশ্রয় দেয়নি। কোনো পুরুষ বিয়ে করে নিতে রাজি ছিলো না কিন্তু তারা সর্বক্ষণ প্রস্তুত ছিলো কেমন করে আমাদের সতীত্ব লুটে নিয়ে আনন্দ উপভোগ করবে। আমি সেই নির্মম মুহর্তে বড় সাহেবকেই কাণ্ডারী মনে করলাম।

পরে জানতে পারলাম, বড় সাহেব আমাদের গ্রামের মালিক রায় বাহাদুর। প্রচুর অর্থের মালিক তিনি। রায় বাহাদুরের ব্যবহার মন্দ ছিলো না- তিনি আমাকে তার সবকিছু দিলেন- অর্থ ঐশ্বর্য যা আমার মন চাইলো তাই দিলেন আমাকে।

জীবনে আমি এতো অর্থ দেখিনি, আমার মনে হতে লাগলো, আমি বুঝি স্বপ্ন দেখছি! সমস্ত দেহে আমার মণি মুক্তাখচিত অলঙ্কার। পায়ের তলায় লুটোপুটি খাচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। ব্যথা-বেদনা সব ভুলে গেলাম,ভুলে গেলাম নিজের অস্তিত্ব– আমি বিয়ে করলাম বৃদ্ধ রায় বাহাদুরকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো শোহেলী রায় বাহাদুর মাতাল কিন্তু চরিত্রহীন নয়, তিনি আমাকে স্ত্রীরূপে পেয়ে অনেক খুশি হলেন। কিসে আমি সুখী হবো, কিসে আমার মন সব সময় প্রফুল্ল থাকবে, এটাই তার চিন্তা। রায় বাহাদুর তার যথাসর্বস্ব আমাকে বিলিয়ে দিয়েছেন কিন্তু….

থেমে পড়লো শোহেলী, একটা প্রচণ্ড ব্যথা যেন তার কণ্ঠ রোধ করে দিলো, যা বলতে চায় তা যেন সচ্ছলভাবে বলতে পারছে না। একটু থেমে বললো– মিঃ আলম, আমি বড় একা, বড় অসহায়। সব পেয়েছি আমি পেয়েছি স্নেহ-ভালবাসা-অর্থ ঐশ্বর্য কিন্তু আমি যা পাইনি তা কোনোদিন পাবো না। হয়তো।

বনহুর বললো–দেখুন, মানুষ একাধারে সব কিছু পায় না। মানুষ যদি সব কিছু পেতো পূর্ণভাবে তাহলে এ পৃথিবী তার কাছে হয়ে উঠতো স্বর্গসম। তাই আপনিও সব পেয়েছেন, হয়তো সামান্য কিছু পাননি যার জন্য আপনি ব্যথিত।

 সামান্য নয় মিঃ আলম, যা আমি পাইনি তা সামান্য নয়। একদিন ভেবেছিলাম, অর্থ আর ঐশ্বর্য থাকলে মানুষ বুঝি সর্বসুখী হয়, কিন্তু আজ আমি বুঝতে পারছি, অর্থ আর ঐশ্বর্যই মানুষের সব বাসনা। পূর্ণ করতে পারে না। হঠাৎ শোহেলী বনহুরের কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেমিঃ আলম!

বনহুর বিস্মিত হয় না শোহেলীর ব্যবহারে, কারণ ওর মনের ব্যথা ও সে বেশ উপলব্ধি করতে পেরেছে। সত্যিই বাঙালি মেয়েদের সমাজে কত বাধা। হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতির মধ্যেই রয়েছে এই সমাজ-বিড়ম্বনা। নিজে নয়, মা নয়– মাতামহীর ত্রুটির জন্য সমাজ থেকে তারা বঞ্চিতা। কতবড় অসহায়া এদেশের নারীকুল। বনহুরের কাঁধে মাথা রেখে শাহেলী যুঁপিয়ে কাঁদছিলো, বাধা দিতে পারে না বনহুর।

শোহেলীর কান্না দেখে বনহুরের চক্ষুদ্বয় সিক্ত হয়ে উঠে।

কতক্ষণ যে কেটেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে বনহুরের। শোহেলীর কান্না থেমে গেছে, সোজা হয়ে বসে শোহেলী বলে– মিঃ আলম, জানি না কেন আপনাকে আমি এসব বললাম। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, করবেন মিঃ আলম……

উঠে দাঁড়ালো শোহেলী।

বনহুরও উঠে পড়লো, কেমন একটা সহানুভূতির সুর হঠাৎ তার কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো–কি চান আপনি? কি পেলে আপনার মনের দুঃখ লাঘব হবে বলুন?

 শোহেলী অন্ধকারে চোখ তুলে তাকালো, বনহুরের মুখখানা বুঝি স্পষ্ট করে দেখতে চাইলো সে একবার। তারপর মাথাটা নত করে নিয়ে বললো পারবেন? আমার মনের দুঃখ লাঘব করতে পারবেন। আপনি?

চেষ্টা করবো।

হঠাৎ কথাটা বলে বনহুর নিজেই বেশ বিব্রত বোধ করলো। সে সব বুঝেও কেন এমন অবুঝের মত কথা বললো। সত্যি কি সে পারবে– পারবে শোহেলীকে খুশি করতে? পারবে তার দুঃখ-বেদনা লাঘব করতে?

শোহেলী যেন অন্ধকারে আলের সন্ধান পেলো, বললো–একটু ভালবাসা….একটু প্রেম পারবেন। দিতে আমাকে? বলুন পারবেন? মন্ত্রমুগ্ধের মত বনহুর বললো– পারব।

সত্যি?

বনহুর চট করে কোনো জবাব দিতে পারলো না এবার।

হঠাৎ শোহেলী বনহুরের একখানা হাত মুঠায় চেপে ধরলো কথা বলছেন না কেন?

উ কি বললেন?

শুনতে পাচ্ছেন না?

মিসেস শোহেলী …না না, সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, চলুন ফিরে যাই হোটেলে।

 কিন্তু?

আবার আর একদিন আসা যাবে।

আসবেন তো?

আসবো।

 পা বাড়ালো বনহুর গাড়িখানার দিকে।

শোহেলী তাকে অনুসরণ করলো।

ড্রাইভিং আসনের দরজা খুলে ধরলো বনহুর– উঠুন।

 শোহেলী নীরবে উঠে বসলো।

বনহুর গাড়িতে উঠে বসে ষ্টার্ট দিলো। সমস্ত রমনা পার্ক তখন নীরব হয়ে গেছে। দু’একজন যারা তখনও বসে কথাবার্তা বলছিলো তারাও ফিরে যাবার জন্য উঠে পড়েছে, এগিয়ে চলেছে পার্কের গেটের দিকে।

জনমুখর পথ বেয়ে বনহুরের গাড়িখানা ছুটে চলেছে। বনহুর নিজকে আজ সংযত করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে মনে সান্ত্বনা অনুভব করছে। এমন একটা অবস্থায় আজ পড়েছিলো সে, যে মুহূর্তে কোনো পুরুষ পারে না মনকে কঠিনভাবে সামলে রাখতে। সুন্দরী তরুণী শোহেলীর প্রেম নিবেদনে তার মনেও যে শিহরণ জাগেনি তা নয় কিন্তু সে পাষাণের মত শক্ত হয়ে পড়েছিলো, ভেবেছিলো এতো সহজে তার আনমনা হওয়া চলে না।

গাড়িতে বসে কিছুক্ষণ উভয়েই নীরব রইলো। শোহেলী কোনো কথা বলছে না, হয়তো তার মনে গভীর বেদনা এখন জমাটভাবে দানা বেঁধে উঠেছে। ..

বনহুর গাড়ি চালাচ্ছিলো, চোখ ছিলো তার সামনের দিকে। শুধু আজ নয়, বেশ কয়েকদিন হলো এসব রাস্তায় সে গাড়ি চালিয়ে এসেছে। ঢাকা শহরের পথঘাট তার প্রায় সব পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। অসংখ্য দ্রুতগামী যানবাহনের ভিড় এড়িয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলো বনহুর।

শোহেলী আসনে ঠেশ দিয়ে বসেছিলো, মন হচ্ছে সে যেন ক্লান্ত আর অবসন্ন হয়ে পড়েছে অন্তরের সব কথা অপকটে আজ ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়েছে বলে হাল্কা লাগছে বুঝি তার মনটা। সব কথা যেন তার নিঃশেষ হয়ে গেছে অন্তর থেকে। শোহেলী নিজেই জানে না, কেন সে তার জীবনের ঘটনাগুলো একটা অজানা অচেনা মানুষেরই কাছে প্রকাশ করলো।

বনহুর বললো- শোহেলী!

বলুন মিঃ আলম?

আপনার বাবা-মা-ভাই আর অবশিষ্ট বোনগুলো এখন কোথায়? কোথায় আছে তারা?

জানি না, তবে শুনেছিলাম আমার বাবা পাগল হয়ে গেছেন। পরপর বোনগুলোর অন্তর্ধান, তারপর অভার রাক্ষসীর তাড়া তিনি সহ্য করতে পারেননি….. বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো শোহেলীর গলা।

বনহুর বুঝতে পারলো, পিতার প্রতি কন্যার গভীর আকর্ষণের অনুভূতি কত গাঢ় যা বিনষ্ট হয়নি এতো ঝড়-ঝঞ্ঝার প্রচণ্ড আঘাতেও। বললো বনহুর- শোহেলী, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?

বলুন?

আপনার পিতামাতা আর অসহায় ছোট ভাইবোনদের খোঁজটা আমাকে জানাবেন?

কেন?

এতোটুকু সহায়তা করতে যদি পারি!

 না। আমি তাদের দিকে কাউকে ফিরে তাকাতে দেবো না।

 সেকি?

যে পিতা আমাদের সর্বনাশের মূল, সেই পিতাকে আমি দেব সহায়তা করতে? মরে গেলেও না।

 আপনি তো জানেন, কেন তিনি আপনাদের উপর এই নৃশংস আচরণ করেছিলেন? ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ হারিয়ে ফেলে তার স্বাভাবিক জ্ঞান। মানুষ পরিণত হয় পশুতে।

 মিঃ আলম, আমি কি নিজে পারতাম না আমার পিতা-মাতা ভাই-বোনদের সাহায্য করতে?

পারতে, কিন্তু করোনি, কেন করোনি তা একটু পূর্বেই তুমি নিজেই বলেছে। শোহেলী, তুমি ভুল করেছো…

কখন যে বনহুর শোহেলীকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে ফেললো খেয়াল নেই। হঠাৎ বললো– মাফ করবেন, আমি আপনাকে—-

 না না, আর আপনি’ বলে নয়, তুমি’ বলেই আমাকে ডাকবেন, অনেক খুশি হবো মিঃ আলম।

কেন যেন বনহুর ইচ্ছা করেই এপথ-সেপথ ঘুরে ফিরে গাড়ি চালিয়ে নিচ্ছিলো, সোজা হোটেল অভিমুখে না গিয়ে একটু বিলম্ব করছিলো পথের মধ্যে। অবশ্য বনহুরের মনে একটা অভিসন্ধি ছিলো, নূরী নিউমার্কেট গিয়েছিলো সে যেন ফিরে এসে হোটেলে প্রবেশ করে থাকে এবং সেই কারণেই বনহুরের পথে বিলম্ব করা।

শোহেলীর কথায় বললো বনহুর– যদি খুশি হন তাই বলবো।

 আচ্ছা মিঃ আলম, ঢাকায় আপনার কি কেউ নেই?

না।

 ঐ চাকরটি বুঝি সব সময় আপনার সঙ্গে থাকে?

হা।

ও কিন্তু ভালভাসে আপনাকে।

 কেমন করে বুঝলেন?

আপনি হোটেলে আসার পর কয়েকদিনের জন্য না জানি কোথায় উধাও হয়েছিলেন, তখন আমি দেখতাম আপনার চাকরটা সব সময় মুখখানা ভার করে বসে আছে। সর্বক্ষণ কি যেন চিন্তা করছে, বেশ বুঝতে পেরেছি সে আপনার অনুপস্থিতির জন্যই এমন ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলো।

ওঃ তুমি তাহলে প্রথম থেকেই——-

হাঁ, আমি প্রথম দিন থেকেই আপনাকে অনুসরণ করে আসছি। আপনি আমাকে লক্ষ্য না করলেও আমি প্রতিদিন আপনাকে লক্ষ্য করেছি। রোজ আপনি যখন বাইরে গেছেন আমি হোটেলের জানালায় দাঁড়িয়ে দেখেছি আপনাকে কখন ফিরে আসবেন সেই প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করেছি জানালার পাশে। যখন আপনি হোটেলের বাগানে পায়চারি করেছেন তখন আমি তন্ময় হয়ে দেখেছি আপনাকে। কতদিন ভেবেছি গায়ে পড়ে আলাপ করবো কিন্তু আমার বিবেক বাধা দিয়েছে– না না, তা হয় নানা জানি কোথাকার কে, পরিচয় করতে গেলে যদি কথা না বলে তবে অপমান হব, তাই সাহস হয়নি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে। কিন্তু আর পারিনি, পারিনি নিজকে সংযত রাখতে। আপনি যখন বাগানে বসেছিলেন তখন এসে পড়েছিলাম। একটু থেমে বললো– জানি না, আপনি আমাকে ঘৃণা করছেন কিনা? কিন্তু আমি পারলাম না মিঃ আলম।

শোহেলী আসনে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

বনহুর গাড়ি চালিয়ে চলেছে, সেও নীরব। শোহেলীর শেষ কথার কোনো জবাব সে দেয়নি বা খুঁজে পায়নি।

গাড়ি হোটেলের গেটে প্রবেশ করতেই অবাক হলো বনহুরহরি দাঁড়িয়ে আছে গেটের অদূরে।

বনহুর দুঃসাহসী বটে কিন্তু আজ সে কেমন যেন ভড়কে গেলো, মনে মনে বেশ বিব্রত বোধ করলো সে। গাড়ি থামলো, অন্যান্য দিনের মতো আজ হরি ছুটে এলো না বনহুরের গাড়ির পাশে। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই রইলো।

বনহুর বুঝতে পারলো হরির মনোভাব। গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে ধরলো।

 শোহেলী নেমে দাঁড়ালো, হাত বাড়িয়ে দিলো বনহুর দিকে।

বনহুর অগ্যতা হাত বাড়ালো শোহেলীর দিকে।

 হেসে বললো– গুডনাইট মিঃ আলম, কাল আবার দেখা হবে।

শোহেলী চলে গেলো তার নিজের ক্যাবিনের দিকে।

 বনহুর ডাকলো–হরি!

কোনো জবাব না দিয়েই হরি গাড়ির দরজা বন্ধ করে গাড়িতে চাবি আটকালো, তারপর চলে গেলো ক্যাবিনে।

বনহুর মৃদু হাসলো, বুঝতে পারলো, হরি ভীষণ রাগান্বিত হয়ে পড়েছে। নিজের কামরায় এসে বনহুর ড্রেস পরিবর্তন করছিলো। অন্যান্য দিন হরি তাকে সাহায্য করে এসব ব্যাপারে। আজ হরি কামরায় এলো না।

বনহুর ড্রেস পরিবর্তন করে বাথরুমে প্রবেশ করলো। ফিরে এসে দেখলো, হরি তার পরিত্যক্ত জামাকাপড়গুলো গুছিয়ে তুলে রাখছে। ড্রেসিং আয়নাটার সম্মুখে দাঁড়িয়ে চুলগুলো আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো বনহুর নূরী, কি হলো তোমার?

কি আবার হবে?

কথা বলছে না যে?

 তোমার কথা বলার লোকের তো অভাব নেই।

ওঃ মিসেস শোহেলীর কথা বলছো?

 হাঁ, কবে থেকে ওর সঙ্গে তোমার আলাপ হলো?

আজ।

মিথ্যে কথা।

না, সত্যি করে বলছি। নূরী? বনহুর নূরীর কাঁধে হাত রাখলো– আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো না নূরী।

কোনোদিন করেছি তোমাকে অবিশ্বাস– কিন্তু….আমি দেখছি আজকাল তুমি বেশ পাল্টে গেছো।

মানে?

মানে তুমি যাকে পাও তাকেই সঙ্গিনী করে নাও।

দোষ কি এতে? চাপা একটু হাসলো বনহুর।

নূরীর রাগ আরও চরমে উঠলো, সে ক্রুদ্ধভাবে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে।

 বনহুর শয্যায় গা এলিয়ে দিলো। মিছামিছি ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো চুপচাপ।

খাবার জন্য ডাক পড়লো, বয় এসে জানালো খাবার দেওয়া হয়েছে।

তবু বনহুর উঠলো না।

নূরী লক্ষ্য করলো বাইরে থেকে।

রাত বেড়ে আসছে, তবু জাগলো না বনহুর।

নূরী আলগোছে এসে দাঁড়ালো বনহুরের শিয়রে। বনহুরের চোখ বন্ধ থাকলেও সে নূরীর পায়ের শব্দ শুনেই বুঝতে পারলো, নূরী এসেছে। বনহুরের নিশ্বাস পড়ছে বেশ জোরে জোরে। সে যে না ঘুমিয়ে জৈগে আছে বুঝার জো নেই।

বনহুরের মাথায় হাত রাখলো নূরী–হুর! হুর ঘুমিয়েছো?

 পাশ ফিরলো বনহুর, কোনো জবাব দিলো না।

নূরী আবার ডাকলো– হুর, উঠো খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।

এবার কথা বললো বনহুর ক্ষিধে নেই।

সেকি? সেই দুপুরবেলা খেয়েছো, বিকেলে নাস্তাও করোনি বুঝি?

যাও বিরক্ত করো না।

উঠো লক্ষ্মীটি।

 মোটেই উঠবো না। কথাটা বলে বালিশে মুখ লুকিয়ে হাসে বনহুর।

সে জানে, নূরী তার উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবে না।

নূরী বনহুরের চুলে আংগুল চালিয়ে দিতে দিতে বলে আবার তুমি যা খুশি করো আর আমি কিছু বলবো না। কিন্তু একটি কথা তোমাকে রাখতে হবে বলো রাখবে?

উ হু কোনো কথাই আমি তোমার রাখবো না।

 কি বললো না শুনেই বলছো?

হাঁ, আমি জানি তুমি খেতে বলবে।

 হেসে ফেলে নূরী–না খেলে আমার বয়েই যাবে।

বনহুর এবার নূরীর হাতখানা ধরে টেনে নেয় কাছে তবে যে আমার এতো সখের ঘুমটা নষ্ট করে দিলে?

শোন হুর?

বলো?

এ হোটেল ছাড়তে হবে।

কোথায় যাবে?

ঢাকা শহরের বাড়ির অভাব হবে না।

বেশ, তাই হবে।

এবার তবে খাবে, চলো।

না।

 কেন খাবে না?

তুমি আমাকে ভুল বুঝ বা অবিশ্বাস করো তা আমি সহ্য করতে পারবো না।

হুর

বলো আমাকে তুমি ভুল বুঝবে না?

 না।

নূরী খাবারের থালাটা এনে বনহুরের মুখে তুলে দিতে লাগলো।

খাওয়া শেষ হলে বললো নূরী– চলি?

না।

সেকি?

আজ থাকবে আমার কামরায়।

 সর্বনাশ, লোকে বলবে কি বলো তো?

না, এমনি করে তোমাকে দূরে রেখে আমি থাকতে পারবো না নূরী।

 লক্ষ্মীটি ছেড়ে দাও। কেউ এসে পড়বে যে?

 ছাড়বো না।

এমন সময় দরজার বাইরে বয়ের আসার শব্দ শোনা যায়।

বনহুর নূরীকে মুক্ত করে দেয়– যাও হরি।

বয় খাবারের থালা– বাসন নিয়ে যায়, হরিও বেরিয়ে যায় তার পিছনে পিছনে।

*

ভোরে দৈনিক পত্রিকাখানা নিয়ে চোখ বুলাচ্ছিলো বনহুর, এখনও টেবিলে নাস্তা দেওয়া হয়নি।

 হরি বিছানা গুমাচ্ছিলো।

 বনহুর সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলো।

বাইরে মিষ্টি একটা কণ্ঠ ভেসে উঠলো– আসতে পারি?

 বনহুর তাকালো নূরীর দিকে, তারপর বললো–এসো।

কামরায় প্রবেশ করলো শোহেলী—- কি করছেন মিঃ আলম?

 এই তো পত্রিকাখানায় চোখ বুলাচ্ছি। বস।

শোহেলী বসলো, একটু হেসে বললো– আপনি কিন্তু বেশ আছেন– হরি সবসময় আপনার তদারক করে।

হাঁ। আড়নয়নে একবার বনহুর নূরীর দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, নূরী তখন বিছানার চাদরখানা পাল্টে পাতছিলো।

শোহেলী বললো– মিঃ আলম, জানেন কাল অতোরাতে ফিরেও দেখি রায় বাবুর নেশা ছুটেনি। সত্যি, আপনার সঙ্গে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ যেন স্বর্গসুখ অনুভব করছিলাম।

 বনহুর কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঘাবড়ে যাচ্ছিলো, কি বলতে আরও কি বলে বসে শোহেলী কে জানে। বনহুর শোহেলীর কথায় কোনো জবাব না দিয়ে পত্রিকাখানায় দৃষ্টি বুলিয়ে যাচ্ছিলো মনোযোগ সহকারে।

শোহেলী পুনরায় বললো– মিঃ আলম, হোটেলে ফিরে স্বামীর নেশাতুর চেহারা দেখে আমার মনের অবস্থা যে কি হলো তা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। গোটারাত আমার কেমনভাবে কেটেছে জানিনা।

মাতাল হলেও তিনি আপনার স্বামী, কোনো নারীর উচিত নয় স্বামীকে ঘৃণা করা। বললো বনহুর।

শোহেলী গম্ভীর কণ্ঠে বললো- আপনি পুরুষ মানুষ তাই আমার মনের ব্যথা বুঝতে পারবেন না? মিঃ আলম, আপনি কাল বলেছেন আমার সব ব্যথা-বেদনা আপনি দূর করতে চেষ্টা করবেন?

বনহুর চমকে উঠলোকাল খেয়ালের বশে কি বলে বসেছে সে নিজেই যে উপলব্ধি করতে পারেনি। বনহুর তাকিয়ে দেখলো, নূরী বেরিয়ে গেছে কক্ষ থেকে। হয়তো শোহেলীর কথাটা তার কানে গিয়েছে।

বনহুর কথার মোড় ফেরাতে চেষ্টা করলো– একটা কথা কাল তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আচ্ছা, তুমি হিন্দু মেয়ে অথচ তোমার নামে ঠিক মুসলমানী ঢং আছে– এর কারণ কি?

ওঃ শোহেলী মুসলমানী নাম তাই বলছেন?

হাঁ, শোহেলী নামটা মুসলমানদেরই ঘরে বেশি শোনা যায়।

মিঃ আলম, কাল আপনাকে বলেছি না আমার স্বামী রায় বাবু নর হত্যা করেছেন?

 হা বলেছো।

আমি আপনার কাছে কোনো কথা লুকোইনি কারণ আপনাকে আমি প্রথম নজরে দেখেই বিশ্বাস করে ফেলেছি। সেই কারণেই সব কথা অকপটে প্রকাশ করেছি আপনার কাছে। হা, কি বলছিলাম, আমার স্বামী রায় বাবু একজনকে খুন করে পালিয়েছেন। তিনি বাংলো থেকে পালিয়ে নিজের বাড়িতে কয়েক মাস আত্মগোপন করেছিলেন, সেই সময় তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বেশ ভালই ছিলাম ইট পাথরে গড়া কারাগারসম প্রাসাদের মধ্যে। কিন্তু একদিন পুলিশ কেমন করে জানলো রায় বাবু তার বাড়িতে লুকিয়ে আছেন।

 খবরটা রায় বাবুর কানে আসতে বিলম্ব হলো না, তিনি যখন শুনলেন পুলিশ তার সন্ধান পেয়েছে তখন তিনি অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে পড়লেন। সেই দিনই গভীর রাতে আমাকে নিয়ে রায় বাবু ভেলা ভাসালেন। নদীপথে ঘুরেফিরে একদিন দিল্লী গিয়ে হাজির হলাম। তারপর সেখানে গিয়েও স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। না জানি কখন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে বসে। তাই তিনি নাম পাল্টে নিলেন নিজাম হোসেন নামে আর আমার নাম হলো শোহেলী…

 এতোক্ষণে বনহুর বুঝতে পারলো, হিন্দু মেয়ে হয়েও কেন এর নাম শোহেলী। খুনী পলাতক আসামীর পত্নী শোহেলী বনহুরকে ভাবাপন্ন হতে দেখে বললো আমার মার দেওয়া নাম জ্যোৎস্না রাণী।

বনহুর হেসে বললো– হাঁ, তোমার বাবা-মা ঠিক তোমার চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে নাম। রেখেছিলেন। জ্যোৎস্নার মতই সুন্দর তুমি—

 কি যে বলেন! একটু হাসলো শোহেলী, তার সে হাসির মধ্যে ছিলো না কোনো আনন্দ-ভরা উচ্ছ্বাস, ছিলো শুধু বেদনা আর বুকভরা নিশ্বাসের হাহাকার।

বনহুরের কথা মিথ্যা নয়, শোহেলীর চেহারা সত্যিই সুন্দর নির্মম জ্যোৎস্নার আলোর মতই স্নিগ্ধ। হঠাৎ বলে উঠে শোহেলী– চলুন না আমার স্বামীর সঙ্গে আলাপ করবেন?

এখন নয় শোহেলী, পরে হবে।

 তা অবশ্য ঠিক, কেননা এখনও রায় বাবুর নিদ্রাভঙ্গ হয়নি।

কথা শেষ হয় না শোহেলীর, একজন বয় শশব্যস্তে ছুটে আসে মেম সাহেব, শীগগির চলুন, বাবু বমি করছেন।

সেকি! বলে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো শোহেলী, বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

বনহুর পুনরায় পত্রিকাখানা চোখের সামনে তুলে ধরে পত্রিকায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু শাহেলীর ব্যথাকরুণ মুখখানা ভাসতে লাগলো তার চোখের সামনে।

শোহেলী বড় অসহায়া মেয়ে। তার রূপ যৌবন-ভরা মনোহরণকারী সৌন্দর্য। তার স্নিগ্ধ কোমল। হাস্যোজ্জ্বল মুখ, হরিণীর মত ব্যথাকরণ দুটি চোখ সত্যিই বড় করুণ।

বয় নাস্তা এনে টেবিলে রাখলো।

বনহুর তাকালো নূরীর সন্ধানে, কিন্তু নূরী কইতাকে তো দেখছে না আশেপাশে। তবে কি সে অভিমানে করেছে! বনহুরের ঠোঁটের কোনে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। নাস্তার টেবিলে বসতে যাবে, এমন সময় পূর্ব বয়টা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলোসাহেব, চলুন, আপনাকে মেম সাহেব ডাকছেন।

কেন?

বুড়ো ভদ্রলোক বমি করতে করতে একেবারে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন।

বনহুরের আর নাস্তা খাওয়া হলো না, সে উঠে শ্লিপিং গাউনটা পরে নিয়ে বেরিয়ে গেলো বয়ের পিছনে।

শোহেলীদের কামরায় পৌঁছতেই একটা উৎকট গন্ধ প্রবেশ করলো তার নাকে- কি বিশ্রী গন্ধ!

বনহুরকে দেখেই শোহেলী কাদ কাঁদ স্বরে বলে উঠলো–মিঃ আলম, শীগগির ডাক্তার ডাকুন, ডাক্তার ডাকুন। আমার স্বামী হঠাৎ এমন হলো কেন?

বনহুর দেখলে, খাটের উপর কাৎ হয়ে পড়ে আছে বৃদ্ধ রায় বাবু একদিকে পা আর একদিকে মাথা ঝুলছে। খাটের উপর এবং পাশে পাকার নোংরা জিনিস, বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছেন চারিদিকে।

তখনও টেবিলে কয়েকটা মদের বোতল খালি পড়ে আছে।

বনহুর একনজরে কক্ষটা একবার দেখে নিলো, যে-সব আসবাব কক্ষমধ্যে রয়েছে তা মূল্যবান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আলনায় অনেকরকম মূল্যবান শাড়ি ভাজ করা। ড্রেসিং আয়নার পাশে নানারকম প্রসাধন দ্রব্য। বনহুরের দৃষ্টি ফিরে এলো শোহেলীর ভয়বিহ্বল মুখমণ্ডলে। তাড়াতাড়ি রায় বাহাদুরের হাতখানা তুলে নিয়ে নাড়ী দেখলো বনহুর তারপর আশ্বাস দিয়ে বললো– ভয় নেই শোহেলী। বেশি নেশা পান করায় এমন হয়েছে, সেরে উঠবে এক্ষুণি!

সারবে তো? ব্যথাকরুণ শোহেলীর কণ্ঠস্বর।

হাঁ সারবে।

 ডাক্তার ডাকতে হবে না?

না, আমার কাছে একটা ঔষধ আছে, খাইয়ে দাও সেরে যাবে। বনহুর বেরিয়ে গেলো, একটু পরে একটু ছোট্ট ঔষধের শিশি হাতে ফিরে এলো– এটা খাইয়ে দাও।

শোহেলী ঔষধটা খাইয়ে দিলো স্বামীকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সংজ্ঞা ফিরে এলো রায় বাহাদুরের

*

রায় বাহাদুর সেদিন সুস্থ হবার পর স্ত্রীর মুখে সব শুনে খুশি হলেন– বিদেশে তাদের এমন একজন বন্ধুস্থানীয় লোক আছে, এ যে তার কল্পনার বাইরে। রায় বাহাদুর একসময় বনহুরের কামরায় এসে তাকে অভিনন্দন জানালেন। বনহুরের দেওয়া ঔষধ খেয়ে তিনি বেশ সুস্থ মনে করছেন।

এরপর থেকে বনহুরের সঙ্গে রায় বাহাদুর মানে নিজাম হোসেন একেবারে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লেন। প্রায়ই বনহুরকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বের হতেন বা বাগানে বসে গল্প সল্প করতেন। সরল-সচ্ছ ভদ্রলোক। নিজাম হোসেন। হঠাৎ একটা খুন হওয়ায় তাঁর জীবনে এসেছে এক মহা পরিবর্তন। তিনি ইচ্ছাকৃত এ দোষে দোষী নন।

নিজাম হোসেন আর শোহেলী বনহুরের সঙ্গে যতই গভীরভাবে মিশছে ততই নূরীর মন চঞ্চল হয়ে পড়ছে। বনহুর বুঝি ক্রমান্বয়ে সরে পড়ছে তার কাছ থেকে। আজকাল নূরী অভিমান করলে বনহুর তেমন করে আর ঘাবড়ে যায় না। তার অভিমান ভাঙানোর জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে আর পড়ে না। সব সময়। বনহুর উদাসভাবে কিছু চিন্তা করে।

নূরীও আসে না গায়ে পড়ে কথা বলতে, সেও এড়িয়ে চলে ইচ্ছা করে। বনহুরের পাশের কামরাতেই ঘুমাতো নূরী। সে আজকাল প্রায়ই জেগে জেগে লক্ষ্য করতো বনহুরকে। অনেক রাত পর্যন্ত বনহুরের কক্ষে আলো জ্বলতে দেখে সে কি করে? বসে বসে কাটায় না বই পড়ে? নিজ মনেই প্রশ্ন করে নূরী। রাগ আর অভিমানে সে উঁকি দিয়েও দেখে না।

একদিন গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো নূরীর, কান পেতে শুনলো বনহুরের দরজায় বয়ের কণ্ঠস্বরসাহেব সাহেব, দরজা খুলুন।

দরজা খোলার শব্দ হলো।

পরক্ষণেই শুনতে পেলো বয়ের গলা–মেম সাহেব আপনাকে ডাকছেন, আজ আবার সাহেব অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

আচ্ছা যাও, আমি আসছি। বনহুরের কন্ঠস্বর।

একটু পরে বনহুরের বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলো নূরী, মনটা ওর চঞ্চল হয়ে উঠলো নিজের অজান্তে কেন তার এমন লাগছে ভেবে পেলো না সে। চুপচাপ শুয়ে থাকার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।

বনহুর শোহেলীর কক্ষে প্রবেশ করে আজ বিস্মিত হলো, কই আজ তো নেই সেই বিশ্রী উকট গন্ধ, নেই কোনো গোঙানির শব্দ। খাটের দিকে তাকিয়ে বনহুর আরও অবাক হলো–রায় বাহাদুর তো সেখানে নেই, কক্ষের চারিদিকে তাকালো সে। দেখলো শোহেলী শয্যায় শুয়ে আছে একা এলোমেলো চুল, চোখদুটো লাল টকটকে দেহের বসন সংযত নয়। পাশের খাটের উপর পড়ে আছে একটা খালি মদের বোতল আর কাঁচের গ্লাস।

থমকে দাঁড়ালো বনহুর।

শোহেলী উঠে দাঁড়ালো জড়িত কণ্ঠে বললো–মিঃ আলম, এসেছেন? আসুন সরে আসুন– আমার পাশে—

 বনহুরের মুখকঠিন হয়ে উঠলো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো–শোহেলী, তুমিও—ছিঃ ছিঃ ছিঃ, তুমিও মদ খাও?

শোহেলী শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো টলতে টলতে এগিয়ে এলো বনহুরের পাশে না খেলে বাঁচবো কি করে বলেন?

 শোহেলীর মুখ থেকে তীব্র উৎকট গন্ধ বেরিয়ে এলো, বনহুর রাগতকণ্ঠে বললো–আমাকে কেন ডেকেছে?

মিঃ আলম এই নির্জন নিস্তব্ধ কক্ষে আমি কি করে একা থাকি বলুন?

তবে বয় গিয়ে আমাকে মিথ্যা কথা বলেছে? সাহেব আজ আবার অজ্ঞান হয়ে আছেন বললো– এ কথা মিথ্যা?

খিল খিল করে হেসে উঠলো শোহেলী জড়িয়ে ধরলো বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা–মিথ্যা সে। বলেনি, আমি ওকে পাঠিয়েছিলাম।

কেন? কেন এভাবে আমাকে মিথ্যা কথা বলে—

মিঃ আলম, আপনি যদি মেয়েছেলে হতেন তবে বুঝতে পারতেন কি অসহ্য ব্যথা আমার বুকে তোলপাড় করছে। না না, কেউ বুঝবে না আমার ব্যথা আমার বেদনা—

রায় বাবু কই?

জানিনা। যেদিন থাকে মদের নেশায় চুরচুর আর যেদিন না থাকে সেদিন কোথায় কাটায় কে জানে। আর আমি একা সম্পূর্ণ একা নির্জন কক্ষে ছটফট করে মরি—হঠাৎ বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে শোহেলী উচ্ছ্বসিতভাবে।

বনহুর ক্ষণিকের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে যায়।

ঠিক সেই মুহূর্তে নূরী উঁকি দেয় দরজার ফাঁকে দেখতে পায় তার বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তরুণীটি। আর দাঁড়াতে পারে না সে চলে যায় সেখান থেকে।

বনহুর বিব্রত কণ্ঠে বলে–শোহেলী সংযত হও। এসব তোমার অন্যায়।

অন্যায়? কি করেছি আমি যা অন্যায়?

স্বামীর উপর রাগ করে নেশা পান করা—

 না, আমি রাগ করে নেশা পান করিনি মিঃ আলম। আমি নিজকে ভুলে থাকার জন্য—–

 তাই তুমি মেয়েছেলে হয়ে মদ খাবে?

কি করবো বলুন? আমাকে বলে দিন কি করবো আমি?

ধৈর্য ধারণ করতে হবে।

ধৈর্য–হাঃ হাঃহাঃ ধৈর্য ধারণ করবো। কিন্তু আর যে আমি পারছি না ধৈর্য ধরতে মিঃ আলম। বনহুরের জামাটা দুহাতে চেপে ধরে শোহেলীবলুন কিভাবে আমি ধৈর্য ধরবো? আবার কেঁদে উঠে হাউমাউ করে। হাসি আর কান্নায় শোহেলীর দেহটা নেতিয়ে পড়ে বনহুরের হাতের উপর।

এতো বেশি নেশা পান করেছিলো শোহেলী যে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। বনহুর ওকে শুইয়ে দেয় খাটের উপর, চাদরখানা দিয়ে ঢেকে দেয় শরীরটা তারপর বেরিয়ে যায় কামরা থেকে।

*

পরদিন হোটেলে হরিকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। বনহুর বুঝতে পারলো, সে রাগ বা অভিমান করে কোথাও চলে গেছে। তেমন করে ঘাবড়ে গেলো না বনহুর। কিন্তু মনের কোনায় একটা দুশ্চিন্তা খোঁচা দিতে লাগলো তার। কোথায় গেলো সে, কোথাই বা আছে কে জানে। বনহুর গোপনে অনুসন্ধান চালালো।

শোহেলী আসে, বনহুরের ঘরখানা অগোছানো দেখে বলে–মিঃ আলম, আপনার হরি কোথায়?

বনহুর চট করে জবাব দিতে পারে না, একটু ভেবে বলে–বড় বিশ্বাসী ছিলো, কিন্তু আমাকে না বলে পালিয়েছে।

 বনহুরের বলার ভঙ্গী দেখে হাসে শোহেলী বিশ্বাসী ছিলো তবু পালালো! ওঃ বুঝেছি এলে আবার রাখবেন, এজন্যই বুঝি এতো? বনহুর হাসে শুধু।

 শোহেলীর স্বামীর সঙ্গে বনহুরের আলাপ হয়েছে। আজকাল অবসর সময়টা নিজাম হোসেন আর শোহেলীর সঙ্গেই কাটে বনহুরের। হরি না বলে চলে গেছে, ওর জন্য মাঝে মাঝে কথা উঠে, বনহুর আনমনা হয়ে যায় কিন্তু উতালা হয় না। জানে, ঢাকা শহরে হরি হারিয়ে যাবে না, নিশ্চয় সে ফিরে আসবে একদিন।

কিন্তু দিনের পর দিন গড়িয়ে যায়–হরি আর ফিরে আসে না। বনহুর বেশ চঞ্চল হয়ে পড়ে, এতোদিন ভেবেছিলো রাগ বা অভিমান করে হরি কোথাও আত্মগোপন করেছে কিন্তু এবার বনহুর সত্যিই ঘাবড়ে যায়সব সময় হরি থাকতো তার পাশে পাশে, ছায়ার মত তাকে আগলে রাখতো আর আজ কদিন তার কক্ষ শূন্য। বিছানা এলোমেলো ঘরের আসবাব বিক্ষিপ্ত ছড়ানো। যেখানে বনহুর স্লিপিং গাউনটা খুলে রাখে সেখানেই পড়ে থাকে। যেখানে জামাটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় সেখানেই লুটোপুটি খায়, গুছিয়ে রাখার যেন কেউ নেই। সর্বক্ষণ বনহুর হরির অভাব অনুভব করে।

 শোহেলী বলে–মিঃ আলম আজকাল আপনাকে বড় ভাবাপন্ন লাগে, ব্যাপার কি বলুন তো?

একটু হেসে বলে বনহুর-শরীরটা ক’দিন ভাল যাচ্ছে না।

ওঃ বুঝেছি হরির জন্য মন খারাপ না কি?

হাঁ, ও থাকতে কোনো অসুবিধা ছিলো না, এখন একটু অসুবিধা হচ্ছে, তাই মনে পড়ে ওর কথা।

 সত্যি হরি কিন্তু আপনাকে খুব ভালবাসতো।

হয়তো বাসতো।

হয়তো নয় মিঃ আলম, কতদিন তার সঙ্গে আলাপ করে আমি ওর মনের কথা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ছোকরা গেলো কেন?

তাইতো ভেবে পাই না।

 যাক সে গেছে নিজের কপাল নিয়ে গেছে, আমার বয়টা আপনার কাজ করে দেবে।

শোহেলী প্রায়ই এসে হানা দেয় বনহুরের ঘরে। আসুন তাস খেলা যাক।

সময় কাটানোর জন্য না করতে পারে না বনহুর, শোহেলীর সঙ্গে মেতে উঠে তাস খেলায়।

এখানে বনহুরকে যখন শোহেলী তার রূপসুধা পানে প্রলুব্ধ করার চেষ্টায় ব্যাপৃত ছিলো তখন নূরী। হরি রূপ পাল্টে ঢাকায় এক ধনবানের গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলো বোন রূপে।

প্রথম দিনের কথা নূরী ভুলবে না কোনোদিন—হোটেল থেকে বিদায় হয়ে সে যেদিন রাতের অন্ধকারে পথে বেরিয়ে এলো তখন তার সম্বল ছিলো মাত্র কয়েকটা টাকা আর বনহুরের দেওয়া একটা আংটি যা সে কোনোদিন কাছছাড়া করেনি। যখন সে হরি বেশে ছিলো তখন আংটিটা হাতের আংগুলে পরতো না। গোপনে লুকিয়ে রাখতে নিজের কাছে।

নূরী রাতের অন্ধকারে ফুটপাত ধরে এগুতে লাগলো।

কে যেন বলে উঠলো–কোন হ্যায়?

হরি পিছনে তাকিয়ে দেখলো দু’জন পুলিশ এগিয়ে আসছে।

 সে থেমে পড়লো, হাত জুড়ে বললো–হাম মজুর হত্যায়।

মজুর তো এতনা রাতমে কাহা ঘুমতা?

 হুজুর কাম করকে ঘর যাতা।

 কাহা তোমরা ঘর?

হুজুর ওধার একটু দূরমে।

 জলদি চল্ যা।

বহুৎ আচ্ছা হুজুর।

হরি দ্রুত পা চালালো কিন্তু কোথায় যাবে এই রাতদুপুরে। পথে কতরকম বিপদ যে ওৎ পেতে বসে আছে কে জানে। এভাবে চলে আসাটা তার ঠিক হয়নি হয়তো। কিন্তু হোটেলে থাকাও যায় না– চোখের সামনে তার হুর অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে যা করবে আর সে এসব দৃশ্য নিজে সহ্য করবে নানা, তা সে পারবে না, আর পারবে না বলেই সে আজ বেরিয়েছে কোথায় চলেছে, কেন চুলেছে। জানে না হরি।

 ক্লান্ত অবশ পা দু’খানা নিয়ে আর সে চলতে পারছে না। অনেক দূর এসে পড়েছে হরি বেশি নূরী।

এবার তার সম্মুখে দুটো লোক এসে পড়ে হুমড়ি খেয়ে তার গায়ে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হরি, একটা বিদঘুটে গন্ধ লাগে তার নাকে। তাড়াতাড়ি নাকে হাতচাপা দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

 লোক দুটোর গা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিলো, জড়িত তাদের কণ্ঠস্বর একজন বললো–কে রে হারামজাদা?

অন্য আর একজন বলে উঠে ছেচড়া চোর।

হেউ করে ঢেকুর তোলে প্রথম লোকটা-ছেঁচড়া—কি বললি ছেঁচড়া চোর?

হাঁ, তাই হবে, নাহলে এভোরাতে পথে বের হয় কেউ?

তাই তো ঠিক বেটা ছেঁচড়া চোর। ধরিয়ে দে বেটাকে পুলিশে।

 এ্যাঁ পুলিশ! বলিস কি আঙ্গুল পুলিশ যদি দেখে তাহলে ছেঁচড়া চোর ছেড়ে আমাদের হাতে হাতকড়া পরাবে, কাজ নেই ওকে পুলিশে দিয়ে। পালা-পালা বাবা ঝটপট পালিয়ে যা—

হরি বুঝতে পারলো এরা তাড়ি খেয়ে মাতাল হয়েছে। যতদূর সম্ভব দ্রুত সরে পড়লো সেখান থেকে।

আর যে চলতে পারছে না, একটা বড় বাড়ি দেখতে পেয়ে সরে এলো গেটে কোনো পাহারাদার নেই। হরি গেটটা ফাঁক করে ভিতরে প্রবেশ করলো। ওপাশেই সুন্দর একখানা বারান্দা হরি বারান্দায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো, ভাবলো ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে সরে পড়বে।

কিন্তু হরির ঘুম যখন ভাঙলো তখন ঢাকার রাজপথ সরগরম হয়ে উঠেছে।

ড্রাইভারের ডাকে ঘুম ভাঙলো হরির–এই ছোকরা কোন হো তুম?

ধড়মড় করে উঠে বসে হরি, চোখ রগড়ে তাকায়। সম্মুখে একটা সাদা উদী পরা লোক দাঁড়িয়ে। আছে। হরি চিনতে পারলো, লোকটা ড্রাইভার ছাড়া কেউ নয়। চোখ তুলে তাকালো হরি।

লোকটা রাগত কণ্ঠে বললো–এই তুম হিয়া কেইসে আয়া?

হরি এবার গেটের দিকে আংগুল দেখিয়ে বললো–ঐ ঐ গেটসে আয়া।

জলদি নিকলো হিয়াসে। ফিন্ আয়েগা তব কুত্তা লাগা দেখা।

 কুত্তা।

হা।

 তুম্ তো এক কুত্তা।

কিয়া হাম কুত্তা? নিকলো, আভি হিয়াসে নিকলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে বেরিয়ে আসে এক যুবক মূল্যবান সার্ট-প্যান্ট টাই পরা। হরি আর ড্রাইভারকে ঝগড়া করতে দেখে অবাক হয়।

হরি একনজরে দেখে নেয়–হাঁ সুন্দর বটে, তার হুরের মতই দেখতে কতকটা। হরি যুবকের পা থেকে মাথা অবধি দেখতে থাকে।

যুবক হরিকে দেখছে নিপুণ দৃষ্টি মেলে।

ড্রাইভার বলে উঠেসাহাব, এ ছোকরা বহুৎ কম বখৎ হ্যায়। গেট ঘুমাকে অন্তর মে আয়া আওর হিয়া নিদ আয়া। ভাগো হিয়াসে—

এবার সাহেব কথা বললো–রেহনে দেও। তারপর হরিকে জিজ্ঞাসা করলো কে তুমি, কি চাও?

হরি আমতা আমতা করে বলে–আমি আমি মানে আমার নাম হরি।

হরি!

 হাঁ, আমি একটা চাকরি খুঁজছি সাহেব।

সাহেব বলেন–চাকরি? চাকরি করবে তুমি?

 দয়া করে যদি দেন একটা চাকরি?

 কি কি কাজ পারো তুমি?

সব পারি, যা আপনি বলবেন।

 বেশ, আজ থেকে তুমি থেকে যাও আমার বাড়িতে। মাইনে কত দিতে হবে।

যা খুশি দেবেন। বললো হরি….একদিন বনহুর তাকে এমনি করেই প্রশ্ন করেছিলো, কথাটা মনে হতে চোখ দুটো ছলছলে হয়ে উঠলো তার।

সাহেব বললেন–ড্রাইভার, একে ভিতর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো। বাবুর্চিকে বলো, আজ থেকে এ আমাদের বাড়িতে থাকবে।

ড্রাইভার ভেবেছিলো, সাহেব তাকে হুকুম করবে, ‘ওকে গলা ধাক্কা দিয়ে গেটের বাইরে বের করে দাও’ কিন্তু ভিতর-বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে অবাক হলো কিছুটা। বললো–সাহাব, একঠো বাহারকে আদমী,…..

হোনে দেও, তুমকো যো বাত বলা উসি কাম করো।

 সাহেবের হুকুম ফেলতে পারলো না ড্রাইভার, অগত্যা হরিকে সঙ্গে নিয়ে ভিতর-বাড়িতে চললো।

 সেদিন হরি আশ্রয় পেলো এ বাড়িতে।

কিন্তু হরি অবাক হলো অন্দরবাড়িতে প্রবেশ করে। কোনো মেয়েমানুষ নেই এ বাড়িতে। চিন্তায় পড়লো হরি কিন্তু এখন চলে যাবার কোনো উপায় নেই।

হরির কাজ বুঝিয়ে দিলো বাবুর্চি।

 ড্রাইভার সাহেবকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো তখনকার মত।

বাবুর্চি হরিকে কাজ বুঝিয়ে দিলো, সেইভাবে কাজ করতে লাগলো সে।

একসময় হরি বাবুর্চিকে জিজ্ঞাসা করে বসলো–আচ্ছা বাবুর্চি, তোমাদের সাহেবের মেম সাহেব কই?

বাবুর্চি হেসে বললো–সাহেব তো এখনো বিয়ে করেননি।

ওঃ তাই বুঝি কোনো মেয়েমানুষ দেখছি না?

হ।

সাহেব শুধু একা থাকেন?

না, তার এক বন্ধু থাকেন এ বাড়িতে।

বন্ধু?

হাঁ, তার নাম সমীর কুমার বাবু।

 সেকি, তোমাদের সাহেব হিন্দু নাকি?

হিন্দু হতে যাবে কেন?

তবে যে তাঁর বন্ধুর নাম সমীর কুমার বাবু বললে?

 কেন, মুসলমান লোকের বন্ধু হিন্দু হয় না?

 তা হবে না কেন? হয়। আচ্ছা বাবুর্চি, তোমাদের সাহেবের নামটা কি বললে নাতো?

 বাঃ ঢাকা শহরে থাকো আমাদের সাহেবের নাম জানো না?

তা জানবো কেমন করে?

শুধু ঢাকা নয়, গোটা পৃথিবীর লোক সবাই তাকে চিনে।

সবাই চিনে কিন্তু আমি তো আর চিনি না। বললো না কি তার নাম?

তাঁর নাম মিঃ আহাদ চৌধুরী–প্রখ্যাত ডিটেকটিভ, বুঝলে?

হরি অবাক হয়ে নামটা উচ্চারণ করে মিঃ আহাদ চৌধুরী, প্রখ্যাত ডিটেকটিভ..

হাঁ, বিখ্যাত ডিটেকটিভ আমাদের সাহেব। মস্ত বড় বড় চোর, ডাকু খুনীকে……হাত দু’খানা গামছা দিয়ে জড়িয়ে ফেলে বলে–এইরকম করে ধরে বেঁধে ফেলেছে। চলো, পরে সব গল্প এক এক করে শোনাবো, এখন কাজ করবে চলো?

হরি বাবুর্চিকে অনুসরণ করে।

অল্পক্ষণ পরেই বাইরে শোনা যায় গাড়ির হর্ণ, পরক্ষণেই কলকণ্ঠ ভেসে আসে–আহাদ, রাতটা কেমন করে কাটালাম তোমাকে কি বলবো বন্ধু?

সাহেবের গলা–ঘরে চলো সব শুনছি।

 ড্রইংরুমে এসে বসলেন মিঃ আহাদ আর তার বন্ধু সমীর কুমার।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা মিঃ আহাদ চৌধুরী এবং তাঁর সহকারী মিঃ সমীর কুমারকে কে না। চিনে! আহাদ চৌধুরী সব সময় দেশ-বিদেশেই কাটান, যদিও তাঁর মাতৃভূমি পূর্ব-পাকিস্তানের এক বিশিষ্ট পল্লীতে। দেশে তার একমাত্র মাছাড়া আর কেউ নেই। মস্ত বড় জমিদারের সন্তান তিনি। যদিও এখন জমিদারী প্রথা নেই তবু তাদের যে বিষয়-আসয় আছে তা প্রচুর। অগাধ ঐশ্বর্য আর অর্থের অধিকারী মিঃ আহাদ চৌধুরী।

 বয়স হয়েছে তবু তিনি বিয়ে করেননি। দেশে মা নাসিমা খানম খুব করে ধরেছেন, এবার তাকে বিয়ে করতেই হবে। মায়ের অনুরোধ এতোদিন এগিয়ে চললেও এবার আর রেহাই নেই, তাই মিঃ আহাদ ঢাকায় এসে আস্তানা গেড়েছেন। বিরাট এক সমস্যা দেখা দিয়েছে তার সামনে এই বিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে।

আহাদ চৌধুরী এ বাড়িটা ভাড়া নিয়েছেন প্রায় মাস কয়েক হবে, মাঝে কয়েকবার দেশে মায়ের কাছেও গিয়েছিলেন। মা বলেছেন–বাবা আহাদ, এবার যদি বিয়ে করে ঘরের লক্ষী ঘরে না আনো তবে আমি আত্নহত্যা করবো।

 মিঃ আহাদ সব খুলে বলেছেন তাঁর বন্ধুবর সমীরের কাছে, সমীর চিন্তিত হয়ে পড়েছে–তাই তো, বড় বিপদের কথা! বিয়ে না করলে হবে মাতৃহত্যা আর বিয়ে করলে হবে আত্নহত্যা। কারণ সমীর জানে, তার বন্ধু আহাদ অনেকদিন পূর্বেই দস্যুরাণীকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করেছেন।

কদিন হলো সমীর ব্যস্তভাবে রাণীর সন্ধানে ঢাকা শহর চষে ফিরছে। তাকে যে না পেলেই নয়, দস্যুরাণী সম্প্রতি মন্থনা দ্বীপের কাজ শেষ করে ফিরে এসেছে আস্তানায়।

 সমীরের বিশ্বাস, মিঃ আহাদ যেখানেই থাকুক না কেন, দস্যুরাণীও সেখানে আগমন করবে। প্রকাশ্যে দেখা না দিলেও সে গোপনে সব সময় লক্ষ্য রেখেছে তার উপর, তাই সমীর নিশ্চিন্ত। কিন্তু দিনের পর দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, কই তার পাত্তাটি নেই আজও।

 আহাদ চৌধুরীর চেয়ে বেশি ঘাবড়ে গেছে সমীর, যেমন করে তোক রাণীকে তার খুঁজে বের করতেই হবে। গোটা দিন ঢাকা শহরে সে সন্ধান চালিয়ে এসেছে কিন্তু কোথায় দস্যুরাণী! সমীর জানে, রাণীকে একবার দেখলেই সে চিনে নিবে। পথে কত মেয়েকেই সে রাণী বলে ভুল করেছে। শেষ পর্যন্ত ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেনি। হঠাৎ পরিচয় হয়ে গেছে তার মিঃ আলমের সঙ্গে। এ কথার-সে কথার মধ্যে রাত বেড়ে গিয়েছিলো তাই ফিরতে আর পারেনি। মিঃ আলমের আতিথ্য প্রহণ করেছিলো সে। ভোরে টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছিলো সমীর আমি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকা পড়ে গেছি, এসে নিয়ে যাও আমাকে।

মিঃ আহাদ ঘুম থেকে জেগেই ফোন পেয়ে ছুটেছিলেন বন্ধু বরকে নিয়ে আসতে।

ড্রইংরুমে বসে কপালে আঘাত করলো সমীরকই কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না। বন্ধু এখন উপায়?

মিঃ আহাদ হাতের সিগারেটটা এ্যাসট্রেতে গুঁজে রেখে সোজা হয়ে বসলেন, একটু নীরস হাসি। হেসে বললেন–ঘরের ছাদে উষ্ট্রের অন্বেষণের মতই ঢাকা শহরে তোমার রাণীকে খোঁজা, বুঝলে? কোথায় মন্থনা দ্বীপ, শিখান্দ্রী পর্বত আর কোথায় ঢাকা শহর!

সমীর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–আহাদ, তুমি বড় ছেলেমানুষের মত কথা বললে?

কি রকম?

জানো না, রাণীর অসাধ্য কিছুই নয়। নিশ্চয়ই রাণী এতোদিন আস্তানা থেকে চলে এসেছে তোমার সন্ধানে।

এই ঢাকা শহরে?

হাঁ।

সম্ভব নয়, কারণ রাণী এমন সময় আস্তানা ছেড়ে কিছুতেই আসতে পারে না। জানো তো কত কাজ বাকি আছে ওর আস্তানায়।

জানি। তবু আমার মন বলছে সে আসবে।

মিঃ আহাদ একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলেন, মন তার চলে গেছে দূরে, অনেক দূরে কোনো অজানা দেশে। সমীরের কথায় কোনো জবাব দেন না তিনি।

সমীর বললো–কি হে, চুপ করে রইলে যে? বলো আমার কথা ঠিক কিনা? আমি জানি, সে। তোমার সন্ধানে আসবেই আসবে।

 বেশ, তুমি তাহলে রোজ একবার করে ঢাকা শহরটা চষে বেড়াও, কি বলে?

কিন্তু কাল থেকে ভাড়াটে ট্যাক্সিতে আর যাচ্ছি না। তোমার গাড়িটা এবার আমাকে দেবে।

আর আমি?

তুমি ভাড়াটে গাড়ি ব্যবহার করবে।

আচ্ছা, তাই হবে। মিঃ আহাদ পুনরায় আর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলেন, সম্মুখস্থ ধুম্রকুন্ডলির দিকে তাকিয়ে বললেন মিঃ আহাদ–আচ্ছা সমীর?

বলো বন্ধু?

হোটেলে যে ভদ্রলোকটিকে দেখলাম মানে তুমি যার আশ্রয়ে কাল রাত কাটিয়েছো…

মানে মিঃ আলমের কথা বলছো তো?

 হাঁ, লোকটাকে কিন্তু সম্পূর্ণ বাঙালি বলে মনে হয় না।

তোমার সন্দিগ্ধ মনে একটুতেই সন্দেহ জাগে।

না না তা বলছি না, বলছি লোকটা অত্যন্ত ভদ্র ও মহৎ।

সত্যি, দেখলে তো অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের সঙ্গে কেমন ভাব জমিয়ে নিয়েছিলেন ভদ্রলোক?

 সারারাত বুঝি গল্প করে কাটিয়েছো?

 হাঁ, কত গল্প করলেন!

আর শুনলেন তোমার কাছে, না?

তা একটু শুনলেন বই কি!

 সব কথা তো ফাঁস করে দাওনি? মানে রাণীর কথা?

না না, সমীরকে এখনও তুমি বোকা মনে করো বুঝি? আচ্ছা আহাদ?

বলো?

ভদ্রলোককে তুমি যে দাওয়াত করে এলে, তা হঠাৎ এতো আদর কেন?

তোমাকে একদিন আপ্যায়িত করেছেন কাজেই তাকে একদিন নিমন্ত্রণ না জানালে কেমন দেখায়। বলো?

হাঁ ঠিক বলেছো আহাদ, ভদ্রলোক কিন্তু বড় মিশুক।

মিশুক তো বটেই কিন্তু আর একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি তার মধ্যে।

কি?

অদ্ভুত সৌন্দর্যের অধিকারী ভদ্রলোক।

একেবারে নির্ভুল একটা কথা বলেছে আহাদ, যেমন তোমার সৌন্দর্য্যে বিশ্বের তোক বিমুগ্ধ তেমনি ঐ ভদ্রলোকের রূপ!

কি যে বলো, আমার আবার সৌন্দর্য্য দেখলে কোথায়?

যাও অতো ন্যাকা সাজতে হবে না। সত্যি আহাদ, তোমরা দু’জন কিন্তু ভাই-ভাই মনে হয়। যেমন তুমি তেমনি মিঃ আলম।

নাও হয়েছে, এবার উঠো।

কোথাও যাবে নাকি?

না, তোমাকে বেরুতে হবে। ওঃ আর একটা কাজ করেছি সমীর, তোমাকে না বলেই একটা বয় রেখেছি।

বয়?

হাঁ, বেচারা বড় গরিব…..

আর তুমি তাকে তাই রেখে দিলে?

না দিয়ে কি করি বলো?

কেন, আমাদের বাড়ি ছাড়া কি আর বাড়ি ছিলো না ঢাকা শহরে?

ছিলো কিন্তু কোথায় অতো খুঁজবে, তাই রেখে দিলাম। দেখবে ছেলেটা বেশ কাজে পাকা।

 কাজ না দেখেই খুব যে তারিফ করছো?

 চলো, কাজ দেখবে চলো। উঠে দাঁড়ান মিঃ আলম।

 সমীরও উঠে পড়তে বাধ্য হয়।

হরি তখন মসলা করছিলো, মরিচের ঝালে হরির রক্তাভ গন্ড আরও রক্তাভ হয়ে উঠেছে। খুব কষ্ট হচ্ছিলো তার।

মিঃ আহাদ আর সমীর এসে দাঁড়ালো।

সমীর বললো–আরে ছোঃ এই বুঝি মসলা করা?

 তবে কি মসলা বাটা? হেসে বললেন মিঃ আহাদ।

 সমীর ভ্রূ কুঁচকে বললো–এই ছোকরা, তুমকো নাম ক্যা?

আরে বাংলায় বলল, ও খাঁটি বাংলা ভাষী।

এ্যা, বাংলা জানে নাকি? তবে ঠিক পাঞ্জাবী ছোকরার মত লাগছে। তা মাথায় আবার পাগড়ি কেন?

ওটা ওর অভ্যাস।

বল ছোকরা, তোর নাম কি?

মসলা করতে করতে হরি হয়রাণ হয়ে পড়েছিলো। মিঃ আহাদ আর সমীরের সামনে আরও বিব্রত বোধ করছিলো সে। বললো–আমার নাম হরি।

হরি! তুই হিন্দু? বললো সমীর।

 হরি কিছু বলবার পূর্বেই বললেন মিঃ আহাদ–হ হিন্দু।

যা বাঁচালে, তবুও ভাল পাকিস্তানে হিন্দু চাকরও পাওয়া যায় তাহলে? এই হরি, আজ থেকে তুই আমার চাকর, বুঝলি?

দেখলে কেমন বন্ধুর মত কাজ করেছি? বললেন মিঃ আহাদ।

*

আজ বাবুর্চি বাজারে গেছে, হরি রান্নাঘরে কি যেন কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। হরির মন সব সময় বিষণ্ণ ভাবাপন্ন থাকে। কি যেন ভাবে সে সর্বক্ষণ। আত্নগোপন করে সে আশ্রয় নিয়েছে এ বাড়িতে কিন্তু তার অন্তরে সদা-সর্বদা তার হুরের চিন্তা। যার জন্য সে সুদূর কান্দাই থেকে হাজার হাজার মাইল দূর। পূর্ব পাকিস্তানে এসে পড়েছে, তাকে ত্যাগ করে চলে এসেছে সে ক্ষুণ্ণ হয়ে। না জানি তার অন্বেষণে হুর ঢাকা শহর চষে ফিরছে কিনা?

সমীর কুমার ড্রাইভারসহ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে কোনো কাজে, বাসায় আছেন মিঃ আহাদ চৌধুরী। বাবুর্চি সাহেব আর তার বন্ধুকে নাস্তা খাইয়ে তবে গেছে। এভোবড় বাড়িখানা সম্পূর্ণ নীরব।

হরি কি যেন করছে এমন সময় পিছনে এসে দাঁড়ালেন মিঃ আহাদ, শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলেন—

 ফিরে তাকালো হরি, চোখেমুখে একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠেছে তার।

 মিঃ আহাদ বললেন–কে তুমি?

আজ্ঞে?

বলো কি উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি আমার বাসায় এসেছো?

আমি…আমি..

কঠিন কণ্ঠে বললেন মিঃ আহাদ ন্যাকামি করো না, বলো কি উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি এখানে এসেছো?

 সাহেব আমি, আমি একজন বয় ছাড়া কিছু নই…..

 মিঃ আহাদ একটানে খুলে ফেললেন হরির মাথার পাগড়িটা। সঙ্গে সঙ্গে কোঁকড়ানো একরাশ রেশমী চুল ছড়িয়ে পড়লো হরির চোখেমুখে। প্রকাশ পেয়ে গেলো তার নারীরূপ।

 তুমি পুরুষ সেজে আমাকে ধোকা দিয়ে বয় সেজেছিলে, কিন্তু সবার চোখে ধুলো দিলেও আমার চোখে পারবে না। বলল, কি উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি এখানে এসেছো?

নূরীর মুখমন্ডল রক্তাভ আকার ধারণ করলো, মিঃ আহাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে সাহসী হলো না আর সে, নতমুখে বললো-বিশ্বাস করুন, আমি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি।

তবে পুরুষের ড্রেসে এ অভিনয় কেন?

মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো নূরী। সহসা কোনো জবাব দিতে পারলো না। কিই বা জবাব দেবে সে,তবু বললো–আমাকে জড়িয়ে দেবেন না সাহেব। আমি শপথ করে বলছি, আপনাদের কোনো অন্যায় করবো না।

কে তুমি?

আমার নাম নূরী।

কোথায় তোমার বাড়ি? নিশ্চয়ই তুমি বাংলাদেশের মেয়ে নও।

না, আমার দেশ কান্দাই।

কান্দাই? পশ্চিম পাকিস্তানের নিকটে যে কান্দাই আছে?

হা।

তুমি এ শহরে এলে কি করে?

আমার স্বামীর সঙ্গে এসেছিলাম, কিন্তু আমার স্বামী…….।

থেমে গেলো নূরী।

 মিঃ আহাদ বললেন–থামলে কেন?

আমার স্বামী আমাকে ভালবাসেন না। না’ শব্দটা বলতে নূরীর খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তারপর বললো–তাই আমি চলে এসেছি।

 মিঃ আহাদের মনে একটা মায়ার সঞ্চার হলো, তিনি বললেন–বেশ, তাহলে থাকো। কিন্তু আমার বাসায় তো কোনো মেয়েছেলে নেই, কাজেই তোমার অসুবিধা হতে পারে। একটু চিন্তা করে বললেন–বেশ, তুমি হরির বেশেই থাকবে।

 আচ্ছা সাহেব। বললো নুরী!

আহাদ চৌধুরী কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলেন নূরীর অনাবৃত মুখমন্ডলের দিকে, মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি নূরীর অপরূপ সৌন্দর্যে।

নূরী দৃষ্টি তুললো, মিঃ আহাদের সঙ্গে চোখোচোখি হতেই মাথা নত করে নিলো।

 নুরী বললো–আমার বড় ভাই নেই, আপনি আমার ভাই।

মিঃ আহাদ হেসে বললেন–বেশ, তাই হবে। একটু ভেবে নিয়ে বললেন–হরির বেশ ত্যাগ করে তুমি নতুনভাবে এ বাড়িতে আগমন করো–আমার বোন হয়ে, কেমন?

হরির চোখেমুখে ফুটে উঠলো কৃতজ্ঞতার ছাপ।

আহাদ চৌধুরী বললেন–এসে আমার সঙ্গে।

হরিকে নিয়ে গেট পেরিয়ে পথে এসে দাঁড়ালেন আহাদ চৌধুরী একটা বেবী টেক্সি ডেকে উঠে পড়লেন হরিকে নিয়ে। তারপর যখন ফিরে এলেন, তখন হরি নয়, মিঃ আহাদের সঙ্গে এক তরুণী।

ততক্ষণে সমীর এসে পড়েছে, বন্ধুর সঙ্গে এক যুবতাঁকে দেখে প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে যায়, পরে সামলে নিয়ে বলে ব্যাপার কি বন্ধু?

মিঃ আহাদ হেসে বললেন–হঠাৎ রেহানার ফোন পেয়ে চলে গেলাম….ওর আগে পরিচয় করিয়ে দি। এর নাম সমীর কুমার–আমার সহকারী এবং বন্ধু, আর এর নাম মিস রেহানা—-আমার মামার মেয়ে মানে মামাতো বোন।

বাঃ বাঃ চমৎকার! সমীর হা করে নূরীর পা থেকে মাথা অবধি দেখতে লাগলো। দু’চোখে তার রাজ্যের বিস্ময়, নির্নিমেষ নয়নে দেখছে। নূরীর দেহে সম্পূর্ণ আধুনিক তরুণীর ড্রেস। ফিকে গোলাপী শাড়ি ব্লাউজ, হাতে গোলাপী রুমাল, পায়েও গোলাপী স্যান্ডেল। একটি ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে, তার রংটাও ফিকে গোলাপী। একরাশ সোনালী চুল ছড়িয়ে আছে কাঁধের উপর–অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে নূরীকে বাঙালি মেয়ের ড্রেসে।

মিঃ আহাদ বললেন নিয়ে চলো ওকে পথ দেখিয়ে।

হাঁ তাই তো, আসুন আসুন মিসরেহানা, ভিতরে চলুন। ছিঃ ছিঃ এতোক্ষণ মেহমানকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে! আহাদ আর নূরী সমীরকে অনুসরণ করলো।

সমীর তো ভিতরে প্রবেশ করে ডাকাহাকা শুরু করলোহরি, ও হরি, কোথা গেলি হতভাগা?

 বাবুর্চি রান্নাঘর থেকে গলা বাড়িয়ে বললো-স্যার, হরি পালিয়েছে।

 হরি পালিয়েছে–বলো কি!

বাবুর্চি এবার সম্মুখে এসে দাঁড়ায় স্যার, প্রথমেই বলেছিলাম বাইরের ছোকরাদের বিশ্বাস নেই, দেখলেন তো কেমন করে চোখে বালি দিয়ে পালালো!

মিঃ আহাদ মনে মনে কৌতুক অনুভব করলেও মুখে গাম্ভীর্য টেনে বললেন–যে চলে গেছে তাকে নিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে আর লাভ হবে না। এসো রেহানা।

হাঁ, ঘরে চলো বোন। দেখো বন্ধুর বোন বলে আমিও কিন্তু তোমাকে তুমি বলবো, মনে কিছু নিও না।

নূরী তো হাবা বনে গেছে–কোথায় চাকর হয়ে এসেছিলো আর কোথায় একেবারে গৃহস্বামীর বোন!

সেদিন থেকে নূরীর জন্য মিঃ আহাদের বাড়িতে একটি কামরা বেছে দেওয়া হলো।

কয়েক দিনের মধ্যেই নূরীর সঙ্কোচ কেটে এলো ধীরে ধীরে। মিঃ আহাদ আর সমীরের কাছে হয়ে এলো সে সচ্ছ-স্বাভাবিক। একসঙ্গে বসে খাওয়া, একসঙ্গে গল্প করা, একসঙ্গে বেড়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেলো নূরী।

প্রায়ই মিঃ আহাদের সঙ্গে নূরী নিউমার্কেট যেতো, সংসারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করে আনতে দু’জনে মিলে। কোনোদিন সমীরও যেতো তাদের সঙ্গে। নূরীর সঙ্গে আহাদের পবিত্র ভ্রাতৃত্ব ভাব জমাট বেঁধে উঠেছিলো দিন দিন গভীরভাবে। ছোট বোনের মতই আব্দার করে নূরী তার সঙ্গে।

অবশ্য নূরীর মনে একটা অভিসন্ধি ছিলো, নিউ মার্কেট গেলেই সে মিঃ আহাদের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকতো। আর চারিদিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করতো বনহুরের সাক্ষাৎ পায় কিনা!

একদিন নূরীর অভিসন্ধি পূর্ণ হলো……নিউ মার্কেটে একটা দোকান থেকে বের হচ্ছে মিঃ আহাদ আর নূরী, ঠিক সেই মুহূর্তে অদূরে এগিয়ে আসছে বনহুর। নূরীর দৃষ্টি গিয়ে পড়লো তার উপর। বনহুরের হাতে একটা প্যাকেট ছিলো, সে গম্ভীর ভাবাপন্নভাবে এগিয়ে আসছে।

নূরী ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ বলে উঠলো–ভাইজান উঃ বড় মাথা ঘুরছে। পড়ে গেলাম, ধরুন আমাকে..

মিঃ আহাদ নূরীকে ধরে ফেললেন।

 নুরী মিঃ আহাদের হাতের মধ্যে হাত রেখে চলতে লাগলো।

ঠিক সেইদন্ডে বনহুরের দৃষ্টি এসে পড়লো মিঃ আহাদ আর নূরীর উপর। মুহূর্তে তার মুখ কঠিন হয়ে উঠলো, একবার শুধু তাকিয়ে দেখে নিয়ে দ্রুত বিপরীত দিকে চলে গেলো।

নূরী ইচ্ছা করেই এই দৃশ্যটা বনহুরের দৃষ্টিপথে তুলে ধরলো। বনহুর চলে যেতেই নূরী বললো– এখন অনেকটা ভাল লাগছে। একাই চলতে পারবো।

পড়ে যাবে না তো?

না।

বাসায় ফিরে নূরীর মনে আজ আনন্দ ধরে না। কেমন একটা ধোকা আজ সে লাগিয়ে দিয়েছে তার বনহুরের মনে। এমনি একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো নূরী।

মনোবাসনা সফল হওয়ায় নূরী যখন খুশি হয়েছে তখন বনহুর হোটেলে ফিরে নিজকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারছিলো না। কক্ষমধ্যে পায়চারি করছিলো আর ভাবছিলো, নূরী এমন হয়ে গেছে! সে আর একজনকে ভালবাসতে পারলো! এতোটুকু লজ্জা বোধ হলো না তার। কিছুতেই বনহুরের বিশ্বাস হচ্ছিলো না ব্যাপারটা। না না, এ কখনও হতে পারে না কিন্তু নিজের চোখকে সে কি করে অবিশ্বাস করবে! বনহুর অধর দংশন করে, যে ভদ্রলোকটির সঙ্গে নূরীর এতো মাখামাখি দেখলো সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে কদিন আগে পরিচয় ঘটেছিলো বনহুরের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। বনহুরের সঙ্গে যখন তাঁর আলাপ হয়েছিলো তখন সে তো তাকে মহৎ ব্যক্তি বলেই মনে করেছিলো কিন্তু নূরীর সঙ্গে এতোদূর ঘনিষ্ঠতা হলো কি করে?

বনহুর ইচ্ছা করলে ওদের ফলো করতে পারতো কিন্তু তার মনে সে প্রবৃত্তি জাগেনি, একটা অসহ্য দ্বন্দ্ব মনকে অস্থির করে তুলেছিলো।

বনহুর কক্ষমধ্যে পায়চারি করে চলেছে, এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে শোহেলী–গুড নাইট মিঃ আলম!

গম্ভীর কণ্ঠে বলে বনহুর–গুড নাইট।

চলুন না নাইট শো দেখে আসি?

সম্ভব নয় আজ।

 কেন?

বনহুর শোহেলীকে এড়াবার জন্য বললো বড্ড মাথা ধরেছে।

তাহলে চলুন রমনা পার্কে।

এ সময় রমনা পার্কে–বলেন কি!

 মিঃ আলম, আমার বড় খারাপ লাগছে, চলুন না কোথাও?

 রায় বাবু কোথায়? তিনি বুঝি বাইরে গেছেন? বললো বনহুর।

শোহেলী একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে চেপে নিয়ে বললো–আজকাল উনি প্রায় রাতই বাইরে। থাকেন।

ভ্রু কুঁচকে তাকালো বনহুর–প্রায় রাতই উনি বাইরে থাকেন?

হা।

কিন্তু আপনি একদিন বলেছিলেন, আপনার স্বামী মাতাল কিন্তু চরিত্রহীন নন?

হাঁ, আমি তাই জানতাম। তাছাড়া তার যে অবস্থা তাতে তাকে চরিত্রহীন ভাবাটা আমার মনের বিরুদ্ধে ছিলো।

আপনার কি সন্দেহ হয় তিনি কোনো নাইট ক্লাব বা কোনো সন্দেহজনক স্থানে যান?

না, আমার তেমন কোনো সন্দেহ হয় না।

আপনি তাকে এ সম্বন্ধে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন?

করেছিলাম, কিন্তু উনি কোনো জবাব দেননি। আমিও তাই তেমন করে আর জানতে চাইনি। অবশ্য ওর প্রতি আমার আর কোনো আপত্তি নেই। যেখানে খুশি যাক থাক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মিঃ আলম, আমি ঐ বৃদ্ধের হাত থেকে পরিত্রাণ চাই। বাঁচতে চাই……ধপ করে বসে পড়ে শোহেলী বনহুরের শয্যার উপর।

বনহুর হাতঘড়ির দিকে তাকায় রাত আটটা বেজে গেছে। টেবিলে খাবার দেওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। বললো বনহুর–খেয়ে নিয়ে মধুমিতা’ হলে যাওয়া যাক।

হঠাৎ মতের পরিবর্তন হলো কেন?

মনেই ছিলো না মধুমিতা হলে একটা ভাল ছবি হচ্ছে। ক’দিন ভেবেছি যাবো-যাবো কিন্তু হয়েই উঠেনি।

মিঃ আলম!

বনহুর চোখ তুলে তাকালো–একি, শাহেলীর চোখেমুখে এক করুণ বেদনার ছাপ ফুটে উঠেছে। সহসা বনহুর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারে না, শোহেলীর দৃষ্টি যেন তাকে আকর্ষণ করছে। বনহুর নিজের শিরায় শিরায় অনুভব করলো এক শিহরণ। বুকের মধ্যে হৃদপিন্ডটা টিপটিপ করছে, বনহুর এগিয়ে গেলো দরজার দিকে, লঘু হস্তে দরজার খিল বন্ধ করে দিলো। তারপর কয়েক পা সরে এসে দাঁড়ালো শোহেলীর পাশে। নিশ্বাস দ্রুত বইছে বনহুরের। একটা কুপ্রবৃত্তি দানবের মত জেগে উঠলো তার মধ্যে। ধীরে ধীরে কোনো অতলে তলিয়ে যাচ্ছে যেন বনহুর। শোহেলীর দক্ষিণ হাতখানা দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলো হাতের মুঠায়। তারপর এক ঝাঁকুনি দিয়ে টেনে নিলো নিজের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বনহুরের কানে কানে বলল…..ছিঃ এ তুমি কোথায় নামতে যাচ্ছে বনহুর! তুমি না কঠিন সংযমী পুরুষ। আনমনা হয়ে যায় বনহুর, উজ্জ্বল ইলেকট্রিক আলোতে তার ললাটে ঘর্মবিন্দুগুলো ঠিক মুক্তাবিন্দুর মত ঝকঝক করছে। প্রশস্ত ললাটে কয়েক গুচ্ছ চুল লেপটে আছে কৃষ্ণরেখার মত।

 শোহেলী নিষ্পলক চোখে তাকায় বনহুরের পৌরুষদীপ্ত মুখমন্ডলের দিকে, উন্মত্ত এক নেশায় তার সমস্ত দেহখানা যেন শিথিল হয়ে আসছে। একি সে স্বপ্ন দেখছে না জেগে আছে–মিঃ আলমের বাহুবন্ধনে শোহেলী–নিজের অস্তিত্ব যেন হারিয়ে ফেলছে সে!

বনহুর ওকে টেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিবেক তাকে বাধা দিলো। নিজকে সংযত করে নিলো সে শক্তভাবে, তারপর বললো–শোহেলী, আপনি চলে যান, চলে যান এই মুহূর্তে আমার ক্যাবিন থেকে। না না, এ অসম্ভব-অসম্ভব……

শোহেলীকে একরকম প্রায় ধাক্কা দিয়েই সরিয়ে দেয় বনহুর নিজের বাহুবন্ধন থেকে। বিরক্তি আর ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত হয়ে উঠে তার।

শোহেলী অসংযত আঁচলখানা কোনোরকমে তুলে দেয় কাঁধের উপর। সমস্ত মুখমন্ডল তার লজ্জায়, ক্ষোভে রাঙা হয়ে উঠেছে। একটি কথাও সে উচ্চারণ করতে পারলো না মুখ দিয়ে। আস্তে আস্তে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো।

বনহুর দরজা মুক্ত করে দিয়ে বললো–আর কোনোদিন এভাবে আসবে না।

শোহেলী কোনো জবাব দিলো না, বেরিয়ে যাবার সময় একবার তাকালো শুধু বনহুরের মুখের দিকে, তারপর চলে গেলো সে নিজের কামরার দিকে।

পরদিন বনহুর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ত্যাগ করে চলে গেলো, কোথায় গেলো কেউ জানে না।

*

গ্রীন হাউস নাইট ক্লাব।

ঢাকা শহরের বিশিষ্ট এক ক্লাব, এ ক্লাবে শহরের নামকরা গণ্যমান্য ব্যক্তি ছাড়া কেউ পদার্পণ করতে সক্ষম হয় না। এ ক্লাবের মেম্বারদের মধ্যে সবাই প্রায় কোটিপতি। সন্ধ্যার পর এ ক্লাব উজ্জ্বল নীলাভো আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে।

 গ্রীন হাউসের রং গাঢ় সবুজ না হলেও ফিকে সবুজ রং করা। কোথাও সাদা বা গোলাপীর চিহ্ন নেই। সন্ধ্যার পর এই ক্লাবটাকে স্বপ্নপুরী বলে মনে হয়। সাধারণ জনগণ এ ক্লাব দর্শন করা হতো দূরের কথা, কোনোদিন নামটাও বুঝি শুনেছে কিনা সন্দেহ। ঢাকাবাসিগণ এ ক্লাবের নাম অনেকেই জানে না। জানলেও চেনে না কোথায় এ ক্লাব।

সন্ধ্যার পর তেমন ভিড় না হলেও বেশ রাতে এ ক্লাবের সম্মুখে রাস্তায় নানা বর্ণের গাড়ির লাইন জমে উঠে। নতুন ঝকঝকে গাড়ি প্রেসিডেন্ট, প্রিমাউথ, স্টুডি কমান্ডার, ওপেলকার, কুইনকার, মাষ্টার বুইক, আরও কতরকম গাড়ি এসে জমে তার সংখ্যা বলা যায় না। যেমন সব গাড়ি তেমনি তার সব আরোহী। গাড়ির মতই ঝকঝকে চাকচিক্যময় পোশাকধারী সব আগন্তুকের আগমনে সরগরম হয়ে উঠে গ্রীন হাউস।

একখানা ডি কমান্ডার গাড়ি এসে থামলো গ্রীন হাউসের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে এলো। একজন লোক। গ্রীন হাউসের আলোতে স্পষ্ট দেখা গেলো। লোকটা ঢাকার এক মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী। হাতে তার একটি ব্যাগ। মাড়োয়ারী গাড়ি থেকে নেমে প্রবেশ করলো গ্রীন হাউসের মধ্যে।

সোজা সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে।

 সিঁড়ির মুখেই দাঁড়িয়ে ছিলো দুটো সাহেবী পোশাক-পরা ভদ্রলোক। মাড়োয়ারী বাবুকে দেখে তারা অভ্যর্থনা জানালো, তারপর নিয়ে গেলো সঙ্গে করে।

উপরে গিয়ে আর একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। সেই সিঁড়ি বেয়ে তিনজন নামতে লাগলো নিচে। ওদিকে সিঁড়ির মুখেই ছোট্ট একটা কক্ষ। কক্ষমধ্যে একটা বড় টেবিল। কয়েকজন লোক সেই টেবিলে বসে আলাপ-আলোচনা করছে। মাড়োয়ারী বাবুকে দেখে সবাই দাঁড়ালো।

 মাড়োয়ারী বাবু ও তার সঙ্গীদ্বয় সে কক্ষে না দাঁড়িয়ে ওদিকের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেলো, দেয়ালে চাপ দিতেই দেয়ালের এক অংশে একটি ছোট্ট দরজা বেরিয়ে এলো। মাড়োয়ারীবাবু আর ভদ্রলোক দু’জন প্রবেশ করলো, সেই দরজার মধ্যে। আশ্চর্য, দরজাটা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেলো।

কিছু পরে দরজা খুলে গেলো–আবার একজন বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে, টেবিলে যে লোকগুলো বসে গল্পগুজব করছিলো তাদের লক্ষ্য করে বললো–আজকের প্লেনে কারা যাচ্ছো?

দু’জন উঠে দাঁড়ালো–শরীফ আর মদন।

এসো তোমরা।

শরীফ আর মদন উঠে ভিতরে চলে গেলো। লোকটিও তাদের সঙ্গে গেলো।

ওপাশে কক্ষ বা সিঁড়ি নেই–একটা লিফট। লোক দুটিসহ লোকটা লিফটে চড়ে দাঁড়ালো। লিফট এবার সা সা করে নেমে চললো নিচে।

কেউ কল্পনা করতে পারবে না এতো নিচে কোনো গোপন কক্ষ থাকতে পারে গভীর মাটির তলায়। কক্ষটা বেশ বড়সড়, কক্ষের চারপাশে অসংখ্য মেশিন আর কলকজা। কতরকম ছোটবড় মেশিন রয়েছে এখানে তা বুঝা মুস্কিল। কতরকম যন্ত্রপাতি আছে সেই কক্ষে। নানারকম ঔষধপত্রের শিশিও আছে সাজানো। কক্ষের মাঝখানে একটা বড় সেক্রেটারী টেবিল। পাশে তিনখানা মাত্র চেয়ার সাজানো, ওপাশের বড় আর উঁচু চেয়ারটায় বসে আছে জমকালো পোশাক-পরা একটা লোক। মুখে মুখোস, হাতে গ্লাবৃস, পায়ে বুট। মুখোসে মুখখানা তার সম্পূর্ণ ঢাকা। এতোটুকু শরীর তার বাইরে দেখবার উপায় নেই। কালো মুখোসের মধ্যে খুদে দুটি চোখ যেন পিট পিট করছে।

ভয়ঙ্কর আর অদ্ভুত লাগছে লোকটাকে। পাতালপুরীর মেশিনময় কক্ষটার মধ্যে যেন সে একটা দানব বসে আছে। তার পাশে বসে আছে মাড়োয়ারী লোকটা।

ভদ্রলোকটি শরীফ আর মদনসহ এসে দাঁড়ালো অদ্ভুত লোকটার সামনে।

অদ্ভুত পোশাক-পরা লোকটা বললো–তোমরা দু’জন যাচ্ছো আজ।

 হাঁ হুজুর! বললো একজন।

 অদ্ভুত লোকটা কি যেন ইংগিত করলো, সঙ্গে সঙ্গে দ্র-বেশি লোকটা ওদের দুজনাকে ওদিকে একটা মেশিনের পাশে নিয়ে দাঁড় করালো।

মেশিনটার পাশে কালো এপ্রন-পরা দুটি লোক অপেক্ষা করছে, এরা দু’জন গিয়ে দাঁড়াতেই এপ্রন করা লোক দুটো এদের একজনকে মেশিনটার উপর শুইয়ে দিলো, একটা পাইপের মত রবার প্রবেশ করিয়ে দিলো তার মুখের মধ্যে। প্রায় হাতখানেক পাইপ চলে গেলো লোকটার গলার ভিতরে, তারপর পাইপের মুখ দিয়ে কয়েকটা লম্বা-মত বস্তু প্রবেশ করিয়ে দিলো গলার মধ্যে। দ্বিতীয় ব্যক্তির গলার মধ্যেও এইভাবে কিছু লম্বা আকারের বস্তু প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হলো মেশিনের সাহায্যে।

 পাইপ দুটো বের করে নিতেই লোক দু’জন উঠে দাঁড়ালো। সম্পূর্ণ সুস্থ সবল দেহ, কোনো অসুস্থতার লক্ষণ নেই তাদের মধ্যে। শুধু আজ নয়, এদের গলায় এইভাবে অনবরত পাইপ প্রবেশ, করিয়ে মেশিনের সাহায্যে সোনা প্রবেশ করানো হয়ে থাকে এবং তাদের পাঠানো হয় দেশ-বিদেশে।

লোক দু’জনার একজনকে একটা মেশিনের সম্মুখে দাঁড় করানো হলো। মেশিনটা এক্স-রে যন্ত্রের মত কতকটা দেখতে। আসলে এক্স-রে যন্ত্র নয় সেটা। এবার মুখোসধারী লোকটা বাইনোকুলারের মত কিছু একটা যন্ত্র চোখে লাগিয়ে যে লোকটাকে মেশিনের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে তার পিছনে এসে দাঁড়ালো।

মেশিনে যে লোক কাজ করছিলো তার দেহে ছিলো রবারের জমকালো ড্রেস। লোকটা মেশিনের সুইচ্ টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত আলোকরশ্মি বেরিয়ে এলো। লোকটা বাইনোকুলার লাগিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলো, লোকটার পেটের মধ্যে সোনার টুকরোগুলো স্তরে স্তরে সাজানো রয়েছে।

 দ্বিতীয় জনকেও এইভাবে অদ্ভুত রশ্মি দ্বারা পরীক্ষা করে দেখার পর ছেড়ে দিলো।

লোক দুটো জামাকাপড় পরে ভালভাবে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মাড়োয়ারী লোকটা একগাদা টাকা বের করে লোক দু’জনকে দিলো আর দু’টো প্লেনের পাস দিলো–নিয়ে যাও, বোইং-এর পাস রইলো। দেখো সাবধানে যেও, কেউ যেন কোনোরকম সন্দেহ করতে না পারে।

 হুজুর, আজ কি নতুন যাচ্ছি; কতবার গেলাম আর এলাম, একটুও ভুল হয়নি। কথাগুলো বললো শরীফ নামক লোকটা।

 তারপর লোক দু’জন মুখোস-পরা লোকটাকে সেলুট করে বেরিয়ে গেলো। আবার সেই লিফট, তারপর সিঁড়ি, সিঁড়ির শেষে কঠিন পাথরের মজবুত দেয়াল, তারপর ছোট্ট কক্ষ। কক্ষমধ্যে গোলটেবিল, সেই টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসে আড্ডা মারছে কয়েকজন জোয়ান বলিষ্ঠ লোক। এদের দ্বারাই গ্রীন হাউস নাইট ক্লাব থেকে গোপনে সোনা চালান হয়ে থাকে।

এক-একদিন এক-এক বেশে এরা প্লেনের যাত্রী সেজে দেশ হতে দেশান্তরে পাড়ি জমায়। কখনও যায় ট্রেনযোগে, কখনও যায় এরা সদরঘাট হয়ে ষ্টিমার, লঞ্চে বা জাহাজে।

 কে এরা, কি করে এরা, কেউ জানে না। গ্রীন হাউসের এরা মালিক ও সর্বেসর্বা।

মূল্যবান খানাপিনা আর নানারকম বাদ্যযন্ত্রের ঐক্যতানে মুখর হয়ে থাকতো গ্রীন হাউসের অভ্যন্তর। কতলোক আসতো আর যেতো তার ইয়ত্তা নেই– এ সবের পিছনে চলেছে সোনা চালানীর। গোপন কারবার।

লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ চলে যায় দেশ হতে দেশান্তরে, কেউ এর সন্ধান জানে না বা পায় না। গ্রীন হাউসের মালিক কে, তারও কেউ খবর রাখে না!

অদ্ভুত রবারের পোশাক-পরা লোকটাই যে এই গ্রীন হাউসের মালিক এবং সর্বেসর্বা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মাড়োয়ারী লোকটা বিদেশী ব্যবসায়ী, তার দেশ বা বাড়ি কোথায় কেউ জানে না। সম্প্রতি ঢাকায় একটা ব্যবসা খুলে বসেছে। অল্পদিনের মধ্যেই নামও করেছে লোকটা ঢাকা শহরে। ইতিপূর্বে ঢাকায় তেমন কোনো মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী ছিলো না, তাই শশাঙ্ক নারায়ণ দেওজীকে সবাই চেনে।

 অদ্ভুত মুখোস-পরা লোকটা দেওজীর সঙ্গে কি যেন সব আলাপ করলো, তারপর দেওজীর নিকটে কয়েক ফাইল টাকা রেখে বললো–পঞ্চাশ হাজার নিয়ে যান দেওজী বাবু।

আচ্ছা! দেওজী টাকার ফাইলগুলো হাতের এ্যাটাচী ব্যাগের মধ্যে উঠিয়ে নিলো তারপর বেরিয়ে গেলো দ্রুত পদক্ষেপে!

 মাড়োয়ারী ভদ্রলোক গাড়িতে উঠে বসে পাশের আসনে হাতের ব্যাগটা রাখলো তারপর গাড়িতে ষ্টার্ট দিলো সে। গাড়ি উল্কা বেগে ছুটতে শুরু করলো।

গাড়িখানা এ-পথ সে-পথ করে করে তেজগাঁ অভিমুখে চলেছে। একটা নির্জন পথে গাড়িখানা প্রবেশ করতেই তিনি তার পিঠে একটা শক্ত কিছু অনুভব করলো, সঙ্গে সঙ্গে চাপা গম্ভীর কণ্ঠস্বর গাড়ি রুখখা।

 দেওজী চমকেই উঠলো না শুধু, আতঙ্কে শিউরে উঠলো–তার পিঠে শক্ত বস্তুটা যে কি সে অনুভবেই বুঝতে পেরেছে। ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে বললেন–কে তুমি? কি চাও?

গাড়ি রুখো, সব দেখতে পাবে।

 দেওজী গাড়ি রুখতে বাধ্য হলো, ফিরে তাকাতেই তার নজরে পড়লো একটা সাহেবী পোশাক পরা লোক-মাথায় ক্যাপ, মুখে কালো রুমাল জড়ানো, দক্ষিণ হস্তে তার রিভলভার। ভয়ে বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো তার মুখমন্ডল, হতভম্ব হয়ে বললো কি চাও? কে তুমি?

 লোকটা ততক্ষণে দেওজীর হাত থেকে ব্যাগটা এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো, একটা কাগজের টুকরা তার হাতে দিয়ে বললো–নাও, এর মধ্যে আমার পরিচয় পাবে–যাও এবার।

দেওজীর কণ্ঠ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না, সে ভয়কম্পিত হস্তে গাড়ির হ্যান্ডেল চেপে ধরলো।

 সোজা দেওজী পুলিশ অফিসে এসে হাজির হলো। ভয়-বিহ্বলভাবে হন্তদন্ত হয়ে অফিসে প্রবেশ করে হাপাতে লাগলো। কিছুক্ষণ তার কণ্ঠ দিয়ে কোন কথা বের হলো না।

পুলিশ অফিসের কর্মব্যস্ত অফিসারগণ সবাই দেওজীকে এভাবে হাঁপাতে দেখে আশ্চর্য হলেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর মিঃ হাফিজ উদ্দিন তাকে বসার জন্য অনুরোধ জানালেন।

দেওজী আসন গ্রহণ করলো, তারপর বললেন–স্যার, আমার সব গিয়াছে! হামার সব গিয়াছে…..

কি হয়েছে খোলাসা বলুন? জিজ্ঞাসা করলো মিঃ হাফিজ।

 অন্যান্য পুলিশ অফিসার বিস্মিতভাবে প্রতীক্ষা করছেন কি বলবেন ভদ্রলোক তাই শোনার জন্য।

দেওজী শুকনো ঠোঁট দু’খানা জিভ দিয়ে চেটে নিয়ে অসহায় কণ্ঠে বললো–ডাকু হামার সব নিয়াছে ইন্সপেক্টর বাবু। হামার পঞ্চাশ হাজার রূপেয়া……কথা বলার ফাঁকে পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরা বের করে ইন্সপেক্টারের হাতে দিলেন।

ইন্সপেক্টার কাগজের টুকরাটা মেলে ধরলেন উজ্জ্বল ইলেকট্রিক আলোর সম্মুখে, সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুটধ্বনি করে উঠলেন তিনি–দস্যু বনহুর!

পুলিশ অফিসের মধ্যে আচমকা একটা প্রতিধ্বনি জাগলোদস্যু বনহুর? কি বললেন, ঢাকায় দস্যু বনহুর…

সবাই ঝুঁকে পড়লো কাগজের টুকরাখানার উপর। শুধু আশ্চর্য নয়, এ যেন এক প্রচন্ড বিস্ময়কর ব্যাপার। এতোদিন ঢাকার অধিবাসিগণ দস্যু বনহুরের নামই শুধু শুনে এসেছে, কল্পনার চোখে তার চেহারার প্রতিচ্ছবি এঁকেছে, তার অস্তিত্ব অনুভব কেউ করেনি। এবার স্বয়ং দস্যু বনহুর ঢাকায় আবির্ভূত। হয়েছে!

সমস্ত ঢাকা শহরে কথাটা ছড়িয়ে পড়লো বিদ্যুৎগতিতে। পত্রিকায় পত্রিকায়, লোকের মুখে মুখে। সকলের মনেই ভয়-ভীতি আর স্পন্দনের অনুভূতি।

সাড়া পড়ে পেলো গোটা শহরময়–ঢাকা শহরে দস্যু বনহুর!

কুকর্ম দ্বারা যারা ধনবান অর্থশালী হয়েছেন তাদের পিলে চমকে গেলো, হৃদকম্প শুরু হলো। তাদের। এতোদিন বেশ আরামে গোপনে ব্ল্যাক মার্কেট চালিয়ে এবং নানারকম জঘন্য উপায়ে পয়সা। কামিয়ে লক্ষপতি হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন–এবার একি জ্বালা হলো! এতোদিন চিন্তা ছিলো না কিছু, গরিবদের বুকের রক্ত শুষে নিলেও প্রতিবাদ করবার কেউ ছিলো না। যদিও কেউ করতো তার মুখ বন্ধ করতে কতক্ষণ! গলা টিপে কণ্ঠরোধ করে দেওয়া হতো, নয় রাইফেলের গুলীতে।

 কিন্তু যারা মহৎ, যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, ন্যায়নীতি যাদের উদ্দেশ্য, তারা আনন্দে আপ্লুত হলেন। এমন কি ছোটবড় সবাই খুশিতে দীপ্ত হয়ে উঠলেন, দস্যু বনহুর তাদের দেশে আগমন করেছে–এ যেন তাদের সৌভাগ্য। সকলেরই ইচ্ছা, একবার যদি তার ভাব-গম্ভীর মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পেতো তাহলে হয়তো ধন্য হয়ে যেতো। বয়স্ক মহিলারা দস্যু বনহুরকে স্নেহ আর প্রীতির চোখে দেখেন। মধ্যবয়স্ক মহিলাগণ তাকে ভালবাসে সহোদরের মত। আর অবিবাহিতা তরুণীগণ বনহুরকে। শ্রদ্ধা জানায় অন্তরে অন্তরে। এমন একজনকে কে না কামনা করে!

 দস্যু বনহুর তার ভাড়াটে বাড়ির দ্বিতল একটি কক্ষে বসে সব শুনতে পায়, সব জানতে পারে পত্রিকার পাতায়। গতরাতে সে দেওজীকে ফলো করেছিলো কিন্তু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকাকালীন শোহেলীর স্বামী রায় বাহাদুরকে ফলো করে একদিন পৌঁছে গিয়েছিলো গ্রীন হাউস নাইট ক্লাবে। নতুন আগন্তুকের বেশেই সে এ ক্লাবগৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলো।

তারপর বনহুর সরে পড়েছিলো একদিন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে।

 দেওজীর পঞ্চাশ হাজার লুট হবার দুদিন পর মগবাজার এক ধন কুবেরের বাড়িতে হানা দিয়ে। দস্যু বনহুর প্রায় বিশ হাজার টাকা আর বহু সোনা নিয়ে উধাও হয়।

পরপর দু’টি অদ্ভুত ডাকাতিতে পুলিশমহলে চাঞ্চল্য দেখা দিলো। শুধু পুলিশমহলেই নয়, ঢাকা শহরে সৃষ্টি হলো এক ভীতি-ভাব।

বনহুর যেন উন্মাদ হয়ে উঠলো–তেজগা বিমান বন্দর থেকে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বাসায় ফিরছিলেন, সঙ্গে ছিলো তার অনেক টাকা-পয়সা আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। পথের মধ্যে হানা দিয়ে বনহুর সব লুটে নিলো।

পরদিন সংবাদপত্রে খবরটা ছড়িয়ে পড়লো ভীষণ আকারে।

 ঢাকায় এভাবে দস্যুতা কোনোদিন হয়নি–একি শুরু হলো এবার! রাস্তা-ঘাটে, পথে-মাঠে, স্কুটারে, বাসে, ট্রেনে, সব জায়গায় ঐ এক কথাদস্যু বনহুর ঢাকায় এসেছে, সব শয়তান এবার জব্দ হবে। যেমন একদিকে ভয়-ভীতি আর আতঙ্ক, তেমনি অন্যদিকে খুশির উচ্ছ্বাস। যারা দুঃস্থ অসহায় তাদের মনে অফুরন্ত আনন্দ।

বনহুর যেমনভাবে পয়সা লুটে নিতে লাগলো তেমনিভাবে ছড়িয়ে দিতে লাগলো অসহায় গরিব। দিনহীন অনাথদের মধ্যে। পথের ধারে ফুটপাতে পড়ে ধুকে ধুকে যারা মরছে, যারা খর রৌদ্রতাপ বিদগ্ধ পিচঢালা পথে সামান্য ফেরিওয়ালা হয়ে গলাফাটা চিৎকার করে মরছে দুটো পয়সার জন্য, যারা কাঁধে। থলে নিয়ে আনাচে-কানাচে শিলপাটা ধার কাটাও’ বলে আকুল আহ্বান জানাচ্ছে, হয়তো বা সারাটা। দিনে একটি টাকাও কামাতে পারছে না। একটু একটু করে তারা গোটা দিনে হয়তো দশ মাইল পথ হেঁটেছে, কামিয়েছে মাত্র একটি টাকা। ঘরে পাঁচটি ছেলেমেয়ে আর স্ত্রী–একটি বা দুটি টাকায় কি ই বা হবে তাদের! শহরের ভদ্রসমাজে আশ্রয় না পেয়ে যারা ঘর বেঁধেছে রেললাইনের দু’পাশে জলার মধ্যে–এই-সব গরিব বেচারাদের বনহুর মুক্তহস্তে দান করে চলেছে। কিভাবে কখন সে এদের সাহায্য। করতো কেউ বুঝতো না, কেউ জানতো না। এমন সময় একদিন ঢাকা শহরের আশেপাশের অঞ্চল কালবৈশাখীর প্রচন্ড দাপটে চুরমার হয়ে গেলো, শত শত বাড়ি-ঘর ধসে পড়ে নিহত আর আহত হলো অগণিত মানুষ।

এসব এলাকায় এমন কোনো বাড়ি রইলো না যাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কোনো পরিবার একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। কোনো পরিবারে সব মারা পড়লো, হয়তো বা বেঁচে রইলো একটি প্রাণী। কোনো বাড়িতে মা-বাবা সব মরেছে, বেঁচে আছে একটি শিশু। পিতা হারালো পুত্র, পুত্র হারালো পিতা। স্ত্রী হারালো স্বামী-সন্তান। স্বামী হারালো স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। সে এক মর্মান্তিক বীভৎস লীলা কালবৈশাখীর এক ভয়ঙ্কর ধ্বংস খেলা!

যারা সর্বহারা হলো তারা প্রায় সকলেই গরিব অসহায়। যাদের পেটে অন্ন জোটে না, পরনে কাপড় জোটে না, মাথায় তেল পড়ে না, এরাই হলো কালবৈশাখী রাক্ষসীর প্রথম শিকার।

শুধু তারা সর্বস্বান্তই হলো না, হারালো তাদের সবকিছু। মাথা গুজার মত আশ্রয়টুকুও রইলো না তাদের। কালবৈশাখী সব নিঃশেষ করে নিয়ে গেছে–ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেছে সব। কারো ঘরে একমুঠি অন্ন নেই যা তারা ভক্ষণ করে বেঁচে থাকবে। সবাই তো মরেছে যারা বেঁচে আছে তাদের অবস্থা। অবর্ণনীয়। একদিন দুদিন নয়, কেউ কেউ চার-পাঁচদিন অনাহারে রয়েছে। এক গেলাস পানিও তাদের ভাগ্যে জুটছে না। ছোট ছোট শিশুগুলো আকুল হয়ে কাঁদছে, মা-বাবা-ভাই-বোন হারিয়ে ভাঙাচুরা শূন্য ভিটায় দাঁড়িয়ে খুঁজছে হারানো বাপ-মাকে। হায়, আর কি সে কোনোদিন ফিরে পাবে তার বাপ-মা ভাইবোনদের!

কোনো ধ্বংসস্তূপের পাশে বসে কাঁদছে বৃদ্ধা মা, সন্তান তার গিয়েছিলো মিলে কাজ করতে আর সে ফিরে আসেনি। শুধু বৃদ্ধার একমাত্র সন্তানই নয়, এমনি কত বৃদ্ধা মাতার শত শত সন্তান এই প্রচন্ড ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছে, কে তার হিসাব সঠিক বলতে পারবে!

সরকার সহানুভূতি জানিয়েছেন, এসব অঞ্চলের জন্য সরকার লক্ষ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু কবে আসবে তাদের হাতে এই টাকা, আর কবে তারা মাথা গোঁজার আশ্রয় করে নেবে, খাবে দুটি অন্ন পেট পুরে। শত শত মৃতদেহের স্কুপের পাশে বসে বিলাপ করে চলেছে তারা।

যেদিকে তাকাও দেখবে শুধু মৃতদেহ। কি নৃশংস ভয়ানক করুণ দৃশ্য!

অগণিত দেশসেবক ছড়িয়ে পড়েছে এসব বিধ্বস্ত এলাকায়। তারা প্রাণপণে সাহায্য করে চলেছে, শত শত শ্রমিক ধ্বংসস্তূপের মধ্য হতে উদ্ধার করে চলেছে বিকৃত গলিত মৃতদেহগুলো। চারিদিকের আকাশ-বাতাস দুর্গন্ধে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। লোকজন এসব লাশের সক্কার করতে ব্যস্ত, এক-এক কবরে তিন-চারটির বেশি লাশ দাফন চলেছে তবু শেষ নেই। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে–কত মরছে, কত জীবিত থাকছে তার হিসাব নেই।

দস্যু বনহুরও এগিয়ে এসেছে কালবৈশাখী রাক্ষসীর করাল গ্রাসে বিধ্বস্ত এলাকায়, সে অন্যান্য জনসাধারণের সঙ্গে মিশে গেছে এক হয়ে। কখনও বৃদ্ধ শ্রমিকের বেশে, কখনও চাষী কিষাণ মজুরের বেশে, কখনও সাধারণ নাগরিক বেশে সে প্রত্যেকটা অসহায় নরনারীর পাশে এসেছে বন্ধু সেজে। কেউ তাকে চিনতে পারেনি, কেউ বুঝতে পারেনি কে সে। সরকারের অর্থ তখনও এসে পৌঁছায়নি, বনহুর সরকারের পক্ষ হয়ে তাদের মধ্যে অর্থ বিতরণ করে চলেছে। কার কি প্রয়োজন যথাসাধ্য চেষ্টায় তার প্রয়োজন মেটাতে সে দ্বিধা বোধ করেনি। কার আশ্রয় নেই, কার মুখে খাবার নেই, কার ঔষধের প্রয়োজন সব অভাব বনহুর মোচন করার জন্য উন্মুখ। সরকারের অর্থ এসে পৌঁছতে এখনও বিলম্ব আছে–ততদিন কি করে বাঁচবে এরা? জনসাধারণ তারাও মুক্ত হস্তে ঝড়-বিধ্বস্ত এলাকার দুঃস্থ ভাই বোনদের জন্য দান করে চলেছেন, কিন্তু এতো বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এসব অঞ্চলে যা প্রচুর অর্থেও পূর্ণ হবার নয়।

বনহুর তার লুণ্ঠিত অর্থ সব বিলিয়ে দিতে লাগলো এইসব দুঃস্থ লোকজনদের মধ্যে। সবাই জানে, সেও সরকারের প্রেরিত একজন মহৎ হৃদয় ব্যক্তি।

নিঃস্ব-রিক্ত-অসহায় যারা, তারা সবাই বনহুরকে বন্ধু বলে গ্রহণ করে। কেউ জানে না তার আসল পরিচয়।

*

সমীরের আনন্দভরা কণ্ঠস্বর শোনা যায়–আহাদ, দেখো কাকে ধরে এনেছি।

 মিঃ আহাদ মনোযোগ সহকারে সেদিনের ইংরেজি পত্রিকাখানা দেখছিলেন। পর পর কয়েকটা দস্যুতার খবরই তিনি পেয়েছেন। ঢাকা শহরে দস্যু বনহুরের আবির্ভাব তাকে শুধু আশ্চর্যই করেনি, বিস্ময়াহত করে তুলেছে। কোথায় সুদূর কান্দাই শহর আর কোথায় পূর্ব-পাকিস্তান-ঢাকা। দস্যু বনহুর এখানেও আগমন করেছে, এ কম কথা নয়। ঢাকার পুলিশ সুপার মিঃ রফিকুল আলম স্বয়ং মিঃ আহাদ চৌধুরীকে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করতে আহ্বান জানিয়েছেন। আজকের পত্রিকা দেখছিলেন আর ভাবছিলেন দস্যু বনহুর সম্বন্ধে নানা কথা।

সমীরের উচ্ছলকন্ঠে চোখ তুলে তাকালেন, সমীরের সঙ্গে মিঃ আলমকে দেখে উঠে অভ্যর্থনা জানালেন–আসুন, আসুন মিঃ আলম……

, বনহুর প্রথম দিনের মত হাস্যোজ্জ্বল দীপ্ত নয়, তার মুখমন্ডলে গাম্ভীর্যের ছাপ বিদ্যমান। সেদিন সেই ভদ্রলোকের হাতে হাত রেখেই নূরীকে সে নিউমার্কেটে চলতে দেখেছে। একটা ক্ষুব্ধভাব জমাট বেঁধে আছে তার মনের মধ্যে।

মিঃ আহাদ হাত বাড়ালেন মিঃ আলমের দিকে, হ্যান্ডশেক করলেন তিনি তার সঙ্গে।

বিশ্ববিখ্যাত ডিটেকটিভ আর বিশ্ববিখ্যাত দস্যুর হলো অপূর্ব মিলন। কেউ কম নয়–মিঃ আহাদ তার ন্যায়-নীতি আর কর্মে অটল, দস্যু বনহুরও তেমনি তার দুর্ধর্ষ কর্মব্যস্ততায় অবিচল।

আসন গ্রহণ করলো ওরা দুজনা।

সমীর ওপাশের সোফায় বসে পড়ে বললো–আহাদ, তুমি সেদিন উনাকে দাওয়াত করে আসার পর আমি ঠিক সময় তাকে আনতে গিয়েছিলাম, কিন্তু হোটেলে গিয়ে দেখি উনি উধাও। ম্যানেজারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, উনি হোটেল ত্যাগ করে চলে গেছেন। বাস, আমার মনটা গেলো খারাপ হয়ে–দ্রলোক এমন করে কোথায় ডুব মারলেন আচম্বিতে! যাক, ফিরে এসে আহাদ তোমাকে কিছু বললাম না, কারণ তুমিও হয়তো মনে আমার মতই ব্যথা পাবে। ভদ্রলোক কথা দিলেন, না–এ কেমন……একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো সমীর-আজ হঠাৎ পথের মধ্যে দেখা তাই ধরে আনলাম…….।

 হেসে বললেন মিঃ আহাদ–তোমার কাছে আজ পর্যন্ত কেউ পালিয়ে বেঁচেছেন যে উনি বাঁচবেন। দেখুন মিঃ আলম, সমীর কিন্তু বড় রসিক মানুষ, ওর কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না।

বনহুরের ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠলো মাত্র।

বললো সমীর–তোমরা আলাপ করো, আমি ভিতরে চা-নাস্তার আয়োজন করতে বলে আসি।

বেরিয়ে গেলো সমীর।

মিঃ আহাদ সিগারেট-কেসটা মেলে ধরলেন বনহুরের সামনে নিন।

বনহুর আলগোছে একটা সিগারেট তুলে নিলো।

মিঃ আহাদই সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলেন মিঃ আলমের পরে নিজের! একরাশ ধুম্র নির্গত করে। বললেন–মিঃ আলম, আপনি এসেছেন, অনেক খুশি হয়েছি।

বনহুর ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললো সত্যি আমি দুঃখিত যে, সেদিন আপনাকে কথা দিয়েও আসতে পারিনি।

আমি জানতাম, আপনি ভীষণ কোনো অসুবিধায় পড়েছিলেন।

হাঁ, আপনি যা বলেছেন অত্যন্ত সত্য, যে অসুবিধা আমাকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ত্যাগে। বাধ্য করেছে।

হাসলেন মিঃ আহাদ-আপনার কামরায় বসেই সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম। অবশ্য আপনার অপরূপ সৌন্দর্যই এর মূল কারণ।

মিঃ আহাদের কথায় বনহুরের মুখমন্ডল গম্ভীর হয়ে উঠলো, দৃষ্টি নত করে নিয়ে কিছু ভাবলো সে। বুঝতে পারলো, সেদিন মিঃ আহাদ যখন তার কামরায় বসে আলাপ করছিলেন তখন মিসেস শোহেলী প্রবেশ করেছিলো–শুধু প্রবেশই করেনি তার পাশে এমন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিলো যার জন্য বনহুর নিজেও লজ্জাবোধ করছিলো তখন। অবশ্য পরিচয় করে দিয়েছিলো বনহুর মিসেস শোহেলীর সঙ্গে মিঃ আহাদের। এই মুহূর্তে আহাদ যে মনোভাব নিয়ে কথা বললো তা সম্পূর্ণ ইংগিতপূর্ণ।

বনহুরও একটু বিদ্রূপ-ভরা গলায় বললো–মিঃ চৌধুরী, আপনিও এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন বলে মনে হয় না। কারণ…..যা কেমন আছেন বলুন দেখি?

মিঃ আহাদ বুঝতে পারলেন, মিঃ আলম এ প্রসঙ্গ থেকে সরে পড়তে ঢান, কাজেই শান্তকণ্ঠে বললেন–ভাল আছি, তবে মনের অবস্থা মোটেই ভাল নয়।

হাঁ, বছরের প্রথমেই কালবৈশাখী রাক্ষসীর প্রচন্ড থাবা চুরমার করে দিয়ে গেছে কতকগুলো। অসহায় জনগণকে। যাদের হাহাকার আর করুণ রোদনে ভরে উঠেছে আকাশ-বাতাস।

 মিঃ আলম, আপনি ঠিক বলেছেন, নব বৎসরের আগমনী আনন্দে দেশের মাটি যখন আত্নহারা সেই মুহূর্তে কালবৈশাখীর নির্মম পদক্ষেপ সব আনন্দ-হাসি-গান নিভে গেছে দপ করে। সত্যিই এই নৃশংস দৃশ্য সহ্য করা অত্যন্ত কঠিন।

আনমনা হয়ে যায় বনহুর, তার চোখের সামনে ভেসে উঠে এক নিদারুণ করুণ মর্মস্পর্শী দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি।

 মিঃ আহাদ সিগারেটের ধুম্ররাশির ফাঁকে নিপুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন মিঃ আলমের মুখে। তীক্ষ্ণ তীব্র সে দৃষ্টি।

এমন সময় বাবুর্চির হাতে চা-নাস্তার সরঞ্জামসহ কক্ষে প্রবেশ করলো সমীর, মিঃ আহাদ ও মিঃ আলমকে গম্ভীর ভাবাপন্নভাবে বসে থাকতে দেখে বললো কি ভাবছো বন্ধুদ্বয়? বড় যে উদাস লাগছে তোমাদের? ব্যাপার কি?

মিঃ আহাদ এ্যাসট্রেতে হাতের সিগারেটটা খুঁজে রেখে সোজা হয়ে বসলেন।

 বনহুর সত্যিই একটু উদাস হয়ে পড়েছিলো, সে চট করে নিজকে সংযত করে নিয়ে হাসলো।

সমীর বাবুর্চির হাত হতে চা-নাস্তার ট্রেটা নিয়ে মাঝখানের টেবিলে নামিয়ে রাখলোনাও বন্ধু শুরু করো। মিঃ আলম, একটু চা পান করুন।

মিঃ আহাদ সামান্য চানাচুর মুখে ফেলে চিবুতে চিবুতে বললেন কালবৈশাখীর মৃত্যু ছোবলে শত শত লোক যখন চরম অবস্থার সম্মুখীন, সেই মুহূর্তে আর একটা অলৌকিক বিস্ময়কর ঘটনার উদ্ভব ঘটেছে–সে হলো দস্যু বনহুরের আবির্ভাব।

হাঁ, দস্যু বনহুরের আবির্ভাব অলৌকিক বিস্ময়করই বটে। স্থিরকণ্ঠে কথাটা বললো মিঃ আলম।

সমীর বলে উঠলো–এখন একটু চুপ করে দেখি। দস্যু বনহুর, দস্যু বনহুর’ বলছেহঠাৎ এখানে যদি তার আবির্ভাব ঘটে তখন কি হবে বলোতো? মানও যাবে, জানও যাবে! নাও, চা-নাস্তা খেতে খেতে যত পারো গল্প করো, আপনিও নিন মিঃ আলম।

বনহুরও খেতে শুরু করলো।

সমীরও খেতে খেতে বললো–আমি আর বাদ যাই কেন।

 মিঃ আহাদ হেসে বললেন–ডাক্তার না তোমাকে মিষ্টি খেতে বারণ করেছেন?

সর্বনেশে কথা বলো না বন্ধু, মিষ্টি আমার তোমার চেয়েও প্রিয়।

বনহুরও খেতে খেতে হাসিতে যোগ দিলো।

সমীর বললো–আজকের খাবারগুলো যেন অমৃত হয়েছে।

বাবুর্চিকে ধন্যবাদ দিতে হয়। বললেন মিঃ আহাদ।

সমীর কুলে উঠে–আমার বোন, আমার বোন তৈরি করেছে আজ খাবারগুলো, বুঝলে? ভারী। খাসা হয়েছে কিন্তু……

বনহুর চুপচাপ খাচ্ছিলো, ভাবলো নিশ্চয়ই এসব নূরীর তৈরি, মনে মনে ক্ষুব্ধভাব জেগে উঠলেও তাকে বাধ্য হয়ে কিছুটা মুখে করতে হলো।

এমন সময় বাইরে গাড়ি থামার শব্দ হলো।

একটু পরেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ হাফিজ।

 মিঃ আহাদ উঠে অভ্যর্থনা জানালেন–আসুন মিঃ হাফিজ, বসুন।

 মিঃ হাফিজ আসন গ্রহণ করলেন।

মিঃ আহাদ পরিচয় করিয়ে দিলেন মিঃ আলমের সঙ্গে পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ হাফিজের। তারপর চা-নাস্তা খাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন।

মিঃ হাফিজ জানালেন, এইমাত্র তিনি চা পান করে এসেছেন, কাজেই সম্ভব নয়।

খাওয়া শেষ হলো, সমীর বাবুর্চিকে আদেশ দিলো সব নিয়ে যেতে। তারপর শুরু হলো আলাপ আলোচনা।

মিঃ হাফিজ বললেন–মিঃ চৌধুরী, দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারে আপনি আমাদের সহায়তা করছেন কিনা, জানতে চাই?

মিঃ আহাদ একটু চিন্তিত সুরে বললেন–ঠিক কথা দিতে পারছি না, তবে যতদূর সম্ভব আপনাদের সঙ্গে থাকতে চেষ্টা করবো।

করবো নয় করতে হবে, আপনি যখন এ সময় ঢাকায় এসেছেন তখন আপনাকে ছাড়ছি না। আমরা। মিঃ হাফিজের কথার মধ্যে বেশ জোর ছিলো।

মিঃ আহাদ প্রাইভেট ডিটেকটিভ, তিনি সখের গোয়েন্দা। খেয়ালের বশে তিনি এ কাজ করেন, এসব কাজে তিনি কোনোদিন পারিশ্রমিক নেন না।

মিঃ আহাদ শেষ পর্যন্ত দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে কথা দিলেন।

ইন্সপেক্টর মিঃ আলমের সামনে এসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে একটু ইতস্ততঃ করছিলেন, সমীর হেসে বলে–আরে, ইনিও আমাদের একজন বন্ধুলোক। এর সামনে আপনি সবকথা অকপটে বলতে পারেন।

সমীরের কথায় মিঃ আহাদের মুখমন্ডল গম্ভীর হলো, কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না তিনি।

আলাপ-আলোচনা শেষ করে চলে গেলেন মিঃ হাফিজউদ্দিন। যাওয়ার সময় তিনি মিঃ আলমের হ্যান্ডশেক করলেন।

মিঃ আহাদ আর আলম যখন মিঃ হাফিজকে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে ড্রইংরুমে ফিরে আসছিলেন তখন নূরী আড়াল থেকে সব লক্ষ্য করছিলো। বনহুর এসেছে দেখে তার মন আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠছিলো, খুশিতে বুক ভরে উঠেছিলো তার।

সেদিনের মত বনহুর যখন বিদায় চাইলো তখন মিঃ আহাদ তাকে স্বয়ং পৌঁছে দেবার জন্য উঠে পড়লেন। অল্প সময়েই তাদের মধ্যে এক গভীর বন্ধুত্ব ভাব গড়ে উঠেছিলো।

অবশ্য মিঃ আহাদ মিঃ আলমের সঙ্গে একটু বেশি জড়িয়ে পড়ার জন্য আগ্রহশীল ছিলেন।

 গাড়িতে বসে বললেন মিঃ আহাদ-মিঃ আলম, দস্যু বনহুর সম্বন্ধে আপনার ধারণা কেমন?

ভ্রূকুঞ্চিত করে ফিরে তাকালো বনহুর মিঃ আহাদের দিকে আমি ঠিক আপনার কথাটা বুঝতে পারছি না?

মানে দস্যু বনহুর সম্বন্ধে আপনি যা শুনলেন তাতে আপনার কি মনে হয়?

একটু করা হাসির রেখা ফুটে উঠলো বনহুরের মুখে, বললো–আমি দস্যু বনহুর সম্বন্ধে অত্যন্ত চিন্তাশীল হয়ে পড়েছি মিঃ চৌধুরী। কারণ ঢাকার মত শহরে সে বেশিক্ষণ আত্মগোপন করে থাকতে সক্ষম হবে বলে মনে হয় না।

 আপনি নির্ভুল সত্য কথাই ব্যক্ত করেছেন মিঃ আলম। দস্যু বনহুর ঢাকা শহরে যে বেশিদিন নিজকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না, তা জানি।

হাঁ, আমারও তাই মনে হয়।

কিছুক্ষণ উভয়ে নীরব।

মিঃ আহাদ বললেন–দস্যু বনহুরকে লোকে যতই যা ভাবুক আমি কিন্তু মনে মনে শ্রদ্ধা করি।

আচমকা চোখ দুটো তুলে ধরলো বনহুর মিঃ আহাদের মুখের দিকে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার অন্তরটা দেখতে চাইলো মিঃ আহাদের কথাটা গভীর না হাল্কা।

 মিঃ আহাদ বলে চলেছেন, তিনি নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন–পুলিশমহল বা লোকসমাজ তাকে যতই মন্দ চোখে দেখুক, আমি পারি না।

বনহুর বললো–মিঃ চৌধুরী, দস্যু বনহুর সম্বন্ধে আপনি বিশেষভাবে জ্ঞাত নন বলেই আপনি তার প্রতি এতো সদয় হতে পারছেন। জানেন না আসল রূপ কেমন?

 হঠাৎ হেসে উঠলেন মিঃ আহাদ হা হা করেবনহুরের আসল রূপ আমি স্বচক্ষে না দেখলেও তার সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ জ্ঞাত। শুনেছি সে একজন দেশপ্রেমিক।

হতে পারে সে দেশপ্রেমিক কিন্তু তবু সে অপরাধী, একথা আপনি অস্বীকার করতে পারেন না।

তা তো বটেই।

এই আমার বাসা এসে গেছে।

 মিঃ আহাদ গাড়ি রাখলেন।

 নেমে পড়লো বনহুর। বললো সেমিঃ চৌধুরী, আসুন না গরীবালয়ে।

 আজ নয়, দেখা হবে আবার। বললেন মিঃ আহাদ চৌধুরী।

 বনহুর হাত নেড়ে তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানালো।

*

গভীর রাতে কক্ষমধ্যে পায়চারি করে চলেছেন মিঃ আহাদ। সমীর বসে আছে একটা চেয়ারে, মুখমন্ডল তার গম্ভীর। দেয়ালে ঘড়িটা শুধু টিকটিক শব্দ করে চলেছে। মিঃ আহাদের জুতোর শব্দ আর ঘড়ির কাঁটার শব্দ মিলে অদ্ভুত এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে চলেছে।

 পাশের কামরায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে নূরীর–শুনতে পেলো মিঃ আহাদ চৌধুরীর গম্ভীর কণ্ঠস্বরসমীর, তুমি যাই বলল দস্যু বনহুর আমার চোখে ধূলো দিতে পারবে না। আমি তাকে খুঁজে বের করবোই।

তা এই গভীর রাতে কোথায় যাবে?

দস্যু বনহুরের সন্ধানে।

আহাদ, এতোকাল গোয়েন্দাগিরি করে আসছে, এবার দস্যু বনহুরের পাল্লায় পড়ে তোমার গোয়েন্দাগিরির যবনিকা না ঘটে।

কি বলছো তুমি?

বলছি হুশিয়ার হয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। এ দস্যু শুধু দস্যুই নয় বুঝলে? পৃথিবীর কোনো গোয়েন্দাই আজ পর্যন্ত তাকে গ্রেফতারে সক্ষম হয়নি।

হঠাৎ মিঃ আহাদ হেসে উঠলেন–হাঃ হাঃ হাঃ বন্ধু তুমি আমাকে হাসালে! যতবড় দস্যুই হোক তাকে আমার কবলে আসতেই হবে।

কি জানি আমার কিন্তু বড় ভয় করছে।

কারণ?

 দস্যু বনহুর নামটাই যেন কেমন ভয়াল।

 নামটা ভয়াল নয় সমীর, তোমার মনটাই ভীতু। নাও আর বিলম্ব করো না চলো বের হতে হবে।

রাতদুপুরে এভাবে ঘোরাফেরা করলে কবে তোমাকেই পুলিশ দস্যু বনহুর বলে গ্রেফতার করে। বসবে, তখন হবে মজাটা!

কথা বাড়িও না, সমীর। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে–ঠিক রাত দু’টোর মধ্যেই আমি রওয়ানা দেবো।

আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো নূরী, শিউরে উঠলো–আজ কদিন হলো এ বাড়িতে এসেছে তার মধ্যেই সে মিঃ আহাদের সম্বন্ধে বেশ ভালভাবেই জ্ঞাত হয়েছে। মিঃ আহাদ যে একজন প্রখ্যাত ডিটেকটিভ তা নূরী বুঝতে পেরেছে। আজ গভীর রাতে মিঃ আহাদ আর সমীর যখন দস্যু বনহুর সম্বন্ধে আলোচনা করছিলো তখন নূরীর মনটা ভীত আশঙ্কিত হয়ে উঠছিলো।

নূরীর কানে এলো এবার সমীরের ভয়বিহ্বল সুর-ওটা সামলে রেখো ভায়া।

নূরী তাকালো, অন্তরটা কেঁপে উঠলো তার, দেখতে পেলো মিঃ আহাদ টেবিলের ড্রয়ার খুলে রিভলভারে শুলী ভরে নিচ্ছেন।

না না, তার বনহুরকে হত্যা করতে দেবে না সে, বনহুর তাকে যতই অবহেলা করুক, ওকে রক্ষা করবে, বাঁচাবে যেমন করে হোক- কিন্তু কি করবে, কি করে বনহুরকে উদ্ধার করবে ভেবে অস্থির

নূরী যখন গভীর চিন্তায় অস্থির তখন মিঃ আহাদ আর সমীর বেরিয়ে গেলো বাইরে। নূরী অন্ধকারে শুনতে পেলো ভারী জুতোর শব্দ।

পরক্ষণেই গাড়ি ছাড়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো।

নুরী নিজের কক্ষে গিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়লো–ওগো দয়াময়, তুমি ওকে বাঁচিয়ে নিও।

মিঃ আহাদ গাড়ি চালিয়ে চলেছে, পাশে বসে সমীর।

বলে উঠে সমীর–কোথায় চলেছে এখন?

 মিঃ আলমের ওখানে।

 মানে?

মানে তাকে সঙ্গে নেবো।

মিঃ আলমকে সঙ্গে নেবে?

হাঁ, কারণ সে কথা দিয়েছে আমাকে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারে সাহায্য করবে।

রাতদুপুরে তাকে বিরক্ত করা উচিত হবে?

চুপচাপ বসে দেখো।

মিঃ আহাদ বনহুরের বাড়ির গেটে এসে গাড়ি রাখলেন। নেমে পড়লেন উভয়ে। ছোট্ট বাংলা প্যাটার্ণের বাড়ি। সামনে মাঝারি একটা বাগান। বাগানের মধ্য দিয়ে বাড়ির প্রবেশপথ।

মিঃ আহাদ আর সমীর উঠে গেলো বারেন্দায়।

 মিঃ আহাদ টোকা দিলেন দরজায় ঠক্ ঠক ঠক—-

কক্ষ্যমধ্য হতে শোনা গেলো মিঃ আলমের কণ্ঠকে? পরক্ষণেই দরজা খুলে গেলো, বেরিয়ে এলো মিঃ আলম–আরে আপনারা?

মিঃ আহাদ হেসে বললেন–আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হচ্ছে।

 অপেক্ষা করুন, এক্ষুণি আসছি।

মিঃ আহাদ বললেন–ধন্যবাদ।

মিঃ আলম কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে ড্রেস পাল্টে নিলো, তারপর বেরিয়ে এসে দরজা তালাবন্ধ করে বললো–চলুন কোথায় যেতে হবে?

মিঃ আলমের বাড়ি সংলগ্ন বাগানের মধ্য দিয়ে এগুতে এগুতে বললেন মিঃ আহাদ–এভোরাতে আপনাকে বিরক্ত করা ঠিক হলো না। মিঃ আলম, কিন্তু না করে উপায় ছিলো না। আমি জানি, আপনি আমাকে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করায় সহায়তা করতে পারবেন।

মিঃ আলম প্রশ্নভরা দৃষ্টি তুলে তাকালো মিঃ আহাদের দিকে।

বললেন মিঃ আহাদ–আজ একটা চিঠি পেয়েছি, তাতে লেখা আছে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে খোঁজ করলে দস্যু বনহুরের সন্ধান পাবেন।

ভ্রূকুঞ্চিত হয়ে এলো মিঃ আলমের–চিঠি?

হ চিঠি।

মিঃ আহাদ বললেন-এ হোটেলে আপনি ছিলেন কিনা, তাই আপনাকে সঙ্গে করে আনলাম– এতোরাতে কোনো অসুবিধা হতে পারে, আপনার সঙ্গে ম্যানেজারের যখন ভাল পরিচয় আছে তখন কথা শেষ না করে চুপ করলেন মিঃ আহাদ।

 মিঃ আহাদের হেয়ালিপূর্ণ কথাগুলো মিঃ আলমের কাছে অদ্ভুত লাগলো। তার বুঝতে বাকি রইলো না, মিঃ আহাদ অত্যন্ত সুচতুর বুদ্ধিমান, কৌশলে তার আত্মপরিচয় জানতে চান। এতোরাতে তার বাড়িতে হঠাৎ আগমনের কারণও এখন সচ্ছ হয়ে এলো তার কাছে। মৃদু হাসলো বনহুর।

 হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৌঁছে মিঃ আহাদ কিছুক্ষণ ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন, তাতে সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেলোনা।

ফিরে চললেন এবার মিঃ আহাদ।

 মিঃ আলমকে তিনি পৌঁছে দিলেন তার বাড়িতে।

পথে সমীর জিজ্ঞাসা করে বসলোব্যাপার কি বন্ধু, হঠাৎ মিঃ আলমকে নিয়ে এভাবে টানাটানি করছো কেন?

আহাদ চৌধুরী গাড়ির সম্মুখভাবে দৃষ্টি রেখে বললেন–দেখলাম ভদ্রলোক এতোরাতে বাসায় আছেন কিনা।

হো হো করে হেসে উঠলো সমীর বুঝেছি, তুমি মিঃ আলমকে দস্যু বনহুর বলে সন্দেহ করছ।

অসম্ভব কিছুই নয় সমীর।

 কিন্তু মিঃ আলমকে সন্দেহ করার মত কি দেখলে তার মধ্যে?

 তার অপরূপ সৌন্দর্য আর মহৎ ব্যবহার।

অবাক হয়ে বললো সমীর–আশ্চর্য গোয়েন্দা তুমি।

তার চেয়েও আশ্চর্য দস্যু বনহুর, বুঝলে?

কি জানি, আজও আমি তোমাকেই বুঝলাম না।

চাপা একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো মিঃ আহাদের ঠোঁটে।

মিঃ আহাদ আর সমীর যখন কথা বলছিলো তখন গাড়ির পিছন আসনের নিচে কেউ হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়েছিলো। সমীর টের না পেলেও মিঃ আহাদ টের পেলেন, তিনি ড্রাইভ আসন থেকে নেমে পিছন আসনের দরজা খুলে ধরলেন নেমে এসো নূরী।

সেকি! নূরী? কোথায় নূরী? বললো সমীর।

সত্যি সে অবাক হয়ে দেখলো, পিছন আসন থেকে নেমে এলো নূরী, মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো সে পুতুলের মত স্থির হয়ে।

সমীর নূরীর পা থেকে মাথা অবধি নিরীক্ষণ করে বললো–হ্যাঁ তুমি! বোন তুমি কখন গিয়েছিলে আমাদের সঙ্গে?

বললেন মিঃ আহাদ–আমি ওকে গোপনে সঙ্গে নিয়েছিলাম।

কখন, আমি তো জানিনা?

তুমিই যদি জানলে তাহলে ওকে গোপনে নেওয়ার কি দরকার ছিলো?

কি জানি, তোমাকে বুঝা মুস্কিল আহাদ।

মিঃ আহাদ নূরীর কাঁধে হাত রাখলেন–চলো বোন।

নূরী লজ্জিত হতভম্ব, যন্ত্রচালিতের ন্যায় পা বাড়ালো সামনের দিকে।

পরদিন।

নূরী নিজ হস্তে মিঃ আহাদের খাবার নিয়ে এলো তার ঘরে।

একটা কোনো বই পড়ছিলেন মিঃ আহাদ।

 নূরী পাশের টেবিলে খাবার রেখে চলে যাচ্ছিলো, অন্যদিন হলে বলত–ভাইজান, খেয়ে নিন।

আজ কোনো কথাই তার মুখ দিয়ে বের হলো না। কারণ কাল রাতে সে এমনভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবতে পারেনি। নূরী যখন শুনেছিলো মিঃ আহাদ বললেনদস্যু বনহুর সকলের চোখে ধূলো দিয়ে লুকিয়ে থাকলেও আমার চোখে সে ধূলো দিতে পারবে না। তখন নূরী দেখেছিলো তাঁর হাতে জমকালো রিভলভারখানা, শিউরে উঠেছিলো সে মনে মনে। কিছুতেই সে নিজকে ধরে রাখতে পারেনি, আলগোছে গাড়ির পিছন আসনের নিচে লুকিয়ে পড়েছিলো।

নূরীর উদ্দেশ্য ছিলো আত্মগোপন করে এদের কার্যকলাপ দেখা–কোথায় যায় এর, কি করে। যখন মিঃ আহাদ ও সমীর বাংলো প্যাটার্ণের ছোট একটা বাড়ির দরজায় এসে টোকা দিচ্ছিলেন তখন নূরী আশ্বস্ত হয়েছিলো; সে জানতো তার হুর এখন ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে, এ কার বাসা কে জানে! কিন্তু একটু পরেই যখন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো হুর তখন শুধু চমকেই উঠলো না সে, আতঙ্কে শিউরে উঠলো–তাহলে কি তার হুরকে চিনতে পেরেছেন মিঃ আহাদ চৌধুরী। শেষ পর্যন্ত কি ঘটে দেখবার জন্য উদ্বিগ্ন হৃদয় নিয়ে অপেক্ষা করছিলো।

নূরী সবই লক্ষ্য করেছিলো প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সে তখন ভাবতেও পারেনি মিঃ আহাদ তার অস্তিত্ব জানতে পেরেছেন। পরে যখন মিঃ আহাদ তাকে গাড়ি থেকে নামার জন্য বললেন তখন নূরী শুধু স্তব্ধ বিস্মিত হয়নি, ভড়কে গিয়েছিলো ভীষণভাবে। লজ্জায় মরিয়া হয়ে উঠেছিলো নূরী।

 রাতের এই ঘটনার পর নূরীর মাথাটা যেন নত হয়ে এসেছিলো, সহসা সে মিঃ আহাদের সামনে আসতে লজ্জাবোধ করছিলো।

নূরী খাবার টেবিলে রেখে দরজার দিকে পা বাড়াতেই মিঃ আহাদ বললেন–শোনো।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো নূরী, মনে মনে ভয় পেয়ে গেলো। কাল রাতের ঘটনাটার জন্য সে ভড়কে গেলো ভীষণভাবে। নিশ্চয়ই তাকে কৈফিয়ত তলব করে বসবেন তিনি। অপরাধীর মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

 মিঃ আহাদ হস্তস্থিত বইখানা বন্ধ করে টেবিলে রেখে দাঁড়ালেন এগিয়ে এলেন নূরীর পাশে।

 নূরী নতদৃষ্টি তুলে একবার মিঃ আহাদ চৌধুরীর মুখমন্ডল দেখে নিলো। না, সে মুখে নেই কোনো কঠিনতার ছাপ। নূরী কতকটা আশ্বস্ত হলো।

মিঃ আহাদ সচ্ছকণ্ঠে বললেন–ধন্যবাদ নূরী।

 চমকে মুখ তুললো নূরী, হঠাৎ ধন্যবাদে একটু হতবুদ্ধি হয়ে গেলো সে।

মিঃ আহাদ হেসে বললেন–একটা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি নূরী, আমি জানি, তুমি পারবে আমাদের সাহায্য করতে।

প্রশ্নভরা চোখে তাকালো নূরী, মিঃ আহাদের কথা সে যেন ঠিক বুঝতে পারলো না, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো।

মিঃ আহাদ নূরীর হাত ধরে সরে নিয়ে এলেন তারপর সোফায় ওকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসলেন তার পাশে।

নূরী চিত্রার্পিতের মত বসে রইলো।

মিঃ আহাদ বললেন–প্রথম দিনই আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি সাধারণ নারী নও। তোমার মধ্যে একটা বিরাট প্রতিভা লুকিয়ে আছে। নূরী,তোমাকে আমি বোন বলে গ্রহণ করেছি, তুমি আমার কাজে সহায়তা করবে।

হা করবো।

 ধন্যবাদ।

নূরী বিস্মিত আঁখি দুটি তুলে ধরলো আর একবার মিঃ আহাদের মুখে। দৃষ্টি বিনিময় হলো মিঃ আহাদের সঙ্গে নূরীর।

হেসে বললেন মিঃ আহাদ–যাও নূরী, সময় হলে আবার ডাকবো। নূরী মন্থর গতিতে বেরিয়ে গেলো।

*

পুলিশমহলে যখন দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার নিয়ে ভীষণভাবে আলোড়ন চলেছে, সমস্ত শহরময় যখন একটা গভীর আতঙ্কভরা ভীতি-ভাব তখন কালবৈশাখী-বিধ্বস্ত শুশানপুরীতে দস্যু বনহুর দুর্গতদের সেবা যত্ন নিজ হস্তে করে চলেছে। কারো চোখের পানি মুছিয়ে দিচ্ছে, কারো মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, যার মাথা গুজার আশ্রয় নেই তার আশ্রয় তৈরি করে দিচ্ছে। অন্যান্য সেচ্ছাসেবক দলের সঙ্গে মিশে এক হয়ে গেছে যেন সে।

 প্রখর রৌদ্রদগ্ধ দ্বিপ্রহরে পৃথিবী যখন গনগনে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে তখন বনহুর সাবধানে শ্রমিকের বেশে দুঃস্থ অসহায় জনগণের মধ্যে বিচরণ করে ফিরছে। কারও ঘর তৈরি এখনও হয়নি, কারও ঘরে এখনও খাবার এসে পৌঁছায়নি, কারও পরনে কাপড় নেই–অর্থ দিয়ে, ঔষধ পথ্যাদি দিয়ে, নিজ হস্তে আশ্রয় তৈরি করে দিয়ে সাহায্য করে চলেছে।

সরকারের সাহায্য এসেছে, হয়তো তা দিয়ে সব অভাব পূর্ণ হচ্ছে না। হয়তো খাবার কিনতে ঔষধের দাম ফুরিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন অনেক পয়সার। কালবৈশাখী ঝড় যা ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে তা যে সহজে পূর্ণ হবার নয়।

এমনি একদিন বনহুর এক বৃদ্ধার মাথা গুজবার জন্য একটা ছোট্ট চালা তৈরি করে দিচ্ছিলো নিজ হস্তে। তার শরীরে তখন মজুরের বেশ। খালি পা, একটা ছেঁড়া পায়জামা পরা, গায়ে হাফ-হাতা শার্ট। মুখে কিছু কাঁচা-পাকা নকল দাড়ি, মাথায় একটা গামছা বাঁধা সাবল দিয়ে মাটি খনন করে খুঁটি পুতছিলো সে। তাকে দেখলে চিনবার কোনো উপায় নেই। নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণ করেছে দস্যু বনহুর।

অদূরে বৃদ্ধা বসে বসে ধুকছে।

একমাত্র সন্তান ছিলো, কোনো এক মিলে শ্রমিকের কাজ করতো–সে মিলের ছাদ চাপা পড়ে মরেছে। এক নাতনী ছিলো, ঝড়ের মধ্যে কোথায় যে হারিয়ে গেছে, সেও আর ফিরে আসেনি। এও বলে–বুড়ী, তোর নাতনী পুকুরে পড়ে ডুবে মরেছে। হাউ মাউ করে কাঁদে বুড়ী। কেঁদে কেঁদে বুড়ীর চোখে ঘা হয়ে গেছে। আজ কদিন হলো ঝড় তার সর্বস্ব লুটে নিয়ে গেছে–সেদিন থেকে হাড়ি চড়েনি উনুনে। আর রাঁধবেই বা কেনাতনীটা ছিলো, সে-ই কোনোরকমে চারটি চাউল সিদ্ধ করতো। হয়তো বাপ মিলে কাজ করে ফেরার পথে গামছায় চাল-ডাল-আলু বেঁধে আনতো; তাই বাপ-বেটি মিলে রাঁধতে, নিজেরা খেতো আর বুড়ী মাকে দিতো। ছেলে আর নাতনী হারিয়ে বুড়ি উন্মাদিনী হয়ে পড়েছে, বিলাপ করছে কিন্তু তার কথা বুঝা যাচ্ছে না।

আজ দস্যু বনহুর স্বয়ং বৃদ্ধার মাথা গুজবার কাছে ব্যস্ত।

যদিও শতশত লোকজন অসহায় দুর্গতদের সহায়তা করে চলেছে যদিও সরকার প্রচুর অর্থ সাহায্য করে এসব এলাকার দুঃখকষ্ট দূর করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন, তবুও এখনও এমন কত নিরাশ্রয় অসহায় অনাথ রোগক্লিষ্ট ব্যক্তি মৃত্যুর জন্য তিল তিল করে ধুকছে।

বনহুর তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে, দান করছে মুক্তহস্তে। মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, অশ্রু মুছিয়ে দিচ্ছে রুমালে।

 বনহুর যখন বৃদ্ধার ঘরখানা তুলে দেওয়ার জন্য খুঁটি গাড়ছিলো তখন অদূরে একটা গাড়ি এসে থামলো।

হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো সেইদিকে চমকে উঠলো বনহুর গাড়ি থেকে নামলেন প্রখ্যাত ডিটেকটিভ মিঃ আহাদ চৌধুরী সমীর আর তার শিশুকালের সাথী-সঙ্গিনী নূরী। মুহূর্তের জন্য বনহুর আনমনা হয়ে গেলো, ভাগ্যিস চালটা তার মাথার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েনি। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে আপন কাজে মন দিলো সে।

নূরীসহ মিঃ আহাদ এগিয়ে আসছেন, দেখছেন চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। ঝড়বিধ্বস্ত এলাকার নির্মম অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে এসেছে মিঃ আহাদ সঙ্গে রয়েছে নূরী আর সমীর কুমার।

বনহুর আপন মনে কাজ করছিলো।

প্রখর রৌদ্রতাপে তার দেহের বসন ভিজে চুপছে গেছে। গন্ড রক্তাভ হয়ে উঠেছে কিন্তু নকল দাড়ি-গোঁফে ঢাকা পড়ে গেছে তার সুন্দর মুখশ্রী।

বনহুরের পাশ কেটে চলে গেলেন মিঃ আহাদ এবং তার সঙ্গীদ্বয়।

বনহুরের কানে পৌঁছলো মিঃ আহাদের গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠ–এইসব দুর্গত এলাকার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত মানুষ!

সমীরের কণ্ঠ শোনা গেলো–অদ্ভুত মানুষ!

 হাঁ।

সে আবার কি রকম?

 বলবো পরে—

আর কিছু শুনতে পেলো না বনহুর, সে কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু পূর্বের মত উৎসাহ আর এলো না তার মধ্যে। অদূর থেকে ভেসে এলো নূরীর কণ্ঠস্বর কি করুণ দৃশ্য, আমি সহ্য করতে পারছি না।

বনহুর অধর দংশন করলো।

মিঃ আহাদ সমীর আর নূরী ঘুরে ফিরে দেখছেন সব।

আর একটু হলেই বনহুরের কাজ শেষ হয়। তার সঙ্গে আরও দু’জন শ্রমিক তাকে কাজে সাহায্য করছিলো। এরাও মজুর। বনহুর বললো–ভাই, বাকিটুকু তোমরা করে ফেলো।

আর তুমি কোথায় যাবে?

বড় খারাপ লাগছে আমার।

তা হবে না। পয়সা নেবে সমান সমান আর কাজ করবে না? বললো অন্য একজন মজুর।

 বনহুর বললো আমার পয়সাটাও তোমাদের দু’জনাকে দিয়ে দেবো।

এ্যা, কি বললে? তোমার পয়সাও আমাদের দুজনাকে ভাগ করে দেবে।

 হাঁ তাই দেব।

তাহলে যেতে পারো।

বনহুর আলগোছে সরে পড়তে যাচ্ছিলো, সেই মুহূর্তে পিছনে এসে দাঁড়ালেন মিঃ আহাদ কাজ শেষ হয়েছে?

ফিরে তাকালো বনহুর, হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছে বললো–অল্প বাকি আছে।

তবে চলে যাচ্ছো কেন?

সে আমার ইচ্ছা! কথাটা বলে বনহুর দ্রুত চলে গেলো সেখান থেকে।

হাসলেন মিঃ আহাদ।

নূরী বললো-ভাইজান, অমন করে হাসছেন কেন?

সেও আমার ইচ্ছা।

সমীর অবাক হয়ে বললোলোকটা কাজ বাকি রেখে চলে গেলো তার ইচ্ছায়, তুমি হাসছে তাও তোমার ইচ্ছা। এসো বোন, আমরাও চলতে শুরু করি আমাদের ইচ্ছায়।

নূরী বললো–তাই চলুন এসব দৃশ্য আমি আর দেখতে পারছি না।

যাও, তোমরা গাড়িতে দিয়ে বসো, আমি আসছি। বললেন মিঃ আহাদ।

নূরী আর সমীর এগুলো অদূরে থেমে থাকা তাদের গাড়িখানার দিকে।

মিঃ আহাদ মজুরদের একজনকে লক্ষ্য করে বললেন–এখানে যে তোমরা তিনজন কাজ করছিলে তাদের মধ্যে আর একজন কই?

হুজুর, তার বড় মাথা ধরেছে, তাই চলে গেছে। মকবুল বড় ভাল হুজুর, এতো বেলা কাজ করেছে তবু এক পয়সা নেবে না–সব দিয়ে দিবে আমাদের।

মিঃ আহাদ কুঁচকে কিছু ভাবলেন, তারপর ফিরে চললেন গাড়ির দিকে।

গাড়িতে বসে বললেন মিঃ আহাদ–এই যে অগণিত দেশ সেবক আর শ্রমিক দেখছো, এদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এমন একজন যাকে আমি খুঁজে ফিরছি। শুধু আমি নয় সমস্ত পুলিশমহল।

হ্যাঁ কি বললে? দস্যু বনহুর এই ঝড়-বিধ্বস্ত এলাকায় হানা দিতে এসেছে?

হানা দিয়ে নিতে নয়–দিতে। বললেন মিঃ আহাদ।

নূরী বনহুরের নাম শুনেই প্রথমে চমকে উঠেছিলো, পর মুহূর্তে আশ্বস্ত হলো তবু মুখে ভীতভাব টেনে বললোদস্য বনহুর এখানে এসেছে? শীগগির চলুন পালিয়ে যাই ভাইজান।

 না না, ভয় নেই নূরী দস্যু বনহুর দস্যু হলেও অমানুষ নয়। অনেক ভদ্র সে। গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে বললেন মিঃ আহাদ।

 সমীর বললো–দস্যু কোনোদিন ভদ্র হয়? এত চালাক হয়েও বোকার মত কথা বললে কিন্তু।

গাড়ি তখন ছুটতে শুরু করেছে।

 সমীরের কথায় কোনো জবাব দিলেন না মিঃ আহাদ। গাড়ি এগিয়ে চলেছে। পথের দু’ধারে যে দৃশ্য তা সত্যিই মর্মান্তিক।

বিশ্বনিয়ন্তার একি নির্মম পরিহাস। ঝড়বিধ্বস্ত এলাকার দিকে তাকিয়ে মিঃ আহাদ ভুলে গেলেন তার অস্তিত্ব। চারিদিকে শুধু করুণ হাহাকার আর অন্তর্ভেদী দীর্ঘশ্বাস। অসংখ্য ধসে পড়া ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষের পাশে অগণিত মৃতদেহ। শুধু মানুষেরই নয়জীবজন্তুর পশু পাখির লাশ বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়ে আছে।

সেচ্ছাসেবকের দল এবং সরকারের পাঠানো লোকজন এসব মৃতদেহের সংকারের ব্যবস্থা করে চলেছে। ঝড় হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে কিন্তু আজও সবগুলো মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব পর হয়ে উঠেনি। বড় বড় দালান-কোঠা আর মিল কারখানার নিচে চাপা-পড়া লাশগুলো সবেমাত্র উদ্ধার করা হচ্ছে। কারণ বহু ইট-পাথরের স্তূপের নিচে চাপা-পড়া এইসব লাশ উদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার, কাজেই বিলম্ব হচ্ছে বা হয়েছে।

ইট-পাথরের স্তূপের তলা থেকে গলিত বিকৃত মৃতদেহগুলো থেকে দুর্বিষহ দূর্গন্ধ নির্গত হচ্ছে। শ্রমিক এবং সেচ্ছাসেবকগণ নাকে গামছা বেঁধে এবং রুমাল চাপা দিয়ে কাজ করে চলেছে।

গাড়িতে বসেও নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো তাদের।

নূরীর চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো, নাকে রুমাল চাপা দিয়ে গাড়ির একপাশে বসেছিলো চুপচাপ।

গাড়ি রেখে মাঝে মাঝে নেমে হেঁটে হেঁটে দেখছিলেন মিঃ আহাদ, সমীর ও নূরী। কাউকে সহানুভূতি জানাচ্ছিলেন, কাউকে বা পকেট থেকে টাকা বের করে দিচ্ছিলেন, কিন্তু টাকা নেবার লোকও যেন নেই। সবাই প্রায় ঘর-চাপা পড়ে মরেছে যারা বেঁচে আছে তারা আহত হয়ে হসপিটালে আছে।

 নিস্তব্ধ দুপুরে শ্মশানের মতই খা খা করছে যেন চারিদিক। সবুজের চিহ্ন যেন হারিয়ে গেছে কোথায়।

ঝড়বিধ্বস্ত এলাকাগুলো দেখলে মনে হয় যেন কোনো দানব এপথ দিয়ে চলে গেছে, যার নিশ্বাসের অগ্নি হলকায় সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। বড় বড় গাছগুলো যেন সে মুচড়ে দুমড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, পথের আবর্জনার মত দূরে, বহুদূরে। বিরাট বিরাট দালান-কোঠাগুলোকেও যেন সে পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে গেছে খেলনা ঘরগুলোর মত। শুধু তাই নয়, কত ঘরের চালা গিয়ে লটকে আছে লাইটপোষ্ট আর টেলিফোনের থামের সঙ্গে। কত গাছপালার অবস্থাও তাই।

বিস্ময় বিস্ফারিত নয়নে দেখছে নূরী, হঠাৎ সে বলে উঠে–চলুন ফিরে যাই।

সমীর গলিত বিকৃত লাশগুলো লক্ষ্য করে বলে উঠলো–এই সুন্দর পৃথিবীতে সুন্দর মনুষ্য দেহগুলোর কি ভয়ঙ্কর পরিণতি। মানুষ মরে গেলে তার এতো সুন্দর দেহটার এমন বিদঘুটে অসহনীয় গন্ধ হয়, আগে জানতাম না। সত্যি বেঁচে থাকতে দেহটার কত যত্ন কত আদর স্নেহ আর পরিশেষে–

একটা ব্যথাকরুণ হাসির রেখা ফুটে উঠলো মিঃ আহাদের মুখে তিনি বললেন-সুন্দর সুগন্ধময় ফুলগুলোও শুকিয়ে গেলে গন্ধহীন হয়ে পড়ে, তখন লোকে তুচ্ছ বলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তেমনি মানুষের দেহ, প্রাণ বেরিয়ে গেলেই উচ্ছিষ্ট আবর্জনার মতই হয়ে পড়ে নিষ্প্রয়োজনীয়। চলো।

মিঃ আহাদ সমীর ও নূরী ফিরে চললো ঢাকা অভিমুখে।

*

হঠাৎ এক সময় মিঃ আহাদ বনহুরের বাংলোয় এসে উপস্থিত হলেন। আজকাল প্রায়ই তিনি আসেন তাঁর বাংলোতে। মি আলমের সঙ্গে মিঃ আহাদের বন্ধুত্ব আরও জমে উঠেছে গভীরভাবে। মাঝে আরও কয়েকদিন মিঃ আহাদ অকস্মাৎ এসে হাজির হয়েছেন।

আজও তাই মিঃ আহাদের আগমনে কিছুমাত্র বিস্মিত হলো না, তাকে অভ্যর্থনা জানালো–হ্যালো মিঃ চৌধুরী, কি খবর আজ বলুন তো?

মিঃ আহাদ আসন গ্রহণ করে বললেন–খবর নতুন কিছু নেই, তবে পুলিশমহল একটা নতুন খবর ঘোষণা করেছেন—

বনহুর একটু হেসে বললেনদস্যু বনহুরকে যে গ্রেফতার করতে সক্ষম হবে তাকে দশ হাজার টাকা দেওয়া হবে।

হাঁ, আপনি দেখছি ঘোষণাটি ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছেন মিঃ আলম।

জানা আর এমন কঠিন কি বলুন?

এখনও সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়নি কিনা তাই বলছিলাম—-বললেন মিঃ আহাদ।

সংবাদপত্র অফিসে আমি দেখেছি। বললো মিঃ আলম।

 মিঃ আহাদ সিগারেট-কেসটা বের করে বাড়িয়ে ধরলেন মিঃ আলমের সম্মুখে।

মিঃ আলম আলগোছে একটা সিগারেট তুলে নিলো আংগুল দুটো দিয়ে।

মিঃ আহাদ দেখলেন মিঃ আলমের একটা আংগুলে ব্যান্ডেজ বাঁধা বললেন–মিঃ আলম আপনার আংগুলে কি হয়েছে?

ও সামান্য একটু কেটে গিয়েছিলো মাত্র।

ঝড়-বিধ্বস্ত এলাকায় দুর্গতদের সহায়তা করতে গিয়েই বনহুরের আংগুলটা অনেকখানি কেটে গিয়েছিলো, বনহুর সামান্য বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও মিঃ আহাদের বুঝতে বাকি রইলো না। সিগারেটের ধুম্রকুন্ডলির ফাঁকে তাকালেন তিনি মিঃ আলমের মুখের দিকে।

কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন মিঃ আহাদ–আমি কিন্তু আপনার আতিথ্য প্রায়ই গ্রহণ করে থাকি

এটাতো আমার সৌভাগ্য মিঃ চৌধুরী।

আপনি কিন্তু আমাদের ওখানে মোটেই যেতে চান না। সারাটা দিন ঘরে বসে করেন কি? আসুন না একদিন আমার বোনের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবো, খুব খুশি হবে সে আপনার সঙ্গে আলাপ করে।

আপনার বোন!

হাঁ, আমার একটি বোন আছে, বড্ড মিশুক মেয়ে। সেদিন আপনি চলে আসার পর নূরী আপনার কথা শুনে অভিমান-ভরা কন্ঠে বলে ছিলো–ভাইজান, আপনার বন্ধু এলেন, কই আমার সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিলেন নাতো? তাই কথা দিয়েছি, এবার ওর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবো।

বোন! আপনার বোন?

হা।

মিঃ আহাদ লক্ষ্য করলেন, মিঃ আলমের চোখ দুটো যেন অকস্মাৎ আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারলেন যে ঔষধ তিনি প্রয়োগ করতে চান তা কার্যকরী হবে। তরুণ মিঃ আলমকে তিনি কৌশলে আয়ত্তে এনে তার ভিতরের রহস্য উদঘাটন করতে চান।

সেদিন আর বেশি বিলম্ব না করে মিঃ আহাদ উঠে পড়লেন। ফিরে এলেন বাসায়।

গভীর রাতে পায়চারি করছেন, সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছেন মিঃ আহাদ। কি তিনি ভাবছেন তিনিই জানেন। কয়েকখানা কাগজ তিনি বের করে টেবিলে মেলে ধরলেন, দেওজীর পঞ্চাশ হাজার টাকা লুট হবার ঠিক তিনদিন পর হয়েছিলো হাফিজ চৌধুরীর বাড়িতে ডাকাতি। তারপর আরও দু’তিন জায়গায় যে-সব দস্যুতা হয়েছে, সব জায়গাতেই দস্যু বনহুরের নিজ হস্তে লেখা চিঠি। পাওয়া গেছে।

 মিঃ আহাদ কি যেন ভাবছেন, তারপর কাগজপত্রগুলো ভাঁজ করে পকেটে রেখে সমীরের কক্ষের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিলেন-সমীর, সমীর–

আচমকা ঘুম ভেঙে গেলো সমীরের, চটপট দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে বললো–কি ব্যাপার এভোরাতে ঘুমাওনি?

তুমি ঘুমিয়েছো সেই ভাল, শীগগির তৈরি হয়ে নাও, বেরুবো।

 না, তুমি আমায় জ্বালিয়ে মারলে আহাদ। নিশ্চিন্ত মনে যে একটু ঘুমাবো তাও হবে না।

 দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করে যদি দশহাজার পেতে চাও তাহলে উঠে পড়ো।

ওঃ বুঝেছি দশ হাজারের লোভে তোমার চোখে ঘুম হচ্ছে না।

টাকার লোভ কার না আছে বন্ধু, কিন্তু তার চেয়ে বেশি লোভ আমার দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করা। নাও, চটপট তৈরি হয়ে নাও।

কোথায় যাবে এখন? বললো সমীর।

মিঃ আহাদ বললেন–গেলেই বুঝতে পারবে। এসো আমার সঙ্গে।

তারপর মিঃ আহাদ আর সমীর ড্রেসিং রুমের মধ্যে প্রবেশ করলেন। যখন তারা বেরিয়ে এলেন তখন তাদের দেহে সম্পূর্ণ মাড়োয়ারীদের ড্রেস। মিঃ আহাদ হাতঘড়িটা দেখে নিলেন রাত একটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট হয়েছে।

গাড়িতে চেপে বসলেন মিঃ আহাদ আর তার সহকারী সমীর।

গাড়ি ঢাকা শহরের রাজপথ বেয়ে ছুটতে শুরু করলো।

সমীর বললো–তোমার হেয়ালীপূর্ণ ভাবধারা বুঝবার জো নেই। মেহেরবানী করে বলবে কি এখন এই মাড়োয়ারী বাবুর ড্রেসে কোথায় চলেছে?

দেওজী বাবুর ওখানে।

 দেওজী বাবু! যার পঞ্চাশ হাজার টাকা হরণ করে নিয়েছে দস্যু বনহুর?

হাঁ। আমি তার ভাই সীতারাম দেওজী আর তুমি আমার একজন সহকারী রামসিং, বুঝলে?

কিন্তু—-

তীরবেগে।

কোনো কিন্তু নেই, তোমাকে যেভাবে চলতে বলবো সেইভাবে চলবে।

আমার কিন্তু খুব ভাল লাগছে না তোমার কার্যকলাপ।

কেন?

দেশে এলে বিয়ে করবে বলে, কিন্তু বিয়ের মহরৎ বন্ধ রেখে আবার কাঁধে নিলে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারের দায়িত্বভার।

মন্দ কি, বিয়ের আগে যদি দশহাজার টাকা পেয়ে যাই।

ক্ষুব্ধস্বরে বললো সমীরও আমি জানি, টাকার মোহ যে তোমার কত আছে আমাকে বলতে হবে না। নিজের সম্পত্তির লক্ষ লক্ষ টাকা তুমি হাসিমুখে বিলিয়ে দাও অপরের উপকারে আর কিনা দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করে তুমি টাকা নেবে—হাসালে বন্ধু হাসালে।

চুপ। আমাদের পিছনে আর একটা গাড়ি আসছে না?

হাঁ, একটা গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু অনেক দূরে গাড়িটা আছে।

 খুব দ্রুত গাড়িখানা এগিয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে। যেন দুটো আলোর বল ছুটে আসছে।

 মিঃ আহাদ এবার গাড়ির স্পীড আরও বাড়িয়ে দিলেন। কিছুদুর অগ্রসর হবার পর গাড়িখানাকে একটা গলির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিলেন তিনি। গলিপথটা ছিলো বেশ অন্ধকার। মিঃ আহাদ গাড়ি থামিয়ে আলো নিভিয়ে ষ্টার্ট বন্ধ করে দিলেন। স্তব্ধ নিঃশ্বাসে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন তিনি। স্পষ্ট দেখলেন একখানা গাড়ি চলে গেলো সম্মুখ রাস্তা দিয়ে।

গাড়িখানা চলে যেতেই মিঃ আহাদ নিজের গাড়িখানাকে বের করে আনলেন গলিপথ থেকে।

সম্মুখস্থ গাড়িখানা তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

মিঃ আহাদ গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে সম্মুখের গাড়িখানাকে ফলো করলেন।

বেশ দূরত্ব রেখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন মিঃ আহাদ।

এবার হঠাৎ গাড়িখানা সামনের বাঁকে অদৃশ্য হলো। মিঃ আহাদ হতাশ কণ্ঠে বললেন–সামনের গাড়ির চালক টের পেয়েছে।

মানে আমরা তাদের ফলো করছি জানতে পেরেছে।

এটাই কি দস্যু বনহুরের গাড়ি?

না।

তবে কার?

দেওজীর।

বল কি, দেওজী পঞ্চাশ হাজার টাকা হারিয়েও এতোরাতে গাড়ি নিয়ে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?

না বেড়িয়ে যে উপায় নেই।

 মিঃ আহাদের গাড়ি এবার এসে একখানা বাড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে পড়লো।

 বাড়ি নয়, পাশাপাশি কয়েকখানা গুদামঘর যেন।

একটা গাড়ি কেবলমাত্র ওদিকে ভাঙাচুরো একটা টিনের গ্যারেজের মধ্যে উঠছিলো।

 এমন সময় মিঃ আহাদের গাড়ি এসে বাড়িটার সামনে থামলো।

 কে একজন ভিতর থেকে বললো–তুমলোক কোন্ হ্যায়?

 সমীর কোনো জবাব দিতে যাচ্ছিলো।

 মিঃ আহাদ মুখে হাতচাপা দিলেন, তারপর বললেন–হ্যামলোক দেওজী বাবু কা ছোটা ভাই।

লোকটা এবার শশব্যস্তে এগিয়ে এলো–আইয়ে ছোটা বাবু! আইয়ে আপনোক—

মিঃ আহাদ আর সমীর অগ্রসর হলো লোকটার পিছুপিছু। একটা মস্তবড় ঘরের মধ্যে লোকটা প্রবেশ করে বললো–আপনোক কা নাম বলিয়ে হাম বাবুজীকে সামঝাইজে।

বলো সীতারাম দেওজী আয়া আওর রামসিং। যাও, জলদী বল।

 লোকটা চলে গেলো।

 মিঃ আহাদ আর সমীর আসন গ্রহণ করলো।

চুন-বালি খসে-পড়া পুরোনকালের বাড়ি। ঘরখানা একেবারে স্যাঁতসেতে ধরনের। মস্তবড় ঘর অথচ মাত্র ছোট্ট দুটি জানালা। তাও জানালায় মোটা কাপড়ের পর্দা ঝুলছে।

দেয়ালে কতকগুলো দেবদেবীর পুরোন ছবি। একপাশে একটা তাকে সিঁদুর মাখা গণেশ ঠাকুর রাখা হয়েছে। ঘরখানার প্রায় বারো-তেরোখানা চেয়ার রয়েছে। চেয়ারগুলো নতুন না হলেও মজবুত বটে। হাতল আর পিছন দিকগুলো তেলে তেলে পেকে উঠেছে যেন। একপাশে একটা ভোষক পাতা তাতে একটা চাদর বিছানো আছে। কিন্তু আসলে চাদরখানার কি রং বুঝা মুস্কিল তবে মনে হয় সাদাই ছিলো এখন চাদরখানার রং তৈলচিটে হতে হতে প্রায় হলদে কালচে হয়ে উঠেছে। বিছানার উপর কয়েকটা বালিশ গোছানো রয়েছে, বালিশগুলোর অবস্থাও তাই। সাদা কভার তৈলচিটে হয়ে উঠেছে।

 সমীর বললো–শালা মাড়োয়ারী জাতটাই নেষ্টি–

ঠিক সেই মুহূর্তে শোনা গেলো একটা আনন্দভরা কণ্ঠ-আরে তুমলোক আগিয়া ভাই সীতারাম

একটা ভুড়ি-মোটা লোক এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে। লোকটার চোখে ঘুমের জড়তা নেই। মিঃ আহাদ আর সমীর বুঝতে পারলো, এই লোকটাই এক্ষুণি গাড়ি নিয়ে ফিরে এলো শহর থেকে এবং এই লোকটার নামই দেওজী, যার পঞ্চাশ হাজার এখন দস্যু বনহুরের করায়ত্তে।

মিঃ আহাদ এবং সমীরের দেহেছিলো নিখুঁত মাড়োয়ারীর ড্রেস। দেওজীর মনে কোনো সন্দেহ জাগলো না এদের দেখে। দেওজী প্রায় বিশ বছর হলো দেশছাড়া সে বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ে মেতে থাকে, তাই দেশে যাওয়া আর হয়ে উঠে না। পুরো আঠারো বছর সে ভারতে ব্যবসা করতো, সম্প্রতি দু’বছর হলো ঢাকায় এসে বসেছে। দেওজীর জন্মস্থান দিল্লীর ওদিকে কোনো এক শহরে কিন্তু তার বাপ-মা-ভাই-বোন সবাই নাকি লাহোরে বসবাস করেন প্রায় বহুদিন থেকে। কাজেই দেওজীর সঙ্গে আপনজনদের দেখা সাক্ষাৎ অনেকদিন যাবত হয় না। ছোট ভাই সীতারামকে সে দেখে এসেছিলো তখন তার বয়স ছিলো চার কিংবা পাঁচ বছর। তারপর কেটে গেছে বহুদিন–সেই সীতারাম আজ তার সম্মুখে এসে হাজির হয়েছে, এ কম কথা নয়। আত্মহারা দেওজী জড়িয়ে ধরলো—-ভাই, তোম বলো মাতাজী পিতাজীকা তবিয়ৎ ভালাতো?

মিঃ আহাদ যেন খুশিতে আনন্দ-অশ্রু ফেলছেন তেমনি বাষ্পভরা গলায় বললেন পিতাজীকা তবিয়ৎ আচ্ছি নেহি ভাইয়া তুমকো দেখনে কেলিয়ে বহুত পেরেশান হায়। আওর মাতাজীতি উইছি। একবার দেহাদমে চলো না ভাইয়া?

হা সীতারাম এবার দেহাদমে যানে কে লিয়ে হামারা বহুৎ জরুরি হ্যায়।

এ কথা-সে কথার মধ্যে দিয়ে মিঃ আহাদ দেওজীর ভিতরে গভীরভাবে প্রবেশ করলেন।

দেওজী জিজ্ঞাসা করে বসলো তার চিঠিখানা পেয়েছিলো কিনা।

 মিঃ আহাদ জানালেন–হাঁ ভাইয়া আপকা দিয়া হুয়া খত তো হাম পালিয়া।

মিথ্যা নয়, মিঃ আহাদ দেওজীর একখানা চিঠি কৌশলে সগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, এবং সেই চিঠিখানাই হলো দেওজী তার ভাইকে চলে আসার জন্য অনুরোধ করে লিখেছিলো।

সেদিন রাতে বেশিক্ষণ আর আলাপ-আলোচনা হলো না, দেওজী দেশের আর দু’চার কথা জিজ্ঞাসা করে চাকরকে ডেকে তাদের খাবার ও শোবার ব্যবস্থা করে দিয়ে চলে গেলো।

একজন লোক এলো খাবার কথা বলতে, সমীর নাক ধরে বলে উঠলো–তুম যাও তো আমি কিছু খাবো না–

এই সেরেছে! চাপাকণ্ঠে বললেন মিঃ আহাদ, পরক্ষণেই হিন্দি ভাষায় বললেও তুম খানা লে আও।

চলে গেলো লোকটা।

 সমীর মুখ ভেটকে বললো–ছিঃ ছিঃ ছিঃ তুমি খাবে?

না খেয়ে কোনো উপায় নেই, বুঝলে?

কি বিশ্রী বিদঘুটে গন্ধ লোকটার গায়ে, আর তার হাতের খাবার খাবে? আমার তো পেটের নাড়ীভুড়ি সব বেরিয়ে আসতে চাইছে বিদঘুটে গন্ধে। কতদিন এরা গোসল করে না—

চুপ করে মুখ বুজে চারটি মুখে গুঁজে দাও।

 সন্ধ্যায় পেট পুরে খেয়ে ঘুমিয়েছি, খাবো কোন পেটে।

আজকের প্লেনে এলে না খেলে চলবে কি করে?

 তার মানে?

 মানে পরে শুনো, খেয়ে নাও দড়বড়।

একটু পরেই লোকটা খানকয়েক আটার রুটি আর আলু-বেগুনের লারা তরকারি এনে রাখলো তাদের সম্মুখে।

সমীরের চোখ তো ছানাবড়া হা হয়ে গেছে তার মুখমন্ডল ভয়ে আঁতকে উঠে বলে–নাও এবার খাও–

চট করে মিঃ আহাদ বাম হাতে তার মুখ চেপে ধরে–তুম্ সবকুছ মাটি করনে কেলিয়ে বাংলা বাত বোল্তা। দেখো বয় ইছিকো বাত তুম্ সাম্ঝাতা নেহি?

হাঁ হামভি থোরা থোরা বাংলা বলনে শিখা। দাঁত বের করে হাসলো লোকটা।

মিঃ আহাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, যাক, লোকটা তাহলে তেমন বুদ্ধিমান নয়।

 কোনোরকমে খানিকটা রুটি নাকেমুখে গুঁজে শুয়ে পড়লেন মিঃ আহাদ আর সমীর।

 সেকি বিছানায় গন্ধ, যেন নাড়ী ভুড়ি বেরিয়ে আসতে চাইছে।

মিঃ আহাদ আর সমীর শুয়ে পড়লেন, চাকরটা আলো নিভিয়ে চলে গেলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকতে শুরু করলো সমীরের।

মিঃ আহাদ চাদর সরিয়ে উঠে পড়লেন, অন্ধকারে এগিয়ে চললেন দেওজীর কক্ষের দিকে। কক্ষমধ্যে তখনও আলো জ্বলছে। কিন্তু কক্ষের চারপাশের দরজা-জানালা ভালভাবে বন্ধ করা। সামান্য ফাঁক দিয়ে যে আলোকরশ্মি বেরিয়ে আসছিলো সেই ফাঁকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মিঃ আহাদ। কক্ষমধ্যে আলোটা ডিম জ্বলছে, কাজেই স্পষ্ট কিছু দেখতে পেলেন না, শুধু শুনতে পেলেন কার সঙ্গে যেন আলাপ আলোচনা হচ্ছে।

সব শুনে নিলেন মিঃ আহাদ, অন্ধকারে তাঁর মুখমন্ডল গম্ভীর কঠিন হয়ে উঠলো। ফিরে এলেন তিনি নিজ শয্যার পাশে। সমীরের গায়ে ধাক্কা দিয়ে চাপাকণ্ঠে ডাকলেন সমীর, উঠে পড়ো।

সমীর সবেমাত্র আরামে ঘুমিয়েছে, বিরক্তিপূর্ণভাবে বললো–আঃ আবার জ্বালাতন করছ?

 উঠে পড়ো, কাজ শেষ হয়েছে।

 কাজ শেষ হয়েছে মানে?

মানে পরে বলবো। নাও চলো।

 মিঃ আহাদ আর সমীর ফিরে এলো তাদের গাড়িতে। গাড়ি ছুটে চলেছে, হাতঘড়িতে দেখলেন মিঃ আহাদ রাত তখন পাঁচটা বেজে গেছে।

বাসায় ফিরে ড্রেস পাল্টে নিয়ে যখন কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন তখন ভোর হয়ে গেছে।

 মুখোমুখি দুটো সোফায় বসলেন মিঃ আহাদ আর সমীর। উভয়ের চোখমুখ নিদ্রা জাগরণে কিছুটা রুক্ষ লাগছে। মিঃ আহাদ এতটুকুও ঘুমাননি, তাঁর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে।

সমীর বললো–বলো অহেতুক রাতদুপুরে মাড়োয়ারী বাবু সেজে দেওজীর বাড়ি অতিথি হবার কি কারণ ছিলো?

শুধু দেওজী নয় সমীর, আজ কদিন হলো আমি প্রতি রাতে বাইরে বেরিয়েছি।

 বুঝেছি-রাণীর খোঁজে?

না তা নয়।

তবে দস্যু বনহুরের সন্ধানে?

না।

তবে?

 দস্যু বনহুর যাদের অর্থ হরণ করেছে তাদের গোপন রহস্য উদ্মাটনে।

এ তুমি কি বলছো আহাদ? দেখছি গোয়েন্দাগিরী করতে গিয়ে তোমার মাথা খারাপ হয়েছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করে মিঃ আলমবন্ধু মাথা খারাপ হলে সবার মাথাই যে ঘোল হয়ে যাবে।

আরে মিঃ আলম, আসুন আসুন—

 মিঃ আহমদ আর সমীর হ্যান্ডশেক করলেন মিঃ আলমের। সাথে আসন গ্রহণ করলো মিঃ আলম।

মিঃ আহাদ ও সমীর পুনরায় আসন গ্রহণ করলেন।

 মিঃ আলমই বললো–হঠাৎ এসে আপনাদের আলাপে ব্যাঘাত ঘটালাম না তো?

মিঃ আহাদ একটু হেসে বললেন–মোটেই না, বরং এসেছেন যখন ভালোই হলো, একসঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা যাবে।

সমীর বললো–চা-নাস্তার অর্ডার দিয়ে আসি।

 মিঃ আহাদ বললেন–যাও, চা-নাস্তার অর্ডার দিয়ে এসো আর বোনকে ডেকে এনো, মিঃ আলমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো।

মনে মনে খুশি হলো আলম, কারণ সে জানতে পেরেছে মুরীর সঙ্গে মিঃ আহাদের সম্পর্ক ভাই বোনের–শুধু তাই নয়, সে নিজেও গোপনে সন্ধান নিয়ে জেনেছে। মিঃ আহাদ সত্যিই একজন মহৎ ও সৎ ব্যক্তি। পূর্বদিনের মত আজ মিঃ আলমের মুখ গম্ভীর ভাবাপন্ন নয়, সচ্ছভাবে হেসে হেসে কথাবার্তা বলছে সে।

একটু পরেই সমীর আর নূরী প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে। পিছনে বয়ের হাতে চা-নাস্তার ট্রে।

 নূরী কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই দৃষ্টি বিনিময় হলো।

নূরীর মনে একটা দ্বিধা আর সঙ্কোচ ভাব ছিলো, তার জন্য চট করে চোখ দুটো নত করে নিলো সে।

মিঃ আহাদ বললেন–দূরী, লজ্জার কিছু নেই, ইনি আমাদের বন্ধু মিঃ আলম।

নুরী আস্তে হাতখানা তুলে আদাব করলো।

 মিঃ আলম বেশে দস্যু বনহুরও মাথা নত করে আদাব গ্রহণ করলো।

 সমীর চা তৈরি করতে যাচ্ছিলো।

মিঃ আহাদ বললেন–সমীর, আজ তুমি নও বোন নূরী আমাদের চা-নাস্তা পরিবেশন করে খাওয়াবে।

নূরীই চা তৈরি করতে এগিয়ে এলো।

মিঃ আহাদ বললেন–আমার বোনের নাম মিস নূরী।

 হাসলো মিঃ আলম।

নূরীর মুখে অবশ্য হাসি ফুটলো না, কারণ সে অপরাধী। মাথা নিচু করে চা নাস্তা পরিবেশন করছিলো।

সমীর বললো–আমাদের বোনটি বড় লজ্জাবতী কিন্তু!

মিঃ আলম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললোলজ্জা নারীর ভূষণ মিঃ কুমার।

ঠিক বলেছেন মিঃ আলম, মেয়েদের লজ্জাই অলঙ্কার।

চা নাস্তা পান চলেছে, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো সশব্দে ক্রিং ক্রিং করে।

মিঃ আহাদ ফোন ধরলেন–হ্যালো, স্পিকিং আহাদ চৌধুরী। কি বললেন আজ রাতে দেওজীর বাড়িতে দস্যু বনহুর হানা দিয়েছিলো? হ্যালো–হ্যালো কি বললেন অতিথি—-এ্যা, ভাই সেজে অতিথি হয়েছিলো দস্যু বনহুর–কিছু নিয়ে যায়নি তো আজ—নেয়নি কিছু? যাক বাঁচালেন তবু—আচ্ছা আসছি–আচ্ছা আচ্ছা, এখুনি তৈরি হয়ে আসছি, ধন্যবাদ।

রিসিভার রেখে দিলেন মিঃ আহাদ।

নূরী আর মিঃ আলম এবার দৃষ্টি বিনিময় হলো। নূরী দেখলো তার হুরের মধ্যে নেই কোনোরকম অভিমান-ক্ষুব্ধ ভাব। সরল সচ্ছ স্বাভাবিক সে চাহনী। নূরীর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে গেলো যেন ধীরে ধীরে। শোহেলীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার জন্যই নূরী রাগ করেনি, যে দিন সে নিজের চোখে দেখেছিলো শোহেলী তার বনহুরের বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে তাইতো সে সহ্য করতে পারেনি–চলে এসেছিলো যেদিকে দৃষ্টি যায় চলে যাবে বলে। কিন্তু সবই দয়াময়ের ইচ্ছা, চলে এলেও একটি দিনের জন্য নূরী মনে শান্তি পায়নি। অহরহঃ সে দগ্ধীভূত হয়েছে তুষের আগুনে। আজ তার হুরকে পেয়ে আনন্দে আপ্লুত হয়েছে সে।

মিঃ আহাদ রিসিভার রেখে বললেন–পুলিশ অফিস থেকে ফোন করেছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ হাফিজ। আজ আবার নাকি দেওজীর বাড়িতে দস্যু বনহুর অতিথি হয়েছিলো।

 সমীর কিছু বলতে যাচ্ছিলো, মিঃ আহাদ তাকে ইংগিতে থামিয়ে দিলেন। বললেন মিঃ আহাদ আজ দস্যু বনহুর দেওজীর বাড়িতে অতিথি হলেও কেনো উপদ্রব করেনি। দেওজী নাকি ভয়ানক ঘাবড়ে গেছেন এ ব্যাপারে। মিঃ আলম,চলুন না দেওজীর মুখে সব শুনে আসি।

আমি।

হাঁ চলুন, দেওজী এখন পুলিশ অফিসে অপেক্ষা করছেন।

 তা চলুন।

 সমীর বলে উঠলো–উনি এলেন বসে দু’চারটে গল্পসল্প করবো তা না

হবে হবে, আবার আসবে উনি। তারপর নূরীর দিকে তাকিয়ে বললেন–বোন, তুমিও যাবে কি আমাদের সঙ্গে?

নূরী বললো–যদি অসুবিধা না হয়—

বেশ বেশ চলো। যাও, তৈরি হয়ে চলে এসো। বললেন মিঃ আহাদ।

 সমীর একটু ক্ষুব্ধ হলো, এই সকালটা আবার ছুটোছুটি করে কাটাতে হবে বলে।

 নূরী মনে মনে খুশি হলো, তার হুরকে যেতে হচ্ছে, কাজেই তারও যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।

 অল্পক্ষণের মধ্যেই নূরী তৈরি হয়ে ফিরে এলো।

মিঃ আহাদ নূরীকে তার পাশে বসিয়ে নিলেন সমীর চড়ে বসলো মিঃ আলমের গাড়িতে।

পুলিশ অফিসে পৌঁছাতে বেশি বিলম্ব হলো না তাদের। অফিসে পৌঁছতেই মিঃ হাফিজ সসম্মানে অভ্যর্থনা জানালেন।

 ইন্সপেক্টার মিঃ হাফিজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন মিঃ আহাদ মিঃ আলমের এবং বললেন– ইনি আমাকে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারে সহায়তা করবেন।

ইন্সপেক্টার অত্যন্ত খুশি হলেন, হ্যান্ডশেক করলেন তিনি মিঃ আলমের সঙ্গে। সমীরের সঙ্গে পূর্ব হতেই আলাপ পরিচয় ছিলো কাজেই মিঃ আলম এবং নূরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

 দেওজী মিঃ আহাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি এদের দেখে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন–আজ রাতে আমার ভাই সেজে এক লোক গিয়ে হাজির হয়েছিলো, সঙ্গে তার আর একজন ছিলো। আমি বহুদিন দেশে যাইনি, আমার ছোট ভাইকে দেখিনি প্রায় বিশ বছর, কাজেই আমি সেই লোককে ভাই বলে মনে করি এবং আদর যত্নে আমার বাড়িতে আশ্রয় দেই কিন্তু ভোরে দেখি কেউ নেই–উধাও।

মিঃ আহাদ গম্ভীর মুখে বলেন–আশ্চর্য বটে!

 স্যার, দস্যু বনহুর ছাড়া এ অন্য লোক নয়।

সে যে দস্যু বনহুর তা কেমন করে বুঝলেন?

তাদের চাল-চলন, আচার-ব্যবহারে আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। দস্যু বনহুর, আমার বাড়িতে অতিথি সেজে আমার সবকিছু গোপনে জেনে এসেছে।

হুঁ, বললেন মিঃ আহাদ।

মিঃ আলম কথাগুলো মনোযোগে সহকারে শুনছিলো, তার মুখমন্ডল গম্ভীর হলো, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো সে মিঃ আহাদের মুখে। মিঃ আলম দেখলো মিঃ আহাদের ললাটে মিশে যাওয়া একটা চন্দনের টিপের দাগ। অত্যন্ত ভালভাবে লক্ষ্য না করলে কেউ দাগটা বুঝতে পারবে না।

বনহুরের ঠোঁটের কোনো একটা ক্ষীণরেখা ফুটে উঠে মিশে গেলো।

দেওজী তখন ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে চলেছেন–দেখুন ইন্সপেক্টার সাহেব, নিশ্চয়ই দস্যু বনহুর পুনরায় আমার বাড়িতে হানা দেবে হাতে কোনোসন্দেহ নেই, আপনারা আমাকে রক্ষা করবেন। পঞ্চাশ হাজার টাকা হারিয়েছি আবার যদি দস্যু হানা দিয়ে আমার সব নিয়ে যায় তাহলে আমি বাঁচবোনা স্যার।

মিঃ আহাদ অবাক হলেন তিনি এর পূর্বে জানতেন না দেওজী মাড়োয়ারী এতো সুন্দর বাংলায় কথা বলতে পারে।

সব শুনে নিয়ে মিঃ আহাদ ভরসা দিলেন–দস্যু বনহুর যাতে পুনরায় আপনার অর্থ হরণ করতে না পারে সেদিকে পুলিশবাহিনী সতর্ক খেয়াল রেখেছেন এবং রাখবেন।

দেওজীকে আশ্বাস দিলেন মিঃ আহাদ। পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ হাফিজও যতদূর সম্ভব ভরসা দিলেন, দস্যু বনহুর যাতে আর কোনো রকম হামলা চালাতে না পারে সেদিকে তাদের নিপুণ দৃষ্টি থাকবে।

 এমন সময় পুলিশ সুপার স্বয়ং এলেন পুলিশ অফিসে। মিঃ আহাদ মিঃ আলম, সমীর কুমার ও নূরীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চললো। মিঃ আহাদ যখন জানালেন দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারে মিঃ আলম তাদের সাহায্য করবেন তখন তিনি খুশি হলেন।

কিন্তু শত চেষ্টা করেও পুলিশবাহিনী বা মিঃ আহাদ চৌধুরী দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারে সক্ষম হলো না।

সেইদিন রাতে পুনরায় হানা পড়লো গ্রীন হাউসে। প্রায় লক্ষ টাকা হরণ করে নিয়ে গেলো দস্যু বনহুর। এতো পাহারা মোতায়েন থেকেও পুনরায় দস্যুর হানা–ভীষণ এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো শহরময়।

শহরে যখন গ্রীন হাউস নাইট ক্লাবের লক্ষ টাকা লুণ্ঠন নিয়ে তোড়জোড় পড়ে গেলো তখন বনহুর ঘূর্ণি-বিধ্বস্ত এলাকাগুলো নিয়ে মেতে উঠেছে। শুধু ঢাকার আশেপাশেই নয়, বিভিন্ন জেলার ঘূর্ণি-বিধ্বস্ত এলাকায় বিভিন্ন রূপ নিয়ে সে দুর্গত জনগণের মধ্যে অর্থ সাহায্য করে চলেছে।

সেকি মহান মহৎ অপূর্ব হৃদয়ের পরিচয়।

শত শত অর্থ বনহুর বিলিয়ে দিচ্ছে এইসব অসহায় লোকদের মধ্যে। তখন তার কোনোদিকে চাইবার সময় নেই, ভাববার সময় নেই কিছু। অসহায় নিঃসঙ্গ দুঃস্থদের পাশে বন্ধু হয়ে কাজ করে চলেছে।

*

মিঃ আহাদ একসময় নূরীর কক্ষে প্রবেশ করে স্থিরকণ্ঠে ডাকলেন বোন।

বলুন ভাইজান?

একটা কাজ তোমাকে করতে হবে, জানি তুমি পারবে।

 বলুন?

তোমাকে অভিনয় করতে হবে।

অভিনয়! চমকে উঠলো নূরী–অভিনয় সে একবার করেছিলো চিত্রজগত সম্বন্ধে তার কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু অভিনয় সে আর করবেনা, তার হুর পছন্দ করে না এসব।

মিঃ আহাদ হেসে বললেন চিত্রজগতের অভিনয় নয় বোন, বাস্তব অভিনয়।

বিস্মিত চোখ দুটো তুলে তাকালো নূরী মিঃ আহাদের মুখের দিকে। মিঃ আহাদ বললেন–মিঃ আলমকে তোমার কেমন মনে হলো বোন?

মাথা নিচু করে বললো নূরী–আপনার বন্ধু, আপনার মতই সজন হবেন বলেই মনে হলো।

হাঁ, আমিও তাই মনে করি, তবে আমার একটু কেমন যেন সন্দেহ হয়—থামলেন মিঃ আহাদ, তারপর অতি নিম্ন স্বরে বললেননূরী, তোমাকে একটা মিথ্যা অভিনয় করতে হবে, গভীরভাবে প্রবেশ করতে হবে মিঃ আলমের মধ্যে জানতে হবে তার আসল পরিচয়। বলো পারবে? পারবে তুমি আমাকে এটুকু সাহায্য করতে।

পারবো। বললো নূরী।

মিঃ আহাদ নূরীর হাত মুঠায় চেপে ধরলেন–বোন, তোমার উপকারের কথা আমি কোনোদিন তাহলে ভুলবো না।

ভাইয়া, মনে রাখবেন আমি আপনার বোন, বিশ্বাস রাখবেন আমার উপর।

হাঁ তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই আজ এতোবড় একটা দায়িত্ব আমি তোমার উপর ছেড়ে দিচ্ছি। দেখো নূরী, মিঃ আলম কিন্তু অত্যন্ত চালাক এবং বুদ্ধিমান লোক।

যত বুদ্ধিমানই হোক আমি তার ভিতরের রহস্য উদ্মাটন করবোই করবো।

নূরী!

ভাইজান!

চলো বোন একবার ঘুরে আসি।

কোথায় যাবেন?

মিঃ আলমের ওখানে।

 চলুন! খুশি হলো নূরী।

আজ কদিন হলো নতুন ড্রাইভার এসেছে। পাঠান ড্রাইভার–অত্যন্ত বিশ্বাসী, প্রভুভক্ত।

গাড়িতে চড়ে বসে মিঃ আহাদ বললেন–চলো কমলাপুর।

মিঃ আলমের বাসাটা কমলাপুর এলাকায়।

ড্রাইভার পূর্বে একদিন মিঃ আলমের বাসায় গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলো তাই সে এপথ চেনে, অসুবিধা হলো না কিছু।

কিন্তু আলম সাহেবের বাসায় পৌঁছে মিঃ আহাদ আর নূরী বিমর্ষ হলো ঘরের দরজায় তালা লাগানো রয়েছে।

গম্ভীর হলো মিঃ আহাদের মুখমন্ডল।

তখনকার মত ফিরে চললেন মিঃ আহাদ নূরীসহ।

গাড়িতে বসে বললেন মিঃ আহাদ–আমার যা সন্দেহ হয়েছিলো তাই সত্য হলো। জানো নূরী,সে এখন কোথায়?

আমি কেমন করে জানবো ভাইজান।

তোমাকে জানতে হবে। নূরী অবাক হয়ে তাকালো।

মিঃ আহাদ বললেন–কয়েকদিন আগে গ্রীন হাউস নাইট ক্লাবে দস্যু বনহুর হানা দিয়ে লক্ষ টাকা নিয়ে গেছে।

হাঁ শুনেছি, আরও শুনেছি দেওজীর বাড়িতে দস্যু বনহুর নাকি অতিথি সেজে একরাতে আশ্রয় নিয়েছিলো।

 কোনো জবাব না দিয়ে হাসলেন মিঃ আহাদ।

নূরী বললো–দস্যু বনহুর কি ভয়ঙ্কর মানুষ, এমন দুর্দান্ত ডাকুর নাম আমি কোনোদিন শুনিনি। লক্ষ লক্ষ টাকা লুটে নিয়েও যার তৃপ্তি হয় না।

মিঃ আহাদ বললেন নূরী, তুমি দস্যু বনহুর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত নও তাই এ কথা বলছে। এই সুন্দর পৃথিবীর বুকে সে একটি মহান সৃষ্টি।

তবে সে দস্যুতা করে কেন?

 নিজের প্রয়োজনে নয়, দশের কল্যাণে।

ভাইয়া—অস্ফুট ধ্বনি করে উঠে নূরী বিশ্ববিখ্যাত ডিটেকটিভ মিঃ আহাদ চৌধুরীর মুখে তার হুরের সম্বন্ধে এমন একটা উক্তি তার অন্তরে অনাবিল এক আনন্দ এনে দেয়, খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠে সে। বলে নূরী-দশের কল্যাণই যদি তার উদ্দেশ্য তবে সে—

নূরীর কথা শেষ হয় না, তাদের গাড়ির সম্মুখে এসে হাত তুলে দাঁড়িয়েছে তার বাড়ির চাকরটা।

 গাড়ি থামিয়ে ফেলে ড্রাইভার।

মিঃ আহাদ বললেন–আরে তুমি।

হাঁপাতে হাঁপাতে বললো চাকরটা–হুজুর পুলিশ অফিস থেকে ফোন এসেছে।

মিঃ আহাদ গম্ভীর রাগতকণ্ঠে বললেন–তা ফোন এসেছে সে জন্যই এমন দৌড়ে জানাতে আসছো?

হুজুর, দস্যু বনহুর নাকি গ্রেফতার হয়েছে।

 দস্যু বনহুর গ্রেফতার হয়েছে? বল কি?

তাইতো ছুটে আসছি—

 চমকে উঠলো নূরী, ফ্যাকাশে বিবর্ণ হলো তার মুখমন্ডল।

 মিঃ আহাদ বললেন–উঠে পড়ো হামিদ।

 মিঃ আহাদের চাকরের নাম হামিদ ছিলো।

 ড্রাইভারের পাশে হামিদ উঠে বসলো।

 মিঃ আহাদ বললেন–ড্রাইভার, চলো পুলিশ অফিসে।

গাড়িখানা এবার পুলিশ অফিস অভিমুখে ছুটে চললো।

পুলিশ অফিসে পৌঁছে মিঃ আহাদ আর নূরী অফিসের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

মিঃ হাফিজ মিঃ আহাদের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন–মিঃ চৌধুরী দস্যু বনহুর সন্দেহে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে; সেই দস্যু বনহুর কিনা এখনও সঠিক সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছতে পারিনি।

মিঃ আহাদ বললেন–কোথায় তাকে রাখা হয়েছে?

মিঃ হাফিজ বললেন–হাজতকক্ষে।

হঠাৎ মিঃ আহাদের দৃষ্টি চলে গেলো ওদিকের চেয়ারে বসে আছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক এবং তার পাশে এক যুবতী।

 মিঃ হাফিজ বললেন–মিঃ চৌধুরী এদের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেই আসুন।

নূরীর দৃষ্টি ওদের উপর পড়তেই চমকে উঠলো, এ যে সেই মিসেস শোহেলী আর তার স্বামী রায় বাবু অর্থাৎ নিজাম হোসেন। মিসেস শোহেলীর উপর নজর পড়তেই নূরীর সমস্ত দেহে যেন আগুন ধরে গেলো। মেয়েটার জন্যই সে তার হুরকে ত্যাগ করে পালিয়েছিলো। নির্লজ্জ বেহায়া কোথাকার। নূরীর। মুখ গম্ভীর হয়ে উঠলোসে মনে করলো, নিশ্চয়ই তার হুরকে এরা চিনতে পেরেছে এবং দশ হাজার। টাকার লোভে তাকে ধরিয়ে দিয়েছে পুলিশের হাতে। অতিকষ্টে নূরী নিজকে সংযত করে রাখলো।

 কখন যে তাদের পিছনে পাঠান ড্রাইভার এসে দাঁড়িয়েছে, সে অবাক হয়ে শুনছে। দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারের কথা শুনে সে কিছুতেই ধৈর্য ধরতে পারেনি, দেখতে এসেছে একনজর এই দুর্দান্ত দস্যকে।

 মিঃ হাফিজ মিঃ নিজাম হোসেনের সামনে এসে দাঁড়ালেন, বললেন ইনি বিখ্যাত ডিটেকটিভ মিঃ আহাদ চৌধুরী আর ইনি বিদেশী ব্যবসায়ী ধনকুবের জনাব নিজাম হোসেন। আর ইনি মিসেস হোসেন।

মিঃ আহাদের ভ্রুকুঞ্চিত হলো, বন্ধু সমীরকে যেদিন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে তিনি আনতে গিয়েছিলেন সেইদিন এই তরুণীকে তিনি দেখেছিলেন মিঃ আলমের কক্ষে, ক্ষণিকের জন্য এসেছিলো কোনো কারণ বশত। সমীরকে জিজ্ঞাসা করায় জেনেছিলো তার পরিচয়। আজ এখানে এই পুলিশঅফিসে মিসেস শোহেলী আর তার স্বামীকে দেখে কিছুটা অবাক হলেন মিঃ আহাদ।

ইন্সপেক্টার হলেন মিঃ হাফিজ আরও বললেন–মিঃ নিজাম হোসেনই গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছেন দস্যু বনহুরকে।

একটু বিস্মিত হলেন মিঃ আহাদ যে দস্যুকে গ্রেফতার নিয়ে পুলিশবাহিনী অবিরত হন্তদন্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে, যে দস্যর নামে অতি বড় দুঃসাহসীরও হৃদকম্প হয়, যাকে আটকে রাখতে সক্ষম হয়নি। হাঙ্গেরী কারাগার–সেই দস্যকে গ্রেফতার করেছেন এই সত্তর বছরের প্রৌঢ় ভদ্রলোক। একটা হাসি গোপন করে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন জনাব নিজাম হোসেনের সঙ্গে।

 নূরীর মনে তখন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে; কারণ সে জানে, তার হুর মিসেস শোহেলীর সঙ্গে ভালভাবে মিশতো। হয়তো জানতে পেরেছে তার আসল পরিচয় তাই তাকে কৌশলে বন্দী করেছে। রাগে ক্ষোভে নূরীর গা রি রি করে জ্বলে উঠলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে পুলিশ সুপার স্বয়ং এসে পড়লেন। মিঃ আহাদ এবং জনাব নিজাম হোসেন করমর্দন করে ইন্সপেক্টারকে বললেন কোথায় সেই অদ্ভুত দস্যু বনহুর?

স্যার, তাকে হাজতে বন্দী করে রাখা হয়েছে।

পুলিশ সুপার নিজাম হোসেন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন কিভাবে তিনি দস্যকে গ্রেফতার করতে পেরেছেন?

মিঃ হোসেন বললেন–আমার স্ত্রী বুদ্ধি-কৌশলেই আজ আমি এ কৃতিত্বলাভে সক্ষম হয়েছি। কাজেই দস্যকে গ্রেফতারের সুনাম প্রথম তারই প্রাপ্য।

পিছন থেকে পাঠান ড্রাইভার ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বলে উঠলো–আর রূপিয়া কিছু কি পাওনা আপকো না উছব?

 সবাই তাকালো একবার পাঠান ড্রাইভারের মুখের দিকে, কারণ সে ঠিকই বলেছে, দস্যুকে গ্রেফতারের জন্য সুনাম পাবে মিসেস আর পুরস্কার পাবেন কি মিঃ নিজাম হোসেন? কিন্তু পাঠান ড্রাইভারের কথাটা তেমন করে কেউ কানে নিলো না।

 মিঃ আহাদই প্রশ্ন করলেন–মিসেস হোসেন কি করে আপনি দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার সক্ষম হলেন?

 মিসেস শোহেলীর মুখে ঘটনাটা শোনার জন্য উপস্থিত সবাই উন্মুখ হয়ে উঠলো। দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করা কম কথা নয়। তবু নারী হয়ে মিসেস শোহেলী এ কৃতিত্বের অধিকারিণী হয়েছেন। পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণে এবং রাস্তায় অগণিত জনতার ভিড় জমে গেছে। কি করে যে দস্যু বনহুর গ্রেফতার সংবাদটা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা শহরময় বুঝা মুস্কিল। এখনও রেডিও বা পত্রিকায় এ সংবাদ ঘোষণা করা হয়নি।

সবার জানার আগ্রহে মিসেস শোহেলী বলতে শুরু করলো–শহরে দস্যু বনহুরের আবির্ভাবের খবর শোনা অবধি আমার মনে অত্যন্ত ভীতিভাব জেগেছিলো। আমার স্বামী প্রচুর অর্থের মালিক, আমার যে অলঙ্কার আছে তা প্রায় লক্ষ টাকার বেশি হবে। এসবের জন্য আমি সব সময় সাবধান। থাকতাম। প্রথমে আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছিলাম তারপর এখন তেজগার অদূরে বাসা নিয়েছি।

মিঃ আহাদ বললেন–এখন আপনারা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে থাকেন না বুঝি।

না, কারণ আমার ভয় হয় এখানে একা থাকতে।

আর তেজগা বাসায় ভয় হয় না? প্রশ্ন করলেন মিঃ আহাদ।

মিসেস শোহেলী বললো–সেখানে আশে পাশে অনেক বাসা আছে। তাছাড়া বাড়িওয়ালাও থাকেন আমাদের নীচতলায়।

হু! বললেন মিঃ আহাদ।

মিসেস শোহেলী বলছে–আমার স্বামী প্রায় রাতই বাইরে থাকেন।

 মিথ্যে কথা। বলে উঠলেন জনাব নিজাম হোসেন।

মিসেস শোহেলী বললো–মিথ্যে নয়, সম্পূর্ণ সত্য–আমার স্বামী প্রায় রাতই বাইরে কাটান, জানি না কোথায় থাকেন। তবে একথা সত্য তিনি দুশ্চরিত্র নন।

 হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন মিঃ আহাদ কতদিন আগে জনাব নিজাম হোসেনের সঙ্গে আপনার বিয়ে হয়েছে?

শোহেলীর কথা শেষ হয় না, জনাব হোসেন বলে উঠেন–মিথ্যে কথা, ওর সঙ্গে আমার পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে।

পাঁচ বছর! মিসেস শোহেলীর বয়স তখন নিশ্চয়ই বিশ বছরের অনেক কম ছিলো।

তা হলে। বললেন জনাব হোসেন।

কিন্তু আপনি এতো কচি মেয়েকে বিয়ে করতে গেলেন কেন মিঃ নিজাম হোসেন? বললেন পুলিশ সুপার।

হঠাৎ পুলিশ সুপারের কথায় একটু হতভম্ভ হলেন মিঃ হোসেন, আমতা আমতা করে কিছু বলতে। যাচ্ছিলেন, বললেন মিঃ আহাদ-আপনি এ প্রশ্নের জবাব সহজে দিতে পারবেন না বলে মনে হচ্ছে। পুলিশ সুপারের দিকে তাকিয়ে বললেন–আমরা আসল কথা ছেড়ে বেশ দূরে এসে পড়ছি।

 হাঁ, পূর্ব কথায় যাওয়া যাক। বলুন মিসেস হোসেন, আপনি সচ্ছভাবে সব বলুন–আর জনাব হোসেন, আপনার নিকটে অনুরোধ রইলো, মিসেস হোসেনের কথার মাঝখানে আপনি কোনো কথা বলতে যাবেন না। কথাগুলো পুলিশ সুপার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন।

 মিসেস শোহেলী বেশ বিব্রত হয়ে পড়েছেন বলেই মনে হলো। সে চায় না তার স্বামীর কোন। বদনাম হয়, অথচ সত্য বলতে হলে তাকে কিছুটা খোলাসা বলতে হবে। সে বলতে লাগলো–আমার স্বামী রাতে বাসায় থাকলেও সজ্ঞানে থাকেন না, অত্যন্ত মদপানে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। আপনারা বুঝতেই পারছেন আমার অবস্থাটা। এসব কারণেই আমি বাসা নিয়েছি। একটু থামলো মিসেস শোহেলী, একবার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো সে।

জনাব হোসেনের মুখ গম্ভীর থমথমে দেখাচ্ছে। ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি যেন তীব্র আর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে এখন।

মিসেস শোহেলী বলে চলেছেন নতুন বাসায় আসার পর হঠাৎ একদিন একটা চিঠি পেলাম। আমার কাছে প্রেমপত্র লিখেছেন তবে কোনো খারাপ উক্তি ছিলো না তার মধ্যে। চিঠি খানা পেয়ে আমি আমার স্বামীকে দেখালাম উনি বললেন ও কিছু না বুড়ো স্বামী দেখে কেউ তোমার মন পরীক্ষা করছে। প্রথম চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেললাম, ভাবলাম আর চিঠি দেবার সাহস হবে না। কিন্তু কদিন পর আবার একখানা চিঠি রীতিমত প্রেমের চিঠি আমি এখানা লুকিয়ে রাখলাম। তারপর আবার আমি খুব রেগে গেলাম কিন্তু চিঠিগুলো স্বামীকে দেখালাম না কারণ তিনি এসব হেসেই উড়িয়ে দেবেন। ঠিক কয়েকদিন পর আমার টেবিলে ছোরা গাঁথা দেখলাম তাতে একটুকরা কাগজ আটকানো। আশ্চর্য হলাম, ছোরা কি করে এলো আমার ঘরে! তাড়াতাড়ি কাগজের টুকরাটা খুলে নিয়ে পড়ে দেখি সর্বনাশ! দস্যু বনহুরের চিঠি!

কক্ষমধ্য সবাই অবাক হয়ে শুনছেন। মিঃ আহাদের জ কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে।

মিসেস শোহেলী বলছে–তার চোখেমুখে তখন এক ভয় বিহ্বল ভাব ফুটে উঠেছে”বলছে সে– চিঠিখানা আমি পড়লাম তাতে লিখা আছে–”আমার বন্ধুর চিঠির উত্তর দাওনি, কাজেই তোমাকে ক্ষমা করা আমার সম্ভব নয়। যদি আমার বন্ধুর সঙ্গে আজ রাত একটায় তোমাদের বাড়ির পাশের বাগানে দেখা করে তবেই ক্ষমা করবো না হলে মৃত্যু অনিবার্য জেনো।
–বন্ধুর হয়ে
দস্যু বনহুর

মিঃ আহাদ বললেন–চিঠিখানা সঙ্গে আছে আপনার?

 হাঁ আছে। মিসেস শোহেলী ভ্যানিটি থেকে চিঠিখানা বের করতে গেলো।

মিঃ আহাদ বললেন–আগে কথা শেষ করুন, পরে চিঠি দেখবো।

মিসেস শোহেলী পুনরায় বলতে শুরু করলো–চিঠিখানা পড়ে আমার মনের অবস্থা কি হলো বুঝতেই পারছেন। আমি চিঠি খানা আমার স্বামীকে দেখালাম। আমার স্বামী চিঠি পড়ে ভয় না পেয়ে খুশি হলেন। তখন বুঝতে পারলাম না কিছু, কিন্তু রাতদুপুরে যখন বাগানটার আশে পাশে অগণিত পুলিশ ফোর্স এসে লুকিয়ে পড়লো তখন বুঝলাম আমার স্বামীর বুদ্ধিমত্তার কাছে এবার দস্যু বনহুরের সব কারসাজি ফাঁস হয়ে যাবে। দস্যু বনহুর বন্ধুবরের নাম করলেও সেই যে প্রথম থেকে শেষ চিঠির লেখক তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ প্রত্যেকটা চিঠি একই হস্তের লিখা। এবার আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কি করে আমি দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারে সক্ষম হলাম। রাত একটায় সাহসে বুক বেঁধে বাগানটার মধ্যে এসে দাঁড়ালাম। কি ভয়ঙ্কর তখন আমার মনের অবস্থা। সমস্ত দেহটা আমার হিমশীতল হয়ে উঠেছিলো ভয়ে। আমি রুদ্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করছিলাম দস্যু বনহুরের।

কক্ষমধ্যে সবাই নীরব, মিঃ আহাদের মুখোভাবে কোনো পরিবর্তন হয়নি তিনি স্বাভাবিকভাবে শুনে যাচ্ছিলেন।

পাঠান ড্রাইভার তখনও দাঁড়িয়ে আছে তার চোখেমুখে অদ্ভুত এক বিস্ময়ভাব। নূরী আড়ষ্ট হয়ে গেছে যেন, পাথরের মূর্তির মত নিস্তব্ধভাবে বসে আছে সে।

ইন্সপেক্টার মিঃ হাফিজের প্রচেষ্টাতেই আজ দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে, তাই তাঁর মুখোভাব গর্বস্ফীত।

পুলিশ সুপার–তিনি অত্যন্ত প্রসন্ন, দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করা পুলিশমহলের এক পরম কৃতিত্ব।

শোহেলী বলছে-হঠাৎ দেখলাম একটা জমকালোমূর্তি অন্ধকারে এগিয়ে আসছে অতি ধীরে ধীরে–সেকি ভীষণ এক কালো মূর্তি!

নূরী এবার অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–তারপর? তারপর?

 তারপর আমি আর থাকতে পারলাম না চিৎকার করে উঠলাম বাঁচাও–বাঁচাও–দস্যু বনহুর এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে কালো মূর্তিটা পালাতে গেলো কিন্তু বাগানমধ্যস্থ পুলিশবাহিনী ততক্ষণে তাকে গ্রেফতার করে ফেলেছে। থামলো শোহেলী।

মিঃ আহাদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–আমার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না, দস্যু বনহুর এতো বুদ্ধিহীন নয়।

পুলিশ সুপার বললেন–চলুন দেখা যাক।

সবাই মিলে হাজতকক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন। যেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছে দস্যু বনহুরকে।

হাজতের নিকটবর্তী হতেই দেখলেন হাজতকক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একটা জমকালো পোশাক-পরা লোক–মাথা থেকে পা অবধি কালো আলখেল্লা পরা, পায়ে বুট, চোখে গগলস্ মুখে চাপদাড়ি ও গোফ। হাত দু’খানা শিকল দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা।

মিঃ আহাদকে দেখে হাজতকক্ষের মধ্যে দস্যু বনহুর এগিয়ে এলো। লোকটা খুব লম্বা নয় মাঝারি এবং মোটা ধরনের।

সবাই তখন হাজতকক্ষের দরজার শিকের ধারে এসে দাঁড়িয়েছেন। নূরীর দৃষ্টি তখন দস্যু বনহুরের পা থেকে মাথা অবধি উঠানামা করছে। শুধু বিস্ময় নয়, ক্রমেই নূরীর মুখমন্ডল সচ্ছ হয়ে আসছে।

অন্যান্যের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে মিঃ আহাদ চৌধুরীর নতুন পাঠান ড্রাইভারটা তার দু’চোখেও রাজ্যের বিস্ময়। এতোকাল দস্যু বনহুরের নামই সে শুনে এসেছে এখন তাকে স্বচক্ষে দেখছে–কম কথা নয়। সে একজন সামান্য ড্রাইভার হয়ে দস্যু বনহুরকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করলো, এটা তার সৌভাগ্য।

সবার আগে এগিয়ে এলেন মিঃ আহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকাতেই আলখেল্লার মধ্যে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো দস্যু বনহুর। সবাই তাজ্জব হলো, একি ব্যাপার দস্যু বনহুর ধরা পড়ে রোদন করছে।

দস্যু বনহুর কেঁদে উঠতেই মিঃ আহাদ হো হো করে হেসে উঠে সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে পড়লেন, তারপর বললেন–এ অবস্থা কেন তোমার?

আমাকে মাফ করে দাও আহাদ, সব তোমাকে বলবো।

এ কি মিঃ সমীর কুমার আপনি? বলে উঠলেন মিঃ হাফিজ।

তাড়াতাড়ি হাজতকক্ষ থেকে বের করে আনা হলো মিঃ সমীরকে। তার দেহ থেকে কালো আলখেল্লা খুলে ফেলা হলো, হাত এবং পায়ের শিকল খুলে দিলেন মিঃ হাফিজ।

কক্ষমধ্যে সকলেই হতভম্ব বিস্মিত সবাই হাসছেনও বটে।

আহাদ চৌধুরী সমীরের মুখ থেকে নকল দাঁড়ি গোঁফ খুলে নিলেন একটানে তারপর ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন দস্যু বনহুর সেজে মিসেস শোহেলীর কাছে প্রেম করতে গিয়েছিলেন না?

আমাকে ক্ষমা করো আহাদ, আমি আলাপ করে মিসেস শোহেলীকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম।

অফিস মধ্যে একটা হাসির হুল্লোড় বয়ে গেলো।

মিসেস শোহেলীর মুখেও হাসি ফুটে উঠেছে সে সমীরকে ভালভাবে চিনতো ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে থাকাকালে সমীরের সঙ্গে তার পরিচয় এবং অনেক আলাপ-সালাপ হয়েছে। যা দস্যু বনহুরের পাল্লায় যে পড়েনি এজন্য সে অনেকটা সান্ত্বনা পেলো মনে।

 কিন্তু নিজাম হোসেনের মুখ কালো বিবর্ণ দেখাচ্ছে দস্যু বনহুরকে। গ্রেফতার করে তিনি শুধু দশ হাজার অর্থই নয় বিরাট একটা সাফল্য আর কৃতিত্ব লাভ করতে চেয়েছিলেন, সব তার ব্যর্থ হলো। মাথা নত করে গোমড়া মুখে বসে রইলেন তিনি।

*

বোন, মিঃ আলম এসেছেন দেখা করবে না?

আসছি।

বসুন মিঃ আলম।

বসতেই তো এলাম।

আসন গ্রহণ করলো মিঃ আলম।

মিঃ আহাদ সিগারেট কেস বের করে একটা সিগারেট মিঃ আলমকে দিলেন আর একটা নিজে ধরালেন।

একটু পরেই নূরী প্রবেশ করলোহাতে তার চায়ের ট্রে।

 নূরী হেসে বললো কেমন আছেন মিঃ আলম?

 বললো মিঃ আলম–ভালো। আপনি?

না না, আপনি নয়–তুমি। আমার বোনকে বলবেন।

বললেন মিঃ আহাদ।

নূরীও হেসে বললোহ ভাইয়া ঠিক বলেছেন, আপনি’নয়, তুমিই বলবেন।

একটু পরে সমীর এসে হাজির হলো সেখানে মিঃ আহাদ ঠাট্টা করে বললেন–দস্যু বনহুর এসেছে।

চমকে উঠলো মিঃ আলম, পরক্ষণেই নিজকে সামলিয়ে নিয়ে বললো তার মানে? কোথায় দস্যু বনহুর?

এই যে–সমীরের পিট চাপড়ে বললেন মিঃ আহাদ।

অবাক হয়ে তাকালো মিঃ আলম একবার মিঃ আহাদ ও সমীরের মুখে। কিছুই যেন সে বুঝতে পারছে না।

নূরী হেসে বললো–মঃ আলম, আপনি জানেন না একটা ঘটনা ঘটে গেছে।

মিঃ আহাদ বললেন–অদ্ভুত ঘটনা শুনুন। তিনি সমস্ত গল্পটা মিঃ আলমকে বলে শোনালেন।

কক্ষমধ্যে একটা হাসির হুল্লোড় উঠলো।

মিঃ আলম হেসে বললেন–মিঃ সমীর কুমার বাবু যে দস্যু বনহুর নন তারই বা প্রমাণ কি? যদি বলি ইনিই দস্যু বনহুর।

মিঃ আহাদ কথাটা উড়িয়ে দিতে পারলেন না। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন–হাঁ, সে কথা অবশ্য সত্য। দস্যু বনহুর যে আমাদের মধ্যেও একজন হতে পারে বা থাকতে পারে তাতে কোনো ভুল নেই।

মিঃ আলম ও নূরীর দৃষ্টি বিনিময় হলো।

মিঃ আহাদ লক্ষ্য করলেন এটা, বললেন–মিঃ আলম, আপনি বসুন, নূরীর সঙ্গে আলাপ করুন আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। সমীর তোমাকেও যেতে হচ্ছে আমার সঙ্গে।

বেশ চলো, আমাকেই যখন তোমরা দস্যু বনহুর বলে সাব্যস্ত করে নিয়েছে তখন দস্যুতা একটু শিখতে হবে বৈকি! চল কোথায় যেতে হবে। উঠে দাঁড়ালো। সমীর।

 মিঃ আহাদ হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বললেন–আজ আবার ড্রাইভারের শরীর অসুখ বলে ছুটি নিয়ে গেছে, আমাকেই ড্রাইভারী করতে হবে। তারপর নূরীর দিকে তাকিয়ে বললেন–বোন, উনার সঙ্গে কথাবার্তা বলো কেমন?

নূরী মাথা কাত করে সম্মতি জানালো।

 বেরিয়ে গেলেন মিঃ আহাদ ও সমীর অল্পক্ষণ পরেই মোটর ষ্টার্টের শব্দ শোনা গেলো।

এবার মিঃ আলম পাল্টে গেলো মুহূর্তে, খপ করে নূরীকে ধরে ফেললো সে। বাহুবন্ধনে আটকে ফেলে বললো-বলো কেন পালিয়ে এসেছিলে?

ভুল করে। তুমি আমাকে ক্ষমা করো হুর।

না, ক্ষমা আমি করবো না

 তবে কি করবে?

 প্রতিশোধ নেবো—বনহুর নূরীকে গভীরভাবে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললো তারপর—

নূরী বিব্রত হয়ে উঠলো, রাঙা হয়ে উঠলো তার গন্ডদ্বয়। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়লো কাঁধের চারপাশে।

বনহুর ওর চুলগুলো সরিয়ে দিলো ললাট থেকে।

নূরী বললো–জানো হুর, মিঃ আহাদ সন্দেহ করেছেন তোমাকে?

 তা আমি বুঝতে পেরেছি।

আমাকে তাই তিনি নিযুক্ত করেছেন তোমার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তোমার আসল রূপ জেনে নিতে।

হাঃহাঃ করে হেসে উঠলো বনহুর–তাহলে ভাইকে খুশি করবার জন্য আমাকে গ্রেফতার করতে চাও না?

হাঁ চাই! কর্তব্যের খাতিরে। বলো আবার কখন আসবে?

সব সময় তো তোমাদের এখানেই আছি।

 তার মানে?

 মানে পরে জানবে।

কিন্তু তোমার চেহারাটা কেমন যেন রোগা রোগা লাগছেবলোতো এমন হয়েছে কেন? নিশ্চয়ই আবার অনিয়ম শুরু করেছো? বনহুরের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো নূরী।

একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো বনহুর নূরী, আমার দেহটা রোগা হয়ে গেছে একটু তাই তুমি দুঃখ করছে–আর জানো, কালবৈশাখীর নির্মম দাপটে কত অসহায় মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শত শত মানুষ মরেছে, আর যারা বেঁচে আছে তাদের অবস্থা দেখলে প্রাণ শিউরে উঠে। তারা জীবন্মত হয়ে আছে, কারো হাত-পা ভেঙে গেছে, কারো মাথা ফেটে গেছে, চোখ অন্ধ হয়ে পড়েছে, কারো বুকের হাড়গুড়ো হয়ে থেতলে গেছে। এরা সবাই প্রায় হসপিটালে, আর কতক পড়ে আছে ভিটের মাটি আঁকড়ে ধরে। নূরী, সেকি নিদারুণ দৃশ্য!–তাই আমি পারিনি নিশ্চুপ থাকতে। সেদিন তুমি যখন মিঃ আহাদের সঙ্গে বাত্যাদুর্গত এলাকা দেখতে গিয়েছিলে, তখন আমিও ছিলাম তোমাদের পাশে।

 অবাক হয়ে বললো নূরীকই তোমাকে তো দেখিনি?

তিনটি মজুর কাজ করছিলো দেখেছো?

হাঁ, এবার মনে পড়ছে। মিঃ চৌধুরী একটু পরে ফিরে এসে একজনকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমাদের সঙ্গী আর একজন কোথায়? বুঝেছি, তুমিই সরে পড়েছিলে আমাদের অলক্ষ্যে।

নূরী, বাত্যাদুর্গতদের জন্যই আমি এসব টাকা লুটে নিয়েছিলাম, তাছাড়াও এসব শয়তানদের সায়েস্তা করার জন্যও আমাকে এসব করতে হয়েছে।

আর নয়, চলো ফিরে যাই আমরা?

আর কয়েকটা দিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে নূরী।

 কেন বলোতো?

জানতে পারবে সব। নূরী, আজ চলি?

আবার কখন আসবে?

ড্রাইভারের অসুখ সারলেই…..

ওঃ দুষ্ট, এবার আমি বুঝতে পেরেছি।

 বনহুর নূরীর চিবুকে মৃদু টোকা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

 নূরীও উঠে পড়লো ওর সঙ্গে সঙ্গে।

গাড়ি অবধি নূরী বনহুরকে এগিয়ে দিলো।

গাড়িতে বসে বললো বনহুর–আজ গ্রীন হাউস নাইট ক্লাবে মিঃ আমাদের দাওয়াত আছে, তুমিও সঙ্গে যাবে নূরী।

নূরী কিছু বলতে যাচ্ছিলো, বনহুর তখন তার গাড়িতে ষ্টার্ট দিয়েছে।

 নূরী হাত নেড়ে বললোখোদা হাফেজ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন মিঃ আহাদ–সমীর তার সঙ্গে। নূরী হাস্যোজ্জ্বল মুখে এসে দাঁড়ালো-ভাইয়া, চলুন খাবার হয়ে গেছে।

মিঃ আহাদ মিঃ আলম সম্বন্ধে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলেন না। নূরী এ ব্যাপারে খুশিই হলো।

খাবার টেবিলে বসে নানা গল্পসল্পের মধ্য দিয়ে খাওয়া-পর্ব শেষ হলো। মিঃ আহাদ তার শয়নকক্ষে এলেন, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো।

 মিঃ আহাদ সমীরকে বললেন ফোন ধরতে।

 সমীর ফোন ধরেই আনন্দধ্বনি করে উঠলো–হ্যালো……. দাওয়াত …….কোথায় …….গ্রীন হাউস নাইট ক্লাবে…..থ্যাঙ্ক ইউ…… নিশ্চয়ই…নিশ্চয়ই….আমিও যাব তো…আচ্ছা, হাঁ এখুনি বলছি তাঁকে…..রিসিভারের মুখে হাতচাপা দিয়ে বললো সমীর–আহাদ, আজ আটটায় গ্রীন হাউস নাইট ক্লাবে আমন্ত্রণ আছে, যাবে তো নিশ্চয়ই?

সম্ভব হবে না।

 বলো কি?

 আমার অন্য জায়গায় জরুরি কাজ আছে।

 এতোবড় একটা চান্স তুমি নষ্ট করে দেবে?

নষ্ট নয়, তুমি আর বোন নূরী যেও।

রিসিভার রেখে অভিমান-ভরা গলায় বললো সমীর–অগত্যা তাই যাবো। যাই, বোন নূরীকে বলে সব ঠিক করে রাখবে।

বেরিয়ে গেলো সমীর।

 মিঃ আহাদ সিগারেট ধরালেন। একরাশ ধূম্রকুন্ডলির ফাঁকে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন তিনি।

সমীর আর নূরী যখন গ্রীন হাউজ নাইট ক্লাবে এসে পৌঁছলো তখন অন্যান্য প্রায় সবাই এসে গেছেন। মিসেস শোহেলীর বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে মিঃ নিজাম হোসেন সাহেব এই উৎসবের আয়োজন করেছেন। শহরের গণ্যমান্য প্রায় অনেকেই এসেছেন উৎসবে।

সমীর আর নূরী ক্লাবকক্ষে প্রবেশ করে আসন গ্রহণ করলো।

 অদূরে ডায়াসে অর্কেষ্ট্রা বাজছে!

 নানা বয়সী নারী-পুরুষে ক্লাবকক্ষ গমগম করেছে।

দুগ্ধধবল অত্যুজ্জ্বল টিউব আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। মিসেস শোহেলীর পরিধানে আজ ফিকে নীলাভ শাড়ি, গায়ে হাতাকাটা ব্লাউজ, গলায় নীলাভ ফিতায় বাঁধা একটা মূল্যবান লকেট ঠিক বুকের মাঝখানে দুলছে। ফিকে নীলাভ পাতলা শাড়িখানার মধ্য দিয়ে তার দেহের সুঠাম সৌন্দর্য যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সত্যি আজ মিসেস শোহেলীকে অপূর্ব মানিয়েছে। সরু ওষ্ঠদ্বয়ে মিষ্টি হাসির রেখা লেগে আছে যেন, মিসেস শোহেলীর পাশে মিঃ নিজাম হোসেন দাঁড়িয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন।

গ্রীন হাউসে যখন আনন্দ উৎসব চলছে তখন মিঃ আহাদ তার নিজ বাসায় একখানা ছুরি নিয়ে হলঘরে প্রবেশ করলেন। চিরে ফেললেন হলঘরে তার নতুন তৈরি একখানা সোফার গদি। কোনো মায়া করলেন না তিনি। আশ্চর্য, গদিটার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি টেপ-রেকর্ড বাক্স। মিঃ আহাদ ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি টেপ-রেকর্ড বাক্স। মিঃ আহাদ টেপ-রেকর্ড চালু করে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেলো তার নিজের কণ্ঠ….বোন, মিঃ আলম এসেছেন, দেখা করবে না….নূরীর কণ্ঠ….. আসছি…. তার নিজের গলা এবার…..বসুন মিঃ আলম……

মিঃ আহাদ খানিকটা ফিতা বাদ দিয়ে পুনরায় চালু করলেন। এবার আবার তার নিজের কণ্ঠ…..আজ ড্রাইভারের শরীর অসুখ বলে ছুটি নিয়ে গেছে, আমাকেই ড্রাইভারী করতে হবে…..বোন, উনার সঙ্গে কথাবার্তা বলো, কেমন? খানিকক্ষণ কোনো কথা নেই, জুতোর শব্দ শোনা গেলো–এ শব্দটা তার ও সমীরের জুতোর শব্দ। মিঃ আহাদ রুদ্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করছেন, না জানি এবার কি শুনবেন তিনি। ঝুঁকে আছেন মিঃ আহাদ তার ছোট্ট টেপ-রেকর্ড যন্ত্রখানার উপর, চোখেমুখে দারুণ উৎকণ্ঠার ছাপ ফুটে উঠেছে। নড়াচড়ার বেশ তীব্র শব্দ হচ্ছে, মিঃ আলমের নিশ্বাসের ভারী শব্দ এবার মিঃ আলমের কণ্ঠবলো কেন পালিয়ে এসেছিলে? একটু নিস্তব্ধ, তারপর নূরীর চাপা কণ্ঠ–ভুল। করে,…তুমি আমাকে ক্ষমা করো প্র…..

 মিঃ আহাদ অক্ষুট ধ্বনি করে উঠলেন–হুর!

পরক্ষণেই শোনা গেলো মিঃ আলমের কন্ঠ…..না, ক্ষমা আমি করবো না….নূরীর কণ্ঠ…তবে কি করবে…প্রতিশোধ নেবো মিঃ আলমের আবেগ ভরা গলার আওয়াজ…তার কোনো কথা শোনা গেলো না, মিঃ আহাদের মুখমন্ডলে ফুটে উঠেছে এক অদ্ভূত ভাবধারা, তিনি টেপ-রেকর্ডখানার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছেন, সব যেন তার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন নূরীর সঙ্গে তাহলে পূর্ব হতেই মধুর ঘনিষ্ঠতা ছিলো, মিঃ আহাদ বিপুল আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করেন এর পরের কথা শোনার জন্য!

আবার শোনা যায়….জানো হুর, মিঃ আহাদ সন্দেহ করেছেন তোমাকে….মিঃ আলমের গলা….তা আমি বুঝতে পেরেছি..আমাকে তাই তিনি নিযুক্ত করেছেন তোমার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তোমার আসল রূপ জেনে নিতে…..পৌরুষ কণ্ঠের হাসির শব্দ হাঃ হা হা…হাঃহাঃ..হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ

মিঃ আহাদ টেপ রেকর্ডখানা বন্ধ করে উঠে পড়লেন, ড্রয়ার খুলে বের করে নিলেন রিভলভারটা, ফিরে দাঁড়াতেই পাঠান ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেলেন।

[পরবর্তী বই গুপ্ত রহস্য]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *