সুন্দরবনে দস্যু বনহুর

সুন্দরবনে দস্যু বনহুর

বনহুর সখিনার হাত ধরে দ্রুত এগুতে থাকে। সোজা পথ ধরে না এগিয়ে ঝোঁপঝাড় আর জঙ্গল পথ ধরে এগোয় বনহুর সামনের দিকে। বনহুরের সঙ্গে চলতে সখিনার পা দু’খানা যেন মুচড়ে ভেঙে যাচ্ছিলো, তবু এগুতে হবে–বাঁচতে হবে শয়তান মাতব্বর মালিকের কাছ থেকে। অবশ্য এ লোকটাও তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন, বনহুরকে সে-তো পূর্বে কোনোদিন দেখেনি বা ওর সঙ্গে তেমন করে পরিচয়ও নেই। অপরিচিত একজনের সঙ্গে কোথায় চলেছে–তাকে নিয়ে কোথায়ই বা যাচ্ছে কে জানে!

 ভিতরে ভিতরে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলো সখিনা, যদিও আলম ভাই বলেছে তাকে রক্ষার জন্যই সে এখন ওকে নিয়ে চলেছে, কিন্তু একেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না সখিনা। দুর্বল মনটা তার দুশ্চিন্তায় ভরে উঠছে বার বার, চলতে চলতে হঠাৎ বলে উঠে–আমারে লইয়া কই যাইবা আলম ভাই?

বললো বনহুর –মাতব্বরের বাড়ি।

সেহানে আমারে নিয়া কি করবা? ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে বললো সখিনা। সে বেশ হাঁপিয়ে পড়েছিলো।

বনহুর বললো–সখিনা, তুমি এখন মাতব্বরের বাড়ি থাকবে। কারণ এখন মাতব্বরের বাড়ি তোমার জন্য একমাত্র নিরাপদ স্থান।

আমি ঠিক বুঝতে পারতাছি না আলম বাই, যে লোক আমারে আজরাইলের মতন ছিনাইয়া লইবার চায় সে বাড়িতে থাকতি কও?

শোন সখিনা, মাতব্বর অত্যন্ত শয়তান, সুচতুর আর ভয়ঙ্কর লোক-গ্রামে যেখানেই তুমি লুকিয়ে থাকে না কেন, সে তোমাকে খুঁজে বের করবেই। তাছাড়া আমি বেশ বুঝে নিয়েছি, এ গ্রামের সবাই তাকে যমের মত ভয় করে। তুমি যার বাড়িতেই আশ্রয় নেবে সে নিজেই গিয়ে সংবাদ দেবে ঐ লম্পট বাদমাইশটাকে।

দেহো দেহি তুমি ঐ বাড়িতেই আমারে থাকতি কও? যেহানে বাঘের ভয় সেহানেই রাইত অয়, তাই অইছে আমার।

হাসলো বনহুর, ভয় পাওয়া সখিনার স্বাভাবিক। যে যমদূত তার উপর হামলা চালিয়েছিলো এখন কিনা সেই যমের বাড়িতেই তাকে আশ্রয় নিতে হবে–ব্যাপারটা সত্যি ভয়াতুর। সখিনাকে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে, হঠাৎ যদি এতোটুকু ভুল করে বসে তাহলেই তার সর্বনাশ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 বনহুর সখিনাকে বললো–দেখো সখিনা, তোমাকে মাতব্বরের বাড়ি আমার বোন হিসেবে। থাকতে হবে। ওখানে তুমি আপাততঃ কাজ করবে এবং ঝি হিসেবেই থাকবে, বুঝলে? কিন্তু মনে রেখো, মাতব্বর আরফান যেন কোনো সময় তোমার মুখ দেখতে না পায়, কারণ তোমাকে সেখানে আত্নগোপন করে থাকতে হবে। সখিনা, আমি ফিরে না আসা অবধি তুমি তোমার বাপজানের ওখানেও যাবে না বা কাউকে জানতে দেবে না তুমি এ বাড়িতে আছো। আচ্ছা সখিনা, তুমি কি এ বাড়িতে কোনোদিন এসেছে?

না, আমি আই নাই। এতোদূর আইমু কেমন কইরা?

 আচ্ছা, তোমাকে এ বাড়ির কেউ দেখেছে?

 মাতব্বর সাহেব আর অছিমুদ্দিন দ্যাখছে, তাছাড়া আর কেউ আমারে দেহে নাই।

বাঃ তাহলে তো চিন্তাই নেই। মাতব্বর আর অছিমুদ্দিনের চোখ থেকে নিজকে লুকিয়ে রাখবে। পারবে তো সখিনা নিজকে গোপন রাখতে?

সখিনা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, এ লোকটা কেন তাকে ঐ বাড়িতে রাখতে চায়। সব বাড়িতেই সে তার জন্য হানা দিয়ে অন্বেষণ করে ফিরবে, শুধু করবে না নিজের বাড়িতে, এবং সে কারণেই আলম তাকে এ বাড়িতে নিয়ে চলেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আরফান মাতব্বরের বাড়ির অনতিদূরে এসে পৌঁছে যায়। গ্রামের যে প্রান্তে মাতব্বর আরফানের বাড়ি, ঠিক তার বিপরীত প্রান্তে তার কারবারের গুদাম। এখানে তার ব্যবসা চলেনারকেলের ব্যবসা। খুলনা অঞ্চল থেকে নারকেল বোঝাই হয়ে তার ষ্টিমার ঢাকা যায়, সেখানে নারকেল বিক্রির অজুহাত দিয়ে অপেক্ষা করে বেশ কিছুদিন। অনেক লোক, তার ষ্টিমারে.আসা-যাওয়া করে, মাল চালান ব্যাপার নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে কিন্তু একটা। জিনিস লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে, আরফান মালিকের ষ্টিমারের মাল কোনোদিন ফুরোয় না কিছুটা কমে যায় বটে।

 একদিন দেখা যায় ষ্টিমার ফিরে চলেছে অথচ নারকেলের স্তূপ তেমনি রয়েছে, হয়তো বা। বিক্রয় হয়েছে কিছুটা কিংবা হয়নি।

পৃথিবীতে সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত, কেউ কারো দিকে ফিরে তাকাবার সময় নেয়। সদরঘাটেও তেমনি আরফান মালিকের ষ্টিমার বোঝাই নারকেল আসে, বেশ কিছুদিন অপেক্ষা। করে আবার ফিরে যায়। লোকে মনে করে নারকেলে.পরতা পড়েনি তাই বিক্রি না করে আবার নিয়ে চলেছে, নতুন মালের সঙ্গে মিলিয়ে চালিয়ে নেবে।

অবশ্য এ কথাটাও বেশিক্ষণ কারো তলিয়ে ভাববার সময় নেই। হয়তো বা শমসের আলী তার বড় নারকেল বোঝাই নৌকায় বসে একটু ভাবতে চেষ্টা করেছে। বার বার ঐ মালিকের টিমারখানা নারকেল বোঝাই হয়ে আসে, আবার নারকেল সব বিক্রি না করেই ফিরে যায়…..কিন্তু এ নিয়ে গভীরভাবে মাথা ঘামাবার সময় নেই তার, নিজের ব্যবসা নিয়ে সে ব্যস্ত। শুধু শমসের আলীই নয়, মালিকের ষ্টিমার নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, সবাই ভেবেছে কিন্তু বেশিক্ষণ এ নিয়ে চিন্তা করার সময় কারো নেই।

 মালিক ষ্টিমার বড় কারবারী লোকের ব্যবসায়ী ষ্টিমার। আর সব যারা খুলনা অঞ্চল থেকে নারকেল ব্যবসায়ী আসে তারা বড় বড় নৌকা করেই মাল নিয়ে আসে, মাল বিক্রি শেষে ফিরে

আরফান ব্যবসায়ী ছাড়াও আরও দু’একজন ব্যবসায়ীর লঞ্চ বা ষ্টিমার আছে, এ সব ষ্টিমারেও নারকেল বা ডাব বোঝাই হয়ে আসে।

 বনহুর আর সখিনা আরফানের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো, মুখ করুণ বিষণ্ণ, তৈলবিহীন রুক্ষচুল, কদিন দাড়ি-গোঁফ কাটেনি সে, কাজেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফে মুখ ভরে উঠেছে বনহুরের। চোখ দুটোতে অসহায় ব্যথাভরা চাহনি, ডাকলো সেকেউ বাড়ি আছেন? শুনছেন, কেউ বাড়ি আছেন?

একটা লোক বেরিয়ে এলো, চাকর হবে বোধ হয়। বনহুর আর তার সঙ্গের মেয়েটাকে লক্ষ্য করে বললো কি চাও? ভিক্ষা চাও নিকিন?

 বনহুর করুণ চোখে তাকালো চারটার দিকে, হাত জুড়ে বললো-তোমাদের কাজের লোক লাগবে?’

খেঁকিয়ে উঠলো চাকরটা-না না, আমাগো কাজের লোক লাগবো না। তোমরা যাও দেহি।

বনহুর পাশে ঘোমটায় ঢাকা সখিনার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে পুনরায় বলে– তোমাদের বিবি সাহেবকে বল–যদি কাজের লোক নেন?

কইলাম তো লাগবে না, এবার যাও……..

 এমন সময় বেড়ার আড়াল থেকে শোনা যায় নারীর কষ্ট-লোক কি কয় রে ছলিম?

ছলিম এবার সুর নরম করে বলে–আম্মাজান, এই লোকডা মাইয়্যা মানুষ আনছে, রাখোন। চায়।

মাইয়্যা মানুষ, কই দেহি? ভিতরে আইতে কও।

ছলিম এবার বললো-আইসো, মাইয়াডা ভিতরে আইসো, আম্মাজান দেখবো।

বনহুর সখিনাকে লক্ষ্য করে বললো-বোন যাও। ভিতরে যাও।

সখিনা ঘোমটা আরও টেনে দিয়ে ভিতরে এগিয়ে গেলো।

 মাতব্বর বৌ বললো–বাড়ি কনে তোমাগো?

সখিনা বললো- সামগাঁও।

অবশ্য এটাও বনহুরেরই শেখানো কথা, সামগাঁও এ গাঁয়ের পরের গী, তাই সে এ গ্রামের নাম ওকে শিখিয়ে দিয়েছে।

সখিনার কথা শুনে বললো মাতব্বর গৃহিনী–সামগাঁও থেইক্যা আইছে কাম করতি লাইগ্যা?

হাঁ আম্মাজান।

ও মানুষ তোমাগো কে অয়?

 সখিনা ঘোমটার আড়াল থেকে বলে–ও মানুষ আমাগো বাই হয়।

 তোমাগো সোয়ামী নাই?

মাথা নিচু করে সখিনা, কোনো জবাব দেয় না।

অবশ্য পল্লীনারীদের এটা স্বভাব, বিয়ের কথা শুনলে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যায়। সখিনাও তাই কথাটা শুনে কুঁকড়ে গেলো কেঁচোর মত। মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।

 মাতব্বর বৌ বললো-বুঝছি বিয়া হয়নি তোমাগো, না? তা অমন যোয়ান অইছো বিয়া দ্যায়নি ক্যা?

ছলিম এবার বলে–বালো বিয়া আইলে তো দিবো। বালো বিয়া আহে নাই। তাই….আম্মাজান রাহিবেন না তাড়াই দিমু? :

না, তাড়াই দেওয়ার কাম নাই। মানুষ তো কামের লেইগা রাখতে লাগবো।

তা অইলে রাহেন।

 মাতব্বর বৌ জিজ্ঞাসা করলো এবার–তোমাগো নাম কি?

সহিনা।

 বালোই, সহিনা নামডা বালোই। আচ্ছা কও দেহি তোমাগো কত দেওন লাগবো?

বনহুর এতোক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। একটু হকচকিয়ে গেলো, এ কথাটা তো ওকে বলা হয়নি, কি বলতে কি বলে বসবে কে জানে। বনহুরই বলে উঠলো এখন যা হয় দেবেন। তারপর কাজ দেখে মাইনে বাড়িয়ে দেবেন আপনারা।

আচ্ছা তাই অইবো। আইসো সহিনা, অন্দর বাড়িতে আইসো এহন।

 সখিনা বললো–বাইজান আবার আইবেন কবে?

 বনহুর বললোসময় হলেই আসবো, কোনো চিন্তা করো না সখিনা।

আচ্ছা।

মাতব্বর বৌ সখিনাকে নিয়ে অন্দর বাড়ির মধ্যে চলে যায়, বনহুর ফিরে যায় যে পথে এসেছিলো সেই পথে!

*

জমাট অন্ধকারে বড় নৌকাখানা একেবারে মিশে গিয়েছে যেন। নৌকা বোঝাই গোলপাতা, নৌকার সম্মুখে দু’টো লোক লগি হাতে দাঁড়িয়ে, পিছনে হালে বসে একজন মাঝি। পিছনের মাঝিটা বিড়ি খাচ্ছিলো, তারই আলোটা অন্ধকারে পিট পিট করে জ্বলছিলো যেন।

সামনের লোক দুটো উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়েছিলো সম্মুখে সীমাহীন অন্ধকারের দিকে, মাঝে মাঝে পায়ে আর উরুতে চাপড় মারছিলো ওরা, বোধ হয় মশাগুলো হুল বসিয়ে দিচ্ছিলো অলক্ষ্যে।

পিছন নৌকা থেকে হালের মাঝি বলে উঠেকিরে, অতো ছটফট করতাছি ক্যান?

আরে কইস না, মশার কামড়ে জানডা গ্যালো যে। সম্মুখে নৌকা থেকে জবাব দেয় একজন।

দ্বিতীয় জন বলে উঠে এতক্ষণ আইতেছে না ক্যান? মশা যে গাডার সব রক্ত শুইষা নিলো।

আরে লইতে দেও, লইতে দেও, মোটা টেহা পাইবাক্ষণ।

 এমন সময় লণ্ঠন হাতে এগিয়ে আসছে কতকগুলো তোক দেখা যায়। শোনা যায় তাদের চাপা কণ্ঠস্বর।

মাঝিদের একজন বলে উঠে-ঐতো আইসা পড়ছে।

অন্য মাঝি বলে–যা হোক এবার তো বাঁচা যাইবো। স্রোতে নাও ভাসাইয়া বইসা রইমু মশা বেটা ক্যামনে কামড়ায় দেইখ্যা নিমু।

পেছন থেকে হালের মাঝি বলে–গান গাইবা না?

 কও কি গান গান গাই, শেষে জানডা দিমু পুলিশের হাতে,

ততক্ষণে এসে পড়েছে প্রায় লণ্ঠন-হাতে লোকগুলো। নৌকাখানার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো তারা। সম্মুখস্থ লোকটা মাতব্বর আরফান ঠিক যেন সাক্ষাৎ আজরাইল। তার পিছনে আরও কয়েকজন লোক, তাদের মাঝখানে আট-নয়টা বালক-বালিকম। সবাই কাঁদছে, তবে উচ্চৈস্বরে নয়, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ওরা। একে, নিদ্রা জাগরণে তদুপরি অবিরত ক্রন্দনে ছেলে মেয়েগুলোর চোখগুলো লাল হয়ে উঠেছে।

 এবার নৌকাখানা থেকে মাঝি তিনজন নেমে এলো। সালাম জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, সবাই বেশ তটস্থ হয়ে উঠেছে তাদের দেখেই বুঝা গেলো। এতোক্ষণ মশার কামড় খেয়ে নানারকম কথার ফুলঝুরি আওড়াচ্ছিলো, এই মুহূর্তে সব থেমে গেছে। কণ্ঠ যেন রোধ হয়ে গেছে তাদের।

ধমক দিলো আরফান কিরে, তোরা ঠাই দাঁড়াই রইবি, না মাল উঠাইবি?

আরফানের আর একজন অনুচর বলে উঠলো–ওরা আজ হুস্ হারাইছে মালিক, দেখতাছেন না, কেমন টুব তাছে।

 আরফান সম্মুখস্থ মাঝিটার কান ধরে মোচড় দিলো–কিরে টুতাছিস? হুস নাই মাল উঠান লাগবো?

উঠাইতাছি মালিক। কথাটা বলে প্রথম মাঝি একটা ছেলেকে কাঁধে উঠিয়ে নেয় তারপর নৌকায় উঠে যায়।

নৌকাখানা গোলপাতা বোঝাই মনে হলেও আসলে গোলপাতা বোঝাই নয়, নৌকার মাঝখানে মজবুত ধরনের ছৈ আছে। ছৈ এর উপরে সুন্দর করে গোলপাতা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ টেরই পাবে না যে, ভিতরে ছৈ বা কিছু আছে।

নিচে থেকে সবগুলো ছেলে-মেয়েকে নৌকায় উঠিয়ে নেওয়া হলো, বসিয়ে দেওয়া হলো ছৈ এর মধ্যে।

ধমক দিলো আরফান নৌকায় উঠে–পোলাপান তোরা কাঁদছোতো গলা টিপা নদীতে ফেলাই দিমু।

আরফান উল্লার যেমন চেহারা তার গলার স্বর ছিলো তেমনি। ছেলে-মেয়েগুলো যারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো তারা স্তব্ধ হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। আরফানের অসাধ্য ছিলো না কিছু, নির্মম পাষন্ড ছিলো সে। ইচ্ছা করলে সে একটাকে গলা টিপে নদীবক্ষে ফেলে দিলেও তেমন কিছু তার যায় আসে না।

ছেলে-মেয়েগুলো মুহূর্তে কুঁকড়ে গেলো, একে এই রাতদুপুরে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তাদের আনা হয়েছে তদুপরি অন্ধকার নৌকায় ছৈ-এর মধ্যে যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো, সবাই এক কোণে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে রইলো, ভয়ে কেউ টু’শব্দটি পর্যন্ত করছে না।

আরফান তার সঙ্গের লোকগুলোকে বললো–তোমরা যাওগা, আজ রাতই নতুন মাল আনবার লাইগা ঢাকা রওয়ানা দিবা, বুঝলা? হ, হোনো, নারুকুল যা ষ্টিমারে আছে তার উপর শ’পাঁচেক আরও উঠাই লইবা।

আচ্ছা মালিক, তাই আইবো।

যাও, এইবার বেশি মাল আনতে চেষ্টা করবা।

 আচ্ছা।

আরফানের সঙ্গের লোকগুলো অন্ধকারে তলিয়ে যায়–ঠিক গর্তে যেমন করে লুকিয়ে পড়ে গুইসাপগুলো তেমনি। নৌকায় উঠে জেকে দাঁড়ায় এবার আরফান উল্লাহ, মাঝিদের লক্ষ্য করে বলে–ছৈ-এর দরজা গোলপাতায় ঠিক মতন ঢাইকা দে। দেহি মানুষ য্যান টের না পায়।

 মালিক সব ঠিক কইরা দিম, কওন লাগবো না।

 বেটারা না কইলে একটা কাম পারস না তা কয় কি না কওন লাগবো না। কথাগুলো মুখ ভেংচে কর্কশ গলায় বলে আরফান মাতব্বর।

 এবার মাঝিরা কেউ কথা বলতে সাহস পায় না, কারণ আরফান শুধু মালিক নয় তার খুশির উপর নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ। কাজেই সে যা বলে তাই তাদের মেনে চলতে হবে। একটু যদি এদিক-ওদিক হয়েছে তাহলেই সর্বনাশ চাকরি তো যাবেই, প্রাণ নিয়েও টানা-টানি। সোজায় ছেড়ে দেওয়ার ব্যক্তি নয় আরফান, কারণ সে তার গোপন ব্যবসার খোঁজ জানিয়ে দেয় গিয়ে বাইরের লোকজনকে। তাই আরফানের কাছে যারা চাকরি করে তারা আজীবন কাজ করবে বলে পাকা খাতায় নাম-ঠিকানা সব লিখে দেয়, সে কারণেই পালাতে চাইলেও কেউ পালিয়ে বাঁচতে পারে না আরফানের কাছ থেকে।

মাঝিরা এবার নীরবে মালিকের কথামত কাজ করে যায়, গোলপাতাগুলো দিয়ে বেশ করে ছৈ-এর মুখ ঢেকে দেয় ভাল করে।

বলে একজন মাঝি-মালিক এহন নাও ছাড় ম?

 ছাড়বি না তো কি রাইত পোয়াবি এহানে? নাও ছাড়।

নৌকা চলতে শুরু করলো।

আরফান উল্লাহ দৈত্যরাজের মত ছৈ-এর সম্মুখে গোলপাতার উপরে বসে পড়লো।

 জমাট অন্ধকারে নদী বেয়ে নৌকা এগুচ্ছে।

লগি ছেড়ে এবার দাঁড় টানতে শুরু করেছে মাঝিদ্বয়।

হাল ধরে বসে আছে ভোলানাথ মাঝি। সে বেশ চুপচাপ বসে আছে, কোনো কথা নেই তার মুখে। অন্ধকারে যেন জমে গেছে সে।

আরফান বললো–লয়ামিয়া ভার বুধা আইছো।

 হ’ মালিক। দাঁড় টানতে টানতে জবাব দিলো একজন।

ভোলানাথ বুঝি হালে?

হ।

সাবধানে নাও লইবা, বুঝলা?

 হ’ বুঝছি মালিক।

নৌকা চলেছে, শয়তান আরফান হয়তো মালের টাকার হিসাব করছে মনে মনে। এবার মাত্র নটা মাল পেয়েছে, আর অন্যান্য বার এরও বেশি মাল সে চালান দিতে পারে।

মাঝিদ্বয় হুম হুম শব্দ করে দাঁড় টানছিলো।

আরফান বললো–ব্যাটা তামাক সাজ দেহি একজন।

একজন বললো-বাতাস যে উল্টা বইছে মালিক, এহন নাও ছাইড়া দেওন যাইবো না। ভোলা দাদা, হাল ঠিক রাইখো।

আরফান অন্ধকারে বিড়ি ধরালো।

ছৈ-এর ভিতর থেকে তখনও ফুঁপিয়ে কাঁদার চাপা শব্দ বেরিয়ে আসছিলো।

আরফান ধমকে উঠলো আবার কে কাঁদতেছোস? গলা টিইপা ফেলাই দিমু নাকি?

 সঙ্গে সঙ্গে সব নীরব হলো, কাদার শব্দ থেমে গেলো চট করে।

নৌকা চলেছে অন্ধকারে, আরও দু’চারখানা নৌকা পাশ কেটে যাচ্ছে। কোনো কোনো নৌকা থেকে শোনা যাচ্ছে মাঝিদের গলার ভাটিয়ালী সুর–

আরে অ মাঝি বাই কোথা তুমি যাও।
ঘাটে নৌকা ভিড়াইয়া তুমি মোরে নিয়া যাও।

কে একজন আর এক নৌকা থেকে উচ্চকণ্ঠে বললো–কার নাও যায়?

আরফান চাপা স্বরে বললো-ভোলা কইয়া দেও ঝুলগাঁও এর নাও এডা।

পিছন নৌকা থেকে ভোলা উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলো–বুলান গাও এর নাও এডা।

 কিসের নাও? পুনরায় প্রশ্ন হলো।

 ভোলা বললো–গোলপাতার নাও। আর তোমাগো কিসের নাও? কই যাও তোমরা?

জবাব এলো–আমাগো খালি নাও। কাঠ আনবার যাইতাছি বাই।

 আবার নীরব চারিদিক।

জমাট অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। শুধু দাঁড়ের ঝুপঝাঁপ শব্দ আর পানির ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যায় না।

আরফান বিড়ি টানছে গোলপাতার স্তূপে ঠেস দিয়ে বসে। ছৈ-এর ভিতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই, ছেলে-মেয়েগুলো বোধ হয় কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে, রাত তো কম হয়নি।

দূরে নদীর পাড় দেখা যায়, কিন্তু বুঝা যায় না কিছু। গাছ-গাছড়া নজরে পড়ে না, শুধু অসংখ্য আলোর ফুলঝুরি দেখা যায়। জোনাকির আলো সেগুলো।

অন্ধকার আকাশে তারার মালা।

এতোগুলো তারা আকাশে ফুটে থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর অন্ধকার কিছুমাত্র লাঘব হচ্ছিলো না, অন্ধকার যেন আরও ঘনীভূত হয়ে আসছে।

প্রহরের পর প্রহর কেটে চলেছে, শুধু দাঁড় টানার কচ্ কচ্ শব্দ আর পানিতে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিলো না।

বহুদূর এসে পড়েছে নৌকাখানা।

 হঠাৎ দেখা যায় দূরে–অনেক দূরে একটা আলো দোলা খাচ্ছে।

আরফান বলে উঠে-ওরে ভোলানাথ?

কন?

আলো দেহেছিস না?

দেহেছি মালিক। জবাব এলো পিছন নাও থেকে।

বুধা আর লয়া তোরা দেখছো?

হ’ দেখছি।

তা নাও ফিরা, আমাগো এই ঘাটে নামাই দিয়া তোরা যা। শোন্ লয়া, আমোগো অনেক কাম আছে, বাড়ি যাইয়া একবার দেইখ্যা নিমু সবুর আলীর মাইয়া সহিনারে।

লয়া বলে উঠে–সহিনা কি করছে আপনাগো মালিক?

কি করছে কস্ তুই? আমাগো মান-সম্মান সব নষ্ট কইরা দিছে। তোগোরে শোনা লাগবে না, তোরা যাগা। ভোলা, অ’ ভোলো?

কন মালিক? পিছন থেকে শোনা যায় ভোলানাথের গলা।

 শুনছোস, এই যে সপলাঘাট, এহানে আমাগো নামন লাগবো।

আমি সব জানি মালিক, তাইতো অইদিকে নাও ফিরাই নিতাছি।

 হ’ তাই ল’।

 অল্পক্ষণে ঘাটে নৌকা ভিড়ালো।

লণ্ঠনের আলো এখন সরে এলো ঘাটে, দেখা গেলো একটা হাড়-জিরজিরে কঙ্কালসার লোক লণ্ঠন হাতে নৌকাখানার পাশে এসে দাঁড়ালোঘাট চিনতে পারছেন মালিক?

আরফান অট্টহাসি হাসলোতোরে রাখছি ক্যান? ঘাট চিনতে না পারলে তোর জান থাকবো?

মালিক, আমাগো কোনো দোষ নাই, আমি হরদিন ঘাটে দাঁড়াইয়্যা লণ্ঠন দোলাই, কবে কহন আইয়া পড়েন……

 বেশ কইরাছিস হবুল্লা, তোর মাইনা আর এক টেহা বাড়াই দিমু। আরফান নেমে পড়বার পূর্বে ভোলা আর লয়া এসে দাঁড়ায় তার সম্মুখে।

আরফান বলে– ভোলা, লয়া, তোরা তো জানোস, মালগুলা ঠিত পৌঁছাই দিয়া টেহা গুইনা নিবি।

ভোলা বলে–কত নিতে অইবে মালিক?

 সে কতা তোরে কইতে অইবে না, সব আমি বন্দবস্ত কইর‍্যা তবে মাল চালান দিছি। নে, তরা এবার নাও ছাড়। যে টুহুন ভয় আছিলো আমি সাথে আইলাম।

আচ্ছা মালিক। বললো ভোলানাথ!

আরফানের কথায় নৌকা আবার নদীবক্ষে ভাসলো। ঘাটে আর একখানা নৌকা ছিলো, . আরফান নৌকাখানার দিকে এগুতে এগুতে বললোহবুল্লা, জলদি মাঝিগো পাঠাই দেও, এহনই রওনা দিমু, রাত ভোর অইবার আগে…..

আর শোনা গেলো না, আরফানের মালবোঝাই নৌকাখানা তখন স্রোতের টানে অনেকখানি। সরে এসেছে। ধীরে ধীরে হবুল্লার হাতের লণ্ঠনখানা মিটমিটে হয়ে আসছে।

ঝুপঝাঁপ শব্দ তুলে চলেছে নৌকাখানা!

কোথায় চলেছে কে জানে।

ভোলানাথ বলে–বুধা বাই, এবার হালে আইসো, আমি সামনে যাই।

একি কথা ভোলা বাই, তুমি দাঁড়ে আইবা?

হ’ আমারে এবার……।

লয়া বলে উঠে–আমি তা অইলে হালে যাই, তুমি আমার বদলা আইসো।

তাই অউক, আইসো লয়া বাই।

 লয়া দাঁড়োনা নৌকার উপর তুলে রেখে ভোলার দিকে এগিয়ে যায়।

ভোলা এসে দাঁড় টানতে বসে।

ভোর হবার পূর্বেই তাদের সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হবে।

*

আরফান উল্লাহ সমস্ত গ্রামে তন্ন তন্ন করে সন্ধান চালিয়েও খুঁজে পেলো না সবুর আলীর মেয়েকে, সবুর আলী নিজেও বলতে পারে না কোথায় গেছে তার মেয়ে সখিনা। বুড়ো কেঁদে কেটে আরফানের হাত-পা ধরে অনেক অনুনয়-বিনয় করলো তবু রেহাই পেলো না সে শয়তান মাতব্বরের হাত থেকে, ধরে নিয়ে গেলো আরফান সবুর আলীকে তার গুদাম ঘরে। আদেশ দিলো সে অনুচরদের-ওর পিঠে চাবুক মাইরা চামড়া তুইল্যা লও, দেহি তাও মাইয়ার কথা কয় কিনা?

অনুচর একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সপাং সপাং করে আঘাত করতে শুরু করলো।

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো বুড়ো সবুর আলী-মারিস না, আমাগো মারিস না তোরা। মুই। কিছুই জানি না।

বল্ বেটা সহিনা কই গ্যাছে? তারে কোথা রাইখ্যা আইসেছিস বল? আরফান গর্জন করে উঠে।

খুব করে পিটানোর পর মজবুত দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে দিলো আরফান সবুর আলীকে তার নারকেল গুদামের মধ্যে।

তারপর বাড়ি এলো আরফান!

মাতব্বর গৃহিনী স্বামী সেবায় এগিয়ে এলো, ক্লান্ত ঘর্মাক্ত স্বামীকে হাত-পাখা দিয়ে স্বয়ং বাতাস করতে লাগলো।

বাড়ির ঝি-চাকর এরা সবাই খাবার আয়োজনে ব্যস্ত। আরফান খেতে বসলে সখিনা তার সম্মুখে খাবার রেখে গেলো। অবশ্য গৃহকর্তীর আদেশেই তাকে এসব কাজ করতে হচ্ছে।

আরফান বললো–এ মাইয়্যা আবার কে?

গৃহিনী বললো–নতুন রাইখেছি, কাজ-কাম বালোই করে।

 এতোগুলোন ঝি চাকর তাও তোমাগো অয় না? রাহো যত পারো রাহো, টাহা তো আর তোমাগো দেওন লাগবে না।

 খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে আরফান।

খেতে খেতে আরফান যখন কথগুলো বলছিলো সব কানে গিয়েছিলো সখিনার–যাক, তবু তাকে চিনতে পারেনি শয়তানটা। মনে মনে আলম ভাইকে সে ধন্যবাদ জানায়, তার বুদ্ধির তারিফ না করে পারে না।

আরফানের পরিত্যক্ত এটো থালা-বাসন নিয়ে সখিনা যখন কূয়োতলায় যাচ্ছিলো হঠাৎ বৈঠকখানা থেকে শোনা গেলো আরফানের চাপা কণ্ঠস্বর, কাউকে যেন বলছে সে-বাদল, সব. দেখছোস? সব জায়গা?

হাঁ, সব দেহেছি মালিক? সমস্ত গাঁও খান তন্ন তন্ন করে দেহেছি তাও সহিনার কোনো খোঁজ পাইলাম না।

 এ গাঁওটা তো দেখা অইছে, পাশের গাও দেখছোস তোরা?

ই মালিক, পাশের গাঁও-ও আমরা খুঁইজ্যা খুইজ্যা হয়রান পেরেশান অইছি, কিন্তু কোনোহানে তারে পাইলাম না।

ঠিক বুড়ো সবুর আলীর চক্রান্ত, সে-ই মাইয়ারে কোথাও সরাইয়া রাখছে। বাদল, যতক্ষণ বুড়ো তার মাইয়ার খোঁজ না দেয় ততক্ষণ ওরে হাত-পা বাইন্দ্যা চাবুক মারবি, বুঝলি?

হ’ বুঝছি মালিক।

আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো সখিনা, মাতব্বর আরফান আর বাদলার কথা শুনে শিউরে উঠলো সে। সর্বনাশ, তাকে না পেয়ে শয়তানটা তার বাপের উপর অত্যাচার চালিয়েছে। কি করবে সে, কি করে বাপকে উদ্ধার করবে কোনো উপায় যে নেই তার। এক্ষুণি যদি সে বাপকে উদ্ধারের জন্য আত্নপ্রকাশ করে তাহলে রক্ষা নেই, শয়তান আরফান তার সর্বনাশ করবে।

মনঃকষ্ট সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই তার, ধৈর্য ধরে প্রতীক্ষা করতে থাকে সখিনা, কবে ফিরে আসবে সেই মহৎ ব্যক্তিটি–যে তার আলম ভাই।

এখানে যখন সখিনা পিতার জন্য অস্থির চিত্ত নিয়ে আলম ভাই-এর প্রতীক্ষা করতে থাকে তখন আলম ভাই কোথায় কে জানে!

*

মাল বোঝাই গোলপাতাওয়ালা নৌকাখানা সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সূর্যের আলোতে চারিদিক ঝলমল করলেও এ বনের মধ্যে তেমন করে আলো প্রবেশ করতে সক্ষম হচ্ছিলো না। সুন্দরী গাছ আর গোলপাতার ঝাড়ের ঘন ছায়ায় বেশ অন্ধকার লাগছিলো।

একটা সরু নদী বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকাখানা।

ভোলানাথ মাঝি হাল ধরে বসে বসে ঝিমুচ্ছে আর মাঝে মাঝে হাই তুলছে। লয়া আর বুধা মাঝির অবস্থাও সেইরকম। সারা রাত দাঁড় টেনে টেনে হাত ব্যথা হয়ে গেছে। যদিও ভোলা কিছুক্ষণ দাঁড় টেনেছিলো মাঝ নদীতে তবু লয়ার কম খাটুনি হয়নি।

বললো লয়া–কি কাম বাইছা নিছিলা, জানডা গ্যালো। এতো মাল চালান আনি, পয়সা দেয় কয়ডা!

ভোলা বললো–তোরে তাও বালোই দ্যায় মালিক, আমাগো যে কত দেবেন কে জানে।

আজকাল মাল বেশি পাওন যায় না, তাইতো মালিক পয়সা কম দেয়। এর আগে যা মাল আসতো, মালিক পয়সাও দিতো বালো। কথাগুলো বললো বুধা মাঝি।

লয়া বললো–নে অতো কওন লাগবে না, দেহি আর ক’ক্ষ্যাপ দিমু তারপর গুদামের কাম। নিমু। মালিক পয়সা যদি বেশি দেয় তাহলে এ কামই করুম। বিড়ি ধরা একডা দেহি? 🙂

বুধা পকেট থেকে বিড়ি বের করে অগ্নি সংযোগ করলো।

পরম নিশ্চিন্তে বিড়ি ধরিয়ে টানতে শুরু করলো ওরা।

 ছৈ-এর মধ্যে তখন মৃদু মৃদু কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

জেগে উঠেছে বুঝি ছেলে-মেয়েগুলো।

 ভোলানাথ বললো–বুধা, দ্যাখতো বাচ্চাগুলোন জাইগ্যা উঠছে নাকি?

বুধা উঠে গিয়ে গোলপাতা সরিয়ে উঁকি দেয়। দেখতে পায় কেউ কেউ জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। বললো সে হ’ বাচ্চাগুলো জাইগ্যা উঠছে।

ভোলা বললো–অগো খাইতে দে বুধা, বোধ হয় খিদা পাইছে।

মুখ ভেংচে বলে উঠে বুধা–আঃ কি আরামের কতা কইছো ভোলা বাই, মন্ডা মিঠাই দ্যাওন লাগবো।

ভোলানাথ বললো–তাহলে ওরা খাইবোনা? এতো বেলা অইছে?

 লয়া বললো এবার–আজ নতুন কতা কইতেছো ভোলা বাই? লাও-এর মধ্যে কারে কবে খাইতে দেয়?

তা অইলে তোমরা যে খাইলা? আমি যে খাইলাম?

আমরা খাইমুনা তো নাও বাইমু ক্যামনে?

ভোলানাথ আর কোনো কথা বললো না, হাল ধরে চুপচাপ বসে রইলো।

নৌকা চলেছে।

ছৈ-এর মধ্যে কাঁদতে শুরু করেছে বাচ্চাগুলো।

ভোলার কেমন কষ্ট লাগছিলো, মায়া হচ্ছিলো তার মনে। বোধ হয় মনে পড়ছিলো বাড়ির কথা, তার ছেলের কথা। না জানি কেমন আছে তার বাচ্চাটা।

এখন যে নদী ধরে নৌকা এগুচ্ছিলো সে নদীটা বেশ ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে ভিতরের দিকে। দু’পাশের গোল-পাতার ঝাড় ঝুঁকে এসেছে নদীর উপর। বেচা কাঁটার ঝাড় আর সুন্দরী গাছের ডালগুলোও হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছে যেন দু’ধারে।

সুন্দরবন তো আর সীমাবদ্ধ নয়, ধরতে গেলে সীমাহীন। চারিদিকে শুধু ঘন বন আর বন। অসংখ্য সুন্দরী গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাজার হাজার মাইল ধরে বনের পরিধি। সুন্দরবনের মাঝ দিয়ে অসংখ্য নদী প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এসব নদী কইর‍্যা নদী থেকেই শাখা বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত সুন্দরবনের মধ্যে।

এমনি একটি ছোট নদী ধরে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে নৌকাখানা। ক্রমান্বয়ে জঙ্গলটি যেন আরও ঘন মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে হরিণ আর হরিণী নদীতে পানি পান করতে এসে তাদের নৌকা দেখে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিলো।

ভোলা অবাক হয়ে দেখছিলো এসব, এর পূর্বে সে সুন্দরবনে আসেনি কিনা। সুন্দরবনের মধ্যে যতদূর দৃষ্টি চলে যায় পরিস্কার–বেশ সচ্ছ, কোথাও যেন একটি পাতা পর্যন্ত পড়েনি। ভালই লাগছে এখন ভোলার।

কিন্তু এখন যে সরু নদী ধরে তাদের নৌকাখানা চলেছে সে নদীর দু’পাশে ঘন ঝোঁপঝাড় আর জঙ্গল। কেমন যেন গুমোট ভাব চারিদিকে।

আপন মনে লয়া আর বুধা দাঁড় বাইছিলো।

ভোলা বসে আছে হাল ধরে।

 বুধা বললো–এ জাগাড়া বালো নয়, বাঘের ভয় আছে।

 লয়া বললো–চুপচাপ নাও বাইয়া যা, কতা কইসনা কইলাম।

লয়ার কথা শেষ হতে না হতে হুম করে জঙ্গলের মধ্যে একটা আওয়াজ হলো, সমস্ত বনভূমি। যেন কেঁপে উঠলো থর থর করে। বুধা আর লয়া দাঁড় ফেলে দুজন দুজনাকে জড়িয়ে ধরলো। শোনা গেলো বুধার গলা–

–বাঘ, বাঘ আইছে—

 ভোলা সামনে তাকাতেই একটা বিরাট চিতাবাঘ গর্জন করে নৌকার দিকে এগিয়ে এলো।

মুহূর্তে ভোলা তার কাপড়ের ভিতর থেকে বের করে নিলো মস্তবড় সূতীক্ষ ধার ছোরাখানা, প্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়ালো সে দ্রুতগতিতে।

সঙ্গে সঙ্গে চিতাবাঘটা লাফিয়ে পড়লো নৌকার উপর।

ভীষণভাবে আক্রমণ করলো বাঘটা ভোলাকে। ভোলা আর বাঘ মিলে শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ।

লয়া আর বুধা তখন সম্মুখ নৌকার পাটাতনে বসে এ ওকে জড়িয়ে ধরে থরথরিয়ে কাঁপছে। মাঝে মাঝে মুখ উঁচু করে বুধা দেখে নিচ্ছে বাঘের সঙ্গে ভোলার লড়াইটা।

নৌকাখানা দোল খাচ্ছে, এই বুঝি ডুববে এবার।

ছৈ-এর মধ্যে বাচ্চাগুলো এক সঙ্গে চিৎকার করে কাঁদা শুরু করে দিয়েছে–সে এক ভয়ঙ্কর। অবস্থা।

সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নেই কোন মানুষের চিহ্ন, কে এগিয়ে আসবে তাদের উদ্ধার করতে।

 ভোলা মরিয়া হয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে।

লয়া আর বুধা গড়াগড়ি খাচ্ছে নৌকার পাটাতনে।

গোলপাতায় ঢাকা ছৈ-এর মধ্যে ছেলে-মেয়েগুলোও লুটোপুটি খাচ্ছে। ভোলা তার সূতীক্ষ্ণ ছোরাখানা দিয়ে বাঘটাকে কাবু করার চেষ্টা করছে।

ভীষণ চিতাবাঘ, অসম্ভব তার শক্তি, সহজে কাবু করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না ভোলানাথের পক্ষে।

বাঘের নখের আঁচড়ে ভোলার শরীরের কয়েক জায়গায় ক্ষত হয়ে যায়, দরদর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তবু ভোলা কিছুতেই ক্ষান্ত হচ্ছে না।

হঠাৎ বাঘটা আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো নৌকার উপরে। ভোলা তখন হাঁপাচ্ছে ভীষণভাবে। দেহের কয়েক জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে রীতিমত।

বাঘটা লুটিয়ে পড়তেই নৌকার দোলা থেমে এলো ধীরে ধীরে। লয়া আর বুধা এবার পাটাতন থেকে উঠে উঁকি দিলো, মাথা উঁচু করে দেখতে লাগলো বাঘটা গেলো কোথায়।

ভোলার রক্তাক্ত দেহটার দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো বুধা, নৌকার পাশ দিয়ে এগিয়ে জড়িয়ে ধরলো-হায় হায়, একি অইছে তোমার ভোলা বাই?

হঠাৎ দৃষ্টি গেলো নৌকার উপরে পড়ে থাকা চিতাবাঘটার উপরে, আনন্দে চিৎকার করে উঠলোলয়া বাই, দ্যাহ-দ্যাহ, ভোলা বাই, বাঘডা মাইরা ফ্যালাইছে। বাঘডা মাইরা ফ্যালাইছে।

ধড়ফড় করে ছুটে এলো লয়াকও কি? কও কি? ভোলা বাই বাঘডা মাইরা ফ্যালাইছে?

 হ’ দেইখ্যা যাও।

লয়া গিয়ে অবাক হয়ে দেখলো, বিরাট চিতাবাঘটা কাৎ হয়ে পড়ে আছে, সূতীক্ষ্ণধার একখানা ছোরা ঠিক বুকের মাঝখানে বিদ্ধ হয়ে আছে তার। চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে বাঘটা শেষবারের মত।

 লয়া তাকালো ভোলার দিকে, দু’চোখে তার অফুরন্ত বিস্ময়। বাঘটার দিকে একবার তাকিয়ে ভোলাকে জাপটে ধরলোভোলা বাই, তোমাগো গায়ে এতো শক্তি?

 তাড়াতাড়ি গামছাটা ছিঁড়ে পানিতে ভিজিয়ে ভোলানাথের দেহের ক্ষতগুলো বেঁধে দিলো ওরা।

আবার নৌকা চলছে।

বাঘটা ওরা ফেলে দিলো না, লয়া ও বুধার ইচ্ছা–মালিককে দেখিয়ে ভোলা ভাইকে কিছু। বখশীস নিয়ে দেবে। অবশ্য উদ্দেশ্য আছে ভোলা ভাই যদি মোটা বখশীস পায় তাহলে কিছুটা আসতো তাদের হতেও।

 ভোলার দেহের ক্ষত তেমন গভীর বা মারাত্মক ছিলো না। তাই সে সামলে নিলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। আবার সে হাল ধরে বসলো।

এবার নৌকাখানা বেশ স্রোতের টানে ভেসে চলেছে। দু’পাশের ঘন ঝোঁপঝাড় আরও যেন। ঘন আর ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে। সুন্দরবনে এমন অসুন্দর স্থান আছে ভাবতে পারা যায় না।

এক জায়গায় এসে নৌকা থেমে পড়লো।

 লয়া বললো–আইয়া পড়ছি, নেও নাও বাঁধে।

নৌকা বেঁধে লয়া পকেট থেকে একটা হুইসেল বের করে ফুঁ দিলো খুব জোরে। একবার দু’বার তিন বার।

সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের অভ্যন্তর থেকে ঠিক ঐ রকম হুইসেলের শব্দ ভেসে এলো পরপর তিন বার।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চারজন বলিষ্ঠ লোক সরু সরু শিকল আর দড়ি হাতে বেরিয়ে এলো গহন বনের মধ্য থেকে। এক একজনের চেহারা যেন এক একটা সাক্ষাৎ শয়তান। নৌকার নিকটবর্তী হতেই বাঘটার উপর নজর পড়লো তাদের, সঙ্গে সঙ্গে ভোলার রক্তমাখা দেহটার দিকে দৃষ্টি ফেলেই আঁতকে উঠলো। কিছুক্ষণ কেটে গেলো ওদের তাল সামলাতে। সব শুনে অবাক হলো ওরা, ভোলানাথকে ধন্যবাদ জানাতে লাগালো।

 এবার ছেলেমেয়েগুলোকে মজবুত করে হাত বেঁধে নামিয়ে নিলো নৌকা থেকে, তারপর গরু-ছাগলের মত হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চললো।

বনের মধ্য দিয়ে সরু পায়ে চলা একটা পথ।

পথটা ক্রমান্বয়ে এগিয়ে গেছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে।

বুধা নৌকায় রইলো, লয়া আর ভোলানাথ চললো ওদের সঙ্গে সঙ্গে।

বেশ কিছুটা চলার পর দেখা গেলো একটা তাবু খাটানো রয়েছে।

চারপাশে গাঢ় বন, তাঁবুটা বনের আড়ালে যেন ঢাকা পড়ে গেছে একে বারে খুব নিকটে না গেলে দেখা যায় না তাঁবুটা। তাবুর আশে পাশে সুন্দরী কাঠের স্তূপ।

লোক চারজন আর ভোলানাথ ও লয়া মিয়া ছেলে-মেয়েগুলোসহ তাবুর কাছাকাছি এসে পড়লো। তাঁবুর সম্মুখে কয়েকজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে দেখা গেলো। আর দু’জন মাড়োয়ারী বাবুও আছে তাদের মধ্যে।

ছেলে-মেয়েগুলোসহ এরা পৌঁছতেই সবাই তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করলো। আরও কয়েকটা ছেলেমেয়েকে তাঁবুর মধ্যে রাখা হয়েছে। এই বাচ্চাদের তাঁবুর মধ্যে নিয়ে হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হলো। বাচ্চারা সাবই কাঁদছে, তবে জোরে বা চিৎকার করে নয়। কে একজনের চোখমুখ কেঁদে কেঁদে রাঙা হয়ে উঠেছে। ক্ষুধায় পিপাসায় চোখ বসে গেছে এক একজনের। ঠোঁটগুলো শুকিয়ে উঠেছে চটচটে হয়ে। কারো বা গালে চাপড়ের দাগ, কারো বা গলায় আংগুলের ছাপ। হয়তো বা গলা টিপে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে ক্ষান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো।

আরও আশ্চর্য, তাঁবুর মধ্যে যে ছেলে-মেয়েগুলোকে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাদের কারো এক চোখ অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কারো হাতখানা মুচড়ে ভেঙে পিছন দিকে বেঁধে রাখা হয়েছে। কারো বা একখানা পা কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যার চোখ অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তার। চোখ দিয়ে তখনও রক্ত আর পুঁজ গড়িয়ে পড়ছে, ব্যথায় ছেলেটা একেবারে শুকিয়ে গেছে–সেকি মর্মান্তিক নিদারুণ দৃশ্য। সুন্দরবনের অন্তরালেও এমন এক জঘন্য ব্যবসা চলেছে কে তার সন্ধান জানে। কাঠের ব্যবসার নাম করে এরা সুন্দরবন সরকারের কাছে পেয়েছে সুন্দরবনে প্রবেশের ছাড়পত্র।

লয়া আর ভোলা ছেলে-মেয়েগুলোসহ তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করতেই একজন সাহেবী পোশাক পরা লোক এগিয়ে এলো, তারপর এক এক জনের মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো।

ভোলানাথ আর লয়া দাঁড়িয়ে রইলো একপাশে।

ছেলে-মেয়েগুলোকে পরীক্ষা করা শেষ করে সাহেবটা বসলো গিয়ে চেয়ারে। আরও কয়েজন বসেছিলো এক একটা চেয়ারে, সাহেব তাদের সঙ্গে কি যেন আলাপ করতে লাগলো।

ভোলা আর লয়াকে বিশ্রাম করার জন্য তাবুর বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো।

 ওরা এবার কিছু পাউরুটী আর চিনি এনে দিলো ভোলা আর লয়ার সম্মুখে।

ক্ষুধা পেয়েছিলো, গোগ্রাসে পাউরুটী আর চিনি গিলতে শুরু করলো ওরা দু’জনা।

তাঁবুর মধ্যে ছেলে-মেয়েগুলোকে কি খেতে দিলো বুঝা গেলো না, হয়তো শুকনো পাউরুটীই দেওয়া হয়েছে তাদের।

 গোটা রাত জাগরণে লয়া আর ভোলার চোখ মুদে আসছিলো, খাওয়া-দাওয়া সেরে তাবুর বাইরে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে সেইখানে শুয়ে পড়লো গামছা বিছিয়ে।

ঘুম ভাঙলো যখন তখন বেলা প্রায় গড়িয়ে গেছে।

ভোলা আর লয়ার খাবার ডাক পড়লো।

তাঁবুর বাইরেই এক জায়গায় পাক হচ্ছিলো। ভোলা আর লয়া সেখানে এসে খেতে বসলো, দেখলো আরও কতকগুলো লোক খেতে বসেছে সার হয়ে। কিন্তু সেখানে ছেলে-মেয়েগুলো নেই। সাহেব বাবু গুলোও বোধ হয় ভিতরে বসেছে।

মিথ্যা নয়, তাঁবুর মধ্যে বসেছে মালিকের দল আর একপাশে মাটিতে বসে খাচ্ছে বালক বালিকার দল।

বেলা গড়িয়ে এসেছিলো, খাওয়া শেষ করে তাঁবুর মধ্যে পুনরায় ডাকা হলো ভোলানাথ আর লয়া মিয়াকে।

ভোলা আর লয়া তাবুর মধ্যে প্রবেশ করতেই দেখলো কয়েকটা ছেলে-মেয়েকে হাত বেঁধে সার করে রাখা হয়েছে। একজন স্যুট পরা লোক ছেলে-মেয়েগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে দর কষাকষি করছে। হাত ভাঙা অন্ধ আর খোঁড়া ছেলেগুলো আছে সে দলের মধ্যে। নতুন যেগুলো নিয়ে আসা হলো সেগুলো এখন মওজুত রইলো পরের মহাজনের জন্য।

কারণ তাদের কারো হাত ভেঙে, পা খোঁড়া করে, চোখ অন্ধ করে ব্যবসায় উপযোগী করে ভোলা হবে। অবশ্য যে ছেলে-মেয়েগুলো বেশি সুন্দর তাদের এ সব করা হয় না, তাদের কাউকে ঘেটুদলে, কাউকে বা যাত্রাদলের মালিক ক্রয় করে নিয়ে যায়। বড় বড় নাচিয়েরা নিয়ে যায় মেয়েগুলোকে, ভবিষ্যতে এরা নাচনেওয়ালী বা বাঈজী হবে। দেশ হতে দেশান্তরে চলে যায় এসব হারানো ছেলে-মেয়েগুলো। কেউ সন্ধান জানে না, কোথায় গেলো আর কোথায়ই বা যায় তারা। পত্রিকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি, রেডিওতে হারানো সংবাদ প্রচার ছাড়া কেউ কোনো দিন খুঁজে পায় না এইসব ছেলে-মেয়েদের। থানা পুলিশে জানিয়েও কোনো সমাধান হয় না ছেলেধরার। কি ভয়ঙ্কর নির্মম জঘন্য এই ছেলে-হারানো ব্যাপারটা।

 দেশের সবচেয়ে জঘন্য আর কুৎসিত ব্যাপার হলো ছেলে-হারানো ব্যাপার। যারা কালের ভবিষ্যৎ, যাদের উপর নির্ভর করছে আগামী দিনের মঙ্গল সেই সব অমূল্য সম্পদ শিশুদের নিয়ে চলেছে ভয়ঙ্কর নারকীয় এক ব্যবসা।

 প্রতিদিন কত শত শত সন্তানকে পিতামাতার বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, গোপনে ফুসলিয়ে নানাভাবে হরণ করা হচ্ছে এইসব অসহায় অবুঝ শিশুদের। কি ভয়ঙ্কর কি সাংঘাতিক ব্যাপার। কিন্তু আজও এই ছেলেধরা ব্যাপার নিয়ে কেউ তেমন করে মাথা ঘামায় না, তেমন করে ভাববার সময়ও যেন নেই কারো। অথচ দেশ ও সমাজের সবচেয়ে বড় আর নৃশংস কান্ড এই ছেলে হারানো।

সুন্দরবনের অভ্যন্তরেও চলেছে এই কুৎসিত ব্যবসা।

ভোলা আর লয়ার ফিরে যাওয়া আজ হলো না, রয়ে গেলো সেদিনের মত ছেলেধরার তাবুতে। পরদিন টাকা-পয়সা নিয়ে রওয়ানা দেবে তারা গোলপাতা বোঝাই নৌকাযোগে।

 তাঁবুর মধ্যে একপাশে শুয়ে আছে ওরা, নাক ডাকছে ভোলা আর লয়া, নৌকা ঝোঁপের মধ্যে গুঁজে রেখে বুধাও এসেছে। নৌকায় রাত কাটানোর মত সাহস হয়নি তার। সুন্দরবন বাঘ-ভল্লুকের রাজ্য ভয় পাবারই কথা।

 ঘুমিয়েছিলো ভোলানাথ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো তার। একটা চাপা করুণ আর্তনাদ শোনা গেলো তাঁবুর মধ্যে। চাদর সরিয়ে উঁকি দিলো ভোলানাথ যে দৃশ্য দেখলো সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠলো সে কি ভয়ঙ্কর কান্ড! একটা বালককে হাত-পা পিছমোড়া করে বেঁধে মাটিতে শুইয়ে দু’জন বলিষ্ঠ লোক চেপে ধরে আছে আর একজন ভদ্র লোকের মত চেহারা লোকটি ছেলেটার চোখে অস্ত্রোপচার করে চলেছে। লুণ্ঠনের আলোতে ভোলানাথ দেখলো, লোকটা একখানা সূতীক্ষ্ণ ধার ছুরি দিয়ে বালকটার একটা চোখ তুলে নিলো।

ছেলেটা যন্ত্রণায় তীব্র আর্তনাদ করছে কিন্তু মুখ মজবুত কাপড়ে বাঁধা থাকায় আর্তনাদটা ঠিক চাপা গোঙ্গানির মত শোনাচ্ছে। ছেলেটার চোখ দিয়ে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে গড় গড় করে। কি সাংঘাতিক দৃশ্য! এক একটা করে দুটো চোখই উপড়ে ফেলা হলো।

ভোলানাথ দু’হাতে চোখ ঢেকে ফেললো, মুখটা বিকৃত হয়ে উঠলো তার।

ছেলেটার চোখে এবার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হলো, তারপর খুলে দিলো ওর হাত ও পায়ের বাঁধন। এবার ছেলেটাকে শুইয়ে দিলো তাঁবুর মেঝেতে একটা খেজুর পাতার চাটাই-এর উপরে।

তারপর আর একটি ছেলেকে নিয়ে আসা হলো ভদ্রলোকটার পাশে।

আর একজন সাহেব, বাবু মানে স্যুট-পরা ভুড়ি-মোটা লোক যে এখানে ছেলেধরা দলের মালিক, সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছিলো, সে বললো–ডাক্তার এর চোখ অপারেশন না করে একটা হাতের আংগুল অপারেশন করে নিন, আর দু’টো কান।

হেসে উঠলো ডাক্তার-বাঃ চমৎকার নতুন ধরনের মাল তৈরি হবে তাহলে।

 হাঁ, আমার ইচ্ছা এখন থেকে বিভিন্ন ধরনের বিকৃত মাল আমদানী করবো আমি।

পরপর চললো এমনি কয়েকটা অপারেশন।

ভোলানাথ সব দেখলো, কিছু বলবার উপায় নেই তার। বললে ওরা শুনবেই বা কেন। চুপচাপ শুয়েই রইলো সে।

রাত শেষ প্রহর। ভোলা তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো, যদিও বাঘের আঁচড়ে তার দেহের কতকগুলো জায়গায় বেশ ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিলো তবু সে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সে লক্ষ্য করেছিলো, ওদিকে ঝোঁপের মধ্যে নদীবক্ষে একটা ছোট্ট মোটর-বোট রাখা হয়েছে। যদিও ভোলার ভয় হচ্ছিলো, না জানি কোন মুহূর্তে বাঘ ভল্লুক আচমকা তাকে আক্রমণ করে বসবে।

 দুঃসাহসী ভোলানাথ মোটর-বোটখানায় চেপে বসলো। তারপর বেরিয়ে এলো ঝোঁপের মধ্যে হতে মাঝ নদীতে। কিছুদূর ধীরে চালিয়ে নিয়ে স্পীড বাড়িয়ে দিলো, ঠিক ঐ মুহূর্তে একটা বিরাট মোটা রশি হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরলো তার দেহটা। চারিদিক অন্ধকার হলেও ভোলানাথ বুঝতে পারলো, তার দেহে কোনো রশি বা দড়ি জড়িয়ে যায়নি, তার দেহে একটা হিমশীতল বরফের মত ঠান্ডা কিছু জড়িয়ে গেছে; সেটা অন্য কিছু নয়–সাপ।

ভোলানাথ বুকে সাহস সঞ্চয় করে নিলো তার কাপড়ের তলায় ছিলো সেই ছুরিখানা যে ছুরিখানা দিয়ে সে বাঘটাকে হত্যা করেছিলো। ভোলা ছুরিখানা বের করে সাপটার দেহে সজোরে বসিয়ে দিলো পর পর কয়েকবার। আশ্চর্য সাপটা সরাৎ করে তার দেহ থেকে লাফিয়ে পড়লো পানির মধ্যে।

ভোলা মুক্তিলাভ করলো, বুঝতে পারলো ােেটর বোটখানা যখন ঝোঁপের মধ্যে রাখা হয়েছিলো তখন ঐ সর্পরাজ আশ্রয় নিয়েছিলো বোটখানার ভিতরে। তারপর বোটখানা যখন চলতে শুরু করেছিলো সেই মুহূর্তে হটাৎ জড়িয়ে ধরেছিলো তার দেহটাকে।

যা হোক, মস্ত বাঁচা বেঁচে গেলো ভোলানাথ, পালানো তার আর হলো না। ওদিকে পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে ক্রমান্বয়ে, ভোলা দ্রুত মোটর-বোটখানা ধারে ভিড়িয়ে নিয়ে পুনরায় ফিরে গেলো তাঁবুতে। আলগোছে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লো চাদর মুড়ি দিয়ে।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে ভোলানাথ তার খেয়াল নেই। এক সময় ঘুম ভেঙে গেলো কিন্তু শরীরটা একান্ত ব্যথা বোধ হওয়ায় শুইয়ে রইলো সে।

তাবুর মধ্যে তখন সবাই জেগে উঠেছে।

ভোলানাথের কানে গেলো–ডাক্তার, ছেলেগুলোকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছেন তো?

 হাঁ দিয়েছি না হলে এতোক্ষণ তবু মাথায় তুলতে।

 আমাদের কদিন এখানে অপেক্ষা করতে হবে?

অন্ততঃপক্ষে এক সপ্তাহ, না হলে ওদের চোখের ঘা শুকাবে না। দু’টোর পায়ে আর হাতে অপারেশন হয়েছে, সেগুলোও সারতে কয়েক দিন লাগবে।

কিন্তু আমার আশঙ্কা হচ্ছে হঠাৎ যদি ফরেষ্ট অফিসার এসে পড়ে? কিংবা আর কোনো সাহেব—

এতোদূর তারা আসবে না, তাছাড়া এসেও যদি পড়ে মুখ বন্ধ করতে কতক্ষণ। টাকা টাকার কাছে সব মুখ বন্ধ সাহেব, সব মুখ বন্ধ—হাঃ হাঃ হাঃ—–সবাই জানে, আমরা কাঠের ব্যবসা করি—

 তুমি ঠিক বলেছো ডাক্তার, টাকার কাছে সব চুপ হয়ে যায়। যেমন পুলিশের মুখ বন্ধ করে দিয়েছি আমরা। সেবার ধরা পড়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু বড় সাহেব জানবার আগেই ছোটখাট মুখ বন্ধ করে দেওয়ায় বড়দের কানে আর যায়নি, তাই বেঁচে গেলাম।

আমাদের কোনো চিন্তা নেই তেমন, কারণ সিপাই পুলিশগুলো তো আমাদের পয়সায় বেঁচে আছে। তবু সাবধানে থাকতে হয় এই যা। হাঁ এবার মালবাহী ষ্টিমারে শুধু থাকবে সুন্দরী কাঠ আর তলার চোরা ক্যাবিনে থাকবে আসল মাল, হঠাৎ যেন ধরা পড়ার ভয় না থাকে।

*

পরপর কতদিন গত হয়ে চললো হরি মালিকের জন্য ঘাবড়ে উঠলো একেবারে। সব সময় মনটা অস্থির থাকে, না জানি কোথায় গেলে কি হলো তার।

হরি তো ঢাকা শহরের প্রায় পথঘাট সব চিনে নিয়েছে, প্রায়ই সে স্কুটার ধরে চলে আসে সদরঘাটে। নিপুণ দৃষ্টি মেলে লক্ষ্য করে প্রতিটি ষ্টিমার লঞ্চ আর নৌকা। সমস্ত দিন ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখে ফিরে যায় সন্ধ্যায় হোটেলে।

স্কুটার থেকে নেমে অবশ পা দু’খানা টেনে প্রবেশ করে ভিতরে। হোটেলের সম্মুখস্থ জাতীয় পতাকাগুলো পতপত করে তার দিকে তাকিয়ে যেন বিদ্রুপের হাসি হাসে।

 সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় রফিকের ডাকে–কিরে হরি, সাহেব এলো?

কন্ঠ যেন শুকিয়ে গেছে, মাথা নেড়ে জানায় না আসেনি।

এগিয়ে আসে রফিক আজ কদিন হলো গেছে আজও ফিরে এলো না, কোনো বিপদ আপদ ঘটেনি তো?

শিউরে উঠে হরি, অসহায় ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকায়, কোনো জবাব দিতে পারলো না সে, হয়তো বা চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছিলো তাই তাড়াতাড়ি রফিকের দৃষ্টি এড়িয়ে উঠে গেলো উপরে।

পরদিন আবার হরি স্কুটার ধরে চলে এলো সদরঘাটে বাটা জুতোর দোকানের সম্মুখে, নেমে এগুতে লাগলো বেডকভার আর পঞ্চের স্যান্ডেলের দোকানগুলোর পাশ কটিয়ে, একেবারে সোজা ঘাটে এসে হাজির হলো। সদরঘাটে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো, আজ মনটা যেন বেশি অস্থির লাগছে হরির। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে মন তার চাইছে না।

 ওয়াইজ ঘাটের দিকে এগুতে লাগলো হরি, হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গেলো একটা ষ্টিমার তখন ঘাটে ভিড়ছে কেবলমাত্র। হরির চোখকে ফাঁকি দেওয়া কারো সাধ্য নয়, চমকে উঠলো–এইতো সেই ষ্টিমার যদিও ষ্টিমারের গায়ে নামটা সে পড়তে পারলো না তবু সে চিনে নিলো সহজে! এই সেই ষ্টিমার যে ষ্টিমারে নিরুদ্দেশ হয়েছে তার মনিব বনহুর।

 হরি মনোযোগ সহকারে দেখলো, ষ্টিমার বোঝাই শুকনো নারকেল রয়েছে, আস্তে আস্তে ভিড়ছে ষ্টিমারখানা ওয়াইজ ঘাটে। হরির মন আশায়–আনন্দে উফুল্ল হয়ে উঠলো। নিশ্চয়ই সে ফিরে এসেছে। ষ্টিমার ঘাটে ভিড়লেই নেমে পড়বে।

অদূরে দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে রইলো হরি ষ্টিমার খানার দিকে।

ষ্টিমার ঘাটে লেগে গেছে।

কিন্তু কই সে তো ষ্টিমার থেকে নেমে এলো না।

এক মিনিট দুমিনিট করে ঘন্টা কেটে গেলোকয়েকজন নেমে পড়লোকারো বা হাতে বাজারের থলে কারো হাতে তেলের শিশিসবাই সওদা করতে নামছে।

একটা দাড়িওয়ালা খাকি পোশাক-পরা বেশ বলিষ্ঠ লম্বা-চওড়া চেহারার লোক সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে, সমস্ত শরীরে তেল কালির ছাপ।

 হরি এবার খুশি হলো, তার মনিব ছাড়া এ লোকটা কেউ নয়। পিছু নিলো হরি লোকটার।

লোকটা ঘাটের অদূরে একটা পান-বিড়ির দোকানে দাঁড়িয়ে এক খিলি পান কিনে গালে পুরলো তারপর এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো।

হরি একটু দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছে লোকটাকে।

লোকটা এবার কতকগুলো ফল মূলের দোকানের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো কিছু পাকা কলা কিনে নিলো সে।

পয়সা মিটিয়ে এগুতে লাগলো সম্মুখে।

হরি ভেবেছিলো ফল কিনে লোকটা ফিরে আসবে ষ্টিমারে কিন্তু সে এগুতে লাগলো সদরঘাট ছেড়ে সম্মুখে। হরির সন্দেহ আরও দৃঢ় হলো–তার মনিব ছাড়া কেউ নয়।

লোকটা সদরঘাট ত্যাগ করে একটা বাসে উঠে পড়লো। হরিও উঠে পড়লো সেই বাসে। ঠাসাঠাসি অবস্থা, কেউ কারো দিকে তাকাবার সময় নেই বা উপায় নেই। অনেক কষ্টে হরি লোকটার উপর লক্ষ্য রাখলো।

বাসখানা লিয়াকত এভিন্য হয়ে কোর্টের সম্মুখ দিয়ে এগিয়ে চললো। অসংখ্য জনতা আর যান বাহনের ভিড় অতিক্রম করে দ্রুত এগুচ্ছে। মাঝে মাঝে কন্ডাকটরের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে গুলোস্থান—নিউ মার্কেট.–গুলোস্তান—নিউ মার্কেট–

বাসে ভিড় যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে, কতকগুলো লোক ভিতরে স্থান না পেয়ে গাড়ির হ্যান্ডেল ধরে বাদুর–ঝোলা হয়ে চলেছে। প্রখর সূর্যের তাপে জান ত্রাহি ত্রাহি করছে সবার।

কন্ডাকটরের তীব্র চিৎকার গুলোস্তান—নিউ মার্কেট—

একটা বাস স্টপেজে বাসটা দাঁড়িয়ে পড়তেই কয়েকজন লোক নেমে পড়লো, ঠিক যেন দৈত্যরাজ উদরপূর্ণ হওয়ায় কিছুটা উদগীরণ করলো।

একটু ফাঁক পেয়েই দাড়িওয়ালা লোকটা বসে পড়লো সামনের আসনে, কলাগুলো রাখলো কোলের উপর।

গুলিস্তান পেরিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সম্মুখ হয়ে গাড়ি এগুচ্ছে। সেক্রেটারীয়েট গেটের মোড় ঘুরতেই একটা বাস স্টপেজ। গাড়ি থামাতেই কতকগুলো লোক নেমে পড়লো দড়বড়।

এবার দাড়িওয়ালা লোকটা নেমে পড়লো কলার ঝোপা নিয়ে। ভিড়ের মধ্যে হরিও নেমে দাঁড়ালো সকলের অলক্ষ্যে।

দাড়িওয়ালা লোকটা চারদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে ফুটপাত ধরে চলতে লাগলো।

হরিও চলেছে তাকে অনুসরণ করে। তার মনিব যদি হবে সে–তবে মাঝপথে নেমে পড়বে কেন, সোজা সে চলে যেতো ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল অভিমুখে। একটা গলির দিকে চলতে লাগলো দাড়িওয়ালা লোকটা। দক্ষিণ হস্তে তার কলার ঝোপা। হঠাৎ একটা পুলিশের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতেই পুলিশ পিঠ চাপড়ে দিলো দাড়িওয়ালার কি ভাই, ব্যবসা কেমন চলছে?

দাড়িওয়ালা পুলিশটাকে দেখে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলো চট করে সামলে নিলো নিজকে, হেসে বললো-ব্যবসা চলছে একরকম মোটা মুটি, খুব ভাল নয়।

কিছু দিবি আজ?

বেশি নেই, গোটা বিশ নিতে পার আজ।

বিশ টাকা দিয়ে কি হবে বেটা বলতো?

এই আছে এখন, নাও।

কলা কি হবে?

 মাল খুঁজছি, কলা দিয়ে টোপ ফেলবো।

 যা, যা বেটা, মোটা কিছু না দিলে দেখবি মজাটা—

আচ্ছা সিপাহী জী, সালাম।

সালাম।

দাড়িওয়ালা যে তার মনিব নয় এতোক্ষণে বুঝলো হরি। পুলিশ আর দাড়িওয়ালা যখন কথা হচ্ছিলো তখন হরি একটু দূরে দাঁড়িয়ে বাদাম ভাজা চিবোচ্ছিলো।

পুলিশের সঙ্গে দাড়িওয়ালা কথা শেষ করে চলে যায়। হরি আবার আড়ালে আত্মগোপন করে অগ্রসর হয়। মালকিসের মাল? বুঝতে পারে না হরি পুলিশ আর দাড়িওয়ালার কথাবার্তা।

অলিগলি ঘুরে একটা চায়ের দোকানে এসে বসলো লোকটা। এক খিলি পান গালে পুরে। দিয়ে সিগারেট ধরালো কিন্তু লোকটা এখন বেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে বলে মনে হলো! সিগারেট টানছে আর তাকাচ্ছে সামনের দিকে। ওদিকেই কয়েকখানা দালান কোঠা, প্রাচীরঘেরা ছোট্ট– বাগান। বাগানে কয়েকটা ছেলে-মেয়ে খেলা করছে।

দাড়িওয়ালা কিছুক্ষণ বসে বসে হাই তুলে উঠে দাঁড়ালো, কলার ঝোপা হাতে নিয়ে এগুতে লাগলো। ঠিক সেই দন্ডে একটা বল এসে পড়লো প্রাচীরটির বাইরে।

দাড়িওয়ালা বলটা হাতে তুলে নিলো।

সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীর টপকে লাফিয়ে পড়লো আট-ন’ বছরের একটা ফুটফটে বালক। বালকটা লাফিয়ে পড়েই চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, অন্বেষণ করেছে সে তার বলটার।

দাড়িওয়ালা হেসে এগিয়ে এলো–খোকা বল। হাত উঁচু করে বলটা দেখালো।

খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো বালকটার চোখ দুটো, ছুটে গেলো দাড়িওয়ালার পাশেবল দাও।

আগে বলো তোমার নাম কি?

 খোকা হাত বাড়িয়ে বললো–ফিরোজ।

বাঃ বাঃ চমৎকার নাম তো খোকা, আমার ছেলের নামও ফিরোজ ছিলো। বলটা হাতে দিলো খোকার। …

খোকা দাড়িওয়ালার করুণ কণ্ঠ শুনে গম্ভীর মুখে বললো–কেন, তোমার ছেলে নেই?

না বাবা, আজ ছ’মাস হলো মারা গেছে। ঠিক তোমার মতই দেখতে ছিলো।

 ঠিক আমার সমান বুঝি?

হাঁ, ঠিক তোমার সমান।

কি হয়েছিলো তোমার ছেলের?

একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করার ভান করে বললো দাড়িওয়ালা–গাড়ি চাপা পড়ে—

বলো কি?

হাঁ। বাবা কোলে এসো, তোমাকে কোলে নিয়ে প্রাণ জুড়াই। এসো,এসো বাবা—হাত বাড়ালো খোকার দিকে।

খোকা মোহগ্রস্তের মত এগিয়ে গেলোলোকটার দিকে।

দাড়িওয়ালা খোকাকে গভীর স্নেহে কোলে টেনে নিলো, তারপর বললো-কলা খাবে? নাও। খাও বাবা।

একটা কলা ছিঁড়ে হাতে দিলো লোকটা বালকের।

খোকা মনে করলো, আহা বেচারার ছেলে মারা গেছে, সখ করে যখন কলা দিচ্ছে, খাই না। কেন। খোকা কলার খোসা ছড়িয়ে খেতে শুরু করলো।

দাড়িওয়ালা পরপর দুটো কলা ওকে খোসা ছাড়িয়ে দিলো। খোকা খেলো, বললো–আর.. খাবে?

খোকা বললো– না, আর খাবো না।

দাঁড়াও বাবা তোমার হাতমুখ মুছে দি! লোকটা এবার পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে খোকার হাত-মুখ পরিস্কার করে দিতে লাগলো। মুখের কাছে রুমালটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখলো।

একি, খোকা লোকটার কোলের উপর ঢলে পড়েছে।

অদূরে পানের দোকানে দাঁড়িয়ে পান চিবুতে চিবুতে একটা গাছের আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছিলো হরি, অবাক হয়ে গেলো–চিৎকার করে জানাবে না দেখবে কি করে সে।

লোকটা কলার ঝোপা আর বলটা পথে ফেলে দিয়ে বালকটাকে কোলে তুলে দ্রুত বাড়িটার পাশের গলির মধ্যে অদৃশ্য হলো।

হরিও খুব তাড়াতাড়ি আত্মগোপন করে অনুসরণ করলো।

লোকটা চারিদিকে সর্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগুচ্ছে, যেমন কোনো লোক সম্মুখে পড়ে যাচ্ছে। তখন বলছে সেখোকা, খোক একটু সোজা, হ’বাবা, মাজাটা যে আমার ধরে গেলো।

এমনি নানা কথা বলতে বলতে বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালো ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বেবী ট্যাক্সি চলে যাচ্ছিলো। লোকটা ডান হাত তুলে ডাকলো–বেবী—-বেবী—

বেবী ট্যাক্সিটা তার সম্মুখে এসে থেমে পড়লো।

দাড়িওয়ালা লোকটা বলে–ছেলেটা রৌদ্রে একেবারে ঘেমে গেছে। খোকা, খোকা ঘুমিয়ে পড়লি বাবা? একটু সোজা হ’বাবা। নাঃ ঘুমটা বড় জেকে গেছে দেখছি–চলো সদরঘাট।

বেবী ট্যাক্সি ছুটতে শুরু করলো।

হরি মুষড়ে পড়লো মুহূর্তের জন্য–কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার, নিশ্চয়ই লোকটা ছেলেধরা। তার মনিব ঐ ষ্টিমারেই তো চলে গেছে এমনি এক ছেলেধরার পিছনে।

হরির মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি এলো, তার মনিবকে খুঁজে বের করতে হলে ঐ ষ্টিমারকেই ফলো করতে হবে। আর একটা বেবী ট্যাক্সি ডেকে চেপে বসলো হরি–চলো সদরঘাট।

 অল্পক্ষণেই সদরঘাটে পৌঁছে গেলো হরি।

তাড়াতাড়ি বেবীর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়লো হরি, তারপর ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে চললো। চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো কিন্তু ততক্ষণে দাড়িওয়ালা কোথায় ডুব মেরেছে দেখা গেলো না। নিশ্চয়ই সে তার ষ্টিমারে পৌঁছে গেছে।

 হরি একসময় তার চিহ্নিত ষ্টিমারের নিকটে পৌঁছে গেলো। অবাক হয়ে দেখতে থাকে তাকিয়ে তাকিয়ে।

 হঠাৎ তার কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে ফিরে তাকালো, চমকে উঠলো হরি দেখলো দাড়িওয়ালা তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।

হরি ভড়কে গেলো মুহূর্তে, তাহলে কি দাড়িওয়ালা টের পেয়ে গেছে তার কার্যকলাপ। কিন্তু পরক্ষণেই তার সন্দেহ দূরীভূত হলো। দাড়িওয়ালা বললো–কি দেখছিস বেটা?

থতমত খেয়ে বললো হরিবাবু কোনো কাজ—

 কাজ করবি?

 হাঁ বাবু। পেট ধরে বলে–দু’দিন পেটে কিছু পড়েনি।

তোর মা-বাপ আছে?

 মা আছে, বাপ নেই। বাবু কোনো কাজ থাকলে—

 আয় তবে।

 কি কাজ করতে হবে বাবু?

নারকেল তুলবি আর নামাবি পাক করতে পারিস?

পারি কিছু কিছু।

 পাকের জোগাড় দিবি।

আচ্ছা।

 মাস হিসাবে থাকবি?

থাকবো। কত মাইনে দেবেন বাবু?

কত চাস বেটা বল?

বিশ টাকা করে দেবেন।

আচ্ছা তাই হবে। দাড়িওয়ালা ভাবলো এতো কম মাইনে ভালই হলো। ছেলেটার চেহারা ভাল, বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কাজেই ওকে নিয়ে ষ্টিমারে উঠে গেলো।

হরিকে দেখে এগিয়ে এলো কয়েকজন, একজন বললো–এইটাও লইয়া আইলা নাকি?

কেন পছন্দ হচ্ছে না?

অইবোনা কেন? খুব অইছে। বাঃ বাঃ দুদিন পর এক বুড়ারে ধইর‍্যা আনবা হামিদ বাই।

নে বেশি বকবক করিস্ না হাবলু নিয়ে যা ওকে কাজ বাতলে দে। আজ থেকে ও আমাদের এখানে চাকরি করবে।

বালোই অইলো, ছোঁড়া দেখতে বালোই কামও বালোই করবো মনে অয়। তা কত টেহা মাইনা দিবা ঠিক কইর‍্যা আনছো হামিদ বাই?

বিশ টাকা।

বাঃ বাঃ আরও বালো—

নে চুপ কর। আরে এতক্ষণ তোর নামটা শোনা হয়নি, কি নাম তোর?

মাথায় বাধা গামছাটা আর একটু ঠিক করে নিয়ে বলে হরি–আমার নাম মামুদ।

 মামুদ।

 হাঁ বাবু।

 যা কাজ দেখে নেগে।

চলে যায় হরি হাবলুর সঙ্গে। যেতে যেতে কানে আসে কে যেন বললোহামিদ বাই, তুমি বড় লাকী মানুষ, না অইলে প্রথম ক্ষেপেই একটা বালো মাল পাও। তারপর বিশ টেহাতে চাকর পাও-~

এরপর আর কিছু শোনা গেলো না। হরিকে নিয়ে হাবলু তখন ষ্টিমারের নিচের তলায় নেমে চলেছে। যেতে যেতে দেখলো হরি, একটা কামরার মধ্যে কতকগুলো লোক বসে কি সব খাচ্ছে, মদ হবে। শিউরে উঠলো হরি। কিন্তু এসে যখন পড়েছে তখন পালাবার পথ আর নেই।

 হরি মনোযোগ দিয়ে কাজে লেগে পড়লো, অল্পক্ষণেই ষ্টিমারের প্রত্যেকের মন জয় করে নিলো সে। এমন একটা কাজের ছেলে পেয়ে খুশি হলো তারা।

আরও চার দিনে তিনটা ছেলে সগ্রহ করে নিলো ওরা।

মাঝে মাঝে নারকেলের খরিদ্দার আসে, কিছু নারকেল বিক্রিও হয়। নারকেল ব্যবসার অন্তরালে চলে ছেলেধরা ব্যবসা।

রেডিও সংবাদে ঘোষণা শোনা যায়, ছেলে-হারানো সংবাদ।

ষ্টিমারেও বসে ট্রানজিষ্টার শুনে ছেলেধরার দল, হাসে ওরা হা হা করে। হরিও চা পরিবেশন করতে করতে শোনে সব, শিউরে উঠে ওর মন–হ্যায়, এইভাবে কত কার সর্বনাশ এরা করে চলেছে, এর কি সমাধান বা শেষ নেই? হরি নিজের চোখে দেখেছে পুলিশ পর্যন্ত এদের সহায়তা করে চলেছে। এতো নির্ম জঘন্য ব্যাপার কয়টা টাকার লোভে ওরা—ছিঃ ছিঃ ঘৃণায় মন ওর বিষিয়ে উঠে।

হরি যখন এসব ভাবছে তখন হামিদ বলে উঠে হাবলু, আর বেশি দেরি করা চলবেনা মাল যা পাওয়া গেছে সেই যথেষ্ট।

বললো হাবলু–ভয় কি, পুলিশগুলা তো সব আমাগো হাতের মধ্যে। টেহা দিলেই চোখ বুইজ্যা আর এক দিক চইল্যা যাইবো। দেইখাও দ্যাখযো না তারা বুঝলা?

 হামিদ বলে উঠে-পুলিশগুলোকে হাত রেখেছি তাই বলে থানা অফিসারগুলো তো আর আমাদের হাতে নেই?

 তা ঠিক কইছো হামিদ বাই বড় দারোগা যা রাগী মানুষ। এক পয়সা নাহি ঘুষ লয় না।

 ঐ তো মুস্কিল, কোনো রকমে থানা অফিসারের চোখে পড়ে গেলে আর রক্ষা নেই। তখন ঐ ছেচড়া পুলিশগুলো কিছু করতে পারবেনা, টাকা দিয়েও ফল হবে না। সবাই তো আর ঘুষ নেয় না।

সেদিনই সন্ধ্যায় ষ্টিমার ছাড়লো ছেলেধরার দল। এবার তাদের চারটা মাল সংগ্রহ হয়েছে– খুব খুশি নয় ওরা।

 হরিও চললো, না গিয়ে তার কোনো উপায় ছিলো না। তার মনিবও একদিন এই ষ্টিমারে উধাও হয়েছে। যেমন করে থোক তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

হরি দুঃসাহসে বুক বেঁধে ছেলেধরার ষ্টিমারে পাড়ি জমালো। যতই সে এদের কার্যকলাপ দেখে অবাক হচ্ছে ততই নিজকে সামলে নিয়ে তাল মিলিয়ে চলছে। কি ভয়ঙ্কর সাংঘাতিক মানুষ এই ছেলেধরার দল!

ষ্টিমার এগিয়ে চলেছে, হরি গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে ছোট্ট ক্যাবিনটার মেঝেয় কিন্তু চোখে তার ঘুম নেই।

হঠাৎ একটা শব্দ হলো, চোখ তুলে তাকালো হরি–দেখলো একজন কে যেন তার ক্যাবিনে প্রবেশ করলো। অন্ধকারে চেনা যাচ্ছে না কে লোকটা। ভয় হলো হরির কি উদ্দেশ্য নিয়ে লোকটা। এ ক্যাবিনে এসেছে?

হরি নিশ্বাস বন্ধ করে পড়ে রইলো।

ভারী জুতোর শব্দ শোনা যাচ্ছে, আর শোনা যাচ্ছে ষ্টিমার চলার ঝকঝকানি শব্দ।

হরি পিট পিট করে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।

একটা আলো জ্বলে উঠলো ক্যাবিনের মধ্যে, সামান্য ক্ষীণ আলো। সেই আলোকরশ্মিতে দেখতে পেলো হরি সেই দাড়িওয়ালা আর তার পিছনে দু’জন লোক। কেবিনের দেয়ালে চাপ দিতেই একটা দরজা বেরিয়ে এলো। হরি স্পষ্ট শুনতে পেলো ছোট্ট বালকের কাঁদার শব্দ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কোনো বালক যেন।

লোকগুলো ক্যাবিনে প্রবেশ করলো, চাপা ধমকের শব্দ কানে এলো হরির–চুপ করে ঘুমো, না হলে এই দেখ ছোরা, কেটে ফেলবো দু’টুকরা করে।

হরি আঁতকে উঠলো কি ভয়ঙ্কর মানুষ এরা।

চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো সে স্তব্ধ হয়ে।

*

ভোলানাথ, লয়ামিয়া আর বুধা গোলপাতা বোঝাই নৌকা নিয়ে ফিরে চললো, এবার তারা খুলনা হয়ে সপলায় যাবে। গোলপাতা ছেড়ে দিয়ে কিছু শুকনো নারকেল কিনে তবেই ফিরবে। তারা। গোলপাতার কাজ শেষ হয়েছে–এখন নারকেলের প্রয়োজন।

লয়া বাঘের চামড়াটা ছাড়িয়ে সঙ্গে নিয়েছে, ভোলার এ ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ নেই, যত আগ্রহ বুধা আর লয়ার।

কইর‍্যা নদী হয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তাদের নৌকা। কাল রাতের অন্ধকারে এসেছিলো, আজ দিনের আলোয় ফিরে চলেছে। সূর্যের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে যেন। দু’পাশে সুন্দরবন–শুধু বন আর বন! বিস্তৃত প্রান্তর জুড়ে সুন্দরী গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বনের মধ্যে যতদূর দৃষ্টি চলে যায় পরিস্কার ঝকঝকে–মনে হয়, কে যেন ঝাড় দিয়ে রেখেছে। সুন্দরবনের মধ্যে একটি জিনিস দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তাদের, সে হলো সুন্দরী গাছের ফাঁকে মাটিতে অসংখ্য শিং যেন মাথা উঁচু করে আছে। ঠিক যেন গরুর শিং-এর মত জিনিসগুলো। এগুলো যে কোনোরকম গাছ বা গাছের শিকড় তাতে কোনো ভুল নেই।

মাঝে মাঝে বালির চর নজরে পড়তে লাগলো অবাক হলো ভোলানাথ, সেই সব বালির চরে সূর্যের আলোতে গা মেলে দিয়ে শুয়ে আছে অনেক ছোট-বড় কুমীর। তাদের নৌকা চলার শব্দ পেয়ে হুড়মুড় করে কুমীরগুলো নেমে পড়লো নদীর মধ্যে।

 কোথাও বা হরিণী তার শিশুগুলোসহ নদীতীরে পানি পান করছে, একটু শব্দ পাওয়ামাত্র চকিতে পালিয়ে গেলো বনের অন্তরালে।

 কোথাও বা চরে অগণিত বক সাদা ধপধপে পাখা মেলে রোদ পোয়াচ্ছে, কেউ বা লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে বালির উপর। কেউ বা একপা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পানির ধারে চুপটি করে পুটি মাছের আশায়।

 বুধা বড় শয়তান হুম করে একটা শব্দ করলো–সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র বলাকার দল ডানা মেলে উড়ে উঠলো আকাশে। অপূর্ব সুন্দর এ দৃশ্য।

সুন্দরবনের বিস্তৃত অংশের মধ্যে আঁকাবাঁকা অসংখ্য নদী।

এদিক থেকে চলে গেছে ওদিকে। নদীর দু’পাশ গোলপাতা আর বেঙ্কলের গাছ মাথা নুইয়ে যেন অভিনন্দন জানাচ্ছে। পিছনেই সুন্দরী গাছ কাঁচি ছাটার মতই যেন মনে হয় দূর থেকে। সব গাছগুলোই প্রায় এক সমান, কোনোটাই ছোট বড় নয়। সুন্দরবন নামটা সার্থক নাম তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অপূর্ব সুন্দরের সমাবেশ যেন এই সুন্দরবনে।

 বেলা গড়িয়ে পড়লো চৌকানী পৌঁছতে, এটা কোনো বন্দর বা জাহাজঘাটা নয়। নদীতীরে একটা ছোটোখাটো গ্রাম। সুন্দরবন শেষ হতেই দেখা যেতে লাগলো নদীর দু’ধারে গোলপাতার ছাউনী ছোট ছোট কুঁড়েঘর। আরও দেখা গেলো নদীর দু’তীরে উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ অগণিত ছেলে মেয়ে–অবাক হয়ে তারা দেখছে নৌকাগুলো। কেউ বা ঢিল ছুড়ছে কেউ বা হাততালি দিয়ে ধেই ধেই করে নাচছে। কোনো কোনো ছোট বালক হাত নেড়ে ডাকছে নৌকাগুলোকে।

 চৌকানী ছাড়তেই শুরু হলো ভৈরব নদী। প্রশস্ত নদী। অসংখ্য নৌকা-ষ্টিমার তাদের নৌকাখানার পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। প্রায় নৌকাগুলোই সুন্দরী কাঠ বা গোলপাতা বোঝাই হয়ে ফিরে চলেছে খুলনার দিকে। কোনো কোনো নৌকা, ষ্টিমার এবং জাহাজ চলেছে বিভিন্ন বন্দর অভিমুখে।

নানা ধরনের জলযান দেখা যেতে লাগলো।

কোনো কোনো লঞ্চে চলেছে শিকারী দল, কেউ বা চোখে গগলস লাগিয়ে ডেকে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বা বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দূরে দেখছে। কারো বা হাতে বন্দুক শোভা পাচ্ছে। সৌখিন শিকারী দল এরা, তাতে কোনো ভুল নেই।

চালনা বন্দরে পৌঁছতে সন্ধ্যা লেগে গেলো।

 লয়ার নির্দেশে চালনা বন্দরে নৌকা ভিড়ালো ভোলানাথ। এখানে কিছু ডাব আর চিড়া-গুড় কিনে নিলো লয়া পথে খাবার জন্য। ডাব খুব সস্তা, প্রায় দুতিন আনা মাত্র জোড়া। এত সস্তা। ডাব এর আগে দেখেনি ভোলানাথ। সে কয়েকটা কেটে পানি পান করে তৃপ্তি লাভ করলো। লয়া। আর বুধা বসলো চিড়ার পুটলী নিয়ে। পেট পুরে ওরা চিড়া গুড় খেয়ে খানিক্ষণ বিশ্রাম করে নিলো। চালনায়।

 ভৈরব নদী হয়েই তারা খুলনা বন্দর অভিমুখে চললো।

সেখানে গোলপাতা বিক্রয় করার পর কিছু নারকেল কিনে পুনরায় রওয়ানা দেবে তাদের গন্তব্যস্থান সপলা গ্রাম অভিমুখে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ফিরবে তারা আরফান উল্লাহর নারকেলের গুদামে।

*

একদিন লেগে গেলো, হরিসহ হামিদের দল এসে পৌঁছলো আরফান উল্লাহর গুদামে।

এরা যখন এসে হাজির হলো তখন গুদামে হই-হুঁল্লোড় পড়ে গেছে, গুদামের একটা কক্ষে পাওয়া গেছে পঁচা একটা লাশ। লাশটা ঠিক কার বুঝা মুস্কিল পঁচে একেবারে বিকৃত হয়ে পড়েছে। গুদামকক্ষের চৌকির নীচ থেকে পাওয়া গেছে লাশটা।

 থানা-পুলিশ জেনে ফেললে মহা মুস্কিল হবে, কাজেই গোপনে লাশটা পুঁতে ফেলার চেষ্টা করলো আরফান উল্লাহ। দিনে এ কাজ সমাধা করা সম্ভব নয়, কাজেই লাশটা গুদামঘরের এক নিভৃত কোণে রেখে দিলো বস্তা চাপা দিয়ে।

হামিদ আর আরফান উল্লাহ নতুন মাল নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে লাগলো। ছেলে চারটিকে নারকেল স্তূপের আড়ালে একটা ছোট কুঠরীর মধ্যে বন্দী করে রাখা হলো। ওরা ঐখানে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

হরি নতুন লোক, তাই ওকে বিশ্বাস নেই, গুদামঘরের বাইরে চালাঘরের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।

হরি কিন্তু এখানে এসে ভীষণভাবে ভড়কে গেছে, যার অন্বেষণে সে এতোদূর এসে পড়লো–সে কই। হরি যেন ক্রমান্বয়ে অস্থির হয়ে পড়ছে। তারপর যখন সে শুনতে পেলো, গুদামঘরের চৌকির নিচে একটা পঁচা লাশ পাওয়া গেছে তখন তার হৃদপিন্ড যেন কেউ ছিঁড়ে ফেললো টুকরা টুকরা করে, মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগলো–তার মনিবকে কেউ হত্যা করে ফেলেনি তো?

সমস্ত দিন হরি নানারকম দুশ্চিন্তায় কাটালো। রাতে গুদামঘরের এক কোণে শুতে গিয়ে ভাবছে নানা কথা। সে শুনেছে রাত চারটায় লাশটা সরিয়ে ফেলা হবে।

এখন রাত দু’টো, সবাই ঘুমিয়ে আছে।

 হরি শুধু জেগে আছে, আজ তার ভয়-ভাবনা সব যেন উড়ে গেছে কোথায়। চারিদিক নিস্তব্ধ হরি চুপিচুপি উঠে পড়লো, আলগোছে অগ্রসর হতে লাগলো গুদামঘরের মধ্যে। লোকগুলো সব কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ওদিকে লাশটাকে রাতে পুঁতে ফেলার জন্য গর্ত করে রাখা হয়েছে। যারা লাশটাকে পুঁতে ফেলবে তারাও একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিলো, কারণ কিছু পরেই তাদের উঠে পড়তে হবে।

হরি গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করলো বড় গুদামটার মধ্যে। হাবলুর শিয়রে রাখা টর্চটা তুলে নিলো সন্তর্পণে। আবার অগ্রসর হলো, সোজা সে গুদামের মধ্যে নারকেল স্তূপের আড়ালে এসে দাঁড়ালো। একটা বিকট গন্ধ তার নাকে প্রবেশ করলো–সে দুর্গন্ধ কি! হরি বুঝতে পারলো, এটা সেই পঁচা লাশের গন্ধ। নাকে কাপড় চাপা দিলো। হরির মাথায় সর্বদা একটা গামছা বাঁধা থাকতো, যখন হরি পাজামা পরতো তখন সে ব্যবহার করতো টুপি। এক মুহূর্তের জন্যও হরির। মাথা থেকে গামছা বা টুপি সরে পড়তো না।

হরি নাকে কাপড় চাপা দিয়ে টর্চ জ্বেলে ভয়-বিহ্বলচকিত পদক্ষেপে এগুতে লাগলো। ঐ তো ওখানে বস্তাটার নিচে লাশটা ঢাকা আছে। ভয়ে হরির বুক কেঁপে উঠলো–হাজার হলেও লাশ তো! কিন্তু পিছিয়ে গেলে চলবে না, দেখতেই হবে ঐ মৃতদেহটা কার? তার মনিবের সন্ধানেই সে এসেছে এভোদ্র। কিন্তু কই, এখানেও তো পেলো না তাকে–তবে কি তার মনিবকে কেউ হত্যা করে ফেলেছে–ও লাশটা কি তারই….না না, তা হতে পারে না……হতে। পারে না…..তার মনিবকে কেউ হত্যা করতে পারে না। তবে সে গেলো কোথায়? হরি শিউরে উঠলো মনে মনে, তবু কম্পিত পদক্ষেপে লাশটার পাশে এসে দাঁড়ালো, বস্তাটা চট করে সরিয়ে টর্চের আলো ফেললো লাশটার মুখে। বিকৃত লাশটার মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই হরি চিৎকার করে উঠলো–না না, সে নয়….সে নয়….সে নয়…..

 অমনি হরির মুখে হাতচাপা দিলো কে যেন, হরি চমকে ফিরে তাকাতেই বিস্ময়ে অস্ফুট ধ্বনি করলো–কে–কে তুমি?

অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পেলো না, শুধু বলিষ্ঠ একখানা হাত তার মুখে এসে পড়েছিলো।

হরির কণ্ঠস্বরে লণ্ঠন হাতে ছুটে এলো কয়েকজন—স্বয়ং আরফান উল্লাহও। আজ সে বাড়ি না গিয়ে গুদামঘরেই ঘুমিয়েছিলো, কারণ লাশটা পুঁতে না ফেলা পর্যন্ত সে নিশ্চিন্ত নয়।

অন্যান্যের সঙ্গে আরফানও এসে দাঁড়ালো তার গুদামঘরের নারকেল স্তূপের আড়ালে।

 লণ্ঠনের আলোতে আরফান উল্লাহ বলে উঠলো-ভোলানাথ তুমি?

 হরিও তাকালো ভোলানাথের মুখে, আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো হরির চোখ দুটো।

আরফান বললো–এতো রাতে এহানে কি করছিলা তোমরা?

ভোলা জবাব দিলো–আমরা রাতে ঘাটে আইসেছি, তারপর গুদামে আসতে অনেক রাইত। অয়, তাই কাউরে না ডাইক্যা শুইয়া পড়ছিলাম।

লয়া আর বুধা আইসে?

না, ওরা নাও-এ আছে। নারকুল বোঝাই নাও, তাই একা রাইখ্যা আইবে কেমুন কইর‍্যা?

 তা এহানে তুমি আর ঐ ছোকরা ক্যা?

লাশটা দেখতে আইসেছিলাম মালিক? বললো ভোলা! হরির কথা বললে হয়তো সে কোনো বিপদে পড়তে পারে তাই সে নিজের কথা বললো।

হরি তো থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে, এতক্ষণ যে একটা ভয়-ভাবনা-দুশ্চিন্তা তার মনে ঝড় তুলেছিলো সব যেন শেষ হয়ে গেছে, ভোলার দর্শনে অনাবিল এক শান্তি এসেছে তার মনে। আরফানের ভয়ঙ্কর চেহারা আর ভীষণ গর্জনে সে এখন এতোটুকু ভীত নয়।

আরফান বললো–লাশ দেখতে আইছিলা কিন্তু ও কেন তোমাগো সাথে?

হেসে বললো ভোলানাথ–আমারে একা ভয় লাগে তাই অরে সঙ্গে আনছি।

 লাশের কি দেখছ?

দেখছিলাম কার এ অবস্থা অইছে।

চিনতে পারলা?

 চিনতে পারমু না মালিক, এ যে গফরা।

 গফরা?

 হ মালিক।

গফরারে আমি না ক্ষ্যাপে পাঠাইছি, মাল লইয়া গ্যাছে সে দক্ষিণ গাঁও?

 ভোলা হরির হাত থেকে টর্চটা নিয়ে ফেললো লাশটার মুখেভাল কইর‍্যা দেহেন মালিক।

আরফান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো, সে এমন ভাল করে লক্ষ্যই করেনি। গন্ধে। নিকটেই যায়নি সে। এখন ভালভাবে তাকিয়ে চিনতে ভুল হলো না, বললো–তাই তো, এ যে দেখতাছি গফরা। হায়, গফরারে কে এমন কইর‍্যা মারলো?

গফুরের হত্যা ব্যাপার ঘটেছিলো আজ থেকে বেশ কয়েকদিন আগে। স্বয়ং বনহুর ওকে। হত্যা করে গফুর সেজে সে গিয়েছিলো মাল নিয়ে।

অন্যান্যের সঙ্গে ভোলাও যোগ দিয়ে গফুরের লাশ পুঁতে রাখলো মাটির তলায়। লাশ গোপন করার পর নিশ্চিন্ত হলো আরফান উল্লাহ।

*

ভোলানাথ মাঝিকে একসময় নিভৃতে পেয়ে হরি পাশে এসে দাঁড়ালো, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললো–স্যার, আপনি চলে এলেন আর গেলেন না?

তাই বুঝি তুমি আমার সন্ধানে এসেছো?

 হাঁ স্যার! সত্যি আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম একেবারে। তা আপনি ভোলানাথ সেজে,

হেসে উঠলো ভোলানাথ-বেশি বনহুর-হাঁ, ভোলানাথ সেজে আমি ছেলেধরার আসল ঘাটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি।

কোথায় সে ঘাটি?

 সুন্দরবনের অন্তরালে।

সুন্দরবন!

হাঁ, বনটা সুন্দরই বটে কিন্তু তার ভিতরেও যে চলেছে ভীষণ এক জালিয়াতি কুৎসিত ব্যবসা। তুমি কেন এলে হরি, তোমাকে নিয়ে আমি একটা সমস্যায় পড়লাম।

অভিমান-ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো হরি–তাহলে আমি চলে যাই!

পা বাড়ালো হরি সামনের দিকে।

বনহুর ওকে ধরে ফেললো খপ করে হরি।

না না, আমাকে ছেড়ে দিন, যেতে দিন আমাকে।

বনহুর হরিকে বাহুবন্ধনে বেঁধে ফেললো–সকলের চোখে ধূলো দিতে পারো হরি কিন্তু আমার চোখে নয়।

একি, ছেড়ে দিন বাবু, ছেড়ে দিন।

 উ হু ছাড়বো না।

বাবু?

 নূরী, তুমি বড় ছলনাময়ী। কেন, তুমি আমার সঙ্গে ছলনা করো বলোত?

হরির মাথা থেকে গামছাটা খুলে নেয় বনহুর, সঙ্গে সঙ্গে কোঁকড়ানো একগাদা চুল ছড়িয়ে পড়ে চোখেমুখে তার।

বনহুর গভীর আবেগে নূরীর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে, চুম্বনে চুম্বনে রাঙা করে তোলে ওর গন্ডদ্বয়।

 হরিবেশি নূরী বনহুরের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো– কেউ এসে পড়লে তখন কি হবে বলে তো?

নূরী, এতোদিন ধৈর্য ধরে তোমার কার্যকলাপ আমি লক্ষ্য করে এসেছি। কিন্তু আজ আর পারলাম না।

আহ্ ছেড়ে দাও হুর।

না।

 যদি কেউ এসে পড়ে?

এদিকে কেউ আসবে না, শুধু মালিক আরফান ছাড়া। এখন আরফান নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। গফরার লাশ নিয়ে সে জেগেছে সারারাত। নূরী, আমি যখন সুভাষিণীসহ প্লেনে উঠে বসলাম তখন তুমি শিখ তরুণের বেশে আমাদের পিছন আসনে এসে বসলে, সেই মুহূর্তে আমি তোমায় চিনে ফেলেছি। বড় হাসি পাচ্ছিলো তোমার কান্ড দেখে, কিন্তু কোনোরকমে নিজেকে সামলে রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম দেখি তুমি কি করো।

নুরী অবাক হয়ে বলে–কি আশ্চর্য, তুমি আমাকে প্রথমেই চিনে নিয়েছিলে?

হাঁ, তারপর তুমি পরের এরোড্রামে নেমে গেলে আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম কিন্তু একটু পরে একজন বোরখা-পরা তরুণী এসে উঠলো–সেই যে তুমি, তা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।

নূরী বনহুরের চুল ধরে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো তুমি এতো ধূর্ত!

তারপর ভগবগঞ্জে এসে প্রতীক্ষা করছিলাম তোমার। বেশ ঘাবড়ে পড়েছিলাম বিলম্ব দেখে, হঠাৎ এক চাকর এসে হাজির নাম তার হরি। বাঃ চমৎকার বুদ্ধি…..

থাক হয়েছে। নূরী বনহুরের মুখে হাতচাপা দেয়।

বনহুর বলে–কিন্তু এখানে এলে কেন বলো তো? তোমাকে নিয়ে এবার সমস্যায় পড়বো।

না, আমার জন্য তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।

ঠিক সেই মুহূর্তে পদশব্দ শোনা যায়।

বনহুর নিজে নূরীর মাথায় গামছাটা পাগড়ির মত করে বেঁধে দিয়ে চুলগুলো খুঁজে দেয়। পাগড়ির ভিতরে।

একটু পরে আরফান এসে দাঁড়ায়–ভোলানাথ?

 বলুন মালিক?

 আরফান হরির দিকে তাকায়।

বনহুর বুঝতে পারে, ওকে দেখে সন্দেহ হচ্ছে তাই কোনো কথা বলতে চেয়ে বলতে পারছে না আরফান উল্লাহ।

ভোলানাথ বলে এবার-হরি যাও, মালিককে বইল্যা তোমাগো পাওনা মিটাই দিমু।

 হরি বলে–আচ্ছা দিবেন।

চলে যায় হরি।

ভোলানাথ বলে–কন এবার মালিক?

 হোনো ভোলা, তুমি আমাগো বিশ্বাসী আর কামের মানুষ, তাই তোমাগো একটা কথা কইমু?

কন মালিক?

 এ পাড়ার সবুর আলীরে চেনো না।

 তা চিনমু না মালিক? সবাইরে চিনি!

ওর মাইয়্যা সহিনারে চেনো?

তারে দেহিনি মালিক।

আজ কয়দিন অইলো বুড়া সবুর আলীরে বাইন্ধ্যা রাখছি। দিনে একবার কইর‍্যা চাবুক লাগান অয়। তাও বেটির কথা কয় না বুড়া।

কন কি মালিক, সবুর আলীরে বাইন্ধ্যা রাখছেন? চাবুক মারেন তাও মাইয়্যার কথা কয় না?

কয় না, বড় পাজি বুড়া।

 মালিক, আপনি বুড়ারে ছাইড়া দ্যান, আমি ফুসলাইয়্যা তার থেইক্যা কথা আদায় কইরা নিমু।

কি যে কও, বুড়ারে ছাইড়া দিলে আসল কথা কইবো আর?

মালিক আমি কইলাম, দেহেন কাম হাসিল অয় কিনা। বুড়াডারে ছাইড়া দিয়া ভাল ভাল। খাইতে দিমু, ভাল ভাল কাপড় চোপড় দিমু আর দিমু টাহা…..

কও কি ভোলা?

হ মালিক, মাইরা কোনোদিন আসল কথা বাইর করা যায় না, মিঠা কথায় সব অয়।

আচ্ছা, তা অইলে তুমি যা বালো বুঝ তাই করো। কিন্তু মনে রাইখো, বুড়ার বেটী সহিনারে আমার চাই।

আচ্ছা মালিক তাই অইবো।

যাও।

মালিক!

কও? হরি কয়টা টেহা চায়?

আচ্ছা দিয়া দিমুনি। দেহ বুড়ারে ছাইড়া সব জাল পণ্ড কইর‍্যা দিও না।

না মালিক।

ভোলানাথ মালিকের কাছে আদেশ পেয়ে তখনই গুমঘরে গেলো–ভোলা অবশ্য গুমঘর চিনতো না, আরফানই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো তাকে।

 আরফানের সঙ্গে আর একজন লোককে দেখে বুড়ো সবুর আলী ভয়ে কুঁকড়ে গেলো, করুণ কণ্ঠে বললো–আমাগো আর কষ্ট দিও না আরফান বাই, আমি মইরা গেলাম।

ভোলাই কথা বললো প্রথমেনা আর তোমারে কষ্ট দেওয়া অইবো না। তোমারে ছাইড়া দিমু বইলাই আইসেছি।

কি কইল্যা, তোমরা আমাগো ছাইড়া দিবা? আরফান বাই, ও কি সত্য কতা কইছে?

 হ, সত্য কতা। কিন্তু তোমার মাইয়্যারে পাইলে দেখবা কি অয়।

 ভোলানাথ ততক্ষণে বুড়ো সবুর আলীর হাত-পা’র বাঁধন খুলে দিতে থাকে।

আরফান উল্লাহ ভোলার কানে কানে পুনরায় তার মনোভাব ব্যক্ত করে চলে যায় সেখান থেকে।

ভোলা সবুর আলীকে মুক্ত করে দিয়ে বলে–চলো তোমারে বাড়ি রাইখ্যা আসি।

সবুর আলী কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় ভোলার মুখের দিকে। ভোলা চাপা স্বরে বলে– আমি সেই আলম, কোনো চিন্তা করবেন না। আলী সাহেব।

বাবা, তুমি আমাগো সেই আলম?

হা।

আমার মাইয়্যা সখিনা কই গ্যাছে, তুমি তারে সঙ্গে লইয়্যা আইছিলা? কও আমাগো মাইয়া কই?

কোনো ভয় করো না, বলছি তোমার মেয়ে ভালই আছে।

 সত্যি কইছো বাপ?

 হাঁ, সত্যি তোমার মেয়ে ভাল আছে। আচ্ছা, আমি আজ তোমাকে তার সঙ্গে দেখা করাবো।

ভোলানাথ সবুর আলীসহ বেরিয়ে পড়লো।

আজ সবুর আলী ছাড়া পেয়ে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলো, এ ক’দিন ধরে এক অন্ধকার ঘরে নারকেল ছোবড়ার মধ্যে বন্ধন অবস্থায় থেকে জীবন তার ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিলো। হাত-পায়ে ঘা হয়ে গিয়েছিলো একেবারে।

বাড়ি এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সবুর আলী।

একসময় বনহুর চাষীর বেশে এসে হাজির হলো আরফান উল্লাহর বাড়িতে। সন্ধ্যা তখন গড়িয়ে গেছে, ঘরে ঘরে লণ্ঠন জ্বলে উঠেছে। আরফান উল্লাহর বাড়িতেও তখন সন্ধ্যা আলো জ্বলে উঠেছে।

বনহুর ছেঁড়া জামা আর ময়লা একটা লুঙ্গী পরে এসে দাঁড়ালো আরফান উল্লাহর বাড়ির সদর গেটে, চাকরটার নাম ধরে ডাকলো–ছলিম ভাই বাড়ি আছেন?ও ছলিম ভাই…….

 বাড়ির ভিতর থেকে শোনা গেলো ছলিমের গলা–আমাগো কে ডাহে? …

বনহুর বললো–একবার এদিকে আসুন না দয়া করে।

বাইরে বেরিয়ে আসে ছলিম–রুক্ষ চুল, মলিন মুখ বনহুরকে দেখেই বলে উঠে-ও তুমি আইছো?

না, ওকে নিয়ে যাবো।

 নিয়া যাইবা? তা এক মাস অয় নাই তারি মধ্যে আবার লাইয়র?

না ভাই, আমার বাপের অসুখ, তাই দেখতে চায় ওকে।

 বুঝছি, বুঝছি, অমন কত জনা মাইয়া পোলা রাইখ্যা যায় আবার কয়দিন থাইক্যা লইতে আসে, কয় মায়ের জ্বর না হয় বাপের পেটের অসুখ….দাঁড়াও আম্মাজানেরে কই দেহি কি কয়।

ভিতরে চলে যায় ছলিম, একটু পরে দরজার আড়ালে এসে দাঁড়ায় আরফান গৃহিনী, ছলিম আর সখিনাও আসে।

সখিনা এগিয়ে আসে–বাইজান, বাপজী ক্যামন আছে?

তার অসুখ তাই তোমাকে নিতে এসেছি।

আরফান গৃহিনী এ কদিনে সখিনার কাজে মুগ্ধ হয়ে গেছে। তার সব কাজ কেড়ে নিয়ে করেছে সে, ঘর গোছানো থেকে রান্না-বাড়াটা পর্যন্ত। এখন আরফান গৃহিণীর ওকে ছেড়ে দিতে মন চাইছিলো না। বললো সে আড়ালে থেকে দেহো তোমার বোনডা বালোই কাম করে। যা টেহা চাও তাই দিমু, লইয়া যাইও না।

বাপের অসুখ না হলে আসতাম না। বাপকে দেখে আবার রেখে যাবো। আপনার বাড়ি না হলে যে বাঁচা নেই ওর।

সত্যি কইছো কতাডা?

 হাঁ সত্যি বলছি, আজই আবার রেখে যাবো।

 সখিনাকে লক্ষ্য করলো আরফান গৃহিণী–যাও গা, আবার আইয়ো।

আইমু আম্মাজান, না অইলে আমাগো চলবো, না। সখিনা আরফান গৃহিনীর নিকটে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো।

পথে চলতে চলতে বললো সখিনা–আলম বাই, বাপজানের সত্য অসুখ অইছে?

না না, মিথ্যা বলে তোমাকে নিয়ে এলাম বোন।

বাপজান বালো আছে?

ভাল আর কই, তোমাকে না পেয়ে শয়তান আরফান তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুদামে এক অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলো, আমি ফিরে এসে তাকে সেখানে থেকে নিয়ে এসেছি। তোমার বাপ তোমাকে দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সখিনা?

কন বাইজান?

বাপের সঙ্গে দেখা করে আবার চলে আসবে কিন্তু। যতদিন ওকে, মানে আরফানকে সায়েস্তা করতে না পেরেছি ততদিন তোমাকে ওর বাড়িতেই আশ্রয় নিয়ে থাকতে হবে।

আপনে যা কইবেন তাই অইবো।

সখিনা বনহুরকে কখনও আপনি কখনও তুমি বলতো, কারণ সে একটি অশিক্ষিতা গ্রাম্য তরুণী। ভাল কথা বলতে সে জানে না।

বনহুর সখিনাসহ সবুর আলীর বাড়ি পৌঁছে গেলো।

কন্যাকে সুস্থ অবস্থায় দেখে সবুর আলীর আনন্দ আর ধরে না, সস্নেহে মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে নীরবে অশ্রু ফেলেন। আরফানের নৃশংস আচরণে অতিষ্ঠ হলেও তার কন্যা সখিনা যে কোনো কষ্ট পায়নি বা লাঞ্ছিত হয়নি এটাই তার খোদার কাছে হাজার শুকরিয়া।

পিতা আর কন্যা যখন আনন্দে আত্নহারা তখন বনহুর পাশে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিলো, তাদের এই খুশি তার মনেও এক অপূর্ব শান্তি এনে দিচ্ছিলো।

কিন্তু বেশিক্ষণ সখিনাকে এখানে রাখা সম্ভব নয়, হঠাৎ যদি কেউ জেনে ফেলে তাহলে মুস্কিল হয়ে পড়বে। বনহুর বললো-বোন সখিনা, এবার চলো। আর বিলম্ব করা উচিত নয়।

সখিনা পিতার পায়ে সালাম করে উঠে দাঁড়ালো।

 চলেন আলম বাই।

চলো বোন। আলী সাহেব, আপনি নিশ্চিন্ত থাকবেন, সখিনার জন্য কোনো চিন্তা ভাবনা করবেন না।

আচ্ছা বাবা, তুমি যা বালো বোঝো করো।

বনহুর সখিনাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

সখিনাকে নিয়ে বনহুর বেরিয়ে যাবার পরই আরফানের লোক এসে হাজির হয়, একবার দেখে যায় নিজের চোখে সখিনা ফিরে এসেছে কিনা।

ভাগ্য ভাল বলতে হবে তাই রক্ষা পায়—

 বনহুর সখিনাকে নিয়ে তখন আরফান উল্লাহর বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে।

বনহুর যখন সখিনাসহ আরফান উল্লাহর বাড়ি অভিমুখে যাচ্ছিলো তখন হরি দূর থেকে দেখে ফেলে। চাষীর বেশে বনহুরকে চিনতে তার মোটেই দেরি হয় না কিন্তু ওর সঙ্গে মেয়েটি কে? ঘোমটার মুখ ঢেকে ওর সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। অনুসরণ করে হরি বনহুর আর সখিনাকে।

অল্প কিছুদূর এগুতেই হাবলু হরিকে দেখে ফেলে বলে- কিরে, কই যাইতেছো?

হরির অনুসরণ করা আর হলো না, মনের সন্দেহ মনে চেপে বললো নতুন জায়গা, একটু দেখে নিচ্ছি ভাই।

চল আমি তোরে গ্রাম ঘুইরা দেহাইয়া আনি।

অগত্যা হরি অনুসরণ করলো তাকে।

হাবলুর সঙ্গে চললেও হরির মনে ভীষণ একটা তোলপাড় শুরু হলো, তবে কি বনহুর এখানে এসে কোনো মেয়েছেলের পাল্লায় পড়ে গেছে? কে ঐ ঘোমটায় মুখ-ঢাকা তরুণী……

হাবলু বললো–কি ভাবতাছোসরে হরি?

না, কিছু না।

বুঝছি, নতুন দ্যাশে আইয়া তোরে ফাপর লাইগেছে।

 হাবলুর কথায় কোনো জবাব না দিয়ে চলতে থাকে হরি।

জ্যোৎস্না প্লাবিত আকাশ, আলোতে ঝলমল করছে চারিদিক! পথ-ঘাট সব পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।

তবু হরি বেশি দূর যেতে রাজি হয় না, ফিরে যায় আরফান উল্লাহর গুদামে হরি আর হাবলু।

খাওয়া-দাওয়ার পরে হরি তার নির্দিষ্ট জায়গায় শুয়ে পড়ে। তখনও ফিরে আসেনি ভোলানাথ। হরির গা জ্বালা করছে–এখানে এসে ভোলানাথ খুব মেতে উঠেছে মেয়েছেলে নিয়ে! রাগে গস গস করে হরি।

গুদামের এক কোণে একটা মাদুর বিছিয়ে শুয়েছে হরি কম্বলমুড়ি দিয়ে। এ গুদামে কেউ শোয় না, তাই হরি নিজের থাকার জন্য বেছে নিয়েছে এটা।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে হরি ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই।

 হঠাৎ নিজের ললাটের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলো হরির, চোখ মেলতেই অন্ধকারে চাপা একটি কণ্ঠস্বর, যে কণ্ঠের প্রতীক্ষায় সে এতোক্ষণ প্রহর গুণছিলো।

নূরী!

অভিমানে ভরে উঠে নূরীর মন, বলেনা-না, তুমি যাও। হাত খানা সরিয়ে দেয় সে তার ললাট থেকে।

বলে বনহুর নূরী, মিছেমিছি তুমি অভিমান করছে।

না, আমি জানতাম না তুমি এখানে এসে একটা মেয়েকে নিয়ে মেতে উঠবে…..

 এ তুমি কি বলছে নূরী?

 আমি সব দেখেছি।

কি দেখেছো?

 তুমি একটা ঘোমটায় মুখ-ঢাকা মেয়েকে নিয়ে……

নূরী, তোমার সন্দেহ অহেতুক। যাকে তুমি আমার সঙ্গে দেখেছে সে বিপন্না এক তরুণী। নূরী, সৰ শুনলে তুমি কিছুতেই আমার উপর রাগ অভিমান করতে পারবে না। সে আমাকে ‘ভাইজান’ বলে ডাকে। সংক্ষেপে বনহুর সখিনা সম্বন্ধে সব খুলে বললো। আরও বললোনূরী, এই মুহূর্তে আমাকে সপলা গ্রাম ছেড়ে যেতে হচ্ছে।

কোথায় যাবে? চিন্তিত কণ্ঠে বললো নুরী।

নূরী, এরা সাংঘাতিক মানুষ, নারকেল ব্যবসার অজুহাতে এরা ছেলেধরা ব্যবসা চালিয়ে চলেছে। শুধু এরাই নয়, এমনি অনেকগুলো দল আছে যারা দিনের পর দিন শত শত শিশুর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কি ভয়ঙ্কর, কি সাংঘাতিক এরা! নূরী, এদের শায়েস্তা না করা অবধি আমার স্বস্তি নেই।

তুমি যে বলেছিলে কোথায় যাবে?

তা, আজ ভোররাতে একটা ষ্টিমার সপলা ঘাট থেকে সুন্দরবন অভিমুখে ছাড়বে, আমি সেই। ষ্টিমারেই যাবো।

আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।

তা হয় না।

কেন?

আমি ষ্টিমারে মাল নিয়ে যাবো, মানে কয়েকটি ছেলে নিয়ে যেতে হবে আমাকে। তারপর অনেক কাজ আছে আমার, পারবে তুমি আমাকে সহায়তা করতে?

তোমার নুরী কোন্‌দিন তোমাকে সহায়তা করেনি বলো? হুর,আমায় তুমি সঙ্গে নিয়ে চলো, পারবো না আমি একা থাকতে এখানে….নূরী বনহুরের বুকের কাছে জামার খানিকটা অংশ চেপে ধরে।

বেশ, তুমিও চলো তবে।

হাঁ, আমাকেও তুমি সঙ্গে নেবার ব্যবস্থা করো।

বেশ চল।

আনন্দে নূরী বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে ওর ওষ্ঠদ্বয়ে চুম্বন রেখা এঁকে দেয়।

 বনহুর নিজকে সংযত রাখতে সক্ষম হয় না, নূরীকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে।

নূরী বলে–এখানে এসেও তুমি জড়িয়ে পড়লে ছেলেধরার জালে। কোথাও গিয়ে তোমার স্বস্তি নেই হুর?

 আজ নতুন তুমি এটা আবিষ্কার করলে নূরী? দোয়া করো, এই জঘন্য ছেলেধরার মায়াজাল যেন ছিন্ন-ভিন্ন করে দিতে পারি। কি ভয়ঙ্কর এই নারকীয় ব্যবসা! নূরী, আমি সুন্দরবনের অন্তরালে যে নারকীয় দৃশ্য স্বচক্ষে দর্শন করেছি তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। যতক্ষণ আমি এদের ধ্বংস করতে না পেরেছি ততক্ষণ আমার বিশ্রাম নেই।

হুর, ভয় হয় এরা যদি তোমার কার্যকলাপ টের পেয়ে তোমাকে হত্যা করে?

সেজন্য চিন্তা করো না নূরী। শুধু প্রার্থনা করো, আমি যেন এই ব্যবসা সমূলে নিঃশেষ করতে। পারি।

কিন্তু কি করে তা সম্ভব হুর, কি করে তা সম্ভব? পুলিশ এদের হাতের পুতুল–জানো, আমি সেদিন নিজ কানে যা শুনেছি আর দেখেছি সব অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ছেলেধরাদের সাহস কি করে এতো বেড়ে গেছে জানো? শুধু পুলিশদের অমনোযোগিতায়–এরা ওদের পয়সায় বেঁচে আছে..

 নূরী, তুমি যা বলছে সব সত্য কিন্তু আসলে ছোট ছোট অল্প মাইনের পুলিশগুলোই ওদের পয়সা নিয়ে পান-গাঁজা খেয়ে থাকে। আমি এসব পুলিশের সহায়তা নেবো না, আমি যাবো এদের হেড অফিসারের কাছে, তাদের সাহায্যই হবে আমার পাথেয়।

হেড অফিসার–সে আবার কেমন? ..

পুলিশদের উপরওয়ালা। পয়সা যাদের ন্যায়নীতিচ্যুত করতে পারে না। তুমি যে-সব পুলিশদের কথা শুনেছো তারা তো এক আনা পেলেও পকেটে রাখে–অবশ্য সবাই নয়। অনেক পুলিশ সিপাহী আছে যারা প্রাণ দিয়েও দেশ আর সমাজের সেবা করে যায়, বুঝলে?

আমি তো অতো জানি না হুর।

জানো না কিন্তু মনে রেখো একজন আর দুজনকে দিয়েই গোটা পৃথিবীর মানুষের বিচার করা যায় না। এই পৃথিবীতে কত মানুষ আছে কত রকম। এক একজন মানুষের এক এক রকম মনোভাব, তাদের কার্যাবলিও বিভিন্ন ধরনের। নূরী, তুমি একজন বা দু’চার জন পুলিশকে দেখে বা তাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে সমস্ত পুলিশবাহিনীর প্রতি অবিশ্বাস এনো না।

বনহুর নূরীকে যখন কথাগুলো বুঝিয়ে বলছিলো তখন হঠাৎ গুদাম ঘরের দরজা খোলার শব্দ শোনা যায়। কক্ষে প্রবেশ করে আরফান ও আরও একজন কেউ।

 বনহুর তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ে নারকেল স্কুপের আড়ালে। হরি-বেশি নূরী চাদরমুড়ি দিয়ে নাক ডাকাতে থাকে।

সম্মুখ দিয়ে গুদামের চোরা কুঠরী অভিমুখে চলে যায় আরফান উল্লাহ আর পিছনে একজন। নূরী চাদর সরিয়ে উঁকি দেয়। ওদিকের ডিমকরা হ্যারিকেনের আলোতে অস্পষ্ট দেখলো, যে লোকটা আরফানের পিছনে চলেছে সে অন্য কেউ নয়–ঐ দাড়িওয়ালা; নাম তার হামিদ।

 আরফানের সঙ্গে হামিদ নারকেল স্কুপের আড়ালে চলে যেতেই বনহুর বেরিয়ে এলো, চুপি চুপি পিছু নিলো ওদের।

এই গভীর রাতে কি করে, কোথা যায় ওরা–দেখবে সে। আরফান আর হামিদ কয়েকটা গুদামঘর পেরিয়ে একেবারে শেষ গুদামে প্রবেশ করলো।

এ গুদামগুলো এমন এক ভাবে তৈরি যে, প্রত্যেকটা গুদামের মধ্য দিয়ে প্রত্যেকটা গুদামে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সহসা কেউ এ পথের সন্ধান পাবে না। অসংখ্য নারকেলের স্তূপের আড়ালে এমনভাবে দরজাগুলো লুকানো, কেউ বুঝতে পারবে না সেখানে কোনো দরজা আছে।

এমন কি বনহুরও জানতে পারেনি, এ সব নারকেল স্তূপের ভিতরে গোপনে লুকানো আছে এমন এক একটা দরজা। আরফান উল্লাহ আর হামিদ সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো ভিতরে।

বনহুর দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।

পাশের গুদামের মধ্য থেকে শোনা গেলো আরফানের গলা–জে, কেডি, তুমি মালগুলো তৈরি করে রেখো। আজ আবার চারটা মাল চালান যাচ্ছে। ঐ মালগুলোও তৈরি করে রাখবে। আগামী সপ্তাহে এক সঙ্গে বাইশটি মাল ভারতে চালান যাবে। কি বললে? হাঁ, ঠিকভাবে কাজ চালিয়ে যাবে। টাকা-পয়সার ব্যাপারে পরে সব আলোচনা হবে। আমি আর হামিদ মিয়া আগামীকাল এসে পড়বো। কাজে কোনো ভুল যেন না হয়, আচ্ছা গুড় নাইট……।

বনহুর স্পষ্ট বুঝতে পারলো, গভীর রাতে আরফান আর হামিদ চোরা গুদামে নারকেল ভূপের আড়ালে ওয়ার্লেসে সুন্দরবন ঘাঁটিতে কথাবার্তা আদান-প্রদান করছে। আরও আশ্চর্য হলো বনহুর আরফানের মার্জিত কথা শুনে। সে এখানে যেভাবে কথা বলে তাতে মনে হয় সে স্বাভাবিক গ্রামবাসীদের মতই একজন, সেইরকম গ্রাম্য ভাষায় আলাপ আলোচনা করে–কিন্তু আসলে সে সুন্দর বাংলা বলতে পারে, মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দও সে ব্যবহার করছিলো।

 বনহুর আর দেরি না করে দ্রুত নিজের জায়গায় এসে শুয়ে পড়লো, কিন্তু কান আর দৃষ্টি তার সজাগ রইলো।

একটু পরে আরফান আর হামিদ চলে গেলো তাদের শয্যার অদূরে নারকেল স্কুপের আড়াল দিয়ে সামনের গুদামের দিকে।

আরফান আর হামিদের পদশব্দ মিশে যেতেই বনহুর উঠে পড়লো, আবার এলো নূরীর পাশে, ফিস ফিস করে বললোনূরী, আজকেই আমাকে যেতে হবে।

নূরী আচমকা চমকে উঠলো যেন, বললো–কোথায়?

আরফান উল্লাহর মাল চালান যাচ্ছে সুন্দরবনে–সেই ষ্টিমারে যাবো।

আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।

সম্ভব নয়।

কেন?

আমি এবার সুন্দরবন পর্যন্ত যাবো না, মাঝপথে নেমে পড়বোধররা চালনা বন্দরে, সেখান থেকে চলে যাবো খুলনায়।

খুলনা?

 হাঁ, সেখানে গিয়ে আমি খুলনা পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করবো, না হলে সব পণ্ড হয়ে যাবে। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে এখনও সুন্দরবনে ছেলেধরাদের গোপন ঘাটিতে আটকা আছে, তাদের শরীরে নানারকম অস্ত্রোপচার করে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। নূরী বিলম্ব হলে এসব শিশুদের আমি রক্ষা করতে পারবো না। শয়তানের দল আগামী সপ্তাহেই তাদের এইসব জমানো মাল ভারতে চালান দেবে।

ভারতে? বলো কি হুর?

শুধু ভারতেই নয়, এমনি কত শত সন্তানদের এরা দেশ হতে দেশান্তরে চালান দিয়ে এক ভয়ঙ্কর ব্যবসার ফাঁদ পেতে বসেছে। নূরী, তুমি সঙ্গে থাকলে আমি অসুবিধায় পড়বো।

বেশ, তুমি যাও কিন্তু আমি?

তুমি ঢাকায় ফিরে যাও লক্ষ্ণীটি।

না, তুমি ফিরে না আসা অবধি আমি কোথাও যাবো না হুর।

তাহলে এখানেই থেকে যাও, সাবধানে থেকো।

আচ্ছা। হুর, তুমিও সাবধানে চলো! নূরী বনহুরের গণ্ডে এঁকে দেয় একটা গভীর প্রীতি উপহার যা তাকে সংগ্রামে আরও উৎসাহী আর উদ্দীপ্ত করে তুলবে।

বলে বনহুর–এবার তুমি হরি আর আমি ভোলা, কেমন?

 নূরী বনহুরের নাকে মৃদু চাপ দিয়ে হেসে বলে–আচ্ছা।

বনহুর নিজের বিছানায় শুয়ে পড়তেই হাবলু এসে পড়ে। বনহুর ভাবে, ভাগ্যিস ঠিকমত এসে পড়েছিলো নইলে হাবলু এসে দেখতে সে নেই–বিছানা শূন্য, সাড়া পড়ে যেতো গুদামে।

হাবলুকে দেখেই বনহুর নাক ডাকাতে শুরু করলো।

হাবলুও এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে, হাই তুলে নিদ্রালস কণ্ঠে ডাকলো–ভোলা বাই,ও ভোলা বাই উঠো…

বনহুর গা মোড়া দিয়ে উঠে বললো–কে হাবলু?

হ’ তোমাগো মালিক ডাকতাছে।

আমাগো ক্যান?

জানমু ক্যামনে? যহন যা তার মনে অয় তহনই তাই করণ লাগে। চলো দেহি কি হুকুম তার।

হাবলু না জানলেও জানে বনহুর, কি জন্য তাকে ডাকা হচ্ছে–এই মুহূর্তে মাল নিয়ে নৌকা ভাসাতে হবে। ওয়ানা দিতে হবে সুন্দরবন অভিমুখে।

বনহুর হাবলুর সঙ্গে আরফান উল্লাহর সামনে এসে দাঁড়ালো-মালিক, আমাগো ডাকছেন?

 হ ভোলানাথ, তুমি লয়া আর হাবলু আজ ভোর রাতেই রওয়ানা দিবা। রাজু গাড়ি ঠিক, কইর‍্যাছে, মাল গাড়িতেই লইয়া যাইবা। ঘাটে ষ্টিমার আছে, মালিক’ ষ্টিমার, বুঝলা?

বুঝছি, তা এবার নাও যাইবো না?

না, এবার ঠিমার যাইবো। আমি ফরেষ্ট অফিস থেইক্যা পারমিশন লইয়া রাখছি। নাও-এ গেলে বহুৎ দেরি অয়, মাল তাড়াতাড়ি পৌঁছাইতে পারবো না কাজেই ষ্টিমার যাইবো।

বেশ, আমি এহনই মাল লইয়া বিদায় হই মালিক।

 যাও দেহ গাড়িতে মাল উঠছে কিনা।

ভোলা আর বাবলু বেরিয়ে যায়। গুদামের পিছন দিকে কদম গাছের নিচে একটা গরুর গাড়ি দাঁড়িয়েছিলো। সেই গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ভোলা আর হাবলু। তারা পৌঁছে দেখে, লয়া আর বুধা চারটি ফুটফুটে বালককে গাড়িতে উঠিয়ে শুইয়ে দিলো। তারপর গাড়ির পিছনে এবং সামনে বেশ কিছুটা নারকেল স্কুপ করে সাজিয়ে রাখলো। পাকা হাতের কাজ, একটুও বুঝা যাবে না ছৈ এর ভিতরে কোনো মানব শিশু আছে।

 গাড়ি ছাড়লো। লয়া আর ভোলা গাড়িতে উঠে বসলো। হাবলু আর বুধা হেঁটেই রওয়ানা দিলো, হেইয়া জোয়ান চেহারা হাবলু আর বুধার, লাঠি হাতে তারা সম্মুখে এগুতে লাগলো। রাজু গাড়ি চালাচ্ছে।

ভোলার কাপড়ের নিচে আজ শুধু ছোরাই নেই, গুলীভরা একটি রিভলভারও আছে। এ রিভলভার সে কৌশলে সগ্রহ করে নিয়েছে। আরফান উল্লাহর গোপন কুটির মধ্যে মেঝেতে পোচ্ছা আছে একটা মস্তবড় লৌহসিন্দুক; সেই সিন্দুকের মধ্যে স্তরে স্তরে সাজানো আছে অগণিত রিভলভার, পিস্তল, সূতীক্ষ্ণ ধার ছোঁয়া, খাড়া–এমনি অনেকরকম অন্ত্র। সেদিন বনহুর গোপনে আরফান উল্লাহ আলিশের তলা থেকে চাবির গোছা নিয়ে কৌশলে খুলে ফেলে লৌহসিন্দুক। একটা রিভলভার আর কিছু গুলী তুলে নেয়, তার পুনরায় চাবির গোছা রেখে দেয় আরফান– উল্লাহর বালিশের তলায়।

বনহুরের অসাধ্য কিছু নেই, সে অতি সহজেই এ কাজ সমাধা করে নেয়। সাধারণ মাঝির ড্রেসের নিচে আর লুকোনো আছে দুটো মারাত্নক অস্ত্র।

পাড়ি পৌঁছলো একসময় সপলাঘাটে।

মাল উঠিয়ে নেওয়া হলো।

ভোলানাথ, লয়া, বুধা আর হাবলু ষ্টিমারে উঠে পড়লো। এবার ষ্টিমারের খোলসে ছোট একটা খুপড়ীর মধ্যে লুকিয়ে রাখলো ছেলে চারটিকে।এসব খুপড়ীর মধ্যে মুরগী রাখা হয় বা হয়ে থাকে।

রাজু গাড়ি নিয়ে ফিরে চললো।

 ষ্টিমারখানা এবার নদীপথে দ্রুত ছুটে চললো।

বনহুর ষ্টিমারের রেলিং-এ ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে, তার মাথার মধ্যে তখন নানারকম চিন্তার উদ্ভব হচ্ছে। রাত ক্রমান্বয়ে শেষ হয়ে আসছে, ভোর হতে আর কিছু বিলম্ব।

লয়া, বুধা আর হাবলু ষ্টিমারের ডেকে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে, এরি মধ্যে নাক ডাকছে ওদের। নিশ্চিন্ত এখন ওরা, কারণ চালনা বন্দরে না পৌঁছানো পর্যন্ত ওদের কোনো কাজ নেই।

ভোলানাথ শুধু জেগে আছে, তার চোখে ঘুম নেই। ডেকের রেলিং-এ ঠেশ দিয়ে সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে। ভাবছে এই চারটি ছেলেকে সুন্দরবন ঘাটিতে পৌঁছে দেবার সঙ্গে সঙ্গে এদের চোখ বন্ধ করে দেওয়া হবে কিংবা হাত-পা ভেঙ্গে খোঁড়া করে দেওয়া হবে– না না, তা হতে দেবে না সে, আর সুযোগ দেওয়া চলবে না এদের। কাল আরফান উল্লাহ আর হামিদ মিয়া সুন্দরবন ঘাটিতে মিলিত হবে দলের সঙ্গে–এই সুযোগ নষ্ট করবে না ভোলানাথ। ভোলানাথ বার বার তাকাচ্ছে অদূরে ঘুমন্ত লয়া, বুধা আর হাবলুর দিকে, এই মুহূর্তে সে এদের শেষ করে ফেলতে পারে কিন্তু এতো সহজেই এদের শেষ করবে না। সমুচিত শাস্তি হওয়া দরকার, শুধু ছেলেধরাই নয়, ছেলেধরাদের যারা সাহায্য করে তাদেরও মৃত্যুদন্ড দেওয়া উচিত।

ভোলা ডেকের ওপাশ থেকে নিয়ে এলো কয়েকগাছা দড়ি আর কয়েকটা গামছা। তারপর হাতের অগ্নিদগ্ধ সিগারেটটা নদীগর্ভে নিক্ষেপ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো–আর কেউ আশেপাশে নেই। ষ্টিমারের চালক এবং তার সহকারী দু’জন নিচে ইঞ্জিন কামরায় কাজ করছে।

 ষ্টিমারখানা খুব বড় নয়, কাজেই বেশি লোকজনের প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া বুদ্ধিমান আরফান উল্লাহ তার নিতান্ত বিশ্বাসী জন ছাড়া এ ষ্টিমারে কাউকে স্থান দেয় না। এটা শুধু তার কারবারী মালিক’ ষ্টিমার।

আজ মালিক’ ষ্টিমারে নারকেলের স্তূপ পূর্বের মত না থাকলেও কিছুকিছু আছে। যাতে বাইরের লোক দেখলে মনে করে ষ্টিমার-খানা নারকেল ব্যবসায়ী ষ্টিমার–যাত্রীবাহী নয়।

ভোলা দড়ি আর গামছা নিয়ে এসে দাঁড়ালো। চট করে লয়ার মুখে গামছা খুঁজে দড়ি দিয়ে বেশ করে বেধে ফেলল। মুখের ঘোরে আচমকা লয়া এতোটুকু শব্দ করার মত সুযোগ পেলো না। ভোলানাথ লয়াকে বেঁধে শুইয়ে রেখে এবার বুধা ও হাবলুকে বেঁধে ফেললো! অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কাজ করলো ভোলা।

 লয়া, বুধা আর হাবলুর মুখ বাঁধা, হাত দু’খানা পিছমোড়া করে বাঁধা, পা দু’খানাও মজবুত করে বেঁধে ফেলেছে। মুখের ভিতরে গামছার খানিকটা অংশ খুঁজে দেওয়ায় কোনো শব্দ করতে পারছে না ওরা।

প্রথমে ওরা ভেবেছিলো বোধ হয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু পরক্ষণেই টের পেলো– স্বপ্ন নয় সত্য। কে যেন অন্ধকারে তাদের এ অবস্থা করেছে।

ভোর হবার এখনও কিছুটা বাকি। অন্ধকার তাই জমাট বেঁধে উঠেছে।

ভোলানাথ এবার এক একজনকে কাঁধে উঠিয়ে একটা ক্যাবিনে নিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিলো। লয়া, বুধা আর হাবলুকে ক্যাবিনে রেখে ক্যাবিনের দরজায় তালা আটকিয়ে ফেললো।

দুর্দান্ত শক্তিশালী লয়া, বুধা আর হাবলুকে ভোলার কাবু করতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হলো না। ভোলানাথ ওদের তিনজনকে ক্যাবিনে আটকে রেখে ষ্টিমারের সিঁড়ি বেয়ে নিচে ইঞ্জিন কামরায় এসে দাঁড়ালো।

চালক ফিরে তাকাতেই তার পিলে চমকে গেলো। ভোলানাথের হস্তে উদ্যত রিভলভার দেখে হতবাক হয়ে পড়লো, তারপর সামলে নিয়ে বললো–কি ব্যাপার ভোলা ভাই?

সহকারীদ্বয় এবং ফায়ারম্যানটি ভয়ে থর থর করে কাঁপতে শুরু করলো।

হঠাৎ সহকারীদ্বয়ের একজন চিৎকার করে ডাকলোলয়া বাই, লয়া বাই, ভোলা বাই। ক্ষেইপ্যা গ্যাছে, আইসো–আইসো…….

সহকারীটির চিৎকার শুনে হাসি পেলো ভোলানাথ-বেশি বনহুরের কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠে বললো–ইউসুফ, ষ্টিমার খুলনা অভিমুখে নিয়ে চলো।

ষ্টিমার চালকের নাম ইউসুফ ছিলো, কাজেই ভোলা তাকে নাম ধরে আদেশ দিলো।

ভোলার কথায় বললো ইউসুফ–মালিক সুন্দরবন যাইতে কইছে, খুলনা যাইমু ক্যান্ ভোলা বাই?

যেতে হবে–আমার আদেশ।

তুমি কি সত্যি সত্যি ক্ষ্যাপছে ভোলা বাই? জানো, মালিক জানতে পারলে কি অইব?

জানি, আমি যা বলি শোন।

পুনরায় সহকারীদ্বয়ের একজন চিৎকার করে উঠে-লয়া, বুধা, তোমরা কই গ্যালা, ও হাবলু

ভোলানাথ ওর গলা টিপে ধরে–খবরদার, চিৎকার করলে মারা পড়বে। লয়া, বুধা, হাবলু কেউ আর আসবে না।

চালক অস্ফুট কণ্ঠে বলে–এ কি কথা কও ভোলা বাই! ওদের খুন করছে? আইবো না ক্যান?

হাঁ, ওদের খুন করেছি। আমার কথা না শুনলে তোমাদেরও খুন করবো।

একি কথা কও ভোলা বাই!

শোন খুলনা বন্দরে সোজা ষ্টিমার নিয়ে চলো।

 ক্যান?

কাজ আছে।

কইবা না?

 হাঁ, পরে বলবো।

 মালিক যদি জানতে পারে?

আমি এখন মালিক; আমার হুকুম না মানলে মরবে, বুঝলে?

ভোলাবাই একি কথা কও!

বেশি কথা বলো না ইউসুফ, সোজা খুলনা বন্দর অভিমুখে ষ্টিমার নিয়ে চলো।

আচ্ছা, যা কও তাই করমু, তাও প্রাণে মাইরো না……ইউসুফ ভোলার হস্তস্থিত রিভলভারের ভয়ে খুলনা অভিমুখে ষ্টিমার চালাতে শুরু করলো।

ভোলা নিজেও রইলো ইউসুফের পাশে। দক্ষিণ হস্তে তার গুলীভরা রিভলভার।

ইউসুফের সহকারীদ্বয় ও ফায়ারম্যান নিজ নিজ কাজ করে চললো, সকলেরই মুখ বিমর্ষ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। ভোলানাথ তাহলে তাদের আসল অনুচর বা দলের লোক নয়, সে নিশ্চয়ই। পুলিশের লোক।

ইউসুফ ভয় পেয়ে বললো–আমারে হাজতে দিও না ভোলা বাই, তুমি যা কইব্যা তাই করমু।

ইউসুফের বিপন্ন অবস্থা দেখে তার সহকারীদ্বয় ও ফায়ারম্যান কাঁপতে শুরু করেছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। ভয়ে ভয়ে নিজ নিজ কাজ সমাধা করে চলেছে তারা।

*

খুলনা বন্দরে ষ্টিমার পৌঁছলে ভোলানাথ ইউসুফ আর তার সহকারীদ্বয় ও ফায়ারম্যানকে একটা ক্যাবিনে আটকে রেখে তালা বন্ধ করে দিলো তারপর বন্দরে নেমে সেখানে থেকে খুলনা পুলিশ অফিসে ফোন করলো। শুধু তাই নয়, পুলিশ সুপারের নিকটেও জানালো ভোলানাথ, এক্ষুণি খুলনা বন্দরে তিন নম্বর ফ্লাটে চলে আসুন, সঙ্গে পুলিশ বাহিনী প্রস্তুত হয়ে আসবেন। আমি ভোলানাথ এখানেই অপেক্ষা করছি।

খুলনা পুলিশ সুপার ফোনটা অবহেলা করতে পারলেন না। তিনি স্বয়ং পুলিশ ফোর্স নিয়ে হাজির হলেন।

ভোলানাথ প্রতীক্ষা করেছিলো, পুলিশ বাহিনীসহ পুলিশ সুপারকে দেখে চিনতে তার ভুল হলো না। ভোলানাথ পুলিশ ভ্যানের পাশে এসে পুলিশ সুপারকে আদাব দিলোস্যার এসেছেন?

তুমিই ফোন করেছিলে? তোমার নাম ভোলানাথ? বললেন পুলিশ সুপার স্বয়ং।

ভোলা বললো-হা স্যার, আমিই ফোন করেছিলাম। আমার নামই ভোলানাথ।

কিন্তু যেভাবে তুমি ফোন করেছে তা অন্যায়।

স্যার, বেশি ভাববার সময় পাইনি, কারণ ছেলেধরা ষ্টিমার আমি পাকড়াও করেছি।

 হঠাৎ বন্দরে পুলিশ ফোর্সসহ পুলিশ সুপারকে দেখে বন্দরের লোকজন ভড়কে গেলো, দূর থেকে তারা শুধু লক্ষ্য করতে লাগলো, কেউ এগুনোর সাহস পেলো না।

 ভোলার বেশ দেখে পুলিশ সুপার প্রথমে তার সঙ্গে তাচ্ছিল্যভাবে কথা বলছিলেন কিন্তু যখন ভালভাবে আলাপ হলো তখন তিনি ভোলাকে সাধারণ জন মনে করতে পারলেন না। পুলিশ সুপার মনে করলেন, নিশ্চয়ই এই মাঝি-বেশি লোকটি কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হবেন, কোন সি আই ডি অফিসারও হতে পারেন। পুলিশ সুপার অবহেলা করতে পারলেন না ভোলানাথকে।

 তারপর যখন ভোলানাথসহ পুলিশ সুপার এবং পুলিশ ফোর্স মালিক’ ষ্টিমারে উঠে পড়লেন তখন বিস্ময়ে স্তব্ধ হলেন পুলিশ সুপার।

 ভোলানাথ দেখালোএই দেখুন স্যার, এই যে হাত-পা-মুখ বাঁধা অবস্থায় যারা এই ক্যাবিনে বন্দী রয়েছে, এরা ছেলেধরা দলের অনুচর। সবসময় এরা ছেলেধরা সর্দারকে সহায়তা করে থাকে। আর ঐ কামরায় যাদের আটকে রেখেছি তারা এই ষ্টিমার চালক ও তার সহকারীত্রয়। ভোলানাথ-বেশি বনহুর এবার পুলিশ সুপারকে নিচে নিয়ে যায়, তারপর যে ছোট্ট খুপড়ীটার মধ্যে ছেলে চারটিকে আটক করে রেখেছিলো দেখালো।

পুলিশ সুপার মিঃ রহমানের চক্ষুস্থির, তিনি স্বচক্ষে যা দেখলেন তা অতি বিস্ময়কর ব্যাপার। একসঙ্গে চারটি ছেলেকে যেভাবে বন্দী করে রাখা হয়েছে তা মর্মান্তিক। পুলিশ সুপার জীবনে এমন দৃশ্য কোনোদিন দেখেননি, ছেলেধরাগণ কিভাবে ছেলেদের আটকে রাখে তাও তিনি জানেন না। আজ তার নতুন এক অভিজ্ঞতার সঞ্চার হলো। তিনি বলে উঠলেন কি সাংঘাতিক ব্যাপার!

বনহুর বললো স্যার, আপনাকে পুলিশফোর্সসহ আহ্বান জানানোর উদ্দেশ্য শুধু ষ্টিমারের এই ক’জনাকেই গ্রেফতার নুয়, এদের আসল ঘটি ঘেরাও করে সর্দার ও সমস্ত দলবলকে গ্রেফতার করা। সূর, আপনি পুলিশ ফোর্সসহ আমার সূঙ্গে এই ষ্টিমারে চলুন।

পুলিশ সুপারের সঙ্গে সমস্ত পুলিশ ফোর্স অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই এসেছিলো–আর বিলম্ব না করে ষ্টিমারের চালকদের মুক্ত করে দেয় বনহুর, কঠিন আদেশের স্বরে বলে–ইউসুফ, যদি রেহাই পেতে চাও তরে সুন্দরবন তোমাদের ঘাঁটিতে ষ্টিমার নিয়ে চলল। কোনোরকম চালাকি করলে মরবে, বুঝলে?

ভয়ে কাঁপছিলো ইউসুফ ও তার সহকারীত্রয়। শুধু ভোলাকে দেখে নয়, অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স দেখে তাদের পিলে চমকে গিয়েছিলো। ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে বললো ইউসুফ আপনারা যা বলবেন তাই করবো। আমাদের তবু ছেড়ে দেবেন দয়া করে।

হাঁ, তোমাদের মুক্তিই দেওয়া হবে। বললেন পুলিশ সুপার স্বয়ং।

ইউসুফ ও সহকারীত্রয় ষ্টিমারের ইঞ্জিনকক্ষে প্রবেশ করে ষ্টিমার ছাড়বার আয়োজন করলো।

দু’জন অস্ত্রধারী পুলিশকে তাদের ইঞ্জিনকক্ষে পাহারায় নিযুক্ত রাখা হলো।

বনহুর পুলিশ সুপার মিঃ রহমানকে বললোস্যার, পুলিশ বাহিনীকে ষ্টিমারের খোলসের মধ্যে গোপনে লুকিয়ে থাকতে হবে, আপনি ক্যাবিনে বিশ্রাম করবেন। ষ্টিমারের মধ্যে পুলিশের লোক আছে–এ কথা বাইরের কেউ যেন টের না পায়।

 মিঃ রহমান বনহুরের বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে মনে মনে খুশি হলেন, বনহুরের কথামত কাজ করলেন তিনি। সমস্ত পুলিশ ফোর্স ষ্টিমারের মধ্যে আত্নগোপন করে রইলো।

স্বয়ং পুলিশ সুপার নিজেও গোপনে লুকিয়ে রইলেন।

বনহুর ভোলানাথের বেশে চললো।

ষ্টিমার খুলনা বন্দর ত্যাগ করে সুন্দরবন অভিমুখে রওয়ানা দিলো। যখন ষ্টিমার খুলনা বন্দর ত্যাগ করলো তখন বেলা শেষ প্রহর। চালনা বন্দরে পৌঁছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেলো।

বনহুরের উদ্দেশ্য পরদিন ঘাটিতে পৌঁছানো, কারণ আরফান উল্লাহ আর হামিদ ওয়্যারলেসে সুন্দরবন ঘাঁটিতে জানিয়ে দিয়েছে–তারা পরদিন এসে পৌঁছে যাবে। কাজেই বনহুর সেই মুহূর্তে পুলিশ ফোর্স নিয়ে আক্রমণ চালাবে ছেলেধরার ঘাঁটির উপর।

 চালনা বন্দরে ষ্টিমার থামিয়ে ফরেষ্ট অফিস থেকে পারমিশন সংগ্রহ করে নিলো ভোলা। অবশ্য পূর্ব হতেই এখানে আরফান উল্লাহর লোক অপেক্ষা করছিলো, তাকেও ভোলা উঠিয়ে নিলো ষ্টিমারে।

 ষ্টিমার যখন আসার কথা তার চেয়ে দেড়গুণ সময় পরে ষ্টিমার আসায় অবাক হয়ে গিয়েছিলো আরফানের অনুচর বাদলা। ভোলাকে সে খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলো ষ্টিমার পৌঁছতে এতো বিলম্ব হলো কেন।

ভোলা বললো–ষ্টিমারে চলো সব কমু। আমরা পুলিশের হাতে ধরা পড়তে গিয়া বাইচ্যা গেছি।

বলো কি?

হ’ ভাগ্যিস ওরা ষ্টিমারে খোঁজ লইতে উইঠ্যা পড়েনি। ষ্টীমারে চলো, সব জানতে পারবা।

ভোলার সঙ্গে বাদলা উঠে পড়লো ষ্টিমারে। এতোক্ষণ ষ্টিমারের বিলম্ব দেখে সে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো। এবার আনন্দে শিস দিতে দিতে ষ্টিমারের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।

ভোলাকে লক্ষ্য করে বলে–ভোলা বাই, লয়া-বুধা-হাবলু বাই এরা কই গ্যালো? এগোরে দেখতাছি না ক্যান?

 দেখ দেখবা, হগলে ভিতরে আছে।

কি করতাছে ওরা?

 চলো না ভিতরে।

যে ক্যাবিনে লয়া মিয়া, বুধা আর হাবলুকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছিলো সেই ক্যাবিনে বাদলাকে ঠেলে দেয় ভোলা দ্যাহো ওরা এইহানে ক্যামন আরামে হুইয়া আছে।

বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠে–একি দেখতাছি ভোলা বাই….।

 কিন্তু কথা শেষ হয় না, পুলিশ সুপার পিস্তল বাগিয়ে ধরেন–খবরদার নড় না।

ভোলা দ্রুতহস্তে বেঁধে ফেলে বাদলাকে, তারপর মুখে রুমালখানা গুঁজে দেয়।

বাদলা কিছু বুঝবার আগেই কাজ শেষ হয়ে যায়। ওকেও ফেলে রেখে দেয় লয়া, বুধা আর হাবলুর কাছে, তারপর ক্যাবিন বন্ধ করে রাখে ভোলা ভালভাবে।

সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে কইর‍্যা নদী বয়ে এগুচ্ছে ষ্টিমার মালিক। ডেকে দাঁড়িয়ে শুধু ভোলানাথ আর পুলিশ সুপার মিঃ রহমান। নদীর দু’তীরে সুন্দরী গাছগুলো ঝাপসা অন্ধকারের মত লাগছে। জ্যোত্ম রাত, কিন্তু আকাশে মেঘ থাকায় সব কেমন অস্পষ্ট লাগছিলো।

 জঙ্গলের মধ্য হতে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে ফেউ-এর ডাক। শিয়ালের ডাক বড় একটা শোনা যাচ্ছে না। ষ্টিমারখানা মাঝনদী দিয়ে এগুচ্ছিলো তাই হিংস্র জন্তুর তেমন কোনো ভয় ছিলো না।

 নদীর পানিতে সময় সময় ওঁ ওঁ ভেসে উঠেই আবার ডুব দিচ্ছিলো। কখনও বা কুমীর অলস দেহটা ভাসিয়ে এগুচ্ছিলো ধীরে ধীরে। জ্যোত্রার আলো তেমন না থাকলেও বেশ বোঝা যাচ্ছিলো।

ডেকে রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো ভোলানাথ-বেশি বনহুর আর পুলিশ সুপার মিঃ। রহমান।

কইর‍্যা নদীর আঁকাবাঁকা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আছে সমস্ত সুন্দরবনময়। এসব শাখার নামকরণও আছে ভিন্ন ভিন্ন!

এবার ষ্টিমারখানার স্পীড কমিয়ে দেওয়ার জন্য বনহুর নির্দেশ দিলো ইউসুফকে, আরও জানিয়ে দিলো যেভাবে এগুলে শব্দ না হয় সেইভাবে ষ্টিমারখানাকে ঘাঁটিতে নিয়ে চলো।

প্রাণের ভয় কার না আছে।

ইউসুফ বুঝতে পেরেছে, এবার তাদের ছেলেচুরি ব্যবসার পরিসমাপ্তি। এতোদিন সে এই পাপময় জঘন্য ব্যবসার বাহক হিসাবে কাজ করে এসেছে–আজ তার প্রায়শ্চিত্ত। নাছোড়বান্দার মতই ইউসুফ আজ ভোলানাথের কথামত কাজ করে যাচ্ছে–তবু যদি উদ্ধার পায় সে–এই ১৩৮ আশায়।

অত্যন্ত গোপনে সতর্কতার সঙ্গে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো মালিক’ ষ্টিমার, ঘাঁটির অনতিদুরে এসে নদীর কিনারে ষ্টিমার ভিড়লো।

তখন সবেমাত্র ভোর হয়েছে।

সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের শাখায় শাখায় জেগে উঠেছে পাখির কাকলী। প্রভাতের মৃদুমন্দ হাওয়া ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে। স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশ। কে জানে এই সুন্দরবনের মধ্যে লুকিয়ে আছে কত হিংস্র প্রাণী।

ভোলানাথ ডেকে এসে দাঁড়ালো। স্বয়ং পুলিশ সুপার রিভলভার হস্তে দাঁড়িয়ে রইলেন আড়ালে। অন্যান্য পুলিশ ফোর্স অতিসন্তর্পণে ষ্টিমারের অভ্যন্তরে আত্নগোপন করে আছে। কেউ বাইরে থেকে যেন টের না পায় ষ্টিমারে পুলিশ আছে।

লয়া, বুধা, হাবলু আর বাদলকে পূর্বের সেই কক্ষেই হাত-পা-মুখ বন্ধন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। ইউসুফ আর তার সহকারীয় ইঞ্জিনকক্ষে পুলিশ পাহারায় বন্দী রয়েছে।

আর অবুঝ অসহায় শিশু বালক চারজনকে ছোট খাঁচার মত খুপড়ী থেকে বের করে এনে যত্নসহকারে একটা ক্যাবিনে রাখা হয়েছিলো। তাদের ডাব এবং কিছু খাবার খাওয়ানো। হয়েছিলো। স্বয়ং পুলিশ সুপার এবং ভোলানাথ ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। তাদের আশ্বাস দিয়ে বলছিলো–তোমরা আবার তোমাদের আব্বা-আম্মাদের কাছে ফিরে যেতে পারবে। আমরা তোমাদের উদ্ধার করার জন্যই চেষ্টা করছি। নানাভাবে সান্ত্বনা দিয়ে তবে ওদের বুঝিয়ে স্থির রাখা হলো।

 এবার ভোলানাথ মিঃ রহমানকে বললো–স্যার, সমস্ত পুলিশ বাহিনী এই ভোরের অন্ধকারে সুন্দরবনের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে হবে গাছের আড়ালে না লুকিয়ে গাছের ডালে-আশ্রয় নিতে হবে সকলের এবং যতদূর সম্ভব গাছের ডালপাতার আড়ালে চুপচাপ বসে থাকতে হবে। কোনোরকমে ছেলেধরার দল যেন টের না পায় যে পুলিশ সুন্দরবনে প্রবেশ করছে।

হাঁ, যা বলছো ঠিক কথাই বলছো ভোলানাথ। সেইভাবেই কাজ করতে হবে।

 স্যার, কয়েক ঘন্টার মধ্যে ছেলেধরা সর্দার ও তার সহকারী এসে পড়বে, আপনারা ততক্ষণ অপেক্ষা করবেন। তার পূর্বে যা করতে হয় আমিই করবো। স্যার, যতক্ষণ আমি হুইসেলে শব্দ না করবো ততক্ষণ আপনারা নিজ নিজ জায়গা থেকে বের হবেন না যেন।

বেশ, তোমার কথামতই এসেছি, শেষ পর্যন্ত তোমার কথা অনুযায়ীই কাজ করবো ভোলানাথ। যদি ছেলেধরার দলও তাদের সর্দারকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই তাহলে তোমাকে আমরা পুরস্কৃত করবো।

হাসলো ভোলানাথ।

 পুলিশ সুপার ভোরের ঝাপসা আলোতে বনমধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন–চারিদিক কাঠের স্তূপ দেখছি, ব্যাপার কি?

বললো ভোলানাথ–কাঠের ব্যবসার নাম করেই এসব বদমাইশের দল সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ছেলেচুরি ব্যবসা চালিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয় এরা গোলপাতা বোঝাই নৌকার মধ্যে ছেলে চালান দিয়ে থাকে, যেমন কাঠবোঝাই নৌকার খোলের মধ্যে অজ্ঞান করে লুকিয়ে রাখা হয় ছেলে মেয়েদের তারপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দেশ হতে দেশান্তরে।

মিঃ রহমান ভোলানাথের কথাগুলো অবাক হয়ে শুনছিলেন।

ভোলানাথ বললো-স্যার, এখন একটুও বিলম্ব করার সময় নেই, আপনি পুলিশবাহিনীসহ। এই বনের মধ্যে নেমে পড়ুন। ঐ যে পায়েচলা পথ দেখছেন ঐ পথেই কিছুদূর এগুলে পাওয়া যাবে ছেলেধাদের সুন্দরবন ঘটি। এখানেই এরা কাঠের ব্যবসার নাম করে ছেলে-হরণ ব্যবসা চালিয়ে চলেছে।

পুলিশ সুপারের আদেশে পুলিশ বাহিনী সেই বনের মধ্যে নেমে পড়লো, কিন্তু নামবার পূর্বে গহন হয় দেখে ভড়কে যাচ্ছিলো মনে মনে!

ভোলানাথ সাহস দিয়ে বললো–এখানে বনটা যতই ঘন হোক হিংস্র জন্তুর আনাগোনা কম, কারণ এখানে সাক্ষাতে লোকের সমাগম না হলেও অসাক্ষাতে সব সময় লোকের আগমন হয়ে থাকে। কাজেই ভয় তেমন নেই, তবু, সাবধান থাকা প্রয়োজন।

পুলিশ সুপারের আদেশে ইউসুফ ও সহকারীত্রয়কে ইঞ্জিনকক্ষের পাশের কামরায় বন্দী করে পুলিশ পাহারা রাখা হলো। লয়া, বৃধা, হাবলু আর বাদলার অবস্থা কাহিল, না মরে কোনোরকমে বেঁচে আছে এই যা। তাদের ক্যাবিনের মধ্যেও একজন পুলিশ মোতায়েন রাখা হলো। তাছাড়াও কয়েকজন পুলিশ রাইফেল নিয়ে লুকিয়ে রইলো ষ্টিমারের মধ্যে। বাইরে থেকে এতোটুকু সন্দেহ করবার জো নেই।

 পুলিশবাহিনীসহ পুলিশ সুপার স্বয়ং ছেলেধরাদের তাঁবুর পাশে গাছের ডালপাতার আড়ালে আত্মগোপন করে রইলেন। সেকি এক মহা আশঙ্কাপূর্ণ মুহূর্ত। পুলিশ সুপার তাবুর অদূরে একটা ঝাঁপড়া গাছের ডালপাতার মধ্যে লুকিয়ে লক্ষ্য রাখলেন।

 তাঁবুর মধ্যে নিশ্চিন্ত মনে সবাই ঘুমিয়ে আছে। তাঁবুর চারপাশে কাঠের স্তূপ। অসংখ্য সুন্দরী কাঠ টুকরা করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তাবুর চারপাশে। তাবুর সম্মুখভাগে খানিকটা ফাঁকা তাবুতে প্রবেশের পথ সেটা।

তাঁবুর সম্মুখে অগ্নিকুন্ডটা সমস্ত রাত ধরে জ্বলে জ্বলে এখন নিভে এসেছে।

বনের মধ্যে অদূরস্থ কোনো স্থান থেকে শোনা যাচ্ছে জংলী মোরগের ডাক।

 ভোলানাথ ষ্টিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে হুইসেলে উঁদিলো। একবার-দুবার তিন বার। ঠিক ঐ রকম একটা শব্দ শোনা গেলো তাঁবুর মধ্যে পরপর তিন বার।

গাছের শাখায় পাতার আড়ালে বসে পুলিশ সুপার মিঃ রহমান বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে নিপুণভাবে দেখতে লাগলেন। তিনি হুইসেলের শব্দ শুনে ভালভাবে তাঁবুর দিকে দৃষ্টি ফেরালেন।

 তাঁবুর ভিতর হতে চারজন বলিষ্ঠ চেহারার লোক কয়েকগাছা দড়ি হাতে বৈরিয়ে এলো। চলতে লাগলো বনের মধ্যে দিয়ে নদীর দিকে যেদিকে ষ্টীমার খানা নোঙর করা আছে।

ভোলা পূর্ব হতেই বালক চারটিকে ষ্টিমার থেকে নিচে নামিয়ে এনেছিলো, এবার লোক চারজন আসতেই সে বালক চারজনকে তুলে দিলো তাদের হাতে।

 বালক চারজনকে ওরা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললো তারপর নিয়ে চললো তাঁবুর দিকে।

চারজনের মধ্যে যে লোকটা বেশ মাতব্বর গোছের সে বললোলয়া, বুধা, এরা কই? অগো তো দেখতাছিনা।

 বললো ভোলা-ঘুমাইতাছে। গোটারাত জাইগ্যা আইছে কিনা। আর আজ ভেবেই বা আইলা ক্যান?

তা অনেক কান্ড অইয়া গ্যাছে সব পরে জানতে পারবা, এহন অগো নিয়া চল।

বালক চারটিকে হাত বেঁধে বনের মধ্যে দিয়ে তাঁবুর দিকে যেতে লাগলো ওরা।

ভোলানাথ ষ্টিমারেই রয়ে গেলো কারণ তার উদ্দেশ্য ছেলেধরা সর্দার আরফান ও তার সহচর হামিদকে অভ্যর্থনা জানানো।

পূর্বাকাশ রাঙা করে সূর্য উঁকি দিলো। সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে পড়লো সোনালী আলোর আভা। নদীর পানিতে সূর্যের আলোকরশ্মি পড়ে রূপালী পর্দার মত লাগছে। ভোলানাথ রেলিং-এ ভর দিয়ে তাকিয়ে রইলো পূর্বাকাশের দিকে। এমনভাবে কোনোদিন সে সূর্যোদয় উপভোগ করেনি। আজ প্রাণভরে দেখতে লাগলো ভোলানাথ এ দৃশ্য।

 মুগ্ধ নয়নে ভোলানাথ তাকিয়েছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মোটর-বোটের শব্দ শোনা গেলো। সম্বিৎ ফিরে এলো ভোলানাথের। নিশ্চয়ই এ মোটর-বোট আরফান উল্লাহ আর হামিদের।

সন্দেহ মিথ্যা নয় ভোলার, অল্পক্ষণেই একটা মোটর-বোট দৃষ্টিগোচর হলো তার।

ভোলা এবার দ্রুত ষ্টিমার ত্যাগ করে নীচে নেমে মোটর-বোটখানার অপেক্ষা করতে লাগলো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই এসে পড়লো মোটর-বোটখানা, নিকটবর্তী হতেই দেখলো মোটর-বোটে রয়েছে আরফান উল্লাহ স্বয়ং এবং হামিদ ও আরও দু’দুজন তার সহচর।

 ভোলাকে দেখে তারা নেমে পড়লো এবং জিজ্ঞাসা করলো ঠিকভাবে পৌঁছতে পেরেছিলো কিনা?

ভোলানাথ জানালো-হ, আমরা বালো ভাবেই ঘাঁটিতে পৌঁছাইতে পারছি।

হুইসেল দিলো ভোলা পরপর দু’বার তাঁবুর মধ্য হতে বেশি দু’জন লোক বেরিয়ে দ্রুত এগুতে লাগলো বনের মধ্যে সরুপথ ধরে নদীর ধারের দিকে।

আরফান উল্লাহ ও হামিদ আর তাদের সহচরদ্বয়কে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে চললো ঘাটিতে। তাঁবুর মধ্যে যখন ওরা প্রবেশ করলো তখন ভোলাও প্রবেশ করলো তাদের সঙ্গে তাঁবুর মধ্যে।

ভাবুর আশেপাশে বৃক্ষশাখায় বসে সব লক্ষ্য করছিলো পুলিশ বাহিনী। পুলিশ সুপার নিজেও চোখে ব্যাইনোকুলার লাগিয়ে সব দেখছিলেন, প্রতীক্ষা করছিলেন ভোলানাথের হুইসেলের একটি শব্দের।

এ কথাটা পূর্ব হতেই পুলিশ সুপারের সঙ্গে আলোচনা করে রেখেছিলো ভোলানাথ। বলেছিলো সে স্যার, আমি যখন একবার টানা হুইসেল বাজাবো ঠিক সেই মুহূর্তে আপনারা নিজ নিজ স্থান হতে বেরিয়ে পড়বেন।

পুলিশ সুপার ও পুলিশবাহিনী সতর্কভাবে কান পেতে অপেক্ষা করছিলো। যেমন হিংস্র জন্তু শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্ব মুহূর্তে ওৎ পেতে বসে থাকে ঠিক তেমনিভাবে বসে আছে তারা।

তাঁবুর মধ্যে গোল বৈঠক বসলো।

আরফান উল্লাহ, হামিদ ও তাঁবুর মধ্যে ভদ্ৰবেশি আরও চারজন বসলো হিসাব-নিকাশ নিয়ে।

ইতিমধ্যে চা-নাস্তা কফি, চললো।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এবার ভালভাবে হিসাব-নিকাশে মনোযোগ দিলো–এতোদিন কত মাল কোথায় কিভাবে চালান গেছে, কত টাকা নগদ পাওয়া গেছে, কত বাকি আছে, সব নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো।

এই তো সুযোগ, ভোলানাথ তাঁবুর বাইরে এসে খুব জোরে হুইসেলে ফুলিলা।

সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনী যে যেখানে লুকিয়ে ছিলো সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো, পুলিশ সুপার মিঃরহমানও লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন, তারপর উদ্যত রিভলভার হস্তে ছুটলেন তাঁবুর দিকে।

এতো দ্রুত এ কাজ সমাধা হলো যে তাঁবুর ভিতরে ছেলেধরার দল প্রস্তুত হবার পূর্বেই পুলিশবাহিনী তাবুর চারপাশে ঘিরে ফেললো।

ভিতরে প্রবেশ করলো ভোলানাথ প্রথমে, তারপর মিঃ রহমান!

ভোলানাথের হস্তে রিভলভার এবং তার পিছনে পুলিশ সুপারকে উদ্যত রিভলভার হস্তে দেখে প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো ছেলেধরার দল, বিশেষ করে তাদের বিশ্বাসী ভোলানাথকে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে রিভলভার হস্তে দেখে থ’মেরে গেলো ওরা কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বললো আরফান উল্লাহ-ভোলা, একি করতাছো? কিছুইতো বুঝতে পারতাছিনা?

 ততক্ষণে হামিদ খাতাপত্র লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিলো।

মিঃ রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–খবরদার একটি কাগজও লুকোতে চেষ্টা করো না। এবার মিঃ রহমান পকেট থেকে একটা বাঁশি বের করে ফুদিলেন সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন রাইফেলধারী পুলিশ প্রবেশ করে দাঁড়ালো।

 পুলিশ সুপার এবার বললেন–এদের একটিও যেন বাইরে না বের হতে পারে লক্ষ্য রাখো এবং প্রত্যেকের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দাও।

পুলিশ সুপার আদেশ দেবার সঙ্গে সঙ্গে আরফান একখানা সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা বের করে ঝাঁপিয়ে পড়লো ভোলার উপর।

ভোলা খপ করে ধরে ফেললো আরফানের ছোরাসহ দক্ষিণ হাতখানা, পর মুহূর্তেই প্রচন্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলো তার নাকের উপর।

আরফান উল্লাহ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো তাঁবুর মেঝেতে।

ভোলানাথ আরফানের উঠে দাঁড়াবার পূর্বেই ওর জামার ঘাড় ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে নিলো, তারপর আবার এক ঘুষি বসিয়ে দিলো ওর চোয়ালে।

 ঘুরপাক খেয়ে পড়ে গেলো আবার আরফান উল্লাহ, ওর হাতের ছোরাখানা ছিটকে পড়লো কয়েক হাত দূরে।

ভোলানাথের অসীম শক্তি এবং বুদ্ধিকৌশল দেখে পুলিশ সুপার বিস্মিত হলেন। তিনি হামিদ ও অন্যান্য দলবলকে গ্রেপ্তার করে ফেললেন। পুলিশবাহিনী ততক্ষণে প্রত্যেকের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো।

ভোলানাথ আরফানের বুকে রিভলবার চেপে ধরলো–একচুল নড়বে না কিন্তু।

আরফান অগত্যা সোজা হয়ে দাঁড়ালো, ভোলার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষতে লাগলো।

 ভোলা বললো-স্যার, এই বেটা ছেলেধরাদের সর্দার।

হাতকড়া পরিয়ে দাও এর হাতে।

আরফানের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হলো।

তাঁবুর মধ্যে যে কয়জন ছেলেধরা সর্দার মহাজন ছিলো সবাইকে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে ফেলা হলো। আরফান ফাঁদে পড়া ব্যাঘ্রের মত ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। আজ যেন সে দেখতে পেয়েছে ভোলানাথের আসল রূপ।

এবার বললো ভোলানাথ-স্যার, আসুন আমার সঙ্গে।

মিঃ রহমান অনুসরণ করলেন ভোলানাথকে।

কিছুদূর অগ্রসর হতেই তাঁবুর মধ্যে একটা কাঠের স্তূপ পরিলক্ষিত হলো। মিঃ রহমানসহ কাঠের স্তূপের ওপাশে এগুতেই নজরে পড়লো–কিছু পূর্বের সেই চারজন বালককে হাত বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে। বালক চারজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এক এক জনের চোখ টকটকে লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।

মিঃ রহমান বললো–এই চারটি ছেলেকে এরা চুরি করেছে?

বললো ভোলানাথ-স্যার, এই চারটি আজকের মাল। আগের মাল এরা কোনো গোপন স্থানে সরিয়ে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে।

মিঃ রহমান দু’জন পুলিশসহ নিজেও অনুসন্ধান চালালো।

 ভোলানাথ নিজেও অত্যন্ত মনোযোগসহকারে খুঁজতে শুরু করলো, ব্যাপার কি, আগের সেই ছেলেমেয়েগুলো গেলো কোথায়। সে তো জানে, একসঙ্গে অনেকগুলো মাল চালান যাবে এবার, নিজ কানে গতকাল শুনেছে আরফান উল্লাহর ওয়্যারলেসের বক্তব্য।

কিন্তু তাঁবুর মধ্যে তন্ন তন্ন করে সন্ধান চালিয়েও পূর্বের সেই ছেলেগুলোর কোনোই হদিস পাওয়া গেলো না। ঘাবড়ালো না তবু ভোলানাথ এবার সে হঠাৎ তাবুর ভদ্ৰবেশি একটি মহাজনের বুকে রিভলবার চেপে ধরলো শীগগির বলো, কোথায় সেই ছেলেগুলো বলো?

 গভীর কন্ঠে বললো ভদ্রলোকটা–এ চারটি ছেলেই এখানে আছে, এবং তাদের তুমিই এনেছে।

কি বললে, এই চারটি ছেলেই এখানে আছে বা ছিলো?

হা।

মিথ্যাবাদী কোথাকার! তারপর পুলিশ সুপারের দিকে লক্ষ্য করে বললো–স্যার, সহজে এরা গোপন রহস্য প্রকাশ করবে না, আপনি যদি হুকুম দেন আমি যেভাবে খুশি এদের কথা আদায় করে নেবো?

 হাঁ ভোলানাথ, তুমি যেভাবে ইচ্ছা এদের কথা এবং সবকিছু প্রকাশ করে নাও। তুমি তো জানো ছেলে ধরাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কাজেই তুমি যেভাবে খুশি কথা আদায় করে নিতে পারো।

 উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ভোলানাথের মুখমন্ডল কারণ সে মিঃ রহমানের সম্মুখে এদের শাস্তি দিতে কুণ্ঠা বোধ করছিলো। এবার ভোলা ভদ্রলোকটির দক্ষিণ হাতখানা রিভলভারের সম্মুখে ধরে গুলী বিদ্ধ করলো-কি এখনও চুপ থাকবে?

দক্ষিণ হস্তে গুলীবিদ্ধ হওয়ায় লোকটা আর্তনাদ করে উঠলো,থেতলে গেলো ওর হাতখানা, তাজা লাল রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো তাঁবুর মেঝে। ভোলানাথের কথায় বললো–আমি জানি না, আমাকে মাফ করো, ভোলা, আমাকে মাফ করো—

এবার তোমার বাম হস্তখানা গুলীবিদ্ধ করে পঙ্গু করে দেবো বলো মালগুলো কোথায়?

আরফান বলে উঠলোজান নিলেও আমরা বলবো না। তুমি আমাদের হত্যা করো।

পুলিশ সুপার মিঃ রহমান নিজেও ভোলানাথের কার্যকলাপ দেখে বিস্মিত-হতবাক হয়ে পড়েছেন যেন। তিনি অবাক হয়ে দেখছেন। পুলিশ বাহিনীকে আদেশ দিয়েছেন একটি প্রাণী যেন পালাতে না পারে।

 তাঁবুর মধ্যে তখন ছেলেধরা দল কোনোরকম প্রস্তুত ছিলো না বলেই গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে, নইলে একটিকেও পাকড়াও করা যেতো না। এতোটুকু যদি জানতে পারতো ওরা তাহলে হাওয়ায় উড়ে যেতো কিন্তু ভোলানাথের নিপুণ সতর্কতার জন্যই তা সফল হয়নি।

ভোলানাথ এবার ছেলেধরা দলের মধ্যে হতে ডাক্তারকে টেনে আনলো সম্মুখে দাঁতে দাঁত পিষে বললো–ডাক্তার, এতোদিন অসংখ্য অসহায় বালক-বালিকার অঙ্গ তুমি নিজ হস্তে পঙ্গু করেছো আজ আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না। তোমার মুখ দিয়েই জানতে চাই, বলো কোথায় তোমাদের তৈরি মালগুলো জমা করে রেখেছে। গর্জন করে উঠলো ভোলানাথ বলো নইলে তোমার সমস্ত দেহ ক্ষতবিক্ষত করে লবণ মেখে দেবো।.

গম্ভীর হয়ে বললো ডাক্তার জানি না।

জানো না? ভোলানাথ মুহূর্ত বিলম্ব না করে ডাক্তারের একখানা হাত গুলীবিদ্ধ করলো।

উঃ বাবাগো! ডাক্তার বাম হস্তে দক্ষিণ হস্তখানা চেপে ধরলো। রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো ডাক্তারের দেহের বসন।

বললো ভোলা–যে হস্ত দিয়ে তুমি,অসহায় শিশুদের অঙ্গে অস্ত্রোপচার করেছিলে সেই হস্ত আমি খতম করলাম বলো কোথায় তারা?

ডাক্তার ব্যথাকরুণ চোখে তাকালো আরফান উল্লাহ আর হামিদের দিকে।

 ভোলানাথ বললো-ওদের দিকে তাকিয়ে কোনোই ফল হবে না বন্ধু, যদি জীবন বাঁচাতে চাও তবে বলল ওরা কোথায়?

এবার ডাক্তার বলে উঠলো–বলবো না। বলবো না আমি।

 বলবে না? কথা শেষ করেই ভোলানাথ ডাক্তারের আর এক খানা হাতে গুলীবিদ্ধ করলো।

হাতখানা দুমড়ে গেলো একেবারে থেতলে যাওয়া কলাগাছের মত।

এবার ডাক্তার ভূতলে গড়িয়ে পড়ে গেলো, রক্তে ভেসে গেলো মেঝেটা। চিৎকার করে। আর্তনাদ শুরু করলো।

হেসে উঠলো বনহুর, সে আর নিজকে সংযত রাখতে সক্ষম হলো না, তার মধ্যে জেগে উঠেছে দস্যপ্রাণহাঃ হাঃ হাঃ, ডাক্তার এবার তুমি উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছো? এই হস্তদ্বয় দ্বারা তুমি যখন নিষ্পাপ শিশুগুলোর দেহে অস্ত্রচালনা করতে তখন তারা কি নির্মম বেদনায় আর্তনাদ করতো? তখন কি এতোটুকু মায়া হতো না, তোমার মনে শয়তান?

বনহুর টেনে দাঁড় করিয়ে দেয় ডাক্তারকে উঠে, বলো কোথায় সেই অসহায় শিশুগুলো?

এবার ডাক্তার মরিয়া হয়ে উঠেছে, রক্তের স্রোত বইছে তার হাত দু’খানা দিয়ে। চিরদিনের জন্য বিনষ্ট হয়ে গেছে ডাক্তারের হাত দু’খানা।

বনহুর রিভলভার চেপে ধরলো এবার ডাক্তারের পায়ে–পা দু’খানা যদি হারাতে না চাও তবে বলো?

 বনহুরের গুরুগম্ভীর কঠিন কণ্ঠে তাঁবুর মধ্যে যেন বাজ পড়লো। থরথর করে কেঁপে উঠলো তাবুর অভ্যন্তর। পুলিশ বাহিনী সবাই বিস্মিত হতবাক, কারো মুখে কোনো কথা নেই। পুলিশ সুপার নিজেও স্তব্ধ হয়ে দেখছেন।

ডাক্তারের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে, এবার সে চুপ থাকতে পারলো না বললো–চলো আমি বলছি—

ভোলানাথ-বেশি বনহুর রিভলভারখানা চেপে ধরলো ডাক্তারের পিঠে চলো, কোনোরকম চাতুরি করতে যেও না, বুঝলে?

ডাক্তার কোনো কথা বললো না, রোদন করতে করতে এগুলো।

আরফান চিৎকার করে উঠলো ডাক্তার।

 বনহুর গুতা মারলো ডাক্তারের পিঠে–চলল।

পুলিশ সুপার স্বয়ং ভোলনাথ আর ডাক্তারকে অনুসরণ করলেন।

 ডাক্তার রক্তাক্ত দেহে এগুতে লাগলো, তার পরিধেয় বস রাঙা হয়ে উঠেছে। তাবুর শেষ অংশে যে কাঠের স্তূপ ছিলো সেই দিকে এগুতে লাগলো ডাক্তার।

বনহুর রিভলভার উদ্যত করে রেখেছে, কোনোরকম শয়তানি করলেই তার গুলী গিয়ে বিদ্ধ। হবে ডাক্তারের দেহে। কাজেই ডাক্তার বিবর্ণ ফ্যাকশে হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে আর রোদন করছে।

কাঠের স্তূপের পাশে এসে দাঁড়ালো ডাক্তার, বললো–এই কাঠ সরিয়ে ফেলে।

সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সুপারের নির্দেশে পুলিশগণ কাঠের স্তূপ সরিয়ে ফেললো। দেখা গেলো,– সেই স্থানে মাটির নিচে একটা সুড়ঙ্গপথ।

পুলিশ সুপার হতবাক তিনি বিস্ময়সূচক শব্দ করলেন–আশ্চর্য!

বনহুর হেসে বললো–শুধু আশ্চর্যই নয় স্যার, একটু পরে যা দেখবেন তা কল্পনাতীত। আসুন আমার সঙ্গে,–

ডাক্তার বেদনায় অস্থির হয়ে পড়েছিলো, সে আর এগুতে পারলো না, বসে পড়লো ধপ্ করে ভূতলে।

 বনহুর আর পুলিশ সুপার সুড়ঙ্গপথ বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। অন্ধকার সুড়ঙ্গমধ্যে হাতড়ে কিছুদূর নেমে পড়তেই আলোকচ্ছটা দেখতে পেলো তারা। ভিতরে লণ্ঠন জ্বলছে, বনহুর আর পুলিশ সুপার এসে দাঁড়ালো একটা প্রশস্ত জায়গায়, চমকে উঠলেন মিঃ রহমান-অনেকগুলো বালক-বালিকার ক্রন্দনের চাপা শব্দ কানে আসছে।

বনহুর সেই ক্রন্দনের শব্দ লক্ষ্য করে এগুলো, মিঃ রহমান সহ এসে পড়লো আর একটি কক্ষের মত খুপড়ীর মধ্যে। বনহুর সম্মুখস্থ প্রশস্ত কক্ষমধ্য হতে লণ্ঠনটা হাতে উঠিয়ে এনেছিলো। লণ্ঠনের আলোতে দেখলো, অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে মেঝেতে বসে আছে খেজুর পাতার চাটাই এর উপরে। কেউ কেউ কাঁদছে, কেউ বা শুধু আছে তখনও মাথার নিচে হাত রেখে।

 লণ্ঠনের আলোতে দেখলো বনহুর আর মিঃ রহমান–কি মর্মান্তিক করুণ দৃশ্য! কারো চোখ দুটোই অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারো বা একটা চোখ অন্ধ করা হয়েছে। কারো বা হাত একখানা সম্পূর্ণ কেটে ফেলা হয়েছে, কারো বা পায়ের হাড় কেটে বের করে ফেলা হয়েছে। কতকগুলো সুস্থ দেহেই আছে কিন্তু তাদের অবস্থাও শোচনীয়।

কিছুক্ষণ পুলিশ সুপার মিঃ রহমানের মুখ দিয়ে কোনো কথা উচ্চারণ হলো না। তিনি আজ প্রায় বিশ বছর ধরে পুলিশের চাকরি করে আসছেন, কিন্তু এমন রহস্যময় কান্ড তিনি ইতিপূর্বে কখনও দেখেননি। একবার ছেলেধরাদের দুজনকে গ্রেফতার করেছিলেন একটি চোরাই ছেলেসহ, তাদের জেল হয়েছিলো। কিন্তু ছেলেধরাদের যে ঘাঁটি বা এই ধরনের ভয়ঙ্কর একটা ব্যবসা আছে তা তিনি কোনোদিন ভাবতে পারেননি। আজ স্বচক্ষে তিনি দেখছেন এই দৃশ্য।

কয়েকজন পুলিশের সহায়তায় বন্দী বালক-বালিকাগণকে উপরে উঠিয়ে আনা হলো। প্রায় চল্লিশটি শিশু বালক-বালিকা মওজুত ছিলো ছেলেধরাদের সুন্দরবন ঘাটিতে। এসর ছেলে মেয়েগুলোকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমদানী করা হয়েছে।

বনহুর বললো-স্যার আজ যদি ঠিভাবে আপনি আমাকে সাহায্য করতে সক্ষম না হতেন তবে আমি হয়তো এই ছেলেধরা দলকে সায়েস্তা করতে পারতাম না। স্যার, অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।

পুলিশ সুপার বনহুরের হাত মুঠায় চেপে ধরলেন–এই ভয়ঙ্কর ছেলেধরা দলকে গ্রেপ্তার করতে আপনি যে আমাকে সহায়তা করলেন সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। বলুন আপনি কে? কি আপনার পরিচয়? নিশ্চয়ই আপনি সাধারণ ভোলানাথ নন, ভোলানাথের অন্তরালে আপনার আসল পরিচয় ঢাকা আছে, আমি তা বুঝতে পেরেছি।…

 পুলিশ সুপার ভোলানাথকে এতোক্ষণ তুমি বলে সম্বোধন করে আসছিলেন এবার তিনি তাকে সামান্য তুমি সম্বোধন করতে পারলেন না।

হেসে বললো বনহুর–আমি সাধারণ একজন মানুষ। আমার নাম আলম, ঢাকায় থাকি এই পর্যন্ত।

 পুলিশ সুপার বনহুরের কথায় খুব খুশি হতে পারলেন না। তিনি মনে করলেন, নিশ্চয়ই এ ব্যক্তি কোনো সি আই ডি অফিসার কিন্তু সে নিজের সুনাম চায় না, সেই কারণেই হয়তো নিজকে গোপন রাখতে চায়।

বললো বনহুর-আজকেই এই ছেলেগুলো বিদেশে চালান হয়ে যেতো ভাগ্য যে আমরা ঠিকভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়েছি।

মিঃ রহমান আরফান উল্লাহসহ ছেলেধরা দলকে গ্রেফতার করে বনহুরের নির্দেশে ষ্টিমারে ফিরে এলেন। আসার সময় ছেলেধরাদের ঘাঁটি থেকে ওয়্যারলেস ও সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে চললেন। এইসব কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে তাদের হিসাব-নিকাশ। কত ছেলে তাদের আমদানী হয়েছে, কত দেশ-বিদেশে চালান গেছে, কত টাকা তারা এতোদিন ছেলেধরা ব্যবসায় উপার্জন করেছে–সব খুঁটিনাটি লেখা আছে এসব খাতাপত্রে।

– পুলিশ সুপার মিঃ রহমান, কয়েকজন পুলিশকে সুন্দরবন ছেলেদের ঘাঁটিতে পাহারারত রাখলেন। তিনি এবার বন্দীদের নিয়ে ষ্টিমার মালিকে’ ফিরে চললেন খুলনা অভিমুখে।

বনহুরও চললো এই ষ্টিমারে।

 খুলনায় পৌঁছে ছেলেধরা দলকে হাজতে বন্দী করে তারপর আবার যাবেন তিনি সল্লায়। সেখানে আছে আরফানের নারকেল ব্যবসার আড়ত আর তার কয়েজন অনুচর। এদেরও গ্রেফতার করতে হবে।

ভৈরব নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলেছে ষ্টিমার মালিক।

আজ নিজ ষ্টিমারে বন্দী হয়ে চলেছে আরফান উল্লাহ ও তার দলবল। অভিজ্ঞ ছেলেধরা আরফান উল্লাহ প্রায় দশ বছর সে এই ব্যবসা করে চলেছে। নারকেল স্তূপের মধ্যে এবং কাঠের নৌকার খোলের ভিতরে, গোলপাতা বোঝাই নৌকার ছৈ–এর আড়ালে অগণিত ছেলে-মেয়েকে সে চালান করেছে দেশ হতে দেশান্তরে কেউ তাকে কোনোদিন সন্দেহ করতে পারেনি আর আজ কিনা তারই অনুচর সেজে ভোলানাথ মাথায় বজ্রাঘাত করলো। আরফান উল্লাহর ইচ্ছা হচ্ছিলো

সে নিজের মাংস নিজে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভক্ষণ করে।

একটা ক্যাবিনের মধ্যে তাদের ঠাসাঠাসি করে বন্দী রাখা হয়েছে। হাত দু’খানা পিছমোড়া করে হাতকড়া লাগানো। কোমরে মোটাসোটা দড়ি বাঁধা। পায়ে শিকল বাঁধা যেন কোনো রকমে পালাতে সক্ষম না হয়।

*

খুলনায় ছেলেধরা দলকে নামানো হলো। সমস্ত শহরে একটা আশ্চর্যকর সাড়া পড়ে গেলো। লোকে লোকারণ্য ষ্টিমারঘাট। পুলিশ তাদের বাধা দিতে সক্ষম হচ্ছিলো না। সবাই দেখতে চায় এই শয়তান ছেলেধরার দলকে।

ষ্টিমার থেকে যখন সবাইকে বন্ধন অবস্থায় ডেকে নামানো হলো তখন অগণিত জনতা চারপাশ থেকে ঢিল থুথু আর ইট পাটকেল ছুঁড়ে মারতে লাগলো তাদের গায়ে, আর নানারকম কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করতে লাগলো।

চারিদিকে পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় ছেলেধরা দলকে খুলনা পুলিশ অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো। সাবধানে বন্দী করে রাখা হলো হাজতে।

 আর অসহায় শিশু বালক-বালিকাগণকে যত্নসহকারে হসপিটালে রাখা হলো তাদের রীতিমত চিকিৎসার জন্য। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে বাচ্চাদের নিজ নিজ মা-বাপ আত্মীয় স্বজনের নিকটে পৌঁছে দেওয়া হবে।

 তারপর পুলিশ সুপার মিঃ রহমান পুনরায় নতুন পুলিশ ফোর্স নিয়ে চললেন মালিক ষ্টিমারেই সলা বন্দরের দিকে। বনহুরও চললো তার সঙ্গে। মিঃ রহমান বনহুরের সঙ্গে গভীরভাবে বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছেন। সপলায় পৌঁছানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের মধ্যে চললো নানারকম আলোচনা।

 পুলিশ সুপার কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করেই বিস্মিত হলেন, বনহুরের বুদ্ধিমত্তা তাকে। মুগ্ধ করে ফেললো। এর আগে এমন ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছে কিনা সন্দেহ। বনহুরের প্রতিটি কথার মধ্যে ছিলো যুক্তিপূর্ণ ভাবধারা। তিনি মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন তার কথাগুলো।

সন্ধ্যায় সপলা বন্দরে ষ্টিমার মালিক’ পৌঁছে গেলো।

কয়েকজন পুলিশ নিয়ে মিঃ রহমান ও বনহুর এসে হাজির হলো সপলা গ্রামে। আরফান উল্লাহর গুদাম আচমকা ঘেরাও করে ফেললো পুলিশবাহিনী, একটি লোকও যাতে বের হতে না পারে।

আরফান উল্লাহর গুদাম যখন ঘেরাও করা হলো তখন রাত একটা বেজে দশ মিনিট হয়েছিলো। সবাই ঘুমাচ্ছিলো নাক ডাকিয়ে।

 মিঃ রহমানের আদেশে প্রত্যেক ব্যক্তির হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হলো। হরিও বাদ গেলো না, পুলিশ সবাইকে গ্রেপ্তার করে এক জায়গায় জড়ো করলো।

ওদিকে বনহুর তখন হরির অন্বেষণে গুদাম চষে ফিরছে।

হঠাৎ এসে পড়লো বনহুর বন্দীদের সম্মুখে, হরির দিকে নজর পড়তেই বনহুর চমকে উঠলো, তার হাতেও হাতকড়া লাগানো রয়েছে।

বনহুর বললো–স্যার, এটা আমাদের লোক, মানে আমার চাকর।

 ক্ষমা করবেন, আমার পুলিশ বাহিনী একে চিনতে পারেনি।

পুলিশ সুপারের আদেশে হরিকে মুক্ত করে দেওয়া হলো। হরি বনহুরের দিকে তাকিয়ে বললো-হুজুর, কাজ সমাধা হয়েছে তো?

হাঁ হরি, কাজ সমাধা হয়েছে। ছেলেধরা দলকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয়েছি।

হুজুর, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

বনহুর বললো–স্যার, হরি আমাকে এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছে। হরির কাছে আমি কৃতজ্ঞ স্যার।

মিঃ রহমান হরির পিঠ চাপড়ে বললেন-হরি, তোমাকে পুরস্কার দেওয়া হবে।

হাতের মধ্যে হাত কচলায় হরি–হুজুর, আপনাদের মর্জি।

মিঃ রহমান এবার আরফান উল্লাহর বাকি অনুচরগুলোকে বন্দী করে নিয়ে ফিরে চললেন। খুলনার দিকে।

বনহুর আর হরি মিঃ রহমানকে সপলা ঘাটে বিদায় সম্ভাষণ জানালো এসে।

ষ্টিমারখানা সপলাঘাট ত্যাগ করার পর বললো হরি–কাজ শেষ হলো?

হ নূরী।

কে নূরী?

 না না হরি, হাঁ, কাজ শেষ হয়েছে। একটু বাকি আছে তবুও।

কি আবার বাকি রইলো? ছেলেধরা দলবল সব এখন পুলিশের হাতে, সুন্দরবন ঘটিও পুলিশের কবলে।

আছে, একটা কাজ বাকি আছে এখনও।

 কি কাজ?

 বলবো। চলো সপলা গ্রামে।

না। আমি আর সপলায় যাবোনা।

 কিন্তু আমাকে যেতে হবে নূরী।

ফের নূরী বলছো?

কেন, এতো আপত্তি কেন তোমার নাম ধরে ডাকায়?

 হোটেলে ফিরে কি অসুবিধায় পড়বে। হঠাৎ যদি নূরী বলে ডেকে বসো তাহলেই হয়েছে।

ও, সেই ভয় বুঝি?

 ভয় নয়–লজ্জা।

নূরী, এবার ঢাকায় ফিরে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ত্যাগ করে অন্য একটা বাসা ভাড়া করে থাকবো।

কারণ?

কারণ আমি যা করবো তা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে থেকে সম্ভব হবে না।

 বেশ, যা তোমার ভাল লাগে করো।

*

সপলা গ্রামে ফিরে এলো বনহুর আর নূরী।

গ্রাম্যচাষীর বেশ ত্যাগ করে ভাল জামা কাপড় পরে ভদ্র বেশ ধারণ করলো বনহুর, তারপর নূরীসহ আরফান উল্লাহর বাড়িতে আগমন করলো।

 আরফান উল্লাহর গ্রেফতার ব্যাপার নিয়ে সমস্ত বাড়িময় একটা শোকের ছায়া পড়েছে।  একজন ভদ্রলোককে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেলো চাকর ছলিম, বললো—কে আপনি? কি চান কন?

আমি সখিনার ভাই আলম।

 এ্যাকি কন? আপনি, আপনি সখিনার বাই অন?

 হাঁ, তাকে গিয়ে বলল আমি এসেছি।

ছলিম বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো, শোনা গেলো তার গলা–সহিনা, তোমাগো বাই। আইসেছে।

একটু পরে সখিনাসহ ছলিম বেরিয়ে এলো, সখিনা বনহুরকে দেখেই আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।

হেসে বললো বনহুর-সখিনা, আমি তোমার আলম ভাই।

ঘোমাটা ফাঁকে তাকালো সখিনা অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দর বেশধারী ভদ্রলোকটার দিকে। .. এ লোকটা কি করে তার সেই আলম ভাই হবে। না না, তার আলম ভাই–সে যে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ, চুল এলোমলো রুক্ষ, গায়ে জামা-কাপড় ময়লা এবং ছেঁড়া–আর এ যে অদ্ভুত সুন্দর একটি লোক।

বনহুর বুঝতে পারলো সখিনা তাকে চিনতে পারেনি। এবার সে আরও সরে গেলো বললো-”সখিনা তুমি আমার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখ, আমিই তোমার আলম ভাই। চলো, তোমাকে তোমার পিতার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসি। সখিনা, যার ভয়ে তোমাকে এ বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো তাকে আমি পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।

এতোক্ষণ সখিনার যেন বিশ্বাস হলো, সে ভালভাবে বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো–মাফ করো আমাগো আলম বাই, আমি তোমারে চিনতে পারিনি।

এসো বোন তোমাকে পৌঁছে দি।

 বেরিয়ে আসে সখিনা আরফান উল্লাহর বাড়ি থেকে। আজ তার আর কোনো ভয় নেই। যেখানে ছিলো বাঘের ভয় সেখানেই তাকে রাত কাটাতে হয়েছে। শুধু আলম ভাই-এর বুদ্ধির জন্যই বেঁচে গেছে সে শয়তানটার কবল থেকে।

 সখিনাকে নিয়ে বনহুর আর নরী ফিরে এলো সবুর আলীর বাড়িতে।

বৃদ্ধ সবুর আলী কন্যাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হলো। বনহুরকে প্রাণ ভরে দোয়া দিলো বৃদ্ধা সবুর আলী।

সবুর আলী আর সখিনার কাছে বিদায় নিয়ে ফিরে এলো বনহুর আর নূরী হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এতোদিন সে কোথায় ছিলো ম্যানেজার সাহেব এসে জিজ্ঞাসা করলেন।

বনহুর জানালো, তার এক আত্মীয়ের হঠাৎ অসুস্থতার খবর পেয়ে চলে গিয়েছিলো, বলে যাবার মত সময় হয়ে উঠেনি। আত্মীয় সুস্থ হয়ে উঠায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে সে।

সেদিন হোটেলের বাগানে সবুজ দূর্বা ঘাসের উপর বসেছিলো বনহুর। আজ তার দেহে ধবধবে পা জামা আর পাঞ্জাবী পরা রয়েছে। গভীরভাবে বনহুর কিছু চিন্তা করছিলো বসে বসে। হয়তো সেই ছেলেধরা রহস্য ব্যাপার নিয়েই ভাবছিলো সে। আজকের সংবাদপত্রে খবরটা বিরাট আকারে প্রকাশ পেয়েছিলো। এক অজ্ঞাত ভদ্রলোকের সহায়তায় খুলনা পুলিশ সুপার মিঃ রহমান এক দুর্ধর্ষ ছেলেধরা দলকে গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছেন। প্রায় চল্লিশটি হারানো ছেলে-মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা এখন খুলনা হসপিটালে চিকিৎসাধীন আছে। তাদের শরীর কিছুটা সুস্থ হলেই নিজ নিজ পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনের নিকেট পৌঁছে দেওয়া হবে। এইসব কথাই চিন্তা করছিলো বনহুর নির্জনে বসে।

হঠাৎ পিছনে একটা মিষ্টি কণ্ঠস্বর–আপনি একা বসে বসে কি ভাবছেন?

ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় বনহুর সম্পূর্ণ অপরিচিত এক তরুণী ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আধুনিক তরুণী বটে, পরনে ফিকে আকাশী রং-এর শাড়ি, ব্লাউজ গাঢ় নীল। পায়ে নীল হাইহিল। জুতো, গলায় একটা নীল ফিতার বাঁধা বড় লকেট। লকেটখানা বুকের কাছে দুলছে। মাথায় আধুনিক প্যাটার্ণ খোঁপা বাঁধা, বিরাট খোঁপাটার বামপাশে মস্ত একটা গোলাপ গোঁজা রয়েছে। দু’কানে জ্বলজ্বল করছে দুটো মূল্যবান রুবী।

 বনহুর এক নজরে মেয়েটার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে নিয়ে মৃদু হেসে বললো–কি ভাবছি নিজেই জানি না।

 মেয়েটি সরে এলো আরও কয়েক পা, ঠিক বনহুরের পাশে এসে ঘনিষ্ঠভাবে বসে পড়লো মনে হলো যেন কতদিনের চেনা মেয়েটি।

বনহুর একটু সরে বসলো মেয়েটির কাছ থেকে।

তরুণীটি হেসে বললো–ক’দিন থেকে ভাবছি আপনার সঙ্গে পরিচয় করবো কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠেনি।

 বনহুর বাঁকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তরুণীর মুখে মনে পড়লো কদিন আগে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে এই তরুণীটিকে এরোপ্লেনের মধ্যে দেখেছিলো। তবে অল্প সময়ের জন্য, তাই তেমনভাবে আজ স্মরণ হচ্ছিলো না। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে আবার তার দেখা পাবে, ভাবতে পারেনি বনহুর।

তরুণী বললো–যদি কিছু মনে না করেন তবে আপনার নামটা জানতে পারি কি?

 বললো বনহুর নিশ্চয়ই! আমার নাম আলম।

নামটা তরুণী একবার উচ্চারণ করলো আপন মনেই–আলম। সত্য এ নামটা আমার কাছে খুব প্রিয়। মিঃ আলম, আপনি কতদিন আছেন এখানে?

এসেছি প্রায় সপ্তাহ দুই হলো, থাকবো কিছুদিন।

 সত্যি কি যে খুশি হলাম আপনার কথা শুনে।

অবাক হয়ে তাকালো বনহুর –তার থাকা না থাকায় তরুণীর কি আসে যায়। আড়চোখে একবার তরুণীর মুখটা দেখে নিলো সে।

 তরুণী বললো–আপনি আমার কথা শুনে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন। মিঃ আলম, জানেন না আমি কত অসহায়। জীবনে আমার অনেক দুঃখ, ব্যথা-বেদনা।

বনহুর সঙ্কোচিত হয়ে পড়ে, অপরিচিত এক যুবতীর মুখে এমন ধরনের উক্তি অশোভনীয় মনে হয়। তবু নীরব থাকা ছাড়া তেমন কোনো উপায় খুঁজে পায়না সে।

তরুণী বলে চলে–এমন কেউ নেই আমার যার কাছে বসে মনের দুঃখ প্রকাশ করবো।

মনে মনে প্রমাদ গুণলো বনহুর। তবু ভাগ্যি যে হরি বেশি নূরী আজ হোটেলে নেই, সে তার কয়েজন বয় সঙ্গীসহ নিউমার্কেটে বেড়াতে গেছে। হোটেলে বয় সেজে থাকতে হলে ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলে উপায় নেই। তাই নূরী সব সময় ওদের কথায় কাজ করে, তবে নিজকে সামলে রেখেই চলাফেরা করে সে।

বললো এবার বনহুর–আমার কাছে মনের দুঃখ ব্যথা প্রকাশ করে তেমন কোনো ফল হবে বলে মনে করি না।

কিন্তু মিঃ আলম, আমি আপনাকে অনেকখানি বিশ্বাস করি।

কারণ? ভ্রূ কুচকে বললো বনহুর।

 কারণ আপনি যেমন একা নিঃসঙ্গ আমিও ঠিক তেমনি।

আপনার কথা আমি—

 মানে বুঝতে পারছেন না, এইতো? জানেন আমার প্রাণে কত ব্যথা?

তা আমি কেমন করে জানবো? তাছাড়া আমি জেনেই বা কি উপকার করতে পারবো আপনার?

পারবেন। পারবেন মিঃ আলম। কই এতোক্ষণ হলো আলাপ করছি আমার নামটাতো জিজ্ঞাসা করলেন না?

হাঁ, ভুল হয়েছে। বলুন কি নাম ধরে ডাকবো আপনাকে?

মিসেস শোহেলী বেগম। আপনি আমাকে শোহেলী বলেই ডাকবেন।

বনহুর মনে করেছিলো তরুণী অবিবাহিতা, এবং সেই কারণেই সে তার পাশে এসেছে তার সঙ্গ কামনা করে কিন্তু—

কি ভাবছেন মিঃ আলম?

 ভাবছি আপনি বিবাহিতা হয়েও পিতার স্নেহের বন্ধনকে আজও এড়াতে পারেননি?

কে আমার পিতা?

কেন, আপনার সঙ্গে যে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে দেখেছিলাম তিনি কি—

আমার স্বামী।

আপনার স্বামী।

হাঁ মিঃ আলম, ঐ বৃদ্ধা আমার স্বামী—একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে তরুণী, তারপর বেদনা ভরা কণ্ঠে বলে- মিঃ আলম, আমি বড় নিঃসঙ্গ তাই আপনার মত একজন সঙ্গী পেতে চাই।

 এতোক্ষণে বনহুর বুঝতে পারলো তার হেয়ালীপূর্ণ কথাগুলোর মানে। বললো–আপনি বুঝি এই হোটেলেই উঠেছেন মিসেস শোহেলী?

মিসেস নয়, আপনি আমাকে শুধু শোহেলী বলেই ডাকবেন।

আমি তাতেই খুশি হবো বেশি।

বেশ, তাই হবে। আচ্ছা উঠি আজ, কেমন?

 বসুন না আর একটু?

একটু নিউমার্কেট যাবো কিনা।

খুশি হলো মিসেস শোহেলী-আমিও যাবো মিঃ আলম। চলুন না এক সঙ্গেই যাওয়া যাক?

প্রমাদ গুণলো বনহুর, কিন্তু বলে যখন ফেলেছে তখন আর উপায় কি-যেতেই হয়। বললো বনহুর-চলুন যদি আপত্তি না থাকে। কিন্তু আপনার স্বামী?

তিনি হোটেলকক্ষে অচেতন, রাত আটটার পূর্বে তার চেতনা ফিরে আসবে না মিঃ আলম।

 তার মানে?

মানে প্রতিদিন মদ না খেলে তার হজম হয় না, এতো বেশি তিনি রোজ পান করেন তার দরুন তার জ্ঞান ফিরতে পুরো আট ঘন্টা লেগে যায়।

আশ্চর্য এই বয়সেও তিনি এইভাবে নেশা করেন?

হাঁ মিঃ আলম। থাক চলুন আর একদিন সবকথা আপনাকে বলবো।

না, আমি আপনার ঘরের কথা শুনতে চাই না মিসেস শোহেলী।

দেখুন আমি বারবার বলছি আমাকে মিসেস বলবেন না।

বেশ চলুন শোহেলী—কিন্তু কেমন বেখাপ্পা লাগছে না কথাটা আপনার কাছে?

 মোটেই না। চলুন—

বনহুর এগুলো হোটেলের সম্মুখভাগে যেখানে তার গাড়িখানা পার্ক করা আছে। গাড়ির পাশে এসে দরজা খুলে ধরলো বনহুর-উঠুন।

 শোহেলী হাস্যোজ্জ্বল মুখে ড্রাইভ আসনের পাশে বসলো।

বনহুর গাড়ির সম্মুখ দিয়ে ঘুরে ড্রাইভিং আসনে উঠে বসলো। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে গাড়িখানা বের করে আনলো রাস্তায়। একবার হাতঘড়িটা দেখে নিলো বনহুর। বেলা পাঁচটা পঁচিশ বেজে গেছে। হরিকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যেই তার নিউমার্কেট যাওয়া। কিন্তু মিসেস শোহেলীসহ যাওয়াটা তার মনে বাধলো, বিশেষ করে নূরীর কাছে কৈফিয়ৎ দিতে তাকে হিমসিম খেতে হবে।

গাড়িখানা ছুটে চলেছে রাজপথ ধরে।

মিসেস শোহেলীর আনন্দ আর ধরছে না, মিঃ আলমের মত সুন্দর সুপুরুষ একটি লোককে পাশে পেয়ে মন তার ভরে উঠেছে খুশিতে। সব সময় বৃদ্ধ স্বামীর পাশে থাকতে গিয়ে সে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে, আজ যেন মুক্তির নিশ্বাস ফেললো।

বনহুর ভাবলো, এখন কি করা তার কর্তব্য? মিসেস শোহেলীকে চট করে এড়ানো কিছুতেই সম্ভব নয়। বনহুর বলে উঠলো–শোহেলী, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, চলুন না রমনা পার্কে গিয়ে একটু বসা যাক?

ওঃ তা হলে তো আমার প্রাণ ভরে যাবে।

কেন, নিউমার্কেটে যে কাজ ছিলো বললেন আপনার?

না, তেমন কাজ নয়। থাক, আর একদিন হবে। চলুন না রমনা পার্কে যাই।

বেশ চলুন।

রমনা পার্কের গেটের ভিতরে গাড়ি প্রবেশ করলো বনহুরের। এখানে আরও অনেক গাড়ি পার্ক করা আছে। বনহুর একটি জায়গা বেছে নিয়ে গাড়ি রাখলো।

তারপর গাড়ি থেকে নেমে এগুতে লাগলো বনহুর আর মিসেস শোহেলী।

অন্যান্য ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে, এমন জুটি তারা যেন ইতিপূর্বে আর দেখেনি। পাশাপাশি উভয়ে এগিয়ে চলেছে পার্কের পথ ধরে। আরও অনেক পুরুষ-মহিলা শিশু, বালক-বালিকাসহ চলেছে।

বনহুর আর মিসেস শোহেলী নির্জন একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লো।

বনহুরের উদ্দেশ্য কোনোরকমে শোহেলীকে এড়ানো, কিন্তু কিছুতেই যেন তা সম্ভব হচ্ছে না, যতই ওকে ত্যাগ করার চেষ্টা করছে ততই মিসেস শোহেলী আরও নিবিড় হওয়ার চেষ্টা করছে। যেন তার সঙ্গে।

ফ্যাসাদ গুণলো বনহুর।

পাশাপাশি বসে আছে বনহুর আর মিসেস শোহেলী। বেলা শেষের সূর্যাস্তের সোনালী আভা এসে ছড়িয়ে পড়েছে উভয়ের মুখে।

শোহেলী বললো–মিঃ আলম।

 বলুন?

 আমার জীবন কাহিনী আপনাকে শোনাতে চাই মিঃ আলম।

কি ফল হবে তাতে?

জানি না, কিন্তু আমার সমস্ত মন আপনাকে জানানোর জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে। মিঃ আলম, আপনি আমাকে বলবার সুযোগ দিন।

আমাকে বলে যদি তৃপ্তি পান বলুন? বনহুর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো।

মিসেস শোহেলীর মুখমন্ডল অত্যন্ত বেদনা-বিধূর করুণ দেখাচ্ছে। বনহুরের মায়া হলো, সহানুভূতির স্বরে বললো–বলুন মিসেস শোহেলী?

 আবার আপনাকে দেখেই বুঝা যায়। বললো বনহুর একরাশ সিগারেটের ধোঁয়ার ফাঁকে।

মিসেস শোহেলী একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলতে শুরু করলো আবার আমার পিতা। একজন গরিব জমিদার ছিলেন নামে শুধু তিনি চৌধুরী ছিলেন। এই চৌধুরী উপাধি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো যেন এ পৃথিবীতে। সব তার চলে গিয়েছিলো ছিলো শুধু একখানা চুন-বালি খসে পড়া। হাড় জিরজিরে বাড়ি বাড়ি নয় ইমারত। একদিন হয়তো এই ইমারত বাঈজীর চরণের নুপুর ধ্বনিতে মুখর হয়ে থাকতো। পাইক পেয়াদা, আর বরকন্দাজের কলকন্ঠে হয়তো কান ঝালাপালা হয়ে উঠতো। সিংহদ্বারে নহবতের সুর জনগণের মনে জাগাতো এক অপূর্ব মোহের আবেশ। কিন্তু আমি জন্মে অবধি দেখেছি চৌধুরী বাড়িতে এক করুণ বেদনার ছাপ। ইটের স্কুপের আড়ালে অনাহারে তিল তিল করে ধুকে-মরা একটা পরিবার! মিঃ আলম, আমরা ছিলাম একটি নয়-সাত সাতটি বোন আর পাঁচটি ভাই। আমার বড় ছিলো চারটি বোন, আমি পঞ্চম।

বনহুর মনে মনে বিরক্ত হলেও কান পেতে শুনতে লাগলো। একটি সিগারেট শেষ করে পুনরায় আর একটি ধরালো সে।

মিসেস শোহেলী বলে চলেছে–আমার বয়স যখন সাত বছর তখন আমার উপলব্ধি করার ক্ষমতা হয়েছিলো, আমি দেখেছিলাম আমাদের সংসারের আসল রূপ। বাবা বৃদ্ধ–উপার্জনে অক্ষম; ভাইরা সব ছোট ছোট। আমার বড় বোনগুলোর বয়স অনেক হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু কারো বিয়ে হয়নি।

যখন ছোট তখন না বুঝলেও আরও কিছুদিন পর বুঝলাম কেন আমার দিদিদের বিয়ে হচ্ছে না। আমাদের বৃদ্ধ এক চাকরানীর মুখে একদিন গোপনে জানতে পারলাম, আমাদের মা যিনি, তিনি এক পতিতার মেয়ে। সুন্দরী রূপসী বলে বাবা তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করে ঘরে। এনেছিলেন কিন্তু সেদিন তিনি বুঝেননি কত বড় ভুল তিনি করেছিলেন। বুঝলেন বিশ বছর পরে আমার বড় বোনের যখন বিয়ে সম্বন্ধ ফিরে গেলো, আর এলো না কোনো দিন। পেটে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই–ঘরে একটি নয়, বারোটি সন্তান।

 ক্ষুধার জ্বালা কম নয়, বাবা সব সময় চারিদিকে খাদ্যের অন্বেষণে ছুটোছুটি করে ফিরতেন। মাথার ঘাম পায়ে করে রিক্ত হস্তে ফিরে আসতেন। তখন আমাদের মনের অবস্থা যেন কি হতো তা ভাষায় বুঝানো যায় না।

বনহুরের কাছে মিসেস শোহেলীর কথাগুলো প্রথম বিরক্তিজনক মনে হলেও এখন যেন জানার বাসনা ধীরে ধীরে উঁকি দিয়ে উঠলো। বেলা শেষ হয়ে আসছে খেয়াল নেই তার, শুনে। চলেছে বনহুর বিস্ময়ভরা স্তব্ধ মন নিয়ে।

মিসেস শোহেলী বলে যায়–মিঃ আলম ক্ষুধায় কাতর ছোট ছোট ভাই-বোনদের করুণ কান্না দেখে বাবা মাটিতে বসে রোদন করতেন।

বড় বড় বোনগুলো আঁচলে অশ্রু মুছতো শুধু আড়ালে দাঁড়িয়ে মা গাল দিতেন কেন তার মরণ হয় না, কেন ছেলেমেয়েগুলো মরে না, যমকি চোখে দেখে না তাদের –এমনি কত কি। কিছুক্ষণ চুপ রইলো মিসেস শোহেলী হয়তো মনের দুঃখ কিছুটা শান্ত করে নেবার জন্যই সে মাথা। নত করে মাটি থেকে দুর্বাঘাসগুলো টেনে ছিঁড়তে লাগলো, তারপর আবার বলতে শুরু করলো– একদিন দেখলাম, একটা লোকের সঙ্গে বাবা বাইরে আড়ালে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে কিছু বলছে। কেউ যেন তাকে দেখে না ফেলে বা তার কথা না শোনে সেইজন্য বারবার তাকাচ্ছিলেন। এদিক-সেদিকে। মিঃ আলম, পিতাকে এভাবে কথা বলতে দেখে আমার মনে কেমন সন্দেহ। জাগলো, আমি প্রাচীরের আড়ালে আরও সরে এলাম, তাদের কথাবার্তা শুনতে না পেলেও দেখতে পাচ্ছিলাম সব। অবশ্য পিতাকে আমার সন্দেহ করার মত কিছুই ছিলো না, সন্দেহ হচ্ছিলো যে। লোকটার সঙ্গে পিতা কথা বলছিলেন তাকে। তাই আমি সচেনতভাবে লক্ষ্য করছিলাম। দেখলাম। লোকটা বাবার হাতে বেশকয়েকটা টাকা গুঁজে দিলো। মিঃ আলম, সেইদিন আমরা পেট পুরে খেতে পেয়েছিলাম। খেয়ে রাতে ঘুমিয়েছি–আজ কতদিন পর এমন করে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া, তাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো চেয়ে দেখি বড় দিদি পাশের। বিছানায় এলোমেলো বেশে বসে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর সেই সকাল বেলার লোকটা বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে।

 বনহুর আবার দৃষ্টিটা তুলে ধরলো মিসেস শোহেলীর মুখে। অশ্রু ছলছল করছে ওর চোখ দু’খানা। কেমন যেন গম্ভীর হয়ে রইলো কিছু সময় তারপর বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো–এরপর থেকে দিদির ঘরে রোজ আসতে লাগলো. লোকটা। বেশ রাত করে আসতো সে। বাবা মাকে ধমকে দিতেন–ওদের সকাল সকাল খাইয়ে শুইয়ে দিও। আমরা ঘুমোতে দেরি করলে বাবা যেন ভীষণ রেগে যেতেন। কাজেই চোখে ঘুম না পেলেও ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম।

 ক্রমে ব্যাপারটা সরে এলো বাড়ির সকলের। এখন আমাদের দু’বেলা দুটো ভাত জুটতে লাগলো। ক্রমান্বয়ে দিন গড়িয়ে যাচ্ছিলো, প্রায় কয়েক মাস কেটে গেছে। হঠাৎ দিদি একদিন বমি। করতে শুরু করলো, তারপর মাথা ধরা আজকাল প্রায়ই লেগেই ছিলো দিদির সব সময়।

দিদি অসুস্থ তবু সেই শয়তানের মত লোকটা আসতো যেতো তখন অত বুঝিনি কেন সে এমন করে রোজ আসে যায়। অনেক ক’টা দিন চলে গেলো–একদিন দিদি মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে দেখলাম। তখন অনেক রাত আমরা যে ঘরে শুই সেই ঘরের মেঝেতে একটা ছেঁড়া মাদুরের উপর দিদি গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো ঘর ছিলো বটে কিন্তু ব্যবহার উপযোগী ছিলো মোটে দুটো। একটিতে শুতে বাবা-মা আর কোলের বাচ্চাটা আর দ্বিতীয়টায় ঘুমাতাম আমরা সবাই। বড় একটা খাট ছিলো, সেটাতে পাশাপাশি কোনোরকমে রাত কাটাতাম। বড় দিদি মেজো দিদি এরা ঘুমাতো ওদিকের চৌকিতে। যখন থেকে ঐ লোকটা আসা যাওয়া শুরু করলো তখন থেকে মেজো দিদিও শুতো আমাদের খাটে সেকি কষ্ট হতো আমাদের। কিন্তু বাবার ভয়ে আমরা টু শব্দ করতাম না। অভাবের তাড়নায় বাবা এমন হয়ে পড়েছিলেন যার দরুন বাবার চেহারা আর মেজাজ দুই-ই হয়ে পড়েছিলো রুক্ষ আর কর্কশ।

 বড় দিদিরা বাবার সম্মুখে যাওয়ার চেয়ে যমের সম্মুখে যেতেও বুঝি এতো দ্বিধা করতো না। দিদিদের বয়স শেষ হয়ে আসছে তবু কারো বিয়ে হচ্ছে না–এ যেন তাদের নিজেদেরই দোষ। সব সময় বাবা বিষ নজরে দেখতেন দিদিদের তার সঙ্গে আমাদেরও। ভাইরা সব ছোটছোট আমাদের পায়ের কাছে কোনো রকমে ঘুমাতো। ভাগ্যিস খাটখানা খুব বড় ছিলো তাই রক্ষা, এতোগুলো কোনো রকমে রাত কাটাতাম।

 হাঁ, দেখলাম দিদি মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। দিদির পাশে কেউ নেই, শুধু মা। আমি দেখলাম, আমার অন্যান্য দিদিরা সবাই জেগে আছে, কিন্তু কেউ কথা বলতে সাহসী হচ্ছে না। সবাই যেন কাঠের পুতুলের মত আরষ্ট হয়ে গেছে।

কয়েকদিন হলো লোকটা আর আসে না। বাবা সব সময় রুক্ষ মেজাজ নিয়ে থাকতেন। পেটেও ক্ষুধার জ্বালা, লণ্ঠনেও তেল নেই।

এক কোনে মিটমিট করে কেরোসিনের ডিবেটা জ্বলছে। ঘরখানা আধো অন্ধকার। ভাল করে দেখা যাচ্ছে না কিছু। শুধু শোনা যাচ্ছে দিদির মর্মস্পর্শী গোঙ্গানির শব্দ।

 না জানি দিদির কি কষ্ট হচ্ছে। আমার বুকখানা ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো, যখন দিদি বারবার একটু জলের জন্য কাতর কন্ঠে মার কাছে অনুরোধ জানাচ্ছিলো। মন চাচ্ছিলো আমি ছুটে গিয়ে দিদির মুখে জলের গেলাসটা তুলে ধরি। কিন্তু মা কেন যে এতো নিষ্ঠুর হয়েছিলেন আমি পরে বুঝলাম। মেজো দিদি ফিস ফিস করে বললেন–ঘরে জল কোথায় যে দেবে। পাশের বাড়ির ওরা জল দেয়নি। শুনে আমার মনটা ডুকরে কেঁদে উঠলো কিন্তু কি করবো, কোনো উপায় নেই। বাড়িতে বড় ইঁদারা ছিলো বহুকাল অযত্নে নষ্ট হয়ে গেছে, অপরের বাড়ি থেকে পানি বয়ে এনে সংসার চালাতে হতো। দিদির অবস্থা পাড়ার লোক জেনে ফেলায় আমাদের একঘরে করেছিলো। তাই কেউ আর জল দিতো না। আমাদের বাড়ির কিছু দূরে একটা পুকুর ছিলো, সেই পুকুরের জলে আমরা রান্না করতাম এবং পান করতাম। হয়তো আজ পুকুরের জলও ঘরে নেই।

একটু পরেই শুনতে পেলাম ছোট্ট বাচ্চার কন্নার শব্দ। আর সহ্য হলো না, খাটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম, দেখলাম সুন্দর ফুলের মত একটা শিশু মেঝেতে মাদুরের উপর পড়ে আছে।

 আনন্দে বুক আমার ভরে উঠলো, বাচ্চাটাকে কোলে করার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে পড়লাম। ভেবে পেলাম না তখন কেন বাবা-মা এমন গোপনভাবে কথাবার্তা বলছেন।

শুনতে পেলাম বাবার গলা-মুখে নুন গুঁজে দাও। মুখে নুন গুঁজে দাও—-

মায়ের কণ্ঠ– আমি পারবো না যা করতে হয় তুমিই করো। আমি পারবো না জীব হত্যা করতে—

দেখলাম বাবা চোরের মত চুপি চুপি কক্ষে প্রবেশ করলেন। কেরোসিনের ডিবের আলোতে দেখলাম বাবার এক পৈশাচিক রূপ। বাবা সন্তর্পণে এগিয়ে এলেন দিদি যেখানে মেঝেতে পড়ে আছে। এতক্ষণে দিদি নীরব হয়ে গেছে, বোধ হয় আরাম পেয়েছে।

দেখলাম বাবা ফুলের মত শিশুটার গলা টিপে ধরলো। একটা শব্দ হলো কোঁ কোঁ করে। শিউরে উঠলাম আমি, হয়তো আমার পাশেই নিদ্রার ভাণকরা দিদিগণও শিউরে উঠলো। দেখলাম বাবার হাতের মুঠায় ফুলের মত ফুটফুটে শিশুটার মুখ কালির মত কাল হয়ে উঠেছে।

 বনহুর স্তব্ধ নিশ্বাসে শুনে যাচ্ছে মিসেস শোহেলীর কথাগুলো।

বলে চলেছে মিসেস শোহেলী–তারপর কয়েকদিন দিদি বিছানা থেকে উঠলো না। আমাদের সংসারে আবার অভাব আর অনটন চলেছে। কেটে গেলো কয়েকটা দিন–একদিন রাতে দিদির কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। চমকে চেয়ে দেখি, সেই লোকটা দিদির খাটে বসে আছে। দিদির আঁচলখানা তার হাতের মুঠায়। দিদি পালানোর চেষ্টা করছে, লোকটা দিদিকে জাপটে ধরে ফেললো, বাম হস্তে আলোটা নিভিয়ে দিলো সে।

পরদিন মায়ের কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো, শুধু মা-ই নয় আমার অন্যান্য দিদিও বিলাপ করে কাঁদছে। প্রথমে কিছু বুঝতে পারলাম না, পরে দেখলাম দিদিকে মেঝেতে চাদর দিয়ে ঢেকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আমার বড়টা এক সময় আমাকে জানালো, দিদি গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছে–আর সে জাগবে না। মিসেস শোহেলীর গলা ধরে এলো।

বনহুর বললো থাক চলুন এবার ফেরা যাক।

মিসেস শোহেলী বনহুরের কথায় কান না দিয়ে বললো–মিঃ আলম ক’দিন পর আবার আমার মেজো দিদির কাছে লোকটা আসা যাওয়া করতে শুরু করলো। শুধু সেই নয়, আরও কয়েকজন লোক আসতো দিদিদের ঘরে। আমার ছোট ভাই-বোনদের মা বাবার ঘরে শোবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আমাদের অবস্থা ক্রমান্বয়ে উন্নতি হতে লাগলো। আমরা দু’বেলা পেট পুরে খেতে লাগলাম। বাবার গায়ে নতুন জামা উঠলো। মা ছেঁড়া শাড়িখানা পাল্টে নতুন শাড়ি পড়লেন। কিন্তু অবাক হলাম, পাড়া প্রতিবেশীরা আর কেউ আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসতো না। কারো সঙ্গে দেখা হলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতো। তখন না বুঝলেও বুঝলাম কয়েক বছর পরে। বড় দিদির মত মেজো সেজো এরা অমন ঘাবড়ে যেতো না। সব সময়ের জন্য আমাদের বাড়িটা একখানা পাপপুরী হয়ে। উঠলো। আমাদের সামনেই দিদিরা বাইরের লোকগুলোকে নিয়ে আমোদ প্রমোদ করতো। না। করে যে উপায়ও ছিলো না কিছু–একদিকে বাবার তাড়না আর একদিকে ক্ষুধার জ্বালা সব লজ্জা শরমকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো।

বছরে দুটো-তিনটে নিষ্পাপ শিশুকে আমাদের বাড়িতে যে হত্যা করা হতো না তা নয়। তারপর একদিন মেজো দিদি উধাও হলো। কোথায় গেলো কেউ জানে না–দিন গেলো রাত হলো আর ফিরে এলো না সে।..

বনহুর একটা শব্দ করলো মাত্র–উঃ কি জঘন্য।

হাঁ মিঃ আলম, জঘন্যই বটে। তারপর দু’বছর কেটে গেলো সেজো বোন মারা গেলো জারজ সন্তান প্রসবকালে। চতুর্থবোন পালালো এক মোটর ড্রাইভারের সঙ্গে। নিত্য নতুন পুরুষের নির্যাতন হয়তো সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তারপর আমার পালা। আর সব ছোট ছোট। আমি সবে পনেরো পেরিয়ে ষোল বছরে পা দিয়েছি। আবার সংসারে অভাব রাক্ষসী হানা দিয়েছে। ঘরে উনুন জ্বলে না উনুনে হাড়ি উঠে না। বাবার মুখে কথা নেই–চুল রুক্ষ, চোখ কোঠরাগত।

 হাঁ, সেদিন আমি ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। দিদিরা নেই, সব দিদি হারিয়ে গেছে তাই, মা-বাবা আমাকে আর আমার ছোট কয়েকটি ভাইবোনকে ওঘরে শোবার ব্যবস্থা করে। দিয়েছেন।

হঠাৎ একটা কঠিন স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেলো, চিৎকার করে জেগে উঠলাম। দেখি আমার পাশে বসে এক নর শয়তান। আমাদেরই গ্রামের এক মুসলমান কশাই মাতাল। অসহায়ের মত। চারিদিকে তাকালাম–একি, আমার ভাইবোন কেউ নেই সে ঘরে। শুধু আমি একা কখন যে, আমার ছোট ভাইবোনগুলোকে উঠিয়ে মা-বাবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা বুঝতে পারলাম না। তাকালাম কশাই মাতালটার দিকে। মাতাল তখন আমার দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে পিট পিট করে হাসছে। আমি জানতাম কশাইটার অনেক টাকা আছে, সে প্রায়ই বাবাকে আমার জন্য প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করতো। মুসলমান বলে বাবা ওকে তেমন প্রশ্রয় দেননি। আজ আর তিনি পারেননি সংযত থাকতে। কয়েকটা টাকার মোহে বাবা আমাকে তুলে দিয়েছেন ওর হাতে। আমাকে জাপটে ধরতে গেলে কশাই সোনামিয়া। হাঁ, ওর নাম সোনামিয়া ছিলো। আমিও কম মেয়ে ছিলাম না। সোনাকে কামড়ে কাবু করে ফেললাম, কিছুতেই আমি ধরা দিলাম না। বাইরে থেকে বাবা-মার ফিসফাস গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম কিন্তু জানি তাদের ডেকে আমার কোনো লাভ হবে না। আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম। কিছুতেই সোনামিয়া আমার নাগাল পেলো না, আমি দরজা খুলে উল্কা বেগে অন্ধকারে ছুটলাম। বাবা বোধ হয় আমাকে ধরে ফেলেছিলেন বলে আমার মনে হলো আমি তাকে প্রচন্ড এক ধাক্কায় ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। জানিনা তার কি হলো। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি, দিকভ্রান্ত উন্মাদের মত। চারিদিকে জমাট অন্ধকার বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছি তবু সেদিকে আমার খেয়াল নেই–

থামলো মিসেস শোহেলী মনে হচ্ছে সে যেন এই মুহূর্তেই দৌড়াচ্ছে। হাঁপাচ্ছে সে রীতিমত।

 বনহুর তন্ময় হয়ে শুনছে, রমনা পার্ক কখন যে ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে এসেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই।

মিসেস শোহেলী শুকনো ঠোঁট দু’খানা একবার জিভ দিয়ে চেটে ভিজিয়ে নিলো তারপর আবার বলতে শুরু করলো–আমি জানতাম গ্রামে তখন বড় সাহেব এসেছেন। বড় সাহেব কে এবং কেন এসেছেন তা জানতাম না। তিনি যে বাংলোয় থাকেন এটুকু আমি জানতাম। কেউ কোনো অপরাধ করলে বড় সাহেবের কাছে গ্রামের লোক গিয়ে জানাতো এও জানতাম। আমি মনে করলাম এই বিপদ মুহূর্তে ঐ বড় সাহেব ছাড়া আমাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। বাবা মা এরাও আমাকে নরকের পথে ঠেলে দিতে চান, যেমন আমার বড় দিদিদের অবস্থা করেছেন।

 বাংলোর পথ চিনতাম, তাই অন্ধকারেও ভুল হলো না। কোনোরকমে পৌঁছে গেলাম বাংলোয়। আমি ছুটে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলাম বড় সাহেব বাঁচান–বাঁচান আমাকে

দরজা খুলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে।

আমি দমকা হাওয়ার মত বাংলোর মধ্যে প্রবেশ করলাম।

 দেখলাম সে এক অদ্ভুত রূপ, অদ্ভুত রূপ—মিসেস শোহেলীর মুখ যেন বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো।

[পরবর্তী বই ঢাকায় দস্যু বনহুর]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *