১. কিসরা ও কাইসার

পরাজিত অহংকার (অবিরাম লড়াই-২) / মূল : এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ / অনুবাদ : নাসীম আরাফাত

পেশে লফজ

কিসরা ও কাইসার। রোম সম্রাট ও পারস্য সম্রাট। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই সুপার পাওয়ার। এদের সৈন্য-সামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থের কোন হিসাব-নিকাশ নেই, কোন পরিমাণ-পরিমাপ নেই। গোটাবিশ্ব এদের হাতে বন্দী। গোটা পৃথিবী এদের হাতের পুতুল। তাদেরকে চোখ রাঙ্গিয়ে কিছু বলার সাহস কারো নেই। এ দুশক্তির মাঝে অবস্থিত আরব উপদ্বীপ। দিগন্ত বিস্তৃত মরুর দেশ, লুহাওয়া আর বালুর দেশ। এদেশে সবুজের খুবই অভাব, পানির দারুণ সংকট। তাই যেখানেই কুয়ো আছে বা পাহাড় গাত্র বেয়ে ঝর্ণাধারা নেমে আসে, সেখানে মানুষ বসতি স্থাপন করে, মিলেমিশে থাকে। পানির সংকট দেখা দিলে আবার অন্যত্র চলে যায়।

 এরা যাযাবর। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে এরা বেঁচে থাকে। এরা স্বাধীনচেতা। কারো অধীনে এরা থাকতে চায় না। এদের স্থায়ী কোন নিবাস নেই। এদের মাঝে শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা বা রাষ্ট্রব্যবস্থার চিহ্ন নেই। এদের ইতিহাস মারামারি, কাটাকাটি, রক্তারক্তি আর বর্বরতার ইতিহাস। এদের ইতিহাস মদ, জুয়া, নারী আর আত্মম্ভরিতার ইতিহাস।

আল্লাহ্ তায়ালা এদের মাঝেই প্রেরণ করলেন আকায়ে নামদার তাজদারে মদীনা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তিনি হলেন এদের রসূল, এদের রাহবার, এদের শিক্ষক। এরপর ইতিহাসের গতি দ্রুত অন্যদিকে চলতে লাগল। মরুর বুকে এক নতুন জাতির উন্মেষ ঘটল। এক নতুন উম্মাহ জন্মলাভ করল। এরা মুসলিম জাতি। এরা আল্লাহর সৈনিক। ইসলামের জন্য এদের সুখ-শান্তি। ইসলামের জন্য এদের জীবন-মরণ।

 মাত্র এক দশক ঘুরতে না ঘুরতেই মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হল। সুখ-শান্তি আর সমৃদ্ধির হাওয়া বইতে লাগল। মারামারি, কাটাকাটি, বর্বরতা, মদ, জুয়া, নারীভোগ আর আত্মম্ভরিতার অবসান হল। দুদশকের মাথায় গোটা আরব পদানত হল। ইসলাম এবার একটি শক্তির রূপ ধারণ করল। একটি জীবনব্যবস্থার রূপ ধারণ করল।

আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে এবার ইসলাম রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যে প্রবেশ করতে লাগল। তারপরই শুরু হল সুপার পাওয়ারদের সাথে যুদ্ধ, খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, অগ্নিপূজারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। একই সাথে উভয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন রাসূলের (সা.) উত্তরসূরী সাহাবায়ে কেরাম। শ্বাসরুদ্ধকর সে ইতিহাস। লোমহর্ষক সে কাহিনী। যুদ্ধে যুদ্ধে একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল পারস্য সাম্রাজ্য। ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল এ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। আর রোম সাম্রাজ্য পিছু হটতে হাঁটতে একেবারে রোম সাগরের তীরে গিয়ে ঠেকল।

ঐতিহাসিকরা সাধারণত ইসলামের বিজয় ইতিহাস এখানে এসেই শেষ করে দেয়। মিশর বিজয়ের অগ্নিঝড়া রক্তে আঁকা দিনগুলোর কথা বাদ পড়ে যায়। যে মিশরের রণপ্রান্তরসমূহে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের যুদ্ধকৌশল, বীরত্ব ও প্রতিভা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। শত-সহস্র বিজয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে মুসলিম বীর মুজাহিদদের শাণিত তরবারী ও তাকবীরের হৃদয় কাঁপানো ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।

 মাত্র আট-দশ হাজার মুজাহিদ নিয়ে লাখ লাখ রোমান সৈন্যকে কিভাবে তাড়িয়ে নিয়ে গেছেন বীর সেনানী হযরত আমর ইবনে আস (রা.)। কিভাবে প্রতিটি রণাঙ্গনে তাদের পরাভূত করলেন আর বীরদর্পে সামনে এগিয়ে গেলেন। এ বিস্ময়কর কাহিনী ও শ্বাসরুদ্ধকর ইতিহাস এ গ্রন্থের পাতায় পাতায় উপন্যাসের বর্ণিল আবরণে পেশ করা হয়েছে।

নির্ভেজাল ইতিহাস-নির্ভর এ সিরিজটি পাঠকের মনে এক দীপ্তময় আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারলেই আমাদের শ্রম সার্থক হবে। সবশেষে ব্যর্থতা আর সফলতার তুলাদণ্ড বিদগ্ধ পাঠকের হাতে অর্পণ করে এখানেই ইতি টানলাম। এবার চলুন, আমরা ইতিহাসের সেই উত্তাল দিনগুলোতে হারিয়ে যাই। অনুভব করি পরাজিত অহংকারের।

—নাসীম আরাফাত
ঢাকা।

.

প্রকাশকের আরয

 উর্দু ভাষার নন্দিত ঔপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ এখন আর এদেশেও অপরিচিত নন। তাঁর উপন্যাসের পাঠক-প্রিয়তা প্রচুর। ইতিহাসকে অবিকৃত রেখে উপন্যাস লেখায় তার জুড়ি মেলা ভার। ইতিহাস-বিমুখ মুসলিম জাতিকে ইতিহাস জানতে বাধ্য করা তার অঙ্গীকার ছিল কি-না জানি না, তবে কেউ তার বই পড়া শুরু করলে শেষ না করে স্বস্তি পায় না। তাঁর লেখায় পাঠক একই সাথে পায় ইতিহাসের জ্ঞান, আদর্শ ও উপন্যাসের অনাবিল স্বাদ। তাঁর দক্ষ উপস্থাপনায় বাঙ্গময় হয়ে উঠে আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য-ইতিহাস। তরুণপ্রাণ খুঁজে পায় তার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানার সন্ধান। এসব কারণে আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আলতামাশ। আমরা এবার পাঠকের সকাশে পেশ করছি তার বাহতা নীল দরিয়া-এর বাংলা অনুবাদ অবিরাম লড়াই। অন্তত পাঁচটি খণ্ডে শেষ হবে এ উপন্যাস। বর্তমান খণ্ডের নাম পরাজিত অহংকার। ইসলামের অভ্যুদয়ের প্রথম দিনগুলো থেকে নিয়ে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে হেঁটে এ কাহিনী শেষ হয়েছে মিশর বিজয়ের মধ্য দিয়ে। সংঘাত, লড়াই ও বিজয়ের টান টান উত্তেজনায় ভরা এর প্রতিটি পাতা ও অধ্যায়। প্রদীপ্ত ঈমান ও জাগরণের যথেষ্ট উপকরণ-উপাত্ত রয়েছে এ সিরিজে। সিরিজের প্রথম খণ্ড পাঠকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। আশা করি দ্বিতীয় খণ্ড পরাজিত অহংকার ভালো লাগবে। বইটি সকল বিষয়ে ভাল করার চেষ্টা করা হয়েছে। জানি না কতটুকু সফল হয়েছি। বলে রাখছি, হয়ত অসংখ্যক ভুল ও দুর্বলতা এ বইয়ে রয়ে গেছে। তাই পরবর্তী সংস্করণে এর ছোট-বড় দুর্বলতাগুলো দূর করার ওয়াদা করছি। আল্লাহর রহমতের আশায় সাহসে ভর করে পাঠকের হাতে বইটি তুলে দিচ্ছি। সকল পাঠকের কল্যাণ ও শুভ কামনায়।

–মনযূর আহমাদ
১০.০৬.২০০৪ইং

.

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আন্তোনীস স্বপ্ন জগতের এক রঙ্গিন পৃথিবী রচনা করে এগিয়ে চলছে। সে তার মনযিল নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। এগিয়ে চলছে। সফলতা আর ব্যর্থতা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু এখন তার মনে কোন দ্বিধা নেই। কোন সঙ্কা নেই। সে যেন এক নিরাপদ গন্তব্যের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে। কোন্ কবিলার কোন সর্দারের নিকট আশ্রয় নিবে তাও সে ঠিক করে নিয়েছে।

অন্যদিকে রূতাস দিক লক্ষ্যহীন ভাবে ঘুরে ফিরছে। যেন ভবঘুরে। তবে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রোমান সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবে না। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের মুখোমুখি সে আর গিয়ে দাঁড়াবে না। কিন্তু কি করবে? কোথায় যাবে? কার নিকট আশ্রয় নিবে? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো সে স্থির করতে পারেনি। একেক বার একেক কথা ভাবে আবার তা মুলতবী রেখে অন্য ভাবনায় ডুবে যায়। প্রায় দিকভ্রান্ত উন্মাদের মত পথ চলছে। চলতে চলতে দিবস সমাপ্তির পর রাত এগিয়ে এল। কোলাহলময় পৃথিবী অন্ধকারে হারিয়ে গেল। রূতাস এক নির্জন স্থানে শুয়ে দিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল। পরদিন। সকালে আলোর বন্যায় পৃথিবী ঝলমল করে উঠল। আবার শুরু হল রূতাসের যাত্রা।

চলতে চলতে বার বার সে তার পকেট থেকে বের করে স্বর্ণের তৈরী ঈসা (আ.)-এর মূর্তিটি দেখছে। গভীর ভক্তিভরে ছলছল নেত্রে তাকিয়ে রয়েছে। যেন মূর্তিটি তার পথ নির্দেশ করছে। দীর্ঘ চিন্তার পর একটি আশ্রয় স্থান সে মনোনীত করল। সে এক খ্রিস্টান কবিলার মাঝে আশ্রয় নিবে। হিমসে থাকাকালে শারীনা প্রত্যেক দিন তার সাথে এসে সাক্ষাৎ করত। তার নিকট থেকেই সে প্রত্যেক দিনের সংবাদ পেত। শারীনা তাকে শুনিয়েছিল, আরব কবিলাগুলোর যে খ্রিস্টানরা সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে সাহায্য করার জন্য এসেছিল তারা সবাই তিক্ত-রিক্ত ও বিরূপ মনোভাব নিয়ে ফিরে চলে গেছে।

এ কথা ভাবতে ভাবতে সে আবার উদাস হয়ে যায়। আবার দিশেহারা হয়ে যায়। ভাবে, যদি আরব কবিলার খ্রিস্টানরা তাকে আশ্রয় না দেয়। যদি তারা তাকে তাড়িয়ে দেয়। তাহলে সে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিবে!

একবার সিদ্ধান্ত করে ফেলল, না, পথে পথে না ঘুরে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বাহিনীতেই ফিরে যাই। সাথে সাথে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু ক্ষণকাল যেতে না যেতেই সে ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল। সে যেন সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সম্রাট তাকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করছে, রূতাস! তুমি কোথায় গিয়ে পালিয়েছিলে? হিরাক্লিয়াসের ডাগর রক্ত চক্ষু, ক্রোধে লাল চেহারা, রুক্ষ্ম কণ্ঠস্বর যেন ভেসে এল। জল্লাদ! এই নরাধমকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে নিয়ে যাও। এ বেঈমান গাদ্দারের মৃত্যুদণ্ডই উত্তম পুরস্কার। জল্লাদ যেন তাকে হিড়হিড় করে সম্রাটের সম্মুখ থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

রূতাস চমকে উঠে। না, সম্রাটের কাছে আর যাব না। আবার ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নেয়।

দ্বিপ্রহর গড়িয়ে যাবার পর এক খুবসুরত সবুজ শ্যামল স্থানে পৌঁছল। তার পাশ দিয়ে একটি উজ্জ্বল নদী কুল কুল রবে বয়ে চলছে। ছায়া নিবিড় কাকলি মুখর স্থান দেখে বিশ্রামের জন্য ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। ঘাসের উপর গা এলিয়ে দিয়ে কোথায় যাবে ভাবছে। এমনি ভাবনার মাঝে সে গভীর ঘুমে হারিয়ে যায়।

অনেক সময় পর তার ঘুম ভাঙে। চারদিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আকাশে চাঁদ উঠে এসেছে। ভাবল, বহু ঘুমিয়েছি। রাতটা বেশ ভাল কেটেছে। শীতল আবহাওয়ার ছড়াছড়ি। যাত্রা শুরু করলেই ভাল হবে। সকালের মধ্যেই বহুদূর চলে যাওয়া যাবে। ঘোড়ায় আরোহণ করে সে তার অজানা মনযিলের পথে রওয়া হল। এদিকে আন্তোনীস ও লীজা ইউকেলিসকে তাদের শোয়ার জায়গায় নিয়ে গেল। ইউকেলিসের মন এখন শান্ত। লীজা তাকে আদর-স্নেহে আপুত করে তুলে। তার কাছে সে নিজেকে ছোট্ট শিশুর মত ভাবছে। তিনজনই শুয়ে পড়ল। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তারা একটি ঘোড়ার আগমনের পদধ্বনি শুনতে পেল। দূর থেকে ধ্বনিটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে এগিয়ে আসছে। সাথে সাথে গানের আওয়াজ শোনা গেল। রোমান ভাষায় গানটি রচিত। তারা সতর্ক ও উৎকর্ণ হয়ে উঠল। লীজা ফিসফিসিয়ে বলল, কেউ হয়তো আমাদের পশ্চাদ্ভাবন করছে!

আন্তোনীস বলল, মনে হচ্ছে একজন অশ্বারোহী আসছে। পশ্চাদ্বাবন করলে কয়েকজন অশ্বারোহী আসত। মনে হচ্ছে সে কোন মুসাফির অথবা যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা কোন রোমান সৈন্য।

আন্তোনীস বলল, লীজা! তুমি এখানেই শুয়ে থাক। আমি আর ইউকেলিস লুকিয়ে যাই। দেখি, লোকটি কে? যদি মন্দ কিছু মনে হয় তাহলে পশ্চাৎদিক থেকে আক্রমণ করে তাকে শেষ করে দিব।

আন্তোনীস ও ইউকেলিস দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। একটি ছোট্ট ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। অশ্বারোহী সে স্থানটি অতিক্রম করার সময় তার দৃষ্টি শায়িত লীজার উপর পড়ল। সে অশ্বের গতি থামিয়ে দিল এবং আস্তে আস্তে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। ঘোড়াটি পশ্চাতে রেখে লীজার দিকে অগ্রসর হল।

এখনো সে বুঝতে পারেনি যে, শায়িত ছায়ামূর্তিটি একজন নারী। রূতাসের এই দীর্ঘ সফরে এই প্রথম সে মানুষের মুখোমুখি হচ্ছে। নিকটবর্তী হয়ে বুঝতে পারল, শুয়ে থাকা লোকটি নারী। দাঁড়ান অবস্থায়ই সে একটু ঝুঁকল। লীজা উঠে বসল। পরে দাঁড়িয়ে গেল।

রূতাসের চেহারা ভয়ে ফ্যাকাসে ও বিবর্ণ হয়ে গেল। সে চিনে ফেলল, এ তো সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী। দাসী পরিবৃতা হয়ে চলাফেরা করত তাই অনেকেই তাকে চিনে।

রূতাসের কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময় ঝরে পড়ল। বলল, আপনি…..সম্রাজ্ঞী লীজা! আপনি এখানে….সম্রাট হিরাক্লিয়াস কি এখানেই কোথাও আছেন?

লীজার কণ্ঠ থেকে যেন সত্যই সম্রাজ্ঞীর সুর ফুটে উঠল। বলল, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো? কোথায় যাচ্ছ?

রূতাস এ কথা বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী কোন জনমানবহীন প্রান্তরে পড়ে থাকতে পারে। তার মনে হল, হয়তো কোন জ্বীন বা প্রেতাত্মা সম্রাজ্ঞী লীজার আকৃতি ধারণ করে আছে। তাই তার ভয় ও ভীতি আরো বেড়ে গেল।

রূতাসের কণ্ঠে ভয়ার্ত আওয়াজ। বলল, না, না ….. আপনি হিরাক্লিয়াসের সাথে রোমে থাকার কথা। আপনি কার প্রেতাত্মা! আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আপনার সুখ-নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটালাম।

এই বলেই সে ভয় ও ভীতির প্রচণ্ডতায় পশ্চাৎদিকে না ফিরেই দূরে সরে যেতে লাগল।

লীজা তার কণ্ঠে গাম্ভীর্য টেনে এনে বলল, দাঁড়াও। যেয়ো না। তুমি তো রোমান বাহিনীর একজন সৈনিক। তোমার নাম কি?

রূতাস ধীর পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে এসে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, আমার নাম রূতাস। আমি রোমান বাহিনীর সালার ছিলাম। মুসলমানরা আমাকে বন্দী করে রেখেছিল। আমি পালিয়ে এসেছি।….. আমি কি এখন যেতে পারি।

আন্তোনীস এবং ইউকেলিস গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে রূতাসের পশ্চাৎদিক থেকে এগিয়ে এল। উভয়ের হাতে খোলা তলোয়ার। তারা রাতাসের একেবারে নিকটে এগিয়ে এলে রূতাস অনুভব করল, তার পশ্চাৎদিক থেকে কেউ এগিয়ে আসছে। সে ঘুরে দেখেই মুহূর্তে দূরে সরে গেল। সে তার সালার আন্তোনীস এবং সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পুত্র ইউকেলিসকে চিনে ফেলল।

বিস্ময়ে জ্ঞানশূন্যের ন্যায় বলে উঠল, আমি এসব কী দেখছি!…. আপনারা সবাই এখানে কি করছেন?

আন্তোনীসের তরবারীর তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ রাতাসের হৃদপিণ্ড বরাবর চলে গেল। বলল, রূতাস! তুমি কি মনে করছে যে, আমি জানি না, তুমি সম্রাট হিরাক্লিয়াসের গুপ্তচর বাহিনীর অফিসার। তুমি অস্বীকার করতে পারবে যে, তুমি আমাদের সন্ধানেই এদিকে এসেছে?

রূতাস বলল, আপনি কেমন সালার হলেন? আপনার তো একথাই জানা নেই যে, আমি তিন চার মাস যাবৎ রোমান বাহিনীতে নেই। আমি সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পক্ষ থেকে এদিকে আসিনি। আমি মুসলমানদের কয়েদখানা থেকে পালিয়ে এসেছি।

মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলল, আমি চরবৃত্তিতে হিমসে গিয়েছিলাম। আমার সাথে আরো দুজন ছিল। আমরা গ্রেফতার হয়ে গেলাম। আমার সাথী দুজন নিহত হয়েছে। আর আমি সুযোগ পেয়ে পালিয়ে এসেছি।

ইউকেলিসের অগ্নিকণ্ঠ ঝরে পড়ল। বলল, তাহলে এদিকে কিসের সন্ধানে এসেছো? এদিকে তো রোমান বাহিনী নেই!

লীজা বলল, তার চেহারার সজীবতা আর পোষাকের বাহার দেখ। যদি তিন চার মাস বন্দীই থাকতো তাহলে তো চেহারা থাকত বিধ্বস্ত আর কাপড় থাকত অপরিচ্ছন্ন, মলিন। সে তো আমাদেরকে ধোকা দিচ্ছে।

রূতাস তার কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল, হয়তো আপনার বিশ্বাস হবে না যে, মুসলমানরা বন্দীদের সাথে মেহমানের মত আচরণ করে।

আন্তোনীস বাম হাত দ্বারা তার জামার কলার চেপে ধরে তার কোমড় হাতড়ে তরবারীটি নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল, নিশ্চয় তারা মেহমানের মত আদর আপ্যায়ন করে পালিয়ে আসার সময় তারা তোমাকে এ তরবারীটিও দিয়ে দিয়েছে।

তারপর আরো হাতড়ে দেখতে লাগল, কোন খঞ্জর আছে কি না। কিন্তু খঞ্জর পেল না। তবে হাতে একটি শক্ত বস্তু অনুভব করল। সে তা টেনে বের করে চাঁদের রোশনীতে ঝলমল করছে দেখে লীজার হাতে দিল। তারপর বলল, এ ক্রুশ প্রমাণ করে যে, তুমি মিথ্যাবাদী। আর আমি এটাও জানি যে, এ ক্রুশটি কার?

এ ক্রুশটি মালে গণিমত হিসাবে সিপাহসালার আবু উবায়দার নিকট পৌঁছেছিল। নিহত এক রোমান অফিসারের নিকট তা থাকত। এখন তো চিন্তা করতে হবে, যদি তুমি মুসলমানদের কয়েদখানায় বন্দী থাকতে তাহলে কি তারা তোমাকে এই মূল্যবান বস্তুটি তোমার সাথে রাখতে দিত? তারপর আন্তোনীস বলল, আচ্ছা তুমি এখনো কেন মিথ্যা বলে যাচ্ছো? শোন, আমার নাম আন্তোনীস! সত্য কথা বল। অন্যথায় তোমার লাশ এ প্রান্তরে পড়ে থাকবে। পশু পক্ষীর জন্য তা মজাদার খাবার হবে।

রূতাস এবার সত্য কথা বলতে লাগল। আমি আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরছি। আমি শুনেছি, সম্রাট হিরাক্লিয়াস পিছু হটে গেছেন। কিন্তু আমি আর তার নিকট ফিরে যাব না। তবে কোথায় যাব তাও আমার জানা নেই। চরবৃত্তির জন্যই আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু বন্দী হওয়ার পর মুসলমানরা আমার থেকে আমার বাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েছে। তারপর সে তার বন্দী হওয়া থেকে মুক্তি পর্যন্ত সব কাহিনী বলে দিল। শারীনার প্রসঙ্গও বাদ দিল না। কিভাবে শারীনা তাকে কয়েদখানা থেকে মেহমান খানায় থাকার ব্যবস্থা করল। কিভাবে ধোকায় ফেলে মদ পান করিয়ে তার থেকে রোমান বাহিনীর গোপন তথ্য জেনে নিয়েছে। সব কিছুই বলল। তারপর বলল, আমার মনে হয়, আমার তথ্য পেয়েই মুসলমানরা আমাদের বাহিনীকে সহজে পরাজিত করতে পেরেছে। হয়ত এ কারণেই মুসলমানদের সিপাহসালার আবু উবায়দা আমাকে এ কুশটি পুরস্কার দিয়েছেন।

এবার আন্তোনীস ও লীজার নিকট রাতাসের কথা বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হল। আন্তোনীস তাকে বলে দিল, তোমার কথা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু যদি কোথাও তুমি আমাদের ধোকা দেয়ার সামান্যতম চেষ্টা কর তাহলে তোমাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে।

এবার রূতাস জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

 উত্তরে আন্তোনীস অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তার গন্তব্য স্থানের কথা বলে দিল।

রূতাস বলল, তাহলে আপনি আমাকে একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী পাবেন। আমি তো দিশেহারা পথিকের ন্যায় ঘুরে ফিরছিলাম। আপনি আমাকে আমার মনযিলের সন্ধান দিলেন। আরব খ্রিস্টান কবিলাগুলোর সর্দারদের আমিও বেশ ভালভাবেই চিনি। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।

রাতের অধিকাংশ সময় কেটে গেছে। বিশ্রামের জন্য তারা কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। সকালের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়তেই আবার তারা যাত্রা শুরু করল।

***

ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী বিরাট বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আরব খ্রিস্টান কবিলাগুলোর বসবাস। এ কবিলার লোক ইসলাম বিদ্বেষী ও বিরোধী। আমীরুল মুমেনীন হযরত উমর (রা.)-এর নির্দেশে এদের দমন করা হচ্ছে। শায়েস্তা করা হচ্ছে।

খ্রিস্টান কবিলাগুলোর একটি বনু তাগলিবকে নিয়ে এক বিস্ময়কর মজাদার ঘটনা ঘটল। এ কবিতাটি শাম ও ইরাকের সীমান্ত ও ফুরাত অববাহিকার মাঝামাঝি অবস্থিত। শামেরও কিছু এলাকা জুড়ে এদের অবস্থান। মরু অঞ্চল। এ কবিলাকে দমন করার দায়িত্ব ওয়ালীদ ইবনে ওক্কবা (রা.)-কে দেয়া হয়েছে। বনু তাগলিব কয়েকটি বস্তিতে বসবাস করে। দুটি বস্তির রয়েছে সুদৃঢ় কেল্লা, তাবুত তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা।

সালার ওয়ালীদ ইবনে উবা তাদের শায়েস্তা করতে অগ্রসর হলে বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হলেন। প্রধান বাধা হল, বনু তাগলিব প্রকৃতপক্ষেই যুদ্ধবাজ আর দুঃসাহসী। মুজাহিদদের যে বাহিনী প্রথমে মুসাল্লা ইবনে হায়েসা ও তারপর সাআদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.)-এর নেতৃত্বে পারস্য সম্রাট কিসরার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, সে বাহিনীতে বনু তাগলিবের যোদ্ধারাও অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের কারো কারো বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখে সত্যই আরব যোদ্ধারা বিস্মিত ও বিমোহিত হত।

কিন্তু রোমান শক্তির বিরুদ্ধে যখন মুজাহিদরা যুদ্ধ করছিল তখণ বনু তাগলিবের যোদ্ধারা বিদ্রোহ করে বসল। অথচ তখন গোটা ইরাক ও শাম মুসলমানদের পদানত হয়ে গেছে।

সালার ওয়ালীদ ইবনে উবার নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী বনু তাগলিবের দিকে অগ্রসর হল। বনু তাগলিবের যোদ্ধারাও অস্ত্রসজ্জিত হয়ে রণক্ষেত্রে নেমে এল। প্রাণপণে যুদ্ধ করেও বেশ কয়েকটি রণাঙ্গণে তারা পেরে উঠতে পারল না। রণাঙ্গণ ছেড়ে পিছু হটে গেল। মুজাহিদদের বিজয়ের পশ্চাতে কিছু কারণও আছে। তার একটি হল, মুজাহিদদের হাতে পারস্য ও রোম সম্রাটের বহু তাজা ঘোড়া রয়েছে। তাই অধিকাংশ মুজাহিদই অশ্বারোহী। মুজাহিদদের বিজয়ের আরেকদিক হল, তারা ইতিমধ্যে অপরাজেয় শক্তি বলে বিবেচিত রোমান বাহিনীকে পরাজিত করে শামের মরু অঞ্চলে ওদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। তাই মুজাহিদদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল সর্বত্র। পৃথিবীর সকল শক্তি মুজাহিদদের নামে ভীত, সন্ত্রস্ত।

আরব কবিলাগুলোর খ্রিস্টান যোদ্ধারা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে রণাঙ্গণে এলেও টিকে থাকতে পারল না। বনু তাগলিবের সাথেও কয়েকটি রাণাঙ্গণে বুঝাঁপড়া হয়েছে। কিন্তু বিজয় মাল্য ছিনিয়ে আনা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। তারা প্রত্যেকটি রণক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে। অবশেষে তাদের সর্দার সন্ধি করে মুসলমানদের আনুগত্য মেনে নিয়েছে। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করলো না।

সেদিনই সালার ওয়ালীদ ইবনে উক্কবা (রা) হযরত উমর (রা.)-এর নিকট পয়গাম দিয়ে পাঠালেন যে, আমি তাদের ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব দিলাম কিন্তু তারা তা অস্বীকার করেছে। তারা এখন আমীরুল মুমিনীনের ফয়সালার অপেক্ষায় আছে।

হযরত উমর (রা.)-এর দূরদর্শিতা ও গভীর প্রজ্ঞার কথা সর্বজন জ্ঞাত। উত্তরে তিনি লিখলেন, বনু তাগলিবকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে চাপ দিবে না। ইসলাম গ্রহণ করা বা না করা তাদের ইচ্ছা। তবে তাদের সর্দারদের বলে দিবে, যদি তাদের গোত্রের কেউ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে তবে তারা তাকে বাধা দিতে পারবে না।

হযরত উমর (রা.)-এর উত্তর পত্র পেয়ে সালার ওয়ালীদ ইবনে উক্কবা যখন তা বনু তাগলিবের সর্দারদের শুনালেন, তখন তা তাদের মনে দারুণ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল, তখনই বেশ কিছু খ্রিস্টান মুসলমান হয়ে গেল।

উমর (রা.) তার পয়গামে আরো লিখলেন, বনু তাগলিব থেকে জিযিয়া কর গ্রহণ করা হবে। তারা জিম্মি হিসাবে বসবাস করবে। এ বিষয়টি বনু তাগলিবের সর্দাররা মেনে নিতে পারল না। তারা বলল, আমরা জিযিয়া দিতে পারব না। আর আমাদের যেন জিম্মীও ডাকা না হয়।

বনু তাগলিবের এ কথা শুনে সালার ওয়ালীদ ইবনে উক্কবা দারুণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। বললেন, হে বনু তাগলিব! তোমাদের কারণে আমরা আমাদের বিধান রহিত বা পরিবর্তন করতে পারব না। তোমাদের প্রত্যেকটি একগুয়েমীর সমাধানের জন্য আমি আর মদীনায় কাউকে পাঠাব না। মনে রাখবে, জিযিয়া কিছুতেই মাফ করা হবে না।

জনৈক সর্দার দাঁড়িয়ে বলল, আমরা অর্থ দিতে অস্বীকার করছি না। জিযিয়ার চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ আমাদের থেকে গ্রহণ করুন তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তবে তাকে জিযিয়া বলবেন না আর আমাদেরকে জিম্মি বলে অভিহিত করবেন না।

বেশ কিছুক্ষণ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর সিদ্ধান্ত হল যে, বনু তাগলিবের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল মদীনায় গিয়ে হযরত উমর (রা.) এর সাথে সাক্ষাৎ করবে।

তাই হল, বনু তাগলিবের প্রতিনিধি দল মদীনায় গিয়ে হযরত উমর (রা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে বলল, আমরা অর্থ দিতে প্রস্তুত। প্রয়োজনে জিযিয়ার চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ দিতে রাজি। তবে আমাদের আবেদন, একে যেন জিযিয়া বলা না হয়। আর আমাদের যেন জিম্মি বলে অভিহিত করা না হয়। এতে আমাদের গোত্র অসম্মান বোধ করে।

হযরত উমর (রা.) অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, যে জিযিয়া আরোপ করা হয়েছে আমরা তার চেয়ে বেশী নিব না। আর আমরা তাকে জিযিয়াই বলব।

বনু গলিবের এক বর্ষিয়ান সর্দার বলল, কিন্তু আমরা তাকে সদকা নামে অভিহিত করতে চাই।

হযরত উমর (রা.) বললেন, তোমরা তাকে যে নামেই অভিহিত কর কিন্তু আমরা আমাদের বিধান মতে একে জিযিয়াই বলব। …….আমি দারুণ বিস্মিত যে, তোমরা এক নিরর্থক বিষয় নিয়ে কেন এতো বাহানা করছো?

বর্ষিয়ান সর্দার বলল, আমীরুল মুমিনীন! আমরা আপনাকে আমীরুল মুমিনীন মেনে নিয়েছি। সাথে সাথে আমরা এ নিবেদন পেশ করছি, আপনি আমাদের গোত্রীয় মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করবেন। আপনি বনু তাগলিবের উঁচু মর্যাদার কথা অবহিত আছেন। আমরা জিযিয়াকে বেইজ্জতী ও অপমানজনক মনে করি। আর আশা করি, আপনি আমাদের ঐ অবদানের কথা ভুলবেন না যখন আমরা মুজাহিদ বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ইরান সম্রাট কিসরার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। এখনো আমরা আবার আপনাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করব। আমরা আপনার আনুগত্য মেনে নিয়েছি। সুতরাং আমাদের থেকে অর্থ গ্রহণ করুন। তবে আমাদের ইজ্জত ও সম্মানহানীকর কিছু করবেন না।

কিন্তু হযরত উমর (রা.) নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। কথাবার্তায় উত্তপ্তা বেড়ে চলল। তখন হযরত আলী (রা.) হযরত উমর (রা.)-কে সাআদ ইবনে মালেক নামের এক সালারের কাহিনী শোনালেন। তিনি এক অঞ্চল পদানত করার পর পরাজিত লোকদের থেকে জিযিয়া গ্রহণ না করে দ্বিগুণ সদকা গ্রহণ করেছিলেন।

তৎক্ষণাৎ হযরত উমর (রা.)-এর এ ঘটনা স্মরণ হয়ে গেল। তাছাড়া তিনি ভাবলেন, এরা যোদ্ধা। রক্ত খেলায় মেতে উঠাই এদের স্বভাব। তাই কঠোরতা অবলম্বন না করে তাদের দ্বারা কাজ নেয়াই উচিত হবে। অবশেষে ফয়সালা করা হল, তাদের থেকে দ্বিগুণ কর নেয়া হবে এবং একে সদকা নামে অভিহিত করা হবে। বনু তাগলিবের সর্দাররা সানন্দে তা মেনে নিয়ে সাথে সাথে কর পরিশোধ করে দিল। এভাবে একটা শক্তিশালী সম্প্রদায় মুসলমানদের আনুগত্য মেনে নিল। এরপর ধীরে ধীরে একের পর এক তারা ইসলামে দিক্ষীত হতে থাকল।

***

আন্তোনীস, রূতাস, লীজা ও ইউকেলিস আলেপ্পার নিকটবর্তী এক খ্রিস্টান বস্তিতে গিয়ে পৌঁছল। মরুর মাঝে কয়েকটি ঘরবাড়ি নিয়ে এ বস্তিটির অবস্থান। এরা বনু রবীয়ার লোক। আন্তোনীস ও তার সাথীদের দেখে ঘরবাড়ি থেকে লোকেরা বেরিয়ে এল। তারা বুঝতে পারল, এর রোমী। রোমীদের সম্পর্কে এদের মনে দারুণ ক্ষোভ।

আন্তোনীস ও রূতাস দীর্ঘদিন এই আরব কবিলাগুলোর মাঝে কাটিয়েছে। তাই তারা তাদের ভাষা বোঝে। তাদের ভাষায় কথা বলতে পারে। বস্তির লোকদের বলল, আমরা তোমাদের কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। তারা তাদের একটি ঘরে নিয়ে গেল। ঘর থেকে একজন শীর্ণকায় বর্ষীয়ান ব্যক্তি বেরিয়ে এসে তাদের স্বাগত জানাল। সসম্মানে বসাল। বর্ষীয়ান লোকটির কথাবার্তা আচার-আচরণ অসাধারণ। তার কথা বলার ভঙ্গী, উচ্চারণ ও শব্দচয়ন থেকে সহজেই অনুমেয় যে, লোকটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব।

লোকটি সাবলীল কণ্ঠে বলল, তোমরা কি রোমী? আমাদের অন্তরে এখন আর রোমানদের ঐ মর্যাদা নেই যা পরাজয়ের পূর্বে ছিল। তবে তোমরা আমাদের। মেহমান। ঐতিহ্য অনুযায়ী আমরা তোমাদের সমাদর করব, সম্মান করব। তোমরা কি কোথাও যাচ্ছ? তোমাদের কী সহায়তা আমরা করতে পারি? যদি পথ ভুলে এদিকে এসে থাক তাহলে আমরা পথ দেখিয়ে দিতে পারব।

আন্তোনীস বলল, জনাব! আমরা পথ ভুলে এদিকে আসিনি। আমরা আপনার গোত্রের কল্যাণে কিছু করতে চাচ্ছি। কিছু আমাদের জন্যও করতে চাই। সম্রাট হিরাক্লিয়াস পালিয়ে গেছেন। তার বাহিনী মুসলিম মুজাহিদদের হাতে নিঃশেষ হয়ে গেছে। যারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে তারাও বিক্ষিপ্ত। তাদের কোন সংগঠিত অস্তিত্ব নেই। আমি রোমান বাহিনীর একজন সালার। সেও একজন সালার। এই মহিলা আর যুবকটি কে তা পরে বলব। আমরা এখন বলতে চাচ্ছি, আমাদেরকে রোমান মনে করবেন না। আমরা একই ধর্মের অনুসারী পরস্পরে ভাই। সম্রাট হিরাক্লিয়াস প্রথমে বাদশাহ, তারপর খ্রিস্টান। তার ধার্মিকতা কপটতার মুখোশ মাত্র। আর আমরা প্রথমে খ্রিস্টান, তারপর। রোমান।

তারপর আন্তোনীস ঐ ক্রুশটি দেখান যা রূতাসকে সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) দিয়েছিলেন এবং বলল, আমরা এই পিতার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় জীবন বাজি রাখতে চাচ্ছি।

আন্তোনীস আরো বলল, এটা রোম ও পারস্যের মত কোন বাদশাহী হবে না। এটা হবে ঈসা মসীহ এর সালতানাত। আরব কবিলাগুলোর সকল খ্রিস্টান যদি একমত হয় এবং আমার নেতৃত্ব মেনে নেয় তাহলে আমি তাদের নিয়ে একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী গড়ে তুলব। তারপর অল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা মুসলমানদের শাম থেকে তাড়িয়ে দেব।

আন্তোনীসের কথা শুনে বৃদ্ধের মলিন চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অধর কোণে একটি মিষ্টি হাসির রেখা বিকশিত হয়ে আবার মিলিয়ে গেল। মনে হল আন্তোনীসের মত চিন্তা ও ভাবনাই সে দীর্ঘদিন যাবৎ তার হৃদয়ের গহীন প্রকোষ্ঠে লালন করে আসছে।

বৃদ্ধ বলল, আমরা কখনো ইরানীদের গোলাম ছিলাম। কখনো ছিলাম রোমানদের একান্ত অনুগত প্রজা। আর এখন আমরা মুসলমানদের উন্মুক্ত তরবারীর নীচে অবস্থান করছি। গোটা এলাকার সংবাদ আমার নিকট আসছে। আমাদের কবিতাগুলো বিদ্রোহ করলেও তাদের মাঝে কোন ঐক্য নেই। সবাই বিচ্ছিন্ন। কেউ মুজাহিদদের মুকাবিলায় রণাঙ্গনে দাঁড়াতে পারছে না। বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করছে। তাদের আনুগত্য স্বীকার করে নিচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে এখন শুধুমাত্র আলেপ্পা শহরটিই বাকি আছে। আমি এখনো এই কেল্লা পরিবেষ্টিত শহরটির দিকে তাকিয়ে আছি। দুটি শক্তিশালী গোত্র এতে বসবাস করে। বনু রবীয়া ও বনু নুখ। এ পরিস্থিতিতে যদি আমরা আলেপ্পাবাসীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে পারি, মরণপণ যুদ্ধ করে মুজাহিদদের পরাজিত করতে পারি তাহলেই কবিলার অন্যান্য যোদ্ধাদের মনে সাহস সঞ্চারিত হবে। তারাও আমাদের পতাকা তলে ছুটে আসবে। আন্তোনীস বলল, তাহলে কি আপনি ঐ কবিলাগুলোর সর্দারদের এখানে ডেকে আনবেন? আমরা এখনো দৃশ্যপটে আসতে চাচ্ছি না। কারণ হতে পারে, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের গুপ্তচররা আমাদের সন্ধানে প্রত্যেকটি অঞ্চল চষে ফিরছে।

বৃদ্ধ বলল, তোমাদের কোন ভয়ের কারণ নেই। যতক্ষণ আমাদের মাঝে আছো ততক্ষণ তোমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবারও কারো সাহস হবে না। কোন সর্দারকে এখানে ডেকে আনার প্রয়োজন নেই। আমি তোমাদেরকে আলেপ্পায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছি। সর্দাররাই তোমাদের সাথে এসে দেখা করবে। আমি তোমাদেরকে কৃষক ও মজুরের ছদ্মবেশে আলেপ্পায় পৌঁছিয়ে দিচ্ছি।

সুদৃঢ় দুর্গবেষ্টিত আলেপ্পার পরিস্থিতি শান্ত। বিদ্রোহের কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। অল্পসংখ্যক মুজাহিদ স্থায়ীভাবে সেখানে আছে। শহরের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা, কর ও জিযিয়া আদায় করা ইত্যাদি অত্যন্ত আবশ্যকীয় কাজ তারা আঞ্জাম দিচ্ছে। তবে ক্রমান্বয়ে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরব কবিলা গুলোর খ্রিস্টান যোদ্ধারা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। বিভিন্ন কবিলার সর্দাররাও সেখানে বসবাস করছে। সেখানে আসা যাওয়া করছে।

আন্তোনীস, রূতাস, লীজা ও ইউকেলিস যখন আলেপ্পা শহরে প্রবেশ করল তখন কেউ তাদের দিকে একবার ফিরেও তাকাল না। তাদের খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজনও অনুভব করল না। এদের মত কতো বিপর্যস্ত মানুষ একের পর এক আলেপ্পায় আশ্রয় নিচ্ছে। তাদেরকেও তেমনি বিপর্যস্তই মনে করা হল। তাদের সাথে বৃদ্ধের প্রেরিত দুই ব্যক্তি ছিল তারা তাদেরকে এক সর্দারের বাড়িতে পৌঁছে দিল।

আলেপ্পায় পৌঁছে তারা বুঝতে পারল, যে বৃদ্ধের নিকট তারা পৌঁছেছিল তিনি সাধারণ লোক নন। আরব খ্রিস্টান কবিলাগুলোর সর্দাররা তাকে বিশেষ মর্যাদার নজরে দেখে। তার ইশারা-ইঙ্গিতে সকলে উঠাবসা করে। তাকে তারা দিক দিশারী প্রজ্ঞাবান মনে করে। এ কারণেই আন্তোনীস ও তার সাথীরা আলেপ্পায় আরব খ্রিস্টান সর্দারের বাড়িতে পৌঁছলে সর্দার তাদের সাগ্রহে বরণ করে নিয়েছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো কয়েকজন সর্দার এসে উপস্থিত হল। আন্তোনীস তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করার পর তারা আলেপ্পার বাইরে থেকে আরো কয়েকজন সর্দারকে উপস্থিত করল। আন্তোনীসের পরিকল্পনা ও ইচ্ছার কথা শুনে তারা প্রীত হল। একমত হল। সবাই খ্রিস্ট রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। কিন্তু কিভাবে বিদ্রোহের সূচনা হবে? কিভাবে বিজয়ের পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে? এ আলোচনা শুরু হল। অনেক আলোচনা পর্যালোচনা হল। শেষে এক পরিকল্পনা তৈরী হল। এক কার্যপদ্ধতি নির্ধারিত হল।

সে অনুযায়ী সর্দাররা তাদের বিশেষ ব্যক্তিদের ডেকে আনলেন। তাদের জরুরী কিছু নির্দেশ দিয়ে বিদায় জানালেন। এর দুকি তিন দিনের মধ্যেই দুর্গ পরিবেষ্টিত আলেপ্পা শহরে অস্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন কবিলার লোকেরা আশ্রয় প্রার্থীর ভুতনে আসতে লাগল। বন্যার স্রোতের ন্যায় তারা একের পর এক আলেপ্পায় আসছে। শহরের মুজাহিদরা এর তত্ত্ব তালাশের কোন প্রয়োজন অনুভব করল না। আশ্রয় প্রার্থীদের সাথে যুদ্ধাস্ত্র ও আসছে। তীর, ধনুক, বর্শা আসছে, তুনীর আসছে। কিছু অস্ত্র খোলামেলাই আসল। আর কিছু অস্ত্র গোপনে এল।

রোমানরা এ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে। তাদের প্রাসাদগুলো ও রোমান সৈন্যদের ক্যাম্পগুলো খালি পড়ে আছে। তথাকথিত আশ্রয় সন্ধানীরা এসব খালি প্রাসাদ ও ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিতে লাগল। আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে গেল। খালি প্রাসাদ আর ক্যাম্পগুলোতে আর তিল ধারণের ঠাই নেই। এরপরও আরো আশ্রয় সন্ধানী এল। এরা খোলা মাঠে তাঁবু টানাতে লাগল। আন্তোনীস সর্দারদেরকে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী দিচ্ছে। সর্দাররা তা তাদের বিশেষ ব্যক্তিদের সহায়তায় কবিলাগুলোর প্রত্যেক সদস্যের নিকট পৌঁছে দিচ্ছে। এভাবেই অত্যন্ত গোপনে বিদ্রোহের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।

আন্তোনীস ও তার সাথীদের কাউকেই মুজাহিদরা চিনে না। লীজা ও ইউকেলিস তো সম্রাট পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাদের চিনার কোন প্রশ্নই আসে না। তবে ইউকেলিসকে কবিলাগুলোর প্রায় সকল সর্দারই চিনে। আর এ কারণেই সর্দাররা বিনা বাক্যব্যয়ে, নির্বিবাদে আন্তোনীসের পাশে এসে জড়ো হয়েছে।

ইউকেলিস কুস্তুনতীনের হাত থেকে এক আরব কবিলার সুন্দরী কন্যাকে উদ্ধার করেছিল। তাই তার সুনাম কবিলার সর্দারদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাছাড়া হিমসের যুদ্ধের পূর্বে প্রায়ই সে আরব কবিলাগুলোর যোদ্ধাদের মাঝে ঘোরাফেরা করত। সর্দারদের সাথে আলাপ আলোচনা করত। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পুত্র হওয়ার কারণে সবাই তাকে সম্মান করত। আদর আপ্যায়ন করত। তার উদার মন-মানসিকতা ও প্রাঞ্জল কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনত। তার বুদ্ধিমত্তা ও অনাড়ম্বর জীবন যাপনে সবাই বিস্মিত হত। তারা তাকে তাদের ইজ্জত ও আযাদী রক্ষার প্রহরী মনে করত। এবার তারা ইউকেলিসকে তাদের মাঝে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত, বিমোহিত ও আশাবাদী হল।

***

রাতের আঁধার নেমে এলে মাঝে মধ্যে লীজা বাইরে বেরিয়ে আসে। কেল্লার প্রাচীর ধরে ঘুরে বেড়ায়। ইউকেলিস যুবক ছেলে। ঘরে সে বন্দী থাকতে পারে না। তাছাড়া তার তো বন্দী থাকার কোন প্রয়োজনই নেই। মুজাহিদদের কেউ তো তাকে চিনে না।

একদিন তার মন কেমন যেন উতলা হয়ে উঠল। কোন কিছুই তার ভাল লাগছে না। সবকিছুতেই তিক্ততা অনুভব করছে। মনের এই তিক্ততা ও অবসাদ দূর করার জন্য আলেপ্পা শহরের বাইরে উন্মুক্ত প্রান্তরে চলে গেল। উদ্দেশ্যহীনভাবেই ঘোরাফেরা করছে। শহরের বাইরের পৃথিবীটা যেন অন্য জগত। চারদিকে সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু গাছপালা। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের জমিন। এর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে একটি সুন্দর খরস্রোতা নহর। নহরের নির্মল পানিতে প্রাণ জুড়ায়। নহরের কুল ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে চলে এলো। নহরটি বাক কেটে এঁকে বেঁকে সরীসৃপের ন্যায় দূরে বহুদূরে চলে গেছে। ইউকেলিসের মনে এক অজানা প্রফুল্ল উঁকি দিল। গুণগুণ করে গান ধরে আনমনে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটু দূরের ঝোঁপের আড়াল থেকে চারপাঁচ জন যুবতীর হাস্যধ্বনি শুনতে পেল। উৎকর্ণ হয়ে উঠল তার কান। দৃষ্টিতে তার চরম অনুসন্ধিৎসা। তারা দৌড়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ইউকেলিসের সামনে পড়ে গেল। ইউকেলিসকে দেখেই তারা অপ্রস্তুত। হতবাক। তবে তাদের একজন ইউকেলিসকে দেখে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে ক্ষণকাল তাকিয়ে তার দিকে এগিয়ে এল। ইউকেলিস মেয়েটির আচরণে বিস্মিত হল।

মেয়েটি বলল, আপনি আমাকে চিনতে ভুললেও আমি কখনো আপনাকে ভুলব না। আপনিই আমার ইজ্জত রক্ষা করেছিলেন। আপনি না হলে………।

ইউকেলিস মৃদু মিষ্টি হাসির পরাগ ছড়িয়ে বলল, সে তো আমার দায়িত্ব ছিল। আমি কিন্তু তোমাকে চিনতে পারছিলাম না।

মরুর কোলে লালিত মেয়েটি যৌবনের কোঠায় পৌঁছলেও কৈশোরের দূরন্তপণা এখনো দূর হয়নি। অসম্ভব রূপবতী। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যৌবনের জৌলুস। রূপতরঙ্গের কলতান। লাবনী ঝরে পড়ছে আভরণ ভেদ করে। আর আভরণ বাড়িয়েছে তার রূপের মহিমা। নিখুঁত আবেগ আর উচ্ছ্বাসে মেয়েটি নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ইউকেলিসের হাত ধরে তাতে চুমু খেল, চোখে লাগাল। তারপর তার বাম হাতটি গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। ইউকেলিস বলল, জন্ম থেকেই আমার বাম হাতটি এমন নিষ্ক্রিয়। শক্তিহীন।

মেয়েটির চেহারায় বিষাদ বিষাদ ভাব ছড়িয়ে পড়ল। চোখের কোণে নির্মল অশ্রু টলটল করতে লাগল। বলল, আমি আপনাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি। আমি যখন ভাবি আপনাকে জীবনে আর কখনো দেখতে পারব না, তখন আমার হৃদয়ে বিষাদের তরঙ্গ বয়ে যায়। আপনার মত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব আমার নিকট আমার জীবনের চেয়ে বেশী প্রিয়।

ইউকেলিস বলল, সে আমার বড় ভাই ছিল। আমি তাকে হত্যার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বাম বাজু না থাকলেও আমি তলোয়ার, বর্শা ও কুঠার দিয়ে দুতিনজনের মোকাবেলা করে অনায়াশে পরাভূত করতে পারি।

মেয়েটির মধুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বলল, শুনেছি আপনি নাকি সম্রাটের পুত্র। সে সম্রাট তো পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেছেন। তাহলে আপনি এলেন কোথা থেকে?

ইউকেলিস বলল, আমি সম্রাটকে ত্যাগ করে চলে এসেছি। সে দিন তোমার ইজ্জত রক্ষা করেছিলাম। আজ তোমাদের কবিলাগুলোর ইজ্জত রক্ষা করতে এসেছি। এখন থেকে আমি এখানেই থাকব।

মেয়েটির চেহারায় এক অভাবনীয় প্রফুলের প্রভা ছড়িয়ে পড়ল। সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না যে, তার স্বপ্নের শাহজাদা তার সামনে উপস্থিত।

অন্যান্য মেয়ে অনতিদূরে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে দেখছিল। মেয়েটি হাতে ইশারা করলে অন্যান্যরা কলহাস্যে চারদিক মুখরিত করে চলে গেল।

মেয়েগুলো চলে যাওয়ার পর ইউকেলিস ও মেয়েটি নহরের তীরে অবস্থিত একটি সুগন্ধি ফুলের ঝাড়ের পশ্চাতে গিয়ে বসল। তারা ঘেঁসে বসে আছে। মেয়েটি বার বার প্রশান্ত দৃষ্টি মেলে শিশুর সারল্য নিয়ে ইউকেলিসের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার দুরন্ত যৌবন যেন মুক্ত বিহঙ্গের মত পাখা মেলে উড়তে চাচ্ছে। ইউকেলিস আপাঙ্গে চেয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। মেয়েটির মসৃণ দীপ্তিময় মুখ তার চোখের পাতায় নেশা ধরিয়ে দেয়।

এরপরও কয়েকদিন মেয়েটির সাথে ইউকেলিসের দেখা হয়েছে। মেয়েটি তার কবিলার সর্দারের কন্যা। রাতেও সে ইউকেলিসের নিকট এসেছে। দুজনে অভিসারে বেরিয়েছে। কখনো কেল্লার দেয়ালের পাশে নির্জন স্থানে গিয়ে বসেছে। আবার কখনো হাত ধরাধরি করে ঘুরে ফিরেছে। হৃদয় দেয়া-নেয়ার খেলায় তারা অনেক দূর চলে গেছে। ইউকেলিস আলেপ্পায় কি করছে? কি তার উদ্দেশ্য? কে কে তার সাথে এসেছে? এ সব কিছুই ইউকেলিস মেয়েটির নিকট বলে দিয়েছে। মেয়েটি ইউকেলিসের কথা শুনে তাকে আকাশ থেকে নেমে আসা কোন অবতার মনে করছে।

একদিন মেয়েটি কথা প্রসঙ্গে ইউকেলিসকে বলল, আমার মনের এক দুশ্চিন্তা, এক দুর্ভাবনা আপনি কিভাবে দূর করবেন? আপনারা যে বাদশাহী প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন তা যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তাহলে তো আপনি শাহজাদা হয়ে যাবেন। তখন কি আপনার নিকট আমার কোন মর্যাদা থাকবে? আমি কি আপনার পাশে গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগটুকু পাব?

ইউকেলিস তখন শুধুমাত্র কথায় নয়, বরং মেয়েটির ললাটে প্রগাঢ় চুম্বন এঁকে দিয়ে সবলে বুকের মাঝে চেপে ধরে বলল, আমি সর্বদা তোমার নিকট তোমার মনের মানুষ হয়েই থাকব। তোমাকে কখনো ভুলব না।

***

আন্তোনীস যে রাতে যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত করেছিল সে রাতে কবিলার যযাদ্ধারা অনায়াসে কেল্লার মুজাহিদদের কাবু করে ফেলে। মুজাহিদরা তাদের শয়ন কক্ষগুলোতে গভীর ঘুমে নিমগ্ন ছিল। মুজাহিদদের বন্দী করার জন্য যে সব যোদ্ধাদের নির্বাচিত করে আন্তোনীস ও রূতাস ট্রেনিং দিয়েছিল তারা তা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করল। তারা তাদের আক্রমণের অবকাশ না দিয়েই একটি বিরাট কক্ষে বন্দী করে ফেলল।

শহরের প্রধান ফটকে দুজন মুজাহিদ তাদের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ছিল। তারা বুঝতে পারল, শহরে বিদ্রোহ হয়েছে এবং তাদের সাথীদের বন্দী করেছে। তারা কাল বিলম্ব না করে সেখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখন তাদের উপর কয়েকজন বিদ্রোহী যোদ্ধা আক্রমণ করল। তারা প্রাণপণে যুদ্ধ করে জখমী হলেও সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হল। বহু কষ্টে তিন মাইল দূরে পৌঁছে এক বস্তি থেকে দুটি ঘোড়া নিয়ে মরুর বুক চিরে ছুটে চলল। উধ্বশ্বাসে মরুর দুরন্ত বায়ুকে পরাজিত করে বিদ্যুৎবেগে ছুটে চলছে।

প্রায় বিশ মাইল দূরে অবস্থিত কেল্লাসিরিন শহর। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সে শহরে অবস্থান করছেন। মজবুত কেল্লা বেষ্টিত বিরাট এই শহরটি খালিদ (রা.) আক্রমণ করে রোমানদের থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন। জখমী মুজাহিদ দুজন তাদের ক্ষতের কোন পরোয়া না করে তার পরদিন কেল্লাসিরিনে উপস্থিত হল। সোজা খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) এর নিকট পৌঁছে তাকে সংবাদ দিল, আলেপ্পায় আরব খ্রিস্টানরা বিদ্রোহ করেছে।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সংবাদ পাওয়ার পর পরই সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) এর নিকট একজন দূত পাঠিয়ে দিলেন এবং নিজে সৈন্য নিয়ে আলোর পথে রওনা হলেন। ঝড়ো হাওয়ার মত খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) আলেপ্পায় ছুটে এলেন। পশ্চাতে উট আর গরুর গাড়িতে করে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ সামগ্রী পৌঁছার ব্যবস্থা করে এলেন।

অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) আলোয় পৌঁছে কেল্লার চারদিক পর্যবেক্ষণ করে বুঝলেন, সহজে এ কেল্লার পতন সম্ভব নয়। দূর দূরান্ত থেকে আগত কবিলার যোদ্ধারা কেল্লার প্রাচীরে তীর ধনুক আর বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সংখ্যা গুনে শেষ করার নয়। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) এর সাথে চার হাজার মুজাহিদ। তিনি প্রাচীরের উপরে দণ্ডায়মান যোদ্ধাদের উপর তীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তার প্রতিউত্তরে কেল্লার উপর থেকে যেভাবে তীরবৃষ্টি শুরু হলো তাতে মুজাহিদ বাহিনী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না।

সবদিক চিন্তা করে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট এক অশ্বারোহী দূত পাঠিয়ে সংবাদ দিলেন, আরো মুজাহিদ বাহিনীর দরকার। কারণ কেল্লাটি অত্যন্ত মজবুত আর খ্রিস্টান যোদ্ধারা অত্যন্ত সাহসী ও সংখ্যায় প্রচুর। সংবাদ পেয়ে আবু উবায়দা (রা.) সালার ইয়ায ইবনে গানাম (রা.)-কে পাঁচ হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদসহ প্রেরণ করলেন।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) কেল্লার প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলতে ও কেল্লার পতনের ক্ষেত্রে দারুণ দক্ষ ছিলেন। এ জন্য তিনি একটি দুর্ধর্ষ বাহিনীও তৈরী করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসের এই কিংবদন্তী যোদ্ধা কখনো অবরোধ দীর্ঘ হওয়ার পক্ষে ছিলেন না।

অবরোধের পর তিন কি চার দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আন্তোনীস বন্দী মুজাহিদদেরকে রশি দিয়ে মজবুত করে বেঁধে কেল্লার প্রাচীরের নিকটে নিয়ে এসেছে। তারপর সাড়িবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ঘোষণা করল, অবরোধ তাড়াতাড়ি তুলে নাও, না হলে এদের ছিন্ন মস্তক তোমাদের উপহার দেয়া হবে।

একজন বন্দি মুজাহিদ বাঁধা অবস্থায় প্রাচীরের নিকটে দাঁড়িয়ে থেকেই অত্যন্ত উচ্চস্বরে বলল, মুজাহিদ ভাইয়েরা আমার! অবরোধ তুলে নিবে না। আমাদের নিহত হতে দাও। আমরা নিহত হওয়ার জন্যই আল্লাহর পথে বেরিয়েছি। আল্লাহ্ তোমাদের সহায়ক। কেল্লার প্রাচীর ভেঙ্গে ফেল!

বন্দী এই মুজাহিদের শাহাদাঁতের স্পৃহা ও মনের আবেগের উত্তাপে বাইরের মুজাহিদরা জ্বলে উঠল। তারা তখনই আক্রমণের জন্য চিৎকার শুরু করল। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) সেখানে উপস্থিত। তারা সবকিছুই উপলব্ধি করছিলেন। তারা মুজাহিদদের শান্ত থাকার আহ্বান জানালেন। বললেন, অযথা রক্তক্ষয় করে লাভ নেই। বুদ্ধিমত্তার সাথে অগ্রসর হতে হবে, ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে কাজ করতে হবে। সবাই আল্লাহ্র নুসরতের দুআ করতে থাক। আমরা ভাবছি।

প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য আরো দুদিন চেষ্টা করলেন। কিন্তু মুষলধারায় তীর বর্ষণের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। তখন খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) দারুণ ভাবনায় পড়ে গেলেন। চিন্তার সাগরে যেন ডুবে গেলেন। হঠাৎ তার মাথা দুলে উঠল, স্বাগতোক্তি করে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, পেয়েছি। এ পন্থায়ই অগ্রসর হতে হবে।

কেল্লার প্রাচীরের কিছু দূরে এক উঁচু টিবি ছিল। সেখানে ও কেল্লার চার পাশে বিদ্যমান উঁচু উঁচু গাছে মুজাহিদদের আরোহণ করে সেখান থেকে অগ্নি তীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। সা সা করে অগ্নিতীর কেল্লার ভিতরে গিয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু না, তেমন কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল না। কোথাও অগ্নিতীরে আগুন ধরল না। হই হুল্লোর বা বিশৃঙ্খলারও কোন আভাস পাওয়া গেল না। কারণ কেল্লার ভিতরে বাড়িঘর প্রাচীর থেকে অনেক দূরে। সেখানে অগ্নিতীর পৌঁছা অসম্ভব।

***

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) কেল্লার ভিতরের কোন খবরই জানেন না। কেল্লার ভিতরে মুসলমান কোন চর থাকলেও বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। আর বাইরে থেকেও কোন মুসলমান চর আরব খ্রিস্টানের ছদ্মবেশে ভিতরে যেতে পারছে না। কেল্লার প্রাচীরের উপরে দণ্ডায়মান খ্রিস্টান যোদ্ধারা তীর ধনুক আর বর্শা নিয়ে প্রথম দিন যে আগ্রহ স্পৃহার সাথে যুদ্ধ শুরু করেছিল আজও তারা সে অবস্থায়ই আছে।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) তার অধীনস্ত সালারদের এবং মুজাহিদদের ডেকে বলেছেন, আলেপ্পাকে তোমরা নিজেদের শহর মনে করবে। তাদের আত্মবিশ্বাস ও সাহস বৃদ্ধির লক্ষ্যে বলেছেন, শহরে কোন বিজ্ঞ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফৌজ নেই। এরা হয়ত কয়েকদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এবং বিশৃঙ্খলতার মাঝে ডাক চিৎকার করে শত্রুর মনে ভীতি সঞ্চার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু অবরোধের মাঝে স্থির থাকা বা অবরোধ ভেঙ্গে ফেলার ক্ষমতা এদের নেই। এরা অতিশীঘ্রই অস্ত্র সমর্পণ করে আমাদের আনুগত্য মেনে নিবে। বা এমন কোন ভুল করে বসবে যার কারণে তাদের উপর পরাজয় নেমে আসবে।

খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি যে, অবরুদ্ধ খ্রিস্টান যোদ্ধাদের নেতৃত্বে রয়েছে এক রোমান সিপাহসালার আর তার সহযোগী হিসাবে আছে এক রোমান সামরিক অফিসার যে সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট হিমস বিজয়ের সময় বন্দী ছিল। মুসলমানরা এ কথা ভাবতেও পারেনি যে, তাদের মাঝে রয়েছে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের এক স্ত্রী ও তার পুত্র।

কেল্লার ভিতরে আন্তোনীস আর রূতাসের অবস্থা সঙ্গিন। রাতে তারা একটু ঘুমাতেও পারছে না। তাদের ক্ষেত্রে এটা কোন কেল্লা বা কোন এক শহর বিজয়ের যুদ্ধ নয় বরং তাদের জীবন মরণ সংগ্রাম। আন্তোনীসের প্রতিজ্ঞা, সে একটি খ্রিস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেই। আরব খ্রিস্টান যোদ্ধাদের নিয়ে সে সেই রাজ্যে দুর্ধর্ষ বাহিনী গড়ে তুলবে। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হল আলেপ্পাকে ধরে রাখা। এ প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রূতাস হল তার প্রধান। সহযোগী।

হিরাক্লিয়াসের পুত্র ইউকেলিসও নিরবে বসে নেই। এক হাত নিষ্ক্রিয় তাতে তার কোন আক্ষেপ নেই। বাকি এক হাত দিয়েই সে যুদ্ধ করতে পারে। সেও রাত দিন ব্যস্ত। ছুটাছুটি করছে। যোদ্ধাদের উৎসাহ দিচ্ছে। শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে আতঙ্কিত মানুষদের সমবেত করে বক্তৃতা দিয়ে উজ্জীবিত করছে। বলছে, ভয়ের কোন কারণ নেই। বিজয় আমাদের হবেই হবে। অল্পদিনে আমরা আল্লাহর পুত্র ঈসা মাসীহ এর রাজ্য কায়েম করতে যাচ্ছি। নিশ্চয় ঈসা মাসীহের সাহায্য আমাদের সাথে রয়েছে।

কয়েক রাত কেটে গেল সে তার মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পেল না। কেল্লার প্রধান ফটকের উপরে যে কয়েকটি কক্ষ তৈরী করা হয়েছিল তাতেই সে রাত অতিবাহিত করে দিল।

***

আন্তোনীস, লীজা ও ইউকেলিস এক বাড়িতে থাকে আর রূতাস অন্য বাড়িতে থাকে। বাড়ি দুটি অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অত্যন্ত সুন্দর আদলে তৈরী। দেখলেই মনে হয় এ বাড়ি দুটি রোমান কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মনের সকল মাধুরী দিয়ে তৈরী করেছিল। রূতাস তিন চার দিন পর পর লীজার বাড়িতে আসত। কিন্তু অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে সে লীজার বাড়িতে খুব কমই যায়। কারণ দিন রাত সারাক্ষণ তাকে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়।

আন্তোনীস, লীজা ও ইউকেলিস এক বাড়িতে থাকলেও আন্তোনীস এখন আর প্রত্যেক দিন বাড়িতে আসতে পারে না। দুতিন দিন পরপর ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আসে। আন্তোনীস ও রূতাস সর্বক্ষণ কেল্লার প্রাচীরের চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। যোদ্ধাদের নানা পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দিতে থাকে। তাদের অবস্থা দেখে মনে হয় তারা যেন সর্বক্ষণ সর্বত্র থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছে। খ্রিস্টান যোদ্ধাদের উৎসাহ দিচ্ছে। মনোবল বৃদ্ধি করছে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে আন্তোনীস ক্লান্ত শ্রান্ত ও নেতিয়ে পড়া দেহ টানতে টানতে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরই সে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে ও অস্ত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাড়িতে আসলেও মনে হয় সে বাড়িতে নেই।

আন্তোনীস ও রূতাস রোমান বাহিনীর উচ্চ পদস্থ সালার। তাই তারা খুব ভালভাবেই জানে, তারা যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা যুদ্ধ করতে জানলেও সুশৃঙ্খলভাবে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্য তাদের নেই। তাই তারা বারবার দিক নির্দেশনার মুহতাজ। তারা কেল্লার প্রাচীরের উপর ঘুরে ঘুরে পরিস্থিতি দেখে এবং তার যোদ্ধাদের উৎসাহ দেয় যেন মুসলমানরা কিছুতেই প্রাচীরের নিকটবর্তী হতে না পারে। তাছাড়া তারা একদল সাহসী দুর্ধর্ষ যুবককে এমন প্রশিক্ষণ দিয়েছে যারা হঠাৎ কেল্লা থেকে বের হয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে অভাবনীয় ক্ষতি করে আবার নিরাপদে কেল্লায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে।

এক রাত আন্তোনীস বাড়িতে এসে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। শুয়ে পড়ল। লীজা এগিয়ে এল। মনে হচ্ছে, সে আন্তোনীসের সাথে কিছু কথা বলবে। কিন্তু আন্তোনীসের সে দিকে খেয়াল নেই। দুচারটি কথা বলেই আন্তোনীস অবরোধের আলোচনা শুরু করল। সাথে সাথে লীজার চেহারায় বিরক্তির সুস্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল। বুঝা গেল, সে আন্তোনীসের এই কথায় কোন আগ্রহ অনুভব করছে না।

তিক্ততায় ভরা কণ্ঠে লীজা বলল, আচ্ছা আন্তোনীস! তুমি কি আমার সাথে অন্য কোন কথা বলতে পার না!

আন্তোনীস উঠে বিছানায় বসল। বলল, লীজা! তুমি একথা বলছো! আমি তো এ ধারণা রাখি যে, আমি বাড়িতে এলে সবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, এখন অবরোধের পরিস্থিতি কেমন? অবরোধ কখন শেষ হবে? অবরোধ ভেঙ্গে ফেলার কোন পথ কি বের হয়েছে? এখন যা বললে তাতে মনে হয়, আমরা অত্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় আছি। অথচ আমি আমার মনে অন্য কোন চিন্তাকে আশ্রয় দিতে পারছি না।

লীজার অবস্থা স্বাভাবিক হল না। বরং আন্তোনীসের কথায় তার চেহারায় আরো বিরক্তি ও অসন্তোষের ভাব ছড়িয়ে পড়ল।

আন্তোনীস এবার লীজার চেহারায় সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে দেখল, লীজার চেহারায় অন্য ধরনের এক নেশা, তার অবয়বে ভিন্ন প্রকৃতির এক মোহের আলামত নৃত্য করছে। আন্তোনীস তার এই নেশা ও মোহের দাবী ও চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞাত। তাদের মধ্যকার অবস্থা তো নির্মল প্রেম ও ভালবাসায় উজ্জীবিত এক প্রাণ এক দেহের মত নয়। যৌবনের ক্ষুধা নিবারণের জন্যই লীজা তার জীবনাকাশে আন্তোনীসকে টেনে এনেছে। তাই তার দাবী ও চাহিদা স্পষ্ট।

আন্তোনীস বলল, লীজা! আমাদের অবস্থার কথা একটু ভেবে দেখ। এ সময়। কিন্তু মজে থাকার কথা নয়। আমরা যদি এ যুদ্ধে হেরে যাই তাহলে আমাদের কোন আশ্রয় থাকবে না। আমরা এখান থেকে পালিয়ে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিব। বনু তাগলিবের মত যোদ্ধা ও শক্তিশালী কবিলাও বাধ্য হয়ে মুসলমানদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিন্তু তোমারও দায়িত্ব আছে। তোমারও ঘর থেকে বেরিয়ে কেল্লার ভিতরের মহিলাদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তোলা দরকার। প্রয়োজনে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে। মনে রাখবে, জীবন দিয়ে হলেও এ যুদ্ধে আমাদের বিজয়ের মাল্য ছিনিয়ে আনতেই হবে।

তবুও আন্তোনীস লীজাকে তার মনের আবেগ, ইচ্ছা, প্রতিজ্ঞা ও পরিকল্পনার কথা বুঝতে পারল না। কারণ লীজা তার সাথে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তা শুধুমাত্র দৈহিক সুখানুভূতির মাঝেই সীমিত ছিল। সম্রাট হিরাক্লিয়াস লীজাকে তার হেরেমে ফেলে রাখার পর লীজা তার যৌবন ক্ষুধা নিবারণের জন্য যাকে পেতো তাকেই গ্রহণ করত। আন্তোনীসকেই সে তখন অতি নিকটে পেয়েছিল। তাই তাকেই এ কাজের জন্য গ্রহণ করেছিল। উভয়ের এই মিলনের ফলশ্রুতিতে ইউকেলিসের আগমন হয়েছিল। এখন তো ইউকেলিসও তাকে পিতা হিসাবে বরণ করে নিয়েছে।

রাজা-বাদশাহদের স্ত্রী পরিজনের মাঝে সাধারণত জাতীয় কল্যাণ অকল্যাণের চিন্তা থাকে না। কোন দেশ বা অঞ্চলের সাথে তাদের হৃদয়েরও কোন টান থাকে না। তারা জীবনের উত্থান-পতনের ক্ষেত্রে সর্বদা এ পরিণতির জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে যে, অন্য কোন রাজা হয়তো আক্রমণ করে তাদের দেশকে পদানত করে নিবে। তারপর তাদেরকে বন্দি করে নিয়ে তাদের আনন্দ উল্লাস আর বিনোদন সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার করবে। অথবা কোন সালার বা রাজকুমার তাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে স্বপ্নের আকাশে উড়ে যাবে। তখন কারো কিছু বলার অধিকারও থাকবে না। তাই হেরেমের নারীদের বিজয়-পরাজয় আর উত্থান-পতনের সাথে কোনই সম্পর্ক নেই।

লীজার মানসিক অবস্থাও ঠিক তেমনি। আলেপ্পার বিজয় বা পরাজয় তার মূখ্য বিষয় নয়। আন্তোনীসের সাহচর্যই তার বেশী প্রয়োজন। সে একথাও ভেবে দেখেনি যে, আন্তোনীসও তো তার ব্যাপারে নিস্পৃহ ও আগ্রহহীন হয়ে যেতে পারে। আজকাল লীজা তাকে আকর্ষণ করার কিছু চেষ্টা করলেও আন্তোনীস থাকে অন্য চিন্তায় বিভোর। তার এখন লীজার সাথে হাস্যরস করার সুযোগ কই।

লীজার কথায় নৈরাশ্য ভাব ফুটে উঠল। বলল, তুমি তো এখনো তোমার রাজত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আছ। কবে তা হবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারে। কিন্তু এখনই তোমার আচার-আচরণ সম্রাট হিরাক্লিয়াসের মত হয়ে উঠেছে। আমার পাশে বসে তুমি এখন আর কথা বলার ফুরসুতটুকুও পাও না।

আন্তোনীস অত্যন্ত ক্লান্ত। হাত পা যেন এখন আর তার চলে না। তাছাড়া আলেপ্পার বিজয় আর মুসলমানদের পরাজয়ের চিন্তা ভাবনায় তার মাথা আগুন হয়ে আছে। কিভাবে মুসলমানদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করবে এ চিন্তাই সারাক্ষণ তার মাথায় ভনভন করছে। লীজা তাকে যে উদ্দেশ্যের জন্য আহ্বান করছে আন্তোনীস তার সে আহ্বানে সাড়া দিল না। বরং শ্রান্ত দেহ নিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল। মৃত ব্যক্তির ন্যায় তার দেহটি বিছানায় পড়ে রইল। লীজা এগিয়ে এসে তার ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে রইল। যেন একটি ফোয়ারা হঠাৎ শুকিয়ে মরে গেছে।

এ সময়ে লীজার অন্তরে ইউকেলিসের কথাও মনে পড়ে গেল। যাকে বুকের মাঝে রেখে রেখে সে জীবন কাটিয়ে দিল। যার জন্য নিজের জীবনকে নিংড়ে নিংড়ে শেষ করে দিল সেও তার দিকে এখন বেশি লক্ষ্য রাখছে না। দুই দুই তিন তিন রাত সে ঘরে আসে না। কখনো কিছু সময়ের জন্য এলেও কিছু আশার। কথা শুনিয়ে আবার ছুটে বেরিয়ে যায়। আন্তোনীস বলে, সে ঈসা মসীহ-এর রাজত্ব কায়েম করবে। কিন্তু ইউকেলিসের সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে ও কুসতুনতীনকে নিজ হাতে হত্যা করার প্রতি বেশী আকর্ষণ। লীজা কখনো ইউকেলিসকে নিজের কাছে রেখে যুদ্ধে নিহত হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখার চিন্তা করেনি। তার এখন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন আন্তোনীসের! আর আন্তোনীসও যেন তার হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে।

***

পরদিন সকালে সূর্য বেশ উপরে উঠে যাওয়ার পর লীজার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলেই দেখে চারদিক আলো ঝলমল। জানলা গলিয়ে সূর্যের যে আলো ঘরে এসেছিল তা এখন বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে সে সবগুলো কক্ষ ঘুরে দেখল, যেন খাঁ খাঁ করছে। প্রত্যহ সকালেই এমন হয়। কিন্তু আজ সকালের এই একাকিত্ব তার হৃদয়ে যেন কাঁটা হয়ে বিধছে। পরিচারিকা এসে নাস্তা রেখে গেছে। ধূমায়িত খাবার। সুগন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে। লীজা নাস্তা খেতে বসল। অদূরে পরিচারিকাটি নির্দেশের অপেক্ষায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর পরিচারিকাটি ভীত কণ্ঠে বলল, রাণী মাতাজী! ঈশ্বর আপনাকে আরো মর্যাদাবান করুন। আমরা গরীব মানুষ। কবে অবরোধ উঠে যাবে জানলে মনটা আনন্দিত হয়। আপনি হয়তো জানেন না শহরে তরী তরকারির অভাব দেখা দিয়েছে। পানি তো যথেষ্ট আছে। কিন্তু শুধু পানি দ্বারা তো আর জীবন চলে না।

লীজার কণ্ঠ গম্ভীর। বলল, দিশেহারা হয়ো না। ভয়ও পেয়ো না। শীঘ্রই অবরোধ উঠে যাবে। যদি তা না হয় তাহলে আমাদের যোদ্ধারা বাইরে বেরিয়ে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করবে।

পরিচারিকাটি বিনীত কণ্ঠে বলল, রাণী মাতাজী! আপনাকে তো গীর্জায় কখনো দেখলাম না। গীর্জায় প্রত্যহ আমাদের বিজয় আর মুসলমানদের পরাজয়ের জন্য দুআ করা হয়। পাদ্রীরা বলেন, পাপ থেকে তওবা কর। আমাদের পাপের কারণেই এ বিরাট আযাব আমাদের উপর আপতিত হয়েছে। রাণী মাতাজী! আমরা গরীব মানুষ। আমরা আবার কি পাপ করলাম!

পারিচারিকার কথা পূর্ণ না হতেই লীজা হেসে ফেলল। পরিচারিকা কথা বন্ধ করে বিস্ময় বিমোহিত দৃষ্টিতে লীজার চেহারার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর পরিচারিকা বলল, শহরের লোকেরা বলছে, কেল্লার বাইরে গিয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করা হবে। কিন্তু কিছু লোক বলছে, আক্রমণ না করে মুসলমানদের সাথে চুক্তি-পরামর্শ করে নগর প্রাচীর খুলে দেয়া উচিত। তারা বলছে, মুসলমানরা অত্যন্ত ন্যায় পরায়ণ জাতি। বিজিত শহরের লোকদের সাথে তারা অত্যন্ত ভাল আচরণ করে। কখনো কারোর উপর যুলুম অত্যাচার করে না।

লীজার হাসি যেন এবার নতুন প্রাণ পেল। কিন্তু পরিচারিকার কথায় সে কোন ভ্রূক্ষেপই করল না। নির্বিকার থেকেই তার কথাগুলো শুনল। আজকে লীজা একটু দ্রুত নাস্তা সেরে বাইরে বেরিয়ে পড়ল।

শহরের ভিতরে থেকেও অবরোধের হট্টগোল শোনা যায়। যে সব লোক শহর রক্ষার জন্য নগর প্রাচীরে দাঁড়িয়ে আছে তারা বার বার আনন্দ ধ্বনি দিচ্ছে আর মুসলমানদের ব্যঙ্গ করে আক্রমণের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তাদের অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় তারা এখনো অত্যন্ত দৃঢ় মনোবল, অসম্ভব উৎসাহী ও বিজয়ে আশাবাদী। লীজা ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট কোন জায়গায় পৌঁছার লক্ষ্যে সে যাচ্ছে না। নয়ন তাকে যেদিকে পথ দেখাচ্ছে সেদিকেই সে এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের মেয়েরা তাকে চিনে যে, সে তাদের সিপাহসালারের স্ত্রী। কিছুদূর অগ্রসর হলে, বেশ কিছু মহিলা তাকে ঘিরে ধরল। তাদের চেহারায় ভয় ও আতঙ্কের সুস্পষ্ট ছাপ। তারা জিজ্ঞেস করল, আর কতোদিন এ অবরোধ চলবে? দীর্ঘদিন কি এ অবরোধ চলতে থাকবে?

লীজা এক নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে যেন সজাগ হয়ে উঠল। মহিলাদের সাহস দিল। উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলল। অভয় দিয়ে বলল, অবরোধ বেশী দীর্ঘ হতে দেয়া হবে না। অতি শীঘ্রই কেল্লার বাইরে গিয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করা হবে। সুতরাং আমরা নারী হলে কি হবে, আমাদেরও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আমাদেরও অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

লীজার উৎসাহব্যঞ্জক কথায় মহিলারা বেশ মুগ্ধ হল। তাদের চোখ-মুখের আতঙ্ক ভাব দূর হয়ে গেল। কেউ কেউ বলল, আমরা পুরুষদের মত বীর বীক্রমে যুদ্ধ করব। কিছুতেই মুসলমানদের জয়ী হতে দেব না।

লীজার মনের দুর্ভাবনা সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেল। আরো সামনে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ চলার পর নগর প্রাচীরে গিয়ে পৌঁছল। প্রাচীরটি এতো প্রশস্থ যে একসাথে পাশাপাশি চারজন ব্যক্তি অনায়াসে চলতে পারে। কিন্তু তখন প্রাচীরের উপর দিয়ে চলা মুশকিল। কারণ শহরের প্রায় সকল লোক এসে প্রাচীরে উপস্থিত হয়েছে। এদিক সেদিক যাতায়াত করছে। এ ভীড়ের মাঝে পথ করে করে লীজা এগিয়ে চলছে। তাকে যারা চিনে তারা তাকে দেখেই কুর্নিশ করে পথ ছেড়ে দিচ্ছে। লীজা যখন ভীড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখন কাঁধের উপর যেন কার হস্তস্পর্শ অনুভব করল।

লীজার চলার গতি থেমে গেল। পশ্চাতে দৃষ্টি ফেলে দেখে, রূতাস দাঁড়িয়ে আছে। লীজার চেহারা আলোকময় হয়ে উঠল। রূতাসকে জিজ্ঞেস করল, যুদ্ধের পরিস্থিতি এখন কেমন? অবরোধ ভেঙ্গে ফেলা কি সম্ভব? না এখনো আমরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছি?

রূতাসের কণ্ঠ একেবারে শুষ্ক। বলল, আমরা তো মুসলমানদের অবরোধ প্রতিহত করে যাচ্ছি। তবে কোন ভয় নেই, কোন আতঙ্ক নেই সে কথা বলা আত্মপ্রবঞ্চনা মনে করছি।

মুসলমানদের সিপাহসালার হল খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)। আপনার হয়তো জানা নাও থাকতে পারে যে, আমি রোমান সম্রাটের গোয়েন্দা বিভাগের একজন উঁচু শ্রেণীর অফিসার ছিলাম। আমি ছদ্মবেশে মুসলমানদের তাঁবুতে গিয়েছিলাম। অতি নিকট থেকে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-কে দেখেছিলাম। এ সিপাহ সালারের কারণেই শাম থেকে আমাদের পালিয়ে যেতে হয়েছে। সে আমাদের প্রত্যাক্রমণেরও সুযোগ দেয়নি।

লীজা বলল, এ নাম তো আমিও শুনেছি। একদিন সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে বলতে শুনেছি, যদি খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-কে হত্যার কোন ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আমি মুসলমানদের শুধুমাত্র শাম থেকেই তাড়িয়ে দেব না, বরং আরব থেকেও তাড়িয়ে সমুদ্রে নিয়ে ডুবিয়ে মারব। কিন্তু আমাদের ঘাতকরা তো তার টিকিটিও ছুঁতে পারছে না।

রূতাস বলল, আপনি হয়তো জানেন না; দুই বার খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-কে হত্যার জন্য চারজন করে গুপ্তচর পাঠানো হয়েছিল। তাদের গায়ে ছিল মুসলমানদের পোষাক। আরবদের মত তারা অনর্গল আরবীতে কথা বলতে পারত। আমার বিশ্বাস ছিল যে, মুসলিম বাহিনীর কেউ তাদের ধরতে পারবে না। তাদের ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহও করতে পারবে না। কিন্তু তারা সবাই সেখানে পৌঁছে নিহত হয়েছে। আমরা এখন যে অবরোধের মুখোমুখী আছি, এই অবরোধকারীদের সালারও স্বয়ং খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)। কেল্লার প্রাচীর ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া ও কেল্লার পতনের ক্ষেত্রে সে দারুণ অভিজ্ঞ। হঠাৎ রূতাসের দৃষ্টি কেল্লার বাইরে পড়তেই সে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, ঐ তো, ঐ যে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)কে দেখা যাচ্ছে। এদিকে আসুন। এদিকে আসুন। আমি আপনাকে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-কে দেখিয়ে দিচ্ছি।

রূতাস লীজাকে নগর প্রাচীরের এক উঁচু স্থানে নিয়ে গেল। লীজা স্পষ্টভাবে দেখতে পেল, দুটি অশ্বারোহী আগে আগে এগিয়ে যাচ্ছে আর তাদের পিছনে আরো আট-দশজন অশ্বারোহী। রূতাস বলল, অগ্রগামী দুই অশ্বারোহীর ডান পার্শ্বের ব্যক্তিটি খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) আর বাম পার্শ্বের জনের নাম ইয়ায। তার পূর্ণ নাম আমি জানি না। সেও একজন সালার।

রূতাস বলল, এতো দূর থেকে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) এর চেহারা। স্পষ্টভাবে দেখতে পারবে না। নিকট থেকে দেখলে শত্রু হলেও মনে হবে, আল্লাহ তার চেহারায় এক অভাবনীয় প্রভাব লেপ্টে দিয়েছেন। যে কেউ তাকে দেখলে প্রভাবিত না হয়ে পারবে না। তার হৃদয়ের দীপ্তি আর উজ্জ্বল্য তার চেহারা দিয়ে ঠিকরে বেরুতে থাকে। তিনি এমন এক সালার যার জীবন কোষের পাতায় পরাজয় শব্দটি নেই।

লীজার কণ্ঠে ভীতির আভাস। বলল, আচ্ছা, তাহলে কি আলেপ্পাও তারা পদানত করে নিবে।

রূতাস বলল, আমি আপনার মনোবল ভাঙ্গব না। আমরা জীবন দিয়ে যুদ্ধ করব। প্রয়োজনে আলেপ্পা রক্ষার জন্য আলেপ্পার মানুষ জীবন দিবে। দুর্গের ফটক খুলে আমরা সম্মুখ যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করব। রূতাস কি হতে পারে, কি হওয়া সম্ভব সবই একে একে লীজার নিকট বলতে লাগল। লীজা তার ডাগর চোখ জোড়া বাইরের দিক থেকে ফিরিয়ে এনে রূতাসের চেহারায় নিবদ্ধ করল। গভীর ও গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকে দেখল। বারবার আপাদমস্তক তাকে দেখল। তার অধর কোণে মধুর এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল। অত্যন্ত বিমুগ্ধ, অত্যন্ত হৃদয় কাড়া সে দৃশ্য।

তারপর আর লীজা বেশী চিন্তা করতে পারেনি। রূতাসের বাহু ধরে তাকে নগর প্রাচীরের উঁচু স্থান থেকে নিয়ে এল। রূতাস সুবোধ বাধ্যগত পুরুষের ন্যায় তার সাথে চলতে লাগল।

***

আন্তোনীস, ইউকেলিসের মত রূতাসও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সময় কাটাচ্ছে। সেও একজন সালার। বয়স পঁয়ত্রিশ ও চল্লিশের মধ্যে। দেখতে সুশ্রী, চিত্তাকর্ষী। লীজা থেকে তিন চার বৎসরের ছোট। শাহী পরিবারের সন্তান। সাম্রাজ্যের উঁচু পদে কর্মরত ছিল। বয়সে লীজার চেয়ে ছোট হলেও দেখতে লীজার চেয়ে বড় মনে হয়। শাহী খান্দানের সন্তান বলে লীজা রূতাসকে সম্মান করে। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী হওয়ার কারণেও সেও তাকে সম্মান করে।

রূতাস বাইরের দিকে তাকিয়ে লীজাকে বলল, ঐ তো দেখুন, একদল অশ্বারোহী যোদ্ধা চলে যাচ্ছে। হতে পারে একদলের পরিবর্তে আরেক দল আসছে। কিন্তু … কিন্তু আমার মনে হচ্ছে মুসলমানরা ধীরে ধীরে অবরোধ তুলে নিবে।

প্রায় এক হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদ খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর নির্দেশে অবরোধ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। রাতাস ও লীজা অপলক নয়নে দেখছে, অশ্বারোহী দলটি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। যেতে যেতে তারা দূরের এক পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেল। লীজা রাতাসের দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, রূতাসের চেহারায় এক বিমল আনন্দ খেলা করছে। তাকে আগের চেয়ে আরো সুশ্রী মোহময় মনে হচ্ছে। রূতাস ও লীজার মাঝে কোন লৌকিকতা ছিল না। অবরোধ শুরু হওয়ার পর প্রায়ই সে লীজার ঘরে যেত। তবে যখন ঘরে আন্তোনীস থাকে তখন সে কথাবার্তা ও আচার-আচরণে এ কথা বুঝায় যে, সে লীজার নিকট আসে নি। আন্তোনীসের নিকট এসেছে। তারই সাক্ষাৎ প্রার্থী।

লীজার কণ্ঠে বন্ধুসুলভ আবেদন ফুটে উঠল। বলল, রূতাস! একাকী থাকতে থাকতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। শহরের সাধারণ নারীদের সাথে তো আমি খোলামেলা মিশতে পরি না। আর তুমি তো জান আমি কেমন পরিবেশ থেকে এসেছি। আন্তোনীস দিন-রাত বাইরে থাকে। যখন ফিরে আসে তখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ফিরে আর বিছানায় পড়ে নাক ডেকে ঘুমায়। আমি আজ একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে কেল্লার পাঁচিলের নিকট চলে এসেছি। তোমাকে পেয়ে আমার কতো ভাল লাগছে! রূতাস তোমার সাথে যদি আমি তোমার ঘরে যাই তাহলে কি তুমি তা খারাপ মনে করবে?

রূতাস বলল, না, না, অমন কথা বলবেন না। আমি তো এখন আমার ঘরেই যাচ্ছিলাম। সারারাত ঘুমাইনি। এখন যাচ্ছি চলুন। রূতাস লীজাকে নিয়ে তার ঘরে গেল।

রূতাস লীজাকে সসম্মানে বসাল এবং নিজে একটু দূরে বসতে চাইল। কিন্তু লীজা বাহু ধরে তাকে তার পাশে বসাল। এবং একটি হাত তার কোমড়ের উপর রাখল। রূতাস ফিক করে একটু হেসে তার থেকে দূরে সরে যেতে চাইল। কিন্তু লীজা তাকে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরল। তারপর তার সাথে এমন এক অবাধ আচরণ করল যা সে আন্তোনীসের সাথে করে যাচ্ছিল। রূতাস ধারণা করতে পারেনি যে, সে তার সাথে এমন অবাধভাবে মিশবে। তারপর লীজা কামাতুর কণ্ঠে দুচারটি আবেগময় কথাও বলল। রূতাস তো আর অল্প বয়সের বালক নয়। সে সব কিছু বুঝে ফেলল। সে লীজার চেহারায় দৃষ্টি ফেলে তার নিরব আহবানে সুখ অনুভব করল।

রূতাসের কণ্ঠ একটু বেরসিক হয়ে উঠল। বলল, আমার অন্তরে আপনার সম্মান বিদ্যমান। আপনি শাহী খান্দান থেকে পালিয়ে এসেছেন। আমিও তো সেই খান্দানেরই লোক। আমি আপনার ইহতেরাম করি। সম্মান করি। যদি এ দিকটি বাদও দেই যে আপনি শাহী খান্দানের ইজ্জত। তবে একথা তো আমি ভুলতে পারি না যে, আপনি আমার সালার আন্তোনীসের বান্ধবী।

লীজার কণ্ঠে দৃঢ়তার আভাস। এ সময় তুমিই আমার বন্ধু। তুমিই আমার সঙ্গী। আমার থেকে দূরে সরে থাকার চেষ্টা করবে না। এখন আমি সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী নই আর অন্তোনীসের বন্ধুও নই। এখন আমি শুধুমাত্র লীজা। আমাকে সম্মানসূচক কিছু না বলে, প্রেমের আবেশে লীজা বলে ডাক!

রূতাসের কণ্ঠ তবু নিরস শোনা গেল। বলল, লীজা! এ কথাও চিন্তা কর, পাদ্রী প্রত্যেক দিন বিজয়ের দুআ করছেন আর বার বার বলছেন, আমাদের উপর এক মহা বিপদ সমাগত। এ বিপদ থেকে মুক্তির একই উপায় তাহলো, বিগত দিনের পাপ থেকে তওবা করা। সর্বপ্রকার পাপ পরিত্যাগ করা।

লীজা বলল, আমি আপাদমস্তক পাপ। ইরানের শাহী খান্দান থেকে এক জঘন্যতম পাপের প্রতিজ্ঞা করে হিরাক্লিয়াসের হেরেমে এলাম। কিন্তু সে পাপ সংকল্পে সফল হতে পারলাম না। তারপর যখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস আমাকে বিয়ে করে অল্প কিছুদিন পরই হেরেমে নিক্ষেপ করল, তখন আমি আরেকটি পাপ করলাম।

লীজা আবেগে অধীর হয়ে একের পর এক বলে গেল, কিভাবে সে আন্তোনীসকে তার জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য কাছে টেনে নিয়েছে। কিভাবে তার সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। একথাও বললো, ইউকেলিস সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পুত্র নয়। আন্তোনীসের ঔরসজাত।

লীজা বলল, তুমি হয়তো ভুল বুঝে আছো। তুমি মনে করেছো, আমি আন্তোনীসের এই চেষ্টায় একমত যে, আমরা শামে ঈসা মসীহ-এর সাম্রাজ্য কায়েম করব। আন্তোনীসও তাই মনে করে। কিন্তু রূতাস! আমি তোমাকে সত্য কথা বলছি, আমার একমাত্র সন্তান ইউকেলিসকে সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও তার পুত্র কুস্তুনতীনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমি আন্তোনীসের হাতে ধরা দিয়েছি।

বলতে বলতে লীজা রূতাসকে এ কথাও বলে দিল যে, হিরাক্লিয়াস ও কুসতুনতীন ইউকেলিসকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আন্তোনীস যথাসময়ে তা দেখে ফেলে তাদের প্রেরিত ঘাতকদের হত্যা করে উইকেলিসকে রক্ষা করেছে। আর আন্তোনীসও পালিয়ে এসেছে। কারণ এরপর হিরাক্লিয়াস তাকে পেলে আস্তো রাখত! নির্ঘাত হত্যা করত।

রূতাসের শান্ত কণ্ঠ। বলল, আমি এ সব কিছু শুনে বিস্মিত বা হতবাক নই। এ সব কাণ্ড শাহী খান্দানে ঘটা স্বাভাবিক। একজনের স্ত্রী অন্যজনের দাসী হয়। সম্রাটের ছেলে সম্রাটের অন্য স্ত্রী বা দাসীদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলে। তাই আমি বলব যে, রাজা-বাদশাহ আর সম্রাটদের পরাজয়ের কারণও ঐ একটিই। আমরা কি কখনো ভেবেছিলাম যে, ইরান আর রোমের মত অপরাজেয় শক্তি কখনো আরবের সাধারণ বুন্ধুদের হাতে পরাজিত হবে। আর এমন পরাজয় যে, রোম সম্রাট আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মুসলমানরা আমাদের দুশমন হতে পারে, কিন্তু রোমান গুপ্তচর হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন শ্রেণীর মুসলমানের সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছি, মুসলমানদের বস্তিতে থেকেছি, তাদের তাঁবুতে তাঁবুতে ঘুরে ফিরেছি। তাদের মাঝে ভোগ বিলাসের কোন নাম গন্ধও নেই। তাদের সকল কাজ পাহাড়ী ঝরণার মত স্বচ্ছ। যার উপর থেকে গভীরের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। এটাই তাদের শক্তির মূল। যার কারণে কোন শক্তিই তাদের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারছে না। লীজা! আমি এখনো বলছি, আমার কথা শুন, পাপ থেকে দূরে থাক। আন্তোনীসকে নিয়ে গির্জায় যাও এবং তাকে বিয়ে করে নাও।

লীজার কণ্ঠে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল। বলল, রূতাস! তুমি আমার কথা কেন বুঝছো না। আন্তোনীসের সাথে আমার সেই ভালবাসা অবশিষ্ট নেই যা তুমি ধারণা করছে। সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে ভালবেসেছিলাম। কিন্তু সে আমার সাথে যে আচরণ করেছে তাতে আমি বুঝে ফেলেছিলাম সে ভালবাসার উপযুক্ত পাত্র নয়। আমি তখন সালার আন্তোনীসের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে তাকে ধোকা দিয়েছিলাম। আমি একজন মানুষ। তদুপরি একজন যুবতী। আমার এই নিটোল দেহের দিকে চেয়ে দেখ। তার ক্ষুধা আছে। তীব্র চাহিদা আছে। কিন্তু………..।

রূতাস তার কণ্ঠে একটু কোমলতা এনে বলল, তারপরেও লীজা! আন্তোনীসের এই প্রতিজ্ঞা ও প্রচেষ্টাকে আমাদের সম্মান করা উচিৎ। ঈসা মসীহ (আ.)-এর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সে কত মেহনত করছে। আমাদের কর্তব্য তাকে সার্বিক সহায়তা করা।

লীজা মৃদু হেসে শ্লেষভরা কণ্ঠে বলল, রূতাস! তুমি এক নির্বোধ। গুপ্তচর বাহিনীর উচ্চ পদস্থ অফিসারের আরো সতর্ক হওয়ার দরকার। চিন্তা কর, গভীরে পৌঁছ। পশ্চাৎপসরণ আর পরাজয়ের যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে তার আলোকে ভেবে দেখ। আন্তোনীসতো এমন সুখ স্বপ্নে বিভোর যার কোন ব্যাখ্যা নেই। এ অল্প মুসলিম মুজাহিদই তো লাখ লাখ ইরানী ও রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের পরাভূত করেছে। নিষ্পেষিত করেছে। আন্তোনীস এ অশিক্ষিত অচেতন অদূরদর্শী কবিলার লোকদের নিয়ে কিভাবে সেই অজেয় মুসলিম শক্তিকে পরাজিত করবে! তুমি নিশ্চয় বুঝ এটা অবরোধ। আমরা মজবুত কেল্লায় আবদ্ধ হয়ে নিরাপদে আছি। তাই মুসলমানদের সময় লাগছে। যদি খোলা প্রান্তরে হত, তাহলে দেখতে, সূর্যাস্তের আগেই মুসলমানরা এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করত।

রূতাস হালকা ব্যঙ্গ করে বলল, লীজা! তুমি এতো নিরাশ। মনে হয় তুমি আন্তোনীস ও ইউকেলিসের সাথেও এমন ধরনের কথা বল।

লীজা বলল,না, তাদের সাথে এ ব্যাপারে আমি কোন কথাই বলি না। তাদের বিশ্বাস যে, মুসলমানরা অবরোধ তুলে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাবে। তারপরই লীজা রূতাসকে আরো কাছে টেনে এনে কামনায় ভেঙে পড়া কণ্ঠে নীচু স্বরে বলল, রূতাস! তুমি এসব কথা ছাড়। আমি কি চাচ্ছি বুঝ…?

রূতাস যুবক। যৌবনের জোয়ারে তার শরীর প্লাবিত। তাছাড়া সে কোন দুনিয়া বিরাগী পাদ্রী বা সন্নাসীও নয়। তার শরীরের ঘুমন্ত পৌরুষ জাগ্রত হয়ে উঠল। রূতাস বেকারার অস্থির হয়ে উঠল। সহজেই লীজার পাতানো জালে আটকে গেল। যেমন মাকড়সার জালে মাছি আটকে যায়।

রূতাসের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা ও ভয়। বলল, লীজা! ক্ষণিকের জন্যও কি ভেবে দেখেছো, যদি আন্তোনীস আমাদের এই বন্ধুত্বের কথা জানতে পারে, তাহলে কি হবে?

লীজা একটু শ্লেষভরা কণ্ঠে বলল, তাহলে আর কি হবে। আন্তোনীস হয়তো তোমাকে হত্যা করবে।….. কিন্তু আমরা তাকে সে বিষয় জানতে দিব কেন?

তারপর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। লীজা ধীর পায়ে চলে এল।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *