২৬. হনিয়ারা ফিরে

২৬.

পরদিন বিকেলে স্যাম ও রেমি হনিয়ারা ফিরে দেখল রাস্তাঘাট ভেজা। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে। হোটেলের রুমে ঢুকে রেমি খেয়াল করল এক চিলতে হাসি ঝুলছে স্যামের ঠোঁটে।

কী ব্যাপার? প্রশ্ন করল ও।

 ‘গাড়ি নিয়ে ড্রাইভ করার জন্য আজকের দিনটা দারুণ।

চোখ সরু করল রেমি। “ও আচ্ছা, তাই? তোমার মতলবটা কী?

‘চলো আবার রুবো’র সাথে গিয়ে কথা বলি। দ্বীপে জাপানিদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তিনি হয়তো আমাদেরকে কিছু জানাতে পারবেন।

জানলেও বা কী! দেড় মাইল গভীর পানির নিচ থেকে জাহাজ কীভাবে তুলবে সেটাই প্রশ্ন।

 ‘তা ঠিক।’ স্যাম বলল। তবে আমাদের হাতে এখন করার মতো কিছু নেই। অবশ্য শিপে গিয়ে ডাইভারদের ডাইভ করা দেখা যায় কিন্তু সেটা তো কোনো কাজের কাজ হলো না, তাই না?

‘এরআগের বার ওদিকে যাওয়ার পর ফেরার সময় কিন্তু গাড়ি ছাড়া ফিরতে হয়েছিল, মনে আছে?’

কথা দিলাম। আর রাস্তা থেকে ছিটকে যাব না।

‘গুলিও ছোঁড়া হয়েছিল কিন্তু রেমি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমার মনে হয় এসব নিয়ে কথা বলার কোনো মানে হয় না।

‘আমাদের কিছু হবে না।’ থামল স্যাম। খুব আগ্রহের সাথে বলল, সৈকতের পাশ দিয়ে ড্রাইভ করার চেয়ে মজার আর কী হতে পারে?

হয়েছে, ফারগো, হয়েছে।’

নাদান দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল স্যাম।

শহর থেকে বাইরে যাওয়ার পথে একটা রোডব্লকে পড়ল ওরা। পুলিশরা এখন অনেক আয়েশ করছে। তেমন কোনো কড়াকড়ি নেই। স্রেফ রুটিন ডিউটি দিচ্ছে।

কাঁচা রাস্তা শুরু হওয়ার পর গাড়ি ঝাঁকুনি খেতে শুরু করল।

‘স্যাম যা-ই করো, আমাকে কথা দাও, আমরা যেন আটকে না পড়ি।

‘আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

কী চেষ্টা করবে? কথা দেবে না? নাকি আটকে পড়বে না? কোনটা?

 ‘আশা করি, কোনোটাই নয়।’

‘তুমি আমাকে মানানোর চেষ্টা করছ না, আমরা কথার গুরুত্বও দিচ্ছ না।

রুবোর কুড়েঘরের সামনে পৌঁছুল ফারগো দম্পতি। রুবো ছায়ায় বসে নদীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গাড়ির শব্দ শুনে ওদের দিকে তাকাল রুবো। গাড়ি থেকে বের হয়ে রেমি হাত নাড়ল।

রুবো, আমরা আপনাকে বিরক্ত করছি না তো?

হাসল রুবো৷ না। বিরক্ত হমু ক্যান। আরও গল্প শুনাবেন?

জি।

ছায়ার গিয়ে বসল ফারগো দম্পতি। এখানে এত গরম যে ছায়ায় বসেও ঘামছে ওরা। স্যাম কখন বলতে শুরু করবে তার জন্য রেমি অপেক্ষা করছে।

রুবো, আপনি বলেছিলেন, এই দ্বীপে জাপানিরা ছিল। স্থানীয় লোকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করত তারা।

রুবো সায় দিল মাথা নাড়ল। ‘হ। জাপানিরা কুমীরের লাগান বদ আছিল।

 ‘সবাই?

‘হেইডা কওয়া মুশকিল। কিন্তু ব্যাবাক কিছু যে অফিসার চালাইত… হে আস্তা জানোয়ার আছিল।’

‘তার ব্যাপারে আমাদেরকে বলতে পারবেন?

‘শয়তানডার নাম আছিল কুমা… কুমাসাকা। কর্নেল কুমাসাকা। এই নাম আমি জীবনে ভুলুম না।

 ‘কী করতেন তিনি?

রুবো এরআগে যা বলেছিল আজও তা-ই বলল। নতুন কিছুই জানা গেল না। তাই ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করল।

‘দ্বীপের পশ্চিম পাশে জাপানিদেরকে কিছু করতে দেখেছেন কিংবা শুনেছেন কখনও?

কীরাম?

‘অদ্ভুত কিছু। হয়তো সাগরে ডুব দিয়েছিল জাপানিরা কিংবা অন্যকিছুও হতে পারে।’

‘যুদ্ধের শ্যাষের দিকে অনেক গুলাগুলি হইছে। তাই একেবারে সঠিক কইরা কিছু কইতে পারুম না। তয় দ্বীপ ছাইড়া যাওনের আগে সাগরের পাশের এক গ্রামের অনেকজনরে ওরা খুন কইরা গেছিল।

‘তাই?

 ‘আমি শুনছি। দেহি নাই।

মাথা নাড়ল রেমি। বুঝতে পারছি। কী মনে হয়, রুবো? কী হয়েছিল?

‘আমি শুনছি, আমাগো অনেক লোকরে জাপানিরা মাইরা ফালাইছে। প্রথমে কামলা বানায়া কাম করাইসে পরে যাওনের সময় খুন কইরা থুইয়া গেছে।

কামলা? অর্থাৎ শ্রমিক? কী কাজে নিয়েছিল জাপানিরা?”

 “জানি না।’

 ‘স্বাভাবিক কাজ ছিল সেটা?

রুবো মাথা নাড়ল। হেইডা কইতে পারি না। তয় কামের লিডার আছিল কুমাসাকা। মানুষরে মাইরা ফালাইয়্যা মজা পাইত ব্যাডা। আস্তা শয়তান আছিল। পাশে থাকা শুকনো পাতার উপর থুথু ফেলল রুবো। মাত্র দুইজন জান লইয়্যা বাঁচতে পারছিল। বাকি সবাইরে…’দুখী মুখে রুবো মাথা নাড়ল।

‘ওই ঘটনা থেকে লোক বেঁচে ছিল? প্রশ্ন করল স্যাম।

 ‘হ, একজন এখনও বাইচ্যা আছে মনে হয়। ব্যাডার কই মাছের জান।

 ‘সত্যি? আপনি তাকে চেনেন?’

 ‘একটা জায়গায় আপনে অনেকদিন থাকলে এমনেই সবাইরে চিন্না ফালাইবেন।

‘আচ্ছা, তাহলে তো আপনি জানেন তিনি কোথায়।

‘হ, জানি। ওই গ্রামেই থাকে মনে হয়। রেমি’র দিকে তাকাল ও ‘তয় এইহানকার ভাষা ছাড়া অন্য কিছু পারে না।’

‘আমাদেরকে তার কাছে নিয়ে যাবেন?’ রেমি প্রশ্ন করল।

গাড়ির দিকে তাকাল রুবো। বহুত রাস্তা।’

 ‘রাস্তা ভাল না?’

হাসল রুবো। আবার থুথু ফেলল। রাস্তাই নাই। আপনেগো ওই গাড়িতে চইড়া যাইবার পারবেন না।’

‘আচ্ছা, যদি বড় ট্রাক নিই তাহলে আপনি যাবেন আমাদের সাথে? আপনাকে সম্মানী দেব।’

রুবো প্রথমে স্যাম তারপর রেমি’র দিকে তাকাল। কত দিবেন?

 ‘সলোমন ডলারে নেবেন নাকি আমেরিকান ডলারে? স্যাম প্রশ্ন করল।

‘আমেরিকান।

 ‘আচ্ছা, বলুন কত হলে আপনার ন্যায্য সম্মানী হবে?

গভীরভাবে ভাবল রুবো। তারপর বলল, “১০০ আমেরিকান ডলার দিবেন।

ফারগো দম্পতি আর দর কষাকষি করতে গেল না! বেশ, দেব।’ ঘড়ি দেখল রেমি। শহর থেকে এখানে আসতে দেড় ঘণ্টা লাগে। নতুন একটা গাড়ি ভাড়া করে এখানে আসাটা বেশ তাড়াহুড়ো করে করতে হবে। আগামীকাল সকালে এসে আপনাকে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রুবো। দাঁতবিহীন মাঢ়ি বের করে হাসল। ১০০ ডলার।

.

২৭.

সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

নিজের ইয়টে মুখ হাঁড়ি করে বসে আছে জেফরি গ্রিমস। তার থেকে কয়েক ফুট দূরে ইয়টের ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 ‘সব শালা চোর। পালিশের কী হাল! শিরিশ কাগজ দিয়ে ডলা দিলেও এরচেয়ে ভাল পালিশ করা যায়। এই চোরগুলোকে টাকা দেয়া হয় এরকম ফাঁকিবাজি করার জন্য?

 ‘স্যার, এরআগের কাজটাও আপনার পছন্দ ছিল না তাই আমি নতুন করে ইয়টটাকে পালিশ করিয়েছি। আপনার বন্ধুর পরামর্শ নিয়েই করেছি সব। এবার সবকিছু তো ঠিক হওয়ার কথা। বলল ক্যাপ্টেন।

‘কীসের ঠিক? দেখলেই তো মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সিরিয়াসলি? এটা কোনো পালিশ হলো? ইয়টের পেছনের অংশে পা বাড়াল গ্রিমস। এদিকটা বেশ উজ্জ্বল ও সুন্দর করে বার্নিশ করা। যাক, চোরগুলো এই অংশের কাজ একটু ভাল করেছে। রীতিমতো অলৌকিক ঘটনা!’

হঠাৎ তার সেল ফোন বেজে উঠল। কোনো কলারের আইডি ফোন স্ক্রিনে ওঠেনি। শক্ত করে গেল গ্রিমসের পাকস্থলীর ক্যাপ্টেনকে বলল, এখন আপনি আসতে পারেন।

‘জি, স্যার।

ক্যাপ্টেন যথেষ্ট দূরের যাওয়ার আগপর্যন্ত গ্রিমস অপেক্ষা করল। হ্যাঁ, বলছি…

ফিল্টার করা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল ওপাশ থেকে। সব কাজ বেশ দ্রুত এগোচ্ছে।

গ্রিমস হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আমি তো সেরকম কোনো নমুনা দেখতে পাচ্ছি না। আপনি পাচ্ছেন?

এরআগেও বলেছি, কোনো কিছু করতে হলে সময়ের প্রয়োজন। তবে আমি স্বীকার করছি, চাপ আরও বাড়ানো দরকার।’

গ্রিমস চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল ওর দিকে কেউ তাকিয়ে আছে কিনা। গলা নামিয়ে বলল, হঠাৎ করে এরকম কঠিন পদক্ষেপ নেয়াটা কি খুব জরুরী ছিল?

‘সেটা ফলাফলই বলে দেবে। ইতিহাস দেখুন, বড় অর্জনগুলো রক্ত না ঝরিয়ে সম্ভব হয়নি। এই ক্ষেত্রে বাদ যাবে কেন?

‘ওরা তো নির্দোষ এইড কর্মী ছিল।’

আপনি লাভের অংকটা ভুলে যাননি।

‘অবশ্যই ভুলিনি। আমি ভাবলাম… ওটা এই ব্যাপারে সেভাবে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।

‘পারবে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। সামনে আরও হবে… প্রস্তুত থাকুন। আপনার তো এসব তিতা লাগছে মনে হয়।

‘আচ্ছা, এসব করা খুবই জরুরী?’

‘জরুরী না হলে আমি কোনো কাজ করি না। আশা করছি, আপনি আমাকে বরাবরের মতো সাহায্য-সহযোগিতা করবেন?

পানিতে ভাসা ইয়টগুলোর দিকে তাকাল গ্রিমস। একেকটা দাম মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। সব বিলাসিতা। মানুষ শুধু উপরে উঠতে চায়। সবার চেয়ে উপরে সেরা জায়গাটায় থাকতে চায়। এসব বিলাসিতার মাধ্যমে অহমিকা, অহংকার আর অর্থের প্রতাপ দেখাতে চায় মানুষ। গ্রিমস কোনো কাজে পিছ পা হওয়ার লোক নয়। তবে এই প্রজেক্টের ঘটনাগুলো ওর আশানুরূপ হচ্ছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, হ্যাঁ। যা প্রয়োজন মনে হয় করুন। কিন্তু খোদার দোহাই লাগে, তাড়াতাড়ি করুন।

 ‘কাজ চলছে। এতটা অগ্রগতি এরআগে কখনও হয়নি। দ্বীপে লোকজন নেই বললেই চলে। এখন একটু ধাক্কা দরকার।

‘ধাক্কার ব্যাপারে জানতে চাইব?’

‘আপনি যতটুকু জানেন এরচেয়ে বেশি না জানাই ভাল।

ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

একটু পর ফিরল ক্যাপ্টেন। গ্রিমসের এখন ইয়টের পালিশের খুঁত ধরার মতো মানসিক অবস্থা নেই। হাত নেড়ে ক্যাপ্টেনকে সরিয়ে দিল সে। ডকে নেমে এলো। হাজার মাইল গতিতে ওর মনে চিন্তার ঝড় বইছে।

***

গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যাণ্ড

 কাদায় ভরা রাস্তা মাড়িয়ে পাহাড়ী রাস্তায় চলছে টয়োটা ল্যাণ্ড ক্রুজার। ২৫ মিনিট আগে মেইন রোড ছেড়ে এই কাঁচা রাস্তায় ঢুকেছে ওরা। রুবো আছে ওদের সাথে।

আর কতদূর?’ পেছনের সিটে বসা রুবোকে জিজ্ঞাস করল রেমি।

 বুড়ো কাঁধ ঝাঁকাল। এইহানে বহুত দিনে আগে আইছিলাম।

 ‘তা হোক, কিন্তু দূরত্ব তো একই আছে।

‘সমস্যা নাই, তাড়াতাড়ি পৌঁছায়া যামু। রেমিকে আশ্বস্ত করল রুবো।

রেমি ইতিমধ্যে জেনেছে এই দ্বীপে “তাড়তাড়ি”র মানে আক্ষরিক অর্থে “তাড়াতাড়ি” নয়। ওটার মানে “আগামীকাল থেকে শুরু করে “অসীম” পর্যন্ত হতে পারে।

স্যাম রেমি’র দিকে তাকাল। ধৈৰ্য্য একটা মহৎ গুণ।

 ‘ওসব আমাকে শুনিয়ো না।’

একটা ছোট জলপ্রবাহের সামনে এসে থামল ওরা। সামনের রাস্তা দু’দিকে ভাগ হয়ে গেছে। একটা বামদিকে আরেকটা ডানদিকে।

‘কোনদিকে যাব?’ পেছন ফিরে রুবোকে প্রশ্ন করল স্যাম।

 প্রশ্নটা রুবো ভেবে দেখল। মাথা নেড়ে বলল, ‘গিয়ে দেখতে হবে।’

গাড়ি থেকে নামল স্যাম ও রুবো। স্যাম বৃদ্ধকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করল। পানির ধারার সামনে গিয়ে চোখ বন্ধ করল রুবো। মাথা নাড়ল আরেকবার। স্যাম ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ রুবো চোখ খুলল।

আরেকবার যহন এইহানে আইছিলাম তহন পানি আছিল না।

 ‘আর?

‘আমার মনে হইতাছে গ্রামডা ওই দিকে। বামদিক দেখিয়ে বলল রুবো।

কীভাবে বুঝলেন?

‘আমি কিন্তু কই নাই “আমি জানি আমি কইছি “আমার মনে হইতাছে” বুঝছেন?

তারমানে আপনি নিশ্চিত নন…’

‘ওইদিকে না পাইলে অন্যদিকে যামু, সমস্যা কী? বামে না থাকলে ডাইনে থাকব।

‘ভাল বুদ্ধি। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনি জানেন গ্রামটা কোথায়।

 ‘জানি তো।’

 কিন্তু প্রথমবারেই সরাসরি সেখানে নিয়ে যাবেন, অতটা ভালভাবে নয়।’

‘আপনেরা আমারে আনছেন কথা বুঝায়া দেয়ার লাইগ্যা। আমি তো আপনাগো গাইড না।’

বুড়োর কথার বহর দেখে শ্বাস ফেলল স্যাম। টয়োটায় ফিরে গেল।

কী খবর?’ জানতে চাইল রেমি।

কাছাকাছি চলে এসেছি। রুবো বললেন, বামদিকে যেতে হবে।’ বলল স্যাম।

৫ মিনিট চলার পর ওরা এমন এক রাস্তার সামনে এসে পৌঁছুল যেখানে কোনমতে একটা সাইকেল চলার মতো জায়গা আছে। চেহারায় বিরক্তি প্রকাশ পাওয়া সত্ত্বেও স্যাম বিনয়ের সাথে রুবোকে বলল, ‘গ্রামটা কী এখনও সামনে আছে?’

‘যাইতে থাকেন। পাহাড়ের উপরে আছে।’

সরু রাস্তার দু’পাশে থাকা গাছের ডালপালা গাড়ির গায়ে আঁচড় কাটতে শুরু করল। রেমি’র পাশের জানালায় একটা ডাল এসে জোরে গুতো দিতেই দাঁতে দাঁত চাপল রেমি। ফিসফিস করে স্যামকে বলল, এই হলো তোমার ভাল আইডিয়া, না?’

স্যাম পাল্টা জবাব দিতে যাবে ঠিক সেইসময় কিছু কুঁড়েঘর উদয় হলো ওদের সামনে।

‘দেখেছ? রুবো ঠিকই বলেছেন।’ বলল স্যাম। আমরা তাহলে এখানেই থামব? স্যাম পেছন ফিরে রুবোকে প্রশ্ন করল।

মাথা নাড়ল রুবো। তার চোখে মুখে সন্ন্যাসীদের মতো প্রশান্তি দেখা যাচ্ছে। আমরা হাঁটমু এহন।’

পায়ে হেঁটে এগোতে শুরু করল ওরা ৩ জন। কুঁড়েঘরগুলোর ভেতর থেকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে স্থানীয়রা তাকাচ্ছে।

 প্রাচীন আমলের শর্টস আর রং উঠে যাওয়া টি-শার্ট পরিহিত এক বয়স্ক ভদ্রলোক তার কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রুবোকে দেখে হাসল সে। লোকটার বয়স প্রায় ৬০। চোখের ইশারায় দূরবর্তী কুঁড়েঘরে যেতে বলল রুবো তার সাথে কিছু কথা বলে জানাল, ‘ওর খুব ব্যারাম হইছে। চলেন ওইদিকে।

‘অসুখ? কথা বলা যাবে তো?”

 কাঁধ ঝাঁকাল রুবো। চেষ্টা কইরা দেহি।’

সরু পথ দিয়ে পাহাড়ের উঁচু অংশে থাকা কুঁড়েঘরের দিকে এগোল ওরা। নিচের দিকের কুঁড়েঘরে থাকা লোকজন তাদের বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে স্যাম ও রেমিকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। এই গ্রামে অযাচিত উত্তেজনা তৈরি হয়েছে ওরা আসাতে।

 এখানকার লোকজনদেরকে বেশ বন্ধুত্বপরায়ণ বলে মনে হচ্ছে। বিদ্রোহীরা যদি এদেরকে দলে টানার কথা ভেবে থাকে খুব একটা কাজ হবে না , তাই না?’ রেমিকে বলল স্যাম।

 ‘আশা করি, আমাদের ভাগ্য যেন ভাল হয়। অন্তত হনিয়ারা ফেরার আগপর্যন্ত।

গন্তব্যে পৌঁছুনোর পর একজন বয়স্ক ব্যক্তি বেরিয়ে এলো ওদেরকে দেখে। তার গায়ের রং তামাক বর্ণের। বারান্দা থেকে নেমে এলো সে। রুবো তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।

তার সাথে কথা বলতে শুরু করল রুবো। স্যাম ও রেমিকে দেখিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। দেখে মনে হচ্ছে, লোকটাকে বোঝাচ্ছে ওরা অনেক দূর থেকে এসেছে। লোকটা মাথা নাড়ল। বিষয়টা বিবেচনা করবে। কথা শেষে রেমি’র দিকে তাকিয়ে দাঁতবিহীন মাঢ়ি দেখিয়ে লজ্জামাখা হাসি দিল রুবো।

‘কবিরাজ কইল নাউরু এহন খুব ব্যারামে পড়ছে। কথা কইতে পারব কিনা এহুনি কওয়া যাইতাছে না।’ রুবো বলল।

‘আচ্ছা, আমরা কি তাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?

কবিরাজরে তাইলে আমেরিকান ডলার দেওয়ন লাগব।’

কত?

২০।’ স্ত্রীর দিকে তাকাল স্যাম। বেশ।

‘আমাগো হাতে খুব বেশি সময় নাই। নাউরু মরণের কাছাকাছি চইল্যা গ্যাছে।

 স্যাম ও রেমিকে নিয়ে কুঁড়েঘরের দিকে এগোল রুবো। আপনেরা ভিত্রে বহেন। আমি ওর লগে গিয়া কথা কইয়া আসি।’

 মাথা নাড়ল রেমি। সাবধানে ঢুকল অন্ধকার কুঁড়েঘরে। ওর পাশে স্যাম রয়েছে। ভেতরে থাকা ছোট্ট একটা রুম প্রবেশ করল ওরা।

.

২৮.

সূর্যের রশ্মিতে দেখা গেল ভেতরে ধূলো উড়ছে। কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ। কোনমতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ওরা। একটা বিছানা পাতা রয়েছে। একজন খাটো জীর্ণশীর্ণ ব্যক্তি শুয়ে আছে ওতে। তার পুরো শরীর নগ্ন সেফ পরনে একটা জীর্ণশীর্ন নেংটি। বার্ধক্য তার শরীর থেকে জীবনাশক্তি চুষে নিয়েছে। তার অবস্থা দেখে মনে হলো, এই বুঝি দেহ থেকে আত্মা উড়াল দেবে।

বয়স্ক লোকটা ওদের দিকে তাকাল। খুব কষ্ট করে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাচ্ছে বেচারা। রুবো এগিয়ে গেল লোকটার বিছানার কাছে।

লোকটার দিকে ঝুঁকে কানে কানে বিড়বিড় করে কী যেন বলে তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল। কয়েক মিনিট পর কিছু শব্দ মিনমিন করে উচ্চারণ করল লোকটা।

মাথা নাড়ল রুবো, দেয়ালের পাশে থাকা বেঞ্চের দিকে ইশারা করল ফারগো দম্পতিকে। স্যাম ও রেমি গিয়ে বসল ওতে। রুবোও এগোল।

 ‘এইড্যা হইলো নাউরু। অয় কইল কতা কওয়ার চেষ্টা কইরা দেখবো। থামল রুবো। আপনেরা কী জানবার চান?

‘তাকে জাপানিজ কর্নেল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে দেখুন। স্থানীয় লোকদেরকে খাটানো থেকে শুরু করে গ্রামে হত্যাযজ্ঞ পর্যন্ত তার যা যা মনে আছে সব আমরা জানতে চাই।’

নাউরুকে স্থানীয় ভাষায় প্রশ্ন করল রুবো। স্যাম ও রেমি এই ভাষার একবর্ণও বুঝতে পারল না। নাউরুর সাথে কথা বলা শেষে রুবো স্যামের দিকে ফিরল।

 ‘অয় কইতাছে, ওইডা অনেক পুরাইন্যা কাহিনি। কেউ আর ওই কাহিনি লইয়্যা মাতা ঘামায় না। ওই সময়কার বেবাক লোক মইর‍্যা গ্যাছে। শুদু অয় বাইচ্যা আছে এহন। আরেকজন বাইচ্যা আছিল, অর চাচতো ভাই। হার নাম আছিল: কটু।’

 ‘জি, কিন্তু আমরা সেই কাহিনিটা শুনতে আগ্রহী। গোয়াডালক্যানেলে জাপানিরা এসে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছিল, স্থানীয় লোকদেরকে দাস বানিয়ে রেখেছিল এই বিষয়গুলো আমরা এই প্রথম জানতে পেরেছি। তাকে বলুন, যেন শুরু থেকে সব বলে। স্থানীয় লোকদেরকে কোন কাজে লাগিয়েছিল জাপানিরা? কী উদ্দেশ্য ছিল তাদের?’ বলল স্যাম।

নরম কণ্ঠে নাউরুকে প্রশ্ন করল রুবো। উত্তর দিতে গিয়ে বিপদজনকভাবে ওঠানামা করতে শুরু করল নাউরুর বুক। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কথা বলতে বলতে নাউরু’র কণ্ঠ একসময় তেল ফুরিয়ে যাওয়া মোটরের আওয়াজের মতো ধীরে ধীরে বুজে এলো। বেচারা নাউরু তার জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে ওদেরকে তথ্য দেয়ার চেষ্টা করছে।

নাউরুর কথা শুনে ফারগো দম্পতিদের দিকে ফিরল রুবো। ‘গোয়াডালক্যানেলের অফিসার হইয়া এক অফিছার আইছিল… কর্নেল… হ্যাঁতে গ্রাম থেইক্যা ব্যাডা লোকগো ধইরা ধইরা নিয়ে গেছিল। এইহানকার সবাই তারে ড্রাগন কইয়া ডাকত। আস্তা শয়তান আছিল, খাড়া হারামী। এইহানকার মানুষগো হুদাই খুন করছিল শয়তানডা। বেশিরবাগ জাপানিরা ভালা আছিল কিন্তু ওইডা আছিল একড়া কুত্তার বাচ্চা।

 রুবো জানাল স্ত্রীদের কাছ থেকে তাদের স্বামীদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে কাজে লাগানো হয়েছিল তখন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত টানা খাটানো হতো তাদেরকে। এদিকে তাদের স্ত্রী, বোন, বাচ্চাদেরকে গায়েব করে দেয়া হতো। গুজব আছে পাহাড়ের গুহায় ভয়ঙ্কর এক্সপেরিমেন্ট চালাতে জাপানিরা। পুরুষদের কর্মক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে তাদেরকে খুন করা হতো। তারপর লাশ সরিয়ে নেয়ার জন্য তাদের আত্মীয়দেরকে অস্ত্রের মুখে নিয়ে আসা হতো তখন। সেই লাশগুলোকে সৎকার করতে না দিয়ে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলতে বাধ্য করা হতো যাতে হাঙর সেগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে খেয়ে নিতে পারে।

শেষের দিকে সবচেয়ে শক্তিশালী ১০০ জন দ্বীপবাসীকে প্রায় ১ ডজন ভারি কাঠের বাক্স বহন করতে বাধ্য করেছিল জাপানিরা। এখানকার গাছ কেটে বাক্সগুলো বানানো হয়েছিল। খুব ভারি ছিল বাক্সগুলো। মাথায় তপ্ত রোদ নিয়ে পাহাড়ে যেতে হয়েছিল তাদেরকে। পুরো একদিনের সফর। খাবার বলতে দেয়া হয়েছিল কিছু পানি।

বাক্সগুলোকে পাহাড়ের গুহায় ঢোকানো হয়েছিল। কাজ শেষ হতেই কর্নেল নির্দেশ দিয়েছিল সেই ১০০ জন পুরুষকে যেন খুন করা হয়। সৌভাগ্য আর শারীরিক সক্ষমতার জোরে নাউরু আর তার চাচাতো ভাই সেই বিভীষিকা থেকে প্রাণে ফিরতে পেরেছিল সেদিন। একটা গুহায় দু’জন লুকিয়ে ছিল। কয়েকদিন লুকিয়ে থাকার পর সাহস করে বাইরে এসে দেখেছিল সবার মৃত দেহ পচে গলে একাকার।

জাপানিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য কয়েক সপ্তাহ পাহাড়ে গা ঢাকা দিয়েছিল ওরা দুজন। পরবর্তীতে গ্রামে ফিরে দেখল পুরো গ্রাম জনশূন্য। ধীরে ধীরে জঙ্গল গিলে নিল গ্রামটাকে। একপর্যায়ে মিত্রবাহিনি দ্বীপ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলে ওরা দু’জন তাদের সাথে কাজে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পাশ্ববর্তী গ্রামের মেয়েদেরকে বিয়ে করে স্থায়ী হয়েছিল ওরা।

পুরো গল্প শোনার সময়টুকু স্যাম ও রেমি নিজেদের মুখের অভিব্যক্তি যতদূর সম্ভব শান্ত-স্বাভাবিক করে রাখল। গলা পরিষ্কার করল রেমি।

 ‘শুনে খারাপ লাগল। যাক, তারপরও বলব উনি সৌভাগ্যবান। এখনও জীবিত রয়েছেন। একটু থামল ও। কীভাবে আসল প্রশ্ন করবে ঠিক করে নিচ্ছে। ওই বাক্সগুলোতে কী ছিল উনি জানেন?

নাউরুকে প্রশ্নটা করল রুবো। জবাবে নাউরু যেভাবে মাথা নাড়লেন তাতে বোঝা গেল তিনি উত্তরটা জানেন না।

‘গুহাটা কোথায়?

রুবো আবার নাউরুর দিকে ফিরল।

‘অয় ঠিক মতো জানে না। পাহাড়ের উপরে জায়গা। ভালা না।

“উনি কি নির্দিষ্ট করে জায়গাটার ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন? যাতে আমরা গুহা খুঁজে পেতে পারি? আসলে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। প্লিজ, উনাকে আরেকবার জিজ্ঞেস করে দেখুন।

রুবো অনুরোধ রাখল। কিন্তু নাউরু কোনো জবাব দিল না। মাথা নাড়ল রুবো। অরে আর না জ্বালাই আমরা। যদি পরে কইতে চায় তাইলে সব জানবার পারবেন।

 ইতস্তত করছে স্যাম ও রেমি। নাউরু যদি বাক্স আর গুহার ব্যাপারে আরও তথ্য জেনে থাকেন সেগুলো হয়তো আর কারও জানা হবে না। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো তার সাথে মাটিচাপা পড়ে যাবে।

কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। রুবো’র হাতে স্যাম ৫০ ডলার ধরিয়ে দিল। কবিরাজের জন্য…’।

ডলারগুলো পকেটে ঢোকাল রুবো। ঠিক আছে, অরে দিয়া দিমু। নিচের অংশে থাকা কুঁড়েঘরগুলোর দিকে পা বাড়াল সে।

‘রুবো এখানে দীর্ঘদিন ধরে বাস করছে। তার দুই-একটা বিষয় জানাশোনা থাকতে পারে। রেমি হাত ধরতে ধরতে স্যাম বলল।

 রুবো’র পিছু পিছু এগোল ওরা। একটু ধীরে এগোচ্ছে। স্যাম, যদি নাউরু রুবোকে গুহার ব্যাপারে তথ্য দিয়ে থাকে? রুবো যদি সেটা আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে তখন?

রুবো’র যা বয়স তাতে সে ওরকমটা করবে বলে মনে হয় না। তার কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে সে সত্যিকার অর্থেই গুহা অপছন্দ করে। রুবো রহস্যময় বাক্সগুলো খোলার চেষ্টা করতে যাবে বলে মনে হয় না। তার উপর এখন বিদ্রোহীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেইসাথে জায়ান্টসহ আরও কত কী আছে পাহাড়ে কে জানে!

‘আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু রুবো ডলার খুব পছন্দ করে। এমনও হতে পারে, অন্য কারও কাছ থেকে বেশি ডলারে গুহার তথ্য বিক্রি করে দিল।

হুম, সেটা করতে পারে। কিন্তু বিক্রিটা করবে কার কাছে? দ্বীপটাকে খেয়াল করে দেখ। কে অনুসন্ধানে নামতে যাবে? স্থানীয় লোকদের কাছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে? সব তো লবডঙ্কা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেমি। স্যাম বলল, তাহলে সবঠিক আছে? রুবোকে বিশ্বাস করা যায়?

‘স্যাম ফারগো, আপনার কথাই আমার শিরধার্য।

 ‘আহা! আমার কী সৌভাগ্য! আরও কিছু বলি তাহলে?

রেমি স্যামের রসিকতাকে পাত্তা দিল না। নাউরুর গল্প নিয়ে কথা বলতে হবে আমাদের।

রুবোকে নামিয়ে দেই, তারপর। গাড়ির কাছাকাছি এসে সতর্ক হলো স্যাম। গলা চড়াল। রুবো? আমাদেরকে পথ দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আপনি প্রস্তুত তো?

রুবো মাথা নাড়ল। চলেন, যাই গা।

দাঁত বের করে হাসল স্যাম। চলুন।

তার বাড়িতে নামিয়ে দিল তখন মধ্যদুপুর। নিজের বার্ধক্যে আক্রান্ত শরীরটাকে ধীরে ধীরে বয়ে নিয়ে গেল রুবো। তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হলো পুরো পৃথিবীর বোঝা যেন তার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

‘আজকে সবার অনেক পরিশ্রম গেল। তাকে দেখতে দেখতে বলল রেমি।

 ‘তা ঠিক।’ স্যাম সায় দিল।

 ‘বেশ। এবার আমরা কমাণ্ডার আর সেই বাক্সগুলো নিয়ে আলাপ করব।”

হ্যাঁ। পাহাড় জঙ্গলে ঢাকা। কোনো ম্যাপও আঁকা নেই। তাছাড়া যুদ্ধের সময় হয়তো পুরো এলাকা শত্রুপক্ষ চষে বেরিয়েছিল। এমনও হতে পারে বাক্সগুলো আগের জায়গায় নেই। সরিয়ে নিয়েছে কেউ। আবার এও হতে পারে, পানির নিচে থাকা ইমারতের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কোত্থেকে কীভাবে শুরু করতে পারে সে-ব্যাপারেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। এই সমস্যাগুলো না থাকলে বলতাম, গুপ্তধন আমাদের হাতের মুঠোয়!

তাহলে এখানে আমাদের কাজ শেষ?

 হেসে গিয়ার দিল স্যাম। সত্যি বলতে কেবল শুরু।

 ‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই ঝামেলা থেকে তুমি মজা পাচ্ছি।’

‘তোমার ধারণা ঠিক। কারণ, আমি চ্যালেঞ্জ পছন্দ করি।

পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাদামী নদীর দিকে তাকাল রেমি। এবড়োথেবড়ো রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে ওদের টয়োটা লম্ফঝম্ফ করে এগোচ্ছে।

‘গাড়ির লাফানো বন্ধ করো!

“আরে, এটাই তো মজা!”

.

২৯.

গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যান্ড

হাঁটতে হাঁটতে কেশে উঠল লিলি। গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া জলধারা ধরে এগোচ্ছে ও। লিলির বয়স মাত্র ১৪ বছর। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সে অসুস্থ। রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নতুন ওষুধ নিতে শুরু করেছিল কিন্তু হিতে বিপরীত হচ্ছে মনে হয়। তবে আজ একটু সুস্থ্য লাগায় ঘুরতে বেরিয়েছে।

লিলি’র গড়ন বরাবরই হালকা-পাতলা। তবে অসুখের কারণে ও এখন একদম পাটকাঠির মতো হয়ে গেছে। শরীর শুকিয়ে গেলেও ওর দেহের পরিবর্তনগুলো এখনও বোঝা যায়। শিশু আর নারীর মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছে।

হঠাৎ পেছন থেকে ডাল ভাঙার আওয়াজ ভেসে এলো। কাছে কোথাও হবে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল লিলি। কে? কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। লিলি অবাক হলো।

ক্যাডা রে ওইহানে?

 গাছের পাতার খসখসে শব্দ ছাড়া কেউ ওর প্রশ্নের জবাব দিল না।

লিলি আবার চলতে শুরু করল। কাউকে না দেখতে পেলেও উদ্বেগে ওর পেট খিচে রয়েছে। পায়ের পরিষ্কার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল ও। লিলি আবার থামল। কোমরে দুহাত রেখে ঘুরে দাঁড়াল এবার। যৌবনের রেখা ফুটতে শুরু করার পর থেকেই গ্রামের ছেলে-ছোকররা ওকে জ্বালাতে শুরু করেছে। এখন হয়তো ওদেরই কেউ আসছে পিছু পিছু। ও জানে, ছেলেগুলো যদিও কোনো ক্ষতি করবে না। স্রেফ জ্বালায়। লিলি অবশ্য এসবে পটে না, পাত্তাও দেয় না। ওর মা ওকে সাবধান করে দিয়েছে, ছেলেদের অন্তরে শয়তান থাকে। লিলি ভাল করে খেয়াল করে দেখল ওর পেছনে কেউ নেই।

‘আমি শব্দ শুনছি কইলাম। আমারে মদন বানাইতে পারবি না।’ লিলি নিজে যতটা না সাহসী তারচেয়ে সাহসী গলায় বলল কথাটা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল কিন্তু কারও দেখা নেই। ভালই ভালই চইল্যা যা কইলাম। আমি যদি তোরে ধরবার পারি তাইলে কিন্তু খবর কইর‍্যা দিমু!

নেই। কেউ নেই।

ফাইজলামি না কিন্তু। বন্ধ কর এইসব!’ বাক্যের শেষের দিকে এসে ওর কণ্ঠ একটু ভেঙে গেল। জিমি নামের এক ছেলে প্রায়ই আড়াল থেকে ওকে উপহার পাঠায়। লিলি ভাবছে এখন হয়তো জিমি আছে এখানে। বাইরে বাইরে পাত্তা না দিলেও এরকম উপহার পেতে লিলি’র অবশ্য খারাপ লাগে না।

 কারও দেখা না পেয়ে আবার চলতে শুরু করল লিলি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একজোড়া শক্ত হাত ওর মুখ চেপে ধরল পেছন থেকে। খুব জোরে চিৎকার করল লিলি কিন্তু হাতের চাপে সেটা ফাপা আওয়াজের মতো শোনাল। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করল ও। কিন্তু মাথার একপাশে আঘাত লাগতেই লিলি চুপসে গেল। বজ্রমুষ্ঠি গলায় চেপে বসে শ্বাসরোধ হওয়ার সময় সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল লিলি’র।

***

ফিরতি পথে ওর গতি খুবই ধীর। কারণ স্যাম ও রেমি’র গাড়ি একটা ভারি ট্রাকের পেছনে পড়েছে। ভক ভক করে দূর্গন্ধযুক্ত কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এগোচ্ছে ট্রাকটা। নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করে রাস্তার মাঝ দিয়ে চলছে ধীরে ধীরে। ট্রাকটাকে ওভারটেক করতে গিয়ে পিছিয়ে এলো স্যাম। বিপরীত দিক থেকে আরেকটা গাড়ি আসছে।

অবশেষে হোটেলে পৌঁছুনোর পর সেলমাকে ফোন করল স্যাম।

‘হ্যালো! কী অবস্থা? বলল সেলমা। দ্বীপে কীরকম দিন কাটছে তোমাদের?

‘এই তো চলছে। ওদিকের হালচাল কী?

‘সব স্বাভাবিক। ডেস্ট্রয়ারের ব্যাপারে সূত্র পাওয়ার জন্য বিভিন্ন রেকর্ড ঘাটছি। কিন্তু যা বুঝতে পারছি, আর কিছু পাওয়া যাবে না।

‘হতাশ হলাম। যদি কেউ বেঁচে না ফিরত তাহলে তো কেউ জানতেই পারতো না ওই ডেস্ট্রয়ারের কোনো অস্তিত্ব ছিল কখনও।

“এরকম ঘটনা আমি এরআগে কখনও দেখিনি।’

‘বেশ, যদি তোমার হাতে সময় থাকে তাহলে আমি তোমাকে আরেকটা প্রজেক্ট দেব।’

 ‘নতুন প্রজেক্ট নেয়ার জন্যই আমার বেঁচে থাকা।’ সেলমা একটু রসিকতা করল।

‘জায়ান্ট আর জাপানিজদের নিয়ে বিষয়টা।

‘ইন্টারেস্টিং! বলে ফেলো।

স্যাম আপনমনে হাসল একটু। এরআগে বোধহয় এটা নিয়ে একটু বলেছিলাম তোমাকে। তবে এবার আমি সিরিয়াস। এখানার পাহাড়ে গুহা আছে আর সেখানে নাকি জায়ান্টরা থাকে। মাঝেমাঝে বেখেয়ালী লোকজনদের ধরে নিয়ে যায় জায়ান্টরা।

তারপর,

‘জানি, শুনতে হাস্যকর লাগছে কিন্তু এই লোককাহিনিটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে অন্য কারণে। আমি পাহাড়ের গুহাগুলোর প্রতি আগ্রহী।

‘খুলে বল।

‘আমি এখানকার গুহাগুলোর একটা ম্যাপ চাই। জানি, জিনিসটা পাওয়া খুবই কঠিন। ম্যাপ না হোক একটা বর্ণনা হলেও চলবে। জায়ান্টদের গুহা দেখার খায়েশ জেগেছে আমার।

‘আচ্ছা। তাহলে সবমিলিয়ে বিষয়বস্তু মোট তিনটা। জায়ান্ট, গুহা আর জাপানিজ?’

‘হ্যাঁ। আমি চাই এসব নিয়ে তুমি খোঁজ-খবর করে যত বেশি সম্ভব তথ্য যোগাড় করে আমাকে জানাও। আর খোঁজ নিয়ে দেখো, শেষের দিকে জাপানিরা এই দ্বীপে কী কী করেছিল।’

‘জাপানিরা শেষের দিকে দ্বীপ থেকে পালিয়েছিল। ওটা তো আমরা একবার রিসার্চ করেছি, তাই না?

করেছ। কিন্তু আমি অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাপানিদের কাজকর্মের পুরো বিবরণ খুঁজছি।’

নাউরু’র কথাগুলো জানাল স্যাম। দাস বানিয়ে রাখা, গোপন গবেষণা এসবের কোনো উল্লেখ ইতিহাসের কোথাও আছে কিনা জানতে চাই। কিংবা কোনো গুজব। কোনোকিছুই যেন বাদ না পড়ে। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। নাউরুর অবস্থা আশংকাজনক। যেকোনো সময় সে পরকালের ট্রেনে চড়ে বসবে। তার কাছ থেকে হয়তো আর কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব হবে না।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সেলমা। তারপর বলল, কমাণ্ডারের নাম যেন কী বললে?

‘এখনও বলিনি। কেন?

হয়তো তেমন কিছুই না। কিন্তু গোয়াডালক্যানেলে এক কর্নেল…’

বলো, সেলমা…’

‘ডুবে যাওয়া ডেস্ট্রয়ার থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে রিসার্চ করার সময় দেখলাম ওখানে একজন উঁচু পদের অফিসারও আছে। আর্মি। দাঁড়াও, চেক করে দেখি। সম্ভবত কর্নেল হবে।’

কি-বোর্ডে ক্লিক করার শব্দ শুনতে পেল স্যাম।

হ্যাঁ। আমার ধারণাই ঠিক। কর্নেল। নাম: কুমাসাকা। চারজন নাবিকের সাথে তাকেও উদ্ধার করা হয়েছিল। সেলমা জানাল।

তাকে উদ্ধারের পর সেই জাহাজ সোজা টোকিও-তে চলে গিয়েছিল, ঠিক?

 ‘একদম। হতে পারে এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা…’

 হতে পারে তার কারণেই জাহাজটা ঘুরপথে যাত্রা করেছিল।

 কি-বোর্ডে খটাখট কী যেন টাইপ করল সেলাম। না, হলো না।’

কী?’

‘ইতিহাস বলছে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে নিউজিল্যান্দ্রে এক ক্যাম্পে মারা গিয়েছিল কুমাসাকা।

স্যাম খবরটাকে হজম করা পর্যন্ত সেলমা চুপ করে রইল। ‘সেলমা, এই লোক সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করো। সেটা যত গুরুতুহীনই হোক না কেন। সার্ভিস রেকর্ড, পরিবার, শিক্ষা, কাজ.. সব।

“ঠিক আছে, করব। কিন্তু ডেস্ট্রয়ারের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়েই তো তথ্যের অভাবে ভুগছি। এই কর্নেলের ব্যাপারে কতদূর কী হবে কে জানে।

নিজের সেরাটা দিয়ে।

‘দেব।’ সেলমা একটু থামল। আচ্ছা, ল্যাজলোকে কাজে লাগাতে পারব এরকম কোনো খবর আছে তোমার কাছে? লোকটা আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। কয়েকদিন পর পর এসে ছোঁক ছোঁক করে। লোকটাকে কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখা দরকার।’

‘তোমার যদি মনে হয় কুমাসাকা’র ব্যাপারে সে সাহায্য করতে পারবে তাহলে তাকেও কাজে লাগিয়ে দাও।

না। তাকে কঠিন কিছু দিতে হবে। কোনো পাজল কিংবা ধাঁধা। জটি কিছু।’

না, সেরকম কিছু নেই। তবে বিষয়টা মাথায় রাখলাম। লাওস থেকে ফিরে আসার পরেই তার এই হাল হয়েছে?

হ্যাঁ। তবে নতুন একটা প্রজেক্টের পেছনে ইতিমধ্যে মাথা খাটাতে শুরু করেছে সে।’

কী সেটা?

 ‘জলদস্যুদের গুপ্তধন!

মশকরা করলে নাকি, সেলমা?’

 ‘কেন, আমার কণ্ঠ শুনে তাই মনে হচ্ছে নাকি?

 স্যাম একটু থেমে নিরাপদ কথা বেছে নিল। “ঠিক আছে, আমি তাকে ফোন দেব। আর তুমি কর্নেলের ব্যাপারে কী কী জানতে পারলে জানিয়ো।

“ঠিক আছে।

ফোন রাখল স্যাম। এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ও। স্লাইড ডোর ঠেলে রেমি বারান্দায় ঢুকল। কে? সেলমা নাকি লিও?”

‘সেলমা। কিন্তু ভাল কোনো খবর নেই।’

‘কেউ যদি আমাদেরকে তথ্যগুলো যোগাড় করে দিতে পারে সেই ব্যক্তি হলো সেলমা। এ ছাড়া আমাদেরকে কেউ এভাবে সাহায্য করতে পারবে। প্রার্থনা করি ও যেন সফল হয়।

স্ত্রীকে চুমো খেল স্যাম। সুন্দর বলেছ।

 ‘সেলমা কি কাজে নেমে গেছে?

হুম।

সন্ধ্যায় লিও-কে ফোন করল স্যাম। লিও ডারউইনে রয়েছে।

 ‘বন্ধু, কী অবস্থা তোমাদের?’ স্যাম জানতে চাইল।

এখান থেকে সরতে পারলে বাঁচি। আর ভাল লাগে না।

 ‘আমার কথামতো ডাইভ দেয়ার চেষ্টা করেছিলে?

‘আমি তোমার খেলার পুতুল হব কেন?”

 ‘আচ্ছা বাদ দাও। অভিযান কেমন চলছে?

‘ডাইভাররা কাজ করছে। কিন্তু পুরো কমপ্লেক্স পরিষ্কার করতে কয়েক বছর লেগে যাবে। স্রেফ প্রধান ভবন পরিষ্কার করতেই লাগবে কয়েক সপ্তাহ।

কুমীর কিংবা হাঙরের দেখা পেয়েছ?

লিও এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। আরও বড় জাহাজ আনলে সেখানে অনেক বেশি যন্ত্রপাতি থাকতো। কাজ করতে সুবিধে হতো তখন।

‘দেখছি বিষয়টা। কিন্তু ডারউইনে কী সমস্যা?

‘সমস্যা নেই। কিন্তু তোক বেশি হলে কাজ দ্রুত হতো। বাকি জীবনে এখানে কাটানোর কোনো ইচ্ছা নেই আমার।

বুঝলাম। আমরা পৃথিবীর অন্যতম বিচ্ছিন্ন জায়গায় আছি এখন। বড় জাহাজের ব্যবস্থা করে হাজির করতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। তবুও দেখছি। স্যাম হাসল। লিও এই আবিষ্কারের ফলে তুমি তো জাতীয় হিরো হয়ে যাবে! হয়তো তোমার নামে এখানকার সৈকতের নামকরণ করে ফেলবে সরকার! কিছু প্ল্যান করে রাখো।’

বাদ দাও। আমার সত্যি সত্যি সি-সিকনেস হচ্ছে।

বলো কী, বন্ধু। তুমি একজন রাশিয়ান নাগরিক। তোমার রক্তে আছে বিখ্যাত যযাদ্ধাদের রক্ত। তুমি কেন এত দূর্বল হবে?

 ‘আমার পূর্বপুরুষরা সবাই কৃষক ছিল। বরফ ঢাকায় এলাকায় থাকতো তারা। আর জানোই তো বরফ পানির কাছে এলে গলে যায়।

আরও দু’একটা কথা বলে ফোন রাখল স্যাম। চার্জে দিল ফোনটা। রেমি বিছানায় বসে ট্যাবে ইন্টারনেট চালাচ্ছে। স্যামের দিকে তাকাল রেমি।

কী অবস্থা লিও’র?’

বলল এই জাহাজ পছন্দ হচ্ছে না। আরও বড় জাহাজ চায়।

 ‘ওর মুড কি বরাবরের মতো তিক্ত ছিল?

না, এখন একটু ভাল।

হাসল রেমি। আরও বড় জাহাজ আনার আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ নয়।

‘আমি জানি সেটা। তুমি তো ইন্টারনেটে ঢুকেছ। দেখো তো, বড় জাহাজ চেয়ে সেলমাকে একটা ই-মেইল পাঠাতে পারে কিনা।

চটপট ই-মেইল করে দিল রেমি। ক্ষুধা লেগেছে?

 ‘তা আর বলতে।

‘হোটেলের রেস্টুরেন্টে যাওয়া যায়?

আমি ভাবছিলাম, গতরাতে যেখানে ডিনার করেছিলাম সেখানে যাব।’

‘নিরাপদ হবে?’

নিরাপদ না হওয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না। এখান থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে। আর একটু বিপদ হলেই বা কি…?

স্বামী’র দিকে চোখ গরম করে তাকাল রেমি। দেখো, যদি কিছু হয় আমি কিন্তু জোরে চিৎকার করব।

‘এটা তো ভাবিনি!”

রাস্তায় কিছু কুকুর ছাড়া আর কেউ নেই। রেস্টুরেন্টের পার্কিং লটে ঢুকল ফারগো দম্পতি। ওখানে মাত্র ৩ টা গাড়ি পার্ক করা আছে।

কী করছ জানো বোধহয়?’ ভ্রূ কুঁচকে বলল রেমি।

‘এত দুঃচিন্তা করে যদি থেমে যাই তাহলে তো জীবনে আর কোথাও কোনোদিন যাওয়াই হবে না।’

ভেতরে ঢোকার পর ওয়েটার ওদের দিকে এমনভাবে তাকাল ওরা যেন স্পেসশীপ থেকে নেমে আসা এলিয়েন! অবশ্য পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে।

‘আপনাগো যেখানে বইতে মন চায় বহেন।’ আঞ্চলিক ভাষায় বলল ওয়েটার।

টাটকা সামুদ্রিক খাবার দিয়ে ডিনার সেরে আবার পার্কিং লটের দিকে এগোলো ওরা। হালকা বাতাস বইছে এখন। গাড়ির কাছে আসতেই দাঁতে দাঁত চেপে স্যাম অভিশাপ দিল।

কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল রেমি।

টায়ার পাংচার।

বল কি!?

২০ মিনিট পর ঘেমে নেয়ে উঠল স্যাম। অতিরিক্ত একটা চাকা ছিল সেটা জুড়ে দিয়েছে।

কপাল ভাল গ্রামের রাস্তায় এই কাণ্ড হয়নি। কাদার মধ্যে টায়ার বদলানোর কথা ভাবাও যায় না। রেমি বলল।

‘ঠিক বলেছ। এবার উঠে পড়ো।

গাড়ি উঠতে উঠতে রেমি বলল, ‘তোমাকে গোসল করতে হবে।’

তাই তো মনে হচ্ছে।’

ওদেরকে ঢুকতে দেখে সৌজন্য হাসি দিল সিকিউরিটি গার্ড। ডেস্ক ক্লার্কও মাপা হাসি হাসল।

‘লাইটে সমস্যা হয়েছে বোধহয়। হলওয়ে অন্ধকার দেখে বলল স্যাম।

মনে হয় পুরানো হয়ে গেছে।’

 রুমের কাছাকাছি এসে স্যামকে হাত দিয়ে বাধা দিল রেমি। মাথা নেড়ে কান পেতে কী যেন শুনল। তারপর ফিসফিস করে বলল স্বামীকে, যাওয়ার সময় দরজা বন্ধ করে গিয়েছিলে না?

হা, গিয়েছিলাম।’

রেমি কয়েক সেকেণ্ড কিছু বলল না। তাহলে তো ঝামেলা হয়ে গেছে। দেখো, দরজা এখন খোলা।

.

৩০.

দরজার কিনারা ঘেষে এগোল স্যাম। আর এক পা এগোলে রুমে ঢুকতে পারবে এমন সময় একটা অবয়ব উল্কার বেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

‘পুলিশকে খবর দাও!’ চোরের পেছনে ছুটতে ছুটতে রেমিকে বলল স্যাম। দৌড়ে করিডর পেরিয়ে হোটেলের বাইরের দরজার কাছে গিয়ে স্যাম গতি কমাল।

পার্কিং লটের উপর চোখ বোলাতে গিয়ে চোরকে দেখতে পেল স্যাম। রাস্তা পেরিয়ে পালাচ্ছে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে স্যাম দূরত্বটুকু অতিক্রম করে ফেললেও চোরও কম যায় না। স্যামের সাথে চোরের দূরত্ব কমেনি। চোরের উপর নজর রেখে ও ছুটছে হঠাৎ পাশের গলি থেকে একটা সাইকেল এসে ওর বাঁ পাশে এসে ধাক্কা খেল। ব্যথায় জ্বলে গেল অংশটুকু।

সংঘর্ষের স্যাম রাস্তায় পড়ে গেছে। সাইকেলে কে ছিল সেটা ও দেখতে পেল না। কারণ সাইকেলে কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই।

 ধাক্কা সামলে নিজেকে দাঁড় করাল স্যাম। সাইকেল আরোহীও উঠে দাঁড়িয়েছে সাইকেল নিয়ে। স্যামের হাঁটু দপদপ করছে। কিন্তু ভাগ্য ভাল বলতে হবে, ওর পা সম্পূর্ণ অক্ষত আছে, কোথাও ভাঙেনি।

তবে দূরে চলে যাচ্ছে চোরটা।

 স্যাম ছুটল। ছুটতে ছুটতে খেয়াল করে দেখল এখানে আশেপাশে লুকিয়ে পড়ার মতো কোনো জায়গা বা আড়াল নেই। রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে দেখল একটা সরু গলি, গলিতে ছোট ছোট দোকানও আছে।

একটা ছুটন্ত অবয়ব দেখার জন্য চারপাশে চোখ বুলাল স্যাম। দূরের একটা কোণা থেকে ধাতব শব্দ ভেসে এলো। চোখের পলকে সেখানে পৌঁছে গেল ও।

ময়লার ক্যান নিয়ে হুটোপুঁটি করছে একটা সাদা-কালো বিড়াল। এই বিড়ালটাই ধাতব শব্দটির জন্মদাতা। স্যামের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাল প্রাণীটা। কাজের সময় অপরিচিত ব্যক্তির উপস্থিতিতে সে অসন্তুষ্ট, বিব্রত।

কোনো ছুটন্ত পায়ের শব্দ শোনার আশায় কান পেতে রইল স্যাম। কিন্তু কিছুই শুনতে পেল না। এই এলাকায় এখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একদম জনমানবশূন্য মনে হচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ রাস্তার এমাথায়-ওমাথায় চাওয়া চাওয়ি করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্যাম।

চোর পালিয়েছে।

অগত্যা স্যাম হোটেলে ফেরার পথ ধরল। হোটেলের সামনে পুলিশের দুটো গাড়ি দাঁড় করানো আছে। নীল-লাল রঙের লাইট বিচ্ছুরিত হচ্ছে ওগুলো থেকে। শূন্য লবি পার হয়ে রুমের দিকে এগোল স্যাম।

 রুমের বাইরে, দরজার পাশে রেমি দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। স্যামকে দেখতে পেয়ে একটা প্রু তুলে প্রশ্ন করল…

কী অবস্থা?

 ‘ভাল না। পালিয়েছে।

মাথা নেড়ে রুমের ভেতরে তাকাল রেমি। দুই অফিসার রুমের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করছে। ছবি তোলার পাশাপাশি নোটবুকে কী যেন নোট নিচ্ছে খাটো অফিসার! বাথরুমের দরজা খোলা, কাপড় রাখার ক্লোজেট খোলা, সব কাপড় চোপড় এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মেঝেতে ও বিছানায়। অসন্তুষ্টি নিয়ে রেমিকে নিয়ে হলের দিকে পা বাড়াল স্যাম! ডেস্ক ক্লার্ক ও রাতের ম্যানেজার একটু ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে।

ম্যানেজার সামনে এগিয়ে এলো। বিব্রত।

‘আমি খুবই দুঃখিত, স্যার। দয়া করে মাফ করবেন। এরকম ঘটনা এই হোটেলে এরআগে কখনও হয়নি।’

 ‘সবই আমাদের কপাল, বলল রেমি। এখানে আসার পর থেকে আমাদের সাথে এরকমই হচ্ছে।

 প্রায় দেড়ঘণ্টা তদন্ত শেষে দুই পুলিশ অফিসার আবিষ্কার করল রুমে থাকা সেটা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, রেমির ট্যাবলেটটাও চুরি গেছে তবে ওদের পাসপোট দুটো আছে এখনও। অতঃপর রুমে ঢোকার অনুমতি পেল ফারগো দম্পতি। স্যাম দেখল ওর স্যাটেলাইট ফোনটা এখনও টেবিলে চার্জ হচ্ছে। রেমিও দেখল বিষয়টা। অফিসারদের দিকে ঘুরল স্যাম।

‘স্যাট ফোর চুরি হয়নি। বিষয়টা অদ্ভুত নয়?’

লম্বা অফিসার বলল, “হয়তো ওদের মনে ভয় ছিল ফোনটাকে হয়তো ট্র্যাক করা সম্ভব।

আর পাসপোর্ট?

 ‘ওগুলো দিয়ে ওরা এই আইল্যাণ্ডে কী করবে?

 ‘বিক্রি করতে পারতো না?”

‘আপনাদের পাসপোর্ট কে কিনতে যাবে?

সত্যি বলতে, গোয়াডালক্যানেলে চুরি হয়ে যাওয়া জিনিস কেনাবেচা করার মতো কোনো মার্কেট নেই। তাই স্যামের প্রশ্ন শুনে পুলিশ অফিসার কিছুটা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়েছে। স্যাম আর কথা বাড়াল না।

দুই অফিসারের রিপোর্ট লেখা প্রায় শেষ। তারা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এমনসময় রেমি লম্বা অফিসারকে বলল, এখানকার সিকিউরিটি ক্যামেরায় হয়তো কিছু ধরা পড়েছে?

একজন পর্যটকের মুখ থেকে এরকম বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ শুনে অফিসার দু’জন একটু আশ্চর্য হলো। মাথা নেড়ে সায় দিল তারা। ম্যানেজারের সাথে আমরা এ-ব্যাপারে কথা বলব।’ শেষবারের মতো রুমের দিকে তাকাল লম্বা অফিসার। মাথা নেড়ে বলল, এখানে যা হয়েছে সেটার জন্য আমরা লজ্জিত। তবে আমরা বিষয়টা খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। আশা করি, আপনাদের যা খোয়া গেছে সেগুলো উদ্ধার করতে পারব। সলোমন আইল্যাণ্ডে আপনাদের ভ্রমণ তিক্ত হওয়ায় আমি দুঃখিত।’ অফিসারের বলার ধরন দেখে মনে হলো এই অঘটনের জন্য সে নিজেকেই দায়ী ভাবছে।

‘আপনাদের উপর আমার ভরসা আছে।’ বলল স্যাম।

 দুই অফিসারের সাথে ফ্রন্ট ডেকে গেল স্যাম ও রেমি। ক্লার্কের পেছনে মুখ ব্যাদান করে ম্যানেজার বসে আছে। পুলিশ যখন ম্যানেজারকে সিকিউরিটি ক্যামেরার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল তার নজর তখন নিজের জুতোর দিকে। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে জুতো জোড়া। তারপর ধীরে ধীরে বলল…

গত সপ্তাহ থেকে সিকিউরিটি ক্যামেরা সিস্টেম অকেজো হয়ে রয়েছে।

কী?’ চড়া গলায় বলল রেমি।

 ‘কী আর বলব। প্রায় ২০ বছর পুরানো ছিল ওগুলো। নষ্ট হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

‘এটা কোনো কথা! মশকরা করছেন?

 ‘আমি দুঃখিত, ম্যাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন, যা বলছি সব সত্যি।

স্ত্রীর হাত ধরল স্যাম। কিছুক্ষণ পর রেমি একটু শান্ত হলো।

যা-ই হোক, আমাদের রুমটা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করুন। স্যাম বলল। আশা করছি, আমাদেরকে আপাতত অন্য একটা রুমের বন্দোবস্ত করে দিতে পারবেন।

 ‘অবশ্যই, স্যার। তৈরি হয়ে আমাকে জানাবেন। আমি আপনাদেরকে নতুন রুমে নিয়ে যাব।’

রুমের একদম কাছাকাছি গিয়ে নিচু স্বরে বলল রেমি, ‘আমি যা ভাবছি, তুমিও কি তা ভাবছ?

কী? এই চুরির ব্যাপারে?

না। এটা কোনো সাধারণ চুরি নয়।’

রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল স্যাম। এখানে হয়তো এখন পর্যটক হিসেবে একমাত্র আমরাই আছি এবং সবেচেয় ভাল রুমে আছি। তবে কাজটা হয়তো হোটেলের ভেতরের কেউ করতে পারে। কিন্তু এই চুরিতে বাড়তি কী আছে বুঝলাম না। বুঝিয়ে বললো।

ক্যামেরা কাজ না করাতে চোরের খুব সুবিধে হলো।

 ‘আমার মনে হচ্ছে, এখানকার ক্যামেরাগুলো কয়েক বছর ধরে অকেজো।’

সেফের দিকে এগোল রেমি। যে-ই কাজটা করে থাকুক, একদম প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। দেখো, তালা ভেঙে ফেলেছে।

সায় দিয়ে স্যাম মাথা নাড়ল। ঠিক। কিন্তু খেয়াল করে দেখ এই তালা টিনফয়েল দিয়ে তৈরি। চোরের যদি অন্যান্য হোটেলে যদি চুরি করার অভিজ্ঞতা থেকে থাকে তাহলে এগুলোর এরকম বেহাল দশা সম্পর্কে সে খুব ভাল করেই জানে। আমার তো মনে হচ্ছে পেপসি খোলর ওপেনার দিয়ে আমি এই তালা ভাঙতে পারব।’

ঘড়ি দেখল রেমি। খুব বেশি রাত হয়নি এখনও। চোর জানতে, আমরা ডিনার করতে বাইরে বেরিয়েছি।’ একটু থামল ও। আবার দেখ, গাড়ির টায়ায় পাংচার করে দিয়ে দেরি করিয়ে দেয়া হলো আমাদের। এই বিষয়টাও কি কাকতালীয়?’

 ‘বোধহয় না। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতেও পারছি না। একটা শার্ট তুলে নিয়ে ভাঁজ করল স্যাম। তোমার ট্যাবলেটে কী ছিল? লিও’র অনুসন্ধান সম্পর্কিত কিছু? পাসওয়ার্ড ব্যাংকের তথ্য?

‘মোটেও না।’

তাহলে চোর ওটাতে থেকে পাবে কী? সেফে অল্প কিছু টাকা রেখে গিয়েছিলাম। মানিব্যাগটা আমার পকেটেই ছিল। তোমার পার্সও ছিল তোমার সাথে। একটা ট্যাবলেটের দাম আর কত? চাইলেই কিনে নেয়া যায়। ক্রেডিট কার্ড নিতে পারেনি, স্পর্শকাতর তথ্যও পেল না, পাসপোর্টটাও রেখে গেছে। কাঁচা চোর। তবে আমার মনে হয়, এরসাথে ওই রাতে বিচের দু’জনের কোনো সম্পর্ক আছে।

‘তাই? তাহলে বলল, চোর ভেতরে ঢুকল কীভাবে?

 ‘তুমি এই রুমে ঘুমের ঘোরের মাঝেও ঢুকতে পারবে।

 ‘স্যাম, রুমে কিন্তু কার্ড কি দিয়ে ঢুকতে হয়।”

“হুম, কিন্তু সিস্টেমটা খেয়াল করে দেখেছ? খুব উন্নত মানের সিস্টেম যখন দায়সরাভাবে স্থাপন করা হয় তখন এরকমই হয়। জঘন্য।’

‘তো?’

ভাবছি, এটা যদি চুরির চেয়েও বেশি কিছু হয়ে থাকে তাহলে কী সেটা? চোর কী পেয়েছে এখান থেকে? শুধু তোমার শখের ট্যাবলেটটা ছাড়া তেমন কিছুই নিতে পারেনি। আমরা বরং এসব নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করি। চোখ কান খোলা রেখে নিজেদের কাজে মনোযোগ দেই। সবদিক থেকে সেটাই ভাল হবে। তুমি কী বলে?

এক সেকেণ্ডের জন্য চোখ বন্ধ করল রেমি। তা ঠিক আছে। কিন্তু… আমি আর নিরাপদবোধ করছি না।’

‘সেটাই স্বাভাবিক। আমারও একই অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। এখন আর সেটা নিয়ে ভেবে কাজ নেই।

স্যাম ডেস্কে ডায়াল করে ক্লার্ককে বলল, ওরা তৈরি। একটু পর হাজির হলো ম্যানেজার। ওদেরকে হোটেলের অন্যপাশের একটা রুমে নিয়ে গেল সে। আরেকবার ক্ষমা চেয়ে চুপচাপ বিদেয় নিল। কাপড়-চোপড় গুছিয়ে স্যামের দিকে ফিরল রেমি।

‘চোরের চেহারা দেখতে পেয়েছিলে?’

‘না। তবে যতটুকু দেখতে পেয়েছি ততটুকু জানিয়েছি পুলিশকে। স্থানীয় বাসিন্দা, মাঝারি স্বাস্থ্য, দ্রুত নড়তে জানে। কালো হাফপ্যান্ট আর পোলা’র চেক শার্ট পরা ছিল। সাথে ম্যাসেঞ্জার ব্যাগ। এই তো…’

 ‘এই সময় বাইরে খুব বেশি লোক নেই। ভাগ্য ভাল হলে পুলিশ হয়তো তাকে বের করতে পারবে।’

 ছোট্ট করে হাসল স্যাম। সবকিছুই সম্ভব। কিন্তু আমি ভাবছি আগামীকাল সকালে তোমাকে একটা নতুন ট্যাবলেট কিনে দেব।

‘এখানে ট্যাবলেট পাওয়া খুব একটা সহজ হবে না।’

‘গতকাল একটা ইলেকট্রনিক্স শপ দেখেছি। ওখানে হয়তো পেয়ে যাব। গর্জিয়াস কিছু না পেলেও মোটামুটি কাজ চালানোর মতো ট্যাবলেট পাব বলে আশা করছি।’

‘অল্পের উপর দিয়ে বিপদ কেটে গেছে। আরও জঘন্য কিছু ঘটতে পারতো।

‘ঠিক।’ স্ত্রীর দিকে তাকাল স্যাম। আজ রাতে তোমার ঘুম আসবে তো?”

‘অবশ্যই আসবে। আমার দেখভাল করার জন্য একজন শক্ত-সমর্থ পুরুষ আছে। ঘুম আসবে না কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *