২১. অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিতে

২১.

স্যাম পা দিয়ে অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিতেই ইঞ্জিন গর্জে উঠল। ভিড় পাকানো লোকজন সরে গেল দুপাশে। অনবরত হর্ন বাজিয়ে স্যাম তাদেরকে সর্তক করল। লোকজনের ভীড় এড়িয়ে এগোল গাড়ি।

 ‘সাবধানে!’ সিটের হাতল চেপে ধরে বলল রেমি। একলোকের হাতে একটা বেজবল ব্যাট ছিল। অল্পের জন্য স্যাম সেটার আঘাত থেকে বাঁচাল গাড়িকে।

‘দেখেছ? কোনো সমস্যা নেই। স্যাম মুখে বলল ঠিকই কিন্তু কণ্ঠ শুনে ঠিকই বোঝা গেল ও নার্ভাস।

 ‘অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি, স্যাম। মনে হচ্ছে, এখানকার সবাই আমাদেরকে এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে।

‘বাজে কথা। তবে শিপে একরাত কাটালে মন্দ হয় না। এখানকার পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি আর এরকম দৌড়াদৌড়ি করতে রাজি নই।’

‘আর যদি শান্ত না হয়?

 ‘তাহলে হয়তো আমাদেরকে আরও একটা শিপ যোগাড় করতে হবে।’

পুলিশের প্রথম রোডব্লক উদয় হলো। গতকালের চেয়ে আজ তাদের আয়োজন আরও ব্যাপক। অফিসারের সংখ্যা বেশি, সবার পরনে দাঙ্গার পোশাক। সার্চ শেষে স্যাম অফিসারকে জানাল ওরা পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। শুনে অফিসার এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন স্যাম ও রেমিকে আর কখনও দেখতে পাবে না।

পরের রোডব্লকটাও একই রকম। স্যাম খেয়াল করে দেখল, প্রত্যেকটা রোডব্লকে শুধু ওদের গাড়িটাই আছে।

‘একদম জনশূন্য হয়ে গেছে, তাই না?’ স্যামের মনের কথা বুঝতে পেরে বলল রেমি।

‘মনে হচ্ছে কারও ড্রাইভ করার মুড নেই।’

‘গৃহযুদ্ধের মাঝে কেউ পড়তে চাচ্ছে না।

হতে পারে। কিন্তু গাড়ি চালানোর জন্য আজকের সকালটা কিন্তু দারুণ। স্যাম বলল। রেমি খেয়াল করল জঙ্গলের পাশ দিয়ে এগোনোর সময় গাড়ির গতি অনেক বেড়ে গেছে।

পোর্টে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে রেডিওতে ডেস-এর সাথে যোগাযোগ করল স্যাম। কিছুক্ষণ পর তরতর করে পানি কেটে ডারউইন-এর স্কিফ এসে গেল। পাইলটের আসনে রয়েছে সিমস।

‘শুভ সকাল। দিনটা সুন্দর, তাই না?’ সিমস বলল।

 ‘চমৎকার।’ সায় দিল রেমি। স্বামীর সাহায্য নিয়ে স্কিফে চড়ল।

নতুন কোনো খবর আছে?’ স্কিফে চড়ে জানতে চাইল স্যাম।

সিমস স্কিফকে ঘুরিয়ে শিপের দিকে নিল। না। গতকালের মতোই চলছে সব। আপনাদের টিমের লিওনিড সবকিছু তদারকি করছেন।

কিছুক্ষণ পর ডারউইন-এর কাছে পৌঁছে গেল ওরা। দু’জন ক্রু শিপের ডেক থেকে হোস পাইপ নিয়ে কাজ করছে। পানির নিচে থাকা ডাইভারদের সাথে শ্বাস-প্রশ্বাসে যেন কোনো সমস্যা না হয় সেদিকটা দেখছে তারা।

শিপে ওঠার পর ডেস-এর সাথে দেখা হলো।

‘আপনাদেরকে দেখে ভাল লাগল!’ বলল ডেস। দ্বীপের উত্তেজনাময় পরিস্থিতির খবর শুনলাম রেডিওতে।

‘ঠিকই শুনেছেন। আমাদেরকে কমপক্ষে একটা রাত এই শিপে কাটাতে হবে।’ বলল স্যাম। লিওর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী অবস্থা, বন্ধু?

মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়ল লিও। কাজ এগোচ্ছে, বোঝা গেল কাজ নিয়ে সে খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। ওকে নিয়ে পাইলটহাউজের দিকে এগোল স্যাম। বিস্তারিত জানবে।

‘চলো তো দেখি…’ বলল স্যাম।

মনিটরে দেখা গেল গতকালের পর আজ আরও বেশ কয়েকটি নতুন পাথুরে ব্লক পরিষ্কার করা হয়েছে। ইমারতে শেষ অংশে কাজ করছে ডাইভাররা। বুদবুদ আর জঞ্জালের মেঘ ভাসছে পানিতে।

অনেকখানি পরিষ্কার করে ফেলেছে, রেমি বলল। ব্লকের সাইজগুলো দেখেছ? এগুলো পর্যবেক্ষণ করে পাড়ে নিতে হলে কয়েক বছর লেগে যাবে।

 ‘ভিত্তির কিছু অংশও পরিষ্কার করেছি। দেখে মনে হয়েছে, দ্বীপ থেকে বড় ও ছোট পাথর এনে সেগুলোর সমন্বয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল এটা। আমার ধারণা, যখন এগুলোর নির্মাণ কাজ চলছিল তখন এখানে পানির গভীরতা ১৫ ফুটের বেশি ছিল না।’ বলল লিও।

 ‘তাহলে তো তখন ঝুঁকি ছিল না বললেই চলে। স্যাম মনিটরের দিকে তাকাল। এবার ভাব, কত বড় ভূমিকম্প হলে ইমারতগুলোকে প্রায় ৮০ ফুট নিচে নামানো সম্ভব?

ভূম্পিকম্পের প্রথম ধাক্কায় পুরো স্তর সরে গিয়েছিল। তারপর ছোট ছোট ধাক্কায় একদম সাগরের তলায় গিয়ে পৌঁছেছে। পুরোটাকে অনুসন্ধান করার জন্য আরও সময় পেলে তখন বিস্তারিত জানা যাবে।’

 স্যাম দাঁত বের করে হাসল। তা তো অবশ্যই। ধৈর্যধারণ করা মহৎ গুণ, বুঝেছ? এসব ক্ষেত্রে কোনো কিছুই দ্রুত হয় না। আর তুমি সেটা বেশ ভাল করেই জানো।

মুখ হাঁড়ি করল লিও। জানি এবং জিনিসটা আমার খুবই অপছন্দ। তোমাদেরকে কি বলেছি আমার সি-সিকনেস হচ্ছে?

না, এখনও বলোনি।

 ‘আমি নিজেই জানতাম না। গতকাল রাতে ঘুমানো চেষ্টা করতে গিয়ে টের পেলাম।’

 কাশি দিল ডেস। রেমি হেসে ফেলল। স্যাম অনেক চেষ্টা করে নিজের হাসি থামিয়ে রেখে বলল, যদি তুমি ডাইভ দাও তাহলে এই সি-সিকনেসের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে। তারপর দেখা যাবে, বাচ্চাদের মতো সুন্দর ঘুম হচ্ছে তোমার।’

‘মিথ্যা বলছো না তো?

না, না! একদম সত্যি। সিরিয়াসভাবে বলল স্যাম। ওর চেহারা যেন পাথরে গড়া।

পাইলটহাউজে থাকা স্পিকার জ্যান্ত হয়ে উঠল হঠাৎ। অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণে কথা বলছে…

ক্যাপ্টেন, আপনি ওখানে আছেন?’ ডাইভ টিমের লিডার কেট ওয়ারেন জানতে চাইল।

মাইক্রোফোনের দিকে এগোল ডেস। মুখের কাছে নিয়ে বল, হ্যাঁ, কেন্ট। বলো, কী অবস্থা?

‘আপনি হয়তো এটা এখনও দেখেননি, কিন্তু আমরা এমন কিছু পরিষ্কার করেছি যেটা টিমের প্রধানদের মধ্যে থেকে কেউ এসে দেখলে ভাল হতো।

এক ভ্রূ উঁচু করে ডেস-এর দিকে তাকাল স্যাম।

ওয়ারেন ইতস্তত করছে। আমার ভুলও হতে পারে কিন্তু মনে হচ্ছে এটা একটা প্রবেশ পথ। থামল সে। এরপর সে যা বলল সেটা শুনে ধাক্কা খেল পাইলটহাউজের সবাই। আর আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে সম্প্রতি এই পথটাকে ব্যবহার করা হয়েছে।

.

২২.

অক্সিজেন মাস্ক পরে নিল স্যাম। রেমি’র দিকে তাকাল। ওয়েট স্যুট রয়েছে রেমি’র পরনে। দারুণ মানিয়েছে তোমাকে। স্ত্রীর ফিগারের প্রশংসা করল স্যাম।

 ‘উঁহু, অনেক ঢোলা মনে হচ্ছে, তবে আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব। তুমি তৈরি?

তৈরি হয়েই আমার জন্ম!

‘চাপা কম মারো।’ রেমি নিজের রেগুলেটর পরিষ্কার করে পানিতে ডাইভ দিল। স্যামও নামল ওর পিছু পিছু।

পানির নিচে গিয়ে রেমি’র দিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সংকেত দিল স্যাম। একইভাবে রেমিও সংকেত দিল। সব ঠিক আছে। স্যাম ডান দিকে তাকিয়ে ওদিকে যাওয়ার জন্য ইশারা করল। মাথা নেড়ে তাতে সায় দিল রেমি। কয়েক মিনিট পর ওয়ারেন ও তার ডাইভ সহযোগীর সাথে গিয়ে যোগ দিল ওরা। ওদের পরনে কমার্শিয়াল ডাইভিং সট ও কিরবি মরগ্যান হেলমেট রয়েছে। দেয়ালে থাকা একটা ফাঁক দেখাল ওয়ারেন। স্যাম ওদিকে সাঁতরে এগোল।

গ্লোভ পরিহিত হাতে ফাঁকের কিনারা পরীক্ষা করল স্যাম, বৃত্তাকার দাগ দেখা যাচ্ছে। ওয়ারেনের কাছে ফিরে এলো ও। দাগের দিকে ইঙ্গিত করল। ওয়ারেন সংকেত দিল না। অর্থাৎ দাগটা ওরা তৈরি করেনি।

রেমি ও গ্রেগ টরেস রয়েছে ওদের পাশে। ডাইভ ব্যাগ থেকে একটা ফ্ল্যাশলাইট বের করে সুইচ অন করল স্যাম। রেমিও একটা ফ্ল্যাশলাইট বের করে জ্বালাল। গ্রেগ নিজের হাতঘড়িতে টোকা মেরে উপরের দিকে ইশারা করে দেখাল। অর্থাৎ, ওর অক্সিজেন শেষের দিকে ডিকম্প্রেশনের জন্য উপরে যেতে হবে। স্যাম ওকে সংকেত দিল: ঠিক আছে। সংকেত পেয়ে যাত্রা শুরু করল গ্রেগ।

 স্যাম সেই ফাঁকা অংশের দিকে মনোযোগ দিল। লাইট ধরল ওদিকে। রেমিকে নিয়ে ফাঁকা অংশ দিয়ে ভেতরে ঢুকল ও। ওয়ারেন রয়ে গেল বাইরে।

ভেতরে এটা একটা প্যাসেজ। ফ্ল্যাশলাইটের আলোতে দেখা গেল করিডোরের মেঝে ফেটে গেছে। কমুকসহ অনেক সামুদ্রিক জলজ আগাছা জন্মেছে বিভিন্ন অংশে।

নিজের লাইটটা সামনের দিকে ধরল রেমি যাতে স্যাম ওকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিতে পারে। প্যাসেজ দিয়ে সাবধানে এগোল স্যাম। প্যাসেজটা বেশ চওড়া তাই রেমিও স্যামের পাশাপাশি এগোতে পারছে। খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ওরা।

উপরের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে দিনের আলো প্রবেশ করেছে। প্যাসেজ শেষ হয়েছে এখানে। থামল স্যাম। ডানদিকে ঘুরল। এদিকটা অন্ধকার। মনে হলো। পানিতে কেউ কালো কালি গুলে দিয়েছে। হঠাৎ পিছু হটল স্যাম। কালো দীর্ঘ আকৃতির কী যেন ওর দিকে সঁতরে এলো। ফ্ল্যাশলাইটের আলোতে দেখা গেল ওটা একটা ইল মাছ। প্রায় ৪ ফুট লম্বা। শরীরটা তেলতেলে। রেমিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল প্রাণীটা।

যতক্ষণ চোখের আড়াল না হলো ততক্ষণ ওটার দিকে লাইট ধরে রাখল রেমি। তারপর স্যামের দিকে ফিরল। কোনায় থাকা একটা ব্লক পরিষ্কার করল স্যাম। আরও কোন কোন জায়গা পরিষ্কার করা যেতে পারে সেগুলো ইঙ্গিত করে দেখাল।

আসলে স্যাম দেয়াল পরিষ্কার করে চিহ্ন এঁকে যাচ্ছে। ফেরার সময় যাতে পথ হারিয়ে না ফেলে।

রেমিকে পেছনে নিয়ে এগোল স্যাম! আরেকটা মোড় ঘুরতেই একটা বড় চেম্বারে এসে পড়ল ওরা! চেম্বারের একাংশ ধ্বসে গেছে। আলো ফেলে দেয়াল ও মেঝে দেখল ওরা। রেমি এখানে আরেকটা ফাঁক দেখতে পেল। এবারের ফাঁকটা মেঝেতে।

 ফাঁকটার দিকে এগোল স্যাম। চারদিক দেখে নিয়ে ওটার কিনারা পর্যবেক্ষণ করল। রেমিকে দেখাল ফাঁকটার কিনারা। নড করতে গিয়ে একটু জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে ফেলল রেমি! ডাক্তার সর্তক করেছিল কিন্তু রেমি সেসব ভুলে গেছে। ঘাড়ের ব্যথাটা ওর শিরদাঁড়া পর্যন্ত পৌঁছে গেল।

স্যাম অবশ্য স্ত্রীর সমস্যাটা টের পাচ্ছে না। আলো দিয়ে ফাঁকটা পরীক্ষা। করছে ও। রেমি’র দিকে এক নজর তাকিয়ে স্যাম ফাঁকটার ভেতরে সাঁতরে চলে গেল।

 ওর পিছু নিল রেমি। ব্যথাটা যেরকম হঠাৎ করে জেগে ছিল তেমনি চট করে মিলিয়ে গেল। ফাঁক গলে ছোট একটা চেম্বারে এলো ওরা। এখানকার দেয়ালেও উপরতলার মতো সামুদ্রিক আগাছা রয়েছে। সবচেয়ে কাছের দেয়ালের কাছে গিয়ে হাত দিয়ে ঘষা দিল স্যাম। সবুজ-বাদামী রঙের জঞ্জাল ছড়িয়ে পানিতে মেঘের মতো ভাসতে শুরু করল। একটা রেখা দেখা যাচ্ছে দেয়ালের গায়ে। এক ইঞ্চি পুরু। একদম উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রয়েছে রেখাটা।

পরিষ্কার করতে করতে আরেকটা রেখা পেল স্যাম। একটার সাথে আরেকটা এসে মিলিত হয়েছে। দুই মিনিট পর ৩-৪ ফুট সেকশন স্যাম পরিষ্কার করে ফেলল। ভাল করে তাকিয়ে দেখল কিছু একটা আঁকা হয়েছে রেখার সাহায্যে।

কী যেন ঝকমক করে উঠল। দেয়ালের আরও কাছে তাকাল স্যাম। দেয়াল থেকে ওর মুখের দূরত্ব এখন মাত্র ১ ইঞ্চি। লাইট ধরতেই আবার ঝিকিয়ে উঠল জায়গাটা।

ওর পাশে রয়েছে রেমি, মেঝে পরিষ্কার করছে। আগাছার জঞ্জাল পানিতে মিশে পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল রেমি। তারপর স্যামের হাতে টোকা দিল। ঘুরল স্যাম। রেমি মেঝের দিকে ইঙ্গিত করে কী যেন দেখতে বলছে। পানি এখনও ভালভাবে পরিষ্কার হয়নি। স্যাম নিজের লাইট ধরল ওদিকে।

জিনিসটা চোখে পড়তেই স্যামের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। একটা বড় ছুরি বলে মনে হচ্ছে।

ছুরিটা তুলল স্যাম। কিন্তু ওঠানোর সময় ওটার ফলার বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল। অবশিষ্ট যেটুকু রইল সেটাকে একটা জীর্ণ কাঠের টুকরো ছাড়া কিছু বলা যাবে না। ছুরির হাতল। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে রেমি’র দিকে ফিরল স্যাম। রেমি রেখাগুলো দেখছে। স্ত্রীকে নিয়ে দেয়ালের আরও কাছে গেল স্যাম। ঝিকিয়ে ওঠা জিনিসটা দেখাল তাকে। রেমি ইঞ্চিখানেক গভীর রেখা ছুঁয়ে দেখল।

দেয়ালের আরও কিছু অংশ পরিষ্কার করার পর হাতঘড়ি ও এয়ার গজ চেক করল স্যাম। রেমিও করল। স্যামকে সংকেত দিল উপরে যেতে হবে। অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছে।

ওরা ফিরছে এমন সময় মৃদু গুড় গুড় আওয়াজ করে কেঁপে উঠল পুরো ইমারত। উপরের চেম্বারের কয়েকটা বড় ব্লক স্থানচ্যুত হল। ছোট আকারের ভূমিকম্প হচ্ছে। কম্পন থামা পর্যন্ত স্থির হয়ে রইল ফারগো দম্পতি। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর দেখা গেল কোনোকিছু পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে না। তলানিতে থাকা বালু পানিতে মিশে পানি ঘোলা করে দিয়েছে। ওরা যে ফাঁক দিয়ে এখানে এসেছিল সেদিকে তাকিয়ে দেখল ব্লক স্থানচ্যুত হওয়ার ফলে ফাঁকটা বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ, ওদের ফেরার পথ নেই।

স্যাম ফ্ল্যাশলাইট দিয়ে আশপাশ দেখল। আরেকটা রাস্তা খুঁজছে। চেম্বারের একদম অন্যপ্রান্ত বেশ অন্ধকার দেখাচ্ছে। ভূমিকম্পের আগে ওখানে হয়ত দেয়াল ছিল। নতুন ফাঁকা অংশ দেখিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে সেদিকে এগোল স্যাম। সামনে গিয়ে দেখল ওটা একটা প্যাসেজ। পুরো প্যাসেজ সামুদ্রিক আগাছা ও জঞ্জালে বোঝাই। পানিতে আগাছার বিভিন্ন অংশ মিশে সবুজ ধোয়ার মতো তৈরি করে রেখেছে। রেমি’র দিকে তাকাল স্যাম। এয়ার গজ চেক করল। রেমিও চেক করল নিজেরটা। স্যামকে সংকেত দিল: মোটামুটি।

সরু করিডর দিয়ে এগোচ্ছে দু’জন। সামনে স্যাম, পেছনে রেমি। ওদের ফ্ল্যাশলাইটগুলো কোনমতে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সামনে মোড় পড়তেই গতি কমাল স্যাম। এখানকার মেঝেতে বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপের টিলা। দেখা যাচ্ছে।

আবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল স্যাম। পানির উপরে ভেসে ওঠার আগে ডিকম্প্রেশনের জন্য কিছু সময় দরকার। নইলে রক্তে জমা নাইট্রোজেনের কারণে বড়ধরনের শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু ওরা যে গতিতে এগোচ্ছে এভাবে এগোলে ডিকম্প্রেশনের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া সম্ভব হবে না।

সামনে এগোল স্যাম। কিন্তু কোনো রাস্তা পেল না। একটা বড় পিলার রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ছাদের দিকে তাকাল ও। ছোট্ট একটা ফাঁক দেখা যাচ্ছে ছাদে। ওদিকে এগোল স্যাম।

হাত দিয়ে দুই মিনিট কাজ করার পর অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ছাড়া বের হওয়ার মতো যথেষ্ট জায়গা তৈরি করতে পারল। ট্যাঙ্ক রেখে ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল স্যাম। নিচে রেমি অপেক্ষা করছে। ২০ সেকেণ্ড পর স্যাম ফিরে এসে রেমিকে উপরে সঁতরে আসার জন্য ইশারা করল।

 স্যামের মতো রেমিও তার অক্সিজেন ট্যাঙ্ক খুলে তারপর ফাঁক গলল। ওরা এখন অন্য একটা চেম্বারে এসে পৌঁছেছে। ওরা প্রথমে যে চেম্বারে এসে ঢুকেছিল এটা আকারে সেটার চেয়ে ছোট।

চেম্বারের এক কোনার দিকে এগোল রেমি। ওর উরুতে রাখা একটা ডাইভিঙের ছুরি বের করে একটা সেকশন পরিষ্কার করল। ব্লকের আঘাতে এখানকার মেঝে ভেঙ্গে গেছে। একটু আগে ওরা যে ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সেটার চেয়ে এখানকার ফাঁকটা আকারে বড়। রেমি ওর অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নিয়ে ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। স্যামের ভাগ্য অতটা ভাল নয়। ট্যাঙ্ক খুলে তারপর ফাঁক পেরোতে হলো ওকে।

ওরা এখন যে অংশে এসে পৌঁছেছে এখানে সামুদ্রিক শৈবালের কোনো অভাব নেই। ফারগো দম্পতি ছুরি দিয়ে সেগুলো কেটে কেটে উপরের দিকে সাঁতরে চলল।

শেষ শৈবালটিকে কাটার পর দিনের আলোর দেখা পেল ওরা। আলোকে অনুসরণ করে সাঁতরাতে সাঁতরাতে পানির উপরের অংশে পৌঁছে গেল স্যাম ও রেমি। ওরা যেখান দিয়ে ধ্বংবশেষের ভেতরে ঢুকেছিল সেখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে এসে ভেসে উঠেছে এখন। পানির উপরের অংশ দিয়ে সাঁতরে ওদিকে এগোল স্যাম। কারণ ওয়ারেন ওখানে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। স্যাম ওয়ারেনের কাছে গিয়ে পানির উপরে ওঠার সংকেত দিল। সায় দিল অস্ট্রেলিয়ান।

ওয়ারেন নিজের ডিকম্প্রেশন স্টক থেকে ওদেরকে অক্সিজেন দিল। তারপরও ওরা যখন পানির উপরে এসে পৌঁছুনোর পর দেখা গেল অক্সিজেন ট্যাঙ্ক একদম খালি। পানির উপরে মাথা তুলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল স্যাম। ওর পাশে রেমিও ভেসে উঠেছে। সাগরে হালকা ঢেউ। প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে দু’জন। ডারউইন ওদের কাছ থেকে প্রায় ১৫০ ফুট দূরে ভেসে রয়েছে।

১০ মিনিটের মধ্যে ওরা ওদের ডাইভিং গিয়ার ছেড়ে, শরীর মুছে শর্টর্স ও টি-শার্ট পরে নিল। কোন পদ্ধতিতে এগোলে সবচেয়ে ভাল হবে সেটা নিয়ে আলোচনা সেরে পাইলট হাউজে ফিরল স্যাম ও রেমি। লিও মনিটরের সামনে বসে রয়েছে। বরাবরের মতো হাঁড়ির মতো মুখ করে রেখেছে সেটা বলাই বাহুল্য।

ওর পাশে বসে ভূমিকম্প ও কীভাবে অল্পের জন্য প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছে সেসব খুলে বলল স্যাম।

‘তোমাদের কপাল ভাল।

‘আমাদের কপাল এরকমই। দেবতাদের ধন্যবাদ। স্যাম থামল। তুমি একটা থিওরি দিয়েছিলে… ভূমিকম্পের কারণে ইমরাতগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে তোমার থিওরিটা ঠিক। একটু আগে যে ভূমিকম্প হলো ওটা কিন্তু খুব বড় ছিল না। কিন্তু আমাদেরকে বেকায়দা ফেলতে ও ইমারতের ক্ষতি করার জন্য যথেষ্ট ছিল।

‘তুমি বাকি সবাইকে পানি থেকে উঠে আসতে বলেছ কেন? জানতে চাইল লিও। ওরা তো ইমারতের বাইরে ছিল। কিছু টেরই পায়নি।

‘ওদেরকে উঠে আসতে বলেছি কারণ ভেতরে গিয়ে আমরা যা দেখে এসেছি সেটা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই। আর এক আলোচনা দু’বার করাটা আমার পছন্দ নয়।’

ওয়ারেন ও ডেস ইতিমধ্যে হাজির হয়ে গেছে। ডাইভ টিমের বাকিরাও হাজির। সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্যাম ও রেমি কী বলবে সেটা শোনার অপেক্ষায় আছে সবাই। স্যাম নিজের গলা পরিষ্কার করে নিল। রুমে থাকা সবার উপর দিয়ে ধীরে ধীরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে লিও’র উপর এসে থামল ও।

‘একটা জিনিস পেয়েছে রেমি। যা সবকিছু বদলে দিয়েছে।

কী?

রেমি বাধা দিল। প্রথমে জানিয়ে রাখি আমরা কী পাইনি। কোনো গুপ্তধন পাইনি আমরা।’

কাঁধ ঝাঁকাল লিও। কিন্তু ভেতরে বৈঠকখানার মতো একটা বড় চেম্বার আছে। গভীর আঁজ কাটা রয়েছে সেটার দেয়ালে। পুরোটা পরিষ্কার করার আগে বলা মুশকিল কিন্তু আমি মনে করি ওই ভবনটা হলো মূল মন্দির। আর চেম্বারটা হলো রত্ন রাখার কোষাগার। অর্থাৎ, ট্রেজার ভল্ট।

 ‘দেয়ালের গায়ে খাজ কাটা?’ ডেসের কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে সে বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারছে না।

‘হ্যাঁ।’ বলল স্যাম। পাথরের দেয়ালের গায়ে খাজ কাটা। আমার ধারণা পুরো দেয়ালটা পরিষ্কার করলে আমরা চিত্রকর্ম দেখতে পাব। হয়তো কোনো পবিত্র স্থানের ছবি কিংবা দেবতাদের ছবি আঁকা আছে দেয়ালে।

‘এত নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে? জানতে চাইল লিও।

রেমি চোখের এক ভ্রু উঁচু করল। কারণ খাজগুলো সোনা দিয়ে ভরা ছিল।

‘সোনা! অনেকটা বোকার মতো উচ্চস্বরে বলে উঠল ওয়ারেন।

এবার লিও দ্বিধায় পড়ে গেছে। একটু আগেই তো তুমি বললে কোনো গুপ্তধন নেই।’

মাথা নাড়ল রেমি। ঠিকই বলেছি। খাঁজের গায়ে অল্প কিছু সোনা রয়ে গেছে। তুলে ফেলা হয়েছে বাকিটুকু। ওরা সবটুকু তুলে নিতে পারেনি।’

‘ওরা? তারমানে আমাদের আগেই কেউ মন্দিরে ঢুকেছিল? লিও জানতে চাইল।

 ‘ঠিক ধরেছ। দেয়ালের গায়ে সেটার প্রমাণও আছে। সোনা তোলার সময় ওরা কোনো সাবধানতা অবলম্বন কিংবা যত্নবান হওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি। তাই দেয়ালের গায়ে চিহ্ন ফেলে গেছে। ওখানে নিজেদের উপস্থিতি লুকোনোর কোনো চেষ্টাই করেনি তারা। বলল রেমি।

 ‘বুঝলাম। কিন্তু এরকম একটা জিনিসের খোঁজ পেয়েও তারা কাউকে জানাল না? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

 ‘হ্যাঁ, খটকাটা তো এখানেই। খাজ থেকে সোনা তুলতে এক দল ডাইভারদের কমপক্ষে কয়েক সপ্তাহ লেগেছে।’

লিও মাথা নাড়ল। আমি বুঝতে পারছি না। কারা আমাদেরকে হারিয়ে দিল?”

লিও’র দিকে তাকাল স্যাম। সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না… তবে রেমি একটা ক্লু পেয়েছে।’

ক্লু? ওয়ারেন প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ, ক্লু। নিজের ডাইভিং ব্যাগের দিকে এগোল স্যাম। ছুরির সেই হাতলটা বের করে সবার দেখার সুবিধার্থে বেশ কিছুক্ষণ সামনে ধরে রাখল। একটু কাছে এগিয়ে এসে দেখল সবাই। সবার আগে লিও প্রতিক্রিয়া জানাল।

কী এটা? কোনো বাতিল জিনিসের অংশ?

বাতিল নয়, লিও।’

 ‘একটা কাঠের টুকরো পেয়েছ? তাছাড়া আর কী?

হতাশা মিশ্রিত দৃষ্টিতে লিও’র দিকে তাকাল স্যাম। একজন বিজ্ঞানী হয়ে তুমি আসল প্রশ্নটাই করোনি।

কী সেটা?’ ভ্রূকুটি করল লিও।

‘স্যাম কেন পানির নিচ থেকে একটা বাতিল জিনিসের টুকরো এসে সবাইকে মিটিঙে ডাকবে?’ রেমি বলল।

 দাঁত বের করে হাসল স্যাম। “ঠিক। এটাই হচ্ছে আসল প্রশ্ন।

‘এবার উত্তরটা বলো। নাকি এটাও আমাদেরকে আন্দাজ করে নিতে হবে?

 স্যাম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই জীর্ণ কাঠের টুকরোটিকে এখানে নিয়ে আসার কারণ একটাই। আমি যখন জিনিসটা তুলতে গিয়েছিলাম এই অংশটুকু ছাড়া বাকিটুকু খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে এটা একটা ভাঙ্গা বেয়নেটের অংশ। ভাঙ্গা বলছি এই কারণে… হয়তো এই বেয়নেট ব্যবহার করে দেয়াল থেকে সোনা লুট করা হয়েছিল। তারপর লুটের কোনো একপর্যায়ে ভেঙ্গে গেছে।

‘যদি ভেঙ্গেই গিয়ে থাকে তাহলে কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন এটা বেয়নেটের? জানতে চাইল ডেস।

কাঠের টুকরোটাকে কাছে নিয়ে দেখুন। বেয়নেটের হাতলের অংশ দেখতে পাবেন।’

আর আমার মনে হয়, রেমি বলল, হয়তো এটার সাথে ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় এখানে আসা সৈন্যবাহিনির বেয়নেট মিলে যাবে।’

 ‘এই গুপ্তধন সেই যুদ্ধের সময় তোলা হয়েছিল? ধীরে ধীরে বললেন

রেমি সায় দিয়ে মাথা নাড়ল। তবে কাজটা মিত্রবাহিনি লোক করেছে নাকি জাপানিরা করেছে সেটা এখুনি বলা যাচ্ছে না। কারণ আমি নিজে অ্যান্টিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। তবে খুব শীঘ্রই আমি এটার ছবি বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাব। তারপর আমরা জানতে পারব কারা এখান থেকে সোনা সরিয়েছে। যদি খাজগুলোর পুরোটা সোনায় ভর্তি হয়ে থেকে থাকে তাহলে সোনার পরিমাণ নেহাত কম নয়।

.

 ২৩.

স্যামের পাঠানো ছবিগুলো পাওয়ার দু’ঘণ্টা পর ফোন করল সেলমা। রেমি ও স্যাম ব্রিজ থেকে ডাইভারদের কাজ দেখছে। প্রথম চেম্বারে ঢুকেছে ডাইভাররা। কাজের গতি বেশ ধীর। সামুদ্রিক আগাছাগুলো পরিষ্কার করার পর অনেকক্ষণ পানিতে মেঘের মতো ভেসে থাকার ফলে কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। এভাবে দেড় ঘণ্টা কাজ করার পর ক্যাপ্টেন ডেস একটা পান্থ বসিয়ে জঞ্জালগুলো শুষে নেয়ার বুদ্ধি বের করল। পাম্ব ব্যবহার করে আলগা জঞ্জালগুলোর অধিকাংশই সরিয়ে ফেলায় গতি এলো কাজে।

‘তোমাদের ভাগ্য ভাল। বলল সেলমা ‘ মিল্টন গ্রেগরি হলেন ২য় বিশ্বযুদ্ধের অস্ত্র সম্পর্কে জানা অন্যতম জ্ঞানী ব্যক্তি। তোমার দেয়া হ্যাঁন্ডেলের ছবিটার পরিচয় বের করতে তার খুব একটা সময় লাগেনি।

তিনি কী বললেন? স্যাম জানতে চাইল।

‘জাপানিজ আর্মি। টাইপ ৩০ বেয়নেট। হয়তো আরিসাকা রাইফেলের ডগায় ছিল ওটা। এই রাইফালটা জাপানিজ সৈনরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করত।’

উনি নিশ্চিত?

 ‘একদম। মিত্রপক্ষের বেয়নেটের হ্যাঁণ্ডেল ভিন্ন রকমের ছিল। আরেকটা কথা: হ্যাঁন্ডেলের শেষ প্রান্তের দিকে খেয়াল করলে একটা ঝাপসা চিহ্ন দেখতে পাবে। যার নাম : আওবা।’

কী?

‘জাপানিজ রেজিমেন্টের নাম। গোয়াডালক্যানেলে পাঠানো তৃতীয় ব্যাটেলিয়ন, চতুর্থ পদাতিক রেজিমেন্ট। দ্য আওবা রেজিমেন্ট।

এই রেজিমেন্ট কবে এসেছিল?

১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল স্যাম। আপনমনে মাথা নেড়ে মনিটর থেকে চোখ সরাল।

‘সেলমা, তোমাকে একটা কাজ দেব।

‘আন্দাজ করেছিলাম, দেবে।’

‘তোমার আন্দাজ সঠিক। গোয়াডালক্যানেলে জাপানিদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাই। কমাণ্ডে কে ছিল? কতজন সৈন্য এসেছিল এখানে? কবে এখান থেকে পালিয়ে গেছে? কীভাবে পালিয়েছে? সবকিছু জানতে চাই।

কতখানি বিস্তারিত জানতে চাও?

‘তুমি যা পাও সব আমাকে দেবে। সব তথ্যের সাথে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও দিয়ে।

‘দেব।’

 ‘কতদিন লাগবে?

 ‘আমি পিট ও ওয়েণ্ডিকেও কাজে লাগিয়ে দিচ্ছি। কখন লাগবে তোমার?

বরাবরের মতো।

মানে, গতকাল? তাহলে গতকাল দেই?

স্যাম হাসল। তবুও একটু দেরি হয়ে যাবে!’

 “ঠিক আছে। খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবে।’

স্যামের কথা বলা দেখছিল রেমি। আমার ধারণা, জাপানিজ। ঠিক? বলল সে।

‘ স্যাম মাথা নাড়ল। হুম। কিন্তু তাদের ব্যাপারে তথ্য যোগাড় করা কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে।’

ইতিহাস বিজয়ীদের হাতে রচিত।

‘ঠিক বলেছ। জাপানীরা হেরেছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধে। এনসাইক্লোপিডিয়াতে জাপানিজদের অপারেশনের রেকর্ড হয়তো নেই।

 হুম। তবে ভাগ্য ভাল হলে কোনো সূত্র পেয়েও যেতে পারি।

সূর্যের আলোতে সাগরের পানি চিকচিক করছে। সেদিকে তাকিয়ে আছে স্যাম। চিন্তা করে দেখো, কীভাবে কাজটা করেছিল তারা। যুদ্ধের সময়ে দিনের পর দিন ভাইভ দিয়েছে। হরদম শত্রু বাহিনির হামলা চলছিল তখন। আদিকালের স্কুবা আর তামার তৈরি ডাইভিং হেলমেট ব্যবহার করতে হয়েছিল তাদের। অনেকটা জুল ভার্নের গল্পের মতো।

তবে যা-ই হোক, সফল হয়েছিল তারা। দেয়ালের দিকে একবার তাকালেই সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়।

স্যাম চিন্তিতভাবে মনিটরের দিকে তাকাল। কিছু বলার নেই।’

 রাত নামা পর্যন্ত কাজ করল ডাইভাররা। পাম্প ব্যবহার করে জঞ্জাল পরিষ্কার করা হলেও আশানুরূপ গতিতে কাজ এগোল না। লিও কিছুটা অস্থির হয়ে উঠল।

ডিনারে গ্যালিতে জড়ো হলো ডাইভার টিমের সবাই। টাটকা মাছ দিয়ে ডিনার সারতে সারতে হাসি-ঠাট্টায় মেতে রইল।

ক্যাপ্টেন ডেস স্থানীয় রেডিও ব্যাণ্ড টিউন করে রেখেছে। সর্বশেষ খবরা খবর জানা দরকার। রেডিও’র সংবাদ পাঠক জানাল, বিভিন্ন জায়গায় বিশৃঙ্খলা করার অপরাধে এপর্যন্ত ২০ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তবে বিদ্রোহীদের ব্যাপারে কোনো নতুন তথ্য জানা যায়নি। তাই বলা যায়, খুনের পর আপাতত ঘাপটি মেরে রয়েছে তারা।

পরদিন সকালে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবহার স্যাম ওর ই-মেইল চেক করল। সেলমা একটা ফাইল মেইল করেছে। ফাইলটা ডাউনলোড করে পৃষ্ঠাগুলো পড়তে শুরু করল স্যাম। ওদিকে রেমি আরেক কাপ কফিতে চুমুক দিচ্ছে। ফাইলটা পড়া শেষে রেমিকে ফাইলটার ব্যাপারে সংক্ষেপে ধারণা দিল স্যাম।

 ‘জাপানিরা এখানে ওদের সৈন্যদের জন্য পর্যাপ্ত রসদ পাঠাতে গিয়ে প্রচুর ভুগেছে। মূলত এজন্যই এখান থেকে কেটে পড়তে হয়েছিল তাদেরকে। জাহাজে চড়ে যেসব সৈন্যরা ফিরছিল তাদের সবাই ছিল অসুস্থ। ক্ষুধায় কাহিল। এছাড়া আমাশয় ও পুষ্টিহীনতাসহ নানান অসুখে আক্রান্ত ছিল তারা।

এই দ্বীপ কতদিন জাপানিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল?

মাত্র ৭ মাসের মতো। ১৯৪২ সালের জুন থেকে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। যুদ্ধের সবচেয়ে তিক্ত সময় ছিল তখন!

 ‘তাহলে আমাদেরকে স্রেফ ওই ৭ মাসের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। কাজ কমে গেল দেখা যায়।

না। জাপানিদের দিক থেকেও কিছু রেকর্ড আছে।

 ‘তা ঠিক। কিন্তু যেহেতু আমরা জানি এখানে গুপ্তধন ছিল এবং তারা সেটা তুলে নিয়েছে, এখন প্রশ্ন হলো তারপর কী হলো? যুদ্ধের পর কেন বিষয়টা সামনে এলো না?

‘আচ্ছা, নিজেকে দিয়ে হিসেব করো। যদি তুমি এরকম সোনা খুঁজে পেতে কিংবা মূল্যবান রত্ন… যা-ই হোক, কী করতে তুমি? মনে রেখো, তুমি এমন এক জায়গায় আছে যেখানে প্রতিদিন যুদ্ধ হচ্ছে। তোমার দল হেরে যাচ্ছে যুদ্ধে। খাদ্যের অভাবে ভুগছে সবাই। দলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

‘আমি হলে ধন-রত্ন সব নিয়ে এই দ্বীপ থেকে সটকে যেতে চাইতাম।

‘ঠিক। শত্রুপক্ষ তাদের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে আক্রমণ করছে, এরকম অবস্থায় “দ্বীপ থেকে রত্ন নিয়ে পালিয়ে যাওয়া” মুখে বলা যতটা সহজ কাজে করে দেখানো ততটাই কঠিন। ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবল স্যাম। আরেকটা বিষয় আছে। যেখানে তারা ডাইভ দিয়েছিল নিশ্চয়ই একটা জাহাজকে ওখানে কয়েক সপ্তাহ নোঙর করে রাখতে হয়েছে? বিষয়টা শত্রুপক্ষের চোখে খুব সহজেই ধরা পড়ে যাওয়া কথা।

‘সেক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি নোঙর করা জাহাজটা জাপানিদের অফিশিয়াল কোনো জাহাজ ছিল না।

স্যাম মাথা নেড়ে সায় দিল। সেটা এমন কিছু ছিল যা দেখতে সাধারণ জাহাজের মতো। যুদ্ধজাহাজ হলে বিপক্ষের আক্রমণে সাগরে ডুবে যেত জাহাজটা।

ভ্রু কুঁচকাল রেমি। পানির নিচে কোনো ডুবে যাওয়া জাহাজ নেই। তার মানে তুমি কী বলতে চাইছ? জাপানিরা গুপ্তধন পানি থেকে তুলে এখান থেকে স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে?

স্যাম মাথা নাড়ল। হতে পারে। প্রতিপক্ষ খুব কড়া পাহারা দিচ্ছিল সেসময়। সৈন্যদের জন্য দ্বীপে রসদ পর্যন্ত আসতে পারছিল না তখন। অবশ্য তারা যে জাহাজই ব্যবহার করে থাকুক সেটা যদি ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিংবা যদি সার্চ হয় তাহলে সব শেষ। এত বড় ক্ষতি পোষানোর কোনো উপায় ছিল না জাপানিদের। তাই লুটে নেয়া গুপ্তধন নিয়ে উন্মুক্ত সমুদ্রে যাত্রা করাটা খুব বেশি ঝুঁকি ছিল তাদের জন্য।

তাহলে?

মাথা খাটাও। তোমার কাছে গুপ্তধন আছে, ক্ষুধায় ভুগছ। ওদিকে দ্বীপে শত্রুপক্ষ চলে এসেছে। কোনো জাহাজকে আসতে দিচ্ছে না তোমাদের কাছে। সাগরের পাড় জুড়ে জাপানিজ জাহাজ আর নৌকোর ধ্বংসস্তূপে মাখামাখি। দিনের বেলায় সাগরে কড়া পাহারা চলছে। তাহলে তুমি কী করতে?

রেমি একমুহূর্ত ভাবল। সাবমেরিন!

 ‘হ্যাঁ। একটা সম্ভাব্য উপায় হতে পারে। কিন্তু ওতে খুব ঝুঁকি থাকে। পরিকল্পনা মাফিক কিছু না হলে, কোথাও বাড়তি সময় লেগে গেলে সব গড়বড় হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া পাড়ের কাছে সাবমেরিন আনা খুব কঠিন। তবে রাতে সম্ভব। কিন্তু পাড়ে তো বিভিন্ন জাহাজ ডুবে রয়েছে। তাদের সাথে সংঘর্ষ এড়ানোটা প্রায় অসম্ভব।’

তাহলে আমি নিরাপদ সময় পাওয়ার আগপর্যন্ত গুপ্তধনগুলো লুকিয়ে রাখতাম।’

‘আচ্ছা, মানলাম। কিন্তু কীভাবে? প্রতিপক্ষ তো হাল ছাড়বে না। তুমি যতই দেশপ্রেমিক হও না কেন, প্রকৃত সত্য হলো, জাপান এই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ কখনই আজীবন ধরে রাখতে পারবে না।’

‘তাহলে… তাহলে আমি একটু বড় সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম। সুযোগ বুঝে কেটে পড়তাম এখান থেকে।

‘হলো না। দ্বীপে সৈনিকদের কার্যবিধির ধারাবাহিকতার দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় মাত্র একটা উপায় ছিল এখান থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে ফেরার।

কী সেটা…?

 ‘চুড়ান্ত পলায়নের সময়। কোনো এক কারণে প্রতিপক্ষ জাপানিদেরকে সেই পিছু হটার সময় বাধা দেয়নি। একপ্রকার বিনা চ্যালেঞ্জে দ্বীপ ছেড়েছিল জাপানি সৈন্যরা।

‘প্রতিপক্ষ কেন বাধা দিল না?’

“আমি যতদূর জানি, প্রতিপক্ষ ভেবেছিল সামনে বড় কোনো আক্রমণ হতে যাচ্ছে। তাই সমস্ত নৌ-বহর কোরাল সমুদ্রে অবস্থান নিয়েছিল তখন। জাপানিজদেরকে উন্মুক্ত সমুদ্রে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে গিনিপিগ বানিয়েছিল। কেউ আক্রমণ করে কিনা সেটা দেখার জন্য।’

 ‘তোমার জ্ঞান আমার পছন্দ হলো না। এরচেয়ে আমার সাবমেরিন তত্ত্বই ভাল।”

 ‘জানি। কিন্তু সলোমনের এদিকে জাপানিজ সাবমেরিন ছিল না বললেই চলে। অন্তত আমাদের জানা নেই। নিজের চোয়ালে হাত বুলাল স্যাম, মাথা নাড়ল। এছাড়া জাপানিজ সাবমেরিনে মাল রাখার মতো জায়গা খুব কম ছিল।’

বুঝলাম।

স্যাম দাঁত বের করে হাসল। ধরা যাক, পানির নিচে থাকা ইমারতগুলোর খোঁজ পেতে বেশকিছু সময় লেগেছিল জাপানিদের। তবে ইমারতগুলো দেখা ও গুপ্তধন উদ্ধার করার জন্য বেশ ভাল পরিমাণ সময় ছিল তাদের হাতে। আমরা এখন যে পরিমাণ সামুদ্রিক জঞ্জাল সাফ করছি, এটা তাদের মোকাবেলা করতে হয়নি। তাদের কাজ তুলনামূলক দ্রুত এগিয়েছিল। দেয়াল থেকে সোনা আর মূল কোষাগার থেকে কী তুলে নিয়েছিল কে জানে। আমরা জেনেছি বেয়নেটটা যে সৈন্যবাহিনির তারা দ্বীপে এসেছিল সেপ্টেম্বরে। ধরলাম, ১ মাসের মধ্যে তারা গুপ্তধন লুটে নেয়ার কাজ সেরেছিল। তাহলে ততদিনে অক্টোবর মাস গড়িয়েছে। পুরোদমে যুদ্ধ চলছে তখন। দু’পক্ষের অনেক জাহাজ ধ্বংস হয়ে গেছে। এবার ভাবো, তখনকার সময়কে দ্বীপ থেকে গুপ্তধন সরানোর জন্য উপযুক্ত সময় বলে মনে হচ্ছে কি?

গলা পরিষ্কার করল রেমি। হয়তো না। কিন্তু অনেক কিন্তু আছে এখানে।

‘আমি জানি। কিন্তু সময়কালটা দেখো। চূড়ান্ত পলায়নের সময়টা ছাড়া অন্য কোনোসময় দ্বীপ থেকে সটকে পড়াটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।’

রেমি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। একমত। তবে তোমার আগের পয়েন্টটা ভাল ছিল। যদি গুপ্তধন উদ্ধার হয়েই থাকে তাহলে অতদিন লুকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। গুপ্তধনের ঘটনা প্রচার পেল না কেন? গোপন জিনিস বেশিদিন গোপন থাকে না। আমার ধারণা, যুদ্ধে জাপানিদের অনেক খরচ হয়েছিল। এই গুপ্তধন বিক্রি করে সেটা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করার কথা তাদের।

 ‘আমি সেলমাকে বলেছি, জাপানিদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আমাকে যেন দেয়। পলায়নের সময় কোন কোন জাহাজ সেটার দায়িত্বে ছিল, যুদ্ধের পর জাপানিদের সম্পদ বিক্রির রেকর্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক কাজ করতে হবে সেলমাকে। কিন্তু সেলমা এরকম চ্যালেঞ্জ নিতেই পছন্দ করে। আমাদেরকে এসব তথ্য যদি কেউ সরবরাহ করতে পারে তাহলে সে হলো সেলমা।’

ডেকে গেল স্যাম ও রেমি। ডাইভাররা তাদের ডাইভিঙের প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ কীসের ঝলকানি থেকে চোখকে বাঁচানোর জন্য হাত দিয়ে রেমি চোখ আড়াল করল। স্যাম লিও’র সাথে আস্তে আস্তে কথা বলছিল। রেমিকে এভাবে হাত উঁচু করতে দেখে বলল, কী হয়েছে?

রেমি মাথা নাড়ল। হয়তো কিছুই নয়। আমাদের গাড়ির ওখান থেকে কীসের ঝলকানি দেখতে পেলাম।

‘সূর্যের আলো গিয়ে গাড়ির কাঁচে পড়েছে বোধহয়। বলল রেমি।

ডেসের দিকে তাকাল স্যাম। ক্যাপ্টেন ডেস হাতে মগ নিয়ে কফি খাচ্ছে। ‘আপনার কাছে বাইনোকুলার টাইপের কিছু আছে?

সায় দিয়ে মাথা নাড়ল ডেস! পাইলটহাউজ থেকে একটা ওয়াটারপ্রুফ বুশনেল নিয়ে এলো।

বুশনেলের লেন্স দিয়ে পাড়ে তাকাল স্যাম। ডেসের হাতে জিনিসটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আমাকে একটু পাড়ে যেতে হবে। লিফট পাব?’

ডেস মাথা নাড়ল। অবশ্যই। আমি নিজে আপনাকে লিফট দেব, চলুন।

 রেমি’র দিকে ফিরল স্যাম। আমি এখুনি আসছি।’

‘আমিও তোমার সাথে যেতাম। কিন্তু যাব না।’ রেমি নিজের ঘাড় ডলতে উলতে বলল।

‘তুমি ঠিক আছে তো?

ঠিক আছি। রাতে হয়তো বেকায়দাভাবে শুয়েছিলাম।’ রেমি বলল। কিন্তু স্যাম ও রেমি কেউ-ই কথাটা বিশ্বাস করল না।

সমুদ্রে তেমন একটা ঢেউ নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে পোর্টে পৌঁছে গেল স্যাম।

ওদের গাড়িটা স্যাম যেভাবে রেখে গিয়েছিল এখনও ঠিক সেভাবেই রয়েছে। গ্যাস কম্পার্টমেন্ট পরীক্ষা করল স্যাম। না, কেউ অনাহুতভাবে প্রবেশের চেষ্টা করেনি। জানালাগুলোও সব ঠিকঠাক আছে। দরজাগুলো লকড। স্যাম এখন অনেক সতর্ক। পাশের জঙ্গলে কোনো নড়াচড়া শোনা যায় কিনা সেজন্য কান খাড়া করে রাখল ও।

 বাতাসের ফলে গাছের মৃদু নড়াচড়ার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

টয়োটা গাড়ির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর স্কিফে চড়ল স্যাম।

তবে ও টয়োটার আশেপাশে টায়ারের টাটকা ছাপ দেখতে পেয়েছে।

 রেমি’র আশংকা ভুল নয়। শিপের উপর নজর রাখছে কেউ।

.

২৪.

অরউন ম্যানচেস্টার ওয়াটারফ্রন্ট বারের পেছন দিকে বসে রয়েছে। পুরো বার এখন খালি। বারটেণ্ডার ছাড়া কেউ নেই। যখন কোনো গোপন মিটিং করার দরকার হয় তখন এখানে আসে ম্যানচেস্টার। বারটেণ্ডারকে ঘুষ দিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখে। দ্য রাস্টি শ্রিমপার নামের এই বারটা বিগত কয়েক দশক ধরে দ্বীপে মদ পরিবেশন করে আসছে। সারাদিন বন্ধ থাকে। খোলা থাকে শুধু রাতে। অবশ্য আজকের বিষয়টা ভিন্ন।

 বিয়ার খেতে খেতে ঘড়ি চেক করল ম্যানচেস্টার। ওর সহকর্মী ও বিভিন্ন কুকর্মের সঙ্গী গর্ডন রোলিন্স দেখা করবে এখানে। ব্রিটিশ সরকারের গর্ভনর হিসেবে এককালে দায়িত্ব পালন করেছিল রোলিন্স। তাই একই সাথে ক্ষমতা ও অর্থ দুটোই আছে তার।

বারের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকল রোলিন্স। কপালের সামনে হ্যাটটা নিচু করে পরে রয়েছে। এগিয়ে এলো ম্যানচেস্টারের টেবিলের দিকে! এক আঙুল দিয়ে বারটেণ্ডারকে ইশারা করল সে। বসল চেয়ারে। একটু পর বারটেণ্ডার একটা বোম্বে স্যাফায়ার গিবসন নিয়ে এলো। বারটেণ্ডার শ্রবণ-সীমার বাইরে যাওয়ার আগপর্যন্ত ওরা কেউ কথা বলল না।

‘অরউন, বিদ্রোহীদেরকে তো মনে হয় ঈশ্বর পাঠিয়েছেন। আমি বিদেশি অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখেছি। এরকম জাতীয়করণে ওরা খুশি নয় কিন্তু কিছু করার মতো অবস্থায় নেই তাদের।

 সাবধানে মাথা নাড়ল ম্যানচেস্টার। তাতে আমাদের অবস্থায় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

‘আমি আর আপনি সলোমন আইল্যাণ্ডের সম্পত্তির দখল পাব। আকর্ষণীয় মুনাফা হবে।’

হুম। আমি এই ধারণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি বহু বছর হলো।

‘ওভাবেই থাকুন। পর্দার আড়ালে থেকে সব কাজ সারব আমি। উপযুক্ত সময় আসার আগপর্যন্ত নিজের জনদরদী, ভালমানুষী ভাবটা ধরে থাকুন। কাজে লাগবে। আপনি দীর্ঘদিন ধরে এর বিপক্ষে নিজের বক্তব্য দিয়েছেন জনগণের সামনে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে যখন হার স্বীকার করে নেবেন তখন আর কারও কিছু বলার থাকবে না।

ম্যানচেস্টারের চোখ সরু হলো। আচ্ছা, আপনি কোনোভাবে এই বিদ্রোহীদের সাথে জড়িত না তো?’

শান্তভাবে ওকে পর্যবেক্ষণ করল রোলিন্স। অবশ্যই নয়। কিন্তু আমি জানি কীভাবে কোন সুযোগকে কাজে লাগাতে হয়। বিদ্রোহীদের কাজের ধারাকে আমি সমর্থন করি কি করি না সেটা বিষয় নয়। ওরা সরকারকে জাতীয়করণের ব্যাপারে আলোচনায় বসতে বলেছে, এটাই মূখ্য। ছয় মাস আগেও এসব অসম্ভব ছিল কিন্তু এখন সম্ভব হলেও হতে পারে। আর এই সুযোগে কীভাবে পকেট ভারি করা যায় সেটাই ভাবছি আমি।’

বিয়ারে চুমুক দিয়ে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাল অরউন। বলুন, শুনছি…’

***

ডারউইন-এ ফিরে রেমিকে সব খুলে বলল স্যাম। রেমি প্রস্তাব রাখল শিপের সব ক্রুদেরকে ডেকে নিয়ে সর্তক করে দেয়া উচিত। হয়তো কোনো উৎসুক স্থানীয় বাসিন্দা পোর্টে এসে নিরীহভাবে সময় পার করছিল। হয়তো বিষয়টা গুরুত্বর কিছুই নয়। তারপরও সতর্ক থাকা দরকার।

ক্রুদেরকে ডেকে আনল স্যাম। দু’জন এইড-কর্মীর মৃত্যুর সংবাদ কুরা আগে থেকেই জানে। তাই এরকম পানিতে ভেসে থেকে, মাথায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হলেও ওরা ভয় পেল না।

স্যামের কথা শেষ হলে ওকে নিয়ে একপাশে সরে গেল লিও। নিচু গলায় বলল, তোমার কি মনে হয় আমাদের বিপদ হতে পারে?”

হলে ডাঙার চেয়ে কম হবে।’

 ‘খুব একটা ভরসা পাচ্ছি না।’

‘সবকিছুতেই ঝুঁকি থাকে। স্যাম শ্রাগ করল। আমার মনে হয় না, আমাদেরকে কেউ আক্রমণ করবে। কেউ যদি নজরদারি করে থাকে তাতে তো ক্ষতির কিছু নেই। তাছাড়া আমরা এমন এক অঞ্চলে অবস্থান করছি যেখানে বিদ্রোহীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিষয়টাকে হেলাফেলা করা যাবে না।’

 পুরোটা দিন কেটে গেল ধীরে ধীরে। ডাইভাররা তাদের কাজ করছে। সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল স্যাম ও রেমি। আরেকটা রাত জাহাজে কাটানোর দরকার নেই। রেডিওতে নতুন কোনো অঘটনের ঘটনা শোনা যায়নি। হনিয়ারার পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত।

ওরা শহরে এসে দেখল গতকালের চেয়ে আজ যানবাহনের চলাচল বেশি। সবকিছু বেশ স্বাভাবিক লাগছে। আজও রাস্তায় পুলিশের দেখা মিলল। তবে তারা রিল্যাক্স করছে।

হোটেলের পার্কিং লট প্রায় ফাঁকা। তবুও সিকিউরিটি গার্ড তার দায়িত্ব পালন করছে। অতিথিগণ এখানকার অস্থিতিশীল পরিবেশে ঝুঁকি নিয়ে দিন কাটানোর চেয়ে নিরাপদে সটকে পড়াই শ্রেয় ভেবেছে। সামনের দরজার কাছে গাড়ি পার্ক করল স্যাম। আজ লবি একদম খালি। শুধু দু’জন ডেস্ক স্টাফ রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন স্যামকে হাত দিয়ে ইশারা করে একটা চিরকূট ধরিয়ে দিল। মেসেজ। কাগজের দিকে এক পলক তাকিয়ে স্টাফকে ধন্যবাদ দিল স্যাম।

‘সেলমা ফোন করেছিল,’ বলল ও। ভাল লক্ষণ। তার মানে ও কিছু একটা পেয়েছে।’

‘আশা করা যায়।

রুমে গিয়ে স্যাম স্যাটেলাইট ফোন সাথে করে ছোট্ট বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ২য় বার রিং হতেই ফোন ধরল সেলমা।

‘বেশ। তুমি মেসেজ পেয়েছ তাহলে সেলমা বলল।

‘অবশ্যই পেয়েছি।’

‘যুদ্ধের সময়ে জাপানিরা কোনো গুপ্তধন লটেছিল কিনা সেব্যাপারে আমি আমার বিভিন্ন সোর্সের রিপোর্ট ঘেঁটে দেখলাম। কিন্তু কিছু নেই। কিছু না। তারপর আমি খোঁজ করতে শুরু করলাম তাদের ব্যাপারে যারা বিভিন্ন গোপন বা অবৈধ ধন-রতুগুলো কিনে সংগ্রহ করে। কিন্তু তাতেও ফলাফলে কোনো পরিবর্তন এলো না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যদি জাপানিরা গুপ্তধন উদ্ধার করে থাকে তাহলে সেটা এখনও গোপন আছে। বলা যেতে পারে, যুদ্ধকালীন সময়ের অন্যতম বড় গোপন বিষয় এটা।’

‘খারাপ খবর।

‘জানি। তারপরও আমি আরও খোঁজ করে যাচ্ছি। সূত্রের খোঁজ করছি। যদি তোমাদের কোনো কাজে আসে…’

‘সেলমা, বেয়নেট থেকে প্রমাণিত হয়েছে জাপানিরা সেই কোষাগারে ঢুকেছিল। আর আমরা যা দেখে এসেছি… দেয়ালের গায়ের খাঁজেই যদি ওই পরিমাণ সোনা থাকে তাহলে মূল কোষাগারে না জানি কী পরিমাণ ধন-রত্ন ছিল।’

ঠিক। গোপনীয় ধন-রত্ন কেনা-বেচার ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার পর তোমার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জাপানিদের দ্বীপ থেকে পালানোর বিষয়টা নিয়ে ঘাটতে শুরু করলাম। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ।

তারপর?

যা যা পেয়েছি সেসব আমি তোমাকে ই-মেইল করে দেব। কিন্তু গোয়াডালক্যানেলের ওদিকে জাপানি নৌ-বাহিনির যাতায়াতের ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন নৌ-যুদ্ধের রেকর্ড থাকলেও আমাদের যেটা দরকার সেটা নেই। আমাকে অনেক ঘাঁটতে হয়েছে।

‘তারমানে তুমি ইন্টারেস্টিং কিছু খুঁজে পেয়েছ?

হ্যাঁ। হয়তো এটা কিছুই নয় কিন্তু আমি জানতে পেরেছি মিত্রবাহিনির একটা জাহাজ কিছু জাপানি নাবিককে সলোমন সাগর থেকে উদ্ধার করেছিল। দিনটা হলো ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ, সকাল বেলা। বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে যা দেখলাম, নাবিকদের ডেস্ট্রয়ার ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে গিয়েছিল। অধিকাংশ ক্রু মারা গিয়েছিল ডেস্ট্রয়ারের।

দাঁড়াও! আমি জাপানিদের চূড়ান্ত পলায়নের ব্যাপারে অনলাইনে পড়েছিলাম। সেখানে বলা আছে কোনো সূত্র না রেখেই গায়েব হয়ে গিয়েছিল তারা।

হয়তো। আমার প্রশ্ন হলো যুদ্ধের সময় মূল নৌ-বহরের সাথে না থেকে প্রায় ১০০ মাইল দূরে সলোমন সাগরে কোন জাহাজটা ছিল? কেন ছিল? আর জাহাজটার কোর্সও কিন্তু বুগেইনভিল আইল্যাণ্ডের দিকে ছিল না। সেলমা একটু থামল। অনলাইন থেকে এতটুকুই জানা গেছে।

‘তোমরা প্রশ্নের পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে সেলমা। আচ্ছা, তাহলে ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখের গোলমাল এই একটাই?

‘হ্যাঁ। রেকর্ড তো তা-ই বলে। ডেস্ট্রয়ার ডোবার ঘটনাটা চোখের আড়ালেই চলে যেত যদি আরেকটা জাহাজ সলোমন সাগরে না থাকত। কিন্তু এই উদ্ধারকারী জাহাজের ব্যাপারে কোনো তথ্য পেলাম না।

‘আশ্চর্য।

 ‘হ্যাঁ। টোকিও জাহাজটার কোনো ইতিহাসই রাখেনি।

যারা বেঁচেছিল তাদের কী খবর? কেউ কোনো স্মৃতিচারণমূলক কিছু লিখে যায়নি?

না। তাদের সবাইকে আটক করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জেল দেয়া। হয়েছিল।

‘তাহলে আমার প্রশ্নটা তো তুমি বুঝতেই পারছ…’

‘পারছি। বেঁচে যাওয়া নাবিকদের হদিস বের করার চেষ্টা করছি। তবে সময় লাগবে। জেলে যাওয়া নাবিকদের প্রত্যেকের নাম ও জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার তথ্য বের করতে হবে আমাকে। অনেকে যুদ্ধের শেষপর্যন্ত বেঁচে ছিল না। আর যারা বেঁচে ছিল তারা যদি আজও বেঁচে থাকে তাহলে থুরথুরে বুড়ো হয়ে গেছে। আর সেটা হওয়ার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্যাম। তুমি বললে একটা জাহাজ ঝড়ে ডুবে গিয়েছিল। ঠিক কোথায় ডুবেছিল সেটা বের করা সম্ভব?

‘তোমার আগেই আমি এটা নিয়ে চিন্তা করেছি। মিত্রদের নৌ-বাহিনির রিপোর্ট অনুযায়ী, নাবিকদেরকে যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল সেখান থেকে বৃত্তাকার ১৫ মাইলের মধ্যে জাহাজটা ডুবেছে। আর ঝড়ের গতি ছিল উত্তরদিকে।’ সেলমা ইতস্তত করছে। এটা ভাল খবর নয়।

“কেন?”

 ‘সাগরের ওই অংশের গভীরতা ১৬ থেকে ১৭ হাজার ফুট।

স্যাম যেন বুকে ধাক্কা খেল। তাহলে ওই জাহাজে যদি গুপ্তধন থেকে থাকে তাহলে সেগুলো ওখানেই থাকবে।’

 ‘তবে রেইজ দ্য টাইটানিক এর মতো যদি কিছু করতে চাও তাহলে ভিন্ন কথা।

নাহ, সম্ভব না। আমি এরকম খবরের আশা করিনি।’

এখানে আমার কোনো দোষ নেই কিন্তু।

 ‘গোয়াডালক্যানেল থেকে সৈনিক নিয়ে পালানোর সময় একটা ডেস্ট্রয়ার কেন নিরাপদ পথ ছেড়ে সমুদ্রের ওই পথ দিয়ে যাত্রা করতে গেল?’ বলল স্যাম ‘পোর্ট থেকে প্রায় ১০০ মাইল দূরে। কেন ঝড়-ঝঞ্ঝার পথ মাড়াতে গেল?

 ‘আমি আন্দাজ করেছিলাম তুমি এরকম প্রশ্ন করবে। ম্যাপ দেখো, অনেককিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে তাহলে।

‘কেন, সেলমা? কী আছে ওতে?

‘আমার মনে হয় না, ওটা বেজে নোঙ্গর করত। কারণ ডেস্ট্রয়ারটার কোর্স ছিল সোজা জাপানের দিকে।

.

২৫.

রাতে স্যাম ও রেমি ওদের ই-মেইলের ইনবক্স চেক করে দেখল। সেলমার কাছ থেকে একটা সংক্ষিপ্ত মেইল পেয়েছে স্যাম! ডুবে যাওয়া সেই ডেস্ট্রয়ার থেকে উদ্ধার পাওয়া একজনের খোঁজ করছে সেলমা। তার বয়স ৯০-এরও বেশি। একমাত্র সে-ই বেঁচে আছে। সময়ের ফেরে বাকিরা আর পৃথিবীতে নেই। স্যাম আশা করল আগামীকাল হয়তো সেলমা আরও বিস্তারিত তথ্য পাঠাবে। স্যাটেলাইট ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল স্যাম! সেলমার ফোন দু’বার রিং হলো কিন্তু কেউ জবাব দিল না।

 ‘এখানে কী করছ?’ স্লাইডিং ডোর খুলে রেমি জানতে চাইল। হঠাৎ করে রেমি’র আওয়াজ পেয়ে স্যাম চমকে উঠেছে। ওর হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। স্বামীর মুখভঙ্গি দেখে রেমি “সরি” বলল।

‘ব্যাপার না। হঠাৎ করে তোমার কথা শুনে চমকে গিয়েছি আরকী।

 ‘সেলমা?’

‘হ্যাঁ। চেষ্টা করলাম কিন্তু কেউ ফোন ধরল না।’ স্যামের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গিয়ে বিচের বালুতে গিয়ে মুখ গুঁজেছে। সেদিকে তাকাল ও। ‘আমি এখুনি আসছি।

‘আমিও আসি?’

 স্যাম হাসল। আজকের দিনের সেরা প্রস্তাব এটা!’

বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিচে গেল। বালুর উপর থেকে ফোনটা তুলল রেমি। স্যাম ওকে ফিসফিস করে বলল, “তাকিয়ো না। বিচে কয়েকজন লোককে দেখতে পাচ্ছি। নিজেদেরকে আড়াল করার খুব চেষ্টা করছে। আসছে এদিকে।

ঘাড় না ফিরিয়ে বালুর দিকে তাকাল রেমি! এইমাত্র ওদের পায়ের ছাপ পড়েছে বালুতে। আমাদের পেছনে?

হ্যাঁ।

‘তাহলে আমি সামনে থাকব।’

‘তাড়াতাড়ি হাঁটো। এই দ্বীপে এরকম সময়ে বাইরে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

রেমি’র পিছু পিছু দ্রুত এগোল স্যাম। কান খাড়া করে রাখল পেছনের আওয়াজ শোনার জন্য। ধারণা সঠিক। বালুতে দ্রুত স্যাণ্ডেল ওঠা-নামার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। স্যাম সাহস করে পেছনে তাকাল। দু’জন স্থানীয় লোক আসছে ওদের পিছু পিছু। দূরত্ব মাত্র ৩০-৪০ ফুট। খুব দ্রুত দূরত্ব কমে আসছে।’

‘রেমি দৌড়াও!’ বলল স্যাম। রেমি গ্ৰেহাউণ্ডের মতো গতি বাড়াল। দৌড়ের গতি বাড়াতে গিয়ে স্যাম টের পেল ওর জিম করার সময়টা আরও বাড়াতে হবে। হঠাৎ করে দ্রুতগতিতে এগোতে গিয়ে ফুসফুসে যেন আগুন ধরে গেছে।

হোটেলের স্টিলের দরজার কাছে পৌঁছে কি-কার্ড বের করল রেমি। কয়েক সেকেণ্ড পর স্যামও হাজির। কোনমতে কি-কার্ডটা স্ক্যান করাল মিসেস ফারগো। পেছনে তাকিয়ে দেখল লোক দুটো আর মাত্র কয়েক পা দূরে!

দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা। দরজা লাগিয়ে দিল। লবিতে থাকা এক গার্ড এগিয়ে এলো ওদের দিকে।

‘আপনেগো কুনো সমস্যা?

স্যাম ও রেমি একে অন্যের দিকে তাকাল। দু’জনই হাপাচ্ছে। মাথা নাড়ল স্যাম। না, ঠিক আছে। কিন্তু বাইরের বিচে গুণ্ডা টাইপের দু’জন লোক ছিল।

 গার্ড হাতের ব্যাটন মারমুখী ভঙ্গিতে ধরে বলল। আপনাগো কিছু হয় নাই

না, হয়নি। তবে অল্পের জন্য বেঁচে গেছি।’ বলল রেমি।

‘এইহানে এইরাম টাইমে ভালা আচরণ পাইবেন না। বিশেষ কইর‍্যা রাইতে।’ গার্ড বলল। কী যেন বলল রেডিওতে। আমরা বিষয় দেখতাছি।

‘চলো, রেমি।’ স্ত্রীকে নিয়ে রুমে গেল স্যাম। বারান্দায় গিয়ে বিচের দিকে তাকাল। না, লোক দুটো নেই। শুধু তাদের পায়ের ছাপ আছে। সেটাও ধুয়ে যাচ্ছে সাগরের ঢেউয়ে।

‘চন্দ্রবিলাস করতে যাওয়াটা হয়তো ঠিক হয়নি। স্যাম বলল।

 ‘ফোনটা তো আনতেই হতো।

‘তা ঠিক। কিন্তু হাত থেকে পড়ে যাওয়াটাই তো অসাবধানতার পরিচয় দেয়। এই দ্বীপের অবস্থা ভাল নয়, বারবার ভুলে যাই বিষয়টা।

স্যামের বাহুতে মাথা রাখল রেমি। তাতে কী হয়েছে?

 ‘থাক, কিছু না।

পরদিন সকালে ওরা যখন ঘুম থেকে উঠল তখন গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ইন্টারনেটে ঢুকল স্যাম। সেলমা আরেকটা মেসেজ পাঠিয়েছে। সিডনি থেকে ৪০ মাইল দক্ষিণের এক শহরের ঠিকানা দিয়েছে ও। সাথে এক ব্যক্তির নাম। স্যাম নাম ও ঠিকানা শব্দ করে উচ্চারণ করল যেন রেমি শুনতে পায়।

 ‘তোশহিরো ওয়াতানাবি, ওল্লোংগং, সাউথ ওয়ালেস। ১৮ নাম্বার রিজ গার্ডেন।

ওল্লোংগং? এটা কোনো জায়গার নাম। সত্যি?’ রেমি প্রশ্ন করল।

স্যাম মাথা নাড়ল। তাই তো দেখছি। সময় দেখল ও। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরবর্তী ফ্লাইট কয়টায়?

ট্রাভেল ওয়েবসাইট বের করল রেমি। দুই ঘণ্টা পর একটা ফ্লাইট আছে। ব্রিসবেন দিয়ে যাবে। কালকের আগে সরাসরি সিডনি যাওয়ার কোনো প্লেন নেই।’

তাহলে চলো একটু ঘুরে আসি।

 ‘দারুণ। তবে আমার নতুন পোশাক কিনতে হবে।

‘দুনিয়ার ওই এক জিনিস ছাড়া আর কিছু করার নেই নাকি? আগে চলো সকালের নাস্তা সেরে নিই।

হাতে সময় নেই। এয়ারপোর্ট চল।

 আচ্ছা! তাহলে যা খাওয়ার ব্রিসবেনে গিয়ে খাব।’

 ‘আমরা কি এই রুম ছেড়ে দেব?’

না, রুম থাকবে। দুই দিনের জন্য কী কী লাগবে তোমার… সাথে নিয়ে নাও।’

ফ্লাইটে মাত্র অর্ধেক যাত্রী উঠেছে। ব্রিসবেনে নেমে হোটেল বুকিং ও খাওয়া-দাওয়া সেরে জেমস স্ট্রিটে গেল ওরা। শপিং করল। সত্যি বলতে শপিং যা করার রেমি-ই করল। স্যামের শপিং বলতে রেমি’র নতুন পোশাকের ব্যাপারে “ভাল লাগছে” “দারুণ মানিয়েছে” এসব বলে যাওয়া।

 পরদিন সিডনি পৌঁছে সড়কপথে ওললাংগং রওনা হলো ফারগো দম্পতি। ওয়াতানাবি সাহেবের চিকিৎসা যেখানে হয়েছিল সেই নার্সিং হোমের ঠিকানা যোগাড় করে নিজের যাবতীয় শক্তি-সামর্থ্য খাঁটিয়ে ওদের দুজনের জন্য ওয়াতানাবি’র সাথে সন্ধ্যায় একটা মিটিঙের ব্যবস্থা করেছে সেলমা।

ওয়াতানাবি’র বাড়িতে এসে ওরা দেখল ইটের দোতলা বাড়ি। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি গাছ লাগানো। কাছেই একটা হাসপাতাল আছে। বাড়িতে ঢুকতেই এক মোটাসোটা মহিলা এসে ওদের দুজনকে কার্ড রুমে বসতে দিয়ে ওয়াতানাবি-কে আনতে গেল। ৫ মিনিট পর হুইলচেয়ারে একটা রুগ্ন শরীরের জাপানিজকে নিয়ে ফিরল সে। লোকটার চুলগুলো রূপোলী। চেহারায় অনেক বলিরেখা।

 ‘মিস্টার ওয়াতানাবি, আমাদের সাথে দেখা করার জন্য ধন্যবাদ। ওয়াতানাবি যেহেতু অস্ট্রেলিয়ায় বেশ কয়েক বছর ধরে আছে তাই সে ইংরেজি বোঝে, এটা ধরে নিয়ে ইংরেজিতেই বলল রেমি। স্যাম আর ও দু’জন মিলে পরামর্শ করে এসেছে… অপরিচিত কারও কাছে কথা বলার সময় নারীরা আগে কথা বললে পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে সুবিধে হয়। প্রথমেই পুরুষ কথা বললে আবহাওয়ায় মিষ্টতা থাকে না।

ওয়াতানাবি মাথা নাড়ল। কিছু বলল না।

 ‘আমার স্বামী ও আমি হলাম আর্কিওলজিস্ট।’

এবারও কিছু বলল না সে। খুব মিষ্টি করে হাসি দিল রেমি। আমরা যুদ্ধের সময়কার বিষয় নিয়ে জানতে এসেছি। আপনাদেরকে যখন বন্দী করা হয়েছিল, সেই জাহাজের ব্যাপারে কিছু বলুন। অনেক দূর থেকে আপনার কথা শুনতে এসেছি আমরা।’

জাপানির চোখ সরু হলো কিন্তু এবারও সে চুপ। রেমি ভাবল, আরেকবার চেষ্টা করা যাক।

 ‘আপনার সাথে আরও চারজন নাবিককে উদ্ধার করা হয়েছিল শুনেছি। ঝড়ের মধ্যে সমুদ্রযাত্রা অনেক কঠিন ছিল, তাই না?

‘তিনজন নাবিক, একজন সৈনিক।’ বলল ওয়াতানাবি। তার কণ্ঠ বেশ কোমল।

‘আচ্ছা। তাহলে সবমিলিয়ে ৫ জন?

‘হ্যাঁ। ১০০ জন থেকে ৫ জন।

কাহিনিটা বলবেন আমাদেরকে? কী হয়েছিল?

কাধ ঝাঁকিয়ে চেয়ারে নড়েচড়ে বসল ওয়াতানাবি। ঝড়ের কবলে পড়ে আমাদের জাহাজটা ডুবে যায়। তার ইংরেজি উচ্চারণ বেশ ভাল। তবে একটু অস্ট্রেলিয়ান টান আছে।

‘হা, জানি। ডেস্ট্রয়ার, তাই না?

জাপানিজ মাথা নাড়ল। ওটার বয়স ছিল মাত্র ১ বছর। কিন্তু ওই এক বছরেই অনেক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল।

তারপর?

‘সেভাবে মেরামত করা সম্ভব হয়নি। পানি ঢুকে পড়েছিল জাহাজে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কোনো উপায় ছিল না। সাগরে ডুবে গেল জাহাজটা।

‘আচ্ছা। তো দ্বীপের ওদিকে কী জন্য গিয়েছিলেন?’ রেমি জানতে চাইল।

‘গোয়াডালক্যানেল থেকে সৈনিকদের তুলতে গিয়েছিলাম। আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ওদেরকে নিয়ে টোকিও চলে যেতে হবে। অনেক দীর্ঘ যাত্রা। ঝড়টা হঠাৎ করে উদয় হয়েছিল। মেঝের দিকে তাকাল ওয়াতানাবি। ‘আমাদের অধিকাংশের জীবনের শেষ চমক ছিল ওটা।

‘আমাদেরকে সেই রাতের কথা বলুন।’ বলল রেমি। ওই ঘটনার অভিজ্ঞতা যাদের ছিল তাদের মধ্যে একমাত্র আপনিই বেচে আছেন এখনও।

 ওয়াতানাবি তার দু’চোখ বন্ধ করল। খুলল একটু পর। গলা পরিষ্কার করে স্মৃতি হাতড়ে বলতে শুরু করল সে।

‘আমাদের বেজ থেকে সন্ধ্যায় রওনা দিয়েছিলাম। জানতাম, বুগেইনভিল এর ১০০ মাইলের ভেতরে আমাদের কোনো প্লেন আক্রমণ করবে না। কারণ ওইটুকু শত্রুপক্ষের রেঞ্জের বাইরে ছিল। ৩০ নট গতিতে এগোচ্ছিলাম আমরা। সাগর সে-রাতে কেমন যেন দ্বিধা-দ্বন্দে ছিল। ঝোড়ো বাতাস আসছিল পশ্চিম দিক থেকে। কে জানতো, সেই হালকা ঝোড়ো বাতাস থেকে আমাদের কপালে দুর্গতি ঘটবে। রাত সাড়ে দশটার দিকে গোয়ালক্যানেলে পৌঁছুলাম আমরা। সৈনিকদের তুলে নিয়ে ১ ঘণ্টার মধ্যে রওনা হলাম।

ওয়াতানাবিকে উৎসাহ দিয়ে মাথা নাড়ল রেমি।

‘যাত্রার দুই ঘণ্টার পর থেকে শুরু হলো সাগরের রুদ্রমূর্তি ধারণ। পাহাড় সমান উঁচু উঁচু ঢেউ আসতে শুরু করল। সাথে তুমুল বৃষ্টি আর বাতাস। অবশ্য ওর চেয়েও জঘন্য আবহাওয়ার মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা ছিল আমাদের। কিন্তু আগের আঘাতপ্রাপ্ত অংশের মেরামত বিকল হয়ে গেল… সমস্যাটা তৈরি হলো তখন। আমাদের হাতে করার মতো কিছুই ছিল না। কয়েকটা লাইফবোট ছিল কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করে শান্তি পাওয়া যায়নি। কারণ, আমাদের সাথে সৈনিকরা রয়েছে। আবহাওয়ার ভয়ঙ্কর রূপের সামনে জাহাজ খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। দীর্ঘ শ্বাস ফেলল ওয়াতানাবি। অধিকাংশ সৈনিক সাঁতার জানত না। আর যারা জানত তারাও সুবিধে করতে পারেনি। এত এত পানি আর ঢেউ। ৪০, ৫০ ফুট উঁচু ঢেউ এলে আসলে কিছু করার থাকেও না। ওর মধ্যে কারও বেঁচে যাওয়াটা রীতিমতো অলৌকিক ঘটনা। ওভারলোড হয়ে লাইফবোট ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করল জাপানিজ। তারপর এলো হাঙরের দল।

আপনারা তাহলে জাপান ফিরছিলেন?’ স্যাম জানতে চাইল।

 হ্যাঁ। আমাদের ক্যাপ্টেনকে সেটাই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

 কারণ?

ওয়াতানাবি মাথা নাড়ল। তা তো জানি না। আপনি যখন নাবিক হিসেবে কাজ করবেন যখন আপনাকে যা নির্দেশ দেয়া হবে সেটাই পালন করতে হবে।’

হাসল রেমি। আপনারা গোয়াডালক্যানেল থেকে শুধু মানুষই তুলেছিলেন?

 ‘হ্যাঁ।’ ভ্রু কুঁচকে গেল জাপানির। পালানোর মিশন ছিল ওটা।’

‘কোনো মাল কিংবা কারগো তোলার সম্ভাবনা ছিল আপনাদের জাহাজে?

 প্রশ্নটা শুনে ওয়াতানাবি বোধহয় ধাঁধায় পড়ে গেছে। কী লাভ এনে? সৈনিকদের কাপড়-চোপড় ঘেঁড়া- ময়লা। পেটে ক্ষুধা। মুমূর্ষ অবস্থা ছিল ওদের।

‘কোনো কিছু লোড করার মতো সময় ছিল?

একটু ভেবে দেখল জাপানি না। কোনমতে সৈনিকদের তুলে নেয়া হয়েছিল।

হঠাৎ দরজা খুলে এক এশিয়ান নারী ঢুকল রুমে। তার বয়স প্রায় ৬০ বছর হবে। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ ক্ষিপ্ত।

‘এখানে কী করছেন?’ স্যাম ও রেমি’র দিকে তাকিয়ে কৈফিয়ত দাবি করল মহিলা। এমনভাবে প্রশ্নটা করল যেন ওরা দুজন মিলে লোকটাকে এতক্ষণ পেটাচ্ছিল।

‘আমরা জাস্ট কথা বলছিলাম। ওনার অনুমতি নিয়েই। বলতে গেল রেমি। কিন্তু মহিলার কারণে থেমে যেতে হলো।

কথা? কীসের কথা? আমার বাবার সাথে কীসের কথা আপনাদের?

মহিলার দিকে তাকিয়ে চুপসে গেল ওয়াতানাবি। যুদ্ধ নিয়ে কথা বলছিলাম।’

রেমি’র দিকে তাকাল মহিলা। মাথা নাড়ল। বহুত কথা বলেছেন। এবার আসুন। ওনার শরীরের অবস্থা ভাল না। অপরিচিত লোকদেরকে সেই ভয়ঙ্কর রাতের গল্প শোনানোর কোনো দরকার নেই।’

‘দুঃখিত। আমরা জাস্ট…’ বলমে গেল স্যাম।

কিন্তু মহিলা ওকে বলার সুযোগ দিল না। আসুন! উনি ক্লান্ত। দেখেছেন বাবার চেহারা? আপনাদের সমস্যাটা কী? নুন্যতম বিবেকবোধ নেই আপনাদের? নরক থেকে কোনমতে ফিরে এসেছে বাবা। ওনাকে শান্তিতে থাকতে দিন।’

দরজার দিকে এগোল ফারগো দম্পতি। আমরা কিন্তু ক্ষতি হতে পারে এমনকিছু করিনি বা করতে চাইনি। আস্তে করে বলল রেমি।

‘আমি বড় হতে হতে দেখেছি যুদ্ধ আমার বাবাকে কী করেছে। জাপান থেকে সরে এসেছে বাবা। দেশটাকে বাবা অনেক ভালবাসত। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আর কখনও ফিরে যায়নি। আপনারা কী জানেন? কিছু জানেন না। জাস্ট… চলে যান। অনেক হয়েছে।

রেমিকে নিয়ে স্যাম বাইরে বেরোল। ওর মুখ শক্ত হয়ে আছে।

‘উনি বোধহয় ঠিকই বলেছেন। আমরা আসলে খুব বেশি কিছু জানি না। তাই না?

‘স্যাম, আমরা কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে প্রায়ই পড়ি। শোনোনা, ওয়াতানাবি’র সাথে আমাদেরকে কথা বলতে হবে। উনি ছাড়া আমাদের আর কোনো রাস্তা নেই।’

‘জানি। কিন্তু তার মেয়ে তো ক্ষেপে ভূত! বুড়ো লোকটাকে বিব্রত করলাম হয়তো।

‘ওয়াতানাবি’র কোনো আপত্তি নেই কিন্তু। যত আপত্তি তার মেয়ের। বাবাকে সামলে রাখতে চায়।’

স্যাম মাথা নাড়ল। তার দিকটাও আমি বুঝি।

 ‘স্যাম, আমরা ভুল কিছু করিনি। ‘তা তো জানি। কিন্তু কেন এরকম মনে হচ্ছে, ভুল করেছি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *