২০. রাজদূত

২০. রাজদূত

মহামান্য, আমি, স্যর উইলিয়াম নরিস সিপিও জাহাজ থেকে আপনাকে এই চিঠি লিখছি। মরিশাস থেকে পাড়ি দিয়ে দুই সপ্তাহ পার করে আমার প্রিয়মাতৃভূমি ইংল্যান্ডের পথে রয়েছি। ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হওয়ার কারণে আমার শরীর এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, মনে হচ্ছে আমার বয়স কেবল বেয়াল্লিশ বছর হলেও, শেষপর্যন্ত হয়তো আমি আর সেই তীরভূমি দেখা পর্যন্ত বেঁচে থাকবো না। আর তাই আশা করছি মহান মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে একজন দূত হিসেবে আমার প্রতিবেদন একটি চিঠি আকারে পেশ করায় আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের শরৎকালে আমি এই দায়িত্ব নিয়ে ব্রিটেন থেকে রওয়ানা দিয়েছিলাম।

আপনি যেসব উপদেষ্টার সাথে এবিষয়ে আলোচনা করতে চান আর যারা ডাকযোগ পাঠানো আমার তথ্য সম্পর্কে অবহিত নন তাদের জ্ঞাতার্থে আমি জানাচ্ছি, আমার দূতিয়ালির উদ্দেশ্য ছিল আমাদের দেশের বণিকদের বিশেষ সুবিধা দেবার জন্য সম্রাটকে রাজি করান। এছাড়া আপনার তরফ থেকে আমি তাঁর কাছ থেকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির নিশ্চয়তা চেয়েছিলাম যে, অসাধু কর্মকর্তা আর বিদ্রোহীর ছদ্মবেশে দস্যুদের লুণ্ঠন থেকে তিনি আমাদের বণিকদের নিরাপত্তা দেবেন।

 দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর আমি ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর হিন্দুস্তানের পূর্ব উপকূলে মসুলিপত্তনে অবতরণ করি। সেখানে আমাদের দূত পিট আমাকে উষ্ণ সম্বর্ধনা দেন। দীর্ঘ এই সমুদ্রযাত্রার কষ্ট আর একঘেয়েমি অভিজ্ঞতার বিবরণ আমি তুলতে চাই না। তবে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমার কাজ শুরু করার ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়া, যেমন উপযুক্ত দোভাষী আর মোগল এলাকায় ঢোকার অনুমতি ইত্যাদি পেতে বেশ সময় লাগলো। পরিশেষে এই সব প্রক্রিয়ার পর ক্লান্ত হয়ে আমি আবার জাহাজে চড়ে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে হিন্দুস্তানের পশ্চিম উপকূলে সুরাট বন্দরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম। চারমাস পর সেখানে পৌঁছলাম। সেখানে অবস্থানরত ইংরেজ বণিকদের সহায়তায় বেশ শীঘ্রই সম্রাটের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারলাম। ওরা আমাকে জানাল, তিনি বর্তমানে দাক্ষিণাত্যের তপতি নদীর তীরে দুর্গনগর বোরহানপুর থেকে একটি অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল এলাকার মধ্য দিয়ে পথ চলে আমি বোরহানপুর পৌঁছে দেখলাম, তিনি আরো দক্ষিণে শিবির স্থাপন করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, মাঝে মাঝে আমাকে প্রকৃতপক্ষে মারাঠিদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা পার হতে হয়েছিল। তবে ওদের প্রশংসা করতে হয় এজন্য যে, ওরা আমার সাথে যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহার করেছিল। দুর্বল শরীর নিয়ে আমি সাথে সাথে আবার রওয়ানা দিয়ে ১৭০১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল সম্রাটের শিবিরে পৌঁছলাম। পানহালা দুর্গের বাইরে তিনি শিবির স্থাপন করেছিলেন। কেননা দশ বছর মারাঠি কজায় থাকার পর তিনি আবার এই দুর্গটি অবরোধ করে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছিলেন।

তার অধীনে প্রায় ১৫০, ০০০ সৈন্য এবং প্রায় সমসংখ্যক শিবির শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও অবরোধ খুব ধীর গতিতে চলছিল। ইতোমধ্যে কয়েক মাস পার হয়ে গেছে এবং গুজব রটেছিল যা পরবর্তীতে আমি সত্য জেনেছিলাম যে, সম্রাট সামরিক বিজয় সম্পর্কে হতাশ হয়ে দুর্গের সামরিক নেতাদেরকে ঘুষ দিয়ে দুর্গ তার হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনা করছিলেন। বিশাল মোগল শিবির প্রায় ত্রিশ মাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। জানতে পারলাম ওদের কাছে ৫০,০০০ উট, ৩০,০০০ হাতি আর সেই সাথে ২৫০টি ভ্রাম্যমাণ বাজারও রয়েছে। সে যাইহোক জায়গাটির কোনো কোনো স্থানে হাঁটু পর্যন্ত কাদা আর বড় বড় সবুজ শ্যাওলাভরা পানির ডোবা ছড়িয়েছিল। এসব জায়গায় প্রচুর মশা ভন ভন করতো। সম্রাটের অনেক সভাসদ আর সেনাপতি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিছুদিন পর আমিও অসুস্থ হয়ে পড়লাম আর চাল ধোয়া পানির মতো আমার পাতলা পায়খানা শুরু হল। সম্রাটের একজন আমিরের আমার মিশন সম্পর্কে যথেষ্ট সমবেদনা ছিল, তিনি আমাকে আফিম মেশানো টক দই খেতে দিলেন, যাকে ওরা লাসসি বলেন। এটা খাওয়ার পর কিছুটা আরাম পেলাম, তবে আবার ভীষণভাবে এবং ঘন ঘন যন্ত্রণাটি শুরু হল। আমার বেঁচে থাকার ব্যাপারে আমি সন্দিহান হয়ে পড়লাম। তবে আমার পীড়ার বিষয়ে বিশদ বিবরণ দিয়ে মহামান্যকে বিরক্ত করতে চাই না।

কিছুটা আরোগ্য লাভ করার পর শরীর একটু সুস্থ হতেই আমি সম্রাটের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে আর্জি পেশ করা শুরু করলাম। বেশ কয়েকবার কয়েকজন দুর্নীতিপরায়ণ অমাত্য অর্থের বিনিময়ে সম্রাটের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার কথা বলে ব্যর্থ হল। তাদের এই আচরণের একটা কারণ আমি বলতে পারি যে, বেশিরভাগ মোগল সেনার মতো এরাও দীর্ঘকাল–কয়েক মাস কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক বছর যাবত তাদের সেবার বিনিময়ে সম্রাটের কাছ থেকে কোনো বেতন কিংবা পুরস্কার পায় নি। বিরাট এলাকাজুড়ে শিবির স্থাপন করায় আশেপাশের এলাকার লোকদেরও যথেষ্ট ভোগান্তি হয় যার কারণে ওরা মোগলদের শত্রুকে সমর্থন করতে উৎসাহিত হয়।

 সম্রাটের বয়স প্রায় তিরাশি হওয়ায় তার উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা বহুল প্রচলিত ছিল। শাহজাদা মুয়াজ্জমের সমর্থকরা আমার সহযোগিতা কামনা করে জানাল তিনি ক্ষমতায় এলে আমাদেরকে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা দেয়া হবে। আমার এখানে আসার পাঁচবছর আগে সম্রাট তাকে গোয়ালিয়র কারাগার থেকে মুক্তি দেন। গোলকুন্ডি শত্রুদের সাথে যোগাযোগ করার অপরাধে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আমিও যথেষ্ট ভদ্রভাবে তাদেরকে ইংরজেদের বদান্যতার কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম। তবে যখন শাহজাদার সাথে দেখা হল তখন দেখলাম তারও যথেষ্ট বয়স হয়েছে এবং তার মনোবল কিছুটা ভেঙ্গে গেছে মনে হল। তবে তার বাবার রাগ এড়াতে এটাও এক ধরনের ভান হতে পারে, তবে এতে আমার সন্দেহ হল। সম্রাট লৌহকঠিন হস্তে তাঁর ছেলে এমনকি মেয়েদেরকেও শাসন করেন। এমনকি তিনি তার একান্ত প্রিয় পুত্র কমবখসকেও অসদাচরণের জন্য একবার সংক্ষিপ্ত কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। পরে জানতে পেরেছিলাম এই অসদাচরণ ছিল মাতাল হওয়া। লোকে বলাবলি করে তার মা, সম্রাটের প্রিয়তমা স্ত্রী উদিপুরী মহল তার হাঁটুর উপর মাথা রেখে ছেলের মুক্তির জন্য কাকুতিমিনতি করে বলেছিলেন যে, তার নিজের কারণেই তার ছেলে এটা করেছে, দোষ তারই। সে কেবল তার মায়ের বদভ্যাস অনুসরণ করছিল।

আমি প্রথম সম্রাটকে দেখতে পেলাম যখন তিনি একটি শিবিরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, অবরোধ পরিদর্শনের জন্য তাকে পালকিতে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তার পুরো অবয়ব ছিল সাদা ধবধবে, পোশাকে, পাগড়ি, চুলে এমনকি দাড়িও সাদা ছিল। তিনি ছিলেন একজন মর্যাদাজ্ঞাপক ব্যক্তিত্ব, কারও দিকে তাকাচ্ছিলেন না, সারাক্ষণ পবিত্র কুরআনের উপর চোখ রেখে পড়ে যাচ্ছিলেন, একবারও এদিক ওদিক তাকান নি। অনেকেই তার ধার্মিকতার প্রশংসা করে, তবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন চাপিয়ে দেওয়ার কারণে তিনি অনেকের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন।

২৮ এপ্রিল তার সাথে আমি দেখা করার অনুমতি পাই। তিনি অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে আপনার উপহারের জন্য ধন্যবাদ জানান আর আপনার দীর্ঘ শাসন কামনা করেন। এধরনের ভূমিকার পর তিনি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে আমাকে জানান তাঁর কাছ থেকে আমি সেরকম বন্ধুত্ব কিংবা স্বাধীনতা আশা করতে পারি না যা, তাঁর পিতামহ সম্রাট জাহাঙ্গীর আমার পূর্বসূরি স্যর টমাস রো’এর সাথে করেছিলেন। আরো বললেন তিনি বিদেশি মদ কিংবা গভীর রাতে ভিনদেশী দর্শন নিয়ে আলোচনা করার ব্যাপারেও আগ্রহী নন।

 তবে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, তিনি আমাদের অনুরোধের প্রতি বিশেষ সুনজর দেবেন, যদি আমরা ভারত মহাসাগর থেকে জলদস্যুদের উচ্ছেদ করি–যার মধ্যে অনেকেই ইংল্যান্ড আর আমাদের উপনিবেশ থেকে আগত। বিশেষত বোম্বে (মুম্বাই) বন্দরের অদূরে হাজিবাহী মোগল জাহাজ গনজ-এ সাওয়াই থেকে হেনরি এভারি তাঁর হিসেবে প্রায় ২০০,০০০ পাউন্ডের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বিষয়ে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেন। সম্প্রতি জলদস্যুরা কায়েদাহ মার্চেন্ট জাহাজটি দখল করার বিষয়েও অভিযোগ করলেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করে জানালাম যে, তাঁর মতোও আমরাও সাগর থেকে জলদস্যুদের উৎখাত করতে বিশেষ আগ্রহী। আর জানালাম অনেক প্রচেষ্টার পরও এভারিকে ধরতে না পারলেও উইলিয়াম কিডকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যে, কায়েদাহ মাচেন্ট জাহাজের উপর আক্রমণ করেছিল। আমাদের নৌ-বাহিনীর শক্তি আর উভয়ের স্বার্থে এটি ব্যবহার ব্যাপারে তিনি খুব একটা আস্থা স্থাপন করতে পারলেন না। তারপর আমাকে বিদায় জানিয়ে আমার অনুরোধের বিষয় নিয়ে তাঁর রাজকর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করতে বললেন।

এই অর্থলোলুপ লোকগুলোর সাথে বহুবার আলোচনায় বসলাম। প্রায় সকলেই আমার কাছ থেকে বন্ধুত্ব এবং সুভেচ্ছার নিদর্শন কামনা করলো পরিষ্কারভাবে বলা যায় ঘুষ চাইল। সম্রাটের নিষেধ সত্ত্বেও অনেকেই মদের প্রতি বিশেষত ‘উত্তর ব্রিটিশ মদ’এর প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখাল। তারপর অনেক সময় আর অর্থব্যয়ের পর আমি তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু সুবিধা আদায় করলাম, যেমন কর এবং শুল্কের পরিমাণ কমান হল এবং আমাদের বণিক এবং মালামালের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায় করলাম। তবে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, পরবর্তী প্রতিশ্রুতিটি কার্যক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়া বাস্তবায়িত হবে না।

 মোটামুটি গত ছয়মাসের আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, মোগল সাম্রাজ্য এর অভ্যন্তরীণ শত্রুর কারণে দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলছে। সবার আগে শক্তিশালী মারাঠিদের কথা বলতে হয়, তাদের শাসক সম্ভাজির মৃত্যুর পরও তারা টিকে থাকতে পেরেছে। তারপর একসময় যখন তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছিল, তখন আবার শিবাজির ছোট ছেলে এবং সম্ভাজির ভাই-রাজারামের নেতৃত্বে সংগঠিত হল। এরা অবিরত সম্রাট এবং তার সেনাবাহিনীর প্রতি একটি ভীতি হয়ে রইল এবং বিশেষত দাক্ষিণাত্যে ওদেরকে আটকে রাখলো। আমি দেশ ছাড়ার আগে জানতে পেরেছি যে রাজারাম মারা গেছে, তবে তার বিধবা স্ত্রী কোনো রক্তপাত ছাড়াই তাদের নাবালক ছেলেকে তার উত্তরাধিকার নিযুক্ত করতে সফল হয়েছেন।

আরো অনেক বিদ্রোহ রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়–উত্তরে, উদাহরণস্বরূপ, পাঞ্জাবের শিখ আর জাটরা। আমি শুনেছি শিখদের একটি আলাদা ধর্মবিশ্বাস রয়েছে, তারা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। আওরঙ্গজেব তাদের নেতা_যাকে তারা তাদের গুরু বলেন,–সেই তেগ বাহাদুরকে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে কোতল করার পর, শিখরা তেগ বাহাদুরের ছেলে গুরু গোবিন্দ সিং-এর নেতৃত্বে তাদের নিজেদের বন্ধন সুদৃঢ় করে। গুরু গোবিন্দ ইতোপূর্বে মোগল এবং অন্যান্য প্রতিবেশী শক্তির সাথে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ করেছিলেন। আমি যখন হিন্দুস্তান ছিলাম, তখন ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের বাৎসরিক ফসল কাটার দিন, আনাদপুরে শিখদের একটি বিশাল সমাবেশের খবর শুনে মোগল সেনাপতিদের মধ্যে আতঙ্ক জেগে উঠেছিল। তাদের গুরু গোবিন্দ খালসা নামে শিখদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এখন থেকে সকল সদস্য তাদের নামের সাথে সিং’ অর্থাৎ সিংহ যুক্ত করবেন, আধ্যাত্মিক ঐক্য বজায় রাখবেন এবং তাদের নিজেদেরকে এবং ধর্মকে যারা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করবে তাদেরকে প্রতিরোধ করবে। আমি যখন হিন্দুস্তান ছেড়ে আসি তখন মোগলরা শিখদের বিরুদ্ধে একটি বিশাল যুদ্ধাভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

জাটরাও সাহসী যোদ্ধা। ওরা অতর্কিত হামলা করে পালিয়ে যেতে পারঙ্গম। সম্প্রতি ওরা আগ্রার কাছে সম্রাট আকবরের জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল সমাধিসৌধে হামলা চালিয়ে এর বেশিরভাগ সোনার সাজসজ্জা আর আসবাব লুট করে নিয়ে যায়। সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পারস্যের শাহ সবসময় একটি আতঙ্ক ছিল। নিজের সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়াবার জন্য তিনি সবসময় মোগল সাম্রাজ্যের দিকে হাত বাড়াবার সুযোগ খুঁজতেন।

 বিদ্রোহী এবং বহিঃশত্রুর হামলার আশংকা ছাড়াও আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্য আরো অন্যদিক থেকে চাপের মুখে ছিল। দূরবর্তী প্রদেশগুলোর দুর্নীতিপরায়ণ রাজকর্মকর্তারা মনে করতো সম্রাট মারাঠিদের নিয়ে ব্যস্ত আছেন, কাজেই সেই সুযোগে ওরা হিন্দুস্তানের দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে অর্থ আদায় করতো। অবিরত যুদ্ধ চলার কারণে মোগল সাম্রাজ্যের কোষাগারের উপর চাপ পড়ায় সম্রাট কর বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হন, যার ফলে প্রজাদের দুর্দশা আরো বেড়ে যায়।

আমার মতে সম্রাট তার শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব দিয়ে একা তার সাম্রাজ্যকে ধরে রেখেছেন। তাঁকে যেমন সবাই ভয় পায় তেমনি সম্মানও করে। তার বয়স হওয়া সত্ত্বেও কেউ তাঁর বুদ্ধির সূক্ষ্মতা আর অন্যদের মনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে তাদের কার্যকলাপ আগে থেকে বুঝে নেওয়ার ক্ষমতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করে না। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রয়োজনে তিনি সবচেয়ে কাছের পরিচারক আর দেহরক্ষীদের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য বিশেষ যত্নবান থাকেন। আর অনেক সময় সাধারণ মানুষদের প্রতিও ছোটখাট দয়া-দাক্ষিণ্য আর তাদের প্রতি মনোযোগ দেখিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করেন। আবার তাদের প্রতি তাঁর আগ্রহ আর তাদের জীবন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান দেখিয়ে তিনি তাদেরকে অবাক করে দিতেন।

 আমি দেখতে পাচ্ছি, যখন তিনি মারা যাবেন তখন আবার সিংহাসনের দখল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঝে একটি সংঘর্ষ শুরু হবে। তাঁর জীবিত চার ছেলের মধ্যে কে তাঁর উত্তরাধিকার হতে পারবে তা আমি বলতে পারবো না। এর আগে আমি বর্ণনা করেছি শাহজাদা মুয়াজ্জমকে বাইরে থেকে একজন সাধারণ মানুষ মনে হয়েছে। আকবর এখনও পারস্যে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন এবং আমি জেনেছি তাকে আতিথ্য দেওয়া হয়েছে তবে তার মায়ের তরফের আত্মীয় কিংবা শাহের তরফ থেকে কোনো ধরনের সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। তাছাড়া তার উপর শাহের তেমন আস্থাও নেই। আকবরের আপন ভাই আজম বর্তমানে গুজরাটের সুবেদার। সাধারণত সবাই জানে তিনি ঝোঁকের বশে চলেন এবং অত্যন্ত অপরিণামদর্শী, তার দ্বারা কোনো সফল অভিযান সম্ভব নয়। সবার ছোট কমবখসের একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে, তাকে তাঁর বাবার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র মনে করা হয় আর সেজন্য তার পথটি হয়তো সহজ। তবে তার সাথে মেশার পর তাকে আমার অর্বাচীন আর অলস মনে হয়েছে, যদিও তার মধ্যে যথেষ্ট রসবোধ আছে। হয়তো এমনও হতে পারে, আওরঙ্গজেবের শক্তিশালী সেনাপতিদের মধ্যে কেউ তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে নিজেই সিংহাসন দখল করতে পারে। তবে যাই হোক, এই অবশ্যসম্ভাবী বিভ্রান্তি আর অন্তঃকলহ আমাদের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করবে। সেদেশের সাথে আমাদের বাণিজ্য থেকে বর্ধিতহারে যে লাভ হচ্ছে, তা কাজে লাগিয়ে সুবিধাজনক এলাকার গভর্নরদের ঘুষ দিয়ে হাত করে এই সম্পদশালী আর বিশাল দেশে ইংল্যান্ডের অবস্থান আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে।

আমার আশংকা আমার ক্ষয়িষ্ণু স্বাস্থ্য আমাকে আর লিখতে অনুমতি দেবে না। যদি ঈশ্বর আমার আয়ু বাড়িয়ে দেন তবে আবার আমি কাজ শুরু করবো। আর যদি তা না হয়, তবে আমি স্যর উইলিয়াম নরিস, আপনার অনুগত প্রজা এবং হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রদূত, মহামান্যের প্রতি অভিবাদন জানাচ্ছি আর আমার স্ত্রীকে আপনার করুণায় ছেড়ে দিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *