১৯. জল্লাদ

১৯. জল্লাদ

কামরান বেগ হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, জাহাপনা, ক্ষমা করবেন অসময়ে আপনাকে ঘুম থেকে উঠাবার জন্য কোরচিকে বলেছি বলে। তবে আমার কাছে যে খবরটি আছে তার জন্য আর দেরি করা যায় না। আমার দুজন চর সম্ভাজিকে খুঁজে পেয়েছে–সে সংঘামেশ্বরে আছে!’ আওরঙ্গজেব তার গুপ্তচর প্রধানকে এরকম উত্তেজিত হতে কখনও দেখেন নি।

 ‘সংঘামেশ্বর? এটা কী? কোনো দুর্গ?

না জাহাপনা। শাস্ত্রি আর সোনভি নদী যেখানে মিশেছে, সেখানে একটি প্রমোদ উদ্যানের মাঝে এটি একটি প্রাসাদ। জায়গাটা বেশ ছোট আর তেমন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও নেই। আমার লোকেরা এটা ঘুরে দেখে এসেছে। জায়গাটির মালিক কবি-কুলেশ নামে সম্ভাজির একজন সেনাপতি। সে সম্ভাজিকে অতিথি হিসেবে সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমার লোকেরা চুড়িফিতার ফেরিওয়ালা হিসেবে সেখানে কয়েকদিন কাটিয়েছে। ওরা সেখান থেকে শুনে এসেছে, সম্ভাজি সেখানে কবি-কুলেশের সাথে আমোদ-ফুর্তি করছে। তার সাথে কয়েকজন মাত্র সেনা রয়েছে।’

 ‘এত কম সৈন্য কেন সে সেখানে নিয়ে গেছে?

কারণ তার ইচ্ছে ছিল খুব কম সময় সেখানে কাটাবে। তার বেশির ভাগ সেনা সে সেখান থেকে একটু দূরে দেবরুখ নামে একটি স্থানে ছেড়ে এসেছে। ওরা সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র, রসদ নেবে আর প্রশিক্ষণের জন্য কিছুদিন অবস্থান করছে। তবে সংঘামেশ্বরের এমন প্রচণ্ড আর্কষণ যে, সে এক মাসেরও বেশি সময় সেখানে রয়েছে আর সেখান থেকে তার চলে আসারও কোনো নামগন্ধ দেখা যাচ্ছে না।

আওরঙ্গজেব চোখ বুজে একটু ভাবলেন। সম্ভাজি সম্পর্কে তিনি যা যা শুনেছেন এটা তার সাথে খাপে খাপে মিলে যায়। বাবার মতো সাহসী যোদ্ধা হলেও সে যুদ্ধের প্রস্তুতি আর পরিকল্পনার কাজটি তার অধীনস্থ সেনা কর্মকর্তাদের উপর খুশি মনে ছেড়ে দেয়, যা শিবাজি করতেন না। তাঁর মনে একটা প্রশ্ন জাগতেই তিনি বললেন, “তোমার চরেরা সম্ভাজিকে সংঘামেশ্বরে কেমন করে খুঁজে পেল?

কামরান বেগ একটু অপ্রস্তুত হয়ে একমুহূর্ত ইতস্তত করলো, তারপর বললো, ‘এটা প্রথমে ওয়াজিম খান বলেছিলেন যে, সে ঐ জায়গায় থাকতে পারে। সন্তাজি নামে যে তরুণ মারাঠি বন্দীটিকে আপনি ছেড়ে দিয়েছিলেন, প্রথমবার জিজ্ঞাসাবাদের সময় ঐ তরুণটি বলেছিল যে সম্ভাজি সংঘামেশ্বর জায়গাটি পছন্দ করেন…এমনকি সে নিজেও তার সাথে সেখানে সময় কাটিয়েছে।

তাহলে ওয়াজিম খান আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন লোক ছিল …তার প্রধান গুপ্তচরকে বরখাস্ত করার পর থেকে আওরঙ্গজেব কয়েকবার আফসোস করেছিলেন যে, সে আর তার পাশে নেই। তার মন ছিল খুব তীক্ষ্ণ আর পরামর্শগুলোও সবসময় খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ছিল। আর এখন মনে হচ্ছে ওয়াজিম খান তাকে একটা সুযোগ উপহার দিল যে তাকে ভোলা যায় না। তিনি বললেন, কামরান বেগ, তুমি নিশ্চয়ই এখান থেকে সংঘামেশ্বর পর্যন্ত যে এলাকাটি আছে তা ভালো করেই জান। আমাদের সৈন্যদের সেখানে পৌঁছতে কত সময় লাগবে?

‘এই দুর্গ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সংঘামেশ্বর প্রায় একশো মাইল দূরে। ভালো ঘোড়া আর সুসজ্জিত একটি অশ্বারোহী সেনাবাহিনীর সেখানে পৌঁছতে প্রায় দুই দিন লাগবে আর কোনো সাহায্য পৌঁছার আগেই সম্ভাজিকে ধরে আনা যাবে–আমি আমার জীবন বাজি রেখে একথা বলতে পারি!

 ‘একটি সেনাদল কী যথেষ্ট হবে?’

স্থানটি খুব একটা সুরক্ষিত নয়। তাছাড়া একটি ছোট সেনাদল মারাঠি এলাকায় ঢুকলে খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না।

‘ঠিক বলেছ, কামরান বেগ। তুমি একজন ভালো যোদ্ধা আর সেনানায়ক আর আমার প্রধান গুপ্তচর। আমি তোমাকেই এই অভিযানের দায়িত্ব দিচ্ছি। মারাঠি বন্দীটিকে তোমার সাথে নাও। সংঘামেশ্বর সম্পর্কে তার জ্ঞান কাজে লাগতে পারে। আর তোমার জন্য রয়েছে উত্তম পুরস্কার যদি তুমি সফল হতে পার। আর যদি ব্যর্থ হও তবে একজন শহীদ হিসেবে আমাদের মহৎ উদ্দেশ্য আর ধর্মবিশ্বাসের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেবে। দুই দিকেই তোমার জন্য গৌরবজনক সম্মান অপেক্ষা করছে। প্রস্তুতি নেবার জন্য কামরান বেগ দ্রুত চলে যেতেই আওরঙ্গজেব মুখ বিকৃত করে মৃদু হাসলেন। তাঁর গুপ্তচর প্রধানের বাঁচামরা নির্ভর করছে তার চরদের পর্যবেক্ষণের নির্ভুলতা, গুণ আর তার নিজের নির্দেশনার উপর। আসলে এভাবেই এটা হওয়ার কথা।

*

কামরান বেগ তার লোকদেরকে নির্দেশ দিল, আমরা এই জঙ্গলের কিনারায় থামবো। ঐ গাছগুলোর গুঁড়িতে ঘোড়া বাঁধ। আর তুমি ইব্রাহিম আলি চারজন লোকসহ এখানে থেকে ঘোড়াগুলো পাহারা দেবে। আর অন্যরা হেঁটে যাওয়ার জন্য তৈরি হও।’ দ্রুত আলো কমে আসছে, অশ্বারোহী সেনারা চটপট কাজে লেগে পড়লো। বড় চামড়র মশক থেকে পেটপুরে পানি খেয়ে আবার ঘোড়ার জিনের সাথে বেঁধে রেখে অস্ত্রশস্ত্র পরীক্ষা করে নিল। কামরান বেগ ওদের মাঝে ঘুরে ঘুরে দেখে নিল সবকিছু ঠিক আছে কি-না। যখন সবাই তৈরি হল তখন সে খুশি হয়ে একবার ঘোৎ করে একটা শব্দ করলো। বুদ্ধি করে সে তার লোকজনদের মারাঠিদের মতো পোশাক পরিয়েছিল। এতে পথে আসার সময় যেমন ছদ্মবেশ হিসেবে কাজ করেছে তেমনি এখন প্রাসাদে ঢুকতেও সাহায্য করবে।

সে একজন সৈন্যকে বললো, ‘সন্তাজিকে নিয়ে এস। তাকে আমার সাথে রাখবো। কয়েকমুহূর্ত পর সন্তাজি তার সামনে হাজির হল। কামরান দৃঢ়হাতে তার কাঁধ জাপটে ধরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “শোন, এখন সামনে যা হবে তাতে তোমার ভাগ্য নির্ধারণ হবে। যদি আমি দেখি যে সংঘামেশ্বর সম্পর্কে তুমি কোনো কিছু মিথ্যা বলেছ, তাহলে আমি তোমার গলা কাটবো। বুঝতে পেরেছ?

 সন্তাজি মাথা নাড়লো।

তবে যাওয়ার আগে আমি তোমাকে একটা শেষ সুযোগ দিতে চাই। তুমি যা বলেছ তা সব সত্যি?

হ্যাঁ, জনাব।’

“ঠিক আছে। আমরা যখন পথ খুঁজে প্রাসাদের দিকে যাব, তখন আমার চোখ আর কান হয়ে তুমি সারাক্ষণ আমার পাশে থাকবে। হাত বাড়াও। ছুরি বের করে কামরান বেগ ছেলেটির হাতের বাঁধন কেটে দিল। এটা করলাম, যাতে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না হয়। কোনো কিছু করার চেষ্টা কর না। এখন চল।

 ষাটজন লোক নিঃশব্দে জঙ্গলের পথ দিয়ে এগিয়ে চললো। মাঝে মাঝে কেবল। মাটিতে পড়ে থাকা গাছের ডাল আর পাতা মাড়িয়ে চলার সময় মচ মচ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। চাঁদ উঠতেই কিছু আলো পাওয়া গেল তবে একটু পরই গাছ কমে আসতেই কামরান বেগ খুশি হয়ে দেখলো এখন ভালভাবে পথ দেখা যাচ্ছে। একটা খোলা জায়গার কাছে পৌঁছার পর তার মনে হল সামনে পানির আভা দেখা যাচ্ছে। সোনভি নাকি শাস্ত্রি নদী? সে নিশ্চিত হতে পারলো না, তবে এতে কিছু যায় আসে না। সে নদীর তীরের দিক থেকে প্রাসাদে যেতে চাচ্ছে না। তার যে দুই চর সম্ভাজিকে খুঁজে বের করেছিল, তারা বলেছিল দুই নদী যেখানে এক হয়ে সাগরের দিকে চলে গেছে, সেই কোণে কবি-কুলেশ একটি উঁচু মার্বেল চত্বর নির্মাণ করেছিল। আর সেই চত্বরের পেছনেই প্রথমে প্রাসাদ আর তারপর প্রমোদ উদ্যান। আর এই পথ দিয়ে অতিথিরা ভেতরে ঢুকে, এ ধরনের কথাও সন্তাজি বলেছিল।

ওরা এখন গম ক্ষেতের মধ্য দিয়ে দ্রুত ছুটছিল। শেষ মাথায় প্রায় ছয় ফুট উঁচু একটা পাথরের দেয়ালের কাছে পৌঁছল। ছয়জনকে পেছনে পাহারায় রেখে কামরান বেগ বাকি লোকদেরকে দেয়াল টপকাতে নির্দেশ দিল। দেয়াল টপকে লাফ দিয়ে ওরা নিচে নরম ঘাসের জমিনে পড়তেই নাকে ফুলের সুঘ্রাণ পেল। কামরান বেগের নেতৃত্বে ওরা সতর্কভাবে চুপিসারে সামনেই একটি গোলাপবাগানের দিকে এগোল। কামরান সন্তাজির কনুই ধরে সামনে হাঁটছিল। গায়ে কাঁটার খোঁচা খেতে খেতে ওরা গোলাপ বাগান পার হয়ে একটি খোলা জায়গায় পৌঁছল। এখানে একটি বড় আর চারটি ছোট আকারের মার্বেল পাথরের ফোয়ারার পানিতে চাঁদের আলোয় রূপালি রঙ ছড়াচ্ছিল। ঘন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কামরান বেগ উঠেছে দেখতে পেল– সামনে অন্ধকার ভেদ করে ছোট ছোট আলোর ফোঁটা ফুটে রয়েছে। এখানে সেখানে একটা দুটো–খুব বেশি নয়। আস্তে শিস দিয়ে সে ওদেরকে থামতে বলে সন্তাজিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঐ আলাগুলো কী? পাহারাদারদের বেড়ার আলো?’

না, তা মনে হয় না। জনাব। এই বাগানে কয়েকটি ঘর আছে যেখানে কবি কুলেশের লোকরা মাঝে মাঝে এসে নর্তকীদের নাচ-গান উপভোগ করে। রাতে চাকরেরা এখানে মশাল আর মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যায়, যেরকম সমস্ত প্রাসাদে, মার্বেল চত্বরসহ সবজায়গায় ওরা জ্বালায়। এই আলোগুলো নদীর পানির উপর প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করে যেন, এর উপর হীরা। ভাসছে।

কামরান বেগ মুখে ভেংচি কাটলো। এই কবি-কুলেশ মনে হয় ভাবছে সে পৃথিবীতে একটি স্বর্গ বানিয়ে সেখানে থাকছে– যেরকম গোলকুন্ডার শাসকও ভেবেছিল। আর আল্লাহ চাহে তো তারও সে ভুল শীঘ্রই ভেঙ্গে যাবে। সন্তাজি তুমি আমাদেরকে বাগানের মধ্য দিয়ে দ্রুততম পথ দেখিয়ে প্রাসাদে নিয়ে চল, তবে ঐ প্রমোদ ঘরগুলো এড়িয়ে চল।

 তরুণটি মাথা নেড়ে ডান দিকে ইঙ্গিত করলো। এরপর কামরান বেগ দুবার শিস দিয়ে ইঙ্গিত দিতেই মোগল দলটি আবার সামনে এগোল। ঠিকই ওদের বামদিকেই কোনো এক জায়গা থেকে গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। মাথা ঘুরিয়ে কামরান বেগ এবার ঝোঁপের মাথার কিনারায় ছোট ছোট থামের মাথা দেখতে পেল। এর চারপাশে মাটিতে জ্বলন্ত মশাল পুঁতে রাখা হয়েছে। সে সেতারের টুং টাং আর তার সাথে তবলার ছন্দময় বোল শুনতে পেল। এই লোকগুলোর কোনো পরিকল্পনাই নেই। যদি এটা মোগল এলাকা হত, তাহলে কোনো অবাঞ্চিত প্রবেশকারী বিনাবাধায় কোনোভাবেই দেয়ালের কাছে পৌঁছতে পারতো না, আর দেয়াল টপকে প্রাসাদের আঙিনায় ঢোকা তো দূরের কথা।

তবে এত আত্মতুষ্টি লাভ করাটা একটা ভুল হবে। সম্ভাজি হয়তো ফুর্তি করতে ভালোবাসেন, তবে তিনি এত বোকা নন। আর কবি-কুলেশও নয়, একজন সেনাপতি হিসেবে চতুর্দিকে যার বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। মোগলদের গোপন হামলার খবর ওদের কানেও পৌঁছতে পারে, কেননা শুধু আওরঙ্গজেবেরই যে গুপ্তচর আর খোঁজ-খবর নেওয়ার মতো লোক আছে তা নয়। এই নিস্তব্ধতা হয়তো একটা ফাঁদ হতে পারে, মোগলদেরকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে এনে তাদেরকে ধ্বংস করার একটা ফন্দি। সন্তাজিকে কাছাকাছি রেখে কামরান বেগ তার লোকদেরকে দ্রুত চলতে বললো আর একটু পরই সেতারের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে শুরু করলো।

নিচু হয়ে চুপিসারে চলতে চলতে আরো কিছু সুগন্ধি ফুলগাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে ওরা ঠিক সামনেই একটি নিচু সাদা দালান দেখতে পেল। এটাই নিশ্চয়ই সংঘামেশ্বরের প্রাসাদ। এর ছাদে কয়েক ফুট পর পর পাত্রে আগুন জ্বেলে তার শিখায় রাতের আকাশ আলোকিত করে রাখা হয়েছে। এর দোতলার জানালাগুলো থেকে আরো আলো দেখা যাচ্ছে। এছাড়া মূল প্রবেশ পথের খোলা দরজার ভেতর থেকে আলো এসে দালানের বাইরের অর্ধবৃত্তকার উঠানেও কমলা রঙের আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। কামরান বেগ আবার তার লোকদেরকে থামতে ইশারা করলো তারপর মাটিতে বসে পড়তে ইঙ্গিত করলো। চাঁদের অবস্থান দেখে আন্দাজ করা যায়, রাত বেশি হয়নি–বড় জোর রাত নয়টা। বেশি তাড়াহুড়া করার দরকার নেই। শীঘ্রই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে মূল ফটকের পাশে দুজন মারাঠি প্রহরী দেখতে পেল। গাদা বন্দুক দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে ওরা মাটিতে আসনপেতে বসে কথা বলছিল। কয়েকমিনিট পর পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে দুজন লোক প্রাসাদের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে এসে একজন প্রহরীকে কিছু একটা বলতেই লোকটি জোরে হেসে উঠলো। লোকদুটো আবার ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ আর কিছুই ঘটলো না। তারপর একজন প্রহরী উঠে তার সঙ্গীর দিকে পেছন ফিরে ছর ছর শব্দ করে প্রস্রাব করে আবার ফিরে গিয়ে আসনপিড়ি হয়ে বসে পড়লো।

 তারপর অন্ধকারে কোথা থেকে প্রাসাদের পেছনের ডান দিক থেকে নুড়িপাথরের পথ দিয়ে লোহার চাকাওয়ালা গাড়ি আসার ঘর্ঘর শব্দ শোনা গেল। সেদিকে উঁকি দিয়ে কামরান বেগ দেখতে পেল, প্রাসাদের এক কোণ ঘুরে ছয়টি বলদ একটি বড় গরুর গাড়ি টেনে আনছে। দেখে মনে হচ্ছে গাড়িটি নদীর দিক থেকে এসেছে। গাড়োয়ান লম্বা চাবুক হাঁকাতেই, পিপা আর বস্তা বোঝাই গাড়িটি প্রহরীদের পাশ কাটিয়ে ফটক দিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে গেল। প্রহরীরা একবারও এর দিকে ফিরে তাকাল না। কয়েকমিনিট পর দ্বিতীয় আরেকটি মালবোঝাই গরুরগাড়ি অন্ধকার থেকে উদয় হল আর একইভাবে প্রথম গাড়িটিকে অনুসরণ করে ফটকের মধ্য দিয়ে প্রাসাদের ভেতরে চলে গেল।

কামরান বেগ সন্তাজিকে জিজ্ঞেস করলো, এই গাড়িগুলো কী নদী থেকে মালামাল আনছে?

 ‘হ্যাঁ, জনাব। প্রাসাদের রসদ নদীপথে এনে এখান থেকে প্রায় আধামাইল দূরে নদীর একটি ঘাটে এনে রাখা হয়, তারপর গরুর গাড়িতে বয়ে প্রাসাদে নিয়ে আসা হয়। নদীর প্রবল স্রোত আর দুই নদীর সঙ্গমস্থলের তীব্র স্রোতের কারণে নৌকাগুলো আসতে অনেক সময় দেরি হয়।

‘গাড়ির মাল কোথায় খালাস করা হয়?

‘প্রাসাদের মূল উঠানে খালাস করা হয়, সেখান থেকে সিঁড়ি সোজা মাটির নিচে মদের ভাঁড়ারে নেমে গেছে।

 কয়েক মিনিট পর গরুরগাড়িগুলো আবার প্রাসাদ থেকে বের হয়ে নদীর দিকে চলে গেল। কামরান একমুহূর্ত চিন্তা করলো। তার পরিকল্পনা ছিল ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে অন্ধকার আর ছদ্মবেশের উপর নির্ভর করে তার লোকেরা প্রাসাদে ঢোকার চেষ্টা করবে–তবে এখন একটা আরো ভালো পথ বের হয়ে এসেছে…। সে বললো, “আচ্ছা গাছের আড়ালে আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বাগানের মধ্য দিয়ে আমরা খুব তাড়াতাড়ি নদীর ঘাটে পৌঁছতে পারি না?’ সন্তাজি মাথা নেড়ে সায় দিতেই সে আবার বললো ‘চমৎকার, তাহলে সেখানে আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল।

 প্রায় আধাঘণ্টা পর কামরান বেগের লোকেরা অতর্কিত আক্রমণ করে দুই গারোয়ানকে ছুরি মেরে লাশগুলো ঝোঁপের আড়ালে টেনে নিয়ে গেল। সাথে সাথে কামরান বেগ দশজনকে এক একটা গাড়িতে চড়তে বললো। দুজন বসবে গারোয়ানের আসনে আর বাদবাকিরা পিপা আর বস্তার আড়ালে লুকাবে। তার বাকি সৈন্যদেরকে ফটকের উল্টোদিকে আগের জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে বললো, আর লড়াইয়ের শব্দ পাওয়ার সাথে সাথে ওরা প্রাসাদে ঢুকে পড়বে। তারপর সে সন্তাজিকে ঠেলা দিয়ে প্রথম গাড়িতে উঠে বসে একটা পানি নিরোধক কাপড় গায়ের উপর টেনে নিল।

গাড়োয়ানের আসনে বসা লোকটি চাবুক হাঁকাতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। নদীর পথ ধরে চলতে চলতে প্রাসাদের এক পাশ দিয়ে ঘুরে মূল ফটকের দিকে এগোল। ভাগ্যের কি পরিহাস, কামরান বেগ ভাবলো। যখন সে নিজে ছোট ছিল, তখন সম্ভাজি আর শিবাজি বেতের ঝুড়িতে লুকিয়ে আগ্রা দুর্গ থেকে পালিয়েছিল। আর এখন সম্ভাজিকে আবার ধরতে সে নিজে লুকিয়ে একটি প্রাসাদে ঢুকছে। আর এক মিনিট, তারপরই ওরা উঠানে ঢুকে পড়বে…ছুরির বাটে হাত রেখে শক্ত হয়ে বসলো, কেউ কিছু বললেই লাফ দিয়ে উঠবে। শুনতে পেল একজন প্রহরী কিছু একটা বলে উঠতেই তার এক লোক উত্তর দিল। সন্তাজি আগেই ওদেরকে শিখিয়ে রেখেছিল ওরা কিভাবে নমস্কার করে আর কি উত্তর দিতে হবে। গাড়িটা একটা বাঁক নিয়েই উঠানে ঢুকে থেমে দাঁড়াল।

 কামরান বেগ ফিস ফিস করে সবাইকে বললো, যেখানে আছ সেখানেই বসে থাক! অন্য গাড়িটাকে আসতে দাও।’ তবে প্রায় সাথে সাথে পেছন থেকে ষাড়ের মৃদু ডাকের সাথে সাথে গরুর গাড়ির কাঁচকাঁচ শব্দে বুঝা গেল দ্বিতীয় গাড়িটাও এসে পড়েছে।

তারপর কামরান বেগ একটা চিৎকার আর সেই সাথে অর্তনাদ শুনতে পেল। গায়ের উপর থেকে কাপড়টা ফেলে দিয়ে সে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। পেছনের দ্বিতীয় গাড়িটার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলো কি ঘটেছে। একজন মারাঠি মাটির উপর হাত-পা ছড়িয়ে গলা কাটা অবস্থায় চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছে আর তার দুই লোক তার কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে হয়তো গাড়ির ভেতরে উঁকি দিয়ে ওদেরকে দেখে ফেলে চিৎকার করতে যাচ্ছিল। কামরান বেগ চিৎকার করে বললো, সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়, এখুনি!

ঠিকই মারাঠি লোকটির চিৎকার শোনা গিয়েছিল। প্রায় দশজন মারাঠি উঠানে ছুটে এল। কামরান বেগের লোকদের ছদ্মবেশ দেখে ওরা একটু থতমত খেতেই মোগলরা একটু সময় পেল। সাদা পাগড়িপরা লম্বা-চওড়া একজন মারাঠি একটু ইতস্তত করতেই কামরান বেগ লোকটির ডান চোখ লক্ষ্য করে ছুরি চালাল। লোকটি আর্তচিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

এমন সময় একজন তরুণ মোগল সেনা সাবধান করে চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘উপরে তাকান! সাবধান! কামরান বেগ মাথা নিচু করে সরাতেই ছাদের উপর থেকে একজন মারাঠি তার দিকে লক্ষ্য করে গাদা বন্দুকের গুলি ছুড়লো। গুলিটা তার মাথর উপর দিয়ে সাঁৎ করে উড়ে গিয়ে একটা গরুর গাড়ির কাঠে লাগলো। মারাঠি লোকটি আবার গুলি করার প্রস্তুতি নিতেই মোগল সেনাটি তার পিস্তল বের করে তাকে একটা গুলি করলো। মারাঠি লোকটির হাতে গুলি লাগতেই সে তার বন্দুক ফেলে দিয়ে ছুটে পালাল।

কয়েকগজ দূরে ইব্রাহিম আলি দুজন মারাঠির সাথে লড়াই করছিল। ওদের তরোয়ালের আঘাত এড়িয়ে সে লাথি দিয়ে একজনকে ফেলে দিতেই সে তার সঙ্গীর গায়ের উপর পড়তেই দুজনেই মাটিতে পড়ে গেল। এবার ইব্রাহিম আলি প্রথম জনের পেটে তরোয়ালের ডগা ঢুকিয়ে দিল। তারপর দ্বিতীয়জন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই তরোয়ালের এক কোপে তার মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো।

 ইতোমধ্যে যে সৈন্যদেরকে কামরান বেগ প্রাসাদের উল্টোদিকে অপেক্ষা করতে বলেছিল ওরাও উদ্যত তরোয়াল হাতে ছুটে এল। ওদের কয়েকজনের তরোয়ালে রক্তের দাগ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে বাইরে যে দুজন প্রহরী ছিল ওরা তাদেরকেও শেষ করে এসেছে। সন্তাজির হাত শক্ত করে ধরে কামরান বেগ সামনে কতগুলো ভারী থামের উপর একটা বেলকনির দিকে ছুটতে ছুটতে সবাইকে বললো, সবাই আমার পেছনে পেছন এস! জলদি কর!’ এর নিচে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে দেখতে হবে কতজন মারাঠি প্রতিপক্ষ এখানে রয়েছে। তবে চওড়া থামের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে সে দেখলো উঠানটি এখন নির্জন মনে হচ্ছে, লাল টকটকে রক্তের মধ্যে পড়ে থাকা কেবল গোটা ছয়েক মানুষের মধ্যে চারজন স্থির হয়েছে আর দুজনের দেহে তখনও প্রাণ ছিল। এদের মধ্যে তার কোনো লোককে দেখা গেল না। উপরে তাকিয়ে কেবল জ্বলন্ত মশালের অগ্নিশিখার নাচন আর ছায়া ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না।

তরোয়াল হাতে ইব্রাহিম আলি কামরান বেগের মনের কথাটা উচ্চারণ করলো, বুঝলাম না। মারাঠিরা কোথায় গেল? আর ওরা কয়জন ছিল?

 কামরান বেগ বললো, “জানি না। হয়তো কেউ কেউ পালিয়ে গেছে আর অন্যরা কবি-কুলেশ আর সম্ভাজিকে সাবধান করতে গেছে। তারপর সে পেছন ফিরে একটা থামের গায়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়ান সন্তাজির দিকে তাকিয়ে বললো, কবি কুলেশের ব্যক্তিগত আবাস কোথায়?

তরুণটি একটু ইতস্তত করলো, তারপর উপরের দিকে দেখিয়ে বললো, “উপরে। কামরান বেগ বললো, “নিয়ে চল আমাদের। দশজন লোক নিচে পাহারায় রেখে বাদবাকি লোকজনদের নিয়ে তারপর সে সন্তাজিকে অনুসরণ করে বেলে পাথরের চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে একটি মার্বেল পাথরের ঘরের দিকে উঠে চললো।, উপরে উঠে ডান দিকে ঘুরে সন্তাজি ওদেরকে একটি দরজার কাছে নিয়ে এল। দরজার উপর মানুষের মূর্তি খোদাই করা ছিল। ওরা ভাবলো যোদ্ধা? না…আরো কাছে এসে কামরান বেগ দেখলো পেশিবহুল দেহের অধিকারী পুরুষ আর উন্নতবক্ষা নারীর মৈথুন দৃশ্য। চওড়া করিডোরের দুপাশের দেয়ালেও আরো অনেক রঙিন মৈথুন দৃশ্য আঁকা রয়েছে। তবে এই পথের শেষ মাথায় কবি-কুলেশের ঘরের দুই পাল্লার দরজার প্রতি কামরান বেগ আগ্রহ দেখাল।

 সন্তাজি ফিস ফিস করলো, এখানেই কবি-কুলেশ থাকেন।’

 ‘কিরকম দেখতে? কয়টা কামরা আছে?”

বড় একটি ডিম্বাকৃতি ঘর, দুই পাশে পর্দাঘেরা দুটি চোরা কুঠরি আছে আর শেষ মাথায় একটা মার্বেল পাথরের স্নানাগার।

 ‘কোনো জানালা আছে?

 ‘প্রত্যেক চোর কুঠরির উপর একটা জানালা আছে। স্নানাগারে কোনো জানালা নেই।’

কামরান বেগ একমুহূর্ত ভাবলো। দরজার পেছনে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ থাকলেও সে সাবধান হয়ে গেছে। লোকজনসহ সে একটা ফাঁদের মধ্যে ঢুকতে চায় না, বিশেষত যেখানে মনে হচ্ছে আসা-যাওয়ার একটাই মাত্র পথ। তবে দরজার ওপাশে কি আছে তা কেবল সন্তাজির কথাতে জানা যাচ্ছে। সে সন্তাজিকে বললো, আগে তুমি যাও, গিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা কর। আর মনে রেখ যদি কাউকে সাবধান করার চেষ্টা কিংবা অন্য কিছু কর তবে আমার লোকেরা তোমাকে গুলি করবে।

সন্তাজি বড় একটা ঢোক গিললো তবে কিছু বললো না, করিডোর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে দরজার দিকে গেল। কামরান বেগ তার সৈন্যদের নিয়ে পেছনেই রইল। দরজার কাছে পৌঁছে ঠেলা দিতেই দরজাটি খুলে গেল। কামরান বেগ। অবাক হয়ে দেখলো সন্তাজি যা বর্ণনা দিয়েছিল ওপাশে ঠিক সেরকম একটি বড় কামরা দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা নিচু টেবিল পড়ে রয়েছে, তার উপর থেকে খাবারের থালা আর শরবতের গ্লাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে এমব্রয়ডারি করা গালিচার উপর পাতা হলুদ আর লাল রঙের কুশণ আর কোলবালিশের উপর। তারপর সে চোখের এক কোণ দিয়ে দেখতে পেল বামদিকে চোরা কুঠরির হালকা রঙের রেশমি পর্দাটা একবার দুলে উঠলো।

সে এগিয়ে গিয়ে তরোয়ালের ডগা দিয়ে পর্দাটা ফাঁক করলো। দুইজন সুন্দরী মেয়ে, পরনে স্বল্পবসন দেখে মনে হচ্ছে সম্ভবত নর্তকী, আতঙ্কে বড় বড় চোখ করে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

 ‘সন্তাজি এদিকে এস! এদেরকে বল আমরা ওদের কোনো ক্ষতি করবো না, তবে আমি জানতে চাই সম্ভাজি আর কবি-কুলেশ কোথায় আছে।

সন্তাজি দ্রুত কামরান বেগের কথাগুলো তর্জমা করে ওদেরকে শোনাল। তারপর একটি মেয়ের উত্তর শোনার পর কামরান বেগের দিকে ঘুরে বললো, ‘এরা কবি-কুলেশের বাড়ির পরিবার পরিজন। সে বললো, কবি-কুলেশ আর সম্ভাজি এখানে ছিলেন, তবে ওদেরকে এখানে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে বলে ওরা চলে গেছে। কোথায় গেছে সে দেখেনি।’

কামরান বেগ মেয়েটির দিকে তাকাল। যে মেয়েটি কথা বলেছিল বেশ লম্বা, কোঁকড়ানো চুলে মেহেদি রঙ করা আর লাল ঠোঁট–সে তার দিকে তাকাল। তার ভারী বুকের দ্রুত উঠানামা দেখে মনে হল সে সন্ত্রস্ত হয়েছে। সে কি সত্যিকথা বলছিল? হয়তো বলছিল।

 তাই যদি হয় তবে সম্ভাজি কোথায় গেল? বহুবছর ধরে গুপ্তচরের কাজ করতে করতে সে শিখেছে যুক্তি ছাড়াও অন্তর্জানেরও একটি মূল্য আছে। সমস্ত কিছু বিবেচনা করে বোঝা যাচ্ছে সম্ভাজি বেশি দূর যায় নি–যাওয়ার সে সময় পায়নি। দরজার তালা খোলা রেখে ওরা মোগলদেরকে বোকা বানাবার চেষ্টা করেছে, যাতে ওরা ধরে নেয় যে, শিকার এখান থেকে পালিয়ে গেছে। হয়তো সে পালিয়েছে কিংবা পালায়নি…কামরান বেগ দ্রুত চিন্তা করলো। তারপর বললো, ইব্রাহিম আলি, ঘরের বাইরে লোক রাখ নজর রাখার জন্য, যদি কাউকে আসতে দেখে তবে যেন আমাদেরকে সাবধান করে। আর বাকি যারা আছ, তোমরা তন্ন তন্ন করে এই কামরার সবকিছু খুঁজে দেখ। প্রত্যেকটা পর্দা আর আসবাবের পেছনে উল্টে দেখ যেখানে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে। সবকিছু টেনে খুলে ফেল। দেয়ালে টোকা দাও। দেখো এমন কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কি-না যেখানে ওরা লুকিয়ে থাকতে পারে।

তবে আধঘণ্টা পর জমকালো কামরাটির সবকিছু তছনছ ওলটপালট করলেও কিছুই পাওয়া গেল না। লোকগুলোর মুখ দিয়ে দরদর করে ঘাম পড়ছিল। স্নানাগারে গিয়ে দেয়াল থেকে টাইল উপড়ে ফেললো, পাঁচফুট গভীর শূন্য পানির চৌব্বাচ্চার উপর লাফিয়ে দেখলো, তবে এটা বেশ শক্ত মনে হল। আর সবকিছু নীরব কেবল ওদের নিঃশ্বাস আর বিরক্তি প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আর বাইরে যারা ছিল কিংবা নিচে উঠানে যারা ছিল তারাও কিছু দেখেনি কিংবা কিছু শুনেনি। পুরো প্রাসাদটি মনে হচ্ছে নির্জন, এমনকি একজন চাকরও নেই, প্রহরী তো দূরের কথা…

সম্ভাজি ওদেরকে বোকা বানিয়েছে। আওরঙ্গজেবের মুখোমুখি হয়ে যখন সে বলবে দুজন নতকী ছাড়া আর কাউকেই পায় নি, তখন তার চেহারার কথা ভেবে কামরান বেগের বুক কেঁপে উঠলো। আওরঙ্গজেব ব্যর্থতা পছন্দ করেন না। তাকে আবার চেষ্টা চালাতে হবে। প্রয়োজন হলে পুরো প্রাসাদ ভেঙ্গে ফেলবে।

 তবে এখুনি নয়। তার সমস্ত লোকজনের চুল, দাড়ি আর কাপড়চোপড় ঘামে ভিজে রয়েছে। দুই একজনের গায়ের চামড়ায় কেটে গেছে…আচ্ছা আবার পরিশ্রম শুরু করার আগে হাতমুখ ধুয়ে নিলে হয় না? কামরান বেগ সন্তাজির দিকে ফিরে আদেশ করলো, তুমি কোনো কাজ করনি। চৌবাচ্চায় পানি ভর। তরুণ মারাঠিকে একটু ইতস্তত করতে দেখে সে অবাক হয়ে বললো, “শুনতে পাও নি আমি কি বলেছি?

 সন্তাজি মাথা নাড়লো। স্নানাগারেরর দেয়ালের কাছে গিয়ে সে ব্রোঞ্জের একটা চাকা দুই হাত দিয়ে ঘুরাতে শুরু করতেই পাথরের একটা ঢালু পথ বেয়ে পানি এসে চৌবাচ্চায় পড়তে শুরু করলো। কামরান বেগ মূল কামরায় গিয়ে তার লোকদের সাথে কথা বলতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে অবাক হয়ে দেখলো চৌবাচ্চায় পানি ভরতে কেন এত সময় লাগছে। আর এর মেঝেটাও সমান নয়। একদিকে চার-পাঁচ ইঞ্চি গভীরতার পানি ভরেছে আর অন্য প্রান্তে টাইলও ঢাকা পড়ে নি। অগভীর অংশের কাছে গিয়ে কামরান বেগ লক্ষ করলো, নিচের একধারে চৌবাচ্চার দেয়াল আর মেঝে যেখানে মিশেছে। সেখানে কোনো চুনকাম করা হয়নি। ফাটল দিয়ে পানি নিচে চুঁইয়ে পড়ছে। মিস্ত্রি কি ঠিক মতো কাজ করেনি…?

তারপর পানি পড়ার শব্দের উপর দিয়ে তার মনে হল যেন একটা আজব অন্য ধরনের চাপা শব্দ সে শুনতে পেয়েছে। চৌবাচ্চাটি খালি করার পর কোনো ইঁদুর হয়তো পানির নলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে? সে আদেশ করলো, ‘চুপ!’ তারপর হাঁটু গেড়ে চৌবাচ্চার কিনারায় গিয়ে সামনে ঝুঁকে আবার শোনার চেষ্টা করলো। কোনো শব্দ নেই…যা হচ্ছিল তা থেমে গেছে। তারপর শুনতে পেল সন্তাজি চিৎকার করে বলছে, দয়া করে থামুন! আপনারা ওদেরকে পানিতে চুবিয়ে মারবেন!’ তারপর মুখ তুলে দেখলে তরুণ মারাঠি দৌড়ে ব্রোঞ্জের চাকাটির কাছে গিয়ে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে এটা বন্ধ করলো। কামরান বেগ উঠে দাঁড়িয়ে তার কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বুঝিয়ে বল। কি বলতে চাচ্ছ? কে ডুবে মরছে?’ যদিও তার মনে হল উত্তরটা সে জানে।

‘চৌবাচ্চার নিচে এক কোণে একটি গর্ত করা হয়েছে। কবি-কুলেশ এটা একটা লুকোবার জায়গা হিসেবে তৈরি করেছিল। এর আগে আমি যখন এখানে আসি তখন দেখেছিলাম…জানিনা ওরা এখানে আছে কি-না, তবে এখুনি কিছু শব্দ পেয়ে কথাটা বললাম–পানিতে ভরা থাকলে লুকোনোর জায়গাটা ব্যবহার করার কথা নয়। কেননা পানি চুঁইয়ে নিচে চলে যাবে।

 ‘দেখাও কেমন করে গর্তটা খোলা হয়।

সন্তাজি চৌবাচ্চায় নেমে পড়লো, তারপর এর মেঝের এক কোণায় অন্যান্য টালি থেকে একটু বড় আকারের চারকোণা একটি সবুজ মণিখচিত ম্যালাকাইট পাথরের টালির দুই কিনারে আঙুল ঢুকিয়ে ধরে উপরের দিকে টেনে উঠাতে চেষ্টা করলো। প্রাণপণ চেষ্টার পর সে এটা খুলে আনলো। তারপর সেটা কামরান বেগের একটি লোকের হাতে দিয়ে আবার উবু হয়ে চৌবাচ্চায় বসে বেশ সহজেই দ্বিতীয় টালিটা খুলে আনলো। একটু ঝুঁকে ভেতরে উঁকি দিয়ে কামরান বেগ আঁতকে উঠলো। চৌবাচ্চার অগভীর অংশের নিচে একটা গর্ত দেখা যাচ্ছে। সেখানে গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে তরোয়াল হাতে দুজন মানুষ উবু হয়ে বসে আছে।

 কামারান বেগ আদেশ করলো, “ওদেরকে জীবিত টেনে বের করে আন!’

 চুল ধরে টেনে আনতেই একটু বয়স্ক, প্রথমজন উপরে উঠে মাটিতে তরোয়াল ফেলে সহজেই উঠে দাঁড়াল। তবে দ্বিতীয় জনকে টেনে তুলার চেষ্টা করতেই সে তরোয়াল দিয়ে কামরান বেগের একজন সৈনিকের গালে তরোয়াল চালিয়ে কেটে দিল। তারপর তাকে ধরে কাবু করে তরোয়াল কেড়ে নেওয়া হল। তার ভেজা পোশাক থেকে ঝর ঝর করে পানি ঝরছিল, সে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাল। তবে কামরান বেগ কিংবা মোগল সেনাদের দিকে না তাকিয়ে সোজা সন্তাজির দিকে চোখ রাখলো। তারপর বললো, আমি জানি তুমি একজন মারাঠি, তারপরও তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করলে!

সন্তাজি তোতলাতে শুরু করলো, ‘সম্ভাজি…মহারাজ…আমি জানতাম গর্তটা পানিতে ভরে যাবে। ভাবলাম আপনি আর কবি-কুলেশ পানিতে ডুবে মরবেন, সেজন্য আমি কথা বলে উঠলাম!’

সম্ভাজি তার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘মিথ্যা কথা বলো না। কি ঘুষ দিয়ে ওরা তোমাকে হাত করেছে?

‘ওরা কথা দিয়েছে আমার প্রাণ রক্ষা করবে। তবে আমি কখনও একজন বিশ্বাসঘাতক হতে চাই নি…’

তার কথা শুনে সম্ভাজি তার দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞা ভরে হাসতেই, সন্তাজি হঠাৎ সামনে এগিয়ে মারাঠি নেতাকে যে দুজন মোগল সেনা ধরে রেখেছিল, তাদের একজনের কোমরে গোঁজা ছুরি বের করে নিজের গলায় একটা পোচ দিল। তার কাটা গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো, তারপর সে হুমড়ি খেয়ে মার্বেল পাথরের মেঝেতে পড়ে গেল। এক মুহূর্ত দেহটি মুচড়ালো তারপর স্থির হয়ে গেল।

নিচে তাকিয়ে কামরান বেগ দেখলো তার জুতায় রক্তের ছিটা পড়েছে। সে বললো, এই দেহটা নিয়ে যাও আর প্রথামত শেষকৃত্য কর। তবে আগে দুজন সংবাদবাহককে দ্রুতগামী ঘোড়ায় সম্রাটের কাছে পাঠাও। আওরঙ্গজেবের জন্য তারা কেবল এই বার্তা নিয়ে যাবে–আল্লাহু আকবর। তার শত্রু সম্ভাজি শেষ পর্যন্ত আমাদের হাতে ধরা পড়েছে।

*

ক্যাটক্যাটে উজ্জ্বল রঙের ডোরাকাটা পোশাক আর মাথায় ডগাচোখা টুপিপরা লোক দুটির চারপাশে মাছি ভনভন করছিল। একটা রোগা উটের পিঠে ওদেরকে বেঁধে রাখা হয়েছিল, উটটি ধীরে ধীরে চলছিল। দূর দিগন্তে বাহাদুরগড় দুর্গের বুরুজ দেখা যাচ্ছে। আওরঙ্গজেব সেখানে বন্দীদের জন্য অপেক্ষা করছেন। একমুহূর্ত একজন বন্দী মাথা তুলে সামনে তাকাল, তারপর আবার তার মাথা বুকে ঝুলে পড়লো। বন্দীদের কি করা হবে সে সম্পর্কে। আওরঙ্গজেবের পরিষ্কার নির্দেশ ছিল। যদি কেউ উদ্ধার অভিযান চালাবার চেষ্টা করে, সেজন্য প্রথম দুদিন যতক্ষণ না কামরান বেগ তার লোকজনসহ সংঘামেশ্বর আর মারাঠি এলাকা থেকে বের হয়ে না আসবে, ততদিন ওরা। রাতে চলবে আর বন্দীদেরকে কাফেলার মাঝে লুকিয়ে রাখবে। তবে তৃতীয়দিন মোগল এলাকায় ঢোকার পর সাথে সাথে সরাসরি সম্রাটের কাছে না এনে সম্ভাজি আর কবি-কুলেশকে রাজদরবারের অবহেলা আর ঘৃণার পাত্র সাজিয়ে সঙের পোশাক পরিয়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে নিয়ে আসবে। তারপর তার কাছে বাহাদুরগঁড়ে নিয়ে আসবে।

এছাড়া আওরঙ্গজেবের নির্দেশ বন্দীদেরকে কামরান বেগ কোনো খাবার দেয় নি, কেবল রোজ এক পেয়ালা পানি দিয়েছিল। এতক্ষণে তাদের ঠোঁট ফেটে গিয়ে শুকনো হয়ে রয়েছে আর অনেক সময় দেখে মনে হচ্ছিল ওরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিল। তবে যত অপমানই করা হোক না কেন ওরা নির্বিকার রইল। দুই ঘণ্টার পর কাফেলাটি দুর্গের প্রধান তোরণের নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই নাকাড়া বেজে ওদেরকে অভিবাদন জানান হল। কামরান বেগ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তার অভিযান শেষ হয়েছে। সে সফল হয়েছে। লোকজনসহ চারকোণা উঠানে ঢুকতেই দেখলো শেষ মাথায় একটি বড় কাঠের মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। বামপাশে একটি আগুন জ্বালাবার পাত্রে জ্বলন্ত কাঠকয়লা প করা রয়েছে। মাঝখানে চামড়ার পাজামা আর হাতাকাটা জামাপরা একজন লোক একটি লম্বা ছুরির ফলা শান দিচ্ছে। সে একজন রাজকীয় জল্লাদ। কামরান বেগ আগেও তাকে তার কাজ করতে দেখেছে। তার পাশে একটা টেবিলের উপর আরো বেশ কয়েকটি ছোটবড় ছুরি রাখা হয়েছে, রোদে এর ফলাগুলো চকচক করছে। ডান পাশে প্রায় ছয়ফুট উঁচু দুটি শক্ত কাঠের কাঠামো পাশাপাশি খাড়া করে রাখা হয়েছে। মঞ্চের দুদিকে আওরঙ্গজেবের কয়েকজন সেনাপতি আর সভাসদ মুখোমুখি বসে রয়েছেন।

সবার চোখ তার উপর, এটা বুঝতে পেরে কামরান বেগ তার লোকদেরকে থামতে বলার পর সবাই ঘোড়া থেকে নামলো। সহিসরা ঘোড়াগুলোকে সরিয়ে নিতে শুরু করলো, এমন সময় উপর থেকে শিঙ্গা ফুঁকতেই পরিশ্রান্ত ঘোড়াগুলো চঞ্চল হয়ে উঠলো। মাথা ঘুরিয়ে কামরান বেগ দেখলো উঠানের প্রায় পনেরো ফুট উপরে মঞ্চের দিকে মুখ করা কারুকাজকরা বেলেপাথরের একটি বেলকনিতে আওরঙ্গজেব এসে দাঁড়ালেন। তার পরনে সাদাসিধা পোশাক। তিনি যে আসনে বসলেন তার দুপাশে বিশাল আকারের সবুজ রঙের মোগল পতাকা উড়ছিল। তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পরিচারক সঙ্গে সঙ্গে ময়ূরের পালকের একটি বিশাল পাখা নিয়ে তাকে বাতাস করতে শুরু করলো। তিনি বললেন, ‘স্বাগতম কামরান বেগ। তুমি আর তোমার সাহসী লোকেরা আমার সাম্রাজ্যের জন্য বিশাল একটি কাজ করেছ। তুমি সেই নারকি বিধর্মী শিবাজির বিধর্মী ছেলে আর তাকে যে আশ্রয় দিয়েছিল সেই অধঃপতিত লোকটিকেও ধরে এনেছ। ওদেরকে সামনে নিয়ে এস যাতে আমি ভাল করে দেখতে পারি। সম্রাটের চারজন দেহরক্ষী যেখানে উটের উপর বন্দীদের বেঁধে রাখা হয়েছিল সেদিকে ছুটে গেল। উটের পিঠ থেকে নেমে নামিয়ে বন্দীদেরকে টানতে টানতে আওরঙ্গজেবের সামনে এনে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। ‘এখন তুমি যেখানে আছ সেটাই তোমার সঠিক স্থান–ধূলিমাটি, যারা সত্যিকার খোদাকে মানে না আর তাঁর বিশ্বাসী বান্দা, আমার বিরোধিতা করেছে। কেবল একটি কারণে তুমি বাঁচতে পারবে সম্ভাজি, আর তা হল তোমার ভুল স্বীকার করা আর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা।

ফাটা ঠোঁট নিয়ে সম্ভাজি চিৎকার করে বললেন, ‘হিন্দু দেবতারাই আসল ভগবান….। একজন সত্যিকার ঈশ্বর কি করে আপনাকে এসব অন্যায় করার অনুমতি দিল?

তাহলে আর কোনো কথা নেই। তোমরা দুজনেই মরবে। তবে এর আগে তুমি আমাকে বল, আমি যা জানতে চাই–তোমার লুকোনো সম্পদ কোথায় আছে, তোমার কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে যেসব মোগল কর্মকর্তা আর সেনাপতিরা তোমাকে তথ্য দিয়েছে তাদের নামসহ আর যা কিছু জান সব বল। আমি তোমার ন্যায়সঙ্গত শাসক তোমাকে জানাতে নির্দেশ দিচ্ছি।’

সম্ভাজি বেলকনিতে বসা আওরঙ্গজেবের দিকে অবাধ্যভাবে ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর তিনি বললেন, “আমার যাই হোক, আমার দেশের লোকেরা হিন্দুস্তান থেকে আপনাকে আর আপনার সাম্রাজ্যকে ঝেটিয়ে বিদায় করবে… আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি মৃদু হাসছেন। কেন হাসছেন? তার কারণ প্রতারণা আর বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে আপনি আমাকে আপনার ক্ষমতার মধ্যে এনেছেন। তার মানে আপনিই সত্যিকার ব্যর্থ। নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন আপনার এই ঘৃণিত রাজত্বকালে আপনি আসলে কী অর্জন করেছেন? কিছুই না! আপনার সাম্রাজ্য বিদ্রোহে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আমার বাবা, যাকে আপনি পরাভূত করতে পারেন নি তার নাম চিরদিন হিন্দুস্তানে বেঁচে থাকবে, কেননা তিনি ছিলেন একজন বীর এবং মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা। আর আপনার নাম তখনই উচ্চারিত হবে যখন লোকে আপনার অন্যায় আর অত্যাচারের কথা স্মরণ করে আপনাকে অভিশাপ দেবে।

চুপ কর!’

না, আমি চুপ করবো না! আপনি মনে করেন আমি আপনাকে ভয় পাই? যে মানুষ তার নিজের ভাইদের হত্যা করেছে আর তাঁর ছেলেদের কাছ থেকে সম্মান আদায় করতে পারে নি? আমি জানি আকবর আপনার সম্পর্কে কি ভাবেন তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন। তিনি বলতেন কিভাবে আপনি আপনার ঈশ্বরের নামের দোহাই দিয়ে আমার স্বধর্মের লোকদের বিরুদ্ধে প্রতিটা বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের বিশ্বাসযোগ্যতা দেখিয়েছেন। আকবর জানেন আপনি কি তিনি আপনাকে একজন “বক ধার্মিক” বলতেন, যা এখন আমিও বলছি! আর তার মতো আমিও আপনাকে আর আপনার সাথে আর যারা নোংরা কাজগুলো করে তাদের সকলকে ঘৃণা করি। পরবর্তী জীবনে আপনি এমনকি একটি কীট কিংবা ইঁদুর নন বরং একটি মাছি কিংবা একটি পরজীবী কীট…’

আওরঙ্গজেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে! আমি অনেকক্ষণ তোমার প্রলাপ শুনলাম। জল্লাদ তোমার কাজ শুরু করে দাও। সম্ভাজিকে দিয়ে শুরু কর, ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে কর। তবে তার শরীরের যে অঙ্গই প্রথমে কাটো, জিহ্বাটা শেষ পর্যন্ত রেখে দিও। এটা শেষ হওয়ার আগে সে আমাকে বলবে আমি যা জানতে চাই। তারপর আমি তোমাকে বলবো এটা কেটে ফেলতে, যাতে তার দয়াভিক্ষা আমাকে শুনতে না হয়!

দুজন প্রহরী সম্ভাজির দুইবগলের নিচে হাত দিয়ে তাকে টানতে টানতে মঞ্চের দিকে নেওয়া শুরু করতেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, আমি কখনও আপনার কাছে ক্ষমাভিক্ষা করবো না বরং তার আগে আমি আমার জিহ্বা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলবো।’ মঞ্চে তাকে ফেলে দেওয়ার পর সম্রাটের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে সবার সামনে দাঁড়ান একজন জ্যেষ্ঠ সেনাপতি এবার সামনে এগোলেন। তার হাতে একটি লম্বা কাগজের টুকরা ছিল। তিনি বেশ জোরে কাগজটি থেকে পড়তে শুরু করলেন, যাতে সবাই শুনতে পারে।

সম্ভাজি, তুমি একজন খারেজি বিশ্বাসঘাতক। তুমি সম্রাট আওরঙ্গজেব আর তাঁর প্রজাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছ। তোমার অপরাধের কারণে নিষ্পাপ মানুষের রক্ত ঝরেছে। তোমার মৃত্যুর আগে তোমাকে তোমার অপরাধের জবাবদিহি করতে হবে আর আমি যা যা প্রশ্ন করবো তার উত্তর দিতে হবে। উত্তর দিতে তুমি যত দেরি করবে ততই তোমার কঠোর শাস্তির যন্ত্রণা বেড়ে যাবে।

 ‘আমি অপরাধি নই, আমি একজন দেশপ্রেমিক। আমি কোনো কথার উত্তর দেব না!

সেনাপতি বললেন, ঠিক আছে। তারপর তিনি মাথা নাড়তেই জল্লাদ সম্ভাজির ক্ষীণদেহের দিকে এগোল। তিনি ততক্ষণে কোনোমতে দুপায়ের উপর খাড়া হয়েছেন। সঙের জামার কলার বাম হাতে ধরে জল্লাদ তাকে টেনে তুলে ডান হাতে তার পেটে একটি ঘুষি চালাল। তাকে ধরে না রাখলে সম্ভাজি মাটিতে লুটিয়ে পড়তেন। জল্লাদের বজ্রমুষ্টিতে ধরে থাকা অবস্থায় তিনি একটা ভাঙ্গা পুতুলের মতো দুলতে লাগলেন। তারপর আবার ঘুষি মারতেই সম্ভাজি রক্তবমি করতে শুরু করলেন।

‘প্রথম প্রশ্ন। মারাঠিদের মূল ধনাগার কোথায়? আমরা জানতে পেরেছি ছয়মাস আগে তুমি প্রচুর পরিমাণে সোনা আর রত্ন নতুন একটা জায়গায় স্থানান্তর করেছ।’

সম্ভাজি হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোমতে উত্তর দিলেন, “আমি কখনও তোমাদেরকে তা জানাব না আর তোমরা কখনও তা খুঁজে পাবে না।’

‘আবার প্রশ্নটা করছি। ধনরত্ন কোথায় রেখেছ?

 ‘তুমি নিশ্চয়ই কালা। শোননি আমি কি বলেছি?

সেনাপতি এবার মাথা নাড়তেই জল্লাদ সম্ভাজিকে ছেড়ে দিতেই তিনি মঞ্চে টলে পড়ে গেলেন। তারপর তার উপর ঝুঁকে জল্লাদ ছুরির কয়েক পোচে তার দেহ থেকে নোংরা পোশাকটা কেটে ফেলে দিল। সম্ভাজির তারের মতো শক্তিশালী এবং পাকানো শরীরের কয়েক জায়গায় লড়াইয়ের কয়েকটি ক্ষত চিহ্ন ছিল। তার বুকের বাম পাশ থেকে পেটের উপর দিয়ে কুচকি পর্যন্ত একটি লম্বা কাটা দাগের চিহ্ন ছিল। বাম দিকের উরুর নিতম্ব থেকে হাটু পর্যন্ত আরেকটি দাগ ছিল। জল্লাদ তার চুল ধরে তাকে টেনে তুলে কাঠের কাঠামোর দিকে নিয়ে চললো। কাঠামোটির চার মাথায় তার দুই পা আর হাত দুই দিকে ছড়িয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল।

সেনাপতি আবার প্রশ্নের তালিকা দেখে বললেন, “আমরা জানতে পেরেছি তুমি রাজদরবারের কয়েকজন সভাসদকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করেছিলে। কাদের সাথে তোমার যোগাযোগ হয়েছিল? এবার তার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার এবং কর্তৃত্বব্যঞ্জক শোনাল।

সম্ভাজি আবার হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “আওরঙ্গজেবকে এক পয়সা দিয়ে হিন্দুস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম।’

তৃতীয়বার সেনাপতির ইঙ্গিত পেয়ে জল্লাদ কাঠের বেঞ্চের কাছে এগোল এবং ধীরে সুস্থে একটা পাতলা ধারাল ফলার ছুরি বেছে নিল। তারপর সম্ভাজির পেছনে গিয়ে একজন শল্য চিকিৎসকের দক্ষতা নিয়ে তার মেরুদণ্ড বরাবর ছুরিটা একবার লম্বালম্বিভাবে আরেকবার আড়াআড়িভাবে চালাল। রক্তের একটি ছোট নদী বইতে শুরু করতেই সম্ভাজির শরীর মুচড়ে উঠলো, তবে কোনো চিৎকার করলেন না। তারপর জল্লাদ এবার ছুরির কোনো বদলে পিঠের নিচে যে জায়গায় কাটা অংশগুলো মিলেছে সেখানে ছুরির ডগাটি ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর সে কাস্তে চালাবার ভঙ্গিতে মাংসপেশি আর চর্বি থেকে তার শরীরের চামড়া ছিলতে শুরু করলো। অবশেষে সম্ভাজি প্রচণ্ডভাবে একবার আর্তচিৎকার করে উঠলেন।

প্রায় নয় ইঞ্চি লম্বা আর তিন ইঞ্চি চওড়া চামড়ার একটি ফালি তুলে নেবার পর জল্লাদ আবার সেনাপতির দিকে তাকাল। তিনি আবার মোগল দরবারের ষড়যন্ত্রকারীদের নাম জানতে চাইলেন। তবে যেভাবে তার শরীর ঝুলে পড়লো, তাতে পরিষ্কার বুঝা গেল সম্ভাজি জ্ঞান হারিয়েছেন। জল্লাদ তার গায়ে এক বালতি ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিতেই তিনি চমকে উঠে জ্ঞান ফিরে পেলেন। আবার প্রশ্নকর্তা তাকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলেন, তবে সম্ভাজি কেবল মাথা নাড়লেন।

জল্লাদ আবার ছুরি তুলতেই কামরান বেগের পেট উগলে উঠলো, সে বমি করতে একপাশে ঘুরলো। নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করতে গিয়ে সে লক্ষ করলো মঞ্চের এই ভয়ংকর কার্যকলাপ দেখে শুধু তার একারই বমি বমি ভাব হয় নি। সম্রাটের পেছনে তার দেহরক্ষী প্রধান উমর আলি ঠোঁট কামড়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

 নির্বিকার চেহারা নিয়ে জল্লাদ নিয়মনিষ্ঠভাবে তার বিভীষিকাময় কাজটি করে যেতে লাগলো, আওরঙ্গজেব এবার কবি-কুলেশের দিকে তাকালেন। সে তখন তার শাস্তির জন্য অপেক্ষা করছিল। মানুষের চরিত্র বুঝার যে ক্ষমতা তার আছে, তা থেকে তিনি বুঝতে পারলেন, সম্ভাজি রাজি না হলেও এই সেনাপতি কথা বলতে হয়তো রাজি হবে। এটা এমন নয় যে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আসলে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর গুপ্তচরদের কাছ থেকে অবিশ্বস্ততার তথ্য পেয়ে তিনি যাদেরকে সন্দেহ করেছেন তাদের উপর নজর রাখা হচ্ছে। আর এখন গোলকুন্ডা আর বিজাপুর তাদেরকে আর অর্থসাহায্য দেবে না, কাজেই এই ধনাগার সম্পর্কে জেনেই বা কি লাভ? মোগল সম্পদের তুলনায় এটি সাগর সৈকতে এক কণা বালুর মতো। সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি ছিল জনসমক্ষে সম্ভাজির অপমান আওরঙ্গজেবের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার কর। এটা করতে যত দিন লাগুক তিনি সন্তুষ্ট হতে চাইছেন যে, সাম্রাজ্যের প্রতিটি মানুষ বুঝুক এত বছর পার করেও তাদের সম্রাট এখনও একটি বলবীর্য শক্তি হিসেবে রয়েছেন। যাকে কেবল একটি বোকা কিংবা মূর্খ অমান্য করার সাহস দেখায়।

*

তবে মনে হল শেষ পর্যন্ত তিনি সেই সন্তুষ্টি পাবেন না। দুই সপ্তাহ পর আওরঙ্গজেব আবার বেলকনিতে বসে জল্লাদের কাজ লক্ষ করলেন, জল্লাদ সম্ভাজি আর কবি-কুলেশের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কাটছে। মাংসপিণ্ড আর হাড় দেখে তাদেরকে আর মানুষ হিসেবে চেনা যাচ্ছে না। এখন শেষ অপমানজনক কাজটি বাকি রয়েছে, কাটা মুণ্ডুটা নিয়ে দাক্ষিণাত্যের গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়ে দেখান। যে কোনোভাবেই হোক এতদিন অত্যাচার করার পরও সম্ভাজি আর কবি-কুলেশ তার বিরোধিতা করার শক্তি আর সাহস খুঁজে পেয়েছিল।  যখন সম্ভাজির ধরা পড়ার খবর তাঁর কাছে পৌঁছেছিল তখন আওরঙ্গজেব হাঁটুগেড়ে বসে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছিলেন যে, তাঁর সাম্রাজ্য এখন নিরাপদ হয়েছে এবং তার বিজয় সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে এখন মনে হচ্ছে পূর্ণ বিজয় অর্জিত হয় নি আর হয়তো তিনি শিবাজির মতো আরেকটি মারাঠি বীর সৃষ্টি করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *