১৭. বাই-দওলত

১৭. বাই-দওলত

হায়দ্রাবাদে আদিল হাসানের মার্বেল-প্রাসাদের একটি শীতল কামরায় পাশাপাশি বসে আওরঙ্গজেব আর মুয়াজ্জম কথা বলছিলেন। তিনি তাকে বললেন, “এই শহর থেকে আদিল হাসান আর গোলকুন্ডা বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে তুমি খুব ভাল কাজ করেছ মুয়াজ্জম। সিকান্দারকে পরাজিত করে বিজাপুরকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার পর আওরঙ্গজেব সেদিন সকালেই তার অগ্রবর্তী সেনাদল নিয়ে মুয়াজ্জমের সাথে যোগ দিয়েছিলেন।

মুয়াজ্জম মৃদু হেসে বললেন, ‘ধন্যবাদ, বাবা। হায়দ্রাবাদের তেমন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় আমার কাজ সহজ হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে আমার সেনাবাহিনীর শক্তি আর দৃঢ়তা বুঝতে পেরে আদিল হাসান তার সেনাবাহিনীসহ তাদের অস্ত্রশস্ত্র আর কোষাগারের সমস্ত সম্পদ নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে পিছু হটে যান। শহরের অনেক বাসিন্দা তাদের সম্পদ নিয়ে তাকে অনুসরণ করেছে। তিন সপ্তাহ আগে যখন আমি এখানে ঢুকি তখন দেখি প্রায় নির্জন একটি শহরে কেবল কিছু গরিব মানুষ রয়ে গেছে। তারপর শহরের চারমিনার মসজিদে শহরের নতুন শাসক হিসেবে মোল্লাকে দিয়ে আপনার নামে খোতবা পড়াই।’

‘তোমার অর্জন সম্পর্কে তুমি যে বিনয় দেখিয়েছ তা তোমাকে মহৎ করে তুলেছে। তাছাড়া তুমি শহরটিও নিজের আয়ত্তে আনতে সফল হয়েছ। আমি লক্ষ করেছি তুমি প্রত্যাঘাত প্রতিরোধ করতে মুসি নদীর তীরে আর অন্যান্য জায়গায় মাটির বাঁধ নির্মাণ করছে।’ বাবার এই ধরনের বিরল প্রশংসায় মুয়াজ্জমের মন চেহারা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তারপর আওরঙ্গজেব বললেন, “তবে এখানে বেশিদিন থাকা যাবে না। আমার মূল সেনাবাহিনী এখানে পৌঁছার পর তুমি যে সফলতা পেয়েছ তার ফায়দা উঠাতে হবে। আদিল হাসান তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে কোথায় গেছে?

 ‘তিনি তার অধিকাংশ সেনা, পত্নী আর উপ-পত্নীদের নিয়ে এখান থেকে পাঁচমাইল দূরে গোলকুন্ডা দুর্গে আশ্রয় নিয়েছেন। এটাই আমি শুনেছি। আর কিছু সৈন্য পাঠিয়েছেন হীরার খনিগুলো পাহারা দিতে।

‘হীরার খনির দিকে আমাদের মনোযোগ দিলে চলবে না। গোলাকুন্ডা দুর্গ দখল করা আর আদিল হাসানকে পাকড়াও করার কাজটিকে আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। দুর্গটি সম্পর্কে কী জানতে পেরেছ?

‘এটি একটি চারশো ফুট উঁচু কৌণিক আকৃতির দুর্গ যা পাহাড়ের চারধার ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে। এর চতুর্দিক ঘিরে দুটি চক্রাকার শক্তিশালী পাথরের বাঁধ রয়েছে। আর এই বাঁধে ছয়ফুট উঁচু কয়েকটি মজবুত বুরুজ রয়েছে। এগুলো এমন অবস্থানে নির্মাণ করা হয়েছে যে, বাইরে থেকে দেয়ালের উপর কোনো আক্রমণ এলে দুপাশ থেকে গোলাবর্ষণ করা যাবে। একমাত্র প্রবেশ পথটি একটি আঁকাবাকা পেঁচানো ঢালু পথ যা একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত এক সারি ফটকের ভেতর দিয়ে চলে গেছে।’

 ‘পানি আর খাবার সরবরাহ কেমন করে হয়?

‘দুর্গে যথেষ্ট পানি মজুত আছে। তবে এখন মানুষের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় পানি আর যথেষ্ট বলা যাবে না। ওরা কয়েক মাসের জন্য খাদ্য মজুত করার সময় পেয়েছে। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে চললে এতে কয়েক মাস চলার কথা।

 ‘আমাদেরকে যত শীঘ্র সম্ভব দুর্গটি চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলতে হবে। তারপর আমার মনে হয় প্রাথমিকভাবে কিছু আক্রমণ চালিয়ে প্রতিপক্ষের মনোবল যাচাই করে দেখতে হবে দীর্ঘকালব্যাপী অবরোধ এড়ানো যায় কি-না। আদিল হাসানের লাম্পট্য চরিত্রের যে খবর আমি পেয়েছি, তাতে আমার বিশ্বাস হয় না যে, সে একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতা হবে কিংবা তার লোকজনও একান্তভাবে তাকে অনুসরণ করবে না। এ যাবৎ তোমার দৃঢ়সংকল্প দেখিয়ে তুমি আমাকে অবাক করেছ মুয়াজ্জম। তাই আমি তোমাকেই এই অভিযানের প্রথম অংশের নেতৃত্ব দিতে চাই। যাতে তুমি তোমার যোগ্যতা আরো প্রমাণ করতে পার।

*

ছয় সপ্তাহ পর আওরঙ্গজেব ওয়াজিম খানকে পাশে নিয়ে লক্ষ করছিলেন সীসার মতো রঙের আকাশের নিচে ঘোড়ায় চড়ে মুয়াজ্জম এগিয়ে গিয়ে গোলকুন্ডার দেয়ালে গোলাবর্ষণ করার জন্য মোগল গোলন্দাজ সৈনিকদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। তাঁর ছেলে অত্যন্ত কুশলতার সাথে আক্রমণ পরিচালনা করছিলেন। তিনি বাইরের সাথে দুর্গটির যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। তারপর এমন ভান করতে লাগলেন যেন এখুনি মুখোমুখি আক্রমণ করবেন। এরপর গোলকুন্ডিরা কার্যকর কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই শক্তিশালী ও দ্রুতগামী দুই দল সৈন্য পাঠিয়ে বলদের মাথার শিংয়ের মতো দুদিক থেকে দুর্গটি ঘিরে ফেললেন। তার লোকেরা মাটির তলে একটি মাটির নল আবিষ্কার করে নলটি কেটে ফেললো। এই নলটির মাধ্যমে পাহাড়ের পানির জলাধারের সাথে দুর্গের সংযোগ ছিল। গ্রীষ্মের তাপমাত্রা চরমে উঠলে দুর্গের ভেতরে গাদাগাদি করে থাকা লোকদের জীবন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আর খাবার পানির পরিমাণ কমে যেতেই কিভাবে তা ভাগাভাগি করা হবে তা নিয়ে নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে তর্কবিতর্ক লেগে যাবে।

আওরঙ্গজেব ওয়াজিম খানের দিকে ঘুরে বললেন, ‘দিনের পর দিন অভিজ্ঞতা লাভ করে মনে হচ্ছে মুয়াজ্জম একজন পরিপক্ক সেনাপতি হয়ে উঠছে, সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কিরকম শান্তভাব আর কতৃত্ব দেখাচ্ছে। বিশেষত কঠিন পরিস্থিতিতে তাই না, কি বল? ওয়াজিম খান মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো, সম্প্রতি আপনি তাকে যে ধরনের সমর্থন দিয়েছেন, তাতে উনি বিকশিত হয়ে উঠছেন, জঁহাপনা। প্রশংসা করলে মানুষের মনোবল বেড়ে যায়। এটা সবার ক্ষেত্রে ভাল কাজ দেয় কেবল যারা অতিমাত্রায় আত্মগর্ব করে আর অপরিণামদর্শী ছাড়া।

গুম গুম করে মোগল কামানের গুরুগম্ভীর গজনে আর আলোচনা করা গেল না। প্রায় একইসাথে সত্তরটি কামান গর্জে উঠেছে। সাদা ধোঁয়ার বিরাট ঢেউ পুরো যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়লো, গোলকুন্ডার দুটি দেয়াল আর মোগল শিবিরের অবস্থানও ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেল। প্রত্যুত্তরে গোলকুন্ডার কামানের প্রচণ্ড গর্জনও আওরঙ্গজেবের কানে এল। ধোঁয়া সরে যেতেই ধীরে ধীরে একটা ফাঁক বের হয়ে এল, আওরঙ্গজেব দেখলেন, গোলকুন্ডার দেয়াল প্রায় অক্ষত দেখা যাচ্ছে, কেবল প্রধান ফটক-দালানের কছে বুরুজের উপর থেকে কয়েকটা পাথরের টুকরা নিচে মাটিতে খসে পড়েছে। গোলকুন্ডিরাও কিছু সফলতা লাভ করেছে। গোলকুন্ডার গোলার আঘাতে মোগলদের সবচেয়ে বড় কামানগুলোর একটি ব্রোঞ্জের নল এর বারো-চাকার কাঠের কাঠামো থেকে খুলে পড়ে গেছে। মাটিতে পড়ার সময় ভারী নলটির নিচে দুজন গোলন্দাজ সৈনিক চাপা পড়েছে। তাদের একদল সহযোদ্ধা কামানের ভারী নলটি তাদের পায়ের উপর থেকে টেনে সরাতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো, তবে আবার ধোয়ার চাদরে ঢাকা পড়ার আগে তিনি দেখতে পেলেন ওরা সফল হতে পারে নি।

 ‘ওয়াজিম খান, আমার যুদ্ধ হস্তী আনতে বল। এ অবস্থায় আমি আর লড়াইয়ের ময়দান থেকে দূরে থাকতে পারি না। যদিও আমি আমার ছেলেকে কথা দিয়েছিলাম নেতৃত্ব তার হাতেই থাকবে।’

কয়েকমিনিট পর আওরঙ্গজেবের হাতি মোগল সৈন্যরূহ্যের কাছাকাছি পৌঁছল। ধোয়ার ফাঁক দিয়ে সামনে লড়াই দেখার জন্য তিনি তাকিয়ে দেখলেন, আহত সেনারা সেখান থেকে বের হয়ে তাঁকে পাশ কাটিয়ে পেছনের দিকে যাচ্ছে। কেউ কেউ আরেকজনের কাঁধে হাতে ভর দিয়ে চলছিল। অন্যরা হাতে বানানো ক্রাচে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যাচ্ছে। যারা বেশি আহত হয়েছে তাদেরকে গাছের ডাল কেটে বানানো খাটিয়ায় শুইয়ে বেহারারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটি দাড়িওয়ালা লোক তার পেটের বড় একটি ক্ষত থেকে বের হয়ে আসা লাল-নীল নাড়িভূড়ি চেপে ধরে যন্ত্রণায় তারস্বরে চিৎকার করতে করতে যাচ্ছিল।

আওরঙ্গজেব বিড়বিড় করলেন, আল্লাহ যেন তাকে শীঘ্রই পরকালে নিয়ে যান। এ অবস্থায় কোনো হেকিমই কিছু করতে পারবে না।

কয়েকমিনিটের মধ্যে আওরঙ্গজেব তাঁর কামানের সারির কাছে পৌঁছতেই চিৎকার করে গোলন্দাজ সেনাদের উদ্দেশ্যে বললেন, যত দ্রুত পার গোলা ভর। সেনাবাহিনীর বাকি সবার জীবন তোমাদের উপর নির্ভর করছে!’ খালি গায়ে বারুদের ছিটা নিয়ে ওরা নিচু হয়ে গোলা ভরার কাজ করতে করতে না থেমে তার কথার জবাবে বলে উঠলো, ‘সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন! আওরঙ্গজেব দেখলেন গোলন্দাজ সারি পেরিয়ে একটু সামনে একটি উঁচু ঢিবির উপর একজন তরুণ মোগল সেনা কর্মকর্তা পিঠ খাড়া করে একটি ধূসর ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে। তার পাশে তার চেয়েও বয়সে ছোট তরুণ কোরচিও নিজের চঞ্চল হয়ে ওঠা ঘোড়াকে বশ করতে হিমশিম খাচ্ছিল। আওরঙ্গজেব তার মাহুতকে সেনা কর্মকর্তারটি পাশে হাতি থামাতে বললেন। তারপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কী হচ্ছে?

 ‘জাহাপনা, আপনার ছেলে আমাকে এখানে অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি গোলকুন্ডার মূল ফটকের উপর একটি আক্রমণে নেতৃত্ব দিতে গেছেন। হামলা সফল হলে তিনি আমাকে খবর পাঠাবেন। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে, আশা করি তাই হবে, আমি বরকন্দাজ আর আপনার বাঙ্গালি পল্টন থেকে আরো পদাতিক সেনা নিয়ে এগোব, যাতে উনি–’

কথা শেষ না হতেই প্রচণ্ড একটি শব্দে তার কথা থেমে গেল। আওরঙ্গজেবের হাওদা কেঁপে উঠলো আর তার হাতিটি মাথা পেছনে হেলিয়ে শূড় তুলে বৃংহণ করে উঠলো। আওরঙ্গজেব নিজের অজান্তে চোখ বুজতেই উষ্ণ তরল কিছু একটা তার মুখে থপ করে এসে পড়লো আর এর সাথে নরম স্পঞ্জের মতো কিছু ঝুলে রইল। চোখ খুলে তিনি হাতের পিঠে মুখ মুছলেন। তরলটি ছিল রক্ত আর নরম পদার্থটি ছিল তার সেনা কর্মকর্তা কিংবা তার ঘোড়ার মাংস। উভয়ের দেহই মাটিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। আওরঙ্গজেবের হাতির দুজন মাহুতের মধ্যে একজন হাতির পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে রয়েছে। তবে তার শরীরে কোনো যখম দেখা যাচ্ছে না। তরুণ কোরচির ঘোড়াটি আরোহীসহ ভেগে গেছে। কামানের অন্তত কয়েকটা গোলার আঘাতে এটা হয়েছে। তার নিজের সেনাদের মতো গোলকুন্ডি গোলন্দাজ সেনারাও দক্ষ হাতে কামান চালিয়েছে।

 দ্বিতীয় মাহুতটি দ্রুত আওরঙ্গজেবের হাতিটিকে শান্ত করলো। আওরঙ্গজেব ভাবলেন, তিনি কি তার দেহরক্ষী দলসহ মৃত সেনা কর্মকর্তার কাছে অপেক্ষা করবেন, নাকি আরো সামনে এগিয়ে যাবেন। তারপর ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ পেছনে আসতেই দেখলেন আরো দুজন সেনা কর্মকর্তা ছুটে এসেছে। প্রথম লোকটি একটু বয়স্ক আর তার এক চোখে পট্টি বাঁধা। সে বললো, জাহাপনা, আমরা দেখেছি আমাদের সহযোদ্ধা পড়ে গেছেন, তার বদলি হিসেবে আমরা এসেছি।’

 ‘তোমরা তোমাদের নির্দেশ জান?

 “জ্বী, জানি জাহাপনা।

আওরঙ্গজেব মাথা নাড়লেন। যে মাহুতটি নিচে পড়েছিল, তার জ্ঞান ফিরে এসেছে, শুধু ধাক্কার কারণে সে জ্ঞান হারিয়েছিল। এবার সে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর এক হাত বাড়িয়ে অপর মাহুতের বাড়িয়ে ধরা হাত ধরে আবার হাতির কানের কাছে তার জায়গায় উঠে বসলো। আওরঙ্গজেব আবার সামনে এগোবার নির্দেশ দিতেই হঠাৎ দমকা হাওয়া বয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর তার মাথার উপর আবার কানফাটা গর্জন শোনা গেল, আর তার মুখে তরল পড়লো। তবে রক্ত নয় বৃষ্টির ফোঁটা পড়লো আর গর্জনটি ছিল বজ্রপাতের। বৃষ্টি আর বাতাসে ধোঁয়া অনেকটা কমে এলে আওরঙ্গজেব সামনের দৃশ্য দেখতে পেলেন।

প্রথমে তার মনে হল তার ছেলের সৈন্যরা মূল ফটক-ভবনের দিকে চলে যাওয়া ঢালু পথের দিকে না এগিয়ে থেমে পড়েছে। আসলে ওরা ছোট ছোট দলে ছড়িয়ে পড়ে রুক্ষ জমির উপর যে কোনো ধরনের আড়াল খুঁজে তার পেছনে লুকিয়ে দুর্গের দিকে এগোতে চেষ্টা করছিল। তারপর তিনি দেখলেন তাদের একটু পেছনে একসারি ছোট ছোট পাহাড়ের পেছনে সবুজ মোগল পতাকা ছুটছে। হঠাৎ মুয়াজ্জম আর বড় একটি অশ্বারোহী দল উদয় হল। ওরা চড়াই বেয়ে ঢালু পথটির দিকে ছুটছিল। পতাকাগুলো হাওয়ায় পেছন দিকে উড়ছে। ওরা সামনে ছুটতেই বাকি সৈন্যরাও রণহুঙ্কার দিয়ে তাদেরকে অনুসরণ করলো। কেবল বরকন্দাজরা কয়েকটি উল্টানো গরুর গাড়ির পেছনে তাদের অবস্থান নিল। ধোঁয়ার আড়ালে গরুর গাড়িগুলো এনে উল্টো করে ফেলা হয়েছিল। ওরা একনাগাড়ে গুলি করে বুরুজের উপরে গোলকুন্ডি প্রতিরক্ষা সেনাদের মাথা তুলতে দিচ্ছিল না।

তাদের এত চেষ্টা সত্ত্বেও গোলকুন্ডি কামান আর গাদা বন্দুক গুলি ছুঁড়েই চললো। একটা গোলা এসে একটি গরুর গাড়ির উপর আঘাত হানলো। এর পেছনে দশজন গাদা বন্দুকধারী গুঁড়ি মেরে বসে অবস্থান নিয়েছিল। গোলার আঘাতে কাঠের টুকরার সাথে একজন সৈন্যের দেহ উড়ে গেল। ইতোমধ্যে গোলকুন্ডি বরকন্দাজরা তাদের নিকটস্থ লক্ষ্যবস্তু ছুটে যাওয়া অশ্বারোহীদলের উপর গাদা বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে। কয়েকটি ঘোড়া আরোহীসহ হুমড়ি খেয়ে পড়তেই আরোহীরা ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে ছিটকে পড়লো। বৃষ্টি আর ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে আওরঙ্গজেব দেখলেন একজন পতাকাবাহী মাটিতে পড়ার সময় তার হাতে ধরা বড় সবুজ পতাকার ডাণ্ডা তার হাতছাড়া হয়ে গেল। ডাণ্ডাটি তার পাশের ঘোড়ার সামনের পায়ে ছিটকে পড়তেই ঘোড়াটিও মাটিতে পড়ে গেল। পেছনে যারা অনুসরণ করছিল তারা পাশ কেটে মাটিতে পড়া দেহগুলো এড়াতে চেষ্টা করলো। তারপরও আরোহীসহ অনেক ঘোড়া পড়ে গেল। কেবল ছোট একটি দল ফটক-ভবনের দিকে পাক খেয়ে উঠে যাওয়া ঢালু পথের গোড়ায় পৌঁছে মাথা নিচু করে ঘোড়া ছুটিয়ে চলতে লাগলো। আওরঙ্গজেব আর মুয়াজ্জমকে দেখতে পাচ্ছেন না। তার ছেলে কি পড়ে গেছে? না, ঐ যে তাকে দেখা যাচ্ছে। আক্রমণকারী সেনাদের প্রথম সারির সাথে উদ্যত তরোয়াল হাতে সে ছুটছে। চতুর্দিক থেকে কয়েকজন দেহরক্ষী তাকে ঘিরে রয়েছে।

 কয়েকমুহূর্ত পর মুয়াজ্জমের পাশের একজন শিঙ্গাবাদক তার ঠোঁটে শিঙ্গাটা তুললো। এত দূর থেকে আওরঙ্গজেব শিঙ্গার আওয়াজ শুনতে পেলেন না। তবে তার অর্থ বুঝা গেল যখন সাথে সাথে সমস্ত জীবিত অশ্বারোহী সেনা পেছন ফিরে ঘোড়া ছুটিয়ে নিজেদের শিবিরের দিকে রওয়ানা দিল। শিঙ্গাবাদকের হাত থেকে শিঙা পড়ে গেল, সে দুই হাত শূন্যে তুলে ঘোড়ার পিঠ থেকে পেছনে পড়ে গেল। আরোহীহীন একটি ঘোড়া ছুটে যাওয়ার সময় একজন পতাকাবাহীর ঘোড়াকে ধাক্কা মারতেই সে মাটিতে পড়ে গেল। পেছনে মোগল শিবিরে পৌঁছতে হলে তার ছেলে আর অন্যান্য সৈন্যকে খোলা ময়দানটি পার হতে হবে। বৃষ্টির ছাঁট কমে যেতেই ধোঁয়া আবার তার দৃষ্টি পথ। ঢেকে দিল। তিনি প্রার্থনা করলেন মুয়াজ্জম যেন বেঁচে থাকে। আক্রমণ সফল না হলেও সে একজন সত্যিকার মোগল শাহজাদার মতো যুদ্ধ করেছে।

*

দুই ঘণ্টা পর নিরাপদে নিজেদের শিবিরে ফিরে এসে, মুয়াজ্জম তার হাঁটু আর বাহুতে সামান্য যে চোট লেগেছিল, তাতে পট্টি লাগিয়ে তার বাবার লাল তাবুতে এসে সম্রাটের সামনে দাঁড়ালেন।

আওরঙ্গজেব তাকে বললেন, তুমি সত্যি আজ সাহস দেখিয়েছ মুয়াজ্জম। আক্রমণ সফল না হওয়ার জন্য তোমাকে কেউ দোষারোপ করতে পারবে না।’ বাবার কথার উত্তরে তিনি বললেন, ‘ধন্যবাদ, বাবা। তারপর তার ডান হাতে ধরা শরবতের গ্লাসে একটি চুমুক দিয়ে আবার বললেন, আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, আর সৈন্যরাও জানপ্রাণ দিয়ে লড়েছে। ওদের অনেককে হারিয়ে আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি, বিশেষত আমার দুধ-ভাই উমরখানকে। ঢাল বেয়ে উপরে উঠার সময় বুরুজের কিনারা থেকে গোলকুন্ডিরা তার উপর গরম তেল ঢেলে দেয়। তার সারা গা পুড়ে যায়, ফিরে আসার সময় সে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মারা যায়। কি ভয়ঙ্কর–তার গায়ের সমস্ত চামড়া আর চুল পুড়ে গিয়েছিল।

 ‘তার আত্মা আজ রাতে বেহেশতে শান্তিলাভ করবে। আর যে বিশ্বাসীরা আজ আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছে তারাও। আমি তার স্ত্রী আর পরিবার পরিজনদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবো। তারপর এক মুহূর্ত থেমে আওরঙ্গজেব আবার বলা শুরু করলেন, আবার তোমার অভিযানের কথায় আসছি, দ্রুত সফলতা পেতে হলে মুখোমুখি হামলার বদলে আমাদেরকে অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে। আমি ওয়াজিম খানকে আমাদের সাথে যোগ দিতে ডাকছি। অনেক সময় সে খুব ভাল পরামর্শ দিতে পারে।

‘এটা করার আগে ব্যক্তিগতভাবে আমি কি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে পারি?

‘অবশ্যই।

 ‘গোলকুন্ডিদের সাথে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা চালালে কেমন হয়?

 ‘তারা যদি তাদের দুর্গ আর জমি আমার কাছে ছেড়ে দিতে চায় তবে আমি তাদের কথা শুনবো। তবে সেরকম কোনো আলামত তো দেখছি না।’

 মুয়াজ্জম একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে গলা নামিয়ে প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, না, আমি বলছি সমানে সমানে কোনো আলোচনা। আপনি জানেন আদিল হাসানের উজিরের স্ত্রী আমার স্ত্রীর আত্মীয়? ঐ দুই মহিলার মাধ্যমে তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করে জিজ্ঞেস করেছেন, “কেন বিশ্বাসীরা অন্য বিশ্বাসীদের হত্যা করবে? কেন এত বিশ্বাসী আত্মা বেহেশতে যাবে? কেন এত বিধবা আর ছেলেমেয়ে কাঁদবে? আমরা কী কোনো আপস মীমাংসায় আসার জন্য আলোচনা করতে পারি না?” আমি উত্তরে জানিয়েছিলাম বিনা প্রয়োজনে এত প্রাণ বিসর্জন দেওয়া হোক তা আমিও চাই না। যদি আমরা রাজি হই তখন আপস মীমাংসায় আসার জন্য শর্তের বিষয়গুলো আমি আপনাকে জানাতাম। এমনকি শর্তগুলোর কিছু ধারণাও তাকে দিয়েছিলাম। তবে আলোচনা আরো কিছুদূর এগোবার আগে আপনাকে জানাতে চাইনি। তবে উমর খানের মৃত্যু আর আজ আপনি আমার সাহসের প্রশংসা করায় আমি কথাটা বলার সাহস পেয়েছি।

প্রচণ্ড রাগে আওরঙ্গজেবের মুখ কুঁচকে গেল, তিনি হাত মুঠো করে তাঁর ছেলের মুখে একটা ঘুষি মেরে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলেন। তার বাবার আঙুলে পরা তৈমুরের আংটিতে তার চিবুক কেটে গিয়ে ইরানি গালিচায় ফোঁটায় ফোঁটায় লাল টকটকে রক্ত পড়তে লাগলো। আওরঙ্গজেব গর্জে উঠলেন, ‘প্রহরী! এখুনি এখানে এস! এখান থেকে এই বিশ্বাসঘাতককে সরিয়ে নিয়ে যাও।

*

দুই ঘণ্টা পর অন্ধকার হতেই আওরঙ্গজেব দুই সারি প্রহরীর মধ্য দিয়ে হেঁটে তার তাঁবুর সামনে স্থাপন করা একটি মঞ্চের দিকে দ্রুত এগিয়ে চললেন। সেখানে তার ত্রিশজন উচ্চপদস্থ সেনাপতিকে ডেকে আনা হয়েছিল। কঠিন চেহারা নিয়ে তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে ডেকেছি দেখার জন্য, এখানে একজন বিশ্বাসঘাতকের বিচার করা হবে। নিয়ে এস তাকে!

দুজন বলিষ্ঠ প্রহরী মুয়াজ্জমের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় টানতে টানতে নিয়ে এল, তাকে দেখেই সমবেত সেনাপতিরা আঁতকে উঠলো। মঞ্চের কাছে পৌঁছে প্রহরীর তাকে মাটিতে ফেলে দিল। সারাদিনের বৃষ্টিতে মাটিতে কাদাভরা ছিল। মুয়াজ্জম উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। তার চোয়ালে রক্ত জমে কালো হয়ে রয়েছে।

আওরঙ্গজেব তাকে দেখিয়ে বললেন, এই বাই-দওলত, এই জঘন্য নীচ আমার কাছে প্রায় গর্ব করে স্বীকার করেছে যে, সে গোলকুন্ডি শত্রুদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করেছে। ঠিক কি-না বল?

তার ছেলে বিড় বিড় করে বললেন, হ্যাঁ করেছি। তারপর সাহস সঞ্চয় করে মাথা তুলে বললেন, কিন্তু যখন আমি ভাবলাম এটা আমাদের সাম্রাজ্য আর আমাদের বংশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

 ‘এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিসে আমাদের সাম্রাজ্যের স্বার্থ রক্ষা হবে, তা তুমি কি করে ভাবতে পারলে! এই সিদ্ধান্ত একমাত্র আমি নিতে পারি–তুমি কিংবা আমার সভাসদ আর সেনাপতিদের কেউ নয়…’

‘আমি সত্যি দুঃখিত বাবা। আমার উদ্দেশ্য মহৎ ছিল।’

 ‘তোমার দুঃখ আর তোমার উদ্দেশ্য কোনোটারই আমার কাছে মূল্য নেই। আর সেই সাথে আমার সাথে তোমার সম্পর্কও–যা আমি এই মুহূর্তে অস্বীকার করছি। তোমার সাজা ঘোষণা করার আগে তোমার আর কিছু বলার আছে? তুমি জান যে, একজন বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।’

মুয়াজ্জম শান্তকণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ জানি। আর তাই যদি আমার কপালে লেখা থাকে তবে আমি তা মেনে নেব। আমি আপনার প্রতি আর সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত থেকে মৃত্যুবরণ করবো।’

 আওরঙ্গজব একটু ইতস্তত করলেন। প্রথমে রাগের বশে তিনি তার মৃত্যুদণ্ড দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন জনসমক্ষে রায় দিতে গিয়ে তিনি ততটা নিশ্চিত হতে পারছেন না। গৃহযুদ্ধের সময় তার ছেলে মোহাম্মদ সুলতান যখন তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর চাচা শাহ সুজার সাথে যোগ দিয়ে তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, তখন তিনি তার মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে তাকে কারাগারে বন্দী করে। রেখেছিলেন। আর সেই যুদ্ধের পরিণতিতে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করতে পেরেছিলেন। তার ছেলে আকবর পালিয়ে প্রথমে সম্ভাজির কাছে তারপর, তার গুপ্তচরদের খবর অনুযায়ী পারস্যে চলে যাওয়ায় তার ভাগ্য নির্ধারণ করার সুযোগ তিনি পান নি। মোহাম্মদ সুলতান আর আকবর, উভয়ের অপরাধই ছিল সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা, অথচ মুয়াজ্জম কেবল তার বাবার স্বার্থে এই দুঃসাহস দেখিয়েছিল, তারপরও সে এ কাজটি করতে গিয়ে অযৌক্তিকভাবে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। অন্যদিকে মোহাম্মদ সুলতান আর আকবর যখন অপরাধ করে তখন তাদের বয়স কম ছিল। অথচ মুয়াজ্জমের বয়স বেশি–চল্লিশের উপরে, আর সে ওদের চেয়ে অনেক পরিপকৃতা দেখিয়েছে। পরস্পরবিরোধী এসব যুক্তিতর্ক তাকে কোথায় নিচ্ছে? হঠাৎ জাহানারার কথা তার মনে পড়লো, তিনি আকবরের পক্ষে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি জানেন, যদি এখন জাহানা জীবিত থাকতেন তবে তিনি মুয়াজ্জমের জন্যও করুণা ভিক্ষা করতেন।

মুয়াজ্জম, মৃত্যুই তোমার জন্য উপযুক্ত শাস্তি, তবে আমি ক্ষমাশীল হব। তোমাকে গোয়ালিয়রে কারাগারে বন্দী করে রাখা হবে। প্রহরী তাকে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও। কথাটা বলতেই আবার এক পশলা বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো, চোখের পানির মতো বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে আওরঙ্গজেবের গাল ভিজিয়ে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *