১৫. রাজকীয় মোরগ শাবকের লড়াই

১৫. রাজকীয় মোরগ শাবকের লড়াই

বোরহানপুরের দুর্গ-প্রাসাদের প্রধান তোরণের নিচে দিয়ে যাওয়ার সময় আওরঙ্গজেব উপরে তাকিয়ে ফটকের বেলেপাথরের চৌকাঠের উপর যুদ্ধরত হস্তির প্রতিকৃতি খোদাই করা দেখতে পেলেন। তিনি এই স্থানটিকে ঘৃণা করতেন, ঠিক যেরকম তার বাবাও করতেন। এই একটি বিষয়ে তারা দুজনেই একমত ছিলেন। তার কানে বাজলো, পত্নীশোকে কাতর সম্রাট শাহজাহানের সেই কথাগুলো। সম্রাট আকবরের সময়কার কালক্রমিক ঘটনাপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ করা একটি অংশের কয়েকটি লাইন তিনি বার বার বলে যাচ্ছিলেন :

তারা মহান সম্রাটকে জানাল, বোরহানপুর একটি নিকৃষ্ট, অলক্ষুণে এবং অন্ধকার জায়গা। এখানে কোনো মানুষ উন্নতি করতে পারে না…।

সূর্য তখনও দিগন্তে ডুবে যায় নি। আর সারাদিন অনবরত প্রচণ্ড গুমোট গরম ছিল, তা সত্ত্বেও আওরঙ্গজেব কেঁপে উঠেছিলেন। সেই সময়ে তিনি একটি বারো বছর বয়সের সহজসরল বালক ছিলেন। তিনি তাঁর বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার পাশাপাশি নিজেকেও সান্ত্বনা দেওয়ার আশা করছিলেন। তবে শাহজাহান এমন আচরণ করছিলেন, যেন প্রিয়জন হারানোর যে ব্যথাবেদনা পুরো পরিবারকে শোকাহত করেছিল সেটি যেন তার একারই দুঃখ ছিল।

অবশ্য তাঁর মা মমতাজের মৃত্যুর পর তিনি আরো বেশ কয়েকবার বোরহানপুর এসেছিলেন, তবে এবারকার আসাটা একটু অন্যরকম। যতই এর কাছাকাছি হতে লাগলেন ততই তার মনে একটা আতঙ্ক জেগে উঠতে লাগলো। আতঙ্কের এই অনুভূতি এত প্রবল ছিল যে, তিনি তাঁর সাথে উদিপুরী মহলকেও আসতে অনুমতি দেন নি। তিনি তাকে তার সফরসঙ্গীর অধিকাংশ, সদস্যদের সাথে বিশ মাইল দূরে একটি পাহাড়ের উপর আসিরগড় দুর্গে রেখে এসেছিলেন।

এখন তাঁর মনে যে অমঙ্গলাশঙ্কা জেগেছে তার সাথে কি জাহানারার মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক আছে? হতে পারে। এটা অনুভবের পর থেকে গত ছয় সপ্তাহ ধরে অতীতের অনেক ছবি তাঁর মনে ভিড় করেছে। সেইসব স্মৃতির মধ্যে সবচেয়ে প্রবল ছিল এখানে এই বোরহানপুরে এক গ্রীষ্মের সেই রাতের স্মৃতিটি, যখন তাঁর মায়ের নিদারুণ যন্ত্রণা-চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। তখন তাঁর মায়ের কামরার অর্ধেক খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে তিনি দেখেছিলেন, জাহানারা তার মায়ের পাশে বসে কপালে হাত বুলিয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তখন জাহানারার দু’গাল বেয়ে দরদর করে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছিল আর লম্বা চুল ঝুলে রয়েছিল। জাহানারা যখন ঘুরে দেখতে পেলেন আতঙ্কিত হয়ে আওরঙ্গজেব চোখ বড় বড় করে দৃশ্যটি দেখছেন, তখন ছুটে গেলেন দরজা বন্ধ করতে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, আওরঙ্গজেব দেখে ফেললেন মমতাজ পাগলের মতো আর্তচিৎকার করছিলেন আর এমনভাবে বিছানায় আছড়াচ্ছিলেন যে, তাঁর সবচেয়ে কাছের সেবিকা সত্তি আল-নিসাও তাকে ধরে রাখতে পারছিলেন না। তারপর তার মনে পড়লো তাঁর বাবা যুদ্ধের ময়দানে খবর পেয়ে ফিরে এসে সেই পোশাকেই তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে কামরায় ঢুকার সাথে আবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি উঠানের একটি থামের গায়ে হেলান দিয়ে বসে রইলেন যতক্ষণ না তার মায়ের আর্তচিৎকার থেমেছিল। তিনি তখন ভেবেছিলেন এটা ভাল হয়েছে–হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, এই নীরবতার অর্থ, অবশেষে তিনি একটি নতুন শিশুর জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু তার শোকের বিলাপ শুনে তিনি বুঝতে পারলেন যে, সবকিছু ঠিক নয়…

 তিনি আর কখনও মায়ের কামরায় ঢুকেন নি। তাঁর মৃতদেহ তপতি নদীর অপর তীরে অস্থায়ী সমাধিতে নিয়ে যাবার পর, শাহজাহান সেই বাড়িতে ঢোকার মূল দরজা বন্ধ করে দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন থেকে এত বছর তপতি নদীর দিকে মুখ করা দুর্গ-প্রাসাদের স্মৃতি বিজড়িত তিনতলার সেই ঘরগুলো ভূতুড়ে পরিবেশ নিয়ে নীরব হয়ে রয়েছে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই স্থানটি কেউ দেখতেও আসেনি।

 আজ প্রথম মনে হল সেটা ঠিক হয় নি। তিনি প্রায়ই তাজমহলের একফোঁটা নয়নার প্রতিকৃতির মতো গম্বুজের নিচে তাঁর মায়ের জন্য মোনাজাত করতেন। তবে কখনও এখানে প্রার্থনা করেন নি, যে জায়গায় তার মায়ের আত্মা দেহ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তিনি এখুনি কামরাগুলো খোলার ব্যবস্থা করবেন। ঘোড়া থেকে নেমে তিনি বোরহানপুরের নায়েবকে খবর দিলেন।

দুই ঘণ্টা পর শোকের ধবধবে সাদা পোশাকে হাওয়ায় উড়তে থাকা লাল ধুলা আর ঝুলকালি মেখে আওরঙ্গজেব তাঁর মায়ের সেই ঘরটিতে হাঁটুগেড়ে বসে মোনাজাত করতে লাগলেন। প্রায় পঁচিশ বছরে পর্দাগুলো রোদে জ্বলে ন্যাকড়ার মতো রংচটা হয়ে পত পত করে জানালায় উড়ছিল। গালিচা আর আসবাবগুলো অনেক আগেই ইঁদুরে আর ঘুণপোকায় কেটে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর বাদুড়ের মলের ছাতা পড়া দুর্গন্ধে ভেতরের বাতাস দূষিত হয়ে রয়েছে। তাসত্ত্বেও তিনি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে চারপাশে তাকালেন–এখন কামরাগুলো যে অবস্থায় আছে সেটা নয়, তিনি দেখছিলেন একসময় কীরকম ছিল, সুন্দর রুচিশীল আসবাব আর সুগন্ধি মোমবাতি দিয়ে সাজান ছিল। মেঝেতে পড়ে থাকা কিছু একটা তার চোখে পড়তেই নিচু হয়ে তিনি জিনিসটা তুলে ধুলো ঝেড়ে দেখলেন, জিনিসটা একটি হাতির দাঁতের চিরুনি। জিনিসটা তার মায়ের? তিনি অনেক সময় দেখেছেন তাঁর মায়ের পরিচারিকা সাতি আল নিসা তার গোলাপ আতরের সুগন্ধিমাখা লম্বা রেশমের মতো চুল আঁচড়াচ্ছেন। এই সুগন্ধিটি তার মায়ের খুব প্রিয় ছিল।

হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাঁটু ভেঙ্গে সামনে নিচু হয়ে সাতলাপড়া বেলেপাথরের মেঝেতে কপাল ঠেকিয়ে তিনি দোয়া করতে শুরু করলেন প্রথমে তার মায়ের আত্মার জন্য, তারপর জাহানারা আর রওশনআরার জন্য…তারপর নিজের অজান্তেই কখন যে শুধু তার বাবার জন্যই নয়, এতগুলো বছরে তিনি যা কখনও করেন নি–তাঁর ভাই মুরাদ, শাহ সুজা আর দারা শিকোর জন্যও দোয়া করছেন, তা টেরও পেলেন না। এতগুলো বছরে যা তিনি কখনও করেননি। কি কারণে এটা করলেন? বুঝতে পারলেন না। কেবল আল্লাহই জানেন, যিনি মানুষের মনের ভেতরটা দেখতে পারেন।

*

হলুদ রেশমি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আকবর আরেক ঢোক সরাব খেলেন। এটা পেটে পড়তেই তার শরীর মন চাঙ্গা হয়ে উঠলো। সম্ভাজির কাছ থেকে তিনি তাঁর লোকজনসহ আর জগিন্দরের রাজপুতরা উষ্ণ আতিথ্য পেয়েছিলেন। সম্ভাজি এখন তার পাশেই আধশোয়া হয়ে রয়েছেন। মারাঠা রাজ্যে ঢুকতেই তার মন উদ্দীপ্ত হল আর তার সিদ্ধান্তে তিনি অটল হয়ে উঠলেন। এই মুহূর্তে অন্তত তিনি তার বাবার হাতের বাইরে রয়েছেন। বেচারা মুয়াজ্জম…তিনি কখনও তার কাছাকাছিও আসতে পারেন নি, ধরা তো দূরের কথা। অনুমান করতে পারছেন এতে তার বাবার কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। আওরঙ্গজেব সব সময় ভাবতেন মুয়াজ্জম অতিমাত্রায় সতর্ক আর তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে। সবার সামনে তাকে সমালোচনা করতেন, যেরকম অন্য সব ছেলেদের সমালোচনা করেন, কমবক্স ছাড়া। তবে তিনি কখনও ভাবেন নি যে, তার বাবা। নিজের মেয়ের প্রতিও এরকম প্রতিহিংসা পরায়ণ হবেন। জেবুন্নিসার কারারুদ্ধ হবার খবর শুনে তিনি মনে বড় ধরনের চোট পেয়েছিলেন। তিনি নিজেকে দোষী মনে করেছিলেন। কেননা তাকে সমর্থন করাতেই তার বাবা এর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। বিজয়ী হওয়ার পর অবশ্যই হবেন–তার প্রথম কাজ হবে নিজে ঘোড়ায় চড়ে গোয়ালিয়র গিয়ে তাকে মুক্ত করা। তিনি হবেন সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী–পাদিশাহ বেগম, ঠিক যেরকম তার ফুফু জাহানারা বেগম হয়েছিলেন।

 নেংটিপরা দুজন কসরতবাজ কামরায় ঢুকে আকবর আর সম্ভাজির সামনে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করলো। লোক দুটির নমনীয়, মসৃণ পেশিবহুল সারা গায়ে তেল মাখায় চকচক করছিল। তারপর ওরা লাফিয়ে, মোচড় দিয়ে আর এমনভাবে ছুটাছুটি করে উল্টে পড়ে কসরত করছিল যেন, ওদের দেহে কোনো হাড় নেই। একজন শূন্যে লাফ দিয়ে তিনবার ডিগবাজি খেতেই সম্ভাজি তার পাশে রাখা একটি চামড়ার থলে থেকে স্বর্ণমদ্রা বের করে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। তারপর এল মাথাকামানো আর পিপার মতো বুকের একজন লোক, তাকে অনুসরণ করে দুজন লোক ভারী একটি জ্বলন্ত কাঠ-কয়লার চুল্লি কাঁধে বয়ে নিয়ে এসে সাবধানে মেঝেতে রাখলো। মাথা-কামানো লোকটি খাপ থেকে একটি ছুরি বের করলো। ছুরিটি একটি লাল রঙের কাপড়ে কয়েক ভঁজে মোড়ানো ছিল। ভালোভাবে দেখার জন্য আকবর সামনে একটু ঝুঁকতেই লোকটি ছুরিটি চুল্লির আগুনে ঢুকিয়ে কাপড়টিতে আগুনে লেগে দপ করে জ্বলে ওঠা পর্যন্ত ধরে রাখলো। তারপর ছুরিটা মাথার উপর দিয়ে দুই তিনবার ঘুরাল, যতক্ষণ না অগ্নিশিখা লক লক করে জ্বলে উঠতে শুরু করে। তারপর মাথা পেছনের দিকে হেলে, ধীরে ধীরে জ্বলন্ত ছুরির ফলাটি মুখের ভেতরে ঢুকাল। সম্ভাজি আর তার সেনানায়করা করতালি দিয়ে উঠলো। সে ছুরির ফলাটি ঢুকাতে ঢুকাতে শেষপর্যন্ত শুধু হাতলটা বাইরে রইল। তারপর সে জ্বলন্ত ছুরিটি মুখ থেকে বের করে তার সহকারীর হাতে দিল। এরপর আরো দুটি ছুরি খাপ থেকে বের করে একই প্রক্রিয়ায় মুখে ঢুকাল, তবে এবার দুটি ছুরিই তার হা করা মুখের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আকবর সম্ভাজির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মোগল দরবারে এরকম হৈচৈ করে আনন্দোপভোগ করা আওরঙ্গজেব অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছেন। আগুন খেকো আর তার সহকারীরা তাদের সামনে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করতেই আকবর হাততালি দিয়ে তাদেরকে অভিনন্দন জানালেন। তবে মনে হল অনুষ্ঠান এখনও শেষ হয় নি।

সম্ভাজি তাকে বললেন, আমার মন্ত্রী আপনার জন্য বিশেষ একটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছেন…এটা আপনার পছন্দ হবে। তার শত্রুহীন তরুণ মুখে দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল। কথাটা বলতেই পরিচারকরা দেয়ালের চারদিকের জ্বলন্ত মশালগুলো নিভিয়ে দিতেই আলোকিত কামরাটি নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল। তার মনে হচ্ছিল যে কোনো মুহূর্তে তিনি অনুভব করবেন একটি ধারালো ছুরির ফলা তার গলা কেটে ফেলবে কিংবা বুকে বিঁধবে। এখানে বিশ্বাসঘাতকতা হচ্ছে না তো? কিংবা তার বাবার কোনো গুপ্তঘাতক? সম্রাটের চর তো সর্বত্র রয়েছে। তিনি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই অন্ধকারে সম্ভাজির সাথে তার ধাক্কা লাগলো। মারাঠারাজ বললেন, ‘একটু ধৈর্য ধরুন!’ তারপর দুইবার হাততালি দিয়ে চিৎকার করলেন, এবার শুরু কর!

ধীরে ধীরে একটি দরজা খুলতেই একটি ছায়ামূর্তি ভেতরে হাজির হল। তার পেছনে আরো দুটি ছায়ামূর্তি পাঁচটি উঁটিসহ একটি বাতিদানে পাঁচটি মোমবাতি নিয়ে ঢুকলো। ওরা কাছে এগিয়ে আসতেই মোমবাতির আলো আরো জোরালো হতেই আকবর দেখেলন, সবার আগে ছায়ামূর্তিটি একজন নারী। তার চুল কাঁধে লুটিয়ে পড়েছে, পরনের পোশাকটি শরীরের সাথে সেঁটে থাকায় দেহের রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পোশাকটি এমন একটি উপাদানে তৈরি যে এর উপর আলো পড়তেই ঝিকমিক করে উঠছে। এবার দেখা গেল দুটি বালক বাতিদানগুলো বয়ে নিয়ে আসছে। আকবরের বুকের ধুকপুকানি এবার স্বাভাবিক হয়ে এল।

 যে মঞ্চে আকবর আর সম্ভাজি দাঁড়িয়েছিলেন, তার কাছে এসে নারীটি মাথা নুইয়ে অভিবাদন করলো। সম্ভাজি বললেন, স্বাগতম লায়লা।’ রুপালি সুতা দিয়ে তৈরি লায়লার পোশাকটি এতই স্বচ্ছ ছিল যে, এর মধ্য দিয়ে তার সুডৌল স্তন, ক্রমাগত সরু হয়ে যাওয়া কোমর আর নিতম্ব পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। সম্ভাজি ইশারা করতেই সে মোমবাতির আলোয় কোনো বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই নাচতে শুরু করলো।

 দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে সে এমনভাবে পুরো দেহ বাঁকাচ্ছিল যেন, হাওয়ায় কোনো গাছ দুলছে। তারপর সে ঘুরতে শুরু করলো। মোমবাতির মৃদু আলোয় আকবর দেখলেন সে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তার হাত পুরো দেহের উপর বুলাচ্ছে। মেয়েটি জানে তার কি ক্ষমতা আর এতে সে আনন্দ উপভোগ করছে। আকবরের হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হল। কামরায় গভীর নীরবতা…এমন কোনো মানুষ হতে পারে না যে তাকে পেতে না চাইবে। আকবর বুঝলেন, এবার লায়লা তার কাছে এগিয়ে আসছে। তার কাছে এসে সে হাঁটু গেড়ে বসলো, মাথা পেছনে হেলিয়ে দুই হাত তুলে মেহেদি লাগানো চুলে বুলালো। সে এখন তার এত কাছে যে, তিনি তার বুকের উঠানামা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। সম্ভাজি ফিস ফিস করে বললেন, ‘একে আপনার পছন্দ হয়েছে, তাই না? আকবর মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তাহলে এর সাথে যান, আর দুজনে মিলে আমাদের মৈত্রিবন্ধন আর সামনে যে সুমধুর দিনগুলো আমাদের সবার জন্য রয়েছে তা উদযাপন করুন। আপনি দেখবেন সে মোটেই আপত্তি করবে না। লায়লা দাঁড়িয়ে আকবরের দিকে একহাত বাড়িয়ে বললো, “জাহাপনা। তারপর পুরুষ্টু লাল ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে মৃদু হাসলো। সম্ভাজির লোকেরা চিৎকার করে তাকে উৎসাহিত করতেই তিনি তার হাত ধরে কাছেই সম্ভাজি তার থাকার জন্য যে ঘরের ব্যবস্থা করেছেন সেদিকে এগিয়ে চললেন। চাঁপাফুলের সুগন্ধের সাথে তার ঘাম মিশ্রিত মাতাল করা সৌরভ নাকে নিয়ে তিনি তার সাথে চললেন। দরজা বন্ধ হতে না হতেই তিনি তাকে দুই হাতে কাছে টেনে নিলেন। লায়লা ফিস ফিষ করে বললো, ধৈর্য ধরুন জাহাপনা। তারপর এক পা পিছিয়ে এক টানে ঝিকমিক করা পোশাকটি মাথার উপর দিয়ে নিয়ে খুলে মাটিতে ফেলে দিল।

এমন নিখুঁত আর সুন্দর দেহ আকবর কখনও দেখেন নি। তিনি সব ভুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হাসি শুনে তিনি বুঝতে পারলেন যে, তিনি একটি বাচ্চা ছেলের মত হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি আবার তাকে কাছে টেনে নিয়ে তার সারা দেহে হাত বুলাতে লাগলেন। লায়লাও তার ঠোঁটে গভীর চুম্বন করলো।

 লায়লা তাকে ধৈর্য ধরতে বলেছিল, কিন্তু তা অসম্ভব ছিল। তিনি তাকে কোলে উঠিয়ে কাছেই নিচু বিছানায় নিয়ে গিয়ে শোয়ালেন। লায়লা তাকে কাছে টেনে নিল। এরপর পরিপূর্ণ মিলনের যে আনন্দ তিনি পেলেন তাতে খুশিতে হেসে উঠলেন। এখান থেকেই নতুন জীবনের শুরু–তার বাবার ছায়ার বাইরে একটি জীবন, যেখানে তিনি যা ইচ্ছা করেন তা অর্জন করতে পারবেন।

*

আকবর সম্ভাজির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কী মনে হয়? এখন আমরা আক্রমণ করতে পারি?

 ‘কেন নয়? আমার বাবা হলে মোটেই ইতস্তত করতেন না…’

আকবর বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমার বাবাও করতেন না। চক্রান্ত করার। সময় তার বাবা সাপের মতো সর্পিল আর পিচ্ছিল হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে আওরঙ্গজেবের সাহস কিংবা সামরিক কোনো সুযোগ খুঁজে বের করার ধীশক্তি নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করতে পারবে না। সম্ভাজির সাথে যোগ দেওয়ার পর আকবর গত কয়েক মাসে এ ধরনের একটা সুযোগ খুঁজছিলেন। বোরহানপুরে আওরঙ্গজেবের ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে অগ্রবর্তী সেনাদলটি সামনে এগিয়ে এসেছে, তার উপর একটি অতর্কিত হামলা করা যায়। শীঘ্র তিনি তার বাবাকে তার শক্তি দেখিয়ে দেবেন।

আকবর পেটের উপর শুয়ে মোচড়ানোর ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে উঁচু পাহাড়টির চূড়ার কিনারা থেকে একহাজার ফুট নিচে কাদা-মাটির ইটের তৈরি দুর্গটির দিকে তাকালেন। আরেকটু ভালোভাবে দেখার জন্য বুকে হেঁটে সামনে আরেকটু এগোলেন। তিনি আর সম্ভাজি একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে এক মাইল দূরে তপতি নদীর মাঝখানে একটি নিচু দ্বীপে অবস্থিত দুর্গটির উপর নজর রাখছিলেন। দেখতে পুরোনো মনে হলেও এখনও বেশ শক্তিশালী। তবে সম্ভাজির দুইজন চর ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে দুর্গে ঢুকে জায়গাটিতে ঘুরেফিরে দেখে এসে জানিয়েছে, দুর্গ রক্ষার জন্য একটি সেনাদল একমাস আগে থেকে এখানে অবস্থান করছে আর মূল যে সেনাবাহিনীটি আরো দক্ষিণ দিকে অনুসন্ধান করতে এগিয়েছে সেটিও খুব বেশি বড় নয়–বড় জোর একপঞ্চাশ জন সৈন্য হবে। নদীটি চওড়া হলেও, পানি খুব কম, সহজেই পার হওয়া যাবে। আর গোলন্দাজ বাহিনী থেকেও আক্রমণের ভয় নেই। দুর্গের পুরোনো দেয়ালে যে সরু ছিদ্রগুলো রয়েছে সেগুলো তীর ধনুকের উপযোগী করে করা হয়েছিল, কামানের গোলার জন্য নয়। একমাত্র প্রধান ফটকের চেপ্টা ছাদে কামান স্থাপন করা যেত, কিন্তু সেরকম কোনো চিহ্ন সেখানে দেখা যাচ্ছে না।

 আকবর জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা কখন আক্রমণ করবো?

 ‘এখন হলে ক্ষতি কি? আমরা ওদের একজনের জায়গায় দুইজন রয়েছি। আর নতুন চাঁদের আলোও খুব কম, কাজেই অতর্কিতে আক্রমণ করে আমরা ওদেরকে চমকে দিতে পারি।’

 অবশেষে আক্রমণ শুরু হল। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আকবর ভাবতেন সম্ভাজি এত অতিথিপরায়ণ আর তাকে স্বাগত জানালেও, যত দ্রুত সম্ভব মোগলদের মোকাবেলা করার ব্যাপারে তিনি নিজে যেরকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন, তার সাথে তিনিও অংশীদার হবেন কি-না। তবে সেটা ঠিক নয়…সম্ভাজি কেবল সঠিক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কাজেই যখন তার গুপ্তচরেরা খবর দিল মোগলরা এই দুর্গ দখল করে এখানে প্রচুর রসদ জমা করেছে, তখন তিনি আর ইতস্তত করলেন না। তার বাবার সেনাদলের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করলে কি চমৎকার অনুভূতি হবে। আওরঙ্গজেব কখনও ভাবতে পারতেন না যে, তার ছেলের এমন সাহস হবে আর কল্পনা করতে পারবে যে, অগ্রবর্তী মূল মোগল বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে এমন একটি দুর্গ আক্রমণ করবেন, যা তার সেনাপতিরা পেছনে সুরক্ষিত করে রেখে এসেছে…

তারপরও পাহাড়ের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। তারপর পাহাড়ের নিচে গাছের আড়ালে আকবরের নিজের সেনাদল আর মারাঠিরা অস্থায়ী শিবির গেড়ে সেখানে প্রস্তুতি নিতে যে সময় নিচ্ছিল, আকবরের তখন মনে হচ্ছিল সময় যেন কাটছেই না। যখনই আকবর আকাশের দিকে তাকাতেন তখনই তার মনে হত সূর্য যেন একই জায়গায় রয়েছে। নিজের মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাতে তিনি সম্ভাজি আর তার সেনানায়কদের সাথে আক্রমণের ছকটি নিয়ে বারবার আলোচনা করতে লাগলেন। ওরা সবাই এতে একমত হয়েছিল। পরিকল্পনাটি বেশ সহজ ছিল। অন্ধকার নামলেই ওরা প্রস্তুতি নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠবে। তারপর একটু পরই যখন দুর্গের অধিকাংশ লোক খওয়া-দাওয়া আর ঘুমাবার কথা চিন্তা করবে তখন ওরা ছোট ছোট দলে হেঁটে পাহাড় থেকে নামতে শুরু করবে। ঘোড়া নিলে বেশি শব্দ হবে–হেঁটে নদী পার হয়ে যে দ্বীপে দুর্গটি অবস্থিত সেখানে যাবে। সেখানে পৌঁছে দুর্গের প্রধান ফটকের দুইশো গজ দূরে একটি আমগাছের জঙ্গলের আড়ালে সবাই একত্রিত হবে। তারপর যখন মোটামুটি নিশ্চিত হবে যে, ওদেরকে কেউ দেখছে না তখন দুজন লোক চুপি চুপি ফটকের যতদূর সম্ভব কাছাকাছি গিয়ে একটি বড় বস্তা ভর্তি বারুদ রেখে আসবে। একইসাথে অন্যরা দশজন করে দলে বিভক্ত হয়ে দুর্গের সীমানার চতুর্দিকে দেয়াল ঘেঁসে অবস্থান নেবে, যাতে সময় মতো দেয়াল বেয়ে উঠতে পারে। প্রয়োজন বোধে গুলিবর্ষণ করে ওদেরকে সহায়তা করার জন্য প্রতি দলে দুজন বরকন্দাজ থাকবে। তারপর সিদ্ধান্ত মোতাবেক একবার শিঙ্গা বেজে উঠলেই বারুদের বস্তা নিয়ে যে দুজন ফটকের কাছে থাকার কথা ওরা দ্রুত বারুদের বস্তার পলিতায় আগুন লাগিয়ে দেবে। এর বিস্ফোরণের ফলে ফটকের পাল্লাগুলো কজা খুলে উড়ে যাবে আশা করা যায়। কয়েকজন কুশলী যোদ্ধা নিয়ে আকবর কোনো বাধা এলে তা সামলাবে আর সম্ভাজির নির্দেশে অন্যরা দেয়াল দিয়ে আক্রমণ করবে।

পশ্চিম আকাশে কমলা রঙ মুছে যেতেই আকবর পাহাড়ের খাড়া গা বেয়ে চূড়ায় আরোহণ করতে শুরু করলেন। তার কোরচি তার লম্বা তরোয়ালটি নিয়ে তার পাশাপাশি উঠছিল আর পেছন পেছন আসছিল তার দেহরক্ষী দল। সামান্য যে আলো ছিল তাতে সে দেখছিল জগিন্দরের রাজপুত সৈন্যরা লম্বা লম্বা পা ফেলে আসছে। ওরা পিঠে অস্ত্রশস্ত্র বেঁধে নিয়েছিল। সম্ভাজির মারাঠিদের মধ্যে কেউ কেউ কাঁধে কুণ্ডলী করা দড়ি নিয়ে উঠছিল, অন্যরা মই, বারুদের বস্তা আর গাদা বন্দুকের গুলি বহন করছিল।

 পাহাড়ের চূড়া থেকে সরু এক ফালি চাঁদের মান আলোয় তপতি নদীর পানি হালকা চিকচিক করে উঠলো। আর দুর্গের অন্ধকার আকৃতিটি প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না, শুধু ফটকের দালান আর সৈনিকদের আবাসস্থল থেকে মাঝে মাঝে কমলা রঙের আলোর ফোঁটা দেখা যাচ্ছে। কেবল দূর থেকে রাখাল গরুর পাল নিয়ে রাতের জন্য গোয়ালে ফিরতেই গরুর গলার ঘণ্টার টুংটাং আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। আকবর একটি লম্বা শ্বাস নিলেন। একটু পরই সম্ভাজি হাজির হলেন। একটি রুপার পানের বাক্স ধরে মারাঠি নেতা বললেন, ‘পান চলবে? আকবর মাথা নাড়লেন, তার চোখ তখন নিচের দিকে।

তারপর আকবর বললেন, ‘নিচে বেশ চুপচাপ মনে হচ্ছে। তবে আমার বাবার চোখ কান সবদিকে আছে, তাই আমি আমার নিরস্ত্র দুজন চর পাঠিয়েছি গ্রামবাসীর পোশাকে। ওরা দেখে নিশ্চিত হবে যে, আমরা কোনো ফাঁদে পা দিচ্ছি কি-না।

সম্ভাজি বললেন, আপনি কী তাকে ভয় পান?

 আকবর এতক্ষণ পেটের উপর উপুড় হয়ে শুয়েছিলেন, প্রশ্নটি শুনে উঠে বসে। বললেন, কী?

মাঝে মাঝে যখন আপনি আপনার বাবার কথা বলেন, তখন আপনাকে বেশ আতঙ্কিত মনে হয়।

‘আমি তাকে ভয় পাই না, তবে আমি জানি তিনি কী করতে সক্ষম। তাঁর ক্ষমতাকে আমাদের ছোট করে দেখা ঠিক হবে না।’

 ‘তা করি না। তবে আমি কখনও সে কথা ভুলিনি যে, আমার বাবা কিভাবে তাকে বোকা বানিয়ে মিষ্টির ঝুড়িতে লুকিয়ে আগ্রা দুর্গ থেকে আমাকে নিয়ে পালিয়েছিলেন!’ কথাটা বলে সম্ভাজি জিহ্বা দিয়ে চুক চুক শব্দ করলেও আকবর তাতে সুর মেলালেন না। তিনি কি করে বুঝবেন–তিনি তার বাবার সম্পর্কে কি অনুভব করেন, যেখানে সম্ভাজি তার নিজের বাবার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এক মুহূর্ত তিনি কী একটু ঈর্ষা অনুভব করলেন? না তা খুব বেশি হয়ে যায়, এটাকে অনুতাপ বলা চলে। আওরঙ্গজেব যদি অন্য ধরনের বাবা হতেন, তবে আজ তিনি এই পাহাড়ের চূড়ায় থাকতেন না। পরিবার আর তাহাব্বুর খানের মতো বন্ধুদের থেকে অনেক দূরে এমন লোকদের উপর নির্ভর করে থাকতেন না, ভিন্ন পরিস্থিতে যারা তার শত্রু বলে গণ্য হতেন। তবে এখন এ ধরনের চিন্তার অবকাশ নেই। আকবর আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার সময়টা বুঝার চেষ্টা করলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে তার পেছনে একটু শব্দ শোনা গেল। পেছন ফিরে দেখলেন অশোক এসেছে। যে কয়েকজন চরকে দুর্গে পাঠান হয়েছিল ‘অশোক তাদের একজন।

‘নিচে কি আবিষ্কার করলে অশোক?”

 ‘সবকিছু চুপচাপ আর শান্ত মনে হচ্ছে, জাহাপনা। ওরা রাতের জন্য প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়েছে, তবে বাইরে কোনো প্রহরী রাখেনি। মনে হয় ওরা কিছু সন্দেহ করেনি। নদীতে গিয়ে আবার দেখলাম খুব বেশি হলে কোমর পর্যন্ত পানি হবে।

আকবর সম্ভাজির সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে বললেন, তাহলে চলুন, আমরা যাই!’

 ফিস ফিস করে নির্দেশ চলে গেল অপেক্ষমাণ লোকের সারির শেষ পর্যন্ত। প্রথম দলটি পাহাড়ের কিনারা দিয়ে ঢাল বেয়ে নিচে দুর্গের দিকে নামতে শুরু করলো। আকবর তার লোকজনসহ প্রথমে গেলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন দ্রুত দৌড়ে নামেন, কিন্তু তিনি বেশ সাবধানে নামতে লাগলেন যেন কোনো আলগা পাথর গড়িয়ে না পড়ে। হঠাৎ রাতের নৈঃশব্দ ভেদ করে প্যাচার ডাক আর পরপরই এর শিকারের তীব্র আর্তচিৎকার শুনে তিনি চমকে গেলেন। অন্ধকারে শব্দগুলো খুব জোড়ালো শোনাল।

আধঘণ্টা পর আকবর নদীর তীরে পৌঁছলেন। লোকজন তার চারপাশে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। আশঙ্কা করছিলেন, যে কোনো মুহূর্তে হয়তো কেউ সতর্ক করে চিৎকার করবে আর দুর্গের ছাদ থেকে মশালের আলো দেখা যাবে, এমনকি যখন দুজন লোকের হাত থেকে লোহার আঁকশিভরা একটি ধাতুর টিন পড়ে গেল, তারপরও কিছু হল না। এরপর অশোককে অনুসরণ করে আকবর তার লোকজনসহ তপতি নদীর উষ্ণ পানিতে নেমে পড়লেন। অশোক ঠিকই বলেছিল। নদী পারাপারের স্থানটিতে পানি বেশ কম ছিল। পানির উপর গাদা বন্দুক আর বারুদের শিং হাতে নিয়ে যেতে খুব একটা কষ্টকর ছিল না। তাছাড়া নদীর তলদেশে বালুময় আর কোনো স্রোত না থাকায় পা পিছলে পড়ে যাবার কিংবা পানি ছলকে উঠে শত্রুপক্ষকে সতর্ক করে দেওয়ারও ভয় নেই। দ্বীপে পৌঁছে আকবর তার লোকজন নিয়ে আমগাছের ছড়ানো ডালপালার ঘন পাতার ছাউনির নিচে গেলেন, সেখানেই সবার মিলিত হওয়ার কথা। একটুপরই মারাঠি আর রাজপুত সৈন্যরা এসে ওদের সাথে মিলিত হল। তারপর সম্ভাজির দুই লোক বারুদের বস্তা, লম্বা পলিতা আর চকমকির বাক্সের ওজনের ভারে নিচু হয়ে মূল ফটকের দিকে নিঃশব্দে এগোল। আর একই ধরনের জিনিসপত্র নিয়ে আরো দুজন অপেক্ষা করছিল, যদি কোনো কারণে আগের দুই লোকের কোনো ধরনের অঘটন ঘটে। তারপরও সবদিক নিশ্চুপ।

 ইতোমধ্যে দড়ি আর মই নিয়ে দশজন করে এক একটি দল দুর্গের দেয়ালের নিচে অবস্থান নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ওরাও নিঃশব্দে এগিয়ে দেয়ালের নিচে পৌঁছল। এবার ফটকে বারুদ বসাবার লোক দুজনের কাছ থেকে একটি সাংকেতিক নিচু ডাক শোনা গেল, অর্থাৎ ওদের কাজ হয়েছে, বারুদের বস্তাগুলো জায়গামত বসান হয়েছে। আকবরের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নেড়ে সম্ভাজি ফিস ফিস করে ‘শুভকামনা জানিয়ে দুর্গের দেয়ালের নিচে একটি আক্রমণকারী দলের কাছে চলে গেলেন। এবার আকবর সঙ্কেত করতেই একবার শিঙ্গা কুঁকা হল। প্রায় সাথে সাথে দুর্গের ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেল। কয়েক মুহূর্তপর দুর্গের ছাদে মশাল জ্বলে উঠলো। তারপর একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। আকবরের কানে ঘণ্টার মতো বাজতে লাগলো আর প্রচণ্ড ধুলায় তিনি কাশতে শুরু করলেন। বারুদ নিয়ে যারা গিয়েছিল ওরা ওদের কাজ সফলভাবে করেছে।

তরোয়াল হাতে নিয়ে আকবর ধুলা আর ধোয়ার মধ্য দিয়ে প্রধান ফটকের দিতে ছুটে চলতে চলতে চিৎকার করে উঠলেন, “এসো আমার সাথে! বিস্ফোরণের ধাক্কায় ফটক দালানের একপাশের মাটির দেয়াল ভেঙ্গে পড়েছে আর লোহার ফটকের একটি পাল্লা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। ছুটতে ছুটতে তিনি তার অন্যদলের লোকজনের চিৎকার শুনতে পেলেন। ওরা দেয়ালের উপর দিয়ে দড়ি আর আকশি ছুঁড়ে দ্রুত মই বেয়ে দেয়ালে উঠতে শুরু করেছে। তারপর একজায়গায় জমাকরা আবর্জনার উপর পা লেগে হোঁচট খেয়ে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই তার মাথার উপর দিয়ে একটি গোলা শিষ দিয়ে উড়ে চলে গেল।

 নিজেকে সামলে নিয়ে আকবর দেখলেন আধো-অন্ধকারে কয়েক ফুট সামনে সবুজ পোশাকপরা একজন বরকন্দাজ একটি ভাঙ্গা ইটের দেয়ালের আড়ালে অর্ধেক লুকিয়ে রয়েছে। দ্বিতীয়বার গোলার জন্য লোকটি মনোযোগ দিয়ে তার গাদা বন্দুকের লম্বা নলে বারুদ আর গোলা ভরছিল। আকবর ছুরি বের করে সামনে ছোঁড়ার জন্য হাত পেছনে নিতেই লোকটি মুখ তুলে তাকাল। পাকা চুলের লোকটিকে দেখে চিনতে পেরে আকবরের দম বন্ধ হয়ে এল। যুবক বয়সে করিম খান আওরঙ্গজেবের বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদলের একজন সদস্য ছিল। আকবর একটু ইতস্তত করলেন, প্রায় হাত নামিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলেন। তারপর দেখলেন করিম তাকে দেখেই পরিষ্কার চিনতে পেরে গম্ভীর মুখে দ্রুতহাতে বন্দুকে গোলা ভরার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আকবর আর দেরি না করে ছুরিটা ছুঁড়ে মারলেন। ছুরির ডগাটি করিম খানের গলায় বিধলো, সে তখন বন্দুক খাড়া করে আকবরের দিকে তাক করছিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতেই প্রবীণ লোকটি সামনে পড়ে গেল, আর তার হাত থেকে গাদা বন্দুকটি ছিটকে আকবরের পায়ের কাছে পড়ে গেল।

যন্ত্রণায় ছটফট করা করিম খানের দেহের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে আকবর কয়েকগজ সামনে তার লোকজনের দিকে ছুটলেন। ওরা তখন দুর্গের আরো ভেতরে ঢোকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছিল। একজন তরুণ সেনা কর্মকর্তা তরোয়াল হাতে নিয়ে ওদের আগে আগে ছুটে ভেতরের একটি ফটকের দিকে যাচ্ছিল। তারপর সে হঠাৎ চিৎকার করে ঘুরে পড়ে গেল। তরোয়াল ফেলে দিয়ে একহাতে নিজের গলা চেপে ধরলো। শত্রুপক্ষের বরকন্দাজদের গাদা বন্দুকের গোলা লক্ষভ্রষ্ট করার জন্য আকবর তার লোকদের সাথে মিলে এলোপাতাড়ি মোগল সেনাদের দিকে তরোয়াল চালাতে শুরু করলেন। ওরা ওদের আবাস থেকে বের হয়ে অস্ত্র হাতে নিয়ে তৈরি হওয়ার জন্য চেষ্টা করছিল। রক্তে পিচ্ছিল পাথরের মেঝেতে কয়েকবার তার পা পিছলে গেল। তাসত্ত্বেও আকবর তার লোকদের সাহায্যে এগিয়ে গেলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় ওরা তখন দৃঢ়সংকল্প অল্প সংখ্যক মোগলদেরকে ধীরে ধীরে পিছু হটতে বাধ্য করছিল। তারপর ওরা একটি খিলানে ঢাকা চওড়া তোরণের মধ্য দিয়ে দুর্গের অভ্যন্তরস্থ উঠানের দিকে ছুটে গেল। দেহ শক্ত করে তিনি আরো শত্রুর খোঁজে চারপাশে তাকালেন, তবে অধিকাংশই দুর্গের দালানের ভেতরে পালিয়ে গেছে, আর কয়েকজন অস্ত্র মাটিতে ফেলে আত্মসমর্পণ করলো।

দুর্গের ছাদে তখনও প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। আকবর মুখ তুলতেই দেখলেন একজন লোক উপর থেকে মাথা নিচের দিকে করে কঠিন পাথরের মেঝেতে পড়তেই তার মগজ বের হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। চাঁদের আলোয় শত্রু না মিত্র তিনি বুঝতে পারলো না। তার নিজের সৈন্য আর সম্ভাজির সৈন্যরা মনে হল ভালোই লড়াই করছে। শিরস্ত্রাণের সাদা পালক দেখে সম্ভাজিকে সহজেই চেনা যাচ্ছিল। তিনি সবার সমনে দাঁড়িয়ে তার চেয়ে আকারে দ্বিগুণ ভালুকের মতো একজন লোকের সাথে লড়ে যাচ্ছিলেন। ক্ষিপ্রগতিতে লোকটির তরোয়ালের কোপ এড়িয়ে তিনি হঠাৎ সামনে লাফ দিয়ে লোকটির উপরে উঠান হাতের নিচে দিয়ে এগিয়ে তার চওড়া বুকে তরোয়াল বিধিয়ে দিলেন। তার শত্রু কয়েকমুহূর্ত টলমল করতে করতে দুই হাত শূন্যে তুলে নিচে উঠানে পড়ে গেল।

আকবর দেখতে পেলেন তার একজন সেনা কর্মকর্তা ছাদের খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে তার দিকে ছুটে আসছে। সে এসে বললো, ‘জাহাপনা, দুর্গের সুবেদার কয়েকজন সেনাসহ উপরের একটি কামরায় নিজেকে আবদ্ধ করেছে। তবে সে সেখান থেকে চিৎকার করে বলেছে, আপনি যদি তার সৈন্যদেরসহ তার প্রাণ বাঁচাবার অঙ্গীকার করেন, তবে সে দুর্গ খুলে দিয়ে সমস্ত রসদ আপনার হাতে তুলে দেবে। তবে সে বলেছে সম্ভাজি নয় আপনাকে কথা দিতে হবে।

 ‘তাকে বল আমি আর সম্ভাজি এক, তবে আমি তার কথায় রাজি হতে পারি। একটি শর্তে। সে দুর্গে যত মোগল পতাকা আছে সেগুলো আমার হাতে তুলে দেবে। আমি সম্রাট। এটা আমার জন্য উপযুক্ত।

*

আমি আপনার দুর্গ আর এই পতাকাগুলো দখল করেছি। ঠিক সেভাবে আপনার সিংহাসন দখল করবো। আমার মিত্রদের সাথে আপনি অন্যায় আচরণ করেছেন, যেমন করেছেন আমার সাথে। আমি লড়াই চালিয়েই যাব যতদিন না নিজের জন্য আর আমার অত্যাচারিত জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবো।–আকবর।

*

আওরঙ্গজেবের হাসি পেল। তিনি বললেন, ‘আকবর যে একটা বোকা আর সাদাসিধা তা এই চিঠিতেই প্রমাণিত হচ্ছে। সে কি আসলেই ভেবেছে যে, এরকম একটা ছোট্ট গুরুত্বহীন, অরক্ষিত দুর্গ দখল করলেই আমার হাঁটু কাঁপতে থাকবে?

 শরবতের গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে উদিপুরী বললেন, কী এটা? কী লেখা আছে এতে? আওরঙ্গজেব জানেন উদিপুরী শরবত নামে যা পান করছেন, তাতে সম্ভবত শরাব মেশানো আছে। কঠোর ধর্মীয় বিশ্বাস পালন করলেও তিনি এবিষয়ে এখনও আপত্তি করতে পারেন নি। একবার তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেছিলেন যে, তার দেশ জর্জিয়ায়, যেখানে তিনি জন্ম গ্রহণ করেছেন সেখানেই মদ আবিষ্কৃত হয়েছে। আর এর স্বাদ তাকে তার নিজের দেশের কথা মনে করিয়ে দেয় আর তার পেটের শূল বেদনার যে প্রবণতা আছে তার বিরুদ্ধে কাজ করে। বোরহানপুরে তার সাথে আসার জন্য তিনি আবদার শুরু করলে তিনি তাকে আসতে নিষেধ করেন নি। যে রাতে তিনি তার মায়ের ঘরগুলো উন্মুক্ত করেছিলেন, তখন থেকে অনুভব করছিলেন যে, এই স্থানটিতে যে বিষণ্ণ স্মৃতি আর অশুভসূচক লক্ষণ ছিল তার কিছুটা তিনি ছড়িয়ে দিয়ে অদৃশ্য করেছেন। এর ফলে জাহানারার মৃত্যুর পর বিষণ্ণতার কারণে তার মনে যে অসাড়ভাব হয়েছিল তা ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিলেন।

 তিনি বললেন, একটা ছোট্ট জয়ের পর আকবর একটা মুরগির বাচ্চার মতো খুশিতে চেঁচাচ্ছে। আর বিজয়স্মারক হিসেবে কয়েকটা পতাকা দখল করে সেগুলো আমার কাছে পাঠাবার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। সে যেরকম বোকা সেরকম উদ্ধত আর নিজের সম্পর্কে অতিমাত্রায় উচ্চ ধারণা পোষণ করে।

 ‘আমি জানি সে সীমালঙ্ঘন করেছে আর আমি কখনও তার স্বপক্ষে কিছু বলবো না। তবে নিজের রক্তমাংসের সন্তান সম্পর্কে এভাবে আপনার কথা বলাটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। এতে আমার ভয় হচ্ছে যদি আমাদের ছেলে কমবক্স কখনও আপনাকে অসন্তুষ্ট করে, তাহলে তার কী হবে।’

‘তুমি জান আমি কমবক্সকে ভালোবাসি। তবে বড় হলে তাকে শিক্ষা নিতে হবে, যা আকবর নেয় নি; আর সেটা হল আমাকে মান্য করা আর কর্তব্যপরায়ণ হওয়া। আশা করি বড় হওয়ার পর কমবক্স আমাকে নিরাশ করবে না। তবে তার ভাগ্য তার হাতেই রয়েছে, সে কি করতে চাইবে তার উপর। তাকে এটা বুঝিয়ে আর এটা করে মা হিসেবে তুমি একজন সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজই করবে–বিশেষত যে ছেলে একজন শাহজাদা।

উদিপুরী গ্লাস থেকে আরেক চুমুক শরবত খেলেন। আওরঙ্গজেব তার সুন্দর চেহারা এরকম বিষণ্ণ হতে খুব একটা দেখেন নি, তবে তাকে বাস্তবতা বুঝতে হবে–তিনি একজন সম্রাট। লক্ষ লক্ষ মানুষের নিয়তি তাঁর হাতে। দয়া এবং সমবেদনা–এসব হচ্ছে দুর্বলতা এবং নারীসুলভ ভাবাবেগ–যা জাহানারা কখনও স্বীকার করেন নি। এমনকি নিজ পরিবারের প্রতিও দেখানো যাবে না। উদিপুরী জিজ্ঞেস করলেন, এখন আপনি কী করবেন? মানে আকবরের কথা বলছি।’

 ‘এখানে যা করতে এসেছি তাই করবো। মূল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রবর্তী বাহিনীর সাথে মিলিত হব। তারপর তাদের নেতৃত্ব দিয়ে তাকে পরাজিত করে চিরদিনের জন্য তার ঔদ্ধত্য সেখানেই শেষ করে দেব। তিনদিনের মধ্যে বোরহানপুর ছেড়ে চলে যাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *