১৩. মিষ্টভাষী চালবাজ/কপট উপদেষ্টা

১৩. মিষ্টভাষী চালবাজ/কপট উপদেষ্টা

ঘুমের ঘোরে আকবর এপাশ-ওপাশ করছিলেন। রাতে তাঁবুর ছাদে প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ার শব্দে আর ঝড়ো হাওয়ার গর্জনে দু-একবার তার ঘুম ভেঙ্গেছিল। একটি হাত তার কাধ ধরে আস্তে আস্তে ঝাঁকি দিতে দিতে তাকে বললো, “জাহাপনা, রাজপুতরা চলে গেছে।

এটা হয়তো একটা স্বপ্নের অংশ–যে স্বপ্নে চরম ভীতি আর উদ্বেগ একেবারে সামনে চলে আসে। তাকে এখুনি জেগে উঠে দেখতে হবে যে এটা সত্যি নয়। তিনি চোখ খুলে, চোখে আঙুল ঘষে ঘুম কাটাতে চেষ্টা করলেন। তবে হতাশ হলেন বাস্তবে ফিরে এসে। তার তরুণ কোরচি তার রেশমি আলখাল্লা এক হাতে বাড়িয়ে ধরে কথা বলছিল। রাতপোশাকের উপর এটা পরে তাকে অনুসরণ করে তাঁবুর দরজার কাছে এলেন। ছাউনির নিচ থেকে সামনে উঁকি দিয়ে ছোট ছোট খানাখন্দের উপর দিয়ে সামনে তাকালেন। সেখানে রাজপুতদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাহসী আর উদ্যমী সেই যোদ্ধাদের সেরকম কোনো হাঁকডাক, শোরগোল কিছুই শোনা যাচ্ছে না। কোনো চুলার আগুন নেই আর স্তূপ করা অস্ত্রশস্ত্রও দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া মনে হল রাজপুতদের বেশির ভাগ তাবুই নেই।

এটা কেমন করে হতে পারে? তাবুর ভেতরে একটি টেবিলের উপর পানির জগ রাখা ছিল। সেখান থেকে কিছু পানি নিয়ে মাথায় ছিটিয়ে এই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করলেন। ভোরের ঠাণ্ডা পানিতে মাথা ভিজে গেলেও তার চোখের সামনের দৃশ্যটির কোনো পরিবর্তন হল না। এটা বাস্তবতা। আকবর থরথর করে কেঁপে উঠলেন। রাজপুতরা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ধুলায় মিশে গেছে। তার বাবা তাকে ধরতে পারলে তার জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে। নির্বাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝার চেষ্টা করলেন কী হয়েছে, এমন সময় যে কয়েকটি তাবু তখনও ছিল সেখান থেকে কমলা রঙের পোশাকপরা একজন রাজপুত তার দিকে এগিয়ে এল। আকবর সাথে সাথে লোকটিকে চিনতে পারলেন–আম্বারের রাজার ছোট ছেলে জাগিন্দর। একে তিনি তার প্রায় সারা জীবন ধরে চিনতেন। জাগিন্দর কাছে এসে প্রণামের ভঙ্গিতে ভেজা মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই আকবর তাকে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করে বললেন, ‘এসবের দরকার নেই। কি হয়েছে বল?”

‘আমার বেশিরভাগ রাজপুত বন্ধুরা চলে গেছে। শুধু আমি আমাদের কয়েকজন অশ্বারোহীসহ রয়ে গেছি আপনাকে বিষয়টা জানাবার জন্য। কেননা আমি যতটুকু আপনাকে জানি, তাতে আমি বুঝি, যে কারণ দেখিয়ে ওরা চলে গেছে তা আমার বিশ্বাস হয় নি।

 ‘তুমি কী বলতে চাচ্ছ?

 মাটির দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে জাগিন্দর বলতে শুরু করলো, গতকাল আপনি যখন সেনাবাহিনী পরিদর্শন করছিলেন, তখন বিকানিরের রাজা শিবির সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি প্রহরীদলকে চারপাশ টহল দিতে পাঠিয়েছিলেন। ওরা তখন দেখতে পেল দুজন নিরস্ত্র লোক নিঃশব্দে চোরের মতো শিবিরের দিকে আসছে। টহলদলটি সামনে এগোতেই ওরা দ্রুত তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। লোকদুটি শিবিরের দিকে চুপি চুপি আসছিল। ওদেরকে যখন জিজ্ঞাসা করা হল এখানে ওরা কি করছে, তখন ওরা প্রায় সাথে সাথে স্বীকার করলো যে, ওরা আপনার চাকর, আপনি যে চিঠি আপনার বাবাকে লিখেছিলেন তার উত্তর নিয়ে ওরা আপনার বাবার কাছ থেকে আসছিল। তারপর ওরা আওরঙ্গজেবের সিলমোহরসহ চিঠিটা টহলদলের হাতে দিল। ওরা চিঠিটা নিয়ে বিকানিরের রাজার কাছে দিল। তিনি সিলমোহর ভেঙ্গে চিঠিটা পড়লেন, তারপর সাথে সাথে অন্য রাজাদেরকে একটি সভায় ডাকলেন। সেখানে আমিও আমার বাবার সাথে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে দেখলাম বিকানিরের রাজা রেগে ফেটে পড়ে বললেন, “আমি অনেক আগে থেকে উদ্বিগ্ন ছিলাম যে, মোগলদেরকে বন্ধু হিসেবে বিশ্বাস করা যায় কি-না। তারপরও আমি সভায় যোগ দিয়েছি আর আমাদের জনগণের একতার স্বার্থে আপনারা আকবরকে যে সমর্থন দিয়েছেন তাতে বিনা আপত্তিতে সায় দিয়েছি। আর এখন বাবার কাছ থেকে ছেলেকে লেখা এই চিঠিতে আমার সন্দেহই সঠিক প্রমাণিত হল। এটা অবশ্যই সম্রাটের নিজের হাতের লেখা–আমাকে লেখা তার চিঠি থেকে এ লেখা আমি খুব ভাল করে চিনি। এটা এভাবে শুরু হয়েছে শুনুন, “খুব চমৎকার কাজ করেছ, আমার সাহসী ছেলে। অসভ্য আর বর্বর রাজপুতদেরকে ফাঁদে ফেলার জন্য তুমি যে দক্ষতা আর চাতুরি দেখিয়েছ, তার জন্য আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।” আওরঙ্গজেব বিশদভাবে চিঠিটিতে বর্ণনা করেছেন, কিভাবে আপনারা দুজনে মিলে আজ আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য কী পরিকল্পনা করেছিলেন… কিভাবে আপনি আমাদের সেনাদেরকে পথ দেখিয়ে এখান থেকে আজমির দুর্গে যাওয়ার মাঝপথে জঙ্গল আর ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে লুকানো আপনার বাবার সবচেয়ে বড় কয়েকটি কামানের সামনে নিয়ে যাবেন।

আকবরের মাথা ঘুরতে শুরু করলো, জগিন্দর কি বলছে তা বুঝার চেষ্টা করতে লাগলেন, তখনও নিজেকে বুঝাচ্ছিলেন যে এটা বাস্তবতা কি-না। তারপর ফেটে পড়ে বললেন, এটা মিথ্যা, সম্পূর্ণ মিথ্যা। উত্তেজনায় তার গলা কাঁপছিল। আমি কখনও আমার বাবার সাথে চিঠি আদান-প্রদান করি নি। আমার একটা সম্মান আছে, যখন কোনো কথা দেই তা অবশ্যই রাখি। এটা তার আরেকটি জঘন্য চাল…বুঝতে পারছো না?

‘হ্যাঁ, জাঁহাপনা। আমি তা বিশ্বাস করেছি বলেই এখানে রয়ে গেছি। প্রথমে সভার সবাই চিঠিটার বিষয়বস্তু বিশ্বাস করে নি, তবে সভার সবার সামনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পরবর্তীতে বন্দী লোক দুটো আরো কিছু তথ্য জানাল। যেমন, সারির একেবারে প্রথমে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার সময় আপনি হঠাৎ ঘুরে যাবেন আর তার ঠিক আগেই আপনার পাশে পাশে চলা কোরচি তার হাতের পতাকাটি মাটিতে ফেলে দিয়ে আপনার বাবার গোলন্দাজদের সংকেত দেবে। তখন কামানের গোলা বর্ষণ শুরু হবে। ততক্ষণে প্রায় সবাই এটা বিশ্বাস করলেন। আমার বাবা অবশ্য প্রস্তাব করলেন আপনার মুখোমুখি হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন্য আপনাকে একটা সুযোগ দিতে। আপনার সাথে কথা বলার জন্য তিনি একজন সেনা কর্মকর্তাকে পাঠালেন। তবে আপনার দেহরক্ষী দলের একজন সেনানায়ক বললো, আপনি ঘুমাচ্ছেন আর তার কঠোর নির্দেশ আছে, ঘুমন্ত অবস্থায় আপনাকে যেন বিরক্ত না করা হয়। বিশেষত রাজপুতরা যেন কোনো মতেই আপনার শিবিরের কাছে আসতে না পারে। সেনা কর্মকর্তা ফিরে যখন জানাল আপনার দেহরক্ষী দলের নেতা কি বলেছে তখন তা সভাসদদের সন্দেহ আরো উসকে দিল। পরিশেষে ওরা একমত হল যে, সবাই মিলে আপনার সাথে আজমির যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে এই মুহূর্তে এখান থেকে সরে পড়াটাই বরং নিরাপদ হবে। আমার বাবার মতো আরো কয়েকজন কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন, তবে অন্যান্যে যার যার রাজ্যে ফিরে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। রাতে ঝড়ের আড়ালে বেশিরভাগই শিবির উঠিয়ে চলে গেলেন। আমার বাবা এখান থেকে কয়েক মাইল পশ্চিমে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছেন। তবে অন্যদের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।’

‘কিন্তু আমার নিজের অন্যান্য মোগল সেনা কোথায়?

 ‘আমাদের চলে যাওয়ার প্রস্তুতি আর পুরো বিষয়টি শুনে ওদের মধ্যে কিছু লোক আতঙ্কিত হয়ে ভাবলো যে, আপনি আপনার বাবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য ওদেরকে ফাঁদে ফেলেছেন, আর ধরা পড়লে ওদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে। তখন ওরা তাদের সেনাপতি, আপনার বন্ধু তাহাব্বুর খানের তাঁবুতে গিয়ে দেখলো উনিও সেখানে নেই। তখন এই চক্রান্তে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে অনেকেই ইতোমধ্যে চলে গেল আর বাদবাকি যারা এখনও রয়েছে ওরাও চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে–তবে আমার মনে হয় অনেকেই আপনার বাবার কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য যাবে। আর বিদেশিসহ অন্যান্যে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রসদবহর থেকে যা পারছে লুট করে নিয়ে পালাচ্ছে।

আকবরের তরুণ কোরচিটি সারাক্ষণ তার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। তিনি তার দিকে ফিরে বললেন, ‘দেহরক্ষী দলের সেনানায়ককে ডেকে আন। ছেলেটি চলে গেল তারপর একটুপরই ফিরে এসে বললো, তিনিও চলে গেছেন, জাঁহাপনা।

আকবর মাথা নাড়লেন। অবাক হলেন না। এটা পরিষ্কার যে, তার বাবা তাকে ঘুষ দিয়ে বশ করেছেন। কাউকে তার সাথে দেখা করতে না দেওয়াটা ছিল চক্রান্তেরই পরিকল্পনার একটি অংশ, যাতে রাজপুতদের সন্দেহ এতে বেড়ে যায়–আর তা-ই আসলে হয়েছিল। তখনও স্তম্ভিত অবস্থায় তিনি জগিন্দর আর তার কোরচিকে তার পিছু পিছু আসতে ইশারা করলেন। কর্দমাক্ত মাঠে পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র আর সমরসম্ভারের পাশ দিয়ে তাহাব্বুর খানের তাঁবুর দিকে হেঁটে চললেন। যে কজন সৈন্য তখনও রয়ে গিয়েছিল, তারা তাকে দেখে সালাম দিল, তবে বেশিরভাগই দুদ্দাড় করে ছুটে পালাল, বুঝাই যাচ্ছে কেটে পড়ার তালে রয়েছে।

তাহাব্বুর খানের তাঁবুতে ঢুকে আকবর দেখলেন, তার দুধ-ভাইয়ের ব্যবহারের বেশিরভাগ জিনিসপত্র নেই, তবে একটা নিচু টেবিলের উপর সিলমোহর মারা ভাঁজ করা একটা কাগজ খাড়া করে রাখা আছে। উপরে তার নাম লেখা। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা তুলে নিয়ে তিনি ভজ খুললেন।

*

প্রিয় দুধ-ভাই, আপনাকে ছেড়ে যেতে হল বলে ক্ষমা চাচ্ছি। জানি এটা করে আমি আমার সম্মান হারিয়েছি। তবে আর কোনো উপায় ছিল না। গতরাতে আপনার বাবার উপদেষ্টা মিষ্টভাষী চালবাজ ওয়াজিম খান ছদ্মবেশে আমার কাছে এসেছিল। যখন আমরা একা হলাম, তখন সে আজমির দুর্গ ছেড়ে দেবার শর্ত নিয়ে আলোচনা না করে বললো, আপনার বাবা আমার জন্য একটা বার্তা পাঠিয়েছেন। সম্রাট তাকে বলেছেন আমাকে জানাতে যে, আমার বিশাসঘাতকতার কারণে আমার আসন্নপ্রসবা স্ত্রী, ছোট দুই ছেলে আর বাবা মাকে বন্দী করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। তাদেরকে বন্দী করার প্রমাণ হিসেবে ওয়াজিম খান তাদের আংটি দেখাল। যদি আমি তাঁর আনুগত্যে ফিরে না যাই, তাহলে সম্রাট পরিবারসহ আমার একমাত্র ভাই আর সকলকে হত্যা করার নির্দেশ দেবেন। অর্থাৎ এই পৃথিবীর বুক থেকে আমাদেরকে নির্বংশ করা হবে। আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন আমি ওয়াজিম খানকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু জানি তা করতে পারবো না। আমি অনেক অনুনয়-বিনয় করলাম, কিন্তু সে তাতে মোটেই কান দিল না, বরং বলা শুরু করলো হত্যা করার আগে তাদের উপর কি ধরনের অত্যাচার করা হবে। আর বললো, যদি আমি তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে আওরঙ্গজেবের কাছে ফিরে গিয়ে সঠিক দায়িত্ব পালনের পথে যাই তবে আমাকে পুরস্কৃত করা হবে। সে আরো জানাল যে, শুধু আমার কাছেই এই ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়নি… তাছাড়া সে শুনেছে যে, রাজপুতরাও আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে। সে আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললো যে, আপনার বাবা কথা দিয়েছেন যে আপনাকে বন্দী করা হলে তিনি আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন। সে বললো আপনাকে ত্যাগ করলে খারাপের চেয়ে বরং আপনার ভালো হবে। আমি দুর্বল হয়ে শেষ পর্যন্ত তার কথায় রাজি হলাম। অনুভব করলাম পরিবারের স্বার্থে এছাড়া আর কিছু আমার করার ছিল না। কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের সময় সারাদিন আমি আপনাকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন।

*

আকবর চিঠিটা একপাশে ছুঁড়ে ফেললেন। তাহাব্বুর খান আর রাজপুতদের তিনি কোনো দোষ দিতে পারলেন না। তার বাবা কৌশল করতে গিয়ে এমন নিচে নেমেছেন যা, তিনি নিজে কখনও করতে পারতেন না। তবে তিনি আকবরকে ঠিকই বোকা বানিয়েছেন। হিন্দু আর মুসলিম, রাজপুত আর মোগলদের সম্পর্কের মধ্যে যে ফাটল ধরেছিল, তা এত গভীর ছিল যে, তিনি এত অল্প সময়ে তা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। আওরঙ্গজেব বেশ সহজেই পুরোনো ক্ষতটি আবার খুঁচিয়ে তুলেছেন। তবে আকবর এত সহজে হাল ছেড়ে দেবেন না। কারণ একটি বিষয় হল, তিনি বিশ্বাস করেন না যে তার বাবা তাকে ক্ষমা করবেন। এটা ছিল তাহাব্বুর খানকে বশ করার আরেকটি চাল। তার বাবা সব সময় তার কাছের মানুষদের প্রতি ক্ষমাহীন ছিলেন। গৃহযুদ্ধের সময় আওরঙ্গজেব প্রতারণা করে তাঁর ভাই মুরাদকে বন্দী করেছিলেন, তারপর তাকে হত্যা করেন। তাঁর সবচেয়ে বড় ছেলেকে আওরঙ্গজেব নিজে কারাগারে আটক করেছিলেন, যেখানে শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়। যদি আকবর তার সেনাদলকে হারিয়েও ফেলেন, তারপরও তিনি নিজেকে এ ধরনের পরিণতির কাছে সঁপে দেবেন না।

 তাছাড়া তিনি যদি হাল ছেড়ে দেন, তাহলে এই আত্মসমর্পণ হবে চিরদিনের জন্য নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দেওয়া আর সেই সাথে সমগ্র সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন বিভক্তি, সন্দেহ, ধর্মীয় আর তার বাবার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মাঝে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেওয়া। তিনি বরং তার প্রচেষ্টা আরো তীব্রতর করবেন। তার পূর্বপুরুষ বাবর এবং হুমায়ুন তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গিয়ে এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। তার পিতামহ শাহজাহানেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তাদের অভিজ্ঞতা আর নিজের সঞ্চিত সাহস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন সাম্রাজ্যকে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ করতে যা, তার নিজের নামের মহান সম্রাট আকবর প্রথম করেছিলেন। তরুণ কোরচির দিকে ঘুরে তিনি বললেন, যারা এখনও আমার অনুগত আছে তাদেরকে ডেকে আন। আমরা এখুনি আমবারের রাজার কাছে যাব যদি, এতটুকু বলে জগিন্দরের দিকে ফিরে তারপর বললেন, তিনি আমাদের নিরাপত্তা দেন।

‘তিনি তা অবশ্যই দেবেন, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, জাঁহাপনা।

‘তাহলে এখনই রওয়ানা দেওয়া যাক। কয়েক মিনিটের মধ্যে যা যা জিনিসপত্র নেওয়া যায়, নিয়ে বাকি সব কিছু ফেলে যেতে হবে।

‘কোনো খবর পাওয়া গেল?

 বোনের গলার আওয়াজ পেয়ে আওরঙ্গজেব ঘুরে দেখলেন একটি খিলানযুক্ত দরজার মধ্য দিয়ে জাহানারা আজমির দুর্গের প্রাচীর ঘেরা ছাদের একটি নির্জন অংশের দিকে এগিয়ে আসছেন। এখান থেকেই আওরঙ্গজেব নিচে সমতল ভূমির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, যেখান দিয়ে আকবরের শিবিরের অশ্বারোহী দল আসার কথা। তিনি এখনও খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারলেও তার ৬৭ বছর বয়সী বোন একটু কুঁজো হয়ে হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা একটি লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সকাল বেলার ঠাণ্ডা এড়াতে তার গায়ে একটি শাল জড়ান ছিল। না কিছুই না।

জাহানারার চোয়াল ঝুলে পড়লো। আকবরের বিদ্রোহের কারণে তাঁর দেহ-মন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তিনি আওরঙ্গজেবের কাছে স্বীকার করেছেন যে, তার জন্য চিন্তা আর সেই সাথে সাম্রাজ্যের ঐক্যের সাথে তার ভাইয়ের ছেলের প্রতি তার ভালোবাসার দ্বন্দ্ব, এসব মিলে দুশ্চিন্তায় তিনি ঘুমাতে পারছেন না। দুই এক মুহূর্ত পর নিজের অস্থিরতা দমন করতে না পেরে আওরঙ্গজেব ছাদের উপর পায়চারি করতে লাগলেন। একটু পর পর দিগন্তের দিকে তাকাচ্ছেন, তবে বৃষ্টির কারণে সে জায়গাটি ঝাপসা দেখাচ্ছে। তারপর বৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেখা গেল দুজন অশ্বারোহী এদিকে আসছে। মাঠ থেকে ঢালু পথ বেয়ে উপরের দিকে দুর্গের প্রধান ফটকের কাছে আসতে লাগলো। নিশ্চয়ই বার্তাবাহক।

 দীর্ঘ দশ মিনিটের অনিশ্চয়তার পর দুই অশ্বারোহী হাজির হল। আপাদমস্তক বৃষ্টিতে ভেজা আর কাদা ছিটা। পরিষ্কার ধোপদুরস্ত কালো পোশাকপরা ওয়াজিম খান ওদেরকে সাথে নিয়ে এল। চওড়া মুখে হাসি নিয়ে সে বললো, ‘আপনার পরিকল্পনায় কাজ হয়েছে, জাঁহাপনা। রাজপুতরা প্রায় সবাই পালিয়ে গেছে, সেই সাথে আকবরের অধিকাংশ সৈন্য। তাহাব্বুর খান আর অন্যান্য দলছুট সৈন্যরা আপনার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছে। আপনার অনুমতি পেলে ওরা এসে আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করবে।

নিরুদ্বেগ হয়ে আওরঙ্গজেব শরীর মন শিথিল করে হাঁটু গেড়ে মুনাজাতে বসে পড়লেন। এই ধারণাটি আমাকে দেওয়ার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। একটি ন্যায্য কারণ আর শক্তিশালী মন প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কিন্তু দুর্বলচিত্ত এবং বিশ্বাসঘাতক একটি দলকে পরাস্ত করেছে।

 উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জাহানারা জিজ্ঞেস করলেন, আর আকবরের খবর কী?

আওরঙ্গজেব ওয়াজিম খানকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মনে হয় সে। রাজপুতদের সাথে চলে গেছে, তাই না? ওয়াজিম খান মাথা নেড়ে সায় দিল। ‘ঠিক আছে। দুই-তিন দিনের মধ্যে মুয়াজ্জম চলে আসবে। কারণ সে মূল সেনাবাহিনীর আগেই রওয়ানা দিয়েছে। সে এলেই তাকে আমি তার ভাইয়ের খোঁজে পাঠাব। সেখান থেকে সে আকবরকে ধরে শিকলে বেঁধে দিল্লি নিয়ে আসবে।’

তার ভাই যখন বার্তাবহদের ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন আর ওয়াজিম খানকে আরো কিছু নির্দেশনা দিচ্ছিলেন, জাহানারা তখন চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। তার মনে পড়ে গেল সেই কাহিনীর কথা যা তিনি শুনেছিলেন যে, আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা দারাশিকোকে ধরার পর বন্দী করে ছালার পোশাক পরিয়ে একটি হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা দিল্লি ঘুরিয়ে তারপর তাকে হত্যা করেছিল। হায় আল্লাহ আকবরের যেন এই অবস্থা না হয়। তোক তিনটি চলে যাওয়ার পর তিনি আস্তে আস্তে আওরঙ্গজেবকে বললেন, আওরঙ্গজেব, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ যে তোমার কৌশলের কারণে রক্তপাত এড়াননা গেছে। আমি সত্যি আমার পরিবার আর রাজপুতদের মাঝে আমাদের বন্ধু আর সেই সাথে আমাদের সৈন্যদের জন্য ভয় পাচ্ছিলাম…।

আওরঙ্গজেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি খুব বেশি দয়ালু। কতজন রাজপুত মারা যেত সেটা কোনো বিবেচনার বিষয় নয় আর সেই জঘন্য নীচ অপরাধী আকবর আমার ছেলে নয়। তবে আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে, যারা আল্লাহর প্রতি আর সাম্রাজ্যের প্রতি বিশ্বস্ত, তারা কেউ আজ মারা যায় নি আর সেজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে।

আওরঙ্গজেবের কণ্ঠস্বরে ঘৃণার আভাস পেয়ে জাহানারা যে যুক্তিগুলো মনে মনে সাজাচ্ছিলেন তা আর প্রকাশ করলেন না। তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনি আওরঙ্গজেবকে যুক্তি দিয়ে বুঝাবেন যে, সাম্রাজ্যের মাঝে নতুন করে ঐক্য আনার প্রতীকি চিহ্ন হিসেবে আকবর আর রাজপুতদের ক্ষমা করে দেওয়া যায়। তবে এখন এসব কথা বলা বৃথা। তার চেয়ে বরং সময় আর সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্রয়াজন হলে গওহরা, জানি, জেবুন্নিসা আর সম্ভব হলে উদিপুরী মহলের সমর্থন নিয়ে এক ধরনের মেয়েলি দরখাস্তের মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি শুধু বললেন, ‘আকবরকে খোঁজার জন্য মুয়াজ্জমকে পাঠানো এছাড়া এরপর আর কী ব্যবস্থা নেবে?

‘আকবরকে ছেড়ে যারা চলে এসেছে, তাদের আত্মসমর্পণ আমি গ্রহণ করবো, তবে সময় মতো ওদের মধ্যেকার সেনা কর্মকর্তাদেরকে এমন জায়গায় বদলি করবো যাতে ওরা আর কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে। আর যে কথা দিয়েছিলাম সে অনুযায়ী তাহার খানকে সবার সামনে খোলাখুলিভাবে পুরস্কৃত করবো, যাতে সবাই দেখতে পারে যে, আমি আমার কথা রাখি। আর এতে ভবিষ্যতে যদি কাউকে কোনো কথা দেই তা লোকে বিশ্বাস করে। তবে তার উপর নজর রাখা হবে। তার মন আকবরের কাছে পড়ে থাকবে আর তার বিশ্বাসঘাতকতা তার মনকে বিষাক্ত করে তুলবে। কে জানে সে কী করবে? তাকে আমি আর কখনও বিশ্বাস করতে পারবো না।

তার পরিবারের সবাইকে নিশ্চয় কোতল করা হবে না, তাই না?

 ‘মেয়েদেরকে হয়তো করা হবে না–তবে তাদের এমন দুরবস্থা করা যাবে যাতে ওরা চাকরের মতো ছোট কাজ করতে বাধ্য হয়। পুরুষগুলোকে কোতল করে আমি কোনো আনন্দ পাবো না, তবে দুর্বল চিত্ত মানুষদের উচিত নয় কখনও কাউকে ভয় দেখান, যদি তা ওরা পালন করতে পারবে না।’

একঘণ্টা পর ভাইবোন আবার একসাথে সকালের নাস্তা খেতে বসেছেন। আওরঙ্গজেব বেশ তৃপ্তির সাথে রুটি আর সজির তরকারি খাচ্ছিলেন, তবে জাহানারা পারছিলেন না। তিনি কেবল খাবারগুলো আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করে প্লেটের উপর চারপাশে ঘুরাচ্ছিলেন আর আঙুল দিয়ে রুটির টুকরাগুলো ছিঁড়ছিলেন। আওরঙ্গজেবের বিজয় পরিকল্পনা আকবর আর সাম্রাজ্যকে কোথায় নিয়ে ফেলেছে সেকথা ভেবে তার মনে যে দারুণ দুশ্চিন্তা চলছে, সে এ অবস্থায় কেমন করে মুখে খাবার তুলবেন। এমন সময় ওয়াজিম খান কামরায় ঢুকতেই তিনি মুখ তুলে তাকালেন। এই মিষ্টভাষী চক্রান্তকারী লোকটিকে তিনি অত্যন্ত অপছন্দ করেন। সে তার ষড়যন্ত্রমূলক পরামর্শগুলো দিয়ে তার ভাইয়ের সন্দেপ্রবণ মনে একটি আস্থার আসন গড়ে তুলেছে। এখন সে অর্ধেক পোড়া কতগুলো কাগজ হাতে নিয়ে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 ‘জাহাপনা এগুলো আপনার দেখা দরকার। আমার লোকেরা আপনার ছেলের পরিত্যক্ত তাঁবুতে এগুলো খুঁজে পেয়েছে। আমার মনে হয় শাহজাদা খুব তাড়াহুড়া করে চলে যাওয়ার সময় এগুলো পুরোপুরি পুড়াতে পারেন নি।

 ‘কি এগুলো?

তার কাছে লেখা তার বোন জেবুন্নিসার চিঠি।

 জাহানারার শীর্ণ শরীরের মধ্য দিয়ে একটি শীতল স্রোত বয়ে গেল।

নিচু যে খাওয়ার টেবিলে বসে ভাই-বোন নাস্তা খাচিছলেন, আওরঙ্গজেব সেখান থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘দেখি চিঠিগুলো। ইদানীং তিনি গলায় একটা সবুজ ফিতায় চশমা ঝুলিয়ে রাখেন। কম আলোয় কোনো কিছু পড়তে হলে এই চশমাটি ব্যবহার করতেন, আজও সে প্রয়োজন হওয়ায় চশমাটি উঠিয়ে চোখে লাগালেন। কয়েকমুহূর্ত পর চিঠিগুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘আরো বিশ্বাসঘাতকতা। আর এমন এক জায়গা থেকে যা কখনও আশা করি নি!

 ব্যাপারটা অনুমান করতে পারলেও জাহানারা যন্ত্রের মতো জিজ্ঞেস করলেন, ‘জেবুন্নিসা চিঠিতে কি লিখেছে?

‘সে আকবরকে তার বিদ্রোহে সমর্থন আর উৎসাহ দিয়ে তার বিজয় কামনা করেছে।

জেবুন্নিসা যে এরকম ধারণা পোষণ করছে তা জেনে জাহানারা অবাক হলেন না। তাঁর ভাইঝি আকবরের অনেক সহিষ্ণু মতবাদের অংশীদার ছিল, যা তাঁর নিজের মতবাদগুলোরও বেশ কাছাকাছি। তবে বোকার মতো তার বিদ্রোহে উৎসাহিত করা ঠিক হয় নি, আবার কাগজে-কলমে লিখে তা জানান দিয়েও আরো বোকামি করেছে। আওরঙ্গজেবের চোখে এখন যে আগুন জ্বলছে, কি বলে তা উপশম করবেন? তারপরও বললেন, ভাই, জেবুন্নিসা খুবই বোকা একটি মেয়ে–না, তার চেয়েও বেশি, নিজের ভাইকে উৎসাহ দিয়ে সে আপনার অবাধ্য হয়েছে–তবে দয়া করে তার প্রতি বেশি কঠোর হইও না। তুমি জান আর আমিও জানি, আমাদের মধ্যে মতের পার্থক্য থাকলেও ভাই বোনের ভালোবাসার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। যে কারণে রওশনআরা বাবার বিরুদ্ধে তোমার সাথে হাত মিলিয়েছিল। এখন যদি তুমি মনে কর রওশনআরা ঠিক কাজই করেছিল, তাহলে হয়তো এখন তুমি বুঝতে পারছো তিনি তখন কি অনুভব করছিলেন।

ভাই-বোনের ভালোবাসার সম্পর্কেও কথা শুনে তার ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু জেবুন্নিসার সাথে রওশনআরার তুলনা করায় তাঁর ভ্র কুঁচকে উঠলো। এই তুলনাটি করা হয়তো তার ঠিক হয় নি, তবে না করেও পারেন নি। এখন যদি তিনি তার উদ্দেশ্যে সফল হতে চান, তাহলে তাকে অন্য রাস্তা ধরতে হবে। কাজেই আবার বললেন, “আমরা হয়তো ঘটনার পুরোপুরি বিবরণ না জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি যে, সে তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের বাবা একবার ভুল করে নিকোলাস ব্যালেন্টাইন নামে একজন ইংরেজের সাথে আমার সম্পর্ক নিয়ে দোষারূপ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়ে আমাকে গৃহবন্দী করেছিলেন। তুমি অন্তত জেবুন্নিসাকে ডেকে তার কথাটাও শোন।

 না, এই চিঠিগুলোতেই তার অপরাধ পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে। তারপর এক মুহূর্ত পর বললেন, ‘বোন, তাকে দেখলে হয়তো আমার মন নরম হয়ে যাবে আর তাতে আমি সঠিক এবং ন্যায় বিচার করে তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারবো না। কারণ সঠিক শাস্তি হলে তা ভবিষ্যতে কাছের বা দূরের কোনো নারী কিংবা পুরুষ আত্মীয় যদি বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভাবে তাদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

 জাহানারা আর কিছু বললেন না। আর বলেই বা কি লাভ? তাঁকে এখন মেনে নিতে হবে, জেবুন্নিসা আর রাজপরিবারের অন্যান্য মহিলা নিয়ে তিনি আকবরের পক্ষে ওকালতি করার যে আশা করেছিলেন তা এখন ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

*

দুই দিন পর আবার জাহানারা আর আওরঙ্গজেব এক টেবিলে খেতে বসলেন। তিনি জাহানারা আর মুয়াজ্জমকে তার সাথে খাবার খেতে ডেকেছিলেন। মুয়াজ্জম সেদিন সকালেই পাঁচশো অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে দুর্গে পৌঁছেছিল। আকবরের বেশির ভাগ সৈন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে শোনার পর তিনি আকবরকে ধরার জন্য নতুন করে একটি সৈন্যদল গঠন করছিলেন। আর আকবরকে লেখা জেবুন্নিসার চিঠিটা পড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে হাতির পিঠে একটি চারদিক বন্ধ হাওদায় চড়িয়ে আজমির থেকে গোয়ালিয়রে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন। ক্রন্দনরত ভাতিজিকে বিদায় দেওয়ার সময় জাহানারা তাকে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললেন যে, তার বাবা যাতে তাকে ক্ষমা করেন সেজন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। সেই সাথে তার হাতে একটি সুফি কিতাবও গুঁজে দিলেন এই আশায় যে হয়তো এটা পড়ে সে মনে সান্ত্বনা পাবে। তারপর শীঘ্র তিনি আওরঙ্গজেবকে অনুরোধ করবেন জেবুন্নিসার পছন্দের ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্র তার কাছে পাঠিয়ে দিতে যাতে তার কারাবাস একটু সহনীয় হয়।

তার নিজের খাওয়ার রুচি ছিল না। প্রকৃতপক্ষে জেবুন্নিসার ব্যাপারটি জানার পর থেকেই তিনি মুখে প্রায় কিছুই দেন নি আর সামান্য যা কিছু খেয়েছিলেন, সাথে সাথে তা বমি করে ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি শুনেছিলেন সেনা কর্মকর্তারা বলাবলি করতো যে, তাদের দুর্বল চিত্তের সৈন্যরা যুদ্ধের কথা শুনলেই আক্ষরিক অর্থেই অসুস্থ হয়ে পড়তো। তিনিও নিশ্চয়ই আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন–তবে সেটা যুদ্ধের ভয়ে নয়, তিনি অসুস্থ হয়েছেন তাঁর পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তাঁর এই আতঙ্ক যাতে সত্যি সত্যি বাস্তবরূপ লাভ না করে, সেজন্য তাকে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে তা থামাতে। প্রকৃতপক্ষে একটু হলেও সে চেষ্টা করবেন।

 প্লেটে যে সামান্য ডাল আর খাসির মাংসের কাবাব ছিল, তা ছুঁয়েও দেখেন নি। মুখ তুলে দেখলেন আওরঙ্গজেব খাওয়া শেষ করে একটি সুতির কাপড় দিয়ে মুখ মুছে পাশের প্লেটে রাখছেন। তারপর তিনি মুয়াজ্জমের দিকে ফিরে বললেন, তুমি যে এত তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে পৌঁছতে পেরেছ সেজন্য আমি তোমাকে আবার অভিনন্দন জানাচ্ছি। আর সেই সাথে মারওয়াড়ে যে সফল অভিযান করেছ সেই জন্যও।

মুয়াজ্জম মৃদু হেসে বললেন, ‘ধন্যবাদ, বাবা। তবে আগে আওরঙ্গজেবের সাথে থাকলে তিনি যেরকম নরম হাসি দিতেন আজকের হাসিটি সেরকম মনে হল না।

‘এখন আমি চাই তুমি তোমার রাজভক্তি আরেকবার প্রমাণ কর। তুমি সেই বিশ্বাসঘাতক আকবরের খোঁজে গিয়ে তাকে ধরে দিল্লি নিয়ে আসবে। যদি তাকে ধরার জন্য মেরেও ফেলতে হয় তবে, সমস্ত মমর্যন্ত্রণা ঝেড়ে ফেলে তাই করবে। সে জীবিত থাকলে যে রকম তাকে সারা দিল্লি ঘুরিয়ে দেখাতাম সেরকম তার লাশও তাই করতে পারবো।’

 আতঙ্কে জাহানারা জমে গেলেন। মুয়াজ্জমের চেহারাও বদলে গেল আর তার কপালে একটি শিরা দপ দপ করতে লাগলো। সে বললো, “ঠিক আছে। তবে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো যাতে সে আত্মসমর্পণ করে। তাকে আমি মারতে চাই না…সে আমার ভাই।’

 ‘তুমি ভুল বলছো। সে আর তোমার ভাই নয়। জেবুন্নিসার মতো তার কার্যকলাপ তাকেও পরিবারের বাইরে নিয়ে গেছে।’

মুয়াজ্জম মাথা নিচু করে টেবিলের উপর থরে থরে সাজান নানারকম সুস্বাদু খাবারের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি আপনার নির্দেশ পালন করবো, যেরকম মারওয়াড় আর অন্যান্য জায়গায় করার চেষ্টা করেছি।’

‘ভালো। এবার যাও প্রস্তুতি নিতে শুরু কর, যাতে আকবরের খোঁজে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে পার।

মুয়াজ্জম উঠে দাঁড়াল, একটু ইতস্তত করে তার বাবার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে তারপর বের হয়ে গেল।

জাহানারাও উঠলেন। লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি তার ভ্রাতুস্পুত্রকে অনুসরণ করে দরজা পর্যন্ত গিয়ে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। গালে চুমু খাওয়ার সময় ফিস ফিস করে কানে কানে বললেন, “আমার খাতিরে, তোমার নিজের জন্য আর সেই সাথে তোমার ভবিতব্যের জন্য বলছি অতি-উৎসাহী হইও না। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে প্রস্তুতি নিতে থাক আর সেভাবে ভাইয়ের খোঁজেও যাও।

চলে যাওয়ার সময় মুয়াজ্জমের চেহারায় স্বস্তি ফিরে এল। উভয়সঙ্কটে পড়ে সে মনে যে কষ্ট পাচ্ছিল, তার ফুফুর কথায় তার একটা সমাধান খুঁজে পেল।

*

হাতের পিঠে ভ্রূ থেকে ঘাম মুছে আকবর ঘোড়র পাদানিতে দাঁড়িয়ে জঙ্গলঘেরা নদীর তীরের ছোট ছোট ঝোঁপঝাড়ের উপর দিয়ে ওপারে তাকিয়ে বললো, আমার মনে হয় দিনের আলো এখনও যথেষ্ট আছে, কাজেই আমরা সহজেই নদী পার হয়ে তারপর রাতের জন্য তাঁবু খাটাতে পারি, কি বল জগিন্দর?

জগির সায় দিয়ে বললো, আমাদের চরেরা বলেছে নদীর পার খুব বেশি খাড়া নয় আর এসময়ে নদী প্রায় শুকনো থাকায় সহজেই পার হওয়া যায়।’

আকবর মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে চল এগিয়ে যাই। দ্রুত দক্ষিণ দিকে যাওয়ার সময় সে আর জগিন্দর বেশ কাছাকাছি হয়েছে। আকবরের সেনাবাহিনীর যে কজন সৈন্য তার সাথে রয়ে গিয়েছিল আর জগিন্দরের বাবা, আম্বারের রাজা তাদের সাথে যে ৫০০ রাজপুত অশ্বারোহী সেনা তাদের সাথে দিয়েছিলেন সবাই মিলে ওরা দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিল। আকবরের সেনাদলটি এখন বেশ ছোট হলেও সে নিঃসন্দেহ হয়েছে যে, এরা তার প্রতি বিশ্বস্ত। কেননা মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়ার অনেক সুযোগ পেলেও ওরা চলে যায় নি। গৃহীত দায়িত্বের প্রতি তাদের অঙ্গীকার আর একতার কারণে ওর বাবা ওদের পেছনে যে সেনাদলকে পাঠিয়েছিলেন ওরা তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল। কয়েকদিন আগে আকবর সম্ভাজির কাছে একজন দূত পাঠিয়েছিলেন, সে ফিরে এসে খবর দিয়েছিল যে, মারাঠা রাজা দাক্ষিণাত্যে এসে ওদের সাথে যোগ দিয়ে আওঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সবার সাথে লড়বেন। এই খবরে আকবরের সৈন্যদের মনোবল আরো বেড়ে যায়।

 সম্ভাজি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, সবাই মিলে আমরা তাকে দেখিয়ে দেব যে, হিন্দুস্তানের বৃহত্তর স্বার্থে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে একসাথে কাজ করতে পারে। এ ধরনের একজন শাসক, যিনি তারই মতো মনোভাব পোষণ করছেন তাকে তার মিশনের অংশীদার করাটা কত চমৎকার হবে। যখন সময় হবে, তখন সম্ভাজি আর সেই সাথে জগিন্দরের বাবার সমর্থন তিনি আবার অন্যান্য রাজপুত রাজ্যগুলোকেও তার সমর্থনে বিদ্রোহে জেগে উঠতে রাজি করাতে পারবেন। এরপর ওরা সবাই মিলে সাম্রাজ্যের অন্যান্য করদ রাজ্যগুলোর মধ্য থেকেও আরো মিত্র আকর্ষণ করতে পারবেন। আর তার গোঁড়ামিপূর্ণ বাবার সাথে যেসব রাজ কর্মকর্তা আর সেনাপতির নামকাওয়াস্তে সমর্থন রয়েছে তাদেরকেও প্রলুব্ধ করে দলে টানা যেতে পারে। তবে এখনই পরে কি হবে সে চিন্তা করার দরকার নেই। তার প্রথম কাজ হবে সম্ভাজির সাথে এক জায়গায় মিলিত হয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কটি সুপ্রতিষ্ঠিত করা।

 ‘জগির তুমি পঞ্চাশজন রাজপুত যোদ্ধা নিয়ে নদী পার হয়ে তীরের একটু দূরে খুঁটি পুতে ফেল। তারপর আমরা নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত একটি রশি টেনে নেব। এতে আমাদের লোকজন আর দুর্বল ঘোড়াগুলোর নদী পাড় হওয়া সহজ হবে।’

জগিন্দর সাথে সাথে পেছন ফিরে একজন কনিষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাকে ডেকে তার লোকজনসহ তাকে অনুসরণ করতে বললো। তারপর সে ঘোড়া ছুটিয়ে ঝোঁপঝাড়ের মধ্য দিয়ে নদীর তীরের দিকে চললো। পনেরো মিনিটের মধ্যে একজন রাজপুত জগিন্দরের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে এল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, এখন মূল সেনাদল নদী পাড় হওয়া শুরু করতে পারে। আকবর সাথে সাথে তার লোকদের নির্দেশ দিলেন পাঁচজন পাঁচজন করে পাশাপাশি হয়ে নদী পাড় হওয়া শুরু করতে।

 চারপাশে দেহরক্ষী দল নিয়ে তিনি সারির আগে অবস্থান নিলেন। নদীর তীরের গাছের জঙ্গলে ঢুকতেই রাতের জন্য বাসায় ফেরা পাখিগুলো বিরক্ত হয়ে কিচিরমিচির করতে করতে শূন্যে ভাসলো। চর যেরকম জানিয়েছিল নদীর সেরকম পাড় বেশ মসৃণ আর নিচে নদীর বুকে ঘোড়ার খুরের নিচে শক্ত মাটি ছিল। নদীতে তিনফুট গভীর পানির স্রোত বেশ ধীর গতিতে বয়ে চলছিল। তিনি ঘোড়া নিয়ে নদীতে নামতেই একজোড়া সারস ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। একটু পরই তিনি নদীর ওপারে পৌঁছবেন আর তারপর ক্লান্ত শরীরকে বিশ্রাম দিয়ে কিছু খাবার মুখে দিতে পারবেন। একটানা সারাদিন ঘোড়ার পিঠে কাটিয়ে তার হাত-পায়ে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। তার ঘোড়াটি একটু হোঁচট খেয়ে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করলো। সম্ভবত নদীর স্রোত পায়ে লাগতেই ঘাবড়ে গিয়ে একটু অসতর্ক হয়ে উঠেছিল। তিনি ঘোড়ার রাশ শক্ত করে ধরে সামনে ঝুঁকে ঘোড়াটির কানে সান্ত্বনাসূচক কথা বলতে শুরু করলেন। ঠিক তখনই কড়াৎ করে একটি আওয়াজের সাথে সাথে তার উরুতে হুল ফোঁটানোর মত যন্ত্রণা হল। তিনি হাত দিয়ে দেখলেন রক্ত বের হচ্ছে। কি ব্যাপার কী হচ্ছে? তার লোকদের বিশ্বস্ততা নিয়ে তিনি কি ভুল ধারণা করেছিলেন? তার বাবার নির্দেশে এক বা একাধিক লোক কি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল, সুযোগ পেলেই তাকে শেষ করে ফেলার?

না। আরো গুলির শব্দ হতেই তিনি খাপ থেকে তরোয়ালটি বের করলেন। তারপর হঠাৎ চিৎকার করতে করতে একদল অশ্বারোহী নদীর অপর তীরের জঙ্গল থেকে বের হয়ে ঘোড়াসহ ছুটতে ছুটতে নদীতে নেমে পড়লো এবং চারদিকে পানি ছিটিয়ে এসে তার লোকদের উপর আক্রমণ করলো। হামলাকারীদের সবার আগে একটি বাদামি ঘোড়ায় চড়ে মুখভরা দাড়ি নিয়ে একজন লোক তার হাতে ধরা পিস্তল দিয়ে একজন তরুণ রাজপুত অশ্বারোহীকে গুলি করলো। গুলির আঘাতে আহত হয়ে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে মুখ থুবড়ে নদীর অগভীর পানিতে পড়ে গেল। আকবরের একজন দেহরক্ষী তার দিকে ঘোড়া ছুটাতেই সে পিস্তলে আবার গুলি না ভরে, উল্টো করে ধরে কয়েকফুট দূরে থাকতেই দেহরক্ষীটির দিকে ছুঁড়ে মারলো। পিস্তলের ভারী ইস্পাতের বাট দেহরক্ষীর ঘোড়াটির চোখের মাঝখানে আঘাত করলো। যন্ত্রণায় চিহিহি চিৎকার করে ঘোড়াটি সামনের দুই পা তুলে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হতেই তার আরোহী সমেত পাশের দেহরক্ষীকেও পানিতে ফেলে দিল। তারপর কোনোমতে চার পায়ে খাড়া হয়ে গা ঝাড়া দিয়ে যন্ত্রণায় তখনও চিহিহি করতে করতে নদী থেকে উঠে ছুটে পালাল।

 দাড়িওয়ালা হামলাকারীটি এবার তার তরোয়াল কোষমুক্ত করে আকবরের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছিল। আওরঙ্গজেব জিন্দাবাদ–সকল বেঈমান নিপাত যাক’ চিৎকার করতে করতে সে উন্মক্তের মতো আকবরের দিকে তরোয়াল চালাল। আকবর দ্রুত তার তরোয়াল তুলে তার হামলা ঠেকালেন আর তারপর লোকটি আবার তাল সামলিয়ে আবার আক্রমণ করার আগেই আকবর তার তরোয়ালের ডগা লোকটির বগলের কাছে সেঁধিয়ে দিলেন। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরা সত্ত্বেও হামলাকারী আবার আক্রমণ করার চেষ্টা করলো। তবে রক্তক্ষরণের কারণে সে দুর্বল হয়ে পড়ছিল আর এবার আকবর বেশ সহজেই তার তরোয়াল তার পেটে ঢুকিয়ে দিতেই সে ঘোড়ার পিঠ থেকে উল্টে নদীতে পড়ে গেল।

 আকবর চতুর্দিকে চিৎকার, ইস্পাতের পাতের ঠোকাঠুকি আর মাঝে মাঝে পিস্তল আর গাদা বন্দুকের গুলি ছোঁড়ার শব্দ শুনতে পেলেন। তারপর হঠাৎ তার ঘোড়াটি সামনের দুই পা শূন্যে তুলে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হতেই তিনি ঘোড়ার জিন থেকে পেছনের দিকে হড়কে পড়লেন। দুই হাত শূন্যে তুলে পানিতে পড়লেও তরোয়ালের বাট হাতেই ধরে রাখলেন। ঘোড়ার খুরের আঘাত এড়াতে তিনি নদীর কাদাভরা তলদেশে পা রেখে দাঁড়াতে চেষ্টা করতে লাগলেন। হঠাৎ তার চোখে পড়লো প্রায় দশ ফুট দূরে পানির উপরে বড় বড় দুটো হলুদ চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পানিতে মানুষ আর পশুর রক্তের গন্ধ পেয়ে একটি কুমির ত্রিমুখী ধারালো চোয়াল হা করে তার ঘোড়ার পা। কামড়ে ধরতে ব্যর্থ হল। এটা দেখেই হয়তো তার ঘোড়াটি ভয় পেয়ে চমকে উঠেছিল। এবার কুমিরটি আবার চোয়াল হা করে তার দিকে ভেসে এল। সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আকবর দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার তরোয়ালের ডগা কুমিরের দাঁতের মাঝে গলায় বিধিয়ে দিলেন। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করলো। কাটাওয়ালা লেজটি পানিতে কয়েকবার ঝাঁপটিয়ে কুমিরের দেহ স্থির হল। তবে আরেকটি কুমির ভেসে আসতেই তিনি আবার তরোয়াল দিয়ে কোপ মারতেই কুমিরটি ঘুরে চলে গেল।

তারপর পেছনে চিৎকার চেঁচামেচির সাথে অনুভব করলেন দুটো বলিষ্ঠ বাহু তাকে জাপটে ধরে পেছনের দিকে টেনে নিচ্ছে। জগিন্দর তার একজন দেহরক্ষীকে সাথে নিয়ে আবার ঘোড়সহ নদীতে নেমে তাকে টেনে তীরের দিকে নিতে চেষ্টা করলো। তীরে পৌঁছে কোনোমতে নিজেকে সামলে খাড়া হলেন, সারা শরীর থেকে পানি ঝরছিল। হাতে তখনও তরোয়ালটি ধরা ছিল, চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন আর কোনো ঘোড়া পাওয়া যায় কি-না যাতে লড়াইটি চালিয়ে যেতে পারেন। তবে হামলাকারীরা তখন ঘোড়া ছুটিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে পালাতে শুরু করেছে আর আকবরের কিছু সেনা তাদের পিছু পিছু ছুটছে। নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে রয়েছে আর কয়েকটি দেহ পানিতে ভাসছিল। তিনি লক্ষ করলেন একটি কুমির ধীরে একটি মানুষের দেহের দিকে এগিয়ে মুখ হা করে ঊরু কামড়ে ধরলো। সাথে সাথে প্রচণ্ড আর্তচিৎকার শোনা গেল। লোকটি তখনও জীবিত ছিল। কুমির তাকে পানির নিচে টেনে নিতেই সে ব্যর্থভাবে পানিতে হাত ছুঁড়তে লাগলো। তবে আল্লাহকে ধন্যবাদ, লোকটি শীঘ্রই মারা যাবে। তার জন্য করার কিছুই নেই, তবে অন্য কেউ বেঁচে থাকলে তাদেরকে সাহায্য করতে হবে।

কারও কাছে শুকনো পিস্তল কিংবা গাদা বন্দুক থাকলে এই বিভৎস পশুগুলোকে গুলি করে মার। আর অন্যরা কেউ জীবিত থাকলে তাদেরকে উদ্ধার কর। তিনি নিজে দৌড়ে নদীতে নেমে রশি ধরে সাঁতার কেটে একটি লোকের কাছে গেলেন। লোকটি দুর্বলভাবে হেঁটে তীরের দিকে আসার চেষ্টা করছিল। তখনও সে বারো ফুট দূরে ছিল। লোকটির বাড়িয়ে ধরা এক হাত জাপটে ধরে তিনি তাকে পাড়ের দিকে টেনে নিয়ে চললেন, এমন সময় একটা গুলির শব্দ শোনা গেল আর এক মানুষ দূরত্বে নদীর পানি ঘুরতে শুরু করলো। একটা বড় কুমির সবার অজান্তে এগিয়ে আসছিল, তবে পাড় থেকে একজন রাজপুত সেনার নজর এড়াতে পারে নি। সে সবার আগে তীরে উঠায় তার গাদা বন্দুক আর বারুদ শুকনো ছিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আকবর যে লোকটিকে বাঁচিয়েছিলেন তাকে টেনে নিয়ে তীরে উঠলেন। লোকটাকে তিনি চিনতে পারলেন না, তার পরনে ছিল মোগল সৈন্যদের সবুজ পোশাক। তার মানে সে নিশ্চয় হামলাকারীদের একজন। তার বাহুর উপরের অংশে একটি গভীর ক্ষত হয়েছে, চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে লাল মাংসপেশির নিচে সাদা চর্বি দেখা যাচ্ছিল। কয়েকবার নোংরা পানি বমি করে ফেলার পর সে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলো। আকবর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন আমাদের উপর আক্রমণ করেছ?

‘এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটি মোগল ঘাঁটিতে আমরা ছিলাম। আমাদের অধিনায়ক সম্রাটের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। আপনার এদিকে আসার খবর পেয়ে পুরস্কার পাওয়ার আশায় তিনি আমাদেরকে অতর্কিতে আপনাদের উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন। এখন লোকটি পানি থেকে উঠে আসার পর তার ক্ষত থেকে রক্ত উপচে উঠছিল, সারা শরীর কাঁপতে শুরু করলো। সে জিজ্ঞেস করলো, এখন আপনি আমাকে কি করবেন?

 ‘আমার হেকিমকে ডেকে তোমার ক্ষতস্থানে সেলাই করে পট্টি বেঁধে দিতে বলবো, তারপর তোমাকে মুক্ত করে দেব যাতে তুমি সম্রাটের কাছে ফিরে গিয়ে বলতে পার–যে ছেলেকে তিনি অধঃপতিত আর জঘন্য নীচ ব্যক্তি বলেছেন, সে তোমার জীবন বাঁচিয়েছে। আর এও জানাতে পার এর আগে আমার জীবন বাঁচিয়েছিল একজন হিন্দু রাজপুত আর একজন মুসলিম দেহরক্ষী। তাকে জানাবে এতে বুঝা যায়, যারা হিন্দুস্তানে বসবাস করে, তারা কেমনভাবে একসাথে মিলেমিশে কাজ করতে পারে আর আবার করবে যখন আমি তার বদলে সিংহাসনে বসবো।

এবার আকবর ঘুরতেই টের পেলেন তার উরুর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে নিচে পায়ের জুতা পর্যন্ত পড়ছে। তাকেও হেকিমের কাছে যেতে হবে। তিনি জানেন এভাবে একজন সৈন্যকে মুক্ত করে দিয়ে তার কাছে সাম্রাজ্যের ঐক্যের বিষয়ে একটি বার্তা দেওয়া সহজ এবং জনপ্রিয় হলেও তার লক্ষ অর্জন থেকে তিনি এখনও অনেক, অনেক দূরে। যতদিন তার বাবা বেঁচে আছেন তাকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। তিনি কেবল যা সঠিক বিশ্বাস করেন তার জন্য চেষ্টা করে যাবেন। কতদূর সফল হবেন তা অনেকাংশে নির্ভর করছে সম্ভাজির সাথে মৈত্রির উপর। তাকে এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *