১১. তখতইয়া তক্তা!–সিংহাসন না-কি কফিন!

১১. তখতইয়া তক্তা!–সিংহাসন না-কি কফিন!

কালো একটি ঘোড়ার উপর দীর্ঘদেহী একজন মানুষকে দেখিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আকবর তাহাব্বুর খানকে বলেলেন, ‘দ্যাখো! মেবারের রানা কেবল একজন উপদেষ্টা সাথে নিয়ে এসেছেন। এ বিষয়ে আমরা দুজনেই একমত হয়েছিলাম। পামগাছে ছাওয়া ছোট মরুদ্যানটির দিকে রানা এগোতেই তার ঘোড়ার রত্নখচিত লাগামে সকালের রোদ পড়ে ঝিকমিক করে উঠলো। দুই সেনাবাহিনীর মধ্যখানে এই জায়গাতেই ওরা তাদের সাক্ষাতের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। রানার সাথের একমাত্র অশ্বারোহী সঙ্গীটিকে দেখে বেশ কমবয়সি মনে হল। অবশ্য সেটা রানার বিষয়। পামগাছের ছায়ার নিচে এসে রানা ধীরে ধীরে ঘোড়া থেকে নামলেন। তারপর পেছন পেছন তার সঙ্গীকে নিয়ে হেঁটে সামনে যেখানে আকবর আর তাহাব্বুর খান দাঁড়িয়েছিলেন সেদিকে এগোতে শুরু করলেন। ওরা একটি শামিয়ানার নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এর আগের সন্ধ্যায় আকবরের লোকেরা শামিয়ানাটি এখানে খাটিয়েছিল।

 আকবর এক পা সামনে এগোতেই অবাক হয়ে দেখলেন রানা মাথা নুইয়ে তাকে সম্মান দেখাতে শুরু করছেন। আকবর বললেন, এখন লৌকিকতা বাদ দিন। আপনি কি বলতে চান তা জানতে আমি আগ্রহী। কৌতূহলি মানুষের চোখ-কানের নজর থেকে আমরা এখন অনেক দূরে। কাজেই মন খুলে কথা বলুন যাতে, আমরা পরস্পরের উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝতে পারি।’

 ‘আমি অবশ্যই সবকিছু পরিষ্কার করে বলবো। আমি এসেছি মারওয়াড়ের রাজপ্রতিভূ আর আমার নিজের তরফ থেকে। আমরা উভয়েই মনে করি আপনার নামে যার নাম, সেই মহান সম্রাট আকবরের মতোই সাম্রাজ্যের সকল মানুষের প্রতি আপনার সহনশীলতা এবং বিবেচনাবোধ রয়েছে।’

আরেকবার রানা তাকে প্রশংসা করায় আকবর মৃদু হেসে বললেন, আমার সেই মহান পূর্বপুরুষের প্রতি আমারও গভীর শ্রদ্ধাবোধ আছে। আমার শুধু কামনা যদি আমি তাঁর মহত্ত্বের সামান্য পরিমাণও অর্জন করতে পারতাম, তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। তবে তার তুলনায় আমি কিছুই না।’

‘আপনার এই বিনয় আপনাকেই মানায়, জাহাপনা। তবে এর বিচারের ভার অনুগ্রহ করে আমার হাতে ছেড়ে দিন। আপনি আমাকে মন খুলে কথা বলতে বলেছেন। আমি আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করছি। হিন্দু প্রজাদের বিরুদ্ধে আপনার বাবার গোঁড়ামি সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেবে। রাজপুত রাজ্যগুলোর মতো দীর্ঘদিনের মিত্রকে শত্রুতে পরিণত করবে আর তুচ্ছ অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে ধন-সম্পদের অপচয় হবে। এটি করতে গিয়ে তিনি বিদেশি হামলাকারীদের জন্য হিন্দুস্তানকে একটি অরক্ষিত, সহজ লক্ষ্যবস্তু করে তুলবেন। নীতিগতভাবে তিনি যা সঠিক মনে করেন এবং এর পেছনে যে কঠিন বিশ্বাস রয়েছে তার চরম প্রকৃতির বিষয়ে তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত। আর তিনি এমন একগুঁয়ে যে তার মত বদলানো যায় না। এছাড়া আমাদের বিরুদ্ধে আর আমাদের অন্য হিন্দুভাইদের বিরুদ্ধে তাঁর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, অনেকেই আর স্বেচ্ছায় তাঁকে তাদের শাসক হিসেবে মেনে নেবে না। যদিও আমরা বিশ্বাস করি আগে আমরা পরস্পরের মধ্যে লড়াই করলেও তখনকার সময়ের তুলনায় হিন্দুস্তানের রাজ্যগুলো মোগল অধিরাজত্বে অনেক শক্তিশালী হয়েছে, তবুও তাকে সরাতে হবে আর আকবর, আপনিই হচ্ছেন সবার স্বাভাবিক পছন্দ।

রানা তার অভিপ্রায় এবার সুনিশ্চিত করে বলার পর আকবর এমন অভিভূত হলেন যে, তার মুখে সাথে সাথে কোনো উত্তর যোগাল না। রানার চিঠি তার মাঝে যে আকাক্ষা জাগিয়ে তুলেছিল তা নিয়ে তিনি খুব একটা ভাবেন নি। তাহাব্বুর খানের সাথে আলোচনা আর নিজের মনের সাথে দীর্ঘ তর্ক-বিতর্কের পর তার আকাঙ্ক্ষা পূরণের ইচ্ছা আরো গম্ভীর হয়। তবে যখন এসেছে তা মুখে প্রকাশ করার তিনি ইস্ততত করতে লাগলেন। বিষয়টি নিয়ে তার মনে যখন ঝড় চলছিল, তখন তাহার খান বলে উঠলো, আমাকে মার্জনা করবেন, তবে আমরা কী করে জানবো যে আপনি আমাদের প্রতিশ্রুতিকে সম্মান জানাবেন?

রানার কালো চোখে আগুন জ্বলে উঠলো। একজন রাজপুতের দেয়া কথা কি সব সময় ঠিক হয় নি? তবে আপনারা যদি আমাকে সন্দেহ করেন, সেজন্য বলছি, আমার পাশে যে তরুণকে দেখেছেন সে আমার ছেলে। যদি তিনি চান, তাহলে আমার প্রতিশ্রুতির আন্তরিকতা প্রমাণের জন্য তাকে আমি শাহজাদার জিম্মায় ছেড়ে দেবো।’

অবশেষে আকবর পুরোপুরি মনস্থির করে কথা বললেন, আমি নিজেও মনে করি আমার বাবা তাঁর কর্মকাণ্ড দিয়ে সাম্রাজ্যের ক্ষতি করছেন। আপনার কথা আর আমার উপর যে আস্থা রেখেছেন তা প্রকাশ করায়, তা থেকে আমি শক্তি পেয়েছি। এখন তাহাব্বুর খান আর আমি দুজনে মিলে আপনাদের আর সাম্রাজ্যের অন্যান্য জায়গা থেকে যাদেরকে আমাদের পতাকার তলে টেনে আনতে পারবো, তাদের সকলকে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত।’

শেষ পর্যন্ত কথাটি তিনি বলেই ফেললেন। তার বাবার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত এবং অপরিবর্তনীয় পদক্ষেপটি নেবার জন্য রাজি হলেন, যদিও জানেন যে, তার বাবা এজন্য কখনও তাকে ক্ষমা করবেন না। যেমন মোহাম্মদ সুলতানকে করেননি। তবে তিনি যেরকম প্রত্যাশা করেছিলেন, সেরকম ভয়ে কেঁপে উঠেন নি, বরং তার মাঝে এক নতুন শক্তির সঞ্চার হল আর সেই সাথে আত্মবিশ্বাসও জেগে উঠলো। তিনি তার বাবাকে দেখিয়ে দেবেন তাকে ছোট করে, তার সহনশীলতা আর সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য মানুষের সাথে আপস-মীমংসা আর তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার ইচ্ছাকে অবজ্ঞা করে তিনি ভুল করেছেন।

আকবর বললেন, আমি আপনার মৈত্রীর প্রস্তাব গ্রহণ করছি। আমরা সবাই মিলে আমার পূর্বপুরুষ আকবরের সময়ে মোগল সাম্রাজ্য যেরূপ গৌরবময় অবস্থায় ছিল, তা আবার ফিরিয়ে আনবো। আমি জানি রাজপুতরা কথা দিয়ে কথা রাখে। কাজেই রাজপুতদের আন্তরিকতা প্রমাণের জন্য আপনার ছেলেকে জিম্মি হিসেবে রাখার প্রয়োজন নেই।’ কথা বলা শেষ করে আকবর হেঁটে সামনে এগিয়ে রানাকে আলিঙ্গন করলেন। কয়েক মুহূর্ত পর তাকে ছেড়ে দিয়েই আবার বললেন, এখন আমাদের অভিযানের পরিকল্পনা শুরু করতে হবে, তাই না? প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমি যতবেশি সম্ভব আমার নিজের সেনাবাহিনীর সদস্যদের আমার পতাকাতলে আনার চেষ্টা করবো। আর তাহাব্বুর খান আর আমি আশা করি ওদের সবাই আমার দলে আসবে, কি বল তাহাব্বর?’ তার দুধ-ভাই মাথা নেড়ে সায় দিল।

 রানা বললেন, আমি যখন জানবো আপনি এটা করতে সফল হয়েছেন, তখন আমিও আমার সেনাবাহিনী নিয়ে আপনার সাথে যোগ দেব। এছাড়া মারওয়াড় আর অন্য যেকোনো রাজপুত রাজ্যকে রাজি করাতে পারলে তাদেরকেও এতে সামিল করবো। তবে আমাদেরকে দ্রুত কাজ করতে হবে। আমার চরেরা আমাকে নিশ্চিত করে জানিয়েছে–এটা আপনারও জানা উচিত যে, আপনার বাবা মুয়াজ্জমের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আজমিরে ফিরে গেছেন। আপনার ভাই আযম বাংলার সুবেদার পদে যোগ দেবার জন্য চলে যাওয়ার পর আওরঙ্গজেবের সাথে এখন বড়জোর আটশোর মতো সৈন্য রয়েছে। আপনার নিজের বিপুল সংখ্যক সেনা অন্যদের তুলনায় আজমির আর আপনার বাবার অনেক কাছে রয়েছে। এটা আপনার জন্য একটা বড় সুযোগ, তিনি কিছু বুঝার আগেই আপনি এখুনি তাকে বন্দী করে সিংহাসন দখল করতে পারেন। আর এতে নিশ্চিত অনেক কম প্রাণহানি হবে।

*

আকবর দেসুরিতে তার শীতল কামরায় ফিরে গেলেন। মাত্র দুই ঘণ্টা আগে তার সেনা কর্মকর্তারা তার বাবাকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনায় রাজপুতদের সাথে মৈত্রী করার বিষয়ে তাকে প্রায় সর্বসম্মত সমর্থন দিয়েছে। তিনি তার সৈন্যদের সামনে গিয়েছিলেন। রণহস্তির হাওদার উপর দাঁড়িয়ে তিনি অঙ্গীকার করলেন যখন তিনি সম্রাট হবেন তখন সকলকে পুরস্কৃত করা হবে আর এর নিদর্শনস্বরূপ পরদিন সকালে দেসুরি ছেড়ে যাওয়ার আগে আজ সন্ধ্যায় একটি ভোজের ঘোষণা দিলেন। তার কথা শুনে সবাই প্রবল উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো।

তবে এরপরই জানা গেল ইকবাল বেগ তার কয়েকজন সৈন্যসহ ঘোড়া ছুটিয়ে বের হয়ে গেছে–সম্ভবত বিদ্রোহের খবর তার বাবাকে দেওয়ার জন্যই সে চলে গেছে। তাদের চলে যাওয়ার খবরটি হানিফ খান দিয়েছিল। সেই সাথে সে ইকবাল বেগের চলে যাওয়াকে নিন্দা জানিয়ে আকবরের প্রতি তার নিজের আনুগত্যের কথা বললো, আবার সেই সাথে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে তার অবস্থানও তুলে ধরলো। অবশ্য আকবর তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেন নি। হানিফ খানকে সতর্ক নজরদারিতে রাখতে হবে। আর এটা তাকে নিশ্চিত করতে হবে।

এটা জানাকথা যে বিদ্রোহের খবরটি শীঘ্রই তার বাবার কানে গিয়ে পৌঁছাবে। সত্যি বলতে কি এই বিদ্রোহটি শাহজাহানের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেব যে বিদ্রোহ করেছিলেন ঠিক সেরকমই। এখানে ইকবাল বেগ না হলে অন্য কেউ হত। আর তাতে কী আসে যায়? রাজপুতদের সাথে নিয়ে তিনি আজমির পৌঁছার আগে তার বাবা অতিরিক্ত সেনা ডেকে আনার সময় পাবেন না। তবে বাবাকে সম্মান দেখিয়ে অবশ্যই একটা চিঠি লিখে সমস্ত বিষয় ব্যাখ্যা করে জানাতে হবে, তিনি কী করতে যাচ্ছেন আর কেনইবা করতে চাচ্ছেন। নিচু টেবিলের সামনে বসে আকবর একটা টুকরা কাগজ নিলেন। দ্রুত চিঠি লিখে ঘোড়া বদল করে করে রাজকীয় সংবাদবাহক পাঠালে তার চিঠিটা ইকবাল বেগের আগেই তার বাবার হাতে পৌঁছে যেতে পারে।

*

জানালা দিয়ে অস্তগামী সূর্যের আলো আজমির দুর্গের দেওয়ান-ই-আমের ভেতরে এসে পড়ছে আর অনেক থামের লম্বা লম্বা অন্ধকার ছায়া সাদা মার্বেল পাথরের মেঝের উপর পড়ছিল। আওরঙ্গজেব তার ছেলের সংক্ষিপ্ত চিঠিটি পড়ছিলেন। তিনি এই প্রথম আকবরের বিদ্রোহের কথা শুনলেন আর চিঠিতে যা পড়ছিলেন তা তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তবে হাতের লেখা আকবরের আর সিলমোহরও তার। যতই তিনি বিষয়টা নিয়ে ভাবলেন ততই তার মনে শীতল রাগ দেখা দিল। কি করে তার এই ছেলে–যে কি-না মারওয়াড়ের বিরুদ্ধে একটি সমরাভিযানও সফল করতে পারে নি সে আওরঙ্গজেবের চেয়ে নিজেকে সাম্রাজ্য শাসন করার উপযুক্ত মনে করতে পারলো? তার কী দুঃসাহস যে, এমন বিশ্বাসঘাতকতা করে তার বাবা আর তার ধর্মের শত্রু রাজপুতদের সাথে হাত মেলাতে পারলো? তিনি সব সময় আকবরকে নমনীয় আর দুর্বল ভাবতেন, বিদ্রোহ করা তো দূরের কথা সে কখনও সবার আড়ালেও তার বাবার মতের বিরুদ্ধে কোনোদিন উঠে দাঁড়ায় নি। এটা নিশ্চয়ই রাজপুতদের বিশ্বাসঘাতকতা, তারা তাকে মহান বানিয়ে তার মতিভ্রম ঘটিয়েছে। পুরো চিঠি জুড়ে হিন্দু আর মুসলিমের মাঝে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আর জিজিয়া কর তুলে দেবার বিষয়ে মেকি আর লোক দেখানো ধার্মিক লোকের মতো মন্তব্য করা হয়েছে। তার মতোই একই নামের সম্রাট আকবরের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা আর পানির মতো পাতলা সুফিবাদের প্রতি তার বিশ্বাসের কারণে সে রাজপুতদের কথায় সহজেই প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। তারা তাকে আগেকার সময়ের তথাকথিত সমতা এবং ধর্মসহিষ্ণুতার দিকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছে।

তবে তার ছেলে তার চেয়েও বেশি মনের আসল ভাবনা গোপন রেখে চলেছিল? এটা তিনি কখনও সম্ভব হতে পারে ভাবেন নি। এটা হয়তো নীতি বিবর্জিত রাজপুতদের চতুরতা দিয়ে প্ররোচিত আবেগ তাড়িত একটি বিদ্রোহ শুধু নয়। হয়তো আকবর বেশ আগে থেকে এটা পরিকল্পনা করে রেখেছিল। সে তার ভাইদেরও তার সাথে জড়িত করেনি তো? এখন মনে পড়ে গেল তার নিজের পরিকল্পনার কথা, কিভাবে তিনি সাম্রাজ্যের একটি অংশ দেবার লোভ দেখিয়ে, তার ভাই মুরাদ আর শাহ সুজাকে রাজি করিয়েছিলেন, দারা শিকো আর তাঁদের বাবার বিরুদ্ধে তাঁর সাথে হাত মেলাতে। তার মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে কত সহজে তারা তার প্রস্তাবটি লুফে নিয়েছিলেন।

তবে মুয়াজ্জম বেশ সতর্ক আর আত্মবিশ্বাসহীন। মারওয়াড়িদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় বেশ সতর্কতার সাথে বাবার দিক নির্দেশনা মেনে চলেছিল আর রাজদরবারে সহজে মুখ খুলতে না–তাকে মনে হয় এতো সহজে সন্তানোচিত দায়িত্ব পালনের পথ থেকে প্রলুব্ধ করে কুকর্মে প্ররোচিত করা যাবে না। আর এর পরিণতিতে কী হতে পারে সে ভয়তো আছেই।

 তবে আজমের ব্যাপারে কী হতে পারে? আজম আর আকবর একই মায়ের পেটের আপন ভাই আর বয়সেও কাছাকাছি, মুয়াজ্জম তা নয়। সে বেশ বদমেজাজি আর আকস্মিক আবেগে চলে। যদিও জানির সাথে বিয়ের পর মনে হয় সে একটু শান্ত হয়েছে। তবে তাঁর সেনাপতিদের সূত্র থেকে তিনি জানতে পেরেছেন যে, আজম ইতোমধ্যেই এলাহাবাদ ছাড়িয়ে তার সৈন্যদল নিয়ে গঙ্গার বুকে নৌকা বেয়ে বাংলার সুবেদারের নতুন পদে যোগ দেওয়ার জন্য চলে গেছে। এতে বুঝা যাচ্ছে আকবরের ভাইয়েরা হয়তো এতে জড়িত নয় আর এই বিদ্রোহ আসলে কেবল রাজপুত আর তার ছেলের মধ্যেই সীমিত। এই হঠকারিতার জন্য তাদেরকে অবশ্যই ভুগতে হবে।

 এই পরিস্থিতিতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে গিয়ে তিনি মনে একটি ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পারলেন, আকবরের সেনাবাহিনী রাজপুত লুটেরা জোটের সাথে মিলে তাকে বাইরের সাহায্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। তার চেয়ে ভাল হবে বরং আজমির দুর্গে অবস্থান করে তাঁর সেনাদলকে দুর্গ রক্ষায় মোতায়েন করবেন, তারপর সুযোগ বুঝে লোকজনসহ এখান থেকে বের হওয়ার একটা পথ খুঁজবেন। দুর্গটি বেশ সুরক্ষিত এবং তাঁর আটশো সেনাও এখান থেকে বড় ধরনের সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাতে পারবে। আজমির কোষাগার থেকে সোনা বিলিয়ে সৈন্যদের মনোবল চাঙ্গা রখার ব্যবস্থা করবেন। আর এখুনি মুয়াজ্জমকে খবর দিতে হবে, যেন সে তার সৈন্য নিয়ে অবিলম্বে তার কাছে চলে আসে, তবে তাকে এর কারণটি বলা যাবে না। তার ছেলের প্রতিক্রিয়া থেকে শীঘ্রই বুঝা যাবে এই বিদ্রোহে সে জড়িত কি-না।

 এছাড়া তাকে ভেবে বের করতে হবে তার স্বপক্ষে আরো সমর্থক যোগাড় করা যায় কি-না আর সেই সাথে আকবর আর তার মিত্রদের পরিকল্পনা কিভাবে বানচাল করা যায় তাও ভেবে বের করতে হবে। লড়াইয়ের ময়দানে যেমন যুদ্ধ হয় তেমনি তা মানুষের মনেও হয়। সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর আল্লাহর সহায়তা নিয়ে তিনি যেকোনো বিদ্রোহীর চেয়ে শ্রেয়তর প্রমাণিত হবেন। এমন সময় দরজায় কেউ করাঘাত করতেই তাঁর চিন্তার সূত্র কেটে গেল। একজন কোরচি হাজির হয়ে বললো, ‘জাঁহাপনা, ইকবাল বেগ এসেছেন। তিনি এখুনি আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন। তিনি বলেছেন তার কাছে আপনার জন্য অত্যন্ত জরুরি খবর রয়েছে।

‘তাকে বল সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। আমি আমার ছেলের বিশ্বাসঘাতকতার সমস্ত খবর পেয়েছি আর সে ব্যাপারে ব্যবস্থাও নিচ্ছি।’

 সেই সন্ধ্যায় আজমির দুর্গে তাঁর কামরায় একাকী আওরঙ্গজেব ভেড়ার মাংসের তন্দুরি মশলা, দই আর নান রুটি দিয়ে অতি সাধারণ রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। খাবার চিবোতে চিবোতে তিনি তাঁর ছেলের বিদ্রোহ কিভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে দমন করা যায় তা নিয়ে ভাবছিলেন, এমন সময় কামরার ছায়াঘেরা দরজার ঝালর কেঁপে উঠলো আর আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা একটি মূর্তি উদয় হল। কে আসতে পারে এসময়ে না বলে কয়ে? তার হাত চলে গেল কোমরে গোঁজা ছোরার দিকে, তারপর সাথে সাথে দেখলেন তাঁর বোন জাহানারা এসেছেন। মুয়াজ্জমের শিবির থেকে ফেরার পর জাহানারাও আজমিরে তাঁর কাছে চলে এসেছিলেন। তিনি এগিয়ে কামরার আরো ভেতরে আলোর কাছে আসতেই দেখা গেল তার চোখে পানি আর দুই হাত বিক্ষিপ্তভাবে অনবরত কচলাচ্ছেন। তিনি বললেন, “আওরঙ্গজেব, আমি এইমাত্র আকবরের ব্যাপারটা শুনলাম। আমি সবসময় তাকে একজন মর্যাদাবান মানুষ ভাবতাম…বল ব্যাপারটা আসলে সত্যি না। আমার মনে হয়না আমি এটা সহ্য করতে পারবো…এটা কি করে হতে পারে…’ তার মুখ থেকে কথা হারিয়ে গেল।

 ‘হ্যাঁ, এটা সত্যি। আকবর বিদ্রোহ করেছে।

 ‘তুমি এখন কী করবে? আমরা আবার আমাদের পরিবারে রক্তপাত আর ঘৃণা আনতে দিতে পারি না..অবশ্যই না..’।

 তার শক্ত মনের বোনকে এরকম ভেঙ্গে পড়তে তিনি আর কখনও দেখেন নি। আওরঙ্গজেব তাঁর বোনের দুই হাতের কব্জি ধরলেন। তার সারা শরীর কাঁপছিল, আওরঙ্গজেব তাঁর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, ‘শান্ত হোন। আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। আমি ইতোমধ্যেই তাকে ধরে ফেলার পরিকল্পনা করে ফেলেছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

তা কেমন করে হবে?

কারণ আমি এটা করে ছাড়বো। আকবর কিংবা হঠাৎ গজিয়ে উঠা আর কেউ আমাকে ভয় দেখাবে কিংবা আমার সাম্রাজ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে, তা আমি হতে দেব না। সে তার কৃতকর্মের জন্য অবশ্যই ভুগবে।

 ‘আকবর তোমার ছেলে, অথচ তুমি এমনভাবে তার সম্পর্কে কথা বলছো, যেন। সে একজন বাইরের লোক।

 ‘এখন সে আমার কাছে একজন অচেনা মানুষ।

 ‘আওরঙ্গজেব, দয়া করে…এত শীতল হইও না। তাকে কিছু হলেও দয়া দেখাও।

‘কেন.হব? আমার কাছ থেকে সিংহাসন দখল করার জন্য সে বিধর্মী রাজপুতদের আমার বিরুদ্ধে ভিড়িয়েছে। আমার কাছে এসে বস, আমি তোমাকে সবকিছু খুলে বলছি সে কি করেছে। তারপর ভেবে দেখো সে কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য কি-না।’

বিদ্রোহের বিষয়টি আর এর সমর্থকদের সম্বন্ধে তিনি যা জানতেন সবকিছু বলার পর তার বোনের অস্থিরতা মনে হল একটু কমে এল। এখন আর তার দুই হাত একবার মুঠো করে আবার খুলে দেওয়া ছেড়ে স্থির হয়ে কোলের উপর পড়ে রইল। আওরঙ্গজেবের বলা শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ সময় পার হওয়ার পর জাহানারা কথা বললেন, আমাকে ক্ষমা কর। তোমার মনের এই অস্থির অবস্থায় আমার এখানে আসাটা উচিত হয় নি। তবে…’ এতটুকু বলে একটু থামলেন, যেন কি ভাবে কথাটা বলবেন তা মনে মনে সাজাচ্ছেন। তারপর বললেন, “আমার অবশ্য তোমাকে কিছু কথা বলা উচিত, যা আমি জানি তুমি শুনতে চাও না।

বল।

জাহানারা বেশ ধীরে সুস্থে আর ভেবে চিন্তে তাঁর কথা শুরু করলেন আর সেই সাথে ডান হাতের আঙুল দিয়ে শালের এক প্রান্ত পেঁচাতে লাগলেন। আকবরের বিদ্রোহ করাটা ভুল হয়েছে। সম্পূর্ণ ভুল। ছেলে হয়ে এভাবে বাবাকে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা কোনো যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না। আমি এটা তাকে বলবো, ঠিক যেরকম অনেক বছর আগে তুমি আমাদের বাবার বিরুদ্ধে একটা সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলে। আর আমি–’।

 ‘কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। আমি যখন বাবার বিরদ্ধে গিয়েছিলাম, তখন সেটা করেছিলাম আমাদের সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য। তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন আর দারা আর তার খারেজি মতবাদে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। এটা ছিল আল্লাহর প্রতি আমার কর্তব্য।

এ বিষয়ে আমরা কখনও একমত হতে পারবো না, তবে পুরোনো যখম খুঁচিয়ে তোলার এখন সময় নয়। তুমি কর্তব্যের কথা বলছো? বর্তমান আর ভবিষ্যৎ ঝগড়া নিবারণ করা কী আমাদের কর্তব্য নয়? আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি…যদি আমরা একসাথে কাজ করি তাহলে এই বিদ্রোহ শুরু হওয়ার আগেই আমরা থামাতে পারি। আমাকে আকবরের শিবিরে যেতে দাও…আমি তাকে দেখাবো সে কিরকম ভুলভাবে চালিত হয়েছে।’

না। আমি এটা সম্পূর্ণ নিষেধ করছি।

জাহানারা দমে গেলেন। আওরঙ্গজেবের চেহারা একগুঁয়ে দেখাল। জাহানারার মনে পড়লো ছোটবেলায় তিনি এরকমই জেদি ছিলেন। তিনি বললেন, তুমি যদি আমাকে কিছু করতে না দাও, তবে দয়া করে বেশি দেরি হওয়ার আগেই তুমি নিজে তোমার তরফ থেকে মিটমাটের প্রথম পদক্ষেপটি নাও। যদি এটা কর, আমি নিশ্চিত আকবর আর রাজপুতরাও আসলে এতে সাড়া দেবে। তারা হয়তো ইতোমধ্যে এ ধরনের তাড়াহুড়া করার জন্য আফসোস করছে।

 ‘তুমি যা করতে বলছে, তা করলে আমাকে ওরা দুর্বল মনে করবে। বিদ্রোহীদের প্রতি এগিয়ে যাওয়াটা আমার কাজ নয়। বরং তাদেরকেই আত্মসমর্পণ করে উচিত বিচারের জন্য নিজেদেরকে উপস্থাপন স্বীকার করতে হবে, যাতে পুরো সাম্রাজ্য–পুরো পৃথিবী বুঝতে পারে বিশ্বাসঘাতকের কী হয়।

যদি তাদের নেতা তোমার ছেলে হয় তাও?

 বরং আরো বেশি, কারণ, সে শুধু শাসকের সাথে একজন প্রজার যে আনুগত্যের বন্ধন আছে তা ছিন্ন করে নি, সে ছেলের সাথে বাবার সম্পর্কের বন্ধনও ছিন্ন করেছে। আমি তোমাকে মিথ্যা আশ্বাস দেব না–সবচেয়ে বেশি আকবর আশা করতে পারে, তা হল তার ভাই মোহাম্মদ সুলতানের মতো বাকি জীবন গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী হয়ে কাটান।

 ‘তুমি কি বলছো একবার ভেবে দেখ। শুধু একজন শাসকের মতো নয় বাবার মতোও আচরণ কর। এককালে তুমি বিশ্বাস করতে, সেটা সঠিক হোক আর ভুল হোক, যে তোমার আর তোমার মতামতের প্রতি বাবার কোনো শ্রদ্ধা ছিল না। আকবরও হয়তো তোমার ব্যাপারে তাই ভাবতে পারে। আমি জানি সে অসন্তুষ্ট হয়েছে, কারণ তুমি তার খুব বেশি সমালোচনা কর। তুমি যদি তাকে আরো ভালোবাসতে, তার প্রতি আরো আস্থা রাখতে, তাহলে হয়তো সে কখনও অন্যের কথায় কান দিত না কিংবা তার প্রশংসা শুনতে তৈরি থাকতো না। আমি প্রায়ই এ ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছি, কিন্তু তোমাকে যতটুকু জানি তাতে ভয় হত যে, এতে হয়তো ভালো না হয়ে বরং আরো ক্ষতি হতে পারে। তাই বিষয়টা আমি নিজের মধ্যে চেপে রাখি। এখন নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে কেন, আরো কঠিনভাবে চেষ্টা করলাম না।

‘এতে খুব একটা ক্ষতি-বৃদ্ধি হত না। প্রশংসার পরিবর্তে নিন্দাই বেশিরভাগ সময় আকবরের প্রাপ্য ছিল। আমি কেবল চেষ্টা করেছিলাম তাকে সঠিক পথে আনতে–তবে মনে হয় সফল হতে পারি নি।

তাই যদি তোমার উদ্দেশ্য হত, সেক্ষেত্রে তুমি যদি এত কঠোর না হতে তাহলে হয়তো সে রাজপুতদের চাটুবাক্যে এত সহজে প্রভাবিত হত না। তোমার ছেলেদের মধ্যে একমাত্র কমবক্সের প্রতি তুমি যা কিছু আদর ভালোবাসা দেখাও।

তার কারণ সে একটা শিশু মাত্র। যখন কমবক্স বড় হবে তখন আমি আশা করবো সেও আমাকে মান্য করবে আর আমার মতামতের প্রতি সম্মান। দেখাবে।

 ‘তোমার চেহারা দেখে আমি বুঝতে পারছি এত কথা বলে আমি তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাচ্ছি। আর এও জানি এবার যা বলতে যাচ্ছি তা তোমাকে আরো বিরক্ত করে তুলবে। এটা আমি আগেও বলেছি আর অবশ্যই আবারও বলবো। এই বিদ্রোহর জন্য হিন্দুদের প্রতি তোমার আচরণও কিছুটা দায়ী। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না, যদি তুমি আরো সহিষ্ণুতা দেখাতে, তাহলে সাম্রাজ্য শাসন করাটা আরো স্বচ্ছন্দ হত, আর তুমি আর রাজপুতদের মতো তোমার প্রজারা, উভয়েই আরো সন্তুষ্ট থাকতে?

 ‘শাসনের সাথে স্বাচ্ছন্দ্য আর সন্তুষ্টির কী সম্পর্ক? ন্যায় আর কর্তব্য হচ্ছে এখানে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

‘আমি তো কর্তব্যের কথাই বলতে চাচ্ছি–ভালোভাবে শাসন করার কর্তব্য, তোমার অধীনস্থ সমস্ত মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা, শুধু কিছু মানুষকে শাস্তি দেওয়া কিংবা কেউ কেউ যেমন বলে নির্যাতন করা নয়।’

যারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য নয় তাদেরকে আমি কখনও শাস্তি দেই না।’

 ‘পৃথিবী সম্পর্কে তোমার ধারণা কখন এত শীতল হল? একজন সম্রাট হিসেবে তোমার অনেক ভালো কিছু করার ক্ষমতা আছে। তারপরও তুমি কেবল ছায়া ছড়াতে পছন্দ করছে। আমার কথায় তুমি কষ্ট পেলে আমি দুঃখিত, তবে এখানে তোমার মা থাকলে তিনিও একথা বলতেন। তুমি অতি সহজে নিন্দা করতে পার, তবে প্রশংসা করার বেলায় বেশ ধীর…এমন রুঢ় আর ক্ষমাহীন আচরণ কর যে, তোমার ছেলেরাসহ লোকজন সবাই তোমাকে ভয় পায়। সেজন্যই তারা মন খুলে কথা বলে না কিংবা সুপরামর্শও দেয় না। আজ্ঞাবহ মানুষের মতো কেবল তোমার কথায় সায় দেয়।

আওরঙ্গজেব কিছু বললেন না। এতে সাহস পেয়ে জাহানারা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘দয়া কর আওরঙ্গজেব–যদি তুমি দেখ যে আকবরকে ক্ষমা করা কঠিন, তাহলে এই বিদ্রোহ দমন করতে যাতে রক্তপাত না হয় সেজন্য যা কিছু তুমি করতে পার কর। আমাদের পরিবার আবার ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হোক। আমি আর তা সহ্য করতে পারবো না। যত চেষ্টাই করুন তার গলা ভেঙ্গে গেল, একটু দয়া কর, আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি…’।

জাহানারা আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝি। আপনি সারা জীবন আমাদের পরিবারকে এক করে রাখার চেষ্টা করে কাটিয়েছেন। আমি সেটা জানি, যদিও অনেক সময় তা প্রকাশ করি নি। তবে, যাইহোক, এতটুকু বলার পর আওরঙ্গজেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর বললেন, যা ঘটছে তার জন্য আমার দোষ খুঁজতে গিয়ে আপনি একজন পুরুষের জগৎ সম্পর্কে একজন নারীর অজ্ঞতার সাথে প্রতারণা করছেন। আমি সম্রাট আর আমাকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা যতই বেদনাদায়ক হোক। আকবর আর তার বিধর্মী মিত্রদেরকে কোনো ধরনের দয়ামায়া দেখানো হবে না, তাদেরকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। একটু থামলেন, তারপর চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর নরম করে বললেন, এই বিষয় নিয়ে আর তর্ক-বিতর্ক করা অনর্থক বরং আমরা উভয়েই কষ্ট পাব। তার চেয়ে ভালো হয় যদি আপনি দয়া করে আপনার ঘরে ফিরে যান।’ জাহানারা উঠে ধীরে ধীরে কামরা থেকে বের হয়ে গেলেন। নিজের ঘরে ফিরে মনে সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য একটি সুফিবাদের বই তুলে নিলেন। তবে তাঁর দুই-চোখ ভরে পানি চলে আসায় বইয়ের শব্দগুলো ঠিকমত দেখতে পারছিলেন না। সারাটি জীবন তিনি তাঁর পরিবারকে এক করে রাখার চেষ্টা করে এসেছেন আর বার বার ব্যর্থ হয়েছেন। শাহজাহান আর মমতাজ সারাজীবন পরস্পরকে ভালোবেসে আর একসাথে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে কাটিয়েছিলেন, অথচ তাঁদের সন্তানদের একদিন এই পরিণতি হবে কে তা ভেবেছিল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *