১০. আওরঙ্গজেব সাবধান

১০. আওরঙ্গজেব সাবধান

ছোট্ট মোগল দুর্গটি থেকে তখনও কমলা রংয়ের অগ্নিশিখা তারা-ভরা সন্ধ্যার আকাশের দিকে উঠছিল। শিবাজি সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। তপতি নদীর একটি উপশাখা যেখানে মূল নদীর সাথে মিশেছে, তার উপকূলরেখা থেকে অগ্রবর্তী উচ্চভূমির উপর দুর্গটির অবস্থান। দুর্গ থেকে সামনেই একটি জলাভূমি দেখা যায়। দুইদিন আগে তিনি তার লোকজনসহ পাহাড়ের আশ্রয় থেকে বের হয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। অগ্রবর্তী দল নিয়ে তার ছেলে সম্ভাজী দুর্গ আক্রমণ করার আগেই দুর্গরক্ষাকারী মোগল সেনাদল দুর্গের ইটের দুই দেয়ালের ভারী ফটক বন্ধ করে দিয়েছিল। যাইহোক তারপর অবশ্য মোগলরা খুব একটা প্রতিরোধ করেনি। পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টা ওরা তার নিজের সেনাদলকে উদ্দেশ্য করে অত্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে গোলাবর্ষণ করেছিল। মুখোমুখি আক্রমণ করে প্রাণহানি করার তার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। তাই তিনি দুর্গরক্ষাকারী মোগল সেনাদের মনোবল পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তার সেনাদলকে দুর্গ অবরোধ করে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজ সাময়িক অস্ত্রবিরতির পতাকা বৈঠকের তিনি প্রস্তাব দিলেন, মোগলরা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে নিরাপদে দুর্গ ছেড়ে যেতে দেওয়া হবে। মোগলরা সাগ্রহে প্রস্তাবটি গ্রহণ করলো। তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যত্নবান ছিলেন এবং আত্মসমর্পণকারী সেনাদেরকে কোন ধরনের দৈহিক নির্যাতন কিংবা এমনকি টিটকারী দেওয়া থেকেও তার লোকদের বিরত রেখেছিলেন। এতে বরং ভালোই হবে, কারণ যদি এরা আবার মোগল সেনাবাহিনীর চাকরিতে ফিরে যায়, তবে তার উদারতার কথা তাদের অধিনায়কদের জানাবে। তবে তার সন্দেহ সবাই হয়তো মোগলদের অধীনে চাকরিতে নাও ফিরে যেতে পারে। এদের কাহিনীতে উজ্জীবিত হয়ে অন্যান্য মোগল সেনারা তার আক্রমণ বলিষ্ঠভাবে প্রতিহত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।

দুর্গসহ এতে আর যেসব অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী আর অস্ত্রশস্ত্র তার প্রয়োজন ছিল না, সেগুলো পোড়ানো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এরপর লুটের মাল তার সৈন্যদের মধ্যে বিলি-বণ্টনের ব্যবস্থা করা হবে। তারপর পাশে পুত্র সম্ভাজিকে নিয়ে বিজয়-ভোজে পৌরাহিত্য করার কথা। সাধারণত এসব আয়োজনের দিকে তিনি সব সময় উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকেন, তবে আজ তিনি খুব একটা সুস্থবোধ করছেন না। মাথায় যন্ত্রণা আর জলাভূমির অসংখ্য মশার কামড়ে সারা গায়ে চুলকাচ্ছিল আর পেকে উঠে পুঁজ হচ্ছিল। সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা পড়তেই তিনি দেখলেন তার সৈন্যরা অনেকেই গায়ে কম্বল জড়িয়েছে অথচ তিনি গরমে ঘামছিলেন। কপালে হাত দিয়ে দেখলেন সেখানে ঘাম জমেছে। এছাড়া দুর্গ আত্মসমর্পণের ঘটনার উত্তেজনার পর তার হৃৎস্পন্দন এখনও স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসে নি। এখনও বুক ধুকপুক করছে। তার মনে হচ্ছিল তিনি বুকের ধুকপুকানির শব্দটি শুনতে পাচ্ছিলেন।

 যাইহোক। একটু পরই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। পেছনে ঘুরে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে বিজয়োৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগলেন। তাঁবুর ভেতরে একটু ঠাণ্ডা মনে হল। বেশ ভাল। তার পরিচারক একটি তেপায়া তাকের উপর একটি মাটির বাটিতে পানি রেখে গিয়েছিল। পাশেই রাখা একটুকরা সুতির কাপড় তুলে নিয়ে ঝুঁকে পানিতে ভেজালেন। তারপর ভেজা কাপড়টা দিয়ে কপালের ঘাম মুছার জন্য কাপড়ের টুকরাটি তুলতে গিয়েই হঠাৎ তার মনে হল পানির বাটিটা যেন ঘুরে ঘুরে তার দিকে উঠে আসছে। তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল, তিনি জ্ঞান হারিয়ে পানির বাটিটির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতেই বাটিটা তেপায়ার উপর থেকে মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। আর তিনিও মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

আবার চোখ খুলতেই শিবাজি দেখলেন, সম্ভাজি, তার হেকিম আর তার কয়েকজন পরিচারক তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?

হেকিম উত্তর দিল, “আপনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়েছিলেন প্রায় তিনঘণ্টা যাবত। আপনার পরিচারক আপনাকে এ অবস্থায় দেখতে পেয়ে বিছানায় শুইয়ে তারপর আমাকে ডেকে এনেছে।

শিবাজি উঠে বসার চেষ্টা করলেন, তবে আবার ক্লান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। তার গায়ের পাতলা সুতির চাদর আর পরনের সমস্ত জামা-কাপড় মনে হচ্ছে ভেজা। ওরা কি তার জ্ঞান ফেরাবার জন্য গায়ে পানি ছিটিয়েছিল? মুখে হাত বুলিয়ে দেখলেন ঘামে ভেজা। সারা গা কাঁপছে, নিশ্চয়ই খুব জ্বর হয়েছে। খুব কষ্ট করে চোখ মেলে ওদের দিকে তাকালেন। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সবাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি বললেন, আমি কি খুব অসুস্থ? সত্যি কথা বল…আমাকে জানতে হবে…আমি কি মারা যাচ্ছি?

‘জানি না…মহারাজ। তবে আমার মনে হয় আপনি গুরুতর অসুস্থ।

 শিবাজি আবার চোখ বুজলেন, শরীরে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করলেন। তার এখনও অনেক কিছু করা বাকি রয়ে গেছে। তবে তিনি অনুভব করছিলেন যে, তার হাত-পায়ের আঙুল আসাড় হয়ে যাচ্ছে। একজন মানুষের যখন মৃত্যু হয়। তখন কি এরকম অনুভূত হয়? তিনি সবসময় ভাবতেন তার জীবনের শেষদিনটি একটি যুদ্ধের ময়দানে কাটবে–একজন যোদ্ধার সম্মানজনক মৃত্যু, এরকম কাঁপতে কাঁপতে জলাভূমির জ্বরে ভুগে জীবন শেষ হওয়া নয়।

আবার চোখ খুলে ছেলেকে ইশারা করলেন কাছে আসতে। তারপর বললেন, ‘আমার হয়তো আর বেশি সময় নেই সম্ভাজি। মনোযোগ দিয়ে শোন। মোগল নিপীড়ন থেকে আমার দেশবাসী আর আমার ধর্মকে মুক্ত করার পথে আমি অনেক দূর এগিয়েছি…তবে আরো অনেক অনেক দূর পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে আমার আশংকা একা পাড়ি দিয়ে এই অভিযান সম্পূর্ণ করার জন্য তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার চলে যেতে হবে। এটি সহজ পথ নয়, তবে পুত্র, আমাকে কথা দাও, তুমি সমস্ত মানসিক বিভ্রান্তি আর বিহ্বলতা এড়িয়ে হিন্দুস্তানের মানুষদের তোমার পেছনে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এপথে এগিয়ে যাবে।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে তার নিঃশ্বাস নিতে আরো কষ্ট হচ্ছিল। তারপর বলে চললেন, তোমরা সবাই মিলে একটি অপ্রতিরোধ্য জোয়ার সৃষ্টি করে মোগল হুমকি ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিও। তোমাকে যা যা শিখিয়েছি সব মনে রেখো…আঘাত করবে জোরে এবং দ্রুত, একবার এখানে আরেকবার ওখানে। একটি ছায়ার মতো ছলনাময় হবে আর তখন হেঁচড়িয়ে চলা তাদের সেই বিশাল সেনাবাহিনী কখনও তোমাকে ধরতে পারবে না।’ শিবাজির চোখের আলো নিভে এল। তার আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যেতেই শরীরে একবার খিচুনি উঠতেই শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। তারপর তিনি চিরদিনের জন্য স্থির হলেন। সম্ভাজি নিচু হয়ে তার বাবার কপালে চুমু খেল। তারপর সে বললো, আমি মনে রাখবো বাবা।’

*

সব সময় যুদ্ধ শুরু হতেই আওরঙ্গজেব তার বিশ্বস্ত হাতির পিঠে কারুকাজ করা হাওদায় শান্ত হয়ে বসে থাকতেন। দুজন মাহুত হাতিটির কাঁধের দুইপাশে বসতো আর হাওদায় আওরঙ্গজেবের পেছনে তার গাদা বন্দুকগুলো নিয়ে একজন চাপরাশি আর একজন দেহরক্ষী বসে থাকতো। হাতিটির চতুর্দিকে অশ্বারোহী দেহরক্ষীবাহিনী তাঁকে পাহারা দিয়ে চলতো। এরা সবাই অভিজ্ঞ যোদ্ধা এবং ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তাঁর মতো ওদের সবার মনোযোগ সামনের দিকে, মুয়াজ্জমের সেনাবাহিনী আরাবল্লী পাহাড়ে একটি মারওয়াড়ি দুর্গে। আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

 আওরঙ্গজেবের নির্দেশনায় মুয়াজ্জম একজন ধৃত বন্দীর উপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন। যা করতে আকবরের বিবেক মেনে নেয় নি। লোহার শলাকা ব্যবহার করে তরুণ মারওয়াড়ি চরের কাছ থেকে তথ্য টেনে বের করা হয়েছিল। তার তথ্য মোতাবেক মোগল সেনার উপর আরেকটি হামলা করার আগে মারওয়াড়িরা প্রার্থনা করতে এই দুর্গে সমবেত হচ্ছে। আবার তার বাবার নির্দেশনায় মুয়াজ্জম সাথে সাথে আক্রমণে না গিয়ে তার চরকে দেখতে পাঠালেন, মারওয়াড়িদের সমবেত প্রার্থনা শেষের দিকে আসতেই সে মুয়াজ্জমকে সতর্ক করলো। তারপর মুয়াজ্জম দ্রুত তার সেনাদলকে এগিয়ে নিয়ে আক্রমণের জন্য অবস্থান নিয়ে প্রস্তুত হলেন।

আওরঙ্গজেব দেখে খুশি হলেন যে, মুয়াজ্জম সুস্পষ্টভাবে কাজ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, তবে সেই সাথে যথেষ্ট দূরদর্শিতা দেখিয়ে কাজে নেমেছেন, আজমের মতো নয়। আজম তাড়াহুড়া করে পশ্চিমে মেওয়াড়ের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অধৈর্য হয়ে আর ঝোঁকের বশে যে কৌশল নিয়েছিলেন তাতে বরং উল্টো ফল হয়ে প্রচুর প্রাণহানি ঘটেছিল। আওরঙ্গজেব তার ছেলেকে বাংলায় সুবেদার করে পাঠিয়ে দিয়ে তার জায়গায় একজন বিশ্বস্ত উজবেক সেনাপতিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এদিকে দক্ষিণ দিক থেকে আকবর ধীর গতিতে মেওয়াড়ের দিকে এগোলেও, তার বাবা বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলেন যে, মারওয়াড়ের ব্যর্থতার পর তিনি সফলতার সাথে প্রচুর এলাকা দখল করে ধরে রেখেছেন।

 তবে এখন আওরঙ্গজেবের সমস্ত মনোযোগ মুয়াজ্জমের দিকে। তিনি তার হাতির পিঠে হাওদায় বসে সবেমাত্র সবুজ পতাকা উড়িয়ে কামান দাগার জন্য নির্দেশ দিতে শুরু করেছিলেন। এই অভিযানে ব্যবহার করার জন্য তিনি পাহাড়ি এলাকার মধ্য দিয়ে দ্রুত কয়েকটি কামান আনতে পেরেছিলেন। প্রধানত তুর্কি গোলন্দাজ সৈনিকরা বিধ্বস্ত গ্রামাঞ্চলের উপর দিয়ে কামানগুলো টেনে নিয়ে এসেছিল। এই কামানের গোলায় দুর্গের দেয়াল যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে তো ভালই হবে। তবে এই কামানগুলো দাগার ফলে যে পরিমাণ ধোয়া বের হবে তা পদাতিক সৈনিকদের সামনে এগোবার সময় তাদের আড়াল দেবে। কয়েকজন পদাতিক সেনা সাথে গাদা বন্দুক নিয়েছিল যাতে, কোনো মারওয়াড়ি দুর্গের ছাদের কার্নিশের উপর দিয়ে মাথা উঁচু করলেই তাকে গুলি করে ফেলে দেবে। আর অন্যরা চারজন চারজন করে দল বেঁধে কাঁধে মই নিয়ে এগোচ্ছল আর অন্যদলটি বারুদের পাত্র ফটকের গায়ে রেখে তাতে আগুন জ্বেলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। আওরঙ্গজেব আর মুয়াজ্জম ভেবেছিলেন ধোঁয়া আক্রমণকারীদের রক্ষা করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে, তাই ওরা আশপাশের এলাকার ঝোঁপঝাড় থেকে ডালপালা এনে কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য একজায়গায় স্তূপ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কামানের ধোঁয়ার সাথে আরো ধোঁয়া বাড়াবার জন্য এই জ্বালানিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তোপ দাগা শুরু হতেই শুকনো ডালপালার স্থূপে কমলা রংয়ের অগ্নিশিখা দেখা গেল। ধোয়ার চাদরের নিচে ঢেকে সৈন্যরা লুকিয়ে এগোবার আগেই আওরঙ্গজেব দেখলেন গোলার আঘাতে ফটকের পাশের দেয়াল থেকে কয়েকটি পাথরের টুকরা ভেঙ্গে পড়েছে। ঘন ধোয়ার পর্দায় ঢাকা আড়ালের মধ্য দিয়ে বরকন্দাজ বাহিনী এগিয়ে চললো, তাদেরকে অনুসরণ করলো মই বাহক আর পদাতিক সেনা, যারা মই বেয়ে আক্রমণে যাবে। দুই পাশে বারুদের ছোট ছোট পাত্র ঝুলিয়ে জোয়াল কাঁধে একদল সৈন্য তখনও সামনে এগোবার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছিল।

একটু পরই আওরঙ্গজেব গাদা বন্দুকের ফট ফট আওয়াজ শুনতে পেলেন। কমলা রঙেয়ের পাগড়িপরা মারওয়াড়ি সৈন্যরা বুরুজের ছাদের ছিদ্র দিয়ে গাদা বন্দুকের নল বের করে গুলি করছে আর মোগল বরকন্দাজরাও সমানে তার প্রত্যুত্তর দিচ্ছে। একজন মারওয়াড়ির প্রথমে মাথা তারপর হাত-পা শূন্যে ছুঁড়ে মাটিতে পড়লো। ধোয়ার উপরে দুর্গের দেয়ালের গায়ে একটি মইয়ের মাথা দেখা গেল। তারপর পরই একজন মোগল পদাতিক সেনাকে দেখা গেল দুর্গের কিনারা বেয়ে বুরুজে উঠার চেষ্টা করছে। দুজন মারওয়াড়ি তার দিকে ছুটে এসে ধাক্কা দিয়ে মইসহ মোগল সৈন্যটিকে নিচে মাটিতে ধোঁয়া মাঝে লড়াইয়ের ময়দানে ফেলে দিল। একই প্রক্রিয়ায় দু-তিনবার চেষ্টা করার পর অবশেষে একজন মোগল সেনা দুর্গের ছাদে উঠে পড়লো। সে আরেক জনকে মই থেকে উপরে উঠার জন্য সাহায্য করছিল, এমন সময় একজন মারওয়াড়ি সেনা তরোয়ালের আঘাতে তাকে দেয়াল থেকে ফেলে দিল আর অপর মোগল সেনাটিকেও ফেলে দেওয়ার পর সে নিজেও মোগল গাদা বন্দুকের গুলির আঘাতে নিচে পড়ে গেল।

বাতাসে ভেসে ধোঁয়া ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। আগুন জ্বালাবার জন্য মোগলরা খুব বেশি পরিমণে খড়কুটা জমা করতে পারে নি। আর নিজেদের লোকদেরকে আহত করার ভয়ে কামান থেকেও ঘন ঘন গোলা ছোঁড়া সম্ভব ছিল না, কাজেই সেখান থেকেও ধোঁয়া কমে এসেছিল। ধোঁয়া কমে আসতেই আওরঙ্গজেব দেখলেন দুর্গের দেয়ালের নিচে মাটিতে অনেক মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। কিছু মোগল সেনা লাশের স্তূপের আড়ালে লুকিয়ে দুর্গের ছাদের দিকে গুলি ছুঁড়ছিল। তারপর দ্রুত কয়েকবার আগুন জ্বলে উঠার সাথে সাথে দুর্গের মূল ফটকের কাছ থেকে একের পর এক কানফাটা গুড়ুম গুড়ম শব্দ পাওয়া গেল। কামানের গোলার আঘাতে দেয়ালের যে জায়গায় পাথর ভেঙ্গে গিয়েছিল সেখানে বারুদের পাত্র বহন করে যে মোগল সৈন্যরা ফটক উড়াতে গিয়েছিল ওরা তাদের কাজে সফল হয়েছে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মানুষের দেহ,পাথর আর ভাঙ্গা কাঠের টুকরা শূন্যে উড়ে গেল। ধোঁয়া কমে আসার পর দেখা গেল মূল ফটকের একটি পাল্লা আংশিক ভেঙ্গে চুরমার হয়ে একটি মাত্র কজা থেকে কোনোমতে ঝুলছে। আর এরপাশের দেয়ালও ভেঙ্গে গেছে।

 মোগল পদাতিক সেনারা এখন খোয়র উপর দিয়ে হুড়াহুড়ি করে দুর্গে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলো। মারওয়াড়িরা তখনও আপ্রাণ লড়ে চলেছে। দুর্গের উপর থেকে ছোঁড়া মারওয়াড়িদের গাদা বন্দুকের গুলির আঘাতে কয়েকজন মোগল সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আবার বর্শা হাতে কয়েকজন মারওয়াড়ি ফটকের পাশে ভাঙ্গা দেয়ালের কাছে ছুটে এসে মোগল সেনাদের লম্বা বর্শা ছুঁড়ে বিদ্ধ করলো। ভাঙ্গা দেয়ালের ফাঁক দিয়ে দুর্গে ঢোকার জন্য মুয়াজ্জম হাতের ইশারায় কয়েকজন মোগল অশ্বারোহী সেনাকে সামনে এগিয়ে যেতে বলছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে ওরা দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে সামনে এগোল। দ্রুত ছুটে যাওয়ার সময় ওরা মাটিতে পড়ে থাকা কিছু মোগল সেনার মৃতদেহ মাড়িয়ে গেল আর আহত যেসব সৈন্য তাদের যখমি-দেহ কোনোমতে টেনে গড়িয়ে গড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, তাদেরকেও ঘোড়ার খুরের আঘাতে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল। দ্রুত দুবার দুর্গের ছাদের দিক থেকে গাদা বন্দুকের গুলিবর্ষণ হল। গুলির আঘাতে সাথে সাথে কয়েকজন অশ্বারোহী সেনা ঘোড়াসহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। যারা বেঁচেছিল তারা আবার ঘুরে নতুনভাবে আক্রমণ করার জন্য দলবেঁধে প্রস্তুত হল।

আক্রমণকারী মোগল অশারোহী সেনারা দুর্গে ঢোকার চেষ্টা করার সময় মারওয়াড়ি বন্দুকধারীরা ছাদের আড়াল থেকে বের হয়ে তাদেরকে গুলি করার চেষ্টা করতেই নিচে থেকে মোগল বরকন্দাজরাও দুর্গের ছাদের বেশ কয়েকজন মারওয়াড়ি বন্দুকধারীকে গুলি ছুঁড়ে মারতে সক্ষম হয়েছিল। কাজেই আবার যখন মোগল অশ্বারোহীরা আক্রমণ করলো তখন উপর থেকে গাদা বন্দুক ছোঁড়ার শব্দ বেশ কমে এসেছিল। তারপরও অশ্বারোহী সেনারা ভাঙ্গা ইট সুরকির স্তূপ, মানুষ, পশু আর আহতদের ডিঙ্গিয়ে ভেতরে ঢুকতে না পেরে আবার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় হানা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হল।

তবে ওরা সামনে এগোবার আগেই ভাঙ্গা দেয়ালের কাছে কমলা রঙয়ের রণবেশ পরা একদল মারওয়াড়ি এসে উপস্থিত হল। কিছু লোক ঘোড়ার পিঠে আর বাকিরা হেঁটে। উপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে আওরঙ্গজেব দেখলেন সেখানে এখন কেউ নেই আর মোগল পদাতিক সেনারা মই থেকে বিনাবাধায় ছাদে নামছিল। তারপর ফটকের ভাঙ্গা পাল্লাটি সরিয়ে আরো কিছু মারওয়াড়ি সেখানে হাজির হয়ে প্রায় সাথে সাথে ভাঙ্গা দেয়ালের পাশে জমায়েত অন্যান্য মারওয়াড়ীদের সাথে মিলে ওরা একযোগে মোগলদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। উদ্যত অস্ত্র হাতে রণহুঙ্কার দিতে দিতে ওরা ছুটে এল। মারওয়াড়িরা পাগলের মতো প্রাণ দিচ্ছিল, আওরঙ্গজেব ভাবলেন, ঠিক একই রকমভাবে অনেক বছর আগে আমু দরিয়ার ওপারে অশোক সিং তার লোকজনসহ প্রাণ দিয়েছিল। মোগল বরকন্দাজ আর গোলন্দাজ সেনারা ছুটে আসা বেশ কয়েকজন মারওয়াড়ি সেনাকে গোলার আঘাতে মাটিতে ফেলে দিল। তবে ওদের কয়েকজন কামানগুলোর মাঝে এসে কয়েকজন তুর্কি গোলন্দাজ সেনাকে বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করলো। তবে এরপর ওরাও মারা পড়লো। ক্রমান্বয়ে মারওয়াড়ি সৈন্যের সংখ্যা কমে এল।

হঠাৎ দশ-বারো জন মারওয়াড়ি অশ্বারোহী সৈন্য সম্রাটের হাতিটি দেখতে পেয়ে আক্রমণ করার জন্য সেদিকে ছুটে গেল। সাথে সাথে মোগল বরকন্দাজরা গুলি ছুঁড়ে কয়েকজনকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিল। যারা জীবিত ছিল, তারা আওরঙ্গজেবের কাছে আসার আগেই তার দেহরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা ঘোড়া ছুটিয়ে, তাদেরকে ঘিরে ধরে সকলকে তরোয়ালের আঘাতে হত্যা করে মাটিতে ফেলে দিল। আওরঙ্গজেব ভাবলেন, এই রাজপুতরা অপরিণত শিশুর মতো কিরকম বিচারবুদ্ধিহীন বোকা।

সেদিন সন্ধ্যায় সর্বাধিনায়কের টকটকে লাল তাবুতে তিনি আর মুয়াজ্জম চুপচাপ বসে ছিলেন। বাইরে ওদের লোকজন আনন্দ উৎসবে মেতেছিল। এই বিজয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এতে মারওয়াড়ের দরজা তার সেনাবাহিনীর সামনে খুলে যাবে। এই একবারের জন্য আওরঙ্গজেব তার সৈন্যদের মদ খাওয়ার দিকে চোখ বন্ধ করে রইলেন, অথচ অন্য সময় এর জন্য তিনি চাবুক মারার শাস্তি দিতেন। তিনি ঢুলতে শুরু করলেন, যতই বয়স হচ্ছে খাওয়া-দাওয়ার পর এই প্রবণতাও বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একজন কোরচি ভেতরে ঢুকতেই তিনি চমকে জেগে উঠলেন। সে বললো, “দিল্লি থেকে একজন কাসিদ একটি বার্তা নিয়ে এসেছে আর তাকে বলা হয়েছে পৌঁছার সাথে সাথে সে যেন বার্তাটি শুধু আপনার হাতে তুলে দেয়।’

আওরঙ্গজেব দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নিয়ে এস তাকে।

কয়েক মুহূর্ত পর কোরচি বার্তাবাহককে ভেতরে নিয়ে এল। দীর্ঘ পথ চলার পরিশ্রমে ঘর্মাক্ত লোকটি আওরঙ্গজেবকে কুর্নিশ করে বার্তাটি তাঁর হাতে তুলে দিল।

দ্রুত ছুটে আসার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। যাও, বাইরে গিয়ে সবার সাথে আনন্দ কর। এটা তেমার পাওনা হয়েছে।

কাসিদ আর কোরচি বের হয়ে যাওয়ার পর আওরঙ্গজেব সিলমোহর ভেঙ্গে চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন। সাধারণত কঠোর চেহারার আওরঙ্গজেবের মুখে মৃদু হাসি দেখা দিল, তিনি বললেন, ‘আনন্দ কর মুয়াজ্জম। শিবাজি জ্বরে ভুগে মরেছে।

 ‘খুশির কথা। এটা আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য বিরাট একটি খবর। তবে সম্ভাজি কি আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে না তো?

‘আমাদের তাই ধরে নিতে হবে। তবে সে তার বাবার মতো তেমন নেতা নয়। কর্তৃত্ব দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে তার সময় লাগবে আর সে হয়তো মারাঠিদের একত্রিত করে রাখতে পারবে না। ঐ নারকী কাফের শিবাজির মৃত্যুতে নিশ্চিতভাবে রাজপুত আর মারাঠিদের আমাদের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে একত্রিত হওয়ার ঝুঁকি দূর হয়ে গেল। আওরঙ্গজেবের মুখে চওড়া হাসি দেখা দিল। সবকিছু তার অনুকূলে ঘটে চলেছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সহায় হয়েছেন।

*

আকবর দুহাতে চোখ আড়াল করে সূর্যের বিপরীতে তাকালেন। ঝিকিমিকি তাপের কুয়াশার মধ্য দিয়ে ছোট্ট মেবারি শহর দেসুরির বাড়িঘরের ছাদ আর দালান-কোঠা দেখা যাচ্ছে। চরেরা খবর দিয়েছে শত্রুসেনারা শহর ছেড়ে চলে গেছে। তার ইচ্ছে এখানে ঘাঁটি করে তার সৈন্যদেরকে বিশ্রাম দেবেন, তারপর মেবারের রানার শক্ত ঘাঁটি কুম্ভগড়ের দিকে এগোবেন। মেবারে তার সমরাভিযান সফল হয়েছে, মেওয়াড়িদেরকে তাদের কেন্দ্রের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন, চলার পথে যেসব জায়গা তিনি দখল করেছিলেন, সেখানে জমি আর সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি যেন কম হয়। তার আশা যে বিদ্রোহ চলছে, তা শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। আর বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে তিনি যেরকম নরম থাকার চেষ্টা করেছেন, তাতে আশা করা যায় যে, মেওয়াড়িদের সাথে বিরোধও হয়তো সহজে মিটিয়ে ফেলা যাবে। তার বাবা যাই ভাবুন, মোগলদের উত্থানে রাজপুতদের সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর তার ধারণা উভয়ের স্বার্থেই তারা আবার মৈত্রিবন্ধনে আবদ্ধ হবেন। তার ফুফু জাহানারারও তাই বিশ্বাস। তিনি মমতাভরে তাকে যেসব চিঠি লিখতেন তাতে প্রায়ই সুফি শিক্ষকদের লেখার উদ্ধৃতি দিতেন যাতে তাদের উভয়ের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয় যে, কিছু সময় পার হলেই রাজপুত আর মোগল–হিন্দু আর মুসলিম সবাই একদিন আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস করবে। কেবল তাদের মনমেজাজ ঠাণ্ডা হতে আর দুঃসময়ের স্মৃতি ম্লান হওয়ার জন্য কিছু সময় প্রয়োজন।

তার কেবল ইচ্ছা হত তার বাবার ঘন ঘন পাঠান বার্তাগুলো যেন তার ফুফুর চিঠিগুলোর মতো একই রকম মনোমতো হোক। আজ সকালেই আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে দীর্ঘ, গুরুগম্ভীর শেষ চিঠিটি এসেছে। চিঠিতে তার বাবা মারওয়াড়ে মুয়াজ্জমের গৌরবময় অভিযানের কথা তুলে ধরেছেন। ছেলের দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে শত্রুকে ধ্বংস করা আর তার যে কোনো ধরনের ভিন্নমত প্রকাশ কঠোর হাতে থামিয়ে দেওয়ার সক্ষমতারও উচ্চপ্রশংসা করেছেন। আবার সেই সাথে মনে হল যেন, আওরঙ্গজেব ধরেই নিয়েছেন যে, মেবারে আকবরের নিজের সমরাভিযানও সফল হবে। নিশ্চিতভাবেই তিনি অবশ্য তার সাফল্যে তেমন প্রশংসা করেন নি, বরং আরো ভালভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন আর তার অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে অহেতুক উপদেশ আর মেওয়াড়িদের প্রতি আরো কঠোর আচরণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন। মারওয়াড়ের সেনাবাহিনীর অধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি এখনও তার মনে পীড়া দিচ্ছে। অন্যান্যের উপদেশ শুনতে আর তাদের সাথে পরামর্শ করতে পছন্দ করেন, এটা নিয়ে তার বাবার তাকে তিরস্কার করাটা সঠিক হয় নি। ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও অন্য সব বিষয়ে আওরঙ্গজেব কেবল তাঁর নিজের মত খাটানোটাই একমাত্র উপায় মনে করতেন। অনেক সময় উপকারী মন্তব্য করলেও তার বাবা সেটাকে রাজবৈরীর কাছাকাছি সমালোচনা মনে করতেন। তিনি চাইতেন তাঁকে সবসময় এমন লোকজন ঘিরে থাকুক, যারা সামরিক কৌশল আর ধর্মীয় গ্রন্থের বিষয়ে তার ব্যাখ্যার সাথে সমভাবে অংশীদার হোক। কোনো বিষয়ে দ্বিতীয়বার ভাবার জন্য কেউ তাকে অনুরোধ করুক, তা তিনি চাইতেন না। এতে তিনি সাম্রাজ্যের অনেক অংশের সাথে যোগাযোগ আর মূল্যবান উপদেশের অনেক উৎসও হারিয়ে ফেলেন।

তারপরও তার আশা, একবার কুম্ভগড় দখল করলেই তার বাবা নিশ্চয়ই তার সদগুণাবলির শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করবেন। তবে প্রথমে তাকে দেসুরি দখল করতে হবে। তাহাব্বুর খান যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তিনি সেখানে এগিয়ে গেলেন। এই সেনা কর্মকর্তাকেই প্রথমে সেনাবাহিনীর মেবার আক্রমণের এই শাখার ভারপ্রাপ্ত সেনানায়ক করে পাঠানো হয়েছিল। আকবরকে তার উপরে দেওয়ায় তাকে অসন্তুষ্ট মনে হয় নি। তবে সেরকম হওয়ারও কোনো কারণ ছিল না। ওরা একে অপরকে সারাজীবন ধরে জেনে এসেছে। তাহাব্বুর খানের মা, শিশুকালে আকবরের স্তন্যদান করার কাজে নিযুক্ত ধাত্রী ছিলেন আর তাই দুজনে দুধ ভাই ছিলেন। অনেক সময় রক্তের বন্ধনের চেয়েও এই সম্পর্ক শক্তিশালী মনে করা হয়। নিশ্চিতভাবে ওরা একে অপরের সঙ্গ পছন্দ করতেন আর ওদের পরস্পরের মাঝে বিশ্বাসের বন্ধনও অটুট ছিল। সর্বোপরি ওদের অভিযানের সফলতায় তাহাব্বুর খানের সামরিক কুশলতার যথেষ্ট অবদান ছিল। আকবর তার বাবাকে নিয়মিত যে খবর পাঠাতেন তাতে মুক্তকণ্ঠে একথা জানাতেন।

আকবর জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা কী দেসুরিতে ঢুকতে পারবো?

‘হ্যাঁ পারবো। অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য কেউ কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। কি-না কিংবা এ ধরনের আর কিছু দেখার জন্য আমি চর পাঠিয়েছিলাম। ওরা কিছুই খুঁজে পায়নি–মেওয়ারি সেনাদের কোনো চিহ্নই কোথাও নেই।

 ‘খুব ভাল। তাহলে চল আমরা এগোই।’

এক ঘণ্টার একটু আগে ওরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে ভোলা ফটক দিয়ে দেসুরি শহরের মধ্যখানে ধূলিধূসর একটি খোলা ময়দানে পৌঁছলো। জায়গাটি জনমানব শূন্য, কেবল দুটো পথের কুকুর ছায়ায় বসে জিহ্বা বের করে নিজেদের শরীর চাটছে। ওদের অগ্রগতির সফলতায় ওরা দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। হঠাৎ আকবরের মনে হল তার বাবা কিংবা তার পরিবারের অন্যান্য পুরুষ সদস্যের তুলনায়, তাহাব্বুর খানের সাথে তিনি অনেক সচ্ছন্দবোধ করেন।

তিনদিন পর আকবর দেসুরির খালি পড়ে থাকা সবচেয়ে বড় বাড়িটির উঁচু ছাদের একটি কামরায় একটি নিচু পালঙ্কে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এখানেই তিনি তার সদর দফতর স্থাপন করেছেন। কামরাটির দেয়ালগুলোতে উজ্জ্বল লাল, হলুদ আর কমলা রঙয়ের পর্দা টাঙানো ছিল। এই রঙগুলো রাজপুতদের খুব প্রিয়। কামরার তিন কোণায় কুলুঙ্গিতে আয়না ঘেরা কাঁচের বাতিদানে মোমবাতি জ্বলছিল। আর চতুর্থ কোণে একটি হিন্দু দেবতার মূর্তি ছিল। আকবর তার পরিচারকদের এটা নষ্ট করতে কিংবা এর সামনে উৎসর্গ করা ধূপ। আর সামনে ছড়িয়ে থাকা শুকিয়ে যাওয়া গাঁদা ফুলগুলো সরাতে নিষেধ করেছিলেন। কোরচি ঢুকতেই তিনি উঠে বসলেন।

জাহাপনা, মেবারের রানার কাছ থেকে যুদ্ধবিরতির পতাকা নিয়ে একজন দূত এসেছে।

আকবরের মন নেচে উঠলো। একজন রাজদূত কেবল শান্তি চুক্তির শর্ত আলোচনা করার জন্য আসতে পারে–যে শান্তির জন্য তিনি নিজে অতি উৎসাহী ছিলেন। অন্যায্যভাবে কঠোর হবেন না।

তিনি বললেন, “তাহাব্বুর খান আর অন্যান্য জ্যেষ্ঠ সেনা নায়কদের এখানে আসতে বল, তারপর আমি দূতের সাথে কথা বলবো।

কোরচি বললো, “জাহাপনা, সে বলেছে; রানা তাকে পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছেন, সে যেন একা আপনার সাথে দেখা করে।’

 ‘কেন তা কি বলেছে?

না। তবে সে আমাকে বিশেষভাবে বলেছে রানা ব্যক্তিগতভাবে তাকে এই নির্দেশ দিয়েছেন।’

আকবর প্রথমে ভেবেছিলেন প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বিশেষ করে তাহাব্বুর খানের কাছে কোনোকিছু গোপন করতে চান না। তবে এমনও হতে পারে, রানার আত্মসম্মান এত বেশি যে, আনুষ্ঠানিক আলোচনা করার আগে সম্ভাব্য শর্তের বিষয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাকে বাজিয়ে দেখতে চান।

“ঠিক আছে। তাকে বল আমি একান্তে তার সাথে দেখা করবো। তারপর একটা কথা মনে পড়তেই তিনি বললেন, তবে তাকে বলবে, তার সাথে কোনো অস্ত্র আছে কি-না তা দেখার জন্য আমার কাছে আসার আগে তার দেহতল্লাসী করা হবে।’

আধঘণ্টা পর রাজপুত দূত এল। দীর্ঘদেহী সাদা গোঁফওয়ালা একজন লোক। পঞ্চাশের উপর বয়স, সুন্দরভাবে মাথায় কমলা রঙয়ের পাগড়িপরা, গায়ে জ্যাকেট আর সাদা পাতলুন পরা লোকটিকে পথ দেখিয়ে আকবরের কোরচি ভেতরে নিয়ে এল। ভেতরে এসে সে মাথা নুইয়ে শাহজাদাকে সম্মান দেখাল। কোরচি কামরা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর প্রথমে আকবর কথা বললেন, ‘রানার একজন দূত হিসেবে আমি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমাদের মধ্যে। এখন বিরোধ চললেও আমি তার এবং তার লোকজনের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলি নি।

‘একথা শুনলে তিনি অবশ্যই খুশি হবেন, জাহাপনা।

‘এখন বলুন, কেন তিনি আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন।

 তিনি আমাকে কিছুই বলতে বলেন নি, শুধু এই চিঠিটা আপনার হাতে দিতে বলেছেন। এটা পড়ার পর আপনি যদি কোনো উত্তর দিতে চান, তা ফেরত নিয়ে আসতে বলেছেন। এই কথা বলে সে তার পোশাকের ভেতর থেকে একটি সিলমাহর করা কাগজ বের করলো।

 ‘কেন তিনি চাননা যে আমি আর আপনি আমাদের দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা করি?

সত্যি বলতে কী, তিনি মনে করেন আপনার বাবার সাম্রাজ্যে দেয়ালেরও কান আছে। এর বেশি আমি কিছু বলতে পারি না।’

আকবর ভ্রু কুঁচকালেন। এই চিঠির বিষয়বস্তু কি হতে পারে? এটা জানতে চাইলে তাকে দূতের প্রস্তাবে রাজি হতে হবে। এটা না করার কোনো কারণ তিনি পেলেন না। ঠিক আছে। চিঠিটা দিন। আমার লোক শহরের আরামদায়ক কোনো জায়গায় আপনার থাকার ব্যবস্থা করবে। তবে আশা করি আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, সেখান থেকে আমি আপনাকে বের হবার অনুমতি দেবো না। কারণ সে চেষ্টা করলে আপনি আমার সেনাবাহিনী আর অস্ত্রসম্ভার দেখে ফেলবেন।

‘আমি বুঝেছি, জাহাপনা। আমি অপেক্ষা করবো, যতক্ষণ না আপনি কোনো ধরনের উত্তর দিতে ইচ্ছা করেন।

দূতের চলে যাওয়ার পর আকবর সিলমোহর ভেঙ্গে চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন। চিঠিটা পড়তে পড়তে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল আর হৃৎ স্পন্দন দ্রুত হতে লাগলো।

*

আমি এই চিঠিটি লিখছি গভীর দুঃখ নিয়ে, কেননা আমরা যে যুদ্ধ করছি সে যুদ্ধ মেবারের সৃষ্টি নয়। কেন আমরা আমাদের নিজেদের মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছি, যারা দীর্ঘকাল যাবত শত্রু নয় মিত্র ছিল? আমার মনে হয় আপনি আমার অনুভূতির অংশীদার হবেন আর আশা করবো আমাকে অতিবিশ্বাসী ভাববেন না, যদি বলি যে, আপনার নামটি সঠিক হয়েছে। আপনার মতো একই নামের এবং আপনার মহান পূর্বপুরুষ সম্রাট আকবর, যার স্মৃতি চিরদিন হিন্দুস্তানে অম্লান থাকবে, তাঁর মতোই আপনার পরাক্রম আর ন্যায়বোধ সুবিদিত। মহান আকবর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানি লোকের বন্ধু ছিলেন। হিন্দু প্রজাদের বিরুদ্ধে আরোপিত ঘৃণ্য আইন বিলোপ করে তিনি তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। আমি শুনেছি আপনার বাবা ঐ আইনের অনেক আবার চালু করায় আপনি অখুশি হয়েছেন।

মহান আকবর রাজপুত রাজ্যগুলোর একজন বিশেষ বন্ধু ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মোগলদের মতো রাজপুতরাও একটি যোদ্ধা জাতি। তিনি আমাদেরকে তাঁর সেনাবাহিনীর নের্তৃত্বের পদে বসিয়েছিলেন। আমাদের রাজকুমারিদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আপনার শরীরেও রাজপুত রক্ত বইছে। আপনার প্রপিতামহ ম্রাট জাহাঙ্গির একজন রাজপুত রাজকুমারির গর্ভজাত সন্তান ছিলেন, যেরকম ছিলেন আপনার পিতামহ সম্রাট শাহজাহান। আমি নিশ্চিত আপনি এগুলো বুঝতে পারছেন আর মনে মনে আপনি মোগল এবং অন্যান্য রাজপুত রাজ্যগুলোর মধ্যে শান্তি চান, ঠিক যেরকম আমিও চাই। তবে নিয়তির কী পরিহাস, অনেক রাজপুত শাসক বলে থাকেন যে, আজ আপনার বাবা আওরঙ্গজেব সিংহাসনে বসে আছেন, অথচ সে জায়গায় আপনি থাকলে সূর্য, চন্দ্র এবং তারার সন্তানদের মাঝে ন্যায়বিচার আর ঐক্য এনে সম্রাট আকবরের মতো গৌরব ও ন্যায়ের সাথে রাজত্ব করতে পারতেন। আমি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে লিখছি আর আশা করি যে, আপনি আমার সাথে দেখা করতে রাজি হবেন, যাতে আমরা আলাপ-আলোচনা করে আমাদের মধ্যে যে বিভক্তি আছে তা দূর করে সবার ভাগ্য উন্নত করার সর্বোত্তম একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারি। আপনার কাছ থেকে একটি উত্তর পাওয়ার জন্য আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি, যাকে সম্প্রতি আমি শত্রুর বদলে একজন বন্ধু মনে করছি। আমার বিশ্বাস বিপর্যয় থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে যদি তিনি তা প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমি তাই মনে করবো।

*

আকবর বারবার চিঠিটা পড়লেন। সম্রাট আকবরের সাথে তুলনা করার আনন্দ আর রানার শেষ বাক্যটিতে বিদ্রোহের উত্তেজনা, এ দুইয়ের মিশ্রণ রয়েছে। আচ্ছা রানা কি একথার ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, ওরা দুজনে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে আকবরকে সিংহাসনে বসাবেন? কথায় তা পরিষ্কার প্রকাশ না করলেও, অর্থটি তাই দাঁড়ায় আর দূত যে চরম গোপনীয়তার প্রতি জোর দিয়েছিল, তারও একটা ব্যাখ্যা এতে পাওয়া যায়। এমনকি প্রস্তাবটি বিবেচনা করার বিষয়ে তার নিজের ইচ্ছা দেখে আকবর অবাক হয়ে গেলেন। রানা মনে করেন, তিনি আওরঙ্গজেবের চেয়ে ভালোভাবে সাম্রাজ্য শাসন করতে পারবেন আর তার বাবা যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছেন তা সংশোধন করতে পারবেন…কিন্তু আসলেই কি তা পারবেন? তবে মনে মনে বিশ্বাস করলেও তার নিজের ইচ্ছার বিষয়ে এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণের কথা তিনি কখনও ভাবেন নি। তবে তিনি কিভাবে নিশ্চিত হবেন যে, রানার কথাগুলোর মানে আসলে এই? আরো কথা হল, মোগল সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী আর সভাসদদের সমর্থন পাবেন, একথা ভেবে কি নিজের সাথে প্রতারণা করছেন না তো? কোনোভাবেই তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না…আরেকটি মতামতের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে দুধভাই তাহাব্বুর খান ছাড়া আর কে ভালো হতে পারে?

 আধঘণ্টা পর তাহার খান শান্তভাবে বললো, আমিও একমত যে, এই চিঠিতে মনে হচ্ছে আপনার বাবার বিরুদ্ধে একটি মৈত্রী করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ওরা দুজনে একা শহরের দেয়ালের চারদিকে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বেড়াতে আলাপ করছিল। ভেবেচিন্তে ওরা ঠিক করেছিল এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে খোলা জায়গায় ঘোড়ায় পিঠে বসে কথা বলাই সবচেয়ে ভালো হবে।

 ‘তোমার কী মনে হয়, এ-বিষয়ে আমার কী করা উচিত?

 ‘আমার মনে হয় সবার আগে আপনাকে বিবেচনা করতে তবে, রানা আপনার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছে কি-না। একটা ষড়যন্ত্রের মধ্যে আপনাকে টেনে নিয়ে, সে ব্যাপারটা আপনার বাবার কাছে ফাঁস করে দিয়ে আপনাকে আর অভিযানকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

আকবর বললেন, তিনি একজন সম্মানীয় লোক। আমার বিশ্বাস হয় না এরকম একটা কাজ তিনি করতে পারেন। এখন তার মনে যে সন্দেহের সুতা দানা বেঁধে উঠছে তার সাথে মনে যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা একসময় জেগে উঠেছিল এই দুইয়ের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চেপে রাখা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তারপর আবার বললেন, তোমার কী মনে হয় আমি যদি বাবার বিরুদ্ধে যাই তাহলে কী কোনো ধরনের সমর্থন পাবো?

তাহাব্বুর খান কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে বললো, আমার বিশ্বাস আপনি পাবেন। আমি জানি আপনি আমার সমর্থন পাবেন। তবে তাড়াহুড়া করাটা ঠিক হবে না।

‘আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ, তাহাব্বুর খান। সামরিক বিষয়ে তুমি অনেক সময় আমাকে সঠিকভাবে সতর্ক করেছ। তবে এখন যদি কোনো ব্যবস্থা না নেই। তাহলে আর হয়তো কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে না। অন্তত রানার সাথে দেখা করতে রাজি হয়ে দেখি না, তিনি কী বলতে চান?

আর আপনার অতি-সন্দিগ্ধ বাবা যদি সাক্ষাতের কথাটা জেনে যান? সব জায়গায় তাঁর গুপ্তচর ছড়িয়ে আছে। আমরা জানি তিনি আপনার সদর দফতরে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন–ইকবাল বেগ আর হানিফ খান, এদুটো নাম করা যায়। এদের কাজ হচ্ছে কেবল সব খবর তাঁকে জানানো। আপনি কি আপনার সবচেয়ে বড় ভাই মোহাম্মদ সুলতানের দুর্ভাগ্যের অংশীদার হতে চান? বাকি। জীবন কারাগারে কাটিয়ে সেখানেই মৃত্যু বরণ করতে চান?

আকবর একটু ভাবলেন। চতুর্দিকে ছড়ানো তার বাবার গুপ্তচরের জালের কথা তাহাব্বুর খান ঠিকই বলেছে। তারপর একটা ধারণা তার মাথায় এল–যা ভেবে তিনি নিজেকে সাবাস দিলেন, এমনকি তার বাবার মতো চতুর এবং সূক্ষ্মবুদ্ধির মানুষও এই পরিকল্পনাটার কথা ভেবে গর্ব বোধ করতেন। আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ রানার এই চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানে না। তবে অনেকে জানবে যে, একজন মেওয়ারি দূত এসেছে আর তার আসার কারণের বিষয়টি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করবে। আমি চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলবো আর সকলে জানবে যে, আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে আলোচনা করার জন্য রানা আমার সাথে সাক্ষাৎ করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারপর আমি বাবাকে লিখে জানাব যে, আমি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে রাজি হয়েছি। এতে তার কাছে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না আর এদিকে রানার সাথেও গোপনে সাক্ষাৎ করার প্রয়োজন হবে না।’

এক মুহূর্ত পর তাহাব্বুর খান মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো, এতে কাজ হতে পারে। আর যে পুরস্কার পাওয়া যাবে তার কারণে বাকি ঝুঁকি নেওয়া যেতে পারে।

আধঘণ্টা পর আকবর তার কামরায় ফিরে রানাকে উদ্দেশ্য করে লেখা ছোট চিঠিটা সিলমোহর করলেন। এতে শুধু দেখা করার জন্য তিনি রাজি একথা বলা হয়েছে, কি উদ্দেশ্য সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয় নি। এই চিঠিটা তার বাবার হাতে পড়লেও আর এর বিষয়স্তু পড়লে কোনো ক্ষতি হবে না, কেননা এর আগেই আওরঙ্গজেব তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা অন্য চিঠিটাও পেয়ে যাবেন, যাতে আকবর লিখেছেন যে, আত্মসমর্পণের শর্ত আলোচনা করার জন্য একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুটো চিঠিই জায়গামতো পাঠাবার জন্য কোরচির হাতে দিয়ে আকবর কামরাটির এককোণে একটি আয়না লাগানো কুলুঙ্গির কাছে গেলেন যেখানে একটি মোমবাতি জ্বলছিল। সেখানে তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা রানার চিঠিটা জ্বলন্ত মোমবাতির শিখায় পোড়ালেন। তারপর পুরোপুরি এটা নষ্ট নিশ্চিত করার জন্য পোড়া ছাইগুলো মাটিতে রেখে জুতার তলি দিয়ে পিষলেন। তারপর তিনি বুঝতে পারলেন যে, তিনি তার বাবার শাসনের বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু করা পরিকল্পনা করছেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *