০৯. ভূতের রাজ্য

০৯. ভূতের রাজ্য

গরম এত তীব্র ছিল যে, চামড়ার হাওদার ছাউনির ছায়ার নিচে থেকেও আকবরের মাথা টন টন করছিল। সেই একঘেয়ে কমলা রংয়ের মরুভূমি, সবুজ পাতা কিংবা ফুলের এতটুকু চিহ্ন নেই। তার কাছে মোটেই আকষর্ণীয় মনে হচ্ছে না। ২০,০০০ সেনার শক্তিশালী একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে মারওয়াড়ে এসেছে–দুই সপ্তাহ হল। এই দুই সপ্তাহের মাঝে মোগলরা একটিও গুলি ছুঁড়েনি কিংবা একবারও তরোয়াল খাপ থেকে বের করতে হয়নি। বরং মনে হচ্ছে যেন ওরা একটি ভূতুড়ে রাজ্যে এসে পড়েছে প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি মাটির কেল্লা পরিত্যক্ত, প্রত্যেকটা কূপ পাথর দিয়ে ভর্তি। একমাত্র জীবিত প্রাণী বলতে কয়েকটা নেড়ি কুকুর আর কিছু ময়ূর নিচু ধূলিময় গাছের ডালে বসে পেখম ঝাঁপটে আতঙ্কিত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করছে। তবে শীঘ্রই তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে মারওয়াড়ের শাসকদের শত শত বছর ধরে গর্ব বিশাল মেহরানগড় দুর্গে পৌঁছে যাবেন। মূল মারওয়াড়ি সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই সেখানে অবস্থান নিয়ে রয়েছে। আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে চারদিন আগে তিনি দূত পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ওরা দূতকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল। মারওয়াড়িরা কি পরিকল্পনা করছে? দুর্গের দেয়ালের নিচে তার সাথে লড়াই করবে নাকি তাকে বাধ্য করবে দুর্গ অবরোধ করার? সম্ভবত শেষেরটাই হবে–তবে ওদেরকে উৎখাত করতে অনেক মাস ধরে অবরোধ চলবে…

 ঘণ্টাখানেক পর আকবরের যুদ্ধহস্তিটির পা নরম বালুর গভীরে ডেবে যেতেই হাতিটি এমনভাবে দুলে উঠলো যে, তাকে হাওদার দুপাশের কারুকাজ করা কিনারা আঁকড়ে ধরে তাল সামলাতে হল। কয়েকটি বালিয়াড়ির চূড়ার পর দূরে মেহরানগড় দেখা গেল। ঝিকমিক করা কুয়াশার মধ্য দিয়ে ঠিক বুঝা যাচ্ছিল এর চূড়াটি কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে আর কোথা থেকে দুর্গের খাড়া ধূসর দেয়াল শুরু হয়েছে। এমন সময় ঘোড়া ছুটিয়ে একজন মোগল চর এসে তার সামনে হাজির হল। তার ঘোড়াটি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল।

লোকটি বললো, “জাঁহাপনা, ছয়জনের একটি দল ঘোড়া ছুটিয়ে মেহরানগড়ের দিক থেকে সমতল ভূমি পার হয়ে আমাদের দিকে আসছে। প্রায় বালিয়াড়ির গোড়ার কাছে পৌঁছে গেছে, তবে এখান থেকে আপনি ওদেরকে দেখতে পাবেন না। আমরা কি ওদের বাধা দেবো?”

 ‘আমি নিজে একবার ওদেরকে দেখতে চাই। একটা ঘোড়া নিয়ে এসো।’ কয়েকমিনিট পর তামাটে রঙয়ের একটি ঘোড়ায় চড়ে দুজন দেহরক্ষীসহ আকবর চরের পেছন পেছন বালিয়াড়ির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললেন। তারপর ওরা একটি পাহাড়ের আড়ালে এসে পৌঁছে দেখলেন আরো তিনজন মোগল চর সামনে উঁকি দিচ্ছে। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দ্রুত আকবর তাদের সাথে যোগ দিলেন। ওদের একজন বললো, “ঐ যে দেখুন জাহাপনা।

আকবর তার আঙুলের নির্দেশ বরাবর তাকালেন। হ্যাঁ, তাদের প্রায় ঠিক নিচে অশ্বারোহী দলটি বালিয়াড়িতে উঠতে শুরু করেছে। ওরা নিশ্চয়ই জানে তার সেনাবাহিনী অন্য পাশে রয়েছে…ধুলার মেঘ অবশ্য অনেক দূর থেকে দেখা যায়। ওরা কি চাচ্ছে? তিনি সতর্কদৃষ্টিতে ওদেরকে লক্ষ করলেন। লোকগুলোর গায়ের জামা বিবর্ণ কমলা রঙের, প্রায় বালুর মতো একই রং। এত কম লোকের সাথে লড়াই করা যায় না আর যেহেতু ওরা মোটেই নিজেদেরকে লুকাতে চেষ্টা করছে না, তার মানে গুপ্তচর হওয়ার সম্ভাবনাও কম। ওরা হয়তো আলাপ আলোচনা করতে এসেছে। আকবর বললেন, ‘ওরা মারওয়াড়ি, আমি নিশ্চিত। তারপর একজন চরের দিকে ঘুরে বললেন, “আমার মনে হয় ওরা কথা বলতে এসেছে। তবে নজর রাখবে আর যদি সন্দেহজনক কিছু দেখো তাহলে সাথে সাথে খবর পাঠাবে। এমনও হতে পারে আমাদের মনোযোগ অন্যদিকে সরাবার জন্য ওদেরকে পাঠান হয়েছে, যাতে মূল সেনাদল আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। তবে সেরকম আমার মনে হচ্ছে না–কেননা যদি ওদের সেনাবাহিনী আমাদের কাছাকাছি হবার চেষ্টা করে, এই অবস্থান থেকে আমরা সহজেই ওদের দেখতে পাবো।

মাথা ব্যথার কথা ভুলে গিয়ে আকবর মূল সেনাদলের কাছে ফিরে গিয়ে ছোট একটি দল পাঠালেন শত্রুর অশ্বারোহী দলটিকে নিরস্ত্র করে তার কাছে নিয়ে আসতে। তারপর আবার হাতির পিঠে চড়ে প্রচণ্ড গরমে ঘামতে ঘামতে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আধ ঘণ্টা পর তার লোকেরা মারওয়াড়িদেরকে নিয়ে ফিরে এল। বালিয়াড়ির উপর চড়ার পরিশ্রমে ওদের চমৎকার কালো ঘোড়াগুলোর নাক দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। ওদের হাতে ছুরি, তরোয়াল, বল্লম কিছুই নেই, সব তার লোকেরা ওদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। তারপরও বুঝা যাচ্ছে এরা যোদ্ধা। এখন ওরা বালুর উপর ছড়িয়ে দাঁড়াতেই ওদের হাঁটা, চলা, দাঁড়াবার ধরন দেখেই তা বুঝা যাচ্ছে। আকবর বললেন, “আমি আকবর, সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র। তোমরা কে আর কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছ?

অশ্বারোহীরা একে অন্যের দিকে তাকাল। অন্যদের চেয়ে একজনের পরনে ছিল দামি পোশাক, গলায় ভারী সোনার হার ঝুলছিল এবং কানে সোনার দুল। সে বললো, আমরা মারওয়াড়ের বিশেষ দূত। আপনি যে দাবি করেছেন তার জবাব নিয়ে আমরা এসেছি, আমরা আমাদের দুর্গসহ আত্মসমর্পণ করছি। জিনের সাথে ঝুলানো একটি রেশমি কাপড়ের থলে থেকে সে একটি ভাঁজ করা কাগজ বের করলো। তারপর আকবরের ইশারা করতেই একজন কোরচির হাতে তুলে দিল।

আকবর চিঠিটা নিয়ে মোমলাগানো সিলমোহরটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন : একজন রাজপুত যোদ্ধাকে পিঠে নিয়ে একটি ঘোড়া পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে রয়েছে। তারপর সিলমাহরটি ভাঙ্গলেন। তিনি আশা করেছিলেন চিঠির ভাষা হবে, অবাধ্যতা, এমনকি অপমানজনক। তবে বার্তাটি ছিল চমৎকার ফার্সিতে লেখা সহজসরল, আপনি দুর্গ চেয়েছেন। ইচ্ছা করলে তা দখল করে নিন। এটা এখন আপনার। নিচে সই করেছে, দুর্গাদাস রাথোর, মারওয়াড়ের রাজপ্রতিভূ। মারওয়াড়িরা অভিজাতরা আসল রানি হাদির ছেলেকে রাজা করে, সে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত দুর্গাদাসকে তার রাজপ্রতিভূ নিযুক্ত করেছে। মারওয়াড়ের হয়ে কেউ তার চেয়ে বেশি অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারে না।

 “তোমরা চিঠিতে কী লেখা আছে, তা জান?’ লোকগুলো মাথা নেড়ে সায় দিল।

‘শুধু এই বার্তা নিয়ে এসেছ? আর কোনো বার্তা নেই?

কানের সোনার দুলপরা লোকটি বললো, আর কিছুই নেই।

 “ঠিক আছে। দুর্গাদাসকে বল আমি দুর্গসহ তার আত্মসমর্পণের প্রস্তাব গ্রহণ করলাম। আর আশা করি অতি শীঘ্রই মারওয়াড়ের সেনাবাহিনীও আত্মসমর্পণ করবে, যাতে সবার ভালো হবে আর আমরা এই রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারি। আমার লোকেরা তোমাদেরকে সমতল ভূমি পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে তোমরা তোমাদের অস্ত্র ফিরে পাবে আর কোনো বাধা ছাড়াই চলে যেতে পারবে।

মারওয়াড়িরা ঘোড়ায় চড়ে চলে যেতেই তার বাবার কথাগুলো আকবরের মনে পড়লো: শত্রুর মনে নিজেকে ঢোকাও। নিঃশর্তভাবে মারওয়াড়িরা কেন তাদের প্রধান দুর্গটি ছেড়ে দিল? এর মানে কি শুরু হওয়ার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে? এভাবে মুখের কথায় মেহরানগড় ছেড়ে দিয়ে তাকে এত সহজে বোকা বানানো যাবে না। তিনি নিজে তার অধিকাংশ লোক নিয়ে এখানে থেকে প্রচুর বরকন্দাজসহ একটি শক্তিশালী অগ্রবর্তী দল সামনে পাঠাবেন। সমতল ভূমি পার হতে গিয়ে কোনো প্রতিরোধের সামনে না পড়লে আরো সামনে এগিয়ে দুর্গে ঢুকে পুরোপুরি তল্লাসি চালাবে।

বালিয়াড়ির একটি সুবিধামত জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি লক্ষ করলেন ঘণ্টাখানেক পর অগ্রবর্তী দলটি পাহড়ের গোড়ায় পৌঁছেছে। তারপর আঁকাবাঁকা খাড়া পথ বেয়ে চারশো ফুট উচ্চতায় দুর্গের দিকে উঠতে শুরু করেছে। দুর্গের বুরুজ থেকে কামানের গোলার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ কিংবা গাদা বন্দুকের শব্দ শোনার জন্য তিনি অপেক্ষা করে রইলেন, তবে একটু পরই দুর্গ-প্রাচীর হতে আগে থেকে নির্ধারিত করা দশটি জ্বলন্ত মশালের সঙ্কেত দিয়ে তার লোকেরা জানাল যে, দুর্গ দখল করা হয়েছে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই স্নিগ্ধ বাতাস বইতে শুরু করলো, আকবর তখনও হাতির পিঠে বসা অবস্থায় দুর্গের দুতলা সিংহ দুয়ারের দিকে এগিয়ে চললেন। দুর্গাদাসের সিলমোহরের মতো এখানেও দরজার উপরের পাথরের চৌকাঠের উপর অশ্বারোহীসহ একটি তেজস্বী ঘোড়ার মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। পাথরের কাজগুলো দেখে মনে হল বেশ প্রাচীন। কয়শো বছর ধরে মারওয়াড়িরা এই রাজ্য শাসন করে এসেছে? মোগলরা হিন্দুস্তানের শাসক হওয়ার অনেক আগে থেকে হবে নিশ্চয়ই…।

 দ্বিতীয় আরেকটি ফটকের নিচ দিয়ে যাওয়ার পর আকবর তার বাম পাশে সাদা চুনকাম করা একটি দেয়াল দেখতে পেলেন। দেয়ালটির উপর এক সারি ছোট ছোট লাল হাতের ছাপ দেখা যাচ্ছে। এগুলো কি তিনি জানেন–এগুলো হচ্ছে বিধবা রাজমহিষীদের হাতের ছাপ। স্বামীর চিতায় সহমরণে যাওয়ার পথে ওরা এই ছাপ রেখে যান। একে বলা হয় সতি। যশবন্ত সিংয়ের মৃত্যুর পর সন্তান সম্ভব না হলে হাদি আর শিল্পারও কী একই নিয়তি হত? ছোটবেলায় তিনি একটি কাহিনী শুনেছিলেন, কিভাবে তার মতো একই নামের সম্রাট আকবর যখন শুনতে পেলেন, ফতেহপুরে একজন বিধবাকে স্বামীর চিতায় পোড়ানো হবে, তখন তিনি সাথে সাথে ঘোড়ায় ছুটিয়ে সেখানে গিয়ে মহিলাটিকে উদ্ধার করেন।

ছায়াঘেরা পাথর বসানো পায়ে চলা পথসহ উঠান আর মাথার উপরের কারুকাজ করা বেলকনিতে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আকবর হাতির পিঠে চড়ে বেলেপাথরের দুর্গের মধ্যখানে এসে উপস্থিত হলেন। ভারী কংক্রিটের দেয়াল, শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে তীক্ষ্ণ খাঁজকাটা। আর হাতি যাতে ফটক ভেঙ্গে ঢুকতে না পারে, তাই ফটকের উপর তীক্ষ্ণ খুঁটা বসানো হয়েছে। আরেকটি ফটকের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর তিনি একটি খোলা জায়গায় এসে পৌঁছলেন, যার চারদিকে সুন্দর কয়েকটি চৌকোণা ঘর রয়েছে। এগুলো নিশ্চয়ই রাজার থাকার ঘর।

 যে ঘরে যশবন্ত সিং থাকতেন, সে ঘরে এসে স্থিত হওয়ার পর আকবর শরীর মন শিথিল করার চেষ্টা করলেন। মেহরানগড় তার অধীনে এসেছে, তাসত্ত্বেও তিনি মন থেকে এই চিন্তাটা ঝেরে ফেলতে পারছিলেন না যে, কোনো না কোনোভাবে হোক মারওয়াড়িরা আবার হয়তো নতুন কোনো ফন্দি এঁটে তাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করছে। আর আগের মতোই তিনি অন্ধ হয়ে রয়েছেন, তা দেখতে পাচ্ছেন না। দীর্ঘদিন ধরে মেহরানগড় অবরোধ করতে হবে ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। আর এখন হয়তো তাকে অবরোধ করে ফেলবে এ চিন্তায় তাকে উদ্বিগ্ন হতে হবে। কিন্তু তা হতে পারে না। কেবল পাঁচহাজার সৈন্য দুর্গে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। বাকি সেনারা পাহাড়ের গোড়ার চারপাশে শিবির স্থাপন করেছে। জানালা দিয়ে দেখলেন বাইরে অসংখ্য চুলার আগুন অন্ধকার ভেদ করে জ্বলছে। তিনি পাহাড় ঘিরে তিনগুণ পাহারা আর খুঁটির বেড়া বসাতে নির্দেশ দিলেন। না, এবার মারওয়াড়িরা এখানে তাকে আর চমকে দিতে পারবে না।

তাহলে ওরা কি করতে চাচ্ছে? আগামীকাল আরো কয়েকজন চর পাঠাবেন; পাহাড়ের নিচে চারদিকে এলোমেলোভাবে যে মাটির ঘরগুলো রয়েছে, সেখানে হয়তো কেউ এখনও আছে, যে হয়তো কোনো খবর দিতে পারে। তারপর তার কয়েকজন বুড়ো কর্মচারীর কথা মনে পড়লো, যারা তাদের দুর্বল শরীরের কারণে দুর্গেই থেকে গিয়েছে। এদের মধ্যে কেউ হয়তো মারওয়াড়ি সেনাবাহিনী কোথায় আছে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারে। দরজার কাছে গিয়ে তিনি একজন কোরচিকে ডেকে বললেন, আমি শুনেছি কয়েকজন মারওয়াড়ি চাকর এখানে আছে। ওদেরকে এখানে ডেকে আন।

 তিনজন বুড়ো লোককে সাথে নিয়ে কোরচি ফিরে এল। কুঁচকানো মুখের লোকগুলোকে ভীত মনে হচ্ছিল। আকবর বললেন, ‘ভয় পেয়ো না। তোমরা কারা বল?

 সবচেয়ে বুড়ো লোকটি উত্তর দিল। লোকটির পিঠ এতো কুঁজো যে, কেবল চার ফুট হবে সে লম্বায়। কচ্ছপের মতো সামনে গলা বাড়িয়ে সে হাতির দাঁতে বাঁধানো একটা লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে বললো, আমরা যশবন্ত সিংয়ের কর্মচারী। বেশি বয়সের কারণে অক্ষম হয়ে পড়ার পর আর কাজ করতে পারি নি। তিনি আমাদেরকে দুর্গে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমরা এখানে খাবার আর ভাতা পেয়ে থাকি।

যদি আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দাও, তবে দেখবে যে আমিও একজন দয়াশীল মানুষ।

আকবরের কথা শুনে কচ্ছপের মতো গলা যে লোকটির, সে তার সঙ্গীদের দিকে তাকাল। লম্বা, হাড় জিরজিরে একটি লোক, ঢিলা করে পরা বিশাল একটি লাল পাগড়িতে তার মাথা প্রায় ঢাকা পড়েছিল। ছানি পড়া চোখে সে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিল না। সে বললো, আমি এককালে আমার প্রয়াত প্রভুর পেয়াদা ছিলাম। আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করতে পারি।’

‘আমি শুধু জানতে চাই মারওয়াড়ি সেনারা কোথায় আছে?’ প্রশ্নটি করলেও আকবর ভাবলেন তিনি খামাখা প্রশ্নটি করলেন। কিছু জানলেও বুড়ো লোকটি কেনই বা এমন কথা বলবে, যাতে তার স্বজাতির ক্ষতি হতে পারে।

তবে আকবর অবাক হলেন, যখন লোকটি দাঁতহীন মাড়ি বের করে হেসে বললো, তাহলে আপনি জানতে চান আমাদের সৈন্যরা কোথায় আছে? একটু পরই তো আপনি তাদেরকে খুঁজে পাবেন, কাজেই এখনই তা বললে ক্ষতি কী? ওরা সবাই আরাবল্লি পাহাড়ে চলে গেছে–সমস্ত সৈন্য আর তাদের পরিবার। সাথে রাজকোষের সমস্ত ধনদৌলত নিয়ে গেছে।…আপনি একটি খালি দুর্গ দখল করেছেন, তবে মারওয়াড় পান নি।’ বুড়ো লোকটি জিহ্বা দিয়ে চুকচুক আওয়াজ করলো।

 আবার যখন একা হলেন, তখন গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। তার বাবাও আগে থেকে একথা ভাবেন নি। রাজপুতদের গোয়ার্তুমি আর বৃথা সাহসিকতা সম্পর্কে আওরঙ্গজেব যা দাবি করতেন, তার বিপরীতে মারওয়াড়িরা একান্ত বাধ্য না হলে যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিতে মোটেই ইচ্ছুক মনে হচ্ছে না। অদৃশ্য একটি শত্রুকে তিনি কিভাবে পরাস্ত করবেন? তার বাবার সমালোচনামুখর চেহারাটা মনে পড়ে গেল…শুনতে পেলেন তার ব্যর্থতায় তাকে অপমানজনক কথা বলছেন। না, তাকে পাহাড়ে গিয়ে মারওয়াড়িদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।

*

মেঘ শূন্য আকাশের সূর্য ওদের উপর প্রচণ্ড তাপ ছড়াচ্ছিল আর আকবরের চোখ বেয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝরছিল। দুই মাইল লম্বা কাফেলার একেবারে শেষ মাথায় মালবাহী উটগুলোর ফোঁস ফোঁস করে দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ ধীরে ধীরে তার কানে কমে এল। তিনি পেছনে এসে দেখছিলেন মালপত্র নিয়ে পশুগুলো ঠিকমতো তাদের পিছু পিছু আসছে কি-না। খুশি হলেন দেখে যে, কেবল গুটিকয়েক লোক পিছিয়ে পড়েছে আর কয়েকটি মাত্র উট অসুস্থ হয়ে মরুভূমিতে পড়ে রয়েছে। ওদের মাথার উপর আকাশে চক্কর দেওয়া শকুনগুলো শীঘ্রই পশুগুলোকে নিয়ে ভেজে বসবে আর হয়তো কয়েকটি মানুষও এর মধ্যে থাকবে।

তারপর হঠাৎ তিনবার শিঙ্গা বেজে উঠার শব্দ শুনতে পেলেন। সেনাপতিদের বলা ছিল, কোনো বিপদ এলে এভাবে সতর্ক সঙ্কেত দিতে। শব্দটি অগ্রবর্তী দল থেকে এসেছিল, ওরা সামনে আরাবল্লি পাহাড়ের পেছনে তার দৃষ্টির আড়ালে ছিল। ঘোড়ার পেটে পা দিয়ে তো মেরে আকবর কাফেলার পাশ দিয়ে সামনে ছুটতে ছুটতে দেহরক্ষী দলকে চিৎকার করে কাছাকাছি থাকতে বললেন। পাথুরে জমিনের উপর দিয়ে ঘোড়ার খুরের ঠকাঠক শব্দ করে এগিয়ে একটি পাহাড় ঘুরতেই সামনে দেখা গেল জাফরানি রংয়ের পোশাকপরা একদল ঘোড়সওয়ার গরম কুয়াশার মধ্য থেকে বের হয়ে আসছে। মোগল অগ্রবর্তী দলের প্রথম সারির উপর আক্রমণ করতে উদ্যত শত্রুদের খোলা তরোয়ালের উপর রোদ পড়ে ঝলকাচ্ছে।

মোগল অগ্রবর্তী দলটি বেশ ধীরগতিতে এগোচ্ছিল, তবে কয়েকমুহূর্ত পর মারওয়াড়িদের আকস্মিক হামলার ধাক্কায় অগ্রবর্তী দলটি টলমল করে সামান্য পিছু হটে এল। আতঙ্কিত হয়ে কয়েকটি ঘোড়া পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হল। অন্য কয়েকটি পাঁজরে আঘাত পেয়ে পড়ে গেল, আরোহীদেরকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো। তিনজন মারওয়াড়ি একজন মোগল পতাকা বাহককে ঘিরে ধরলো। তরবারির এক কোপে সে একজন মারওয়াড়িকে ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দিল, তবে এতে তার নিজের ঘোড়ার লাগাম তার হাত থেকে ছুটে যাওয়ায় সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। ঘোড়াটা একপাশে হেলতেই আরেকজন মারওয়াড়ি তার তরোয়ালের ডগা মোগল পতাকাবাহকের গলায় বিঁধিয়ে দিল। লোকটি ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লো, তবে তার বাম পা পাদানিতে আটকে গেল। আতঙ্কিত ঘোড়াটি আরোহীর দেহটি পেছন পেছন টেনে নিয়ে ছুটে চললো, লোকটির মাথা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে চললো। আরেকজন মারওয়াড়ি মাটিতে পড়ে থাকা মোগল পতাকাটি তুলে নিয়ে বিজয়োল্লাসে চেঁচিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চললো। মোগল অশ্বারোহীদের প্রথম সারির পেছনে গাদা বন্দুকধারী একটি মোগল পল্টনও আসছিল। তবে বিপদ সঙ্কেত পাওয়ার পর ওরা বন্দুকে গোলা ভরারও সময় পায়নি আর বন্দুক রাখার জন্য যে তেপায়া কাঠামো ওরা পিঠে বেঁধে বহন করছিল, সেগুলো নামিয়ে প্রস্তুত হওয়াতো দূরের কথা। কয়েকজন মোগল বন্দুকধারী অবশ্য দ্রুত হাতে বন্দুক ছুঁড়ে দুইতিনজন মারওয়াড়িকে ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যান্য মারওয়াড়িরা ওদেরকে ঘিরে ফেলে কাস্তে দিয়ে ধান কাটার মতো ওদেরকে কোপাতে লাগলো।

 সম্ভবত পাঁচমিনিটও পার হয় নি, এদিকে আকবর তখনও মাথা নিচু করে ঘর্মাক্ত ঘোড়াটি ছুটিয়ে যেদিকে লড়াই হচ্ছিল সেদিকে ছুটে চলছিলেন। তারপর তার সবুজ পোশাকপরা দেহরক্ষী দল নিয়ে চারদিকে চিৎকার-চেঁচামেচি আর যুদ্ধের কোলাহলের মধ্যে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ভারী গোঁফওয়ালা একজন রাজপুত অশ্বারোহীর উপর তরোয়াল চালিয়ে আকবর লোকটির উরু যখম করলেন তবে সেই সাথে একটি রাজপুত বল্লম তার বুকের বর্মে আঘাত করতেই তিনি পেছনের দিকে টলে পড়লেন। ভাগ্যিস ভারী ইস্পাতের বর্মটি কেবল সামান্য বেঁকে গিয়েছিল। আরেকজন রাজপুত সোজা-লম্বা তরোয়াল নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে তার দিকে এগোতেই তিনি তাকে আঘাত করলেন। তবে তাড়াহুড়ার কারণে আকবরের তরোয়াল লোকটির গায়ে না লাগলেও আঘাত এড়াতে সে একদিকে সরে যাওয়ায় সে নিজেও তার তরোয়াল চালাতে পারলো না। তারপর সে আবার তার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে লম্বা তরোয়ালটিকে বল্লমের মতো সামনে তাক করে আকবরকে আক্রমণ করতে ছুটে এল। তবে আকবরের কাছে পৌঁছার আগেই একজন দেহরক্ষী তার ধারালো তরোয়াল দিয়ে এমন জোরে লোকটির গলায় আঘাত করলো যে, তার মুণ্ডটি ধর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেল আর তার জাফরান রংয়ের পোশাকপরা মুণ্ডুহীন ধড়টি কয়েক মুহূর্ত ঘোড়ার পিঠে খাড়া হয়ে থেকে তারপর মাটিতে পড়ে গেল। আকবর লক্ষ করলেন আরেকজন মারওয়াড়ি তার ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। লোকটি তার সামনে দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় তিনি হাওয়ায় উড়তে থাকা লোকটির আলখাল্লার একপ্রান্ত খামচে ধরে টান দিলেন। মারওয়াড়িটি ঘোড়ার পিঠ থেকে পেছনে মাটিতে আকবরের ঘোড়ার খুরের নিচে পড়ে গেল। এ ঘটনায় আকবরের ঘোড়াটিও আতঙ্কিত হয়ে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হল। আকবর তার তামাটে রংয়ের ঘোড়াটির গলা আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলালেন তবে আতঙ্কিত পশুটিকে শান্ত করতে তার কিছু সময় লাগলো।

ঘোড়াটি শান্ত হওয়ার পর তিনি আর কোনো লক্ষ্যবস্তু আছে কি-না দেখার জন্য চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন মারওয়াড়িরা রণেভঙ্গ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে পালাচ্ছে। ওদের হামলা করার এখনও এক ঘণ্টাও পার হয় নি। দুয়েকজন অশ্বারোহী থেমে নিচু হয়ে আহত আর ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া সঙ্গীদের তুলতে চেষ্টা করছিল। একজন মারওয়াড়ি বামহাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে ডান হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা তার এক সঙ্গীকে তুলতে যাচ্ছিল, এমন সময় একজন মোগল বরকন্দাজ তার পিঠে গুলি করলো। লোকটি দুই হাত শূন্যে ছুঁড়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে তার সঙ্গীর উপর পড়ে গেল। তারপর মৃত্যু যন্ত্রণায় বালুতে পা ছুঁড়তে লাগলো।

চারপাশে তাকাতে তাকাতে আকবর ভাবলেন, এই নিঃস্বার্থ রাজপুত যোদ্ধাদের ব্যক্তিগত সাহসিকতা নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করতে পারবে না। তিনি চাচ্ছিলেন তার লোকজনদের জড়ো করে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাওয়া শত্রুর পিছু নিতে। তবে অনেক মানুষ আর ঘোড়া আহত হওয়ায় আর চারদিকে বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তির কারণে প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে গেল যথেষ্ট অশ্বারোহী নিয়ে আবার তৈরি হতে। আরেক ঘণ্টা পর তিনি ঢেউয়ের মতো উঁচুনিচু বালুময় পাহাড়ি এলাকার ভেতরে ঢুকে কেবল মারওয়াড়িদের ঘোড়ার খুরের ছাপ পেলেন। তবে ছাপগুলো বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ছিল। মনে হল মারওয়াড়িরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

 আকবর তার দেহরক্ষী দলের প্রধানকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কী সবচেয়ে বড় দলটির পিছু নেব।’

সে বললো, আমার মনে হয় তা ঠিক হবে না, জাঁহাপনা। তারা হয়তো আমাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়ি এলাকার আরো গভীরে নিয়ে যেতে চাইছে। যেখানে ওরা আবার একত্রিত হয়ে অতর্কিতে আমাদের উপর হামলা করতে পারে। তাছাড়া একটু পরই সূর্য ডুবে যাবে। অন্ধকার হতে আর বেশি সময় নেই।

আকবর মাথা নেড়ে সায় দিলেন। লোকটি ঠিক বলেছে। তার চেয়ে ভালো হয় মূল বাহিনীর কাছে ফিরে গিয়ে পরদিন ভোরে চর পাঠিয়ে মারওয়াড়ি দলটির অবস্থান খুঁজে দেখা। এই ক্ষতিটির কথা বলার পর তার বাবা কিরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, তিনি তা আন্দাজ করতে পারলেন। তবে আরো ক্ষয়ক্ষতি কিংবা রাতের বেলা আকস্মিক আক্রমণে নিজের জীবন হারানোর চেয়ে সেটা ভালো।

*

আওরঙ্গজেবের তরুণ কোরচি কুর্নিশ করে তাকে জানালো, ‘জাহাপনা, এখুনি একজন কাসিদ-বার্তাবাহক আপনার পুত্র শাহজাদা আকবরের কাছ থেকে জরুরি বার্তা নিয়ে এসেছে। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সম্রাট সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের সুবাহগুলো থেকে যে খাজনার হিসাব এসেছে তা একপাশে সরিয়ে রাখলেন। এগুলো পড়ে তিনি খুব একটা খুশি হননি। অন্য রাজ্যগুলোতেও যে পরিমাণ যেমন হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে কম খাজনা আদায় হচ্ছে। তাঁর আশংকা অবাধ দুর্নীতি এর জন্য দায়ী। তার সুবেদাররা আর তাদের কর্মকর্তারা মনে করেছে যে তাঁর সমস্ত মনোযোগ বিদ্রোহ দমনে আর বিদেশি আক্রমণের দিকে আচ্ছন্ন থাকায় ওরা তার নজর থেকে অনেক দূরে রয়েছে। কাজেই ওরা এই সুযোগে ঘুষ নিতে পারবে কিংবা যে অর্থ খাজনা হিসেবে আদায় হচ্ছে তার কিছু অংশ সবার অজান্তে নিজেদের পকেটে ঢুকাতে পারবে। যখনই তিনি দিল্লির কোষাগারের দপ্তর থেকে অনুসন্ধান করার জন্য কোনো গোমস্তা বা কর পরিদর্শক পাঠাতেন, তারা সাধারণত তাকে আশ্বস্ত করতে যে সব ঠিক আছে। তবে অধিকাংশ মানুষই অর্থের জন্য অসৎ কাজ করতে তৈরি আর সত্যিকার বিশ্বস্ততা আজকাল একেবারে বিরল আর তাদেরকেও হয়তো ঘুষ দিয়ে কেনা যায়। একমাত্র সমাধান হচ্ছে তার নিজেকে একটি রাজকীয় তদন্ত ও অনুসন্ধান কর্ম চালাতে হবে আর কিছু নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাকে পুরস্কার কিংবা শাস্তি কমিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ করার জন্য রাজি করাতে হবে।

 কিন্তু তিনি নিজে সব জায়গায় যেতে পারেন না। তিনি এখানে আজমিরে এসেছেন রাজস্থান আর মারওয়াড়ের বিরুদ্ধে আকবরের অভিযানের কাছাকাছি থাকতে। বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় না হলেও তিনি যা আশা করছিলেন অভিযানটি সেরকম হচ্ছে না। তবে বেশ কিছুদিন হল তার ছেলের কাছ থেকে কোনো খবর আসছে না, কাজেই এই কাসিদের কাছে নিশ্চয়ই কোনো খবর থাকতে পারে। তিনি কোরচিকে বললেন, আমি এখুনি খবরটা দেখবো।

 তরুণ কোরচিটি বহুব্যবহৃত একটি চামড়ার থলে থেকে একটি সিলমোহর করা কাগজ বের করে তার সামনে ধরে বললো, আমি এটা নিয়ে এসেছি জাঁহাপনা।

আওরঙ্গজেব কাগজটা নিয়ে দ্রুতহাতে সিলমোহরটি ভাঙ্গলেন। চিঠির উপরের আনুষ্ঠানিক সালাম ইত্যাদি বাদ দিয়ে তিনি সরাসরি বার্তাটির মূল বিষয়বস্তু জানার জন্য পড়া শুরু করলেন। যতই পড়তে লাগলেন ততই তার ভ্রু কুঁচকাতে শুরু করলো।

 আকবরের অভিযানে কিছুই ফল হয় নি। চিঠির শুরুতে তিনি মারওয়াড়িদের লড়াই করার কায়দা বর্ণনা করেছেন। ওরা অতর্কিতে আক্রমণ করছে, আজ এখানে, কাল ওখানে আর সবসময় ছোট ছোট দলে হামলা করে তার সেনাবাহিনীর অনেক লোককে হতাহত করে আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় হামলাগুলো সন্ধ্যার পর হচ্ছে, যাতে ওরা সহজে পালিয়ে যেতে পারে। মোগল সৈন্যরা একটি নিয়মিত সেনাবাহিনীর বদলে এ ধরনের শত্রুর সাথে লড়াই করতে অভ্যস্ত নয়, যারা দস্যুর মতো আচরণ করছে। তিনি মারওয়াড়িদেরকে প্রলুব্ধ করে পাহাড়ি অঞ্চলের ভেতর থেকে সমতল ভূমিতে আনতে পারছেন না, যাতে ওদের সাথে পরিকল্পিত ও সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী সমন্বয়ে মুখোমুখি লড়াই করা যায়। সেখানে তার অধিক সৈন্যসংখ্যা আর উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও, বিশেষত কামানগুলোর ব্যবহার প্রভাব ফেলতে পারতো। তার সৈন্যরা মারওয়াড়িদের পিছু নিয়ে পাহাড়ি এলাকায় ঢুকতে অনিহা প্রকাশ করছে। অতর্কিত হামলার ভয়ে ওরা এ ধরনের ভূখণ্ডে লড়াই করতে সতর্ক, অভিজ্ঞতা থেকে এই ভীতিটি অংশত যুক্তিযোগ্য। দিন দিন ওরা আরো সতর্ক হয়ে কাছাকাছি দলবদ্ধ হয়ে থাকছে। বিপদের প্রথম কোনো ইঙ্গিত পাওয়ার সাথে সাথে তার চর আর পাহারাদারেরা পিছু হটে মূল সেনাবাহিনীর কাছাকাছি চলে আসছে। কাজেই শত্রুর কাছাকাছি হওয়ার জন্য তিনি যথেষ্ট তথ্যও পাচ্ছেন না। যখনই কোনো কেল্লা দখল করছেন তখনই দেখছেন সেটা খালি। আর রাজপুতদের আক্রমণের ভয়ে তার লোকেরা এ ধরনের স্থানে ঘাঁটি গাড়তেও অনিচ্ছুক হয়ে পড়ছে। আকবর পুরো বিপাকের একটি সারাংশ এভাবে তুলে ধরলেন :

 রাজপুত রণকৌশল আর নিজদেশের অলিগলি-সবজায়গা সম্পর্কে তাদের সম্যক জ্ঞানের সামনে আমাদের সেনাবাহিনীর সংখ্যাধিক্য আর উন্নত অস্ত্রশস্ত্র অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। আমি অবশ্যই স্বীকার করছি–আর সেই সাথে ক্ষমা চাচ্ছি যে আপনার জন্য যে বিজয় আমি অর্জন করতে চেয়েছিলাম তা থেকে এখনও অনেক দূরে রয়েছি।

সর্বাধিনায়কের লাল রঙয়ের তাঁবুর মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে পায়চারি করতে করতে আওরঙ্গজেব, একটার পর একটা বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে ভেবে চললেন। সবজায়গায় বিদ্রোহ চলছে–শিবাজি নিজেকে মারাঠার রাজা ঘোষণা করার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে আর পর্বতে তার সুরক্ষিত আশ্রয় থেকে এখনও সমস্ত দাক্ষিণাত্য জুড়ে লুটতরাজ চালিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে এছাড়াও তাকে পুরো প্রশাসন ঢেলে সাজাতে হবে এবং দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এর মানে মারওয়াড়িদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত শেষ করে দিতে হবে। আকবর কি তার হয়ে এই কাজটি করতে পারবে? তিনি খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছেন না। সর্বতোভাবে তাঁর ছেলে একজন দক্ষ সেনাপতি বটে আর আজম যেরকম মাঝে মাঝে হঠকারিতা করে সেরকমও নয়। তবে মনে হয় না যে, তার বাবার হাতে সে একটি বিপর্যয় তুলে দেবে, তবে নিশ্চিত বিজয়ও কি এনে দিতে পারবে? সে কি নিজেকে দুর্বল দেখাচ্ছে? তার উপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তা পালনে সে কতটুকু অঙ্গীকারবদ্ধ এবং নিবেদিত প্রাণ? সে লিখে জানিয়েছে যে, তার বাবার জন্য সে বিজয় আনতে চাচ্ছে, তবে তাকে নিজের এবং তার ভবিষ্যতের জন্য বিজয় অর্জন করতে হবে। তিনি যে প্রতিবেদন পেয়েছেন, তা থেকে জানা যাচ্ছে যে, কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁর ছেলে ব্যাপকভাবে তার সেনা কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করতে, তাদের মতামত বিবেচনা করতে এবং তাদের সাথে এ বিষয়ে বিতর্ক করতে পছন্দ করে। ঐকমত্যের এ ধরনের ইচ্ছা তাকে জনপ্রিয় করেছে, তবে একজন অধিনায়কের জন্য দক্ষতা এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতার সুস্পষ্টতা জনপ্রিয়তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

অনেক ভাবনা-চিন্তার পর আওরঙ্গজেব তার কোরচিকে ডেকে কাগজ-কলম আনতে বললেন। তারপর আকবরকে একটি চিঠি লিখতে শুরু করলেন। চিঠির প্রথম কথাগুলোই ছিল ভর্ৎসনার….

*

তোমার লোকেরা তোমার কথা মানতে বিমুখ, একথা স্বীকার করে তুমি নিজেকে যেমন লজ্জিত করেছ তেমনি আমাকেও লজ্জায় ফেলেছ। একজন মোগল শাহজাদা কখনও তার অধীনস্থ লোকদেরকে তাকে প্রভাবিত করতে অনুমতি দিতে পারে না। আর কিভাবে, কখন যুদ্ধ হবে সে সম্পর্কে কিছু নির্দেশ করাতো দূরের কথা। একজন নেতাকে নেতৃত্ব দিতে হবে, আর তুমি তা করতে অনিচ্ছুক মনে হচ্ছে। মারওয়াড়িদের রণকৌশল নতুন কিছু নয়, যা তোমার বিশ্বাস। বরং এগুলো শিবাজি আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের উপজাতি, উভয়ের কৌশলের মতো একই রকম। কাবুলের বণিকদের উপর যে দুবৃত্তরা লুণ্ঠন চালাচ্ছিল, তাদেরকে দমন করার জন্য আমি কি নিজে সফলভাবে আমার সেনাদেরকে নেতৃত্ব দিয়ে পেশোয়ারের বাইরে গিরিপথে নিয়ে যাই নি? দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে আর বিদ্রোহীদের কঠিন শাস্তি দিয়ে কী সেখানে সবকিছু অবসান করি নি?

আমার বিশ্বাস মারওয়াড়িদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের এই আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো শক্তিশালী নেতা হিসেবে তুমি নিজেকে তুলে ধরতে পারো নি। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তোমার বদলে মুয়াজ্জম গুজরাটের সুবেদারি ছেড়ে তোমার সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করতে যাবে। যাইহোক আমি তোমাকে এখুনি আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি, যাতে তুমি নিজেকে দায়মুক্ত করতে পার আর প্রমাণ করতে পার যে, তোমার সম্পর্কে আমি যে আপত্তি তুলেছি, তা ভিত্তিহীন।

আমার কাছে খবর এসেছে যে, মেওয়ারিরা তাদের জ্ঞাতিভাই আর মারওয়াড়ের একই ধর্মাবলম্বী ভাইদের সাথে মিলে সশস্ত্র বিদ্রোহ করতে যাচ্ছে। আমি দুটি সেনাবাহিনীর সমাবেশ করতে যাচ্ছি, এরা মেবারে ঢুকে তাদেরকে দমন করবে। একটি অগ্রসর হবে পূর্বদিক থেকে আর অন্যটি যাবে দক্ষিণ দিক থেকে। তুমি এখানে ফিরে এসে দক্ষিণের বাহিনীর নেতৃত্ব নেবে। আর তোমার ভাই আজম পূর্বদিক থেকে অগ্রসর হওয়া বাহিনীর নেতৃত্ব দেবে। আমি নিজে পুরো সমরাভিযানের তত্ত্বাবধান করবো। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন, এবার তুমি তোমার নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আমাকে আর হতাশ করবে না। সিদ্ধান্তটি নিয়ে তাকে জানাতে পেরে খুশি হয়ে আওরঙ্গজেব দ্রুত চিঠিটা শেষ করলেন। কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক কিংবা ব্যক্তিগত বিদায় সম্ভাষণ না দিয়ে কেবল সই করলেন। তারপর লিখলেন–আল্লাহর মেহেরবাণীতে হিন্দুস্তানের সম্রাট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *