০৭. একজন রাজার সিংহাসনে আরোহণ- রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান

০৭. একজন রাজার সিংহাসনে আরোহণ- রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান

দিল্লির লাল কেল্লার দেওয়ান-ই-খাসে আওরঙ্গজেব তাঁর সামনে পা ভাঁজ করে বসে থাকা সভাসদদের দিকে তাকালেন। এদের মাঝে তার দুই মধ্যম পুত্রও বসে রয়েছে। উপদেষ্টাদের সভায় আজম আর আকবরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের উপস্থিতিতে তিনি তাদের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করতে পারবেন আর সেই সাথে তাদেরকে সরকার পরিচালনার কৌশল শেখাবেন, যা তার বাবা তাকে শেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এছাড়া শীঘ্রই তিনি তাদেরকে সুবেদার হিসেবে নিযুক্ত করবেন, যেরকম বড় ছেলে মুয়াজ্জমকে গুজরাটের সুবেদার নিযুক্ত করেছেন। তবে এখন তাঁকে আরো জরুরি একটি বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে। গতকাল একজন কাসিদ কাবুলের কাছে যশবন্ত সিং-এর মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এসেছে।

 আওরঙ্গজেব বললেন, আপনারা সকলে জানেন আজ কেন আপনাদেরকে এখানে আমি ডেকেছি। যশবন্ত সিং মারা গেছেন। এমন একজন মানুষ যার আনুগত্য প্রশ্নাতীত ছিল না, তার মৃত্যুতে আমি খুব বেশি শোক প্রকাশ করার ভান করতে পারি না। কাজেই শুধু শুধু মিথ্যা ভাবাবেগ না দেখিয়ে আমি সময় নষ্ট করবো না। তার চেয়ে বরং মারওয়াড়ের ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থার বিষয়ের দিকে আমরা কথা বলবো। তারপর তিনি তাঁর কোষাধ্যক্ষ সাদাচুলের আবদুল আসিফের দিকে তাকিয়ে বললেন, যশবন্ত সিং-এর কর্মকর্তারা কি বাৎসরিক বকেয়া কর রাজকোষে জমা করেছে?

না জাহাপনা।’

 ‘তাহলে ওরা বকেয়া কর পরিশোধ করা পর্যন্ত প্রশাসনের ভার নিতে মারওয়ারে আপনার লোক পাঠাবেন।

 আজম জিজ্ঞেস করলেন, মারওয়ারের অধিরাজ হিসেবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের বিষয়ে আপনি কী করবেন?

‘যে কাসিদ যশবন্ত সিং-এর মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এসেছিল, সে সাথে করে তার শেষ ইচ্ছাপত্র আর উইলের একটি অনুলিপিও নিয়ে এসেছিল। হঠকারিতা করে সে এই উইলে কে উত্তরাধিকারী হবে তা লিখেছে অথচ একটি করদ রাজ্যের চুক্তির নিয়মে রয়েছে, তার ইচ্ছার কথা পরিষ্কার উল্লেখ করে শেষ সিদ্ধান্ত অধিরাজ হিসেবে আমার হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা। একাজটি করে সে তার নিজের এবং স্বজাতির চরিত্রানুযায়ী ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। যশবন্ত সিং অবশ্য আমার কাজ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে, তাই আমি প্রতিহিংসাপরায়ণ হব না। তার দুই বিধবা স্ত্রী শরৎকালে কাবুল থেকে ফেরার পথে লাহোরে দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আমি ওদেরকে দিল্লিতে ডেকে পাঠাবো যাতে ন্যায় সিদ্ধান্ত নিতে পারি। ইতোমধ্যে আমি অস্থায়ীভাবে প্রশাসক হিসেবে মারওয়ারে আমার রাজকর্মচারী নিযুক্ত করবো যাতে রাজপুতরা বুঝতে পারে যে, আমার সাম্রাজ্যে আমার শাসনক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্ব দেখাবার ক্ষেত্রে তারা ব্যতিক্রম নয়। মারওয়ারে যাওয়ার জন্য যে রাজ কর্মচারীদেরকে বাছাই করা হবে, তাদেরকে অবশ্যই শক্ত মুসলিম, কঠিন চরিত্রের অধিকারী, বিশ্বস্ত এবং দায়িত্ব-কর্তব্যে নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি হতে হবে। সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের মতো হিন্দু ধর্মীয় উৎসব নিষিদ্ধ করে ওরা ফরমান জারি করবে। এছাড়া আমি ওদেরকে আদেশ করছি একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দির বেছে নিয়ে তা ধ্বংস করবে। এটি মারওয়াড়ি আর রাজপুতনার অন্যান্য রাজ্যগুলোর অধিবাসীদের মধ্যে একটা সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে। যাতে ওরা আমার প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করে, যা জীবিতকালে যশবন্ত সিং-এর আচরণে আর মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছায়ও দেখা যায় নি।

আকবর বললেন, কিন্তু বাবা, মোগল কর্মকর্তাদের আগমনে মারওয়াড়িরা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে। আর আপনি যদি ওদের একটিও পবিত্র স্থান ভেঙ্গে ফেলেন, তবে সেটা আগ্রাসন কিংবা বিনা উস্কানিতে একটি লড়াইয়ের নমুনা হিসেবে দেখা হবে না? এই লোকগুলোতে আমাদের মিত্র। আর বিশেষত এমন একটি সময়ে আমরা ওদেরকে ক্ষুব্ধ করে তুলছি, যখন ওরা ওদের মৃত রাজার শোকপালন করছে। তাছাড়া এমনিতেই আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছে–দাক্ষিণাত্যে শিবাজি ছাড়াও সাম্রাজ্যের অন্যান্য এলাকাতেও বিদ্রোহ চলছে, তাই না? এধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আগে আমাদের কি আরো বিবেচনা করা উচিত না?

এমন সময় আজম বলে উঠলো, তুমি সব সময় কাজে না লেগে দেরি করার কারণ খুঁজে বেড়াও। তুমি কি কখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারো না ভাই?

আওরঙ্গজেব ভাবলেন, ধীরস্থির এবং সবার প্রিয় আকবরের তুলনায় আজম তার মৃত ইরানি মায়ের দুর্দমনীয় মেজাজ পেয়েছে। আযম অবশ্য ঠিকই বলেছে। আকবরকে শিখতে হবে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই একমাত্র উপায়। তবে অধৈর্য আর উগ্র আজমেরও কিছু শেখার দরকার আছে–সভাসদদের সামনে তার জিহ্বা সামলাতে হবে। খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে শাহজাদাদের ঝগড়া করা উচিত নয়। ভ্রু কুঁচকে তিনি এক হাত তুললেন। বাবার চোখে ভর্ৎসনার আভাস পেয়ে আজম চুপ করলো। আকবরকে দেখে মনে হচ্ছিল ভাইয়ের মন্তব্য শুনে সে মনে কষ্ট পেয়েছে। আওরঙ্গজেব আকবরের দিকে ফিরে বললেন, ‘আকবর, যেটা তোমার কাছে বৈধ প্রশ্ন মনে হয়েছে তা তুমি আলোচনায় পেশ করেছ, তবে একবার নিজেকে প্রশ্ন কর : রাজপুতরা কি আসলেই আমাদের মিত্র? ওরা আমাদের ধর্মের নয় আর আমাদেরকে সামন্তপ্রভু স্বীকার করেছে, কেননা আমাদের উদারতা থেকে ওরা উপকৃত হচ্ছে। ওদের উপর প্রাথমিক বিজয়লাভের পর আমার প্রপিতামহ সম্রাট আকবর ওদের প্রতি খুব বেশি উদারতা দেখিয়েছিলেন। আর তাই করেছিলেন তোমার পিতামহ–তিনি ওদের কাছ থেকে কেবল ভাসা-ভাসা আনুগত্যের শপথ খুঁজেছিলেন। আর তারপর যখন নতুন একজন রাজপুত রাজা সিংহাসনে বসলো, ওরা সবাই তাদের ঔদ্ধত্য আর অহঙ্কার দেখাতে উৎসাহিত করলো। রাজপুতরা একটি উচ্চণ্ড এবং বিশৃঙ্খল জাতি। ওদের সাথে প্রশংসা আর আপসমূলক আচরণ না করে, আমাদের পূর্বপুরুষদের উচিত ছিল ওদের উপর আমাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। এখন যশবন্ত সিং-এর মৃত্যুর পর তাদের কাজকর্মে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, কাজেই এই সুযোগে মারওয়াড়িদেরকে ওদের উপরে আমার ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। আর যদি ওরা আমাকে অমান্য করে তাহলে ওরা নয়, আমরা উপকৃত হব। আশা করি তুমি সেটা বুঝতে পেরেছ আকবর?’

আকবর শান্তভাবে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, বুঝেছি বাবা।

*

দিল্লি কেল্লার কেন্দ্রীয় উঠানের পানির ফোয়ারার পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে আওরঙ্গজেব হেরেমের চন্দনকাঠের ফটকের দিকে চললেন। ফটকের সামনে দাঁড়ান দুজন তুর্কি নারী প্রহরী ফটক খুলে ধরতেই মেয়েমহলের রোজমেরি, প্যাচুলি আর কস্তুরির মৃদু সুগন্ধ তাকে ঢেকে ফেললো। লাল মখমলের পর্দা ঝুলানো উদিপুরী মহলের আবেদনময় প্রমোদমহলের দিকে না ঘুরে জাহানারা হেরেমে এলে যে অনাড়ম্বর কামরাগুলো ব্যবহার করেন সেদিকে চললেন। জাহানারা তাঁর পরিচারিকাকে পাঠিয়ে তাঁকে দেখা করার জন্য অনুরোধ জানাবার সাথে সাথে তিনি এখানে চলে এসেছেন। জাহানারাকে দেখলে তিনি খুশি হবেন। তিনি যা ভেবেছিলেন, সাম্রাজ্যের পাদিশাহ বেগম হিসেবে জাহানারা তার দায়িত্ব অত্যন্ত অধ্যবসায় সহকারে পালন করছিলেন। তিনি যথাযথ আনুষ্ঠানিকতার সাথে রাষ্টদূত এবং করদরাজ্যের রাজাদের স্ত্রীদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন, তাঁর কথা ও বুদ্ধি দিয়ে তাদেরকে মুগ্ধ করছিলেন। এছাড়া বিপদগ্রস্ত রাজ কর্মকর্তা ও অন্যান্য বিধবার সাহায্যের আবেদনের জবাব দিচ্ছিলেন। হেরেমের খোঁজাদের প্রশাসন দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছিলেন। এতগুলো নারী যেখানে একত্রে বসবাস করছেন, স্বভাবতই সেখানে তাদের পরস্পরের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি আর হিংসাবিদ্বেষ হতে পারে, তিনি সেগুলোরও সমাধা করছিলেন। তাঁর আলাদা ভবনের নির্জনতায় আশ্রয় নেওয়ায় সম্ভবত পরবর্তী কাজটি সহজ হয়েছিল।

আওরঙ্গজেব কামরায় ঢুকে দেখলেন জাহানারা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁর পায়ের আওয়াজ শুনে তিনি মাথা উঁচু করে ঘুরে তাকালেন। আওরঙ্গজেব অবাক হয়ে দেখলেন তিনি ভ্রু কুঁচকে রয়েছেন, মুখের হাসিতে আর কালো চোখে কোনো উষ্ণতা নেই। কোনো ভনিতা না করে, কোনো ধরনের সম্ভাষণ না করে তিনি প্রথমে কথা বললেন, ‘আমি গুজব শুনতে পেলাম, মারওয়াড়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া আর হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে নানা-ধরনের বিধি-নষেধ আরোপ করার পরও তুমি সন্তুষ্ট না হয়ে যারা তোমার স্বধর্মের নয় তাদের সবার উপর জিজিয়া কর আরোপ করতে চাচ্ছ। বিধর্মীদের উপর করারোপের প্রথা সম্রাট আকবর উঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমার এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা সম্পূর্ণ পাগলামি।

 হঠাৎ এরকম প্রচণ্ড আক্রমণে আওরঙ্গজেব একটু ইতস্তত করতে লাগলেন। যেভাবেই হোক ভুল বুঝার কারণে জাহানারা যা সত্যি বিশ্বাস করেন তাই বলছিলেন। তাঁর চারপাশে আর যারা আছেন–এমনকি তাঁর পরিবারের সদস্যদের মতোও জাহানারা নিজের স্বার্থে প্রণোদিত হয়ে চলেন না। তিনি যতদূর সম্ভব কণ্ঠস্বর শান্ত এবং নিচু করে বললেন, হ্যাঁ। আমি আমাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী জিজিয়া কর আরোপ করতে যাচ্ছি। এটা করার জন্য আমাকে সমালোচনা না করে বরং তোমার উচিত আমাদের পূর্বপুরুষদের সমালোচনা করা যারা এ প্রথা বিলোপ করেছিলেন।

জাহানারা প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, “আওরঙ্গজেব, তুমি কি করে এটা করতে পারলে? আর আমাকে আগে বলেনি কেন? আমাদের পূর্বপুরুষরা যা করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে গেছেন তুমি তার সমস্ত পরিত্যাগ করছে। এই কর উঠিয়ে দিয়ে তারা আমাদের জনগণের মাঝে একতা আর সমতা আনার চেষ্টা করছিলেন। তুমি ভুলে গেছ এটা মুসলিম দেশ নয়–আমি তোমাকে আগেই বলেছি এখানকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই হিন্দু। কিন্তু তুমি এমন আচরণ করছে, যা বিভক্তি আর বিদ্রোহ ডেকে আনছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি এমন আচরণ করতেন, তাহলে আমাদের সাম্রাজ্য কখনও টিকে থাকতে পারতো না। তুমি আমার কথা শোন…আমার কর্তব্য তোমার সাথে মনখোলা হওয়া। নাছোড়বান্দার মতো যদি এতে অটল থাক, তাহলে তোমার অনেক বিশ্বস্ত প্রজাকে দূরে সরিয়ে দেবে। আর তাদের তীব্র ক্রোধ আমাদের মাথায় আঘাত হানবে। শূন্য থেকে তুমি এমন একটি ঝড় ডেকে আনবে, যা সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কেন তুমি এটা দেখতে পাচ্ছ না?’ জাহানারা থামলেন, তার চোখমুখ লাল হয়ে রয়েছে।

‘আমি আবার বলছি, করারোপ করাটা আমাদের ধর্মীয় প্রথানুযায়ী একজন শাসকের অবশ্য পালনীয়। আর আমি প্রচলিত মতে বিশ্বাসী একজন মুসলিম শাসক।’ কথাটি বলার সময় অনেক চেষ্টা করেও আওরঙ্গজেব তার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা লুকাতে পারলেন না। তারপর বলে চললেন, আমি দুঃখিত যে কথাটা আগেই তোমাকে বলা হয়নি, তবে এ ব্যাপারে তোমার প্রতিক্রিয়া আমি আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিলাম। তাছাড়া তোমার সাথে ঝগড়া করার আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না। এজন্য আমি আন্তরিকভাবে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। তবে তোমাকে একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, এগুলো তোমার বিবেচনার বিষয় নয়। একজন নারী হিসেবে বাইরের পৃথিবীর ব্যাপারে আমার দিক নির্দেশনা তোমার গ্রহণ করা উচিত, যেরকম আমাদের পারিবারিক বিষয়েও তোমার উপদেশ আমি প্রায়ই মেনে চলি।’

জাহানারা তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। একটা মুহূর্ত তার মনে হচ্ছিল তিনি হয়তো তাঁকে আঘাত করতে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি আওরঙ্গজেবের সামনে হাঁটুগেড়ে বসে তার দিকে তাকিয়ে অনুনয় করে বললেন, দয়া করে বিয়ষটি আরেকবার বিবেচনা কর! আমার জন্য আর আমাদের বংশের খাতিরে।’ এবার তিনি তার দুই পা চেপে ধরে বললেন, যদি তুমি এবিষয়ে অটল থাক তবে আমাদের সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে।’

 আওরঙ্গজেবের আর কিছুই বলার ছিল না। এনিয়ে আর তর্ক করা মানে নিজেদের মধ্যে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা আরো গভীর করে তোলা। দুজনের মধ্যে কেউ হয়তো এমন কিছু বলে ফেলবেন–যার জন্য হয়তো পরে অনুতপ্ত হতে হবে। কাজেই অতীতের কথা না তোলাই ভাল। বোনের হাত থেকে অত্যন্ত ধীরে ধীরে নম্রভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তিনি পেছনে ঘুরে আড়ষ্টভাবে হেঁটে কামরা থেকে বের হয়ে গেলেন।

জাহানারা ডেকে উঠলেন, ‘আওরঙ্গজেব! দাঁড়াও…’ কিন্তু তিনি একবারও ফিরে তাকালেন না।

*

দিল্লির লালকেল্লায় আওরঙ্গজেব রাজমুকুট খুলে একটি কাপড়ের টুকরা দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। একজন তরুণ পরিচারক–কোরচি লম্বা গলার একটি জগ থেকে একটি রত্নখচিত পেয়ালায় শীতল তরমুজের শরবত ঢেলে তাঁর হাতে তুলে দিল। এইমাত্র তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে জিজিয়া কর পুনরায় চালু করার ঘোষণা দিয়ে এসেছেন। হিন্দুদের তাৎক্ষণিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়াতে তিনি যে ঝরোকা বেলকনি থেকে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন দরবারের কর্মকর্তারা তার নিচের প্রথম সারিতে উলেমা আর দরবারের মুসলিম সদস্যদের বসার ব্যবস্থা করেছিলেন। মুসলিম পল্টন থেকে প্রচুর সেনা হাতের কাছে অপেক্ষমাণ ছিল। ঘোষণাটি দেওয়ার পর ভিড়ের পেছন দিক থেকে সামান্য প্রতিবাদের চিৎকার শোনা গিয়েছিল। তার ধারণা, একই রকম প্রতিক্রিয়া অন্যান্য স্থানেও হবে।

 আওরঙ্গজেব শরবতে একটা লম্বা চুমুক দিলেন। বেলকনির হাওয়া বেশ গরম আর গুমোট ছিল। এমনকি পাখিরাও আকাশে না উড়ে ঝাঁক বেঁধে ছাদে বসে রয়েছে। বর্ষা আসার আর বেশি দিন বাকি নেই, বৃষ্টির সাথে সাথে শীতল স্বস্তি মিলবে। হঠাৎ তার শরীর কেঁপে উঠতেই পেয়ালা থেকে শরবত ছলকে পড়লো। তিনি তো অসুস্থ নন, কিন্তু আসলেই কী তাই? গরমে কিংবা এখুনি যা করে এসেছেন তার কারণে কী মানসিক চাপ হয়েছে? না, আবার আরো জোরে কেঁপে উঠলো–ভূমিকম্প হচ্ছে, বেশ বড় ধরনের ভূমিকম্প। নিচু টেবিলের উপর রাখা শরবতের জগটি মাটিতে পড়ে গেল। ফেনিল গোলাপি রং-এর শরবত নীল আর বাদামি রং-এর ইরানি গালিচার উপর পড়ে ভিজিয়ে দিল। একই সাথে ঝুলন্ত দুটো তেলের বাতি মাটিতে পড়তেই কাঁচ ভেঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আওরঙ্গজেব একটা থাম আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলালেন। হাতির দাঁতের কাজকরা একটি আয়না মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল। বাইরে ধপ করে একটা শব্দ হল। বেলকনির চতুর্দিকে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা বেলে পাথরের রেলিং-এর একটা অংশ ভেঙ্গে পড়েছে। এর পরপরই বেলকনির দরজার বেলে পাথরের চৌকাঠে আঁকাবাঁকা ফাটল দেখা দিতেই কিছু ফেঁটে যাওয়ার ভারী আরেকটি শব্দ পাওয়া গেল। আর বিশ ফুট নিচে মাটিতে পড়ে বেলকনির বেশিরভাগ অংশই অদৃশ্য হয়ে গেল। কম্পন থেমে গেছে, তবে আরো কয়েকবার ধুপ করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল। ছাদের কিছু অংশ আর দুর্গের ছাদে কামান-গোলা নিক্ষেপের জন্য ছিদ্রবিশিষ্ট বেলেপাথরের বুরুজের সমতল ছাদ নড়বড়ে হয়ে ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল।

 থাম ছেড়ে আওরঙ্গজেব একটা জানালার কাছে ছুটে গিয়ে বাইরে তাকালেন। পাখিগুলো চক্রাকারে আকাশে উড়ছে আর ভীত হয়ে চিৎকার করছে, উড়ন্ত পাখিগুলোর কারণে আকাশ কালো হয়ে রয়েছে। বুরুজের ছাদের একটি বড় টুকরা সাদা মার্বেল পাথর পানির ফোয়ারার উপর পড়তেই ফোয়ারাটি ভেঙ্গে গেল। ছড়ছড় করে প্রবল বেগে পানি পড়ে মার্বেল পাথরের উঠান ভাসিয়ে দিল। ছাদের লাল টালি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে মার্বেল পাথরের পায়ে চলা পথের উপর ছড়িয়ে পড়লো। উঠানের এক কোণে একজন শ্রমিক সম্ভবত একজন মালি দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রয়েছে আর আরেকজন মালি তার মাথার সাদা পাগড়ির প্যাঁচ খুলছিল। খুব সম্ভব এটা দিয়ে সে অপর লোকটির পায়ের নিচের যে জায়গায় কেটে রক্ত ঝরছিল তাতে বাঁধন দেবে। দুর্গের যতটুকু অংশ আওরঙ্গজেব দেখতে পাচ্ছিলেন, তাতে কেবল এই একজনকে দুর্ঘটনায় আহত মনে হচ্ছে। কিন্তু হেরেম আর জাহানারার অট্টালিকার কি অবস্থা? তার নিজের দালানটির মতো জাহানারার ভবনটিও একইরকমভাবে নির্মিত হওয়ায় আশা করা যায় সেটি হয়তো অক্ষত রয়েছে, তবে তাকে সেটা জানতে হবে। তিনি ঘুরে কোরচির দিকে তাকালেন, সে তখন কাঁপা কাঁপা হাতে মাটি থেকে জগটি তুলছিল।

 ‘ওটা এখন থাক। তুমি এক ছুটে গিয়ে দ্যাখে এস হেরেম আর জাহানারা বেগমের দালানের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি-না। তারপর তার মনে পড়লো, কেল্লার দেয়ালের চারদিকে সাধারণ মানের বাড়িঘর ছড়িয়ে রয়েছে। তারপর বললেন, ‘আর দেহরক্ষী দলের সেনা কর্মকর্তাদের শহরে গিয়ে দেখতে বল সেখানে কিরকম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’

 ঘণ্টাখানেক পর তিনি খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হলেন যে, হেরেম আর জাহানারার মহলে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। হেরেমে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, তবে গুরুতর ক্ষতি বলতে কেবল, উপর থেকে চুনসুরকি খসে পড়ে একজন পরিচারকের পায়ে বড় ধরনের আঘাত লেগেছে। হেকিমরা তার ভাঙ্গা পা কেটে ফেলতে যাচ্ছেন।

তারপর তাঁর দেহরক্ষী দলের প্রধান তাঁকে শহরের অবস্থা বললো, ‘জাহাপনা, শহরে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শহরের উত্তরের ফটকের একটি অংশ ভেঙ্গে পড়েছে। খিলানের উপরের মূল পাথরটি ভেঙ্গে পড়ে একটি গাধা-গাড়ি আর এর গাড়োয়ানকে চাপা দিয়েছে। ফটকের একজন দাড়োয়ান মাথায় সাংঘাতিক আঘাত পেয়েছে, এখনও কথা বলতে পারছে না। বাঁচবে বলে মনে হয় না। যমুনা নদীর তীরের কাছে শহরের দেয়ালের দশফুট অংশ ভেঙ্গে পড়েছে। এর কাছে একটি মসজিদের মিনার ভেঙ্গে পড়েছে আর একটি হিন্দু মন্দিরের পেছনের দেয়ালও ভেঙ্গে দুই টুকরা হয়ে গেছে। বেশিরভাগ কাদা-মাটির ইটের তৈরি ঘরবাড়ি ভেঙ্গে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। কয়েকটি ঘরের ধ্বংসাবশেষের নিচে লোকজন আটকা পড়েছে। অন্যান্য জায়গায় কাঠের ভাঙ্গা টুকরা আর ছাদের খড় ঘরের ভেতরে চুলার আগুনে পড়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে। কোনো কোনো জায়গায় আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।’

আওরঙ্গজেব বললেন, ‘আগুন নিভাতে আর ভেঙ্গে পড়া বাড়ি-ঘরের নিচে চাপাপড়া লোকজনকে উদ্ধার করতে সৈন্য পাঠাও। আগুন নেভাবার জন্য দরকার পড়লে অন্য বাড়িও ভাঙ্গতে বলবে। আর কোষাধ্যক্ষকে বল যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের মধ্যে টাকা বিতরণ করতে।

 ‘আমি এখুনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি, জাঁহাপনা। তবে একটা কথা আপনাকে জানাতে চাচ্ছিলাম। হিন্দুদের মধ্যে কিছু লোক চিৎকার করে বলছিল, আপনি আবার জিজিয়া কর চালু করায় ভগবান রুষ্ট হয়ে ভূমিকম্প ঘটিয়েছেন।’

‘এটা পুরাদস্তুর অযৌক্তিক আর বাজে কথা। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষ সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে–আর সেই সাথে ওদের সবারই ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। বরং আমি বলবো এটা আল্লাহর কাছ থেকে অবিশ্বাসীদের জন্য একটা সতর্ক বার্তা হয়ে এসেছে, যাতে ওরা নিজের আত্মা আর ধনদৌলতেরও স্বার্থে সঠিক পথে ফিরে আসে।

‘জাঁহাপনা আপনি যা বলেছেন, তা অবশ্যই সঠিক। তবে আমি খোলা মনে বলতে চাই, এই সহজ সরল লোকগুলোর তাদের হিন্দু ধর্মের প্রতি গভীর বিশ্বাস রয়েছে। কোনো যুক্তি-তর্ক, তা যতই যুক্তিসংগত হোক তাদেরকে টলাতে পারবে না।’

আওরঙ্গজেব মাথা নাড়লেন। জিজিয়া কর পুনরায় চালু করে তিনি আল্লাহর সামনে সঠিক রয়েছেন, পরিণতি যাই হোক না কেন। এ নিয়ে দিল্লির কিংবা সাম্রাজ্যের অন্য কোথাও কোনো ধরনের বিদ্রোহ দেখা দিলে দরকার পড়লে তা দমন করার জন্য তিনি সৈন্যদের প্রস্তুত থাকতে বলবেন।

*

ভোরের একটু আগে রায়গড় দুর্গের মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি শুনে শিবাজির ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার পেট গুড়গুড় করে উঠলো। অবশ্য এর কারণ হচ্ছে এর আগের দিনটি তিনি উপবাস আর প্রার্থনায় কাটিয়েছেন–তবে ভোজন আর উৎসবের সময়ও হয়ে এসেছে। গত চার মাস ধরে তিনি তার অভিষেকের দিনটি নিয়ে পরিকল্পনা করে আসছিলেন। যত সামান্যই তোক খুঁটিনাটি প্রত্যেকটা বিষয় তিনি নিজে দেখাশুনা করছিলেন। এমনকি এসম্পর্কে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের বিশদ বিষয় পড়েছেন যাতে সিংহাসনে আরোহণের যে ধর্মীয় নিয়মাবলি রয়েছে তা খুঁজে বের করে পুনঃপ্রচলন করতে পারেন। মোগলদের অত্যাচারী শাসনে এগুলো সবাই প্রায় ভুলে গিয়েছিল। রাজ্য শাসনের পবিত্র স্বভাব ধর্মটি যে তিনি কত ভাল বুঝেন, তা সবার সামনে তুলে ধরার জন্য জনসমক্ষে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানে গিয়ে পরিশোধনের যাবতীয় ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান পালন করেছেন। এর ফলে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা তাকে পৈতা প্রদান করলেন। তাদের সহযোগিতার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি সারা হিন্দুস্তান থেকে পঞ্চাশ হাজার ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ করে এনে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, যাতে তারা মারাঠার রাজা হিসেবে তার রাজ্যাভিষেক প্রত্যক্ষ করতে পারে।

শিবাজি উঠলেন, অপেক্ষমাণ সেবকদের সহায়তায় পবিত্র গঙ্গাজল দিয়ে মাথা আর সারা দেহ ধুলেন। পুরোহিতরা এই গঙ্গাজলে মন্ত্রোচ্চারণ করে পবিত্র করে দিয়েছিল। তারপর তিনি ধবধবে সাদা আর ঢিলা লম্বা একটি পোশাক পরলেন। সেবকরা তার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিল, তারপর বাহুতে বাজুবন্ধ, পায়ে নূপুর আর গলায় খাঁটি সোনার হার পরিয়ে দিল। তারপর যখন তিনি একা হলেন, তখন কয়েকটি ধূপকাঠি জ্বেলে ঘরের এককোণে একটি ছোট্ট বেদির সামনে এসে হাঁটুগেড়ে বসে মাথা ঝুঁকলেন। প্রার্থনা শুরু করতেই তার মাথাটা একটু টলে হালকা হয়ে এল, বুঝতে পারলেন এটা ক্ষুধার কারণে নয় …এটা হচ্ছে উত্তেজনা আর প্রত্যাশার একটি মিশ্রণ, তবে একটি অবাস্ত বতার অনুভূতিও রয়েছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, অবশেষে এই দিনটি এসেছে।

একমনে তখনও ধ্যান করে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কামরায় কারোও ঢোকার শব্দ পেয়ে ঘুরপাক খেয়ে উঠা ধূপের ধোয়ার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ পুরোহিত গগা ভট্টোর ছিপছিপে লম্বা দেহ আর তীক্ষ্ণ কালো চোখদুটো দেখতে পেলেন। পুরোহিত বললেন, আসুন প্রভু। লগ্ন উপস্থিত হয়েছে।

রাজা হিসেবে তাকে পবিত্র ঘোষণা করার জন্য পুণ্য নগরী বানারসি থেকে এই বিখ্যাত পণ্ডিত এবং ঋষিকে দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ি এলাকার রায়গড়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি ভালো করেছেন। গগা ভট্টের উপস্থিতি তার নিজ মারাঠি জনগণের উপর তার শাসনে একটি পবিত্র কর্তৃত্ব এনে দিয়েছে আর হিন্দুধর্মাবলম্বী অন্যান্য যারা আছেন তারা সবাই নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে তার কাছে সমবেত হবেন।

পুরোহিতকে অনুসরণ করে শিবাজি উঠান পার হয়ে মন্দিরে ঢুকলেন। ভেতরে গাঁদাফুলে ঢাকা শিবের বাহন নন্দির-ষাঁড়ের একটি পাথরের মূর্তির কাছেই সোনালি রং-এর একটি নিচু বসার চৌকি রাখা ছিল। তার স্ত্রী সয়রা বাঈ আর বড় ছেলে শম্ভাজি অভিষেক আসনের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। পুরোহিত আর সভাসদরা সবাই দলবেঁধে মন্দিরের ভেতরে চারদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 শিবাজি বসার পর গগা ভট্ট তার সামনে একটি সোনার বাটি এগিয়ে নিয়ে বললেন, ‘শিবাজি, মা গঙ্গার এই পবিত্র জল ছিটিয়ে আমি আপনাকে মারাঠিদের রাজা হিসেবে পবিত্র করছি। আপনার শাসন সুদীর্ঘ আর ন্যায়পরায়ণ হোক, যাতে আপনি প্রজাদের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে উঠুন আর দেবতারা আপনার অনুকূল হোন। তারপর একটি সোনার চামচ দিয়ে বাটি থেকে গঙ্গাজল তুলে শিবাজির মুখে আর মাথায় তিনবার ছিটিয়ে দিলেন। তারপর পবিত্র জলে ভরা সোনার জগ হাতে মুখ্য মন্ত্রীরা এগিয়ে এলেন, তারাও নতুন রাজার গায়ে গঙ্গাজল ছিটালেন। তারপর ষোলজন ব্রাহ্মণ নারী, অশুভ আত্মাকে দূর করার উদ্দেশ্যে প্রত্যেকে হাতে একটি করে সোনার থালায় পাঁচটি তেলের প্রদীপ নিয়ে তাঁকে ঘিরে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে প্রদক্ষিণ করলো।

তারপর এল ওজন নেওয়ার অনুষ্ঠান–এটি রাজ্যাভিষেকের একটি প্রাচীন হিন্দু প্রথা, যা তিনি আবার এখানে চালু করছেন। ওজনের ভারে হিমশিম খেতে খেতে চারজন পুরোহিত ওজন মাপার বিশাল একটি দাঁড়িপাল্লা নিয়ে মন্দিরের ভেতরে ঢুকলো।

 ‘আসুন মহারাজ।

 গগা ভট্ট স্মরণ করিয়ে দিতেই শিবাজি উঠে দাঁড়ালেন–ভেজা পোশাকটি গায়ের সাথে লেপ্টে রয়েছে, তারপর হেঁটে দাঁড়িপাল্লার কাছে গিয়ে একটি পাল্লায় উঠে আসন গেড়ে বসলেন। মনে মনে ভাবলেন, কি দুঃখ আমি কত হালকা, এরকম একটি ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানের মধ্যেও তার ঠোঁটে মৃদু হাসির উপক্রম হচ্ছিল। আমি যদি আরো মোটা আর ভারী হতাম তাহলে যে গরিবরা এই দান পাবে তারা হয়তো আরো উপকৃত হত। অনুষ্ঠান শুরু হতেই কয়েকজন পুরোহিত কয়েকটি সোনার বাট অপর পাল্লার উপর রাখলো। তিনি জেনেছেন এককালে এ ধরনের অনুষ্ঠানে সাতটি মূল্যবান ধাতুর মধ্যে এটিই প্রথমে দেওয়ার প্রথা ছিল। তিনি উপরের দিকে উঠতেই একটু কেঁপে উঠলেন। তারপর এল রূপার মুদ্রা, এরপর তামা, দস্তা, টিন, সিসা এবং সবশেষে লোহা। এরপর দেওয়া হল জায়ফল আর লবঙ্গ, তারপর লবণ, কর্পূর এবং মিহি সুতিবস্ত্র এবং সবার শেষে খাদ্যসামগ্রী। পাকা হলুদ কলা থেকে শুরু করে পাকা আম, রসাল মিষ্টি, ঘি এবং উজ্জ্বল সবুজ পান পাতা।

 মন্দিরের সমস্ত অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শিবাজি তার স্ত্রী-পুত্রসহ নিজের মহলে ফিরে গেলেন। সাদা পোশাকটি খুলে ভারী এমব্রয়ডারি করা একটি লাল টকটকে রেশমের পোশাক পরলেন। সয়রা বাঈ নিজেও দামি রেশমি পোশাক এবং প্রচুর অলঙ্কার পরেছিলেন। তিনি শিবাজির শরীর থেকে সাদামাটা অলঙ্কারগুলো খুলে উজ্জ্বল রত্নখচিত গাদা গাদা বালা, আংটি পরিয়ে দিলেন। তার হাতের চামড়া দেখা যাচ্ছিল না। সবকিছু পরিয়ে দেবার পর তিনি বললেন, এবার আপনাকে একজন সত্যিকার রাজার মতো দেখাচ্ছে, যা আপনি আসলেই তাই। এরপর গলায় দামিপাথর বসানো একটি হার পরিয়ে দিলেন আর মাথায় পরালেন ঝিকমিক করা মুক্তাখচিত একটি লাল পাগড়ি। সয়রা বাঈ শিবাজির মতোই দীর্ঘাঙ্গী ছিলেন, তাই পাগড়িটি পরাবার সময় তাকে পায়ের আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে দাঁড়াতে হয়নি। তারপর স্ত্রী ও পুত্রকে পিছনে নিয়ে শিবাজি সিংহাসন দরবারের দিকে এগিয়ে গেলেন। সবার পেছনে একজন বাহক তার তরবারি, তীর এবং ধনুক বয়ে নিয়ে আসছিল। তার চলার সাথে সাথে শিঙ্গা আর ঢোলক বেজে উঠলো। তারপর জ্যোতিষীদের গণনা মোতাবেক কাঁটায় কাঁটায় সঠিক মুহূর্তে দরবারে ঢুকলেন। তারপর তিনি সিঁড়ি বেয়ে অষ্টভুজ সিংহাসনে উঠতেই, সেবকরা অপেক্ষমাণ অতিথিদের উপর ছোট ছোট সোনালি ও রুপালি পদ্মফুল ছিটিয়ে দিল। সমাগত অতিথিদের মধ্যে ছিল দুর্গ এবং এর চারপাশের গ্রামগুলোর হাজার হাজার মানুষের মধ্যে বাছাই করা অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু লোক, যারা তার অভিষেক উৎসব পালন করবেন। আর রাজ সিংহাসনের পেছনে গগা ভট্ট দাঁড়িয়ে ছিলেন।

শিবাজি সিংহাসনে বসতেই গগা ভট্ট তার মাথার উপর একটি লাল ছাতা মেলে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘জয় হোক মহারাজার!’ এবার শিবাজিকে একজন রাজা হিসেবে প্রথম কথা বলতে হবে।

তিনি হাত তুলে সবাইকে চুপ হতে ইশারা করলেন। তারপর বললেন, ‘ভাইসব, আমি এখানে রায়গড়ে আপনাদের সামনে আপনাদের রাজা হিসেবে এসেছি। এটি একটি পবিত্র ভূমিকা। আমার নিজ মারাঠি ভাইয়েরা ছাড়াও সমস্ত হিন্দু

১০৭

ভাইদের রক্ষা করার পবিত্র দায়িত্ব এটি আমার উপর তুলে দিয়েছে। তবে কেমন করে আমি দায়িত্ব পালন করবো, যখন একটি ভিনদেশি হানাদার আমাদের দেশ, আমদের জীবন আর আমাদের আত্মার উপর তাদের ছায়া ফেলেছে? মোগল স্বৈরশাসক আমাদের ইচ্ছামত নিজ ধর্ম পালনে আমাদেরকে নিষেধ করেছে। তার কাছে আমরা মারাঠিরা হলাম পরজীবী কীট। তিনি আমাদেরকে ইঁদুর বলেন–তবে আমরা তাকে দেখিয়ে দেবো যে, আমরা হলাম সিংহ। আমি উপস্থিত সবার সামনে–আর অন্যান্য যারা এই অত্যাচারী শাসকের নিপীড়নে ভুক্তভোগী তাদের সবার সামনে প্রতিজ্ঞা করছি যে, এই মোগলদেরকে বিতাড়িত করবো। ইতোমধ্যে আমি কি প্রমাণ করিনি যে, বুদ্ধিতে আমি তাদেরকে হারাতে পারি? তিনি আমাকে তার ক্ষমতার আওতার মধ্যে নিয়েছিলেন, কিন্তু আমি এই দেশের মাটির মিহি বালুর মতো তার আঙুলের ফাঁক গলে বের হয়ে এসেছি, যে দেশে তার কোনো অধিকার নেই। আপনাদের সহায়তায় আমি বিজয়ী হবো আর হিন্দুস্তানে শান্তি আর ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনবো!’ তারপর শিবাজি উঠে দাঁড়ালেন, তার অস্ত্রগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়ানো অপেক্ষমাণ সেবককে ইশারা করলেন কাছে আসতে। তারপর তার তরবারি হাতে নিয়ে মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ধ্বংস হোক মোগল সাম্রাজ্য!’ সাথে সাথে চারপাশে সবাই তার প্রতিধ্বনি করে উঠলো, ধ্বংস হোক মোগল সাম্রাজ্য!’

 হঠাৎ শিবাজি পটকা ফাটার মতো কড় কড় আর কামানের ভারী গোলার মতো গুম গুম শব্দ শুনতে পেলেন–কি ব্যাপার কামানের গোলার শব্দ নয়তো? প্রজাদের মাথার উপর দিয়ে দরবারের খোলা দরজা দিয়ে বাইরে উঠানের বাইরে দেখতে পেলেন বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। শব্দটি ছিল বজ্রপাতের। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বর্ষা, আশীর্বাদস্বরূপ সেই বৃষ্টি এসেছে, যা হিন্দুস্তানের মাটি আর মানুষকে পরিপুষ্ট করে–এতদিন পর আজ এল। এটা দেবতাদের কাছ থেকে আসা একটি সংকেত, যে তিনি, শিবাজি, মোগলদেরকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেবেন–যেন এর কোনো অস্তিত্বই কোনোকালে ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *