০৫. জাদুকরী রওশনআরা

০৫. জাদুকরী রওশনআরা

‘জাঁহাপনা শীঘ্র উঠুন, খাজাসারা–খোঁজা এখুনি আপনার বোন রওশনআরার ঘরে যেতে আপনাকে অনুরোধ করেছেন।

 আওরঙ্গজেব টের পেলেন, উদিপুরী তার পাশেই নড়ে উঠলেন। জোর করে দুচোখ খুলে তিনি পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলেন হেরেমের পরিচারক একটা মোমবাতি উঁচু করে ধরে রয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে?

 তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, জাঁহাপনা।

 ‘আমি এখুনি যাচ্ছি।’ তাড়াতাড়ি উঠে, আরেকজন পরিচারকের বাড়িয়ে ধরা আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে তিনি হেরেমের নীরব করিডোরের মধ্য দিয়ে হেঁটে রওশনআরার ঘরের দিকে চললেন। কচ্ছপের খোলের মতো কারুকাজ দরজাটি হাট করে খোলা রয়েছে। ভেতরে জাহানারা, গওহরা আর কয়েকজন মহিলা ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দুজন পাগড়িপরা হেকিম রওশনআরা যে বিছানায় শুয়ে রয়েছেন, তার উপর ঝুঁকে রয়েছেন। আওরঙ্গজেব সামনে এগোতেই কাঁপা কাঁপা মোমবাতির আলোয় তাঁর দীর্ঘ দেহের ছায়া ফেললো। ভারি কাঁচের চশমাপরা বয়স্ক হেকিমটি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং বুকে এক হাত রেখে তাকে সম্মান জানালেন। আওরঙ্গজেব দেখলেন অন্য কমবয়সি চিকিৎসকটি তার বোনের ডান কব্জির কাছে একটি ইস্পাতের পাত্র ধরে রয়েছেন তাতে উজ্জ্বল লাল ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ধরছেন।

আওরঙ্গজেবের বিশ্বাসই হচ্ছিল না, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এনার কি হয়েছে? খুব খারাপ কিছু হয়েছে? তার যতদূর মনে পড়ে ছেচল্লিশ বছরের জীবনে তিনি একদিনের জন্যও রওশনআরাকে তেমন অসুস্থ হতে দেখেন নি।

 ‘আমরা এখনও কোন কিছুতে নিশ্চিত হতে পারি নি, জাঁহাপনা। মাত্র কয়েকমিনিট আগে আমরা এসেছি। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি তার শরীরের তাপমাত্রা খুব বেড়ে গেছে আর তিনি একটু পর পর জ্ঞান হারাচ্ছেন। হৃৎস্পন্দনও খুব দ্রুত হচ্ছে। হৃৎস্পন্দনের গতি কমাবার জন্য আমি আমার সহকর্মীকে সামান্য রক্ত বের করতে বলেছি। তাছাড়া তাকে শান্ত করে জ্বর কমাবার জন্য আফিম গাছের রস দিয়ে একটা নির্যাস বানিয়েছি।’

আওরঙ্গজেব বিছানার অন্যপাশে হাঁটুগেড়ে বসে রওশনআরার বামহাতটি তার নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললেন, রওশনআরা…’ হাতটা খুব ভারী আর প্রাণহীন মনে হলো যেন, তাঁর আত্মা তার দেহ ছেড়ে চলে গেছে। রওশনআরার দুচোখ বন্ধ আর হেকিমরা যেরকম বলেছিলেন, ঘামে ভেজা পাতলা চাদরের নিচে তার বুক দ্রুত উঠানামা করছিল। তিনি তাঁর হাতটা একটু মুচড়ে ধরতেই রওশনআরার দুচোখের পাতাগুলো তিরতির করে কেঁপে উঠলো। রওশনআরা এটা আমি …আওরঙ্গজেব।’

ধীরে ধীরে মনে হল অনেক কষ্ট করে রওশনআরা চোখ খুললেন। তাঁর দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও তাকে একটু বিভ্রান্ত মনে হচ্ছিল। তিনি কোনোমতে বললেন, আওরঙ্গজেব…এটা কি আসলেই তুমি?

হ্যাঁ অবশ্যই আমি। তুমি এখনও অসুস্থ বোন। হেকিমসাহেবরা এসেছেন, ওরা বলেছেন শীঘ্রই তোমাকে সুস্থ করে তুলবেন।’ কথাটা বললেও তাতে খুব জোর ছিল না, এমনকি নিজের কানেও তেমন মনে হল না। হেকিম না বললেও তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে তাঁর বোন খুবই অসুস্থ–এটা তার চেহারা দেখে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে।

 ‘আওরঙ্গজেব…আমি তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে চাই। দয়া করে অন্যদেরকে চলে যেতে বল।

আওরঙ্গজেব পেছন ফিরে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা দলটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দয়া করে কিছুক্ষণের জন্য আমাদেরকে একা রেখে আপনারা বাইরে যান। তারপর হেকিম দুজনের দিকে মাথা নেড়ে বললেন, আপনারাও একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। তরুণ চিকিৎসকটি তখন মাত্র রওশনআরার রক্ত নেওয়া শেষ করেছিলেন। এখন তিনি সাদা মসলিনের কাপড় দিয়ে দ্রুত রওশনআরার হাতে একটা পট্টি বেঁধে দিলেন, তারপর যন্ত্রপাতির চামড়ার ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে অন্যান্যের অনুসরণ করে বাইরে চলে গেলেন।

 ‘এখন আমরা একা, রওশনআরা বল।

তিনি আবার চোখ বুজলেন। আওরঙ্গজেব তার মুখের উপর থেকে মেহেদি রং করা একগুচ্ছ চুল টোকা দিয়ে সরিয়ে দিতেই রওশনআরা আবার কথা বলা শুরু করলেন। তবে এত আস্তে বলছিলেন যে, কথাগুলো শোনার জন্য আওরঙ্গজেব তার কাছে আরেকটু ঝুঁকলেন। কি বলতে চাচ্ছেন তিনি? আওরঙ্গজেবের মনে হল তিনি শুনতে পেলেন, “আমি দুঃখিত…খুবই দুঃখিত… আমি এটা বুঝাতে চাই নি…তোমাকে বুঝতে হবে।

 রওশনআরা অস্থির হয়ো না। চুপ করে শোও।

না, আমাকে বলতেই হবে,,’ এবার তার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার হল আর তিনি চোখ খুললেন। কোনোমতে শক্তিসঞ্চয় করে নিজেকে একটু উপরের দিকে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিলেন। তারপর একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘আওরঙ্গজেব, দয়া করে আমার কথা শোন। আমি জানি আমি… আমি তোমাকে হতাশ করেছি। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না…আমি মদ খেয়েছিলাম, কেননা এতে আমি আনন্দ পেয়েছিলাম। আর আমি তোমার সাথে প্রতারণা করবো না, এমন একসময়ে যখন মৃত্যু আমার কাছে চলে এসেছে… দুই-একবার আমি গোপন প্রণয়ী নিয়েছিলাম, ঠিক যা তুমি সন্দেহ করেছিলে। খুব কঠিনভাবে আমাকে বিচার করো না… আমি শুধু চেয়েছিলাম কেউ আমাকে নিয়ে ভাবুক… কারও কাছাকাছি হতে চেয়েছিলাম… একটু উষ্ণতা অনুভব করতে চেয়েছিলাম। যাইহোক আমি চেষ্টা করেছিলাম–এমনকি যখন জাহানারা বাবার সাথে আগ্রা দুর্গেছিলেন আর আমি ছিলাম তোমার পাশে। যদিও আমার মনে সন্দেহ ছিল তোমার আসলে আমাকে প্রয়োজন নেই কিংবা আমার ব্যাপারে তোমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তোমার জন্য এতকিছু করার পরও তুমি শুধু আমাকে সয়ে করে গেছ। এটা ঠিক নয়, আওরঙ্গজেব। এমনকি জাহানারা মুক্ত হওয়ার আগেও আমি অনুভব করেছি যে তুমি আমাকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছ, যেন আমার কোনো গুরুত্ব নেই। আমি একা হয়ে পড়লাম, যেরকম প্রায় সারাজীবন ছিলাম–মা মারা যাওয়ার পর থেকে। এরকম ভাবা কি ভুল ছিল? আমার মনে হচ্ছে আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে…আমার মনে হয় আমার আর বেশি সময় নেই। আমি কী জাহানারার মতো তোমার কাছে আপন? দয়া করে বল?

আওরঙ্গজেব হতবাক হয়ে গেলেন, তার মুখে কোনো কথা জোগাল না। তাহলে গোপন প্রেমিক নেবার কথাটা তাহলে সত্যি…তিনি বুঝতে পারলেন তিনি আর রওশনআরার কপালে হাত বুলাচ্ছেন না। তাঁর যন্ত্রণাকাতর মুখ দেখে অনেক চেষ্টার পর এক হাত বাড়িয়ে আবার তার কপাল ছুঁলেন। এমনকি যে সময়ে তাঁর নিজের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা, তখনও তার মনে জাহানারার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। তাঁকে মিনতি করছেন বলার জন্য যে, জাহানারা নয় তিনিই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই পৃথিবীতে তাঁর শেষ মুহূর্তে হয়তো কয়েকটি মিষ্টি কথা তাকে শান্ত করবে, তবে তিনি মিথ্যা কথা বলতে পারবেন না, বলবেনও না, বিশেষত সেই নারীকে যে এমন ঘোরতর পাপ করেছেন।

রওশনআরা স্থিরদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁকে কিছু একটা বলতেই হবে।

 তিনি বললেন, রওশনআরা, তুমি সম্পূর্ণ ভুল ভেবেছ যে, আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ নই। আমি অবশ্যই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। সেই শুরু থেকেই আমার সংগ্রামের দিনগুলোতে তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছ যখন খুব কম লোকই তা করেছিল। আর হ্যাঁ, আমি অবশ্যই তোমাকে ভালোবাসি… একথাটা জিজ্ঞেস করার দরকার পড়ে না। আমি…’ একটা মুহূর্ত তিনি অনুভব করলেন তিনি দুর্বল হয়ে বলতে যাচ্ছিলেন সেই কথাটা, যা রওশনআরা তার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছিলেন। তারপর নিজের মনকে শক্ত করে বললেন, আমাকে এখন যেতে হবে। তবে আমি তোমার আরোগ্যলাভের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইবো, আমার মোল্লাদেরকেও দোয়া করতে বলবো। এক টুকরা কাপড়ের কোণা গোলাপজলে ভিজিয়ে তার মুখ থেকে ঘাম মুছলেন তারপর তার কপালে একটা চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোলেন।

 ‘আওরঙ্গজেব…’

তিনি তাঁর ক্ষিণ কণ্ঠের ডাক শুনলেন, তবে আর ফিরে তাকালেন না। আর কি বলবেন তাকে? তিনি তাঁর বোন এবং তিনি তাকে ভালোবাসেন, তবে এর বেশি আর তিনি তাঁকে সান্ত্বনা দিতে পারেন না। তাঁর নিজের কথাতেই তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি একজন পাপী।

পাশের ছোট ঘরটিতে সবাই অপেক্ষা করছিলেন, জাহানারা একটু তফাতে দাঁড়িয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব তাঁর একহাত ধরে বললেন, তাঁর অবস্থার কোনো ধরনের পরিবর্তন হলে আপনি সাথে সাথে আমাকে খবর দেবেন। জাহানারা মাথা কাত করে সায় দিলেন। মহিলারা সবাই আবার রোগীর কামরায় ঢুকতেই তিনি সেখান থেকে বের হয়ে উদিপুরীর মহলে না গিয়ে তাঁর নিজের কামরায় গেলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন, তাই সেখানে পৌঁছে মার্বেল পাথরের মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে রওশনআরার জন্য নামাজে বসলেন। যখন নামাজ শেষ করলেন, একটুকরো সোনালি আলোর ছটা জানালার খড়খড়ি দিয়ে ভেতরে এসে পড়লো। মুখে সূর্যের আলোর প্রয়োজন অনুভব করে তিনি বারান্দায় বের হয়ে এলেন। দিগন্তের উপর সূর্যের সোনালি চাকাটি উঠে আসতেই নতুন একটি দিনের শুরু হল। একটু সময় তিনি নিবিষ্টভাবে অবলোকন করলেন, যে দিল্লি নগরী তাঁর সামনে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রথম উনানের ধুয়া চক্রাকারে ভোরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

একটুপরই তাকে সভাসদের সাথে আলোচনায় বসতে হবে। বোনের এমন অসুস্থতা তার উপর তার লজ্জানক স্বীকৃতির কথা বাদ দিলেও, রাজকাজে মন বসাতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু দায়িত্ব পালন করতেই হবে। এটা তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্য, তাছাড়া আরো কিছু জরুরি বিষয় নিয়ে তাঁকে কথা বলতে হবে। বিশেষত হিন্দু কৃষক আর ছোট ছোট বণিকদের ভিন্ন মার্গের এক সম্প্রদায়ের খবর এসেছে, যারা ভিনদেশী প্রথা অনুসরণ করে, তার একজন সুবেদার সতর্কবার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে যে, এরা প্রজাবিদ্রোহ প্রচার করছে।

 ভেতর গিয়ে সুবেদারের পাঠানো প্রতিবেদনটি তুলে নিলেন, যাতে মন্ত্রণাসভায় যাওয়ার আগে আরেকবার পড়ে নিতে পারেন। তবে রওশনআরার চিন্তা তার মনোযোগ বার বার সেদিকে নিয়ে যাচ্ছিল। দুজনের মাঝে বয়সের ব্যবধান মাত্র একবছরের ছোটবেলায় তারা কত কাছাকাছি ছিলেন। যেরকম তাদের বড় দারা আর জাহানারা ছিলেন। রওশনআরার একটি পোেষা বেঁজি ছিল, যা নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে খেলা করতেন। তাদের মায়ের মৃত্যুর পর দুজনের মনে যে দুঃখযাতনা হয়েছিল, তা ওদের দুজনকে আরো নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল…অথচ একটু আগে রওশনআরা অভিযোগ করলেন যে, তিনি একাকীত্বে ভুগছিলেন আর এর জন্য তাকেই দায়ী করলেন। কখন তিনি এটা বুঝতে পারলেন যে, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আল্লাহ তাঁকে নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন আর তা অর্জনের জন্য তিনি কাউকে আস্থায় নিতে পারবেন না–রওশনআরাসহ আর সবাইকে বাদ দিয়ে সমস্ত ভাবনা নিজের মনে রাখতে হবে? যদিও তারপর থেকেই কারও প্রয়োজন কিংবা কারও উপর নির্ভর না করার জন্য তিনি নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তুলেছিলেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি তাঁর বোনকে ভালোবাসেন না। নিশ্চয়ই রওশনআরা তা বুঝতেন? নিজের শালীনতার সীমা অতিক্রম করার কারণে তিনি আওরঙ্গজেবকে দোষারোপ করতে পারেন না। এর জন্য দায়ী তাঁর নিজের লালসা, আওরঙ্গজেবের ব্যর্থতা নয়।

‘আওরঙ্গজেব…’ ডাক শুনে ঘুরে তিনি জাহানারার দিকে তাকালেন। সব শেষ। আমার হাতে মাথা রেখেই সে মারা গেছে। তবে মারা যাওয়ার আগে কেবল তোমার নাম উচ্চারণ করছিল। আর শেষ মুহূর্তটিতে তার মুখে মৃদু হাসির রেখা ছিল–এমন মিষ্টি সে হাসি–আর এমনভাবে আমার দিকে তাকাল ঠিক যেরকম ছোটবেলায় তাকাত…’। জাহানারার দুগাল বেয়ে চোখের পানি নেমে এল, তিনি তার ভাইয়ের কাছে এগিয়ে তাঁকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন।

*

‘চেয়ে দেখুন জাঁহাপনা। ওদের চেহারা সম্পর্কে যা শুনেছিলাম তা সত্যি। পাটের বস্তার ভেতর থেকে কাটা মুণ্ডুটা সাদা মার্বেল পাথরের মেঝেতে পড়ে সামান্য গড়িয়ে তারপর থামল। খোলা বিস্ফোরিত চোখদুটো আওরঙ্গজেবের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুণ্ডুটা দেখতে একটু অদ্ভুত ধরনের। যে কর্মকর্তাটি লোকটিকে একজন গুপ্তচর হিসেবে পাকড়াও করে কোতল করেছিল, সে বলেছিল এদেরকে ‘সতনামি’ বলা হয়। এরা মাথার চুল আর ভ্রূ কামিয়ে ফেলে। গুপ্তচরটির বেশ আগে মৃত্যু হয়েছিল, মুণ্ডুটির চামড়ায় বিভিন্ন ধরনের নকশা ছিল আর ইতোমধ্যে এতে পচন ধরতে শুরু করেছে। গা বমি বমি করা মৃত্যুর গন্ধ আওরঙ্গজেবকে অসুস্থ করে তুললো।

তিনি বললেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে! আমি তোমাকে অবিশ্বাস করার কথা ভাবি নি। মাথাটা বস্তায় ভরে ফেল। আমার কর্মচারী এটা সরিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে। ছোট ছোট দাড়িওয়ালা বেলুচি সেনা কর্মকর্তাটি–মুটি তোলার জন্য হাতড়িয়ে বেড়াল। মাথায় কোনো চুল না থাকায় কাজটা সহজ ছিল না। শেষপর্যন্ত এটা তুলে সে বস্তায় ভরলো আর একজন চাকর মাথাসুদ্ধ বস্তাটা এক হাত তফাতে রেখে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে কামরা থেকে বের হয়ে গেল।

আওরঙ্গজেব বললেন, “আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় না যে এধরনের অদ্ভুত সম্প্রদায় আছে–হিন্দুস্তানে বিভিন্ন ধরনের ভুল ধর্মীয় বিশ্বাস গজিয়ে উঠেছে। শুকর, গরু থেকে শুরু করে মাছ, মুরগি সবকিছু যেসব মানুষ খুশিমনে খায় আর যাদের এধরনের উদ্ভট প্রথা আছে, যেখানে নারী-পুরুষ একসাথে অংশ গ্রহণ করে, তারা কখনও আমার ক্ষমতার বিরুদ্ধে মোটেই হুমকি নয়। সে স্থানীয়ভাবে হোক আর ক্ষণস্থায়ীভাবেই হোক।’

 ‘জাহাপনা এটা সত্যি ওরা কি খায় তা নিয়ে ওরা মাথা ঘামায় না আর নারী ও পুরুষ একসাথে দল বেঁধে থাকে। তবে সমস্যা হচ্ছে এখান থেকে বেশি দূরে নয় এই দিল্লিতেই নারনউল নামে একটি স্থানে ওরা একজন ধর্মোন্মাদ নেতা পেয়েছে–তাও আবার পুরুষ নয়, জটপাকানো চুলের একজন বয়স্ক মহিলা। জ্বলজ্বলে চোখের মহিলাটি নিজেকে একজন জাদুকরী হিসেবে ঘোষণা করছে। সে এমন তীব্র ভাবাবেগ আর এমন বাচনভঙ্গি ব্যবহার করে যে, তার অনুসারীরা সম্পূর্ণ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে ওদেরকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে যে, যদি ওরা তার কথামতো কাজ করে তাহলে তার যাদুমন্ত্র আর যাদুর ওষুধ খেলে তলোয়ারের আঘাত আর বন্দুকের গুলি ওদের কিছুই করতে পারবে না। তার শক্তিতে ওদের এত গভীর বিশ্বাস জন্মেছে যে, বাহুতে তার বানিয়ে দেওয়া মন্ত্রপূত কবচ পরে ওরা তার নেতৃত্বে একটি-দুটি নয়, আমাদের বেশ কয়েকটি ছোট আকারের নগররক্ষী বাহিনীকে পরাভূত করেছে। অত্যন্ত ধীরে ধীরে গোপনে, ছদ্মবেশে কিংবা অনেক সময় নর্দমার মধ্য দিয়ে এমনকি মল-নর্দমার মধ্য দিয়ে ঢুকে ওরা ভেতর থেকেই হামলা করেছে। বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, গায়ে মলদূষণ হওয়া নিয়ে ওদের কোনো পরোয়া নেই। মোটেই পরোয়া করে না।

 কর্মকর্তাটি একমুহূর্ত দম নেওয়ার জন্য থেমে আবার হুড়মুড় করে বলা শুরু করলো, ‘আচমকা যেন জাদুমন্ত্রে হঠাৎ উদয় হয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে যে, জাদুকরীর জাদুর মায়ায় ওরা দেয়াল ভেদ করে এসেছে আর ওরা অলঙ্নীয়। এতে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে আমাদের সমস্ত সেনা আর সেনা কর্মকর্তারা দুর্বল হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলে। তারপর ওরা চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে পালিয়ে যায়। এই সতনামিদের আতঙ্ক এমন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে, ওরা এখনও মাত্র পাঁচহাজার হলেও পায়ে হেঁটে প্রকৃতপক্ষে কোনো বাধা ছাড়াই দিল্লির দিকে এগিয়ে আসছে। আর চলার পথে দলে দলে কৃষকরা ওদের সাথে যোগ দিচ্ছে। গুপ্তচরের যে মুণ্ডুটা আমি আপনাকে দেখিয়েছি, তাকে এখান থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে একটা গ্রাম থেকে ধরেছিলাম। আমি খবর পেয়েছি ওদের মূল দলটি দিল্লি থেকে এর দ্বিগুণ দূরত্বে রয়েছে। এভাবে তাড়াতাড়ি আলুথালু বেশে আপনার সামনে হাজির হওয়ার জন্য অনুগ্রহ করে আমাকে মার্জনা করবেন সঁহাপনা। তবে আমার মনে হয় আত্মরক্ষা করার মতো যথেষ্ট সৈন্য আমাদের হাতে নেই। কারণ আমাদের মূল সেনাবাহিনী এখন পাঞ্জাবে শিখদের মোকাবেলা করছে। আমি সত্যি আতঙ্কিতবোধ করছি। তারপর সে নীরব হল।

আওরঙ্গজেব কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শান্ত হও, জওয়ান। আমাদের সিপাহিদের আতঙ্ক মনে হচ্ছে এমন ছোঁয়াচে যে, তা তোমার গলায় চেপে বসেছে। একজন সেনা কর্মকর্তার মনের ভেতরের উদ্বেগ যাইহোক, তা বাইরে প্রকাশ করা যাবে না। এটা তুমি ঠিক বলেছ যে আমাদের সেনাবাহিনীর মূল অংশ গুরু তেগ বাহাদুরের নেতৃত্বে শিখদের মোকাবেলা করছে। তবে ওদের তাই করার কথা। শিখরা আমাদের শাসনের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘস্থায়ী হুমকি। ওরা সাহসী, সুশৃঙ্খল আর উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ওদের ধর্মমত–আমাদের মতো না হলেও, তুমি যে জাদুকরীর প্রলাপ বকার কথা বলেছ তার চেয়ে অনেক সুসঙ্গত। সেনা কর্মকর্তাটি কাঁধ সোজা করে দাঁড়াল, তবে তার চেহারায় তখনও উদ্বেগের ছাপ রয়ে গেছে। সে বললো, জাহাপনা, আমি অসঙ্গত আপনাকে আতঙ্কিত করতে কিংবা নিজেকেও অতিরিক্ত আতঙ্কগ্রস্ত দেখাতে চাই নি। সেনাবাহিনীকে কোথায় আপনি মোতায়েন করবেন, সে ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি উদ্বিগ্ন–আর স্বীকার করছি এখনও তাই বুঝতে পারছি না কেমন করে এই সতনামিদের প্রতিরোধ করবো।

আওরঙ্গজেব বললেন, ‘সে ভাবনা আমার। এখন তুমি যাও, বিষয়টা নিয়ে আমাকে ভাবতে দাও।’ তারপর সেনা কর্মকর্তাটি ঝুঁকে তাঁকে সালাম জানিয়ে দরজার দিকে এগোতেই আওরঙ্গজেব নরম কণ্ঠে বললেন, ‘এত তাড়াতাড়ি ছুটে এসে খবরটা দিয়েছ, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এধরনের হুমকির খবর যত তাড়াতাড়ি আমি পাবো তত দ্রুত আমি ওদের মোকাবেলা করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবো।’

লোকটি চলে যাওয়ার পর আওরঙ্গজেব কয়েক মিনিট বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দিল্লি শহরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকজনের বিশ্বাসপ্রবণতা দেখে তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলেন। কোনো শুভ বা অশুভ লক্ষণ, জাদু আর ফকিরের বিভিন্ন ধরনের কেরামতি ও প্রলাপ বকার উপর তাদের অন্ধ বিশ্বাস তাদের কোনো আধ্যাত্মিক উন্নতি না করলেও তাদের অসুস্থ মনে ঠিকই প্রভাব ফেলে। হিন্দুস্তানের মানুষদেরকে তাদের ভুল দেখিয়ে দিয়ে সঠিক পথে আনাটা তার কর্তব্য। এটা করাটা তাঁর শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে, যা তিনি নিজের জীবনে করেছেন। তবে তাঁর এখনকার কাজ হল এই অদ্ভুত সতনামি আর তাদের জাদুকরীকে দ্রুত সম্পূর্ণরূপে দমন করা। কেননা একবার এরা ছড়িয়ে পড়লে তার সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু কি করে এটা করা সম্ভব, যেখানে তার বেশিরভাগ সেরা সেনা পাঞ্জাবে রয়েছে, এটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐ সেনা কর্মকর্তাটির আচরণ তাকে পরিষ্কার দেখিয়েছে যে, উদ্বেগ আর প্রায় আতঙ্ক কত দ্রুত সবচেয়ে অনুগত ব্যক্তিকেও প্রভাবিত করতে পারে।

শহরের দিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে একের পর এক সম্ভাবনার কথা ভাবতে লাগলেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল আর রান্নার চুলার আগুন অন্ধকার ভেদ করে ফুটকি দিয়ে জ্বলে উঠতে লাগলো। তারপর তাঁর মনে ধারণাটা এল। প্রচণ্ড অগ্নিকাণ্ড এড়াতে হলে তাকে আগুন দিয়েই আগুনের সাথে লড়াই করতে হবে। তাঁর নিজের লোকজন আর সৈন্যরা যদি জাদুমন্ত্র আর তাবিজ-কবচে বিশ্বাস করে, তাহলে তিনিও তাদেরকে দেখাবেন যে, তিনিও এসব প্রয়োগ করতে পারেন। মুসলিম সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য ইমামদের বলবেন যথারীতি দোয়াকালামের ব্যবস্থা করতে আর যেসব হিন্দু বিভিন্ন দেবদেবীতে বিশ্বাস করে তাদের ব্যাপারেও হিন্দু পুরোহিতরাও সেরকম ব্যবস্থা নেবে। যারা একটু অনিচ্ছুক হবে, তাদের ক্ষেত্রে ‘দান করলে ঠিকই কাজ দেবে। সতনামিদের মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে সৈন্যরা দিল্লি ত্যাগ করার আগে এসব দোয়া আর মন্ত্র পার্চমেন্ট কাগজে লিখে কাগজগুলো পতাকায় সেলাই করে ইমাম আর পুরোহিতরা সেনাদলের সামনে প্রদর্শন করবে। পরের দিন সেনাবাহিনী যখন রওয়ানা দেবে, তখন সবার আগে এগুলো থাকবে। আর তাদের মনে সাহস যোগানোর জন্য তিনি নিজে এই সেনাদলের নেতৃত্ব দেবেন। এই বাহিনী মূলত্ব অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে গঠিত হবে, যাতে পায়ে হেঁটে আসা সতনামিদের বিরুদ্ধে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা যায়। তাছাড়া এদের বেশিরভাগই মাত্র কিছুদিন পূর্বে সাধারণ কৃষক ছিল।

*

আরেকবার তাঁর বিশাল যুদ্ধহস্তীর পিঠে সোনার পাতে মোড়া হাওদায় বসে আওরঙ্গজেব মাথার উপর হাত তুলে অশ্বারোহী বাহিনীকে সতনামিদের উপর আক্রমণ করার ইঙ্গিত দিলেন। ওরা তখনও এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে অস্ত্র হাতে নেবার চেষ্টা করছিল। দিল্লি থেকে প্রায় বিশ মাইল দূরে ধীরে বয়ে চলা যমুনার একটি উপনদীর কর্দমাক্ত তীরে ওরা যখন রাতের জন্য শিবির স্থাপন করতে যাচ্ছিল, তখন তিনি তাঁর সেনাদল নিয়ে অতর্কিতে ওদের উপর আক্রমণ করলেন। তাঁর কথাই ঠিক ছিল। মুসলিম আর হিন্দু ধর্মগুরুরা যে প্রার্থনা তৈরি করে দিয়েছিলেন, তাতে সেনাদলের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওরা মাত্র ছয় ঘণ্টায় দিল্লি থেকে এই দূরত্ব পেরিয়ে এসেছিল। এখন তার সৈন্যদের মধ্যে কোনো আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে না। বরং ওরা উল্লাসে চিৎকার করতে করতে বল্লম সোজা করে কিংবা তরোয়াল খাপমুক্ত করে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে। বিশেষত লখনৌ থেকে আসা মুসলিম আর রাজস্থান থেকে আসা হিন্দু সেনারা তাদের যার যার ধর্মীয় পতাকা উড়িয়ে চলছিল। দূরদর্শিতা দেখিয়ে তিনি তাদেরকে একেবারে সামনে না রেখে মাঝখানের সারিতে রেখেছিলেন, কেননা কোনো একজন পতাকাবাহীর মৃত্যু কিংবা দোয়া এবং মন্ত্ৰলেখা পতাকা কাদায় পড়ে গেলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

 মুষ্টিমেয় কয়েকজন সামি ছুটে আসা মোগলদের দিকে তীর ছুঁড়লো। ঘাড়ে তীরের আঘাতে আহত হয়ে একেবারের সামনের একটি ঘোড়া মাটিতে লুটিয়ে পড়লো, সাথে সাথে এর সওয়ারিও ডিগবাজি খেয়ে ঘোড়াটির মাথার উপর দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আরেকজনের পায়ে তীর বিধতেই সে তার ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারাতেই ঘোড়াটি একপাশে ঘুরে গেল। যাইহোক আওরঙ্গজেব তার মাহুতকে বললেন তার অশ্বারোহীবাহিনীকে অনুসরণ করতে, যাদের প্রথম দলটি ইতোমধ্যেই সতনামিদের মাঝে ঢুকে পড়েছিল। তবে বেলুচি সেনা কর্মকর্তাটি যা অনুমান করেছিল তার চেয়ে সতনামিদের সংখ্যা অনেক বেশি মনে হল। এদের বেশির ভাগেরই হাতে ছিল তীর-ধনুক আর কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করা সাধারণ মানের বিভিন্ন হাতিয়ার।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সতনামিদের পতন শুরু হল। কেউ কেউ মোগল সেনাদের ঘোড়ার চাপে পিষ্ট হল আর অনেকে মোগল সেনাদের তরোয়ালে কাটা পড়লো। অনেকেই মরছিল, তবে আহত হলেও কেউ পেছন ফিরে পালাতে চেষ্টা করলো না। অর্ধনগ্ন কংকালসার দেহের একজন সতনামির মুখ তোয়ালে কেটে গেলেও সে তার কাস্তে দিয়ে ক্ষেতে ধান কাটার মতো ধীরে সুস্থে ছুটে চলা ঘোড়ার পায়ে আঘাত করে চললো। মাংসপেশি কেটে যাওয়ায় দুটি ঘোড়া হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল, তারপর একজন মোগল সেনা বর্শা দিয়ে তাকে গেঁথে ফেললো।

নেংটিপরা লম্বা, বলিষ্ঠ গড়নের আরেকজন সতনামি লাফ দিয়ে মোগল বাহিনীর একটি কালো ঘোড়ার ঘাড়ের উপর চড়ে বসে কেবল গায়ের জোরে আর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে টেনে আরোহীসহ ঘোড়াটিকে মাটিতে টেনে নামাল। তারপর হতবুদ্ধি হয়ে পড়া মোগল সৈন্যটির হাত থেকে তরোয়াল কেড়ে নিয়ে তার গায়ে ঢুকিয়ে দিল। তার দেখাদেখি অন্যান্য সতনামিরাও তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করলো। সবাই সফল হল না, কেউ ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল আবার কেউ ঘোড়র পায়ে পিষ্ট হল। তবে প্রায় বিশজন মোগল সেনা মাটিতে পড়ে গেল। কেউ কেউ নদীর তীরে কাদার উপর হাতপা ছড়িয়ে পড়ে রইল আবার কেউ কেউ চারপাশ থেকে ছুরি আর বর্শা নিয়ে একনাগাড়ে কুপিয়ে চলা সতনামিদের প্রতিহত করে যেতে লাগলো। যাইহোক শীঘ্রই নদীর তীরে স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা সতনামিদের লাশের সংখ্যা দেখে বুঝা গেল লড়াই মোগলদের সপক্ষেই যাচ্ছে। তারপরও শরীরের কয়েক জায়গায় আহত হয়ে পড়ে যাওয়া পর্যন্ত বাকি সতনামিরা মাটি কামড়ে ধরে লড়াই করে চললো।

 আওরঙ্গজেবের যুদ্ধহস্তীটি সতনামি শিবিরের কেন্দ্র থেকে সামান্য দূরে মোগল অশ্বারোহী বাহিনীর প্রথম সারির কাছাকাছি পৌঁছতেই বড় একটি তাঁবু থেকে দশবারোজন লোক হৈ হৈ করে ছুটে বেরিয়ে এল। এদের কয়েকজনের হাতে গাদা বন্দুক ছিল আর তা ওরা আওরঙ্গজেবের দিকে নিশানা করার চেষ্টা করতে লাগলো। আওরঙ্গজেবের দুজন দেহরক্ষী ওদেরকে আক্রমণ করলো, তবে তার আগেই একজন সতনামি গুলি ছুঁড়লো। মাথায় গুলির আঘাত লেগে একজন দেহরক্ষী তার ঘোড়ার ঘাড়ের উপর লুটিয়ে পড়লো। আতংকিত ঘোড়াটি ছুটে নদীতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আর আরোহীর দেহটি মুখ নিচু করে কাদাভরা পানিতে পড়ে গেল। সবুজ পাগড়িপরা দীর্ঘদেহের অপর দেহরক্ষীটি তার বীরত্ব দেখিয়ে চললো। সে তিনজন সতনামি বন্দুকবাজকে ঘায়েল করলো। লোকগুলো তাদের লম্বা নলের বন্দুক সোজা করে ধরার আগেই সে ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝুঁকে তরোয়াল দিয়ে অর্ধনগ্ন সতনামিদের হাড্ডিসার শরীরে কুপিয়ে চললো।

 একজন সতনামি গাদা বন্দুক ছুঁড়তেই ক্ষিপ্রগামী ঘোড়াটি ঘুরিয়ে সে ধাক্কা দিয়ে বন্দুকের নলটি সরিয়ে লোকটির কামানো মাথায় তরোয়ালের কোপ মেরে মাথাটা কেটে দুভাগ করে দিল। দ্বিতীয় সতনামিটি দ্রুত তার প্রাচীন বন্দুকটি ঘুরিয়ে বন্দুকের বাট দিয়ে দেহরক্ষীর ঘোড়াটির গলায় আঘাত করলো। যন্ত্রণায় চিহিহি করে ঘোড়াটি পেছনের পা উঁচু করে আরোহীকে পিঠ থেকে ফেলে দিল। সতনামিটির পায়ের কাছে মোগল দেহরক্ষীটি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো, তোয়াল হাত থেকে ছুটে গেল। সতনামিটি আবার বন্দুকের কুঁদো উঁচু করে দেহরক্ষীটির তলপেটে আঘাত করলো। শরীর ভাঁজ করে মোগল সেনাটি উঠে বসতেই সমিটি তার পাগড়িপরা মাথা লক্ষ করে বন্দুকের কুদো চালালো, তবে মোগলসেনাটি ঠিক সময়ে শরীর মুচড়ে সরে গেল। তারপর সে কোমর থেকে ছুরি বের করে সতনামিটির নগ্ন ঊরুতে বাটপর্যন্ত ছুরির ফলাটি ঢুকিয়ে দিল। লোকটি সেদিকে মোটেই খেয়াল না করে আবার তার বন্দুকের কুঁদো উঠিয়ে আঘাত করলো। তবে দেহরক্ষী বন্দুকের কুঁদোটা ধরে ফেলে এক টানে সতনামিটির হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। তারপর অতিকষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে বন্দুকের কুঁদোটা দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে কয়েকবার সতনামিটির মুখে আঘাত করে তার নাকমুখ থেতলে দিল।

 ইতোমধ্যে অন্য সতনামিটি আওরঙ্গজেবের দিকে গুলি ছুঁড়লো। গুলি লেগে হাওদার কাঠের ছাদের একটি অংশ ভেঙ্গে গেল। আওরঙ্গজেব চিৎকার করে মাহুতকে বললেন, ‘ঐ লোকটা আবার গুলি ভরার আগেই তার উপর হাতি চালিয়ে দাও। সাথে সাথে মাহুত তার নির্দেশ মেনে হাতি এগিয়ে নিল। তবে হাতিটি সতনামি বন্দুকধারীর কাছে পৌঁছাবার আগেই, যে দেহরক্ষীটি লড়াই করছিল, সে লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। লোকটির পায়ের গোড়ালি ধরে তাকে টেনে মাটিতে নামিয়ে তার হাত থেকে গাদা বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল। তারপর ঘুসি মেরে তাকে অজ্ঞান করে ফেললো।

যে তাঁবুর আড়ালে বন্দুকধারীরা লুকিয়ে ছিল, এখন সেই তাঁবুর কাপড় এক টানে সরিয়ে ছোটখাট কঠোর চেহারার লম্বা পাকাচুলের একটি নারী মূর্তি দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে বের হয়ে এল। সে বার বার উচ্চারণ করে চললো, ‘আমি জাদুকরী! আমি জাদুকরী!’ জাদুকরীটি ডানে বামে না তাকিয়ে মাথা উঁচু করে সোজা আওরঙ্গজেবের হাতিটির দিকে হেঁটে চললো। কয়েকজন দেহরক্ষী ভয়ে পিছিয়ে এল। কেউ তাকে থামাতে এগিয়ে এল না। আওরঙ্গজেবের হাতির সামনে এসে থেমে সে সম্রাটের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, আপনি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না। আপনার অস্ত্র দিয়ে আমাকে আর আমার অনুসারীদের উপর আঘাত করলে, তা আবার সেরে যাবে আর আমরা আবার জেগে উঠবো। তবে আমি যেখানে আঘাত করবো, তা কখনও সারবে না। আমি মনে আঘাত করবো। আমি অভিশাপ দিচ্ছি আপনি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন, তবে কখনও আপনার পরিবারে কিংবা রাজত্বে শান্তি খুঁজে পাবেন না।

আওরঙ্গজেব কোনো উত্তর না দিয়ে পেছনে বসা আর্দালিকে বন্দুকটা দিতে বললেন। হাতে তুলে নিয়ে জাদুকরীর দেহের দিকে লক্ষ্যস্থির করলেন। সে মোটেই ঘাবড়াল না, বরং আওরঙ্গজেবের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার তার সেই সম্মোহনকর মন্ত্র আউড়াতে শুরু করলো। একটি মুহূর্ত আওরঙ্গজেব থমকালেন, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে গুলি ছুড়লেন। জাদুকরীর হাড়জিরজিরে বুক থেকে ফিনকি দিয়ে লাল টকটকে রক্ত বের হয়ে তার পুরোনো পাতলা মসলিনের পোশাক রাঙিয়ে দিল, কিন্তু তার চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না এমনকি চোখের পাতাও কাঁপলো না। সে স্থির দৃষ্টিতে আওরঙ্গজেবের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখ থেকে গল গল করে রক্ত বের হয়ে চিবুক ভিজিয়ে দিলেও সে তখনও সেই মন্ত্র আউড়ে চললো। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটু ভেঙ্গে সামনের দিকে মুখ করে দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে কাদার উপর মুখ থুবড়ে পড়তেই মন্ত্র থেমে গেল।

আওরঙ্গজেব নির্দেশ দিলেন, তার দেহটি নিয়ে যেসব শহর আর গ্রাম সে দখল করেছিল সেসব জায়গায় ঘুরিয়ে দেখাও। প্রত্যেক জায়গায় একজন করে সতনামি বন্দীকে কোতল করবে আর লাশগুলো শিকলে বেঁধে ফেলে রাখবে পচার জন্য, যাতে কারও মনে সন্দেহ না থাকে যে ওরা মারা গিয়েছে আর তার অনুসারীরা যে কোনো মানুষের মতোই মরণশীল। তারপর মাহুতের দিকে ফিরে বললেন, ‘হাতি ঘুরাও। আমরা এখন দিল্লি ফিরে যাবো। সন্ধ্যার অন্ধকার পথ দিয়ে হাতি চলা শুরু করতেই তিনি সামনে যে কাজগুলো বাকি আছে সেগুলোর কথা ভাবতে শুরু করলেন পাঞ্জাবে শিখ বিদ্রাহীদের দমন করতে হবে, শিবাজি দক্ষিণে ধীরে ধীরে তার শক্তি সংহত করছে, তাকে আবার ধরতে হবে, আর সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পারস্যের সহায়তায় উচ্ছশৃঙ্খল উপজাতিরা যে বিদ্রোহ শুরু করেছে তাও দমন করতে হবে। এতকিছু ভাবনার পরও সেই মহিলার কথাগুলো তাঁর মাথায় তখনও প্রতিধ্বনিতৃ করছিল। যতই তিনি নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন যে, ঐ মহিলাটি একজন বিকৃতমস্তিষ্ক কাফের আর তিনি একজন বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এবং এমন একটি ধর্মের অনুসারী যেখানে এই ধরনের অভিশাপের কোনো স্থান নেই, তারপরও তাঁর মন থেকে কথাগুলো চলে যাচ্ছিল না।

*

সিফিরকে দেখে একটু অস্থির মনে হচ্ছিল, বিয়ের মুকুটের নিচে তার চোখে সতর্ক দৃষ্টি দেখা যাচ্ছে। তাকে নিরীক্ষণ করে আওরঙ্গজেব ভাবলেন, দীর্ঘ বারো বছর গোয়ালিয়রের দুর্গে আটক থাকার পর তাঁর ভ্রাতুষ্পত্রের একটু সন্ত্রস্ত থাকাটাই স্বাভাবিক। লাল কেল্লায় মূল ময়দানে বিয়ের অনুষ্ঠান তখন শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। সিফিরের চৌকোণা চওড়া কপাল আর মুখের সাথে তার বাবা দারা শিকোহর চেহারার কোনো মিল নেই। অথচ তার বোন জানির সাথে তার বাবার বেশ মিল রয়েছে। হয়তো সে তার প্রয়াত মা নাদিরার মতো দেখতে হয়েছে। আওরঙ্গজেব ভ্রু কুঁচকালেন। অনেক চেষ্টা করেও তিনি নাদিরার কথা কিছুই মনে করতে পারলেন না, শুধু এটুকু মনে পড়লো যে, তাঁর ভাই সবার চেয়ে তাঁকেই বেশি ভালোবাসতেন আর যখন তিনি আর দারা তাঁর সেনাদলের তাড়া খেয়ে পালাচ্ছিলেন, তখন পালাবার সময় পথেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

এই বিয়ের ধারণাটিও জাহানারার মাথা থেকে এসেছিল। তিনি আওরঙ্গজেবকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, বন্দী সিফিকে গোয়ালিয়র দুর্গ থেকে মুক্ত করে তাকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়ে তুমি আবার সবার কাছে প্রমাণ করবে যে, আমাদের পারিবারিক কলহের দিনগুলোর অবসান হয়েছে। আর আমাদের মধ্যে যদি কেউ আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করতে চাইলেও, এই বিয়ে তা অনুৎসাহিত করবে। তবে এই সিদ্ধান্তটি নিতে আওরঙ্গজেব বেশ লম্বা সময় নিলেন। দারার অনেক সমর্থক এখনও রয়েছে। তাঁর সাম্রাজ্যের মধ্যে অনেকেই তাঁকে হটিয়ে দারার একমাত্র জীবিত ছেলেকে সিংহাসনে বসাবার ষড়যন্ত্র করতে পারে। মোগল রাজবংশের মাঝে যে বিভক্তি হয়েছে তার অবসান ঘটাবার জন্য তিনি যে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন, তা জাহানারাকে দেখাবার জন্য তিনি ভারসাম্য বজায় রেখে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিফিরকে মুক্ত করার ঝুঁকি নিলেন। অবশেষে অনেক ভেবে একটি উপায় বের করলেন, যাতে জাহানারার ইচ্ছা পূরণের সাথে সাথে তাঁর নিজের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যায়। যদিও সিফিরকে গোয়ালিয়র ফিরে যেতে হবে না, তবে সে সম্পূর্ণ স্বাধীনতাও পাবে না–অন্তত এখুনি নয়। নববধূকে নিয়ে সে বরং দিল্লির যমুনা নদীর সেলিমগড় দ্বীপে থাকবে। আরাম আয়াসেই জীবন কাটাবে আর কোনো কিছুর অভাব হবে না, তবে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকবে আর গুপ্তচরেরা সবসময় তার উপর নজর রাখবে।

 রুপালি সুতা দিয়ে বোনা ঝিকমিক করা বিয়ের ঘোমটায় ঢাকা দীর্ঘাঙ্গি যে তরুণীটি সিফিরের পাশে বসে রয়েছে, সে আওরঙ্গজেবের নিজেরই মেয়ে জুবদাতুন্নেসা। সম্রাট আকবরের সময় থেকে শুরু করে এই প্রথম একজন মোগল সম্রাটের মেয়ের বিয়ে হল। অবশ্য এটিও জাহানারার কারণেই হয়েছে। তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন, এটা ঠিক নয় যে, একজন সম্রাটের মেয়ে বিয়ে করতে পারবে না? স্বামী-সন্তানের সুখ থেকে কেন তাদেরকে বঞ্চিত করা হবে?’ আওরঙ্গজেব অনুভব করলেন, এই কথাগুলো রওশনআরার মৃত্যুর ঠিক আগের কথাগুলো প্রতিধ্বনি করছে। তিনি জাহানারার চোখে বেদনার আভাস দেখতে পেলেন–সেটা নিজের জন্য কিংবা রওশনআরার জন্য কিংবা হয়তো উভয়ের জন্যই হতে পারে।

সিংহাসনের সম্ভাব্য দাবিদার প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্ম সীমিত করার জন্য সম্রাট আকবর যে নিয়ম প্রচলিত করেছিলেন, এযাবত তিনি তা নিয়ে কখনও প্রশ্ন তুলেন নি। তবে এই মোল্লারা তাঁকে জানালেন যে, কোরআনে এর কোনো ভিত্তি নেই। তাছাড়া তিনি দেখলেন যে, এটি যৌন অপরাধ উৎসাহিত করতে পারে। রওশনআরা তার যৌনাচারের কারণ হিসেবে একেই দায়ী করেছিলেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, সম্ভবত এই নিয়মটি এর উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম রাজবংশের ভেতরে যে সংঘাত চলেছে, এটি তা প্রতিরোধ করতে পারে নি। বিষয়টি নিয়ে অনেক বিবেচনা করে তিনি নিশ্চিত হলেন যে, আবেগ নির্ভর এবং অযৌক্তিক আইন দিয়ে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা যাবে না। সাম্রাজ্য দৃঢ়ভাবে টিকিয়ে রাখার সর্বোত্তম এবং একমাত্র উপায় হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষার উপর ভিত্তি করে সরকার ও পরিবার, উভয়ের উপর কঠোর এবং অটল নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। তাঁর অনেক পূর্বপুরুষ তাদের জীবনের পরবর্তী বছরগুলোতে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন–মদ, আফিম এমনকি মেয়ে-মানুষে মজে গিয়ে এদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন। অথচ তাদের উচিত ছিল নির্মমভাবে নিজেদের কর্তৃত্ব ঘোষণা করা। তিনি সে ভুলটি করবেন না। রাজত্বের শুরুতে তিনি যেরকম কঠোর হাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, শেষেও সেরকম নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবেন। কাজেই তাঁর মেয়েদের বিয়ে হলে তিনি সেরকম কোনো হুমকির আশংকা করেন না।

আওরঙ্গজেব উঠে দাঁড়িয়ে নববধূ আর বরকে শেষবারের মতো দোয়া করে হাস্যোজ্জ্বল অতিথিদের মধ্য দিয়ে হেঁটে বিয়ের আসর থেকে বের হয়ে গেলেন। খাওয়া-দাওয়া আর আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে বিয়ের আসর অনেক রাত পর্যন্ত চলবে। তাকে এখন অনেক জরুরি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। পেশোয়ার থেকে তাঁর সুবেদার খবর পাঠিয়েছে যে, পারস্যের শাহ-এর কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বিদ্রোহীরা দিন দিন আরো শক্তিশালী আর অবাধ্য হয়ে উঠেছে। সব সময়ের মতো মোগল সাম্রাজ্যের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ওরা মোগল সাম্রাজ্য এলাকার ভেতরের গ্রামগুলোর উপর আক্রমণ চালিয়ে ধূলিসাৎ করছে আর শান্তিপ্রিয় বণিকদের কাফেলার উপরও লুটপাট চালাচ্ছে।

শীঘ্রই তাঁকে আবার সামনে থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধাভিযানে বের হতে হবে। তবে আল্লাহর ইচ্ছায় এবার তিনি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ একটি রাজপরিবার রেখে যাচ্ছেন। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে যে কোনো সময়ের তুলনায় এবারই প্রথম ওরা এরকম একতাবদ্ধ। হয়েছেন। এই বিয়েটি এই একতার একটি জোরালো প্রতীক হয়ে থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *