০৪. বিদ্রোহ ধূলিসাৎ হল

০৪. বিদ্রোহ ধূলিসাৎ হল

রওশনআরা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, মনে রেখো জানি হচ্ছে–দারার মেয়ে! যে বিশ্বাসঘাতককে তুমি ঘৃণা কর তার মেয়েকে কেন ছেলের বউ বানাচ্ছ? অনেক সময় আমি তোমাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।’

আওরঙ্গজেব ভাবলেন, তবে আমি তোমাকে ঠিক বুঝি। যেহেতু জাহানারা এই প্রস্তাবটি এনেছে শুধু একারণেই আজম আর জানির মধ্যে এই বিয়েতে তিনি রাজি হচ্ছেন না। বড় বোনকে সাম্রাজ্যের পাদিশাহ বেগমের পদে পুনর্বহাল করায় রওশনআরা তার ক্ষোভ চেপে রাখতে পারে নি। একটা বাচ্চামেয়ের মতো অস্থিরভাবে ঠোঁট ফুলিয়ে তিনি বললেন, এটা ঠিক না। সে নয়, আমিই তোমার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম! আগ্রা দুর্গ থেকে পালিয়ে এসে কে তোমার শিবিরে যোগ দিয়েছিল? সেটা জাহানারা নয়–সেটা ছিলাম আমি! কে তোমাকে জানিয়েছিল আগ্রা দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের বাবা কতজন প্রহরী আর কয়টা কামান রেখেছেন? আমি!’ প্রথম প্রথম আওরঙ্গজেব মিষ্টি কথায় তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিলেন, তারপর চমৎকার গোলকুন্ডা হীরা বসানো সুন্দর একটা সোনার হার দিয়েছিলেন। রওশনআরা সাগ্রহে সেটা গ্রহণ করেছিলেন–আর করবেন না কেন? তিনি রত্ন খুব ভালোবাসেন। তা সত্ত্বেও রাজদরবার দিল্লিতে ফিরে আসার পর তিনি মুখ গোমড়া করে হেরেমে নিজের ঘরেই বসেছিলেন আর একবারও জাহানারাকে দেখতে তার প্রাসাদে যান নি। আর এখন…

আওরঙ্গজেব বললেন, ‘বোন, আমাকে বিচার করতে দিন কোনটি আমাদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। এমনকি আগ্রা থাকাকালীন আমি লক্ষ করেছি আজম তার চাচাতো বোনের প্রতি একটু বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল– আর আপনি নিজেও এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ–সতর্ক হওয়ার জন্য বলেছিলাম! তবে আমি কখনও একথা ভাবি নি যে তুমি তাদের বিয়ে দিতে চাইবে।

আওরঙ্গজেব বললেন, ‘দারার মেয়ের সাথে আমার একজন ছেলের সম্পর্ক করলে আমার অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে, কমবে না। আর এতে দুনিয়ার সবাই জানবে যে, অতীতে আমাদের সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছিল তা আমি মেটাতে চাই।’ কথাগুলো বলার সময় আওরঙ্গজেব সচেতন হলেন যে, প্রায় একই কথা জাহানারা তাকে বলেছিলেন।

কিন্তু তুমি আমাকে সব সময় বলতে যে, আজমের সাথে কোনো অভিজাত ব্যক্তির মেয়ে কিংবা বিদেশি কোনো শাহজাদির বিয়ে দেবে…?

‘তা এখনও করা যায়…শুধু জানিই আজমের একমাত্র স্ত্রী হবে কেন?

 যাই হোক তোমার উচিত ছিল অন্তত এই বিয়ের ব্যাপারটা আমাকেই প্রথমে বলা, অথচ আমাকে হেরেমের অন্যের কাছ থেকে খবরটা শুনতে হল। ভেবে দেখেছ এতে আমার মনের অবস্থা কি হয়েছে? অন্য আরেকজন মহিলার দিকে তাকিয়ে আমার কিরকম লেগেছিল বলো তো?”

 ‘আমি দুঃখিত, সত্যি আমার ভুল হয়ে গেছে। তোমাকেই আমার প্রথমে বলা উচিত ছিল।’

 ‘এখন যে সেটা বুঝতে পেরেছ সেজন্য আমি খুশি হয়েছি।’

‘সেক্ষেত্রে আমিও আশা করি যে, তুমি বুঝবে কেন আমি বিয়েটা দিতে চাচ্ছি। যাই হোক, তোমাকে দেখে আমি খুশি হয়েছি, কারণ একটা ব্যাপারে আমার তোমার সাহায্য প্রয়োজন।’

 ‘আমার সাহায্য?

 ‘চাকরি করার সময় আমাদের যেসব কর্মকর্তা মৃত্যুবরণ করে, তাদের বিধবা স্ত্রী আর পরিবারের সাহায্য করার জন্য আমি একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলাম। খাজাঞ্চী আমাকে জানিয়েছে এখানে প্রচুর দেনা হয়েছে, অথচ আমি প্রতিবছর এতে হাজার হাজার রুপি অনুদান দেই। সম্ভবত এটা ঠিক মতো চালাতে পারছে না কিংবা কেউ তহবিল তছরূপ করছে। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি উপযুক্ত ভাবতে পারছি না, যে বিষয়টা তদন্ত করে আমাকে জানাবে। তুমি কী কাজটা করবে?

এক মুহূর্ত পর রওশনআরা বললেন, হ্যাঁ। তার মুখে খুশির মৃদু হাসি দেখে আওরঙ্গজেব বুঝলেন যে, তাঁর পরিকল্পনায় কাজ হয়েছে। তিনি সব সময় জানতেন কিভাবে তার বোনকে সামলানো যায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি একা থাকতে পছন্দ করতেন না, সব সময় চাইতেন কেউ না কেউ তাকে সঙ্গ দিক, সবাই তাকে দেখুক আর তাকে গুরুত্ব দিক। আর এতে তার মধ্যে এমন একটি ভাব হত যে, তোষামোদে সহজেই ভুলে যেতেন আর কেউ অবজ্ঞা করলে ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা হত। জাহানারা রাজদরবারে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তিনি নিজের শক্তিতে আস্থাহীন ছিলেন–এমনকি আওরঙ্গজেবের প্রতিও শ্রদ্ধাবান ছিলেন। সব সময় তাঁকে খুশি করতে চেষ্টা করতেন। পরবর্তীতে বড় বোনের প্রতি তাঁর বিরক্তি আর ঈর্ষা তার উপর চেপে বসে। এখন থেকে তার সাথে ঘন ঘন দেখা করতে হবে, তার প্রশংসা করতে হবে বিশেষত সবার সামনে আর প্রচুর উপহার দিতে হবে। আওরঙ্গজেব তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, এখন আমাকে ক্ষমা কর। মাগরেবের নামাজের আগে আমাকে প্রচুর কাজ করতে হবে।

 আবার একা হওয়ার পর আওরঙ্গজেব জানালার ধারে একটা কৌচে বসে চোখ। বুজে দুই হাত চিবুকের নিচে রেখে চিন্তায় মগ্ন হলেন। বিয়েটা দশ সপ্তাহের মধ্যে হবে আর তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন এটাকে জমকালো করতে। সম্প্রতি তিনি যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, সাধারণ পোশাক পরবেন আর রত্নালঙ্কার পদদলিত করবেন, সেই কারণে এই উৎসবটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ করা থেকে থামানো যাবে না। এমন উৎসব করতে হবে যা তাঁর প্রজারা কখনও দেখেনি। বিয়ের উৎসবটি জমকালো করার এক মাত্র উদ্দেশ্য হল, সারা পৃথিবীকে মোগল সাম্রাজ্যের সম্পদ আর স্থায়িত্ব দেখান আর সর্বোপরি এই সাম্রাজ্যকে যে তিনি দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে রেখেছেন তাও সকলকে দেখান।

*

দিল্লির লাল কেল্লায় জাহানারার চমৎকার মহলের সিঁড়ির সবচেয়ে উঁচু ধাপে দাঁড়িয়ে আওরঙ্গজেব শোভাযাত্রা সহকারে বরের আগমন দেখছিলেন। মোগল কায়দার সবুজ পোশাকপরা পাশাপাশি দশজন করে মোট দুইশোজন বেহারা খাঁটি সোনার থালায় মণিমুক্তা, স্বর্ণমুদ্রা আর দামি মশলা গোলমরিচ, দারুচিনি আর লবঙ্গ নিয়ে সমান তালে পা ফেলে হেঁটে সবার সামনে এগিয়ে আসছে। ওদেরকে অনুসরণ করছে রূপালি শিরস্ত্রাণ আর বুকে বর্মপরা রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একটি দল। ওদের কালো ঘোড়ার কেশর রেশমের মতো ঝিকমিক করছে।

এর পেছনেই সোনালি জ্যাকেটপরা চৌদ্দ বছর বয়সি আজম লম্বা গলা, বড় বড় চোখ আর ফাঁকাসে পশমের একটি আখালটেক ঘোড়ায় চড়ে আসছিল। আওরঙ্গজেব এই ঘোড়াটি তাকে বিয়ের উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। আমু দরিয়ার ওপারে জন্ম নেওয়া আখালটেক ঘোড়াগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং টেকসই ঘোড়া। এই ঘোড়ায় চড়েই তাদের পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খান তার বিজয় অভিযান চালিয়েছিলেন। আজমের একপাশে চব্বিশ বছর বয়সি মুয়াজ্জম, যে ইতিমধ্যেই বিবাহিত আর অন্যপাশে নয় বছর বয়সি আকবর। দুজনেই রুপালি রঙের পাগড়ি আর জ্যাকেট পরে রয়েছে। ওদের পোশাক আর পাগড়িতে বসানো হীরাগুলো রোদে আগুনের মতো ঝিকমিক করে জ্বলছিল। আওরঙ্গজেব সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। পার্থিব জিনিসের বিষয়ে গর্ব করাটা ঠিক না হলেও, ময়ূর সিংহাসনে বসার পর আর কখনও এমন অনুভূতি তার হয়নি যা আজ এই প্রথম হল…

প্রথম সারির কুলিরা মহল থেকে চল্লিশ ফুট দূরে থাকতেই ওদেরকে সেখানেই থামার জন্য মহলের ছাদ থেকে সূর্যধ্বনির সংকেত শোনা গেল। কুলিরা সাথে সাথে থেমে পড়ে থালাসুদ্ধ হাত সামনে বাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর দুই সারিতে বিভক্ত হয়ে পাঁচজন ডানে আর পাঁচজন বামে তিন পা এগিয়ে গেল। ওদের পেছনে দেহরক্ষীবাহিনীও ঘোড়ার রাশ টেনে দুই দিকে ভাগ হয়ে ঘোড়া দাঁড় করালো। দুই ভাইকে পেছন পেছন দুই পাশে নিয়ে মাঝখানের পথ দিয়ে আজম ওর ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে এল। মহলের সিঁড়ির গোড়ায় এসে তিনজনই ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল আর আজম সিঁড়ি বেয়ে উঠে আওরঙ্গজেবের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, আপনার দোয়া দিন বাবা।

 ‘আমার দোয়া তোমার উপর রয়েছে। এখন উঠে আমার সাথে ভেতরে এস। তোমার কনে সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

এখন যদিও দিনের আলো রয়েছে, তাসত্ত্বেও জাহানারার মহলে সোনার বাতিদানে লম্বা সুগন্ধিযুক্ত মোমবাতি জ্বলছে। এর সুগন্ধের সাথে ধূপ আর চাপা ও উঁই ফুলের মালার সৌরভ মিশে লাল বেলেপাথরের স্তম্ভগুলোর চারপাশে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। মূল অনুষ্ঠানটি হবে মহলের প্রস্থ বরাবর এপাশ থেকে ওপাশে চলে যাওয়া উঁচু ছাদ আর মার্বেল পাথরের মেঝের বিরাট একটি কামরায়। অতিথিরা সেখানেই সমবেত হয়েছেন। আওরঙ্গজেব ঢুকেই দুইপাশে নজর বুলিয়ে দেখলেন সমস্ত আয়োজন ঠিক আছে কি-না। অসংখ্য তারা এমব্রয়ডারি করা সোনালি রঙের রেশমি কাপড়ের ঘোমটার আড়ালে ফুল আঁকা একটি মঞ্চে জানি বসে রয়েছে। মঞ্চের পাশেই একটি মার্বেল পাথরের তাকের উপর বিয়ের মুকুট রাখা ছিল, যেটা আওরঙ্গজেব আজমের মাথায় পরাবেন। এই মঞ্চটি কাশ্মির থেকে প্রজারা উপহার পাঠিয়েছে। জানির কোলের উপর আংটি পরা দুটি হাত ভাঁজকরা রয়েছে আর মেহেদি লাগানো দুই পা দেখা যাচ্ছিল।

মঞ্চের পেছনে পর্দা ঘেরা জায়গা থেকে জাহানারাসহ রাজপ্রাসাদের মহিলারা অনুষ্ঠান দেখবেন। তাঁর কথাতেই এই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে, এটা রাজবংশের অতীতের ঘা নিরাময় করা ছাড়াও সাম্প্রতিক বিরোধের মীমাংসার পথ মসৃণ করবে। হিন্দুদের সাথে তার আচরণ নিয়ে জাহানারার সাথে মতভেদ হওয়ার পর থেকেই তিনি অনুভব করছিলেন যে, দুজনের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে–এমনকি তিনি ভেবেছিলেন হয়তো জাহানারা তাঁর সাথে দিল্লি ফিরে যাবেন না। আগ্রা দুর্গে বন্দী জীবন কাটাবার বছরগুলোতে জানি তার সাথেই ছিলেন। আর যেভাবে তিনি জানির সম্পর্কে কথা বলেছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল জানিকে তিনি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। এই বিয়েতে সম্মতি দিয়ে আর দিল্লিতেই বিয়ের অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করে আওরঙ্গজেব চাচ্ছিলেন যে, জাহানারা রাজদরবারে ফিরে আসুন।

আজম কনের পাশে তার নির্দিষ্ট আসনে বসতেই আওরঙ্গজেব মোল্লাকে বিয়ে পড়াতে ইশারা করলেন।

 মোল্লা প্রথম জানিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এই মানুষকে আপনার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি?”

কয়েকপ্রস্থ ঘোমটার আড়াল থেকে তার পরিষ্কার জবাব শোনা গেল, হ্যাঁ।’

এরপর মোল্লার কথায় আজমও বিয়েতে তার মত দিলেন এবং যথারীতি বিয়ের দোয়া পড়তে শুরু করলেন। তারপর আওরঙ্গজেব চকচকে বিয়ের টায়রা মুকুটটি তাক থেকে তুলে তার ছেলের মাথায় পরিয়ে দিলেন। মুকুটের সোনার তারে বসানো মুক্তাগুলো হাওয়ায় ফুলের মতো কাঁপছিল। সবশেষে তিনি খানসামার হাত থেকে এক বাটি গোলাপজল নিয়ে তাতে আলতোভাবে দুই হাত ধুলেন, এরপর আরেকজন পরিচারক এক গ্লাস পানি দিতেই তিনি বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রথানুযায়ী তা সম্পূর্ণ পান করে বরকনের পবিত্র মিলন নিশ্চিত করলেন।

 নববধূ আর বর দীর্ঘজীবী হোক। তাদের মিলনে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আর তারা অনেক সন্তানের জন্ম দিক!

রাজকীয় ভোজে অংশ গ্রহণের জন্য যাদেরকে অবশ্যই আমন্ত্রণ করার কথা তাদের সবার জন্য জাহানারার ছোট্ট মহলে স্থান সংকুলান হওয়ার কথা নয়। সেজন্য আওরঙ্গজেব দিওয়ান-এ-আমের সামনে দুগের বিশাল খিলানে ঢাকা উঠানে বিশালাকায় চারকোণা তাঁবু টাঙাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফুলবাগান আর গোলাপজলের বুদ্বুদ উঠা ফোয়ারা পার হতেই তিনি জাফরান, ঘি আর মাখন দিয়ে রান্নাকরা খাবারের খুশবু অনুভব করলেন। সম্রাটের বাবুর্চিরা গত কয়েকসপ্তাহ থেকেই রান্নার প্রস্তুতির জন্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে সর্বোৎকৃষ্ট সামগ্রী আনার জন্য বায়না দিয়ে চলেছিল। হিরাটের চারপাশের বিভিন্ন বাগান থেকে মিষ্টি রসালো তরমুজ, সুমিষ্ট আঙ্গুর আর ডালিম, পাঞ্জাব থেকে কাঠবাদাম আর আখরোট, কাশ্মির থেকে শুকনো খুবানি আর চেরি, রাজকীয় শিকারের জঙ্গল থেকে তিতির পাখি, কোয়েল জ্যান্ত ধরে দিল্লি নিয়ে আসা হবে, উত্তরের পাহাড়ি এলাকা থেকে খাদ্যের স্বাদগন্ধ বাড়াতে পুদিনা, মৌরি এবং ধনেপাতা, এবং দক্ষিণ থেকে গরম মশলা…

গুম গুম করে বেজে ওঠা নাকাড়া আর শিঙাধ্বনির সাথে সাথে সামনে পেছনে দেহরক্ষীদল নিয়ে আওরঙ্গজেব তাঁবুতে ঢুকলেন। তাঁবুর ঠিক মাঝখানে মখমলে ঢাকা একটি মঞ্চের উপর একটি নিচু টেবিল পাতা হয়েছিল, তিনি এই টেবিলের পেছনে তার আসনে বসলেন। আবার নাকাড়া বাজিয়ে আজম আর অন্য শাহজাদাদের আগমন ঘোষণা করা হল। বর আওরঙ্গজেবের পাশে বসলেন আর মুয়াজ্জম আর আকবর একটু নিচে একটি ডিভানে বসলেন। তিনজনকেই খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। পেশিবহুল মুয়াজ্জম তার কাশ্মিরি রাজপুত মায়ের কাছ থেকে চওড়া কপাল, লম্বা টিকেলো নাক এবং শক্ত চোয়াল পেয়েছেন। মাত্র কিছুদিন আগে শাহজাহান জোর করে তাকে যে নওয়াব বাঈয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন, তার চেয়েও মুয়াজ্জমের কপাল আর নাক অনেক সুন্দর। আজম আর বালক আকবরের সাথে তাদের পারসিক মা দিলরাস বানুর চেহারার খুব একটা মিল নেই। তিনি আওরঙ্গজেবের প্রধান মহিষী ছিলেন, পুত্র আকবরকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তবে এদের দুজনের মধ্যেই বিশেষত–আজমের মাঝে তিনি নিজের ছায়া খুঁজে পান। একটি মুহূর্ত তার মনে সবচেয়ে বড়ছেলে মোহাম্মদ সুলতানের চেহারাটা ভেসে উঠলো। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করলে ইঁদুরের সাথে অন্ধকার কারাকক্ষে পঁচে মরার বদলে, আজ সেও এই উৎসবে সামিল হত। তবে মোহাম্মদ সুলতানের পরিণতি আল্লাহর সামনেই রয়েছে আর পৃথিবীর সামনেও রয়েছে। এজন্য তার মনে কোনো আফসোস নেই…

সোনালি এমব্রয়ডারি করা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আওরঙ্গজেব ভোজ শুরু করার ইঙ্গিত দিলেন। সবুজ পোশাকপরা খানসামারা সর্বপ্রথম বড় বড় সোনার বারকোশে রোস্ট করা ময়ূর নিয়ে এল। ময়ূরের লম্বা উজ্জ্বল পালক ছড়িয়ে রয়েছে। আরো আনলো খাসি আর হরিণের মাংসের রোস্ট। এরপর এল পোলাও, যার উপরে ছড়ান রয়েছে সোনার পাতা মোড়ানো ফল আর বাদাম। আরো এল জাফরান দেওয়া ভাত, কাঠবাদাম আর কিসমিস দেওয়া সুগন্ধিযুক্ত সদ্য সেঁকা রুটি আর ঢাকনা দেওয়া সোনালি আর রুপালি রঙের স্যুপভাণ্ডে আখনি দেওয়া মৃদু ফুটন্ত অবস্থায় বাবুর্চির মন-পসন্দ বিশেষ ধরনের রান্না। আওরঙ্গজেব খেতে পছন্দ করেন, তবে তিনি অন্যদের আগেই খাওয়া শেষ। করেন, যাতে কেউ তাকে পেটুক মনে না করতে পারে। তারপর যখন স্ফটিকের পাত্রে বিভিন্ন ফল আর সোনালিপাতে মোড়ানো মিষ্টি টেবিলে টেবিলে পরিবেশন শুরু হল, তখন তিনি উঠে পড়লেন এবং সবুজ রেশমি ঝালর দেওয়া কাঠের পার্টিশনের ওপারে মেয়েমহলের দিকে গেলেন।

 তিনি খুশি হয়ে দেখলেন যে, জাহানারা শোকের পোশাক খুলে অন্য পোশাক পরেছেন। গাঢ়নীল পোশাক পরে তিনি কনের একপাশে একটি কুশনে বসে রয়েছেন। আর আওরঙ্গজেবের মেয়ে জেবুন্নিসা আর তাঁর ছোট বোন গওহারা আরেক পাশে বসে রয়েছে। জাহানারাকে দেখে মনে হল তিনি খোশমেজাজেই আছেন, জেবুন্নিসা কিছু একটা বলে উঠতেই তিনি হেসে উঠলেন। তবে রওশনআরা কোথায়? তিনি চারপাশে চোখ বুলালেন, কিন্তু কোথাও তাকে দেখা গেল না।

 তাকে দেখেই লজ্জাবনত জানি ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নামিয়ে দিল, তবে তিনি এগোতেই জাহানারা বললেন, তোমার শ্বশুরের সামনে তোমার মুখ ঢাকার দরকার নেই। একথার পর জানি ধীরে ধীরে সোনালি রঙের পাতলা রেশমি ঘোমটাটি ঠেলে সরিয়ে তার দিকে তাকাল। একেবারে দারার মতো দেখতে, সেই একই ডিম্বাকৃতি মুখ, একই রকম ঘন আর কালো চোখ, মসৃণ কপোল, যা তার ভাইয়ের বেলায় বেশ মেয়েলি মনে হত। কি ভাবছিল মেয়েটি? তিনি যে উদারতা দেখিয়ে স্বামী হিসেবে তাকে একজন শাহাজাদাকে দিচ্ছেন, এজন্য কি সে তার সঠিক মূল্যায়ন করছে, নাকি সে তার বাবার চরম পরিণতির কথা স্মরণ করছে? জাহানারা হয়তো তাকে বলেছেন অতীতকে ভুলে গিয়ে সবকিছু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে, যা তিনি নিজেই করেছেন। আর বর্তমানে যা হচ্ছে তার জন্য কৃতজ্ঞ হতে।

তিনি জানির দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, ‘জানি, আমি তোমাকে আমার মেয়ে হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছি। ইনশাল্লাহ আমার ছেলের সাথে তোমার বিয়েতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে আর তোমরা এই বিয়েকে ফলপ্রসূ করে তুলবে।

 ‘ধন্যবাদ, জাহাপনা।

 ‘এই উপলক্ষে আমি তোমাকে, আমার বোন আর মেয়েদের সবাইকে উপহার হিসেবে দেবার জন্য রাজকোষাগার থেকে নিজ হাতে বাছাই করে কিছু রত্ন এনেছি।’ তিনি ঘাড় কাত করতেই পাঁচজন বাদি, প্রত্যেকে একটি করে চামড়ার কাসকেট বয়ে নিয়ে এল। গম্বুজ আকৃতির ঢাকনি খুলতেই ভেতরে হীরা, রুবি, পান্না আর সমুদ্রনীল নীলকান্তমণি ঝলমল করে উঠলো। একটা কাসকেট একটু বড় ছিল–সেটা নববধূর জন্য আর অন্যগুলো তার বোন আর মেয়েদের জন্য। তবে একজন বোনকে সেখানে দেখা যাচ্ছে না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, রওশনআরা কোথায়?

গওহরা উত্তর দিল, ‘বিয়ে পড়ানোর সময় তিনি বলেছিলেন, তাঁর মাথা ধরেছে– আর তাই তাঁর ঘরে ফিরে যাচ্ছেন।

 ‘আমি নিশ্চিত মাথাধরার কথা ভুলে গিয়ে হাকিম তাকে আমাদের সাথে যোগ দিতে বলবেন, তাহলে তা নিরাময় হবে। একজন নোকর পাঠিয়ে তাকে জানাও যে আমি অনুরোধ করেছি তিনি যেন এখুনি এখানে চলে আসেন, আমি তার আসা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করছি।’

আওরঙ্গজেব জাহানারার পাশে বসলেন। ওদের চারপাশে মহিলারা নিজেদের মধ্যে মৃদুকণ্ঠে কথা বলছিলেন, কেউ কেউ সামনে এগিয়ে নববধূ আর শাহজাদিদের উপহারগুলো দেখছিলেন। জুই ফুলের মিষ্টি সুবাস উদিপুরী মহলের কথা মনে করিয়ে দিল। তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী হেরেমের অন্যান্য মহিলাদের সাথে এখানে আসতে পারেন নি, তবে তিনিও এই বিয়ে উপলক্ষে তার কাছ থেকে উপহার পাবেন। আওরঙ্গজেব নিজ হাতে তার সুন্দর আসন্নপ্রসবা দেহ রত্নালঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে দেবেন…এমন সময় হঠাৎ তাবুর পুরুষমহলের দিক থেকে লোকজনের উচ্চকণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল। পার্টিশনের অপর পাশ থেকে তার খানসামা বললো, জাহাপনা, জরুরি সংবাদ এসেছে।

আওরঙ্গজেব দ্রুত মেয়েমহল থেকে বের হয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী। খবর?’

 ‘একজন কাসিদ-সংবাদবাহক এই মাত্র ঘোড়ায় চড়ে এসেছে। প্রায় বিশ হাজার জাট সেনা মথুরা আক্রমণ করে চারদিকে লুটপাট চালাচ্ছে।

মথুরা এখান থেকে আগ্রার পথে মাত্র নব্বই মাইল দূরে! জাটদের হঠাৎ কি হল? আওরঙ্গজেব জানেন জাহানারা এখন বলবেন, হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে তিনি যে কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন তার ফলশ্রুতিতে তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে জাটদের ধূমায়িত অসন্তোষ এখন প্রকাশ্য প্রজাবিদ্রোহে রূপ নিয়েছে। ঠিক আছে তাই যদি হয় হোক সেটা। এতে আরো ভালো হবে। এর অর্থ তার শত্রুরা এখন জ্বলন্ত গোলা থেকে ইঁদুরের মতো ঘর ছেড়ে বাইরে চলে এসেছে। আর তিনি তাদেরকে ধ্বংস করবেন, যার জন্য ওরা উপযুক্ত!

*

এক একটা মিনিট যাচ্ছে আর দিগন্তের উপর লাল ধূলির মেঘটি সগর্জনে আরো বড় হচ্ছে। বিশালদেহী রণ-হস্তির পিঠে হাওদায় সোজা হয়ে বসে আওরঙ্গজেব হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে সামনে দূরে বৃক্ষশূন্য বালুকাময় সমতলভূমির উপর দিয়ে ছুটে আসা ঘোড়সওয়াড় দলটির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। একটু পরই তিনি এক এক করে আলাদা লোকগুলোর অবয়ব আর সবার আগের ঘোড়সওয়াড়ির বর্শার চকচকে ডগাটি দেখতে পেলেন। তিনি জানতেন জাটরা অনভিজ্ঞ উচ্ছঙ্খল জনতা আর মনে হচ্ছে সেভাবেই ওরা হঠকারীর মতো তাঁর নিজের সুশৃঙ্খল বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে। আসুক ওরা।

বিদ্রোহের কথা কানে আসতেই তিনি তার সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং দ্রুত হঠাৎ গজিয়ে উঠা বিরোধী পক্ষের দ্বিগুণ সংখ্যক সেনা নিয়ে গঠিত দুটি দল সামনে পাঠালেন। একটি সেনাদল গেল আগ্রা থেকে আর অপরটি দিল্লি থেকে। তিনি নিজে পরবর্তী সেনাদলের সাথে চললেন। তবে তিনি যেরকম আশা করেছিলেন সেরকম দ্রুত বেগে ওরা চলতে পারলো না। ভারি ভারি কামান নেওয়ার কারণে তাদের চলার গতি একটু সুথ হয়ে পড়েছিল। তবে কামান নেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল, কেননা জাটদের কোনো কামান নেই আর এতে ওদের বিরুদ্ধে একটু বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। সময় বাঁচাবার জন্য তিনি রাতেও চলার নির্দেশ দিলেন, তবে কামান টেনে নিয়ে চলা বড় বড় সাদা ষাঁড়গুলো চলার গতি থামিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। লম্বা চাবুক দিয়ে গাড়োয়ানরা বার বার আঘাত কষালেও, সারাদিন দীর্ঘপথ চলায় ক্লান্ত পশুগুলো আর উঠে দাঁড়াল না। গোলন্দাজ বাহিনী, পদাতিক বাহিনী, রসদবহর টানা গাড়ি আর শিবিরের অন্যান্য লোকজন সবাই একসাথে মিশে জট পাকাতে শুরু করলো। প্রায় বিশৃঙ্খল হয়ে পিছিয়ে পড়া সেনাদলটি ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ করে যাওয়ার সময় তার কাছে খবর এল যে, শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য মূল দলের আগে একেবারে সামনের প্রান্তে ছোট অগ্রবর্তী দলটির উপর দুটি বাঘ উপরি আক্রমণ করে দুজনকে মেরে ফেলেছে। এই খবরটির উপর তিনি খুব একটা আস্থা রাখতে পারলেন না, কেননা বাঘ সাধারণত একাই শিকারের উপর আক্রমণ করে। এধরনের গুজব বরং আরো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলো। দলটি পুরোপুরি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ার আগেই তিনি রাতে চলা বাদ দিলেন।

আধখানা চাঁদের বেমানান আলোয় তার সেনা কর্মকর্তারা ঘোড়ায় চড়ে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল, তাদের দিকে লক্ষ করতে করতে তিনি ভাবছিলেন এই সুযোগে জাটদের আক্রমণ করার আশংকা নেই, কেননা ওরা এখনও অনেক দূরে রয়েছে। তবে সেনাবাহিনী নিয়ে তার এগিয়ে যেতে দেরি হওয়ার সুযোগটা নিয়ে ওরা সমস্ত লুণ্ঠিত মালামাল নিয়ে অনেক দূরের জঙ্গল আর মথুরা আর রাজপুতনার মাঝের মরুভূমিতে হারিয়ে যাবে। তবে ওরা যায় নি। ওদের নেতা গোকলা মোগল নগররক্ষী বাহিনী আর কোষাগারের উপর হামলা চালিয়েই চললো। তারপর আগ্রা থেকে আওরঙ্গজেব যে সেনাদলটি পাঠিয়েছিলেন, তাদেরকে কৌশলে এড়িয়ে গোকলা সরাসরি সম্রাটের মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধ করার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে সামনে এগোতে শুরু করলো।

পরিকল্পনা মাফিক তাঁর নিজের সেনাসংখ্যা শত্রুর চারগুণ না হলেও, লড়াই আসন্ন হতেই আওরঙ্গজেব নিশ্চিত হলেন যে তাঁর কাছে এখনও যে পরিমাণ সৈন্য রয়েছে, তা গোকলাকে তার হঠকারিতার জন্য অনুতপ্ত হতে বাধ্য করবে। তাঁর হাতির কাছে দাঁড়ান দুজন সেনাকে তিনি চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন, আমার সেনাপতিদের কাছে যাও। ওদেরকে বল জাটদের আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হতে। সামনের সারিতে অশ্বারোহীদল রাখতে বল, যাতে ওদের ঠিক পেছনে আমাদের শ্রেষ্ঠ গাদা বন্দুকধারী সেনাদলটিকে ওরা ঢেকে রাখে। আর সেই সাথে আমাদের সাথে আনা কামানগুলোও সাজাতে বল। জাটরা আক্রমণে সামনে এলেই আমাদের অশ্বারোহীদলটি দুই পাশে সরে গিয়ে শত্রুদেরকে আমাদের বন্দুকধারী সেনা আর গোলন্দাজদের মুখোমুখি করবে। তারপর শত্রুসেনার আক্রমণ যখন ভোতা হয়ে যাবে আর ওরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে, তখন অশ্বারোহীবাহিনী ওদের উপর চড়াও হয়ে ওদেরকে কচুকাটা করবে। আমি ঐ নিচু টিলার উপর থেকে যুদ্ধের গতিবিধি লক্ষ করবো। ইনশাল্লাহ, আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন আর আমরা জয়ী হব।’

প্রায় আধাঘণ্টা পর আওরঙ্গজেব তার পছন্দের জায়গা থেকে লক্ষ করলেন উন্মুক্ত জাট আশ্বারোহীসেনার প্রথম দলটি রণহুঙ্কার দিতে দিতে দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে মাথা নিচু করে বর্শা বাগিয়ে এল। তাঁর নির্দেশমত বন্দুকধারী আর গোলন্দাজবাহিনীকে ঢেকে রাখা সামনের সারির মোগল অশ্বারোহী সেনাদলটির দিকে ওরা ছুটে এল। আবার তাঁর নির্দেশ মোতাবেক একেবারে শেষ মুহূর্তে মোগল অশ্বারোহীরা ডানে আর বামে ঘোড়া নিয়ে সরে গেল। ওরা সরে যাওয়ার সাথে সাথে তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করে দ্বিতীয় সারির সেনারা গাদা বন্দুক আর কামানের গোলা ছুঁড়তে শুরু করলো। রণক্ষেত্র গাদা বন্দুকের পট পট আর কামানের প্রচণ্ড শব্দে ভরে গেল। একদুই মিনিট সাদা ধোঁয়ায় তিনি কিছুই দেখতে পারলেন না, অথচ তার মনে হচ্ছিল যেন অনেকক্ষণ ধরে এটা হচ্ছিল। হঠাৎ মৃদু হাওয়ায় ধোয়ার পর্দাটা পাতলা হয়ে যেতেই, তিনি দেখলেন অনেক জাট অশ্বারোহীসেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে। আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো দ্রুত ছুটে পালাচ্ছিল। আহত ঘোড়াগুলো মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে কিংবা তাদের সওয়ারিদের মতো ভাঙ্গা পা নিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে।

 তার নিজের মোগল অশ্বারোহীসেনাদের সবুজ পোশাকে চেনা যাচ্ছিল। ওরা আবার এই এলোমেলো লড়াইয়ে ছুটে ফিরে এসে শত্রুসেনাদের উপর এলোপাতাড়ি তরোয়ালের কোপ চালাতে লাগলো। তবে ওরা কোনোভাবেই বেশি সুবিধা করতে পারছিল না। জাটদের বেপরোয়া আক্রমণের তীব্রতা এত প্রবল ছিল যে, ওরা মোগল বন্দুকধারী আর গোলন্দাজদের সারির কয়েক জায়গা ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়লো। এরপর জাটরা কাস্তে দিয়ে কাটার মতো করে কেটে মোগল বন্দুকধারীদের একটি সারির সৈন্যদেরকে রক্তাক্ত করে মাটিতে ফেলে দিল। তা সত্ত্বেও অন্য বন্দুকধারীরা উত্তেজিত হয়ে ইস্পাতের লম্বা দণ্ড দিয়ে তাদের বন্দুকে বারুদ আর গোলা ঢুকিয়ে আবার গুলি ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত হল। আবার কোথাও কোথাও জাট অশ্বারোহীদের তাড়া খেয়ে কিছু কিছু বন্দুকধারী অস্ত্র ফেলে দিয়ে পেছনের দিকে ঘুরে ছুটে পালাতে লাগলো। এ দৃশ্যটি দেখে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। লক্ষ করলেন পালাতে গিয়ে একজন বন্দুকধারী হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, তারপর সে আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই একজন জাট তার বর্শা দিয়ে তাকে গেঁথে ফেললো, উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে এই কাপুরুষের। তবে পদাতিক সেনারা কেন এটা বুঝতে পারে না যে, জ্বলন্ত চুল্লিতে ফেলা পাখির মত বর্শার ডগা দিয়ে অশ্বারোহী শত্রুরা তাদের বিদ্ধ করবে এই ভয়ে দুই হাত তুলে আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে প্রাণ ভয়ে পালানোর চেয়ে ওরা যদি একসাথে দাঁড়িয়ে অশ্বারোহীদের মোকাবেলা করতো তাতে ওদের জীবনের উপর তেমন ঝুঁকি ছিল না, বরং এতে সম্মান ছিল।

শুধু বন্দুকধারীই ছত্রভঙ্গ হয়নি, জাটরা গোলন্দাজ বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কয়েকজন গোলন্দাজ সেনাকে মেরে কয়েকটি কামানও দখলে নিল। কয়েকজন শত্রু সেনা ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সাথে আনা দড়ি দিয়ে কামানের নলের সাথে বেঁধে কামানের মুখ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে মোগল সেনাদের দিকে কামান দাগার চেষ্টা করতে লাগলো। এত দ্রুত কেমন করে এত জাট সৈন্য তার সেনাদের মধ্যে ঢুকতে পারলো? সম্ভবত ওরা একটি ঘোড়ার পিঠে দুজন করে সওয়ার হয়েছিল। যুদ্ধে সফল হবে এই ভেবে জাটরা দড়িসহ এসেছিল যাতে কামানগুলো হস্তগত করতে পারে।

 লড়াইয়ের ময়দানের সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা কোথায় তা দেখতে গিয়ে আওরঙ্গজেবের হৃতস্পন্দন বেড়ে গেল। তবে তিনি অবিচল থাকার চেষ্টা করলেন, ধীরস্থিরভাবে নড়াচড়া করলেন, কোন ধরনের অস্থিরতা প্রকাশ করলেন না, যাতে তার হাবভাব দেখে তার চারপাশের সৈন্যরা ঘাবড়ে না যায়। তাৎক্ষণিক বিপদটি টের পেলেন যখন দেখলেন কমলা রঙের রণবেশে একদল জাট অশ্বারোহী সেনা সংঘবদ্ধ হয়ে দ্রুত তার দিকেই এগিয়ে আসছে। এদের ঠিক মাঝখানে দুজন পতাকাবাহি সৈন্য বড় একটি কমলা রঙের পতাকা জোর হাওয়ায় পেছনে হেলে যাওয়া থেকে ধরে রাখার চেষ্ট করছে। লক্ষ করলেন এদের মাঝে ভারি গোঁফওয়ালা একজন লোক তাঁকে দেখিয়ে ইশারা করছে। এই লোক জাটদের নেতা গোকলা ছাড়া আর কেউ নয়।

হঠাৎ প্রথম সারির দুজন জাট অশ্বারোহী ঘোড়ার পাদানিতে দাঁড়িয়ে ওদের লম্বা নলের গাদা বন্দুক তার দিকে তাক করলো। ওরা গুলি ছুঁড়তেই তিনি সাদা ধোঁয়া বেরুতে দেখলেন, তবে তিনি নড়াচড়া না করেই স্থির রইলেন, কেননা তিনি জানতেন তিনি ওদের বন্দুকের পাল্লা থেকে অনেক দূরে রয়েছেন। যুদ্ধের হট্টগোলের মধ্যে তিনি তাঁর হাতির কাঁধে বসা দুই মাহুতের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললেন, ‘সামনে চল।’ দুই মাহুতের মধ্যে পাকা চুলের বয়স্ক লোকটির সারা মুখ বসন্তের দাগে ভরা ছিল। সে আংকা–একটি ইস্পাতের দণ্ড দিয়ে হাতিটির গায়ে খোঁচা মেরে নিচু পাহাড় থেকে নেমে সমতলভূমিতে লড়াইয়ের ময়দানের দিকে নিয়ে চললো। শুড় তুলে হাতিটি উচচনাদ করে ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করলো। পাহাড়ের পাদদেশে নামতেই তাঁর অশ্বারোহী দেহরক্ষীবাহিনীর সদস্যরাও তার চারপাশে কাছাকাছি অবস্থান নিল। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘সমস্ত বিজয় পতাকা উড়িয়ে দাও আর শিঙ্গা আর নাকাড়াবাদকদের আক্রমণের ইঙ্গিতসূচক নাকাড়া আর ভেরী বাজাতে বল। আমি আমার সৈন্যদের দেখাতে চাই যে, আমি শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য সামনে এগোচ্ছি। এতে তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে। সবুজ পতাকাগুলো মেলে ধরতেই বাতাসে পতপত করে উড়তে শুরু করলো। সাথে সাথে ভেরী বেজে উঠলো আর শান্ত ঘোড়ার পিঠের দুইপাশে ঝুলানো শক্ত উঁটের চামড়ার ঢোলকের উপর দ্রুত কাঠির ঘা পড়তেই যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো।

আওরঙ্গজেব তাঁর দেহরক্ষীদল নিয়ে গোকলার অশ্বারোহীদলটির দিকে এগোতে লাগলেন। তারপর আরেকজন জাট সেনা পাদানিতে দাঁড়িয়ে তার গাদা বন্দুক তাক করলো। এবার ওরা বন্দুকের পাল্লার মধ্যে ছিল। পাকাচুলো মাহুতটি শরীর মুচড়ে আওরঙ্গজেবের হাতির কাঁধ থেকে সামনের দিকে পড়ে গেল। তার সারা মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেল। দীর্ঘদিনের মাহুত মাটিতে পড়ে যেতেই হাতিটি একপাশে হেলে তার উপর পা ফেলা এড়াল। এতে হাওদাটি ভীষণভাবে দুলে উঠতেই আওরঙ্গজেব দুই হাতে হাওদার দুই ধার আঁকড়ে ধরে মাটিতে পড়ে যাওয়া সামলালেন। প্রায় সাথে সাথে দ্বিতীয় মাহুত প্রথম মাহুতের জায়গায় বসে হাতিটিকে স্থির করলো।

 আওরঙ্গজেব তার পেছনে বসা খানসামাকে বললেন, শিগগির আমাকে একটা বন্দুক দাও।’ লোকটি সাথে সাথে তাঁর হাতে একটি বন্দুক তুলে দিল। হাতির দাঁতের নকশা করা বাঁট শক্ত করে ধরে বেশ সাবধানে তিনি গোকলার দিকে লক্ষ স্থির করলেন। সে তখন তার বাঁকা তরোয়াল দিয়ে একজন মোগল দেহরক্ষী সেনার উপর কোপ মেরে চলছিল। আওরঙ্গজেব গুলি ছুঁড়তেই তাঁর দেহরক্ষীর ঘোড়াটি পেছনের দিকে লাফ দিতেই এর আরোহী মাটিতে পড়ে গেল। মাটিতে পড়ার আগে গোকলার তরোয়ালের আঘাতে সে আহত হল। আওরঙ্গজেবের গোলাটি গোকলাকে আঘাত না করলেও এটি পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ান আরেকটি ঘোড়ার মাথায় আঘাত করলো। সাথে সাথে ঘোড়াটি তার আহত আরোহীকে পিঠে নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। গোকলা তার ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে মাটিতে পড়ে পা ছুঁড়তে থাকা ঘোড়াটি এড়ালো, তারপর আওরঙ্গজেবের হাতির দিকে ঘোড়া ছুটাল। কঠোর চেহারার কয়েকজন জাট সেনা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাকে অনুসরণ করলো।

আওরঙ্গজেব আবার খানসামাকে বললেন, তাড়াতাড়ি আমার আরেকটা বন্দুক দাও।’ লোকটি দ্রুত দ্বিতীয় বন্দুকটি তার হাতে তুলে দিতেই তিনি আবার এর লম্বা নল বরাবর সতর্কতার সাথে লক্ষ্যস্থির করলেন। এমনসময় তার হাতিটি মাটিতে পড়ে থাকা একটি মানুষের দেহের সাথে হোঁচট খেতেই আওরঙ্গজেবের ছোঁড়া গোলাটি এবার গোকলার কালো ঘোড়াটির ঘামে ভেঁজা দেহে আঘাত করলো। ঘোড়াটি মাটিতে পড়তেই গোকলা এক লাফে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে নামলো। মোগলদের তরোয়াল আর বন্দুকের হামলায় সে তার সমস্ত সঙ্গী হারিয়েছে। মাটিতে নেমেই সে তার কমলা রঙের আলখাল্লা উড়িয়ে বাঁকা তরোয়াল হাতে সামনের দিকে ছুটে চললো। লক্ষ্যবস্তু থেকে সে একশো ফুটের মধ্যে পৌঁছতেই আওরঙ্গজেব তাঁর রত্নখচিত খাপ থেকে তরোয়াল বের করলেন। ঠিক তখনই তার একজন দেহরক্ষী উজবেক সেনা ঘোড়ার পিঠ থেকে জাট নেতার উপর লাফিয়ে পড়লো। গোকলার হাত থেকে তরোয়াল পড়ে গেল আর মোগল সেনাটি তাকে টেনে মাটিতে ফেললো।

কয়েকমুহূর্ত লোকদুটো মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে সুযোগমতো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছিল। তারপর একসময় গোকলা তার কোমরের খাপ থেকে ছোরা বের করে উজবেক সেনাটির কুঁচকির গভীরে ঢুকিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতেই লোকটা কেঁপে উঠে দুই হাতে ক্ষতস্থান চেপে ধরলো। গোকলা কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। চারপাশে তাকিয়ে সে বুঝলো সে এখন একা এবং শীঘ্রই তাকে মেরে ফেলা কিংবা বন্দী করা হবে। জাট নেতা হাত পেছনে দুলিয়ে হাতের ছোরাটি সোজা আওরঙ্গজেবের দিকে ছুঁড়ে মারলো। তার নিশানা খুব ভাল ছিল। ডগা উল্টিয়ে ছুরিটি সোজা উড়ে গেল, এবার আওরঙ্গজেব শরীরে একটা মোচড় দিয়ে সরে গেলেন। তারপরও ছুরিটি তাঁর বামকনুইয়ের নিচের অংশ ঘেসে পিছলে গেল। হাওদার একপাশে কাঠের কিনারায় ধপ করে বসে পড়ার আগে তিনি বাম হাতটি উঁচু করে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিলেন।

আওরঙ্গজেবের বাম হাত আর দুই আঙুলের ফাঁক দিয়ে টপ টপ করে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো। এদিকে তাঁর দুই সৈনিক গোকলাকে দুদিক থেকে শক্ত করে চেপে ধরলো, তারপরও সে ছাড়া পাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। তিনি ওদেরকে বললেন, তাকে মেরে ফেলো না। পেছনে নিয়ে যাও। বিজয় নিশ্চিত করার পর আমি তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব। তাকে বন্দী করার খবর একবার ছড়িয়ে পড়লে আমাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে। একজন সেনা কর্মকর্তা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘জাহাপনা, আপনার হাত কেটে গেছে, একটু অপেক্ষা করলে হত না, যাতে হাকিম ক্ষতস্থানটা পরিষ্কার করে একটা পট্টি বেঁধে দিতে পারেন।’

না, সামান্য ছড়ে গেছে। তার চেয়ে বরং ওদের নেতা ধরা পড়ার পর ওদের মাঝে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, সে সুযোগটা এখন আমাদের নিতে হবে। ঘণ্টা দুয়েক পর সূর্য যখন মধ্যগগনে এসেছে আর বাতাস মাটি থেকে লাল ধুলি উড়িয়ে নিচ্ছিল, তখন দুইজন সিপাহি গোকলাকে ঠেলে নিয়ে এসে আওরঙ্গজেবের সামনে নতজানু করে বসালো। তিনি একটু দূরে সর্বাধিনায়কের লাল টকটকে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে তিনি রাজকীয় আলখাল্লা পরেছেন আর হাকিম তার হাতের ক্ষতস্থান সেলাই করে নিখুঁতভাবে পট্টি বেঁধে দিয়েছিলেন। অবশ্যই তিনি ঠিক বলেছিলেন। গোকলা বন্দী হবার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তার বেশিরভাগ সেনা লড়াই থামিয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করলো। তবে পালবার সময়ও ওরা শৃঙ্খলা বজায় রেখেছিল। আওরঙ্গজেব হতাশ হয়ে দেখলেন অধিকাংশ জাট সেনাই পালিয়ে গেছে, তিনি যে আশা করেছিলেন, দ্বিতীয় আরেকজনের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে ওরা আবার আক্রমণে ফিরে আসবে, তা আর হল না। তিনি তাঁর সৈন্যদের বললেন, জাটদের ধাওয়া করতে আর কোনো গ্রামবাসী যদি পলাতক কোনো জাট সেনা আশ্রয় দেয়, তবে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে যেন আর কেউ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস না পায়।

আওরঙ্গজেব এবার গোকলার দিকে ফিরে বললেন, তুমি কেন আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলে সে সম্পর্কে তোমার সম্রাটকে তোমার কিছু বলার আছে? গোকলা তার ক্ষতবিক্ষত মুখ তুললো। তার বাহারি মোচ রক্ত মেখে জট পাকিয়ে গেছে তবে চাউনিতে এখনও নিঃশঙ্ক স্পর্ধা দেখা যাচ্ছে। সে বললো, ‘আপনি আমাদের জীবন আর এখন আমাদের ধর্মের উপর যে অত্যাচার অনাচার চালাচ্ছেন, তা থেকে আমার দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য আমি যা করণীয় করেছি। জাটদেরকে আপনার শাসন করার অধিকার আমরা স্বীকার করি না। আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আপনাকে হত্যা করা। সেজন্য সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি আমার লোকদেরকে পিছু হটতে দেই নি আর সেজন্যই আমি সামনে এগোই। আমার কাছে আপনি অশুভের একটি প্রতিমূর্তি। যদি পৃথিবী থেকে আপনাকে সরিয়ে দিতে পারতাম, তবে আমার জীবনের বেঁচে থাকা সার্থক হত। তবে আমার একমাত্র গভীর দুঃখ যে, আমি ব্যর্থ হয়েছি।’ কথাগুলো বলার পর গোকলা দাঁড়াতে চেষ্টা করলো, তবে দুই প্রহরী তাকে আবার ঠেলে নিচে চেপে ধরলো।

আওরঙ্গজেব অতিকষ্টে রাগ সামলালেন। একজন সম্রাট হিসেবে একজন পরাজিত বিদ্রোহীর সাথে আর বেশিক্ষণ কথা বলাটা শোভা পায় না। সেরকম কিছু করার অর্থ গোকলা আর তার ঘৃণাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যা হওয়াটা ঠিক হবে না। তিনি বললেন, আমি নই, তুমি এখন মরবে। তোমার বিশ্বাসঘাতক দেহের প্রতিটি অঙ্গ আলাদা আলাদা করে কেটে টুকরোগুলো আগ্রা শহরের ফটকে ঝুলিয়ে রাখা হবে। তারপর তার পেছনে দাঁড়ান দেহরক্ষীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখুনি তাকে কোতল করার ব্যবস্থা কর। আর আমার নির্দেশ মতো সাথে সাথে তার দেহটির ব্যবস্থা নিতে বলবে। এই সাধারণ বিশ্বাসঘাতককে নিয়ে আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না, যতই সে উদ্ধত হোক।

এইকথা বলে সম্রাট ধীরে ধীরে হেঁটে তার লাল তাবুর দিকে ফিরে গেলেন, একবারও পেছন ফিরে গোকলার দিকে তাকালেন না। তাকে তখন প্রহরীরা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কোতল করার জন্য আর সে চিৎকার করে ছাড়া পাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। আওরঙ্গজেব মন শান্ত হওয়ার পর ভাবলেন, বিজয়লাভের জন্য তাকে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে। তারপর তাঁকে ভাবতে হবে কিভাবে অন্য ভয়ঙ্কর বিদ্রোহী শিবাজিকে ধরা যায়।

*

রওশনআরা, তোমাকে দেখে খুব খুশি হলাম। আজকাল তোমার দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না।’ জাহানারা ভাবলেন, সে নিশ্চয়ই শুনেছে আওরঙ্গজেব জাটদের পরাজিত করেছেন আর শীঘ্রই দিল্লি ফিরে আসছেন। তবে রওশনআরাকে দেখে খুব একটা খুশি মনে হল না। রঞ্জক দিয়ে লাল করা তার পাতলা ঠোঁটের রেখা আর চেহারা দেখে মনে হল বেশ চাপে রয়েছেন আর কোনো বিষয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। জাহানারার পরিচারিকা তাকে একটা মিষ্টি খেতে সাধলেও তিনি হাত নেড়ে মানা করলেন। তারপর বসে চারপাশে তাকিয়ে বললেন, “তোমার ঘরটাতো আগের চেয়ে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। দেয়ালে ঝুলানো ঐ রেশমি পর্দাগুলো নতুন, তাই না? অবশ্য আওরঙ্গজেব তোমাকে সবচেয়ে ভালো জিনিস ছাড়া অন্য কিছু নিতে দেবেন না, তাই না? কথাটা বলতে গিয়ে তার গলার স্বর ভেঙ্গে যাচ্ছিল।

রওশনআরা, তোমার কি হয়েছে বলতো?

 ‘এমন ভাণ দেখাচ্ছ যেন তুমি কিছুই জানো না!’

 ‘সত্যি, আমি জানি না…বল না তোমার কি হয়েছে?

রওশনআরা তার কোমরবন্ধে গুঁজে রাখা ভাঁজ করা একটি কাগজ টেনে বের করে বললেন, এটা! এটাই হল ব্যাপারটা!

 ‘কি এটা?

ভাবাবেগে কাঁপতে কাঁপতে তিক্তকণ্ঠে রওশনআরা বললেন, আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে পাওয়া একটা চিঠি…সব দোষ তোমার! আমি জানি তার উপর তোমার কিরকম প্রভাব আছে। সে তোমাকে দাম দেয় আর শুধু তোমার কথা শুনে, কিন্তু তোমার কি দরকার ছিল তোমার পদবী ব্যবহার করে আমার ব্যাপারে নাক গলাবার? এখন এমন নির্দোষ সাজার চেষ্টা করো না। আমাকে তুমি বোকা বানাতে পারবে না। আমি ঠিক জানি তুমি কি করেছ… আওরঙ্গজেবকে আমার সম্বন্ধে নানারকম গল্প বলেছ।

‘তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

“জানো না? আওরঙ্গজেব যখন তোমাকে দরবারে ফিরিয়ে নিয়ে এল আর তুমি আমার জায়গাটা দখল করে পাদিশাহ বেগম হলে, একবারও আমার কথা ভাবলে না যে, আমি কি ভাবতে পারি…আমি…’

 রওশনআরা, আমি জানি এটা তোমার জন্য কষ্টকর হয়েছিল। বিষয়টা নিয়ে আমার উচিত ছিল তোমার সাথে আরো কথা বলা, কিন্তু আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে কি বলবো, সত্যি বলতে কি আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আর একই সাথে কখনও ভাবিনি যে তুমি এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে।’

রওশনআরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কেন এটা হয়েছিল? আমি বলছি শোন! তুমি ধরে নিয়েছিলে, যেরকম দারাও সবসময় মনে করতেন যে, সবার বড় হওয়ার কারণে সমস্ত সম্মান তোমার প্রাপ্য আর বাকি আমাদের সাথে ছোট বাচ্চা মনে করে সেরকম ব্যবহার করবে, যখন ইচ্ছা একটু খাতির করবে…’।

ভাইয়ের কথা বলতেই জাহানারা অন্যদিকে মুখ ফেরালেন, যাতে তার বোন তার চেহারায় কষ্ট আর রাগ দেখতে না পায়। আওরঙ্গজেবের উত্থানকে রওশনআরা যেভাবে বর্ণনা করছিল, তাতে মনে হচ্ছিল এটা ভ্রাতৃঘাতী লড়াই নয়, যা রক্তপাত আর মৃত্যু ঘটিয়েছিল বরং এটা বাচ্চাদের একটা ঝগড়া। রওশনআরা সবকিছুকে একটা সংকীর্ণ, আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিতে বিচার করতেন– হয়তো এছাড়া তার আর উপায় ছিল না, তাছাড়া তিনি স্পষ্টতই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছেন। নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে এনে জাহানারা তার বোনের কাছে হাটুগেড়ে বসে তার হাত ধরার চেষ্টা করলেন, তবে রওশনআরা তার দুহাত শক্ত করে নিজের কোলে ভাঁজ করে রাখলেন।

 জাহানারা শান্তস্বরে বললেন, ‘যত ইচ্ছা আমার সমালোচনা কর, তবে দারাকে নয়। তিনি এখন মৃত আর তুমি জান তিনি আমাকে কতটা আপন ভাবতেন…’ তারপর বলতে চাচ্ছিলেন, তোমাকেও তাই ভাবার কথা; কেননা তিনি তোমারও ভাই ছিলেন, কিন্তু তার বদলে বললেন, ‘এখন বলতো, একটু আগে যে আমাকে দোষ দিলে, আমি তোমার ব্যাপারে নাক গলিয়েছি, একথাটার মানে কি?

‘আওরঙ্গজেব অভিযানে যাওয়ার ঠিক আগে আমি তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তুমি জানো নিশ্চয়ই সেটা।

না জানি না, তারপর বল।

‘আমি তাকে বলেছিলাম আমার পদবী কেড়ে নিয়ে সে আমার মনে কতটা কষ্ট দিয়েছে। সে বললো সে সেটা বুঝতে পেরেছে…তাই সে আর তুমি দুজনে মিলে আমার জন্য অন্য কোনো দায়িত্ব দেবে…সে আমাকে মূল্য দেয় আর আমাকে ভালোবাসে। আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু এখন দেখলাম কথাগুলো সে আসলে সেই অর্থে বলেনি…কোনোটাই না!’ রওশনআরার কপালে একটা শিরা দপদপ করতে লাগলো, চোখে পানি এসে গেছে।

 ‘কেন নয়?

কারণ তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার মতো দুর্গের ভেতরে আমিও একটা মহল পেতে পারি কি-না। সে কথা দিয়েছিল বিষয়টা বিবেচনা করবে…এমনকি এও বলেছিল কোনটা আমার জন্য ভালো হবে…তারপর দ্যাখো আজ একজন সংবাদবাহক এই চিঠিটা নিয়ে এসেছে, যাতে আওরঙ্গজেব লিখেছে সে আমার কথা রাখতে পারবে না। তোমার মতো আমাকে নিজস্ব আলাদা মহল দিয়ে সে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে নাকি খবর পেয়েছে যখন সে দূরে ছিল, তখন আমি মদের আসর বসিয়েছিলাম। আরো জানাল বেশ কিছুদিন আগে থেকে সে জানতো যে আমি মদ খাই–তবে এ বিষয়ে সে চোখ বুজে রাখতে চেয়েছিল, তবে ইদানীং আমার বাড়াবাড়ি করার খবর পেয়েছে–একদিন না-কি আমাকে বেঁহুশ অবস্থায় বিছানায় বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল আর এতেই সে সিদ্ধান্ত বদলেছে। সে আমাকে মদ খেতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে আর বলেছে, আমি যেন কখনও আলাদা মহলের জন্য আর তাকে অনুরোধ না করি! কিন্তু সবচেয়ে খারাপ যে বিষয়টা তা হচ্ছে …’

দাসিরা সবাই কামরা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল আর ওরা একা ছিলেন। তারপরও রওশনআরা গলা নামিয়ে কথা বলছিলেন আর জাহানারা তার খুব কাছে এসে কথাগুলো শুনছিলেন। সে বললো, সে না-কি শুনেছে আমার গোপন প্রেমিক আছে। সে আমাকে সতর্ক করে বললো, যদি কেউ তাকে এর প্রমাণ দিতে পারে তাহলে ভয়াবহ পরিণতি হবে আর আমাকে জানাল, সে আমার কয়েকজন চাকরকে সরিয়ে দিয়ে তার বিশ্বস্ত লোকদের সে জায়গায় বহাল করবে, যারা তাকে আমার সমস্ত গতিবিধির খবরাখবর তাকে জানাবে। এটা অনেকটা কারাগারের মতো হয়ে দাঁড়াবে আর এর সবকিছু তোমার কীর্তি। তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাও, কেননা আমি তোমার পক্ষে দাঁড়াই নি। তুমি আসার আগে আওরঙ্গজেব আমাকে বিশ্বাস করতো…আমার উপর নির্ভর করতো …আর এখন সবকিছু বদলে গেছে। রওশনআরা এখন ফিসফিস করা ছেড়ে কর্কশকণ্ঠে জাহানারাকে দোষারোপ করে কথা বলছিলেন। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আওরঙ্গজেব যখন ফিরে আসবে, তখন তুমি তার কাছে গিয়ে বলবে যে, তুমি যা বলেছে তা সত্যি নয়…কোনোটাই নয়!

 তার বোন তাকে এভাবে দোষারোপ করায় জাহানারা হতভম্ব হয়ে ভাবতে শুরু করলেন। কি করে তিনি তাকে বোঝাবেন যে, এগুলো কোনোটাই তার কাজ নয়? অবশেষে তিনি বললেন, আমার কথা শোন। তুমি নিশ্চিত হয়ে ভেবেছ। যে, আওরঙ্গজবের চোখে আমি তোমাকে খারাপ দেখাতে চাই, তবে আসলে এটা আমি কখনও চাই না। আগ্রা দুর্গে এতগুলো বছর বাবার সেবায় একাকী কাটাবার সময়, শুধু জানি আমার সঙ্গী ছিল। তখন আমি সব সময় আমাদের সেই দিনগুলোর কথা ভাবতাম, যখন আমরা সবাই একসাথে মিলে হাসিখুশি আর আনন্দে দিন কাটাতাম। সেই সময়গুলো আর ফিরে আসবে না, যেমন মৃতও আর জীবিত হয় না। তবে তখন আমি বিশ্বাস করতাম আর এখনও করি যে, এককালে আমরা যেরকম ছিলাম তার কিছুতো উদ্ধার করতে পারি। সেজন্যই আওরঙ্গজেব যখন আমাকে দরবারে আসতে বললো, তখন আমি তার কথায় রাজি হলাম, যদিও আমার কিছুটা সন্দেহ ছিল। আমি আর কোনো বিভক্তি চাই না আমি সমস্ত ক্ষত নিরাময় করতে চাই যাতে, শাহজাহান আর মমতাজের আর যেসব ছেলেমেয়ে আছে তারা যেন একটি পরিবার হয়ে থাকে।

রওশনআরা এখন তার কান্না থামিয়ে একাগ্র হয়ে জাহানারার দিকে তাকাল। এবার একটু সাহস করে জাহানারা আবার রওশনআরার হাত ধরতে চাইলে তিনি বাধা দিলেন না।

 ‘বোন, আমি আমার মায়ের জীবনের কসম খেয়ে বলছি, আওরঙ্গজেব তোমার সম্বন্ধে যা যা শুনেছে তা আমি বলি নি। তবে এ ধরনের গুজব শোনার পর সে এরকম কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাতে আমি অবাক হইনি। তুমি লক্ষ করনি সে কিরকম বদলে যাচ্ছে? ধর্মীয় বিশ্বাসে সে সবসময় গোঁড়া আর কঠোর নীতিপরায়ণ ছিল, তবে এখন–যা, আমার মনে হচ্ছে সমস্ত দুনিয়াই দেখতে পাচ্ছে–এগুলো আরো কঠোরতা আর সমস্ত কিছু ব্যাপী হচ্ছে। যেটাকেই সে ইসলামের সঠিক পথ মনে করছে, তাতেই সে আরো কঠোরভাবে লেগে থাকছে। আমি বিশ্বাস করি তার ভাবনা ঠিক নয়। আমি তাঁকে বার বার বুঝাতে চেষ্টা করেছি যে, এটা একটা বিপজ্জনক পথ। এটা খুবই সংকীর্ণ, এতে কোনো ধরনের আপস করার সুযোগ নেই আর এটি মানুষের দুর্বলতাকে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না। কিন্তু সে আমার কথা শুনেনি–তুমি হয়তো ভেবেছ তার উপর আমার খুব প্রভাব আছে, কিন্তু আসলে তা না। এখন যে সে তোমার উপর এত কঠিন হচ্ছে, এর কারণ তোমার আচরণ সম্পর্কে সে যা শুনেছে, তার মতে এটা আমাদের ধর্মবিশ্বাসের নীতির সাথে খাপ খায় না। তুমি দ্যাখো সে কিভাবে গানবাজনা বাদ দিয়েছে, কারণ সে মনে করে এটা যে আনন্দ দেয় তা আত্মপ্রশ্রয়ী আর সেই কারণে এটা শোনা গুনাহ। তবে এসবের মানে এই নয় যে আওরঙ্গজেব তোমাকে ভালোবাসে না…সে মনে করে সে যা করছে তা তোমার ভালর জন্যই করছে।

 জাহানারা তার হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই, রওশনআরা গাল থেকে ঘসে চোখের পানি মুছলেন। তারপর গলায় ঝুলানো একটা রিবন থেকে দামি পাথর বসানো ছোট্ট আয়নাটা নিয়ে মুখ পরীক্ষা করলেন। লেপ্টে যাওয়া সুর্মার দাগ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। জাহানারা ভাবলেন, তিনি কি তাঁর বোনকে বুঝাতে পেরেছেন? তবে একটা কথা তাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে হবে। মদ খাওয়া একটা ব্যাপার তবে একজন শাহজাদির গোপন প্রণয়ী নেওয়াটা …তাদের পূর্বপুরুষদের যুগে এ ধরনের ঘটনায় সাথে সাথে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হত। এমনকি এখনও ধর্মের ব্যাপারে আওরঙ্গজেব যেরকম কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে, সেক্ষেত্রে কে জানে সে কি করে ফেলবে, যদি হাতে-নাতে রওশনআরাকে পরপুরুষের সাথে অশোভন অবস্থায় ধরে ফেলে? তাঁকে অবশ্যই তার বোনকে সাবধান করতে হবে, তবে কথাগুলো বলার সময় তাকেও বুঝে শুনে বলতে হবে। হয়তো তিনি রওশনআরাকে বুঝাতে পেরেছেন যে, তার ভাই তাঁর সম্পর্কে যা যা শুনেছে, তা জাহানারা বলেন নি, তবে এর মানে এই নয় যে তার প্রতি রওশনআরার বৈরি মনোভাব কেটে গেছে। বিশ্বাস অর্জন তো অনেক দূরের কথা।

 ‘রওশনআরা, একটা কথা আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাই। আমার কথায় কিছু মনে করো না, তবে তুমি কিন্তু বলেছে যে, আওরঙ্গজেব গুজব শুনেছে যে তোমার গোপন প্রণয়ী আছে। আচ্ছা…তুমি কি এমন কিছু করেছ যে কারণে লোকে হয়তো ভাবতে পারে যে বিষয়টা আসলেই তাই?’ রওশনআরা তাঁর দিকে তাকালেন তবে কিছুই বললেন না আর জাহানারার মনটা দমে গেল। তিনি আবার বললেন, রওশনআরা–দয়া করে…’

 ‘দয়া করে কি বলবো? তোমাকে এমন কথা বলবো যা তোমার বিষয় নয়? যদি আমার গোপন প্রেমিক থাকেও–এর মানে বলছি না যে আছে–আর থাকলেই বা কি? মোগল সম্রাটের কন্যারা যেহেতু বিয়ে করতে পারে না, তার মানে এই নয় যে তারা জীবনের আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করবে–এরকমভাবে আমার দিকে তাকিও না। তুমি কে বিচার করার? তুমি আর তোমার সেই ইংরেজ–নিকোলাস ব্যালেনটাইনের ব্যাপারটাই বা কি? তুমি তো সবসময় ভাণ করতে যে তুমি একেবারে শুদ্ধ, কিন্তু আমি জানি তুমি করতে। আর সেজন্য আমি বাবাকে কথাটা বলেছিলাম, তবে একারণে নয় যে ব্যাপারটা আমি অনুমোদন করি না। তুমি একজন ভণ্ড-তপস্বী ছিলে, তাই তোমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। এখনও যেরকম হয়েছে!

রওশনআরা তুমি বুঝতে পারছে না…আমি এখানে কোন বিচার করতে বসি নি, আমি শুধু তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছি। তোমাকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে…’।

কিন্তু তাঁর বোন তার কথায় কান দিলেন না। বরং তিনি পেছনে ঘুরে কামরা থেকে বের হয়ে গেলেন। জাহানারা তাঁর বোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তবে একমুহূর্ত পর তিনি আর তার বোনের রাজকীয় অবয়বটা দেখছিলেন না, তাঁর চোখে তখন ভেসে উঠেছে একটি যুবকের চেহারা। চুল আর গায়ের রঙ গমের মত আর চোখ দুটো গ্রীষ্মের আকাশের মত নীল। রওশনআরা ভুল বলেছিলেন। তিনি আর নিকোলাস প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন না। তবে দুজনের মাঝে বিচ্ছেদের পর এতগুলো বছরে তিনি কখনও তার কথা ভুলতে পারেন নি আর ভাবতেন অন্য জীবনে কি হবে কে জানে…’

*

বাদামি ঘোড়ায় চড়ে আওরঙ্গজেব লাহোর দরজা দিয়ে দিল্লির লালকেল্লায় প্রবেশ করলেন। তার আগে আগে চলা দেহরক্ষীবাহিনীর বুকের বর্মে বিকেলের রোদ ঠিকরে পড়ে ঝিকমিক করছিল, মূল সেনাবাহিনী আরো পেছনে রয়েছে। জাটদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করায় তিনি নীরবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। কিছুক্ষণ পর সূর্য দিগন্তের নিচে ডুবে যাওয়ার পর তিনি হাতির পিঠে চড়ে শহরের রাস্তা দিয়ে জামে মসজিদে গিয়ে আন্তরিকতার সাথে নামাজ আদায় করবেন। সাদা কারুকাজ করা বেলে পাথরের মসজিদটি পুরো সাম্রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে বড়। তাঁর বাবা শাহজাহানের আমলে পাঁচহাজার শ্রমিক আর কারিগরের ছয় বছর লেগেছিল এটা নির্মাণ করতে আর দশ লক্ষ রুপিরও বেশি খরচ পড়েছিল। এটি তার বাবার এমন একটি কীর্তি যার জন্য তিনি সত্যি গর্ববোধ করেন।

আওরঙ্গজেব ঘোড়া নিয়ে কেল্লার বিশাল আঙিনায় ঢুকলেন। পরে তিনি তার সেনা কর্মকর্তাদের ডেকে এনে পুরস্কারস্বরূপ, টাকা, ঘোড়া, সুন্দর তরোয়াল আর সম্মানসূচক আলখাল্লা বিতরণ করবেন, যারা গোকলার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে বিশেষ বীরত্বসূচক অবদান রেখেছিল। তবে এখন তাঁর মন কেবল উদিপুরী মহলের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়ে রয়েছে, যিনি মাত্র চার দিন আগে তাঁকে একটি পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছেন। এটা আরেকটি শুভ লক্ষণ যে, উপর থেকে তাঁর উপর আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে।

 তিনি হেরেমে ঢুকতেই একটার পর একটা দরজা খুলে গেল আর তার কানে বাজতে লাগলো, ‘সম্রাট আসছেন’ চিৎকারটি। রওশনআরার মহলে ঢোকার দরজার কাছাকাছি পৌঁছার পর তিনি সেখানে দাঁড়ালেন না। এখন তার বোনের সাথে দেখা করার ইচ্ছা নেই আর তিনি হয়তো সেখানে নেই। খুব সম্ভব অন্যান্য বোনদের সাথে তিনি এখনও জালি দেওয়া বেলকনিতে রয়েছেন, যেখান থেকে রাজকীয় মহিলারা তাঁর আনুষ্ঠানিক আসা-যাওয়া লক্ষ করতে পারেন। তবে উদিপুরী তাঁর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন…

 মহলে ঢুকতেই তিনি গোলাপ আতরের খুশবু পেলেন, এটা উদিপুরী মহলের প্রিয় সুগন্ধি, ঠিক যেরকম তাঁর মা মমতাজের তা ছিল। দরজার বাইরে হেরেমের দাঁড়ান পরিচারকের প্রতি ইশারা করে তাকে চলে যেতে বলে তিনি ভেতরের কামরায় ঢোকার দরজা ঠেলে খুললেন। চৌকাঠে পা দিয়েই তিনি থমকে দাঁড়ালেন। উদিপুরী কৌচের উপর আধশোয়া হয়ে রয়েছেন। লম্বা কালো চুল কাঁধের উপর এসে পড়েছে আর তিনি একমনে তার বাচ্চার দুধ খাওয়া দেখছেন। সেই সুদূর ককেশাস পর্বত এলাকায় তাঁর নিজ দেশ জর্জিয়ায় যত উচ্চ পরিবারেরই হোন, কোনো মা তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবার জন্য ধাত্রী রাখেন না। কি সুন্দর দৃশ্যটি–মা আর তাঁর সন্তান তার মায়ের নীল শিরাওয়ালা শুভ্র মসৃণ স্তন থেকে দুধ চুষে খাচ্ছে।

তাঁকে দেখেই উদিপুরীর দুচোখে খুশির ঝলক দেখা দিল। তিনি বললেন, ‘আওরঙ্গজেব আসুন, আপনার ছেলেকে দেখুন। পাতলা কালো চুলের ছোট্ট মাথাটা কোলে ধরে তিনি শিশুটিকে বুক থেকে সরিয়ে নিয়ে আওরঙ্গজেবের দিকে তুলে ধরলেন। দুধ খাওয়া থেকে সরিয়ে নিতেই শিশুটি ছোট ছোট পাগুলো ছুঁড়তে ছুঁড়তে কান্না জুড়ে দিল। আওরঙ্গজেব তাকে কোলে নিলেন।

তিনি উদিপুরীর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, আমি এর নাম দিতে চাই কম বক্স। মোল্লারা বলেছে এই নামটি শুভ। তুমি খুশি তো এই নামে?

 উদিপুরী ঘাড় কাত করে সায় দিলেন।

কম বক্সের ছোট্ট নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকাতেই আওরঙ্গজেব আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন, তার দম বন্ধ হয়ে এল। পৃথিবীর অশুভ কোনো কিছুর ছোঁয়া এই শিশুটির গায়ে এখনও লাগেনি। এই ছেলেটি তার অন্যান্য ভাইদের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, হয়তো–বৃদ্ধবয়সে এই ছেলেই তাঁর অবলম্বন হবে। তবে একমাত্র আল্লাহই জানেন ভবিষ্যতে তার নিজের আর এই শিশুটির কপালে কি লেখা আছে। তবে তিনি প্রার্থনা করলেন যেন কম বক্সের প্রতি তার অনুভূতি সবসময় যেন এরকমই থাকে। ছেলেটি যেন কখনও জানতে না পারে, শীতলতা আর প্রত্যাখ্যানের কষ্ট, যা তিনি নিজে তার বাবার হাতে সহ্য করেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *