০৩. বন্দী

০৩. বন্দী

আগ্রা দুর্গের দেওয়ান-ই-আম-এর মঞ্চের উপর আওরঙ্গজেব একটি সোনালি চেয়ারে খুশিমনে বসলেন। একপাশে দেয়ালের উঁচু জায়গা থেকে জাফরির আড়াল থেকে জাহানারা তাকিয়ে রয়েছেন। বোনের সাথে মিটমাট করে ফেলার পর গত তিনটি মাস কেবল ভাল খবরই পাওয়া যাচ্ছিল আর এখন জাহানারা এবং পুরো সভাসদ আওরঙ্গজেবের সর্বশেষ বিজয় দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। যে শিবাজি সুরাট বন্দর তছনছ করার সাহস দেখিয়েছিল, ১৫০,০০০ সেনার বিশাল একটি বাহিনী এবং উন্নততর কৌশল দিয়ে তাকে পরাভূত করা হয়েছে। তিনি বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। মারাঠি নেতা তেইশটি দুর্গ ফেরত দেওয়াসহ ৪০০,০০০ রুপি ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, একটু পরই তার বালক পুত্র সম্ভাজিকে নিয়ে দরবারে এসে আওরঙ্গজেবের সামনে নতজানু হবেন।

শিঙ্গা বেজে উঠতেই আওরঙ্গজেব বুঝলেন, শেষ পর্যন্ত সেই মুহূর্তটি এসে গেছে, এবার এই মরুভূমির ইঁদুরজোড়া আসল মোগল জাকজমক টের পাবে। তিনি ওদেরকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে রোজকার প্রথামাফিক একের পর এক রাজকীয় ডিক্রি জারি করতে শুরু করলেন এবং আর্জিদারদের বিরাট একটি সারির অভিযোগ ইত্যাদি সমাধান করতে লাগলেন। পার্থিব জগতের প্রতীক জাঁকালো পোশাক-অলঙ্কার ইত্যাদি ব্যবহারকে তিনি সাধারণত অসার দম্ভের প্ররোচনা এবং ধর্মদ্রোহিতাপূর্ণ অহংকার হিসেবে ঘৃণা করেন। তবে অনেক সময় এগুলো কাজে লাগে আর এখন সেই সময়টি এসেছে। অত্যন্ত যত্নসহকারে সোনালি এমব্রয়ডারি করা দুধ-সাদা ব্রোকেডের আলখাল্লা পরেছেন। আলখাল্লাটির গলায় আর হাতে মুক্তার মালা সেলাই করা, খোদাই করা পান্না আর রক্তলাল রুবির মালা গলায় পেঁচিয়েছেন। হীরকখচিত কোমরবন্ধ থেকে আলমগির তরোয়ালটি ঝুলছে। বিখ্যাত এই তরোয়ালটি তার পূর্বপুরুষ বাবর, ফারগানা থেকে এনেছিলেন আর আঙুলে ঝলমল করছে তৈমুরের সোনার বাঘের মাথাওয়ালা একটি আংটি। তিনি মনে মনে তাঁর নিজের প্রতিচ্ছবিটি এভাবে আঁকলেন : ছেচল্লিশ বছর বয়সে জাগতিক সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী পূর্ণতাপ্রাপ্ত সম্রাট আওরঙ্গজেব। ষষ্ঠতম এবং আল্লাহর মেহেরবাণিতে হয়তো সমগ্র মোগলদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। এই ভাবমূর্তিটি তাঁকে পরিতৃপ্ত করলো।

দুপাশে ছয়জন করে মোগল দেহরক্ষীদল শিবাজি আর তার পুত্রকে ঘিরে সভাসদদের সারির মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে এল। দেহরক্ষীদের পরনে সবুজ পোশাক, বুকে চকচকে পালিশ করা বর্ম আর হাতে লম্বা বর্শা। সবাই ঘুরে উৎসুক দৃষ্টিতে দাক্ষিণাত্যের নেতার দিকে তাকাল। আওরঙ্গজেবের চেয়ে মারাঠি নেতা অন্তত ছয় ইঞ্চি বেঁটে আর হালকা-পাতলা গড়নের। শিবাজি মঞ্চের সামনে এসে থামলেন, তার ছেলে কয়েক পা পেছনে দাঁড়াল। একজন পরাভূত শত্রু হিসেবে বিনয়ের সাথে মাটির দিকে চোখ না রেখে তিনি অপলকভাবে সরাসরি সম্রাটের মুখের দিকে তাকালেন। সাথে সাথে আওরঙ্গজেব তাচ্ছিল্যের সাথে মাথা ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালেন। আরেকবার তূর্যধ্বনি হল, আওরঙ্গজেবের সচিব সামনে এগিয়ে শিবাজির সামনে একটি কাগজ মেলে ধরলো। তিনি এখন যে আনুগত্যের শপথ নেবেন, সেই বাক্যগুলো এতে লেখা ছিল।

শিবাজি আর তার দিকে তাকিয়ে নেই, এটা বুঝতে পেরে আওরঙ্গজেব আবার মঞ্চের উপর থেকে নিচের দিকে তাকালেন। বাক্যগুলো জোরে জোরে না পড়ে তিনি ভ্রু কুঁচকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করছিলেন। তারপর তিনি ঘুরে সচিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শব্দগুলো ফারসিতে লেখা হয়েছে– ভাষাটি আমি ভালই জানি, আপনি শুনতেই পাচ্ছেন, তবে আমি আমার দেশীয় ভাষায় শপথ নিতে চাই।’

আওরঙ্গজেবের দেহ কঠিন হয়ে গেল। পরাজিত হয়েও কি লোকটার শিক্ষা হয় নি? তিনি বললেন, আপনি আমার দরবারের ভাষা–ফারসিতে শপথ নেবেন।

 শিবাজি বললেন, ঠিক আছে। তারপর তিনি গম্ভীর কণ্ঠে সাবলিলভাবে ফারসিতে শপথবাক্য পাঠ করা শুরু করলেন, আমি শিবাজি, মারাঠি গোষ্ঠীর নেতা এই মর্মে সম্রাট আরঙ্গজেবের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করছি, যাকে আমি আমার অধিরাজ স্বীকার করছি এবং বিশ্বস্ততা এবং সম্মানের সাথে তার সেবা করবো। একই সাথে আমার পুত্র সম্ভাজিও এই শপথ বাক্য মেনে চলবেন।

আওরঙ্গজেব শুনেছিলেন যে, শিবাজি নিজেকে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে দাবি করতেন। শপথবাক্য পাঠ করার পর আওরঙ্গজেব একবার মাথা নেড়ে তাঁর স্বীকৃতি জানালেন, তারপর দরবারে নীরবতা নেমে এল। মারাঠি লোকটিকে বুঝতে হবে যে, মোগল সাম্রাজ্যে সে কতটা গুরুত্বহীন। আর এই পূর্ণ দরবার ছাড়া আর কোথায় সেটা ভালো হয় দেখান, যেখানে হাজির রয়েছে ঐ কমলা রঙ-এর পোশাকপরা রাজপুতদের মতো অন্যান্য সামন্তরাজা, যাদেরকে তিনি আগ্রায় ডেকে এনেছিলেন। অবশ্য মাঝে মাঝে ঐ রাজপুত রাজাদের অহঙ্কারও তার কাছে অসহ্য মনে হত।

তিনি দরবারের সচিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার এই সর্বশেষ সামন্ত রাজাকে ঐ সেনাপতিদের পেছনে নিয়ে যাও, যাতে তিনি লক্ষ করতে পারেন কিভাবে আমরা দরবারের কাজ চালাই আর সেখান থেকে তিনি শিখতে পারেন। শিবাজি ঘুরে দেখলেন, আওরঙ্গজেব দরবার কক্ষের একেবারে পেছন দিকে দেখাচ্ছিলেন, যেখানে সর্বকনিষ্ঠ কর্মকতারা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটা দেখে অপমানে তার মুখ লাল হয়ে গেল। আওরঙ্গজেবের সামনে যারা উপস্থিত ছিল তারা সবাই শাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তিনি বুঝতে পারলেন ওরা ভালোভাবেই তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে যে, তিনি এই হঠাৎ গজিয়ে উঠা পরাভূত শত্রুর দর্পচূর্ণ করতে চলেছেন। অন্য কোনো অদূরদর্শী মানুষ হলে তাকে ফাঁসি দিয়ে দিত, অথচ তিনি তার সাথে কত মহানুভবতাই না দেখিয়েছেন। একজন বীর শহিদ হলে ভবিষ্যতে তার জাতিকে বিদ্রোহে অনুপ্রেরণা যোগাতো, অথচ তার বদলে চোখের সামনে নতজানু হয়ে থাকা একজন অধীনস্ত সামন্ত রাজা নিশ্চয়ই অনেক ভাল।

আওরঙ্গজেব অপেক্ষা করছিলেন দেখার জন্য যে শিবাজি তার জন্য নির্ধারিত জায়গায় যান কি-না, কিন্তু তার বদলে মারাঠি নেতা সচিবের বাধা এড়িয়ে সামনে একেবারে মঞ্চের কিনারায় এসে বললেন, ‘জাহাপনা, আপনার মতো আমিও একজন শাসক। আমার শরীরে রাজরক্ত বইছে, অথচ আপনি আমাকে আমার চেয়ে নিচু স্তরের মানুষের সারিতে স্থান দিচ্ছেন। কেন আমাকে অপমান করছেন?

 শিবাজি এত কাছে এসে পড়েছেন যে, আওরঙ্গজেব তার দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন আর তার চোখে আগুন দেখতে পাচ্ছিলেন। কামরায় নীরবতা আরো গাঢ় হয়ে এসেছিল। ধীরে ধীরে আওরঙ্গজেব উঠে দাঁড়ালেন। ইচ্ছে করেই কণ্ঠস্বর শান্ত রেখে বললেন, আপনি এক্ষুনি আমার আনুগত্য ঘোষণা করে শপথ বাক্য পাঠ করেছেন, অথচ তারপরও আমার কথা অমান্য করে প্রকাশ্যে আমার বিরোধিতা করছেন।

 শিবাজি সাথে সাথে উত্তর দিলেন, আর আপনি সবার সামনে আমায় অবমাননা করছেন। আমি আর এখানে থেকে অপমান সহ্য করবো না। এই কথাটি বলেই সাথে সাথে পেছন দিকে ঘুরে শিবাজি তার ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে সভাসদদের মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে বাইরের দিকে চললেন। আওঙ্গজেব আদেশ দিলেন, ‘প্রহরী, ঐ লোকটিকে থামাও! তাকে আর তার ছেলেকে গ্রেফতার কর। ফাওলাদ খান, যে পর্যন্ত না আমি এদের ভাগ্য নির্ধারণ না করি, ততদিন আপনি আগ্রার সুবেদার হিসেবে এদেরকে আপনার হেফাজতে রাখবেন।

শিবাজি ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকালেন, তবে প্রহরীরা তাকে আর তার ছেলেকে দ্রুত বাইরে নিয়ে যেতেই তিনি বাধা দিলেন না। আওরঙ্গজেব আবার সিংহাসনে বসলেন। কেউ তার দিকে না তাকালেও অনুমান করতে পারছিলেন যে, ভেতরে ভেতরে তিনি রেগে ফেটে পড়ছিলেন। তিনি বললেন, ‘চলুন আমরা দরবারের কাজে ফিরে যাই–বাংলা থেকে খাজনা কিরকম আদায় হল…।’

*

শিবাজি বেশ সাবধানে তার কাঁধ সমান উঁচু বিশাল আকৃতির বেতের ঝুড়িগুলোর ভেতরের মালামাল পরীক্ষা করলেন–নানরুটি, বাক্সভরা শুকনো খুবানি আর কিসমিশ, চাউল আর ডালের ছোট ছোট থলে। তারপর মৃদু হাসলেন–যেরকম বলেছিলেন সবকিছু সেরকমই এসেছে।

শেষ ডালাটি বন্ধ করার পর তার নায়েব একুজি বললো, “মহারাজ, আগ্রার গরিব মানুষেরা রোজ আপনার নাম গান গায়। আমি প্রহরীদেরকে জিজ্ঞেস করবো তারা ঝুড়িগুলো পরীক্ষা করবে কি-না। তারপর বেহারাদেরকে ঝুড়িগুলো গাড়িতে তুলতে বলবো।

 ‘খুব ভাল। প্রহরী আর বেহারাদেরকে রোজকার মতো পাওনা মিটিয়ে দিতে ভুলো না। আমি নিশ্চিত হতে চাই যেন খাবারগুলো যাদের জন্য পাঠানো হচ্ছে। তাদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছুক। শুনেছি বাজারে রুটির দাম খুব বেড়ে গেছে আর আমাদের সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ অনাহারে রয়েছে। শিবাজি এর বেশি বললেন না। আওরঙ্গজেবের চোখ আর কান রয়েছে সবজায়গায় আর সেজন্যই তিনি বেশ সাবধানে কথা বলেন।

গত তিনমাস ধরে ওদেরকে দুর্গের সংকীর্ণ যে ঘরে আবদ্ধ রাখা হয়েছিল সেখান থেকে প্রতিদিন বিকেলে তিনি একুজিকে দুর্গের বাজারে পাঠিয়ে আসছেন। তার নায়েবের সেখানে যাওয়ার অনুমতি ছিল। সেখান থেকে সে আগ্রার গরিব মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেবার জন্য খাবার কিনতে যেত। শুকনো খাবার ভর্তি তিনটি ঝুড়ি শিবাজি শহরের একটি মন্দিরে পাঠাতেন। প্রথম প্রথম প্রহরীরা এই দানকর্ম করার অনুমতি দিতে রাজি ছিল না, ওরা সুবেদার ফাওলাদ খানের কাছ থেকে অনুমতি আনার কথা বলেছিল। সুবেদারও সন্দেহ করেছিলেন, প্রথম কয়েকদিন খাবার ভর্তি ঝুড়ির ভেতরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখলেন আর ফেরার সময় আবার পরীক্ষা করলেন যে, ভেতরে কেউ শিবাজির জন্য কোনো অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে কি-না। তবে শিবাজি যেরকম আশা করেছিলেন, রোজ রোজ একই রকম পরীক্ষা করতে করতে সুবেদার বিরক্ত হয়ে গেলেন। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে এই কাজের ভার প্রহরীদের উপরেই ছেড়ে দিলেন। আর শিবাজির কাছ থেকে প্রতিদিন রূপার মুদ্রা পেয়ে ওরা খুশি মনেই এই কাজটি করে চললো।

 এখন ওরাও ওদের দায়িত্বে শিথিল হতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ সময় ওরা পেটমোটা বেতের ঝুড়িগুলোর ভেতরে একবার উঁকি মেরেই ছেড়ে দিত। ছোট একটি উঠানের চতুর্দিকে চারটি কামরা নিয়ে শিবাজির কারাগার। এখান থেকে বের হবার যে ফটক রয়েছে তার বাইরে একটি গাধার গাড়িতে ঝুড়িগুলো তোলা হল। মাল তোলার পর হলুদ পাগড়িপরা গড়োয়ান লাগামটি একবার ঝাঁকি দিতেই গাধার গাড়িটি দুর্গের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চললো। গেট পার হয়ে শহরের রাস্তা ধরে মন্দিরের দিকে চলতে শুরু করলো। খাবারগুলো সেখানে বিতরণ করা হবে। শিবাজি নিজেকে বাহবা দিলেন, প্রহরীগুলো কি বোকা। শুকনো ফলের ভেতরে লুকিয়ে রেখে মন্দিরের পুরোহিতের কাছে তিনি যে লিখিত বার্তাটি পাঠিয়েছেন, তা ওরা দেখতে পায় নি। আর পুরোহিত যে উত্তরটি পাঠিয়েছিলেন তাও ওরা দেখে নি। চিঠির উত্তর লেখা ছোট কাগজটি পেঁচিয়ে বেতের ঝুড়ির বেতের ফাঁকে গুঁজে রাখা ছিল। শিবাজি যা জানতে চেয়েছিলেন, তার উত্তরে ওরা লিখে জানিয়েছিল, ওরা তার কয়েকজন সেনাপতির সাথে যোগাযোগ করেছিল আর তাদেরকে বলেছিল ওরা যেন দ্রুতগামী দুটি ঘোড়া নিয়ে শহরের বাইরে নির্দিষ্ট স্থানে তৈরি হয়ে থাকে। শিবাজির পালিয়ে বের হওয়া পর্যন্ত ওরা তার জন্য অপেক্ষা করবে।

তবে সেই মুহূর্তটি কখন আসবে? তিনি সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন দেখতে যে, রোজকার খাবার বিতরণের কাজটি গতানুগতিক হতে হতে একসময় প্রহরীরা পুরোপুরি কখন এ থেকে সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার মনে একটু অহঙ্কার ছিল যে, ধৈর্য ধরা আর সেই সাথে ঠিক কখন আঘাত হানতে হবে সেটি জানাটাও তার একটি শক্তি। একুজি বাজারে জোর গুজব শুনে এসেছে যে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আওরঙ্গজেব কান্দাহার অভিযানে সেনাবাহিনী পাঠাবেন আর সেই সাথে তার মারাঠি বন্দীদেরকেও তাদের সমস্যাসঙ্কুল নিজের দেশ থেকে কাবুলে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেবেন। একথাটি যদি সত্যি হয় তবে মাহেন্দ্রক্ষণটি এগিয়ে আসছে।

ঝুড়িগুলো পাঠিয়ে দেবার পর একুজি একটি পিতলের ঘটিতে তার প্রভুর পানের জন্য পানি ঢেলে একজন ভৃত্যকে পান করতে দিল। খাবারের স্বাদ গ্রহণের জন্য শিবাজি কয়েকজন ভৃত্য রাখার অনুমতি পেয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠানটি লক্ষ করে শিবাজি মুখ বাঁকিয়ে হাসলেন। কারাগারে বন্দী হওয়ার পর প্রথম প্রথম তিনি সন্দেহ করতেন যে, আওরঙ্গজেব হয়তো তাকে বিষপ্রয়োগ করতে চেষ্টা করবেন কিংবা তার গলায় ছুরি চালাবার জন্য একজন গুপ্তঘাতক পঠাবেন। কিন্তু কিছুই হয় নি। এ ধরনের কাঁচা কাজ করে একজন শহীদ সৃষ্টি না করে আওরঙ্গজেব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। শিবাজি এখন বুঝতে পেরেছেন দুর্গে থাকাকালীন হয়তো তিনি যথেষ্ট নিরাপদ থাকবেন। তার জীবন নাশের যেকোনো চেষ্টা সম্ভবত আগ্রা থেকে কান্দাহারের পথে হতে পারে। লোকজনের চোখ-কান এড়িয়ে অনেক দূরে এমনভাবে কাজটি করা হবে যেন, কোনো ডাকাত কিংবা বিদ্রোহীর ঘাড়ে দোষ চাপানা যায়। সম্রাটের দিকে কেউ আঙুল দেখাতে না পারে। এই আরেকটি কারণে আওরঙ্গজেব তাকে কান্দাহার পাঠাবার আগেই তাকে অবশ্যই পালাতে হবে।

এখন মনে হচ্ছে যেন, দেবতারা তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। ঘণ্টাখানেক আগে একুজি যখন বাজারে ছিল তখন তিনি প্রহরীদেরকে কিছু বলাবলি করতে শুনেছিলেন, যা যতশীঘ্র সম্ভব তার নায়েবকে জানাতে হবে। পানির পাত্রটি একুজির হাত থেকে নেবার সময় তিনি তার গলায় ঝুলানো একটা চামড়ার ফিতা থেকে ঝুলে থাকা পিতলের গনেশের মূর্তিটি ছুলেন। গোপন সঙ্কেতটি টের পেয়ে একুজি বুঝতে পারলো যে, তিনি প্রহরীদের কান এড়িয়ে তাকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলতে চাচ্ছেন। কালো পাগড়িপরা মাথাটা সামান্য হেলে সে সায় দিল।

পানি খাওয়া শেষ করে শিবাজি ধীরে ধীরে উঠান পেরিয়ে উঁচু একটা দেয়ালের পেছনে লুকানো ছোট প্রস্রাবখানার দিকে এগোলেন। একুজিও দ্রুত সেখানে গেল। দুজনেই কানখাড়া করে একমুহূর্ত অপেক্ষা করলেন, তবে উঠান থেকে কোনো শব্দ শোনা গেল না। শিবাজি সশব্দে প্রস্রাব করতে শুরু করে ফিসফিস করে তার নায়েবকে বললেন, তুমি যখন বাইরে ছিলে তখন আমি শুনলাম একজন প্রহরী বলছিল, পানিপথ যুদ্ধে মোগলদের বিজয়ের বার্ষিকী পালনের জন্য আগামীকাল বিরাট ভোজ আর আতশবাজির উৎসব হবে। সেদিন থেকেই তাদের হিন্দুস্তানের অভিশপ্ত বিজয়যাত্রা শুরু হয়েছিল।

‘হা মহারাজ। আমিও বাজারে লোকজনদের এটা বলাবলি করতে শুনেছি। আর ফেরার পথে দেখলাম বড় একটি মাঠে সবুজ মখমলের তাঁবু খাটানো হচ্ছে। মনে হয় সেখানেই ভোজ হবে।’

 ‘চমৎকার। পুরো দুর্গে সবার মনোযোগ ভিন্নমুখী থাকবে। পালাবার চেষ্টা করার জন্য এটাই সুবর্ণ সুযোগ। শিবাজি শরীর বাঁকা করে চওড়া গলার একটি মাটির ঘড়া থেকে পানি ঢেলে নিয়ে হাত ধুলেন। আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কিভাবে পালাতে হবে সেটা ওরা কয়েকশো বার আলোচনা করেছেন মাঝে মাঝে এই প্রস্রাবখানায়, আবার অনেকসময় গভীর রাতে ফিসফিস করে পুরো পরিকল্পনার প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।

 রাতে বিছানায় শুয়ে শিবাজি ফিসফিস করে তার পাশে শোয়া ছেলেকে খবরটা জানালেন। এই প্রথম তিনি তার নয় বছর বয়সি ছেলে সম্ভাজিকে এই পরিকল্পনার কথা জানালেন আর অনুভব করলেন কথাটা শুনেই তার ছেলের দেহ শক্ত হয়ে গেল। তিনি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, কোনো চিন্তা করোনা, শুধু আমি আর একুজি তোমাকে যা যা করতে বলবো ঠিক তাই করবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

 পরদিনটি এত ধীরে কাটছিল যে, শিবাজি প্রায় অস্থির হয়ে উঠলেন। তবে বিকেল গড়াতেই তার চার দেয়াল ঘেরা আবাসের বাইরে থেকে মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, সম্ভবত ভোজের অতিথিরা এসে গেছে। সূর্য দিগন্তে ডুবে যাওয়ার আগেই প্রচণ্ড শব্দে প্রথম আতশবাজি আকাশে উড়লো। ছোট ছোট তারাগুলো ভালভাবে দেখা যাচ্ছে না। তারপর পরই উল্লসিত চিৎকার। একুজি রোজকার মতো ঠিক সময়েই বাজারে গিয়েছে। তিনি আশা করলেন উৎসব চলাকালীন বাজার হয়তো ভোলা থাকবে, যাতে একুজি শুকনো খাবাগুলো কিনতে পারে আর গাধার গাড়িটি দুর্গে ঢুকে বেতের ঝুড়িগুলো নিতে পারবে। নায়েবের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করার সময় তিনি ধীর স্থির থাকার চেষ্টা করলেন, অহেতুক উঠানে পায়চারি কিংবা অস্বাভাবিক কিছু করা থেকে বিরত থাকলেন যাতে দুই প্রহরীর দৃষ্টি আকৃষ্ট না হয়। প্রহরী দুজন একটা নিম গাছের ছায়ায় বসে পান চিবুচ্ছিল। শেষপর্যন্ত একুজি ফটকে এসে হাজির হল আর তার পেছনে দুজন কুলির মাথায় দুটো ঝুড়ি যথারীতি দেখা যাচ্ছে। এবার তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। এপর্যন্ত ঠিক আছে, তবে কঠিন কাজটি এখনও বাকি রয়ে গেছে।

একুজি জিজ্ঞেস করলো, “মহারাজ, মালামালগুলো এসে গেছে। আপনি কি রোজকার মতো দেখে নেবেন?

‘অবশ্যই দেখবো। তবে বাইরের আতশবাজির শব্দ আর হৈহুল্লোরে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। ঝুড়িগুলো বরং ভেতরে আমার কামরায় নিয়ে এসো। নায়েবের পিছু পিছু কুলিরা ঝুড়িগুলো মাথায় করে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তবে শিবাজি যেখানে ছিলেন, সেখানেই রইলেন, প্রহরীরা কিছু বলে কি-না শোনার জন্য। ঠিক তখনই আরেকটি আতশবাজি ফুটে উঠতেই প্রহরী দুজন শিবাজির দিকে পেছন ফিরে একটা পাথরের বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে আতশবাজির খেলা দেখার জন্য আকাশের দিকে তাকাল।

মোট তিনটি ঝুড়ি ভেতরে কামরায় নেওয়া পর্যন্ত শিবাজি অপেক্ষা করলেন। সেখানে সম্ভাজি তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আর একুজি দুই কুলিকে বিদায় করে দিতেই ওরা বাইরে এসে প্রায়ান্ধকার আকাশে আতশবাজির সোনালি রঙের তারা দেখতে লাগলো। নিঃশব্দে তিনি এক থেকে পাঁচশো পর্যন্ত গুণতে শুরু করলেন, এই সময়ের মধ্যে দুটি ঝুড়ি থেকে যথেষ্ট পরিমাণ শুকনো খাবার নামিয়ে একুজি একটা ঝুড়ির ভেতর সম্ভাজিকে ঢুকালো। তারপর শিবাজি উঠলেন এবং নিচু হয়ে স্যান্ডেল থেকে কিছু ধুলা ঝাড়ার ভান করে তারপর ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে হেঁটে চললেন।

একুজি ফিসফিস করে বললো, ‘জলদি করুন, মহারাজ!’ শিবাজি দরজার কাছে রাখা খোলা ঝুড়িটার ভেতরে ঢুকলেন। ঝুড়ির ভেতরে গুঁড়িসুরি মেরে বসতেই একুজি তার মাথা, ঘাড়ে রুটি, আর খাবারের প্যাকেট ভরতে শুরু করলো। যতদূর সম্ভব খাবার সামগ্রী দিয়ে তাকে পুরোপুরি ঢেকে ঢাকনিটা বন্ধ করার আগে একুজি কুলিদেরকে ডাকলো, ‘বেয়ারা, এখানে এস!’ তবে বাইরের প্রচণ্ড হট্টগোলের শব্দে কুলিরা তার ডাক শুনতে পেল না। শিবাজি অনুভব করলেন, একুজি তার ঝুড়িটি পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে গিয়ে আবার জোরে চিৎকার করে কুলিদের ডাকলো। তারপর আতশবাজির শব্দ হঠাৎ থেমে যেতেই শিবাজি পাথরের মেঝেতে কুলিদের খালি পায়ে হাঁটার শব্দ শুনতে পেলেন। তারপর অনুভব করলেন ঝুড়িটি উপরের দিকে উঠছে, তিনি দুপাশে তার পেশিবহুল দুই হাত ঠেকা দিয়ে বসলেন। কুলিটি ঝুড়িটি মাথায় করে উঠান পার হয়ে নিচে পাথরের মেঝেতে রাখলো। তারপর দুবার ধপ করে শব্দ হতেই বুঝলেন অন্য ঝুড়িগুলোও তার পাশে এসে গেছে।

তিনি শুনলেন একুজি চেঁচিয়ে বলছে, আপনারা কি ঝুড়িগুলোর ভেতরে দেখবেন? আমি কিন্তু এখনও এর মুখ বাঁধিনি।’ শিবাজি চোখ বুজলেন। এত ধীরে কখনও সময় পার হয় নি। তার পিঠ দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগলো। সম্ভাজি কিভাবে সামলাচ্ছে কে জানে? সে সাহসি ছেলে, তবে বয়স মাত্র নয় বছর…

 কেউ কথা বললো না। ব্যাপার কি? কি হচ্ছে? হয়তো যে কোনো মুহূর্তে ঝুড়ির ঢাকনি খুলে যাবে আর তারপর তিনি অনুভব করবেন একটা আঙুলে খোঁচা মেরে মেরে দেখছে, একসময় তার গায়ে খোঁচা মারবে। তারপর তার চুল ধরে তাকে টেন বের করবে। কিন্তু তারপর আবার আতশবাজি আকাশে উড়লো। প্রায় একই সাথে সাথে এক ঝটকা মেরে ঝুড়িটাও উপরের দিকে উঠলো। শিবাজি আবার চলতে শুরু করেছেন। আতশবাজির নতুন প্রদর্শনীর দিকে অবশ হয়ে তাকিয়ে ওরা হয়তো ঝুড়িগুলো নিয়ে চলে যেতে কুলিদেরকে ইশারা করেছিল। আতশবাজির শা শা আর হিস হিস শব্দ হলেও শিবাজি ওদের হাঁটার ছন্দ বুঝতে পারছিলেন আর গুণতে চেষ্টা করছিলেন কয় পা গেল। আট, নয়, দশ …একজন কুলি বিড়বিড় করে বললো, এই শিবাজি দিন দিন আরো দানশীল হচ্ছেন। আমি শপথ নিয়ে বলবো এই ঝুড়িটা ভীষণ ভারি। কিন্তু ওরা ওদের চলা থামাল না…এগার, বারো, তেরো…এখন মনে হয় ওরা ভেতরের গেটের চৌকাঠের নিচ দিয়ে যাচ্ছে। এখানেই গাধার গাড়িটা অপেক্ষা করার কথা। হাউই বাজির শাঁ শাঁ হিস হিস শব্দের ভেতর দিয়ে কান খাড়া করে তিনি লাগামের মৃদু টুংটাং শব্দটা ঠিকই ধরতে পারলেন। গাধার গাড়িটা এসে গেছে।

 ঠিক তখনই কুলি তার ঝুড়িটা মাটিতে ফেলে দিল। এক মুহূর্ত ঝুড়িটা সামনে পেছনে দুলতে লাগলো–যদি উল্টে পড়ে ঢাকনিটা খুলে যায় তাহলে তিনি ধরা পড়ে যাবেন। শিবাজি নিজের দেহ কুণ্ডলি পাকিয়ে শক্তভাবে একটা বলের মতো করে রাখলেন আর আশা করলেন যেন ঝুড়িটার দুলুনি থেমে যায়। একুজি চিৎকার করে উঠলো, এই বুন্ধু সাবধানে রাখ! যদি আমার প্রভুর কাছ থেকে রূপার মুদ্রা পেতে চাও, তাহলে অসাবধান হয়ো না। নাও ঝুড়িটা তোল আবার। ঝুড়িটা আবার উঠলো। যখন অনুভব করলেন গাড়িতে রাখার জন্য ঝুড়িটা আরো একটু উঠলো, তখন শিবাজি বহুকষ্টে একটা বিজয় উল্লাসের চিৎকার দমন করলেন। গাড়িটা যেভাবে তার নিচে পর পর দুবার দুলে উঠলো, তাতে বুঝা গেল তার ঝুড়িটাই প্রথমে তোলা হয়েছে। এক মুহূর্ত পর গাড়োয়ান চাবুক হাঁকাতেই গাড়িটা দুর্গ থেকে বের হওয়ার ঢালু পথ বেয়ে নামা শুরু করতেই শিবাজি টের পেলেন তার ঝুড়িটা সামনের দিকে সামান্য টাল খেল।

সবকিছু ভালোভাবে চললে শীঘ্রই ওরা মন্দিরে পৌঁছে যাবেন। সেখানে পুরোহিত তাকে আর তার ছেলেকে ভবঘুরে ভিক্ষুকের ছদ্মবেশ নিতে সাহায্য করবে। তারপর আগ্রার সরু গলির মধ্য দিয়ে পথ দেখিয়ে শহরের দেয়ালের বাইরে আমবাগানের কাছে নিয়ে যাবেন, যেখানে তার লোকজন ঘোড়া নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। তারপর গরম বাতাসে চুল উড়িয়ে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ওরা দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ের দিকে জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে চলবেন।

*

আগ্রা দুর্গের বুরুজের উপরে দাঁড়িয়ে আওরঙ্গজেব নিচে কুচকাওয়াজ ময়দানের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সেখানে পাকানো চাবুক বার বার প্রহরীদের খোলা পিঠের উপর পড়ছিল। ওরা আর্তনাদ করছিল আর ওদের ক্ষতবিক্ষত দেহের নিচে বালু রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছিল। দুই হাত পা দুই দিকে ছড়িয়ে একটা কাঠের ফ্রেমের উপর ক্রুশের মতো শুইয়ে হাত-পা চামড়ার ফিতা দিয়ে বাঁধা ছিল। ওরা টানাটানি করে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল হাতপায়ের বাঁধন ছিঁড়তে।

 একশো চাবুক মারা হল সঠিক শাস্তি। এই লোকদুটোর দায়িত্বে অবহেলার কারণে মারাঠি নেতা পালাতে পেরেছেন। এর ফলে শিবাজি আবার একজন বীর হবেন আর তিনি নিজে হবেন একজন হাস্যাস্পদ ব্যক্তি। আর শুধু তাই নয়। শিবাজি যে পালিয়েছেন সেটা কেবল আজ সকালে ওরা আবিষ্কার করেছে। অথচ পরিষ্কার গত সন্ধ্যায় তিনি আর তার ছেলে বেশ চতুরতার সাথে প্রতিদিন যে দান সামগ্রী বেতের ঝুড়িতে করে মন্দিরে পাঠাতেন, তার মধ্যে লুকিয়ে পালিয়েছেন। আর তার নায়েব, যে নিশ্চয়ই তার পালাবার সমস্ত ব্যবস্থা করেছিল, সেও গতরাতে চুপিসারে শিবাজির চাকরবাকরসহ পালিয়েছে। আওরঙ্গজেব সাথে সাথে তাদেরকে ধরার জন্য কয়েকজন ঘোড়সওয়াড় পাঠিয়েছিলেন, তবে পলাতকদের ধরার তেমন আশা নেই।

আর্তচিৎকার থেমে গেছে। মন হল প্রহরী দুজন জ্ঞান হারিয়েছে। তারপরও চাবুকমারা চলছে–তিনি হুকুম দিয়েছিলেন যদি ওরা জ্ঞান হারায় তবুও চাবুক মারা চলতেই থাকবে। কাঠের আড়াআড়ি খুঁটি থেকে দেহগুলো এখন কশাইয়ের হুক থেকে ঝুলানো মাংসপিণ্ডের মতো নিস্তেজ হয়ে ঝুলছিল। যদি বেঁচেও থাকে–হয়তো থাকবে–তবে জীবনের বাকি দিনগুলো চাবুকের ঘায়ের ক্ষত বয়ে বেড়াবে। সবসময় মনে থাকবে কিভাবে ওরা দায়িত্ব অবহেলা করেছিল। আর দুর্গের সুবেদার ফাওলাদ খানকে কাবুলে নির্বাসনে পাঠানো হবে।

পেছন ফিরে আওরঙ্গজেব ধীরে ধীরে তাঁর মহলের দিকে হেঁটে চললেন। পরিচারকদেরকে লেসের সুতার তৈরি টাটি পর্দাটি নামিয়ে দিতে বলে তিনি শক্ত মার্বেল পাথরের মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে প্রায়ান্ধকারে নামাজ পড়া শুরু করলেন। সব সময়ের মতো যখনই আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হন, তখন অনিশ্চিত এই পৃথিবীতে একমাত্র নিশ্চিত এই সত্তাই সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়ায়। শেষবারের মতো মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে সেজদার পর যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন অনুভব করলেন তার মন অনেক শান্ত এবং পরিষ্কার হয়েছে। শিবাজি তাকে বোকা বানিয়েছেন। তবে তার পালিয়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কোনো ঐশী উদ্দেশ্য রয়েছে। হয়তো আল্লাহ তাকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, তিনি একটু বেশি গর্বিত হয়ে যাচ্ছেন, নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে বেশি আস্থাবান হয়েছেন এবং এক ও অদ্বিতীয় সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে অতিরিক্ত ঢিলেমি দিয়েছেন। অবশ্যই এটাই প্রথম নয় যে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন তিনি কতটুকু ভালো মুসলিম। অনেক সময় যখন রাতে ঘুম আসতো না, তখন তিনি ধর্মবিশ্বাসের প্রতি তাঁর একাগ্রতা প্রমাণের জন্য উপায় খুঁজে বেড়াতেন– আরো মসজিদ নির্মাণ করবেন, গরিবদের উদ্দেশ্যে অনুদান আরো বাড়িয়ে দেবেন, মক্কায় আরো বেশি উপঢৌকন পাঠাবেন…।

তবে এসব কাজ তার মনে আনন্দ এনে দিত। তবে এই প্রথমবার তার মনে হল, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার কাজে তাঁকে তাঁর প্রিয় কিছু কোরবানি দিতে হবে। তবে সেটা কি? নারীর মধ্যে তিনি যে আনন্দ খুঁজে পেতেন? তার বেগমদের মধ্যে দিলরাস বানু অনেক দিন আগে মারা গিয়েছেন আর নওয়াব বাঈয়ের কাছে আকর্ষণ করার মতো তেমন কিছু নেই। তবে রাতের পর রাত উদিপুরী মহলের বাহুর উষ্ণতায় তিনি দুনিয়ার কষ্ট ভোলার চেষ্টা করে চলেছেন। ইন্দ্রিয়পরায়ণ উদিপুরী তার সুগন্ধিময় দেহ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরে যে সুখ দেন, তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলে কি আল্লাহর প্রতি তার কর্তব্য সমাধা হবে? না, আল্লাহ নারীকে সৃষ্টি করেছেন একটি উদ্দেশ্যে–পুত্র জন্ম দেবার জন্য। ইতিমধ্যে তাঁর চারটি পুত্রসন্তান হয়েছে, তার মধ্যে মোহাম্মদ সুলতান তার বাবা আর ভাইদের সাথে লড়াই চলার সময় তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যার পরিণতিতে সে বাকি জীবন অন্ধকূপে বন্দী হয়ে কাটাবে। আর বাকি তিনজন–মুয়াজ্জম, আজম আর আকবর বর্তমানে তাদের দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ওরা তাঁর গর্ব। তবে কে জানে ভবিষ্যতে কি হবে? যদি ওদের মধ্যেও কেউ বিশ্বাসঘাতক হয়ে দাঁড়ায় কিংবা কোনো একজন যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা অসুখে মারা যায়? সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে তাঁর আরো পুত্রসন্তানের প্রয়োজন; কাজেই এখন যৌনকর্ম থেকে বিরত হওয়ার সময় নয়। তাকে অন্য কিছু ত্যাগ করতে হবে। তার মধ্যে সংগীত হল একটি। তবলা আর সেতারের আওয়াজ সবসময় তাকে ইন্দ্রিয়সুখ দিত, তবে সেটি কি চপলতা এবং স্বার্থপরতা নয়? নিজেকে খুশি করা ছাড়া সংগীতের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। তাকে এটাই ছাড়তে হবে। রাষ্ট্রের কোনো অনুষ্ঠানের প্রয়োজন ছাড়া সুন্দর দামি পোশাক আর রত্নালঙ্কার পরা বাদ দিতে হবে। ঈশ্বরপ্রেমী একজন মানুষের এসব পোশাক পরিচ্ছদের অনাবশ্যক অলঙ্কার কোনো প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতে সরলতাই হবে তার ব্যক্তিগত স্লোগান। তাহলেই আল্লাহ তার বর্জন এবং আত্মত্যাগ অনুমোদন করবেন এবং অবিশ্বাসী শিবাজির বিরুদ্ধে তাঁকে বিজয় এনে দেবেন।

 মারাঠি নেতার কথা মনে পড়তেই তার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি কল্পনা করলেন, পালিয়ে যাওয়ার পর সে উল্লাস করছে …আত্মতৃপ্তির হাসি দিয়ে আর গর্ব করে তার অনুসারীদের কাছে বর্ণনা করছে কিভাবে মোগলদেরকে বুদ্ধির খেলায় বোকা বানিয়েছে। ঠিক আছে, সে, তার অনুসারী আর অন্যান্য যারা একই ধর্মবিশ্বাসী তারা সবাই এই স্পর্ধা দেখানোর কারণে অনুতপ্ত হবে।

*

 দুইদিন পর ফজরের নামাজের পর আওরঙ্গজেব দেওয়ান-এ-খাসে এলেন। সেখানে তার অনুরোধে ধর্মীয় উপদেষ্টা, উলামারা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কালো আলখাল্লা পরা কালো দাড়িওয়ালা মোল্লারা তাকে দেখে মাথা নুইয়ে অভ্যর্থনা জানাতেই তিনি তাদেরকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। তাঁকে ঘিরে অর্ধবৃত্তাকারে ওরা ভারী লাল-নীল কার্পেটের উপর বসলেন।

আপনারা তো জানেন যে, রাজদ্রোহী মারাঠি নেতা শিবাজি পালিয়েছে। তার পলায়ন আমার আর আমার সাম্রাজ্যের জন্য একটি অবমাননার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্যই আমি আপনাদেরকে এখানে আসতে আহ্বান জানিয়েছি। সমস্ত রাজদ্রোহী আর অসন্তুষ্ট ব্যক্তিরা এখন শিবাজিকে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজন বিজয়ী ব্যক্তি মনে করবে। এছাড়া ওদের মধ্যে যারা বিধর্মী তারা এই বিষয়টি তুলে ধরবে যে, তারা সবাই একই ধর্মবিশ্বাসী আর তার পলায়নে মন্দিরের পুরোহিতরা যে সাহায্য করেছে সেকথাটিও বলবে। আর এসব কথা বলে ওরা অন্য হিন্দুদেরকেও বিদ্রোহে সামিল হতে আহ্বান জানাবে। আমি এটা হতে দেবো না। অনেক চিন্তাভাবনার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এখন সময় এসেছে সেই কাজটি করার, যা আমরা প্রায়ই আলোচনা করেছি। আপনাদের মধ্যে অনেকেই যে কাজটি করার জন্য প্রায়ই আমাকে চাপ দিতেন, তা হল–হিন্দু প্রজাদেরকে আমার ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব দেখানো। আমি তাদেরকে দেখাতে চাই, তাদের ধর্মের উপর বিধিনিষেধ কম আরোপ করে মোগলরা কতটুকু সহনশীলতা আর মহানুভবতা দেখিয়েছেন। তবে তারা যদি আমার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহে সমর্থন করে তাহলে আরো কঠিন বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।’

অনেক মোল্লা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। আবার কেউ কেউ তাদের নেতা হিরাত থেকে আগত আলেম, সাদা দাড়িওয়ালা আবু হাকিমের দিকে তাকালেন। তিনি হাত তুলে বললেন, ‘আমি কী একটা কথা বলতে পারি, জাহাপনা?

 ‘অবশ্যই বলুন, আবু হাকিম।’

‘আপনার কথা আমাদেরকে আনন্দ দিয়েছে আর এ থেকে আপনার বিস্তৃত এবং গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখছি যে, কাফেররা কিভাবে আপনার মহান পূর্বপুরুষ, আল্লাহ তার বেহশত নসীব করুন–সম্রাট আকবরের কাছ থেকে পাওয়া স্বাধীনতা আর সমযোগ্যতা থেকে অন্যায় সুবিধা নিচ্ছে। হিন্দু ধর্ম’টির, যদি আমরা এটাকে একটা ধর্ম বলেই থাকি, এর যারা পৌরহিত্য করে থাকেন, তারা হচ্ছে বাঁচাল ধরনের কিছু পুরোহিত। আমি যতদূর খবর পেয়েছি, তা থেকে জানতে পেরেছি, ওরা মনে করে ধূপ-ধুনার ধোঁয়ায় আধো-অন্ধকার মন্দিরগুলো ওদের জন্য নিরাপদ আর সেখান থেকেই ওরা আপনার আশীর্বাদ ধন্য শাসনের বিরুদ্ধে মানুষজনকে ক্ষেপিয়ে তোলার মতো হঠকারিতা করছে। মোগলদেরকে ওরা ভিনদেশি হানাদার হিসেবে অভিযুক্ত করে আর দাবি করে যে, হিন্দু প্রজাদের উপর আপনার কোনো আইনগত কর্তৃত্ব নেই, যাদেরকে আপনি এবং আপনার পূর্বপুরুষরা তাদের মাটি থেকে অধিকারচ্যুত করেছেন। তাদের উপর করারোপ করা কিংবা তাদেরকে শাস্তি দেবারও কোনো অধিকার আপনার নেই, কাজেই ওরা আপনার হুকুম এবং কোনো তলব মানতে বাধ্য নয়। অবশ্যই আমরা সকলে এই জঘন্য মানুষগুলোকে আপনার ক্ষমতা আর শাসনের বদান্যতা বুঝাতে মহামান্য জাহাপনাকে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের ধর্মের বদান্যতাও শিক্ষা দেবো, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছেন আপনি।

মাথা নিচু করে লোকটির কথাগুলো শুনতে শুনতে আওরঙ্গজেব ভাবছিলেন, আবু হাকিম একজন বাঁচাল আর অতিবিগলিত মোসাহেব, নিজের কণ্ঠস্বর শুনে সে নিজেই ধন্য হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় তার দীর্ঘ এবং গুরুভার নসিহতগুলো বিশ্বাসীদের অনুপ্রাণিত করার বদলে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার উদ্দেশ্যে করা হত। তবে তাকে উলেমাদের প্রধান নিযুক্ত করার সময় আওরঙ্গজেব বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সম্রাটের মনের ইচ্ছা আগাম . ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন এবং তার বৈধতা দানের জন্য নিজে নিজেই যথাযত ধর্মীয় যুক্তি খুঁজে বের করতে পারেন। এই আবু হাকিমই তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, খারেজি দারাকে ফাঁসি দিয়ে তিনি আল্লাহর কাজই করছেন আর এই কাজের জন্য নরকপ্রাপ্তির বদলে বরং তাকে পুরস্কৃত করা হবে।

 ‘ধন্যবাদ আবু হাকিম। খুবই ভালো হয় যদি আপনি আর অন্যান্য উলেমারা আমার সাম্রাজ্যের সকল মসজিদ, মাদ্রাসায় আপনাদের ভাইদেরকে বুঝান, যেন তারা ওয়াজ-নসিহত করার সময় আমার শাসনের আইনানুগ এবং সদাশয় দিকটি এবং আমাদের ধর্মের সঠিক পথে এর আনুগত্যের কথাটিও তুলে ধরেন। আমার সকল প্রজাদের সামনে আমার কর্তৃত্ব স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে আমি হোলি আর দেওয়ালির মতো হিন্দু উৎসব নিষিদ্ধ করতে রাজকীয় ফরমান জারি করবো। এছাড়া হিন্দুদের পবিত্র স্থাপনাগুলো ধ্বংস করার আদেশ …’

একজন তরুণ মোল্লা জিজ্ঞেস করলো, ‘সবকটি নিশ্চয়ই নয় জাহাপনা?’ সাথে সাথে আবু হাকিমের ঘন ভ্রুর নিচ থেকে কড়া চোখে তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বুঝতে পারলো সম্রাটের কথার মাঝে কথা বলে সে ভুল করেছে। এখন সে চোখ নামিয়ে সোজা কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইল।

 ‘ভালো প্রশ্ন করেছেন, অবশ্যই সবকটি নয়। সবকটি ধ্বংস করার চেষ্টা করাটা অবাস্তব আর অবিজ্ঞ হবে। আমি প্রথমে মথুরার মন্দিরটা দিয়ে শুরু করতে চাই, এটা হিন্দুদের একটা প্রধান তীর্থকেন্দ্র আর এখান থেকেই লোকজনের অসন্তুষ্টির খবর এসেছে আর ওখানে খাজনা আদায় করতে গিয়ে আমার লোকেরা ওদের হাতে নাজেহাল হয়েছে। এতেও যদি প্রজারা আমার কর্তৃত্ব ক্ষমতার প্রতি নত না হয় তাহলে ওদেরকে শিক্ষা দেবার জন্য আমি আরো মন্দির বেছে নেব। হয়তো নতুন কিংবা মেরামত করা মন্দিরগুলো বেছে নেব। আর পার্থিব অর্থে আমার শাসন এবং আমাদের নিজ ধর্মের প্রাধান্য প্রমাণ করতে যেসব মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হবে সেসব জায়গায় নতুন নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হবে।’

আওরঙ্গজেব একটু থেমে তাঁর কথার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলেন। তার কথায় উলেমারা একটু অবাক হলেও তাদের মুখের ভাব দেখে বুঝা গেল ওরা কতটা তার কথায় সায় দিয়েছে। তিনিই প্রথম মোগল সম্রাট, যিনি তাঁর ধর্মকে শাসন কাজে ব্যবহার করছেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা, যত বড়ই হন না কেন, সবাই আপস করেছিলেন। কেউ কেউ, বিশেষত আকবর–এমনভাবে কাজ করেছিলেন যেন, তাঁদের প্রকৃত কোনো ধর্ম মোটেই ছিল না। অন্যরা পার্থিব জীবনে ধর্মকে উপেক্ষা করে কেবল মুখে মুখে ধর্মবিশ্বাসের কথা বলেছিলেন। এরা ব্যক্তিগত জীবনে মদ, আফিম আর অন্যান্য আমোদপ্রমোদে ব্যস্ত ছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি এ ধরনের আচরণ লক্ষ করেছিলেন, যখন তাঁর পিতামহ জাহাঙ্গীর আর তাঁর বাবা শাহজাহানের মধ্যে লড়াই চলছিল, তখন তাঁর পিতামহ জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ভবিষ্যতে ভালো ব্যবহার করবেন এই আশায় তাকে আর দারা শিকোহকে জিম্মি করে রেখেছিলেন। রাতের পর রাত পিতামহের তত্ত্বাবধানে থাকার সময় তারা দেখেছেন, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান মদের গ্লাসে আফিমের বড়ি মিশিয়ে দিচ্ছেন। আর প্রতি চুমুকের সাথে জাহাঙ্গীর তাঁর ধর্মকে অমান্য করেছেন, সুরার প্রভাবে তার মাথা ঘুলিয়ে গিয়েছিল আর তার নামকাওয়াস্তে কুচক্রী স্ত্রীকে সাম্রাজ্য শাসন করার অনুমতি দিয়ে সাম্রাজ্যকে বিপন্ন করে তুলেছিলেন।

 তিনি আবার বললেন, আমার আরো কিছু বলার আছে। আমি যদি আমার প্রজাদের সামনে আমাদের ধর্মবিশ্বাস আর সেই সাথে আমার কর্তৃত্বের প্রাধান্য তুলে ধরতে চাই, তাহলে আমার নিজেকেও ব্যক্তিগতভাবে ধর্মের প্রতিটি আচার-আচরণ পালনে লোকজনের সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।’

 আবু হাকিম বললেন, কিন্তু জাহাপনা, এই দুনিয়ায় আপনার চেয়ে ধর্মভীরু– এবং নিয়ম-কানুন নিষ্ঠার সাথে পালন করে এমন মুসলিম সন্তান আর কেউ নেই।’

 ‘আপনি ভুল বলেছেন। একটি দৃষ্টান্ত রাখার জন্য আমাকে আরো কিছু অবশ্যই করতে হবে। আমি জানি যে, অনেক সময় আমি বেশ অসতর্ক হয়ে পড়ি। দৃষ্টান্তস্বরূপ যেমন, সংগীতের প্রতি আমার অনুরাগ আমার মনকে আমার দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। শক্তির অপচয় হয় এবং আমাকে আলসে করে দেয়। কাজেই এখন থেকে আমি রাজদরবারে বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিষিদ্ধ করতে চাই। এছাড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কোনো উপলক্ষ ছাড়া দামি পোশাক আর রত্নালংকার ব্যবহার করবো না আর সভাসদদেরও তা করতে বোঝাবো। এই ধরনের অলঙ্করণ অতিমাত্রায় ব্যক্তিগত অহঙ্কার আর অসার দম্ভের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না, আর এটা আধ্যাত্মিক জীবন যাপন থেকে আমাদেরকে বিচ্যুত করে দেয়। আর আমি আমার জীবনের কালানুক্রমিক ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ করার গোমর দেখানোর নিয়ম থেকে দরবারের লিপিকারকে বিরত করতে চাই। আমার বিচারক হচ্ছেন আল্লাহ, যার এ ধরনের লেখ্য প্রমাণের প্রয়োজন নেই, তাই আমারও নেই। আপনাদের আর যদি কিছু বলার না থাকে তাহলে আপনারা এখন আসতে পারেন। ফরমানগুলো তৈরি হবার পর আবার আপনাদের তলব করবো, যাতে আমরা সবাই আবার আলোচনা করবো কিভাবে আমার পরিকল্পনা কাজে লাগানো যায়।’

সন্ধ্যায় কামরায় একাকী বসে আওরঙ্গজেব একটু পরিতৃপ্তি অনুভব করলেন। শিবাজির পলায়নের ঘটনাটি এখনও তার মনে পীড়া দিচ্ছে, তবে এটা হয়তো একটি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। কেননা এটা তার দর্পচূর্ণ করে দিয়ে তাঁকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাছাড়া সংগীত সুখ বিসর্জন দেবার মতো শক্তি খুঁজে পেয়ে তিনি খুশি হয়েছেন। পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর দরবারের ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ পরিত্যাগ করার তুলনায় এটা করতে তাঁর অনেক চেষ্টা করতে হয়েছে। আর একবার জনসমক্ষে ঘোষণা দেওয়ার পর আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। তবে অন্যরকম বৈধ আনন্দের উৎস এখনও আছে তার কাছে। একটু পর তিনি উদিপুরী মহলের কাছে যাবেন…তবে একজন কোরচি হঠাৎ উদয় হয়ে তাঁর এই সুখ-ভাবনায় ছেদ ঘটাল।

 ‘জাঁহাপনা, শাহজাদি জাহানারা বেগমসাহিবা এসেছেন। তিনি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছেন।’

 ‘অবশ্যই। তাকে এখানে নিয়ে এস। জাহানারা কামরায় ঢুকতেই আওরঙ্গজেব তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘আসুন বোন। তিনি তখনও তাঁর বাবার জন্য শোকের সাদা পোশাক পরেছিলেন, যদি নিয়মমাফিক সে সময় পার হয়ে গেছে।

 তিনি আওরঙ্গজেবের হাত একমুহূর্ত ধরে রেখে তারপর বললেন, ‘ধন্যবাদ আওরঙ্গজেব, আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছ, সেজন্য ধন্যবাদ।

 আওরঙ্গজেব তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, আপনার চেহারা আগের চেয়ে ভালো দেখাচ্ছে। আসলেই এটা সত্যি। গত কয়েকমাসে তার চেহারা অন্যরকম ছিল। তবে একটু কাছে এগিয়ে তিনি দেখলেন আজ রাতে তার অভিব্যক্তিতে বেশ টান টান আর উদ্বিগ্ন ভাব দেখা যাচ্ছে। আওরঙ্গজেব বললেন, ‘কি ব্যাপার আপনি এত রাতে এখানে জাহানারা?

 ‘তোমার সাথে আমার অতি জরুরি কিছু কথা বলার প্রয়োজন ছিল। একটু আগে যা শুনতে পেলাম, তা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি নাকি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব পালন নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছ আর ওদের কয়েকটা মন্দির ভেঙ্গে ফেলতে চাচ্ছ। আমার একজন পরিচারিকা বললো তার স্বামী নাকি আজ সন্ধ্যার নামাজে মতি মসজিদে মোল্লাকে এই ঘোষণা দিতে শুনেছে। এটা কি আসলে সত্যি?

হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। বেশ কিছুদিন ধরে আমি এই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছিলাম। তবে শিবাজির অবাধ্যতা প্রমাণ করেছে যে, অন্যরা তার দেখাদেখি বিদ্রোহ শুরু করার আগেই আমার কর্তৃত্ব হিন্দুদের সামনে দেখাবার এটিই সঠিক সময়। প্রজাদেরকে দেখাতে হবে যে, আমার সহ্যের একটা সীমা আছে আর তাছাড়া ভেতর-বাইরের যে কোনো ধরনের হুমকি থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য।

‘কিন্তু হিন্দুরা তো তোমার প্রজাদের মধ্যে অনেক সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর অনেকেই সাম্রাজ্যের ভাল এবং বিশ্বাসী সেবক। আমাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই ওরা আমাদের প্রতি বিশ্বস্ত। বিদ্রোহের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ভেবে দ্যাখো আমাদের নিজ ধর্ম থেকেই তো অনেক শত্রু এসেছে সেই বিজাপুর আর গোলকুন্ডার সুলতান থেকে শুরু করে পারস্যের শাহ, আর আমাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উচ্ছঙ্খল আফগান গোত্র পর্যন্ত কতজন আছে বল। এদের তুলনায় আমাদের বিশ্বস্ত হিন্দু প্রজারা এমন কি করেছে যে, তাদের ক্ষেত্রে এটা হবে? ওদের ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই ওদেরকে সরাসরি শিবাজির মতো রাজদ্রোহীর শিবিরে ঠেলে দেওয়া। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না, যে আশংকা তুমি এড়াতে চাইছো এতে বরং তা আরো সৃষ্টি হবে? আওরঙ্গজেবের ঠোঁট থেকে হাসি মুছে গিয়ে চেহারা কঠিন হল। তার বোনের সাথে মাত্র বনিবনা হয়েছে, অথচ তা কত ভঙ্গুর…তাকে আরো সাবধান হতে হবে যাতে এই সম্প্রীতিটা নষ্ট না হয়। অথচ তিনি আওরঙ্গজেবের বিচার বিবেচনাকে চ্যালেঞ্জ করছেন–যা আর কেউ করার সাহস করবে না। আর তার এই সিদ্ধান্তে তিনি কাউকেই নাক গলাতে দেবেন না, এমনকি জাহানারাকেও নয়।

তিনি শান্তভাবে বললেন, আমি আপনার সাথে একমত নই। আমি চাই এমনভাবে আমার ক্ষমতা প্রকাশ করবো যেন কেউ তা উপেক্ষা করতে না পারে। যাতে তারা বুঝতে পারে যে, শিবাজির সাথে বিদ্রোহে সামিল হলে আমার প্রতিশোধ কিরকম প্রবল হতে পারে। আপনি একজন নারী এবং দীর্ঘদিন নির্জনে জীবন-যাপন করেছেন। সাম্রাজ্য শাসনের বাস্তবতা আর শত্রুর মনমেজাজ আপনি কি আমার মতো বুঝতে পারবেন?

জাহানারা বললেন, আমি ঠিকই বুঝি! আমি কি বাবাকে একসময় রাষ্ট্রের কাজে সহায়তা করি নি? তিনি কি আমার মায়ের নামাঙ্কিত সিলমোহর আমার হাতে তুলে দেননি, যা দিয়ে আমি ফরমান জারি করতে পারতাম? তিনি কি মাঝে মাঝে আমার পরামর্শ চেয়ে তা আমলে নেন নি?’ এক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখদুটো জ্বলে উঠলো, তারপর আবার বললেন, “তোমাকে সাবধান না করলে, আমি আমার বাবা আর পূর্বপুরুষদের প্রতি আমার কর্তব্য পালনের দায়িত্বে ব্যর্থ হব। আর যদি তোমার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করার বিষয়ে তুমি নিজের অবস্থানে অনড় থাকো, তাহলে মোগলরা এতদিন সংগ্রাম করে যা গড়ে তুলেছিল তা অস্থির, হয়তো ধ্বংস করে ফেলবে। এতকাল যেখানে কোনো বিভেদ ছিল না, এখন তা গড়ে উঠবে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকবে। তাদের ধর্মের প্রতি বৈষম্য দেখিয়ে তাদেরকে দূরে ঠেলে দেওয়ার পরিবর্তে অভিজাত হিন্দু পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলে আমরা কি হিন্দুস্তানে আমাদের অবস্থান সংহত করে তুলি নি? তাদের রক্ত কি আমাদের ধমনিতে বইছে না–তোমার ছেলের ধমনিতে কি নেই? একজন রাজপুত অভিজাত নারীর গর্ভে কি তোমার একটি পুত্র সন্তান নেই? এজন্য কি মুয়াজ্জমকে তুমি অন্যদের চেয়ে কম ভালোবাস? একজন মানুষের ধর্মের দিকে না তাকিয়ে আমাদের রাজবংশ আর সাম্রাজ্য কি উন্নতি লাভ করে নি?’

 ‘আপনি আপনার উদার সুফি বিশ্বাসে অতিরিক্ত প্রভাবিত হয়েছেন। আপনি এটাকে আপনার জন্য উপযুক্ত দর্শন মনে করতে পারেন, তবে এগুলো আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস উৎপাদন করা থেকে অনেক দূরে রয়েছে।’

 ‘হ্যাঁ, আমি একজন সুফি। সব সময়ই তা থাকবে আর এটাই আমাকে সহনশীল হতে আর অন্যকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। তবে শুধু একারণেই আমি তোমাকে একাজ থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করছি না। আমি তোমাকে এসব বলছি কেননা এটা আমাদের শাসন কাজ চালিয়ে যাবার ব্যাপারে অনেক বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। আওরঙ্গজেব, তোমাকে কে এই পরামর্শ দিয়েছে? উলেমারা দিয়েছে? আমার মনে হয় মোল্লারা তোমার আর তোমার রাজত্বের ভালো করার বদলে নিজেদের ক্ষমতার ব্যাপারটি নিয়ে বেশি ভাবে।

 আরঙ্গজেবের ঠোঁট থেকে হাসি মুছে গেল, তিনি বললেন, এটা আমার একার সিদ্ধান্ত ছিল। এমনকি মোল্লাদের সাথে আলোচনা করলেও সিদ্ধান্ত একা আমিই নেব। আল্লাহর নামে বলছি জাহানারা, আমি জানি যে আমি ঠিকই করছি।’

তুমি যখন ছোট ছেলেটি ছিলে, তখন তুমি খুব একরোখা ছিলে। যা সঠিক মনে করতে তার জন্য তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় বড় ছেলেদের সাথে লড়াই করতে। আমি তোমার সাহস দেখে তোমাকে আরো ভালোবাসতাম আবার সেই সাথে তোমার জন্য দুশ্চিন্তাও করতাম। যখন কোনো ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলো তখন তুমি খুব সরল মনে দুনিয়াকে বিচার কর–ভালো আর মন্দ তোমার কাছে সাদা আর কালোর মতো। তুমি সব সময় আশা কর। পৃথিবী যৌক্তিক পথে নয় বরং তোমার যুক্তিমতো চলুক। যদি হিন্দু প্রজারা তোমার ক্ষমতা প্রদর্শনের সামনে মাথা নত না করে, তাহলে কি হবে? তুমি কেবল তোমার আর তোমার উত্তরাধিকারীদের জন্য তকলিফ আর অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করবে যার কোনো প্রয়োজন নেই।

মিনতি নিয়ে আওরঙ্গজেবের মুখের দিকে তাকাতেই তাঁর চোখে পানি চলে এল। তবে আওরঙ্গজেবের চেহারায় কোনো ধরনের আবেগ কিংবা প্রতিক্রিয়া নেই দেখে তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, এতক্ষণ যে কথাগুলো বলেছেন তা পরোপুরি বিফলে গেছে। পেছনে ফিরে তিনি দ্রুত কামরা থেকে বের হয়ে গেলেন। আওরঙ্গজেব তাকে অনুসরণ করতে উদ্যত হলেন–তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর মনে ব্যথা দিয়েছেন, যা তিনি কখনও চান নি। তবে নিজেকে থামালেন। আর কিই বা তিনি বলতে বা করতে পারেন? জাহানারার জানা উচিত ছিল যে, জাগতিক বিষয়ে তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভ নেই। এটা তাকে শিখতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *