০২. বেগম পাদিশাহ

০২. বেগম পাদিশাহ

রুপা আর ফিরোজা দিয়ে বাঁধানো কুরআনটি নামিয়ে রেখে রওশনআরার দিকে তাকিয়ে আওরঙ্গজেব বললেন, কি ব্যাপার বোন? রওশনআরা তখনও হাঁপাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন তিনি ছুটতে ছুটতে হেরেম থেকে আওরঙ্গজেবের খাসকামরায় এসেছেন কোনোমতে কেবল এতটুকু বলতে পারলেন, দুজন কাসিদ-বার্তাবাহক–আগ্রা থেকে এসেছে। ওরা জাহানারার কাছ থেকে আমার জন্য একটি বার্তা নিয়ে এসেছে।

 জাহানারা? উনি তো অসুস্থ ছিলেন, তাই না?

না…জাহানারা নন, আমাদের বাবা অসুস্থ। তিনি জানিয়েছেন, বাবা এখন মৃত্যুশয্যায়। তিনি অনুরোধ করেছেন, আমি যেন তোমাকে রাজি করিয়ে তার কাছে নিয়ে যাই। বাবা তোমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন।

আওরঙ্গজেব উঠে দাঁড়ালেন, কি বলবেন?

জাহানারা কিছু বলেন নি, তবে বেশ জোর দিয়ে এটা জানিয়েছেন তুমি যদি এখুনি না যাও তাহলে খুব দেরি হয়ে যাবে।

দেরি হবে, কার জন্য? আমার না বাবার?

রওশনআরা চোখ পিটপিট করলেন। অনেকসময় আওরঙ্গজেবের মন বোঝা খুব কঠিন হয়। তারপর সাহস করে বললেন, হয়তো তোমাদের দুজনের জন্য।

 তিনি বহুদিন আগে আমার শ্রদ্ধা হারিয়েছেন। তাছাড়া এখন আমরা একজন আরেকজনের সাথে কি কথা বলবো? তিনি আমাকে ভর্ৎসনা করবেন। আর আমি তাকে বলবো, আমি যা করেছি তা সাম্রাজ্যের ভালোর জন্য করেছি। এতে আমাদের দুজনের কি লাভ হবে?

রওশনআরার চোখে পানি এল। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, আওরঙ্গজেব তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরবেন, কিন্তু তা হবার নয়। মুখ স্থির করে তিনি সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার মুখ দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। রওশনআরা বললেন, তোমার মনে আছে যখন আমি একেবারে ছোট ছিলাম তখন বাবা আমাকে একবার কিভাবে নদী থেকে উদ্ধার করেছিলেন? আমার অবশ্য এঘটনার কিছুই মনে নেই। অবশ্য তখন তো আমি খুব ছোট ছিলাম– জাহানারার কিন্তু ঠিক মনে আছে। যখন আমরা বড় হচ্ছিলাম তখন তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন কিভাবে আমাদের ঘোড়ার গাড়িটা উল্টে পানিতে পড়তেই আমি মায়ের হাত থেকে ছিটকে পানিতে পড়ে গিয়ে প্রায় ভেসে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বাবা আমাকে উদ্ধার করেন। শুধু তার কারণেই আজ আমি বেঁচে আছি।

এই কাহিনী আমি বহুবার শুনেছি। আর যখন আমাদের মা বেঁচে ছিলেন, তখনকার সময়ের বাবার অনেক স্মৃতি আমার নিজেরও মনে আছে। তবে আমরা দুজনেই জানি মা মারা যাবার পরের বছরগুলোতে সবকিছু কিরকম বদলে গিয়েছিল। আমাদের বেশি আবেগপ্রবণ হওয়া উচিত নয়। বিশেষত একজন সম্রাট হিসেবে আমি চাই না কোনো ধরনের আবেগ আমার বিচারবুদ্ধিকে ঘোলা করে দিক।

তবে অনেকসময় আমার কি মনে হয় জানো, আমরা হয়তো সঠিকভাবে তাঁকে বিচার করতে পারিনি। মনে হয় তিনি আমাদের জন্য যা ভালো ভেবেছিলেন, তাই করছিলেন।

আওরঙ্গজেব তার বোনের দুহাত ধরে বললেন, এটা খুবই স্বাভাবিক যে এরকম একটি মুহূর্তে আমরা সেই বন্ধনের কথা ভাবি, যা আমাদেরকে পরিবারকে একসাথে বেঁধে রেখেছিল। তবে আমরা নিজেদের সাথেই প্রতারণা করবো, যদি আমরা ভাবি যে, আমরা যা করেছি তা ভুল ছিল। তাছাড়া কি করতে হবে সে সিদ্ধান্ত তুমি নাওনি। সেটা আমার নিজের ভালোর জন্য কিংবা সুবিধার জন্য ছিল না, সেটা করা হয়েছিল সাম্রাজ্যের স্বার্থে। দুনিয়া এবং আল্লাহর সামনে এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি নিজে নিয়েছি। তোমার মনে রাখা উচিত, তখন আমি যদি সাথে সাথে কিছু না করতাম, তাহলে কি হতে পারতো? দারা শিকোহ শুধু খারেজি ছিলেন না, তিনি তাঁর ভাইদেরকে ঘৃণা করতেন। তিনি খুব দুর্বল চিত্তের মানুষ ছিলেন। যার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা লড়াই করেছিলেন, হাতে সময় পেলে তিনি তার অধিকাংশই ধ্বংস করে ফেলতেন। আর এদিকে আমাদের বাবার তাঁর প্রিয়পুত্রের কোনো দোষই চোখে পড়ে না। যেন একজন মানুষ ভরদুপুরের সূর্যের দিকে খোশমেজাজে তাকিয়ে রয়েছেন।

রওশনআরা মাথা নাড়লেন। তাঁর ভাই হয়তো ঠিকই বলেছেন–সাধারণত তিনি তাই বলেন। সেই যখন থেকে শাহজাহানের হাত থেকে সিংহাসন ছিনিয়ে নিয়ে আওরঙ্গজেব তার বড় বোন জাহানারার জায়গায় তাকে সাম্রাজ্যের প্রধান সম্রাজ্ঞী করেছিলেন, তারপর এতোবছর ওরা এসব বিষয় নিয়ে কখনও কোনো কথা বলেন নি। আর তিনি এতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। মসৃণগতিতে আর বেশ আনন্দে তাঁর জীবন কেটে যাচ্ছিল, পদবি, সম্পদ…এদুনিয়ার জীবনে যা তিনি চেয়েছেন তার অধিকাংশ এখন তাঁর হয়েছে। তিনি হেরেম শাসন করেন। যদিও মাঝে মাঝে এমনভাবে নিজের ইচ্ছাপূরণ করেন, যা তিনি জানেন তার ভাই অনুমোদন করবেন না, তবে এসব বিষয়ে তিনি খুবই সতর্ক থাকেন। তিনি একজন ভালো সম্রাজ্ঞী ছিলেন, ঠিক যেরকম একজন ভালো কন্যাও ছিলেন। তারপর একসময় বুঝতে পারলেন দারা শিকোহ এবং জাহানারার তুলনায় তার বাবার কাছে তিনি কিছুই না। তবে এজন্য তাঁর অবশ্যই অপরাধ বোধ করা উচিত নয়। হাতের পিঠে চোখের পানি মুছে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে এখন তুমি কি করবে আরওরঙ্গজেব? তুমি কি আগ্রা যাবে?

 আওরঙ্গজেব ধীরে ধীরে তাঁর বোনের হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, জানি না।

তিনি বুঝতে পারলেন তাঁকে এখন সাবধানে ভাবতে হবে। তাঁর বাবার অসুস্থতার খবরটি অপ্রত্যাশিত নয়। আর তা হবেই বা কেন? শাহজাহান বৃদ্ধ হয়েছেন, আর কারাধ্যক্ষ নিয়মিত তাকে যে খবর জানাতো, তাতে বোঝা যাচ্ছিল সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি আরো দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। যদি আওরঙ্গজেব সম্ভবে চিন্তা করেন আর নিজের মনের সত্যিকার অনুভূতি নিজের কাছে না লুকান, তাহলে এটা ঠিক যে, সেই যখন তিনি তার বাবাকে সিংহাসনচ্যুত করে তাকে বন্দী করেছিলেন, তখন থেকেই গত ছয় বছরে তিনি বেশ কয়েকবার তাঁর বাবার মৃত্যু কামনা করেছিলেন। অন্তত আন্তরিকভাবে এটাও ভাবতেন যে….

কিন্তু এখন যেহেতু তাঁর বাবার শেষ সময় আসলেই ঘনিয়ে এসেছে, তখন তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না কি করবেন। রওশনআরাকে যাই বলুন না কেন, শাহজাহানকে বন্দী করে তিনি কি একটু অপরাধ বোধ করছেন না? কেন একবারও তাকে দেখতে কারাগারে যাননি? এটা কি এ কারণে যে, তিনি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, যদি তাঁর বাবা তাকে ক্ষমা করে দেন, তার প্রতি ভালোবাসা দেখান আর এতে বাবার প্রতি তাঁর মন নরম হয়ে যায়? কিন্তু দুজনে মিটমাট করে ফেললে তার পরিণতিটা কি হবে? শাহজাহান আবার সিংহাসনে ফিরে আসবেন নাকি তার ভাই দারা শিকোর জীবিত পুত্র বসবে? না, সাম্রাজ্যের স্বার্থে এটা কখনও তিনি হতে দেবেন না। কিংবা এটা হয়তো অন্যকিছু : তার ভয় হচ্ছে শাহজাহানের চোখে না জানি কি দেখতে পাবেন। শুধু ঘৃণাই দেখতে পাবেন, ভালোবাসা নয়, যা তিনি ছোটবেলায় একজন পিতার কাছ থেকে আশা করতেন। অথচ তার বাবা তার সমস্ত ভালোবাসা তার খারেজি জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।

এমনকি যখন তিনি দিল্লি থেকে বজরায় যমুনা নদীর উপর দিয়ে তাজমহলে যেতেন প্রার্থনা করতে, যেখানে রত্নখচিত সাদা মার্বেল পাথরের কবরে তার মা শুয়ে আছেন, তখনও তিনি একবারও চোখ তুলে আগ্রা দুর্গের দিকে তাকাননি। দুর্গের লাল বেলেপাথরের দেয়ালের ছায়ার নিচ দিয়ে যাওয়ার সময়, সচেতন হয়ে ভাবতেন যে, শাহজাহান হয়তো দুর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদের উপরে তাঁর কারাগারের অষ্টকোণ টাওয়ারের ভেতর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এমন একটি মাস যায়নি যে, শাহজাহান তাকে চিঠি লিখে আদেশ করেছেন কিংবা অনেক সময় মিনতিও করেছেন অন্তত একবারও তাকে দেখতে যেতে। কিন্তু তিনি নিজেকে সংযত রেখেছেন, কোনো উত্তর দেননি। দুই-একদিন এই বিষয়টি নিয়ে একবারও ভাবার চেষ্টা করেননি। তিনি নিজেকে বুঝাতেন এই চিঠিগুলো একধরনের ফন্দি, যাতে তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবেন। তাঁকে দেখার জন্য বাবার মোটেই কোনো আকুলতা নেই।

সুতরাং তিনি কোনোদিন তার বাবাকে দেখতে যাননি। আর একজন সন্তান হিসেবে এখন করুণা দেখাবার জন্যইবা কেন যাবেন? আর বাবার মৃত্যুশয্যায় এখন উপস্থিত হলে কি উদ্দেশ্য সাধন হবে? শুধু আবার জেগে উঠবে সন্দেহের অনুভূতি, কিংবা হয়তো অপরাধ বোধ, যা ইতিমধ্যেই তার মনে জেগে উঠছে আর সেই সাথে সম্ভবত সত্যিকার দুঃখ বোধ। একটু আগেই অতিরিক্ত ভাবাবেগ সম্পর্কে রওশনআরাকে কি সাবধান করেননি? স্বভাব সুলভভাবে চোখ বুজে চিন্তা করার পর তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস নিলেন। মনে হয় উপায় একটা খুঁজে পাওয়া গেছে।

শাহজাদা মুয়াজ্জমকে একটা চিঠি লেখো। সে আগ্রা থেকে কেবল বিশ মাইল দূরে শিবির স্থাপন করেছে। তাকে বলো ঘোড়ায় চড়ে দুর্গে যেতে, সেখানে গিয়ে পিতামহকে দেখার পর ফিরে এসে আমাকে জানাবে তিনি কেমন আছেন। আমার ছেলেকে সেখানে পাঠিয়ে আমি আমার বাবার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা দুটোই প্রদর্শন করবো। আর এই ফাঁকে একটু চিন্তা করার সুযোগ পাবো যে, সেখানে আমি নিজে যাবো কি যাবো না।

আওরঙ্গজেব যে তার উপর আস্থা রেখেছেন এই কথাটি ভেবে রওশনআরা কৃতজ্ঞ বোধ করলেন। তিনি সাথে সাথে বললেন, এখনই লিখছি। এই কথাটি বলে তার খাড়া রেশমি ঘাগড়ার খসখস শব্দ করে ঘুরে চলে গেলেন।

একা হওয়ার পর আওরঙ্গজেব আবার কুরআন শরিফ তুলে নিলেন। পাতা খুলে সূরার দিকে তাকালেও পবিত্র আয়াতের দিকে মনোযোগ দিতে পারলেন না। পিতার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্তটি আপাতত স্থগিত করার কারণে মনে হয় তাঁকে আর হয়তো জীবিত দেখতে পারবেন না। আর সেই সাথে একটি মুখোমুখি অবস্থা এড়াতে পেরেছেন, যেখানে তিনি হয়তো তাঁর আবেগ সামলাতে পারতেন না, পরিণতি তো দূরের কথা। একমুহূর্তের জন্য চোখ বুজতেই অন্ধকারের বদলে পরিষ্কার তাঁর সবচেয়ে বড় বোন জাহানারার মুখটা দেখতে পেলেন, যেন তিনি এখানেই ছিলেন। জাহানারা তাঁর বাবার সাথে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেছিলেন আর তাই তার বিদ্রোহের সময় থেকেই আওরঙ্গজেব তাঁর বড় বোনকে দেখতে পারেননি। এখন তার মনের অবস্থা কি কে জানে আর তাঁকেই বা কিভাবে তিনি বিচার করবেন?

*

তিন সপ্তাহ পর শোকের শাদা পোশাক পরে আওরঙ্গজেব ঘোড়ায় চড়ে ধীরে ধীরে বাঁকা ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠে তীক্ষ্ণ কীলক বসানো আগ্রা দুর্গের বিশাল প্রথম ফটকের ভেতর দিয়ে এগোলেন। শেষ যখন তিনি এখানে এসেছিলেন, তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেছে, তারপরও সবকিছু চেনা মনে হচ্ছে। লাল বেলেপাথরের দুর্গ, উঠান আর বাগান সবকিছু সেই আগের মতোই আছে। সিংহাসনে বসার পর যখন তাঁর বাবা নতুন পরিবার নিয়ে এখানে বসবাস করতেন ঠিক তখনকার মতো। ঐ থামগুলোর মাঝে আওরঙ্গজেব তার ভাইদের সাথে তরোয়াল নিয়ে খেলতেন…আর তাঁদের অপরূপ সুন্দর প্রিয় মা গোলাপ সুরভিত কামরায় বসে সারাক্ষণ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করতেন…?

মমতাজের মৃদু হাসির কথা মনে পড়তেই আওরঙ্গজেব ভ্রু কুঁচকালেন। তার স্মৃতি ছিল অম্ল-মধুর। তাজমহল থেকে মাত্র আসার পর এখন তা আরো বেশি মনে পড়ছে, যেখানে এখন তাঁর বাবা তাঁর মায়ের পাশে শুয়ে রয়েছেন। সমাধির পাশে বসে তিনি একা কেঁদেছিলেন, সেটা কি মমতাজের জন্য এবং তাঁর মৃত্যুর পর তিনি যে একাকীত্বে ভুগছেন সে জন্য, নাকি শাহজাহানের জন্য অথবা তার নিজের জন্য, তা নিশ্চিত নয়।

আওরঙ্গজেব চিবুক তুললেন। কেউ যেন তার চেহারায় একজন সম্রাটের উপযুক্ত গাম্ভীর্য ছাড়া আর কিছুই না দেখতে পায়, যিনি তাঁর বাবার মৃত্যুতে শোক পালন করছেন। চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, সবকিছু ঠিকঠাক আছে। যেরকম তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন; যখন একজন বার্তাবাহক মুয়াজ্জমের কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছিল যে, সে আগ্রা পৌঁছে দেখে শাহজাহান ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। দুর্গের উপরে সবুজের জায়গায় সাদা পতাকা উড়ছে। ফোয়ারাগুলো স্ত ব্ধ। এমনকি গোলাপঝাড় থেকে সমস্ত ফোঁটাফুল কেটে ফেলা হয়েছে। কেউ যেন বলতে না পারে যে, তিনি তাঁর বাবার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা দেখান নি, যিনি শুধু তাঁর বাবাই নন, তিনি এককালে মোগল সম্রাটও ছিলেন।

বহু স্তম্ভ শোভিত দেওয়ান-ই-আমে পৌঁছার পর তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন। সেখানে সাদা পোশাক পরা সভাসদ ও সেনাপতির একটি দল নীরবে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঘোড়া থেকে নেমে তিনি ডানে-বাঁয়ে তাকাতে তাকাতে অপেক্ষমাণ দলটির সারির মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চললেন। ওরা সবাই বুকে ডানহাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁর প্রতি আনুগত্য ও বাধ্যতা প্রকাশ করছিল। মার্বেল পাথরের মঞ্চের কাছে পৌঁছে আওরঙ্গজেব ধীরে ধীরে সিঁড়ির তিনটি ধাপ বেয়ে মঞ্চে উঠে ঘুরে তাকালেন। আওরঙ্গজেব দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে এই মঞ্চেই ময়ূর সিংহাসনটি ছিল। তিনি দুই হাত তুলে শুধু বললেন, আজকের এই বিষাদময় দিনে আমার কাছে, আপনাদের সম্রাটের কাছে আসার জন্য আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজ রাতে যখন আপনারা প্রার্থনা করবেন, আমি অনুরোধ করবো তখন এই কথাটি মনে রাখবেন, যেরকম আমিও স্মরণ করবো যে, এই পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং আমরা এখন যেরকম আছি তার জন্য সবাই মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ এবং আমরা যে অবস্থানেই থাকি না কেন, সকলকে তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তারপর আওরঙ্গজেব পেছন ফিরতেই একজন ভৃত্য–কোরচি দরজা মেলে ধরতেই তিনি ভেতরে খাসমহলের দিকে এগিয়ে চললেন।

 বার্নিশ করা চকচকে সোনালি শামিয়ানার নিচে সাদা মার্বেল পাথরের কামরাটি ম্লান আলোয় মৃদু দীপ্তি ছড়াচ্ছে। একটি মুহূর্ত তার মনে হল যেন, তাঁর মায়ের সুন্দর মূর্তিটি একটি ধনুকাকৃতি খিলানের নিচে দাঁড়িয়ে তার স্বামী আর সন্তানদের জন্য অপেক্ষা করছেন, যেন সবাই একসাথে নৈশ আহার করতে পারেন।

তারপর তিনি কামরায় ঢুকে তার জন্য পেতে রাখা একটি নিচু, নরম আসনে বসে একটি রেশমি বালিশে হেলান দিলেন। দেয়ালে আয়না বসানো কুলুঙ্গিতে মোমবাতির শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে। খানসামারা তাঁর সামনে একটি সাদা কাপড় বিছিয়ে তার উপর খাবারের থালা সাজিয়ে রাখতে শুরু করলো। ভোর থেকে তিনি কিছুই খান নি, তারপরও তার মোটেই খিদে পায় নি। কেবল সামান্য সাদা ভাত, ডাল আর তন্দুরি থেকে মুরগির মাংস নিলেন। তারপর যমুনা থেকে আনা বরফ-শীতল পানি খেলেন। কোরচি তাঁর নিজস্ব পেয়ালায় পানি ঢেলে দিল। এই পেয়ালাটি তিনি যেখানে যান সেখানেই তাঁর কোরচি সাথে বয়ে নিয়ে যায়। আলোকভেদ্য কিন্তু অস্বচ্ছ একটি জেড পাথর কেটে গোলাপের আকৃতি দেওয়া হয়েছিল। পানিতে বিষ থাকলে সাথে সাথে এটি বিবর্ণ হয়ে যাবে।

খাওয়া শেষ করে আওরঙ্গজেব বেলকনিতে গেলেন। যমুনা নদীর বাঁকের উপরে পূর্ণিমার চাঁদ উঠছে। তাজমহলের মুক্তার মতো গম্বুজ রূপালি আলোয় ভরে গেল। কয়েকমুহূর্ত আওরঙ্গজেব এই দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে রইলেন… ভাষায় বর্ণনা করা যায় না এমন একটি বিষণ্ণ অথচ অপরূপ দৃশ্য। তারপর পেছন ফিরলেন। এখন তিনি সাক্ষাৎকারটি করতে চাচ্ছেন তা আর দেরি করা যায় না আবার তার ভীষণ ভয়ও করছিল। একবার হাততালি দিলেন।

 মসলিনের পর্দা সরিয়ে কোরচি বেলকনিতে ঢুকে বললো, জাঁহাপনা?

আমার বোন শাহজাদি জাহানারার কাছে যাও। আমার তরফ থেকে সালাম। জানিয়ে তাকে এখানে আসতে বল।

অপেক্ষা করতে করতে আওরঙ্গজেব বেলকনিতে পায়চারি করতে লাগলেন আর সেই সাথে তার লম্বা আঙুল দিয়ে সবুজ জেড পাথরের তসবিহ জপ করতে লাগলেন। এটা সবসময় তাঁর কোমরবন্ধ থেকে ঝুলে থাকে। সেই সাথে তাঁর বুকও ঢিপঢিপ করছিল যেন এখুনি কোনো যুদ্ধে ছুটবেন। একটুপরই পেছনে মানুষের পায়ের শব্দ শোনা গেল আর কোরচি বলে উঠলো, জাঁহাপনা, তিনি এসেছেন।

ঠিক আছে। তুমি এখন যাও আর দ্যাখো কেউ যেন আমাদের বিরক্ত না করে।

 তিনি ঘুরে দেখলেন সাদা মসলিন পোশাক পরা শীর্ণ একটি মূর্তি, মাথা সাদা শালের ঘোমটায় ঢাকা, ছায়ায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। ভাই, বোন, একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আওরঙ্গজেব নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, আপনি কেমন আছেন জাহানারা? একটু কাছে আসুন আপনাকে দেখি।

 তাঁর বোন কয়েক পা সামনে এগিয়ে ধীরে ধীরে মাথার ঘোমটা নামিয়ে দিলেন। শেষ যখন আওরঙ্গজেব তাঁকে দেখেছিলেন, তারপর এই সাত বছরে তার বয়স বেশ বেড়ে গেছে মনে হল। তাঁর একান্ন বছর বয়স থেকেও তাকে আরো বয়স্ক মনে হচ্ছিল। মোটা বেনি করা চুল প্রায় সাদা হয়ে গেছে আর চিবুক চামড়া থেকে ঠেলে উঠেছে। বাম গালে আর গলায় এখনও আগুনে পোড়ার দাগগুলো রয়েছে। অল্পবয়সে সেই আগুনে তিনি প্রায় পুড়ে মরছিলেন। চোখের নিচে কালি। আওরঙ্গজেব কি বলবেন, তা মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন, কিন্তু তার এই জীর্ণশীর্ণ মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে তাঁর মুখ থেকে কোনো কথা বের হল না। তাঁকে ইতস্তত করতে দেখে জাহানারা আরো কাছে এগিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে একজন সম্রাটের উপযুক্ত সম্মান দেখাতে শুরু করলেন।

আওরঙ্গজেব তাঁকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, না? তিনি বাধা দিলেন না, আর যখন তাঁকে ছাড়লেন তখন আওরঙ্গজেব দেখলেন তার চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আর এটা দেখে তাঁর নিজের চোখের পাতাও খচখচ করে উঠলো, তিনি বহু কষ্টে তা সামলিয়ে বললেন, এখানে এসে আমার পাশে বসুন। অনেকদিন হল আপনি আমার পাশে বসেন না। তাঁকে আবেগে ভেসে গেলে চলবে না। জাহানারা স্বেচ্ছায় তার বাবার সাথে কারাবরণ বেছে নিয়েছিলেন, অথচ তিনি এখানে ম্রাজ্ঞী হতে পারতেন। আর তার চেয়ে বেশি খারেজি দারাকে ভালোবাসতেন… আর এই কথাটাই তার সবসময় মনে পড়তো, যখনই তিনি জাহানারার কথা ভাবতেন। আর এটাই তাকে শক্তি যোগাতো এই কথাটি ভুলে যেতে যে, যতকিছুই হোক তার বড় বোন তাঁর কাছে মায়ের মতো ছিলেন আর তিনি সব ব্যাপারে তার সম্মতি চাইতে পারতেন।

জাহানারা মৃদুকণ্ঠে বললেন, আমি খুশি যে, শেষ পর্যন্ত আমাদের বাবা, আমাদের মায়ের পাশেই শান্তিতে শুয়ে রয়েছেন। যা যা করার দরকার সবকিছুই আমি করেছি–মোল্লারা সারাদিনরাত তাঁর আত্মার শান্তির জন্য মঙ্গল কামনা করে দোয়া করেছেন।

 ধন্যবাদ।

 শেষ মুহূর্তে তিনি আমাকে বলেছিলেন, যে তোমার বিরুদ্ধে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই… তিনি তোমাকে ক্ষমা করেছেন।

একথাটি শোনার পর আওরঙ্গজেব সমুচিত জবাব দিয়ে বলতে চাচ্ছিলেন : কি জন্য তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন? তাঁর অযোগ্য হাত থেকে সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য আর আমার ধর্মভ্রষ্ট ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য, যিনি এটা ধ্বংস করে দিতেন? আমি তাঁকে ক্ষমা করি নি…তিনি কখনও আমার কাজের প্রশংসা করেন নি।

কিন্তু তিনি এই কথাগুলো উচ্চারণ না করে বরং জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু বলেছেন?

তিনি আমাকে বলেছেন, আমি যেন তোমাকে অনুরোধ করি, যেকোনো উপায়েই হোক তুমি যেন তোমার ছেলেদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখো আর ছেলেদেরকে পরস্পরের সাথে লড়াই করতে অনুমতি দিও না। তিনি তখত ইয়া তক্তা–সিংহাসন কিংবা শবাধার–একজন যোদ্ধার এই গোপন নীতিমালা বা সংকেত লিপির কথা বলেছেন, যা আমরা তৃণভূমিতে আমাদের পুরোনো দেশ থেকে নিয়ে এসেছি। তিনি বলেছেন যখন আমরা হিন্দুস্তানে প্রবেশ করেছি তখন থেকেই এটা আমাদের বংশের বিপর্যয়ের হেতু হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেবারে শেষ নিশ্বাস নেওয়ার সময় তিনি ফিসফিস করে আমাকে বললেন যে, আমাদের রাজবংশের সবচেয়ে বড় হুমকিটা সবসময় ভেতর থেকে এসেছে। যদি আমরা সাবধান না হই, তাহলে আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করবো আর আমাদের শত্রুদের কিছুই করতে হবে না, ওরা কেবল আমাদের একদা বিশাল সাম্রাজ্য থেকে লুটের ভাগ নিয়ে যাবে। তিনি বললেন, তিনি চেষ্টা করেছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থামাতে, তবে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি কি শুধু এ বিষয় নিয়েই নিজেকে ভর্ৎসনা করেছেন?

না। তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, জীবনে তিনি ভুল করেছেন…অবশ্য আমরা সবাই তাই করি।

 আওরঙ্গজেব অনুভব করলেন জাহানারা তাঁর দুহাতের মাঝে তার হাতটা ধরেছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি মনে হয়, আমি যা করেছি তা ভুল ছিল?

তুমি জানো আমি তাই মনে করি। একজন পুত্র এবং একজন ভাই হিসেবে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করনি। তুমি দারাকে তোমার শত্রু বানিয়েছ, মিত্র বানাও নি। তারপর যখন তাঁকে পরাজিত করলে, তখন তাঁকে আর তাঁর ছেলেকে মেরে ফেলার দরকার ছিল না। কিংবা অন্য ভাইদের বিরুদ্ধে না গেলেও পারতে। কথাগুলো বলার সময় তিনি হয়তো অনুভব করতে পারছিলেন যে, তাঁর দুহাতের মধ্যে আওরঙ্গজেবের হাতটি শক্ত হয়ে গেছে, তাই তিনি আরো জোরে তার হাতটা চেপে ধরে বললেন, কিন্তু আওরঙ্গজেব, যা হবার হয়েছে। যে বাবার সাথে তুমি এত অন্যায় করেছে, তিনি যদি তোমাকে ক্ষমা করতে পারেন, আমারও তা করা উচিত। আমরাতো এখনও ভাই আর বোন, তাই না? তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনও কমে যায় নি। যদিও আমি বাবার সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি এটা করেছি, কেননা আমি মনে করেছিলাম এটাই আমার জন্য ঠিক–একজন কন্যা হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব ছিল।

আওরঙ্গজেব তার মাথা এমনভাবে নিচু করলেন, যাতে জাহানারা তাঁর মুখটা দেখতে না পারেন। যে বোনকে তিনি সবসময় ভালোবাসতেন, তার সাথে আবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ফিরে পেয়ে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, আপনি এখুনি আমার সাথে দিল্লিতে আমার দরবারে চলুন। আমাদের মায়ের মৃত্যুর পর বাবা যেমন আপনাকে সম্রাজ্ঞী করেছিলেন, এখন আপনি আবার এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবেন। আমি আপনাকে পাদিশাহ বেগম–শাহজাদিদের রানি করবো। ইচ্ছে করলে আপনি আপনার নিজের জন্য আলাদা মহল…দাসিচাকর… আমার ধনভাণ্ডারের সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন, সব নিতে পারেন।

জাহানারা মৃদু হাসলেন, যে হাসির কথা আওরঙ্গজেবের ভালো মনে আছে। তিনি বললেন, উপাধি কিংবা বিলাসিতা নয়, সবচেয়ে ভালো হয় যদি তুমি কথা দাও যে, সাম্রাজ্যের মঙ্গল করবে আর পরিবারের বাকি আমরা যারা আছি তাদের দিকে খেয়াল রাখবে। হে আল্লাহ, এটাই হবে আমাদের বংশের নতুন সূচনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *