০১. বাঘ-নখ

ট্রেইটরস ইন দ্য শ্যাডোস : এম্পায়ার অব দ্য মোগল (৬) / মূল : অ্যালেক্স রাদারফোর্ড / ভাষান্তর : কাজী আখতারউদ্দিন

শাসন করার কাজটি এতই সূক্ষ্ম যে, একজন রাজাকে তাঁর নিজ ছায়ার প্রতিও ঈর্ষান্বিত হতে হয়।
-সম্রাট আওরঙ্গজেব

০১. বাঘ-নখ

একটি সমর সভায় যোগ দিতে দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ি পথ দিয়ে পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়ে যেতে যেতে দাড়িওয়ালা মারাঠা সেনানায়ক তার সঙ্গীর সাথে কথা বলছিল–বিখ্যাত বিজাপুরী সেনাপতি আফজাল খান শিবাজীকে সাময়িক অস্ত্রবিরতির আহবান জানিয়েছিলেন, যাতে ওরা পরস্পর সাক্ষাৎ করে যুদ্ধ থামাবার শর্ত নিয়ে বিজাপুরীদের সাথে একমত হতে পারেন। শিবাজী সাময়িক অস্ত্রবিরতি এবং দেখা করার বিষয়ে রাজি হলেন। তবে আফজাল খানকে তার বিশ্বাস নেই, তাই সতর্কতার সঙ্গে প্রস্তুতি নিলেন। তিনি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত তার দুর্গের নিচে ঘন জঙ্গলের মাঝে গাছ কেটে পরিষ্কার করে একটি খোলা জায়গায় সাক্ষাতের স্থান নির্ধারণ করলেন। আফজাল খানের অহমিকার কথা ভেবে তিনি এই স্থানটির ঠিক মাঝখানে রেশমি পর্দা ঝুলানো একটি জমকালো তাঁবু খাড়া করলেন। তারপর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ফাঁকা স্থানটি পর্যন্ত দুটি পথ তৈরি করলেন। একটি তার নিজের দুর্গের দিক থেকে, অপরটি আফজাল খানের শিবিরের দিক থেকে। তিনি তার শত্রুকে চিঠি লিখে জানালেন–এরকম একটি জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ এমন দুইজন বিখ্যাত নেতার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতের জন্যই অপেক্ষা করছে। তিনি আফজাল খানকে প্রথমে এসে এই চমৎকার পরিবেশ উপভোগ করতে আহ্বান জানালেন। তার এসব করার উদ্দেশ্য, যাতে তিনি জানতে পারেন আফজাল খান কোন পথ দিয়ে আসেন এবং নিজে আসার আগে পাহাড়ের উপরের দুর্গ থেকে পরিষ্কারভাবে শত্রুর আগমন লক্ষ করতে পারেন।

এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি পঞ্চাশজন পদাতিক সৈন্য পাঠিয়ে খোলা জায়গাটির চারদিকে ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে বললেন। আমি আমার লোকজনসহ তাদের মধ্যে ছিলাম। অস্ত্রসহ ভালোভাবে লুকোবার জন্য তিনি আমাদেরকে পাতাসহ গাছের ডালপালা শরীরে বাঁধার নির্দেশ দিলেন। সাক্ষাৎকারের নির্দিষ্ট সময় ঘনিয়ে আসতেই, শিবাজি তার দুর্গের উঁচু প্রাকার বেষ্টিত ছাদ থেকে দেখতে পেলেন–আফজাল খান প্রায় একশো লোক নিয়ে আসছেন। সাথে সাথে তিনি গোপিনাথ ব্রাহ্মণ নামক দূতকে পাঠালেন। আফজাল খানকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল যে, তারা উভয়েই শুধু একজন সশস্ত্র দেহরক্ষী সাথে নিয়ে আসার বিষয়ে সম্মত হয়েছিলেন। তাই তাকে প্রস্তাব দেওয়া হল বাকি সেনাদেরকে এক মাইল দূরে একটি টিলার কাছে থামাতে। এই স্থানটি আগেই দৈবাৎ লাল ক্রস চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলেন।

যথাসময়ে বিজাপুরী সেনাপতি টিলার কাছে তার লোকজনদের ছেড়ে বাকি পথটুকু কেবল একজন দেহরক্ষীসহ পালকিতে চড়ে তাবুতে পৌঁছলেন। আমি আমার লোকজনসহ পথের কাছেই লম্বা ঘাসের জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে ছিলাম। সবাই স্থির থাকতে চেষ্টা করছিলাম, তবে একটা কথা কি জান, ব্যাপারটা এতো সহজও ছিল না। একে তো গরম তার উপর চারদিকে মশা-মাছি ভন ভন করছিল। আমাদের উপর নির্দেশ ছিল, আফজাল খান কোনো চালাকি করার চেষ্টা করলে আমরা বের হয়ে আসবো। সোনার কাজকরা চার বেহারার পালকিতে চড়ে তিনি আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, তার দেহে কোনো বর্ম নেই। কেবল একটি দুধসাদা ঢোলা আলখাল্লা পরে রয়েছেন, কোমরে রত্নখচিত কোমরবন্ধ বাঁধা। তাকে অনুসরণ করা মাথা কামানো বলিষ্ঠ দেহরক্ষীকে আমি চিনতে পারলাম। চেনার ভাল কারণ, সে ছিল সাঈদ বান্দা। তোমার ওখান থেকে আমার নাকের উপর যে কাটা দাগটা দেখতে পাচ্ছো, সেটা এই মাথা কামানো দানবটির তরোয়ালের আঘাতের ফলে হয়েছে। আমি যেখানে লুকিয়ে ছিলাম সেখান থেকে প্রায় একশো গজ দূরে ছোট দলটি তাবুর কাছে পৌঁছাবার পর বেহারারা পালকি নিচে নামিয়ে একটু পিছিয়ে মাটিতে আসন পেতে বসলো। আফজাল খান তার দেহরক্ষী সাঈদ বান্দাকে তাবুতে ঢুকতে ইশারা করলেন। সে ভেতরে ঢুকে এক মুহূর্ত পরেই বেরিয়ে এল। আপাতত সবকিছু ঠিকঠাক আছে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে আফজাল খানকে ইশারা করলো। আফজাল খান পালকি থেকে বেরিয়ে তাঁবুতে ঢুকলেন।

এরপরই আমি পাহাড়ের উপরে দুর্গ থেকে তুর্যধ্বনির শব্দ শুনতে পেলাম। কয়েক মিনিট পর শিবাজি পায়ে হেঁটে এগিয়ে এলেন। তিনিও নীল সুতির সাধারণ একটি পোশাক পরে ছিলেন। আফজাল খানের মতো তিনিও একজন মাত্র দেহরক্ষী সাথে নিয়ে এসেছেন। শিবাজি তাঁবু থেকে কয়েক পা থাকতেই আফজাল খান দরজার কাছে হাজির হলেন। ওরা একটি বেমানান জুটি ছিল আফজাল খান চওড়া, গাট্টাগোট্টা ধরনের আর ভালুকের মতো লোমশ দেহ। আর আমাদের নেতা ছিলেন ছোটখাট হালকা-পাতলা গড়নের, তারের মতো পাকানো দেহ। সেনাপতির কাছে এসে শিবাজি একটু ঝুঁকলেন। আর সেনাপতি মুখে চওড়া হাসি নিয়ে দুই হাত দুই দিকে মেলে এগিয়ে গেলেন, যেন তাকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছেন। ঠিক তখনই একটি ধাতুর ঝিলিক চোখে পড়লো। আফজাল খান তার চওড়া আস্তিনের মধ্যে একটি ছোরা লুকিয়ে রেখেছিলেন, এখন সেটা বাগিয়ে শিবাজির বুক বরাবর আঘাত হানলেন। কিন্তু তুমি তো জান শিবাজি কিরকম দ্রুত আর ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন। তিনি ঝট করে পেছনে শরীর দোলালেন। ধারালো ছুরিতে কেবল তার নীল আলখাল্লাটি সামান্য কেটে গেল। আমি আমার লোকজনসহ এক লাফে দাঁড়িয়ে অস্ত্র নিয়ে সামনে ছুটলাম। এদিকে শিবাজি আফজাল খানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আফজাল খান আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, সাদা আলখাল্লা লাল টকটকে রক্তে ভিজে গেল।

 তাহলে এটা সত্যি–শিবাজি বাঘ-নখ ব্যবহার করেছিলেন?

হ্যাঁ, ওটা তিনি তার ডান হাতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর তার ধারালো ইস্পাত দিয়ে কাজটি সমাধা করেন। যখন শিবাজি আফজাল খানের দেহরক্ষী সাঈদ বান্দার দিকে ফিরলেন, তখন পালকির সেই সাহসী বেহারাগুলো ছুটে এসে সেনাপতিকে ধরাধরি করে পালকিতে তুলে নিল। তারপর পেছনে রক্তের ধারা ফেলে রেখে পালকি নিয়ে পথে নামলো। আমি চিৎকার করে আমার লোকদেরকে বেহারাদের পাকড়াও করতে বললাম, এদিকে আফজাল খানকে। পালকি থেকে টেনে নামালাম। তখন তার মুমূর্ষ অবস্থা, কাজেই খুব সহজেই তার বিশাল ভূঁড়িতে তরোয়াল ঢুকিয়ে তাকে শেষ করে দিলাম। তারপর শিবাজির দিকে ছুটে গেলাম, ভেবেছিলাম সাঈদ বান্দাকে হত্যা করে অপমানের প্রতিশোধ নেবো, এতে শিবাজিকেও সাহায্য করা হবে। কিন্তু তরোয়ালধারী লোকটি ততক্ষণে মর মর অবস্থায় হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছিল। বাঘ-নখের আঘাতে তার গলা চিরে দুফাঁক হয়ে গিয়েছিল, সে দু-হাতে গলা ধরে রেখেছিল। তার কণ্ঠনালী চিরে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে দাক্ষিণাত্যের লাল মাটি ভিজে যাচ্ছিল। প্রায় শাসরুদ্ধ হয়ে সেনানায়ক কথা থামালো, সে যেন আবার সেই লড়াইয়ে ফিরে গেছে।

কয়েক মুহূর্ত পর তার সঙ্গী বললো, এই গল্প বার বার শুনেও আমার ক্লান্তি নেই। কিন্তু আপনার কি মনে হয়, শিবাজি আমাদেরকে আজ কেন এখানে ডেকেছেন? নতুন কোনো অভিযানের পরিকল্পনা হচ্ছে নাকি?

সেটা শীঘ্রই জানতে পারবো।

লোক দুটি শিবাজির প্রধান তাঁবুর কাছে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামতেই গোধূলি হয়ে এলো। তাঁবুর ভেতরে ঢুকে ওরা দেখলো মারাঠি নেতা ইতোমধ্যেই জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে চলেছেন। মারাঠিদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি যার কোনো শ্রদ্ধা নেই, সেই মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে মারাঠিদের দেশে একজন ভিনদেশি হানাদার হিসেবে ধিক্কার জানাতে গিয়ে প্রচণ্ড আবেগে তার দু-চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছিল। তিনি আমাদেরকে বলেন, পাহাড়ি ইঁদুর, অথচ তিনি নিজেই একজন পরজীবী কীট। ক্ষমতার লোভে নিজের ভাইদেরকে শেষ করে দিয়েছেন। অন্যায়ভাবে সিংহাসন দখলের জন্য এতোগুলো বছর তাঁর পিতাকে বন্দী করে রেখেছেন, যা তাঁর নিজ ধর্ম বিশ্বাসে একটি গর্হিত অপরাধ। ইঁদুর হই বা না হই, আমরা তাঁর হাত কামড়ে দিয়েছি আর বার বার কামড়াতেই থাকবো যতক্ষণ না আমরা তাঁর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হই।

 জ্বালাময়ী ভাষণ এবং নাটকীয় অঙ্গভঙ্গি দিয়ে শিবাজি তার লোকদের মনে উত্তেজনার আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে তার পরিকল্পনা খুলে বললেন। আমরা উত্তর পশ্চিমে যাবো, ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রাতে চলবো, যাতে লোকজনের চোখে না পড়ি। তারপর সবাই একত্রিত হয়ে মোগলদের সম্পদশালী সুরাট বন্দর আক্রমণ করে লুণ্ঠন চালাবো। আমার গুপ্তচরেরা জানিয়েছে গর্বিত আওরঙ্গজেব বোকার মতো এই বন্দরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল রেখেছেন। তাঁর বিশ্বাস কেউ এখানে আক্রমণ করতে সাহস করবে না। শীঘ্রই জানতে পারবেন, তার নিজের আর আমাদের লোকদের সামনে তাকে নতজানু হতে হবে। এখন সবাই যাও, যুদ্ধের জন্য আর সেই সাথে অর্জিত পুরস্কার ও চিরস্থায়ী বিজয় গৌরবের জন্য প্রস্তুত হও! তার কথায় সায় দিয়ে তার সেনানায়কেরা গর্জে উঠলো।

দেরিতে আসা দুই সেনানি বের হওয়ার সময়, একজন অপরজনকে বলছিল, এবার আওরঙ্গজেবের গলাকে বাঘ-নখ থেকে সতর্ক হতে হবে।

*

ঘোড়ায় চড়ে শিবাজি বললেন, এখনই সময়। মোগলদেরকে তাদের অপরাধ আর বিজয় অভিযানের জন্য রক্ত দিয়ে মূল্য দিতে হবে। তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে হবে হিন্দুস্তান আমাদের, তাদের নয়। তারপর তিনি পায়ের গোড়ালি দিয়ে কালো ঘোড়াটির পাঁজরে গুঁতো দিলেন। একটি ঝোঁপের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বের হয়ে ঘোড়াটি সৈকতের নরম বালুর উপর দিয়ে ছুটে চললো। পাঁচশো লোক নিয়ে শিবাজি সুরাটের চারপাশ ঘিরে থাকা নিচু মাটির দেয়ালের দিকে ছুটে চললেন। পশ্চিম দিকে তার মাসব্যাপী যাত্রা বেশ দ্রুত হয়েছিল এবং অধিকাংশ সময় তারা কারও চোখে পড়েনি। তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চলছিল। যেসব মোগল সেনানায়ক এসব ছোট ছোট দলের কথা শুনেছিল তারা এদেরকে ঘুরে বেড়ানো ডাকাত মনে করে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে নিজেদের আরাম আয়েশে মত্ত হয়ে পড়ে। অবশ্য শীঘ্রই তারা এবং তাদের মতো অন্যরাও নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে।

ঘামে ভেজা দেহ নিয়ে ঘোড়াটি প্রতিরক্ষার প্রথম বাধা-তিনফুট উঁচু দেয়ালটি টপকাতে এক লাফ দিতেই শিবাজি তার তরোয়াল সামনে বাগিয়ে ঘোড়াটির ঘাড়ের দিকে একটু ঝুঁকলেন। দেয়ালের পেছন থেকে আত্মরক্ষার জন্য দাড়িওয়ালা একজন মোগল সৈন্য এক হাত উঠাতেই শিবাজি তার তরোয়ালের এক কোপে সৈন্যটির হাত কব্জি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। সৈন্যটিকে পেছনে ফেলে শিবাজি আবার তরোয়াল চালালেন। দ্বিতীয় আঘাতটি পড়লো একজন মোগল সেনা কর্মকর্তার মুখে। লোকটির দাঁত ভেঙ্গে রক্তাক্ত চোয়াল বুকের উপর ঝুলে পড়লো। সামান্য যে কজন মোগল সেনা বাইরের দেয়াল প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল, তারা শহরের ভেতরের দেয়ালের দিকে ছুটে চললো। কয়েকজন তাদের অস্ত্র ফেলে ছুটে পালালো। তারপর শিবাজি একের পর এক গাদা বন্দুকের গুলি ছোঁড়ার ফট ফট আওয়াজ শুনতে পেলেন। তার পাশের বেগুনি রঙের পাগড়িপরা মারাঠি সৈন্যটি বুকে হাত চেপে ধীরে ধীরে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। পেছন থেকে ছুটে আসা ঘোড়াগুলো খুর দিয়ে তাকে মাড়িয়ে গেল। কাছাকাছি আরেকটি ঘোড়া পা ভাঁজ করে বালুর উপর লুটিয়ে পড়লো, সাথে সাথে এর আরোহীও ছিটকে মাটিতে পড়লো। তারপর আরো দুই-তিনজন মারাঠি মাটিতে পড়ে গেল। তবে বাদবাকিরা দৃঢ়তার সাথে ঘোড়া ছুটিয়ে চললো।

 সুরাটের উপরের দিকে তাকিয়ে শিবাজি শহরের দক্ষিণ দিকের বন্ধ ফটকের ঠিক পেছনে একটি দুই-তিনতলা ভবনের সমতল ছাদে গাদা বন্দুকধারী একদল মোগল সেনার ছায়ামূর্তি দেখতে পেলেন। লোহার দণ্ড দিয়ে ঠেলে ঠেলে বন্দুকের নলে বারুদ ভরে তারা আবার গুলি ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বামহাতে ঘোড়ার মুখ সেদিকে ঘুরিয়ে শিবাজি চিৎকার করে উঠলেন, ওরা বন্দুকে বারুদ ভরার আগেই ফটকের দিকে ছোটো। সেই সাথে ডান হাতের তরবারি দিয়ে ছুটে পালানো একজন মোগল সেনার পিঠে আঘাত করলেন। শীঘ্রই তার কয়েকজন লোকসহ তিনি ফটকের কাছে পৌঁছলেন। তিনি আশা করছিলেন, ভেতরে যারা আছে তারা হয়তো ফটকের দরজা একটু ফাঁক করবে যাতে তাদের ছুটে আসা সঙ্গীরা ভেতরে ঢুকতে পারে। কিন্তু না, কঠিন মনের আত্মরক্ষাকারীরা যথেষ্ট বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, তারা বরং তাদের সাথিদেরকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেবে, কিন্তু তাকে ভেতরে ঢুকার সুযোগ দেবে না।

শিবাজি দ্রুত ভাবতে লাগলেন, তাহলে কিভাবে তিনি লোকজনসহ শহরের ভেতরে ঢুকবেন?

একবার ভাবলেন ঘোড়ার পিঠ থেকে দেয়ালে চড়লে কেমন হয়? না, প্রায় বার ফুট উচ্চতা খুব বেশি হয়ে যায়। একজনের উপর একজন দাঁড়িয়ে মানব-সিঁড়ি তৈরি করলে কেমন হয়? না, এটাও খুব ঝুঁকিপূর্ণ আর অনেক সময় লাগবে। তারপর হঠাৎ তার চোখে পড়লো একটি জংধরা ছোট কামানের নল মাটির দেয়ালের ছায়ায় পড়ে রয়েছে। তিনি চিৎকার করে বললেন, ঐ কামানের নলটা নাও, ওটাকে দুরমুশ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ঘোড়ার পিঠ থেকে এক লাফে নেমে তিনি মাটিতে পড়ে থাকা কামানের নলটির দিকে ছুটলেন। তার কয়েকজন দেহরক্ষীও তাকে অনুসরণ করলো। এদের মধ্যে একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আবার উঠে দাঁড়াল। একটু পরই বর্মের নিচে ঘামতে ঘামতে আটজন লোকসহ শিবাজি কামানের নলটি তুলে ফটকের সামনে বয়ে নিয়ে এলেন।

একজন মারাঠি বললো, রাতেরবেলা ওরা বামদিকের যে ছোট দরজাটা ব্যবহার করে সেটার উপর আঘাত করলে হতো না?

 শিবাজি উত্তর দিলেন, ভালো কথা বলেছে। তিন বলার সাথে সাথে এর কজা লক্ষ্য করে আঘাত কর। হাঁপাতে হাঁপাতে ওরা কামানের ভারি নলটি একবার পেছনের দিকে নিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে ছোট দরজাটির কজা লক্ষ্য করে আঘাত করলো। কোনো ফল নেই। আবার! এবার দরজার কিছু কাঠের টুকরা ভাঙ্গলেও, দরজাটি জায়গা মতোই রইল। আরো জোরে! তৃতীয় আঘাতে দরজাটি কজা থেকে খুলে এল। শক্তিশালী গড়নের একজন তরুণ দেহরক্ষী প্রথমে ঢুকলো, তারপর শিবাজি আর তার প্রায় বিশজন সেনা তাকে অনুসরণ করলো। একটু নিচু হয়ে ওরা দালানটির দিকে ছুটে চললো, যেখান থেকে মোগলরা গুলি ছুঁড়ছিল। হঠাৎ একজন মোগল সেনা গুলি ছুঁড়তেই তরুণ দেহরক্ষীটির পায়ে গুলি লাগতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। একজন মারাঠি সেনার হাতে বারুদভরা গাদা বন্দুক ছিল, সে ধীরে সুস্থে লক্ষ্য স্থির করে গুলি ছুঁড়লো। সবুজ জ্যাকেটপরা একজন মোগল সেনার শরীর মুচড়ে উঠলো, হাত পা ছুঁড়ে ছাদের উপর থেকে সে মাটিতে পড়ে গেল। মাটিতে পড়ে তার মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে গেল। বাদবাকিরা ছাদ থেকে লাফিয়ে নেমে পালাবার চেষ্টা করতে লাগলো। তবে মারাঠিরা তাদের উপর চড়াও হয়ে তলোয়ার চালাতে লাগলো, কেউ ছাড়া পেল না।

শিবাজি আর তার লোকজনেরা একটু দম নেবার জন্য থামতেই একজন মারাঠি। দৌড়ে উপরে এসে বললো, মহারাজ, মোগলরা শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। অস্ত্রসহ বড় একটি দল ঘোড়ায় চড়ে উত্তর দিকের ফটক দিয়ে পালাচ্ছে। মনে হল ওদের মধ্যে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাও আছে। অন্যরা নৌকা বেয়ে বন্দরে অপেক্ষমাণ মোগল জাহাজের দিকে যাচ্ছে। জাহাজগুলো ইতোমধ্যে পাল তুলতে শুরু করেছে।

কাপুরুষের দল। ওদের টাকা-কড়ি কোথায় আছে খোজো–নির্দয়ভাবে আওরঙ্গজেব যে করের বোঝা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে…তবে শহরের সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি করো না। আমাদের মতো ওরাও মোগলদের হাতে অত্যাচারিত হয়েছে। তবে নিয়মানুযায়ী অনুসন্ধান করবে। মোগলরা ওদের রত্নভাণ্ডার ভালোমতোই লুকিয়ে রাখে।

 শিবাজি নিজে কয়েকজন লোক নিয়ে বন্দরের সামনের দিকে মুখ করা গুদামগুলোর একটির দিকে চললেন। তবে ওরা সাবধানে দালানের দেয়াল ঘেঁসে চললো, কেননা মোগলদের পালিয়ে যাওয়াটা একটি ফাঁদও হতে পারে। কিংবা ছাদে আরো মোগল সেনা ওঁৎ পেতে থাকতে পারে। তবে সৈকতে পৌঁছে ওরা দেখলো সব একেবারে নীরব। সকালের রোদে সাগরের পানি চিকচিক করছে। ওরা জনশূন্য জাহাজঘাট ঘুরে দেখলো, অন্যসময় জায়গাটি জনসমাগমে সরগরম থাকতো। বড় বড় কতগুলো উজ্জ্বল হলুদ রঙের কাপড়ের গাঁট জাহাজঘাটে পড়ে রয়েছে। কুলিরা যেখানে ফেলে রেখে পালিয়েছে, সেখানেই পড়ে রয়েছে। ফেলে রাখা দুটো পিপা থেকে মরিচ ধুলায় পড়ে রয়েছে। সৈকতে আছড়ে পড়া ছোট ছোট ঢেউয়ের শব্দ আর মাঝে মাঝে দু একটা গাংচিলের চিৎকার ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

শিবাজি তার লোকজনসহ নিঃশব্দে বেলেপাথরের কয়েকটি বড় বড় দালানের চারপাশ ঘিরে থাকা একটি উঁচু ইটের দেয়ালের দিকে এগোলেন। হঠাৎ একটি বন্দুকের গুলি শিবাজির কানের পাশ দিয়ে ছুটে গেল। আরো কয়েকটি গুলি তার পায়ের চারপাশে ধুলি উড়িয়ে গেল। একজন মারাঠি তার রক্তাক্ত পায়ের ডিম ধরে মাটিতে পড়ে গেল। শিবাজি চেঁচিয়ে উঠলেন, সবাই যে যেখানে পারো লুকাও। গুলি আসছিল ইটের দেয়ালঘেরা আঙিনাটি থেকে। গুপ্তচরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে শিবাজি অনুমান করলেন এই দালানগুলোতে নিশ্চয়ই ইউরোপীয় বণিকরা থাকে। তার ধারণা সত্য প্রমাণিত হল যখন একটি দালানের উপরের তলা থেকে সাদা চামড়ার একজন মানুষ জানালা দিয়ে মুখ বের করে সাবধানে উঁকি দিল। গাদা বন্দুক হাতে আরেকটি লোক জানালার সামনে এসে দ্রুত একবার গুলি করেই বসে পড়লো। আরেকজন মারাঠি সেনা পড়ে গেল, রক্তে তার সাদা জামা লাল হয়ে গেল। তার একজন সঙ্গী সামনে ছুটে এল, তারপর তার কাঁধের নিচে হাত দিয়ে ধরে তাকে কাপড়ের গাঁটরির আড়ালে টেনে নিয়ে গেলো।

শিবাজি একমুহূর্ত ভাবলেন। দালান-কোঠাগুলোর চারপাশ ঘিরে থাকা উঁচু দেয়ালের চারদিকে অন্তত পঞ্চাশ ফুট খোলা জায়গা রয়েছে। তার লোকেরা এই জায়গাটুকু পার হতে ভীত নয়, তবে নিসন্দেহে কয়েকজন মারা পড়বে। শুধু শুধু তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে কী লাভ? তাই তিনি বললেন, পিছু হটে পুরো দেয়ালটি ঘিরে ফেল আর নজর রাখা কেউ যেন এখান থেকে বের হতে কিংবা ঢুকতে না পারে। আমরা এখন মোগলদের কোষাগারের অনুসন্ধান করবো, তারপর বিদেশিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।

 ঘণ্টা দুয়েক পার হল, তবে পুরোনো নগর দুর্গটিতে কয়েকটি রূপার মুদ্রা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। শিবাজি বুঝতে পারলেন ওরা আসল ধনভাণ্ডারের সন্ধান এখনও পায়নি, যা অবশ্যই আছে। দুটো বড় পাম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে হতবুদ্ধি হয়ে তিনি ভাবছিলেন মূল ধনরত্নগুলো ওরা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। এমন সময় পাকাচুলের একজন মারাঠি সেনা-কর্মকর্তা তার কাছে এসে বললো, মহারাজ, আমার একজন লোক বলছে, যখন সে ঐ কুয়াটির কিনারায় চারপাশে পাথরের আস্তরণ দেওয়া অংশটির উপর পা ঠুকছিল তখন এক জায়গায় ফাপা আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। তার ধারণা এর নিচে হয়তো কোনো গোপন কুঠরি থাকতে পারে। কুয়াটির পানিতে আমি একটি পাথর ফেলে দেখেছি, যেরকম ধারণা করেছিলাম ততটুকু গভীর মনে হল না। লোকটির কথাই হয়তো সঠিক।

ঠিক আছে, তাহলে ঐ পাথরের আস্তরণগুলো তুলে ফেল।

 মারাঠিরা দ্রুত কাজে লেগে পড়লো। হাতের কাছে যা পেল তাই দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পাথরের আস্তরণগুলো তুলতে শুরু করলো। দশ মিনিটের মধ্যে ওরা একটা খাড়া সিঁড়ি দেখতে পেল, সোজা কুয়াটির নিচের দিকে নেমে গেছে। তালা দেওয়া একটি ধাতব বেষ্টনী দিয়ে ঢোকার পথটি বন্ধ করা ছিল। গাদা বন্দুকধারী একজন মারাঠি তালাটির মধ্যে একটু বারুদের গুঁড়া ঢেলে, আগুন লাগিয়ে দিয়ে পেছনে সরে দাঁড়াল। দপ করে আগুন জ্বলে উঠতেই একটা দুম শব্দ হল, তারপর তারের জালটি খুলে গেল। ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে শিবাজি ভেতরে কয়েকটি লোহার সিন্দুক দেখতে পেলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, সিন্দুকগুলো খোল। তার হুকুম তামিল করতে তার লোকেরা ছুটে এল। একটু পরই ভারি ডালাগুলো খুলতেই ভেতরে থরে থরে সাজানো সোনা রূপার মুদ্রা পাওয়া গেল।

 ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে শিবাজি সবচেয়ে বড় সিন্দুকটির মুদ্রাগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। সোনা-রূপার মুদ্রাগুলো তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে পড়ছিল। এমন সময় মোটাসোটা একজন মারাঠি সেনা-কর্মকর্তা তার কাছে ছুটে এল। এই লোকটি ইউরোপীয়দের আবাসের চতুর্দিক ঘেরাও করা সেনাদলের নেতৃত্বে ছিল। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে শুরু করলো, মহারাজ, ইউরোপীয়রা … এতটুকু বলেই সে দম নিতে থামলো।

বল, ইউরোপীয়রা কী?

 ওরা তাদের জান-মাল রক্ষার বিনিময়ে মুক্তিপণের টাকা দেবার প্রস্তাব দিয়েছে।

হ্যাঁ বল, তারপর।

আরেকবার দম নিয়ে লোকটি আবার বলা শুরু করলো। সাদাচুলের দাড়িওয়ালা একজন ইউরোপীয় বণিক দুই হাত মাথার উপর তুলে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। সে আমাদের ভাষায় চেঁচিয়ে বললো, এখানে যে দায়িত্বে আছে, তার সাথে সে কথা বলতে চায়। আমি বাইরে এসে বললাম আমিই এখানে দায়িত্বে আছি। তখন সে কেবল বললো, আমরা তাদের কোনো ক্ষতি না করলে বণিকেরা আমাদেরকে কয়েক লাখ মুদ্রা দেবে। আমি তাকে জানালাম আপনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন, তবে আমি এখুনি আপনাকে কথাটি জানাচ্ছি।

শিবাজি একটু থেমে চিন্তা করলেন। ইউরোপীয়রা উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। শক্তিপ্রয়োগ করে ওদেরকে পরাজিত করতে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও অনেক সময় লেগে যাবে। আর এই ফাঁকে মোগলরাও আরো সৈন্য নিয়ে ফিরে আসতে পারে। মুক্তিপণের টাকার পরিমাণটি বিশাল। আর তার সাথে এই সিন্দুকগুলোর টাকা মিলিয়ে তার লোকদের লুটপাটের ক্ষুধা মেটানো ছাড়াও হিন্দুস্তানের অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে তার সমরাভিযানের খরচও দীর্ঘদিন চালানো যাবে। তাছাড়া এই বিদেশিদের শত্রু বানিয়ে কি লাভ, যেখানে শোনা যায় মোগলদের সাথে এদেরও সুসম্পর্ক নেই? এদের সমর্থন–বিশেষত ওরা যেসব আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র যোগান দিতে পারবে, তা আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার ভবিষ্যৎ লড়াইয়ে বেশ কাজে লাগবে। ওদেরকে বল আমি ওদের প্রস্তাব গ্রহণ করেছি।

*

দিল্লির লাল কেল্লায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই কাকগুলো তাদের বাসার খোঁজে কা কা চিৎকার করতে করতে ফিরে আসতে লাগলো। খাস মহল থেকে বের হয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেব দুই পাশে সারবেঁধে মাথা নুইয়ে থাকা অমাত্য এবং সিপাহসালারদের মধ্য দিয়ে হেঁটে তিনদিক খোলা দিওয়ান-এ-আম-এর দিকে হেঁটে চললেন। ডানে বামে না তাকিয়ে মার্বেল পাথরের মঞ্চে উঠে তিনি তার পিতার রত্নখচিত সোনার ময়ূর সিংহাসনে বসলেন। দুধ সাদা সাধারণ আলখাল্লা পরা দীর্ঘ, হলকা-পাতলা গড়নে তার কঠোর আত্মসংযমী ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হচ্ছে। লম্বা সুন্দর হাতের আঙুলগুলো সিংহাসনের ঝলমলে হাতলে রাখলেন। কাঁচা-পাকা দাড়ি সুন্দরভাবে ছাঁটা। বাজপাখির মতো বাঁকা নাকের উপরে হাসিহীন কালো চোখদুটো হলুদ রেশমি পোশাকপরা সুরাটের সুবেদারের দিকে স্থির হয়ে রয়েছে। দুজন প্রহরী তাকে এগিয়ে নিয়ে আসছিল। মঞ্চের বারো ফুট দূরত্বে এসে সুবদার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে উপুড় হয়ে লম্বা হল।

শান্ত ভাবলেশহীন কণ্ঠে আওরঙ্গজেব বললেন, উঠুন। এ ধরনের অসংযত, লোক দেখানো বিনয় দেখাবার প্রয়োজন নেই। আমার যা দরকার, তা হল সুরাটে আপনার কার্যকলাপের সঠিক ব্যাখ্যা। কিভাবে আপনি ভূঁইফোড় শিবাজি আর তার পাহাড়ি দস্যুদের শহর লুট করতে দিলেন?

জাহাপনা, শহর রক্ষার জন্য আমার পর্যাপ্ত সেনা ছিল না। হাজার হাজার মারাঠি হঠাৎ আক্রমণ করে বসে। ওরা ধর্মোম্মাদ, নিজের জীবনের প্রতি ওদের কোনো দয়ামায়া নেই। তাছাড়া সুরাটের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আপনার সিংহাসনে বসার শুরু থেকেই ঠিক ছিল না।

আপনার আসলে মোট কতজন লোক ছিল?

 ছয়শো পঞ্চাশের বেশি না।

আর কামান?

দশটি। তবে সবকটিই ছোট আর পুরোনো আমলের।

বাইরে থেকে কোনো বিপদ আসার খবর জানাতে নগরের সীমানার বাইরে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘোড়সওয়ার টহলের ব্যবস্থা নেননি কেন?

টহলদার ছিল…তবে ঘোড়সওয়ার ছিল না। এখন বুঝতে পারছি জাহাপনা, তা যথেষ্ট ছিল না।

আরওরঙ্গজেব নীরবে সুবেদারের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সুবেদার তোতলাতে শুরু করলো, জাঁহাপনা, আমি সকল নগরবাসীকে নির্দেশ দিলাম, যার যার মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে জান বাঁচাতে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিতে।

 আপনিও তাই করলেন, তাই না?

 সুবেদার মাথা নিচু করে বললো, হ্যাঁ।

সুরাট ছেড়ে চলে গেলেন আর এদিকে চারদিন ধরে নগরে লুটপাট চললো।

সুবেদার মাথা নেড়ে সায় দিল। হঠাৎ গলা শুকিয়ে যাওয়ায় তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না। সারা মুখে দরদর করে ঘাম ঝরছে, হলুদ রেশমি আলখাল্লার কাঁধ ঘামে ভিজে গেছে।

 ইউরোপীয়রা কি করে তাদের সম্পদ রক্ষা করতে পারলো, অথচ আপনি পারলেন না?

আতঙ্কে সুবেদারের দুচোখের মণি কাঁপছিল, দুহাত ঘষতে ঘষতে সে বললো, জাহাপনা, ওদেরতো ছোট একটি জায়গা ছিল, আর আমাকে গোটা শহরের প্রতিরক্ষা দেখতে হয়। তারপর থেমে একবার ঢোক গিলে আবার বলা শুরু করলো, বিদেশিদের হাতে নতুন নতুন অস্ত্র ছিল…আর আমার লোকও ছিল খুব কম…ওরা ভয় পাচ্ছিল মারাঠিরা হয়তো…

আওরঙ্গজেব মনে মনে ভাবলেন, পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে সুবেদার বুঝতে পারে নি। যে, তিনি কতটুকু জানেন আর তার গুপ্তচরের জাল কতদূর ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি বললেন, আপনার আগের বর্ণনা অনুযায়ী শহর রক্ষার জন্য, যে তিন হাজার সৈন্য নিযুক্ত করার কথা ছিল তার কি হল? তারপর আওরঙ্গজেব এক টুকরা কাগজ বের করে বললেন, আপনার স্বাক্ষর করা এই রশিদটি আমার খাজাঞ্চি আমাকে দিয়েছেন। রাজকীয় কোষাগার থেকে সেনাবাহিনীর খরচ জোগাতে আপনাকে বার্ষিক যে ভাতা দেওয়া হত এটি তার রশিদ। এই স্বাক্ষর আর সিলমোহর কী আপনার নয়?

এবার সুবেদার থর থর করে, কাঁপতে কাঁপতে আওরঙ্গজেবের সামনে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়লো। কোনো উত্তর দিতে পারলো না। ভাতা গ্রহণ করে সেই টাকা দিয়ে সেনা নিয়োগ করা, তাদের বেতন দেওয়া আর তাদেরকে যথাযথ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত না করে পুরো টাকাটা সে আত্মসাৎ করেছে। এটা বুঝতে পেরে আওরঙ্গজেব কঠিন চেহারা নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি শুধু আপনার ম্রাটের সাথে বেইমানি করেন নি, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ভঙ্গ করে আল্লাহর সাথেও বেইমানি করেছেন, যেখানে চুরি এবং দুর্নীতি নিষেধ করা আছে। উদ্ধত একজন কাফের এবং কিছু বিদেশি, যারা ইতোমধ্যেই আমাদের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছে, তাদের সামনে আমাকে আর আপনার ধর্মের অপমান করেছেন। যদি মারা যেতেন তাহলে আপনি একজন শহিদ হতেন। আর এখন কী হয়েছেন? একজন হীন কাপুরুষের মতো আপনার প্রভুর সামনে কাতর স্বরে কাঁদছেন। তবে আমি দয়ালু তাই আপনাকে পরকালে পাঠাবো না, তবে আপনার আর আপনার পরিবারের সমস্ত সম্পদ রাজকোষে সমর্পণ করবেন। যে পাপ করেছেন তা থেকে শুদ্ধ হতে একজন গরিব এবং নগণ্য তীর্থযাত্রীর মতো মক্কায় হজ করতে যাবেন। পথে যেতে যেতে ভিক্ষা করে যা পাবেন তা দিয়ে জীবন ধারণ করবেন। এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যান!

 সুবেদার মাটিতে বসে পড়েছিল, একবার দাঁড়াবার চেষ্টা করে আবার ঢলে পড়লো। দুজন প্রহরী তার দুই বাহু জাপটে ধরে তাকে টেনে নিয়ে চললো। সে পেছন পেছন মাটিতে হলুদ তরলের দাগ রেখে যেতে লাগল। কাপুরুষ লোকটি তার প্রস্রাব সামলাতে পারে নি।

আওরঙ্গজেব এবার তার সভাসদ আর সেনাপতিদের দিকে ফিরলেন। এই লোকটির পরিণতির কথা মনে রাখবেন। সাম্রাজ্যে কোনো ধরনের দুর্নীতি আমি সহ্য করবো না। আপনাদের মধ্যে কেউ তা লঙ্ঘন করলে আমি কোনো দয়া দেখাবো না। আর ঐ বেইমান শিবাজিকে নির্মূল করতে আমি ইতোমধ্যেই একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাঠিয়েছি। মোগল বংশের প্রতি সে যে অপমান করেছে, তার জন্য দুনিয়ার বুক থেকে তাকে মুছে ফেলা হবে। এবার আপনারা যেতে পারেন। নবোদ্যম নিয়ে আর নিঃস্বার্থভাবে দৃঢ়সংকল্প হয়ে যার যার দায়িত্ব পালনে লেগে পড়ুন।

 রাত নেমে এসেছে আর এখন কাকের বদলে আকাশে বাদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আওরঙ্গজেব খাসমহলের দিকে ফিরে চললেন। সেখানে পৌঁছে একাকী একটি চাবি নিয়ে ছোট একটি হাতির দাঁতের বাক্স খুলে একটা কাগজের টুকরা বের করলেন। সেখানে দাঁড়িয়েই শিবাজির কাছ থেকে যে চিঠিটা পেয়েছিলেন, তা আরেকবার পড়লেন। চিঠিটা কাউকে দেখান নি।

আপনারা, মোগলরা মনে করেন আপনারা কুশলী যোদ্ধা। কিন্তু আপনাদের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধারাও আমার দেশে বেশিদিন টিকতে পারে নি। মারাঠিদের ভূমি রুক্ষ আর কঠিন হলেও তা আমাদের। আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি আর শেষ মানুষটি আর দুর্গগুলো থাকতে তা রক্ষা করবো। এখানে অনুপ্রবেশ করলে আপনারা নিজেদের রক্তের সাগরে ডুবে যাবেন।

অন্য কেউ হলে এধরনের দাম্ভিকতাপূর্ণ আর ঔদ্ধত্য মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে ঝোঁকের মাথায় হঠকারী কিছু একটা করে বসতো। নিঃসন্দেহে শিবাজিও আওরঙ্গজেব সম্পর্কে তাই ভেবেছিলেন। তবে অভিজ্ঞতা আওরঙ্গজেবকে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার মূল্য আর এখন কি করা দরকার সেদিকে মনোযোগ দিতে শিখিয়েছে। এক্ষেত্রে যারা প্রকাশ্যে তাঁর বিরোধিতা করার স্পর্ধা দেখিয়েছে, তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। এটা তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে যথাসময়েই করবেন। তবে বিজয় যখন আসবে, তখন তা হবে পরিপূর্ণ ও চিরকালের জন্য, যা হঠাৎ গজিয়ে উঠা উচ্চাভিলাষী যে কোনো বিদ্রোহীর জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *