৫. মারীদার রাষ্ট্রীয় কোষাগার

মারীদার রাষ্ট্রীয় কোষাগার এখন মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বারের দখলে। ইবনে আব্দুল জব্বার এখন মারীদার একচ্ছত্র আমীর বনে গেছেন।

ওখানকার অধিকাংশ নও মুসলিমই ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্ট ধর্মে ফিরে গেছে। এটা তাহরীকে মুআল্লিদীন- ধর্মত্যাগী আন্দোলনকারীদের প্রথম সাফল্য। নও মুসলিমদের দুমুখো সাপের আচরণে অবতীর্ণ করতে পেরে ওরা এখন অন্যরকম এক বিজয়ের স্বাদ উপভোগ করছে।

ইউগেলিস ও ইলওয়ার মারীদাতেই বসে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের হাতে গড়া ফৌজের সংখ্যা এখন চল্লিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মারীদা দখলের পর এদের সৈন্য সংখ্যা হো হো করে বাড়তে থাকে। তবে এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়মিত কোন সৈন্য নয়।

এরা সবাই এই শহরের নাগরিক। বিচ্ছিন্নভাবে এরা লড়তে জানে। কিন্তু সেনাবাহিনীর আকারে দলবদ্ধ হয়ে এরা কখনো লড়াই করেনি।

তারপরও এরা খুব সহজেই মারীদা জয় করে নেয়। এজন্য ওদের আনন্দ বাঁধ ভাঙ্গা আকার ধারণ করেছে। ওরা এখনো লুটপাট চালিয়ে তাদের বিজয় উৎসব করছে। মুসলমানদের ঘর বাড়িগুলো একেবারেই তছনছ হয়ে গেছে। মুসলিম নারীদের তো কোথাও কোন হদিস নেই। কে কোথায় আছে, এটা কেউ জানে না।

যারা বিদ্রোহীদের হাতে মারা পড়েছে তাদের স্ত্রী, বোন বা মেয়েরা চলে গেছে বিদ্রোহীদের দখলে।

মারীদা শহরের মধ্যাংশে বিশাল বড় এক ময়দান রয়েছে। এখানে ঘোড় দৌড়, সৈনিকদের কুচকাওয়াজ হয় এবং প্রেগ্রাউন্ড হিসাবেও এ ময়দান ব্যবহৃত হয়।

লুটেরা প্রশাসনের ডাকে শহরের সবাই সেই ময়দানে জমায়েত হলো। একটু পর ইউগেলিস ইলওয়ার ও মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার ঘোড়ায় চড়ে সমবেত মানুষের মধ্যে এসে উপস্থিত হলো।

মারীদার বিজয়ী লোকেরা! ইউগেলিস তার ঘোড়ার রেকাবে পা রেখে দাঁড়িয়ে অতি উঁচু আওয়াজে বললো, তোমাদের সবাইকে স্বাধীনতার উষ্ণ শুভেচ্ছা। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার মারীদার আমীর ও এবং সুলতানও। বাদশাহও। তোমাদের বাদশাহ এখন তোমাদরে মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন…।

মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল জব্বার জিন্দাবাদ!

 ঈসা মাসীহ জিন্দাবাদ!

 উন্দলুস আমাদেরই দেশ!

এখানে মুসলমানদের কোন স্থান নেই।

 পৃথিবীর কোথাও মুসলমানদের জায়গা নেই।

 পুরো পৃথিবী খ্রিষ্টানদের।

হাজার হাজার মানুষের এ ধরণের বিভিন্ন স্লোগানে মারীদার যমীন ও আসমান কেঁপে কেঁপে উঠছে। খ্রিষ্টান মেয়েরাও এই বিজয় উৎসবে যোগ দিয়েছে।

একটু পর দেখা গেলো, নারী-পুরুষ এখানে একাকার হয়ে গেছে। তারপর শুরু হলো অশ্লীলতা আর নির্লজ্জ প্রদর্শনী। যেন ওখানে কোন মানুষ নেই। সব চতুষ্পদ জন্তু। যাদের কখনো লাজ-শরম বলতে কোন কিছু ছিল না।

***

বন্ধুরা! নানা চিৎকার চেঁচামেচি অশ্রাব্য শব্দের ভেতর থেকে ইউগেলিসের কণ্ঠ শোনা গেলো। সবাই ধীরে ধীরে নীরব হয়ে গেলো। ইউগেলিস বললো,

আমীর মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার প্রমাণ করে দিয়েছেন ধর্ম কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তিনি তোমাদেরকে স্বাধীনতা উপহার দেয়ার জন্য নিজের হুকুমত ও ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন…।

আজ তোমরা মারীদা জয় করেছে। একদিন তোমরা কর্ডোভাও দখল করে নেবে। উন্দলুস তোমাদের কাছে অনেক বড় কুরবানী চাচ্ছে।

এসময় এক ঘেড় সাওয়ার ছুটতে ছুটতে ভিড় চিড়ে সেখানে এসে দাঁড়ালো, যেখানে তিন নেতা দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়সওয়ারের চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। তিন নেতা ঘোড়সাওয়ারের কথা শুনলো। কথা শেষ হলে ইউগেলিস আরেকবার ঘোড়ার রেকাবিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে উঁচু আওয়াজে বলতে লাগলো,

মারীদার বীর বাহাদুররা! তোমাদের পরীক্ষা দেয়ার সময় এসে গেছে। এই মাত্র খবর এসেছে, আমীরে উন্দলুসের ফৌজ এদিকে ধেয়ে আসছে। শহরের ফটকগুলো ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও। সাহসী লড়াকুরা অধিক সংখ্যায় শহরের প্রাচীরে গিয়ে উঠো। শত্রুপক্ষ কাছে আসলেই তীর বৃষ্টি শুরু করে দেবে।

আকাশ ফাটানো শ্লোগান আর মেঘ গর্জনের আঘাত হেনে দুশমনকে বরণ করে নেবে। কর্ডোভার সৈন্যরা প্রাচীরের কাছে ঘেষলে ওপর থেকে বর্শা মেরে মেরে ওদেরকে শেষ করে দেবে। অবরোধ দীর্ঘ হয়ে গেলেও ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এই শহরে খাবার দাবারসহ অন্যান্য রসদ পত্রের কমতি নেই।

ইউগেলিসের কথা শেষ হলে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার গর্জে উঠলেন,

মারীদার সিংহরা! বিজয় অবশেষে তোমাদেরই হবে। তবে মনে রেখো, তোমাদের মোকাবেলা হবে এক অভিজ্ঞ সেনাদলের সঙ্গে। আব্দুর রহমানের ফৌজ কেল্লা জয় করতে জানে।

তোমরা কেবল শ্লোগানের উন্মত্ততা দিয়ে এই ফৌজকে পরাজিত করতে পারবে না। তবুও ওরা যতই শক্তিশালী হোক ওদেরকে পরাজিত করা খুব কঠিন কাজ নয়; যদি তোমরা জমিয়ে নির্ভয়ে লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারো। তবে হামলার সময় কিন্তু তোমরা হুলুস্থুল বাঁধিয়ে বসো না।

যেদিক থেকেই দুশমন আসবে সেদিকেই তোমরা তীর বৃষ্টি শুরু করে দিবে। মনে রেখো, এটাই তোমাদের শেষ সুযোগ। কর্ডোভার ফৌজ যদি একবার কেল্লার ভেতরে আসতে পারে তাহলে তোমাদের যে কী পরিমাণ হবে সেটা তোমরা এখন চিন্তাও করতে পারবে না।….

এ ফৌজ তো এক সময় আমারই ফৌজ ছিলো। তাই আমি ভালো করেই জানি, এই ফৌজ যখন দুশমনের ওপর চড়াও হয় তখন একজন সিপাহীর মনেও সামান্যতম করুণা থাকে না। হিংস্র প্রাণী হয়ে উঠে। কেল্লায় ওরা ঢুকতে পারলে তোমাদের পাইকারী ধরে হত্যা ছাড়া আর কিছুই হবে না।…

শুধু কি তাই, তোমাদের স্ত্রী-কন্যারা কর্ডোভার সিপাহীদের তাবুতে চলে যাবে বিনামূল্যে পাওয়া পণ্যের মতো। যে স্বাধীনতা তোমরা পেয়েছো এর মূল্য বুঝার চেষ্টা করো। এই স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব তোমাদেরই।

লোকদের জোশ-জযবা, লড়াইয়ের স্পৃহা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বারের বক্তৃতায়। শ্লোগানে শ্লোগানে তারা চারদিক মুখরিত করে তুললো।

মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর জব্বার, ইউগেলিস ও ইলওয়ার দক্ষ লড়াকু ও যোদ্ধাদের বেছে বেছে আলাদা করে লড়াই ও লড়াই পরিচালনার স্কিম বানাতে শুরু করলো।

***

সালার আব্দুর রউফ ও সালার মুসা ইবনে মুসার সেনা ব্যটালিয়ান ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। তিন দিনের দূরত্ব তারা দুই দিনেই অতিক্রম করে।

আব্দুর রহমান তার নিজের কিছু সেনা ব্যাটালিয়ান নিজের সঙ্গে রেখে পথেই এক জায়গায় সাময়িক তাবু ফেললেন এবং কয়েক ব্যাটালিয়ান সৈন্যসহ উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহকে মারীদার দিকে এগিয়ে যেতে বললেন।

আপনার নিশ্চয় জানা আছে উবাইদুল্লাহ! আব্দুর রহমান বললেন, ঐ লুটেরা বিদ্রোহীদের আসল মাথা ফ্রান্সের শাহ লুই। আমি আমার সেনা ইউনিট নিয়ে ফ্রান্স ও মারীদার পথে ঘাপটি মেরে থাকবো। মারীদা অবরোধ করলে ফ্রান্সের ফৌজ অবরোধ ভাঙ্গতে পেছন থেকে এসে আমাদের ওপর হামলা চালাতে পারে। আর এমন ঘটলে ফ্রান্সীরা যেন পথেই কচু কাটা হয় এখানে থেকে আমি সে ব্যবস্থা করবো।

কিন্তু ফ্রান্সের ফৌজ যদি এসেই পড়ে তাহলে আপনার সামান্য এই সেনাদল সম্ভত: ওদেরকে রুখতে পারবে না; উবাইদুল্লাহ বললেন, সে ক্ষেত্রে আমাদের কাছে সেনা সাহায্য চেয়ে পাঠাবেন।

মুসলমান সবসময় সংখ্যায় কমই ছিলো উবাইদুল্লাহ! আব্দুর রহমান আত্মবিশ্বাসের সুরে বললেন, আর সবসময় সংখ্যায় স্বল্পই থাকবে মুসলমানরা। আমার এই সামান্য ফৌজই ফ্রাসীদের রুখে দেবে।

তবে আমরা সম্মুখ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে না। ছোট ছোট দলে ফৌজকে ভাগ করে ওদের ওপর গেরিলা হামলা চালিয়ে যাবো। এই এলাকাতেই চোর পুলিশ খেলার মতো ফ্রান্সীদের সঙ্গে আমরা খেলে যাবো এবং এখানে ওদেরকে আটকে রাখবো। আপনি এগিয়ে যান উবাইদুল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।

এটাই ছিলো উন্দলুসের আমীর আব্দুর রহমানের আসল রূপ। তিনি এই দেশের বাদশাহ। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে এসে হয়ে গেলেন লড়াকু সিপাহী।

তার এই সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিকরা দারূণ দূরদর্শী এক সিদ্ধান্ত বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু সঙ্গীতের মাতাল করা সুর আর নারীর উন্মত্তরূপ তাকে এমনভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়াতে সবসময় মুখিয়ে থাকতো যে, তার এই অমিত সংগ্রামী পুরুষটি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়তো। বাস্তব এই দুনিয়া থেকে তিনি পরাবাস্তব এক দুনিয়ায় হারিয়ে যেতেন।

মারীদায় কর্ডোভার অনুগত যে সামান্য ফৌজ ছিলো ওরা তা বিদ্রোহীদের হাতে প্রথমেই বন্দি হয়ে পড়ে। তবে একজন কমান্ডার তখনই পালাতে সক্ষম হয়। কমান্ডার খ্রিষ্টান এক প্রহরীকে খতম করে তার পালানোর পথ সহজ করে নেয়। বিদ্রোহীরা এজন্য অন্য বন্দি ফৌজদের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যায় এবং তাদের প্রহরা আরো নিচ্ছিদ্র করে রাখে।

এই কমান্ডারই মারীদা বিদ্রোহীদের দখলে চলে যাওয়ার খবর কর্ডোভায় নিয়ে যায়। এরই ভিত্তিতে কর্ডোভার ফৌজ জরুরি ভিত্তিতে রণ প্রস্তুতি নিয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়ে।

যেদিন মারীদায় খবর পৌঁছলো, কর্ডোভার ফৌজ আসছে সেদিন তো শহর জুড়ে দারুণ অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়লো। বিদ্রোহীদের এক কমান্ডার বন্দি ফৌজের কাছে এলো এক প্রস্তাব নিয়ে।

আগামী কাল নাগাদ কর্ডোভার ফৌজ মারীদা অবরোধ করে নিবে। বিদ্রোহী দলের কমান্ডার বন্দি মুসলিম সিপাহীদেরকে বললো, তবে আমরা কোন মূল্যেই এই অবরোধকে সফল হতে দেবো না। যদি অবরোধ কোন কারণে সফল হতে থাকে এবং কর্ডোভার ফৌজ শহরে ঢুকে পড়ার আশংকা দেখা দেয় তাহলে তোমাদেরকে সবার আগে আমরা শেষ করে দেবো।….

তবে এক শর্তে তোমরা তোমাদের প্রাণ বাঁচাতে পারো। সেটা হলো, আমাদের সঙ্গে তোমরা হাত মেলাও এবং অবরোধ ব্যর্থ করার ক্ষেত্রে তোমরা ভূমিকা রাখো। কর্ডোভার ফৌজ অবরোধ উঠিয়ে চলে গেলে তোমরা মুক্ত হয়ে যাবে। তখন যেখানে ইচ্ছা তোমরা চলে যেতে পারবে।

আসলে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ যোদ্ধার দরকার। তাই ওরা এই প্রস্তাব দিয়ে একটা চাল চাললো।

বন্দীদের মধ্যে মাত্র চারজন সেই কমান্ডারের প্রস্তাবে রাজি হলো। এর মধ্যে একজন আবী রায়হান। সে গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার ছিলো। বাকি তিনজন দক্ষ সিপাহী। অন্যান্য বন্দিরা আবী রায়হান ওদের সেঙ্গ হাত মেলানোতে খুবই বিস্মিত হলো। বিশেষ করে আবি রায়হানের ব্যাপারে। কারণ, বরাবরই আবী রায়হান কর্ডোভার দারুণ অনুগত এক কমান্ডার এবং দায়িত্বশীল মুসলমান।

আবী রায়হান তার তিন সিপাহীকে নিয়ে বিদ্রোহী কমান্ডারের সাথে চলে গেলো। অন্যান্য বন্দি সিপাহীরা ওদেরকে খুব তিরস্কার করলো। গাদ্দার, বেঈমান, মুনাফিক, হারামখোর কাপুরুষ ইত্যাদি যা মুখ দিয়ে আসলো তাই বললো। কিন্তু কোন কিছুই ওদেরকে ফিরিয়ে রাখতে পারলো না।

***

বিদ্রোহী কমান্ডার আগে আগে চলছে। আর তার পেছনে যাচ্ছে এই চারজন। যখন ওরা একটা গলির মোড় ঘুরলো আবী রায়হান ইচ্ছে করেই একটু পেছনে রয়ে গেলো। কমান্ডার সামনে এগিয়ে গেলো। আবী রায়হান পেছন ফিরে একটু হেঁটে অন্য গলিতে ঢুকে পড়লো।

বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর বিদ্রোহী কমান্ডার টের পেলো, ওদের চারজনের একজন গায়েব। কিন্তু ততক্ষণে আবী রায়হান বেশ দূরে চলে গেছে।

সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ক্রমেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। পুরো শহরে খবর ছড়িয়ে পড়েছে কর্ডোভার ফৌজ আসছে। শহরের প্রত্যেকেই তাই নিজের নিরাপত্তা চিন্তায় নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। আবী রায়হানের মতো সাধারণ এক বন্দি লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার খবর এখন কে রাখতে যাবে।

মারীদা বিশাল এক শহর। শহর প্রাচীরের ভেতর বেশ কিছু এলাকা এবড়ো খেবড়ো খানাখন্দ ও খাল বিলে ভরা। এগুলোর মধ্যে শহরের বাইরে বয়ে যাওয়া এক নদীর পানির প্রবাহ রয়েছে। বাইরের নদী ও ভেতরের এই গভীর খানাখন্দ শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরো সুরক্ষা দিয়েছে।

এই খন্দাখন্দ এলাকায় প্রাচীন কালের বেশ কিছু দালান কোঠার ধ্বংস্তূপ রয়েছে এর ব্যাপারে বেশ ভীতপ্রদ নানা কাহিনী এই শহরে প্রচলিত রয়েছে। তাই ওখানে কেউ যাওয়ার সাহস করে না। এখানে ঝোঁপঝাড় ও বড় বড় গাছের এলো মেলো এক জঙ্গলও আছে।

আবী রায়হান তার বন্দি সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেলো না। সে কেল্লা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। কিন্তু কর্ডোভার ফৌজ আসার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শহরের ফটকগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফটকগুলোর আশেপাশে কঠোর প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

শহরের কোথাও তো আবী রায়হানের ঠিকানা হওয়ার কথা নয়। তাই সে ঐ পরিত্যক্ত এলাকার দিকে রুখ করলো। সূর্যাস্তের পর ওখানে গিয়ে পৌঁছলো আবী রায়হান। হাঁটতে হাঁটতে সে পোড়া বাড়ি ঘরের ধ্বংস্তূপের ভেতরে চলে গেলো।

তখনই তার মনে পড়লো, এ জায়গা তো ভৌতিক এলাকা হিসাবে পরিচিত। কোন কিছু থেকে থাকলে তো ওকে ছাড়বে না। তারপর আবার শীতের প্রচণ্ডতা রয়েছে এখানে। রাত যত গম্ভীর হবে শীতের প্রকোপও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে।

চার দিকেই মৃত্যুর বিভিষিকা আর অশরীর নাচ দেখতে পেলো আবী রায়হান। তার বেঁচে থাকার একমাত্র পথ হলো, বিদ্রোহী কমান্ডারের কাছে চলে যাওয়া। তারপর ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের ফৌজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে পড়া। কিন্তু এটা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

শীত ওকে বেশ ভোগাতে শুরু করলো। সে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলো, সে ধ্বংস্তূপের ছাদের কিছু অংশ অখন্ড রয়ে গেছে; সে ধ্বংস্তপের এক জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিলো।

***

আল্লাহর নাম আর পবিত্র কুরআনের আয়াতের অবিরাম উচ্চারণ তার মুখে। সব ভরসা তার আল্লাহর ওপর। অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতার হচ্ছে। চার দিকে যমধরা নির্জনতা। অশরীরি কোন কিছুর অস্তিত্ব এখনো সে টের পায়নি।

শীতে এখন সে রীতিমতো ঠক ঠক করে কাঁপছে। বড় বড় পাতায় ভরা এক বৃক্ষের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো আবী রায়হান। এ সময় শুনলো আবী রায়হান একটা আওয়াজ।

যেন কোন শিশু কাঁদছে। আরো কান পেতে শুনলো। হ্যাঁ, কোন শিশুই কাঁদছে। এখানে কোত্থেকে বাচ্চা আসবে? এ নিশ্চয় কোন প্রেতাত্মার নাকি কান্না। আবী রায়হান বুঝলো, এখন শুধু কোথাও লুকানো বা শীতের থাবা থেকেই বাঁচাই নয়, এই শহর থেকে বের হওয়াই সবচেয়ে বড় কাজ।

একটা রাস্তা তার জানা আছে। সে সেনা কমান্ডার। এই শহরে সে বহুদিন ধরে আছে। তাই সে জানে, শহর প্রাচীরটি বেশ মজবুত হলেও নিশ্চয় কোথাও কোন দুর্বল জায়গা আছে কিনা। সে জানে, শহরের ড্রেনেজ পানি ও বৃষ্টির পানি এই বড় নালা দিয়ে শহর প্রাচীরের নিচ দিয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে।

সে ভেবে দেখলো, এই নালা দিয়ে শহরে থেকে বেরোনো যাবে কিনা। নালা এত চওড়াও নয়।

প্রাচীন ভৌতিক ধ্বংসাবশেষ। প্রেতাত্মার নাকি কান্না। বিভিন্ন ভৌতিক শব্দ তার শরীরের শক্তি অর্ধেক শুষে নিয়েছে।

আবী রায়হান কুরআন শরীফের একটি আয়াত উঁচু আওয়াজে পড়তে পড়তে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে একটা সরু গলি দিয়ে ঢুকে পড়লো। দুই কামরার মাঝখান দিয়ে এটি একটি রাস্তা। এর ওপর ছাদও আছে। তবে সামনের দিকে ছাদের এক অংশ ধ্বসে পড়ে আছে।

তার কাছে মনে হলো, ওপর থেকে কেউ যেন জোরে শিষ দিচ্ছে কিংবা নিঃশ্বাস ফেলছে।

প্রেতাত্মার উপস্থিতিতি যেন সে টের পেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো, পা ঘেষটে ঘেষটে তার পেছন পেছন কে যেন আসছে। সে নিশ্চিত হয়ে গেলো তার পেছন পেছন কেউ একজন আসছে। জনহীন বিরাণ ভূমিতে ভূত-প্রেত আর মৃত আত্মা ছাড়া এখানে আর কে আসতে পারে।

আবী রায়হান পেছন ফিরে তাকালো না। দ্রুত পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেলো। রাস্তার বাম দিকে মোড় নিলো। বাম দিকে সে মোড় নিয়ে এত ভেতরে চলে গেলো যে, বাইরের আওয়াজ এখন আর ভেতর আসছে না। এতক্ষণে তার অস্থিরতা কিছুটা কমলো।

পোড়া বাড়ি থেকে আচমকা একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। স্পষ্ট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। নাকি কোন সুর নেই এই আওয়াজে। বাচ্চা এক নাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। আবী রায়হান পেছনে যে ফিরে যাবে সে সাহসও পাচ্ছে না। কারণ, পেছনে আবার কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আচমকা থেমে গেলো। কোন নারীর চাপা কণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেলো। কোন ধরনের চেষ্টা ছাড়াই তার ভেতর একটা পরিবর্তন এসে গেলো। মৃত্যু অবধারিত সে এটা জেনে গেছে। তাই তার ভয়-ডর সব চলে গেছে। সে এখন নিঃশংক।

তবে তার হাত দুটি খালি। লুটেরা বিদ্রোহীরা তার ও তার সঙ্গীদের সব অস্ত্র শস্ত্র এমনকি ছোট ছোট খঞ্জর আর চাকু গুলিও নিয়ে নিয়েছে। সে নিজেকে বললো, এই ভূত-প্রেত বা অশরিবী যেই আসুক আমার কিছুই করতে পারবে না। নিজেকে আবার বললো,

এই বেটা! আমি কোন চোর ডাকাত নই। আল্লাহর সিপাহী। আল্লাহর নামে লড়াই করি। কাফেরদের কয়েদ থেকে পালিয়ে এসেছি। এখন ওদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবো। ওদের সামনে আত্মসম্পণ করবো না। প্রাণ গেলেও না।

প্রেতাত্মাকেও সে আল্লাহর কোন সৃষ্টি বলে জানে। তাই তার আশা আল্লাহ তাআলা তার এক নগণ্য সিপাহীকে ওদরে হাত থেকে বাঁচাবেন।

বাচ্চার কান্নার আওয়াজ সে আরেকবার শুনতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে এক পুরুষালী কণ্ঠও শোনা গেলো। পরিস্কার আরবী ভাষায় কথা বলছে লোকটি।

ওকে দুধপান করাও, না হয় গলা টিপে দাও।

 তারপর এক নারীর কণ্ঠ শোনা গেলো। এও আরবী ভাষায় কথা বলছে।

আহা! আস্তে কথা বলো। বাইরে যেন আওয়াজ না যায়।

 আবী রায়হান একে জীবিত কোন মানুষের কণ্ঠ বলে মনে করছে না।

***

তবুও আবী রায়হান পা টিপে টিপে সামনে এগিয়ে গেলো। আলোর হালকা রেখা যেন ওকে ধোকা দিলো। নাকি এখানে কোথাও প্রদীপ জ্বলছে।

আবী রায়হান ধীর কদমে সামনে এগিয়ে গেলো। সে এখন ভয়ংকর ও রহস্যময় কোন প্রাণীর মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলো।

আবী রায়হান একটু সামনে এগোলো। তখনই তার পেছন থেকে আওয়াজ ভেসে এলো,

এখানেই দাঁড়াও। এক পাও এগোবে না। কে তুমি?

সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার বা খঞ্জরের ফলা তার পিঠে এসে লাগলো। আবী রায়হান জায়গা থেকে নড়লো না। স্থির হয়ে রইলো।

কে তুমি? আবী রায়হান আরবীতে প্রশ্নের জবাবে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে প্রাণে মারার আগে আমার কথা শুনে নাও। আমি মারীদার মুসলিম ফৌজের একজন কমান্ডার। আমাদের সবাইকে নিরস্ত্র করে কয়েদ করা হয়েছিলো। আমি পালিয়ে এসেছি। তারপর থেকে কেল্লা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এসময় তার সামনে একটা প্রদীপ ধরা হাত ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। যে প্রদীপ ধরে রেখেছে তার অন্য হাতে তলোয়ার। এ লোকটিও জিজ্ঞেস করলো,

কে এসেছে এখানে?

আমার নাম আবী রায়হান। আমি মারীদার ফৌজের কমান্ডার।

তোমরা কি মৃত আত্মা না জীবিত মানুষ? আবী রায়হান সংশয়ের সুরে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা যাই হওনা কেন আমাকে সব খুলে বলল। তোমরা যদি প্রেতাত্মাও হও তবুও তোমরা আরবী। আরবদের মৃত আত্মা মন্দ হতে পারে না। তোমরা অবশ্যই কোন ভালো মানুষের আত্মা।

তাই তোমরা আমাকে সাহায্য করো। আমাকে কেল্লা থেকে বের হতে সাহায্য করো। আমি আমার ফৌজকে নিয়ে কেল্লায় ঢুকবো এবং ঐ লুটেরাদের কাছ থেকে মারীদা আবার ফিরিয়ে নেবো।

সামনে চলো।

***

কামরাটি একটি গুহার মত। ভেতরে দুটি প্রদীপ জ্বলছে। এখানে বার তেরজন যুবতী মেয়ে এবং তিন চারজন মহিলা বসে আছে। এরাও প্রায় যুবতী। এক মহিলা এক বাচ্চাকে দুধ পান করাচ্ছে। পুরুষ দুজনই মাত্র এখানে। যারা আবী রায়হানকে এখানে নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া পুরুষ বলতে একজন বৃদ্ধ রয়েছে।

ওদেরকে দেখে নাও। একজন আবী রায়হানকে বললো, এরা আমাদের মুসলমানদের মেয়ে। মারীদার আধিবাসী আরবদের কন্যা ওরা। ওদের কারো বাবা, মা, কারো ভাই, কারো মা-চাচা কারো বোন শহীদ হয়েছে লুটেরাদের হাতে। আমাদের কিছু মেয়ে তো লুটেরাদের হাতে বন্দি। এদেরকে বড় কষ্টে উদ্ধার করে এনে এখানে লুকিয়েছি।

কার পাপের শাস্তি আমরা ভোগ করছি? বৃদ্ধ আরব বললেন, এখানে বেঈমান নও মুসলিম আর খ্রিষ্টানরা বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার মারীদা দখলের পায়তারা করছেন। অথচ কর্ডোভার কোন খবর নেই। ওরা এখানে একটি ফৌজও বাড়ায়নি। আর আমীরে মারীদা কোন মরণ ঘুম ঘুমিয়েছিলেন কে জানে! এত বড় ঝড় যে তার চারপাশে বয়ে যাচ্ছে সেদিকেও তিনি চোখ রাখতে পারলেন না।

এসব কথা বলার সময় এখন নয়। আবী রায়হান বললো, বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তোমরা সম্ভবত: খুব একটা জানো না।

না, এক লোক বললো, বাইরের অবস্থা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। তোমরা হয়তো জানো। কতদিন হয়ে গেলো। আমরা এভাবে পোকা-মাকড়ের মতো এখানে বসবাস করছি। এই মেয়েগুলো তো আমাদের জন্য অনেক বড় পরীক্ষা। ওদের ইজ্জত আবরু রক্ষা করে আমরা এখান থেকে বেরোতে চাই।

আমি এ শহর থেকে একাই বেরোতে চেষ্টা করছিলাম। আবী রায়হান বললো, কিন্তু এই মেয়েগুলো এখন আমার জন্যও অনেক বড় ব্যাপার। ওদেরকে না নিয়ে আমি এখান থেকে যাবো না। আমি সর্বাবস্থায় তোমাদের সঙ্গ দেবো।

আর এই পরিত্যক্ত দালান-কোঠার বাইরের খবর হলো, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার মারীদার বাদশাহ বনে গেছেন। খ্রিষ্টানরা তার আনুগত্য মেনে নিয়েছে। খ্রিষ্টানদের বড় দুই নেতা ইউগেলিস ও ইলওয়ারই তার সবেচেয় বড় শক্তি। আজকের সর্বশেষ খবর হলো, কর্ডোভার ফৌজ মারীদার দিকে এগিয়ে আসছে। তারপর তারা মারীদা অবরোধ করবে।

শহরের ছোট ছোট শিশুরাও লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। অবস্থা এমন থাকলে সম্ভবত: অবরোধও সফল হবে না। এক বিদ্রোহী কমান্ডার এসে আমাদেরকে বললো, ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কর্ডোভার ফৌজকে পরাজিত করতে পারলে আমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে। আর যারা হাত না মেলাবে তাদেরকে হত্যা করে দেয়া হবে।……

এই প্রস্তাবে মাত্র তিনজন রাজি হলো। অন্যরা অস্বীকার করলো। আর চতুর্থ বক্তি আমি। আমি এ উদ্দেশ্যে ওদের সঙ্গ দিয়েছি যে, আমি পালানোর কোন একটা উপায় বের করে নেবো। তা আমি বের করে পালাতেও পেরেছি। তারপর এখানে লুকাতে এসে তোমাদের সঙ্গে দেখা। তোমাদেরকে আমি মৃত আত্মা মনে করছিলাম।

এখন তো আমরা প্রেতাত্মা হওয়ার মতো অবস্থাতেই পৌঁছে গেছি। বৃদ্ধ বললেন, বাদশাহদের পাপের শাস্তি আমরা এখন ভোগ করছি।

মুহতারাম! বৃদ্ধের কথার জবাবে বললো আবী রায়হান, এটা আপনাদের নিজেদের কৃত কর্মের শাস্তি। এদেশে যত আরব মুসলমান আছে তারা নিজেদেরকে এখানকার খ্রিষ্টানদের বাদশাহ মনে করে আসছে। খ্রিষ্টানদের সাথে আপনাদের আচার-ব্যবহার এতই অবহেলার যে, ওদেরকে আপনারা কেবল ঘৃণা আর লাঞ্চনাই দিয়ে এসেছেন।….

আপনারা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়াকেই ইসলামের চূড়ান্ত মনে করেন আর বলেন, আপনারা আল্লাহর নিকটবর্তী বান্দা বনে গেছেন। যারা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আল্লাহর বান্দাদেরকে ভালোবাসে তাদেরই আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন। এটাই ইসলামের আসল বৈশিষ্ট্য। আপনারা ইসলামের এই অমোঘ বৈশিষ্ট্যকে আস্তকুঁড়ে ছুঁড়ে মেরেছেন। নও মুসলিমদের সঙ্গে আরবের মুসলমানদের ব্যবহার কখনো ইসলাম সম্মত ছিলো না।

আরবের মুসলমানদের মধ্যে এই বোধ কখনো জন্মালো না যে, জনগণের আবেগ চেতনা নিয়ে যখন শাসক শ্রেণীর লোকেরা খেলায় মেতে উঠে তখন একদিন না একদিন জনগণ আগুনের অঙ্গার হয়ে জ্বলে উঠে। সেই আগুনেই পড়েছেন আপনারা। আপনাদের নিজেদের হাতে তৈরি করা জাহান্নামেই আপনারা জ্বলছেন।

আল্লাহর দরবারে দুআ করুন। আমাদের ফৌজ যেন এসে মারীদা অবরোধ করে নেয়। তবে আমার মনে হয় না আমাদের ফৌজ এত তাড়াতাড়ি শহরে ঢুকতে পারবে। কারণ, শহরের সবাই ওদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।

তবে ভেতর থেকে দরজা বা শহরের ফটক খুলে দেয়ার মতো সুযোগ পাওয়া গেলে অন্যরকম চিত্র দাঁড়াতে পারে। আমার তো আশংকা হচ্ছে, বিদ্রোহীরা আমাদের বন্দি সিপাহীদেরকেও কতল করে দিতে পারে।

***

যে কোন কুরবানীর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। দুই জনের একজন আবী রায়হানকে বললো, ভেতর থেকে ফটক খোলার কিংবা তোমার সিপাহীদেরকে কোন ধরণের সাহায্য করার পথ বের করতে পারবে না তুমি? তুমি তো অভিজ্ঞ সৈনিক। কমান্ডারও। অনেক কিছুই তো জানো তুমি।

আমি শুধু সাধারণ সৈনিকের ট্রেনিং নিইনি, গেরিলা সৈনিকও আমি। আবী রায়হান বললো। কিন্তু আমাদেরকে এই মেয়েদেরও হেফাজতের চিন্তা করতে হবে। এরা না হলে অবশ্য এখনই কাজে নেমে পড়া যেতো।

আমরা মেয়ে বলে তো আমাদের শরীর মোমের তৈরি নয়; এক ঘোড়ষী মেয়ে বললো, তোমরা আমাদেরকে সিপাহীদের মতো লড়াতে চাইলে আমরা তোমাদেরকে হতাশ করবো না।

আমরা পালিয়ে এখানে এজন্য লুকিয়ে বসে আছি যে, দুশমনের সংখ্যা পঙ্গপালের মতো। এধরনেরই আরেকটি মেয়ে বললো, লড়াই যদি পৃথক পৃথক হয় তাহলে কাবার রবের শপথ! আমরা পালানোর কথা মোটেও চিন্তা করবো না। আমরা বীর লড়াকু মুসলমানদের মেয়ে। কমান্ডার! তুমি কোন পরিকল্পনা ভেবে দেখো। আমাদের সৈনিক মনে করো। আমাদের ইযযত আবরুর কথা চিন্তা করো না।

এখন তোমরা এখানেই থাকো। আবী রায়হান বললো, খবর সঠিক হলে আজ রাতেই মারীদা অবরোধ হওয়ার কথা। আমাকে ভাবতে দাও। তোমাদের কাছে অস্ত্র-শস্ত্র কী আছে?

এখন আমরা এখানেই থাকবো। আর আমাদের কাছে আছে চারটি বর্শা, নয়টি তলোয়ার, কয়েকটি খঞ্জর, তিনটি ধনুক এবং অনেকগুলো তীর আছে। কেউ একজন জবাবে বললো

এতো বলতে গেলে মাশাআল্লাহ অনেক। রায়হান খুশি হয়ে বললো। খ্রিষ্টানরা নিজেদের মেয়েদেরকে মাটির নিচ দিয়ে, রাতে দুশমনের শয়নগৃহে এবং তাদের রূপ যৌবনকে চরম অস্ত্র বানিয়ে ব্যবহার করে। কিন্তু আমি ত করবো না। আমরা মুসলমান। আমি তোমাদেরকে সিপাহী বানিয়েই লড়াই করব। এটাই ইসলামের শান-অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য।

খ্রিষ্টানদের মেয়েরা যেমন করে মুসলিম মেয়েরা দুশমনের সামনে তেমন করে নেচে গেয়ে, অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গি করে দুশমনকে জাদুমুগ্ধ করে না। তারা তলোয়ারের ঝলক আর নির্ভীকতা দিয়ে দুশমনকে কুপোকাত করে দেয়। তৈরি থেকো আমার প্রিয় বোনেরা! আর কয়েকদিন অভুক্ত থাকার জন্যও প্রস্তুতি নিয়ে রাখো।

***

সে রাতেই মারীদা অবরোধ হয়ে গেলো। মারীদার লোকেরা এরাতে মুহূর্তের জন্যও দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।

সূর্যাস্তের পর থেকেই খবর আসতে থাকে কর্ডোবার ফৌজ শহরের কাছাকাছি চলে এসেছে। তখন থেকেই লোকেরা যার যার ঘরে খাদ্য সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জমা করতে থাকে। যাতে শহরে খাদ্য সংকট দেখা না দেয়।

শহরের চারটি প্রধান ফটকই ভেতর থেকে সিলগালা করে বন্ধ করে দেয়া হলো। অস্ত্র ধরতে জানে এমন প্রত্যেকেই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলো। প্রত্যেকেই তীরে পূর্ণ তিন চারটি করে তুনীর নিজের সঙ্গে রাখলো।

শহরের প্রাচীরের ওপর বড় বড় পাথরের অনেকগুলো স্তূপ রাখা হলো। অনেক জ্বালানি কাষ্ঠও সুপিকৃত করে রাখা হলো।

কর্ডোভার সিপাহীরা শহর প্রাচীরের কাছে ঘেষলে অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে জ্বলন্ত লাকড়িও তাদের ওপর ছোঁড়া হবে। যদি সিঁড়ি বা ঝুলন্ত রশি লাগিয়ে প্রাচীর বেয়ে ওপরের উঠার চেষ্টা করা হয় তাহলে জ্বলন্ত আঙ্গারসহ ফুটন্তপানি ছিটানোরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

প্রতিটি ফটকের চারপাশে অসংখ্য লোক তীর ও বর্শা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেলো ফটক ভেঙ্গে হামলা চালালে হামলাকারীরা যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে। শহরের প্রাচীর থেকে অবরোধকারীদেরকে দূরে হটিয়ে রাখার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে।

মারীদার সামান্য দূরে থাকতেই সালার আবদুর রহউফের ইউনিটের দেখা পেয়ে যান সিপাহসারার উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ। সালার আব্দুর রউফের সেনা ইউনিটগুলোর নেতৃত্বও তিনি নিয়ে নিলেন।

উবাইদুল্লাহ সেনা ইউনিটগুলোকে পূণর্বিন্যাস করে প্রয়োজনীয় কিছু সৈন্যকে সাধারণ কৃষকের বেশে আগেই মারীদার দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মারীদার বিদ্রোহী বাহিনী যদি শহরের বাইরে এসে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয় তাহলে ওরা এসে সিপাহসালারকে সেটা জানাবে।

কিন্তু উবাইদুল্লাহর কাছে খবর আসতে থাকে শহরের বাইরে দুশমনের ফৌজের নাম নিশানাও নেই।

বন্ধুরা আমার। উবাইদুল্লাহ তার সালারদের বললেন, মারীদার লুটেরা বিদ্রোহীদের মধ্যে যদি রণ কৌশলের সামান্যতম ধারণা থাকতো তাহলে ওরা শহর থেকে বেশ দূরে থাকতেই আমাদেরকে বাঁধা দিতো এবং এ লড়াই দীর্ঘ করতে বাধ্য করতো। এমন তো নয় যে, আমাদের ফৌজ আসার খবর ওরা জানে না। ওরা শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এতই মজবুত করে নিয়েছে যে, অবরুদ্ধ হয়ে লড়াই করতেই ওরা বেশি নিরাপদ মনে করছে।

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ তার ফৌজকে আরো বিস্তীর্ণ করে দিলেন। সম্মুখভাগের ইউনিটগুলোকে দারুণ শক্তিশালী রাখলেন। যাতে কোথাও গুপ্তঘাতক থাকলে সমুচিত জবাব দিতে পারে। কিন্তু যতই তারা এগিয়ে যেতে লাগলো গুপ্তঘাতক বা অযাচিত লড়ায়ের সম্ভাবনা বা আশংকা কমে আসতে লাগলো।

যতই রাত বাড়তে লাগলো শীতও তত তীব্র হতে লাগলো। এর মধ্যেই সেনারা তাদের চলার গতি অব্যাহত রাখলো। অবশেষে মারীদার প্রাচীরের ওপর জ্বলন্ত মশালের আলো ছায়া দেখা যেতে লাগলো।

উবাইদুল্লাহ সালার আব্দুর রউফকে হুকুম দিলেন, তিনি তার ইউনিটকে আরো দ্রুত যেন চলার হুকুম দেন এবং মারীদা শহর অবরোধের আওতায় নিয়ে নেন। আর ওযীর হাজিব আব্দুল করীমকে বললেন, তিনি যেন তার ইউনিটগুলোকে অবরোধকারীদের পেছনে নিয়ে পজিশনে দাঁড় করিয়ে দেন।

রাতের প্রথম প্রহরে মারীদার প্রাচীরের ওপর থেকে শোর গোল উঠলো,

দুশমন এসে গেছে, শহর অবরোধ হয়ে গেছে, আমরা এখন এ শহরে অবরুদ্ধ, খবরদার! হুশিয়ার!!

তখনই প্রাচীরের ওপর থেকে কর্ডোভার ফৌজের ওপর তীর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু ফৌজ তীরের নাগালের অনেক বাইরে। অসংখ্য তীর বৃথাই ছোঁড়া হতে লাগলো। সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ উঁচু আওয়াজে ঘোষণা করলেন,

আমরা মারীদার বিদ্রোহীদের ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ দিচ্ছি। শহরের দরজা খুলে দাও। আমরা তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবো। কাউকে গ্রেফতার করা হবে না।

সাহস থাকলে সাহস দেখাও মুসলমানের বাচ্চারা। প্রাচীরের ওপর থেকে জবাব এলো, এগিয়ে এসে পারলে দরজা খুলে নাও।

কর্ডোভার এক কমান্ডার প্রধান ফটকের একেবারে কাছে চলে গেলো। কমান্ডার মারীদার বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যে বললো,

আমীরে উন্দলুস এই অবরোধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যদি অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পন না করো তাহলে….

কমান্ডার এতটুকু বলতেই চার-পাঁচটি তীর দেহে বিদ্ধ হয়ে গেলো।

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ যখন দেখলেন বিদ্রোহীরা কোনোভাবেই আত্মসমর্পন করবে না। তিনি হুকুম দিলেন, ফটকগুলোর ওপর হামলা চালাও। কিন্তু বিদ্রোহীরা প্রাচীরের ওপর থেকে জ্বলন্ত কাঠ আর আগুনের অঙ্গার ফেলতে শুরু করলো। প্রথম হামলায় যারা গেলো তারা আগুনে জ্বলতে জ্বলতে ফিরে এলো।

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ শহরের আভ্যন্তরীণ অবস্থান সম্পর্কে জানেন। তিনি দুটি বড় মিনজানীক প্রস্তুত করলেন। তারপর শহরের ভেতর পাথর নিক্ষেপের হুকুম দিলেন।

***

প্রাচীরের ওপর এত বেশি শোরগোল যে, সে আওয়াজ শহরের প্রাচীন ধ্বংস স্তূপে লুকানো লোকেরাও শুনতে পাচ্ছে।

আবী রায়হান একটি বর্শা ও একটি তলোয়ার নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লো। সে দেখতে চাচ্ছে ফটকগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি আছে কিনা। এখন আর তার ধরা পড়ার আশংকা নেই। চার দিকেই সবাই ব্যতিব্যস্ত। লোকজন ছুটোছুটি করছে হন্যে হয়ে। কে কার পাশ দিয়ে যাচ্ছে সেদিকে তাকানোর ফুরসত নেই কারো। কেউ কাউকে কখন জিজ্ঞেস করবে তুমি কে এবং কোথায় যাচ্ছো।

আবী রায়হান চোখমুখ চাদরে ঢেকে এই ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলো। প্রত্যেকটি ফটকের কাছে গিয়ে দেখলো। শত শত প্রহরী ফটকগুলোর চারপাশে পজিশন নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে। ভেতর থেকে কোন ফটকই ভোলা সম্ভব নয় এবং কোনটার ফাঁক গলেও বাইরে যাওয়া অসম্ভব।

আবী রায়হান দেখলো, একদল সশস্ত্র বিদ্রোহী শ্লোগান দিতে দিতে প্রাচীরের দিকে যাচ্ছে। সেও কর্ডোভার ফৌজের বিরুদ্ধে ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে এবং মুসলমানদেরকে গালিগালাজ করতে করতে প্রাচীরের দিকে চলে গেলো।

সেখানে শহরবাসীদের ভিড়ের চাপ এত বেশি যে, দাঁড়ানোর মতো জায়গা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়লো। এখানে ভিড় করা সশস্ত্র লোকদের অধিকাংশই বাইরে কর্ডোভার ফৌজি শিবিরের দিকে তীর ছুড়ছে।

এ সময় অবরোধকারীদের দিক থেকে মিনজানীক দিয়ে ছোঁড়া একটি ভাড়ী পাথর প্রাচীরের ওপরে এসে পড়লো। পুরো প্রাচীর থর থর করে কেঁপে উঠলো। দশ বারজন প্রাচীর থেকে তখনই খসে পড়লো নিচের দিকে। দুতিনজন প্রাচীরের ওপরেই পাথরের আঘাতে চিরা-প্যপ্টা হয়ে মারা পড়লো।

আবী রায়হান খুশি হলেও নিজে কিছুই করতে পারেনি বলে হতাশ হয়ে ওখান থেকে চলে এলো।

***

আবী রায়হান আবার প্রাচীন ধ্বংস গাঁথায় ফিরে এলো। ওখানে যারা লুকিয়ে আছে ওদেরকে জানালো, রাতের অন্ধকারে বাইরের অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নি।

তবে যে করেই হোক আমার ফৌজের জন্য আমি যে কোন একটি ফটক খোলার চেষ্টা চালাবোই। এতে জানের বাজি লাগাতে হলেও লাগাবো। আবী রায়হান বললো।

তোমার সঙ্গে আমরাও জানের বাজি লাগাতে চাই। ওদের একজন বললো।

হ্যাঁ, আমরাও পিছিয়ে থাকবো না। মেয়েরা সমস্বরে বলে উঠলো।

বন্ধুরা! সুযোগ এলে তোমরা অবশ্যই তোমাদের বীরত্ব প্রতিভা দেখাতে পারবে। কিন্তু এখনই এর প্রয়োজন পড়বে না। আবী রায়হান বললো।

সকাল হতেই আবী রায়হান বেরিয়ে পড়লো। ওর চেহারা কাপড়ে ঢেকে নিলো। প্রাচীরের ওপর গিয়ে চড়লো। নিজের ফৌজকে এবার ভালো করে দেখতে পেলো। শহরবাসীদের শস্যক্ষেত ও ফল বাগান বেশির ভাগই শহরের বাইরে। এগুলো এখন কর্ডোভার ফৌজের দখলে।

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ হুকুম দিলেন। ক্ষেতের সব ফসলগুলো কেটে ফেলল। বাগানগুলোও পরিস্কার করে দাও। হাজারো তলোয়ার পাকা আধাপাকা ফসলগুলোর ওপর উঠানামা করতে লাগলো। এগুলো ঘোড়ার দানাপানি হিসাবে ব্যবহার করার জন্য একত্রিত করা হতে লাগলো। বিভিন্ন ফলের বৃক্ষও কুড়াল দিয়ে কাটা হতে লাগলো।

আবী রায়হান লক্ষ্য করলো, কর্ডোভার ফৌজের সিপাহীরা প্রাচীরে রশিযুক্ত আংটা প্রাচীর গাত্রে গাঁথার জন্য এগিয়ে আসছে। তাদের পেছনে তীরন্দারা পজিশন নিচ্ছে। যাতে প্রাচীরের ওপরের দুশমনরা এদের তীরান্দাযীর কারণে মথা তুলতে না পারে। এবং প্রাচীর সুড়ঙ্গকারীরা অক্ষত অবস্থায় প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

কিন্তু বিদোহীরা দারুণ নির্ভীকতার সঙ্গে এর মোকাবেলা করছে। কর্ডোভার ফৌজ চারো ফটকের ওপর হামলা করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি ফটকের ওপরই বুরুজ রয়েছে। যেখন থেকে নিক্ষেপিত তীর আর বর্শা হামলাকারীদেরকে রক্তাক্ত করে পিছু হটিয়ে দিচ্ছে।

আবী রায়হান প্রাচীর থেকে নেমে এলো। তার মাথায় নতুন একটি চিন্তা এলো। এখন সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে কাগজ কলম দরকার। সে একটি বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় টোকা দিলো। এক মহিলা দরজা খুলে দিলো। সশস্ত্র লোক দেখে মহিলা বুঝলো, এ লোক সিপাহী ছাড়া অন্য কেউ নয়।

এই যে আপা! তিন চারটি কাগজ, কলম, আর কালি দরকার। এক কমান্ডার পাঠিয়েছেন। তাড়াতাড়ি করুন। আবী রায়হান জরুরি গলায় বললো।

ওখানে তো লোকজন নিজেদের রক্ত পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। মহিলা দ্রুত কাগজ, কলম, কালি নিয়ে এলো।

আর কিছু কি লাগবে ভাই? মহিলা জিজ্ঞেস করলো ব্যাকুল হয়ে।

না, ধন্যবাদ।

আবী রায়হান সেগুলো নিয়ে বহুপথ ঘুরে প্রাচীন ধ্বংস গাথায় চলে গেলো। ওখানে যারা আছে এর মধ্যে বেশ কয়েকজন মেয়ে শিক্ষিত এবং হাতের লেখাও বেশ পরিস্কার ও গুছানো। তাদেরকে দিয়ে তিনটি কাগজের ওপর একই কথা লেখালো। লেখা ছিলো এরকম,

দক্ষিণমুখী ফটকের কাছ থেকে সব ফৌজ সরিয়ে নিন। অধিক সৈন্য প্রধান ফটকের আশে পাশে মোতায়েন করুন। এতে বিদ্রোহীরা দক্ষিণমুখী ফটক থেকে তাদের সব মনোযোগ হটিয়ে প্রধান ফটকের ওপর নিবদ্ধ করবে। রাতে আমরা দক্ষিণ প্রান্তরের ফটক খোলার চেষ্টা করবো।

লেখার নিচে রায়হান নিজের নাম লেখলো এবং পদবীও উল্লেখ করলো।

লিখিত কাগজ তিনটি ভাঁজ করে প্রত্যেকটি তীরের মধ্যে সুতা দিয়ে বেঁধে দেয়া হলো। প্রত্যেকটি তীরের সঙ্গে একটা করে কাপড় বেঁধে দেয়া হলো। যার অর্থ হলো, এই তীরের সঙ্গে বিশেষ পয়গাম রয়েছে।

আবী রায়হান তীর তিনটি তুনীরে ভরে ধনুক নিয়ে পোড়া এলাকা থেকে বেরিয়ে এলো। সেখান থেকে এমনভাবে বেরিয়ে এলো যে, সতর্ক চোখও তাকে দেখতে পেলো না।

***

রায়হান প্রাচীরের ওপর উঠে গেলো। সে দেখলো, অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে যারা লড়ছে তারা মূলত শহরবাসী। নিয়মিত ফৌজের সিপাহী নয়। তাদেরকে সরাসরি কমান্ড করার মতো কেউ নেই। আর না ওদের আছে কারো কমান্ড মেনে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা। সেও ওদের দলের অংশ হয়ে গেলো।

রায়হান প্রাচীরের দক্ষিণ দিকে গেলো এবং লিখিত কাগজ বাঁধা একটা তীর বের করলো। ওর ধনুকটি বেশ মজবুত। ধনুকটি এমনভাবে টেনে ধরলো, যাতে তীর অনেক দূর পর্যন্ত ছুটে যায়। ধনুক যতটুকু টানার টেনে তীর ছুঁড়ে দিলো।

এই তীর সেসব তীরের মিছিলে যোগ দিলো যেগুলো বিদ্রোহীরা ওপর থেকে ছুঁড়ে মারছে। আবু রায়হান তার ছোঁড়া তীরটির দিকে তাকিয়ে রইলো। তীরটি কার্ডোভার ফৌজি ছাউনির প্রায় মাঝখানে গিয়ে পড়লো।

রায়হান ওখান থেকে সরে প্রাচীরের ওপর দিয় হেঁটে হেঁটে একটু দূরে গিয়ে দ্বিতীয় তীরটি ছুড়লো। এভাবে আরেকটু দূরে গিয়ে লিখিত পয়গাম বাঁধা তৃতীয় তীরটি ছুড়লো।

কর্ডোভার এক সিপাহীর সামনে একটি তীর গিয় পড়লো। এর মধ্যে কাগজ বাধা দেখে সিপাহীর কৌতূহল হলো। সে এটি তুলে তার ইউনিট কমান্ডারকে দিলো। কমান্ডার সুতোয় বাঁধা কাগজটি সুতোমুক্ত করে ভাজ খুলে পয়গামটি পড়লো।

পয়গামটি পড়ে সালার আব্দুর রউফের কাছে নিয়ে গেলো। আব্দুর রউফ সেটি সিপাহসালার উবাইদুল্লাহর কাছে নিয়ে গেলেন।

এটা থোকাও হতে পারে। উবাইদুল্লাহ এটি দেখে বললেন।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আব্দুর রউফ বললেন, একটি থোকা তো এই হতে পারে যে, আমরা দক্ষিণ দিকের ফটকের সামনে থেকে সৈন্য সরিয়ে নিলে বিদ্রোহীরা সেই দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে আমাদের ওপর হামলা করতে পারে। আর এমন ঘটলেও কোন অসুবিধা নেই। কারণ, এ থেকেও আমাদের যথেষ্ট ফায়দা উঠাতে পারি। বিদ্রোহীরা বাইরে এলেও ওদেরকে আমরা ভেতরে আর যেতে দেবো না। সেই ফটক দিয়ে আমরাই ভেতরে ঢুকে পড়বো।

আরেকটি থোকা এই হতে পারে যে, ফটক খোলা দেখে আমরা যখন ভেতরে ঢুকবো তখন হতে পারে, চারপাশ থেকে গুপ্ত ঘাতকরা আচমকা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। উবাইদুল্লাহ বললেন।

আমরা ভেতরে ঢোকার পর কীসের সম্মুখীন হতে হবে সেটা ভাবনার বিষয় নয়। আব্দুর রউফ বললেন, যে করেই হোক আমাদের যে কোন একটি ফটক খোলা চাই। তখন আমার পূর্ণ এক ইউনিট সেনা বাঁধ ভাঙ্গা জ্বলোচ্ছাসের মতো ভেতরে ঢুকে পড়বে। তখন গুপ্ত ঘাতকরা এমনিতেই ভেসে যাবে। ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে।

সিদ্ধান্ত হলো ঝুঁকিই নেয়া হবে।

***

সূর্যাস্ত হচ্ছে। এ সময় রায়হান প্রাচীরের ওপর থেকে দেখলো, দক্ষিণমুখী ফটকের সামনে থেকে কর্ডোভার মোতয়েনকৃত ফৌজ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। যেন অবরোধ উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে।

ওদিকে প্রধান ফটক ও পশ্চিম প্রান্তের ফটকের ওপর অবিরাম হামলা চালানো হচ্ছে। প্রাচীরের ওপর তীরান্দাযদের বিশাল ভিড় লেগে আছে। এরাও ওই ফটকগুলোর আশে পাশে গিয়ে ভিড় করতে লাগলো।

এখানে অবস্থা বা পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন ঘটলে প্রাচীরের লড়াকুরা উঁচু আওয়াজে সেটার ঘোষণা করে দেয়। এবার তাদের একটি ঘোষণা শোনা গেলো,

দুশমন দক্ষিণ মুখী ফটক থেকে সরে গেছে। অন্যান্য ফটকগুলোর প্রতি সবাই মনোযোগ দাও। হুশিয়ার! সাবধান!

সূর্যাস্তের পর রায়হান প্রাচীন ধ্বংস গাঁথায় চলে গেলো।

আমার পয়গাম পৌঁছে গেছে। রায়হান সবাইকে জানালো, দক্ষিণের ফটক থেকে আমাদের ফৌজ সরে গেছে। তবে আমদের সালারের নজর এই ফটকের ওপর নিবদ্ধ থাকাবে। তাই আজ রাতেই ফটক খুলতে হবে। কিন্তু আমি যে পরিকল্পনা করেছি এর জন্য শুধু আমাদের এই তিনজন লোকই যথেষ্ট নয়। কম পক্ষে দশজন দরকার।

এই প্রয়োজন আমরা পূরণ করবো এক মেয়ে বললো। কমান্ডার! তুমি কি করতে চাও সেটা শুধু বলো।

হ্যাঁ, ওদেরকে নিয়ে যাও। এ ছাড়া উপায়ও নেই অবশ্য। বৃদ্ধ লোকটি বললেন।

তবে পুরষদের পোষাক পরে যেতে হবে ওদের। কারো সামান্যতম সন্দেহ হলেও এর যে কী পরিণতি হবে তা তো বুঝতেই পারছো তোমরা। রায়হান। বললো।

এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন যদি আমরা হই তাহলে আমরাও কাউকে কোনো সুযোগ দেবো না। প্রাণ বাজি রেখে লড়বো। তারপর প্রাণ দেবো। এক মেয়ে বললো।

আবী রায়হান তার পরিকল্পনার কথা ওদেরকে জানালো।

***

আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমান এখনো মারীদা থেকে বেশ দূরে। তাঁর সৈন্যদেরকে তিনি দূর দূরন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন। দ্রুতগামী পত্রদূতের মাধ্যমে সবার মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। এই বাহিনীর গেরিলা ইউনিটের সৈন্যরা প্রায় সারাক্ষণ ঘোড়ার ওপর সাওয়ার থেকে টহল দিয়ে যাচ্ছে।

ওদিকে সাধারণ কৃষকের পোষাকে কিছু অভিজ্ঞ সৈন্য দুশমনের চৌকি পর্যন্ত মোতায়েন রয়েছে।

আব্দুর রহমান যদিও এক জায়গায় তার অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার স্থাপন। করেছেন। কিন্তু তার অধিক সময়ই ঘোড়ার পিঠের ওপর কাটছে। প্রতিটি ইউনিটের কমান্ডারদের কাছে গিয়ে রিপোর্ট নিচ্ছেন। কিছু বলার থাকলে বলছেন। এটা ওটার নির্দেশ দিচ্ছেন। মুসাইবিনে মুসা ও ফারতুন এই দুই সালার সব সময় ছায়ার মতো তার সঙ্গে রয়েছেন।

অতন্দ্র-সজাগ এক সৈনিক বনে গেছেন এখন আব্দুর রহমান। যেন যুদ্ধের ময়দানেই তাঁর জন্ম এবং এই ময়দানেই তিনি প্রাণ নজরানা দিয়ে রেখেছেন। সঙ্গীতের মাদকীয় সূরে আর রূপ-যৌবনের অপার মোহে ডুবে থাকা আব্দুর রহমান এখানে এসে এমন সতর্ক আর স্বত:স্ফুর্ত যেন চিতা তার শিকারের পেছন ধাওয়া করে যাচ্ছে।

তার আত্মিক শক্তি আর দুঃসাহসিক চেতনা এখন সতত জাগ্রত। তিনি যেন তার অজান্তেই মানবীয় স্বভাবের এই প্রকৃতিকে উন্মোচন করছেন যে, মানুষ যখন চাইবে, স্বংকল্প করবে তখন তার আত্মিক ও দৈহিক শক্তি জাগ্রত করে আকাশের বিদ্যুৎকেও হার মানাতে পারে।

ঐ লুটেরা কাফেরের দল যদি এই চেষ্টায় থাকে যে, আমাদেরকে এখান থেকে তাড়িয়ে দেবে তাহলে তারা দারুণভাবে হতাশ হবে। আবদুর রহমান একদিন রাতে তার দুই সালারকে বললেন, সালতানাতে ইসলামিয়া সংকুচিত হবে না; বরং সম্প্রসারিত হবে। ক্রমেই এর সমৃদ্ধিই ঘটবে। উন্দলুস শহীদদের আমানত। উলসের আবরু ইযযত ইসলামেরই সম্ভ্রম। নাপাক রক্ত থেকে এর মাটিকে আমরা পবিত্র রাখবো।

তাঁর দুই সালার তার এই জ্যবাদীপ্ত অবস্থায় একথা বলতে ইতস্ত করলেন যে, আপনি যারিয়াব ও সুলতানার মায়াজাল থেকে বেরিয়ে আসুন। তাঁদের আশংকা, যারিয়াব ও সুলতানার কথা শুনে যদি তিনি বলে উঠেন, যারিয়াব ও সুলতানাকে এখানেই ডেকে নিয়ে এসো।

ফ্রান্সের শাহেলুইকে আমাদের চিরতরে খতমকরে দিতে হবে। আবদুর রহমান অনঢ় সংকল্পের গলায় বললেন, ফেতনা আর ষড়যন্ত্র যেখান থেকে মাথাচাড়া দেবে সেখানে আল্লাহর বজ্ৰ হুংকার হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো।…..

মারীদার বিদ্রোহীদেরকে যখন হাতে পাবো। কারো প্রতিই করুণা করবো না। ইসলামের শত্রু ও মুসলমানদের ধ্বংসকামীদেরকে যদি ক্ষমা করে দিই তাহলে আল্লাহ তাআলা আমাকে এই দুনিয়ায় এবং আখেরাতেও এর সমুচিত। শাস্তি দেবেন।

কিন্তু আল্লাহর পথে তার দুশমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে আমি ফরজ বলে বিশ্বাস করি। আল্লাহর দুশমন কাফেররা অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পন করবে। জান ভিক্ষা চাইবে, বন্ধুত্বের জনস্য তোমাদের পায়ে মাথা ঠুকবে তবুও কখনো তাদেরকে বিশ্বাস করবে না।

কিন্তু আমীরে মুহতারাম! সালার ফারতুন বললেন, কুরআনের হুকুম হলো, দুশমন সন্ধির জন্য হাত বাড়ালে তোমরা সন্ধি করে নাও।

এটাও কুরআনের হুকুম যে, ওদের ওপর কখনো বিশ্বাস রাখবে না। আব্দুর রহমান বললেন, ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করার নির্দেশ দিয়েছে কুরআন। কারণ, ওরা ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি না করে ক্ষান্ত হয় না। ওদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করলে ওরা যখন দেখবে নিজেদের স্বার্থ হাসিল হয়ে গেছে ওরা তখন তোমাদেরকে না জানিয়েই চুক্তি ভেঙ্গে ফেলবে।….

তোমরা কী দেখতে পাচ্ছো না এরা আমাদেরকে নিয়ে যেমন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। মারীদার বিদ্রোহ তখন হয়েছে যখন ফ্রান্সের দিকে অভিযান চালাতে যাচ্ছিলাম। এরা ফ্রান্সকে আমাদের হামলা থেকে বাঁচানোর জন্য মারীদার লোকজনকে ক্ষেপিয়ে বিদ্রোহ করিয়েছি।

আপনি কি জানেন! মারীদার বিদ্রোহের কল-কাঠি কে নেড়েছে? সালার মুসা ইবনে মুসা জিজ্ঞেস করলেন।

মারীদার বিদ্রোহ তো মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বারের হাত ধরে পুর্ণতা পেয়েছে। আব্দুর রহমান বললেন, তবে ওর পেছনে খুঁটি নাড়ছে খ্রিষ্টান নেতারা।

এদের একজন হলো ইউগেলিস আরেকজন ইলওয়ার। মুসা ইবনে মুসা বললেন।

ওদের দুজনকেই গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। মারীদা থেকে নতুন খবর আসছে না। তবে আমার বিশ্বাস উবাইদুল্লাহ ইনশাআল্লাহ খুব দ্রুতই শহরে ঢুকে পড়বে।

***

সালারে আলা উবাইদুল্লাহ যত দ্রুত সম্ভব শহরে ঢোকার জন্য সব চেষ্টার অতীত করে যাচ্ছেন। সৈন্যরা যে কোন মূল্যে প্রাচীরে সুড়ঙ্গ করতে শহীদ আর যখমী হচ্ছে। কিন্তু শহর প্রাচীরের ওপর থেকে বৃষ্টির মতো তীর আসছে। বর্শা, ভারী পাথর, জ্বলন্ত অঙ্গার, জ্বলন্ত কাঠখন্ডও তাদের ওপর ছুঁড়ে মারা হচ্ছে। কখনো কখনো মনে হচ্ছে, পাথরের প্রাচীর আগুনের পাহাড় হয়ে গেছে।

কমান্ডার ও সিপাহীদের অদম্য জোশ-জযবা আর অবিরাম হামলার দৃশ্য দেখে উবাইদুল্লাহ আশা করছিলেন কয়েক দিনের মধ্যেই তারা শহরে ঢুকে পড়তে পারবেন। তিনি সালার ও কমাণ্ডারদেরকে বলতেন, আমার সিপাহীরা ফটক ভাঙ্গতে না পারলেও বিদ্রোহী শহরবাসীর মনোবল ভেঙ্গে দেবে ঠিকই।

কর্ডোভার মিনজানীকও দুশমনের তেমন ক্ষতি করতে পারছে না। কারণ, মারীদার তীরান্দাজরা এমন উপযুক্ত জায়গায় মিনজানীক স্থাপন করতে দিচ্ছে না, যেখান থেকে মিনজানীক দ্বারা নিক্ষেপিত পাথর শহরের ভেতর গিয়ে পড়তে পারে।

শহরের ভেতর তো রায়হান তার সতীর্থ ফৌজের জন্য রাস্তা পরিস্কার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মেয়েরাও তার সঙ্গ দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে।

তাদের তো পুরুষালী পোষাকে যাওয়া ভীষণ জরুরি। কিন্তু ওখানে রায়হান ও বৃদ্ধ লোকটি ছাড়া মাত্র দুজন পুরুষ রয়েছে। তাদের পোষাক তো নিজেদের জন্যই দরকার। তলোয়ার, বর্শা ও খঞ্জর যথেষ্ট পরিমাণ না হলেও কাজ চলে যাওয়ার মতো আছে।

অগত্যা সবার কাছে যে পরিমাণ চাদর, অতিরিক্ত কাপড় ছিলো সেগুলো কাজে লাগিয়ে মেয়েদের মুখ, বুক, কাঁধ ইত্যাদি চাদরে ঢেকে নেয়া হলো। রাতের অন্ধকারও অবশ্য ওদের জন্য সবচেয়ে বড় পর্দা। অনেক বড় এক ঝুঁকিতে ওরা পা দিতে যাচ্ছে।

মাঝ রাতের কিছু আগে আবী রায়হান তাদের ভুতুড়ে আস্তানা থেকে বের হলো। তার সাথে রয়েছে দুজন পুরুষ ও দশটি মেয়ে। ওদের জন্য এখন দরকার শহরের ভেতরে হৈ-হুঁলুস্থল অবস্থার সৃষ্টি হওয়া।

ঘটনাক্রমে শহরের লোকজনের মধ্যে হুলস্থল বেঁধে গেছে। কারণ, কর্ডোভার ফৌজ মিনজানীক এখন এমন জায়গায় স্থাপন করতে পেরেছে যেখান থেকে নিক্ষেপিত পাথর প্রাচীর টপকে শহরের ভেতরে এসে পড়ছে।

কয়েকটি ভারি পাথর বাড়ি ঘরের ছাদে গিয়ে পড়লো। ভেতরের লোকজন বাবাগো-মাগো বাঁচাও বাঁচাও, বলে বেরিয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দিলো। এদেরকে দেখে শহরের লোকদের মধ্যেও হুল্লোড় লেগে গেলো। বাড়ি-ঘর দালান কোঠা থেকে লোকজন বেরিয়ে আসতে লাগলো। শহরময় হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেলো।

***

রায়হানের রুখ দক্ষিণ ফটকের দিকে। সে একটু এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গীদের এবং মেয়েদেরকে শেষবার বলে দিলো তাদের কী করতে হবে। কোথায় কোথায় সতর্ক থাকতে হবে।

এখন প্রত্যেকে এতটুকু দূরত্বে থেকে সামনে বাড়বে যেন একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোন সম্পর্ক নেই। আর হাঁটতে হবে প্রায় ছোটার মতো করে। কারণ, সবাই কিন্তু ছুটোছুটি করছে। ধীরপদে চললে লোকে সন্দেহ করতে পারে। আবু রায়হান তাদেরকে বলে দিলো।

দুক্ষিণমুখী ফটকের সামনে এসে গেলো ওরা। ওখানে চার পাঁচটি মশাল জ্বলছে। শহরে হুলুস্থুল আরো বেড়ে গেছে। ফটকের সামনে ও ডানে বামে কমপক্ষে পঞ্চাশজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ফটকের ওপর বুরুজে তীরন্দাজরা রয়েছে। তবে এখন ওদের মধ্যে বেশ টিলেটালা ভাব। কারণ, এদিক থেকে কর্ডোভার ফৌজ সরে গেছে।

আবী রায়হান তার গেরিলা দলটিকে অন্ধকারে লুকিয়ে রাখলো।

তারপর নিজে ফটকের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুট লাগালো। ওদের স্থানীয় ভাষা সে ভালোই জানে। তাদের ভাষায় বেশ ঘাবড়ে যাওয়া গলায় বললো, এখানে এতগুলো মানুষ কি করছে? এই ফটকের সামনে তো দুশমনের কোন ফৌজ নেই। আর ওদিকে প্রধান ফটক ভেঙ্গে ফেলছে দুশমনরা। মুসলমানদের তো ভেতরে ঢুকতে আর দেরি নেই। আমাকে শুধু এতটুকু বলে তোমাদের দিকে দৌড়ানো হয়েছে যে, ওদের সবাইকে প্রধান ফটকের দিকে নিয়ে এসো। বলা হয়েছে, এখানে চার পাঁচজন থাকলেই চলবে। বাকিরা সবাই ওদিকে চলে যাও… তাড়াতাড়ি এসো হতভাগারা! শহর তো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

ওরা নিজেরাই জরুরি ভিত্তিতে ফায়সালা করলো, কে কে ফটকের সামনে থাকবে। আর বাকিরা প্রধান ফটকের দিকে দৌড় লাগালো। দক্ষিণ ফটকে মাত্র চারজন লোক রইলো। বাকিরা এতক্ষণ বেশ দূরে চলে গেছে। আবু রায়হানও ওখান থেকে সরে এলো।

রায়হান ফিরলো তার নিজের লোকজন নিয়ে। এরা এই চারজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মেয়েরা তাদের তলোয়ার আর বর্শার আঘাতে ওদেরকে শেষ করে দিলো।

তারপর ওরা সবাই মিলে ফটকের এক দিক খুলে ফেললো।

আমি আমাদের ফৌজকে খবর দিতে যাচ্ছি। রায়হান বললো, সবাই তোমরা এই ফটকে থাকতো। কেউ এদিকে এসে ফটক বন্ধ করতে চাইলে যাতে তা না পারে।

ফটকের ওপরের বুরুজ থেকে তিন চারজন লোক নিচে নেমে এলো। সেখানে কয়েকটি মশাল জ্বলছে। ওরা দেখলো ফটক সামান্য খোলা। রায়হান তখনই বাইরে বের হচ্ছিলো। সেটাও ওরা দেখে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে দেখলো, ফটকের সামনে চারটি মানুষ তাজা রক্তে ডুবে আছে।

এক লোক রায়হানের দিকে বর্শা ছুঁড়ে মারলো। সেটা রায়হানের গায়ে গিয়ে বিদ্ধ হলো। মেয়েরা আর দেরি করলো না। মুহূর্তের মধ্যেই ওরা বুরুজ থেকে নেমে আসা লোকদেরকে খতম করে দিলো। ওদিকে আবু রায়হান শত চেষ্টা করেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। পড়ে গেলো।

তোমাদের একজন আমাদের ফৌজের কাছে যাও। রায়হান আহতগলায় বললো, সামনে গিয়ে ডান দিকে যাবে। সেখানে আমাদের ফৌজের লোকজনকে পাবে। ওদেরকে বলবে। দক্ষিনের ফটক খোলা হয়েছে।

দলের দুজন পুরুষের একজন দৌড়ে গেলো। দলের অন্যরা সবাই এদিক লুকিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলো। কেউ যদি এদিকে আসে তাকে ওরা সঙ্গে সঙ্গে খতম করে দেবে।

এক অদম্য জলোচ্ছাসের দৃশ্যধারণ করলো সেখানে। মানুষ ও ঘোড়ার সম্মিলিত ঝড় হয়ে দক্ষিণ ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। প্রাচীরের ওপর থেকে তীর বৃষ্টি হচ্ছে। এতে কর্ডোভার কয়েকজন ফৌজ ঘায়েলও হলো। কিন্তু এখন কোন তীর বা বর্শার আঘাত এই ফৌজকে রোখার জন্য যথেষ্ট নয়।

এরা নিয়মিত সৈন্য। লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা এদের অনেক দিনের। বড় কেল্লা এবং কেল্লা বেষ্টিত শহর জয় করার অভিজ্ঞতা রয়েছে এদের। প্রত্যেক সৈন্য জানে তাকে কি করতে হবে। প্রত্যেকেই কমান্ডারের নির্দেশ পালন করতে জানে।

পুরো এক ইউিনিট সেনা ভেতরে ঢুকে পড়লো। কিছু সৈন্য মশাল জ্বালিয়ে প্রাচীরের ওপর চলে গেলো। এবার বিদ্রোহী বাহিনীর তীরান্দাযরা কচুকাটা হতে লাগলো। ইতিমধ্যে যারা ভেতরে চলে এসেছে তারা আরেকটি ফটক খুলে দিয়েছে। এবার তো বিদ্রোহীরা জীবন-মৃত্যুকে তুচ্ছ করে লড়তে লাগলো।

আবিদীন নামে তদান্তিন এক ঐতিহাসিক ছিলেন। অনেক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকও তার লেখা বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আবিদীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক তথ্য উপস্থাপন করেন,

ধর্মদ্রোহী মুআল্লিদীনরা তো জানতো, ওরা বিদ্রোহের অনেক বড় অপরাধী। ওদের এই মারীদা ছাড়া তো অন্য কোন দেশ বা সালতানাত ছিলো না যে, পরায ঘটলে ওদের ওপর জিযিয়া-কর আরোপ করে ওদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে। ওরা তো খেলাফতের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করেছে।

ওরা খেলাফতের পবিত্র মসনদে কালিমা লিপ্ত করে অপমানিত করেছে। মুসলমানদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট চালিয়েছে। ওদের সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হলো, মুসলিম মেয়েদের ওপর ওরা হাত উঠিয়েছে।

ওদের ইযযত আবরুর ওপর ওরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এর ভয়াবহ শাস্তির কথা তো ওরা জানতো। এই শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য ওরা জানবাজি রেখে এমন বেপরোয়া হয়ে লড়তে লাগলো যে, কেল্লার ভেতরে আসা কর্ডোভার ফৌজের পা টলে উঠলো।

এ লড়াই ছড়িয়ে পড়লো শহরের অলিগলি থেকে নিয়ে বাড়ি ঘরের অন্দরমহল পর্যন্ত। দুদলেরই শ্লোগানে আকাশ বাতাস তখন মুখরিত। মুসলিম এক সালারের নির্দেশে এক শ্লোগান শোনা গেলো, কাউকে জীবিত রাখবে না। একজন বিদ্রোহী লুটেরাও জীবিত থাকতে পারবে না। সবগুলোকে শেষ করে দাও। অস্ত্রধারী কাউকে ক্ষমা করবে না।

সকাল হওয়ার পর দেখা গেলো শহরের প্রতিটি গলিতে রক্তের বন্যা বইছে। হাঁটতে গেলেই পা পিছলে যাচ্ছে।

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ শহরের দরজা খোলার খবর পেয়েই দ্রুতগতির এক পত্রদূত এই পয়গাম দিয়ে আমীরে উন্দলুসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন,

মুহতারাম আমীর! যেকোন ভাবেই হোক শহরের দক্ষিণ প্রান্তের ফটক খোলা গিয়েছে। আমরা শহরে ঢুকছি। ইতিমধ্যে দক্ষিণমুখী ফটক দিয়ে এক ইউনিট সেনা ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

উবাইদুল্লাহ শহরে ঢুকেই হুকুম দিলেন, সরকারি যত ভবন আছে এবং হাকিমদের ভবনের ওপর হামলা চালাও।

সঙ্গে সঙ্গে তিনি হুকুম দিলেন, এক গেরিলা দল এখনই গিয়ে শহরের অর্থ কোষাগারের দখল নাও। এক সালারকে তিনি এজন্য নির্দেশ দিলেন। আর তিনি নিজে তার মুহাফিজদল ও কিছু সৈন্য নিয়ে কয়েদখানায় চলে গেলেন।

সেখানে সামান্য কিছু লড়াই হলো। কয়েদ খানার প্রধান জেলারকে ধরে আনা হলো। তিনি হুকুম দিলেন, আমীরে মারীদাসহ যতজন মুসলমান কয়েদী আছে সবাইকে ছেড়ে দাও। জেলার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে সবাইকে কয়েদমুক্ত করে দিলো।

সিপাহলার দ্বিতীয় হুকুম দিলেন এবং সালার আব্দুর রউফও একই হুকুম দিলেন, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার, ইউগেলিস ও ইলওয়ারকে জীবিত গ্রেফতার করা হোক। কিন্তু বড় সমস্যা দেখা দিলো, ফৌজের কেউ এই তিনজনকে চিনে না। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বারকে কেবল দুএকজন সালার চিনেন।

তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য শহরের সব দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। সেখানে যথেষ্ট পরিমাণ প্রহরীও নিযুক্ত করা হলো। কিন্তু এটা কেউ দেখলো না, ততক্ষণে অনেক সময় চলে গেছে। যাদের শহর থেকে পালানোর তারা এতক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে।

***

 আবদুর রহমানের কাছে মারীদার খবর নিয়ে পত্রদূত পৌঁছতেই তিনি সালার মুসা ইবনে মুসা এবং সালার ফারতুনকে বললেন,

তোমরা যে পজিশনে তোমাদের সৈন্যদেরকে রেখেছে সেভাবেই রাখো। ফ্রান্সের ফৌজ নজরে পড়লে ওদেরকে সামনেও অগ্রসর হতে দেবে না এবং পিছপাও হতে দেবে না।

একথা বলে তিনি তার মুহাফিজ ইউনিট নিয়ে মারীদার রওয়ানা হয়ে গেলেন। তার দলের চলার গতি রাখলেন খুব দ্রুত। পরদিন দুপুর নাগাদ তিনি মারীদায় পৌঁছে গেলেন। শহরে তখনো লড়াই চলছে।

নিজেদের আমীরুল মুমিনীনকে দেখতেই চারদিক থেকে ঘোষিত হতে লাগলো,

আমীরে উন্দলু এসে গেছেন। আমীরুল মুমিনীন এসে গেছেন।

আব্দুর রহমানের ঝান্ডা দেখে ফৌজ আরো নতুন করে উজ্জিবীত হয়ে উঠলো। আব্দুর রহমান বিভিন্নত হুকুম দিতে শুরু করলেন। তিনি প্রথম হুকুম দিলেন, কাউকে যেন ক্ষমা করা না হয়।

সুর্যাস্তের সময় বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ করতে লাগলো। তারপর এদের সবাইকে এক ময়দানে জমা করা হলো। এত বেশি মশাল জ্বালানো হয়েছে যে, অন্ধকারের অস্তিত্ব যেন মিটে গেছে। আব্দুর রহমানের এক হুকুম মতে সৈন্যরা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে পুরুষদেরকে বের করে আনতে লাগলো।

মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার, ইউগেলিস এবং ইলওয়ারকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। পাদ্রীদেরকেও পাকড়াও করা হলো।

শহরের প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করা হলো, তারা কাদের প্ররোচনায় বিদ্রোহ করেছে? প্রত্যেকেই কারো না কারো নাম নিলো। এদের সবাইকে পাকড়াও করা হলো। এভাবে অসংখ্য লোককে গ্রেফতার করা হলো।

এই গ্রেফতার অভিযান দুদিন চলতে লাগলো। যার ওপরই সামান্য সন্দেহ হলো থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর শহরবাসীকে এক ময়দানে একত্রিত করে বলা হলো,

যদি বেঁচে থাকতে চাও তাহলে বিদ্রোহীদের নেতাদের নাম বলে দাও।

এভাবে বেশ কিছু লোককে পাকড়াও করা হলো। যারা মুসলিম মেয়েদেরকে আপহরণ করে ছিলো এবং মুসলমানদের শত শত ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলো তাদেরকে ভিন্ন এক জায়গায় একত্রিত করা হলো।

আব্দুর রহমান হুকুম দিলেন, এদের সবাইকে কতল করে দাও। তবে যে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার, ইউগেলিস ও ইলওয়ারকে সনাক্ত করতে পারবে তাকে প্রাণভিক্ষ দেয়া হবে। কিন্তু ওদের ব্যাপারে কারোই কিছু জানার কথা নয়।

পরে জানা যায়, এ তিনজন শহরের দরজা খুলতেই শহর থেকে বেরিয়ে যায়। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার লিজবন গিয়ে আশ্রয় নেয়। আর ওই দুজন অন্য কোথাও চলে যায়।

এ সময় আব্দুর রহমান জানতে পারেন, শহরের সর্বপ্রথম ফটক খুলে দেয় এই শহরেই বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি থাকা এক কমান্ডার আবু রায়হান। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর বিচক্ষণতা দিয়ে সে এক অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে তোলে এবং শহীদ হয়ে যায়। তার সঙ্গে বেশ কিছু মেয়েও এই অভিযানে অংশ নেয়।

আব্দুর রহমান আবু রায়হানের মা বাবা; স্ত্রী-সন্তানদেরকে কয়েক লক্ষ্য দিনার পুরস্কার দেন। আর ঐ মেয়েদেরকেও দুহাতভরে পুরস্কার দেন।

মারীদা এখন এক লাশের শহর। এ যেন এক পরিত্যক্ত শহর। পুরো শহরের পরিস্কার পরিচ্ছন্নের কাজ আব্দুর রহমান নিজ হাতে তদারকি করলেন। তারপর মারীদার পূর্বের গভর্ণর যাকে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল জব্বার কয়েদ করেছিলো তাকেই গভর্ণর নিযুক্ত করলেন।

***

কর্ডোভায় কয়েকদিন আগেই খরব পৌঁছে, আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমান অভিযান থেকে ফিরে আসছেন। চাটুকাররা তাদের তোষামোদী প্রতিভা দেখানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলো। মহলের সাজ-সজ্জা চলতে লাগলো।

যারিয়ার ও সুলতানা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের লোকেরা আগেই তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছে, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যে অভিযানে বের হয়েছিলেন আব্দুর রহমান সেটা তো বন্ধ করা গেছে। কিন্তু মারীদার বিদ্রোহ বিদ্রোহীদের রক্তেই ডুবে গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে এ সংবাদ এসেছে, যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে আব্দুর রহমান একেবারেই বদলে গেছেন। তার যেন মনেই নেই তিনি শাহে উন্দলুস এবং নিজেকে শাহে উন্দলুস বলতেন।

শাহী মহল সংলগ্ন বাগানের সুবেশী ফুলে ভরা এক সুরভিত কোনে সুলতানা মালিকায়ে তরূব ও মুদ্দাসিরা পায়চারী করছে। মুদ্দাসসিরাকে সুলতানা ডাকিয়ে এনেছে। মুদ্দাসসিরার সঙ্গে সুলতানা এমন ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠে কথা বলতে লাগলো যেটা আগে কখনো দেখা যায়নি।

না তিনি নিজে যাচ্ছিলেন না সালারদেরকে যাওয়ার হুকুম দিচ্ছিলেন। মুদ্দাসসিরা বললো, তিনি যদি সেনা অভিযানের হুকুম না দিতেন ফ্রান্স উন্দলুসের ওপর হামলা করে বসতো আর মারীদার বিদ্রোহীদেরকেও কাবু করা যেতো না।

তিনি মারা গেলে কি তুমি বিধবা হয়ে যেতে না। তোমার বাচ্চারা কি এতীম হয়ে যেতো না? সুলতানা জিজ্ঞেস করলো।

আল্লাহর পথে মুসলিম নারীরা নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে কুরবানী দিয়ে ও সন্তানদেরকে এতীম করতে পিছপা হয় না কখনো। মুদ্দাসসিরা বললো, ইসলামের ইযযত আবরু সব সময় আমাদের কাছে এই ত্যাগ তিতিক্ষা দাবী করে থাকে।

শহীদের স্ত্রী এ কথাটা শুনতে কি আপনি অপছন্দ করেন? শাহে উন্দলুসের ব্যাপারে আপনার এত মাথা ব্যথা কেন মালিকায়ে তরুব! তিনি শহীদ হয়ে গেলে তো আপনি পরবর্তী স্পেন শাসকের রক্ষিতা হয়ে যাবেন। তাই আপনার তো কোন সমস্যা নেই।

আমি শাহে উন্দলুসের রক্ষিতা নই। আমি তার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছি। আমি সিংহাসনের উত্তরাধিকারকে জন্ম দিতে যাচ্ছি। সুলতানা চ্যালেঞ্জের সুরে বললো।

***

উন্দলুসের মাটি এখনো এতো নাপাক হয়নি যে, এর শাসকবর্গের উত্তরাধিকার সে হবে যার মার তার বাবার সঙ্গে বিয়েই হয়নি। মুদ্দাসসিরা বললো, অবৈধ সন্তান উন্দলুসের আমীর হতে পারবে না। আর মনে রেখো মালিকায়ে তরুর! আমি শাহে উন্দলুসের হাতে তোমার মতো শরাবের পেয়ালা দেবো না; তলোয়ারই দেবো।

মুদ্দাসসিরা! সুলতানা তীক্ষ্মকণ্ঠে বললো, মন থেকে সব আত্ম তৃপ্তি দূর করে দাও। এসব আবেগী কথা বার্তা বন্ধ করো। আমি তোমার কাছে অনুরোধ করছি না। তোমাকে আমি বলছি। শাহে উন্দলুসের ওপর তোমার প্রভাব বিস্তার করা ছেড়ে দাও।

তোমার হুকুম আমি মানতে যাবো কেন? মুদ্দাসসিরা বললো, কোন পুরুষের রক্ষিতা তার স্ত্রীর ওপর হুকুম চালাতে পারে না। আমি বনু উমাইয়ার কন্যা। কারো রক্ষিতা নই।

মুদ্দাসসিরা আর ওখানে দেরি করলো না। তীব্ৰপায়ে হেঁটে ওখান থেকে বেরিয়ে গেলো। সুলতানার ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। বিড় বিড় করে বললো,

একদিন তোমাকে দেখিয়ে দেবো, হুকুম কোন রক্ষিতার চলবে না বৈধ স্ত্রীর?

মারীদার অলিগলি এখন রক্তের নদী হয়ে গেছে। যে ময়দানে বিদ্রোহীদেরকে হত্যা করা হয়েছে সেটা এখন রক্তের বিল।

মারীদার কেল্লা জয় করতে ও বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রনে আনতে অসংখ্য মুজাহিদ শহীদ হয়েছে। আহত মুজাহিদের সংখ্যাও কম নয়। আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমান শহীদদের দাফন করে আহত ও গাজী মুজাহিদদের নিয়ে এখন কর্ডোভার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করবেন।

কর্ডোভার লোকেরা তাদের আমীর ও মুজাহিদদেরকে বরণ করে নেয়ার জন্য প্রস্তুত। শাহী প্রসাদও তার আমীরকে যথাযযাগ্য মর্যাদায় বরণ করে নেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।

ইতিহাসের অন্যতম সঙ্গীতজ্ঞ যারিয়াব তার কামরায় তারই নিজের সংস্কার করা গিটার নিয়ে বসে আছে। হৃদয়স্পর্শী এক গান গাইছে যারিয়ার। এই গানের গীতিকার সে নিজেই। হৃদয়ের অতি গভীর থেকে তার গানের শব্দগাঁথা বের হচ্ছে। তার গানের সুর মাধুরী থেকে যেন এক রূপসী প্রতিম দরজায় উদয় হলো।

আমীরে উন্দলুস কর্ডোভায় নেই। সুলতানা তাই এখন তার প্রকৃত রূপ নিয়ে এক প্রকার রূপের শাসন জারি করেছে।

যারিয়াবের গানের জাদুকরী সুর লহরী সুলতানাকে দরজার চৌকাঠে যেন বন্দি করে ফেললো। যারিয়াব যেমন স্বপ্নের রঙ্গমহলে বসে গেয়ে যাচ্ছে। সুলতানাও সেই স্বপ্নের সহযাত্রী। এই স্বপ্ন থেকে না সে নিজে, জাগতে চাচ্ছে, না যারিয়াবকে জাগাতে চাচ্ছে। সে জানে, যারিয়ারের সামনে গেলে তার স্বপ্ন ও মুগ্ধতার ভূবন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

যারিয়াব গেয়ে যাচ্ছে। তার গানের কথায় যে নারীর রূপের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে সেটা কোন বেহেশতী হুরের বর্ণনাই হতে পারে। গানের প্রতিটি শব্দ সুলতানার অস্তিত্বের অনুপরমানুতে গিয়ে তরঙ্গ তুলছে। সুলতানা নিজেকে নিজে বলতে লাগলো,

এতো আমার কথাই বলছে। আমি ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। এতে আমার রূপ ও আমার ভালোবাসার বেদনা বিধুর বর্ণনা দিচ্ছে। এতে আমাকে কল্পনা করে আমারই অদৃশ্য প্রতিমূর্তির পূজা করছে।

সুলতানার রূপ কারো সঙ্গেই তুলনীয় নয়। কোটির মধ্যেও এমন রূপসী মেয়ে পাওয়ার দুস্কর। তবে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি সুন্দরী বলে নিশ্চয় কোন মেয়ে এককভাবে দাবী করতে যাবে না। কিন্তু সুলতানা নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে বলে মনে করতো।

সুলতানা আবার মনে মনে বললো,

একি আমার ভালোবাসার কথাই বলছে? অন্য কেউ তো নয়? তার সুর মুছনা আর গানের কথাগুলো তো আমার রূপেরই অনুবাদ করছে।

সুলতানার আরেকটি রাতের কথা মনে পড়লো। সে রাতে সুলতানাই যারিয়াকে তার জায়গীরে নিয়ে গিয়েছিলো। দুজনে মখমল ঘাসে অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিলো। চারদিক তখন ফুলের সৌরভে সুরভিত। যারিয়াব তাকে বললো,

তুমি আমার কাছে থাকলে তো আমার ব্যক্তিত্ববোধই যেন শেষ হয়ে যায়। আমি তোমার অস্তিত্বে হারিয়ে যাই।

যারিয়াব একথা সুলতানার বাহুধরে আলতো করে তার দিকে আকর্ষণ করে। সুলতানা তার কাছে না এসে দূরে সরে যায়।

আমি তৃষ্ণার্ত। দূরে সরে যেয়ো না। যারিয়াব তৃষ্ণায়পূর্ণ মাদক কণ্ঠে বললো।

ভালোবাসার আসল রহস্য তুমি মনে হয় বুঝোনি। তুমি কি এই না পাওয়ার তৃষ্ণায় দারুণ এক স্বাদ অনুভব করছো না? সুলতানা বলেছিলো।

মিলনের যে কি আনন্দ সেটা কী তুমি জানো না? যারিয়াব জিজ্ঞেস করেছিলো।

কিন্তু মিলনের ব্যকুল প্রতীক্ষায় যে আনন্দ সেটা মিলনে নেই। সুলতানা বলেছিলো।

একবার সে তার দীক্ষাগরু ইউগেলিসকে বলেছিলো, যারিয়াবের ব্যাপারে সে দুর্বল। যারিয়াবকে সে ভালোবাসতে চায়। ইউগেলিস সুলতানকে খ্রিষ্টানদের এক মায়াবী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার জন্য নির্বাচন করে এনেছে। যে অস্ত্র অতি সুক্ষ্মভাবে মুসলমানদের শিকড়ে ছুরি চালাবে। তাই ইউগেলিস তাকে বলে ছিলো,

সুলতানা! শোনো, প্রেম ভালোবাসা পাপ নয়, অপরাধও নয়। কিন্তু যারা নিজেদের আত্মর্যাদাবোধের ব্যাপারে সচেতন, ব্যক্তিত্বের উপলব্ধি যাদের সহজাত তারা নিজেদের উদ্দেশ্য, মিশন ও অমূল্য ব্যক্তিত্ববোধকে শুধু একজন মানুষের ভালোবাসায় বিসর্জন দিতে পারে না।

আমরা তো তোমাকে সাম্রাজ্ঞী বানাচ্ছি। তোমার মধ্যে আমি সম্রাজ্ঞীর মহানত্ব দেখেছি। কিন্তু সেই আসনের শীর্ষচূঢ়ায় পৌঁছতে হলে তোমাকে নাটকের মঞ্চ সাজাতে হবে। যারিয়াবের ওপর তোমার মায়াবী জাল বিস্তার করে রাখো। ওকে জাগতে দিয়ো না। ওকে তোমার রূপ আর রূপের প্রেমে উন্মাতাল হয়ে থাকতে দাও।

আজ রাতে যারিয়াব যখন নিজের সঙ্গীতের সুর মুছনায় নিজেই মন্ত্রমুগ্ধ। এই জাদুর তীব্রতা সুলতানাকেও দারুণভাবে স্পর্শ করেছে। সুলতানা তখন নিজের মধ্যে এক ব্যকুলতা অনুভব করলো। একবার ভাবলো, যারিয়ারকে সে আজই বলবে, তাকে সে ভালোবাসে। কিন্তু এতটুকু ভাবতেই সে এখান থেকে দৌড়ে পালানোর তাড়না অনুভব করলো।

সুলতানার মনে পড়লো, যারিয়াবকে তার প্রেমিক নয়; তার টোপ বানাতে হবে। তাকে সম্রাজ্ঞী হতে হবে। সে কুলুপতরার মতো অসংখ্য হৃদয়ের প্রেম, ভালোবাসাকে পায়ে পিষে, মানবতাকে আস্তকুঁড়ে নিক্ষেপ করে রূপের মায়ায় জড়ানো নিষ্ঠুরতার স্বপ্ন দেখতে লাগলো।

আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমানের ব্যাপারে তার মনে কোন ভাববেগ নেই। সে তো তার দেহ তাকে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার মনে আব্দুর রহমানের এতটুকু স্থান নেই।

যারিয়াকে সে তার স্বপ্নের ভূবণ থেকে বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছিলো না। কিন্তু যারিয়ারের সঙ্গে তার কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে।

পর দিন শাহে উন্দলুস যুদ্ধজয়ী সেনা দল নিয়ে আসবে। সুলতানা ও যারিয়াব মারীদার বিদ্রোহ উস্কে দিয়ে তো ফ্রান্সের ওপর হামলা রুখে দিয়েছিক্ষ্মলা; কিন্তু শাহে উন্দলুস তারপরও বিজয়ী বীর হিসেবে ফিরে আসছেন।

এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়াতে সুলতানার মধ্যে কোন হতাশা নেই। তারপরও সে পরাজয়ের তিক্ততা অনুভব করছে এ কারণে যে, শাহে আব্দুর রহমানের মধ্যে এখনো তলোয়ারের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে।

তাই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য সুলতানার যারিয়ারেব সাহায্যের প্রয়োজন।

***

পায়ের মৃদ শব্দে যারিয়াবের গান থেমে গেলো। সে পেছনে ফিরে দরজার দিকে তাকালো। সে যেন তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না।

তুমি কি বাস্তব না আমার কল্পনার কোন অপসরী? যারিয়াব সবিস্ময়ে ফিস ফিস করে বললো।

সুলতানা রিনঝিনিয়ে হেসে উঠলো। যারিয়ার ধীরে ধীরে উঠলো। সুলতানা কাছে এগিয়ে গেলো। যারিয়াব কম্পিত দুহাতে সুলতানার গাল স্পর্শ করলো। তারপর তার হাতে সুলতানার রেশম কোমল কয়েকটি চুল নিয়ে গভীর নিঃশ্বাসে কলো। তারপর সুলতানার উন্মুক্ত কাঁধে হাত রাখলো। সুলতানা কলকলিয়ে হেসে উঠলো।

যারিয়াব সুলতানার দুবাহু ধরে তাকে গালিচায় বসিয়ে দিলো। নিজে তার সামনে বসে পড়লো।

কখনো কখনো আমার নিজের সুর আর এই গিটারের আওয়াজ আমাকেও নিবিষ্ট করে ফেলে; যারিয়ার স্বগোতিক্তের মতো বললো, গিটারের তারের জলতরঙ্গ আমার কণ্ঠের বানী একাকার হয়ে তোমার অপরূপ রূপ ধারণ করে নিয়েছিলো। আর সেই কল্পনাকে তুমি এখন কাংখিত বাস্তবে রূপ দিলে।

সুলতানা হেসে উঠলো এবং বললো, আমি কি কালনাগিনী? যে বাঁশির করুণ সুরে এসে হাজির হয়?

তুমি কালনাগিনীই সুলতানা! যারিয়াব বললো, উন্দলুসের কালনাগিনী তুমি, তোমার বিষের মধ্যে রূপের মাধুরী আছে। আছে মাদকতা এবং তীব্র এক নেশা…

সুলতানা! আমি সেই মানুষ, যে শাহে উন্দলুস আব্দুর রহমানের মতো এমন বিজ্ঞ, নির্ভীক, বীর বাহাদুর শাসকের ওপর অনায়াসে প্রাধান্য বিস্তার করতে পেরেছি। তুমি তো দেখোই, বড় বড় আমীর, রঈস আমারই হাত ধরে শাহে উন্দলুসের কাছে যেতে পারে।

যে কোন ধরনের অনুরোধ, উপরোধ আমাকে দিয়েই করায়। কিন্তু তুমি যখন আমার সামনে আসো তখন মনে হয় তুমি যেন আমাকে কোথাও দংশন করেছে। আর আমার ওপর তোমার বিষের মাদকীয়তা চেপে বসেছে।…..

কিন্তু তোমার সুর-সঙ্গীতকে আমি দংশন করবো না, সুলতানা বললো, কিন্তু তুমি যা চাচ্ছো সেটা হলে তোমার এই অমূল্য সুর সঙ্গীতের মৃত্যু ঘটবে। তখন কিন্তু তোমার আওয়াজ শুনে উন্দলুসের নাগিনী আর ছুটে আসবে না। না তোমার আওয়াজ তাকে এতটুকু দুলাতে পারবে।

তারপর তুমি হয়তো এক নাগিনীকে পিঞ্জরায় বন্দি করে প্রাণহীন সুর সঙ্গীতের প্রতি তাকে আকর্ষণ করতে চেষ্টা করবে, আর নিজেকে নিজে এই ভেবে থোকা দেবে। যে, তোমার বেসুরো সঙ্গীতে এই নাগিনী বুঝি দুলে দুলে উঠছে।

সুলতানা তার মুখ যারিয়ারের একেবারে কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, আমার প্রিয়তমা যাররী! আমি তো তোমারই। তোমারই থাকবো। এসো, প্রেম ভালোবাসার জগত থেকে একটু বের হয়ে এই দুনিয়ার বাস্তবতার মুখোমুখি হও।

যারিয়ার সুলতানাকে তার প্রতি আরো আকর্ষিত করার জন্য ওর একেবারে কাছে চলে গেলো। এত কাছে যে, ওর বিক্ষিপ্ত রেশম কোমল চুলগুলো যারিয়াবের গাল স্পর্শ করতে লাগলো। সুলতানা বললো,

আমাদের স্বপ্নের ভূবনে এক কালো মেঘ কুন্ডলী পাকাচ্ছে।

আর সেই কালো মেঘটা হলো মুদ্দাসসিরা! যারিয়াব সুলতানার কথা পূর্ণ করলো। মুদ্দাসসিরাই শাহে উন্দলুসের বুকে তার মুজাহিদী সত্বাকে জাগিয়ে তুলেছে, তুমি তো এটাই বলতে চাচ্ছিলে!

তুমি যে দাবী করেছো, শাহে উন্দলুসের ওপর তুমি বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে। এটা তো মুদ্দাসসিরাই ভুল প্রমাণিত করে দিলো। আব্দুর রহমান আমাদের হাত থেকে ছুটে গেছে। সুলতানা বললো।

সুলতানা! যারিয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, কখনো মনে হয়, তোমার ভালোবাসা আমাকে অন্য কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে, যেদিকে আমার যাওয়ার কথা নয়, আমি তো সঙ্গীত জগতের বাদশাহ।

তুমি একজন গোলাম সুলতানা কিছুটা খোঁচা দিয়ে বললো। তুমি এক বাদশাহর গোলাম। ভুলে গেছো তুমি, হাকিম আর সালাররা তোমাকে এক দরবারী গায়ক ছাড়া আর কিছু বলে না? নিজেকে নিজে ধোকা দিয়ো না যিররী। আমি তোমাকে এক রাজ সিংহাসনে বসা অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। আর আমি এই স্বপ্ন নিয়ে নিজেকে তোমার পায়ে সোপর্দ করে দিচ্ছি। তুমি আমাকে তোমার সম্রাজ্ঞী বানাবে।

তুমি আমার হৃদয় রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। এসো, কাছে এসো। যারিয়াব মাদকীয় কণ্ঠে বললো।

দুজন তারপর এক নিষিদ্ধ জগতে হারিয়ে গেলো। শেষ মুহূর্তে সুলতানা ফিস ফিস করে বললো,

যাররী! মুদ্দাসসিরাকে আমাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দাও।

বেশ কিছুক্ষণ পর, দুজনে সিক্ত দেহে মুখোমুখি হয়ে কথা বলছে। ওদের মাঝখানে মদের সুরাহী।

কাউকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়ার চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দাও মালিকায়ে তরুব! যারিয়াব বললো, মুদ্দাসসিরাকে আমি আমার পক্ষে নিয়ে নেবো।

কিন্তু তুমি এটা কেন বলেছে যে, তুমি ভুল পথে যাচ্ছো? সুলতানা হেসে জিজ্ঞেস করলো।

আমি অনুভব করছি, আমার পথ এটা নয়। তুমি তো তোমার স্বপ্নের পথে যাচ্ছে, যে পথে তোমার প্রবৃত্তির প্রশান্তি আছে বলে মনে করো সেটাকেই তোমার গন্তব্য মনে করছে। আর আমাকেও তোমার প্রেম সে পথে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার পথ ভিন্ন কিছু। যারিয়াব কিছুটা গম্ভীর গলায় বললো।

তুমি অনেক জ্ঞানী এবং দূরদর্শীও। সুলতানা বললো, আমরা, দুজন মুসলমান। কিন্তু আমাদের সামনে যা ঘটছে তা থেকে আমাদের চোখ বন্ধ করে তো থাকতে পারি না। খ্রিষ্টানরা যে মিশন ও যে কঠিন সংকল্প নিয়ে জেগে উঠেছে এবং যে ত্যাগ ওরা দিয়ে যাচ্ছে এতে তো এটা পরিস্কার যে, ইসলামের ঝান্ডা আর বেশি দিন এখানে উড়বে না।……

তারপর কী হবে জানো? তুমি দরবারী গায়কদের মধ্যে একজন গায়ক হয়ে থাকবে। আর আমি ওদের কোন জেনারেলের রক্ষিতা হয়ে থাকবো। ইউগেলিস তো আমাকে সবকিছু বলেছে। তোমার প্রতি উনি দারুণ খুশি। তুমি মুসলমান আমীর উমারা ও অভিজাত শ্রেণীর সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে। ওদেরকে ইসলামের আসল চেতনা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে।…

সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন খ্রিষ্টানরাই এখানকার বাদশাহ বনে যাবে। তাহলে ওদের সঙ্গে আমরা কেন শত্রুতা সৃষ্টি করতে যাবো যে, আমাদের শুধু এটাই করতে হবে। শাহে উন্দলুসের চিন্তার জগৎটাকে আমাদের হাতের মুঠোয় রাখতে হবে। তিনি আগামীকাল আসছেন। মুদ্দাসসিরাকে বলল সে যেন তার কাছ থেকে দূরে থাকে। মুদ্দাসসিরার প্রতি তিনি বেশ দুর্বল এবং তার কথাকেই তিনি খুব গুরুত্ব দেন।

আমি এখনই মুদ্দাসসিরার কাছে যাচ্ছি। যারিয়াব বললো।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *