৪. উন্দলুসের বাদশাহ

উন্দলুসের বাদশাহ যিনি উন্দলুসকে ইসলামী সালতানাত বলেন এবং আপনাদেরকে ইসলামের শিক্ষা দেন তিনি বড় বড় পাপের মধ্যে ডুবে আছেন। ইমাম বললো, তিনি মদ পান করেন, সুন্দরী মেয়েদেরকে উলঙ্গ করে নাচান এবং সবার সামনেই অশ্লীল কর্ম করেন।……

মুসলমান কারো গোলাম নয়। আপনাদের কাছ থেকে যে ভূমিকর, আয়করসহ আরো নাম না জানা কত ধরনের খাজনা আদায় করা হয় এসবের পয়সা আপনাদের বাদশাহর ভোগে বিলাসে খরচ হয়।

এভাবে ইমাম দেশের বিরুদ্ধে আজে বাজে কথা বলে লোকদের মধ্যে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দিতে লাগলো। প্রমাণের স্থলে কিছু কুরআনের আয়াত ও বানোয়াট হাদীসের উদ্ধৃতি দিলো।

তার পাঠদান শেষ হলো। মুসল্লীরা একে একে চলে গেলো। উবাইদুল্লাহ। উঠলেন না, বসে রইলেন। তার সঙ্গে দুজন কমান্ডার ছিলো। তারাও বসে রইলো।

আপনারা কেন বসে আছেন? ইমাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো। আপনার পাঠদানে এতই মুগ্ধ হয়েছি যে, আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। উবাইদুল্লাহ বললেন।

অবশ্যই, অবশ্যই, ইমাম বললো এবং জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কোত্থেকে এসেছো? আগে তো তোমাদেরকে আর দেখিনি।

আমরা মুসাফির। কর্ডোভা যাচ্ছি। উবাইদুল্লাহ বললেন, আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, উন্দলুসের বর্তমান এই পাপিষ্ঠ বাদশাহর বিরুদ্ধে আমরা কী করতে পারি? আপনি বলেছেন, বাদশাহ অপকর্ম করে যাচ্ছেন। আর আমাদের পেট কেটে পয়সা নিয়ে ভোগবিলাসে মজে আছেন।

আমার কাছে তো মনে হয় এ ধরনের বাদশাহকে সিংহাসন থেকে গলাধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয়াই সবচেয়ে বড় জিহাদ। যাতে খোদার নিরপরাধ বান্দারা তার জুলুম অত্যাচার থেকে মুক্তি পায়। এ ব্যাপারে আপনি কি বলেন?

তোমরা কি আরেকদিন আসতে পারবে? ইমাম বললো, তখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবো। আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে।

ইমাম উঠে দাঁড়ালো এবং মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলো। উবাইদুল্লাহ ও তার কমান্ডাররাও তার পিছু নিলেন। ইমাম যে গলিতে ঢুকতো তারাও তার পিছু পিছু সে গলিতে ঢুকতেন। একবার ইমাম দাঁড়িয়ে পড়লো।

তোমরা আমার পিছু পিছু আসছো কেন? ইমাম জিজ্ঞেস করলো ভঁ কুচকে।

আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা চলতে চাই। উবাইদুল্লাহ সরল গলায় বললেন।

ইমাম কিছু না বলে আবার হাঁটা দিলো। উবাইদুল্লাহরাও তার পিছু নিলেন। হাঁটতে হাঁটতে ইমাম একসময় জনবসতি থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং খোলা তেপান্তরে গিয়ে উঠলেন। উবাইদুল্লাহ তার পথরোধ করে দাঁড়ালেন।

ইমাম সাহেব! আপনি কোথায় থাকেন? উবাইদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন।

আমি এই বসতিতেই থাকি। কিন্তু আমি তো বলেছি একটু বাইরে যাচ্ছি। এক কাজে। ইমাম একটু উষ্ণ গলায় বললো।

চলুন। এক সঙ্গে আমরাও যাই। অসুবিধা তো আর নেই কিছু। উবাইদুল্লাহ বললেন।

ইমাম কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে তাদেরকে এড়িয়ে যেতে চাইলো। সঙ্গে সঙ্গে উবাইদুল্লাহর চোখের ইংগিতে দুই কমান্ডার খঞ্জর বের করে ফেললো। দুই খ রের ফলা তার দুই পাঁজরে গিয়ে ঠেকলো।

আমাদেরকে তোমার ঘরে নিয়ে চলো। উবাইদুল্লাহ বললেন, চালাকি করতে চেষ্টা করবে না। আমার সঙ্গে ফৌজ আছে। বসতির প্রতিটি ঘরে তল্লাসি চালানো হবে। আর বিশৃংখলার সৃষ্টি করলে তোমার দুপা ঘোড়ার পেছনে বেঁধে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়া হবে।

রহস্যজনক ইমাম বসতির এক পাশে একেবারে জনবিচ্ছিন্ন একটি বাড়িতে থাকতো। পরে জানা যায় সে বাড়িতে অন্য কারো প্রবেশের অনুমতি ছিলো না। কারণ বলা হতো, ইমাম সাহেবের কাছে কিছু অশরীরী আত্মা ও জ্বিন পড়তে আসে।

ইমাম উবাইদুল্লাহ ও তার দুই কমান্ডারকে তার সেই বাড়িতে নিয়ে গেলো। বাড়িতে প্রথমেই দুটি অতি সুন্দরী মেয়ে দেখা গেলো। বাড়িতে তল্লাশি চালানোর পর দেখা গেলো, একটি কামরাকে রীতি মতো গির্জা বানিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে ক্রুশ, কুমারী মরিয়াম (আ) ও ঈসা মাসীহের প্রতিমূর্তিও আছে। গির্জাকে যেমন উপাসনার জন্য সাজানো হয় সে কামরাটিকেও খুব যত্ন করে সাজানো হয়েছে।

উবাইদুল্লাহর জিজ্ঞাসাবাদ থেকে জানা গেলো, ইমাম ছয় সাত মাস ধরে মসজিদে ওয়াজ-নসীহতের নামে এভাবে মানুষকে বিকৃত শিক্ষা দিচ্ছে।

কমান্ডাররা সবকিছু উঠিয়ে নিলো। তারপর মেয়ে দুটি ও ইমামকে গ্রেফতার করে ওরা বসতি থেকে বেরিয়ে গেলো। পথ চলতে চলতে ইমাম উবাইদুল্লাহকে লোভাতুর প্রস্তাব দিয়ে বললো,

আপনারা মেয়ে দুজনকে নিয়ে নিন। যত টাকা চাইবেন আগামীকালকে পরিশোধ করে দেয়া হবে। চাইলে আপনাদের তিনজনকে এর চেয়ে অনেক সুন্দরী মেয়ে চিরদিনের জন্য দিয়ে দেয়া হবে।

অন্ধকার রাস্তায় মেয়ে দুটি উবাইদুল্লাহ ও দুই মান্ডারের গায়ে ঘেঁষে ঘেঁষে পথ চলছিলো। নিজেদেরকে অর্ধ উলঙ্গ করে সবরকম জাদু চালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু উবাইদুল্লাহ পাথর হয়ে রইলেন। সঙ্গে দুই কমান্ডারও। তারা কোন কথাই বললো না পথে।

অবশেষে তারা তাদের তাঁবুর শিবিরে পৌঁছে গেলো।

 উবাইদুল্লাহ তাদেরকে নিজের তাঁবুতে নিয়ে গেলেন।

তোমরা দুজন ভালো করে শুনে রাখো, উবাইদুল্লাহ মেয়ে দুজনকে বললেন, তোমরা এক সেনা তাঁবুতে আছো। তোমাদেরকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করা হবে। যদি তোমরা মিথ্যা বলো তাহলে সৈনিকদের কাছে তোমাদেরকে ছুঁড়ে দেয়া হবে। এরা সবাই হিংস্র-ক্ষুধার্ত। যে চরম যন্ত্রণা ভোগ করবে সেটা কল্পনা করে দেখো। কখনো তা সহ্য করতে পারবে না। বাঁচতেও পারবে না এবং মরবেও না।

আমার প্রস্তাব কি আপনার পছন্দ হয়নি? ইমাম উবাইদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলো। এখন তার সুরে অনুনয় নয়, চ্যালেঞ্জ ফুটে উঠলো। যেন ধমক দিচ্ছে।

চুপ বদমায়িশ! উবাইদুল্লাহ ধমকে উঠলেন, এখন আমি তোমাকে তোমার প্রাণ বাঁচানোর প্রস্তাব পেশ করছি। সত্য বলবে তো বেঁচে থাকতে পারবে।

সত্য শুনবে? ইমাম নির্ভয়ে বললো, তোমাদের এই সাধের ইসলামী সালতানাতের পতন শুরু হয়ে গেছে। আমরা আমাদের মেয়েদের যৌবনকে ব্যবহার করি বলে আমাদেরকে তোমরা কাপুরুষ বলবে। যা ইচ্ছা তা বলে নাও। কিন্তু আমরা একে কাপুরুষতা মনে করি না।…..

এই মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখো, ওরা খুশি মনে আমাদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ওদেরকে কেউ বাধ্য করেনি। বরং ওরাই ওদেরকে নিতে আমাদেরকে বাধ্য করেছে। আমরা আমাদের খ্রিষ্টধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিচ্ছি। আমরা এদেশ থেকে মুসলান ও ইসলামকে বের করবোই। আমরা না পারলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অবশ্যই সফল হবে।…..

আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যে ভয়ংকর ঝড় সৃষ্টি করেছি তার মরণ-ছোবল থেকে তোমরা তোমাদের সালতানাতকে বাঁচাতে পারবে না। আমরা তো তোমাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে হামলা করতে পারবো না। তাই তোমাদের ধর্ম বিশ্বাসকে আমরা পাল্টে দিচ্ছি। পাল্টে দিচ্ছি তোমাদের চিন্তাধারাও।

তোমাদের এই দলে কারা কারা আছে এটা কি বলবে না?

না সে জবাব দিলো, আমাদের দলে কে বা কারা আছে এটা জেনে কি করবে তোমরা? নিজেদের দলের দিকে মনোযোগ দাও আগে। তোমাদের অনেক মসজিদে মসজিদে ইমামরা লোকদেরকে বিকৃত তাফসীর শোনাচ্ছে। ঐ বেচারাদের জানা নেই, ওরা যে শিক্ষকদের কাছে পড়েছে তারা মুসলমান নয়, খিষ্টান ছিলো।…..

এখন তোমরা মসজিদগুলোতে বিকৃত তাফসীরই শুনবে। কিছু ইহুদীও আলেম ও ইমামের বেশে তোমাদের ধর্মকে বিকৃত করছে। আর বাকিটা আমার মতো ইমামরা পূর্ণ করছে।…..।

তোমাকে এত কিছু বলে দিচ্ছি কারণ, তুমি একজন সালার। তোমার জীবন তো লড়াইয়ে লড়াইয়ে কেটেছে। তোমরা নিশ্চয় কুরআন তেলাওয়াত করো। কিন্তু নিজেদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তোমরা বুঝেইনি। আমি সেটা বুঝেছি। পবিত্র কুরআন এক পরিপূর্ণ জীবনবিধান গ্রন্থ।…..

মুসলমানরা যদি পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা নিয়ে চলতো তাহলে উন্দলুসের সালতানাত এই ইউরোপীয় সমুদ্র থেকে সমুদ্রের ওপার পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করতো যেখানে সূর্য অস্ত যায়।…..

কিন্তু এই ইসলামী সালতানাত আজ উন্দলুসেই ভুমিশুন্য হয়ে পড়ছে। এটা ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের কৃতিত্ব যে, তারা কুরআনকে জাদু ও তাবীজের এক সূত্র হেসাবে সমাজে প্রচার করে দিয়েছে। তারপর এতে বিভিন্ন বিরোধ ও সংঘাত সৃষ্টি করে এক একটি আয়াতের একাধিক তাফসীর প্রচার করে দিয়েছে।

সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ নীরবে সব শুনে গেলেন। এখন আর তাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। এরা আদাজল খেয়ে ধর্মের বিকৃতি সাধনে নেমেছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসী এরা।

উবাইদুল্লাহ মেয়ে দুটিকে তার এক সহকারীর কাছে হাওলা করে দিলেন তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। তিনি নিজেও সেই ভূয়া ইমামের কাছ থেকে আরো কিছু জানার অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার কাছ থেকে আর বিশেষ কিছুই জানা গেলো না।

রাতের শেষ প্রহরে ছাউনি তুলে কর্ডোভার দিকে কোচ করার হুকুম দিলেন উবাইদুল্লাহ। নকল ইমাম ও দুই মেয়েও সৈন্যদের হেফাজতে দলের সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা দিলো।

***

উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ পর দিন রাতে কর্ডোভায় প্রবেশ করলেন। কয়েদীদেরকে এই হুকুম দিয়ে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দিলেন যে, আগামীকাল যেন তার সামনে এদেরকে হাজির করা হয়।

কর্ডোভায় ঢোকার মুখে ওযীর হাজিব আবদুল করীম, সালার আবদুর রউফ, সালার মুসা ইবনে মুসা ও সালার ফারতুন শহরের প্রধান ফটকের বাইরে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমীরে উন্দসই এভাবে স্বাগত জানানোর কথা বলে দিয়েছিলেন।

উবাইদুল্লাহ বেশ ক্লান্ত ছিলেন। তবুও ওহীর ও সালারদের সঙ্গে নিয়ে গেলেন তার হাবেলিতে। পথে যা যা ঘটেছে সবকিছু তাদেরকে সংক্ষেপে শোনালেন। তাকে কিভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিলো এবং প্রায় অলৌকিকভাবে কি করে তিনি বেঁচে গিয়েছেন তাও জানালেন সবাইকে। কয়েদীদের ব্যাপারেও আলোচনা করলেন।

তবে একটা জিনিস নিশ্চিত হওয়া গেছে, খ্রিষ্টানরা ময়দানের লড়াইয়ে যেতে চায় না। উবাইদুল্লাহ বললেন, ওরা মাটির নিচ থেকে আমাদের ওপর আঘাত হানতে চাচ্ছে। ফিরতি পথে আমি বহু জায়গায় তাঁবু ফেলি। আর গোয়েন্দা, গুপ্তচর ও টহল সেনা ইউনিট দ্বারা আশপাশ ও দূরদুরান্ত এলাকার অবস্থা জরিপ করি।…..

আমি যেসব খবরাখবর পাই এতে আমি নিশ্চিত, আমাদের ভেতর থেকেই কোন বড় ধরনের ফেতনা ফাসাদ লালিত পালিত হচ্ছে। সীমান্ত এলাকার লড়াই থেকে যে কয়েদী ধরে এনেছি এদের মধ্যে কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনাসদস্যও আছে। ওদের থেকে কিছু গোপন তথ্য উদ্ধার করেছি। ওরা বলেছে, ফ্রান্সের বাদশাহ লুই উন্দলুসের বিদোহের পেছনে হাওয়া দিচ্ছেন। তার ফৌজ এখানকার খ্রিষ্টানদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে।…..

আমি তিন তিনবার ইউগেলিস ও ইলওয়ার নামের দুজন লোকের কথা শুনেছি। জানা গেছে, এরা কট্টর খ্রিষ্টান। খ্রিষ্টধর্মের বড় পণ্ডিত এবং অসম্ভব মেধার অধিকারী। এরা দুজন এখানকার সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ষড়যন্ত্রে সবচেয়ে বেশি তৎপর।…..

সারা দেশে প্রথমে আমাদেরকে গুপ্তচর বৃত্তির ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সংবাদ পৌঁছানোর মাধ্যমটা যেন খুব দ্রুততর হয়। দ্বিতীয়তঃ সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়াতে হবে। গ্রাম্য এলাকাতেও সেনা চৌকি বসাতে হবে। কারণ, উন্দলুসকে আমি অনেক বড় শংকার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।

উবাইদুল্লাহ! হাজিব আবদুল করীম কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, এখানে তুমি আরো অনেক কিছুই দেখবে। তুমি সীমান্ত অভিযানে চলে যাওয়ার পর এখানে ঈসা মাসীহের আত্মপ্রকাশের নাটকও খেলা হয়েছে। আবদুল করীম সেই গির্জার পুরো ঘটনা ও এর বিরুদ্ধে তাদের নেয়া পদক্ষেপের কথা শুনিয়ে বললেন,

আমাদের শাহে উন্দলুস ভয়ংকর সেই অপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছেন এবং শহীদদের লাশগুলো পর্যন্ত প্রথমে দেখতে চাননি। তার এই নির্বিকার ভাব দেখে আমরা ভীষণ হারান হয়েছি।

তোমরা কি তাকে এভাবেই ছেড়ে দিলে?

না ভাই! আমি ও আবদুর রউফ তাকে শাহী নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অনেক কিছুই বলেছি। তাকে লজ্জা দিয়েছি। অতি ক্ষুব্ধ অবস্থায় তার ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। ওযীর বললেন।

যারিয়াব ও সুলতানা তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। এখন তিনি ওদের মাথা দিয়েই চিন্তা ভাবনা করেন। সালার আবদুর রউফ বললেন।

দরবারে তো তোষামোদকারী চামচা ও তোষামোদে উপদেষ্টাদের শাসন চলছে। অন্ধের মতো নজরানা আর বখশিষ দেয়া হচ্ছে। সালার মুসা ইবনে মুসা বললেন।

এর একটাই প্রতিকার। সালার ফারতুন বললেন, এ লোকগুলোর কাউকেই বেঁচে থাকতে দেয়া হবে না। না হয় উন্দলুস থেকে আমাদের সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যেতে হবে।

না। সালার উবাইদুল্লাহ বললেন, রক্তপাত ও সিংহাসন কেড়ে নেয়ার পরিণাম সাধারণত ভালো হয় না। এতে গৃহযুদ্ধেরও সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে দুশমন তো এর আগুনে তেল-ঘি ঢালতে থাকবে।……

পুরো জাতিই এতে লড়াই করে নিজেদের বৃথা রক্ত ঝরিয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়বে। আর দুশমন বড় আরামে আমাদের সীমান্তে ঢুকে পড়বে। তখন আমরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবো। আমরা যদি আমীরে উন্দলুসকে হত্যা করি তাহলে রেওয়াজ দাঁড়িয়ে যাবে হত্যা করো আর রাজত্ব করো।

কিন্তু এর তো কোন প্রতিকার ভেবে চিন্তে বের করতেই হবে। সালার ফারতুন বললেন, ওদের কাউকে জীবিত রাখা যাবে না। আর না হয় উন্দলুস থেকে আমাদেরকেও জীবিত পালাতে দেবে না খ্রিষ্টানরা।

না এতে তো কোন প্রতিকার হবে না এটা আগেই বলেছি। উবাইদুল্লাহ বললেন, তবে একমাত্র প্রতিকার আমার মনে যা আসছে তা হলো আমীরে উন্দলুসকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তিনি গতানুগতিক কোন শাসক হওয়ার কথা ছিলো না। তার দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার ব্যাপারে আপনারা সবাই জানেন।

তার পিতার শাসনামলে সালতানাতের শাসনভার তার হাতেই এক প্রকার নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তিনি নিজে লড়াইও করেছেন এবং সেনাদলকে লড়িয়েছেনও। আমি তো বলবো, উন্দলুসে এর চেয়ে যোগ্য কোন শাসক আর পাওয়া যাবে না।

আমরা আর কত দিন এর অপেক্ষায় থাকবো? হাজিব আবদুল করীম বললেন, আমরা কিন্তু আবদুর রহমানের মানসিকতায় নিজেদেরকে নিয়ে যেতে পারবো না। আমাদের ঈমান ও স্বাধীনতার অপ্রতিরোধ্য চেতনা জিবন্ত রাখতে হবে। আমীর কেন খলীফাও যদি বিপথগামী হয়ে যায় তাহলে ইসলাম তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অনুমতি দেয়। তাকে বাধা দিতে বলে। আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবকিছু করতে হবে। আবদুর রহমানের সন্তুষ্টি নয়।

আমি সকালে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাচ্ছি। উবাইদুল্লাহ বললেন, আমি ঐ ছদ্মবেশী ইমাম ও তার সঙ্গের মেয়েদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাবো। আমার কথা শুনে তিনি যদি আমার আবেগকে ঠাণ্ডা করতে চেষ্টা করেন তখন আমি আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে কোন উপায় বের করবো।…..

ফ্রান্সের দিক থেকে আমি বেশ শংকিত। ফ্রান্স আমাদের ওপর হামলার করার আগে আমরা যেন ফ্রান্সের ওপর হামলা চালাতে পারি আমীরে উন্দলুসকে এ ব্যাপারে রাজি করতে চেষ্টা করবো।

আপনারা সবাই সালার। আপনারা জানেন, দুশমন আপনাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত হয়ে উঠছে। এজন্যই ওদের ওপর এখনই হামলা করে দিতে হবে। প্রস্তুত অবস্থায় ওদেরকে পাকড়াও করতে হবে। বড় শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের উন্দলুসকে বাঁচাতে হবে আমাদের। ইসলামের দুর্গকে আমাদের অজেয় রাখতে হবে।

***

প্রধান সেনাপতি উবাইদুল্লাহ আবদুর রহমানের সাক্ষাত কামরায় বসে তাকে তার অভিযানের কথা শোনাচ্ছেন। এসব কথা ও ঘটনা সালারদেরকেও একবার। শুনিয়েছেন। গির্জায় আগুন লাগার ঘটনার পর আরো কয়েক মাস কেটে গেছে।

আমীরে উন্দলুস! উবাইদুল্লাহ বললেন, গির্জাগুলোয় তো হুকুমতে উন্দলুসের বিরুদ্ধে বক্তৃতা চলে, মসজিদেগুলোতেও এ বিষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আমি এক খ্রিষ্টান ও দুটি মেয়েকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছি। এ লোক অনেক দিন ধরে এক মসজিদে ইমামতি করছিলো। আমার দুই কমান্ডার এই খিষ্টান ইমামকে মসজিদে গিয়ে ওয়াজ করতে দেখে। তারা এসে আমাকে বিস্তারিত জানায়।…..

ছদ্মবেশে আমরা সে মসজিদে গেলাম। সে লোকদেরকে প্রতিদিন সবক দেয়। আমি শুনলাম তার সবক। সে পবিত্র কুরআনের বিকৃত তাফসরি করে কুরআনের অবমাননা করছিলো। তারপর সে মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করছিলো। তার বাড়িতে তল্লাশি চালালাম। বাড়ির এক কামরা থেকে ক্রুশ, ইঞ্জীল, হযরত ঈসা ও মরিয়ম (আ) এর মূর্তি উদ্ধার করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে এই মেয়ে দুটিকেও পাওয়া গেলো।….. ওদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই ওরা জানালো, ওরা খ্রিষ্টান ও ইসলামকে বিকৃত করে প্রচার করছে।

তাকে আমি শাস্তি দেবো উবাইদুল্লাহ! আবদুর রহমান বললেন, আপনার এত উত্তেজিত ও পেরেশান হওয়া উচিত নয়। এই এক লোক আমাদের কী ক্ষতি করতে পারবে? ওর সঙ্গী মেয়ে দুটিই বা উন্দলুসের কী বিগড়াতে পারবে?

উবাইদুল্লাহর বিস্ময়ের সীমা রইলো না। উন্দলুসের শাসকের এটাও জানা নেই যে, তার হুকুমতের বিরুদ্ধে দেশের আনাচে কানাচে কী তুফান উঠছে। আর তিনি বলছেন, এই এক লোক আর দুটি মেয়ে আমাদের কী ক্ষতি করতে পারবে।

উবাইদুল্লাহ তাকে গির্জার ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিলে আবদুর রহমান তাকে বললেন, ওযীর আবদুল করীম ও সালার আবদুর রউফ বড়ই ভুল কর্মকাণ্ড করেছে। তারা গির্জায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

আমীরে উন্দলুস! প্রধান সেনাপতি উবাইদুল্লাহ হয়রান হয়ে বললেন, আপনি এসব কি বলছেন? মনে হচ্ছে আমার অনুপস্থিতিতে আপনার আশেপাশে আপনার বিরুদ্ধে কী ঘটছে তা থেকে আপনাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে।

আমি তো একজন মানুষের অধিক কিছু নই, আবদুর রহমান এমন গলায় বললেন যাতে শাহী তেজ বা দাপটের ছিটেফোঁটাও নেই;……

আমি নিজে গিয়ে তো পুরো দেশের অবস্থা দেখে আসতে পারবো না। আমাকে যা বলা হয় তা আমি সত্য বলে ধরে নিই।

আবদুর রহমানের সামনে টেবিলের ওপর লম্বা একটি সুবেশী কাগজ পড়ে আছে। এতে বিশাল এক কবিতা লেখা আছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে উবাইদুল্লাহ কবিতাটি পড়ে নিলেন। এটা আমীরে উন্দলুসের প্রশংসায় লেখা হয়েছে। কবিতাটি হাতে নিলেন উবাইদুল্লাহ।

আমীরে উন্দলুস! উবাইদুল্লাহ বললেন, উন্দলুস যদি আপনার ব্যক্তিগত কোন রাজত্ব হতো এবং আমি আপনার নিজস্ব কর্মচারী হতাম তাহলে আপনার কাছে এলে প্রথমে ঝুঁকে কুর্ণিশ করতাম, তারপর আপনাকে সিজদা করতাম। এরপর সেসব কথা বলতাম, যা এই কবিতায় আপনার কাল্পনিক প্রশংসায় লেখা হয়েছে।…..

আপনার কানে যা কিছু দেয়া হয় তাকেই আপনি সত্য ও সঠিক বলে মেনে নেন।…..কেন? আমীরে উন্দলুস! কেন এমন হবে এবং এমন আর কতদিন চলবে?

উবাইদুল্লাহ! আবদুর রহমান হতাশ গলায় বললেন, তোমাদের কী হয়ে গেলো? আবদুল করীম ও আবদুর রউফকেও মনে হয় আমার প্রতি অসন্তুষ্ট। আমি বুঝি ওরা কী বলতে চায়। ওদের মনোভাব সম্পর্কে তো আমি জানি। কিন্তু তোমরা তো দরবারের আদব-শিষ্টাচারের কথাও ভুলে যাও।

আর এটাই সেই বিষের বীজ যা আপনি আপনার হাতে উন্দলুসের রগ রেশায় বপন করে চলেছেন। উবাইদুল্লাহ বেপরোয়া গলায় বললেন, প্রথম ভয়াবহ ব্যাপার হলো, আপনি তোষামোদ পছন্দ করেন খুব বেশি। ঐ কবি ও কলমবাজ চাটুকারদের আপনার মনমস্তিষ্কে সওয়ার করে নিয়েছেন, যারা আপনার কেবল স্তুতিই পাঠ করতে জানে।…..

আপনার কানে শুধু চাটুকারদের কথাই ঢুকে। আরেকটা বিষের বীজ যেটা আপনি বপন করেছেন। সেটা হলো দরবারের আদব ও শিষ্টাচার। কোন মানুষের কখনো দরবার থাকতে পারে না। ইসলাম একমাত্র আল্লাহর দরবারের কথাই বলে। যাতে আমরা সবাই সিজদাবনত হয়ে থাকি।…..আমীরে উন্দলুস! নিজেকে আপনি খোদা বানাবেন না।

উবাইদুল্লাহ! এসব কি বলছো? আবদুর রহমান গর্জন করে উঠলেন, তুমি কি আমাকে ফেরাউন বানাচ্ছো?

উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এসময় কামরায় যারিয়াব ঢুকলো। প্রধান সেনাপতি উবাইদুল্লাহকে দেখে প্রথমে থমকে গেলো। তারপর দুদিকে দুই হাত প্রসারিত করে উবাইদুল্লাহর দিকে এগিয়ে গেলো।

স্বাগতম! সুস্বাগতম….বিজয়ী সেনাপতি উবাইদুল্লাহ!…..যারিয়াব একথা বলে উবাইদুল্লাহর সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে এগিয়ে এলো।

উবাইদুল্লাহ কোন পাত্তা দিলেন না। বসে থেকেই শুধু করমর্দন করলেন। যারিয়াব আনন্দ প্রকাশ করতে করতে বললো,

আমীরে উন্দলুস! আমরা প্রধান সেনাপতির ফিরে আসাতে আনন্দোৎসব করবো। আমার পুরো নর্তকী দল এমন সেরা নাচ নাচবে যা আকাশের নক্ষত্ররাজিকেও নাচিয়ে তুলবে। আমি এমন গান শোনাবো যা আজ পর্যন্ত আপনাকেও শোনাইনি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ যারিয়াব! যেন ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন আবদুর রহমান, আমার এই সিংহ, এই উবাইদুল্লাহ ভাই, এতই ক্লান্ত যে, ওর মন মেজায বড় চটে আছে।

কিসের উৎসব করবে যারিয়াব! উবাইদুল্লাহ তীর্যক কণ্ঠে বললেন, সে সব শহীদদের শাহাদাত বরণের জন্য উৎসব করবে যাদের ব্যাপারে এখানে দরবারের কারো এটাও জানা নেই যে, ওরা কেন ওদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে?

এ সময় কামরায় ঢুকলো সুলতানা। সেও যারিয়াবের মতো উবাইদুল্লাহকে দেখে আনন্দে ফেটে পড়ার অভিনয় করে উৎসবের কথা বললো। তারপর আবদুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে পড়লো।

উবাইদুল্লাহ লক্ষ্য করলেন, তার কথায় আবদুর রহমানের চেহারায় যে থমথমে ভাব ফুটে উঠেছিলো, রাগে প্রায় লালচে দেখাচ্ছিলো। সুলতানার স্পর্শে সে চেহারা অন্যরকম হয়ে উঠলো।

উবাইদুল্লাহর যেন শরীরে আগুন লেগে গেছে। কিন্তু তিনি নিজের রাগকে বড় কষ্টে চেপে রাখলেন।

আমীরে উন্দলুস! তিনি বড় নিয়ন্ত্রিত কণ্ঠে বললেন, লড়াইয়ের ময়দানে আত্মবিসর্জনকীদের উৎসব করার আগে আমি আপনার সঙ্গে একা একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।

উবাইদুল্লাহ সুক্ষ্মদর্শী লোক। তিনি যারিয়াব ও সুলতানার এই কুট চালের ধরণ বুঝে ফেললেন। তাকে ওযীর আবদুল করীম ও আবদুর রউফ আগেই বলে দিয়েছেন। এরা দুজন আমীরে উন্দলুসকে একা থাকতে দেয় না। কোন সালার বা কোন উচ্চপদস্থ হাকিম তার সঙ্গে কথা বলতে এলে এরা লেজ তুলে ঠিকই সেখানে পৌঁছে যায়। আর আমীরে উন্দলুসের কান বন্ধ করে রাখে।

ইতিহাস সাক্ষী, উন্দলুসের প্রায় সব শাসকই তোষামোদ ছাড়া অন্য কিছু বুঝতেন না। তারা ইসলামী খেলাফতের প্রতিনিধি ছিলেন কাগজে কলমে। কিন্তু বাস্তবে তারা রাজকীয় দরবার প্রতিষ্ঠা করেন। টুকারদের পরিবেষ্টনে তারা সবসময় থাকতেন। বাইরের কোন সঠিক রিপোর্ট তাদেরকে দেয়া হতো না।

চাটুকার হাকিমরা ইসলামের কথা বলতে ঠিক, কিন্তু তাদের বাস্তব জীবন ছিলো ইসলাম বিরোধী।

উবাইদুল্লাহ যখন আবদুর রহমানকে বললেন তিনি একান্তে তার সঙ্গে কথা বলতে চান তখন আবার তার চোখ মুখ থমথমে হয়ে উঠলো। দুজনের মধ্যে কিছুটা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হলো।

আমাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিন। উবাইদুল্লাহ বলেন, তবে আপনাকে বলে দিচ্ছি আপনার দরবার থেকেও আমি চলে যাবো। উন্দলুস থেকে অবশ্য যাবো না। আমি আপনাকে এই মিথ্যা প্রবোধ দিয়ে যাবো না যে, উন্দলুস আপনার মালিকানাভুক্ত রাজত্ব।…..

যে পর্যন্ত আমার মধ্যে ও আমার সঙ্গের কমান্ডারদের মধ্যে ঈমান ও স্বাধীনতার আপোষহীন চেতনা উজ্জীবিত থাকবে, সে পর্যন্ত উন্দলুসকে কেউ তার ব্যক্তিগত জায়গীর বানাতে পারবে না।

আমি তো তোমার কথা শুনছিই উবাইদুল্লাহ! আবদুর রহমান বললেন, যারিয়াব ও সুলতানার সামনে কথা বললে কোন সমস্যা নেই।

আমি ওদের দুজনের মুখের ওপরই বলে দিচ্ছি, এক দরবারী চাটুকার গায়ক ও হেরেমের এক রূপসী নারীকে যদি আপনি আপনার সালতানাতের স্পর্শকাতর ও গোপন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে দেন তাহলে না আপনি থাকবেন, না থাকবে উন্দলুস। উবাইদুল্লাহ বললেন, আপনি যদি বাদশাহ না হতেন এরা আপনার চেহারাও কখনো দেখতে চাইতো না।…..

আর এই লোক যদি এমন চাটুকার গায়ক না হতো এবং এই নারী যদি এমন রূপসী না হতো, আপনি কখনো তাদের দিকে চোখ উঠিয়ে তাকাতেন না। ওদের মধ্যে এই জাদুই আছে…..একজনের কাছে সঙ্গীত, আরেকজনের কাছে রূপ আর মনভোলানো অঙ্গভঙ্গি…..

এ ছাড়া অন্যকিছু নেই ওদের মধ্যে। এই জাদুর গুণেই ওদেরকে আপনার একান্ত বিশ্বস্ত মনে হয়।

যারিয়াব ও সুলতানা একে অপরের দিকে তাকালো। চোখে ইঙ্গিত করলো এবং ওখান থেকে এমনভাবে বেরিয়ে গেলো যাতে ক্ষোভ আর প্রতিবাদের অঙ্গভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আবদুর রহমান উবাইদুল্লাহর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।

উবাইদুল্লাহ। আবদুর রহমান রুক্ষ গলায় বললেন, তুমি চাচ্ছোটা কী? তোমরা কেন ভুলে যাচ্চে আমি আমীরে উন্দলুস এবং আমাকে ইতিহাস শাহে উন্দলুস বলে স্মরণ করবে। আমার একটি ব্যক্তিগত জীবনও আছে। এতে কেন তোমরা বিঘ্ন ঘটাতে আসো?

এজন্য যে, আল্লাহ তাআলা আপনাকে সালতানাতে ইসলামিয়ার বিশাল এক অঞ্চলের আমীর বানিয়েছেন, উবাইদুল্লাহ বললেন, আর আমীরের কোন ব্যক্তিগত জীবন থাকে না। আমীর এই মসনদে বসে-যার ওপর আপনি বসে আছেন- ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে পড়েন না।

তিনি দেশের পয়সা দিয়ে তোষামুদে গায়ক আর সুন্দরী বেলেল্লা নারীদের লালন পালন করেন না। তিনি পারেন না আনন্দ উৎসব করতে। তার কাছে যদি ব্যক্তিগত জীবন এত প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে তার এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়া উচিত।

উবাইদুল্লাহ! তোমার আসল উদ্দেশ্য কী সেটা বলে ফেলো। আবদুর রহমান অসন্তুষ্ট গলায় বললেন।

যে মানসিক অবস্থা আপনি নিজের মধ্যে সৃষ্টি করে রেখেছেন এ অবস্থায় আসলে কোন উদ্দেশ্য, গুরুত্বপূর্ণ কোন আলোচনাই চলে না। উবাইদুল্লাহ বললেন, আমি যুদ্ধের কথা বলবো। লড়াইয়ের কথা বলবো। আপনি কি ফ্রান্সে হামলা করার কথা শুনবেন?…..।

আপনি সেই বিদ্রোহীদের কথা শুনবেন যারা আপনারই আশেপাশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে? আপনি সেই রক্তদানের কথা শুনবেন যা উন্দলুসের মাটি আমাদের কাছে দাবী করছে?

আবদুর রহমানের মেজাজ একেবারেই চড়ে গেলো। যতই হোক, তিনি তো একজন বাদশাহই। তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

এ ফয়সালা করবো আমি, ফৌজ কোথায় যাবে এবং কীভাবে ব্যবহার করা হবে! আবদুর রহমান পায়চারী করতে করতে বললেন, আমি কোন সালার বা সেনাপতিকে এ অনুমতি দিতে পারি না যে, সে তার মন মতো যা ইচ্ছা তাই করবে। তুমি তোমার অধীনস্থ সালারদের বলে দাও, আমি যে কোন সময় সবাইকে ডাকবো এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করবো।

পরিস্থিতি এতই উদ্বেগজনক যে, আপনাকে এখনই ফয়সালা করতে হবে। উবাইদুল্লাহ শান্ত গলায় বললেন, আমি প্রধান সেনাপতি! পরিস্থিতি সম্পর্কে আমিই সালারদেরকে অবহিত করবো। এটা আমারই দায়িত্ব। আর শিগগিরই আমাদেরকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমার হুকুম ছাড়া ফৌজের ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়া চলবে না। আবদুর রহমান এক রোখা গলায় বললেন।

আমীরে উন্দলুস! শান্ত ও মৃদুকণ্ঠে বললেন উবাইদুল্লাহ, আপনি মুসলিম ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করছেন। মুহাম্মদ ইবনে কাসিম হিন্দুস্তানের কুফরস্তানে ইসলামের আলো পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং ইসলাম ক্রমেই পুরো উপমহাদেশে বিস্তার করছিলো। কিন্তু তখন খলীফা সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক জ্বলে উঠলেন এ কারণে যে, মানুষ খলীফার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেবে এবং এক সেনাপতির গীত গাইবে।

তিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে মুহাম্মদ ইবনে কাসিমকে ভারতবর্ষ থেকে ডাকিয়ে এনে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করলেন। তারপর তার রহস্যজনক মৃত্যু হলো।

আমার মনে এমন কোন হিংসা-বিদ্বেষ নেই উবাইদুল্লাহ!

উন্দলুসের ইতিহাস নিশ্চয় আপনার স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। উবাইদুল্লাহ আবদুর রহমানের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, যার মধ্যে হিংসা কাজ করে সে নিজেকে অহিংসই মনে করে আত্মতৃপ্তি বোধ করে। উন্দলুসের সীমান্ত সমুদ্র তীরে পৌঁছে নৌযানগুলোকে যে তারিক জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি যখন উন্দলুস জয় করলেন তখন সালারে আলা মুসার মনে এ ধরনেরই হিংসাত্মক মনোভাব জেগে উঠলো।…..

তিনি তারিক ইবনে যিয়াদের অগ্রগামীতার সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন। শুধু বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন না। বরং কুচক্রী হয়ে তার কাছে কৈফিয়তও চাইলেন, তিনি কেন তার হুকুম ছাড়া এতদূর চলে এলেন?

তিনি তারিকের হাত থেকে কমান্ডিং নেতৃত্ব নিয়ে নিলেন। কিন্তু তারিক শান্ত মাথায় ব্যাপারটা সামাল দিলেন এবং তাকে এ নিশ্চয়তা দিলেন যে, হুকুম মুসারই চলবে। তারিক তারই অধীনস্থ হয়ে থাকবে। অবশেষে দুজনের মধ্যে চমৎকার একটা সমঝোতা হয় এবং উভয়ে ফ্রান্সের সীমান্ত পর্যন্ত তাদের বিজয় কেতন ওড়াতে সক্ষম হয়।

আমার মনে আছে উবাইদুল্লাহ! এ তো আমার বাপ দাদাদের কথা। আমি এসব ভুলবো কি করে? আবদুর রহমান বললেন।

***

না, আপনার সেভাবে কিছুই মনে নেই যেভাবে মনে থাকলে বিবেক কখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকতে পারে না। উবাইদুল্লাহ বললেন, আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আপনার পূর্ব পুরুষরা কী কী পদস্খলনের শিকার হয়েছিলো।…..

যখন মুসা ও তারিক বিন যিয়াদ ফ্রান্সের সীমান্তে পৌঁছে গেছেন তখন খলীফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের হুকুম এসে গেলো, তাদের দুজনকে বাগদাদে ফিরে যেতে হবে। আর সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন নেই।

এদের জনপ্রিয়তার কারণে তিনিও তার খেলাফতকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছিলেন। মুসা জিদ ধরেছিলেন তিন ফিরে যাবেন না। কিন্তু তারিক বলেছিলেন, তিনি খেলাফতের হুকুমকে অমান্য করার মতো পাপ করবেন না। তিনি চলে গেলেন বাগদাদে। তারপর মুসাকেও যেতে হলো।

তারপর কি হয়েছিলো আমি জানি ইবনে আবদুল্লাহ। আবদুর রহমান ঝাঝালো কণ্ঠে বললেন, খলীফা মুসার সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করেছিলেন। আর তারিকের অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয়।

আমীরে উন্দলুস আবদুর রহমানের অবস্থা এখন এমন হয়ে গেলো যেন তিনি সেনাপতি উবাইদুল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণের কাছাকাছি চলে এসেছেন। সেনাপতি তাকে তার পিতৃপুরুষের ইতিহাস শুনাচ্ছেন। তার শোনানোর ভঙ্গিতে একে তো ছিলো তিক্ত বাস্তবতা, তারপর তিনি আবেগদীপ্ত কণ্ঠে বলে যাচ্ছিলেন।

এই আবেগে ক্রোধ থাকলেও তাতে আগ্রাসী মনোভাব ছিলো না।

উবাইদুল্লাহ তাকে দোষারোপ করছিলেন না। তার দৃঢ় কণ্ঠের বক্তব্যে একটি সংকল্পই ফুটে উঠছিলো। সেটা হলো, আমীরে উন্দলুস কিছু না করলে তিনি নিজেই উন্দলুসকে বাঁচাতে যুদ্ধের সব ধরনের পদক্ষেপই নেবেন।

আবদুর রহমান তাকে চুপ করাতে অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি স্বয়ং আবেগ ও নতুন এক স্বংকল্পময় ক্ষুব্ধতায় ভেসে গেলেন। তার রাজত্ব ও শাসন ক্ষমতা এবং তার ব্যক্তিত্ব এই উবাইদুল্লাহর ব্যক্তিত্বে যেন একাকার হয়ে গেলো।

উবাইদুল্লাহ তাকে বনী উমাইয়ার ইতিহাস শোনাচ্ছিলেন। আবদুর রহমান তো বনী উমাইয়ারই এক উজ্জ্বল শাসক পুরুষ ছিলেন এক সময়।…..

উবাইদুল্লাহ তাকে শুনিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্ত। তিনি তাকে কোন গল্প কাহিনী শোনাচ্ছিলেন না। এটা সেই শতাব্দী এর আগের শতাব্দীরই খেলাফত ও উন্দলুসের ইতিহাস। …..

এই ইতিহাসই আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। আমরা সেই ইতিহাসকে উপেক্ষা করতে করতে আজ অধঃপতনের চরমে পৌঁছেছি।

***

আমীরে উন্দলুস! উবাইদুল্লাহ বলে গেলেন, আপনি বলছেন, সিপাহসালার মুসার সঙ্গে খলীফা খুব বাজে ব্যবহার করেছিলেন। এতটুকু বলাই যথেষ্ট হবে না। মুসা ও তারিক যখন দামেশকের কিছুটা দূরে তখন খলীফা ইবনে আবদুল মালিকের ভাই সুলাইমান তার সঙ্গে এসে সাক্ষাত করলেন। খলীফা তখন মৃত্যু শয্যায়। আর কয়েকদিনের মেহমান মাত্র তিনি।…..।

সুলাইমান তাদেরকে বললেন, তারা এ অবস্থায় যেন দামেশকে না যায়। তার খেলাফতের গদির দাবীদার একের অধিক। এর মধ্যে সুলাইমানও একজন। তিনি মুসা ও তারিককে তার দলে ভিড়িয়ে অর্থাৎ সেনাবাহিনীকে হাত করে খেলাফতের গতি দখল করতে চান।…..

মুসা তাকে বললেন,

‘খেলাফতের ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই। আমি কিংবা তারিক আমরা কেউ খলীফা হতে চাই না। আমাদেরকে ফিরে আসতে বলা হয়েছে। আমরা ফিরে এসেছি। আমরা খলীফার কাছে তো অবশ্যই যাবো। তাকে না পেলে কমপক্ষে তার জানাযায় তো শরীক হতে পারবো।‘

‘সুলাইমান মূসাকে রাজি করাতে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। অবশেষে মুসা তাকে এই জবাব দিয়ে চুপসে দিলেন যে, কোন সিপাহসালার বা সালারের রাজনীতির ব্যাপারে কোন আগ্রহ থাকা উচিত নয়। আর আমি ফৌজেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করতে দেবো না। সুলাইমান এ কথা শুনে রুষ্ট হয়ে চলে গেলেন।…..’

‘অবশেষে সিপাহসালার মুসা ও তারিক খলীফার সামনে গিয়ে হাজির হলেন। তার সামনে উপহার-উপঢৌকনের স্তূপ আর কাড়ি কাড়ি টাকা পয়সা রাখা হলো। খলীফা ওয়ালিদ তখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তিনি তো খুশি হয়ে গেলেন। কিন্তু তার ভাই সুলাইমান জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে রইলেন। তারপর মাত্র চল্লিশ দিন ওয়াীলদ ইবনে আবদুল মালিক বেঁচে ছিলেন।…..’

কিন্তু মুসলিম জাতির দুর্ভাগ্য যে, খেলাফতের গতিতে বসলেন সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক। তিনি সিপাহসালার মুসা থেকে সেই প্রতিশোধ নিলেন যা, বনী উমাইয়ার ইতিহাসকে চিরদিন লজ্জা দেবে।

মুসার বিরুদ্ধে নিজের লোকজনকে লেলিয়ে দিয়ে নিজের মতো করে অনুসন্ধান চালিয়ে তাঁর সব অর্জনকে তছনছ করে দিলেন। তার বিরুদ্ধে সাজানো, মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করা হলো।…..

তার বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ পরবর্তীতে এক অক্ষরও কেউ সত্য বলে প্রমাণ করতে পারেনি। তার ওপর এমন বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ চাপিয়ে দেয়া হলো যে, তিনি সেটা পরিশোধ করতে পারলেন না।……

সেফাট নামে এক ইংরেজ ঐতিহাসিক লিখেছেন, সুলাইমান সিপাহসালার মুসার ওপর এক লাখ দীনার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দায়ের করে। কেউ কেউ দেড় লাখ দীনারের কথাও উল্লেখ করেছেন।

একজন সৎ, নির্লোভ সিপাহসালার এত টাকা কী করে পরিশোধ করবেন? উবাইদুল্লাহ বলছিলেন কিন্তু সুলাইমান তার বিরোধী পক্ষ থেকে বড়ই পৈশাচিক প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। যে ব্যবহার তিনি মুসার সঙ্গে করলেন তা শুনে আজো অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। উত্তপ্ত বালিতে একটি কাঠের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলেন নরপিশাচ সুলাইমান।…..

আপনি কি জানেন তখন মুসার বয়স কত ছিলো?…..আশি বছর বয়সে তিনি তারিককে সঙ্গে নিয়ে উন্দলুস জয় করেন। এর পুরস্কার তিনি এই পেলেন যে, একাধারে কয়েক দিন মরুর আগুন ঝরা সূর্যের নিচে ফুটতে থাকা বালির ওপর খালি পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। তারপর তাকে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করা হলো।…..

আপনি কি জানেন আমীরে উন্দলুস! সিপাহসালার মুসার এক যুবক ছেলে ছিলেন আবদুল আজীজ। তিনিও ছিলেন মুসলিম সেনাদলের একজন সালার। খলীফা সুলাইমানের এই ভয় ছিলো, মুসার এই ছেলে তার বাপকে নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে পারে। সুলাইমান আবদুল আজীজকে এক মুনাফিক সন্ত্রাসী আরব দিয়ে তখন খুন করিয়েছেন যখন তিনি তার সেনাদলকে নিয়ে ফজর নামায পড়ছিলেন। আর তিনি ইমামতি করছিলেন।…..

ইতিহাস থেকে আপনি এই কুৎসিত অধ্যায় কি করে মুছে ফেলবেন যে, আবদুল আজীজ সুরা ফাতেহা শেষ করে সুরা ওয়াকিয়া শুরু করেছিলেন। এ সময় সুলাইমানের পাঠানো সেই খুনী তাকে হত্যা করে।…..

নরাধম সুলাইমান এতেই ক্ষান্ত হলেন না। বরং আবদুল আজীজের কর্তিত মাথা তার পিতা কিংবদন্তী বীর মুসার কাছে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দিলেন। মুসা সন্তানের এই কর্তিত মাথা দেখে চিৎকার করে বললেন, ঐ হতভাগা এমন এক মানুষকে খুন করলো যে দিনে জিহাদ করতো, আর রাত কাটিয়ে দিতে ইবাদতে…..মুসা আশি বছর বয়সেও এই চরম আঘাত বুক পেতে নিলেন।…..

***

উবাইদুল্লাহ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন। কান্না চাপা কণ্ঠে বলে গেলেন,

৯৭ হিজরীর হজ্জের কথা মনে করুন আমীরে উন্দলুস! সে বছর ইসলামের দুমুখী সাপ, মুনাফিক সুলাইমান হজ্বে গিয়েছিলেন। তিনি সেই বৃদ্ধ সিপাহসালার মুসাকে পায়ে শিকল বেঁধে তার সঙ্গে নিয়ে যান। তারপর তাকে সেই বুদ্ধ-ভিক্ষুকদের সারিতে দাঁড় করিয়ে দেন যারা হাজিদের কাছ থেকে ভিক্ষা চাইতে থাকে। সুলাইমান তাকে বলেন, ভিক্ষা চাও, আর জরিমানা আদায় করো এবং মুক্ত হয়ে যাও।…..

সে বছরের হাজিরা দারুন আনন্দিত ছিলো। একে অপরকে মোবারকবাদ দিচ্ছিলো এ কারণে যে, সালতানাতে ইসলামিয়ায় উন্দলুসের মতো এত বড় একটি দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু কারো জানা ছিলো না, উন্দলুস বিজয়ের অন্যতম রূপকার শিকল বাঁধা পায়ে ভিখিরীদের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে।…..

অবশেষে আল্লাহ তাআলারও তার ওপর রহম হলো। তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় আল্লাহর প্রিয় হয়ে গেলেন।…..আর তারিক ইবনে যিয়াদ গুমনাম হয়ে এই দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। পশুত্ব বরণকারী সুলাইমান তাকে আর কোন অভিযানে যেতে দেননি।

আবদুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন। তিনি অস্থির হয়ে কামরায় পায়চারী করতে লাগলেন।

আল্লাহর দেয়া কানুন আর বিধি বিধানকে নিজের হাতে নেয়ার চেষ্টা করবেন না আমীরে উন্দলুস! উবাইদুললাহ বললেন, আপনি চাইলে আমার সঙ্গে সে ব্যবহার করতে পারেন যা খলীফা সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক মুহাম্মদ ইবনে কাসিম, সিপাহসালার মুসা ও সিপাহসালার তারিক বিন যিয়াদের সঙ্গে করেছেন।

কিন্তু আপনাকে এও বলে দিচ্ছি, আমি ও আমার কোন সালার সত্যের আওয়াজ ও সত্যপথ থেকে এক চুল পরিমাণও হটবো না। আপনাকে আমি সতর্ক করে দিচ্ছি, আপনার পরিণাম হবে ভয়াবহ।

এতটুকু বলে উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ উঠে পড়লেন এবং আর কিছু না বলে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আবদুর রহমান নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে সেই দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন যে দরজা দিয়ে তার প্রধান সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ধুপধাপ পায়ে বেরিয়ে গেছেন।

উবাইদুল্লাহ সেই তাল-তরঙ্গ ছিঁড়ে দিয়ে গেছেন যেটা ব্যবহার করে যারিয়াব ও সুলতানা তাকে বাস্তবতা থেকে দূরে নিস্তব্ধ-শীতল রাখতে চেষ্টা করতো। তিনি দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লেন। মাথা নামিয়ে এক হাত কপালে ঠেকিয় গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।

***

 তিনি কাঁধের ওপর কারো হাতের মৃদু স্পর্শ অনুভব করলেন। মাথা উঠিয়ে দেখলেন, মুদ্দাসসিরা।

মুদ্দাসসিরা এক সময় তার পরিচারিকা ছিলো। এখন তার স্ত্রী। রূপ যৌবনে সুলতানার চেয়ে বেশি না হলেও কম নয়। তার মুখের ভাষায় বাচ্চাদের মতো কেমন নিষ্পাপ এক সরলতা রয়েছে। সুলতানা আসার আগে আবদুর রহমানের সবচেয়ে প্রিয় ছিলো এই মুদ্দাসসিরা। এখনো কম প্রিয় নয়।

আপনি কি হেরে গেছেন? মুদ্দাসসিরা আবেগদীপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি সে আবদুর রহমান নন যিনি তার পিতার শাসনামলে সীমান্ত, এলাকায় কয়েকবারই ফ্রান্সীয়দেরকে রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন?

আপনি কি আর সে আবদুর রহমান নন যিনি সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শারলেমীন সালিবীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিলেন। শারলেমীন যখন তার পরাজয়ের প্রতিশোদ নিতে ওরতুশা অবরোধ করলো, তখন এমন শক্তিশালী ও নিশ্চিদ্র অবরোধ কে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলেন?…..আবদুর রহমানই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন।…..হ্যাঁ, আপনিই।

আবদুর রহমান তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তার এই সরল ও নিষ্পাপ সজীব-পেলবতায় ভরা মুদ্দাসসিরাকে বেশ ভালো লাগলো।

মুদ্দাসসিরাকে একবার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু মুদ্দাসসিরা তখন তীব্র বেগে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো। আবদুর রহমান স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। কিন্তু তার ভেতর এক ঝড় দানা বেঁধে উঠতে লাগলো।

মুদ্দাসসিরা কয়েক মুহূর্ত পরেই ফিরে এলো। তার হাতে কোষবদ্ধ। তলোয়ার। তলোয়ারটি খাপ থেকে এক ঝটকায় বের করে ফেললো মুদ্দাসসিরা। তারপর খাপটি এত জোরে একদিকে ছুঁড়ে মারলো যে, সেটি দরজার বাইরে। গিয়ে পড়লো। মুদ্দাসসিরা তলোয়ারটি আবদুর রহমানের মুখের কাছে নিয়ে ধরলো।

এর ঘ্রাণ নিন আগে, মুদ্দাসসিরা বললো, একে ভালো করে দেখুন। সেসব কাফেরদের রক্তের গন্ধ পাবেন যাদেরকে এই তলোয়ার দিয়ে আল্লাহ ও তার রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে হত্যা করেছেন। এই তরোয়ারের চকচকে দীপ্তিতে সেসব কাফেরদের দুর্গগুলো দেখতে পাবেন যেগুলো আপনার তলোয়ারের আঘাতে জয় করেছিলেন। এই তলোয়ার ভোতা হয়ে যায়নি। এতে ঝং ধরেনি। আপনি কেন এভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলবেন?

তুমি কি শোনোনি এ লোক আমকে কী সব কথা বলে গেছে? আবদুর রহমান বললেন অনেকটা অভিমানী গলায়।

এক সিংহকে জাগাতে এবং তাকে গভীর গুহা থেকে বের করতে হলে সেই গুহার সামনে আগুন জ্বালাতে হয়। মুদ্দাসসিরা বললো, প্রধান সেনাপতি আপনাকে যা বলেছে তার প্রতিটি শব্দ আমি শুনেছি। আমি তো আপনাকে আমার ভালোবাসার দোহাই দিতে পারবো না। কারণ, আপনি আপনার ভালোবাসা একাধিক নারীর মধ্যে বণ্টন করে রেখেছেন।…..

আপনাকে আমি সেই দুই বাচ্চার দোহাই দিয়ে বলছি, যাদেরকে আপনি জন্ম দিয়েছেন। আপনার সেই সন্তানদেরকে এবং তাদের অনাগত সন্তানদেরকে আপনার সামনে রাখুন। তাদেরকে ইতিহাসের সেই পাথেয় দিয়ে যান যা আপনার পূর্বপুরুষরা দিয়ে যেতে পারেনি। তাদেরকে তো বনী উমাইয়ার কিংবদন্তী সালার ও বিজয়ী সিপাহসালারদের নিকৃষ্ট হন্তারক বলা হয়। তাদের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যেন আপনার দ্বারা না হয়।

মুদ্দাসসিরা তলোয়ারটি তার কোলে রেখে দিলো এবং তার চেহারা দুহাতে তুলে ধরে চোখে চোখ রেখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

কিন্তু ওরা চাচ্ছেটা কী? আবদুর রহমান সজাগ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কাছে যে সালাররা আসে তারা কিছু বাঁকা ও তীর্যক কথাবার্তা ছুঁড়ে চলে যায়।

গোথাক মার্চ এক শক্তি হয়ে উঠছে, মুদ্দাসসিরা বললো, ফ্রান্সের শাহ লুই তাকে মদদ দিচ্ছে…..আপনার নিজের এক রাজ্য মারীদায় বিদ্রোহের অঙ্গার জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

তোমাকে একথা কে বলেছে?

তারাই বলেছেন যাদের কথা আপনি শুনতে চান না।

আর আমার কাছে এসব কথা কে গোপন করছে?

আমি এ প্রশ্নের উত্তর দেবো না। মুদ্দাসসিরা বললো, না হয় আপনি সতীন বিদ্বেষ ও হিংসার অপবাদ আমার ওপর আরোপ করবেন। কে জানে আপনি না আবার বলে দেন, মুদ্দাসসিরা তুমি আর যাই হও একজন পরিচারিকাই তো ছিলে। তুমি অপূর্ণ জ্ঞান-বুদ্ধির মেয়ে।

আপনাকে আমি রাজত্ব ও নেতৃত্বের উচ্চাসন থেকে টেনে হেঁচড়ে নাময়ে অধঃপতনের নোংরা আঁস্তাকুড়ে ফেলতে চাই না। আপনার প্রিয় লোকদের কেউ কেউ মনে প্রাণেই তা চায়। যাদের প্রেম-ভালোবাসায় আপনি আজ উন্মত্ততা আর অন্ধত্ব বরণ করে ভাবছেন আপনি ও আপনার রাজত্ব নিরাপদ রয়েছে। আপনার অন্তরে শুধু এই তলোয়ারেরই প্রেম ভালোবাসা লালন করা উচিত।

আবদুর রহমান তলোয়ারটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুদ্দাসসিরাও নিশ্চুপ তার দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো।

আবদুর রহমানের মুখের বর্ণ ক্রমেই দীপ্তিময় হয়ে উঠলো। আচমকা তিনি উঠে দাঁড়ালেন। প্রহরীকে আওয়াজ দিলেন। প্রহরী দৌড়ে এলো।

সিপাহসালারকে গিয়ে বলো তার সব সালার ও নায়েবে সালারকে নিয়ে যেন এখনই আমার কাছে চলে আসেন।

মুদ্দাসসিরার দিকে তাকিয়ে তার মুখটি এক হাতে তুলে কপালে একটি গভীর চুম্বন একে বললেন,

মুদ্দাসসিরা! তুমি এখন যাও। তলোয়ারটি নিয়ে যাও। সময় হলে আমি এটি তোমার কাছ থেকে চেয়ে নেবো।

মুদ্দাসসিরার দুচোখ কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে উঠলো। কান্নার প্রবল একটা বেগ সামলে সে আর কিছু বলতে পারলো না। ধীর পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো।

***

সিপাহসালার ও সব সালাররা যখন তার সামনে গিয়ে বসলেন আবদুর রহমান তখন একজন বদলে যাওয়া মানুষ।

তিনি কামরায় পায়চারী করছিলেন। যেন এক বিজয় সালার দৃঢ় পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তিনি সালারদের সামনে গিয়ে বসলন। তার চোখের দৃষ্টিতে এমন এক দৃষ্টির বিচ্ছুরণ ঘটলো যে, সালারদের ওপর সেই আগের আবদুর রহমানের শ্রদ্ধাযুক্ত ভালোবাসা বিস্তার করলো।

সালারে আলা উবাইদুল্লাহ! তিনি বললেন, আমাকে সীমান্তের সঠিক খবর শোনান যা ফ্রান্সের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়েছে। আমাকে বলুন আমাদের আভ্যন্তরীণ অবস্থা কী? এও বলুন ফ্রান্সের ওপর হামলা করতে গেলে কী কী সমস্যায় পড়তে হবে?

দৃঢ় সংকল্প করে নিলে কোন সমসাই সমস্যা হয়ে সামনে দাঁড়াতে পারবে না। উবাইদুল্লাহ বলেন, বাস্তবতা ও সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, আমদে মাত্র কয়েকদিনের প্রস্তুতি দরকার।

উবাইদুল্লাহ আবদুর রহমানকে বিস্তারিত সব শোনালেন, বাইরে থেকে এবং ভিতর থেকে উন্দলুস কত বড় বিপদের মধ্যে রয়েছে। অন্যান্য সালাররাও আরো অনেক কিছু জানালেন। সবকিছু শুনে আবদুর রহমান যখন কথা বললেন তখন সবাই বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

আমরা ফ্রান্সের ওপর হামলা করতে যাচ্ছি। আবদুর রহমানের দৃঢ় গলা আন্দোলিত হলো, যেখানে ফেতনা আর ফ্যাসিবাদ লালিত পালিত হচ্ছে আমরা সে জায়গা একেবারে ধ্বংস করে দেবো।

সালারদের নিস্তব্ধতা নির্ভার হাসির মুখরতায় রূপান্তরিত হয়ে উঠলো। ওরা তো সবাই রণাঙ্গণের স্বপ্নপুরুষ। এই হুকুম শোনার জন্যই তো তারা ব্যাকুল ছিলেন। আবদুর রহমান হামলার পরিকল্পনা, কৌশল ও দিক নির্দেশনা দিতে শুরু করলেন।

যে সেনা ইউনিটগুলো অভিযানে বের হতে ও যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত তার থেকে কয়েকটি ইউনিট সালার মুসা ইবনে মুসার নেতৃত্বে কাল সকালে গোথাক মার্চ এর দিকে রওয়ানা হয়ে যাবে। আবদুর রহমান দৃঢ় কণ্ঠে বলে গেলেন,

কয়েকটি ইউনিট সালার আবদুর রউফের কমান্ডে ফ্রান্সের সীমান্ত অভিমুখে কোচ করবে।…..

মুসা ইবনে মুসা গোথাক মার্চের ওপর হামলা করবে। আর আবদুর রউফ সীমান্ত এলাকায় ছোট ছোট হামলা করবে এমনভাবে যাতে মনে হয় সীমান্ত পর্যন্ত এসব হামলা সীমাবদ্ধ থাকবে। আমি নিজে তোমাদের পেছন পেছন রওয়ানা হয়ে যাবো। আমার সঙ্গে উবাইদুল্লাহ, আবদুল করীম ও ফারতুনের সেনা ইউনিটগুলো থাকবে।…..

এদেরকে নিয়ে আমি ফ্রান্সের ওপর তীব্র হামলা চালাবো। তারপর সবগুলো ইউনিট আমার ডানে বামে এসে হামলা করে ফান্সের জয় পূর্ণ করবে।

ওখানকার অভিযান শেষ হলে আমরা আভ্যন্তরীণ চক্রান্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। সবার আগে জরুরি হলো, প্রতিবেশী যেসব দেশ থেকে এসব চক্রান্তের কলকাঠি নাড়া হচ্ছে তাদেরকে আগে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা। আমি এই যুদ্ধকে চূড়ান্ত যুদ্ধ হিসাবে দেখতে চাই।

সালাররা সবাই এ পরিকল্পনা পছন্দ করলেন। কিছু পরামর্শ দেয়া হলো। কিছু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলো। তারপর এমন এক কুশলী পরিকল্পনা নেয়া হলো, যার দ্বারা ফ্রান্সের সালতানাতে ইসলামিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হওয়াটা সুনিশ্চিত বলে দেখা যাচ্ছিলো।

***

তারপর আবদুর রহমানের বিন্যাস অনুযায়ী সেনাবাহিনী রওয়ানা হয়ে গেলো সীমান্ত এলাকা অভিমুখে। তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে কমপক্ষে বিশ দিন লেগে যেতে পারে। সালার মুসা ইবনে মুসা ও সালার আবদুর রউফ এর সেনা ইউনিট আগেই রওয়ানা হয়ে গেছে। দুদিনের বিরতিতে আমীরে উন্দলুস আবদুর রহমানও তার ইউনিট নিয়ে কোচ করলেন।

প্রায় অধিকাংশ সেনা ইউনিট নিয়ে যখন পুরো সেনাবাহিনী কর্ডোভা থেকে রওয়ানা করছিলো তখন এক ঘোড়সওয়ার সপাটে ঘোড়া ছুটাচ্ছিলো। তার গন্তব্য মারীদা।

যারিয়াব, সুলতানা, আবদুর রহমানের অন্যান্য প্রণয়নী রূপসী মেয়েরা এক উঁচু প্রান্তরে দাঁড়িয় অপসৃয়মান সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়েছিলো। শহরের হাজারো লোক সেনা দলকে খোদা হাফেজ জানাতে বাড়ির ছাদে উঠে দুহাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছিলো।

লোকটি কি সময়মতো পৌঁছতে পারবে? যারিয়াবকে সুলতানা জিজ্ঞেস করলো।

সময়ের আগেই পৌঁছে যাবে। যারিয়াব বললো।

আবদুর রহমানকে এই হামলার জন্য উস্কে দিতে মুদ্দাসসিরার অনেক বড় হাত রয়েছে। সুলতানা বললো, আবদুর রহমান এখনো তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মুদ্দাসসিরাকে আমি জীবিত রাখবো না।

চিন্তা ভাবনা করে যা কিছু করার করো সুলতানা! যারিয়াব বললো, মহলে এমন কোন আচরণ করবে না যাতে আবদুর রহমান সন্দিহান হয়ে উঠেন। তুমি মনে হয় এখনো বুঝতে পারোনি, আবদুর রহমান কতটা দূরদর্শী এবং দুঃসাহসী। চিন্তা করো না, তাকে মাঝ রাস্তা থেকেই ফিরে আসতে হবে।

যে ঘোড়সওয়ার একা উধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো তাকে যারিয়াবই পাঠিয়েছে।

মারীদা থেকে বিতাড়িত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার এখন এক যুদ্ধ শক্তি হয়ে উঠেছে। হাজারো খ্রিষ্টান তার দলে যোগ দিয়েছে। এর মধ্যে সেসব নওমুসলিম আছে যারা প্রকাশ্যে মুসলমান এবং গোপনে খ্রিষ্টানই রয়ে গেছে। এদেরকে বলা হতো মুআল্লিদীন।

এরা উন্দলুসের বিরুদ্ধে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তুলেছে এবং সেটাকে বিদ্রোহ আন্দোলনের রূপ দিয়েছে। ইতিহাসে যাকে তাহরীকে মুআল্লিদীন বলা হয়েছে।

ঘোড়সওয়ার রাতেই পৌঁছে গেলো মারীদা পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলে। সেখানে তাদের দল নেতাকে সংবাদ দিলো, আবদুর রহমান ফ্রান্সের ওপর হামলা করতে যাচ্ছেন।

আবদুর রহমান তার এই অভিযানের কথা এক প্রকার গোপনই রেখেছিলেন। কিন্তু যেখানে তোষামোদকারীদের অস্তিত্ব আছে সেখানে তারা জামার আস্তিনে লালিত পালিত ভয়ংকর সাপ হয়ে উঠতে সময় নেয় না।

পনের ষোল দিন পর সালার মুসা ইবনে মুসা ও সালার আবদুর রউফ যার যার নির্ধারিত রণাঙ্গনস্থলে পৌঁছে গেলেন। আবদুর রহমানও তার পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্ধেক পথ অতিক্রম করে গেছেন।

এ সময় মারীদা থেকে এক সেনা কমান্ডার পথিমধ্যে আবদুর রহমানের কাছে গিয়ে পৌঁছলো। সে তাকে ভয়ংকর এক সংবাদ দিলো যে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার মারীদার ওপর হামলা করেছে। মারীদার গভর্ণরকে গ্রেফতার করেছে। আর খ্রিষ্টানরা সারা শহরে লুটপাট চালাচ্ছে। সেখানে এখন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারের হুকুম চলছে।

আবদুর রহমান ফ্রান্সের দিকে তার অগ্রগামীতা স্থগিত করে দিলেন। পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে তিনি মোটেও বিলম্ব করলেন না।

দ্রুত গতির এক সংবাদবাহককে এই পয়গাম দিয়ে সালার আবদুর রউফের দিকে পাঠালেন যে, তিনি সংবাদ প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে অভিযান মুলতুবী রেখে যেন তীব্র বেগে মারীদা অভিমুখে রওয়ানা দেন। আবদুর রহমান আরো নির্দেশ দেন, মারীদা পৌঁছেই কাল বিলম্ব না করে মারীদা অবরোধ করে নেবে।

আবদুর রহমান ফ্রান্সের ওপর হামলা মুলতুবী রেখে ঝড়ো বেগে তার সেনা ইউনিটগুলো নিয়ে মারীদার দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন।

উন্দলুসের কালনাগিনী ইতিমধ্যে স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ পুরুষকে তার ভয়ংকর ছোবল হানতে সফলই হয়েছে।

***

ক্রুশ-কে কেন্দ্র করে সেদিনই ক্রুসেডের যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিলো যেদিন গির্জার পূজারীরা অনুভব করলো ক্রুশের ওপর কালেমায়ে তায়্যিবার প্রাধান্য বিস্তার শুরু হয়ে গেছে।

এটা সুলতানা সালাহউদ্দিন আইয়ূবীরও অনেক আগের কথা। ইসলাম যখন রোম সাগর অতিক্রম করে খ্রিষ্টজগতে মহাজাগরণ হয়ে প্রবেশ করলো তখন থেকেই ক্রুশের পূজারীরা কোমরে গামছা বেঁধে ইসলামের বিরুদ্ধে আদা জল খেয়ে লেগে পড়ে।

প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হয়ে ময়দানে নেমে পড়ে। যেটা আগে ছিলো রাজায় রাজায় যুদ্ধ সেটাকে বলা হতে লাগলো দুই ধর্মের যুদ্ধ।

মুসলমানরা সবসময় একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে হাতে তলোয়ার নিয়েছে। যুদ্ধের কলা কৌশল ও নেতৃত্বদানে তারা বিশ্বজোড়া দক্ষতা-খ্যাতি অর্জন করে অল্প সময়েই। প্রতিটি রণাঙ্গনে তারা তাদের অসাধারণ রণাঙ্গনীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে।

নিপুণ নেতৃত্বদান ও গেরিলা কৌশল এবং অদৃশ্য বিজয়ী স্পৃহা স্বল্পসংখ্যক সেনাদল নিয়ে পাঁচ থেকে দশগুণ সেনা শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে থাকে মুসলমানরা।

মুসলমানরা যে এলাকা জয় করতে সে এলাকা তলোয়ার দিয়ে নয়, প্রেম, ভালোবাসা, চারিত্রিক মধুরিমা দিয়ে সে এলাকার মানুষের মন জয় করে নিতো।

খ্রিষ্টজগত ইসলামের অপ্রতিরোধ্য বিজয় ও সাফল্য দেখে নিজেদের যুদ্ধ শক্তির সঙ্গে অন্যান্য কলা-কৌশলও ব্যবহার করতে শুরু করলো। সেটা হলো মাটির নিচ থেকে চক্রান্তের জাল বিস্তার করা। মানুষের মানবিক দুর্বলতা, নারীর রূপ-সৌন্দর্য, শাসন ক্ষমতা ও ধন-সম্পদের লোভকে গির্জার পূজারীরা ব্যবহার করতে শুরু করলো।

মুসলিম আমীর উমারা, ওযীর, হাকিম, সালার, সিপাহসালারদের মধ্যে নারী ও সম্পদের লোভ জাগিয়ে ক্রমেই তাদেরকে জাতির গাদ্দারে কাতারে নিয়ে দাঁড় করালো।

ইসলামের সবচেয়ে বড় ও ভয়ংকর শত্রু ইহুদীরা মাটি খুঁড়ে উঠা এসব ষড়যন্ত্র ও পায়তারার পক্ষে সর্বশক্তিতে হাওয়া দিয়ে গেলো। ইহুদীরা খ্রিষ্টানদেরকে নতুন নতুন ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টির মাল মশলা জোগাড় করে দিলো। নিজেদের অতি সুন্দরী ও চরিত্রহীন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তা অসংখ্য মেয়ে সরবরাহ করলো।

খ্রিষ্টানরা এই মায়াবী কৌশলের সাফল্য দেখে নিজেদের মেয়েদেরকেও এ কাজে ব্যবহার করতে শুরু করলো এবং তাদেরকে মুসলিম আমীর উমারাদের মহলে ঢুকিয়ে দিলো।

ইসলামের মূল ভিত্তিকে বিকৃত করার জন্য ওরা এমন এমন আলেম শ্রেণী গড়ে তুললো যারা কুরআন হাদীসের শিক্ষা নিয়ে মসজিদে মসজিদে ইমামের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়লো এবং মনগড়া তাফসীর ও জাল হাদীস শুনিয়ে মুসল্লীদেরকে বিভ্রান্ত করতে লাগলো।

এভাবে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওরা চিন্তা-চেতনা, আকীদা বিশ্বাস ও আদর্শিক সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়।

আর এর বিপরীতে মুসলিম পথনির্দেশক ও শাসক শ্রেণীর চিন্তা-চেতনা তিমির থেকে তিমিরেই তলিয়ে যেতে থাকে।

ইহুদী-খ্রিষ্টানদের পাতা মায়াবী জালে তারা বড় আয়েশী ভঙ্গিতে পা দিতে থাকে। নিজেদের ওপর ক্ষমতার নেশা সওয়ার করে তাতেই বুঁদ হতে থাকে। অনেক সালার ও সিপাহসালারকে ক্ষমতার লোভী বানিয়ে তাদেরকে গৃহ-যুদ্ধে নামিয়ে দেয়।

যারা এসব গৃহ-যুদ্ধের অবতারণা করে দেশের ছোট-বড় অংশের ক্ষমতা পেলো তারা সে অঞ্চলগুলোকে এত দুর্বল করে ছাড়লো যে, সেটা দেশ ও জাতির অতি রুগ্ন অংশ হয়ে উঠলো। রণাঙ্গন ছেড়ে ওরা প্রশাসন চালাতে এসে চরম অযোগ্যতা ও অক্ষমতার পরিচয় দিলো।

এদের মধ্যে যাদের সামান্যতম মেধা-বুদ্ধি ছিলো তাও তোষামোদকারীরা অকেজো করে দেয়। কল্পজগতে তাদেরকে প্রজাপ্রিয় ও সপ্ত মহাদেশের বাদশাহ বানিয়ে দেয়।

মতাদর্শিক ও বিশ্বাসগত স্নায়ুযুদ্ধে জয় হয় সে জাতি, যাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের কোন ব্যক্তিগত লোভ ও স্বার্থ কাজ করে না।

যারা নিজেরা ব্যক্তির উর্ধ্বে উঠে সব চিন্তা চেতনাকে কার্যকর করে এবং বাইরের কোন প্রভাব, উস্কানি কিংবা কোন লোভ লালসার সামনে নিজেদেরকে বিকিয়ে দেয় না। তারা শত্রুকে শত্রুই মনে করে। নিজেদেরকে বাদশাহ মনে করে তৃপ্ত থাকে না।

কিন্তু মুসলিম শাসকদের মধ্যে এ গুণটি খুব কম সময়েই দেখা গেছে। আল্লাহ তাআলার দেয়া শাসন ক্ষমতাকে তারা ব্যক্তিগত শাসন ক্ষমতা মনে করতে লাগলো। আর ইসলামের দুশমনরা তো তাদের মধ্যে এ মনোভাবই জাগিয়ে তুলতে চাইতো।

***

৮২২ থেকে ৮৫২ খ্রিঃ উন্দলুসের এক উত্তাল কাল। সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ, ওযীর ও সালার হাজিব আবদুল করীম, সালার আবদুর রউফ, সালার মুসা ইবনে মুসা, সালার ফারতুন উন্দলুসের শাসক আবদুর রহমানকে এমনই এক মায়াবী জালের ভেতর থেকে টেনে তুলেন।

অবশ্য এতে মুদ্দাসসিরা নামের অতি রূপসী ও ঈমানদীপ্ত এক নারীর কথা না বললে তার প্রতি অবিচারই করা হবে। মুদ্দাসসিরার পবিত্র স্পর্শেই আবদুর রহমান অনেকটা জেগে উঠেন।

যারিয়াব ও সুলতানার মায়াবী জালের কঠিন নিগড় থেকে তারা ছাড়া আর কেউ মুক্ত করে আবদুর রহমানকে রণাঙ্গনে নিয়ে যেতে পারতেন না।

আবদুর রহমান যখন সেনাবাহিনরি মূল অংশ নিয়ে ফ্রান্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছিলো, এই সেই আবদুর রহমান নন যিনি মহলের মাদকীয় আচ্ছন্নতায় বিভোর হয়ে থাকেন।

তার চোখ মুজাহিদীনে ইসলামের উজ্জল দীপ্তিতে পূর্ণ ছিলো। তার দেহের ভাষা ছিলো ঋজুতোয় দৃঢ়। তিনি আপাদমস্তক সিপাহসালার বনে গিয়েছিলেন। তার মন-মস্তিষ্ক কর্মতৎপর সালারের মতো ধারালো হয়ে উঠলো।

তার কাছে যখন খবর পৌঁছলো মারীদায় বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এবং এর নেতৃত্ব দিচ্ছে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার, তার চেহারায় তখন সামান্যতম দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েনি। যেন তার জন্য এ খবর প্রত্যাশিতই ছিলো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে নিলেন এবং ফ্রান্সের দিকে অগ্রসরমান অভিযান মুলতবী রাখলেন।

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারকে যখন দুর্নীতির অভিযোগে মারীদার গভর্ণরের পদ থেকে পদচ্যুত করা হলো তখন খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীদের সবচেয়ে বড় দুই লিডার ইউগেলিস ও ইলওয়ার মারীদায় পৌঁছে গেলো।

তারা সেখানে অনেকটা গা ঢাকা দিয়ে রইলো। গোপন এক জায়গায় মারীদার সব গির্জার পাদ্রীদের ডেকে বেশ কিছু দিক নির্দেশনা দিয়ে দিলো।

তাদের দিক নির্দেশনা মতে পাদ্রীরা লোকদেরকে বলতে লাগলো, মারীদার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে গোলাম বানানোর জন্য অনেক বড় ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। খ্রিষ্টানরা যদি এ বোঝা মাথা পেতে নেয় তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই এই বোঝার নিচে চাপা পড়ে তারা ভিখিরী হয়ে যাবে।

লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার জন্য তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে। আর মুসলমানরা সহজেই তাদেরকে নিজেদের গোলাম বানিয়ে নেবে। এর একমাত্র প্রতিকার হলো, কর্ডোভায় কেউ যেন ট্যাক্স না দেয়। প্রতিটি গির্জায় রাত দিন এভাবে ক্ষোভ ছড়িয়ে দিতে লাগলো পাদ্রীরা।

এর মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার তার লুটেরা বাহিনী দিয়ে ট্যাক্স উসুলকারী সরকারি কর্মকর্তাদেরকে হত্যা করায়। এর সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করিয়ে দেয়, এখন থেকে ধার্যকৃত ট্যাক্সের অর্ধেক দিলেই চলবে এবং তার লোকেরা ট্যাক্স উসুল করবে।

ট্যাক্স উসুলকারি কর্মকর্তাদেরকে শহরের বাইরে জঙ্গুলে এলাকায় হত্যা করে সেখানেই লাশ দাফন করে দেয়া হয়।

তারা যখন সময়মতো অফিসে ফিরে আসলোনা তখন সংশ্লিষ্ট অফিসের লোকেরা তাদেরকে খুঁজতে শুরু কররো। কিন্তু কোথাও তাদের কোন হদিস পাওয়া গেলো না। এদিক ওদিক লোকদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোন সদুত্তর মিললো না।

কিছুদিন পর জানা গেলো, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার ট্যাক্স উসুল করে নিয়েছে। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। সাধারণ লোকেরাও যেহেতু অর্ধেক পয়সা বেঁচে যাওয়ায় তার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলো তাই তারাও তার কোন হদিস দিলো না।

ইউগেলিস ও ইলওয়ার শহরের আনাচে কানাচে ও দূর দুরান্তের গ্রামে ঘুরে লোকদেরকে ধর্মের নামে ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলে উস্কে দিতে লাগলো। তারা বলতে লাগলো,

আমাদের বাদশাহ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার। এখন মারীদা ও আশপাশের এলাকা স্বাধীন। তাই প্রত্যেকে যেন আজ থেকেই সৈনিক হয়ে যায়। মারীদার বর্তমান গভর্ণর আমাদের হাতে বন্দি। এজন্য এখন কর্ডোভা থেকে ফৌজ আসবে। এই ফৌজের মোকাবেলা করা আমাদের এখন বড় কর্তব্য কাজ। নিশ্চয় উন্দলুসকে মুসলমানদের কবল থেকে মুক্ত করার সৌভাগ্য মারীদার লোকদেরই হবে।

লোকেরা দলে দলে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারের ঝান্ডাতলে জমা হতে লাগলো। গোপনে চলতে লাগলো তার জঙ্গি প্রস্তুতি। মারীদার প্রশাসন এ ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ রইলো। অবশ্য তাদের লোকবলও খুব বেশি ছিলো না।

***

এক রাতে প্রতিটি ঘরে বড় গোপনে খবর পৌঁছে গেলো, কাল সকালৈ নাকারা বেজে উঠতেই লোকেরা যেন সশস্ত্র হয়ে ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে আসে। তারপর গভর্ণর মহলে হামলা করে গভর্ণরকে গ্রেফতার করা হবে।

মারীদার গভর্ণ তো এটা জানতে পেরেছিলেন, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার এ অঞ্চলের পুরো ট্যাক্স উসুল করে নিয়েছেন। কিন্তু তার এতটুকু সন্দেহ কোন দিন হয়নি যে, মারীদার লোকেরা মুহাম্মদের ফৌজ বনে গেছে। যেকোন সময় এর বিস্ফোরণ ঘটবে।

মারীদার অধিকাংশ এলাকাতেই খ্রিষ্টানদের প্রাধান্য রয়েছে। যেসব খ্রিষ্টান ইসলাম গ্রহণ করে তারাও গোপনে খ্রিষ্টানই রয়ে যায়। আরব থেকে আসা মুসলিম পরিবারগুলো ভিন্ন অভিজাত এলাকায় থাকে। শহরে কি হচ্ছে সেটা তো তাদের জানার কথা নয়।

ঐতিহাসিকরা পরিস্কার ভাষায় লিখেছেন, আরব থেকে যে সব মুসলমানরা সরকারি বিভিন্ন পদে চাকরি নিয়ে উন্দলুসে এসেছে তাদের আচার ব্যবহার ছিলো আপত্তিজনক।

এরা নিজেদেরকে উন্দলুসের বিজয়ী ও শাসক শ্রেণীর লোক বলে মনে করতো। রাজকীয় ঢঙে চলাফেলা করতো। খ্রিষ্টান নাগরিকদের থেকে নিজেদেরকে বেশ দূরত্বে রাখতো। তাদেরকে এড়িয়ে চলতো। আর কেউ মুসলমান হয়ে গেলে মুসলমান হিসেবে তাকে মূল্যায়ন করতো না। তাদের সঙ্গে কর্কশ ভাষায় কথা বলতো, সামান্য ছুতোয় রূঢ় আচরণ করতো।

এই আপত্তিজনক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নওমুসলিমদের মনে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা না জন্মে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। যেটা ক্রমেই ঘৃণা এবং বিদ্রোহের পরিণতিতে পৌঁছে।

খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠি যখন কোন বিশৃংখলা করতো, কোন চক্রান্ত করতো তখন সেটা দেখার মতো কিংবা তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার মতো কাউকে পাওয়া যেতো না। তারা মাটির নিচ থেকে সর্বত্র চক্রান্তের জাল বিছিয়েও মুসলমানদের কাছ থেকে তা গোপন রাখতে পারতো।

তাদের সাফল্যের এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় কারণ।

আর গভর্ণরের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এতই দুর্বল ছিলো যে, তারা এটাও অনুসন্ধান করে জানতে পারতো না শহরে কী হচ্ছে।

মারীদার গভর্ণরের নিরাপত্তা বাহিনী সংখ্যায়ও ছিলো কম। কয়েকজন বডিগার্ড ও আধা ইউনিট সেনা সদস্য। মারীদার মতো শহরের জন্য এ পরিমাণ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য যথেষ্টই কম বলা যায়।

***

এখনো মাঝ রাত পেরোয়নি। গভর্ণর মহল ও আরব্য মুসলমানদের এলাকা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শহরের এক অংশ ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু শহরের বড় এক অংশ তখনো জেগে আছে। প্রতিটি ঘরে প্রত্যেক সদস্য সশস্ত্র হয়ে নিচ্ছে। বাইরের বিশাল এক ময়দান সশস্ত্র লোকে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার দরবেশের ছদ্মবেশে আগেই শহরে এসে বসে আছে। সে পর্যন্ত তার সশস্ত্র লোকের সংখ্যা (ঐতিহাসিকদের মতে) চল্লিশ হাজারে পৌঁছে গেছে।

জানা কথাই, এ এক অনিয়মিত ফৌজ। যাতে শহরবাসীই বেশি এবং ছাটাই করা পুরনো কিছু সেনাবাহিনীর সদস্যও এ দলে আছে।

অর্ধেক ফৌজ শহরের বাইরে শহরের প্রধান ফটক খোলার অপেক্ষায় রয়েছে।

আচমকা শহরের ভেতর শোরগোল উঠলো। যেটা গভর্ণরের মহলের কাছে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি ও উদ্ধত শ্লোগানে পরিণত হলো। মারীদার গভর্ণরের বডিগার্ডরাও সামান্য যে সেনা সদস্য ছিলো তারা পুরোপুরি জেগে উঠারও সুযোগ পেলো না।

গভর্ণরের চোখ যখন খুললো তখন তার চারপাশে আট দশজন লোক। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাতে নাঙ্গা তলোয়ার। তারা তাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে বাইরে নিয়ে গেলো।

বাইরে এমন হৈ চৈ, চিৎকার চেঁচামেচি যে, নিজের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না।

হাজার হাজার মশালের জ্বলন্ত ফুলকি যেন এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। অসংখ্য ঘোড়া চারদিকে ছুটাছুটি করছে। মুসলমানদের বাড়িগুলো থেকে ওঠা আগুনের শিখা যেন আকাশকে ছাড়িয়ে যেতে যাচ্ছে। মুসলমানদের বাড়ি ঘরগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে। এর আগে সেখানে লুটপাট চালানো হয়েছে।

আমার মুহাফিজরা কোথায়? এসব কী হচ্ছে? মারীদার গভর্ণর গর্জন ছেড়ে বললেন।

ওদেরকে তোমার আগেই কয়েদখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এক বিদ্রোহী নেতা বললো, আর তোমার হাতে গোনা ফৌজকে নিরস্ত্র করে এদের আশেপাশে প্রহরা দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে।…..এটা বিদ্রোহ হচ্ছে। তোমাদের সব শাসন ক্ষমতা খতম হয়ে গেছে। তুমি এখন আর আমীর নও, আমাদের হাতে-বন্দি।

তাকে বড় একট রাজকীয় কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে ফানুস জ্বলছে। এটা গভর্ণরের এজলাস কক্ষ। সেখানে এখন কয়েকজন লোক বসে আছে। তাকে একজনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। গভর্ণর লোকটিকে দেখে চমকে উঠলেন।

তুমি? তিনি সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার?…..আরে ডাকাতের গোদা! এসব তোমারই শয়তানি?

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার হো হো করে হেসে উঠলো।

আমার কাছে জবাবদিহি চওয়ার সময় এখন আর নেই, মুহাম্মদ হাসতে হাসতে বললো, তোমার রাগ-অভিমান এখন কচুর পাতা…..বাকি জীবন তোমার কয়েদখানায় পড়ে থাকতে হবে।

হায়রে বেকুব গাদ্দার! মারীদার আমীর বললেন, নিজের পরিণামের কথা এভাবে ভুলে যেয়ো না। গাদ্দাররা কোন বাদশাহকে কতল করতে পারে ঠিক; কিন্তু বাদশাহ হতে পারে না। মাত্র কয়েকদিনই ক্ষমতার নেশা উপভোগ করে নিতে পারবে। তারপর নিজের পরিণাম নিজের চোখেই দেখতে পাবে।…..

যারা আজ তোমাকে কাঁধে করে এ পর্যন্ত এনে এই আসনে বসিয়েছে তারাই একদিন তোমাকে আমাদের অনুগ্রহ আর করুণার ওপর একলা ফেলে রেখে এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পালিয়ে যাবে।

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বার এখন বিজয় ও ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। গভর্ণরকে সে কোন পাত্তা দিলো না। তার কথা শুনবে কখন! চোখেমুখে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললো,

ওকে নিয়ে যাও।…..ওর সারা খান্দানকে কয়েদখানায় ছুঁড়ে মারো।

গভর্ণরের সীমিত সেনা সদস্যদের নিরস্ত্র করে তাদেরকে সশস্ত্র প্রহরার বেষ্টনীতে রাখা হয়েছে। যে দিকেই চোখ যাচ্ছে সেদিকেই আগুনের জ্বলজ্বলে শিখা দেখা যাচ্ছে।

গভর্ণরের এক সেনা কমান্ডার একটি গাছের ঝোঁপের আড়ালে অনেকক্ষণ লুকিয়ে রইলো। তারপর সুযোগ বুঝে গাছে চড়ে বসলো। শহর জুড়ে তখন কেয়ামতের বিভীষিকা চলছে। মুসলমানদের ও বিত্তশালী খ্রিষ্টান ব্যবসায়ীদের ঘরে লুটপাট চলছে। জ্বলছে বহু বাড়ি ঘর।

কমান্ডার গাছের ওপর বসে পালানোর পরিকল্পনা করতে লাগলো। এর নিচে এক ঘোড়সওয়ার প্রহরী টহল দিচ্ছে। কায়দা করে প্রহরীর ঘোড়ার ওপরই লাফিয়ে পড়লো কমান্ডার। পর মুহূর্তেই তার হাত থেকে তলোয়ার ছিনিয়ে নিলো এবং তার ঘাড়ের অর্ধেক এক কোপে কেটে ফেললো। প্রহরী ঘোড়া থেকে কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে পড়ে গেলো। কমান্ডারও ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো উধ্বশ্বাসে।

শহরের ফটক তো তখন অবারিত। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল জব্বারের বাইরে থাকা সশস্ত্র ফৌজ শহরের ভেতর ঢুকছে। শহরের ভেতরের আতংকিত-ভীতসন্ত্রস্ত লোকজন বাইরে যাচ্ছে। লুটপাট ছুটাছুটির মধ্যে কে কোথায় যাচ্ছে আসছে সেদিকে তাকানোর মতো অবস্থা নেই কারো।

কমান্ডার এই চরম হুলুস্থুল অবস্থার মধ্যে নির্বিঘ্নে শহর থেকে বেরিয়ে গেলো। কর্ডোভার দিকে ঘোড়া ছুটালো। তার সামনে দীর্ঘ পথ। দ্রুত পৌঁছে মারীদার বিদ্রোহের খবর দিতে হবে তাকে। বাকি রাত ঘোড়া ছুটিয়েই কাটালো সে।

সকাল হলো, সূর্য মাথার ওপর উঠে এলো। কিন্তু সে থামলো না।

এক জায়গায় সে উন্দলুসের দুই সেনা সদস্যকে দেখতে পেলো। তাদের কাছে গিয়ে জানতে পারলো, তারা বিশেষ কাজে কর্ডোভা থেকে অন্য এক শহরে যাচ্ছে। তাদেরকে মারীদার অবস্থা জানিয়ে বললো, সে এখন কর্ডোভায় এ সংবাদ জানাতে যাচ্ছে।

কর্ডোভা গিয়ে কী করবে? এক সৈনিক বললো, আমীরে উন্দলুসকে তুমি ফ্রান্সের পথে পাবে। ফ্রান্সের ওপর হামলা করতে যাচ্ছেন তিনি পুরো সেনাবাহিনী নিয়ে। তুমি সেদিকে চলে যাও। পথ চেনা আছে তো?

হ্যাঁ, চেনা আছে।

অনবরত সফরে কমান্ডারের ঘোড়া তখন বেশ ক্লান্ত। তারা তাদের একটি তাজাদম ঘোড়া দিয়ে দিলো। তাজাদম ঘোড়া পেয়ে এবার তার ছুটার গতি আরো তীব্রতর হয়ে উঠলো। ঘুম, ক্লান্তি, ক্ষুধার উর্ধ্বে উঠে সে প্রায় উড়ে চললো।

অবিশ্বাস্য কম সময়ে আমীরে উন্দলুস আবদুর রহমানকে সে পেয়ে গেলো।

আবদুর রহমান তার সেনাবাহিনীর অভিমুখ করে দিলেন মারীদার দিকে।

***

সালার আবদুর রউফকে ফ্রান্সের অভিযান থেকে ফিরে আসতে হলো। তীব্র গতিতে তিনি এগিয়ে আসতে লাগলেন। তিনি সবচেয়ে বেশি মারীদার কাছে ছিলেন। ওদিক থেকে আবদুর রহমনও যথাসম্ভব দ্রুত তার সেনাদল নিয়ে এগিয়ে আসছেন।

আবদুর রহমান সৈনিকদের মধ্যে যারা তবলা, নাকারা বাজাতে পারে, যুদ্ধ সঙ্গীত গাওয়ার মতো যাদের সুকণ্ঠ রয়েছে তাদের সেনাবাহিনীর মাঝখানে অবস্থান দেয়া হলো। যাতে তাদের আওয়াজ দলের শেষ সৈনিকটি পর্যন্ত পৌঁছে।

সারেঙ্গীবাদকদেরকে বলা হলো, তারা যেন এমন উত্তেজক বাদ্যযন্ত্র বাজায় যাতে রক্ত টগবগ করে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াগুলোও উত্তেজিত ও তীব্র গতির হয়ে উঠে। সৈনিকদের তো রক্ত গরম করা এমন উত্তেজক সঙ্গীত ভালোই জানা ছিলো।

কিছুক্ষণ পরই রক্ত টগবগ করা বাদ্যের দামামা ও যুদ্ধ সঙ্গীতের অনলবর্ষী ছন্দায়িত গর্জনে যেন কাছে-দূরের পাহাড়গুলোও হেলে উঠতে লাগলো।

ওরা গাইছিলো এক আরবী সঙ্গীত। উন্দলুসের বিজয় উপলক্ষ্যে শতবর্ষ আগে এক বিখ্যাত কবি খাদ্দান তুসী এটা রচনা করেন।

সমুদ্রের জ্বলোচ্ছাসে ভরা তরঙ্গ
মহাসাগরের একেকটি পৰ্বতীয় ঢেউ চতুরঙ্গ
মন্থন করে, পায়ে পিষে
খোদার সিংহপুরুষ যারা ছিলেন
রণ-হাওয়ার শাহবাজ হয়ে যারা এলেন
রাসূলের (সা) প্রতি উৎসর্গ প্রাণ
অকাতরে করে গেলো দান।
ভয় পায়নি সমুদ্রের চোখ রাঙানি
বিন্দু বিন্দু করে দিয়েছে সিন্ধু,
ঢেউ, তরঙ্গের পাহাড় খন্ড।
সাইক্লোন, ঝড়, টর্নেডো থাকেনি আর অখন্ড।
 থমকে গেছে আকাশের বিদ্যুৎ চমক
যখন শুনেছে তারেক অগ্নি সেনাদের বজ্ৰধমক।
এগিয়ে এসেছে সমুদ্র তীর যেন পায়ে হেঁটে
 সিজদাবনত হয়ে-বিনীত কণ্ঠে বলে,
 মুজাহিদরা! বিশ্বজয়ী বীর যোদ্ধারা।
ছিলো তো তোমাদেরই প্রতীক্ষা
শতাব্দীর অগ্নিপরীক্ষা।
ফেলে আসা পথের দিকে আর তাকিয়ো না
ওখানে লেখা নেই তোমাদের জন্য কোন গৌরবনামা
তারেকের ভেতর কুদরতী হাত জ্বেলে দিলো এই অগ্নিবীনা।
 দৃপ্ত পদের মুজাহিদরা!
জ্বালিয়ে দাও স্মৃতি তাড়ানো ঐ কিশতীগুলো
 ফিরে যাওয়ার রাহা রুদ্ধ,
শুধু সামনে এগিয়ে যাও, প্রত্যেকেই হয়ে যাও
 ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ ঝড় অপ্রতিরোধ্য।
ফিরে যেতে হলে
প্রাণ যাবে না-যাবে না বুকের এক ফোঁটা নিঃশ্বাস
 যাবে নিঃসাড় লাশ।
তারপর তো এগিয়ে যাওয়ার গল্প
সৈন্য সংখ্যা তো ছিলো বড় স্বল্প
 লড়তে লড়তে, কাটতে কাটতে
 মরতে মরতে, মারতে মারতে
আছড়ে পড়লো কিছু এখানে,
 ঝাঁপিয়ে পড়লো কিছু সেখানে।
তাণ্ডবলীলা করতে করতে প্রাচীর হয়ে এগিয়ে এলো
জালিম আর কুফরের পাহাড়
ফেটে গেলো, হটে গেলো
হাজারো জয়ের বদ্ধ পথ খুলে দিলো
অবিরত অগ্রসরমান মুজাহিদ দল
 চূড়াস্পশী সংকল্প, কী ভীষণ
ঈমানের শক্তি-বল।
উন্দলুসের মাটি-উঠলো হেলে দুলে,
আজানের মর্ম সুরে
কুরআনের গভীর আহবানে
রাসূলের (সা) জীবন্ত অনিঃশেষ বাণীতে।
সেই সুরের মধুর গুঞ্জরণ, আওয়াজের স্মারক
 লেখা হয়েছে মুজাহিদদের তপ্ত রক্তে।
আমাদের ওপর রয়ে গেছে রক্তের করজ
এটা আমাদের ফরজ
সেই রক্তের ঋণ শোধ দাও
 মুজাহিদরা!
বাঁধভাঙ্গা জলোচ্ছাসের মতো এগিয়ে যাও।
জালিম-কুফরের পাহাড় আজ
 আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে, ভেঙ্গে পড়ছে,
 চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে।
 ঈমানের দীপ্তিতে সেজে নাও
রণ সাজ।
মুজাহিদ! মুজাহিদ।
তছনছ করে দাও– চূর্ণ বিচূর্ণ
মুখ-মুখরিত রাখো-আল্লাহ আল্লাহ।
 লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ!
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ!!

***

এই ঐতিহাসিক যুদ্ধসঙ্গীত মুজাহিদদের জোশ-জযবা, উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুললো। আবদুর রহমান এটাই চাচ্ছিলেন। ঘোড়াগুলোর চলায় যেন ক্ষুরাঘাতে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো।

আবদুর রহমানের দেহেও যেন নব উদ্যোমের রক্ত ও ভরে দিয়েছে। দারুণ সতেজ তিনি।

তিনি ঝাণ্ডাধারীর হাতে ধরে রাখা ঝাটির দিকে তাকালেন। সেটা এমন পত পত করে উড়ছে যেন সৈনিকদের রণসঙ্গীত ও দৃপ্ত হুংকার এর মধ্যেও নতুন প্রাণ ভরে দিয়েছে। কাপড়ের এই টুকরোর মধ্যেও যেন এই উপলব্ধি জেগে উঠেছে, কুফুরের ঐ কালো পাহাড়ের হৃদপিন্ড ভেদ করে তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে হবে।

আবদুর রহমান চলন্ত অবস্থায় তার বাম দিকে তাকালেন। তার চোখ পড়লো সালারে আলা উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহর ওপর। আব্দুর রহমান তার ঘোড়া উবাইদুল্লাহর ঘোড়র কাছে নিয়ে গেলেন।

উবাইদুল্লাহ! আব্দুর রহমান বললেন, যেদিন এমন রক্ত বিশুদ্ধ করা ঈমান জাগানিয়া রণসঙ্গীত থেকে মুসলমানরা মুখ ফিরিয়ে নেবে সেদিনই মুসলমানদের পতন শুরু হয়ে যাবে।

সঙ্গীতে এমন এক শক্তি আছে যে, তা ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে তুলে, উবাইদুল্লাহ বললেন, কিন্তু সঙ্গীতে এই অপশক্তিও আছে যে, জাগ্রত আত্মাকে তা চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। রক্ত যেমন উত্তপ্ত করে তুলে তেমনি রক্ত হিম শীতলও করে দেয়। এটা শ্রোতার ওপর নির্ভর করে যে, সে কোন ধরনের সঙ্গীত পছন্দ করে।

এমন শক্তি রয়েছে নারীর মধ্যেও। আব্দুর রহমান বললেন, একজন নারী তলোয়ারের তীক্ষ্ম ফলার মতো। আবার কোষবদ্ধ তলোয়ারও একজন নারী। তীব্র ধারযুক্ত তলোয়ারকে অকেজো করে দিতে পারে একজন নারী। দুই রূপেই আমি নারীকে দেখেছি। আমার হাতে তো মুদ্দাসসিরা নামের এক নারীই তলোয়ার উঠিয়ে দিয়েছিলো।

আর আপনার তলোয়ার কোষবদ্ধ করে কে রেখেছিলো?

আব্দুর রহমান উবাইদুল্লাহর এ কথায় চমকে উঠে তার দিকে তাকালেন। যেন বেখেয়ালে কথা বলতে বলতে আচমকা সম্বিৎ ফিরে পেয়েছেন।

উবাইদুল্লাহ তার মুখের বিব্রত অবস্থা দেখে এ বিষয়ে আর এগুলেন না। তিনি বুঝতে পারছেন, আব্দুর রহমানের স্মৃতির পাখা উড়ে গেছে তার মহলের দিকে। যেখানে যারিয়াবের মাতাল করা সঙ্গীত ও সুলতানার অবাধ্য রূপ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

উবাইদুল্লাহ মারীদা অবরোধের ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করলেন। আব্দুর রহমান লড়াইয়ের ময়দান থেকে ফিরে যাননি এটা দেখে উবাইদুল্লাহ বেশ স্বস্তিবোধ করলেন।

মারীদার বিদ্রোহ দমনের ব্যাপারে আব্দুর রহমানও বেশ উৎসাহ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথার সুরে দারুণ এক আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া অনুভব করলেন উবাইদুল্লাহ। মারীদা এখনো বেশ দূর। কর্ডোভার সেনাদল অবিরত তাদের চলার গতিতে। একটা ছাউনি ফেলা তো জরুরী হয়ে উঠেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *