১. উন্দলুস কী নাগিন

কাল নাগিনী / মূলঃ এনায়েতুল্লাহ আলতামাস / অনুবাদঃ মুজাহিদ হুসাইন ইয়াসীন

আমার কথা

‘উন্দলুস কী নাগিন’ এর রূপান্তরিত নাম কাল নাগিনী। স্পেনে মুসলমানদের আটশ বছরের শাসনকাল বিশ্ব ইতিহাসে আনন্দ বেদনার স্মৃতি হয়ে আছে। আজো শত কোটি মুসলমানের মনের জিজ্ঞাসা অস্কুট আর্তনাদ হয়ে উঠে- কেন স্পেনে মুসলমানরা এক গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেও ব্যর্থতার গ্লানিতে নিজেদের ভাগ্যকাশকে কালিমাযুক্ত করলো? অলৌকিকতার দীপ্তিতে পূর্ণ এক জয়কে কি করে পরাজয়ের বেদনা বিদূর অনাকাংখিত এক অধ্যায়ে রূপান্তরিত করলো? এ জন্য কারা দায়ী? কেনই বা দায়ী? আসল খলনায়ক কারা? তাদের পরিণতি হয়েছিলো কেমন?

 এধরণের অসংখ্য ব্যক্ত-অব্যক্ত জিজ্ঞাসা ও রহস্যময়তার নাটকীয় সমাধান দিয়েছেন এনায়েতুল্লাহ আলতামাস এই কালনাগিনীতে। শুধুই দুর্লভ নয়, ইতিহাসের অচেনা-অজানা দরজা খুলে দিয়েছেন পাঠকের সামনে। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন এর কলা-কুশলী, নায়ক-নায়িকাদের ঔপন্যাসীয় মনোমুগ্ধকার উপস্থাপনায়।

এটা ঠিক যে, স্পেনের ইতিহাস অবলম্বনে আরো ঐতিহাসিক উপন্যাস রচিত হয়েছে; তুলনা নয় এক শব্দে বলা যায়, এখানে যেসব চমক জাগানো তথ্যের সমাহার ঘটেছে এর সিকিভাগও সেগুলোতে অনূদিত হয়নি। পাঠক যখন এর প্রামাণ্যতার সজীবতায় আলোকিত হবেন তখন নিজেই এই সরল সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন।

সময়, পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং সমকালের উপলদ্ধিকে বিবেচনা রেখে এর ভাষা আঙ্গিক কিছুটা পরিমার্জিত করতে হয়েছে। তাই কালনাগিনী অনূদিত না হয়ে রূপান্তরিত বললেই বোধ করি আমাদের প্রতি সুবিচার করা হবে।

—মুজাহিদ হুসাইন ইয়াসীন

.

.

কাল নাগিনী

মুসলমানদের আলো ঝলমলে একটি অতীত, প্রদীপ্ত গৌরবে প্রাঞ্জল একটি ইতিহাস, অপরাজেয় বীরত্ব ও শৌর্য-বীর্যে ভরা অনবদ্য এক অমরগাঁথা আজো জুড়ে আছে ইউরোপের অন্যতম শক্তিধর দেশ স্পেনের সঙ্গে।

৮২৫ খ্রিঃ। তখনকার যে স্পেনে মুসলমানদের শাসন ছিলো তাতে বর্তমানকালের পর্তুগালও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। পুরো স্পেনকে তখন বলা হতো উন্দলুস।

ফ্রান্সের বাদশাহ লুই তার রাজমহলের এক খাস কামরায় বসা। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্র পোথাক মার্চের বাদশাহ ব্রেনহার্টও রয়েছেন সেখানে। আর উন্দলুসের কর্ডোভা প্রদেশের ইউগেলিস নামের এক খ্রিষ্টানও রয়েছে সেখানে। অবশ্য এ লোক তেমন পদাধিকারের অধিকারী নয়।

সভাষদ হিসাবে সেখানে উপস্থিত আছেন শাহ লুই-এর দুজন জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রীও।

ইউগেলিস! শাহ লুই রাজকীয় গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমাকে যখন বলা হলো তোমার কোন পদাধিকার নেই বা সরকারিভাবে তোমার উল্লেখযোগ্য পরিচিতি নেই তখন তোমাকে সাক্ষাতের অনুমতি দেবো কি দেবো না–এটা ফায়সালা করাআমার জন্য মুশকিল হয়ে গেলো…..।

কিন্তু এখন তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তোমার মতো লোককে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়াটা জরুরী। তবে আমার শুধু একটা সন্দেহ দূর করতে হবে, আমি কি করে নিশ্চিত হবো যে, তুমি মুসলমানদের গুপ্তচর নও?….

আরেকটি কথা হলো, তুমি আবেগে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছো। এখানে দরকার হলো কাজ করা ও সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া। যারা আবেগে অন্ধ হয়ে কথা বলে তারা কিন্তু প্রয়োজনের সময় লাপাত্তা হয়ে যায়। যখন ত্যাগ দেয়ার মতো চরম বাস্তব অবস্থার সামনে দাঁড়াতে হয় তখন কিন্তু এদেরকে আর দেখা যায় না।

মহামান্য বাদশাহ! আমি আপনাকে কোন প্রমাণ উপস্থাপন করে বিশ্বাস করাতে পারবো না যে, আমি মুসলমানদের গুপ্তচর নই। ইউগেলিস আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললো, আপনার গোয়েন্দা বিভাগ যদি মুসলমানদের মতো বিচক্ষণ ও দূরদর্শী হয় তাহলে কর্ডোভার খ্রিষ্টান সমাজগুলো থেকে জেনে আসতে বলুন, আমি আপনার জন্য বিশ্বাসযোগ্য কিনা। আর আপনার দ্বিতীয় কথার জবাব তখনই পাবেন যখন ত্যাগ ও কুরবানী দেয়ার সময় উপস্থিত হবে।

আমি সাবধানতা ও সতর্কতার পক্ষে। তোমাকে নিয়ে না আমার ভয় আছে, না মুসলমানদের ব্যাপারে কোন ভয় আমাকে কাবু করতে পারবে! শাহ লুই বললেন।

আপনার পূর্বপুরুষরাও তো সতর্কতার পক্ষে ছিলেন। ইউগেলিস মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললো। এর পরিণামেই মুসলমানরা আজ একশ বছরের বেশি সময় ধরে উন্দলুস শাসন করছে এবং দাপটের সঙ্গে। আপনিও তেমন সতর্কতা অবলম্বন করছেন। সেখানে আমরা আজ গোলাম হয়ে আছি। আমাদের পবিত্র ধর্ম গোলাম হয়ে আছে।…..

আপনার অন্তরে যদি পবিত্র পিতা ঈসা মাসীহ ও চিরকুমারী মরিয়ামের ভালোবাসা ও মর্যাদাবোধ থাকতো, তাহলে আপনি এমন নিশ্চিন্ত মনে সিংহাসনে বসে থাকতে পারতেন না। আমি কি কেবলই একটি অকর্মা-আবেগী লোক, যে এতদূর থেকে আপনার দরবারে পৌঁছেছে? আমি এক উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি।…

আর এটা আমার ব্যক্তিগত কোন উদ্দেশ্য নয়। আমার কাছে যদি সেনাবাহিনী থাকতো, যেমন আপনার কাছে আছে তাহলে মুসলমানদেরকে আমি উন্দলুস থেকে বের করে দিতে না পারলেও তাদেরকে সেখানে শান্তিতে দেশ শাসন করতে দিতাম না। আর কিছু হোক না হোক, তাদের ওপর অনবরত গেরিলা ও নৈশ হামলা চালিয়ে যেতাম।…

আমি তোমার এই জযবা ও আবেগকে অবশ্যই মূল্যায়ন করি ইউগেলিস! শাহ লুই বললেন, কিন্তু তুমি সম্ভবতঃ জানো না, আরবের এই মুসলমানদেরকে যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা অতি কঠিন কাজ।

কঠিন এজন্য যে, মুসলমানরা ধর্মীয় আবেগকে উন্মাদনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে লড়াই করে। শাহ লুই বলতে লাগলেন, তাদের প্রবল বিশ্বাস হলো, তারা একমাত্র খোদার সন্তুষ্টির জন্য অমুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তারা বলে, লড়াইয়ের সময় খোদা তাদের সঙ্গে থাকেন।

ইউগেলিস! তুমি যদি উন্দুলুসে মুসলমানদের আগমনের কথা শুনে না থাকো তাহলে আমার কাছ থেকে শুনে নাও। ওদের সংখ্যা ছিল মাত্র সাত হাজার। উন্দুলুসের উপকূলে পৌঁছে ওরা তাদের সবগুলো নৌযান জ্বালিয়ে দেয়। যাতে ফিরে যাওয়ার কল্পনাও ওদের মাথায় না আসে।..

তুমি তোমার ফৌজ বা সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে পারবে, কিন্তু তাদের মধ্যে এই চিন্তা-চেতনা ও জযবা সৃষ্টি করতে পারবে না যে, তারা মন থেকে ঘরে ফিরে যাওয়ার চিন্তা দূর করে দেবে। পিছু না হটার মানসিকতা গড়ে তোলা অত সহজ কাজ নয়। এই জযবা ও অদম্য স্পৃহার কারণেই মুসলমানরা যেখানেই হামলা করেছে বিজয় লাভ করেছে। তাদের ওপর যারা হামলা করেছে তারা পিছু হটেছে।….

আজ এক শতাব্দী পার হয়ে গেছে, মুসলমানরা শুধু সামনে অগ্রসরই হচ্ছে। পিছু হটেনি। ফ্রান্সও তাদের হাত থেকে নিরাপদ নয় সম্ভবতঃ এটা তুমি জানো না। তারা সুযোগ পেলে ফ্রান্সে হামলা করে এই দেশটিও তাদের সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেবে।

তাহলে কি ওদের বিরুদ্ধে আপনি কিছুই করবেন না? আমি তো ওদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরিয়ে দেয়ার চিন্তা করছি। আপনাকে শুরুতেই বলেছি, আমি এক গোপন সংগঠন ও জঙ্গি দল গড়ে তুলেছি। যারা উন্দুলুসের সাধারণ মানুষকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং হুকুমতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুত করছে।

আমাদের অতিথি বন্ধু ইউগেলিস কি জানেন না এ পর্যন্ত কত হাজার হাজার খ্রিষ্টান মুসলমান হয়ে গেছে? শাহ লুই এর প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রে কেনিথ বললেন, ওরা পাক্কা মুসলমান হয়ে গেছে। ওরা সেই ধর্ম-শাসিত শাসকদের বিরুদ্ধে কখনো বিদ্রোহ করতে রাজি হবে না যাদেরকে তারা মন-প্রাণ দিয়ে মেনে নিয়েছে।

ইউগেলিসের ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। তার দৃষ্টি সভার সবার ওপর দিয়ে ঘুরে এলো। সবার নজরও তার দিকে। সে তার ঠোঁটের হাসি ধরে রেখে বললো,

হ্যাঁ, এটা আমি জানি। কিন্তু আপনার এটা জানা নেই যে, এই খ্রিষ্টান যারা তাদের ধর্ম বদল করেছে তারা কিন্তু আমারও অনুসারী। ওরা নিঃসন্দেহে মুসলমান হয়েছে, মসজিদে গিয়ে নামাযও পড়ে। সময়মতো রোজাও রাখে। কিন্তু তাদের অন্তর থেকে এখনো ক্রুশের ভালোবাসা বের হয়নি। ওরা ভেতর ভেতর তেমন খ্রিষ্টানই রয়ে গেছে যেমন আগে ছিলো।………..

এর কারণ হলো, আরবের কিছু মুসলমান যারা সুশিক্ষিত নয়, তারা এসব নওমুসলিমকে খাটো চোখে দেখে এবং তাদেরকে নিজেদের প্রজা মনে করে। তাদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করে না। এরই ফায়দা এখন আমরা পাচ্ছি।

এই নওমুসলিমরা মুসলমানদের জন্য থোকা হয়ে আছে। ওরা ওদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামায পড়ছে এবং তাদের আড়ালে গিয়ে তাদেরই শিকড় কাটার পরিকল্পনা আঁটছে। ওদের একজন পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে কোন খ্রিষ্টীয় বাদশাহর সাহায্যেরও প্রয়োজন। সাহায্য বলতে আমি বুঝাচ্ছি সেনা। সাহায্য।

ইউগেলিস এ বিষয়ে আরো বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বললো। এতে ফ্রান্সের বাদশাহ শাহ লুই নিশ্চিত হয়ে গেলেন এ লোক মুসলমানদের গুপ্তচর নয়। এলোক সে উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছে, যা শাহ লুই এর অন্তরে লালিত হচ্ছে এবং তাকে তা অস্থির করে তুলছে। সেটা হলো, স্পেন থেকে মুসলমানদেরকে উৎখাত করা হবে। অন্যথায় ইসলাম পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়বে এবং খ্রিষ্টজগতেও একসময় ইসলাম বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

ইউগেলিস! শাহ লুই এবার আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, নিজেকে নিজে তুমি একা ভেবো না। মুসলমানদের খোলা ময়দানে পরাজিত করা সম্ভব নয় আমি যে একথা বলছিলাম এর অর্থ এই নয় যে, আমি কিছুই করবো না। আমি গোথাকমার্চের বাদশাহ ব্রেন হার্টকে এজন্যই এখানে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে ডেকেছি।…..

আমাদেরকে মুসলমানদের শিকড় মাটির নিচে গিয়ে কাটতে হবে। এখন উন্দুলুসের বাদশাহ আবদুর রহমান ছানী। আমি জেনে নিয়েছি সে কেমন স্বভাবের এবং তার চালচরিত্র কেমন! সে আক্ষরিক অর্থেই কঠিন যোদ্ধা। লড়তেও জানে। লড়াতেও জানে। নিজের ধর্মের প্রতি ভালোবাসা তার মনে প্রাণে জুড়ে রয়েছে।…..

সঙ্গে সঙ্গে সে উন্দুলুসের সীমানা বিস্তৃত করার পরিকল্পনাও করছে। জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোসকতায় তার ভূমিকা অনন্য। তার বাবা আবদুর রহমান আলহাকাম (প্রথম) উন্দলুসের ক্ষতি কম করে যাননি। ভোগবিলাস প্রিয় ছিলেন তিনি। তোষামোদকারীদের দুহাত ভরে এনআম ও নজরানা দিতেন। নিজেকে সারা দুনিয়ার বাদশাহ বলে দাবি করতেন।

কিন্তু আবদুর রহমান ছানী তার বাপের মতো নয়। তার বাপ মুসলমানদের এই সালতানাত ও ইসলামের যে ক্ষতি করে গিয়েছেন আবদুর রহমান এর ক্ষতিপূরণ করছে। তবে তার এসব গুণ ও ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে একটি দুর্বলতাও তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। সেটা হলো, সে গান-বাদ্য সংগীত ও নারীর প্রতি সীমাহীন আসক্ত। যুদ্ধের ময়দান থেকে দূরে রাখতে তার এই দুর্বলতাকে আরো স্থায়ী করে তুলতে হবে আমাদের।….

ইউগেলিস! আবেগ ও উন্মাদনা থেকে বেরিয়ে এসো। আমি জেনে গিয়েছি তুমি এক একজন করে মুসলমানকে হত্যা করতে চাও। তাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে নামতে চাও। কিন্তু এভাবে চিন্তা করলে তুমি কখনো সফল হবে না। আমাদের আসল উদ্দেশ্য হলো, আমাদের মহান ধর্মের শত্রুরা যেন ইউরোপ ছেড়ে পালায়। তাই ওদেরকে মারতে হলে ওদের দুর্বল লোকদেরকে আগে টার্গেট করে এদেরকে ওদেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করো।

এটা কিভাবে এবং কোন পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা হবে? আবদুর রহমানকে কেন হত্যা করা হবে না?। ইউগেলিস জিজ্ঞেস করলো।

***

শাহ লুই তার প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকালেন। তারপর দুজনই হেসে উঠলেন।

আমাদের প্রিয় বন্ধু! শাহ লুই এর প্রধানমন্ত্রী বললেন, তুমি এক আবদুর রহমানকে হত্যা করলে দেখবে আরেক আবদু রহমান সিংহাসনে বসেই কয়েক হাজার খ্রিষ্টানকে হত্যা করেছে। কারণ, হত্যাকারী যে একজন খ্রিষ্টান এতে কারো সন্দেহ না থাকায় এতগুলো খ্রিষ্টানকে হতা করাও বৈধতা পেয়ে যাবে।…..

তা ছাড়া তাকে হত্যার পর হতে পারে তার স্থলে এমন আরেক বাদশাহ আসবে যে সবদিক দিয়েই পাক্কা ও খাঁটি মুসলমান। আবদুর রহমানের মধ্যে যে দুর্বলতা ছিলো সে দুর্বলতাও তার মধ্যে হয়তো থাকবে না। আমি তোমাকে যে কৌশল ও পদ্ধতি গ্রহণ করতে বলবো, সেটা হলো, আবদুর রহমান সুন্দরী নারীদের প্রতি এতই দুর্বল যে, সে তার এক সুন্দরী কানীয-পরিচারিকাকে বিয়ে করে নিয়েছে। তার হেরেমে এমন এমন মেয়ে আছে যাদেরকে দেখলে তুমি চকচকে হীরা ছাড়া অন্য কিছু বলবে না। তবে ওরা তার মতোই মুসলমান এবং তার ভক্তও।…..

তাকে আসলে এমন এক নারীর জালে ফাঁসাতে হবে, যে তার ওপর নিজের রূপের কারিশমা বিস্তার করতে পারবে এবং তার বিবেক-বুদ্ধিকে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেবে। এমন একটি মেয়ের তালিকা আমাদের হাতে আছে।

সে কি মুসলমান না খ্রিষ্টান? ইউগেলিস ও বাদশাহ ব্রেন হার্ট একই সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন।

নামে কেবল মুসলমান। প্রধানমন্ত্রী বললেন, আসলে এ ধরনের মেয়েদের কোন ধর্ম হয় না। তোমরা কেউ কেউ হয়তো জানো, উন্দুলুসের এক জায়গায় তরূব নামে একট জায়গীর আছে। জায়গীরদার মুসলমান ছিলো। মারা গেছে। তার এক মেয়ে রেখে গেছে। নাম সুলতানা। নিজেকে সে মালিকায়ে তরূব বলে। অর্থাৎ তরূব-এর সম্রাজ্ঞী।…….

আমার গুপ্তচররা আমাকে জানিয়েছে, সে তার জায়গীরের পরিধি বাড়ানোর জন্য নিজের রূপের জাদু প্রয়োগ করে আসছে। অসম্ভব চতুর, ধূর্ত, তীক্ষ্ণ ছল-চাতুরীর অধিকারী। এতই বেশি যে, অঙ্গুলি হেলনে শাহজাদাদেরকে নাচিয়ে তারপর আস্তকুড়ে ফেলে দিতে পারে। সে নাকি এতই সুন্দরী এবং তার দৈহিক গঠন এতই আগুন ঝরানো যে, তাকে এ দুনিয়ার নয়, আসমানী কোন মাখলুক মনে হয়।…..

সম্ভবতঃ শাহ উন্দলুস আবদুর রহমান ছানী এখনও তাকে দেখেননি। তোমার বুদ্ধির জোর থাকলে তুমি তা প্রয়োগ করে সুলতানাকে হাত করে নাও। আর তাকে বলো, আমাদের কাজ করে দিলে শাহে ফ্রান্স তাকে একটি প্রদেশই দিয়ে দেবেন।………।

তুমি ওর দুর্বলতাও ব্যবহার করো। সেটা হলো, সে এক জায়গীরদারের কন্যা ছাড়া কিছুই নয়। অথচ নিজেকে সে মালিকা বা সম্রাজ্ঞী বলে। অর্থাৎ সে সম্রাজ্ঞী হতে চায়। আমরা ওকে সম্রাজ্ঞী বানিয়ে দেবো।….তুমি কি এ কাজ করতে পারবে?

ব্যবসায়িক চুক্তি? ইউগেলিস হেসে বললো, আমি অবশ্যই করবো। ওর সঙ্গে আগে আলাপ করে নিই।

আমরা আরেকটা ব্যাপার জানতে পেরেছি, আবদুর রহমান সঙ্গীতের প্রতি অন্ধ ভক্ত। শাহ লুই বললেন, যারিয়াব নামক এক সঙ্গীতজ্ঞকে তার দরবারে রেখেছে। সুলতানা মালিকায়ে তরূব যদি এই যারিয়াবকে হাত করে নেয় তাহলে আমাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে।

আপনি যদি মনে করেন এমনটি করলে কাজ আরো সহজ হয়ে যাবে তাহলে সে ব্যবস্থাও করবো আমি। ইউগেলিস বললো, কিন্তু আমি একে কাপুরুষতা মনে করি যে, আমরা মুসলমানদের তলোয়ারের ভয়ে চোরের মতো পর্দার আড়ালে এভাবে তৎপরতা চালিয়ে যাবো।

আমাদের উদ্দেশ্য কি ইউগেলিস? বাদশাহ ব্রেন হার্ট বললেন, ইউরোপ থেকে মুসলমানদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে সারা দুনিয়ায় খ্রিষ্টীয় মতবাদকে ছড়িয়ে দেয়া। মুসলমানদের চিন্তা-চেতনাকে আমাদের পাল্টে দিতে হবে। যাতে তাদের অন্তর থেকে নিজেদের ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের আত্মসম্মানবোধ দূর হয়ে যায়।……….

আমাদের মেয়েরা গর্বের সঙ্গে মুসলমানদের শিকড় মাটির নিচ থেকে কাটতে থাকবে। ওরা সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করবে। দুশমনকে ধ্বংস করতে সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা বৈধ। আমরা যদি ইসলামের এই অপ্রতিরোধ্য গতির টুটি চেপে না ধরি তাহলে ইসলামের ঝাণ্ডা বিশ্বের প্রতিটি আনাচে কানাচে পতপত করে উড়তে থাকবে খুব শিগগিরই।

মনে রেখো, আমরা মুসলমানদেরকে মুসলিম বাদশাহদের হাতেই দুর্বল করে তুলবো। ইসলামকে ভিত্তিহীন ধর্ম বানিয়ে ছাড়বো। শাহ লুই বললেন, আবদুর রহমানের ওপর যদি আমরা নারী ও সঙ্গীতের নেশা চাপিয়ে দিতে পারি। তাহলে আমাদের বন্ধু ব্রেন হার্ট উন্দুলুসের সীমান্ত এলাকায় বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে পারবে, সঙ্গে সঙ্গে গেরিলা হামলাও চালাতে পারবে।

ইউগেলিস! তুমি উন্দলুসে বিদ্রোহ সৃষ্টির সব ব্যবস্থা গড়ে তোলো। এই গোপন তৎপরতায় তুমি একা নও, আমাদের লোকজনও তোমার সঙ্গে থাকবে।

***

যখন ফ্রান্সের রাজদরবারে সালতানাতে উন্দুলুসের ধ্বংসের ষড়যন্ত্র চলছিলো; এরও এক শ চৌদ্দ বছর আগে এক যুবক সালার তারিক ইবনে যিয়াদ সাত হাজার ঈমানদীপ্ত সৈনিককে নিয়ে উন্দুলুসের তীরে নৌযান থেকে নামেন। তারপর সবগুলো নৌযান আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে দেন। তারপর তার সৈনিকদের উদ্দেশ্য যে ভাষণ দেন ইতিহাসের পাতায় এর প্রতিটি শব্দ আজো অক্ষয় হয়ে আছে। তারিক ইবনে যিয়াদ বলেছিলেন,

হে ইসলামের অকুতোভয় যুবকেরা। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানোর এখন আর কোন পথ খোলা নেই। তোমাদের সামনে শত্রুদল আর পেছনে সমুদ্র। পালানোর একমাত্র উপায়-অবলম্বন নৌযানগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরম ধৈর্য, দৃঢ়তা, কঠিন সংকল্প ও অপরাজেয় আদর্শ ছাড়া তোমাদের কাছে এখন আর কোন কিছুই নেই।

তোমরা জেনে রাখো, এই দ্বীপের মতো মহাদেশে (উন্দলুস চারদিক সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপের মতো) তোমাদের উদাহরণ এমন যেমন কৃপণের দস্তরখানায় অসহায় এতীমের অবস্থান। তোমাদের মনোবলে সামান্য ঘাটতি দেখা গেলেই তা মুহূর্তে ধ্বংস করে দেবে তোমাদেরকে। তোমাদের শক্রদলের সৈন্যসংখ্যা অগণিত এবং অস্ত্রশস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ।

আর তোমাদের কাছে তলোয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। শত্রদলের রসদ সংগ্রহের হাজারো উপায় ও পথ খোলা আছে। তোমাদের সে তুলনায় কোন উপায় ও পথ খোলা নেই। সে পথ তোমাদেরকেই করে নিতে হবে। তোমরা যদি দৃঢ় মনোবল ও অসীম বীরত্বের সঙ্গে কাজ না করো তাহলে তোমাদের পা উপড়ে যাবে। তখন মুসলিম জাতির নাম ধূলোয় লুটিয়ে যাবে। আর দুশমনের মনোবল বেড়ে যাবে।

নিজেদের আত্মমর্যাদাবোধ ও ইসলামের ঝাণ্ডাকে উচ্চকিত রাখতে হলে একটি পথই খোলা আছে। সেটা হলো, যে শক্রদল তোমাদের মোকাবেলায় এগিয়ে আসছে, ভয়াবহ আতংক হয়ে তাদের ওপর ছেয়ে যাও। তাদের শক্তি খতম করে দাও। আমি তোমাদেরকে এমন কোন ব্যাপারে ভয় দেখাচ্ছি না, যেটার ব্যাপারে আমি নিজেকে নিজে আক্রান্ত বোধ করছি না। তোমাদেরকে এমন কোন ময়দানে লড়তে বলছি না যেখানে আমি নিজে লড়াই করবো না।…..।

আমীরুল মুমিনীন ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক তোমাদের মতো বীর বাহাদুরকে এজন্য বেছে নিয়েছেন যাতে তোমরা এ দেশের রাজা বাদশাহ ও আমীর উমরাদের কন্যাদের জামাই হতে পারো। এখানকার যুদ্ধবাজ শাহসওয়ারদের যদি তোমরা খড়কুটার মতো উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারো তাহলে এখানে আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে। এ মাটির জমাটবাঁধা হাজার বছরের অন্ধকার দূর করে তাকে আলো ঝলমলে করে তুলতে হবে। এটা মনে রেখো, যে পথে আমি তোমাদেরকে ডাকছি সে পথের প্রথম পথিক আমিই হবো।…..

দুপক্ষের সৈন্যরা যখন লড়াইয়ে মুখোমুখি হবে তখন সবার আগে আমিই থাকবো। সবার আগে যার তলোয়ার দুশমনের ওপর আঘাত হানবে সেটা হবে আমার তলোয়ার। আমি শহীদ হয়ে গেলে তোমরা তো বিবেক বুদ্ধি দিয়েই কাজ করবে এবং আমার স্থলে অন্য কাউকে নির্বাচিত করে নেবে। তারপরও খোদার রাহে প্রাণ উৎসর্গ করতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যে পর্যন্ত আদিগন্ত বিস্তৃত এ এলাকা বিজয় না হবে সে পর্যন্ত তোমরা তলোয়ার হাত থেকে ছাড়বে না।

যেখানে দাঁড়িয়ে তারিক ইবনে যিয়াদ এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝলসানো শব্দগাঁথাগুলো উচ্চকিত করেছিলেন সেটা ছিলো একটি পাহাড়ের চূড়ার মতো জায়গা, ইতিহাস সে পাহাড়কে আজো স্মরণ করে জাবরাল্টা নামে।

এর আগে এ এলাকা জার্মানরা জয় করেছিলো। তারা নাম দিয়েছিলো আন্দালাস। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে যখন তারিক ইবনে যিয়াদের নেতৃত্বে আরবের সিংহরা এ দেশ জয় করলো তখন এর নাম দিলো উন্দলুস। পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, নদী, খাল বিল, ঝর্ণাধারা, বড় বড় শহর এমনকি অনেক গ্রামের নামও তারা পাল্টে ফেললো। সেখানকার পশ্চাদপদ ও বর্বরীয় সংস্কৃতি ধুয়ে মুছে পবিত্র করে এই দেশের অধিবাসীদেরকে এক আধুনিক ও সার্বজনীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি উপহার দিয়ে তাদেরকে আলোকিত করে তুললো।

***

তারপর তারিক ইবনে যিয়াদ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। কেটে গেলো এরপর শতাব্দীকাল কিংবা আরো অধিক সময়। উন্দলুসের সিংহাসনে তারা এসে বসলো, যারা তাকি ইবনে যিয়াদ ও তার সাত হাজার সঙ্গীর রক্ত ঝরানো ইতিহাস হৃদয় মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়েছে।

মুজাহিদরা পবিত্র রক্ত দিয়ে ইতিহাসের যে সুবিশাল অধ্যায় রচনা করেছিলো, সিংহাসনের মোহগ্রস্তরা তার ওপর নিজেদের অসৎ কর্মের কালো পর্দা চড়িয়ে দিলো। যে রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা ছিলো আল্লাহর, তা হয়ে গেলো দিকভ্রান্ত মানুষের। যে দরবার ন্যায়-নীতি ও সততা বিমূর্ত প্রতীক ছিলো তা হয়ে গেলো অশ্লীল নর্তকীদের নিরাপদ নৃত্যক্ষেত্র।

সে দরবার হয়ে উঠলো উলঙ্গপনার রঙমহল। শাসকরা বনে গলো বাদশাহ। আর তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রইলো তোষামোদকারীরা। শাসকরাও তোষামুদে কথা শুনে পুলকিত হতে লাগলো।

৮২২ খ্রিঃ (২২৭ হিঃ সনে) উন্দলুসে এমনই একজন বাদশাহ মারা গেলেন। তার নাম আলহাকাম। তারীখে উন্দলুস নামক গ্রন্থে আলহাকামকে এভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছেঃ

আলহাকাম নিজের রাজ্যক্ষমতা ও ভোগবিলাসে মত্ত জীবন স্থায়ী করার স্বার্থে কুট-কৌশল, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও অবর্ণনীয় জুলুম অত্যাচার ও নির্যাতন নিপীড়নের পথ বেছে নিয়েছিলেন। না জনগণের ইযযত সম্মানের পরোয়া করেছেন, না তাদের জানমালের।…

নিজের বাদশাহী নিষ্কন্টক করার জন্য এক দুজন নয়, হাজার হাজার মানুষের রক্ত ঝরিয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিলো নিরপরাধ। লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছেন। ইচ্ছে হয়েছে তো হাজারো মানুষের ভিটে-বাড়ি, জায়গা জমি ছিনিয়ে নিয়েছেন। তার জুরুম অত্যাচারের লক্ষ্যবস্তু যেমন সাধারণ জনমানুষ ছিলো তেমনি শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, আলেমে দ্বীন ও মুফতী সাহেবরাও ছিলেন।…..

রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র কায়েম রাখার জন্য যে কোন অবৈধ কলাকৌশল, অজুহাত, চক্রান্তকে বৈধ করে নিয়েছিলেন আলহাকাম। আলহাকামের কাল ছিলো একনায়কতন্ত্রীয় স্বৈরশাসন ব্যবস্থার এক ঘৃণ্য উদাহরণ। যেমন ইচ্ছে তেমন ভোগ করো এর কলংকজনক প্রতীক ছিলো আলহাকামের শাসনকাল।

***

আল হাকামের মৃত্যুর পর তার ছেলে আবদুর রহমান ছানী একত্রিশ বছর বয়সে উন্দুলুসের সিংহাসনে অভিষিক্ত হন। তার ব্যাপারে ইতিহাসের মূল্যায়ন এরকম,

সাহিত্য, কাব্য কবিতার যত রথী মহারথী, গানবাদ্য ও নৃত্যকলার যত অভিজ্ঞ মুখ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের যত বড় বড় পন্ডিত আবদুর রহমানের দরবারে সমবেত হয় সেটা আর কোন কালের ইতিহাসে দেখা যায়নি। তবে আবদুর রহমান যেমন শিল্প-সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন তেমনি সঙ্গীতের প্রতিও ছিলো তার তীব্র আকর্ষণ।

একদিকে তিনি ছিলেন অতি তীক্ষ্ণধারী তলোয়ার চালনাকারী, যুদ্ধ ও লড়াইয়ে ক্ষিপ্র ও অভিজ্ঞ, অন্যদিকে ছিলেন সুন্দরী নারীর প্রতি অন্ধভাবে আসক্ত।

তার মহলের তিন পরমা সুন্দরী মেয়ের কাছে তার জীবন-যৌবন সঁপে রাখেন। এরা ছিলো তার মহলের পরিচারিকা। একসময় এরা হয়ে উঠে আবদুর রহমান ছানীর পরম প্রেমাস্পদ।

মুদ্দাসসিরা নামের পরিচারিকাটির রুপে মুগ্ধ হয়ে আবদুর রহমান তাকে বিয়ে করেন। আরেকজন ছিলো জারিয়া নামের পরিচারিকা। এ যেমন সুন্দরী তেমনি ছিলো তার কণ্ঠে জাদুমুগ্ধকারী সুর। আবদুর রহমান তার গান শুনতে শুনতে প্রহরের পর প্রহর কাটিয়ে দিতেন। আরেকজন পরিচারিকা হলো শিফা। এও ছিলো অতি রূপবতী। তার সিগ্ধ রূপ যে কোন পুরুষকে হতভম্ব করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।

***

উন্দুলুসের সে রাতটি অন্যান্য রাতের মতোই সন্ধ্যা নামার পর ঘনিয়ে এলো। আবদুর রহমান শাহী মহলে গায়ক যারিয়াবের জাদুময় সুর মাধুরী সবাইকে মাতাল করে তুললো। সুন্দরী জারিয়াও আবদুর রহমানের পাশে বসে যারিয়াবের সঙ্গে সুর মিলাচ্ছে। শাহে উন্দলুস আব্দুর রহমান ছানী গান ও তার সুর লহরীতে এমনভাবে বিমুগ্ধ ও মগ্ন যে, তার মাথা থেকে এটা নেমে গেছে, তিনি সেই সালতানাতের সুলতান, সেই দেশের শাসক, যেখানে ক্রুশের পূজারীদের কালো ছায়া ক্রমেই চারদিক থেকে বিস্তার করে চলেছে।

এটা আর তার মনে রইলো না, ইসলামের সুমহান বাণী নিয়ে তাকে আরো অনেক দূর সফর করে যেতে হবে। এই শাহী মহলই তার শেষ গন্তব্য নয়। তাকে ইসলামী সাম্রাজ্রের সীমানা আরো দিগন্তপ্রসারী করে তুলতে হবে। যাতে পথহারা মানবজাতি আল্লাহর সত্যধর্মের আলোয় পথপ্রাপ্ত হয়।

সে রাতেই মালিকায়ে তরূব সুলতানার বাড়িতে এক দরবেশ পা রাখলো। সুলতানা এই দরবেশকে আগেও তার মহলের মতো বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেছে। সুলতানা তার সাদা দুটি ঘোড়ায় জুড়ে রাখা গাড়িতে করে বৈকালিক ভ্রমণে বের হয়ে এই দরবেশকে প্রথমে দেখতে পায়। দরবেশ তার গাড়ির পাশ দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যায়। সুলতানার পাশে বসে থাকা তার এক সঙ্গী বলে উঠে,

এ লোকের মনে হয় মাথা খারাপ। পাগল। একে কয়েকবারই দেখেছি।

ভিখারীও হতে পারে। আরেক সখি বলে উঠে।

না। সুলতানা বললো, ভিখারী নয়। এর চোখেমুখে কি যেন একটা আছে। কথা শুনলে মনে হয় এ কোন সাধারণ দরবেশ নয়। আমি একে কাছ থেকেও দেখেছি। এর চোখে বুদ্দি ও জ্ঞানের দীপ্তি স্পষ্টতর হয়ে আছে। আমি কোন পুরুষের চেহারা চিনতে ভুল করিনি কোন দিন। এ আমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।

দরবেশ হোক আর সাত মহাদেশের শাহেনশাহ হোক, তোমার রূপের জাদু সবাইকে সমানভাবে ঘায়েল করে ফেলে। সখির কণ্ঠে জলতরঙ্গ বেজে উঠলো যেন।

সুলতানা ঘুরে দেখলো, দরবেশ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি এই রূপের সম্রাজ্ঞীর শুভ্র অশ্বজোড়ার গাড়ির দিকে নিবদ্ধ। গাড়িটিকে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে চলছে। সুলতানার গাড়িও সামনে এগিয়ে চলছে। সুলতানা তার বৈকালিক ভ্রমণ শেষ করে ফিরে এলো। সূর্যাস্ত তখনো হয়নি।

দেখলো দরবেশ সেই আগের জায়গাতেই দাঁড়ানো। সুলতানার কৌতূহল বেড়ে গেলো। সে তার গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেললো। দরবেশকে চোখের ইশারা তার সামনে আসতে বললো। দরবেশ ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো।

তোমাকে আরো কয়েকবার এখানে দেখেছি আমি। সুলতানা জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো এবং জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি সব মেয়েকেই এমন গভীর দৃষ্টিতে দেখো যেমন আমাকে দেখছিলে?

দুনিয়ায় কিছু নারী আছে মালিকায়ে তরূব থেকেও আকর্ষণীয়া। দরবেশ সপ্রতিভ কণ্ঠে বললো, কিন্তু মালিকার রূপের আকর্ষণ মন-প্রাণ ও আত্মকেও ছাড়িয়ে যায়। আর যার রূপ আত্মাকে অতিক্রম করে যায় সে নারী মর্ত্যলোকের সেসব নারীর চেয়েও মহান যারা তার চেয়ে সুন্দরী।

তুমি কি আমাকে এভাবে দেখার জন্য আমার বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকবে।

হ্যাঁ, দরবেশ নির্বিকার কণ্ঠে বললো, এবং কিছু বলার জন্যও। মালিকার কাছ থেকে কিছু শোনার জন্যও।

কি বলার জন্য?

এতগুলো মানুষের সামনে বলবো কি করে যাদের রাক্ষুসে চোখ মালিকার চেহারা চেটেপুটে খাচ্ছে। ওদের সামনে কি দরবেশ কিছু বরতে পারে? দরবেশ সকৌতুকে বললো, দেখুন মালিকায়ে তরূব! পথচারীরা কেমন করে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে?

আমি মালিকাকে সে পথ দেখাতে চাই যে পথে চললে এসব লোক মালিকাকে এভাবে অভব্যের মতো নগ্ন চোখে দেখবে না, বরং তাদের দৃষ্টি থাকবে মাটির দিকে এবং মালিকার সম্মানে তাদের মাথা অবনত থাকবে। উন্দলুসের সিংহাসনে মালিকার জন্য জায়গা খালি রয়েছে।

তুমি যদি কোন গনক হও এবং ভবিষ্যতের পর্দা উঠাতে পারো তাহলে আজ রাতে আমার ওখানে চলে এসো। দারোয়ান তোমাকে বাধা দেবে না।

***

রাতে দরবেশকে দারোয়ান বাঁধা দেয়নি। বরং সসম্মানে সুলতানার কামরা নিয়ে গেলো। কামরায় সুলতানা ছাড়া আর কেউ ছিলো না।

সুলতানার গায়ে তখন রেশমী কাপড়ের পোষাক। যেটা তাকে আবৃত নয়, অনেকখানি নগ্নই করে রেখেছে। ওর খোলা চুল কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো। ঝুলানো ফানুসের আলোয় তার রূপ আরো কয়েকগুণ হয়ে যেন ঠিকরে পড়ছে।

ইতিহাসে এসেছে, সুলতানার আওয়াজ ছিলো দারুণ সুরেলা, তার চালচলন, অঙ্গভঙ্গি জাদুর মুগ্ধতায় ভরা, তার হাসিতে মদের ক্রমআচ্ছন্নতা। খোদা যেমন তাকে রূপ দিয়েছেন, এর চেয়ে বেশি দিয়েছেন বুদ্ধির ক্ষিপ্রতা ও চতুরতা। তার দৃষ্টিতে- চাহনিতে সবসময় প্রেম ও ভালোবাসার ঝলক লেপ্টে থাকে। কিন্তু স্বভাবে সে দারুণ প্রতারণা প্রিয়। সে তার রূপের ব্যবহার জানে। জানে কি করে পুরুষকে বশ করা যায়। এসব তার কাছে ছিলো পানি পানের মতো সহজ।

দরবেশ তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও তার দৃষ্টি কেঁপে উঠলো ভূমিকম্পের কাঁপুনির মতো। তারপর তার দৃষ্টি ঘুরে এলো তার মুখের দিকে।

উন্দুলুসের সিংহাসনে আমার জন্য জায়গা খালি আছে এটা তুমি কি করে বললে? সুলতানা মালিকায়ে তরূব জিজ্ঞেস করলো।

এটা পরমাত্মার জগতের কথা মালিকা! দরবেশ বললো, আমি জানি, আপনি কোন সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হতে ব্যাকুল হয়ে আছেন। কিন্তু সে পথ আপনি খুঁজে পাচ্ছেন না। আজ পর্যন্ত এমন কাউকে আপনি পাননি যে আপনাকে সে পথটা দেখাবে।

তুমি যদি আমাকে সে পথ দেখিয়ে দাও তোমাকে আমি অর্ধেক জায়গীর পুরস্কারস্বরূপ দিয়ে দেবো।

আমার কোন নজরানা-পুরস্কারের প্রয়োজন নেই মালিকায়ে তরূব! আমার পায়ের তলায় ধনভান্ডার পড়ে আছে। কিন্তু সেটা বেকার। এসব আমার জন্য নয়। আমি অন্য কোন জগতের মানুষ।–শাহে উন্দলুস আবদুর রহমান ছানী আপনার প্রতীক্ষায় বসে আছেন।

কিন্তু তিনি আমাকে দেখেছেনই বা কবে? সুলতানা লোভাতুর কণ্ঠে বললো, শুনেছি মহলের তিন পরিচারিকা বাদশাহকে তাদের জালে জড়িয়ে রেখেছে। এও শুনেছি, আবদুর রহমান নাকি পাক্কা মুসলমান ও অতি উঁচু চরিত্রের মানুষ। তিনি আবার ভীষণ লড়াকু বাদশাহও। সম্ভবতঃ এ কারণেই তার পর্যন্ত আমার নাম পৌঁছেনি।

সুলতানার কথায় লোভ-মোহগ্রস্ততার নেশা ঝরে পড়ছিলো।

আমি মালিকা বা সম্রাজ্ঞী হবো একথা বলা ছাড়া কি তুমি আমার কোন সাহায্য করতে পারবে না? সুলতানা বললো, তুমি কি এমন কোন উপায় বলে দিতে পারবে না যেটা আমাকে সিংহাসন পর্যন্ত পৌঁছাবে। দরবেশ তো অনেক কিছুই করতে পারে।

আপনি আগে আমাকে বলুন, কোন মুসলিম বাদশাহর রানী হতে চান, নাকি…..

কথার মাঝখানে মালিকায়ে তরূব হেসে উঠলো এবং বললো,

আমার কোন স্বপ্ন কোন ধর্মের সঙ্গে জড়িত নয়। আমি যদি কোন ধর্মের আসল অনুসারী হতাম তাহলে এতদিনে কারো স্ত্রী হয়ে দুই সন্তানের মা হয়ে যেতাম।

তাহলে আমি আপনাকে যা বলবো তা আপনাকে করতে হবে। তা কি আপনি করতে পারবেন? দরবেশ জিজ্ঞেস করলো, একটি দেশের অঙ্গরাজ্য আপনার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সে রাজ্য কোন মুসলমানের হবে না। সেটা আপনি এর বিনিময়ে পাবেন যে, শাহে উন্দলুস আবদুর রহমান ছানীর মন মস্তিষ্কে আপনাকে চেপে বসতে হবে। অতি রূপসী এক ফানুস হয়ে তাকে অধিকার করতে হবে আপনাকে।

তারপর তাকে বাধ্য করবো, তিনি যেন আমাকে রাণী করে নেন?

না, দরবশ বললো, এমন করলে তিনি আপনাকে সম্রাজ্ঞী বা রানী নয়, তার স্ত্রী বানাবে। তারপর একদিন আপনার মোহ কেটে গেলে আপনাকে হেরেমে নিক্ষেপ করবেন। তারপর আরেকজন রানী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তার শয়নকক্ষে এসে হাজির হবে,–এভাবে চলতেই থাকবে। আমি আপনাকে একটা কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছি। আপনি সেটা প্রয়োগ করলে একদিন আপনি আপনার স্বাধীন অঙ্গরাজ্যের অধিকারী হবেন। সৈন্যসামন্তও থাকবে এবং আপনি স্বাধীনভাবে রাজত্বও করবেন।

সুলতানা অতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী। সে মনোযোগ দিয়ে দরবেশের কথা শুনছে। আর গভীর চোখে তার চেহারা নিরীক্ষা করছে। হঠাৎ সে চমকে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে দরবেশের দাড়ি ধরে সজোরে টান দিলো। দাড়ি গোড়া থেকে উঠে এলো। তার আরেক হাত দরবেশের মাথায় রাখলো এবং মাথার কাপড় তার হাতের মুঠোয় নিয়ে টানদিতেই এক ঝটকায় মাথার কাপড় ও মাথার দীর্ঘ চুল উঠে এলো।

***

মাথার চুল ও দাড়ির রঙ সাদা রঙ দিয়ে শুভ্র করে তুলেছিলো। এটা আসলে ছিলো ছদ্মবেশ। ছদ্মবেশ খসে যাওয়ার পর পূর্ণ এক যুবকের অবয়ব বেরিয়ে এলো।

কে তুমি? সুলতানা হয়রান হয়ে রাগত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, এখানে কি নিতে এসেছো? তোমার কি এতটুকু ভয় নেই যে, আমি তোমাকে হত্যা করিয়ে তোমার লাশ গায়েব করে দিতে পারবো?

লোকটি ভয় না পেয়ে অভয়ের হাসি হেসে বললো,

আমার নাম ইউগেলিস–সুলতানা মালিকা! ছদ্মবেশ ধারণ করেছি এজন্য যে, তোমার কাছে আসার সহজ আর কোন পদ্ধতি ছিলো না এবং এটা নিরাপদও। আমি এমন কোন উদ্দেশ্যে এখানে আসিনি যে, তুমি আমাকে হত্যা করাবে। আমার ছদ্মবেশ ধরা পড়ে যাওয়ার পরও সে কথাই বলবো যা এতক্ষণ বলে এসেছি। ধর্মের কথা এজন্য বলেছি, তোমার ওপর যদি ইসলামের প্রাধান্য দেখতাম তাহলে এই ছদ্মবেশেই এখান থেকে চলে যেতাম।

তুমি আমাকে কি খ্রিষ্টান বানাতে এসেছো?

না সুলতানা! তুমি এখন যেমন মুসলমান আছো তেমন মুসলমানই থাকবে এবং সম্রাজ্ঞী হওয়ার পরও মুসলমানই থাকবে। ইউগেলিস আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।

 ইউগেলিস তার পকেট থেকে আলতো করে একটি হার বের করলো। এতে খচিত মনিমুক্তাগুলো থেকে বিচিত্র বর্ণের আলো ঠিকরে বেরোতে লাগলো। হারটি সুলতানার সামনে তুলে ধরে বললো,

এমন হার কখনো দেখেছো? এমন হীরা-মনিমুক্তা কখনো দেখেছো? এমন হার কোন সম্রাজ্ঞীর গলাতেই দেখা যায়।

হারটি সুলতানার দিকে এগিয়ে ধরে ইউগেলিস বললো,

এটা তোমার জন্য উপহার…..জানেনা এটা কে পাঠিয়েছেন? শাহে ফ্রান্স শাহ লুই। এটা তোমার জন্যই।

সুলতানার চোখের মণি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। তার ঠোঁট দুটি নিমিষেই শুকিয়ে গেলো। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে রইলো। সে এমন দুর্মূল্যের হার কখনো দেখেনি। তার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না এমন একটি হারের মালিক এখন সে এবং এটা পাঠিয়েছেন কোন বাদশাহ।

শাহ লুই কি চান? সুলতানা নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো। তার ক্ষণিক আগের লোপ পাওয়া বিবেক বুদ্ধি আবার জেগে উঠলো। মনে পড়ে গেলো, সে অতি সুন্দরী এক যৌবনময়ী মেয়ে। যার রাজা বাদশাহদের কাছেও উঁচু মূল্যের চাহিদা আছে।

তিনি তোমাকে নিজের মালিকা বা রানী বানাতে চান না। ইউগেলিস সোজা সাপ্টা কথা পাড়লো, তিনি তোমাকে একটি আস্ত অঙ্গরাজ্য দিতে চান। তোমাকে কোন ধোকাও দেয়া হবে না এবং তোমার সঙ্গে কেউ প্রতারণাও করবে না। বরং তোমাকে এক থোকা ও প্রতারণার বাস্তব প্রতিমূর্তি বানানো হবে।

আর আমাকে শাহে উন্দুলুসের মহলে ঢুকিয়ে তাকে ধোকা দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে? সুলতানা বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বললো, আমি তোমার সাহসের প্রশংসা করছি। কারণ, আমি যে তোমাকে গ্রেফতার করিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারি সে ভয়টুকুও তোমার মধ্যে নেই। কিংবা সে বাস্তব জ্ঞানটুকুও তুমি রাখো না।

এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তুমি জীবিত থাকলে তো! ইউগেলিস শীতল গলায় বললো, আমার মুখ একটি। হাত ও বাহু অনেক। আমি একা নই। পুরো একটা শক্তিশালী দল ছায়ার মতো আমার সঙ্গে রয়েছে। তুমি শুধু আমাকে দেখছো, আমার ছায়া দেখার মতো শক্তিশালী দৃষ্টি তোমার নেই।

***

 আমি যতটুকু মাটির উপরে আছি এর চেয়ে অধিক মাটির গভীরে আর অস্তিত্ব শিকড় গেড়ে আছে। ইউগেলিস বুক টান টান করে বললো, আমাকে গ্রেফতার করানোর মতো বোকামি কখনোই তুমি করতে পারবে না। আমি তোমার ভবিষ্যৎ চমকাতে এসেছি। এই কেয়ামত নামানো রূপ থেকে ফায়দা উঠাও সুলতানা!…..

তোমার চেহারায় যা আজ বিদ্যুতের মতো চমকাচ্ছে। এ চমক ক্ষণকালের। একসময় এই চমক তোমার কেবল স্মৃতির সঙ্গী হয়ে থাকবে। আমরা তোমার কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছি না। অনেক কিছু দিচ্ছি বরং তোমাকে। আবদুর রহমান তার চোখের মণিকোঠায় তোমার আসন দেবেন। তাকে যদি তোমার দেওয়ানা বানাতে পারো সেটা হবে তোমার ঐতিহাসিক কৃতিত্ব প্রদর্শন।

তুমি যদি বলো আমি নিজেই তার মহলে গিয়ে হাজির হবো তাহলে কিন্তু এটা আমি মানতে পারবো না। তাছাড়া আমি নিজে গেলে তো আমার মূল্যও কমে যাবে। সুলতানা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো।

তাকে তোমার রূপের ঝলক দেখানোর কাজ আমাকেই করতে হবে। ইউগেলিস তাকে আশ্বস্ত করে বললো, শুধু বলো তুমি আমার সঙ্গে আছো। বাকি কাজ আমার।

আমাকে কি করতে হবে?

আবদুর রহমানের ওপর নেশা বিস্তার করতে হবে। তিনি তার তিন অতি রূপসী পরিচারিকার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। তাদেরকে তুমি প্রতিদ্বন্ধী মনে করবে না। বরং ওদেরকে হাতে নিয়ে আবদুর রহমানের সব প্রতিভা আর যোগ্যতা শেষ করে দেবে। তিনি সাধারণ লোক নন। তিনি যদি নারীদের মোহময় পরিবেষ্টন ও রাগ-রঙ থেকে বেরিয়ে আসেন তাহলে পুরো খ্রিষ্টজগতের ওপর তিনি এক আতংক হয়ে ছেয়ে যাবেন।…..

তাকে বাস্তবতা থেকে দূরে রাখতে হবে। প্রায় অজ্ঞ-অসচেতন করে রাখতে হবে তাকে। বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা বা অচেতন করা যাবে না,–এর বিনিময়ে তুমি যা পাবে সেটা হবে তোমার স্বপ্ন ও কল্পনার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।

আমি রাজি। সুলতানা অধীর আগ্রহ নিয়ে বললো।

এখন শোনো! তোমাকে কি করতে হবে। ইউগেলিস বললো এবং তার পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত তাকে বোঝাতে লাগলো।

***

যে রাতে রূপের এমন ভয়াবহ জাদুতে ভরা চক্রান্ত হচ্ছিলো সালতানাতে উন্দলুসের বিরুদ্ধে, সে রাতে সালতানাতে ইসলামিয়া উন্দলুসের কর্ণধার আবদুর রহমান ছানী ডুবে ছিলেন সুন্দরী নারীদের রূপ যৌবনের অতল সমুদ্রে। আর মগ্ন ছিলেন যারিযাবের মন উন্মাতাল করা গান ও নর্তকীদের নৃত্যকলায়।

যাবিয়াব আসলে ইরানের অধিবাসী ছিলো। তার আসল নাম আলী ইবনে নাফে। উপনাম আবুল হাসান। কিন্তু যারিয়ার নামেই সে বিখ্যাত হয়ে উঠে। যাবিয়াব বিশ্ববিখ্যাত এক গায়ক হয়ে উঠে। পৃথিবী বিখ্যাত আরেক সঙ্গীতজ্ঞ ইসহাক আল মুছিলী তার সঙ্গীতগুরু। খলীফা হারুনুর রশীদের দরবারী গায়ক ছিলেন ইসহাক মুছিলী।

কিন্তু যারিয়াবের সুরে যে আশ্চর্য শক্তি ও রাগ-রাগিনী সম্পর্কে তার যে অগাধ জ্ঞান ছিলো সেটা দিয়ে তার গুরু মুছিলীকেও সে অতিক্রম করে গিয়েছিলো। যারিয়াব শুধু দরবারী গায়ক বা সঙ্গীতজ্ঞই ছিল না। দেখতে দারুন সুদর্শন। ইতিহাস ও দর্শনে দারুন পান্ডিত্য ছিলো তার। কথা বললে সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনতো এবং খুব দ্রুত তার মতাবলম্বী হয়ে উঠতো।

তার ব্যাপারে এমন জনশ্রুতিও ছড়িয়ে পড়ে, তার দখলে কোন জিন বা অশরীরী কিংবা অপার্থিব কোন শক্তি রয়েছে।

এক সময় সে আফ্রিকা চলে যায়।

আবদুর রহমানের বাবা আলহাকাম তার খ্যাতির কথা শুনে তার দরবারের এক ইহুদী গায়ককে আফ্রিকা পাঠিয়ে দেন যারিয়াবকে নিয়ে আসতে। কিন্তু যাবিয়াব কর্ডোভা তখন পৌঁছে যখন আলহাকামের মৃত্যু হয়ে গেছে এবং আবদুর রহমান ছানী শাসন ক্ষমতার লাগাম নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছেন।

যারিয়াবকে হতাশ হতে হয়নি। কারণ, আবদুর রহমানও তার বাবার মতো দারুণ সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন। তিনি যারিয়াবকে পেয়ে বুকে তুলে নেন। যারিয়াব খুব অল্প দিনেই পুরো রাজদরবারে প্রভাব বিস্তার করে। সে যে শুধু একজন সঙ্গীতজ্ঞই নয়, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন ইতিহাসে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি সেটাও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়।

দুই তিন দিন পর আবদুর রহমান শিকারে গেলেন। যে বনজঙ্গলে তিনি শিকার করতে গেলেন সেখানে অনেক হরিণ রয়েছে। মুহাফিজ ও রাজকর্মচারীসহ অনেক লোক রয়েছে তার সঙ্গে।

আবদুর রহমান ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে হাতে তীর ধনুক নিয়ে একটি হরিণকে ধাওয়া করলেন। কিন্তু এসময় একটু দূরে একটি ঘোড়ার গাড়ি দেখা গেলো। গাড়ির সামনে দুটি সাদা ঘোড়া জুড়ে রয়েছে।

এক মুহাফিজ ঘোড়ার গাড়িটি সেখান থেকে দূরে হটানোর জন্য সেদিকে তার ঘোড়া ছুটালো। সেই ঘোড়ার গাড়ির রুখ সেদিকে রইলো যেদিকে আবদুর রহমান যাচ্ছিলেন। তিনি জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে সেই সাদা ঘোড়া দুটি ভয় পেয়ে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে। নিচের জমি সমতল নয়। তাই ঘোড়ার গাড়িটি ডানে বামে কাত হয়ে যাচ্ছে।

আবদুর রহমান তার মুহাফিজদেরকে হুকুম দিলেন, গাড়ির ঘোড়া দুটিকে থামাতে। তিন চার মুহাফিজ সেদিকে ঘোড়া ছুটালো। গাড়ির ঘোড়াগুলো তাদের দিকে কয়েকটি ঘোড়া ছুটে আসতে দেখে দিকবিদিক হয়ে ছুটতে শুরু করলো। গাড়োয়ান ঘোড়ার লাগাম ধরে তার দিকে সমানে টানছিলো। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ভেতর থেকে এক নারীর চিৎকার ভেসে আসতে লাগলো। কখনো কখনো তার ভয়ার্ত মুখ বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগলো। পরমুহূর্তেই সেটা আবার গাড়ির ভেতর হারিয়ে যেতে লাগলো।

মুহাফিজরা সেনাবাহিনীর লোক। তারা তাদের ঘোড়া ছুটাতে ছুটাতে গাড়ির সাদা ঘোড়ার পাশাপাশি নিয়ে গেলো। তারপর দুই মুহাফিজ তাদের ছুটন্ত ঘোড়া থেকে গাড়ির ঘোড়া দুটির ওপর প্রায় লাফিয়ে গিয়ে সওয়ার হলো। তারা দক্ষতার সঙ্গে ঘোড়ার লাগাম ধরে আস্তে আস্তে ঘোড়া দুটিকে শান্ত করে ফেললো এবং ঘোড়া শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।

গাড়ি থেকে অতি রূপসী একটি মেয়ে নেমে এলো। নেমেই মুহাফিজদের শুকরিয়া আদায় করলো।

তার মুখ এখনো ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। সে হাফাচ্ছিলো। গাড়োয়ানের অবস্থা এর চেয়ে আরো ভয়াবহ।

মুহাফিজরা তাকে বললো এটা শাহে উন্দলুস ও শাহী খান্দানের শিকারক্ষেত্র। তাদের গাড়ি কি করে এদিকে এলো?

মেয়েটি বললো, এটা তার জানা ছিল না যে, এই বনভূমি শাহী খান্দানের শিকারক্ষেত্র। মুহাফিজরা বললো, তাকে শাহে উন্দুলুসের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তিনি হুকুম দিয়েছেন, গাড়ির ঘোড়া দুটি নিয়ন্ত্রণে এলে গারোয়ান ও যাত্রীকে যেন তার সামনে হাজির করা হয়।

মুহাফিজদের ঘোড়া চলতে লাগলো আগে আগে। এর পেছন পেছন চলছে ঘোড়ার গাড়িটি। গাড়ির ভেতর থেকে মেয়েটি গারোয়নের দিকে মুখ বের করে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

ইউগেলিস! আমার ঘোড়া কি আসলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। আমার তো ভয়ে রক্ত শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছিলো।

ইউগেলিস নিঃশব্দে হেসে উঠলো এবং নিচুগলায় বললো,

আমার কারিশমার প্রশংসা করো সুলতানা! ঘোড়া প্রথমে মোটেও লাগাম ছাড়া হয়নি। আমি ঘোড়া ছুটিয়েছিই এমনভাবে যে, দূর থেকে যে দেখবে সে মনে করবে ঘোড়া মনে হয় লাগাম ছাড়া হয়ে গেছে।…..

হ্যাঁ, আমি যে সংবাদ পেয়েছি, আবদুর রহমান শিকার করতে আসছেন এটা সঠিক বলেই প্রমাণিত হলো। এখন ওরা তোমাকে তার সামনে নিয়ে যাচ্ছে। এই শিকার ক্ষেত্রের বনভূমিতে ঢুকে পড়া অপরাধ। আমার কৃতিত্ব তুমি দেখেছো। এখন তোমার কৃতিত্ব দেখাও।

***

শাহী মহলেও ইউগেলিসের লোক রয়েছে। সে লোকই সময়মতো তাকে খবর দেয়। অমুক দিন শাহে উন্দলুস অমুক বনভূমিতে শিকার করতে যাচ্ছেন। এ খবর পেয়ে ইউগেলিস সুলতানাকে নিয়ে সব পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলে। সে অনুযায়ী কয়েকবার রিহার্সেলও করে নেয়।

সুলতানা ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলো। সামনে আবদুর রহমান দাঁড়ানো। এর আগে তার চোখ মুখ রাগে থমথমে হয়েছিলো। সুলতানার প্রতি নজর পড়তেই তার সেই থমথমে ভাব নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।

সুলতানার রূপের জাদু পথম দেখাতেই তার কারিশমা দেখিয়েছে। আবদুর রহমান গারোয়ান ইউগেলিসের দিকে তাকালো।

অপরাধ নেবেন না শাহে উন্দলুস! ইউগেলিস ঝুঁকে পড়ে বললো, ঘোড়া তাবু থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। এই শিকারভূমির সীমানা সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিলো না।

আবদুর রহমান তার পুরো কথাও শুনলেন না। তার চোখ আটকে গেলো সুলতানার চেহারায়।

শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে আমার কোন আফসোস হচ্ছে না। কে তুমি মেয়ে? আবদুর রহমান সুলতানাকে জিজ্ঞেস করলেন।

মালিকায়ে তরূব। সুলতানা বললো, আমার নাম সুলতানা।

কোন দেশের মালিকা-সম্রাজ্ঞী?…..তোব কোন দেশ?…..আবদুর রহমান তার লোকদের দিকে জিজ্ঞাসু সৃষ্টিতে তাকালেন।

তরূব আসলে একটি জায়গীর। কোন দেশ নয় তরূব। কেউ একজন জানালো।

সুলতানা তাকে জানালো, তার বাবা মারা গেছে। এখনো তার বিয়ে হয়নি। এখন সে তার বাবার জায়গীরের মালিক।

তুমি সত্যি সত্যিই সম্রাজ্ঞী হতে পারো। আবদুর রহমান বললেন, তুমি সদ্য যুবতী মেয়ে। নিজের ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিজেই ফয়সালা করতে পারো।…..আমার বিশ্বাস, তমি বুঝে গেছো আমি কি বলতে চাচ্ছি।

বুঝে গেছিশাহে উন্দলুস! সুলতানা মুচকি হেসে বললো, এতটুকু ইশারা ইংগিত তো বুঝাই যায়।

এক ঝর্ণার ধারে দারুণ সুসজ্জিত একটি তাঁবু খাটানো হয়েছে। সুলতানাকে সেখানে নিয়ে গেলেন আবদুর রহমান। সেখানে রাজকীয় দস্তরখান সাজানো ছিলো। সুলতানাকে নিয়ে তিনি দস্তরখানায় বসলেন। ইউগেলিসও সঙ্গে রইলো। দস্তরখানায় পাখির ভূনা গোশত ও একটি হরিনের রানের রোষ্ট পরিবেশন করা হলো। হরিণটি কিছুক্ষণ আগে আবদুর রহমান শিকার করেছেন।

খুশিতে আবদুর রহমানের ভেতরটা ঝন ঝন করে উঠছিলো। তার আশাতীত প্রিয় এক শিকার মিলে গেছে। সুলতানাকে দেখে দেখে তিনি নিশাকাতর হয়ে উঠছিলেন।

***

এই নেশা আবদুর রহানের ওপর সবসময় ছেয়ে রইলো। সুলতানা তার বিবাহিত স্ত্রী না হয়েও মহল, হেরেম ও আবদুর রহমানের শয়নকক্ষে একক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করলো।

ইতিহাসও তার ব্যাপারে কলম ধরতে বাধ্য হয়েছে,

সুলতানার রূপ-সৌন্দর্য তার দেহে কুদরত যেন নিজ হাতে ভরে দিয়েছেন। এই মেয়ে যেমন সুন্দরী ছিলো তেমনি চতুর ও কুচক্রী ছিলো। কুটিল বুদ্ধি তার রগরেশায় পরিপূর্ণ হয়ে ছিলো। দারুন সৌখিন ছিলো। তেমনি ছিলো চঞ্চলা…..।

নিজেকে এমন সুক্ষ্ম উপস্থাপনায় বাদশাহর সামনে তুলে ধরতো বাদশাহ তার পায়ে এসে প্রায় আছড়ে পড়তেন। এই অবাধ্য যৌবন আর অনাচারী রূপ আবদুর রহমানকে মালিকায়ে তরূবের জন্য পাগল দিওয়ানা করে রাখে।……….

রূপ-যৌবনের ব্যবহার সে এমন নিষ্ঠুরভাবে করতো যে, একবার আবদুর রহমান তাকে উপহার-উপঢৌকন হিসাবে এত বেশি দিরহাম দীনার দেন যে, খাজাঞ্চীও আর্তনাদ করে উঠে।…..

একবার শাহে উন্দলুসের প্রতি অভিমান করে সে তার কামরার দরজা বন্ধ করে রাখে। এটা দেখে শাহ আবদুর রহমানের অবস্থা ক্রমেই অস্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগলো। তিনি তার কয়েকজন গোলামকে মালিকায়ে তরূবের কাছে পাঠান যে, তারা অনুনয় বিনয় ও তোষামোদ করে বাদশাহকে তার কামরায় আসার অনুমতি আদায় করে নিয়ে আসে। কিন্তু মালিকা কারো কথাই শুনলো না।…..

তখন বাদশাহর প্রধানমন্ত্রী ও দুজন উপদেষ্টা তাকে পরামর্শ দিলো, এমন সাধারণ একটি মেয়ে এভাবে জিদ ধরে দরজা লাগিয়ে বসে আছে যে, বাদশাহর ইযযত সম্মানের প্রতিও সে ভ্রূক্ষেপ করছে না। তাহলে তো উচিত তার দরজার সামনে ইটের দেয়াল দাঁড় করিয়ে দেয়া। যাতে সে ভেতরেই দম বন্ধ হয়ে মরে যায়।……

আবদুর রহমান এ পরামর্শ তো গ্রহণ করলেনই না, বরং যারা এ ধরনের পরামর্শ দিলো তাদের ওপর চটে উঠে হুকুম দিলেন, মালিকায়ে তরূবের দরজার সামনে দিরহামের থলে এমনভাবে একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে রাখো যেমন দেয়াল তোলার সময় ইট নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত গেঁথে দেয়া হয়। আরো হুকুম দিলেন, সবচেয়ে মূল্যবান মোতির স্তূপ যেন দরজার সামনে এনে ফেলা হয়।…..

তার হুকুম পালন করা হলো। আবদুর রহমান মালিকায়ে তরূবের দরজায় গিয়ে তাকে ডেকে বললেন, দরজা খুলে দেখো, তোমার দরজার সামনে কী? এসব ধনদৌলত সবই তোমার জন্য।

দরজা খুলে গেলো। মালিকায়ে তরূব তো এই খেলার দক্ষ খেলোয়াড়। সঙ্গে সঙ্গে আবদুর রহমানের পায়ে আছড়ে পড়লো। তার হাতে চুমু খেলো। এমন ভাব দেখালো যেন সে বাদশাহর প্রেমে অন্ধ।….

অন্ধ তো হয়ে গেছে আবদুর রহমান। যিনি এটাও দেখলেন না মালিকায়ে তরূব আনলে কিসের প্রেমিক। সে বাদশাহের হাতে চুমু খেলেও প্রথমেই কিন্তু বাদশাহকে তার কামরায় নিয়ে গেলো না। আগে দিরহাম ও মোতির থলেগুলো কামরায় উঠিয়ে রেখে তারপর বাদশাহকে তার কামরায় নিয়ে গেলো।

***

মহলজুড়ে কানাঘুষা চলতে লাগলো। হেরেমের মেয়েরা দাঁত দিয়ে পিষে পিষে তাদের আঙ্গুল দংশন করতে লাগলো। সবাই তো আবদুর রহমানকে অতি কঠোর লড়াকু বাদশাহ বলে জানতো। সে বাদশাহকে যে মেয়ে এভাবে তার গোলাম বানিয়ে নিয়েছে তার হাতে নিশ্চয় কোন জাদু আছে। তাকে কেউ কেউ জাদুকরও বলতে শুরু করলো।

সবচেয়ে বেশি পরাজয় ও হতাশা ফুটে উঠলো সেই তিন সুন্দরী পরিচারিকার চোখে মুখে, যাদেরকে আবদুর রহমান দৃষ্টির আড়াল হতে দিতেন না। সুলতানা এসে তাদের প্রাণপুরুষকে কেড়ে নিয়েছে।

সেদিন সুলতানা তাদের তিনজনকে তার কামরায় ডেকে পাঠালো। তিনজন বুক ভরা ঘৃণা নিয়ে তার কাছে গেলো।

তোমরা আমার কাছে এসে বসো। সুলতানা তাদের তিনজনকে একেবারে কাছ ঘেঁষে বসালো এবং বললো, আমি জানি, এখানকার সবাই আমার বিরুদ্ধে কানাঘুষা করছে। সেসব কিছু আমার কানেও পৌঁছে গেছে। কিছু তো তোমরাও বলেছো।

তিনজনই থতমত খেয়ে গেলো। তাদের চোখেমুখে ভয়ের ছায়া নেমে এলো। ভয় হলো, সুলতানা এখন চাইলেই তাদেরকে হেরেম থেকে বের করে দিতে পারবে। শাহে উন্দলুস তার হাতের পুতুল। তাদের তিনজনের ব্যাপারে কতলের হুকুমও নিতে পারবে সে।

তোমাদের চেহারা এমন ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করলো কেন? সুলতানা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কি আমাকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছো? মন থেকে এ ধরনের ভাবনা দূর করে দাও। আমিও তোমাদেরকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না, তোমরাও আমাকে তোমাদের শত্রু মনে করো না।

তোমাদের মধ্যে কেউ এমন নেই যার মনে শাহে উন্দলুসের ভালোবাসা আছে। আমরা চারজনই শাহে উন্দলুসের ভালোবাসার কথা এজন্য উচ্চারণ করি যে, তিনি একজন বাদশাহ। আজ যদি তিনি নিহত হন এবং তার সিংহাসনে কোন বৃদ্ধ বসে যায়, তাহলে এই আমরা চারজনই তার প্রেম ভালোবাসায় বেহাল হয়ে যেতে থাকবো।

তোমরা আমার শক্তি দেখে নিয়েছে। আমি কি না করতে পারি। কিন্তু আমি তোমাদের বিরুদ্ধে ও হেরেমের কোন মেয়ের বিরুদ্ধেই বাদশাহর কাছে কোন অভিযোগ করবো না। কারো বিরুদ্ধে তার কানও ভারি করবো না।

তিন পরিচারিকার চেহারায় প্রাণ ফিরে এলো।

মুদ্দাসসিয়া! সুলতানা মুদ্দাসসিরা নামক পরিচারিকাকে বললো, শাহে উন্দলুস তোমাকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। তুমি তার স্ত্রী। তোমার প্রতিও তিনি কম আসক্ত নন। কিন্তু তুমি কি এটা বিশ্বাস করো তার অন্তরে তোমার ভালোবাস আছে এবং তিনি শুধু তোমারই?

আসলে তিনি কারোই নন। মুদ্দাসসিরা বললো, আমিও তার শুধু একলা স্ত্রী নই। আমাকে তিনি অন্যদের চেয়ে অধিক পছন্দ করেন বলে আমাকে বিয়ে করেছেন। এখন তুমি তার কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের। তাই…..

কিন্তু আমি তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে না। সুলতানা মুদ্দাসসিরার কথা কেড়ে নিয়ে বললো, বিয়ে ছাড়াই আমি তার কাছে থাকবো। তোমাদের তিনজনকেই আমি এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি, তোমরা আমাকে তোমাদের শত্রু মনে করো না। আমি বলেছি একজন নারী আমি। তাই কোন নারীর মন আমার দ্বারা পদপিষ্ট হতে দেবো না…..

এখন তার সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আমার প্রতি। এ থেকে এটা বুঝে নিয়ো না, তাকে আমি তোমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। এই মনোযোগ আমি তোমাদের দিকে ফিরিয়ে দেবো। আমার মনে এমন কোন ইচ্ছে নেই যে, তাকে একলা আমি দখল করে রাখবো। নিজেদের চেহারা থেকে হতাশা ও অভিমান ধুয়ে মুছে ফেলো।

সুলতানা ওদের সঙ্গে আরো কিছু কথা বললো। ওরা তিনজন যখন তার কামরা থেকে বের হলো তখন তাদের দৃষ্টিতে সুলতানা মালিকায়ে তরূব বা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রইলো না আর। সে হয়ে গেলো তাদের সহমর্মী। তাদের সখি বা বান্ধবী।

***

এটা একেবারেই অবিচার, জুলুম। গতকালও যাদের জন্য আপনি পাগল দিওয়ানা ছিলেন আজ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে আপনি শুধু আমার প্রেমেই মজে গেছেন। মালিকায় তরূব একদিন আবদুর রহমানকে বললো, আপনি শুধু একজন পুরুষ নন, আপনি বাদশাহও। আপনার তো হৃদয়ের বাদশাহ হওয়া উচিত।

কোন নারীর প্রতি এ জুলুম আমি সহ্য করতে পারবো না যে, তার প্রেম ভালোবাসাকে আপনি আস্তকুড়ে ছুঁড়ে মারবেন। আমি দুই তিন দিনের জন্য বিশেষ কাজে আমার জায়গীরে যাচ্ছি। আপনি মুদ্দাসসিরা, জারিয়া ও শিফাঁকে সেই প্রেম ও ভালোবাসা দিন যা আমার আসার আগে দিতেন। আর না হয় তাদের দীর্ঘশ্বাস আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে।

না, সুলতানা! আবদুর রহমান ব্যাকুল হয়ে বললেন, আমি তো দু তিন মুহূর্তও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না, আর তুমি দুই তিন দিনের কথা বলছো!

আমি আপনাকে এজন্য চাই না যে, আনি অনেক বড় বাদশাহ। সুলতানা বললো, না আপনাকে এজন্য ভালো লাগে যে, আপনার কাছে সোনা, রূপা, হীরা জহরতের বড় বড় ভাণ্ডার রয়েছে। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে আপনাকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু যখন কোন নারী আপনার কারণে দুঃখ পায় তখন আমার ভালোবাসা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। দু তিন দিনের জন্য আমি এখান থেকে অনুপস্থিত থাকবো।

সন্ধ্যায় তার জায়গীরে পৌঁছে গেলো সুলতানা। যাওয়ার আগে আবদুর রহমানকে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। যেন আবদুর রহমানকে ছাড়া সে মুহূর্তকালও বাঁচবে না।

তার নিরাপত্তার জন্য আবদু ররহমান নিজের বডিগার্ডও পাঠিয়ে দিলেন। এরা রাতে সুলতানার বাড়ির চারপাশে প্রহরা দেবে। ইউগেলিসও গারোয়ানের ছদ্মবেশে সুলতানার সঙ্গে এসে গেলো। তার প্রতি কারো কোন সন্দেহ হলো না।

আমি মনে হয় সবদিক দিয়েই সফল। সুলতানা ইউগেলিসকে বললো, আমি মোটেও ভাবিনি, এ লোক নারীর ব্যাপারে এতই দুর্বল যে, দুনিয়া আখেরাত সবই ভুলে যাবে।

মাথায় কোন নারী চেপে বসলে বড় বড় যুদ্ধবাজও হাতিয়ার উঠানোর যোগ্য থাকে না। ইউগেলিস বললো, কোন নারী যদি কোন কাপুরুষের পিঠে হাত রেখে তাকে বলে, আমি তোমার আত্মমর্যাদাবোধের প্রতীক, তাহলে সে কাপুরুষও অতি কঠিন যুদ্ধবাজকে হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য করে। উন্দলুসের বাদশাহকেও আমরা এভাবে বেকার করে ছাড়বো।

ইউগেলিস তার পকেট থেকে ছোট একটি বাক্স বের করলো। সেটা খুলে সুলতানার সামনে রেখে বললো,

সুলতানা! এই সামান্য নজরানা শাহে ফ্রান্স লুই-এর পক্ষ থেকে। তবে তোমার আসল এনআম তোমার অপেক্ষায় আছে।

আমাকে আর কি করতে হবে? সুলতানা জিজ্ঞেস করলো।

এটাই যা তুমি করে যাচ্ছে। আমি তোমাকে সময়মতো সবকিছু বলে যাবো।

যে তিন পরিচারিকার জন্য আবদুর রহমান পাগলপারা ছিলেন ওদেরকে আমি হাত করে নিয়েছি। মহলে এখন আমার সঙ্গে কারো কোন শত্রুতা নেই। পুরুষদের মধ্য একমাত্র গায়ক যারিয়াব আছে যার ওপর শাহে উন্দলুস বলতে গেলে আশেক। দরবারে যারিয়াবের দারুন প্রভাব। বলতে গেলে তারই হুকুম চলে দরবারে। সে যা ইচ্ছা তা করতেও পারে এবং করাতেও পারে।…..

যারিয়াবের মধ্যে এমন এক অপার্থিব শক্তি আছে যে, সে যা কাউকে দিয়ে মানাতে চায় মানিয়ে নেয় সেটা। শাহে উন্দলুস যেন তার সামনে বাচ্চা বনে যান। আমাকে সে একটু ভিন্ন চোখে দেখে। আমি সে দৃষ্টি পড়তে পারি। আমার পুরোপুরি বিশ্বাস আছে, অন্যকে যে জাদুতে বশ করে সেও আমার জাদুর শিকার হয়ে যাবে।

একে আমাদের হাত করা জরুরি। ইউগেলিস বললো, আর আরেকবার শুনে নাও সুলতানা! আবদুর রহমানকে মেরে ফেলা যাবে না। তার থেকে আমাদের ফায়দা উঠাতে হবে। তাকে ভোগবিলাসে মত্ত রাখো, বাকি কাজ আমরা করবো।

ইউগেলিস! সুলতানা একটু ভারি গলায় বললো, আমার ব্যাপারে তোমাকে একটা কথা আমি বলে দিচ্ছি। আমি কখনো কারো হাতের খেলনা হইনি। অন্যকে আমি আমার খেলনা বানিয়ে অভ্যস্ত। তুমি আমাকে এখনো বলোনি তোমাদের আসল পরিকল্পনা কী? তোমাদের চক্রান্তটা কি যেটার জন্য তোমরা আমাকে দিয়ে শিকড় উপড়ানোর কাজ করিয়ে যাচ্ছো।…..

আমার প্রতি কি তোমাদের কারো বিশ্বাস নেই? আমাকে দিয়ে তোমাদের চক্রান্ত সফল করে পরে আমাকেই ছুঁড়ে ফেলবেন এর কি নিশ্চয়তা আছে? আমাকে এসব মূল্যবান মণিমুক্তা দিয়ে খরিদ করার চেষ্টা করো না ইউগেলিস!

আমাকে বলা হয়েছিলো তুমি অনেক বুদ্ধিমান এবং সব ধরনের ইংগিত বুঝতে পারো। ইউগেলিস বললো, আমার তো মনে হয় তোমাকে বেছে নিয়ে আমি কোন ভুল করিনি। এখনো কি তুমি বুঝতে পারোনি আমাদের পরিকল্পনা ও চক্রান্তটা কী?……..

তোমার হয়তো মনে আছে, প্রথম সাক্ষাতে যখন তুমি আমার ছদ্মবেশ ধরে ফেলেছিলে তখন আমি আমার পরিচয় দিয়ে তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার ধর্ম কি?….আর ধর্মের ব্যাপারে তোমার চিন্তাভাবনা কি?

তুমি বলেছিলে ধর্মের ব্যাপারে তোমার কোন আগ্রহ নেই। তোমার ধর্ম শুধু সম্রাজ্ঞী হওয়ার এক স্বপ্ন। আমি তোমাকে বলেছিলাম, তোমাকে আমরা সম্রাজ্ঞী বানিয়ে দেবো। এখন কিছু দিন শাহ আবদুর রহমানের সম্রাজ্ঞী হয়ে থাকো। উন্দলুসের মুসলিম শাসনের যখন পতন ঘটবে তখন এক অঙ্গরাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবে তুমি। আর সেটা তোমাকে দেবেন শাহে ফ্রান্স।………

আমাদের মূল পরিকল্পনা হলো, এই দেশে বিদ্রোহ সৃষ্টি করা। আমরা অতি গোপনে এক আন্দোলন শুরু করেছি। তুমি হয়তো জানো, যেখানে বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় সেখানে বাদশাহর সৈন্যরা ব্যাপক হত্যাকৰ্ম চালায়। বাদশাহ যদি যারিয়াবের মতো গায়ক ও তোমার মতো জাদু জাগানো সুন্দরীর মধ্যে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে তাহলে তার সব ব্যবস্থাপনা দুর্বল ও বিশৃংখল হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়।…..

তোমার কাজ এটাই হবে, শাহে উন্দলুসকে নিজের রূপ যৌবন দিয়ে বেঁধে রাখা। যখন তাকে জানানো হবে তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে তখনো যেন তিনি বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে না আসেন।…..আমি কি বলছি তুমি বুঝতে পেরেছো সুলতানা?…..

আমরা আবদুর রহমানকে বাঁচিয়ে রাখবো ঠিক, কিন্তু তার ভেতরের অকুতোভয় লড়াকু যোদ্ধা ও দূরদর্শী নেতৃত্বদানের ক্ষমতাকে গলা টিপে মেরে ফেলবো। এটা সহজ কাজ নয়। এজন্য তোমার পুরস্কারও নির্ধারণ করা হয়েছে এত বেশি।–একটি রাজত্ব, যার রানী হবে তুমি।

***

ইউগেলিস কোন কাল্পনিক বা ঔপন্যাসিক চরিত্র নয়। ইতিহাসের অতি জলজ্যান্ত এক চরিত্র ইউগেলিস। স্পেন থেকে মুসলিম শাসন গুটিয়ে যাওয়ার এবং মুসলমানদের পতনের প্রথম সারির ভিলেন এই ইউগেলিস। কুদরত তাকে অসাধারণ মেধার অধিকারী করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দারুন পন্ডিত ছিলো সে। আরবী ভাষায়ও সে দক্ষতা অর্জন করে। পবিত্র কুরআনের গভীর জ্ঞানও সে আয়ত্ব করতে সক্ষম হয়।

উন্দলুসের পাম্পুলুনা নামক স্থানে খ্রিষ্টীয় উপসনালয়ের এক পোড়াবাড়ি আছে। সেখান থেকে ইউগেলিস একটি বই সংগ্রহ করে। এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনাদর্শ নিয়ে অনেক অর্থহীন ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা লেখা আছে। বইটি হাতে লেখা। এর মধ্যে বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিহীন ও বানোয়াট উদ্ধৃতিও দেয়া আছে। যে কারণে ভিত্তিহীন একটি বই মুখদের কাছে নির্ভরযোগ মনে হওয়ার সবরকম উপাদান তাতে ছিলো।

ইউগেলিস বইটির কয়েকটি কপি করালো। সেগুলো বিভিন্ন গির্জায় বন্টন করে দিলো আর পাদ্রীদেরকে বলে দিলো, তারাও যেন এগুলোর কপি তৈরী করিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। এভাবেই ইসলামের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা, ভিত্তিহীন কথাবার্তা, আপত্তিজনক ও অশ্লীল মন্তব্য দেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে গেলো।

মুসলিম শাসক যাদেরকে ইসলাম আমীর বলে সম্মানিত করেছে। তারা এতে সন্তুষ্ট না হয়ে নিজেদেরকে রাজা বাদশাহ বলতে লাগলো। তারা টেরই পেলো না, সারা দেশে ইসলাম ও সালতানাতে উন্দলুসের বিরুদ্ধে কী বিষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

ইউগেলিস শহরের পর শহর ঘুরে ঘুরে শাহে ফ্রান্স পর্যন্ত পৌঁছে। সে ইসলাম ও ইসলামী সালতানাতের পতনকে তার জীবনের মিশন বানিয়ে নেয়। প্রতিটি গির্জায়, দেশের প্রতিটি শহরে অলিগলিতে এসব কথা শোনা যেতে লাগলো যে, খ্রিষ্টধর্ম ছেড়ে দিলে পরবর্তী প্রজন্মও মুসলমানদের গোলাম হয়ে থাকবে।

সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী তারাই হয় যারা নিজেদের ধর্মের ব্যাপারে আত্ম সচেতন। মুসলমানদের ধ্বংসলীলা শুরু হয়ে গেছে। কারণ, তাদের শাসকরা নিজেদের ওপর মদ, নারী ও নর্তকীদেরকে সওয়ার করে নিয়েছে। সিংহাসন ও রাজমুকুটই এখন তাদের ধর্ম হয়ে গেছে। তারা তাদের জাতিকে এখন ধোকা দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।….

মুসলিম জাতি থেকে তাদের লড়াকু মনোভাব ও সেই দৃঢ় সংকল্প-মনোবল দূর হয়ে যাচ্ছে, যার সাহায্যে তারা অর্ধেক দুনিয়ায় বিজয় কেতন উড়িয়েছিলো। এখন তাদের বাদশাহরা তাদেরকে সে অবস্থানে নিয়ে গেছে যেখান থেকে আর কোন তারিক ইবনে যিয়াদের আবির্ভয়াব ঘটবে না। এই জাতি এখন বন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাদশাহী হবে খ্রিষ্টীয় জাতির। শাসন চলবে ক্রুশের।

ইউগেলিস সুলতানা মালিকায়ে তরূবকে যে আন্দোলনের কথা বলেছিলো সেটা ইতিহাসে স্থান পেয়েছে মুআল্লিদনি আন্দোলন নামে। এর ইংরেজী নাম RENEGADES এর অর্থ হলো, ধর্মের ব্যাপারে যারা দুমুখী।

মুআল্লিদীন বা দুমুখী ধর্মানুসারী সেসব খ্রিষ্টানকে বলা হতো, যারা কোন এক সময় মুসলমানদের আচার আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে এবং পরে ব্যক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্য খ্রিষ্টধর্মে ফিরে যায়; কিন্তু প্রকাশ্যে নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়। তুলাইতা, মুলয়কা ও কর্ডোভায় এদের সংখ্যা ছিলো বেশি।

ইউগেলিসের মতো যখন এসব দুমুখী মুসলমানরা যোগ্য নেতা-লিডার পেয়ে গেলো তখন প্রকাশ্যে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ না করে মুসলমান রয়ে গিয়ে উন্দলুসের শিকড় কাটতে শুরু করলো।

ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ওরা মসজিদে গিয়ে নামায পড়তে এবং সাধারণ মুসল্লীরা পাক্কা মুসলমান মনে করতো তাদেরকে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা ইসলামের চরম শত্রু হয়ে খ্রিষ্টধর্মে ফিরে যায়।

ইউগেলিস তার আরেকজন সহযোগী পেয়ে যায়। সে হলো ইলিয়ার। দুজনই প্রথমে এক খ্রিষ্টান পণ্ডিত ও ধর্মপ্রচারক সিনেট জুওয়াইলিসের ছাত্র ছিলো। পরে ইবট স্পেয়ারান্দিয়ো এর মতো বিখ্যাত খ্রিষ্টান পন্ডিতের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। স্পেয়ারান্দিয়ো ইসলামের বিরুদ্ধে অতি আপত্তিজনক একটি বইও লিখেন।

***

সুলতানা মালিকায়ে তরূব তার জায়গীরে যাওয়ার সময় আবদুর রহমানকে বলে যায়, সে দুতিন দিন ওখানে থাকবে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে সে ওখানে গিয়েছিলো সেটা প্রথম দিনেই হাসিল হয়ে যায়। সেখানে সে এক রাতই থাকে। আর এটা হয়ে যায় তার জীবনের এক স্মরণীয় রাত।

ইউগেলিসের মুখের ভাষায় দরুণ আকর্ষণ রয়েছে। তার ব্যক্তিত্বেও ছিলো অন্যকে কাছে টানার মতো চমক জাগানো। তাই সুলতানার ভালো লেগে যায় তাকে। তা ছাড়া ওকে যে খুশি রাখাও দরকার এটাও সে বুঝে গেছে। কারণ, এত বড় চক্রান্তের মূল হোতা তো ইউগেলিসই। তার হাত ধরে সে একটি অঙ্গরাজ্যের সম্রাজ্ঞী হতে যাচ্ছে।

কিন্তু সুলতানা লক্ষ্য করেছে, ইউগেলিস তার দিকে সেই দৃষ্টিতে তাকায় না যে দৃষ্টিতে কোন পুরুষ কোন নারীর দিকে তাকায়। কিংবা আবদুর রহমানও যে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকানোর পর তাকে কিনে নিয়েছেন।

রাতে ইউগেলিস সুলতানার বাড়িতেই রইলো। তাকে জানালো, ভোরের অন্ধকার থাকতে থাকতে সে বেরিয়ে যেতে চায়। ইউগেলিস তাকে বললো,

‘সুলতানা! জল্লাদের তলোয়ার আমার মাথার ওপর ঝুলে আছে। প্রতিটি মুহূর্ত আমার মৃত্যুভয়ে কাটে। বাইরে তোমার শাহী মুহাফিজ প্রহরায় দাঁড়িয়ে। ওরা যদি আমার আসল পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারে তো সূর্যোদয়ের আগেই আমার গর্দান কেটে নেবে। এজন্য আমি বিয়ে করিনি। কোন মেয়েকে আমি বিধবা ও সন্তানদেরকে এতিম করতে চাই না। আমার মিশনের জন্য আমি আমার সব আবেগ পায়ে পিষে দিয়েছি।‘

রাতে সে পৃথক কামরায় ঘুমালো। মাঝরাতের খানিক পর তার চোখে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো। তার চোখ খুলে গেলো। বিদ্যুৎ-বেগে কোমরবন্দ থেকে খঞ্জর বের করে ফেললো। সুলতানা না বললে পর মুহূর্তেই খ র তার বুকে আমূল বিদ্ধ হয়ে যেতো।

কেন? কি হয়েছে? কি খবর এনেছো? ইউগেলিস ঘাবড়ে যাওয়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

কিছু হয়নি। তোমার যৌবনের আবেগ জাগাতে এসেছি ইউগেলিস! সুলতানা তার বিছানায় আধশোয়া হতে হতে তার গলা ধরে বললো, যে কথা তুমি বলতে পারোনি সেটা আমি জানি। নিজেকে এভাবে জ্বালিয়ো না।

ইউগেলিস জোর করে হাসতে চেষ্টা করলো, তারপর বিষণ্ণ গলায় বললো,

আমাকে সেসব পুরুষদের কাতারে দাঁড় করিয়ো না সুলতানা! যারা কোন নারীর সংস্পর্শে আসাটাকে জীবনের শেষ গন্তব্য বলে মনে করে। তুমি আমার যে আবেগকে জাগিয়ে তুলতে এসেছে সেটা জেগে উঠলে জেগে উঠবে আমার শরীর। কিন্তু মরে যাবে আমার প্রাণ। আমার নিজের শারীরিক ব্যাপারে যেমন কোন আগ্রহ নেই, তোমার শরীর নিয়েও আমার কোন আকর্ষণ নেই।

সুলতানা এমনভাবে দূরে সরে গেলো যেন ইউগেলিস তাকে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।

আমাকে কি তোমার যোগ্য মনে করো না ইউগেলিস? সুলতানা এমন সুরে জিজ্ঞেস করলো যেন এখনো ব্যাপারটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না।

তুমি যদি যোগ্য না হতে তাহলে আমি তোমাকে এমন ভয়াবহ এক কর্মতৎপরতার সঙ্গে জড়াতাম না। ইউগেলিস নরম গলায় বললো, তোমাকে আমি শাহী মহলে পাঠাতাম না। তোমাকে আমি স্থান দিয়েছি আমার হৃদয়ে, আমার আত্মায়। আমি তোমার ইবাদত করবো। আর যার ইবাদত করা হয় তাকে পবিত্র মনে করা হয়। আমি তোমাকে পবিত্রই রাখবো।

এ কথাটাই আমি তোমাকে বুঝাতে চাচ্ছি। নারীকে যে শারীরিকভাবে বা তার মন-মানসে সওয়ার করে নিয়েছে সে তার উদ্দেশ্যে খুব কমই সফল হয়েছে। সে তখন পশু হয়ে যায়। তার সাফল্য ও শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এটাই সেই দরজা যা আমি শাহে উন্দলুস আবদুর রহমান ছানীর সামনে বন্ধ করে রাখতে চাই।

আমি যদি দেহের রূপ ও যৌবনরসের আকর্ষণে আসক্ত হয়ে যাই তাহলে নিজের অজান্তেই এই মহান লক্ষ-উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাবো; যার জন্য আমি আমার জীবনের সব চাওয়া পাওয়া বিসর্জন করে দিয়েছি।

সত্যিই তুমি মহান। সুলতানা আবেগরুদ্ধ হয়ে ইউগেলিসের হাতদুটো তার ঠোঁটে চুঁইয়ে বললো, তুমি আমার কাছে যে ত্যাগ চাইবে সেটাই আমি তোমাকে দেবো, তোমার এই মহত্ত্বের দাম আমি যে কোন মূল্যে দেবো।

সুলতানা কামরা থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো।

***

পরদিনই সুলতানা আবদুর রহমানের মহলে পৌঁছে গেলো। আবদুর রহমান কল্পনাও করেননি সুলতানা পরদিনই ফিরে আসবে। সুলতানা তার গলা পেচিয়ে বললো,

আপনাকে ছাড়া একটি রাত কাটানোও কঠিন হয়ে গিয়েছিলো। আমি এখন আপনার সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে পারবো না।

সুলতানার এই মন পাগল করা অভিনয় ও তার দেহের রসালো গন্ধ আবদুর রহমানকে বেহুশ করে দিলো।

এক রাতে সুলতানা দরবারের গায়ক যারিয়াবকে তার কামরায় ডেকে আনলো। আবদুর রহমানকে তখন তার প্রিয় পরিচারিকা ও স্ত্রী মুদ্দাসসিরার কাছে রেখে এসেছে।

তোমার আওয়াজে জাদু আছে যারিয়াব। সুলতানা চোখে মাদকীয়তা এনে যারিয়াবের চোখে চোখ রেখে বললো, আর এটাও আমি অনুভব করি, আমাকে যখন তুমি দেখো তখন তোমার আওয়াজ আরো সুরেলা হয়ে যায়।

এটা কি অন্যায়? যারিয়াব হেসে জিজ্ঞেস করলো।

না; সুলতানা বললো, তুমি আমাকে আসলে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তোমার এই নেশাতুর চোখ থেকে যেন সুরের তরঙ্গ ঠিকরে বেরোতে থাকে।

শাহে উন্দলুস আবদুর রহমানের এক খাস জিনিস সুলতানা, এটা জানা থাকায় যারিয়ার প্রথমে একটু দ্বিধান্বিত ছিলো। কিন্তু দীর্ঘ সময় পর যখন সে সুলতানার কামরা থেকে রোরোলো তখন সে বিশ্বাস করতে শুরু করলো, সুলতানা আবদুর রহমানের না, সুলতানা তার। তারই প্রেম-ভালোবাসা সুলতানার হৃদয়রাজ্যে ঝড় তুলছে।

সে রাতের পর থেকে তাদের গোপন সাক্ষাৎ চলতে লাগলো। কয়েক দিন পর সুলতানা আবদুর রহমানকে বললো, মহলের এই চার দেয়ালের বাইরে কয়েক দিন তার জায়গীরে গিয়ে থাকতে চায়। আর ক্লান্তি দূর করতে যারিয়াবকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চায়। তার স্বাস্থ্যহানির আশংকার কথা আবদুর রহমানকে এমনভাবে জানালো যে, আবদুর রহমান বিলম্ব না করে তাকে যারিয়াবের সঙ্গে রওয়ানা করিয়ে দিলেন।

রাতে জায়গীরে ইউগেলিসও এসে গেলো। আর যারিয়াব তো আগেই তার সঙ্গে এসেছে। যারিয়াব সুলতানার প্রেমে প্রায় অন্ধ হয়ে গেলো। তার সব চিন্তার কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠলো সুলতানা। সুলতানা এটাক কাজে লাগালো। আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে তার মনে ঘৃণা উস্কে দিলো। সুলতানা কয়েকবারই যারিয়াবকে বলেছে,

‘যারিয়াব! আমরা আসলে অন্যের হাতের পুতুল। তোমার সুর কিনে নেয়া হয়েছে। আমার রূপ বিক্রি হয়ে গেছে। না তুমি পালাতে পারবে, আমার জন্য কোন পালানোর পথ আছে। আর পালিয়ে যাবোই বা কোথায়? মাটির অতল থেকেও ধরে নিয়ে এসে জল্লাদের হাতে তুলে দেবে।‘

সুলতানা আকারে ইংগিতে জানিয়ে দিয়েছে, তাদের দুজনের মুক্তির পথ তৈরী করা হচ্ছে। ইউগেলিস নামের এক খ্রিষ্টান এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। এতে সফল হতে পারলে সুলতানা একট রাজ্যের মালিক হবে। যারিয়াব হবে সে রাজ্যের সবকিছু।

সেদিনই সুলতানার জায়গীরে ইউগেলিসের সঙ্গে যারিয়াবের পরিচয় হলো। সুলতানা যারিয়াবকে এমন আগলে আগলে রাখতে লাগলো যেমন মা তার একমাত্র সন্তানকে আগলে রাখে।

যারিয়াব শুধু গায়ক ও সঙ্গীতজ্ঞই ছিলো না। বরং অসম্ভব মেধা, প্রতিভা ও বিজ্ঞতাও ছিলো তার। কিন্তু সুলতানা চুম্বকের মতো তার ধ্যান মনকে দখল করে নেয়। কিছু অপূর্ণতা থেকে থাকলে ইউগেলিস সেটা পূর্ণ করে দিলো। যারিয়াব নির্দ্বিধায় তার হাতের খেলনা হয়ে গেলো।

ওদের জীবনাচরণ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, রুচি স্বভাব বদলে দাও। ইউগেলিস যারিয়াবকে বেশ কিছু কথা বলার পর বললো, যে জাতি নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যায় সে জাতি বেশি দিন বেঁচে থাকে না। তারা স্বাধীনও থাকতে পারে না এবং কোন দেশ শাসন করারও যোগ্য থাকে না।…..

আমি জানি, এতে সময় লাগবে। কয়েক বছর লেগে যাবে। কিন্তু কোন জাতিকে চিরদিনের জন্য নিঃশেষ করে দিতে এর চেয়ে উপযুক্ত কোন উপায়ও নেই। এর বিপরীতে আমরা যদি শাহে উন্দলুসকে যুদ্ধের ময়দানে চ্যালেঞ্জ করে বসি তাহলে আরব থেকে কাতরে কাতারে সৈন্য এসে যাবে। তাই শাহে উন্দলুস আবদুর রহমানকে যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা সম্ভব নয়।

ইউগেলিস ও সুলতানা কথায় কথায় যারিয়াবকে দরবারী গায়ক থেকে এক রাজ্যের রাজা ও সুলতানাকে তার রানী বানিয়ে দিলো।

সুলতানা যারিয়াবকে তার জায়গীরে তিন দিন আতিথ্য দান করলো। তার জায়গীরটি সুসজ্জিত কয়েকটি বাগানে পরিবেষ্টিত হয়ে অতি মনোগ্রাহী জায়গায় পরিণত হয়েছে। এই তিন দিন সেসব বাগানেই তাদের অধিক সময় কাটলো।

যারিয়াব যখন শাহী মহলে ফিরে এলো তখন তার চিন্তা ভাবনা, স্বপ্ন-বিশ্বাস এমনকি তার আচার আচরণও পাল্টে গেলো। তার সুর আগের চেয়ে আরো মনকাড়া হয়ে উঠলো।

সুলতানা তার চেষ্টায় যারিয়াবকে আবদুর রহমানের ওপর আগের চেয়ে আরো কয়েকগুণ বেশি সওয়ার করে দিলো। সুলতানার মতো আবদুর রহমানের দৈনন্দিন জীবনে যারিয়াবও বিশাল অংশ দখল করে নিলো।

***

সময় যেমন অতি দ্রুত বয়ে চলছে তেমনি ইউগেলিসি, সুলতানা ও যারিয়াবের সমন্বিত মাটি ফোঁড়া মিশনও দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে।

এক রাতে শাহে উন্দলুসের প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম ইবনে আবদুল ওয়াহিদ সঙ্গে দুজন লোক নিয়ে সিপাহসালার-প্রধান সেনাপতি উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহর বাসভবনে গিয়ে হাজির হলেন।

উবাইদুল্লাহ ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাদেরকে বসালেন। হাজিব আবদুল করীম তাকে কোন ধরনের লোক-সৌজন্যতা দেখাতে নিষেধ করলেন।

উবাইদ! হাজিব সেনাপতিকে বললেন, এই দুজন লোককে চেনো? তার সঙ্গে আসা লোক দুজনকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ, কেন নয়? উবাইদুল্লাহ জবাব দিলেন, এরা আমাদের গোয়েন্দা ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। গোপন সব তথ্য উদ্ধার করে আনে।

তাহলে শোনো, এরা কি খবর নিয়ে এসেছে? হাজিব দুজনকে রিপোর্ট শোনাতে ইংগিত করলেন।

মহামান্য সিপাহসালার! তাদের একজন বললো, কর্ডোভার সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে, তুলায়তা, মুলায়কা ও বার্সিলোনা রাজ্যগুলোতে খ্রিস্টানরা সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা অতি গোপনে সেসব মুসলমানদেরকে দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে যারা কিছুদিন আগে খ্রিষ্ট ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হয়েছিলো। এরা দুমুখো সাপ।

এই দুমুখোরা আমাদের সঙ্গে নামাযও পড়ে। আরেকজন গুপ্তচর বললো, আবার পর্দার আড়ালে আমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিগগিরই এরা মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়াবে। ওদের এটাও জানা আছে, সংখ্যায় ওরা যত বেশিই হোক, আমাদের সেনাবাহিনীর সামনে বেশি দিন টিকতে পারবে না। কিন্তু ওরা প্রাণপাত করার শপথ নিচ্ছে।

এরা আরো জানালো, শাহ লুই এই বিদ্রোহের পালে হাওয়া দিচ্ছেন। আর খ্রিষ্টান অঙ্গরাজ্য গোথাক মার্চের রাজা ব্রেন হার্ট উন্দলুসের সীমান্ত এলাকায় হামলা চালিয়ে যতটা পারে ততটা এলাকা দখল করে নেবে।

এই গোয়েন্দারা নওমুসলিম খ্রিষ্টানদের ছদ্মবেশ ধরে খ্রিষ্টানদের দলে ঢুকে পড়ে। তারপর তাদের গোপন তৎপরতার খুঁটিনাটি বের করে নিয়ে আসে। তারা আরো জানায়, ইউগেলিস নামের এক খ্রিষ্টান এই বিদ্রোহের পেছন থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

বিদ্রোহের আগুন কয়েক জায়গাতেই লাগার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়ার খবর আগেই পেয়ে যান প্রধানমন্ত্রী হাজিব আবদুল করীম। তিনি শাহে উন্দলুস আবদুর রহমানকে এ ব্যাপারে সাবধান করতে চাইলে তিনি সেটা মোটেও গুরুত্ব দেননি।

উবাইদ ভাই। হাজিব সেনাপতিকে বললেন, আমাদের আমীর ও বাদশাহ যদি নিজের দেশ সম্পর্কে এমন বেপরোয়া হয়ে যান তাহলে আমাদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? আমরাও কি এমন বেপরোয়া হয়ে যাবো?

না, কখনো না, সেনাপতি উবাইদুল্লাহ বললেন, উন্দলুসের এই পবিত্র মাটি আবদুর রহমানের নয়। এটা সেই স্বাধীন বীর মুক্তি সেনাদের জমি, যারা আরব থেকে আল্লাহর পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন। তারা তাদের ঘর-বাড়ি, তাদের সন্তানদের কাছে ফিরে যাননি।

এটা আমাদের ও সালতানাতে ইসলামিয়ার দুর্ভাগ্য যে, উন্দলুসের শাসকরা এক খান্দান ও এক গোত্রের পরিত্যজ্য সম্পদ হিসাবে একে আঁকড়ে ধরে আছে। একে নিজেদের পিতৃপুরুষদের উত্তরাধিকার সম্পদ মনে করছে।…..

এরা শাহী খান্দান বনে গেছে। তাদের এ দেশর মাটি ও এদেশের মানুষের ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই। তাদের সব আগ্রহ-আকর্ষণ বাদশাহী ও ভোগবিলাসী জীবনেই সীমাবদ্ধ। দেশের আসল শত্রু তো এই শাসক শ্রেণীই, যারা তোষামোদকারীদের বেষ্টনীতে বসে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে।…..

এটা আমাদের পালনীয় কর্তব্য, দেশকে কুফরীর করালগ্রাস থেকে বাঁচানো। বিদ্রোহ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের খবর আমিও পাচ্ছিলাম। আজ তুমিও সেটার সত্যায়ন করলে। আমার পরামর্শ মতো চলুলে আমাদের দুজনেরই আবদুর রহমানের কাছে যাওয়া উচিত।

আমার মতামতও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তিনি তো মালিকায়ে তরূব ও গায়ক যারিয়াবের দখলে রয়েছেন এখন। এরা তো জিন ভূতের চেয়েও ক্ষমতাবান। ওরা এমন এক দেয়াল তুলে রেখেছে যে, ওতে আমরা দুজন প্রবেশ করতে পারবো না।

চেষ্টা করবো দেয়াল ফুড়ে ঢুকতে। বললে এখনই যাওয়া যায়। উবাইদুল্লাহ দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *