১৬. সৈকতে লোক চলাচল নিষিদ্ধ

১৬.

সৈকতে লোক চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছে পুলিশ, মুসা বলল। রবিন আর টনির সঙ্গে বসে বসে পাথর ছুঁড়ছে পানিতে।

মিসেস রথরক খুন হওয়ার পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে। খুনীকে ধরতে পারেনি পুলিশ। কোন মোটিভ বের করতে পারেনি। তিন খুনের কোনটারই কোন কিনারা করতে পারেনি ওরা, সূত্র পায়নি।

কিন্তু মুসার ধারণা, পুলিশ আসল ব্যাপারটা জানে। ভ্যাম্পায়ারের কথা না জানলে সৈকত বন্ধ করে দেয়ার কথা মাথায় আসত না ওদের। কিন্তু পুলিশ ভূত বিশ্বাস করলে লোকে হাসবে, এই ভয়ে ঘোষণা দিতে পারছে না।

রবিনকে কথা দিয়েছে মুসা, ওর সঙ্গে ভ্যাম্পায়ারের আলোচনা আর করবে না। টনি অবশ্য খোলাখুলি কিছু বলছে না, তবে মুসা বুঝতে পারছে, সে-ও এ নিয়ে আলোচনা করতে চায় না।

একটা সান্তনার কথা–রবিনের দুর্বলতা যা ছিল, তার চেয়ে আর বাড়েনি। তবে মুখের দিকে তাকানো যায় না এখনও। কণিকা নিশ্চয় ওকে রেহাই দিয়েছে। রক্ত খাওয়া বন্ধ করেছে।

তবে, মুসা জানে, আপাতত বন্ধ করেছে। সুযোগ পেলেই আবার খাবে, কোন সন্দেহ নেই। মায়া করে ভ্যাম্পায়ার তার শিকার ছেড়ে দিয়েছে, এ কি কোনদিন হয়!

মেজাজ খারাপ করে একটা গোল পাথর তুলে নিয়ে পানিতে ছুঁড়ে মারল মুসা। একটা ঢেউ তখন তীরে আছড়ে পড়ে ভাঙছে। তার মাথায় পড়ল পাথর। পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ব্যাঙের মত কয়েকটা লাফ দিয়ে কিছুদূর গিয়ে তারপর ডুবল।

মুসার মত মারার চেষ্টা করল টনি। হলো না। ডুবে গেল। বলল, কি করে মারো তুমি? তোমারটা লাফায় আর আমারটা ডুবে যায়?

মারার কায়দা আছে, জবাব দিল মুসা।

রবিন হাসল। মুসার মনে হলো, জোর করা হাসি। আজকাল আর হাসি আসে না ওদের। তিন তিনটে মানুষ খুন হওয়ার পর–বিশেষ করে পরিচিত আর বন্ধুজন, হাসি থাকার কথা নয়।

সৈকতে চলাফেরা সত্যি বন্ধ করে দেবে? বলল রবিন।

তাহলে আর এখানে থেকে লাভটা কি হবে আমাদের, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল টনি। বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভাল।

পুলিশও সেটাই চায়, মুসা বলল।

কিন্তু আমার মোটেও যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার সেই একঘেয়ে পরিবেশ, কাজ নেই কর্ম নেই, সময় কাটতে চাইবে নাঃ নাহ, সৈকত বন্ধ করে দিলেও আমি যাচ্ছি না। সিসিকে নিয়ে আব্বা-আম্মা চলে গেলেও আমি থেকে যাব।

থেকে কি করবে? সৈকতটাই এখানে আসল। আর তো তেমন কোন জায়গা নেই। এখানে যা কিছু আনন্দের, সব এই সৈকতকে ঘিরে।

ঘড়ি দেখল টনি। কিমি অপেক্ষা করবে বীচ এমপোরিয়ামে। আমি যাই। পরে কথা বলব তোমাদের সঙ্গে।

 সৈকত ধরে হেঁটে যাওয়া টনিকে যতক্ষণ চোখে পড়ল, তাকিয়ে রইল মুসা। তারপর ফিরল রবিনের দিকে। কণিকা কি তোমাকে বলেছে, মিসেস রথরকের গলায় দাঁতের দাগ ছিল?

জবাব না দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল রবিন। হাঁটতে শুরু করল।

ছাড়ল না মুসা। পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমি দেখেছি। কণিকা এ ব্যাপারে কিছু বলেনি?

না। থাক না ওসব কথা।

রবিনের হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের দিকে ফেবাল মুসা, শোনো, কণিকা যে ভ্যাম্পায়ার, এটা আমাকে প্রমাণ করতে দাও নইলে তোমাকেও ভ্যাম্পায়ার বানিয়ে ছাড়বে খুব শীঘ্রি। আমি প্রমাণ করতে পারব।

ওহ, মুসা, প্লীজ! গুঙিয়ে উঠল রবিন, আমাকে রেহাই দাও।

রবিনের কথা কানেই তুলল না মুসা, তুমি দুর্বল কেন..

 ফ্লু কিংবা অন্য কোন ভাইরাসে ধরেছে।

তাহলে তোমার গলায় দাগ এল কোত্থেকে? পোকার কামড় হলে চলে। যেত। ভ্যাম্পায়ারের হলে যাবে না এত সহজে।

আবার গুঙিয়ে উঠল ররিন।

প্রমাণ করতে পারলে তো বিশ্বাস করবে আমাকে? তোমাকে অনুরোধ করছি, আমাকে একটা সুযোগ দাও, কোনমতেই হাল ছাড়ল না মুসা। যদি না পারি এ ব্যাপারে আর টু শব্দ করব না কখনও, কথা দিলাম। কণিকাকে আর সন্দেহ করব না।

বেশ, হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল রবিন, আমি রাজি। বুঝতে পারছি, আমি তোমাকে সুযোগ না দিলে আমাকে রেহাই দেবে না তুমি। তবে তোমার ধারণা যে ভুল হবে, এখনই আমি লিখে দিতে পারি।

যাক, খানিকটা এগোনো তাহলে গেল! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা।

রাজি তো হলাম, কি করতে চাও এখন? জিজ্ঞেস করল রবিন।

প্রথমেই তোমাকে কথা দিতে হবে, প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কণিকার সঙ্গে একা কোথাও যাবে না।

এটা কোন কথা হলো?

হলো। তুমি যেহেতু প্রমাণ চাও, আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। নইলে প্রমাণ করব কি করে? রবিন, শোনো, কোন মানুষকে যদি তিনবার ভ্যাম্পায়ারে কামড়ায়, সেই মানুষটাও ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায়। জীবন্মত অবস্থার ভয়াবহ যন্ত্রণা থেকে তাকে মুক্তি দেয়ার একটাই উপায় থাকে তখন, বুকে কাঠের গজাল মেরে…

হয়েছে, হয়েছে, তাড়াতাড়ি দুই হাত তুলে মুসাকে থামাল রবিন। যাব না কোথাও কণিকার সঙ্গে।

একা দেখাও করবে না ওর সঙ্গে। আশেপাশে আর কেউ আছে কিনা। শিওর হয়ে নেবে।

বুঝলাম! আর…

রবিন, আমি ইয়ার্কি মারছি না!

 সে তো দেখতেই পাচ্ছি। ঠিক আছে, যা বলছ করব।

 কথা দিচ্ছ?

দিচ্ছি। এখন বলো, তোমার উদ্দেশ্যটা কি? কি করতে চাও?

খুব সহজ। কি করলে ভ্যাম্পায়ার ধ্বংস হয়?

কণিকার বুকে কাঠের গজাল ঢোকাতে পারব না আমি!

ঢোকাতে বলাও হচ্ছে না। তারচেয়ে সহজেই সম্ভব। গজাল ছাড়া অন্য কিসে ভ্যাম্পায়ার মরে, বলো তো?

জানি না।

 রোদ। সূর্যের আলো।

তোমার মাথাটা পুরোই গেছে!

রবিনের কথা হাত নেড়ে ঝেড়ে ফেলে দিল মুসা। কি করে মারবে ভ্যাম্পায়ারকে বোঝাতে লাগল, এই সময় পেছনে শব্দ শুনে থেমে গেল। ফিরে তাকিয়ে দেখে কণিকা।

স্থির হয়ে গেল মুসা। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে ও? কতখানি শুনেছে?

.

১৭.

কি ব্যাপার? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল কণিকা, কি আলোচনা করছিলে। তোমরা? আমাকে দেখে থেমে গেলে কেন?

কণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমানের চেষ্টা করল মুসা, ওদের পরিকল্পনার কথা কতখানি জেনেছে মেয়েটা।

রবিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল কণিকা। এমন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন তোমরা? হাঁটবে, না অন্য কিছু করবে?

মুসার দিকে তাকাল রবিন। কণিকার দিকে ফিরে বলল, আমি যেতে পারব না। শরীর ভীষণ দুর্বল।

আমাকেও বাড়ি যেতে হবে, তাড়াতাড়ি বলল মুসা।

বেশ, যাও, কণিকা বলল। কাল দেখা হবে। মেইন স্ট্রীটের দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। কয়েক পা গিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল, ওহহো, ভুলে গিয়েছিলাম। কাল সন্ধ্যায় সৈকতে একটা বড় পার্টি হবে। সবাই আসবে। তোমাদেরও দাওয়াত দিতে বলে দিয়েছে।

তাই নাকি, খুশি হয়ে রবিন বলল, খুব ভাল খবর শোনালে।

তাহলে কাল ওই সময় দেখা হবে, কণিকা বলল।

হ্যাঁ, কোনমতে দায়সারা জবাব দিল মুসা। কণিকাকে দূরে চলে যাওয়ার সময় দিল। তারপর বলল, আমাদের কথা শুনে ফেলেনি তো?

ফেললে আর কি করব! তবে কোনভাবেই যেন ও অপমানিত না হয়, সে-খেয়াল রাখতে হবে আমাদের।

*

ছিলে কোথায় তুমি? পরদিন রাতে সৈকতের পার্টিতে এলে মুসাকে জিজ্ঞেস করল রবিন। খাবার তো সব শেষ।

হোকগে শেষ। বারগার খেয়ে এসেছি।

হাই, মুসা, হাত নাড়ল কণিকা। আরও অনেকগুলো ছেলেমেয়ের সঙ্গে রবিনের পাশে বসেছে সে।

মধ্যরাত পার হয়ে গেছে। সারা সৈকত জুড়েই চলছে বীচ পার্টি। কথা রেখেছে রবিন। কণিকার সঙ্গে একা হয়নি একটিবারের জন্যেও।

চোখ বুলিয়ে চারপাশটা দেখল মুসা। হুল্লোড় করছে ছেলেমেয়েরা। সোডার ক্যান ছুঁড়ে মারছে এর ওর গায়ে। খালি ক্যান দিয়ে একটা পিরামিড বানানো হয়েছে। উচ্চতা হবে ছয় ফুট। ক্রমেই আরও উঁচু হচ্ছে ওটা। ভলিবল খেলার চেষ্টা করছে কয়েকজন, অন্ধকারে জ্বলে এ রকম বল দিয়ে। বাতাসে কয়লার ধোয়া আর সাগর থেকে ধরা তাজা মাছের কাবাবের সুগন্ধ।

কণিকার দিকে তাকাল সে।

 আজকের রাতটাই তোমার শেষ রাত কণিকা!

 রবিনের রক্ত আর খেতে পারবে না তুমি! কারোর রক্তই পাবে না!

ওর প্ল্যানটা হলো, রবিনের সঙ্গে কণিকাকে কোন একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে আটকে ফেলবে। বসিয়ে রাখবে সকাল পর্যন্ত। সূর্য ওঠার আগে কোনমতেই বেরোতে দেবে না।

সাগরের ওপরের আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। শোনা গেল বজ্রের গুডুডু চিমনি দিয়ে ভলকে ভলকে বেরোনো ধোয়ার মত কোথা থেকে কালো মেঘ এসে ছেয়ে ফেলল রাতের আকাশ।

বৃষ্টি! চমৎকার! খুশি হলো মুসা। বৃষ্টি এলে ওর প্ল্যানমত কাজ করতে সুবিধে হবে। ঘরে ঢুকতে বাধ্য হবে কণিকা। আর একবার ঢুকলো কোনমতেই ওকে সকালে সূর্য ওঠার আগে বেরোতে দেয়া হবে না।

ডলি এল এই সময়। টনি আর রবিনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। ওদের কথা শুনতে লাগল।

বৃষ্টি! আহ! আসে না কেন এখনও?

মুসার পাশে বসে পড়ল ডলি। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, চলো, সৈকতের ওদিক থেকে হেঁটে আসি।

না। বসো। এখন আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে না, মুসা বলল। আমি এখন সবার সঙ্গেই থাকতে চাই।

রবিনের কাছ থেকে কিছুতেই দূরে সরা চলবে না এখন। সুযোগ দিলেই ভুলিয়েভালিয়ে তুলে নিয়ে যাবে ওকে কণিকা। আর গেলেই সর্বনাশ ভ্যাম্পায়ারের সম্মোহন বেশিক্ষণ এড়াতে পারবে না রবিন।

মিনতি ভরা চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে আছে ডলি! জোরে নিঃশ্বাস ফেলল।

হাঁটতে যেতে রাজি না হওয়ায় ও এত দুঃখ পেল কেন বুঝতে পারল না মুসা। সবার সামনে অপমান বোধ করল নাকি?

দূরে আবার গুড়গুড় শব্দ। আবার বজ্রপাত।

 নীচে নেমে আসছে কালো মেঘ।

এসো বৃষ্টি। আরও তাড়াতাড়ি। প্লীজ।

কিন্তু মুসার অনুরোধে কান দিল না বৃষ্টি। দূরেই রইল বিদ্যুৎ চমকানো, দূরেই রইল বজ্রের গর্জন।

ভোররাত তিনটের দিকে পার্টিটা হয়ে গেল একেবারে প্রাগৈতিহাসিক। বুনো উন্মাদনায় মেতে উঠল সবাই। হই-হুঁল্লোড়, নাচাকোদা, যার যা ইচ্ছে চালিয়ে যাচ্ছে।

মনে হচ্ছে খুনের কথাটা ভুলতে চাইছে সবাই, ডলি বলল।

 মাথা ঝাঁকাল মুসা।

মুসা, এবার তো হাঁটতে যেতে পারি আমরা? সারারাত এক জায়গায় বসে থাকার ইচ্ছেটা আজ তোমার কেন হলো, বুঝতে পারছি না।

কি জবাব দেবে ভাবছে মুসা, এই সময় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল আকাশ গুড়গুড় করে উঠল মাথার ওপর। চমকে ওপর দিকে তাকাতেই আকাশের এমাথা ওমাথা চিরে দিয়ে গেল বিদ্যুতের শিখা। পরক্ষণে বজ্রপাতের বিকট শব্দ।

মুহত পরেই অঝোরে নামল বৃষ্টি।

লাফ দিয়ে উঠে হাসাহাসি, চেঁচামেচি করতে করতে দৌড় দিল ছেলেমেয়ের দল। আর বাইরে থাকা যাবে না। এখন ঘর দরকার।

মুসা। চিৎকার করে উঠল ডলি, এদিকে! একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে মেইন স্ট্রাটের দিকে ছুটল সে।

চমৎকার!

রবিনের দিকে ফিরে বলল মুসা, শুরু করো।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল রবিন। গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। কণিকার দিকে ফিরে বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল, এসো, কণিকা। থিয়েটারটা সবচেয়ে কাছে। ওখানেই যাব।

থিয়েটারের দিকে দৌড় দিল দুজনে। পেছনে ছুটল মুসা। পাথরের কুচির মত গায়ে এসে আঘাত হানছে বৃষ্টির ফোঁটা। বাতাসে ঝাঁপটা দিয়ে এনে এত জোরে চোখে ফেলছে, চোখ মেলে রাখা কঠিন। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল। গুড। কেউ নেই।

রবিনের পাশ কাটিয়ে গিয়ে একটানে থিয়েটারের দরজাটা খুলে ফেলল

হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল রবিন আর কণিকা। মাথার ওপরে বিদ্যুৎ চমকাল। থরথর করে বাড়িটাকে কাঁপিয়ে দিল বজ্রপাতের শব্দ।

লবিতে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাপাতে লাগল ওরা।

বাপরে বাপ! হঠাৎ করে কি নামাটাই নামল!কণিকা বলল। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি।

হঠাৎ করে আর কোথায়। অনেকক্ষণ থেকেই তো গর্জাচ্ছে। মেঝেতে পা হকে জুতোয় ঢুকে যাওয়া পানি বের করতে লাগল রবিন।

দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে ওর। দেখতে পাচ্ছে মুসা। দুর্বল শরীরে এ ভাবে দৌড়ানোটা কঠিন হয়ে গেছে ওর জন্যে।

চলো, বেসমেন্টে ঢুকে বসে থাকি, মুসা বলল। ওখানটায় গরম পাব। এখানে ঠাণ্ডা।

বেসমেন্টে নামার দরজায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। থিয়েটারের লোক ছাড়া অন্য কারও ঢোকা নিষেধ। কিন্তু তালা নেই। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল মুসা। এত রাতে আর কে দেখতে আসবে। নিষেধ অমান্য করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল সে। রইল সুবার পেছনে। দরজাটা লাগিয়ে দিল।

বেসমেন্ট থেকে বেরোনোর দুটো দরজা। একটা দিয়ে ঢুকেছে ওরা। অন্যটা দিয়ে বেসমেন্ট থেকে সরাসরি বাইরে যাওয়া যায়।

কোন জানালা নেই।

এক্কেবারে নিখুঁত। এ রকম ঘরই দরকার ছিল।

বহু বছর ধরে নাটক হচ্ছে এই থিয়েটারে। নানা রকম জিনিসে বোঝাই # করে রাখা হয়েছে ঘরটা। প্লাস্টিকে মোড়ানো পোশাক ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে একদিকের দেয়ালে। তার ওপরের তাকগুলোতে নানা ধরনের হ্যাট। পুরুষের। মহিলাদের।

একটা কাঠের বাক্সের ওপর বসে পড়ল মুসা। দুটো টুল খুঁজে নিয়ে তাতে বলল রবিন আর কণিকা।

সকালের অপেক্ষায় থাকতে হবে এখন। আর কিছু করার নেই। রবিন আর মুসা দুজনে একই কথা ভাবছে। কণিকাকে আটকে রাখতে হবে সূর্যোদয়। পর্যন্ত।

ভিজেছে তিনজনেই। ভেজা চুল নিয়ে অনুযোগ করতে থাকল কণিকা। মুসা লক্ষ করল, ওর হাতে ঘড়ি নেই। তাতে আরও ভাল হয়েছে। সকাল হলো কিনা, বুঝতে পারবে না কণিকা। এ

রবিনের চোখে শীতল দৃষ্টি। একে শরীর খারাপ। তার ওপর মুসার এসব পাগলামি তার পছন্দ হচ্ছে না।

সবই বুঝছে মুসা। বলল না কিছু। সকাল হোক। রোদের আলো এসে পড়ুক কণিকার গায়ে। ওই দৃষ্টি আর থাকবে না রবিনের।

কথা বলতে লাগল সে। কিন্তু রবিন তাতে যোগ দিতে পারল না বিশেষ। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। শুয়ে পড়তে চাইছে। কিন্তু শোয়ার জায়গা নেই বলে বসেই থাকতে হলো।

কটা বাজে? অবশেষে জিজ্ঞেস করল কণিকা।

সোয়া তিনটে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিথ্যে কথা বলল মুসা। বাজে আসলে অনেক বেশি। ভোরের আলো ফোঁটার সময় হয়ে গেছে প্রায়। আর পনেরো মিনিট পরেই কণিকা আর ভ্যাম্পায়ার থাকবে না। জীবন্মাতের অভিশাপ মুক্ত হয়ে চিরকালের জন্যে চলে যাবে পরপারে। দুঃখ হচ্ছে না মুসার। বাঁচিয়েই দিচ্ছে বরং কণিকাকে। জীবন্ত থাকার যন্ত্রণা বড় সাংঘাতিক।

আমি আর বসে থাকতে পারছি না, রবিন বলল। এখুনি গিয়ে বিছানায় পড়তে না পারলে মারা পড়ব।

কিন্তু এই ঝড়ের মধ্যে যাবে কি করে? মুসা বলল।

এখানে থেকে তো বৃষ্টির শব্দও শুনতে পারছি না, কণিকা বলল। কমল কিনা বুঝব কিভাবে? জানালা নেই কিছু নেই। চলো, ওপরে চলে যাই।

যে নামা নেমেছে, এত তাড়াতাড়ি থামবে না বৃষ্টি।

আমি ওপরে গিয়ে দেখে আসি।

তুমি বসো। রবিন যাক। নড়াচড়া না করলে বরং কিছুটা স্বাভাবিক হবে। ও। এভাবে বসে থাকলে ঘুমিয়ে লুটিয়ে পড়বে এখানেই।

হাসল কণিকা। তা অবশ্য ঠিক। রবিন, যাও। কোক মেশিন তত আছে, ওপরে। একটা কোকটোক আনতে পারো নাকি দেখো।

দ্বিধা করতে লাগল রবিন। ওর দিকে তাকিয়ে আছে মূসা। মনে মনে তাগাদা দিচ্ছে–যাও না! দেরি করছ কেন? তীরে এসে তরী ডুবিয়ো না!

আস্তে করে উঠে দাঁড়াল রবিন। বুড়ো মানুষের মত পা টানতে টানতে এগিয়ে চলল সিঁড়ির দিকে। আধমরা লাগছে ওকে।

পাঁচ মিনিট পর তিন ক্যান কোক নিয়ে ফিরে এল সে। বৃষ্টির কথা বলল, আরও বেড়েছে। কমার কোন লক্ষণই নেই। একটা ক্যান কণিকাকে দিয়ে আরেকটা মুসাকে দিল। দেয়ার সময় চোখে চোখে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল।

ইঙ্গিতটা বুঝল মুসা। এর মানে বৃষ্টি আসলে থেমেছে। সূর্য ওঠার সময় হয়েছে।

কণিকার এখন অগ্নিপরীক্ষার সময়। মুসা জানে, এই পরীক্ষায় পাস করতে পারবে না কণিকা।

তাকে আরও পাঁচ মিনিট সময় দিল মুসা। তারপর খপ করে হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। কোক খাওয়া শেষ হয়নি কণিকার। ক্যান থেকে শার্টে পড়ল অনেকখানি।

আরে! কি করছ? তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে উঠল কণিকা। ছাড়ো, ছাড়ো! হাত থেকে ছেড়ে দিল ক্যানটা। মুসার জুতোতে ছলকে পড়ল কোক।

স্থির দাঁড়িয়ে আছে রবিন। তাকিয়ে আছে কণিকার দিকে।

রবিন! চিৎকার করে উঠল মুসা। তাকিয়ে আছ কেন হাঁ করে? দরজা খোলো!

মুসা! কণিকাও চিৎকার করে উঠল, ছাড়া আমাকে!

বাইরে বেরোনোর দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল রবিন। নবে হাত রেখে ফিরে তাকাল কণিকার দিকে। বড়

রবিন! ককিয়ে উঠল কণিকা। আমাকে বাঁচাও!

টানতে টানতে ওকে দরজার দিকে নিয়ে চলল মুসা। রবিনকে বলল, খোলো! খোলো!

ছাড়া পাওয়ার জন্যে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে দিল কণিকা। লাথি মেরে, আঁচড়ে, খামচে অস্থির করে তুলল মুসাকে। হাত ঝাড়া দিল। শরীর মোচড়াতে লাগল। কি করছ তুমি? ছাড়ো আমাকে!

আর দ্বিধা করল না রবিন। একটানে খুলে ফেলল দরজার পাল্লা। ওপরে উঠে গেছে কংক্রীটের সিঁড়ি। রোদ উঠেছে। সিঁড়ির মাথায় এসে পড়েছে উজ্জ্বল রোদ।

কেঁদে উঠল কণিকা, তুমি না বললে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। কই? মিথ্যে কথা বললে কেন? কি করতে চাও তোমরা?

 মুসার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল সে। কিন্তু পারল না। কব্জিতে আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল মুসার আঙুল।

ধাক্কা দিয়ে ওকে দরজার বাইরে বের করে দিল মুসা। ওপরে এনে ঠেলে দিল রোদের মধ্যে।

চিৎকার করে উঠল কণিকা।

.

১৮.

 চোখ মুদে ফেলল মুসা। হঠাৎ করে রোদ পড়াতে মেলে রাখতে পারল না। মাথা সামান্য সরিয়ে নিয়ে আবার মেলল চোখ।

খাইছে! নিজের অজান্তেই মুসার মুখ থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা। ভাবতেই পারেনি এমন কিছু ঘটবে।

 দিব্যি রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কণিকা। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে মুসার দিকে। কিছুই হয়নি ওর।

খাইছে! আবার বলল মুসা। ঝুলে পড়ল নিচের চোয়াল। কণিকার গায়ে আগুন ধরছে না। বোমার মত ফেটে যাচ্ছে না।

সকালের রোদে চকচক করছে কণিকার কালো চুল। চোখের ওপর হাত এনে রোদ আড়াল করে জিজ্ঞেস করল, হয়েছে? তোমার প্রশ্নের জবাব পেয়েছ?

মুসা ভেবেছিল রবিন রেগে উঠবে। কিন্তু উঠল না। বরং সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। বলল, আমার শরীরটা ভাল থাকলে আজই তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম।

কথা বলার জন্যে মুখ খুলেও বন্ধ করে ফেলল মুসা। কথা খুঁজে পেল না।

আনমনে নিচের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে দুজনের পাশ কাটিয়ে আবার বেসমেন্টে ফিরে চলল কণিকা। সিঁড়ির গোড়ায় নেমে ফিরে তাকিয়ে বলল, আমি যে ভ্যাম্পায়ার নই, আর কোন সন্দেহ আছে?

রবিন বলল, মুসা, তুমি বরং রকি বীচে ফিরে যাও…

না, যেতে হবে না, ক্লান্ত ভঙ্গিতে একটা টুলে বসে পড়ল কণিকা। বসো। কথা আছে।

মুসা আর রবিন যার যার আগের জায়গায় বসল।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না, গলায় জোর নেই মুসার। ধাক্কাটা হজম করতে পারেনি এখনও। ভুলটা কোথায় করলাম?

ভুলটা তোমার মগজে, রবিন বলল। গাধার মত তোমার কথা শুনতে গেছিলাম! কিছু মনে কোরো না, কণিকা। আমি দুঃখিত। ও আমাকে এমন করে বোঝাতে লাগল…

ভুল করেনি ও, রবিনকে অবাক করে দিয়ে বলল কণিকা। ভ্যাম্পায়ার এখানে সত্যি আছে। সেজন্যেই এখানে এসেছি আমি। ওগুলোর অত্যাচার বন্ধ করতে।

কণিকা… তাকিয়ে আছে মুসা। তুমি..

মুচকি হাসল কণিকা। হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল কালো চুল। টান দিয়ে খুলে আনল। বেরিয়ে পড়ল কোকড়া কালো চুল। এক এক করে প্লাস্টিকের নকল নাক, নকল দাঁত, গালে লাগানো রবারের আলগা চামড়া, গালের ভেতর দিকে লাগানো প্যাড় খুলে নিয়ে রাখল পাশের একটা বাক্সের ওপর। হাসিমুখে তাকাল দুই সহকারীর দিকে।

কিশোর! একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল মুসা আর রবিন।

আস্তে! চট করে দরজার দিকে চোখ চলে গেল কিশোরের। মেয়েলী কণ্ঠস্বর আর নেই। তার স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, কেউ শুনে ফেলবে! মুসার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তা শেষ দিকের অভিনয়টুকু কেমন লাগল?

হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা। কথা নেই মুখে।

অভিনয় কিশোরের জন্মগত ক্ষমতা। ছদ্মবেশ নেয়ার ক্ষমতাও অসাধারণ। গ্রীনহিলসে থাকতে বহুবার এর প্রমাণ পেয়েছে ওরা। পুলিশম্যান ফগর্যাম্পারকটকে কত যে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। ওকে এ রকম ছদ্মবেশ নিতে দেখে যত না অবাক হলো, তার চেয়ে বেশি হলো এই বেশে ওকে স্যান্ডি হোলোতে দেখে।

তোমার না রাশেদ চাচার সঙ্গে কোথায় যাওয়ার কথা? অবশেষে কথা খুঁজে পেল মুসা।

ছিল, কিন্তু যাইনি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু কেন?

রিকির মৃত্যুটা ভাবিয়ে তুলেছিল আমাকে। তার ওপর দেখলাম জিনার অবস্থা। তোমার মুখে সব শুনেও ভ্যাম্পায়ারের কথা বিশ্বাস করিনি। তবে বুঝতে পারছিলাম রহস্যময় কিছু ঘটছে এখানে। একটা কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে পুরানো পত্রিকা ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। শিওর হয়ে গেলাম, আমার ধারণাই ঠিক হবে।… তোমাদের না জানিয়ে ছদ্মবেশে আসার কারণ, ভ্যাম্পায়ারের নজরে পড়তে চাইনি। বরং আমি ওদের খুঁজে বের করে ওদের দলে মিশে যেতে চেয়েছিলাম…

কিন্তু আমাদের জানিয়ে এলে কি অসুবিধে হত? মুসা বলল, আমরা না চেনার ভান করতাম।

পারতে না। স্বাভাবিক আচরণ করতে পারতে না কোনমতেই। এতটা বড় অভিনেতা তোমরা নও। আমি চাচ্ছিলাম, তুমি অন্তত আমাকে সন্দেহ করো। ভ্যাম্পায়ার ভাব। তাহলে ভ্যাম্পায়াররা আর আমাকে সন্দেহ করবে না। কারণ জন আর লীলার মৃত্যুর ব্যাপারে তোমাকে সন্দেহ করবে ওরা, বুঝতে পেরেছিলাম। কার কার সঙ্গে তোমার খাতির, জেনে যেত সহজেই। ওদের সন্দেহের আড়ালে থেকে কাজ করতে চেয়েছিলাম আমি।

সফল হয়েছ?

তা বলতে পারো।

তারমানে তুমি বলতে চাইছ ভ্যাম্পায়ার সত্যি সত্যি আছে এখানে। রবিনের কণ্ঠে অবিশ্বাস।

 কেন, মুচকি হাসল কিশোর, আমাকেও মুসার মত পাগল মনে হচ্ছে। নাকি? তারপর সিরিয়াস হয়ে গেল। হ্যাঁ, ভ্যাম্পায়ার সত্যি সত্যি আছে। এখানে। ওগুলোর শয়তানী বন্ধ করতে না পারলে আরও কত মানুষকে যে খুন করবে ওরা, তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। রক্তের নেশায়, বিশেষ করে ক্ষমতার নেশায় ওরা উন্মাদ। ওরা আমাকে ওদের দলের মনে করেছে। দুবার সন্দেহ করে ধরে ফেলেছিল প্রায়, অল্পের জন্যে বেঁচে গেছি। ইমি আর অ্যানিকে ওরাই খুন করেছে। মিসেস রথরককেও। প্রথম দুজন খুন হওয়ার আগে কিছু জানতে পারিনি। কিন্তু মিসেস রথরকের ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলেছিলাম। যখন গেলাম, দেরি হয়ে গেছে। বাঁচাতে আর পারলাম না। অল্পের জন্যে।

কারা করেছে এ কাজ? রাগে কাঁপছে মুসা। রিকির লাশটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। ওর নিরীহ, লাজুক হাসিটা স্পষ্ট দেখতে পেল।

কিমি আর ডলি।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। বুকের মধ্যে দাপাতে শুরু করেছে। হৃৎপিণ্ডটা। ডলি!

বসো। মাথা ঠাণ্ডা করো। কিমি আর ডলি দুজনেই ভ্যাম্পায়ার। আমাকে সন্দেহ করলে, আর ডলিকে চিনতে পারলে না?

আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করল মুসা, ডলি! কিমি।

রক্তের নেশায়, খিদেয় পাগল হয়ে গিয়েছিল দুজনে। ইমি আর অ্যানিকে সৈকতে একা পেয়ে রক্ত শুষে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলেছিল। হুঁশ ছিল না যে মরে যাবে। কিংবা খিদের ঠেলায়, কেয়ারই করেনি। একই কাণ্ড করেছে মিসেস রথরকের বেলায়ও।

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, মাথা নাড়ল রবিন। কিশোর, সব কথা যদি খুলে না বলল, তুমিও পাগল হয়ে গেছ ভাবতে বাধ্য হব। ভাবব, স্যান্ডি হোলোতে এসে মুসা আর জিনাকে যে রোগে ধরেছে, তোমাকেও সেই রোগে ধরেছে। সত্যি কি তুমি ভূত বিশ্বাস করছ?

মাথা নাড়ল কিনোর, না। তবে ভ্যাম্পায়ার বিশ্বাস করছি। কারণ, আছে ওরা। নিজের চোখে দেখেছি। তবে এ ভ্যাম্পায়ার ভূত নয়, ভূতেরও বাড়া, মানুষরূপী পিশাচ। সেই প্রাচীনকাল থেকেই ব্ল্যাক ম্যাজিক, জাদুটোনায় বিশ্বাস করে আসছে মানুষ। ভেবেছে, শয়তানের উপাসনা করে তাকে ভজাতে পারলে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়। ভ্যাম্পায়ার হওয়ার চিন্তাও সেই বিশ্বাসেরই কুফল।

ব্রাম স্টোকার ড্রাকুলা লেখার বহু আগে থেকেই ভ্যাম্পায়ারের কথা জানত মানুষ। বিশেষ করে জার্মানী আর তার আশপাশের কয়েকটা দেশের লোকে। তারা নানা রকম পূজা-অর্চনার মাধ্যমে ভ্যাম্পায়ার হতে চাইত। ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্যে। তাদের আরও একটা বিশ্বাস ছিল, এই ক্ষমতা লাভ করতে পারলে অনন্তকাল বেঁচে থাকা যাবে। তবে এর জন্যে কিছুদিন বেশ কষ্ট করতে হবে। কিছু ক্রিয়াকর্ম পালন করতে হবে, বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। আসল ভ্যাম্পায়ার যা করে থাকে বলে ওদের বিশ্বাস, সেসব ওদের মত করেই পালন করতে হবে। কোন রকম উল্টোপাল্টা করলে চলবে না। এই যেমন দিনের বেলা কফিনে শুয়ে থাকা, সন্ধ্যার পর বেরিয়ে রক্ত খাওয়া–সাধনা চলাকালে অন্য কোন রকম খাবার খাওয়া চলবে না, তাহলে সব মাটি। মোট কথা ভ্যাম্পায়ার যা যা করে, ঠিক তাই তাই করতে হবে। আসল ভ্যাম্পায়ার যেহেতু ভূত, তার অনেক ক্ষমতা, কিন্তু বাস্তব মানুষের তো আর সে-ক্ষমতা নেই। মানুষের রক্ত খাওয়ার জন্যে তাই নানা কৌশল আর ওষুধের আশ্রয় নিতে হয়। শিকারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাকে সম্মোহন করে ভোলাতে হয়, সুযোগমত ওষুধ শুকিয়ে তাকে বেহুশ করতে হয়, তারপর দাতে লাগানো কৃত্রিম ধাতব দাঁত দিয়ে গলার শিরা ফুটো করে রক্তপান করতে হয়। অকাল্টের বই পড়ে জেনেছি এ সব।

যাই হোক, পুরানো আমলেও গুরু থাকত এদের, এখনও আছে। এখানে যে দলটা আছে, তাদের গুরুর নামটা নিশ্চয় শুনেছ তোমরা, বেশ গালভরা–কাউন্ট ড্রাকুলা…

কোথায় আছে ব্যাটা! দাঁতে দাঁত চাপল মুসা। নাম বলো। ধরে এয়সা ধোলাই দেব…।

বলছি, হাত তুলল কিশোর, তাকে কোনমতেই ছাড়া হবে না। তবে আগে জানতে হবে কোথায় আছে সে, কোন ঠিকানায়। চ্যালাগুলোকে পুলিশে ধরে ধোলাই দিলেই সুড়সুড় করে নাম বলে দেবে।

তাহলে চলো, এখনই ধরব। কিমি আর ডলি তো? দুই মিনিটও লাগবে। কাবু করে ফেলতে। থাকে কোনখানে?

কেন, আন্দাজ করতে পারছ না? জন আর লীলা কোনখানে ছিল?

ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ!

হ্যাঁ, এতে অবাক হওয়ার কি আছে? ঘাটি হিসেবে এত চমৎকার জায়গা আশেপাশে আর কোথায় আছে?

তা বটে। আমি মনে করেছি, জন আর লীলাকে যেহেতু ওখানেই খতম করা হয়েছে, জায়গা পাল্টাবে ওরা, ধরা পড়ার ভয়ে ওখানে থাকতে আর সাহস করবে না…কিন্তু বাড়িটা তো পুড়ে গেছে?

একটা পুড়েছে। আরও অনেক বাড়ি আছে ওখানে।

 চলো তাহলে। এখনই যাব।

অত তাড়াহুড়া নেই। সারারাত জেগে ওরা দিনের বেলা বেহুশের মত ঘুমাবে কফিনের মধ্যে। তৈরি হয়ে যেতে হবে আমাদের। সারারাত জেগেছি, আমাদেরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া দরকার। তারপর বেরোব। বলা যায় না, কিমি আর ডলি বাদেও ওখানে আরও লোক থাকতে পারে। কাউন্ট ড্রাকুলা নামে বদমাশটাও হয়তো ওই দ্বীপেই থাকে, ভিন্ন কোন বাড়িতে। লড়াই করে ওদের কাবু করতে হলে শক্তি দরকার।

গলায় হাত বোলাতে বোলাতে রবিন বলল, আমার গলার দাগ দুটো তাহলে কিসের? নিশ্চয় পোকার কামড়ই হবে। আমি তো রাতে একা ওই দুই ভ্যাম্পায়ারের কারও ত্রিসীমানায়ও যাইনি।

তুমি না গেলে কি হবে? ভুরু নাচাল কিশোর। ওরা এসেছিল তোমার কাছে। ডলির কাজই হবে। ওটার খিদেই বেশি। তুমি এমনিতে অসুস্থ মানুষ। রাতের বেলা মরার মত ঘুমিয়েছ। চুরি করে বোর্ডিঙে তোমার ঘরে ঢুকে তখন রক্ত খেয়ে এসেছে। ঘুমের মধ্যেই ওষুধ শুকিয়ে নিশ্চয় বেহুশ করে নিয়েছিল তোমাকে। সেটা করা এমন কোন কঠিন কাজ নয়।

শয়তানের দল! শিউরে উঠল রবিন।

তোমাকেও খতম করে দিত ওরা। বেঁচে গেছ মুসার জন্যে। ও তোমার ওপর এমনভাবে চোখ রাখা আরম্ভ করেছিল, বেশি সাহস করতে পারেনি ডলি। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে।

কৃতজ্ঞ চোখে মুসার দিকে তাকাল রবিন। আবার ফিরল কিশোরের দিকে। টনির কিছু করল না কেন তাহলে কিমি?

ওই একই কারণ, ধরা পড়ার ভয়। পিছে পিছে থেকে সিসি বাঁচিয়ে দিয়েছে ভাইকে। তবে টনিকেও ছাড়ত না ওরা। সুযোগমত ঠিকই সাবাড় করত। ওকে খাঁচায় পোরা মুরগী ভেবেছিল আরকি। যখন ইচ্ছে খাওয়া যাবে।

ঘড়ি দেখল কিশোর। চলো। অনেক বকবক করা হয়েছে। ঘুমানো দরকার।

ঘুমের কথায় হঠাৎ আবার দুর্বল বোধ করতে লাগল রবিন। এতক্ষণ উত্তেজনায় খেয়াল ছিল না। মুসার দিকে তাকাল, একা যেতে সাহস পাচ্ছি না।

হাসল মুসা, ভ্যাম্পায়ারের ভয়?

না, ভীষণ দুর্বল লাগছে। মাথা ঘুরে যদি পড়ে যাই।

চলো। আমি যাচ্ছি সঙ্গে।

.

১৯.

টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। দড়ি খুলল মুসা। লাফ দিয়ে উঠে পড়ল নৌকায়।

কিশোর আগেই উঠে বসে আছে।

ডক হাউসের ভেতরে মৃদু ঢেউয়ে দুলছে নৌকা।

হুডওয়ালা প্লাস্টিকের রেইন কোট পরে এসেছে দুজনেই। হুড তুলে দিয়ে শক্ত হয়ে বসল মুসা।

মাত্র দুপুর হয়েছে। কিন্তু কালো মেঘে এতটাই ভারী হয়ে গেছে আকাশ, প্রায় রাতের মত অন্ধকার। দাঁড়ের আঙটায় দাঁড় ঢুকিয়ে দিয়ে বাইতে শুরু করল সে।

গলুইয়ের কাছে বসেছে কিশোর। এদিকে মুখ করে। শক্ত হয়ে আছে। চোয়াল। চোখে কঠিন দৃষ্টি। বোঝা যাচ্ছে বন্ধুদের খুনের প্রতিশোধ নিতে মুসার মতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে।

রবিন এলে ভাল হত। সাহায্য করতে পারত। কিন্তু এতটাই অসুস্থ সে, বিছানা থেকে উঠতে কষ্ট হয়। তা ছাড়া সারারাত জেগে থাকার উত্তেজনা আর পরিশ্রমে আরও বেশি কাহিল হয়ে পড়েছে।

নৌকার পাটাতনে পড়ে আছে দুটো নাইলনের ব্যাগ। দুটোতে একই জিনিস আছে। কাঠের চোখা গজাল। বড় হাতুড়ি। ভ্যাম্পায়ার ধ্বংস করার সরঞ্জাম। কিশোরের বুদ্ধিতে নেয়া হয়েছে এসব। এগুলো দিয়ে কি করবে কিশোর, জানে না মুসা। বেকায়দায় পড়লে খুন করবে নাকি মানবভ্যাম্পায়ারের বুকে গজাল ঢুকিয়ে!

রোদ থাকলে ভাল হত, কিশোর বলল। বিচ্ছিরি আবহাওয়া।

 ভ্যাম্পায়ারের জন্যে চমৎকার।

কি জানি। চাঁদনী রাতে বেরিয়েও ভ্যাম্পায়াররা আনন্দ পায়।

পাবেই। আধামানুষ তো! মানুষেরা যাতে যাতে আনন্দ পায়, ওরাও পায়।

মানুষেরা মানুষের রক্ত খায় না।

কে বলল? নরখাদকদের কাহিনী ভুলে গেছ? এই শতকের গোড়ার দিকেও আফ্রিকার জঙ্গল আর প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক দ্বীপে মানুষখেকো মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে।

তা ঠিক, আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল মুসা। মনে হচ্ছে আগামী পুরো হপ্তাটায়ই বৃষ্টি থাকবে। থাকুকগে। ভ্যাম্পায়ারগুলোকে খতম করতে পারলে আর থাকব না এখানে। বাড়ি ফিরে যাব।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, কিন্তু যে হারে অন্ধকার হচ্ছে…

বৃষ্টির বেগ খানিকটা বাড়ল। রেইন কোর্টের ওপর ফোঁটা পড়ার একটানা আওয়াজ হতে থাকল পুট পুট করে। সাগর শান্ত। ঢেউ এতই কম, হ্রদের পানির মত লাগছে। তাতে সুবিধে হয়েছে। নৌকার গতি বেশি। দ্রুত এগিয়ে চলেছে দ্বীপের দিকে।

ভয় লাগছে? জিজ্ঞেস করল মুসা।

হ্যাঁ। তবে কাজ সারতেই হবে। স্যান্ডি হোলোতে এই ভ্যাম্পায়ারের ব্যবসা খতম করে ছাড়ব আজ। তোমার ভয় লাগছে না?

না, হাসল মুসা। ভয় তো ভূতকে। মানুষকে আবার কিসের ভয়?

কিন্তু মানুষকেই ভয় করা উচিত। কারণ ওরা বাস্তব। ক্ষতি করার ক্ষমতা সীমাহীন।

চুপ হয়ে গেল মুসা। এই তর্কের শেষ নেই। সে ভুত বিশ্বাস করে, কিশোর করে না। অতএব যুক্তি দেখানোরও শেষ হবে না।

কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দ্বীপটা দেখল মুসা। কাছে চলে এসেছে। মেঘলা অন্ধকারের মধ্যে সামনে খাড়া হয়ে রয়েছে কালো দেয়ালের মত। জিনাকে নিতে এসে রাতের বেলা দেখেছিল সেদিন। দিনের বেলা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর মনে হলো আজ।

দেখেই মনে হয় শয়তানের ঘাটি, কিশোর বলল।

হ্যাঁ, সত্যি সত্যি শয়তান বাস করে ওখানে।

আরও কাছে এলে গাছগুলোকে আলাদা করে চেনা গেল। দ্বীপের কিনারে ঘন হয়ে জন্মেছে বড় বড় গাছ।

বরফ শীতল এক ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ল মুসার কপাল থেকে। কেঁপে উঠল সে।

পুরানো ডকটা রাতের বেলা দেখেছে। কোনখানে ছিল, মনে করতে পারল না। আন্দাজে এগিয়ে চলল। তীরের একপাশ থেকে আরেক পাশে চোখ বোলাল। কিন্তু দেখতে পেল না ওটা।

কোথায়? কোনখানে ছিল?

তীরের আরও কাছে চলে এল নৌকা।

 নাহ, নেই! গায়েব!

কি গায়েব? জানতে চাইল কিশোর।

ডকটা…ওহহো, না না আছে। মানে, ছিল।

করাতে কাটা কতগুলো তার মাথা পানি থেকে উঁকি দিয়ে আছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে কোন্‌খানে ছিল ডকটা। এমনভাবে কেটে নষ্ট করে ফেলেছে, নৌকা বাঁধারও কিছু নেই।

ভ্যাম্পায়ারেরাই কেটে ফেলেছে, মুসা বলল। নৌকা নিয়ে কেউ এসে যাতে ওদের গোপন ঘাঁটি খুঁজে বের করে হামলা চালাতে না পারে সেজন্যেই এই সতর্কতা। নিজেদের নৌকা ভেতরে কোন খাড়িটাড়িতে লুকিয়ে রাখে।

তাহলেই বোঝো, চোখের পাতা সরু করে ফেলল কিশোর। এই একটা ব্যাপার থেকেই বোঝা যায় ওঁরা ভুত নয়; মানুষ। কিন্তু ওরা কিছু সন্দেহ করে ফেলল নাকি? আমরা আসব বুঝতে পেরেছে।

অসম্ভব নয়। সাবধানে তীরের কাছে নৌকা নিয়ে এল মুসা। টেনে তোলার জায়গা খুঁজতে লাগল। বড় বড় পাথর আর পাথরের খাড়া দেয়াল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না।

সাঁতরে উঠলে কেমন হয়? কিশোরের প্রশ্ন।

নৌকাটা কোথায় রেখে যাব? নোঙর নেই। ভেসে চলে যাবে। তখন ফিরব কি করে?

দ্বীপটার যে পাশে খোলা সাগর, সেদিকে নৌকা নিয়ে গেল মুসা। ওপাশে বড় বড় ঢেউ। লোফালুফি শুরু করে দিল যেন নৌকাটাকে নিয়ে। এখনই ঢেউয়ের মাথায় চড়ছে নৌকা, পরক্ষণেই ঝপাৎ করে একেবারে নিচে দুই ঢেউয়ের মাঝখানের উপত্যকায়, তারপর আবার ওপরে। চলতেই থাকল এ রকম। মোচার খোলার মত দুলছে। গলুইয়ে বাড়ি খেয়ে পানি ছিটকে এসে পড়ছে চোখে মুখে।

খোলা সাগরে বেরোনোর উপযুক্ত নয় এই নৌকা, শঙ্কিত হয়ে বলল কিশোর। দুই হাতে দুদিকের কিনার চেপে ধরে রেখেছে। ভেতরের দিকটাতে থাকাই উচিত ছিল।

তীরের কাছে একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল মুসার। চিৎকার করে উঠল, দেখো, ঢোকার মুখ!

কিশোরও দেখল। একটা খালমত ঢুকে গেছে দ্বীপের ভেতরে।

 ওটার দিকে নৌকা বাইতে লাগল মুসা। ঢেউয়ের জন্যে বাইতে খুব অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু হাল ছাড়ল না সে।

খালের প্রবেশ মুখে ঢুকতেই ঢেউয়ের অত্যাচার কমে গেল। মাথার ওপর খাড়া হয়ে আছে বড় বড় গাছ। ছাতার মত ছড়িয়ে আছে ডালপালা। কিছু ডাল পানির ওপর ঝুঁকে পড়ে পানি ছুঁই ছুঁই করছে।

কুচকুচে কালো লাগছে পানির রঙ। তার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে ভেসে এগিয়ে চলল নৌকা। আগের বারের কথা মনে পড়ল মুসার। রাত ছিল। মাথার ওপরে উড়ছিল অগণিত বাদুড়। বনের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল নেকড়ের ডাকের মত ডাক। বাদুড়রা দিনে ওড়ে না, কিন্তু নেকড়ে যে কোন সময় হামলা চালাতে পারে। যদিও এখন ডাক শোনা যাচ্ছে না, তবু। সাবধান থাকতে হবে। কোন্‌দিক দিয়ে এসে ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কোন ঠিক নেই। তা ছাড়া মেঘলা বনের চেহারা রাতের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে না।

ওদিকে নিয়ে যাও, হাত তুলে দেখাল কিশোর। বন ওখানে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে পানিতে। নৌকা রেখে যাওয়ার উপযুক্ত জায়গা।

নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিল মুসা। নরম মাটিতে ঠেকল নৌকার তলা। লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে দড়িটা একটা গাছের ডালে বেঁধে ফেলল সে।

ব্যাকপ্যাক দুটো ওর দিকে ছুঁড়ে দিল কিশোর। তীরে নামল।

ভারী দম নিল মুসা। বাতাসে একধরনের ভেজা ভেজা ভাপসা গন্ধ। যাব?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। উত্তেজনায় চকচক করছে চোখ।

দ্বীপটা যে এত ছোট, আগে বোঝেনি মুসা। আগের বার পুড়িয়ে রেখে যাওয়া বীচ হাউসটার কাছে পৌঁছতে কয়েক মিনিটও লাগল না। ওটার দিকে। এগোতে গিয়ে আরও কতগুলো প্রায় একই ধরনের বাড়ি চোখে পড়ল। বাড়ি মানে বাড়িঘরের কঙ্কাল, ধ্বংসাবশেষ।

কফিনগুলো খুঁজে বের করব কি করে? ঘড়ির দিকে তাকাল মুসা। বিকেল তো হয়ে এল। দুজন দুদিকে গিয়ে খুঁজব নাকি? তাতে সময় বাঁচবে।

সত্যি কি লাভ হবে তাতে? ব্যাগটা হাত বদল করল কিশোর।

একা হতে ভয় পাচ্ছ নাকি?

দ্বিধা করল কিশোর। মাথা ঝাঁকিয়ে স্বীকার করল, পাচ্ছি না বলা যাবে না। খুনীদের সঙ্গে লাগতে এসেছি আমরা। সাধারণ খুনী নয়, একেবারে পিশাচ, জীবন্ত মানুষের গা থেকে রক্ত চুষে চুষে খেয়ে খুন করে। ওদের পক্ষে সব সম্ভব। এটা ওদের রাজত্ব। ধরে, বেধে রক্ত খেয়ে যদি লাশগুলো সাগরে ভাসিয়ে দেয় কিচ্ছু করার থাকবে না আমাদের।

ধরো কফিনে শোয়া অবস্থায় পাওয়া গেল ওদের। কি করব? গজাল ঢুকিয়ে দেব হৃৎপিণ্ডে?

না। খুন হয়ে যাবে সেটা। শুধু ভয় দেখাবে।

যদি ভয় না পায়?

পিটিয়ে বেহুশ করার চেষ্টা করবে।

তারপর?

কফিনের ডালা আটকে রেখে চলে যাব, যাতে বেরোতে না পারে। পুলিশ নিয়ে ফিরে আসব।

একে অন্যকে গুডলাক বলে দুজন দুদিকে রওনা হয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকিয়ে মুসা দেখল, কালো একটা বাড়ির কঙ্কালের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে কিশোর। ঘুরে দাঁড়াল মুসা। ডানের আরেকটা কঙ্কালের দিকে এগিয়ে চলল সে। দরজার কাছে এসে দ্বিধা করল। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখে সইয়ে নেয়ার জন্যে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ড পরেই বুঝতে পারল, ঘরে আরও কেউ রয়েছে।

.

২০.

 দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল মুসা।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের অন্ধকারের দিকে। ব্যাগটা হাতে ঝোলানো। চেন খুলে গজাল বের করতে সময় লাগবে। ততক্ষণে আক্রমণ করে বসবে ঘরে যে আছে। ডলি কিংবা কিমিকে ভয় করে না সে। দুটো মেয়ে কিছুই করতে পারবে না ওর। তার ভয়, কাউন্ট ড্রাকুলাকে। পালের গোদা। পুরুষ মানুষ। সঙ্গে পিস্তল থাকা অস্বাভাবিক নয়।

খুট করে একটা শব্দ হলো।

তাকাল সেদিকে।

খুব আবছাভাবে নড়াচড়া চোখে পড়ল। মৃদু গরগর কানে এল। রেগে গেলে কুকুর যা করে।

হঠাৎ বুঝে ফেলল প্রাণীটা কি। নেকড়ে!

মহাসঙ্কটে পড়ে গেল মুসা। কি করবে? এগোনোর প্রশ্নই ওঠে না। পিছানোও বিপদ। মুহূর্তে এসে আক্রমণ করে বসবে নেকড়েটা।

জিম করবেটের মানুষখেকো বাঘ শিকারের কাহিনী মনে পড়ল। চৌগড়ের ভয়াবহ বাঘিনীর মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিলেন একবার তিনি। হাতে ছিল রাইফেল। বাঘিনীটা এতটাই কাছে ছিল তাঁর, কোন রকম নড়াচড়া করতে গেলেই ঝাঁপিয়ে এসে পড়ত। খুব ধীরে ধীরে হাতের রাইফেলটা ঘুরিয়ে টার্গেট করে তারপর গুলি করেছিলেন।

সেই বুদ্ধিটাই কাজে লাগাল এখন সে। খুব ধীরে যেন অনন্তকাল ধরে। চেষ্টা করে নেকড়েটাকে চমকে না দিয়ে হাতের ব্যাকপ্যাকটা প্রায় পেটের ওপর নিয়ে এল। অন্য হাতটা আনল চেনের ওপর। করবেটের মত অতটা সাবধান থাকতে পারেনি, নড়াচড়া বোধহয় একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল নেকড়ের গরুগরানি। হাতটা যেভাবে আছে সেভাবেই রেখে দিল সে। একেবারে স্থির। গরগর কমলে চেন খুলতে শুরু করল। ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকাল। আঙুলে ঠেকল হাতুড়ির বাট। ঠিক এই সময় আক্রমণ করে বসল নেকড়ে।

একসঙ্গে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল। হাত থেকে ব্যাগটা ছেড়ে দিল মুসা। টান দিয়ে বের করে আনল হাতুড়ি। নেকড়েটা এসে ওর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই হাতুড়ি ঘুরিয়ে আন্দাজে বাড়ি মারল।

থ্যাপ করে একটা আওয়াজ হলো। বাড়িটা লাগল নেকডের পেটে। ভয়ঙ্কর গর্জন করে মুসার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওটা।

পড়ে গেল মুসা। হাতুড়ি ছাড়ল না। চিত হয়ে পড়েছে। ওই অবস্থাতেই আবার বাড়ি মাবল লাগল নেকড়ের গলায়। প্রচণ্ড ব্যথায় আবার গর্জে উঠে থমকে গেল প্রাণীটা। পরক্ষণে দাঁত বের করে মুসার টুটি কামড়ে ধরতে এলো।

নাকে মুখে বাড়ি মারতে লাগল মুসা। তেলে দিল কটা। দরজা দিয়ে আসা আলোয় দেখতে পেল রক্ত বেরোচ্ছে নেকড়ের নাক থেকে। গুঙিয়ে উঠল ওটা। ভীষণ রাগে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মুসার বুকে।

 কানের পাশে বাড়ি মারল মুসা। মোক্ষম আঘাত। কাত হয়ে পড়ে গেল নেকড়েটা। ঠেলা মেরে বুকের ওপর থেকে নেতিয়ে পড়া প্রাণীটাকে সরিয়ে দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। মরেনি এখনও। চোখ মিটমিট করে তাকাচ্ছে। ব্যথাটা সহ্য হয়ে গেলেই আবার উঠে দাঁড়াবে। আবার কামড়ে ছিঁড়তে আসবে ওকে। সুযোগ দেয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি ব্যাকপ্যাক থেকে একটা কাঠের গজাল বের করে চোখা মাথাটা ঠেসে ধরল নেকড়ের হৃৎপিণ্ড বরাবর। বাড়ি মেরে মেরে ঢুকিয়ে দিল যতখানি যায়।

থরথর করে কেঁপে উঠল নেকড়ের শরীরটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল গজালের চারপাশ থেকে। ঠিক মুমূর্ষ কুকুরের মত আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে লাগল মুখ দিয়ে।

গজাল বেঁধা নেকড়ে! ভয়ানক দৃশ্য তাকাতে পারল না আর মৃণা! নেকড়ের মতই থরথর করে কাঁপতে লাগল সে-ও। মায়াই লাগছে প্রাণীটার। জন্যে। না মেরে উপায় ছিল না। না মারলে তাকে মরতে হত।

ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে হাতুড়ি হাতে ছুটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ভেতরে আর কেউ আছে কিনা দেখারও প্রয়োজন বোধ করল না। ভয়ঙ্কর নেকড়ের সঙ্গে একঘরে বাস করার কথা নয় কারও।

কথাটা মনে হলো এই সময়–পোষা নেকড়ে নয় তো ওটা? তাই হবে। নইলে এত বিপজ্জনক একটা প্রাণীর সঙ্গে বাস করার সাহস হত না কিমি আর ডলির। তা ছাড়া এই দ্বীপে নেকড়ে আসবেই বা কোথা থেকে। দ্বীপ পাহারা দেয়ার জন্যেই রাখা হয়েছে প্রাণীটাকে। ঠিক। কাউন্ট ড্রাকুলার প্রহরী। ট্রানসিলভানিয়ার সেই দুর্গের মত। এর আগের বার যখন এসেছিল সে, তখনও ছিল ওটা। আগুনের ভয়ে নিশ্চয় কাছে আসেনি সেবার। একটাই আছে? না আরও? সাবধান থাকতে হবে। কোনদিক থেকে এসে ঘাড়ে পড়বে কে জানে। সাবধান থেকেও কতটা লাভ হবে বলা যায় না। দল বেঁধে এসে একযোগে আক্রমণ চালালে কিছুই করার থাকবে না ওর মুহূর্তে টেনে, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

 বাড়িটার কাছ থেকে সরে এসে দ্রুত অন্য বাড়ির খোঁজে হাঁটতে লাগল।

বুনো পথে চলতে গিয়ে দিরে বেলাতেও গা ছমছম করতে লাগল। ভূতুড়ে বন। সত্যি সত্যি ভূত থাকলেও এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভয় তার শক্তি কেড়ে নিয়েছে যেন। পা দুটো অসম্ভব ভারী লাগছে। বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে।

পাওয়া গেল আরেকটা বাড়ি। একটা পাশ ধসে পড়েছে। ঢুকে কিছু পেল না।

একের পর এক বাড়িতে ঢুকে দেখতে লাগল সে। কোনটাতেই কফিন দেখল না। কিমি আর ডলিকে পেল না। যে ঘরেই তাক, আলমারি, সিন্দুক রয়েছে, কোনখানে খোঁজা বাকি রাখল না।

কিন্তু কিমিও নেই। ডলিও না। কোন চিহ্নই নেই ওদের। গেল কোথায়? কোন্‌খানে আছে?

ছোট্ট এক টুকরো খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল সে। ঘড়ি দেখল। তিনটে পঁয়তাল্লিশ। আগের বার যখন দেখেছিল, তখনও ছিল তিনটে পঁয়তাল্লিশ। হঠাৎ খেয়াল করল, সেকেন্ডের কাটাটা চলছে না। এই ব্যাপার! বন্ধ হয়ে গেছে। ঘড়ি। নেকড়ের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় বাড়ি লেগে নিশ্চয়।

সময় বোঝার উপায় নেই আর। কতক্ষণ ধরে রয়েছে বলতে পারবে না। সূর্য ডোবার কত দেরি, তাও জানা গেল না।

বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু ভারী মেঘে ঢেকে রেখেছে আকাশ। সময় অনুমান করা কঠিন। তবে সন্ধ্যা বোধহয় হয়ে গেছে। আলো নিভে যাওয়ার আগেই কিমি আর ডলিকে খুঁজে বের করতে না পারলে আজকের মত ফিরেই যেতে হবে। রাতের বেলা অন্ধকারে ওদের খুঁজতে যাওয়াটা হবে চরম বোকামি। খুঁজে পাবেও না। ওদিকে মারাত্মক বিপদের ঝুঁকি নিতে হবে। আরও নেকড়ে থেকে থাকলে রাতের বেলা ভয়ানক বিপদে পড়বে।

 কিশোর কোথায়? কাউকে নিশ্চয় খুঁজে পায়নি এখনও। তাহলে যোগাযোগ করত ওর সঙ্গে। নাকি বিপদে পড়ল? চিৎকার তো শোনা যায়নি।

খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল মুসা। কোনদিকে যাবে বুঝতে চাইছে। বনের ভেতর থেকে ভেসে এল একটা কাঁপা কাঁপা ডাক। নেকড়ে! তারমানে আরও আছে! দূর থেকে শেয়ালের ডাকও অনেক সময় নেকড়ের মত লাগে। তবু, খারাপটা ভেবে রাখাই ভাল। প্রাণীটাকে নেকড়ে ধরে নিল সে।

রাতের আর কত বাকি? রাত পর্যন্ত কি অপেক্ষা করবে ওটা? একটাই আছে আর, না আরও বেশি?

ভুল করে আবার তাকাল ঘড়ির দিকে। তাকিয়েই মনে পড়ল নষ্ট। সেই তিনটা পঁয়তাল্লিশই বাজে। বাদুড়েরা এখনও বেরোয়নি। ওরা বেরোতে শুরু করলেই বুঝতে হবে সন্ধ্যা লেগে গেছে।

কিশোরকে ডাকার কথা ভাবল। চিৎকার করতে হবে তাহলে। নেকড়ের কানে যাবে সেই ডাক। হয়তো কিশোরের আগে ওরাই ছুটে আসবে। বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতেও এখন ভয় লাগছে। কিন্তু উপায় নেই। নৌকার কাছে যেতে হলেও বনের ভেতর দিয়েই যাওয়া লাগবে।

 নৌকা! তাই তো! এখান থেকে কতখানি দূরে, অনুমান করতে পারল না। সাগরের খোলা দিকটা দিয়ে খালে ঢুকেছিল। খুঁজে বের করতে সময় লাগবে। নেকড়ের তাড়া খেলে এখন পৌঁছতে পারবে না ওটার কাছে।

আতঙ্ক যেন চেপে ধরল ওকে। গাছপালার ফাঁকে ঘুরে বেড়াতে লাগল চঞ্চল দৃষ্টি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে জায়গাটা ঘাসে ছাওয়া। ভাল করে তাকাতে চোখে পড়ল একজায়গার ঘাস চ্যাপ্টা হয়ে আছে। কেউ মনে হয় হেঁটে গেছে এখান দিয়ে।

রাস্তা?

 না, রাস্তা এখনও পুরোপুরি হয়নি। হেঁটে যাওয়ার ফলে একটা পায়ে চলা পথ তৈরি হচ্ছে। নেকড়ের কাজ?

ধূর! অত চিন্তা করে কিছু করতে পারবে না। নিজেকে ধমক লাগাল সে-যা হোক একটা কিছু করে ফেলো, নয়তো ভ্যাম্পায়ার খোঁজা বাদ দিয়ে মানে মানে কেটে পড়ো এখান থেকে।

 কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাতুড়িটা বাগিয়ে ধরে পা বাড়াল সে। বনে এসে ঢুকল। বনটা এদিকে বেশ গভীর। এগিয়ে চলল গাছপালার মাঝখান দিয়ে। গায়ে বাড়ি লেগে সড়াৎ সড়াৎ করে সরে যাচ্ছে ডাল। পাতায় লেগে থাকা পানি মুহূর্তে ভিজিয়ে দিল শরীর। ঘন হয়ে জন্মে আছে মোটা মোটা লতা ঝুলে আছে রাস্তার ওপর। হাঁটতে গেলে জড়িয়ে ধরে।

এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো সে। সামনে ডালপাতা জড়িয়ে ধরে দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে রেখেছে লতার দঙ্গল। তার ওপাশে বাড়ির দেয়ালের মত কি যেন চোখে পড়ছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে ডাল সরিয়ে দেখতে যেতেই খোঁচা লাগল হাতে। কুটুস করে কি যেন বিধল।

আউক! করে হাতটা সরিয়ে এনে তাকাল। খাইছে! দুটো ফুটো। ভ্যাম্পায়ারে দাঁত বসালে যেমন হয়। দুই ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এসেছে। চুষে ফেলতে গিয়ে থমকে গেল। ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপে এসে এ ভাবে রক্ত খাবে! নিজেও ভ্যাম্পায়ার হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি মুখ সরিয়ে আনল।

যাবে কি করে ওপাশে, ভাবনায় পড়ে গেল সে। কাটার জন্যে ছোঁয়াও যাচ্ছে না।

 ব্যাকপ্যাক থেকে একটা গজাল টেনে বের করল। ঢুকিয়ে দিল লতার দঙ্গলের মধ্যে। চাড় মেরে মেরে ফোকর বড় করতে লাগল। তাকাল তার ভেতর দিয়ে।

বাড়িই আছে ওপাশে একটা। দ্বীপের অন্য বাড়িগুলোর তুলনায় মোটামুটি অক্ষত। আলো ফুরিয়ে আসার আগেই কাজ সারার তাগিদে দ্রুত হাত চালাল সে। ফোকরটা বড় করে ফেলল যাতে কোনমতে গলে অন্যপাশে চলে যেতে পারে। গজালটা আবার ব্যাগে ভরল।

কিন্তু কাঁটার জন্যে ফোকর গলে যাওয়াও এক ঝকমারি। কাপড়ে আঁকড়ে ধরল কাটা, ব্যাগ টেনে ধরল, হাতের, মুখের চামড়া ছড়ে গেল। সব কিছু সহ্য করেই আসতে হলো অন্যপাশে।

আকাশের দিকে তাকাল। বন্ধ হওয়ার পর আর শুরু হয়নি বৃষ্টি। মেঘের দল টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে ছুটতে আরম্ভ করেছে। কেউ যেন তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে ওগুলোকে। নেকড়ের দল! মনে পড়ল আবার।

সূর্য ডোবার আর কত বাকি? কতটা সময় হাতে আছে আর?

বাড়িটার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সে। নব চেপে ধরে মোচড় দিতে সহজেই ঘুরে গেল। ঠেলা দিতে ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে আটকে গেল পাল্লা। কোন কিছুতে লেগে গেছে।

জোরে ঠেলা দিল সে।

সামান্য একটু খুলে আবার আটকে গেল।

গায়ের জোরে ঠেলতে শুরু করল সে। যাতে আটকে ছিল, মেঝেতে ঘষার শব্দ তুলে সরে যেতে লাগল সেই জিনিসটা।

ফুটখানেক ফাঁক হতেই আর খোলার চেষ্টা করল না সে। তার মধ্যে দিয়েই চেপেচুপে কোনমতে ঢুকে পড়ল।

অন্ধকার ঘর। দরজা দিয়ে যা সামান্য আলো আসছে। আর কোনদিক দিয়ে আসার পথ নেই আর।

যার চোখে অন্ধকার সয়ে আসার অপেক্ষা করতে লাগল। চোখে পড়ল একটা ড্রেসার। এটাই দরজা আটকে রেখেছিল।

ধীরে ধীরে নজরে এল পুরো ঘরটাই। একটা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে সে। অদ্ভুত গন্ধ। আগুনের কুণ্ড করে নিভিয়ে ফেলার পর যা হয় অনেকটা সেরকম।

সমস্ত ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগল তার দৃষ্টি। পুরো ঘরটাই প্রায় খালি।

আরেকটা দরজা দেখে সেটা দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল। এই ঘরটা আরও বেশি অন্ধকার। ভেজা বাতাস। ভাপসা গন্ধ। কোণে কোণে অন্ধকার ছায়া। রান্নাঘর দিয়ে আসা আলোয় সে-অন্ধকার কাটছে না। দেখা যায় মোটামুটি।

দেয়ালগুলোর দিকে তাকাল সে। জানালা আছে। তবে তক্তা লাগিয়ে। পেরেক ঠুকে আটকে দেয়া হয়েছে।

ছায়াতে কি আছে দেখার চেষ্টা করল।

এককোণে ওটা কি?

আরে একটা নয়, তিনটে। ছায়া এতই গভীর, বোঝা যায়নি প্রথমে।

তিনটে আয়তাকার বাক্স পড়ে আছে।

কফিন!

দম বন্ধ করে ফেলল সে। তিনটে কেন? দুটোতে কিমি আর ডলি। তৃতীয়টায় কে আছে?

কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল বুকের মধ্যে। যা খুঁজতে এসেছিল পেয়েছে। পাওয়া গেছে ভ্যাম্পায়ারের গোপন আস্তানা।

সাবধান রইল কোন রকম শব্দ যাতে আর না হয়। দরজা খোলার সময় যেটুকু করে ফেলেছে, ফেলেছে। ওই শব্দে যদি জেগে গিয়ে না থাকে, ভাল। জাগাতে চায় না। আস্তে করে নামিয়ে রাখল ব্যাকপ্যাকটা। একটা গজাল। বের করে রাখল একটা কফিনের পাশে। হাতুড়িটা মাথার ওপর তুলে, বাগিয়ে ধরে রেখে, টান দিল কফিনের ডালা ধরে।

তুলেই থমকে গেল। ভেতরে বিছানা আছে। কিন্তু মানুষ নেই।

হাতের তালু রেখে বিছানাটা ছুঁয়ে দেখল। গরম। তারমানে এইমাত্র বেরিয়েছে। নিশ্চয় দরজা খোলার শব্দে জেগে বেরিয়ে গেছে।

সোজা হয়ে দাঁড়াল মুসা। পেছনে শব্দ হলো।

 চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে।

ধড়াস করে উঠল বুক। একটা হার্টবীট মিস হয়ে গেল। পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লম্বা এক লোক। কালো আলখেল্লা, মুখ ভর্তি দাড়ি, ব্যাকব্রাশ করা চুল, ফ্যাকাসে চেহারা–সব মিলিয়ে একেবারে ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা। ট্রানসিলভানিয়ার দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে যেন।

তবে এই ড্রাকুলার হাতে পিস্তল আছে। খসখসে গলায় হুকুম দিল, কোন শয়তানি করার চেষ্টা করলেই গুলি খাবে। এখানে কি জন্যে এসেছ?

জবাব দেয়ার আগেই রান্নাঘর থেকে ঢোকার দরজায় আরেকটা মূর্তিকে দেখতে পেল মুসা। কিশোর।

কি হলো, জবাব দিচ্ছ না কেন?

এই জন্যে, পেছন থেকে বলে উঠল কিশোর।

ঘুরে দাঁড়াতে গেল ড্রাকুলা। সময় দিল না কিশোর। নির্দ্বিধায় কাঠের হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারল লোকটার মাথায়।

 এক আঘাতেই ড্রাকুলা কাত। হাতের পিস্তলটা মেঝেতে পড়ল খটাং করে। কাটা কলাগাছের মত টলে উঠে পড়ে যেতে শুরু করল লোকটা। হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেঝেতে। বেহুশ হয়ে গেছে।

ধরো ব্যাটাকে! ওর কফিনেই শুইয়ে ডালা লাগিয়ে বন্দি করি। তারপর পুলিশ আনতে যাব।

শব্দ শুনে অন্য দুটো কফিনের ডালাও খুলে গেছে। উঁকি দিল কিমি আর। ডলি। দৃশ্য দেখে হাঁ হয়ে গেল দুজনেই।

কঠোর কণ্ঠে আদেশ দিল কিশোর, চুপচাপ থাকো। নইলে বসের অবস্থা করে ছাড়ব। ভ্যাম্পায়ারগিরি ঘুচিয়ে দেব আজ। হাতের হাতুড়িটা তুলে নাচাল। মাথায় বাড়ি খাওয়ার ইচ্ছে আছে?

ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল ডলি। বোঝা গেল, ইচ্ছে নেই।

 জিজ্ঞেস করল কিশোর, এ দ্বীপে আর কে কে আছে তোমাদের সঙ্গে?

কেউ না, জবাব দিল কিমি।

সত্যি বলছ?

সত্যি।

তাহলে কোথায় আছে?

বহু জায়গায়। কোটার নাম বলব?

 সবগুলোরই বলতে হবে। পরে। দ্বীপে আর কেউ নেই তো?

না, মাথা নাড়ল কিমি।

থাকলে ওর মাথা ফাটানোর আগে তোমার মাথা ফাটাব, বলে দিলাম। হুমকি দিল কিশোর।

সত্যি নেই।

হু। শুয়ে পড়ো এবার। কোন রকম শয়তানির চেষ্টা করলে এটা ঢোকাব হৃৎপিণ্ডে, একটা গজাল দেখাল কিশোর। ভ্যাম্পায়ার-খেলা অনেক খেলেছ। অনেক নিরীহ মানুষকে খুন করেছ। রবিনের রক্ত খেয়েছ। তোমাদের খুন। করার জন্যে হাত নিশপিশ করছে আমার। সুযোগটা দিয়ো না।

বিশ্বাস করল ওরা। সুযোগ দিল না কিশোরকে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে ভেতর থেকে ডালা নামিয়ে দিল।

সঙ্গে করে দড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। তিনটে কফিনের ডালা বাক্সের সঙ্গে পেঁচিয়ে বাঁধা হলো, যাতে ভেতর থেকে কোনমতেই বেরিয়ে আসতে না। পারে তিন ভ্যাম্পায়ার।

কাজ শেষ করে দুই হাত ঝাড়তে ঝাড়তে মুসার দিকে তাকাল কিশোর, যাও এবার, পুলিশ নিয়ে এসোগে। আমি এদের পাহারা দিচ্ছি।

যদি দলে আরও লোক থাকে? তোমার ওপর হামলা চালায়?

নেই। কিমি মিথ্যে বলেনি। ডলির মত অভিনয় জানে না ও। আর যদি থাকেও, মেঝে থেকে পিস্তলটা তুলে নিল কিশোর, কিছু করতে এলে গুলি খেয়ে মরবে। দেখামাত্র বুকে গুলি করব। কোন ঝুঁকি নেব না। হাতে পিস্তল আছে যখন, নেকড়ে এলেও ভয় নেই যাও যাও, দেরি কোরো না। ওই শয়তানগুলো আসার আগেই নৌকায় উঠে পড়োগে।

ঠিক আছে, যাচ্ছি। সাবধানে থেকো। আমি যাব, আর আসব।

একটা গজাল আর হাতুড়ি তুলে নিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুসা।