কালো বিদ্যুৎ [রহস্য নাট্য]

কালো বিদ্যুৎ 

[ রহস্য নাট্য ]

পার্বত্য দেশ। অরণ্য। গাছেদের অশ্রান্ত মর্মর ধ্বনি, নিঝরের ঝরঝর জলতান এবং মাঝে মাঝে দু-তিন রকম পাখির সাড়া ভেসে আসছে।

একখানি ডাকবাংলো দেখা যাচ্ছে।

অমিয় সেন, তাঁর স্ত্রী লতিকা সেন ও তাদের বন্ধু কবি সরল রায় ধীরে ধীরে ডাকবাংলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।

সূর্য অস্তগত, একটু পরেই সন্ধ্যা হবে।

 

সরল। অমিয়, এতক্ষণ পরে বোধহয় দুর্ভাগ্যের ধাক্কা সামলাবার একটা উপায় হল। এই দ্যাখো, আমরা ডাকবাংলোর কাছে এসে পড়েছি!

লতিকা। (উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে) আহা, জায়গাটি কী চমত্তার!

অমিয়। হ্যাঁ লতিকা, যিনি এখানে বাংলোর জন্যে স্থান নির্বাচন করেছেন, তিনি আর আমাদের সরল নিশ্চয়ই একজাতের মনুষ্য।

সরল। অর্থাৎ?

অমিয়। অর্থাৎ তিনিও তোমার মতোই কবি।

লতিকা। ওদিকে পাহাড়ের-পর-পাহাড়ের স্থির তরঙ্গমালা, তাদের কোলে কোলে দুলছে। ঘন বনের স্নিগ্ধ শ্যামলতা, আর ওই সবুজের ওপরে ঝকমকে জরির পাড়ের মতন দেখাচ্ছে। ছোট্ট ঝরনাটিকে! আমার আর এখন এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না!

অমিয়। ওটা বলা বাহুল্য। কারণ, ইচ্ছা করলেও আজ তুমি এখান থেকে যেতে পারবে। বনের পথে আমাদের ভগ্নচক্র মোটর হয়েছে নিশ্চেষ্ট, কাজেই আজ রাত্রে ওই বাংলোর জঠরে প্রবেশ করা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায়ই নেই।

লতিকা। তা জানি গো, জানি। কিন্তু মোটরখানা ভেঙেছে বলে এখন আর আমার কোনও দুঃখই হচ্ছে না।

অমিয়। তার মানে?

লতিকা। তোমার মোটর অচল না হলে তো আজ এমন অপূর্ব শোভার হাটে রাত্রিবাস করতে পারতুম না!

অমিয়। লতিকা, তোমার কাব্য-ব্যাধি দেখছি সরলেরও চেয়ে মারাত্মক!

সরল। অমিয়, তুমি অকারণেই বারবার আমাকে নিয়ে টানাটানি করছ। কারণ আমি লতিকা দেবীর মত সমর্থন করি না। আমার কাব্য-রাজ্য হচ্ছে সম্পূর্ণ নিরাপদ। পেট ভরে খেয়ে আরামে সোফায় বসে বা বিছানায় শুয়ে কবিতায় প্রকৃতি বর্ণনা পাঠ করা যায় নিশ্চিন্ত প্রাণে। কিন্তু এই ভয়াবহ বিজন জঙ্গলে শূন্যউদরে রাত কাটাতে হবে শুনে আমার মনে একটুও আনন্দ হচ্ছে না।

লতিকা। আপনার কথাগুলো অকবির মতন হল সরলবাবু! একটু পরেই চাঁদ উঠবে, তখন তার রুপোলি রূপের স্বপ্নে এক রাতের উপবাসকে তুচ্ছ বলে মনে হবে।

সরল। উপবাসকে তুচ্ছ ভাবব, এত বড়ো নির্বোধ কবি আমি নই।

লতিকা। কবিমশাই, এত সহজে হাল ছাড়ছেন কেন? এটা যখন ডাকবাংলো, তখন কোনও আয়োজনই কি এখানে হতে পারে না?

সরল। নির্জন বনের এরকম সব ডাকবাংলোর ব্যবস্থা আমি জানি। আগে থাকতে খবর না দিলে এখানে যা ভক্ষণ করতে হয় তার নাম হচ্ছে বিশুদ্ধ বায়ু।

অমিয়। দ্যাখো সরল, বাংলোর বারান্দা থেকে একটি লোক আমাদের লক্ষ করছে।

সরল। হু, লোকটিকে সরকারি কর্মচারী বলেই মনে হচ্ছে। অমিয়। আরে, আরে, ওঁকে যে আমি চিনি। মি. দত্ত, সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ।

সরল। উনিও তোমাকে চিনতে পেরেছেন। ওই দ্যাখো, তাড়াতাড়ি এদিকে এগিয়ে আসছেন।

অমিয়। হ্যালো দত্তসাহেব, আপনি এখানে বনবাসী কেন? নমস্কার।

মি. দত্ত। নমস্কার, নমস্কার! আমিও আপনাকে ঠিক ওই প্রশ্নই করতে পারি।

অমিয়। আমার মোটরের একখানা চাকা গাড়িকে ত্যাগ করে নদীর জলে ঝাপ খেয়েছে। ড্রাইভার তাকে উদ্ধার করবার চেষ্টায় আছে, আর আমরা এসেছি আশ্রয়ের সন্ধানে।

দত্ত। সঙ্গে শ্রীমতী সেন বুঝি?

অমিয়। হ্যাঁ আর উনি হচ্ছেন আমাদের বন্ধু, অতি-আধুনিক ধাঁধা-প্রণেতা সরল রায়।

দত্ত। ধাঁধা-প্রণেতা?

অমিয়। অর্থাৎ ভদ্রতার খাতিরে যাকে কবি বলে ডাকা হয়। আমার মতে, কবিতা মাত্রই ধাঁধা ছাড়া আর কিছুই নয়।

সরল। মি. দত্ত, আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে আমার বন্ধুটির পেশা হচ্ছে কন্ট্রাকটারি করা? কিন্তু আজ দেখছি উনি হঠাৎ কাব্য সমালোচক হওয়ার চেষ্টা করছেন। বাংলা কাব্যজগতের বিপদ আসন্ন!

দত্ত। কাব্যজগতের বিপদের কথা নিয়ে এখন আমার মাথা ঘামাবার সময় নেই। এখানে এসে একটা জরুরি মামলা নিয়ে ভারী জড়িয়ে পড়েছি।

অমিয়। এই বিজন অরণ্যে জরুরি মামলা! কীসের মামলা?

দত্ত। মামলাটা যে কীসের, এখনও তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবে বড়ই রহস্যময় ব্যাপার। পরে শুনবেন। আজ তো আপনারা এইখানেই আছেন?

সরল। অবশ্য যদি স্থানাভাব না হয়—

অমিয়। স্থানাভাব হলেও আমাদের থাকতে হবে। সামনে রাত্রি, সঙ্গে মহিলা, গভীর অরণ্য। তাড়িয়ে দিলেও যেতে পারব না।

দত্ত। (হেসে) সে ভয় নেই। মিসেস সেন, আপনাকে অত্যন্ত শ্রান্ত দেখাচ্ছে, বাংলোর ভেতরে গিয়ে আপনি একটু বিশ্রাম করুন, আমার বাবুর্চি এখনই চা তৈরি করে দেবে।

সরল। মি. দত্ত, আপনি আমার মৃতদেহে জীবন সঞ্চার করলেন। আপনার বাবুর্চি যখন আছে তখন নিশ্চয়ই এখানে দীয়তাম ভুজ্যতাম-এর অভাব হবে না! হ্যা লতিকা দেবী, এতক্ষণ পরে আমার মনে হচ্ছে, আপনার কথা সত্য বটে! এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চমৎকার!

লতিকা। (হাস্য করে) বাবুর্চির নামেই কবিবরের সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত হয়ে উঠল নাকি? আচ্ছা, ততক্ষণ আপনি চপ-কাটলেটের স্বপ্ন দেখতে দেখতে প্রকৃতিকে উপভোগ করুন, আমি জামা-কাপড় বদলে আসি।

(প্রস্থান)

দত্ত। সরলবাবু, আপনার সৌন্দর্যবোধকে আমি এইবারে দুঃখ দিতে চাই।

সরল। তার মানে? আপনার বাবুর্চির ভাণ্ডারে কি অন্নাভাব হয়েছে?

দত্ত। তা নয়। কিন্তু আপনি যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখছেন, আমি সেখানে দেখছি কেবল অপ্রাকৃতিক বিভীষিকা।

সরল। বিভীষিকা?

দত্ত। হ্যাঁ, দারুণ বিভীষিকা। সেই কথা বলব বলেই মিসেস সেনকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলুম। আপনারা আজ রাত্রিবাস করতে এসেছেন মৃত্যুপুরীর মধ্যে!

অমিয়। কী বলছেন দত্তসায়েব!

দত্ত। অত্যুক্তি করছি না। মাসখানেক আগে সরকারি কাজে ইঞ্জিনিয়ার কুমুদ মিত্র এই বাংলোয় এক রাত বাস করতে আসেন। পরদিন সকালে অনেক বেলাতেও তার ঘুম ভাঙেনি দেখে সকলে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে। বিছানা খালি, ঘরের সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ, কিন্তু কুমুদবাবু অদৃশ্য! বাংলোর সর্বত্র, আশপাশের সমস্ত জঙ্গল পাহাড় তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কুমুদবাবুর কোনও চিহ্নই আর পাওয়া যায়নি।

অমিয়। কী সর্বনাশ!

দত্ত। তার এক হপ্তা পরে বাংলোর ভেতর থেকে অদৃশ্য হয়েছে এক চাকর। ঠিক একই ব্যাপার। সে-ও কপূরের মতন শূন্যে মিলিয়ে গেছে বদ্ধ-দ্বার ঘরের ভেতর থেকে। ব্যাপার দেখে বাংলোর বাকি চাকররা ভয়ে দলবেঁধে পালিয়ে গিয়েছে—তাদের ধারণা, এসব ভৌতিক কাণ্ড!

অমিয়। তাদের ধারণা হয়তো ভুল নয় দত্তসাহেব! দত্ত। আপনারাও ভূত মানেন? সরল। দিনের বেলায় নয়, রাত হলেই আমরা ভূত মানি।

দত্ত। কিন্তু পুলিশের আইনে ভূতের অস্তিত্ব নেই। সে দারোগার এলাকায় এই বাংলো, গেল হপ্তায় তিনি এসেছিলেন এখানে তদারক করতে। কিন্তু তিনিও আর থানায় ফিরে যাননি।

সরল ও অমিয়। (একসঙ্গে) আঁঃ, বলেন কী?

দত্ত। হ্যাঁ। দারোগা সমস্ত দরজা-জানলা নিজে ভেতর থেকে বন্ধ করে শুয়েছিলেন। বাইরে ঘরের দরজার কাছে পাহারায় নিযুক্ত ছিল দুজন চৌকিদার। কিন্তু সকালে বেলা দশটার সময়ও দারোগার ঘুম ভাঙল না দেখে দরজা ভেঙে ফেলা হয়। শূন্য খাট, সব।

জানলা ভেতর থেকে বন্ধ, কিন্তু দারোগা অদৃশ্য!

অমিয়। চৌকিদাররা রাত্রে কোনও শব্দ-টব্দও শোনেনি?

দত্ত। খালি একবার তাদের কানে গিয়েছিল, ঘরের ভেতরে খাটখানা মড়মড় করে উঠেছিল, আর কিছু নয়।

অমিয়। তাহলে নিশ্চয় এসব ভৌতিক কাণ্ড!

দত্ত। তর্কের অনুরোধে আপনার কথা না হয় স্বীকারই করলুম। ভূতরা যেন অশরীরী, তাদের ছায়া-দেহ না হয় দেওয়াল বা দরজা-জানলার পাল্লা ভেদ করে ঘরের ভেতরে ঢুকতে পারে কিন্তু যে তিনজন মানুষ অন্তর্হিত হয়েছে, তারা তো আর সূক্ষ্ম দেহের অধিকারী নয়? তাদের দেহ কেমন করে বাতাসে মিলিয়ে গেল? আর এমনভাবে একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন চাকর আর একজন দারোয়ানের দেহ হরণ করে কোনও নিম্নশ্রেণির প্রেতাত্মারও এতটুকু লাভ হবে না। ওই তিনজন মানুষের কী হল? কেউ যে তাদের হত্যা করেছে, ঘরের মধ্যে এমন কোনও চিহ্নই পাওয়া যায়নি। এখানকার জঙ্গলে বাঘ-ভালুক আছে বটে, কিন্তু তারা তো দেওয়াল ভেদ করে ঘরে ঢুকতে পারে না! কুমুদবাবু আর দারোগাবাবুর গায়ের জামা আর পায়ের জুতোও পাওয়া গেছে ঘরের মধ্যে। খালি গায়ে খালি পায়ে তারা। কোথাও যেতে পারেন না। এই অদ্ভুত সমস্যা সমাধান করবার জন্যেই আজ পাঁচ দিন ধরে আমি এখানে বাস করছি, এইবারে হয়তো আমাকেই অদৃশ্য হতে হবে!

সরল। মি. দত্ত, মি. দত্ত! আপনার বাবুর্চি যদি পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হয়, তাহলেও তার হাতের রান্না খাওয়ার জন্যে আমার আর একটুও লোভ নেই। হা ভগবান, নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে!

অমিয়। তাই তো সরল, এ আমরা কোথায় এসে পড়লুম! আবার ফিরে গিয়ে ভাঙা গাড়িতেই বসে থাকব নাকি?

সরল। বাপ, সেটা হবে আরও ভয়ানক! যে মুল্লুকে ঘরের ভেতরই এমন কাণ্ড, রাত্রে সেখানে বাইরে থাকলে কি আর রক্ষা আছে?

দত্ত। আমার সঙ্গে মিলিটারি পুলিশ আছে, আর আপনাদেরও হাতে বন্দুক আছে। দেখছি। সুতরাং অতটা ভয় পাওয়ার কারণ নেই।

সরল। না স্যার, বিলক্ষণ ভয় পাওয়ার কারণ আছে। আমাদের দেহই যদি বাতাসে মিলিয়ে যায়, বন্দুক নিয়ে করব কী?

অমিয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে চারদিক ঢেকে গেল। বনের ভেতরে ফেউ ডাকছে, নিশ্চয়ই বাঘ বেরিয়েছে। কপালে যা আছে তাই হবে, কিন্তু এখন আমাদের আর বাইরে থাকা উচিত নয়।

দত্ত। হ্যাঁ, এইবারে ভেতরে চলুন। কিন্তু দেখবেন, মিসেস সেন যেন ঘুণাক্ষরেও কোনও কথা না শশানেন! সরলবাবু আজ আমার সঙ্গেই শোবেন, অমিয়বাবুর ঘরের চারদিকেই পাহারার ব্যবস্থা থাকবে। এ কদিন যখন কিছুই হয়নি, তখন আজকের রাতটাও হয়তো ভালোয় ভালোয় কেটে যাবে।

সরল। মি. দত্তের কথাই যেন সত্য হয়! আজ যদি অদৃশ্য না হই, তাহলে কাল অমিয়ের গাড়ি তৈরি না হলেও আমি পদব্রজেই বেগে পলায়ন করব।

দত্ত। ভেতরে চলুন।

 

বাংলোর একখানি ঘর। লতিকা জানলার ধারে চেয়ারে বসে আছে।

অমিয়ের প্রবেশ।

অমিয়। খোলা জানলার ধারে বসে কী করছ?

লতিকা। পাহাড়ের মাথায় চাঁদের সোনার মুকুট। আলো-ঝলমল বনে গাছের পাতায় জ্যোৎস্নার জয়গান, আর হিরে-মানিক ছড়াতে ছড়াতে ঝরনা গাইছে পরিললাকের গান। এইসব দেখছি আর শুনছি।

অমিয়। দেখছ, এখানকার জানলায় গরাদে নেই?

লতিকা। গরাদে-দেওয়া জানলা আমার ভালো লাগে না। মনে হয় যেন, জেলখানায় বসে আছি।

অমিয়। লতিকা, কবিত্ব সবসময়ে নিরাপদ নয়। মনে রেখো আমরা গহন বনের মধ্যে আছি, এ হচ্ছে হিংস্র পশুদের রাজ্য। জানলাগুলো বন্ধ করে দেওয়াই উচিত।

লতিকা। দ্যাখো, তুমি যখন সাবধান করে দিলে, তখন একটা কথা বলব? অমিয়। কী কথা? লতিকা। আমার কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। অমিয়। অস্বস্তি?

লতিকা। হ্যাঁ, অস্বস্তি আর ভয়। তুমি হেসো না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, সামনের পাহাড়ের ওই ঝোপটার ভেতর থেকে ভয়ংকর দুটো চোখ মেলে কে যেন আমার পানে তাকিয়ে আর তাকিয়েই আছে…ওকী, ওকী, তোমার মুখ অমন সাদা হয়ে গেল কেন? ভয় নেই, এটা শুধু আমার মনেরই ভ্রম!

অমিয়। (ভিতু ব্যস্ত কণ্ঠে) কোন ঝোপের ভেতর থেকে লতিকা, কোন ঝোপের ভেতর থেকে?

লতিকা। কী আশ্চর্য, তুমি এতটা ব্যস্ত হচ্ছ কেন? বলছি তো, আমার মনের ভ্রম! দ্যাখো না, ওখানে কেউ নেই!

অমিয়। (সামলে নিয়ে) ওখানে কোনও বন্য জন্তু থাকাও অসম্ভব নয়! জানলাগুলো আমি বন্ধ করে দি। (একটা জানলা বন্ধ করে) দ্যাখো লতিকা, ওই ঝোপটা সত্যি-সত্যিই কেমন নড়ে উঠল!

লতিকা। জোরে বাতাস বইছে, ঝোপ তো নড়তেই পারে।

অমিয়। বাতাসে ঝোপ একদিকেই নুয়ে পড়ে। কিন্তু যেদিক থেকে বাতাস আসছে, ওঝোপটা সেদিকেও নুয়ে নুয়ে পড়ল। এসব ভালো লক্ষণ নয়। আমি আগে জানলাগুলো বন্ধ করে দি। (জানলাগুলো একে একে বন্ধ করতে লাগল)

লতিকা। এমন চাঁদের আলো তুমি কি নষ্ট করে দিতে চাও?

অমিয়। (জানলা সশব্দে বন্ধ করতে করতে) হ্যাঁ, চাই। প্রাণ থাকলে অমন ঢের চাঁদের আলো দেখবার সময় পাব!

লতিকা। তোমার আজ কী হল বলো দেখি? ভয়ে তোমার সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে! তোমার এরকম ভয়ের কারণ কী?

অমিয়। আমি ভয় পাইনি লতিকা, আমি খালি সাবধান হতে চাই।

লতিকা। ডিনার খেতে বসে দেখলুম, তোমরা সবাই যেন কেমন একরকম হয়ে গেছ। কারুর মুখেই হাসি নেই, কেউ ভালো করে কথা কয় না, আমাদের পেটুক কবিমশাইও আজ খিদে নেই বলে ছুরি-কাটা ফেলে উঠে পড়লেন, তোমাদের ওই পুলিশসাহেবও থেকে থেকে উঠে গিয়ে তোকজনদের চুপিচুপি কীসব হুকুম দিয়ে আসেন, চারদিকে বন্দুক-ঘাড়ে সেপাইদের পাহারা, এ সমস্তই আমি লক্ষ করেছি! আসল ব্যাপারটা কী বলো তো?

অমিয়। যা লক্ষ করেছ, সবই তোমার মনের ভুল! রাত হল, এখন শুয়ে পড়ো।

লতিকা। ও কী, তুমি যে বন্দুকটা পাশে নিয়েই শুয়ে পড়লে! বন্দুকের আজ এত আদর কেন?

অমিয়। এটা হচ্ছে ভীষণ জঙ্গল। আত্মরক্ষার উপায় করে রাখলুম।

লতিকা। ঘরের জানলা-দরজা সব বন্ধ, কার কাছ থেকে তুমি আত্মরক্ষা করতে চাও?

অমিয়। তোমার অর্থহীন প্রশ্নের পর প্রশ্নের জ্বালায় যে অস্থির হয়ে উঠলুম লতিকা! নাও, শুয়ে পড়ো!

লতিকা। হুকুম তামিল করলুম, প্রভু! কিন্তু সরলবাবু কোথায় শুলেন?

অমিয়। মি. দত্তের সঙ্গে। তুমি না থাকলে আমিও সেইখানেই আস্তানা পাততুম।

লতিকা। তাই নাকি? মি. দত্তের সঙ্গ কি এতই লোভনীয়?

অমিয়। জঙ্গল হচ্ছে বিপজ্জনক জায়গা। এখানে নারীর আবির্ভাব হচ্ছে আবার বিপদের ওপরে বিপদের মতো! দয়া করে আর প্রশ্ন না করে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো।

 

(কিছুক্ষণের স্তব্ধতা)

লতিকা। ওগো?

অমিয়। কী?

লতিকা। শুনছ?

অমিয়। কী শুনব?

লতিকা। কেমন একরকম শব্দ?

অমিয়। (খানিকক্ষণ কান পেতে শুনে) বাইরে জেগে রয়েছে খালি বনের কান্না, আর মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার উচ্ছাস। আর-কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছি না তো!

লতিকা। না, শব্দটা থেমে গেছে।

অমিয়। রাত অনেক হল লতিকা! মিছে জেগে জেগে কাল্পনিক শব্দ শুনে আমাকে চমকে দেওয়ার চেষ্টা কোরো না। ঘুমিয়ে পড়ো।

লতিকা। (কাতর স্বরে) ওগো, আমার যে বড্ড ভয় করছে! আবার মনে হচ্ছে, কে যেন তাকিয়ে তাকিয়ে আমাকে দেখছে।

অমিয়। লতিকা, এইবার সত্যি-সত্যিই তুমি হাসালে। জানলা-দরজা সব বন্ধ, ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে, কোথাও একটা ছায়া পর্যন্ত নেই। আমি ছাড়া এখানে তোমার মুখের পানে কে আর তাকিয়ে থাকবে?

লতিকা। কেউ এখানে নেই বটে, কিন্তু তবু তার নিষ্পলক চোখ দুটো যেন থেকে থেকে আমার বুকের ভেতরে এসে বিঁধছে!

অমিয়। (বিরক্ত স্বরে) লতিকা, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তোমার:ওসব পাগলামির কথা আর আমি শুনব না, এই আমি ঘুমলুম।

অল্পক্ষণের নীরবতা

 

লতিকা। (হঠাৎ সভয়ে উচ্চ আর্তনাদ করে) ওগো, ওগো, ওগো ওঠো গো!

অমিয়। (ধড়মড়িয়ে উঠে বসে) আঁ আঁ! কী হল, কী হল?

লতিকা। (হাঁপাতে হাঁপাতে) কালো বিদ্যুৎ-কালো বিদ্যুৎ।

অমিয়। (হতভম্বের মতো) কালো বিদ্যুৎ! সে আবার কী?

লতিকা। ঠিক যেন একটা কালো বিদ্যুৎ দেওয়ালের ওপরে ছড়িয়ে পড়েই আবার সৎ করে মিলিয়ে গেল।

অমিয়। কোথায়? কোন দিকে?

লতিকা। ওইখানে গো, ওইখানে।

(বাহির থেকে দ্বারে ঘন ঘন ধাক্কা)

সরলের কণ্ঠস্বর। দরজা খোললা, দরজা খোলো!

(অমিয় দরজা খুলে দিলে। বন্দুক হাতে করে মি. দত্তের ও সরলের ভিতরে প্রবেশ)

দত্ত। মিসেস সেন অমন চেঁচিয়ে উঠলেন কেন?

সরল। কী হয়েছে লতিকা দেবী, আপনার মুখ মড়ার মতন সাদা কেন? আপনার দেহ যে ঠকঠক করে কাঁপছে। কী দেখেছেন আপনি?

অমিয়। কালো বিদ্যুৎ!

দত্ত। (সবিস্ময়ে) কালো বিদ্যুৎ আবার কাকে বলে? অমিয়। জানি না দত্তসাহেব! হয়তো লতিকার চোখের ভ্রম!

লতিকা। (ক্রন্দনস্বরে) না- গো,না! ভ্রম নয় গো, আমি যে স্বচক্ষে দেখেছি! ঠিক ওইখানে। দেহ দিয়েই মিলিয়ে গেল!

সরল। এ ঘর নিরাপদ নয়! আমার নাকে কেমন একটা বন্য গন্ধ আসছে!

অমিয়। কবিদের ঘ্রাণশক্তি দেখছি সাধারণ মানুষের চেয়ে প্রখর! আমি কিন্তু কোনও গন্ধই পাচ্ছি না।

দত্ত। (গম্ভীর স্বরে) মি. সেন, এটা কৌতুকের সময় নয়। মিসেস সেন নিশ্চয়ই কিছু দেখেছেন! (নিম্ন স্বরে) জানেন মি. সেন, কুমুদ মিত্র আর দারোগাবাবু এই ঘর থেকেই অদৃশ্য হয়েছিলেন!

সরল। কিন্তু কালো বিদ্যুৎ বলতে কী বুঝব? আর, এই বন্য গন্ধটা? মি. দত্ত, আপনি কি কোনও গন্ধ পাচ্ছেন না?

দত্ত। পাচ্ছি বলেই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু গন্ধটার উৎপত্তি কোথায়? দরজা-জানলা বন্ধ। ঘরের চার দেওয়াল, খড়ের চাল, খাটের তলা সব পরিষ্কার-স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এখানে অন্য জীবের মধ্যে উড়ছে কেবল গোটা-কয়েক মশা! তবু এখানে কালো বিদ্যুৎ খেলে কেন, আর বন্য গন্ধই বা আসে কেন? এ যে অসম্ভব রহস্য!

(আচম্বিতে বাইরে বিষম একটা কোলাহল উঠল। উপরি উপরি বন্দুকের শব্দ)

দত্ত। (সচমকে) ও কীসের গোলমাল? সেপাইরা বন্দুক ছেড়ে কেন?

(দরজার সামনে একজন চৌকিদার ছুটে এল)

চৌকিদার। (ভীত চিত্তারে) হুজুর! কালা শয়তান কালা শয়তান! দত্ত। কালা শয়তান!

(ঘরের খড়ের চালের ওপরে ভীষণ ঝটাপটির শব্দ) সরল। ও আবার কী ব্যাপার! চালখানা ভেঙে পড়বে নাকি?

অমিয়। (সভয়ে) দত্তসায়েব—দত্তসায়েব! দেওয়ালের ওপরে, চালের তলাকার ফঁাকের দিকে তাকিয়ে দেখুন!

দত্ত। (স্তম্ভিত স্বরে) প্রকাণ্ড কালোমতো কী ওটা?

সরল। তীব্র হিংসা-ভরা দু-দুটো চক্ষু যেন অগ্নিবৃষ্টি করছে! অমিয়। বন্দুক ছছাড়ো–বন্দুক ছোড়! অজগর! ও যে অজগর সাপ!

(মি. দত্ত, অমিয় ও সরল তিনজনেই প্রায় একসঙ্গে বন্দুক তুলে গুলিবৃষ্টি করলেন। ভীষণ গর্জন করে সাংঘাতিক রূপে আহত মস্তবড়ো সর্পের সুদীর্ঘ দেহ মাটির ওপরে আছড়ে পড়ে ছটফট করতে লাগল।)

লতিকা। (অভিভূত স্বরে) মা গো!

অমিয়। লতিকা অজ্ঞানের মতো হয়ে গেছে—ওকে নিয়ে আমি বাইরে যাই! দত্ত। সকলকেই বাইরে যেতে হবে, ওর ল্যাজের একটা ঝাপটা গায়ে লাগলে দেহ গুড়িয়ে যাবে!

(সকলের তাড়াতাড়ি বাইরে প্রস্থান)

 

অমিয়। আমাদের গুলিতে সাপটার মাথা গুঁড়ো হয়ে গেছে!

সরল। বাপরে বাপ, এতবড়ো অজগর জীবনে আমি দেখিনি! ওর দেহটা বোধহয় সতেরো-আঠারো হাত লম্বা!

দত্ত। (একটা আস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে) এতক্ষণে সব রহস্য পরিষ্কার হল। ঘরের চাল আর দেওয়ালের মাঝখানকার ফাঁক দিয়ে ওই ভীষণ জীবটা ভেতরে ঢোকবার পথ আবিষ্কার করেছিল। ওর দেহের একপাকে মুহূর্তের মধ্যে মানুষ মারা পড়ত। তারপর মৃতদেহটা গ্রাস করে ও আবার ঘর থেকে ওই পথেই বেরিয়ে যেত। আজকেও ও শিকার ধরতে ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু ঘরের লোক জাগ্রত দেখে কালো বিদ্যুতের মতোই সাৎ করে আবার বাইরে অদৃশ্য হয়। সেখানেও সেপাইদের বন্দুকের গুলি খেয়ে বা শব্দে ভয় পেয়ে আবার ভেতরে আসতে বাধ্য হয়। তারপর আমাদের গুলিতে ওর সব লীলাখেলা ফুরিয়ে গিয়েছে!

সরল। লতিকা দেবীর উপমা দেওয়ার শক্তি দেখে আমি মুগ্ধ হচ্ছি। কালো বিদ্যুৎ! চমৎকার উপমা!

দত্ত। মিসেস সেন অনায়াসেই পুরস্কার দাবি করতে পারেন! কারণ ধরতে গেলে একরকম ওঁর জন্যেই এতবড়ো একটা রহস্যের কিনারা হল, আমারও মান বাঁচল।

লতিকা। (শ্রান্ত, ক্ষীণ স্বরে) হ্যা মি. দত্ত, আপনার কাছ থেকে আমি একটা পুরস্কার। দাবি করতে পারি।

দত্ত। কী পুরস্কার, বলুন।

লতিকা। কাল ভোরেই আপনার মোটরে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারবেন?

দত্ত। নিশ্চয়, নিশ্চয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *