মেজর ডাগলাস : মানুষ ও গাধা

মেজর ডাগলাস
মানুষ ও গাধা

গাধা তো গাধাই। শুদ্ধ করে বড়জোর তাকে গর্দভ বলা যায়। তাকে সাজিয়ে পরিয়ে আদর করে সোহাগ করে যতই মাথায় তোলা হোক, সে গাধাই থেকে যায়। তার স্বজাত নির্বোধীয় কার্যকলাপের কোন উন্নতি ঘটে না। কিন্তু সুস্থ সুবোধ মানুষকে যখন গাধা বলা হয় বা গাধা বলে মনে করা হয়, তখন ফলাফল হয় ভিন্ন রকমের।

সাদা চামড়ার ইংরেজরা নিজেদের নিবোধীয় কর্মকান্ডকে মহাবুদ্ধি ধরের কীর্তি বলে জাহির করার জন্য কালো চামড়ার লোকদের গাঁধা। ভাবতে পছন্দ করে এবং তাদেরকে ঘৃণাও করে। কালো-শ্যামলা সবই তাদের চোখে অচ্ছুত। যেখানেই তারা তাদের শ্বেত শাসন চালিয়েছে, যে দেশেই জবর-দখল চালিয়েছে; সেখানকার মানুষ তাদের চোখে ছিল গাঁধার মতো নিবোধ।

আমাদের মেজর ছিলো ডগলাস কার। সে নিশ্চয়ই তার সন্তানদের মরার আগে একবার না একবার বলে গেছে, মানুষকে কখনো গাধা মনে করতে নেই।

ঘটনাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের। জার্মান সেনারা তখন উত্তর আফ্রিকার লিবিয়ায় প্রবেশ করেছে। তাদের বিখ্যাত সেনাপতি জেনারেল রোমেল উত্তর আফ্রিকায় হামলা চালিয়ে ইংরেজদের চরমভাবে পিছু হটতে বাধ্য করে। ইংরেজ সেনাবাহিনীতে তখন হিন্দুস্তানী অর্থাৎ উপমহাদেশের সেনারা যোগ দিয়েছিলো। এরপর ইংরেজ বাহিনী আমেরিকা থেকে সেনা সাহায্য নিয়ে জবাবী হামলা চালায় জার্মানদের ওপর। ও দিকে জেনারেল রোমেল নিজের দেশের ডিক্টেটর শাসক হিটলারের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয় এবং তাকে উত্তর আফ্রিকা ছাড়তে হয়। এ সময় সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াইটি হয় বেনগাজী ও আল আমীন নামক মরু সাহারায়। মরুর ইতিহাসে সেটাই ছিলো গোলা-বারুদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।

জার্মানদের পিছু হটার পর দেখা গেলো, সেই মরু অঞ্চলের অবস্থা বড়াই ভয়ঙ্কর। গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে গিয়েছিলো। মানুষের পরিবর্তে সেখানে রাজত্ব দখল করে মানুষ খেকো হিংস্র প্রাণী। চারদিকে লাশ আর লাশের ছড়াছড়ি। জ্বলে যাওয়া এবং ভেঙ্গে যাওয়া ট্যাঙ্কের ভেতরও মানুষ খেকো প্রাণী দেখা যাচ্ছিলো।

ইংরেজ ফৌজে আমি ছিলাম মেজর পদাধিকারী। তখন ছিলাম বিন গাজী থেকে তেইশ মাইল দূরের এক ফৌজি পোষ্টে। এটা ছিলো লিবিয়ার এক প্রদেশ সিগনালারের হেড কোয়াটার। এ এলাকা থেকে যুদ্ধের উত্তাপ এখন অনেক দূরে সরে গেছে। মিত্র বাহিনী তখন রোম সাগর পাড়ি দিয়ে ইটালি বিজয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো। তাই আমরা সিগনালারের হেড কোয়ার্টারে বসে দারুণ আমোদে সময় কাটাচ্ছিলাম।

বলছিলাম মেজর ডাগলাসের কথা। তিনি এসেছিলেন বৃটিশ ইন্টেলিজেন্স থেকে। সিগনালারের ভাষা ছিলো আরবী ভাষার অশুদ্ধ রূপ। মেজর ডাগলাস মার এলাকার আরবীটা বেশ বলতে পারতেন। ক্যাম্পের নিম্নশ্রেণীর নওকার কর্মচারী ছিলো সে এলাকার স্থানীয় লোকেরা। এরা জোব্বা পরতো। কথা বলতে আরবীতে। এদের অধিকাংশই ছিলো বেদুইন মূর্খ। এরা ছিল এমন জগতের মানুষ বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ছিলো একেবারেই কম।

এসব এলাকার অধিকাংশের পেশাই হয় লুটপাট আর ডাকাতি। বেদুইনদের মধ্যে ফৌজি অফিসারদের যারা নওকর চাকর ছিলো, তাদের পূর্ব পেশা চুরি, রাহাজানি, ডাকাতি হলেও সেনাক্যাম্পে এসে এসব করতো না। আমাদের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিষ বেদুইনদের বড় বাজার বিনগাজী থেকে আনতে হত। ইংরেজদের মদও আসতো ওখান থেকে। এখানে যুদ্ধ মুলতবী হওয়াতে আমরা নিরাপদ ছিলাম। তাই প্রয়োজন পড়লে অফিসাররা জিপ নিয়ে বিনগাজী চলে যেতো। তাদের সঙ্গে তখন একজন বেদুইন নওকর অবশ্যই থাকতো।

এক সকালে মেজর ডগলাস তার নওকর বেদুইন আবদুল্লাহ গালালাকে নিয়ে জিপে চড়েন। অনেক অফিসারই প্রয়োজনীয় নানান জিনিস আনার জন্য তার কাছে পয়সা দিয়ে দেয়। সরকারি কিছু রসদ পত্রও আনার প্রয়োজন ছিলো।

খুব বেশি হলে ফিরতে তাদের চার ঘন্টার ওপরে লাগার কথা না। সকাল সাতটায় বেরিয়ে ছিলো। এখন বারটা বাজে। ফেরার নাম নেই। তবে এনিয়ে কেউ ভাবিত হয়নি। যখন তিনটা বাজলো তখন কেউ কেউ চিন্তিত হয়ে উঠলো। কারণ, আজ দুপুরে মরুতে ঝড় উঠেছিল। মরু ঝড় পথচারীদের জন্য বড়ই ভয়ংকর হয়ে দেখা দেয়। এক হাত সামনের কোন জিনিষও দেখা যায় না। কেউ যদি ভয়ে বসে পড়ে তাহলে কয়েক মিনিটের মধ্যে তার ওপর বালির টিবি দাঁড়িয়ে যাবে এবং এর নিচে সে সমাধিস্থ হয়ে যাবে।

এজন্য ঝড়ের সময় কেউ পথে থেমে থাকে না। যত কষ্টই হোক, দিক হারিয়ে গেলেও মুসাফিররা পথ চলা অব্যাহত রাখে। হিসাব করে দেখা গেছে এগারটার দিকে ঝড় উঠেছিলো। ঘন্টা খানেক ছিলো ঝড়ের তান্ডব। সেনা ক্যাম্প থেকে বিনগাজি পর্যন্ত নিয়মিত কোন রাস্তা না থাকলেও ফৌজি গাড়ির নিয়মিত যাতায়াতের কারণে রাস্তার একটা শক্ত আদল গড়ে উঠেছিলো। তাছাড়া মেজর জগলাস গিয়েছিলেন জিপ নিয়ে। সঙ্গে আছে অভিজ্ঞ মরুচারী বেদুইন। আশংকাজনক কোন কিছু হওয়ার কথা ছিলো না। অবশ্য জিপ নষ্ট হয়ে গেলে ভিন্ন কথা।

চারটা বাজার পর অন্য অফিসাররা ঠিক করলেন মেজরের খোঁজে গাড়ি পাঠাতে হবে। একটা জিপে একজন মোটর মেকানিক, দুই ক্যান পেট্রোল ও প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস দিয়ে আমাকে পাঠানো হলো।

গাড়ি নিয়ে আমি রাস্তায় নামলাম। চারদিকে তীক্ষ্ম চোখ রেখে গাড়ি চালাতে লাগলাম। বিনগাজী পর্যন্ত কোথাও মেজর জগলাসের গাড়ি চোখে পড়লো না। বিনগাজী শহরের কয়েকজন দোকান্দারের সঙ্গে জানাশোনা ছিলো আমার। অধিকাংশ জিনিস ওদের দোকান থেকেই আমি কিনে থাকি। ওরা জানালো, মেজর জগলাস প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নয়টার দিকে বের হয়ে গেছেন।

শহর থেকে বের হয়ে আমি সেনা চেক পোস্টেও খোঁজ নিলাম। জানা গেলো, মেজর সাহেব সেখানে গিয়েছিলেন এবং নয়টার একটু পর চেকপোস্ট থেকে বের হয়েছেন। একথা জানালো সেখানকার এক ইংরেজ মেজর।

তিনি তো একজন ইন্টেলিজিন্সী অফিসার আমি বললাম- অত্যন্ত বিচক্ষণ লোক। এখানকার ভাষাও জানেন। তার তো এভাবে লাপাত্তা হওয়ার কারণ নেই।

তিনি এখানকার ভাষা জানলেও সম্ভবত এখানকার বেদুইনদের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে জানেন না ঐ ইংরেজ অফিসার বললেন- মরু ঝড়ে যদি তিনি পথ হারিয়ে বেদুইনদের এলাকায় গিয়ে উঠে থাকেন তাহলে তার জন্য আপনাদের করার কিছুই থাকবে না। বেদুইনরা এমনিতেই আমাদের ওপর চটে আছে। আর তাদেরকে শায়েস্তা করার ক্ষমতাও নেই ইংরেজ আর্মির।

আমার মনের আশংকা আরো ঘনীভূত হলো। আমি হেড কোয়ার্টার ক্যাম্পে ফিরে এলাম। বালির সমুদ্রে গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে চালানো যাচ্ছিলো না। ২৩ মাইলের দূরত্বে পৌঁছতে দুই ঘণ্টা লেগে গেলো। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেলো। না মেজর ডাগলাস তখনো পৌঁছেনি। তখনই কয়েকটি পার্টি তাকে খোঁজার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো। প্রতিটি গাড়িতেই ওয়ার্লেস সেট ফিট করা ছিলো।

মাঝ রাতের দিকে একটি পার্টি খবর পাঠালো, মেজর জগলাসকে পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানী একটি দলের নেতৃত্বে ছিলাম আমি। খবর পেয়ে পার্টি নিয়ে হেড কোয়ার্টারে ফিরে এলাম। জানতে পারলাম, মেজর ডগলাসকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মেজরকে পাওয়া গিয়েছে খুব করুণ অবস্থায়। তৃষ্ণা, ক্লান্তি, ঝড়ের ধকল তাকে অসাড় করে ফেলেছিলো। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছিলো তার। জিপের বাইরে বালির ওপর পড়ন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। জিপ গাড়ির সবগুলো টায়ারের হাওয়া বের হয়ে গিয়েছিলো। পরদিন জিপ উদ্ধার করে আনা হয়। তবে আব্দুল্লাহ গালালাকে কেউ খুঁজে পায়নি।

পরদিন সন্ধায় মেজরকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়। তার এই অবস্থা এবং সাময়িক অন্তর্ধান কি কারণে হয়েছিলো এটা জানার জন্য সবাই উন্মুখ হয়েছিলাম। তিনি ক্যাম্পে ফিরে এসেই হল রুমে গিয়ে বসলেন। অন্যসব অফিসারও বসলো তাকে ঘিরে। তিনি রহস্য ভাঙ্গতে লাগলেন।

বিনগাজী থেকে ফেরার সময় আবহাওয়া স্বাভাবিকই ছিলো। কিন্তু মাঝপথে আসার পর হঠাৎ করেই মরুতে ঝড় উঠলো। মনে হচ্ছিলো; সমস্ত মরুর বালু তাদের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। জিপের পেছন দিক ছিলো ত্রিপলে ঢাকা। আর সামনের দিক ছিলো ভোলা। অর্থাৎ সামনের সিট দুটো ছিলো খোলা আকাশের নিচে। আর ঝড় আসছিলো জিপের ডান দিক থেকে। এজন্য বালির স্রোত এমনভাবে ভেতরে এসে মুখে আঘাত করছিলো যেন গতির জানালা দিয়ে পানির উন্মাতাল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সামনের পথ দেখা যাবে তো দূরের কথা জিপের সামনের দিকও দেখা যাচ্ছিলো না।

এ অবস্থায় জিপ নিয়ে কোথাও আশ্রয় নেয়াও সম্ভব ছিলো না। কারণ, গাড়ি থামালে মুহূর্তের মধ্যেই টায়ারগুলোকে বালির ঢিবি অকেজো করে দেবে। তারপর পুরো গাড়ির উপরেই গড়ে উঠবে বড় এক টিলা।

যখন মরু ঝড় শুরু হয় তখন অল্প সময়ের মধ্যেই বড় বড় বালির ঢিবি টিলা ঝুড়ি ঝুড়ি হয়ে হারিয়ে যায়। সমুদ্রের পানির মতো মরু এলাকা যেন স্রোতস্বিনী হয়ে উঠে। যেখানেই সামান্য বাধা পায় সেই স্রোতধারা সেখানেই দাঁড়িয়ে যায় বড় সড় একটা টিলা। এজন্য মরুর এসব টিলাকে বলা হয় চলন্ত টিলা।

মেজর ডাগলাসের মতো বিচক্ষণ এক সেনা অফিসারও নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। তার জান্তে হোক আর অজান্তে হোক এক ফাঁকে গাড়ির রুট ঘুরে গেলো অন্য দিকে। সেখানে যদি কোন পথ থাকতে সড়ক থাকতো বা চিহ্ন থাকতো তাহলে নিশ্চিত হওয়া যেতো জিপ সোজা রাস্তা ধরে চলছে। সেখানে কিছুই ছেলো না। সেটা ছিলো, নিরেট অন্ধকার। অন্ধের মতো গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে রাখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না মেজর ডাগলাসের।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ঝড় থেমে গেলো, আশপাশের অবস্থান অস্পষ্ট হয়ে চোখে ধরা দিতে লাগলো। মেজর তবুও গাড়ি থামালেন না। যখন দৃষ্টিসীমা সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে গেলো তখন জিপ থামালেন। নেমে চারদিকে তাকালেন। গালালা তাকে জানালো, মূল পথ থেকে তারা অনেক দূরে চলে এসেছে। এই বেদুইন ছিলো এক অভিজ্ঞ মরু রহস্য ভেদী। সে মেজরকে এক দিক দেখিয়ে বললো।

এদিক দিয়ে পথ চললে তিন ঘণ্টার মধ্যে হেড কোয়ার্টারে পৌঁছা যাবে।

মেজর আবার জিপে স্টার্ট দিলেন। দুই আড়াই মাইল দূরের টিলায় ভরা এলাকা দেখা যেতে লাগলো। বালির ওপর দিয়ে জিপ এগুচ্ছিলো ধীর গতিতে। হঠাৎ মেজর ডাগলাস গাড়ি হাডব্রেক করলেন। সামনে পড়ন্ত এক বস্তুর দিকে তার চোখ। সেটা চকচক করছিলো। এ জিনিস মেজর খুব ভালো করেই চিনেন। এগুলো ভূমি মাইন। এ এলাকা কিছুদিন আগেও উত্তপ্ত রণাঙ্গন ছিলো। এখানে সেনা দলের মোর্চা ছিলো, ক্যাম্প ছিলো, আবার অস্থায়ী চেকপোষ্ট, ছিলো। যেখানে এমন সৈনিকি কেন্দ্র থাকে তার সামনের এলাকায় অবশ্যই মাইন পুঁতে রাখা হয়।

মাইন মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয় এবং এর একটা পিন মাটির ওপর আড়াআরিভাবে বিছিয়ে রাখা হয়। এর ওপর হালকা করে মাটি বা বালি ঢেলে দেয়া হয়। এর ওপর পা পড়লেই মাইন বিস্ফোরিত হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। আর ট্যাংক বা গাড়ি হলে তা ধ্বংস করে দেয়।

জার্মানদের ভূমি মাইন আরো ভয়ংকর। ওরা মাটিতে মাইন পুঁতে একটা তার আরেকটার সঙ্গে জুড়ে দেয়। আর একটা ফুটলে একে একে সবগুলোই কাটতে থাকে। আর সে এলাকায় মুহূর্তের মধ্যে কেয়ামত নেমে আসে।

এটা যুদ্ধবাজ সব ফৌজেরই রীতি। তারা পিছু হটার সময় এভাবে মাইন পুঁতে রেখে যায়। যুদ্ধের পর অনেক মানুষ এসবে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। যে এলাকায় মাইন বিছানো হয় সে এলাকাকে মাইন ফিল্ড বলা হয়।

লিবিয়ার যুদ্ধ আক্রান্ত মরুভূমির বেদুইনরা মাইন ফিল্ড খুঁজে বের করার চমৎকার এক উপায় বের করে। মরুচারী বেদুইনদের প্রধান পেশা উট পালন হলেও গাধাও পালে কেউ কেউ। ওরা যখন যাযাবরি করে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যায় তখন পথ চলে খুব সাবধানে। যেখানেই সন্দেহ হয় সামনে মাইন ফিল্ড আছে সেখানে একটা গাধাকে মেরে টেরে সামনের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। যদি মাইন চাপা থাকে এবং জোড়া তারের মাইন হয় তখন গাধার পায়ে সংঘর্ষ বেধে একটা মাইন ফাটলেই হলো। এক সাথে সবগুলো ফেটে যায়। এতে গাধার দেহ তো টুকরো টুকরো হয়ে যায়; কিন্তু পুরো বেদুইন দল বেঁচে যায়।

মেজর ডাগলাসের বেদুইনদের এই পদ্ধতি জানা ছিলো। কিন্তু তার কাছে গাধা ছিলো না। ছিলো শুধু তার নওকর আব্দুল্লাহ গালালা। সাধাসিধে মানুষ গালালা পরিশ্রম করতে ভালোবাসতো। নিজের মুনিবের কাজ করতো বড় নিষ্ঠার সঙ্গে। কিন্তু মেজর ডাগলাস তার কাছ থেকেই গাধার কাজটি আদায় করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

তিনি নিশ্চিত ছিলেন, গালালা যেহেতু অনেক দিন ধরে তার নওকরী করে এবং নিজের গোত্র থেকে অনেক দূরে থাকে, এজন্য সে জানা তো দূরের কথা অনুমানও করতে পারবে না, তাকে পাঠানো হচ্ছে গাধার স্থলে মাইন বিস্ফোরণের টার্গেট হওয়ার জন্য। আর এক গালালা মাইনের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে আরো কত গালালা আসবে। একে তো এরা বেদুইন এবং ইতর জাত। তারপর আবার মুসলমান। দুনিয়াতে এদের সংখ্যা যত কমবে দুনিয়া ততই নিরাপদ হয়ে উঠবে। আর মেজর ডাগলাসের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ এক মানব সন্তান যদি খামোখা মাইনের আঘাতে মারা যায় তাহলে দুনিয়ার মানুষের আফসোসের শেষ থাকবে না।

এই ভেবে মেজর ডগলাস গালালাকে বললেন।

এখানে বসে থেকে এক দিক দেখিয়ে দিলে তো হবে না। সামনে গিয়ে সঠিক দিক নির্ণয় করে এসো।

মেজরের মুখে তখন ধূর্তের হাসি খেলছিলো। অবশ্য মাইন ফিল্ডের রাস্তা ছাড়া মেজরের সামনে আর কোন রাস্তা ছিলো না। দুই দিকে ছিলো টিলার সারি। সেখান দিয়ে পাড়ি নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।

গালালা কোন কথা বললো না। মুখে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে মাথা একদিকে কাত করলো। অর্থাৎ সে দেখে আসতে রাজি। গালালা সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। গালালা কয়েক কদম যাওয়ার পর মেজর যমিনে হামাগুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, যেকোন সময় গালার পায়ের নিচ থেকে মাইন বিস্ফোরিত হবে। তখন মাইনের তীক্ষ্ম ব্লেডের টুকরো উড়ে এসে মেজরের গায়ে লাগতে পারে। কিন্তু এ জাতীয় কিছুই ঘটলো না। তিনি দেখলেন, গালালা নিচের দিকে তাকিয়ে কখনো ডান দিকে কখনো বাম দিকে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে পাগুলো অনেক ওপরে উঠিয়ে আবার সাবধানে নিচে নামাচ্ছে। এভাবে দেড়শ দুইশ গজ গিয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলো একটু ধূসর পথে।

গালালা মেজরের দিকে না এসে জিপের দিকে এগিয়ে গেলো অতি সহজ ভঙ্গিতে। যেন জিপের মধ্যে জরুরী কিছু একটা আছে। সেটা তার এখনই খুব দরকার। সামনের সিটের ওপর রিভলবার পড়েছিলো। পাশে পড়েছিলো গুলি ভরা কার্তুজের বাক্স।

এটা মেজরের ব্যক্তিগত রিভলবার। মেজর ভাবলেন, আব্দুল্লাহ গালালা হয়তো দরকারী কোন কিছুর জন্য জিপে উঠেছে। এজন্য তিনি যেভাবে ছিলেন সেভাবেই রইলেন। কিন্তু একটু পর খুটখাট আওয়াজ হলে উঠে বসলেন। দেখলেন, গালালা রিভলবারে গুলি ভরছে। কি ঘটছে প্রথমে তিনি হুতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে বুঝতে চেষ্টা করলেন। তারপর হন্তদন্ত হয়ে জিপের দিকে ছুটে গেলেন।

কিন্তু ততক্ষণে গালালা রিভলবারে ছয়টি গুলি ভরে ফেলেছে এবং তার নল মেজরের দিকে তাক করে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। বৃটিশ ইন্টেলিজেন্সির এত বড় দুর্দান্ত অফিসার সামান্য এক বেদুইনের দিকে করুণা প্রার্থী চোখে তাকিয়ে রইলেন।

আমি একজন মানুষ, গাধা নই- আব্দুল্লাহ গালালা গম্ভীর গলায় বললো, তুমি আমাকে মেরে তোমার রাস্তা পরিষ্কার করতে চেয়েছিলে। সেখানে অসংখ্য মাইন ওঁৎ পেতে ছিলো আমার জন্য। ঝড়ের তান্ডবে সবগুলোর উপর থেকে বালি মাটি সরে গেছে। এজন্য আমি সাবধানে এগিয়ে আবার ফিরে আসতে পেরেছি।

না হয় এতক্ষণে আমার দেহটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো। তোমাদের সাদা চামড়ার ইংরেজদের মত ধূর্ত শয়তান নই বলেই আমরা সবসময় ঠকে এসেছি। সাধারণ একটা গাধার মূল্যও তোমরা আমাদেরকে দিতে চাও না। আমি আমার অপমানের প্রতিশোধ নেবো। আর শুনে রেখো, মরুচারীরা যে তাদের গাধা দিয়ে মাইন ফিল্ড খুঁজে বের করে সেটা আমার অজানা নয়।

মেজর ডাগলাস নিজেকে কিছুটা সামনে নিয়েছিলেন। গালালার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে অফিসারের মতো হুকুমের সুরে বললেন, রিভলবারটি দিয়ে দাও আমাকে।

আয় ফিরিঙ্গ, গালালার কণ্ঠ চিড়ে যেন চাবুক বেরিয়ে এলো, আমি তোমাদের নুন খেয়েছি এজন্যে তোমাকে হত্যা করবো না। মুসলমানরা তোমাদের মতো বেঈমান নয়। যদি পথ হারিয়ে মরে যাও আমাকে কেউ দোষ দিতে পারবে না। যাও, হাঁটতে থাকো। দাঁড়িয়ে থাকলে গুলি চালাবো আমি … যাও?

গালালার খুনি মূর্তি দেখে মেজর হাঁটতে শুরু করলেন। কয়েক কদম গিয়ে ফিরে গালালার কাছে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো, সে যেন তাকে মাফ করে দেয় এবং জিপটি তাকে ছেড়ে দেয়।

গালালা বাতাসে ফায়ার করে বললো, হাঁটতে থাকো গাঁধা; আমাকে গাধা মনে করো না।

মেজর হাঁটা শুরু করলেন গোমরা মুখ করে। আর গালালা জিপের টায়ারগুলো ফুটো করে দিতে লাগলো। তারপর গালালা মেজরের যা কিছু ছিলো তা নিয়ে এক দিকে হাঁটা ধরলো।

মুসলমানদের আমরা যতটা নির্বোধ মনে করি, পরে ডাগলাস স্বীকার করেন। তারা আসলে ততটা নির্বোধ নয়। প্রয়োজনে আমাদের চেয়েও অনেক বিচক্ষণ। ওদের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধও অনেক বেশি। সত্যি বলতে কি সেই বেদুইন আমাকে আসলে মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিক্ষা দিয়েছে।

মেজর ডাগলাস : মানুষ ও গাধা

মেজর ডাগলাস : মানুষ ও গাধা

মেজর ডাগলাস
মানুষ ও গাধা

গাধা তো গাধাই। শুদ্ধ করে বড়জোর তাকে গর্দভ বলা যায়। তাকে সাজিয়ে পরিয়ে আদর করে সোহাগ করে যতই মাথায় তোলা হোক, সে গাধাই থেকে যায়। তার স্বজাত নির্বোধীয় কার্যকলাপের কোন উন্নতি ঘটে না। কিন্তু সুস্থ সুবোধ মানুষকে যখন গাধা বলা হয় বা গাধা বলে মনে করা হয়, তখন ফলাফল হয় ভিন্ন রকমের।

সাদা চামড়ার ইংরেজরা নিজেদের নিবোধীয় কর্মকান্ডকে মহাবুদ্ধি ধরের কীর্তি বলে জাহির করার জন্য কালো চামড়ার লোকদের গাঁধা। ভাবতে পছন্দ করে এবং তাদেরকে ঘৃণাও করে। কালো-শ্যামলা সবই তাদের চোখে অচ্ছুত। যেখানেই তারা তাদের শ্বেত শাসন চালিয়েছে, যে দেশেই জবর-দখল চালিয়েছে; সেখানকার মানুষ তাদের চোখে ছিল গাঁধার মতো নিবোধ।

আমাদের মেজর ছিলো ডগলাস কার। সে নিশ্চয়ই তার সন্তানদের মরার আগে একবার না একবার বলে গেছে, মানুষকে কখনো গাধা মনে করতে নেই।

ঘটনাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের। জার্মান সেনারা তখন উত্তর আফ্রিকার লিবিয়ায় প্রবেশ করেছে। তাদের বিখ্যাত সেনাপতি জেনারেল রোমেল উত্তর আফ্রিকায় হামলা চালিয়ে ইংরেজদের চরমভাবে পিছু হটতে বাধ্য করে। ইংরেজ সেনাবাহিনীতে তখন হিন্দুস্তানী অর্থাৎ উপমহাদেশের সেনারা যোগ দিয়েছিলো। এরপর ইংরেজ বাহিনী আমেরিকা থেকে সেনা সাহায্য নিয়ে জবাবী হামলা চালায় জার্মানদের ওপর। ও দিকে জেনারেল রোমেল নিজের দেশের ডিক্টেটর শাসক হিটলারের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয় এবং তাকে উত্তর আফ্রিকা ছাড়তে হয়। এ সময় সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াইটি হয় বেনগাজী ও আল আমীন নামক মরু সাহারায়। মরুর ইতিহাসে সেটাই ছিলো গোলা-বারুদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।

জার্মানদের পিছু হটার পর দেখা গেলো, সেই মরু অঞ্চলের অবস্থা বড়াই ভয়ঙ্কর। গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে গিয়েছিলো। মানুষের পরিবর্তে সেখানে রাজত্ব দখল করে মানুষ খেকো হিংস্র প্রাণী। চারদিকে লাশ আর লাশের ছড়াছড়ি। জ্বলে যাওয়া এবং ভেঙ্গে যাওয়া ট্যাঙ্কের ভেতরও মানুষ খেকো প্রাণী দেখা যাচ্ছিলো।

ইংরেজ ফৌজে আমি ছিলাম মেজর পদাধিকারী। তখন ছিলাম বিন গাজী থেকে তেইশ মাইল দূরের এক ফৌজি পোষ্টে। এটা ছিলো লিবিয়ার এক প্রদেশ সিগনালারের হেড কোয়াটার। এ এলাকা থেকে যুদ্ধের উত্তাপ এখন অনেক দূরে সরে গেছে। মিত্র বাহিনী তখন রোম সাগর পাড়ি দিয়ে ইটালি বিজয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো। তাই আমরা সিগনালারের হেড কোয়ার্টারে বসে দারুণ আমোদে সময় কাটাচ্ছিলাম।

বলছিলাম মেজর ডাগলাসের কথা। তিনি এসেছিলেন বৃটিশ ইন্টেলিজেন্স থেকে। সিগনালারের ভাষা ছিলো আরবী ভাষার অশুদ্ধ রূপ। মেজর ডাগলাস মার এলাকার আরবীটা বেশ বলতে পারতেন। ক্যাম্পের নিম্নশ্রেণীর নওকার কর্মচারী ছিলো সে এলাকার স্থানীয় লোকেরা। এরা জোব্বা পরতো। কথা বলতে আরবীতে। এদের অধিকাংশই ছিলো বেদুইন মূর্খ। এরা ছিল এমন জগতের মানুষ বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ছিলো একেবারেই কম।

এসব এলাকার অধিকাংশের পেশাই হয় লুটপাট আর ডাকাতি। বেদুইনদের মধ্যে ফৌজি অফিসারদের যারা নওকর চাকর ছিলো, তাদের পূর্ব পেশা চুরি, রাহাজানি, ডাকাতি হলেও সেনাক্যাম্পে এসে এসব করতো না। আমাদের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিষ বেদুইনদের বড় বাজার বিনগাজী থেকে আনতে হত। ইংরেজদের মদও আসতো ওখান থেকে। এখানে যুদ্ধ মুলতবী হওয়াতে আমরা নিরাপদ ছিলাম। তাই প্রয়োজন পড়লে অফিসাররা জিপ নিয়ে বিনগাজী চলে যেতো। তাদের সঙ্গে তখন একজন বেদুইন নওকর অবশ্যই থাকতো।

এক সকালে মেজর ডগলাস তার নওকর বেদুইন আবদুল্লাহ গালালাকে নিয়ে জিপে চড়েন। অনেক অফিসারই প্রয়োজনীয় নানান জিনিস আনার জন্য তার কাছে পয়সা দিয়ে দেয়। সরকারি কিছু রসদ পত্রও আনার প্রয়োজন ছিলো।

খুব বেশি হলে ফিরতে তাদের চার ঘন্টার ওপরে লাগার কথা না। সকাল সাতটায় বেরিয়ে ছিলো। এখন বারটা বাজে। ফেরার নাম নেই। তবে এনিয়ে কেউ ভাবিত হয়নি। যখন তিনটা বাজলো তখন কেউ কেউ চিন্তিত হয়ে উঠলো। কারণ, আজ দুপুরে মরুতে ঝড় উঠেছিল। মরু ঝড় পথচারীদের জন্য বড়ই ভয়ংকর হয়ে দেখা দেয়। এক হাত সামনের কোন জিনিষও দেখা যায় না। কেউ যদি ভয়ে বসে পড়ে তাহলে কয়েক মিনিটের মধ্যে তার ওপর বালির টিবি দাঁড়িয়ে যাবে এবং এর নিচে সে সমাধিস্থ হয়ে যাবে।

এজন্য ঝড়ের সময় কেউ পথে থেমে থাকে না। যত কষ্টই হোক, দিক হারিয়ে গেলেও মুসাফিররা পথ চলা অব্যাহত রাখে। হিসাব করে দেখা গেছে এগারটার দিকে ঝড় উঠেছিলো। ঘন্টা খানেক ছিলো ঝড়ের তান্ডব। সেনা ক্যাম্প থেকে বিনগাজি পর্যন্ত নিয়মিত কোন রাস্তা না থাকলেও ফৌজি গাড়ির নিয়মিত যাতায়াতের কারণে রাস্তার একটা শক্ত আদল গড়ে উঠেছিলো। তাছাড়া মেজর জগলাস গিয়েছিলেন জিপ নিয়ে। সঙ্গে আছে অভিজ্ঞ মরুচারী বেদুইন। আশংকাজনক কোন কিছু হওয়ার কথা ছিলো না। অবশ্য জিপ নষ্ট হয়ে গেলে ভিন্ন কথা।

চারটা বাজার পর অন্য অফিসাররা ঠিক করলেন মেজরের খোঁজে গাড়ি পাঠাতে হবে। একটা জিপে একজন মোটর মেকানিক, দুই ক্যান পেট্রোল ও প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস দিয়ে আমাকে পাঠানো হলো।

গাড়ি নিয়ে আমি রাস্তায় নামলাম। চারদিকে তীক্ষ্ম চোখ রেখে গাড়ি চালাতে লাগলাম। বিনগাজী পর্যন্ত কোথাও মেজর জগলাসের গাড়ি চোখে পড়লো না। বিনগাজী শহরের কয়েকজন দোকান্দারের সঙ্গে জানাশোনা ছিলো আমার। অধিকাংশ জিনিস ওদের দোকান থেকেই আমি কিনে থাকি। ওরা জানালো, মেজর জগলাস প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নয়টার দিকে বের হয়ে গেছেন।

শহর থেকে বের হয়ে আমি সেনা চেক পোস্টেও খোঁজ নিলাম। জানা গেলো, মেজর সাহেব সেখানে গিয়েছিলেন এবং নয়টার একটু পর চেকপোস্ট থেকে বের হয়েছেন। একথা জানালো সেখানকার এক ইংরেজ মেজর।

তিনি তো একজন ইন্টেলিজিন্সী অফিসার আমি বললাম- অত্যন্ত বিচক্ষণ লোক। এখানকার ভাষাও জানেন। তার তো এভাবে লাপাত্তা হওয়ার কারণ নেই।

তিনি এখানকার ভাষা জানলেও সম্ভবত এখানকার বেদুইনদের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে জানেন না ঐ ইংরেজ অফিসার বললেন- মরু ঝড়ে যদি তিনি পথ হারিয়ে বেদুইনদের এলাকায় গিয়ে উঠে থাকেন তাহলে তার জন্য আপনাদের করার কিছুই থাকবে না। বেদুইনরা এমনিতেই আমাদের ওপর চটে আছে। আর তাদেরকে শায়েস্তা করার ক্ষমতাও নেই ইংরেজ আর্মির।

আমার মনের আশংকা আরো ঘনীভূত হলো। আমি হেড কোয়ার্টার ক্যাম্পে ফিরে এলাম। বালির সমুদ্রে গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে চালানো যাচ্ছিলো না। ২৩ মাইলের দূরত্বে পৌঁছতে দুই ঘণ্টা লেগে গেলো। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেলো। না মেজর ডাগলাস তখনো পৌঁছেনি। তখনই কয়েকটি পার্টি তাকে খোঁজার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো। প্রতিটি গাড়িতেই ওয়ার্লেস সেট ফিট করা ছিলো।

মাঝ রাতের দিকে একটি পার্টি খবর পাঠালো, মেজর জগলাসকে পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানী একটি দলের নেতৃত্বে ছিলাম আমি। খবর পেয়ে পার্টি নিয়ে হেড কোয়ার্টারে ফিরে এলাম। জানতে পারলাম, মেজর ডগলাসকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মেজরকে পাওয়া গিয়েছে খুব করুণ অবস্থায়। তৃষ্ণা, ক্লান্তি, ঝড়ের ধকল তাকে অসাড় করে ফেলেছিলো। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছিলো তার। জিপের বাইরে বালির ওপর পড়ন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। জিপ গাড়ির সবগুলো টায়ারের হাওয়া বের হয়ে গিয়েছিলো। পরদিন জিপ উদ্ধার করে আনা হয়। তবে আব্দুল্লাহ গালালাকে কেউ খুঁজে পায়নি।

পরদিন সন্ধায় মেজরকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়। তার এই অবস্থা এবং সাময়িক অন্তর্ধান কি কারণে হয়েছিলো এটা জানার জন্য সবাই উন্মুখ হয়েছিলাম। তিনি ক্যাম্পে ফিরে এসেই হল রুমে গিয়ে বসলেন। অন্যসব অফিসারও বসলো তাকে ঘিরে। তিনি রহস্য ভাঙ্গতে লাগলেন।

বিনগাজী থেকে ফেরার সময় আবহাওয়া স্বাভাবিকই ছিলো। কিন্তু মাঝপথে আসার পর হঠাৎ করেই মরুতে ঝড় উঠলো। মনে হচ্ছিলো; সমস্ত মরুর বালু তাদের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। জিপের পেছন দিক ছিলো ত্রিপলে ঢাকা। আর সামনের দিক ছিলো ভোলা। অর্থাৎ সামনের সিট দুটো ছিলো খোলা আকাশের নিচে। আর ঝড় আসছিলো জিপের ডান দিক থেকে। এজন্য বালির স্রোত এমনভাবে ভেতরে এসে মুখে আঘাত করছিলো যেন গতির জানালা দিয়ে পানির উন্মাতাল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সামনের পথ দেখা যাবে তো দূরের কথা জিপের সামনের দিকও দেখা যাচ্ছিলো না।

এ অবস্থায় জিপ নিয়ে কোথাও আশ্রয় নেয়াও সম্ভব ছিলো না। কারণ, গাড়ি থামালে মুহূর্তের মধ্যেই টায়ারগুলোকে বালির ঢিবি অকেজো করে দেবে। তারপর পুরো গাড়ির উপরেই গড়ে উঠবে বড় এক টিলা।

যখন মরু ঝড় শুরু হয় তখন অল্প সময়ের মধ্যেই বড় বড় বালির ঢিবি টিলা ঝুড়ি ঝুড়ি হয়ে হারিয়ে যায়। সমুদ্রের পানির মতো মরু এলাকা যেন স্রোতস্বিনী হয়ে উঠে। যেখানেই সামান্য বাধা পায় সেই স্রোতধারা সেখানেই দাঁড়িয়ে যায় বড় সড় একটা টিলা। এজন্য মরুর এসব টিলাকে বলা হয় চলন্ত টিলা।

মেজর ডাগলাসের মতো বিচক্ষণ এক সেনা অফিসারও নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। তার জান্তে হোক আর অজান্তে হোক এক ফাঁকে গাড়ির রুট ঘুরে গেলো অন্য দিকে। সেখানে যদি কোন পথ থাকতে সড়ক থাকতো বা চিহ্ন থাকতো তাহলে নিশ্চিত হওয়া যেতো জিপ সোজা রাস্তা ধরে চলছে। সেখানে কিছুই ছেলো না। সেটা ছিলো, নিরেট অন্ধকার। অন্ধের মতো গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে রাখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না মেজর ডাগলাসের।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ঝড় থেমে গেলো, আশপাশের অবস্থান অস্পষ্ট হয়ে চোখে ধরা দিতে লাগলো। মেজর তবুও গাড়ি থামালেন না। যখন দৃষ্টিসীমা সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে গেলো তখন জিপ থামালেন। নেমে চারদিকে তাকালেন। গালালা তাকে জানালো, মূল পথ থেকে তারা অনেক দূরে চলে এসেছে। এই বেদুইন ছিলো এক অভিজ্ঞ মরু রহস্য ভেদী। সে মেজরকে এক দিক দেখিয়ে বললো।

এদিক দিয়ে পথ চললে তিন ঘণ্টার মধ্যে হেড কোয়ার্টারে পৌঁছা যাবে।

মেজর আবার জিপে স্টার্ট দিলেন। দুই আড়াই মাইল দূরের টিলায় ভরা এলাকা দেখা যেতে লাগলো। বালির ওপর দিয়ে জিপ এগুচ্ছিলো ধীর গতিতে। হঠাৎ মেজর ডাগলাস গাড়ি হাডব্রেক করলেন। সামনে পড়ন্ত এক বস্তুর দিকে তার চোখ। সেটা চকচক করছিলো। এ জিনিস মেজর খুব ভালো করেই চিনেন। এগুলো ভূমি মাইন। এ এলাকা কিছুদিন আগেও উত্তপ্ত রণাঙ্গন ছিলো। এখানে সেনা দলের মোর্চা ছিলো, ক্যাম্প ছিলো, আবার অস্থায়ী চেকপোষ্ট, ছিলো। যেখানে এমন সৈনিকি কেন্দ্র থাকে তার সামনের এলাকায় অবশ্যই মাইন পুঁতে রাখা হয়।

মাইন মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয় এবং এর একটা পিন মাটির ওপর আড়াআরিভাবে বিছিয়ে রাখা হয়। এর ওপর হালকা করে মাটি বা বালি ঢেলে দেয়া হয়। এর ওপর পা পড়লেই মাইন বিস্ফোরিত হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। আর ট্যাংক বা গাড়ি হলে তা ধ্বংস করে দেয়।

জার্মানদের ভূমি মাইন আরো ভয়ংকর। ওরা মাটিতে মাইন পুঁতে একটা তার আরেকটার সঙ্গে জুড়ে দেয়। আর একটা ফুটলে একে একে সবগুলোই কাটতে থাকে। আর সে এলাকায় মুহূর্তের মধ্যে কেয়ামত নেমে আসে।

এটা যুদ্ধবাজ সব ফৌজেরই রীতি। তারা পিছু হটার সময় এভাবে মাইন পুঁতে রেখে যায়। যুদ্ধের পর অনেক মানুষ এসবে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। যে এলাকায় মাইন বিছানো হয় সে এলাকাকে মাইন ফিল্ড বলা হয়।

লিবিয়ার যুদ্ধ আক্রান্ত মরুভূমির বেদুইনরা মাইন ফিল্ড খুঁজে বের করার চমৎকার এক উপায় বের করে। মরুচারী বেদুইনদের প্রধান পেশা উট পালন হলেও গাধাও পালে কেউ কেউ। ওরা যখন যাযাবরি করে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যায় তখন পথ চলে খুব সাবধানে। যেখানেই সন্দেহ হয় সামনে মাইন ফিল্ড আছে সেখানে একটা গাধাকে মেরে টেরে সামনের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। যদি মাইন চাপা থাকে এবং জোড়া তারের মাইন হয় তখন গাধার পায়ে সংঘর্ষ বেধে একটা মাইন ফাটলেই হলো। এক সাথে সবগুলো ফেটে যায়। এতে গাধার দেহ তো টুকরো টুকরো হয়ে যায়; কিন্তু পুরো বেদুইন দল বেঁচে যায়।

মেজর ডাগলাসের বেদুইনদের এই পদ্ধতি জানা ছিলো। কিন্তু তার কাছে গাধা ছিলো না। ছিলো শুধু তার নওকর আব্দুল্লাহ গালালা। সাধাসিধে মানুষ গালালা পরিশ্রম করতে ভালোবাসতো। নিজের মুনিবের কাজ করতো বড় নিষ্ঠার সঙ্গে। কিন্তু মেজর ডাগলাস তার কাছ থেকেই গাধার কাজটি আদায় করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

তিনি নিশ্চিত ছিলেন, গালালা যেহেতু অনেক দিন ধরে তার নওকরী করে এবং নিজের গোত্র থেকে অনেক দূরে থাকে, এজন্য সে জানা তো দূরের কথা অনুমানও করতে পারবে না, তাকে পাঠানো হচ্ছে গাধার স্থলে মাইন বিস্ফোরণের টার্গেট হওয়ার জন্য। আর এক গালালা মাইনের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে আরো কত গালালা আসবে। একে তো এরা বেদুইন এবং ইতর জাত। তারপর আবার মুসলমান। দুনিয়াতে এদের সংখ্যা যত কমবে দুনিয়া ততই নিরাপদ হয়ে উঠবে। আর মেজর ডাগলাসের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ এক মানব সন্তান যদি খামোখা মাইনের আঘাতে মারা যায় তাহলে দুনিয়ার মানুষের আফসোসের শেষ থাকবে না।

এই ভেবে মেজর ডগলাস গালালাকে বললেন।

এখানে বসে থেকে এক দিক দেখিয়ে দিলে তো হবে না। সামনে গিয়ে সঠিক দিক নির্ণয় করে এসো।

মেজরের মুখে তখন ধূর্তের হাসি খেলছিলো। অবশ্য মাইন ফিল্ডের রাস্তা ছাড়া মেজরের সামনে আর কোন রাস্তা ছিলো না। দুই দিকে ছিলো টিলার সারি। সেখান দিয়ে পাড়ি নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।

গালালা কোন কথা বললো না। মুখে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে মাথা একদিকে কাত করলো। অর্থাৎ সে দেখে আসতে রাজি। গালালা সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। গালালা কয়েক কদম যাওয়ার পর মেজর যমিনে হামাগুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, যেকোন সময় গালার পায়ের নিচ থেকে মাইন বিস্ফোরিত হবে। তখন মাইনের তীক্ষ্ম ব্লেডের টুকরো উড়ে এসে মেজরের গায়ে লাগতে পারে। কিন্তু এ জাতীয় কিছুই ঘটলো না। তিনি দেখলেন, গালালা নিচের দিকে তাকিয়ে কখনো ডান দিকে কখনো বাম দিকে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে পাগুলো অনেক ওপরে উঠিয়ে আবার সাবধানে নিচে নামাচ্ছে। এভাবে দেড়শ দুইশ গজ গিয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলো একটু ধূসর পথে।

গালালা মেজরের দিকে না এসে জিপের দিকে এগিয়ে গেলো অতি সহজ ভঙ্গিতে। যেন জিপের মধ্যে জরুরী কিছু একটা আছে। সেটা তার এখনই খুব দরকার। সামনের সিটের ওপর রিভলবার পড়েছিলো। পাশে পড়েছিলো গুলি ভরা কার্তুজের বাক্স।

এটা মেজরের ব্যক্তিগত রিভলবার। মেজর ভাবলেন, আব্দুল্লাহ গালালা হয়তো দরকারী কোন কিছুর জন্য জিপে উঠেছে। এজন্য তিনি যেভাবে ছিলেন সেভাবেই রইলেন। কিন্তু একটু পর খুটখাট আওয়াজ হলে উঠে বসলেন। দেখলেন, গালালা রিভলবারে গুলি ভরছে। কি ঘটছে প্রথমে তিনি হুতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে বুঝতে চেষ্টা করলেন। তারপর হন্তদন্ত হয়ে জিপের দিকে ছুটে গেলেন।

কিন্তু ততক্ষণে গালালা রিভলবারে ছয়টি গুলি ভরে ফেলেছে এবং তার নল মেজরের দিকে তাক করে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। বৃটিশ ইন্টেলিজেন্সির এত বড় দুর্দান্ত অফিসার সামান্য এক বেদুইনের দিকে করুণা প্রার্থী চোখে তাকিয়ে রইলেন।

আমি একজন মানুষ, গাধা নই- আব্দুল্লাহ গালালা গম্ভীর গলায় বললো, তুমি আমাকে মেরে তোমার রাস্তা পরিষ্কার করতে চেয়েছিলে। সেখানে অসংখ্য মাইন ওঁৎ পেতে ছিলো আমার জন্য। ঝড়ের তান্ডবে সবগুলোর উপর থেকে বালি মাটি সরে গেছে। এজন্য আমি সাবধানে এগিয়ে আবার ফিরে আসতে পেরেছি।

না হয় এতক্ষণে আমার দেহটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো। তোমাদের সাদা চামড়ার ইংরেজদের মত ধূর্ত শয়তান নই বলেই আমরা সবসময় ঠকে এসেছি। সাধারণ একটা গাধার মূল্যও তোমরা আমাদেরকে দিতে চাও না। আমি আমার অপমানের প্রতিশোধ নেবো। আর শুনে রেখো, মরুচারীরা যে তাদের গাধা দিয়ে মাইন ফিল্ড খুঁজে বের করে সেটা আমার অজানা নয়।

মেজর ডাগলাস নিজেকে কিছুটা সামনে নিয়েছিলেন। গালালার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে অফিসারের মতো হুকুমের সুরে বললেন, রিভলবারটি দিয়ে দাও আমাকে।

আয় ফিরিঙ্গ, গালালার কণ্ঠ চিড়ে যেন চাবুক বেরিয়ে এলো, আমি তোমাদের নুন খেয়েছি এজন্যে তোমাকে হত্যা করবো না। মুসলমানরা তোমাদের মতো বেঈমান নয়। যদি পথ হারিয়ে মরে যাও আমাকে কেউ দোষ দিতে পারবে না। যাও, হাঁটতে থাকো। দাঁড়িয়ে থাকলে গুলি চালাবো আমি … যাও?

গালালার খুনি মূর্তি দেখে মেজর হাঁটতে শুরু করলেন। কয়েক কদম গিয়ে ফিরে গালালার কাছে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো, সে যেন তাকে মাফ করে দেয় এবং জিপটি তাকে ছেড়ে দেয়।

গালালা বাতাসে ফায়ার করে বললো, হাঁটতে থাকো গাঁধা; আমাকে গাধা মনে করো না।

মেজর হাঁটা শুরু করলেন গোমরা মুখ করে। আর গালালা জিপের টায়ারগুলো ফুটো করে দিতে লাগলো। তারপর গালালা মেজরের যা কিছু ছিলো তা নিয়ে এক দিকে হাঁটা ধরলো।

মুসলমানদের আমরা যতটা নির্বোধ মনে করি, পরে ডাগলাস স্বীকার করেন। তারা আসলে ততটা নির্বোধ নয়। প্রয়োজনে আমাদের চেয়েও অনেক বিচক্ষণ। ওদের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধও অনেক বেশি। সত্যি বলতে কি সেই বেদুইন আমাকে আসলে মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিক্ষা দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *