২৬. আর্কাইভস ডিপার্টমেন্টের দিকে

২৬.

পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আর্কাইভস ডিপার্টমেন্টের দিকে যাত্রা করলো স্যাম ও রেমি। ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে রেমি ভিতরে ঢুকলেও স্যাম রয়ে গেলো বাইরেই। ভিতরে ঢোকার আগে চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নিতে চাচ্ছে।

বিল্ডিংর ভিতরে ঢুকে ডিরেক্টরি থেকে রেকর্ড ডিপার্টমেন্টটা বের করে নিলো রেমি। হলওয়েতে অনেক কর্মচারীর আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। অবশ্য কর্মচারীদের সবাই কাজে এতোই ব্যস্ত যে কেউই তার দিকে তাকাঁচ্ছে না। হলুদ জামা ও ফিরোজা রঙের স্কার্ফ পরা এক মহিলাকে কাউন্টারে ম্যানিলা কাগজের স্তূপ রাখতে দেখে এগিয়ে গেলো তার দিকে। গিয়ে বলল, এক্সকিউজ মি, আপনি রেকর্ড ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন?

ডাক শুনে তার দিকে ফিরে তাকালো মহিলা। হ্যাঁ। আপনাকে কি এখনো সাহায্য করা হয়নি?

রেমি মুচকি হেসে বলল, এখনো না।

ক্ষমা করবেন। গত রাতের অপ্রত্যাশিত ঝড়ে একটু এলোমেলো হয়ে গেছে সব। রাতে অ্যালার্মও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। দালানের ভিতরেও পানি ঢুকে গেছে। এজন্যই আসলে ব্যস্ত হয়ে আছে সবাই। তবে, যাই হোক, কিভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?

আমরা আসলে কিছু পুরোনো জাহাজের ঘোষণাপত্র দেখতে এসেছিলাম।

আমরা?

আমার হাজব্যান্ডও আছে সাথে। একটু বাইরে আছে ও। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে।

মহিলা কাউন্টার থেকে একটা ফর্ম বের করে রেমির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনারা গবেষক?

আচ্ছা, তাহলে এই ফর্মটা পূরণ করে দিন। আমি ফিরে আসছি এখনই।

ধন্যবাদ।

ফর্ম পূরণ করতে করতে স্যামও এসে গেছে ভিতরে।

এসে রেমিকে বলল, বাইরে সব ঠিকঠাকই আছে বলে মনে হচ্ছে। ভিতরের কী অবস্থা?

অতটা ভালো না। ঝড়ে এলোমেলো হয়ে আছে সব।

 অন্ততপক্ষে এয়ার কন্ডিশনারটা তো ঠিক আছে। গতরাতের বৃষ্টির পর দ্বীপটা স্টিম বাথে পরিণত হয়ে গেছে।

মহিলা আবার ফিরে আসতেই ফর্মটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলো রেমি। কাগজটা ভালো করে দেখে মহিলা বলল, জাহাজের ঘোষণাপত্রই তো?

হ্যাঁ, জবাব দিল রেমি। একটা প্রশ্ন ছিলো। গত কিছুদিনে কি আমরা ছাড়াও অন্য কেউ এই সময়কালের রেকর্ড দেখার জন্য এসেছিলো এখানে?

না। আপনারাই শুধু, বলে তাদেরকে নিয়ে আর্কাইভের দিকে পা বাড়ালো মহিলা। আর্কাইভে গিয়ে তাদেরকে কোন সারিতে খুঁজতে হবে সেটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, এখানের সবকিছু বছরের ক্রমানুযায়ী সাজানো আছে। নির্দিষ্ট জিনিসটা খুঁজতে খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা না। তবে মাঝেমধ্যে কিছু ফাইল উলটপালটও হয়ে যায়। আপনারাই খুঁজে দেখুন। | ধন্যবাদ, বলল রেমি। মহিলার শেষ আশঙ্কাটা সত্য না হওয়ার প্রার্থনাই করছে। শত শত ফাইল আছে এখানে। এরমানে একটা ফাইল উলটপালট হয়ে গেলে, সেটা খুঁজে বের করাও বেশ কষ্টকর হবে।

 সারির দুই প্রান্ত থেকে খোঁজা শুরু করলো দুইজন। স্যাম চলে গেছে সারির শেষ প্রান্তে। আর রেমি খুঁজছে শুরুর প্রান্ত থেকে। এক এক করে ফাইলগুলো দেখতে দেখতে কাছাকাছি এগিয়ে আসছে ওরা। দেখতে দেখতেই একটা সময় সারির মাঝ বরাবর দেখা হলো তাদের। সাথে সাথেই স্যাম বলে উঠলো, প্রায়ই আসা হয় এখানে?

কপাল ভালো যে লাইটহাউজে আমাদের প্রথম দেখায় এটা বলোনি তুমি।

তাই? আমার তো মনে হয় আমি এটাই বলেছিলাম।

না। ভালো করেছিলে না বলে। তাহলে আর কখনো সেকেন্ড ডেট হতো না আমাদের। তারপর তাকের সারির দিকে নির্দেশ করে বলল, আমি খুঁজে পাইনি এখনো।

স্যামও তাকের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, খুব সম্ভবত বইটা আমাদের চোখে পড়েনি এখনো। আমার মনে হয় আমাদের…

আমিও এটাই ভাবছিলাম।

এখন আমি তোমার অংশে খুঁজে দেখি, আর তুমি আমার অংশে দেখো।

 তাই করলো তারা। কিন্তু ফলাফল সেই আগেরটাই।

এখন পাশের তাকে খুঁজতে শুরু করেছে স্যাম। যদিও তারা যে বছরেরটা খুঁজছে সেটার সাথে এটার বছরের কোনো মিল নেই। রেমিও আরেকবার সারিগুলো চেক করে দেখছে। একটা একটা করে বই বের করে দেখছে ও। ভাবছে হয়তো ভুল করে কেউ অন্য কোনো সালের সাথে বইগুলো উলট-পালট করে রেখেছে।

কিছুই পাইনি, বলল স্যাম। অবাক ব্যাপার, তাই না?

অবশ্যই। বলে তাক থেকে আরেকটা বই বের করে আনলো রেমি। যদিও সে কয়েক শতাব্দী পরের রেকর্ডও পেয়ে গেছে, কিন্তু কোনোভাবেই কাক্ষিতটা খুঁজে পাচ্ছে না। প্রায় এক ঘন্টা ধরে খোঁজাখুঁজির পর হঠাৎ রেমি বলে উঠলো, স্যাম… এভেরির পোষা কুকুরগুলো এখনো এখানে আসেনি কেন?

 আমাদের অপেক্ষা করছে ওরা। আমরা তথ্য পেলে সেটা আমাদের থেকে চুরি করবে। এতেই তো কষ্ট কম।

কিন্তু যদি…

 এক মহিলার আগমনের কারণে বলতে গিয়েও থেমে গেলো রেমি। এই মহিলাই তাদেরকে এখানে ঢুকতে সাহায্য করেছিলো। তাদেরকে এখনো এখানে দেখে মহিলা চমকে উঠে বলল, এখনো এখানে?

বইটা এখানে নেই, রেমি জানালো।

অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কোন বছরেরটা খুঁজছেন আপনারা?

 ষোলশ চুরানব্বই থেকে ষোলশ ছিয়ানব্বইয়েরগুলো।

এগিয়ে গিয়ে তাকের সারিতে খুঁজতে শুরু করলো মহিলা। এই তাকগুলোতেই একটু আগে খুঁজে দেখেছে রেমিরা। আশা করছি বইগুলো হয়তো এলোমেলো করা হয়নি… তারপর কয়েক মুহূর্ত পরেই বলে উঠলো, দাঁড়ান। মনে পড়েছে। রিসার্চ টেবিলে অনেকগুলো বইয়ের একটা স্তূপ দেখেছিলাম। প্রজেক্টের কাজে কিছু বই ব্যবহার করছিলো একজন। খুব সম্ভবত এখনো ওখানেই রয়েছে।

বলে তাদেরকে টেবিলের কাছে নিয়ে গেলো মহিলা। আসলেই টেবিলের ওপর বেশ কতগুলো মোটা মোটা বই রয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যে একটা বই অন্যগুলোর থেকে একটু দূরে পড়ে আছে।

স্যাম এগিয়ে গিয়ে বইটা তুলে নিলো হাতে। ভালো করে মলাট এবং বাইন্ডিংর লেখাটা পরীক্ষা করে জানালো, দেখে মনে হচ্ছে এটাই খুঁজছিলাম আমরা।

অবশেষে পাওয়া গেলো তাহলে। বলে স্যামের দিকে এগিয়ে গেলো রেমি। বইটা কেন অন্যগুলোর থেকে আলাদা করে সরিয়ে রাখা হয়েছে সেটা ভাবার মতো সাহসও করতে পারছে না। স্যাম ওদিকে মলাট উল্টিয়ে বইয়ের পাতাগুলো দেখছে। কয়েক পাতা উল্টাতেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে গেলো।

একটা তদন্ত জারি করা হয়েছিলো তখন।

কিসের তদন্ত?

১৬৯৬ সালের জুনে মিরাবেল চুরি গিয়েছে বলে দাবি উঠেছিলো। ওটার ব্যাপারেই তদন্ত জারি করা হয়েছিল।

বেশ। তাহলে তো এর মাধ্যমে আসল মালিকের নাম জানা যাবে।

যদি সাক্ষ্যগুলো পড়তে পারি আর কী! বলে রেমির দিকে বইটা কাত করে ধরলো স্যাম।

রেমি তাকিয়ে দেখলো ফুলেল স্ক্রিপ্টের লেখাটা পড়া আসলেও বেশ কঠিন একটা কাজ। টাইপিংর আধুনিকতার প্রশংসা করাই লাগছে এখন।

যাই হোক, এখানে দেখো, বলে পাতার নিচের দিকের একটা অনুচ্ছেদের দিকে নির্দেশ করলো স্যাম। এক ক্রু মেম্বার সাক্ষ্য শুনো, তাকে মাদাগাস্কারে আটক করে ক্যাপ্টেন হেনরি ব্রিজম্যানের ফ্যান্সিতে করে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। ওটাতে করে প্রথমে জামাইকাতেই এসেছিলো ওরা। তারপর যাত্রা করেছিলো নিউ প্রভিডেন্সের দিকে। এরপর নাসাউতে পৌঁছে তারা নিজেদেরকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধাওয়াকৃত ইন্টারলুপার বলে দাবি করে বন্দরে নেমেছিলো।

ইন্টারলুপার?

আমার জানা ইতিহাস যদি সঠিক হয়ে থাকে, লাইসেন্সবিহীন দাসব্যবসায়ীদেরকে ইন্টারলুপার বলা হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাসনীতি এড়িয়ে যাওয়ার একটা উপায় ছিলো এটা।

ব্রিজম্যান দাসব্যবসায়ী ছিলো?

 সাথে একজন জলদস্যুও।

 তো এই লোকই কি আমাদের আগ্রহের জাহাজের মালিক ছিলো?

না, লেখাগুলো দেখতে দেখতে বলছে স্যাম। নিরাপদে বন্দরে নামতে দেওয়ার জন্য ব্রিজম্যান গভর্নর ট্রটকে ঘুষ হিসেবে ফ্যান্সি উপহার দিয়েছিলো। যদিও ট্রট ঐ জাহাজ এবং ব্রিজম্যানের কথা অস্বীকার করেছিলো, তবে ক্রু মেম্বারদের দাবি ট্রট উপহারটা নিজের করে নেওয়ার আগেই ওটার কার্গোর একটা অংশ চুরি গিয়েছিলো। আর চোর মিরাবেল নিয়ে পালানোর সময় ডুবে গিয়েছিলো স্নেক আইল্যান্ডে। বলতে বলতে হুট করেই থেমে গেলো স্যাম। অনুচ্ছেদের পরের অংশটা পড়তে পড়তে বলল, এটা বেশ ইন্টারেস্টিং…

কী?

রয়েল নেভি ধাওয়া করছিলো ব্রিজম্যানকে… নেভির কমান্ডার… বলে পাতা উল্টালো স্যাম। নেই…, কিছুক্ষণ পাতাটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল স্যাম।

নেই মানে? কমান্ডার নেই? নাকি এখানে কমান্ডারের কথা উল্লেখ নেই? তারপর কাছে বইটা ভালো করে দেখার জন্য কাছে ঝুঁকে বলল, এটাই তো সঠিক বইটা?

কয়েকটা পৃষ্ঠা নেই এখানে।

বলে বইয়ের বাধাইয়ের সাথে আটকে থাকা খাজকাটা ছেঁড়া কাগজের কোনাগুলো দেখালো স্যাম। কাগজের কোনাগুলো প্রমাণ করছে যে একসময় কিছু পৃষ্ঠা ছিলো এখানে।

 স্যামের দিকে চোখ তুলে তাকালো রেমি। চোখে সন্দেহের দৃষ্টি ফুটে আছে ওর। ঐ মহিলা বলেছিলো গতরাতে অ্যালার্ম নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলো না?

সন্দেহাতীতভাবেই, অ্যালার্ম নষ্টের সাথে ঝড়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

 অযথাই সময় নষ্ট হলো তাহলে আমাদের।

বইটা নিয়ে কাউন্টারে দেখানো দরকার। দেখি বইয়ের ব্যাপারে কারো কিছু মনে আছে কিনা অথবা কারা কারা আগে এই বইটা পড়েছে।

 অফিসে পৌঁছুতেই কাউন্টারের মহিলা তার হাতের কাগজগুলো রেখে তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কোনো সমস্যা?

স্যাম বইটা বাড়িয়ে দিলো মহিলার দিকে। আমরা এই বইটাই খুঁজছিলাম। তবে এখানে কিছু পৃষ্ঠা নেই। ওগুলোই দরকার ছিলো আমাদের।

নেই মানে? বইটার দিকে তাকিয়ে বলল মহিলা। আমি বুঝতে পারছি না কিছুই।

কেউ একজন ওগুলো ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।

এমন কাজ কেন করবে কেউ? তারা তো চাইলেই এগুলো ফটোকপি করে নিতে পারে।

 আপনি নিশ্চিত যে আমাদের আগে কেউ এই বইটার খোঁজ করতে আসেনি?

ইদানিংকালে কেউ আসেনি। রয়েল নেভাল ডকইয়ার্ডের মিউজিয়ামের ঘোষণাপত্রের জন্য এক ইতিহাসবীদ খোঁজ করেছিলো এটার। তবে এটা আরো বেশ কয়েকবছর আগের কথা। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠলো মহিলার। এক মিনিট, প্লিজ, বলে ফোনের পর্দার দিকে একবার দেখে বলল, আপনাদের কি আরো কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি? আমাকে আসলে এই ফোনটা পিক করতে হবে।

 না, যতোটা করেছেন, তাই যথেষ্ট। ধন্যবাদ।

বলে অফিস থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। তারপর সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে, ঠিক তখনই হুট করে থমকে দাঁড়ালো স্যাম। এমনভাবে থেমে গেছে যে রেমি প্রায় হোঁচটই খেতে নিয়েছিলো তার শরীরে।

ফেউ হাজির হয়ে গেছে, বলে পার্কিং লটের দিকে নির্দেশ করলো স্যাম। পার্কিং লটের দিকে তাকাতেই সাদা এসইউভিটা দেখতে পেলো রেমি। গাড়িটার সাথে ওয়্যারহাউজের ডাকাতদের একজনও দাঁড়িয়ে আছে। যদিও লোকটা তাদেরকে দেখতে পায়নি। ফোনের পর্দায় কী যেন একটা দেখছে লোকটা।

তাড়াতাড়ি করে রেমিকে টান দিয়ে লবির একপাশে সরে গেলো স্যাম। ডাকাতের নজর থেকে দূরে সরে থাকতে চাচ্ছে।

কী করবো এখন? রেমি জানতে চাইলো।

অন্য কোনো এক্সিট আছে কিনা খুঁজে দেখা দরকার।

অন্য এক্সিটটা পেতে বেশিক্ষণ খুঁজতে হলো না তাদের। দালানের পাশেই একটা এক্সিট রয়েছে। স্যাম দরজা খুলে বাইরের দৃশ্যটা দেখে জানালো, সবকিছু ঠিকঠাকই মনে হচ্ছে।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে পার্কিং লটের উলটো দিকে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। একটু এগিয়ে কোনা ঘুরতেই ডাকাতটার সাথে সরাসরি দেখা হলো তাদের। জ্যাক স্তানিস্লভ। এই লোকটাই বইয়ের দোকানে ডাকাতি করতে এসেছিলো। চামড়ার কোটের পকেটে হাত রেখে সরাসরি তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে জ্যাক। মুখে ফুটে আছে কুৎসিত এক হাসি।

সাথে সাথেই থমকে গেলো স্যাম। রেমিকে তার পিছনে আড়াল করে নিয়ে সরাসরি চোখ তুলে তাকালো জ্যাকের দিকে। হুট করেই দেখি তোমার দেখা পেয়ে গেলাম এখানে।

হুট করে? বলে জ্যাক তার ডান পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে তাক করে ধরলো স্যামের দিকে। দেখা যখন হলোই, তাহলে ভালো মানুষের মতো উলটো ঘুরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাও। আমার বন্ধুরা তোমাদের অপেক্ষা করছে ওখানে।

যদি না যাই?

হাত ওপরে তুলো, নয়তো তোমাদেরকে এখানেই মরতে হবে।

কিছু না বলে ধীরে ধীরে হাত ওপরে উঠিয়ে নিলো স্যাম। তারপর হুট করেই ডান হাত দিয়ে ঘুষি মারলো জ্যাকের মুখে এবং বাম হাত দিয়ে আটকে ফেললো জ্যাকের পিস্তল ধরা হাতটা। মুহূর্তের মধ্যেই জ্যাককে দালানের দেয়ালে আছড়ে ধরে পিস্তলটা কেড়ে নিলো, তারপর নল ঠেকিয়ে ধরলো জ্যাকের মাথায়।

অবশ্য রেমি প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোনো সুযোগ পায়নি। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই পিঠে বন্দুকের নলের ছোঁয়া টের পেলো ও। পিছনের দিকে মাথা ঘুরাতেই দেখলো লম্বা এক লোক তার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙাচ্ছে। তোমার স্বামীকে থামতে বলল।

ভালোভাবেই প্রস্তুত হয়ে এসেছে লোকগুলো।

স্যাম…

ডাক শুনে মাথা ঘুরাতেই রেমির পিঠে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে রাখা লোকটাকে দেখতে পেলো স্যাম। এখন আর কিছুই করার নেই তার। আস্তে আস্তে অস্ত্রটা নিচে নামিয়ে আবার তা ফেরত দিয়ে দিলো জ্যাককে।

ছাড়া পেয়েই তার ওপর খেঁকিয়ে উঠলো জ্যাক। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমার দিকটাও দেখবে। যাই হোক, বোকামি করো না, নাহলে ইভানের ট্রিগারের খুশি হতে সময় লাগবে না।

আর কিছু না করে হাত মাথার পিছনে উঁচিয়ে ধরলো স্যাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাদা এসইউভিটা এসে থামলো তাদের পাশে। জ্যাক গাড়িটার দিকে ইশারা করে বলল, গাড়িতে চড়ে বসো।

জ্যাক তাদের বিপদটা আঁচ করতে পারছে ঠিকই, তবু জায়গা থেকে নড়ছে না।

ইভান বলল, তোমাদেরকে জনসম্মুখে গুলি করে মারতে কোনো সমস্যাই হবে না আমার। তোমার সুন্দরী স্ত্রীকে দিয়েই শুরু করছি তাহলে। রেমির দিকে তাক করা বন্দুকটা দেখিয়ে আস্ফালন ছড়িলো ইভান। তারপর বলল, ফার্গো, বোকামি না করে এখনই ব্যাকসিটে উঠে বসে।

একদম ভিতরের কোনায় গিয়ে বসবে, বলে স্যামকে ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে ঢুকালো জ্যাক। তারপর রেমির দিকে বন্দুক তাক করে বলল, এখন তুমি উঠো। মাঝের সিটে বসবে তুমি। | তাই করলো রেমি। জ্যাক উঠে বসলো তার পাশে। তার পেটে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে রেখেছে লোকটা। সিট বেল্ট বেঁধে নাও সবাই।

তাই করলো রেমি। স্যামও একই কাজ করতে করতে বলল, আমাদের কিছু হলে তোমাদের ইনস্যুরেন্সের মূল্য বেড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করছো?

সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে থাকা নতুন লোকটা পিছনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিসের ইনস্যুরেন্স?

কোথায় নিয়ে যাচেচ্ছা আমাদেরকে? জানতে চাইলো স্যাম।

এইতো ছোট একটা ভ্রমণে।

বলে গাড়ি চালু করলো ড্রাইভার মোড় থেকে বেশ কয়েকটা রাস্তা চলে গেছে সামনের। তারা এগিয়ে যাচ্ছে বামের রাস্তাটা দিয়ে। স্পষ্টতই এই রাস্তায় মানুষের আনাগোনা খুব কম। অবশ্য সরু রাস্তাটা দিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে ড্রাইভারকে। তাছাড়া সর্পিলাকার রাস্তার মোড়গুলোর জন্য গতিও ঠিকমতো বাড়াতে পারছে না।

এভাবেই বেশ কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর জ্যাক বলল, যথেষ্ট দূরে এসেছি। এখানেই থামাও।

সরু আরেকটা মোড় পেরিয়ে রাস্তার পাশে নিয়ে গাড়িটা থামালো ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নেমে স্যামের দরজা খুলে রেমিকে নিয়ে বেরিয়ে ইশারা করলো লোকটা।

কোনো প্রতিবাদ না করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো স্যাম। স্যামের পর রেমিও বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। বাইরে পা রাখতেই জঙ্গলের আটকে রাখা গরমের উত্তাপটা টের পেলো ও। জঙ্গলের সবুজ পাতাগুলো থেকে এখনো গতরাতের বৃষ্টির পানি টুপটুপ করে পড়ছে। অতিরিক্ত আর্দ্রতায় এতোক্ষণে বাম্পায়িত হয়ে যাওয়ার কথা পানির। তবে এর পরিবর্তে ঝর্নার মতো করে পাহাড়ের পাশ দিয়ে পড়ছে ওগুলো।

জ্যাক তাদের দিকে পিস্তল তাক করে ধরে বলল, রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়াও, দুজনই।

আরে ভাই, একটু তো অপেক্ষা করো, বলে উঠলো স্যাম। মারবেই যখন, তখন মরার আগে তো বউটাকে বিদায়ী একটা চুমু খেয়ে নিতে দিবে।

আচ্ছা, আচ্ছা, তাড়াতাড়ি করো।

রেমির আরো কাছে গিয়ে দাঁড়ালো স্যাম। রেমির দিকে গভীরভাবে ঝুঁকে ফিশিং ভেস্টে হাত ঢুকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, মনে হয় আমাদের ছুটিটা

আরো কয়েকদিন পর থেকে শুরু করতে হবে।

কথাটায় শুনে হাসার চেষ্টা করলো রেমি।

সাথে সাথেই পাক খেয়ে ঘুর গেলো স্যাম। তারপর দুই হাত দিয়ে রিভলভার ধরে বুলেট ছুঁড়ে দিলো ড্রাইভারের কপাল বরাবর।

.

২৭.

ধুপ! ধুপ!

আরো দুইবার গুলি করলো স্যাম। তবে এবার গুলিগুলো ডাকাতদের কারো গায়েই লাগেনি। কেন লাগেনি সেটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে দেখলো যে তার পায়ের নিচের মাটি ক্ষয় পড়তে শুরু করেছে।

 পিছিয়ে যেতে যেতে অসতর্কভাবে তারা পাহাড়ি রাস্তার বেশি কিনারের দিকে চলে গেছে। তাদের শরীর ভার নিতে পারেনি কর্দমাক্ত মাটির রাস্তাটা। ঝট করেই ব্যালেন্স হারিয়ে দুজনই পড়ে গেলো পাহাড়ের ধার দিয়ে।

 স্যাম গিয়ে আছড়ে পড়েছে সবুজ ও বাদামি জালিকাময় জঙ্গলের পাতাবহরের মধ্যে। তবে তার পতন থেমে যায়নি এতে। পিঠ ঘেষে ঠিকই পিছলে পড়ছে সে।

পড়তে পড়তে রেমির হাতও একসময় ছুটে গেছে তার হাত থেকে। আরো কিছুটা পিছলে পড়ার পর পতন থামানোর জন্য গাছের ডাল আঁকড়ে ধরলো স্যাম। রেমিকে এখন আর দেখতে পাচ্ছে না। পাতার ঝোঁপের আড়ালে হারিয়ে গেছে রেমি।

ধুপ! ধুপ! ধুপ!

ফিরতিগুলির আওয়াজে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উড়ে যেতে শুরু করেছে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাখিগুলো। শব্দ শুনে স্যাম ওপরের দিকে তাকাতেই দেখলো একটা গাছের গুঁড়ি গড়িয়ে আসছে তার দিকে। সরে গিয়ে পাশের দিকে আছড়ে যেতেই স্যাম দেখলো মাশরুমের একগুচ্ছ ঝাঁক তার পতন ঠেকিয়ে রেখেছে। দৃশ্যটায় চমকে গিয়ে ওপরের দিকে তাকাতেই গাছের উপড়ে যাওয়ার গুঁড়িটা এসে আঘাত করলো তার শরীরে। মিনিট খানেকের ভিতরেই ব্যথায় ভরে উঠলো তার শরীর। তবে কপাল ভালো যে পঁচে যাওয়ার কারণে গুঁড়ির আঘাতের তীব্রতা অতোটা বেশি ছিলো না। নাহলে শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যেতো এতক্ষণে।

 গর্ধভ! ইভানের গলার স্বর ভেসে আসছে ওপর থেকে। তাদেরকে এভাবে পালিয়ে যেতে দিলে?

যতটুক ওপর থেকে পড়েছে, এরপর আর কোনোভাবেই বাঁচার কথা না তাদের, জ্যাক বলল। আর যদি পতন থেকে বেঁচেও যায়, তবু এটা থেকে বাঁচতে পারবে না।

বলেই ধুপ ধুপ করে গুলি করতে শুরু করলো দুজনে। গুলির শব্দ শুনেই আত্মা কেঁপে উঠলো স্যামের।

রেমি…

 বুলেট শেষ হয়ে যাওয়ায় অবশেষে গুলি থামালো ওরা।

কিছু দেখছো তুমি? ইভান জিজ্ঞেস করলো।

না। নিচে নামো। নেমে দেখো ওরা আসলেই মরেছে কিনা।

হ্যাঁ, নেমে ঘাড়টা ভাঙ্গি আর কী! খেঁকিয়ে উঠে বলল ইভান। এরচেয়ে গাড়ি নিয়ে ঢালু পথ ধরে নেমে যাওয়াই ভালো। পাহাড়ের নিচের রাস্তাটায় গিয়ে চেক করলেই হবে।

লরেঞ্জোর কী করবো? জ্যাক বলল। এখানেই ফেলে যাবো ওকে?

 পাহাড়ের ধার দিয়ে ফেলে দাও। ফার্গোদের সাথে পঁচুক।

বলে রাস্তার পাশ দিয়ে লাশটা ফেলে দিলো ওরা। ঝোঁপঝাড় ভেঙ্গে লাশ গড়িয়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেলো স্যাম। কিছুক্ষণ পর এসইউভির ইঞ্জিনের গর্জনও শুনতে পেলো। গাড়িটা পাহাড়ের ওপরের দিকে রাস্তা বরাবর এগিয়ে যাচ্ছে, নিচের দিকে না। প্রশস্ত জায়গা না থাকায় গাড়ির মোড় ঘুরানোর জন্য কিছুটা পথ পিছিয়েই যেতে হচ্ছে তাদেরকে।

রেমি? ডাকাতগুলো চলে যাওয়ার পর মৃদুস্বরে ডাকলো স্যাম।

আমি নিচে আছি।

তার প্রায় পনেরো ফুটের মতো নিচ থেকে এসেছে শব্দটা! রেমির সাড়া পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো স্যাম। তখনই বুঝতে পারলো যে এতোক্ষণ ধরে উৎকণ্ঠায় শ্বাস আটকে রেখেছিল ও। ঠিক আছো তুমি?

চামড়া ছিলে গেছে, তবে হাড়গোড় ভাঙেনি।

ডাকাতগুলো মোড় ঘুরানোর মতো জায়গা খুঁজছে। নিচের দিকে যাওয়ার প্ল্যান তাদের।

নিচের রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছি আমি। আমার থেকে দূরত্বটা খুব বেশি না।

আমি আসছি তোমার কাছে। তারা পৌঁছার আগেই নিচে নেমে যাওয়া দরকার আমাদের। তারা ওখানে থেকে ওপরের দিকে খুঁজবে, নিচের দিকে না।

বলে আস্তে আস্তে তাকে আটকে রাখা গাছের গুঁড়ির কাছ থেকে সরে আসতে শুরু করলো স্যাম। আশেপাশে তাকিয়ে নিজের বন্দুকটা খুঁজছে ও। তার থেকে আটফুট ওপরে পাহাড়ের কর্দমাক্ত দেয়ালে গেঁথে আছে বন্দুকটা। বন্দুকটা হাতে নেওয়ার জন্য আবারো ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলো। পিচ্ছিল মাটির কারণে আরোহণটা আরো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ের গায়ে পা ঢুকিয়ে সিঁড়ির মতো ধাপ করে ওপরের দিকে উঠতে হচ্ছে তাকে। বন্দুকটা তুলে নিয়ে নিচে নামতে শুরু করলো স্যাম। নিচে নামাটা ওপরে উঠার থেকেও বেশি কষ্টকর লাগছে। তবু আস্তে আস্তে একটু একটু করে রেমির দিকে নেমে যাচ্ছে। পুরো শরীর কাঁদা এবং গাছগাছাড়ির পাতায় ভরে গেছে তার। রেমির পাশে পৌঁছে দেখলো, রেমির অবস্থাও তার মতোই হয়ে আছে।

তারপর আরো কিছুটা নেমে ওপরের দিকে তাকালো স্যাম। লম্বা একটা দাগের ধারা দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে। তাদের নেমে আসার চিহ্ন নির্দেশ করছে দাগটা। কেউ দাগটা দেখলেই তাদের গতিপথ বুঝে যাবে। আমাদের সাবধানে নামতে হবে। ছাপ রেখে যাওয়া যাবে না।

শুনেই স্যামের দিকে তাকালো রেমি। কোনো প্ল্যান?

অন্ততপক্ষে রাস্তার বিশফুট নিচে নেমে যেতে হবে তাদেরকে। আমি আগে আগে নামছি। আমাকে অনুসরণ করো। আমি যেখানে যেখানে পা ফেলবো তুমি সেখানে সেখানেই ফেলবে।

পাঁচ ফুট নিচে থাকা গাছের গুঁড়িটার দিকে তাকালো স্যাম। নিচের দিকের ঢালটা ওপরেরটার মতো অতোটা খাড়া না। লাফ দিয়ে খুঁড়ির ওপর নেমে দাঁড়ালো স্যাম। তারপর রেমির দিকে তাকিয়ে বলল, রেডি?

হ্যাঁ, বলে লাফ দিলো রেমি।

রেমির কোমড়ে ধরে তাকে নিচে নামিয়ে আনলো স্যাম। তারপর একইভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে গেলো আরো কিছুটা পথ। লাফিয়ে নামার ফলে তাদের নেমে যাওয়ার ছাপটা আর এখন দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা থেকে পাঁচফুট ওপরে থাকতেই হুট করে থেমে গেলো স্যাম। এসইউভির ইঞ্জিনের গর্জন ভেসে আসছে ওপর থেকে।

তারা আসছে, বলল রেমি।

তাড়াতাড়ি করে নিচের রাস্তায় লাফিয়ে নামলো স্যাম ও রেমি। রাস্তার ওপর দিয়ে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে নিচের পর্বতটার দিকে তাকালো স্যাম। একটু আগে তারা যে ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে ওটার মতোই খাড়া এই পর্বতটাও। নামার সময় ছাপ না রেখে যাওয়ার ব্যাপারেও সতর্কভাবে থাকতে হবে ওদের। দশ ফুট নিচে ফার্নের একটা ঝোঁপ দেখতে পেলো স্যাম। আপাতত ওখানে লুকিয়ে থাকতে পারবে ওরা। এক গাছের গুঁড়ি থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে গেলো। গিয়ে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়েছে মাত্র, ঠিক ওইসময়ই ওপর থেকে এসইউভির থেমে যাওয়ার শব্দ ভেসে আসতে শুনলো স্যাম।

দরজা খুলে গাড়ি থেকে দুই ডাকাতের বেরিয়ে আসার শব্দ শুনতে পাচ্ছে এখন। রাস্তার ধার পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে ওরা।

তাদেরকে দেখতে পাচ্ছো? ইভান জিজ্ঞেস করলো।

ঐ যে ওখানে, জ্যাক বলল।

 আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

রাস্তার পাশের পাহাড়ের গায়ে দেখো। পিছলে পড়ার দাগ দেখা যাচ্ছে। ওখান দিয়েই পড়েছে ওরা।

ওহ, হ্যাঁ, এখন দেখতে পাচ্ছি আমি। তবে দাগটা তো একটু গিয়ে আর নেই। তোমার কি মনে হয় তারা ওখানে কোথাও লুকিয়ে আছে?

মরেও যেতে পারে। হয়তো আমার গুলিগুলো তাদের শরীরে আঘাত করতে পেরেছে কোনোভাবে।

ফার্নের পত্রবহ ফাঁক করে ওপরের দিকে তাকাতেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকদুটোকে দেখতে পেলো স্যাম। দুজনের হাতেই বন্দুক রয়েছে। অবশ্য তারা তাদের থেকে উলটো দিকে ফিরে আছে। এসইউভিটা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপর, গাড়ির সম্মুখ দরজাটা হাঁ হয়ে আছে একদম।

দৃশ্যটা দেখে লোভ লাগছে স্যামের।

অবশ্য পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে নেই। হয়তো কোনোরূপ শব্দ না করেই রাস্তা পর্যন্ত উঠে যেতে পারবে, কিন্তু কভার নেওয়ার মতো কোনো উপায় নেই তাদের। ডাকাতগুলো সশস্ত্র না থাকলে স্যাম হয়তো সুযোগটা কাজে লাগাতো। ভাবনাটা মাথায় আসার সাথে সাথেই জ্যাক তার পিস্তল নিয়ে তাদের দিকে ঘুরে দেখলো স্যাম। লোকটা এখন তাদের লুকানো জায়গাটার দিকেই পিস্তল তাক করে রেখেছে।

রেমিকে জমে যেতে দেখে ওদিকে ফিরে তাকালো স্যাম। রেমির পায়ের ফাঁক দিয়ে একটা মোটা অজগর সাপ গড়িয়ে যাচ্ছে। নড়ো না, একদম নড়বে না, সাপটাকে গড়িয়ে যেতে দেখে ফিসফিসিয়ে বলল স্যাম।

নেই এখানে, ঘুরে ওপরের দিকে তাকাতেই জ্যাক বলতে শুনলো স্যাম। নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে লোকটা। তারপর হঠাৎ করেই আবার গুলি করতে শুরু করলো জ্যাক। স্যামের ঠিক পাশ কেটে গেলো যেন বুলেটগুলো। কিছু একটা আছে নিচে। চোখে পড়েছে আমার।

কী দেখেছো? বলল ইভান। কিছু একটার শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি।

স্যামও শুনতে পাচ্ছে শব্দটা। টুপ-টুপ একটা শব্দ। প্রথমে শব্দটা আসছিলো তার পিছন থেকে, এখন চতুর্দিক থেকেই আসছে। একমুহূর্ত পর বুঝতে পারলো যে এটা বৃষ্টি পড়ার শব্দ। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।

কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি, কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর জবাব দিলো জ্যাক। চলো, এখন ভাগি এই জায়গা থেকে।

ফার্গোদের ব্যাপারে কী করবো?

তারা যদি এখনো বেঁচে থাকে, তাহলেও তাদের ফিরে আসতে বেশ কয়েকদিন লাগবে। এই রাস্তা দিয়ে খুব একটা গাড়ি চলাচল করে না।

স্যাম এখনো রেমিকে হাত দিয়ে আটকে রেখেছে। ওপর থেকে এসইউভির ইঞ্জিনের গর্জনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে এখন। কিছুক্ষণ পর ইঞ্জিনের শব্দটা দূরে মিলিয়ে যেতেই রেমি স্যামের পাশে সরে এসে বলল, তোমাকে কি আগে বলেছিলাম যে আমি সাপ ঘৃণা করি?

শোকর থাকো যে ওটা ক্ষুধার্ত ছিলো না। বলে নিচের পর্বতের দিকে তাকালো স্যাম। পর্বতটা একদম খাড়াভাবে নেমে গেছে নিচের দিকে। এসইউভিটার পুরোপুরি চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো স্যাম। এভেরির লোকেরা চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আশ্রয় থেকে বেরুনোর কোনো ইচ্ছা নেই তার।

 গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির পানির ছিটা আসছে তার মুখে। পানির ছিটা উপভোগ করতে করতে রেমিকে বলল, আমি ভাবিনি যে আমরা এবার বাঁচতে পারবো।

 পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রেমি বলল, অবশ্যই ভাবছিলাম। আমার কখনো বেঁচে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ ছিলো না।

যখন ঐ সাপটা দেখা দিলো তখনও না?

ঝট করে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো রেমি। ভয় পাচ্ছে যেন আরো সাপের সাথে দেখা হবে তাদের। এটা নিয়ে মজা করবে না।

কাঁপতে শুরু করেছে রেমি। বৃষ্টির পানির ঠাণ্ডায় না, খুব সম্ভবত উত্তেজনার তীব্রতায় কাঁপছে। স্যাম জানে এখন তাদেরকে শরীর চালু রাখতে হবে। এভাবে এক জায়গায় আটকে থাকলে কোনো উপকার হবে না। আমাদের যাওয়া দরকার এখন, বলে রেমিকে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো স্যাম।

এরপর আস্তে আস্তে আবারো রাস্তায় উঠে এলো ওরা। ওপরে উঠেই পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে আনলো স্যাম। এখানে সিগন্যাল পাওয়ার আশা করাটা হয়তো বোকামি হবে, তাই না?

বোকামি? একবার ভাবো তো, লুকিয়ে থাকার সময় কেউ ফোন করলে কী অবস্থা হতো?

 ভালো বলেছে।

স্যামের হাতের সাথে হাত পেঁচিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলো রেমি। ফিরে যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে বলে ধারণা তোমার?

নিশ্চিত না আমি, বলল স্যাম। তবে কপাল ভালো যে, এটা পাহাড়ের একটা ঢাল মাত্র।

 তোমার এই দিকটা আমার ভালো লাগে, ফার্গো। সবসময়ই ভালো দিকটা দেখো তুমি। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সফলতার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম প্রায়… এতো দূর এসেও কোনো লাভ হলো না। অহেতুক একটা ভ্রমণ…

তবে, দুজন তো একসাথে আছি।

শুনে মুচকি হেসে স্যামের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো রেমি। এভাবেই হেঁটে এগুচ্ছে ওরা।

****

প্রায় এক ঘন্টা ধরে হাঁটছে ওরা। বৃষ্টির তীব্রতা কিছুটা কমে এসেছে এখন। তবে এতে তাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। বৃষ্টির পানিতে ভিজে পুরোপুরি চুপচুপে হয়ে গেছে ওরা। ঠাণ্ডায় হাঁটাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও প্রায় তিন-চার মাইলের মতো এগিয়ে এসেছে, তারপরও ঢালু পথে নেমে যাওয়া রাস্তাটা এখনো অতিক্রম করতে পারেনি।

আরো বেশ কিছুক্ষণ ধরে হেঁটে এগুনোর পর মূল রাস্তার মোড়টা চোখে পড়লো ওদের! মোড়ে পৌঁছেই ঝট করে থেমে গেলো স্যাম। তার আশঙ্কা হচ্ছে, এভেরির লোকেরা হয়তো কাছে পিঠেই কোথাও দাঁড়িয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

রেমিকেও থামতে বলে আশেপাশের দৃশ্যটা একবার ভালো করে দেখে নিলো স্যাম। কাউকে বা সন্দেহজনক কোনো কিছু দেখতে না পেয়ে রেমিকে বলল, রাস্তার একদম ধার ঘেষে হাঁটা উচিৎ আমাদের। এভেরির লোকেরা আমাদের অপেক্ষায় থাকলে থাকতেও পারে।

 এভাবেই আরো কয়েক মিনিট হেঁটে যাওয়ার পর আবারো মোবাইলটা চেক করলো স্যাম। এখনো কোনো সিগন্যাল নেই ফোনে। হতাশ হয়ে আবারো পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো মোবাইলটা। ঠিক তখনই একটা ক্ষীণ শব্দ কানে এলো তার। পাহাড়ের দিক থেকে একটা শব্দ এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। শব্দটা শুনো, ভেজা রাস্তায় চাকার ঘর্ষণের শব্দও শুনতে পাচ্ছে এখন। নিউট্রাল গিয়ারে কোনো গাড়ি আসছে।

গাড়িটা কেন নিউট্রাল গিয়ারে চলছে সেটা ভাবতে গিয়ে দুটো কারণ মাথায় এলো স্যামের। এক, হয়তো গাড়িটার কোনো সমস্যা হয়েছে, নয়তো দুই, কেউ একজন তাদের যানের ইঞ্জিনের আওয়াজের শব্দটা গোপন রাখতে চাচ্ছে।

দ্বিতীয় কারণটা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে স্যামকে। শব্দটা কাছিয়ে আসার সাথে সাথেই রেমির হাত খাবলে ধরে লুকিয়ে পড়লো রাস্তার পাশের ঝোঁপটায়।

.

২৮.

স্যাম আশা করছে তাদেরকে হয়তো কেউ দেখেনি। একটু আগে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় খুশি হলেও, এখন আরেকবার মুষলধারে বৃষ্টির আশা করছে। এতে করে তাদেরকে দেখে ফেলার সম্ভাবনা আরো কমে যাবে।

কিন্তু বৃষ্টির বদলে শুধু গাছের পাতা থেকে টুপটুপ পানিই পড়ছে শুধু। কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই তাদের দৃষ্টিসীমায় এসে উপস্থিত হলো গাড়িটা। পাতার আড়াল থেকে ১৯৭০ দশকে হলুদ সিজে৫ জিপটা দেখতে পেলো স্যাম। কাদামাটিতে ভরে আছে গাড়িটা। এখনো নিউট্রাল গিয়ারেই আছে। অবশ্য গাড়িটা কে চালাচ্ছে সেটা না দেখা পর্যন্ত নড়ার কোনো ইচ্ছা নেই স্যামের। আরো একবার এভেরির লোকদের হাতে বন্দি হওয়ার কোনো শখ নেই তার। তাদের সামনে এসেই হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠলো জিপটা। ইঞ্জিন চালু হয়ে গেছে।

নাহ, এভেরির লোকদের কেউ নেই গাড়িতে।

 তাড়াতাড়ি করে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে গাড়ির উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে ডাকতে শুরু করেলো স্যাম। হেল্প! চেঁচিয়ে বলছে ও। এখানে আসুন!

রেমিও দৌড়ে আসছে তার সাথে সাথে। সেও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে। জিপটাকে। কিন্তু জিপটা এতক্ষণে রাস্তার মোড় পর্যন্ত চলে গেছে। বেশি দেরি করে ফেলেছে তারা। স্যাম ভাবছে জিপের লোকটা হয়তো তাদেরকে দেখেওনি, হয়তো তাদের ডাকও শুনেনি। হতাশ হয়ে এগুতে যাবে, ঠিক তখনই থেমে গেলো জিপটা। পিছিয়ে আসছে তাদের দিকে।

 জিপের ড্রাইভার লোকটা বেশ লম্বা, শরীরের চুলগুলো সাদা, থুতনীতে হালকা দাড়ি, চোখগুলো সবুজ। স্যামদের কাছে পৌঁছে কৌতূহল মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, লিফট চাই?

 হ্যাঁ, খুবই উপকার হতো এতে, স্যাম জানালো।

সাথে রেমি যোগ করলো, যদি কাদামাটিতে আপনি কিছু মনে না করেন। আরকী!

শুনে হেসে উঠলো লোকটা, এটা খুব একটা ক্লাসিক গাড়ি না। হালকা একটু কাদায় তেমন কোনো সমস্যা হবে না এটার। তবে তাড়াতাড়ি উঠুন। আরেকদফা বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।

তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে উঠে বসলো ওরা। রেমি বসেছে গাড়ির পিছনের সিটে। আর স্যাম সামনের সিটে। ধন্যাবাদ। খুবই উপকার করলেন আমাদের।

আরে এসব কিছু না। ব্রেক চাপতে গিয়ে ইঞ্জিন থেমে গিয়েছিলো আমার। রাস্তার মধ্যে থাকা ঐ অজগরটাই যত সমস্যা করেছে। কপাল ভালো যে পাহাড়ি ঢাল দিয়ে যাচ্ছিলাম। বলে একবার স্যামের দিকে তাকালো লোকটা। এদিকের রাস্তায় তো পর্যটকদের দেখা যায় না সাধারণত।

আমরাও স্ব-ইচ্ছায় আসিনি এখানে। কিংস্টন থেকে কয়েকজন বন্দুকধারী ধরে এনেছিলো আমাদেরকে।

ছিনতাই করেছে? কিংস্টনের কোথায় ছিলেন আপনারা?

রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টে। আমাদের গাড়িটাও ওখানেই আছে।

শুনে চোখ বড়ো বড়ো করে স্যামের দিকে তাকালো লোকটা। পাবলিক প্লেসের সামনে থেকে তো সাধারণত পর্যটকদের কিডন্যাপ করা হয় না।

এখন আর ওসব বলে কী হবে! তারা তাদের জিনিস পেয়ে গেছে। আর… যাই হোক, আমরা তো বেঁচে আছি। এটাই আসল কথা।

 হ্যাঁ, এটাই আসল কথা, বলে পিছন থেকে স্যামের কাঁধে হাত রাখলো রেমি।

 তো, আলোচনার বিষয় পাল্টানোর জন্য বলল স্যাম, আপনি কি জামাইকাতেই থাকেন? নাকি ভ্রমণে এসেছেন?

 ভ্রমণে এসেছি। আমার এক বন্ধু কফির চাষ করে এখানে। তার ওখানে যাওয়ার জন্যই এই জিপটা চালাই আমি। বর্ষার মৌসুমে এসব রাস্তায় কাদার পরিমাণ বেড়ে যায় অনেক।

যাত্রার বাকিটা সময় কফি চাষের জটিলতা নিয়েই বেশি কথা বলল ওরা। সাথে সাথে দ্বীপের মাছ ধরার উপযুক্ত জায়গাগুলো নিয়েও।

রেকর্ড ডিপার্টমেন্টের পার্কিং লটে পৌঁছেই প্রথমে আশেপাশের দিকে তাকালো স্যাম। এভেরির লোকেরা নেই দেখে নিশ্চিত হয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। বেরিয়েই আবারো ধন্যবাদ জানালো জিপের ড্রাইভারকে। সাথে সাথে এটাও জানালো গ্যাস বা সমস্যার জন্য লোকটা কিছু চায় কিনা।

 ওসবের দরকার নেই। নতুন অল্টারনেটরের জন্য এমনিতেও এদিকে আসা লাগতো আমার। অবশ্য একটা প্রশ্ন জানার আগ্রহ আছে আমার। আপনারা এখানে আসলে কী তথ্য জানার জন্য এসেছিলেন?

জাহাজের ঘোষণাপত্র দেখতে, স্যাম বলল, সতেরশো শতকের। আমরা যেটার জন্য এসেছিলাম ওটাই নেই এখানে।

 ওহ, আচ্ছা, শুভকামনা তাহলে, বলে ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি এগিয়ে যেতে শুরু করলো লোকটা। তারপর হঠাৎ করেই গাড়ি থামিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল, জানি না এটা আপনাদের কাজে লাগবে কিনা। হঠাৎই মনে পড়লো আমার। পোর্ট রয়েলের ফোর্ট চার্লস মেরিটাইম মিউজিয়ামে খুঁজে দেখতে পারেন একবার। শুনেছি ওখানের সংগ্রহশালা নাকি বেশ সমৃদ্ধ।

 তথ্যটার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে, বলে আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে লোকটা বিদায় জানালো ওরা। লোকটা চলে যেতেই মনে পড়লো যে কথা বলার ফাঁকে লোকটার নামই জিজ্ঞেস করা হয়নি তাদের।

 পোর্ট রয়েল যাত্রাটা আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে। এই মুহূর্তে তাদের একটা লম্বা শাওয়ার, উষ্ণ খাবার এবং ভালো একটা ঘুমের দরকার। পুনরায় অনুসরিত না হওয়ার জন্য চালাকি করে গাড়ি চালালেও, হোটেল রুমে পৌঁছানো না পর্যন্ত পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছে না স্যাম।

কপাল ভালো যে হোটেলের মিনি বারে আর্জেন্টাইন মারলটের একটা বোতল ছিলো। গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে রেমির দিকে বাড়িয়ে দিলো স্যাম। তারপর নিজের গ্লাসটা উঁচিয়ে ধরে টোস্ট করলো, মরতে মরতে কোনো রকমে বেঁচে যাওয়া এবং আমাদের লিফট দেওয়া ঐ ড্রাইভারের প্রতি…

সাথে রেমিও তার গ্লাসের সাথে আলতো টোকা দিয়ে যোগ করলো, ..এবং আগামিকাল পোর্ট রয়েলে আমাদের কাঙিক্ষত অনুসন্ধানটার প্রতিও।

****

পোর্ট রয়াল। জেলেদের এক নিরিবিলি শহর। একসময় জায়গাটা পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত শহর নামে পরিচিত ছিলো। স্প্যানিশদের হাতে গোড়াপত্তন হয়েছিলো শহরটার। ১৬৫৫ সালে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার পর, এককালের সবচাইতে কুখ্যাত শহরটাই এখন পরিণত হয়েছে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলোর একটায়। এর পিছনে জলদস্যুদের সাথে সম্পৃক্ততার অবদানও আছে। অবশ্য ১৬৯২ সালের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প না ঘটলে হয়তো শহরটা আগের মতোই কুখ্যাত থাকতো। ভূমিকম্পের কারণে শহরের অর্ধেকটাই ডুবে গিয়েছিলো সমুদ্রের তলায়। গত তিন শতক ধরে এখনো সমুদ্রের পানি ও বালির নিচে ডুবে আছে শহরের অর্ধেকটা।

ভূমিকম্পের পর টিকে থাকা কাঠামোগুলোর মধ্যে ফোর্ট চার্লস একটা। যেটাকে এখন ম্যারিটাইম মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার করায়। ফি দিয়ে ইটের দুর্গের ভিতরে ঢুকতেই উপকূলীয় বাতাসের ঝাঁপটা টের পেলো স্যাম ও রেমি। পেটালোহার গোলাগুলো এখনো সারিবদ্ধভাবে আটকে রয়েটু দেয়ালের প্রাচীরে। একসময় এগুলো দিয়েই শহরটাকে সুরক্ষা দেওয়া হতো। প্রশস্ত চতুরের ওপর দিয়ে পুরোনো নাবিকদের হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। ওখানেই গড়ে উঠেছে মিউজিয়ামটা।

ভিতরে দস্তার তৈরি বিশেষ বাক্সে প্রদর্শন করিয়ে রাখা হয়েছে জিনিসগুলো। প্রাত্যাহিক জীবনে ব্যবহৃত প্রায় সবকিছুই রাখা আছে। প্রদর্শনীতে। এগুলোর মাঝে চীনের জেড খোদাইকৃত অলঙ্কারও রয়েছে। এগুলোই পোর্ট রয়েলের ধন-সম্পদের প্রমাণ দিচ্ছে।

এটা দেখো, স্যাম, পকেট ওয়াচের একটা ছবির দিকে নির্দেশ করে বলল রেমি। এই ঘড়িটা পানি থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছিলো। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে এগারোটা তেতাল্লিশ। ধারণা করা হয়, ঐ সময়টাতেই ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিলো শহরে, এবং ভূমিকম্পের পরপরই থেমে গিয়েছিলো ঘড়ির সময়।

 চমৎকার আর্টিফ্যাক্ট। নিচে হয়তো এখনো এগুলোর অনেক কিছু পড়ে আছে।

আক্ষেপ এটাই যে জামাইকান সরকার আমাদেরকে এখানে ডাইভ দেওয়ার অনুমতি দিবে না।

 একবারে বেশি কিছু করতে চেয়ো না, রেমি। এখন সাহায্য করার মতো কাউকে খুঁজে বের করা উচিৎ আমাদের।

সত্যি বলতে সাহায্যই খুঁজে নিলো তাদেরকে। দুই মহিলাকে রুমে ঢুকতে দেখলো ওরা। তাদের মধ্যে লম্বাজন তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, শুভ সকাল। মেরিটাইম মিউজিয়ামে স্বাগতম।

শুভ সকাল, রেমি বলল। আমরা আশা করছি আপনারা হয়তো গবেষণার কাজে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবেন।

শুনে মুচকি হাসলো মহিলা।

আমাদেরকে বলা হয়েছিলো যে আপনাদের কাছে পুরোনো জাহাজের ঘোষণাপত্রের কপিগুলো আছে। বিশেষ করে বললে ১৬৯৪ থেকে ১৬৯৬ এর গুলো।

না। আমরা খুবই দুঃখিত। আপনারা কি কিংস্টনের আর্কাইভে খুঁজে দেখেছেন?

দুর্ভাগ্যবশতঃ ঐ বইটা সম্পূর্ণ ছিলো না। আমাদেরকে একজন জানালো আপনাদের কাছে হয়তো ওটার কপি থাকতে পারে।

আমার জানামতে নেই। এর জন্য আবারো ক্ষমা চাইছি আমি।

আচ্ছা, ধন্যবাদ, বলে মহিলাকে বিদায় জানালো ওরা।

মহিলা চলে যেতেই স্যাম বলল, ভালো চেষ্টা করেছে। হয়তো সেলমা এতক্ষণে কিছু বের করে ফেলেছে।

দুজনই জানে এটা শুধুই একটা সান্ত্বনাবাণী মাত্র। সেলমা কিছু পেয়ে থাকলে এতক্ষণে তাদেরকে জানিয়ে দিতো।

নাই মামার চেয়ে তো কানা মামা ভালো, স্যাম বলল।

কানা মামা আছে কোনো?

আমরা তো এখন চাইলে আমাদের ছুটিটা নিতে পারি।

শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হাসলো রেমি। হাসলেও চোখ থেকে হতাশার ছাপটা দূর করতে পারছে না। চলো, বাসায় ফিরে যাই।

 বেরিয়ে আসতে যাবে, ঠিক তখনই দ্বিতীয় মহিলা তাদের দিকে এগিয়ে এসে নিচু কণ্ঠে বলল, আপনার কথাগুলো শুনতে পেয়েছি আমি। পুরোনো জাহাজগুলো ঘোষণাপত্র খুঁজছেন আপনারা?

হ্যাঁ, স্যাম জবাব দিলো।

কিংস্টনের আর্কাইভ ডিপার্টমেন্ট পুরোনো সব রেকর্ডকে ডিজিটাল কপিতে পরিণত করতে চেয়েছিলো, কিন্তু বাজেটের কারণে সম্ভব হয়নি। আমাদের কপাল ভালো যে টাকা ফুরিয়ে যাবার আগেই কিছু কপি স্ক্যান করে ফেলতে পেরেছিলাম। ডিরেক্টদের একজন মিউজিয়ামের জন্য ওগুলোর রিপ্রিন্ট করার আশা করছে। তবে ভূমিকম্পের ঠিক পরের কয়েকবছরের কপি ছাড়া আর কিছুই নেই।

ভূমিকম্পের পরের কয়েক বছরের কপি? আশাবাদী কণ্ঠে বলে উঠলো রেমি। কোন কোন বছরের?

ষোলশো তিরানব্বই থেকে ষোলশো ছিয়ানব্বইয়েরগুলোই আছে শুধু।

 প্লিজ, ওগুলোই দেখান আমাদের, বলল রেমি।

.

২৯.

রাস্তার অপর পাশ থেকে স্বামীর গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছে আলেক্সান্দ্রা এভেরি এবং ভাড়াটে পার্সোনাল ইনভেস্টিগেটর কিপ রজার্স। চার্লসের বেরিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে প্রায়, ভাবতেই চার্লস এভিরেকে অফিস বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলো আলেক্সান্দ্রা। লোকটার সাথে তার স্বঘোষিত ক্লায়েন্টও আছে।

দ্রুততার সাথে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলো কপি। দেখতে তো বেশ, ঐ মেয়েটা।

 ওরা সবাই দেখতে বেশ, বলল আলেক্সান্দ্রা। চার্লস কিভাবে তার মেয়ের বয়েসী কারো সাথে ডেট করতে সেটা কখনো ভেবে পায় না সে। অবশ্য চার্লস কখনোই তার সন্তানদের সাথে অতোটা ঘনিষ্ঠও ছিলো না। বাচ্চাকালে নিজের কাছে রাখার চেয়ে বেবিসিটারের কাছেই রাখতো বেশি। তারপর বয়স বাড়তেই পাঠিয়ে দিয়েছিলো বোর্ডিং স্কুলে। আলেক্সান্দ্রা সবসময়ই সপ্তাহান্তে গিয়ে দেখা করতো তাদের সাথে, ফোনে খোঁজ নিতো। আর চার্লস দূরত্বটাকেই বেশি পছন্দ করতো, বলতো এতে নাকি বাচ্চাদের চরিত্র বিকশিত হবে।

আর এখন, চার্লসই অবাক হয়, কেন তার সন্তানরা কখনো তার সাথে কথা বলে না ভেবে।

আপনার কাজে লেগে যাওয়া উচিৎ, চার্লসের গাড়ি রাস্তার মোড় ঘুরে হারিয়ে যেতে দেখে বলল কিপ।

মাথা ঝাঁকালো আলেক্সান্দ্রা। অফিসে পৌঁছে তোমাকে ফোন দিবো আমি।

আমি আছি এখানেই।

বলে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পেরিয়ে অফিসের দিকে পা বাড়ালো আলেক্সান্দ্রা। সে কী করতে যাচ্ছে সেই ব্যাপারে যদি চার্লসের বিন্দুমাত্রও ধারণা থাকতো, তাহলে সে কখনোই অফিসে ঢোকার সুযোগ পেতো না। আর তাছাড়া আগের সপ্তাহে বেশ কয়েকবার এখানে আসার কারণে গার্ডরাও তাকে চিনে ফেলেছে ভালোভাবে।

সবাই তাকে বিরক্তিকর, যন্ত্রণাদায়ক এবং শীঘ্রই সাবেকে পরিণত হতে যাওয়া এক মহিলা ভাবে। শেষ অংশটা সত্য। শীঘ্রই চার্লসের সাবেক পত্নীতে পরিণত হয়ে যাবে সে। যাই হোক, এতে করে এই মুহূর্তে তার এখানে অনবরত আসাটাকে অদ্ভুতভাবে দেখবে না কেউ। যদিও সে নিশ্চিত না, তারপরও এটা বুঝতে পারছে যে তার স্বামী এখন সচারচর কোম্পানি কিনে ফতুর করার ব্যবসা থেকে অন্য কিছু নিয়ে মেতে আছে। নিশ্চিতভাবেই কোম্পানি ফতুর করার ব্যবসা দিয়েই নিজের সাম্রাজ্য দাঁড় করিয়েছে চার্লস। তবে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সে খেয়াল করছে তার স্বামী শুধু টাকা বাড়ানোর জন্যই এটা করে না, বরং মানুষের জীবন ধ্বংস করাটাও বেশ উপভোগ করে লোকটা।

এমন না যে সে তার স্বামীর চেয়ে খুব ভালো কেউ। মানুষটাকে তো সে তার টাকার জন্যই বিয়ে করেছিলো। অবশ্য পরবর্তীতে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার আচরণেরও পরিবর্তন ঘটে। ধীরে ধীরে ন্যায়বোধ, বিবেকের জন্ম নেয় ওর মাঝে। খুব সম্ভবত সন্তানদের ওপর এই ধরনের জীবনযাপনের প্রভাব দেখেই কিছুটা বদলে যায় ও।

 সন্তানদের জন্য বদলে যাওয়ার ভাবনাটা বেশ ভালো লাগলেও বদলানোর কারণটা ঠিকই ভালোভাবে জানে আলেক্সান্দ্রা। স্বামীর সম্পদ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার শঙ্কাও আছে তার মনে। তাদের বিবাহিত সময়কালে স্বামীর অর্জন করা সম্পদের ওপর থেকে অধিকার ছাড়ার কোনো ইচ্ছা নেই তার। এজন্যেই আইনজীবীদের দলে কিপকেও ভাড়া করেছে ও।

যতক্ষণ পর্যন্ত তার শরীরে এক রত্তি শ্বাস টিকে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত চার্লসকে তার অধিকারের সম্পদ নিয়ে পালিয়ে যেতে দিবে না।

অবশ্য শ্বাস টিকিয়ে রাখাটা বেশ কঠিন একটা কাজ তার জন্য। গত কিছুদিন ধরে চার্লস যেভাবে আচরণ করছে তাতে চার্লসের কবল থেকে তার বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। নিশ্চিতভাবেই চার্লস তার সাম্রাজ্যকে নিজের কাছে। রাখার জন্য কোনো না কোনো উপায় খুঁজছে।

যাই হোক, এখন তাকে প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে চার্লস কিছু একটা লুকিয়ে রাখছে অন্যদের কাছ থেকে। এবং সে এতে পুরোপুরি নিশ্চিত যে প্রমাণ পাওয়া গেলে সেটা একমাত্র চার্লসের অফিসেই পাওয়া যাবে।

ভাবতে ভাবতেই লবিতে এসে দাঁড়ালো আলেক্সান্দ্রা। সে এসে দাঁড়াতেই ডেস্কে কাজ করা সিকিউরিটি গার্ড তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, একটু আগেই আপনার স্বামী বেরিয়ে গেছে, মিসেস এভেরি।

আমার সেলফোনটা নিশ্চয় ডেস্কে রেখে যায়নি, তাই না?

 না, ম্যাম।

মনে হয় তার অফিসেই ফোনটা ফেলে রেখে এসেছি। আমিই গিয়ে নিয়ে আসছি। আর আমার ফিরতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। কয়েকটা ফোন কল করতে হবে আমার।

কিছু না বলে আস্তে করে মাথা ঝাঁকালো গার্ড লোকটা। তারপর আবারো ফিরে গেলো তার মনিটরে চোখ রাখার কাজে।

 যাক, এতে অন্তত দেরি হলেও সে কিছু সন্দেহ করবে না, ভেবে পেন্টহাউজে যাওয়ার এলিভেটরের দিকে পা বাড়ালো আলেক্সান্দ্রা।

চার্লসের সেক্রেটারিও চলে গেছেন। তাই অফিসের সামনের লবিটাও পুরোপুরি খালি হয়ে আছে। পারফেক্ট। অবশ্য চার্লসের অফিসের দরজাটায় ঠিকই তালা দেওয়া। চাবির সেট বের করে আনলো আলেক্সান্দ্রা। সবগুলোই ডুপ্লিকেট চাবি। যেসব রুমকে গুরুত্বপূর্ণ চার্লস তার থেকে আড়াল করে রাখতে চায় সেসব রুমের চাবিই এগুলো।

 লোকটা কত চেষ্টাই করছে, কিন্তু লাভ হচ্ছে না…যদি খালি সে এই চাবির সেটের কথাটা জানতো….

 চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে অফিসে ঢুকলো আলেক্সান্দ্রাতখনই গুপ্ত ক্যামেরার বিষয়টা মাথায় এলো ওর।

তবে এটা কোনো কাজে দিবে না। সে যতোটা জানে, কোম্পানির অর্ধেক মালিকের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগে মামলা করাটা প্রায় অসম্ভব কাজ।

ভিতরে ঢুকেই কাজে লেগে গেলো আলেক্সান্দ্রা। প্রথমেই ডেস্ক ড্রয়ারগুলো খুলে খুলে দেখছে। লোকটা খুবই পরিপাটি মানুষ। সবকিছুই একদম নিখুঁতভাবে সাজিয়ে রাখে। নিশ্চিতভাবেই লুকিয়ে রাখার মতো কোনো কিছু একদম সরাসরি নজরে পড়ার মতো কোনো সাধারণ জায়গায় রাখবে না। এটা ভেবেই চার্লসের চেয়ারটায় বসে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আলেক্সান্দ্রা। অফিসের কোনার টেবিলের ওপর থাকা ম্যাপ বইটাই শুধু চোখে পড়লো তার। এই বইটা নিয়ে খুবই মোহাগ্রস্ত হয়ে আছে চার্লস।

উঠে গিয়ে বইটা হাতে নিলো ও বইটার মধ্যে কী এমন আছে যার জন্য লোকটা এতো পাগল হয়ে গেছে? দেখে বইটাকে খুব একটা বিশেষ কিছু মনে হলো না আলেক্সান্দ্রার কাছে। দেখতে তাদের লাইব্রেরিতে থাকা পুনর্মুদ্রিত বইটার মতোই দেখাচ্ছে। মলাট উল্টে বইয়ের ভঙ্গুর পাতাগুলো দেখেই পার্থক্যটা বুঝতে পারলো। তবে আকর্ষণ পাওয়ার মতো কিছুই নেই বইটাতে। এই ভেবে বইটা বন্ধ করতে যাবে, তখনই দেখলো যে কেউ একজন পেন্সিল দিয়ে বর্ডারের দিকে কিছু চিহ্নের ওপর গোল দাগ দিয়ে রেখেছে। চিহ্নগুলোকে দেখতে একটু অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে যেন…

ওগুলো কি কোনো বর্ণ?

আসলেই ওগুলো বর্ণ। প্রাচীন-ধাচের বর্ণগুলোকে দেখতে অনেকটা দক্ষ হাতে থাকা চিত্রের মতো দেখাচ্ছে।

তো, এগুলোর ওপর গোল দাগ দেওয়া কেন?

ভেবে ভালো করে দেখার জন্য আরো কাছে কুঁকলো আলেক্সান্দ্রা। ঠিক তখনই বেজে উঠলো তার ফোন।

কাউচে রাখা পার্সটার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফোনটা বের করে আনলো আলেক্সান্দ্রা। কিপ কল করেছে। কল রিসিভ করে বলল, কপাল ভালো নিচে থাকার সময় ফোন দাওনি তুমি।

ফোন সাইলেন্ট করা না আপনার? ওসবের কথা মনে থাকে কার?

আপনার অন্তত থাকা উচিৎ। যেহেতু আপনি আপনার স্বামীর অফিসে চুরি করে ঢুকেছেন, তাই সতর্ক থাকা জরুরি। অফিসে পৌঁছে তো আপনার আমাকে ফোন করার কথা ছিল।

 তুমি যদি আমার জায়গায় থাকতে-আসলে তোমাকে এই কাজের জন্যই ভাড়া করেছি আমি-তাহলে এটা নিয়ে এতো দুঃশ্চিন্তা করার সুযোগ পেতে না।

 ঠিক বলেছেন। তবে আপনার স্বামীর অফিসে আপনি খোঁজাখুঁজি করলে সেটা নিয়ে কেউ সন্দেহ করবে না। আমার মতো অপরিচিত কেউ করতে গেলেই সন্দেহের উদ্রেক হবে। আর তাছাড়া কোনটা মানানসই আর কোনটা বেমানান সেটাই বা আপনার থেকে ভালোকরে জানে কে? তো, যাই হোক, খুঁজে পেয়েছেন কিছু?

এখনো না। শুধু একটা জলদস্যুর বই পেয়েছি মাত্র। তার দাবি এটা নাকি পূর্বপুরুষদের থেকে চুরি গিয়েছিলো।

অরিজিনাল বইটা পেয়েছেন?

 হা। অবশ্য বইটায় কৌতূহল জাগানোর মতো কিছুও আছে, বলে টেবিলে রাখা হলুদেটে কাগজগুলোর দিকে তাকালো আলেক্সান্দ্রা। কেউ একজন বইয়ের বর্ণগুলোর ওপর গোল দাগ দিয়ে রেখেছে। বর্ণগুলোও দেখতে কিছুটা অন্যরকম। অনেকটা গুপ্তসংকেতের মতো।

তার মোহের কারণটা বুঝা যাচ্ছে। আপনি ওগুলোর ছবি তুলে নিয়ে আসুন। আমি চেক করে দেখবো। আপনি কি উনার কম্পিউটারটা দেখেছেন?

না। এখনো না।

দ্রুত করুন তাহলে। এমনিতেই অনেক সময় পেরিয়ে গেছে।

তার সাথে থাকা আইটেমটাকে তো দেখেছো? আমার মনে হয় না খুব শীঘ্রই তার ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে।

যাই হোক, ঝুঁকি নেওয়া উচিৎ হবে না তবুও। জলদি করুন।

কল কেটে দ্রুত বইয়ের প্রতিটা পাতার ছবি তুলতে শুরু করলো আলেক্সান্দ্রা। তার মন বলছে, চার্লসের গোপনীয় কাজটার সাথে এগুলোর অবশ্যই কোনো সম্পর্ক আছে।

ছবি তোলা শেষে ল্যাপটপটা চালু করলো। ল্যাপটপ পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড থাকলেও, পাসওয়ার্ডটা জানে ও। চার্লস প্রায় সবকিছুতেই এই পাসওয়ার্ডটা ব্যাবহার করে। পাসওয়ার্ডের ঘরে Pirate লিখতেই লকটা খুলে গেছে। লকটা খুলে যেতেই কম্পিউটারের ফোল্ডারগুলো ঘেটে দেখতে শুরু করছে ও।

আগ্রহ জাগানোর মতো কিছুই নেই ফোল্ডারগুলোতে।

আলেক্সান্দ্রা জানে সে কিছু একটা মিস করছে। কী মিস করছে ভাবতে ভাবতে চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার তাকালো অফিসের চারপাশে।

ঠিক তখনই তার নজর পড়লো টেবিলে থাকা নোটপ্যাডটার দিকে। প্যাডের ওপরের কাগজটা অবশ্য ছিঁড়ে নেওয়া, তারপরও কাগজে লেখা ফার্গো শহরের নামটা এখনো মনে আছে তার। কথাটা মনে পড়তেই ইন্টারনেটে ফার্গো লিখে সার্চ দিলো। নর্থ ডাকোটায় চার্লস কী করছে সেটা সে কোনোভাবেই ভেবে বের করতে পারছে না।

তবে ইন্টারনেট সার্চ হিস্টোরিতে নর্থ ডাকোটার ব্যাপারে কিছুই নেই।

তার বদলে রয়েছে ফার্গো গ্রুপ, স্যাম ফার্গো, রেমি ফার্গো জাতীয় কিছু নাম।

হোয়াট দ্য…?

আরো কিছুটা ঘাটাঘাটি করতেই ফার্গো দম্পতিদের ওপর চার্লসের আগ্রহের কারণটা ধরতে পারলো ও।

ফার্গোরা আসলে গুপ্তধন শিকারী।

 ঠিক তখনই আবার ফোন বেজে উঠলো তার। অবশ্যই, কিপের কল এটা। ফোন ধরেই সে বলল, তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না এটা। চার্লস কিসের পিছে লেগেছে তা জেনে গেছি আমি।

দ্রুত বেরিয়ে আসুন ওখান থেকে। আপনার স্বামী ফিরে এসেছে।

.

৩০.

পরদিন সকালে সেলমার কল পেয়ে স্যাম জিজ্ঞেস বলল, আশা করছি ভালো কোনো সংবাদ দিতে পারবে।

আগের দিন পোর্ট রয়েল থেকে ডিজিটাল কপিটা নিয়েই পাতাগুলো সেলমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো স্যাম। সেলমা আসলে এইগুলোরই আশা করছিলো। এতে জামাইকা থেকে ছেড়ে যাওয়া জাহাজগুলো নিয়ে গবেষণা করতে সুবিধা হয়েছে ওর।

আমিও, সেলমা বলল, স্নেক আইল্যান্ডে ডোবা জাহাজ এবং জামাইকায় ক্যাপ্টেন ব্রিজম্যানের কার্গো থেকে চুরি যাওয়া জাহাজ দুটোর মধ্যে সংযোগসূত্র পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো, ডুবে যাওয়া জাহাজের নামটা আসলে অনেকগুলো শূন্যস্থানই পূরণ করে দিয়েছে। বিশেষ করে এখন আমরা নিশ্চিত জানি যে সাইফার হুইলটা ঐ জাহাজের সাথে করেই ডুবেছিলো।

কিভাবে জানলে এটা? স্যাম জানতে চাইলো।

ব্রিজম্যান আসলে পাইরেট হেনরি এভোরির আরেক নাম ছিলো।

এভোরি? রেমি বলে উঠলো। এভেরি আর এভোরি শব্দ দুটো প্রায় একই রকম শোনাচ্ছে। এটা কি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার?

না, সেলমা জানালো। ভুল উচ্চারণের কারণে নামটা বদলে গেছে। তবে বেশিরভাগ নথিপত্রেই দুটো নামই ব্যবহার করা হয়েছে। হেনরি এভোরি বা এভেরি, যেটাই বলেন না কেন-আসলে এই লোকই ছিলো ক্যাপ্টেন হেনরি ব্রিজম্যান। প্রথমে দাস ব্যবসায়ী ছিলো, তারপর একসময় জলদস্যুতে পরিণত হয়। অবশ্য আমার দৃষ্টিতে দুটো আসলে একই জিনিস।

তো, কী হয়েছিলো তার? স্যাম জিজ্ঞেস করলো।

গায়েব হয়ে গিয়েছিলো পুরোপুরি। সর্বশেষ বাহামাসে দেখা গিয়েছিলো তাকে। ধারণা করা হয় এরপর ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাকি জীবন সেখানেই লুকিয়েছিলো। ঐ সময়টায় ওয়ান্টেড অপরাধীদের একজন ছিলো লোকটা। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই পৃষ্ঠাগুলো ছাড়া কিন্তু অন্য কোথায়ই ব্রিজম্যান বা ফ্যান্সির জামাইকা যাত্রা করার কোনো তথ্য নেই। স্পষ্টতই, চার্লস এভেরি এই তথ্যটা আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছিলো।

এছাড়া আর কী কী লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছে?

দুটো জিনিস। এক, এভোরির প্রথমবার মিরাবেল আক্রমণ করার ব্যাপারটা। দুই, মিরাবেলর প্রতি আগ্রহ থাকা ইংরেজ বিনিয়োগকারীদের পরিচয়।

বিনিয়োগকারীদের? মানে, জাহাজের মালিক সংখ্যা একের থেকে বেশি?

মালিক আসলে একজনও হতে পারে। তবে কয়েকজন বিনিয়োগকারী থাকার অর্থ মনে হচ্ছে, জাহাজের ক্ষমতা আসলে বেশ কয়েকজনের হাতে ছিলো। আর ক্রু মেম্বারের বক্তব্য থেকে আমরা যেটা জানতে পেরেছি স্পেনের উপকূলে প্রথমবার মিরাবেল আক্রমণের সময় এভোরি একটা জিনিস ছিনিয়ে নিয়েছিলো। ধরে নিচ্ছি সাইফার হুইলটাই কেড়ে নিয়েছিলো। এই আক্রমণটা হয়েছিলো জামাইকার ঘটনার আরো কয়েক বছর আগে। বক্তব্য থেকে জানা গেছে, এভোরি নাকি জাহাজের প্রতিটা কোনা খুঁজে খুঁজে দেখেছিলো। এর মানে সে আগে থেকেই জানতো যে হুইলটা ঐ মিরাবেলেই আছে। আর তাছাড়া জাহাজটা ধ্বংস বা নিজের জলদস্যু না ভিড়িয়ে ওটাকে ছেড়ে দিয়েছিলো এভোরি। এমনকি জাহাজের ক্যাপ্টেন বা ক্রুদেরও কাউকে হত্যা করেনি।

দ্রুত ওখান থেকে চলে যেতে চাইছিলো, স্যাম বলল। আর দ্বিতীয় আক্রমণটা হয়েছিলো জামাইকাতে?

 মিরাবেল আসলে তাকে অনুসরণ করে গিয়েছিলো ওখানে। বক্তব্য অনুযায়ী, জামাইকাতে এভোরির থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা চুরি হয়েছিলো বলে জানা গেছে। এরপর মিরাবেল পালিয়ে যায়। ধরে নিচ্ছি সাইফার হুইলটা নিয়েই পালিয়েছিলো। ফ্যান্সির ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময়ই স্নেক আইল্যান্ডে ডুবে যায় জাহাজটা। আর এরপরের ইতিহাস তো আপনারা জানেনই। মিরাবেলের সাথে সাথে হুইলটাও হারিয়ে গিয়েছিলো এভোরির নাগাল থেকে। খুব সম্ভবত এই কারণেই পরবর্তীতে জলদস্যুতা ছেড়ে দিয়েছিলো লোকটা।

ইতিহাস বলছে ঐ সময়ের পর হেনরিকে আর দেখা যায়নি, স্যাম বলল! যদি এটাই হয়ে থাকে, তাহলে এটাও তো ধরে নেওয়া যায় যে সে মিরাবেলকে আটকাতে পেরেছিলো। তাই না? হয়তো পাথরে ধাক্কা খেয়ে জাহাজের সাথে সাথে সেও ডুবে গিয়েছিলো পানিতে। এমনটার কি সম্ভাবনা নেই?

 যৌক্তিক ধারণা, সেলমা জানালো। তবে স্নেক আইল্যান্ডের ঠিক কোথায় সাইফার হুইলটা খুঁজতে হবে এটার ম্যাপ কিন্তু অন্য কথা বলছে। ম্যাপটা দেখে মনে হচ্ছে এভোরি হুইলের সঠিক স্থানটা মনে গেঁথে নিয়ে ফিরে এসেছিলো। হয়তো পরবর্তীতে গিয়ে ওটা তুলে আনার ইচ্ছা ছিলো তার। তবে, লোকটার ভাগ্য খারাপ ছিলো। তার ব্রিজম্যান ছদ্মনামটা ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো তখন। রয়েল নেভির সাথে সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও ধাওয়া করছিলো তাকে। খুব সম্ভবত এরজন্যেই এভোরি স্নেক আইল্যান্ডে আর কখনো ফিরে যেতে পারেনি। কিছু ইতিহাসবিদের মতে, সে ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছিলো এবং গুপ্তসম্পদ তুলতে না পারায় কাঙাল হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলো। লাযলোর ধারণা ইংল্যান্ডে ফিরে লোকটা তার বাকি থাকা সমস্ত অর্থ খরচ করেছিলো মূল সাইফার হুইলটা খোঁজার পিছনে। এই কারণেই শেষমেশ কাঙালে পরিণত হতে হয়েছিলো তাকে।

আমরা কি নিশ্চিত যে সে কখনো মূল সাইফার হুইলটা বের করতে পারেনি? আর, তাছাড়া এটার কি আসলেই কোনো অস্তিত্ব আছে? বলল রেমি।

 পুরোপুরি নিশ্চিত বলা যায়, সেলমা জানালো। প্রথমত, হেনরি এভোরি যদি সাইফার হুইলটা হাতে পেয়ে যেতো, তাহলে চার্লস এভেরি কখনোই এটার পিছনে লাগতো না। লোকটা তার পরিবারের ইতিহাস সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানে। আর দ্বিতীয়ত, লায়লোর গবেষণা কনফার্ম করছে যে আসলেই এটার অস্তিত্ব আছে। এটা দখল করার আগেই এভোরি-ব্রিজম্যান হয় মারা গিয়েছিলো নয়তো ধরা পড়ে গিয়েছিলো রয়েল নেভির হাতে। তবে, এই সাইফার হুইলটা কোথা থেকে এসেছিলো বা এটা মালিক কে ছিলো সেটার ব্যাপারে সে কিছু বলে যায়নি। ধরে নিচ্ছি, সে এই তথ্যগুলো জানতো। যাই হোক, চার্লস এভেরিও এই ঘোষণাপত্রগুলো পেয়ে গেছে এখন। কোনো সন্দেহ নেই যে সেও এখন এটার পিছে লেগেছে।

হাত বাড়িয়ে মেরিটাইম মিউজিয়াম থেকে আনা ডিজিটাল কপিটা টেনে এনে ওটার দিকে তাকালো স্যাম। কিংস্টনের আর্কাইভে পড়া কোর্টের বক্তব্যের কয়েকটা পৃষ্ঠাই শুধু আছে এখানে। তো, সে এই সাইফার হুইলটা প্রথমে কার থেকে চুরি করেছিলো সেটা জানা এখনো বাকি আছে আমাদের?

 ঘাটাঘাটি করে মিরাবেল-এর দুজন বিনিয়োগকারীর পরিচয় বের করেছি আমরা। দুজনই ইংল্যান্ডে থাকতো। তারমানে ধরে নেওয়া যায় যে জাহাজটাও ইংল্যান্ডেরই ছিলো। তো, পরবর্তীতে ওখানেই যেতে হবে আপনাদের।

রেমির দিকে তাকালো স্যাম। তো, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে যাত্রার ব্যাপারে কী মত তোমার?

কোনো অমত নেই। বছরের এই সময়ের ব্রিটেন আমার বেশ ভালোই লাগে।

****

পরদিন বিকালের দিকে লন্ডন সিটি এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌঁছালো ওরা। রাতটা বিশ্রাম তার পরদিন খুব সকাল সকাল কাজে লেগে গেলো আবার। সেলমা তাদেরকে দুটো নাম ও ঠিকানা দিয়েছে। একজন গ্রেস হারবার্ট, ব্রিস্টলের ঠিক পাশেই থাকে মানুষটা। অন্যজন হ্যারি ম্যাকগ্রেগর, থাকে কিছুটা দূরের নটিংহামের উত্তরে। তবে তাদের কার কাছে গেলে সুবিধা হবে সেই ব্যাপারের কিছুই বলতে পারেনি সেলমা। তাই গাড়ির জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে আগে কোথায় যাবে সেটা নির্ধারণের জন্য কয়েন দিয়ে টস করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো স্যাম। হেডস আসলে হারবার্টের ওখানে যাবো। টেইলস আসলে ম্যাকগ্রেগরের ওখানে, বলে কয়েনটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার খাবলে ধরলো স্যাম।

 হেডস আসুক, রেমি বলল। আমার মন বলছে ব্রিস্টলে গেলে হয়তো কিছু পাওয়া যাবে।

 যদি ওখানে আমাদের আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটা না পাই, তাহলে কিন্তু তখন অনেক দূরের নটিংহামে যেতে হবে।

 মহিলাদের অনুমানশক্তি হিসেবে ভেবে নাও এটাকে। আমি ব্রিস্টলের পক্ষে, হেডস আসুক।

 হাত খুলে কয়েনটার দিকে তাকালো স্যাম। টেইলস। দেখেই কয়েনটা পকেটে ভরে রেমির দিকে তাকিয়ে বলল, এভাবে খেলার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো মানে হয় না। তোমার অনুমানের প্রতি বিশ্বাস আছে আমার।

টেইলস এসেছে, তাই না?

গাড়ি এসে যাওয়ায় প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে স্যাম বলল, তুমি চালাও, আর আমি দিক নির্দেশনা দিই। ঠিক আছে?

কী! আমি নাহয় ড্রাইভ করলাম, কিন্তু তুমি যে ম্যাপের দিকে মনোযোগ রাখবে সেটা কিভাবে বিশ্বাস করবো?

কখনো কি ভুল নির্দেশনা দিয়েছি আমি?

একবার কিন্তু…

বাদ দাও, বলে ভত্যকে বখশিস দিয়ে গাড়ির চাবিটা নিয়ে নিলো স্যাম।

লন্ডনকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। ধীরে ধীরে রাস্তার পাশের দালানের সংখ্যা কমছে, সেই সাথে বাড়তে শুরু করেছে খামারের সংখ্যাও। মৃদু কুয়াশাও পড়তে শুরু করেছে। উইন্ডশিল্ডের ওয়াইপার চালু করে নিলো স্যাম। পরের দুই ঘন্টা এই কুয়াশার ভিতর দিয়েই এগিয়ে গেলো ওরা।

পাহাড়ের ঢালের সবুজ দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেমি। খুবই মনোরম একটা জায়গা।

হ্যাঁ, যদি কুয়াশাচ্ছন্ন শীতলতা তোমার পছন্দ হয় আর কী!

শুনে স্যামের দিকে তাকিয়ে রেমি বলল, এটার থেকে কি জামাইকার ঐ উত্তপ্ত আবহাওয়াই পছন্দ তোমার?

লা জোলার উষ্ণ বায়ুর আবহাওয়াই বেশি পছন্দ আমার।

জবাব না দিয়ে ফোনের পর্দার দিকে তাকালে রেমি। সোজা পথে আরো দশ মাইল পর একটা মোড় পাবে। মোড়ে গিয়ে ডানে বাঁক নিবে।

 বাক নিয়ে খোয়া বিছানো দুই লেনের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। এভাবেই আরো কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর অবশেষে হারবার্টদের খামার বাড়িটা চোখে পড়লো ওদের। একটা বড়ো কটেজ এবং কিছু ছোটো ছোটো দালানে গড়ে উঠেছে বাড়িটা। কটেজের চিমনি দিয়ে ধোয়া বেরুচ্ছে।

 পার্ক করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। নুড়ি বিছানো ড্রাইভওয়েটা ক্রস করে গিয়ে নক করলো দরজায়। এক মহিলা এসে খুললো দরজাটা। মহিলার বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি, বাদামি চুলগুলো ছোটো ছোটো করে ছাঁটা, কপালের দিকের চুলগুলো কিছুটা ধূসর বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। চোখগুলোও কিছুটা ধূসর। দরজা খুলে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা নিশ্চয় ফার্গো দম্পতি?

হ্যাঁ। আপনিই মিসেস হারবার্ট? বলল স্যাম।

আসলে, হারবার্ট-মিলার। তবে আমাকে গ্রেস বললে ডাকলেই খুশি হবো। আসুন, ভিতরে আসুন। চা চলবে? কেটলি চুলোতেই বসানো আছে।

অবশ্যই, বলল রেমি।

বলে তাদেরকে নিয়ে বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে গেলেন মহিলা। তারা রুমে গিয়ে বসার কিছুক্ষণ পরই চীনামাটির চায়ের কাপসহ একটা রুপালি ট্রে নিয়ে ফিরে এলেন আবার। লম্বা ভ্রমণের পর স্যাম আসলে এই মুহূর্তে একটা কড়া কফির আশা করছিলো, তবে তারপরও চায়ে আপত্তি জানালো না। দুধ চিনি ছাড়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিসেস হারবার্ট-মিলারের কথা শুনছে। নিজেকে ঐতিহাসিক সম্পদসমূহেরর উত্তরাধিকারিণী হিসেবে আবিষ্কারের পর চমকে যাওয়ার অভিজ্ঞতার ব্যাপারে জানাচ্ছেন মহিলা।

হুট করেই একদিন একটা কল এলো, চায়ের কাপে চিনি নিয়ে নাড়তে নাড়তে বলছেন মহিলা। সেটাও আবার লন্ডনের এক সলিসিটরের কল। কল দিয়ে জানতে চাইলো আমি মিলফোর্ড হারবার্টসের গ্রেস হারবার্ট কিনা। বলে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে নিলেন মহিলা। স্বাভাবিকভাবেই ঐসব সম্পদ বিক্রির তালিকায় তুলে দিয়েছিলাম আমরা। পুরোনো শীতল একটা দুর্গে গিয়ে। থাকার কথা চিন্তাও করতে পারি না আমি। যদিও মিলফোর্ড খুবই সুন্দর একটা জায়গা। এমনটাই শুনেছি আমি। তবে আমার মনে হয় না আমি চাইলেও আমার স্বামীকে ওখানে গিয়ে থাকার ব্যাপারে কখনো রাজি করাতে পারব কিনা।

জায়গাটা আসলেই সুন্দর, রেমি বলল। অনেক বছর আগে আমি একবার গিয়েছিলাম ওদিকে।

স্যাম অবশ্য আলোচনাটা আরো দ্রুত সারতে চাচ্ছে। তাই বলল, ওখানে কি ঐতিহাসিক মর্যাদাসম্পন্ন কিছু চোখে পড়েছে আপনার? অবশ্যই, ঐ দুৰ্গটা ছাড়া।

 আমি আসলে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না। সব কিছুই ভাগাভাগি করা হয়ে গেছে। উত্তরাধিকার সূত্রে আমি দুৰ্গটা পেয়েছি, আর আমার নটিংহামের কাজিন হ্যারি ম্যাকগ্রেগর পেয়েছে ওখানের কিছু ভূসম্পত্তি পেয়েছে। খুব সম্ভবত সে হয়তো কিছু জানলে জানতে পারে। অবশ্য আমার মতো সেও ঐতিহাসিক মর্যাদার সবকিছু মিউজিয়ামে দিয়ে দিয়েছে। মিউজিয়াম বেশ আগ্রহের সাথেই গ্রহণ করে নিয়েছে ওগুলো। যদিও পরে জানা গেছে যে স্যার এডমুন্ড হারবার্ট আসলে নাজায়েজ সন্তান ছিলেন। বলে বিস্কুটের প্লেটটা হাতে তুলে নিলেন মিসেস হারবার্ট-মিলফোর্ড। কুকি?

 স্যাম তুলে নিলো একটা বিস্কুট। ধন্যবাদ। তবে রেমি নিলো না একটাও।

প্লেটটা আবার টেবিলের কোনায় রেখে মহিলা বললেন, আমার কাজিন আর আমি যে আসলেই আত্মীয় এটার প্রমাণ বলতে শুধু একটা পারিবারিক বংশলতিকার বইই আছে আমার কাছে। অন্যান্য জিনিসগুলোর সাথে বইটাও আমার ভাগে পড়েছিলো। যদি বংশলতিকাটা আমি ঠিকমতো পড়ে থাকি তাহলে আমরা মায়ের দিক থেকে জ্ঞাতি ভাই-বোন এবং পরিবারের সর্বশেষ পুরুষ উত্তরাধিকারের বংশধর।

ঐতিহাসিক জিনিসগুলোর কি কোনো তালিকা আছে আপনার কাছে? স্যাম জানতে চাইলো।

 হ্যাঁ, আছে। আপনারা দেখতে চান?

হ্যাঁ, অবশ্যই।

টেবিল থেকে উঠে পাশের রুমে বিলের হিসাব করতে থাকা সেক্রেটারি কাছ থাকে একটা ম্যানিলা খাম নিয়ে এলেন মিসেস হারবার্ট-মিলার। তারপর খাম থেকে একটা কাগজের গোছা বের করে এনে তুলে দিলেন স্যামের হাতে। আসলে খুব বেশি কিছু ছিলো না। সবই নিলামের জন্য তুলে দেওয়া হয়েছিলো। মনে হয় খুব সম্ভবত তাদের কাছে সবগুলো জিনিসের ছবি তোলা আছে। ছবিগুলো এখনো আমাকে দেওয়া হয়নি।

স্যামের দিকে ঝুঁকে কাগজগুলোর দিকে তাকালো রেমি। দেখে বলল, তালিকাটা কিন্তু খুব একটা ছোটোও নয়।

ভেবে দেখুন, আমার মতো একজনের বৈঠকখানায় হাপসিকর্ড (বাদ্যযন্ত্র) থাকলে কেমন বিদঘুঁটে লাগতো? অথবা বর্ম রাখলে? যদি ওসব রাখার মতো কোনো আলাদা কক্ষও থাকতো, তারপরও বিদঘুঁটেই লাগতো। এরচেয়ে ভালো ওগুলো বিক্রি করে দিয়ে অর্থটা খামারের কাজে লাগানো। অবশ্য, তারপরও আমি কিছু জিনিস রেখে দিয়েছি।

তাই? রেমি বলল।

 এই টি-সেটটা রেখে দিয়েছি। চমৎকার জিনিস এটা।

পিরিচের ধারে আঙুল বুলিয়ে দেখলো একবার। আসলেই।

কিছু পেইন্টিংও রেখে দিয়েছি, বলে দেয়ালে কোট-অফ-আর্মসের (বংশ পরিচায়ক চিহ্ন) দুইপাশে ঝুলানো খামারের দৃশ্যের দুটো ছবির দিকে নির্দেশ করলেন মহিলা। খামারবাড়িতে ওগুলোকে অতোটা বেমানান দেখায় না। আর পারিবারিক ক্রেস্টটা আসলে গৌরবের প্রতীক হিসেবে রাখা। স্বাভাবিকভাবেই, কেউ তো নিশ্চয় প্রতিদিন জানতে পারবে না যে সে এক শাসকের নাজায়েজ ছেলের বংশধর। যদিও সেই শাসক আসলে তেমন কেউ বড়ো কেউ ছিলো না, সাধারণ এক জমিদার ছিলো মাত্র। আর এর নিচের ঐ চামড়ার ঢালটা স্যার হারবার্টের সময়কালীনের নিদর্শন। তবে আমি ওটা রেখে দিয়েছি ওটার কেন্দ্রে থাকা কেল্টিক নটের নকশাটা থাকার কারণে।

রেমি চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, আমি কি একটু কাছ থেকে দেখতে পারি ওটা?

অবশ্যই।

 বলে উঠে দেয়ালের কাছে চলে গেলো রেমি।

ওদিকে স্যাম কাগজে থাকা তালিকাটা দেখতে দেখতে বলল, এখানে বেশ পাঁচমিশালী দ্রব্যাদির কয়েকটা বাক্সের কথা উল্লেখ আছে দেখি। ওগুলোতে কী আছে আসলে?

কিছু টুকিটাকি জিনিসপত্র। কাগজের স্তূপ, বইই বেশি। একটা বাক্স দেখে মনে হচ্ছিলো কেউ একজন কোনো ভাঙ্গা বৰ্ম ভরে রেখেছে ওটার ভিতর। অ্যাপ্রেইজারের ধারণা ওগুলোর কিছুর ঐতিহাসিক মূল্য থাকলে থাকতেও পারে। এজন্যেই আমি আর আমার কাজিন ওগুলোকে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ধার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি জানি না আসলেই ওগুলোর কোনো সত্যিকার মূল্য আছে কিনা….. বলতে বলতেই হুট করে মহিলার চোখ পড়লো স্যামের খালি চায়ের কাপটার দিকে। আরেককাপ দিবো?

না, না। ধন্যবাদ।

এরপর মহিলা নিজের কাপে আরেকবার চা ঢেলে নিয়ে বললেন, এমন না যে আমরা ধনী বলে ওগুলোকে ছেড়ে দিয়েছি। আসলে আমাদের ওগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় পড়ে থাকার চেয়ে জিনিসগুলোকে মিউজিয়ামে রাখাতেই আগ্রহ বেশি আমাদের। সামনের সপ্তাহান্তে হয়তো ফান্ড-রেইজারদের একটা অনুষ্ঠান আছে মিউজিয়ামে। ঐ অনুষ্ঠানেই জিনিসগুলোকে প্রদর্শনীতে রাখতে চাচ্ছে ওরা  

ফান্ড-রেইজার? দেয়ালের কাছ থেকে ফিরে এসে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো রেমি। আমাদেরও যাওয়া উচিৎ তাহলে।

টিকিটের বিক্রি খুব সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে, বললেন মিসেস হারবার্ট মিলার। কয়েক সপ্তাহ আগেই সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।

কপাল খারাপ তাহলে, স্যাম বলল। ঐ অনুষ্ঠানের পূর্বেই কি জিনিসগুলো দেখার মতো সুযোগ করে দিতে পারবেন আপনি?

অবশ্যই।

বলে মিউজিয়ামের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির নাম ও যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বরটা তাদেরকে জানালেন মিসেস হারবাট-মিলার। দেরি না করে সাথে সাথেই মোবাইলে তথ্যগুলো টুকে নিলো স্যাম। আরো বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল ওরা। তারপর একটা সময় সব কিছু সম্পর্কে জানার পর মহিলাকে অতিথিপরায়ণতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেওয়ার জন্য পা বাড়ালো ওরা।

দরজা দিয়ে বেরুতে যাবে ঠিক তখনই দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা পেইন্টিংগুলোর দিকে চোখ আটকে গেলো স্যামের। ছবির শিল্পীর নামটা তার পরিচিত না। তবে তার নজর আটকে গেছে কোট-অফ-আর্মসটা দেখে। ঘুরে মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, এটার একটা ছবি তুললে নিশ্চয় কিছু মনে করবেন না আপনি?

আরে নাহ। আপনি চাইলে ছবি তুলতে পারেন।

মোবাইল বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো স্যাম। কোট-অফ-আর্মস এবং এর নিচে ঝুলানো ঢাল দুটোরই ছবি তুলে নিচ্ছে। পারিবারিক চিহ্নের ইংরেজ ঐতিহ্যের সাথে খোদাইকৃত কেল্টিক নটটাকে কিছুটা উদ্ভট লাগছে। তবে কেউ যদি এর কোনো মানে বের করতে পারে, তাহলে একমাত্র সেলমাই পারবে না। তবে বয়সের প্রভাবে ঢালের চিহ্নটা ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় এবং মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠায় পরিষ্কার ছবি ভোলা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ফ্ল্যাশ বন্ধ করেই ছবি তুললো স্যাম। তবে রুমে আলো কম থাকায় এতেও খুব একটা লাভ হলো না। অবশ্য, সেলমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। এটা দিয়েই তথ্য বের করে আনতে পারবে মেয়েটা। ছবি তোলা শেষে মহিলাকে আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো স্যাম।

মিসেস হারবার্ট-মিলার মুচকি হেসে বলল, আরে ধন্যবাদ লাগবে না। আপনাদের সাথে কথা বলে বেশ ভালো লেগেছে আমার। তবে আমার স্বামী আপনাদের সাথে দেখা করতে পারেনি বলে দুঃখিত। হুট করেই বেড়া মেরামতের কাজ পড়ে গিয়েছে। তবে আমার মনে হয় গতকালের মেহমানদের ওপর কিছুটা অসন্তুষ্ট ও।

 মেহমান? রেমি বলে উঠলো।

আপনাদের কালও কয়েকজন এসেছিলো উত্তরাধিকারের ব্যাপারে কথা বলতে। সত্যি বলতে, আমি জানি না সবাই কেন এটা নিয়ে এতো মেতে আছে। দুৰ্গটা দেখলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন এটা। আমার স্বামীর ভাষায় ওটা শুধু পাথরের একটা স্তূপ মাত্র।

দরজার মুখে গিয়ে থেমে দাঁড়ালো স্যাম। আপনি কি তাদের নাম বলতে পারবেন? অথবা তারা কী নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছিলো সেটা?

দুঃখিত, নামগুলো ঠিক মনে নেই আমার। তবে তারাও আপনাদের মতোই মিউজিয়ামে দিয়ে দেওয়া বাক্সগুলো নিয়েই আগ্রহী ছিলো।

এরপর আর কিছু না বলে মহিলার থেকে বিদায় নিলো। গাড়িতে গিয়ে বসে ফোনটা রেমির হাতে দিয়ে স্যাম বলল, একটা কাজ করো। ছবিগুলো সেলমাকে পাঠিয়ে দাও।

 কোট-অফ-আর্মসটা বেশ অদ্ভুত লাগলো। মহিলার পূর্বপুরুষ ছিলো সাধারণ এক জমিদারের নাজায়েজ ছেলে মাত্র। সেই তুলনায় ক্রেস্টে আভিজাতিক প্রতীকের সংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি।

 আমিও ঠিক এটাই ভাবছি, বলতে বলতে খামারের ড্রাইভওয়ে থেকে মূল সড়কে গাড়ি বের করে আনলো স্যাম। সাথে রিয়ারভিউ মিররটাও চেক করে নিচ্ছে।

 পাঠিয়ে দিয়েছি, বলে ফোনটা গাড়ির সেন্টার কনসোলে রেখে দিলো রেমি। তারা আমাদের আগে আসায় খুব একটা অবাক হইনি আমি।

প্রতিবারই তাদের থেকে এককদম পিছিয়ে আছি আমরা। এতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি এখন।

আশা করছি মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ জিনিসগুলো দেখানোর আগে এদের ব্যাপারে কিছুটা খতিয়ে দেখবে। নাহলেও অন্ততপক্ষে পরিচয় পত্র দেখতে চাইবে।

ব্রিটিশ মিউজিয়াম সঠিক নিরাপত্তা প্রটোকল বজায় রাখবে বলেই ভাবতে চাচ্ছি আমি। হয়তো আমাদেরও তাদেরকে জানিয়ে রাখা দরকার যে আগামীকাল আমরা ওখানে যাবো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *