০৬. ক্ষয়ে যাওয়া চামড়ার বাইন্ডিং

০৬.

বেশ কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রেমি। আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যাওয়া চামড়ার বাইন্ডিং, সোনালি হরফের শিরোনাম, লালচে-সোনালি কাগজগুলো চোখে পড়ছে তার। মলাট উল্টিয়ে দেখলো পাতার অক্ষরগুলো কেমন যেন ভাঙা ভাঙা। এটা দেখেই বুঝা যায় যে এটা বর্তমান যুগের লেজার প্রিন্টারে ছাপানো হয়নি। মি, পিকারিং কিন্তু আমাকে এই বইটা দেখায়নি।

তাহলে এটা তোমার কাছে আসলো কিভাবে?

আমি জানি না। এটার জন্য আমি ঊনপঞ্চাশ ডলার আর ট্যাক্সই দিয়েছি শুধু। আমি হাত বাড়িয়ে বইটা স্পর্শ করতে গিয়েও থেমে গেলো রেমি। আমাদের গ্লাভস লাগিয়ে নেওয়া উচিৎ।

থামো, থামো। এটার জন্য তুমি মাত্র ঊনপঞ্চাশ ডলার খরচ করেছো মাত্র? নাকি তুমি দশমিকের আগে কয়েকটা শূন্য বসাতে ভুলে গিয়েছিলে?

 না। তবে বন্দুকওয়ালা দোকানে আসতেই মি. পিকারিং আমার হাত থেকে পুনর্মুদ্রিত বইটা কেড়ে নিয়ে বলেছিলো, বইটা র‍্যাপ করতে নিয়ে যাচ্ছে। এই বইটা কিন্তু আমার হাত থেকে কেড়ে নেওয়া ঐ বইটা না।

 তোমার কি মনে হয় মি. পিকারিং প্যাক করে দেওয়ার নাম করে সেফ থেকে বইটা বদলে দিয়ে

খুব সম্ভবত তাই ঘটেছে। তিনি হয়তো ডাকাতটাকে দোকানে দেখেই তার মতলব বুঝে ফেলেছিলেন, এখনো টেবিলের ওপর রাখা মোটা বইটার দিকেই তাকিয়ে আছে ও। বইটাকে দেখে এখনো বিশ্বাসই করতে পারছে না যে ওটা অরিজিনাল কপি। পুলিশকে ফোন করে এটা জানানো উচিৎ আমাদের।

অবশ্যই জানানো উচিৎ। তবে আমরা যদি তা করি, তাহলে কিন্তু তারা এটা দেখতে চাইবে। আর এই মুহূর্তে আমি এই বইয়ের বিশেষত্ব জানার ব্যাপারেই বেশি উদগ্রীব হয়ে আছি।

তাহলে কি এটা প্রথমে ফিনিক্সের বিশেষজ্ঞের কাছেই নিয়ে যাবো?

 হ্যাঁ, আগে আমরা জানি এটার ব্যাপারে। তারপর পুলিশকে জানাবো।

****

পরদিন সকালেই প্রফেসর ইয়ান হপকিন্সের সাথে দেখা করার জন্য ফিনিক্সে যাত্রা করলো ওরা। প্রফেসর বর্তমানে মোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দী ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছেন। এছাড়া অবসরের পর থেকে শখ হিসেবে পুরোনো অ্যান্টিক বই মেরামতের কাজও হাতে নিয়েছেন।

ফার্গোরা যখন ওখানে পৌঁছুলো তখনও তিনি এই কাজই করছিলেন। তাদেরকে হেঁটে আসতে দেখে চোখ তুলে তাকালেন তাদের দিকে। চোখে কালো-ফ্রেমের একটা রিমড গ্লাস পড়ে রেখেছেন উনি। আপনারাই নিশ্চয় মি. অ্যান্ড মিসেস ফার্গো?

 হ্যাঁ, স্যাম বলল। তবে আমাদেরকে তুমি করেই ডাকুন। স্যাম ও রেমি বলে ডাকলেই খুশি হবো।

আচ্ছা, আমি ইয়ান, বলে উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দুজনের সাথেই হাত মেলালেন প্রফেসর। তো, আমার বন্ধু লাযলো বলল তোমাদের কাছে নাকি দ্য হিস্ট্রি অফ পাইরেটস অ্যান্ড প্রাইভেটিয়ার্সর অরিজিনাল কপি আছে?

খুব সাবধানে তার ব্যাগ থেকে বইটা বের করে টেবিলের ওপর রাখলো রেমি। আমরা জানতাম না যে এটা আসলেই অনেক মূল্যবান কিনা, তবে মনে হচ্ছে কারো কাছে এটা খুবই মহামূল্যবান কিছু।

আগে একবার দেখে নেওয়া যাক। বলে সাদা গ্লাভস বইটা টেবিল থেকে হাতে তুলে নিলেন প্রফেসর। নেড়েচেড়ে দেখছেন। চামড়ার বাইন্ডিং ও স্পাইনের পুরোটাই এখনো ঠিকঠাক আছে। সামনে-পিছনের স্বর্ণখচিত প্যাটার্নগুলোও এখনো চকচক করেছে… পাতার ধারের অংশটা একটা মসৃণ হয়ে গেছে, তবে ক্ষয়ে যায়নি…। বইটা টেবিলের ওপর রেখে মলাটটা উল্টালেন। এটা…, বলে প্রথম পাতায় থাকা ম্যাপটার ওপর আঙুল বুলিয়ে নিলেন কিছুক্ষণ, তারপর বইটা উলটে শেষ পাতায় থাকা ম্যাপটাও একই কাজ করলেন। এই দুই পাতাই বইয়ের এই নির্দিষ্ট কপিটাকে মূল্যবান কিছুতে পরিণত করেছে। আমি যতগুলো কপি দেখেছি সেগুলোর বেশিরভাগেরই এই এন্ডপেপারগুলো নেই। তোমরা কি খেয়াল করে দেখেছো যে ম্যাপ দুটো এক না? সামনেরটা কিন্তু পিছনেরটা থেকে আলাদা। প্রথম দেখায় কিন্তু কেউই এটা ধরতে পারবে না।

কেন ওগুলো খুলে নিবে কেউ? রেমি জানতে চাইলো।

আমার মনে হয় ম্যাপগুলো আসলেই বইয়ে বর্ণনা করা জলদস্যুদের ম্যাপ। তবে যেহেতু বর্তমানটাসহ পরবর্তী সংস্করণগুলোতে এই এন্ডপেপারগুলো নেই, তাই মনে হচ্ছে কেউ ভাবছে এই পুরোনো এন্ডপেপারগুলো হয়তো বইটাকে সুন্দর একটা সাজ দিবে। গতবছর ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে একটা কপির এন্ডপেপার চুরি যাওয়ার পর এক লেখক এই মন্তব্যই করেছে। ক্যামেরা থাকার পরও শুধু এন্ডপেপার চুরিটাকে বেশ সাহসিক কাজই বলা যায়। বলে হাতে থাকা বইটার এন্ডপেপারের প্রান্ত ধরে একটু টান দিতেই হালকা একটু সরে গেলো কাগজটা। তবে এমন না যে পাতাটা ছোটানো খুব কঠিন একটা কাজ। নিজেরাই দেখো এই কপির আঠাও কিন্তু ছুটে গেছে।

সেলমা ও লায়লোর বলা ছোটোখাটো ত্রুটিটা দেখতে পেলো স্যাম। বলল, এই পাতাগুলো যদি অক্ষতও থাকতো তাহলে কি আপনার মনে হয় এটার মূল্য কিছুটা বাড়তো? মানুষ খুন করার মতো মূল্য হতো কি?

এক মুহূর্তের জন্য স্যামের দিকে তাকিয়ে রইলেন প্রফেসর। কিছুটা চমকিত দেখাচ্ছে তাকে। আমার দৃষ্টিতে না। এই কপিটা নিশ্চিতভাবেই বেশ চমৎকার একটা কপি, এর থেকেও অনেক অনেক মূল্যবান বই রয়েছে। আমার মনে হয় কেউ হয়তো বইটা তার সংগ্রহে যুক্ত করতে চাচ্ছে।

কতো দাম হতে পারে? রেমি জানতে চাইলো। যেহেতু আপনি একজন সংগ্রাহক এবং এটা চাইছিলেন।

 যদি ধরে নিই বইয়ের অন্যান্য অংশও অক্ষত আছে এবং কোনো কিছুই মিসিং নেই… তাহলে কত? চার, পাঁচ হাজার ডলারের মতো হবে।

মাত্র? স্যাম বলে উঠলো।

এটা আসলে খুব একটা বিরল বইও না। শুধু পুরোনো বই। আর বিষয়বস্তুর জন্য এটা শুধু সমুদ্র ও জলদস্যুপ্রেমী সংগ্রাহকদের কাছেই আগ্রহের কিছু হতে পারে। তাই, হ্যাঁ, পাঁচ হাজারের থেকে বেশি হবে না। আর এটাও হতো যদি এন্ডপেপারগুলো অক্ষত থাকতো।

তারপরও, রেমি তার ভ্রু কুঁচকে বলল, দামটা কম না। যেখানে আমার এটা কিনতে পঞ্চাশ ডলারও খরচ করতে হয়নি। তবে কপাল খারাপ। আমার মনে হয় বইটা পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে।

কিসের জন্য? প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন। তুমি যদি দাম দিয়ে থাকো, তাহলে তো আইনত বইটা তোমারই।

বইটা কিভাবে তার হাতে এসেছে সেটা প্রফেসরকে ভেঙে বলল রেমি।

সব শুনে বইটার ওপর গ্লাভস পরা আঙুল বুলাতে বুলাতে প্রফেসর বললেন, বইটা কেনার পিছনে দেখি বেশ ভালোই ইতিহাস জড়িয়ে আছে।

হ্যাঁ, এর জন্যই মনে হচ্ছে যে আমরা হয়তো কিছু এড়িয়ে যাচ্ছি, রেমি বলল।

আসলেই এড়িয়ে যাচ্ছি, স্যাম যোগ করলো। আমাদের হোটেল রুমে দুই ডাকাত আক্রমণ করেছিলো। তারা কী যেন একটা চাবির কথা বলাবলি করছিলো।

ঝট করে তার দিকে চোখ তুলে তাকালেন প্রফেসর। চাবি? কিসের চাবি?

আমরা আশা করছি, স্যাম বলল, আপনি হয়তো ওটা বের করতে পারবেন। অন্য বইগুলোর থেকে কি এই বইটায় আলাদা কিছু আছে? অদৃশ্য লেখা? অথবা অন্যান্য কপির থেকে ভিন্ন কাগজ?

আরো ভালো ভাবে খতিয়ে দেখতে হবে তাহলে। বিভিন্ন আলোর নিচে নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। প্রতিটা পৃষ্ঠারই ছবি তুলতে হবে যাতে পরবর্তীতে তোমরা পার্থক্যটা ধরতে পারো। অবশ্যই, এই কাজটার জন্য একটা ফি দিতে হবে তোমাদের। খরচের পরিমাণ বাড়লো আর কী তোমাদের।

স্যাম তার ওয়ালেটটা বের করে বলল, আপনার স্ট্যান্ডার্ড ফি কত?

ঘন্টায় একশো পঁচিশ ডলার। অবশ্য বইটা বেশি বড়ো না। এর জন্য মনে হয় না খুব বেশি একটা সময় লাগবে। বড়োজোর ঘণ্টাদুইয়েক।

ওয়ালেট থেকে পাঁচশো ডলারের নোট বের করে স্যাম বলল, এটা দিয়ে কি কাজটাকে তালিকার প্রথমে নিয়ে আসা যায়?

আমার ক্লায়েন্টকে একটা কল করি তাহলে। বলি যে তার কাজটা শেষ হতে কিছুটা সময় বেশি লাগবে।

ধন্যবাদ সেটার জন্য। ঘড়ি দেখলো স্যাম। প্রায় সাড়ে এগারোটার মতো বাজে। রেমিকে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে চলো প্রফেসরের কাজ করার ফাঁকে লাঞ্চটা সেরে আসি?

অবশ্যই, বলল রেমি। তারপর প্রফেসর হপকিন্সের দিকে তাকিয়ে বলল, কোনো রিকেমেন্ডেশন, প্রফেসর?

এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা চমৎকার ইটালিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। মার্সেলিনো রিস্টুরান্টে নাম। খুবই নামকরা জায়গা। সত্যি বলতে, তোমরা চাইলে কাজ শেষে বইটা নিয়ে ওখানেও যেতে পারবো আমি। আমার যে ক্লায়েন্টের সাথে দেখা করার কথা তিনিও ওদিকেই থাকেন।

চমৎকার, রেমি বলল। তাহলে ওখানেই দেখা হচ্ছে।

****

ওল্ড টাউন স্কটসডেলের জলপ্রপাতের ধারেই অবস্থিত রেস্টুরেন্টটা। পরিবেশটা চমৎকার। স্যাম আগে আগে গিয়ে পেটা লোহার গেটটা ধরে রাখলো রেমির জন্য। তারপর কাঁচের দরজাটা। ভাজা রসুন এবং তাজা উদ্ভিদের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে জায়গাটা। তারা ভিতরে ঢুকতেই সিমা নামের এক মহিলা অভ্যর্থনা জানালো ওদের। তাদেরকে টেবিলে বসার জন্য অনুরোধ করে বলল, বুন অ্যাপেতিতো।

জানালার ধারে থাকা দুটো খালি টেবিল দেখতে পেলো ওরা। জানালাটা দিয়ে বাইরের প্রাঙ্গণটা দেখা যায়। বাম পাশের টেবিলটার ওপরে ছোটো একটা প্ল্যাকার্ডে রেখা রয়েছে লেখক ও গুণী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত আসন। তাই এগিয়ে গিয়ে ডান পাশের টেবিলটায় বসলো রেমি। মেনু দেখে তাজা পনির, বাগানে ফলানো টমেটো, লাল মরিচ এবং পুদিনা পাতায় তৈরি ইসালাতা কাপ্রিজি এবং সাদা ওয়াইন কোজি ই বিয়াঙ্কো অর্ডার করলে রেমি। স্যাম খাওয়ার জন্য বেছে নিলো আরুগুলার ওপরে বিছানো কাছা অহ্য টুনা মাছ, ঝলসানো স্যামনে তৈরি কারপাচ্চিও নামের একটা ডিশ এবং টেবিলের জন্য অর্ডার করলো ধবধবে সাদা ওয়াইন ফালানঘিনা নুদো এরোইকো।

ওয়াইন এসে পৌঁছাতেই রেমি তার গ্লাসটা স্যামের উদ্দেশ্যে উঁচিয়ে ধরে টোস্ট করলো, আশা করছি প্রফেসর হপকিন্স রহস্যময় চাবিটা খুঁজে বের করতে পারবে।

আমিও।

তাদের খাওয়া শেষ শেফ মার্সেলিনো এগিয়ে এলো তাদের দিকে। তাদেরকে স্বাগতম জানালো। লোকটায় গলায় কড়া ইতালিয়ান টান লেগে আছে। আপনারা হয়তো আমার সুন্দরী বধূর সাথে ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়েছেন, বলে সিমার দিকে ইশারা করলো শেফ। আশা করছি আপনারা হয়তো লাঞ্চটা উপভোগ করেছেন। তো, খাওয়া শেষে ডেজার্ট নেওয়ার ইচ্ছা। আছে কি?

খাবারটা চমৎকার ছিলো, রেমি জানালো৷ ডেজার্ট…? কথা শেষ না স্যামের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু।

আমি সবসময়ই সুন্দরী রমনীর সাথে টিরামিসু শেয়ার করায় রাজি থাকি। (টিরামিসু-ইটালিয়ান ডেজার্ট।)

আচ্ছা, তাহলে, শেফের দিকে ঘুরে বলল রেমি। একটা ডেজার্টের অর্ডার দিচ্ছি আমরা।

এক্ষুণি নিয়ে আসছি, হালকা মাথা নত করে টেবিলের কাছ থেকে সরে গেলো মার্সেলিনো। তার গাঢ় চোখগুলো চকচক করছে যেন। কিছুক্ষণ পরই আবার ফিরে এলো টিরামিস নিয়ে। তাদেরকে উপভোগ করতে বলে আবারো টেবিল ত্যাগ করলো লোকটা।

চামচ দিয়ে ডেজার্টের প্রথম টুকরোটা মুখে তুলে নিলো রেমি। নিখুঁত স্বাদে মুগ্ধ ও। ইতালির পর এটাই দেশটার সবচেয়ে বড়ো সম্পদ।

এটা নিশ্চিতভাবেই গত মাসে রোমের ডোমাস মাগ্লানিমিতে তে খাওয়া টিরামিসুটার মতো অতোটা ভালো নয়, তবে… বলতে বলতে চামচভর্তি করে মুখে তুলে নিলো স্যাম। ওয়াইনের সাথে সাথে তৃপ্তির সাথে গিলে নিচ্ছে খাবারটা। চোখ বন্ধ করে উপভোগ করার পর বাক্যটা শেষ করলো, তবে আমার মনে হয় আমাদের দুটো প্লেট নেওয়া উচিৎ ছিলো।

 দ্বিতীয় আরেকটা টুকরো নিতে চাচ্ছিলো রেমি, ঠিক তখনই দেখতে পেলো প্রফেসর হপকিন্স মোড়কাবৃত বইটা নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকছেন। ঢুকে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিকে তাকালেন প্রফেসর। তারপর তাদেরকে চোখে পড়তেই হেঁটে আসলেন তাদের দিকে। তোমাদের খাবারের সময় বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

বসুন, প্লিজ, স্যাম বলল। আমাদের খাওয়া শেষ অনেক আগেই। তবে টিরামিসুকে আসলে ঠিক মানা করতে পারছিলাম না।

মনোয়োম পরিবেশ, তাই না? চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন প্রফেসর।

খুবই চমৎকার, বলে প্রফেসরের হাতে থাকা প্যাকেজটার দিকে তাকালো স্যাম। বলল, কিছু পেয়েছেন ওটাতে?

প্রথমে কিছুই পাইনি। বইটার অবস্থা এখনো চমৎকার। অবশ্যই আমি প্রতিটা পৃষ্ঠা পরীক্ষা করে দেখেছি। তীর্যক আলো, কৃষ্ণ আলোসহ বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর নিচে নিয়ে দেখেছি। কোনো পৃষ্ঠার কোনো কিছুতেই চাবি আছে বলে কিছু মনে হয়নি। এটাই তো খুঁজছিলে তোমরা?

মাথা ঝাঁকালো রেমি ও স্যাম।

আমার এক ফ্রেন্ডের মেটাল ডিটেক্টর ছিলো। তাকে নিয়ে এসে ডিটেক্টরের নিচেও বইটা পরীক্ষা করিয়েছি। আমার ধারণা ছিলো চাবিটা হয়তো বাইন্ডিংয়ের মধ্যে আছে, ডিটেক্টরের নিচে নিলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু কিছুই পাইনি। তখনই বুঝতে পারলাম যে চাবিটা আসলে ধাতব কোনো বস্তুই নয়। বইটা আসলে জলদস্যু এবং তাদের ম্যাপ নিয়ে লেখা। তাহলে ম্যাপেই চাবি কেন থাকবে না?

মাথা ঝাঁকালো রেমি। হ্যাঁ, এটার সম্ভাবনা আছে।

তাই আমি আবার প্রতিটা পৃষ্ঠা ঘেটে দেখছি। তোমরা যেমনটা চেয়েছিলে, অন্য কপির সাথে তুলনা করার জন্য ছবিও তুলে নিয়েছি সবগুলোর। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমার কাছে বর্তমানে অন্য কোনো কপি নেই। ভাবলাম তোমরা হয়তো পরে আমার বানানো ডিজিটাল কপিটা দিয়ে তুলনা করে নিতে পারবে। হয়তো দেখতে পাবে এই এডিশনে এমন কিছু লেখা আছে যেটা অন্য কোনোটায় নেই। বিশেষ করে যে পৃষ্ঠাগুলোতে ম্যাপের ছবি আছে সেগুলো। বইয়ে পরবর্তীতে কিছু যোগ করা হয়েছে কিনা তার জন্য বইয়ের কালিও পরীক্ষা করে দেখেছি… বলে বাক্সটায় একটা চাপড় দিয়ে গভীর শ্বাস নিলেন প্রফেসর। যাই হোক, চাবি অন্বেষণের ব্যাপারে ফিরে যাই আবার। যখন আমি বুঝলাম যে জিনিসটা আমার সামনেই আছে, তখন মনে হলো যে আমি কেন এটা আগে ধরতে পারিনি। বলে প্রথমে রেমি এবং পরে রেমির দিকে তাকালেন তিনি। কিন্তু আর কিছু বললেন না।

প্রফেসরের হুট করে থেমে যাওয়ায় মনে মনে ছটফট করতে শুরু করেছে রেমি। কোনোরকমে স্বাভাবিক স্বরে বলল, আসলে কোন ব্যাপারটা আপনি আগে ধরতে পারেননি?

 অন্যান্য কপিগুলোতে কেন এন্ডপেপারগুলো নেই। আমি জানি তারা কিসের খোঁজ করছে।

.

০৭.

প্রফেসর হপকিন্স একটা ম্যানিলা খাম খুলে বললেন, এটা লুকানো ছিলো এন্ডপেপারের পিছনে।

আমি কি দেখতে পারি? হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো স্যাম।

অবশ্যই।

হাতে নিয়ে কাগজটা মেলিয়ে ধরলো স্যাম, যাতে রেমি ও সে একসাথেই দেখতে পারে। একটা হলুদ পার্চমেন্ট রয়েছে খামের ভিতরে। পার্চমেন্টট বইয়ের মলাটের সমানই বড়ো, কালো কালি দিয়ে কিছু একটা আঁকা রয়েছে কাগজটায়। চিত্রটা একটা দ্বীপের মানচিত্র। এর পাশেই রয়েছে চিহ্ন সম্বলিত একটা বৃত্ত, এবং ওপরে আছে একটা বর্গাকার চিহ্ন, কিছু একটা লেখা আছে। চিহ্নটার নিচে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই স্যাম বুঝতে পারলো যে ওটা একটা পূর্ণাঙ্গ বর্ণ। সাইফার হুইল? প্রফেসরের কাছে জানতে চাইলো।

 ওটারই একটা চিত্র, প্রফেসর জানালেন। এটার পিছনেই ছুটছে ডাকাতেরা। যদি আগে চুরি এবং এন্ডপেপার ধ্বংসের খবরগুলো প্রকাশ না হলে-এটা কারো নজরেই আসতো না। সত্যি বলতে, আমি তোমাদেরকে জিজ্ঞেসই করতে যাচ্ছিলাম যে ছুটে যাওয়া এন্ডপেপারটা আবার আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিবো কিনা। ঠিক তখনই জিনিসটা চোখে পড়লো।

সামনে ঝুঁকে বইটাকে আরো কাছ থেকে দেখে রেমি বলল, আমি ভাবছি মি. পিকারিং বইটা আমাকে দেওয়ার সময় এর ভিতরে থাকা কাগজটা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কিনা!

ভালো একটা প্রশ্ন, ভাবলো স্যাম। তবে সে এখনই ওটা নিয়ে কিছু ভাবতে চাচ্ছে না। আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছি না, প্রফেসর হপকিন্সের দিকে তাকিয়ে বলল শুধু।

যেহেতু তোমরা আমাকে সাধারণের থেকে দ্বিগুণ ফি দিয়েছে, তাই ধরা যায় ওটাতেই ধন্যবাদ বলা হয়ে গেছে। নিশ্চিতভাবেই চমৎকার একটা রহস্য পেয়ে গেছে তোমরা।

হঠাৎই রেমির ফোনে আলো জ্বলে উঠলো। একবার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ফোনটা উলটে রাখলো শুধু। মূল্যবান সময় ব্যয় করে আমাদের কাজটা করে দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

প্রফেসর মুচকি হেসে বললেন, আর আমারও পরবর্তী অ্যাপোয়েন্টমেন্টের সময় হয়ে গেছে প্রায়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে হাত মেলানো শেষে আবার বললেন, তাহলে লাঞ্চ উপভোগ করতে থাকো। উঠলাম আজ।

প্রফেসর চলে যেতেই রেমি তার ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো। ব্রি মেসেজ দিয়েছে।

কী লিখেছে? স্যাম জিজ্ঞেস করলো।

যত দ্রুত সম্ভব তাকে কল করতে।

বিলের চেক দিতে বলে তাড়াতাড়ি করে ডেজার্টটা শেষ করে নিলো দুজন। বিল আসতেই মোটা অঙ্কের টিপসহ বিল পরিশোধ করে তাড়াতাড়ি করে দৌড় লাগালো ভাড়া করা গাড়িটার দিকে।

গাড়িতে উঠে রেমি ফোন দিলো ব্রিকে। লাউডস্পিকার অন করে কথা বলছে ও। ব্রি? ঠিক আছে তুমি? তোমাকে না পেয়ে বেশ দুঃশ্চিন্তায় আছি আমরা।

আমি ঠিক আছি। এখন। আ-আমি নর্থ ক্যারোলিনায় আছি।

নর্থ ক্যারোলিনা?

 কাজিনের কাছে এসেছি। তার বাবার ব্যাপারে খবরটা জানাতে।

 আমরা খুবই খুবই দুঃখিত, ব্রি।

আমি জানি। এখন শুনুন। আমি শুধু ভাবছি-আমার আঙ্কেল কি আপনাকে ঐ বইটা দিয়েছিলো? যখন আপনি ওখানে গিয়েছিলেন? পাইরেটস অ্যান্ড প্রাইভেটিয়ার্স?

স্যামের তাকালো রেমি। বলতে কিছুটা দ্বিধা লাগছে ওর। কোনোরকমে বলল, আমি তার থেকে একটা কপি কিনেছি। কেন?

 আমার কাজিন… মানে মেয়েটা খুবই ভেঙে পড়েছে। আসলে আঙ্কেল নাকি বইটা তাকে দেওয়ার প্রমিজ করেছিলো। আর আমিও আশা করছি বইটা হয়তো তার হাতে তুলে দিতে পারবো। বাবাকে মনে রাখার স্মৃতিস্মারক বলতে পারো।

তোমার চাচার সাথে যা হয়েছে, তাই আমরা ভাবছিলাম বইটা পুলিশের হাতে তুলে দিবো।

না! প্লিজ…

ব্রি? তুমি নিশ্চিত যে তুমি ঠিক আছো?

আ… হ্যাঁ। শুধু ভেবে দেখুন ঘটনাটা আমাদের জন্য কতটা ভয়ানক। আর বইটা আমার কাজিনের জন্য অনেক বড়ো কিছু এখন। আপনি যদি এটা পুলিশের হাতে তুলে দেন, তাহলে এটার জন্য আদালতেও যেতে হতে পারে। সে এখন এতো ভ্রমণের জন্য আসলে প্রস্তুত না। আর… কথা শেষের আগেই কান্না ভেঙে পড়লো ব্রি। কয়েকসেকেন্ড কাঁদার পর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, স্যরি। ঘটনাটা খুবই ভয়ানক আমাদের জন্য।

তোমাকে সাহায্য করার জন্য কী করতে পারি আমরা? রেমি জিজ্ঞেস করলো।

আমি আশা করছি বইটা মেইল করে পাঠিয়ে দিতে বললে ক্ষুব্ধ হবেন না আপনারা। বাবার স্মৃতিস্মারক হিসেবে বইটা রাখতে চাচ্ছে ও।

 অবশ্যই। ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো কিছু বলোনি তুমি। বুঝেছি ব্যাপারটা। তবে মেইল না, স্যাম আর আমি নিজ হাতেই নিয়ে আসবো বইটা।

না। আপনাদের এটা করতে বলতে পারি না আমি। এটা অনেক বেশি হয়ে যায়।

আমরাই জোর করছি, স্যামের দিকে তাকিয়ে বলল রেমি। স্যামও ওদিকে সাড়া দিয়েছে রেমির প্রস্তাবে। এই বইটা আসলে অনেক মুল্যবান। পোস্ট অফিসে করে পাঠানোর ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না আমরা। তোমার ঠিকানাটা মেসেজ করে দাও। কালকের ভিতরেই পৌঁছে যাবো আমরা।

অবশ্যই, পাঠাচ্ছি। ধন্যবাদ…

কথা শেষের আগেই আবারো ফুপাতে শুরু করলো ব্রি। রেমি তাকে আশ্বস্ত করে বলল, কালই আসছি আমরা। আর তোমার বোনকে আমাদের সমবেদনা জানিও।

পার্কিং লট থেকে গাড়িটা বের করে রাস্তায় নিয়ে এলো স্যাম। ব্যস্ত রাস্তার ওপর দিয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। ব্রির সাথে রেমির কথা শেষ হওয়ার পর মন্ত ব্য করলো, খুব ভেঙে পড়েছে ও।

স্বাভাবিক, রেমি বলল। প্রথমে হল ডাকাতি, তারপর হার্ট অ্যাটাক। মি. পিকারিংর মেয়ের কী অবস্থা তা ভাবতেও পারছি না এখন। দেখতে আসার মতো অবস্থাটাও নেই। যাক, অন্ততপক্ষে ব্রি তো আছে এখন ওর সাথে।

বইটার ব্যাপারে…?

ওটা নিয়ে আমিও ভাবছি। আমার মনে হয় পিকারিংর মেয়েকে বইটা অন্তত দেখানো উচিৎ আমাদের। তারপর নাহয় সিদ্ধান্তটা ও ই নিবে। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তো তার সিদ্ধান্তের মূল্যটাই অগ্রাধিকার পাবে। অন্ত তপক্ষে এতে করে তো আমরা বুঝাতে পারবো বইটা কেন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ আমাদের।

সিগন্যালে লাল বাতি জ্বলে থাকায় গাড়ি থামালো স্যাম। স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে আবারো চোখ ফিরিয়ে আনলো রাস্তার ওপর। আমার মনে হয় নর্থ ক্যারোলিনা ভ্রমণের জন্য আমাদের ফ্লাইটের পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে।

****

ব্যক্তিগত জেট বিমান থাকার সুবিধা এটাই যে যখন খুশি তখন পরিকল্পনা বদল করা যায়। সেলমা ওদের জন্য ওখানে হোটেল ও রেন্টাল কারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। রাতে ভালো একটা ঘুম এবং সকালে হালকা নাস্তা খেয়ে গাড়িতে করে ব্রির মেসেজ পাঠানো ঠিকানাটায় রওনা করলো ওরা। রেমি অবশ্যই সেলমার মাধ্যমে অবস্থানটা আসলেই সঠিক কিনা সেটা খতিয়ে দেখেছে। এটা জেনে স্বস্তি পেয়েছে যে ওখানে বসবাসকারী ল্যারেইন পিকারিং-স্মিথ সত্যিই জেরাল্ড পিকারিংর মেয়ে।

ল্যারেইন হারলো নামের একটা পল্লী এলাকায় থাকে। টোবাকো ফার্মে ঘেরা পূর্বের পথ ধরে মাইলের পর মাইল এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। গন্তব্যে যখন পৌঁছালো তখন তাদের মাথার ওপরের আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করে পুরো এরিয়াটার ওপর চোখ বুলাযলো স্যাম। সাদা ক্ল্যাপবোর্ডের ফার্মহাউজ এটা। নুড়ি পাথরের তৈরি ড্রাইভওয়েতে একটা কালো এসইউভি দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে ওপরের জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে কেউ একজন দেখছে তাদের। পর্দার হালকা নাড়াচাড়াটা স্যামের নজরেও পড়েছে।

রেমি তার কোলের ওপরে থাকা বইটার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, চলো, জিনিসটা পৌঁছে দিয়ে আসি তাহলে।

তুমি নিশ্চিত এটা তুমি দিয়ে দিতে চাও?

হ্যাঁ। এটাকে প্রমাণ হিসেবে তুলে দেওয়া বা আদালতের কেস বানিয়ে দেওয়ার চেয়ে পিকারিংর মেয়ের হাতে তুলে দেওয়া ভালো। হয়তো বইটা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ সেটা জানাতে পারবে ও।

গাড়ি থেকে নেমে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে দরজায় নক করলো স্যাম। রেমিও দাঁড়িয়ে আছে তার সাথে। কয়েক মুহূর্ত দরজা খুলে তাদের সামনে উপস্থিত হলো ব্রি। তার চোখগুলো হালকা লাল এবং ফুলে আছে। কোনো সন্দেহ নেই যে সে এতোক্ষণ কাঁদছিলো। মি. অ্যান্ড মিসেস ফার্গো… মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলার চেষ্টা করছে ব্রি। বইটা এনেছেন?

বাদামি কাগজে মোড়ানো পার্সেলটা ব্রির হাতে তুলে দিলো রেমি। তোমার কাজিনের কী অবস্থা?

ও… ওর অবস্থা আসলে অতোটা ভালো না। বলে বইটা বুকে জড়িয়ে ধরলো বি। আপনাদেরকে ভিতরে আসতে বলতাম, কিন্তু…

ব্যাপার না, রেমি বলল। আমরা আশা করছিলাম, বইটা কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা তুমি জেনে থাকলে যদি আমাদেরকে জানাতে। কেন কেউ একজন এই বইটা খুঁজছে?

আমি জানি না আসলে, হালকা শ্রাগ করে বলল ব্রি। তবে বইটা এত পথ বেয়ে এখানে নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ আপনাদের।

তুমি নিশ্চিত তুমি ঠিক আছো?

মাথা ঝাঁকালো ব্রি।

কেউই আর কোনো কথা বলছে না। নীরবতায় পরিবেশটা কেমন যেন অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। পুরোপুরি অস্বস্তিকর হয়ে উঠার আগেই রেমি এক পা পিছিয়ে গিয়ে মুচকি হেসে বলল, কোনো কিছুর দরকার লাগলে নির্দ্বিধায় জানিও আমাদেরকে।

সত্যি বলতে একটা কথা জানার ছিলো আসলে। মি, উইকহ্যামের কী অবস্থা? ডাকাতিতে তার তো কোনো ক্ষতি হয়নি?

না।

কিছু বলার আগে একবার বইটার দিকে তাকালো ব্রি। তারপর রেমির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, তাকে বলবেন আমি তাকে মিস করছি এবং সুযোগ পেলেই তাকে চিঠি লিখব। জানাবেন তো?

অবশ্যই, স্যামের বাহুতে হাত প্যাচিয়ে নিতে নিতে বলল রেমি। আমাদেরও যাওয়া দরকার। লম্বা ফ্লাইট।

স্যামও আলতোভাবে মাথা নেড়ে বলল, বাই।

গুডবাই, বলে দরজাটা লাগিয়ে দিলো ব্রি।

ওদিকে স্যামকে নিয়ে গাড়িতে ফিরেই রেমি বলল, ও বিপদের মধ্যে আছে। শুনানি সে কী বলেছে? আমাকে বলেছে মি. উইকহ্যামকে মেসেজ দিতে। পিকারিংর বিড়ালকে। সংকেত এটা। আমাদের ওখানে গিয়ে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা উচিৎ এখন।

আইডিয়াটা ভালো না, রেমি।

কিন্তু তোমার সাথে তো এখন পিস্তলটা আছে।

আর শত্ৰু কয়জন? আমরা এটাও জানি না যে ওখানে কে আছে এখন। তোমারটাও যদি সাথে থাকতো, তাহলে একটা ঝুঁকি নিতে পারতাম।

 ভ্রূ কুঁচকে স্যামের দিকে তাকালো রেমি। তারপর সেলফোনটা বের করে বলল, তাহলে পুলিশকে ফোন করে আমাদের দল ভারি করা উচিৎ।

 হ্যাঁ, তবে এই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই ফোন করো না, স্যাম বলল। ব্রি যদি কারো জিম্মি হয়ে থাকে, তারমানে হলো ঐ লোকটা আমাদের ওপরও নজর রাখছে। বলে আর দেরি না করে ফার্মহাউজের সামনে থেকে গাড়িটা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো স্যাম।

 ফার্মহাউজটা চোখের আড়াল হতেই পুলিশকে ফোন করলো রেমি। পুলিশের লোকেরা তাদেরকে জানালো তারা যেন বাড়িটা থেকে মাইলখানেক দূরে হাইওয়ের ধারে অবস্থিত মার্কেটটায় অপেক্ষা করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মার্কেটে পৌঁছে গেলো ওরা। পার্কিং লটে গাড়িটা পার্ক করতেই হঠাৎ বেজে উঠলো রেমি ফোন। বের করে দেখলো, সেলমা অতিদ্রুত যোগাযোগ করার অনুরোধ করে মেসেজ পাঠিয়েছে।

দেরি না করে স্পিকার অন করে ফোন করলো রেমি। তুমি কি আমাদের পাঠানো ডিজিটাল ছবিগুলো থেকে কিছু খুঁজে পেয়েছো? জিজ্ঞেস করলো ও।

এখনো না, মিসেস ফার্গো। তবে এজন্যে ফোন করতে বলিনি আমি। আপনার খোঁজে একজন পুলিশ এসেছিলো একটু আগে। ব্রি মার্শালের গাড়িটা খুঁজে পেয়েছে ওরা। এয়ারপোর্টের কাছে একটা রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিলো গাড়িটা। গাড়িতে কয়েক বাক্স ফান্ড-রেইজার টিকেট আর ফার্গো ফাউন্ডেশনের নামে চেকভর্তি একটা খাম পেয়েছে। অফিসার জানতে চাইছিলো গাড়িটা আমরা টো ইয়ার্ড থেকে ওগুলো তুলে নিয়ে আসবো কিনা।

 স্যামের তাকালো রেমি। স্যাম বলল, ধস্তাধস্তির কোনো চিহ্ন ছিলো কি গাড়িতে।

অফিসার পরিষ্কার করে কিছু বলেনি, মি. ফার্গো। তবে আমার মনে হয় ছিলো, লোকটা হয়তো একবার হালকা একটু বলেছিলো।

 ধন্যবাদ, সেলমা, স্যাম বলল। আমরা এখানের ডেপুটিকে বলেছি ব্রির খোঁজ নিতে। তাকে এই ব্যাপারটাও জানিয়ে দিবো আমরা।

প্রায় দশ মিনিট পরই কার্টরেট কাউন্টি শেরিফের ডেপুটি এসে পৌঁছালো মার্কেটে। গাড়ি থেকে বেরুতেই উপত্যকার দমকা বাতাস সজোরে চপেটাঘাত করলো যেন লোকটাকে। আরেকটু হলেই মাথার ওপরের হ্যাটটা উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো প্রায়। ফার্গোদের দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে তাদেরকে একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতে বলল ডেপুটি। ওখানে তারা মোটামুটি আড়াল হয়ে থাকতে পারবে।

একত্র হতেই ডেপুটিকে পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে বলল রেমি। সব শুনে দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টি ফুটে উঠলো ডেপুটির মুখে। এটা কি সম্ভব না যে এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে মহিলার গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো? তারপর হয়তো কোনো ক্যাব বা কিছুতে করে বাড়িতে ফিরে গিয়েছে।

হয়তো, বলল রেমি। তবে তার সদ্যমৃত চাচার বিড়ালের কাছে মেসেজ পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু কিছুটা অদ্ভুতই।

অনেক মানুষই তাদের পোষাপ্রাণীদের সাথে কথা বলে।

স্যাম বুঝতে পারছে যে প্রমাণের অভাবে ডেপুটি তাদের কথা বিশ্বাস করছে না। এক পা সামনে এগিয়ে অফিসারের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, এটা কি সম্ভব না যে আমরা ভাবছি আমাদের বন্ধু কোনো বিপদে আছে, এবং এর জন্য তার ওখানে গিয়ে একবার চেক করে দেখা দরকার কিনা? সে ঠিক আছে কিনা সেটা দেখার জন্যও কি একবার যাওয়া যাবে না?

অবশ্যই। তবে এমন না যে আমি আপনাদের বিশ্বাস করিনি, বলল ডেপুটি। যদিও গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে লোকটা পুরোপুরি বিশ্বাসও করেনি। আমি শুধু যুক্তি মেলাচ্ছি। আমি শুধু এই এরিয়ার একজন ডেপুটি মাত্র, তো আমার হ্যান্ডেল করার মতো কিছু হলে আমি অবশ্যই তা করব। নাহলে, ব্যাকআপ টিমের জন্য বিশ মিনিটের মতো অপেক্ষা করার অপশনও আছে।

অবশ্যই, বলল স্যাম। তারপর ওয়ালেট থেকে তার কার্ড বের করে ডেপুটির হাতে দিয়ে বলল, এখানে আমাদের সেল নাম্বারগুলো আছে। যদি ওখানে গিয়ে কিছু জানতে পারেন, তাহলে অবশ্যই জানাবেন আমাদের।

 কার্ডটা হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে রওনা করলো ডেপুটি, তারপর গাড়িতে করে ছুট লাগালো ফার্মহাউজের রাস্তার দিকে।

তারাও ডেপুটির গাড়িটা অনুসরণ করতে চাচ্ছিলো, তখনই রেমি দেখলো যে ডেপুটির সম্মুখ রাস্তা থেকে একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। এটা ফার্মহাউজে পার্ক করে রাখা ঐ এসইউভিটাই।

তুমি নিশ্চিত?

 একদম।

 গাড়ি চালু করলো স্যাম। তুমি দেখেছো ভিতরে কে আছে?

 দুইজন পুরুষ। যদিও আমি নিশ্চিত না। তবে প্যাসেঞ্জারের সিটে থাকা লোকটাকে পিকারিংর দোকানে ডাকাতি করতে আসা বন্দুকধারী বলেই মনে হচ্ছে আমার, বলল রেমি। ওদিকে স্যাম ইতিমধ্যেই এসইউভিটা অনুসরণ করতে শুরু করেছে। ব্রির কী হবে?

 বিশ মিনিটের ব্যাসার্ধে থাকা একমাত্র ডেপুটি চেক করতে গেছে তাকে। আর লোকটা তোমার বলা বিড়ালের গল্পে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে আমার মনে হয় না যে সে সব কাজ ফেলে আমাদের কথায় একটা গাড়িকে অনুসরণ করা শুরু করবে। যদি তাকে রাজিও করাই তারপরও কিন্তু প্রমাণ নেই যে ঐ গাড়িটা অবৈধ কিছু করছিলো।

ভালো বলেছো।

তবে দুই লেনের গ্রাম্য রাস্তায় নজরে না পড়ে কাউকে অনুসরণ করা একদমই অসম্ভব কাজ। স্যাম যদিও চেষ্টা করছে এসইউভি থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে এগুতে। ধারণা করছে এই রুটটা হয়তো বুফোর্টের দিকে চলে গেছে। যদিও এটা চলে গেছে পানির ধারে অবস্থিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার দিকে। অনুসরণ করতে করতে দেখলো এসইউভিটা রাস্তার ডান দিকে মোড় নিয়ে চলে গেছে। স্যামও মোড় ঘুরালো। তবে ওদিক দিয়ে এগুনোর মতো আর কোনো রাস্তা নেই। বরং রাস্তার এক পাশে বড়ো একটা ডকে বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো ওয়্যারহাউজ দাঁড়িয়ে আছে। গতি কমালো স্যাম, তবে গাড়ি থামালো না। ওদিকে এসইউভি গাড়িটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। গাড়িটার খোঁজে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো, কিন্তু কোনো চিহ্নও দেখা যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছে কিছু? রেমিকে জিজ্ঞেস করলো।

না। খুব সম্ভবত ডকে চলে গেছে গাড়িটা, নয়তো ওয়্যারহাউজগুলোর কোনোটার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে।

তখনই হঠাৎ স্যামের ফোন বেজে উঠলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে রেমির হাতে তুলে দিলো, যাতে করে ফোন রিসিভের স্পিকারফোনে কথা বলতে পারে ও।

 ডেপুটি ওয়াগনার বলছি, অন্য প্রান্ত ভেসে এলো স্বরটা। আপনাকে শুধু জানাতে চাচ্ছি যে আমি বাড়িটা চেক করে দেখেছি। কেউই সাড়া দেয়নি।

স্যাম… ফিসফিসিয়ে বলল রেমি।

শুনেই স্ত্রীর দিকে তাকালো স্যাম, তারপর চোখ পড়লো রাস্তার পিছনের দিকে। চেক করে দেখার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। আমরা বাসার সামনে থাকা ঐ গাড়িটার পিছে অনুসরণ করছিলাম। আমার স্ত্রীর ধারণা গাড়ির লোকগুলোর একজন নাকি দেখতে স্যান ফ্রান্সিসকোতে ডাকাতি করা ঐ লোকটার মতোই।

আপনাদের বন্ধু কি ঐ গাড়িতে ছিলো?

তাকে দেখিনি আমরা।

আপনারা কোথায় এখন?

পানির ধারে। বুফোর্টের দশ-পনেরো মিনিটের মতো দক্ষিণে খুব সম্ভবত

একটা উপকার করুন শুধু। দয়া করে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসবেন না। আমি বুফোর্ট থেকে ব্যাকআপ পাঠানোর চেষ্টা করছি ওখানে? বলে ফোন কেটে দিলো ডেপুটি।

ডেপুটির সাথে কথা বলা শেষে রাস্তার পাশে নিয়ে গাড়িটা দাঁড় করালো স্যাম। খুব সম্ভবত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আমার।

দরজার হাতলের দিকে হাত বাড়ালো রেমি। আমাদের হাতে হয়তো পনেরো মিনিট সময় নেই।

রেমি, বলেই খপ করে তার হাত আঁকড়ে ধরলো স্যাম।

 রেমিও হাত থামিয়ে চোখ তুলে তাকালো স্যামের দিকে।

স্যাম তার দিকে ঝুঁকে চুমু খেয়ে বলল, তুমি নিশ্চয় ভেবে বসোনি যে আমি তোমাকে ওখানে একা যেতে দিবো?

অবশ্যই না। মুচকি হেসে দরজাটা খুললো রেমি। এখন চলো, আমাদের বন্ধুকে খুঁজে বের করি।

.

০৮.

বেল্ট থেকে রিভলভারটা বের করে এনে ট্রাঙ্কটা উঁচিয়ে ধরলো স্যাম। আর রেমি সামনের দিকে নজর রেখে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ধরনের নড়াচড়া চোখে পড়লেই স্যামকে সতর্ক করে দিবে ও। যদিও স্যাম ঐদিকে আশা করছে যেন কোনো অস্ত্রের প্রয়োজন না পড়ে, কিন্তু তার ইন্দ্রিয় আবার অন্য কথা বলছে। রাস্তায় শুধু একটা গাড়িই দেখা গিয়েছিলো। যদি ব্রি ঐ বিচহাউজটাতে না থেকে থাকে, তাহলে অবশ্যই সে এসইউভিটাতে ছিলো। যেহেতু তারা ওকে দেখতে পায়নি, তারমানে মেয়েটার আহত বা মৃত হওয়ারও ভালো সম্ভাবনা আছে।

দুজনই তাদের সেলফোনগুলো সাইলেন্ট করে নিয়েছে। রেমিরটা যদিও তার হাতেই রয়েছে, স্যাম তারটা ভরে রেখেছে পকেটে। ট্রাঙ্ক থেকে নিজের জন্য একটা টায়ার আয়রন তুলে নিয়ে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের রিভলভারটা রেমির হাতে তুলে দিলো স্যাম। রেডি? জিজ্ঞেস করলো ও।

হ্যাঁ, রেডি।

 কোনার দিকে একবার নজর ফেলে স্যাম বলল, ওকে ক্লিয়ার।

দমকা বাতাস বইছে চারপাশে। বাতাসের ভিতরেই ঘাটের ওপর দিয়ে হেঁটে প্রথম ওয়্যারহাউজটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। কাঠের তক্তার ওপর তাদের পদশব্দ এবং পানিতে লাফাতে থাকা সিগালের চিৎকার ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

ঘাটে কোনো নৌকা বা কর্মরত কাউকেই চোখে পড়লো না ওদের। আরেকটু ভালো করে দেখার পরই বুঝতে পারলো যে ওয়্যারহাউজগুলো আসলে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। জানালাগুলো ভাঙ্গা, দরজাগুলোও বাইরে থেকে তালা দিয়ে আটকানো। কাউকে কিডন্যাপ করে আটকে রাখার জন্য নিখুঁত জায়গা এটা।

রেমিকে সাথে নিয়ে ওয়্যারহাউজের পাশ ঘেষে এগিয়ে যাচ্ছে স্যাম। হঠাৎই একটা ক্ষীণ শব্দ ভেসে এলো তার কানে। সাথে সাথেই থেমে গেলো। রেমিকেও থেমে যাওয়ার জন্য ইশারা করে ফিসফিসিয়ে বলল, শুনো।

জং ধরা কিছুর আওয়াজ মনে হচ্ছে। কড়কড়ে শব্দ।

মাথা ঝাঁকিয়ে ওয়্যারহাউজের শেষ প্রান্তের দিকে ইশারা করলো স্যাম। হঠাৎই সিগ্যালের চিৎকারের শব্দ তাদের মাথার ওপর থেকে। চিৎকার শুনে এক মুহূর্তের জন্য থতমত খেয়ে গেলো রেমি। তাকিয়ে দেখলো তাদের থেকে কয়েক ফুট দূরেই সিগ্যাল লাফিয়ে পড়েছে পানিতে।

স্যাম ওদিকে সব ঠিকঠাক আছে হাত উঁচিয়ে সংকেত দিলো তাকে।

মাথা ঝাঁকিয়ে আবারো স্যামকে অনুসরণ করতে শুরু করলো রেমি। ওয়্যারহাউজে থাকা কারো নজরে না পড়ার জন্য একটা জানালার পাশে গিয়ে লুকিয়েছে স্যাম। যদিও কপাল খারাপ, ডকটা বেশ লম্বা এবং তারা কেউই জানে না এসইউভির লোকগুলো এতগুলো ওয়্যারহাউজের কোনটায় গিয়ে লুকিয়েছে।

বিল্ডিংয়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছেই কোনার দিকে তাকালো স্যাম। দুই বিল্ডিংয়ের মাঝখানে একটা এসইউভি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটার উল্টোপাশে থাকা ওয়্যারহাউজের একটা দরজা কিছুটা ফাঁক হয়ে আছে। থেমে গেলো ও। গাড়িটা ওখানে।

ভিতরে কেউ আছে?

দেখে তো মনে হচ্ছে নেই, বলল স্যাম। অবশ্য পরের বিল্ডিংয়ের দরজাটা খোলা। আমি নিশ্চিত তারা এখন ওই বিল্ডিংটাতেই আছে।

মাথা ঝাঁকালো রেমি। তারপর ফিরে তাকালো পিছনের রাস্তার দিকে। ডেপুটির গাড়িটা দেখার আশা করছে। স্যাম অবশ্য তাকে এটা বলল না যে ডেপুটি এখন তাদের থেকে কমপক্ষে হলেও দশ মিনিটের দূরত্বে রয়েছে। এখন যা করার তাদের নিজেদেরই করতে হবে।

ওয়্যারহাউজটার দিকে আরো কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইলো স্যাম। আক্ষেপ করছে, হাতে যদি টায়ার আয়রনের চেয়ে আরো ভালো কিছু থাকতো।

এসইউভিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই মনে পড়লো, তারা তো সামনের সিটে বসা দুজনকেই দেখেছিলো মাত্র। পিছনের সিটের ব্যাপারে তো কিছুই জানে না।

রেমিকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলে উবু হয়ে গাড়িটার দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলো স্যাম। গাড়িটার কাছে পৌঁছে উঁকি দিতেই কালো কাঁচের আড়ালে একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেলো।

 ব্রি পড়ে আছে গাড়ির ফ্লোরবোর্ডে। তার হাতগুলো পিছমোড়া করে বাধা। মুখে একটা কাপড়ের টুকরো ঢুকানো, পাগুলোও বেধে রাখা।

 ব্রির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জানালায় আলতো টোকা দিলো স্যাম। শব্দ। শুনেই তার দিকে চোখ তুলে তাকালো ব্রি। স্যাম তার ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ থাকার ইশারা করে জানালো যে ওরা তাকে এখানে ফেলে রেখে যাবে না।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো ব্রি। গাড়ির দরজাটা খোলার চেষ্টা করলো স্যাম। অবশ্যই, দরজাটা লক করা। ব্রির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আশেপাশে একবার তাকালো। তারপর আবার রেমির কাছে ফিরে গিয়ে বলল, ব্রি আছে গাড়িতে।

ঠিক আছে ও?

বেঁধে ফেলে রেখেছে, তবে সুস্থই আছে, স্যাম জানালো। ওয়্যারহাউজটা একবার চেক করে দেখা দরকার। আমাদের বিরুদ্ধে কারা আছে সেটা জেনে লড়াইয়ে নামা উচিৎ।

একমত হয়ে ওয়্যারহাউজের খোলা দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলো ওরা।

শোনার জন্য দেয়ালে কান পাতলো স্যাম, তবে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। তোমার পার্সে নিশ্চয় এখন ঐ আয়নাটা নেই?

কিসের জন্য লাগবে ওটা?

কিভার থেকে না সরে ভিতরে কী আছে তা দেখার জন্য।

রেমি তার ফোনটা উঁচিয়ে ধরে বলল, ক্যামেরা লেন্সে কাজ চলবে?

অবশ্যই চলবে। তোমার মতোই চমৎকার, বুদ্ধিদীপ্ত একটা আইডিয়া দিয়েছে।

তোষামোদ করে কিন্তু…

সব জায়গায় সুবিধা করা যায় না?

সেলফোন পাওয়া যায় না, ফিসফিসিয়ে বলে ক্যামেরা অপশনটা চালু করে ফোনটা স্যামের দিকে বাড়িয়ে দিলো রেমি।

টায়ার আয়রনটা মাটিতে রেখে দরজার দিকে ঝুঁকে ক্যামেরাটা বাড়িয়ে ধরলো স্যাম। মিনিটখানেক ধরে ভিডিও করার পর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর পিছিয়ে গিয়ে প্লে করলো ভিডিওটা।

 দেখো, ভিডিওয়ের দিকে ইশারা করে বলল স্যাম। একটা বেঞ্চের ওপর তিনজন লোক ঝুঁকে বসে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে আছে। খুব সম্ভবত রেমির ফিরিয়ে দেওয়া বইটাই দেখছে। স্ক্রিনটা বেশ ছোটো হলেও দৃশ্যটা পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে। তিনজনের মধ্যে দুইজনের হাতে থাকা পিস্তলও দেখতে পাচ্ছে ওরা।

হোটেল রুমে আসা নকল পুলিশ দুইজন, রেমি বলল।

এবং সাথে বইয়ের দোকানের ডাকাতও আছে।

কী করবে এখন ওরা? অপেক্ষা করবে নাকি আক্রমণ করবে? ঝুঁকিটার ব্যাপারে একবার ভেবে নিলো স্যাম। একটা পিস্তল এবং টায়ার আয়রনের বিপক্ষে তিনজন সশস্ত্র শত্রু। ঝকিটা অনেক বেশিই। তবে জুটি হিসেবে স্যাম এবং রেমিও বেশ ভয়ঙ্কর। ঘিলুহীন কিডন্যাপারদের ঘায়েল করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না তাদের। টায়ার আয়রনটা মাটি থেকে তুলে, রেমিকে নিয়ে দরজার মুখ থেকে গাড়ির অন্য পাশে সরে গেলো স্যাম। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, আমাদের প্রথম কাজ হলো ব্রিকে ঐ গাড়ি থেকে বের করে আনা।

সে ভেবেছিলো গাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙে দরজাটা খুলবে। তবে ঠিক তখনই তার চোখ পড়লো ঝিকমিক করতে থাকা লাল অ্যালার্ম বাতিটার ওপর।

কোনো প্ল্যান বি? রেমি জিজ্ঞেস করলো।

আসলে স্যামের প্রথম প্ল্যানটা দিয়ে কিন্তু এখনো কাজ সাড়া যাবে। যানটা দেখে অনেকটা পুরোনো মডেলের গাড়ির মতো মনে হচ্ছে। স্যাম আশা করছে এটায় হয়তো আধুনিক মোশন অ্যালার্ম সিস্টেমটা এখনো যুক্ত করা হয়নি। ছোটো চাকুটা বের করে এনে রেমির হাতে দিয়ে বলল, কাঁচ ভাঙার সময় আমাকে কভার দিবে তুমি। যদি অ্যালার্ম না বাজে, তাহলে আমি এসইউভির পিছনে সরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আর যদি বেজে উঠে, তাহলে আমাদের দিকে তেড়ে আসবে গুণ্ডাগুলো। তখন হয়তো বির বাধন কাটার জন্য কয়েক সেকেন্ডের মতো সময় পাবে। ঐ সময়ের ভিতরেই চেষ্টা করবে তাকে নিয়ে দূরে সরে যেতে। তখন আমি গুলি করে তাদের গতি কমানোর চেষ্টা করবো।

স্যামের কথাগুলো মেনে নিয়ে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রেমি। পিস্ত লটা তাক করে রেখেছে ওয়্যারহাউজের দরজার দিকে।

স্যাম ওদিকে টায়ার আয়রনটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভারের জানালাটার সামনে। গাড়ির সেফটি গ্লাসগুলো ভাঙার মতো করেই ডিজাইন করে থাকে। যদিও তারপরও কাঁচটা যথেষ্টই শক্ত। এর মানে হলো ভাঙার জন্য স্যামকে এখন শুধু সঠিক জায়গাটাতেই আঘাত করতে হবে। একটার বেশি আঘাতের সুযোগ নেই। নাহলে অ্যালার্ম বেজে উঠার সম্ভাবনাই বেশি। হালকা একটা পিছিয়ে গিয়ে লোহার মাথাটা দিয়ে ডান দিকের নিচের কোনায় আঘাত করলো স্যাম। কাঁচ ফেটে হীরার টুকরোর মতো গুড়ো গুড়ো হয়ে পড়তে শুরু করেছে। ড্রাইভারের সিটের ওপর।

তবে অ্যালার্ম বেজে উঠেনি। তার মানে অবস্থা এখন পর্যন্ত তাদের অনুকুলেই আছে। টায়ার আয়রনটা ফেলে পিস্তলটা নিয়ে এসইউভির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা রেমির দিকে দৌড়ে গেলো স্যাম। দরজার দিকে পিস্তলটা তাক করে দাঁড়ানোর পর রেমিকে ইশারা করলো তার কাজ করার জন্য।

গাড়ির কাছে পৌঁছে লকটা খুলে নিলো রেমি। পিছনের দরজাটা খুলতে যাবে ঠিক তখনই তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠলো গাড়িটা। অ্যালার্ম সিস্টেম তার কাজ করতে শুরু করেছে। এরমানে এখনই গুণ্ডাগুলো তেড়ে আসবে তাদের দিকে। চোখের কোণ দিয়ে রেমির দিকে তাকালো স্যাম। রেমি এখন উবু হয়ে ব্রির বাঁধন কাটার চেষ্টা করছে।

ওয়্যারহাউজের দরজাটা খুলে যেতেই মনে মনে গালি দিয়ে উঠলো স্যাম। গাড়িটার দিকে বন্দুক তাক করে কেউ বেরিয়ে এলো বিল্ডিংটা থেকে।

হেই! চেঁচিয়ে উঠলো স্যাম। সাথে সাথে গর্জে উঠলো তার ৩৫৭ এর রিভলভারটাও। বুলেটটা মুখে গিয়ে আঘাত করার সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো লোকটা। পড়ার সময় লোকটার হাত থেকেও কিছু একটা ছিটকে পড়েছে। গাড়ির চাবি!

 সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে চাবিটা তুলে নিয়ে রেমির দিকে তাকিয়ে বলল, রেমি, চাবি!

বলে গাড়ির ওপর দিয়ে চাবিটা রেমির দিকে ছুঁড়ে দিলো স্যাম।

শূন্য থেকে চাবিটা লুফে নিয়ে ড্রাইভার সিটে চড়ে বসলো রেমি। চাবিটা ইগনিশনে লাগিয়ে ঘুরাতেই ইঞ্জিনটা আবার প্রাণ ফিরে পেলো যেন। দৌড়ে এসে তাড়াতাড়ি প্যাসেঞ্জার সিটে চড়ে বসলো স্যাম। ঠিক তখনই বিল্ডিং থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো অন্য দুই কিডন্যাপারও। গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে ওরা।

.

গ্যাস প্যাডাল চেপে ধরলো রেমি। সাথে সাথেই বিপজ্জনকভাবে ঘাটের প্রান্তের দিকে দৌড় লাগালো গাড়িটা।

 রেমি, কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো স্যাম।

 আমি দেখেছি ওটা, বলে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরানো শুরু করলো রেমি। আবারো ড্রাইভওয়েতে ফিরে এসেছে গাড়িটা।

পিছনে ফিরে তাকালো স্যাম। দ্বিতীয় লোকটা পিস্তল তাক করে রেখেছে তাদের দিকে। তবে গুলি করতে দেরি করছে। সুযোগটা হাতছাড়া করলো না স্যাম। তারা গুলি করার আগেই ট্রিগারে চাপ দিলো। সাথে সাথেই দেখলো যে তৃতীয় লোকটা তার বাম হাঁটু আঁকড়ে ধরে নুয়ে পড়েছে সামনের দিকে। অর্থাৎ, স্যামের টার্গেট মিস যায়নি।

 গুলিবর্ষণ হচ্ছে অন্যপাশ থেকেও। গোলাগুলির শব্দে তাদের কানে প্রায় তালা লেগে যাওয়ার দশা। দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এসইউভির গ্যাস প্যাডালে পা চেপে ধরে রেখেছে রেমি। কাম অন, স্পিড আপ!

ওদিকে বুলেটের আঘাতে গাড়ির পিছনের কাঁচটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। বিপদ বুঝতে পেরে স্যাম সতর্ক করলো, মাথা নুইয়ে রাখো। শুধু সতর্ক করেই থেমে যায়নি, সাথে সাথে ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে গুলিও ছুড়ছে অনবরত।

যতটা সম্ভব মাথা নুইয়ে রেখেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে রেমি। রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত গতি কমানোর কোনো ইচ্ছা নেই তার। দ্রুত গতিতে মোড়টা পেরিয়ে আবারো উঠে এলো রাস্তায়। একটু আগে এই পথটা দিয়েই এসেছিলো ওরা। অবশ্য বৃষ্টির মধ্যে গতি অব্যাহত রেখে গাড়ি চালানোটা বেশ কঠিন হয়ে গেছে এখন।

 বেশ কিছুটা এগুনোর পর ডেপুটির পেট্রোলকারের টিমটিমে হেডলাইটগুলো চোখে পড়লো ওদের। গাড়িটা আরো কাছে পৌঁছাতেই মৃদু সাইরেনের শব্দও শুনতে পেলো ওরা।

ডেপুটিকে দেখে রাস্তার কিনারে নিয়ে গাড়িটা থামালো রেমি। ডেপুটিও তার গাড়িটা এনে দাঁড়ালো তাদের ঠিক পাশেই। সাইরেনের শব্দটা থামিয়ে দিয়েছে এখন।

আমাদের বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি, প্যাসেঞ্জার দরজাটা খুলতে খুলতে বলল রেমি।

ব্রিকে হাত-পা বাধা অবস্থায় পিছনের সিটে পড়ে থাকতে দেখে এক মুহূর্তের জন্য বাকশূন্য হয়ে গেছে ডেপুটি। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কেউ আহত হননি তো?

 ব্রির মুখ থেকে কাপড়ের টুকরোটা খুলে এনে রেমি জিজ্ঞেস করলো, কী অবস্থা তোমার?

 আ- বলতে গিয়েও থেমে গেলো ব্রি। তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল, আমি ঠিকই আছি। আমার কাজিন? ও কোথায়? ও ঠিক আছে তো?

আমি জানি না, স্যাম জানালো।

 রেমিকে ব্রির বাঁধন কেটে দেওয়ার জন্য বলে স্যামকে নিয়ে গাড়ির পিছনের দিকে চলে গেলো ডেপুটি। আসলে কী ঘটছে সেটা জানতে চাইলো স্যামের কাছে।

রেমির ফোনে ভোলা ভিডিওটা দেখিয়ে ডেপুটিকে পুরো ব্যাপারটাই সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে জানালো স্যাম।

কোথায় ঘটেছে এটা? সব শুনে জানতে চাইলো ডেপুটি।

স্যাম উত্তরের দিকে নির্দেশ করে বলল, এই তো প্রায় পাঁচ মাইলের মতো দূরে হবে জায়গাটা। রাস্তার পাশের ডকে কতগুলো পুরাতন ওয়্যারহাউজ আছে। ওগুলোর দ্বিতীয়টার সামনে।

সব শুনে ডেপুটি এসইভির ডান বাম্পারে লেগে থাকা বুলেটের দাগ এবং গুঁড়িয়ে যাওয়া পিছনের জানালাটার দিকে তাকালো একবার। তারপর রেডিওটা বের ডিস্প্যাচারকে বুফোর্টের বাইরে অবস্থিত পরিত্যাক্ত ওয়্যারহাউজের গোলাগুলির ব্যাপারে রিপোর্ট করে নিলো। তিনজন সন্দেহভাজনঃ তিনজন পুরুষ, ফর্সা শরীর, কালো পোশাক।

 ডিস্প্যাচারকে তথ্যগুলো জানানো শেষে গাড়ির দিকেই রওনা করছিলো ডেপুটি, ঠিক তখনই ব্রি ডেকে থামালো তাকে। আমার কাজিনের ব্যাপারে বলুন।

কী বলবো তার ব্যাপারে? জবাবে বলল ডেপুটি।

আপনার কি তার সাথে কথা হয়েছে?

ফার্মহাউজে?

 মাথা দুলিয়ে সায় দিলো ব্রি।

স্যরি, ম্যাম। ওখানে কারোরই সাড়া পাইনি আমি। দরজাও লক করা ছিলো।

জবাব শুনে রেমির দিকে ফিরে তাকালো ব্রি। চেহারায় উদ্বেগের ছাপ লেগে আছে। আমাদের ওখানে গিয়ে চেক করা দরকার। কে জানে ওর সাথে বাজে কিছু ঘটেছে কিনা?

.

০৯.

রেমির হাত খামচে ধরলো ব্রি। প্লিজ, ল্যারেইন হয়তো কোনো বিপদের মধ্যে আছে।

ওর কথা কিন্তু ঠিক, স্যাম বলল। আমাদের খোঁজ নেওয়া উচিৎ একবার।

স্যার, স্যামকে উদ্দেশ্য করে বলল ডেপুটি ওয়াগনার। আপনার ওপর বিশ্বাস রাখছি আমি। আপনি বুঝে শুনেই কাজ করবেন। বুফোর্ট থেকে ওরা কখন ব্যাকআপ পাঠাবে তা আমি জানি না। আর ঐ তিনজন সশস্ত্র ডাকাতগুলোর ওপর নজর রাখতে আমরা মাত্র একজন ডেপুটিকেই পাঠিয়েছি। ব্যাকআপ ছাড়া ওকে আর এগুতে দিতে পারছি না।

বুঝতে পেরেছি আমরা।

ডেপুটি এরপর ব্রির দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আপনাদের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আপনারা তিনজন-যদি আপনার কাজিনকে খুঁজে পান, তাহলে চারজন-শেরিফের অফিসে এসে স্টেটমেন্ট দিয়ে যাবেন।

মাথা ঝাঁকিয়ে ব্রি সায় দিতেই তাদের থেকে বিদায় নিয়ে পেট্রোল কারে ফিরে গেলো ডেপুটি লোকটা।

 চলো তাহলে, ডেপুটি চলে যেতেই বলল স্যাম। ড্রাইভারের দরজাটা খুলে গাড়িতে ঢুকছে ও।

 আমাদের গাড়িটা কী করব? সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো রেমি।

ফিরে যাওয়ার সময় ওটা নিয়ে যেতে পারবো, বলল স্যাম।

ব্রিও উঠে বসলো রেমির পিছনের সিটে। স্যামকে বলল, প্লিজ একটু জলদি করুন।

শক্ত হয়ে বসে থাকো, বলে গাড়ি নিয়ে হারলোর দিকে ছুট লাগালো স্যাম। উইন্ডশিল্ডের ওয়াইপারগুলো চালু করে দিয়েছে যাতে বৃষ্টির কারণে সামনের দিকে দেখতে অসুবিধা না হয়। পিছনের ভাঙা জানালাটা দিয়ে শো শোঁ করে বাতাস ঢুকছে গাড়ির ভিতরে। ড্রাইভারের জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানির ছিটা আসছে অনবরত। স্যামের মুখ, কাঁধ সব প্রায় ভিজেই গেছে পানিতে। এমনকি প্যাসেঞ্জার সিটে বসে থাকা রেমির শরীরেও পানির ছিটা লাগছে। ব্রির কী অবস্থা দেখার জন্য পিছনের দিকে তাকালো একবার। তরুণ মেয়েটা পুরোপুরিই হতভম্ব হয়ে আছে এখন? তোমার চাচার ব্যাপারটায় খুবই মর্মাহত আমরা, বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ ছাপিয়ে বলল রেমি।

আমি জানি। কিন্তু আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছি এটা। কয়েকমুহূর্ত পর ব্রি সামনের দিকে ঝুঁকে রেমির কাঁধে হাত রেখে বলল, আসার জন্য ধন্যবাদ আপনাদের।

বৃষ্টির ছিটা থেকে বাঁচতে ড্রাইভিং সিটের কিছুটা পাশ দিকে সরে গেছে স্যাম। গাড়ি চালাতে চালাতেই ব্রির দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা এতেই খুশি যে তুমি ঠিকঠাক আছে।

রেমি জানালো, শুনেছি তুমি নাকি এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছিলে। স্যান ফ্রান্সিসকোই যাচ্ছিলে নিশ্চয়?

হ্যাঁ, যেতে চেয়েছিলাম। তারা আমার গাড়িটা রাস্তা থেকে ফেলে দেওয়ায় আর যেতে পারিনি।

সেলমা কল করেছিলো আমাদের, রেমি বলছে। পুলিশ তোমার গাড়িটা খুঁজে পেয়েছে। তোমার ফোন পাওয়ার আগ পর্যন্ত বেশ দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম আমি।

তারা আমার দিকে বন্দুক ধরে রেখেছিলো। আমি তো কখনোই আপনাদের এরকম বিপদে ফেলতে চাইনি।

ভাঙা জানালা দিয়ে বাতাস ও দমকা বৃষ্টির ছিটা আসায় কথা চালিয়ে যাওয়া বেশ অসম্ভব হয়ে উঠেছে ওদের জন্য। তাই বলল, আগে গিয়ে তোমার বোনকে দেখে আসি, তারপর কথা বলবো আমরা।

ফার্মহাউজে পৌঁছাতে প্রায় দশ মিনিটের মতো লাগলো ওদের। থামানোর সাথে সাথেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় লাগালো ব্রি। দরজা খোলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। জোরে জোরে করাঘাত করছে এখন। কোনো সাড়া নেই তবুও। ল্যারেইন! ল্যারেইন! কাঁদতে শুরু করলো ও।

 রেমি ও স্যামও এগিয়ে এলো দরজার কাছে। ব্রিকে কাঁদতে দেখে স্যাম বলল, আমি দেখি অন্যভাবে ঢোকার কোনো পথ আছে কিনা!

বলে পা বাড়ালো বাড়ির পিছনের দিকে। রেমি এবং ব্রিও অনুসরণ করছে তাকে।

বাড়ির পিছন দিকেও একটা দরজা আছে। স্যাম খোলার চেষ্টা করলো দরজাটা। এটাও তালা লাগানো দেখে ব্রি বলল, লাথি দিয়ে খুলতে পারবেন না?

ওটার হয়তো প্রয়োজন পড়বে না, তালাটার দিকে তাকিয়ে বলল স্যাম। ওয়ালেট থেকে ক্রেডিট কার্ডটা বের এনে দরজার ফ্রেমের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে হালকা নাড়া দিতেই খুট করে খুলে গেলো তালাটা। তোমার কাজিনের উচিৎ দরজার জন্য ডেডবোল্ট জাতীয় কিছু ব্যবহার করা, দরজাটা খুলতে খুলতে বলল স্যাম।

কোনো জবাব না দিয়ে দৌড়ে রান্নাঘর পেরিয়ে ব্রি ডাকতে শুরু করলো, ল্যারেইন! কোথায় তুমি?

ডাকতে ডাকতে হলওয়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ব্রি। রেমি ও স্যামও দৌড়ে আসছে তার পিছু পিছু।

দৌড়ে আসতে আসতেই মুখের ওপর থেকে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে নিচ্ছে রেমি। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে যাবে, ঠিক তখনই শুনতে পেলো তাদের নিচ থেকে কিছু একটার শব্দ ভেসে আসছে। ঝট করে থেমে শব্দটার দিকে লক্ষ্য করে তাকালো ও। সে নিশ্চিত যে তাদের নিচ থেকে থাবার শব্দ আসছে। এখানে দেখো! সিঁড়ির নিচে থাকা স্টোরেজ ক্যাবিনেটের দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুললো ও।

বোনকে বের করার জন্য প্রায় উড়ে এসে ক্যাবিনেটের দরজার সামনে এসে পৌঁছালো ব্রি। ল্যারেইন!

ব্রির মতো ল্যারেইনকেও হাত-মুখ বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছিলো। ব্রি তার মুখ থেকে কাপড়ের টুকরোটা সরিয়ে জানতে চাইলো, তুমি ঠিক আছে?

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো ল্যারেইন।

হাত-পায়ের বাধন কেটে ল্যারেইনকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো স্যাম ও রেমি।

এরপর তাকে জড়িয়ে ধরে কাউচে নিয়ে বসানোর পর ব্রি বলল, তোমাকে নিয়ে অনেক দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম আমি।

তুমি এখানে আসলে কিভাবে? ল্যারেইন জানতে চাইলো।

ব্রি ফার্গো দম্পতিকে দেখিয়ে বলল, ফার্গো দম্পতি। আমার বন্ধু। তারাই ঐ বইটা নিয়ে এসেছে এখানে।

ল্যারেইন তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। আ- দূর থেকে বজ্রপাতের শব্দ ভেসে আসায় বাক্যটা বলে শেষ করতে পারলো না। তারপর হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কিছু ড্রিঙ্ক করা দরকার আমার। হাত কাঁপছে ওর।

বসুন, বলল রেমি। আমি নিয়ে আসছি। পানি চলবে?

ধন্যবাদ, তবে আমার মনে হয় আরো কড়া কিছু দরকার এখন।

বলে রান্নাঘরে দিকে পা বাড়ালো ল্যারেইন। অন্যরাও আসছে তার পিছু পিছু। ডিশওয়াশার র‍্যাক থেকে গ্লাস তুলে নিয়ে ফ্রিজ থেকে ভদকার বোতল বের করে আনলো ল্যারেইন। গ্লাসে ঢেলে চুমুক দিতে যাবে ঠিক তখনই বি বলে উঠলো। তোমার কি মনে হয় ওটা খাওয়া ঠিক হবে এখন? আমাদের কিন্তু পুলিশের কাছে যেতে হবে।

ঠিকই করছি আমি। তোমার কি কোনো ধারণা আছে ক্যাবিনেটের ভিতর থাকতে কেমন লাগে, বিশেষ করে যখন এটাও অজানা যে কেউ তোমাকে খুঁজতে আসবে কিনা?

 জবাবে ব্রি কিছু বলল না। ব্রির অস্বস্তিটা বুঝতে পেরে রেমি তার কাঁধে হাত রেখে বলল, তোমরা দুজন কী অবস্থায় ছিলে সেটা আমি কল্পনাও করতে পারছি না। এমনকি তোমরা কেউই কারো ব্যাপারে কিছুই জানতে না। নিশ্চয়ই অবস্থাটা খুব খারাপ ছিলো তোমাদের জন্য।

 হ্যাঁ, খুবই খারাপ ছিলো, ল্যারেইনের চোখের দিকে তাকিয়ে জবাবটা দিল ব্রি।

ব্রির মন্তব্যে কিছুটা চমকে গেছে ল্যারেইন। গ্লাসটা নামিয়ে বলল, ওহ, ব্রি… আমি দুঃখিত। আমাকে কি ক্ষমা করতে পারবে তুমি?

কিসের জন্য?

তারা তো তোমাকেই কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিলো। নিশ্চিতভাবেই আমার থেকেও বাজে অবস্থায় ছিলে তুমি।

 এর জন্য দুঃখিত হবার কিছু নেই। মি. অ্যান্ড মিসেস ফার্গো যে আমাকে খুঁজে বের করতে পেরেছে এতেই খুশি আমি।

হা। ভাগ্য ভালো ছিলো তোমার।

 ফোনটা কোথায়? ল্যারেইনকে জিজ্ঞেস করলো রেমি। শেরিফের অফিসে ফোন করা উচিৎ আমাদের। তারা হয়তো আপনি ঠিক আছেন কিনা সেটা জানার অপেক্ষায় আছে।

পুরো বাড়ি জুড়েই বেশ কয়েকটা পোর্টেবল হ্যান্ডসেট আছে। সিঁড়ির কাছের হলওয়েতেও আছে একটা।

কথাটা শুনেই হলওয়ের দিকে পা বাড়ালো স্যাম। কিছুক্ষণ পরই ফোনে কথা বলতে বলতে রান্নাঘরে ফিরে এলো আবার। হ্যাঁ, হ্যাঁ। বুঝতে পেরেছি। আমরা এখানেই থাকবো।

তারপর ফোন কেটে রিসিভারটা কাউন্টারের ওপর রেখে বলল, তারা গোয়েন্দা বিভাগের একজনকে পাঠাবে এখানে।

মাথা ঝাঁকালো ব্রি। তবে রেমি বলল, সন্দেহভাজনদের ব্যাপারে কী বলল? কাউকে কি ধরতে পেরেছে?

ইনভেস্টিগেটর এখানে এলেই হয়তো ওটার ব্যাপারে জানা যাবে।

ভদকার বোতলটার দিকে একবার তাকালো ল্যারেইন। তারপর আবার স্যামের দিকে ফিরে বলল, এখানে কেন লোক পাঠাচ্ছে ওরা?

ওরা বলতে পুলিশ? আমাদের স্টেটমেন্ট এবং প্রমাণ সংগ্রহের জন্য।

উত্তরটায় ল্যারেইন কিছুটা চমকে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কী ধরনের প্রমাণ?

আঙ্গুলের ছাপ-টাপ, খুব সম্ভবত।

ভদকার গ্লাসটা কাউন্টারে নামিয়ে রাখলো ল্যারেইন। কী একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনা ঘটছে।

 ব্রি এগিয়ে এসে তার বোনের হাতে ধরে বলল, পুলিশ অপরাধীকে খুঁজে বের করবে। কে জানে, হয়তো এতোক্ষণে ধরেও ফেলেছে।

গ্লাসে আরো কিছু ভদকা ঢালার মাধ্যমে নিঃশব্দে জবাব দিলো ল্যারেইন। রেমি অবশ্য এটার জন্য তাকে দোষ দিতে পারছে না। হাজার হোক, সদ্যই বাবাকে হারিয়েছে, আর কিছুক্ষণ আগে নিজেও বন্দী ছিলো ছোটো একটা চাপা জায়গায়। কিচেন টেবিলের সামনে থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ওটাতে বসে শুধু বলল, মনে হয় আমাদের সবারই একটু বসে রিল্যাক্স করা উচিৎ। বেশি দুঃশ্চিন্তিত বা আতঙ্কিত হওয়াটা কোনো উপকারে আসবে না।

 ভালো বলেছেন, বোতলটা হাতে নিয়ে টেবিলের দিকে আসতে আসতে বলল ল্যারেইন। ব্রি, তুমিও একটা গ্লাস নিয়ে এসে জয়েন করো আমার সাথে।

আমি ঠিক আছি।

না, তুমি ঠিক নেই। তারা তোমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলো। এক ঢোক গিলো তুমিও।

ব্রি অবশ্য তা করলো না। ভদকার পরিবর্তে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো শুধু। তারপর কাজিনের পাশে বসে বলল, আমি জানি না তুমি কিভাবে কড়া জিনিসটা গিলতে পারো।

এটা শক্তি যোগায় শরীরে, বলে গ্লাসে লম্বা চুমুক দিলো ল্যারেইন।

ল্যারেইনকে নিয়ে কিছুটা দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছে রেমি। মহিলা যেভাবে ঢোক গিলছে তাতে তার আশঙ্কা হচ্ছে মানুষটা হয়তো পুলিশ এসে পৌঁছানোর পর কিছু বলার মতো অবস্থায় থাকবে না। তাই নিজে থেকেই কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার সিদ্ধান্ত নিলো ও। অল্প কয়েকটা প্রশ্নে হয়তো তেমন কোন ক্ষতি হবে না কারো। আশা করছি প্রশ্নটায় হয়তো কিছু মনে করবেন না, কিন্তু আসলে কী ঘটছে এসব?

ল্যারেইন মাথা নাড়তে নাড়তে আক্ষেপের স্বরে বলল, যদি জানতাম!

আপনার বাবার ম্যাপ বইটার সাথে কি এসবের কোনো সম্পর্ক আছে?

প্রশ্নটা শুনে ব্রির দিকে একবার তাকালো ল্যারেইন। বলল, বাবা যদি আমার বলা ক্রেতার কাছে বইটা বিক্রি করতো, তাহলে হয়তো এসবের কিছুই ঘটতো না এখন।

আপনি উনার জন্য ক্রেতা খুঁজে দিয়েছিলেন? জানতে চাইলো রেমি।

হ্যাঁ, বলল ল্যারেইন। একজনকে পেয়েছিলাম। বইটার জন্য অনেক বড়ো অঙ্কের টাকা দিতে চেয়েছিলো লোকটা। বইটার দামের থেকেও কয়েকগুণ বেশি।

ওদিকে স্যাম শুধু এক জানালা থেকে আরেক জানালায় পায়চারি করছে। বাড়ির সামনের দিকটায় তাকাচ্ছে একটু পরপর। রেমি অবশ্য স্যামের দিকে মনোযোগ না দিয়ে ল্যারেইনকে জিজ্ঞেস করলো, কে?

নামটা মনে নেই আমার।

আমার আছে, বলল ব্রি। লোকটার নাম চার্লস এভেরি।

যে নামই হোক, ল্যারেইন তার গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলছে, আমি শুধু এটাই জানি যে, বাবা হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলো বইটা বিক্রি করবে না। কেন করবে না সেটাও বলেনি।

 আঙ্কেল উদ্বিগ্ন ছিলো, ব্রি বলল। বইয়ের কপির ব্যাপারে অনেকগুলো ফোন এসেছিলো তার কাছে। আর এরপর হঠাৎই এক আগন্তুক এলো বইয়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর করতে। খুব সম্ভবত ঘটনাগুলোর টাইমিং-এর কারণেই আঙ্কেল পিছিয়ে গিয়েছিলো।

স্যাম আবার রান্নাঘরে ফিরে এসেছে। জানালা দিয়ে ড্রাইভওয়েতে একবার নজর ফেলে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, টাইমিং?

মাথা ঝাঁকালো ব্রি। বইয়ের প্রথম মুদ্রণের অন্যান্য কপিগুলো থেকে এন্ডপেপার চুরির ব্যাপারটা সম্পর্কে জানতো আঙ্কেল। আমার মনে হয় আঙ্কেল হয়তো ভেবেছিলো একই কারণে তাকেও কেউ টার্গেট করেছে।

যুক্তি আছে তোমার কথায়, স্যাম বলল। কিন্তু আমরা এটার সাথে জড়ালাম কিভাবে?

মিসেস ফার্গোর সাথে কাজ শুরু পরই আমি আঙ্কেলকে আপনাদের ব্যাপারে বলেছিলাম। বলেছিলাম, আপনারা গুপ্তধন শিকার থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ফার্গো ফাউন্ডেশন এবং দাঁতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তখনই আঙ্কেল বলল যে বইটা কি আপনাদের কারো কাছে দেওয়া যায় কিনা। আপনাদের দিতে পারলে নাকি তার কাঁধ থেকে বোঝা নেমে যাবে।

 হুম, এখন বুঝতে পারছি, খুব একটা সন্তুষ্ট শোনাচ্ছে না ল্যারেইনকে। বাবা কোনো সংগ্রাহকের কাছে বিক্রি করেনি, কারণ বাবা আপনাদের কাছে বিক্রি করবে ভেবে ঠিক করে রেখেছিলো।

দোকানে যাওয়ার মুহূর্তটার কথা স্মরণ করে ব্রিকে বলল, দোকানে গিয়ে কিন্তু আমার মনে হয়নি যে উনি আমাদের আশা করছিলেন।

ওটার জন্য দুঃখিত, ব্রি বলল। ঐদিন সকালেই আমি আঙ্কেলকে ফোন করে বলেছিলাম যে আপনারা দোকানে যাবেন। আঙ্কেল তখন অন্য একটা ফোন কলে পাওয়া হুমকি একটু দুঃশ্চিন্তিত ছিলো, তাই আমার কথাটা ভালোভাবে খেয়াল করতে পারেনি। ক্ষমাসুলভ হাসি ফুটে রয়েছে তার মুখে। আমি ভেবেছিলাম বইটা দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেই আঙ্কেল আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে।

 হুম, ল্যারেইন বলল। আর এখন বাবা মরেই গেছে।

 ব্রি তার বোনের কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনার সুরে বলল, ডাকাতির কথা শুনে আমি রাতেই তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ চোখ চকচক করে উঠলো ব্রির, পানি পড়ছে তার গাল বেয়ে। আমি খুবই দুঃখিত। আমি যেতে পারিনি। এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথেই আমাকে ধরে ফেলেছিলো ওরা। এরপর শুধু জানি, আমি ল্যারেইনের এখানে আছি। গাল থেকে চোখের অশ্রু মুছে রেমির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো ও। তারা বলছিলো, বইটা না পেলে নাকি তারা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। আমি ভেবেছিলাম তারা হয়তো সত্যিই তা করে বসবে। নাহলে আমি কখনো…।

 ব্রি, বলল রেমি। তুমি ওটাই করেছো তোমার যেটা করা দরকার ছিলো। আমি তোমাকে একমুহূর্তের জন্যও সন্দেহ করিনি।

স্যাম আবারো জানালার দিকে তাকিয়ে দ্রুত গতিতে পায়চারি করতে শুরু করেছে। প্রতিবারই যখন জানালা থেকে সে তাদের দিকে ফিরে আসে, ততবারই ব্রি আর ল্যারেইন উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকায় ওরে দিকে। দুইজনের উদ্বেগ দেখে রেমি মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, পানি খাওয়া দরকার আমার। পানি খেয়ে আসছি।

বলে ক্যাবিনেট থেকে একটা গ্লাসে পানি ঢেলে স্যামের দিকে এগিয়ে গেলো রেমি। স্যামের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, কী করছো তুমি? এভাবে তো তাদেরকে আরো নার্ভাস করে তুলছে।

রেমির দিকে তাকিয়ে স্যাম নিচুস্বরে বলল, আমাদের হাতে মাত্র একটা পিস্তলই আছে। আর আছিও এখন নির্জন এক জায়গায়। এখন আমরা খুবই ইজি টার্গেট। তাই চোখ রাখতে হচ্ছে।

ঠিক তখনই বিজলি চমকালো আকাশে। এতো উজ্জ্বল আলো যে রান্নাঘরও আলোকিত হয়ে গেছে বিজলির কারণে। এরপরই ভেসে এল বজ্রপাতের বিকট এক শব্দ। ব্রি ও ল্যারেইন দুইজনই চমকে গেছে শব্দে। ঠিক তখনই বেজে উঠলো টেবিলের ওপর রাখা হ্যান্ডসেটটাও! চমকে উঠে ওটার দিকে তাকালো ল্যারেইন।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলো ও। হ্যালো?… হ্যালো? কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো জবাব আসছে না। আরো কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে ফোনটা কেটে ল্যারেইন বলল, হয়তো কোনো রং নাম্বার ছিলো।

একে-অপরের দিকে তাকালো রেমি ও স্যাম। সত্যি বলতে দুইজন একই কথা ভাবছে এখন। ডাকাতগুলো কল করে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে তারা আবার বাড়িতে ফিরে এসেছে কিনা।

পিছনের দরজাটা ঠিকঠাকমতো লাগানো আছে কিনা তা চেক করে দেখছে রেমি। আর স্যাম পিস্তলটা বের করে ল্যারেইনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাসায় কি আরো কোনো অস্ত্র আছে?

.

১০.

ফোন আসার পর থেকে প্রতিটা শব্দই ভয় পাইয়ে দিচ্ছে ওদেরকে। জানালায় বৃষ্টির পানির ফোঁটার শব্দ, মেঘের গুড়গুড়, বজ্রপাতের শব্দে প্রতিবারই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে ব্রি ও ল্যারেইন।

পুলিশেরা আর মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বে আছে। তবে তাদের এখানে এসে পৌঁছার আগ পর্যন্ত একেবারেই স্বস্তি পাচ্ছে না স্যাম। অদ্ভুত ফোন কলটা দুই মহিলাকেই ভয় পাইয়ে দিয়েছে। যদিও ফোন আসাটা কাকতালীয় হতে পারে, তারপরও টাইমিংয়ের কারণে কেউই স্বাভাবিক থাকতে পারছে না।

স্যাম তার হাতের রিভলভারটা রেমিকে দিয়ে দিয়েছে। এর পরিবর্তে ল্যারেইনের মৃত স্বামীর জং ধরা শটগানটা তুলে নিয়েছে ও। মহিলাদের সবাই এখন ফ্রন্ট রুমে বসে আছে। তবে সে দাঁড়িয়ে আছে জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তাটার ওপর নজর রাখার জন্য।

ল্যারেইন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত। স্যামের এই আইডিয়াটা ভালো লাগেনি। তবে এই মুহূর্তে ল্যারেইনের মাথা থেকে আইডিয়াটা সরানোও বেশ কঠিন কাজ। আর এই কঠিন কাজটাই বেশ ভালোভাবে করছে রেমি। অন্য দুইজনকে বইটার ব্যাপারে নানান প্রশ্ন করে মনোযোগটা অন্য দিকে সরিয়ে রাখছে ও। সবাই কেন এই বইটার পিছনে লেগেছে?

উত্তরটা বলার আগে একবার ব্রির দিকে তাকালো ল্যারেইন। তারপর বলল, আ-আমি তাদেরকে এটার ব্যাপারে বলতে শুনেছিলাম। মানে ঐ লোকগুলোর থেকে যারা আমার বাসায় এসেছিলো। ঠিক তখনই ব্রিকেও নিয়ে আসা হয় এখানে।

তারা কী বলেছিলো আসলে?

বলেছিলো যে তারা বইটা থেকে ম্যাপটা পেলেই চাবির জন্য সবকিছু পেয়ে যাবে। যদি ওটা ওখানে থাকে, তাহলে তারা তাদের টাকাটা পাবে এবং আমাদেরকে ছেড়ে দিবে।

মাথা ঝাঁকালো ব্রি। হ্যাঁ, আমাকেও এটা বলেছে ওরা। তারা আমাদেরকে তখনই ছাড়বে যখন তারা বই এবং তাদের টাকা হাতে পাবে। তবে তারা কোথায় যেন চাবি খুঁজতে যাচ্ছিলো। সত্যি বলতে আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো ভুল বুঝেছি।

 বইটা, রেমি বলল ল্যারেইন, কি কারণে তারা ভাবলো যে এটাই ঐ বইটা?

এই ব্যাপারে ব্রি আমার থেকে ভালো বলতে পারবে।

 স্যাম ভাবছে, নিশ্চিত ভাবেই বইয়ের ইতিহাসের ব্যাপারে ওরা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ধরতে পারছে না। আর একমাত্র যে ব্যক্তিটা এসবের ব্যাপারে জানতো সে এখন মৃত। তোমার আঙ্কেল এটার ব্যাপারে কী বলেছিলো?

 আঙ্কেল বলেছিলো, বইটা নিয়ে আরো রিসার্চ করা নাকি বাকি আছে। আঙ্কেল এই কাজটাই করছিলো, তখনই ল্যারেইন চার্লস এভেরি নামের একজনের কাছে বইটা বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলে।

চার্লস এভেরি… স্যামের কাছে নামটা বেশ পরিচিত লাগছে। তবে কেন লাগছে সেটা বুঝতে পারছে না। আরো কিছু বিষয়ও বেশ খোঁচাচ্ছে ওকে। কিডন্যাপের টাইমিং এবং স্থানটাও বেশ অদ্ভুত ছিলো। বইটার জন্য তারা কেন ব্রিকে এতো দূর থেকে ধরে এনেছে? হয়তো ল্যারেইনের নির্জন বাড়ির কোনো সম্পর্ক আছে এর সাথে। তবে এটা ছাড়াও আরো একটা কারণ বেশ খোঁচাচ্ছে ওকে। ল্যারেইন, বলল ও, আপনাকে টার্গেট করার কোনো কারণ বলতে পারবেন?

অবশ্যই। বইটার মালিক ছিলো আমার বাবা।

এটা ছাড়াও কোনো কারণ? যাই হোক, এই চার্লস এভেরি লোকটার সাথে কি আপনি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছেন?

 লোকটাকে কখনো দেখিনি আমি। অন্য একজনকে বাড়িতে পাঠিয়েছিলো।

এছাড়া অন্য কেউ কি বইটার ব্যাপারে জানতে বাসায় এসেছিলো অথবা যোগাযোগ করেছিলো?

মাথা নাড়লো ল্যারেইন। না। কেন?

আমার কাছে একটা ব্যাপার অদ্ভুত লাগছে। সবগুলো ঘটনাই ঘটছে এখানে। অন্য কোথাও না।

আপনার কি মনে হচ্ছে চার্লস এভেরি আছে এটার পিছনে।

সত্যি বলতে এই ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই।

চেয়ারে হেলান দিয়ে ব্রির দিকে তাকালো ল্যারেইন। এমন কি হতে পারে না যে বাবা এটার ব্যাপারে অন্য কারোর সাথেও কথা বলেছিলো? ব্রি, তুমি বাবার খুব কাছের ছিলে। তোমাকে কি কিছু বলেছিলো?

নির্দিষ্ট কারো ব্যাপারে কিছুই বলেনি। শুধু একবার বলেছিলো সে কিছু একটা খুঁজে পেয়েছে। তবে এটাও বলেছিলো যে আঙ্কেল এই বইটা নিয়ে আরো কিছু গবেষণা করতে চায়।

জানালার দিকে তাকালো স্যাম। দূর থেকে হেডলাইটের আলো ভেসে আসছে। ব্রির দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে আবারো দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো জানালার দিকে। কখনকার ঘটনা এটা?

 ফাস্ট এডিশনের অন্যান্য কপিগুলো থেকে এন্ডপেপার চুরির ব্যাপারগুলো নিয়ে আর্টিকেল বের হওয়ার পরপরই বলেছিলো, বলে পানির গ্লাসটার দিকে হাত বাড়ালো ও। এরপরই ঘটলো ডাকাতির ব্যাপারটা, আর… বলতে বলতে রেমির দিকে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে হাসলো। আমি এরকম কিছু হতে দিতে চাইনি। অন্তত আপনার সাথে না। যদি আমি বইটার ব্যাপারে ভালো করে জানতাম, তাহলে কখনোই বলতাম না ওটার কথা।

যা ঘটেছে ওটার জন্য নিজেকে দোষারোপ করো না, ব্রি, বলল রেমি।

ঠিক তখনই বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো ইনভেস্টিগেটর। তাদের সবার স্টেটমেন্ট। স্যামের গুলি করা ডাকাতটাকে নিয়েই বেশি আগ্রহ লোকটার। কারণ খুব সম্ভবত পুলিশ ওয়্যারহাউজে গিয়ে কাউকেই খুঁজে পায়নি। আপনি নিশ্চিত আপনি কাউকে গুলি করেছিলেন? স্যামকে জিজ্ঞেস করলো গোয়েন্দা লোকটা।

পুরোপুরি নিশ্চিত।

আচ্ছা। তাহলে মনে হয় এটার সাথে যে জড়িয়ে আছে সে নিজের পরিচয় দিতে চাচ্ছে না।

এরই মধ্যে সিএসআই টিমও এসে উপস্থিত হলো ঘটনাস্থলে। পাউডার ছিটিয়ে ছিটিয়ে আঙুল ও অন্যান্য ছাপ সংগ্রহ করছে এক মহিলা। সব দেখে আগের থেকেও আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে ল্যারেইন। ভদকার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে শুধু। রেমির ধারণা, ল্যারেইনের হয়তো আরো অনেক অনেক বেশি ড্রিংক করা বাকি আছে। অবশ্য এটার জন্য কেউ দোষ দিবে না তাকে।

ডিটেক্টিভের তদন্ত শেষ হতে হতে প্রায় বিকাল পাঁচটার মতো বেজে গেছে। সব শেষ হওয়ার স্যাম ও রেমিকে জানালো যে প্রমাণের জন্য এসইউভিটা নিয়ে যেতে চাচ্ছে, তারা যদি তাদের রেন্টাল কারটা আনতে যেতে চায় তাহলে ডিটেক্টিভের সাথেই যেতে পারবে।

 প্রস্তাবটা মেনে নিতে দ্বিধা করলো না স্যাম। রেমি শুধু ব্রির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, তুমি কি আমাদের সাথে ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে যেতে চাও?

ব্রিকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে। ল্যারেইনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ল্যারেইনকে একা রেখে যেতে চাই না।

আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, ল্যারেইন বলল। আমাকে দেখার জন্য এক বন্ধু আসবে। যাও। আমি ঠিকই থাকবো।

তুমি নিশ্চিত?

আমি একা নই, ছাপ নিতে থাকা মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল ল্যারেইন। আর রাস্তাতে মাত্র এক মাইল দূরেরই। যদি আমার বন্ধু। সময়মতো এখানে এসে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে সিএসআইয়ের সাথে করে তার ওখানেই চলে যাবে। যদি ওটা সম্ভব হয় আর কী!

সিএসআইয়ের মহিলা অমত করলো না এতে। বলল যে এতে কোনো সমস্যা হবে না।

 তাহলে, হ্যাঁ, রেমির দিকে তাকিয়ে বলল ব্রি। আপনাদের সাথেই যাব আমি।

****

দুই ঘন্টা পর এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখে জেটটা তাদের অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছে।

স্যাম ও রেমি দুজনই তাদের ভেজা পোশাকগুলো বদলে নিয়েছে। পোশাকগুলো এসইউভির ভাঙা জানালার কাছে ভরেছিলো। জেটে চড়েই স্যাম চলে গেছে ককপিটে তার ক্রুদের সাথে যাত্রার ব্যাপারে আলোচনা করতে। আর রেমি ওদিকে ব্রিকে নিয়ে মেইন কেবিনের একটা টেবিলের পাশে বসে আছে।

ব্রি অবশ্য ফোনে কথা বলছে এখন। তুমি কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছো না কেন? আমি বাসায় পৌঁছেই ফোন দিবো তোমাকে… আচ্ছা, পৌঁছার পর কথা বলবো তোমার সাথে।

ফোনটা কাটার পর রেমি জানতে চাইলো, সব কিছু ঠিক আছে?

ল্যারেইনকে ফোন করেছিলাম তার বন্ধু এসে তাকে নিয়ে গেছে কিনা জানার জন্য। নিয়ে গেছে। আমরা ওখান থেকে চলে আসার পর বেশ ভালো পরিমাণেই ড্রিংক করেছে ও।

 ওটা তখনই বুঝেছিলাম। ড্রিংকের কথায় মনে পড়লো, ডিনারের আগে কি তুমিও কিছু ড্রিংক করবে?

হ্যাঁ, বলল ব্রি। যদি বেশি ঝামেলা না হয় আর কী!

কী নিবে তুমি? চা, কফি নাকি কড়া কিছু?

আপনি জানেনই… বলতে গিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিলো ও। আমার মনে হয় কড়া কিছুই ভালো হবে। তবে ভদকা না হলেই ভালো। হালকা শেরি হলেই চলবে।

ঠিক তখনই ট্রেতে করে পনির ও চিপস নিয়ে এসে উপস্থিত হলো তাদের ফ্লাইট এটেন্ডেন্ড স্যান্ড্রা। রেমি ওসবের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, দুই গ্লাস শেরি হলে ভালো হয়। সত্যি বলতে, স্কচও নিয়ে এসো। কোনো সন্দেহ নেই যে স্যামও আমাদের সাথে জয়েন করবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শেরি ও স্কচ নিয়ে আবার ফিরে এলো স্যা। তারপর আবার চলে গেলো তার নির্দিষ্ট জায়গায়। রেমি তার গ্লাসটা তুলে একটা চুমুক দিয়ে বলল, তোমাকে ফিরে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে আমার।

ধন্যবাদ, ক্লান্তি হাসি হেসে বলল ব্রি। তারপর গ্লাসটা তুলে নিয়ে চুমুক দিলো। অ্যালকোহলের স্বাদে মুখ কিছুটা বিকৃত হয়ে গেছে ওর। আমি যতটায় অভ্যস্ত, তার থেকেও কিছুটা বেশি কড়া এটা।

মুচকি হেসে উঠলো রেমি। তখনই স্যামও এসে যুক্ত হলো তাদের সাথে। রেমির পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো, ল্যারেইনের অবস্থা কী এখন?

ভালোই, মনে হয়। খুব আপসেট হয়ে আছে ও। সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাচ্ছে বারবার। বলছে এটা নাকি তারই দোষ, সে ই চার্লস এভেরিকে এটাতে টেনে এনেছে।

 ট্রেতে কয়েকটা চিপসের টুকরো তুলে নিয়ে স্যাম বলল, আমরা কিন্তু এখনো জানি না আসলেই এর পিছনে ঐ লোকটা আছে কিনা।

ল্যারেইন ভাবছে ঐ লোকটার হাত আছে। ও বলছে ডাকাতদের একজন নাকি ফোনে চার্লি নামের একজনের সাথে মার্কারের ব্যাপারে কিছু বলাবলি করছিলো।

মার্কার? স্যাম বলল।

বইটার সাথে হয়তো কোনো সম্পর্ক আছে ওটার। আমি ধরে নিচ্ছি। এটার সাথে হয়তো ঐ চাবিটার সাথে জড়িত কিছু হবে।

ও কি কোনো জায়গার কথা বলেছে? জানতে চাইলে স্যাম।

কোনো আইল্যান্ডের কোনো পিট বা ওকের ব্যাপারে যেন কী বলছিলো ও। ল্যারেইন অবশ্য প্রচুর মদ্যপ হয়ে আছে এখন, বলল ব্রি।

ঠিক তখনই ককপিট থেকে আবারো মেইন কেবিনে ফিরে এলো স্যা। এসে স্যামের দিকে হেসে তাকিয়ে বলল, বাধা দেওয়ার জন্য ক্ষমা করবেন, মি, ফার্গো। টেকঅফের জন্য ক্লিয়ারেন্স পেয়েছি আমরা।

 একটু অপেক্ষা করো, বলে ব্রির দিকে তাকিয়ে বলল, ল্যারেইন কি ওক আইল্যান্ডের মানি পিটের কথা বলছিলো?

হতে পারে। তার কথা আসলে স্পষ্ট বুঝতেও পারিনি অতোটা।

তোমার কী মনে হয়, রেমি? জানতে চাইলো স্যাম।

নোভা স্কশিয়া? রহস্যটার শেষ বিন্দু পর্যন্ত দেখার ইচ্ছা আছে ওর, তবে সে এখন ব্রির সুস্থতা নিয়েই বেশি দুঃশ্চিন্তিত হয়ে আছে। যদি ব্রি এই যাত্রার জন্য রাজি থাকে, তাহলে ওখানে যাওয়া উচিৎ আমাদের।

আমি ঠিকই থাকবো। আমাকে নিয়ে ভাববেন না।

সম্ভষ্ট হয়ে স্যাম স্যান্ডাকে জানালো, পাইলটকে জানাও যে ফ্লাইট প্ল্যানে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন গন্তব্য হ্যাঁলিফ্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল। ব্রিকে ওখান থেকেই বাসায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবো আমরা।

ওকে, মি. ফার্গো।

স্যান্ড্রো চলে যেতেই ব্রি বলল, ডাকাতগুলো যদি এখনো ওখানে থেকে থাকে? আমি নিজেও বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না।

তার দিকে তাকিয়ে সহানুভূতিশীল হাসি হাসলো রেমি। বলল, সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিন্তু তুমি চাইলে লা জোলায় আমাদের ওখানে থাকতে পারো।

ঐ বাড়িটাকে আসলে একটা দুর্গ বলা যায়। তুমি নিরাপদেই থাকবে আমাদের এখানে। সাথে সায় দিলো স্যাম।

মাথা নাড়লো ব্রি। না, আমি কোনোভাবেই আপনাদের বোঝা…

তুমি তা হবেও না, রেমি জানলো। তুমি আর সেলমা একসাথে থাকলে আমরা দ্রুতই এই রহস্যের সমাধান করতে পারবো। বলতে গিয়ে মনে পড়লো, ল্যারেইন বলছিলো বইয়ের ইতিহাসের ব্যাপারে নাকি তুমিই বেশি জানো…?

অল্প কিছুটা। আমি এট জানি যে আঙ্কেল জেরাল্ড বইটা কিনেছিলো আমার বাবার দিকের এক দূরবর্তী আত্মীয়ের এস্টেট সেলের সময়। কিং জনের সময়ের পর থেকেই মার্শাল ফ্যামিলির পুরুষরা তাদের এই স্বগোষিত পাবিরারিক ইতিহাসকে পাহারা দিয়ে আসছিলো। বলতে গিয়ে হালকা হেসে উঠলো ব্রি। অবশ্যই, এটা কোনোভাবেই সম্ভব না, কারণ এই বইটা লেখাই হয়েছিলো সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকের সময়ে। আর, আপনারাই বলুন, জলদস্যু ও প্রাইভেটিয়ারদের নিয়ে লেখা একটা বই কেউ কি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংরক্ষণ করে যাবে?

করবে না। তবে যদি মূল্যটা সবার আগ্রহের চাবিটার মতো কিছুর সাথে। সম্পর্কিত হয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু আলাদা কথা। তাই না? রেমি বলল।

 এমনকি এই বইটার ইতিহাস নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বইয়ের ম্যাপগুলোর জন্য একটা চাবি আছে, আর এই ম্যাপটা হলো জলদস্যু ও প্রাইভেটিয়ারদের নিয়ে-যাদের আগমনই ঘটেছে কিং জনের শাসনকালের আরো কয়েক শতাব্দী পর। তো, বুঝতেই পারছেন আপনারা। আমি জানি না কিভাবে এই বইটা আমাদের কোনো সাহায্যে আসতে পারে।

ব্রির দিকে তাকিয়ে রেমি মুচকি হেসে বলল, তেমন কিছু না হলেও, আগ্রহ জাগানিয়া ইতিহাস বলাই যায়।

আপনারা দুইজনই আমার সাথে অনেক ভালো আচরণ করেছেন। এতো কিছু ঘটার পরও- কথা থামিয়ে দিয়ে হাসার চেষ্টা করলো ব্রি, কিন্তু পারলো না। বরংচ আরো কান্নায় ভেঙে পড়েছে।

স্যামকে সরার ইশারা করে নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়ালো রেমি। তারপর গিয়ে বসলো ব্রির পাশে। মেয়েটাকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে। হয়তো হাত-মুখ দিয়ে একটু ঘুমানো উচিৎ তোমার। একটা ভালো ঘুম দিলেই কিছুটা ভালো বোধ করবে। আর এসব নিয়ে কথা বলার জন্য পরেও অনেক সময় পাওয়া যাবে।

মাথা ঝাঁকালো ব্রি। হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

ব্রিকে সাথে নিয়ে বিমানের পিছনের অংশে থাকা স্লিপিং কোয়ার্টারগুলোর দিকে নিয়ে গেলো রেমি। কয়েকমিনিট পরেই ফিরে এলো আবার। বেচারী, স্যামকে বলছে, খুবই খারাপ লাগছে ওর জন্য।

 তার কিন্তু দুঃখবোধ করার অধিকার আছে। শুধু ভাবো তোমার আঙ্কেল মারা গেছে, এবং এরপর তোমাকে কিডন্যাপ করেছে কেউ।

ও এখন নিরাপদ আছে। এবং এটাই সবচেয়ে মুখ্য বিষয়। বলে গ্লাসটা উঁচিয়ে ধরে একটা চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেলো রেমি। স্যামের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু। তো, এখন কী বলবে? তোমার বলা আরাম ও বিশ্রামের সপ্তাহটা শুরু হচ্ছে কবে থেকে?

আহা, রেমি! ভালো একটা মুহূর্তকে নষ্ট করছো কেন? প্রতিদিন তো আর নিশ্চয় নর্থ ক্যারোলিনার টারমাকে বসে পঁচিশ বছরের পুরোনো স্কচ খাওয়া হয় না।

 নষ্ট করার কোনো চেষ্টাই করছি না আমি। বলে ড্রিংকে চুমুক লাগালো রেমি। মুহূর্তটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছে। স্যামের অন্যান্য গুণগুলোর মধ্যে এটাকেও বেশ পছন্দ করে রেমি। সবসময়ই হাসিখুশি মুডে থাকতে পারে মানুষটা। শুধু ভাবছি আমার ক্যালেন্ডারের আরো কয়েকটা দিন এভাবে আটকে রাখা উচিৎ হবে কিনা!

তাহলে, কালদিন পর থেকেই শুরু হবে সপ্তাহটা।

 কাল থেকে না? রেমি বলল।

প্রশ্নটার কোনো জবাব না দিয়ে স্যাম প্রসঙ্গ পালটে বলল, ওক আইল্যান্ডে পৌঁছার আগেও কিন্তু আরো অনেক কিছু করা বাকি আছে আমাদের। ধরেই নিচ্ছি ব্রি হয়তো তার কাজিনের মদ্যপ কথাগুলো স্পষ্টভাবেই শুনতে পেয়েছে। তারমানে ওখানে যাওয়ার পর হয়তো দুই তিনজন ক্ষিপ্ত গডফাদারের টার্গেট প্র্যাক্টিসেও পরিণত হতে পারি আমরা।

ট্রিপ ইনস্যুরেন্স করা আছে তো আমাদের?

আমি জানতাম আমি কিছু একটা ভুলে গেছি, আঙুলে চুটকি বাজিয়ে বলে উঠলো স্যাম।

হুম। তা এই চার্লস এভেরি নামের লোকটাকে নিয়ে ধারণা কী তোমার?

কথাটা শুনে স্কচের গ্লাসটা হাতে তুলে নিলো স্যাম। হাতে নিয়ে গ্লাস নাড়তে নাড়তে গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহগুলো নিয়ে ভাবছে। একটা-দুটো ঘটনা না, বরং সবগুলো ফ্যাক্টস নিয়েই বিবেচনা করছে! টাইমিংই তো সবকিছু, তাই না?

আমিও এই একই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলাম। লোকটা হুট করেই জানতে পারলো যে সে বইটা পাবে না। আর এরপরপরই ঘটলো ডাকাতি ও কিডন্যাপিংর ঘটনাগুলো।

 এক ঢোকে গ্লাসটা খালি করে নিলো স্যাম। টেবিলের পাশে থাকা প্যাড এবং কলম হাতে তুলে নিয়ে বলল, এই নামটা আমি সেলমার গবেষণার তালিকায় যুক্ত করলাম। এতে করে শুধু আমরা চার্লস এভেরি সম্পর্কেই না, সাথে সাথে সে কেন এই বইটার ওপর আগ্রহী সেটাও জানতে পারবো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *