ঈমানের প্রদীপ্ত স্পর্শে

ঈমানের প্রদীপ্ত স্পর্শে

হিন্দু জাট এলাকার এক থানার দায়িত্বে ছিলাম আমি। জাটরা হিন্দুদের মধ্যে অনেকটা ব্যতিক্রম। লড়াই মারপিট ও দুঃসাহসিক কাজে এদের খুব নাম ডাক। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এদের আলাদা রেজিমেন্ট আছে। ইংরেজ আমলে বলা হতো জাট রেজিমেন্ট।

সৈনিকি ও জমিদারী পেশাতেই প্রধানত এদের আগ্রহ বেশি।

এক সকালে শহরের সরকারী হাসপাতাল থেকে খবর এলো, সেখানে একজন বিষ খাওয়া রুগী এসেছে। তখন এ ধরনের বিষ খাওয়া বা খুন খারাবির ঘটনা এতটা ঘটতো না।

হাসপাতাল গিয়ে জানতে পারলাম, রুগীকে অজ্ঞান অবস্থায় আনা হয়েছিলো। ডাক্তার বেশ অভিজ্ঞ লোক। রুগী অজ্ঞান অবস্থায়ও যেভাবে ছটফট করছিলো তা দেখেই ডাক্তার নিশ্চিত হয়ে যান ওটা বিষ খাওয়া বা খাওয়ানোর ফেস।

তবুও তাকে ইনজেকশন দেয়া হয়। এই ইনজেকশনের মাধ্যমে নিশ্চিত মৃত্যুপথের রুগীরও কয়েক মিনিটের জন্য জ্ঞান ফিরে। একেও সে ইনজেকশন দেয়া হয়, যাতে সে এতটুকুও বলে যেতে পারে যে, কে তাকে বিষ খাইয়েছে বা এ ব্যাপারে যদি কোন ইংগিতও দিয়ে যায় তাহলেও মামলা অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।

কিন্তু ইনজেকশনে তেমন কোন প্রতিক্রিয়াই হয়নি। অজ্ঞান থাকাবস্থায় মারা যায় সে।

উপশহর থেকে প্রায় চার মাইল দূরের এক গ্রামের বিরাট এক জমিদার ছিলো এ লোক। এ ধরনের জমিদারকে ঠাকুর বলা হয়। ঠাকুররা ধনে মানে খুব প্রভাবশালী হয়।

এমন একজন ঠাকুরের নিহত হওয়ার ঘটনা খুব মামুলি নয়। ডাক্তার পোষ্টমর্টেমের জন্য লাশ হাসপাতালেই রেখে ছিলেন। সেখানে ঠাকুরের বড় ছেলে ছিলো। তাকে আমি থানায় নিয়ে এলাম।

ঠাকুর হত্যার রিপোর্টের ওপর প্রথমে এফ. আই. আর লেখানোর ব্যবস্থা করলাম। তারপর ঠাকুরের ছেলেকে হালকা কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। প্রশ্নের উত্তরে সে যা বললো এ থেকে আরো কতগুলো প্রশ্নের জন্ম দিলো। অর্থাৎ তার উত্তরগুলো পরিষ্কার হলো না।

শুধু স্পষ্ট করে এতটুকু বুঝা গেলো, ঠাকুরের সঙ্গে কারো এমন কোন শত্রুতা ছিলো না যে, বিশ খাইয়ে প্রতিশোধ নেবে।

গ্রাম থেকে বেশ কিছু দূরে তার একটি ছোট বাগান বাড়ি আছে। বাগানে সজির ফলনই বেশি হয়।

ঠাকুর সেখানে মাঝে মধ্যে রাত কাটাতো। গতকাল রাতে বাগান বাড়িতে গিয়েছিলো। মাঝ রাতের অনেক আগেই সেখান থেকে চলে আসে। ঘরের সবাই তখন ঘুমে। সে তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগায়। শব্দ পেয়ে জেগে উঠে তার বড় ছেলেও।

তারা তখন দেখলো, ঠাকুর ব্যথায় কাতরাচ্ছে। ঠাকুর জানালো, তার পেট জ্বলছে এবং সারা দেহ মুচড়ে মুচড়ে আসছে।

কেন এমন হচ্ছে? কি হয়েছে? পেরেশান হয়ে ঘরওয়ালারা জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু ঠাকুর কাতরানির শব্দ ছাড়া কোন উত্তর দিতে পারলো না। ইংগিতে কিছু একটা বুঝাতে চাইলো। কেউ কিছু বুঝলো না।

ঠাকুরের ছেলে দৌড়ে গায়ের দুজন উঝা বদ্যিকে নিয়ে এলো। তারা এসে বললো, বিষাক্ত কোন কিছু ঠাকুর সাবকে কেটেছে।

তারা ঠাকুরের হাত পা পরীক্ষা করে দেখলো, কিন্তু কাটা-ছেঁড়ার কোন লক্ষণ পাওয়া গেলো না। দুজনে পরামর্শ করে ঠাকুরকে কি এক ঔষধ খাইয়ে দিলো। ঠাকুর কয়েক মহূর্ত পর বেহুশ হয়ে গেলো।

ঠাকুর সাব এখন কিছুটা আরামবোধ করছেন। এজন্য শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সকালে উনাকে আরো ঔষধ দেয়া হবে। একথা বলে উঝা দুজন চলে গেলো।

এক দেড় ঘন্টা পর ঠাকুর সে অবস্থাতেই বুকে পেটে খামচে খামচে হাত ফেরাতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে ছটফট করতে লাগলো। সকাল পর্যন্ত তার এভাবেই কাটলো।

কিন্তু সূর্য উঠতেই তার অবস্থা আরো বিগড়ে গেলো। বয়স্ক কয়েকজন লোক তখন বললো, ঠাকুর সাহেবকে তাড়াতাড়ি হাসপাতাল নিয়ে চলো। সেই অর্ধ মৃত অবস্থায় তখন ঠাকুরকে হাসপাতাল আনা হয়।

***

আমি জানতে চাচ্ছিলাম, ঠাকুরের চালচলন কেমন ছিলো আর গ্রামের লোকদের সঙ্গেই বা তার সম্পর্ক কোন পর্যায়ের ছিলো। কারো ছেলে তো আর বাপ সম্পর্কে বলতে পারে না যে, সে খারাপ লোক ছিলো। তবুও ঠাকুরের ছেলেকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম।

সে জানালো, না তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। জমিটমি নিয়েও কারো সঙ্গে বিরোধ ছিলো না। আত্মীয় স্বজনের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিলো সহজ।

তুমি বলেছো ঠাকুর মাঝে মধ্যে বাগান বাড়িতে রাত কাটাতেন। তিনি সেখানে কি করতেন? আমি হঠাৎ করেই প্রশ্নটি করলাম।

ঠাকুরের ছেলে চুপসে গেলো একেবারে।

পানটান চলতো? তাশ খেলা হতো? না গান বাজনা হতো? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আমি দেখিনি কখনো। মনে হয় উনার দোস্ত ইয়ারদের নিয়ে গল্পগুজব করতেন।- সে বললো আমতা আমতা করে।

ওর দ্বিধান্বিত অবস্থা দেখে বুঝলাম, নিজের বাপ সম্পর্কে সে বেফাঁস কিছু বলতে চায় না।

আরেকটা সন্দেহ হলো, সে হয়তো তার বাপকে বিষ দিয়ে মারতে পারে। এ ধরনের ঘটনাও খুব বিরল নয়। এ সন্দেহটা মাথায় রেখে তার কাছ থেকে আমি জেনে নিলাম, তার মা জীবিত আছে কিনা।

ছেলে বললো, তার মা জীবিত আছে। হতে পারে এটা তার সতালো মা। আপন মা মারা যাওয়ার পর ঠাকুর যুবতী কোন মেয়েকে বিয়ে করেছে। যার সঙ্গে এই ছেলের অবৈধ সম্পর্ক ছিলো।

যা হোক, ঠাকুরের ছেলে আমাকে মূল্যবান কোন তথ্য দিলো না। হয়তো মিথ্যাই বলেছে আমার সঙ্গে। যাক, এতে আমার কিছু যায় আসে না। শক্ত হলেও আসল কথা নেয়ার মতো লোক আমি ঠিকই বের করে আনবো।

ঠাকুরকে যারা হাসপাতাল এনেছে, তাদের মধ্যে থেকে দুজনকে আমি হাসপাতাল থেকে থানায় নিয়ে এলাম। এরা ঠাকুরের আত্মীয় নয়; প্রতিবেশি। তবে একজন ঠাকুরের মতোই প্রভাবশালী স্তরের লোক।

ঠাকুরের ছেলেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুর কেমন লোক ছিলো, আর কি কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে?

ঠাকুরের কোন জানী দুশমনের ব্যপারে আমার জানা নেই যে, তাকে হত্যা পর্যন্ত করবে- প্রভাবশালী লোকটি বললো- তবে এতটুকু বলতে পারি, ঠাকুর খুব ভালো লোক ছিলো না। নারী ঘটিত ব্যাপারে তো সে মোটেও সুবিধার ছিলো না।

মেয়েদের মধ্যে কাদের কাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো এটা বলতে পারেন?

সে চার পাঁচজন মেয়ের কথা বললো। কিন্তু এরা সবাই গরিব ঘরের মেয়ে। ঠাকুরকে বিষ খাওয়ানোর মতো দুঃসাহস এদের কারোই হওয়ার কথা না। সে লোক আরো জানালো, ঠাকুর তার বাগান বাড়িতে প্রায়ই মদ গান ও জুয়ার মাহফিল জমাতো। নর্তকী এনে নাচাতো। গায়িকা নর্তকীদের আনতো শহর থেকে।

অনেক সময় কেটে গেলো। ইতিমধ্যে ডাক্তার তার পোষ্টমর্টেমের রিপোর্ট থানায় পাঠিয়ে দিলো যে, ঠাকুরকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।

থানার কাজ এটা দেখা যে, ঠাকুর কি আত্মহত্যা করেছে, না তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ কারণে আমার জন্য জরুরী হলো, তার ঘর বাড়ি। ও ফ্যমিলি হিস্টোরী জানা। তার বন্ধু ও শত্রুদের মধ্যে এবং গ্রাম্য রাজনীতিতে তার কি ভূমিকা ছিলো এটাও বের করতে হবে।

কারণ, হত্যার মামলা বা তদন্তে সর্ব প্রথম দেখা হয় হত্যার আসল উৎসটি কোথায়। এটা জানা খুবই কঠিন কাজ। অনেক গভীরে ডুব দিয়ে শরীরে কাদামাটি লাগাতে হয়।

আমি ঠাকুরের গ্রামে রওয়ানা হতে যাবো এ সময় আমার জুনিয়র সাব ইনস্পেক্টর আমাকে পৃথকভাবে ডেকে নিয়ে সে গ্রামেরই একটা মামলার কথা স্মরণ করিয়ে দিলো।

চার পাঁচ দিন আগে এই ঠাকুরই তার গ্রামের এক বৃদ্ধকে নিয়ে থানায় এসেছিলো। বৃদ্ধের প্রায় সতের বছরের এক মেয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে। গরিব মানুষ। পুলিশের ভয়ে ও নিজের দুর্নামের ভয়ে থানায় আসছিলো না।

এই নিহত ঠাকুর সাহেব তাকে থানায় নিয়ে আসে। আমি মেয়ের লাপাত্তা হওয়ার রিপোর্টও লিখেছিলাম। আইনের চোখে মেয়ে ছিলো অপ্রাপ্ত বয়স্কা। মামলা নেয়া ও সে অনুযায়ি ব্যবস্থা নেয়া অত্যাবশ্যক।

রিপোর্ট লেখার পর জিজ্ঞেস করেছিলাম, মেয়ে কি সুন্দরী ছিলো? আর তার চালচলন কেমন ছিলো?

ঠাকুর জানালো খুব সুন্দরী ছিলো না। তবে স্বাস্থ্য খুব সুন্দর ছিলো।

মেয়ের বাবার সামনে ঠাকুর বললো, না, মেয়ের স্বভাব চরিত্র ভালোই ছিলো। কিন্তু এক ফাঁকে বৃদ্ধকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে বললো ভিন্ন কথা।

আসলে ঐ বুড়োকে খুশি করার জন্য বলে ছিলাম। তার মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। ঠাকুর তখন বলেছিলো- এরা মজুরী করে খেটে খাওয়া লোক। এদের মেয়েরা যৌবনে পৌঁছার আগেই প্রেমপ্রীতি শুরু করে দেয়। ঐ মেয়ে নিজেই ভেগেছে। আপনি এ নিয়ে বেশি ছুটাছুটি করবেন না। দেখবেন, মেয়ে নিজে নিজেই কোথাও গিয়ে উপস্থিত হয়েছে।

আমি ঠাকুরের কথায় তখন প্রভাবান্বিত হয়নি তেমন। কারণ, এসব ঠাকুর, বড় বড় জমিদার জায়গীরদাররা ছোট ঘরের লোকদের মানুষ বলে মনে করে না। গরিব ঘরের মেয়েদের এরাই নষ্ট করে। তারপরও আমার মনে হলো ঐ মেয়ে নিজ ইচ্ছায় লাপাত্তা হয়েছে।

তবুও এ কেসের ভার থানাকে নিতে হবে। ইনস্পেক্টরের ব্যক্তিগত ধারণা এতে কার্যকরি হবে না। তাই সাব ইনস্পেক্টর বিশ্বনাথকে এ দায়িত্ব দিয়েছিলাম। সে তদন্ত করছিলো। আজ এজন্য বিশ্বনাথ সে কেসের কথা স্মরণ করিয়ে দিলো।

ঠাকুরের নিহত হওয়ার সঙ্গে ঐ মেয়ের লাপাত্তা হওয়ার সম্পর্ক না থাকলেও এটা মাথায় রাখলে ভালো হবে যে, সে গ্রামের এক মেয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছো বিশ্বনাথ আমাকে পরামর্শ দিলো।

আমারও মনে হলো ঠাকুরের নিহত হওয়ার সঙ্গে ঐ মেয়ের কোন সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। কারণ, ঠাকুর নিজেই মেয়ের বাপকে জোর করে থানায় নিয়ে এসেছিলো।

***

ঠাকুরের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে চার দিকে লোকের মাতম। ঠাকুরের স্ত্রী ঠাকুরের চেয়ে তিন চার বছরের ছোট হবে। চুল সাদা হতে শুরু করেছে। ছেলে যা বলেছিলো ঠাকুরের স্ত্রী তাই বললো। তার মতে ঠাকুর সেই বাগান বাড়ি থেকেই কিছু একটা খেয়ে এসেছে।

আমার মাথায় আরেকটা চিন্তা এলো। রাতে ঠাকুর বাগান বাড়ি থেকে এসেছে এটা তো তাদের অনুমান। এমনও হতে পারে, ঠাকুরকে কেউ অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে বিষ খাইয়েছে। 

ঠাকুরের স্ত্রী জানালো, তাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক সহজ ছিলো। ঘরে কোন ঝগড়া বিবাদ ছিলো না। সে নিশ্চিত গ্রামের কারো সঙ্গে তার বিরোধ ছিলো না।

ঠাকুরের স্ত্রী কথায় আমি আস্থা রাখতে পারছিলাম না। কারণ, স্বামীর মৃত্যু তাকে বেহাল অবস্থা করে দিয়েছে। দু একটা কথা বলেই সে কেঁদে কেঁদে উঠছিলো।

আমি বাগান বাড়িতে চলে গেলাম। ছয় সাত একর জায়গা জুড়ে বাগানটি। ঘন গাছ গাছালিতে সুন্দর সাজে পরিপাটি করে রাখা। ভেতরের বাড়িটি খুব বড় না। বড় বড় দুই কামরা বিশিষ্ট। সামনে প্রশস্ত উঠোন আছে এবং চারদিক পাচিল ঘেরা। বাগানে তিনজন মালি কাজ করে। বাগানের পাশেই তাদের যার যার সংসারের ঝুপড়ি।

মালি তিনজনকে ডেকে আনলাম। ঠাকুর মারা গেছে এ সংবাদ এরা না জানলেও এতটুকু জানে যে, ঠাকুরকে নিয়ে কোন ঝামেলা হয়েছে।

আমি তাদেরকে এক জায়গায় বসিয়ে বাড়িটি দেখার জন্য ভেতরে চলে গেলাম। এখানে এসেছিলাম আমি একাই। ঠাকুর বাড়ির কাউকে আনিনি।

দেখলাম, এক ঘরের দরজার ভেতর দিকের চাবিসহ তালা ঝুলানো। মালি তিনজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,

ঠাকুর এখানে না থাকলে কি দরজা তালা লাগানো থাকে?

জি হুজুর!- এক মালি জবাব দিলো- তালা তখনই খোলা হয় যখন ঠাকুরজি আসেন এখানে। সকালে দরজায় তালা না দেখে ভেবেছিলাম, ঠাকুর সাব ভেতরে শুয়ে আছেন।

এদেরকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ভেতরটা আরো ভালো করে দেখে নেয়া জরুরী। উঠোনটা ঘুরে ফিরে কামরার ভেতরে গেলাম। প্রথমেই নজরে পড়লো একটা বোতলের দিকে। দেশী মদের বোতল। পাশে দুটি গ্লাস রাখা। আমার পেছন পেছন হেড কনস্টেবলও চলে এসেছিলো।

তাকে বললাম, সাবধানে এগুলো উঠিয়ে নাও। কারণ, এতে আঙ্গুলের ছাপ অবশ্যই আছে। আর এই বোতলের মধ্যে যে বিশ মেশানো মদ ছিলো এতে কোন সন্দেহ নেই। গ্লাস দুটোতে তখনও কয়েক ফোঁটা মদ লেগে ছিলো।

কামরায় একটি খাট বিছানো। সুক্ষ্ম চোখে দেখলাম, খাটের চাদর এলোমেলো হয়ে আছে। নিশ্চই এখানে কোন মহিলা বা মেয়েকে নিয়ে ধস্তাধস্তি হয়েছে। দ্বিতীয় কামরায় গিয়েও তল্লাশি চালালাম। কিন্তু এখানে এমন কিছু পেলাম না যা আমাকে তদন্ত কাজে সাহায্য করবে।

ঘরের আরেক দিকের দরজা দিয়ে বাইরে তাকালাম। সেখানে ছোট একটি উঠানের মতো খালি জায়গা আছে। এরপর ছোট একটি খাল। তারপরই ফসলি ক্ষেতের দিগন্ত বিস্তৃত সারি।

সেখানে আমার তদন্তের সাহায্যের জন্য কিছু ছিলো না। আমি প্রথম কামরায় এসে খাটে উঠে বসলাম। মালিদের একজনকে রেখে অন্য দুজনকে কামরা থেকে বের করে দিলাম। এই মালিটি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলো। সহজ সুরে ওর সঙ্গে কথা বলে ভয় দূর করে দিলাম।

রাতে ঠাকুরের সঙ্গে এখানে কে এসেছিলো?- মালিকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

হুজুর! আমি ভালো করে দেখেছি, ঠাকুর সাব একলা এসেছিলো- মালি বললো।

তুমি তখন কোথায় ছিলে! বাড়ির ভেতরে ছিলে না বাইর?

বাগানে যারা কাজ করে পুরুষ হোক মেয়ে হোক কিংবা বাচ্চাই হোক ঐ বাড়ির কাছে ঘেষারও অনুমতি নেই। ঠাকুরজী ভেতরে থাকলে তো আমরা এদিকে আসার সাহসও করতে পারি না….

কাল যখন ঠাকুরজি আসেন আমি তখন দেয়ালের কাছে ছিলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, নিজের ঘরে চলে যাও। আমি চলে এলাম।

এটা কখন?

সূর্য ডুবে অন্ধকার নেমে এসেছিলো তখন।

তুমি ঠাকুরের পর আর কাউকে বাগানে আসতে দেখেছিলে?

না, হুজুর! আমি সেখান থেকে চলে এসেছিলাম।

তুমি তো এটা জানো যে, এখানে কি হয় না হয়? ঠাকুর কি এখানে মেয়ে মানুষ আনতো না? দোস্ত ইয়ারদের নিয়ে আনন্দ করতো না?

আমি আপনাকে শুধু বলছি হুজুর! ঘরের ভেতর যা হতো তা শুধু একজন লোকই জানে…. তার নাম দুর্গা। ঠাকুরজির খাস নওকর। সে সব সময় ঠাকুরজির সঙ্গে থাকতো। নওকরদের মধ্যে দুর্গাই কেবল ঐ বাড়িতে যেতে পারতো।

সে কি রাতেও এখানে ছিলো?

ও তো সূর্যাস্তের আগেই চলে এসেছিলো। আমি ভালো করে দেখেছি যে, বাইরের দরজায় যে তালা লাগানো ছিলো সেটা দুর্গা খুলেছে।

রাতে ঠাকুর যখন এখান থেকে বের হয় তুমি তখন কোথায় ছিলে?

আমি কিছুই জানি না হুজুর! আমি আমার ঘরে চলে গিয়েছিলাম। সকালে যখন বাগানে আসি তখনো আমার ধারণা ছিলো ঠাকুর সাব বাড়ির ভেতরইে আছেন।

***

এই নওকরকে আমি অন্য কামরায় পাঠিয়ে দিলাম। যাতে সে অন্য নওকরদের সঙ্গে এখনই কিছু বলতে না পারে। তারপর দ্বিতীয় আরেক নওকরকে ডেকে আনলাম। তার জবানবন্দিও প্রথম নওকরের মতোই হলো। আমার জন্য বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া গেলো না। তাকে বলালম উঠানে গিয়ে বসে থাকো।

তৃতীয় নওকারকে এরপর ভেতরে ডেকে আনলাম। পুরনো লোক সে।

ঠাকুর সাহেবের নওকরি কত বছর ধরে করছো? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।

সঠিক জানা নেই হুজুর! বৃদ্ধ নওকর বললো, মোটা মোটা হিসেবে চল্লিশ বছর তো হবেই। ঠাকুরজির বিয়ে আমার সামনেই হয়েছে।

তুমি কি জানো তোমাদের ঠাকুর এখন কোথায়?

আমরা তো বলছিলাম তিনি এখানেই শুয়ে আছেন। কিন্তু পরে জানলাম, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এখন হাসপাতালে আছেন।

আমি যদি বলি, ঠাকুর মরে গেছে, তুমি কি করবে তখন?

আমি কি করতে পারবো হুজুর! গায়ের সব ঠাকুর মরে গেলেও তো আমি ঠাকুর হতে পারবো না। আমরা তো ঠাকুরদের নওকরি করার জন্য জন্মেছি।

সে হালকা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো- তিনি কি সত্যিই হাসপাতালে না আপনি যা বলেছেন তাই ঠিক!

আমি যা বলেছি তাই ঠিক, তোমার ঠাকুর মারা গেছে। তার লাশ এখন তার বাড়িতে।

অবিশ্বাসী চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

আচ্ছা ঠাকুর নাকি মেয়েদের ব্যাপারে সুবিধার লোক ছিলো না? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আপনি ঠিকই শুনেছেন হুজুর! পয়সা থাকলে কার চরিত্র আবার সাধু থাকে?- বুড়ো বললো।

প্রশ্নোত্তরে এই বুড়োও দুর্গার কথা বললো।

আমি বুঝতে পালাম, দুর্গাকে আমার খোঁজে বের করা জরুরী। বুড়োকে জিজ্ঞেস করলাম, দুর্গা এখন কোথায় থাকতে পারে? বুড়া জানালো, ঠাকুরের হাবেলিতে, না হয় ওর নিজের বাড়িতে।

দুর্গা লোক কেমন?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

পাক্কা বদমায়েশ আদমী হুজুর!- বুড়ো নওকর এ কথা বলেই হাত জোড় করে ভীত গলায় বললো- হুজুর! একথা আমার মুখ থেকে বের হয়ে গেছে। দুর্গা পর্যন্ত যদি আমার এ কথা পৌঁছে তাহলে সে আমার ঝুপড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে।

অন্যদের মতো বুড়োও জানতো না, রাতে ঠাকুর কোথায় ছিলো। আমি এক কনস্টেবলকে ডেকে বললাম, ঠাকুরের বাড়িতে গিয়ে তার ছেলেকে বলো দুর্গাকে যেন এখানে পাঠিয়ে দেয়।

কনস্টেবল যখন ফিরে এলো তার সঙ্গে তখন দুর্গা ছিলো না, ছিলো ঠাকুরের ছেলে।

দুর্গা কোথায়?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আমি তো এ জন্যই এসেছি- ঠাকুরের ছেলে বললো- বাবার এই আকস্মিক মৃত্যুতে আমি এমন দিশেহারা ছিলাম যে, কোথায় কি ঘটেছে সে খবরও ছিলো না আমার। দুর্গাকে তো সকাল বেলাই দেখা যায়নি। এখন পর্যন্ত তার কোন হদিস নেই।

সে তো সকাল সকাল আমাদের বাড়িতে চলে আসতো। আপনার কনস্টেবলের সঙ্গে দুর্গার বাড়িতে গিয়ে ওর মাকে জিজ্ঞেস করে ছিলাম। ওর মা ও বউ বললো, কাল সন্ধ্যায় যে দুর্গা বের হয়েছে আজ সারা দিনেও ফিরেনি দুর্গা। যাওয়ার সময় বলেছিলো, ঠাকুরের কাছে যাচ্ছে।

দুর্গার গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা আমার তদন্তের জন্য একটা সূত্র হতে পারে ভেবে আমি কিছুটা নির্ভার বোধ করলাম। অবশ্য দুর্গাকে ঠাকুর সাহেব কোন কাজে অন্য কোথাও পাঠিয়ে থাকতে পারেন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আজকের রাতটা দুর্গার অপেক্ষায় কাটাবো।

ঠাকুরের ছেলে জানালো, দুর্গা খুন জখম করার মতো লোক নয়। তবে মন্দ লোক যে, এতে কোন সন্দেহ নেই। গ্রামের লোকেরা তাকে খুব ভয় পায়। সে ছিলো ঠাকুরের বডিগার্ড।

উল্লেখযোগ্য কোনই সূত্রই আমি পেলাম না। তাই রাতটা বাগান বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। চৌকিদার ও পাহারাদাররা বাইরে যার যার ডিউটিতে ছিলো। থানার সোের্সরাও তৎপর ছিলো বেশ। সোর্সদের মধ্যে দুজন তো বেশ অভিজাত ঘরের লোক। কিন্তু থানা পুলিশ ও তদন্ত কাজে গুপ্তচরবৃত্তি করার কাজ করতো তারা খুব আন্তরিকতা নিয়ে। এটা ছিলো তাদের শখের পেশা।

আজকাল এ ধরনের লোক কমই পাওয়া যায়। যারা অপরাধের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে এভাবে উজাড় করে দিতে পারে।

রাতে আমি একবার থানা সোর্সদের কাছ থেকে রিপোর্ট নিলাম। তবে আলাদা আলাদাভাবে। দুর্গার ব্যপারে সবাইকেই বিশেষভাবে জিজ্ঞেস করলাম। এটা তো সব পুলিশ অফিসারই জানেন যে, ঠাকুর, শেঠ ও জায়গীরদারদের খাস নওকর ও বডিগার্ড থাকে। মুনিবের হুকুমে তারা নারী অপহরণ ও হত্যার ঘটনা ঘটায়। মুনিবদের ফুর্তি করার উপকরণও এরাই জোগাড় করে দেয়। অনেক গোপন ব্যাপারও এরা জেনে থাকে।

সোর্সদের কাছ থেকেও জানা গলো, ঠাকুর ফুর্তিবাজ লোক ছিলো।

বাগানে জুয়া খেলা হতো, নাচ গান হতো। কারা জুয়া খেলতে আসতো, নাচগান করতে আসতো, তাদের নামের ফিরিস্তি আমার সামনে পেশ করা হলো। তবে ঠাকুর মারা যাওয়ার রাতে নাচগান করতে কেউ আসেনি।

বাগানের তিন নওকরও জানালো, নাচগান হলে তারা নিশ্চয় টের পেতো। কারণ, যখন গানবাজনা হয় তখন ঢোল তবলার আওয়াজ তাদের ঝুপড়ি থেকেও শোনা যায়।

জনাব! সবচেয়ে দৃষ্কৃতিকারী ছিলো ঠাকুর- এক অভিজ্ঞ সোর্স জানালো দুর্গার প্রতি ঠাকুর দুর্বল ছিলো এজন্য যে, দুর্গার বউটি খুব সুন্দরী। আর তার সুন্দরী একটি বোনও আছে। বয়স একুশ বাইশ হবে। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি বলে দেড় বছর ধরে বাপের বাড়ি পড়ে আছে। ঠাকুর দুর্গাদের বাড়িতে প্রায়ই যেতেন।

দুর্গা কি তা জানতো?

কি জানি! দুর্গা হয়তো ঠাকুরের আসল নিয়তের কথা জানতো না।

….দুর্গার একটা জিনিস সবাই খুব পছন্দ করে, গ্রামের যেকোন মেয়ে হোক, নষ্টা মেয়ে হলেও দুর্গা সে মেয়েকে ইজ্জত করে। মন্দ দৃষ্টিতে কোন মেয়ের দিকে সে তাকায় না। এ থেকেই বুঝা যায়, দুর্গা ঠাকুরের তার বাড়িতে আসা যাওয়ার ব্যপারটা পুরোপুরি জানতো না।

হতে পারে, ঠাকুরের নিয়ত খারাপ ছিলো না।

ঠাকুরের নিয়ত ভালো হতেই পারে না। ইনস্পেকটর সাহেব! আমার তো মনে হয়, দুর্গা ঠাকুরের কাজে অন্য কোথাও যায়নি। সে আত্মগোপন করেছে। সে তার বউ বা বোনের সঙ্গে হয়তো ঠাকুরকে দেখে ফেলেছিলো। তারপর….

কোথায় যেতে পারে সে?

ওর তো অনেক ঠিকানা আছে। ডাকু ও ছিনতাইকারীদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিলো।

***

আমি রাতের মধ্যেই চৌকিদার, পাহারাদার ও পুলিশ কনস্টেবলকে পাঠিয়ে দিলাম যে, বাগান বাড়িতে যারা জুয়া খেলতে ও নাচ গান করতে আসতো সকালে ওদেরকে থানায় হাজির করতে হবে।

আমাকে এক মহিলার কথা বলা হলো, যে ঠাকুরের বাগান বাড়িতে কাজ কর আসতো। মহিলা এমনিতে খুব সাধারণ। চার পাঁচ বছর হলো বিধবা হয়েছে।

অর্ধেক রাত পার হয়ে গেছে। রাতের বিশ্রাম বাদ দিয়ে দিলাম। চৌকিদারকে ডেকে বললাম, ঐ বিধবা মহিলাকে নিয়ে এসো।

মহিলা ভীত কম্পিত হয়ে আমার কাছে এলো। একে দেখেই মনে মনে বললাম, এই মহিলা আমার কাজে আসবে। বয়স তার ছত্রিশ সাতত্রিশ হবে। এ ধরনের মহিলা গ্রামের মতো শহরেও আছে। পুলিশ এদেরকে ভালো করেই চিনে।

এদের নামধাম, আকার আকৃতি ভিন্ন হলেও এদের কাজ হয় অভিন্ন। মহিলাকে আমি বসিয়ে বললাম, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যা জিজ্ঞেস করবো ঠিকঠাক জবাব দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে।

আমি মহিলার চোখে চোখ রেখে মুখে মাপা হাসির রেখা ঝুলিয়ে এমন দুটি কথা বললাম, সে বুঝে গেলো আমাকে ধোকা দেয়া সহজ কাজ নয়।

ঠাকুর সম্পর্কে যা তার জানা আছে সব খুলে বলতে বললাম।

ঠাকুর হত্যার কোন করণও যদি জেনে থাকো তাও বলে দাও আমি বললাম।

আমি এত ভেতরের খবর জানি না- মহিলা বলতে লাগলো- খুন করার মতো উনার সঙ্গে কারো এত শক্ত দুশমনী ছিলো এতো আমি ধারণাও করতে

পারি না। বাগানবাড়ির ঐ ঘরগুলোর ভেতর ঠাকুর কি করতেন না করতেন তা আমার জানার কথা নয়। এটা দুর্গা জানে। যে মেয়েদের সঙ্গে উনার সম্পর্ক ছিলো তা আমি বলে দিচ্ছি।

মহিলা তিন চারটি মেয়ের নাম বললো। কিন্তু আমার সব মনোযোগ ছিল দুর্গার দিকে। মহিলাকে দুর্গার স্ত্রী ও বোন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। মহিলা জানালো, ওরা দুজন খুব চালাক মেয়ে।

এই মহিলার হাতে ঠাকুর দুর্গার বউ ও বোনোর জন্য উপহার পাঠাতেন। তারা উপহার গ্রহণ করতে ঠিক; কিন্তু ঠাকুরের হাতে ধরা দিতো না। ঠাকুর ওদের ঘরে গেলে দুজনে বেশ খাতির যত্ন করতো কিন্তু কাছে ঘেষতো না।

আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, দূর্গা জেনে ফেলেছিলো, ঠাকুর তার বউ ও বোনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইতেন।- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না- মহিলা বললো- আমি সব সময় সতর্ক ছিলাম। অবশ্য দুর্গা যদি কোন সন্দেহ করে থাকে অথবা ওর বোন বা বউ যদি দুর্গাকে বলে থাকে সেটা তো আমার জানার কথা না।

মহিলাকে নিয়ে আমি অনেক মাথা খরচ করলাম। তার কাছ থেকে এতটুকুই পেলাম যে, ঠাকুর নারী শিকারি ছিলো। আমার মতে তার হত্যার কারণও এটাই। এখন প্রশ্ন হলো, সেই মেয়েটি কে? যার কারণে ঠাকুরকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।

মহিলাকে তখনোই ছেড়ে দিলাম না। হেড কনস্টেবল ও পাহারাদারকে বললাম, আমাকে দুর্গার বাড়িতে নিয়ে চলো। চৌকিদার আমাদের আগে আগে চললো।

এক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমার ইংগিতে দরজায় জোরে জোরে আঘাত করলো। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো না। দ্বিতীয় বার খট খটানোর পর দরজা খুললো। আমি টর্চ জালালাম।

দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো এক মেয়ে। হয়তো দূর্গার স্ত্রী হবে।

 চৌকিদার বললো- পুলিশ।

আমি মহিলাকে উঠোনে নিয়ে আসতে বললাম। মহিলা নিজেই উঠোনে চলে এলো।

দুর্গা কোথায়?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

কাল সন্ধ্যায় বের হয়েছে। এখনো ঘরে ফিরেনি- আতংকিত গলায় বললো।

কোথায় গিয়েছিলো?

ঠাকুরের বাড়ি।

এ সময় কামরা থেকে আরেকটি মেয়ে বেরিয়ে এল।

কি হয়েছে? কে এখানে?- ঘাবড়ানো গলায় বলতে বলতে সে এলো।

আরে আলো জ্বালো, ইনি পুলিশ ইনস্পেকটর সাব- পাহারাদার বললো।

মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে আলো জ্বালালো। ওদিকে আমার কনস্টেবলরা তল্লাশি শুরু করে দিয়েছে। আমি ঘরের ভেতর চলে গেলাম। ঘরে একটি চারপায়া ছিলো।

চারপায়ার ওপর এক বুড়ি সদ্য ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে চোখ ডলছিলো। ঘরের দুদিকে দুটি কামরা ছিলো। একটার মধ্যে গেলো হেড কনস্টেবল। আরেকটার মধ্যে আমি।

চারপায়ার নিচে, জিনিসপত্রের আড়ালে আড়ালে সব খানে খুঁজলাম। সারা বাড়িতে চিরুনী তল্লাশি চালালাম। দুর্গার ছায়াও বের করতে পারলাম না।

বুড়ি দুর্গার মা। বয়স বেশি নয়। কিন্তু সেদিন খুব জ্বর ছিলো। জরের কারণে শরীর দুর্বল হলেও মুখ চলছিলো বুড়ির পুরো দমে। একথা ওকথা বলে বিরক্তি প্রকাশ করছিলো।

কেন এত রাতে হাঙ্গামা? তার ছেলে এমন কি অন্যায় করেছে? এমন নিষ্পাপ ছেলেটাকে নিয়ে এই রাত দুপুরে হুজ্জতি করা কি ভদ্রতা?

বুড়ির কোন কথার উত্তর দিলাম না আমি।

সেখানে দুর্গার বউ ও বোন দাঁড়িয়ে ছিলো। আমার সোর্স এদের রূপ সম্পর্কে যা বলেছিলো তা আসলে অনেক কম বলেছিলো। এরা এর চেয়ে অনেক বেশি রূপসী।

ওদেরকে বাইরের কামরায় নিয়ে এলাম। আমি চারপায়ার ওপর পা তুলে বসলাম আগে। তারপর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম। প্রথমে দুর্গার স্ত্রীকে তারপর তার বোনকে জিজ্ঞেস করলাম।

দুজনেই জানালো, ওরা ঠাকুরের বদ নিয়ত বুঝতে পারতো, কিন্তু ঠাকুরের দেয়া জিনিসও ফিরিয়ে দিতো না।

দুর্গা কি এসবে সন্দেহ করতো না?

সন্দেহ কেন করবে?- দুর্গার স্ত্রী জবাব দিলো- বদ নিয়ত ছিলো ঠাকুরের। আমাদের নিয়তে কোন দোষ ছিলো না। আমাদের দুজনের কেউ কখনো উনার সঙ্গে একা কথা বলতাম না।

দুজনেই খুব চালাক। দুর্গাকে যে ঠাকুর হত্যার তদন্তে আমি খুঁজছি এটা ওরা বুঝে গেলো।

দুর্গার বউ বললো, দুর্গা গ্রামের বাইরে কখনো গেলে ওদেরকে জানিয়ে যেতো। এবার তো সে কিছুই বলে যায়নি।

এর অর্থ হলো, দুর্গা কোথাও আত্মগোপন করেছে। কিন্তু আমি দুর্গার বউ ও বোনের সামনে এমন ভাব করলাম যে, দুর্গার ওপর যে সন্দেহ ছিলো তা দুর হয়ে গেছে, দর্গাকে এখন আর আমার দরকার নেই।

তবে সেখান থেকে বের হয়ে এসে আমার দুই সোর্সকে বলে দিলাম, দূর থেকে যেন দুর্গার বাড়ির ওপর নজর রাখে।

***

বলা যায় এক প্রকার শূণ্য হাতেই থানায় ফিরে এলাম। থানায় এসে দেখলাম আমার জন্য সাতজন লোক হাজির করা হয়েছে। ঠাকুরের বাগান বাড়িতে এরা জুয়া খেলতে আসতো। এর মধ্যে তিন চারজন উঁচু ঘরনার লোক। অন্যরা পেশাদার জুয়াড়ি। এর মধ্যে তো একজন দু বছর জেল খেটে যাওয়া দাগী আসামী।

পেশাদার অপরাধী ও জুয়াড়িদের জিজ্ঞাসাবদ একটু অন্য ধরনের হয়। কারণ এদের কাছ থেকে কথা আদায় করা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে। এই মামলায়ও এরা আমাকে মুশকিলে ফেলে দেয়। তবে পরে আমি সব ঠিক করে নিই। ভেতরের কথা বের করতে বাধ্য করে তুলি।

এরপর যারা অপেশাদার ছিলো তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করি। এরা সৌখিন জুয়াড়ি এবং এ পথে আনাড়ী। এখনো অন্য কোন অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়েনি। পুলিশের মুখোমুখিও এই প্রথম হয়েছে।

বড় বড় জমিদার ও জায়গীরদারদের ছেলে ছেলে ওরা। নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে পুলিশের সামনে পেটের সব কথা উপড়ে দেয়। ঠাকুরের কথাবার্তা এমন করে বললো যেন এরা তার দুশমন ছিলো। এরা আমার কিছু সন্দেহ দূর করলেও সেখানে নতুন সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছে।

কখনও মনে হচ্ছে আমার তদন্ত সঠিক ভাবে এগুচ্ছে। আবার কখনো মনে হচ্ছিলো আমি ভুল পথে যাচ্ছি।

হত্যার কারণ তো নারীঘটিত প্রেম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হতে পারে। এই সূত্রে এক যুবতীর নাম উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে তার পরকীয়া পুরুষের নামও এলো। আরো দুই নর্তকীর নাম উঠলো। ঠাকুর এদেরকে কখনো কখনো বাগান বাড়িতে ডেকে আনতেন।

এদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে চার পাঁচ দিন কেটে গেলো। জিজ্ঞাসাবাদে এরাও আরো কয়েকজনের নাম সন্দেহভাজনের তালিকায় ঢুকিয়ে দিলো। এদের পেছনে আরো কয়কে দিন লাগলো।

এসব থেকে আমি উল্লেখযোগ্য কিছুই পেলাম না। দর্গারও কোন খোঁজ নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমি দুর্গার আকার আকৃতির বর্ণনাসহ অন্যান্য রিপোর্ট জেলার সমস্ত থানায় নিয়ে পাঠিয়ে দিলাম।

দুর্গার স্ত্রী ও বোনকে রাতের বেলা ওদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম পুলিশ প্রহরায়। আর দিনের বেলায় থানায় এনে আটকে রাখতাম। এটা এজন্য করছিলাম যে, দুর্গা যদি জানতে পারে তার ঘরের যুবতী মেয়েদের এভাবে বেইজ্জতী করা হচ্ছে তাহলে সে নিজেই থানায় এসে আত্মসমর্পণ করবে।

দুর্গার বউ ও বোনকে কয়েকবার বলেছি, শুধু এটা বলো যে, ঠাকুর তোমাদের ইজ্জতের ওপর হাত উঠিয়েছিলো। তোমাদেরকে হয়রানি থেকে মুক্তি দেবো। ওরা তা অস্বীকার করেছে।

আমার সন্দেহ ছিলো, ওরা জানে যে, দুর্গা তার স্ত্রী ও বোনের বেইজ্জতীর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ঠাকুরকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে।

ওদিকে মদের বেতাল ও গ্লাসের ওপর আঙ্গুলের ছাপের রিপোর্ট ইলাহাবদ থেকে চলে এসেছে। অন্যদিকে ঠাকুরের পোষ্টমর্টেমের রিপোর্টও এসে গিয়েছিলো।

এতে সত্যায়ন করা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিকে বিষয় দেয়া হয়েছিলো। থানায় ও থানার বাইরে যাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম তাদের হাতের ছাপ আগেই নিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু কারো হাতের ছাপের সঙ্গেই বোতল ও গ্লাসের ছাপের মিল খুঁজে পেলাম না। অর্থাৎ এখনো আমরা ঠাকুরের হত্যাকারীর কেশও স্পর্শ করতে পারিনি।

তদন্ত কাজে শহর থেকে বিশ মাইল দূরের এক গ্রামেও যেতে হয়েছিলো। সেখানে ঠাকুরের কাছে আসা যাওয়া ছিলো এমন দুই নর্তকীর জবানবন্দি নিতে হয়েছিলো। তাদের পেছনে আরো তিন দিন নষ্ট করি। কিন্তু লাভের খাতা এখানেও শূণ্য।

তবে পাওয়া গেছে এতটুকু যে, এখন যাকে খুঁজে বের করতে হবে সে হলো দূর্গা। অন্যান্য পুলিশ অফিসাররাও বলেছে, দুর্গা সাধারণ কোন অপরাধী নয়, তার হাত অনেক লম্বা।

***

বাইশ তেইশ দিনের ঘটনা। ঠাকুর হত্যার তদন্ত কাজ আগের জায়গাতেই ঝুলে আছে। হঠাৎ এক দিন আমাদের ওপর মুসিবত নেমে এলো। আমাদের ইংরেজ ডিএসপি থানায় এসে হাজির।

ডিএসপি ও এসপিরা এভাবেই কোন না কোন থানায় এসে হাজির হয় এবং চলতি তদন্তনাধীন মামলার ফাইল ঘেটে দেখেন, থানা পুলিশরা ঠিক মতো কাজ করছে কিনা। তখন বিশেষ করে ইনস্পেক্টরদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন।

অবশ্য মাঝে মধ্যে তারা খোশ মেজাযেও আসেন এবং থানা ও এর আওতাধীন এলাকা পরিদর্শন করে চলে যান।

কিন্তু এবার ডিএমপি এলেন ভিন্ন উদ্দেশ্যে। তিনি এসেই নিহত ঠাকুরের গ্রামের কথা বলে বললেন,

সেখান থেকে যে এক মেয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিলো তার ফাইলটি বের করো ……..

ঐ মেয়ের বাবাকে থানায় নিয়ে এসেছিলো এই নিহত ঠাকুর। ঐ কেস আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। তাই এর তদন্তভার দিয়েছিলাম আমার জুনিয়র সাব ইনস্পেকটরকে।

ঠাকুর তখন বলেছিলো, ঐ মেয়েকে কেউ অপহরণ করেনি, মেয়ে নিজেই কোথাও চলে গেছে। আমার ধারনাও ছিলো তাই। এর দুই তিন দিন পরই ঘটে ঠাকুরের বিষ প্রয়োগে হত্যার ঘটনা। আমি তখন এই মামলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

ডিএসপি সাহেব ফাইল দেখলেন। সাব ইনস্পেক্টর এই ফাইলে অনুমান নির্ভর কিছু কথা লিখে ফাইল তাকবন্দি করে রেখেছিলো।

ডিএসপি চোখ গরম করে বললেন, এক মাসে এতটুকু তদন্ত হয়েছে?

আমরা মাথা নিচু করে রাখা ছাড়া কোন জবাব দিতে পারলাম না।

ডিএসপি খাস গাইয়া ভাষায় আমাদেরকে অনেক গালাগাল করলেন। এই ভাষা কোত্থেকে যে তিনি শিখেছেন আল্লাহই ভালো জানেন।

চাবুক মারার মতো ভাষায় বললেন, তোমরা এই মামলাকে শুধু এ কারণে ফাইল চাপা দিয়ে রেখেছো যে, অপহৃত মেয়ে এক গরিব বাপের মেয়ে। তোমরা সেসব মামলাতেই আগ্রহ পোষণ করো যেগুলোর তদন্ত করতে গিয়ে তোমরা খাতির যত্ন পাও।

তোমরা থোকাবাজ। বেঈমান হিন্দুস্তানি- তিনি বললেন।

ডিএসপি জানালেন, অপহৃত ঐ মেয়ের বড় ভাই ফৌজে ল্যান্স নায়েকের পদে আছে। সে তার বোনের হারিয়ে যাওয়ার খবর জানতে পারে তার বাবার প্রেরিত চিঠি মাধ্যমে।

চিঠিতে তার বাবা একথাও লিখে যে, এই মামলার তদন্তের ব্যপারে পুলিশের মোটেও আগ্রহ নেই।

নায়েক চিঠি পেয়ে মামলার তদন্তে গুরুত্ব দেয়ার জন্য তার কমান্ডিং অফিসারের কাছে দরখাস্ত লিখে। কমান্ডিং অফিসার দরখাস্ত পাঠিয়ে দেয় ব্রিগেড কমান্ডারকে। ব্রিগেড কমান্ডার নায়েকের জেলার ডিপুটি কমিশনারকে এ ব্যপারে দরখাস্ত সংযুক্ত করে এক হুকুমনামা পাঠায়। ডিপুটি কমিশনার সেটা পাঠিয়ে দেয় পুলিশে আইজিকে।

উপরস্থ এসব সেনা কর্মকর্তা ও পুলিশ অফিসার ছিলো ইংরেজ। তখন চলছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

ইংরেজদের অবস্থান তখন খুব একটা সংহত ছিলো না। তাদের পক্ষে হিন্দুস্তানী সৈন্যরা বিভিন্ন ফ্রন্টে জানবাজি রেখে লড়ছিলো। এজন্য ইংরেজরা হিন্দুস্তানি সৈন্যদের সন্তুষ্ট রাখতে অনেক কিছুই করতো।

কোন মামুলি সিপাহীও যদি তার কমান্ডিং অফিসারকে দরখাস্ত দিতো যে, তার গ্রামে তার খান্দানের লোকরা অমুকের শত্রুতার শিকার। কমন্ডিং অফিসার সঙ্গে সঙ্গে ডিপুটি কমিশনারের মাধ্যমে সে এলাকার পুলিশ ইনস্পেকটরকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য হুকুম দিয়ে দিতো।

আমাদের ডিএসপিও তার উপরওয়ালের হুকুমেই এসেছেন। তিনি ইংরেজ হওয়ায় এক হিন্দুস্তানি সৈন্যের অভিযোগ দূর করতে কম আন্তরিক ছিলেন না। ডিএসপি সাহেব সাব ইনস্পেক্টরকে হুকুম দিলেন, এখনই অপহৃত সেই মেয়ের গ্রামে তদন্ত শুর করো।

তোমাদেরকে আমি কোর্ট মার্শাল করিয়ে ছাড়বো- ডিএসপি সাহেব জলদ গম্ভীর কণ্ঠে হুমকি দিলেন- শুধু পাঁচটা দিন সময় দিচ্ছি তোমাদেরকে। আমি সঠিক রিপোর্ট চাই। ঐ মেয়েকে অপহৃরণ করা হয়েছে, না সে নিজের ইচ্ছায় গিয়েছে। অপহরণ হলে রিপোর্টের সঙ্গে আসামীকেও হাজির করতে হবে।

ডিএসপি সাহেব আমাদের রক্ত পানি করে চলে গেলেন। আমরা ঠাকুর হত্যা মামলাসহ অন্যসব মামলার কাজ স্থগিত রেখে ঐ মেয়ের অপহরণ মামলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

***

তদন্ত কাজে দুদিনের মধ্যেই আমাদের নাভিশ্বাস উঠে গেলো। যে গ্রামের যাকেই সামান্য সন্দেহভাজন মনে হতো তাকেই ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। মাত্র পাঁচ দিনের এত অল্প সময়ে একটা কেসকে সুরতহাল করার এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আর হতে পারে না।

এ পদ্ধতি ছাড়া আমি আরেকটা পদ্ধতি বের করলাম। সেটা হলো, সারাক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করা। উঠতে বসতে আমি দরবারে এলাহীতে আর্জি জানাতে লাগলাম।

হে আল্লাহ! আমার ঈমানদারী ও আমানতদারীর সম্মান আপনি অক্ষুণ্ণ রাখুন। এই চ্যালেঞ্জে আমাকে সফল করুন। এই কেসের সঠিক সুরতহাল করে দিন। আল্লাহ তাআলা মনে হয় তার দয়ার সাগরে আমার আর্জি কবুল করে নিলেন।

তদন্তের তৃতীয় দিন। আমি ও আমার সাব ইনস্পেক্টর রাম সাহা মিলে গ্রামের এক তৃতীয়াংশ লোককে থানা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেছি। কিন্তু সে মেয়ের নাম ছাড়া আর কিছুই জানতে পারলাম না। মেয়ের নাম হলো দুলারী। ডিএসপির দেয়া সময় পাঁচ দিনের মধ্যে আর মাত্র দুই দিন বাকি আছে।

তৃতীয় দিনের সূর্য অস্তগামীর পথে। সাব ইনস্পেক্টর রাম সাহাকে দুলারীদের গ্রাম থেকে ফিরে আসতে দেখা গেলো। তার চাল চলনেই বুঝা যাচ্ছিলো, আজও সে ব্যর্থ হয়েছে।

তার মুখটি শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। আমার সামনের চেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে এমনভাবে বসলো যেন সে পরাজয় মেনে নিয়েছে। তার এ অবস্থা দেখে আমার মুখ দিয়েও কথা সরছিলো না। এ সময় পোষ্ট অফিসের এক পিওন আসলো।

সে ভেতরে না এসে আমাকে বাইরে রেখেই ইশারায় ভেতরে ডাকতে লাগলো। প্রথমে আমি রেগে গেলেও মনে হলো সে যেন কিছু এটা বলতে চায় যা আমার জন্য জরুরী। মনে মনে বললাম, রাখো, তুমি যদি এছাড়া অন্য কোন সুপারিশ নিয়ে এসে থাকো তাহলে তোমাকেও সাইজ করে ছেড়ে দেবো।

আমি আপনার পোষ্ট অফিসের ডাক পিওন- আগন্তুক পিওন বললো আমি গ্রামে গঞ্জে পোষ্ট অফিস থেকে চিঠি বিলি করি। যে গ্রামের মেয়ে লাপাত্তা হয়েছে সে গ্রামেরও দশ বারটি চিঠি ছিলো আমার কাছে। আপনি জানেন, গ্রামের লোকেরা সাধারণত লেখাপড়া খুব একটা জানে না। তাই তাদের চিঠি আমাকেই পড়ে দিতে হয়।

আমি একটা চিঠি পড়লাম, এটা লিখেছেন এক হাবিলদার। লাপাত্তা হয়ে যাওয়া মেয়ের ভাই নায়েক জগমোহন যে জাট রিজিমেন্টে আছে ইনি সেই রেজিমেন্টেরই হাবিলদার।

হাবিলদার তার স্ত্রীকে লিখেছেন, নায়েক জগমোহনের বোন দুলারী তার বাসায় আছে। ঐ হাবিলদার বাড়িতে কিছু একটা পাঠাবেন। তিনি লিখেছেন, সে জিনিসটি দুলারীকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবো। হাবিলদার এও লিখেছেন, তিনি তার রেজিমেন্টের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে দূর্গা নামের এক লোককেও দেখেছেন।

আমার কাছে মনে হলো, এই ডাক পিওন আকাশ থেকে নেমে এসেছে। না হয় আমি স্বপ্ন দেখছি। অথবা এ লোক মিথ্যা বলছে।

তুমি কি বাজে বকছো?- আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো- দুলারীর ভাই নিজেই তো দরখাস্ত দিয়েছে তার বোন দুলারী লাপাত্তা হয়ে গেছে। এটা কি করে বিশ্বাস করবো যে, সে তার বোনকে নিজের কাছে রেখেছে এবং তার বোন অপহরণ হয়েছে বলে তদন্তের দরখাস্ত করেছে,……… আর ঐ দুর্গাই বা সেখানে কি করছে?

আপনি স্যার হাবিলদারের ঘরে চলে যান- ডাক পিওন বললো- আমি জানি, দুলারী লাপাত্তা হয়ে যাওয়াতে গ্রামের ওপর কেমন বিপদ নেমে এসেছে। সে গ্রামে পুলিশের সাধারণ কোন কনস্টেবলকে দেখলেই লোকজন এদিক ওদিক পালাতে শুরু করে। হাবিলদারের বাপ হাত জোড় করে আমাকে বলেছে, আমি যেন কাউকে এই চিঠির কথা না বলি। তাহলে পুলিশ তাদের সবাইকে থানায় নিয়ে যাবে। তারপর মারপিট করবে…….

আমি স্যার…. নিজের দায়িত্ব পালন করেছি। প্রয়োজন হলে আমি এই চিঠির ব্যাপারে সব রকম সাক্ষ্য দেবো। সময় মতো শুধু আমাকে ডেকে পাঠাবেন।

ডাক পিওনকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় করলাম। তারপর আর বিলম্ব করলাম না। সাব ইনস্পেক্টর রাম সাহা ও দুই কনস্টেবলকে নিয়ে হাবিলদারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম।

এলাকার চৌকিদারের মাধ্যমে হাবিলদারের বাড়ি চিনে নিলাম। দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে দিলো হাবিলদারের বাবা।

বুড়ো তার সামনে দুই পুলিশ অফিসারকে দেখে ভয়ে যেন কাঁপতে লাগলো। আমার ভয় হলো, অজ্ঞান না হয়ে যায় আবার। হাতজোড় করে আবোল-তাবোল বকতে লাগলো।

ভয় নেই চাচা! আমি তার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বললাম আমরা আপনাকে কিছু করতে আসিনি। আপনার ছেলে যে চিঠিটি পাঠিয়েছে সেটা দিয়ে দিন।

হুজুর!- বুড়ো বললো- হুজুর! আমি গরিব মানুষ। আমি চিঠি দিয়ে দেবো। কিন্তু আমাকে থানায় নিয়ে যাবেন না। চিঠি পড়ে দেখুন। আমার ছেলেরও কোন দোষ নেই।

ততক্ষণে ঘরের সবাই জেগে উঠেছে। ভেতরে সঙ্গে সঙ্গে আলোও জ্বালানো হয়েছে। কারো ফুপানির আওয়াজও আসছে। বুঝা গেলো, পুলিশের ভয়ে কাঁদছে। পুলিশ তো আসলে ভালো মানুষের বন্ধু। তাহলে কেন যে পুলিশকে মানুষ এত ভয় পায়!

চিঠি নিয়ে এলো বৃদ্ধ। চিঠিটা পড়ে দেখলাম। চিঠি পড়ে বুঝা গেলো, হাবিলদার এটা জানেন না যে, যে মেয়ের কথা তিনি লিখেছেন সে গ্রাম থেকে লাপাত্তা হয়ে গেছে। আর পুলিশ সারা গ্রামে চিরুনী অপারেশন শুরু করে দিয়েছে। তিনি হয়তো ভেবেছেন, সেই মেয়ে এমনিই তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছে।

হাবিলদারের বাপকে বললাম, ভয় নেই কোন। তাকে শুধু আমার সাক্ষী বানাবো। শুধু এতটুকু বললেই হবে যে, আমি আমার ছেলের চিঠি পেয়েছিলাম। আর চিঠি ডাক পিওন পড়ে শুনিয়েছে।

ভয় বৃদ্ধকে এমনভাবে জাপটে ধরেছিলো যে, আমার পায়ে পড়ে বলতে লাগলো, যা বলবেন হুজুর তাই করবো। তবুও থানায় নিবেন না।

বৃদ্ধকে আমি উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। এবার বৃদ্ধ যেন কিছুটা আশ্বাস পেলো। তার মুখে হাসি ফিরে এলো।

***

পরদিন ভোরেই লরিতে করে ডিএসপি সাহেবের হেডকোয়ার্টারে রওয়ানা হয়ে গেলাম। লরি এক ঘন্টার মধ্যে সেখানে পেঁছে দিলো। ডিএসপি তখনও অফিসে আসেননি। আমি তখন উত্তেজনায় টগবগ করছি। অপেক্ষা করতে পারলাম না। ডিএসপির বাংলোয় চলে গেলাম।

তিনি তখন তৈরী হয়ে বের হচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই আগুন দৃষ্টিতে ঘুরে তাকালেন। আমি স্যালুট করলাম।

কি রিপোর্ট এনেছো?- তিনি ধমকে উঠলেন- ঐ মেয়ের কেসের রিপোর্ট এনেছে, না অন্য কোন ধান্ধায়?

আমি পকেট থেকে হাবিলদারের চিঠিটা তাকে দিলাম। কাগজের ভাজ খুলে চিঠিটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।

পড়ে শোনাও- বিরক্ত হয়ে বললেন- জানো না, আমরা তোমাদের ভাষা শুধু বলতে পারি লিখতে পারি না?

আমি চিঠি পড়ে শুনিয়ে জানালাম কিভাবে এ চিঠি আমার হস্তগত হয়েছে। তারপর ডিএসপি সাহেবের কাছে অনুরোধ রাখলাম, আমাকে যেন জবলপুর সেনা ছাউনির ঐ জাট রেজিমেন্টে যাওয়ার অনুমতিপত্র লিখে দিন, যাতে ওখানে গিয়ে আমি তদন্ত করতে পারি।

আমার অফিসে চলো।

ডিএসপি আমাকে সরকারী অনুমতিপত্র দিয়ে দিলেন। এ দিয়ে আমি যেকোন রেজিমেন্টে গিয়ে তদন্ত কাজ চালাতে পারবো এবং এতে এও লেখা আছে যে, সেনা অফিসাররা যেন আমাকে সহযোগিতা করে।

পর দিন সন্ধ্যায় আমি জবলপুর পৌঁছলাম। সেখানকার পুলিশ হেড কোয়ার্টারে রাতটা কাটালাম।

সকালে সেখানকার এসপির সঙ্গে সাক্ষাত করলাম। পুরো ঘটনা তাকে শোনালাম এবং সরকারি অনুমতি পত্রও দেখালাম। তিনি আর্মি ব্রিগেডিয়ারকে ফোনে কি যেন বললেন এবং আমার পথ পরিষ্কার করে দিলেন।

দিনের সাড়ে এগারটায় আমাকে পৌঁছে দেয়া হলো জাট রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দফতরে। এতেই দুলারীর ভাই নায়েক জগমোহন আছে। আমার কাগজ দেখলেন তিনি।

ঐ মেয়ে এখানে আছে সেটা আপনি কি করে জানলেন?- ইংরেজ কর্ণেল আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।

আমি হাবিলদারের চিঠি তাকে পড়ে শোনালাম। তিনি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। বললেন,

আমরা যদি চাপ না দিতাম- কর্ণেল বললেন- তাহলে আপনারা পাত্তাই দিতেন না এ কেসকে। আমরা দেখতে চাই, পাবলিকের প্রতি আপনারা কতটুকু খেয়াল রাখেন আর নিজেদের দায়িত্বে কতটুকু যত্মবান।

সাহেব বাহাদুর!- আমি বললাম- যদি একটি মেয়ে এমন একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় যাকে গ্রামের সবাই বদমায়েশ বলে জানে এবং সবাই অনেক ভয় পায় তাহলে আমাদের তদন্ত কি করতে পারবে? এই চিঠিতে দুর্গা নামে যার কথা এসেছে সে অনেক বড় বদমায়েশ। এতে এক হত্যা মামলায় পুলিশের চোখে আসামী। হত্যার রাত থেকেই এ দুর্গা লাপাত্তা।

আপনি কি নিশ্চিত হত্যার আসামী সেই?

 নিশ্চিত তো হওয়া যাবে তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের পর সাহেব বাহাদুর!

তবে পরিস্থিতি ও সাক্ষ্য তার বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। আপনার কাছে আমি অনুরোধ রাখছি, ঐ মেয়ে ও দুর্গাকে আমার কাছে হাওলা করে দিন। আপনার রেজিমেন্টের কিছু লোকের জবানবন্দিও আমার প্রয়োজন হতে পারে। আমি আপনার সহযোগিতার জন্য দরখাস্ত পেশ করছি।

কর্ণেল কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। তারপর তার ক্যাপ্টেনকে ডাকিয়ে আনলেন। ইংরেজীতে সলাপরামর্শ করতে লাগলেন তারা।

দুই ইংরেজের ধারণা ছিলো, আমি ইংরেজি বুঝি না। অথচ আমি এফ, আই পাশ করে সরাসরি আই, এম, আইতে ভর্তি হয়েছিলাম। ইংরেজ অফিসারদের সঙ্গে ইংরেজিতেই আমি কথা বলি।

এরা তো দেখি আমাকে বেওকুফ বানিয়েছে- কর্ণেল ক্যাপ্টেনকে বললেন নায়েক জগমোহন তো কখনো একথা বলেনি যে, যে লোক তার বোনকে কয়েদি থেকে উদ্ধার করে এনেছে সে নিজেই অনেক বড় বদমায়েশ। এই ইনস্পেক্টর তো জোর সন্দেহ করছে, গ্রামে সে কাউকে হত্যা করে এসেছে।

স্যার! মাফ করবেন- ক্যাপ্টেন বললো- এদেরকে প্রথমেই আমাদের বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। এই হিন্দুস্তানিদের রাজনীতিই হলো মিথ্যা বলা। প্রথম দিনই ঐ মেয়ে ও ঐ বদ লোককে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া উচিত ছিলো আমাদের।

শোন ক্যাপ্টেন!- কর্ণেল বললেন- আমি দেখতে চাই, আমাদের হিন্দুস্তানি পুলিশ নিজেদের ডিউটিতে কতটা কার্যকর, আমার কাছে মনে হয়েছিলো, এই মেয়েকে গ্রামের কোন জমিদার বা শেঠ অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন সন্দেহ হচ্ছে, এ নিয়ে ওরা যে কাহিনী শুনিয়েছে সেটা সত্যি নয়……

আমি চাই, নায়েক জগমোহন, তার বোন ও ঐ লোককে পুলিশের হাওলা করে দেয়া হোক। ইনস্পেক্টর এখানেই তদন্ত করে দেখুক। আসল ঘটনা আমিও জানতে চাই। আমি নিজে এই রিপোর্ট ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারকে লিখে পাঠাবো। না হয় এরা নিজেরা আবার এক জোট হয়ে উল্টা পাল্টাও কিছু করে বসতে পারে। তখন সব ঝামেলা আমার ওপর এসে পড়বে….. সুবেদার মেজরকে বলো, ওদেরকে এখানে পাঠিয়ে দিতে।

কর্ণেল আমাকে বললেন, ওদেরকে এখানে আনা হচ্ছে। আমি ইংরেজিতে বললাম, তাহলে তো আমার জন্য কাজ সহজ হয়ে গেলো।

ইনস্পেক্টর! আপনি তো চমৎকার ইংরেজি বলেন। খুশি হলাম।- কর্ণেল বললেন উচ্ছাসিত হয়ে।

***

একটু পর তিনজনকে আমার সামনে উপস্থিত করা হলো। দুর্গাকে দেখেই আমি চিনে ফেললাম। দুটো ডাকাতি কেসে সে আসামীদের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে ছিলো। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা সাক্ষ্য।

ক্যাপ্টেন আমাকে তদন্তের জন্য পৃথক কামরায় নিয়ে গেলেন। সেখানে ছিলো তিনটি চেয়ার ও একটি বড় রেভলিং চেয়ার।

প্রথমে আমি ঐ মেয়েকে ডেকে পাঠালাম।

দেখো, দুলারী- আমি দুলারীর চোখে চোখ রেখে বললাম- গ্রামে গঞ্জে সব ধরনের মিথ্যাচার, ধোকাবাজি চলে। পুলিশ ও আর্মি কর্মকর্তার সামনে যদি মিথ্যা বলো, ইংরেজ অফিসার তোমাকে বাইরে দার করিয়ে গুলি করে মারবে। না হয় সারা জীবনের জন্য তোমাকে জেলে পাঠিয়ে দেবেন। এখন একমাত্র আমিই আছি, যার সামনে তুমি সত্য বললে নিরাপদ থাকবে।

এটা তো অবশ্যই সত্য যে তুমি দুর্গার মতো বদমায়েশের সঙ্গে ঘর থেকে পালিয়ে এসেছে। আর এখানে এসে তুমি তোমার ভাইয়ের মাধ্যমে ইংরেজ অফিসারদের ভিন্ন কথা শুনিয়েছে।

না না- দুলারী এমনভাবে বললো যেন তার গলায় ছুরি চালানো হচ্ছে আমি দুর্গার সঙ্গে ঘর থেকে বের হইনি। আমাদের গায়ের ঠাকুর আমাকে অপহরণ করে তার কাছে বন্দি করে রেখেছিলো। অবশ্য সে আমাকে কোন কষ্ট দেয়নি। অনেক অপ্যায়ন করেছে। আর সবসময় বলেছে, আমাকে বিয়ে করতে চায়।

এই মেয়ের কথা শুনে আমার মনে হলো, পুরো কামরা আমার মাথার সঙ্গে ঘুরছে। কল্পনাও করিনি, এই মেয়ের কেস ঠাকুরের কেসের সঙ্গে এভাবে জট পাকিয়ে যাবে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, ওকে কি জিজ্ঞেস করবো। মনে হচ্ছিলো, কোন সিনেমায় আমি অভিনয় করছি।

তুমি কোন ঠাকুরের কথা বলছো? দুলারীকে জিজ্ঞেস করলাম।

সে ঐ ঠাকুরের কথাই বললো যাকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার নাম ছিলো কালি রায় ঠাকুর।

আমার কথা মন দিয়ে শোন দুলারী। তোমাকে বলেছি আমি মিথ্যা বললে তোমার কি পরিণাম হবে। পুরা ঘটনা তুমি খুলে বলল।

ঘটনা ছিলো এরকম- দুলারী বলতে শুরু করলো। আমি সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে আমাদের বকরিগুলো বাড়ি নিয়ে আসছিলাম। গ্রাম থেকে একটু দুরে কয়েকটি টিলা আছে। জায়গাটি খুব নির্জন। সেখান দিয়ে আসার সময় ওপর থেকে হঠাৎ আমার মাথার ওপর মোটা একটা কাপড় এসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে কেউ আমার দুহাত শক্ত করে ধরে ফেললো। ভয়ে আমি চিৎকার করতে লাগলাম।

তখন আরেকজনের আওয়াজ এলো- ওর মুখ বেঁধে দাও….

ওরা আরেকটি কাপড় দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিলো। তিন চারজন ছিলো। ওদেরকে রুখার মতো শক্তি আমার ছিলো না। তারপর তারা আমাকে নিয়ে একটি ঝোঁপের আড়ালে বসে পড়লো। হয়তো অন্ধকার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। কথা বলছিলো না কেউ।

অন্ধকার নামার পর তারা আমাকে দুজন করে কাঁধে নিয়ে পথ চলতে লাগলো। পালা করে আমার দেহ কাঁধ বদল হতে লাগলো….

অনেক পর আমার মনে হলো, একটা দরজা খুলেছে। অর্থাৎ আমাকে কোন কামরায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক কামরায় নিয়ে গিয়ে আমাকে খাটের ওপর নামিয়ে রাখলো ওরা। তারপর আমার মুখের বাঁধন খুলে দিলো। মাথার ওপর থেকে মোটা চাদরটিও সরিয়ে নিলো।

দেখলাম, সেখানে তিন চারজন লোক রয়েছে। দুজনের চেহারা কাপড়ে ঢাকা। ওরা বাইরে বলে গেলো। আমার সামনে এখন দুজন দাঁড়িয়ে। একজন ঠাকুর। আরেকজন ছিলো দুর্গা। দুজনকে দেখে আমি কেঁপে উঠলাম……

আমি যদি খারাপ মেয়ে হতাম তাহলে কোন চিন্তা ছিলো না। কিন্তু আমার কাছে জীবনের চেয়ে ইজ্জত অনেক প্রিয় …….

আমি কাঁদতে শুরু করলাম। মিনতি করে বলতে লাগলাম। আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও। ভেবেছিলাম, ওরা আমাকে নিয়ে জোর জবস্তি করবে। কিন্তু তারা তা করলো না। ঠাকুর আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, আমাকে তিনি খারাপ উদ্দেশ্যে উঠিয়ে আনেন নি।

তিনি ভগবানের কসম খেয়ে বললেন, তিনি আমাকে বিয়ে করবেন। দুর্গাও আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করলো।

আমি ওদেরকে বললাম, বিয়ে কি

মানুষ এভাবে করে? ….. আমার বাপকে বললো, তিনি গরিব মানু। বললেই তিনি বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন……।

ঠাকুর বললেন, তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমার বাবা তখন চিঠির মাধ্যমে আমার ভাইয়ের মতামত চান। ভাই নিষেধ করে দেন।

ঠাকুর আমাকে একথাও বলেন, তুমি আমার মনে এমনভাবে ঢুকে পড়েছে যে, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।

দুর্গা খারাপ লোক ঠিক, কিন্তু সেও আমাকে বললেন, দেখো দুলারী! সত্য কথা হলো, তোমাকে না পেয়ে নিশ্চয় তোমার বাপ পেরেশান হবে। আমি তাকে বলবো, তোমার মেয়েকে আমি খুঁজে বের করে দেবো।

কামরায় দুটি দরজা ছিলো। দরজা দুটি তালা লাগিয়ে ওরা চলে গেলো। সারা রাত ভয়ে ভয়ে কাটালাম আমি। ওরা আমাকে সামান্যতম বিরক্তও করেনি। পরের দুদিন ঠাকুর আমাকে বুঝিয়ে গেলো, আমি যেন দু একটা দিন ধৈর্য ধরি তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি বুঝতে পারলাম, আমার ইজ্জত নিয়ে ঠাকুরের মতলব খারাপ নয়। হলে তো ঠাকুর যেকোন সময় তার মনোবাসনা পুরন করতে পারতো…….

ঠাকুর অনেকগুলো টাকা ও সোনার অলংকার আমার সামনে রেখে মিনতি করে বলতে লাগলেন,

আমি তোমাকে রাণী বানিয়ে দেবো। তার এই বিনয় ভাব ও টাকা পয়সা দেখে ঠাকুরের প্রতি করুণায় ভরে উঠলো আমার মন। আমি তাকে বললাম, এগুলো আপনার কাছে রেখে দিন। আগে আমার বাপকে রাজি করান।

আচ্ছা দুলারী! দূর্গা কি সব সময় ঐ কামরায় থাকতো?

না সে মাঝে মধ্যে আসতো।

দুর্গা তোমাকে ভয় দেখাতো না?

না জনাব! দুর্গা তো খুব সুন্দর করে কথা বলতা। তৃতীয় রাতে ঠাকুর আমার জন্য বিরাট খাবারের আয়োজন করলেন। বললেন, আজ তোমাকে দারু (মদ) পান করাবো।

আমি বললাম, ছিঃ ছিঃ এগুলো তো খারাপ জিনিস। আমি পান করবো না। ঠাকুর বড় করুণ গলায় বললেন, আমি এত করে বলছি, দুএক ঢোক পান করে দেখো না। তার মন গলানো ব্যবহার দেখে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তিনি অন্য কামরায় চলে গেলেন। হয়তো শরাবের বোতাল ওখানে ছিলো…..

***

এ সময় দুর্গার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলছিলো। পরক্ষণেই ঠাকুর খালি হাতে এ কামরায় এসে আমার সামনে বসে পড়লো। তার পর দুর্গা এলো। তার হাতে শিরকার দুটি গ্লাস ছিলো। একটি গ্লাস আমার হাতে দিলো। আরেকটি ঠাকুরের হাতে।

খাও খাও- ঠাকুর বললেন। আমি ভয়ে ভয়ে একটু মুখে নিলাম। তিতায় আমার মুখ বিকৃত হয়ে গেলো। ঠাকুর তখন আমার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে নিলেন। ঠাকুর আর দুর্গা এক নিঃশ্বাসে গ্লাস শেষ করে ফেললো। তাদের বার বার বলায় আমি একটু একটু করে আমার গ্লাসও খালি করে ফেললাম। ঠাকুর ভাজা মুরগির একটা বড় টুকরার প্লেট সামনে রাখলেন …..

ঠাকুর তখন বললেন, আমার মাথাটা ঘুরছে।

দুর্গা বললো, তাহলে আরেকটু পিয়ে নিন। দুর্গা আরো অর্ধেক গ্লাস এনে ঠাকুরের হাতে দিলো। ঠাকুর সেটা মুখে দিয়েই কখনো তার পেটে কখনো মাথায় হাত ফেরাতে লাগলেন। চোখমুখ কুচকে বললেন

দুর্গা! তুমি ভুল করোনি তো?- দুর্গা হেসে বললো, সে কি ঠাকুর সাব!

 দুর্গা এ কথা বলে কি বোঝাতে চাইলো বুঝলাম না আমি…….

ঠাকুরের অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছিলো। দুর্গাকে বললেন, তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে। দুর্গা বললো, তিনি যেন আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়িতে চলে যায়। সে গেলে দুলারী এখানে একলা রয়ে যাবে। ঠাকুর বিড় বিড় করে কি যেন বলতে বলতে চলে গেলেন। একটু পর দুর্গা আমাকে বললো, দুলারী! চলো এখান থেকে পালাতে হবে।

কোথায় নিয়ে যাবে?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

শোন। এখানে থাকলে তুমি মারা যাবে- দুর্গা বললো- তুমি কুমারী মেয়ে। ঠাকুর তোমাকে এক সন্যাসীর কথায় অপহরণ করেছে। দুএকদিনের মধ্যে তোমাকে কতল করে তোমাকে দিয়ে জাদু টোনা করবে। তখন ঠাকুর বিরাট ধন ভাণ্ডারের মালিক বনে যাবে।

আমার সন্দেহ হলো- দুলারী বলে গেলো- দুর্গা মনে হয় আমাকে ধোকা দিচ্ছে। কিন্তু সে যখন পুরো কথা বুঝিয়ে বললো আমি শুধু বিশ্বাসই করলাম না, ভয়ে কুকড়ে গেলাম। দূর্গা তো এখানেই আছে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। ওর সঙ্গে আমি ঠাকুরের বাগান বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। রাতভর আমরা পায়দল চললাম।

সকালের দিকে দুর্গা আমাকে এক গ্রামে নিয়ে গেলো। সেখানে তার পরিচিত এক বাড়ির পৃথক কামরায় নিয়ে আমাকে বসালো। এক বুড়ি আমাকে এক বাটি দুধ ও দুটি পরোটা খাওয়ালো।

অনেক্ষণ পর দুর্গা এলো। আমাকে বললো, তোমাকে আমি তোমার ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাবো। আমার কাছ থেকে জেনে নিলো আমার ভাই থাকে জবলপুর জাট রেজিমেন্টে…….

এবার দুর্গার ওপর আমি সন্ধিহান হয়ে উঠলাম। তকে বললাম, তুমি আমার বাপের কাছে না নিয়ে ভাইয়ের কাছে কেন নিয়ে যাবে?

সে বললো, আমরা তোমার গ্রামে গেলে ঠাকুরের লোকেরা আমাদের আস্ত রাখবে না। তাছাড়া পুলিশ তার হাতে আছে। আমাদেরকে সোজা জেলখানায় চালান করে দেয়া হবে। তাই তোমার ভাইয়ের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা তাকে শোনালে সে সবকিছু বুঝতে পারবে।

আমি অপরাগ ছিলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ওর সঙ্গে যাওয়াটাই স্থির করলাম। আল্লাহর নাম জপতে লাগলাম। গ্রাম থেকে দেড় দুই ক্রোশ দূরে রেল স্টেশন। এক লোক ঘোড়ার গাড়িতে করে আমাদেরকে রেল স্টেশনে পৌঁছে দিলো …….

পরদিন আমরা জবলপুর জাট রেজিমেন্টের ছাউনিতে পৌঁছলাম। জিজ্ঞেস করে করে এখানে পৌঁছলাম। তারপর আমার ভাইকেও খুঁজে পাওয়া গেলো। ভাই তো আমাকে দেখে দারুন হয়রান গেলেন।

দুর্গা ভাইকে বললো, সব কথা আপনার বোনের কাছে শুনুন। আমি সংক্ষেপে সব ভাইকে শোনালাম। ভাই বললেন, তোমরা বসো এখানে, আমি আসছি। অনেক্ষণ পর আমার ভাই এসে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ভাইয়ের সঙ্গে আরেকজন ছিলেন। তিনি এখানকার সুবেদার। আমাকে সুবেদার ঘরে রেখে গেলেন। দুর্গাকে অন্য কোয়ার্টারে রাখা হলো………

ভাই প্রায়ই এসে আমাকে দেখে যেতেন। বলতেন, তিনি এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপরস্থ কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত দিয়েছেন। পুলিশ হয়েতো একদিন এসে তোমাদেরকে নিয়ে যাবে। না হয় আমি ছুটির পর তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো।

একদিন এক মহিলা সুবেদারের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এলো। মহিলাকে আমি চিনে ফেললাম। তিনি আমাদের গ্রামের। তার স্বামী এখানকার হাবিলদার।

হাবিলদারের স্ত্রীকে তুমি কি বলেছিলে?

বলেছি, আমি ভাইকে দেখতে এসেছি। মহিলা দুর্গাকে চিনতো। জিজ্ঞেস করতে লাগলো, এই বদমায়েশ এখানে কি করে এলো?

আমি তাকে বললাম, ও আমার ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ও আমারও ধর্ম ভাই। আসলে আমার অই নিজেই আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলো, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, তুমি তোমার ভাইকে দেখতে এসেছে……. তারপর তো আপনি এলেন…

***

দুলারীকে অন্য কামরায় পাঠিয়ে দুর্গাকে ডেকে আনলাম।

দেখো দুর্গা!–আমি দুর্গাকে বললাম- এখন তুমি শুধু পুলিশের হাতেই নও আর্মির হাতেও বন্দি। আমি উপযুক্ত প্রমাণ নিয়েই এ পর্যন্ত এসেছি। দুলারী তার ভেতরের সব কথা আমার কাছে খুলে বলেছে। কিছুই সে লুকোয়নি। তোমার বয়ান যদি সামান্যতমও এর বিপরীত হয়, দেখবে তোমার কি অবস্থা হয়। এখন বলো আসলে কি হয়েছিল?

হুজুর!- দুর্গা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো- লোকে আমাকে বলে দুর্গা বদমায়েশ। বদমায়েশকে মানুষ বদমায়েশই তো বলবে। বদমায়েশ ভালো কিছু করলেও লোকে বলে এর মধ্যেও বদমায়েশি কিছু আছে। আমি একটা ভালো কাজ করেছি তবে বদমায়েশি কায়দায় করেছি। আপনি একে নিশ্চয় পুলিশি ও আইনের দৃষ্টিতে দেখবেন। কিন্তু আপনি কি এটা মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে পারবেন না?

আমার কাছ থেকে ওয়াদা নিচ্ছো দুর্গা! তুমি যদি ভালো কাজ করে থাকো এর প্রতিদান তোমাকে আমি দেবো। কিন্তু তুমিও ওয়াদা করো আমার কাছে কিছুই লুকাবে না।

হুজুর এর আগে বলুন ঠাকুরের এখন কি অবস্থা?

 ওর তো ছাইও এখন আর অবশিষ্ট নেই। মারা গেছে।

দুর্গার সঙ্গে এ ব্যপারে অনেক কথা হলো। আমি ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করে গেলাম। অবশেষে সে রহস্যের পর্দা উঠত শুরু করলো। ঠাকুরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এই বদমায়েশি সূত্রেই দুর্গা বলতে লাগলো–

তিনি ছিলেন আমার মুনিব। আমার কারণে তিনি নিরাপদ থাকতেন। আর আমার টাকা পয়সা, আরাম আয়েশের সব প্রয়োজন তিনি পূর্ণ করতেন।……..

একদিন ঠাকুর আমাকে একটা গোপন কথা জানালেন। আমাদের গ্রাম থেকে দুই আড়াই মাইল দুরে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি আছে। ওখানে সাধু সন্নাসীরা থাকে। ঠাকুরকে কেউ বলেছে, সেখানে এক সন্নাসী আছে। যার হাতে গায়েবী ইলম আছে। কিন্তু সন্নাসী কাউকে সেটা বলে না। তবে কারো প্রতি সন্নাসী খুশি হয়ে গেলে তার বাড়ি টাকা পয়সা ও সোনা রূপায় ভরে যায়।

ঠাকুর তার কাছে যাওয়া আসা শুরু করলেন। তাকে শরাবের কয়েকটা বোতল দিলেণ। টাকা পয়সাও দিলেন অনেক।

আমাকে ঠাকুর বলতেন, সন্নাসীকে তিনি হাত করে নিয়েছেন। তার হাতে সত্যিই গায়েবী কিছু আছে….

একদিন ঠাকুরকে বেশ আনন্দিত মনে হলো। আমাকে ঘর থেকে ডাকিয়ে নিয়ে বললেন, দুর্গা দাস! আমার কাজ আর মুসিল হবে না। যদি একটা কাজ করতে পারো, তোমার ঘর দৌলতে ভরে যাবে।

আমি জানতে চাইলাম কি কাজ?

ঠাকুর বললেন- ঐ সন্নাসী বলেছেন, খেয়াল রাখবে, গ্রামের কোন কুমারী মেয়ে যদি সোমবার রাত শেষে মঙ্গলবার মারা যায় তাহেল তার মাথার খুপড়ির হাড় যেটা চার ইঞ্চি থেকে কম হতে পারবে না- সেটা জোগাড় করে আনতে হবে।

সন্নাসী বলেছে, সে হাড়টি আমার কাছে আনতে হবে। আমি এর ওপর আমল করবো এবং তোমাকে দিয়ে দেবো। এই হাড় বিশেষ কোন এক সময় যদি লোহার টুকরার ওপর ঘুরানো হয় লোহ সোনা হয়ে যাবে…..

ঐ হাড় বিশেষ এক সময়ে তোমার ঘরের এক কোনায় রেখে দেবে। দেখবে, অগনিত পয়সা তোমার কাছে আসছে।

ঠাকুর আমাকে বললেন, আমি সারা গায়ের মেয়েদের ব্যপারে খোঁজ খবর নিয়েছি। একটি মেয়ে আমার চোখে পড়েছে। যার বয়স ষোল বছরের চেয়ে কম ও সতের বছরের বেশি হবে না। আমার বিশ্বাস সে ভদ্র মেয়ে এবং কুমারী……..

ঠাকুর দুলারীর কথা বললেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে, সে মেয়ে এই বয়সেই মঙ্গলবার মরে যাবে।

তিনি বললেন- এ কাজটাই তো করতে হবে তোমাকে। তুমি সুযোগ বুঝে ওকে উঠিয়ে আনন। তার মৃত্যু হবে এমনভাবে যে রক্তও বের হবে না এবং সেদিন হবে মঙ্গলবার।

আমি ঠাকুরকে এ থেকে ফেরাতে অনেক চেষ্টা করলাম। তাকে এও বললাম, আমার বিশ্বাস হয় না, কোন মানুষের এমন অদৃশ্য শক্তি থাকতে পারে। কিন্তু ঠাকুর কোন কথাই শুনতে তৈরী ছিলেন না।

তিনি আমাকে বললেন, যা খুশি তুমি চাও তোমাকে আমি দেবো, আগে মেয়েকে উঠিয়ে আনন। পরে যা করার করবো আমি। এরপর শুধু বাকি থাকবে লাশ গায়েব করার কাজ।

***

এরপর দুর্গা সে কথাই শোনালো যা দুলারী বলেছিলো। দুর্গার নেতৃত্বেই দুলারীকে অপহরণ করা হয়েছিল।

ঘটনার রাতে আমি ঠাকুরের বাগান বাড়ির কামরায় গিয়ে দেখলাম, ঠাকুর সেখানে রয়েছেন- দুর্গা তার বয়ানে বললো- তার সামনে ছিলো শরাবের দুটি গ্লাস। পাশে শরাবের বোতল পড়েছিলো। আমি যে কামরার দরজায় এসেছি ঠাকুর সেটা টের পাননি। দেখলাম, তিনি ছোট একটা পুরিয়া খুলে শরাবের একটা গ্লাসে ঢেলে দিলেন। তারপর গ্লাসটা হাতে নিয়ে হালকাভাবে ঝাঁকি দিলেন। সেটা ছিলো সামান্য পাউডার…….

আমাকে মুহূর্তের জন্যও ভাবতে হলো না। আমার মনে ডেকে উঠলো, ঠাকুর একটি গ্লাসে শরাবের সঙ্গে বিশ মিশিয়েছেন। আর এটা পান করাবে দুলারীকে। আমার মনে পড়ে গেলো, আজকে সোমবার। এই বিশ খাওয়ার পর দুলারী নিশ্চয় আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত মরে যাবে…..

আচমকা ঠাকুর আমার দিকে ফিরে তাকালেন। বললেন, ভালো করেছো তুমি এসেছে। আমাদের সঙ্গে তুমিও খেয়ে পিয়ে নাও। ঠাকুর গ্লাস দুটি হাতে নিয়ে অন্য কামরার দিকে রওয়ানা দিলেন।

আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম- ঠাকুর জি! খুব খারাপ দেখাচ্ছে, আপনি সাধারণ একটি মেয়ের সামনে নিজ হাতে গ্লাস নিয়ে গিয়ে রাখবেন। আমি আপনার নওকর। এ তো আমার কাজ। গ্লাস ও খাবার দাবার আপনার ও দুলারীর সামনে নিয়ে রাখবো।

যে গ্লাসে পাউডার মেশানো হয়েছে ঠাকুর তার ওপর হাত রেখে বললেন, এ গ্লাসটি দেবে দুলারীকে…..

ঠাকুর তো মহা খুশি আমি তাকে মহারাজা বানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু হুজুর! জানি না আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন কিনাঃ আমার ভেতর তখন অন্যরকম এক পরিবর্তন এসে গেলো।

আমি তো জানতামই, এই মেয়েকে ঠাকুরের হাতে মরতে হবে। কিন্তু যখন মদের মধ্যে পাউডার মেশাতে দেখলাম তখন বুঝে গেলাম, এটা বিষ। তাছাড়া ঠাকুর বিশেষ করে আমাকে বলেছে, ঐ গ্লাসটি দুলারীর সামনে রাখতে হবে। আমার ওপর ঠাকুরের শতভাগ আস্থা ছিলো। ঠাকুর অন্য কামরায় চলে গেলেন….

আমার ভেতর কী যেন কেপে উঠলো, আহা! বুড়ো এক বাপের একটি মাত্র মেয়ে। বাপও শরীফ লোক। বেটিও শরীফ ……হুজুর। আমি অনেক মন্দ লোক। কিন্তু গাঁয়ের যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন কখনো কোন মেয়েকে আমি আপত্তিকর চোখে দেখিনি।

আমার বোনের কথা মনে হলো আমার, যে বিধবা হয়ে আমার ঘরে বসে আছে। ওকে যদি এভাবে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং থোকা দিয়ে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে তাহলে আমার বৃদ্ধ মার কি অবস্থা হবে?

আমার এটাও মনে পড়লো, দুলারীকে আমিই উঠিয়ে এনেছিলাম। তার বাপের না জানি কি অবস্থা…..।

ঠাকুর আপনাকেও তো থোকা দিয়েছিলো। দুলারীর বাপকে থানায় নিয়ে এসে মেয়ের অপহরণ মামলা দায়ের করে যায়। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দুলারীকে বাঁচাতে হবে। আর এই ঠাকুর বাচলে অনেক মানুষের ক্ষতি করবে। গ্লাস পাল্টে দিলাম। ঠাকুরের সামনে রাখলাম বিষের গ্লাস। আর দুলারীর সামনে রাখলাম ঠাকুরের গ্লাসটি।

আমি ঠাকুরের দিকে তাকালাম। ঠাকুরও আমার দিকে তাকালেন। আমি তাকে চোখ টিপে দিলাম। ঠাকুরের ঠোঁটে তখন নিষ্ঠুর হাসি ঝুলছিলো। ঠাকুর তো নিশ্চিত ছিলেন, সকাল পর্যন্ত দুলারী শেষ হয়ে যাবে। তখন তার খুপড়ির হাড় কেটে নেয়া হবে। এরপর বাগানে কোথাও লাশ মাটি চাপা দিয়ে রাখবে।

ঠাকুর জানতেও পারলেন না আমি তার মৃত্যুর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বড় আয়েশ করে গ্লাসের সবটুকু মদ ঠাকুর সাবাড় করে দিলেন।

শরাবে বিষ মেশানো হলো কেন? দুধ বা অন্য কোন খাবার জিনিসেও তো মেশাতে পারতো?

আসলে শরাব যেহেতু একটু তিতকুটে হয় তাই এতে বিষের স্বাদ জিহ্বায় অনুভূত হয় না। আর এটা ঠাকুরেরই আবিষ্কার ছিলো যে, শরাবে বিষ মেশানো হবে।

আমি অনুমান করছিলাম, ঠাকুর সকালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এই অনুমান করার কারণ হলো, ঠাকুর দুলারীকে মঙ্গলবার সকালে মৃত অবস্থায় দেখতে চাচ্ছিলেন। ঠাকুর যখন বিষের ক্রিয়া সহ্য করতে না পেরে তার বাড়ির দিকে রওনা করেছিলেন আমি তখন দুলারীকে নিয়ে সেখান থেকে পালালাম। এক গ্রামে আমার এক বন্ধু ছিলো। যে পেশাদার ছিনতাইকারী। সেটা অন্য থানায়। রাতের মধ্যেই দুলারীকে ওখারে নিয়ে গেলাম…….

আমি ওকে ওর বাবার কাছে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেখানে আপনার হুলিয়া আমার ওপর ঝুলছিলো। তা ছাড়া ঠাকুর যদি মরে গিয়ে না থাকে তাহলে তো…

আসলে আমি এমন কাজ করতে পারবো কখনো তা ভাবতে পারিনি। তাই কোন কিছু ঠিক করতে পারছিলাম না। দিশেহারার মতো হয়ে গিয়েছিলাম। তাই আমি ওকে আমার ছিনতাইকারী বন্ধুর ওখানে নিয়ে গেলাম।

এটি সেই ছিনতাইকারী যে একবার আমার এলাকায় ধরা পড়েছিল? তারপর তুমি ওর ছাফাই গেয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলে- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

জি হুজুর! সেই- সে বললো আমাকে, আগের ইনস্পেক্টরের সঙ্গে তার চুক্তি ছিলো। তখন সে নিরাপদও ছিলো। কিন্তু নয়া ইনস্পেক্টর এসেই তাকে হুমকি দিয়েছে যে, এই এলাকা থেকে বেরিয়ে যাও না হয় জানে মেরে ফেলবো। এজন্য সে নিজেই সেখান থেকে গাঠুরী গোল করছিলো। আমাকে সরাসরি বললো, ভাই! এই মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে এখনই পালাও, না হয় তোমরা ধরা পড়ে যাবে……….

তখন ওর সঙ্গে সলা পরামর্শ করে ঠিক করলাম, দুলারীকে তার ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দেয়াই নিরাপদ। কারণ, ইংরেজরা ফৌজকে অনেক কদর করে। পুলিশ সে পর্যন্ত যেতে পারবে না। তবে দুলারীর ভাই নায়েক জগমোহন আমাকে বললেন, তুমি যে ঠাকুরকে বিষ দিয়েছো এটা আমার কর্ণেলকে জানানো যাবে না। তাহলে কর্ণেলই তোমাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে দেবে।

***

দুর্গার জবানবন্দির পর দুলারীর ভাইয়ের জবানবন্দি নেয়ার আর প্রয়োজন ছিলো না। তবুও আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার্থে নেয়া হলো তার জবানবন্দি। এসব ঘটনা আমি রিপোর্ট আকারে লিখে ঐ রেজিমেন্টের কর্ণেলকে শোনালাম। কর্ণেল ক্ষেপে গেলেন এ কারণে যে, তারা তার কাছে বিষের ঘটনা লুকিয়েছে।

এমনিতে কর্ণেল দূর্গার কৃতিত্বে খুশি ছিলেন। যেস এক অবলা নারীকে মৃত্যুপুরী থেকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু মিথ্যাচার তাদের কাছে অসহ্য।

যা হোক, কর্ণেলের পরামর্শে এবং সাক্ষ্যের খাতিরে দুর্গা, দুলারী ও তার ভাই জগমোহনকে নিয়ে রাতের মধ্যেই গাড়িতে করে আমাদের থানায় চলে এলাম।

সকালে দুর্গাকে নিয়ে ঐ সন্নাসীর ডেরায় অভিযান চালিয়ে তাকে থানায় নিয়ে এলাম। এক হিসেবে সন্নাসী আইনের চোখে অপরাধী নয়। কিন্তু ধোকাবাজ হিসেবে অবশ্যই অপরাধী।

সন্নাসীকে জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুরকে সে যে জাদু বিদ্যা দিয়েছে এতে কি সত্যিই মাথার হাড় দিয়ে লোহাকে সোনা বানানো যায়?

আমি কখনো পরীক্ষা করে দেখিনি- সন্নাসী জবাব দিলো- আমার উস্তাদ আমাকে শুধু এটা শিখিয়েছিলো। আমি শেখালাম ঠাকুর সাবকে। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম, এমনভাবে সব দিক দিয়ে মিলিয়ে কোন মৃত মেয়ের হাড় কেউ আনতে পারবে না।

সন্নাসীকে ছেড়ে দিলাম। থানায় এসে পূর্ণ রিপোর্ট তৈরী করে ডিএসপি সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। ডিএসপি আমাকে ধন্যবাদ জানালেন।

তবে দুর্গার বদলে যাওয়া চরিত্র আমাকে মুগ্ধ করে দিলো। এক নিষ্পাপ মেয়েকে বাঁচানোর জন্য প্রভাবশালী এক বদকারকে শশ্মানে পাঠিয়ে দিয়েছে। মানবিক দিক দিয়ে এটা অবশ্যই পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত ঘটনা। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি দুর্গাকে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আইনের দাবী বড় নির্মম।

আমার দায়িত্বও পালন করতে হবে এবং আইনকেও সাহায্য করতে হবে। আমি দুর্গার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারা মোতাবেক শাস্তির মামলা দায়ের করলাম। আর দুর্গাকে বললাম, তুমি বিষ দেয়ার ঘটনা স্বীকার করবে না। আদালতে দাঁড়িয়ে বলবে, দুলারীকে সে ওখান থেকে যখন নিয়ে যায় তখন ঠাকুর ওখানে ছিলো না।

আর আমিও এমন সাক্ষ্য পেশ করলাম না যে, ঘটনার রাতে ঠাকুর তার বাগান বাড়িতে ছিলো, আর দুর্গাও যে সেখানে গিয়েছিলো এমন সাক্ষ্য পেশ করলাম না।

দুর্গার উকিলও ছিলো খুব জাদরেল লোক। আদালত দুর্গার বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করতে পারলো না। তারপর দুর্গা বেকসুর খালাস পেয়ে গেলো।

এর দুদিন পর দুর্গা, তার বোন, স্ত্রী ও তার মা এবং দুলারী, তার ভাই ও বাপ আমার কাছে এসে আর্জি জানালো, মুসলমানদের মধ্যে যে মানবিক বদান্যতা এভাবে চর্চিত হয়, সৎ কাজের এত কদর করা হয় তা তাদের জানা ছিলো না। তাই তারা মুসলমান হতে চায়।

থানা মসজিদের ইমাম সাহেবের মাধ্যমে তাদেরকে কালেমা তায়্যিবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্–পড়িয়ে ইসলামে দীক্ষিত করা হলো।

অবশ্য পরে ইংরেজ ডিএসপি ওদের মুসলমান হওয়ার ঘটনাও শুনেছিলেন। তিনি এ ঘটনায় খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না। মাস তিনেক পর থানা পরিদর্শনে এসে আমাকে বললেন,

তোমরা শুধু আসামী ধরে ধরে শাস্তিই দাও না, হিন্দু ধরে ধরে মুসলমানও বানাও।

এক ইংরেজের মুখে এমন ব্যত্মাক বিদ্বেষমূলক মন্তব্য আমার কাছে ভালো লাগলো না। আমার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে চাকরির মায়া চলে গেলো। আমি দৃঢ় গলায় জবাব দিলাম,

স্যার! ওদেরকে যদি মুসলমান না বানিয়ে ইহুদি-খ্রিষ্টান বানাতাম তাহলে নিশ্চয় আমি আপনার চোখে পুরস্কারের যোগ্য হতাম! কিন্তু এখন তিরস্কারের যোগ্য।

ডিএসপি সাহেব ভাবেন নি, আমি মুখের ওপর এমন কথা বলতে পারবো। তিনি থতমত খেয়ে গেলেন। সম্ভবতঃ তার ভুলটি বুঝতে পেরেছিলেন।

তার লাল বর্ণের মুখটি আরো লালচে হয়ে উঠলো।

ব্যাপারটি আমাকে দারুন আনন্দ দিলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *