হৃদয়ের কাঁটা

হৃদয়ের কাঁটা

সবাই তাকে চাচা মাজেদ বলে। না, পাড়ার বুলি হিসেবে মাজেদ সাহেবকে চাচা মাজেদ ডাকা হতো না। এই ডাকার মধ্যে শ্রদ্ধা আর সমীহের সরল অভিব্যক্তি ছিলো। কারণ, বিধাতা তাকে এমন সুর মাধুরী দান করে ছিলেন যার সুর তরঙ্গ পথিকের পথ রোধ করে দিতো। তবে তিনি হিরু ওয়ারিস শাহ গীতি ছাড়া আর কিছুই গাইতেন না।

তার গাওয়ারও কোন সময় ছিলো না। কখনো অর্ধ রাতের পর তার সুর লহরী চাঁদ তারাকেও আচ্ছন্ন করে ফেলতো। কখনো মধ্য দুপুরের উধাস হাওয়ায় হঠাৎ তার সুর বেজে উঠতো। সারা গ্রাম নিথর স্তব্ধ হয়ে যেত।

কিন্তু কেউ হাজার অনুরোধ করলেও তার গলায় সুর উঠতো না। দু টুকরো বিন্ন হাসি উপহার দেয়া ছাড়া আর কিছু দিতেন না তখন। তবে অতিথি এলে তাকে নিরাশ করতেন না। একটু বললেই হতো। চাচা মাজেদ বলতেন, আমার এই মেহমান হিরু ওয়ারিশ শাহ শুনতে এসেছে। মেহমানকে তিনি খুশি করে দিতেন।

একবার সে গ্রামে আমাকে আতিথেয়তা গ্রহণ করতে হলো। তখনই আমি তার সুরের ভক্ত হয়ে যাই। মনে করেছিলাম তার সুরে কেবল সাধারণ আকর্ষণই আছে; কিন্তু তার কাছে যাওয়ার পর অনুভব করলাম, এর মধ্যে গভীর দাগের কোন কাহিনী আছে।

সে গ্রামে যাওয়ার পট ভূমিটা ছিলো এরকম

অন্য এলাকার এক পীরের মুরিদ ছিলাম আমি। এর অর্থ এই নয় যে, আমি অশিক্ষিত, গোঁয়ার। পরীক্ষা না দিলেও বি.এ. পর্যন্ত পড়া আছে আমার। তবে আমার বাবার মুখে শৈশব থেকেই সেই পীরের কারামত শুনে এসেছি।

আমাদের বংশের সবাই ঐ পীরের মুরিদ। পীরের গদি আমাদের এলাকা থেকে একটু দূরে। বছরে দুবার পীরের আস্তানায় যেতাম। একবার শুধু সালাম করতে। আরেকবার বাৎসরিক উরসে।

অন্যদের মতো আমিও বিশ্বাস করতাম, পীরের কজায় জ্বিন আছে। কাউকে যদি জিন উত্যক্ত করতে পীর সেই জিনকে হাজির করে শাস্তি দিতেন। এ ধরনের অনেক কাহিনী আমি সত্য বলে বিশ্বাস করতাম।

সে বছর উরসে গিয়ে আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। উরসে কাওয়ালির তিনটি দল এসেছিলো। কাওয়ালি আমার খুব প্রিয়। কাওয়ালির এক গায়কের সুর আমার কাছে খুব ভালো লাগলো। আমার সহকর্মীকে তার কথা বলছিলাম।

তুমি হৃদয়কাড়া সুর যদি শুনতে চাও আমাদের গ্রামে চলো- সহকর্মী বললো।

সে চাচা মাজেদের কথা বললো। বিভিন্ন কাওয়ালি ও গানের দল তাকে তাদের দলে ভেড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি এসবে পাত্তা দেন না। পীরেরাও তাকে উরসের সময় দাওয়াত করেন। তিনি সাড়া দেন না। আমার সহকর্মীর কথা শুনে মনে হলো, চাচা মাজেদ অন্যদের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম এবং পোড় খাওয়া মানুষ।

***

রাতে চাচা মাজেদের বাড়িতে আমার মেজবান সহকর্মীর সঙ্গে বসেছিলাম। চাচার বয়স পৌঢ়ত্বে ছাড়িয়ে গেছে। তার ও এক স্ত্রীর সংসার এটা। একেবারে আটপৌঢ়ে। দরিদ্রই বলা যায়। তবে বেশ হাসিখুশি। অভাবের জন্য তাদের মধ্যে কোন হাপিত্যেশ নেই।

চাচা মাজেদ অতিথির অনুরোধ পেয়ে আমাকে ওয়ারিশ শাহ শোনাতে বসলেন। গাওয়া শুরু করলেন। ঢোক, তবলা, হারমেনিয়াম ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র নেই। তাতে কি? চাচার কণ্ঠে সবকিছুই যেন ঝংকৃত হচ্ছে। কেমন গম্ভীর জ্বালা ধরা সুরে গেয়ে চলেছেন।

এক কলি শেষ হওয়ার আগেই দুচারজন করে শ্রোতার দল আসতে লাগলো। সবার স্থান মাটিতে। মাটিতে একটা শতরঞ্চি পাতা আছে। আশ্চর্য সেখানে কেউ বসছে না। যেন সেখানে বসলে চাচা মাজেদের সঙ্গে বেয়াদবি হবে।

সেখান থেকে আমি যে সুধা নিয়ে ফিরলাম তা আমার শুকনো জীবনকে করে তুললো রসাবৃত। আমার সহকর্মী তার সম্পর্কে পরে এমন দুএকটা কথা বলেছিলো, যার টানে পনের ষোল দিন পর আমি আবার সে গ্রামে গিয়ে উঠলাম।

উপহার হিসেবে দুটো জিনিস নিয়ে গেলাম। চাচী অর্থাৎ চাচা মাজেদের স্ত্রীর খুব পছন্দ হলো সেগুলো। সারাদিন সেখানে রইলাম। সন্ধ্যায় ফিরে এলাম। কয়েকদিন পর আবার গেলাম। তৃতীয় সাক্ষাতে চাচা মাজেদ আমাকে ছেলের মর্যাদা দিয়ে দিলেন। তাদের কোন ছেলে মেয়ে নেই।

আমার সহকর্মীর কাছ থেকে তার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম চাচা মাজেদ তার কিছু সত্য বলে জানালেন। আর কিছু গুজব বলে উড়িয়ে দিলেন। চতুর্থ সাক্ষাতে তিনি আমাকে তার জীবনের অতি চমকপ্রদ কাহিনী শোনালেন।

***

দক্ষিণ পাঞ্জাবের এক গ্রামে দরিদ্র এক পিতার ঘরে আমার জন্ম।–চাচা মাজেদ নিজের জীবনের গল্প শুরু করলেন।

বুঝতে শিখার পর আমার বাবাকে বিত্তশালীদের ঘরে চাকর খাটতে দেখেছি। যার বিনিময়ে আমরা দানা পানি পেতাম।

ঈদের সময় সালামী আর রঙ্গীন কাপড় পেতাম। আমার বাবার মতোই আমি সেই ছোট থেকেই উঁচু জাতের লোকদের বেগার খাটতে শুরু করি……

কিন্তু উঁচু নিচুর এই ফারাক আমি মেনে নিতে পারতাম না। শীত বা গরমে কখনো জুতা পায়ে দেয়ার ভাগ্য হয়নি। আমার বয়সের ছেলেরা কত সুন্দর সুন্দর জুতা পরতো। দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমার একটিই কাপড় ছিলো। সেলওয়ার বা চাদর কেবল ঈদে পড়তে পারতাম……..

বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেও চৌধুরী বাড়ি থেকে ডাক আসলেই ছুটতে হতো বাবাকে। একান্তই যেতে না পারলে আমার মা যেতো। পুরষালী কাজ হলেও আমার মাকেই করতে হতো।……

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরের এই অনুভূতি দৃঢ়তর হলো যে, আমিও ওদের মতোই মানুষ যারা আমাকে ও আমার মা বাবাকে গোলাম বানিয়ে রেখেছে। কোত্থেকে এ অনুভূতি আমার ভেতর জন্ম নিলো জানি না।

পড়া লেখা জানতাম না তাই এসব কথা বই থেকে পড়ারও প্রশ্ন উঠে না। কেউ বলেওনি এসব কথা। না কখনো তারা এই ভাগ্যহত জীবনের জন্য দুঃখবোধ করেছে। তারা আমাদের এই লাঞ্চনার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের জন্য সম্মানজনক জীবনের কল্পনাও করেনি..

মনে মনে আমি যাই ভাবি না কেন তা তো প্রকাশ করার মতো সাহস ছিলো না। তবে খোদা আমাকে কণ্ঠ দিয়ে আমার জ্বালা কিছুটা হলেও ভুলে থাকার সুযোগ দিয়েছিলেন।…..

আমাদের গ্রামে এসে এক অন্ধ গায়ক ওয়ারিস শাহের সংগীত গাইতেন। তার কাছ থেকে শুনে শুনে আমি কয়েকটা কলি মুখস্থ করে নিই। ক্ষেত খামারে গিয়ে সেই কলিগুলো গুন গুন করে আওড়তাম। নিজের কণ্ঠ নিজের কাছেই বেশ লাগতো।

একদিন সেই অন্ধ গায়ককে ধরলাম, আমাকে গান শেখাতে হবে। তিনি তখন আমার গানের গলা শুনতে চাইলেন। আমি শোনাতেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি আমার গুরু হয়ে গেলেন। ওয়ারিশ শাহের অনেক গান জানি আমি। সব তার কাছ থেকেই শোনা এবং শেখা……..

গ্রামের লোকেরা আমার কাছে ওয়ারিস শাহ শুনতে চাইতো। আমার কাছে ভালো লাগতো। আমি ভেবে ছিলাম, এই কষ্টের কারণে হয়তো সবার চোখে আমি কিছুটা হলেও সম্মানের পাত্র হবো। কিন্তু এ ছিলো আমার অলীক কল্পনা। উঁচু জাতের লোকেরা আমাকে তাদের ব্যবহারে জানিয়ে দিলো যে, তোমার কণ্ঠের মূল্য থাকতে পারে, তোমার কোন মূল্য নেই আমাদের কাছে।

কখনো কোন চৌধুরীর বাড়িতে অতিথি এলে আমার ডাক পড়তো। আমাকে ফরশের ওপর বসিয়ে বলতো

আরে ছেমরা! ওয়ারিস গীত শোনা!

আমি গেয়ে শোনানোর পর হুকুম হতো- যা, যা ভাগ। আমি সেখান থেকে চলে আসতাম…..

এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেলো। কারো হুকুমে গাইতে আমার ইচ্ছে হতো, সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিতাম।

আমার গ্রাম থেকে তিন চার মাইল দূরে এক পীরের আস্তানা ছিলো। সেখানে একটি প্রসিদ্ধ মাজারও আছে। তার মুরিদ দূরদূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিলো। শোনা যেতো, জিনদের মধ্যেও তার মুরিদ আছে। তারা সালাম করতে আসে নিয়মিত।

পীর মধ্য বয়স্ক ছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী এক যুবক ছেলে রেখে মারা যান। তারপর পীর আরো দুই বিয়ে করেন। একজনের বয়স হবে ত্রিশ বত্রিশ। আরেকজন সদ্য যুবতী। বয়স তার ছেলের সমান…..

একদিন আমার অন্ধ গুরু আমাকে সেই পীরের কাছে নিয়ে গেলেন। পীর সাহেব নাকি ওয়ারিসশাহ ও সুরেলা কণ্ঠের পাগল। আমার বয়স তখন ষোল কি সতের। পীরের নির্দেশে আমি গেয়ে শোনালাম।…..

শেষ হতেই পীর আমার অন্ধ গুরুকে বলে উঠলেন

হাফেজ! এই ছেলে তোমার নাম ডুবাবে।

তাকে হাফেজ বলেই ডাকা হতো।

হাফেজ বললেন, ইয়া সরকার! এতো আল্লাহর দেয়া নেয়ামত। আমি তো সরকারকে খুশি করতে চেয়েছি। এজন্য আমার চেয়ে মধুর কণ্ঠস্বর আপনার দরবারে হাজির করেছি…….

***

আমার গান শুনে খুশি হয়ে পীর সাহেব তার মুরিদ বানিয়ে নিলেন আমাকে। সেদিন থেকে প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তার দরবারে হাজিরা দিতাম। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেখানে মেলা বসতো। বিভিন্ন পেশার নারী পুরুষ দলে দলে মাজারে বাতি জালাতে ও পীরকে সালাম করতে আসতো। যুবতী ও মেয়েরাও আসতো………

আজকাল তো ফিলি আর অবাস্তব গান চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সুরেলা কণ্ঠস্বরও কমে গেছে। আমাদের সময় লোকেরা ওয়ারিস শাহ, ইউসুফ যুলেখা ও সাইফুল মুলুকের গীত শুনতো।

গায়কদের পেছনে লম্বা লাইন দেখা যেতো। গভীর রাতে তাদের কণ্ঠ ধ্বনি যে পর্যন্ত পৌঁছতো সে পর্যন্ত মুগ্ধতার নৈঃশ্বদ নেমে আসতো। লোকেরা পছন্দ করতো সুরেলা কণ্ঠ।

সুরেলা কণ্ঠের সঙ্গে যদি আবেগ মধিত শব্দ ছন্দের সঙ্গীত হতে মেয়েরা তো তখন পাগলপারা হয়ে যেতো। দেখবে, ছিনেমার গান যত ভালোই হোক, মানুষ বেশিক্ষণ শুনতে পারে না। কিন্তু ওয়ারিস শাহের মতো প্রাচীন সঙ্গীত-কলার ক্ষেত্রে আজো মানুষের আকর্ষণ কমেনি……..।

সেটা ছিল আসলে পৌরুষদীপ্ত যুগ। দামী পোষাকের চেয়ে সুগঠিত স্বাস্থের কদর ছিলো বেশি। পোশাকের চাকচিক্য দেখা হতো না। দেখা হতো পোশাকের ভেতরের দেহটা কেমন। কুস্তি কাবাডি ছিলো মানুষের প্রিয় বিনোদন।

কোন গ্রামের পালোয়ান বা কাবাডি খেলোয়াড় যদি হেরে যেতে সারা গায়ের নাক কাটা যেতো। আমাদের গাঁয়ে বারজন বিখ্যাত কাবাডি খেলোয়াড় ছিলো। তাদের পেশী বহুল দেহগুলো দেখার মতো ছিলো। তাদেরকে আমার এত ভালো লাগতো যে, আমিও স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে শুরু করলাম………

ওয়ারিস শাহ গেয়ে যেমন নাম হয়ে গেলো। কাবাডির কোর্টে নামার পরও বড় বড় খেলোয়াড়রা সার্টিফিকেট দিয়ে দিলো যে, চেষ্টা করলে আমিও নামাকরা খেলোয়াড় হতে পারবে। তাদের উৎসাহে আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো। ছয় মাসের নিবিড় প্রশিক্ষণ আমাকে আমাদের গ্রামের মান রাখার উপযুক্ত করে তুললো।

গাঁয়ের বড় চৌধুরী আমার জন্য রোযানা এক সের দুধের ব্যবস্থা করে দিলেন। আরেক চৌধুরী খাঁটি ঘি ও মধুর দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে আমার স্বাস্থ্য এমন চমৎকার হয়ে উঠলো যে, আমার চেয়ে বয়সে বড় যুবকরাও ঈর্ষা করতো,

প্রথম দফায় তিন চার গ্রামের সঙ্গে জিতে এলাম আমরা। আমাদের জেলার এক গ্রামের কাবাডি খেলোয়াড়দের খ্যতি ছিলো দূরদূরান্ত পর্যন্ত। আমরাই ওদেরকে হারিয়ে ভালো একটা শিক্ষা দিয়ে দিলাম।

মাজারের উরসে কাবাডি খেলা হতো। পীরের মুরিদ, মুসলমান হিন্দু সবাই খেলা দেখতে আসতো। ঐ গ্রামের খেলোয়াড়রাও আসতো। শক্ত লড়াই হতো। হার জিতের মধ্যে ব্যবধান হতো উনিশ বিশ।

ওদের গ্রামেও আমরা কাবাডি খেলতে গিয়েছি। কাবাডি খেলা শেষ হওয়ার পর আমাদের বেশ ঘরোয়া আপ্যায়ন করতো তারা। আর প্রতিবারই ওয়ারিশ শাহ শোনাতে হতো আমাকে। গাওয়া শেষ করার পর ন্যরানাও মিলতো……

গায়ক ও খেলোয়াড় হিসেবে আমার তো বেশ নামডাক হয়ে গেলো। কিন্তু আমি রয়ে গেলোম নিচু জাতের সেই অচ্ছুত মানুষ। কয়েকবারই আমার কানে একথা এসেছে

জাত তো কামিন, তবে খোদা গুন দিয়েছে ছেলেটাকে।

গ্রামে আমার আলগা একটা সম্মানের স্থান হয়ে গেলো। কিন্তু উঁচু জাতের কারো সঙ্গে বসতে পারতাম না। আর বেগার খাটারও কোন শেষ ছিলো না…….

জাতপাতের এই নিচুতা আমাকে বড় কষ্ট দিতো। এক সময় আমি গ্রামের বাইরে বাইরে কাটাতে লাগলাম। বেশির ভাগ সময় পীরের আস্তানায় কাটতো। পীরও আমাকে খুব পছন্দ করতেন।

কিছু দিনের মধ্যে সেখানকার এমন কিছু লোকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়ে গেলো যারা জুয়া খেলা, চুরি করা এসব কাজকে অন্যায় মনে করতো না।

এরাও আমার মতোই কামিন জাতের লোক ছিলো। কামিন জাত হওয়ার কারণে যেন পীর এদেরকে আরো বেশি পছন্দ করতেন।

দেখতাম, মাঝে মধ্যে ওরা পীরের সঙ্গে ভেদের কথাও বলে। এদের দলে আমি ভালো করেই মিশে গেলাম। এক সময় তাদের জুয়ার আড্ডায়ও আমার স্থান হয়ে গলো…..

***

মাজারে অনেক মেয়ে ছেলেও আসতো। একদিন পীরের ডেরার দিকে যাচ্ছিলাম। পথের দুপাশের গম ক্ষেতের শীষগুলো বেশ উঁচু হয়ে উঠেছে। এখনো হলুদ বর্ণ ধারণ করেনি রং। বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে গমের শীষ……….

আমি প্রকৃতির মধ্যে ডুবে গিয়ে হাটছিলাম। আচমকা ক্ষেতের আল থেকে এক মেয়ে বেরিয়ে আসলো। যেন নীল পরী। রূপ যেন নিসর্গের সাজকেও হার মানায়। দেখেই বুঝলাম, বিত্তশালী ঘরের………

সে হেসে জিজ্ঞেস করলো, পীরজির কাছে যাচ্ছো?

আমি বললাম, হ্যাঁ……

সে বললো, একটু আস্তে হাটো। আমিও ওদিকে যাচ্ছি বলতে বলতে আমার পাশে চলে এলো।

হাটছে আর কথা বলছে এমন করে, যেন সে আমার গ্রামের মেয়ে। শিশু কাল থেকেই আমাদরে পরিচয়। আমি তার গ্রামের নাম জানতে চাইলাম। সে যে গ্রামের কথা বললো, সে গ্রামে অনেকবার কাবাডি খেলতে গিয়েছি। ওরা কখনোই জিততে পারেনি আমাদের সঙ্গে।

মেয়ের নাম তামীমা বানু, বাবার নাম শুনে তো ঘাবড়ে গেলাম। সে গ্রামের বিশিষ্ট ধনী আর চৌধুরী জাত। আমার ভয় পাওয়ার কথা ছিলো না। কারণ আমার মনে কিছুই ছিলো না। কিন্তু সে যাচ্ছিলো আমার সঙ্গে ……

কেউ দেখে ফেললে আমাকে বেইজ্জতিও করতে পারে। আর একথা তো বলবেই, আরে কামিন জাত! তোর এত বড় সাহস?

আমি একবার দ্রুত পা চালিয়ে ওকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। তামীমা খপ করে আমার হাত ধরে বললো- আমাকে রেখে পালিয়ে যেতে পারবে না।

ওর মুখে ও ঠোঁটে রাঙাবর্ণ খেলে যেতে দেখলাম। শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা না থাকলেও এবং আনাড়ি হলেও এই দূরন্ত বয়সের যে কোন ছেলেই এর অর্থ বুঝতে পারবে। আমি শিওরে উঠলাম। ওকে এড়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও ছিলো শাহজাদী আর আমি গোলাম…….।

যেমন খুশি তেমন হুকুম সে আমার ওপর চালাতে পারে। উঁচু জাতওয়ালারা কোন পাপ করলে নিজেদের অধিকার আছে মনে করেই করে।

তামীমা বললো- তুমি এমন ভীত হয়ে পড়লে কেন? কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি বলব, মাজার যাচ্ছি। একে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।

অর্থাৎ ও বলছিলো, উঁচু জাতের মেয়েরা কামিন ছেলেদেরকে নিজেদের হেফাজতের জন্য নিয়ে যায়…… আমরা পীরের আস্তানায় পৌঁছে গেলাম। আর তামীমা বানু মিশে গেলো মেয়েদের সঙ্গে……….

পীরের ওখানে যাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলো, ওদের সঙ্গে এবং পীরের সঙ্গে গভীরভাবে মেলামেশার কারণে পীরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকটা ইয়ার দোস্তদের মতো হয়ে গেলো। মনে হতো, তিনি পীর নন আর আমি মুরিদ নই।

আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, দাগী গুণ্ডা, বদ মায়েশ ও অপরাধীদেরকে পীর তার আস্তানায় আশ্রয় দেয়। অপরাধীদের জন্য এ জায়গাটা নিরাপদ………

তবে পীরের জিন হাজির করার কারামতকে আমি সত্য বলে বিশ্বাস করতাম। চার পাঁচবার আমি তার এই কামালিয়াত দেখেছি। প্রথমবার তো ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে ছিলো।

এক রাতে এক লোককে আনা হলো, তাকে জিনে ধরেছে। সঙ্গে তার পাঁচ সাতজন আত্মীয়ও ছিলো। পরে তাকে পীরের খাস বৈঠকে বসা হলো। জিনে ধরা লোকের আত্মীয়রা ও কয়েকজন মুরিদ সেখানে ফরশের ওপর বসা ছিলো। পীর বসা ছিলেন গালিচার ওপর। তার পেছনে উঁচু উঁচু মখমলের তাকিয়া।

প্রথমে পীর বিড় বিড় করে কি যেন পড়লেন। তারপর উঁচু আয়াজে বললো, এসো, এক্ষুনি এসো। আমি দেখতে চাই তুমি কে?….

চাপা ঝনঝনানির আওয়াজ উঠলো। আমি কামরার সব দিকে তাকালাম। সেখানে যারা ছিলো সবার মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়লো। ঘুঙ্গুর ধ্বনির সঙ্গে এবার কারো কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো।

একবার সন্দেহ হলো, শব্দ আসছে পীরের পেছন থেকে। আমি বসা ছিলাম, পীরের গদির তাকিয়ার পেছনে। তাই সবই দেখতেও পাচ্ছিলাম। যাকে জিনে ধরেছে সে হেচড়াতে হেচড়াতে একদিকে সরে গেলো। তার পুরো দেহ কাঁপতে লাগলো………..

পীর জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কোত্থেকে এসেছো?- আওয়াজ এলো- ওর দোকানের ওপর আমার আস্তানা।

পীর জিজ্ঞেস করলেন- কী দোষ করেছে সে?

আওয়াজ এলো- সে আমার মাথার ওপর পা রেখেছিলো।

পীর প্রশ্ন করছিলেন আর শূন্য থেকে এভাবে জবাব আসছিলো। এটা সবাই জানে, জিনরা যখন চলা ফেরা করে তখন নাকি ঘুঙ্গুর বাজার আওয়াজ হয়। কামরায় ঘুঙ্গুর বাজার শব্দ হচ্ছিলো। তারপর পীর ঐ জিনে ধরা লোকের সঙ্গে এবং খোদ জিনের সঙ্গে কি আচরণ করেছিলেন সে এক লম্বা কাহিনী। এভাবে চার পাঁচবার জিনের শব্দের মুখোমুখি হয়েছি আমি………

এরপর তো আমি নিজেই জিন বনে গেলাম। পীরের খাস মুরিদদের মধ্যে আমার স্থান হয়ে গেলো। আমি নিজেই ঘুর বাজাতাম এবং জিনের ভাষায় কথা বলতাম।

আমার মতো বলশালী ও সাহসী লোকের প্রয়োজন ছিলো পীরের। তার কাছে এ ধরনের চারজন মুরিদ ছিলো। আমি হয়ে গেলাম পাঁচ নম্বর……..

ভেদের কথা হলো, পীর যেখানে বসতেন, এর পেছনে একটি গর্ত খোদাই করা ছিলো। সেখানে বড়সড় একজন লোক বসতে পারতো অনায়াসে। সাক্ষাত প্রার্থীদের ঐ কামরায় ডাকার পূর্বে ঐ গর্তের ভেতর একজন গিয়ে বসে পড়তো। তখন গর্তের ওপর মোটা পাতের ঢাকনি দেয়া হতো।

এর ওপর বিছানো হতো গালিচা।

তারপর মুরিদ আর সাক্ষাতপ্রার্থীদের ভেতরে আসার অনুমতি মিলতো। পীর সাহেব যখন জিনকে ডাকতেন তখন গালিচার নিচ থেকে ঘুঙ্গুর বেজে উঠতো। আর সে লোক এমন শব্দে ও সুরে কথা বলতে যেটা পুরুস্বালী ও মেয়েলী কণ্ঠের মাঝামাঝি সুর হতো। আবার একটু নাকা নাকাও হতে…..

এর আগে আমরা জিনে ধরা ব্যক্তিদের বাড়ি ঘর দেখে আসতাম। ঘরের লোক কজন, সে কি করে, ছেলে মেয়ে কজন, প্রত্যেকের ব্যাপারে যতটুকু জানা যায় ইত্যাদি জেনে আসতাম। তারপর সে অনুযায়ি কথা বলতাম। লোকে শুনে তো তাজ্জব হয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলতো। আরে এসব জানলে কোত্থেকে?…

***

একটা ঘটনার কথা তোমাকে বলি আমি। সারা ড্রামা তুমি বুঝতে পারবে। এক মহিলা তার স্বামীকে চাইতো না। আবার স্বামী থেকে তালাকও নিতে পারছিলো না। অর্থাৎ মহিলা সুন্দরী হওয়াতে স্বামী তাকে তালাক দিতে চাচ্ছিলো না। অন্য এক লোকের সঙ্গে মহিলার গোপন প্রেম ছিলো।

তিন বছর ধরে তাদের দাম্পত্য জীবন চলেছে এভাবেই। মহিলা পীরের কাছে এসে বললো, তাকে যেন এমন একটি তাবিজ দেয়া হয় যাতে তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়……

পীর মহিলাকে তাবিজ না দিয়ে অন্য একটা সবক দিলো। সবক অনুযায়ি মহিলাকে জিনে ধরলো। মহিলা জিনে ধরার এমন অভিনয় করলো যে, স্বামী বাড়ির লোকেরা ভয়ে আতংকে পীরের কাছে দৌড়ে এসে, বললো ইয়া সরকার। আমাদের বউকে বাঁচান।

পীর তাদেরকে এটা তাবিজ ও কিছু আমল দিয়ে বিদায় করে দিলেন। ওদিকে মহিলাও পীরের সবক অনুযায়ী জিনে ধরা ছদ্মবেশ ধারণ করে অভিনয় চালিয়ে গেলো। অবশেষে তার স্বামীর বাড়ির লোকদের জানানো হলো, অমুক দিন জিনকে হাজির করা হবে…….

তারপর পীরের খাস কামরায় জিনকে হাজির করা হলো। মহিলার স্বামী ও তার আত্মীয়স্বজনরা জিনের ঘুঙ্গুর বাজার গম্ভীর ধ্বনি শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলো। সেই জিন কে ছিলো জানো? আমি ছিলাম।

পীরের গালিচার নিচে বসে ঘুঙ্গুর বাজিয়ে বাজিয়ে এবং পীরের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হুমকি দিলাম, তার স্বামী যদি তাকে তালাক না দেয় তার পুরো বংশ ধ্বংস করে দেবো। তারপর ওকে আমি নিজেই বিয়ে করে ফেলবো,

গ্রামের লোকেরা আজ শিক্ষিত হয়েও এসব ভাওতাবাজিতে বিশ্বাস করে। আর তখনকার দিনে গ্রামে তা দূরের কথা শহরেও শিক্ষিত লোকজন খুঁজে পাওয়া যেতো না।

পরদিনই ঐ মহিলার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দিলো। পীরও তার কাছ থেকে মোটা টাকার বখশিস আদায় করে নিলেন ……

পীরের এক ছেলে ছিলো। লোকেরা বাপের মতোই ছেলেকে মান্য করতো। কিন্তু বাপ বেটার মধ্যে সম্পর্ক ছিলো খুব খারাপ। এর কারণ হলো, বিশ একুশ বছরের পীরের এক বউ ছিলো। পীরের ছেলের সমবয়সী।

পীরের নিজের ছেলে ও স্ত্রীর ওপর সন্দেহ ছিলো। সন্দেহ বেঠিকও ছিলো না। কিন্তু বাপ তো এসব নিয়ে উচ্চ বাচ্চও করতে পারতো না। আর তারাও জানতো, পীরের পীরাকীর দূর কতদুর।

একদিন পীরের কয়েকজন চ্যালা এক হিন্দু যুবতাঁকে উঠিয়ে আনে এবং রাতে রাতেই পীর তার কাজ শেষ করে মুরিদদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। মুরিদরা তাকে যেখান থেকে উঠিয়ে এনেছিলো সেখানে রেখে আসে। এ ঘটনা ছেলে ও পীরের যুবতী স্ত্রী জানতো। ………

আমরা গুপ্তচরের মতো মুরিদদের ঘরের নানান টুকিটাকি ব্যপারও জেনে এসে পীরকে জানাতাম। আমাদের বাতলানো সংবাদ অনুযায়ী পীর তাদেরকে গায়েবের কথা জানিয়ে দিতে। মুরিদরা হয়রান হয়ে যেতো, পীরজি তাদের ঘরের গোপন থেকে গোপন কথাও জেনে ফেলেছেন। ……

পীর আমাদেরকে বিনিময়ে অনেক কিছু দিতো। লোকেরা তার সামনে সিজদা করতো। সন্তানহীন মহিলারা তার কাছে সন্তান নিতে আসতো। আবার পীরের বাপের মাজারে বড় বড় সিন্নী দিতো। সিন্নীর পয়সা চলে যেতো পীরের পকেটে। কিন্তু লোকেরা জানতো না আসল পীর ছিলাম আমার পাঁচজন…….

ওহ! তামীমার কথায় আসি। এর মদ্যে তামীমা গম ক্ষেতের পাশে আমার সঙ্গে আরো কয়েখবার দেখা করে। একবার সরাসরি বলে দেয়, সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তামীমা বিবাহিতা ছিলো। স্বামীর ঘরে পাঁচ মাসের বেশি থাকতে পারেনি।

জাতপাতের ছোট খাট বিষয় নিয়ে বিরোধ শুরু হয় ছেলে ও মেয়ে পক্ষের মধ্যে। তামীমার মা বাবাও নিজেদের উঁচু নাক নিয়ে বসে থাকে। ছেলের মা বাবাও বলে দেয়, মেয়ের মান রাখতে চাইলে মেয়েকে স্বামীর বাড়ি পাঠিয়ে দাও। আর নিজেদের মান নিয়ে পড়ে থাকতে চাইলে মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখো…….

কিন্তু তামীমা বাপের বাড়িতে বসে থাকতে রাজী নয়। সে স্বামীর ঘরে যেতে চাইতো যে কোন বিনিময়ে। কিন্তু ওর মা বাবা তা হতে দেবে না। একবার সে খুব জিদ করলো। তখন মা বাবা দুজনে মিলে ওকে মারপিট করে। তারপর থেকে তামীমা চুপচাপ হয়ে যায়।

তবে একবার লুকিয়ে স্বামীকে চিঠি লিখে যে, তোমার ভেতর যদি পৌরষত্ব থাকে আমাকে এসে নিয়ে যাও। স্বামী জবাব দেয়, আমি এত আত্মসম্মানহীন পুরুষ নই। তোমার বাপকে বলল, আমাদের বাড়িতে এসে তোমাকে রেখে যেতে। মীমাংসার সম্ভবনা ছিলো না একেবারেই……..

মা বাবার চাপে স্বামী তামীমাকে তালাক দেয়ার হুমকি দেয়।

তামীমার প্রস্তাব নিয়ে দু দণ্ড ভাববার মতো স্থিরতা ছিলো না আমার। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ওর ডাকে সাড়া দিলাম। তারপর থেকে তার একই বুলি, চলো কোথাও পালিয়ে যাই। সে তত উঁচু জাতের আমীর ঘরনার মেয়ে। আমি ওকে নিয়ে যাবো কোথায়?

একদিন বললো, আমি অনেক অলংকার ও নগদ টাকা পয়সা নিয়ে আসবো। তখন আমরা পালাবো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম সেদিন। আরেকদিন মাজারে এসে বললো

আমি চলে এসেছি আর ফিরে যাবো না।

সে তার বাড়ি থেকে মাজারে সালাম করার কথা বলে এসেছে। আমি ওকে বাড়ি ফিরে যেতে বললাম। কিন্তু ও বেকে বসলো। সে জানালো, আজ ওর মা বাবা ওকে খুব মেরেছে। ওর স্বামীর কথা বলতেই ওরা ওকে এভাবে মেরেছে…

বলো, এমন অত্যাচার আর কতদিন সইবো?- সে বললো।

ঘর থেকে সে নগদ টাকা পয়সা আর স্বর্ণালংকারও নিয়ে এসেছে। আমার আঁতে ঘা দিয়ে বললো,

তোমাকে আমি কিন্তু সাহসী পুরুষ বলে জানি। মেয়েদের মতো ভীতু হয়ে পিঠ দেখাবে না

আমি ওকে বললাম, দেখো আমি কামিন জাতের ছেলে, আর তুমি অনেক উঁচু জাতের মেয়ে, তুমি কি আমার সাথে থাকতে পারবে?

সে বললো- তোমার চেয়ে উঁচু কেউ নেই

সে আরো এমন কিছু কথা বললো, আমার পৌরুষ জেগে উঠলো……..

***

ওকে বললাম, তুমি মাজারে যাও। সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি পীরের কাছে গিয়ে সারা বৃত্তান্ত শোনালাম। বললাম, তামীমাকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। পীর যখন শুনলো, মেয়ে অমুক ঘরের। ঘাবড়ে গেলো পীর। বলতে লাগলো

তুমি তো মিয়া কামিন জাতের ছেলে। আর ও বড় চৌধুরীর মেয়ে। যদি ধরা পড়ো, ওরা তোমাকে কেটে কুকুর দিয়ে গোশত খাওয়াবে। ওকে ফিরিয়ে দাও।

আমি বললাম, তিন চারদিন তামীমাকে এখানে রাখবো এবং এ কয়দিনে ভেবে বের করবো কি করা যায়। জিন ভূতের নাটাই খেলবো, না অন্য কোথাও চলে যাবো।

পীর আমাকে উপদেশ দিলো,

কারো মেয়েকে এভাবে লুকিয়ে রাখা খুব খারাপ কাজ। ফিরিয়ে দিয়ে এসো। পীরকে আমি বললাম

আপনার জন্য আমি এর চেয়ে খারাপ কাজ করছি। এই মেয়েকে কোন মূল্যেই হাতছাড়া করবো না। বিয়ে করে ওকে আমার জন্য বৈধ করে নেবো।

পীরের শাহরগ তো ছিলো আমাদেরই হাতে। পীর মেনে নিলো আমার কথা। বললো, যাও মেয়েকে নিয়ে এসো……

মাজারে গিয়ে তামীমাকে বললাম, আমার পেছন পেছন এসো। পীরের কাছে যখন ও পৌঁছলো, ওকে দেখে পীরের চোখ ট্যারা হয়ে গেলো। যেন এ ধরনের বস্তু সে আর কোন দিন দেখেনি।

পীরের কুৎসিত আবেগ উছলে উঠলো। বলে উঠলো

তোমরা আমার কাছে আশ্রয় চেয়েছে। তোমাদের দুজনকে আমি আমার বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখবো। এবং নিজ হাতে তোমাদের বিয়ে পড়াবো….

পীর তার কথা রাখলো। পীরের বাড়িটি বিশাল ছিলো। আমাকে এমন একটি কামরা দেয়া হলো যেখানে আমরা ছাড়া আর কেউ যাবে না। পরদিন আমাদের বিয়ে পরিয়ে দিলো। কালেমা পড়িয়ে নিজেই সাক্ষী হলো। নিজেই। কাজী হলো…..

যদি জিজ্ঞেস করো, আমার পরবর্তী পরিকল্পনা কি ছিলো? তোমাকে জবাব দিতে পারবো না আমি। তখন ছিলো উন্মুক্ত যৌবনের তাপ। তামীমার প্রতি নিখাদ ভালোবাসার তীব্রতা আমাকে চিতার শক্তি আর সাহস দিয়েছিলো। কিন্তু বুদ্ধির ঘর ছিলো অন্ধকার।

আমার ভাবনা বলো চিন্তা বলো একটাই ছিলো। এত বড় ঘরের এমন সুন্দরী মেয়ে আমার জন্য ঘর ছেড়ে চলে এসেছে, আর আমার মতো এমন বীর যুবক তাকে উপেক্ষা করবে। তাছাড়া পীর আমার মনোবল এই বলে আরো বাড়িয়ে দিলো যে

চিন্তা করো না, আরামে থাকো, এখানে তোমাদেরকে জিনও দেখতে পাবে না……

পরদিনই তামীমার মা পীরের কাছে এসে হাজির। আমরা তো জানতামই কেন এসেছে মহিলা। পীরকে এসে জানালো, তার মেয়ের স্বামী আত্মহত্যা করেছে। তামীমাকে তার পূর্ব স্বামীর আত্মহত্যার খবর জানালাম আমি। কোন প্রতিক্রিয়া হলো না তার।

ঘটনা দুঃখজনক হলেও আমি একটু ভারমুক্ত হলাম যে, এই মেয়ে আমার জন্য এখন সম্পূর্ণ বৈধ হয়ে গেছে। 

পরে পীর আমাকে বলেছিলো, তামীমার মা এই প্রার্থনা নিয়ে আসে যে, জিনদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমার মেয়ে কোথায় আছে? পীর মহিলাকে বলেছিলো, এখনো জানা যায়নি কোথায় গেছে। শুধু এতটুকু জানা গেছে যে, সে নিজ ইচ্ছায় গিয়েছে। একাধারে পাঁচ ছয় দিন মহিলা পীরের দরবারে হাজিরা দিলো……

***

তামীমাকে আমি এ কয়দিন লুকিয়ে রাখলাম। সাত দিনের দিন তো কেয়ামত এসে গেলো। ঘুম থেকে উঠেই শুনি পীর তার কামরায় মরে পড়ে আছে। আমি গিয়ে লাশ দেখলাম।

চিত হয়ে পীর পড়ে আছে সে কামরায় যেখানে জিনদের হাজির করা হতো। চোখ দুটি খোলা।

আগুনের মতো সারা এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়লো, তাদের পীর মুরশিদ কতল হয়ে গেছে। মুরিদরা পিল পিল করে তার আস্তানার দিকে আসতে লাগলো। হাজারো মুরিদ জমা হয়ে গেলো অল্প সময়ের মধ্যে। দেখলাম সবাই ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। মেয়েরাও কাঁদছে চিৎকার করে……..

আমার ভয় হলো, তামীমাকে না আবার কেউ দেখে ফেলে। তাই যে কামরায় ওকে লুকিয়ে রেখেছিলাম সে কামরার বাইরে থেকে পুরনো একটি তালা ঝুলিয়ে দিলাম। কাঁদছিলো তো সবাই।

কিন্তু পীরের ছেলে ছিলো ব্যতিক্রম। তার চোখ দুটো ছিলো শুকনো। আরেকজন হলো পীরের হোট স্ত্রী। সেজেগুজে আস্তানার এক কোনে শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। পীরের ছেলে কয়েকবার লোকজনের ভিড়ে গিয়ে বলে আসলো, এ হলো জিনদের কারসাজি………

বেলা চড়ার আগেই পুলিশ এসে গেলো। পুলিশ অফিসারের কাছেও পীরের ছেলে বললো, আপনারা সময় নষ্ট করবেন না। তদন্ত করে কিছুই পাবেন না। কারণ, পীরদেরকে কোন মানুষ হত্যা করতে পারবে না। এটা জিনদের কাজ। আমার বাবার কজায় বড় বড় অবাধ্য জিন ছিলো। এ ধরনের কোন এক জিন কজা থেকে বেরিয়ে গেছে। তারপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তাকে হত্যা করেছে……

পুলিশ অফিসার ছিলো হিন্দু। সে অনেক জেরা করলো মুরিদদেরকে। ভেতরে পীরের ছেলের সঙ্গে অনেক্ষণ কাটালো। লাশ ভেতরেই ছিলো।

সবাই জানতত, লাশ পোষ্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু পীরের লাশের সঙ্গে কোন বেয়াদবীমূলক কিছু হবে এটা কেউ পছন্দ করছিলো না। তারপরও পুলিশের দায়িত্ব তো পালন করতেই হতো। তিন চার ঘন্টা পর ইনস্পেক্টর বাইরে এলো এবং কনস্টেবলদের নিয়ে থানায় ফিরে গেলো…

লাশ কামরায় খাটের ওপর শোয়ানো ছিলো। সেভাবেই পড়ে রইলো। ওদিকে পীরের ছেলে ঘোষণা করিয়ে দিলো, তার পিতার মৃত্যু জিনদের হাতে হয়েছে। মুরিদদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়লো।

পীরের ছেলে আরেকটা কাজ করলো। খাস মুরিদদের মাধ্যমে রটিয়ে দিলো যে, সে তার বাবার সমস্ত জিনকে নিজের কজায় নিয়ে নিয়েছে এবং তার বাবার ঘাতক জিনকে যেভাবেই হোক ধরে এনে হত্যা করা হবে……

পীরের লাশকে আমি ও তার এক খাস মুরিদ মিলে গোসল দিলাম। কাফনও পরালাম। তারপর বড় শান শওকতের সঙ্গে জানাযা অনুষ্ঠিত হলো। যেখানে তার বাবা পীরের কবর সেখানেই তাকে দাফন করা হলো। এতে মাজারের মর্যাদা আরো বেড়ে গেলো। কারণ; এই মাজারে এখন দুই জন পীর কবরস্থ হয়েছে……….

আমার আবার ভয় হলো, তামীমা না আবার ধরা পড়ে যায়। পীরের ছেলে এটা জানতো না যে, এই বাড়ির এক কামরায় আমি একটি মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছি। সে শুধু জানে, আমি ওর বাপের খাস মুরিদদের একজন ছিলাম। ছেলেরও এ ধরনের মুরিদের প্রয়োজন আছে।

সে আমাদেরকে তার ইয়ার বন্ধুদের দলে ভিড়িয়ে নিয়ে তার বাপের বড় স্ত্রীকে পৃথক একটি বাড়ি দিয়ে দিলো। আর ছোট স্ত্রীকে নিজের সঙ্গে রেখে দিলো। দুজনই ছিলো তার সলো মা।

ছোট স্ত্রী তার সমবয়সীই ছিলো। একে নিয়ে বাপ বেটার মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ ছিলো। ছোট স্ত্রী নিজেই পীরের ছেলেকে পছন্দ করতো। তা ছাড়া পীরজাদা তখনো বিয়ে করেনি……

যা হোক একদিন আমি ওকে বলে দিলাম, তাদের বাড়ির এক কামরায় তার বাপের অনুমতিতে এক মেয়েক লুকিয়ে রেখেছি। সে মেয়ে আমার জন্য ঘর ছেড়ে চলে এসেছে। তখন তার বাপ আমাদের বিয়ে পরিয়ে দিয়েছে। পীরজাদা মেয়ে দেখতে চাইলো। আমি তাকে সে কামরায় নিয়ে গেলাম। তামীমাকে দেখে তার মুখের হাসি চওড়া হয়ে গেলো।

বললো- আরে কামিন! এই তোমার ভাগ্য? এতো এই গদির বরকত। আমাদের খেদমত করে যাও এবং আয়েশও করে যাও আরো বেশি করে।

তামীমার মাথা ও গালে হাত বুলিয়ে দিলো এবং আমার দিকে আজব চোখে তাকিয়ে রইলো….

তামীমা খুব ঘাবড়ে গেলো। আমার দুহাত খামচে ধরে বললো, এখানে আর একদিনও থাকা ঠিক হবে না। এতো এর বাপের চেয়ে বড় বদমায়েশ মনে হয়। পীরজাদা সেদিনই তার মনের বদমায়েশি রূপ দেখিয়ে দিলো।

জোয়ান হওয়াতে বাপের চেয়ে বেপরোয়াও ছিলো বেশি। তাছাড়া সারা এলাকার লোকেরা তাকে পীর বলে মেনে নিয়েছে।

সে আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বললো- ঐ মেয়েদের বাড়িতে এখান থেকে বেশি দূরে নয়। ওদের সারা খান্দান আমাদের মুরিদ। ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু মেয়ের হাওয়াও আমরা বাইরে যেতে দেবো না। ভয় পেয়ো না, শুধু এটা খেয়াল রাখবে যে, ওকে শুধু নিজের বউ মনে করো না। তোমার পীর মুরশিদের দিকেও খেয়াল রেখো…….

মাথায় আমার আগুন জ্বলে উঠলো। কিন্তু আমি নিজেকে কঠিনভাবে শাসন করলাম। বহু কষ্টে শান্ত রাখলাম নিজেকে। আর পীরজাদার সামনে বিগলিত হয়ে বললাম,

আমরা সরকারের মাজারের গোলাম। এমন কথা বলারই বা কি প্রয়োজন। আমার সবকিছুই আপনার জন্য উন্মুক্ত।

সে খুব খুশি হলো। তাকে বললাম, আমার কিছু টাকা-পয়সা দরকার। এই বলে দুশ টাকা চাইলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিলো। তখন দুশ অনেক টাকা। বড় বড় সরকারি অফিসারের বেতনই ছিলো ত্রিশ টাকার নিচে। তামীমার কাছেও বেশ কিছু টাকা ছিলো……

রাতে যখন পীরজাদা শরাব খেয়ে মাতাল হয়ে তার ছোট সতালো মায়ের ঘরে চলে গেলো। খাস মুরিদরাও যার যার ডেরায় ফিরে গেলো, তামীমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি। এমন এক সফরে বেরিয়ে পড়লাম যার মনযিল জানা ছিলো না আমার।

এখন তো আমরা দুজনই সবার চোখে আসামী। মনযিল তাই মৃত্যুও হতে পারে। ছিলাম আমি গোঁয়ার গ্রাম্য। দেহাতের বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কিছুই জানতমা না। আমরা পায়দল যাচ্ছিলাম রেল স্টেশনের দিকে। সেখান থেকে চার মাইল দূরে রেল স্টেশন। চাঁদনী রাত ছিলো। ক্ষেত খামারের ভেতর দিয়ে পথ করে চলছিলাম আমরা……..

কয়েকবার আমি পিছন ফিরে তাকালাম। মাজারের গম্বুজটি চোখে পড়লো আমার। বহু দূর থেকে সেটি দেখা যায়। মানুষ তো একে কাবা শরীফ মনে করে। একে সিজদা করে। মান্নত মানে। সিন্নী করে।

কে তাদেরকে বলবে, এ গদি আসলে বদকারদের নোংরা আড়া। এখানে কারো বোন, মেয়ে ও স্ত্রীর আবরু নিরাপদ থাকে না। এখানে কোন জিনও বন্দি নেই। কয়েকজন খাস মুরিদই এখানকার জিন।

পীরকে কোন জিন হত্যা করেনি। হত্যা করেছে কোন মানুষ। ভেবে দেখো তো, যদি লোকদেরকে বলে দিতাম, আসল জিন আমি ও আমার চার সঙ্গী। তাহলে কি কেউ এটা বিশ্বাস করতো? তুমি লোকদেরকে আমার কাহিনী শুনিয়ে দেখো, বলবে, ভূয়া গল্পবাজ লোক…….

***

যুগ আজ কত উন্নতির পথে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের লোকেরা আজো পীরের পায়ে সিজদা করে। এখনো মাজারে গিয়ে মাথা ঠুকে। তাদের স্ত্রী, বোন, মেয়েরা পীরের খাস কামরায় গিয়ে নিজেদেরকে নযরানা হিসেবে পেশ করে…….

যে মাজারে সালাম করার জন্য লোকেরা লম্বা লম্বা সফর করে আসে, সেই মাজারের ওপর শত অভিশাপ দিয়ে আমি আরো ভয়ংকর সফরে বের হয়ে পড়েছি। আমার আসল পীর মুরশিদ তো ছিলো আল্লাহ ও তার রাসূল (স)-এর পবিত্র জাত। অন্তরে তাদের নামই স্মরণ করছিলাম।

আমিও পাপ করেছিলাম। একেবারে নিষ্পাপ ছিলাম না। তামীমার স্বামী জীবিত থাকতে ওকে আমি বিয়ে করি। অথচ তার স্বামী তাকে তালাকও দেয়নি।

আমার মূর্খ মাথায় একবার একথাও এলো না যে, তামীমাকে নিয়ে আমি ওদের গ্রামে যাই। সবার সামনে ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে বলে উঠি, এই যে দেখে নাও তোমাদের ইযযত, অহংকার, জাতপাতের রাজনীতিকে এক কামিনের পায়ে আছড়ে ফেলেছে।

ঐ উঁচু জাতের ভূরি ওয়ালারা তো একেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব মনে করে যে, নিজের স্বামীর বাড়ি থেকে মেয়েকে এনে ঘরে বসিয়ে রাখা। আর স্বামীও শ্বশুরালয় থেকে স্ত্রীকে উঠিয়ে আনাকে নিজের বেইজ্জতি মনে করে……।

আরো বলতাম, তোমরা তার দেহ মন আর যৌবনের দিকে তাকাওনি। তাকিয়েছো নিজেদের মিথ্যা অহংকারের দিকে। এ কারণে মেয়ে মনের ও দেহের তৃষ্ণা মেটাতে তার পছন্দ মতো একজনকে বেছে নিয়েছে……

কত চিন্তা যে মাথায় এলো। সবই উদ্ভট চিন্তা। নিজের পরিণাম সম্পর্কে তো জ্ঞানই ছিলো না। খোদার কাছে আমি মাফ চাইলাম। তার কাছে সাহায্য চাইলাম। একটু কান্নাও করলাম মুখ লুকিয়ে। তামীমা বুঝতে পারেনি।

মোটেও আশা করিনি খোদা আমাকে মাফ করবেন। কারণ, আমি জানতাম কত বড় পাপী ছিলাম আমি। জেনে শুনে পাপ করে ছিলাম আমি…..

তারপরও ভরসা ছিলো ঐ মহান সত্ত্বার ওপরেই। রাত থাকতেই আমরা ষ্টেশনে পৌঁছে গেলাম। তামীমা মুখ ঢেকে রেখেছিলো চাদর দিয়ে। আমি মাথা মুখ চাদর দিয়ে আবৃত রেখেছিলাম।

কোথায় গেলে সুবিধা হবে তা তো জানতাম না। তামীমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো- দিল্লির টিকেট কেটে ফেলো।

দিল্লি তো আমিও চিনি না, তামীমাও না। কখনো কেউ দিল্লি যাইনি আমরা। আসল কাজ হলো এখন যত দূরে চলে যাওয়া যায়। এখানে বসে থাকাটা বিপজ্জনক।

তাছাড়া আমরা মনে করতাম, দিল্লির চেয়ে দূরের আর কোন জায়গা নেই। শুধু জানতাম দিল্লি মুসলমানদের শহর। কি কারণে জানি আমারও মনে হলো দিল্লি ছাড়া আর কোথাও আমাদের আশ্রয় মিলবে না…..

গাড়ি পৌঁছতে এখনো দু ঘন্টা বাকি আছে। অন্ধকার এক কোনে গিয়ে আমরা বসে পড়লাম। তামীমা এখন আমার চেয়ে অনেক সাহসী মেয়ে। আমাকে এটা সেটা বলে সাহস বাড়াতে লাগলো।

দিল্লিতে কিভাবে যাওয়া যায়, কি করে দিল্লি চিনবো এক ফাঁকে এটা জিজ্ঞেস করে নিলাম এক লোকের কাছ থেকে। চিন্তিত ছিলাম পথে আবার গাড়ি পাল্টাতে হয় কিনা।

লোকটি জানালো, চিন্তা নেই এই গাড়ি সোজা দিল্লি যাবে, পরদিন দুপুরে গিয়ে পৌঁছবে।…… গাড়ির সময় হলে দুটি টিকেট কেটে নিয়ে এলাম। তখন গাড়িতে এত ভিড় হতো না। বিশেষ করে রাতে গাড়ির কম্পার্টমেন্ট খালি যেতো। আমরা নিরালা একটা কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়লাম……

গাড়ি আমাদেরকে এক বিপদ থেকে উদ্ধার করে অজানা এক গন্তব্যের দিকে নিয়ে চললো। যে গন্তব্য সম্পর্কে কোন জ্ঞাণই ছিলো না। অজানা সেই দেশে পৌঁছে গেলাম। গাড়িতে আর কোন ধরনের ঝামেলা হয়নি।

এত বড় স্টেশন দেখে তো আরো ঘাবড়ে গেলাম। মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। যে দেশের রেল স্টেশন এত বড় সে দেশটা না জানি কত বড়।

এত বড় শহরে আমরা কোথায় যাবো, আল্লাহ তাআলা আমাদের সাহায্য করলেন। স্টেশনে দাঁড়িয়ে দুই আনাড়ী যুবক যুবতী যখন কোথায় যাবো না যাবো এই ভেবে অস্থির হয়ে পড়ছিলাম, তখনই আল্লাহর এক বান্দা এগিয়ে এলো……..

***

এ যেন আল্লাহর পাঠানো ফেরেশতা। আমাকে দেখে হয়তো আচ করে নিয়েছিলো, এরা এই শহরে নতুন এবং অসহায়। আর আমার বউ তামীমাকে দেখে হয়তো আশংকা করেছে এত সুন্দরী মেয়েকে এই লোক এত বড় শহরে বড় বিপদে পড়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না।

লোকটি নেক দিলের মানুষ ছিলো। আমি তাকে বললাম, রোজগারের তালাশে দিল্লিতে এসেছি। জানি না, লোকটির মনে কেন এ সন্দেহ জাগলো না যে, আমি কোন সন্দেভাজন লোকও হতে পারি।

আর এ মেয়ে আমার স্ত্রীও না হতে পারে। লোকটি আমাদেরকে তার বিরাট বাংলোয় নিয়ে গেলো। বাংলোটির মালিকদের সামনে আমাদের হাজির করলো। বড় বড় দুটি বাগান আছে সে লোকের। মহিষও আছে গোটা কয়েক……

তার এ ধরনের লোকের প্রয়োজন ছিলো, যে তার বাগান আরো সুন্দর করে গড়ে তুলবে এবং মহিষগুলোরও রাখালি করবে। আগে যেসব মালি ও নওকর ছিলো তারা হয় পালিয়ে গেছে না হয় কাজ না বোঝার কারণে বাদ পড়েছে। আমি দেহাতী বলে আমাকে পছন্দ করলো মালিক। বাংলোর সঙ্গে আমাদেরকে দু রোমের কোয়ার্টারও দিয়ে দিলো………..

আজো যখন সেই স্মৃতির পাতা উল্টে দেখি। আমার কাছে মনে হয় এসব কিছুই ঘটেনি। অনেক দিন ধরে আমি কল্পনার জগতে স্বপ্নের রঙ্গীন পাতা দিয়ে সাজিয়েছি এসব।

এতো এক ধরনের কারামতই ছিলো, পরদেশে পা রাখলো একজন লোক আর তাকে আরেকজন এমনভাবে আশ্রয় দিলো যেন খোদা তাকে আমার অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো। কোন পূণ্য কাজের পুরস্কার খোদা দিয়েছিলেন এটা? এমন কোন পূণ্যের কথা তো আমার স্মরণে পড়ে না। আমি তো পাক্কা পাপী ছিলাম। তার ওপর ছিলাম কামিন–নিকৃষ্ট জাতের ইতর লোক……

বাগানের দায়িত্ব নিয়ে নিলাম আমরা। আর মহান আল্লাহর দরবারে মাথা ঝুঁকিয়ে দিলাম। তাছাড়া যেহেতু সেখান থেকে আমাদের আর পালানোর প্রয়োজন ছিলো না, আমরা পালিয়ে কোথাও যেতেও পারতাম না; তাই মন প্রাণে ঢেলে দিলাম বাগানের পেছনে। দুজনে মিলে বাগানটাকে দারুণ সুফলা করে তুললাম।

এ যেন আমাদের নতুন জীবনের চ্যালেঞ্জ। অল্প দিনের মধ্যেই ফল ফলাদি ও সবজির এত প্রচুর ফলন শুরু হলো যে, প্রতিদিন আমি কয়েক গাড়ি সজি ফল বাজারে নিয়ে যেতাম আর মুঠি মুঠি পয়সা নিয়ে ফিরে আসতাম। সঙ্গেসঙ্গে যত্নআত্নি করে মহিষগুলোকে তাজা করে তুললাম…….

মালিক তো দারুন খুশি আমাদের কাজে। যেমন অভিজাত বংশের ছিলো তারা, তেমনি ভদ্র ও সজ্জনও ছিলো। আমাদের দুজনের সরল নিয়ত ও কঠোর পরিশ্রম দেখে তাদের পরিবারের মধ্যে আমাদেরকে গণ্য করে নিলো। আমরা শুধু নামকাওয়াস্তে ছিলাম নওকর।

তামীমার শুধু রূপই ছিলো না। বাইরের রূপের মতো ভেতরটাও ছিলো রূপময়- দারুণ কোমল। হাজারো খেটে মুখে ভুবন ভুলানো হাসিটা ঠিকই ধরে রাখতে পারতো।

মালিকের পরিবারের নারী মহলে তামীমা হয়ে উঠলো সবার নয়নের মনি। মালিকের স্ত্রী বলো, আমার মেয়ে বলো, অন্যকোন আত্মীয় স্বজন বললো, তামীমার নামে সবাই পাগল। তামীমাকে ছাড়া তাদের কোন গল্পের আসরই জমে না……..

একটু চিন্তা করে দেখো তো, এতবড় ঘরনীর মেয়ে। অথচ সাধারণ এক কামিনের ভালোবাসার টানে নওরের জীবন বেছে নিয়েছে। নিজেও কামিন বনে গেছে। তারপরও বাধ্য হয়ে নয়, হাসি মুখে।

কোন অনুযোগ করেনি কোন খাটুনির জন্য। অভিমান করেনি এই জীবনের জন্য। এদের সঙ্গে আমরা এমনভাবেই মিশলাম যে, তামীমা গল্পে গল্পে আমাদের ফেলে আসা অতীত কাহিনী শুনিয়ে দিলো……..

এভাবে দুই বছর পার হয়ে গেলো।

বাংলোর মালিক আমাকে ডেকে বললো, ঘর থেকে জানতে পেরেছি, তোমার স্ত্রী এক আমীর পরিবারের মেয়ে। আশ্চর্য, এমন উঁচু ঘরের মেয়ে কি করে এত কষ্টের কাজ করে যাচ্ছে। সত্যিই না দেখলে বিশ্বাস হতো না।

আমি আর বাকি কথা লুকানোটা ভালো মনে করলাম না। তাকে পুরো ঘটনা শুনিয়ে দিলাম। তামীমা ওদেরকে যা শোনায়নি তাও শুনিয়ে দিলাম। বাদ পড়লো না পীরের কথাও। পীরের আসল রূপ, তার কারসাজি তাও বললাম। পীরের ছোট স্ত্রীর সঙ্গে তার ছেলের অবৈধ সম্পর্ক এবং এ নিয়ে পরবর্তীতে পীরকে হত্যার কাহিনীও শোনালাম।

এও শোনালাম, হত্যার পর পীরজাদা পুলিশের সঙ্গে মিলে তার বাপের হত্যার আসল কারণ লুকিয়েছিলো। তারপর সর্বত্র ছড়িয়ে দেয় যে, তাকে জিনেরা হত্যা করেছে। অথচ পীরের কজায় কোন জিনটিন ছিলো না। জিন থাকলে ছিলাম আমরা পাঁচ গুনাহগার।

আমি অবশ্যই হত্যাকারী কে- তা জানি। কিন্তু বাংলোর মালিককে সেটা বলিনি।

***

চাচা মাজেদকে আমি এখানে থামিয়ে দিলাম। বললাম- আপনি না বললেও এটা তো পরিষ্কার যে, পীরের ঘাতক তার ছেলে।

চাচা মাজেদ শব্দ করে হেসে উঠলো। এবং বললেন- হাজী সাহেব (বাংলোর মালিক)-ও একথা বলেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, পীরের ছোট স্ত্রীকে পাওয়ার জন্য ও গদিনেসীন হওয়ার লোভে পীরজাদাই তাকে হত্যা করেছে। পীরজাদা ইনস্পেক্টরকে ঘুষ দিয়ে থানায় এটা প্রমাণ করেছে যে, পীরকে হত্যা করেছে জিনেরা।

আমি হাজী সাহেবকে বলেছিলাম, আমারও তাই মনে হয়। অথচ ঘাতক পীরজাদা তো ছিলোই না, কোন জিনও ঘাতক ছিলো না।

তাহলে কে ছিলো হত্যাকারী?- হয়রান হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

আমি ছাড়া আর কে হতে পারে? পীরকে আমি নিজ হাতে হত্যা করেছি চাচা মাজেদ বললেন নির্বিকার কণ্ঠে।

আমি চমকে উঠলাম। অবিশ্বাস্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

চাচা মাজেদের বুক থেকে যেন পাষাণভার নেমে গেলো। তিনি বলে উঠলেন

আজ প্রথমবারের মতো এই রহস্যভার আমার বুক থেকে বেরিয়ে এলো। আল্লাহর পর এতদিন আমার স্ত্রীই একথা জানতো। আজ অতীত ঘাটতে ঘাটতে স্মৃতির তরী এমনভাবে দুলে উঠলো যে, গোপনীয়তার অতলান্ত থেকে এই রহস্য বেরিয়ে এলো। অর্ধ শতাব্দী আগের এক পবিত্র নিষ্পাপ হত্যা এতদিন যেন ভেতরে হৃদয়ের কাঁটা হয়ে ছিলো। আজ প্রথম সেই কাঁটা আমি টেনে বের করলাম।

আচ্ছা! কতল করেছিলেন কিভাবে?

তুমি তো দেখি কাহিনীর মাঝখান থেকে ভুলে গেছো- তিনি বললেন মনে করে দেখো, তামীমা আমার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে এবং যখন পীরের কাছে গিয়ে আমি আশ্রয় চাইলাম পীর আমাকে ভয় দেখালো, ধরা পড়লে এই এই অসুবিধা হবে। ওকে ফিরিয়ে দিয়ে এসো। আমি উল্টো হুমকি দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলাম।

যা হোক, পরে পীর তামীমাকে দেখে মনে মনে উন্মাদ হয়ে উঠলো। ভালো এক শিকার পাওয়া গেছে। পীর বললো, আমাদেরকে তার বুকে আশ্রয় দেবে……..

নিজেই সে আমাদের বিয়ে পরিয়ে দিলো। তখনই পীরের নিয়ত আঁচ করতে পারলাম। তামীমাকে এখানে এনেই আমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। ওকে নিয়ে কোথায় যাবো? পাঁচ ছয় দিন এভাবেই কেটে গেলো।

সপ্তম দিনের রাতে পীর আমাকে একটা কাজে বাইরে পাঠালো। কাজটা এমন ছিলো যে, সারা রাত আমাকে বাইরে কাটাতে হবে। আমি চলে গেলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর খচ করে মনে একটা কথা জাগলো যে, পীর তো এ কাজে আমাকে দিনেও পাঠাতে পারতো। রাতে কেন পাঠালো?

আমার সন্দেহ হলো, যে কোন কারণেই হোক, পীর আমাকে অনুপস্থিতে রাখতে চাইছে। আমি সেখান থেকেই দৌড় শুরু করলাম…….

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের কামরায় গেলাম। কামরার দরজা নক করে ভোলা পেলাম। তামীমা কামরায় নেই। সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়ে গেলো। তামীমাকে খুঁজতে গিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম।

তখনই পীরের জিন হাজির করা কামরা থেকে নারী কণ্ঠ পেলাম। দরজা ধাক্কা দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে দরজার আড় খুলে গেলো। কামরায় একটি ছোট ল্যম্প জ্বলছিলো।

পীর তামীমাকে জাপ্টে ধরে রেখেছিলো আর মুখে তার নাপাক মুখ ঘষতে চেষ্টা করছিলো। তামীমা তাকে গাল দিচ্ছিলো আর তার বন্ধমুক্ত হতে চেষ্টা করছিলো।

পরে তামীমা বলে ছিলো, পীর তাকে কোন এক বাহানা দিয়ে সে কামরায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো……..

পীরের পিরাকী যে কোন পর্যন্ত তা তো আমি জানতামই। এ দৃশ্য যেন আমার ভেতর অগ্নিয়গিরি ফাটিয়ে দিলো। ক্রোধ আমাকে করে দিলো অন্ধ। তার ওপর আমি হামলে পড়লাম। পেছন থেকে পীরের ঘাড় দুহাতে চেপে ধরলাম। ঘাড়ে এত জোরে কোপ বসালাম যে, পীরের বাহুবন্ধন থেকে তামীমা সহজেই বেরিয়ে গেলো। আমি ঘাড় ছাড়লাম না।

আমার দেহে তখন পাহাড় টলিয়ে দেয়ার মতো শক্তি। আমার হাতের চাপ আরো বেড়ে গেলো। পীর একবার ছটফট করে উঠলো। তারপর নাক দিয়ে ঠুস করে বাতাস ছেড়ে দিলো। তখন তার দেহ কেমন ঢিলে হয়ে গেলো। যখন ছেড়ে দিলাম তখন পীর পড়ে গেলো,

***

তখনই বেটাকে আযরাঈল (আ) এসে জাহান্নামে নিয়ে গেছে সেটা আমি বুঝতে পারিনি। তামীমাকে নিয়ে আমাদের কামরায় চলে এলাম। তামীমা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলো। সে বলতে লাগলো, পীর তো এর প্রতিশোধ নেবে। তার কজায় জিন আছে।

আমি তাকে বললাম, সে পীরও নয় এবং তার কাছে কোন জিনটিনও নেই। তোমার সঙ্গে যা করতে চেয়েছিলো সে সেটাই। অর্থাৎ বড় লম্পট ও বদমায়েশ। সকালে তার সঙ্গে কথা বলেই এখান থেকে বের হবো। দৈহিক শক্তি, যৌবনের উত্তাপ আর প্রচণ্ড সাহস আমাকে বেপোরোয়া করে তুললো। রাতটা সেখানেই কাটিয়ে দিলাম।

সকালে আমার চোখ খুললো এই আওয়াজে সরকার মারা গেছেন….. লাশ ফরশের ওপর পড়ে আছে……

আমি গিয়ে দেখলাম। রাতে যেভাবে রেখে এসেছিলাম পীর সেভাবে পড়ে আছে। বুঝলাম আমার হাতেই সে মারা গেছে। তাহলে তো জিনের হাতেই মারা গেছে। কারণ, আমি তার পাঁচ জিনের এক জিন।

ভয়ও পেলাম। ভয়ে ঘাম ছুটে গেলো আমার। তামীমার তো কাঁপুনি এসে গেলো। তখন আমাদের পালানোর পথও বন্ধ। কারণ, এ অবস্থায় পালালে ধরা পড়লে ঘাতক হিসেবে প্রথম সন্দেহভাজন আমরা হতাম। এর মধ্যে পীরের ছেলে রটিয়ে দিলো, এটা জিনদের কাণ্ড।…….

তুমি হয়তো আশ্চর্য হচ্ছে, পীরের ছেলে কেন এমন করলো?

বাপ বেটার মধ্যে তো আগ থেকেই শত্রুতা ছিলো। তারপর বাপের গদির ওপরও ছেলের লোভ কম ছিলো না। সাধারণ মুরিদরা তো এটা জানতো না। পীরজাদা যেদিকেই যেতো তার সামনে সিজদায় পড়ে যেতো লোকে…..

এটা শুধু জানতাম আমরা পাঁচ জিনের দল। পীরজাদা বাপের লাশ দেখে খুশিই হলো। সে এ থেকে ফায়দা উঠালো যে, সাধারণ মানুষের মনে এই ভয় ঢুকিয়ে দিলো, এই গদির দায়িত্বে বড় বড় ভয়ংকর জিনের দল আছে। লোকদেরকে এটাও বিশ্বাস করাতে পেরেছিলো যে, কোন পীরকে কোন মানুষ কখনো হত্যা করতে পারবে না।

হয় স্বাভাবিক মৃত্যু, না হয় জিনরা হত্যা করবে। পুলিশ অফিসারকে থলে ভরে ঘুষ দেয় সে। হত্যার ঘটনা থানার কাগজেই উঠতে দেয়নি।

তারপর ঘোষণা করে দেয়, তার বাপের সব জিন তার কজায় চলে এসেছে এবং তার বাপের ঘাতক জিনদেরকে চরম শাস্তি দিয়ে মারবে…

এর ফলে সাধারণ লোকেরা পীরজাদাকে এমন ভক্তি শ্রদ্ধা শুরু করলো এবং তার পায়ে এত ন্যরানা দিয়ে গেলো যে, তার বাপকেও এত নজরানী দেয়নি কেউ। তবে ভেতরে ভেতরে সে আমাদেরকে খুঁজে দেখতে বলতো, আমার আব্বাজানের আসল ঘাতক কে? বের করতে পারলে পুরস্কার দেয়া হবে। তারপর তো আমি চলেই এলাম।

দেশে আপনি কবে এসেছিলেন?- আমি জিজ্ঞেস করলাম চাচা মাজেদকে।

সেটা আরেক কাহিনী- তিনি হেসে বললেন- সেটা আরেক দিন এসে শুনে যেয়ো। তবে খোদা আমাকে পুরোপুরি মাফ করেন নি। তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে হয়েছিল আমার। তিন বছরের বেশি কেউ বাঁচেনি। যতটুকু বয়স্ক দেখা যায়, আমি আসলে এত বয়স্ক নই। সন্তানের শোক আমাদের বয়স অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। দেখো আমার স্ত্রী তামীমাকে।

আমি তার প্রৌঢ়া স্ত্রীর দিকে তাকালাম। এ বয়সেও তার চোখ মুখ অপরূপ। দেহে সতেজ এক রূপের ছোঁয়া লেগে আছে বড় সজীব হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *