পীরের কেরামতি যারিনার তেলেসমাতি

পীরের কেরামতি যারিনার তেলেসমাতি

বিয়ের এক মাস পর কারো স্ত্রী লা পাত্তা হয়ে গেলে আমার মতে সেটা যে কারো জন্যই সমুদ্রের অতলান্তে পড়ার মতো ঘটনা। আমি তখন সাব-ইনপেক্টর ছিলাম।

এক লোক একদিন থানায় এসে জানালো, বিয়ের এক মাসের মাথায় তার স্ত্রী লা পাত্তা হয়ে গেছে। তার ভেতরে ক্রোধের আগুন জ্বললেও চেহারা ছিলো লজ্জায় অনুতাপে আনত।

থানার রিপোর্ট করতে তার সঙ্গে আসে তার বাবা ও মেয়ের বাবা। দুদিন হয়েছে এক মাসের বধু কন্যা গুম হয়েছে। অর্থাৎ এক মাস আগের বিয়ে যাদের হয়েছিল সেই বর বাড়ি থেকে গুম হয়েছে। তাদের দাবী, মেয়ে অপহৃত হয়েছে।

জিজ্ঞেস করলাম, কে অপহরণ করেছে? তাদের এটা জানা নেই।

তাহলে কি কাউকে সন্দেহ হয়? না, তাদের কাছে কাউকে সন্দেহজনক মনে হয় না।

ওদের গ্রামটি ছোটও নয়, বড়ও নয়। মাঝারি ধরনের। এরা স্বচ্ছল মুসলিম পরিবার। মেয়েও বাড়িও বেশ অবস্থাসম্পন্ন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়ে লাপাত্তা হলো কি করে?

তারা জানালো, তাদের বাড়ি পাকা করা। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িই কাঁচা। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি সে তুলনায় পাকা তো বটেই, বড়সড় এক হাবেলি সেটা, উঠোনের দুদিকে দুই সারি ঘর। এক দিকের এক ঘরে রাতে গুম হওয়া মেয়ে যারিনা ও তার স্বামী ইকবাল শুয়েছিলো। ওরা ওই ঘরেই থাকে। ঘরের অন্যরা আরেকদিকের ঘরগুলিতে থাকে।

ভোরের আঁধার থাকতেই যারিনার শ্বশুর শাশুড়ি উঠে পড়েন। প্রতিদিন তারা এ সময়ই উঠেন। গাভী ও মহিষের দুধ দোহনের ব্যাপারে তদারকি করেন। সেদিনও উঠে দেউরীতে গিয়ে দেখেন সদর দরজা খোলা।

যারিনার শ্বশুর শাশুড়ির আগে এবাড়িতে আর কেউ উঠে না। দরজা খোলা দেখে শ্বশুর যারিনার কোঠায় গিয়ে দেখলেন, তাদের বউ যারিনা বিছানায় নেই। শ্বশুর শাশুড়িকে গিয়ে জানালেন। শাশুড়ি ভাবলেন হয়তো তাজা হাওয়া খেতে বাইরে গেছে। একটু পর চলে আসবে।

কিন্তু সকাল গড়িয়ে বেলা চড়ার পরও যারিনা ফিরলো না।

যারিনাদের বাড়ি সেখান থেকে দেড় মাইল দূরে। সেখানে গিয়েও তার কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না, কোথায় খুঁজবে কোথায় যাবে কেউ কিছুই বুঝতে পারছিলো না। আশে পাশের বাড়িগুলোতেও খোঁজা হলো। অপেক্ষায় অপেক্ষায় দিনটি এভাবেই কেটে গেলো।

রাতে যারিনার বাবা ও শ্বশুর তাদের এলাকার পীরের কাছে গিয়ে হাজির হলেন।

পীর সাহেব নানা হিসাব কিতাব করে বললেন, মেয়ে তো অনেক দূরে চলে গেছে। ফিরেও আসবে। তবে চেষ্টা করতে হবে খুব। পীর সাহেব তাদেরকে এক মুঠি কালো মাসকেলাই- এর অর্ধেক থাকবে পেষা এবং আরো কয়েকটা জিনিস আনতে বললেন।

এসব জিনিস সময় মতো পীরকে দেয়া হলো।

পীর নিশ্চয়তা দিলেন, সন্ধ্যার দিকে মেয়ে উড়তে উড়তে চলে আসবে। যারিনার বাবা ও শ্বশুর পীরকে দ্বিগুণ নজরানা দিয়ে বিদায় হলেন।

যেমন আর্জেন্ট ছবি বা তাৎক্ষণিক ড্রাই ওয়াশ করতে হলে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হয় তেমনি তারাও পীরকে বলে আসলেন, সন্ধ্যার আগে যদি মেয়ে ফিরে আসে ঝোলা ভরে পয়সা দিয়ে যাবেন দরবার শরীফে। যারিনার বাবা তো পীর সাহেবকে একটি বকরি দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দিলেন।

পরে যখন শুনলাম, ওদেরকে থানায় পাঠিয়েছে এক শিখ ভদ্রলোক তখন খুব আফসোস হলো পীরের জন্য। শিখ তাদেরকে পরামর্শ দেয়, আরে মিয়ারা বেওকুফী বন্ধ করে থানায় যাও। পুলিশকে ঘটনা খুলে বলো। এ সব পীর সাহেবরা মেয়েদের অপহরণ করতে পারবেন কিন্তু অপহৃত মেয়ে উদ্ধার করতে পারবে না।

যা হোক, উভয় পক্ষের অভিভাবকরা এ ঘটনা গোপন রাখার খুব চেষ্টা করে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে কোন কিছুর ওপর বেশি দিন পর্দা ফেলে রাখা সম্ভব নয়।

মেয়ে কি ঘর থেকে কিছু নিয়ে গেছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না কিছুই নিয়ে যায়নি। আমরা খোঁজ করে দেখেছি। এসব নিশ্চিত হয়েই তো আমরা বলছি, আমাদের মেয়েকে অপরণ করা হয়েছে। শ্বশুর জবাব দিলেন তটস্থ হয়ে।

কারো সঙ্গে আপনাদের সঙ্গে শত্রুতা ছিলো?

না, জনাব! শ্বশুর বললেন, ছোট খাটো ঝগড়া ঝাটি তো একজনের সঙ্গে আরেকজনের হয়েই থাকে। হত্যা বা অপহরণ করার মতো শক্রতা তো কারো সঙ্গে নেই।

দেউরির দরজা কি ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো?

খুব ভালো করে বন্ধ ছিলো। আমি নিজেকে শিকল লাগিয়ে ছিলাম, শ্বশুর বললেন।

আমাকে একটা কথা খুব ভেবে বলবেন, আমি বললাম, এমনও তো হতে পারে, অপহরণকারী বাড়ির দেয়াল টপকে ভেতরে বসেছে এবং আপনাদের মেয়েকে দরজা খুলে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।

আমি যারিনার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আচ্ছা, তুমিই বলো, তুমি তো শুইয়েই ছিলে, মৃত তো ছিলে না, তারা মেয়েকে উঠানোর সময় কমপক্ষে তো সামান্যতম শব্দ ও তো করবে, ধস্তাধস্তি চিৎকার চেঁচামেচি করবে। সে তো লাড়কিই ছিলো, লাকড়ি তো ছিলো না যে, কেউ এসে আরাম করে বয়ে নিয়ে চলে গেছে।

আমি জানি না সে কিভাবে গিয়েছে। স্বামী বেচারার গলা কেঁপে উঠলো। আমি আপনাদের সবাইকে বলছি মেয়ে নিজ ইচ্ছায় চলে গেছে- আমি প্রাথমিক ফয়সালা শোনালাম আমি আপনাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করি, মেয়ের চাল চলন কেমন ছিলো?

আপনারা বলবেন, মেয়ে বড় সতী স্বাধ্বী ছিলো। কিন্তু আমি বলছি ঐ মেয়ে তার স্বামী ইকবাল ছাড়া আরো অন্য কাউকেও পছন্দ করতো। তার গলা ধরেই মেয়ে হাওয়া হয়ে উড়ে গেছে। এখন হয়তো আপনারা বলে উঠবেন। সে তো ইকবালের জন্য জান কবুল মেয়ে ছিলো……..

আমি জানতে চাই, কে আপনাদের মধ্যে সত্য বলবেন?

তিনজনের কারো মুখ দিয়েই কথা বেরোলো না। যেন তাদের বাক শক্তি অসা হয়ে গেছে।

জনাব! আমরা তো এটাই বলবো যে, আমাদের মেয়ে এরকম ছিলো না। আপনি যে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। একেবারে চুপচাপ শান্ত মেজাযের ছিলো ঐ মেয়ে। নিরবতা ভেঙ্গে শ্বশুর বলে উঠলেন।

তারা মূল্যবান দুটা দিন সময় নষ্ট করে এখানে এসেছেন। তাই মেয়ে কি নিজেই চলে গিয়েছে না অপহৃত হয়েছে তা জানাটা এখন বেশ দুরূহ হয়ে গেছে।

আপনারা কি আপনাদের পীর সাহেবকে জানাননি যে, সন্ধ্যার পরও মেয়ে ফিরে আসেনি?

জানিয়েছিলাম জনাব! শ্বশুর বললেন, তিনি বলেছেন, মেয়ের ওপর কঠিন তাবিজ করা হয়েছে। ফিরে আসবে, তবে সময় লাগবে অনেক দিন।

***

যারিনার শ্বশুর বাড়ি অর্থাৎ ইকবালের বাড়িতে গেলাম আমি। বাড়ির বারান্দার দিকের যে ঘরে ইকবালরা থাকতো প্রথমে সে ঘরে গেলাম।

স্বামী স্ত্রীর খাট দুটি পরস্পরে সঙ্গে লাগানো ছিলো। আর বাড়ির চার দেয়ালও এত উঁচু যে, সাধারণভাবে সেটা টপকে ভেতরে যাওয়া সহজ নয়। ছাদ দিয়েও ভেতরে ঢোকা মুশকিল হবে। এ ঘর থেকে একমাত্র পেশাদার ডাকাত ছাড়া অন্য কেউ জলজ্যন্ত একটা মানুষ উঠিয়ে নিতে পারবে না।

আমার মনে আরেকটা সন্দেহ উঁকি দিলো যে, যারিনার স্বামী ইকবালও তো কোন কারণ যারিনাকে হত্যা করতে পারে। তারপর লাশ কোথাও ফেলে আসতে পারে।

কিন্তু এই সন্দেহ এজন্য কাঁচা যে, ইকবাল যারিনাকে হত্যা করে লাশ কোথাও ফেলে আসলে কোথাও না কোথাও থেকে লাশ পাওয়ার খবর আসতো। অবশ্য লাশ দাফনও করে দিতে পারে। ইকবালের ওপর আমার সন্দেহ আরেকটা কারণ ছিলো। সে সবসময় চুপ চাপ। ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে এখানে আসে। সব কথার জবাব তার বাবাই দিচ্ছিলেন।

জনাব, ইকবালের বাবা বললেন, আমার ছোট মাথায় একটা কথা এসেছে, যারি না যদি নিজেই যেতো তাহলে সঙ্গে করে সোনাদানা টাকা পয়সাও নিয় যেতো।

আমি কথাটাকে জরুরী মনে করলাম না। ওর পরকীয়া সম্পর্ক এমন লোকের সঙ্গেও হতে পারে যে বেশ ধনাঢ্য। তার সোনাদানার প্রয়োজন নেই।

যা হোক, এসব কথা এখনই আমার জানা জরুরী নয়। আর যারিনার শ্বশুরের পরামর্শ আমার এজন্য প্রয়োজন নেই যে, তার নাক কাটা গেছে এবং সেখানে এখন মাছি বসেছে। কারো ঘর থেকে নববধূর পালিয়ে যাওয়াটা বড় দুর্নামের বিষয়। আমার কাছে এমন অনেক মাধ্যম আছে যার দ্বারা মাড়ির নিচের গোপন বিষয়ও আমার জানা হয়ে যায়।

এখানে আরেকটা দিক আছে, এ ঘটনা যে সময়ের সে সময়টা আজকের তুলনায় অনেক পবিত্র ছিলো। মানুষের মধ্যে আদর্শ আর নীতিবোধ বিপুলভাবে জাগ্রত ছিলো। ছেলে মেয়ের অবাধ মেলা মেশা ছিলো অকল্পনীয় ব্যাপার। লজ্জা ও শ্লীলতা ছিলো সমাজের ভূষণ। তাই কোন বাড়ি থেকে কোন মেয়ের উধাও হয়ে যাওয়াটা যেমন বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো তেমনি ছিলো দুঃসাহসের ব্যাপার।

আমি ইকবালকে পৃথকভাবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। তাকে সতর্ক করে দিলাম, হয় সে নিজে বলবে না হয় অন্যদেরকে আমি জিজ্ঞেষ করে জেনে নেবো আসল ঘটনা কি? তবুও ওর জবাব আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। ওকে বিদায় করে ওর মাকে নিয়ে বসলাম।

না-জ্বি: আমি পরিষ্কার ভাষায় বললাম, এখন আর নিজের সম্মান অসম্মানের কথা মনে রাখবেন না। এসব বিষয় যখন পুলিশের হাতে চলে যায় তখন আর কোন কিছুর পরওয়া থাকে না। আপনার বউ যে নিজে ইচ্ছায় গিয়েছে। এটা নিশ্চিত। কোন দুশ্চিন্তা না কর আমাকে সব কথা খুলে বলুন। সবার আগে বলুন, মেয়ের স্বভাব চরিত্র কেমন ছিলো? চাল চলন কেমন ছিলো? আপনার ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোন ধরনের ছিলো? এমনকি ঘরের অন্যদের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিলো তার? চঞ্চল বুদ্ধিমান ছিলো, না সরলা- লাজুক ছিলো?

ওর দুটি গুণ দেখে আমরা আত্মীয়তা করি- ইকবালের মা বললেন, একটা হলো তার রূপ। আরেকটা হলো তার শান্ত স্বভাব। ওদের বাড়িতেও সে স্বল্প ভাষী ছিলো। নামায রোযার প্রতিও খুব যত্নশীল।

সবসময় খুব যত্নশীল।

 সবসময় কি উধাস উধাস মন মরা থাকতো

 না, হাসি খুশি থাকতো

আর আপনাদের বাড়িতে

 এখানেও চুপচাপ থাকতো

 আর হাসি খুশি?

 ইকবালের মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। চিন্তামুক্ত কণ্ঠে বললেন, ওদের বাড়ির মতো এখানে হাসি খুশি থাকতো না।

আর ইকবালের সঙ্গে?

নতুন বউ এর ব্যাপার তো জানেনই। বিয়ের পর যারিনা আমাদের সামনে সব সময় ইকবালের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেতো। এজন্য ওদেরকে কখনো কথাও বলতে দেখিনি।

এমন সুন্দরী বউ পেয়ে ইকবাল নিশ্চয় অনেক খুশি? আমি ধারালো গলা জানতে চাইলাম। আমি সঠিক জবাব চাই। ভেবে চিন্তে বলবেন। এতে হয়তো জানা যাবে- যারিনা নিজ ইচ্ছায় গিয়েছে না কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেছে।

আমার ছেলেকে খুব খুশি মনে হতো না- ইকবালের মার হতাশ কষ্ট, আমার ছেলে তো বড় হাসিখুশি ফুর্তিবাজ ছেলে ছিলো। কিন্তু বিয়ের পর তার মুখের হাসি যেন কে কেড়ে নিয়েছে।

যদি জিজ্ঞেস করি যারিনার সঙ্গে আপনাদের ব্যবহার কেমন ছিলো আপনি বলবেন খুব ভালো ছিলো, সত্য কথা বলবেন না।

আমি সত্য না বললে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আমাদের প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করুন। যারিনার মাকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন। তবে ওকে প্রায়ই বলতাম, লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা কিছু একটা বলল, নইলে আশ পাশের লোকেরা তো বদনাম দেবে শাশুড়িকে।

তখন সে কি বলতো?

তখনো নিরব থাকতো- ইকবালের মা বললেন, বউ শ্বশুড়ির যুদ্ধ তো অতি প্রাচীন প্রবাদ। কিন্তু ও তো মুখই খুলতো না।

এই মহিলাকে নিয়ে আমি অনেক মাথা খাটালাম। এ থেকে এতটুকু পেলাম যে, ইকবাল ও যারিনার সম্পর্কের মধ্যে একটা কিন্তু ছিলো।

ইকবালের বাড়িতে যারিনা সুখী হতে পারেনি এবং ইকবালের মতো প্রাণচঞ্চল ছেলে বিয়ের পর একেবারে চুপসে যায়। আমি মাথায় এটাও টুকে রাখলাম যে, যারিনার শ্বাশুড়ি তাকে চাপের মধ্যে রাখতে কিংবা ছেলের কানভারী করে যারিনাকে তার হাতে মার খাওয়াতো। গ্রামাঞ্চলের লোকেরা এখনো পুত্র বধূকে মারপিট করে গর্ববোধ করে।

আরা অনেক কিছু জানার ছিলো আমার। ইকবালের বাড়িতে যারিনার মাও এসেছিলো। তাকে নিয়ে ইকবালের বাড়ির দেউরিতে বসে পড়লাম আমি।

***

যারিনার মা খুব কাঁদছিলেন। মা হিসেবে মেয়ে হারানোর আঘাত সওয়ার মতো অবস্থা তার ছিলো না। কিছু সান্ত্বনা বাণী শুনিয়ে তাকে আমি শান্ত করলাম।

আপনার মেয়েকে ফিরে পেতে চাইলে মেয়ে সম্পর্কে কোন কথাই গোপন রাখবেন না। আমি একটু জোরের সঙ্গে বললাম। প্রথম কথা হলো, সে কোথায় এবং কার সঙ্গে গিয়েছে এ সম্পর্কে এক আপনার কোন ধারণা আছে?

আল্লাহর কসম সামনে রাখুন। আমার মাথার ওপর কুরআন শরীফ রেখে দিন- যারিনার মা ত্রস্ত গলায় বললেন, কারো সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে না আমার যারিনা। নিরবে বসে আল্লাহকে স্মরণ করা মেয়ে সে।

ইকবালের সঙ্গে বিয়ে হওয়াতে সে কি খুশি ছিলো?

 না জনাব! আমি সত্য সত্য বলছি সে খুশি ছিলো না।

কি বলতে যারিনা? ইকবাল ভালো নয় এসবই তো মনে হয় বলতো।

প্রথম প্রথম বলতো, আমাকে বিয়ে করাবেন না। অন্যের ঘরে আমি সুখী হতে পারবো না। আমি ওকে অনেক বুঝিয়ে বললাম, ইকবাল এত সুদর্শন যুবক। ওর সঙ্গে তুমি সুখী হবে। তখন বললো, আমাকে ইকবালের সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। কারণ জিজ্ঞেস করলাম, ও বললো, বিয়ে শাদীকে আমি ভয় পাই। তখন আমি মনে করেছি, অল্প বয়সী মেয়ে বলে বিয়ের কথা শুনে ঘাবড়ে গেছে।

আপনার কি মনে হয় মাজ্বী! আমি জিজ্ঞেস করলাম- সে কি ইকবাল পছন্দ করতো না? তাহলে কাকে পছন্দ করতো?

ইকবালকে পছন্দ করতো না এমন নয়- যারিনার মা জবাব দিলেন- আপনি ইকবালকে দেখেছেন। যেকোন মেয়েই ওকে পছন্দ করবে…. ঘরের বাইরে আমার মেয়ের কোন আগ্রহ ছিলো না, অন্যান্য যুবতী মেয়েদের মতো সে কাউকে সই সখিও বানায়নি। না, সে আর কাউকে পছন্দ করতো না। আমি কসম খেতে পারবো এ ব্যাপারে।

কসমের কথা বলবেন না মাজী! আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। কেউ কারো মনের খবর জানে না,….. ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা হয়তো ওকে কষ্ট ক্লেশে যন্ত্রণা দিতো। এ কারণে সে ভয়ে পালিয়েছে।

সে পলিয়ে যাবে কোথায়? নিজের ঘরেই ফিরে আসতো। তাছাড়া এক মাসে সে দুই তিনবার আমার কাছে আসে। আমি ওর শ্বশুর শাশুড়ি ও ইকবালের আচার ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। সে কোনদিন কোন অভিযোগ করেনি।

মাজী! আমার গলা দৃঢ় হয়ে গেলো- আপনার মেয়েকে আমি কোথাও না কোথাও থেকে বের করে আনবো। কিন্তু এর আগে ওর বান্ধবীদের কাছ থেকে আমি জেনে নেবো যে, সে কাউকে না কাউকে পছন্দ করতোই। নিজের ইচ্ছাতেই সে গিয়েছে। কেউ ওকে উঠিয়ে নেয়নি।

মহিলা চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমি তার চোখমুখ জড়িপ করতে লাগলাম। মহিলা বেশ অভিজাত ঘরের। তাই তার বার্তার ধরনও ছিলো বেশ মার্জিত।

আপনি বলছেন ও নিজ ইচ্ছাতে গিয়েছে। মহিলা আহত গলায় বললেন, একথায় আমি দুঃখ পেয়েছি, এটা একেবারে ভুল। তবে আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। সেটা হলো, যারিনার ঘুমের মধ্যে চলা ফেরার অভ্যাস ছিলো। কিন্তু…. কিন্তু আমি আর কিছু বলতে পারছি না।

ঘুমের মধ্যে চলা ফেরা করতো? আমি চমকে উঠলাম- ঘুমের মধ্যে কি সে ঘরের বাইরে চলে যেতো?

এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন আমার জিহ্বার ডগায় এসে ভিড় করলো। যা আমি কোন বিরতি ছাড়া এক নিঃশ্বাসে জিজ্ঞেস করলাম। যারিনার মা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন আমাকে বেকুব ঠাওরাচ্ছেন। তিনি নিশ্চয় ভাবছেন, আরে ওই বেকুব এমন করছে কেন? অবশ্য এই হতভম্ব চোখেই আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

অনেকে অবশ্য জানেন, ঘুমের মধ্যে চলা ফেরা করার ওই রোগ সাধারণত শিশুদের হয়ে থাকে। অনেক শিশু আছে, যারা ঘুমের মধ্যেই বিছানা থেকে উঠে, ঘরে বা বারান্দায় ঘুরে ফিরে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে। এই ঘোরা ফেরার সময় চোখও খোলে না। সকালে উঠে তার আর কিছুই মনে থাকে না। এটা এক প্রকারের মানসিক রোগ।

যারিনার মা জানালো। যারিনাও মাসে দুএকবর মাঝ রাতে উঠে চলা ফেরা করতো। ঘরের কেউ জেগে উঠলে তাকে বাধা দিতো। তখন তার কোন অনুভুতি হতো না যে, তাকে কউ হাটা চলা ফেরা করতে বাধা দিচ্ছে। আঙ্গিনায় বা বারান্দায় ঘুরে সে আবার ফিরে আসতো। দুবার সে বাড়ির ওপর তলার দিকেও উঠে পড়েছিলো। তার ভাগ্য ভালো, দুবারই তার মা তাকে দেখে ফেলে এবং তাকে নিচে নিয়ে আসে। তার চোখ তখন অর্ধেক ভোলা থাকতো।

বিয়ের পাঁচ ছয় মাস আগ থেকে এ রোগ দেখা দেয়। অর্থাৎ তার তের চৌদ্দ বছর বয়সে এ রোগ দেখা যায়।

তার মা বাবা এ রোগের চিকিৎসা করান নানা তাবিজ কবজ ও খানকা শরীফের মাটি দিয়ে।

তাদের এটা জানা ছিলো না যে, এ হলো মস্তিস্কের অসাড়তা। এ এমন এক মানসিক রোগ বা তাবিজ কবজ বা সাধারণ চিকিৎসা ভালো হয় না। ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা এই অসুখের কথা জানতো?

না জনাব- যারিনার মা বললেন- বললে তো আত্মীয়তা করতে ওরা রাজি হতো না।

যারিনার মাকে নিয়ে আমি অনেক সময় ব্যয় করলাম। তাকে বার কয়েক বললামও, তার মেয়ে অন্য কাউকে ভালো বাসতো। তারা যেন তাকে খুঁজে বের করে। কিন্তু মাহিলা অস্বীকার করে বলেন, এমন কেউ আছে বলে তার জানা নেই। আমার মাথায় যারিনার ঘুম রোগ আটকে যায়।

তারপর আমি সেখানকার চৌকিদার নৈশপ্রহরী ও দুইজন অভিজাত লোককে থানায় ডাকিয়ে এনে বললাম,

তোমাদের এলাকার একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে। তোমাদের তাই বসে থাকা উচিত হবে না। তারা যেভাবেই হোক চার দিক যেন খোঁজে বেড়ায়। যারিনার স্বভাব চরিত্র কেমন, কারো সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিলো কিনা এসব যেন খুটে বের করে আমাকে এসে জানায়।

চৌকিদার আমাকে জানালো, ইকবাল খুব প্রাণোচ্ছল ছেলে ছিলো। কিন্তু বিয়ের পর তার ঠোঁটে হাসি দেখা যায়নি।

যা হোক, যারিনা বাবা, ইকবালের বাবা ও ইকবালকে আমি থানায় নিয়ে আসলাম। কেউ হারিয়ে গেলে তার মামলা নেয়ার আগে অনেক লেখালেখি করতে হয়। তারপর অন্যান্য থানায়ও হারানো ব্যক্তির নাম ঠিকানা আকার আকৃতির বর্ণনা সম্বলিত রিপোর্ট পাঠাতে হয়। রিপোর্ট লেখককে আমি এ কাজে লাগিয়ে দিলাম। আর অন্যদের বিদায় করে ইকবালকে আমার সামনে বসালাম।

***

তুমি যদি এখনো আমাকে কিছু না বলে তাহলে আমি বলবো, তোমার বউ তোমাকে পছন্দ করতো না। আর তুমি তাকে হত্যা করে লাশ কোথাও চাপা দিয়ে রেখেছে আমি ইকবালকে ভীতি ধরানো গলায় বললাম

তোমার নিরবতা আমার সন্দেহ ক্রমেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। তুমি দেখেছে, তোমাদের এলাকার কত লোকের সাথে আমি কথা বলেছি। এরপর তোমারাও যারিনার মাও তো আমাকে কিছু কথা বলেছে। তুমি শুধু আমাকে এতটুকু বলল, বিয়ের আগে তুমি এত সজীব প্রাণ ছিলে আর বিয়ের পর এত চুপসে গেলে কেন? এমন সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে তুমি কোন অসুখে পড়লে?

আমি ওকে হত্যা করিনি। হত্যা করলে তো বিয়ের প্রথম রাতেই করতাম। কোন ক্রুদ্ধ মূর্তি যেন ইকবালের ভেতর থেকে বলে উঠলো।

কেন? প্রথম রাতেই হত্যা করার কথা কেন মনে হলো?

তার বুক থেকে হাহাকার বেরিয়ে এলো। যেন সেখানে এক নদী দুঃখ জমাট বেধে আছে। তার মাথাটি সামনের দিকে নুয়ে পড়লো। আমি তাকিয়ে রইলাম। তারপর যখন মাথা উঠালো মনে হলো অনেক কষ্টে বড় এক বোঝা উঠাচ্ছে। চোখ গুলো রক্ত বর্ণ হয়ে উঠলো। তার সুন্দর মুখটা ছেয়ে গেলো বিমর্ষতার কালো ছায়ায়।

আমি দুর্বল ছেলে নই- যেন তাল হারানো গলায় কথা বলছে ইকবাল আর আমি জানতাম না, দুঃখ আর হতাশ কাকে বলে? আমার এলাকার মেয়েরা তো আমাকে তৃষ্ণকাতর নয়নে দেখতো। অথচ বিয়ের প্রথম রাতেই আমার নববধু আমাকে স্পষ্ট বলে দিলো, আমার কাছে আসবে না। আমি অন্তর থেকে তোমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করিনি। না, ভীত অনুতপ্ত গলায় সে একথা বলেনি। বড় স্পর্ধিত গলায় হুকুমের সুরে বলেছিলে। তোমার হাত দুটি পেছনে রাখো…

বিয়ের আগে আমাকে সবাই বলেছে, তুমি যে বউ পাচ্ছো সে এতই চুপচাপ থাকে যে, লোকে তাকে বোবা বলে। অথচ সে বোবা মূক মেয়েটি আমাকে বোবা বানিয়ে দিলো। লোকে যে আমাকে নির্ভীক সাহসী ছেলে বলে জানতে আমার সেই নির্ভীকতা কোথায় যেন চলে গেলো। আমি টলমলে পায়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার মন মগজ সব আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। যে ছেলে নিজেকে শাহজাদা মনে করতো। মেয়েরা যার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়ে যেতো। তাকে এক মেয়ে বলছে, আমার কাছে আসবে না। সে তো বরফের সঙ্গে গলে পানি হয়ে যাবে। অথবা আগুনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠবে। না হয় সে আত্মহত্যা করবে বা বিপক্ষকে গলা টিপে মারবে। আমার মনে হলো, আমি বরফের মতো গলে গলে পানি হয়ে যাচ্ছি…..।

কথা বলার মতো কোন শক্তি আমার মুখে জোগলো না। সে ভেবেছে, আমি রাগ সামলাতে গিয়ে কথা বলতে পারছি না। সে বললো, তুমি পুরুষ আমি দুর্বল এক মেয়ে। আমাকে মারো, খুন করো, কিন্তু তোমার স্ত্রী হবো না। তুমি জোর করে স্ত্রী বানাতে চাইলে তোমার সঙ্গে লড়াই করে পারবো না আমি। কিন্তু মনে রেখো, তোমার বিরুদ্ধে এমন অপবাদ ছড়িয়ে দিবো যে, সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না……।

আমি জানাতাম, মেয়েরা যদি বদনাম রটিয়ে দেয়, আমার স্বামী পৌরষত্বহীন তাহলে সে পুরুষ আর কারো সামনে মুখ খুলতে পারে না। ওকে অমি অনেক কিছু বললাম। বুঝলাম যে, সে বিয়ের শুরুতেই কেন অস্বীকার করলো না। এখন তো সে আইন সম্মত স্ত্রী।

সে বললো, আমি পালাবো না। তোমার ঘরেই থাকবো, কিন্তু স্বামী স্ত্রীর কোন সম্পর্ক রাখবো না।

এতক্ষণ সে ঘোমটা মুখে রেখেই কথা বলছিলো। তারপর সে তার মুখের ঘোমটা সরালে। রূপের এক তীব্র ধাক্কায় যেন আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সাধারণ চেহারার কেউ হলে না জানি আমি কি করতাম। কিন্তু ওর রূপ আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলো…..।

আমি ওকে বললাম, আমি তো এত কুৎসিত নই যে, আমাকে দেখে তোমার ঘৃণা উপচে পড়ছে। সে বললো, কে বলেছে তোমাকে আমি ঘৃণা করছি। তুমি তোমার এলাকার শ্রেষ্ঠ রূপদর্শন ছেলে। তোমাকে দেখে যে কোন মেয়ের মনে শিহরণ জাগবে। কিন্তু তুমি আমাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে আমি তোমাকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। যদি আমাকে তালাক দিয়ে দাও তোমার ওই অনুগ্রহ সারা জীবনেও আমি ভুলবো না….।

আমি একথার কোন জবাব দিলাম না। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, সেই ভাগ্যবান কে যার কারণে তুমি আমার পৌরুষত্বে লাথি মারছো?

সে বললো, এটা তো আমি কখনেই বলবে না…… নরক বাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার রাতটা কাটলো। সকাল বেলা মনে হলো সমস্ত দুনিয়া আমার চোখের সামনে দুলছে।

তুমি কি তোমার মা বাবাকে এসব কথা জানাওনি?

না, জানাইনি। যদি এর কারণ জিজ্ঞেস করেন আমি কোন সদুত্তর করতে পারবো না। মনে হচ্ছিলো ঐ মেয়ে যেন আমাকে বশীকরণ তাবিজ করেছে। আপনি পুরো গ্রামে জিজ্ঞেস করেন। আমি কেমন সাহসী ছেলে ছিলাম। কিন্তু ঐ মেয়ের সামনে আমার সব বীরত্ব উধাও গলো। বন্ধুরা ঠাট্টাচ্ছলে রসিকতা করে আমাকে জিজ্ঞেস করে, প্রথম রাত আমার কেমন কেটেছে। আমি বড় কষ্টে জবাব দেই, ভালো কেটেছে।

জাদুটোনা সম্পর্কে অনেকে অনেক কিছু বলে। কেউ একে বিশ্বাস করে আবার কেউ অস্বীকার করে। কিন্তু বিদ্যার অস্তিত্ব ও এর বাস্তবতা যে আছে এটা পরীক্ষিত সত্য। তবে এর প্রতিক্রিয়া ভালোমন্দ দুটোই হতে পারে।

কিন্তু অধিকাংশ মানুষই শত্রুর বিরুদ্ধে এটা ব্যবহার করে। এ ধরনের দুটি মামলা আমার কাছে অনেক দিন আগে এসছিলো। ইকবালের বিশ্বাস যে, যারিনা তার ঘরে আসার আগেই তাকে জাদু করেছে। এ কারণেই তার মতো টগবগে এক যুবক এক মেয়ের সামনে বরফ হয়ে গেছে। ওর মাথায় যারিনার বিরুদ্ধে আর কিছুই খেললো না। 

সেই কথা বলে যাচ্ছিলো আর আমি অধৈৰ্য্য হয়ে অপেক্ষা করছিলাম যে, সে শেষ এটা স্বীকার পর্যন্তরিনাকে যে হত্যা করেছে করবে বা সে নিজেই যারিনাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। সে এখন তার পছন্দের লোকের কাছে আছে।

আচ্ছা! তুমি কি শেষ পর্যন্ত জানতে পেরেছে। যারিনা কাকে ভালোবাসতো?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আমি অনেক জানতে চেষ্টা করেছি, এ তথ্য উদ্ধার করতে পারিনি। আর গ্রামের লোকেরা ওকে অত্যন্ত ভালো মেয়ে বলে জানে- ইকবাল বললো।

তোমাদের এখানে থাকাকালে কোন রাতে কি এমন হয়েছে যে, যারিনা বিছানা থেকে উঠে এমনিই বাড়ি ঘর ঘুরে ঘুরে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছে?

না জনাব!- ইকবাল সবিস্ময়ে বললো- এমন তো কখনো হয়নি? আপনি একথা কেন জিজ্ঞেস করছেন?

আমি এ প্রসঙ্গে এড়িয়ে গেলাম। যারিনার গুম হওয়ার ঘটনা এর সঙ্গে কতটুকু সম্পৃক্ত- এ বিষয়ে আমি নিজেই অস্পষ্টতার মধ্যে ছিলাম।

***

কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার শুরু করলাম। ওকে সহজে ছেড়ে দিলাম না। ওকে শক্ত জেরা করলাম, সে যারিনার বিরুদ্ধে কিছু একটা অবশ্যই করেছে। ওকে শক্ত করে জেরা করলাম, সে যারিনার বিরুদ্ধে কিছু একটা অবশ্যই করেছে।

আমার মধ্যে নতুন এক মানসিক ব্যধি দেখা দিলো- ইকবাল এবার আরো সরল কণ্ঠে বললো

আমি কাউকে কিছু বলতে লজ্জা পেতাম। যারিনার ওপরও কোন জোর খাটালাম না। ছয় সাত দিন পর আমি আমাদের পীর সাহেবের কাছে গেলাম। তার পায়ে মাথা রেখে কেঁদে কেঁদে তাকে বললাম, আমার স্ত্রী অন্য কারো বশ মেনে নিয়েছে। এজন্য সে আমাকে স্বামী বানাতে আগ্রহী নয়। আর সে আমার ওপর এমন তাবিজ করেছে যে, ওর সামনে আমি কিছুই বলতে পারি না।

পীর সাহেব বললেন, ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি বললাম, ইয়া পীর দস্তগীর! সে কখনো আসবে না। সে বুঝে ফেলবে, আমি ওর মনকে ওর প্রেমিকের কাছ থেকে ছিনিয়ে আমার অধীনে নিয়ে আসতে যাচ্ছি। পীর সাহেব বললেন, ঠিক আছে, ওকে আনতে হবে না। আমিই তোমাদের ঘরে চলে আসবো…….

সেদিন সন্ধ্যায় পীর সাহেব আমাদের ঘরে এসে হাজির। আমি তো আনন্দে গদগদে হয়ে গেলাম। আমার সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেছে। আমার পীর আমার ঘরে চলে এসেছেন। তিনি যারিনাকে এটা টের পেতে দিলেন না যে, তারই মাথা ঠিক করতে তিনি এসেছেন।

তিনি যারিনার মাথায় হাত রেখে তাকে পাঁচ টাকা সালাম দিয়ে বললেন, আমি চিল্লায় বসেছিলাম। তাই এতদিন পর নব দুলহানকে মোবারকবাদ ও সালামী দিতে এসেছি। তিনি কিছু একটা পড়ে যারিনার সারা দেহে ফুঁক দিলেন এবং যারিনাকে আরেকটু কাছে নিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললেন, তোমার চোখে আমি তোমার দুশমনের ছায়া দেখতে পাচ্ছি।

যারিনা কিছুই বললো না। পীর সাহেব একটি তাবিজ লিখে পানিতে মিশিয়ে যারিনাকে খাইয়ে দিলেন। তিনি যারিনাকে অনেক ভয় দেখালেন, শত্রুর এই ছায়া কখনো কখনো অনেক ভয়াবহ রূপ নিয়ে থাকে……

পীর সাহেব যারিনার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। রাতে যারিনা আমাকে বললো, পীর সাহেবকে যদি তুমি ডেকে এনে থাকো, তাহলে তার তাবিজ আমার কিছুই করতে পারবে না। আমি মিথ্যা বললাম, না পীর সাহেবকে ডাকিওনি এবং তার সঙ্গে আমার কোন কথাও হয়নি।

সে কি তোমার সঙ্গে রাগ দেখিয়ে কথা বলতো? ঝগড়া বিবাদ করতো? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না জনাব! অনেক শান্ত ও মার্জনীয় ভঙ্গিতে কথা বলতো।

ইকবাল যে পীরের কথা বলেছে, সে পীরের কাছে তাদের পুরো বংশ ও এলাকার সবাই তার মুরিদ। হেন কাজ নেই যা পীরের খানকায় ঘটে না। তার এক জোয়ান ছেলে আছে। খেয়ে খেয়ে অপদার্থ থেকে লাল মহিষে পরিণত হয়েছে। আমি যখন এই থানায় নতুন আসি তখন থানার এক হিন্দু আই. এস. আই আমাকে সতর্ক করে দেয় যে, পীরের ঐ ছেলে এক নম্বর মেয়ে শিকারী। কিন্তু পীরের ছেলে বলে লোকে চুপ থাকে।

একদিন নিজ এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সেই পীরের আস্তানায়ও ঢু মেরে আসি। আগের থানা অফিসারের সঙ্গে পীরের খুব দরহম মরহম ছিলো। পীর আমাকেও সে ধরনের অফিসারই মনে করলো। আর আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে লাগলো। যেন এ এলাকার হুকুমত তার হাতে।

আমি আর তাকে বেশি বাড়তে দিলাম না। তার কানে বোমা ফাটিয়ে দিলাম। পরিস্কার ভাষায় বলে দিলাম, এই এলাকার হাকিম আমি এবং সে তার ছেলেকে যেন লাগাম পরিয়ে রাখে। পীর সাহেব প্রথমে তার মৃত পূর্ব পুরুষদের ক্রোধাৰিত আত্মার ভয় দেখালো। কিন্তু তার মাথা থেকে হুকুমতের ভূত আর শাহেনশাহী আমি নামিয়ে দিলাম।

এই ছেলেটি আমার বড় বেততমিজ হয়ে গেছে- পীর তখন আপসরফার সুরে বললো- আমার নিজের ঘরও তো তার হাত থেকে নিস্তার পায় না। আপনাকে সত্য করে বলছি, এই ছেলের সঙ্গে আমার কথা বার্তাও বন্ধ। আমার ও গদির মান সম্মানের ব্যপারে না হলে ওকে আমি অনেক আগেই ঘর থেকে বের করে দিতাম।

ইকবাল আবার বলতে শুরু করলো- দুদিন পর আবার আমাদের বাড়িতে পীর সাহেব এলেন। যারিনাকে কাছে বসিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বললেন, বড় বিষ ছায়া পড়েছে তার ওপর। পীর সাহেব তখন আমাকে ঘর থেকে বের করে দেন। তাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হয় সেটা আজো পর্যন্ত জানতে পারি নি আমি। পীর যারিনাকে আরেকটি তাবিজ পানিতে গুলিয়ে পান করান এবং চলে যান……

আমি নিয়মিত পীর সাহেবের দরবারে সালাম জানাতে থাকলাম। পীর সাহেব বলতেন, মেয়ের ওপর যে তাবিজ করা হয়েছে এর আছর যতদিন থাকবে ততদিন ঐ মেয়ে কাউকে স্বামী বলে মেনে নেবে না। আমি উনাকে খুশী করতে বহু চেষ্টা করে বললাম, যেভাবেই হোক এই আছর আপনি দূর করে দিন। তিনি বলতেন, দূর হয়ে যাবে, তবে সময় লাগবে……

এর কিছু দিন পরই যারিনা লাপাত্তা হয়ে যায়। আমি ছুটে পীর সাহেবের কাছে গেলে তিনি বললেন, আমিও এই ভয় পাচ্ছিলাম। তার ওপরের ছায়াটা বড় ভয়ংকর ছিলো। সেটাই তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আমি বললাম, ইয়া পীর ও মুরসিদ! ওকে ফিরিয়ে আনুন।

পীর সাহেব বললেন, এখন যদি ও ফিরে আসে তাহলে তোমার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সে তোমার স্ত্রী হবে না তখন কোনদিন। আর ওকে খুঁজতে যেয়ো না কোথাও। থানায়ও যেয়ো না। তাহলে কিন্তু সবাই মারা পড়বে।

তাহলে থানায় আসলে কেন?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আমার বাবা ও যারিনার বাবা আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি এজন্য চুপচাপ ছিলাম যে, আমার পীর ও দস্তগীর আমাকে নিষেধ করেছেন থানায় আসতে।

তুমি কি বউ ফিরে পেতে চাও?

কি করবো ওকে নিয়ে? পীর সাহেবের শক্তিতে যদি আসে তাহলে তো খুব ভালো। আর আপনি যদি ওকে কারো কাছ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন তাহলে ও আমার কি কাজে লাগবে?

ইকবালের কথায় পীরকেও এই মামলায় সন্দেহভাজনদের তালিকায় নিয়ে এলাম। কিন্তু এখনই তাকে ঘাটাতে চাইলাম না। কারণ, পীর এতো কাঁচা লোক নয় যে সহজে আমার জালে জড়িয়ে যাবে।

আগে আমাকে সাক্ষীর জাল বুনতে হবে তারপর পীরকে জাল দিয়ে ধরতে হবে। কিন্তু এখন আমার চিন্তার বিষয় হলো, যারিনা কাকে পছন্দ করবো সেটা আগে খুঁজে বের করা।

***

পরে তিনদিন আমি আর এই মামলার দিকে মনোযোগ দিতে পারলাম না। হত্যার এক মামলায় সেশন কোর্টে আমি সাক্ষী ছিলাম। দ্বিতীয় দিনও আরেকটি মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তৃতীয় দিন থানারই অন্য আরেক কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

সেশন কোর্ট আমার থানা থেকে আঠাশ মাইল দূরে। কিদার নাথ শির্মা নামে সেশন কোর্টের এক পি,পি (সরকারী ওকিল) এর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ট পরিচয় ছিলো। লোকটা এসব ব্যপারে অভিজ্ঞও খুব।

আমি শর্মাকে যারিনার ঘটনা শোনালাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম এমন কি হতে পারে, ঘুমের মধ্যে ঐ মেয়ে বাইরে চলে গেছে?

এমন হলে আশ্চর্যের কিছু নয় এটা- শর্মা বললেন- ঐ মেয়ে সমসময় চুপচাপ থাকতো। কে জানে ওর মনে কত কিছুই তো গোমট হয়ে থাকতে পারে। সে কিছু বলতো না এবং আবেগও প্রকাশ করতে পারতো না। সে থাকতো কল্পনার জগতে। এ ধরনের মানুষ ঘুমের মধ্যে কথা বলে অথবা উঠে চলা ফেরা করে। ঘুমের মধ্যে সে এমন জায়গায় যায় যেখানে জাগ্রত অবস্থায় যেতে পারে না। এটা একেবারেই মানসিক ব্যধি……..

আমার মনে হয়, ঐ মেয়ের পছন্দের বাইরে বিয়ে হওয়াতে সে তার স্বামীকে মেনে নিতে পারেনি। তবে স্বামীর ঘরে সে বন্দিনীর মতো ছিলো। এজন্য ঘুমের মধ্যে তার চলাফেরার রোগটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এবং সে রাতে বের হয়ে পড়ে, হয়তো ক্ষেত খামার দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলো। কেউ দেখে ফেলেছে এবং এমন রূপবর্তী মেয়ে হাতছাড়া না করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।

যদি পিপি কিদারনাথ শর্মার ধারনা মতে যারিনা হারিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এ মামলায় আমার জন্য সফল হওয়া একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমি এটা মাথায় রেখে যারিনার প্রেমিক কে তা খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার বিশ্বাস, যারিনা গেলে তার কাছেই গিয়েছে।

যারিনা গুম হয়েছে পাঁচ দিন চলে গেছে। থানায় বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদানকারী লোকজন ও থানায় আসা যাওয়া আছে দুই গ্রামের এমন প্রভাবশালী লোকদের কাছ থেকে যারিনা সম্পর্কে যে রিপোর্ট পাওয়া গেছে তার মুল কথা হলো, যারিনা অত্যন্ত ভালো সতী ৰাধী ও শান্ত মেজাযের মেয়ে।

যারিনার গ্রামের চৌকিদারের বউ স্বচ্ছল বাড়িগুলোতে কাজ করে। একেও আমি গোপনে খবর আদান প্রদানের জন্য লাগিয়ে রেখেছিলাম।

চৌকিদার তার বউ থেকে খবর নিয়ে আসে যে,

আব্বাস নামে যারিনার এক মামত ভাই আছে। তেইশ চব্বিশ বছরের মোটামুটি চেহারার এক ছেলে। ওর মা নেই। দুটি বোন আছে। ওরাই ঘর সামলে রাখে। যারিনাদের ঘরে আব্বাসের বেশ যাতায়াত ছিলো। যারিনার মাও তার ভাইয়ের ছেলে আব্বাসকে একটু বেশিই খাতির যত্ন করতো।

যারিনা অন্য কারো ঘরে যেতো না- চৌকিদার জানালো- ও শুধু ওর মামার বাড়িতেই যেতো। আমার বউ আগেও দেখেছে, যারিনা আব্বাসকে দেখে চমকে উঠতো। ওর সঙ্গে যত কথা বলতো অন্য কারো সঙ্গে এত কথা বলতো না। আব্বাসের বোনরাও যারিনার সঙ্গে বান্ধবীর মতো মিশতো। আমার বউ যারীনা ও আব্বাসকে একই খাটে বসা অবস্থায় দেখেছে।

আমি তখনই চৌকিদারকে তার স্ত্রী ও যারিনার মাকে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিলাম। আমি এটা আদৌ মানতে পারছিলাম না যে, আব্বাস যারিনাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে তার বাড়িতে। এ ক্ষেত্রে ওদের মা বাবা কেউ এ অনুমতি দেবে নাযে, যারিনাকে বিবাহিতা অবস্থায় আব্বাস নিজের বাড়িতে রাখুক।

চৌকিদার সময় মতোই যারিনার মা ও তার বউকে নিয়ে এলো। যারিনার মাকে অন্য ঘরে বসিয়ে চৌকিদারের বউকে অফিস ঘরে বসালাম এবং যারিনা সম্পর্কে যা যা জানে সব জানাতে বললাম।

যারিনা আব্বাস ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে কথা বলতে না- চৌকিদারের বউ বললো- আব্বাসের ঘরে আমার যাতায়াত অনেক দিনের। আব্বাসের বোনদেরকে আমার খুব ভালো লাগে, ওরা আমাকে বেশ খাতির যত্ন করে। এজন্য ওদের ঘরের কাজও করি মন প্রাণ দিয়ে। ওখানে থাকাও হয় বেশি। তাই আব্বাস ও যারিনাকে আমি ওখানে যেভাবে দেখেছি আর কারো তা দেখার কথা নয়।

ওদেরকে আমি খাটের ওপরও বসা দেখেছি কয়েকবার। যারিনা তো এমনি চুপচাপ স্বভাবের ছিলো। কিন্তু আব্বাসকে দেখলেই গোলাপের পাপড়ির মতো ফুটে উঠতো। মুখের ভাষা মধু হয়ে ঝরতো। যারিনা কয়েকবার আমাকে গোপনে- যাতে কেউ না জানে সেভাবে আব্বাসকে ওদের বাসায় পাঠাতেও বলেছে।

বিয়ের পর ওদেরকে এক সঙ্গে দেখেছো তুমি?

যারিনা তো এক মাসের মধ্যে তিন চার বার বাড়িতে এসেছে চৌকিদারের বউ বললো- এর মধ্যে দুবার ওদেরকে এক সঙ্গে দেখেছি। উভয়ের চোখে মুখে তখন স্পষ্ট হতাশার ছাপ ছিলো। একবার তো যারিনার চোখে পানিও দেখেছি।

এই মহিলার কথায় আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, যারিনার প্রেমিক তার মামত ভাই আব্বাস।

পীর সাহেবকেও আমার সন্দেহ হয়- চৌকিদারের স্ত্রী বললো- পীরের খানকায় কি হয় না হয় তা তো আপনি জানেনই। তবে পীর আমার প্রতি খুব মেহেরবান। তিনি একদিন আমাকে লোক মাধ্যমে ডাকিয়ে বললেন, যে কোন ছুতোয় যারিনার শ্বশুর বাড়ি যাও। যারিনার কানে কানে বলল, তোমার স্বামী পীর সাহেবকে দিয়ে তোমাকে তাবিজ করাতে চায়।

কিন্তু পীর সাহেব তা করতে চান না। যে তাবিজ তোমাকে পান করানো হয়েছে সেটা তাবিজ ছিলো না, সাদা কাগজ ছিলো। তাই তুমি যেকোন দিন পীর সাহেবের কাছে চলে যাও, তিনি তোমাকে এমন তাবিজ দেবেন যে, ইকবাল তোমাকে তালাক দিয়ে দেবে। আর তোমার প্রেমিকের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে যাবে……।

খোদার মেহেরবাণীতে আমার আর ওদিকে যেতে হয়নি। যারিনাই দুদিন পর ওদের বাড়িতে বেড়াতে এলো। সুযোগ বুঝে ওকে আমি পীরের পয়গাম দিলাম।

যারিনা সব শুনে বললো,

পীর সাহেবকে বলবে, আপনি এমনিতেই আমার প্রতি অনেক মেহেরবানী করেছেন, আপনি যদি তালাক দেওয়াতে পারেন এবং অন্যের সঙ্গে বিয়েও পরানোর শক্তি রাখেন তাহলে আমাকে ছাড়াই আপনি একাজ করতে পারবেন। যদি আপনি এটা সত্যিই করে দিতে পারেন তাহলে আপনি যা বলবেন এর চেয়ে বেশি নজরানা পাঠিয়ে দেবো আপনার পদ মোবারকে।

আমি পীর সাহেবকে যারিনার জবাব শুনিয়ে দিলাম- চৌকিদারের বউ বলে গেলো। তিনি বললেন, ওকে বলো গিয়ে ওকে ছাড়া এই তদবির সম্ভব নয়। পরদিন সকালে যারিনাকে পীরের দ্বিতীয় পয়গাম শুনিয়ে দিলাম।

আরে আমি যদি এ ধরনের মেয়ে হতাম তাহলে ইকবালের চেয়ে সুপুরুষ আর কে আছে? অথচ ইকবালকেও আমি জবাব দিয়ে দিয়েছি। আমি আর কারো কাছে যেতে পারবো না। এত বোকা নই আমি।

এর কিছু দিন পরই যারিনা লাপাত্তা হয়ে গেলো।

পীর যারিনার কথা শুনে কি বললো?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

পীর সাহেব মাথা দুলিয়ে বলেছিলেন, এসে যাবে।

***

চৌকিদারের স্ত্রীকে ওয়েটিং রোমে পাঠিয়ে দিলাম। একটু একাকি ভাবতে বসলাম। আমার সামনে এখন দুজন মানুষ, পীর ও আব্বাস। আব্বাসের ব্যপারে আমি পরিষ্কার।

সে যারিনাকে তার ঘরে রাখতে পারবে না। আমি চৌকিদারকে ডেকে আব্বাসের ওপর সবসময় নজর রাখতে বললাম। সে যে দিকেই যায় তার যেন পিছু নেয়। গভীর রাতেও যদি আমাকে জানানোর মতো কোন কিছু ঘটে তাহলে যেন আমাকে এসে জাগিয়ে তোলে।

ওর বউকে আবার ডাকলাম ভেতরে। বললাম, তুমি আব্বাসের ঘরের ভেতর নজর রাখবে। আর পীরের কাছেও যেন যাতায়াত অব্যহত রাখে। আর চোখ কান এমনকি নাকের ঘ্রাণ শক্তিও যেন কাজে লাগিয়ে দেখে, ওখানে যারিনার গন্ধ পাওয়া যায় কিনা।

কোন এক দৈব ইশারায় পীরের ওপরই কেন জানি আমার সন্দেহ বাড়ছিলো। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পীরের যে প্রভাব ছিলো সেটা জাদুর চেয়েও তীব্র ছিলো।

এজন্য পীরের আস্তানায় প্রমাণ ছাড়া হানা দেয়া সহজ কাজ ছিলো না।

ঝুলিতে সাক্ষ্য প্রমাণ না নিয়ে পীরের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব ছিলো না। এজন্য আব্বাসের বউ ছাড়াও কয়েকজন গুপ্তচর পীরের আস্তানায় লাগিয়ে দিলাম। আব্বাসের গতিবিধির ওপর চোখ রাখার জন্যও গুপ্তচর নিযুক্ত করলাম।

যারিনার মা একা আসেননি। সঙ্গে তার স্বামীও ছিলো। মা কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে ঢোকেন। চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করেন।

আমার মেয়ের কোন খবর পেলেন ইনস্পেক্টর সাব?

আগে বসুন মা জী!- আমি সান্তনার সুর ফুটিয়ে বললাম- আল্লাহ বড় সাহায্যকারী। কিন্তু আপনি সব ব্যপার খুলে বললে আপনার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে পারবো…….

আমাকে শুধু এতটুকু বলুন, ও কাকে পছন্দ করতা? সে যখন আপনাকে বলেছিলো আমাকে বিয়ে করাবেন না, তারপর এও বলেছিলো, ইকবালের সঙ্গে আমাকে বিয়ে দেবেন না। তখন তো নিশ্চয় আপনি বুঝেছিলেন, ও নিজ পছন্দে বিয়ে করতে চায়।

যারিনার মার ঠোঁট দুটো ফাঁক হলো মাত্র। কিছু বলতে পারলেন না। আমি তার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। তারপর তার মাথাটি এমনভাবে নিচু করলো যেন অচেতন হয়ে ঢলে পড়ছে। সম্মান ও অভিজাত্যবোধ তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। তার মেয়ে অন্য কাউকে পছন্দ করতো এ কথটা বের করতে তার কণ্ঠ চিড়ে যাচ্ছে।

আপনি যে কথাটা বলতে সংকোচ বোধ করেছেন সেটা আমি বলে দিচ্ছি আমি প্রত্যয়ের গলায় বললাম- ও আব্বাসকে পছন্দ করতো………

আব্বাস আপনার ভাই পুত্র না? ……. মুখ খুলুন। আড়াল করবেন না কিছু। আপনার মেয়ে ফিরে পেতে চাইলে আড়াল করবেন কিছুই।

হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। ও আমাকে এও বলেছিলো, আমার বিয়ে আব্বাসের সঙ্গে দিন- কথাটা বলতে পেরে যেন যারিনার মা একটু আরামবোধ করলেন।

তাহলে দিলেন না কেন? আমার মতামত চললে তো যারিনা আব্বাসের ঘরেই যেতো। কিন্তু যারিনার বাবা ওর ঘোর বিরোধী। আমার ভাই সম্পর্কে তার ধারনা খুব উঁচু নয়। বিয়ের আগে তিনি বলেছেন, ইকবালের পরিবার ধনে মানে অনেক বেশি আমির ঘরনার।

তাছাড়া দেখতে শুনতে ইকবাল আব্বাসের চেয়ে অনেক আকর্ষণীয়। তারপরও যারিনার মামাকে বলেছিলাম, যারিনার বাপকে যেভাবেই হোক খুশি করে আব্বাসের জন্য যারিনাকে চেয়ে নাও। কিন্তু আমার ভাই যারিনার বাপকে কিছু বলাটা নিজের জন্য অপমানজনক মনে করতো।

যারিনার মা শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলেন, যারিনা আব্বাসকে শুধু ভালোই বাসতো না, তাকে একটা দিন না দেখলে যেন তার প্রাণের সাড়া পেতো না। কিন্তু অধিকাংশ মানুষেরই পারিবারিক নীতি ব্যক্তি স্বার্থের শৃংখলে এমনভাবে বন্দি যে, নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সন্তানের ইচ্ছাকে গলা টিপে হত্যা করে।

যারিনার মাকে জিজ্ঞেস করলাম, এমনকি হতে পারে যে, ইকবালের কাছ থেকে পালিয়ে যারিনা আব্বাসের কাছে চলে এসেছে। কথাটা যেন তার সহ্য হলো না। দুই কান চেপে ধরলেন। তারপর বুদ্ধিমানের মতো একটা উক্তি করলেন।

যদি ওর স্বামীর ঘর থেকে ও পালাতেই তাহলে তো বিয়ের আগেই আব্বাসের সঙ্গে পালিয়ে যেতো। হায়! আমার মেয়ের ওপর এত বড় জুলুম হলো অথচ আমি কিছুই করতে পারলাম না। আর করারই বা ছিলো কি আমার?

যারিনা আপনাকে মনে হয় বলেছে, ইকবালের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন? ওদের মধ্যে কোন হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল?

হৃদ্যতা? ও যখনই আসতো। কান্না ছাড়া আর কিছু শোনাতো না।

 ওর সঙ্গে ইকবালের এবং ইকবালের সঙ্গে ওর ব্যবহার কেমন এসবও কি আপনাকে জানাইনি যারিনা?

না কখনই বলেনি, তার গলায় চিন্তা ক্লিষ্টতা।

উনাকে বাড়ি পঠিয়ে দিলাম।

***

আজ সারাটা দিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি গেলো। তাই বিছানায় যেতেই গভীর ঘুম। কতক্ষণ পর জানিনা, সজোরে দরজায় কড়াঘাতের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গলো। দরজা খুলে দেখি, যারিনাদের গ্রামের চৌকিদার।

জনাব! ক্ষমা করবেন- হাতজোড় করে বললো- জরুরী একটা খবর এনেছি। আমি গাঁয়ে টহল দিচ্ছিলাম। হঠাৎ কাউকে স্ববেগে দৌড়ে গ্রামের দিকে আসতে দেখলাম। আমি পথের পাশে আড়াল নিয়ে লুকিলে পড়লাম। চাঁদের আলো তখন আবছা মেঘে ঢাকা…….. কিছুই দেখা যায় না।…

তবে মানুষ দেখা যায়। দৌড়াচ্ছিলো কোন এক নারী। ওর হাতে একটি কুড়াল উদ্বত অবস্থায় ধরা ছিলো। আমাকে সে দেখেনি। আমার কাছ ঘেষে দৌড়ে গেলো। চিনতে পারলাম না ওকে।

আমি ওকে অনুসরণ করার জন্য একটি ঘরের পেছনে দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়লাম। আমার ছুটন্ত পায়ের শব্দ মনে হয় শুনে ফেলেছিলো। সে একবার পেছন ফিরে দেখে নিলো। তারপর আবার দৌড়ের গতি তীব্র করে তুললো। আমি এবার এমন জায়গায় গিয়ে ওর ওপর চোখ রাখলাম যেখান থেকে ওকে সহজে দেখা যায়।

নারী মূর্তি আব্বাসের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজায় আওয়াজ দিলো। দরজা খুলে গেলো এবং সে ভেতরে চলে গেলো…….

ও যদি স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে আসতো আমার সন্দেহ হতো না। সে ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়াচ্ছিলো এবং তার হাতে ছিলো একটি কুড়াল।

আমি ঘড়ি দেখলাম। আজো সেই স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে। তখনো এগারটা বাজেনি। কয়েক মিনিট বাকি ছিলো।

থানা থেকে ওদের গাঁ দেড় কি পৌনে দুই মাইল। আমি কোয়ার্টার থেকে রাত পোহালেই থানায় চলে গেলাম। একজন হেড কনেস্টবল ও তিনজন কনেস্টেবল নিয়ে সাইকেল রিক্সায় করে রওয়ানা হয়ে গেলাম। সঙ্গে প্রয়োজনীয় অস্ত্রপাতিতো ছিলোই। মূল সড়ক পথে না গিয়ে গ্রামের ভেতরের সংক্ষিপ্ত পথে এগুলাম। চৌকিদার সাইকেল নিয়ে আসেনি। তাই সে দৌড়ে আসছিলো।

গ্রামের বাইরে থাকতেই সাইকেল ছেড়ে দিলাম। সারা গ্রাম এমন নিথর নিঃশব্দ যেন কোন মৃত্যুপুরীতে ঢুকেছি। আমরা আব্বাসের বাড়ি চিনতাম না। চৌকিদারের জন্য অপেক্ষা করতে হলো। বেচারা দৌড়াতে দৌড়াতে আসায় তার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। সে আমাদেরকে আব্বাসদের বাড়ির সামনে নিয়ে গেলো।

আমি সজোরে দরজায় করাঘাত করলাম। কোন সাড়া পাওয়া গেলো না। দুই কনস্টেবলকে বাড়ির পেছন দিকে পাঠিয়ে দিয়ে আবার করাঘাত করলাম। না, এবারও সারা মিললো না। চৌকিদারকে বললাম, আব্বাসের বাপকে জোরে আওয়াজ দিয়ে বলল, থানার ওসি সাহেব এসেছে, দরজা খোলো। না হয় তোমার ছেলেকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে।

চৌকিদারের আওয়াজ ভেতের পৌঁছতেই দরজা খুলে গেলো। দরজার মুখে এক প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে। চৌকিদার জানালো, এই লোকই আব্বাসের বাবা।

 তোমাদের বাড়িতে যে কুড়াল হাতে একটি মেয়ে এসেছে ওকে হাজির করো- আমি হুকুম করলাম।

লোকটি দাঁড়িয়ে রইলো অথর্বের মতো। পূর্ণবার আমি হুকুম করলাম। লোকটি তখন আমার হাত জড়িয়ে ধরলো।

আপনি ভেতরে আসুন- লোকটি বললো- যে এসেছে সে আমার ভাগ্নি যারিনা। কি করবো না করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আপনি ভেতরে এসে দেখুন।

আমি ভেতরে চলে গেলাম। প্রশস্ত উঠনো আরকজন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে আমি চিনি। তিনি ছিলেন যারিনার বাবা। যারিনার বাবা আমাকে বাড়ির বড় একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে যারিনার মা দাঁড়িয়ে আছেন স্থানুর মতো। আরো তিনজন ছেলে তিনজন মেয়েও দাঁড়িয়ে ছিলো।

ওদের পরিচয় দেয়া হলো, দুজন যারিনার ভাই, অপরজন আব্বাস। ইকবালের মতো সুপুরুষ না হলেও বলবান এক আকর্ষণীয় যুবক আব্বাস। মেয়েদের মধ্যে দুজন আব্বাসের বোন। আর তৃতীয় জন যারিনা। ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখটি। তবুও রূপের বিচ্ছুরণ ইহা সারা ঘরকে স্নিগ্ধ করে রেখেছে।

আমি চৌকিদারকে বললাম, এলাকার সাধারণ প্রহরী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মেম্বারকে নিয়ে এসো। সঙ্গে দুজন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিকেও নিয়ে আসতে বলবে।

কথামতো কাজ করা হলো। চারপাঁচজনের একটা দল আসলে ওদেরকে বড় কামরায় নিয়ে আসা হলো।

আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা কি হারিয়ে যাওয়া মেয়ে যারিনাকে চিনে কিনা। সবাই তাকে চিনে বলে সনাক্ত করলো। আমি মেয়ের উপস্থিতিতে লিখিত রিপোর্টের ব্যবস্থা করে সবাইকে থানায় আসতে বললাম। কারণ, এখানে আমি শুনানির কাজ শুরু করতে চাইলেও সে পরিবেশ ছিলো না।

চৌকিদার যখন মেম্বারকে আনতে গিয়েছিলো, তখন আমি যারিনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। কিন্তু ভয় তাকে এমনভাবে চেপে ধরেছিলো যে, সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই বলতে পারলো না। অবশ্য এই শোচনীয় অবস্থা অন্যদেরও কম নয়। তাই জবানবন্দি শোনার জন্য থানাই উপযুক্ত জায়গা।

থানায় গিয়ে আব্বাস ও যারিনাকে আমার অফিসে বসালাম। যদিও ওদের আলাদা আলাদা জবানবন্দি নেয়া উচিত। কিন্তু মেয়ে যেহেতু এখন উপস্থিত তাই ওদেরকে এক সঙ্গেই বসালাম। যারিনার দিকে আরেকবার লক্ষ্য করলাম। শুধু রূপই নয় অত্যন্ত আকর্ষনীয় দেহ সৌন্দর্যের অধিকারিনী। এমন রূপবতী মেয়ে আমি খুব একটা দেখিনি ইতিপূর্বে।

আব্বাস! মিথ্যা বলবে না- আমি সতর্ক করে দিলাম তবে নরম গলায় তুমি ডাকতি করোনি। চুরি করোনি। পুরুষের মতো কাজ করেছে। এখন ভয় নেই। যা কিছু করেছো তুমি ভালোবাসার গভীর টানে করেছে।

এতটুকু বলে একটু থামলাম। ওকে নিরীক্ষণ করলাম, তারপর আবার শুরু করলাম,

যারিনা বিবাহিত না হলে ওকে ঘর থেকে বের করে নেয়া তেমন অপরাধের কাজ হতো না। আমি তখন রিপোর্ট লিখতাম, প্রাপ্ত বয়স্কা এই মেয়ে। তাই সে নিজ ইচ্ছায় ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেছে। আইনত এই অধিকার তার আছে। কিন্তু ও তো একজনের স্ত্রী। কারো স্ত্রীকে উঠিয়ে নেয়া- অপহরণ করা শক্ত অপরাধ। ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজন ভালো বলেই বলেছে যারিনা অলংকার ও টাকা পয়সা নেয়নি। শুধু ও একলা গিয়েছে।

আব্বাসের চেহারা দেখে মনে হলো নতুন এক আতংক ওকে গ্রাস করছে। কিন্তু যারিনার ভীত মুখে এখন লড়াইয়ের আভাস!

আমাকে ও অপহরণ করেনি- যারিনা বলে উঠলো জোর দিয়ে আমি নিজেই গিয়েছি।

তবুও এটা অপরাধ। তাছাড়া তোমাকে আমরা ওর বাড়ি থেকে আবিষ্কার করেছি।

আপনারা আমার একটু আগে আমি ওদের বাড়িতে ঢুকেছি- ওর সুর ক্রমেই দৃঢ় হয়ে উঠছে।

এতদিন কোথায় ছিলে?

এবার যারিনাকে চিন্তাযুক্ত মনে হলো, কিছু একটা লুকোতে গিয়ে যেন বিপদগ্রস্থ।

আমি যেখানেই ছিলাম, ওর কাছে ছিলাম না- যারিনা বললো।

আব্বাসকে যদি বাঁচাতে চাও তাহলে বলে দাও তুমি কোথায় ছিলে? আমি প্রাথমিক অস্ত্র ব্যবহার করলাম- এটাও মনে রেখো, যে জায়গার কথাই বলবে এটাও প্রমাণ করতে হবে তুমি এতদিন ওখানে ছিলে। মাত্র দুটি পথ খোলা আছে তোমার সামনে। বলে দাও, কোথায় ছিলে। না হয় আব্বাসের জন্য কয়েদখানা বেছে নাও।

***

যারিনার ব্যপারে যা শুনেছিলাম তাই ঠিক মনে হলো। কথা বার্তায় সে খুবই অপ্রতিভ। প্রথম দিকে একটু উত্তেজিত হলেও এখন যেন আরো নিস্তেজ। এছাড়াও মনে হলো ওর মধ্যে সরলতাই বেশি।

তুমি বলছো আমাদের পৌঁছার একটু আগে তুমি ওদের বাড়ি পৌঁছেছে আমি জেরার সুরে বললাম

তাহলে ভীত-আতংকিত হয়ে দৌড়াচ্ছিলে কেন? আর তোমার হাতে কুড়াল ছিলে কেন?

ও কিছু বললো না।

তুমি যদি সে মেয়ে না হও তাহলে আব্বাসকে বলতে হবে সে মেয়ে কে ছিলো যার হাতে উদ্ধত কুড়াল ছিলো?– আমি বললাম।

আব্বাস ও চুপ করে রইলো। আমি ওদেরকে চেপে ধরলাম। জেরার পর জেরা করে নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিলাম। ওরা তো কেউ পেশাদার অপরাধী নয়। তাই ভেঙ্গে পড়তে সময় লাগলো না।

যারিনা তো ঘরের চার দেয়ালের বন্দিনী। ও একেবারে কোনঠাসা হয়ে গেলো। চোখ পানিতে ভরে গেলো এবং ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

এ সময় বাইরে থেকে কোলাহল শোনা গেলো। এক হেড কনস্টেবল দৌড়ে এসে বললো,

স্যার! পীর সাহেব তার ছেলের লাশ নিয়ে এসেছে।

 চমকে উঠার জন্য এর চেয়ে বেশি শোনার প্রয়োজন নেই।

আমি এক কনস্টেবলকে থানার নিয়ম অনুযায়ী আব্বাসদের সামনে দাঁড় করিয়ে বাইরে দৌড়ে গেলাম।

পীর আমার দিকে দৌড়ে আসছিলো। থানার সামনে একটি খাঁটিয়া রাখা, আমার বেটা!- পীর শুধু এতটুকুই বললো হাহাকার করে।

খাঁটিয়ার ওপর লাশ চাদর দিয়ে ঢাকা। মুখটুকু শুধু উন্মুক্ত। আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম। তারপর নাড়ি পরীক্ষা করলাম। অতি ক্ষীণলয়ে শ্বাস নিচ্ছিলো।

এতো জীবিত, তবে জ্ঞান নেই- আমি ঘোষণা করলাম।

যখমি ছিলো তো?- পীর চোখ বড় বড় করে বললো।

আরে কেবলা! আপনার মাথা তো খারাপ হয়নি? ওকে এখনই সোজা হাসপাতাল নিয়ে যান- পীরকে আমি বললাম।

আইন মতে প্রথমে ওর যখম দেখে রিপোর্ট লেখার দায়িত্ব ছিলো আমার। কিন্তু আমি বললাম, ওকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাও, আমি আসছি। শুধু এতটুকু দেখেছি, পীরের ছেলের ঘাড়টি রক্তাক্ত কাপড়ে মুড়ানো।

হাসপাতালে তৎক্ষণাৎ পাঠানোর অর্থ এই নয় যে, ঐ গুণ্ডা ছেলের জন্য আমার দরদ উথলে উঠেছে। আমি শুধু ওর জবানবন্দি নিতে চেয়েছিলাম যে, কে ওকে মেরেছে। তারপর তার মরার খাহেশ হলে মরবে। আমার কিছু এসে যায় না।

আমার আইএসআই জগন্নাথকে তখন হাসপাতাল পাঠিয়ে দিলাম। তাকে দায়িত্ব দেয়া হলো, পীরের ছেলে জ্ঞান ফিরে আসলে ডাক্তারের উপস্থিতিতে তার তাৎক্ষণিক জবানবন্দি নিয়ে নেবে।

যারিনার কেসের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তাই কাউকেও আমি একথা জিজ্ঞেস করিনি যে, পীরের ছেলের এ অবস্থা কি করে হলো? এসব দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছি আইএসআইকে। এই লাইনে তার অভিজ্ঞতাও কম নয়।

আমি আব্বাস ও যারিনার প্রতি মনোযোগ দিলাম। তখন রিপোর্ট লেখক হেড কনস্টেবল এলো।

স্যার! আপনি যে এখানে? সে বললো- এত বড় সঙ্গীন ঘটনা। যখমিকে অনেক দূরের এক ফসলি ক্ষেত থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে। কে জানে, রাত কয়টায় উনি আক্রান্ত হয়েছেন? দেহে তো মনে হয় এক ফোঁটা রক্তও অবশিষ্ট নেই।

আরো দুইদিন ঝরলেও ওর রক্ত খতম হবে না- কঠিন সুরে বললাম আমি- এরা এদের মুরিদের অনেক রক্ত চুষে খেয়েছে। তুমি এক কাজ করো হাসপাতাল চলে যাও। জগন্নাথকে গিয়ে বলো পুরো কেসের তদন্ত যেন সেই শেষ করে আসে। আর তুমি এফ.আই.আর. লিখে ফেলো। জগন্নাথ চলে আসার পর যদি যখমির জ্ঞান ফিরে, আমাকে খবর দেবে। আমি গিয়ে জবানবন্দি নিয়ে নেবো।

হেড কনেষ্ট বলে চলে গেলো।

কি ছোট শাহ মারা গেছেন?- আব্বাস হতভম্ব হয়ে বললো।

এ ধরনের দাগী-পাপী এত তাড়াতাড়ি মরবে না। তুমিও মনে হয় ঐ গদির মুরিদ- আমি বললাম।

হ্যাঁ জনাব! উনার তো হাজার হাজার মুরিদ আছে- আব্বাস বললো।

 যারিনা ওখানকার মুরিদ নয়- আমি যারিনার দিকে কৌতুক চোখে তাকিয়ে বললাম- ঠিক না যারিনা? পীর সাহেব যে তোমাকে ডেকেছিলো, তুমি তো আর যাওনি, না?

মরা মানুষের মতো যারিনার মুখের বর্ণ সাদাটে হয়ে গেলো। চোখ দুটো হয়ে গেলো প্রাণহীন। রূপের যে দীপ্তি এতক্ষণ বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো সেটা এখন ম্লানতর। ভয় হলো- আবার না বেহুশ হয়ে যায়।

যারিনা! আশ্বাসের সুরে বললাম- এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কোথায় গিয়েছিলে বা কে তোমাকে ফুসলিয়ে বা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলো?

যারিনার উত্তর শোনার আগে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলাম- কুড়াল হাতে ঐ মেয়েটি কে ছিলো, যে তোমাদরে বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো? না বললে মনে রেখো, এই মেয়ের গুম হওয়া নিয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। কয়েকজন সাক্ষীর সামনে ওকে তোমাদের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তোমার বাবাকেও আইনত করণীয় হওয়া সত্ত্বেও পাকড়াও করিনি……..

কারণ আমি জানি, যারিনার সঙ্গে তোমার প্রেম-প্রনয় আছে। তোমার কাছে বিয়ে বসার ইচ্ছে ছিলো যারিনার। কিন্তু তা আর হয়নি। যারিনা বিয়ের প্রথম রাতেই ওর স্বামীকে পরিস্কার বলে দিয়েছে, আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নেবো না…..।

তোমাকে আরেকবার বলছি, বিবাহিত এক মেয়েকে তুমি অপহরণ করেছে, সত্য কথা বলতে না চাইলে শাস্তির জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও এই মুহূর্তেই। এই প্রেমের কারণে তোমাকে অনেক খেসারত দিতে হেব……

***

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই যারিনা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো।

সেটা আমি ছিলাম। কুড়াল আমার হাতেই ছিলো। আব্বাস আমাকে অপহরণ করেনি। আমি নিজেই গিয়েছি।

কোথায়! কার কাছে?……… আর গভীর রাতে ওর বাড়িতে কেন গেলে?……….. আমার কথা শোন যারিনা! তোমাকে বা আব্বাসকে শাস্তি দেবোই এই ভেবে আতংকিত হয়ো না। তোমাদেরকে আমি বেকসুর বিদায় করতে পারবো। শুধু সত্য কথা বলো।

জনাব! আব্বাস মিনতি করে বললো- আপনি আমাকে গ্রেপ্তার করুন। ওকে আমিই অপহরণ করেছি। রাতে ও অন্য কোথাও থেকে আসেনি। এত দিন ও আমার কাছেই ছিলো। ওকে আমি বন্দি করে রেখেছিলাম।

আমি রেগে গেলাম আবার হয়রানও হলাম যে, একি বাজে বকছে। দুজন দুই কথা বলছে! আর তাদের প্রতি আমার সহমর্মিতার বিষয়টা উপলব্ধি করছে না।

তোমরা তো জঙ্গলি আছই- আবি বজ্র গম্ভীর কণ্ঠে বললাম- আমাকেও জঙ্গলি ভাবছো। তোমরা আসামী এবং থানায় বসে আছে। এই অনুভূতিটুকুও কি নেই! তুমি এটা কেন ভাবছো না, তোমার বোন দুজনকেও থানায় ডেকে আনা হয়েছে। এটা একটা সম্মানিত পরিবারের জন্য কতটুকু অসম্মান।

তোমার বাপ বোন থেকেও আমি জবানবন্দি নেবো। যারিনার বাপ, মা ভাইও এখানে। তোমরা তো জানো না, থানাওয়ালাদের জিজ্ঞাসাবাদ কত কঠিন হয়ে থাকে। সবার বেইজ্জতি হবে।

আমি আব্বাস ও তার পরিবারের জন্য জান দিয়ে দেবো- মুহূর্তের মধ্যে সাহসের দীপ্ত ছড়িয়ে পড়লো যারিনার কণ্ঠে- আমি আপনাকে সবকিছু খুলে বলছি। আব্বাস আমাকে বাঁচাতে মিথ্যা কলা বলছে। আমি আল্লাহ তাআলাকে ভয় করি। আপনি থানার অফিসার। আমার ব্যক্তিত্ববোধ আপনি আসলে বুঝবেন না।

যে যারিনার ব্যপারে শুনছিলাম কথা বলতে জানে না তার মুখ এখন খৈ ফৌটায় ব্যস্ত হয়ে গেছে। একটু আগে যে মুখটি মরার মতো সাদাটে হয়ে গিয়েছিলো সেটি এখন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।

ওর সৌন্দর্যের ছটায় ঘর আবার আলোকিত হয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিষ্পাপ সাফল্যের কমনীয়তা ফুটে উঠেছে। আমার মনে হলো, এই কান্তিবর্তী মেয়ের পক্ষে বড় ধরনের অপরাধ করা কঠিন কাজ। তাই ওকে অভয় দিয়ে বললাম, যা ঘটেছে এর কানকড়িও যেন বাদ না যায়।

আমি যা করেছি আমার আল্লাহ দেখেছেন- যারিন বললো- আল্লাহর সাহায্যের প্রতি আমার পরম ভরসা আছে। আপনার সামনে মিথ্যা বললে আল্লাহর সামনেও মিথ্যা বলতে পারবো।

পুলিশের সোর্সরা অনেক ভয়ংকর ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে। আর বড় বড় অপরাধীদের ব্যপার তো আছেই। ওদের কাহিনী শুনলে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে এবং ভোলা যায় না তা সহজে। যারিনার ঘটনাও সেরকম। আজো সেই স্মৃতি তাজা। জানিনা যারিনা আমার ওপর কি প্রভাব ফেলে গেছে। ও যে জবানবন্দি দিয়েছে, এখানে শুধু প্রয়োজনীয় অংশটুকু উল্লেখ করা হয়েছে।

যারিনা কথা শুরু করলো এখান থেকে যে, সে আব্বাসকে ভালোবাসতে। এছাড়া অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে কথা বলতো না। চুপচাপ থাকা তার আজম স্বভাব। কারো কোন কথা বা কাজ খারাপ লাগলে, দুঃখ পেলে নিজের বুকেই তা চেপে রাখতো। রাতে মাঝে মধ্যে তার স্লিপিং ওয়ার্ক তথা ঘুমের মধ্যে চলা ফেরার স্বভাব ছিলো।

বিশ পঁচিশ দিন পরপর এমন হতো। ঘরের সবাই সকাল হলে বলতে, গত রাতে সে ঘুমের মধ্যে সারা বাড়ি ও আঙ্গিনায় ঘুরে বেড়িয়েছে।

ইকবালের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সে তার মার কাছে অনুরোধ রেখেছে, কেঁদেছে যে, ইকবালের সঙ্গে যাতে তার বিয়ে না দেয়া হয়। আব্বাসের সঙ্গে যাতে দেয়া হয়। কিন্তু তার বাবা তার স্বপ্নকে গলা টিপে মেরেছে।

আব্বাস আমার সামনেই তো বসা আছে- যারিনা বলে গেলো। আমি ওকে বলে রাখছি, কোন কিছু মিথ্যা হয়ে গেলে আমাকে বাধা দিয়ো…..

আমি এবং সে দুজনে মিলে কুরআন শরীফের ওপর হাত রেখে কসম করি যে, আমরা বিয়ে করবো। ও বলেছিলো, আমি আর কোন মেয়েকে আমার জীবনে স্থান দেবো না। আমি কসম করেছিলাম, আমি কোন পুরষকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবো না।

তারপর তো ইকবালের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে গেলো, কিন্তু পবিত্র কুরআনের প্রতি যে তার তাযীমবোধ ছিলো, তার মধ্যে ভীষণভাবে সেটা অনুতপ্ততা জাগালো। ওর কসম ভেঙ্গে গেছে। তার অনিচ্ছায় হলেও এর শস্তি তো পেতেই হবে।

বাসর ঘরে তাকে বসানোর পর সে কায়মনোবাক্যে আল্লাহকে ডেকেছে। দুআ করেছে–

হে আল্লাহ! আপনার পবিত্র কালামের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার শক্তি দিন।

বাসর ঘরে ইকবাল আসার পর তো সে তার স্বামীকে তার প্রত্যাখ্যানের কথা জানিয়ে দিলো।

যারিনা আমাকে বললো, সে তো এমন সাহসী ও মুখ চোটা ছিলো না যে, একজন সবল যুবককে এ ধরনের কথা বলতে পারবে। সে নিজেই হয়রান হয়ে গেলো ইকবালকে কি করে এমন কথা বলে ফেললো। তারপর তার তখন বিস্ময়ের সীমা রইলো না ইকবাল যখন পেছনে হটে গেলো।

যারিনা আশা করেছিলো, ইকবালের মতো এমন পুরুষ একজন নারীর প্রত্যাখ্যান সইতে পারবে না। তাকে চড় দেবে বা আঘাত করবে এবং জোর করে ওকে বশ মানাতে চেষ্টা করবে। কারণ, যারিনা আগেই জানে, ইকবাল অত্যান্ত সুপুরুষ নির্ভীক পুরুষ। এলাকায় ডাকাবুকা হিসাবে তার বেশ খ্যাতি আছে।

যারিনার মতো আমার বিস্ময়ও কম ছিলো না। আমিও তো একজন পুরুষ। ইকবাল যে আবেগ উদ্দমতা ও তীব্র কামনা নিয়ে বাসর ঘরে গিয়েছিলো, একজনপুরুষই সেটা অনুভব করতে পারে। এটা সবাই তো বুঝতে পারবে, ইকবাল ছিলো গ্রামের কয়েক ক্লাশ পড়ুয়া ছেলে। এরকম ছেলের বউ যখন যারিনার মতো এক সুন্দরী মেয়ে হবে তখন তার অবস্থা- ভাবাবেগ কেমন তীব্রতর হওয়ার কথা?

এক কথায় সে রাতে যে কোন যুবক আদিম পর্বে এসে চরম হিংস্র হয়ে যায়। অথচ ইকবাল যারিনার প্রত্যাখ্যানের জবাবে একেবারে নিভে গেলো। ওর আগুনে যৌবন বরফ হয়ে গেলো। ইকবাল বলেছিলো, যারিনা আমাকে তাবিজ করেছে।

***

যারিনা ইকবালের মতোই হুবহু বর্ণনা দিলো ওদের বাসর রাতের। এই এক মাসের মধ্যে ইকবাল আর যারিনাকে তার স্ত্রী বানানোর সাহস করেনি। বরং তিন চারবার যারিনাকে মিনতি করেছে। কিন্তু যারিনাকে গলাতে পারেনি। তবে ওর সঙ্গে কখনো বিরূপ আচরণ করেনি।

তোমার ইচ্ছেটা কি ছিলো যারিনা?- আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম- তুমি যেভাবে চালাতে চেয়েছে কতদিন চলতো এমন? ইকবাল কত দিন এটা সহ্য করতে?

আমি চেয়েছিলাম ইকবাল অসহ্য হয়ে আমাকে তালাক দিয়ে দেবে। যারিনা বললো- তালাক না দিলে সে আমাকে মারপিট করতো। তখন আমি ওর নামে কাপুরুষের বদনাম ছড়াতাম যে, ও আমাকে মেরে ফেলতে চায়। আর না হয় শেষ পর্যন্ত আমিই আত্মহত্যা করতাম।

যারিনা এরপর শোনালো পীরের কথা। যত অপ্রতিভ আর অমেশুক হোক যারিনা, সে তো নির্বোধ নয়। পীর যখন ওর কাছে আসলো তখনই সে বুঝে ফেলে পীরকে ইকবাল এনেছে। পীর যে যারিনাকে বলেছে, তোমার চোখ ভয়ংকর ছায়া দেখা যাচ্ছে যারিনা এতে মোটেও ভয় পায়নি। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে মুক্তির জন্য দুআ করতো।

যারিনার শ্বশুড় বাড়িতে পীর দ্বিতীয়বার যখন আসলো, যারিনাকে পৃথক এক কামরায় বসানো হলো। পীর তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার তো তোমার স্বামীকে ভালো লাগে না।

যারিনা পীরের কাছে স্বীকার করলো, হ্যাঁ, ওকে তার ভালো লাগে না। পীর তাকে তাবিজ পান করিয়ে চলে গেলো এবং চৌকিদারের স্ত্রীকে দিয়ে যারিনাকে ডাকালো।

যারিনা পীরের বদ নিয়ত তখনই টের পেয়ে গেলো। পীরের যদি অলৌকিক কোন ক্ষমতা থাকতো তাহলে তো সে কবেই ইকবালের শুধু স্ত্রীই নয় দাসী বানিয়ে ফেলতো।

শ্বশুর বাড়িতে যারিনা একটা দুশ্চিন্তা আর ঘোরের মধ্যে ছিলো। আরেকটা চাপ ছিলো ইকবাল ওর বিরুদ্ধে কিছুই করছে না। যারিনার কল্পনায় সবসময় আব্বাসই আসতো।

ঘুরে ফিরে আব্বাসের ছবিই বিচরণ করতে যারিনার মনের আঙ্গিনায়। ওখানে এবং নিজের বাড়িতেও ওর এমন কোন সখি বা বান্ধবী ছিলো না যার কাছে মনের কথা বলে হালকা হবে সে। কষ্ট আর হতাশার আগুন ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো।

এই আচ্ছন্নতার মধ্যেই সে একদিন স্বপ্নে দেখলো, অনেক দূরে আব্বাস দাঁড়িয়ে আছে। ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওদের মাঝখানে মেঠু সড়ক, নাড়া মুড়ানো যমিন আর বৃক্ষ সাড়ি। ও আব্বাসের কাছে ছুটতে শুরু করলো। আচমকা কোত্থেকে দুই লোক ছুটে এসে ওকে ধরে টেনে হেচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো। আর সে হাত পা ছুঁড়তে লাগলো। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিলো না। এক লোক ওকে কাঁধে তুলে নিলো। আরেকজন ছুড়ি বের করে ওকে প্রাণনাশের হুমকি দিলো।

তারপর যারিনার চোখে আধার নেমে এলো। তারপর আলো আধরি এবং এর কিছুক্ষণ পর ওর চেতনার আলো ফিরে পেলো। ও দেখলো এক লোক তাকে কাঁধে তুলে রেখেছে আরেকজন ছুরি দেখাচ্ছে।

স্বপ্নের ঘোর কাটতেই ও বুঝতে পারলো স্লিপিং ওয়ার্ক হয়েছে তার। ঘুমের মধ্যেই সে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো। সুযোগ পেয়ে ওরা অপহরণ করেছে। সে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো। কিন্তু ধূ ধূ ফসলি মাঠে আর কত দূর আওয়াজ পৌঁছবে।

ওকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দাঁড় করানো হলো। ছুড়ি ওয়ালা ওর গলায় ছুরি ধরে হুমকি দিলো চিৎকার বন্ধ না করলে যবাই করা হবে। যারিনা চিৎকার করেই বললো, হ্যাঁ, আমাকে যবাই করে দাও।

কোন প্রেমিকের কাছে যাচ্ছিলে। আমরা তোমাকে আর এগুতে দেবো না ওদের একজন বললো।

যারিনা কাঁদতে কাঁদতে জানালো, ওর ঘুমের মধ্যে চলাফেরার রোগ আছে, সে অমুকের মেয়ে অমুকের স্ত্রী।

একজন তখন বললো, ঠিক আছে, চলো। তোমাকে তোমাদের বাড়িতে রেখে আসি। একথা বিশ্বাস করে যারিনা একটু পিছিয়ে গিয়ে গায়ের উড়না ঠিক করতে গিয়ে সেটা একটু আলগা করলো। ওমনিই একজন উড়নাটি কেড়ে নিয়ে তার মুখের ভেতর খুঁজে দিলো। তারপর তাকে উঠিয়ে নিলো।

ওদেরকে চিনতে পেরেছিলে?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না, যারিনা বললো- এমনিই তো চাঁদ মেঘে ঢাকা ছিলো, তারপর আবার গুণ্ডা দুজনের মাথা ও চেহারা পাগড়ি দিয়ে ঢাকা ছিলো।

ওকে উল্টো করে কাঁধের ওপর নিয়ে যাচ্ছিলো। এজন্য কোন দিকে যাচ্ছে সেটা যারিনা বুঝতে পারছিলো না। ওরা তাকে এক বাড়িতে নিয়ে গেলো। তখন কারো গলার শব্দ তার কানে পৌঁছলো- শিকার শিকার।

বাড়ির এক কামরায় নিয়ে ওকে খাটের ওপর প্রায় ছুঁড়ে ফেললো। সেখানে টিম টিম করে একটি চেরাগদান জ্বলছিলো। লোক দুটি বাইরে চলে গেলো। এবং বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেলো। ভয়ে যারিনা বেহুশ হয়ে গেলো। কতক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরলো মনে নেই। চোখ খুলতেই দেখলো, সে অন্য আরেকটি খাটের ওপর বসা।

তুমি বলেছিলো, আমার কারামত দেখতে চাও- পীর হাসতে হাসতে বললো- দেখেছো আমার কারামত……. আমার জিনেরা তোমাকে কিভাবে উঠিয়ে এনেছে?

ঘুমের মধ্যে আমি জানি না কোথা চলে গিয়েছিলাম- যারিনা কাঁদতে কাঁদতে পীরের কাছে হাত জোড় করে বললো- আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে ছেড়ে দিন। আমার স্বামী আমাকে জানে মেরে ফেলবে।

পীরের মনে দয়ার উদ্রেক হবে তো দূরের কথা, পীর যারিনার কথায় আরো মজা পেলো। হিংস্র জানোয়ারের মতো আচরণ করলো ওর সঙ্গে। যারিনার আর্তচিৎকার শোনার জন্য কেউ এলো না।

***

পীর যারিনাকে লোভের চূড়ান্ত দেখিয়ে বললো, পীর তাকে এ এলাকার পীর সম্রাজ্ঞী বানাবে। ইকবালকে তালাক দিতে বাধ্য করাবে। তারপর তাকে বিয়ে করবে। কিন্তু যারিনার আর্ত চিৎকার চলতেই থাকে।

দুই দিন পীর ওকে এভাবেই কয়েদ করে রাখে। শুধু একজন পরিচারিকা খাবার দিয়ে যেতো। কামরায় আর কেউ আসতো না।

এক রাতে আবার পীর হানা দিলো। যারিনা তার পায়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলো। কিন্তু সে তখন হিংস্র জানোয়ারের চেয়েও নিকৃষ্ট প্রাণী হয়ে গেছে।

আরো দু তিন রাত এভাবেই কেটে গেলো। এক রাতে কামরায় পীরের ছেলে এসে হাজির হলো। দূর দূরান্তের গ্রামের মেয়েরাও তাকে ভালো করে চেনে। যারিনাও তাকে দেখেছে আগে। তার লম্পটের গল্পও শুনেছে অনেক। তাকে দেখে যারিনা আরো ঘাবড়ে গেলো।

কিন্তু পীরের এই ঠুণ্ডা মার্কা ছেলে যারিনার সঙ্গে বড় নরম- আদুরে গলায় কথা বললো- আমি আজই জেনেছি, আমার বাপ তোমাকে ধরে এনে এখানে কয়েদ করে রেখেছে। তোমাকে যে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবো সেই সুযোগও পাচ্ছিলাম না। আজ এখন সুযোগ পাওয়া গেছে।

এখন কোথায় পীর?- যারিনা জিজ্ঞেস করলো।

এখানেই আছে- পীরের ছেলে বললো- কিন্তু মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে।

ছোট শাহজী!–যারিনার গলা ভেঙ্গে পড়লো মিনতিতে- আমাকে আমার মা বাবার কাছে পৌঁছে দাও। টাকায় তোমার দু হাত ভরে দেব।

আমি কিছুই নেবো না তোমার কাছ থেকে ছোট শাহজী বললো- চলো তোমাকে ভোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।

ছোট শাহ যারিনাকে চোরের মতো পা টিপে টিপে হাবেলি থেকে বের করে আনলো। তার হাতে একটি কুড়াল ছিলো। প্রায় আধা মাইল যাওয়ার পর যারিনা দেখলো ওরা ওদের গ্রামের উল্টো দিকে যাচ্ছে। যারিনা প্রশ্ন তুললো, আমাদের গ্রাম তো ওদিকে। আপনি এদিকে যাচ্ছেন কেন?

ছোট শাহ বললো, ঘোর পথে যাচ্ছি। পথে আমার বাপের লোকজন থাকতে পারে।

অনেক দূর যাওয়ার পরও ছোট শাহ রাস্তা বদলি করলো না। যারিনা বললো, ছোট শাহজী! আমাদের গ্রাম তো দেখি অনেক দূর সরে গেছে।

তোমাকে আমি তোমাদের গ্রামে নিয়ে যাচ্ছি না- ছোট শাহ গাঢ় কণ্ঠে বললো- তোমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে গিয়ে তুমি খুশী হয়ে যাবে। তোমাকে আমি বিয়ের আগে দেখিছি। তখনই ঠিক করি, তোমাকে আমার রানী বানাবো। আমি আমাদের গদির শক্তি প্রয়োগ করতেই তুমি স্বেচ্ছায় আমার হাতে ধরা দিয়েছে। এখন তুমি তোমার ঘরের কথা ভুলে যাও।

যারিনা তার কাহিনী শোনাতে গিয়ে বললো,

আমি প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, নিজেকে নিজে খতম করে দেবো। কিন্তু যে কামরায় আমাকে রাখা হয়েছিলো সেখানে ধারালো কিছুই পেলাম না, যেটা দিয়ে বুক বা পেট চিড়ে আত্মহত্যা করতে পারবো। এরপর ছোট শাহ যখন তার আসল রূপের কথা জানালো তখন আমার ভেতর আর কোন দ্বিধা দ্বন্দ রইলো না। আমি মৃত্যুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিলাম।

ছোট শাহকে শান্ত গলায় বললাম। ঠিক আছে, আমি কোন বাধা দেবো না। আমি আপনার সঙ্গেই থাকবো। কিন্তু আপনি আমায় রাখবেন কোথায়? পীরজী আপনার প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন না?

ছোট শাহ তখন তার বাপকে কয়েকটি অকথ্য গালি দিয়ে বললো,

ওকে আমি সোজা করে ফেলবো। এখন তোমাকে অন্য একটি গ্রামে নিয়ে যাচ্ছি। দুই তিন দিনপর তোমাকে এসে নিয়ে যাবো আমি।

যারিনা আসলে ছোট শাহকে আশ্বস্ত করতে চাইলো, সে এখন তার অনুগত হয়ে গেছে। যারিনার কথায় দারুণ খুশি হলো ছোট শাহ। রতের গাঢ় নির্জনতার মধ্যে ছোট শাহ যারিনাকে নিয়ে হাটছে।

যারিনার কথায় ছোট শাহের ভেতর আবেগ উথালপাতাল করে উঠলো। যারিনাকে মুহূর্তের জন্য জড়িয়ে ধরলো। যারিনাও খুব আনন্দ পাচ্ছে এমন ভান করে ছোট শাহের হাত থেকে কুড়ালটি নিয়ে নিলো। কিছু দুর পর্যন্ত যারিনা প্রেম ভালোবাসার কিছু সংলাপ আওড়িয়ে প্রেমিকের অভিনয় করে গেলো।

এক সময় যারিনা হঠাৎ করে একটু পেছনে সরে এলো। তারপর আর দেরি করলো না। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কুড়াল দিয়ে আঘাত হানলো ছোট শাহের ওপর। কোপটি পড়লো ছোট শাহের কাঁধের কাছে। ছোট শাহ আর্তনাদ করে পেছন দিকে ফিরতে ফিরতে যারিনা আরেকটি কোপ বসালো। এটা লাগলো একেবারে কাঁধের মাঝখানে।

ছোট শাহ এই দুই আঘাতে কাবু হওয়ার মতো লোক ছিলো না। সামান্য টলতে টলতে যারিনাকে ধরতে এগিয়ে এলো। এমন দুঃসাহসিক কাজ যারিনা করতে পারবে কখনো কল্পনাও করেনি।

এজন্য উত্তেজনায় কাঁপছিলো। যখন ছোট শাহকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলো, খুব ভয় পেয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেলো কাঁপুনি। কুড়ালটিও যেন ধরে রাখতে পারছিলো না।

কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে আরেকটি কুড়ালের আঘাত হানলো ছোট শাহের ওপর। কিন্তু কুড়ালের ব্লেডটি উল্টে গিয়েছিলো। তাই বাট তার মাথায় পড়লো হাতুড়ির বাড়ির মতো করে। মাথায় আঘাত পেয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ছোট শাহ। বেহুশ হয়ে পড়ে গেলো।

নিজ গ্রামের পথ যারিনার জানা ছিলো। সেদিকে ছুটতে শুরু করলো। ছোটার সুবিধার জন্য কুড়ালটি ফেলে দিলো। কিন্তু একটু এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে কুড়ালটি উঠিয়ে নিলো। যাতে পথে কোন বদমায়েশ বা চোর ডাকাত ঝামেলা করলে তাকে শায়েস্তা করতে পারে।

যারিনা আমাকে বলেছিলো, মৃত্যুর সঙ্গে সে বন্ধুত্ব করে নিয়েছে। কিন্তু একজন মানুষ মেরে তার যে অবস্থা হলো সেটা সে বর্ণনা করতে পারছিলো না। বলার সময় তার শরীর কাঁপছিলো। ঠিকমতো শব্দও বের হচ্ছিলো না। সে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাচ্ছিলো। কোথায় যাবে কার কাছে যাবে কিছুই ফয়সালা করতে পারছিলো না।

নিজের মা বাবার কাছে? ইকবালের কাছে? আব্বাসের কাছে?

নিজ গ্রামে পৌঁছার পরে ভয় তাকে আরো ভীষণভাবে চেপে ধরলো। সে অবস্থাতেই সে আব্বাসের ঘরে চলে গেলো।

***

রক্তমাখা কুড়াল আর রক্তাক্ত কাপড়ে যারিনাকে দেখে আব্বাসের বাপ, মা বোনরা হতভম্ব হয়ে গেলো। যারিনার মুখ থেকেও কোন কথা বের হচ্ছিলো না। বড় কষ্টে সে যতটা সম্ভব ঘটনা শোনালো।

আব্বাসের বাবা–যারিনার বাবা ও ভাইকে ডেকে নিয়ে এলো। তাদের মাথা ঘুরে গেলো। কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিলো না তারা।

ওরা একটা কাজ করলো। আব্বাসের এক বোনের কাপড় যারিনাকে পরিয়ে দিলো। আর রক্তাক্ত কাপড়টি লুকিয়ে ফেললো। কুড়ালটিরও রক্ত ধুয়ে লুকিয়ে রাখলো। দুশ্চিন্তায় দিশেহারার চরমে পৌঁছে গেলো তাদের অবস্থা। তখনই ওদেরকে দিয়ে পাকড়াও করি আমি।

জনাব! যারিনার কথা শেষ হলে আব্বাস বললো- একটা মেহেরবাণী করুন। রিপোর্ট লিখে দিন, ছোট শাহকে আমি কুড়াল দিয়ে মেরেছি। আমার নামে এ অপরাধ লিখুন যারিনাকে ছেড়ে দিন।

সত্যি বলতে কি, আমিও চক্করেড় পরে গেলাম। ঐ পীর ও তার ঘোট শাহের ওপর তো আমার আগ থেকেই ঘৃণা ছিলো। এ ঘৃণা ক্রোধে রূপান্তরিন হলো। পীরের ছেলে ছোট শাহ মরেছে না জীবিত আছে এ খবরের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি ভেতর ভেতর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। যারিনাকে বাঁচাবো। আর পীরকে নারী অপহরণের দায়ে গ্রেফতার করবো।

যারিনা ও আব্বাসকে অন্য কামরায় বসিয়ে ওদের দুজনের বাপকে ডেকে বললাম,

আপনারা মেয়েদের সবাইকে নিয়ে বাড়ি চলে যান। আর যারিনার রক্তমাখা পোষাকাদি আগুনে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে ফেলুন। আর কুড়ালের বাটটি ভেঙ্গে জালিয়ে দিন। স্টিলের ব্লেডটি পরিত্যক্ত কোথাও পুতে ফেলুন বা কোন কূপের ভেতর ফেলে দিন। তবে কেউ যাতে আপনাদের এ সব কাজ না দেখে বা ঘুনাক্ষরেও জানতে না পারে।

হাসপাতাল থেকে খবর এলো, ছোট শাহ কথা বলার মতো উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। আই.এস.আই.-এর আসারও সময় হয়েছে।

আমি হাসপাতালে চলে গেলাম। ছোট শাহ-এর জ্ঞান পুরোপুরি ফিরেছে। তার সামনে পীর বসে আছে। পীরকে বললাম, আপনি বাইরে গিয়ে বসুন। পীর যেতে রাজী নয়, চোখ গরম করে তাকালাম। কাজ হলো। বাইরে চলে গেলো।

কী খবর ছোট সরকার! পীরের ছেলেকে বললাম- এমন দুঃসাহস কোন হতভাগার! খালি নামটা বলল, ওকে দশ বছরের জেল দেব!

জানি না জনাব! সে বললো, ওরা ছিল তিনজন। দুজন আমার ওপর কুড়াল চালালো। আমি বেহুশ হয়ে গেলাম। আপনি আমার পকেট দেখুন। কিছু পয়সা ছিলো। তাও গায়েব।

বেটা বলছে কি? এমন মোটা দাগের ধোকা দিচ্ছে আমাকে? নাকি মাথায় চোট খাওয়াতে মাথায় গণ্ডগোল হচ্ছে!

কি বলছো ছোট শাহ! হুশ কি পুরো পুরি ফিরছে তোমার?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

হ্যাঁ পুরোপুরি জ্ঞান ফিরেছে। এই যে আপনি থানাদার আর ইনি ডাক্তার সাহেব!

আমি ও ডাক্তার সাহেব এবার তার সঙ্গে গল্পের ভঙ্গিতে হালকা সুরে কথা বলে দেখলাম। না, সত্যিই পুরাপুরি জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু ছোট শাহ একই কথা বলতে লাগলো। তিন হামলাকারী মিলে তাকে কুড়াল দিয়ে মেরেছে।

এর মধ্যে কোন মেয়ে ছিলো না তো?- আমি তার চোখে চোখ রেখে এক টুকরো বাঁকা হাসি উপহার দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

জনাব! কোন মেয়ে ছিলো না, এটা মেয়েদের ব্যপার নয়- বলার সময় তার গলা ঈষৎ কেঁপে গেলো। মুখের ওপর দিয়ে শংকার ছায়া ঘুরে গেলো।

ডাক্তার সাহেব অন্য রোগীর কাছে চলে গিয়েছিলেন। তবুও আমি ছোট শাহের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললাম,

আমি জানি এটা কিসের চক্কর ছিলো। তুমি যদি চাও, তাহলে তুমি যা বলবে রিপোর্টে আমি তাই লিখবো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ পীরের ছেলে খুশি হয়ে উঠলো- হ্যাঁ তাই লিখুন। আমি আমার বেইযযতী চাই না।

সে যা বলতে চায় আমি বুঝে ফেললাম। সে চায় তার বাপ যাতে টের না পায় যে, শিকারকে ছেলে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আর শিকারও শিকার হয়ে গেছে।

আপনি কারো বিরুদ্ধে রিপোর্ট বা মামলা লিখবেন না। আমিও কোর্টে মামলা উঠাতে চাই না- পীর পুত্র বললো।

পীরের সঙ্গে ছেলের ব্যপার নিয়ে কথা বলা জরুরী। পীরকে ভেতরে ডেকে জানালাম, তার ছেলে কি বলছে।

ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো পীর। ছেলে বাপের দিকে মাথা ঘুরিয়ে বড় অকথ্য ভাষায় জবাব দিলো। অপমানে পীরের চেহারা লাল হয়ে উঠলেও পীর কিছু বললো না। ছেলের কাছ থেকে এ ধরনের ব্যবহার পেয়ে পীর অভ্যস্থ।

পীর তো এই ধারনায় খোশ মেজাযে ছিলে যে, আমি আসল ঘটনা জানি না। পীর হয়তো নিশ্চিতভাবেই জানতো, যারিনাকে তার ছেলেই দখল করেছে। আগ থেকেই পিতা পুত্রের মধ্যে খিটমিট লেগেছিল।

এ ঘটনার পর তো সেটা ভীষণ শক্রতার রূপ নিবেই। পীর হাসপাতালেও এসেছে এ কারণে যে, যাতে লোকে বলতে না পারে মরণাপন্ন ছেলেকে দেখতে বাপ এলো না।

আচ্ছা পীরজী! আমি পীরের কাছে জানতে চাইলাম- আপনি কি আপনার ছেলের ওপর হামলার ব্যাপারে মামলা দায়ের করবেন?

আমি কি জানি ও যখম হয়েছে কোথায়?- পীর বললো তাচ্ছিল্য করে আমার পক্ষ থেকে রিপোর্ট করার মতো কিছু নেই।

***

পীর ও তার ছেলে মামলা না করাতে আমি খুশিই হলাম। যারিনা বেঁচে গেলো। কিন্তু এখন বিষয় হলো, যারিনাকে না জড়ালে পীরকেও তার অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়া যায় না। কিন্তু যারিনাকেও জড়ানো যাবে না। পীরকে শাস্তি দিতে হবে। কমপক্ষে মানসিকভাবে পীরকে পঙ্গু করে দিতে হবে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো, প্রথমে যে দুজন যারিনাকে তুলে নিয়েছিলো এবং পীরের হাবেলিতে পৌঁছে দিয়েছিলো তাদেরকে তো যারিনা সনাক্ত করতে পারবে না। আর এটাও প্রমাণ করা যাবে না পীর যারিনাকে বন্দি করে অমানুষিক অত্যাচার করেছে। যারিনাকে তো পাওয়া গেছে অন্য জায়গা থেকে।

পীরকে আমি পৃথকভাবে ডাকলাম।

আমার কথা মন দিয়ে শুনুন পীর সাহেব!- পীরের প্রতি আমার তীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললাম- এসব ঘটনা কি করে ঘটলো তা আমি জানি। আপনার ছেলে আপনার শিকার মারতে গিয়ে নিজেই পটকা খেলো। আপনাকে এজন্য গ্রেপ্তার করে শাস্তিও দিতে পারি।

আপনি এলাকায় নতুন এসেছেন- পীর দাপট দেখাতে চাইলেও তার সুরে স্পষ্ট অনিশ্চয়তা ছিলো আমার ওপর হাত উঠানোর মতো ভুল করবেন না। আপনি যদি আমার লোকজনকে ধরে তাদের কাছ থেকে সাক্ষ্য নিতে চান তাহলে আসলে আপনি লজ্জিত হবেন। বাইরে যে সাক্ষ্য তারা আপনার সামনে দেবে আদালতে গিয়ে সেটা অস্বীকার করে বসবে।

তুমি যা কিছু হওনা কেন আমার সেটা জানা আছে- আমি আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলাম

তোমার মতো বদমায়েশরা ভালো মানুষের মুখোশ পরে একের পর এক অপরাধ করেই চলে। আরো বড় কোন অপরাধের অপেক্ষায় রইলাম আমি। যা দিয়ে তোমাকে যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায়। তখনই তোমাকে ধরবো এবং তোমার আস্তানা উপড়ে ফেলবো। তোমার ভালোর জন্য বলছি, বদমায়েশি কর্মকাণ্ড তোমার বাড়ির চার দেয়ালের ভেতরে থাকতে দাও। তুমি যদি যারিনার বিরুদ্ধে বা তার মা বাবাকে উত্যক্ত করো বা কোন ছুতোয় চড়াও হও; দেখবে, তোমার পীরগিরি উলঙ্গ করে ছাড়বো……

এটা মনে করো না, তোমাকে আমি গ্রেপ্তারি বা শাস্তির হুমকি দিচ্ছি। তোমার ছেলের হাতে তোমাকে খতম করবো। মুরিদরা তোমার লাশ তখন পাবে, যখন তোমার নাপাক দেহ অর্ধেক কুকুর খেয়ে শেষ করে ফেলবে।

পীরের মুখ দেখে মনে হলো, কে যেন তাকে আচ্ছামতো জুতা পেটা করে আলকাতরা মেখে দিয়েছে। আমি আসলে যারিনাকে নিরাপদ রাখতে চাচ্ছিলাম। তাকে এটা জানালাম না যে তার ছেলেকে যারিনা মেরেছে।

যা হোক, পীর শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করলো। আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলো। আগের থানাদারকে যে মাসোহারা দিতে আমি যদি এর চেয়ে বেশি নিতে চাই তাও দিতে প্রস্তুত সে।

ঘুষের কথা বলায় তাকে আমি আরো কিছুক্ষণ শাসিয়ে সাবধান করে দিলাম যে, ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের নোংরা প্রস্তাব নিয়ে না আসে।

পীরের ছেলেকে নিয়ে আমার বড় সমস্যা ছিলো। এখনো সে সুস্থ হয়নি। দুই তিন দিন পর তার সঙ্গে কথা বলবো বলে ঠিক করলাম। থানায় ফিরে এসে আব্বাস ও যারিনাকে জরুরী কিছু কথা বলে ওদেরকে চলে যেতে বললাম। দুজনে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমার মুখের কথা তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না।

আমাদেরকে কি থানায় আসতে হবে আবার?- যারিনা জিজ্ঞেস করলো।

না, আমি তোমাদেরকে বোঝালামটা কি? আর ডাকবো না তোমাদেরকে….

এখন তুমি নিজেই তোমার সিদ্ধান্ত নাও। স্বামীর বাড়িতে যাবে না বাবার বাড়িতে যাবে। এটা একান্তই তোমার ব্যাপার।

দুজন চলে গেলো।

এর দিন তিন পর আমি হাসপাতালে গেলাম। পীরপুত্র সুস্থ হয়ে উঠেছে। পীরকে যেসব কথা বলেছিলাম তাকেও সে কথা বললাম। এটাও বললাম যে, তোমার তো লজ্জা থাকা উচিত, এক মেয়ের হাতে এভাবে মার খেয়েছো তুমি।

আমি এর প্রতিশোধ নেবো- সে গোঁয়ারের মতা বললো।

সাবধান! কণ্ঠ হিংস্র করে বললাম- যারিনা যদি আবার অপহৃত হয় বা তার কোন ক্ষতি হয় কিংবা উড়ো কোন হুমকি দেয়া হয় সোজা তোমাকে গারদে পুড়াবো। তারপর এমন মার মারবো যে, হাত থেকে গোশতগুলো খুলে খুলে আনবো। মোট কথা তুমি বা তোমার কোন লোক ওদের এলাকায় দেখা গেলে তোমার চামড়াই প্রথমে আমি তুলবো। আমি আমার কথা কখনো মাটিতে ফেলি না। মনে রেখো, আমার এলাকার সব গুণ্ডা বদমাশ আমার হাতে রয়েছে।

পীর ও পীরের ছেলের অপরাধ জগত এরপর অনেক ছোট হয়ে যায়।

এর আট দশ দিন পর কেউ একজন আমাকে জানালো, ইকবাল যারিনাকে তালাক দিয়ে দিয়েছে। তবে যারিনা তার আচরণের জন্য ইকবালের কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। আরো মাস পাঁচেক পর আব্বাসের সঙ্গে যারিনার বিয়ে হয়ে যায়। স্পর্শকাতর একটি খুনের মামলার কারণে বিয়ের নিমন্ত্রণে আমি যেতে পারিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *