৬১. কার্ট আর জো

৬১.

কার্ট আর জো সাথে সাথে AS-42-টার আড়ালে সরে এলো। পানির উচ্চতা এখন দুই ফুট। আরো বাড়ছে। ট্যাঙ্কবিধ্বংসী কামানটা বাঁকা হয়ে গিয়েছে। কার্টের ব্রেড়া সাব মেশিন গানটাও দেখা গেল না আশেপাশে।

“আমাদেরকে মেরে ফেলেও আর কোনো লাভ হবে না সাকির।” কার্ট বলল চিৎকার করে। এই জায়গাটা পানিতে ডুবে যাবে পুরোটা একটু পরে। তারপর মাটির ওপরেও পানি উঠতে থাকবে। কারো না কারো চোখে তো পড়বেই। আপনার খেলা শেষ। আপনার সব পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে এবার।”

জবাবে প্রথমেই সাকির হেসে দিলেন। “পানি বন্ধ করার উপায় একটা বের করবই। আর তোরা যা করেছিস সেটও ঠিক করা কোনো ব্যাপার না আমার জন্যে। একটু বাড়তি ঝামেলা হবে এই যা।”

 “মোটেও না। আপনার কম্পিউটার দিয়ে আমি আমার কর্তাদেরকে মেসেজ পাঠিয়েছি। আপনি মাটির ওপর যেতে যেতেই আপনার কীর্তিকাহিনী পুরো দুনিয়ার সামনে ফাস হয়ে যাবে। সবাই জেনে যাবে যে খরার জন্যে আপনিই দায়ী। পিওলা আর আপনার বাকি সব লোক সম্পর্কেও সবাই সব জেনে যাবে। সবাই এটাও জানবে যে আপনি যে বিষটা ব্যবহার করে সবাইকে মরণ ঘুম পাড়াচ্ছেন সেটা আসলে আফ্রিকান কোলা ব্যাঙ থেকে বানানো হয়। পরের বার যখন আপনি কাউকে বলবেন যে আপনি কাউকে মেরে ফেলে আবার জ্যান্ত করতে পারেন, সে নিশ্চিত হাসবে।”

হঠাৎ কয়েকটা গুলি এসে AS-42-টার নিচের অংশে আঘাত করলো।

কার্ট বুঝলো খোঁচাটা একেবারে জায়গামতো লেগেছে।

“বন্দুক হাতের একটা পাগলকে আরো ক্ষেপানো কী ঠিক হচ্ছে?” বলল জো।

“আমাদের মাঝখানে একটা গাড়ি আছে তা ভুলে গিয়েছ? কার্ট বললো।

“উনি তেলের ট্যাঙ্কে গুলি করলে?”

“ভাল কথা বলেছ। ভাগ্য ভালো যে আমরা পানিতে ডুব দিতে পারবো যদি জায়গামতো গুলি লেগেই যায়।”

পানি কার্টের কোমর পর্যন্ত চলে এসেছে। প্রতি মিনিটে প্রায় এক থেকে দুই ইঞ্চি বাড়ছে পানি। কার্ট একবার ভাবলো সাঁতার দেবে কিন্তু একটা জিনিস চোখে পড়ায় মত বদলে ফেলল। ওদের ঠিক উল্টো পাশে একটা লম্বা, চ্যাপ্টা সবুজাভ কিছু একটা নড়তে দেখা যাচ্ছে।”

“নতুন একটা ঝামেলা হাজির।” বলল কার্ট।

জোও দেখেছে জিনিসটা। “গুলি খেয়ে মরবো নাকি কুমিরের পেটে যাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।”

পানি এখন পুরো রুম জুড়েই, আর কুমিরের গর্তে পৌঁছে গিয়েছে।

“আপনি হয়তো ভাবছেন এখান থেকে পালাতে পারবেন, কিন্তু কুমিরগুলোর হাত থেকে বাঁচবেন কীভাবে? চেঁচিয়ে বলল কার্ট।

“ওরা তোদেরকেই খেতে ব্যস্ত থাকবে। আমাকে বিরক্ত করবে না। আমি উঁচু জায়গাতেই আছি।” বললেন সাকির।

 সাকির ভাঙ্গা গাড়িটার একটা ফোকর দিয়ে উঁকি দিল। সাকির একটা পাথরের কফিনের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু একটা তার পায়ের কাছে পড়ে আছে।

আপনার ওখানেও পানি পৌঁছে যাবে একটু পরেই। তার চেয়ে আমি একটা প্রস্তাব দেই ভেবে দেখেন। আপনি আর আপনার লোকেরা ঢোকার সুড়ঙ্গটা দিয়ে চলে যাই আর আমরা এলিভেটরটা দিয়ে ওপরে উঠি। তারপর কোনো শুকনো জায়গায় না হয় আবার আমাদের হিসেবটা চুকিয়ে নেবো।”

 আরো একটা কুমির গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো। ওটার পিছনে আরো দুটো তারপর ভুস করে ডুবে গেল পানিতে। নাস্তা হিসেবে ওদেরকে খুঁজে নিতে ওগুলোর বেশি সময় লাগবে না।

“আমি আরো ভালো একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। তোরা দুজন এক্ষুনি হাত উঁচু করে দাঁড়া আর আমি তোদেরকে সাথে সাথে একেবারে ওপরে পাঠিয়ে দেই।” বললেন সাকির।

“এটা আরো ভালো প্রস্তাব হয় কী করে?” জিজ্ঞেস করল কার্ট।

“কারণ সেটা না হলে আমি এই ইতালিয়ান মহিলার দুই হাঁটুতে দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিয়ে পানিতে ফেলে দেব আর তোরা ওখানেই দাঁড়িয়ে দেখবি।”

“এই জিনিস আবার জিজ্ঞেস করতে হয়?” বলল জো।

কার্ট হতাশ হয়ে মাথা নাড়লো, “এখন অন্তত আমরা জানি যে ও কোথায়।”

ওদিক থেকে রেনাটা চিৎকার করল, “আমাকে শেষমেশ মেরে ফেলবেই। আপনারা পালান। বের হয়ে যান। আমার চেয়ে সত্যটা সবার জানাটা বেশি জরুরি।”

 কার্ট ওর শরীরটা বাঁকিয়ে আবারো সেই ফোকর দিয়ে তাকাল, “উনি একটা কফিনের ওপর দাঁড়ানো। রেনাটা ওনার সামনেই পড়ে আছে। কিন্তু RPG-টা মারা হয়েছে অন্য দিকে থেকে। ওদিকে কাউকে দেখতে পাচ্ছ?”

জো মাথা ঝাঁকালো, “কিংস-এর ওপরে একজনকে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত আর কোনো রকেট নেই। নাহলে কাবাব হয়ে যেতাম এতোক্ষণে।”

 কার্ট জোর দিকে তাকাল। কাটের চোখের ওপরের দিকটা কেটে রক্ত পড়ছে আর বুকের কাছটা চেপে ধরে রেখেছে, “আমাদের হাতে কিছুই করার। নেই।”

“জানি। আমিও সেটাই ভাবছি, আমরা যুদ্ধ করে মরতে পারি, অথবা আত্মসমর্পণ করে মরতে পারি। অথবা এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ডুবে মরতে পারি। যদি না কুমিরের পেটে যাই।” বলতে বলতে জো ব্রেড়া সাব মেশিনগানটা ছুটিয়ে আনলো।

“তার মানে তুমি যুদ্ধ করে মরতে চাও।” বলল কার্ট।

“তুমি কী অন্য কিছু করতে চাচ্ছ নাকি?”

কার্ট মাথা ঝাঁকালো। “আমি আত্মসমর্পণ করতে চাচ্ছি।” চোখ টিপ দিয়ে বলল কার্ট।

জো পুরো হতভম্ব হয়ে শুনে। কিন্তু কার্ট ওর হাতের মধ্যেকার ব্লাক মিস্টের ভয়াল দুটো দেখালো। এক হাতেই সুন্দর এটে গিয়েছে।

“স্ফিংসের ওপরের লোকটাকে মারতে পারবে?” জিজ্ঞেস করল কার্ট।

জো এটা সেটা টানাটানি করে দেখে নিলো ব্রেডাটা ঠিক আছে কি-না। “দশটা গুলি আছে। একটা না একটা তো লাগবেই।

হঠাই একটা গুলি আর চিৎকার শোনা গেলো।” এবার গুলি করেছি মাংসে কিন্তু পরের বার মালাই চাকি মিস হবে না।” চিৎকার করে বললেন সাকির।

দুই হাতের মুঠোয় দুটো ভায়াল লুকিয়ে কার্ট ওর মাথার পিছনে হাত রেখে উঠে দাঁড়ালো।

“ফাস্ট বল করবে। স্নাইডার বা কাৰ্ভ যেন না হয়।” বলল জো।

(বেস বল খেলার পরিভাষা। ফাস্টবল হলো ৯০-১০৬ মি/ঘন্টা বেগে ছোঁড়া বেস বল। স্নাইডার এর চেয়ে আস্তে ছোঁড়া বল আর কার্ড হলো বাঁকানো বল।

কার্ট দাঁত বের করে হাসলো আর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। উঠে দাঁড়ানো মাত্র গুলি খাবে এই আশংকা করছে।

ও সোজা হয়ে সাকিরের চোখের দিকে তাকাল। রেনাটা তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।

“তোর সাথের জন কই?” সাকির চিৎকার দিলেন।

কার্ট জোর দিকে একবার তাকাল, তারপর বলল, “ওর পা ভেঙে গিয়েছে দাঁড়াতে পারবে না।”

“এক পায়েই দাঁড়াতে বল।”

জো মাথা ঝাঁকালো। গুলি করার জন্যে প্রস্তুত ও।

“আপনি বলেন!” বলল কার্ট। তারপর একটা ভায়াল সাকির যে কফিনটার ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেটা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো। কিন্তু ওটা কফিনে লাগলো না। পানিতে পড়ে টুপ করে ডুবে গেল।

সাকির জিনিসটা ছুটে আসতে দেখেই খানিকটা পিছিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ওটা ওনার পর্যন্ত আসলো দেখামাত্র পিস্তল তুলে কার্টের দিকে গুলি করলেন। কার্টও এর মধ্যে অন্য ভায়ালটা ডান হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছে। এবারেরটা ঠিক সাকিরের দুইপায়ের ফাঁকে পাথরের ওপর পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ভেতরে যা ছিল তা সোজা ওপরে উঠে গেল।

সাকির টলতে টলতে পিছিয়ে গেলেন। চোখে ঝাপসা দেখছেন তিনি। কি হয়েছে বুঝতে পারছেন কিন্তু তার আর কিছুই করার নেই। ব্লাক মিষ্ট তাকে গ্রাস করছে। আরো একবার কার্টের দিকে গুলি করলেন কিন্তু সেটার ধাক্কায় নিজেই উল্টো পানিতে পড়ে গেলেন।

জোও তৎক্ষণাৎ মাথা বের করে গাড়িটার পাশে রাইফেলটা বসিয়ে স্ফিংস-এর দিকে গুলি করা শুরু করল। নিস্তব্ধ ঘরটায় ব্রেডার গুলির আওয়াজ কামানের গোলার মতো শোনালো।

প্রথম গুলিটা লাগল না। কিংস-এর ওপরের সৈন্যটা পিছিয়ে আড়ালে চলে গেল। কিন্তু পরের গুলিটা মূর্তিটার মাথাটা উড়িয়ে দিল।

 সৈন্যটা বড় দেরিতে নিজের ভুল বুঝতে পারলো। কিংসটা আসলে প্লাস্টারের তৈরি। তার ওপরে সোনার পাতা আর দামি পাথর রাখা। আর জো যে অস্ত্রটা থেকে গুলি করছে সেটা লোহার পাত পর্যন্ত ভেদ করতে পারে। তাই মূর্তিটার মাথাটা ঠিক কাগজের টুকরোর মতো উড়ে গেল চারপাশে।

পরের গুলিটা তার গায়েই লাগলো আর সে হাঁটুর ওপর পড়ে গেল। পরের গুলিটার ধাক্কায় সে স্ফিংস-এর গা থেকে গড়িয়ে পানিতে পড়ে গেল। তারপর মুখ উপুড় করে ভাসতে লাগল।

.

৬২.

কার্ট চারপাশে তাকিয়ে শোনার চেষ্টা করছে। পুরো ঘরটা জুড়ে পিনপতন নিস্তব্ধতা। গোলাগুলি শেষ। একটু পরেই স্ফিংস-এর কাছে পানিতে আলোড়ন উঠল। কারণ একটা কুমির মৃত সৈন্যদের দেহটা খুঁজে পেয়েছে। ওটাকেই সে এখন টানাটানি শুরু করেছে।

“রেনাটাকে নিয়ে এসো।” জো বলল।

কার্ট অবশ্য এর মধ্যেই এগোতে শুরু করেছে। গাড়ি থেকে একটা গ্যাস মাস্ক তুলে নিয়ে পরেও ফেলেছে।

 অর্ধেকটা জীবন পানিতে কাটানোর পরও কার্ট প্রতিবার অবাক হয়। পানি হাঁটুর ওপর উঠলেই দৌড়াতে এত কষ্ট কেন হয় ভেবে। ও যত সম্ভব দ্রুত সামনে এগিয়ে দেখতে পেল রেনাটা পানিতে ভাসছে। জ্ঞান নেই। ও ওকে টেনে কাঁধের ওপর তুলে একটা পাথরের কফিনের ওপরে উঠে দাঁড়ালো। ওপরে উঠেই ও আসল ঝামেলাটা দেখতে পেল। গর্ত থেকে সব কুমিরই বের হয়ে এসেছে। ওরা এখন খাদ্যের সন্ধানে পুরো সমাধিক্ষেত্রটা চষে বেড়াচ্ছে। চারটা দেখা যাচ্ছে। পানির নিচে আরও থাকতে পারে।

জোও কাত হওয়া গাড়িটার ওপর চড়ে বসেছে। আপাতত নিরাপদ ওরা তবে পানি আরও বাড়ছে। আশেপাশে কোনো কুমির চোখে না পড়ায় কার্ট জো-কে ওর কাছে আসতে ইশারা করল।

জোও একটা গ্যাস মাস্ক পরে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে কাছের কফিনটায় উঠে বসলো। তারপর একটা থেকে আরেকটায় লাফিয়ে লাফিয়ে কার্টের কাছে পৌঁছে গেল। একেবারে মাইনকার চিপায় পড়ে গেলাম দেখছি।”জো বলল।

 কাঁপা কাঁপা হলেও মাস্কের ভেতর দিয়েও কার্ট জোর কণ্ঠের ব্যঙ্গটা টের পেল।

“তাইতো দেখছি।”

সাকির মাত্র চার ফুট পানিতে চিত হয়ে আসছেন। তার পাশেই ভাসছে ব্লক মিস্টের শেষ ভায়ালটা।

“পানিতে খেয়াল রেখো তো।” বলে কার্ট পানিতে নেমে সাকিরের দিকে এগুলো। সাকির আর ভায়াল দুটোই ওর দরকার। সাকিরের মুখ থেকে কথা বের করতে পারলে কাজে দেবে।

ও এক হাতে ভায়ালটা নিয়ে অন্য হাতে সাকিরকে টান দিল। সাকিরকে টেনে আনা লাগছে বলে ওর গতি আরো কমে গেল।

“তাড়াতাড়ি,” জো চিৎকার দিয়ে ব্ৰেডাটা তুলে কার্টের মাথার ওপর দিয়ে গুলি করল।

 কার্ট চেষ্টা করছে কিন্তু পানি ওকে টেনে ধরছে বার বার। দৌড়ানোর চেষ্টা করতেই পা গেল পিছলে। তারপরও হাড়ে পাঁচড়ে কোনো মতে ও একটা কফিনের ধারে পৌঁছেই সেটায় উঠে পড়ল। তারপর সাকিরকেও টান দিল ওপরে তোলার জন্যে।

পর মুহূর্তেই পানির বিশাল একটা ঢেউ আছড়ে পড়ল কফিনটার গায়ে। একটা বারো ফুট লম্বা কুমির এগিয়ে এসে সাকিরের পা কামড়ে ধরলো। তারপর এক টানে কার্টের হাত থেকে ছুটিয়ে সাকিরকে পানির নিচে টেনে নিয়ে গেল।

পানির রঙ প্রথমে লাল হয়ে গেল তারপর বাকি কুমিরগুলোও সেদিকে ধেয়ে আসায় লালের মাঝে ছোপ ছোপ সবুজ দেখা যেতে লাগল। কিন্তু একজন লাশটা নিয়ে সাঁতরে একপাশে চলে গেল। বাকিরাও তাকে ধাওয়া করল।

“শেষমেশ ওনার পরকালের দেবতার সাথে সাক্ষাৎ ঘটতে যাচ্ছে,” বলল জো।

“কেন যেন মনে হচ্ছে সাকিরের কাজ-কর্ম ওসাইরিসের পছন্দ হবে না।” বলল কার্ট।

 “লোকটার এমনটাই পাওনা ছিল, কিন্তু ওনার সাথে সাথে আমাদের প্রতিষেধক পাওয়ার শেষ আশাটা ভেসে গেল।” বলল জো বিষণ্ণ কঠে।

কার্ট উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশটা পরীক্ষা করল। আমরা যদি সতর্ক না হই তাহলে আমাদের অবস্থাও ওনার মতোই হবে। এই জায়গায় থাকলে আর বেশিক্ষণ টিকতে পারবো না। আমি আমাজনের কুমিরদেরকে দেখেছি পাঁচ ফুট লাফ দিয়ে গাছের ডাল থেকে পাখি ধরতে। আর বিশাল বিশাল মহিষ পর্যন্ত ওরা এক টানে পানির কিনার থেকে টেনে নিয়ে যায়।”

জো’ও জানে সে কথা, “ওরা তো এখন খাওয়ায় ব্যস্ত। এখন ভেগে গেলে কেমন হয়?”

“আমি রেনাটাকে নিচ্ছি। তুমি মেশিন গানটা নাও। আমরা সোজা সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে ওসাইরিস প্লান্টে ফিরে যাবো। আমি ভায়ালটা এখানেই ভেঙে রেখে যাচ্ছি। আর তুমি সামনে যা পড়বে সেটাকেই গুলি করবে। আর যত দ্রুত সম্ভব এগোবো আমরা।”

“ঠিক আছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে শেষ কাজটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।” বলল জো।

 কার্ট রেনাটাকে কাঁধে তুলে নিলো আর বাম হাত দিয়ে ওর পা প্যাচিয়ে ধরল। আর ডান হাতে ভায়াল।

“এগুনো যায়।” সামনে থেকে বলল জো।

তারপর নিশ্চিত হওয়ার জন্য সামনের দিকে গুলি ছুড়লো কয়েকটা। তারপর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে সামনে বাড়লো। জো অবশ্য মোটামুটি নিশ্চিত যে সুড়ঙ্গের আধাআধি যাওয়ার আগেই ও জ্যান্ত কুমিরের পেটে যাবে। হঠাৎ বামে কিছু একটা দেখে গুলি করল। জিনিসটা একটা জুতো। তারপর ডানে ঘুরলো কিন্তু কিছু নেই।

কার্টও নেমে ভায়ালের মুখটা খুলে ফেলল। তারপর ভেতরের জিনিস ওদের পিছন দিকে ছড়াতে ছড়াতে এগুলো।

জো আবার গুলি করতেই ও চমকে ফিরে তাকাল। তবে এবার ঠিকই কিছু একটা উল্টো দিকে ছুটে পালালো। কিন্তু ওটা কিছুদূর গিয়েই আবার ঘুরে ওদের দিকে ছুটে এলো।

পিছনে ফিরে দেখে জানোয়ারটা ওদের প্রায় ধরে ফেলেছে। জো! চিৎকার দিল ও।

আবারো ব্রেডার শব্দ পাওয়া গেল। কিন্তু দুটো গুলি করেই ওটা আটকে গেল। কুমিরটা না থেমে কার্টের পায়ে এসে তো দিল।

ধাক্কায় কার্ট উল্টে পড়ে গেল, তবে কুমিরটা ওকে কামড় দেয়নি। ও আবার পানির ওপর মাথা তুলে দেখলো কুমিরটা একটা নিরীহ খেলনার মতোই ভেসে যাচ্ছে একদিকে। তা সেটা কী জো’র গুলি খেয়ে নাকি ব্লাক মিস্টের প্রভাবে সেটা কার্ট-জানে না।

জো দ্রুত বেগে সামনে বাড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পানি ছাড়িয়ে শুকনো জায়গায় উঠে এলো।

 ওরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো সেখানে। আরও কিছুক্ষণ নিতো কিন্তু পানির উচ্চতা বাড়ছেই।

“চলো ফেরা যাক।” বলল কার্ট।

 জো ব্রেডাটা ঠিকঠাক করে আবার সেই ভেতরে ঢোকার সুড়ঙ্গটা ধরে মমি ব্যাঙ আর আনুবিসের রুমটা পেরিয়ে ট্রামের রাস্তাটার কাছে চলে এলো। একটা গাড়ি তখনও আছে। ওরা চড়ে বসলো সেটায়। ফিরে চললো ওসাইরিস প্লান্টে।

পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পৌঁছে দেখে জেনারেটর রুমের দরজাটা হা করে খোলা। ট্রাম থেকে নামতেই ঈজিপশিয়ান মিলিটারির ড্রেস পরা বেশ কয়েকজন লোক ওদেরকে ঘিরে ধরলো। হাতে রাইফেল। জো ওর হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত মাথার ওপর তুলে ধরলো। কার্টও রেনাটাকে কাঁধের ওপর রেখেই হাত ওপরে তুললো।

তীক্ষ্ণ চোখের এক লোক ওদের দিকে এগিয়ে এলো। তার ইউনিফর্মে একটা ঈগল অফ সালাদিন লাগানো। তার মানে সে একজন মেজর।

 লোকটা রেনাটার নিশ্চল দেহটা একবার পর্যবেক্ষণ করল তারপর কার্ট আর জোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কী আমেরিকান?”

কার্ট মাথা ঝাঁকালো।

“জাভালা আর অস্টিন?”

 দুজনেই মাথা ঝাঁকালো এবার।

“আমার সাথে আসুন। জেনারেল ইদো আপনাদের সাথে দেখা করতে চান।”

.

৬৩.

ইদো তার পুরাতন ইউনিফর্মটা পরেছেন আজ। এই দুই বছর পরও ঠিকঠাক হয়েছে সেটা।

“আমরা চলে আসার পর কী আবার আর্মিতে যোগ দিলেন নাকি?” জিজ্ঞেস করল জো।

“দেখানোর জন্যে পরেছি শুধু। আমিই এদেরকে এখানে এনেছি। তাই ভাবলাম ওদের মতো সাজাটাই ভালো।” ব্যাখ্যা করলেন ইদো।

“এখানে ঢুকতে খুব ঝামেলা হয়েছে নাকি?”

“বেশি না। এখানকার বেশিরভাগ লোকই বেসামরিক। তবে সুড়ঙ্গ থেকে বের হওয়া ওসাইরিসের বিশেষ দলটার সাথে কিছুটা গোলাগুলি হয়েছে। তবে সাকির যে ব্যাপারটা হালকাভাবে নেবে না সেটা জানি। আমাদের যেমন মিলিটারি বা সরকারে লোজন আছে, তার আরও বেশি আছে।”

 “সাকিরকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না। কুমিরের বদহজম করা ছাড়া আর কোনো ঝামেলা করার ক্ষমতা আর তার নেই।” বলল জো।

কার্ট বিস্তারিত ব্যাখ্যা করল। কীভাবে সাকির মারা গিয়েছে আর ওরা সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে কি গুপ্ত ধন খুঁজে পেয়েছে সেসব। সেসব অবশ্য আবারো পানিতে তলিয়ে গিয়েছে।

 ইদো পুরোটাই মোহাবিষ্টের মতো শুনলো, “এ এক দারুণ বিজয়।” সবশেষে মস্তব্য করল সে।

“তবে বিজয়টা পুরোপুরি হয়নি।” খালি ভায়ালটা তুলে ধরে বলল কার্ট, “আমরা শুধু বিষটা খুঁজে পেয়েছি। প্রতিষেধকটা পাইনি। তার ওপর হাসানও পালিয়ে গিয়েছে। ও একবার ওসাইরিসের সমর্থকদের কাছে পৌঁছাতে পারলেই রাজনৈতিকভাবে তখন ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে।”

 “হাসান একটা বুড়ো শেয়াল। কতবার যে সে ধরা পড়তে পড়তে পালিয়ে বেঁচেছে তার ইয়ত্তা নেই। তবে এবার সে একটা ছাপ রেখে গিয়েছে। যারা ধরা পড়েছে তাদের ভাষ্যমতে ও নাকি খনির দিকের একটা বের হওয়ার রাস্তা। দিয়ে পালিয়েছে। সাথে ছিল মুখে ব্যান্ডেজ ওয়ালা একটা লোক। নাম নাকি স্করপিয়ন।”

কার্ট আর জো দৃষ্টি বিনিময় করল। “কোথায় গিয়েছে বলতে পারবেন?”

ইদো মাথা নাড়লেন, “না। তবে কয়েকজন পাইলটের কাছ থেকে একটা তথ্য পেয়েছি। আসেন আপনাদের দেখাই।”

উনি ওদের দেওয়ালে ঝোলানো একটা মানচিত্রের কাছে নিয়ে গেলেন। “এই ম্যাপে ওসাইরিস জলাধারগুলো থেকে পানি সরাতে যে পাম্পগুলো ব্যবহার করতো সেগুলো দেখানো আছে। প্রায় ১৯টা প্রাথমিক পাম্প আর ছোট-খাটো আরো কয়েক ডজন পাম্প আছে। যতদূর জানা গিয়েছে যে সবই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে। শুধু একটা বাদে।”

ইদো কায়রোর পশ্চিমে একটা জায়গা দেখালেন। জায়গাটা হোয়াইট ডেজার্ট নামে পরিচিত। আমরা যেসব পাইলটকে আটক করেছি তাদের দেয়া তথ্য মতে ওরা প্রতিদিন এই জায়গাটায় খাবার পানি আর রসদপত্র নিয়ে যায়।”

“তার মানে এটা মানুষেরাই চালায়?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

ইদো মাথা ঝাঁকালেন। “কিন্তু কোন মানুষ পাইলটগুলো বলল ওখানে ওসাইরিসের লোক বাদেও অন্য বেসামরিক লোকজনও আছে। প্রতি তিনদিন অন্তর নাকি এসব বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে প্যাকেট করা বিভিন্ন জিনিস ডেলিভারি নেন।”

ব্রাড গোলনার মারা যাওয়ার আগে ওকে কি বলেছিল তা মনে পড়ল কার্টের।

“তার মানে ওখানেই ওরা প্রতিষেধকটা বানায়। ওটা চেক করে দেখতে হবে।”

“আমার হাতে এতো লোক নেই। পুরো সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন পাওয়ার আগে এটা করা সম্ভব না।” ইদো বললেন।

“আমাদেরকে শুধু একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে দিন।”

“আমার কোনো হেলিকপ্টারও নেই। তবে ছাদের ওপর একটা আছে। ওসাইরিস ইন্টারন্যাশনালেরই হেলিকপ্টার।”

.

৬৪.

রেনাটাকে মেডিকেল টিমের তত্ত্বাবধানে রেখে কার্ট, জো আর ইদো হেলিকপ্টারটায় এসে বসলো। এটার গায়ে ওসাইরিসের ছাপ্পা মারা।

ইদো-ই প্রধান পাইলটের সিটে বসলেন, জো বসলো তার পাশে আর কার্ট পিছনে বসে নিচের চকচকে সাদা বালি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। মাইলকে মাইল শুধু বালি, কোনো জনবসতি নেই। মাঝে মাঝে কিছু উঁচু উঁচু পাথর দেখা যাচ্ছে। তারপরও কেমন অপার সৌন্দর্যে মহিমান্বিত চারপাশ। হঠাৎ মরুভূমিতে দুটো গাড়ি চোখে পড়ল, তবে ভালো করে খেয়াল করতেই বোঝ গেল ও দুটো পরিত্যক্ত।

আর কিছুদূর পরেই লম্বা চিকন পাইপ লাইনটা চোখে পড়ল। ওটা শেষ হয়েছে একটা ধূসর দালানের পাশে। তারপর থেকে বালির নিচে ঢুকে গিয়েছে। যেন একটা সাপ মাটির নিচে ঢুকছে।

 “ঐতো। ওখানেই পাইপ বালির ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছে। কার্ট বলল। ইদো সেদিকে হেলিকপ্টার নামাতে শুরু করলেন। দালানটার পাশে কোনো গাড়ি বা কোনো লোকজনও দেখা গেল না।

“মনে তো হচ্ছে কেউ নেই।” বলল জো।

*এখনই বলা সম্ভব না। ভেতরে বসে আছে কি-না কে জানে।” ইদো জবাব দিলেন।

“একটা হেলিপ্যাড দেখা যাচ্ছে।” বলল কার্ট।

 “এখানেই নামাচ্ছি তাহলে।”

 ইদো কপ্টারটা নামাতেই চারপাশে হালকা ধূলোর ঝড় উঠল।

কার্ট সেই ফাঁকে লাফ দিয়ে নেমে পড়েছে। হাতে একটা AR-15। যদি কেউ আক্রমণ করে বসে সেই লক্ষ্যে। ওর নজর প্রতিটা দরজা আর জানালার দিকে। সুযোগ পাওয়া মাত্র গুলি করবে। কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না।

জো আর ইদোও নামলো পরপরই। কার্ট আঙুল দিয়ে সামনের দিকে দেখালো। একটা ভাঙ্গচুরের আওয়াজ পেয়েছে ও। যেন ওপর থেকে বড় কিছু একটা আছড়ে পড়েছে।

জো আর ইদো ওর কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরে গেল যাতে করে কোনো একজন একবারে ওদের তিনজনকেই গুলি করতে না পারে। সামনে এগিয়ে একটা দরজা খোলা পেল ওরা। ওটা বাতাসে দোল খাচ্ছিলো। আর বারবার বাজুর সাথে বাড়ি খাচ্ছে কিন্তু হুড়কে টেনে দেয়ার কারণে ঠিকমতো লাগতে পারছে না।

ইদো ওটার হাতলের দিকে ইঙ্গিত করে ইশারায় দেখালেন যে উনি ওটাকে খুলে ধরবেন। কার্ট আর জো মাথা ঝাঁকালো।

ইদো দরজাটা টেনে ধরতেই কার্ট আর জো ওদের রাইফেল ঘরটার ভেতরে তাক করে ধরলো। ওদের শক্তিশালী ফ্লাশ লাইটের আলোয় পুরো রুম ভেসে গেল।

“কেউ নেই।” বলল জো।

কার্ট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ভবনের নকশাটা দারুণ। যে কেউ এখানে কাজ করে আরাম পাবে। ছাইরঙ্গা দেয়াল। পাকা মেঝে। তিনটে পাম্প ঘরের ভেতর। সেগুলো থেকে পাইপ বেরিয়ে প্যাঁচ খেয়ে খেয়ে একসাথে এসে মিলেছে। শুধু দূরে পড়ে থাকা একটা জিনিসই এখানকার না বলে মনে হলো, “এটা আবার কি?”

জোও কার্টের ডাক শুনে সেদিকে লাইট তাক করল।

সামনেই একটা ধাতব খাঁচা আর শক্তিশালী একটা কপিফল চোখে পড়ল।

“এটা তো ঐ মাটির নিচের গুহার এলিভেটরটার মতো লাগছে।”

“আমরা ওখান থেকে কমপক্ষে তিরিশ মাইল দূরে। তবে তোমার কথা ঠিক। একই জিনিস।” বলে,

কার্ট চালু করার সুইচটা টিপে দিল, “নিচে নেমে দেখে আসি চলো।”

তিনজনই খাঁচাটায় চড়ে বসলো। জো একটা সুইচ টিপতেই দরজা বন্ধ হয়ে খাঁচাটা নিচের দিকে নামা আরম্ভ করল।

এখানেও প্রায় কয়েকশো ফুট নিচে নেমে এলো ওরা। দরজা খুলতেই চোখে পড়ল আরো অনেক পাম্পওয়ালা আরেকটা রুম।

“এগুলো তো দেখি ওপরেরগুলোর চাইতেও বড়। ওসাইরিসের পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পেরগুলোর মতো।” বললেন ইদো।

এগুলো থেকে পাইপ বেরিয়ে মাটির ভেতর ঢুকে গিয়েছে, এগুলো তো জলাধার থেকে প্রচুর পানি সরিয়ে ফেলছে।”

“কিন্তু তোমার বদান্যতায় এখন তো আবার ফেরত পাঠাচ্ছে।” বলল জো।

ওরা পাম্পগুলো পার হয়ে এগুলো। ল্যাবরেটরিটা খুঁজছে। একটা দরজা দিয়ে ঢুকে ওরা একটা কন্ট্রোল প্যানেল খুঁজে পেল। ডিসপ্লে দেখে বোঝা গেল যে পাম্পগুলো এখনো উল্টো দিকেই পানি পাঠাচ্ছে।

“ওরা পাম্পগুলো আবার ঠিক করে দেয়নি দেখে অবাক হচ্ছি।” বলল জো কার্টও একই কথা ভাবছে। ও কীবোর্ড টিপে কিছু একটা করতে চাইলো কিন্তু স্ক্রিনে একটা পাস ওয়ার্ড চাইলো। ও কয়েকটা উল্টো-পাল্টা সংখ্যা প্রবেশ করালো কিন্তু কাজ হলো না। তারপর আরেকটা মেসেজ বক্স উদয় হলো যেখানে লেখা, “সিস্টেম লক। ওসাইরিসের কমান্ড কী প্রয়োজন।”

 “এটা অনেক দূরের একটা স্টেশন আর পাম্পের দিক বদলানো হয়েছে একেবারে মেইন কন্ট্রোল রুম থেকে। এরা সম্ভবত ওখানকার পাস ওয়ার্ড জানে না, তাই দিক বদলে দিতে পারেনি।”

ওরা রুমের আশপাশটা দেখতে লাগল।

 “এটা দেখো।” বলল জো।

কার্ট ওর দিকে এগুলো। জো আর ইদো একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সমাধিক্ষেত্রের ভেতরের ল্যাবেও ওরা এরকম একটা দরজাই দেখেছিল। পাশেই একটা কীপ্যাড লাল রঙে জ্বলজ্বল করছে।

“এটাই তো খুঁজছি,” বলল কার্ট।

 “কিন্তু ঢুকবো কীভাবে?” জিজ্ঞেস করল জো।

 আমিও সেটাই ভাবছি।” বলে কার্ট গোলনারকে যে পাসওয়ার্ড টিপতে দেখেছিল সেটাই টিপলো।

কীপ্যাডটা এক মুহূর্তের জন্যে কালো হয়ে গেল। তারপর সেখানে ব্রাডগোলনারের নাম দেখা গেল কিন্তু দরজা খুললো না। তারপর আবার কীপ্যাড আবার লাল হয়ে গেল।

“ইস! ভেবেছিলাম কাজ হবে।” বলল জো।

 “গোলনারের নাম আছে কিন্তু সে সম্ভবত এখানে ঢুকতে পারে না।”

কার্টের বলা শেষ না হতেই কীপ্যাড সবুজ হয়ে গেল আর হিস শব্দ তুলে দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। দুজন লোক আর একজন মহিলা বের হয়ে এলো ভেতর থেকে। প্রত্যেকের পরনে ল্যাব কোট। প্রথম লোকটা বেটে, ঘন জ্ব, চশমার ওপর দিয়ে বেরিয়ে আছে।

“ব্রাড?” ইতিউতি তাকিয়ে ডাকলো লোকটা।

 “দুঃখিত! উনি আমাদের সাথে নেই।” বলল কার্ট।

ওরা এবার ওদের দিকে ভালো করে খেয়াল করল। তারপর ইদোর ইউনিফর্মের দিকে খেয়াল হতেই না জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটার উত্তর পেয়ে গেল ….”আপনারা মিলিটারির লোক।”

ইদো বললেন, “আপনারা ভেতরে লুকিয়ে আছেন কেন?”

ওরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগল। তাদের ভীত দৃষ্টি দেখেই বোঝা গেল যে কাজটা করতে তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে। লম্বা জওয়ালা লোকটা মুখ খুললো শেষমেশ,” ওসাইরিসের বিল্ডিংয়ে হামলার খবর পেয়ে এখানকার লোকেরা খুব নার্ভাস হয়ে পড়ে। কি করবে না করবে সেজন্যে বারবার ওখানে ফোন করতে থাকে কিন্তু কোনো জবাব আর আসে না। এরপর হঠাৎ পাম্পগুলো আবার উল্টোদিকে চলা আরম্ভ করে। ওরা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে ঠিক করার কিন্তু কাজ হয়নি। তারপরই রেডিওতে ওরা তল্লাসীর খবর পায়। তখন ওরা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যায়। ওরা ল্যাবটা ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছিল কিন্তু আমরা ভেতরে ঢুকে বসে ছিলাম। আমরা জানি ওরা আমাদেরকে দিয়ে কি করিয়েছে। তাই প্রতিষেধকটা ধ্বংস হোক সেটা আমরা চাইনি।”

 “তার মানে এখানেই ওটা বানান আপনারা?” জিজ্ঞেস করল কার্ট। লোকটা মাথা ঝাঁকালো।

“এটা কাজ করে কীভাবে?”

“কোলা ব্যাঙগুলো থেকে নিতে হয়। লোকটা বলল।

 “ওদের চামড়া থেকে সম্ভবত।” বললো কার্ট।

 “হ্যা! আপনি কীভাবে জানেন?”

‘ব্রাড গোলনার আমাকে বলার চেষ্টা করেছিল। তবে পুরোটা বলার আগেই সাকির তাকে গুলি করে। কিন্তু সেও আপনার মতোই অপরাধবোধে ভুগছিল। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাই আমাদের যা যা জানা দরকার সেসব জানিয়ে দিয়ে যান। উনি বলছিলেন ব্যাঙের চামড়া নাকি কন্টেইনারে করে কোথায় কোথায় পাঠানো হচ্ছিলো।”

 লোকটা মাথা ঝাঁকালো, “যখন ঐ শুকনো চামড়াটা বৃষ্টির পানি পায় তখুনি ওটা থেকে একটা রাসায়নিক পদার্থ বের হয় যেটা ব্যাঙের স্নায়ুতন্ত্রকে আবার জেগে ওঠার জন্যে সংকেত দেয়। ফলে ব্যাঙের শীতনিদ্রা শেষ হয়। তবে মানুষের ওপর কাজ করার জন্য সংকেতটা একটু উন্নত করা লেগেছে। তবে কাজ একই রকম করে।”

“এখন কী পরিমাণ প্রতিষেধক আছে আপনাদের কাছে?”

“প্রচুর।”

“পাঁচ হাজার লোকের জন্য হবে?”

“ল্যাম্পেডুসার জন্যে? আমরা জানি ওখানে কি হয়েছে। হ্যাঁ, পাঁচ হাজার লোকের জন্যেও হয়ে যাবে।” বলল লোকটা।

“আশা করি পাঁচ হাজার একজনের জন্যেও হবে।” বলে কার্ট ইদোর দিকে ফিরলো।

“আপনি কী এদেরকে আর প্রতিষেকধটা আবার কায়রো নিয়ে যেতে পারবেন?

“আমরা কী থেকে যাবো নাকি?” জিজ্ঞেস করল জো।

কার্ট মাথা ঝাঁকালো, “তবে বেশিক্ষণ এখানে একা থাকতে হবে না।”

ইদো বুঝলেন ব্যাপারটা। তারপর থেকে তিনজনের দিকে ফিরে বললেন, “আপনাদের কী প্রতিষেধকটা নেয়ার জন্যে বিশেষ যন্ত্রপাতি কিছু লাগবে?”

“না। কক্ষ তাপমাত্রাতেই প্রতিষেধকটা টিকে থাকতে পারে।”

“তাহলে যত দ্রুত সম্ভব রওনা দেয়াই ভালো,” বললেন ইদো।

লোকগুলো সাথে সাথে প্রাস্টিকের খাঁচাগুলো একটা চাকা লাগানো ট্রেতে তুলতে লাগলো। ওগুলোর মধ্যে প্রতিষেধকের ভায়াল ভরা।

ইদো জো আর কার্টের দিকে ফিরে বললেন, “রেনাটাকে কায়রো পৌঁছা মাত্রই প্রতিষেধক দেয়ার ব্যবস্থা করবো, চিন্তা করবেন না।”

“ধন্যবাদ” বলল কার্ট।

.

কিছুক্ষণ পরেই ইদো প্রতিষেধক, বৈজ্ঞানিক আর আরো প্রতিষেধক তৈরির মালামালসহ হেলিকপ্টারটা নিয়ে উড়াল দিলেন। কার্টের অনুরোধে ইদো আগে হেলিকপ্টারটা দরকারের চাইতে বেশি ওপরে উঠিয়ে তারপরে পূর্বে কায়রোর দিকে রওনা দিলেন।

“তোমার কী মনে হয় হাসান ওটা দেখতে পাবে?” জো জিজ্ঞেস করল।

কার্ট মাথা ঝাঁকালো; আশেপাশের দশ মাইলের মাঝে থাকলে ওর নজর এড়ানোর কথা না। আশা করি তাহলে ও ভাববে যে এখানে আর কেউ নেই।”

“হাসান এখানে আসবে বলে তোমার মনে হয়?”

“তুমি যদি হাসান হতে, আর তোমার শেষ অবলম্বনটা এই বিল্ডিংয়েই থাকতো তাহলে তুমি কী করতে?”

জো কাঁধ ঝাঁকালো, “আমি হলে ছুটি কাটাতে ফ্রান্সে চলে যেতাম। কিন্তু হাসান ছুটি কাটানোর লোক বলে আমার মনে হয় না।”

কার্ট জোর দিয়ে বলল, “ও হাল ছাড়বে না। আর ওর একমাত্র উপায় হলো পাম্পগুলো আবার আগের দিকে চালানো আর খরাটা অব্যাহত রাখা। আর তা যদি করতে পারে তাহলে কিছুটা অন্তত লাভ পাবে। কিন্তু আমাদের দুজনকে ও আশা করবে না মোটেও। এখন চলো ভালো কোথাও লুকানো যাক।”

ওরা আবার এলিভেটরে করে নিচে নেমে জায়গাটা আবার ভালো করে দেখতে লাগল।

“যতবারই ওদের মুখোমুখি হয়েছি ততোবারই একজন লোক আড়াল থেকে বেশ ঝামেলা বাধিয়েছে।”

“স্করপিয়ন।” বলল জো।

“আর হাসান যদি তাকে এখানে নিয়ে আসে, তাহলে বরাবরের মতো এবারও ওকে কোথাও লুকিয়ে থাকতে বলবে।”

“সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা হলো এলিভেটরটা। কিন্তু ওটার চারপাশ ঘেরা থাকায় গুলি করার জন্যে ওর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। সারা রুমেই যেদিকে খুশি গুলি করা যাবে।

কার্ট খাঁচার রডগুলো বেয়ে ওপরে উঠে গেল। তারপর পাথর আর এলিভেটরের মাঝে যে জায়গা সেখানটায় গিয়ে দাঁড়ালো। লুকানোর জন্যে যথেষ্ট জায়গা আছে। এমনকি এলিভেটর ওপরে উঠলেও সমস্যা হবে না। কার্ট পা ভাজ করে একটা জায়গায় বসতে বসতে বলল, “এটা ওপরে পাঠিয়ে দাও। খামাখা ওদেরকে অপেক্ষা করিয়ে রেখে লাভ নেই।”

 জো “আপ” বোমটায় চাপ দিতেই ওটা সোজা ওপরে উঠে গেল। কার্ট আর এলিভেটরের মাঝখানে তখনও এক ফুট দূরত্ব।

“আমি কন্ট্রোল রুমে থাকবে। পাম্প উল্টাতে হলে ওরা ওখানেই প্রথম আসরে।” যেতে যেতে বলল জো।

.

৬৫.

স্করপিয়নই ল্যান্ড রোভারটা চালাচ্ছে। এই মরুভূমি ধরেই ওকে জ্বলন্ত সূর্যের মাঝে হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছিল। প্রায়ই সেদিনের কষ্ট আর যন্ত্রণার কথা মনে পড়ছে ওর। মাঝে মাঝেই দূরে মানুষের মরীচিকা দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই ভূতের মতো হারিয়ে যাচ্ছে।

একটু পরই আবার আমেরিকানগুলোর কথা মনে পড়ল ওর। NUMA’র। লোক দুটো মাত্র ক’দিনেই পুরো সংস্থাটাই গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলা যায়। ও ওদেরকে একটা শিক্ষা অবশ্যই দেবে। এমনকি যদি ওসাইরিস ধ্বংস হয়ে যায় আর হাসানের শেষ চেষ্টাটাও যদি ব্যর্থ হয় তবুও সে ওদেরকে খুঁজে বের করবেই। ওর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ও দরকার হলে।

হাসান চুপচাপ একঘেয়ে বালিয়াড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। পাশের সিটেই ও বসা। মাঝে মাঝেই বাতাস দিচ্ছে আর SUy-টা হালকা বালির আস্তরণে ঢেকে যাচ্ছে। ওপরে গনগনে সূর্য।

পাম্পিং স্টেশনটা চোখে পড়তেই স্করপিয়ন গাড়ি থামিয়ে দিল।

 “কি হল? গাড়ি থামালে কেন?” হাসান জিজ্ঞেস করল।

 “দেখেন।”

হাসান একটা বাইনোকুলার বের করে বিল্ডিংটার দিকে তাকাল। ওর চোখ এখন আর স্করপিয়নের মতো তীক্ষ্ণ নেই। তবে বাইনোকুলারটা দিয়ে ঠিকই গ্যাজেল হেলিকপ্টার চোখে পড়ল।

“ওটা তো আমাদের,” বলল হাসান।

“এখানে কী করছে?”

বাকিরা ওখান থেকে পালিয়ে এখানে চলে এসেছে এমনটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সে গ্লোভ বক্স থেকে একটা রেডিও টেনে নিয়ে ওসাইরিসের ফ্রিকোয়েন্সি ডায়াল করলো। কল করতে যাবে তখনই দেখে ল্যাবের লোকজন একটা ট্রলি নিয়ে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে প্রাস্টিকের বেশ কয়েকটা খাঁচা ওরা হেলিকপ্টারে তুলে দিল।

কাজ শেষ করে চারজনই হেলিকপ্টারে উঠে পড়ল আর হেলিকপ্টার চালু হয়ে গেল। তারপর ওপরে উঠে সোজা পূর্ব দিকে চলে গেল।

ওরা প্রতিষেধকটা নিয়ে গিয়েছে। তবে চলে যে গিয়েছে সেটাই বাঁচোয়া।” বলল হাসান।

“ওরা আবার ফিরে আসবে।” বলল স্করপিয়ন।

“পাম্পগুলো আবার আগের দিকে ফেরাতে আমার মাত্র কয়েক মিনিট লাগবে। আর একবার সেটা করতে পারলে জীবনেও আর ওরা ওটা আর উল্টো দিকে ফেরাতে পারবে না। চালাও এখন।”

স্করপিয়ন আবার গিয়ার ঠেলে রোভারটা চালানো শুরু করল।

মাটির নিচের ঘরটায় কার্ট অপেক্ষা করছে ধৈর্য ধরে। আশেপাশে পাম্পের ধুপধুপ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। জো লুকিয়ে আছে কন্ট্রোল রুমে।

হঠাৎ কার্টের চমক ভেঙে দিয়ে এলিভেটরের খোলটা কাঁপতে আরম্ভ করল। ওপরে তাকিয়ে দেখে এলিভেটরটা নামছে ধীরে ধীরে। এখান থেকে ওটাকে ছোট্ট একটা চতুর্ভুজ মনে হচ্ছে। মাঝামাঝি এসে ওটা একটা লাইট পেরিয়ে এলো, চতুর্ভুজটার একটা পাশ কিছুক্ষণ আলোয় জ্বলজ্বল করল, তারপর আবার অন্ধকার।

কার্ট আরো খানিকটা পিছিয়ে গেল। একটুপরই এলিভেটরটা ওকে পেরিয়ে আরো তিরিশ ফুট নিচে নেমে থামল।

 কার্ট ওর AR-15-টা নামিয়ে রেখে একটা বেরেটা কুঁগ্যার পয়েন্ট ফোরটি ফাইভ তুলে নিয়েছে হাতে।

 টং করে একটা শব্দ হয়ে সামনের দরজাটা খুলে গেলে। দুজন লোক বেরিয়ে এলো। কার্ট সাথে সাথে হাসানকে চিনতে পারলো। অন্যজন সম্ভবত তাহলে স্করপিয়ন। দুজনেই বন্দুক উঁচিয়ে রেখেছে, যেন ঝামেলার আশংকা করছে।

হাসানের হাতে একটা নাক-বোচা পিস্তল, স্করপিয়নের হাতে লম্বা নলের স্নাইপার রাইফেল।

“মনে তো হচ্ছে কেউ নেই,” পিস্তল হোলস্টারে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল হাসান।

“তবে বেশিক্ষণ এরকম থাকবে না।” বললো স্করপিয়ন।

হাসান মাথা ঝাঁকালো, “কোথাও লুকিয়ে অপেক্ষা করো যাতে মিলিটারি বন্ধুরা আবার ফিরে আসলে আটকানো যায়। আমার বেশিক্ষণ লাগবে না।”

করপিয়ন রুমের চারপাশে তাকাল। কার্ট আর জো-এর মতো ও-ও একই সিদ্ধান্তে পৌঁছালো : পুরো রুমটাই একসাথে কভার করার সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো এলিভেটরের খোল। তারপর রাইফেলটা কাঁধে ঝুলিয়ে কার্ট যেখানে ছিল সেখানে উঠে এলো।

কার্ট চাইলে দুজনকেই মেরে ফেলতে পারতো, কিন্তু ওর দুজনকেই জ্যান্ত ধরার ইচ্ছা। কিন্তু তারপরও অন্ধকারে বসে সোজা স্করপিয়নের মাথার দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে।

হাসান সামনে বাড়লো আর স্করপিয়ন কার্টের ঠিক দশ ফুট নিচে অবস্থান নিলো। ওখান থেকে ও কন্ট্রোল রুমের ভেতরটাসহ পুরো রুমটাই দেখতে পাবে। তবে ও একটা বারের জন্যও ওপরে তাকায়নি। তাকালেও অবশ্য কার্টকে দেখতে পেতো না। কারণ মাত্রই হোয়াইট ডেজার্টের চোখ ধাঁধানো বালির মধ্যে গাড়ি চালিয়ে এসে এখন এই অন্ধকারে ওর চোখ এখনো সয়ে আসেনি।

স্করপিয়ন দণ্ডটার ওপর সিধে হয়ে রাইফেলটা কাঁধের ওপর ফেলে বসে থাকল।

হাসান কন্ট্রোল রুমের দরজার সামনে একবার থেমে আবারো আশপাশটা একবার পরীক্ষা করল, তারপর ঢুকে পড়ল ভেতরে। তারপর ভেতরে উধাও হয়ে গেল দৃষ্টি থেকে।

 স্করপিয়ন বসেই থাকল। একজন স্নাইপারের কাজই হলো চুপচাপ স্থির অবস্থায়, ধৈর্য ধরে বসে থাকা। কিন্তু ওর মন স্থির না। বারবার আগের কথা মনে পড়ছে। কণ্ঠস্বর মাথায় ঘুরছে। সাকির তাকে মরুভূমিতে হাঁটার আদেশ করছেন সেটা মনে পড়ছে। অস্টিন নামের আমেরিকানটা ওকে গোজো দ্বীপের সাগরে রাইফেলটা ফেলে দিতে বলছে সেটা মনে পড়েছে। আর একটু হলেই ও গুলি করতে গিয়েছিল তখন। এখন মনে হচ্ছে ওর আসলে কথা না শুনে গুলি করা উচিত ছিল। তখনই মেরে ফেলা উচিত ছিল। বা হ্যাঁগেনের বদলে ওকে মারলেই ভালো হতো। কিন্তু ওকে সে আদেশ দেয়া হয়েছিল না। তবে আগের দুবার বাঁচলেও তৃতীয়বার আর রক্ষা নেই।

চারপাশের নিস্তব্ধতার কারণেই ওর ইন্দ্রিয়গুলো আরো সজাগ হয়ে গিয়েছে। পাম্পের গুনগুন শুনতে ভালোই লাগছে। কিন্তু এতোক্ষণে তো ওটা পাল্টে যাওয়ার কথা। হাসান করছেটা কী?

স্করপিয়ন বেশ কয়েকবার চোখ কচলে আঁধারের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু চোখে অন্ধকারের মাঝেও সবুজ সবুজ ঝলক দেখতে লাগল। মরুভূমির সূর্যের রেশ এখনো কাটেনি। ও মাথা কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। ওর হাসানকে রক্ষা করতে হবে। মন অন্য দিকে গেলে চলবে না।

ও জোর করে সব চিন্তা সরিয়ে কন্ট্রোল রুমের দিকে নজর দিল। অবশেষে ও একটা অবয়বকে দেখতে পেল ভেতর থেকে এগিয়ে এসে কন্ট্রোল রুমের সিটের ওপর বসতে। প্রথমে কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছিলো সব। একটু পর সেটা স্পষ্ট হলো। আরে ওটা তো হাসান না, ওটা অস্টিন।

“সেটা কীভাবে সম্ভব?” ভাবলো স্করপিয়ন।

ও আরো ভালো করে তাকিয়ে রাইফেলটা কাঁধে তুললো।

হঠাৎ বুঝতে পারলো ও সব। হেলিকপ্টারটা দিয়ে অস্টিন আবার ওদেরকে বোকা বানিয়েছে। সে আগেই এসে কন্ট্রোল রুমে লুকিয়ে ছিল। হাসান মনে হয় এতোক্ষণে মরেই গিয়েছে।

স্করপিয়ন শক্ত করে রাইফেলটা চেপে ধরলো। ওর ঠাণ্ডা মাথাটা আজ আর ঠাণ্ডা রাখতে পারছে না। ও রাইফেলটা চোখের সামনে আনলো তারপর সেটা অস্টিনের রুপালি চুলগুলোর ওপর স্থির হতে একটা লম্বা দম ফেলল। তারপর শরীরটা স্থির হতেই ট্রিগার টেনে দিল।

 ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে গুলিটা ছুটে গেল তারপর সোজা সেটা অস্টিনের পিঠে গিয়ে বিধলো আর ও মুখ থুবড়ে চেয়ারের ওপর পড়ে গেল। মারা গিয়েছে সাথে সাথে।

স্করপিয়ন একটা বড় শ্বাস নিয়ে অস্টিনের সঙ্গীর খোঁজ করল চারপাশে। কাছে পিঠেই কোথাও আছে সে ও নিশ্চিত। চোখের সাথে সাথে রাইফেলও ঘুরছে এদিক সেদিক।

হঠাৎ কন্ট্রোল রুমের দরজাটা ধড়াম করে খুলে গেল। কেউ একজন সেদিক দিয়ে একটা চেয়ার ছুঁড়ে মেরেছে। চেয়ারটা পাথুরে মেঝেতে উল্টে-পাল্টে পড়তেই স্করপিয়ন ওর ভুল বুঝতে পারলো। অস্টিন না, ও আসলে হাসানকে গুলি করেছে।

 ও চেয়ার ঠেলে দেয়া লোকটার দিকে বন্দুক তাক করল কিন্তু ততোক্ষণে সে লাফ দিয়ে একপাশে সরে গিয়েছে।

হঠাৎ কেউ একজন ওকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে নিয়ে ফেলল। স্করপিয়ন তাকিয়ে দেখে লোকটা অস্টিন। ও রাইফেলটা তোলার চেষ্টা করল কিন্তু নলটা কোণার দিকের একটা দেয়ালে আটকে গেল। জায়গাটা খুবই হোট। ও তাই সামনে লাফ দিয়ে অস্টিনের পেটে গুতো দিল। তারপর রাইফেলটা ফেলে দিয়ে একটা ছুরি তুলে নিলো।

 স্করপিয়ন মাত্রই হাসানকে গুলি করে মেরেছে আর এখন কোণঠাসা একজনের মতো যুদ্ধ করা লাগছে।

 কার্ট ওর শরীরের কাছ থেকেই হাত না বাড়িয়েই গুলি করল। আর স্করপিয়ন ছুরিটা বাগিয়ে ধরে কার্টকে আঘাত করার চেষ্টা করল।

কার্টের গুলিটা স্করপিয়নের ছুরি ধরা হাতটাতে গিয়ে লাগল। স্করপিয়ন উল্টে পড়ে গেল, আর হাত থেকে ছুরিটা গেল খসে। সুস্থ হাতটা দিয়ে কোনো মতে দণ্ডটা ধরে থাকল ও। ছুরিটা নিচে মাটিতে পড়ে ঝনঝনিয়ে উঠল।

“আত্মসমর্পণ করো।” আদেশ দিল কার্ট।

স্করপিয়ন সে কথায় পাত্তা না দিয়ে পকেট থেকে আরেকটা অস্ত্র বের করল। একটা তিনকোণা ছুরি বসানো নাকল। হাসান ওকে এটা দিয়েছিল উপহার। তিনকোণা আকৃতিটা হচ্ছে পিরামিড আর ফারওদের পুনর্জন্মের ক্ষমতার প্রতীক। ওসাইরিসের প্রত্যেক গুপ্তঘাতককেই এটা দেয়া হয়।

ও ওটা আঙুলের মধ্যে পরে মুঠো করে ফেলল হাত।

 “থামো।” চেঁচিয়ে উঠল কার্ট।

 কিন্তু স্করপিয়ন সামনে ঝাঁপ দিল আর কার্ট আবারো গুলি করল। এবার গুলি লাগলে অন্যপাশের কাঁধে। স্করপিয়ন টালমাটাল হয়ে একপাশে হেলে পড়ল। ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও আরো একবার আঘাত করার চেষ্টা চালালো ও। কার্ট এবার গুলি করল পায়ে।

 তারপরও দাঁতে দাঁত কামড়ে স্করপিয়ন ঝুলে রইল ওখানে। একটা বার শুধু অস্টিনকে ধরতে পারলেই হয়, তারপর দুজনই একসাথে মরতে পারবে।

কার্ট স্করপিয়নের চেহারার একগুয়ে ভাবটা পড়তে পারলো, “কখন হাল ছাড়তে হয় জানা নেই নাকি তোমার?”

দাঁত বের করে হাসলো স্করপিয়ন, “কখনোই না।”

আবার আঘাত করার চেষ্টা করল ও। কার্ট নির্দ্বিধায় গুলি চালালে আবার। এবার অন্য ঊরুটায়। স্করপিয়ন এবার আর ভারসাম্য রাখতে পারলো না। খোলটা থেকে সোজা এলিভেটরের ওপর গিয়ে আছড়ে পড়ল। তারপর সেখান থেকে গড়িয়ে গুহার মেঝেতে পড়ে গেল।

অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে ও মারা গেল।

.

৬৬.

জো আর কার্ট কায়রো পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওসাইরিস ইন্টারন্যাশনালের গোপন কার্যকলাপের সবটাই ফাঁস হয়ে গেল সবার কাছে। ওটার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের একটা ডাটাবেস খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। টাকা-পয়সার লেনদেন, ঘুষ, হুমকি কাদেরকে দেয়া হয়েছে সব আছে। সেই সাথে সব লোকের নাম বা বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীদের নামও আছে ওতে।

ওসাইরিস এর বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকবে তবে এটা আর ব্যক্তিগত থাকবে না, জাতীয়করণ করা হবে। কারণ বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী- ই সন্ত্রাসী।

কার্ট রেনাটাকে নিয়ে বেশ টেনশনে ছিল। ওকে পাওয়া গেল একটা হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরেছে তবে এখনও চেতনা আসেনি পুরোপুরি।

“মনে হলো যেন একটা কুমির স্বপ্নে দেখলাম।” বলল রেনাটা।

“ওটা কোনো স্বপ্ন ছিল না।” বললেন কার্ট। তারপর ও কীভাবে প্রতিষধকটা খুঁজে পেল আর কীভাবে ওটা কাজ করে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলো রেনাটার কাছে। কিছুক্ষণ পর একটা ইতালিয়ান মেডিকেল টীম এসে ওকে নিয়ে গেল। ওরা ওকে আরো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণে রাখার জন্যে ইতালি নিয়ে যাবে।

এরপর ট্রাউট দুজনের সাথে দেখা করল। ফ্রান্সে ওদের কি ঝামেলা হয়েছে তা সবিস্তারে খুলে বলল ওরা।

“গামায় তো ভিয়েনেভের ছবিগুলো ছিঁড়ে ফেলা আরম্ভ করেছিল। কারণ ওর ধারণা ছিল উনি এগুলোর ভেতরেই গোপন জিনিসটা লুকিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম দুটো ছবিতে কিছুই ছিল না। তৃতীয়টা দেখার আগেই স্করপিয়ন নামের একজন ছবিটা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়।” বলল পল।

 “দারুণ কাজ দেখিয়েছ তোমরা। কিন্তু দ্য চ্যাম্পিয়নের ভাষান্তর করা কাগজগুলো ছবির মধ্যে লুকানো বলে মনে হয়েছিল কেন?” জিজ্ঞেস করল কাট।

“আসলে দ্য শ্যাম্পেনকে লেখা ভিয়েনেভের চিঠিগুলো পড়ে মনে হয়েছিল যে ছবির মাঝেই বোধহয় উনি কোনো সূত্র রেখে যাচ্ছেন।”

“চিঠি?”

“হ্যাঁ, ওনার শেষ চিঠিটায়। ওটায় ভিয়েনেভ নেপোলিয়ন ব্লাক মিস্ট হাতে পেলে কি করে বসবেন সে ব্যাপারে নিজের ভয় তুলে ধরেন। “সম্ভবত সত্যটা প্রকাশিত না হওয়াই মঙ্গল। ওটা আপনার কাছে আপনার ঐ ছোট্ট নৌকাটাতেই লুকানো থাক। যে নৌকায় করে আপনি গুইলামে টেল-এ আশ্রয় নিতে ছুটেছিলেন। আমি আর পল যখন ভিয়েনেভের আঁকা ছবিগুলো দেখলাম তখন ওর মধ্যে একটা ছোট্ট সাম্পানের ছবিও ছিল। প্রাণপণে কয়েকজন সেটা বাইছে। আমরা ভেবেছিলাম ওটার ভেতরেই বোধহয় লেখাগুলো লুকানো আছে।” ব্যাখ্যা করল গামায়।

 “কিন্তু ওটা খুলে দেখার আগেই লোকটা আমাদের কাছ থেকে ওটা কেড়ে নেয়।” বলল পল।

“অবশ্য ওটার ভেতর কিছু আছে বলে আমি টের পাইনি। শুধু ভেবেছিলাম যে আছে বোধহয়।” বলল গামায়।

কার্ট কান ওদের দিকে থাকলেও ও আসলে খেয়াল করে কথাগুলো শুনছিল না। ওর মাথায় চলছে অন্য চিন্তা, “চিঠিতে কী লেখা আর একবার বলো তো।”

গামায় আবার বাক্যগুলো বলল, “সম্ভবত সত্যটা প্রকাশিত না হওয়াই মঙ্গল। ওটা আপনার কাছে আপনার ঐ ছোট্ট নৌকাটাতেই লুকানো থাক। যে নৌকায় করে আপনি গুইলামো টেল-এ আশ্রয় নেয়ার জন্যে ছুটছিলেন।”

“আপনার কাছে আপনার ঐ ছোট্ট নৌকাতেই” কার্ট বিড়বিড় করল। হঠাৎই ব্যাপারটা ধরতে পারলো ও, “গামায় তুমি একটা জিনিয়াস।”

“জিনিয়াস? কীভাবে?” জিজ্ঞেস করল গামায়।

“সবভাবেই। তোমরা দ্রুত মাল্টা চলে যাও। ওখানে গিয়ে দ্য চ্যাম্পিয়নের সাথে দেখা করবে। ইটিয়েনকে বলবে উনার পূর্বপুরুষের আঁকা আবুকির উপসাগরে যুদ্ধের ছবিটা দেখাতে। ওটা দেখলেই সব বুঝতে পারবে।” বলল কার্ট।

.

৬৭.

গোজো দ্বীপ, মাল্টা
রাত ৯টা

গামায় আর পল দ্য শ্যাম্পেনদের সাথে দেখা করতে এসেছে। নিকোল এসে ওদের ভেতরে নিয়ে গেলেন।

“কিছু মনে করবেন না। এখনও সব এলোমেলো হয়ে আছে।” বললেন উনি।

ইটিয়েন ওদের সাথে ফায়ার প্লেসের ওখানটায় দেখা করলেন। ওটা অবশ্য এখন নেভানো।

“আপনাদের স্বাগতম। কার্ট অস্টিন আর জো জাভালার বন্ধু মানে আমাদের বন্ধু। তা আপনাদের আগমনের কারণটা কী জানতে পারি?” বললেন ইটিয়েন।

“ও আমাদেরকে একটা ছবি দেখতে বলে দিয়েছে। ওর নাকি খুব পছন্দ হয়েছিল ওটা,” বলল গামায়।

“হা হা! এমিলের আঁকা একটা ছবি।” ইটিয়েন জবাব দিলেন।

“আবুকির উপসাগরের।”

ইটিয়েন ফায়ার প্লেসের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালেন। তার পেছনেই আবুকির উপসাগরের ছবিটা দেখা গেল।

“আমরা কী ছবিটা একটু নামিয়ে দেখতে পারি?” পল জিজ্ঞেস করলেন। ইটিয়েনের চেহারায় ভাজ পড়ল, “কেন?”

“কারণ আমরা ধারণা করছি যে এমিল তার ভাষান্তর করার কাগজপত্র এটার পিছনে লুকিয়ে রেখেছেন। পরে হয়তো ভিয়েনেভকে পাঠাতেন। এটা এমন একটা ছবি যেটা কোনো ফ্রেঞ্চ নাগরিকই নিজের কাছে রাখতে চাইবে না। তাই এটা ওনার কাছে রাখাটাও ছিল নিরাপদ।”

“আমার বিশ্বাস হয় না।” বললেন ইটিয়েন।”

“সত্য না মিথ্য খুঁজে বের করার এই একটাই উপায় আছে।”

খুবই সতর্কতার সাথে ছবিটা ধরে নামানো হলো। তারপর একটা ব্লেড দিয়ে ক্যানভাসের পিছনের অংশটা আলাদা করা হলো। তারপর গামায় সাবধানে ওর হাতটা ঢুকিয়ে দিল ভেতরে। নিচের দিকে হাত নামাতেই আঙুলের মাথায় একটা ভাজ করা কাগজের অস্তিত্ব টের পেল ও। তারপর নখের সাহায্যেই চেপে ধরে হলুদ হয়ে যাওয়া এক টুকরো কাগজ টেনে বের করল। তারপর একটা ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখে অত্যন্ত যত্নের সাথে ভাজ খোলা হলো।

শুরুতেই কিছু হায়ারোগ্লিফিক আঁকা। তার নিচেই ওটার অনুবাদ। ব্লাক মিস্ট, অ্যাঞ্জেলস ব্ৰেথ, মিস্ট অফ লাইফ। কোণায় একটা তারিখও আছে।

 “ফ্ৰিমায়ের চৌদ্দ, মানে ডিসেম্বর ১৮০৫,” বললেন ইটিয়েন। তারপর আবার কাগজটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “এখানেই ছিল….শুরু থেকেই।”

“একশো বছর পার হলেও এমিলের অবদান এখন সবার কাছেই স্বীকৃত হবে বলেই আশা করি। ছবি আঁকার তারিখ আর ভিয়েনেভের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারটাতেই প্রমাণ হবে যে এমিলই সর্বপ্রথম হায়ারোগ্লিফ অনুবাদ করতে সক্ষম হন। আর এই আবিষ্কারটাও পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়েই থাকবে। নেপোলিয়নের বিজ্ঞসভার সবচেয়ে বিদ্বান ব্যক্তি হিসেবেই উনি পরিচিতি পাবেন।” বলল গামায়।

.

৬৮.

রো

গত চব্বিশ ঘন্টা ধরে এক মুহূর্তের জন্যেও আলবার্তো পিওলা টিভির সামনে থেকে নড়েননি। প্রতি মুহূর্তেই কায়রোতে ওসাইরিস পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের নানান খবর প্রচারিত হচ্ছে। ওটার ভেতরটা এখন পুলিশ আর সেনাবাহিনীর লোকজনে গিজগিজ করছে। একটা হেলিকপ্টার থেকে ভিডিও করে দেখানো হচ্ছে যে নদীর একটা জায়গায় পানি প্রবল স্রোত সমেত আবার পাইপে ঢুকে জলাধারগুলোয় ফেরত চলে যাচ্ছে। কমপক্ষে একশো সৈনিক আশে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কিং লট ভরা, জিপ, ট্রাঙ্ক আর সেনাবাহিনীর ট্রাক।

 ল্যাম্পেডুসার দুর্ঘটনা আর উত্তর-আফ্রিকার খরার জন্যে যে ওসাইরিস দায়ী একথা চারদিকে চাউর হয়ে গিয়েছে। সাকির আর হাসান মারা যাওয়ার খবর পেয়ে পিওলা ভেবেছিল ওসাইরিসের সাথে তার সম্পৃক্ততার খবর বোধহয় আর ফাস হবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মনটা কেমন কেমন করছে। তাই ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে পালিয়ে যাবে। দেরাজ খুলে একটা নাইন মিলিমিটার পিস্তল আর কয়েক তাড়া টাকা বের করল। বিশ হাজার ইউরো আছে ওখানে। তারপর ওর সেক্রেটারির ডেস্ক থেকে একটা চাবি নিয়ে নিলেন। ওটা নম্বর প্লেট বিহীন একটা ফিয়াট গাড়ির চাবি। এটা ওনার সেক্রেটারিই চালায়। এই গাড়িতে তাকে কেউ খুঁজবে না।

অফিস থেকে বের হয়ে বারান্দা দিয়ে এগুলেন সামনে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন শান্ত থাকার। সিঁড়ি বেয়ে অর্ধেক নামার পরই সিঁড়ির গোড়ায় কয়েকজন পুলিশ চোখে পড়ল। উনি ঘুরে উল্টোদিকে হাটা আরম্ভ করলেন।

 “সিনর পিওলা, আর আগাবেন না। আপনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে।” একজন চিৎকার করে ডাক দিল।

পিওলা ঘুরেই গুলি করলেন।

পুলিশগুলো ছিটকে দূরে সরে গেল আর পিওলা বারান্দা ধরে দৌড় দিলেন। প্রথমেই যে রুমটা চোখে পড়ল উনি সেখানেই ঢুকে পড়লেন। তারপর রুমের লোকজনকে ধাক্কা মারতে মারতে অন্যপাশের দরজাটার দিকে ছুটলেন। একজন সামনে থেকে সরতে দেরি করায় তাকে ঘুসি মেরে ফেলেই দিলেন। এদিকে পুলিশ এসে পড়েছে পিছু পিছু। সেদিকেও গুলি ছুড়লেন আবার।

পিওলা দরজাটা খুলে হুড়মুড় করে মেইন কনফারেন্স রুমে ঢুকে পড়লেন। “সরো সরো আমার সামনে থেকে।” চিৎকার করে বললেন সবাইকে।

 উদ্যত পিস্তল হাতে তাকে দেখে লোকজন সবাই লোহিত সাগরের মতোই দুই ভাগ হয়ে সরে গেল দুদিকে। শুধু খাটো করে ছাটা লাল চুল আর ছাগুলে দাড়িওয়ালা এক লোক দাঁড়িয়েই থাকল। লোকটা সামনে এগিয়ে পাশে সরে যাওয়ার ভান করে পিওলাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিল।

পিওলার হাতের টাকাগুলো চারপাশে উড়ে গেল। কিন্তু বন্দুকটা তখনও হাতছাড়া হয়নি। আবার উঠে দাঁড়িয়ে গুলি করার জন্য সেটা ওপরে তুললো। কিন্তু তার আগেই সেই একই লোক তার হাতে থাবা দিয়ে ওটা ফেলে দিল।

পিওলা এতোক্ষণে লোকটাকে চিনতে পারলেন : জেমস স্যান্ডেকার, আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট। এক মুহূর্ত পরেই স্যান্ডেকারের ডান মুষ্ঠি তার চোয়াল স্পর্শ করল আর উনি আবার মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন।

 আঘাতটা এতই জোরে ছিল যে পুলিশ আসার আগ পর্যন্ত পিওলা আর নড়তেই পারলেন না। তবে পুলিশ তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় গালাগালির তুবড়ি ছুটিয়ে গেলেন। রুম থেকে বের হওয়ার আগে দেখলেন জেমস স্যাভেকার নিজের হাতের গাট মালিশ করছেন আর মুচকি মুচকি হাসছেন। পিওলা চলে যেতেই স্যান্ডেকার আবার একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। রুমের প্রায় সবাই-ই আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। শুধু স্যান্ডেকারের মুখেই সন্তুষ্টির হাসি।

ওনার সহযোগী টেরি কারুথার্স ওনার হাতে লাগানোর জন্যে এক বালতি বরফ নিয়ে এসেছে।

“ওটার ভেতর যদি শ্যাম্পেনের বোতল না থাকে তাহলে আমার কাছে আনার দরকার নেই।” বললেন স্যাভেকার।

কারুথার্স হতাশ হয়ে বালতিটা নামিয়ে রাখলো, “তা তো আনিনি স্যার।”

স্যাভেকার কাঁধ ঝাঁকালেন, “খুব খারাপ।” তারপর জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে নতুন একটা সিগার বের করে তার জিপ্পো লাইটারটা দিয়ে ধরাতে লাগলেন।

বরাবরের মতোই কারুথার্স বলল, “এখানে সিগারেট খাওয়া নিষেধ স্যার।”

স্যান্ডেকার তার চেয়ারে হেলান দিলেন, “আমি জানি।” তারপর প্রায় নিখুঁত গোলাকার একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বললেন, “আমি জানি।”

.

৬৯

পাম্পগুলো উল্টো চলার ফলে নীল নদ থেকে জলাধারগুলোয় পানির প্রবাহ কয়েকদিনের মধ্যেই এতো বেশি বেড়ে যায় যে ওটা মাটির নিচের প্রস্তর স্তরেও ফাটল ধরে যায়। ফলে কোটি কোটি বছর ধরে আটকে থাকা কয়েক বিলিয়ন গ্যালন পানি বের হয়ে পড়ে। লিবিয়ার শত শত শুকিয়ে যাওয়া লেক, পুকুর, কূপ, পানি সংরক্ষণাগার সব আবার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।

লিবিয়ার গ্রিস্ত পাম্পিং স্টেশনটায় তেলের মতো করে পানি উঠতে শুরু করে। আর আশেপাশের এলাকাটা বৃষ্টিপাতের মতোই ভিজিয়ে দেয়। রেজা দেখতে আসার পর ওটা বন্ধ করা হয়। উনি এখন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন। তারপর উনি বাচ্চা ছেলেদের মতো হৈচৈ করা আরম্ভ করেন। আর পল আর গামায় ট্রাউটকে তা ভিডিও করে করে পাঠান। সাথে আন্তরিক ধন্যবাদ তো আছেই।

পানির সরবরাহ ঠিক হতেই দ্রুত লিবিয়া আবার সহনশীল অবস্থায় ফিরে গেল। ফলে সরকারকে আর পদত্যাগ করতে হয়নি। তবে যারা ক্য করতে চেয়েছিল তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিউনিসিয়া আর আলজেরিয়ার সরকারও দ্রুত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। আর ব্লাক মিস্টের প্রতিষেধক সহজলভ্য হওয়ার পরপর যেসব মন্ত্রীকে তাদের মত বদলাতে বাধ্য করা হয়েছিল তারাও আবার আগের অবস্থানে ফিরে এসে সেসব সরকারকেই সমর্থন দিচ্ছেন।

 মিসরের অবস্থা অবশ্য তুলনামূলক অস্থিতিশীল। নতুন নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব হয়েছে। তাদের ইন্ধনে দাঙ্গা হাঙ্গামা লেগেই আছে। ইদোকে আবারো মিলিটারিতে পুনর্বহাল করে মেজর জেনারেল পদে ভূষিত করা হয়েছে।

 ইতালি থেকে ল্যাম্পেডুসার আক্রান্তরা সবাই চিকিৎসা পেয়ে এখন সুস্থ হয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগই আবার ওখানেই ফিরে গিয়েছে। তবে যারা আর ওখানে না গিয়ে সিসিলিতে থেকে যেতে চেয়েছে তাদেরকে ইতালির নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছে।

ব্লাক মিস্টের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া একজন ব্যক্তিগতভাবে কার্টকে ধন্যবাদ জানাতে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেয়ে গিয়েছে। ওরা তখন ছবির মতো সুন্দর গ্রিক দ্বীপ মাইকোনোমে মাছ ধরে বেড়াচ্ছিলো।

“এরচেয়ে সুন্দর পুরস্কার আর হয় না।” বলল কার্ট।

ওর পরনে কালো রঙের সাঁতারের পোশাক। আর রেনাটা পরেছে লাল রঙের বিকিনি। দুজনেই রোদে পুড়ে বাদামি হয়ে গিয়েছে। বহুদিন পর একটু শান্তিতে সময় কাটাচ্ছে ওরা। কার্টের হাতে একটা বিলে কার্ট-স্যালমন ব্রুই রিজার্ভ শ্যাম্পেনের বোতল।

রেনাটা মাছ ধরা নৌকাটার ওপর ঝোলানো জালের দোলনটায় হেলান দিল। কার্ট এটা ওর জন্যে বসিয়েছে ওখানে। “এত বছর আগে মিসরীয়রা ব্লাক মিস্ট বের করার পদ্ধতি কীভাবে বের করল সেটা ভেবে আজও অবাক লাগে।”

শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দেয়ার ফাঁকে বলল রেনাটা।

“শত শত বছরের পর্যবেক্ষণের ফল। এমিল যে অংশটুকু অনুবাদ করেছিলেন তাতে দেখা যায় যে ওসাইরিসের পুরোহিতরা লক্ষ করেন যে যেসব বাচ্চা কুমির কোলা ব্যাঙ ধরে খাচ্ছে তারা কেমন একটা সম্মোহিত অবস্থায় চলে যাচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বের করেন যে এটা মানুষকেও একইভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তারপর থেকেই তারা অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তাদের মন্দিরের ভেতর ব্যাঙ চাষ শুরু করেন আর তাদের নির্যাস ব্যবহার করে নানান তন্ত্রমন্ত্র দেখানো শুরু করেন। ব্যাখ্যা করল কার্ট।

“কিন্তু তাহলে প্রতিষেধক বের করল কীভাবে?”

এটা অবশ্য পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে ব্যাঙের চামড়া-ই যে আসল জিনিস সেটা ওরা জানতে পেরেছিল। যে এনজাইমটা ব্যাঙগুলোকে জাগিয়ে তুলতে সেগুলোই বাম্পাকারে বা ধোয়ার সাহায্যে প্রবাহিত করা হতো। একবার আক্রান্ত মানুষ সেটা গ্রহণ করলেই আবার তার স্নায়ুতন্ত্র কাজ করা শুরু করতো। তবে যেটুকু জেনেছি, তাতে তাদের পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েক মাস লেগে যেতো।”

 রেনাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “পদ্ধতিটাকে অনেক উন্নত করে দেয়ার জন্যে ওসাইরিসের বিজ্ঞানীদের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত আমার।”

কার্ট মাথা ঝাঁকালো, “ভালো খবর হচ্ছে ওরা এই নির্যাসটার আরো বেশি কীভাবে ব্যবহার করা যায় সে ব্যাপারে গবেষণা করে যাচ্ছেন। দুর্ঘটনায় আঘাত প্রাপ্ত রোগীদেরকে বিভিন্ন ক্ষতিকারক ওষুধ দিয়ে কোমায় পাঠানোর বদলে এটা দিয়ে এখন চেষ্টা করা হচ্ছে। নভোচারীদেরকে দীর্ঘ সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য নাকি এই ওষুধটা ব্যবহারের চিন্তা-ভাবনা চলছে।” বলল কার্ট।

 “ভাবছি সেই প্রাচীন মিসরীয়রা আর কী কী আবিষ্কার করেছিল যা আজও বের করা যায়নি।”

“হুম! ঐ সমাধি ক্ষেত্রটা থেকে পানি সেচে বের করে ফেলা হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখন ভালো করে খুঁজে দেখবেন ওখানে কী কী আছে। আমি নিশ্চিত ওখানে দারুণ দারুণ কিছু জিনিস পাওয়া যাবে।”

রেনাটা আরো একচমক শ্যাম্পেন মুখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর কার্টের গায়ে হেলান দিয়ে বলল, “সাহারিয়ানগুলোর কী হবে? ওগুলো ওখানে গেল কীভাবে তা কী বের করা গিয়েছে?”

কার্ট মাথা ঝাঁকালে আমরা যে সৈন্যটাকে পেয়েছিলাম সে আর আরও ছয়জন এগুলো এক অমাবস্যার রাতে ওগুলো চালিয়ে নিয়ে যায়। ওদের উদ্দেশ্য ছিল রোমেল আর অক্ষ শক্তির সৈন্যরা যখন এদিকে আসবে তখন পিছন থেকে অতর্কিত আক্রমণ করা। কিন্তু রোমেল কায়রো আসার আগেই এল আলামিন থেকে ফিরে চলে যান।

“তাই ওরা খামাখাই অপেক্ষা করতে থাকে।”

 কার্ট মাথা ঝাঁকালো, “এজন্যেই সম্ভবত তারা বেঁচে গিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত। গাড়ির ড্রাইভারেরা ইতালিয়ান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল কিন্তু তাদের সাথে যারা ছিল তারা সবাই ছিল কায়রোতে বসবাস রত ইতালিয় অভিবাসী। ঐ সময়ে কায়রোতে প্রচুর ইতালিয়ান বাস করতো। এমনকি ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীও ছিলেন ইতালিয়। এজন্যেই চিঠিটায় বলা হয়েছিলো যে তারা ধরা পড়লে গুপ্তচর সন্দেহে গুলি করে মারা হবে।” বলল কার্ট।

“আনা-মেরির কোনো খোঁজ পাওয়া গিয়েছে? ওরা নিশ্চয়ই কী হয়েছিল তা জানতে চাইবে?” জিজ্ঞেস করল রেনাটা।

কার্ট ওর শ্যাম্পেনের গ্লাসটা শেষ করে টেবিলে নামিয়ে রাখলো। শান্ত পানিতে নৌকাটাও স্থির দাঁড়িয়ে আছে। “আপনার দেশের ইতিহাস বিদরা ঐ মহিলাসহ বাকি সব সৈন্যেরই আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ করছেন।”

 রেনাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আশা করছি তাকে খুঁজে পাবে। ঐ সৈন্যটা নিজের লোকদের বাড়ি পাঠিয়ে ঠিক কাজই করেছিলেন। মুসোলিনির মতো একজন মানুষের জন্য জীবন দেয়ার কোনো মানে নেই।”

“আমারও একই মত। কারণ ওরা যদি যুদ্ধ করতে বের হতো তাহলে ব্রিটিশদের হাতে একেবারে কচু কাটা হয়ে যেতো।” বলল কার্ট।

রেনাটা কার্টের বাহুতে একটা টোকা দিয়ে বলল, “তা এখন কী করবেন? আমরা কি সারা জীবন এখানেই থাকবো, শ্যাম্পেন খাবো আর সাঁতার কেটে এসে সূর্য স্নান করতে থাকবো?”

কার্ট লাল হয়ে আসা সমুদ্রটার দিকে তাকাল, “না করার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না আমি।”

হঠাৎ ওদের পাশেই জাভালা পানির ওপর ভেসে উঠে পানিতে ডুব দেয়ার যন্ত্রপাতি নৌকার ওপর ছুঁড়ে দিল।

“যত প্রেম সব আজই করে নাও হে। কাল কিন্তু তোমাকেই ডুব দিতে হবে। ফিনিশিয়ান যে যুদ্ধ জাহাজটার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছ সেটা উদ্ধার করা কোনো মানুষের কাজ না।”

“কোনো সমস্যা নেই। তবে শর্ত একটাই। আমার ওয়াইন সেলারের ধারে কাছেও যেতে পারবে না তুমি।” জবাব দিল কার্ট।

“অবশ্যই। তুমি এমন জনের সাথে কথা বলছো যে কোনোদিন ওসব ফোঁস করা পানি ছুঁয়েও দেখেনি।” বলল জো।

“তাহলে আপনি কী খান?” জিজ্ঞেস করল রেনাটা।

জাভালা দাঁত বের করে হাসলো, “প্রিয়তম–আপনি একজন মর্দ লোকের সাথে কথা বলছেন–একজন সত্যিকারের পুরুষ মানুষ—যে কি-না সরাসরি টাকিলা খায় সাথে একটু লবণ আর লেবু হয়তো নেয়, আর খায় সিগার।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *