৯. নির্দেশ অমান্য করতে প্রস্তুত

০৯.

তারিক বিন যিয়াদ এক পর্যায়ে আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশ অমান্য করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর আমীর মুসা বিন নুসাইরের অধীন ছিলেন। ইতিপূর্বে তিনি যখন মুসা বিন নুসাইরের নির্দেশ অমান্য করেছিলেন তখন তিনি কারো অধীন ছিলেন না। তাঁর আমীর মুসা বিন নুসাইর তাকে বললেন, আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশ এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। বার্তাবাহক আবু নসরও তাঁকে বলে দিলেন, আমীরুল মুমিনীনের গোসা থেকে বেঁচে থাকাই বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে।

মুসা বিন নুসাইরের মনে খলীফার নির্দেশ সম্পর্কে সামান্য সন্দেহ সৃষ্টি হলেও তিনি আবু নসরকে এই বলে ফিরিয়ে দিতেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তার পক্ষে দামেস্ক যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। আন্দালুসিয়া তার হাতের মুঠোয়, আর ফ্রান্স তার পদতলে–এই অবস্থায় দামেস্ক গেলে সদ্য বিজিত আন্দালুসিয়া হাত ছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুসা বিন নুসাইর দামেস্ক যাওয়াই সমীচীন মনে করলেন।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ গিবনের রচনা থেকে জানা যায়, মুসা বিন নুসাইরের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী পাইরেন্স থেকে সামনে অগ্রসর হয়ে ফ্রান্সের মধ্যভাগ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। সেসময় ফ্রান্সের বাদশাহ ছিলেন চার্লস মারটিল। মুসলিম বাহিনীর চেয়ে তার সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তারা ছিল অনেক বেশি সুশৃঙ্খল আর আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সুসজ্জিত।

চার্লসের সাথে মুসলিম বাহিনীর যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় মি. গিবন তার কোন বিবরণ দেননি। তিনি এতটুকুই লেখেছেন যে, চার্লস মারটিল ফ্রান্সের মধ্যাঞ্চলের কোন এক এলাকায় মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করে। তখন মুসলিম সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত বিজয় অভিযান সীমাবদ্ধ রাখা সমীচীন মনে করেন এবং পিছু হটে আসেন।

মি. গিবন লেখেন, এই সময় তুর্কিরা জামানের উপর আক্রমণ করে বসে। কিন্তু পোল্যন্ডের বাদশাহ সোবসকি তুর্কিদেরকে জার্মানির সীমান্ত এলাকায় রুখে দেয়। মি. গিবন আরও লেখেন, তুর্কি ও আরবদের এই আক্রমণ যদি সফল হয়ে যেত তাহলে ইউরোপের ধর্ম খ্রিস্টবাদের পরিবর্তে ইসলাম হত।

বাস্তব অবস্থা হল এই যে, খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক যদি মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদকে দামেস্ক ডেকে না পাঠাতেন তাহলে এই দুই সিপাহসালার ফ্রান্স জয় করে তবেই ক্ষান্ত হতেন। মুসা বিন নুসাইর যুদ্ধের ময়দানে যেমন অকুতোভয় নির্ভীক সিপাহসালার ছিলেন, তেমনি রণাঙ্গনের বাইরেও ছিলেন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।

নওয়াব যুলকদর জংবাহাদুর স্বীয় গ্রন্থ ‘খেলাফতে উন্দুলুস’-এ একাধিক অমুসলিম ইতিহাসবিদের বরাত দিয়ে একটি ঘটনা লেখেছেন। এই ঘটনা থেকেও আরবদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।

ঘটনাটি এ্যাশবেলিয়া অবরোধের সময়কার। (পূর্বে এ্যাশবেলিয়া অবরোধের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে।) এ্যাশবেলিয়ার বাহিনী জীবনবাজি রেখে মুসলিম বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছিল। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের সামনে ঠিকতে না পেরে তারা সন্ধির প্রস্তাব দিতে বাধ্য হয়।

অন্য আরেকটি বিবরণে পাওয়া যায় যে, মুসলিম বাহিনী এ্যাশবেলিয়ার শহররক্ষা প্রাচীরের একটি অংশ ভাঙ্গতে সক্ষম হয়। সেই ভাঙ্গা দেয়াল দিয়ে একদল মুসলিম সৈন্য ভিতরে চলে আসে। এদের সকলেই ছিলেন আরব। খ্রিস্টান সৈন্যরা এই আরব সৈন্যদের উপর এমন প্রচণ্ড আক্রমণ করে যে, সকল অরিব সৈন্যই শহীদ হয়ে যান। পরবর্তীতে এখানে এসকল শহীদগণের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এটি শহীদি স্মৃতিসৌধ নামে আজও বিদ্যমান আছে।

বিপুল সংখ্যক মুসলিম সৈন্যের জীবনহানির কারণে মুসা বিন নুসাইর হতাশ হয়ে সন্ধির প্রস্তাব পেশ করেন। শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ মুসা বিন নুসাইরের নিকট আসেন। মুসা বিন নুসাইর মুসলিম বাহিনীর পক্ষে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করেন। এ্যাশবেলিয়ার ব্যক্তিবর্গ শর্ত কবুল করতে অসম্মতি জানালে দুদিন পর পুনরায় আলোচনার দিন ধার্য হয়।

মুসা বিন নুসাইরের দাড়ি ও মাথার চুল ছিল সম্পূর্ণ সাদা। সেসময় পর্যন্ত কেবলমাত্র মুসলমানগণই খেজাব সম্পর্কে অবগত ছিলেন। মূলত মুসলমানরাই খেজাব আবিষ্কার করেছিলেন। আন্দালুসিয়ার অধিবাসীরা খেজাব সম্পর্কে অবগত ছিল না।

এ্যাশবেলিয়ার প্রতিনিধি দল দ্বিতীয়বার সন্ধির শর্ত নিয়ে আলোচনা করার জন্য আসেন। মুসা বিন নুসাইর তখন তাঁর দাড়ি ও চুলে লাল রংগের খেজাব লাগিয়ে রেখেছিলেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা মুসা বিন নুসাইরকে অবাক হয়ে দেখছিলেন। তারা ভাবছিলেন, সাদা চুল লাল হয়ে গেল কীভাবে? সন্ধির শর্ত নিয়ে আলোচনা শুরু হল। কিন্তু দ্বিতীয়বারের আলোচনাও ফলপ্রসূ হল না। কারণ, মুসা বিন নুসাইরের পক্ষ থেকে অনেক কঠিন শর্ত আরোপ করা হচ্ছিল। তিনি তাদেরকে অস্ত্র সমর্পণের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। দুদিন পর আবারও আলোচনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।

দুদিন পর উভয় পক্ষ তৃতীয়বারের মতো আলোচনায় বসলেন। এবার এ্যাশবেলিয়ার প্রতিনিধি দল এসে দেখল যে, মুসা বিন নুসাইরের লাল দাড়ি ও চুল কালো হয়ে গেছে। তিনি কালো খেজাব ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় আশি বছর। হাটার সময় তাঁর মাথা সামান্য ঝুঁকে পড়ত। কিন্তু মুসা বিন নুসাইর নওজোয়ানের মতো সিনা টান করে মাথা উঁচিয়ে হাটছিলেন। আজকের আলোচনাও ভেস্তে গেল।

মুসা বিন নুসাইর অত্যন্ত কঠোর ভাষায় প্রতিনিধি দলকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আর কোন আলোচনা নয়, তোমাদের সাথে আমাদের পরবর্তী সাক্ষাত হবে তোমাদের শহরে। তোমাদের সৈন্যদের লাশ মাড়িয়ে আমাদের সৈন্য শহরে প্রবেশ করবে। তখন আমার তলোয়ারই তোমাদের শর্ত নির্ধারণ করবে।

নওয়াব যুলকদর জংবাহাদুর লেখেছেন :

এ্যাশবেলিয়ার প্রতিনিধি দল দুর্গে ফিরে এসে নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করতে বসল।

‘ওদের শর্ত মেনে নাও।’ প্রতিনিধি দলের একজন নেতা বলল। ঐ সিপাহসালার কোন অলৌকিক শক্তির অধিকারী হবেন। তোমরা নিশ্চয় দেখেছ, তিনি কতটা বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। তাঁর একটি চুল-দাড়িও কালো ছিল না। আমরা দেখলাম, তাঁর সাদা-শুভ্র চুল-দাড়ি প্রথমে লাল হয়ে গেল। তারপর লাল চুল-দাড়ি কালো হয়ে গেল। এখন তিনি নওজোয়ানদের মতো কথা বলছেন, চলাফেরা করছেন। তাছাড়া এই মুসলিম বাহিনী দেখতে দেখতে গোটা রাজ্যের উপর ঝেকে বসেছে।’

প্রতিনিধি দলের পারস্পরিক আলোচনার ফলাফল এই দাঁড়াল যে, তারা সকলেই মুসা বিন নুসাইরের যাবতীয় শর্ত মেনে নিল।

***

উপরের ঘটনা থেকে মুসা বিন নুসাইরের বুদ্ধিমত্তা আর বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। মুসা বিন নুসাইর তার অসাধারণ ধীশক্তি আর দূরদৃষ্টির মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, খলীফার নির্দেশ মেনে নেওয়া উচিত। যারপরনাই তিনি আর তারিক বিন যিয়াদ দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে টলেডু এসে পৌঁছেন। সালার মুগীস আর-রুমিও তাঁদের সাথে দামেস্ক যেতে চান। মুসা বিন নুসাইর তাকে দামেস্ক নিতে চাচ্ছিলেন না।

‘সম্মানিত আমীর! মুগীস আর-রুমি বললেন। আমি কর্ডোভা জয় করেছি। কর্ডোভার গভর্নর হাতিয়ার সমর্পণ করতে অস্বীকার করেছিল। সে যুদ্ধে আমাদেরকে অনেক বেশি জানের নাযরানা পেশ করতে হয়েছিল। অবশেষে জীবনবাজি রেখে আমি গভর্নরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আপনি আমিরুল মুমিনীনের জন্য উপহারস্বরূপ ত্রিশ হাজার যুদ্ধবন্দী ও অসংখ্য দাস-দাসী নিয়ে যাচ্ছেন। আমি শুধু এই একজন যুদ্ধবন্দীকে আমিরুল মুমিনীনের কাছে পেশ করতে চাই–এই অধিকার কি আমার নেই।

 ‘অবশ্যই তোমার এই অধিকার আছে।’ মুসা বিন নুসাইর তার আবেদন মঞ্জুর করে তাকে দামেস্ক যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন।

মুসা বিন নুসাইর কয়েক দিন টলে অবস্থান করতে চাচ্ছিলেন। তিনি দ্রুতগতির এক ঘোড়সওয়ারকে এই বার্তাসহ দামেস্ক পাঠিয়ে দিলেন যে, মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন, তাঁরা অতিসত্তর দামেস্ক এসে পৌঁছবেন।

টলেডু এসে মুসা বিন নুসাইর খলীফার জন্য বরাদ্ধকৃত হাদিয়া আর বায়তুল মালের গনিমত পৃথক করা শুরু করেন। যুদ্ধবন্দীর সংখ্যাই ছিল কয়েক হাজার। সেসকল বন্দীদের খোঁজ-খবর নেওয়া এবং তাদের মধ্য থেকে যাদেরকে দামেস্ক নিয়ে যাবেন, তাদেরকে নির্বাচন করাও অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয় ছিল।

জুলিয়ান ও আউপাস মুসা বিন নুসাইরের সাথেই ছিলেন। আউপাস মেরিনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তারিক বিন যিয়াদ যখন টলেডু জয় করেন তখন একদিন মেরিনা এক ইহুদি জাদুকরের লাশ হাদিয়াস্বরূপ তারিক বিন যিয়াদের সামনে পেশ করে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের পর থেকে আউপাস মেরিনাকে অনেক জায়গায় তালাশ করেছে, কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পায়নি। এবার মুসা বিন নুসাইরের সাথে টলেডু আসার পরও আইপাস মেরিনার খোঁজ-খবর নিতে লাগল। অনেক খোঁজাখুজির পর মেরিনার সন্ধান পাওয়া গেল। আউপাস একদিন মেরিনার কাছে গিয়ে উপস্থিত হল।

মেরিনা হল টলেডুর অধিবাসী। সে নিজ গৃহে বাবা-মার কাছে না গিয়ে ছোট্ট একটি উপাসনালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। এই উপাসনালয়টি ছিল অত্যন্ত প্রাচীন আর লোকালয় থেকে অনেক দূরে। লোকজনের আনাগুনা এখানে ছিল না বললেই চলে। মেরিনা এই নির্জন উপাসনালয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সেখানে আস্তানা গেড়ে বসে। সে সবসময় সাদা কাপড়ে নিজেকে আবৃত করে রাখত। কাপড় দিয়ে এমনভাবে মাথা পেঁচিয়ে রাখত যে, বাইরে থেকে একটি চুলও দেখা যেত না।

বহুদিন পর আউপাসকে দেখতে পেয়ে মেরিনার চোখে-মুখে কোন রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল না। মেরিনা সবরকম ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার উর্ধ্বে চলে গিয়েছিল।

‘এখানে কী করছ, মেরিনা!?’ আটপস আবেগতাড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

‘তপস্যা করছি।’ মেরিনা আত্মনিমগ্ন ভঙ্গিতে ভাবাবেগহীন কণ্ঠে উত্তর দিল। ‘খোদাওন্দের নিকট আপন গুনাহের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করছি। তুমি কেন এসেছ?’

‘মেরিনা, আমি তোমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে এসেছি। আউস বলল। ‘এটা তোমার উপযুক্ত স্থান নয়। তুমি শাহীমহলের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য।

 ‘শাহীমহল! মেরিনা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠল। সেই শাহীমহল, যেখানে আমার আশা-আকাক্ষা, প্রেম-ভালোবাসা, স্বপ্ন-সাধনার সমাধি রচিত হয়েছে?

এখন আর সেই মহলে রডারিক নেই। আউপাস বলল। রডারিকের বংশের কেউই আজ সেখানে থাকে না। সেই মহল এখন মুসলমানদের দখলে। সেখানে পাপাচারের কোন নাম-নিশানাও নেই। সেখানে কেউ মদ্য পান করে না। কেউ কোন নারীর উপর নির্যাতন করে না। সেই মহল এখন পবিত্র হয়ে গেছে।

‘আউপাস, আমি এখনও পবিত্র হয়নি। মেরিনা বলল। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমি আমার আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য চেষ্টা করে যাব।’

‘আমি তোমাকে মুসলমানদের আমীরের নিকট নিয়ে যেতে চাই।’ আউপাস বলল। আমি তাকে বলতে চাই, এই সেই নারী, যে আড়ালে থেকে গোয়াডিলেট নদীর তীরে সংঘটিত যুদ্ধে রডারিককে পরাজিত করেছিল।’

‘এ কথা শুনে মুসলমানদের আমীর আমাকে পুরস্কৃত করবেন, তাই না? মেরিনা বলল। আউপাস, এ কথাই তো তুমি আমাকে বলতে চাচ্ছ? দুঃখিত, আউপাস! আমি উপহার-উপঢৌকনের দুনিয়া থেকে বের হয়ে অনেক দূর চলে এসেছি।’

‘আমীর মুসা তোমাকে দেখতে চান, মেরিনা!’ আটপাস বলল। তোমার মনে কি আমার জন্য সামান্য ভালোবাসাও অবশিষ্ট নেই? আমি তোমাকে আমার ভালোবাসার দোহায় দিয়ে বলছি, আমার সাথে চল, পরে না হয় ফিরে আসবে…। আমীর মুসা দামেস্ক চলে যাচ্ছেন।

ভালোবাসার দোহায় দেওয়াতে মেরিনা আউপাসের সাথে যেতে রাজি হল।

ইউরোপিয়ান ইতিহাসবিদ গোয়ানগোজ লেখেন, মেরিনার ব্যক্তিত্বের মাঝে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। সে সত্যিকার অর্থেই দুনিয়াবিমুখ হয়ে গিয়েছিল। তার মাঝে এক অপার্থিব আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটেছিল।

***

রডারিককে পরাজিত করার পিছনে মেরিনার যে বিশাল ভূমিকা ছিল সে ব্যাপারে তারিক বিন যিয়াদ, জুলিয়ান ও আউপাস সকলেই মুসা বিন নুসাইরকে অবহিত করেছিলেন। সেই দুর্দান্ত সাহসী মেয়ে মেরিনা এখন মুসা বিন নুসাইরের সামনে দাঁড়ানো। মুসা বিন নুসাইর আশ্চর্য হয়ে মেরিনাকে দেখছেন। মেরিনাও গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

 ‘বস, মেয়ে। মুসা বিন নুসাইর মেরিনাকে লক্ষ্য করে বললেন। আমাদের কাছে তোমার গুরুত্ব অনেক বেশি। আমরা অবশ্যই তোমাকে তোমার কাজের প্রতিদান প্রদান করব।’

আউপাস মেরিনাকে মুসা বিন নুসাইরের কথা তরজমা করে শুনাচ্ছিল। কিন্তু মেরিনার চোখে-মুখে এমন একটা প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল যেন, সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। তার দৃষ্টি মুসা বিন নুসাইরের চেহারার উপর আটকে আছে।

 ‘তোমার আমীরকে বল, তিনি যেন স্বদেশে ফিরে না যান।’ মেরিনা আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠল। এই সফর তাঁর জন্য কল্যাণকর হবে না।’

‘আমি আমার দেশে গেলে কী ক্ষতির সম্মুখীন হব?’ মুসা বিন নুসাইর মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন।

‘এই সফর আপনার জন্য শুভ হবে না।’ মেরিনা দৃঢ়কণ্ঠে বলল। এই সফর আপনার জন্য লাঞ্ছনা আর অপমানের কারণ হবে। আরও খারাপ কিছুও হতে পারে।’

কথা বলতে বলতে মেরিনার আওয়াজ উঁচু হতে লাগল। তার কণ্ঠ থেকে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। সে বলতে লাগল, যাবেন না, আমীর! … আপনি যাবেন না…। পরিণতি ভাল মনে হচ্ছে না …। আপনার চোখ বলছে, এই চোখে পুনরায় আন্দালুসিয়া দেখা সম্ভব হবে না।’

মুসা বিন নুসাইর হাসি ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি হাসতে হাসতে বললেন। মুসলমান তার সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখে। আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কোন মুসলমান যদি কোন মানুষের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য মনে করে তাহলে সে মুশরিক হয়ে যায়।’

‘আমি কোন ধর্মের কথা বলছি না।’ মেরিনা বলল। আমি হয়তো আমার ধর্ম সম্পর্কেও কিছু জানি না। আমি এও জানি না যে, আমি কীভাবে বুঝতে পারলাম, আপনার এই সফর শুভ হবে না। আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনার আশে-পাশে মৃত্যু ঘুরাফেরা করছে।’

‘তুমি কি কোন পণ্ডিতের কাছ থেকে এই বিদ্যা অর্জন করেছ?’ মুসা বিন নুসাইর জানতে চাইলেন।

 ‘না।’ মেরিনা বলল। আমার ভিতর থেকে, আমার নিজের অস্তিত্ব থেকে আমি একটি আলো অনুভব করি। আমি আপনাকে কোন ধোঁয়াশার মধ্যে রাখতে চাই না। আমি আপনাকে বলতে চাই, আমি কী ছিলাম, কী হয়েছি?’

‘তোমার সম্পর্কে আউস আমাকে সবকিছুই বলেছে।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তোমার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে, তা আমি জানি। তোমার অনাকাক্ষিত দুঃখ-কষ্টের জন্য আমরা সকলেই সমবেদনা প্রকাশ করছি। বরং তুমি এখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছ, সে কথায় বল।’

পৃথিবীর এক অন্ধকার জগতে আমার বসবাস ছিল। মেরিনা বলতে লাগল। আমি নির্যাতিত ছিলাম বটে, তবে আমি নিজেকে গুনাহগার মনে করি। আমি রডারিকের রক্ষিতা ছিলাম। রডারিককে আমার হাতের মুঠোয় নেওয়ার জন্য আমি অনেক ধোঁকা, আর ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলাম। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য আমি অনেকের সাথে প্রতারণা করেছি। আত্মপ্রবঞ্চনার মাঝে আমার যৌবন অতিবাহিত হয়েছে। তার পর আমি এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছি। সে আমার সম্প্রদায়ের জাদুকর ছিল। আমি তাকে হত্যা না করলে একজন বেগুনাহ মেয়েকে তার হাতে জীবন দিতে হত। সে রডারিকের বিজয়ের জন্য ঐ মেয়েকে বলি দিতে চাচ্ছিল।

 ‘আমি এ সবকিছুই জানি।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমরা তোমার এই সাহসিকতার প্রশংসা করি। আমরা এর প্রতিদান দিতে চাই।’

‘না, জনাব! মেরিনা বলল। আমি আপনাদের প্রতি কোন রকম অনুগ্রহ করিনি। অনুগ্রহ করে থাকলে নিজের প্রতি করেছি। আমি রডারিক থেকে প্রতিশোধ নিয়েছি। এখন আমার অন্তরে কোন উপহার-উপঢৌকনের লোভ নেই। আমি আমার অন্তরাত্মাকে গুনাহের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করছি। এখন সমগ্র আন্দালুসিয়ার বাদশাহীও যদি আমার পদতলে রেখে দেওয়া হয় তাহলেও আমি সেই নির্জন ছোট্ট উপাসনালয় থেকে বের হবে না, যেখানে আমি নিজেকে বন্দী করে রেখেছি। আমার অন্তরাত্মা পবিত্র হয়ে গেছে। আমি যেখানে থাকি সেখানে রূহানী জগতের আত্মারাও এসে থাকে। সম্ভবত তারাই আমাকে ভবিষ্যতের সংবাদ দিয়ে যায়।’

মুসা বিন নুসাইরের ঠোঁটের উপর মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠল। তিনি অন্যান্য সালারদের লক্ষ্য করে বললেন, এই মেয়ের মস্তিষ্ক ঠিক নেই।’

 ‘আমি আপনাকে আরেকটি বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি।’ মেরিনা বলল। ‘আমার প্রতি দয়ার্দ হয়ে আমাকে সেই প্রাচীন উপাসনালয় থেকে উঠিয়ে এই মহলে এনে আরাম-আয়েশে রাখবেন–এমনটি চিন্তাও করবেন না। আউপাস আমাকে ভালোবেসে ছিল। পরিণতিতে তার খান্দানের বাদশাহী রক্তের দরিয়ায় ভেসে গেছে। তার ভাই যিনি বাদশাহ ছিলেন, মারা গেছেন। রডারিক আমাকে তার মহলে নিয়ে গিয়েছিল। সে আমাকে তার কামনা-বাসনার পুতুল বানিয়ে রেখেছিল। তার বাদশাহীর নাম-নিশানাও আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেও বেঘোরে মারা গেছে। আমি আপনার মহলে কিছুতেই থাকব না।’

মেরিনা কিছুক্ষণ নীরব থেকে পুনরায় বলতে শুরু করল।

‘আমি আপনাকে আবারও বলছি, এই সফরের চিন্তা মন থেকে বের করে দিন।’ এ কথা বলে মেরিনা একেবারে চুপ হয়ে গেল। গোটা দরবারে পীনপতন নীরবতা ছেয়ে গেল। মেরিনা ধীরে ধীরে বসা থেকে উঠে গাম্ভির্যের সাথে পা ফেলে দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। তারপর পেছন ফিরে বলল :

মুসলমানদের আমীর, আন্দালুসিয়া হল প্রেতাত্মাদের দেশ। এখানে আবহমান কাল থেকে মানুষের রক্ত ঝরেছে। ভবিষ্যতেও রক্ত ঝরবে। এখানের মাটিতে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও রহস্যময় ভেদ লুকানো আছে। এখানের আকাশে-বাতাসে রহস্যের ছড়াছড়ি।

এ কথা বলে মেরিনা দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।

 ‘এই মেয়েটির প্রতি আমার আন্তরিক সহানুভূতি আছে। মুসা বিন নুসাইর বললেন। দ্রুত সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ কর। টলেডুর পরিবর্তে এ্যাশবেলিয়াই হবে আন্দালুসিয়ার রাজধানী। দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা এ্যাশবেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হব।’

***

দুদিন পর বিশাল বড় এক বাহিনী নিয়ে মুসা বিন নুসাইর এ্যাশবেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। আবদুল আযীয এ্যাশবেলিয়াতেই ছিলেন। পূর্বেই তাঁকে জানানো হয়েছিল যে, মুসা বিন নুসাইর আর তারিক বিন যিয়াদ এ্যাশবেলিয়া আসছেন। সংবাদ শুনে আবদুল আযীযের স্ত্রী এজেলুনা তৎপর হয়ে উঠল।

‘গোটা শহর সম্মানিত আমীরকে সংবর্ধনা জানাবে।’ এজেলুনা আবদুল আযীকে বলল। শহরের অধিবাসীগণ শহর থেকে বের হয়ে পথের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আমীর মুসাকে খোশআমদের জানাবে।

 ‘না, এজেলুনা!’ আবদুল আযীয বললেন। আমীর মুসা এমনটি পছন্দ করবেন না। আমাদের ধর্ম লোকজনকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা প্রদানের অনুমতি দেয় না। এটা অহংকার আর অহমিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা ফেরাউনদের কর্মপন্থা।

‘এখানকার অধিবাসীরা মুসলমান নয়। এজেলুনা বলল। এরা তোমাকে, তোমার বাবাকে, আর সিপাহসালার তারিক বিন যিয়াদকে বাদশাহ মনে করে। এখানকার লোকজন রাজা-বাদশাহকে সম্মান করতে অভ্যস্ত। যদি তোমরা তাদেরকে এই কথা চিন্তা করার সুযোগ করে দাও যে, তোমরাও তাদের মতো সাধারণ মানুষ তাহলে তাদের উপর তোমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বহাল রাখতে পারবে না। তারা তোমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসবে। তোমার সম্মানিত পিতা একজন সাধারণ প্রজার মতো আসবেন, আর প্রজা সাধারণ তাঁর প্রতি কোন সম্মান প্রদর্শন করবে না–এই অপমান আমি মেনে নিতে পারব না। এর যাবতীয় ব্যবস্থা আমি নিজেই করব।’

ইতিহাসবিদগণ লেখেছেন, এজেলুনা এক মোহনীয় জাদু হয়ে আবদুল আযীযের উপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। একদিকে আবদুল আযীয ছিলেন স্ত্রীর অতিশয় বাধ্যগত স্ত্রৈণ এক স্বামী। অপরদিকে দুর্দান্ত এক সিপাহসালার, আর বিচক্ষণ প্রশাসক।

এজেলুনা শুরু থেকে রাজরানী হতে চাচ্ছিল। মুসা বিন নুসাইরের আগমনের কথা শুনে সে শহরময় ঘোষণা করিয়ে দিল যে, কয়েকদিনের মধ্যেই মিসর, আফ্রিকা ও আন্দালুসিয়ার সম্মানিত আমীরের শুভাগমন হবে। যখনই ঘোষণা করা হবে, তিনি আগমন করছেন, তখন শহরের সকল নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু শহর থেকে বের হয়ে সম্মানিত আমীরকে খোশআমদেদ জানাবে।

এজেলুনা মুসা বিন নুসাইরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য জমকালো আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এ উপলক্ষে সে এ্যাশবেলিয়ার সকল প্রশাসকের কাছে বিভিন্ন নির্দেশনামূলক বার্তা পাঠাতে লাগল। এই বিশাল আয়োজনের অংশ হিসেবে দু’জন ঘোড়সওয়ারকে টলেডুর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তাদের দায়িত্ব হল, মুসা বিন নুসাইরের কাফেলা টলেডুর সীমানা অতিক্রম করার সাথে সাথে তারা ঘোড়া ছুটিয়ে এসে এজেলুনাকে সংবাদ দেবে।

অবশেষে মুসা বিন নুসাইরের আগমনের দিন সমাগত হল। সে দিন দ্বীপ্রহরের সময় ঘোড়সওয়ার দু’জন দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে শহরে এসে প্রবেশ করল। তারা সরাসরি আবদুল আযীযের সামনে এসে বলল, শীঘ্রই আফ্রিকা ও আন্দালুসিয়ার সম্মানিত আমীরের আগমন ঘটছে। তারা যে দূরত্বের কথা বলল, তা বেশি হলে এক ঘণ্টার পথ হবে।

সংবাদ পেয়ে এজেলুনা ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। সে আস্তাবল থেকে ঘোড়া আনানোর পরিবর্তে আগত ঘোড়সওয়ারদের একজনের ঘোড়ায় চড়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। কার কাছে যেতে হবে, কার উপর কোন দায়িত্ব থাকবে–এ জাতীয় সকল বন্দোবস্ত এজেলুনা পূর্বেই করে রেখেছিল।

***

এ্যাশবেলিয়ার দিকে বিশাল এক বাহিনী এগিয়ে আসছে। কাফেলার সামনের সারিতে আছেন মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন যিয়াদ, আর মুগীস আর-রুমীসহ অন্যরা। তাদের পিছনে দুই থেকে আড়াইশ সৈন্যের রক্ষীবাহিনী। তাদের পিছনে কয়েক হাজার যুদ্ধবন্দী। বন্দীদের হাত রশি দিয়ে বাঁধা। বন্দীদের মাঝে আছে রডারিকের সৈন্যবাহিনীর উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা আর সাধারণ সিপাহী। অনুগ্রহ করে উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদেরকে ঘোড়র উপর সওয়ার হওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দী হল কর্ডোভার গভর্নর। মুগীস আর-রুমী তাকে বন্দী করেছিলেন। বন্দীদের পিছনে ঘোড়াগাড়ির বিশাল বহর। ঘোড়াগাড়িগুলো দাসী-বান্দিতে ঠাসা। এদের পিছনে অসংখ্য খচ্চর আর খচ্চরচালিত টাঙাগাড়ি। এগুলোর উপর বিপুল পরিমাণ গনিমতের মাল বোঝায় করা।

শহর থেকে দেড় মাইল দূরে কাফেলা পৌঁছলে দেখা গেল, শহরের অধিবাসীরা রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ মানুষের সামনে মুসলিম সিপাহীরা বর্শা হাতে নিয়ে দাঁড়ানো। প্রতিটি বর্শার অগ্রভাগে ত্রিকোণবিশিষ্ট সবুজ ঝাণ্ডা বাঁধা। প্রত্যেক সিপাহী তার বর্শার নিম্নাংশ মাটির সাথে লাগিয়ে উপরের অংশ সামনের দিকে সামান্য ঠেলে দিয়ে ধরে আছে। বহুদূর পর্যন্ত সবুজ ঝাণ্ডার আশ্চর্য রকম সুন্দর এক দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। সেই সাথে সৈন্যদের অভিন্ন সফেদ পোশাক সৌন্দর্যের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পদাতিক সৈন্যদের সারি যেখানে এসে শেষ হয়েছে সেখান থেকে অশ্বারোহী সৈন্যদের সারি শুরু হয়েছে। শিশু ও নারীদেরকে সকলের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে। তারা সকলেই হাত নেড়ে নেড়ে কাফেলাকে স্বাগতম জানাচ্ছে, আর সমস্বরে চিৎকার করে বলছে, মুসা বিন নুসাইর খোশ আমদেদ! মুসা বিন নুসাইর জিন্দাবাদ! যুবতী মেয়েরা ফুলের ডুলি হাতে নিয়ে মুসা বিন নুসাইরকে লক্ষ্য করে ফুলের পাপড়ী ছুঁড়ে মারছে।

এই দৃশ্য দেখে মুসা বিন নুসাইরের ঠোঁটের কোণে ভিন্ন রকম মুচকি হাসির আভা ঝিলিক দিয়ে উঠল। দম্ভ আর ঔদ্ধত্বের কারণে তার গর্দান ঈষৎ বেঁকে ছিল। প্রফেসর ডোজি, ডানপাল, ইবনে বাশকুল ও ড. কুন্ডে প্রমুখ ইতিহাসবিদগণ আরও কয়েকজন ইতিহাসবিদের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন, মুসলিম বিজেতাগণ এ জাতীয় রাজকীয় শান-শওকাত ও জমকালো অভ্যর্থনার, পক্ষপাতি ছিলেন না। ইসলামে এ জাতীয় রাজকীয় মহড়া প্রদানের কোন সুযোগ নেই। উচিত ছিল মুসা বিন নুসাইর এই রাজকীয় জমকালো অভ্যর্থনাকে অপছন্দ করে জিজ্ঞেস করবেন, কে এই অনৈসলামিক প্রথার আয়োজন করেছে? তাঁর উচিত ছিল এ জাতীয় মহড়া প্রদর্শনকারীকে জনসম্মুখে ডেকে এনে তিরস্কার করা। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, তিনি এই রাজকীয় অভ্যর্থনায় আনন্দিত হন। তার মুচকি হাসি, আর চেহারার অভিব্যক্তি থেকে সুস্পষ্টরূপে বুঝা যাচ্ছিল, তিনি অত্যন্ত খুশী হয়েছেন। তবে তারিক বিন যিয়াদ, মুগীস আর-রুমীসহ অন্যান্য সালারদের চেহারার অভিব্যক্তিতে বিরক্তির চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল।

শহরের প্রধান ফটকের সামনে মুসা বিন নুসাইরকে যে অভ্যর্থনা প্রদান করা হয় এক কথায় তা ছিল অভাবনীয় ও অতুলনীয় এক অভ্যর্থনা। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আর মুসলমানগণ এক কাতারে দাঁড়ানো ছিল। মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন যিয়াদ ও মুগীস আর-রুমীসহ অন্যান্য সালারগণ ঘোড়া থেকে নেমে এলেন। মুসলমান ব্যক্তিবর্গ স্বাভাবিকভাবে তাঁদের সাথে মোসাফাহা করেন। কিন্তু আন্দালুসিয়ার অধিবাসীরা প্রথমে মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করে, তারপর মুসা বিন নুসাইরের হাত তাদের হাতের মধ্যে নিয়ে শ্রদ্ধাভরে চুমু খেতে থাকে। তারিক বিন যিয়াদসহ অন্যান্য সালারদেরকে সাধারণভাবেই অভ্যর্থনা প্রদান করা হয়। মোটকথা, এজেলুনা মুসা বিন নুসাইরকে আন্দালুসিয়ার অন্যান্য বাদশাহদের মতোই একজন বাদশাহ বানিয়ে দেয়।

***

‘প্রিয়। রাতে এজেলুনা আবদুল আযীযকে লক্ষ্য করে বলল। আমি এ কথা ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি যে, তুমি নিজেকে এবং তোমার মহান পিতাকে একজন সাধারণ মানুষ কেন মনে কর? তোমার পিতা হলেন, শাহানশা আর তুমি হলে শাহজাদা। আমি তোমার পিতাকে শাহানশার মর্যাদা দিতে চাই।’

এজেলুনা সম্পর্কে সকল ইতিহাসবিদই লেখেছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই নারী অসাধরণ রূপ-যৌবনের অধিকারী ছিল। কিন্তু সেই সময়ে তার চেয়েও অনেক বেশি রূপসী নারী ছিল। তারপরও এজেলুনার মাঝে এমন কী জাদু ছিল যে, সে রডারিকের মতো পাষাণ হৃদয় বাদশাহকে মোমের মতো বানিয়ে ফেলেছিল, আর আবদুল আযীযের মতো বিচক্ষণ মর্দেমুমিন সালারকে তার হাতের পুতুলে পরিণত করেছিল?

ইতিহাসবিদদের বিবরণ থেকে বুঝা যায়, এজেলুনার আসল জাদু ছিল তার মুখের কথায় আর শরীরের অঙ্গ-ভঙ্গিতে। তার কথার জাদু আর মোহনীয় অঙ্গ-ভঙ্গিই মুসা বিন নুসাইরের মতো বিচক্ষণ ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে ফেলেছিল।

ইতিহাসে যে নারীকে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী মনে করা হয়, সেই ক্লিওপেট্রীও খুব বেশি সুন্দরী ছিল না। তার সেবিকাদের মধ্যে তার চেয়েও বেশি রূপসী ও আকর্ষণীয় দেহসৌষ্টবের অধিকারিনী নারী ছিল। ক্লিওপেট্রার মাঝে যে সম্মোহনী শক্তি ছিল অন্য কোন নারীর মাঝে তা ছিল না। ক্লিওপেট্রার কুটকৌশল আর ষড়যন্ত্রের সামনে জুলিয়াস সিজারের মতো যোদ্ধাও নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। জুলিয়াস সিজারের স্থলাভিষিক্ত এ্যান্থনি মিসর আক্রমণ করলে ক্লিওপেট্রা তার মোকাবেলায় সৈন্যবাহিনী না পাঠিয়ে তাকে ভালোবাসার জালে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলে যে, তার বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায় এবং সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। ক্লিওপেট্রার মতো এজেলুনার মাঝেও হয়তো এমনই কোন সম্মোহনী শক্তি ছিল।

মুসা বিন নুসাইর এ্যাশবেলিয়ায় বেশি দিন অবস্থান করেননি। তিনি পুত্র আবদুল আযীযকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করে তার উপর সকল দায়-দায়িত্ব অর্পণ করে দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পড়েন।

মুসা বিন নুসাইর যেদিন আবদুল আযীযকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করেন সেদিনটিই ছিল এজেলুনার জীবনে সবচেয়ে আনন্দের দিন। এজেলুনা যখন রডারিকের বিবি ছিল তখনও তার জীবনে এমন আনন্দময় কোন দিন আসেনি। সে রডারিকের কাছে পরম প্রিয় ছিল ঠিকই, কিন্তু রানীর মর্যাদা রডারিক অন্য বিবিকে দিয়ে রেখেছিল। তাই সে কোন দিনই রানীর মতো ইচ্ছা-স্বাধীন ছিল না। আজ সে আবদুল আযীযের বিবি হওয়ার সুবাদে রানী যেমন হয়েছে, তেমনি নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়নের স্বাধীনতা লাভ করেছে।

***

গনিমতের যে অংশ বায়তুল মালের জন্য বরাদ্ধ ছিল মুসা বিন নুসাইর তা সাথে করে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। বেশ কিছু মূল্যবান তোহফা খলীফার জন্য বরাদ্ধ করা হয়েছিল। এ্যাশবেলিয়ার যুদ্ধবন্দীও একেবারে কম ছিল না। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে রাজ্যের উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও ছিল। সকলকে দামেস্ক নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হল।

অবশেষে একদিন মুসা বিন নুসাইর এ্যাশবেলিয়া থেকে জাবালুত তারিকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। দূরত্ব ছিল তিনশ মাইলেরও কিছু বেশি। পথে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় শহর পড়ে। মুসা বিন নুসাইরের কাফেলা যে শহরের নিকট দিয়ে অতিক্রম করত, সে শহরের অধিবাসীরা রাস্তার উভয় পার্শ্বে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানাত। দূর থেকে খোশ আমদেদ আর জিন্দাবাদের ধ্বনী শুনা যেত। পথে পথে মুসা বিন নুসাইরকে লক্ষ্য করে ফুলের পাপড়ী ছিটিয়ে দেওয়া হত।

চলার পথে মুসা বিন নুসাইরের কাফেলাকে এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোর ব্যবস্থা এজেলুনাই করেছিল। সে মুসা বিন নুসাইরের যাত্রাপথে অবস্থিত সকল শহরের প্রশাসকদের নিকট নির্দেশ পাঠিয়ে ছিল যে, প্রত্যেক শহরের অধিবাসীরা শহর থেকে বাইরে এসে মুসা বিন নুসাইরকে যেন অভ্যর্থনা জানায়।

মুসা বিন নুসাইরের এই বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ কাফেলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইতিহাসবিদগণ লেখেছেন। মুসা বিন নুসাইর চাচ্ছিলেন, খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেকের দরবারে আন্দালুসিয়ার শান-শওকত ও জাকজমকের পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে। তিনি খলীফার দরবারে এ বিষয়টি তুলে ধরতে চাচ্ছিলেন যে, তিনি শুধুমাত্র একটি রাজ্যই জয় করেননি; বরং সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের হৃদয়-মনও জয় করেছেন। মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়ার যেসকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে গোথ সম্প্রদায়ের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ যেমন ছিলেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গও ছিলেন। তিনি কয়েকজন ইহুদি সরদারকেও এই কাফেলায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

এই কাফেলায় প্রায় ত্রিশ হাজার যুদ্ধবন্দী ছিল। ঘোড়াগাড়িতে করে শত-সহস্র দাসী-বান্দি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এদের সকলেই ছিল আন্দালুসিয়ার অধিবাসী। তারা মুসলমানদের সাথে দামেস্ক যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিল। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও আমীর-উমারাদের স্ত্রী-কন্যারা তাদের স্বামীদের সাথে দামেস্ক যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে, তাদেরকেও সাথে নেওয়া হল। ইতিহাসবিদগণ তাদের সকলের রূপ-সৌন্দর্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

মালে গনিমতের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, কয়েক হাজার খচ্চরের উপর সেগুলো বোঝাই করা হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে তলোয়ার, বর্শা, তীর-ধনুকসহ ছোট-বড় সবরকম যুদ্ধসামগ্রী ছিল। মোটকথা, মুসা বিন নুসাইরের কাফেলার শান-শওকত আর জাঁকজমক যে কোন রাজা-বাদশাহর জন্যও ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বয়ং মুসা বিন নুসাইরও এই জাঁকজমক দেখে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর কথাবার্তা আর চাল-চলনে আত্মঅহমিকা ফুটে উঠেছিল।

কয়েক দিন পর কাফেলা জাবালুত তারিকের সদ্র বন্দরে এসে পৌঁছে। এখানে বড়সড় কয়েকটি জাহাজ আর মালবাহী কিস্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। এখানেও হাজার হাজার লোক মুসা বিন নুসাইরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত হয়েছিল। আন্দালুসিয়ার অসংখ্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ মুসা বিন নুসাইরকে আল-বিদা জানানোর জন্য জাবালুত তারিক পর্যন্ত এসেছিলেন। তারা যেভাবে মাথা উঁকিয়ে আর তোষামোদ করে মুসা বিন নুসাইরকে বিদায় জানাচ্ছিলেন তাতে করেও মুসা বিন নুসাইরের চিন্তা-চেতনায় অহংবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। কোন মানুষই পূজনীয় নয়–ইসলামের এই মৌলিক বিশ্বাস সেদিন চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

বিশাল বড় এই কাফেলা মিসরের সমুদ্র তীরবর্তী শহর কায়রোয়ান এসে যাত্রা বিরতি করল। সেসময় কায়রোয়ান ছিল মিসরের রাজধানী। দু-এক দিন কাফেলা এখানে অবস্থান করে দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। কায়রোয়ান থেকে আরব বংশভোত নেতৃবর্গ ও বার্বার সরদারগণ এবং মিসরের নেতৃস্থানীয় লোকজন কাফেলার অন্তর্ভুক্ত হলেন।

“তারিখে উন্দুলুস’ নামক গ্রন্থে বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মিসর ও আফ্রিকার সরদার ও সালারগণ মুসা বিন নুসাইরকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল যে, মনে হচ্ছিল, তারা তাঁর চার পাশে মানব ঢাল তৈরী করে রেখেছেন। তাদের সকলের আচরণই ছিল দাসত্বসূলভ।

গনিমতের মাল ও উপহার-উপঢৌকনের সামগ্রী ঘোড়া ও খচ্চরের উপর বহন করে জাবালুত তারিক পর্যন্ত আনা হয়েছিল। সেখান থেকে জাহাজ ও কিস্তির মাধ্যমে কায়রোয়ান আনা হয়েছে। কায়রোয়ান থেকে সেগুলো উটের উপর বোঝাই করে দামেস্ক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বোঝা বহনকারী উটগুলোকে রঙবেরঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হয়েছে।

কোন ঐতিহাসিকই লেখেননি যে, এই কাফেলা কতদিন পর দামেস্ক এসে পৌঁছে। কায়রোয়ান থেকে দামেস্কের দূরত্ব ছিল কমপক্ষে তিন মাসের। মুসা বিন নুসাইর যেদিন দামেস্ক এসে পৌঁছেন সেদিন ছিল শুক্রবার। তাঁর আগমনের অব্যবহতি পরই দামেস্কের জামে মসজিদে জুমার নামাযের আযান শুরু হয়।

তারিক বিন যিয়াদ আর মুগীস আর-রুমী কাফেলার পিছন দিকে ছিলেন। তারা পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। দূর থেকে দামেস্ক শহর দেখা যাচ্ছিল। তারিক বিন যিয়াদ ও মুগীসের চেহারায় অসম্ভষ্টির ছাপ সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছিল। দামেস্ক থেকে কয়েক মনযিল দূরে মুসা বিন নুসাইর এমন এক নাটকীয় ঘটনার জন্ম দেন, যা কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই অবাক হয়ে যান। মুসা বিন নুসাইরের মতো বয়োবৃদ্ধ মর্দে মুমিনের এ কী হয়ে গেল, তিনি এমন কেন করলেন?

খেলাফতে উন্দুলুস’ নামক গ্রন্থে এ ঘটনার বিবরণ এভাবে এসেছে :

‘সর্বশেষ যাত্রা বিরতির পর কাফেলা সকাল সকাল রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মুসা বিন নুসাইর চাচ্ছিলেন, জুমার নামাযের আগেই দামেস্ক গিয়ে পৌঁছতে। কাফেলা রওনা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে মুসা বিন নুসাইর মুগীস আর-রুমীকে ডেকে পাঠান। তারিক বিন যিয়াদ সেখানে পূর্ব থেকেই উপস্থিত ছিলেন। মুগীস উপস্থিত হলে মুসা বিন নুসাইর তাকে লক্ষ্য করে বললেন,

‘মুগীস, তোমার সেই বন্দীকে আমার হাতে সোপর্দ করো। তোমার বন্দী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সে কর্ডোভার গভর্নর ছিল। আমি নিজে তাকে আমীরুল মুমিনীনের কাছে সোপর্দ করতে চাই।’

‘সম্মানিত আমীর।’ মুগীস বললেন। সে তো আমার বন্দী, আমি কর্ডোভার যুদ্ধে জীবনবাজি রেখে তাকে বন্দী করেছি। আপনিও আমাকে অনুমতি দিয়েছেন, আমি যেন নিজ হাতে তাকে খলীফার দরবারে পেশ করি …।

‘আমি তোমাকে বলছি, এই বন্দীকে আমার হাতে সোপর্দ করো।’ মুসা বিন নুসাইর রাজকীয় ভাবগাম্ভির্যের সাথে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন।

“ঠিক আছে, তবে আমি অবশ্যই আমিরুল মুমিনীনকে বলব, সেই গভর্নরকে আমি গ্রেফতার করেছি।’ মুগীস আর-রুমী বললেন। আমিরুল মুমিনীনকে আমি এ কথাও বলব যে, কত অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে জীবনবাজি রেখে আমি কর্ডোভা শহর দখল করেছি।’

আমি তোমাকে খলীফার সামনে উপস্থিত হতে দেব না।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন।

‘কেন?’ মুগীস জিজ্ঞেস করলেন। আমি কি কোন রণাঙ্গনে পৃষ্ট প্রদর্শন করেছি? আপনি আঠার হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর মাধ্যমে যে বিজয় অর্জন করেছেন, আমি মাত্র এক হাজার সৈন্যের মাধ্যমে সেই পরিমাণ বিজয় অর্জন করেছি। তারপরও আমার এতটুকু অধিকারও কি নেই যে, আমি আমিরুল মুমিনীনের সাথে সাক্ষাত করতে পারব?

‘না, তোমার সেই অধিকার নেই।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তোমার সেই অনুভূতিও নেই যে, আমি তোমাকে কী পরিমাণ সম্মানিত করেছি, অথচ তুমি এই সম্মানের যোগ্য ছিলে না। তুমি ইহুদি ছিলে, তারপর গোথ হয়েছ, অতঃপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছ। তুমি ছিলে দ্বিতীয় শ্রেণির সালার। আমি তোমাকে আরবী সালারদের সমমর্যাদা দান করেছি।’

 ‘ইসলাম মানুষের মাঝে জাত-পাতের বিভক্তি সৃষ্টি করে না। মুগীস: বললেন। এ কারণেই আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি। আপনি যতটা ইচ্ছা আমাকে লাঞ্ছিত করতে পারেন, করেন। তবে মনে রাখবেন, আমি একবার যখন মুসলমান হয়েছি, তখন আজীবন মুসলমানই থাকব। মুসলমান হয়েই মৃত্যু বরণ করব। সম্মানিত আমীর, আমি আপনাকে স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমার কয়েদি আমি আপনাকে দেব না।’

মুসা তার একজন দেহরক্ষীকে ডেকে বললেন, “কর্ডোভার খ্রিস্টান গভর্নরকে এখানে নিয়ে এসো। দেহরক্ষী গভর্নরকে নিয়ে আসল।

‘এই লোকই তো তোমার কয়েদি-না? মুসা বিন নুসাইর জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ, এই লোকই।’ মুগীস বললেন।

মুসা বিন নুসাইর বন্দী গভর্নরের পিছন দিকে চলে এলেন। তারপর হঠাৎ কোষ থেকে তরবারী বের করে গভর্নরের গর্দান লক্ষ্য করে এমন সজোরে আঘাত হানলেন যে, তার দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল। দেহটা কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর হয়ে গেল।

মুগীস আর-রুমী আর তারিক বিন যিয়াদ কোন কথা না বলে ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে গেলেন।

***

কাফেলা আবার দামেস্কের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করল। তারিক বিন যিয়াদ আর মুগীস আর-রুমী মুসা বিন নুসাইরের সামনে থেকে চলে এসে একত্রে পথ চলছিলেন। তারা উভয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাদের মনের কষ্ট চেহারায় সুস্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছিল।

‘ইসলামে এজন্যই রাজকীয় জাঁকজমক নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যাতে আমীরের মন-মস্তিষ্কে দম্ভ-অহংকার সৃষ্টি হতে না পারে। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। লক্ষ্য করে দেখ, এতো বয়োবৃদ্ধ, এতো বুদ্ধিমান একজন মানুষের দিল-দেমাগে বাদশাহীর জাঁকজমক কী প্রভাব সৃষ্টি করেছে!

 ‘আরেকটি বিষয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে।’ মুগীস বললেন। আবদুল আযীযের খ্রিস্টান স্ত্রী বৃদ্ধের দেমাগ বিগড়ে দেওয়ার জন্যই এমন রাজকীয় অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করেছিল।’

মুসা বিন নুসাইর স্বীয় পুত্র আবদুল আযীযকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। কায়রোয়ান এসে তিনি তার দ্বিতীয় পুত্র আবদুল্লাহকে আফ্রিকার পূর্ব দিকের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। পশ্চিম দিকের দায়িত্ব তৃতীয় ছেলে আবদুল মালেকের হাতে ন্যস্ত করেন। বাদবাকি এলাকার দায়িত্ব অর্পণ করেন সবচেয়ে ছোট ছেলে মারওয়ানের উপর।

এই বৃদ্ধ আমীর আন্দালুসিয়ায় ও আফ্রিকায় তাঁর পারিবারিক বাদশাহী কায়েম করেছেন। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এখন তিনি আমিরুল মুমিনীনের কাছ থেকে তাঁর পুত্রদের নিযুক্তির ব্যাপারে অনুমোদন আদায় করবেন। কোন একজন বার্বারকে যদি তিনি কোন এক অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত করতেন তাহলে আমাদের মন খুশী হয়ে যেত।

‘আপনার সেই টেবিলটিও তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন। মুগীস বললেন। দেখবেন, তিনি আমীরুল মুমিনীনকে বলবেন, এটি হযরত সুলায়মান আ.-এর টেবিল। অত্যন্ত কষ্ট করে তিনি এটি অর্জন করেছেন।’

 ‘তিনি সত্যিই যদি এমনটি করেন তাহলে তাকে সকলের সামনে শরমিন্দা হতে হবে। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আমি এজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করে রেখেছি।’

তারিক বিন যিয়াদ ও মুগীস আর-রুমী যদিও মুসা বিন নুসাইরের শত্রু হয়ে যাননি, তথাপি তিনি তাদেরকে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে সক্ষম হননি।

***

পূর্বেই দামেস্কে এ সংবাদ প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল যে, আন্দালুসিয়ার বিজেতাগণ আগমন করছেন। তাদের সাথে আসছে অসংখ্য যুদ্ধবন্দী, যুদ্ধলব্ধ দাস-দাসী, আর বিপুল পরিমাণ গনিমতের মাল। কাফেলা পৌঁছার সংবাদ শুনা মাত্রই দামেস্কের ছোট-বড় সকলেই মুসলিম বাহিনীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য শহর থেকে বের হয়ে এলো। তারা শ্লোগানে শ্লোগানে মুসলিম বাহিনীকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে লাগল। কাফেলা শহরে প্রবেশ করতেই পুরবাসিনী নারীগণ দরজা-জানালা খোলে এবং বাড়ির ছাদে উঠে হাত নেড়ে খোশ আমদেদ জানাতে লাগলেন।

মুসা বিন নুসাইরের কাফেলা বিশাল বিস্তৃত এক ময়দানে এসে অবস্থান গ্রহণ করল। উটগুলোকে বসিয়ে সামানপত্র নামানো হচ্ছিল, এমন সময় একজন অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে নেমে মুসা বিন নুসাইরের সামনে এসে দাঁড়াল। আগন্তুক মুসা বিন নুসাইরকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটি পয়গাম গুনাল। তখন এই পয়গামের কথা অন্য কেউ হয়তো শুনেনি; কিন্তু ইতিহাসের পাতায় সেই পয়গামের কথা আজও লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। সেই পয়গাম ছিল খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেকের তাই সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের পক্ষ থেকে। সুলায়মান বিন আবদুল মালেকের মর্যাদা হল তিনি খলীফার ছোট ভাই। পয়গাম নিয়ে আসা ব্যক্তি সুলায়মানের খাস লোক।

 ‘সুলায়মান বিন আবদুল মালেক আপনার জন্য পয়গাম পাঠিয়েছেন।’ অশ্বারোহী বলল। তিনি বলেছেন, আমিরুল মুমিনীন খুবই নাযুক অবস্থায় আছেন, যে কোন সময় তিনি ইন্তেকাল করতে পারেন। আপনি তার সাথে সাক্ষাত করবেন না এবং কোন হাদিয়া ও গনিমতের মাল তাঁকে দেবেন না। কয়েক দিন অপেক্ষা করুন। তার ইন্তেকালের পর সুলায়মান আমীরুল মুমিনীন হবেন। তখন তাঁর নিকট সকল হাদিয়া, দাসী-বান্দি ও গনিমতের মাল পেশ করবেন।’

‘এটা নির্দেশ নাকি অনুরোধ? মুসা বিন নুসাইর জিজ্ঞেস করলেন।

‘আপনি যা মনে করেন। অশ্বারোহী বলল। ‘আমি আপনার কাছে পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি।’

‘সুলায়মানকে আমার সালাম পৌঁছে দেবেন।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমি এই পাপের কাজ কখনই করব না যে, খলীফার মৃত্যুর অপেক্ষা করব। তাকে বলে দেবেন, আমি খলীফার নির্দেশে এখানে এসেছি, খলীফার সাথেই দেখা করব। আল্লাহ না-করুন, খলীফার ইন্তেকাল হয়ে গেলে তাঁর বড় ছেলেও খলীফা হতে পারেন। এটা তো জরুরী নয় যে, সুলায়মানই তার স্থলাভিষিক্ত হবেন। সে যাইহোক, বর্তমানে ওলিদ হলেন আমীরুল মুমিনীন। তাঁকে মান্য করা আমার কর্তব্য। যা কিছু দেওয়ার আমি তাকেই দেব। যা কিছু নেওয়ার তাঁর কাছ থেকেই নেব। আমি সবার আগে তার সাথেই সাক্ষাত করব।’

‘আমীর, এমনটি করবেন না। অশ্বারোহী বলল। আপনি আমীরুল মুমিনীনের সাথে সাক্ষাত করবেন না। সুলায়মান তাঁর ভাই। তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আমীরুল মুমিনীন অসুস্থ। হেকিম বলেছেন, কেউ যেন তার সাথে সাক্ষাত না করে।’

অশ্বারোহী চলে গেল। মুসা বিন নুসাইর হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি দ্রুত খলীফার সাথে সাক্ষাত করতে চাচ্ছিলেন। আল্লাহ তার ইচ্ছা পূর্ণ করার ব্যবস্থা করলেন। রাজদরবারের এক ব্যক্তি তাকে বলল, ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও খলীফা ওলিদ জুমার নামায আদায় করার জন্য মসজিদে আসছেন।

মূলত খলীফা ওলিদ নামায পড়ার জন্য নয়; নামায পড়ানোর জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, আর বেশি দিন তিনি বাঁচবেন না। তিনি শেষ বারের মত ইমামতের সৌভাগ্য অর্জন করতে চাচ্ছিলেন। প্রকৃত অর্থেই খলীফা ওলিদ ছিলেন একজন মর্দে মুমিন। ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তারের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর অনুমতিতে এবং তাঁরই পৃষ্টপোষকতায় মুহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু আক্রমণ করেছিলেন। তারিক বিন যিয়াদকে আন্দালুসিয়া অভিযানের অনুমতিও তিনি দিয়েছিলেন এবং এ ব্যাপারে সবধরনের সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন।

***

মুসা বিন নুসাইর যখন জানতে পারলেন যে, খলীফা ওলিদ জুমার নামায আদায়ের জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন তখন তিনি নির্দেশ দিলেন, যেসকল উপহার-উপঢৌকন খলীফার জন্য আনা হয়েছে সেগুলো মসজিদে নিয়ে যাও। মুসা বিন নুসাইর মসজিদে এসে খলীফার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর খলীফা মসজিদে উপস্থিত হলেন। মুসা খলীফার সাথে সাক্ষাত করলেন। তারিক বিন যিয়াদ আর মুগীস আর-রুমীও খলীফার সাথে সাক্ষাত করেন। আনন্দের আতিশায্যে খলীফা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।

নামাযের পর মুসা খলীফা ওলিদের সামনে মসজিদেই উপহার সামগ্রী ও গনিমতের মাল প্রদান করেন। বিপুল পরিমাণ মহামূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী দেখে খলীফার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। অন্যরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। খাঁটি স্বর্ণের এত বিপুল পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী তারা কখনও দেখেনি।

খলীফার ভাই সুলায়মান সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। তাঁর চেহারায় সুস্পষ্টরূপে ক্রোধের চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তিনি এমনভাবে মুসা বিন নুসাইরের দিকে তাকাচ্ছিলেন যে, মনে হচ্ছিল, সুযোগ পেলে তিনি মুসাকে জীবন্ত কবর দিয়ে দেবেন। এসকল উপহারসামগ্রী দিয়েই তো তিনি তাঁর মহল সাজাতে চেয়েছিলেন। তাই তো তিনি মুসা বিন নুসাইরের নিকট পয়গাম পাঠিয়েছিলেন, কয়েক দিন অপেক্ষা করার জন্য। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল খলীফা ওলিদ অল্প কয়েক দিনের মেহমান মাত্র।

মুসা বিন নুসাইর উপহারের একেকটি বস্তু বের করছিলেন আর তার বিবরণ দিচ্ছিলেন। অবশেষে তিনি সেই টেবিলটি বের করলেন, যেটি টলেডু বিজিত হওয়ার পর তারিক বিন যিয়াদের হস্তগত হয়েছিল। তারিক বিন যিয়াদ পলায়নপর কয়েকজন পাদ্রি থেকে এই টেবিলটি উদ্ধার করেছিলেন। কথিত আছে, এটি হযরত সুলায়মান আ.-এর টেবিল।

‘আমীরুল মুমিনীন! মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমি এই টেবিলটি টলেডুর পাদ্রিদের থেকে অনেক কষ্ট করে অর্জন করেছি। বিশেষ করে আপনার জন্য এটি আমি নিয়ে এসেছি। এই টেবিলের সাথে যেসকল মণি-মুক্তা আর হীরা-জহরত লাগানো আছে, আজকাল সেগুলো কোথাও পাওয়া যায় না। এটি হযরত সুলায়মান আ.-এর মালিকানাধীন ছিল। কেউ বলতে পারে না, এটি কীভাবে আন্দালুসিয়া এসেছে।’

খলীফা ওলিদ চতুর্দিক থেকে ঘুরে ঘুরে টেবিলটি দেখছিলেন। তার চেহারায় আনন্দের ছাপ যতটুকু পরিলক্ষিত হচ্ছিল, তার চেয়েও বেশি বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠছিল। হযরত সুলায়মান আ.-এর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে খলীফা ওলিদ এটিকে পবিত্র মনে করছিলেন।

ইবনে নুসাইর! খলীফা ওলিদ বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে বলে উঠলেন। আমার জন্য তুমি যে হাদিয়া এনেছ, কেউ তার মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না। এই টেবিলের কথা কী আর বলব! তুমি নিজেই বল, তোমাকে কী পুরস্কার দেব?

‘আমীরুল মুমিনীন! তারিক বিন যিয়াদ বলে উঠলেন। তিনি পাশে দাঁড়িয়ে মুসা বিন নুসাইরের কথা শুনছিলেন, আর মনে মনে দগ্ধ হচ্ছিলেন। এই পুরস্কারের হঙ্গার আমি। এই টেবিল আমীর মুসা অর্জন করেননি, বরং আমার মুজাহিদগণের কৃতিত্ব এই যে, তারা এই টেবিল হস্তগত করতে সক্ষম হয়েছেন। আমীর মুসা এই টেবিল আমার কাছ থেকে হুকুম বলে নিয়ে নিয়েছেন।

খলীফা ওলিদের চেহারার রং তৎক্ষণাৎ পাল্টে গেল। ধীরে ধীরে সেখানে গোসার চিহ্ন ফুটে উঠল। খলীফা ওলিদ তারিক বিন যিয়াদের উপর রাগান্বিত হয়ে পড়েন। তিনি মনে করেছেন, তারিক তার আমীরের উপর মিথ্যা কথা বলার অপবাদ আরোপ করেছেন। মুসা বিন নুসাইরের মত প্রবীণ আমীরের উপর ধোঁকাবাজির অভিযোগ কেউ-ই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না।

‘ইবনে যিয়াদ!’ খলীফা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন। তোমার কি এই অনুভূতি নেই যে, তুমি কত বড় ব্যক্তির উপর কতটা নিকৃষ্ট অপবাদ আরোপ করছ? তোমার কি জানা নেই, এই দুঃসাহসের শাস্তি কত ভয়াবহ হতে পারে? তুমি কি এটা প্রমাণ করতে পারবে যে, এই টেবিল আমীর মুসার প্রচেষ্টায় নয়; বরং তোমার প্রচেষ্টায় আমাদের হস্তগত হয়েছে?

‘হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। একটি নয়; আমি কয়েকটি প্রমাণ পেশ করতে পারব। আমি সেই সিপাহীদেরকে আপনার সামনে উপস্থিত করতে পারব, যারা এই টেবিল একটি ঘোড়াগাড়ি থেকে উদ্ধার করেছিল। আমি আন্দালুসিয়া থেকে সেসকল পাদ্রিদের ডেকে এনে আপনার সামনে উপস্থিত করতে পারব, যারা এই টেবিল নিয়ে টলেডু থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল।

‘আমি তোমাকে এতটা সময় দিতে পারব না। খলীফা ওলিদ বললেন। আমার জীবনের কোন ভরসা নেই। ক’দিন বাঁচব কে জানে? এসকল লোকদের আসতে না জানি কত দিন লেগে যাবে। তোমার কৃতিত্ব আর বিজয়-সাফল্যের কারণে আমি তোমাকে এই সুযোগ দিচ্ছি যে, তুমি তোমার আমীরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, তারপর তোমার দেশে ফিরে যাবে। যদি এটা করতে না পার তাহলে এই অনর্থক অপরাধের শাস্তি ভোগ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও।’

‘আমি এখানেই একটি প্রমাণ পেশ করতে পারি, আমীরুল মুমিনীনা তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এই টেবিলের পায়া চারটি লক্ষ্য করুন। তিনটি পায়া এক রকম, আর চতুর্থটি স্বর্ণ দ্বারা তৈরী। একেবারে সাদামাটা।

খলীফা ওলিদ গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখলেন, তিনটি পায়ায় অত্যন্ত মূল্যবান ও দুর্লভ মণি-মুক্ত আর হীরা-জহরত লাগানো আছে। আর চতুর্থ পায়াটি একেবারেই সাদামাটা।

‘এই টেবিলের চতুর্থ ও আসল পায়া আমার কাছে আছে।’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আমীর মুসা যখন টলেডু আসেন তখন তিনি সর্বপ্রথম আমাকে আমার লসকরের সামনে চাবুক দিয়ে আঘাত করেন। তারপর আমাকে জেলখানায় নিক্ষেপ করেন। আমীর মুসার এ সকল আচরণ দেখে আমার মনে তার নিয়ত সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। অতঃপর আমি যখন তার সাথে এই টেবিল সম্পর্কে আলোচনা করি তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দেন, আমি যেন এই টেবিল তার হাতে সোপর্দ করি। টেবিল আনার জন্য তিনি আমাকে মুক্ত করলে আমি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে টেবিলের একটি পায়া খুলে রাখি। তারপর আমীর মুসাকে বলি, এটি অত্যন্ত রহস্যময় টেবিল। এটি যখন আমাদের হস্তগত হয় তখন এর পায়া চারটিই ছিল। এখন একটি পায়া অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেদিন আমার মনে যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল আজ আপনার সামনে তা বাস্তব রূপ লাভ করেছে। আমীর মুসা টলেডুতে এর চতুর্থ পায় স্বর্ণ দিয়ে তৈরী করিয়েছিলেন। আপনি অনুমতি দিলে এই টেবিলের আসল পায়াটি এখনই আমি আপনার সামনে পেশ করতে পারি।’

খলীফা ওলিদের অনুমতি নিয়ে তারিক বিন যিয়াদ বের হয়ে এসে অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এলেন। তাঁর হাতে টেবিলের আসল পায়াটি দেখা যাচ্ছিল। তিনি মুসা বিন নুসাইরের তৈরীকৃত পায়াটি খোলে আসল পায়া টেবিলের সাথে জোড়ে দিলেন।

‘আমীরুল মুমিনীন!’ মুগীস আর-রুমী বলে উঠলেন। তিনি এখানেই ছিলেন। আমি আমীর মুসা সম্পর্কে আরও কিছু কথা বলতে চাই। এ কথা বলার জন্য আপনার অনুমতি নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। ইসলাম এই অনুমতি দিয়ে রেখেছে। স্বয়ং খলীফাও যদি কোন অন্যায় করেন তাহলে রাজ্যের একজন সাধারণ মানুষও তার কাছে জাবাবদিহি করতে পারে।’

‘বল, মুগীস! তুমি যা বলতে চাও, বল।’ খলীফা ওলিদ বললেন।

 ‘আমীরুল মুমিনীন!’ মুগীস বললেন। আমি মাত্র সাতশ সৈন্য নিয়ে প্রচণ্ড ঝাবিক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতে কর্ডোভা শহর দখল করেছিলাম। আশ-পাশের আরও দুটি কসবাও আমি সেই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিজিত করেছি। সে বিজয়ের কথা আমি আপনার নিকট পরে কখনও বর্ণনা করব। এই বিজয়ের পুরস্কার আমি আল্লাহর কাছ থেকে নেব। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই আমি জিহাদ করেছি। কিন্তু আমীর মুসা আমাকে বলেছেন, তুমি প্রথমে ইহুদি ছিলে, তারপর গোথ সম্প্রদায়ের লোক হয়েছ, অতঃপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছ। এ জন্য তুমি আরব সালারদের সমান হতে পার না। আমি আপনার সামনে পেশ করার জন্য কর্ডোভার গভর্নরকে আমার ব্যক্তিগত বন্দী হিসেবে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু দামেস্ক প্রবেশ করার আগে সর্বশেষ যেখানে আমরা যাত্রা বিরতি করেছিলাম, সেখানে আমীর মুসা আমাকে হুকুম দেন, আমি যেন গভর্নরকে তাঁর হাতে সোপর্দ করি এবং এ কথা প্রচার করি, গভর্নর আমার বন্দী নয়; আমীর মুসার বন্দী। আমি এ কথা মানতে অস্বীকার করলে আমীর মুসা নিজ হাজে গভর্নরকে হত্যা করে ফেলেন।

‘আল্লাহর কসম!’ হঠাৎ খলীফার ছোট ভাই সুলায়মান চিৎকার করে বলে উঠেন। আমীর মুসার এই অপরাধ কিছুতেই ক্ষমার যোগ্য নয়। সে তারিকের টেবিল আর মুগীসের বন্দীকে নিজের বলে দাবি করে–এ কথা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, সে আন্দালুসিয়ায় যে বিজয় অর্জন করেছে, তা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করেনি; খলীফার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য করেছে।

‘তাঁর এই অপরাধও কি ছোট করে দেখার সুযোগ আছে যে, তিনি তাঁর ছেলেকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করেছেন। মুগীস বললেন। তিনি আফ্রিকাকে তিন ভাগে বিভক্ত করে সেখানকার শাসনভার তাঁর অপর তিন ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। আন্দালুসিয়া, আর আফ্রিকায় কোন বার্বার সালারের কি কোনই অধিকার নেই। আন্দালুসিয়ার বাদশাহ আর তার ভয়ঙ্কর সমর শক্তিকে বার্বার সিপাহীরাই পরাস্ত করেছিল। তারাই আমীর মুসার বিজয়ের পথ সুগম করে দিয়েছিল।

‘আর কিছু শুনার মত ক্ষমতা আমার নেই।’ খলীফা ওলিদ বললেন। ‘একদিকে তোমাদের সেই বিজয়গাথা, যা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অনাগত প্রজন্ম তোমাদেরকে নিয়ে গর্ববোধ করবে। তোমাদের সমাধিতে ফুলের সওগাত পেশ করবে। অপরদিকে তোমাদের এই নীচু মানসিকতা আর নিষ্ঠার দৈন্যতা তোমাদেরকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। তোমরা একজন আরেকজনকে হেয় করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছ। আমার ভাবতেও অবাক লাগছে, মুসা বিন নুসাইরের মত প্রবীণ, বিদগ্ধ আর বুদ্ধিমান আমীর যদি এতটা নীচু মানসিকতা পোষণ করেন তাহলে উম্মতে মুহাম্মদীর ভবিষ্যত কি হবে?

খলীফা ওলিদ উঁচু মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আল্লাহকে ভয় করতেন এবং সকল কাজ আল্লাহর রেজামন্দি অনুযায়ী করতে চেষ্টা করতেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। হেকিম তাঁকে বিছানা থেকে উঠতে নিষেধ করেছিলেন। শরীরের এই নাযুক অবস্থা আর হেকিমের নিষেধাজ্ঞাসত্ত্বেও আন্দালুসিয়ার বিজেতাদের আগমনের সংবাদ শুনে তিনি শুধু বিছানা ছেড়েই উঠেননি; বরং জুমা নামায পড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি হাসি মুখেই জুমার নামায আদায় করেন। কিন্তু মুসা বিন নুসাইরের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ, আর তারিক বিন যিয়াদ ও মুগীস আর-রুমীর তীক্ত কথার কারণে এতটাই ব্যথিত হন যে, কথা বলতে বলতে তিনি একেবারে মুষড়ে পড়েন। অবশেষে তিনি শুধু এতটুকুই বলতে পারেন :

এদের সকলকে পঞ্চাশ হাজার করে দেরহাম পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হোক। আমি কাউকেই খালি হাতে ফিরিয়ে দেব না। এখন সকলকে যেতে বললো।

মুহূর্তের মধ্যে খলীফার রোগের প্রকোপ বেড়ে গেল। সাথে সাথে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হেকিম ডেকে পাঠানো হল। হেকিম এসে নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন, তোমরা সকলে মিলে আমীরুল মুমিনীনকে হত্যা করে ফেলেছ।

সকল নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থে এই ঘটনা সবিস্তারে লিপিবদ্ধ আছে। তারা লেখেছেন, খলীফা ওলিদ হযরত সুলায়মান আ.-এর টেবিল মক্কা মুকাররমা পাঠিয়ে দেন। দুই জন ঐতিহাসিক লেখেছেন, মক্কা মুকাররমা পাঠানোর আগে টেবিলের সাথে লাগানো সকল হীরা-জহরত খোলে নেওয়া হয়। তারপর এই টেবিল ইতিহাসের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যায়।

***

এই ঘটনার পর খলীফা ওলিদ আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। কিছু দিন পর তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়। খলীফা অসুস্থ থাকাকালীন মুগীস আর-রুমী খলীফার ছোট ভাই সুলায়মানের কাছে আমীর মুসা বিন নুসাইরের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পেশ করেন। তারিক বিন যিয়াদও মুসা বিন নুসাইরের আচরণে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি সুলায়মানের নিকট মুসা সম্পর্কে কোন অভিযোগ না করলেও সুলায়মান মুসার দুশমন হয়ে গিয়েছিলেন। খলীফা ওলিদ জীবদ্দশায় বড় পুত্রকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু লিখিত হুকুমনামা জারি করার কোন ফুরসত তিনি পাননি। সুলায়মান এই সুযোগের ফায়দা উঠিয়ে নিজেই খলীফা হয়ে বসেন এবং খুতবায় তার নাম যুক্ত করে দেন। খলীফা হওয়া মাত্রই সুলায়মান যে কাজটি করেন, তা হল তিনি মুসা বিন নুসাইরকে দরবারে ডেকে পাঠান।

মুসা বিন নুসাইরের আগমনের সংবাদ শুনামাত্রই সুলায়মান বার্তাবাহকের মাধ্যমে এই সংবাদ পাঠিয়ে ছিলেন যে, তিনি যেন তার সাথে নিয়ে আসা হাদিয়া-তোহফা আর গনিমতের মাল খলীফার নিকট পেশ না করেন। কিন্তু মুসা বিন নুসাইর সুলায়মানের কথা শুনেননি। এ কারণে সুলায়মান মুসার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। পরবর্তীতে হাদিয়া-তোহফার আধিক্য দেখে সুলায়মানের মনের অসন্তষ্টি দুশমনীর রূপ ধারণ করে। সুলায়মান যখন মুসাকে দরবারে ডেকে পাঠান তখন সেখানে সুলায়মানের আজ্ঞাবহ ও মোসাহেব শ্রেণির লোজন উপস্থিত ছিল।

 ‘মুসা বিন নুসাইর!’ সুলায়মান বললেন। আজ থেকে তুমি কোন রাজ্যের আমীর নও। তুমি একজন মিথ্যুক, খেয়ানতকারী ও বদদ্বীন লোক।

সুলায়মান ভরা দরবারে টেবিলের ঘটনা সবাইকে শুনান। অতঃপর মুগীস আর-রুমী যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, তা শুনান এবং নিজের পক্ষ থেকে বেশকিছু অভিযোগ উত্থাপন করে এই হুকুম প্রদান করেন যে, একে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করো।’

প্রায় সকল মুসলিম-অমুসলিম ইতিহাসবিদগণ লেখেছেন, মানুষ হিসেবে সুলায়মান বড় ভাই ওলিদের তুলনায় একেবারে উল্টো ছিলেন। ওলিদকে দিনের উজ্জ্বলতার সাথে তুলনা করা হলে সুলায়মানকে তুলনা করা হত নিকষ কালো অন্ধকার রাতের সাথে। সুলায়মানই ছিলেন প্রথম খলীফা যিনি রাজতন্ত্রের বুনিয়াদ স্থাপন করেছিলেন। শরীয়তের বিধান অনুযায়ী উচিত ছিল, মুসা বিন নুসাইরকে আইনের সম্মুখীন করা। শাস্তি বা নিষ্কৃতি–যেটাই তার প্রাপ্য হবে, কাজী সেই ফয়সালা প্রদান করবেন। কিন্তু সুলায়মান ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ হাতে আইন তুলে নেন এবং মুসা বিন নুসাইরকে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দেন। সুলায়মান শুধু এতটুকু করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি এই নির্দেশ জারি করেন যে, এই কয়েদিকে এতটা শাস্তি প্রদান করা হোক, যেন তার বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়ে, কিন্তু মৃত্যুবরণও যেন না করে।

ইসলামে এ ধরনের শাস্তির কোন অবকাশ তো নেই-ই; বরং শরীয়তের দৃষ্টিতে এমন শাস্তি জঘন্য অপরাধের অন্তর্ভুক্ত। মুসার বয়স প্রায় আশি বছর হয়ে গিয়েছিল। সামান্য কষ্ট স্বীকার করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারপরও তাকে প্রচণ্ড রোদে উত্তপ্ত বালুর মধ্যে শুইয়ে রাখা হত। কখনও তাঁকে খুটির সাথে বেঁধে রাখা হত।

অসহ্য জুলুম-নির্যাতনের কারণে মুসা বিন নুসাইরের শরীরের চামড়া উঠে গোশত বের হয়ে গিয়েছিল। খলীফা ওলিদ যেসকল পুরস্কার মুসা বিন নুসাইরকে দিয়ে ছিলেন সুলায়মান সেগুলোসহ মুসা বিন নুসাইরের স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেন। পরিণামে মুসা বিন নুসাইরের গোটা পরিবার পথের ফকিরে পরিণত হয় এবং মেহনত-মজদুরী করে বহু কষ্টে দু-বেলা খাদ্য যোগার করতেও ব্যর্থ হয়।

এত কিছুর পরও সুলায়মানের জিঘাংসা চরিতার্থ হয়নি। এক-দেড় বছর পর যখন মুসা বিন নুসাইরকে চিনাও যেত না, তখন সুলায়মান হজ্জে যাওয়ার ইচ্ছা করলে মুসা বিন নুসাইরকে হাত-পায়ে বেড়ি পরিয়ে তার সাথে মক্কা শরীফ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকাল বেলা মুসাকে কাবা গৃহের অদূরে বসিয়ে দেওয়া হত, যেন তিনি হাত পেতে লোকদের কাছে ভিক্ষা করেন। অনবরত জুলুম-নির্যাতন আর দুঃখ-বেদনার ভারে ন্যজ মুসা বিন নুসাইর তাঁর ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা ভুলে গিয়েছিলেন। সারাদিন তিনি হাজিদের সামনে হাত পেতে ভিক্ষা চাইতেন। সন্ধ্যা বেলা সুলায়মানের লোক এসে তাকে সেখান থেকে নিয়ে যেত। ভিক্ষাবৃত্তি করে সারাদিন তিনি যা উপার্জন করতেন, সেগুলো তার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হত। সুলায়মান তার উপর জরিমানা ধার্য করেছিলেন। তাঁর থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অর্থ দিয়ে জরিমানার হিসাব পূর্ণ করা হত। তাঁকে বলা হয়েছিল, ভিক্ষা করে জরিমানার অর্থ উপার্জন করতে। যখন তিনি জরিমানার সকল অর্থ উসুল করতে পারবেন তখনই তাকে মুক্ত করে দেওয়া হবে।

এই হল আন্দালুসিয়া বিজেতা মুসা বিন নুসাইরের শেষ পরিণতি, যার আলোচনা দিয়ে আমরা এই উপাখ্যান শুরু করেছিলাম। মুসা বিন নুসাইরের সাথে যে নির্মম আচরণ করা হয়েছে, তার বিস্তারিত আলোচনা আমরা শুরুতে করে এসেছি। এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়–এতটা নির্দয় ও নির্মম শাস্তিই কি মুসা বিন নুসাইরের প্রাপ্য ছিল। এটা ঠিক যে, মুসা বিন নুসাইর খলীফার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য তারিক বিন যিয়াদ আর মুগীস আর-রুমীর সাথে যে আচরণ করেছেন, তা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য ছিল না। তিনি অত্যন্ত নীচু মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তারপরও মুসা বিন নুসাইরের বীরত্ব, সামরিক প্রজ্ঞা ও বিজয়গাথা এতটাই সুবিশাল ছিল যে, তাঁর এই অপরাধকে সহজেই ক্ষমা করে দেওয়া যেত। মুসা বিন নুসাইরের গোটা জীবন অতিবাহিত হয়েছে রণাঙ্গনে শাহসওয়ারী করে।

মুসা বিন নুসাইর বার্বার সম্প্রদায়কে আরবদের তুলনায় নীচু জাত মনে করেছিলেন, কিন্তু তিনিই সভ্যতা বিবর্জিত, উশৃঙ্খল বাবার সম্প্রদায়কে ইসলামের ঝাণ্ডাতলে সমবেত করেছিলেন। বার্বাররা কখনও কারও বশ্যতা স্বীকার করেনি। এই মুসা বিন নুসাইরই তো তাদেরকে দামেস্কের খেলাফতের অনুগত করেছিলেন। তারিক বিন যিয়াদের মতো সিপাহসালার তো তাঁরই সৃষ্টি, যিনি অতি অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে আন্দালুসিয়ার সামরিক শক্তিকে তছনছ করে দিয়েছিলেন; যিনি আন্দালুসিয়ার সীমান্ত পার হয়ে ফ্রান্সের সীমানা পর্যন্ত ইসলামের বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন।

মুসা বিন নুসাইর যে কতটা মহান ব্যক্তি ছিলেন, একটি ঘটনা থেকে তাঁর সেই পরিচয় পাওয়া যায়। ঘটনাটি হল–একদিন খলীফা সুলায়মান হুকুম দিলেন, মুসা বিন নুসাইরকে হত্যা করে ফেলা হোক। সেই মজলিসে রাজ্যের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইবনুল মুহাল্লাব উপস্থিত ছিলেন। তিনি মুসা বিন নুসাইরের হিতাকাক্ষী ছিলেন। খলীফা সুলায়মানের উপরও তাঁর যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তিনি সুলায়মানকে বললেন, মুসা বিন নুসাইরকে ক্ষমা করে দিতে। সুলায়মান ইবনুল মুহাল্লাবের এতটুকু অনুরোধ রাখলেন যে, তিনি মুসা বিন নুসাইরকে হত্যা করলেন না বটে; কিন্তু তাকে ক্ষমাও করলেন না। ইবনুল মুহাল্লাব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে কয়েদখানায় গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন, মুসা বিন নুসাইর প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মাথা কাঁপছে। কিছুক্ষণ পর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

‘এঁকে তাঁর কুঠরিতে নিয়ে চলো।’ আমীর ইবনুল মুহাল্লাব বললেন। এঁকে জলদি পানি পান করাও।’

প্রহরীরা মুসা বিন নুসাইরকে উঠিয়ে কুঠরিতে নিয়ে গেল। চোখে-মুখে পানির ছিটা দেওয়া হল। কিছুক্ষণ পর তাঁর হুশ এলো।

“ইবনে নুসাইর, আমাকে চিনতে পারছ?’ ইবনুল মুহাল্লাব জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যাঁ!’ মুসা বিন নুসাইর বহু কষ্টে চোখ খোলে উত্তর দিলেন। তুমি আমার বন্ধু ইবনুল মুহাল্লাব। তুমি আমাকে মুক্ত করতে এসেছ, নাকি দেখতে এসেছ, আমি কবে মারা যাব?

‘আজই তোমার মৃত্যুর ফয়সালা হয়েছিল, ইবনে নুসাইর ইবনুল মুহাল্লাব বললেন। সুলায়মান তোমাকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছিল। আমি তোমার প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি। কিন্তু তোমার এই নিকৃষ্ট দুশমন তোমাকে ক্ষমা করতে রাজি হয়নি। ইবনে নুসাইর, তুমি তো এতটা নির্বোধ ছিলে না। আমার ভাবতেও অবাক লাগে, তুমি এই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় কেন দিলে? খলীফা ডাকতেই তুমি কেন চলে এলে? তোমার যোগ্যতা আর সাহসিকতার কোন তুলনা হয় না। তুমি নিজেই তোমার তুলনা। তুমি জানতে যে, খলীফা ওলিদ অসুস্থ। তিনি এতটাই বয়োবৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, অসুস্থতা কাটিয়ে উঠা তার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তোমার ভাল করেই জানা ছিল যে, ওলিদের পর তার ভাই সুলায়মান খেলাফতের মসনদে সমাসীন হবেন। তিনি তোমার পুরাতন দুশমন। তোমার বিরুদ্ধে তাঁর সামান্য বাহানার প্রয়োজন ছিল। আর সেটা তিনি পেয়ে গেছেন।

 ‘আমি যদি না আসতাম তাহলে ওলিদ অসন্তুষ্ট হতেন।’ মুসা বিন নুসাইর বললেন। তার নির্দেশ খুবই কঠিন ছিল।’

‘তুমি না আসলেই ভাল হত, ইবনে নুসাইর! তুমি না আসলেই ভাল হত। ইবনুল মুহাল্লাব বললেন। “তুমি একটি বিশাল রাজ্য জয় করেছিলে। তারিক বিন যিয়াদ ও মুগীস আর-রুমীর মতো অন্যান্য সালাররাও তোমাকে শুধু আমীর নয়; জন্মদাতা পিতার মতো শ্রদ্ধা করত। তাছাড়া তোমার কাছে অসীম সাহসী যুদ্ধজয়ী বিশাল এক বাহিনী ছিল। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সম্পদের কোন কমতি ছিল না। বার্বার সম্প্রদায় তোমার অনুগত ছিল। রাজ্য এতটাই উর্বর যে সেখানে খাদ্যের কোন অভাব নেই। তারপরও তুমি দামেস্কের জাহান্নামে কেন এলে? নিজেকে আন্দালুসিয়ার স্বাধীন বাদশাহ ঘোষণা করে দিতে! সমুদ্রের ওপারে কোন খলীফাই দামেস্ক থেকে তোমার বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাত না।’

‘ইবনুল মুহাল্লাব, আমি গুনাহগার ঠিকই, কিন্তু আমি আমীরুল মুমিনীনের হুকুম অমান্য করতে চাচ্ছিলাম না। মুসা বিন নুসাইর বললেন। আমি তারিক বিন যিয়াদকে বেত্রাঘাত করেছিলাম। কারণ, সে আমার হুকুম অমান্য করেছিল। যদি আমাদের বিজিত রাজ্যের আমীরগণ নিজেদেরকে স্বাধীন বাদশাহ ঘোষণা করে তাহলে ইসলামী সাম্রাজ্য খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে, উম্মতে মুহাম্মদীর ঐক্যের বাঁধন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, ইসলাম মক্কা মুকাররমার মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।

‘ইবনে নুসাইর, ধন্যবাদ তোমাকে। ইবনুল মুহাল্লাব বললেন। আমি যা বললাম, তোমার তাই করা উচিত ছিল–আমি তা বলছি না। আমি তোমার মনের কথা জানতে চাচ্ছিলাম। কথা দিচ্ছি, খলীফা সুলায়মানের সাথে তোমার সমঝোতার ব্যাপারে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব।’

ইবনুল মুহাল্লাবের কথার উত্তরে মুসা বিন নুসাইর যে কথা বলেছিলেন, তা আজও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।

 ‘ইবনুল মুহাল্লাব, পানির প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি এতটাই তীক্ষ্ণ যে, তারা নদী-সমুদ্রের তলদেশের ধূলিকণা পর্যন্ত দেখতে পারে, কিন্তু তাদেরকে ধরার জন্য যে জাল নিক্ষেপ করা হয় তা দেখতে পায় না। আমি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলাম ঠিকই; কিন্তু সুলায়মানের জালে আটকা পড়ে গেছি।’

ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, ইবনুল মুহাল্লাব মুসা বিন নুসাইরের বীরত্ব ও অসংখ্য বিজয়-কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করে সুলায়মানের কাছে থেকে তাঁর মুক্তির ব্যাপারে আদেশনামা জারি করতে অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু সুলায়মান এতটাই কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন যে, শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তিনি মুসা বিন নুসাইরকে ক্ষমা করেননি।

এ সময় আচানক আততায়ীর হাতে মুগীস আর-রুমী নিহত হয়ে যান। কে বা কারা তাঁকে হত্যা করেছে, তার কোন হদিস পাওয়া গেল না। ধারণা করা হয় যে, আমীর মুসার কোন ভক্ত বা আত্মীয় তাঁকে হত্যা করেছে। কারণ, মুসা বিন নুসাইরের এই অবস্থার জন্য তিনি অনেকটা দায়ী ছিলেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, সুলায়মানই ছিলেন মুগীসের হত্যাকারী।

সুলায়মান খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর পরই ইসলামী সালতানাতের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করে ফেলেন। সুলায়মান হিন্দুস্তানে ইসলামের ঝাণ্ডা স্থাপনকারী সিন্দু বিজেতা মুহাম্মদ বিন কাসেমকে দামেস্কের কারাগারে বন্দী করে অসহনীয় কষ্ট দিয়ে হত্যা করেন। সমরকন্দ বিজেতা কুতায়বা বিন মুসলিমকে একই কারাগারে হত্যা করেন। ইরাকের গভর্নর ইয়াযিদ বিন আবি মুসলিমকে–যিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন সুলায়মানের নির্দেশে দামেস্কের কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। ভাগ্যের জোরে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। পাঁচ বছর তিনি বন্দী ছিলেন। সুলায়মানের মৃত্যু হলে তিনি মুক্ত হয়ে আফ্রিকার আমীর নিযুক্ত হন।

ইবনুল মুহাল্লাব ছিলেন সুলায়মানের প্রকৃত দোস্ত। ইবনুল মুহাল্লাব সবসময় আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে থাকতেন। দু-হাতে পয়সা উড়াতেন। একবার তিনি বায়তুল মালের ষাট লক্ষ দেরহাম আত্মসাৎ করলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাঁকে আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত দেওয়ার হুকুম দেন, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাঁকে গ্রেফতার করে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করেন। তিনি কয়েদখানা থেকে পালিয়ে যান। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও খলীফা ওলিদের মৃত্যু হলে তিনি ফিরে আসেন। সুলায়মানের সাথে তার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। সুলায়মান তাকে পূর্ব পদে পুনর্বহাল করে বলেন, ‘ইবনুল মুহাল্লাবের সন্তানাদির দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালে আমি তার চোখ উপড়ে ফেলব।

সুলায়মানের এই ঘোষণা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। এ থেকে বুঝা যায়, সুলায়মান যেমন বদদ্বীন ও অসঙ্কর্মপরায়ন ছিলেন, তেমনি বদদ্বীন ও অসৎকর্মপরায়ন লোকদেরকেই বড় বড় পদে নিযুক্ত করে রেখেছিলেন।

তারিক বিন যিয়াদ বলতে গেলে অনেকটা ভাগ্যবান ছিলেন। কারণ, তিনি সুলায়মানের হাতে নিহিত হননি। তারিক ছিলেন বাবার সম্প্রদায়ের। সুলায়মানের সাথে তাঁর খান্দানি কোন দুশমনি ছিল না। নেতৃত্ব বা রাজনীতি নিয়ে কোন দ্বন্দ্ব-কলহও ছিল না। খলীফা ওলিদ মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন যিয়াদকে অনেক উপহার-উপঢৌকন দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। তিনি উভয়কে একটি করে বাড়ি প্রদান করেছিলেন। সুলায়মান মুসা বিন নুসাইরকে উপহারের অর্থ ও বাড়ি থেকে বঞ্চিত করেন, আর তারিক বিন যিয়াদকে আরও বেশি হাদিয়া-তোহফা প্রদান করে এই নির্দেশ দেন, তিনি যেন বাকী জীবন নিজ গৃহে অতিবাহিত করেন।

কোন ইতিহাসবিদই লেখেননি যে, তারিক বিন যিয়াদ বাকী জীবন দামেস্কেই অতিবাহিত করেছেন নাকি স্বীয় জন্মভূমি উত্তর আফ্রিকা চলে গিয়েছিলেন? ইতিহাসে শুধু এতটুকু পাওয়া যায় যে, সুলায়মান তাঁকে কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন। এভাবেই আন্দালুসিয়ার মহান বিজেতা গুমনামীর অন্ধকারে হারিয়ে যান। অথচ তিনি এই চিন্তা করে আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে যুদ্ধজাহাজগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, যেন ফিরে যাওয়ার কোন উপায় অবশিষ্ট না থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নযোগে যে মহান যোদ্ধাকে বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, তিনি ইতিহাসের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাবেন–এটা কিছুতেই হতে পারে না। ইতিহাসের পাতায় তারিক বিন যিয়াদ এমনই এক মহাপুরুষ হয়ে বেঁচে আছেন, যিনি শত-সহস্র বছর পরও মুসলিম জনপদে ও প্রজন্ম পরম্পরায় যুবসমাজের হৃদয়ে বীরত্ব ও সাহসিকতার উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বিরাজ করছেন। কোন অমুসলিমও যখন আন্দালুসিয়ার ইতিহাস চর্চা করেন তখন তিনিও তারিক বিন যিয়াদকে শুধুমাত্র একজন বীরই মনে করেন না; বরং তার প্রতি স্বশ্রদ্ধ সালাম পেশ করেন।

***

মুসা বিন নুসাইর কারাগারের অন্ধকারে ধীরে ধীরে মুত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ওদিকে তার ছেলে আবদুল আযীয আন্দালুসিয়ার জনসাধারণের জীবনধারা পাল্টে দিচ্ছিলেন। আবদুল আযীয ছিলেন দুনিয়াবিমুখ ও পুণ্যবান ব্যক্তি। ইসলাম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে উৎসর্গিত প্রাণ। তার বিজ্ঞতাপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা এবং ইসলামী নিয়ম-নীতির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরী করে বাহ্যত তাদেরকে এক জাতিতে পরিণত করেছিল।

আন্দালুসিয়ায় বেগার খাটানো ও দাসত্ব প্রথা চালু ছিল। সেখানকার খ্রিস্টান ও ইহুদি আমীর-উমারা, নেতৃবর্গ ও জায়গিরদাররা গরীব কৃষক-শ্রমিককে নামমাত্র খাদ্যের বিনিময়ে ব্যবহার করত। এসকল দরিদ্র লোকদের কৃষি জমি ক্রয় করা ও গৃহ নির্মাণের কোন অধিকার ছিল না। আবদুল আযীয এই অমানবিক প্রথা বন্ধ করার জন্য হুকুম জারি করেন। তিনি কৃষক-শ্রমিকদেরকে জমি ক্রয়ের ও গৃহ নির্মাণের অধিকার প্রদান করেন। জনসাধারণের মাঝে এই হুকুমের প্রভাব এতটা ব্যাপক আকারে পরিলক্ষিত হয় যে, দলে দলে লোকজন মুসলমান হতে শুরু করে। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের উপাসনালয়গুলো বিরান হতে থাকে। দিন দিন মসজিদসমূহে নামাযীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আন্দালুসিয়ার বিভিন্ন শহরে আজও সেই সময়ের নির্মিত অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন মসজিদ অবশিষ্ট আছে।

আবদুল আযীয আন্দালুসিয়ার নির্যাতিত-নিষ্পেষিত জনগণকে সম্মান ও মর্যাদার জীবন প্রদান করেন। তিনি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেননি। তবে পাদ্রিরা ধর্মের নামে যে অপকর্ম ও অধর্ম চালু করেছিল, তিনি সেগুলোর শিকড় উপড়ে ফেলেন। পাদ্রিরা জনসাধারণের উপর যে শাসন-শোষণ ও জুলুম-নির্যাতন চালাত চিরতরে তার পথ বন্ধ করে দেন।

আবদুল আযীয এমন সময় আন্দালুসিয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন গোটা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা ও বিশ্বাসহীনতার পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। লোকজন ঘর-বাড়ি ছেড়ে আশ-পাশের রাজ্যে পালিয়ে যাচ্ছিল। আবদুল আযীয গোটা রাজ্যে এমন এক শান্তির পরিবেশ তৈরী করেন যে, পালিয়ে যাওয়া লোকজন পুনরায় যার যার গৃহে ফিরে আসে। যেসকল জায়গিরদার ও নবাবরা মুকুটহীন বাদশাহ সেজে বসেছিল তিনি তাদের সেই বাদশাহী খতম করে দিয়ে ছিলেন এবং জনগণের প্রতি তাদের হারিয়ে যাওয়া সম্মান ও মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের এমন প্রসার ঘটিয়ে ছিলেন যে, ইতিপূর্বে যেসকল লোক দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করত, তারাও এখন সুখ-স্বাচ্ছন্দময় জীবনযাপন করছিল।

আবদুল আযীয প্রকৃত জ্ঞানী ও গুণী লোক ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র কথার মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসার করেননি; বরং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করেছিলেন। অন্য ধর্মের লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গর্ব অনুভব করত। ফজরের নামায ও জুমার নামাযের ইমামতি তিনি নিজেই করতেন। এতকিছুর পরও তাঁর খ্রিস্টান স্ত্রী ছিল তাঁর জন্য কমজোরীর বড় কারণ। আবদুল আযীযের মতো অকুতোভয় সিপাহসালার, সুভিজ্ঞ আলেমে দ্বীন এবং বিচক্ষণ শাসক যখন এজেলুনার কাছে আসতেন তখন তিনি একজন দুর্বলচিত্রের মানুষে পরিণত হয়ে যেতেন। খ্রিস্টান হওয়ার কারণে এজেলুনা বেপর্দা ঘুরাফেরা করত। সে তার অধীনস্থদের উপর হুকুম চালাত। তার মনের পুরনো ইচ্ছা ছিল, সে রাজরানী হবে। প্রকৃত অর্থে সে রানী হয়ে গিয়েছিল। তার চাল-চলন আর আচার-আচরণ ছিল রানীর মতো।

আবদুল আযীযের দুর্বলতার মূল কারণ হল তার হৃদয়ে এজেলুনার প্রতি সীমাহীন মহব্বত ছিল। এজেলুনা তার কথার জাদু আর আকর্ষণীয় অঙ্গ-ভঙ্গি দিয়ে আবদুল আযীযের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিল। আবদুল আযীয ছিলেন সহজ-সরল মানুষ। তিনি বাদশাহ হতে চাইতেন না। কিন্তু এজেলুনা এমন রীতি-নীতি চালু করেছিল যে, আবদুল আযীযকে সকলেই বাদশাহর মতোই সম্মান প্রদর্শন করত। কেউ আবদুল আযীযের সাথে সাক্ষাত করার জন্য আসলে এজেলুনা খাদেমের মাধ্যমে বলে পাঠাত, আমীরের সাথে এখন সাক্ষাত করা যাবে না। ওমুক সময় এসো। যদি কোন সালার বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দেখা করতে চাইত তাহলে এজেলুনা নিজেই তাদের সাথে দেখা করে কথাবার্তা বলত। তারা কখনও সামরিক ও প্রশাসনিক কোন বিষয়ে আমীরের ফয়সালা জানতে চাইলে অধিকাংশ সময় এজেলুনা নিজেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিত। মুসলিম সমাজে এ জাতীয় কাজকর্মকে অত্যন্ত নিন্দনীয় মনে করা হয়। আমীরের উপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করবে, ফয়সালা প্রদান করবে–এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। ইসলামের বিধান হল, কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সিপাহসালার, এমনকি আমীরুল মুমিনীনের সাথে যে কোন ব্যক্তি যে কোন সময় বিশেষ প্রয়োজনে সাক্ষাত করতে পারবে। প্রয়োজনে অর্ধ রাত্রিতেও তাঁদেরকে ঘুম থেকে জাগানো যাবে।

এজেলুনা যে নিয়ম চালু করেছিল তাতে করে সালারগণ ও উচচপদস্থ কর্মকর্তাগণ দিন দিন অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ছিলেন। এ ব্যাপারে আবদুল আযীযের কাছে তারা অভিযোগ নিয়ে গেলে তিনি হেসে উড়িয়ে দিতেন। একদিকে ছিল আবদুল আযীযের সুমহান কীর্তি। তিনি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার সাথে সাথে মানুষের অন্তরে ইসলামের প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি করেছিলেন। দিন-রাত মেহনত করে দেশ ও জনগণের জন্য ঈর্ষনীয় পর্যায়ের উন্নতি সাধন করেন। জনহিতকর আইন-কানুন প্রণয়ন করেন। ফলে সাধারণ মানুষ আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ার সাথে সাথে ইজ্জত ও সম্মানের জীবন লাভ করে। অপরদিকে আবদুল আযীয এক নারীকে নিজের উপর অত্যধিক প্রাধান্য দিয়ে অকৃত্রিম বন্ধুদের কাছে বিরাগভাজন হয়ে পড়েন।

এজেলুনা আবদুল আযীযের জন্য নিয়মিত দরবারের আয়োজন করত। সে আবদুল আযীযের পিছনে দাঁড়ানোর জন্য দু’জন বিশেষ প্রহরী নিযুক্ত করেছিল। তারা রাজা-বাদশাহদের প্রহরীর ন্যায় জাঁকজমকপূর্ণ লেবাস পরিধান করত। এ প্রথাও ইসলাম সমর্থিত ছিল না।

ঐতিহাসিকগণ লেখেন, এজেলুনা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপরও তার কর্তৃত্ব চালাত। একদিন উচচপদস্থ কর্মকর্তাগণ সকলে মিলে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, এ ব্যাপারে খলীফাকে সব কিছু জানানো হবে। কোন কোন কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত এমন ছিল যে, শেষ বারের মতো আবদুল আযীযকে সতর্ক করা হোক, তিনি যেন এই নারীর মোহজাল থেকে বের হয়ে আসেন, অন্যথায় এর পরিণতি হবে এই রাজ্যের জন্য এবং ইসলামের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। অবশেষে শেষোক্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করার জন্য সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেন।

***

আবদুল আযীয সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতেন। তিনি রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে সময় দিতে পারতেন না। আসল কারণ হল, এজেলুনা আবদুল আযীযকে তাদের সাথে বসার সুযোগ দিত না। এ সময় এজেলুনা আবদুল আযীযকে এই পরামর্শ দেয় যে, আপনি এই রাজ্যের বিধানদাতা। আমি লক্ষ্য করছি, মুসলিম প্রশাসকগণ আপনার সমকক্ষতা দাবি করছেন, আপনি তাদেরকে বলুন, তারা যখন আপনার সাথে সাক্ষাত করতে দরবারে আসবে তখন তারা যেন ঝুঁকে আপনাকে সালাম করে। এতেকরে তাদের উপর আপনার প্রভাব বজায় থাকবে। অন্যথায় দেখবেন, একদিন তারা আপনার হুকুম মানতে অস্বীকার করে বসবে।’

‘না, এজেলুনা! আমি এমন হুকুম দিতে পারি না। আবদুল আযীয বললেন। আমি এতটা নীচে নামতে পারব না। আমার আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ হল, কোন মানুষ কোন মানুষের সামনে মাথা ঝুকাবে না। একমাত্র আল্লাহর সামনে মাথা ঝুঁকাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনেও কেউ মাথা ঝুকাত না। কারও সামনে মাথা ঝুঁকানো আর কাউকে মাথা ঝুঁকাতে হুকুম করা সমান অপরাধ।

এজেলুনা আবদুল আযীযকে তার সমতে আনতে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। এজেলুনা খুবই শক্ত ধাতুর তৈরী মেয়ে মানুষ ছিল। সে তার কথা না মানিয়ে ক্ষান্ত হওয়ার পাত্রী ছিল না। সে আবদুল আযীযের সাথে সাক্ষাত প্রার্থীদের জন্য একটি পৃথক কামরা তৈরী করালো। সে কামরায় প্রবেশের জন্য এমন দরজা লাগানো হল যে, প্রবেশকারীকে প্রায় রুকুর মতো মাথা ঝুঁকিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে হত। দরজার সামনে রাখা কুরসিতে আবদুল আযীয বসে থাকতেন। এভাবে এজেলুনা তার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করল।

সালারগণ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ দরজা দেখেই বুঝতে পারলেন যে, কী উদ্দেশ্যে এই দরজা বানানো হয়েছে। একজন শাহী কর্মচারীও তাদেরকে বলে দিল যে, আমীরের সামনে মাথা ঝুঁকানোর জন্যই এজেলুনা এই দরজা লাগিয়েছে। এটা তাদের প্রতি এমন এক আঘাত ছিল যে, কেউই তা সহ্য করতে পারলেন না। সকলেই বলতে লাগলেন, আমাদেরকে অপমান করার জন্য নয়; বরং ইসলামকে অপমান করার জন্যই এজেলুনা এ ব্যবস্থা করেছে।

এ সময়টিতে আবদুল আযীয আন্দালুসিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ খাজনা উসুল করে দারুল খেলাফত দামেস্ক পাঠানোর ব্যবস্থা করছিলেন। এটাই ছিল আন্দালুসিয়া থেকে পাঠানো প্রথম খাজনা। একজন সহকারী সালার এই খাজনা নিয়ে যাচ্ছিলেন। ইতিহাসে এই সহকারী সালারের নাম লেখা হয়নি।

***

সহকারী সালার দামেস্ক পৌঁছে খলীফা সুলায়মানের সাথে সাক্ষাত করেন এবং আন্দালুসিয়া থেকে নিয়ে আসা খাজনা ও হাদিয়া-তোহফা পেশ করেন।

‘আন্দালুসিয়ার খবর কী? খলীফা সুলায়মান জানতে চান। কেমন চলছে আন্দালুসিয়ার হুকুমত?

‘হুকুমত তো ঠিকই চলছে, আমীরুল মুমিনীন!’ সহকারী সালার বললেন। ‘কিন্তু হুকুমত পরিচালনাকারী ঠিক মতো চলছেন না।’

‘খোলাসা করে কথা বলো।’ সুলায়মান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন। মনে হচ্ছে, সেখানে এমন কিছু হচ্ছে, যা হওয়া উচিত নয়।’

‘আমীরুল মুমিনীন! সহকারী সালার বললেন। আপনার প্রশ্নের জবাব আন্দালুসিয়ার সকল সালার ও কর্মকর্তাগণ দিয়েছেন। তাঁরা আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন, আমি যেন সেখানকার প্রকৃত অবস্থা আপনার সামনে তুলে ধরি। মূলত আন্দালুসিয়ায় এখন এক অমুসলিম নারীর হুকুমত চলছে।’

‘এ তো সেই খ্রিস্টান নারী নয়, যাকে আবদুল আযীয শাদী করেছে?’ সুলায়মান জিজ্ঞেস করলেন। সে নারী সম্ভবত এখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি!

‘হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন! তার কথাই বলছি।’ সহকারী সালার বললেন। ‘তার নাম এজেলুনা। আমীর আবদুল আযীয তাকে রানী বানিয়ে রেখেছেন। সে বড় বড় প্রশাসকগণকেও আন্দালুসিয়ার আমীরের সাথে সাক্ষাত করতে দেয় না। সেখানে বাদশাহী দরবার বসে, আর হুকুম চলে এজেলুনার।

সহকারী সালার খলীফাকে এজেলুনা সম্পর্কে সবকিছু বললেন। ছোট দরজার কথাও বললেন। অবশেষে জানালেন, একজন প্রশাসকও আমীরের প্রতি সন্তুষ্ট নন। আমীরের প্রতি শুধু অসন্তুষ্ট থাকলে কোন চিন্তা ছিল না। চিন্তার বিষয় হল, সিপাহী, শহরের অধিবাসী ও প্রশাসকগণ যে কোন সময় বিদ্রোহ করে বসতে পারে। সকলের মনেই আমীরের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ বিরাজ করছে।

খলীফা আর কিছু শুনতে চাচ্ছিলেন না। তিনি রাগে-গোসায় অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েছিলেন। মুসা বিন নুসাইরের খান্দানের সদস্যদের বিরুদ্ধে সামান্য বাহানাই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। মুসা বিন নুসাইরের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও ছিল যে, তিনি খলীফার অনুমতি ছাড়াই তার ছেলেকে আন্দালুসিয়ার আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। সুলায়মান তার পছন্দের কাউকে এই পদ দিতে চাচ্ছিলেন।

‘তুমি আন্দালুসিয়া ফিরে যাও।’ সুলায়মান বললেন। “সকলকে বলো, আমি অতিসত্ত্বর তাদের এই সমস্যার সমাধান করব।

***

আন্দালুসিয়ার আমীর আবদুল আযীযের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ ছিল, তা এভাবে নিরসন হল যে, একদিন তিনি ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন। প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহা শেষ করে যেই সূরা ওয়াকিয়া তেলাওয়াত শুরু করেন, ওমনি প্রথম কাতার থেকে এক ব্যক্তি বিদ্যুৎবেগে সামনে অগ্রসর হয়ে চোখের পলকে তরবারী বের করে এক আঘাতে তার মাথা দেহ থেকে পৃথক করে ফেলে। নামাযরত লোকজন কোন কিছু বুঝার আগেই আঘাতকারী কর্তিত মস্তক উঠিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

এই ঘটনার বিশ-পঁচিশ দিন পর আবদুল আযীযের কর্তিত মস্তক একটি চামড়ার থলিতে ভরে মখমলের কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে দামেস্কে খলীফা সুলায়মানের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। কর্তিত মস্তক দেখে খলীফা কারারক্ষীকে নির্দেশ দেন, ‘আন্দালুসিয়ার আমীরের কর্তিত মস্তক কয়েদখানায় তার বাবার সামনে রেখে এসো।’

নির্দেশ পালন করা হয়। আবদুল আযীযের কর্তিত মস্তক কয়েদখানায় তার পিতা মুসা বিন নুসাইরের সামনে রেখে আসা হয়। মুসা বিন নুসাইর পূর্ব থেকেই অকথ্য জুলুম-নির্যাতন, আর লাঞ্ছনা-গঞ্জনার কারণে অন্তিম অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। এক্ষণে প্রাণপ্রিয় পুত্রের কর্তিত মস্তক দেখে হুঁশ হারিয়ে ফেলেন। হুঁশ ফিরে এলে দেখেন মস্তক সেখানে নেই।

মুসা বিন নুসাইর প্রিয় পুত্রের কর্তিত মস্তক দেখে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তারা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, যে দিনের আলোতে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করত, আর রাতের আঁধারে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করত। ছেলে আমার রাতের অন্ধকারে ইবাদতে লিপ্ত থাকত, আর দিনের বেলা রোযা রাখত।

ইতিহাসও এ কথার সাক্ষী দেয় যে, আবদুল আযীয দিনের আলোতে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন, আর রাতের অন্ধকারে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মশগুল থাকতেন। কিন্তু তিনি এ কথা বুঝতে সক্ষম ছিলেন না যে, কোন পুরুষ যখন কোন নারীকে তার ইচ্ছাশক্তির উপর প্রাধান্য দেয় তখন সে নারী পুরুষের বিবেক-বুদ্ধির উপর বেঁকে বসে এবং সেই পুরুষকে কাঠের পুতুল বানিয়ে ছাড়ে। সম্ভবত তিনি এটাও জানতেন না যে, ছলনাময়ী নারীর কারণে অনেক রাজা-বাদশাহও পথের ভিখারী হয়ে গেছেন। রাজসিংহাসন তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। জেনে হোক বা না জেনে হোক, আবদুল আযীযও এই ভুলের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি এক নারীকে তার ইচ্ছাশক্তির উপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

মুসা বিন নুসাইর অবশ্যই একজন বিদগ্ধ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তিনিও মানব স্বভাবের অন্য আরেকটি দুর্বলতার শিকার হয়ে পড়েছিলেন। মানব স্বভাবের সেই দুর্বলতা হল, মানুষ যখন কারও গুণে মুগ্ধ হয়ে তার সামনে অবনত হয়ে পড়ে তখন সে নিজেকে খোদা ভাবতে শুরু করে দেয়। তোষামোদ তখন তার কাছে পছন্দনীয় হয়ে উঠে। আত্মপ্রশংসা ও আত্মতৃপ্তির দুর্বলতা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।

মুসা বিন নুসাইর পুত্রের কর্তিত মস্তক দেখার পর অল্প কয়েক দিনই জীবিত ছিলেন। ৭১৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর এক বছর পর খলীফা সুলায়মানও মারা যান।

জুলিয়ান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেন। তিনি সিউটার রাজা হিসেবে বহাল থাকেন। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দিতে আৰু সুলায়মান আইউব নামে ইসলামী ফেকাহ ও শরীয়তের একজন বহুত বড় আলেম অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি জুলিয়ানের তৃতীয় অধস্তন পুরুষের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

একজন ইহুদি জাদুকর বলেছিল, আন্দালুসিয়ার মাটি হল, রক্ত পিপাসু। সে সবসময় রক্ত পান করতে চায়। জাদুকরের এই কথা কঠিন বাস্তব হয়ে দেখা দেয়। মুসা বিন নুসাইর এবং তার পুত্রকে হত্যা করা হয়। মুগীস আর-রুমীকেও হত্যা করা হয়। এরপর আন্দালুসিয়ায় মুসলমানদের আটশ বছরের ইতিহাসে যুদ্ধ-বিগ্রহের ঘটনা ঘটতেই থাকে। হত্যা ও প্রতিহত্যার মাধ্যমে সিংহাসন হাতবদল হতে থাকে। পরিণামে একদিন আন্দালুসিয়া ইসলামী সালতানাত থেকে পৃথক হয়ে যায়।

আল্লাহ হাফেজ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *