৫. যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে

০৫.

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। রডারিকের পরাজিত সৈন্যরা আত্মরক্ষার জন্য দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। আহত সৈন্যদের মর্মভেদি চিৎকার আর চেঁচামেচিতে গোটা রণাঙ্গনে কেয়ামতের বিভীষিকা বিরাজ করছে। “লাকা পর্বতের পাদদেশ থেকে গোয়াডিলেট নদীর তীর পর্যন্ত বিশাল-বিস্তৃত জায়গাজোড়ে শুধু লাশ আর লাশ। নিহিত সৈন্যদের শরীর থেকে প্রবাহিত রক্ত আর রণাঙ্গনের মাটি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আহত সৈন্যদের অনেকেই উঠতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পরক্ষণেই আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল। অনেকে শেষ নিঃশ্বাস গ্রহণ করছিল। সবচেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল সে সকল সৈন্য, যাদের শরীরে তীর বিদ্ধ হয়েছিল। ছুটন্ত ঘোড়া আর পদাতিক বাহিনীর পায়ের আঘাতে উড়ন্ত ধুলা খণ্ড খণ্ড মেঘমালার ন্যায় আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডোর দিকে উড়ে যাচ্ছিল।

ঐতিহাসিক স্ট্যাফিজ লেখেন : ‘বড় আশ্চর্যের বিষয় হল, মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ অবাক হয়ে রডারিকের পরাজয়ের শেষ দৃশ্যাবলী দেখছিলেন। আজ পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাসের বিস্ময় এই যে, মাত্র বার হাজার সৈন্যের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী এক লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনীকে কীভাবে এমন করে ধ্বংস করে দিল?’

রডারিকের অশুভ আত্মা যখন রক্ত ও মাটির মাঝে গড়াগড়ি খাচ্ছিল তখন তারিক বিন যিয়াদ ঘোড়া ছুটিয়ে এক উঁচু পাহাড়ের উপর এসে দাঁড়ালেন। সেখান থেকে তিনি রণাঙ্গনের পূর্ণ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, তাঁর জানবাজ মুজাহিদ সাথীরা শহীদ ও আহত মুজাহিদগণকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে রণাঙ্গন থেকে উঠিয়ে আনছে। আর কয়েকজন মুজাহিদ আন্দালুসিয় সৈন্যদেরকে গ্রেফতার করছে। আন্দালুসিয় সৈন্যরা ঝোঁপঝাড়ে, গাছের আড়ালে এবং লাশের নিচে আত্মগোপন করতে চেষ্টা করছে। তারা হয়তো এই আশঙ্কা করছে যে, মুসলিম সৈন্যরা তাদেরকে হত্যা করে ফেলবে।

তাদের নিজ হাতে বানানো নৌকার পুলের কোন ক্ষতি হয়নি। তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সেই পুল পার হয়ে পালাতে চেষ্টা করল। সকলেই ধাক্কাধাক্কি করে সামনে অগ্রসর হল। ধাক্কাধাক্কির কারণে কয়েকজন পুল থেকে পানিতে পড়ে গেল। যারা হাতিয়ার সমর্পণ করে বন্দীত্ব বরণ করে নিয়েছিল তারাই শুধু নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত মনে বসেছিল।

কে যেন নির্দেশ দিল, পুল দিয়ে যেসকল আন্দালুসিয় নদী পার হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে বাধা প্রদান করো। সাথে সাথে কয়েকজন তীরন্দাজ মুজাহিদ নদীর তীরে চলে এলো। তারা কয়েকজন বন্দীকে দিয়ে ঘোষণা করাল যে, ‘আন্দালুসিয় সকল সিপাহী যেন ফিরে আসে, অন্যথায় তাদের উপর তীর নিক্ষেপ করা হবে। ঘোষণা শুনে পিছনে আসার পরিবর্তে তারা আরও দ্রুতগতিতে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। ফলে তাদেরকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করা হল এবং বেশ কয়েকজন আন্দালুসিয় সৈন্য তীর বিদ্ধ হয়ে পুলের উপরই পড়ে গেল। তাদেরকে দেখে অন্য সৈন্যরা পিছনে চলে এলো। কিন্তু যারা পুলের শেষ প্রান্তে চলে গিয়েছিল তারা পালিয়ে গেল। পলায়মান এই সৈন্যদের সংখ্যাও খুব কম ছিল না।

তারিক বিন যিয়াদ রণাঙ্গনের অন্য দিকে তাকিয়ে দেখেন, কয়েকজন মুজাহিদ বিশ-পঁচিশজন যুবতী মেয়েকে পিছন দিক থেকে হাঁকিয়ে নিয়ে আসছে। এরা সকলেই রডারিকের অন্দরমহলের মেয়ে ছিল। রডারিকের মনোরঞ্জনের জন্য তার সাথে রণাঙ্গনে এসেছিল।

তারিক বিন যিয়াদ নিচে নেমে এলেন। মেয়েদেরকে তার সামনে নিয়ে আসা হল। তাদের মধ্যে মাত্র একজন ছিল মধ্য বয়সের। তাকেই এসকল মেয়েদের দায়িত্বশীল মনে হচ্ছিল। অন্যসব মেয়েদের সকলেই ছিল অল্প বয়স্ক যুবতী। কারো রূপ-লাবণ্য কারও চেয়ে কম ছিল না।

‘এ সকল মেয়েরা কি শাহীখান্দানের সাথে সম্পর্কিত?’ তারিক বিন যিয়াদ জিজ্ঞেস করলেন।

‘না, ইবনে যিয়াদ!’ জুলিয়ান বললেন। এরা বিভিন্ন খান্দানের সাধারণ মেয়ে। শাহানশাহে আন্দালুসিয়া এদের মাধ্যমে চিত্তরঞ্জন ও মনোরঞ্জন করত। সে আবার কিসের বাদশাহ, যার অন্দরমহলে বিশ-পঁচিশজন রক্ষিতা না থাকে!

এদেরকে জিজ্ঞেস করো, এদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে, যে বাদশাহর অন্দরমহলে আনন্দে ছিল না?’ তারিক জানতে চাইলেন।

যখন তাদেরকে এই প্রশ্ন করা হল তখন তাদের প্রায় সকলেই একযোগে উত্তর দিল, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে বাদশাহর নিকট অর্পণ করা হয়েছে। এই সকল মেয়েদের মধ্যে খ্রিস্টান মেয়েও ছিল, কিন্তু বেশিরভাগই ছিল ইহুদি।

‘বাদশাহ কোথায়? তারিক বিন যিয়াদ জিজ্ঞেস করলেন।

এই প্রশ্নের উত্তর কোন মেয়েই দিতে পারবে না।’ সরদারনী বলল। চার রাত হল, বাদশাহ কোন মেয়েকে তার তাঁবুতে ডাকেনি। প্রতি রাতেই আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম, কিন্তু সে রাগ করে তাঁবু থেকে আমাকে বের করে দিত। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন থেকেই সে রাগে-গোসায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। রাতের বেলা সে এত বেশি শরাব পান করত যে, এক রাতে আমি তাকে বেহুশ অবস্থায় মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি, তখন আমি একজন দারোয়ান ডেকে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেই। সকাল হওয়ার সাথে সাথে সে পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠত।

 রডারিকের বাহিনী মুসলিম বাহিনীর হাতে চরমভাবে পরাজিত হল। মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের মাথার উপর ছিল আল্লাহ তাআলার কুদরতি হাত, আর তাঁর অন্তরে ছিল রাসূলুল্লাহর এশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম পূর্বেই তাঁকে বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। মূলত এই সুসংবাদ রাসূলুল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের নির্দেশ ছিল। রাসূলুল্লাহ তারিক বিন যিয়াদকে এই বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারিক! তুমি যদি আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাক তাহলে পরাজিত হয়ে ফিরে যাবে না। আল্লাহ তোমার সাথে আছেন।

তারিক বিন যিয়াদ রাসূলুল্লাহর নির্দেশ পূর্ণরূপে পালন করেছিলেন।

আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিকের এই নির্মম পরাজয়ের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল তার পাপ। পাপের কারণেই সে পরাজিত হয়েছে। কে জানে, কত কুমারী মেয়ে তাকে হৃদয়বিদারী আর্তনাদের মাধ্যমে অভিশাপ দিয়েছিল। কিশোরী উস্তোরিয়া মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বলেছিল, ‘রডারিক হোর বাদশাহীর উপরও ঘোড়া দৌড়ানো হবে। উস্তোরিয়ার প্রেতাত্মা সব সময় রডারিকের চিন্তা-চেতনায় আতঙ্ক ছড়াত। উস্তোরিয়ার মতো অসংখ্য কুমারী মেয়ের অভিশাপই রডারিককে চরম পরাজয়ের শিকার হতে বাধ্য করেছে।

তারিক বিন যিয়াদ রণাঙ্গনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রডারিকের রক্ষিতা মেয়েদেরকে তাঁর সামনে উপস্থিত করা হয়েছে। আন্দালুসিয়ার যেসকল সৈন্য পালিয়ে গিয়েছিল তাদেরকে খোঁজে খাঁজে ধরে আনা হচ্ছিল। অন্দরমহলের মেয়েদের সামনে দিয়ে তিন-চারজন বন্দীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। দুজন মুজাহিদ ছিলেন তাদের সাথে। সেই বন্দীদের মধ্যে এক বন্দীর লেবাস-ছুরত ও চালচলন দেখে তাকে সম্ভ্রান্ত মনে হচ্ছিল। তারিক বিন যিয়াদের সামনে বৃত্তাকারে দাঁড়ানো রক্ষিতাদেরকে দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘সামনে অগ্রসর হও।’ একজন মুজাহিদ তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল। দাঁড়িয়ে থেকো না।’

‘এই মেয়েদের মাঝে আমার ছোট বোন আছে। সেই বন্দী বলল। তার সাথে একটু দেখা করতে দাও। হয়তো আর কখনও তাকে দেখতে পাব না।’

সে মুজাহিদ ছিল বার্বার। এমনিতেই বার্বারদের দয়ামায়া কিছুটা কম। তাই সে বন্দীকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সামনে অগ্রসর হতে বলল।

‘ইনি আমার বড় ভাই।’ অপরূপ রূপসী এক মেয়ে তারিক বিন যিয়াদ ও জুলিয়ানের সামনে হাতজোড় করে বলল। মেহেরবানী করে সামান্য সময়ের জন্য আমাকে তার সাথে দেখা করতে দিন।

‘তাকে আসতে দাও। তারিক সেই মুজাহিদকে লক্ষ্য করে বললেন। ‘শেষবারের মতো বোনের সাথে দেখা করে নিক।

আন্দালুসিয় সিপাহী বৃত্তাকারে দাঁড়ানো মেয়েদের নিকটে চলে এলো। সে ধীরে ধীরে তার বোনের দিকে অগ্রসর হল। তার সাথে একজন মুজাহিদও ছিলেন। যেন সে সিপাহসালারের সামনে কোন ধরনের বেয়াদবী না করতে পারে। মুজাহিদের হাতে ছোট বর্শা ছিল। আন্দালুসিয় সিপাহী আর মুজাহিদ যখন সেই মেয়ের সামনে পৌঁছল তখন অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে মেয়েটি মুজাহিদের হাত থেকে বর্শা ছিনিয়ে নিল। তারপর ততোধিক ক্ষিপ্রগতিতে সেই বর্শা আপন ভায়ের বুকে সমূলে বসিয়ে দিল। মেয়েটি বর্শা টেনে বের করে পুনরায় আঘাত করার জন্য হাত উপরে উঠাল। পাশে দাঁড়ানো একজন মুজাহিদ মেয়েটির হাত ধরে ফেলল এবং তার হাত থেকে বর্শা ছিনিয়ে নিল।

বর্শার একটি আঘাতই যথেষ্ট ছিল। বর্শা সমূলে তার বুকের মাঝে বিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। শক্ত-সামর্থ সুদর্শন সেই যুবকের হাটু প্রথমে মাটি স্পর্শ করল, তারপর সে এক দিকে ঢলে পড়ল।

‘তুমি এটা কি করলে?’ জুলিয়ান সেই মেয়েকে জিজ্ঞেস করল। নিজের ভাইকেই হত্যা করে ফেললে? সে হাতিয়ার সমর্পণ করেছে–এ জন্যই কি তাকে তুমি হত্যা করলে?

 ‘না, আমি আরও আগেই তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সুযোগ পাইনি। মেয়েটি বলল। আপনারা যদি আমাকে এই অপরাধের জন্য শাস্তি দিতে চান তাহলে শাস্তি দিতে পারেন। আপনাদের কাছে তলোয়ার আছে, বর্শা আছে, আপনারা আমার দেহ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলুন।

মেয়েটির কথা তারিক বিন যিয়াদকে শুনানো হল।

‘তাকে বল, তাকে আমরা কোন শাস্তি দেব না।’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। তবে তাকে জিজ্ঞেস কর, সে তার ভাইকে কেন হত্যা করেছে?

‘এই ভাই আমাকে বাদশাহ রডারিকের অন্দরমহলে যেতে বাধ্য করেছে। মেয়েটি বলল। ‘আমার ভাই ছিল একজন সাধারণ সৈনিক, কিন্তু সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল তার। তাই সে আমাকে ধোঁকা দিয়ে একদিন রডারিকের অন্দরমহলে নিয়ে যায়। তারপর সে আমাকে এই মহিলার নিকট রেখে চলে আসে। মহিলা আমাকে মহল দেখানোর অযুহাতে মহলের অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে। তখন থেকে বৃদ্ধ রডারিক আমাকে তার ইচ্ছা মতো ব্যবহার করতে থাকে। আমি ছিলাম তার হাতের খেলনা। দুই বছর যাবৎ আমি অন্দরমহলে আছি। এই মহিলাকে আমি কয়েকবারই বলেছি, আমাকে আমার ভায়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে দাও। প্রতিবারই সে আমাকে উত্তর দিয়েছে, অন্দরমহলের কোন মেয়ের বাইরে যাওয়ার কোন নিয়ম নেই এবং অন্য কোন পুরুষেরও এখানে আসা নিষেধ। এই মহিলাই আমাকে বলেছে, আমার ভাই সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদ পাওয়ার জন্য আমাকে অন্দরমহলে রেখে গেছে। দুই বছর পর আজ আমার ভায়ের পাওনা মিটানোর সুযোগ এসেছে।

‘যে বাহিনীতে এমন ভাই থাকবে সে বাহিনীর পরিণতি এমনই হবে।’ কমান্ডার মুগিস আর-রুমি মন্তব্য করলেন।

‘এ সকল মেয়েরা যদি নিজ নিজ ঘরে যেতে চায় তাহলে তাদেরকে যুদ্ধবন্দী বানানোর প্রয়োজন নেই। সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ নির্দেশ দিলেন। এদেরকে আমাদের বাহিনীর সাথেই থাকতে দাও। এদের যেন কোন রকম কষ্ট না হয়। আমরা সামনে অগ্রসর হওয়ার সময় যখন এদের এলাকা আসবে তখন এদেরকে যার যার ঘরে পৌঁছে দেওয়া হবে।’

***

দ্বিতীয় দিন তারিক বিন যিয়াদ আমীর মুসা বিন নুসাইরের নিকট এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি গোয়াডিলেট যুদ্ধের পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরেন। সবশেষে তিনি লেখেন :

‘এখন পর্যন্ত আমি কোন শহর বিজিত করতে সক্ষম হইনি, তাই বিশেষ কোন তোহফা প্রেরণ করছি না। আমার মনে হয়, আমীরুল মুমিনিন যুদ্ধবন্দীর তোহফাঁকেই বেশি পছন্দ করবেন। এ সকল যুদ্ধবন্দী সবসময় তাঁর নিকটই থাকবে। কেননা, তাদের বাদশাহ পানিতে ডুবে মারা গেছে। এসকল বন্দীকে মুক্ত করার জন্য, কিংবা তাদের মুক্তিপণ দেওয়ার জন্য কেউ বেঁচে নেই। আমাদের কোন সিপাহীও তাদের কাছে যুদ্ধবন্দী হিসেবে নেই, যার মুক্তিপণের জন্য হলেও এদের কাউকে মুক্ত করার প্রয়োজন হবে।

সম্মানিত আমীর! আরেকটি মূল্যবান তোহফা আছে, তা হল আন্দালুসিয়ার বাদশাহ রডারিকের প্রিয় সাদা ঘোড়া। ঘোড়াটির নাম হল, উরলিয়া। বাদশাহর তলোয়ারটিও পাঠানো হল। এখন আমি সামনে অগ্রসর হচ্ছি। আমার সফলতার জন্য যেন মসজিদসমূহে দুআর আয়োজন করা হয়।‘

যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধলব্ধ আহত ঘোড়াগুলোকে মিসর পাঠানোর জন্য যুদ্ধ জাহাজের প্রয়োজন দেখা দিল। জুলিয়ানের চারটি বড় বড় যুদ্ধ-জাহাজ তারিক বিন যিয়াদ জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। মুসলমানদের নিজস্ব কোন যুদ্ধ-জাহাজ ছিল না।

ঐতিহাসিকগণ লেখেন, ইতিপূর্বে মুসলিম বাহিনী কখনও নৌযুদ্ধের সম্মুখীন হয়নি। তাদের যুদ্ধ-জাহাজের কোন প্রয়োজনও পড়েনি। পরবর্তীতে মুসলিম বাহিনী যখন যুদ্ধ-জাহাজে চড়ে নৌযুদ্ধের জন্য সমুদ্র-অভিযান শুরু করেন তখন সে সকল বাদশাহর নৌশক্তিকে অতল সমুদ্রে ডুবিয়ে ছাড়েন, যারা নিজেদের যুদ্ধ-জাহাজগুলোকে অপরাজেয় মনে করত।

আন্দালুসিয়ার যুদ্ধবন্দীদেরকে মিসর পাঠানোর জন্য আন্দালুসিয়ার একটি বড় যুদ্ধ-জাহাজ নেওয়া হল। যুদ্ধবন্দী সৈন্য আর আহত ঘোড়ার সংখ্যা এত অধিক ছিল যে, সেই জাহাজে করে যুদ্ধবন্দী ও ঘোড়াগুলো কায়রোয়ান সমুদ্রসৈকতে রেখে আসতে তিন দিন লেগে গেল।

উত্তর আফ্রিকার বার্বার গোত্রসমূহ চরম উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠার মাঝে দিন অতিবাহিত করছিল। তারা কায়রোয়ানের সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকত। রণাঙ্গনের সংবাদ শুনার জন্য অধীর আগ্রহে তারা অপেক্ষা করছিল। কেউ কেউ তো সিউটার সমুদ্রবন্দরে গিয়েও বসেছিল।

অবশেষে যখন কায়রোয়ানের বন্দরে যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে প্রথম জাহাজটি এসে ভিরল তখন বাবার জনগোষ্ঠি মাঝি-মাল্লাদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বন্দীদের সাথে বার্বার মুজাহিদও ছিল। তারা যুদ্ধ জয়ের সংবাদ শুনালে আগত লোকেরা তাদের গোত্রের নিকট সংবাদ পৌঁছানোর জন্য ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

যেখানে যেখানে তারিক বিন যিয়াদের বিজয় আর আন্দালুসিয়ার বিশাল সেনাবাহিনীর পরাজয়ের কথা পৌঁছল, সর্বত্র আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। নারী-পুরুষ-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই পাগলের ন্যায় নাচতে শুরু করল।

অলিগলি সর্বত্র ঘোষণা হতে লাগল, ‘তারিকের সৈন্য সংখ্যা খুবই কম। সামনে অগ্রসর হলে তার বিপদ হতে পারে। তারিকের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও।

এমন অসংখ্য ঘোষণা শ্লোগানে রূপান্তরিত হয়ে গেল। প্রতিটি পাড়া-মহল্লা শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল। কিশোর-যুবক-মধ্যবয়সী পুরুষরা দল বেঁধে সিউটা এবং কায়রোয়ানের সমুদ্রসৈকতে জড়ো হতে লাগল। কয়েক দিন পূর্বেই আন্দালুসিয়ার যুদ্ধ-জাহাজ বন্দীদেরকে রেখে ফিরে গেছে। নিরুপায় হয়ে বাবার সিপাহীরা নৌকার ব্যবস্থা করে তারিক বিন যিয়াদের সৈন্যদলে যোগ দেওয়ার জন্য আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হল।

যুদ্ধবন্দীদের রেখে যাওয়ার জন্য যেসব জাহাজ সিউটা এসেছিল তার একটিতে হেনরি সিউটা বন্দরে এসে নামল। সে জাহাজ থেকে নেমেই জুলিয়ানের মহলের দিকে ছুটে গেল। হেনরি যখন সিউটার বন্দরে এসে নামল তখন পর্যন্ত আন্দালুসিয়ার রণাঙ্গন সম্পর্কে কোন খবর সিউটা এসে পৌঁছেনি।

হেনরি জাহাজ থেকে নেমে যখন জুলিয়ানের মহল লক্ষ্য করে দৌড়াতে লাগল। তখন দুই-তিনজন বাবার সম্প্রদায়ের লোকও তার পিছনে পিছনে দৌড়ে এলো।

‘তুমি কি আন্দালুসিয়া থেকে আসছ?’ দৌড়াতে দৌড়াতে একজন বার্বার হেনরিকে জিজ্ঞেস করল।

 ‘হা।’ হেনরি না থেমেই উত্তর দিল। আমি জানি তোমরা কি জানতে চাচ্ছ…, বার্বারদেরই বিজয় হয়েছে।’

‘একটু থেমে ভালো করে বল, ভাই!’ বার্বার লোকটি দৌড়ে হেনরিকে ধরে ফেলল।

হেনরি না থেমেই সংক্ষেপে আন্দালুসিয়ার বিজয়, রডারিকের মৃত্যু এবং তার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের সংবাদ দিল।

‘কায়রোয়ান চলে যাও।’ হেনরি বলল। সেখানে আন্দালুসিয়ার হাজার হাজার যুদ্ধবন্দীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

বার্বার লোকগুলো বিজয়-ধ্বনী করতে করতে চলে গেল। হেনরিও পুনরায় মহলের উদ্দেশ্যে দৌড় লাগাল। দুর্গের ভিতর জুলিয়ানের মহল ছিল। দুর্গ বেশি দূরে ছিল না।

ফ্লোরিডা দুর্গের উপর দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল। এটা তার প্রতিদিনের অভ্যাস। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসংখ্যবার সে দুর্গের উপর এসে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকত। কোন জাহাজ দেখা গেলে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে জাহাজ দৃষ্টির আড়াল না হত, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ঐ জাহাজের দিকে তাকিয়ে থাকত। জাহাজ দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে তার চেহারায় হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠত; অন্তর দমে যেত। এমনিভাবে দিনের পর দিন অতিবাহিত হয়ে যেতে লাগল।

অবশেষে একদিন তার অপেক্ষার পালা শেষ হল। সে দূর থেকে দেখেই চিনতে পারল যে, হেনরি জাহাজ থেকে নিচে নেমে আসছে। সাথে সাথে সে দৌড়ে নিচে নেমে এলো।

হেনরি দুর্গের ছোট দরজা লক্ষ্য করে ছুটে আসছিল। এটাই মহলে প্রবেশের রাস্তা। দিনের বেলা মহলের দরজা খোলাই থাকত। হেনরি দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। মহলের সকলেই তাকে চিনত। কেউ তাকে বাধা দিল না।

হেনরি মহলের বাগিচায় প্রবেশ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই বাগিচায় বাইরের কারো প্রবেশের অনুমতি ছিল না। হেনরি অত্যন্ত উত্তেজিত ছিল। সে বিশাল বড় এক সংবাদ নিয়ে এসেছে। তাই সে কোন কিছুর পরোয়া করল না। বাগিচায় পৌঁছে সে কিছুটা সাভাবিক হতে চেষ্টা করল।

 ‘হেনরি!’ হেনরি শুনতে পেল, কে যেন পিছন দিক থেকে তার নাম ধরে ডাকছে এবং তাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে।

সে পিছনে তাকাতেই ফ্লোরিডা তাকে দুই বাহু প্রসারিত করে ঝাঁপটে ধরল। সেও ফ্লোরিডাকে বাহুবন্দী করে নিল। অনেক দিন পর প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার অনুভূতি তাদেরকে সবকিছু ভুলিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরই ফ্লোরিডা হেনরির বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে দুই পা পিছনে সরে এলো। তার চেহারায় অসন্তুষ্টির স্পষ্ট ছায়া পরিলক্ষিত হল।

 ‘তুমি খালি হাতে এসেছ কেন?’ ফ্লোরিডা হেনরিকে জিজ্ঞেস করল। মনে পড়ে, কি ওয়াদা করেছিলে আমার সাথে? রডারিকের মাথা কোথায়?

হেনরি চুপ করে শুনছিল, আর মিটি মিটি হাসছিল।

‘হেনরি!’ ফ্লোরিডা হেনরির কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল। আমি বুঝতে পারছি, তুমি বলতে এসেছ, মুসলিম বাহিনী রডারিকের হাতে পরাজিত হয়েছে, আর তুমি রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে এসেছ। আমার বাবা কী গ্রেফতার হয়েছেন নাকি মৃত্যুবরণ করেছেন?

‘না, ফ্লোরা!’ হেনরি বলল। কাউন্ট জীবিত আছেন। রডারিক মারা গেছে।’

‘তাহলে তার কর্তিত মাথা কেন আননি?

‘সে পানিতে ডুবে মারা গেছে, তার লাশ পাওয়া যায়নি। হেনরি রডারিকের জুতা ফ্লোরিডাকে দেখিয়ে বলল। তার এই জুতা পাওয়া গেছে। তার সাদা ঘোড়া নদীর তীরে দাঁড়ানো ছিল। ঘোড়ার কাছেই তার তলোয়ার আর জুতা পড়েছিল। এসকল বস্তু আমি এমনি এমনিই পেয়ে যায়নি। আমি তলোয়ার নিয়ে রডারিকের বাহিনীর মাঝে ডুকে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি রডারিকের ঝাণ্ডা দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি নদী পর্যন্ত পৌঁছে যাই।

রডারিকের বাহিনী মুসলিম বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে মার খাচ্ছিল। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় আমি রডারিকের সাদা ঘোড়া দেখতে পাই। কিন্তু রডারিককে সেখানে দেখতে পেলাম না। দেখি, ঘোড়ার নিচে রডারিকের তলোয়ার আর জুতা পড়ে আছে। আমি তার তলোয়ার আর জুতা উঠিয়ে তার ঘোড়ায় আরোহণ করে সিপাহসালার তারিক বিন যিয়াদের নিকট এসে পৌঁছি এবং তাকে বলি যে, রডারিক নদীতে ডুবে মারা গেছে। ঘোড়া আর বহু মূল্যবান হিরা-মুক্তা খচিত তলোয়ার তারিক বিন যিয়াদ নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। আমি তার নিকট আবেদন করি যে, জুতা জোড়া যেন আমার কাছে রাখা হয়। তিনি আমাকে জুতা জোড়া রাখার অনুমতি দেন। প্রমাণস্বরূপ সেই জুতাই আমি তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।’

আনন্দে ফ্লোরিডার চেহারা ঝলমল করে উঠল। এতদিন পর তার প্রতিশোধের আগুন নির্বাপিত হল।

***

প্রফেসর ডোজি এবং গিয়ানগোজ লেখেন, মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদের চিঠি পাওয়ামাত্রই অধীর আগ্রহে তা পড়তে লাগলেন। তার চেহারা আবেগের আতিশয্যে লাল হয়ে গেল। তারিক বিন যিয়াদ আট দিনের যুদ্ধের বিবরণ লেখে ছিলেন, কিন্তু সে বিবরণ পড়ে আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইরের মন ভরল না।

 ‘তুমি নিজে যুদ্ধের বিবরণ দাও।’ মুসা বিন নুসাইর বার্তাবাহককে বললেন। ‘আট দিনের যুদ্ধের প্রত্যেক দিনের পূর্ণ বিবরণ দাও। তুমি নিজ চোখে যা কিছু দেখেছ, সবকিছু আমাকে শুনাও।’

ঐতিহাসিকগণ লেখেন, যুদ্ধের বিবরণ শুনতে শুনতে মুসা আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তিনি তন্ময় হয়ে ঝুলে ঝুলে গোয়াডিলেট যুদ্ধের সরেজমিন প্রতিবেদন শুনছিলেন। এরপর তিনি খলীফার নিকট যে চিঠি লেখেছিলেন তার কিছু অংশ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। খলীফার নিকট যুদ্ধের বিবরণ লেখার পর তিনি এই মন্তব্যও লেখেন :

‘আমীরুল মুমিনিন। এই যুদ্ধ কোন সাধারণ যুদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধকে রোজ কেয়ামতের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আমি যুদ্ধের যে মৌখিক বিবরণ শুনেছি, তাতে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। আমাদের বিজয় অসম্ভব ছিল। মাত্র বার হাজার সৈন্যের একটি ক্ষুদ্র দল এক লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে অর্ধ দিবসও ঠিকে থাকার কথা নয়। আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর জীবন উৎসর্গকারীদের কারিশমা এটা। আমরা শুধু তাদের শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে পারি। বিনিময় ও প্রতিদান তো কেবল আল্লাহই দেবেন।’

মুসা বিন নুসাইর চিঠির সাথে রডারিকের ঘোড়া ও তলোয়ার খলীফার নিকট পাঠিয়ে দেন। ত্রিশ হাজার যুদ্ধবন্দীকেও তিনি দামেস্কের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন।

ইবনে মানছুর নামে এক আরব কবি বন্দীদের এই দুর্দশা দেখে যে কাব্য রচনা করেন, তার মর্মার্থ হল :

‘ত্রিশ হাজার যুদ্ধবন্দীর এই বিশাল বহর দেখে মনে হচ্ছে, ইসলামের মোকাবেলায় কুফুরী শক্তি কতটা অসহায়, কতটা অক্ষম। বন্দীদের জন্য আমার মায়া লাগে, প্রথমে তো তারা একটি ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভেজালে বন্দী ছিল, তার পর তারা বাদশাহর হুকুমের গোলাম ছিল। এখন তারা যুদ্ধবন্দী হয়ে নাঙাপায়ে পথ চলছে, এখনও তাদেরকে কেউ এই সুসংবাদ দেয়নি যে, তোমরা অন্ধকার থেকে আলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছ, মিথ্যা থেকে সত্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদেরকে এখনও বলা হয়নি যে, ইসলামে বাদশাহর পক্ষ থেকে কোন বাধ্যবাধকতা নেই, কোন জুলুম-নির্যাতনের আশঙ্কা নেই, ইসলামে বাদশাহ ও গোলামের মাঝে কোন ব্যবধান নেই।‘

লুকহার্ট নামে এক ইউরোপিয়ান কবি রডারিকের পরাজয় কবিতার আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি তার সেই কবিতার নাম দিয়েছেন। ‘আন্দালুসিয়ার শোকগাথা।

রডারিকের বাহিনী যখন পূর্ণরূপে পরাজিত হয়ে যায় তখন রডারিক উঁচু একটি স্থানে গিয়ে সে দৃশ্য দেখতে থাকে। এই দৃশ্যকেই লুকহার্ট তার চমৎকার রচনা শৈলী ও কাব্যরসে পরিপূর্ণ শোকগাথায় এভাবে তুলে ধরেছেন :

‘রডারিক তার শাহীঝান্ডা দেখতে পেল গতকালও তা মাথা উঁচু করে বাতাসে পতপত করে উড়ছিল কিন্তু আজ তা এক টুকরো ছিন্ন কাপড়ে পরিণত হয়েছে রক্তে রঞ্জিত হয়ে ধুলোবালিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রডারিক বিজয়-ধ্বনী শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু এটা ছিল মুসলিম বাহিনীর বিজয়-ধ্বনী।

তার ক্লান্ত ও হতাশাগ্রস্ত চোখের দৃষ্টি রণাঙ্গনের সর্বত্র ঘুরে ফিরছিল সে তার জেনারেল ও সেনাপতিদের খোঁজছিল রণাঙ্গনে যারা মারা গেছে, তারা ব্যতীত সকলেই পালিয়ে গেছে। রডারিক আফসোস করে নিজেকে বলল, আমার বাহিনীর নিহত সৈন্যদের লাশ কেউ গুণতে পারবে না এত লাশ গণনা করা করো পক্ষেই সম্ভব নয়। বিশাল-বিস্তৃত রণাঙ্গন রক্তে লাল হয়ে আছে তার দৃষ্টি সেই রক্তের সরোবরে বারবার আটকে যাচ্ছে। তার চোখ থেকে এমনভাবে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে যেমনভাবে কোন আহত সিপাহীর শাহরগ থেকে রক্তের শেষ ফুটা গড়িয়ে পড়ে। রডারিক নিজেকে সম্ভোধন করে বলল, গতকালও আমি আন্দালুসিয়ার বাদশাহ ছিলাম আজ আমি কিছুই না। সুউচ্চ প্রাসাদের শাহীদরজা আমার আগমনের বার্তা শুনামাত্রই খোলে যেত। কিন্তু আজ আমার জন্য পৃথিবীর কোথাও এতটুকু জায়গা নেই, যেখানে আমি নিশ্চিন্তে বসতে পারি। পৃথিবীর সকল দরজাই আমার মুখের উপর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হতভাগা! তুমি তো মনে করতে, গোটা পৃথিবীর সমস্ত শক্তি তোমার হাতের মুঠোয় …। হাঁ, আমি তো হতভাগাই, আজ আমি শেষবারের মতো সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখছি। হে মৃত্যু! তুমি ধীরে ধীরে কেন আসছ? আমাকে আলিঙ্গন করতে তোমার কিসের এত ভয়? এসো মৃত্যু, জলদি এসো।‘

এই বিজয়ের মাধ্যমে একাত্ববাদের অনুসারী মুজাহিদগণ ইসলামী ইতিহাসের আরেক সোনালী অধ্যায় রচনা করেন। বরং এভাবে বললেও ভুল হবে না যে, আন্দালুসিয়ার মাটিতে খ্রিস্টানরা স্বহস্তে নিজেদের রক্ত দিয়ে ইসলামী ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায় রচনা করে।

***

তারিক বিন যিয়াদ তাঁর সহকারী সেনাপতিদের ডাকলেন। জুলিয়ান ও আউপাস তার সাথে ছিলেন।

‘আমরা এখানে আর বেশি দিন থাকতে পারি না। তারিক তার সহকারী সেনাপতিদের বললেন। এই রণাঙ্গন থেকে যেসব সিপাহী পালিয়ে গেছে, কোথাও তাদের বিশ্রাম নেওয়ার এবং সংঘটিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। তাদের পিছু ধাওয়া করতে হবে এবং এখনই সামনে অগ্রসর হতে হবে।’

জুলিয়ান ও আউপাসের দিক-নির্দেশনায় মুসলিম বাহিনী সামনে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। এমন সময় তারিক বিন যিয়াদের নিকট সংবাদ এলো যে, অসংখ্য বার্বার মুসলমান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে মিসর থেকে আন্দালুসিয়া এসে পৌঁছেছে।

বার্বার জাতিগোষ্ঠির লোকেরা বিজয়ের সংবাদ শুনামাত্রই কায়রোয়ান ও সিউটার সমুদ্রসৈকত থেকে নৌকা ভাড়া করে আন্দালুসিয়া আসতে শুরু করেছিল। তারিক বিন যিয়াদ ঘোষণা করলেন, অগিত বার্বারদেরকে সেনাবাহিনীতে শামিল করে নেওয়া হোক। তবে তাদেরকে ভালোভাবে এ কথা বুঝতে হবে যে, এখানে লড়াই করতে হবে। লুটতরাজ করার কোন ইচ্ছা থাকলে, তা যেন মন থেকে বের করে দেয়।

সামনে ছিল ‘শাদুনা’ দুর্গ। এটি ছিল ছোট্ট একটি দুর্গ। মুসলিম বাহিনীকে দূর থেকে আসতে দেখে এই দুর্গে যত সৈন্য ছিল সকলেই পালিয়ে গেল। শহরের অধিবাসীরাও পালিয়ে যেতে লাগল। তারিক বিন যিয়াদ তৎক্ষণাৎ অশ্বারোহী বাহিনীর কমান্ডারকে বললেন, ‘জলদি কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে পাঠিয়ে পলায়নরত শহরের অধিবাসীদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা কর। তাদেরকে এই অভয় দাও যে, তাদের জান-মাল ও ইজ্জতের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করা হবে।’

অশ্বারোহী বাহিনী পলায়নরত শহরবাসীদেরকে ফিরিয়ে আনল। এর কিছুক্ষণ পরই শহরবাসীদের একটি প্রতিনিধি দল তারিক বিন যিয়াদের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো।

‘আমরা অসহায়। প্রতিনিধি দলের সবচেয়ে বৃদ্ধ সামনে অগ্রসর হয়ে বললেন। ‘আমরা দুর্বল। আর দুর্বলের এই অধিকার নেই যে, সে সবলের উপর কোন শর্ত আরোপ করবে। একমাত্র বাদশাহই পারেন, আপন সমর-শক্তির মাধ্যমে দুর্বল রাজ্যের উপর আক্রমণ করে সে রাজ্যকে দখল করে নিতে। তখন তার সৈন্যরা বিজিত রাজ্যের লোকদের ঘর-বাড়ী লুটতরাজ করে এবং তাদের কন্যাদেরকে বেআবরু করে। আপনিও বোধ হয় তাই করবেন! এই শহরে আপনাকে বাধা দিতে পারে এমন কোন শক্তি নেই। মেহেরবানী করে আমাদেরকে যেতে দিন। খোঁজ করে দেখুন, আমরা আমাদের যুবতী মেয়েদেরকে ছাড়া আর কিছুই সাথে নেইনি। আপনি শহরে প্রবেশ করুন, আমরা আপনাকে স্বাগত জানাব।’

তারিক বিন যিয়াদকে জানানো হল, বৃদ্ধ কী বলছে।

‘তাকে বলো’, তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আমরা এমন এক ধর্ম সাথে নিয়ে এসেছি, যা দুর্বলকে সবলের হাত থেকে হেফাযত করে এবং কাউকে বাদশাহ হওয়ার অনুমতি দেয় না। আমাদের ধর্মে কাউকে লুণ্ঠন করার কোন অনুমতি নেই। আর কোন নারীকে বেআবরু করার শাস্তি হল, অপরাধীকে লক্ষ্য করে এই পরিমাণ পাথর নিক্ষেপ করা হবে যেন, সে পাথরের আঘাতে মারা যায়।

এদেরকে বলো, আমরা রাজ্য জয় করতে আসিনি; বরং এই রাজ্যের লোকদের অন্তর জয় করতে এসেছি। তবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে নয়; প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে। সকলেই নিজ নিজ গৃহে চলে যাও। ধন-সম্পদ গোপন করার কোন প্রয়োজন নেই। যার যা আছে, তা তারই থাকবে।

প্রতিনিধি দলকে যখন তারিক বিন যিয়াদের কথা শুনানো হল তখন তাদের চেহারায় অনাস্থা ও অবিশ্বাসের চিহ্ন ফুটে উঠল। তারা কোন কিছু বলার আগেই তারিক বিন যিয়াদ ঘোড়া ছুটিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে গেলেন। তার পিছনে মুজাহিদ বাহিনীও চলতে শুরু করল। এমনিভাবে শাদুনা দুর্গ রক্তপাতহীনভাবে মুসলিম বাহিনীর করায়ত্ব হয়ে গেল।

তারিক বিন যিয়াদ শহরের প্রশাসনিক কাজের জন্য যাদেরকে নিযুক্ত করেন তাদের সকলেই ছিল গোথ ও খ্রিস্টান। একজন মুসলমানকে শুধু প্রধান প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। সিপাহীদের মধ্য থেকে কেউ শহরবাসীদের দিকে চোখ উঠিয়েও দেখল না। একদিন অতিবাহিত হতে না হতেই শহরবাসীদের অন্তর থেকে বিজয়ীদের ব্যাপারে সকল ভয় ও দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল।

***

সামনে ছিল আরেকটি ছোট শহর কারমুনা’। তারিক বিন যিয়াদ আট-দশ দিন শাদুনায় অবস্থান করেন। বাবার গোত্রসমূহ থেকে যেসব জোয়ানরা এসেছিল, কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে তাদের সংখ্যা ছিল বার হাজার। আবার কেউ কেউ লেখেছেন, তাদের সংখ্যা হল, পঞ্চাশ হাজার। প্রকৃত সত্য হল, তাদের সংখ্যা বিশ থেকে পঁচিশ হাজার হবে। তারিক বিন যিয়াদ তাঁর সালারদের নির্দেশ দিলেন, এসকল নবাগত যুবকদেরকে যেন ভালোভাবে যুদ্ধের নিয়ম-শৃঙ্খলা শিক্ষা দেওয়া হয়।

অবশেষে তারিক বিন যিয়াদ সৈন্যবাহিনীসহ কারমুনার উদ্দেশ্যে রওনা হতে চাইলে শহরের দুইজন সম্মানিত ও বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি তারিক বিন যিয়াদের নিকট এসে বললেন,

‘প্রথম দিন আমরা আপনার কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারিনি। কিন্তু আপনি কার্যত প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, আপনার ধর্ম মানবতার ধর্ম। আপনার ধর্ম প্রজা সাধারণের উপর কোন ধরনের অন্যায়ের অনুমতি দেয় না। এই শহরের প্রতিটি শিশু পর্যন্ত আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমরা আপনার অনুগ্রহের প্রতিদান এভাবে দিতে পারি যে, আমরা আপনাকে সামনের বিপদ সম্পর্কে অবহিত করে দেব।

এই বসতি যতটা সহজে আপনি জয় করেছেন সামনের কোন শহর জয় করা আপনার জন্য এতটা সহজ হবে না। এখান থেকে যেসকল সৈন্য পালিয়ে গেছে তারা আপনার ভয়ে পালিয়ে যায়নি। তাদের কমান্ডার ও দুর্গরক্ষক শহরবাসীদেরকে প্রথমে বলেছিল, তারাও মুসলিম বাহিনীর সাথে লড়াই করবে এবং দুর্গ অবরোধ সফল হতে দেবে না। আমরা উভয়ে সেই মিটিংএ ছিলাম। আমরা বলেছিলাম, এই শহরের সৈন্যসংখ্যা খুবই কম। তাছাড়া শহরবাসীদের অবরোধ বানচাল করার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই।’

তখন অন্য আরেকজন সেনা অফিসার বলল, এখানে যুদ্ধ করার মতো রিস্ক নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এই শহর হামলাকারীদের জন্য বিনা যুদ্ধেই ছেড়ে দেওয়া হোক। সামনের দুর্গে একত্রিত হয়ে আমরা হামলাকারীদের শক্তি নিঃশেষ করে দেব।’

দুর্গপ্রধান বলল, ‘রডারিকের নির্বুদ্ধিতার কারণে আমাদের পরাজয় হয়েছে। তাছাড়া গোথ সৈন্যদের গাদ্দারীও আমাদের পরাজয়ের আরেকটি বড় কারণ।

অন্য একজন কমান্ডার বলল, আমরা এখন রডারিক থেকে মুক্ত হয়ে গেছি। এখন আমরা উত্তমরূপে লড়াই করতে পারব।’

‘সবশেষে সকলে সর্বসম্মতিক্রমে এই সিন্ধান্তে উপনীত হল যে, মুসলিম বাহিনীকে দূর থেকে দেখা গেলেই দুর্গের সৈন্যরা দুর্গ থেকে পালিয়ে যাবে এবং পরবর্তী শহরে গিয়ে আশ্রয় নিবে।

‘কী বললে, তোমাদের সৈন্যরা ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল না?’ তারিক বিন যিয়াদ জিজ্ঞেস করলেন।

‘যারা গোয়াডিলেটের যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসেছিল, তারা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল।’ দ্বিতীয় বৃদ্ধ উত্তর দিল। কিন্তু দুর্গের সৈন্যরা এবং শহরের লোকেরা তাদেরকে এতটা লজ্জা দিয়েছে যে, তারা এখন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৈরী হয়ে গেছে। তাদের অন্তরে এখন ভয় নেই, আছে প্রতিশোধের আগুন। এজন্যই আমরা আপনাকে সতর্ক করতে এসেছি, আপনাদের জন্য সামনের লড়াই খুবই কঠিন হবে।’

***

তারিক বিন যিয়াদ কারমুনা পৌঁছে দুর্গ অবরোধ করে বুঝতে পারলেন, সহজে এ দুর্গ দখল করা সম্ভব হবে না। অবরোধ দীর্ঘ হবে। দুর্গপ্রাচীরের উপর তীরন্দাজ ও বর্শা নিক্ষেপকারীরা বীরের ন্যায় দাঁড়িয়েছিল। তারিক বিন যিয়াদ দেয়ালের চতুর্দিক ঘুরেফিরে দেখলেন, কোথাও দেয়াল ভাঙ্গার ব্যবস্থা আছে কিনা, কিন্তু দুর্গের দেয়াল ছিল অত্যন্ত মজবুত। অগত্যা দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করা হলে উপর থেকে বৃষ্টির ন্যায় তীর-বর্শা নিক্ষেপ হতে লাগল। ফলে বেশ কয়েকজন মুসলিম সৈন্য আহত হলেন এবং কয়েকজন শহীদ হয়ে গেলেন।

কয়েক দিন পর্যন্ত একই পদ্ধতিতে চেষ্টা করা হল, কিন্তু কোন সাফল্য এলো না। উপর থেকে অবিরাম তীর-বর্শা নিক্ষেপ হত, আর অসভ্য ভাষায় খ্রিস্টান সৈন্যরা মুসলিম সৈন্যদেরকে গালাগাল করত।

‘জঙ্গলি বার্বার। এটা শাদুনা নয়, এটা হল কারমুনা।’ দুর্গপ্রাচীরের উপর থেকে খ্রিস্টান সৈন্যরা বলতে লাগল। এখান থেকে চলে যাও, অসভ্য জঙ্গলি কোথাকার, আমাদের হাতে কেন মরতে এসেছ? বাঁচতে চাইলে ফিরে যাও। ডাকাত, লুঠেরার দল। আমরা স্বর্ণ-রুপার কয়েকটা টুকরা নিক্ষেপ করছি, তা নিয়ে এখান থেকে চলে যাও। কালো চেহারার বানরের দল! পরাজিত রডারিক মরে গেছে। আমাদেরকে রডারিকের মতো বেকুব মনে করো না।

অবরোধ দীর্ঘায়িত হতে লাগল। কোন কোন ঐতিহাসিক লেখেছেন, অবরোধ এক মাস স্থায়ী হয়েছিল। কেউ লেখেছেন, দুই মাস স্থায়ী হয়েছে। অবশেষে এক রাতে অবরোধ উঠিয়ে নেওয়া হল। ফলে দুর্গপ্রাচীরের উপর আন্দালুসিয়ার সৈন্যরা নাচতে শুরু করল। তারা চিৎকার করে মুসলিম বাহিনীকে গালাগাল করতে লাগল। শহরের অধিবাসীরাও দুর্গপ্রাচীরের উপর উঠে এলো। মশালের আলোতে রাতের অন্ধকার দূর হয়ে গেল। গোটা শহর যেন উল্লাসে ফেটে পড়ল।

অর্ধ রাতের পর লোকজন প্রাচীর থেকে নেমে যার যার ঘরে চলে গেল। দীর্ঘ অবরোধের কারণে ক্লান্ত সিপাহী ও সিপাহসালার সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল। দুর্গের প্রধান ফটকের উপর চোরা-কুঠরিতে ও ফটকের পিছনে কয়েকজন প্রহরী তখনও জেগেছিল। এমন সময় দুই-আড়াই শ সিপাহী এসে ফটকের সামনে দাঁড়াল। তাদের একজন উচ্চ আওয়াজে প্রহরীদেরকে চিৎকার করে ডাকল। তারা আন্দালুসিয় ভাষায় কথা বলছিল।

‘তোমরা কারা?’ প্রহরীদের কমান্ডার চোরা-কুঠুরি থেকে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল।

‘আমি সিউটার গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ান। ফটকের বাহির থেকে আওয়াজ এলো। মশাল নিচু করে আমাকে দেখ।

প্রহরীদের কমান্ডার কাউন্ট জুলিয়ান সম্পর্কে জানত এবং তাকে চিনত।

 ‘আপনারা কোথা থেকে আসছেন? কমান্ডার জিজ্ঞেস করল।

‘ফটক খোলে প্রথমে আমাদেরকে আশ্রয় দাও।’ জুলিয়ান বললেন। এরা আমার রক্ষিবাহিনীর লোক। আমার আট শ রক্ষিসেনা মারা গেছে। আমরা গোয়াডিলেটের যুদ্ধ থেকে কোন রকম প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি। পাহাড়ে জঙ্গলে আত্মগোপন করে থেকে অবশেষে আমরা এখানে আসতে পেরেছি। এই দুর্গ অবরোধ করে রাখা হয়েছিল, তাই আমরা দুর্গ থেকে দূরে আত্মগোপন করেছিলাম। আজ অবরোধ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাই আমরা আশ্রয় নিতে এসেছি। আমি নিজেও আহত, আমার রক্ষিসেনাদের মধ্যে বিশ-পঁচিশজন সৈন্যও আহত। দীর্ঘ ক্লান্তি আমাদেরকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। জলদি ফটক খোল।

ঐতিহাসিকগণ লেখেন যে, জুলিয়ানের পোশাক-পরিচ্ছদ ও শারীরিক অবস্থা এই সাক্ষী দিচ্ছিল যে, সে অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত। তার সাথে যে দুই-আড়াই শ সিপাহী ছিল তাদের অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। প্রহরীদের কমান্ডার কয়েকটি মশাল জ্বালিয়ে ভালো করে দেখল যে, আশ্রয়প্রার্থী স্বয়ং জুলিয়ানই। রাতের অর্থ প্রহর অতিবাহিত হয়ে গেছে অনেক্ষণ হয়। কমান্ডার তাই দুর্গপতিকে জাগানো সমীচীন মনে করল না। দুর্গের ফটক খোলে দেওয়া হল।

জুলিয়ান দুই-আড়াই শ’ সিপাহীসহ দুর্গে প্রবেশ করলেন। প্রহরীরা কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই জুলিয়ানের সিপাহীরা প্রহরীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সকলকে হত্যা করে ফেলল। জুলিয়ানের সাথে অগিত সিপাহীরা দৌড়ে অন্যান্য ফটকের নিকট পৌঁছে গেল। ফটক-প্রহরীরা কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই মুর্দা লাশে পরিণত হল। একে একে সকল ফটক খুলে দেওয়া হল। দুর্গের সিপাহীরা অবরোধ উঠে যাওয়ার আনন্দে শরাব পান করে বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছিল। মুসলিম বাহিনী অবরোধ উঠিয়ে দূরে কোথাও যায়নি। আশেপাশেই ছিল। জুলিয়ানের ইশারার অপেক্ষা করছিল। রাতের অন্ধকার তাদেরকে ঢেকে নিল।

এটা ছিল জুলিয়ানের একটা কুটকৌশল। জুলিয়ান তারিক বিন যিয়াদের সাথে পরামর্শ করে এ কৌশল তৈরী করেছিলেন।

দুইজন ঐতিহাসিক লেখেছেন, জুলিয়ানের সাথে যে দুই-আড়াইশ সিপাহী ছিল তারা সকলে ছিল গ্রিক এবং জুলিয়ানের নিজস্ব ফৌজ। কিন্তু অন্য ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, তারা সকলেই ছিল মুসলমান। তারা নিজেদের লেবাস পরিবর্তন করে নিয়েছিল। এই তথ্যকেই সঠিক বলে মনে হয়। কারণ, জুলিয়ানের সাথে তার নিজস্ব কোন ফৌজ ছিল না।

প্রহরীদেরকে হত্যা করে দরজা খোলে জুলিয়ান স্বয়ং মশাল হাতে নিয়ে প্রাচীরের উপর উঠলে। তিনি মশাল উঁচু করে ধরে ডানে-বামে ঘুরাতে লাগল। তারিক বিন যিয়াদ এই ইঙ্গিতেরই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি সাথে সাথে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। তাঁর বাহিনী পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল। তারিক বিন যিয়াদকে অগ্রসর হতে দেখে বাবার বাহিনী প্লাবনের ন্যায় দুর্গের দিকে ছুটে চলল। তারা খোলা দরজা দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করল। দুর্গের ভিতর হৈহুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। দুর্গের সিপাহীরা জাগ্রত হয়ে দেখতে পেল, তারা মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী।

মুজাহিদ বাহিনী দুর্গে প্রবেশ করার পর দুর্গের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ও সাধারণ সিপাহী সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেল। বিশ-পঁচিশ মাইল সামনে দুর্গের মতো দেখতে একটি শহর ছিল। নাম ইসিজা। এটা ছিল বিরাট এক শহর। শহরের চতুর্পার্শ্বে মজবুত প্রাচীর। গোটা শহরটি দুর্ভেদ্য এক দুর্গ। তাছাড়া ইসিজা হল খ্রিস্টধর্মের প্রাণকেন্দ্র। এখানে বিশাল বড় এক গির্জা আছে। গির্জার পাশে ধর্মীয় পাঠশালা। এখানে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গির্জা ও খানকা ছিল।

এটা সে সময়ের কথা যখন পাদ্রিরা খ্রিস্টধর্মের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে খানকা কেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা চালু করেছিল। তারা ধর্মের ব্যাপারে চরম স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল। ফলে প্রত্যেক পাদ্রিই ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা দিত। তাদেরকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা স্বয়ং বাদশাহরও ছিল না। জনসাধারণ তাদেরকে পূত-পবিত্র মনে করত।

খ্রিস্টান ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, পাদ্রিরা গির্জা ও খানকার মতো পবিত্র স্থানকেও ভোগ-বিলাসের কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। তারা সেখানে যৌনকামিতা ও মদমত্ততার স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে রেখে ছিল। এসব সত্বেও সাধারণ মানুষ ইসিজাকে অতি পবিত্র স্থান মনে করত।

***

তারিক বিন যিয়াদের পরবর্তী লক্ষ্য হল এই ইসিজা শহর। জুলিয়ান ও আউপাস তাঁকে আগেই জানিয়ে ছিলেন যে, “ইসিজা খ্রিস্টানদের অত্যন্ত পবিত্র এক নগরী। খুব সহজে তা হস্তগত করা সম্ভব হবে না। শহরের সাধারণ মানুষও জীবনবাজি রেখে লড়াই করবে। অবলা নারীরা পর্যন্ত ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসবে।

জুলিয়ান ইসিজার ব্যাপারে তারিক বিন যিয়াদকে যা বলেছিলেন,তা ছিল পূর্ণরূপে বাস্তব। গোয়াডিলেটের যুদ্ধ থেকে যেসব সৈন্য পালিয়ে এসে প্রথমে শাদুনা ও কারমুনায় আশ্রয় নিয়েছিল, তারপর সেখান থেকে ইসিজা এসে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা এ সংবাদ প্রচার করছিল যে, মুসলিম বাহিনী একের পর এক শহর দখল করে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে।

এ সংবাদ শুনে মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু প্রতিরোধের স্পৃহাও তৈরী হয়েছিল। পালিয়ে আসা সৈন্যরা বলছিল, তাদের রাজ্যে কোন সেনাবাহিনী হামলা করেনি; বরং এটা এমন এক ধর্মীয় হামলা, যা খ্রিস্টধর্মের মতো সত্য ধর্মকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।

অন্যান্য রণাঙ্গন থেকে যেসকল সৈন্য পালিয়ে ইসিজা এসে পৌঁছেছিল স্থানীয় লোকেরা তাদেরকে তিরস্কার করে বলছিল,

‘এ সকল কাপুরুষদেরকে শহর থেকে বের করে দেওয়া উচিত।’

‘হে বেহায়া ও নির্লজ্জের দল! শাদুনা ও কারমুনার মেয়েদেরকে কি দুশনের হাতে তুলে দিয়ে এসেছ?

‘আমাদের মেয়েদের হেফাযত আমরা নিজেরাই করব।’

 ‘এই কাপুরুষদেরকে জীবিত রেখে কোন লাভ নেই।

 ‘এদের পোশাক খোলে মেয়েলোকের পোশাক পরিয়ে দাও।’

‘ইসিজার নারীরাও লড়াই করবে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসা নারীরা চিৎকার করে বলছিল। এ সকল কাপুরুষদেরকে কেউ এক ঢোক পানিও দেবে না। এর পানির পিপাসায় ছটফট করে মরুক।’

‘ক্ষুধার যন্ত্রণায় এরা ধুকে ধুকে মরুক।’

 ‘এদেরকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হোক।’

এ ধরনের হাজারো অভিসম্পাদ তীরের ন্যায় তাদের প্রতি নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। তারা এখানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য এসেছিল, কিন্তু তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। সেনাবাহিনীর লোকেরাও তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করছিল না। তারা যেহেতু সিপাহী ছিল এবং যুদ্ধের জন্য তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল, তাই তাদের জন্য পানাহারের ব্যবস্থা করা হল। তাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে অফিসাররা তাদেরকে জিজ্ঞেস করল, আক্রমণকারীদের লড়াই করার পদ্ধতি কি?

এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারল না। যারা উত্তর দিল, তারা শুধু এ কথা বলল, আক্রমণকারীদের লড়াই করার পদ্ধতি কিছুই বুঝে আসে না। মাত্র কয়েক হাজার সিপাহী এক লাখের চেয়ে বেশি সংখ্যক সিপাহীকে কীভাবে খতম করে ফেলল, আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। শাহানশা রডারিকও তাদের যুদ্ধকৌশল বুঝতে না পেরে মারা গেছেন।

সন্ধ্যার পর বড় পাদ্রি এক সাধারণ সভা আহ্বান করলেন। সেই সভায় পালিয়ে আসা সিপাহী ও দুর্গের সকল সিপাহীকে আহ্বান করা হল। শহরের সর্বস্তরের জনসাধারণ ও সিপাহীরা সভাস্থলে সমবেত হল। পাদ্রি ওয়াজের ভঙ্গিতে তার বক্তব্য শুরু করল। ফলে মানুষের মাঝে ধর্মীয় ভাবাভেগ সৃষ্টি হল। অবশেষে সে তার আসল বক্তব্য শুরু করল।

‘ভায়েরা আমার! এ হামলা শুধু তোমাদের রাজ্যের উপর নয়; বরং এ হামলা তোমাদের ধর্মের উপর। এ আক্রমণ তোমাদের মান-সম্মান ও ইজ্জত-আবরু উপর। এই শহরের গুরুত্ব ও পবিত্রতা সম্পর্কে তোমরা ভালোভাবেই অবগত আছ। যদি তোমরা এ শহর দুশমনের হাতে তুলে দাও তাহলে মনে করবে, কুমারী মরিয়মকে তোমরা দুশমনের কাছে অর্পণ করেছ। পবিত্র কুশকে তোমরা দুশমনের পদতলে সমর্পণ করেছ। ঈসা মসীহের রাজত্বের মুলোৎপাটন করেছ। মনে করবে, তোমরা তোমাদের যুবতী মেয়েদেরকে বিধর্মীদের হাতে তুলে দিয়েছ।

হামলাকারীরা রক্তপিপাসু ডাকাত। তারা নারীদের ইজ্জত লুণ্ঠনকারী, তারা দাস ব্যবসায়ী। তোমাদের কন্যাদের সাথে তারা তোমাদেরকেও নিয়ে যাবে। গোলামের মতো তোমাদেরকে ধনীদের কাছে বিক্রি করবে। তোমাদের এই পবিত্র গির্জা ও খানকাসমূহকে তারা আস্তাবলে পরিণত করবে। বল, তোমরা কি এমনটি মেনে নিবে?

‘না, ফাদার! না।’ সমবেত জনতা এক বাক্যে চিৎকার করে জবাব দিল। ‘আমরা এই শহরের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য জীবন বিলিয়ে দেব।

 ‘এখন আমি আমার সিপাহী ভাইদের লক্ষ্য করে দু-একটি কথা বলব। পাদ্রি সামান্য সময়ের জন্য থেকে পুনরায় বলতে শুরু করল। যারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে এসেছে, জনসাধারণ তাদেরকে বহু তিরস্কার করছে। তারাও লজ্জিত এবং অনুতপ্ত হয়েছে। লড়াইয়ের ময়দান থেকে পলায়ন করা পাপ। তবে এখন যদি তারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে দুশমনকে তাড়িয়ে দিতে পারে বা পরাজিত করতে পারে তাহলে তাদের পূর্বের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। আর যে এই পবিত্র শহর রক্ষার্ধে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে, সে সরাসরি বেহেশতে প্রবেশ করবে।’

পাদ্রি শহরের অধিবাসী এবং সৈন্যদের মাঝে যুদ্ধের স্পৃহা সৃষ্টি করার জন্য অত্যন্ত জ্বালাময়ী ও রক্ত গরমকরা বক্তৃতা পেশ করল। শ্রোতারা উত্তেজনাকর শ্লোগান দিল। জনসাধারণ ও সৈন্যবাহিনী সকলেই জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল।

***

তার পর পাদ্রি ঐ সকল মেয়েদের নিকট গেল, যারা নিজেদের জীবন-যৌবন এবং যৌবনের সকল সাধ-আরমানকে ধর্মের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিল। ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, দূর-দূরান্ত পর্যন্ত তাদের সৌন্দর্যের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা সকলেই ছিল চিরকুমারী। তাদেরকে ‘নান বলা হত। শুধু পাদ্রিরাই তাদের সাথে থাকত। এ সকল পাদ্রিরাও ছিল চিরকুমার।

বড় পাদ্রি সকল নানকে হলরুমে একত্রিত করে সাধারণ জলসায় যে বক্তব্য রেখেছিল, সেই একই বক্তব্য নানদেরকে শুনাল। সে মুসলমানদেরকে লুটেরা, ডাকাতি, হিংস্র, জঙ্গলি ইত্যাদি অভিধায় অভিযুক্ত করে বলল,

 ‘এ সকল হামলাকারীরা তোমাদের মতো সুন্দরী যুবতীদেরকে মখমল ও রেশমের কাপড়ে জড়িয়ে রাখবে না। তারা তোমাদের সাথে পাষবিক আচরণ করে তোমাদেরকে মেরে ফেলবে, অথবা আধমরা করে সাথে নিয়ে গিয়ে মরুবেদুঈন সরদারদের কাছে বিক্রি করে দেবে। এই শহর শত্রুর হাতে চলে যাবে, কিংবা আমাদের জীবন চলে যাবে–এ ব্যাপারে আমরা কোন চিন্তা করি না, আমাদের চিন্তা শুধু তোমাদের জন্য। তোমরা যদি তাদের হাতে চলে যাও তাহলে তোমাদের পরিণাম হবে খুবই ভয়াবহ।

‘ফাদার। তাহলে আমরা কর্ডোভা বা টলেডো চলে যাচ্ছি না কেন?’ একজন কুমারী নান বলল।

‘তোমাদের জন্য কোন জায়গাই নিরাপদ নয়। পাদ্রি বলল। তবে একটা ব্যবস্থা আছে, শুধু তার মাধ্যমেই এই বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। আর এ জন্য পাঁচ-ছয়জন সাহসী মেয়ের প্রয়োজন। সামনে অগ্রসর হয়ে তাদের ভয় পেলে চলবে না।’

 ‘কি কাজ করতে হবে? ফাদার!’ একজন নান জিজ্ঞেস করল।

‘আক্রমণকারীদের সবচেয়ে বড় কমান্ডার তারিক বিন যিয়াদকে হত্যা করতে হবে। পাদ্রি বলল। তার সাথে যে তিন-চারজন বড় জেনারেল আছে, তাদেরকেও হত্যা করতে হবে।’

সাথে সাথে গোটা হলরুমে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। মনে হল যেন, এখানে জীবিত কোন মানুষ নেই।

 ‘এটা তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। পাদ্রি বলল। তারা আসছে, এসেই এই শহর দখল করে নিবে। তার পর তারা তোমাদেরকে তাদের রক্ষিতা। বানাবে। ভালো করে জেনে রাখো, এমন হবে না যে, তাদের একজন তোমাদের একজনকে তার রক্ষিতা বানাবে। তারা হল সিপাহী; সেনাবাহিনীর লোক। তোমাদের একেকজনের অবস্থা হবে সেই খরগোশের ন্যায়, নেকড়ে বাঘের পাল যার উপর আক্রমণ করেছে। এ পরিস্থিতির শিকার হওয়ার পূর্বেই তোমাদের উচিত তাদেরকে শেষ করে দেওয়া। তোমাদের মাঝে এমন কেউ কি নেই, যে এই মহান কাজের জন্য রাজি হবে?

মুসলিম বাহিনী কারমুনা থেকে রওনা হয়ে রাস্তায় এক স্থানে যাত্রা বিরতি করবে। যারা যেতে চাও তাদেরকে সেখানে পৌঁছে দেওয়া হবে। তারা সেখানে গিয়ে বলবে, আমরা তারিক বিন যিয়াদের কাছে যেতে চাই। তাদেরকে কেউ বাধা দেবে না। প্রত্যেকের কাপড়ের নিচে একটি করে খঞ্জর লুকানো থাকবে। তারিক বিন যিয়াদ অবশ্যই কোন একজনকে নিজের তাবুতে রেখে দেবে, আর অন্য মেয়েদেরকে তার জেনারেলরা নিয়ে যাবে। তারপর তোমরা নিজেরাই বুঝেতে পারছ, তোমাদেরকে কী করতে হবে। এই কাজের জন্য পাঁচ-ছয়জন মেয়ের প্রয়োজন। বল, কে কে তৈরী আছ?

মেয়েরা একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পর একটি মেয়ে উঠে দাঁড়াল। তাকে দেখে আরেকজন রাজি হল। তারা উভয়ে এই বিপদজনক মিশনে যাওয়ার জন্য তৈরী বলে নিজেদের ইচ্ছা ব্যক্ত করল। তাদের উভয়ের পীড়াপিড়ীতে আরেকজন রাজি হল।

‘তিনজনই যথেষ্ট। পাদ্রি বলল। ‘তোমরা আমার সাথে এসো।’

পাদ্রি তাদেরকে দুর্গপতির নিকট নিয়ে গেল। দুর্গপতি ছিল একজন অভিজ্ঞ জেনারেল। সে মেয়েদেরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিল, কীভাবে এই মিশন সফল করতে হবে।

***

তারিক বিন যিয়াদ কারমুনা থেকে ইসিজার দিকে রওনা হলেন। মুসলিম বাহিনী একদিনে পঁচিশ-ত্রিশ মাইল রাস্তা অতিক্রম করত। মুসলিম বাহিনীর দ্রুত অগ্রসর হওয়ার কথা সে সময় সকলের নিকট মশহুর ছিল। পৃথিবীর যেখানেই মুসুলিম বাহিনী যুদ্ধ করেছে সেখানেই তারা দ্রুত অগ্রসর হয়ে দুশমনকে বিস্মিত করে দিয়েছে। সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী এবং সুলতান মাহমুদ গজনবীর দ্রুত অগ্রসর হওয়াকে ইউরোপিয় ঐতিহাসিকগণ প্রাণ খেলে মোবারকবাদ জানিয়েছিলেন।

তারিক বিন যিয়াদ তাঁর বাহিনী নিয়ে একদিনে পঁচিশ-ত্রিশ মাইল রাস্তা অতিক্রম করতেন। কিন্তু কারমুনা ও ইসিজার মাঝে তিনি এই উদ্দেশ্যে যাত্রা বিরতি করলেন যে, ইসিজা পৌঁছেই তিনি শহর অবরোধ করবেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে শহর কজা করে নিবেন। এ জন্য সৈন্যদেরকে একরাতের জন্য বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি ইসিজা ও কারমুনার মাঝে এক রাতের জন্য যাত্রা বিরতি করেন।

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে তাৰু স্থাপন করা হল। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে রাতের গাঢ় অন্ধকার গোটা বাহিনীকে ঢেকে নিল। তারিক বিন যিয়াদ তাঁর তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। ইতিমধ্যে তাকে সংবাদ দেওয়া হল যে, একজন আন্দালুসিয় বৃদ্ধ তারিকের সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়। বৃদ্ধের সাথে তিনটি যুবতী মেয়েও আছে।

তারিক বিন যিয়াদ তাদের সকলকে ভিতরে ঢেকে দারোয়ানকে নির্দেশ দিলেন দোভাষীকে পাঠিয়ে দিতে।

দারোয়ান বেরিয়ে গেলে তারিক মেয়েদের দিকে তাকিয়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁর চেহারায় এমন ছাপ ফুটে উঠল যে, তিনি ইতিপূর্বে এত সুন্দরী মেয়ে কখনও দেখেননি। মেয়েরা গভীরভাবে তারিক বিন যিয়াদকে দেখছিল। তিনজনের ঠোঁটেই মুচকি হাসির রেখা ঝিলিক দিয়ে উঠল।

দোভাষী আসলে তারিক বিন যিয়াদ তাকে বললেন, ‘এদেরকে জিজ্ঞেস কর, এরা এখানে কেন এসেছে?

বৃদ্ধ আপন ভাষায় তার আগমনের কারণ বর্ণনা করল। মেয়েরাও বৃদ্ধের কথায় সায় দিল।

‘বৃদ্ধ বলছে, তারা নাকি ইসিজা হতে কারমুনা যাচ্ছিল। দোভাষী তারিক বিন যিয়াদকে লক্ষ্য করে বলল। এই মেয়েদের একজন বৃদ্ধের ভাগ্নি আর অন্য দু’জন তার ভাতিজি। তাদেরকে বলা হয়েছে, কারমুনায় শান্তি ফিরে এসেছে। এখন ইসিজার উপর হামলা করা হবে। হামলাকারী সৈন্যরা মেয়েদেরকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে তাদের লাশ পাওয়া যায়। এই ভয়ে সে মেয়ে তিনটিকে কারমুনা নিয়ে যাচ্ছে।’

‘সে তাদেরকে আমার কাছে কেন নিয়ে এসেছে?’ তারিক জিজ্ঞেস করলেন।

‘ক্ষুধ-পিপাসা তাদেরকে আপনার এখানে নিয়ে এসেছে। দোভাষী বলল। ‘বৃদ্ধ বলছে, তারা সিপাহীদের কাছে খানা-পানি চাইতে পারত, কিন্তু তার আশঙ্কা হয়েছে, সিপাহীরা মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত করবে। এ জন্য সে আপনার নিকট আসাই ভালো মনে করেছে। আর এই মেয়েরাও আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাচ্ছে। এই মেয়েটি বলছে, জেনারেল তারিক বিন যিয়াদ অত্যন্ত বীরপুরুষ, তিনি রডারিককে হত্যা করে ভালোই করেছেন।’

তারিক বিন যিয়াদ দারোয়ানকে ডেকে বললেন, ‘এই চারজনের জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা কর, বিশ্রামের জন্য উত্তম বিছানা দাও এবং খানা খাওয়াও।

দোভাষীকে লক্ষ্য করে বললেন, “এদেরকে বলে দাও, মেয়েরা এখানে পূর্ণ হেফাজতে থাকবে। সকালবেলা তারা কারমুনার উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারবে।

দারোয়ান ও দোভাষী তাদেরকে তারিক বিন যিয়াদের তাবু থেকে বাইরে নিয়ে গেল। কিন্তু একটি মেয়ে পুনরায় তারিকের তাঁবুতে ফিরে এসে একেবারে তার কাছে বসে পড়ল। সে ইশারায় তাকে বুঝাতে চাচ্ছিল যে, সে আজ রাত এই তাঁবুতে কাটাতে চায়। তারিক দোভাষীকে পুনরায় ডেকে এনে বললেন, ‘মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করো, সে কি বলতে চায়?

দোভাষী তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, “সে তারিক বিন যিয়াদের সাথে কিছুক্ষণ একান্তে অতিবাহিত করতে চায়।’

‘তাকে বুঝিয়ে বল, আমরা এমন ধর্মের অনুসারী, যা কোন বেগানা নারীকে একাকী কোন পরপুরুষের সাথে থাকার অনুমতি প্রদান করে না। তারিক বিন যিয়াদ দোভাষীকে বললেন। তাকে বুঝাতে চেষ্টা কর যে, আমি কেবল এ বাহিনীর সিপাহসালার নই; বরং তাদের ইমামও। তাই আমি এমন কোন কাজ করতে পারি না, যার কারণে অন্যরা ভুল পথে পা বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে যায়।

মেয়েটি আশ্চর্য হয়ে তারিক বিন যিয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে তারিকের সাথে অনেক কথা বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু সে তারিকের ভাষা বুঝে না, আর তারিকও তার ভাষা বুঝে না। তবে সে এটা ভালো করেই বুঝত যে, পাপাচারিতার জন্য কোন ভাষার প্রয়োজন হয় না। সুতরাং এই ব্যক্তি কেন মাঝখানে আরেকজনকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, যে উভয়ের মনের ভাব ও ভাবনাকে তরজমা করে বুঝাবে?

দোভাষী মেয়েটিকে এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করল যে, সিপাহসালার এখানে তার উপস্থিতি একেবারে পছন্দ করছেন না। তিনি চান, তুমি এখান থেকে চলে যাবে। কিন্তু মেয়েটি এখানেই থাকবে বলে গো ধরে রইল।

‘তাকে বল, সে যেন এখান থেকে বের হয়ে যায়। তারিক রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন। সে যদি আমার কথা না শুনে, তা হলে আমি তাদের সকলকে এখন থেকে বের করে দেব।’

দোভাষী মেয়েটিকে বলল, ‘সিপাহসালার তোমার আচরণে অত্যন্ত রেগে গেছেন। তুমি এখান থেকে চলে যাও, অন্যথায় তোমাদের সকলকে এখান থেকে বের করে দেওয়া হবে।

মেয়েটি আরও বেশি আশ্চর্য হয়ে তারিক বিন যিয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর উঠে ধীরে ধীরে তারিক বিন যিয়াদের দিকে অগ্রসর হল। সে আর কাপড় সামান্য উঠিয়ে ডান হাত কমরে রাখল। অতঃপর যখন সে তার হাত বের করে আনল তখন দেখা গেল, তার হাতে একটি খঞ্জর। মেয়েটি তারিক বিন যিয়াদের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে খঞ্জর তাঁর পদতলে রেখে দিল।

তারিক বিন যিয়াদ হতভম্ব হয়ে দোভাষীর দিকে তাকালেন। দোভাষী মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, এটা আবার কি?

‘আমি যা শুনেছিলাম তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মেয়েটি বলল। আজ আমি এমন এক ব্যক্তিকে দেখলাম, যে আমার মতো সুন্দরী যুবতী একটি মেয়েকে উপেক্ষা করল। আমি এই সিপাহসালারকে হত্যা করতে এসেছিলাম। আমার সাথে যে দুজন মেয়ে এসেছে তারাও একই উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে। ঐ বৃদ্ধ ব্যক্তি যে আমাদের সাথে এসেছে, সে আমাদের কোন আত্মীয় নয়। তাকে আমাদের বড় পাদ্রি ও ইসিজার দুর্গপতি পাঠিয়েছে। তারা আমাদেরকে বলেছিল, তোমরা এভাবে মুসলমানদের প্রধান সেনাপতির কাছে পৌঁছবে। তারপর সে তোমাদের সৌন্দর্য ও রূপ-যৌবন দেখে তোমাদেরকে তার খাছ কামরায় স্থান দেবে। তখন তোমরা সুযোগ বুঝে, তার বুকে খঞ্জর বসিয়ে দেবে এবং তার মুখ চেপে ধরে শাহরগ কেটে ফেলবে। তারপর স্বভাবিকভাবে তাঁবু থেকে বের হয়ে আসবে। অন্য যে দুজন মেয়ে আমার সাথে এসেছে তাদেরও দায়িত্ব হল, দুজন সালারকে তাদের রূপ-যৌবনের ফাঁদে ফেলে হত্যা করা। তুমি তোমার সিপাহসালারকে বল, তিনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন। আমি তা মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আছি।’

‘আমি এদেরকে কোন শাস্তিই দেব না। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এই মেয়েরা স্বেচ্ছায় আসেনি তাদেরকে পাঠান হয়েছে। তবে যে ব্যক্তি এদেরকে নিয়ে এসেছে তাকে কাল সকালে ফজর নামাজের পর হত্যা করা হবে।’

মেয়েটি যখন তারিক বিন যিয়াদের ফায়সালা শুনল তখন সে বলল, ‘আমি আরও কিছু কথা বলতে চাই, সম্মানিত সিপাহসালার! আপনি হয়তো এ কথা ভেবে অবাক হচ্ছেন যে, এই মেয়ে কত বড় সাহসী। সে একটি বিজয়ী দলের সিপাহসালারকে হত্যা করতে এসেছে। আমি কখনই এত বড় সাহসী ছিলাম না। আমি তো এই জীবন সম্পর্কে একেবারে বিরক্ত হয়ে গেছি। এমন জীবন গ্রহণ করতে আমরা বাধ্য হয়েছি। আমাদের ধর্মের লোক আমাকে এবং আমার সাথীদেরকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। কারণ, আমরা ধর্ম্যাজিকা। আমাদের দিন-রাত অতিবাহিত হয় উপাসনালয়ে। আমাদেরকে চিরকুমারী মনে করা হয়। এটাই নিয়ম যে, ধর্ম্যাজিকা ও ধর্মযাজক আজীবন অবিবাহিত থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হল, কোন ধর্মযাজক বা কোন ধর্ম্যাজিকাই কুমার বা কুমারী নয়। আমাদের উপাসনালয়ের পাশেই আমাদের বিশ্রামাগার। সেখানে দিন-রাত অপকর্ম, আর পাপাচার হয়। সেনাবাহিনীর বড় বড় অফিসাররা সেখানে আসে। শরাব পান করে উন্মাদ হয়ে আমাদের সাথে রাত্রি যাপন করে। দিনের আলো ফোঁটার সাথে সাথে গির্জা ও উপাসনালয়সমূহে হিতোপদেশ আর উপাসনার মাধ্যমে মানুষদেরকে খোদার ভয় দেখানো হয়। তাদেরকে এ ধারণা দেওয়া হয় যে, পাদ্রি ও ধর্ম্যাজিকা নারীগণ আসমান থেকে অবতীর্ণ নিষ্পাপ ফেরেশতা। এ সকল ধর্মগুরুরা টলেডোর শাহীমহলকেও নিজেদের করতলগত করে রেখেছে। রডারিকের মতো জালিম বাদশাহও তাদেরকে ভয় পেত।

‘রডারিক তাদেরকে ভয় পেত না। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। বরং সে ধর্মগুরুদের সামনে এ জন্য মাথা নত করে রাখত, যেন তারা তোমার মতো আকর্ষণীয় ও সুন্দরী, যুবতী ধর্ম্যাজিকাদেরকে তার দরবারে পেশ করে।

তারিক বিন যিয়াদ দোভাষীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘এ মেয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে। তাকে বল, সে যেন আরও কিছু কথা আমাদেরকে শুনায়।’

‘ইসিজা খ্রিস্টানদের একটি পবিত্র শহর। মেয়েটি বলল। কিন্তু প্রার্থনালয়ে যেসব ধর্মযাজিকা আছে, তাদের অধিকাংশ ইহুদিদের মেয়ে। আমিও ইহুদি। আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী। আমার বয়স যখন তের-চৌদ্দ বছর তখন আমাকে জোরপূর্বক এক গির্জায় নিয়ে গিয়ে যাজিকা বানানো হয়। বাবা, মা, ভাই, বোন ঘর-বাড়ী সবই তারা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। তার পর গির্জার ঐ পাদ্রিরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ–আমার সতীত্ব ও কুমারীত্ব ছিনিয়ে নেয়। অথচ সাধারণ মানুষ আমাকে কুমারী ও ধর্মযাজিকা মনে করে তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছে।

আমি আমার নিজের যে ঘটনা বর্ণনা করলাম–এটা প্রতিটি ধর্ম্যাজিকার জীবন বৃত্তান্ত। আমি সিপাহসালারের নিকট আবেদন করছি, তিনি যেন এই শহরে–যাকে খ্রিস্টানরা অত্যন্ত পবিত্র শহর মনে করে আগুন লাগিয়ে দেন। অথৈ পাপে নিমজ্জিত এই শহরের নাম-নিশানা মিটিয়ে দেন।

আমার এই শরীর ছাড়া মুসলিম সেনাপতিকে দেওয়ার মতো আর কিছুই আমার কাছে নেই। আমার একান্ত ইচ্ছা এই যে, আমি সেনাপতির ধর্ম গ্রহণ করে নেব, অতঃপর তিনি আমাকে শাদী করবেন। কিন্তু আমি আমার এ বাসনা পূর্ণ হতে দেব না। কারণ, আমি একটি অপবিত্র মেয়ে, আর সিপাহসালার আল্লাহ তাআলার প্রিয়পাত্র এবং অনেক সম্মানী ব্যক্তি। আমি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে বলছি, বিজয় আপনাদেরই হবে। পরাজয় ঐ সকল পাপীদেরই হয়, যারা ধর্মের লেবাস পরিধান করে লোকচক্ষুর অন্তরালে আকণ্ঠ পাপে নিমজ্জিত থাকে।

‘এই মেয়েকে অন্য মেয়ে দুটির কামরায় নিয়ে যাও। তারিক বিন যিয়াদ দোভাষীকে লক্ষ্য করে বললেন। আর এদের সাথে যে বৃদ্ধ এসেছে, তাকে এখানে নিয়ে এসো।’

মেয়েটি চলে গেলে সেই বৃদ্ধ তারিক বিন যিয়াদের তাবুতে প্রবেশ করল। তারিক বিন যিয়াদের হাতে সেই খঞ্জরটি ছিল, যেটি ঐ মেয়ে তাঁর পদতলে রেখে গেছে।

‘তুমি কি এ খণ্ডর দ্বারা আমাকে হত্যা করতে চাচ্ছিলে?’ তারিক বিন যিয়াদ বৃদ্ধকে খঞ্জরটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

বৃদ্ধ ভয়ে ও বিস্ময়ে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন, তার চোখ দুটি কুঠরি ছেড়ে বের হয়ে আসবে। সে থর থর করে কাঁপছিল।

‘যে জাতী তার নারীদেরকে ঘর থেকে বের করে ময়দানে নিয়ে আসে তাদের অবস্থা এমনই হয়, যেমনটি তোমাদের হচ্ছে।’ তারিক বিন যিয়াদ বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে বললেন। আমরা মিথ্যা ও অকল্যাণের মূলোৎপাটন করতে এসেছি। আমরা আল্লাহ্ তাআলার এই জমিনকে পাপমুক্ত করতে এসেছি। আর তোমাদের ধর্মগুরু ও সিপাহসালাররা সেই পাপের আশ্রয় নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথ রুদ্ধ করতে চাচ্ছে।

আমি যুদ্ধের ময়দানে তীর অথবা তলোয়ারের আঘাতে মৃত্যুবরণ করব। আমি যে আল্লাহর পয়গাম নিয়ে এই রাজ্যে এসেছি, সে আল্লাহ আমাকে ব্যভিচারে লিপ্ত অবস্থায় কোন নারীর হাতে মারতে পারেন না। তুমি আমাকে বল, ইসিজার সৈন্য সংখ্যা কত? দুর্গের প্রাচীর কেমন? এমন কোন রাস্তা আছে কি, যেখান দিয়ে আমরা দুর্গের ভিতর প্রবেশ করতে পারব?

‘দুর্গ বহুত মজবুত।’ বৃদ্ধ বলল। শহর রক্ষাপ্রাচীর এতটাই শক্ত যে, আপনি কিছুতেই তা ভাঙতে পারবেন না। আপনার সিপাহী প্রাচীরের কাছেই যেতে পারবে না। কারণ, শহরের প্রতিটি শিশু পর্যন্ত তীর, বর্শা, পাথর ও জ্বলন্ত লাকড়ি নিয়ে প্রাচীরের উপর প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে। এই শহর রক্ষার জন্য নারীরা পর্যন্ত লড়াই করবে। বড় পাদ্রি শহরবাসী ও সিপাহীদেরকে পূর্ণরূপে উত্তেজিত করে রেখেছে। যে সকল সিপাহী পরাজিত হয়ে পালিয়ে ইসিজায় আশ্রয় নিয়েছে, তারা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করবে।

‘তুমি কে?’ তারিক বিন যিয়াদ বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমি একজন পাদ্রি। বৃদ্ধ বলল।

‘তুমি কি আমাকে এবং আমার দুইজন সালারকে ঐ মেয়েদের মাধ্যমে হত্যা করার জন্য এখানে এসেছ?’ তারিক বিন যিয়াদ জিজ্ঞেস করলেন।

‘হা, সিপাহসালার! বৃদ্ধ বলল। আমি এই ইচ্ছা নিয়েই এসেছিলাম, তবে এখন সে ইচ্ছা ত্যাগ করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন।’

তারিক বিন যিয়াদের হাতে খঞ্জর ছিল। তিনি আস্তে আস্তে বৃদ্ধের কাছে এসে পূর্ণ শক্তি দিয়ে বৃদ্ধের বুকে খঞ্জর বসিয়ে দিলেন।

 ‘সাপ কখনও দংশনের ইচ্ছে ত্যাগ করতে পারে না।’ তারিক বৃদ্ধের বুক থেকে খঞ্জর বের করতে করতে বললেন।

বৃদ্ধ তার হাত দুটি বুকের উপর রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। তারিক বিন যিয়াদ দারোয়ানকে ডেকে বললেন, ‘সেনা ছাউনি থেকে বহুদূরে এ লাশ ফেলে আসবে। আর মেয়ে তিনটির ব্যাপারে নির্দেশ হল, তাদেরকে পৃথক পৃথক স্থানে রাখবে এবং তাদের জন্য কঠিন হেফাজতের ব্যবস্থা করবে।’

তারিক বিন যিয়াদ জুলিয়ান, আইপাস ও অন্যান্য সালারদেরকে ডেকে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ পেশ করলেন।

***

ফজরের পর পরই মুসলিম বাহিনী ইসিজার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। নিয়ম অনুযায়ী তারিক বিন যিয়াদ নামাজের ইমামতি করলেন। নামায শেষে তিনি গোটা বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘সামনের শহর জয় করা সহজ হবে না; বরং আমাদেরকে খুব বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে হবে।

তিনি সৈন্যদের লক্ষ্য করে অত্যন্ত তেজদ্বীপ্ত ও জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন।

ইসিজার বড় পাদ্রি এবং অভিজ্ঞ দুর্গপতি এ খবরের অপেক্ষায় ছিল যে, মুসলমানদের সিপাহসালার এবং আরও দু’জন সহকারী সালার নিহত হয়েছে, তাই মুসলিম বাহিনীর পক্ষ থেকে সেনা-অভিযান মূলতবী করে দেওয়া হয়েছে।

এসব কথা ভেবেই তারা সাত সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে দুর্গপ্রাচীরের উপর উঠে কারমুনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারা আশা করছিল, তাদের লোক মেয়ে তিনটিকে সাথে নিয়ে ঘোড়াগাড়িতে চেপে খুব ভোরেই ইসিজার দিকে রওনা হয়ে যাবে। কিন্তু তারা কোন ঘোড়াগাড়ি দেখতে পাচ্ছিল না। ধীরে ধীরে সূর্য উপরের দিকে উঠছিল, আর তাদের মনেও সন্দেহ দানা বাঁধছিল।

সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হয়ে এলো। সূর্য তার পূর্ণ শক্তি দিয়ে পৃথিবীর বুকে আগুন ছড়াতে লাগল। হঠাৎ দূর আকাশে ধূলিঝড় দেখা গেল। তারা প্রমাদ গণল, এটা তো কোন কাফেলার আগমন মনে হচ্ছে না। ছোট কোন কাফেলা আসলে এত ধূলিকণা উড়ত না। তারা সেই ধূলিধূসর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটন্ত ঘোড়ার ধূসর আকৃতি তাদের নজরে পড়ল।

‘দুশমন আসছে। দুর্গপতি প্রাচীরের উপর হতে সুউচ্চস্বরে আওয়াজ দিল।

দুর্গের সৈন্যরা প্রত ছিল। কমান্ডাররা গত রাতে সিন্ধান্ত নিয়েছিল যে, দুর্গের মাঝে অবরোদ্ধ হয়ে পড়ার চেয়ে খোলা ময়দানে আক্রমণকারীদের মুকাবেলা করা হবে। তাদের ধারণা ছিল, মুসলমানদের সিপাহসালার এবং আরও দুজন সহকারী সালার নিহত হয়েছেন। তাই মুসলিম বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যহত হবে।

নিজেদের উপর তাদের পূর্ণ আস্থা ছিল। কারণ, তারা পূর্ণরূপে প্রস্তুতি নিয়েছিল। তারা এ কথা ভেবে মনে মনে খুশী হচ্ছিল যে, মুসলিম বাহিনী যদি তাদের সিপাহসালার ছাড়া হামলা করে তাহলে তারা খুব তাড়াতাড়ি মারা পড়বে। তারা এটা ভাবতেই পারছিল না যে, মুসলিম বাহিনীর সিপাহসালার এত সুন্দর মেয়েদেরকে প্রত্যাখ্যান করবে, এবং তাদের হাতে নিহত হওয়া থেকে বেঁচে যাবে।

দুর্গপতির ঘোষণার সাথে সাথে দুর্গের তামাম দরজা খুলে গেল এবং ইসিজার সৈন্যবাহিনী দ্রুতবেগে দুর্গ ছেড়ে বাইরে চলে এলো। ইসিজার বাহিনীতে নওজোয়ান ও মধ্যবয়সি জনসাধারণও ছিল। লড়াইয়ের সামান্য অভিজ্ঞতাও তাদের ছিল না। সুতীব্র আওয়াজে যুদ্ধের ডঙ্কা বেজে উঠল। নিয়মিত সিপাহী এবং সাধারণ মানুষের মাঝে সুস্পষ্টরূপে যুদ্ধের উন্মাদনা পরিলক্ষিত হচ্ছিল।

***

তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী সুতীব্র বেগে এগিয়ে আসছিল। অগ্রগামী বাহিনীর কমান্ডার দেখতে পেল, দুর্গ হতে সৈন্যরা বের হয়ে ময়দানে সারিবদ্ধ হচ্ছে। কমান্ডার সাথে সাথে অগ্রগামী বাহিনীর প্রতিটি ইউনিটকে সেখানেই থামিয়ে দিল। তারপর তিনি তাঁর ঘোড়া হাঁকিয়ে তারিক বিন যিয়াদের নিকট পৌঁছে ঘটনা বর্ণনা করল।

তারিক তার সৈন্যবাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করলেন। এক ভাগের দায়িত্ব দিলেন মুগীস আর-রুমীকে, আরেক ভাগের দায়িত্ব দিলেন যায়েদ বিন কুসাদাকে, আর তৃতীয় ভাগের দায়িত্ব নিজ হাতে রাখলেন। দায়িত্বশীলদেরকে অতি দিকনির্দেশনা দিয়ে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দিলেন। মুগী আর-রুমীকে তিনি শহরের শেষ প্রান্তে পাঠিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য হল, তারা শহরের পিছন দিকে অবস্থান নিবে।

যায়েদ বিন কুসাদাকে সেখান থেকেই ডান দিকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাকে এই নির্দেশ দিলেন যে, দুশমনের দৃষ্টি এড়িয়ে যথাসম্ভব দূরে চলে যাবে। তার পর পথ ঘুরে শত্রুবাহিনীর বাম পার্শ্বে অবস্থান নিবে। আক্রমণের নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। অতঃপর তারিক নিজে শত্রুবাহিনীকে লক্ষ্য করে সামনে অগ্রসর হলেন। তিনি শত্রুবাহিনীর নিকট পৌঁছামাত্রই শত্রুবাহিনীর মধ্য ভাগ মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে বসল।

ঐতিহাসিক লেনপোল লেখেন, ইসিজা বাহিনীর এই হামলা ছিল মরণপণ হামলা। ইসিজা বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা দেখে মনে হচ্ছিল, শহর রক্ষার জন্য তারা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। অন্যান্য ঐতিহাসিকগণও লেখেছেন, এই প্রথম আন্দালুসিয়ার সৈন্যদের মাঝে লড়াইয়ের প্রচণ্ড উন্মাদনা দেখা যাচ্ছিল।

প্রফেসর ডোজি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, খ্রিস্টান বাহিনী এত প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করছিল যে, তা প্রতিহত করা তারিকের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। তারিকের সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, কয়েক হাজার নতুন বার্বার সিপাহী এসে তার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। ফলে তাঁর বাহিনীর সংখ্যা কয়েক হাজার বেড়ে গিয়েছিল। অন্যথায় ইসিজার সৈন্যবাহিনী তাঁকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করত। বাবার সম্প্রদায় এমনিতেই যুদ্ধবাজ ছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহ, আর খুন-খারাবি ছিল তাদের সহজাত বিষয়। তারা কোন অবস্থাতেই পরাজয় স্বীকার করে নিতে পারত না। তারা জীবনবাজি রেখে লড়ে যাচ্ছিল। আর শরীরের তাজা খুন ও জানের নাযরানা পেশ করছিল।

ইসিজা বাহিনীর জেনারেল মুসলিম বাহিনীকে পিছন দিক হতে আক্রমণ করার জন্য তার সৈন্যদলের বামবাহুকে আরও বামদিকে সরে যেতে নির্দেশ দিয়ে বলল, ঘুরপথে মুসলিম বাহিনীর পিছনে গিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করবে। জেনারেলের নির্দেশ অনুযায়ী সৈন্যদলের বামবাহু বাম দিকে সরে যেতে লাগল; কিন্তু তাদের জানা ছিল না যে, সেদিকে মুসলিম বাহিনীর কয়েকটি ইউনিট প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে।

মুসলিম বাহিনীর কমান্ডার যায়েদ বিন কুসাদা খ্রিস্টান সৈন্যদেরকে বাম দিকে সরে আসতে দেখে তিনি তাঁর বাহিনীকে আরও পিছনে নিয়ে গেলেন, যেন শত্রুবাহিনী তাদেরকে দেখতে না পায়।

খ্রিস্টান বাহিনী যখন সামনে অগ্রসর হয়ে ডানদিকে মোড় নিল এবং বেশ কিছু দূর অগ্রসর হয়ে গেল তখন যায়েদ বিন কুসাদা তাঁর বাহিনী নিয়ে পিছন দিক থেকে খ্রিস্টান বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। খ্রিস্টান বাহিনী আক্রমণের আকস্মিকতায় একেবারে ভড়কে গেল। তারা এই হঠাৎ আক্রমণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারল না। ফলে তারিক বিন যিয়াদের পিছন দিক একেবারে নিরাপদ হয়ে গেল।

রণাঙ্গনের পরিধি বেড়ে গেল। শহর-রক্ষা প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ এ ভয়াবহ যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছিল। তারা মুগীস আর-রুমীর বাহিনীকে দেখে ফেলল। মুগীস আর-রুমী শহরের বাম দিকে সামান্য দূরে তারিক বিন যিয়াদের হুকুমের অপেক্ষা করছিল। একজন বেসামরিক লোক তাদের জেনারেলের নিকট ছুটে গিয়ে মুগীস আর-রুমীর বাহিনী সম্পর্কে সংবাদ দিল। জেনারেল তার বাহিনীর ডান বাহুকে মুগীস আর-রুমীর বাহিনীকে শায়েস্তা করার জন্য পাঠিয়ে দিল।

মুগীস আর-রুমী ছিলেন অত্যন্ত চৌকস ও সচেতন। তিনি তার কয়েকজন সৈন্যকে সংবাদ সগ্রহের জন্য সামনে পাঠিয়ে ছিলেন। তাদের একজন দৌড়ে এসে তাকে সংবাদ দিল, শত্রুবাহিনীর কয়েকটা দল এদিকে আসছে। মুগীস তারিক বিন যিয়াদের নির্দেশের অপেক্ষা না করে তার বাহিনীকে সামনে অগ্রসর হওয়ার হুকুম দিলেন। তার নিকট যথেষ্ট সংখ্যক অশ্বারোহী ছিল।

মুগীস আর-রুমী ধেয়ে আসা খ্রিস্টান বাহিনীর সাথে সামনা-সামনি লড়াই করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি তাঁর বাহিনীকে আরও সামনে নিয়ে গিয়ে শত্রুবাহিনীর ডান পার্শ্বে আক্রমণ করলেন। তার আক্রমণ এতটাই কঠিন ও তীব্র ছিল যে, শত্রুপক্ষ পিছু হঠতে বাধ্য হল। তাদের পিছনেই ছিল শহর-রক্ষা প্রাচীর। তারা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করছিল, কিন্তু মুগীস আর-রুমী তাদের উপর এমন প্রচণ্ড আক্রমণ করেছিলেন যে, তারা পিছু হটতে গিয়ে শহর-রক্ষা প্রাচীরের কারণে বাধাপ্রাপ্ত হল। তারা সামনে অগ্রসর হয়ে পাল্টা আঘাত হানার আপ্রাণ চেষ্টা করল, কিন্তু মুসলিম বাহিনী তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল।

বার্বার যোদ্ধারা এখানে সাহসিকতা ও রণনৈপুন্যতার এমন পারঙ্গমতা প্রদর্শন করল, যা বহুকাল সমর-ইতিহাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ইসিজার বাহিনীও জীবনবাজি রেখে লড়াই করছিল।

যুদ্ধ এখন তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। তারিক বিন যিয়াদ সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় ছিলেন। তাঁর উভয় পাশের সৈন্যরা পৃথক পৃথকভাবে যুদ্ধ করছিল। তারিক কোন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে পারছিলেন না। তাঁর প্রতিটি সৈন্যই মরণপণ লড়াই করছিল। তাঁর কোন রিজার্ভ বাহিনীও ছিল না। তিনি নিজেও একজন সাধারণ সৈনিকের মতো লড়াই করছিলেন। তার বাহিনীর সৈন্যদেরই বেশি ক্ষতি হচ্ছিল।

যায়েদ বিন কুসাদা যেহেতু পিছন দিক হতে আক্রমণ করেছিলেন, তাই তিনি শত্রুবাহিনীর বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যায়েদ বিন কুসাদা ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ সালার। তিনি দূর থেকে দেখতে পেলেন, তারিক বিন যিয়াদ বেশ বিপদের মধ্যে আছেন। তিনি তার বাহিনীর এক চতুর্থাংশকে তারিকের সাহায্যে পাঠিয়ে দিলেন। ফলে তারিকের বিপদ কিছুটা হালকা হল। কিন্তু খ্রিস্টান সৈন্যরা তাদের পবিত্র নগরী রক্ষার্থে জীবনবাজি রেখে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করছিল। লাকাসহ অন্যান্য রণাঙ্গন ও দুর্গ থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যরা আহত সিংহের ন্যায় লড়াই করছিল। তারা বীরবিক্রমে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করে তাদেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলছিল।

মুগীস আর-রুমী খ্রিস্টান বাহিনীকে ফাঁদে ফেলে তাদের বেশ ক্ষতিসাধন করছিলেন। তাদের পদাতিক বাহিনী দুর্গপ্রাচীর আর অশ্বারোহী বাহিনীর মধ্যবর্তী স্থানে বন্দী হয়ে পড়েছিল। তাদের অনেকেই ঘোড়র পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা পড়ল। ঘোড়াগুলো পরস্পরে এমনভাবে জড়সড় হয়েছিল যে, অশ্বারোহীদের জন্য তীর-তলোয়ার ও বর্শা চালানো একেবারে অসম্ভব হয়ে গেল। ফলে তারা নিজেদের হাতিয়ার দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগল।

রণাঙ্গনে তারিক বিন যিয়াদের একটি স্থায়ী নির্দেশ ছিল, ঘোড়ার যেন কোন ক্ষতি করা না হয়। কারণ, ঘোড়াগুলো মুসলিম বাহিনীর কাজে লাগবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মুগীস আর-রুমী ঘোড়ার পরোয়া না করে নির্দেশ দিলেন, তীর ছুঁড়ে দুশমনের ঘোড়াগুলো জখম করে ফেল। নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে মুসলিম বাহিনী ঘোড়াগুলো লক্ষ্য করেও তীর-বর্শা ছুঁড়তে লাগল। তীরের আঘাতে আহত ঘোড়া আরোহীর নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়ে এলোপাথাড়ি ছুটতে লাগল। নিয়ন্ত্রণহীন ঘোড়া তার আরোহীকে ফেলে দিলে অন্য ঘোড়া এসে তাকে পদপিষ্ট করে চলে যেত।

মুগীস আর-রুমীর ফাঁদ থেকে খ্রিস্টান বাহিনী পালানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু খুব কম সংখ্যকই পালাতে পারল। মুগীস তার কিছু সৈন্যকে তারিক বিন যিয়াদের সাহার্যে পাঠিয়ে দিলেন। এতে তারিকের বিপদ আরও হালকা হয়ে গেল এবং যুদ্ধের যে হাওয়া খ্রিস্টানদের অনুকূলে প্রবাহিত হচ্ছিল, তা এখন তাদের প্রতিকূলে বইতে শুরু করল।

ইতিহাসে ইসিজার খ্রিস্টান সৈন্যবাহিনীর ভূয়ষী প্রশংসা করা হয়েছে। কারণ, তারা সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সাথে লড়াই করে মুসলিম বাহিনীর যে ক্ষতি সাধন করেছিল, মুসলিম বাহিনী ইতিপূর্বের যুদ্ধগুলোতে এই পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি।

মুসলিম বাহিনী এত বিপুল পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। প্রাথমিক পর্যায়ের কয়েকটি যুদ্ধে বিজয়ের আনন্দে তারা বিভোর ছিল। ইসিজার খ্রিস্টানরা তাদের সেই মুগ্ধতা দূর করে দিল।

একজন পোর্তগিজ ঐতিহাসিক লেখেন, এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী এমন ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, যা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। সন্ধ্যা নাগাদ খ্রিস্টান বাহিনী পরাজিত হয়ে গেল টিকই, কিন্তু মুসলমানদের দেমাগ থেকে এই আনন্দ-অনুভূতি বের হয়ে গেল যে, তারা যেদিকেই যাবে বিজয় তাদের পদচুম্বন করবে।’

***

শেষ বিকেলের সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে ডুবে গেল। সেই সাথে আন্দালুসিয়ায় খ্রিস্টানদের বীরত্বের সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল। তাদের দুর্গপতিসহ জেনারেলদের সকলেই নিহত হল। সাধারণ সিপাহীদের মাঝে খুব স্বল্প সংখ্যকই জীবিত রইল। তারিক বিন যিয়াদকে যখন তার বাহিনীর ক্ষয়-ক্ষতি সম্পর্কে জানানো হল তখন তিনি একেবারে বাকহীন হয়ে গেলেন। তার মুখ থেকে একটি কথাও বের হল না। তার শারীরিক অবস্থা ছিল একেবারে শোচনীয়। মনে হচ্ছিল, তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গার হাড়-গুড় ভেঙ্গে গেছে। সারাদিন তিনি একজন সাধারণ সিপাহীর মতো লড়াই করেছেন।

খ্রিস্টান সিপাহীদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিল, তারা ক্লান্তির কারণে চলা-ফেরা করতে পারছিল না। যে যেখানে ছিল সেখানেই বসে পড়ল। এখন তারা যুদ্ধবন্দী। সিপাহীদের মাধ্যে যারা পলানোর চেষ্টা করছিল তাদেরকে পাকড়াও করে নিয়ে আসা হচ্ছিল। শহরে ঘোষণা করে দেওয়া হল, কেউ যদি কোন সিপাহীকে আশ্রয় দেয় তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

তারিক বিন যিয়াদ নির্দেশ দিলেন, আহতদেরকে মুসলিম বাহিনী ময়দান থেকে নিয়ে আসবে, আর শহরবাসী তাদেরকে সাহায্য করবে। আহত ব্যক্তি মুসলমান হোক বা খ্রিস্টান সকলের সাথে এক রকম ব্যবহার করা হবে। কেউ এই হুকুম অমান্য করলে তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

তারিক বিন যিয়াদ ঐ মেয়ে তিনটিকে তলব করলেন, যারা তাঁকে হত্যা করার জন্য এসেছিল। তিনি বড় পাদ্রিকেও ডেকে পাঠালেন। বড় পাদ্রি এলে তারিক বিন যিয়াদ মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এই ব্যক্তিই কি তোমাদেরকে পাঠিয়েছিল আমাকে হত্যা করতে?

‘হ্যাঁ, সিপাহসালার!’ একটি মেয়ে বলল। সেই আমাদেরকে পাঠিয়েছিল এবং হত্যা করার পন্থাও বলে দিয়েছিল।’

‘আমার বাহিনীর কোন সিপাহী তোমাদের কোন উপাসনালয়ের বারান্দায়ও পাও রাখবে না। তারিক বিন যিয়াদ পাদ্রিকে লক্ষ্য করে বললেন। উপাসনালয় যে ধর্মেরই হোক না কেন, আমাদের কর্তব্য হল, তার সম্মান রক্ষা করা। আমরা কারও ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করব না। প্রত্যেক ধর্মের লোক নিজস্ব ইবাদত ও ধর্ম-কর্ম সম্পাদনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু তোমরা তোমাদের ধর্মীয় বিধানকে কলঙ্কিত করেছ, আমি তোমাদের এই অপরাধ ক্ষমা করব না। কুমারী মেয়েদেরকে রক্ষিতা বানিয়ে রাখার শিক্ষা কি হযরত ঈসা আলাইহিস্সালাম তোমাদেরকে দিয়েছেন? কক্ষণও না। তিনি তোমাদেরকে এমন বিধান কখনও শিক্ষা দেননি। তোমাদেরকে হত্যা করা উচিৎ।

পাদ্রি অনেক কাকুতি-মিনতি করে প্রাণ ভিক্ষা চাইল। নিজেকে রক্ষার জন্য সে অনেক অযুহাত পেশ করল। কিন্তু তারিক বিন যিয়াদ তাকে বন্দী করার নির্দেশ দিলেন এবং ভোরেই তাকে হত্যা করার হুকুম জারি করলেন।

অন্যান্য ধর্মীয় পণ্ডিতদেরকে ডেকে তারিক বিন যিয়াদ নির্দেশ দিলেন, সকল ধর্ম-যাজিকাদেরকে তাদের মা-বাবার নিকট পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যে যেই এলাকার তাকে সেই এলাকায় পৌঁছে দিতে হবে।’

তারিক বিন যিয়াদ ইসিজা বাসীদের উপর মোটা অংকের জরিমানা আরোপ করলেন। কারণ তারা তাদের বাহিনীর সাথে সমান তালে যুদ্ধ করছিল। ফলে মুসলিম বাহিনীর যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। এছাড়াও তিনি তাদের উপর নিরাপত্তা-কর আরোপ করেন।’

ইসিজার প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব তারিক বিন যিয়াদ খ্রিস্টানদের উপরই ন্যস্ত করেন। তবে প্রধান প্রশাসক হিসেবে একজন মুসলিমকে নিয়োগ দেন।

***

পর দিন সকালে এক হৃদয়বিদারক ও বেদনাবিধুর দৃশ্যের অবতারণা হয়। শহীদগণের লাশ পাঁচটি কাতারে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে। তারিক বিন যিয়াদ জানাযার নামায পড়ানোর জন্য সামনে অগ্রসর হলেন। শহীদগণের কাফনের ব্যবস্থা শহরবাসীরা করেছিল। শহরবাসীরা শহীদগণের জানাযা ও দাফনের দৃশ্য প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করছিল।

এক বিশাল-বিস্তৃত এলাকা জোড়ে গণকবরের ব্যবস্থা করা হল। সর্বপ্রথম যেসকল মুজাহিদীন ইউরোপে আল্লাহ্ তাআলার একত্ববাদ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেসালাত পৌঁছে দিয়েছিলেন–এটা ছিল তাদের সর্বশেষ আরামগাহ।

তারিক বিন যিয়াদের দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর প্লাবন বইছিল। মুজাহিদগণ থেমে থেমে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিচ্ছিলেন। শহীদগণকে দাফন করে তারিক বিন যিয়াদ অশ্রুসজল চোখে কবরস্থান থেকে বের হয়ে এলেন। এমন সময় তাকে সংবাদ দেওয়া হল, কায়রো থেকে মিসর ও আফ্রিকার আমীর মুসা বিন নুসাইরের কাসেদ এসেছে।

তারিক বিন যিয়াদ কাসেদ থেকে পয়গাম নিয়ে পড়তে লাগলেন। পয়গাম পড়তে পড়তে তার চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেল। তার কাছেই জুলিয়ান ও অন্যান্য সালারগণ উপস্থিত ছিলেন।

 ‘তোমাদের কেউ কি আমাকে বলতে পার, এই নির্দেশের মাঝে কি এমন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় আছে?’ তারিক বিন যিয়াদ বিরক্তির সাথে তাঁর সালারদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। তারপর তিনি মুসা বিন নুসাইরের পয়গাম পড়ে তাদেরকে শুনাতে লাগলেন।

মুসা বিন নুসাইর তারিককে লেখেছিলেন :

 ‘বুদ্ধিমত্তার দাবি হল, তুমি যেখানে আছে সেখানেই অবস্থান করবে। এমন যেন না হয় যে, জয়ের নেশায় সামনে অগ্রসর হতে গিয়ে গোটা বাহিনীই চরম পরাজয়ের শিকার হয়। পরবর্তী নির্দেশ না আসার আগ পর্যন্ত সামনে অগ্রসর হবে না। খুব শীঘ্রই এ ব্যাপারে আমি দিক-নির্দেশনা পাঠাচ্ছি, কিংবা আমি নিজেই ফৌজ নিয়ে উপস্থিত হচ্ছি।’

অধিকাংশ ঐতিহাসিকই মুসা বিন নুসাইরের পয়গামের হুবহু বিবরণ না দিয়ে শুধু মন্তব্য পেশ করেছেন। তারা লেখেছেন, মুসা বিন নুসাইর তারিককে শুধু হুকুমই দেননি; বরং তাকে বাধ্য করেছিলেন, যেন তিনি সামনে অগ্রসর না হতে পারেন।

খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, ‘মুসা বিন নুসাইর যখন দেখলেন যে, তাঁর গোলাম তারিক বিন যিয়াদ আন্দালুসিয়ার মতো এক বিশাল রাজ্যের বিজেতা হয়ে যাচ্ছে, সে মাত্র বার হাজার সৈন্যের মাধ্যমে রডারিকের এক লাখের চেয়েও বেশি সৈন্যকে শুধু পরাজিতই করেনি; বরং তাদের নাম-নিশানা পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়েছে। ফলে ইসলামী সালতানাতের খলীফার কাছেও সে এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হতে যাচ্ছে, তখন মুসার অন্তরে তারিক বিন যিয়াদের ব্যাপারে পত্রিকার জন্ম নিল। মুসা বিন নুসাইর হিংসার বশবর্তী হয়ে তারিককে সামনে অগ্রসর হতে বাধা দিয়ে নিজে আন্দালুসিয়ার বিজেতা হওয়ার গৌরব অর্জন করতে চাচ্ছিলেন।’

অসম্প্রদায়িক ঐতিহাসিকগণ, বিশেষ করে মুসলিম ইতিহাসবিদগণ লেখেছেন যে, মুসা বিন নুসাইরের এই নির্দেশ সঠিক ছিল। কারণ, তিনি চিন্তা করেছিলেন, তারিক বিন যিয়াদ বয়সে তরুণ। আবেগের বশবর্তী হয়ে সামনে অগ্রসর হতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের শিকার হতে পারেন। তখন যে সকল এলাকা বিজয় হয়েছে সেগুলোও হাত ছাড়া হয়ে যাবে।

কোন রকম পক্ষপাতিত্বের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে এবং কোন রকম মন্তব্য থেকে বিরত থেকে, মুসা বিন নুসাইর তারিককে সামনে অগ্রসর না হওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সমরশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে তা কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল–সে ব্যাপারে তল্কালিন পরিস্থিতিতে তারিক বিন যিয়াদ ও তাঁর সালারগণ কী মতামত ব্যক্ত করেছিলেন এবং তাঁরা কী সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন, নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিকগণের বরাত দিয়ে তা-ই এখানে আমরা উল্লেখ করছি।

তারিক বিন যিয়াদ কবরস্থান থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে তার সালারদেরকে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। এই আলোচনায় সালারদের সাথে তিনি জুলিয়ানকেও উপস্থিত হতে বললেন। এর প্রথম কারণ হল, জুলিয়ান আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার সাথে তারিক বিন যিয়াদের সাহায্য-সহযোগিতা করছিলেন। এমনকি তিনি একজন খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও তার স্বজাতিকে ধোঁকা দিয়ে কারমুনা দুৰ্গ তারিক বিন যিয়াদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কারণ হল, জুলিয়ান ছিলেন একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। বিশেষ করে সমরশাস্ত্রে তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা ছিল অতুলনীয়।

‘হে আমার বন্ধুগণ!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমীরের এই হুকুমের পিছনে কি এমন হেকমত লুকিয়ে আছে? একদিকে ইসলামের বিধান হল, আমীরের আনুগত্য করো; তার বিরুদ্ধাচরণ করো না। অপর দিকে আমরা যদি সামনে অগ্রসর না হয়ে এখানে বসে থাকি তাহলে আন্দালুসিয় সৈন্যরা মনে করবে, ইসিজার যুদ্ধে আমরা যে বিপুলসংখ্যক সৈন্য হারিয়েছি, তা আমরা বরদাশত করতে পারছি না। তাই সামনে অগ্রসর হতে ভয় পাচ্ছি।’

‘বিন যিয়াদ! মুগীস আর-রুমী বললেন। আন্দালুসিয়রা যা মনে করার তা করুক। আমদের চিন্তা করার বিষয় হল, আমরা আন্দালুসিয়দের ঘাড়ের উপর চেপে বসেছি। এখন আমরা যদি সেখান থেকে নেমে যাই তাহলে আন্দালুসিয়রা তাদের বিক্ষিপ্ত সামরিক-শক্তিকে একত্রিত করে ফেলবে। তখন তারাই আমাদের জন্য মহাবিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমরা শত্রুপক্ষের উপর আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। এখন শত্রুপক্ষকে সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া ছাড়া, আমীরের এই নির্দেশের মাঝে আমি আর কোন হেকমত খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘বিন যিয়াদ! আপনি চিন্তা কর দেখুন। জুলিয়ান বললেন। আমীরের হুকুম মান্য করার ব্যাপারে আপনাদের ধর্মের যে নির্দেশ রয়েছে, সে ব্যাপারে আমি কোন মন্তব্য করব না। আমাদের ধর্মের নির্দেশও এমনিই। তবে আমীর যদি এমন কোন নির্দেশ দেন, যার কারণে ধর্মের ও ধর্মের অনুসারীদের ক্ষতি হয় তাহলে আমি মনে করি–এমন হুকুম পালন করা পাপ।

বিন যিয়াদ! আপনি চিন্তা করে দেখুন, আপনি লাকা উপত্যকা জয় করেছেন। গোয়াডিলেটের যুদ্ধে আপনি রডারিকের সাথে তার প্রধান প্রধান প্রশাসক এবং অভিজ্ঞ জেনারেলদেরকে হত্যা করেছেন। আন্দালুসিয়ার প্রকৃত বাহিনীকে আপনি ধ্বংস করে দিয়েছেন। যেসকল সৈন্য পালিয়ে গেছে তারা আপনাদের সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে ভীতি ছড়াচ্ছে। তারা সামান্য সময়ের জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলে হাল ছেড়ে দেয়। এমতাবস্থায় আপনি কি তাদেরকে এই সুযোগ করে দেবেন, যাতে তারা একত্রিত হয়ে আপনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, নাকি তাদের পিছু ধাওয়া করবেন, যেন তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে না পারে?

 ‘আমি কোথাও তাদেরকে নিশ্চিন্তে বসার সুযোগ দেব না।’ তারিক বিন যিয়াদ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন।

‘আমীর মুসা বিন নুসাই এখান থেকে অনেক দূরে। যায়েদ বিন কুসাদা বললেন। এখানকার বাস্তবতা ও আন্দালুসিয় বাহিনীর অবস্থা সম্পর্কে তার সঠিক কোন ধারণা নেই।’

‘তাছাড়া এই ইসিজা শহরের ব্যাপারটিই লক্ষ্য করুন। জুলিয়ান বললেন। ‘এটা আন্দালুসিয়ার চৌরাস্তা। এখান থেকে একটি রাস্তা গেছে কর্ডোভার দিকে। আরেকটি গ্রানাডার দিকে। তৃতীয়টি মালাগার দিকে। আর চতুর্থটি গেছে আন্দালুসিয়ার রাজধানী টলেডোর দিকে। আপনি যদি এ চারটি শহর দখল করে নিতে পারেন তাহলে মনে করবেন, গোটা আন্দালুসিয়াই আপনি দখল করে নিয়েছেন। আপনি সামনে এগিয়ে চলুন, আমীর যদি নারাজ হন তাহলে আমি তার সাথে কথা বলব।’

‘আমি নিজেই তার সাথে কথা বলতে পারব।’ তারিক বললেন। তবে তাঁর সাথে কথা পরে হবে, এখন আমরা সামনে অগ্রসর হব।

***

আমীরের হুকুমের পরোয়া না করে তারিক বিন যিয়াদ অন্য শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সিন্ধান্ত নিলেন। তার বাহিনীকে তিনি দু’ভাগে ভাগ করলেন। এক ভাগের সেনাপতি নিযুক্ত করলেন যায়েদ বিন কুদাকে। ঐতিহাসিকদের অনেকে তাঁর নাম লেখেছেন, যায়েদ বিন কায়সারী। তারিক বিন যিয়াদ তাকে মালাগার দিকে পাঠিয়ে দিলেন। অপরভাগের নেতৃত্ব তারিক বিন যিয়াদ নিজ হাতে রেখে কর্ডোভার দিকে অগ্রসর হলেন।

কোন ঐতিহাসিকই উল্লেখ করেননি, ইসিজায় কত সংখ্যক মুজাহিদ শহীদ হয়েছেন। মুসলিম বাহিনীর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ থেকে বুঝা যায়, শহীদগণের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে। যদিও ইতিপূর্বের বিজয়-সংবাদ শুনে কয়েক হাজার নতুন বার্বার যোদ্ধা মুসলিম বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।

যাহোক, তারিক বিন যিয়াদ কর্ডোভা পৌঁছে কর্ডোভার দুর্গ অবরোধ করলেন। কিন্তু প্রথম দিনই তিনি বুঝতে পারলেন যে, শহরে প্রবেশ করা বড় কঠিন হবে। দুর্গের প্রাচীর ও ফটকের কাছে যাওয়াও ছিল আত্মহত্যার শামিল। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, দুর্গের চতুরপার্শ্বে ছিল পরিখা। তারিক বিন যিয়াদ সর্বাত্মক চেষ্টা করলেন, কিন্তু দুর্গে প্রবেশের কোন উপায়ই তিনি বের করতে পারলেন না। কেবল একটি উপায়ই অবশিষ্ট ছিল, আর তা হল, দীর্ঘ দিন দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকা। ইতিমধ্যেই নয় দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে।

‘মুগীস!’ তারিক বিন যিয়াদ সালার মুগীসকে ডেকে বললেন। “তুমি এখানেই থাক, আমি সামনে অগ্রসর হচ্ছি। আমরা তো এ কারণই আমীরের হুকুম উপেক্ষা করেছিলাম, যেন আন্দালুসিয় বাহিনী শান্তিতে কোথাও বসতে না পারে এবং সংঘবদ্ধ না হতে পারে। সুতরাং আমি এখানে দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকতে পারি না। দুর্গের যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে, কয়েক মাস লেগে যাবে। আমি রাজধানী টলেডোর দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আমাদের এই বাহিনীকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করে নেব। এক ভাগ তোমার সাথে থাকবে, আরেক ভাগ আমার সাথে টলেডো যাবে।’

 ‘বেশির ভাগ সিপাহী আপনার সাথে রাখুন, বিন যিয়াদ! মুগীস আর-রুমী বললেন। আমার কাছে মাত্র সাতশ সিপাহী রেখে যান।

‘কেবল সাতশ সিপাহী! তারিক বিন যিয়াদ অবাক হয়ে বললেন। মাত্র সাতশ সিপাহীর সহযোগিতায় তুমি এ দুর্গ জয় করতে পারবে?

‘মুগীস মাত্র সাতশ সিপাহীর মাধ্যমে এ দুর্গ দখল করতে পারবে কি না-সে ব্যাপারে আমি আপনাকে কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। জুলিয়ান বললেন। তবে ইবনে যিয়াদ! এটা আমি আপনাকে নিশ্চয় করে বলতে পারি, আপনি স্বল্পসংখ্যক সিপাহী নিয়ে টলেডো জয় করতে পারবেন না। টলেডো হল রাজধানী, আন্দালুসিয়ার প্রাণকেন্দ্র। টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই মজবুত। এটাই উত্তম হবে যে, আপনি অধিকাংশ সিপাহী আপনার সাথে নিয়ে যাবেন।

‘আমার জন্য চিন্তা করবেন না।’ মুগীস বললেন। আল্লাহর সাহায্যই আমার জন্য যথেষ্ট। এ দুর্গ আমি দখল করবই, ইনশাআল্লাহ্।

‘আকাশ-কুসুম চিন্তার কথা রাখ, মুগীস!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। ‘আল্লাহ তাআলা শুধু তাদেরকেই মদদ করেন, যারা বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

 ‘আমি বলছি, বাছাইকৃত সাতশ সিপাহী আমার কাছে রেখে আপনি সামনে রওনা হয়ে যান। মুগীস বললেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলা আমাদের বিজয়ের ব্যবস্থা করে দেবেন। আমরা শুধু শুধু পরিখার এপাশে এভাবে বসে থাকব না।’

অগত্যা তারিক বিন যিয়াদ মুগীস আর-রুমীর পছন্দমতো সাতশ সিপাহী রেখে অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে নিয়ে টলেডোর দিকে রওনা হয়ে গেলেন। জুলিয়ান ও আউলাস তার সাথে গেলেন।

কর্ডোভার দুপ্রাচীরের উপর তীর-ধনুক ও বর্শা হাতে নিয়ে যে মানব-প্রাচীর সৃষ্টি হয়েছিল তা বিস্ফোরণ উনখ আগ্নেয়গিরির ন্যায় বিকট শব্দে ফেটে পড়ল। সেই বিস্ফারিত আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের পরিবর্তে আকাশ বির্শিকারী জয়-ধ্বনি বের হতে লাগল। সেই সাথে তারা মুসলিম বাহিনীকে দুয়োধ্বনি দিতে লাগল।

চলে গেছে…, ওরা চলে গেছে…।’

 ‘এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যাচ্ছি…, হে লুটেরার দল…!?

 ‘দেখ…, দেখ…, আমাদের মেহমানরা চলে যাচ্ছে…।’

‘থামো…, থামো…, একটু দাঁড়াও…, আমরা দরজা খুলে দিচ্ছি…।’

তীর, ধনুক আর বর্শা হাতে নেচে-কুদে খ্রিস্টান বাহিনী বিজয়-উল্লাস পালন করছিল। তারা মুসলিম বাহিনীকে তিরস্কার করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। তারিক বিন যিয়াদ তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। অবরোধ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। মুগীস আর-রুমী তার সাতশ সিপাহীকে খন্দক হতে দূরে পিছন দিকে নিয়ে গেলেন। কর্ডোভার খ্রিস্টানরা আত্মতুষ্টিতে ভোগতে লাগল যে, মুসলিম বাহিনী নিরাশ হয়ে অবরোধ উঠিয়ে নিয়েছে।

রাতে শহরে আনন্দ-উৎসব হচ্ছিল। গির্জাসমূহে যাজক-যাজিকারা খুশীতে মেতে উঠেছিল। ইসিজা থেকে পালিয়ে আসা বেশকিছু সিপাহী ও শহরবাসী কর্ডোভায় আশ্রয় নিয়েছিল। তারা ইসিজা যুদ্ধের অত্যন্ত ভয়াবহ চিত্র শহরবাসীর সামনে তুলে ধরছিল। সাধারণ মানুষ এভেবে খুশী ছিল যে, তাদের উপর থেকে বিপদ দূর হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে তাদের কাছে এই রাত ছিল আনন্দের রাত; উৎসবের রাত।

কর্ডোভা শহরের অদূরে সবুজ লতা-গুল্মে ঘেরা ছোট-বড় অসংখ্য টিলা ছিল। মুগীস আর-রুমী তার বাহিনীকে সেই টিলাসমূহের মাঝে আত্মগোপন করে থাকতে বলে নিজে তাদের থেকে পৃথক হয়ে এক স্থানে একাকী নিবিষ্ট চিত্তে নফল নামায পড়ছিলেন। নামায শেষ করে তিনি আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন,

‘হে আল্লাহ! তুমি এক, তোমার কোন শরীক নেই। হে পরওয়ারদিগার! তুমি যাকে ইচ্ছে তাকে ইজ্জত দান কর, যাকে ইচ্ছে তাকে বেইজ্জতি কর। তুমি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আমি তোমার উপর ভরসা করেই মাত্র সাতশ সৈন্য নিয়ে এ শহর জয় করার ওয়াদা করেছি। আমি এ শহরের বাদশাহ হতে চাই না; বরং তোমার বাদশাহী এ শহরে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।

হে আমার আল্লাহ! তুমি আমাকে সাহস ও হিম্মতদান কর, যেন আমি তোমার একত্ববাদ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালতের বাণী নিয়ে এ দুর্গে প্রবেশ করতে পারি এবং বাতিলের ঘোর অমানিশার মাঝে চিরসত্যের প্রদীপ জ্বালাতে পারি। হে দয়াময়! আমাকে তোমার দরবারে এবং আমার সাথীদের সামনে লজ্জিত করো না।’

মুগীস আর-রুমী দুআ শেষ করে আল্লাহর দরবারে প্রসারিত হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে তার বাহিনীর কাছে গিয়ে বসে পড়লেন। সকল সিপাহী তাঁর পাশে এসে একত্রিত হল।

‘প্রিয় সংগ্রামী সাথীগণ! মুগীস আর-রুমী উচ্চস্বরে তাঁর বাহিনীকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন। আমি সিপাহসালারকে বলেছিলাম, আমাকে কেবল সাতশ অশ্বারোহী দিন আমি আপনাকে এ শহর উপহার দেব। আমি আমার দাবি ও প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার জন্য তোমাদেরকে নির্বাচন করেছি। এ প্রতিশ্রুতি আমি সিপাহসালারের নিকট করিনি, বরং স্বয়ং আল্লাহর নিকট করেছি। আমি এ ওয়াদা তোমাদের বীরত্বের উপর ভরসা করে করেছি। আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার কর, আমরা এই শহরের প্রাচীর ভেদ করে তাতে প্রবেশ করব। অন্যথায় আমরা এখানেই জীবন দিয়ে দেব। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন, তোমরা আল্লাহর সঙ্গ ছেড়ে দিও না।

‘আমরা আপনার সাথে আছি। আমরা অঙ্গীকার করছি, জীবন দিয়ে হলেও আমরা এই শহর দখল করব।’ সাতশ সিপাহী এক যোগে চিৎকার করে বলে উঠল।

***

সকাল হওয়ার সাথে সাথে মুগীস আর-রুমী একা একা বের হয়ে পড়লেন। তিনি দুর্গ ও শহর-রক্ষা প্রাচীর ভালোভাবে দেখতে চাচ্ছিলেন। হয়তো প্রাচীরের উপর উঠার বা তা ভাঙ্গার উপযুক্ত কোন জায়গা পেয়েও যেতে পারেন। ঐতিহাসিকগণ লেখেছেন, এমন সময় একজন রাখাল কিছু ভেড়া-বকরী নিয়ে এদিকে আসল। সে মুগীসকে দেখে সালাম করে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের বাদশাহকে যারা পরাজিত করেছে, আপনি কি সে বাহিনীর লোক?

মুগীস আন্দালুসিয়ার ভাষা বুঝতেন এবং কথা বলতেও পারতেন। তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ, দোস্ত! তুমি কি আমাকে তোমার দুশমন মনে কর?

‘না, আমরা খুবই গরীব মানুষ। রাখাল বলল। আমরা কাউকে দুশমন বানানোর সাহস করতে পারি না।’

মুগীস আর-রুমী রাখালের সাথে বন্ধুর মতো আলাপ করতে করতে সামনে অগ্রসর হতে লাগলেন।

‘দাঁড়ান।’ রাখাল মুগীসকে বলল। আপনারা যদি শহরের ভিতর প্রবেশ করতে চান তাহলে পিছন দিকে চলে যান। ওদিকে নদী ও খন্দক আছে। ওদিকের এক জায়গায় দুর্গের প্রাচীর সামান্য ভাঙ্গা, কিন্ত জায়গাটা খুবই উঁচু। সেই জায়গার আলামত হল, সেখানে বিশাল একটি বৃক্ষ আছে। সেই বৃক্ষের ডাল প্রাচীরের উপর গিয়ে পড়েছে। সেখান দিয়ে আপনারা প্রাচীর ভাঙ্গতে পারবেন। নিজে গিয়ে দেখে আসুন, এ কাজ করতে পারবেন কি না?

মুগীস আর-রুমী ছদ্মবেশ নিয়ে অনেক দূর ঘুরে সমুদ্রের পাড়ে পৌঁছলেন। তিনি সমুদ্র পাড় থেকেই দুর্গপ্রাচীরের সেই ভাঙ্গা স্থানটি দেখতে পেলেন। কিন্তু এই সামান্য ভাঙ্গা দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। আরও কিছু জায়গা ভাঙ্গার প্রয়োজন হবে।

প্রাচীরের উপর পাহারাদার টহল দিচ্ছিল। মুগীস চুপি চুপি ফিরে এসে তার সালারদেরকে সবকিছু বললেন। তারা চার-পাঁচজনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দেয়ালের সেই ভাঙ্গা জায়গাটি দেখে এসে বলল,

‘প্রাচীরে ঐ ভাঙ্গা জায়গার চেয়ে দুর্গের নিকটবর্তী গাছই বেশি উপকারে আসবে।’ আবু আতিক নামের একজন জেনারেল বললেন। রাতের অন্ধকারে গাছের ডাল বেয়ে প্রাচীরের উপর উঠা সম্ভব হবে, কিন্তু পাহারাদারদের উপস্থিতিই সবচেয়ে ভয়ের কারণ।‘

মুগীস আর-রুমীও এই গাছের কথা চিন্তা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কাছে মনে হয়েছে, এই পথে বিপদ বেশি; সাফল্য কম।

ঐতিহাসিক লেনপোল নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখেন, ‘মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ-পারঙ্গমতা ও সাহসিকতার ক্ষেত্রে অতুলনীয় ছিল। তাদের বিজয়ের মূল কারণও এটাই ছিল। তাদের মানসিক শক্তি ছিল প্রচুর। তাছাড়া ঐশী সমর্থনও ছিল তাদের পক্ষে। রণাঙ্গনে কখনও কখনও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো, যা তারিক বিন যিয়াদের জন্য সাফল্য বয়ে আনত।

মুগীস আর-রুমী প্রাচীরের ভাঙ্গা স্থান এবং নিকটবর্তী গাছের সন্ধান পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই ভাঙ্গা প্রাচীর আর গাছকে কাজে লাগান অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল।

প্লান-পরিকল্পনা করতে করতেই সেদিনের সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল। রাতের আঁধারে ঢেকে গেল কর্ডোভা নগরী। কিছুক্ষণ পর শুরু হল প্রবল ঝড়ো হাওয়া। সেই সাথে বজ্রসহ বৃষ্টি। নিকষ কালো অন্ধকার রাত, তার উপর বিকট বজ্রপাতের শব্দে গোটা নগরী থরথর করে কাঁপছিল। তুফানের তোড়ে শিকড়সহ গাছ-পালা উপড়ে পড়ছিল।

মুগীস ও তার মুজাহিদ সাথীদের জন্য এ ভয়াবহ তুফানের হাত থেকে বাঁচার মতো কোন আশ্রয় ছিল না। তাদের কাছে কোন তবুও ছিল না। আর যদি থাকতও তাহলে ঝড়ো বাতাস তা উড়িয়ে নিয়ে যেত। ঘোড়াগুলো চিৎকার করে ছটফট করছিল। টিলার আড়ালে নিয়ে ঘোড়াগুলোকে কোন রকম বেঁধে রাখা হল।

মুগীস আর-রুমী উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, এখনই দুর্গ আক্রমণ করার উপযুক্ত সময়। এ তুফান আল্লাহ তাআলার নেয়ামত। জলদি ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে নদীর দিকে চল। এই তুফানের সময় প্রাচীরের উপর কোন পাহারাদার থাকবে না। সাথে কোদাল নিয়ে নাও।’

প্রবল ঝড়-তুফান আর ঝবায়ু উপেক্ষা করে মুগীস আর-রুমী সাতশ অশ্বারোহীকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে, বা কোথাও বজ্রপাত হলে ঘোড়াগুলো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এদিক-সেদিক ছুটতে চেষ্টা করত। কিন্তু অশ্বারোহী মুজাহিদগণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ঘোড়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখছিলেন। তুফানের সাথে প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি অশ্বারোহীদের চেহারা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল।

কর্ডোভা নগরীর অবস্থান ‘এ্যাশবেলিয়া নদীর অববাহিকায়। মুসলমানগণ এই নদীর নাম রেখেছিলেন কর্ডোভা নদী। এখনও এই নদীর অস্তিত্ব আছে। অশ্বারোহীদেরকে প্রাচীর থেকে দূরে রাখা প্রয়োজন ছিল, তাই নদীর যেখানে হাঁটু পানি ছিল সেখানে ঘোড়াগুলোকে রাখা হল। নদী উপর দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়ার জন্য কোন সমম্যা ছিল না। আসল সমস্য ছিল, মুষলধার তুফান আর শিলাবৃষ্টি।

পাহারাদাররা প্রাচীরের চোরা কুঠরিতে আশ্রয় নিয়েছিল। মুগীস আর-রুমী তাঁর চারজন সহযোগীসহ প্রাচীরের সেই স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন যেখানে প্রাচীর সামান্য ভাঙ্গা ছিল এবং গাছের ডাল সেই প্রাচীরের উপর পড়ে ছিল।

‘সালার!’ আবু আতীক চাঁপা আওয়াজে বললেন। প্রাচীর ভাঙ্গার প্রয়োজন নেই। আমি রশী সাথে এনিছি, আমাকে গাছে উঠতে দিন।

আবু আতীক রশি নিয়ে গাছে উঠে পড়লেন এবং ডাল বেয়ে প্রাচীরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। মুষলধার বৃষ্টির কারণে গাছের ডাল ভিজে পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল। পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। সেই সাথে প্রচণ্ড বাতাসের ঝাঁপটা ডালটাকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না।

আবু আতীক গাছের মগডালে চেপে বসলেন। প্রচণ্ড তুফানী বাতাসে ডাল একদিকে কাত হয়ে পড়ল। পর মুহূর্তে ডাল আবার নিজ স্থানে ফিরে এলে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেয়ালের উপর লাফিয়ে পড়লেন। দেয়ালও বৃষ্টির কারণে পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল। টাল সামলাতে না পেরে তিনি দেয়াল থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলেন। দেয়ালের শেষ প্রান্তে এসে অলৌকিকভাবে তার দেহ আটকে গেল। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেন।

আবু আতীক দ্রুত হাতে তার শরীরে পেচাননা রশি খোলে রশির এক মাথা প্রাচীরের খুঁটির সাথে বেঁধে বাকী অংশ নিচে নামিয়ে দিলেন। সাথে সাথে সাত-আটজন সিপাহী রশি ধরে ঝুলে প্রাচীরের উপর উঠে এলো। তাদের প্লান ছিল নদীর দিকে দুর্গের যে দরজা আছে, তা তারা উনাক্ত করে দেবে। তারা তলোয়ার বের করে প্রহরীদের একটি কুঠরিতে ঢুকে পড়ল। কুঠরিতে মশাল জ্বলছিল। চারজন প্রহরী আরামে বসে গল্পগুজব করছিল। মুজাহিদরা তাদেরকে সামান্য সুযোগ দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল।

এমনিভাবে আরও চারটি কুঠরিতে তারা হানা দিয়ে প্রত্যেকটির প্রহরীকে হত্যা করে ফেলল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে ফটকের কাছে চলে এলো। ফটকে কয়েকজন প্রহরী ছিল। তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলল। মুজাহিদগণ তাদরেকে হত্যা করে ফটক খোলে দিল। তার পর আবু আতিক বাইরে গিয়ে মশাল জ্বালিয়ে সংকেত দেওয়ার সাথে সাথে মুসলিম অশ্বারোহীগণ নদী থেকে বের হয়ে তুফানের গতিতে দুর্গে প্রবেশ করল।

দুই-তিনজন আন্দালুসিয় সিপাহীকে ধরে গাইড বানানো হল। সকল সিপাহীই ঘুমিয়ে ছিল। ছাউনিগুলোতে আগুন লাগিয়ে প্রতিটি সিপাহীকে চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হল। যারা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করল তারাই শুধু বাঁচতে পারল। শহরের অধিবাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলার কোন সুযোগই পেল না।

ঐতিহাসিক এস.পি.স্কাট লেখেন, সকাল বেলা পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে ঝড়-বৃষ্টি একেবারে থেমে গেল। শহরের অধিবাসীরা ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখল, দুর্গ মুসলিম বাহিনীর দখলে চলে গেছে। কিন্তু দুর্গের ভিতর আরেকটা দুর্গ ছিল। সেটা এখনও মুসলিম বাহিনীর দখলে আসেনি। এটা ছিল খ্রিস্টান ধর্ম যাজকদের কেন্দ্র। এর ভিতরে বহুত বড় একটি গির্জা ছিল। পাশেই ছিল পাদ্রিদের ও যাজিকাদের আবাসস্থল এবং ধর্মীয় পাঠশালা। এই বিশাল-বিস্তৃত দুর্গের চতুর্পাশের প্রাচীর ছিল অনেক উঁচু, আর ফটক ছিল লৌহ নির্মিত। প্রাচীরের চতুর্পাশে তীরন্দাজরা মোর্চা বানিয়ে ওঁৎ পেতে ছিল।

স্কাট লেখেন, কর্ডোভার গভর্নর চল্লিশজন রক্ষিসেনা নিয়ে এই দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল। তার সাথে চারশ সিপাহীও ছিল। মুগীস গভর্নরকে লক্ষ্য করে ঘোষণা করলেন, বাইরে এসে আত্মসমর্পণ কর তাহলে নিরাপত্তা পাবে, আর মুকাবেলা করলে কঠিন শাস্তি পাবে।’

‘দুর্গপ্রাচীর ও ফটকের কাছে এসে দেখ, কে শাস্তি পায়।’ গভর্নর প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে জবাব দিল। বাঁচতে চাইলে এই শহর থেকে বের হয়ে যাও।’

দুর্গে প্রবেশ করার জন্য মুগীস বহু চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পেলেন না। তাকে বলা হল, এই দুর্গের ভিতর ফল-মুল ও খাদ্য-দ্রব্য এত বিপুল পরিমাণে মওজুদ আছে যে, কয়েক মাসেও তা খতম হবে না।

প্রায় এক মাস পর মুগীস জানতে পারলেন যে, শহরের ভিতরে যে ঝর্ণা আছে তার পানি ঐ দুর্গের ভিতরে যায়। দুর্গের লোকেরা এই পানিই পান করে। মাটির নিচে প্রধিত পরনালার মাধ্যমে এই পানি দুর্গে যায়। মুগীস নালার মুখ বন্ধ করে দিলেন। এর তিন-চারদিন পরই দুর্গের ফটক খোলে দেওয়া হল।

মুগীস আর-রুমি প্রথমেই গভর্নরের গর্দান উড়িয়ে দিলেন। তারপর দুর্গের ভিতর যেসকল ফৌজি অফিসার ছিল তাদের সকলকে হত্যা করলেন। যেসকল তীরন্দাজ দুর্গপ্রাচীরের উপর অবস্থান নিয়েছিল তাদেরকে যুদ্ধবন্দী করা হল। শহরের অধিবাসীদেরকে কোন কিছুই বলা হল না। ধর্ম যাজিকাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হল।

ওদিকে উত্তর আফ্রিকার রাজধানী কায়রোয়ানে আমীর মুসা বিন নুসাইর আঠার হাজার সিপাহী একত্রিত করলেন। তিনি ইতিপূর্বে খলীফা আবদুল মালেক বিন মারওয়ানের নিকট থেকে আন্দালুসিয়ার যুদ্ধে শরীক হওয়ার জন্য অনুমতি নিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল তারিক বিন যিয়াদ তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী যুদ্ধ বন্ধ করে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। মুসা বিন নুসাইর চাচ্ছিলেন, সামনের বিজয়-অভিযানে শামিল হবেন।

কিন্তু তারিক বিন যিয়াদ ও তার সালারগণ আমীর মুসা বিন নুসাইরের নির্দেশ অমান্য করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আমীরের নির্দেশ অমান্য করার কারণে আন্দালুসিয়ার ইতিহাসে আরেকটি নতুন অধ্যায় রচিত হচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *