১৪. আমি একা

আমি একা

পৃথিবীর সব কথা ভুলে গিয়েছি—মনে জাগছে খালি এক চিন্তা। প্রতিশোধ চাই–প্রতিশোধ চাই! দৈত্যকে বধ করতে হবে।

কিংবা সে করবে আমাকে বধ। দুনিয়ার আমাদের দুজনের ঠাঁই নেই।

অশোক, প্রণব, মমতা—যাদের নিয়ে ছিল আমার ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন, দৈত্য একে একে তাদের কেড়ে নিয়েছে। আবার বাবারও মৃত্যুর হেতু সে।

আমারও বাঁচবার সাধ নেই। কিন্তু কেবল প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যেই আমার বাঁচা দরকার।

নদীর ধারে বসে বসে এইসব ভাবছি। হঠাৎ পাহাড়ের ওপর থেকে শুনলুম উৎকট অট্টহাসি!

তারপর শোনা গেল তার উল্লসিত কণ্ঠস্বর; অজয়, আমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। আজ তোমাকে করেছি আমারই মতন দুঃখী। কিন্তু তোমাকে আমি বাঁচিয়েই রাখব? দুঃখকে ফাকি দিয়ে তোমাকে আমি মরতে দেব না!

বেগে পাহাড়ের ওপরে উঠতে লাগলুম। কিন্তু তিন চারটে আশ্চর্য লাফ মেরে সে আবার কোথায় অদৃশ্য হল।

কিন্তু তারপর আরম্ভ হয়েছে আমার যে অভিযান, এর সমাপ্তি কোথায় জানি না। কখনও বনে বনে, কখনও মাঠে মাঠে, কখনও পাহাড়ে বা মরুভূমিতে বা নদীপথে ছুটে বেড়াচ্ছি আমি শত্রুর সন্ধানে! কখনও দূরে তার মূর্তি দেখি, কখনও তার সাড়া পাই এবং কখনও বা মাটির ওপরে পাই তার পদচিহ্ন! এমনি করে সে আমাকে ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে দেশে। দেশে। কিন্তু সে যেন আলেয়া, দেখা দিলেও ধরা দেয় না।

 

কতদিন শহরে বাস করিনি—সভ্যতার সংস্পর্শে আসিনি। কতদিন আহার জোটেনি। কতদিন বনের পশুপক্ষী মেরে অসভ্যের মতন আগুন পুড়িয়ে খেয়েছি। জীবন হয়ে উঠেছে। ঘৃণ্য, দুঃসহ! একমাত্র আনন্দের স্বাদ পাই কেবল নিদ্রায়। স্বপ্নে দেখি আবার প্রিয়জনদের মুখ!

মাঝে মাঝে দীর্ঘকাল তার সাক্ষাৎ না পেয়ে যখন হতাশ হয়ে পড়ি, তখন সে নিজেই আবার তার সন্ধান দেয়! হয়তো পাহাড়ের ওপর বা গভীর অরণ্যের ভেতর লুকিয়ে সে চিৎকার করে বলে,—অজয়, নিরাশ হোয়ো না, আমি আছি। আমার ইচ্ছা, চিরদিন ভবঘুরের মতন তুমি ছুটোছুটি করে বেড়াও! তুমি জানি আজ দু-দিন তুমি উপোসি। তোমার জন্যে এখানে একটা খরগোশ মেরে রেখে গেলুম। পুড়িয়ে খেয়ে না খেলে আমার পিছনে ছুটবে কেমন করে? এসো শত্রু, আমার অনুসরণ করো, এখনও আমাদের শেষ যুদ্ধের দেরি আছে!

কিছুদিন আগে সে আবার আমাকে শুনিয়ে বললে, এইবার আমি হিমালয়ে বেড়াতে যাব। অতএব প্রস্তুত হও! সে হচ্ছে বরফের দেশ, সেখানে পদে পদে তুমি কষ্টভোগ করবে, আর তোমার যন্ত্রণা দেখে আমি করব আনন্দলাভ!

হিমালয়েই যেতে হল! দিনে দিনে ওপরে উঠছি, উঠছি, উঠছি। ক্রমে এত ওপরে উঠলুম যে নীচের দিকে তাকালে দেখি, মেঘের পর মেঘ ভেসে যাচ্ছে। কষ্ট যা পেয়েছি তা আর বলবার নয়। দেহের রক্ত জমে গিয়েছে, বরফের ঝড় মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গি… শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ হওয়ার মতন হয়েছে। আর অনাহারে থেকেছি যে কতদিন, তার হিসাব নেই।

কেবলমাত্র প্রতিহিংসার ঝেকেই সহ্য করতে পেরেছি এই দারুণ পথকষ্ট। আঙুল যখন খসে পড়বার মতন হয়েছে, তখনও আমি ফিরিনি, বসিনি বা দাঁড়াইনি—ছুটে আর ছুটে চলেছি। আমি যেন কালবৈশাখীর মেঘ, ধেয়ে চলাই আমার ধর্ম। কিন্তু দানব এখনও আমাকে ধরা দেয়নি। দেখি, সে আরও কত দূরে যায়?

সুন্দরবাবু, কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে, এইবারে হয়তো সব ছুটোছুটির শেষ হবে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আর আমার দেহের শক্তি নেই। বোধহয় আমার পরমায়ু ফুরিয়ে এসেছে। হয়তো সে বাঁচবে আর আমি মরব।

কিন্তু আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি কি? আপনাকেও আমার মতন ভবঘুরে হতে বলি না, কিন্তু যদি কখনও আমার মৃত্যুর পর দানবের দেখা পান, তাহলে কিছুতেই তাকে ক্ষমা করবেন না, ছেড়ে দেবেন না। হত্যা করবেন, তাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করবেন। তাহলে আপনি লাভ করবেন আমার আত্মার আশীর্বাদ।

(অজয়ের কাহিনি সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *