১.৮ আগ্রা দুর্গের আঙিনাতে

১.৮

আগ্রা দুর্গের আঙিনাতে বিশেষভাবে তার জন্য তৈরি মঞ্চের রক্তলাল চাঁদোয়ার নিচে বসে আছেন শাহজাহান। সামনে সেনাপতি আর সভাসদদের দল। শুনছেন করতালের ঝনঝন আর ঢাকের বাজনা। দুই বছর আগে মমতাজের মৃত্যুর পর এই প্রথম দুর্গের মাঝে সংগীত আয়োজনের অনুমতি দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও এবারই প্রথম নিজের সাধারণ সাদা শোকের কাপড় ছেড়ে পরিধান করেছেন দামি পোশাক আর রত্ন। উজ্জ্বল সবুজ ব্রোকেডের আলখাল্লা, কোমড়ে পেঁচানো রত্নখচিত কোমরবন্ধনী, গলায় রত্নের হার আর কব্জিতে ও রত্ন পাথরের সমাহারে নিজের কাছেই কেমন যেন লাগছে। কোন আনন্দই পাচ্ছেন না এত জাঁকজমকের মাঝে। কিন্তু আজ দারা শুকোহর বিবাহের দিন আর যেমনটা আসফ খান স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, মমতাজ থাকলেও এটিই চাইত যেন ম্রাট রাজাকীয় জৌলুস নিয়ে বাড়িয়ে দেন জ্যৈষ্ঠ্য পুত্রের বিবাহ উৎসব।

দুর্গের বাইরে অবস্থিত ভিড়ের জনতার হর্ষধ্বনি আর সংগীতের মূর্ঘনায় তিনি বুঝতে পারলেন যে এগিয়ে আসছে বর ও তার ভাইয়ের। এক ঘণ্টা আগে শাহ সুজা, আওরঙ্গজেব আর মুরাদ যমুনার তীরে প্রাসাদে গেছে, যেটি তিনি বিবাহ উপহার হিসেবে দিয়েছেন দারাকে। এখন নিশ্চয়ই ফিরে আসছে চার ভাই। জমকালো কালো ঘোড়র উপর বসে আছে দারা, তার সামনে সোনালি ওড়না পরিহিত শতখানেক পরিচারক। সবার হাতে রত্নপাথর সোনা, রুপা আর চুড়ো করে রাখা রঙিন মশলা ভর্তি গোলাকার ট্রে–কমলা পেশতা আর হলুদ রক্ত লাল ডালিম, বেগুনি ফিগ আর সবুজ পেয়ারা। সবকিছুই তুলে ধরছে বর কনের সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের চিহ্ন।

নিশ্চিত যে অন্তত তিনটা বাদ্য একসাথে বেজে উঠল দারা ও তাকে অনুসরণ করে আসা ভাইদেরকে স্বাগত জানাতে। মঞ্চের কাছে এগিয়ে আসার সময় সিংহাসনের পাশে দেয়ালের উপরে পর্দা ঘেরা জায়গার দিকে একটু তাকাল দারা, জানে যে সেখান থেকে তাকিয়ে আছে দুই সহোদরা। বিবাহের প্রস্তুতি দায়িত্ব গ্রহণের জন্য যথেষ্ট উৎসুক জাহানারার আবদার রক্ষা করেছেন শাহজাহান। বিবাহ ভোজের জন্য সোনালি পাতায় মোড়ানো বাদাম আর শুকনো ফল দিয়ে তৈরি পোলাও থেকে শুরু করে উজ্জ্বল পোশাকের রাজস্তানী নর্তকীরা, গভীর রাতকে আলোকিত করে তোলার জন্য মধ্যরাতে আতশবাজির প্রদর্শনী সহ সবকিছুর পরিকল্পনা করতে দেখে অবাক হয়ে ভেবেছেন সম্রাট যে আত্মবিশ্বাস আর অধিকারবোধে পূর্ণ হয়ে কত দ্রুত বেড়ে উঠছে তাঁর কন্যা।

সময় এসেছে দারার মাথায় বরের জন্য তৈরি মুক্তোর মুকুট পরিয়ে দেওয়ার। অন্য দিনের চেয়েও দ্রুত খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলো আসলান বেগ, সামনে বাড়িয়ে ধরল ভেলভেট কুশনে রাখা মুকুট, উঠে দাঁড়ালেন শাহজাহান। দুই হাতে মুকুটটিকে ধরে উঁচু করে ধরলেন, যেন সকলে স্পষ্ট দেখতে পায়, তারপর পরিয়ে দিলেন পুত্রের মাথায়। আমি এখানে উপস্থিত সবাইকে বলছি যেন তারা দেখে যে আমি আমার প্রিয়তম জ্যেষ্ঠ পুত্রকে আশীর্বাদ করছি তার চাচাত বোন আমার সৎভাই পারভেজের কন্যা নাদিরার সাথে বিবাহ উপলক্ষে। মহান আল্লাহ তাদের এই মিলনকে আশীর্বাদিত করুন, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বহু সন্তান ও একসাথে বহু বছর আনন্দে কাটানোর বর প্রদান করে। এরপর দারার কাঁধ ধরে উপস্থিত সভাসদদের দিকে মুখ করে ঘুরিয়ে দিয়ে সম্রাট বলে উঠলেন, আমি আরো কিছু ঘোষণা দিতে চাই। এতদ্বারা আমি আমার পুত্রকে বারো হাজার ঘোড়ার সেনাপ্রধান রূপে নিয়োগ দান করছি। এই বয়সে আমার পিতাও আমাকে এই একই পদ পুরষ্কার দিয়েছিলেন।

দারার পিঙ্গলবর্ণ চোখ জোড়াতে খুশির আভা দেখতে পেলেন শাহজাহান। শীঘি শাহ সুজাও হয়তো বিবাহ করবে, তাকেও সম্মানিত করবেন তিনি; কিন্তু হয়ত একই সন্তুষ্টির সাথে নয়। দারা সবকিছু, একজন পুত্র–একজন মোগল শাহজাদা যেমন হওয়া উচিত। দারা একজন দক্ষ তলোয়ারবিদ, প্রশংসিত মুষ্টিযোদ্ধা যে কিনা নিজের চেয়েও ভারী লোকদের সহজেই হারিয়ে দেয়। একই সাথে বিদ্যানুরাগী দারা তার দাদাজান জাহাঙ্গীরের মতই বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক জীবন নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী। অন্যদিকে শাহ সুজার প্রধান আকর্ষণ হল আনন্দের পিছু নেয়া– একজন তরুণের জন্য যদিও স্বাভাবিক, কিন্তু তাঁর মোগল পূর্বপুরুষদের বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়েছে শত্রু হস্তে নয়, বরঞ্চ নিজেদের দুর্বলতার কারণে। এদের মাঝে একজন নাদিরার পিতা। তরুণ বয়সেই মদ্যপ পারভেজ মৃত্যুবরণ করেছিল।

দারা এ সমস্ত বদ অভ্যাস থেকে মুক্ত। যদি এভাবেই নিজেকে প্রমাণ করতে থাকে তাহলে শীঘিই হয়ত তাকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করবেন শাহজাহান। মমতাজ থাকলেও এটাই চাইতেন। আর দারার কনিষ্ঠ ভাইরাও এটাই আশা করে। ফলে স্থিতাবস্থা আর নিশ্চয়তা ফিরে আসবে, পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলোতে যেটির অভাবে ভীষণ রক্তপাতে বিশৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিল সাম্রাজ্য। যদি তিনি এটা অর্জন করতে পারেন তাহলে নিজেকে নিয়ে গর্বিত বোধ করারও কারণ খুঁজে পাবেন। ভবিষ্যত প্রজন্মও তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তার পরেও সম্রাট ভেবে দেখলেন যে তাঁর পরিবার পূর্বপুরুষ থেকে পৃথক তাঁর পুত্রেরা সকলেই আপন ভাই, সৎ ভাই নয়। আর তাই তাদের মাঝে বন্ধনও অনেক গভীর আর শক্তিশালী। দারার বয়স মাত্র উনিশ আর তিনি নিজেও একজন শাসক হিসেবে তরুণ। তাই সম্ভবত উত্তরাধিকারী নিয়ে এখনই এত তাড়াহুড়া না করলেও চলবে।

*

জাহাপনা, হাতির দল তাদের যুদ্ধ শুরু করার জন্য প্রস্তুত।

ঘোড়ার উপর বসে কপাল থেকে ঘাম মুছলেন শাহজাহান। এই ভেবে খুশি লাগছে যে ঘোড়ার পিঠে বসে এখনো ছেলেদের সাথে খেলতে পারেন তিনি। এই প্রতিযোগিতার নিয়ম হচ্ছে তিনশ গজ দূরে যমুনার তীরে রাখা তরমুজের মাঝে কে সবার আগে বর্শা নিক্ষেপ করতে পারবে।

আগ্রা দুর্গের চারপাশে জড়ো হওয়া ভিড়ের জনতার উন্মত্ত চিৎকারের মাঝে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দারা শুকোহ্র বিবাহের চতুর্থ দিনের আনন্দায়োজনে। শাহ সুজা আর আওরঙ্গজেব দুজনকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হারিয়েছেন সম্রাট। কিন্তু হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে আওরঙ্গজেবের সাথে। ভাইয়ের চেয়ে দুই বছরের ছোট হওয়া সত্ত্বেও অনেক এগিয়ে যায় শাহ সুজাকে ছেড়ে আর কৌতুকের সঙ্গে শাহজাহান খেয়াল করে দেখেছেন যে, পিতাকে হারাতে না পেরে বিমর্ষ আওরঙ্গজেব ধুলার মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিজের দস্তানা।

নিজের ঘামে ভিজে যাওয়া ঘোড়াকে ঘোরাতেই সম্রাট শুনতে পান। যে ইতিমধ্যে বাজনা বাজানো শুরু হয়ে গেছে একটু দূরে নদীতীরে তাঁদের জন্যই বিশেষভাবে তৈরি ঘেরা জায়গায় হাতির সাথে যুদ্ধস্থানে। অশোক সিংয়ের সাথে ছুটতে ছুটতেই মাহুতকে ইশারা করেন শাহজাহান যেন হাতির কানের উপর থেকে সবুজ সিল্কের স্কার্ফ খুলে ফেলে যুদ্ধ শুরু করা হয়। খানিকটা সন্ত্রস্ত হয়ে ডাক ছাড়ে সম্রাটের ঘোড়া। মাটির দেয়ালের বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে গুঁড় উঁচিয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে হাঁক ছাড়ে হাতি দুটো। নিজের ঘোড়াকে ফিসফিসিয়ে সান্ত্বনার বাণী শোনান শাহজাহান। হাঁটু দিয়ে তো লাগান শক্তভাবে, টেনে ধরেন লাগাম। দেখতে পান যেন ইতিমধ্যেই তার একটু সামনে নিজ নিজ ঘোড়ায় চেপে বসে দেয়ালের প্রায় কাছে পৌঁছে গেছে আওরঙ্গজেব আর শাহ সুজা। এর আগের খেলাতে যে বর্শা ব্যবহার করেছিল তাই ঝুলছে তাদের লাগামের পাশে। দেয়ালের অপর পাশে আসফ খানের সাথে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে দারা।

সবার প্রথমে চোখ পড়ল দামোদারের উপর তীক্ষ্ণ দাঁত আর ভয়ংকর শুড়অলা বিশাল প্রাণী যেটির নামকরণ হয়েছে আকবরের বিখ্যাত যুদ্ধ হাতিগুলোর একটির নামানুসারে মনে হল আজকেও এটিই শ্রেষ্ঠ। নিজের মাহুতের তাড়া খেয়ে মাটির দেয়ালের কাছে গিয়ে খানিকটা দেয়াল ভেঙে আঘাত করল প্রতিপক্ষ জলপার উপর। শক্ত ধূসর কাঁধে আঁকাবাঁকা করে লম্বা ক্ষত সৃষ্টি হল। অশোক সিংয়ের পিতা আম্বারের রাজা দুটো হাতিই পাঠিয়েছেন দারার বিবাহ উপহার হিসেবে। আবারো আঘাত করার জন্য ছুটল দামোদার; কিন্তু এবার এগোতে গিয়ে ভাঙা দেয়ালের সাথে খানিকটা হোঁচট খেয়ে পড়ায় কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, বাতাসে ভেসে বাচ্চাদের খেলনা পুতুলের মত উড়ে যায় মাহুত। কঠিন মাটিতে পড়ে প্রায় সাথে সাথেই মনে হল অচেতন হয়ে গেল মাথার চারপাশে লাল রক্তের পুকুর নিয়ে। নিজের সুযোগ এসেছে বুঝতে পারে জলপা, এছাড়া মাহুতও চড়ে বসে তাগাদা দিয়েছে কাঁধে। নিজের ক্ষত নিয়ে এগিয়ে যায় জলপা। লাল শুড় পেঁচিয়ে ভেঙে ফেলে অবশিষ্ট দেয়াল। এরপর মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে গুতো দিয়ে প্রায় ক্ষত করে ফেলে দামোদারের ডান কানে।

মাথার পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, হাচোড়পাচোড় করে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধের ডাক ছাড়ে দামোদর; কিন্তু এবার দ্রুত প্রতিক্রিয়া করে জলপা। নিজের বিশাল গম্বুজের মত মাথা নেড়ে ছুটে আসে দামোদারের দিকে, এবার প্রতিপক্ষকে আঘাত করে বাম পাশে। হঠাৎ করেই দমোদার যেন হাল ছেড়ে দেয়। যথেষ্ট হয়েছে। মাথা ঘুরিয়েই ছুটে আসতে থাকে দেয়ালের যে পাশে আওরঙ্গজেব আর শাহ সুজা দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে। হালকাভাবে নিজের ডান কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিতে চায়। দেয়ালের উচ্চতা পাঁচ ফুট আর বেশ মোটা, তাই দ্বিতীয় আঘাত করতে হল দামোদারকে, কিন্তু হল না। কিন্তু তৃতীয় আঘাতের সময়ে চাপ সহ্য করতে পারল না লাল মাটি। মাহুতহীন হাতি দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়ল, এগিয়ে যেতে লাগল নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের দিকে।

হাতির আগমনে ভীত হয়ে আবারো ডাক ছেড়ে উঠল শাহজাহানের ঘোড়া। নিজের ঘোড়র উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে গিয়েই শাহজাহানের চোখে পড়ল যে ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে আসছে আওরঙ্গজেব। চেষ্টা করছে উন্মাদ হাতি আর দর্শনার্থীদের মাঝে যেতে, বেশিরভাগেরই কাঁধে হোট ছেলেমেয়ে আর মনে হল যেন ভয়ের চোটে নিজের জায়গায় শিকড় গজিয়ে গেছে লোকগুলোর। আওরঙ্গজেবের কোন কিছু–সম্ভবত তার পাগড়িতে থাকা হীরা অথবা ঘোড়ার রত্নখচিত লাগামের ঝনঝন শব্দ–দামোদারের নজরে কাড়ল আর নিজের রক্তমাখা মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে ছুটে গেল বিশাল জম্ভটা। শুড় পেঁচিয়ে গভীর ডাক ছেড়ে চিৎকার করে আগে বাড়লো।

আওরঙ্গজেব ফিরে এসো। পুত্রের দিকে এগোতে থাকা দামোদারকে দেখে চিৎকার করে উঠলেন শাহজাহান। নিশ্চিতভাবে এখনি ঘোড়ার উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলা হবে ছেলেটাকে।

দূর থেকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে পনেরো বছর বয়সী আওরঙ্গজেব। এক হাতে চেষ্টা করছে ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করতে, অন্য হাতে চেষ্টা করছে নিজের বর্শা টেনে নিতে। কিন্তু তার আগেই পৌঁছে গেল দামোদার। কাঁধের কাছে আঘাত করল ঘোড়াকে ডান দাঁতের মাথা দিয়ে, ডাক ছেড়ে আওরঙ্গজেবকে ফেলে দিল ঘোড়া। কোনভাবে নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে পায়ের উপর দাঁড়াল আওরঙ্গজেব, হাতে টেনে নিল তলোয়ার। এই ফাঁকে পরিচারকেরা এসে আতশবাজি ফুটাতে লাগল দামোদারের সামনে যেন দিকভ্রষ্ট হয় প্রাণীটার মনোযোগ। বিস্বাদ ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল বাতাস, বিস্ফোরণের ফলে খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেল দামোদার।

শাহ সুজা না! চিৎকার করে উঠলেন শাহজাহান। এখনো নিজের ঘোড়াকে সামলানোর চেষ্টা করতে করতে দেখতে পেলেন যে নিজের বর্শা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ধোয়ার দিকে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র। সাথে সাথে পিছু নিল অশোক সিং। শাহ সুজা ছুঁড়ে মারলো নিজের অস্ত্র কিন্তু দামোদারের মোটা চামড়ায় কোন আঘাতই করতে পারলো না বর্শা–ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারপাশে মাটিতে পড়ে থাকা কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে টালমাটাল হয়ে ঘোড়া পিঠ থেকে ফেলে দিল আরোহীকে। ফলে মাটিতে পড়ে গেল শাহ সুজা, ও নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে অশোক সিং পৌঁছে গেল ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া দুই শাহজাদা আর উন্মাদ হাতির মাঝখানে। কিন্তু তারপরই এত জোরে গর্জন হল যে কেঁপে উঠল পুরো ধরিত্রী। নিজের মাহুতকে ফেলে দিল জলপা। বেচারা এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিল জলপাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। দামোদারের তৈরি করা দেয়ালের ফোঁকর গলে এগিয়ে এলো প্রতিপক্ষের দিকে। ফিরে তাকিয়ে এ অবস্থা থেকে মুহূর্তখানেকের জন্য মাটিতে যেন জমে গেল দামোদার, মাথা নিচু, তারপর আবারো কী হল সাহস হারিয়ে মরিয়া হয়ে চিৎকার করেই নেমে গেল নদীতীরে যমুনার কাছে। পিছু নিল জলপা। সামনে থেকে সরে গেল দর্শকেরা।

ঘোড়া থেকে নেমে ছেলেদের কাছে দৌড়ে গেলেন শাহজাহান। দুজনেরই ধুলায় মাখামাখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলেও দেখে বোঝা গেল আঘাত লাগে নি কারোরই। নিরবে চোখের পাতা বন্ধ করে মুহূর্তখানেক কৃতজ্ঞতা জানালেন শাহজাহান। এরপরই বুকে টেনে নিলেন দুই পুত্রকে।

তোমরা দুজনেই বেশ সাহস দেখিয়েছ। তোমরা সত্যিই বাহাদুর। তুমিও অশোক সিং।

এটা আমার দায়িত্ব ছিল এগিয়ে আসাটা, জাহাপনা। দামোদারকে আমার পিতা দিয়েছেন উপহার হিসেবে।

আবারো পুত্রদের দিকে চাইলেন সম্রাট, আওরঙ্গজেব–তুমি একটু বেশিই হঠকারী। একটা হাতির সাথে যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসা উচিত হয়নি। অপেক্ষা করা উচিত ছিল দেহরক্ষীদের জন্য।

কাঁধ ঝাঁকালো আওরঙ্গজেব। সময় ছিল না ততটা আর আমি জানি আমি হঠকারী নই। হ্যাঁ, জানতাম যে ঝুঁকি আছে; কিন্তু চেষ্টা করেছি দর্শকদের নিরাপদ রাখতে। যদি আমি মারা যেতাম কোন অসম্মান হত না। আমরা সকলেই একদিন মৃত্যুবরণ করব। দেখার বিষয় হল কেমন করে এর মুখোমুখি হই আমরা। কিছু না করাতেই বরঞ্চ লজ্জা বেশি।

কথা বলতে বলতে দারার দিকে তাকাল। বেড়ার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে দারা। কী বোঝাতে চাইলো আওরঙ্গজেব? এটাই কি যে তার বড় ভাই এগিয়ে আসার চেষ্টা না করায় একজন কাপুরুষ? যদি তাই হয় তাহলে এটা সঠিক হল না। দারা অনেক দূরে ছিল। কিন্তু নিশ্চয় এটা এরকম কিছু নয়–মুহূর্তটুকুর বাহাবা নেবার আশায় উদগ্রীব এক কিশোর ছেলের ভাবনা আর বড় ভাইয়ের দিকে কথার তীর ছোঁড়া থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হয়েছে। শাহজাহানের তাই উচিত হবে না পারিবারিক পূর্ব বিদ্বেষের স্মৃতি স্মরণ করে এ ঘটনার মাঝে কোন অন্য উদ্দেশ্যে খোঁজা।

.

১.৯

চোখ বন্ধ করে একের পর এক ধাক্কা দিয়ে মাথা পেছনে হেলিয়ে প্রচণ্ড দেহসুখ অনুভব করলেন শাহজাহান। এরপর হাঁপাতে হাঁপাতে পড়ে গেলেন তার মতই ঘামে ভিজে থাকা বালুচি রমণীর নরম মাংসল শরীরের উপর। উন্নত বক্ষ আর গোলাকার অধর সহ অসম্ভব সুন্দরী এই নারী, ভাবলেন তিনি। ব্রাকেড কুশনের উপর ছড়িয়ে আছে হেনা লাগান উজ্জ্বল চুল। আর কাজলে রাঙানো চোখ জোড়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রমণী বুঝতে পারলো যে সন্তুষ্ট হয়েছেন সম্রাট।

খাজাসারা, রাজকীয় হারেমের তত্ত্বাবধায়ক ভালোই পছন্দ করেছে। আপনার পছন্দ কী, জাহাপনা? তাকে জিজ্ঞেস করেছিল খাজাসারা। কৃশকায় নাকি মাংস? লম্বা বা বেঁটে? কালো নাকি ফর্সা? তাকিয়ে ছিল শাহজাহান। মমতাজের সাথে বিবাহের পর এত বছরে হারেম থেকে কোন নারীকে কখনো ডাকেনি শাহজাহান। অন্যান্য শাসকেরা মোগল সম্রাটের সন্তুষ্টি লাভের আশায় বিভিন্ন নারী পাঠিয়েছে তার কাছে কিন্তু এই কিছুদিন আগে ছাড়া এ সম্পর্কে ভাবেন নাই তিনি।

তুমি পছন্দ করে দাও। উত্তর দিয়েছিলেন শাহজাহান। আমার কিছু যায় আসে না।

মমতাজের মৃত্যুর পর বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলেও অন্য কোন নারীর প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ শারীরিক আকাক্ষা যেন সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল।

জাহাপনা, আপনি পুরুষদের মাঝে তেজী ঘোড়া। বলে উঠল বালুচি রমণী। আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভেঙে বলল, আমি এতটা শক্তির কথা কখনো জানতাম না…

গড়িয়ে উঠে গেলেন শাহজাহান। তাকিয়ে রইলেন বিতৃষ্ণা নিয়ে রমনীর উপর নয় নিজের উপর।

কী হয়েছে? আপনাকে অসন্তুষ্ট মনে হচ্ছে, জাহাপনা? বিছানা থেকে উঠে গিয়ে সম্রাটের শরীরের সাথে চেপে ধরল নিজের নিরাভরণ দেহ। যেন হেনা রঞ্জিত বক্ষ অনুভব করেন তিনি। আমি কি আপনাকে সুখী করতে পারিনি?

নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুনরায় জেগে উঠলেন শাহজাহান আর রমণীর মোলায়েম হাসি জানিয়ে দিল যে সেও বুঝতে পেরেছে। সম্ভবত আপনাকে একেবারে অসন্তুষ্ট করিনি। হাত ঘুরে বেড়াতে লাগল সম্রাটের শরীরে। হঠাৎ করেই ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে রমণীর সুগন্ধি মাখা কেশগুচ্ছে মুখ ডুবিয়ে আবারও তার দেহে প্রবেশ করেন সম্রাট। খানিকটা বেশি সময় লাগল এবার, হাতের মাঝে মাথা রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে রইলেন শাহজাহান। কাঁপছে এখনো শরীর কিন্তু শরীরের উদ্দীপনা মরে যেতেই অশ্রু গড়াতে লাগল চোখ বেয়ে। কী করেছেন তিনি? মমতাজের প্রতি পবিত্র ভালোবাসার সাথে কীভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তিনি?

চলে যাও। মাথা না তুলেই বলে উঠলেন। অনুশোচনায় ডুবে গেলেন আবারো।

জাহাপনা? 

আমি বলেছি যাও। তোমাকে আর কোন দরকার নেই।

*

খাওয়া-দাওয়া প্রায় নেইই আর তাঁর কর্চি জানিয়েছে যে মদ বর্জনের আইন সত্ত্বেও প্রায়ই মদের জন্য তলব করেন আর নির্দেশ দিয়েছেন যেন গজনী থেকে তাজা এনে দেয়া হয়। মাঝে মাঝে এর মাঝে আফিমও মিশিয়ে নেন… চারদিন আগে পরিচারকেরা এমন অবস্থায় পায় যে জনগণের সামনে প্রাত্যহিক ঝরকা বারান্দায় আসার মত অবস্থাও ছিল না। প্রায় টেনে আনতে হয় বারান্দায় আর দুই পাশে দুইজন কর্চি সাহায্য করে যেন তিনি আশীর্বাদ দিতে পারেন। মাঝে মাঝে সপ্তাহ খানেক ধরে মদ বা আফিম কিছুই স্পর্শ করেন না, কিন্তু তখনো এমনকি আসলান বেগও পারে না তাকে দিয়ে দরবারের কাজ করাতে। তার বদলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে তাকিয়ে থাকে দূরের কিছু একটার দিকে আর কেউ আসতে চাইলেন ভর্ৎসনা করে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি যা পেরেছি করেছি। কথা বলেছি কিন্তু যেহেতু আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেননি তাই তেমন নজরও দেননি।

মাথা নাড়লো জাহানারা।

তোমার চিঠি পড়ে আমি বুঝতে পেরেছি যে তুমি কতটা উদ্বিগ্ন, তবে অবস্থা এতটা খারাপ হবে ভাবিনি।

কিছু সময়ের জন্য বাইরে ছিলে তুমি। আমি প্রায় প্রতিদিনই দেখতে গেছি আব্বাজানকে। আশা করেছিলাম যে অবশেষে নিশ্চয়ই নিজের শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছে–অন্তত পাঁচ বছর তো হয়ে গেছে যে আমাদের আম্মাজান মারা গেছেন–কিছু সময়ের জন্য এমনটাই মনে হয়েছিল। কিন্তু হয়ত আমি ভুল করেছি, তাই দেখেছি যা দেখতে চেয়েছি। অথবা সে ভেঙে পড়েছে…দিনে দিনে আরো বেশি বিমর্ষ হয়ে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে নিজেকে।

অন্তত আমাদের মায়ের সমাধি নির্মাণের প্রতিও কি কোন আগ্রহ নেই?

হ্যাঁ, বেশির ভাগ দিনেই যান কাজের অগ্রগতি দেখতে, বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়ে আসেন বিশেষ করে মার্বেলের মাঝে রত্ন খোদাইয়ের সম্পর্কে। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেন না আর ফিরে আসার সাথে সাথেই আবারও একাকিত্বে ডুবে যান। যদি এখনই সাবধান না হন তাহলে নিজের শারীরিক বা মানসিক সুস্থতা খুইয়ে বসবেন নতুবা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দেখা দেবে; কিন্তু নিজের বা সাম্রাজ্যের প্রতি যে বিপদ ঘনিয়ে আসছে যে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই তার…

বিপদ? তোমার সত্যিই ধারণা যে অবস্থা আবারো এতটা খারাপ হয়েছে?

আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু সম্ভবত তাই…আমি শুধু তোমাকে বলতে পারি যা দেখেছি এই কয়েকদিনের মাঝে। আবারো কাজে মনোসংযোগ করতে কষ্ট হচ্ছে আব্বাজানের। কামরান ইকবাল আর আমাদের নানাজী আসফ খানের পরপর মৃত্যুর ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে তাঁকে। অতীতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। এর চেয়েও বড় কথা, তারা দুজনেই খোলামেলাভাবে আব্বাজানের সাথে কথা বলতে পারতেন যখনই তারা দেখতেন যে কোন সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে–আর কীভাবে এই সমস্যার মোকাবেলা করা যায় দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই তাও বলতে পারতেন। তাদের তৎপরতা না থাকায় দাপ্তরিক নিয়োেগ আর কর সম্পর্কিত বিষয়ে মনোযোগ না দেয়ার জেদ করেছেন পিতা।

কিন্তু এগুলো কি দরকারী?

হ্যাঁ, এগুলোই একত্রে বেঁধে রেখেছে আমাদের সাম্রাজ্যকে। সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির জন্য এগুলো জরুরি যে শুধুমাত্র সেনাপতি আর কর্মীদের বাহ্যিক বিশ্বস্ততা নয়–বরঞ্চ তাদের সত্যিকারের সমর্থন আর গভীর আগ্রহ। কিন্তু তাদের অভিযোগ আর আর্তি শোনার সময় নেই আব্বাজানের আর না তিনি প্রদেশগুলো থেকে পাঠানো প্রতিবেদন পড়ে দেখেন। যাই হোক, আমি পড়েছি আর দেখেছি যা ঘটতে যাচ্ছে…

 কী বলতে চাও?

আমরা নীতিহীন শিথিল হয়ে যাচ্ছি। অভিজাতদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি তাদের উচ্চাকায় আমল না দিয়ে; একই সাথে তাদের কাজকর্মের উপর মনোযোগ না দিয়ে। যদিও তারা এখনো বাহ্যিকভাবে বিশ্বস্ত আছে আর এই পার্থক্যটুকু তেমন চোখেও পড়ছে না–আমরা যে স্বর্ণ দেই তার বিনিময়ে রাজকীয় কাজের জন্য সৈন্য বাহিনী টিকিয়ে রাখার মত আইন অবজ্ঞা করতেও দ্বিধা করছে না। যখন তুমি বাইরে ছিলে তখন আগ্রা দুর্গের সেনাপ্রধান আজমীরের প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল যেন তিন মাসের জন্য আমাদের লাহোর ভ্রমণের সময় রাজকীয় দরবারকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁচ হাজার সৈন্য প্রেরণ করে। কিন্তু সেখানকার শাসনকর্তা প্রতি উত্তরে জানিয়েছে যে স্থানীয় জমিদারেরা এত দ্রুত এত পুরুষ জোগাড় করতে পারবে না।

কিন্তু তাদেরও তৈরি থাকার কথা যদি হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হয় সে কারণে। আমরা কি তাদের অঞ্চলে পরিদর্শক পাঠাচ্ছি যেন তারা সঠিক সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন রাখছে কিনা বা কর সংগ্রহ করছে কিনা তা তদারক করে আসতে?

হ্যাঁ। কিন্তু জমিদারেরা নিশ্চয়ই ঘুষ দিচ্ছে তাদেরকে। আমি আসলান বেগকে বলেছিলাম যেন আজমীর পরিদর্শনের রেকর্ডগুলে পরীক্ষা করে দেখা হয়। এতে বের হয়ে এসেছে যে মাত্র তিন মাস আগে মোগল রাজকর্মকর্তারা সেখান থেকে ঘুরে এলেও কোন ভুলের কথা লিখেনি।

এদেরকে কঠিন শাস্তি দেয়া উচিত যেন উদাহরণ হিসেবে কাজে দেয় আর আজমীরের শাসনকর্তাকেও শাস্তি দিতে হবে। অন্তত তার অনুমতিতেই এরকম দুর্নীতি হতে পারছে। আর সবচেয়ে খারাপ দিক সে নিজেও এতে জড়িত ছিল। আব্বাজান কিছু না করলেও আমি এ ব্যাপারটা নিজে দেখব। যেমনটা তুমি বলেছ একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেন কেউ এটা ভাবার সাহস না পায় যে সম্রাটের মনোযোগ অন্য কোথায় অথবা তাঁর শাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। নতুবা অর্ডার রাজার মত বিদ্রোহের কবলে পড়ব আমরা …শাহ সুজা আর আওরঙ্গজেব কী বলে এসব কিছুর ব্যাপারে?

আমি জানি না। আমি তাদের কাছেও চিঠি লিখেছি। কিন্তু আওরঙ্গজেব তো বেশ ব্যস্ত। গত কয়েক বছর ধরে তো সে আগ্রাতেই নেই। অর্ডা বিদ্রোহ দমনের জন্য তার অভিযান বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে আর বেশি সময়ও লাগছে যা আব্বাজান বা অন্য কেউই ধারণা করতে পারেনি। এখন দাক্ষিণাত্যে তার বিজয় সত্ত্বেও পুরো অঞ্চল এখনো এতটা বিশৃঙ্খল হয়ে আছে যে, স্থানীয় সমস্যা নিয়ে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। এদিকে আবার সীমান্তবর্তী সমস্যাও আছে। শাহ সুজা পুরোদমে বাংলা সামলাচ্ছে। গঙ্গা ব-দ্বীপে আরকানীজরা আমাদের বণিকদের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।

অমি শুনেছি আব্বাজান নাকি শাহ সুজাকে ওড়িশার শাসনকর্তার দায়িত্ব ও প্রদান করেছেন?

হ্যাঁ। শাহ সুজা চেয়েছে আর আব্বাজানও একমত হয়েছেন, আমি কিছুই জানতে পারিনি। আমি এর বিরুদ্ধেই পরামর্শ দিতাম। যদিও সে এ ধরনের নিয়োগের শক্তি আর মর্যাদা বেশ উপভোগ করছে; কিন্তু আমার মনে হয় এতটা দায়িত্বপূর্ণ আর পরিশ্রমের কাজ সামলানোর ক্ষমতা নেই শাহ সুজার অথবা হতে পারে যে আমিই তাকে ভুল ভেবেছি।

দারার হাত ধরে হাসল জাহানারা। আমি খুশি হয়েছি যে তুমি আগ্রাতে ফিরে এসেছ। আমি তোমার অভাব অনুভব করছিলাম। খুব কম লোকই আছে এখানে যাদের সাথে আমি এই কথাগুলো বলতে পারি…কখনো কখনো সাত্তি আল-নিসা আর রোশনারা কিন্তু আমি বাড়িয়ে বলছি না পিতার সাথে আমার মত এত সময় কাটায় না। এখন তো সে বেশ খুশি কেননা রাজকীয় মীনা বাজার পুনরায় চালু করতে চেয়েছে রোশনারা আর আব্বাজানও একমত হয়েছে। কিন্তু অনেক হয়েছে। এখন তোমার কথা শুনতে চাই। সুরাটে ভ্রমণ সফল হয়েছে?

হ্যাঁ, নিকোলাস ব্যালান্টাইনকে সাথে নেবার তোমার পরিকল্পনাও ভালো ছিল। একজন দোভাষী হিসেবে খুব কাজে লেগেছে আর আলোচনাকে ভালোভাবে পরিচালনা করতেও আমাকে সাহায্য করেছে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজি হয়েছে আমাদের বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার্থে আর আরব সাগর হয়ে মক্কা পর্যন্ত আমাদের তীর্থযাত্রীদের জাহাজগুলোর জন্য তাদের জাহাজ সরবরাহ করতে। মোগলদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন সৈন্য নেই, কিন্তু ইংরেজদের মত সমুদ্রে কীভাবে লড়তে হয় আমরা জানি না। আমাদের হয়ে জলদস্যুদের মোকাবেলা করবে তারা।

সুরাট বণিকেরা নিশ্চয়ই বেশ সম্মানিত বোধ করেছে যে একজন মোগল শাহজাদা ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছে আলোচনার জন্য।

 মুচকি হাসল দারা। আমার মনে হয় বিস্মিতও হয়েছে। আমি বেশ শক্তিশালী একটা প্রদর্শনী করেছি–স্বর্ণ দিয়ে সাজানো একশ হাতি আর সবুজ পাগড়ি আর টিউনিক পরিহিত হাজার অশ্বারোহী, এই বিদেশীদেরকে মুগ্ধ করা সহজ–এত প্রাচুর্য দেখে হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে চোয়াল।

ফলাফলে আব্বাজানও সন্তুষ্ট হবেন। আমাদের জাহাজে জলদস্যুদের আক্রমণে রেগে গিয়েছিলেন… থেমে গেল জাহানারা। কিন্তু আরো কিছু ব্যাপার আছে যা তোমার জানা উচিত… প্রায় প্রতিরাতেই হারেমে খবর পাঠান রমণীর জন্য। কখনো দুজন এমনকি তিনজনও। এমনকি সোনা আর মুক্তা খোদাই করে একটা আয়নাঘরও নির্মাণ করছেন যেন ভালোবাসাবাসির দৃশ্য চাক্ষুস করতে পারেন।

হাঁ করে তাকিয়ে রইল দারা। তুমি কীভাবে এসব জানো?

খানিকটা দুঃখের সাথে হাসল জাহানারা। হারেমে এটা বেশ পরিচিত মুখরোচক গল্প। আমি সাত্তি আল-নিসাকে বলেছিলাম খাজাসারাকে জিজ্ঞেস করতে, সেও নিশ্চিত করেছে এর সত্যতা। একই নারীর জন্য দুবার খবর পাঠান না তিনি আর যতক্ষণ একসাথে থাকেন তেমন একটা কথাও বলেন না। আরো বলেছে যে আব্বাজান নাকি বিপজ্জনকভাবে নিচ্ছে– বিশেষভাবে পছন্দ করেন ঘোড়া বানানো… প্রথমে শুনে তো আমি থ হয়ে গেছি। মাথাতেই আসেনি যে আমাদের আম্মাজানকে এতটা ভালোবাসার পরেও কীভাবে এমন করছেন…কিন্তু তারপরই খারাপও লেগেছে। মায়ের মৃত্যুর শোেক কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারেন নি আব্বাজান আর এখন তাই যা পারেন করছে। মনে হচ্ছে যেন পুরুষ হিসেবে নিজের সক্ষমতার পরীক্ষা নিতে শুরু করেছেন যখন কিনা একজন সম্রাট হিসেবেই মনোযোগী হবার কথা।

নীরবে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল দুই ভাই-বোন। জাহানারা বলে উঠল, আমি কাউকে একথা বলিনি। কিন্তু বোরহানপুরে, আম্মাজান যখন ব্যথায় শুয়ে আব্বাজানের আসার অপেক্ষা করছেন, তখন আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে যেন তাঁর মৃত্যু হলে আমি যেন আব্বাজানের উপর নজর রাখি আর কোন অনর্থ থেকে দূরে রাখি। আমি নিশ্চিত না যে কী বুঝিয়েছেন বা আমি কী করব। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে আম্মাজান আব্বাজানের চরিত্র ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে মায়ের পরামর্শ আর সহায়তা বিশেষ করে মানুষের প্রকৃতির প্রতি অন্তদৃষ্টি ছাড়া আব্বাজান সমস্ত শক্তি সাহস, ক্ষমতা আর সম্পদ সত্ত্বেও দিকভ্রষ্ট হয়ে যাবেন–নোঙ্গর ছেড়ে ভেসে যাবে তরী। আমাদেরকে তাকে রক্ষা করতে হবে আর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে হবে দারা..তার নিজের জন্য আর সাম্রাজ্যের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে।

*

আগ্রা দুর্গের প্রধান আঙিনায় গাছের সাথে ঝুলছে হাজার হাজার জ্বলন্ত রঙিন লণ্ঠন। একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মেরুন ভেলভেটের বিশাল তাঁবু। সপ্তাহখানেক পরিশ্রম করে শ্রমিকেরা এটি নির্মাণ করেছে আঠারো দিনব্যাপী নওরজ উৎসবের জন্য–আকবর প্রবর্তিত নতুন বছর উদ্যাপন উৎসব। ভেতরে সবটুকু ভূমি ঢেকে দেয়া হয়েছে মোটা নরম সিল্কের কার্পেট আর সোনা, মুক্তা ও দামি পাথরের তৈরি অ্যামব্রয়ডারী করা ব্রোকেডের পর্দা দিয়ে। উৎসব শুরু হবার পর থেকে প্রতি রাত্রে শাহজাহান তাঁবুতে দরবার বসিয়ে অভিজাতদের কাছ থেকে উপঢৌকন আর শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন অথবা তাদের ঝিকমিকে প্যাভিলিয়নে ঘুরে বেড়ান। আজ সন্ধ্যাটা অবশ্য একটু ভিন্ন হবে। আজ রাতে রাজকীয় মীনা বাজার বসবে। অভিজাতদের স্ত্রী ও কন্যরা চমৎকার সিল্ক আর ক্ষুদ্র অলঙ্কারের পসরা সাজিয়ে নিজেরাই ব্যবসায়ী বনে যায়। খুব কমই হয় এরকম যখন দরবারের নারীরা সিল্কের পর্দা ফেলে বাইরে আসে আর পুরুষেরা সরাসরি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের সৌন্দর্যমাখা মুখের দিকে।

এরকমই এক উষ্ণ রাতে রাজকীয় মীনা বাজারে মমতাজকে প্রথম দেখেছিলেন শাহজাহান..রাজকীয় তাবুর সোনালি সামিয়ানার নিচে দাঁড়িয়ে অনুতপ্ত হয়ে ভাবলেন কেন রোশনারকে আবারো মীনা বাজার করার অনুমতি দিয়েছেন। মেয়েটা তর্ক করছিল যে রাজগৃহস্থালীর নারীদের জন্য এটাই বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মীনা বাজার অম্ন মধুর নানা স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে যা ভুলে গেলেই ভালো হত… কীভাবে নিজের দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল চৌদ্দ বছর বয়সী মমতাজ, চুলে জ্বলজ্বল করছিল মুক্তা আর হীরা… চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মিষ্টি ডোনমিনের সুবাস…ছোট একটা ফুলদানির জন্য তাঁর হাতে শাহজাহান তুলে দিয়েছিলেন উজ্জ্বল সোনার মোহর।

কিন্তু দায়িত্ব পালন করতে হবে তাঁকে। সম্রাটের পরিদর্শনের মাধ্যমেই শুরু হবে মীনা বাজারের আনুষ্ঠানিক সূচনা। উঠে বসলেন অপেক্ষারত সুসজ্জিত পালকিতে। আটজন পেশীবহুল তাতার হারেমের নারী পরিচারকের কাঁধে চেপে বাতাসে ভেসে উঠলেন সম্রাট। আগে আগে চলল খাজাসারা, পাহারা দেয়ার জন্য পাশেপাশে থাকল মসৃণ চেহারা খোঁজারা; শাহজাহান শুরু করলেন মীনা বাজার পরিভ্রমণ। পারস্যবাসী দাদীর কাছ থেকে শেখা গোলাপের মুখরোচক ব্যঞ্জন বানিয়েছে জাহানারা। এর সুগন্ধের সাথে সাথে সম্রাট চোখে দেখলেন রাজবাজীর বয়স্ক পরিচারকদের তৈরি চিনি আর মাখনের মিষ্টি।

আঙিনার অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ অংশে পৌঁছলেন শাহজাহান। এখানকার দোকানগুলোতে পসরা সাজিয়েছে সভাসদ আর কর্মকর্তাদের পত্নী আর কন্যরা। প্রশংসাসূচক বাক্য আর দর কষাকষির ভান করতে করতে এগোবার সময় সম্রাটের মনোযোগ চলে গেল পণ্যের দিকে নয়, নারীদের দিকে। কয়েকজনকে চিনতে পারলেন কিন্তু বাকিদেরকে কখনো দেখেননি, যেমন বেগুনি সিল্কের রোব পরিহিত লম্বা এক নারী, বেণী করা চুলে গেঁথে রেখেছে গাঁদা ফুল। একজন রমণীর তুলনায় কাঁধ দুটো চওড়া হলেও কোমর বেশ সরু। কালো চোখ জোড়া সাহসের সাথে তাকিয়ে রইল সম্রাটের দিকে। দোকানের মালিক হিসেবে অন্য নারীদের চেয়ে তার পসরার দিকেই মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইলেন শাহজাহানের।

কে এই নারী? খাজাসারার কাছে জানতে চাইলেন সম্রাট।

কলিমা বেগম। লাহোরে আপনার শাসনকর্তার স্ত্রী। আপনি দাক্ষিণাত্যে থাকাকালীন দুজনে বিবাহ হয় কিন্তু স্ত্রী হিসেবে তেমন প্রিয় নয়। পাঁচ বছর আগে বিয়ে করা স্ত্রীকে নিজের সাথে লাহোরে নিয়ে গেছে লাহোরের শাসনকর্তা কলিমাকে রেখে গেছে। আপনি কি তার দোকান ঘুরে দেখতে চান জাহাপনা?

না, কিন্তু আজ রাতে তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে।

সে একজন বিবাহিত নারী, জাহাপনা…

এটা তোমার দেখার বিষয় নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজে আগ্রহী, আমার আদেশ মতই কাজ করবে।

এক বা দুই ঘণ্টা পরে নিজেকেই শুধোলেন শাহজাহান যে তিনি কেন করলেন এমনটা। গত বিশ বছরে যে হারেমের দিকে তিনি আগ্রহ দেখাননি সেখান থেকে কাউকে পাঠানোর জন্য খাজাসারাকে আদেশ দেয়া এক কথা আর তাঁর কোন এক প্রাদেশিক শাসনকর্তার স্ত্রীকে ডেকে পাঠানো তো পুরো ভিন্ন কথা। কি হয়েছে তাঁর নিজের দুঃখ ভোলার জন্য এমন কাজ এতটাই অর্থহীন যেমন রাস্তার কোন এক কুকুরীর উপর চড়াও হয় কুকুর?… না….খাজাসারাকে জানাতে হবে যে তিনি মত বদলেছেন।

কলাই করা ঘন্টির কাছে পৌঁছলেন শাহজাহান, যেন ডেকে পাঠাতে পারেন কোন পরিচারককে। তারপরই থেমে গেলেন। হৃদয়ে মমতাজের জায়গা কেউ কখনো নিতে পারবে না…যতবারই তিনি কোন নারীকে বিছানায় নিয়ে যান, ততবারই নিজেকে আরো বেশি করে বঞ্চিত মনে হয়। তারপরও নারী দেহের সান্নিধ্যে খুঁজে পান ক্ষণস্থায়ী আরাম। এছাড়াও অন্য নারীদের সাথে ভালোবাসাবাসির সময় স্পষ্টতই বুঝতে পারেন যে এরা মমতাজের তুলনায় কতটা নিকৃষ্ট মন আর শরীরের দিক দিয়ে। আবারো প্রমাণিত হয় অকৃত্রিম আর একনিষ্ঠ ভালোবাসা রয়ে গেছে তাদের মাঝে।

শাহজাহান বিস্ময় নিয়ে ভাবতে লাগলেন যে খাজাসারা যখন তাকে সম্রাটের বিছানায় নিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন কী চলছে কলিমার মনে। এটা তো নিশ্চিতভাবেই বোঝা গেছে যে সে-ও আগ্রহী। কলিমার চোখের দৃষ্টি স্মরণ করে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই রইল না তাঁর। কলিমা কি নার্ভাস বোধ করছে? অথবা সম্ভবত ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা করা শুরু করে দিয়েছে যে কীভাবে এই অবস্থার ফায়দা নেয়া যায়? আর তিনি নিজে? নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্য পুরুষের স্ত্রীকে হস্তগত করছেন ঠিক যেভাবে ডেভিড বাথশেরাকে চুরি করেছিল। এটা কি একজন সম্মানীয় লোকের মত কাজ? হয়তো বা। যদি কলিমা রাজি হয় তাহলে প্রমাণ হয়ে যাবে যে স্বামীর ভালোবাসা পাবার যোগ্য নয় সে। তার মানে তিনি স্বামী বা স্ত্রী কারো ভালোবাসাতেই অনধিকার প্রবেশ করছেন না, যেমনটা তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। মমতাজের মৃত্যু।

মধ্যরাতের খানিক আগে দরজায় শোনা গেল মৃদু করাঘাতের শব্দ। প্রবেশ করল খাজাসারা। একেবারে পিছনেই কলিমার লম্বা দেহ ঢেকে আগে ক্রিম রঙা আলখাল্লায়, লম্বা করে টানা ঘোমটায় ঢেকে আছে মুখ। আমি কলিমা বেগমকে নিয়ে এসেছি জাহাপনা। জানালো খাজাসারা। আপনি আবার ডেকে না পাঠানো পর্যন্ত কি হারেমে ফিরে যাবো?

না, বাইরে অপেক্ষা করো।

তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীকে দেখে আবারো ফিরে এলো শাহজাহানের বিস্মিত ভাব। দ্বিধায় পড়ে ভাবতে লাগলেন তিনি কেন করছেন এমনটা? দুজনে একাকী হতেই এগিয়ে গেলেন কলিমার দিকে। আস্তে করে ফেলে দিলেন ঘোমটা। এইবার বেণী না করা থাকাতে দুই কাঁধের উপর আলতো করে ছড়িয়ে আছে উজ্জ্বল কেশরাজি। যেরকম আত্মবিশ্বাসী ছিল মীনা বাজারে ঠিক সেভাবেই ম্রাটের দিকে তাকিয়ে হাসলো কলিমা। ডান হাতে গলার কাছ থেকে নিজের পোশাকের রুপালি সুতা খুলতে শুরু করে দিল।

না, এখনি না।

 জাহাপনা? হাত ছেড়ে দিল কলিমা।

আজ রাতে তোমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছি, কী মনে হয় তোমার?

কারণ আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করেছি। দেখেছিলাম যে বাজারে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে।

তোমার নিজের কী অনুভূতি? স্বেচ্ছায় নিজেকে তুলে দিচ্ছ আমার হাতে?

অবশ্যই জাহাপনা।

কিন্তু, তুমি তো বিবাহিত। তোমার স্বামী?

অনেক মাস যাবত তাকে দেখি না আমি। তার কাছে আমি যেমন কিছু না, তেমনি আমার কাছে সেও। আমাকে বিয়ে করেছিল যৌতুকের কারণে। পাঞ্জাবে তার জমির পাশেই আমার পিতার জমি–এছাড়াও তার অন্য স্ত্রী আছে যাকে আমার চেয়েও বেশি পছন্দ করে।

কিন্তু তার প্রতিই বিশ্বস্ত থাকা কি তোমার দায়িত্ব নয়?

আমার সম্রাট যখন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন সে ডাকে সাড়া দেয়াও কি আমার দায়িত্ব নয়?

একের পর এক কথা সাজাতে পটু এই নারী, ভাবলেন শাহজাহান। তাকে প্রেমকলা শিখিয়েছে যারা সেসব রাজকীয় হারেমের বেশ্যাদের চেয়ে কোন অংশে উন্নত নয় এ নারী, সে সময় তিনি ছিলেন নারী সম্পর্কে অজ্ঞ, শিখতে আগ্রহী তরুণ শাহজাদা।

তোমার পোশাক খুলে ফেল। হুক খুলে ক্রিমরঙা পোশাক মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল দেখতে পেলেন শাহজাহান। পুরোপুরি নিরাভরণ দেহে সুগন্ধি তেল মাখানো উজ্জ্বল ত্বক, কোমরে ঝুলছে ছোট ছোট সোনালি পাতাওয়ালা স্বর্ণের চেন।

ঘুরে দাঁড়াও। আস্তে করে নড়ে উঠতেই কেঁপে উঠল সোনালি পাতার দল। চৌকোণা কাঁধ জোড়া মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের সাথেই মিল বেশি। তেমনি পেছন দিক, গোলাকার পৃষ্ঠদেশ আর লম্বা পেশীবহুল পা দেখতে কামোদ্দীপক কিন্তু সুন্দরী নয়–অন্তত তার কাছে তো নয়ই।

আবারো তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল কলিমা, আরেকটু হলেই শাহজাহান তাকে আদেশ দিতে যাচ্ছিলেন যেন পোশাক পরে নিজেকে ঢেকে নেয়। কিন্তু তার আগেই হাত দুটো তুলে মাথার পেছনে চুল হাত বুলাতে লাগল কলিমা। অসম্ভব পরিচিত এই ভঙ্গি কতবার একই ভঙ্গিমাতে তিনি দেখেছেন মমতাজকে! হঠাৎ করেই তীব্র বাসনায় হেঁয়ে গেল মন।

ওখানে শুয়ে পড়। নিচু ব্রোকেডের চাদরে ঢাকা ডিভানের দিকে হেঁটে গেল কলিমা। নিজের পোশাকের পাথরের বোতাম খুলে ফেললেন শাহজাহান। নারী দেহের উত্তাপ পেলেন শাহজাহান নিজের নিচে। মুহূর্তখানেক পরে ডান হাতে প্রস্তুত করে নিলেন ক্ষেত্র–কিন্তু কলিমার উরু জোড়া একেবারে ভিন্ন মমতাজের নরম মাংসল দেহ থেকে আনন্দে মৃদু ডাক ছাড়তে লাগল কলিমা–ভান না সত্যি বলতে পারবেন না সম্রাট–এরপর চিৎকার করতে করতে শাহজাহানের কাঁধ ঘামচে ধরল কলিমার হাতের নখ। এবারেও তার স্বর শুনতে পেলেন না তিনি, কানে বাজতে লাগল মমতাজের মোলায়েম কণ্ঠ, শাহজাহানকে ফিসফিস করে তাড়া দিচ্ছি তাকে আরো বেশি করে ভালোবাসতে।

দুই ঘণ্টা পরে ঘামে সিক্ত শরীর নিয়ে উঠে বসলেন শাহজাহান। হাতের উপর মাথা রেখে অন্ধকারকে ধন্যবাদ জানালেন। এই-ই ভালো। যদিও জানালার ফাঁক গলে চুঁইয়ে পড়া ঝাপসা আলোতে বোঝা গেল যে ভোরের আর খুব বেশি দেরি নেই। নিজের আনন্দ মেটার সাথে সাথেই তাড়িয়ে দিয়েছেন কলিমাকে; কিন্তু এখনো তার সুবাদ ঘুরে বেড়াচ্ছে শয্যা মাঝে। পাশে রাখা মার্বেলের টেবিলে রুপার পাত্র থেকে পানি ঢেলে নিলেন এক কাপ, শেষ করে ফেললেন এক চুমুকে। ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা দেখে জেগে ওঠার পর এখনো কাঁপছে শরীর। এর সাথে কলিমার কোন সম্পর্কই নেই। দেখতে পেয়েছেন যমুনার তীরে ভূতের মত উঠে গেছে। মমতাজের সমাধি, যদিও মার্বেলের বিশুদ্ধতা যথাযথ আছে। নিজের সৃষ্টির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে, কিন্তু তখনই তীক্ষ্ণভাবে ভেঙে পড়তে লাগল সাদা গম্বুজ–ঠাণ্ডা পাথরের কোন টুকরো নয় ঠিক যেন কোন নারীর বক্ষ। মমতাজের বক্ষ। হঠাৎ করেই আতঙ্কিত চোখে দেখতে পেলেন ফিনকি দিয়ে রক্ত উজ্জ্বল লাল রক্ত ছুটতে শুরু করল গম্বুজের মাথা থেকে, ধেয়ে আসতে লাগল বেগুনি রঙের ছোট নদী…

অন্য আরেকটা দৃশ্য এসে ঢেকে ফেলল সমাধিকে সন্তান প্রসবের যন্ত্রাণাতে গুঙ্গিয়ে উঠছে মমতাজ, ভিজে গেছে রক্ত আর ঘামে, চিৎকার করছে বাচ্চাটা এসে যেন সমাপ্তি ঘটে ব্যথার…এরপর আবারো রক্ত, এবার গড়িয়ে পড়ছে জল্লাদের খড়া থেকে, মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল তাঁর সত্তাই শাহরিয়ারের কর্তিত মস্তক…দৃশ্যপট বদলে গেল আবারো; জানি স্বামী খসরুর মৃত্যুর ভার সইতে না পেরে জ্বলন্ত কয়লার দিকে এগিয়ে গেল মুখে তুলে নিতে…একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লাল-সোনালি আভার দিকে…সাবধানে বেছে নিল ছোট একটা কয়লার টুকরা…তুলে নিল…মুখের কাছে এনে অনুভব করল এর তীব্র তাপ, এরপরই চোখ বন্ধ করে মুখ খুললো…চিৎকার করে গিলে ফেলল। এরপর জানির ঝলসানো মাংসের গন্ধ এসে লাগল নাকে, কাঁপতে কাঁপতে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন হতভম্ব শাহজাহান।

বড় বেশি মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে গেছে তার পরিবারে। মোগলরা কী করেছে যে এরকমটা হল? আল্লাহতায়ালা মোগলদের অসীম ক্ষমতা আর সমৃদ্ধির বর প্রদান করলেও এতটুকু শান্তিতে থাকার ফুরসত দেননি, যা কিনা একেবারে তুচ্ছ একটি পরিবারেরও অধিকার আছে পাবার। তার নামের অর্থ পৃথিবীর শাসক, অথচ এই অন্ধকারে বসে মনে হল তাঁকে নিয়ে উপহাস করছে শব্দ দুটো।

*

আরেকটু আরাম পাবার জন্য নিজের জায়গা বদল করলেন শাহজাহান। গোধূলি বেলাতে হারেমে ফিরে গেছে মোটা কালো চুল আর অদ্ভুত হলুদ চোখের অধিকারিনী তুর্কি বেশ্যা। তাঁর শরীর নিংড়ে নিয়েছে এ রমণী অথচ মন তবুও অশান্ত। বহু রাত ধরেই ঘুমাতে পারছেন না তিনি। উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলেন নিচু টেবিলের তালা লাগান ড্রয়ারের দিকে, চাবি ঘুরিয়ে বের করে আনলেন ছোট্ট মদের বোতল, এর ভেতরে ফেলে দিলেন ছোট্ট এক চিমটি অফিম। জানেন যে এই জিনিস দিয়ে মেহরুন্নিসা শেষ করে দিয়েছে তাঁর পিতাকে কিন্তু তাকে ন্দ্রিা যেতেই হবে। একটু পরেই চলে গেলেন সুবাস মাখা সুখের কোলে। তিনি এবং মমতাজ পাশপাশি শুয়ে আছেন আগ্রাতে তাদের প্রথম প্রাসাদের বাগানে জেসমিন ছাওয়া কুঞ্জবনে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলেন মমতাজের গাল, তাকিয়ে দেখলেন হাসলেন মমতাজ, আস্তে করে এগিয়ে এলো তার দিকে। আস্তে আস্তে তার চোলির পান্না বোতাম খুলতে শুরু করলেন শাহজাহান, আঁটোসাঁটো পোশাকের নিচে ভেলভেটের মত নরম বক্ষ।

দয়া করে জেগে উঠুন…সন্ধ্যা খাবারের জন্য কাপড় পাতা হয়েছে আর আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি…ভুলে গেছেন?

একটা গলার স্বর কোন এক নারীর কণ্ঠ–ভেসে এলো শাহজাহানের বিবশ চেতনাতে। চোখ খুলে চেষ্টা করলেন মনোসংযোগ করতে, কিন্তু তার ডিভানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গোলাপি পোশাকের দেহটা ঝাপসা হল শুধু। এমনকি কাছে এগিয়ে এসে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেও আলাদা করে চিনতে পারলেন না, মনে হল যেন কালো চুলের আড়ালে ঢেকে আছে অর্ধেক। দ্বিধাগ্রস্তভাবে আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। মমতাজ? যদি মমতাজ তাঁর পাশেই শুয়ে থাকে তাহলে এমন হবে কীভাবে? কিন্তু দেহটা তাঁর আরো কাছে ঝুঁকে আসতেই কমলার মিষ্টি সুবাস পেলেন মমতাজের প্রিয় সুগন্ধিগুলোর একটি যা সে ব্যবহার করত। তার মানে মমতাজই। হাত বাড়িয়ে কোমল স্তনে রুক্ষ হাত রাখলেন শাহজাহান।

থামেন। কী করছেন?…অনুগ্রহ করে এমন করবেন না…

নারীদেহ ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করতেই আরো জোরে চেপে ধরলেন সম্রাট, ডান হাতেও কাজে লাগিয়ে উরুসন্ধিতে যেতে চাইলেন। নরম কাপড় ভেদ করে দৃঢ় মাংসপেশীর উষ্ণতা আর আবেদন টের পেলেন তার বিপরীত…মমতাজ কখনো তাঁকে কোন কিছুতে বাঁধা দেয়নি। এটা শুধুমাত্র তাকে প্ররোচিত করা জন্য একটা খেলা…

যুদ্ধরত নারীদেহের গলায় হাত পেঁচিয়ে শাহজাহান চেষ্টা করলো তাকে শুইয়ে দিতে, শরীরী গন্ধে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। তুমি জানো। তুমি আমার কাছে কতটা… ফিসফিস করে জানালেন, নারীদেহে আবদ্ধ হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে স্পষ্ট। মমতাজ সব সময় সাড়া দিয়েছে তার ডাকে। একেবারে প্রথম রাত থেকেই মমতাজ জানতো যে কীভাবে আনন্দ দিতে হয় ও গ্রহণ করতে হয় আর তাদের মাঝে সবসময় তাই ছিল। কিন্তু আরেকটু কাছে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ করে গড়ান দিয়ে ডিভান থেকে ছিটকে গেল নারী, মুখের উপর লুটিয়ে পড়ল কেশরাজি।

কোথায় যাচ্ছো তুমি? যেও না…লাফ দিয়ে নামলেন শাহজাহান কিন্তু ধরার আগেই পিতলের বোল তুলে ছুঁড়ে মারল তাঁর দিকে, এসে আঘাত লাগল তার ডান কপালে। মুখের উপর গড়িয়ে পড়ল রক্তের ধারা। ব্যথায় কেঁপে উঠে পিলার ধরে নিজেকে সামলাতে চাইলেন তিনি। এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করে ফেললেন চোখ।

আব্বাজান!

আবারো চোখ মেলে তাকিয়েই জাহানারাকে দেখতে পেলেন শাহজাহান। চোলির সামনের অংশ খুলে উন্মুক্ত হয়ে আছে সব। কী ঘটেছিল? মাথা নাড়তে লাগলেন যেন এইভাবে কেটে যাবে চেতনার মেঘ। মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন…কান্না ভেজা কাজল লেপ্টে থাকা চেহারাতে শোক আর প্রতিবাদের ভাষা…

থ হয়ে গেলেন যে তিনি কী করতে যাচ্ছিলেন, জাহানারা…আমি চাইনি…এক কদম এগিয়ে গেলেন সামনে, কিন্তু পিছিয়ে গেল জাহানারা, পেছন থেকে আসা ছাদের বাতাসে উড়তে লাগল তার গোলাপি মসলিনের স্কার্ট।

না…আর কাছে আসবেন না! অদ্ভুত শোনালো মেয়েটার গলা–উচ্চ আর রুক্ষ স্বর–ঘরে থেকে বের হবার দরজার দিকে তাকিয়ে আছে; কিন্তু পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন শাহজাহান। পিলার ছেড়ে এপাশে সরে দাঁড়াবেন শাহজাহান কিন্তু আবার কি মনে করে থেমে গেলেন। এভাবে কীভাবে যেতে দেবেন জানাহারাকে? আগে কথা বলতে হবে তার সাথে…

আমাকে বলতে দাও কী ঘটেছিল…

না! একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জাহানারা তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড়ে চলে গেলেন ছাদের দিকে।

জাহানারা…দৌড়ে পিছু নিলেন শাহজাহান। বাইরের মৃদু আলোতে প্রথমে কিছুই ঠাহর করতে পারছিলেন না, আলো জ্বলছে তেলের পাত্রে, কিন্তু তারপরেই একটা শব্দে বুঝতে পারলেন যে কোথায় আছে জাহানারা ছাদের একেবারে শেষ মাথার কাছে একটা সিঁড়িতে যেটা সরাসরি নেমে গেছে হারেমে। দাঁড়াও…

এক মুহূর্তের জন্য পিছু ফিরে তাঁকে দেখল জাহানারা, তারপর মসলিনের স্কার্ট তুলে ধরে দৌড়ে নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে, হঠাৎ করেই পা হড়কে হোঁচট খেলো সামনের দিকে। হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করল কিছু ধরে তাল সামলাতে। নিচে পড়ার সময় স্কার্টের প্রান্ত গিয়ে পড়ল তেলের শিখার উপর। আতঙ্কে জমে গিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন কাপড়ে ছড়িয়ে পড়ল কমলা রঙা আগুনের জিহ্বা আর চিৎকার শুরু করে দিল তার কন্যা।

খানিকটা দৌড়ে, খানিকটা টলতে টলতে এগোতে লাগলেন শাহজাহান, কিন্তু তিনি পৌঁছবার পূর্বেই হারামের নারী পরিচারিকারা ছুটে আসলো সিঁড়ি বেয়ে, নিশ্চয়ই তারা শুনতে পেয়েছে মেয়েটার চিৎকার। কী ঘটেছে দেখতে পেয়ে দুজন হাঁটু গেড়ে ধপ করে বসে পড়ল জাহানারায় পাশে, একজন চেষ্টা করল খালি হাত দিয়েই আগুন নিভিয়ে দিতে–আরেকজন চেষ্টা করতে লাগল জ্বলন্ত স্কার্ট খুলে নিতে। খানিকটা কাজও হচ্ছিল, কিন্তু একজন ঠিক জাহানারার উপরেই ঝুঁকে পড়াতে আগুন ধরে গেল তার লম্বা চুলে, নিজের মাথা খামচে ধরে চিৎকার জুড়ে দিল সেও। এর প্রায় সাথে সাথে দ্বিতীয় জনের কাপড়েও আগুন ধরে গেল, উঠে দাঁড়িয়ে একটা ঝরনার দিকে এগিয়ে যেতেই হালকা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল আগুন, মনে হল মানব মশালে পরিণত হয়েছে পরিচারিকাটি।

এরই মাঝে এগিয়ে এসেছে অন্য সেবাদাসীরাও। সবাই মিলে পানি ঢালতে লাগল জাহানারার উপর। পানি ঢেলে নিভিয়ে দিল আগুনের শিখা, তারপর নজর দিল বাকি দুজনের উপর। কিন্তু শাহজাহান তাকিয়ে আছেন কেবল নিজ কন্যার দিকে। হাঁটু গেড়ে বসে পোড়া কাপড়ের টুকরা সরিয়ে ফেলতে লাগলেন, ভয় পাচ্ছেন যে কী দেখবেন তা ভেবে।

উপুড় হয়ে শুয়ে আছে জাহানারা, পিঠের কিছু অংশ আর বাম পা মারাত্মকভাবে পুড়ে গেছে আর অনিন্দ্য সুন্দর চুলের বেশির ভাগই ভস্ম হয়ে গেছে। পোড়া মাংসের গন্ধ নাকে ঢুকতেই হাঁপাতে লাগলেন সম্রাট।

হাকিমেরা আসছে, জাহাপনা। শুনতে পেলেন বলে উঠল কেউ একজন। ধোঁয়া আর শোকাচ্ছন্ন চেহারায় নেমে এলো অশ্রু জল, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই শক্তপোত হাত এগিয়ে এলে তাকে সাহায্য করতে। মিনিটখানেক পরে দুজনে হাকিম এসে ঝুঁকে পড়ল জাহানারার উপর। শ্বাস পড়ছে কিন্তু পোড়া ক্ষতগুলো বেশ খারাপ। অবশেষে বলে উঠল হাকিম দ্বয়ের একজন।

কোথায় নিয়ে যাবো, জাহাপানা? নিজের প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো শাহজাদীকে? জানাতে চাইল অন্য হেকিম।

না…দুর্গের ভেতরে রাজকীয় হারেমে তার জন্য মহল তৈরি কর। সেবাদাসীদের দিকেও সব রকম খেয়াল রাখবে–জাহানারাকে সাহায্য করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে তারা আদেশ প্রদান শেষে শাহজাহান। তাকিয়ে দেখতে পেলেন যে হাকিমের নিদের্শানুযায়ী বাকি সেবাদাসীরা এসে পানিতে ভেজা তুলার চাদর দিয়ে ঢেকে দিল জাহানারা আর অন্য দুই নারীকে। তারপর সাবধানে তুলে নিল শিবিকাতে।

ছাদের থেকে নামার সময় আস্তে আস্তে তাদের পিছু নিলেন শাহজাহান। পলকের জন্য যমুনা নদীর দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল মমতাজের অর্ধনির্মিত সমাধি। মায়ের মত আবার কন্যাকেও মৃত্যুবরণ করতে দিও না। প্রার্থনা করতে লাগলেন শাহজাহান। এর বদলে আমাকে শাস্তি দাও, আমি এরই যোগ্য।

.

১.১০

জাহানারা বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে উঠতেই কাছে ঝুঁকে এলেন শাহজাহান। খানিকটা কেঁপে উঠল চোখের পাতা। কিন্তু তারপরই আবার স্থির হয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল অসুস্থ কক্ষের আলো-আঁধারীতে। অবস্থার যদিও তেমন অবনতি হয়নি তারপরও উদ্বিগ্ন হয়ে আছে হাকিমেরা। খুব কম সময়েই পুরোপুরি চেতনা থাকে জাহানারার আর গোলাপি বর্ণের পোড়া ক্ষতগুলো ড্রেসিংয়ের পরেও ভয়ঙ্কর লাগে দেখতে। গত দশ দিন ধরেই চলছে এরকম। যতটা পারেন কন্যার বিছানার কাছেই সময় ব্যয় করছেন শাহজাহান। দর্শনার্থীদের সামনে কেবল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেখা দিয়ে আসেন। মাথা নামিয়ে বসে আছেন সম্রাট। বারে বারে মাথায় ভাসছে সে রাতের স্মৃতি। অফিমের ঘোরে জাহানারাকে মমতাজ ভেবে ভুল করেছিলেন। আর নিজ কন্যার প্রতি এমন অপরাধ করতে যাচ্ছিলেন যা খোদা এবং মানুষ উভয়ের চোখেই জঘন্যতম অপরাধ। তিনি নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না, তাহলে কীভাবে আশা করেন যে জাহানারা তাঁকে ক্ষমা করবে?

রোগীর ঘরে এসে প্রায়ই তাকে সঙ্গ দেয় দারা আর মুরাদ। কয়েক দিনের মাঝেই বোরহানপুর থেকে আওরঙ্গজেব আর বাংলা থেকে শাহ সুজাও এসে পৌঁছে যাবে। আবারো একত্রিত হবে তার পুরো পরিবার; কিন্তু পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। কীভাবে তিনি তাদেরকে বলবেন যে সত্যিই কী হয়েছিল? কোথায় গেল সেই সৌভাগ্যের তারকা যা তাঁকে আগ্রাতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল মমতাজের মৃত্যুর পর?…তারপরেও এমন নয় যে ভাগ্য তাঁর প্রতি বিমুখ হয়েছে। বরঞ্চ নিজের দুর্বলতা দিয়ে তিনিই এটিকে ডেকে এনেছেন। জাহানারা যদি সুস্থও হয়ে যায় তার ক্ষত সব সময় মনে করিবে দেবে যে কীভাবে তিনি কন্যার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছিলেন। নিজের ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিলেন যে প্রথমটাতে শুনতেই পাননি কক্ষের মাঝে হাকিমের পায়ের শব্দ, কাছে এসে ডেকে উঠল হাকিম, জাহাপানা?

কী হয়েছে?

বিদেশীটা বলছে সে সে একজন ইউরোপীয় ডাক্তারকে চেনে যে হয়তো শাহজাদীকে সাহায্য করতে পারবে। যদিও আমার সন্দেহ হচ্ছে তারপরেও আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে আপনার কাছে পৌঁছে দেব বার্তা।

কোন বিদেশী?…নিকোলাস ব্যালান্টাইনের কথা বলছ?

হা, ইংরেজ লোকটা।

এখনি আমার কাছে পাঠিয়ে দাও তাকে। যদি সে জানে যে কেউ একজন বা কিছু সাহায্য করতে পারবে আমি এ সম্পর্কে শুনতে চাই।

আধ ঘণ্টা পরে তার সামনে ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। জাহানারার স্কার্টে যে জায়গাতে আগুন ধরে গিয়েছিল তার থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরত্ব।

কী অবস্থা? আমি জেনেছি যে তুমি নাকি একজন চিকিৎসককে চেনো যে শাহজাদীকে সাহায্য করতে পারবে?

মাথা নাড়ল নিকোলাস।

একজন ফরাসী চিকিৎসক এখন এখানে আগ্রাতে স্থায়ী হয়েছে। অনেক বছর আগে একবার দেখা হয়েছিল তার সাথে আমার প্রভু স্যার টমাসকে সুস্থ করে তুলেছিল পাকস্থলী প্রদাহ থেকে আর আমি জানি যে, একাজে তার দক্ষতা অসাধারণ। মাননীয়া জাহানারার পুড়ে যাওয়া সম্পর্কে আমার কাছে শুনে একটা প্রতিষেধকের কথা জানিয়েছে। যুদ্ধের সময় কামান ফেটে বা তীরের মাধ্যমে পুড়ে যাওয়া সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য এ ওষুধ আবিষ্কার করেছে সে। এই ওষুধ আরব, তার নিজের দেশ আর হিন্দুস্তানের যৌথ জ্ঞানের মাধ্যমে তৈরি। শপথ করে জানিয়েছে যে এতে ব্যথা কমে যায়। আরো জানিয়েছে যে তাড়াতাড়ি লাগাতে পারলে পোড়া চামড়া নতুন করে গজাতে থাকে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আমার সাথে করেই নিয়ে এসেছি যদি আপনি তার সাথে কথাবলতে চান–আমি দোভাষীয় কাজ করব। অল্প অল্প ফারসী বলতে পারে ডাক্তার।

ভেতরে নিয়ে আসো তাকে।

খাটো চৌকানো দেহাবয়বের ডাক্তারের কালো বেল্ট বাঁধা রোব গোলাকার পেটের কাছে এসে আঁটসাঁট হয়ে আছে।

কী ধরনের চিকিৎসার প্রস্তাব করতে চাও তুমি?

অনুবাদ করে শোনালো নিকোলাস আবার মনোযোগ দিয়ে ডাক্তারের উত্তর শুনে নিয়ে ঘুরে তাকালো শাহজাহানের দিকে। চিকিৎসা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একবার রোগীকে অবশ্যই দেখতে চায়। জানতে চাইছে এটা কি সত্যি যে কাঁধ, পেছন দিকে আর পা মারাত্মকভাবে পুড়ে গেছে?

মাথা নাড়লেন শাহজাহান। এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে আবারো বলে উঠলেন ডাক্তার। এখানে আগ্রাতেও একই রোগের চিকিৎসা করেছে বলে দাবি করছে। খড়ে ছাওয়া ছাদ এতটাই শুকিয়ে ছিল যে ফুলিঙ্গ থেকেই আগুন ধরে যায়। গত মাসে শহরের উত্তর দিকে এভাবেই আগুন ধরে গিয়েছিল বাড়ির সারিগুলোতে। বেশ কয়েকজন নারী মারা গেছে কারণ তারা পর্দা ভেঙে বাইরে আসতে ভয় পেয়েছিল। কিন্তু সে কয়েকজনকে বাঁচাতে পেরেছে…এর সাথে যে মলমের কথা আপনাকে বলেছি তা তার নিজের আবিস্কার, এ সব কিছুই রোগীর যন্ত্রণা কমাতে পারে।

সে ব্যথা কমানোর কথা বলছে। রোগীর সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে পারবে? আমার কন্যার দুজন সেবাদাসী পুড়ে যাবার কারণে মারা গেছে।

আমি এর উত্তর জানি। জাহাপনা–আমি নিজেই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলেছে যে চেষ্টা করবে কিন্তু কোন প্রতিজ্ঞা করতে পারবে না–অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না শাহজাদীকে দেখতে পাচ্ছে।

আর ক্ষতের আকার? যদি আমার কন্যা সুস্থ হয়েও যায় এটা কমাতে পারবে সে?

ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিল নিকোলাস, না, জাহাপনা পুড়ে যাবার ফলে সৃষ্টি ক্ষতের দাগ পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারবে না।

এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তাকে জানিয়ে দাও যে যদি সে আমার কন্যার জীবন রক্ষা করতে পারে তাহলে যা চায় পাবে।

আবারো ফিসফিস করে ডাক্তারের সাথে আলাপ করে নিকোলাস উত্তর জানালো, জানতে চাইছে কত দ্রুত রোগিনীকে দেখতে পারবে?

এখানে রাজকীয় হারেমে তাকে দেখাশোনা করা হচ্ছে। কেবলমাত্র অসম্ভব জরুরি হলেই আমার হাকিমেরা প্রবেশের অনুমতি পায়। কোন বিদেশীকে এর আগে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়নি। এ ধরনের বিপর্যয়ের মুহূর্তে যদিও এসব নিয়ম বোকামীর সামিল, তার পরেও শ্রদ্ধা দেখাতেই হবে। তোমাদের দুজনকে হারেমে যাবার অনুমতি দিলাম আমি। কিন্তু আমার নপুংসক ভৃত্যেরা তোমাদের মাথা ঢেকে নিয়ে যাবে।

ফরাসী লোকটা কিছু বলে উঠতেই মাথা নিচু করে শুনলো নিকোলাস। জাহাপনা, শাহজাদী খাদ্য আর পানীয়ের উপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার কথা বলছে ডাক্তার।

তাকে জানাও যে আমার কন্যা প্রায় অচেতন অবস্থায় আছে। দুর্ঘটনার পর থেকে তার ঠোঁটের মাঝে কয়েক ফোঁটা পানি মিশ্রিত আফিম গিয়েছে শুধুমাত্র ব্যথা কমাবার জন্য, বিশেষ করে পট্টি বাঁধার সময়।

ডাক্তার জোর দিয়ে বলছে যে যত শীঘ্রি সম্ভব শাহজাদীকে খাবার খাওয়াতে হবে নরম করে দেয়া ফল বিশেষ করে কলা– কিন্তু বিশেষ যত বেশি বার সম্ভব পানি খাওয়াতে হবে। শরীরে তরল দরকার।

আধ ঘণ্টা পরে ফরাসী ডাক্তারের কাঁধে হাত রাখলো নিকোলাস। খাজাসারা যেভাবে নির্দেশ দিয়েছে ঠিক সেভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এরপর একজন খোঁজা-মৃসণ চেহারা, লাবণ্যময়–দুই বিদেশীর মাথার উপর সবুজ ব্রোকেডের কাপড় পরিয়ে দেয়। ঠিকঠাক বেঁধে যতক্ষণ পর্যন্ত না সন্তুষ্টি আসে যে হ্যাঁ, একজন বিদেশীও হারেমে প্রবেশের পর কিছু দেখতে পাবে না। নিকোলাসের ঘাড়ে সুড়সুড়ি লাগালো রেশমি কাপড়ের স্পর্শে। যাই হোক, খাজাসারার নির্দেশে আস্তে আস্তে পা ফেলে সামনে বাড়লো দুজনে। খোঁজা ভৃত্যের কাঁধে হাত রেখে চলেছে ডাক্তার।

কয়েক বছর আগে একবার হারেমে এসেছিলাম আমি। ফিসফিস করে জানালো ফরাসী ডাক্তার, গুজরাটের মোগল শাসনকর্তার অন্দর মহলে। তার বহু স্ত্রীর একজনের ধারণা হয়েছিল যে তাঁকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। আসলে বেশি খেয়ে ফেলেছিল সেই নারী আর আমি শুধু পেট পরিস্কারের ওষুধ দিয়েছিলাম। কিন্তু তার হাতের পালস খুঁজে পেতে যে কী কষ্ট হয়েছিল তা কখনোই ভুলবো না আমি। হাতের মাঝে এত মুক্তার মালা জড়ানো ছিল যে প্রথমে তো আমি খুঁজেই পাইনি পালস্ ।

ডাক্তার মুচকি হাসতেই নিকোলাস দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল। একই সাথে চিৎকার করে সাবধান করে দেয়া হল যে দুজন বিদেশী এগিয়ে আসছে। তাই হারেমের অন্তপুরবাসিনীরা যেন দৃষ্টিসীমার আড়ালেই থাকে।

সামনে এগোতে গিয়ে জুতার নিচে নরম কার্পেটের স্পর্শ পেল নিকোলাস। আরো পাওয়া গেল ধূপ-ধুনার চনমনে মিষ্টি গন্ধ। আরো কয়েকবার এঁকেবেঁকে মোড় নিয়ে এগোতে দিয়ে আরো কয়েকটি দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। কিন্তু বৈচিত্র্যময় এই হারেমে প্রবেশ নিয়ে কল্পনাগুলো মনমত হল না। ভারতে আসার পর থেকে যৌন আনন্দের এ ক্ষেত্র সম্পর্ক বহু রসাত্মক কাহিনী শুনে এসেছে সে। যাই-হোক আবারো মনে পড়ে গেল আহত আর সম্ভবত মৃত্যুপথযাত্রী শাহজাদীর কথা। শাহজাহানের সব ছেলেমেয়েদের মাঝে জাহানারা আর তার ভাই দারা শুকোহকেই একেবারে তাদের বাল্যকাল থেকে চেনে নিকোলাস। জাহানারা বেশি আগ্রহী ছিল নিকোলাসের নিজের দেশের প্রথা নিয়ে প্রশ্ন করার ব্যাপারে–কেমন করে বাস করে নারীরা আর কেমন করেই বা একজন নারীই হয়ে উঠেছে এর সর্বময় শাসনকর্তা।

হঠাৎ করেই মোলায়েম মোমবাতির আলোতে পিটপিট করে উঠল নিকোলাসের চোখ জোড়া। মাথা থাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে কাপড়ের টুকরো। বড়সড় একটা রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে নানানা ধরনের শিকড় বাকড় আর কর্পূরের গন্ধ পেল নিকোলাস আর ডাক্তার। চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল জাহানারাকে। বদলে দেখতে পেল তিন রমণী সিল্কের কাপড় ধরে রেখে আড়াল করে রেখেছে কোন একজনকে। এটাই নিশ্চয়ই আহত জাহানারার শয্যা।

মহামান্যার ক্ষত পরীক্ষা করার জন্য ডাক্তার এখন আসতে পারে। ঘোষণা করল খাজাসারা। কিন্তু দোভাষীকে পর্দার ওপাশেই থাকতে হবে। ডাক্তারকে নিজের কাঁধ থেকে চামড়ার ব্যাগ নামাতে দেখল নিকোলাস। এরপর নিজের নাকের উপর একজোড়া মোটা কাঁচের চশমা বসিয়ে দিল ডাক্তার। এরপর একজন দাসী পর্দা একটু তুলে ধরতেই ভেতরে ঢুকে গেল ডাক্তার। উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল নিকোলাস। মনে হল বহু যুগ পরে, কিন্তু হয়ত পনের বা বিশ মিনিটের বেশি হবে না উদয় হয় ডাক্তার।

তো? সাহায্য করতে পারবে তাকে? জানতে চাইল নিকোলাস।

পোড়া ক্ষতগুলো মারাত্মক আর পানি বের হচ্ছে–আমি মলম লাগিয়ে দিয়েছি আর দুই জগ ভর্তি করে রেখে যাবো যেন তার সেবাকারীরা পরে লাগিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমি যতটা ভয় পেয়েছিলাম অবস্থা ততটা খারাপ নয়। আমার ধারণা বেঁচে যাবে। পালস্ স্বাভাবিক, নিঃশ্বাসও ঠিক-ঠাকভাবে নিচ্ছে। কিন্তু সুস্থ হতে এখনো সময় লাগবে আর যত্নও প্রয়োজন।

সম্রাট তুমি যা চাও দিতে চেয়েছেন। কিছু চাও?

জানি আমি। এ মহান মানুষগুলোর ধারণা যে তাদের বিত্ত দিয়ে যে কোন কিছু বা যে কাউকে ক্রয় করা সম্ভব। কিন্তু এই ক্ষেত্রে শাহজাদীর তারুণ্য আর শক্তিই তার সবচেয়ে বড় সহায়ক হতে পারে, আমি নই।

*

আইভরি বাঁধাইকৃত বইটা নামিয়ে রাখার আগে আরো একবার কবিতাটা পড়ে দেখল জাহানারা। দারার নিজের লেখা কবিতাটা পড়তে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। অসম্ভব ভালো লেগেছে যেদিন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছে শয্যাপাশে বসে আছে তার ভাই। জাহানারা হাসতেই, দারার চোখে চিকচিক করে উঠেছে কান্না–এই অশ্রু কী খুশিতে যে সে বেঁচে আছে নাকি সৌন্দর্যহানির দুঃখে, নিশ্চিত নয় জাহানারা। বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট আয়নাটা তুলে নিয়ে নিজের মুখের সামনে ধরল শাহজাদী। বাম গালের চামড়ায় মসৃণ, উজ্জ্বল একটা লাল চিহ্ন গলা পর্যন্ত নেমে যেতে যেতে চওড়া হয়ে গিয়েছে। পেছন দিক বা বাম পা দেখতে কেমন লাগছে কোন ধারণাই নাই। এখনো বেশ দুর্বল তাই নিজে বাঁকা হয়ে দেখার সামর্থ্য নেই। কিন্তু অনুমান করতে পারছে।

যাই হোক, অন্তত ব্যথাটা ধীরে ধীরে কমে গিয়ে মাথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। যদিও এর সাথে অন্য সমস্যাও জুড়ে যাচ্ছে। আগুন লেগে যাবার রাতে শাহজাহানের আচরণের স্মৃতি এতটাই তাজা আর তিক্ত যে মনে হল মাত্র তিনদিন আগেই ঘটেছে এমনটা ছয় সপ্তাহ আগে নয়…সে সময় একমাত্র চিন্তা ছিল পালিয়ে যেতে হবে। মনে পড়ে গেল পা বেঁধে পড়ে গিয়েছিল কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে, যখন দৌড়ে পালাচ্ছিল, কিন্তু তারপরই সব অন্ধকার ছায়া আর সীমাহীন ব্যথা। পুরোপুরি চেতনা ফিরে পাবার আগের দীর্ঘ সময়টাতে ঝাপসা ঝাপসাভাবে মনে পড়ে যে পিতা এসে বসে থাকতেন তার বিছানার পাশে, হাকিমদের সাথে আলোচনা করতেন জাহানারার সুস্থতা নিয়ে। প্রথম প্রথম এতটাই দুর্বল ছিল যে বুঝতে পারত না তার কী হয়েছিল। কিন্তু টুকরো টুকরো আলোচনা শুনে অংশগুলোকে জোড়া লাগিয়ে বুঝতে পারে মসলিনের স্কার্টে আগুন ধরে গিয়ে মারাত্মকভাবে পুড়ে গেছে সে।

যখন নিশ্চিত হয়ে গেছে যে জাহানারা সুস্থ হতে আর বেশি দেরি নেই তখন খেয়াল করে দেখেছে যে শাহজাহান একাকী রুমে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ না কেউ সাধারণত দারা, মুরাদ, অথবা রোশনারা সাথে থাকত। যখন ঘুম আসে না, অন্ধকারে শুয়ে থেকে বারংবার মনে পড়ে যায় সেই ভয়ঙ্কর রাতের স্মৃতি। চেষ্টা করে কোন একটা ব্যাখা খুঁজে পেতে যেন সবকিছু সত্ত্বেও পিতার প্রতি সে ভালোবাসা অনুভব করে, তার সাথে যেন সমঝোতা করতে পারে। কী হয়েছিল যে নিজ কন্যার সাথে এহেন আচরণ করলেন তিনি?

কারো সাথে যদিও সে আলোচনা করেনি যে কী হয়েছিল-বৃদ্ধ আর বিশ্বস্ত সাত্তি আল-নিসা, ভাইরা কিংবা রোশনারা কারো সাথেই না…এমনকি তার বোনও বিশ্বাস করতে চাইবে না, যদি বিশ্বাস করেও বুঝতে পারবে না।

আজ কেমন আছ জাহানারা? তোমাকে ভালো দেখাচ্ছে!

আওরঙ্গজেব কখন এসেছে শুনেতেই পায়নি জাহানারা। হলুদ পোশাকের নিচে কিছু একটা নিয়ে এসেছে। হাসি লুকালো জাহানারা হয়ত আরেকটা উপহার। তার ভাইরা একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেন জাহানারা একটা ছোট্ট অসুস্থ শিশু তাই তাকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে হবে। গতকাল বাংলা থেকে আনা কোরাল আর মুক্তার তৈরি নেকলেস উপহার দিয়েছে শাহ সুজা।

প্রতিদিনই অনুভব করছি যে সুস্থ হচ্ছি।

ভালো। দেখো কী এনেছি তোমার জন্য। পোশাক থেকে স্বর্ণের পাখির খাঁচা বের করল আওরঙ্গজেব। বাঁকানো আইভরি দাঁড়ের উপর বসে আছে হালকা নীলাভ রঙের ঘুঘু, গলায় পেঁচানো পদ্মরাগমনির কলার।

অনেক সুন্দর। ধন্যবাদ ভাই।

এটা কী? হাতে বই তুলে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টে দেখতে লাগল আওরঙ্গজেব।

দারার লেখা কয়েকটা কবিতা। সুরাটে যাবার পথে একজন সূফী সাধকের সাথে দেখা হয় আর তার সান্নিধ্যেই আর শিক্ষায় উৎসাহী হয়ে এ সকল পদ্য রচনা করেছে দারা। সেই সূফী সাধককে আগ্রতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে দারা যেন তারা আরো আলোচনা করতে পারে।

দারা কেন এত আগ্রহী হল? আর দেখ কী লিখেছে এখানে :

আমি আনন্দিত হয়েছি যে প্রতিটি মানুষই তার নিজস্ব পথে খুঁজে ফেরে সৃষ্টিকর্তাকে।

আওরঙ্গজেবের অবজ্ঞা ভরা কণ্ঠে বিস্মিত হয়ে গেল জাহানারা।

দারা সঠিক লেখেনি? আত্মিক জ্ঞানের সন্ধান করা তো আমাদের সকলেরই দায়িত্ব…আত্মিক শান্তি…যে পথেই আমরা তা পারি না কেন।

মোল্লা আর তাদের লেখনি? তারাই তো আমাদের পথপ্রদর্শক আল্লাহর কাছে। তাদেরকে আর তাদের বিচারকে অবহেলা করে নিজস্ব পথে চলা শুধুমাত্র বিশ্বাসঘাতকতা, আর বিপথগামীতাই নয়–এটা ধর্মদ্রোহীতা।

তাই? দারা মনে করে আলোকিত জ্ঞান অন্বেষণের পথে বাধা হচ্ছেন কয়েকজন মোল্লা–তারা সৃষ্টিকর্তা আর মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে যায় নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য। আমিও এ ব্যাপারে একমত।

এটা একেবারে যাচ্ছে-তাই চিন্তা। ঠাস করে বইয়ের মলাট বন্ধ করে জাহানারাকে ফিরিয়ে দিল আওরঙ্গজেব। যখন তোমার শরীর আর মন শক্তি ফিরে পাবে তুমি বুঝতে পারবে।

সম্ভবত। অথবা যেহেতু আমি তোমার চেয়েও একেবারে কাছ থেকে অনুভব করেছি মৃত্যুকে, তুমি স্বীকার করবে যে আমি হয়তো অস্তিত্বের সত্যিকারের আচরণ বুঝতে পারি। আমাদের বিশ্বাস তোমার মত নয়, শুধু এই কারণেই দারা আর আমার উপর রাগ করো না…

আমি কখনোই তোমার সাথে রাগ করি না। কিন্তু দরবারে ফিরে আসার পর থেকে দেখছি যে দারা কতটা উদ্ধত হয়ে গেছে আর কীভাবে অন্যদের মতামতকে অশ্রদ্ধা করছে। একজন শিশু হিসেবেও ভালো ছিল, সব সময় ভাবতো যে ওই সবচেয়ে ভালো জানে আর আমাদেরকে বলে দিত যে কী করতে হবে। কখনো বুঝতে পারেনি যে নিজে কী করছে। যখন থেকে আমি দক্ষিণে গেছি, সময় পেয়েছি মুসলিম বিভিন্ন রাজ্য গোলকুন্ডা, বিজাপুর আর আহমেদনগরকে কাছ থেকে দেখার। তাদেরকে দমিয়ে রেখে আমাদের রাজত্বের অধিকারে আনার জন্য আমাদেরকে শক্তি দেখাতে হবে কিন্তু শুধু সামরিক শক্তি বলে, সত্যিকারের বিশ্বাসের পালনকারী আর অনুসরণকারী হিসেবে ধর্মীয় শক্তি দিয়ে। আমাদের পিতার বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহের অন্যতম একটি কারণ ছিল যে পিতার মাঝে তিন ভাগই হিন্দু অংশ আর বিবাহ করেছে একজন শিয়া মুসলিমকে…

আমাদের পিতা একজন সম্রাট। তাঁর জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলার তাদের কোন অধিকার নেই। ঠিক একইভাবে আমাদের মা, সুন্নি অথবা শিয়া যাই হোক না কেন, তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম আর সকলের প্রতি দয়ালু…

রাগে কাঁপতে থাকলো জাহানারার কণ্ঠস্বর। যদি আমরা নিজেরাই এ ধরনের সংকীর্ণ নিচুমনা কথার প্রভাবে পড়ে যাই তাহলে শুধু যে মায়ের স্মৃতিকে অপমান করব তা না আমাদের বেশির ভাগ প্রজার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো।

আমি দুঃখিত। আমি তোমাকে উত্তেজিত করতে চাইনি…চলো অন্য কোন কিছু নিয়ে কথা বলা যাক। বিছানার কাছে হাঁটু গেড়ে বসল আওরঙ্গজেব। যখন আমি প্রথম ফিরে এসেছি তখন তুমি বলেছিলে যে একজন বিদেশী চিকিৎসক তোমাকে সাহায্য করেছে অলৌকিক এক মলম দিয়ে। কে সে?

নিকোলাস ব্যালান্টাইনের একজন বন্ধু–নিকোলাসই তাকে নিয়ে এসেছিল। অসম্ভব শক্তি আছে লোকটার–একজন অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও, শেষ অংশটুকু যোগ না করে পারল না জাহানারা।

আওরঙ্গজেবের কালো চোখ জোড়া দেখে মনে হল যে সেও বুঝতে পেরেছে ভালো। আওরঙ্গজেব ভালোই বলেছে; কিন্তু যদি সে ঠিক বলে থাকে যে দারা মাঝে মাঝে বিধর্মীদের প্রতি ঝুঁকে যায়, তাহলে তো সে নিজেও সংকীর্ণমনা আর অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।

দুই ঘণ্টা পরে চলে গেল আওরঙ্গজেব। ঘরের চারপাশের কুলঙ্গিতে তেলের বাতি জ্বেলে দিতে শুরু করল সেবাদাসীর দল, সম্রাটের আগমন, ঘোষণা শুনতে পেল জাহানারা। কয়েক মুহূর্ত পরেই কক্ষে প্রবেশ করলেন শাহজাহান একা। জাহানারার দেখভালের জন্য এক কোণায় বসে থাকা হামিককে জানালেন চলে যেতে। হাকিমের পেছনে জোড়া দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই হঠাৎ করে সন্ত্রস্ত বোধ করতে লাগল জাহানারা। মনে পড়ে গেল পিতার আচরণ। ভাবতে লাগল কক্ষে তাদের সাথে কেউ থাকলে কতই না ভালো হত।

বিছানার কাছে না এসে জানালার কাছে হেঁটে গেলেন শাহজাহান। তাকিয়ে রইলেন গোধূলির দিকে। শব্দ বলতে শুধুমাত্র বাইরের আঙিনাতে নিম গাছের কাছে থাকা ময়ূরের ব্যাকুল ডাক। এরপর ধীরে ধীরে জাহানারার দিকে ঘুরে তাকালেন। কিন্তু কথা বলার আগে কেটে গেল আরো বেশ কিছু মুহূর্ত। কর্কশ শোনাল কণ্ঠস্বর। কতবার যে আমি ভেবেছি তোমার কাছে আসব ক্ষমা চাইতে অন্তত বুঝিয়ে বলতে…কিন্তু এই সাহসটুকু না করতে পারার আগপর্যন্ত বুঝি নি যে আমি একটা কাপুরুষ। এখন দেখ আমি এসেছি, যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার…শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না…

না.. দয়া করে…পিতার যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারা দেখে ভয় উধাও হয়ে গেল জাহানারার মন থেকে। সেই রাত নিয়ে আর কথা বলব না…আমাদের দুজনেরই উচিত ভুলে যাওয়া। উঠে বসল জাহানারা, মানসিকের চেয়েও শারীরিক ব্যথায় ককিয়ে উঠল বেশি। কেননা পোড়া ক্ষতগুলোর জন্য শরীর টানটান করতে এখনো ব্যথা হয়।

তোমার হৃদয় অনেক দয়াবান। আমার জন্য প্রায় মরতে বসেছিলে তুমি…কেননা পিতা-কন্যার সম্পর্কের সব সীমা লঙ্ঘন করেছি আমি। এ কারণেই বলতে হবে আমাকে…আমি ভাবতে পারছি না যে সে রাতে আমাকে যেভাবে দেখেছিলে তারপরে আর কখনো আমার দিকে তাকাতে পারবে কিনা। আমি কোন অজুহাত দিতে চাই না। কিন্তু ঘুমের জন্য আফিম নেয়াতে আমি দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। অন্য দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলাম আমি…অর্ধ-চেতনার বশে ভেবেছিলাম তুমি মমতাজ এবং ফিরে এসেছ আমার কাছে…আমি ভেবেছিলাম যে আমি মমতাজকে পেতে চলেছি। আমি বুঝতেই পারিনি যে এটা তুমি, যতক্ষণে পেরেছি অনেক দেরি হয়ে গেছে আর পালিয়ে গেছ তুমি।

আপনি ভেবেছিলেন আমি আম্মাজান?

হ্যাঁ, আমি তাকেই স্বপ্নে দেখছিলাম আর বাস্তবের সাথে মিলিয়ে ফেলছিলাম। আর কখনোই এমনটা ঘটবে না, আমি শপথ করছি। তোমার দুর্ঘটনার পর থেকে এক ফোঁটা মদ বা একদানা আফিমও ঠোঁটে ছোঁয়াইনি আমি।

অন্তত এতে খুশি হয়েছি আমি।

কিন্তু ক্ষমা করতে পারবে আমাকে…যা করেছি শুধু তাই না, ভয়ংকর অবস্থাটার জন্য? মাথা নিচু করলেন শাহজাহান। আমি নিজেকেই দোষারোপ করছি যে সভাইদেরকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলাম বলে তোমার আম্মাজান মৃত্যুবরণ করেছেন, তেমনি আমার কৃতকর্মের জন্যেই আহত হয়েছ তুমি–উপর থেকেই এ শাস্তি পেয়েছি আমি।

চুপ করে রইল জাহানারা। এখন বুঝতে পারছেন কীভাবে ঘটল ঘটনাটা। পিতার কোন অনৈতিক কর্ম নয় এটা বরঞ্চ এমন এক দুঃখ যা থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারেননি বা মেনেও নিতে পারেননি। যদি এখন জাহানারা না বলে যে সে ক্ষমা করেছে, নিজেকেও যদি তা বোঝাতে না পারে সেই রাতের ঘটনা কুরে কুরে খাবে তাদের দুজনকেই। আগুন লাগার আগে তার সবচেয়ে বড় দুঃশ্চিন্তা ছিল যে চারপাশের জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন পিতা। যদি এখন থেকে জাহানারা ফিরিয়ে দেয় তাহলে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন শাহজাহান।

মুখে হাসি ফোঁটালো জাহানারা আর সাধারণভাবেই জানালো, হ্যাঁ, আমি ক্ষমা করেছি। মুহূর্তখানেক পরেই অনুভব করল যে আগ্রহভরে তার হাত ধরলেন শাহজাহান। বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে চেষ্টা করল কেউ যাতে আবেগপ্রবণ না হয়ে ওঠে তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আগুন লেগে যাওয়া রাত নিয়ে আর কখনো কথা বলব না আমরা–এতে শুধুমাত্র ব্যথাই বাড়বে। এর চেয়ে বরঞ্চ সামনের দিকে তাকানো যাক! আগে যেভাবে দেখতাম, সেভাবে তোমার কাছে আসা আর্তি-অনুরোধ পাঠিয়ে দেবে না আমার কাছে?

আবারো তোমার সাহায্য পেলে কৃতজ্ঞ হব আমি।

পিতার আচরণে স্বস্তি দেখতে পেয়ে আরো যোগ করল জাহানারা। যখন আমি আবার আগের মত ঠিকঠাক হাঁটতে পারব– চিকিৎসকেরা জানিয়েছে যে আর বেশি দেরি নেই–নৌকা করে আমাকে নিয়ে যাবেন মায়ের সমাধি দেখে আসতে? কতটা উন্নতি হয়েছে দেখতে চাই আমি। শুধু আপনিই তাকে ভালোবাসতে না, আব্বাজান, আমরাও বাসতাম।

মেয়েটা তাকে আরো একবার সুযোগ দিচ্ছে পরিবারের সাথে মিলিত হবার, বুঝতে পেরে চোখে জল এল শাহজাহানের। সেভাবেই উত্তর দিলেন, আমরা সবাই যাবো, অনেক দিন হয়ে গেল–অনেক দিনের চেয়েও বেশি–আমরা পুরো পরিবার একত্রিত হইনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *