৪. রডারিকের পরাজিত ফৌজ

“নিজেদের ধর্মীয় বিধানকে তোমরা পদদলিত করছ। আমি তোমাদের এ অপরাধ ক্ষমা করতে পারিনা। কুমারী রাহেবাদেরকে তোমরা উপ পত্মী হিসেবে গ্রহণ করতে পার এমন বিধান কি হযরত ঈসা (আ)-এর ধর্মে রয়েছে…না… তোমরা হত্যার উপযুক্ত।”

রডারিকের পরাজিত ফৌজের ত্রিশ হাজার কয়েদীকে একত্রিত করে বাঁধার পূর্বের দৃশ্যছিল এক হৃদয় বিদারক ও মর্মান্তিক। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত দীর্ঘ প্রশস্ত ময়দান, ময়দানে হাশরে পরিনত হয়েছিল। লাশের স্তূপ রক্তগঙ্গায় হাডুডুবু খাচ্ছিল। হাজার হাজার আহতরা কাতরাচ্ছিল। অনেকে উঠে দাঁড়াবার কোশেশ করছিল। অনেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিল। আহতদের আত্ম চিল্কারে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। যাদের শরীরে তীর বিদ্ধ ছিল তারা সবচেয়ে বেশী চিৎকার করছিল। অশ্ব ও পায়দল সৈন্যদের পদাঘাতে উড়ন্ত ধূলী কনা বাতাসে ভর করে স্পেনের রাজধানী টলেডোতে গিয়ে পৌঁছেছিল। একজন ইতিহাসবেত্তা লেখেন, এটা কোন বিস্ময়কর নয় যে তারেক ইবনে যিয়াদ জালেম বাদশাহ্ রডারিকের পরাজয় আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যক্ষ করছিলেন। ইতিহাস আজ পর্যন্ত পেরেশান যে বার হাজার সৈন্য কিভাবে এক লাখ বাহিনীকে পরাস্ত করে নাম নিশানা মিটিয়ে দিল।

রডারিকের আত্মম্ভরিতা যখন যুদ্ধের ময়দানে ভূলণ্ঠিত, তারেক ইবনে যিয়াদ তখন অশ্বপিঠে সোয়ার হয়ে পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন। তার বিজয়ী মুজাহিদরা আহতদেরকে ও শহীদ সাথীদের শব পূর্ণ ইহতেরামের সাথে একত্রিত করছিল। কিছু মুজাহিদ ঐ সকল স্পেনীদেরকে পাকড়াও করছিল যারা উঁচু ঘাস ও গাছ-পালার মাঝে লুকাবার কোশেশ করতে ছিল। কেউ কেউ তাদের সাথীদের লাশের নিচে আত্মগোপনের ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। মুসলমানরা তাদের হত্যা করবে হয়তো তাদের মনে এ ভয় বিরাজ করছিল। নৌকা দ্বারা তাদের তৈরীকৃত পুল পূর্ণ মাত্রায় সহী সালামতে ছিল। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেকে সে পুল অতিক্রম করছিল। একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে পিছে ফেলে আগে যাবার চেষ্টা করছিল। এ পরিস্থিতিতে অনেকেই তার নিজ সাথীর দ্বারা সাগরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। ইতমেনান ও শান্তিতে সেই ছিল যে, হাতিয়ার সমর্পণ করে মুসলমানদের হাতে নিজেকে সোপর্দ, করেছিল।

যে সব স্পেনী কিস্তির পুল দিয়ে অতিক্রম করছিল তাদেরকে ফিরিয়ে আনার হুকুম কে দিয়েছিল তা জানা নেই। বহু তীরন্দাজ মুসলমান সমুদ্র পাড়ে গিয়ে কয়েকজন কয়েদী দ্বারা ঘোষণা করাল তারা যেন সকলে ফিরে আসে তা নাহলে তাদের ওপর তীর নিক্ষেপ করা হবে। স্পেনীরা ফিরে আসার পরিবর্তে আরো দ্রুত অগ্রসর হবার প্রতিযোগিতা শুরু করল। এরিমাঝে কামান হতে তীর গিয়ে কয়েকজন স্পেনীকে ফেলে দিল। এ অবস্থায় তাদের মাঝে আতংক আরো বেড়ে গেল অনেকে পিছে ফিরে এলো কিন্তু যারা অপর প্রান্তের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল তারা প্রত্যাবর্তন করল না। এদের সংখ্যাও একেবারে কমছিল না।

তারেক ইবনে যিয়াদ দেখতে পেলেন, তার দু’তিনজন মুজাহিদ বিশ-পঁচিশ জন যুবতাঁকে হাঁকিয়ে নিয়ে আসছে। এরা ছিল রডারিকের হেরেমের। তারেক ইবনে যিয়াদ চূড়া থেকে নেমে এলে যুবতীদেরকে তার সামনে আনা হলো, তাদের মাঝে একজন কেবল মাঝ বয়সী বাকী সকলেই কিশোরী ও যুবতী, একে অপরের চেয়ে সুন্দরী।

তারেক ইবনে যিয়াদ : এরা কি শাহী খান্দানের?

জুলিয়ন : না ইবনে যিয়াদ! এরা প্রজাদের বিভিন্ন খান্দানের লাড়কী। এরা। রডারিকের আমোদ-ফুর্তির উপকরণ। বিশ-পঁচিশজন উপ-পত্মীই যদি না থাকল তাহলে কিসের বাদশাহী।

তারেক : তাদেরকে জিজ্ঞস কর, তাদের মাঝে এমন কেউ আছে কি যে বাদশাহর হেরেমে স্বেচ্ছায় ছিল না।

তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা সকলেই বলল, তাদেরকে জোরপূর্বক বাদশাহর কাছে সোপর্দ করা হয়েছিল। তাদের মাঝে খ্রীষ্টানও ছিল তবে অধিকাংশ ছিল ইহুদী।

বাদশাহ্ কোথায়?

“এ প্রশ্নের জবাব কোন লাড়কী দিতে পারবে না।” হেরেমের প্রধান রমণী জবাব দিল। চার রাত ধরে বাদশাহ তার খিমাতে কাউকে আহ্বান করেনি। প্রতিরাতে আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম কিন্তু সে আমাকে ধমক দিয়ে বের করে দিত। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন থেকে সে গোস্বায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। রাতে সে প্রচুর পরিমাণ শরাব পান করত, একদিন রাতে তাকে বেঁহুশ অবস্থায় উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলাম। দারোয়ানকে ডেকে তাকে বিছানাতে শয়ন করিয়ে ছিলাম।

স্পেনের শাহানশাহ্র ফৌজকে যে মুসলমানরা পরাজিত করেছিল তাদের সিপাহসালার তারেক ইবনে যিয়াদের শিরে ছিল আল্লাহ্ তায়ালার কুদরতের হাত। আর অন্তরে ছিল রাসূলে খোদা (স)-এর ইশক ও মহব্বত। রাসূল (স) তাকে বাসারত দিয়ে ছিলেন। এ বাশারত প্রকৃত অর্থে তাঁর ফরমান ছিল, “তারেক! তুমি যদি আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হও তাহলে পরাজিত হবে না। আল্লাহ তোমার সাথে রয়েছেন।”

তারেক রাসূল (স)-এর ফরমান তামীল করেছিলেন।’

স্পেনের বাদশাহ্ রডারিককে তার পাপ পরাজিত করেছিল। তার পরাজয় হয়েছিল শিক্ষনীয়। না জানে কত কুমারীর হৃদয়কে সে ভেঙ্গে করেছে খান খান। সে বিদ্রোহীদের ইস্তুরিয়া নাম্নী এক কিশোরীর অন্তর করেছিল চুরমার। তার ওপর তলোয়ার চালানোর পূর্বে বলেছিল তোমার বাদশাহীর ওপর ঘোড়া দৌড়ান হবে। তোমার সিংহাসন হবে চিরতরে ভূলণ্ঠিত।

রমণীদেরকে যখন তারেকের সম্মুখে উপস্থিত করা হলো তখন তিনি উম্মুক্ত ময়দানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যেসব কয়েদীরা লুকিয়েছিল তাদেরকে খুঁজে বের করা হচ্ছিল। তিন-চারজন কয়েদী তারেকের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করছিল। তাদের মাঝে একজন পোশাক-আষাক, চলা-ফেরা অন্য কয়েদীদের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল। সে তারেকের সামনে রমণীদেরকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

এক মুসলিম মুজাহিদ তাকে ধমক দিয়ে বলল, এখানে না দাঁড়িয়ে সামনে অগ্রসর হও।

কয়েদী : এ মেয়েদের মাঝে আমার ছোট বোন রয়েছে। তার সাথে একটু সাক্ষাৎ করতে দাও, আবার কবে দেখা হবে কিনা তার কোন ঠিক নেই। উক্ত মুজাহিদ ছিল বর্বর, দয়া-মায়া কাকে বলে সে তা জানত না। তাই তাকে দু’হাতে। ধাক্কা দিয়ে সম্মুখে যাবার জন্যে বলল।

 ‘এ হলেন আমার বড় ভাই।” এক সুন্দরী যুবতী তারেক ও জুলিয়নকে বলল, আমার সামনে কিছুক্ষণের জন্যে তাকে আসার অনুমতি কি আপনারা তাকে দেবেন?

তারেক মুজাহিদদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তাকে আসতে দাও। তার ভগ্নির সাথে শেষ মুলাকাত করে নিক।

কয়েদী মহিলাদের সীমানায় এসে আস্তে আস্তে তার বোনের দিকেঅগ্রসর হতে। লাগল। তার সাথে মুজাহিদ ছিল যাতে সিপাহ্ সালারের সামনে যেন কোন বেয়াদবী না করতে পারে। মুজাহিদদের হাতে ছোট ছোট বর্শা ছিল যা দুশমনের প্রতি নিক্ষেপ করা হতো। কয়েদীর বোন অতি দ্রুততার সাথে মুজাহিদের হাত থেকে একটি বর্শা ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত বেগে তার ভায়ের বুকে বিদ্ধ করে দেয়। বর্শা বের করে আবার দ্বিতীয় বার আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুত হলে এক মুজাহিদ তাকে বাধা দিয়ে তার হাত থেকে বর্শা কেড়ে নেয়। কিন্তু বর্শার এক আঘাতেই কয়েদী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিস্ক্রীয় হয়ে যায়।

জুলিয়ন স্পেনী ভাষায় যুবতাঁকে বলল, তুমি তোমার ভাইকে হত্যা করলে? সে হাতিয়ার অর্পন করে আত্মসপৰ্মণ করেছে এজন্যে হয়তো তাকে হত্যা করলে?

যুবতী : না, সে কারণে নয়। অনেক আগেই তাকে হত্যা করতাম কিন্তু তার কোন সুযোগ পাইনি। আপনারা যদিএর শাস্তি দিতে যান তাহলে দিতে পারেন। আপনাদের হাতে তলোয়ার রয়েছে, রয়েছে বর্শা তার মাধ্যমে আমাকে টুকরো টুকরো করতে পারেন।

যুবতীর কথা তারেককে বুঝিয়ে বলা হলো।

 তারেক : তাকে বল, আমরা তাকে কোন শাস্তি দেব না। তাকে জিজ্ঞেস কর, তার ভাইকে হত্যা করল কেন?

যুবতী : আমার ভাই ফৌজে ভর্তি হয়েছিল সে পদোন্নতি চাচ্ছিল। সে লালসায় একদিন আমাকে ধোকা দিয়ে শাহী মহলে নিয়ে এসে হেরেমের রমণীদের সাথে সাক্ষাৎ করালে রমণীরা হেরেম পরিদর্শনের কথা বলে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে। বুড়ো বাদশাহ আমাকে ক্রীড়নকে পরিণত করে। আজ দু’বছর ধরে আমি হেরেমে রয়েছি। হেরেমের রমণীদের কে আমি বার বার আমার ভাইএর সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়ার কথা বলেছি কিন্তু তারা বলেছে, হেরেমের কোন আওরত বাহিরের কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে না। তারা আমাকে বলেছিল তোমার ভাই পদমর্যাদা হাসিলের জন্যে তোমাকে হেরেমে পাঠিয়েছে।… আজ দু’বছর পর তার সাথে আমার হিসাব-নিকাশের মওকা মিলেছে।

সালার মুগীছে রূমী : যে ফৌজের মাঝে এমন ভাই থাকে তার পরিণাম এমনই হয়।

তারেক ইবনে যিয়াদ : এ যুবতীরা যদি নিজ বাড়ী যেতে চায় তাহলে কয়েদী বানিও না। এদের সকলকে তোমাদের সাথে রাখ। যেন কোন প্রকার কষ্ট না পায়। আমরা সম্মুখে অগ্রসর হব। যখন কোন লাড়কীর বাড়ী পাওয়া যাবে তখন তাকে তার আপনজনদের কাছে সোপর্দ করে আসবে।

***

দ্বিতীয়দিন তারেক ইবনে যিয়াদ তার আমীর মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে একটি পয়গাম লেখান তাতে তিনি রডারিকের সাথে যুদ্ধের পূর্ণ বিবরণ দেন। তার শেষে লেখেন,

“এখন পর্যন্ত কোন শহর বিজয় করতে পারিনি তাই বিশেষ কোন তুহফাহ্ পাঠাতে পারলাম না। ত্রিশ হাজার জঙ্গী কয়েদী রয়েছে। আমার ধারণা আমীরুল মু’মিনীন ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক এ তুহফা খুবই পছন্দ করবেন। এ কয়েদীরা সর্বদা আপনার কাছেই থাকবে কারণ তাদের বাদশাহ্ সলীল সমাধিত হয়েছে ফলে তাদেরকে পণ দিয়ে মুক্ত করার বা অন্য কোন শর্তে ছাড়াবার কেউ নেই। আমাদের কোন কয়েদী স্পেনীদের হাতে নেই যার মুকাবালায় তাদেরকে মুক্ত করতে হবে এমনও নয়। আমীরে মুহতারাম! আরেকটি তুহফা আপনার দরবারে পেশ করছি তাহলে স্পেন বাদশাহ্র মাহবুব (প্রিয়) ঘোড়া “ইলয়া” আর তার সুসজ্জিত তলোয়ার। আমি এখন সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছি, আমার কামিয়াবীর জন্যে মসজিদে মসজিদে দোয়া করাবেন।”

কয়েদী এবং বেকার ঘোড়া পাঠাবার জন্যে সমুদ্র জাহাজের প্রয়োজন ছিল। জুলিয়নের চারটি বিশাল জাহাজ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। মুসলমানদের কাছে বিকল্প আর বড় কোন জাহাজ ছিল না। ফলে কয়েদীদেরকে পাঠাবার জন্যে স্পেনীদের বড় কিশতী নেয়া হলো। কয়েদী আর বেকার ঘোড়ার সংখ্যা কম ছিল না। তিনদিন তিনরাত একাধারে পারাপারের কাজ অব্যাহত ছিল।

উত্তর আফ্রিকার বর্বর গোত্রের লোকেরা বেকারার ও পেরেশান হয়ে উঠেছিল, তারা যুদ্ধের খবরের জন্যে সমুদ্র তীরে অপেক্ষমান ছিল। পরিশেষে কয়েদীদের প্রথম কিশতী তীরে ভিড়ল। বর্বররা খবর নেয়ার জন্যে মাল্লাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কয়েদীদের সাথে বর্বর সৈন্যরা ছিল। তারা যুদ্ধের খবর তাদেরকে বললে অপেক্ষমান বর্বররা দ্রুতবেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে নিজ নিজ কবিলাতে গিয়ে পৌঁছল। যেখানে যেখানে তারেক ইবনে যিয়াদের বিজয় আর স্পেনীদের পরাজয়ের সংবাদ পৌঁছল সেথায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। নারী-পুরুষ শিশু-কিশোররা উম্মাদের ন্যায় নাচতে লাগল।

তারেকের কাছে বর্বর ফৌজ খুবই কম।”

“সম্মুখে গিয়ে কোথাও আবার শক্রর হাতে আটকা না পড়ে।”

“তারেক ইবনে যিয়াদের সাহায্যের জন্যে প্রস্তুত হও।”

 এ ধরনের নানা কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। এর ফলশ্রুতিতে বর্বররা কিসতী জোগাড় করে জোয়ান-নওজোয়ান, মাঝবয়সী বর্বর মুসলমানরা তারেক ইবনে যিয়াদের মদদের জন্যে সমুদ্র পাড়ে গিয়ে একত্রিত হয়ে স্পেনে পৌঁছতে লাগল।

এদিকে হিজি একটা নৌকা থেকে নেমে জুলিয়নের মহলের দিকে দ্রুত বেগে ছুটে চলল। এ হলো সেই হিজি যে রডারিকের মাথা কেটে এনে জুলিয়নের বেটী ফ্লোরিডার পায়ের কাছে রাখার ওয়াদা করেছিল। হিজি যখন সিওয়াস্তাতে পৌঁছল তখন পর্যন্ত সেখানে স্পেনের যুদ্ধের কোন খবর পৌঁছেনি। সে যখন নৌকা থেকে নেমে ছুটতে লাগল তখন তার পিছু পিছু তিন-চারজন বর্বর ছুটতে লাগল।

তুমি কি স্পেন থেকে এসেছ? দৌড়াতে দৌড়াতে হিজি এক বর্বরের আওয়াজ শুনতে পেল।

না দাঁড়িয়েই হিজি জবাব দিল। যা, আমি জানি তুমি কি জানতে চাচ্ছ… বর্বররা বিজয় অর্জন করেছে।

বর্বর : একটু দাঁড়াও ভাই! ভালভাবে বলে যাও!

হিজি দ্রুত চলতে চলতে সংক্ষেপে যুদ্ধের ঘটনা, রডারিকের মৃত্যু ও তার ফৌজ হালাকীর খবর শুনিয়ে দিল।

হিজি : কায়রোতে যাও সেখানে স্পেনের হাজার হাজার কয়েদীকে অবতরণ করান হবে।

বর্বর মুসলমানরা বিজয়ের খুশী প্রকাশ করে ধ্বনী দিতে দিতে ফিরে গেল। আর হিজি মহলের দিকে গ্রুত বেগে হেঁটে চলল। মহল ছিল কেল্লার ভেতর আর তা ছিল নিকটেই। ফ্লোরিডা কেল্লার প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে নিষ্পলক * চেয়ে ছিল। সে প্রতিদিন এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ কয়েকবার প্রাচীরে দাঁড়িয়ে সাগর বক্ষে নির্নিমিষ দৃষ্টে চেয়ে থাকত। কোন কিশতী দেখলে অপলক নেত্রে তা প্রত্যক্ষ করত, কিন্তী চলে গেলে তার চেহারায় নৈরাশ্যতার ছাপ ফুটে উঠত। এভাবে সে দিনের পর দিন প্রহর গুনছিল। পরিশেষে সে যার প্রতীক্ষায় ছিল তাকে দেখতে পেল। সে দূর থেকেই দেখতে পেল কিশতী হতে যে অবতরণ করল সে হিজি।

ফ্লোরিডা কেল্লার প্রাচীর হতে দৌড়ে নামল। হিজি মহলের সদর দরজার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। দিনের বেলা, তাই দরজা খোলা। হিজি কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করল। তাকে সকলেই চিনত একারণে কেউ বাধা দিল না। মহলের যেখানে ফুল বাগান, উঁচু গাছ-পালা ও পত্র-পল্লবে ঘেরা সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। বহিরাগত কারো সেখানে যাবার অনুমতি ছিল না। অনেক বড় বিস্ময়কর খবর নিয়ে এসেছিল তাই হিজি বড় পেরেশান ছিল। ফলে সে কোন কানুনের পরওয়া করেনি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সে একটু ঝিরিয়ে নিচ্ছিল।

হিজি : হিজি পশ্চাতে মেয়েলি কণ্ঠ ও পদধ্বনি শুনতে পেল। পিছনে ফিরতে ফ্লোরিডা তীব্র আবেগে তাকে বুঝে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ পরেই ফ্লোরিডা হিজিকে ছেড়ে দিয়ে হালকা ধাক্কা মেরে পিছু হটে গেল। তার চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ ভেসে উঠল।

ফ্লোরিডা : তুমি রিক্ত হাতে এসেছ, তোমার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ কর, রডারিকের মাথা কোথায়?

হিজি ফ্লোরিডার কথা শুনে মৃদু হাসল।

ফ্লোরিডা হিজির কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকি দিয়ে বলল হিজি! বল, মুসলমানরা রডারিকের কাছে পরাজিত হয়েছে আর তুমি সেখান থেকে পালিয়ে এসেছ? আমার বাবা কি গ্রেফতার হয়েছে না নিহত হয়েছে?

হিজি: না ফ্লোরা! গভর্নর জীবিত রয়েছেন, রডারিক নিহত হয়েছে।

 তার মাথা কেন নিয়ে আসনি?

হিজি : সে সলিল সমাহিত হয়েছে। মাটি থেকে শাহী পাদুকা তুলে ফ্লোরিডার দিকে তুলে ধরে বলল, তার এ জুতা হস্তগত হয়েছে। তার সফেদ ঘোড়া দরিয়ার কিনরায় দাঁড়িয়ে ছিল। ঘোড়ার কাছে পড়েছিল তার এ পাদুকা ও তলোয়ার। এ জিনিস আমার হাতে এমনিতেই আসেনি। আমি তলোয়ার নিয়ে রডারিকের ফৌজের মাঝে প্রবেশ করেছিলাম। রডারিকের পতাকা দেখতে না পেয়ে সমুদ্র পাড় পর্যন্ত পৌঁছে ছিলাম। রডারিকের ফৌজ মুসলমানদের হাতে নিহত হচ্ছিল। আমি রডারিকের সফেদ ঘোড়া দেখতে পেলাম কিন্তু তাতে রডারিক সোয়ার ছিল না। তার পাদুকা ও তলোয়ার উঠিয়ে তার ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে সিপাহসালার তারেক ইবনে যিয়াদের কাছে গিয়ে খবর দিলাম রডারিক সলিল সমাহিত হয়েছে। ঘোড়া ও মুক্তা খচিত তলোয়ার তারেক তার কাছে রেখে দিলেন। পাদুকা আমার কাছে রাখার জন্যে আবেদন করলাম। তিনি অনুমতি দিলেন। আমি তা তোমার জন্যে। নিয়ে এসেছি। ফ্লোরিডার চেহারা চমকে উঠল। তার প্রতিশোধ পূর্ণ হলো।

***

দু’জন ঐতিহাসিক প্রফেসর দুজি এবং গিয়ানগুজ লেখেছেন, মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে তারেক ইবনে যিয়াদের পয়গাম পৌঁছলে তিনি তা তড়িঘরি করে পড়লেন। আবেগে তার চেহারা লাল হয়ে গেল। আট দিন যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তারেক ইবনে যিয়াদ দিয়েছিলেন কিন্তু মুসা ইবনে নুসাইর তাতে পূর্ণ শান্ত হলেন না,

“তুমি তোমার ভাষায় শুনাও” বার্তা বাহককে মুসা বললেন। “আট দিন যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দাও, তুমি যা নিজ চোখে দেখেছ তা বল।”

ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, মুসা ইবনে নুসাইব আবেগে উদ্বেলিত হয়ে গিয়েছিলেন। চুলে ঢুলে যুদ্ধের বর্ণনা শ্রবণ করছিলেন। বর্ণনা শ্রবণের পর খলীফার কাছে বিস্তারিত পত্র লেখেছিলেন তার শেষাংশে লেখেছিলেন,

“এ যুদ্ধ কোন সাধারণ যুদ্ধের মত ছিল না। কোন সহজ ব্যাপার ছিল না। পূর্ণ হাশরের ময়দান ছিল। আমি মৌখিক যে বর্ণনা শুনেছি তাতে আমার শরীর শিহরে উঠেছিল। আমাদে বিজয় ছিল সন্দেহজনক। বার হাজার সৈন্য এক লাখের মুকাবালায় অর্ধদিনও টিকতে পারে না। এটা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রেমে জীবন উৎসর্গকারীদের কারিশমা। আমরা তাদেরকে কেবল মুবারকবাদ জানাতে পারি, প্রতিদান তো স্বয়ং আল্লাহ পাক দেবেন।

মুসা ইবনে নুসাইর রডারিকের ঘোড়া ও তরবারী পয়গামের সাথে খলীফার দরবারে দামেস্কে পাঠিয়ে দেন। এর সাথে ত্রিশ হাজার কয়েদীও পাঠান। ইবনে মানসুর নামক এক আরব লেখক সে দৃশ্যকে এভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন,

“সে ত্রিশ হাজার সৈন্য দেখে বুঝা যাচ্ছিল যে,ইসলামের মুকাবালায় কুফর কতটা অসহায়। কয়েদী দলকে ভীতির চাদর ঢেকে নিয়ে ছিল। এতদিন তারা বাতিল আকীদা-বিশ্বাসে বন্দী ছিল। ছিল তাদের বাদশাহর গোলাম। আর এখন তারা যুদ্ধ বন্দী হয়ে হেঁটে চলেছে। তাদেরকে এ খবর তখনো দেওয়া হয়নি যে, তোমরা ঘোর হতাশা হতে বেরিয়ে আলোর পথে যাচ্ছো, বাতিল হতে হকের দিকে যাচ্ছ। তাদেরকে খবর দেওয়া হয়নি যে, ইসলামের বাদশাহ জালেম নয়, নির্যাতনকারী ও নিপীড়ক নয়। ইসলামে মুনিব-গোলাম একই মর্যাদা রাখে।

একজন ইউরোপিয়ান কবি রডারিকের পরাজয়ের বিবরণ এভাবে দিয়েছেন, “যখন রডারিকের সৈন্য পরাজিত হলো তখন সে একটা উঁচু টিলার ওপর গিয়ে পরিস্থিতি দেখতে লাগল, সে দেখতে পেল, গতকালও যে শাহী পতাকা পতপত করে উড়ছিল আজ তা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে রক্তমাখা মাটিতে পড়ে আছে। সে মুসলমানদের বিজয় ধ্বনি শুনতে পেল। তার পরাজিত-নিরাশ বিস্ফোরিত আঁখিযুগল তার জেনারেল ও ক্যাপ্টেনদেরকে তালাশ করতে লাগল। কিন্তু দেখল যারা নিহত হয়েছে তারা ছাড়া বাকীরা পলায়ন করেছে।

রডারিক আহ্! ধ্বনী উচ্চারণ করে নিজেকে সম্বোধন করে বলল, আমার ফৌজের লাশের গণনা কেউ করতে পারবে না, কে করতে পারে এত বিপুল পরিমান শব দেহের গণনা?… এত বিস্তৃত ময়দান রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। খুন দেখে তার নয়নযুগল বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল যেন কোন আহত সিপাহীর গর্দান হতে শেষ রক্ত বিন্দু প্রবাহিত হচ্ছে।

“রডারিক নিজেকে লক্ষ্য করে বলল, গতকল্য পর্যন্ত আমি স্পেনের বাদশাহ ছিলাম। আজ কিছুই নই। আলিশান কেল্লার দরজা আমার সৈন্যদেরকে দূর থেকে দেখেই খুলে যেত। এখন এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমি শান্তিভরে একটু বসতে পারি। আমার জন্যে দুনিয়ার তাবৎ দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।… হে বদনসীব! তুমি মনে করেছিলে পৃথিবীর সারা তাকৎ তোমার হাতে…। হ্যাঁ আমি হতভাগা। আজকে আমি শেষবারের মত সূর্যকে অস্তমিত হতে দেখছি। হে মৃত্যু! তুমি এত ধীর পদে আসছো কেন? আমাকে ছুঁ মেরে তুলে নিতে ভয় পাচ্ছ কেন? এসো… দূত এসো।”

***

তারেক ইবনে যিয়াদ তার সকল জেনারেলদেরকে ডাকলেন, জুলিয়ন ও আওপাস তার সাথে ছিল।

তারেক : আমরা এখানে আর বেশীক্ষণ অবস্থান করতে পারছি না। এ ময়দান থেকে যেসব স্পেনীরা পলায়ন করেছে তাদের স্থির থাকতে দেয়া যাবে না। তাদের পিছু ধাওয়া করতে হবে তাই রওনা হবার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ কর।

জুলিয়ন ও আওপাসের তত্ত্বাবধানে ফৌজ রওনা হবার প্রস্তুগ্রিহণ করছিল এরি মাঝে তারেক জানতে পারলেন বিপুল পরিমাণ বর্বর মুসলমান ফৌজে যোগদানের জন্যে এসেছে। যে সকল বর্বর গোত্রে বিজয়ের খবর পৌঁছেছে সেখান থেকেই মুসলমানরা স্পেনে পৌঁছা শুরু করেছে। তারেক ইবনে যিয়াদ তাদেরকে ফৌজে শামিল করে নেয়ার নির্দেশ দিলেন আর বললেন, তাদেরকে যেন জানিয়ে দেয়া হয়, তারা যুদ্ধের জন্যে এখানে এসেছে লুটতরাজের চিন্তা যেন কেউ না করে।

সম্মুখে সাধনা নামেএকটা কেল্লা ছিল। মুসলমানদেরকে দূর থেকে আসতে দেখে কেল্লাতে যত সৈন্য ছিল তারা সবাই পালিয়ে গেল। শহরের সাধারণ জনগও চলে যাচ্ছিল।

তারেক ইবনে যিয়াদ ঘোড় সোয়ার বাহিনীর প্রধানকে বলল, কয়েকজন সোয়ারী দ্রুত পাঠিয়ে দেয়া হোক তারা গিয়ে শহরীদেরকে যেন আশ্বস্ত করে যে, তাদের ধন-সম্পদ, ইজ্জত-আব্রুর পূর্ণ হিফাজত করা হবে।

ঘোড় সোয়ারী গিয়ে তাদেরকে যার যার বাড়ীতে ফিরিয়ে পাঠাল। আর শহরবাসীদের একটি প্রতিনিধিদল তারেক ইবনে যিয়াদের কাছে আসল। প্রতিনিধি দলের মাঝে যে সবচেয়ে বেশী বয়স্ক সে বলল, আমরা দুর্বল, কমজোর। দুর্বলদের এমন কোন অধিকার থাকে না যে তারা শক্তিশালীদের ওপর কোন শর্ত আরোপ করবে। এ অধিকার বাদশাহদের রয়েছে যে তারা সৈন্যদের শক্তি বলে দুর্বল দেশে আক্রমণ করে দখল করে নিয়ে মানুষের ঘর-বাড়ী লুটতরাজ ও রমণীদের ইজ্জত হরনের হুকুম দেবে। আপনিও এমন কিছুই করবেন। এ পল্লীতে আপনাকে কেউ বাধা দেবে এমন কেউ নেই। আমাদেরকে যাবার অনুমতি দিন। সকলের ধন-সম্পদ নিয়ে নেন। আমরা আমাদের জোয়ান লাড়কী ছাড়া সাথে কিছুই নিচ্ছি না। আপনি বস্তিতে প্রবেশ করুন, আমরা আপনাকে ইস্তেকবাল জানাব। বৃদ্ধের বক্তব্য তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হলো।

তারেক বললেন, তাদের সকলকে ভালভাবে বুঝিয়ে দাও, আমরা এমন ধর্ম নিয়ে এসেছি যা দুর্বলকে সবলের হাত থেকে রক্ষা করে। আর যাকে তাকে বাদশাহ হবার অনুমতি প্রদান করে না। আমাদের ধর্মে লুটতরাজের কোন অনুমতি নেই। কোন রমণীর ইজ্জত হরনের শাস্তি হলে তাকে প্রস্তারাঘাতে নিহত করা। তাদেরকে বলে দাও, আমরা এদেশ কবজা করতে আসিনি। এসেছি এখানের মানুষের হৃদয় জয় করতে, তবে জোরপূর্বক নয় পেয়ার ও মহব্বতের মাধ্যমে। নিজ নিজ ঘরে যাও, মূল্যবান জিনিস পত্র লুকানোর কোন প্রয়োজন নেই যার কাছে যা আছে তা তারই।

প্রতিনিধি দলকে যখন তারেক ইবনে যিয়াদের বক্তব্য বুঝিয়ে দেয়া হলো তখন তাদের চেহারায় নৈরাশ্যতা ও অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠল। তারা আর কিছু না বলে তারেকের ঘোড়ার পিছু পিছু হেঁটে চলল। তাদের পিছনে মুজাহিদ দলও অগ্রসর হলো, এভাবে সাধনা কেল্লাবন্দি পল্লী কোন প্রকার হতাহত ছাড়াই হাতে এসে গেল।

শহরের কার্যাবলী সম্পাদনের জন্যে প্রধান কর্মকর্তা মুসলমান আর বাকীরা গোথা ও খ্রীষ্টান নিয়োগ করলেন। শহরবাসীদের প্রতি কেউ চোখ তুলে তাকাল না। ফলে শহরের সকলের মন হতে সন্দেহ ও আশংকা দূরীভূত হলো।

সমুখে কারমুনা নামেএকটি ছোট শহর রয়েছে। আট দশ দিন তারেক এ শহরেই অতিবাহিত করলেন। ইতোমধ্যে উত্তর আফ্রিকা থেকে বর্বর গোত্রের মুসলমানরা আসতে লাগল। কোন কোন ঐতিহাসিক তাদের সংখ্যা বার হাজার আবার কেউ পঞ্চাশ হাজার বর্ণনা করেছেন, তবে তাদের সংখ্যা বিশ-পঁচিশ হাজারের মাঝে ছিল। শৃংখলাবদ্ধভাবে যুদ্ধ করার কৌশল তাদেরকে শিখিয়ে দেয়ার জন্যে তারেক তার জেনারেলদের নির্দেশ দিলেন।

তারেক যখন তার ফৌজ নিয়ে কারমুনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন শহরের দু’জন বয়স্ক ভদ্রলোক এলো। তাদের মাঝ থেকে একজন বলল,

প্রথম দিন আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আপনি বাস্তব প্রমাণ করেছেন, আপনার ধর্ম মানুষকে মানুষের মর্যাদা দান করে আর সাধারণ জনগণকে নির্যাতনের অনুমতি দেয় না। এ বস্তির আবাল-বৃদ্ধ সকলেই আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমরা আপনার অনুগ্রহের প্রতিদান হিসেবে সম্মুখের বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া কর্তব্য মনে করি।…

এ পল্লী যত সহজে আপনার হাতে এসেছে সামনে আর কোন শহর এত সহজে আপনার করতলগত হবে না। এখান থেকে যে সব ফৌজ পলায়ন করেছে তারা আপনাদের ভয়ে পলায়ন করেনি। তাদের কমান্ডার প্রথমে শহরবাসীকে বলেছিল তারাও যেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং কেল্লা যেন মুসলমানরা জয় করতে নাপারে। আমরা দু’জন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমরা বলেছিলাম ফৌজ সংখ্যা অল্প আর শহরবাসী যুদ্ধে অভিজ্ঞ নয়।

একজন ফৌজি অফিসার বলেছিল, এখানে যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়ারই দরকার নেই। বরং এ শহর আক্রমণকারীদের ছেড়ে দিয়ে আমরা সম্মুখে গিয়ে সকলে একত্রিত হয়ে শক্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। রডারিকের বোকামী ও গোথাদের গাদ্দারীর দরুন আমাদের পরাজয় হয়েছে। পরিশেষে সকলেই তার কথা মত একমত হলো যে, মুসলমানদেরকে আসতে দেখলেই তারা পালিয়ে যাবে এবং সম্মুখে গিয়ে সম্মিলিত ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

 তারেক : তোমাদের ফৌজরা কি ভয় পায়নি?

শহরবাসী; যারা রডারিকের সাথে যুদ্ধে শরীক হয়ে পালিয়ে এসেছে তারা অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। কিন্তু কেল্লার অন্যান্য ফৌজরা ও শহরবাসীরা তাদেরকে এত পরিমাণ ভর্ৎসনা দিয়েছে যে, তারাও প্রতিশোধের জন্যে প্রস্তুত হয়েছে। তাদের অন্তরে এখন ভয় নেই। আছে প্রতিশোধ স্পৃহা। আমরা আপনাকে সতর্ক করার জন্যে এসেছি যে, সম্মুখে মুকাবালা খুব কঠিন হবে।

***

তারেক ইবনে যিয়াদ কারমুনা পৌঁছে কেল্লা অবরোধ করার পর বুঝতে পারলেন, সহজে এ কেলা কজা করা যাবে না। অবরোধ দীর্ঘ হবে। প্রাচীরের ওপর তীরন্দাজ ও বর্শা নিক্ষেপকারীরা প্রস্তুত হয়েছিল। তারেক দেয়ালের চতুর্দিক ঘুরে ফিরে দেখলেন কোথাও তা ভাঙ্গার ব্যবস্থা আছে কিনা কিন্তু দেয়াল ছিল অত্যন্ত মজবুত। দরজা খোলার চেষ্টা করা হলে ওপর থেকে তীর ও বর্শার আঘাতে কয়েকজন মুসলমান আহত ও কয়েকজন শহীদ হয়ে গেল। চার-পাঁচ দিন এভাবে চেষ্টা করা হলো কিন্তু ওপর থেকে অবিরাম তীর-বর্শা বৃষ্টি নিক্ষেপ হবার সাথে সাথে ধিক্কার আসতে লাগল,

“এটা সাধনা নয়! বর্বররা! এটা হলো কারমুনা।

“অসভ্যরা আমাদের হাতে কেন মরার জন্যে এসেছ? বাঁচতে চাইলে ফিরে যাও।”

“ডাকাত-দস্যুর দল! কিছু সোনা-চান্দী নিক্ষেপ করছি তা নিয়ে চলে যাও।”

হে হতভাগারা! পরাজিত রডারিক নিহত হয়েছে। কিন্তু আমরা জীবিত রয়েছি।

অবরোধ বেশ দীর্ঘ হয়েছিল। কোন ঐতিহাসিক এক মাস আর কেউ দু’মাসের কথা উল্লেখ করেছেন।

এক রাতে অবরোধ তুলে নেয়া হলো। প্রাচীরের ওপর স্পেন ফৌজরা নৃত্য করতে লাগল। শহরবাসীও প্রাচীরের ওপর একত্রিত হলো। মশালের আলোতে রাত দিনে পরিণত হলো। সারা শহরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।

অর্ধ রাত্র পর শহরবাসী প্রাচীর হতে নেমে নিজ নিজ বাড়ীতে চলে গেল। দীর্ঘ দিনের অবরোধে ক্লান্ত সিপাহীরাও ঘুমিয়ে পড়ল। প্রাচীরের বুরুজে ও দরজার সম্মুখে কয়েকজন পাহারাদার জেগে রইল। দু’শ, আড়াইশ ব্যক্তি দরজার সম্মুখে এসে স্পেনী ভাষায় পাহারাদারদেরকে ডাকতে লাগল।

এক বুরুজ হতে পাহারাদারদের কমান্ডার জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা?” বাহির থেকে আওয়াজ দেয়া হলো, “আমি সিওয়াস্তার গভর্নর জুলিয়ন। মশাল নিয়ে এসে আমাকে বাঁচাও।”

গভর্নর জুলিয়ন সম্পর্কে তাদের জানা ছিল এবং ইতোপূর্বে তারা এনাম শুনেছে।

কামান্ডার : তুমি কোথা কেথে এলে?

জুলিয়ন : দরজা খুলে আমাকে রক্ষা কর। সাথে যারা রয়েছে তারা আমার রক্ষীবাহিনী। প্রায় সাত-আটশ সিপাহী হালাক হয়ে গেছে। আমরা রডারিকের সাথে প্রধান যুদ্ধে শরীক ছিলাম এবং কোন মতে জানে বেঁচে পালিয়ে এখানে এসেছি। কেল্লা অবরোধ ছিল একারণে আমরা লুকিয়ে ছিলাম। আজ অবরোধ উঠতেই আমরা তোমাদের কাছে এসেছি। আমি আহত। আমার সৈন্যদের মাঝেও বিশ পঁচিশজন আহত। আমরা বড় ক্লান্ত-শ্রান্ত। ক্ষুধা-তুষ্টে আমাদের জীবন উষ্ঠাগত। তাড়াতাড়ি দরজা খোল।”

জুলিয়নের পোষাক-আশাক ও তার চেহারার অবস্থা সাক্ষী দিচ্ছিল যে অনেক মুসীবত ভোগ করেছে। তার সাথে যে দু’শ আড়াইশ ফৌজ ছিল তারে অবস্থাও চিল অত্যন্ত করুণ।

ওপর থেকে একাধিক মশালের আলোতে দেখা হলো, প্রকৃত অর্থেই সে জুলিয়ন।

অধরাত্রের পরের সময়। কেল্লার জিম্মাদারকে জাগানোর প্রয়োজন না মনে করে দরজা খুলে দেয়া হলো।

দু’শ আড়াইশ ফৌজসহ জুলিয়ন ভেতরে প্রবেশ করে সৈন্যদের ইশারা করতেই তারা পাহারাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সকল দরজা খুলে দেয়া হলো। কেল্লার ফৌজ অবরোধ উঠে যাবার আনন্দে শরাব পান করে বিভোর ঘুমাচ্ছিল! মুসলমান অবরোধ তুলে নিয়ে বেশী দূরে যায়নি। তারা জুলিয়নের ইশারার অপেক্ষায় অদূরেই কোথাও লুকিয়ে ছিল। রাতের চাদর তাদেরকে ঢেকে নিয়ে ছিল।

এটা ছিল জুলিয়নের কৌশল যা সে তারেকের সাথে পরামর্শ করে তৈরী করে ছিল।

ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, জুরিয়নের সাথে যে দু’শ আড়াইশ ফৌজ ছিল তারা সকলে ছিল ইউনানী ও জুলিয়নের নিজস্ব ফৌজ। কিন্তু অন্য ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, তারা সকলেই ছিল মুসলমান। তারা তাদের লেবাস পরিবর্তন করে নিয়ে ছিল। এটাই সঠিক বলে মনে হয় কারণ জুলিয়নের সাথে তার নিজস্ব ফৌজ ছিল না।

পাহারাদারদেরকে হত্যা করে দরজা খুলে মশাল হাতে নিজে জুলিয়ন প্রাচীরের ওপর গেল। মশাল উঁচু করে ডানে-বামে ঘুরাতে লাগল। তারেক ইবনে যিয়াদ এরই অপেক্ষায় ছিলেন। তার ফৌজ পূর্ব হতেই প্রস্তুত ছিল। তারেক ঘোড়া দৌড়ানোর সাথে সাথে তার ফৌজরা প্লাবনের ন্যায় কেল্লার দিকে ছুটে চলল এবং খোলা দ্বার দিয়ে সোজা কেল্লার ভেতর চলে গেল। কেল্লাভ্যন্তরে হৈ-হুঁল্লোড় শুরু। হয়ে গেল। কেল্লার ফৌজ জাগ্রত হয়ে দেখতে পেল তারা কয়েদী।

মুজাহিদদের ফৌজ কেল্লায় প্রবেশ করার পর কেল্লার কিছু ফৌজ ও অফিসার পলায়ন করার সুযোগ পেয়েছিল। বিশ-পঁচিশ মাইল সামনে একটা কেল্লা বন্দী শহর ছিল এবং ঐ শহর ছিল খ্রিস্টানদের ধর্মের কেন্দ্র। সেখানে ছিল একটা বড় গির্জা তার সাথেই ছিল পাঠশালা। এছাড়াও সেখানে আরো বেশ কয়েকটা ছোটগির্জা ও খানকা ছিল।

এটা সে সময়ের কথা যখন পাদ্রীরা আদর্শচ্যুত হয়ে শাহানশাহী জীবন যাপন করছিল এবং ধর্মের মাঝে নিজেদের পক্ষ হতে কমবেশ করছিল। ধর্মের ব্যাপারে তারা চরমভাবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল। তাদেরকে বাধা দেয়ার ব্যাপারে স্বয়ং বাদশাহও সাহস করতেন না। তারা সাধারণ জনগণের কাছে নিজেদেরকে বাহ্যত ভাবে পূত-পবিত্র প্রমাণিত করে রেখেছিল। তারা জনগণকে অধীনতার রশীতে। এমনভাবে বেঁধে রেখেছিল যেভাবে এখন বর্তমানে পাকিস্তানে ভন্ডপীররা তাদের মুরীদদের রেখেছে। স্বয়ং খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, পাদ্রীরা গির্জা ও খানকার মত ইবাদত খানাকে তারা ভোগ-বিলাসের কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। সেথায় গোত্রপ্রীতি ও শরাব পানের আড্ডা খানা ছিল। তারপরও সে শহরকে পবিত্র স্থান মনে করা হতো।

***

তারেক ইবনে যিয়াদের এখন লক্ষ্য সম্মুখস্থ শহর ইসাজা। জুলিয়ন ও আওপাস তাকে আগেই জানিয়ে দিয়ে ছিলেন, ইসাজা খ্রিস্টানদের অত্যন্ত পবিত্র নগরী ফলে তা সহজে হস্তগত করা যাবে না। শহরের নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ সকলে জান প্রাণ দিয়ে লড়াই করবে।

জুলিয়ন তারেককে মৌখিকভাবে যা বলছিল তা কার্যতঃ ইসাজা শহরে হচ্ছিল। রডারিকের সাথে যুদ্ধে যেসব সৈন্য পালিয়ে এসে সাধনা ও কারমুনাতে আশ্রয় নিয়েছিল। এ দু কেল্লা মুসলমানরা দখল করার পর তারা পলায়ন করে ইসাজায় পৌঁছে ছিল। সে শহরে খবর পৌঁছে ছিল মুসলমানরা একেরপর এক বিজয়ার্জন করে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে। মানুষের মাঝে ভয় সৃষ্টি হয়েছিল ঠিক কিন্তু যুদ্ধের স্পৃহাও পয়দা হয়েছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল তাদের মুলকে কোন রাজা বাদশাহর ফৌজ হামলা করেনি বরং এমন ধর্মের দস্যু দল হামলা করেছে যারা খ্রীস্টান ধর্মের মত সত্য ধর্মকে খতম করে দিবে। পিছনের শহরের ফৌজরা যখন পলায়ন করে ইসাজাতে পৌঁছতে ছিল তখন সেথাকার লোকরা তাদেরকে ভর্ৎসনাবানে বিদ্ধ করছিল, তাদের তিরস্কারের ভাষা ছিল এরূপ :

“এসব বুজদিলদেরকে শহর থেকে বের করে দাও।”

“বেহায়া ও নির্লজ্জের দল! সাধনা ও কারমুনার বেটীদেরকে দুশমনের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে।”

“আমাদের বেটীদেরকে আমরা নিজেরাই হেফাজত করব। এ বুজদিলদেরকে জীবিত রেখে কোন লাভ নেই।”

 “তাদের পুরুষের পোশাক খুলে রমনীদের কাপড় পরিয়ে দাও।”

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নারীরা বলছিল, ইসাজার নারীরা লড়াই করবে, এসব নালায়েকদেরকে কেউ এক ঢোঁক পানি দেবে না। তারা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ধুকে ধুকে মরুক। তাদেরকে প্রস্তারাঘাতে নিহত কর।

এ ধরনের হাজারো অভিসম্পাদ তীরের ন্যায় তাদের প্রতি নিক্ষেপ হচ্ছিল। তারা এখানে আশ্রয় তালাশ করতে এসেছিল কিন্তু তাদের জন্যে ছিল না কোন আশ্রয়। সেখানে যারা ফৌজ ছিল তারাও তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করছিল না, যত যায় হোক তারা যেহেতু ফৌজ ছিল তাদের দ্বারা যুদ্ধ করাতে হবে তাই তাদের জন্যে খানা-পিনার ব্যবস্থা করা হলো। সেখানকার অফিসার আক্রমণকারীদের ব্যাপারে জানতে চাইল।

 কিন্তু সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারল না। দু’একজন মুখ খুলে কেবল এ কথা বলল, কিছুই বুঝে এলো না মাত্ৰকয়েক হাজার লোক এক লাখের চেয়ে বেশী ফৌজকে কিভাবে খতম করে ফেলল। শাহান শাহ্ রডারিকও তাদের চাল না বুঝতে পেরে মারা গেল।

সন্ধ্যার পর বড় পাত্রী সাধারণ সভা আহ্বান করল। তাতে পালিয়ে আসা ও শহরী ফৌজ, সকলকে আহ্বান করা হলো। ক্রমে শহরের জন সাধারণ ও ফৌজরা সভাস্থলে সমবেত হলো। পাদ্রী প্রথমে ওয়াজের ভংগিতে বক্তব্য শুরু করল, তাতে মানুষের মাঝে খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি মহব্বত-ভালবাসা শত গুণ বেড়ে গেল। তারপর সে তার আসল কথায় এলো,

… এ হামলা তোমাদের মুলকের ওপর নয় বরং এ হামলা তোমাদের ধর্মের ওপর। এ আক্রমণ তোমাদের মান-সম্মান ও ইজ্জতের ওপর। এ শহরের পবিত্রতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে তোমরা ভাল করেই জ্ঞাত। তোমা যদি এ শহর দুশমনের হাতে তুলে দাও তাহলে মনে করবে তোমরা কুমারী মরিয়মকে দুশমনের কাছে অর্পণ করলে। যেন তোমরা ক্রস দুশমনের পদতলে নিক্ষেপ করলে। ঈসা মসীর রাজত্ব চিরতরে মুলোৎপাটন করলে। আর তোমাদের যুবতী মেয়েদেরকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের হাতে তুলে দিলে। হামলাকারীরা দস্যু-ডাকাত, ইজ্জতহরণকারী, তারা তোমাদের বেটীদের সাথে তোমাদেরকেও নিয়ে যাবে। গোলামের মত তোমাদেরকে ধনীদের কাছে বিক্রি করবে। তোমাদের গির্জা-ইবাদত খানা ও খানকাকে তারা আস্তাবলে পরিণত করবে। বল, তোমরা কি এমনটি চাও?

“না ফাদার না! আমরা এ শহরের জন্যে জীবন বিলিয়ে দেব।” সমবেত জনসাধারণ জবাব দিল।

পাদ্রী : এখন আমি ফৌজদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলল,এরা যুদ্ধ ময়দান হতে পালিয়ে এসেছে। তোমরা তাদের বহু তিরস্কার করেছ, তারাও লজ্জিত হয়েছে। লড়াইয়ের ময়দান থেকে পলায়ন করা পাপ কাজ। এখন যদি তারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে দুশমনকে পরাজিত করে, তাহলে তাদের পূর্বের পাপ মোচন হয়ে যাবে, আর যে এ শহর রক্ষার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে সে স্বর্গে প্রবেশ করবে।

ফৌজদের মাঝে যুদ্ধ-স্পৃহা ফিরিয়ে আনার জন্যে পাদ্রী অত্যন্ত জোরাল বক্তৃতা পেশ করল। শ্রোতারা তাকবীর ধ্বনী দিয়ে তার বক্তব্যকে স্বাগত জানাল এবং আমজনতা ও ফৌজ সকলেই জীবন বাজী রেখে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হলো।

তারপর পাত্রী ঐ সকল রমণীদের ঘরে গেল যারা নিজেদের জীবন-যৌবন ধর্মের জন্যে ওয়াকফ করে ছিল। ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, তারা এত সুন্দরী ছিল যে তাদের সৌন্দর্যের চর্চা দূর দূরান্ত পর্যন্ত হতো। তারা সকলে চির কুমারী ছিল। তাদের সাথে পাদ্রীরা থাকত। তারা সারা জীবন বিবাহ-শাদীতে আবদ্ধ হতো না।

 বড় পাদ্রী সকল নারীকে হলে একত্রিত করে সাধারণ জলসায় যে বক্তব্য রেখেছিল সে বক্তব্যই নারীদেরকে শুনান। মুসলমানদেরকে দস্যু-ডাকাত, হামলাকারী ও জঙ্গলি জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করল।

পাদ্রী : তোমাদের মত সুন্দরী যুবতীদেরকে মখমল ও রেশমে জড়িয়ে রাখবে না। হয়তো জানে মেরে ফেলবে বা আধমরা করে সাথে নিয়ে গিয়ে অমানবিক আচরণ করবে। আমাদের এ শহরের কোন আশংকা নেই। আমাদের আশংকা তোমাদের ব্যাপারে। তোমরা যদি তাদের হাতে চলে যাও তাহলে পরিণাম খুবই খারাপ হবে।

এক যুবতী বলল, তাহলে আমরা কি কর্ডোভা বা টলেডো চলে যাব ফাদার?

পাদ্রী : না, তোমাদের জন্যে কোন জায়গা নিরাপদ নয়। তবে একটা তরীকা রয়েছে যদ্বারা এ বিপদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে বা বিপদ হালকা হবে তার জন্যে প্রয়োজন চার-পাঁচ সাহসী লাড়কী।

একজন যুবতী জিজ্ঞেস করল, কি কাজ করতে হবে?

পাদ্রী : মুসলমানদের সবচেয়ে বড় কমান্ডার যার নাম তারেক। তাকে হত্যা করতে হবে এবং তার সাথে যে দু’তিনজন বড় জেনারেল রয়েছে তাদেরকেও।

সকলকে নিরবতা ছেয়ে নিল। যেন হলে কেউ নেই।

পাদ্রী : কাজ তেমন কঠিন নয়। তারা আসছে, এসেই এ শহর দখল করে তোমাদেরকে তাদের সাথে রাখা শুরু করবে। তোমরা ভাল করে জেনে নাও, তোমরা একজন তাদের একজনের কাছে থাকবে এমনটি আদৌ হবে না। তোমাদের অবস্থা তো এমন হবে যেমন একটা বকরী নেঘড়ে বাঘের পালের মাঝে পড়লে যেমন হয়। এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার পূর্বেই তোমরা তাদেরকে রাস্তার মাঝে কেন হত্যা করবে না? তোমাদের মাঝে একজন যুবতীও কি এমন নেই?

মুসলমানদের ফৌজ কারমুনা থেকে রওনা হয়ে রাস্তার মাঝে এক জায়গায় তাবু ফেলবে। যারা যেতে চাও তাদেরকে সেথায় পৌঁছে দেয়া হবে। তারা সেখানে। গিয়ে বলবে আমরা তারেক ইবনে যিয়াদের কাছে যেতে চাই, তাদেরকে কেউ বাধা দেবে না। প্রত্যেক লাড়কীর কাপড়ের মাঝে খঞ্জর লুক্কায়িত থাকবে। তারেক ইবনে যিয়াদ একজন যুবতাঁকে নিজের তাবুতে রাখবে আর বাকীদেরকে তার জেনারেলরা। নিয়ে যাবে।

তারপর তোমরা তো নিজেরাই বুঝো খঞ্জর কিভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ কাজের জন্যে পাঁচ-ছয়জন লাড়কীর প্রয়োজন… কে কে তৈরী আছো?

রমণীরা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ী করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণপর একজন উঠে দাঁড়াল, তার পর আরেক যুবতী উঠল। তারা দুজন এ বিপদ জনক মিশনে যাবার জন্যে তৈরী বলে জানাল। তাদের দু’জনের পীড়াপিড়ীতে আরেকজন রাজি হলো।

পাদ্রী : তিনজনই যথেষ্ট, তোমরা আমার সাথে এসো।

পাদ্রী তাদেরকে কেল্লার যিম্মাদারের কাছে নিয়ে গেল, যিম্মাদার একজন অভিজ্ঞ জেনারেল ছিল। সে রমণীদেরকে কোন্ মিশনে পাঠান হবে এবং তারা সে কাজ কিভাবে সম্পাদন করবে তা ভাল করে বুঝিয়ে দেবে।

***

ফৌজের সাথে তারেক ইবনে যিয়াদ কারমুনা হতে ইসাজার দিকে রওনা হলেন। পঁচিশ-ত্রিশ মাইল রাস্তা মুসলমানরা একদিনে অতিক্রম করত। মুসলমানদের দ্রুত পায়দল চলার কথা তৎকালে মাশহুর ছিল। পৃথিবীর যেখানেই তারা যুদ্ধ করেছে পায়ে হেঁটে সেখানে তারা দুশমনকে বিস্মিত করে দিয়েছে। সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী ও সুলতান মাহমুদ গজনবীর পায়দল অগ্রসরতাকে ইউরোপের ঐতিহাসিকরা প্রাণ খুলে মোবারকবাদ জানিয়েছেন। তারেক ইবনে যিয়াদ তার সৈন্যবাহিনীকে একদিনে পঁচিশ-ত্রিশ মাইল অতিক্রম করাতেন কিন্তু ইসাজাতে পৌঁছেই যেহেতু শহর অবরোধ করে অতিদ্রুত শহর কজা করতে হবে তাই সৈন্যদের একরাত আরামের বড় প্রয়োজন ছিল ফলে তিনি পথিমাঝে তাবু স্থাপন করেছিলেন।

তাবু স্থাপন করা হয়েছে। রাতের আঁধার গাঢ় হয়ে আসছে। তারেক তার তাবুতে। এরি মাঝে সংবাদ দেয়া হলো এক স্পেনী বৃদ্ধ তার সাথে তিনজন যুবতী লাড়ীকও রয়েছে তারা সিপাহ্ সালারের সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়।

তারেক তাদের সকলকে ভেতরে আহ্বান করে দারোয়ানকে নির্দেশ দিলেন দু’ভাষী পাঠানোর জন্যে।

দারোয়ান বেরিয়ে গেলে তারেক রমণীদের দিকে নজর তুলে তাকালেন। তারপর তার চেহারাতে এমন ছাপ ফুটে উঠল যেন তিনি ইতিপূর্বে এত সুন্দরী লাড়কী আর কোনদিন দেখেননি। রমণীরা গভীরভাবে তারেককে দেখছিল আর মুচকি হাসছিল।

দুভাষী আসলে তারেক ইবনে যিয়াদ তাকে বললেন, এদেরকে জিজ্ঞেস কর, তারা এখানে কেন এসেছে?

বৃদ্ধ কারণ বর্ণনা করার পর রমণীরাও একে একে কিছু বলল।

দুভাষী তারেক ইবনে যিয়াদকে লক্ষ্য করে বললেন,এরা ইসাজা হতে কারমুনা যাচ্ছিল। এ মেয়েদের মাঝে একজন হলো ফুফু আর দু’জন তার ভাতিজী। তাদেরকে বলা হয়েছে, কারমুনাতে শান্তি ফিরে এসেছে এখন ইসাজার ওপর হামলা হবে। হামলাকারীরা মেয়েদেরকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে হত্যা করবে। এ ভয়ে তারা কারমুনা যাচ্ছিল।

তারেক; তারা আমার কাছে এসেছে কেন?

দুভাষী :বৃদ্ধ বলছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা তাদেরকে আপনার দরবারে নিয়ে এসেছে। তারা ফৌজদের কাছে খানা-পানি চায়তে পারত কিন্তু তারা লাড়কীদের উত্ত্যক্ত করবে এ কারণে তারা আপনার দরবারে আসাটা ভাল মনে করেছে। আর এ রমণীরা আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে ও প্রশংসা করছে।

তারেক দারোয়ানকে ডেকে বললেন, “এদের চারজনের জন্যে তাবু তৈরী কর, বিছানা বিছাও, খানা তৈরী কর।”

দুভাষীকে লক্ষ্য করে বললেন, এদেরকে তাবুতে নিয়ে যাও আর বলে দাও, রমণীরা এখানে পূর্ণ হেফাজতে থাকবে।

দারোয়ান ও দুভাষী তাদেরকে তারেকের খিমা হতে বাহিরে নিয়ে গেল, কিন্তু এক জন মেয়ে পুনরায় তারেকের খিমাতে ফিরে এসে একেবারে তারেকের কাছে বসে পড়ল। সে ইশারাতে তারেককে বলছিল সে আজরাত এ খিমাতে কাটাবে। তারেক দুভাষীকে ডেকে মেয়েটি কি বলতে চায় তা জিজ্ঞেস করার জন্যে বলল, দুভাষী জিজ্ঞেস করলে সে তারেকের খিমাতে কিছু সময় অতিবাহিত করতে চায় বলে জানাল।

তারেকঃ তাকে বুঝিয়ে বল, আমরা এমন ধর্মের অনুসারী যা কোন বেগানা রমণীর সাথে একাকী থাকার অনুমতি প্রদান করে না। তাকে বুঝানোর চেষ্টা কর আমি কেবল এ ফৌজের সিপাহ্ সালার নই বরং এদের ইমামও বটে। ফলে আমি এমন কোন কর্ম করতে পারি না যদ্বরুণ অন্যরা সুযোগ পায় ভুল পথে চলার।

মেয়েটি আশ্চর্য হয়ে তারেকের মুখপানে চেয়ে রইল। সে তারেকের সাথে অনেক কথা বলতে চায়, কিন্তু সে তারেকের জবান বুঝেনা আর তারেকও বুঝেনা তার জবান। তবে সে এতটুকু তো অবশ্যই বুঝে যে পাপের কোন ভাষা নেই। তিনি মাঝখানে আরেকজনকে তরজমাকারীর জন্যে কেন দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।

 দুভাষী এ কথা মেয়েটিকে বুঝাবার চেষ্টা করল যে, সিপাহসালার তার উপস্থিতি একেবারে পছন্দ করছেন না। কিন্তু মেয়েটি তার মতে অটল।

তারেক রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, তাকে বল, সে যেন এখান থেকে বেরিয়ে যায় ভানাহলে তাদের সকলকেই এ এলাকা হতে বের করে দেয়া হবে।

তরজুমান মেয়েটিকে বলল, সিপাহ সালার অত্যন্ত গোস্বান্বিত। এখান থেকে চলে যাও, না হলে সকলকে বের করে দেয়া হবে।

মেয়েটি আরো বেশী আশ্চর্য হয়ে তারেক ইবনে যিয়াদের মুখ পানে চাইল। সে ধীরে ধীরে তারেকের দিকে অগ্রসর হলো। একেবারে তারেকের কাছে গিয়ে সে তার ফ্রোকের তলদেশ হতে একটা খঞ্জর বের করে তারেকের পদতলে খঞ্জর রেখে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারেক কিছুটা বিস্মিত হয়ে দুভাষীর দিকে তাকালেন।.দুভাষী মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কি?

মেয়েটি : আমি যা শুনেছিলাম তা ভুল প্রমাণিত হলো। আজ আমি সর্ব প্রথম এমন ব্যক্তি দেখলাম যে আমার মত সুন্দরী যুবতী ললনাকে ফিরিয়ে দিল। আমি সিপাহসালারকে হত্যা করতে এসেছিলাম। আমার সাথে যে দু’জন লাড়কী এসেছে। তারাও একই উদ্দেশ্যে এসেছে আর ঐ বৃদ্ধ ব্যক্তি যে আমাদের সাথে এসেছে, সে আমাদের কোন আত্মীয় নয়। তাকে আমাদের বড় পাত্রী ও কেল্লাদার পাঠিয়েছে। তারা আমাদেরকে বলেছিল, তোমরা এভাবে মুসলমানদের প্রধান সেনাপতির কাছে পৌঁছবে। তারপর সে তোমাদের সৌন্দর্য মাধুরী ও যৌবন সুরা দেখে খাছ কামরাতে তোমাদেরকে স্থান দেবে, আর তোমরা সুযোগ বুঝে, তার বুকে খঞ্জর বসিয়ে দেবে, তারপর মুখ চেপে ধরে গর্দান কেটে ফেলবে। অতঃপর কামরা হতে চুপিসারে নিরাপদে বেরিয়ে আসবে। এমনিভাবে বাকী দু’জন মেয়েরও দু’জন সালারকে কতলের প্লান ছিল। তুমি তোমার সিপাহসালারকে বল, তিনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন তা আমি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত রয়েছি।

তারেক : তাদেরকে কোন শাস্তি দেব না। তারা স্বেচ্ছায় আসেনি তাদেরকে পাঠান হয়েছে। তবে যে ব্যক্তি তাদেরকে নিয়ে এসেছে তাকে সকালে ফজর নামাজের পর কতল করা হবে।

মেয়েটি যখন অরেক ইবনে যিয়াদের ফায়সালা শুনল, তখন বলল, সে আরো কিছু কথা বলতে চায়। তারপর সে বলতে লাগল,

“সিপাহ্ সালার হয়তো আশ্চর্যবোধ করছেন, এ মেয়ে কতবড় বীরাঙ্গনা দুঃস্বাসহী যে, একজন বিজয়ী সিপাহসালারকে কতল করতে এসেছে। আমি এত বড় বীরঙ্গনা নই তবে আমাদেরকে জোরপূর্বক যে জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়েছে তাতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আমাদের ধর্মের লোক আমাকে এবং আমার সাথীদেরকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে কারণ আমরা ধর্ম যাজিকা আর আমাদের দিবা রজনী অতিবাহিত হয় ইবাদতখানায়। আমাদেরকে কুমারী মনে করা হয় এবং একজন যাজিকা ও যাজক আজীবন অবিবাহিতই থাকে কিন্তু বস্তুতঃ যাজক-যাজিকা কেউই কুমার থাকে না। আমাদের ইবাদত খানার সাথেই আমাদের আরামগাহ্। তাতে দিন-রাত সর্বদা চলে অপকর্ম, পাপাচার। ফৌজের বড় বড় অফিসাররাও সেথায় আসে, শরাব পান করে উন্মাদ হয়ে আমাদের সাথে রাত যাপন করে কিন্তু দিনের আলোতে গির্জা ও ইবাদত খানাতে নসীহত ও প্রার্থনার মাধ্যমে মানুষকে খোদার ভয় দেখান হয়। তাদেরকে এ ধারনা দেয়া হয় যে পাদ্রী ও যাজিকারা আসমান থেকে অবতারিত নিষ্পাপ ফেরেশতা। এ ধর্ম গুরুরা টলেডোর শাহী মহলকে নিজেদের করতলগত করে রেখেছে। রডারিকের মত জালেম বাদশাহও তাদেরকে ভয় পেত।

তারেক ইবনে যিয়াদ : ভয় পেতনা, বরং ধর্ম গুরুদের সামনে মাথা নত এ কারণে করত যাতে তারা আকর্ষণীয়, সুন্দরী যুবতী যাজিকা তার দরবারে পেশ করে।

তারেক তরজুমানকে বললেন, এ মেয়ের কথা বেশ অর্থবহ তাকে বল, সে যেন আরো কিছু কথা আমাদেরকে শুনায়।

মেয়ে : ইসাজা খ্রীস্টানদের একটি পবিত্র শহর। কিন্তু প্রার্থনালয়ে যেসব যাজিকারা রয়েছে তারা অধিকাংশ ইহুদীদের কন্যা। আমিও ইহুদী। আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী। আমার বয়স যখন তের/চৌদ্দ বছর তখন আমাকে জোরপূর্বক এক গির্জাতে নিয়ে গিয়ে বৈরাগীনি বানানো হয়। আপন বাবা, মা, ভাই, বোন বাড়ী ঘর তো আমার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়ে ছিলোই অধিকন্তু পাদ্রীরা আমার সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিস ছিনিয়ে নিয়েছে তা হলো আমার কুমারীত্ব। তবে মানুষ আমাকে কুমারী যাজিকা বলে সম্মান করত। আমি যে কাহিনী বর্ণনা করলাম তা প্রত্যেক বৈরাগিনীর জীবন বৃত্তান্ত।… আমি সিপাহসালারের কাছে আবেদন পেশ করছি খ্রিস্টানরা যে শহরকে পবিত্র মনে করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেন এবং পারাশীতে নিমজ্জিত শহরের নাম-নিশানা মিটিয়ে দেন।

মুসলমানদের প্রধান সেনাপতিকে আমার এ শরীর ছাড়া আর কিছু ইনয়াম হিসেবে পেশ করতে পারি না। আমার একান্ত ইচ্ছে আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি আর তিনি আমাকে শাদী করুন, কিন্তু আমার এ বাসনা পূর্ণ হতে দেব না। কারণ আমিএকজন অপবিত্র মেয়ে আর সিপাহসালার খোদা প্রিয় ও অনেক বড় সম্মানী ব্যক্তি। আমি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলছি বিজয় তোমাদের অবশ্যম্ভাবী। পরাজয় ঐ সকল ধোকাবাজদের হয় যারা ধর্মের নেবাস পরিধান করে অগোচরে পাপের সাগরে হাবুডুবু খায়।

তারেক ইবনে যিয়াদ তরজমানকে লক্ষ্য করে বললেন, “এ লাড়কীকে ঐ লাড়কীদের কামরাতে নিয়ে যাও আর এদের সাথে যে আদমী এসেছে তাকে এখানে নিয়ে এসো।”

মেয়েটি চলে গেল। মেয়েদের সাথে যে বৃদ্ধ এসেছিল সে তারেকের কামরাতে প্রবেশ করল। যে খঞ্জর মেয়েটি তারেকের পদতলে রেখেছিল তা তারেক ইবনে যিয়াদের হাতে ছিল।

“তুমি কি এ খঞ্জর দ্বারা আমাকে হত্যা করতে চাও? তাকের খঞ্জর দেখিয়ে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন।”

বৃদ্ধ ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। তার চোখগুলো হয়ে ছিল এত বড় বড় যেন মনি বেরিয়ে আসবে।

তারেক ইবনে যিয়াদ দুভাষীর মাধ্যমে বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে বললেন, যে ব্যক্তি মহিলাদেরকে ময়দানে অবতরণ করায় তার এ অবস্থাই হয় যা তোমার হচ্ছে। আমরা অসৎ ও বাতিলের মুলোৎপাটনে এসেছি। আমরা আল্লাহ তায়ালার এ জমিনকে পাপমুক্ত করতে এসেছি আর তোমাদের ধর্মগুরু ও ফৌজের সালাররা সে পাপের আশ্রয় নিয়ে হকের রাস্তায় প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে। আমি যুদ্ধের ময়দানে তীর বা তলোয়ারের দ্বারা মৃত্যু বরণ করব। আমি যে আল্লাহর পয়গাম নিয়ে এ কুফরী রাজ্যে এসেছি সে আল্লাহ আমাকে গোনাহর কাজে লিপ্ত রেখে এক আওরতের হাতে মারবেন না। তুমি আমাকে বল, ইসাজাতে সৈন্য সংখ্যা কত, কেল্লার প্রাচীর কেমন এবং এমন কোন রাস্তা আছে কি যা দিয়ে কেল্লার ভেতর আমরা প্রবেশ করতে পারব?

বৃদ্ধ : কেল্লা বহুত মজবুত। প্রাচীর এত শক্ত যে আপনি কোথাও তা ভাঙতে পারবেন না। আপনার সিপাহীরা প্রাচীরের কাছেই যেতে পারবে না কারণ শহরের আবালবৃদ্ধ বণিতা, নারী-পুরুষ সকলে তীর বর্শা নিয়ে প্রাচীরের ওপর সর্বাত্মক প্রস্তুত থাকবে। বড় পাদ্রী শহরবাসী ও ফৌজদেরকে পূর্ণদ্যমে তৈরী করে রেখেছে। যে সকল ফৌজ প্রথম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেছে তারা জীবনবাজী রেখে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে প্রস্তুত রয়েছে।

তারেক : তুমি কে?

বৃদ্ধ :আমি পাদ্রী।

তারেক : তুমি আমাকে এবং আমার দু’সালারকে ঐ মেয়েদের মাধ্যমে হত্যা করার মানসে এসেছিলে না কি?

বৃদ্ধ : হ্যাঁ সিপাহ সালার! আমিঐ ইরাদাতেই এসেছিলাম তবে এখন অন্তর থেকে সে ইরাদা ত্যাগ করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন।

তারেক খঞ্জর হাতে আস্তে আস্তে বৃদ্ধের কাছে এসে পূর্ণ শক্তি দিয়ে বৃদ্ধের বুকের ওপর আঘাত হানলেন।

খঞ্জর বৃদ্ধের বুক হতে বের করতে করতে বললেন,সাপ কখনো দংশনের ইচ্ছে পরিত্যাগ করতে পারে না।

বৃদ্ধ হস্তদ্বয় বুকের ওপর রেখে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ল। তারেক দারোয়ানকে ডেকে বললেন, “আমাদের অবস্থান থেকে দূরে এ লাশ ফেলে আসবে। আর তিন ললনার ব্যাপারে নির্দেশ দিলেন তাদেরকে যেন পৃথক পৃথকভাবে হেফাজতে রাখা হয়। তারপর তিনি জুলিয়ন, আওপাস ও অন্যান্য সালারদেরকে ডেকে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ পেশ করলেন।

 ফজরের পরই কালো ইসাজার দিকে রওনা হলো। সে সময় নিয়ম ছিল প্রধান সেনাপতি ইমামতি করতেন সে অনুপাতে তারেক ইবনে যিয়াদ নামাজের ইমামতি করে ফৌজদের উদ্দেশ্যে বললেন, সম্মুখের শহর একেবারে সহজে করতলগত হবে না বরং বেশ শক্তি প্রয়োগ করতে হবে এবং বেগ পেতে হতে পারে। এভাবে তিনি বেশ তেজদ্বীপ্ত ভাষণ দিলেন।

ইসাজার বড় রাহেব এবং কয়েকটা লড়াই এর অভিজ্ঞ কেল্লাদার এ খবরের অপেক্ষায় ছিল যে, মুসলমানদের সিপাহসালারসহ আরো দু’জন সালার হত্যা হয়েছে ফলে তার সৈন্যরা অভিযান মূলতবী করেছে। সে সাত সকালেই কেল্লার প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে কারমুনার দিকে নিষপলক চেয়েছিল। তার আশা ছিল তিন লাড়কীর ঘোড়া গাড়ী দেখতে পাবে, সূর্য ক্রমে ওপরে উঠছিল কিন্তু ঘোড়ার গাড়ী নজরে আসছিল না।

দূর আকাশে সে ধূলি উড়তে দেখতে পেল। কিন্তু এত ধূলীকণা ছোট কাফেলার দরুন উড়বে না। সে ধূলিধূসর দিগন্তে চেয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে দেখতে পেল অশ্বপ্রতিচ্ছবি।

“দুশমন আসছে” কেল্লাদার প্রাচীর হতে উচ্চস্বরে আওয়াজ দিল।

কেল্লার ফৌজ পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। ফৌজের কমান্ডাররা বিগত রাতে ফায়সালা করে ছিল, কেল্লার মাঝে বন্দি হয়ে পড়ার চেয়ে খোলা ময়দানে আক্রমণকারীদের মুকাবালা করা হবে। তাদের ধারণা ছিল যেহেতু মুসলমানদের প্রধান সেনাপতিসহ আরো দু’জন সেনাপতি নিহত হবে তাই মুসলমান সম্মুখে অগ্রসর হবে না তারপরও তারা নিজেদের ফৌজ তৈরী রেখে ছিল। আর মনে মনে খুশী হচ্ছিল মুসলমানরা যদি তাদের সিপাহসালার ছাড়া হামলা করে তাহলে তারা তাড়াতাড়ি মারা যাবে। তারা এটা কখনো ধারণা করতে পারেনি যে, মুসলমানদের সিপাহসালার এত সুন্দরী ললনাকে প্রত্যাখ্যান করবে আর সে তাদের কতলের হাত থেকে বেঁচে যাবে।

দুর্গপতির ঘোষণায় শহরের তামাম দরজা খুলে গেল আর সিপাহীরা অত্যন্ত দ্রুতবেগে কেল্প ছেড়ে বাহিরে চলে এলো। দামামা বেজে উঠল, ফৌজের মাঝে যুদ্ধ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হলো।

তারেক ইবনে যিয়াদের বাহিনী ক্ৰমে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে চলল। সম্মুখ দলের কমান্ডার দেখল কেল্প হতে সৈন্যরা বের হয়ে ময়দানে কাতার বন্দি হচ্ছে। এ অবস্থা দেখে সে তার দলকে দাঁড় করিয়ে অশ্ব হাঁকিয়ে তারেক ইবনে যিয়াদের কাছে পৌঁছে ঘটনা বর্ণনা করল।

তারেক তার সৈন্য বাহিনীকে তিন ভাগেভাগ করলেন। এক ভাগের দায়িত্ব মুগীছে রূমী আরেক ভাগের দায়িত্ব যায়েদ ইবনে কাসাদাকে দিলেন আর এক দলের দায়িত্ব নিজে রাখলেন। দায়িত্বশীলদেরকে তৎক্ষণাৎ দিক নির্দেশনা দিলেন। মুগীছে রূমীকে তিনি শহরের এক প্রান্তে পাঠিয়ে দিলেন উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে শহরের পশ্চাতে রাখা।

যায়েদ ইবনে কাসাদাকে বামদিকে প্রেরণ করলেন সাথে নির্দেশ দিলেন দুশমনের নজর এড়িয়ে যথা সম্ভব তাদের কাছে পৌঁছে যাবে। আর হুকুম না দেয়া পর্যন্ত হামলা করবে না। তারেক নিজে দুশমন যে দিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে গেলেন। তিনি দুশমনের কাছে পৌঁছা মাত্রই তারা আক্রমণ করে, বসল।

 ঐতিহাসিক লেইনপোল লেখেছেন, ইসাজার ফৌজের সে হামলা একেবারে মামুলী ছিল না। বরং অত্যন্ত শক্তছিল এবং আক্রমণের অবস্থা দেখে প্রতীয়মান হয়, তাদের লড়াই এর স্পৃহা ছিল আর সে শহর হেফাজতে তারা হয়েছিল দৃঢ় প্রতিক্ষ। প্রফেসর দুজি লেখেছেন, খ্রীস্টান ফৌজরা এত শক্ত আক্রমণ করেছিল যে তা সামাল দেয়া তারেকের জন্যে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তারেকের সৌভাগ্য যে কয়েক হাজার নতুন বর্বর ফৌজ এসে তার ফৌজে যোগ দিয়ে ছিল তানাহলে ইসাজার ফৌজরা তার পরাজয় ডেকে আনত। বর্বর কওম জন্মগত ভাবেই লড়াকু-যুদ্ধবাজ তাই সহজে পরাজয় স্বীকার করে নেয়া তাদের জন্যে অসম্ভব ছিল ফলে তারা জীবনবাজী রেখে লড়ছিল কিন্তু তাদের অনেক ফৌজ মৃত্যু কোলে ঢলে পড়েছিল।

 ঈসায়ী ফৌজের জেনারেল মুসলমানদের পশ্চাৎ হতে আক্রমণ করার জন্যে তার বাম পার্শ্বের দলকে বামদিকে পাঠিয়ে দিল। সৈন্যদল পেছনে যেতে লাগল কিন্তু তাদের জানা ছিল না যে সেদিকে মুসলমানদের একটি দল রয়েছে। মুসলমান সৈন্যদলের কমান্ডার খ্রীস্টান ফৌজ আসতে দেখে তার সৈন্য বাহিনীকে আরো পিছনে নিয়ে গেলেন যাতে খ্রীস্টানরা তাদেরকে দেখতে না পায়।

খ্রীস্টান বাহিনী আরো কিছুটা সম্মুখে গিয়ে ডানদিকে ফিরে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল এরি মাঝে যায়েদ ইবনে কাসাদা তার বাহিনী নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দুশমনরা প্রস্তুতি নেয়ারই সুযোগ পেল না। এতে তারেক ইবনে যিয়াদের পশ্চাৎ একেবারে নিরাপদ হয়ে গেল।

যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল। শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরে দাঁড়িয়ে সাধারণ জনতা এ ভয়াবহ যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছিল। তারা মুগীছে রূমীর বাহিনী দেখতে পেল। তারা বাম দিকে শহর হতে কিছুটা দূরে তারেক ইবনে যিয়াদের হুকুমের অপেক্ষায় ছিল। একজন শহরী দ্রুত গিয়ে মুগীছে রূমীর সংবাদ তাদের জেনারেলকে দিলে, জেনারেল তার ডান দিকের বাহিনীকে মুগীছের দিকে পাঠিয়ে দিল।

মুগীছে রূমী ছিলেন অত্যন্ত চৌকস ও সচেতন। তিনি তার কয়েকজন সৈন্যকে খবর নেয়ার জন্যে সম্মুখে পাঠিয়ে ছিলেন তারা দৌড়ে এসে তাকে সংবাদ দিল যে দুশমনের কিছু ফৌজ এদিকে আসছে। মুগীছ তারেক ইবনে যিয়াদের নির্দেশের অপেক্ষা না করে তার বাহিনীকে সম্মুখে অগ্রসর হবার হুকুম দিলেন। তার কাছে বেশ যথেষ্ট পরিমাণ অশ্বারোহী ছিল।

মুগীছে রূমী সামনা-সামনি না লড়ে তার সৈন্য বানিীকে আরো সম্মুখে নিয়ে দুশমনের পার্শ্ব থেকে হামলা করলেন। তাদের আক্রমণ এত কঠিন ছিল যে, দুশমন পিছু হঠতে লাগল। তাদের পিছনে ছিল শহরের প্রাচীর। তারা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করছিল কিন্তু মুগীছের বাহিনী তাদের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করল যে তারা পিছু হটতে হটতে তাদের পিঠ দেয়ালে লেগে গেল। তারা সম্মুখে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করল কিন্তু মুসলমানরা তাদের সে চেষ্টা সফল হতে দিল না। বর্বর মুসলমানরা একান্তভাবে জীবনবাজী রেখে লড়ে গেল। যুদ্ধ তিনভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ সবচেয়ে বিপদে ছিলেন। তার দু’পাশের সৈন্যরা পৃথক পৃথকভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কোন কৌশল অবলম্বনেরও কোন রাস্তা ছিল না। তার প্রতিটি সৈন্য নিজে নিজে লড়াই করছিল। তার কোন রিজার্ভ বাহিনী ছিল না। তারেক নিজে একজন মামুলী সৈনিকের মত লড়ছিলেন। তার ফৌজের ক্ষতি হচ্ছিল ব্যাপকভাবে।

যায়েদ ইবনে কাসাদা যেহেতু দুশমনের পশ্চাৎ হতে আক্রমণ করেছিলেন এ কারণে দুশমনের লোকসান বেশি হয়েছিল। যায়েদ ইবনে কাসাদা ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ সালার। তিনি দূর থেকে দেখতে পেলেন তারেক ইবনে যিয়াদ বেশ বিপদে আছেন তাই তিনি তার সৈন্যের এক চতুর্থাংশ তারেকের সাহায্যে পাঠিয়ে দিলেন এতে তারেকের বিপদ কিছুটা হালকা হলো। কিন্তু খ্রীস্টান ফৌজরা তাদের পবিত্র নগরী রক্ষার্থে জীবনবাজী রেখে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করছিল।

মুগীছে রূমী ঈসায়ী ফৌজকে যে ফাঁদে ফেলেছিলেন এতে তাদের বেশ লোকসান হচ্ছিল। তারা প্রতিপক্ষের ঘোড় ও প্রাচীরের মাঝে বন্দী হয়ে পড়েছিল। তারা অনেকেই ঘোড়ার পিট হতে পড়ে পদতলে পৃষ্ট হচ্ছিল। অশ্বারোহীরা এমন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল যে, তীর-তরবারী চালানো একেবারে মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা পরস্পরে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছিল।

দুশমনের ঘোড়া অক্ষত রাখার ব্যাপারে তারেকের বিশেষ নির্দেশ ছিল যাতে ঐ ঘোড়া প্রয়োজনে নিজেদের কাজে আসে কিন্তু এ পরিস্থিতিতে মুগীছে রূমী ঘোড়ার পরওয়া করলেন না। দুশমনের ঘোড়া জখম করার ব্যাপারে নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশের ফলে বর্বর মুসলমানরা আরোহীর সাথে সাথে ঘোড়ার শরীরও তীর বর্শা দিয়ে আঘাত হানতে লাগল। এতে করে যে ঘোড়া আহত হলো সে তার আরোহীর বাগ মানলা না। কিছু অশ্ব ও আরোহী অন্য অশ্বের পদ তলে পৃষ্ট হলা।

দুশমনরা পালাতে লাগল। কিন্তু খুব কম সংখ্যই পালাতে পারল। মুগীছ তার কিছু ফৌজ তারেকের মদদে পাঠিয়ে দিলেন। এতে তারেকের বিপদ আরো হালকা হয়ে গেল এবং যুদ্ধের হাল যা খ্রীষ্টানদের পক্ষে যাচ্ছিল তা ঘুরে গেল।

ইতিহাস খ্রীষ্টান ফৌজকে জানায় সাধুবাদ; কারণ তারা যে সাহসীকতা ও …দৃঢ়তার সাথে লড়ে মুসলমানদের যে পরিমাণ ক্ষতি করেছিল তা বেশ ব্যাপক ছিল। মুসলমানরা এত পরিমাণ ক্ষতির জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তারা প্রথমপর্যায়ে বিজয়ের খুশীতে ছিল। সাঁঝ নাগাদ খ্রীস্টানরা পরাজিত ঠিকই হলো কিন্তু মুসলমানদের মাথা থেকে এ বিষয়টা বের করেদিল যে তারা যেদিকেই যাক বিজয় তাদের অতি সহজে, পদচুম্বন করবে না।

একদিকে দিবসের সূর্য ডুবছিল অপরদিকে খ্রীস্টানদের বাহাদুরীর সূর্য হলো অস্তমিত। তাদের দুর্গপতি, তামাম জেনারেল নিহত হলো। সিপাহীদের মাঝে খুব স্বল্প সংখ্যক জীবিত রইল। তারেকের সৈন্য বাহিনীর ক্ষয়-ক্ষতির হিসেব যখন তাকে দেয়া হলো তখন তিনি একেবারে ‘খ’ মেরে গেলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্লান্ত-শ্রান্ত যে, তার শরীরের গ্রন্থিগুলো খুলে গেছে। পুরো দিন একজন মামুলী সৈনিকের মত লড়াই করেছেন।

খ্রীস্টান ফৌজদের মাঝে যারা জীবিত ছিল তারা চলা-ফেরা করার কাবেল ছিল না। যে যেখানে ছিল সে সেখানেই বসে পড়েছিল। এখন তারা কয়েদী। তাদের মাঝে যারা পলায়নের চেষ্টা করছিল তাদেরকে পাকড়াও করে আনা হচ্ছিল। শহরে এলান করে দেয়া হলো, কেউ যদি কোন ফৌজকে আশ্রয় দেয় তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।

তারেক ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিলেন আহতদেরকে মুসলমানরা ময়দান থেকে নিয়ে আসবে আর শহরবাসী তাদের সেবা-শশ্রুষা করবে। আহত ব্যক্তি মুসলমান হোক বা স্পেনী সবার সাথে এক রকম ব্যবহার করতে হবে কেউ এর বিপরীত করলে তাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।

তারেক ইবনে যিয়াদকে যে তিন রমণী হত্যা করতে এসেছিল তাদের তলব করলেন, তারপর তাদেরকে যে বড় পাদ্রী পাঠিয়ে ছিল তারেক আহ্বান করে রমণীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তিই কি তোমাদেরকে পাঠিয়েছে।

রমণীদের মাঝ থেকে একজন জবাব দিল, হা সিপাহ সালার সেই আমাদেরকে পাঠিয়েছে এবং হত্যার পন্থা সেই বাতলিয়ে দিয়েছে।

তারেক ইবনে যিয়াদ পাদ্রীকে লক্ষ্য করে বললেন, আমার ফৌজের একজন আদমীও তোমাদের কোন ইবাদত খানার বারান্দাতেও যাবে না। ইবাদত খানা যে ধর্মেরই হোকনা কেন আমাদের জন্যে তার সম্মান রক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য। আমরা কোন ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবনা। প্রত্যেক ধর্মের লোক নিজ ইবাদত ও ধর্মের কর্ম সম্পাদনে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। কিন্তু যেভাবে তোমরা তোমাদের ধর্মীয় বিধানকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে আমি তোমাদের এ গোস্তাখী মাফ করব না। কুমারী রমণীদেরকে তোমরা উপ-পত্নী হিসেবে গ্রহণ করতে পারো, এমন কোন বিধান কি হ্যরত ঈসা (আ)-এর ধর্মে রয়েছে। না… এমন বিধান নেই, ফলে তুমি হত্যাযযাগ্য।

পাদ্রী থর থর করে কাঁপতে লাগল এবং নিজেকে বাঁচাবার জন্যে অনেক কিছু বলল। কিন্তু তারেক তার কথার প্রতি কর্ণপাত না করে তাকে বন্দী করে আগামীকাল প্রভাতে হত্যার নির্দেশ দিলেন।

তারেক ইবনে যিয়াদ অন্যান্য পাদ্রীদেরকে নির্দেশ দিলেন, তারা যেন যুবতী রমণীদেরকে তাদের নিজ নিজ বস্তিতে পাঠিয়ে তাদের পিতা-মাতার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।

তারেক ইবনে যিয়াদ স্পেনী ফৌজদের সেবা-যত্নের জন্যে শহরবাসীদের ওপর চাদা নির্ধারণ করলেন আর তারা যেহেতু ফৌজের সাথে মিলে যুদ্ধ করে ছিল, তাই তাদের ওপর কর নির্ধারণ করলেন।

একজন খ্রীস্টান ঐতিহাসিক নাম তার এইচ. পি. সিকাড, তিনি লেখেছেন, তারেক ইবনে যিয়াদ যখন ইসাজার বিজয়ার্জন করলেন তখন পাদ্রীরা পরম্পরে বলাবলি করতে লাগল, মুসলমানরা হিংস্র জাতি, তোমাদের সাথে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করবে। যুবতী বৈরাগিনীরা তাদের ভয়ে নিজেদের চেহারা বিকৃত করে ফেলেছিল তারপরও তাদের প্রতি মুসলমানরা বিন্দুমাত্র দয়া করেনি, তাদেরকে হত্যা করেছে।

 কিন্তু এইচ. পি. সিকাডের এ বক্তব্যকে তার স্বজাতি ঐতিহাসিকরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা লেখেছেন, পাদ্রীরা মুসলমানদের আচার ব্যবহারে এত মুগ্ধ হয়েছিল যে, তাদের অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। আর যুবতী যাজিকারা মুসলমান ফৌজের সাথে পরিনয়ে আবদ্ধ হয়েছিল।

একজন ইউরোপীয়ান ঐতিহাসিক লেখেছেন, মুসলমানরা যে, অমুসলিমদের ইবাদতখানা নষ্ট করেছে ইতিহাসে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তারেক ইবনে যিয়াদ শহরের দায় দায়িত্ব খ্রীষ্টান অফিসারদের হাতে সোপর্দ করে ছিলেন কিন্তু তাদের ওপররাস্ত কর্মকর্তা ছিল মুসলমান।

***

পরের দিন সকালে শহীদদের লাশ পাঁচ কাতারে সারিবদ্ধ করে তারেক ইবনে যিয়াদ যখন জানাযার নামাজ পড়াচ্ছিলেন, তখন এক হৃদয়বিদারক বেদনা বিধুর অবস্থার অবতারণা ঘটেছিল। শহীদের কাফন শহরবাসীরা ব্যবস্থা করেছিল। শহরবাসীরা শহীদদের জানাযা ও দাফনের দৃশ্য প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করছিল।

কিছুক্ষণের মাঝে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বিশাল গণ কবরে পরিণত হলো। কবর স্থান ঐসব মুজাহিদদের সমাধিস্থল যারা সর্ব প্রথম ইউরোপ পর্যন্ত আল্লাহ্ তায়ালার একত্ববাদের ও রাসূল (স)-এর রেসালতের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন।

মুজাহিদরা আল্লাহ আকবার ধ্বনি দিচ্ছিলেন, তারেক ইবনে যিয়াদের নয়ন যুগল অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল। শহীদদের দাফন সম্পর্ণ করে তারেক ফাতেহা পাঠ করে অশ্রুসজল চোখে কবরস্থান হতে বেরুচ্ছিলেন এরি মাঝে তাকে খবর দেয়া হলো কায়রো থেকে আমীরে মিশর ও আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইরের কাসেদ এসেছে। তারেক কাসেদ থেকে পয়গাম নিয়ে পড়তে লাগলেন। পয়গাম পড়তে পড়তে তার চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেল। তার কাছে জুলিয়ন ও অন্যান্য সালাররা ছিলেন।

“তোমাদের কেউ কি বলতে পারো এ নির্দেশের মাঝে কি দানেশমন্দী রয়েছে?” অস্বাভাবিক অবস্থায় তারেক তার সালারদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। তারপর মুসা ইবনে নুসাইরের পয়গাম পড়ে তাদেরকে শুনাতে লাগলেন।

মুসা ইবনে নুসাইর তারেককে লক্ষ্য করে লেখেছিলেন,

বিবেকের দাবী হলো তুমি যেখানে আছে সেখানেই অবস্থান করবে। তানাহলে বিজয়ের উল্লাসে সম্মুখে অগ্রসর হতে হতে হঠাৎ পরাজয়ের মুখে পড়তে হতে পারে। সম্মুখে অগ্রসর হবে না, যতক্ষণ দ্বিতীয় পয়গাম না পাঠাই বা আমি নিজে আরো ফৌজ নিয়ে উপস্থিত না হই।

কোন ঐতিহাসিকই মুসা ইবনে নুসাইরের পয়গামের পূর্ণ বিবরণ পেশ করেনি। তারা কেবল এতটুকু উল্লেখ করেছে যে, মুসা তারেককে কেবল হুকুমই দেননি বরং তাকে বাধ্য করেছিলেন তিনি যেন সম্মুখে অগ্রসর না হতে পারেন। খ্রীস্টান ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, মুসা ইবনে নুসাইর লক্ষ্য করলেন, তারেক যে তার গোলাম ছিল এখন সে স্পেনের মত এত বড় বিশাল রাজ্যের বিজয়ী হতে যাচ্ছে। সে মাত্র বার হাজার সৈন্যের মাধ্যমে রডারিকের এক লাখের চেয়ে বেশী ফৌজকে কেবল পরাজিত করেনি বরং তাদের নাম-নিশানা মিটিয়ে দিয়েছেন। ফলে ইসলামী সালতানাতেও খলীফার কাছে সে এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হতে যাচ্ছে। এতে মুসার অন্তরে বিদ্বেষ জন্ম নিল। তারেককে এ নির্দেশ দেয়ার পিছনে তার এ বিদ্বেষ কাজ করেছে। তারেক কে বাধা দিয়ে নিজে বিজয়ী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চেয়েছিল।

কিন্তু যারা সঠিক ঐতিহাসিক বিশেষ করে মুসলমান ইতিহাসবিদরা লেখেছেন, মুসা ইবনে নুসাইরের সে নির্দেশ যথাযথ ছিল। কারণ তিনি চিন্তা করেছিলেন তারেক ইবনে যিয়াদ তরুণ যুবক ফলে তিনি আবেগের বশীভূত হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে গিয়ে আটকে না পড়েন এবং যে এলাকা বিজয় হয়েছে তা যেন হাত ছাড়া না হয়ে যায়।

মুসা ইবনে নুসাইরের নির্দেশ সঠিক ছিল কিনা এ বিতর্কে আমরা না গিয়ে সে নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তারেক ও তার সেনাপতিরা কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ছিলেন তা আমরা তুলে ধরছি যার বিবরণ নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদরা লিপিবদ্ধ করেছেন।

তারেক কবরস্থান থেকে বেরিয়ে তার সালারদেরকে আহ্বান করে ছিলেন সালারদের সাথে তিনি জুলিয়নকেও রেখেছিলেন। কারণ জুরিয়ন ছিলেন বয়স্ক, অভিজ্ঞ অধিকন্তু তিনি খ্রীস্টান হওয়া সত্ত্বেও তার স্বজাতির বিরুদ্ধে তারেকের সাথে পূর্ণ বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়ে কৃতিত্ব দেখিয়ে ছিলেন।

তারেক ইবনে যিয়াদ : হে আমার বন্ধুবর! তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও। আমি বুঝতে পারছি না আমীরের এ হুকুমের মাঝে কি হিকমত লুক্কায়িত রয়েছে। একদিকে ইসলামের বিধান, আমীরের অনুসরণ কর, তার বিরুদ্ধাচরণ কর না, অপর দিকে আমরা যদি সামনে অগ্রসর না হয়ে এখানে স্থির বসে থাকি তাহলে স্পেনীরা মনে করবে যে আমাদের বিপুল পরিমাণ সৈন্য শহীদ হয়েছে তাই আমরা সামনে অগ্রসর হতে ভয় পাচ্ছি।

মুগীছে রূমী : ইবনে যিয়াদ! স্পেনীরা যা মনে করার তা করুক। কিন্তু আমাদের দেখার বিষয় হলো যে, আমরা স্পেনীদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছি। এখন আমরা যদি তা হতে অবতরণ করি তাহলে স্পেনীরা বিক্ষিপ্ত শক্তিকে একত্রিত করে আমাদের জন্যে বিপদের কারণ হতেপারে। আমরা দুশমনের ওপর ভীতির চাদর বিছিয়ে দিয়েছি। আমি এর মাঝে কোন হিকমত খুঁজে পাচ্ছিনে যে আমরা দুশমনকে একত্রিত হবার সুযোগ দেব।

জুলিয়ন : লক্ষ্য কর তারেক! আমীরের হুকুম তামীলের ব্যাপারে তোমাদের ধর্মের যে নির্দেশ সে ব্যাপারে আমি কিছু বলব না, আমাদের ধর্মের নির্দেশ তোমাদের মতই তবে আমীর যদি এমন নির্দেশ দেয় যদ্বরুণ ধর্ম ও ধর্মের অনুসারীদের ক্ষতি হয়, এমন হুকুম পালন করাকে আমি পাপ মনে করি। তুমি চিন্তে কর তারেক! তুমি কয়েকটা যুদ্ধে বিজয়ার্জন করলে। বিশেষ করে রডারিকের যুদ্ধে রডারিকের সাথে বড় বড় আমীর ওমারা ও অভিজ্ঞ সেনাপতিদেরকে হত্যা করেছ। স্পেন ফৌজের আসল বুহ্যকে তুমি চুরমার করে দিয়েছ। যারা পলায়ন করেছে তাদের অন্তরে রয়েছে তোমাদের ভয়। এ অবস্থায় তুমি কি তাদের একত্রিত হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই এর সুযোগ দিবে, না তাদের পিছু ধাওয়া করবে যাতে তারা স্বস্তির খাস না নিতে পারে?

যায়েদ ইবনে কাসাদা : আমীরে মুসা এখান থেকে অনেক দূরে। ফলে এখানকার বাস্তব চিত্র ও স্পেনী ফৌজদের অবস্থা সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন।

জুলিয়ন : তাছাড়া এ ইসাজা শহরের ব্যাপারে তুমি লক্ষ্য কর। এটা স্পেনের চৌরাস্তা, এখান থেকে একটা রাস্তা কর্ডোভা, আরেকটা গ্রানাডা, তৃতীয় আরেকটা রাস্তা সালাগা আর চতুর্থ রাস্তা গেছে স্পেনের রাজধানী শাহী মহল টলেডোর দিকে। তুমি যদি এ চারটি শহর দখলে আনতে পারো তাহলে মনে কর যে পুরো স্পেন তোমার দখলে এসে গেল। তুমি সম্মুখে অগ্রসর হও, আমীর যদি নারাজ হন তাহলে আমি তার সাথে কথা বলব।

তারেক : আমি নিজেও তার সাথে আলাপ করতে পারি কিন্তু আলাপ আলোচনা পরে হবে। এখন আমরা সম্মুখে অগ্রসর হবো।

***

আমীরের হুকুমএড়িয়ে অন্য শহরের দিকে অগ্রসর হবার ফায়সালা তারেক গ্রহণ করলেন। তার ফৌজকে তিনি দু’ভাগে ভাগ করে এক ভাগের সেনাপতি যায়েদ ইবনে কাসাদাকে নিয়োগ করে তার নেতৃত্বে মালকুন শহরের দিকে ফৌজ পাঠালেন। অপরভাগের নেতৃত্ব তারেক নিজের হাতে রেখে কর্ডোভার দিকে অগ্রসর হলেন।

তারেক ইবনে যিয়াদ কর্ডোভা অবরোধ করলেন, কিন্তু প্রথম দিনই অনুধাবন করতে পারলেন শহরে প্রবেশ করা বড় কঠিন। প্রাচীর ও দরজার কাছে যাওয়া আত্মহত্যার নামান্তর। কেল্লার চতুরপার্শ্বে ছিল পরিখা। তারেক সর্বোপরি চেষ্টা করলেন, কেবল একটা চেষ্ঠার বাকী ছিল তা হলো অবরোধ সময় বৃদ্ধি করা। নয়দিন অতিবাহিত হয়ে গেল।

তারেক : মুগীছ! তুমি এখানেই থাক, আমি চললাম। আমরা তো আমীরের হুকুম উপেক্ষা এ কারণে করলাম যেন স্পেনী ফৌজ একত্রিত না হতে পারে এবং তারা যেন স্বস্তি না পায়। এখানে যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে কয়েক মাস লেগে যাবে। এখানে অবরোধ করে বসে থাকলে চলবে না। আমি রাজধানী টলেভোর দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এখানে যে সৈন্য আছে তা দু’ভাগে ভাগ করছি।

মুগীছে রূমী : অধিকাংশ ফৌজ তোমার সাথে রাখ ইবনে যিয়াদ। আমাকে মাত্র সাতশত সৈন্য দাও।

সেরেফ সাত শত! মাত্র সাতশত ফৌজের দ্বারা তুমি এ কেল্লা কজা করতে পারবে? আশ্চর্য হয়ে তারেক মুগী কে জিজ্ঞেস করলেন।

জুলিয়ন : মুগীছ সাত শত ফৌজ নিয়ে এ কেল্লা করতলগত করতে পারবে কিনা তা জানি না তবে তারেক! তুমি স্বল্প ফৌজ দ্বারা টলেডো জয় করতে পারবে না। টলেডো হলো রাজধানী, স্পেনের প্রাণ কেন্দ্র তাই সহজে তা কব্জা করা যাবে না। ফলে অধিকাংশ ফৌজ তুমি তোমার সাথে নিয়ে সেদিকে রওনা হও।

 মুগীছ : আল্লাহর মদদই আমার জন্যে যথেষ্ট। এ শহরে আমি প্রবেশ করবই, ইনশাআল্লাহ।

তারেক : মুগীছ! কল্পনা ও স্বপ্নজগতের কথা বল না। আল্লাহ তায়ালা তো তাকে মদদ করেন যে, বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য রেখে চেষ্টা করে।

 মুগীছ : আমি যে সাতশত ফৌজ নির্বাচন করব, তা তুমি রেখে বাকীগুলো নিয়ে রওনা হয়ে যাও। রাসূল (স) আমাদেরকে বিজয় সুসংবাদ দিয়েছেন ফলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিজয়ের ব্যবস্থাও করে দিবেন। আমরা এ পরিখার পাশে কেবল বসে থাকব না।

মুগীছে রুমীর পছন্দমত সাতশত সৈন্য রেখে বাকী ফৌজ সাথে নিয়ে তারেক টলেডোর দিকে রওনা হলেন। তার সাথে জুলিয়ন ও আওপাসও গেলেন।

***

কর্ডোভার দেয়ালের ওপর তীর-কামিন, বর্শা হাতে মানুষের যে প্রাচীর সৃষ্টি হয়েছিল তা খুশীতে ফেটে গেল আর তার মাঝ থেকে ভেসে এলো বিজয় উল্লাস।

“তারা চলে গেল- তারা চলে গেল।”

 “এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যাচ্ছ মুসলমানরা।”

“আমাদের মেহমানরা চলে যাচ্ছে।”

 “দাঁড়াও আমরা দরজা খুলে দিচ্ছি।”

তীর-ধনুক, বর্শা হাতে নেচে নেচে খ্রীষ্টানরা বিজয় ধ্বনী দিচ্ছিল। ফেটে পড়ছিল তারা অট্টহাসিতে। তারেক তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, মুগীছে রূমী তার সাতশত ফৌজ খন্দক হতে দূরে পশ্চাতে নিয়ে গেলেন। মুসলমানরা নিরাশ হয়ে অবরোধ উঠিয়ে নিয়েছে এ খুশীতে খ্রীস্টানরা আত্মহারা।

রাত্রে শহরে হচ্ছিল আনন্দ উৎসব। গির্জাতে যাজক-যাজিকারা খুশীতে মেতে উঠেছিল। ইসাজা যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে শহরবাসী শুনে ছিল, মুসলমান ফৌজ চলে যেতে দেখে তারা মনে করল এ মুসীবত তাদের ওপর থেকে চলে গেল। তাই এ খুশীতে তারা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছিল।

কর্ডোভা শহরের অদূরে লতা-গুল্মে ঘেরা এক সবুজ-শ্যামল বনানীতে, মুগীছে রূমী তার ফৌজ থেকে পৃথক হয়ে একাকী নিবিষ্ট চিত্তে নফল নামাজ পড়ে, আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

“হে আল্লাহ! তুমি একক সত্ত্বা, তোমার কোন শরীক নেই। হে পরওয়ার দেগার! তুমি যাকে ইচ্ছে তাকে ইজ্জত দান কর, যাকে ইচ্ছে তাকে বেইজ্জতি কর, তুমি তাবৎ কিছুর ক্ষমতাবান। আমি তোমার ওপর ভরসা করে মাত্র সাতশত সৈন্য দ্বারা এ শহর জয় করার ওয়াদা করেছি। আমি এ শহরের বাদশাহ হতে চাই না। বরং তোমার বাদশাহী এ শহরে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।

ওগো দয়াময়! তুমি আমাকে সাহস ও হিম্মতদান কর যাতে আমি তোমার একত্ববাদ ও মুহাম্মদ (স)-এর রিসালতের বানী নিয়ে এ কেল্লাতে প্রবেশ করতে পারি এবং বাতিলের ঘোর তমাশায় যেন হকের প্রদীপ প্রোজ্জ্বল করতে পারি। আমাকে তোমার দরবারে ও আমার সাথীদের কাছে লজ্জিত করোনা দয়াময়।

দোয়া শেষ করে চোখের পানি মুছে ফৌজদের কাছে গিয়ে বসে পড়লেন, সকল সোয়ারী তার পাশে এসে জমা হলো।

উচ্চস্বরে মুগীছে রূমী বলতে লাগলেন,

হে আমার প্রিয় সাথীরা! আমি সিপাহ্ সালারকে বলেছিলাম, আমাকে কেবল সাতশত সোয়ারী দিন আমি আপনাকে এ শহর উপহার দেব। আমি আমার দাবী ও প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার জন্যে তোমাদেরকে নির্বাচন করেছি। এ প্রতিশ্রুতি আমি সিপাহ সালারের কাছে করিনি বরং স্বয়ং আল্লাহর কাছে করেছি আর এ ওয়াদা তোমাদের বীরত্বের ওপর ভরসা করে করেছি। আল্লাহর কাছে অঙ্গিকার কর আমরা হয়তো এ শহরের প্রাচীর ভেঙ্গে তাতে প্রবেশ করব তানাহলে সকলে মৃত্যুর শুরা পান করব। আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন, তোমরাও আল্লাহর সাথে থেকো।

 স্বমস্বরে জবাব এলো,

“আমরা তোমার সাথে আছি, আমরা অঙ্গিকারাবদ্ধ হচ্ছি আমরা হয়তো এ শহর দখলে নেব তা নাহলে জীবন দিবো।”

সকাল বেলা। মুগীছে রূমী একাকী বেরুলেন কেল্লা ও শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীর দেখার মানসে। হয়তো প্রাচীরের ওপর উঠার বা তা ভাঙ্গার উপযুক্ত কোন জায়গা পাওয়া যেতেও পারে। একজন রাখাল ভেড়া-বকরী নিয়ে আসছিল। সে মুগীছকে দেখে সালাম করে জিজ্ঞেস করল, আমাদের বাদশাহকে যারা পরাজিত করেছে আপনি কি সে ফৌজের একজন মুগীছ স্পেনী জবান জানতেন, তাই জবাব দিলেন, হা দোস্ত! তুমি আমাকে তোমার দুশমন মনে করছ?

রাখাল : আমরা খুবই গরীব। কাউকে দুশমন ভাবার ক্ষমতা আমাদের নেই।

মুগীছ রাখালের সাথে বন্ধুসূলভ আলাপ করতে করতে তার সাথে যেতে লাগলেন।

রাখাল : দাঁড়াও। তোমরা যদি এ শহরের ভেতর প্রবেশ করতে চাও তাহলে পিছন দিকে চলে যাও। সেদিকে দরিয়াও আছে খন্দকও আছে। এক জায়গায় প্রাচীর একটু ভাঙ্গা আছে। সে জায়গার আলামত হলো সেখানে একটা বৃক্ষ আছে। যার ডাল প্রাচীরের ওপর গিয়ে পড়েছে। সেথা হতে তোমরা প্রাচীর ভাঙ্গতে পারো। নিজে গিয়ে দেখে এসো, একাজ তোমরা করতে পারবে কিনা।

মুগীছে রূমী ছদ্দবেশে অনেক দূর ঘুরে সমুদ্র পাড়ে গেলেন। দেয়ালের ভাঙ্গা স্থান তিনি খুঁজে পেলেন, কিন্তু যে পরিমাণ ভাঙ্গা তা দিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। আরো ভাঙ্গা লাগবে। প্রাচীরের ওপর পাহারাদার ছিল। মুগীছ চুপি চুপি ফিরে এসে চার-পাঁচজন ফৌজকে সে স্থান দেখে আসার জন্যে পাঠালেন।

প্রাচীরে ভাঙ্গা স্থানের চেয়ে তার কাছে যে গাছ রয়েছে তা দ্বারা উপকার বেশী হবে কারণ তার ডাল বয়ে প্রাচীরের ওপর যাওয়া যাবে। কিন্তু পাহারাদাররা বড় ভয়ের কারণ।

ঐতিহাসিক লেইনপোল লেখেন, মুসলমানরা যুদ্ধ বিদ্যা ও বীরত্বে নজীর বিহীন ছিল। তাদের বিজয়ের কারণ মূলত: এটাই ছিল। তাছাড়া ঐশী শক্তিও তাদের পক্ষে হামেশা ছিল। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো যা তাদের পক্ষে যেত। মুগীছে রূমী দেয়াল ভাঙ্গা ও প্রাচীরের কাছে গাছ পেয়ে ছিলেন কিন্তু তা কাজে লাগান কঠিন ছিল।

 সূর্য অস্তমিত হলো, আঁধারের চাদর ঢেকে নিল কর্ডোভা নগরীকে। কিছুক্ষণ পর প্রবল বেগে শুরু হলো ঝড়-বৃষ্টি। বাতাসের তীব্রতায় গোটা নগরী থরথর করে কাঁপছিল। বৃষ্টি এত প্রবল হচ্ছিল যেন প্রস্তর নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। গাছ-পালা উপড়ে পড়ার উপক্ষম। এ ভয়াবহ তুফানের হাত থেকে বাঁচার কোন উপায় ছিলনা মুগীছ ও তার সাথীদের জন্যে। তাদের কোন তাবু ছিল না আর যদি থাকতও তবুও তা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যেত। ঘোড়া চিৎকার করে ছটফট করছিল। টিলার পাদদেশে গিয়ে কোন মতে জীবন রক্ষা করছিল।

 মুগীছে রূমী উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, এখন উপযুক্ত সময়,এ তুফান আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত। ঘোড়াতে জিন লাগিয়ে দ্রুত প্রাচীরের কাছে চল, এখন প্রাচীরের ওপর কোন পাহারাদার নেই। কোদাল সাথে নিও।

এ প্রবল বৃষ্টি ও ঝঞ্ঝা বায়ুর মাঝে সাতশত সৈন্য নিয়ে মুগীছে রূমী রওয়ানা হলেন। বিজলীর উৎকট চমক আর বজ্রের প্রকট ধ্বনিতে ঘোড়া বাগ না মেনে এদিকে সেদিকে ছটার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আরোহীরা তাদের দক্ষতা বলে ঘোড়াকে বাগে রেখেছিল।

কর্ডোভার অদূর দিয়ে সাগর অতিবাহিত হয়েছে। ঘোড় সোয়ারদেরকে যেহেতু প্রাচীর হতে দূরে রাখা দরকার ছিল তাই সাগরের মাঝে হাঁটু পানিতে তাদেরকে রাখা হয়েছিল। সাগরের প্রবল স্রোত তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল।

পাহারাদাররা বুরুজের মাঝে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

মুগীছে রূমী তার চারজন সহযোগীসহ প্রাচীরের কাছে গাছ-পালা ও লতা গুলোর মাঝে অবস্থান নিলেন।

আবু আতীক : সালার! প্রাচীর ভাঙ্গার প্রয়োজন নেই। আমি রশী সাথে নিয়ে এসেছি, আমাকে গাছে উঠার অনুমতি দিন।

আবু আতীক রশী নিয়ে গাছে উঠে প্রাচীরের দিকে যে ডাল ছিল তাতে গেল। কিন্তু প্রচণ্ড বাতাস তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। বৃষ্টিতে ডাল পিছলে হয়ে গিয়েছিল ফলে পা পিছলে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল। তবুও সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেয়ালের ওপর পৌঁছে প্রাচীরের খুঁটির সাথে রশী বেঁধে বাকী অংশ রশী নিচে নামিয়ে দিলে সাত-আটজন ফৌজ রশী ধরে প্রাচীরের ওপর উঠে গেল। তারা তলোয়ার উন্মুক্ত করে পাহারাদারের একটা বুরুজে পৌঁছে সে বুরুজের চারজন পাহারাদারকে অতর্কিতভাবে হত্যা করে। অনুরূপভাবে আরো কয়েক বুরুজের পাহারাদারদেরকে হত্যা করে তারা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে দরজার কাছে এসে সেখানে যে পাহারাদার ছিল তাদেরকে হত্যা করে দরজা খুলে দিল। তারপর আবু আতিক বাহিরে গিয়ে মশাল জ্বালিয়ে সংকেত দেয়ার সাথে সাথে মুসলিম সোয়ারীরা তুফানের মত প্রবল বেগে কেল্লার মাঝে প্রবেশ করল।

দু’তিনজন স্পেনী ফৌজকে রাহবর বানিয়ে মশালের আলোতে মুসলিম ফৌজ কেল্লার আনাচে-কানাচে পৌঁছতে ছিল। স্পেনী ফৌজ ঘুমিয়ে ছিল তাদেরকে চিরতরে নিদ্রাপুরে পাঠিয়ে দেয়া হলো, যারা আত্মসমর্পণ করে স্বেচ্ছায় ধরা দিল তারাই কেবল কতলের হাত থেকে রেহায় পেল। শহরীরা কোন মুকাবালাই করতে পারল না।

সকাল বেলা। ঝড়-বৃষ্টি খতম হয়েছে। কেল্লা ছিল মুসলমানদের হাতে, কিন্তু কেল্লার ভেতর ছিল আরেকটা কেল্লা যা মুসলমানদের দখলে আসেনি। সেটা ছিল খ্রীস্টান পাদ্রীদের ও যাজিকাদের আবাসস্থল ও দরসগাহ। তার প্রাচীর ছিল অতি উঁচু আর দরজা ছিল লোহার।

কর্ডোভার গভর্নর রাতের আঁধারে কিছু সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সেখানে পালিয়ে গিয়েছিল। মুগীছ এলান করলেন, আত্মসমর্পণ কর তাহলে রক্ষা পাবে আর মুকাবালা করলে পাবে শাস্তি।

গভর্নর প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে জওয়াব দিল, পাদ্রীদের কাছে এসে দেখ শান্তি কে পায় তখন বুঝবে। বাঁচতে চায়লে এ শহর হতে চলে যাও।

এ সুরক্ষিত স্থানে প্রবেশের জন্যে মুগীছ বহু চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পেলেন না। তাকে বলা হলো তার ভেতরে ফলমুলের এত পরিমাণ গাছ পালা আছে যে কয়েক মাসেও তা খতম হবে না।

 প্রায় এক মাস পর মুগীছ জানতে পারলেন, শহরের ভেতরে যে নালা রয়েছে তার পানি দুর্গের ভেতরে যাবার ব্যবস্থা রয়েছে। দুর্গের লোকরা এ পানিই পান করছে। মুগীছ নালার মুখ বাঁধ দিয়ে ভেতরে পানি যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, তারপর তিন-চারদিন পরেই দরজা খুলে গেল।

মুগীছ প্রথমে গভর্নরের গর্দান উড়িয়ে দিলেন। তারপর তার মাঝে যেসব ফৌজি অফিসার ছিল তাদেরকে হত্যা করলেন। তীরন্দাজদেরকে করলেন বন্দী আর যাজিকাদের করে দিলেন মুক্ত।

উত্তর আফ্রিকার রাজধানীতে আমীর মুসা ইবনে নুসাইর আঠার হাজার ফৌজ একত্রিত করলেন। তিনি পূর্বেই স্পেন যুদ্ধে শরীক হবার অনুমতি খলীফা ওয়ালীদ থেকে নিয়ে রেখেছিলেন। তার ধারণা ছিল তারেক ইবনে যিয়াদ তার নির্দেশ মুতাবেক যুদ্ধ বন্ধ করে তার জন্যে অপেক্ষা করছেন, তিনি গিয়ে বিজয়াভিজানে শামিল হবেন।

কিন্তু তারেক ইবনে যিয়াদ ও তার সালাররা যে আমীরে মুসার নির্দেশ অমান্য করে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন তা স্পেনের আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করছিল।

***

যায়েদ ইবনে কাসাদাকে তারেক ইবনে যিয়াদ যেদিকে প্রেরণ করেছিলেন, সেদিকে ছিল স্পেনের বড় শহর গ্রানাডা। স্পেনের নামকরা জেনারেল তিতুমীর যে তারেকের সাথে সর্ব প্রথম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছিল সে গ্রানাডাতে অবস্থান করছিল। সে মুসলমানদের বিজয় খবর শুনতে পাচ্ছিল তাই গ্রানাডা রক্ষার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করছিল।

কেল্লার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও শহরের প্রাচীরের কোন ত্রুটি ছিল না। ফৌজের কোন অভাব ছিল না এতদ্বসত্ত্বেও ফৌজের মাঝে যুদ্ধের কোন স্পৃহা ছিল না তারা হয়ে পড়েছিল হতদ্দম। এ বিষয়টা তিতুমীরকে ভাবিয়ে তুলেছিল।

 রডারিকের মৃত্যু সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। রডারিককে মানুষ বড় বাহাদুর ও যুদ্ধবাজ মনে করত। তার ব্যাপারে মাশহুর ছিল, সে মহলে জালিম বাদশাহ্ আর যুদ্ধ ময়দানে মহাবীর। তাকে পরাজিত করার ক্ষমতা অন্য কোন বাদশাহর নেই। এ কারণে মানুষের ধারণা ছিল সে মরে নাই বরং জীবিত আছে এবং এক সময় ফিরে আসবে। আবার অনেকে মনে করত যদি মরেও যায় তবুও তার প্রত্যাবর্তন ঘটবে। কিন্তু এ বিশ্বাস সকলের ছিল না অনেকে আবার একথাও বলত, মুসলমানরা যে যুদ্ধবাজ তারা রডারিককে কেবল পরাজিতই করেনি বরং একেবারে দুনিয়া হতে চির বিদায় দিয়েছে।

তিতুমীরের ফৌজের মানসিক এ অবস্থা তার জন্যে বড় ভয়াবহ ছিল। সে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়েছিল। তার পরাজয়কে সে বিজয়ে পরিনত করার স্বপ্ন দেখছিল। তাছাড়া সে স্পেনের বাদশাহ হবারও খাব দেখছিল। তার অধিনস্থ– অফিসারদেরকে সে এ লোভই দেখিয়েছিল। তার অফিসারদেরকে বলেছিল,

“এখন দেশে কারো হুকুমত নেই। যে বিজয়ার্জন করবে সেই হবে রাজত্বের অধিকারী। আফ্রিকার বর্বররা লুটতরাজের জন্যে এসেছে। তারা এক জায়গায় পরাজিত হলেই পলায়ন পদ হবে তারপর রাজ্যের অধিকারী হবো আমরা। তোমরা বসবে আমার জায়গায় আর আমি বসবো রডারিকের স্থানে। তবে তার জন্যে আগে প্রয়োজন হামলাকারীদেরকে বিতাড়িত করা।”

ফৌজি অফিসারদের জন্যে এতটুকু ইশারাই যথেষ্ট ছিল। তারা বড় পদের প্রত্যাশায় হামলাকারীদেরকে পরাস্ত করার জন্যে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগল।

তিতুমীর বলল, তোমরা সকলেই শুনেছ তারা গ্রানাডার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তারা তিন দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের কমজোরী পয়দা করেছে। তাদের একটি দল গ্রানাডার দিকে আসবে, তাদেরকে সমুলে ধ্বংস করতে হবে। যদি আমরা এ দলকে খতম করতে পারি তাহলে কর্ডোভার দিকে তাদের যে দল গিয়েছে তাদের ওপর আগ্রমণ করতে পারব। তারপর আমরা টলেডোর দিকে যে দল গিয়েছে তাদেরকে খতম করতে পারব। আর তাদেরকে পরাস্ত করার একটা পদ্ধতি হলো গ্রানাডার দিকে যে দল অগ্রসর হচ্ছে তাদেরকে পথিমধ্যে জায়গায়-জায়গায় আক্রমণ করা হবে যাতে তারা গ্রানাডা নাগাদ না পৌঁছতে পারে। আর যদি পৌঁছেও তাহলে তারা যেন ক্লান্ত শ্রান্ত থাকে এবং তাদের ফৌজ যেন অবশিষ্ট থাকে কম। তাহলে আমরা তাদেরকে দ্রুত আত্মসমর্পণ করাতে পারব।

একজন উপরস্থ অফিসার বলল, আপনার পরিকল্পনা খুবই ভাল। আমরা মুসলমানদেরকে গ্রানাডা অবরোধ করার সুযোগই দেব না। শহর থেকে দূরে, ফাঁকা ময়দানে তাদের সাথে যুদ্ধ হবে। আপনি রডারিকের আসনে আসীন হবার কথা বলছিলেন, আপনি কি ভুলে গেছেন যে, রডারিকের এক বেটা রয়েছে। তার বর্তমানে আপনি স্পেনের মুকুট কিভাবে পরিধান করবেন?

তিতুমীর জবাব দিল, সে তো পাগল।

অফিসার তার মাতা তো পাগল নয়। তাছাড়া ইউগুবীলজি, সেও আপনার মত জেনারেল। সবসময় টলেডোতে থেকেছে। রডারিকের বিবি তাকে খুব পেয়ার করে আর ফৌজদের মাঝেও তার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে ফলে সে ফৌজকে আপনার বিরুদ্ধে রানীর পক্ষে উসকে দেবে। আপনি যদি তার বিরুদ্ধে যান তাহলে সে আপনাকে হত্যা করবে বা আপনাদের পরস্পরে লড়াই শুরু হবে এতে করে দুশমন পুরো মূলক পূর্ণ মাত্রায় বিজয় করার সুযোগ পাবে।

তিতুমীর তার একথা শুনে এমনভাবে হাসতে লাগল যেন তার অফিসার একেবারে পাগলপনা কথা বলেছে। সে এর কোন জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না।

তিতুমীর বলল, এটা পরের বিষয় আগে এসো, ফৌজ ভাগ করেনি। কোথায় কত ফৌজ পাঠান যায় তা ভেবে দেখি।

গ্রানাডাতে চারটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল, তিতুমীর সে জায়গাগুলোর প্রত্যেকটিতে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করল এবং ফৌজদের খোঁজ খবর নিয়ে প্রত্যেক জায়গাতে একই ভাষণ পেশ করল,

 “ঐ শাহেন শাহ্ রডারিক মৃত্যু বরণ করেছে যে, স্পেনকে নিজের পৈত্রিক সম্পদ ও তোমাদেরকে তার গোলাম বানিয়ে রেখেছিলেন। স্পেনের জমিতে উৎপাদিত প্রতিটি শস্যকণার হকদার তোমরা। তোমরা তোমাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের প্রতিটি পয়সার মালিকও তোমরা। এখন থেকে তোমাদের জমির উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক আর কেউ জোর করে নিয়ে যাবে না। তোমাদের নিজ হাতে উপার্জিত প্রতিটি জিনিসের মালিক তোমরাই হবে। তোমরা যারা ফৌজে আছ তাদের বাপ-ভাই থেকে কোন প্রকার কর আদায় করা হবে না। কোন ফৌজ যদি লড়াই এ আহত হয় তাহলে তাকে তার নির্ধারিত বেতন-ভাতা সর্বদা প্রদান করা হবে। আর কেউ যদি নিহত হয় তাহলে তার উত্তরাধিকারীদেরকে এক সাথে পূর্ণ টাকা পরিশোধ করা হবে।”

তিতুমীরের ভাষণ এ পর্যন্ত আসতে ফৌজরা ধ্বনী শুরু করেদিল।– “তিতুমীর জিন্দাবাদ, স্পেন জিন্দাবাদ।” তাদের ধ্বনী শেষ হলে তিতুমীর তার ভাষণ আবার শুরু করলেন,

“আফ্রিকার এ বর্বর মুসলমানরা তোমাদের মুলুক ও তোমাদের ঘর-বাড়ী লুট করবার জন্যে এসেছে। তারা তোমাদের মেয়ে-বোন ও নওজোয়ান স্ত্রীদেরকে ধরে নিয়ে যাবে এবং তাদেরকে তোমাদের সামনে বেআব্রু করবে। এ ডাকাতরা দশ বার বছরের বাচ্চাদেরকেও ধরে নিয়ে যায়। যদি তাদের হাত থেকে ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত বাঁচাতে চাও তাহলে জীবন বাজী রেখে লড়াই কর। দুশমনের ভয় অন্তর থেকে বের করে দাও। তারা এত বড় বাহাদুর নয় যা তোমরা শুনেছ। যেসব ফৌজ পরাস্ত হয়ে পালিয়ে এসেছে তারা বলবে মুসলমানরা মানুষ নয় তারা জিন ভূত। এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা, তারা তোমাদের মতই মানুষ। পৃথিবীতে যদি কেউ বাহাদুর থেকে থাকে তাহলে তা রয়েছ তোমরা।”

তিতুমীর যাদের সম্মুখে ভাষণ দিচ্ছিল তারা জানত না যে, সে প্রথমে মুসলমানদের সাথে লড়াই করে পরাস্ত হয়ে পলায়ন করে এসেছে, আর এখন বড় বড় কথা বলে ভাষণ দিচ্ছে। সেই প্রথম মুসলমানদেরকে জিন-ভূত হিসেবে অবহিত করেছিল।

***

তিতুমীর গ্রানাডাতে পৌঁছার পূর্বেই যায়েদ ইবনে কাসাদা গ্রানাডার অদূরে কেল্লা বন্দী শহর নাগাদ পৌঁছে তা অবরোধ করে ফেললেন। প্রাচীরের ওপর তীরন্দাজ ও বর্শাধারী ফৌজ মওজুদ ছিল। তারা তীর, বর্শা নিক্ষেপ করতে লাগল। কিন্তু মুসলমানদের কামান ছিল বেশ শক্তিশালী, তারা দূর হতে তীর নিক্ষেপ করতে পারত। তাই প্রাচীরের ওপর থেকে যে তীর নিক্ষেপ করা হচ্ছিল তা মুসলমানদের কাছে এসে পৌঁছছিল না। কিন্তু মুসলমানরা যা নিক্ষেপ করছিল তা জায়গায় পৌঁছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছিল।

মুসলমানদের তাকবীর ধ্বনী স্পেনীদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করছিল। মুসলমানরা অবিরাম তীর বর্ষণ করার দরুন প্রাচীরের ওপর যে ফৌজ ছিল তা মাথা তুলে দাঁড়াবার অবকাশ পেল না। মুসলমানরা চেষ্টা করছিল দেয়ালের ওপর চড়ার বা প্রাচীর ভাঙ্গার। কিছু মুজাহিদ দরজার কাছে পৌঁছে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল।

মুসলমানরা এমন স্পৃহা ও বীরত্বের সাথে লড়াই করছিল যেন তারা পুরো কেল্লা প্রাচীরসহ উপড়ে ফেলে দেবে। মুসলমানদের ব্যাপারে স্পেনীদের মনে যে আতংক ছিল তা পূর্ণ মাত্রায় জেগে উঠল। মুসলমানরা যে তীর নিক্ষেপ করছিল তা প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে পল্লীর ভেতর পড়ছিল। এতে শরীদের মাঝে ত্রাস আরো বেড়ে গেল ফৌজরা বিলকুল ভেঙে পড়ল। বেগতিক দেখে কেল্লাদার দরজা খুলে দেয়ার হুকুম দিল।

মুসলমানরা কেল্লার ভেতর প্রবেশ করল। তেমন ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই তা মুসলমানদের করতলগত হলো।

***

একটু সম্মুখে আরো দুটো বড় নগরী। মালাকা ও মুরশিয়া। মালাকার ফৌজরা বীরত্ব প্রদর্শনের জন্যে কেল্লার বাহিরে কাতার বন্দি হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। তাদের এ বীরত্ব প্রদর্শন তিতুমীরের ভাষণের কারণে ছিল। কিন্তু তাদের জানাছিল না তাদের লড়াই এমন মুসলমানের সাথে যারা যুদ্ধের মাঝে খুঁজে পায় সুখ। জন্মের পরেই যাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয় যুদ্ধলড়াই।

জেনারেল যায়েদ তারেক ইবনে যিয়াদের শেখান বিশেষ কৌশল বলে স্পেনীদেরকে এমনভাবে পিছনে নিয়ে গেলেন যে তাদের পিঠ প্রাচীরে ঠেকে গেল। ঘোড়া পায়দলদেরকে পৃষ্ঠ করছিল। আর মুসলমানরা তাদেরকে চিরতরে খতম করছিল। জেনারেল যায়েদ দুশমনকে যুদ্ধে লিপ্ত করে তার কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদকে পাঠিয়ে দিলেন দরজা ভাঙ্গার জন্যে।

স্পেনীরা কেল্লা হতে বেরিয়ে সাহসীকতা ও বীরত্বের পরিচয় ঠিকই দিল কিন্তু তারা কেল্লা হেফাজতের কথা ভুলে গিয়েছিল। কেল্লার বাহিরে তারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করছিল অপর দিকে মুসলমানদের জানবাজ ফৌজরা কেল্লার দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করল। পরিশেষে স্পেনীরা হাতিয়ার ছেড়ে দিল। তিতুমীরের জ্বালাময়ী ভাষণ কোন কাজে আসল না। যেখানে তীর-তলোয়ার চলতে থাকে সেখানে শব্দবান বাতাসে হারিয়ে যায়।

এখন যায়েদের সম্মুখে স্পেনের অন্যতম নগরী গ্রনাডা। জেনারেল তিতুমীর কেল্লা বন্দি এ নগরীতে রয়েছে। প্রথম পরাজয়ের প্রতিশোধ ও স্পেন রাজ্যের সম্রাট হবার প্রত্যাশায় লড়াইয়ের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখে ছিল। সেও অবরুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করা ভাল মনে করল না। তার ফৌজকে শহর হতে বের করে কিছু দূরে কাতার বন্দি করল।

যায়েদ ইবনে কাসাদার সৈন্য সংখ্যা তিতুমীরের সৈন্যের চেয়ে কম ছিল এতটুকু উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া কার সৈন্য সংখ্যা কত ছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান কোন ঐতিহাসিকই উল্লেখ করেননি। স্পেনী ফৌজের সাথে শহরীরাও যোগ দিয়েছিল। মুসলমানরা সংখ্যায় কম হওয়া ছাড়াও তাদের আরেকটা দুর্বলতা ছিল যে তারা ছিল ক্লান্ত শ্রান্ত। একেতো এসেছে বহুদূর সফর করে তাছাড়া যুদ্ধ তো পর্যায়ক্রমে লেগেই রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে তাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু সম্মুখে দুশমনকে কাতার বন্দি দেখে তারা ঈমানী বলে বলিয়ান হয়ে বিশ্রামের কথা ভুলে গিয়ে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরী হয়ে গেল।

সম্মুখে দুশমন যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, যায়েদ ইবনে কাসাদা তার বাহিনীকে একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড় করিয়ে, দুশমনের সৈন্য সংখ্যা ও তাদের কি ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে তা লক্ষ্য করতে লাগলেন।

তিতুমীরের জানাছিল যে, মুসলমানদের তাকবীর ধ্বনী স্পেনী সৈন্যদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। তাই সে আগেই তার সৈন্যদেরকে ধ্বনী দেয়ার জন্যে হুকুম দিল। সাথে সাথে তারা যুদ্ধ শুরু করার জন্যে উস্কাতে লাগল। দুশমনের উদ্দীপনা স্পৃহা দেখে যায়েদ বুঝতে পারলেন তারা জীবন বাজী রেখে লড়ার জন্যে প্রস্তুত। মুসলমান ফৌজরা ক্লান্ত একথা ভেবে যায়েদ বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন কিন্তু এ পরিস্থিতিতে পিছু তো আর হটা যায় না তাই তিনি যেখানে ছিলেন সেখান থেকেই। ফৌজকে প্রস্তুতি নিয়ে তাকবীর দেয়ার নির্দেশ দিলেন। ফৌজের স্পৃহা-উদ্দীপনা বাড়াবার জন্যে বলতে লাগলেন,

“বর্বর ভাইরা আমার! তোমাদের স্পৃহা ও ঈমানী শক্তি যাচাই করার সময় এসেছে। আমি আরবী। আজ তোমাদের প্রমাণ করতে হবে যুদ্ধের ময়দানে আরবীদের চেয়ে বর্বররা বেশী ত্যাগী ও জানবাজ। স্মরণ রেখ! তোমাদের অন্য সাথীরা অন্য শহরের দিকে গেছে। তাদের কাছ থেকে তোমাদের তিরস্কার শুনতে না হয় যে, গ্রানাডার দিকে যারা গেছে তারা বুজদিল ও বেঈমান ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো তোমরা যদি পরাজিত হও তাহলে আল্লাহর সামনে তোমরা কি জবাব দেবে।”

এতটুকু বলার পরেই বর্বররা উচ্চস্বরে শ্লোগান দিয়ে উঠল, “আমরা তোমার সাথে আছি যায়েদ! আমরা তোমার সম্মুখে থাকব, আমরা আদৌ পলায়ন পদ হবো না।”

ঐ যুদ্ধের বিবরণদানকারী ঐতিহাসিক প্রফেসর ডিজি লেখেন, যায়েদ ইবনে কাসাদা ঘোড়ায় সোয়ার ছিলেন, তিনি ঘোড়াকে কেবলামুখী করে মাথা নত করে দোয়ার জন্যে হাত উঠালেন। তার ঠোঁট নড়ছিল, নাজানি কি বলে তিনি আল্লাহর কাছে বিজয় কামনা করছিলেন। ক্রমে তার মাথা ও হাত আসমানের দিকে উঁচু হতে লাগল। মুনাজাত শেষ না করেই তিনি বলতে লাগলেন, “হে ইসলামের রক্ষকরা! আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে বিজয়ের সুসংবাদ দান করেছেন।”

তারপর প্রায় একশত জানবাজ মুজাহিদকে পৃথক করে তাদেরকে কিছু হিদায়াত দিলেন, সে মুতাবেক তারা যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল সে রাস্তায় চলে গেল। কিছু দূর যাবার পর তারা মোড় ঘুরে উঁচু-নিচু টিলার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।

তিতুমীর মুসলমানদের সাথে আরেক বার যুদ্ধ করেছে। তারেক ইবনে যিয়াদ কি কৌশল অবলম্বন করে তাদেরকে কচুকাটা করেছিল সে তসবীর তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তাই সে তার কমান্ডার ও ফৌজদেরকে বলে দিল মুসলমানরা হামলা করার পর যদি পিছনে সরে যায় তাহলে তাদের পিছু না গিয়ে বরং তারা যেন আরো নিজেদের পিছনের দিকে চলে আসে।

এদিকে যায়েদ তার সৈন্যদেরকে বললেন, তোমরা যে ক্লান্ত-শ্রান্ত এটা যেন দুশমনের কাছে প্রকাশ না পায়। দুশমনের যে সৈন্য এখানে রয়েছে তার অধিকাংশ অন্য যুদ্ধ হতে পলায়ন করে এসেছে। তাই তাদের দিলে বর্বরদের ভয় রয়েছে ফলে এমনভাবে লড়তে হবে যাতে তাদের সে ভয় যেন আরো বেড়ে যায়। উল্টো আমাদের মাঝে যেন ভীতির সঞ্চার না হয়।

তিতুমীর তার ফৌজকে এমন জায়গায় কাতার বন্দি করেছিলেন যে তার ডানে ও বামে উঁচু টিলা থাকার দরুন সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ ছিল। যায়েদ তার সৈন্যকে তিনভাগে ভাগ করলেন। তিনি মধ্যভাগকে সম্মুখে পাঠালেন আর নিজে পিছনে থাকলেন। অপর দিকে গ্রানাডার দ্বিগুণ সৈন্য সামনে অগ্রসর হলো, তাদের পিছনে রইল তিতুমীর নিজে।

 মুসলমানরা তাকবীর দিতে দিতে দ্রুত সম্মুখে অগ্রসর হলে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেল। স্পেনী ফৌজ বুঝতে পারল না যে, মুসলমানরা ক্রমে পিছু হঠছে। তারা সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগল। তিতুমীর পিছু দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সামনে এগুতে নিষেধ করছিল।– হঠাৎ করে টিলার দু’ পাশ থেকে তিতুমীরের ফৌজের ওপর তীর-বর্শা বৃষ্টি শুরু হলো। এরি মাঝে টিলার পাদদেশ হতে বর্বর ঘোড় সোয়াররা দ্রুত বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে স্পেনী ফৌজের পশ্চাতে চলে গেল। সেদিক থেকে তারা জীবন বাজী রেখে বীরত্বের সাথে আক্রমণ করল। তীর-বর্শার আঘাতে স্পেনী ফৌজ এলোমেলো হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল।

ঐতিহাসিক নেইলপোল লেখেন, স্পেনী ফৌজের মাঝে আগে থেকেই মুসলমানদের ব্যাপারে যে ত্রাস ছিল তা তীর-বর্শার চেয়ে বেশী কাজে লাগল। ইতিপূর্বে যেসব সৈন্য অন্য যুদ্ধ হতে পালিয়ে এসে ছিল তারা এমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল যে মুহূর্তের মাঝে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল।

যুদ্ধ শুরু হবার পূর্বেই যায়েদ ইবনে কাসাদা একশ জানবাজ ফৌজকে পৃথক করে শহরের পিছনে পাঠিয়ে দিয়ে ছিলেন। তিনি তাদেরকে বলেছিলেন তারা দূর দিয়ে শহরের পিছনে গিয়ে কেল্লার দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করবে কারণ স্পেনের তাবৎ সৈন্য কেল্লার বাহিরে চলে এসেছে সম্ভবতঃ কেল্লার পাহারাতে কেউ নেই বা থাকলেও খুব কম সংখ্যক রয়েছে।

জানাবাজদের এ দল শহরের পিছনে পৌঁছে গেল। প্রাচীরের ওপর একজন দাঁড়ান ছিল সে মুসলমানদেরকে আসতে দেখে, দ্রুত ঘোড়ায় মোয়র হয়ে তিতুমীরের কাছে গিয়ে খবর পৌঁছাল যে, কিছু সংখ্যক মুসলমান পশ্চাৎ’ হতে শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিতুমীর প্রায় তিনশর মত অশ্বারোহীকে শহরের পশ্চাতে পাঠিয়ে দিল আর যেসব সৈন্য এখনো যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি তাদেরকে হুকুম দিল তারা যেন শহরের ভেতর চলে যায়।

স্পেনী ফৌজ শহরের দিকে যাবার জন্যে পিছু ফিরতেই যায়েদ ইবনে কাসাদা তার সাথে রক্ষিত ফৌজ নিয়ে পশ্চাদ হতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। হামলা যেহেতু পশ্চাৎ দিক থেকে ছিল তাই স্পেনীদের বেশ ক্ষতি হলো।

নেইলপোল লেখেন, অন্য কোন যুদ্ধে এত পরিমাণ মানুষ আর মরেনি। তিতুমীর যে তিনশ ফৌজ শহরের পশ্চাতে পাঠিয়ে ছিল বর্বররা তাদেরকে একেবারে কচুকাটা করেছিল। কোন ফৌজ যদি প্রাণ নিয়ে পালাবার সুযোগ পেয়ে ছিল তাহলে সে শহরের দিকে যায়নি, জ্ঞানশূন্য হয়ে অন্য দিকে ছুটে আত্মগোপন করেছিল।

তিতুমীরকে যুদ্ধ ময়দানে পাওয়া গেল না। স্পেনী ফৌজদের পতাকা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। যুদ্ধ শেষ হয়েছিল কিন্তু যায়েদ ইবনে কাসাদার নির্দেশ ছিল কোন দুশমনকে যেন জিন্দা না রাখা হয়।

যুদ্ধ ময়দান হতে গ্রানাডা বেশ একটু দূর ছিল। দুশমন বাহিনী পুরো সাফ করে সালার যায়েদ গ্রানাডার দিকে রওনা হলেন। তিনি তার ফৌজদেরকে সুসংবাদ দিলেন যে আল্লাহ্ তায়ালা তাদেরকে বিজয় দান করেছেন। এখন কাজ হলো কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করে শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা, সম্ভবতঃ শহরে কেউ আর প্রতিরোধ করবার নেই। যায়েদ ইবনে কাসাদা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে কেল্লার দিকে দৃষ্টিপাত করে থ’ মেরে গেলেন। কেল্লার প্রাচীরের ওপর মানুষের দরুন আরেকটি প্রাচীর তৈরী হয়েছে। অবরোধের সময় সব কেল্লার ওপরে সিপাহী থাকে কিন্তু এত পরিমাণ মানুষ তিনি ইতিপূর্বে আর কোথাও দেখেননি। প্রাচীরের ওপর যারা রয়েছে তাদের সকলের হাতে তীর-বর্শা, গায়ে বর্ম ও মাথায় লৌহ শিরস্ত্রান।

যায়েদ তার সহকারী সালারকে লক্ষ্য করে বললেন, আমরা মনে করেছিলাম যে, গ্রানাডার তাবৎ সৈন্য খতম করে দিয়েছি। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তো দেখা যাচ্ছে তার বিপরীত। ময়দানে যে সৈন্য ছিল তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী সৈন্য দেখা যাচ্ছে শহরের হেফাজতে রয়েছে তাই এখন সম্মুখে অগ্রসর হওয়া ঠিক হবে না।

পড়ন্ত বিকেল। দিবাকর হারিয়ে যাবার জন্যে উঁকি মারছে। যায়েদ ইবনে কাসাদা কেল্লা অবরোধ করলেন। মুসলমান বহু ফৌজ শহীদ হয়ে ছিলেন, অনেকে হয়েছিলেন আহত। বাকীরা পূর্ণ মাত্রায় ক্লান্ত-শ্রান্ত তারপরও সালার যায়েদ প্রাচীরের কাছে গিয়ে ঘোষণা করলেন, হে কেল্লাবাসী! তোমরা তোমাদের ফৌজের পরিমাণ লক্ষ্য কর। তোমরা যদি যুদ্ধ ব্যতীত শহরের দরজা খুলে দাও তাহলে সকলে পাবে নিরাপত্তা তানা হলে সকলকে করা হবে হত্যা।

কোন কেল্লা অবরোধ করে এমন ঘোষণা দিলে সাধারণতঃ ভেতর থেকে দাম্ভিকতাপূর্ণ জবাব আসে কিন্তু যায়েদ ইবনে কাসাদার ঘোষণার কোন জবাব এলো না।

অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ কেল্লার দরজা খুলে গেল। আর তিতুমীর সফেদ পতাকা হাতে বেরিয়ে এলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো তিতুমীর সন্ধির পতাকা নিয়ে কেবল মাত্র একজন কর্মচারীকে সাথে নিয়ে চলে এসেছে। তার সাথে কোন দেহ রক্ষী, সৈন্য সামন্ত কিছুই নেই। যায়েদ ইবনে কাসাদা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তিতুমীরকে ইস্তেকবাল জানালেন। তারপর দু’জন পরস্পরের মুখোমুখি হলেন।

তিতুমীর : এখানের যে বড় কমান্ডার তার নির্দেশে আমি আপনার কাছে এসেছি। তিনি আপনার কাছে পয়গাম পাঠিয়েছেন যে আপনি যদি অবরোধ করেন। তাহলে এক বছর অতিবাহিত হয়ে যাবে তবুও কিছু করতে পারবেন না। প্রাচীরের দিকে তাকালেই আপনি অনুধাবন করতে পারবেন যে শহরের অভ্যন্তরে কি পরিমাণ। ফৌজ মওজুদ রয়েছে।

যায়েদ ইবনে কাসালা দুভাষীর মাধ্যমে জবাব দিলেন, এত পরিমাণ সৈন্য থাকার পরেও তুমি সন্ধির জন্যে কেন এসেছ? আমার ফৌজ তো তুমি দেখছেই। আগের তুলনায় এখন আরো কমে গেছে।

তিতুমীর : আমাদের জেনারেল খুব রহম দিল ইনসান। তিনি দেখেছেন লড়াই এর দরুন তার বিপুল পরিমাণ ফৌজ হালাক হয়েছে, আপনার ফৌজের লুকসান হয়েছে। এখন আবার যদি লড়াই হয় তাহলে উভয়ের লুকসান হবে, তিনি এটা। চাচ্ছেন না। আর যদি সন্ধি না করেন তাহলে আপনাকে তো বলছিই যে আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য সামন্ত রয়েছে, আপনি কেল্লা কজা করতে পারবেন না।

যায়েদ ইবনে কাসাদ। ধোকার আশংকা করতে ছিলেন। তারপরও তিতুমীর যেভাবে প্রস্তাব পেশ করেছে তার কথা বিশ্বাস করে সন্ধি প্রস্তাবে তিনি সম্মত হলেন।

তিতুমীর বলল, তবে হ্যাঁ, সন্ধির শর্ত কিন্তু আমরা পেশ করব। আর সবচেয়ে বড় শর্ত হলো, শহরবাসীর জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর হেফাজত করার দায়িত্ব থাকবে আপনার ওপর। আপনার কোন ফৌজ কোন শহরবাসীর ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। দ্বিতীয় শর্ত হলো ভান্ডারে যে টাকা-পয়সা আছে তা আমরা স্বেচ্ছায়। আপনার সমীপে পেশ করব। তৃতীয় শর্ত থাকবে আপনি আমাদেরকে যুদ্ধ বন্ধি বানাবেন না। আর আমি আপনার পক্ষ হতে এলাকার গভর্নর নিযুক্ত হব। আপনার সকল বিধি-বিধান মেনে নিয়ে পূর্ণ মাত্রায় আপনার অনুগত থাকব।

সন্ধির এ শর্তাবলী লিপিবদ্ধ করে যায়েদ ইবনে কাসাদা তাতে স্বাক্ষর করে নিজের সীল মোহর লাগিয়ে দিলেন।

যায়েদ ইবনে কাসাদার এক সহকারী কমান্ডার একটু গোস্বার স্বরে বলল, ইবনে কাসাদা! আপনি আমাদের সকলের মৃত্যুর পরওয়ানার ওপর স্বাক্ষর করে সীল লাগিয়েছেন।

আরেকজন কমান্ডার বলল, ঠিকই ইবনে কাসাদা! মনে হচ্ছে আপনি খুব ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন তাই আপনার বুদ্ধিতে কাজ করছে না।

যায়েদ ইবনে কাসাদা : আল্লাহর ওপর আমার পূর্ণ ভরসা রয়েছে। তোমরা কি আশংকা করছ যে, তিতুমীর আমাদেরকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছেআমরা ভেতরে গেলে তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের নাম নিশানা মিটিয়ে ফেলবে।

কমান্ডাররা বলল, ঘটনা হয়তো এমনই ঘটবে।

যায়েদ ইবনে কাসাদা : তোমাদের বুদ্ধির অভাব আছে। কোন কেল্লাদার দুশমনের সামান্যতম ফৌজকেও ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় না। আমাদের তো ফৌজ রয়েছে তাদের প্রবেশের জন্যে সে সকাল বেলা দরজা খুলে দেবে। তারা। হয়তো বুঝতে পেরেছে, বর্বর মুসলমান সংখ্যায় কম হলেও তাদেরকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।

যায়েদ ইবনে কাসাদা সারা রাত ঘুমোতে পারলেন না। তিনি চিন্তা করতে ছিলেন না জানি তাকে কোন ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে কিনা। তিনি তার কমান্ডারদেরকে রাতে বিদ্রি থেকে চৌকস থাকার জন্যে এবং প্রভাতে কেল্লাতে প্রবেশ করার সময় চতুর্দিকে ভালভাবে লক্ষ্য করার নির্দেশ দিলেন।

প্রভাত হলো। এক মুজাহিদ ফজরের আযান দিলে তাবৎ লস্কর যায়েদ ইবনে কাসাদার পিছনে নামাজ পড়ল। যায়েদ তার অধিনত কমান্ডারদেরকে বললেন, কেল্লার ভেতর প্রবেশ করার সময় সবাই যেন সতর্ক থাকে।

সকাল বেলা। সূর্য উঠার পূর্বেই কেল্লার ভেতর হতে একজন এসে যায়েদ ইবনে কাসাদাকে বলল, জেনারেল তিতুমীর আপনার জন্যে ইন্তেজার করছে। যায়েদ তার সৈন্য বাহিনীকে তার পিছু পিছু আসার নির্দেশ দিয়ে আগন্তুকের সাথে রওনা হলেন।

ফৌজ পূর্ব হতেই তৈরী ছিল। যায়েদ নির্দেশ দেওয়া মাত্র তারা রওনা হয়ে গেল। ধারণা ছিল হয়তো প্রাচীরের ওপর পূর্বের ন্যায় ফৌজ থাকবে কিন্তু দেখা গেল প্রাচীরে কেউ নাই।

তিতুমীর ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে যায়েদের ইন্তেজারে ছিল। যায়েদ পৌঁছলে তাকে এস্তেকবাল করে ভেতরে নিয়ে গেল।

যায়েদ : আমার ফৌজরাও কি ভেতরে আসতে পারবে?

তিতুমীর : হ্যাঁ, তা তো বটেই। আমি কি সন্ধি পত্রে উল্লেখ করিনি যে কেল্লা আপনাকে সোপর্দ করব?

যায়েদ ইশারা করামাত্র তামাম ফৌজ কেল্লাভ্যন্তরে প্রবেশ করল এবং পূর্ব নির্দেশ মুতাবেক পূর্ণ সতর্ক রইল। কেল্লার ভেতর কোন ফৌজ চোখে পড়ল না। ঘরের ছাদে আওরাত ও বাচ্চাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। কিছু কিছু বৃদ্ধ মানুষও ছিল। এতে যায়েদের সন্দেহ আরো প্রবল হলে মনে হয় নিশ্চয় কোন ফাঁদ পাতা হয়েছে।

যায়েদ : আপনার ফৌজ ও কেল্লাদার কোথায়?

তিতুমীর : এখানে কোন ফৌজ নেই। এখানে আপনি ফৌজের একটা সদস্যও পাবেন না। আমি আপনার কাছে মিথ্যে বলেছিলাম। আমার দেহরক্ষীও নেই। যে একজন ব্যক্তি দেখেছেন সে আমার ব্যক্তিগত কর্মচারী, আমাকে ছেড়ে যেতে সে রাজী হয়নি।

যায়েদ : আমি তোমার একথা কি বিশ্বাস করব?

তিতুমীর: ফৌজ এমন কোন ছোট জিনিস নয়-যে তা লুকিয়ে রাখব। এ সারা শহর আপনাকে সোপর্দ করেছি। আপনার কাছে ফৌজ আছে। শহর তল্লাশী করে দেখতে পারেন। আমাকে ছাড়া এখানে আপনি কোন সৈন্য দেখতে পাবেন না। আমার তাবৎ ফৌজ আপনার হাতে কতল হয়েছে আর যারা জীবিত আছে তারা। পালিয়ে গেছে।

যায়েদ : তুমি মিথ্যে বলছ। দেয়ালের ওপর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে ফৌজ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সে সৈন্য আমি দেখতে চাই।

আবাল-বৃদ্ধ জনতার দিকে ইশারা করে হেসে তিতুমীর বলল, এরা হলো সে ফৌজ যাদেরকে আপনি প্রাচীরে দেখেছিলেন, আপনি যদি দেখতে চান তাহলে তা আমি আবার দেখাতে পারি। আমি ধোকা দিয়ে সন্ধি পত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছি। আমার কাছে কোন ফৌজ নাই। তাই পলায়ন করার পরিবর্তে এ পদ্ধতি অবলম্বন। করেছি। যাতে আপনি মনে করেন কেল্লা অভ্যন্তরে বিপুল পরিমাণ সৈন্যের সমাবেশ রয়েছে।

যায়েদ : এ প্রতারণার কি দরকার ছিল? তুমি কি এ বৃদ্ধ বনিতাকে আমাদের হাতে কতল করাতে চাচ্ছিলে? আমি যদি কেল্লা আক্রমণের ইচ্ছে করতাম তাহলে এ নিষ্পাপ শিশু-কিশোররা তো আমাদের তীর বর্শার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতো। আর তুমি মনে করোনা যে আমি তোমার ফৌজ দেখে ভীতু হয়ে সন্ধি করেছি।

তিতুমীর : আমি জানি আপনাকে ভীতি প্রদর্শন সম্ভব নয়। আর আমি আপনাকে ভয়ও দেখাই নাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল আপনি এমন পদ্ধতি গ্রহণ করেন যাতে দ্বিতীয় বার যেন আর রক্তপাত না ঘটে। আমি আপনাকে পূর্ণ মাত্রায় আশ্বস্তঃ করছি যে, আপনার সাথে আমি যে অঙ্গিকারাবদ্ধ হয়েছি তা কোন চালবাজী নয় প্রকৃত অর্থেই আমি আপনার আনুগত্য স্বীকার করেছি। আমি আমার নিজস্ব কোন ফৌজ তৈরী করব না বরং পরিপূর্ণভাবে আপনার অধীনত থাকব।

ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেন তিতুমীরের বুদ্ধিমত্তা দেখে যায়েদ এত পরিমাণ প্রভাবান্নিত হন যে প্রধান সেনাপতি তারেক ইবনে যিয়াদের অনুমতি ছাড়াই তিনি তিতুমীরকে গ্রানাডার গভর্নর নিযুক্ত করেন তবে তাকে এক আরবী শাসনকর্তার অধীনে রাখেন।

গ্রানাডার অধিবাসীদের মাঝে ইহুদীদের সংখ্যাধিক্য ছিল। তারা রডারিকের শাসনে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল তাই তারা মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। গ্রানাডার সরকার পরিচালনার জন্যে যায়েদ মুসলমানদের সাথে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকেও নিয়োগ করেছিলেন। প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার মত লোক বেশ অভাব ছিল মুসলমানদের মাঝে। এ অভাব মিটানোর জন্যে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে এসব কাজে নিযুক্ত করতে হতো। পরিণামে ঐ ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা বিদ্রোহ করেছে এবং ইসলামী সালতানাতানের ক্ষতি সাধনের জন্যে সর্বোপরি চেষ্টা করেছে।

যে সময় মুগীছে রূমী ও যায়েদ ইবনে কাসাদা নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে আপন গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক সে সময় তারেক ইবনে যিয়াদও টলেডোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। টলেডো যেহেতু রাজধানী ছিল এজন্যে জুলিয়ন ও আওপাস তারেকের সাথে ছিল। টলেডো শহর কেবল দরিয়ার পাড়েই ছিল না বরং দরিয়া দ্বারা তা বেষ্টিত ছিল। দরিয়ার কিনারাতেই একটি ঝিল ছিল যাতে দরিয়ার পানি এসে জমা হতো। এ ঝিলের পাড়েই মেরীনার সাথে আওপাসের সাক্ষাৎ হয়েছিল।

টলেডো শহর একদিকে তো সাগর বেষ্টিত অপর দিকে কেল্লা বন্দি এ শহর বেশ উঁচুতে ছিল। কেল্লা ও শহরের প্রাচীর খুব ভারী ও বড় মজবুত পাথর দ্বারা তৈরী করা, হয়েছিল। শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীরের আশে-পাশে ছিল গভীর ও প্রশস্ত পরিখা। যারাই সিংহাসনে বসেছে তারাই শহরের প্রতি রক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করেছে।

তারেক ইবনে যিয়াদ ময়দানে-পাহাড়ে সামনা-সামনি লড়াই করেছেন। বার হাজার সৈন্য দ্বারা এক লাখ সৈন্য পরাস্ত করেছেন। কিন্তু কেল্লা কবজা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। তার কৌশল-পদ্ধতিও আলাদা। তারপর টলেডোর মত শক্তিশালী ও মজবুত হলে তো কোন কথাই নেই। আল্লাহর ওপর ভসরা করে তারেক সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন।

টলেডোতে বাদশাহ রডারিকের মাতম চলছিল। কেবল শাহী মহল নয় বরং গোটা শহর বিষণ্ণতার চাদর ডেকে নিয়ে ছিল। রডারিকের এক লাখ ফৌজের কিছু পলায়নকৃত ফৌজ টলেডোতে পৌঁছেছিল এ ছাড়া অন্যান্য যুদ্ধ থেকেও পলায়ন পদ সৈন্যরাও সেখানে একত্রিত হয়েছিল। তারা সেখানে পৌঁছে মুসলমানদের ব্যাপারে মানুষের মাঝে এমন প্রচারণা চালিয়ে ছিল যে মুসলমানরা যেন এমন হিংস্র বাঘ সিংহ যে যাকে সামনে পায় তাকে মুহূর্তের মাঝে খতম করে দেয়।

রডারিক যখন ভূমধ্য সাগরের যুদ্ধের জন্যে স্বেচ্ছালোক সংগ্রহ করছিল তখনও টলেডোতে মুসলমানদের ব্যাপারে নানা ধরনের প্রচারনা চলছিল। যেমন একে অপরে বলাবলি করছিল,

“তারা মুসলমান বা অন্য যাই হোকনা কেন তারা মানুষ নয়। অন্য কোন মাখলুক।”

“তারা নেকড়ে বাঘ, অজগর, সম্মুখে যা পায় তা গ্রাস করে চলে যায়।”

“বাদশাহ্-রডারিকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।”

“তারা আমাদের বাদৃশাহকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে।”

 “এটা তাদের অভ্যাস, তারা যাকে পরাজিত করে তার গোস্ত তারা ভক্ষণ করে।”

তারা এদিকে আসছে, লুটতরাজের কোন সীমা থাকবে না।” : এ ধরনের নানা প্রচারনা টলেডোর মানুষের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করে চলছিল।

মানুষের ঘরে ধন-দৌলত, যুবতী ললনা ছিল কিন্তু কেউ তার কোন চিন্তা করছিল না সকলেই নিজের জীবনের চিন্তে করছিল। ধনী-গরীব সকলে নিজের জান বাঁচানোর চেষ্টা করছিল।

তৎকালে এটাই স্বাভাবিক ছিল যে, বিজয়ীরা লুটতরাজ ও মানুষের ইজ্জত আব্র হরণ করতো। যার ফলে মানুষ পলায়ন করে চলে যেত। সুতরাং মুসলমানদের ব্যাপারে এসব-প্রচারণা মানুষের কাছে কোন আশ্চর্যজনক কিছু মনে হলো না। তাই টলেডো ছেড়ে জনসাধারণ পলায়ন করতে লাগল ফলে কিছু দিনের মাঝেই পুরো শহর জনশূন্য হলো। কেবল সেনা সদস্যরা রয়ে গেল, তারাও ছিল একেবারে ভীত-সন্ত্রস্ত।

ফৌজ ছাড়া শহরে আর যেসব লোকছিল তারা হলো ইহুদী ও গোথা সম্প্রদায়ের লোক। তারা মুসলমানদের পক্ষে ছিল। মুসলমানদের ব্যাপারে উদ্ভট প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে এরাই মানুষের মাঝে বেশী ত্রাস সৃষ্টি করেছিল।

***

টলেডোতে বেশ অনেকগুলো গির্জা ছিল তার মাঝে একটা ছিল বড় গির্জা। গির্জাতে ছিল যাজিকা ও বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ। পূর্বেই বলা হয়েছে গির্জার পাদ্রীরা নিজেদেরকে খোদা প্রেরিত ফেরেশতা ও দুনিয়া ত্যাগী বলে দাবী করত, বস্তুত তারা ছিল ভোগবিলাসী, দুনিয়াদার ও প্রবৃত্তি-পূজারী। বাদশাহদের কাছ থেকে তারা জায়গীর নিয়েছিল। জায়গীরের অর্থ সম্পদ ছাড়াও গির্জার নামে তারা মানুষের কাছে পয়সা নিয়ে সম্পদের বিশাল ভান্ডার গড়ে তুলেছিল। সকল পাদ্রী বড় পাদ্রীর কাছে গিয়ে বলল, এত বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ সোনা-দানা, টাকা-পয়সা কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়?

বড় পাদ্রী বলল, অবশ্যই কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার। এত পরিমাণ সম্পদ সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সাথে যদি নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে নিজেদের লোকরাই তা লুট করে নিবে। সুতরাং তাবৎ ধন-সম্পদ, মনি-মুক্তা, টাকা-পয়সা একত্রিত করে আন্ডার গ্রাউন্ডে গর্ত করে সবকিছু মাটিতে পুঁতে রাখ।

রাতে সম্পদের বাক্স প্রধান গির্জার আন্ডার গ্রাউন্ডে পৌঁছে গেল। আন্ডার গ্রাউন্ডে ফ্লোর খুঁড়ে তাবৎ খাজানা মাটি চাপা দিয়ে রাখা হলো। পাশে রয়ে গেল প্রায় ছয় ফুট লম্বা ও তিনফুট চওড়া একটা গর্ত। খননকারী ছিল তিনজন, তাদের কাজ প্রায় শেষের পথে এরি মাঝে বড় পাদ্রীর ইশারায় আরো তিনজন ব্যক্তি খোলা তলোয়ার হাতে সেখানে প্রবেশ করল।

বড় পাদ্রী খননকারীদেরকে নির্দেশ দিল গর্তের মাঝে যে অবশিষ্ট মাটি রয়েছে তা তুলে ফেল। নির্দেশ মুতাবেক তারা মাটি উঠানোর জন্যে ঝুঁকার সাথেসাথে তলোয়ার ধারীরা তিন খনন কারীর গর্দান উড়িয়ে দিল। তারপর খালী গর্তে তাদের লাশ রেখে মাটি চাপা দিয়ে দেয়া হলো। বড় পাত্রী বলল, এখন এ তাবৎ সম্পদ পূর্ণ মাত্রায় নিরাপদ হয়ে গেল, আর কেউ ছিন্তাই বা নষ্ট করতে পারবে না।

তারপর প্রধান পাদ্রী আন্ডার গ্রাউন্ডের ঢাকনা ফেলে দিয়ে তার ওপর ফরশ বিছিয়ে একটা টেবিল রেখে দিল আর সে টেবিলের ওপর ক্রসবিদ্ধ অবস্থায় হযরত ঈসা (আ)-এর মূর্তি রেখেদিল।

প্রধান পাদ্রী বলল,এখন আমাদের এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়া দরকার। নতুন বিজয়ীরা আসুক। তারপর পরিস্থিতি শান্ত হলে আমরা ফিরে আসব। আমাদের সম্পদাদি হেফাজতে থাকবে। আর একটা কথা ভাল করে শুনে নাও, একজন যুবতী যাজিকাও যেন এখানে না থাকে তাহলে মুসলমানরা তাদেরকে দাসীতে পরিণত করবে।

***

সূর্য দেবী সবেমাত্র অস্তমিত হয়েছে। তারেক ইবনে যিয়াদ টলেডো থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরত্বে রয়েছেন। ফৌজ রয়েছে তাবুতে। তিনি জানেন না তার সাথী মুগীছে রূমী ও যায়েদ ইবনে কাসাদা কি অবস্থায় আছে।

টলোডা হতে বার/তের মাইল দূরে দু’শ আড়াই শ নারী-পুরুষ, শিশু কিশোরের আরেকটি কাফেলা অবস্থান করছে তবে সে কাফেলা কোন ফৌজের নয়। স্বয়ং প্রধান পাদ্রী সে কাফেলাতে আরো দু’চারজন পাদ্রীসহ রয়েছে। কাফেলা খোলা আসমানের নিচে গভীর ঘুমে অচেতন। তাদের সোয়ারী গুলো পাশেই বাঁধা রয়েছে।

রাত্রি দ্বিপ্রহর। কাফেলার অদূরে একটি গাছের ওঁতে আয়না মেরী নাম্নী এক যুবতী ললনা নিষপলক নেত্রে চেয়ে আছে কাফেলার দিকে। তের-চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে গির্জায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখন তার বয়স বাইশ-তেইশ বছর। বাহ্যিকভাবে তো তাকে ধর্ম যাজিকা বানানো হয়ে ছিল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাকে, পাদ্রীরা বানিয়ে ছিল উপ-পত্নি। আর এরূপ পত্নী বানানকে পাদ্রীরা অধিকার বলে মনে করত।

নিদ্রিত কাফেলার কাছ থেকে একটি ছায়া মূর্তি ধীরে ধীরে আয়না মেরির কাছে গিয়ে পৌঁছল।

আয়না মেরী : সেই কখন থেকে তোমার প্রতিক্ষায় আছি। তুমি এভাবে খালি হাতে কেন এলে জিমি? ঘোড়া কোথায়? দ্রুত ঘোড়া নিয়ে এসো, এখান থেকে আমাদের ফিরে যেতে হবে।

 জিমি : কি হয়েছে সব কিছু খুলে বল মেরী! তুমি কেবল এ গাছের দিকে ইশারা করে রাত্রি দ্বিপ্রহরে দু’টো ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলে।

মেরী যে গির্জায় যাজিকা ছিল সেখানে নওকর ছিল পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের সুদর্শন যুবা জিমি। তার শয়ন স্থল গির্জার ভেতরেই ছিল। মেরী তাকে দেখা মাত্র তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সে গির্জাতে আরো চার-পাঁচ জন যাজিকা ছিল কিন্তু মেরীর বদকিসমত সে ছিল তাদের সকলের চেয়ে কম বয়সী ও সবচেয়ে সুন্দরী। মাঝ বয়সী পাদ্রীরা তাকে ভোগ্য বস্তু বানিয়ে রেখেছিল।

জিমির সাথে প্রথম সাক্ষাতে মেরী অনুভব করতে পেরেছিল যেমনিভাবে তার হৃদয় গভীরে জিমির প্রেম-ভালবাসা আসন গেড়ে বসেছে ঠিক তেমনিভাবে জিমিও তার জন্যে বেকারার হয়ে উঠেছে। প্রথম মুলাকাতেই মেরী তার ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় খুলে দিয়েছিল। বলেছিল তার শত-সহস্র বেদনার কথা। সে বলেছিল তাকে তের চৌদ্দ বছর বয়সে কিভাবে জোর পূর্বক গির্জাতে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং তাকে বুঝানো হয়েছিল খোদা তাকে তার বন্দেগীর জন্যে নির্বাচন করেছেন ফলে দুনিয়ার সাথে এখন তার তাবৎ সম্পর্ক চুকে গেছে।

প্রথম মুলাকাতেই মেরী কান্না মাখা গলায় জিমিকে বলেছিল,

“কিন্তু পাদ্রীরা আমার সাথে যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ও যে আচরণ করেছে তাতে তারা আমাকে ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী করে তুলেছে। ঈসা মসীকে একবার গুলিতে চড়ান হয়েছিল। আর আমি প্রতিদিন, প্রতিটি রাত্রে শুলিতে চড়ি। ঈসা মসীকে হাতে-পায়ে কিলক বিদ্ধ করা হয়েছিল। আর আমার হৃদয় অন্তরে কিলক মারা হয়। প্রতি রাত্রে, প্রতিটি মুহূর্তে আমি ধুকে ধুকে মরি। আমি তো একজন পতির স্বপ্ন দেখতেছিলাম। আমি খোদার মহব্বত চাই না। আমি চাই এক ইনসানের ভালবাসা-মহব্বত। কিন্তু আমাকে কে ভালবাসবে? কে আমাকে তার হৃদয় গভীরে স্থান দেবে? আমি নিজেই আমার শরীর থেকে দুর্গন্ধ পাই, আমার নিজেকে ঘৃনা হয়। তুমিও কি আমাকে ঘৃণা করবে জিমি?

জিমিঃ তোমার শরীরের প্রতি আমার কোন মোহ নেই, নেই কোন কাংখা। আমার লক্ষ্য, আমার চাওয়া-পাওয়া কেবল মাত্র তোমার হৃদয়-মন।

যে মায়া-মমতা, প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক হৃদয়-মনের সাথে, শরীরের সাথে নয় জিমি প্রথম সাক্ষাতে মেরীকে সে ভালবাসা ও প্রেমের কথা বলেছিল। মেরি এতদিন আর কাংখায় ছিল কাতর তা সে পেয়েছিল। তারা দু’জন সেথা হতে পলায়নের অঙ্গিকার করেছিল। কিন্তু গীর্জা থেকে কোন যাজিকা পালিয়ে যাবে এটা ছিল একেবারেই অসম্ভব। প্রতিটি গীর্জার যুবতীরা কয়েদীর মত বসবাস করত। তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ এমন স্বতন্ত্রধর্মী ছিল যে কোন যাজিকা পালিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখা তার জন্যে ছিল একেবারেই অসম্ভব। জিমির ঘরও ছিল দূরে। টলেডোতে তার এমন কেউ ছিল না যে, সেখানে মেরীকে লুকিয়ে রেখে পরে সময় মত পালিয়ে যাবে। তার পরও তারা প্রতিক্ষা করে ছিল পালিয়ে যাবার জন্যে।

ছ’ মাসে তাদের প্রেম-ভালবাসা এমন পর্যায় পৌঁছেছিল যে তাদের বিচ্ছেদের কথা চিন্তা করাই ছিল অবান্তর। তারা একে অপরের জন্যে জীবন উৎসর্গ করাকে, মামুলী জ্ঞান করত। ২. তারপর টলেডোতে মুসলমানদের ভয়-ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। কিছু দিনের মাঝেই মানুষ শহর ছেড়ে চলে যেত লাগল।

একদিন জিমি মেরীকে বলল, মেরী! এখন সুযোগ এসেছে, শহরের দরজা সর্বদা খোলা। মানুষ দলে দলে পরিবার পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমরাও আমাদের পোষাক বদলিয়ে পালিয়ে যেতে পারি।

মেরী : এখন তারা আমার প্রতি আরো বেশী নজর রাখছে। আমি সামান্যতম একটু এদিক-সেদিক গেলে তারা পাগলের মত তালাশ করতে থাকে।

জিমিঃ প্রধান পাদ্রীর কামরাতে তোমার পরিবর্তে অন্য কোন যাজিকাকে পাঠিয়ে দাও।

মেরী : আমাকে ছাড়া সে অন্য কোন নারীর প্রতি ঘুরেও তাকায় না। আমাকে ছাড়া তার অবস্থা এমন হয়, যেমন তোমাকে ছাড়া আমার অবস্থা আর আমাকে ছাড়া তোমার অবস্থা হয়।

জিমি : তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমি তাকে হত্যা করতে পারি, তারপর দু’জন নিরাপদে শহর থেকে বেরিয়ে যাব।

মেরী : না জিমি! না, তুমি ধরা পড়ে যাবে। আমি নিজের জন্যে কোন চিন্তা করি না, আমিতো মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করতে চাই। তবে তোমার জন্যে আমার চিন্তে হয়।

আরো বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। জিমি বারবার কেবল পাদ্রীকে হত্যার কথা বলতো। স্পেনের রাজধানী টলেডোতেও কোন শাসনকর্তা ছিল না। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে কেউ রাজ কার্য সম্পাদনও করছিল না।

সাত সকালে শহরের ফটক খুলে দেয়া হতো আর গভীর রজনী নাগাদ তা ঐভাবে উম্মুক্ত থাকতো।

টলেডোর এ অবস্থা সম্পর্কে তারেক ইবনে যিয়াদ অবগত ছিলেন না। জুলিয়ন ও আওপাস তাকে বলেছিল, টলেডোতে প্রবেশ করা বড়ই কঠিন হবে। রডারিকের উত্তসূরীরা জীবনবাজী রেখে শহর হিফাজতের জন্যে লড়ে যাবে ফলে অবরোধ বেশ লম্বা হবার সম্ভাবনা।

***

মেরী জিমিকে লক্ষ্য করে বলল, দিনের বেলা তোমাকে আমি সব কথা বলতে পারিনি। আমাদের পাদ্রী প্রধান গীর্জাতে ধন-সম্পদ লুকিয়ে এসেছে। সে আমাকে এত মুহব্বত করে যে তার পূর্ণ বিবরণ আমাকে সে দিয়েছে।

জিমি : সে সম্পদের সাথে আমাদের কি সম্পর্ক?

মেরী : সে সম্পদ্ধ আমাদের হস্তগত করতে হবে।

জিমি : তোমার দেমাগ ঠিক নেই। আমরা সম্পদ আরোহণ করে কি করব? সে সম্পদ বা কোথায় রাখব?

মেরী : তাবৎ সম্পদ আমরা উঠাব না; বরং আমাদের প্রয়োজন মত আরোহণ করব। শহরে আমাদের বাড়ীতে থাকব। আমাদের বাড়ী খালী পড়ে রয়েছে। বাড়ীর সবাই চলে গেছে।

জিমি : মুসলমানরা আসলে পরে কি করবে?

মেরী : আমরা মুসলমান হয়ে যাব। শুনেছি ইসলাম গ্রহণ করলে মুসলমানরা খুব ভাল ব্যবহার করে।

জিমি তো আর ফেরেশতা নয় যে তার সম্পদের লালসা ছিল না। তাছাড়া মেরীর প্রেম তো ছিলই তাই সে টলেডো প্রত্যাবর্তনের জন্যে প্রস্তুত হলো।

কাফেলা গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত। জিমি ধীর পদে তার ঘোড়ার কাছে গিয়ে তা নিয়ে ফিরে এলো মেরীর কাছে। তারপর মেরীকে সম্মুখে বসিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিল। কাফেলার কোন সদস্য বিন্দুমাত্র খবরও পেলনা যে এক অশ্ব দু’সোয়ারী নিয়ে তাদের ছেড়ে চলে গেল।

পূর্ব দিগন্তে আলোর ঝলক উঠতেই কাফেলা রওনা হবার জন্যে তৈরী হলো। মেরী ও জিমিকে না পেয়ে প্রধান পাদ্রী ঘোষণা করে দিল। “সে লাড়কী তার বিবি, বেটী কিছুই না, সে চলে গেছে তাতে এতো হৈ চৈ করার কি আছে; এ ধরনের আরো নানা কথা বলে অন্য পাদ্রীরা তামাশা করতে লাগল। তার পছন্দ হয়েছে চলে গেছে এতে ভাল হয়েছে, সফরে এত সুন্দর ললনা না থাকাই ভাল। আমাদের সাথে আরো মেয়ে আছে তারাও যদি পালিয়ে যায় তাহলে কোন অসুবিধা নেই বরং আরো ভাল। এসব কথা শুনে প্রধান পাদ্রী নিশ্চুপ হয়ে গেল। কাফেলা রওনা শুরু করল। তারা রোমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। রোমে ছিল তাবৎ গীর্জার মারকাজ ও পোপের হেড কোয়ার্টার।

সকাল হতে না হতেই মেরী ও জিমি টলেডোতে পৌঁছে গেল। তারা শহরের প্রধান ফটক খোলার অপেক্ষায় রইল। ফটক খোলার সাথে সাথে তারা শহরে প্রবেশ করল। মেরী জিমিকে নিয়ে তার নিজ আবাসস্থলে ফিরে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল ঘরের আসবাব পত্র সব ঠিক ঠাক পড়ে আছে যেন ঘরের মানুষ কিছুক্ষণের জন্যে বাহিরে গেছে এখনই ফিরে আসবে।

গভীর রজনী। দু’জন পায়দল হেঁটে চলল প্রধান গীর্জার দিকে। তাদের ধারণা ছিল গীর্জার গেইটে তালা লাগান থাকবে কিন্তু তারা গেইট উম্মুক্ত পেল। গীর্জার ভেতর নিবিড় অন্ধকার। এর চেয়ে আরো বেশী আঁধার হলেও জিমি-মেরী গীর্জায় প্রবেশ করতে পারবে, কারণ গীর্জার প্রতিটি আনাচে-কানাচ সম্পর্কে তারা পূর্ণ ওয়াকিফ।

মশাল, খঞ্জর ও কোদাল হাতে তারা আন্ডার গাউন্ডের প্রবেশ দ্বারে পৌঁছে গেল। তারপর মশাল জ্বালিয়ে নিচে চলে গেল। মেরী বলল, দেখলে আমরা কত সহজে এখানে পৌঁছে গেলাম।

জিমি : এখানে যে বিপুল পরিমান মাল-সম্পদ রয়েছে তা সবতো আমরা উঠাতে পারব না।

মেরী : যতটুকু পারি ততটুকু নিয়ে যাব।

জিমি : এখানে আমি কিছুই রেখে যাব না। যা পারি তা নিয়ে তোমাদের ঘরে রেখে এসে পুনরায় আবার আসব। সমস্ত ধন-সম্পদ তোমাদের ঘরে পুঁতে রাখব। মুসলমানরা যদি আসে তাহলে আমরা বাহ্যত মুসলমান হয়ে যাব ফলে তারা আমাদের বাড়ীতে আক্রমণ করবে না। বাড়ীর অভ্যন্তরে আমরা ঈসায়ী ধর্ম পালন করব।

মেরী : ধর্মের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। কেউ মুসলমান হোক বা খ্রীস্টান তা আমার কাছে সমান সমান। তুমি খনন কাজ শুরুকর। খনন করার প্রয়োজন ছিল না। মাটি সরানোর প্রয়োজন ছিল। জিমি অতি দ্রুত মাটি সরাতে লাগল। এক স্কুপের মাটি প্রায় শেষ হয়ে গেছে অল্প কিছু বাকী। আরো কিছু মাটি সরাতেই জিমি লাফ দিয়ে পিছু হটে এলো, যেন ফনাদার সর্প বের হয়ে হঠাৎ তার ওপর হামলা করেছে।

মেরী : কি হলো, অমন করছ কেন?

 জিমি : সামনে এসে তুমিও দেখ কেমন খাজানা।

মেরী : মশাল হাতে গর্তের কাছে গিয়েই চিৎকার মেরে উঠল। গর্তে তিনটি লাশ পড়ে আছে। লাশের সাথে কোন মাথা নেই, কেবল ধড় পড়ে আছে। মেরী কাঁপতে কাঁপতে জিমিকে জড়িয়ে ধরল।

জিমি : লাশের গায়ের রক্ত এখনো শুকোয়নি। মনে হচ্ছে যেন সবেমাত্র কেউ তাদেরকে হত্যা করে দাফন করে গেছে।

মেরী : তাদেরকে কতল করা হয়েছে কেন?

জিমি : এরা হয়তো খাজানার খবর জানত। তাই তারা খানাজা নিতে এসেছিল আর পাদ্রী মনে হয় কিছু পাহারাদার রেখে গেছে তারা এদেরকে হত্যা করে অথবা এরা বেশী সংখ্যক লোক এসেছিল এদের বাকী সাথীরা শরীক কমানোর জন্যে এদেরকে হত্যা করেছে।

মেরী : তাহলে তো খাজানা আর নেই।

 জিমিঃ তুমি সরে যাও আমি আরেক স্তূপের মাটি সরিয়ে দেখছি। জিমি দ্বিতীয় স্তূপের মাটি সবে সরানো শুরু করেছে হঠাৎ এক ব্যক্তি তলোয়ার হাতে দৌড়ে এসে জিমির ওপর আক্রমণ করে বলতে লাগল, এ খাজানা আমার। এর কারণে আমি একাকী এখানে রয়ে গেছি।

তলোয়ারের আঘাতে জিমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হামলাকারী মেরীর প্রতি আক্রমণের জন্যে উদ্যত হতেই মেরী তার হাতের জ্বলন্ত মশাল তার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল। মশালের আগুনে তার চেহারা পুড়ে গেল। তলোয়ার হাত থেকে পড়ে গেল। সে বেহুঁশ হয়ে বসে পড়ল মাটিতে।

 মেরী মশাল তুলে নিয়ে দ্বিতীয়বার আবার তার চেহারার ওপর ছুঁড়ে মারল। চেহারা আরো ঝলসে গেল। তারপর সে মাটিতে পড়ে গেলে মেরী তার খঞ্জর বের করে আক্রমণকারীর বুকে আঘাত হানল।

জিমি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে বলল, মেরী! দ্রুত এখান থেকে পালিয়ে যাও।

মেরী : না, তোমাকে এখানে রেখে আমি আদৌ যাব না। মেরী জিমির কাছে গিয়ে তার মাথা কোলে নিতেই জিমি নিঃশ্বেস ত্যাগ করে চিরতরে বিদায় নিলো। আক্রমণকারী আগেই মারা গেছে।

মশাল গালিচার ওপর পড়ে জ্বলছে। খাজানার স্তূপের উপর দুটো লাশ পড়ে আছে। তাদের শরীর হতে রক্ত বেয়ে পড়ছে।

মেরী ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। হঠাৎ তার মনে হলো আরো কেউ আসতে পারে। হয়তো গির্জাতেই কেউ আছে। সে মশাল ফেলে রেখেই আন্ডার গ্রাউন্ড হতে ওপরে উঠে এলো। নিচের সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। নিকষ কালো আঁধার। সে যদি গীর্জা সম্পর্কে ওয়াকিফ না হত তাহলে কোন কিছুর সাথে ঠোকর খেয়ে পড়ে থাকত। গীর্জা হতে বেরিয়েই সে দৌড়াতে লাগল।

স্পেনের রাজধানীতে নিথর নিস্তব্ধ ভীতিকর রজনী। শহরের অধিকাংশ বাড়ী শূন্য পুরীতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা একজন যুবতী রমণীর জন্যে বড়ই ভয়ংকর। সে নিজেকে আরো সাহসী করে রওনা হয়ে এক সময় নিজ বাড়ীতে পৌঁছে গেল। বাড়ীতে পৌঁছে ঘরের ভেতর হতে দরজা বন্ধ করে দিল।

৭১২ খ্রীস্টাব্দের পড়ন্ত বিকেল। আমীরে আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইর ১৮ হাজার লস্কর নিয়ে স্পেনের দক্ষিণ সীমান্তে অবতরণ করলেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদের সাহায্যে স্পেনে পৌঁছননি। স্পেন বিজয় নায়ক তারেক ইবনে যিয়াদকে অবহিত করা হচ্ছিল। তারেকের বিজয় সংবাদ খলীফা ওয়ালীদের কাছে পৌঁছেছিল। স্বয়ং খলীফা তারেকের কাছে পত্র প্রেরণ করেছিলেন। তারেক ছিলেন মুসার আজাদকৃত গোলাম। তার আজাদকৃত গোলামকে স্পেন বিজেতা বলা হবে এটা হয়তো মুসা ইবনে নুসাইর স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি।

ঐতিহাসিকরা লেখেন, সে সময় মুসা ইবনে নুসাইরের বয়স হয়েছিল আশি বছর। বুদ্ধির প্রখরতা কমে এসেছিল। তাই তার অধীনত ও মুশীরদের পরামর্শে তিনি সাধারনতঃ কাজ করতেন। এসব পরামর্শ দাতারাই তাকে বুঝিয়ে ছিল যে, স্পেনের মত বিশাল সাম্রাজ্যের বিজয় নেতা হিসেবে আপনার একজন সাধারণ কৃতদাসকে অভিহিত করা হবে এটা সমীচীন নয়। আপনার জন্যে অসম্মানও বটে। তাছাড়া তারেক ছিলেন অনারব বর্বর মুসলমান। আর মুসা ছিলেন আরব। আর অনারবদের প্রতি আরবদের হেয় দৃষ্টি সব সময় ছিল এবং এখনও আছে। তাই মুসা ইবনে নুসাইর হয়তো বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন নি। ফলে তিনি নিজে বিশাল সৈন্য সামন্ত নিয়ে রওনা হয়েছিলেন স্পেন পানে।

তারেক ইবনে যিয়াদ যেসব এলাকা জয় করে সম্মুখে অগ্রসর হয়েছিলেন তার মাঝে দুটো প্রসিদ্ধ এলাকা মেদুনা-শেদুনা ও কারমুনা ছিল। মুসা ইবনে নুসাইরের গোয়েন্দারা তাকে খবর দিয়েছিল যে, তারেক ইবনে যিয়াদ দুই শহরে রাজকার্য। পরিচালনার জন্যে খ্রিস্টানদের নিয়োগ করেছেন। তারেকের এটাও কমতি ছিল যে, রাজকার্য পরিচালনার মত উপযুক্ত লোক তার ফৌজে ছিল না। মুসা ইবনে নুসাইর অবগত হলেন ঐ দুই শহরে খ্রিস্টানরা বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মুসা ইবনে নুসাইর হঠাৎ করে ঐ দুই শহরে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে হাজির হয়ে শহর নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আরবী গভর্নর নিয়োগ করলেন। মুসা ইবনে নুসাইরের কৃতিত্ব তো এতটুকুই ছিল যে, দুটো শহরে হয়তো বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতেছিল তিনি তা নিভিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দামেস্কে খলীফার দরবারে খবর পাঠান হলো তিনি ঐ দু’শহর জয় করেছেন।

মুসা ইবনে নুসাইর যখন ইসাবেলা শহরের দিকে অগ্রসর হলেন তিনি যুদ্ধের সম্মুখিন হলেন। তারেক ইবনে যিয়াদ এসব ছোট খাটো শহর ছেড়ে দিয়েছিলেন কারণ তার কৌশল ছিল টলেড়ো হলো রাজধানী এমনিভাবে কর্ডোভা ও গ্রানাডা স্পেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর এ তিনটা শহর হাতে এলে বাকীগুলো এমনিতেই এসে যাবে। তখন দুশমনরা মনোবল হারিয়ে ফেলে রনে ভঙ্গ দেবে। যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে তারেকের এটা বিরাট বড় বিচক্ষণতা ছিল।

মুসা ইবনে নুসাইর ধারনা করেছিলেন, অতি সহজেই তিনি ইসাবেলা হস্তগত করতে পারবেন কিন্তু সেখানে গিয়ে যখন শহর অবরোধ করলেন তখন বুঝতে পারলেন তার ধারণা ঠিক নয় এবং এত সহজে শহর কজা করা যাবে না।

শহরবাসী প্রতিরোধের ব্যবস্থা এরূপ করল যে, সকাল বেলা হঠাৎ করে শহরের ফটক খুলে যেত আর ঘোড় সোয়াররা বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার মত এসে মুসলমানদের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে শহরে ফিরে যেত। তারা কখন কোন দিন আসবে তা কিছুই জানা যেত না।

মুসা ইবনে নুসাইর এ অবস্থা মুকাবালার অনেক কোশেশ করলেন, কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পেলেন না, অবরোধ দীর্ঘায়ীত হতে লাগল। মুসা অভিজ্ঞ সালার ছিলেন, তিনি নিজে যুদ্ধের ময়দানে মামুলী ফৌজের মত লড়াই করেছেন কিন্তু এখন তিনি উপনীত হয়েছেন বার্ধক্যে, আগের মত তকত আর নেই।

ঈসায়ী ফৌজ হররোজ তার ফৌজের লোকসান করতে লাগল, তিনি খুঁজে পেলেন না কি করবেন। পরিশেষে তার দু’ ছেলে আব্দুল্লাহ্ ও মারওয়ান বীরত্ব প্রদর্শন করলেন। তারা পদ্ধতি অবলম্বন করলেন, ঈসায়ী ফৌজ যখন বাহিরে এসে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করে তখন তারা দু’জন তাদের ঘোড় সোয়ার দ্রুত হাঁকিয়ে একদম প্রাচীরের কাছে গিয়ে দুশমনের পিছনে অবস্থান করে তাদের শহরে ফিরে যাবার রাস্তা বন্ধ করে দিল তারপর তাদের ওপর পশ্চাৎ-সম্মুখ হতে. আক্রমণ করে হালাক করা হলো। এভাবে কয়েকবার করে ঈসায়ী ফৌজের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হলে, তাদের ফৌজ সংখ্যা কমে গেল। পরিশেষে দেড় মাস পর কেল্লা বিজয় হলো।

তারেক ইবনে যিয়াদ টলেডোর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। তিনি এখন যে পরিমাণ চিন্তিত এত চিন্তিত ইতিপূর্বে আর কখনও হননি। টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাকে পেরেশান করে তুলেছিল। প্রয়োজনে কয়েকবার মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে সৈন্য সামন্তের আবেদন করার পর তিনি তা পাঠান নি। এ দুঃখের কথা কয়েকবার তিনি তার সাথীদের কাছে প্রকাশ করেছেন। তার সৌভাগ্য কয়েক হাজার বর্বর মুসলমান স্বেচ্ছায় তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। তানাহলে এত কম সংখ্যাক ফৌজ দিয়ে তিনি এত বড় সফলতার্জন করতে পারতেন না।

টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতি মজবুত তা তারেক ইবনে যিয়াদ জানতে পেরেছিলেন কিন্তু টলেডোর আভ্যন্তরীণ অবস্থা কি সে ব্যাপারে তিনি অবগত ছিলেন না।

বাদশাহী তখত খালী। সে তখতে কে বসবে তা নিয়ে টলেডোর শাহী মহলে চলছে জোর হাঙ্গামা রডারিকের যেসব সন্তান ছিল তাদের মাঝে কেবল রজমান্ড নামে একজন ছেলে ছিল তার বৈধ সন্তান। তার বয়স ছিল আঠার-উনিশ বছর। নিয়মানুপাতে সেই ছিল তখত আসীন হবার অধিকারী কিন্তু এ বয়সেই সে এত বিলাস প্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বাবার সালতানাতের প্রতি তাকে বারবার মনোযোগী, করে তোলার চেষ্টা করেও কোন কাজ হয়নি। সে ছিল শিকারী প্রেমী আর কোন সুন্দরী যুবতী দেখলেই তাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসতো আবার কিছুদিন পর তাকে বাদ দিয়ে আরেক জন নিয়ে আসতো।

রডারিক ছিল স্পেনের শাহেন শাহ। তার যখন যা ইচ্ছে তাই সে করত। স্পেনই নয় আশে-পাশের দেশ থেকে সে সুন্দরী রমণীদের কে তার হেরেমে এনে রাখত। কিছুদিন পর তাদেরকে বিদায় করে দিয়ে নতুনদের আয়োজন হতো। তার বৈধ স্ত্রী ছিল একজন,এ ছাড়া আরো দু’জনকে সে হেরেমে স্থায়ীত্ব দান করেছিল এবং তাদের সাথে সে বৈধ স্ত্রীর আচরণ করতো। এ সকল রমণীদের ছেলে সন্তান ও হয়েছিল। তারা সকলেই ছিল অবৈধ। রডারিকের মৃত্যুর পর এ সকল মহিলারাও উঠে পড়ে লাগল তাদের সন্তানদেরকে রডারিকের স্থলাভিষিক্ত করার জন্যে। কিন্তু রডারিকের বৈধ সন্তান রজমান্ডের বর্তমানে অন্য কেউ শাহী আসনে আসীন হতে পারছিল না।

টলেডোতে ফৌজের জেনারেল ইউগোবেলজী ছিল। সে ছিল রডারিকের ডান হাত-বাম হাত। সে সব সময় টলেডোতেই শাহী মহলে থাকত। আসলে সে ছিল রানীর প্রিয়জন। যার ফলে সে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল।

 রডারিকের বেটা রজমান্ড ঐ সকল যুবতীদেরকে তার শয্যাসঙ্গী বানাত যারা; রডারিকের উপ-পত্নির গর্ভজাত ছিল আর রডারিক ছিল তাদের পিতা। তাদের মাঝে লিজা নামে এক যুবতীও ছিল। বয়স ছিল বিশ-পঁচিশ বছর। তার এক ভাই ছিল। মহলে তার বেশ ভাল প্রভাবও ছিল।

ইউগোবেলজীও ছিল রডারিকের মত বিলাস প্রিয়। রডারিকের পরে সে হয়ে ছিল মহলে অঘোষিত সম্রাট। সে লিজার প্রেমে পড়ে লিজাকে কাছে পাবার জন্যে পাগল পারা হয়ে উঠে। কিন্তু লিজা তাকে এড়িয়ে চলছিল। পরিশেষে জেনারেল তাকে শাদীর প্রস্তাব দিল তবুও সে তাতে সাড়া দিল না।

তারেক যখন টলেভোর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন তখন এক রাত্রে লিজা জেনারেল ইউগোবেলজির কাছে উপস্থিত হলো।

“তুমি কেমন আছো?” জেনারেল জিজ্ঞেস করল।

“আপনার কাছে এসেছি। আপনি আশ্চর্যবোধ করছেন নাকি?”

 “তোমাকে এখানে আসতে কেউ দেখেনি তো?”

“না কেউ দেখেনি।”

লিজার জানা ছিলনা মহলের এক ব্যক্তি তাকে প্রত্যক্ষ করেছে এবং তার পিছু পিছু এসেছে। সে হলো রজমান্ড।

আমি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও বেকুফ নই। তোমার চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছে তুমি নিশ্চয় কোন বিশেষ মাকসাদে এসেছ। তোমার সে মাকসাদ কি তা বল।

লিজা বলল, আমি অল্প বয়সী ও অজ্ঞ। আমার অভিজ্ঞতা নেই কাউকে আয়ত্তে আনতে হলে কিভাবে কথা বলতে হয়। এ কারণে আমি খোলাখুলিভাবে বলছি, আপনি আমাকে শাদী, করতে চেয়েছিলেন আর আমি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আমার স্থলে যদি আপনি হতেন তাহলে আপনিও অস্বীকার করতেন, আপনি আমার : আর আপনার বয়সের পার্থক্য লক্ষ্য করুন। এখন আমি আপনার কাছে আমাকে সমর্পণ করার জন্যে এসেছি। আপনি শাদী করে বিবি হিসেবে রাখতে পারেন বা এমনিতে রাখবেন তা আপনার ইচ্ছে।

ইউগোবেলজী বলল, এছাড়া আমি তোমাকে অন্য আরেকটি বিষয় জিজ্ঞেস করছি। তাহলে কি জনে এসেছ তা কল।

 লিজা বলল, আপনি জানেন বারকান আমার ভাই আর আপনি এ বিষয়ে অবগত আছেন, আমরা দুই ভাই-বোন শাহানশাহ রডারিকের সন্তান। সিংহাসনের, দাবীদার আমার ভাইও য়ে রয়েছে এটাকে আপনি মনে করেন না?

ইউগোবেলজী বলল, কিন্তু বারকানতো বাদশাহর বিধি সম্মত সন্তান নয়। ধর্মও তাকে রডারিকের সন্তান মেনে নেয় না। তোমার এ অভিপ্রায় ছোট বাচ্চার মত। এ আশা একেবারে পরিত্যাগ কর।

 ইউগোবেলজী শরাব পান করছিল। লিজা তার কোলে বসে বাচ্চাদের মত তাকে পিয়ার করতে লাগল। শরাব ও সুন্দরী যুবতী ললনা যেন তাকে নতুন যৌবন এনে দিল। সে অভিভূত হয়ে বলল,

তুমিই বল,আমি তোমার ভাইকে কিভাবে তখত আসীন করতে পারি।

লিজা বলল, রজমান্ডকে কতল করিয়ে দেন। তখত তাজের উত্তরাধিকারী তো সেই। ঘোষণা হোক বা না হোক বাদশাহ সেই। যদি সে না থাকে তাহলে আপনি বারকানকে বাদশাহ্ বানাতে পারেন।

“তুমি কি নিজের ভাইয়ের মাথায় স্পেনের মুকুট রাখার জন্যে সৎ ভাইকে হত্যা করতে চাও”।

বৃদ্ধ জেনারেল, শরাবের নেশায় টলতে টলতে বলল,

লিজা বলল, শুধু এজন্যেই নয় বরং তার দ্বারা মুলকের বড় লোকসান হবে। আপনি প্রত্যক্ষ করছেন আধা মুলক হাতছাড়া হয়ে গেছে। হামলাকারীরা বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার মত ধেয়ে আসছে। শাহজাদার বাপ মারা গেছে। তবুও সে পূর্বের ন্যায় বিলাসীতায় ডুবে আছে। গত রজনীতে সে আমাকে জোর পূর্বক বাগানে ধরে নিয়ে গেছে। আমি নিজেকে তার হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি। আমি বহুবার চিৎকার করে বলেছি আমি তোমার বাপের বেটী তবুও রেহায় পাইনি। তবুও কি আপনি তাকে জিন্দা রাখার অধিকারী মনে করেন।

ইউগোবেলজী বলল, হ্যাঁ মনে করি। না তাকে আমি হত্যা করতে পারব না। তাকে হত্যা করা সম্ভব নয়।

লিজা বলল,আপনি কি রানীকে ভয় করেন?

না। কোন বাপ নিজের সন্তানকে হত্যা করতে পারে না। রজমা আমার বেটা, রডারিকের বেটা নয়। রডারিক থেকে রানীর কোন সন্তান হয়নি।

এটা লিজার জন্যে কোন আশ্চর্যের কথা ছিল না। শাহী মহলে এমনটিই হতো। কে কার সন্তান? এ প্রশ্নের জবাব কেবল সন্তানের মা-ই দিতে পারতো।

লিজা জেনারেল ইউগেবেলজীকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি মুসলমানদের হাত থেকে শহরকে রক্ষা করতে পারবেন।

জেনারেল জবাব দিতে যাচ্ছিল এরি মাঝে কামরার দরজা খুলে এক নওজোয়ান প্রবেশ করল।

জেনারেল পেয়ার করে বলল এই যে রজমান্ড! এসো এসো।

রজমা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ তাদের কথাবার্জ শুনছিল।

রজমান্ড জেনারেলকে লক্ষ্য করে বলল, আমার বাবা তুমি? আমি নিজেকে বাদশাহর ছেলে মনে করতাম। এ কথা বলেই সে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে খঞ্জর বের করল। ইউগোবেলজী শরাবের নেশায় উন্মাদ ছিল। রজমান্ড খঞ্জর তার বুকে বসিয়ে দিল। বৃদ্ধ জেনারেল তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

লিজা চিৎকার করে পলায়ন করতে ছিল কিন্তু রজমান্ড তাকে পাকড়াও করে, ‘ তার বুকেও খঞ্জর বসিয়ে দিয়ে চিরতরে খতম করে দিল। ….

***

তারেক ইবনে যিয়াদ তার বাহিনী নিয়ে দরিয়া পাড়ে পৌঁছল। তারেকের ধারণা ছিল দরীয়ার পুলের কাছে স্পেনের ফৌজ থাকবে, তারা পুল পার হতে দেবে না এবং সেখানে প্রচন্ড লড়াই হবে কিন্তু তারেক সেখানে কাউকে পেলেন না।

তারেক তার সাথীদের উদ্দেশ্য করে বললেন, এত বড় ধোকাতে ইতিপূর্বে আর কোন দিন পড়িনি। স্পেনীরা আমাদেরকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে।

সালার আবু জুরয়া তুরাইফ বলল, হ্যাঁ ইবনে যিয়াদ! এটা ধোকা ছাড়া আর কিছু নয়। এ দরিয়া শহরের চতুর্দিকে রয়েছে আমরা সামনে অগ্রসর হলে দরিয়ায় আটকা পড়ব আর অপর দিক থেকে শহরের ফৌজ এসে যাবে তখন বের হওয়া বড়ই মুশকিল হয়ে যাবে।

তারেক : কিন্তু এখান থেকে তো ফিরেও যেতে পারছিনে। আমরা সম্মুখেই অগ্রসর হবো।

চারপাশে ঘোড় সোয়ার আর মাঝখানে পায়দল, আর চতুরপার্শ্বে তীরন্দাজ সদা সতর্ক অবস্থায় তারেক তার বাহিনী পুল পার করলেন। তারপর কোর আশে পাশে দেখার জন্যে দু’জন ঘোড় সোয়ারকে দ্রুত পাঠিয়ে দিলেন।

শহরে আওয়াজ উঠল, “তারা এসে গেছে।” এ আওয়াজ দ্রুত শহরময় ছড়িয়ে পড়ল। শহয়ে স্বল্প সংখ্যক লোক বিদ্যমান ছিল। তাদের মাঝে অধিকাংশ ছিল গোখা ও ইহুদী সম্প্রদায়।

যে সোয়ারীকে অগ্রে পাঠান হয়েছিল, তারা এসে রিপোর্ট দিল কেল্লার আশ পাশে কোন ফৌজনেই। তারেক মনে করলেন আরো বেশী সতর্কতা অবলম্ফন করা জরুরী। তিনি তার অধীনত জেনারেল, জুলিয়ন ও আওপাসকে পরামর্শের জন্যে আহ্বান করলেন। তারা ফায়সালা করল, শহর অবরোধ করে সেখানের ফৌজরা কি করে তা লক্ষ্য করা যাক। এ ধরনের শলা-পরামর্শ হচ্ছে এরিমাঝে একজন হঠাৎ বলে উঠল, শহরের সদর দরজা খুলে গেছে। সকলেই সেদিকে তাকিয়ে দেখল যে, পাঁচ-ছয়জন সম্ভ্রান্ত লোক ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে তাদের দিকে আসছে। তারেক ইবনে যিয়াদ তার সাথীদেরকে নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে গেলেন। শহর থেকে যারা এসেছিল তাদের একজন বলল, “আমরা সন্ধি ও বন্ধুত্বের পয়গাম নিয়ে এসেছি। আপনারা আমাদের সাথে আসেন এবং শহরের দায়িত্ব বুঝে নিন।”

জুলিয়ন ও আওপাস তাদেরকে চিনতে পারলেন, তাদের দু’জন ইহুদী আর বাকীরা গোখা সম্প্রদায়ের। তারা সকলে অশ্ব থেকে অবতরণ করে জুলিয়ন ও আওপাসকে জড়িয়ে ধরল। তারা তারেকের সাথে করল করমর্দন।

আগত দলের প্রধান বলল, তুমি মহান তারেক ইবনে যিয়াদ! স্পেন তোমার।

তারেক : না আমার নয়। বরং এটা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের মুক হবে। যিনি আমাকে বিজয়ের সু-সংবাদ প্রদান করেছেন। ইসলামে কেউ বাদশাহ হয় না। বাদশাহী হয় কেবল আল্লাহর। তাঁর বাদশাহীতে সকল মানুষের থাকে সমমর্যাদা ও অধিকার।

গোথা সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বলল, আমরা কি এ বিশ্বাস করতে পারি যে, আমরা আমাদের অধিকার পূর্ণ মাত্রায় পাব?

তারেক : তোমরা যে অধিকার ফিরে পাবে তা তোমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও স্মরণ রাখবে। তোমরা কেন এসেছ। শহরে কি কোন হকিম বা শাহী খান্দানের কেউ নেই।

তারেক জবাব পেলেন, শহর পুরো খালি। ফৌজরাও শহর ছেড়ে চলে গেছে। একজন জেনারেল ছিল তাকেও রডারিকের ছেলে কতল করেছে। শাহী মহলে আপনাকে ইন্তেকবাল জানান হবে।

এ প্রতিনিধি দলের সাথে জুলিয়ান ও আণ্ডপাসের যদি পূর্ব পরিচয় না থাকত তাহলে তারেক একেও প্রবঞ্চনা মনে করতেন।

তারেক তার বাহিনী নিয়ে কেল্লার দিকে অগ্রসর হলেন।

***

মুসলমানরা শহরে প্রবেশ করার পর শহরে যেসব লোক ছিল তারা ধ্বনি দিয়ে তাদেরকে ইন্তেকাল জানাল। শহরের ফৌজ যেখানে বিশ্রাম করত সেখানে মুসলমান ফৌজদেরকে বিশ্রামের জন্যে নিয়ে গেল। তারেক ইবনে যিয়াদ, তার অন্যান্য সালার ও জুলিয়ন-আওঁপাসকে শাহী মহলে নিয়ে যাওয়া হলো।

 ঐ শহরে যেসব ধন-দৌলত মুসলমানদের হস্তগত হলো তা ছিল অপরিসীম। তারেকের নির্দেশে শাহী মহলের তামাম মনি-মুক্তা এক কামরাতে একত্রিত করা হলো। তার মাঝে স্পেনের বাদশাহের মুকুটও ছিল। পঁচিশটি মুকুট পাওয়া গেল, যা সম্পূর্ণ স্বর্ণের ছিল। মুসলমানরা কোন ঘরে প্রবেশ করেনি, কোন প্রকার লুটতরাজের কাছেও যায়নি। কেবল যেসব ঘর খালি পড়েছিল সেখান থেকে মূল্যবান সম্পদ তারা একত্রিত করেছিল।

পুরো টলেডো শহর এখন তারেকের কজায়। ইহুদী ও. গোথা সম্প্রদায়ের লোক তার কাছে একত্রিত হয়েছে। তিনি তাদের মাঝ থেকে কয়েক জনকে নির্বাচন করে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের হুকুম দিলেন।

সবেমাত্র প্রভাত হয়েছে। তারেককে জানান হলো এক নওজোয়ান ঈসায়ী লাড়কী তার সাথে মুলাকাত করতে চায়। তারেক মুলাকাতের ইজাযত দিলেন। এক সুন্দরী যুবতী ললনা তারেকের কাছে এলো, তার চেহারাতে রয়েছে ভীতির চিহ্ন। পদযুগল কাঁপছে থর থর করে।

তারেক দুভাষীর মাধ্যমে বললেন, তাকে বল, ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি অন্যদের মতই সাধারণ একজন মানুষ। তাকে জিজ্ঞেস কর কেন এসেছে কোন মুসলমান তাকে কষ্ট দিয়েছে কিনা?

মেয়েটি আস্তে আস্তে মাথা হেলিয়ে বল, না। কোন মুসলমান আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। আমার নাম লিজা। জোর পূর্বক আমাকে যাজিকা বানানো হয়েছিল। আমি শুনতে পেলাম আপনার ফৌজরা গীর্জায় গিয়ে ছিল তারা সেখানে কিছু পায়নি। আপনার লোক আমার সাথে পাঠান। গীর্জার ধন-সম্পদ আন্ডার গ্রাউন্ডে গর্তে লুক্কায়িত রয়েছে। আপনারা আসার পূর্বে যদি কেউ তা উঠিয়ে নেয় তাহলে আমাকে কোন শাস্তি দেবেন না। তারপর সে গির্জার বর্ণনা দিল। তারেক কয়েকজন ফৌজ ঐ যুবতীর সাথে পাঠালেন। তারা এসে দুটো লাশ ফরশের ওপর এবং আরো তিনটি লাশ অন্য একটি গর্তে দেখতে পেল।

তারপর ঐ যুবতীর নির্দেশনা মুতাবেক অন্য আরেকটি গর্ত খুঁড়ে খাজানার দু’টো বাক্স পাওয়া গেল।

গীর্জা থেকে যখন খাজানা সংগ্রহ হচ্ছে তখন আওপাস মেরীনার কামরাতে। যৌবনে তারা পরস্পরে এমন প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল যে একে অপরের জন্যে আত্মহুতি দিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তন ঘটিয়ে রেখেছে তার মাঝে দীর্ঘ দিনের বিচ্ছেদ। এখন তারা অর্ধ-বয়সী। মেরীনা শাদী করেনি কারণ সে ছিল রডারিকের রক্ষিতা। আওপাস সিওয়াস্তা গিয়ে শাদী করে, তার সন্তানাদিও রয়েছে।

“বাকী জীবন কি আমার সাথে অতিবাহিত করবে মেরীনা? আওপাস জিজ্ঞেস করল।”

মেরীনা : না, আওপাস! আমার বাকী জীবন ইবাদত খানাতে অতিবাহিত হবে। যাতে আমার আত্মা পূত-পবিত্র হয়। এখন আমি খোদার নৈকট্য লাভ করতে চাই।

আওপাস মুচকী হেসে বলল, দেখ যাজিকা হয়ে যেওনা আবার। এখনও তুমি যুবতী। আযাদ জিন্দেগীর সাধ কিছুটা ভোগ করতে পার।

মেরীনা : আমি যে অপবিত্র তা তুমি ভাল করেই জান। তাই আমার প্রেম ভালবাসা তোমার অন্তর থেকে বের করে দাও। একটা কাজ করতে হবে আওপাস! তাহলো স্পেন বিজয়ী সিপাহ্ সালার তারেক ইবনে যিয়াদকে একটা তুহফা দিতে চাই তুমি আমাকে তার কাছে পৌঁছে দাও।

আওপাস : পৌঁছে দেব। তবে কি তুহফা দেবে?

মেরীনা; একটি ভারী বাক্স। আগামীকাল তিন-চারজন লোক নিয়ে এসে বাক্স বহন করে আমার সাথে যাবে।

পরদিন সকালে এক বছর ধরে যার-তালাবন্ধ এমন একটি কামরা খুলে আওপাস বাক্স বের করার জন্যে গেল। দরজা খুলে বাক্সের কাছে যেতেই আওপাস দ্রুত পিছু হঠে এলো।

আওপাস : মেরীনা! এ কামরাতে কি আছে এত দুর্গন্ধ, কোন মানুষ না প্রাণী মরে পঁচে আছে।

মেরীনা : কামরা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার দরুন এ দুর্গন্ধ। তাছাড়া কামরাতে কি পড়ে আছে তার দিকেও লক্ষ্য করে দেখ। এটা ইহুদী যাদুকর বুজনের কামরা। সে এখানে মানুষের তরতাজা মস্তক, কলিজা ও হাড়-হাড়ি রাখত। এখানে সে সাপ-বিচ্ছুও রাখত। এছাড়া এমন কিছু জিনিস রাখত যার দুগন্ধে দম বন্ধ হয়ে যেত।

সে এখন কোথায়?

চলে গেছে। তার এ বাক্স তারেককে তুহফা হিসেবে পেশ করতে চাই। এর মাঝে কি আছে? তুমি অনুভব করতে পারছ না এ থেকে কি পরিমাণ দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে

এতে কি আছে তা কেবল তারেক ইবনে যিয়াদ দেখবে। অন্য কারো দেখা সমীচীন হবে না। তিনি যদি খারাপ মনে করে কোন শাস্তি দিতে চান তাহলে তা আমি নির্দ্বিধায় গ্রহণ করব।

চারজন ব্যক্তি বাক্স বহন করে চলল। আওপাস মেরীনাকে সাথে নিয়ে তারেকের সম্মুখে উপস্থিত হলো।

আওপাস : ইবনে যিয়াদ! এ হলো সেই লাড়কী যে হাজার হাজার গোথা ও ইহুদী ফৌজ আমাদেরকে দান করেছে। রডারিকের সাথে যুদ্ধে যে কয়েক হাজার গোখা ও ইহুদী ফৌজ আমাদের সাথে এসে মিলে ছিল তার ইন্তেজাম এ লাড়কী করেছিল।

তারেকঃ আমরা তাকে আশাতীত ইনয়াম প্রদান করব।

মেরীনা : হে সিপাহসালার! আমি এ কাজ ইনয়ামের আশায় করিনি।

আমি রডারিক থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছি। আমি আপনার কৃপা চাই না। আমি আমার অন্তরকে তৃপ্তি প্রদান করেছি। আপনার জন্যে একটা হাদিয়া নিয়ে এসেছি।

বাক্স তারেকের সম্মুখে পেশ করা হলে মেরীনা চাবি বের করে তার তালা খুলে ঢাকা উঠানোর সাথে সাথে তারেক ইবনে যিয়াদ ও তার সাথে আরো যারা ছিলেন সকলে দূরে সরে গেলেন। চেপে ধরলেন নাক। এত পরিমাণ দুর্গন্ধ বের হলো যে কামরাতে অবস্থান করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়াল।

“বাক্সে কি আছে” তারেক ইবনে যিয়াদ জিজ্ঞেস করলেন।

মেরীনা : এক ব্যক্তির লাশ। এক বছর অবধি এ বাক্সে তালা বন্ধ রয়েছে।

জুলিয়ন : রডারিকের লাশ নয় তো?

মেরীনা : না। শাহ্ রডারিককে আমরা যেতে দেখেছি ফিরে আসতে দেখিনি। জুলিয়ন! এ লাশ যার তাকে আপনি চিনেন। রডারিকের প্রিয় যাদুকর বুদাজনের এ লাশ। সিপাহ্ সালারকে বলছি। এ যাদুকর যদি জীবিত থাকত তাহলে, সিপাহু সালার আজ এখানে বিজয়ী বেশে দাঁড়িয়ে থাকতেন না। এখানে থাকতো রডারিক আর সিপাহ্ সালার থাকতেন তার সম্মুখে জিঞ্জির পরা।

তারেক : এ রমণীকে বল, পুরো ব্যাপারটা খুলে বর্ণনা করতে।

জুলিয়ন : এ ব্যক্তির নাম ছিল বুসাজন। রডারিককে ভবিষ্যত্বানী শুনাতো। এ ব্যক্তি ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্রে পারদর্শী। রডারিক তাকে বিশেষভাবে নিজের কাছে রেখে ছিল। তাকে জিজ্ঞেস না করে রডারিক কোন কাজ করত না। সে ছিল যাদুকর।

তারেক : সে কি ইহুদী ছিল।

 জুলিয়ন : হ্যাঁ ইবনে যিয়াদ। ইহুদী ছিল।

তারেক : যাদু বিদ্যা ইহুদীদেরই উদ্ভাবিত। ইহুদীরাই এ ব্যাপারে পারদর্শী হয়।

আওপাস : মেরীনা এখন বল, এ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে কিভাবে?

মেরীনা : রডারিক যখন আপনার মুকাবালায় যাচ্ছিল তখন সে কিছু অশুভ নিদর্শনের সম্মুখীন হয়েছিল। তখন সে এ ব্যক্তিকে ডেকে বলেছিল এ অশুভ নিদর্শন কে শুভতে পরিণত করার জন্যে তথা আপনার ওপর বিজয় অর্জনের তদবীর করার জন্যে। এ যাদুকর রডারিকের কাছে ষোল-সতের বছরের এক লাড়কীর আবেদন করে বলল, সেই লাড়কীর কলিজা বের করে এমন আমল করবে যাতে রডারিক বিজয়ী হবে আর হামলাকারীরা পরাজিত হয়ে একেবারে চিরতরে খতম হয়ে যাবে। রডারিক আমাকে হুকুম দিল আমি যেন এ ধরনের এক লাড়কী ব্যবস্থা করে দেই। আমার কাছেএ বয়সের এক লাড়কী ছিল। আমি রাতের বেলা সে লাড়কীকে নিয়ে যাদুকরের কাছে গেলাম। যাদুকর সে লাড়কীর কলিজা বের করার জন্যে তাকে তার টেবিলে শয়ন করিয়ে তার দিকে ঝুঁকে পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় আমি তার মাথাতে লোহার ডান্ডা দ্বারা স্বজোরে আঘাত হানি। সে বেহুশ হয়ে পড়ে গেলে তার গলাটিপে তাকে হত্যা করে পরে আমরা দুজন মিলে তার লাশ এ বাক্সে ভরে রাখি। সকালে রডারিক রওনা হয়ে গেল আর আমি ঐ লাড়কীকে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে এলাম। সে হতে তার লাশ এ বাক্সে বন্দি রয়েছে। সে যদি তার তদবীর পূর্ণ করতে পারত তাহলে বিজয় রডারিকের হতো।

তারেক : তার মৃতদেহ আমার কাছে কেন নিয়ে এসেছ?

মেরীনা : এর চেয়ে উত্তম তুহফা আর আমার কাছে ছিল না যা আমি আপনার কাছে পেশ করব। এখন কেবল হাড়গুলো রয়েছে। আপনি এগুলো হয়তো জ্বালিয়ে ফেলুন বা দাফন করুন তা আপনার ইচ্ছে… আজ থেকে আমি পূর্ণ মুক্ত।

মেরীনা ঝুঁকে তারেককে সালাম করল। তারপর “এখন আমি মুক্ত, এখন আমি মুক্ত” একথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।

তারপর আওপাস তাকে বহু তালাশ করল, কোথাও তার সন্ধান পেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *