বাংলাদেশে দস্যু বনহুর

বাংলাদেশে দস্যু বনহুর

বনহুরের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বললো মিস শ্যালন– বড় দুষ্ট তুমি!

বনহুর কোনো কথা বললো না, মুখভাব তার গম্ভীর হয়ে উঠেছে। মুক্ত জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা তীব্র অনুভূতি তার সমস্ত দেহ-মনে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে, নিজেকে বড় উত্তেজিত মনে করলো বনহুর। অধর দংশন করে বললো– যাও, যাও শ্যালন, এখানে আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করো না– যাও তুমি–

শ্যালনের মুখভাব রাঙা হয়ে উঠেছে, হঠাৎ বনহুরের গম্ভীর হয়ে যাওয়ার কারণ সে ভেবে পেলো না। ধীর পদক্ষেপে সে ক্যাবিন ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলো।

বনহুর পায়চারী করতে লাগলো, বার বার আংগুল দিয়ে মাথার চুলগুলো টেনে ছিঁড়তে লাগলো, অধর দংশন করে আপন মনে বলে উঠলো–না না তা হয়না, সে দস্যু হতে পারে কিন্তু সে লম্পট নয়। কোন অসহায় নারীর জীবনকে সে বিনষ্ট করতে পারে না। শ্যালন অবলা-অসহায় বুদ্ধিহীন, তাই বলে তার সর্বনাশ সে করতে পারেনা।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে ম্যাকমারা, হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে ডাকে– আলম!

বলুন স্যার?

আমরা এখন বাংলাদেশ অভিমুখে চলেছি। প্রথমে কোথায় আমরা অবতরণ করবো এখনও ঠিক করিনি। তোমার কাছে এলাম কথাটা জিজ্ঞেস করতে।

বনহুর ম্যাকমারাকে আসন গ্রহণ করতে বলে নিজেও আসন গ্রহণ করলো।

ম্যাকমারা একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বললেন– এখন আমাদের জাহাজ ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে চলেছে। আমরা দু’সপ্তাহ পর বঙ্গোপসাগরে পৌঁছতে সক্ষম হবো, তারপর আমাদের জাহাজ একসময় পৌঁছবে ডায়মণ্ড হারবার বন্দরে।

বনহুরের চোখ দুটো খুশিতে চক চক করে উঠলো, বাংলাদেশের দৃশ্যগুলো তার চোখে কল্পনার রঙ ছড়িয়ে দিলো। বললো বনহুর প্রথমে কোন্ শহরে অবতরণ করতে চান স্যার?

কলকাতা! প্রথম আমি কলকাতা নগরীতেই কয়েকদিন কাটাবো ভাবছি।

 বেশ, তাই ভাল।

আলম!

 বলুন স্যার?

 আমাদের সঙ্গে তোমার কোনো কষ্ট বা অসুবিধা হচ্ছে না তো?

ন্যা স্যার, আমি বেশ ভালই আছি, তবে দেশের জন্য মনটা বড় কাঁদছে।

আলম, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো- করবো করেও আমার সময় হয়ে ওঠেনি।

বেশ তো করুন?

আমার একবার শ্যালনকে যখন তোমার হাতে সঁপে দেবো মনস্থ করেছি তখন তোমার সম্বন্ধে আমার সব জানা উচিত; আচ্ছা আলম?

বলুন?

তোমার বাড়ি কোথায় তা আজও জানিনা।

 কান্দাই শহরের এক অখ্যাত অঞ্চলে।

তার মানে?

মানে, জায়গাটা বড় সুবিধার নয়।

গ্রামাঞ্চলে বুঝি?

হাঁ, গ্রামাঞ্চলই বটে।

তা তোমার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন আছেন কি?

 বাবা নেই, মা আছেন। আত্মীয়-স্বজন আছেন কিছু কিছু।

 অবস্থা কেমন?

 মোটামুটি আছে।

তোমার চেহারা দেখলে কিন্তু খুব বড়ঘরের ছেলে বলে মনে হয়।

আমার বাবা কান্দাই-এর বড় একজন নামকরা জমিদার ছিলেন।

সে রকম আমার ধারণা। দেখ আলম, বাংলায় গিয়ে একটা শুভদিন দেখে তোমার আর শ্যালনের বিয়েটা–

নিশ্চয়ই– নিশ্চয়ই– কিন্তু—

 কিন্তু আবার কি?

আমার মায়ের বিনা অনুমতিতে আমি কিছু করতে পারবো না।

তাহলে শ্যালনকে তুমি—

 আপাততঃ সম্ভব নয়।

আলম!

ঘাবড়াচ্ছেন কেন, সময় এলে সব হবে স্যার।

ম্যাকমারা আলমের হাত মুঠোয় চেপে ধরলেন–দেখ আলম, তোমাকে ছাড়া আমার শ্যালন কিছু ভাবতে পারেনা। সে শুধু তোমাকেই চায়।

বনহুর কোনো কথা বলতে পারে না।

ম্যাকমারাও নিশ্চুপ।

শুধু জাহাজের একটানা ঝক ঝক শব্দ আর সাগরের জলোচ্ছাসের গর্জন ধ্বনি ক্যাবিনটাকে মুখর : করে তুলেছে।

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন ম্যাকমারা– শ্যালনের খুশির জন্য আমার সব বিলিয়ে দিতে পারি। আলম, বলো তুমি কি চাও?

হাসলো বনহুর।

ম্যাকমারা বললেন– জানি তুমি বলবে না। কিন্তু মনে রেখো আলম, আমার অবর্তমানে আমার কন্যা শ্যালন সব ঐশ্বর্যের অধিকারিনী হবে। তোমার কোনো কিছুর অভাব হবে না কোনোদিন।

বনহুর এবার সোজা হয়ে বসলো, বললো সে– স্যার, আমি সব শুনেছি শ্যালনের মুখে, কিন্তু আমারও একটা কথা আছে যা বললে আপনি আপনার সংকল্প ত্যাগ করবেন।

কি এমন কথা বলো আলম?

অনেক দিন থেকে আমিও কথাটা বলবো-বলবো ভাবছি কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি। স্যার, শ্যালনকে বিয়ে করা আমার সম্ভব নয়।

চমকে ওঠেন ম্যাকমারা– কেন!

ইতিপূর্বে আমার বিয়ে হয়েছে– আমি বিবাহিত।

হেসে উঠলেন ম্যাকমারা– তাতে কি আসে যায়! আমাদের মধ্যে যত খুশি বিয়ে করা চলে, কোনো বাধা নেই।

আশ্চর্য হয়ে শুনলো বনহুর।

ম্যাকমারা বলে চলেছেন– আমি দুটি মহিলাকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করেছিলাম। সর্বশেষ স্ত্রীর গর্ভে শ্যালন জন্মেছে।

বনহুর ঢোক গিলে বলে–ধন্যবাদ।

ম্যাকমারা বললেন এবার শ্যালনকে তুমি বিয়ে করতে রাজি হলে তাতে আমার বা শ্যালনের কোনো অমত থাকবে না।

বনহুর ভেবেছিলো, শেষ পর্যন্ত বিয়ের কথা বলে ম্যাকমারা এবং শ্যালনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু ব্যাপারটা যত সহজ হবে ভেবেছিলো, তা হলোনা। বনহুর বেশ চিন্তাগ্রস্থ হলো।

ম্যাকমারা তখনকার মত বিদায় গ্রহণ করলেন।

বনহুর তার শয্যায় দেহটা এলিয়ে দিয়ে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো। মনের আকাশে ভেসে উঠলো পাশাপাশি দুটি মুখমনিরা আর নূরী–

মনিরার সঙ্গে দেখা করা তার একান্ত প্রয়োজন ছিলো। মা হয়তো তার অন্তর্ধানে পাগলিনী হয়ে পড়েছেন। না জানি নূর কেমন আছে। কান্দাই থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এখন সে রয়েছে। ফিরে যাবার কোনো উপায় নেই, ম্যাকমারার দলের সঙ্গে তাকে যেতেই হবে। বাংলাদেশের নামই সে শুনেছে কিন্তু এবার সে চোখে দেখবে, উপভোগ করবে বাংলাদেশের মাটির আস্বাদ।

*

সারাদিন বনে বনে কাঠ সগ্রহ করে সন্ধ্যায় আশ্রমে ফিরে আসে কেশব; ফুলের জন্য নানা জাতীয় সুস্বাধু ফল সংগ্রহ করে আনে সে।

সন্ন্যাসী বাবাজী তখন হয়তো আশ্রমের অদূরে কোনো বৃক্ষতলে ধ্যানমগ্ন রয়েছেন। কেশব কাঠের বোঝাটা মাথা থেকে নামিয়ে রেখে উঁকি দেয় কুঠিরের মধ্যে, নাম ধরে ডাকে সে– ফুল, ফুল– যোগিনীর মত ধীর-মন্থর গতিতে কেশবের পাশে এসে দাঁড়ায় ফুল, বলে– কেশব ভাই, আমাকে ডাকছো?

হাঁ ফুল, এই দেখ তোমার জন্য আজ নতুন এক রকম ফল এনেছি। কেশব কোচড় থেকে ফল বের করে মেলে ধরে ফুলের সম্মুখে নাও।

ফুল যেমন দাঁড়িয়ে ছিলো তেমনি থাকে, কোন কথা বলে না।

কেশব বলে আবার–ফুল, তোমার জন্য অনেক কষ্ট করে এ ফলগুলো আমি সংগ্রহ করেছি। ভারী সুন্দর আর সুমিষ্ট ফল।

ফুল বলে–কেন তুমি আমার জন্য এতো কষ্ট করতে যাও কেশব ভাই?

ফুল, তোমার জন্য আমি সব কষ্ট হাসি মুখে গ্রহণ করতে পারি। তবু তুমি যদি আমার প্রতি সদয় হও।

কেশব ভাই?

 ফুল, তুমি যা বলবে আমি জানি, কিন্তু ফল, তুমি ছাড়া আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে।

তাই বুঝি তুমি আমার—

হাঁ ফুল, তোমার অনুগ্রহ আমার কামনার বস্তু। ফুল, আমার প্রতি তুমি সদয় হও।

কেশব ভাই!

নাও, এ ফলগুলো তুমি নাও ফুল।

ফুল হাত দুটি পাতে– দাও।

শুধু আজ নয়– প্রতিদিন কেশব ফুলের জন্য বন থেকে ফল সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। কেশবের। স্বপ্ন-সাধনা সব কিছু ফুল। ফুলকে সে জীবনে ভালবেসেছে, ফুলের মধ্যে সে খুঁজে পেয়েছে নতুন এক আস্বাদ, কিন্তু ফুলকে সে কোনোদিন পাবে কিনা তা সে জানেনা।

*

সেদিন ছিলো পূর্ণিমা, জ্যোছনা ভরা রাত।

ফুল একা বসেছিলো ঝরণার পাশে একটি পাথরখণ্ডে। জ্যোছনার আলো ঝরণার পানিতে এক অপূর্ব ছন্দের সৃষ্টি করে চলেছে। ফুরফুর হাওয়ায় অজানা ফুলের সুরভি বয়ে চলেছে। ফুল আপন মনে। একটা গান গাইছিলো।

ফুলের কণ্ঠের করুণ একটা সুর সমস্ত বনভূমির স্তরে স্তরে ছড়িয়ে পড়ছিলো।

ফুলের কণ্ঠে সুর শুনে বৃক্ষ-লতা-গুল্ম যেন তন্ময় হয়ে পড়েছিলো, বনের পশুপাখিও যেন হারিয়ে ফেলেছিলো তাদের আপন সত্ত্বা, মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো সবাই।

সন্ন্যাসী বাবাজীর ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেলো সে গানের সুরে। তিনি তার আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন, মোহগ্রস্তের মত অগ্রসর হলেন।

গান শেষ হয়ে গেলো।

সন্ন্যাসী বাবাজী ফুলের কাঁধে হাত রেখে ডাকলেন– মা!

 ফুল হঠাৎ সন্ন্যাসী বাবাজীর মধুর আহ্বানে তার বুকে মুখ লুকিয়ে উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে উঠলো।

সন্ন্যাসী বাবাজীর চোখ দুটো আদ্র হয়ে উঠলো, তিনি সস্নেহে ফুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এক সময় বলে উঠলেন সন্ন্যাসী বাবাজী– ফুল, আমি জানি তোমার বুকে অনেক ব্যথা লুকিয়ে আছে। মা, আমি তোমায় যোগ সাধনা শেখাবো; যে সাধনা তোমাকে ভুলিয়ে দেবে তোমার সষ ব্যথা বেদনা– সব কিছু। বাস্তব জগৎ হতে তুমি সরে আসবে অনেক দূরে।

তাই করো বাবাজী, তাই আমাকে শিখিয়ে দাও। আমি যেন আমার সমস্ত কথা, সমস্ত স্মৃতি ভুলে যাই, ভুলে যাই আমার অস্তিত্ব।

তাই হবে মা, তাই হবে। কিন্তু কেশবকে তুমি এতোটুকু করুণা করবে না মা?

আমার কোনো উপায় নেই বাবা।

মা, আমি তোমার মনের উপর কোনো জোর করবোনা। তা ছাড়া কেশব আমার হাতে গড়া ছেলে, সে নিশ্চয়ই তোমার অমতে তোমাকে কোনো রকম বিরক্ত করবে না।

হাঁ, কেশব ভাই আমাকে কোনোদিন অন্যায়ভাবে কিছু বলেনি।

মা, চলো ঘরে চলো।

চলো বাবাজী।

 ফুল আর সন্ন্যাসী বাবাজী আশ্রমে ফিরে এলো।

সেদিন হতে ফুল সন্ন্যাসী বাবাজীর নিকটে যোগ সাধনা শিখতে লাগলো।

সন্ন্যাসীর সম্মুখ আসনে বসে যোগ সাধনা করতো ফুল। তার দেহে শুভ্রবসন, চুলগুলো মাথার উপর ঝুটি করে বাঁধা, ললাটে চন্দনের আল্পনা।

আসনে মুদিত নয়নে বসে থাকতো ফুল। সন্ন্যাসী বাবাজী অদূরে আর একটি আসনে উপবিষ্ট থাকতেন।

ফুল বললো– বাবাজী, কি বলব? কি বলে সাধনা করতে হয় আমি তো জানিনে?

মা, তুমি হিন্দু নারী নও, তুমি মুসলমান; আমাদের আর তোমাদের সৃষ্টিকর্তা একজন, জাতি যদিও দু’রকম। তোমাদের দেহ-মন সব আছে- তেমনি আছে আমাদের। তোমাদের দেহ ও প্রাণ আছে– আমাদেরও তেমনি। তোমাদের দেহে যেমন রক্ত-মাংসের সমাবেশ– তেমনি আমাদেরও। আমরা ডাকি ভগবান আর তোমরা ডাকো খোদা। কিন্তু নামের উচ্চারণে ভিন্নরূপ শোনা গেলেও আসলে ভগবান বা খোদা সেই একজন– যিনি সমস্ত পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। মা, আমাদের সাধনা আর তোমাদের সাধনার রূপ ভিন্ন আকার হলেও সাধনা– সাধনাই। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাকে তুমি যেভাবে ডাকবে তাতেই। তিনি সাড়া দেবেন মা, প্রকাশ্যে তিনি কোনো দিন সাড়া দেন না, তিনি সাড়া দেন কাজের মাধ্যমে। তোমার যা মনে চায় সে ভাবে তুমি ডাকবে তোমার সেই অন্তর্যামী মহান সৃষ্টিকর্তাকে। দেখবে, ভুলে যাবে তোমার সব ব্যথা বেদনা– সমস্ত কিছু!

তাই হবে বাবাজী– তাই হবে।

সেদিনের পর থেকে ফুল সন্ন্যাসী বাবাজীর সঙ্গে বসে যোগ সাধনা করে চললো।

সন্ন্যাসী বাবাজী হিন্দু ব্রাহ্মণ আর ফুল মুসলমান কন্যা। সন্ন্যাসী বাবাজী ডাকেন তার ভগবানকে, আর ফুল ডাকে তার খোদাকে। যদিও উচ্চারণ দু’জনার দু’রকম কিন্তু আসলে একজনকেই তারা ভিন্ন ভিন্ন রূপে ডেকে চলেছে।

সন্ন্যাসী বাবাজী আর কেশব ভজন গান করতো। ফুল অবাক হয়ে শুনতো। তন্ময় হয়ে যেতো। সন্ন্যাসী বাবাজী আর কেশবের ভজনের সুরে।

ফুল অবসর সময় কাটাতো বনের হরিণ-শিশু আর হরিণ-হরিণীদের নিয়ে। ফুলকে দেখলে ওরা পালিয়ে যেতো না, বরং ওকে দেখলে ওরা এগিয়ে আসতো, ঘিরে দাঁড়াতো ফুলের চারপাশে। হরিণ শিশুকে কোলে করে ফুল বসে আদর করতো, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতো।

তখন হরিণ-হরিণী ফুলের হাত চাটতো বা চিবুক মুখে চেটে সোহাগ জানাতো।

অদূরে দাঁড়িয়ে কেশব উপভোগ করতো এ দৃশ্য। এক সময় এসে বসতো ফুলের পাশে, আবেগ ভরা কণ্ঠে ডাকতো– ফুল!

হরিণ শিশুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আনমনে জবাব দিতো ফুল– বলো?

 ফুল, আমার জীবনটা কি তুমি ব্যর্থতায় ভরে দেবে?

ফুল তাকায় কেশবের মুখে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে– কেশব ভাই, যা হবার নয় কেন তুমি তা নিয়ে এতো ভাবো। আমার জীবন রক্ষাকারী তুমি, তোমাকে আমি তিরস্কার করতে পারবো না।

ফুল।

বলো?

তোমার অমতে আমি তোমাকে স্পর্শ করবো না ফুল। কিন্তু তুমি মনে রেখো, আমার জীবনে তুমিই প্রথম আমার স্বপ্ন। নারী সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞান ছিলাম ফুল, তুমিই আমার চেতনা এনে দিয়েছো। তোমাকেই আমি ভালবেসে ফেলেছি ফুল–

ফুলের গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা। ঠোঁট দু’খানা কেঁপে উঠে শুধু কিন্তু কোনো কথা বলতে পারেনা।

কেশব এগিয়ে আসে আরও, ফুলের চোখে অশ্রু দেখে সে বিচলিত হয়ে উঠে, বেদনাকাতর কণ্ঠে বলে– তুমি কাঁদছো?

তাড়াতাড়ি আঁচলে চোখের পানি মুছে ফেলে বলে– না না কাঁদিনি, কাঁদিনি কেশব ভাই—

ফুল, কেঁদোনা, তুমি যাতে বেদনা পাও তা আমি চাইনে। তোমাকে সুখী করাই আমার ইচ্ছা। ফুল, তুমি যদি আমাকে ভালবাসতে না পারো তা হলে আমি কোনো দিন জোর করে তোমার কাছে ভালোবাসা দাবি করবো না।

কেশব উঠে দাঁড়ালো, একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ধীর-মন্থর গতিতে সেখান থেকে চলে গেলো।

ফুলের মুখ বিষণ্ণ-মলিন হয়ে উঠেছে, একটা গভীর বেদনার ছাপ ফুটে উঠে তার চোখে। উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকে ফুল কেশবের চলে যাওয়া পথের দিকে। আজ থেকে কয়েক মাস পূর্বে সে দেখেছে। কেশবকে সর্বপ্রথম, তার পাশে ব্যাকুল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে বসেছিলো সে! ফুল চোখ মেলে চাইতেই আনন্দে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠেছিলো, খুশির উচ্ছ্বাসে তার মুখটা তুলে ধরে ডেকে উঠেছিলো– ফুল!

অপূর্ব একটা অনুভূতি জেগেছিলো কেশবের মনে, ফুলের মতই সুন্দর লেগেছিলো ওকে, তাই সে ফুল বলে ডেকেছিলো প্রথম ওকে।

ফুল চোখ মেলে তাকিয়েছিলো, প্রথম সে দেখেছিলো কেশবকে সুন্দর দেবকুমারের মতই একটি যুবক। মাথায় কোঁকড়ানো এক রাশ চুল। গলায় জড়ানো যজ্ঞ উপবীত। পরনে গেরুয়া বসন। টানা টানা ডাগর দুটি চোখে মায়াময় চাহনী। ফুল স্মরণ করে কে এই যুবক, কোথায় তাকে দেখেছে। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ে না; যুবকটিকে সে স্মরণ করতে পারে না।

একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে এসেছিলো তার। ফুল ফিরে তাকিয়ে দেখেছিলো অপূর্ব জ্যোতির্ময় এক বৃদ্ধকে।

বৃদ্ধ গম্ভীর গলায় বলেছিলেন– আর ভয় নেই কেশব, এ যাত্রাও বেঁচে গেলো।

ফুল উঠে বসতে গিয়েছিলো তখন।

 বৃদ্ধ বাধা দিয়ে বলেছিলো–উঠো না মা, তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন।

 ফুল নিষ্পলক নয়নে দেখেছিলো বৃদ্ধের মুখে মায়া-মমতার গভীর এক সমাবেশ।

তারপর কেটে গেছে কতদিন, ফুল বৃদ্ধের সান্নিধ্য এড়াতে পারেনি। এক মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছে সে।

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী আর কেশবের দয়ায় সে পুনর্জীবন লাভ করেছে, তাই সে আজও তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কেশব ভালবাসে তাকে। ফুল জানে, কেশবের ভালবাসা কত গভীর, কত নিবিড়। কিন্তু। ফুল পারে না তা গ্রহণ করতে। কেশব নিষ্পাপ, নির্মল, পবিত্র এক যুবক। ফুল জানে, কোনো নারীকে সে আজও স্পর্শ করেনি, তার চরিত্রে নেই কোনো কলুষিত ছাপ। তবু ফুল পারে না তাকে গ্রহণ করতে–

হঠাৎ ফুলের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়, সন্ন্যাসী বাবাজী এসে দাঁড়ান তার সম্মুখে মা!

চমকে ফিরে তাকায় ফুল, বলে- বাবা, বলো?

 ফুল, কেশবের কি হয়েছে?

 কেন?

কেশব কুঠিরের মধ্যে অন্ধকারে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। মা, ওকে ব্যথা দিনে মা। আমি তোর কাছে করজোরে বলছি– ও বড় অভিমানী, বড় অসহায়! জীবনে ও কারো কাছে এতোটুকু স্নেহ মায়া মমতা পায়নি। যা একটু পেয়েছে তা আমার কাছে। কিন্তু আমি তো ওর তপ্ত হৃদয়ে সুধা বর্ষণ করতে পারিনে। তুই নারী, তোর বুকে লুকিয়ে আছে মায়ের প্রাণ, বধূর দরদ, ভগ্নির স্নেহ– মা, মা, কেশবকে তুই ভালবাসতে না পারিস একটু স্নেহ, একটু মায়া-মমতা দিয়ে ওকে সজীব করে তোল–

বাবা, আমি তাই করবো, তাই করবো।

যাও মা, কেশব কুঠিরে একা শুয়ে আছে, যাও।

কুঠির মধ্যে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়ায় ফুল।

কেশব বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে উবু হয়ে, হয়তো নীরবে রোদন করছে সে।

ফুলের হৃদয়ে একটা ব্যথা টন টন করে উঠলো, বড় মায়া হলো ওর মনে। সত্যি, কেশব কোনোদিন কারো কাছে এতোটুকু ভালবাসা পায়নি, পায়নি কারো স্নেহ-আদর। ফুল ওর বিছানার পাশে। গিয়ে বসলো, হাতখানা রাখলো কেশবের পিঠে।

কেশব চমকে তাকালো– কে!

 আমি! ফুলের গলাটা কেঁপে উঠলো নিজের অজ্ঞাতে।

কেশব শয্যায় উঠে বসলো– ফুল, কেন তুমি এলে? কেন তুমি আমার মনে জ্বালা ধরিয়ে দাও!

না না, আমি– আমি তোমাকে– উঠে দাঁড়ায় ফুল।

 ফুল, আমার কাছ থেকে তুমি পালাতে পারবে না। যেতে দেবো না তোমায় ফুল। কেশব ফুলের হাত ধরে ফেলে।

ফুল আঁতকে উঠে ছেড়ে দাও কেশব ভাই।

তা হয়না ফুল।

 তুমি না বলেছিলে, আমার কাছে শপথ করেছিলে তুমি আমাকে কোনদিন স্পর্শ করবেনা?

ফুল।– সঙ্কুচিত ভাবে ছেড়ে দেয় কেশব ফুলের হাতখানা। বলে সে ফুল, আমাকে তুমি মাফ করে দাও। আমাকে তুমি মাফ করে দাও–

কেশব ভাই!

ফুল। ফুল– বোন আমার!

এমন সময় সন্ন্যাসী বাবাজী এসে দাঁড়ান কুঠিরের দরজায়, হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলেন সাধু– সাধু– ধন্য কেশব, ধন্য তুমি! কেশব তোমার সংযমশক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আজ থেকে তোমরা দুইজন ভাই-বোন হলে।

অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো ফুল– বাবাজী!

কেশব তখন খুশিভরা চোখে তাকিয়ে আছে সন্ন্যাসী বাবাজীর মুখে।

সন্ন্যাসী বাবাজী যেমন এসেছিলেন তেমনি বেরিয়ে গেলেন কুঠিরের মধ্য হতে।

 কেশব ফুলের হাত ধরে বললো- ফুল, বোন চলো।

 চলো কেশব ভাই।

এখন থেকে ফুলের আর কোন সংকোচ বা দ্বিধা নেই। নেই কোন দ্বন্দ্ব। কেশব আর ফুল ঠিক ভাই আর বোনের মত। এক সঙ্গে ওরা বনে ফুল চয়ন করে মালা গাঁথে। কখনও বা কেশব ফল পেড়ে এনে ফুলকে দেয়, ফুল প্রাণভরে ভক্ষণ করে। কোনো কোনো সময় কেশব ভজন গান করে, ফুল। শোনে। ফুল গান গায়– কেশব তন্ময় হয়ে যায় ফুলের গানের সুরে।

এমনি করে দিনগুলো গড়িয়ে চলে ফুল আর কেশবের।

*

কারো কোমল হস্তের স্পর্শে বনহুরের সুখনিদ্রা ভঙ্গ হয়ে যায়। চোখ না মেলেই সে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে বিছানায়। কোনো একটা কোমল হস্ত তার ললাটে এবং চুলে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হতে থাকে।

বনহুর একটা নিশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শোয়। মনে করে, নিশ্চয়ই কোমল হস্তের অধিকারিণী তার ক্যাবিন ত্যাগ করে চলে যাবে। কিন্তু সে আশা সফল হয় না বনহুরের। হস্ত-সঞ্চালন বন্ধ হয় না বরং আরও গম্ভীর হয়ে উঠে। তার গায়ের চাদরখানা টেনে দেয় হস্ত-সঞ্চারণকারিণী।

বনহুর খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে– কে তুমি?

ক্যাবিনের অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বুঝতে পারে বনহুর হস্ত-সঞ্চারণকারিণী অন্য কেহ নয় ম্যাকমারার কন্যা শ্যালন!

শ্যালন জবাব দেয় না কোনো।

বনহুর তার হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়– কে তুমি?

 তবু নিরুত্তর শ্যালন।

বনহুর ঝুঁকে টেবিল ল্যাম্পটার সলতে বাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে শ্যালন উঠে দাঁড়ায়, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় সে বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর শয্যায় উঠে বসেছিলো, আবার সে শয্যায় শুয়ে পড়ে শান্ত কণ্ঠে বলে– শ্যালন, এতো রাতে আমার ক্যাবিনে তোমার আগমন অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। আমি চাইনে, তোমার আচরণ অন্যের মনে। সন্দেহ আনে। ধরো তোমার আব্বা যদি এতো রাতে তোমাকে আমার ক্যাবিনে দেখেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি খুশি হবেন না।

আলম, বাবা এখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন।

অন্যান্য কেউ তো দেখে ফেলতে পারে।

আমি জানি, ওরা সবাই ভীতু, এতো রাতে জাহাজে কেউ জেগে নেই।

শুধু ক্যাপ্টেন আর সারেংগণ ছাড়া, তাই না?

 হ আলম, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই এদিকে আসবে না।

 কি চাও তুমি আমার কাছে?

 শ্যালন মাথা নীচু করে।

একটু হাসির শব্দ হয় বনহুরের মুখ থেকে, বলে এবার বনহুর –শ্যালন, এ জাহাজে তোমাকে। সঙ্গীরূপে পেয়ে সত্যি আমি নতুন জীবন লাভ করেছি। তোমাকে না পেলে আমি হয়তো আজ এ জাহাজে টিকে থাকতে পারতাম না। কিন্তু আমি হয়তো তোমাকে কোনোদিন সন্তুষ্ট করতে পারবো না শ্যালন।

শ্যালন আলমের মুখে দৃষ্টি তুলে ধরলো।

বনহুর বললো–তুমি যা চাও আমি জানি, কিন্তু তা সম্ভব নয়। শ্যালন, পূর্বেই বলেছি– আমি তোমাকে ভালবাসি সত্য, কিন্তু গ্রহণ করতে পারিনে। বনহুর শ্যালনের হাতখানা শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরে অস্ফুট কণ্ঠে বলে– শ্যালন, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

আলম!

শ্যালন, আমি তো পাথর নই– আমি মানুষ। তোমার কাছে আমার অনুরোধ– তুমি নির্জনে আমার পাশে এসো না।

কেন?

সে প্রশ্নের জবাব তুমি নিজের মনকে করো।

 আলম, আমাকে ভাল লাগেনা, এই তো?

ভুল বুঝছো শ্যালন, তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। তোমার মধ্যে আমি খুঁজে পাই আমার হারানো প্রিয়াকে, তাই তাই আমার ভয় হয় হঠাৎ যদি নিজেকে আমি হারিয়ে ফেলি–

আলম!

শ্যালন, তুমি এভাবে আর এসোনা আমার পাশে। আমাকে উত্তেজিত করোনা।

বেশ, আমি আর আসবোনা। শ্যালন বনহুরের হাতের মুঠা থেকে নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

বনহুর মৃদু হাসে।

*

পর পর কয়েকদিন আর শ্যালন এলোনা বনহুরের ক্যাবিনে।

বনহুর যখন ম্যাকমারার ক্যাবিনে যায় তখন শ্যালন সরে পড়ে সেখান থেকে। একটা দুর্দমনীয় অভিমান তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বনহুরের সঙ্গে দেখা হলেও সে কথা বলেনা, মুখ ভার করে থাকে।

এসব লক্ষ্য করে হানে বনহুর। সেও আর গায়ে পড়ে কথা বলতে যায় না শ্যালনের সঙ্গে।

বনহুর এদিন ম্যাকমারার কক্ষে প্রবেশ করে দেখে শ্যালন একা বসে বই পড়ছে। ম্যাকমারা ক্যাবিনের বাইরে কোথাও কোনো কাজে আটকা পড়ে আছেন।

আকাশ সেদিন মেঘাচ্ছন্ন, সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে ঝুপ ঝাঁপ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, মাঝে মাঝে সাগরবক্ষে বাজ পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

বনহুর ক্যাবিনে প্রবেশ করে ডাকলো– শ্যালন।

শ্যালন যেমনভাবে বই পড়ছিলো তেমনি পড়তে থাকে, কোনো রকম সাড়া দেয় না।

বনহুর হাসলো, শ্যালনের মুখভাব লক্ষ্য করে বললো– শ্যালন, রাগ করেছো?

তবু কোনো জবাব দিলোনা শ্যালন, যেমন বসে ছিলো, তেমনি রইলো।

বনহুর আরও কয়েক পা সরে এসে একটা সিগারেট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে বললো– বেশ, চলে যাচ্ছি।

ঠিক সে মুহূর্তে বাজ পড়ার শব্দ জাহাজটাকে কাঁপিয়ে তুললো। জাহাজখানার নিকটে সাগরবক্ষে কোথায় বাজ পড়লো।

শ্যালন বই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে এসে জাপটে ধরলো বনহুরকে।

 বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিলো।

পরক্ষণেই শ্যালন সরে যাচ্ছিলো কিন্তু বনহুরের বলিষ্ঠ বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারলো না।

বনহুর হেসে বললো– অভিমান ঘুচে গেছে তো?

শ্যালন কোনো কথা বললোনা।

এমন সময় ক্যাবিনের বাইরে পদশব্দ শুনে শ্যালনকে মুক্ত করে দিয়ে বললো–তোমার বাবা আসছেন।

অল্পক্ষণ পর ক্যাবিনে প্রবেশ করলেন ম্যাকমারা। শরীরে তার ওয়াটারপ্রুফ ভিজে জুতোটা খুলে রেখে ক্যাবিনে এসে দাঁড়ালেন। বনহুরকে দেখে বললেন– আলম তুমি এখানে, আর আমি তোমাকে খুঁজে ফিরছি তোমার ক্যাবিনে।

বনহুর একটা সোফায় বসে পড়ে বললো– এই বৃষ্টির মধ্যে আপনি কেন কষ্ট করে আমার ক্যাবিনে গিয়েছিলেন, আমাকে ডেকে পাঠালেই আমি আসতাম।

শোন আলম, কাল আমাদের জাহাজ ডায়মণ্ড হারবারে পৌঁছবে বলে আশা করছি। জাহাজে আমাদের পুরো তিন সপ্তাহ কেটে গেলো, তবে আকাশের অবস্থা যদি আরও খারাপ হয় তাহলে আমরা বাধ্য হবো আরও কিছু সময় বঙ্গোপসাগরে থাকতে। হাঁ, যে কথা তোমাকে বলবো বলে খুঁজছি সেকথা হলো, প্রথমে আমরা কলকাতা শহরে কয়েকদিন কাটাবো। এতে তোমার মত আছে কিনা জানতে চাই? কারণ আমি ওয়্যারলেসে কলকাতা পুলিশ কমিশনার বিনয় সেনকে আমাদের আগমনবার্তা জানিয়ে দেবো। বিনয় সেন আমার বাল্যবন্ধু, এখন সে কলকাতায় আছে।

‘পুলিশ কমিশনার কথাটা বনহুরের কানে যদিও সুমধুর লাগলো না তবু বললো– একথা আমাকে জিজ্ঞাসা করার কারণ কি স্যার?

এই সাধারণ কথাটা তুমি বুঝতে পারলেনা আলম? তোমার যদি এতে অমত থাকে তবে তুমি যেখানে যেতে চাও তাই হবে।

না না, আমার এতে অমত থাকবে কেন। আমারও সখ এক বার কলকাতা নগরীটা দর্শন করি।

বেশ, তোমার কথা শুনে খুশি হলাম অনেক। কলকাতায় আমার আত্মীয়-স্বজন অনেকে আছেন। বিনয় সেন আমার বিশিষ্ট বন্ধু। আমরা একই সঙ্গে লণ্ডনে পড়াশোনাও করেছি। পড়াশোনা শেষ করে আমি চলে এলাম নিজের দেশ ছেড়ে জমরুদে; বৈজ্ঞানিক হিসাবে এক ল্যাবরেটরীতে কাজ নিলাম। আর বিনয় যেন পুলিশ বিভাগে বিশিষ্ট আসন গ্রহণ করে কমিশনার পদে নিযুক্ত হলো। যদিও আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ বহুদিন যাবৎ নেই, তবু আমাদের বন্ধুত্ব এখনও পূর্বের ন্যায় অটুট আছে। আমরা এখনও উভয়ে উভয়কে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করে থাকি। জানো আলম, বিনয় সেন পুলিশ বিভাগে যথেষ্ট নাম করেছে। বহু ডাকাত আর দস্যুকে সে গ্রেপ্তার করে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। দস্যু বনহুরের নাম হয়তো শুনেছো, তাকেও গ্রেপ্তারের জন্য বিনয় একবার কান্দাই গমন করেছিলো–

বনহুর অস্ফুট কণ্ঠে বললো– কান্দাই!

 হাঁ, বিনয় সেন দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারে কান্দাই শহরেও গিয়েছিলো, কিন্তু সফলকাম হয় নি।

 কেন তিনি সফলকাম হলেন না স্যার?

শ্যালন এবার বলে উঠলো– দস্যু বনহুরের নাম তো তুমি শোননি আলম কি সাংঘাতিক দস্যু সে! মিঃ সেন কেন, অমন কত পুলিশ অফিসার তাকে গ্রেপ্তারে হিমসিম খেয়ে গেছে।

হাঁ, শ্যালন যা যা বলছে সব সত্য, খাঁটি সত্য কথা। যদিও কান্দাই আমি কোনোদিন যাইনি, কিন্তু দস্যু বনহুর সম্বন্ধে আমি অনেক কথা অবগত হয়েছি। শুধু কান্দাই শহরেই নয়, সমস্ত আরাকান হতে জমরুদ এবং প্রায় পৃথিবীর বহু স্থানে দস্যু বনহুর তার প্রভাব বিস্তার করেছে। আমি লিবিয়াতে বসে সব অবগত হয়েছি।

দস্যু বনহুর তাহলে ভয়ানক লোক? বললো বনহুর।

শুধু ভয়ানক নয়, সাংঘাতিক দস্যু; হ কি যেন বলছিলাম– বিনয় সেন সেই দুর্দান্ত দস্যুকে গ্রেপ্তার করতে কান্দাই গিয়েছিলো। অবশ্য তখন বিনয় হামবাদ শহরের পুলিশ কমিশনার ছিলো।

বনহুর বললো এবার আপনার পুলিশ কমিশনার বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে অত্যন্ত সুখী হবো স্যার।

হাঁ, বিনয় আমাদের দেখলে অনেক আনন্দ পাবে। তাছাড়া আমার সম্পর্কে এক দাদা রয়েছেন। মস্তবড় ব্যবসায়ী কলকাতায় তার বড় বড় কারবার আছে– নাম আলবার্ড, প্রথমে আমি তার ওখানেই উঠবো। দেখো আলম, তুমি তাকে দেখলে বিশ্বাস করবে না, যদিও সে আমার বয়সে বড় তবু তাকে আমার চেয়ে বয়সে অনেক কম বলে মনে হয়। আলবার্ড বড় ভালবাসেন, স্নেহ করে আমাকে। বহুদিন পর আলবার্ড দাদাকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করবো বলে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। পার্ক সার্কাসে তার বাড়ি। আমাদের জাহাজ ডায়মণ্ড হারবার থেকে খিদিরপুর ডকে পৌঁছলে আমরা মোটর যোগে তার ওখানে যাবো।

*

ম্যাকমারার কথা অনুযায়ী তাদের জাহাজ ডায়মণ্ড হারবার বন্দরে নোঙ্গর করলো। দুই দিন সেখানে অপেক্ষা করবার পর ম্যাকমারার জাহাজ খিদিরপুর ডকের দিকে অগ্রসর হলো।

বৃদ্ধ ম্যাকমারার আনন্দ আর ধরে না। তিনি বালকের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন। বহুদিন পর বাংলা দেশের মাটির আস্বাদ গ্রহণের আশায় তিনি যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছেন।

শ্যালন হেসে বললো– বাবা, তোমাকে খুব আনন্দমুখর লাগছে, ব্যাপার কি বলো তো?

বনহুরও বসেছিলো তাদের পাশে, বই পড়ছিলো সে শ্যালনের কথায় বলে উঠে বনহুর– মাতৃভূমির ডাক স্যারকে আকর্ষণ করছে, তাই তিনি আনন্দমুখর হয়ে উঠেছেন।

ম্যাকমারা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলেন– হা আলম, তুমি ঠিকই বলেছো। মাতৃভূমির আকর্ষণ আমকে সত্যিই চঞ্চল করে তুলেছে।

নানা কথাবার্তা আর গল্প-সল্পের মধ্যে সময় অতিবাহিত হয়ে চলে।

খিদিরপুর ডকে পৌঁছে দেখেন ম্যাকমারা, পুলিশ কমিশনার বিনয় সেন স্বয়ং এসেছেন বন্ধুবর ও তার কন্যাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে যেতে। বহুদিন পর বন্ধুদ্বয় মিলিত হয়ে আনন্দিত হয়ে উঠলেন। উভয়ে উভয়কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁরা। তারপর পরিচয়ের পালা।

ম্যাকমারা তাঁর কন্যা শ্যালনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার মেয়ে শ্যালন। আর এ হচ্ছে আমার ভাবী জামাতা মিঃ আলম। অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গেও বিনয় সেনের পরিচয় করিয়ে দিলেন ম্যাকমারা এবং বিনয় সেনের পরিচয় দিলেন তার দলবলের কাছে।

বিনয় সেনের সঙ্গে বনহুরের হ্যাণ্ডসেক হলো।

বিনয় সেন বললেন– ম্যাকমারা, তোমার ভাবী জামাতাকে দেখে সত্যি আমি আনন্দ বোধ করছি।

বিনয় সেনের কথা শুনে হাসলো বনহুর।

এরপর সবাই রওয়ানা দিলো।

বিনয় সেন নিজের গাড়িতে ম্যাকমারা, শ্যালন আর বনহুরকে উঠিয়ে নিলেন। আর অন্যান্য দুটি গাড়িতে চললো ম্যাকমারার সঙ্গী ছাত্রদল।

প্রথমে খিদিরপুর ডাকবাংলোয় এসে উঠলো তারা।

খবর পেয়ে ম্যাকমারার সম্পর্কীয় দাদা আলবার্ড এসে হাজির হলেন খিদিরপুর ডাকবাংলোয়। অত্যন্ত অমায়িক ভদ্রলোক আলবার্ড। অল্পক্ষণেই তার ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হয়ে পড়লো।

ডাকবাংলোয় বসে সবাই মিলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো, চা-নাস্তার অবসরে চললো নানা রকম আলাপ-আলোচনা। আফ্রিকার জঙ্গলের কাহিনী শোনাতে লাগলেন ম্যাকমারা।

কয়েকজন মিলে নানারকম আমোদ-আহ্লাদ আর গল্পে-সল্পে অনেক সময় কাটিয়ে দিলেন। যখন রওয়ানা দেবেন ঠিক সে মুহূর্তে এসে হাজির হলেন ম্যাকমারার এক আত্মীয় মিঃ এথোল। মিঃ এথোলকে দেখে ম্যাকমারা অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি যেমন খুশি হলেন তেমনি অবাকও হলেন, কারণ ম্যাকমারা বাংলাদেশে আগমন করেছেন, তা এথোল জানলেন কি করে!

ম্যাকমারা প্রশ্ন করে বসলেন– এথোল, আমার আগমনবার্তা তোমায় কে জানলো?

একটু গম্ভীর হাসি হেসে বললেন মিঃ এথোল–তুমি বাংলাদেশে আসবে আর আমি জানবো না? ম্যাকমারা, এথোল তোমার সব সংবাদই জানে, বুঝলে? কখন তুমি কোথায় কি করছো আমার অজানা নেই।

মিঃ এখোলের কথাগুলো বেশ হেয়ালীপূর্ণ বলে মনে হলো বনহুরের কাছে। কুঞ্চিত করে তাকালো এথোলের মুখে।

এথোল জেদ ধরে বসলো– প্রথম তার ওখানেই যেতে হবে তাদের। কিন্তু মিঃ আলবার্ড নাছোড় বান্দা; তিনি ধরে বসেছেন বহুদিন পর ভাই-এর সাক্ষালাভ ঘটেছে কিছুতেই তিনি ছেড়ে দেবেন না, বিশেষ করে প্রথমে তার ওখানেই আতিথ্য গ্রহণ করতে হবে।

কমিশনার বিনয় সেন অবশ্য তেমন জেদ ধরে না বসলেও ওখানে যেতে হবে এ সুনিশ্চয়।

 ম্যাকমারা রাজি হলেন প্রথম তিনি তাঁর দাদা আলবার্ডের ওখানেই যাবেন।

পার্ক সার্কাস আলবার্ডের তিন তলা বাড়ি।

বড় হলঘরটার পাশের কামরায় বনহুর আর অন্যান্য ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আলবার্ড। আর ম্যাকমারা ও শ্যালনের জন্য আলবার্ড তিন তলায় নিজের শয়নকক্ষের পাশে কামরায় জায়গা করে দিলেন। বহুদিন পর ভাইকে তিনি পেয়েছেন, খুশিতে উপছে পড়লেন যেন আলবার্ড।

বনহুর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে আসছে প্রায় আফ্রিকার জঙ্গল থেকে। ব্যাপারটা হলো এই ম্যাকমারা কোনো সময় তার দেহের বসন উন্মোচন করতেন না। তিনি সর্বক্ষণের জন্য একটা জামা পরে থাকতেন। জামাটা তিনি কোনোদিন পরিষ্কার করতেন বলেও মনে হয় না।

জামাটা তার সর্ব নীচে পরা থাকতো, এমনকি গেঞ্জিটাও তিনি ঐ জামার উপরে পরতেন। এ ব্যাপার নিয়ে প্রফেসার ম্যাকমারার ছাত্রদের মধ্যে বেশ একটা উৎসুক ভাব ছিলো কিন্তু কেউ সে ব্যাপারের সমাধান খুঁজে পায়নি।

বনহুর পর্যন্ত এ ব্যাপারে শ্যালনকে প্রশ্ন করেছিলো –আচ্ছা শ্যালন, তোমার আব্বার দেহটা তুমি দেখেছো কোনোদিন?

শ্যালন হেসে বলেছিলো– কেন বলো তো?

বনহুর বলেছিলো তোমার আব্বা সর্বক্ষণ একটা জামা গায়ে রাখেন, তিনি কি ঐ জামাটা কোনোদিন পরিষ্কার করেন না?

না। এ ব্যাপারে আমিও বাবাকে অনেক বলেছি। কিন্তু বাবা কোনোদিন ঐ জামা পাল্টান না বা পরিষ্কার করেন না।

বনহুর অস্কুটকণ্ঠে বলেছিলো– আশ্চর্য!

তারপর আর কোনোদিন এ ব্যাপারে সে আগ্রহশীল ছিলোনা। কারণ নানা মানুষের নানা ধরণের স্বভাব! ম্যাকমারার হয়তো ওটা অভ্যাস ছাড়া কিছু নয়।

বনহুর অনেকদিন এমন নরম বিছানায় শয়ন করেনি। মিঃ আলবার্ডের আতিথ্যে খুশি হলো। বনহুর। খাওয়া-দাওয়ার পর পরম নিশ্চিন্তে শয্যা গ্রহণ করলো সে।

অল্পক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়লো বনহুর।

রাত বেড়ে আসছে।

কলকাতা নগরী এক সময় ঝিমিয়ে এলো। রাজপথ প্রায় জনশূন্য হয়ে এসেছে।

 কোনো এক গির্জা থেকে রাত চারটা বাজার ঘন্টাধ্বনি হলো।

 ঠিক সে মুহূর্তে তীব্র একটা আর্তনাদ শোনা গেলো আলবার্ডের বাড়ির তিন তলা থেকে।

ঘুম ভেঙে গেলো বনহুরের, বিদ্যুৎ গতিতে বিছানায় উঠে বসলো, সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেলো নারীকণ্ঠের আর্ত-চীৎকার। বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে উপরে ছুটলো, কিন্তু যেদিক থেকে আর্তনাদ এবং নারীকণ্ঠে, চিৎকার শোনা গিয়েছিলো সেদিকে না গিয়ে ছুটে গেলো বনহুর মিঃ আলবার্ডের শয়নকক্ষের দিকে এবং দরজায় এসে দাঁড়াতেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন আলবার্ড, নিদ্রাজড়িত ভয়ার্ত কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন– মিঃ আলম আপনি!

হাঁ, এ দিকে কোথাও তীব্র আর্তনাদ শোনা গেলো–

ব্যস্তকণ্ঠে বললেন আলবার্ড– আমিও সে রকম শুনলাম। চলুন দেখি আমার বাড়ির কোথায় কার কি দুর্ঘটনা ঘটেছে–

তখনও একটা গোঙ্গানীর মত শব্দ ওদিকের কামরা থেকে ভেসে আসছে। বনহুর আর মিঃ আলবার্ড ছুটে গেলো পাশের কামরার দরজায়। আলবার্ড বলে উঠলেন– এ কক্ষেই তো ম্যাকমারা আর শ্যালন আছে।

দরজায় চাপ দিতেই খুলে গেলো।

 কক্ষে প্রবেশ করলেন আলবার্ড আর বনহুর।

 বিষ্ময়ে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলেন আলবার্ড- খুন!

বনহুর তাকিয়ে দেখলো ওদিকের বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে শ্যালন আর এদিকের খাটের নিচে মেঝেতে রক্তাপুত অবস্থায় উবু হয়ে পড়ে আছেন ম্যাকমারা। একখানা ছোরা সমূলে বিদ্ধ। হয়ে আছে তার পিঠে। বনহুর আরও অবাক হয়ে দেখলো– ম্যাকমারার দেহে তার এতো সাধের সেই তেলচিটে জামাটা নেই।

মিঃ আলবার্ড ম্যাকমারার রক্তাক্ত দেহের উপর মাথা রেখে রোদন করে চলেছেন।

ততক্ষণে বাড়ির অন্যান্য লোকজন এবং চাকর-বাকর সবাই ছুটে এসে জড়ো হয়েছে। হঠাৎ একটা খুনের দৃশ্য লক্ষ্য করে সকলের মুখ ভয়ার্ত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

এমন সময় অতর্কিতে কক্ষে প্রবেশ করলেন মিঃ এথোল। তার পেছনে কমিশনার বিনয় সেন আর পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ রাজেন্দ্রনাথ এবং কয়েকজন পুলিশ।

বললেন এথোল স্যার, দেখুন আমার কথা সত্য কিনা। আমি জানতাম, আজ রাতেই ম্যাকমারা খুন হবে এবং সে সন্দেহেই আমি ম্যাকমারা ও তার কন্যাকে আমার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য কাউকে রেহাই দেয় না–

আলবার্ড অপূর্ণ নয়নে উঠে দাঁড়ালেন, মিঃ বিনয় সেন ও মিঃ রাজেন্দ্রনাথকে দেখতে পেয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন।

এথোল গম্ভীর কঠিন কণ্ঠে বললেন- মিঃ আলবার্ড তার ভাইকে হত্যা করেছে।

 কক্ষমধ্যে যেন বাজ পড়লো।

বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো মিঃ এথোল এবং পুলিশ কমিশনার মিঃ বিনয় সেন ও ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথের মুখে।

এথোলের কথায় ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথ আলবার্ডের হস্তে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন।

বিনয় সেন বললেন– আহা, মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেছে, তোমরা ওকে দেখ।

কয়েকজন পুলিশ শ্যালনের দিকে এগুতেই বনহুর বললো– ওর জন্য ঘাবড়াবার কিছু নেই, অজ্ঞান হয়ে গেছে একটু পরেই জ্ঞান ফিরে আসবে। বনহুর নিজে শ্যালনের চোখে মুখে ফুঁ দিতে লাগলো। একটা চাকরকে পানি আনার জন্য ইংগিত করলো বনহুর।

সামান্য কয়েকটা ঘন্টার মাত্র ব্যবধান– তারই মধ্যে কি সর্বনেশে কাণ্ডটাই না ঘটে গেলো!

আজ সন্ধ্যার পর তারা সবাই মিলে যখন আলবার্ডের বাড়িতে আগমন করেছিলেন তখন কত আনন্দই না প্রকাশ করেছিলেন আলবার্ড, এবং সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ডিনার খাইয়েছিলেন। সবাই মিলে যখন বিদায় গ্রহণ করেছিলেন তখন রাত বারোটা প্রায় বেজে গিয়েছিলো।

মিঃ বিনয় সেন যখন বিদায় নিয়ে গাড়ির দিকে এগুচ্ছিলেন তখন ম্যাকমারা ফিস ফিস করে তার কানে কিছু বলেছিলেন– এটা আর কেউ লক্ষ্য না করলেও বনহুর করেছিলো। বিনয় সেনকে ম্যাকমারা শেষ বারের মত কি বলেছিলো তা একমাত্র নিহত ম্যাকমারা আর পুলিশ কমিশনার বিনয় সেন ছাড়া আর কেউ জানে না। কি এমন গোপন কথা তিনি বন্ধুর কাছে বলেছিলেন তিনিই জানেন। তারপর বনহুর শয্যা গ্রহণের পর অল্পক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, আর্তনাদের শব্দে যখন তার ঘুম ভাঙলো তখন রাত চারটে।

একটা বয় পানি এনে বনহুরের হাতে দিলো, সে তখন শ্যালনের চোখে ঝাপটা দিতে লাগলো। অল্পক্ষণে শ্যালনের জ্ঞান ফিরবে বলে মনে হলো না বনহুরের।

মিঃ বিনয় সেন এবং মিঃ রাজেন্দ্রনাথ ম্যাকমারার লাশ পরীক্ষা করে দেখছিলেন।

আলবার্ডের হাতে তখন হাতকড়া লাগানো হয়ে গেছে। তিনি নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছেন, এবং মাঝে মাঝে উচ্চারণ করছেন–ঈশ্বরের শপথ, আমি আমার ভাইকে হত্যা করিনি– আমার ভাইকে আমি হত্যা করিনি–

মিঃ এথোল ক্রুদ্ধভাবে বলছেন–তুমি মিছেমিছি নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছো। তুমি যদি ম্যাকমারাকে হত্যা না করবে তাহলে কেন তাকে জেদ করে তোমার বাড়িতে নিয়ে এলে? আমার বাড়িতে তাকে যেতে দিলে না কেন তবে বলো? নিশ্চয়ই এ তোমার কাজ।

পুলিশ অফিসারদ্বয়ের লাশ পরীক্ষা এবং ডায়রী লেখা শেষ হলে, বনহুর তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। বললো সে এথোলকে লক্ষ্য করে– মিঃ এথোল, আপনাকে আমি একটি প্রশ্ন না করে পারছিনে। বলুন আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব দেবেন?

বলুন, যদি দেবার মত প্রশ্ন হয় নিশ্চয়ই দেবো!

দেখুন, ম্যাকমারা খুন হয়েছে রাত্রি চারি ঘাটকায়, আর আপনি পুলিশ কমিশনার এবং ইন্সপেক্টার সাহেবকে নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছেন ঠিক রাত্রি সাড়ে চারটায়। মাত্র অধঘণ্টা সময়ে আপনি এখানে এসে পৌঁছেছেন। তাতে মনে হয় ম্যাকমারা রাত্রি চারি ঘটিকায় খুন হবেন, এ কথা আপনি জানতেন?

হা জানতাম, জানতাম বলেই আমি ম্যাকমারার বিশিষ্ট বন্ধু মিঃ সেন এবং ইন্সপেক্টারকে নিয়ে পার্ক সার্কাস রওয়ানা দিই কিন্তু তার পূর্বেই খুনী তার কাজ শেষ করে ফেলেছে।

কি করে আপনি জানলেন–ম্যাকমারা আজ রাতে নিহত হবেন?

সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় না। আপনি বুঝি আমাকে সন্দেহ করছেন?

 মোটেই না।

তবে আমাকে এভাবে প্রশ্ন করার কি মানে হয়?

 আমাকে ক্ষমা করবেন। তবে হাঁ, পুলিশ আপনাকেও রেহাই দেবে না।

বিনয় সেন হাসলেন–ধন্যবাদ মিঃ আলম। আপনি ঠিকই বলেছেন, মিঃ এথোলকেও আমরা। এতো সহজে ছেড়ে দেবো না।

পুলিশ অফিসে তাকেও কৈফিয়ৎ দিতে হবে।

সেদিন এর বেশি আর কিছু জানা সম্ভব হলো না বনহুরের পক্ষে। ম্যাকমারার লাশ পোষ্টমর্টেমের জন্য মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ ইন্সপেক্টার দলবল নিয়ে বিদায় গ্রহণ করলেন।

ততক্ষণে শ্যালনের জ্ঞান ফিরে এসেছে।

 সে বনহুরকে বারবার প্রশ্ন করছে–তার বাবা কেমন আছেন।

 তিনি বেঁচে আছেন তো?

 বনহুর সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে-হাঁ, তোমার বাবা জীবিত আছেন।

 তাকে হসপিটালে রাখা হয়েছে।

*

বনহুর কক্ষমধ্যে পায়চারী করছে আর সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে। কক্ষমধ্যে ধুম্ররাশি ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে এক যজ্ঞকুণ্ডের আকার ধারণ করেছে। বনহুরের ললাটে গভীর চিন্তা-রেখা ফুটে উঠেছে। সে ভাবছে প্রফেসার ম্যাকমারার হত্যা-রহস্যের কথা ভাবছে তার গায়ের ছোট্ট জামাটার কথা। নিশ্চয়ই ম্যাকমারার জামাটাই তাঁর হত্যার কারণ। কিন্ত কেন, কি ছিলো তার। জামার মধ্যে…

বনহুর থমকে দাঁড়ায়, অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা এ্যাসট্রেতে নিক্ষেপ করে পুনঃ আর একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে, তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বাইরে। গাড়ি-বারান্দায় গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো, বনহুর গাড়ির ড্রাইভ-আসনে চেপে বসলো।

কলকাতা নগরী তার কাছে নতুন হলেও একদিনে সে শহরের বহু স্থানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। ডায়মণ্ড হারবার থেকে দমদম পর্যন্ত সে ঘুরেফিরে দেখেছে। আলিপুর, বালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া, ভবানীপুর, ধর্মতলা, বৌবাজার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, এমনকি সে মনুমেন্টের সঙ্গেও পরিচিত হয়ে গিয়েছে। বনহুর আজ পার্ক-সার্কাস রোড হয়ে ধর্মতলার দিকে অগ্রসর হলো। হাতঘড়ির দিকে একবার দেখে নিলো বনহুর, রাত একটা বিশ মিনিট। শীতের রাত নয়; গ্রীষ্মকাল– কাজেই রাত একটায় কলকাতা নগরী সন্ধ্যা রাতের মতই গমগম করছে। তবে ছোট-খাটো সঙ্কীর্ণ গলিপথগুলো নীরব নিঝুম হয়ে পড়েছে।

বনহুরের গাড়ি ধর্মতলা রোড ত্যাগ করে বেনিয়া পুকুর রোডে প্রবেশ করলো। এটা খুব বড় রাস্তা নয়, তবু দোকানপাট যথেষ্ট রয়েছে; মাঝে মাঝে ব্যবসায়ী লোকদের বাড়িও দেখা যায়। বেনিয়া পুকুর হয়ে লোয়ার চিৎপুর রোড দিয়ে বৌবাজারের মোড়ে এসে বনহুর গাড়ি রাখলো। আবার হাতঘড়ির দিকে। তাকিয়ে দেখে নিলো বনহুর। এতোটা পথ আসতে তার সম্পূর্ণ এক ঘন্টা সময় লেগেছে। অনেক ঘুরেফিরে এপথে-সে পথে তাকে আসতে হয়েছে।

বৌবাজারের অদূরে চৌমাথায় একটা মাঝারী রকমের বাড়ি। বনহুর দূর থেকে লক্ষ্য করলো বাড়িটার সবগুলো কামরার জানালা– কপাট বন্ধ।

বনহুরের গাড়ি থেকে প্রায় একশত হাত দূরে সেই বাড়িখানা। এ বাড়িই মিঃ এথোলের। বনহুর আশ্চর্য হলো– এতোবড় ধনবান লোক হয়ে ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকেন, ব্যাপার কি!

অবশ্য বনহুর এথোলের বাড়ির সন্ধান লাভ করেছিলো আলবার্ডের এক বয়ের কাছে। কয়েকদিন ধরে বনহুর সকাল-সন্ধ্যা দ্বিপ্রহর আলবার্ডের একটি শিক্ষিত বয়কে সঙ্গে করে কলকাতার প্রায় বহু জায়গা চষে ফিরেছে।

আলবার্ড এখন হাজতে।

বাড়িতে তার বৃদ্ধা স্ত্রী এবং দুই সন্তান ছাড়া আর কেউ আপন জন নেই। তবে আলবার্ডের কারবার অনেক, ইণ্ডাষ্ট্রি আছে যথেষ্ট। কর্মচারী, দাস-দাসী চাকার-বাকরের অভাব নেই। প্রত্যেকটা ইণ্ডাষ্ট্রির জন্য ম্যানেজার এবং বিভিন্ন কর্মচারী রয়েছে। আলবার্ডের জ্যেষ্ঠপুত্র আর্থার শিক্ষিত এবং জ্ঞানবান যুবক প্রায় বনহুরের সমবয়সী। বনহুরের বেশ ভাব জমে গেছে আর্থারের সঙ্গে। সে নিজে বনহুরকে সহায়তা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে তার বাবাকে নির্দোষ প্রমাণিত করার জন্য। আর্থারের বিশ্বাস, তার বাবা কাকা ম্যাকমারার হত্যাকারী নয়।

আজ সকালে বনহুর আলবার্ডের বয় পিলুকে সঙ্গে করে দেখে গেছে মিঃ এথোলের বাড়িটা। কিন্তু এখন আশ্চর্য হলো বনহুর পিলু তাকে ধোকা দিয়েছে, এ বাড়িতে কেউ বাস করে বলে মনে হলো না। চোখে দূরবীণ লাগিয়ে বনহুর ভালোভাবে লক্ষ্য করলো, সত্যিই এ বাড়ি তালাবন্ধ। বনহুর তার গাড়ি নিয়ে বাড়িটার দরজায় এসে দাঁড়ালো। বহুদিন বাড়িখানা মেরামত না করার দরুণ বাড়িটা জিরজিরে মনে হচ্ছিলো।

বনহুর এবার গাড়ি থেকে নেমে পড়লো, পকেট থেকে এক গোছা চাবি বের করে বাড়ির দরজায় যে তালা লাগানো ছিলো তাতে একটির পর একটি লাগিয়ে চললো। বাড়িখানা এমন স্থানে যেখানে তেমন কোনো লোকজনের ভীড় নেই।

অল্পক্ষণেই তালা খুলে গেলো; বনহুর সন্তর্পণে ভিতরে প্রবেশ করলো। জমাট অন্ধকার, বাড়ির কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। এগুতে লাগলো বনহু। বাড়িটা তো তার জানাশোনা নেই, কাজেই বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে গিয়ে বেঁচে যাচ্ছিলো। আর খানিকটা এগুতেই হঠাৎ একটা ফিসফিস চাপা পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেলো।

থমকে দাঁড়ালো বনহুর। দ্বি

তলের কোনো কক্ষ থেকে আওয়াজটা ভেসে আসছে।

বনহুর জানেনা, এ বাড়ির দ্বিতলে উঠার সিঁড়িটা কোন ধারে। তবু ভালভাবে সন্ধান করে চললো, অল্পসময়েই পেয়ে গেলো সিঁড়িটা। বনহুর পকেটে হাত দিয়ে রিভলভারখানা বের করে দক্ষিণ হস্তে চেপে ধরলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো সে এবার।

সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রাখতেই বনহুর বুঝতে পারলো–প্রশস্ত একটা টানা বারান্দা সোজা চলে গেছে উত্তর দিকে। ওদিকের কোণের একটা কক্ষ থেকেই আওয়াজটা আসছিলো। বনহুর অগ্রসর হলো। কথার আওয়াজ লক্ষ্য করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো সে। সাবধানে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো, কক্ষমধ্যে দু’জন ফিস ফিস করে আলাপ করছে স্পষ্ট বোঝা গেলো।

বনহুর দরজায় কান লাগিয়ে কথাবার্তা বুঝবার চেষ্টা করলো, কিন্তু যে ভাষায় কথাবার্তা চলছে তা বাংলা বা ইংরেজি ভাষা নয়। চীনা, জাপানী ভাষাও নয়– কি ভাষা তা বনহুর বুঝতে পারলোনা।

বনহুর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ওদিকের শার্শীতে চাপ দিয়ে খুলে ফেললো, এবং লাফিয়ে। পড়লো কক্ষমধ্যে। দক্ষিণ হস্তে তার গুলী ভরা রিভলভার।

কক্ষ অন্ধকার!

বনহুর এবার পকেট থেকে টর্চ বের করে আলো জ্বালালো। আশ্চর্য হয়ে গেলো সে–কক্ষ শূন্য! কিন্তু তখনও কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

বনহুর বিস্মিত হয়ে দেখলো– কক্ষের এক কোণে একটা টেবিলের উপর টেপ রেকর্ড চালু করা রয়েছে। সেই টেপ রেকর্ডের কথাবার্তাই এতোক্ষণ বনহুর শুনতে পাচ্ছিলো। বনহুর এবার সুইচ টিপে আলো জ্বালালো। কক্ষটি খুব বড় নয়। মূল্যবান আসবাব বলতে একটি খাট, একটি টেবিল আর কয়েকখানা চেয়ার। এক পাশে একটা আলমারী, আলমারীর মধ্যে কিছুসংখ্যক বই।

বনহুর আলমারীটা খুলে ফেললো। এক একখানা বই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে আবার স্ব-স্থানে রেখে দিলো। প্রায় অনেকগুলো বই সে মেলে মেলে দেখলো। নানা ভাষার বই সে দেখলো আলমারীটাতে।

আলমারী বন্ধ করতেই দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করলেন মিঃ এথোল। বনহুরকে দেখে কিছুমাত্র আশ্চর্য না হয়ে বললেন– বাইরে আলবার্ডের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই বুঝেছিলাম আপনি এসেছেন।

বনহুর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে এখোলের মুখের দিকে।

এথোল ঠিক পূর্বের মতই স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন– বসুন।

 বনহুর আসন গ্রহণ না করে গম্ভীর গলায় বললো– এটাই বুঝি আপনার বাড়ি?

 কেন, সন্দেহ ছিলো নাকি?

হাঁ, আপনি নামকরা একজন ধনবান লোক অথচ আপনার এ রকম বাড়ি– আমি ভাবতে পারিনি।

বসুন, বলছি।

বনহুর আসন গ্রহণ করলো।

এথোল সিগারেট-কেসটা বের করে বনহুরের সম্মুখে এগিয়ে ধরলেন–নিন।

বনহুর আলগোছে একটা সিগারেট তুলে নিলো এথোলের সিগারেট-কেস থেকে। কিন্তু সে এখোলের অলক্ষ্যে সিগারেটটা নিজের পকেটে রেখে, নিজস্ব একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরে তাতে অগ্নিসংযোগ করলো।

এথোলও তার নিজের সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে একরাশ ধূয়া নির্গত করলেন।

বনহুর তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন– এতো রাতে আপনাকে বিরক্ত করলাম বলে মনে কিছু করবে না।

নিশ্চয়ই আমি খুশি হয়েছি, এবং আমি আপনার নিকটেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনাকে না পেয়ে বাসায় ফিরে এলাম। অবশ্য জানতাম, আপনি এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

বনহুর আরও অবাক হলো, বললো– কি করে আপনি জানলেন, আমি আপনার জন্য আপনার বাড়িতে অপেক্ষা করছি!

এ সহজ কথাটা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে– আশ্চর্য ছেলে তুমি! দেখ আলম, তোমাকে তুমি বললাম বলে মনে কিছু করোনা।

নিশ্চয়ই না। কিন্তু আপনি জানেন আমি আপনার কাছে কেন এসেছি?

বৎস, আমি জানবো না! দেখো আলম– তুমি আমাকে সন্দেহ করেছে– আমিই হয়তো বন্ধু ম্যাকমারা হত্যা-রহস্যের সঙ্গে জড়িত আছি।

সন্দেহ নয়, আপনি নিশ্চয়ই জানেন কে আপনার বন্ধু ম্যাকমারাকে হত্যা করেছে?

হেসে উঠলেন এথোল– ছেলেমানুষ তোমরা, গভীর রহস্য বুঝতে এখনও তোমাদের অনেক বিলম্ব আছে।

আপনি কি বলতে চান, ম্যাকমারা হত্যা-রহস্য ব্যাপার আপনি জানেন না?

না। তবে জানি– কেন সে নিহত হয়েছে।

কেন সে নিহত হয়েছে আপনি না বললেও আমি জানি।

হেসে উঠলেন আবার এথোল মিথ্যা কথা, কেন ম্যাকমারা নিহত হয়েছে একমাত্র আমি। আর হত্যাকারী ছাড়া কেউ জানে না।

আপনি শুনতে চান কেন ম্যাকমারা হত্যা হয়েছে?

আমি জানি তুমি জানো না। শুধু তুমি কেন, তার কন্যাও জানেনা। আলম, তুমি স্থির হয়ে বসো কয়েকটা কথা আমি তোমাকে বলবো। হয়তো কথাগুলো বলার পর আমারও মৃত্যু ঘটতে পারে।

বনহুরের কাছে ঘটনাগুলো ক্রমেই আরও রহস্যময় বলে মনে হতে লাগলো।

এথোল তার হস্তের অর্ধদগ্ধ সিগারেটে শেষবারের মত টান দিয়ে সিগারেটটা মেঝেতে ফেললেন, তারপর পায়ের তলায় ফেলে বুট দিয়ে পিষে নিবিয়ে দিলেন।

বনহুর অবাক হলো আরও। টেবিলে এ্যাসট্রে অথচ মিঃ এথোল তার উচ্ছিষ্ট সিগারেট এ্যাসট্রেতে নিক্ষেপ না করে মেঝেতে ফেললেন কেন, এবং বুট দিয়ে এমনভাবে পিষে ফেললেন– যেন এতোটুকু চিহ্ন না থাকে! টেবিলে এ্যাসট্রে সম্পূর্ণ ফাঁকা।

বনহুর এ্যাসট্রে লক্ষ্য করছে দেখে মিঃ এথোল বললেন– আমার এ্যাসট্রে পরিষ্কার করবার লোক নেই এখানে, তাই আমি–কথা শেষ না করে গম্ভীর হলেন।

বনহুর কিছু চিন্তা করছিলো।

মিঃ এথোল বললেন আবার– আলম, আমি এইমাত্র পার্ক সার্কাসে গিয়েছিলাম তোমার সন্ধানে।

কিন্তু তোমাকে না পেয়ে আমি উৎকণ্ঠিত হইনি, কারণ আমি জানি তুমি আমার এখানে এসেছো। তারপর ফিরে যখন দরজায় আলবার্ডের গাড়ি দেখলাম তখন আমার ধারণা স্থির হলো। হাঁ, তুমি হয়তো ভাবছো এতোবড় বাড়ি অথচ লোকজন নেই কেন? আসলে শুধু এটাই আমার বাড়ি নয়, ডালহৌসী স্কয়ারে আমার মস্ত বড় বাড়ি আছে সেখানে আমার আত্মীয়-স্বজন-পরিবার সব আছে। তুমি হয়তো জানোনা– আমি একজন বৈজ্ঞানিক।

বনহুর বলে উঠলো– আপনি বৈজ্ঞানিক?

হাঁ, এই পাশের কামরায় আমার ল্যাবরেটরী। সারাদিন আমি আমার সাধনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, বাড়িতে নানা অসুবিধার জন্য এখানে এ বাড়িটা আমি বেছে নিয়েছি। আমাকে মাঝে মাঝে বাইরে যেতে হয়, তাই আমি বাড়ির দরজায় তালা বন্ধ করে যাই। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে তুমি আরও অবাক হয়েছে।

হাঁ, আপনি বেশ বুদ্ধি করেছেন, বাসায় আপনি নেই অথচ কথাবার্তা চলছে আপনার ঘরে।

ঠিক বলেছো। আমি টেপরেকর্ডে এমন এক ভাষার সৃষ্টি করেছি যা আমাদের বাংলাদেশের লোক বুঝতে পারবে না। কলকাতা শহর– চোর-জোচ্চোরের তো অভাব নেই, কাজেই আমি এ ব্যবস্থা করেছি।

হেসে বললো বনহুর– সত্যি, আপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছিনে।

 যাক, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, কেন আমি আমার বাড়িতে এ রকম ব্যবস্থা করেছি।

হাঁ, পেরেছি। কিন্তু আপনি এতো রাতে আমার সন্ধানে পার্ক সার্কাসে কেন গিয়েছিলেন তা জানতে পারি কি?

যে কারণে তুমি এসেছো আমার সন্ধানে?

বনহুর অবাক হলো এথোলের কথায়। মনোভাব গোপন করে বললো সে– ম্যাকমারার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করাই হলো আমার উদ্দেশ্য।

ঠিক আমারও তাই।

আপনি কি আমাকে প্রফেসার ম্যাকমারার হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেন?

তুমি যেমন আমাকে সন্দেহ করছো, ঠিক ঐ রকম একটা সন্দেহের ছোঁয়া আমার মনেও দোলা জাগাচ্ছে। কিন্তু যাক সে সব কথা– এখন কাজের কথায় আসা যাক।

বনহুর কোনো জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ আর একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো।

এথোল হেসে বললেন– আমি যে সিগারেটটা তোমাকে দিয়েছিলাম নিঃসন্দেহে পান করতে পারো।

বনহুর চমকে উঠলো, তবে এথোল তার কার্যকলাপ টের পেয়েছেন। সে যে সিগারেটটা পান না করে পকেটে রেখেছে তা তিনি বুঝতে পারলেন কি করে? বনহুর বললো– আমি নিজের সিগারেট ছাড়া অন্য কোনো সিগারেট পান করিনে।

ধন্যবাদ! তোমার বুদ্ধিমত্তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। হাঁ, তোমার সহায়তা পেলে আমি ম্যাকমারার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হবো।

বনহুর ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকালো মিঃ এথোলের মুখে।

মিঃ এথোল আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর কিছুক্ষণ পায়চারী করে কি যেন ভাবলেন।

বনহুর সিগারেটের ধূম্ররাশির ফাঁকে সব লক্ষ্য করছিলো। এখোলের কথাবার্তা এবং আচরণ তাকে আরও ভাবিয়ে তুলেছিলো।

মিঃ এথোল হঠাৎ পায়চারী বন্ধ করে বললেন– তুমি আমার বন্ধুবর ম্যাকমারার ভাবী জামাতা, কাজেই তোমার কাছে না বলার বা লুকোবার কিছু নেই।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললো বনহুর এগোলের মুখে।

মিঃ এথোল বলতে শুরু করলেন সেদিন রাতে আলবার্ডের বাড়ি থেকে আমন্ত্রণ খেয়ে আমরা যখন বিদায় নিচ্ছিলাম তখন আমাকে আড়ালে ডেকে বলেছিলো ম্যাকমারা– এথোল, তুমি আমার পরম আত্মীয়– তোমাকে আমার মনের কথা বলবো। আমি বলেছিলাম, বলো? ম্যাকমারার মুখ তখন বেশ করুণ এবং ভয়ার্ত দেখাচ্ছিলো। আমার কথায় সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলেছিলো– এথোল, বাংলাদেশে এলাম কিন্তু বাংলার মাটি আমাকে সহ্য করতে পারছেনা। আমি বুঝতে পারছি মৃত্যু আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আজ রাতটা যদি আমি জীবিত থাকতে পারি তাহলে হয়তো আমি বাঁচলেও বাঁচতে পারি। আমি হেসে বলেছিলাম– বাজে কথা ভেবে মন খারাপ করছো। কি এমন কাজ করেছে যার জন্য তোমার মৃত্যু ঘটতে পারে! সে কথার কোনো জবাব দেয়নি ম্যাকমারা, তার চোখে-মুখে একটা আশঙ্কাপূর্ণ ভাব ফুটে উঠতে দেখেছিলাম তখন।

বনহুর সোজা হয়ে বসলো তার আসনে– তারপর?

আমি বলেছিলাম তোমার যদি এতো ভয় তবে আমার ওখানে চলো। কিন্তু ম্যাকমারা আমার কথার কোনো জবাব দিলোনা। হাঁ, তারপর আমরা চলে এসেছিলাম।

কিন্তু আবার ঠিক সময় আপনি হাজির হয়েছিলেন।

শুধু আমি নই, পুলিশ কমিশনার স্বয়ং আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন, আরও ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টার এবং কয়েকজন পুলিশ।

আপনি কি করে অনুমান করলেন আপনার বন্ধুবর ম্যাকমারা সত্যিই নিহত হবেন বা হয়েছেন?

আলবার্ডের বাড়ি থেকে বাসায় ফিরে আমি কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিলাম না। যতই ভাবছিলাম ম্যাকমারার কথাগুলো, ততই যেন কেমন অস্থির হয়ে পড়ছিলাম; কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলাম না। রাত তখন তিনটে কিংবা সাড়ে তিনটে– আমি বাথরুমে প্রবেশ করলাম। বাথরুম থেকে হঠাৎ শুনতে পেলাম আমার টেবিলে ফোনটা ক্রিং ক্রিং শব্দ করে বেজে উঠলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে যখন ফোন ধরলাম তখন আমার হাতঘড়িতে চারটে বাজতে দশ মিনিট বাকী। রিসিভার হাতে তুলে নিতেই শুনতে পেলাম বন্ধু ম্যাকমারার ব্যাকুল ভয়ার্ত কণ্ঠ– হ্যালো, হ্যালো এথোল– এথোল– আমিও জবাব দিলাম –হ্যলো স্পিকিং এথোল– কিন্তু কি হলো– আর কোনো শব্দ শুনতে পেলামনা। বার বার ম্যাকমারার নাম ধরে ডাকলাম কিন্তু কোনো সাড়া নেই, ভালভাবে শোনার চেষ্টা করলাম রিসিভার কানে লাগিয়ে –মনে হলো একটা ধস্তাধ্বস্তির ক্ষীণ শব্দ ফোনের মধ্যে ভেসে আসছে। পরক্ষণেই আর একটি শব্দ শুনলাম– নারীকণ্ঠের আর্তনাদের ক্ষীণ শব্দ–

বনহুর অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনছিলো মিঃ এখোলের কথাগুলো। এবার বললো বনহুর– হাঁ, আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে ম্যাকমারার কক্ষে টেবিলে রিসিভারখানা এক ধারে ঝুলছিল এবং আপনি তা সকলের অলক্ষ্যে স্বস্থানে তুলে রেখেছিলেন।

আমি–হাঁ হাঁ রেখেছিলাম– কি জানি কেন যে আমি ও কাজ করতে গিয়েছিলাম। একটু থতমত খেয়ে গেলেন এথোল।

বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে পকেট থেকে রিভলভার বের করে ধরলো মিঃ এথোলের বুকে– সঠিক করে বলুন, কেন তাকে হত্যা করেছেন?

এবার এথোল এতোটুকু বিচলিত হলেন না, অট্টহাসি হেসে বললেন– বৎস, তুমি দেখছি আমাকেই খুনী বানিয়ে বসেছে। যদি বলি, তুমি তাকে হত্যা করেছে।

আমি!

হাঁ, তুমি রাতে ঐ বাড়িতেই ছিলে কিনা। দেখ আলম, একটি কথা মনে রেখো– খুনীকে এখনও আমরা কেউ জানিনা। তবে তোমার চেয়ে আমি একটু বেশি জানি, কারণ ম্যাকমারা কেন খুন হয়েছে। একথা আমার জানা নেই। তুমি যা এখনও জানোনা।

ঠিক বলেছেন, আমি জানিনে কেন সে খুন হয়েছে এবং কে তাকে খুন করেছে।

তাহলে মিছেমিছি আমাকে এভাবে অপদস্ত করার মানে কি হয় বলো? মিঃ এথোল বনহুরের রিভলভারের মাথাটা ধরে সরিয়ে দেয়।

বনহুর বলে উঠলো এবার বলুন, কেন ম্যাকমারা খুন হয়েছে?

 কিন্তু আমার আপত্তি আছে কথাটা বলতে।

 তাহলে আমার হাতে আপনাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে।

তুমি ছেলেমানুষ, একটুতেই উতলা হচ্ছে, সবুর করো– সব জানতে পারবে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, আমার সহায়তা ছাড়া কেউ ম্যাকমারার হত্যাকারীকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে না।

সেদিন মিঃ এথোলের কাছে এর বেশি জানা সম্ভব হলোনা। বনহুর বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসলো।

গাড়িতে উঠে বনহুর সুইচ টিপে গাড়ির ভিতরে আলো জ্বেলে ফেললো এবং সম্মুখের ছোট্ট আয়নাখানা বাঁকিয়ে নিচু করে নিলো, যাতে পিছন আসনের সব স্পষ্ট দেখা যায়।

আয়নাটা নিচু করে নিয়ে তাতে দৃষ্টি ফেলতেই বনহুর দেখতে পেলো– তার গাড়ির পিছন আসনের তলায় উবু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কেউ বসে আছে। আশ্চর্য হলো না বনহুর, কারণ সে জানে এমন থাকা স্বাভাবিক।

গাড়ি ছুটতে শুরু করলো, ইতিমধ্যে বনহুর আয়নাটাক আরও নিচু করে নিয়েছে। বনহুর সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, কে একজন নিশ্চুপ বসে আছে গুটিসুটি মেরে।

বনহুর পকেটে হাত দিয়ে রিভলভারের অস্তিত্ব অনুভব করে নিলো। তার রিভলভারে দু’টি গুলী মজুত রয়েছে। কে এ লোক– কি এর অভিসন্ধি? বনহুর পার্ক সার্কাস রোডের দিকে না গিয়ে সোজা গাড়ির মোড় ঘুরিয়ে নিলো ধর্মতলা রোডের দিকে। তারপর মেছো বাজার বড় বাজার হয়ে এলোপাথাড়ি হয়ে এগিয়ে চললো গঙ্গার দিকে।

গঙ্গার ধারে এসে গাড়ি রাখলো বনহুর, তারপর পকেট থেকে রিভলভার বের করে পিছন আসনে উদ্যত করে ধরলো–বেরিয়ে এসো!

ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো লোকটা।

বনহুর বামহস্তে পকেট থেকে টর্চ বের করে মুখে ফেললো, সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো– শ্যালন, তুমি!

হাঁ, আমাকে মাফ করো।

বনহুর টর্চের আলো ফেলে শ্যালনের পা থেকে মাথা অবধি লক্ষ্য করলো। সম্পূর্ণ একটি পুরুষের ড্রেস। বনহুর শ্যালনকে চিনতে বিলম্ব করেনি, অন্য কেউ হলে এতো সহজে তাকে নারী বলে চিনতে পারতো না।

বনহুর রিভলভার প্যান্টের পকেটে রেখে গম্ভীর গলায় বললো– শ্যালন, তুমি এ গাড়ির মধ্যে কি করতে এসেছো?

শ্যালন ভড়কে গিয়েছিলো, বনহুরের গম্ভীর কণ্ঠস্বরে ঢোক গিলে বললো– তুমি একা চলে এলে তাই আমি–

কখন তুমি গাড়িতে উঠেছিলে?

যখন তুমি গাড়িতে চেপে, আবার কি যেন মনে করে ভিতরে গিয়েছিলে—

 হাঁ, আমি টর্চ আনতে আমার ঘরে গিয়েছিলাম।

 আমি ঠিক তখন গাড়ির পিছনে চেপে বসেছি।

একাজ করে তুমি ভাল করোনি শ্যালন।

তুমি একা চলে এলে, আর আমি একা–

শ্যালন তোমার বাবার মৃত্যু হয়েছে; এখন তোমাকে সাবধানে চলাফেরা করতে হবে, তোমার যে শত্রু নেই তা নয়।

সেজন্যই তো আমি একা ও বাড়িতে থাকতে পারলাম না।

শ্যালন, আমাকে এখন সব সময় এখানে-সেখানে ছুটোছুটি করে বেড়াতে হচ্ছে। তোমার পিতার হত্যাকারীকে যেমন করে হোক খুঁজে বের করবোই করবো। বনহুর দাঁতে দাঁত পিষে বললো।

শ্যালন বলে কিন্তু আমি ও বাড়িতে একা থাকতে পারবো না।

তাহলে আমি কি সব সময় তোমাকে পাহারা দিয়ে রাখবো?

শ্যালন কোনো কথা বলে না।

বনহুর আবার বললো তোমার পিতার হত্যাকারীর সন্ধানে আমাকে সমস্ত কলিকাতা শহর চষে ফিরতে হবে।

আমিও তোমার সঙ্গে থাকবো।

শ্যালনের কথায় বনহুরের হাসি পেলো, রাগও হলো, বললো সে– তুমি আমার সঙ্গে থাকলে আমি কাজ করতে পারবো?

কেন পারবে না, আমি তোমাকে সহায়তা করবো।

তা হয় না শ্যালন, এটা তোমার বাবার মত জীবজন্তুর ফটো তোলার ব্যাপার নয়। তোমাকে বাড়িতে থাকতেই হবে।

না, আমি পারবো না।

কি মুস্কিল হলো তোমাকে নিয়ে।

 তাহলে বাবা নেই– আমার বেঁচে কি হবে।

কি করতে চাও?

 গঙ্গায় ডুব মারবো।

বেশ, তাই করো।

 শ্যালন আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে গঙ্গার দিকে ছুটলো।

 বনহুর বলিষ্ঠ হাতের মুঠায় খপ করে ধরে ফেললো শ্যালনের সরু কোমল হাতখানা।

 শ্যালন এবার দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো।

বনহুর শান্ত কণ্ঠে বললো– এতো ছেলেমানুষ তুমি। শ্যালন, বেশ কথা দিলাম, তোমাকে আগলে নিয়েই ঘরে বসে থাকবো। তোমার বাবার হত্যাকারীর সন্ধান না-ই-বা হলো, কেমন?

শ্যালন কোনো কথা বললো না।

বনহুর বললো– চলো, উঠো এবার গাড়িতে।

 বনহুর নিজের আসনের পাশে শ্যালনকে বসিয়ে নিলো।

 গাড়ি এবার গঙ্গার তীর বেয়ে হাওড়া ব্রীজের দিকে এগুতে লাগলো।

 শ্যালন বললো– কোথায় যাচ্ছো?

হাওড়া ব্রীজের উপরে যাবো।

সেখানে কেন?

তুমি দেখোনি– তাই!

 ব্রীজের উপর এসে গাড়ি রেখে নেমে দাঁড়ালো বনহুর, শ্যালনকে লক্ষ্য করে বললো–এসো।

ব্রীজের একপাশে এসে দাঁড়ালো বনহুর আর শ্যালন। রাত তখন শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। জনশূন্য হাওড়া ব্রীজ। মাঝে মাঝে দু’একটা প্রাইভেট, কার এদিক থেকে ওদিকে দ্রুত চলে যাচ্ছে। হয়তো বিশেষ কোনো প্রয়োজনেই গাড়িগুলো গ্যারেজ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।

গঙ্গার বুক সম্পূর্ণ অন্ধকার নয়। যদিও কোনো স্টিমার বা জাহাজ তখন চলাচল করছিলো না, কিন্তু গঙ্গার ভাসমান ল্যাম্পগুলো আলো বিতরণ করছিলো। তা ছাড়া গঙ্গাতীরে থেমে থাকা নৌকাগুলো থেকে। লণ্ঠনের বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি গঙ্গার জলে এক মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে।

বনহুর বললো–শ্যালন, কলিকাতা শহরে এই আমার প্রথম পদক্ষেপ। জানতাম না এখানে এসে আমাকে এভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে। তোমার বাবার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে না পারলে আমার স্বস্তি নেই।

জানি আমার বাবার হত্যাকারী আমারও শত্রু, তাইতো আমার এতো ভয়।

শ্যালন, তুমি যদি এমনভাবে আমাকে সব সময় আঁকড়ে ধরে রাখতে চাও তাহলে আমার পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। বনহুর গঙ্গার জলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্থির হয়ে দাঁড়ালো।

শ্যালন বুঝতে পেরেছে, বনহুর অভিমান করেছে তাই সে বনহুরের হাতখানা চেপে ধরে বললো আর আমি তোমাকে ধরে রাখবো না, কথা বলো? কথা বলো আলম?

শ্যালন! ফিরে তাকায় বনহুর শ্যালনের মুখের দিকে।

শ্যালনের গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু।

বনহুর পকেট থেকে রুমাল বের করে শ্যালনের চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।

 শ্যালন বনহুরের বুকে মাথা রেখে ডাকলো– আলম!

বনহুর বললো– চলো শ্যালন, ভোর হয়ে এসেছে।

*

কয়েক দিন পরের কথা।

বনহুরের গাড়ি এসে থামলো লালবাজার পুলিশ অফিসের সামনে। বনহুর নেমে সোজা পুলিশ অফিসে প্রবেশ করতেই ইন্সপেক্টার মিঃ রাজেন্দ্রনাথ উঠে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন।

বনহুর এবং মিঃ রাজেন্দ্রনাথ আসন গ্রহণ করার পর বললো বনহুর– ইন্সপেক্টার সাহেব, ম্যাকমারা হত্যা ব্যাপারে আপনারা কত দূর অগ্রসর হয়েছেন জানার জন্য এসেছি।

ভাল কথা, বসুন আমি আপনাকে দেখাচ্ছি। এ পর্যন্ত আমরা ডায়রীতে যা জানতে পেরেছি, সমস্ত আপনাকে দেখাবো। আপনি ম্যাকমারার প্রধান সঙ্গী–মানে ভাবী জামাতা, কাজেই ম্যাকমারা হত্যা রহস্য উদঘাটনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত প্রয়োজন।

কথাগুলো বলে ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথ ওসি মিঃ জয়দেব ভৌমিককে ম্যাকমারা হত্যা রহস্যের পুলিশ রিপোর্টে যতটুকু সংগ্রহ করা হয়েছে দেখাতে বললেন। আরও বললেন–ইনি ম্যাকমারার ভাবী জামাতা, এর কাছে কিছু গোপন করার নেই।

বনহুর লালবাজার পুলিশ অফিস থেকে যখন বের হলো তখন বেলা ঠিক দ্বিপ্রহর। সোজা গাড়ি নিয়ে সে মিঃ এখোলের বাড়িমুখো রওয়ানা দিল। ইচ্ছা করেই বনহুর বৌবাজার রোড না হয়ে বেন্টিক স্ত্রীট হয়ে ধর্মতলা দিয়ে বৌবাজার আসতে মনস্থির করে নিলো। প্রায় ঘন্টাখানেক আঁকাবাঁকাভাবে গাড়ি চালিয়ে বৌবাজার রাস্তায় আসতেই বনহুরের গাড়ির পাশ কেটে চলে গেলো ঠিক মিঃ এখোলের গাড়ির মত একটি কুইন কার। বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এক পলকে দেখে নিয়ে ছিলো গাড়ির মধ্যে শুধু এথোলই নন, দ্বিতীয় কোনো একজন ছিলো বা আছে তার পাশে। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিকে তো বনহুর চিনতে পারেনি!

বনহুর নিজের গাড়িখানা এথোলের বাড়িমুখো আর না নিয়ে সামনের রাস্তার বাঁকে ব্যাক করে এথোলের গাড়িকে ফলে করলো।

সম্মুখের গাড়িখানা তখন দ্রুত এগুচ্ছে। বনহুর কিন্তু সোজা এগোলের গাড়িখানাকে ফলো করলো না, সে একটু এদিক-ওদিক করে গাড়ি চালাতে লাগলো!

সম্মুখের গাড়িখানা তখন দ্রুত এগিয়ে চলেছে।

বনহুর এথোলের গাড়িখানাকে লক্ষ্য করে এ গাড়ি সে গাড়ির পাশ কেটে নিজের গাড়ি চালাতে লাগলো।

এপথ-সেপথ দিয়ে গাড়িখানা এবার হ্যারিসন রোড ধরে ছুটছে। বনহুর ঠিকভাবে ফলো করে আসছে সামনের গাড়িখানাকে। কিন্তু বেশ দূরত্ব রেখে গাড়ি চালাচ্ছিলো বনহুর। কলিকাতা শহর যানবাহনের ভীড়ের চাপে অতি সাবধানে তাকে গাড়ি চালাতে হচ্ছিলো।

বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি একভাবে চালানোর পর হঠাৎ সামনের গাড়িখানা ষ্ট্ৰাণ্ড রোড ধরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সম্মুখে এসে থেমে পড়লো।

বনহুরও প্রথম গাড়িখানা হতে বেশ কিছু দূরত্ব রেখে কতগুলো গাড়ির পাশে নিজের গাড়িখানা ব্রেক করে থামিয়ে ফেললো। গাড়িতে বসেই লক্ষ্য করলো– মিঃ এথোল এবং আর এক ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে ভিক্টোরিয়া হলের সিঁড়ি বেয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন।

বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত অগ্রসর হলো ভিক্টোরিয়া হলের দিকে। সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই বনহুর দেখতে পেলো– লিফটে উঠে দাঁড়িয়েছেন এথোল এবং সঙ্গের লোকটি।

বনহুর এগোলের সঙ্গীকে ঠিক চিনতে পারলো না, কারণ তার চোখে কালো চশমা, মুখে ফ্রেঞ্চকাটা দাড়ি। মাথায় ক্যাপ আছে। ক্যাপটা বেশ কিছুটা কাৎ হয়ে আছে সামনের দিকে! ভদ্রলোকের ঠোঁটের ফাঁকে বিলেতী পাইপ!

চকিতে একনজর দেখে নিতেই লিস্টখানা অদৃশ্য হলো।

বনহুর দু’নম্বর লিফটে চেপে দাঁড়ালো।

কিন্তু আশ্চর্য দ্বিতলে কোথাও দেখতে পেলোনা বনহুর মিঃ এথোল আর তার সঙ্গী ভদ্রলোককে। পুনরায় লিফটে তিন তালায় গমন করলো। দর্শকগণের ভীড়ে সকলের অলক্ষ্যে বনহুর খুঁজে চললো তার শিকারদ্বয়কে।

বিরাট হলের ভিতরে নানা রকম শিল্পসৃষ্টির মধ্যে মিঃ এথোল আর তার সঙ্গী কোথায় যে তলিয়ে গেছে খুঁজে পেলো না বনহুর।

প্রায় ঘণ্টা দুই বনহুর সমস্ত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চষে ফিরলো কিন্তু তাদের সন্ধান পেলো না। এবার সে আর বিলম্ব না করে ফিরে এলো নিজের গাড়িখানার পাশে। তাকিয়ে দেখলো এথোলের গাড়িখানা অদৃশ্য হয়েছে। বুঝতে পারলো, তাকে এড়ানোর জন্যই এই প্রচেষ্টা। নিশ্চয়ই এথোল এবং তার সঙ্গী বুঝতে পেরেছিলেন তারা সে কারণেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সম্মুখে এসে তারা গাড়ি রেখে ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন। তার চোখে ধুলো দেয়া হলো ওদের মূল উদ্দেশ্য।

বনহুর গাড়িতে স্টার্ট দেবার পূর্বে তার রিভলভারখানার অস্তিত্ব একবার অনুভব করে নিলো। গাড়িখানা আবার ছুটতে আরম্ভ করলো।

এবার বনহুরের গাড়ি এথোলের বাড়ি অভিমুখে চলেছে। কিন্তু বনহুর এখোলের বাড়িতে এসে দেখলো- আজ দরজায় তালা বন্ধ নেই। দরজা মুক্ত। বনহুর ভিতরে প্রবেশ করে সন্ধান নিয়ে জানতে পারলো, এথোল এখনও ফেরেন নি। আর একটা ব্যাপার আজ লক্ষ্য করলো সে বাড়িতে একটি বৃদ্ধ চাকর ঘর-দোর পরিস্কার করছে। তার কাছেই বনহুর জানতে পারলো, মিঃ এথোল এখনও আসেন নি।

আজকের মত বনহুর বাসায় ফিরে যাওয়াই সাব্যস্ত করে নিলো। গাড়িতে চেপে বসলো যখন তখন বেলা চারটা বাজতে পঁচিশ মিনিট বাকি। ক্ষুধায় পেটের মধ্যে জ্বালা করছে। সেই সাত সকালে আজ বেরিয়েছিলো বনহুর। শ্যালন অবশ্য তার জন্য নাস্তা তৈরি করে নিয়ে এসেছিলো, এতো চাকর বাকর থাকা সত্ত্বেও শ্যালনের এতো অনুরাগ ভালই লাগে ওর। বেচারী শ্যালন! এ দুনিয়ায় ওর আপন জন বলতে কেউ নেই– একমাত্র পিতা ম্যাকমারাই ছিলেন শ্যালনের সম্বল। মেয়েটা পিতাকে হারিয়ে কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে। কাউকে সে আর বিশ্বাস করতে চায় না। যতক্ষণ বনহুর বাসায় থাকে। ততক্ষণ শ্যালন ওর পাশেই থাকে ছায়ার মত। বনহুর হয়তো ভোরে ঘুম থেকেই উঠেনি শ্যালন এসে বসে থাকবে তার শিয়রে। হয়তো একটা বই নিয়ে পড়বে, নয় কাটা দিয়ে সোয়েটার বুনবে। বনহুরের জন্য সে একটা সুন্দর প্যাটানের সোয়েটার তৈরি করেছে। বনহুর জেগে উঠলে শ্যালন উঠে পড়তো, হেসে এগিয়ে গিয়ে বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে তার গণ্ডে একে দিতো চুম্বন রেখা। এতে সে কোনো রকম সংকোচ বা দ্বিধা বোধ করতো না বনহুরও ওকে বাধা দিতো না এ ব্যাপারে, যদিও সে নিজে কিছুটা সঙ্কোচিত হতো।

বনহুর বাথরুমে প্রবেশ করলে শ্যালন ওর জন্য নিজ হস্তে নানা রকম নাস্তা তৈরি করে এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখতো, যতক্ষণ বনহুর বাথরুম থেকে ফিরে না আসে ততক্ষণ সে টেবিলের পাশে। বসে সোয়েটার বুনতো বা বই পড়তো।

বনহুর বাথরুম থেকে ফিরে এলে তাকে চা-নাস্তা পরিবেশন করে নিজেও খেতো। ওর সঙ্গে যতক্ষণ বনহুর কক্ষে থাকতো ততক্ষণ শ্যালন নানা গল্প-সল্প আর নানা আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে উঠতো।

মাঝে মাঝে আলবার্ডের পুত্র আর্থার এসে যোগ দিতে বনহুর আর শ্যালনের সঙ্গে। আর্থার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বনহুর আর শ্যালনের সঙ্গে গভীরভাবে ভাব জমিয়ে নিয়েছিলো।

আর্থার বলেছিলো বনহুর আর শ্যালনকে আমাদের বাড়ি মনে করবে তোমাদের বাড়ি। এখানে তোমাদের মত হাজার জন থাকলেও আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া মিঃ আলম, আপনি আমার বাবাকে নির্দোষ প্রমাণিত করার জন্য এতো চেষ্টা করছেন। আমার বাবা যে ম্যাকমারা কাকার হত্যাকারী নন এটা আমি জানি। অযথা আমার বাবাকে ম্যাকমারা কাকার হত্যাকারী বলে সন্দেহ করা হয়েছে। মিঃ আলম, আমার বাবাকে নির্দোষ প্রমাণিত করার জন্য এবং কাকার আসল হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার জন্য যত অর্থের প্রয়োজন হয় আমি দেবো। আপনি ইচ্ছামত আমার বাড়ির যাবতীয় জিনিস ব্যবহার করতে পারেন। আপনাকে আমি দুটো শব্দবিহীন কার দিলাম, আপনি এগাড়ি দু’খানা ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারেন।

বলেছিলো বনহুর অশেষ ধন্যবাদ।

বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী আর্থার ঠিক পিতার মতই সদা হাস্যময় এবং আলাপী মানুষ। তেমনি সরল স্বাভাবিক স্বচ্ছপ্রাণ ছেলে। বনহুরের বড় ভাল লাগে আর্থারকে;

আর্থার শুধু বিশাল ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারীই নয় তার চেহারা সুন্দর সুদর্শন, শিক্ষিত যুবক। বনহুর মনে মনে একটা আশা পোষণ করতো। আর্থার আর শ্যালনকে সে মনের আসনে একত্রে প্রতিষ্ঠা করেছিলো। শ্যালনের স্বজাতি এবং আত্মীয় আর্থার, তাছাড়া শ্যালনকে সে কামনা যে না করে তা নয়। কিন্তু আর্থার লাজুক ধরনের ছেলে, শ্যালনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশবার মত তার সাহসই হতো না।

বনহুর অবশ্য শ্যালনকে আর্থারের সাথে মিশবার সুযোগ দিয়ে অনেক সময় সরে থাকতো। একদিন প্রকাশ্য বলেছিলো বনহুর– আচ্ছা শ্যালন, আর্থারকে তোমার কেমন লাগে?

শ্যালন বনহুরের নাকটা আংগুল দিয়ে টেনে দিয়ে বলেছিলো– হঠাৎ এ প্রশ্ন কেনো আলম?

বলেছিলো বনহুর– আর্থারের সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ হলে কেমন হয় বলো তো?

ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলো শ্যালন– অসম্ভব। আমি ওকে গ্রাহ্যই করিনি। কথাটা বলে চলে গিয়েছিলো শ্যালন সেখান থেকে।

বনহুর এরপর আর কোনো কথা বলা অবকাশ পায়নি।

বনহুর আজ যখন পার্ক সার্কাস বাসায় ফিরে এলো তখন পাঁচটা বেজে গেছে।

শ্যালন ঘর-বার করছিলো। মাঝে মাঝে দোতলায় বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে তাকাচ্ছিলো জনমুখর। রাজপথের দিকে। কত গাড়িই না এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে, কিন্তু তার আকাঙ্খিত গাড়িখানা কই। হঠাৎ শ্যালনের দৃষ্টি চলে যায়, অগণিত গাড়ির ভীড়ের ভিতর হতে বেরিয়ে আসে তার পরিচিত গাড়িখানা। যে গাড়ির জন্য সে ব্যাকুল হয়ে প্রতীক্ষা করছে।

বনহুরের গাড়ি এসে পৌঁছতেই শ্যালন ছুটে এসে দাঁড়ালো গাড়িখানার পাশে।

বনহুর নেমে দাঁড়াতেই ওর কণ্ঠ বেষ্ঠন করে অভিযোগের সুরে বললো শ্যালন– এতো বিলম্ব করলে কেন, বলো তো?

আর্থারও তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলো।

বনহুর শ্যালনের এই স্বচ্ছ আচরণে একটু সঙ্কোচিত হলো। হেসে বললো– ভিতরে চলো সব বলছি।

বনহুর অগ্রসর হলো। আর্থারকে লক্ষ্য করে বললো– আসুন, কথা আছে।

 আর্থার আর শ্যালন বনহুরকে অনুসরণ করলো।

 খাবার টেবিলে এসে বসলো ওরা তিন জন।

শ্যালন খাবার পরিবেশন করছিলো।

আর্থার বললো– আমি খেয়েছি। কিন্তু শ্যালন এখনও অভুক্ত রয়েছে।

বনহুর নিজের খাবার মুখে দিতে গিয়ে হাতখানা আবার নামিয়ে নিলো, বিস্ময় ভরা দৃষ্টি তুলে ধরলো শ্যালনের মুখে, তারপর গম্ভীর গলায় বললো– এ কেমন কথা শ্যালন?

শ্যালন হেসে খাবার নিজের মুখে তুলে দিতে দিতে বললো– তুমিও তো অভুক্ত ছিলে—

 তাই এভাবে নিজেকে কষ্ট দেবে শ্যালন?

আর্থার বললো– মিঃ আলম, সত্যি ওর কথা আপনি ভাবতে পারবেন না। আপনি চলে যাবার পর সে ঘরে খিল এটে বসে থাকবে, একদম বাইরে বের হবে না, বা কারো সঙ্গে কথা বলবে না।

কত করে অনুরোধ করলাম দরজা খুলে চারটি মুখে দিতে, কিন্তু কিছুতেই সে খাবে না…

 এ তোমার ভারী অন্যায় শ্যালন। বনহুর কঠিন গলায় বললো।

 তুমি অমন ভাবে না খেয়ে চলে যাবে আর আমি বাড়ি বসে খাবো, না?

তাহলে কাল থেকে আমি রোজ না খেয়ে যাবো আর তুমিও উপোস করে মরো। থাক, আমি এখনও খাবো না। দেখি কতক্ষণ তুমি অভুক্ত থাকতে পারো।

আর্থার বললো–কাজ কি হবে আর এতোক্ষণে মান অভিমান করে। খান আপনি–শ্যালন, তুমিও খাও।

বনহুর খেতে লাগলো বটে কিন্তু শ্যালনের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা বললো না!

বনহুর যেমন খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতে যাবে ঠিক সেই সময় কক্ষে প্রবেশ করলো এথোল। বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো–আলম, তুমি নাকি আমার বাসায় গিয়েছিলে আমার সন্ধানে?

হাঁ। বললো বনহুর।

আর্থার এবং শ্যালনও উঠে দাঁড়িয়েছিলো।

 বনহুর মিঃ এথোলকে আসন গ্রহণ করতে বলে নিজেও আসন গ্রহণ করলো।

বনহুর গম্ভীর মুখে সিগারেট ধরালো, তারপর সিগারেট কেসটা এথোলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো–গ্রহণ করুন।

মিঃ এথোল সিগারেট-কেস থেকে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে বললেন…আলম, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। চলো নির্জনে যাই।

বনহুর এ রকম কোনো উক্তির অপেক্ষা করছিলো, বললো–চলুন। উঠে দাঁড়ালো বনহুর, শ্যালনের দিকে তাকিয়ে তাকে বারণ করলো তার সঙ্গে যেতে।

আর্থার বুঝতে পেরে সে যেমন বসে ছিলো তেমনি রইলো।

মিঃ এথোল আর বনহুর চলে গেলো বনহুরের শয়নকক্ষে। পাশা-পাশি দুটো সোফা অধিকার করে নিয়ে বসলো তারা। কক্ষ নির্জন। দরজা জানালায় মোটা ভেলভেটের নীল পর্দা ঝুলছে।

কক্ষমধ্যে বিরাজ করছে একটা স্নিগ্ধ-শীতল মিষ্টি পরিবেশ। একপাশে মূল্যবান একটি আধুনিক খাট, সে খাটে বনহুর শয়ন করে। পাশেই সেল্ফ, কয়েকখানা বই রয়েছে সেলফে। তাছাড়া মেঝেতে কয়েকটা সুন্দর আধুনিক সোফা, সোফার মাঝখানে একটি ছোট্ট টেবিল।

টেবিলে পা তুলে বসলেন মিঃ এথোল, তারপর একমুখ ধুয়া উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন তিনি–আলম, অযথা আমার পিছনে ঘোরার কি মানে হলো বলো? এই দুপুরে কাঠফাটা রোদটা শুধু কষ্ট করে কাটালে।

মিঃ এথোলের কথায় বনহুর অবাক হলো, তাহলে কি এথোল তাকে…

বনহুরকে ভাববার সময় না দিয়ে বললেন এথোল–আমি তোমার হাত এড়াবার জন্যই ভিক্টোরিয়া হলে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিলাম!

বনহুরের মুখমণ্ডল মুহূর্তের জন্য বিবর্ণ হলো, পরক্ষণেই বললো সে–আপনার সঙ্গীটি কে ছিলেন। তা জানবার জন্যই আমি আপনার গাড়িখানা ফলো করেছিলাম।

ওঃ এই কথা, তা তুমি পরে এক সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেও পারতে? আমার একজন বিশিষ্ট বন্ধু আমার সঙ্গে ছিলো।

দেখুন, আপনি লুকোবার চেষ্টা করলেও আপনি আমার কাছে নিজের কার্যকলাপ গোপন রাখতে পারবেন না। মিঃ এথোল, আপনি যতই সচ্ছ হওয়ার চেষ্টা করুন না কেনো–কিন্তু আমি জানি আপনার সব কথা।

মুহূর্তে মিঃ এথোলের মুখ ফ্যাকাশে হলো। নিজেকে পোপন করার জন্য মুখটা অন্যদিকে ফেরালেন একবার।

বনহুর তীব্রকণ্ঠে বললো–আপনার সঙ্গীটি কে আপনি না বললেও আমি তাকে ঠিক চিনতে পেরেছি।

সত্যি বলছো আলম? এবার মিঃ এথোল খুশিতে যেন উচ্ছল হয়ে উঠলো।

বনহুর বিস্মিত হলো, অদ্ভুত মানুষ এই এথোল।

*

ঐদিন রাতের কথা।

বনহুর শয্যায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। রাত তখন ঠিক চারটে বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। হঠাৎ টেবিলে ফোনটা বেজে উঠলো সশব্দে। বনহুর আশ্চর্য হলো, এতো রাতে কোথা হতে ফোন এলো–বিশেষ করে রাত চারটায়।

রিসিভার হাতে তুলে নিয়ে কানে ধরতেই ওদিক থেকে শোনা গেলো মিঃ এথোলের উত্তেজিত ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর–হ্যালো, হ্যালো–আলম…তুমি শীঘ্র…চলে…থেমে গেলো কণ্ঠ।

বনহুর বলে উঠলো–হ্যালো, আমি আলম বলছি…বলুন…হ্যালো বলুন…

ওদিক থেকে শোনা গেলো এথোলের আর্তকণ্ঠ–উঃ, আঃ…হ্যা…লো..বি…রিসিভার পড়ে যাওয়ার শব্দ হলো।

বনহুর বার বার রিং করতে লাগলো–হ্যালো, হ্যালো…কিন্তু আর কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না ওদিক থেকে। বনহুর এবার রিসিভার রেখে, দ্রুত হস্তে নাইট ড্রেস পাল্টে নিলো, তারপর ড্রয়ার খুলে বের করে নিলো রিভলভারখানা। হাত-ঘড়িটা এক নজর দেখে নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলো।

বনহুরের হাতে গাড়িটা উল্কা ছুটে চলেছে। পথ প্রায় জনশূন্য। গাড়ি চালাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তার। গাড়িখানা যে মিঃ এথোলের বাড়ি-মুখো চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিছু সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলো গাড়িখানা।

বনহুরের বাড়ি মিঃ এথোলের বাড়ির সম্মুখ গেটে না লাগিয়ে পিছন বাড়িটার পাশে রেখে নেমে পড়লো সে। অতি দ্রুত পিছন বাড়ির প্রাচীর টপকে প্রবেশ করলো ভিতর বাড়িতে, তারপর কৌশলে পার হয়ে গেলো বনহুর এথোলের বাড়ির পিছন দিক দিয়ে বাগানের মধ্যে। বনহুর এবার এথোলের শোবার কক্ষের পিছন পাইপ বেয়ে দ্রুত উঠতে লাগলো উপরের দিকে। মাত্র কয়েক মিনিট, বনহুর একেবারে উঠে এলো উপর তলার পিছন রেলিং এর পাশে। এ সব তার অভ্যাস আছে, কোনো কষ্ট হলো না। রেলিং বেয়ে সোজা বনহুর চলে এলো দ্বিতলের সম্মুখ দরজায়। যেমন কক্ষে প্রবেশ করেছে, ঐ মুহূর্তে একটি লোক সাঁ করে চলে গেলো পিছনের শার্শী দিয়ে ওদিকে।

 এক নজর দেখলেও বনহুর চিনতে পারলো, এ সেই লোক–যে আজ দ্বিপ্রহরে এখোলের গাড়িতে তার সঙ্গে ভ্রমণ করে ফিরেছে। বনহুর বিলম্ব না করে ঝুঁকে পড়লো শার্শী দিয়ে নিচের দিকে। কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখা গেলো না, পরক্ষণেই মোটর স্কার্টের শব্দ শোনা গেলো। বনহুর গাড়িখানাকে ফলো করবে, না এথোলের খোঁজ নেবে ভেবে নিলো। কিন্তু তার পূর্বেই দৃষ্টি চলে গেলো টেবিলের পাশে। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো, পরক্ষণেই ছুটে এলো চেয়ারে কাৎ হয়ে পড়ে রয়েছেন মিঃ এথোল। বাম পাশের বুকে একখানা ছোরা সমুলে বিধে আছে। তাজা টকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ছোরার পাশ দিয়ে। দক্ষিণ হাতখানা ঝুলছে, রিসিভারখানাও তার হাতের পাশে পড়ে রয়েছে। বনহুর বুঝতে পারলো–মিঃ এথোল মৃত্যুর পূর্বে তাকেই ফোন করেছিলেন, কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। হত্যাকারী তার সব শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু কে এই হত্যাকারী, যে শুধু ম্যাকমারাকেই হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি–মিঃ এথেলকেও হত্যা করলো।

বনহুর ভাবলো এখন তার কি কর্তব্য। এখানে থাকা তার ঠিক হবে না। হঠাৎ বনহুরের নজর পড়লো–টেবিলে ওয়েটচাপা একটা ভাঁজ করা কাগজে। তাড়াতাড়ি ওয়েট সরিয়ে ভাঁজ করা কাগজখানা হাতে তুলে নিয়ে লাইটের সামনে মেলে ধরলো। একটা ছোট্ট চিঠি, এবং চিঠিখানা এথোলকে লেখা হয়েছে। ওতে লিখা আছে পড়লো বনহুর রাতে আমি আসবো। তুমি তোমার ঘরে প্রতিক্ষা করো। বিশেষ কথা আছে তোমার সঙ্গে! –হিতৈষী বন্ধু

বনহুর চিঠিখানা ভাঁজ করে পকেটে রাখলো, ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়িতে শোনা গেলো ভারী বুটের শব্দ। বনহুর বিলম্ব না করে যে পথে সেই হিতৈষী বন্ধু অন্তর্ধান হয়েছিলো, ঐ পথে সেও অদৃশ্য হয়।

পিছন পাইপ বেয়ে অতি অল্প সময়ে বনহুর নেমে আসে নিচে। তারপর নিজের গাড়িখানার পাশে। গিয়ে হাজির হয়। বনহুর যখন গাড়িতে ষ্টার্ট দিলো তখন এথোলের কক্ষের জানালা দিয়ে নিচের দিকে রাইফেলের গুলীর শব্দ শোনা যেতে লাগলো। হয়তো পুলিশ এসে গেছে এবং এথোলের হত্যাকারীর সন্ধানে পর পর গুলী ছুঁড়ে খোঁজ করছে। কিন্তু আশ্চর্য, পুলিশ এতো দ্রুত কি করে এ খুনের সন্ধান পেলো!

বনহুরের গাড়ি তখন সোজা পার্ক সার্কাস অভিমুখে ছুটতে শুরু করেছে।

জন-বিহীন পথ বেয়ে বাড়িখানা কিছুক্ষণের মধ্যেই পার্ক সার্কাসে মিঃ আলবার্ডের বাড়ির বাড়ি বারান্দায় এসে পৌঁছলো। গাড়ি থেকে নেমে নিজের কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর, কিন্তু শয্যা গ্রহণ করতে পারলো না। কক্ষমধ্যে পায়চারী করে ফিরতে লাগলো মনে তার নানা চিন্তা উদয় হচ্ছে। যে ব্যক্তি ম্যাকমারাকে হত্যা করেছে, সে-ই হত্যা করেছে মিঃ এথোলকে। কিন্তু এথোলকে হত্যা কেন করা হলো! ম্যাকমারার নিকটে এমন কোনো জিনিস ছিলো, যার লোভে তাকে হত্যা করা হয়েছে! এথোলের কাছে তো সে জিনিস ছিলো না, তবু তাকে হত্যা করা হলো। এখোলের নিহত হবার একমাত্র কারণ, ম্যাকমারা হত্যা-রহস্য তিনি জানতেন। এ হত্যা-রহস্য যাতে উদঘাটন না হতে পারে, সে কারণেই। ম্যাকমারার হত্যাকারী হত্যা করলো মিঃ এথোলকে। আজ দ্বিপ্রহরে যে ব্যক্তি এগোলের সঙ্গে ঘুরে ফিরেছে সেই খুনী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কে সে? বনহুর তাকে দেখেছে বটে কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পায়নি। দ্বিপ্রহরে যে ব্যক্তিকে এগোলের সঙ্গে দেখেছিলো, কিছু পূর্বে তাকেই বনহুর দেখেছে এথোলের কক্ষ হতে পিছন শার্শী দিয়ে পালাতে। লোকটার দেহে দ্বিপ্রহরের সেই ড্রেসটাই পরিহিত রয়েছে। স্যুট-প্যান্ট-টাই এবং মাথায় একটি ক্যাপ, ক্যাপটি দিয়ে তার মুখের প্রায় অর্ধেকটা ঢাকা পড়ে গেছে। বনহুর গভীরভাবে চিন্তা করে কে এই ব্যক্তি এবং কেন সে পর পর হত্যা করে চলেছে। ম্যাকমারার সেই ছোট্ট ময়লা জামাটার মধ্যে কি ছিলো, যা জানতে পেরেছিলো তার হত্যাকারী…

বনহুর নিজে দস্যু, অথচ এভাকে তাকে গোয়েন্দার কাজে নিয়োজিত হতে হবে ভাবতে পারেনি! অবশ্য তাকে এর পূর্বেও কয়েকবার কয়েকটি হত্যা-রহস্য উদঘাটন করতে হয়েছিলো।

হঠাৎ বনহুরের চিন্তা-স্রোতে বাধা পড়ে। টেবিলে ফোনটা বেজে উঠে সশব্দে। বনহুর চট করে রিসিভার হাতে উঠিয়ে নেয় না, ফোনটা অবিরত ক্রিং ক্রিং শব্দ করে চলেছে।

বনহুর পাশের চেয়ারে বসে ধীরে-সুস্থে রিসিভার হাতে উঠিয়ে নিয়ে নিদ্রা-জড়িত কণ্ঠের অনুকরণে বললো–হ্যালো, আমি আলম বলছি…কি বললেন, খুন…কোথায়? মিঃ এথোল খুন হয়েছেন বলেন কি!

বনহুরের ঠোঁটে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

 ব্যস্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো শ্যালন-আলম, কে খুন হয়েছে? কে খুন হয়েছে?

রিসিভারের মুখে হাত চাপা দিয়ে শ্যালনকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর–মিঃ এথোল খুন। হয়েছেন…

অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো শ্যালন–এথোল কাকা খুন হয়েছেন!

হ! রিসিভার রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় বনহুর–শুধু এথোল কাকাই নয়, এমনি আরও কতজন যে নিহত হবেন তার সঠিক হিসাব বলা কঠিন।

শ্যালনের মুখ ছাই-এর মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, বনহুরের পাশে ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে কম্পিত গলায় বলে-কে তাকে খুন করেছে?

কেমন করে বলবো, বলো?

আলম, এই মুহূর্তে কে তোমাকে ফোন করেছিলো? কে তোমাকে জানালো এথোল কাকা খুন হয়েছে?

পুলিশ সুপার মিঃ বিনয় সেন। গম্ভীর গলায় বললো বনহুর। এবার সে বাইরে বের হবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালো শ্যালন, আমি যাচ্ছি।

কোথায় যাবে?

পরে বলবো।

বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। কিন্তু গাড়িতে উঠতে যাবে, পিছনে শ্যালন এসে দাঁড়ালো। অবাক কণ্ঠে বললো বনহুর শ্যালন, তুমি কেন এলে?

আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।

অসম্ভব।

আমি যাবো।

দেখো, ছেলেমির একটা সীমা আছে।

বেশ, আমাকে না নিলে। যাও, কিন্তু তোমার আসল জিনিস কই?

 পকেটে হাত দিয়ে মনে পড়লো রিভলভারের কথা। শ্যালন বললো– যাও, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?

বনহুর দ্রুত চলে গেলো রিভলভারখানা আনতে।

শ্যালন ঠিক সেই মুহূর্তে গাড়ির পিছনে খোলসের মধ্যে প্রবেশ করে চুপটি মেরে বসে রইলো।

বনহুর মনে করলো শ্যালন ফিরে গেছে তার কক্ষে। তবু গাড়ির ভিতরটা একবার ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখে নিলো।

গাড়িতে ষ্টার্ট দিয়েই হাতঘড়িটা দেখে নিলো বনহুর। ভোর ছয়টা বাজতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকী!

বনহুরের গাড়ি ছুটে চলেছে।

পার্ক সার্কাস রোড ত্যাগ করে কড়েয়া রোড় হয়ে ভবানীপুর অভিমুখে চললো।

ভোরের হাওয়া তখন বইতে শুরু করেছে!

ধ্রুবতারা অন্তর্ধান হয়েছে অনেকক্ষণ।

বনহুরের গাড়ি এসে থামলো ভবানীপুর একটা হোটেলের সম্মুখে।

এ হোটেলেই ম্যাকমারার বিশ্বস্ত ছাত্রগণ বাস করছে। ম্যাকমারা নিহত হবার পর তারা দেশে ফিরে যাবার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ম্যাকমারার জাহাজ এখনও খিদিরপুর ডকে অপেক্ষা করছে।

বনহুর গাড়ি রেখে হোটলে প্রবেশ করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় একটি কামরার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। কক্ষের দরজায় টোকা দিয়ে শব্দ করলো সে।

এখনও হোটেলের অভ্যন্তর লোকজনের কলকণ্ঠে সরগরম হয়ে ওঠেনি। দু’চার জন হোটেলবাসী বিদেশী ভদ্রলোক কেবলমাত্র শয্যা ত্যাগ করে প্রাতঃক্রিয়া সমাধা করতে বাথরুমে প্রবেশ করেছেন। কেউ বা এসে দাঁড়িয়েছেন রেলিং এর পাশে। ভোরের হাওয়া উপভোগ করছেন হয়তো।

ম্যাকমারার ছাত্রগণ প্রফেসারের আকস্মিক মৃত্যুতে একেবারে ভয়-বিহ্বল হয়ে পড়েছে। যে রাতে ম্যাকমারা নিহত হন সে রাতে তারাও ছিলো আলবার্ডের বাড়িতে। আলম সাহেবের সঙ্গেই হলঘরের পাশের কামরায় ঘুমিয়ে ছিলো। ম্যাকমারা নিহত হবার পর তারা আর সে বাড়িতে থাকতে রাজি হয়নি। ভীষণভাবে ভীত হয়ে পড়েছিলো ছাত্রদল।

বনহুর অনেক বলে-কয়েও যখন তাদের আর সে বাড়িতে রাখতে পারলোনা তখন আর্থারের সাহায্যে ভবানীপুর এ হোটেলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। এখানে ওদের যেন কোনো কষ্ট না হয় সেজন্য মাঝে মাঝে বনহুর নিজে এসে তাদের দেখাশোনা করতো।

ছাত্রদের মধ্যে ম্যাকমারার প্রধান ছাত্র হুইসন স্মিথ ছিলো সকলের চেয়ে বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী। বনহুরের খুব ভাল লাগতো এই যুবকটিকে। আফ্রিকার জঙ্গলে বনহুর ওকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতো। তারপর জাহাজে যখন শ্যালন থাকতো না তার পাশে, তখন হুইসন ছিলো তার সাথী। হুইসন স্মিথের সঙ্গে বনহুরের অনেক কথা চলতো, আজও তার সঙ্গে দেখা করে গোপন কোনো কথা আলোচনা আশায় সে এই রাত ভোরে এসে উপস্থিত হয়েছে।

বনহুর বার কয়েক দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একজন ছাত্র, সম্মুখে আলমকে দেখে বললো সে কি ব্যাপার? আপনি?

হাঁ, হুইসনের সঙ্গে জরুরি কথা আছে, সে কি উঠেনি?

ছাত্রটি যেন অবাক হলো, সে বললো–হুইসন তো রাতে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পার্ক সার্কাস গিয়েছিলো।

পার্ক সার্কাস! আমার সঙ্গে দেখা করতে?

 হাঁ, কিন্তু সে ফিরে আসেনি।

 বনহুর চমকে উঠলো যেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো হুইসন রাতে ফিরে আসেনি!

না!

বনহুর কিছুক্ষণ মৌন থেকে কি যেন গভীরভাবে চিন্তা করলো। তারপর বললো–আচ্ছা চলি।

ছাত্রটি বললো–সে ফিরে এলে তাকে কিছু বলবো কি?

বলতে হবে না, আমি সময় হলে আবার আসবো। কথা শেষ করে বনহুর দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।

কিন্তু হোটেলের সম্মুখে এসে দাঁড়াতেই বিস্মিত হলো। তার গাড়িখানা কোথায় উধাও হয়েছে। এদিক-সেদিন ব্যস্তভাবে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। আশেপাশে কয়েকখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে–শুধু তার গাড়িখানাই নেই। বনহুর নিজের ভুল বুঝতে পারলো, গাড়ির চাবি সে সঙ্গে না নিয়েই গাড়ি থেকে নেমে চলে গিয়েছিলো হোটেলের মধ্যে। বনহুর যখন ভাবছে ঠিক সেই মুহূর্তে তার পাশে গাড়ি এসে থামলো।

ফিরে তাকিয়ে চমকে উঠলো বনহুর-এযে তারই গাড়ি! আরও অবাক হলো গাড়ির ড্রাইভিং সিটে লক্ষ্য করে–শ্যালন বসে আছে! বনহুর গম্ভীর রাগত কণ্ঠে বললো–একি!

দেখো রাগ করোনা লক্ষীটি! তুমি আমাকে নিয়ে না এলেও আমি তোমার সঙ্গে ছায়ার মত রয়েছি।

তা দেখতেই পাচ্ছি। বললো বনহুর।

গাড়িতে উঠে এসো কথা আছে। শ্যালন একটু ব্যস্তভাবেই কথাটা বলে ড্রাইভিং আসন ত্যাগ করে সরে বসলো।

বনহুর বললো–কি করে এলে? আর গিয়েছিলেই বা কোথায়?

শ্যালন পিছন দিকে তাকিয়ে বললো–এসেছি ছামার বক্সে।

 নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মরোনি?

না, ফাঁক ছিলো।

এতো ব্যস্ততার মধ্যেও বনহুরের হাসি পেলো। ড্রাইভিং আসনে চেপে বসে বললো–গাড়ি নিয়ে কোথায় উধাও হয়েছিলে?

শ্যালন বাড়ির আশেপাশে সর্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখে নিয়ে বললো–জানো, তুমি যখন চলে গেলে তখন একটা লোক তোমার গাড়ির পাশে এসে উঁকিঝুঁকি মেরে কি একটা জিনিস পিছনের আসনের নিচে রেখে গেছে।

বনহুর অবাক হয়ে বললো–দেখোনি কি জিনিস?

না, দেখবো কি করে–লোকটা গাড়িতে জিনিসটা রেখে দ্রুত অন্য একটা গাড়িতে চেপে পালাতে গেলো।

তারপর?

আমি আমাদের গাড়ির ছামার বক্সে বসে উঁকি দিয়ে সব দেখছিলাম। লোকটা যেমন ওর গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছিলো, অমনি আমি ছামার বক্স থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি নিয়ে লোকটার গাড়িকে ফলো করলাম। সে গাড়িতে কি রেখে গেলো দেখবো কখন? তাছাড়া লোকটা এমন চোরের মত চুপি চুপি কাজ করলো–তাতে মনে হলো, সে নিশ্চয়ই কোনো ভাল জিনিস রাখেনি…

এ সন্দেহ মনে হওয়ার পরও তুমি জিনিসটা না দেখে গাড়িখানাকে ফলো করলে?

হ।

শেষ পর্যন্ত সফলকাম হয়েছে?

 হয়েছি, চলো আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু তার পূর্বে সে কি জিনিস আমার গাড়ির পিছন আসনের তলায় লুকিয়ে রেখেছে দেখতে হয়। বনহুর গাড়ি থেকে নেমে পিছন আসনের দরজা খুলে ফেললো। সীটের তলায় লক্ষ্য করে অস্ফুট ধ্বনি। করে উঠলো–এযে ডিটোনেটার!

শ্যালন ঝুঁকে পড়ে বললো–সেটা কি?

এক ধরনের টাইম বোম্। কিন্তু কি আশ্চর্য, এতোক্ষণ বলো নি?

 ওটা কেন রেখে গেলো? গাড়িখানাকে ধ্বংস করার জন্য বুঝি?

শুধু গাড়িখানাকেই ধ্বংস করা উদ্দেশ্য নয় গাড়ির চালককেও।

 উঃ কি সাংঘাতিক!

শ্যালন, আর মুহূর্ত বিলম্ব করা ঠিক নয়, চলো আগে এটার সৎগতি করে আসি।

কোথায় যাবে?

বনহুর ড্রাইভিং আসনে চেপে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

 শ্যালন বসেছে তার পাশের আসনে।

ডিটোনেটারটা তখন পিছনের আসনের তলায় পড়ে রয়েছে।

বনহুরের গাড়ি স্পীডে ছুটে চলেছে।

পথঘাটে সবেমাত্র যানবাহন চলাচলের ব্যস্ততা বেড়ে উঠেছে। বনহুর ষাট মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছিলো, সম্মুখে দৃষ্টি রেখে বললো–শ্যালন, এ মুহূর্তে আমাদের মৃত্যু ঘটতে পারে। জানিনা বোমটার টাইম শেষ হয়ে এসেছে কি না।

কি সর্বনাশ, আমি যদি ওটাকে আগেই দূরে ফেলে দিতাম…

না দিয়ে খুব ভালই করেছো শ্যালন। ওটা ফেলতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনতে।

 তবে তুমি ওটাকে ফেলে দাও না গাড়ির বাইরে?

কি ভয়ঙ্কর কথা বলছো শ্যালন। জানোনা বোটা কত বড় সাংঘাতিক। পথের ধারে ফেলবো পাথের লোকের মৃত্যু ঘটবে যে!

তাহলে কি করবে?

যদি বোমটাকে শেষ পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেতে পারি, তবে একেবারে গঙ্গার জলে।

*

অদৃষ্ট ভাল বলতে হবে বোন্টা নিয়ে বনহুরের গাড়ি গঙ্গা-তীরে এসে পৌঁছলো। এর মধ্যে বোম শান্ত হয়েই রইলো। বনহুর বললো–শ্যালন, তুমি দূরে সরে যাও। যদি মরতে হয় একাই মরবো।

আর আমি বেঁচে থাকবো? তা হবে না। আঃ বিরক্ত করো না শ্যালন, বলছি সরে যাও। সরে যাও।

শ্যালন সরে যেতে বাধ্য হলো।

বনহুর এবার দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে ডিটোনেটার বোটা আস্তে করে হাতে তুলে নিলো, তারপর গঙ্গার অথৈ পানিতে ঝপ করে ফেলে দিলো।

শ্যালন তখনও আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরে।

বনহুর লক্ষ্য করলো বোটি গঙ্গার অথৈ পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে একটা ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হলো। বনহুর বুঝতে পারলো–বোটির টাইম শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কি সর্বনাশ! আর এক সেকেণ্ড হলেই তার মৃত্যু ঘটতো তাতে কোনো ভুল নেই।

ভাগ্যিস, আশেপাশে কোনো জনমানব ছিলোনা! গঙ্গার তীর নীরব নিস্তব্ধ, দূরে কয়েকখানা বড় নৌকা বাঁধা রয়েছে। নৌকার যাত্রিগণ এখন হয়তো ঘুমে অচেতন। পূর্ব আকাশ রাঙা করে উঁকি দিয়েছে ভোরের সূর্য।

ফিরে দাঁড়ালো বনহুর।

 শ্যালন কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

বনহুর শ্যালনের দক্ষিণ হাতখানা মুঠায় চেপে ধরলো–শ্যালন, আজ তুমিই আমাকে সদ্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করলে। আমি বুঝতেও পারতাম না, আমার গাড়ির পিছন আসনের তলায় কেউ ডিটোনেটার বোম রেখে গেছে। উঃ কি সাংঘাতিকভাবে বেঁচে গেলাম আজ!

দেখলে তো আমাকে তুমি সঙ্গেই আনতে চাইছিলে না।

সত্যি আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ শ্যালন।

আর আমাকে তুমি আফ্রিকার জঙ্গলে কত বার গরিলার কবল থেকে বাঁচিয়েছো। সব আমার মনে আছে, থাকবে চিরকাল।

শ্যালন, দেখ ভোরের সূর্য আমাদের দু’জনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

 শ্যালন হেসে বললো–এবার হতে আমাকে সঙ্গে নেবে তো?

 নেবো।

চলো।

কিন্তু জানো আমার এক মুহূর্ত এখন বিশ্রামের অবকাশ নেই শুধু তোমার পিতার হত্যা-রহস্যই নয়, আরও অনেক রহস্য এখন জট পাকিয়ে উঠেছে সব রহস্য উদঘাটন করতে হবে।

তুমি কি গোয়েন্দা?

 যদি বলো তাই।

তোমার দুঃসাহস দেখলে আমার আর একটি কথা মনে হয়।

 বলো?

 তুমি ডাকাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর।

 তার চেয়েও!

 তুমি দস্যু।

 মনে করো তাই।

 হেসে উঠে শ্যালন-রাগ করলে?

মোটেই না। চলো! গাড়ির দিকে অগ্রসর হলো বনহুর, তখনও শ্যালনের হাতখানা তার হাতের মুঠায়।

গাড়িতে বসে বললো বনহুর–আমার কাজ আছে, তোমাকে রেখে আসি কেমন?

সঙ্গে নিতে যখন এতো আপত্তি তখন বেশ তাই চলো।

শ্যালনকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে সোজা বনহুর হাজির হলো লালবাজার পুলিস অফিসে। পৌঁছতেই থানার ওসি সসম্মানে অফিসের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বসালেন বনহুরকে।

ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথ অফিসে ছিলেন না। একটু পরে ফিরে এলেন। তিনি মিঃ এথোলের হত্যা ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এইমাত্র বৌবাজার থেকে তিনি ফিরছেন!

রাজেন্দ্রনাথ অফিসে প্রবেশ করে বনহুরকে হ্যাণ্ডসেক করলেন–হ্যালো মিঃ আলম, ভাল তো?

বললো বনহুর-কই আর ভাল বলুন। পর পর একি হত্যাকাণ্ড শুরু হলো বলুনতো! আজ আবার একটা খুন।

রাজেন্দ্রনাথ আসন গ্রহণ করে মাথার সরকারি ক্যাপটা খুলে টেবিলে রেখে বললেন–এথোলের লাশ মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে তবে এলাম। সত্যি, এসব কি রকম হত্যাকাণ্ড শুরু হলো! আমাদের পুলিশ মহল বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

কোন রকম ক্লু পেলেন?

তেমন কিছু পাইনি। তবে হত্যাটা ঠিক মিঃ ম্যাকমারা হত্যার অনুকরণেই হয়েছে। তাঁর মতই এর বুকেও ছোরা বসানো। মিঃ ম্যাকমারার দক্ষিণ হস্তখানা যেমন টেলিফোনে সংলগ্ন ছিলো তেমনি মিঃ এথোলও কারো কাছে ফোনের আলাপ করছিলেন সেই মুহূর্তে তিনি নিহত হয়েছেন।

বনহুর বুঝতে পারলো মিঃ এথোল হত্যা হবার পূর্ব মুহূর্তে তার কাছেই ফোন করেছিলেন, কিন্তু বনহুর সম্পূর্ণভাবে সে কথা চেপে গেলো। অবাক হবার ভান করে বললো–আশ্চর্য!

বললেন রাজেন্দ্রনাথ–শুধু আশ্চর্যই নয় মিঃ আলম, একেবারে যেন বিস্ময়কর ব্যাপার। লাশগুলো পরীক্ষা করে এমন মনে হয়েছে, যেন কোনো বন্ধুর সঙ্গে আলাপরত অবস্থায় তারা খুন হয়েছেন। এতটুকু ধস্তাধস্তি বা নড়াচড়া করবার সুযোগ তারা পাননি।

বনহুর হঠাৎ বলে উঠলো–অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড ইন্সপেক্টার।

অদ্ভুতই বটে। দুটো মহৎ প্রাণ কোনো হিংস্র শয়তানের কঠিন হস্তে নিঃশেষ হয়ে গেলো।

 আরও কটা হবে কে জানে। বললো বনহুর।

রাজেন্দ্রনাথ দাঁতে দাঁত পিষে বললো–তৃতীয় হত্যা হবার পূর্বেই হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করতে হবে। মিঃ আলম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারেন।

বলুন আমি আপনাদের কি কাজে আসতে পারি?

আমার বিশ্বাস, আপনি নিজেও এব্যাপারে আগ্রহশীল। অবশ্য কারণ আছে–আপনার ভাবী শ্বশুর নৃশংস ভাবে প্রাণ হারালেন–থামলেন রাজেন্দ্রনাথ।

বনহুর বললো–আপনি ঠিক বলেছেন ইন্সপেক্টার। এ হত্যা রহস্য আমাকেও বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।

রাজেন্দ্রনাথ হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডসেক করলেন বনহুরের সঙ্গে–আপনি আমাদের সহায়তা করবেন নিশ্চয়ই?

করবো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো বনহুর।

এবার বনহুর মিঃ এথোলের হত্যা-রহস্য নিয়ে গভীরভাবে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করলো মিঃ রাজেন্দ্রনাথের সঙ্গে।

কথাবার্তা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় হঠাৎ ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো ওসি ফোন। ধরলেন–পরক্ষণেই রিসিভারের মুখে হাত রেখে বললেন–স্যার, আপনার ফোন।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ ফোন ধরলেন এবার–হ্যালো, আজ্ঞে হাঁ এই মাত্র-ফিরে এসেছি–হাঁ লাশ মর্গে পাঠিয়ে দিয়েই এসেছি–আজ্ঞে না তার ঘরে কেনো রকম ধস্তাধস্তির চিহ্ন পর্যন্ত ছিলো না। আচ্ছা স্যার, আসছি–সাক্ষাতে সব বলবো, হা–এখানে মিঃ আলম আছেন। তাকেও আনবো? আচ্ছা স্যার, মিঃ আলমকে জিজ্ঞেস করে নিই তিনি এখন আমার সঙ্গে আসতে পারবেন কিনা। রিসিভারের মুখে হাত চাপা দিয়ে বললেন ইন্সপেক্টার মিঃ রাজেন্দ্রনাথ-কমিশনার স্বয়ং ফোন করেছেন। আপনাকে আমার সঙ্গে তার ওখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন।

বনহুর বললো–বেশ, যাবো চলুন।

রাজেন্দ্রনাথ পুনরায় ফোনে মুখ রেখে বললেন–স্যার, মিঃ আলম আমার সঙ্গে আসছেন। রিসিভার রেখে চেয়ারে ঠেশ দিয়ে বসলেন রাজেন্দ্রনাথ রাত থেকে এতটুকু বিশ্রাম নেই।

থানা অফিসার দেবনারায়ণ বললেন-”স্যার, চা লাগবে?

হাঁ, আনতে বলুন। দেখি শরীরটা একটু চাঙ্গা করে নিই।

 অল্পক্ষণে চা এলো।

চা পান শেষ করে ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথ এবং বনহুর গাড়িতে চেপে বসলো। বনহুর অবশ্য নিজের গাড়িতেই চললো।

ডালহৌসী স্কোয়ার সেক্রেটারী-এটের অদূরে কমিশনার বিনয় সেন গুপ্তের বিরাট হোয়াইট ওয়াশ করা বাড়ি। লোহার ফটকে রাইফেলধারী পুলিশ দণ্ডায়মান। লাল কাকড় বিছানো পথ চলে গেছে গাড়ি বারান্দায়। গাড়ি-বারান্দার দুপাশে দু’জন রাইফেল ধারী পাহারাদার সদাসর্বদা দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।

পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ রাজেন্দ্রনাথের গাড়ি এবং মিঃ আলমের গাড়ি–পর পর দুখানা গাড়ি লৌহ ফটক পার হয়ে প্রবেশ করলো ভিতরে। রাইফেলধারী পাহারাদারগণ সেলুট করে সরে দাঁড়ালো।

কমিশনারের বাসা-সংলগ্ন অফিসঘর।

বিনয় সেন অফিস ঘরেই ছিলেন। তিনি কক্ষমধ্যে উত্তেজিত ভাবে পায়চারী করছিলেন, চোখে মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। অদূরে একখানা চেয়ারে পুলিশ সুপার বসে কাগজপত্র দেখছেন।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ এবং মিঃ আলমবেশী দস্যু বনহুর প্রবেশ করলো সেই কক্ষে।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ কক্ষমধ্যে প্রবেশ করেই মিলিটারী কায়দায় সেলুট করলেন মিঃ সেন এবং মিঃ বোসকে।

বনহুর বললো–গুড মর্নিং।

বিনয় সেন অস্ফুট একটু শব্দ করলেন–গুড মর্নিং। বসুন আপনারা। কথাটা বলে নিজেও আসন গ্রহণ করলেন কমিশনার।

পুলিশ সুপার শ্রী সমর বোস একবার মাত্র চোখ তুলে দেখে নিয়ে পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন।

বিনয় সেন বললেন–আমি আশ্চর্য হয়েছি–পর পর একইভাবে দুটি খুন সংঘটিত হলো।

স্যার, মিঃ এথোলের খুন আর ম্যাকমারার হত্যা ঠিক একই ভাবে ঘটেছে। ম্যাকমারাও যেমন ফোন করছিলেন তাঁর বন্ধুর কাছে, তেমনি মিঃ এথোলও মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে কারো নিকটে ফোন করছিলেন, কারণ মিঃ এথোলের হাতের পাশেই পড়ে ছিলো রিসিভারখানা।

হা, আপনি ফোনে আমাকে সেরূপ বলেছেন।

বনহুর শান্ত কণ্ঠে বললো–স্যার, আপনি আমাকে যখন ফোন করে মিঃ এথোলের মৃত্যু-সংবাদ জানালেন, তখন আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। আপনি না হয়ে যদি অন্যকেহ আমাকে এ সংবাদ জানাতেন তাহলে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতাম না।

বিনয় সেন গম্ভীর গলায় বললেন–আমি ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথের ফোন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। বন্ধু ম্যাকমারা হত্যার পর মিঃ এথোলের নিহত সংবাদ আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করে ফেলেছে। আমি রাজেন্দ্রনাথের ফোন পেয়েই আপনার কাছে ফোন করেছিলাম।

পুলিশ সুপার এবার কাগজপত্র সরিয়ে রেখে সোজা হয়ে বসলেন। তিনি বললেন–ইন্সপেক্টার মিঃ এখোলের নিহত সংবাদ আপনি কখন কোন সময় পেয়েছিলেন?

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ বললেন–কাল একটা ডাকাতি কেস নিয়ে আমাকে পুলিশ অফিসে রাত চারটা অবধি কাজ করতে হয়েছিলো। কাজ শেষ করে যখন বাসায় ফিরবো–ঐ মুহূর্তে বৌবাজার মিঃ এথোলের বাড়ি থেকে তার বৃদ্ধ বয় ফোন করেছে–তার মনিব নিহত হয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে এখানে। ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে তবে বৌবাজার রওয়ানা দিই।

পুলিশ সুপার মিঃ বোস পুনরায় প্রশ্ন করলেন–আপনি যখন থানা অফিসার এবং পুলিশসহ মিঃ এথোলের বাড়িতে পৌঁছলেন তখন রাত কয়টা আন্দাজ ছিলো?

স্যার, রাত তখন কত হবে আমার ঠিক মনে নেই কারণ মিঃ এথোলের মৃত্যু-সংবাদ আমাকে অত্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছিলো।

পরপর পুলিশ সুপার মিঃ বোস ইন্সপেক্টার মিঃ রাজেন্দ্রনাথকে মিঃ এথোল হত্যা সম্বন্ধে নানারূপ প্রশ্ন করে চললেন।

বিনয় সেন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনে যেতে লাগলেন। মিঃ ম্যাকমারা তাঁর অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু ছিলেন। মিঃ এখোলের সঙ্গেও তার গভীর একটা বন্ধু ভাব ছিলো। বিনয় সেন পর পর এদের দু’জনার হত্যাকাণ্ডে একেবারে মুষড়ে পড়েছেন।

মিঃ এথোল হত্যা ব্যাপার নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলার পর মিঃ বিনয় সেন বনহুরকে লক্ষ্য করে বললেন–মিঃ আলম, আপনি আমার বন্ধু ম্যাকমারার ভাবী জামাতা। আমার পুত্র স্থানীয় আপনি। একটি কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবো বলে আজ আপনাকে আমি ডেকেছি।

করুন স্যার?

আচ্ছা মিঃ আলম, আপনি নিশ্চয়ই জানেন–ম্যাকমারা আর এগোলের মধ্যে গভীর ভাব ছিলো?

শুধু আমি নই, আপনি নিজেও জানেন তাদের সম্বন্ধ কেমন ছিলো।

আমি জানি, তবু আপনাকে কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম। আচ্ছা মিঃ আলম আপনি আজ বেশ কয়েকদিন হলো মিঃ আলবার্ডের বাড়িতে আছেন। ও বাড়ির অনেক ব্যাপারই আপনি লক্ষ্য করেছেন। নিশ্চয়ই। বলুন তো আলবার্ড পুত্র আর্থার কেমন ধরণের ছেলে? অবশ্য একজন সম্বন্ধে এ রকম প্রশ্ন করা যদিও ঠিক নয় তবু করতে বাধ্য হচ্ছি।

স্যার, আলবার্ড সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ হলেও আর্থার সম্বন্ধে আমি অত্যন্ত সচেতন। আর্থার এ যুগের ছেলে হয়েও সে অতি সহজ-সরল-স্বাভাবিক থাকে বলে সৎ চরিত্র।

বিনয় সেন পুলিশ সুপার মিঃ বোসের দিকে তাকিয়ে বললেন—

দেখুন আমি যা বলেছিলাম সত্যি কিনা। আমারও ঐরূপ ধারণা আর্থার সম্পূর্ণ এ ব্যাপারে নির্দোষ।

মিঃ বোস বললেন–কিন্তু পুলিশ রিপোটে তাকেও সন্দেহ করা হয়েছে।

ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথ বললেন–মিঃ ম্যাকমারা হত্যা ব্যাপারে মিঃ এথোল মিঃ আলবার্ডকে হত্যাকারী বলে প্রমাণ করেছিলেন। এটাও এথোলের নিহত হবার কারণ হতে পারে। পিতাকে হত্যাকারী প্রমাণিত করার অপরাধে সৎচরিত্র আর্থারও নৃশংস হয়ে উঠতে পারে।

আপনারা কি বলতে চান আর্থার মিঃ এথোলের হত্যাকারী? বললো বনহুর।

বিনয় সেন বললেন আবার–হাঁ, তাকে আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। এবং সে কারণেই আপনাকে আমি আমার এখানে আসার অনুরোধ জানিয়েছি। আমরা জানতে চাই–মিঃ এথোল যখন খুন হলেন। তখন আর্থার কোথায় ছিলো তার বাসভবনে না বাইরে?

স্যার, যদিও আমি সত্যি কথা বলছি, তবুও শপথ করে বলছি– আর্থার তখন বাড়িতে ছিলো।

বিনয় সেন গম্ভীর মুখে বললেন–হু!

 মিঃ বোস বললেন–কি করা যাবে স্যার? আর্থার কি—

হাঁ, সে মুক্তই থাক কিন্তু তার গতিবিধি লক্ষ্য রেখে চলতে হবে। মিঃ আলম?

 বলুন স্যার?

আপনি এ হত্যা ব্যাপারে পুলিশ বাহিনীকে সাহায্য করলে আমি অত্যন্ত খুশি হবো। এবং আপনাকে–

থাক আপনি খুশি হলেই আমি কতার্থ হবো মিঃ সেন।

কথা ক’টি বলে উঠে দাঁড়ালো বনহুর–আমি এবার যেতে পারি?

ইয়েস। কিন্তু আপনি আমার কথা মনে রাখবেন মিঃ আলম। এ হত্যা ব্যাপারে আপনি ইচ্ছা করলে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন এবং পারবেন।

আমি কথা দিয়েছি স্যার করবো।

বনহুর বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে। যাবার সময় প্রথমে বিনয় সেন, পরে মিঃ বোস এবং মিঃ রাজেন্দ্রনাথের হ্যাণ্ডসেক করে বিদায় গ্রহণ করলো।

পুলিশ সুপার বললেন এবার–স্যার, আমার মনে হয় মিঃ আলবার্ডের পুত্র মিঃ আর্থার এই হত্যা ব্যাপারে জড়িত আছে।

পুলিশ ইন্সপেক্টার সুপারের কথায় যোগ দিয়ে বললেন–আমারও সেই রকম সন্দেহ হয়। আর্থার সম্বন্ধে মিঃ আলম যতই প্রশংসা করুন, আর্থার পিতার ব্যাপারে ক্রোধান্ধ হয়ে মিঃ এথোলকে হত্যা করা অসম্ভব নয়।

মিঃ বিনয় সেন স্থির কণ্ঠে বললেন–গভীরভাবে সন্ধান না নেয়া পর্যন্ত কাউকে দোষারূপ করা যায় না। আপনারা মিঃ এথোল হত্যা-রহস্য উদ্ঘাটনে যথার্থভাবে মনোযোগী হন। শুধু তাই নয়, মিঃ। ম্যাকমারার হত্যারহস্যও উদ্ঘাটন করার জন্য আমাদের পুলিশ বিভাগকে আমি নির্দেশ দিচ্ছি। অচিরেই এ দুটি হত্যাকাণ্ডের গুপ্ত রহস্য ভেদ করা চাই। কে এদের হত্যাকারী? কি তার উদ্দেশ্য?

মিঃ বোস বললেন–ম্যাকমারা হত্যা-ব্যাপার নিয়ে পুলিশ মহল অত্যন্ত গভীর মনোযোগ সহকারে সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে স্যার। কিন্তু এখনও হত্যাকারী সম্বন্ধে কোনো রকম ক্লু আবিষ্কার হলো । আবার আর একটি খুন।

হাঁ আবার খুন! কিন্তু কেন এ খুন হচ্ছে বা কে করছে–তাকে খুঁজে বের করতে হবে। মিঃ বোস, আপনি সি, আই, ডি, বিভাগকে জানিয়েছেন, যে এ হত্যাকারীর সন্ধান দিতে পারবে তাকে চূড়ান্তভাবে পুরস্কৃত করা হবে।

তখনকার মত সবাই উঠে পড়লেন। কথাবার্তা এখন এ পর্যন্ত রইলো। বিদায় গ্রহণ করলেন পুলিশ সুপার মিঃ বোস এবং ইন্সপেক্টার মিঃ রাজেন্দ্র নাথ।

*

বনহুর বিছানায় শুয়ে সিগারেট থেকে ধূম্ররাশি নির্গত করে চলেছিলো, গভীর চিন্তায় তার মন আজ আচ্ছন্ন। বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখতে না রাখতে এক হত্যা-রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লো সে। এ হত্যা-রহস্য তাকে শুধু উন্মত্তই করে তোলে নি তার মনে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ম্যাকমারার জামার মধ্যে কি লুকানো ছিলো? যার জন্য ম্যাকমারা প্রাণ হারালো, নিহত হলেন এথোল। পরপর দুটো হত্যার পিছনে যে ম্যাকমারার জামা তাতে কোন সন্দেহ নেই। বনহুর সিগারেট থেকে শেষ বারের মত ধূম্ররাশি নির্গত করে সিগারেটটা ফেলে দিলো পাশের ছাইদানীতে। হঠাৎ একটা শব্দ হলো ঘটাং করে। বনহুর চমকে উঠলোনা, মনে করলো শ্যালন বুঝি দরজা খুলে তার কক্ষে প্রবেশ করলো।

বনহুর ফিরে তাকাতেই বিস্মিত হলো–তার কক্ষের দরজা খুলে গেছে, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাকমারার ছাত্র হুইসন স্মিথ। যার সন্ধানে বনহুর আজ সকাল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত প্রায় সমস্ত কলকাতা শহর চষে ফিরেছে।

বনহুর দ্রুত শয্যা ত্যাগ করে এগিয়ে গেলো, হুইসন! হুইসন তুমি–কিন্তু ওকে ধরতে গিয়ে চমকে উঠলো বনহুর হুইসনের পিঠের বাম পাশে একখানা সূতীক্ষধার ছোরা বিধে রয়েছে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে তার জামা-প্যান্ট। ঢলে পড়ে যাচ্ছিলো হুইসন বনহুর ওকে তাড়াতাড়ি সম্মুখের সোফাটায় বসিয়ে দিয়ে দ্রুত হস্তে লাইট জ্বাললো। এতোক্ষণ ডিমলাইটের আলোতে হুইসনকে চিনলেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না।

লাইটের উজ্জ্বল আলোতে বনহুর স্তম্ভিত হতবাক হয়ে গেলেও বুদ্ধি হারালো না, ক্ষিপ্ততার সঙ্গে ছোরাখানা খুলে ফেললো একটানে। সঙ্গে সঙ্গে তাজা রক্ত ফির্কী দিয়ে বেরিয়ে এলো।

বনহুর বুঝতে পারলো হুইসনের মৃত্যুর আর বিলম্ব নেই। ঝুঁকে পড়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বললো– হুইসন বলো? বলো কি বলতে এসেছে আমার কাছে? কি বলতে চাও তুমি–

কিন্তু হুইসন অনেক চেষ্টা করেও একটি কথা উচ্চারণ করতে পারলো না, কিছু বলতে গেলো অমনি ঘাড়টা ঢলে পড়লো এক পাশে। বনহুর বার বার ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকলো–হুইসন–হুইসন হুইসন–

হুইসনের প্রাণবায়ু তখন অসীমে বিলীন হয়ে গেছে।

বনহুর হুইসনের মাথাটা সোফায় ঠেশ দিয়ে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো চোখমুখ তার কঠিন হয়ে উঠেছে। না জানি হুইসন তাকে কি সংবাদ জানানোর জন্য এমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো। গতরাতে সে হোটেলে সঙ্গীদের বলে এসেছিলো, আমি মিঃ আলমের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। কিন্তু সে তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়নি। ফিরেও যায়নি সে আর। কোথায় আটকা পড়েছিলো হুইসন? কে তাকে বন্দী করে রেখেছিলো? আর কেনই বা তাকে এভাবে ছোরাবিদ্ধ করে হত্যা করলো? কি বলার জন্য শেষ পর্যন্ত হুইসন রাতের অন্ধকারে তার কাছে ছুটে এসেছিলো? বনহুর ক্ষিপ্তের মত চঞ্চল হয়ে উঠলো, একটি কথাও যদি হুইসন বলে যেতে পারতো তবু বনহুর স্বস্তি পেতো। বনহুরের ইচ্ছা হলো নিজের দেহে নিজে দংশন করে। চঞ্চলভাবে কিছুক্ষণ পায়চারী করে সে। ভাবে কে এই নৃশংস হত্যাকারী যে পরপর হত্যা করে চলেছে। ম্যাকমারা ও এথোলকে হত্যা করেও নিশ্চিন্ত হয়নি–আবার সে হত্যা করলো হুইসনকে–বনহুর উন্মাদের মত টেবিলে মুষ্টিঘাত করলো, হুইসনের মৃতদেহ তার কক্ষের সোফায় শায়িত ভুলে গেলো সে কথা। দাঁতে-দাঁতে পিষে তাকালো মুক্ত জানালা দিয়ে ঘুমন্ত মহানগরীর দিকে। কতক্ষণ যে একভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো বনহুর খেয়াল নেই, হঠাৎ মনে পড়লো কক্ষে লাশ রেখে এভাবে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ যদি দেখে ফেলে তাহলে বিভ্রাট ঘটবে– তাড়াতাড়ি বনহুর ফিরে এলো লাশের পাশে। দ্রুত হস্তে হাতড়ে চললো হুইসনের জামার পকেটগুলো। যদি কোনো কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়।

বনহুর হুইসনের জামার পকেটে হাত পুরে খুঁজে চলেছে, রক্তে তার হাত দু’খানা চুপসে উঠেছে। একটা কিছু পাওয়া গেলো না হুইসনের পকেটে। বনহুর ছোরাখানা হাতে তুলে নিয়ে দেখছে ঠিক সেই দণ্ডে কক্ষে প্রবেশ করলো আর্থার। তার পিছনে পুলিশ ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথ, ও, সি, জয়দেব ভৌম আর দুজন পুলিশ।

বনহুর ছোরা হস্তে ফিরে তাকাতেই মুহূর্তের জন্য আড়ষ্ট হলো। উঠে দাঁড়ালো সে–দু’চোখে তার বিস্ময়।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ রিভলভার উদ্যত করে ধরলেন–খবরদার নড়বেন না।

আর্থার দাঁত পিষে বললো–আলম, তুমি সবার চোখে ধূলো দিতে পারো কিন্তু আমার চোখে নয়।

বনহুর স্থির দৃষ্টি মেলে তাকালো আর্থারের মুখে, কিন্তু একটি কথাও সে উচ্চারণ করলোনা।

ততক্ষণে শ্যালন এসে দাঁড়িয়েছে, তার নিদ্রাজড়িত দু’চোখে রাজ্যের ভয়-ভীতি আর বিস্ময়।

আর্থার বললো– ঘন্টাখানেক পূর্বে কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। এ ঘর থেকেই কথার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আমি দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখি–ইসনের দেহ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, আর ছোরা হস্তে দাঁড়িয়ে আছে আলম। সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার কক্ষে ফিরে যাই। এবং ফোন করি পুলিশ অফিসে–

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ এবং মিঃ ভৌম অল্পক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বনহুর মিঃ রাজেন্দ্রনাথের রিভলভারে হাত দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করে।

ছিটকে পড়ে রিভলভারখানা কয়েক হাত দূরে।

বনহুর মুহূর্ত মধ্যে ওদিকের মুক্ত জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায়। জানালায় কোনো সিকের ফর্মা বা কাঁচের শার্শী আটকানো ছিলো না। চুড়ান্ত গরম বোধ করায় বনহুরই খুলে দিয়েছিলো কাঁচের শার্শীগুলো কিছুক্ষণ পূর্বে। এক্ষণে তারই কাজে এলো, শার্শী খুলে রাখার জন্য পালাতে সক্ষম হলো সে।

গাড়ি বারান্দায় আর্থারের দেয়া তার গাড়িখানা পার্ক করা ছিলো বনহুর ক্ষিপ্তভাবে ছুটে গিয়ে চেপে বসলো ড্রাইভিং আসনে। তারপর আর কে পায় তাকে।

সাঁ করে বেরিয়ে গেলো বনহুরের মডেল কুইন গাড়িখানা। গেট পার হতেই শুনতে পেলো পিছনে পরপর কয়েকবার রাইফেলের গুলীর শব্দ।

হঠাৎ এভাবে ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথ অপদস্থ হয়ে যাবেন ভাবতেও পারেননি। তিনি প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারখানা হাতে উঠিয়ে নিয়ে পুলিশদ্বয় এবং ওসি, মিঃ ভৌমকে আদেশ দিলেন, ওর গাড়ির চাকা লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়তে। কিন্তু যখন মিঃ ভৌম আর পুলিশদ্বয় গাড়ি বারান্দায় এসে গুলী ছুড়লেন তখন বনহুরের গাড়ি আলবার্ডের লৌহগেট পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়েছে।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথও গুলী ছুড়লেন ছুটে এসে। কিন্তু তিনিও কৃতকার্য হলেন না। এবার তিনি মিঃ ভৌমকে পুলিশদ্বয় সহ মিঃ আলমের গাড়িখানাকে ফলো করার জন্য নির্দেশ দিলেন।

ইন্সপেক্টারের আদেশ পেয়ে আর এক দণ্ড বিলম্ব না করে মিঃ ভৌম পুলিশদ্বয় সহ পুলিশ ভ্যানে চেপে বসলেন।

বনহুরের গাড়িখানা তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

মিঃ ভৌম এবং পুলিশদ্বয় অনুসরণ করলো বনহুরের গাড়িখানাকে।

ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথ ফিরে এলেন হুইসনের লাশের পাশে।

আর্থারও মিঃ রাজেন্দ্রনাথের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলো, সেও ফিরে আসে কক্ষমধ্যে।

শ্যালন তখনও দাঁড়িয়ে আছে ঠিক পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে, তাকিয়ে আছে সে নিহত। হুইসনের মুখের দিকে। সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে! আলম হুইসনকে হত্যা করেছে কিন্তু কেন সে ওকে হত্যা করলো? তবে কি আলম জানতে পেরেছিলো–হুইসন তার পিতা এবং এথোলের হত্যাকারী? তাই বুঝি আলম হুইসনকে হত্যা করেছে–

শ্যালন যখন নানা রকম এলোমেলো চিন্তা করে চলেছে, তখন বললো আর্থার–শ্যালন, তোমার বাবাকেও মিঃ আলম হত্যা করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং মিঃ এথোলকেও–

না, না। এ হতে পারে না, আমার বাবাকে কিছুতেই সে হত্যা করতে পারে না। এমন কি এথোলকেও হত্যা করতে পারে না আলম।

রাজেন্দ্রনাথ বলে উঠলেন–মিস শ্যালন, আপনি মেয়েমানুষ, এসব রহস্যপূর্ণ কাজ বুঝবেন না।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ হুইসনের লাশ পরীক্ষা করতে থাকেন এবং লাশ পরীক্ষা শেষে আর্থারের নিকট হতে হুইসন হত্যার সাক্ষ্য গ্রহণ করে ডায়রী লিখলেন।

*

বনহুরের গাড়ি সোজা পার্ক সার্কাস রোড হয়ে উল্কাবেগে ছুটে চলেছে। পিছনে প্রায় দু’শো গজ দূরে তীর বেগে ছুটে আসছে পুলিশ ভ্যান। মিঃ ভৌম স্বয়ং রাইফেল হস্তে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছেন– সীমার মধ্যে এলেই তিনি গুলী ছুঁড়ে সামনের গাড়ির চাকার টায়ার ফাটিয়ে দিবেন। কিন্তু কিছুতেই। বনহুরের গাড়িখানাকে লক্ষ্যের মধ্যে আনতে পারছেন না।

সুদক্ষ ড্রাইভারের মত গাড়ি চালাচ্ছে বনহুর। গাড়ির হ্যাণ্ডেলে হাত রেখেই একবার বাম হস্তের কব্জির উপর রেডিয়াম হাত ঘড়িটার দিকে তাকালো সে। রাত পাঁচটা পঁয়ত্রিশ। কলকাতা শহর সম্পূর্ণ সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে। যদিও দু’একটা গাড়ি মাঝে মাঝে পথে দেখা যাচ্ছিলো, সেগুলো তেমন কোনো বাধার সৃষ্টি করছিলো না বনহুরের। ডবল স্পীডে গাড়ি ছুটছে।

বনহুরের গাড়ি এবার পার্ক সার্কাস রোড ত্যাগ করে কড়েয়া রোড ধরে অগ্রসর হলো। সামনের আয়নায় দৃষ্টিকোণে দেখে নিচ্ছিলো, পিছনের গাড়িখানার সার্চলাইট দুটো তীর বেগে ছুটে আসছে। বনহুর এতোক্ষণ পুলিশ ভ্যানটাকে এড়িয়ে অন্য পথে উধাও হতে পারতো, কিন্তু গভীর রাত্রির জনহীন ফাঁকা পথ– কাজেই সহজে এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

দক্ষ পুলিশ ড্রাইভার মরিয়া হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, কিন্তু তার চেয়েও দক্ষ ড্রাইভার দস্যু বনহুর। কিছুতেই তাকে আয়ত্বের মধ্যে আনতে পারছে না পুলিশ ভ্যানখানা। কড়েয়া রোড অতিক্রম করে ওয়েলেসলী স্ট্রীটে প্রবেশ করলো বনহুর। ওয়েলেসলী স্ট্রীটের মাঝপথে গিয়ে একটা গলি ধরে ছুটলো এবার বনহুরের গাড়িখানা। কিছুক্ষণ অবিরাম গাড়ি চালিয়ে এ পথ সে-পথ করে এক সময় পুলিশ ভ্যানটাকে ছাড়িয়ে নিলো সে। তারপর আরও কিছুক্ষণ এলোপাথাড়ি নানা জায়গায় ঘুরে ফিরে ইডেন গার্ডেনের সম্মুখে এসে গাড়ি রাখলো বনহুর।

ততক্ষণে ভোরের হাওয়া দোলা জাগিয়েছে ইডেন গার্ডেনের মনোরম পুষ্পবৃক্ষের শাখায় শাখায়। অজানিত ফুলের সুরভি প্রাতঃভ্রমণকারীদের মনে এনেছে এক অপরিসীম আনন্দস্রোত। কতগুলো গাড়ি গার্ডেনের গেটের পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

রাত পাঁচটা থেকে সম্পূর্ণ দেড় ঘন্টা ধরে অবিরাম গাড়ি চালিয়ে তবেই না পুলিশ ভ্যানটার নিপুণ দৃষ্টি থেকে নিজের গাড়িখানাকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে বনহুর। এখন ভোর ছ’টা বেজে চল্লিশ মিনিট হয়েছে। বনহুর হাত ঘড়িটা দেখে নিয়ে ইডেন গার্ডেনে প্রবেশ করলো।

বেশ কিছু সংখ্যক প্রাতঃভ্রমণকারী গার্ডেনে ভোরের হাওয়া উপভোগ করছেন।

বনহুর বেশ ক্লান্ত বোধ করছিলো। একটা নির্জন স্থান দেখে সেখানে বসে পড়লো। হাত দু’খানা দিয়ে ঘামে ভেজা জামার কলার দু’টো উঁচু করে নিয়ে বুকে ফুঁদিয়ে ক্লান্তি দূর করবার চেষ্টা করছিলো।

এমন সময় কিছুদূরে নজর চলে গেলো তার, স্পষ্ট দেখলো– মিঃ ভৌম আর পুলিশদ্বয় ইডেন গার্ডেনের মধ্যে এগিয়ে আসছে। চারদিকে সর্তক দৃষ্টি মেলে এগুচ্ছে তারা। বনহুর বুঝতে পারলো তার সন্ধানেই পুলিশ কর্মচারীত্রয় এ গার্ডেনে আগমন করেছেন, কিন্তু আশ্চর্য। কি করে এখানে তারা ঠিক ঠিক এসে হাজির হয়েছে।

বনহুরের বিশ্রাম আর হলো না, কয়েকজন প্রাতঃভ্রমণকারী ভদ্রলোক তার পাশ দিয়ে গল্প করতে করতে গার্ডেন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। বনহুরও তাদের সঙ্গে মিশে অগ্রসর হলো। কিন্তু বনহুরের গাড়ি রয়েছে এক নম্বর গেটে। এটা দু’নম্বর গেট। বনহুর তাকালো এদিক-ওদিক, ওপাশে কয়েকটা প্রাইভেট কার দাঁড় করানো রয়েছে। একটা কারে ড্রাইভার বসে ঝিমুচ্ছিলো, ভোরের হাওয়ায় তার। দু’চোখে ঘুমের পরশ লেগেছে।

বনহুর পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলো রিভলভারখানা তার পকেটে ঠিক জায়গায় আছে কিনা। বনহুর বুদ্ধি করে রিভলভারখানা পকেটে রেখেছিলো, না হলে ওটাকে সঙ্গে নেবার সময় তার হতো না। অবশ্য রিভলভারখানা পকেটে রাখার উদ্দেশ্যও ছিলো। বনহুর বাইরে বের হবে কিনা এ নিয়েই ভাবছিলো, ঠিক সে মুহূর্তে তার কক্ষে প্রবেশ করেছিলো হুইসন। কাজেই রিভলভার তার পকেটেই রয়ে গিয়েছিলো।

এখন ওটার নিতান্ত প্রয়োজন।

বনহুর ওদিকের গাড়িখানার পাশে এসে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখলো, ড্রাইভার সীটের সঙ্গে হেলান দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঝিমুচ্ছে। মাঝে মাঝে মাথাটা গড়িয়ে যাচ্ছিলো সীটের এক পাশে, আবার সরিয়ে সোজা করে নিচ্ছিলো মাথাটা সে।

বনহুর গাড়িটার একেবারে কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারের কাঁধে হাত রেখে ব্যস্তভাবে বললো ড্রাইভার ড্রাইভার–

এ্যা– চোখ রগড়ে তাকালো ড্রাইভার।

বনহুর পূর্বের ন্যায় ব্যস্তকণ্ঠে বললো–আরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছো, সাহেব যে ডাকা ডাকি শুরু করেছেন। যাও যাও, দেখো কি হলো তাঁর।

সাহেব ডাকছেন, আমাকে?

 হাঁ, যাও চট করে—

ড্রাইভার তার আসন ত্যাগ করে দ্রুত নেমে দৌড় দিলো গার্ডেনের ভিতরে।

বনহুর উঠে বসলো ড্রাইভিং আসনে, তার পর সাঁ করে বেরিয়ে গেলো ইডেন গার্ডেনের দু’নম্বর গেটের সম্মুখ হতে। এবার কে নাগাল পায়।

কলকাতা নগরী এখন জনমুখর হয়ে উঠেছে।

পথঘাট জনাকীর্ণ।

অসংখ্য গাড়ির আঁকে বনহুরের গাড়ি মিশে গেলো।

কোথায় চলেছে, কোথায় যাবে–কোনই স্থিরতা নেই বনহুরের। দিক্-হারার মত একদিকে চলেছে সে। গাড়ির হ্যাণ্ডেল চেপে ধরে তাকিয়ে আছে সম্মুখের দিকে। এতোক্ষণে গাড়ির মালিক হয়তো তার গাড়ির নম্বর জানিয়ে পুলিশ অফিসে ডায়রী করে দিয়েছে কাজেই বেশিক্ষণ এ গাড়ি ব্যবহার করা। তার চলবে না। ঐ যে কথায় বলে–নিয়তি কাউকে পরিহার করে না। ঢেকি স্বর্গে গেলেও তাকে ধান ভানতে হয়। বনহুর খুন না করেও তাকে খুনী বনতে হয়েছে। এতোক্ষণে পুলিশ মহল তার সন্ধানে সমস্ত কলিকাতা চষে ফিরছে। শুধু একটি নয়– তিনটি খুন! যে ব্যক্তি ম্যাকমারা এবং এথোলকে। খুন করেছে–সেই খুন করেছে হুইসন স্মিথকে। কিন্তু পুলিশ তাকেই সন্দেহ করেছে। এর মূল হলো আর্থার। আর্থারের ভুলের জন্য তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। বনহুর চেয়েছিলো বাংলার মাটিতে বাঙালি সন্তানের মত সুশান্ত হয়ে কাটাবে। ভুলে যাবে সে তার বিগত জীবনের কথা। অন্ততঃ যতদিন বাংলাদেশে থাকবে ততদিনের জন্য। তা হলো কই?—

বনহুর নির্দোষী হয়েও এখানে দোষী। তাকে এখন অপরাধীর মত পালিয়ে বেড়াতে হবে। নিজের জন্য এতোটুকু বিচলিত নয় সে। মনে তার প্রচণ্ড আক্রোশ –কে এই হত্যাকারী, কেন সে পর পর। হত্যা করে চলেছে। যেমন করে হোক তাকে খুঁজে বের করতেই হবে, আবিস্কার করতে হবে তার খুনের উদ্দেশ্য।

কিন্তু খুনীকে খুঁজে বের করতে এবং উদ্দেশ্যকে আবিস্কার করতে চাই প্রচুর অর্থ। অর্থ ছাড়া সম্ভব নয় কিছুতেই একাজ।

দস্যু বনহুর আজ অর্থশূন্য।

সমস্ত দিন বনহুর গাড়ি নিয়ে অসংখ্য গাড়ির ভীড়ে ডুবে রইলো।

ক্ষুধায় পেটের মধ্যে তার জ্বালা করছে, পকেটে হাত দিয়ে দেখলো কয়েকটা টাকা মাত্র তার সম্বল আছে। একটা হোটেলের সম্মুখে গাড়ি রেখে কিছু খেয়ে নিলো সে।

তারপর আবার ছুটলো গাড়ি নিয়ে।

অবশ্য কারণও ছিলো, সন্ধান করে ফিরছে এ মহানগরীর কোথায় সে আস্তানা গ্রহণ করবে। কোথা থেকে সে তার কাজ ঠিকভাবে চালিয়ে যাবে। এক এক করে অনেক জায়গাই ঘুরে ঘুরে ফিরলো বনহুর–ভবানীপুর, কালিঘাট, যাদুঘর, ভিক্টোরিয়া, আলিপুর, মেছোঁয়াবাজার, বড় বাজার, রাজা বাজার, শ্যামবাজার, দমদম, ব্যারাকপুর, বালিগঞ্জ, খিদিরপুর, এমন কি গোবরা গোরস্থানেও সে গাড়ি নিয়ে ছুটলো। গেলো সে নিমতলা শ্মশানঘাটে; আরও বহু জায়গা বনহুর চষে বেড়ালো কলকাতা শহরের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। নিজের ক্ষুধা নিবারণের চেয়ে গাড়ির ক্ষুধা মিটিয়ে নিলো সে কয়েকবার।

কলিকাতা নগরীর বুকে এক সময় নেমে এলো রাতের অন্ধকার। অসংখ্য তারকামালার মত জ্বলে উঠলো ইলেকট্রিক আলোগুলো।

বিচিত্রময় মহানগরী রূপ নিলো বৈচিত্রময়ী রূপে।

দিবালোকের কর্মকোলাহলের মুখরতা আরও গাঢ় হয়ে এলো। পথচারী জনগণের মধ্যে দেখা দিলো আরও চঞ্চলতা। সারাদিনের কর্মব্যস্ত জনগণ ক্লান্তির অবসাদ মুছে ফেলে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, কেউ বা বাড়ি ফেরার তাগিদে ব্যস্ত, কেউ বা প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের আশায় উন্মুখ। কেউ বা ক্লাব আর ফাংশানে। কেউ ছুটেছে থিয়েটার বা সিনেমা হলের দিকে। আর কেউ বা চলেছে পরিবার পরিজন নিয়ে বন্ধু-বান্ধবীর আমন্ত্রণে যোগ দিতে। কত জনার কত কাজ, সবাই নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। পথের ধারে ভিখারীর দল সন্ধ্যা ভ্রমণকারী বাবুদের কাছে দুটো পয়সার আশায় গলার জোর আরও। বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচাচ্ছে-বাবু দুটো পয়সা দিন, বাবু দু’টো পয়সা দিন–

ওয়াসেল মোল্লার দোকানের সম্মুখে এক গাদা গাড়ির পাশে এসে থামলো একটা গাড়ি। নেমে এলো গাড়ি থেকে বনহুর গোটাদিন ভর সে বহু জায়গায় ঘুরে ফিরেছে। ওদিকে ভিখারীটা চেঁচাচ্ছে বাবু দুটো পয়সা দিন, বাবু দুটো পয়সা দিন–

বনহুর পকেটে হাত পুরে হাতড়ে একটা সিকি বের করে ভিখারীর হাতে ছুঁড়ে দিলো, তারপর প্রবেশ করলো দোকানের মধ্যে।

বনহুর ভিতরে চলে যেতেই ভিখারী পাশে এক কম্বল মুড়ি দেয়া অন্ধকে বললো–মিঃ রবিন, এটাই হলো সেই গাড়ি, যে গাড়ির সন্ধানে আমরা এতোক্ষণ অনেক জায়গায় সন্ধান করে ফিরছি।

এ্যাঁ, সত্যি আপনি গাড়ির নাম্বার লক্ষ্য করেছেন?

হাঁ, দেখুন–ভিখারী নোটবুক বের করে মিলিয়ে দেখে নিলো।

মিঃ রবিন বললেন–মিঃ ঘোষ আপনি ঠিক আবিস্কার করে ফেলেছেন।

যা হোক, লোকটা যতক্ষণ না ফিরে আসছে ততক্ষণ এভাবেই অপেক্ষা করতে হবে। ভিখারী বেশী মিঃ ঘোষ বললেন।

মিঃ ঘোষ এবং মিঃ রবিন সি, আই, ডি পুলিশ অফিসার। সকালে ব্যারিষ্টার সমরেশ বিশ্বাসের গাড়িখানা হঠাৎ এ ভাবে উধাও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত থানায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, এবং তিনি পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। গাড়ি এবং গাড়ি হরণকারীকে গ্রেপ্তার করতে পারলে তাকে এ পুরস্কার দেওয়া হবে।

মিঃ ঘোষ এবং মিঃ রবিন কয়েকজন পুলিশকে আশে পাশে গোপনে রেখে তারা ভিখারীর ছদ্মবেশে ওয়াসেল মোল্লার দোকানের সম্মুখের গাড়িগুলোর নাম্বার লক্ষ্য করছিলেন। শুধু ওয়াসেল মোল্লার দোকানের সম্মুখেই নয়, এমনিভাবে সি আই ডি পুলিশ শহরের বহু স্থানে নাম করা হোটেল, দোকান, ক্লাব সিনেমা হলের এবং নিউমার্কেটের সম্মুখে সজাগ পাহারা দিচ্ছিলো। যে সে কথা নয়– ব্যারিস্টার বিশ্বাসের গাড়ি। প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা মূল্যের গাড়ি-যেমন করে হোক খুঁজে বের করতেই হবে।

মিঃ ঘোষের নিপুণ দৃষ্টি এড়াতে পারেনি গাড়িখানা। মিঃ ঘোষ বাঁশিতে ফুঁ দিলেন–সঙ্গে সঙ্গে আশে পাশে থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকজন ছদ্মবেশী পুলিশ। ভিখারীবেশী মিঃ ঘোষ তাদের কানে কানে বললেন–তোমরা নিকটেই অপেক্ষা করবে, গাড়ি এবং গাড়ি হরণকারীকে পাওয়া গেছে। লোকটা দোকানে প্রবেশ করেছে, ফিরে এলেই আমি হুইসেল বাজাবো, ততক্ষণাৎ তোমরা গাড়ি এবং গাড়ির চালককে গ্রেপ্তার করবে।

মিঃ ঘোষের নির্দেশ অনুযায়ী সি আই ডি পুলিশ এদিক-ওদিক গা ঢাকা দিয়ে রইলো।

বনহুর ভিতরে প্রবেশ করে একটা সিল্ক জমকালো বড় রুমাল খরিদ করে নিলো, তারপর পূর্বের দরজা দিয়ে না বেরিয়ে অপর এক দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। এবার মোটর গাড়ির মায়া ত্যাগ করে ট্রাম গাড়ির হ্যাণ্ডেল ধরে উঠে পড়লো। অসংখ্য প্যাসেঞ্জারের ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলো নীরবে।

কণ্ডাকটারের গলা ফাটা চিৎকারে কান ঝালাপালা করছিলো। একটানা হেঁকে চলেছে। কণ্ডাকটার–ভবানীপুর–কালিঘাট–বালিগঞ্জ–

বনহুরের গন্তব্যস্থান কোথায় কোন্ দিকে কে জানে।

*

হুইসনের মৃতদেহের মর্মান্তিক দৃশ্যটাই ভাসছিলো আর্থারের চোখের সম্মুখে। রক্তমাখা দেহ, মৃত্যুমলিন বিকৃত মুখ, আর তার বুকের সেই ক্ষতটা যে ক্ষত দিয়ে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো আলমের কক্ষের মেঝের কার্পেটে। কি ভয়ানক সাংঘাতিক দৃশ্য! কয়েক দিন পূর্বেই নিহত হয়েছেন তার বড় কাকা ম্যাকমারা। এ বাড়িতেই তিনি নিহত হয়েছেন। পর পর দুটি হত্যাকাণ্ড কম কথা নয়।

দুটি হত্যাকাণ্ডে আর্থারের বাড়ির সবাই ভীত-আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, তারপর আলবার্ডকে মিথ্যা খুনী সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সব ব্যাপারে শুধু আর্থারই নয়, আর্থার জননী মিসেস এলিনা বার্ডও একেবারে মুষড়ে পড়েছেন।

আর্থার তার পিতার কক্ষেই শোয়।

এ কক্ষেই লোহার সিন্দুক আছে। অর্থ এবং মূল্যবান দ্রব্যাদি এ কক্ষেই থাকে, কাজেই তাকে এ ঘরে ঘুমাতে হয়।

সমস্ত বাড়িটায় একটা ভীতিকর ভাব জেগে আছে।

 আর্থারের চোখে ঘুম নেই।

দারুণ গ্রীষ্মের মধ্যেও আর্থার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছে। কিন্তু কিছুতেই তার চোখে ঘুম আসছে না। একটু সামান্য খুট খাটু শব্দতেই চমকে উঠছে সে। না জানি ম্যাকমারা কাকা বা হুইসন স্মিথ ভূত হয়ে না তার সম্মুখে এসে হাজির হয়!

ওদিকে তার কক্ষ আর মায়ের কক্ষের মাঝামাঝি কক্ষটায় শ্যালন শোয়। বেচারী বালিকা মাত্র; ভয়ে কুঁকড়ে থাকে সর্বক্ষণ। পিতার মৃত্যুর পর সে আলমকেই তার একমাত্র ভরসা ভেবে আঁকড়ে ধরেছিলো। এই বাংলা দেশে তার আপন বলে কেউ ছিলো না। যদিও আলবার্ড পরিবার তার পিতার আত্মীয় তবুও সে ওদের কাউকে নিজের করে নিতে পারছিলো না। আলমকে সে শুধু ভালই বাসতোনা, বিশ্বাস করতো আপন জনের চেয়ে বেশি– সেও খুনী! আলম খুনী–কথাটা স্মরণ হতেই শিউরে উঠে শ্যালন, সে বিশ্বাস করতে পারে না আলম খুনী। কিন্তু আর্থার তাকে এমনভাবে বলেছে বিশ্বাস না করেও যেন পারে না সে। আর্থার বলেছে–তার পিতা ম্যাকমারা এবং এথোল কাকাকেও নাকি আলম হত্যা করেছে। হুইসনকে হত্যা করতে সে নিজের চোখে দেখেছে। কি করে ছোরাখানা সমূলে বসিয়ে দিলো তার বুকে–

আর্থারের কথা শুনে আর্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলো শ্যালন–উঃ! কি ভয়ঙ্কর। সরল মনে বিশ্বাস করেছিলো সে ওর কথাগুলো।

তবু মাঝে মাঝে মনে হতো শ্যালনের –আলম হত্যাকারী নয়। আর্থার মিথ্যা বলেছে; কিছুতেই তার মনে অবিশ্বাস আসতো না। আলমকে সে ভুলতে পারতো না কোনো সময়ের জন্য। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতীক্ষা করতো সে ওর। আলমের সঙ্গে জড়ানো স্মৃতিগুলো তার মনে এক অভিনব আলোড়ন সৃষ্টি করতো। বিছানায় শুয়ে ভাবতো ওর কথা। আলমকে সে যত নিষ্ঠুর শয়তান বলে ভাবতে চেষ্টা করতো ততই যেন আরও সুন্দর দেবমূর্তি হয়ে ধরা দিতো ও তার কাছে।

ও ঘরে শ্যালন যখন আলম সম্বন্ধে নানারূপ চিন্তা করে চলেছে, এ ঘরে তখন আর্থার ভয়ে শিউরে উঠছিলো। কিছুক্ষণ হলো তার কক্ষের পিছন জানালার শার্শীর বাইরে কিসের যেন খুট খুট আওয়াজ হচ্ছিলো। চাদরের ফাঁকে উঁকি দিয়ে একবার দেখে নিয়েছিলো,কিন্তু কিছুই সে দেখতে পায়নি। আর্থারের মনে পড়েছিলো–অশরীরী আত্মা নাকি দেখা যায় না, তবে তাদের বিচরণ অস্তিত্ব নাকি বোঝা যায়। তবে কি ম্যাকমারা কাকা– না হুইসনের আত্মা তার ঘরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। ভয়ে আর্থারের দেহ ভিজে চুপসে উঠছে। চোখ মুছে বিছানায় পড়ে রইলো সে অসাড়ের মত।

একটা শব্দ হলো, কেউ যেন লাফিয়ে পড়লো মেঝেতে।

তবে কি প্রেত-আত্মা কক্ষে প্রবেশ করলো। চাদরের নিচে থর থর করে কাঁপছে আর্থার। মনে মনে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করছে সে।

মেঝেতে জুতোর শব্দ হলো, কেউ যেন তার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো।

আর্থারের হৃদপিণ্ড তখন ধরাস ধরাস করছে, এ বার অশরীরী আত্মা তাকে গলা টিপে হত্যা করবে। চিৎকার করে কাউকে ডাকবে তারও উপায় নেই, গলাটা ওর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেন। চাদর সরিয়ে চোখ মেলে দেখবে তাও সাহস হচ্ছে না। না জানি প্রেত-আত্মার রূপটা কেমন কি ভয়ঙ্করই না হবে! আর্থার কাঁপতে শুরু করেছে, আর প্রাণপণে স্মরণ করছে ঈশ্বরকে।

হঠাৎ তার মুখের চাদর সরে গেলো।

 চমকে চোখ মেলে তাকালো আর্থার, সঙ্গে সঙ্গে অস্কুট ধ্বনি করে উঠলো–কে, কে তুমি!

আমি হুইসনের হত্যাকারী!

 তুমি আলম?

হা। বনহুর তার মুখের কালো রুমালখানা একটানে খুলে নিয়ে পকেটে রাখলো, দক্ষিণ হস্তে তার উদ্যত রিভলভার।

আর্থার শয্যায় যেমন শুয়ে ছিলো তেমনি রইলো, ছাই-এর মত বিবর্ণ হয়ে উঠেছে তার মুখমণ্ডল। এতো রাতে এমতাবস্থায় আলম কি করে প্রবেশ করলো তার কক্ষে। ভীতভাবে তাকালো আর্থার আলমের মুখের দিকে।

আলমের চোখ দিয়ে যেন অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। কঠিন তার মুখমণ্ডল। আর্থার তাকালো দরজার দিকে।

বনহুর দাঁত পিষে বললো–খবরদার চিৎকার করলেই তোমার অবস্থা হুইসনের মত হবে।

এখানে কেন তুমি? এখানে কেন, বলো?

হুইসনকে হত্যা করেছি, এবার তোমাকে। বনহুর আর্থারের শরীরের চাদর একটানে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

এতোক্ষণও শুয়ে ছিলো সে, উঠে বসবার সাহস তার হয়নি। বনহুরের রিভলভারখানার দিকে বার বার তাকিয়ে দেখে নিচ্ছিলো। কখন বুঝি ওর একটা গুলী তার জীবনের ইতি ঘটিয়ে দেয়। বনহুর চাদরখানা ছুঁড়ে ফেলে দিতেই কম্পিতভাবে উঠে বসলো আর্থার; শয্যায় হাত জুড়ে বললো আমি–আমি কি অন্যায় করেছি তোমার?

গম্ভীর কণ্ঠে বললো বনহুর–হুইসন যে অপরাধ করেছিলো!

আর্থার কোনো উত্তর দেবার পূর্বেই বনহুর রিভলভার চেপে ধরলো তার বুকে–চাবি দাও।

চাবি! কিসের চাবি?

সিন্দুকের।

তুমি শুধু খুনীই নও, তুমি চোর-ডাকু—

আমি চোর-ডাকু-খুনী যা বলো সব। দাও চাবি, দাও শীঘ্র।

 কেন, কি করবে চাবি তুমি?

তোমার বাবাকে নির্দোষ প্রমাণিত করে হাজতবাস থেকে মুক্ত করে আনবো, তাই আমার প্রয়োজন প্রচুর অর্থ।

অর্থ!

হাঁ, বিলম্ব-করো না, বা চালাকি করতে যেও না মরবে।

আর্থারের মুখ ছাই-এর মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, আজই সে ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা উঠিয়ে এনেছে, কালকেই তার কারবারের জন্য প্রয়োজন।

চাপা গর্জন করে উঠে বনহুর–চাবি বের করো। সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারের আগাটা ঠেকায় সে আর্থারের বুকে।

আর্থার ভয় পেয়ে গেছে–হুইসনকে যে হত্যা করেছে, তাকে হত্যা করা তার পক্ষে কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। আর্থার চাবির গোছা বনহুরের হাতে তুলে দিলো।

বনহুর চাবি নিয়ে লৌহ-সিন্দুক খুলে ফেললো। দ্রুত হস্তে টাকার ফাইলগুলো পকেটে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চাবির গোছা ছুঁড়ে দিলো আর্থারের হস্তে, তারপর বললো–শ্যালনকে দেখাশোনা করো আর্থার। তার প্রতি যদি কোনো রকম অন্যায় আচরণ করো তাহলে তোমার মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনো। আসিবাই বাই–

বনহুর যে পথে এসেছিলো সে পথে বেরিয়ে গেলো।

আর্থার এবার কম্পিত হস্তে রিসিভারখানা তুলে নিলো হাতে–হ্যালো, হ্যালো, লালবাজার পুলিশ অফিস–

অল্পক্ষণেই পুলিশ এসে হাজির হলো। মিঃ ভৌম এবং কয়েকজন পুলিশ ফোন পেয়েই ছুটে এলেন গাড়ি নিয়ে। কিন্তু তাঁরা কোনো কিছুই করতে পারলেন না। রাতেই খবরটা জানানো হলো পুলিশ সুপার মিঃ বোসের কাছে। তিনি জানালেন কমিশনার বিনয় সেনকে।

পরদিন দৈনিক সংবাদ-পত্রিকায় এ খবর বের হলো, তার সঙ্গে বের হলো পর পর কয়েকটি হত্যা-রহস্য। ইতিপূর্বেও কলিকাতা শহরময় এ হত্যা-ব্যাপার নিয়ে একটা ভীষণ চঞ্চলতা দেখা দিয়েছে। তারপর আবার এ রহস্যজনক ডাকাতি।

শহরে নানাস্থানে পত্রিকা সংবাদ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে লাগলো। পথে-ঘাটে, ট্রামে বাসে, হোটেলে, ষ্টলে, দোকানে–এমনকি সিনেমা হলেও এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আজ রাতের ডাকাতির ব্যাপার নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হলো।

ক্যালকাটা গ্র্যাণ্ড হোটেল।

একটি বিশিষ্ট কামরায় সোফায় বসে সিগারেট পান করছিলো আর দৈনিক-সংবাদ পত্রিকাখানা দেখছিলো দস্যু বনহুর। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছে গত রাতে পার্ক সার্কাসের একটি বাড়িতে অদ্ভুত ডাকাতির সংবাদটা।

বনহুরের ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কুণ্ডলি পাকানো ধর্মরাশির দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে উঠলো–দস্যু বনহুরের প্রথম পদক্ষেপ এটা–পরক্ষণেই ডাকলো বনহুরবয়, বয়–

কক্ষে প্রবেশ করলো একটি বয়–স্যার, ডাকছেন?

হাঁ শোন, কয়েক দিনের মধ্যে আমার গাড়ি আসছে, একটা গ্যারেজের ব্যবস্থা করো।

আচ্ছা স্যার, কোনো অসুবিধা হবে না।

আমার খাবার নিয়ে এসো।

বয় বেরিয়ে গেলো।

অল্পক্ষণ পরে টেবিলে খাবার সাজিয়ে বললো–স্যার খাবার দিয়েছি।

 বনহুর পত্রিকাখানা রেখে উঠে খাবার টেবিলে এসে বসলো।

বয় পরিবেশন করছিলো।

 বনহুর বললো–তোমার নাম কি?

 বয় হেসে বললো-স্যার, আমার নাম মিঠু। গরীব লোক আমরা—

 তাহোক। মিঠু, তোমাকে আমি নাম ধরে ডাকবো, কেমন?

তাই ডাকবেন স্যার।

আচ্ছা মিঠু, এ হোটেলে তুমি কতদিন কাজ করছো?

 বছর তিন-চার হবে।

দেখ মিঠু, সত্যি তোমাকে আমার বড় ভাল লেগেছে।

কত সাহেব আসেন আবার চলে যান; কিন্তু কেউ আমাদের সঙ্গে আপনার মত এমন করে কথা। বলে না। আপনাকেও আমার খুব ভাল লেগেছে স্যার।

সত্যি! বনহুর খেতে খেতে আনন্দধ্বনি করে উঠে।

মিঠু হাসে–হাঁ স্যার। খাওয়া শেষ হলে বনহুর দশ টাকার একখানা নোট গুঁজে দেয় মিঠুর হাতে–তোমার বখশীস্।

 দশ টাকা।

হাঁ। শোন মিঠু, আমাকে অনেক সময় নানা কাজে বাইরে ঘোরাফেরা করতে হবে, কারণ আমি কলকাতায় জরুরি এক কাজ নিয়ে এসেছি, বেশ কিছুদিন থাকতে হবে।

টাকাটা খুশি হয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বললো মিটু–স্যার আমাকে সব সময় পাবেন। যা। বলবেন তাই করবো।

বেশ, আমার কথা মতো কাজ করো, কেমন?

করবো স্যার।

বনহুর জামা-কাপড় পরে নিয়ে তখনকার মত বেরিয়ে পড়লো, ক্যাবিনে তালা বন্ধ করে চাবিটা নিজের পকেটে রাখলো সে।

একটা ট্যাক্সি ডেকে চেপে বসলো বনহুর, ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললো–ভবানীপুর।

*

হুইসন নিহত হবার পর ম্যাকমারার ছাত্রগণ দেশে ফিরে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তারা আর একটি দিনও কলকাতায় থাকা উচিৎ মনে করছে না।

বনহুর আজ তাদের নিকটেই উপস্থিত হলো গিয়ে।

ম্যাকমারার ছাত্রগণ মিঃ আলমকে পেয়ে সবাই ঘিরে ধরলো, একবাক্যে সবাই জানালো–আর তারা থাকতে রাজি নয়।

বনহুরও এতে আপত্তি করলো না, এবং তাদের যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালো। শ্যালনকেও তার দেশে পৌঁছে দেবার জন্য নিয়ে যেতে বললো সে।

ম্যাকমারার ছাত্রদলের নেতা মিঃ লুই, শ্যালনকে দেশে নিয়ে যাবার জন্য স্বীকার করলো। লুই নিজে গেলো পার্ক সার্কাসে আর্থারের বাড়িতে, বললো–আমরা চলে যাচ্ছি, চলো তোমাকে তোমার দেশে পৌঁছে দেব।

কিন্তু শ্যালন কিছুতেই স্বীকার হলোনা, সে মৃত পিতার কথা স্মরণ করে রোদন করে চললো। তারপর কান্না থামিয়ে বললো–দেশে আমি কার কাছে ফিরে যাবো, কে-ই বা আছে আমার! আমি যাবো না, আলমকে ছাড়া আমি কোথাও যাবোনা।

আর্থার বোঝালো–সে একজন খুনী-হত্যাকারী। তোমার পিতাকেও সে হত্যা করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু এতো শোনা সত্ত্বেও শ্যালন আলমকে অবিশ্বাস করতে পারলো না। সে বললো–আমি জানি, সে হত্যাকারী নয়! আমার মন বলছে সে নির্দোষ।

মিঃ লুইও এ কথা বিশ্বাস করতে পারেনি, মিঃ আলম যে হুইসনকে হত্যা করেনি, এটা তারা। জানে। এতোদিন তারা আলমের সঙ্গে এক সাথে কাটিয়েছে, ওকে চিনতে বাকি নেই তাদের। কাজেই আলম যে তাদের নিকটে গিয়েছে এবং এক্ষণে সেখানেই অবস্থান করছে এ কথা প্রকাশ করে না লুই আর্থারের নিকটে।

শ্যালনের কাছ থেকে বিফল হয়ে ফিরে আসে লুই হোটেলে। সব কথা খুলে বলে তার দলবল এবং মিঃ আলমের কাছে। শ্যালন আর দেশে ফিরে যেতে রাজি নয়। দেশে তার নাকি আপনজন বলতে কেউ নেই। তাছাড়া আলমকে সে কিছুতেই কলকাতায় রেখে ফিরে যাবে না।

কথাটা শুনে হাসলো বনহুর, কোনো উত্তর দিলো না মিঃ লুই এর।

শেষ পর্যন্ত ম্যাকমারার ছাত্রগণ শ্যালনকে কলকাতায় রেখেই ফিরে যাওয়া মনস্থ করে নিলো।

বনহুর নিজে গিয়ে তাদের খিদিরপুর ডকে জাহাজে তুলে দিয়ে এলো। জাহাজে যাতে ছাত্রগণের কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য বনহুর নিজ অর্থ ব্যয় করে সব ব্যবস্থা করে দিলো।

ম্যাকমারার ছাত্রদলকে বিদায় দিয়ে বনহুর যখন ফিরে এলো গাড়িতে, তখন নিজের অজ্ঞাতে তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছিলো! বার বার মনে পড়ছিলো ম্যাকমারাকে, আজ ফিরে যেতে ম্যাকমারা তার দলবল নিয়ে, কিন্তু নিয়তি তা হতে দিলো না।

ম্যাকমারা হলো নিহত আর সেই সঙ্গে জড়িয়ে পড়লো সে নিজে। আর একটা সমস্যা তাকে আরও বিভ্রাটে ফেলছে–সে হলো শ্যালন–

হটাৎ বনহুরের চিন্তা ধারায় বাধা পড়ে ড্রাইভার বলে বাবু সাব, আভি কাঁহা যাওগে?

 চমক ভাঙ্গে বনহুরের, এ্যা–চলো পার্ক সার্কাস–

সবেমাত্র আর্থার বেরিয়ে গেছে। পথে গাড়ি রেখে ফোনে জেনে নিয়েছিলো বনহুর, তাই সোজা সে চলে এলো আর্থারের বাড়ির সম্মুখে।

গাড়ি-বারান্দায় গাড়ি পৌঁছতেই নেমে চলে গেলো সে শ্যালনের কক্ষে।

শ্যালন একটা বই পড়ছিলো, মুখে দারুণ চিন্তার ছাপ। এলোমেলো চেহারা, মলিন বিষণ্ণ করুণ দুটি চোখ। বনহুর কক্ষে প্রবেশ করতেই শ্যালন চোখ তুলে তাকালো, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ওর গলা–আলম। আলম তুমি এসেছো?

শ্যালন কেন তুমি গেলেনা? তোমার বাবার ছাত্রগণ দেশে ফিরে গেলো আর তুমি–

না, না আমি যাবো না, আলম তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।

সেকি কথা শ্যালন? এ তুমি কি বলছো?

আলম, আমি জানি তুমি একদিন না একদিন আসবে। আর আমি সেই প্রতীক্ষায় ছিলাম।

 শ্যালন আমি খুনি–

না, না তুমি খুনী নও। আমি জানি তুমি খুনী নও।

শ্যালন! বনহুর যেন একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো, পুনরায় বললো–শ্যালন সত্যি তুমি আমাকে বিশ্বাস করো?

হাঁ আলম, জানি, আমি জানি তুমি খুনী নও।

 শ্যালন!

বলো?

আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছিনে। বাড়ির অন্যান্য কেউ জেনে ফেললে এক্ষুণি আমাকে বিপদে পড়তে হবে।

আমিও যাবো তোমার সঙ্গে। বললো শ্যালন।

বনহুর ব্যস্তকণ্ঠে বললো–তুমি জানো না শ্যালন, আমি এখন কি অবস্থায় আছি। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।

আবার আসবে বলো?

আসবো। শ্যালনের বাহুবন্ধন থেকে নিজকে মুক্ত করে নেয় বনহুর, তারপর বলে–আসিবাই, বাই–

বনহুর বেরিয়ে যায়, শ্যালন ছুটে গিয়ে দাঁড়ায় বেলকোনির ধারে, ঝুঁকে পড়ে হাত নাড়ে।

বনহুরের গাড়িখানা অদৃশ্য হয়ে যায় মোড়ের বাঁকে।

*

কমিশনার ভবন।

গভীর রাত।

একখানা গাড়ি গিয়ে থামলো কমিশনার ভবনের অনতিদূরে বাগানের ওপাশে। জমকালো পোশাক পরা একটি ছায়ামূর্তি নেমে এলো গাড়ি থেকে। কৌশলে বাগান মধ্যে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলো কমিশনার ভবনের পিছন দিকে।

পুলিশ কমিশনার বিনয় সেন গভীর নিদ্রায় অচেতন।

হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো তাঁর। চোখ মেলে তাকাতেই আড়ষ্ঠ হলেন তিনি। একটা জমকালো ছায়ামূর্তি তাঁর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

কক্ষ সম্পূর্ণ অন্ধকার।

বিনয় সেন জেগে উঠার পূর্বেই ডিম লাইট অফ করে দিয়েছিলো ছায়ামূর্তি।

কমিশনার জেগে উঠেই গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–কে–কে–কে তুমি?

চাপা কণ্ঠে বললো ছায়ামূর্তি-আমি ম্যাকমারার প্রেত আত্মা!

হ্যাঁ কি বললে? ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর বিনয় সেনের।

আমি তোমার মৃত বন্ধুর আত্মা।

বিনয় সেন বিছানায় সোজা হয়ে বসে চিৎকার করতে যাবেন। কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। একে নিদ্রার ঘোের এখনও তার সম্পূর্ণ কাটেনি, তারপর মৃত বন্ধুর আত্মা– ফিস্ ফিস্ করে চাপা কণ্ঠে ছায়ামূর্তি কথা বলছিলো, সম্পূর্ণ অদ্ভুত সে কণ্ঠ স্বর ঠিক যেন ম্যাকমারার গলার আওয়াজ বলে মনে হলো তাঁর।

বিনয় সেন বললেন–কি চাও তুমি আমার কাছে?

 যা তুমি নিয়েছো আমার বুক থেকে ছিনিয়ে।

না, না আমি তোমাকে দেবোনা! তুমিতো মরে গেছো কি করবে ওটা নিয়ে?

মরেও আমি স্বস্তি পাচ্ছিনা, তুমি আমাকে হত্যা করেছে আমিও তোমাকে হত্যা করে আমার জিনিস ছিনিয়ে নেবো।

আমি পুলিশ ডাকবো।

ফোন অকেজো হয়ে গেছে।

বিনয় সেন সুইচ্ টিপে আলো জ্বালাতে চেষ্টা করলেন; কিন্তু আলো জ্বললোনা।

হেসে উঠলো ছায়ামূর্তি আলো জ্বলবেনা আর!

এ তুমি কি করেছে?

আমি প্রেত আত্মা, আমি সব পারি।

তোমাকে আমি গুলী করে হত্যা করবো।

চাপা স্বরে হেসে উঠলো ছায়ামূর্তি–হত্যা করবে! করো–

বিনয় সেন ড্রয়ার খুলে বের করলো রিভলভার। ছায়ামূর্তিকে লক্ষ্য করে গুলী ছুড়লো। কিন্তু একি গুলী তো বের হচ্ছে না। পর পর ফায়ার করে বিফল হলেন তিনি। এবার আশ্চর্য না হয়ে পারলেন না।

ছায়ামূর্তি বিনয় সেনকে জাগাবার পূর্বেই মেইন সুইচ অফ করে দিয়েছিলো। আর বের করে। নিয়েছিলো রিভলভারের গুলী। ফোনের কানেকশানও নষ্ট করে দিয়েছিলো সে। বিনয় সেনের মাথা ঘেমে দর দর করে ঘাম ঝরে পড়ছে। বিবর্ণ পাংশু মুখে ধপাস্ করে বসে পড়লেন বিছানায়। চিৎকার করে বললেন–পাবে না, সে জিনিস তুমি পাবে না।

তবে মরো–ছায়ামূর্তি দু’হাত বাড়িয়ে বিনয় সেনের গলা টিপে ধরলো।

কি ঠাণ্ডা, ঠিক যেন বরফের মত দু’খানা হাত ৷ শিউরে উঠলেন বিনয় সেন, জীবিত মানুষের স্পর্শ এমন হিমশীতল হয়না। ঢোক গিলে বললেন বিনয় সেন–দাঁড়াও দাঁড়াও আমি দিচ্ছি–

দাও—

আলো না জ্বাললে কি করে দেবো?

বলো আমি বের করে নিচ্ছি। চাবি দাও।

চাবি! না, না, আমি –আমি দিচ্ছি–বিনয় সেন অন্ধকারে লৌহ আলমারী খুলে ফেললেন, হাতড়ে বের করলেন একটা ছোট্ট বাক্স।

অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। খুদে বাক্সটা খুলে ফেললেন বিনয় সেন, সঙ্গে সঙ্গে একটা নীলাভ আলো উজ্জ্বল তারার মত চক চক করে উঠলো বিনয় সেনের হাতের মুঠায় ক্ষুদ্র বাক্সটার ভিতরে। বিনয় সেন বলে উঠলেন আপন মনেইনা, না, আমি এটা দেবো না-আমি এটা দেবো না–এটা হস্তগত করতে আমি শুধু তোমাকেই হত্যা করিনি, হত্যা করেছি বন্ধু এথোলকে, আমি হত্যা করেছি হুইসনকে–

এথোলকে কেন তুমি হত্যা করেছিলে?

এথোল জানতো এই অমূল্য রত্নটির কথা এবং সে জেনেছিলো আমিই ওটা নিয়েছি–তাই আমি ওকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলাম।

আর হুইসন?

সে আমাকে ম্যাকমারা হত্যার দিন দেখেছিলো আলবার্ডের বাড়ির কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে। আমি–আমি মৃত্যুর হুমকি দেখিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলাম; কিন্তু হুইসন মৃত্যুর ভয়ে কয়েকদিন মুখ বন্ধ করে থাকলেও সে নিজকে আয়ত্বে রাখতে পারেনি, সে বলতে গিয়েছিলো ম্যাকমারার ভাবী জামাতা মিঃ আলমের কাছে।

তারপর?

আমি তাকে শেষ পর্যন্ত বলবার সুযোগ দিই নাই—

 ছায়ামূর্তি বলে উঠলো “তুমি তাকে হত্যা করলে?

হ্যাঁ, আমি বাধ্য হয়ে হুইসনকে হত্যা করেছি। জানো ম্যাকমারা, শুধু এই রত্নটার লোভে আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি। পুলিশ কমিশনার হয়েও আমি এতো হীন কাজে প্রবৃত্ত হয়েছি। তাই ওটা আমি ভিক্ষা চাই তোমার কাছে–

তা হয় না, ওটার জন্য তুমি একটি নয় তিন তিনটি খুন করেছো, এখন তোমাকেও হয়তো মরতে হবে–কাজেই ওটা আমার কাছেই থাক। ছায়ামূর্তি এক ঝটকায় বিনয় সেনের হাত থেকে কেড়ে নিলো উজ্জ্বল বস্তুসহ ক্ষুদে বাক্সটা। তারপর বললো–এবার তুমি নিশ্চিন্ত—

*

কথা শেষ করে ছায়ামূর্তি বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

পুলিশ অফিসে মিঃ রাজেন্দ্রনাথ কাজ করছিলেন।

অন্যান্য পুলিশ অফিসারগণ নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।

এমন সময় পিয়ন একটা পার্সেল রেখে বললো–স্যার সই দিন।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ রিসিটে নাম সাইন করে পার্সেলটা মিঃ ভৌমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো– খুলে দেখুন কি এলো।

মিঃ ভৌম পার্সেল খুলে ফেললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য কণ্ঠে বললেন–এযে দেখছি টেপ রেকর্ড!–

অফিসের সবাই ঘিরে ধরলো, ব্যাপার কি?

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ টেপরেকর্ডটা নেড়েচেড়ে সোজা করে রাখলেন, দেখলেন ফিতে ফিট করাই রয়েছে। তিনি আলগোছে চালু করে দিলেন টেপ রেকর্ড।

একি সবাই চমকে উঠলো–এযে মিঃ বিনয় সেনের গলা। স্তব্দ হয়ে শুনছে পুলিশ অফিসারগণ।

 কে–কে–কে তুমি—

 চাপা অস্পষ্ট একটা কণ্ঠ–আমি ম্যাকমারার প্রেত আত্মা—

হ্যাঁ কি বললে—

আমি তোমার বন্ধুর আত্মা–

টেপরেকর্ডে বেশ কিছুক্ষণ আর কোনো কথা নেই। পুলিশ অফিসের কক্ষ যেন নিস্তব্দ মেরে গেছে। সবাই তাকাচ্ছে এ ওর মুখে।

আবার শব্দ ফুটলোকি চাও তুমি আমার কাছে—

অদ্ভুত চাপা ফিসফিসে আওয়াজ–যা তুমি নিয়েছে আমার বুক থেকে ছিনিয়ে–

ভয়ার্ত চঞ্চল কণ্ঠ পুলিশ কমিশনারের–না, না, আমি তোমাকে দেবোনা–তুমি তো মরে গেছো, কি করবে ওটা নিয়ে–

–ফিসফিসে অস্ফুট কণ্ঠ–মরেও আমি স্বস্তি পাচ্ছিনে–তুমি আমাকে হত্যা করেছো–আমিও তোমাকে হত্যা করে আমার জিনিস ছিনিয়ে নেবো–

মিঃ রাজেন্দ্রের চোখে-মুখে কঠোর কর্তব্যের ছাপ ফুটে উঠেছে। কঠিন হয়ে উঠছে তাঁর মুখমণ্ডল। তিনি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনছেন।

–আমি পুলিশ ডাকবো—

কমিশনারের গলা টেপ্ রেকর্ডে হলেও চিনতে ভুল হয় না পুলিশ ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথের।

ঠিক সেই মুহূর্তে টেবিলে ফোনটা সশব্দে বেজে উঠে টেপ রেকর্ড বন্ধ করে দিয়ে রিসিভার হাতে তুলে নিয়ে কানে ধরতেই বিবর্ণ হয়ে উঠে ইন্সপেক্টার রাজেন্দ্রনাথের মুখমণ্ডল–মিঃ সেন মৃত–

পুলিশ অফিসে যেন বাজ পড়লো।

রিসিভার রেখে ব্যস্তকণ্ঠে বললেন মিঃ রাজেন্দ্রনাথ–সর্বনাশ হয়েছে, মিঃ ভৌম কমিশনার মিঃ সেনকে তাঁর কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।

তখনকার মত টেপ রেকর্ড সাবধানে তুলে রেখে সবাই মিলে পুলিশ ভ্যানে ছুটলেন কমিশনার ভবনের দিকে।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য কয়েকজন বিশিষ্ট পুলিশ অফিসার সহ কমিশনার ভবনে পৌঁছে তারা দেখলেন পুলিশ সুপার মিঃ বোস ব্যস্তভাবে পায়চারী করছেন। আরও অনেকে কয়েকজন পুলিশ অফিসারও রয়েছে সেখানে।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ অভিজ্ঞ ইন্সপেক্টার, তিনি আসায় মিঃ বোস তাঁকে নিয়ে কমিশনার কক্ষে প্রবেশ করলেন।

রাজেন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য অফিসারগণ বিস্ময়ভরা নয়নে দেখলেন– কমিশনার মিঃ সেন লৌহ। আলমারীর পাশে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, স্থির আড়ষ্ট তার দেহ। চোখদুটো অধমেলিত।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ মিঃ সেনের হাতখানা স্পর্শ করে বললেন–বহুক্ষণ আগে শেষ হয়ে গেছেন।

পুলিশ সার্জন পরীক্ষা করে বললেন–হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মিঃ সেনের মৃত্যু ঘটেছে।

মিঃ বোস বলেন–কেউ তাঁকে হত্যা করেনি।

না। বললেন সার্জন।

মিঃ রাজেন্দ্রনাথ বললেন–মিঃ সেনের মৃত্যু সম্বন্ধে আমরা অল্পক্ষণ পর স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হবো। কিছুক্ষণ পূর্বে পুলিশ অফিসে পাঠানো ‘টেপরেকর্ড ব্যাপারটা’ বললেন তিনি।

এবার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন টেপরেকর্ড না শোনা পর্যন্ত সবাই উদ্বিগ্ন রইলো।

.

ঢং ঢং করে রাত দুটো বাজার শব্দ শোনা গেলো। কলকাতা শহর সম্পূর্ণ সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েনি এখনও। তবে সন্ধ্যারাতের উচ্ছলতা নেই এখন। গাড়ি-ঘোড়া, যান-বাহন চলছে, কেমন যেন শিথিলতা এসেছে তাদের চলার মধ্যে।

দোকান-পাট গম গম না করলেও দুচারটে ষ্টল, হোটেল এখনও সরগরম করে বসে পান-বিড়ি সিগারেট খাচ্ছে ট্যাক্সিচালক, ট্রাম-বাসের কণ্ডাকটার আর কুলী-মজুরের দল। যারা সেদিনের শেষ উপার্জনের দুটো পয়সার আশায় এতোক্ষণও ছুটো ছুটি করে ফিরছিলো পয়সাওয়ালা বাবুদের পিছু পিছু তারাই এখন আসর জমিয়ে বসেছে।

রাত বেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্ত অবশ দেহটা নিয়ে একটু রস-রচনা সৃষ্টি করে চলেছে ওরা।

পথের দুধারের বাড়িগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে।

নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে বাড়ির মালিকগুলো তাদের ছেলে-মেয়ে বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে। গেটের পাহারাদার এতোক্ষণ ঝিমুচ্ছিলো টুলটায় বসে বসে, এবার সে দাঁড়িয়ে খাটিয়ায় শুয়ে নাক ডাকতে শুরু করেছে।

পার্ক সার্কসের মোড়ে বিরাট তিন তলা আলবার্ডের বাড়িটাও নিস্তব্দ হয়ে গেছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এতোদিন পর আজ কতকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে আর্থার। তাই নিদ্রাটাও হয়েছে ঘন। আজ পুলিশ অফিস থেকে তাকে ডাকা হয়েছিলো,এবং জানানো হয়েছে তার পিতা ম্যাকমারা হত্যা ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাঁকে অচিরেই মুক্তি দেয়া হবে।

আর্থার আরও জেনেছিলো–ম্যাকমারা, এথোল এবং হুইসনকে একই ব্যক্তি হত্যা করেছে তিনি হলেন বিনয় সেন। কিন্তু ম্যাকমারার প্রেত-আত্মার বেশে কে তার ওখানে গিয়েছিলো যে হত্যাকারীকে আবিস্কার করে তার পিতাকে নির্দোষ প্রমাণে সক্ষম হয়েছে–তবে কি সে আলম?

আর্থারের মনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছিলো আলমের সেদিনের কথাগুলো–তোমার পিতাকে নির্দোষ প্রমাণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন–নিশ্চয়ই ম্যাকমারা কাকার প্রেত-আত্মারূপে বিনয় সেনকে খুনী প্রমাণে সক্ষম হয়েছে আলম। শ্রদ্ধাবনত হয়ে আসে আর্থারের মাথাটা।

এসব চিন্তা করতে করতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে আর্থার।

 ওদিকের কক্ষে ঘুমিয়েছেন আর্থার জননী। অসুস্থ মানুষ তিনি, রাত জাগতে পারেন না মোটেই।

বাড়ির চাকর-বাকর সবাই ঘুমিয়ে।

এমন সময় শ্যালনের দরজার টোকা পড়লো।

শ্যালন আজ কিছুতেই ঘুমাতে পারেনি। যখন সে জানতে পেরেছিলো হুইসনের হত্যাকারী আলম নয়। তার বাবা আর এথোল কাকাকে যে খুন করেছিলো সেই খুন করেছিলো হুইসনকে এবং সে এখন জীবিত নয়–মূত। আলম খুনী নয় সে নির্দোষ–নিষ্পাপ। শ্যালন আনন্দে আজ আত্মহারা– আলমকে সে ভালবাসে। বিশ্বাস করে। সেও যে খুনী বলে স্বীকার করেনি কোনো দিন, প্রমাণ হলো সত্যি সে খুনী নয়–

হঠাৎ চমকে উঠে শ্যালন, একবার– দু’বার–তিনবার টোকা পড়লো দরজায়।

শ্যালন ভয় পেলো না আজ। একটা দুর্বার সাহস তাকে শয্যা থেকে ঠেলে দিলো যেন–শ্যালন! দরজা খুলে দিতেই দেখলো। সম্মুখে দাঁড়িয়ে আলম।

শ্যালন আনন্দধ্বনি করে উঠলো তুমি!

বনহুর বললো–শ্যালন, চুপি চুপি আমার সঙ্গে চলে এসো খুব শীঘ্র করে।

 তোমার সঙ্গে?

হা ভয় নেই, আবার পৌঁছে দেবো।

শ্যালন দরজাটা ভাল করে বন্ধ করলো, তারপর বললো–চলো।

আমার হাত ধরো শ্যালন। বাড়ির পিছনের সরু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে হবে। ওদিকের রাস্তায় আমার গাড়ি অপেক্ষা করছে।

শ্যালন বনহুরের হাত ধরে তার গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো।

 বনহুর ড্রাইভিং আসনের দরজা-খুলে বললো উঠে পড়ো।

 শ্যালন গাড়িতে উঠে বসলো।

বনহুর ড্রাইভিং আসনে, স্টার্ট দিলো এবার।

 শ্যালন বললো–কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে?

তোমাকেও যদি হত্যা করি সেই ভয় হচ্ছে বুঝি?

আমাকে হত্যা করবে, বেশ তো করো।

 সাবাস শ্যালন, তুমি নির্ভীক নারী। যা হোক তাহলে সত্যি ভয় পাওনি।

না মোটেই ভয় পাইনি। আলম, আমি সব শুনেছি।

কি শুনেছো?

হুইসনের হত্যাকারী তুমি নও। আমার বাবাকে যে হত্যা করেছে সেই হত্যা করেছে এথোল আর হুইসনকে।

এতো সংবাদ তুমি কোথায় পেলে শ্যালন?

আর্থার আমাকে বলেছে, আরও বলেছে–তুমিই নাকি তার বাবাকে সদ্য ফাঁসির মঞ্চ থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছে।

আমি! গাড়ির সম্মুখে দৃষ্টি রেখে বললো বনহুর।

 আলম, তুমি নিজেকে অমনভাবে গোপন রাখতে চাও কেন?

কারণ আমি দোষী।

শ্যালন হেসে উঠে–তোমার সব দোষ আমি জানি। আর্থার দাদার কাছে ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়ে গিয়েছিলে–এই তো! কিন্তু তার বাবার মঙ্গলের জন্যই তুমি ও কাজ করেছিলে তাও জানি।

গাড়ি তখন সোজা গঙ্গার দিকে ছুটে চলেছে।

 শ্যালন বললো–একি এতো রাতে গঙ্গা তীরে কেন?

তোমার সঙ্গে একটা প্রয়োজনীয় কথা আছে শ্যালন।

 কি এমন কথা আলম? আমার যেন কেমন সন্দেহ হচ্ছে। এতো রাতে গঙ্গার তীরে—

প্রথমেই বলেছি ভয় নেই।

 কিন্তু—

কিন্তু নয় শ্যালন, কথা আছে।

গাড়ি নিয়ে গঙ্গার ধারে এসে পৌঁছলো বনহুর আর শ্যালন।

 বনহুর বললো–এবার নামতে হবে।

শ্যালন তাকালো চারদিকে গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন গঙ্গাতীর। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে। সাঁ সাঁ করে বাতাস বইছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে কেমন একটা উৎকট শব্দ। কোনো অশরীরী আত্মা যেন চলাফেরা করছে সেখানে।

শ্যালন বনহুরের কথা মত নেমে দাঁড়ালো।

একটা হিমশীতল হাওয়া শ্যালনের দেহে যেন কাঁপন ধরিয়ে দিলো। গভীর রাতে গঙ্গার হাওয়া বড় ঠাণ্ডা।

শ্যালন ভীষণভাবে ভয় পেয়েছে; কিন্তু কিছু বলতে পারছে না, মনে মনে ভাবছে–তাকে এভাবে গভীর রাতে নির্জন গঙ্গাতীরে নিয়ে আসার কি মনে হয়। তবে কি কোনো কু-অভিসন্ধি নিয়ে তাকে এখানে এনেছে আলম।

কিন্তু যাকে নাকি ভালবাসা যায়, বিশ্বাস করা যায়, তাকে নাকি ভয় পাওয়া যায় না। শ্যালন গঙ্গাতীরে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘাবড়ে গেলেও আলমকে সে ভয় পেলো না। আলমের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো শ্যালন।

বনহুর হেসে বললো–শীত পাচ্ছে বুঝি?

হাঁ, বড্ড শীত।

বনহুর নিজের শরীর থেকে কোটটা খুলে শ্যালনের দেহে জড়িয়ে দিলো, তারপর ওর হাত ধরে নিয়ে গেলো একেবারে গঙ্গার ধারে।

শ্যালন বনহুরের হাতখানা আঁকড়ে ধরে রাখলো, একবার ভীত কণ্ঠে বললো–এখানে আমাকে কেন নিয়ে এলে আলম? আমার ভাল লাগছে না।

শ্যালন, এখনই ঘাবড়ে গেছে কেন তোমাকে এখানে এনেছি জানলে আরও ঘাবড়ে যাবে।

 কেন?

 যদি বলি তোমাকে হত্যা করবো বলে ফুসলিয়ে নিয়ে এসেছি?

 তুমি আমাকে হত্যা করবে?

হাঁ।

তাহলে এখানে কেন, আমার ঘরেই তো আমাকে হত্যা করতে পারতে?

হেসে উঠলো বনহুর–তাহলে বুঝতে পেরেছো আমি তোমাকে এখানে হত্যার জন্য আনিনি। শ্যালন, তোমার বাবা কেন নিহত হয়েছেন জানো?

এখানে আমি ও কথা শুনতে চাইনে আলম।

তোমাকে শুনতে হবে।

না, আমাকে নিয়ে চলো।

কোথায়? আর্থারের বাসায়?

হাঁ!

কিন্তু সে আশ তুমি ত্যাগ করো শ্যালন।

আলম! শ্যালন করুণ কণ্ঠে ডাকলো এবার। সত্যি সে দারুণ ভয় পেয়ে গেছে।

বনহুর পকেট থেকে বের করলো রিভলভার, চেপে ধরলো শ্যালনের বুকে–তোমাকে আমি খুন করবো।

আর্তনাদ করে উঠে শ্যালন–বাঁচাও বাঁচাও–

বনহুর অট্টহাসি হেসে উঠে-হাঃ হাঃ হাঃ এখানে গলা ফেটে চিৎকার করলেও কেউ জানবে না, কেউ সাড়া দেবে না। কারণ এটা শ্মশানঘাট। নিমতলা শ্মশান–

শ্যালন ভুলে গেলো আলমের হাতে রিভলভার; ঝাঁপিয়ে পড়লো সে তার বুকে, কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে থর থর করে কাঁপতে লাগলো।

বনহুর বললো–শ্যালন, ভয় নেই। আমি তোমাকে হত্যা করতে আনিনি। এই নিমতলা শ্মশানঘাটে আজ তোমার পিতার হত্যাকারীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে।

উঃ কি ভয়ঙ্কর জায়গা।

এই ভয়ঙ্করের বুকে আজ সমর্পণ করবো তোমার পিতার হত্যা রহস্যের অমূল্য সম্পদ–বনহুর পকেট থেকে বের করলো একটি ছোট্ট ক্ষুদ্র বাক্স খুলে ফেললো সেটা। সঙ্গে সঙ্গে একটা উজ্জ্বল নীলাভ আলো অন্ধকারে ঝক ঝক করে উঠলো।

শ্যালন মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলো ভয় আর ভীতি, বললো–ওটা কি?

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–এটাই লুকানো ছিলো তোমার বাবা ম্যাকমারার ছোট্ট জামার চোরা পকেটে। আর এটার জন্যই নিহত হয়েছেন তিনি। এথোল এবং হুইসন স্মিথও এর জন্য মৃত্যুবরণ করেছে। পুলিশ কমিশনার বিনয় সেন এটার লোভ সামলাতে পারলেন না তারও মৃত্যু ঘটলো এই এটার জন্য–

আলম ওটা তুমি আমাকে দাও।

উঁ হু ওটা কারো জন্য নয়–বনহুর নীলাভো উজ্জ্বল বস্তুটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো গঙ্গার বুকে।

শ্যালন বিস্ময়ভরা কন্ঠে বললো–এ কি করলে আলম!

হাঁ ওটা আমি গঙ্গার বুকে বিসর্জন দিলাম। কারণ ওটা যার কাছে থাকবে তাকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে।

আলম, ওটা কি ছিলো?

 ওর নাম মাণিক–সাত রাজার ধন।

শ্যালনের দু’চোখে বিস্ময়, অবাক গলায় বললো–মাণিক হাতে পেয়ে তুমি গঙ্গার জলে ফেলে দিলে?

হেসে বললো বনহুর–দস্যু বনহুরের কাছে সবই তুচ্ছ।

শ্যালন অন্ধকারে অবাক চোখে তাকালো, কণ্ঠ তার আড়ষ্ট হয়ে গেছে, কোনো কথা তার মুখ দিয়ে। বের হলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *